• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

যেভাবে বেঁচে থাকি – আহমাদ মোস্তফা কামাল

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » বিশেষ রচনা » যেভাবে বেঁচে থাকি – আহমাদ মোস্তফা কামাল

যা কিছু সুন্দর তা-ই বেদনাময়; যেমন প্রেম, সম্পর্ক, স্মৃতি; যেমন লাবণ্যর মুখ। কিন্তু যা কিছু বেদনার, তার সবই সুন্দর নয়; যেমন প্রিয়জনের মৃত্যু।

২.
সারা রাত শুয়ে ছিলাম, ঘুম আসেনি। এ নতুন কিছু নয়, ঘুম আমার প্রায়ই আসে না। রাতভর ছটফট করি। ঘুমের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমহীন জেগে থাকা খুব কষ্টের। ‘এই বুঝি ঘুম এল’ বা ‘আরেকটু অপেক্ষা করলেই ঘুম আসবে’ ভাবতে-ভাবতে শুয়েই থাকা হয় শুধু, ওঠাও হয় না, কিছু করাও হয় না, কেবল বিছানা-বালিশের সঙ্গে অবিরাম অহেতুক যুদ্ধ! অথচ না শুয়ে, পড়লে একটা বই পড়া যেত বা গান শোনা যেত বা প্রিয় কোনো সিনেমা দেখা যেত নিজের ছোট্ট মনিটর-ওয়ালা কম্পিউটারে। কিংবা কিছুই না করে কেবল চুপচাপ বসে থাকা যেত ছোট্ট ওই ব্যালকনিতে, নিজের শখের রকিং চেয়ারে। চেয়ারটা আমি কিনেছিলাম মায়ের জন্য। মাকে নিয়ে অনেক শখ-আহ্লাদ ছিল আমার, সমস্ত আয়োজন-অনুষ্ঠান আর পরিকল্পকনার কেন্দ্রেও থাকত মা। বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবলে মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতাম, সিনেমা দেখার কথা ভাবলে মাকে নিয়ে দেখার কথা ভাবতাম, শখের কিছু খেতে-খেতে ভাবতাম মায়ের জন্যও একটু নিয়ে যাই। অথচ মা এগুলোর কিছুই চাইত না কখনো। মায়ের আসলে কোনো চাওয়াই ছিল না। অদ্ভুত এক মানুষ ছিল। এমন নির্মোহ মানুষ জীবনে খুব কম দেখেছি আমি। কিংবা কে জানে আমার এত সব শখ-আহ্লাদে সাড়া দেওয়ার মতো শারীরিক সামর্থ্যও হয়তো ছিল না তার। বয়স হয়ে গিয়েছিল, নানা রোগ-শোকে শরীর ভেঙে পড়েছিল, অথচ ব্যাপারটা মেনে নিতে ইচ্ছেই করত না আমার। এই যেমন চেয়ারটার কথাই ধরা যাক। ভেবেছিলাম একটা ইজিচেয়ার কিনে দেব। নাটক-সিনেমায় যেমন সচ্ছল বুড়ো মানুষদের ইজিচেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়, মা-ও তেমনি বসে-বসে পত্রিকা পড়বে বা বই পড়বে বা আকাশ দেখবে—এ রকম একটা চিত্রকল্প হয়তো মনের মধ্যে গাঁথা ছিল। অথচ কিনতে গিয়ে নিয়ে এলাম রকিং চেয়ারটা। মনে হলো, এই চেয়ারটা তো খানিকটা ইজিচেয়ারের মতোই, সেই সঙ্গে আবার দোল খাওয়ার সুযোগও থাকছে। মা বসে-বসে কিশোরী মেয়েদের মতো দোল খাচ্ছে চেয়ারে, কল্পনায় দৃশ্যটাকে ভারি মনোমুগ্ধকর মনে হলো। রকিং চেয়ার দেখে মা হেসেই বাঁচে না, বলল, ‘এই চেয়ারে আমি বসতে পারা নাকি রে পাগলা? কী যে সব পাগলামি করিস তুই!’ ‘পারবে না কেন, নিশ্চয়ই পারবে’—বলে আমি বেশ কসরৎ করে মাকে বসিয়ে দিই। ‘পড়ে যাব, পড়ে যাব’ বলতে-বলতে মা হাসতে থাকে আর আমি ‘পড়বে না, আমি ধরে রেখেছি তো’ বলতে-বলতে দোল দিতে থাকি। দোল খেতে-খেতে মায়ের মুখটি কিশোরীর মতো অমলিন হাসিতে ভরে ওঠে। বড় সুন্দর, মনোহর সেই দৃশ্য। চোখ ভরে যায়, মন ভরে যায়। কিন্তু এখন বেদনা হয়ে বুকে বাজে। মা চলে গেছে। তার আগে অনেক দিন বিছানায় পড়ে ছিল। রকিং চেয়ারটা তখন একাই দোল খেত কদাচিৎ, যখন বাতাস এসে দোল দিয়ে যেত। আর এখন দ্যাখো, কী বিষণ্ন পড়ে আছে ছোট্ট ব্যালকনিটার একপাশে—অবহেলায়, হয়তো অপেক্ষায়ও।

৩.
লাবণ্যর সঙ্গে আমার কদাচিৎ দেখা হয়, কথা হয় তার চেয়েও কম। অথচ দীর্ঘদিন ধরে আমি তার প্রেমে পড়ে আছি। নানাভাবে আমি এই প্রেমে পড়ার কারণটি আবিষ্কার করতে চেয়েছি এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যর্থ হয়েছি। অপ্রত্যাশিত, কারণ, নিজের সম্বন্ধে আমি সব সময় এ রকম ধারণাই পোষণ করে এসেছি যে কোনো কিছুই কার্যকারণ ছাড়া ঘটে না, এবং সেই কারণ আবিষ্কারে আমি অতিশয় পারঙ্গম। আমার এই সক্ষমতার বা পারঙ্গমতার স্বাক্ষর আমি অনেকবারই রাখতে পেরেছি, কিন্তু এ ব্যাপারটাতে পারছি না। লাবণ্যর কথা মনে হলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে ওর অনির্বচনীয় মুখটি। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ওর চোখ দুটো। অমন আশ্চর্য কালো-গভীর-ভাষাময় চোখ আমি আর দেখিনি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি বলে কখনো ওকে ভালোভাবে দেখাই হয়নি আমার। মাঝেমধ্যে মনে হয়—আমি কেবল ওর চোখই দেখেছি এত দিন ধরে, ও যে দেখতে কেমন সেটি বর্ণনা দিতে বললে হাস্যকরভাবে ব্যর্থ হব, কারণ চোখের কথা বলতে-বলতেই আমার বেলা ফুরিয়ে যাবে। কিংবা উল্টোটাও হতে পারে। আমি হয়তো ওর চোখ নিয়ে কিছুই বলতে পারব না। কী-ই বা বলা যায় অমন চোখ নিয়ে! যে চোখ হূদয়ভেদী, যে চোখ মমতাময়ী, যে চোখ সমুদ্রের তলদেশের মতো গভীর ও রহস্যময়, তার বর্ণনা কীভাবে দেওয়া সম্ভব? এই চোখের কারণেই কি প্রেমে পড়লাম আমি? তা কি আমাকে মানায়? এ তো কিশোর বয়সের প্রেমের মতো হয়ে গেল। অবশ্য প্রেম সব সময়ই মানুষকে কিশোর করে তোলে। কিংবা বলা যায় ইনোসেন্ট করে তোলে। প্রেমে পড়ার আরেক নাম তাই কৈশোরের কাছে ফেরা, সরলতার কাছে ফেরা। এসব কথা ওকে জানানোই হলো না কখনো। হবে কীভাবে? আমি যে ভীতু! তা ছাড়া ও সব সময়ই সব আয়োজন-অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। সব সময় তাকে ঘিরে থাকে অসংখ্য স্তাবক। কবিরা ঘুরে-ঘুরে কবিতা রচনা করে, গায়কেরা ঘুরে-ঘুরে সুর তৈরি করে, আবৃত্তিশিল্পী আর অভিনেতারা তাদের অসাধারণ বাচনভঙ্গি দিয়ে তাকে প্রশংসার ঝুড়ি উপহার দেয়। বিশেষ করে আমার কবিবন্ধুরা সব সময় তাকে ঘিরে থাকে। এই কবিরা আবার শুধু কবি-পরিচয়েই সীমাবদ্ধ নেই। কেউ পত্রিকার সম্পাদক, কেউ অনলাইন সাময়িকীর সম্পাদক, কেউ টেলিভিশনের প্রযোজক, কেউ নাটক-সিনেমার পরিচালক। শুধু কবিতা দিয়ে মুগ্ধ করার দিন ফুরিয়েছে, এখন এ রকম সব পরিচয়ও লাগে। আমার এগুলো কিছুই নেই। গল্পলেখক ছাড়া আমার আর কোনো আইডেনটিটিই নেই, সেই গল্পও বহুদিন ধরে আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, ওকে নিয়েও কোনো গল্প লিখতে পারিনি কখনো! এই ছোট্ট আইডেনটিটি নিয়ে, তাই, লাবণ্যর ধারে-কাছেও যাওয়ার সাহস হয় না আমার! এসব আর কি! সে জানে না, না-ই বা জানল। আমার দুঃসহ সময়গুলো তো সে কল্পনার রঙিন সুতোয় বুনে দিতে সহায়তা করে, আমি তাতেই ধন্য। কী সুন্দর এই প্রেম, অথচ বেদনাময়। তাকে কোনো দিন না বলতে পারার বেদনা, না জানতে দেওয়ার বেদনা, না পাওয়ার সম্ভাবনার বেদনা!

৪.
সারা রাত ঘুম হয়নি বলে খুব ভোরেই উঠে পড়ি। মনে হয়, বাইরে থেকে ঘুরে আসি একটু। ভোরের হাওয়া গায়ে মাখার আনন্দই আলাদা। মনে পড়ে, আমার কোনো ব্যাপারে বাবার কোনো মাথাব্যথা ছিল না, শুধু প্রতিদিন ভোরে ডেকে বলতেন—‘ওঠ খোকা, সকাল হয়ে গেছে। একটু হাঁটাহাঁটি কর। ভোরের বাতাসে স্বাস্থ্য ভালো হয়।’ হায়, আমি কখনো স্বাস্থ্যসচেতন ছিলাম না। নানা রকম অসুখবিসুখ আমার নিত্যসঙ্গী। সেই ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম রোগে ভোগা জীর্ণ-শীর্ণ দুর্বল বালক। শরীরে সহ্য হতো না বলে খেলাধুলাও করতে পারতাম না, অল্পে হাঁফিয়ে উঠতাম, জ্বর-টর এসে একাকার হয়ে যেত। বড় হয়েও অবস্থা পাল্টায়নি। আমার অসুস্থতা কমেনি, বরং পত্রপল্লবে বিকশিত হয়েছে। কত রকম সমস্যায় যে ভুগি আমি, তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙে কোনো না কোনো যন্ত্রণা নিয়ে। হয় মাইগ্রেনের যন্ত্রণা, নইলে পায়ে তীব্র ব্যথা, পিঠ বা ঘাড়ে ব্যথা, আর এর কোনোটাই না হলে বুকে এক ধরনের অস্বস্তি—প্যালপিটিশন। ঢাকার সব ধরনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বার ঘোরা হয়ে গেছে আমার, কোনো লাভ হয়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্ভবত আমার এসব যন্ত্রণার সমাধান দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। আমার বন্ধুদের কাছে বা আত্মীয়স্বজনের কাছে আমার অসুস্থতার খবর তাই এখন আর কোনো খবরই নয়, কেউ ব্যাপারটাকে পাত্তাই দেয় না। বরং ‘সুস্থ আছি’ খবরটিই দ্রুত চাউর হয়ে যায়, বন্ধুবান্ধব ফোন করে বলে—‘এখন তো সুস্থ আছিস, চল একটা জম্পেশ আড্ডা হয়ে যাক, বহু দিন আড্ডা হয় না!’ অন্যদের কথা আর কী বলব, আমার নিজের কাছেও ব্যাপারটা ও রকমই। কোনো দিন সকালে উঠে যদি টের পাই, শরীরে কোনো অস্বস্তি নেই, সুস্থ আছি, মনে হয়—একেই হয়তো স্বর্গসুখ বলে! সত্যিই, একমাত্র অসুস্থ মানুষেরাই জানে সুস্থতা কী অসাধারণ মর্যাদাপূর্ণ ব্যাপার। বলাই বাহুল্য, এসব অসুস্থতার জন্য আমি দায়ী নই। ছোটবেলা থেকেই ভুগছি। এখন কেউ যদি আমার এই বয়সের জীবনযাপনের খুঁটিনাটি অনিয়মকে এসব অসুস্থতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান, তাহলে আমি অবশ্যই প্রশ্ন করব—ছোটবেলা থেকে কেন এসব বয়ে বেড়াচ্ছি? ওই বয়সে নিশ্চয়ই আমি অনিয়ম করতাম না, করার সুযোগই তো ছিল না। তখন তো নিজের জীবন বলতে কিছু ছিল না, যাপনের ধরনটা নির্ধারণ করত মা-বাবা। যা হোক, দার্শনিক ভিটগেইনস্টাইন বৈষয়িক সাফল্যের সব সম্ভাবনা উপেক্ষা করে, দাম্পত্য-পারিবারিক-সামাজিক জীবনের সঙ্গে সযত্নে রচিত দূরত্ব বজায় রেখে খুব বিচিত্র একটি জীবন কাটিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্তে বলেছিলেন—‘টেল দেম আই হ্যাভ হ্যাড এ ওয়ান্ডারফুল লাইফ!’ এ কথাটি পড়ে আমার মনে হয়েছিল, মৃত্যুর সময় কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি বলব—‘টেল দেম, আই হ্যাভ হ্যাড এ পেইনফুল লাইফ!’

৫.
বেরোনোর সময় পকেটে টাকা নিতে ভুলিনি। জানি হাঁটতে বেরোলেই খিদে লাগবে। তা ছাড়া রাত জাগারও একটা খিদে আছে! একটু হাঁটার পরই টের পাই, পেট জানান দিচ্ছে। পেটের ডাকে সাড়া দিতে মধুমিতায় ঢুকি। এখানকার ভাজি-হালুয়া-পরোটার নাশতাটি সম্ভবত ঢাকার সেরা। সচরাচর খাওয়ার সুযোগ হয় না, খেতে হলে অনেক সকালে আসতে হয়! অত সকালে কে-ই বা নাশতা খেতে বাইরে বেরোতে চায়! আজকে সুযোগ পেয়ে গেলাম, পেটপুরে খেতে কোনো কার্পণ্যই করলাম না। তারপর আবার হাঁটা। হাঁটতে-হাঁটতে প্রেসক্লাব। হয়তো ক্যাম্পাসের ওদিকে যাওয়ার একটা ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দেখলাম সাভারগামী বাসগুলো হাঁকছে। এত সকালে মানুষ যায় কোথায়! চুলোয় যাক, তাতে আমার কী—এমনটি ভেবেও আমি নিজেই একটাতে উঠে পড়ি। কিন্তু সাভার না গিয়ে নেমে পড়ি হেমায়েতপুরে। বাম দিকে বাঁক নিলেই সিঙ্গাইর রোড। আমি সেদিকেই রওনা দিই। আবার বাস। সিঙ্গাইর। রিকশা। বিনোদপুর। বাড়ি। মায়ের কবর। কী এক টানে এই সাতসকালে মায়ের কাছে চলে এসেছি, বলি—‘মা আমি এসেছি।’ ঠিক আগের মতো। বেঁচে থাকতে, মা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকত। জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকত, যখন শয্যাশায়ী তখনো জানালার দিকে চোখ ফেলে রাখত, যে পর্যন্ত না আমি এসে বলতাম—‘মা আমি এসেছি!’ মা কি এখনো অমন করে তাকিয়ে থাকে? মৃত্যুর পর কোথায় যায় মানুষ, কী হয় তাদের? পার্থিব জগতের সঙ্গে কি কোনোভাবেই দেখা হয় না? পৃথিবীর মানুষের কোনো কথাই কি পৌঁছায় না তাদের কানে? এসব প্রশ্নের উত্তরই হয় না জানি। কিন্তু, তবু, মায়ের কবরের পাশে বসে তার সঙ্গে অবিরাম কথা বলতে ভালো লাগে। আমার সব না-বলা কথা, সব জমানো কথা, যে কথাগুলো কাউকে কখনো বলতে পারিনি বা পারি না, সেই সব কথা! একতরফা এই কথাবার্তা, বলাইবাহুল্য। মৃত্যুর ওপার থেকে মায়ের কোনো সাড়াই মেলে না। অথচ, আগে যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলতাম, রাজ্যের সব কথা—সবকিছু তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, জেনেও—মা যে কী চমৎকারভাবে সাড়া দিত! কখনো হাসত, কখনো চোখ ভরে উঠত জলে! কখনো কিছুই না বলে আমার বুকে-পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করত! কী যে অসামান্য সেই আদরের অনুভূতি! বয়স হয়ে যাওয়া সন্তানের বুকে-পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে মা যখন তার শৈশব-কৈশোর ফিরিয়ে আনে, তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুন্দর দৃশ্যটি রচিত হয়! এখন সেই সুযোগ নেই। বড় বেদনাময় মায়ের এই নীরবতা, কিন্তু একটুও সুন্দর নয়!

৬.
বাড়িটার উত্তর দিকে ছোট্ট একটা নদী বয়ে চলেছে। ওটা বাড়ির পেছন দিক। নদীর পাশেই মায়ের কবর। কী যে নির্জন হয়ে আছে! কতগুলো বেলিফুলগাছ লাগিয়েছিলাম কবরের চারপাশ ঘিরে, মায়ের প্রিয় ফুল ছিল বলে। এখন ডালপালা ছড়িয়ে ছেয়ে গেছে। গিয়ে দেখি, এই ভোরে প্রায় সব গাছে ফুল ফুটে আছে। দেখে মনে হয়, শত-শত শুভ্র-সৌরভময় ফুল একসঙ্গে মায়ের কবরকে ঢেকে রেখেছে। বেঁচে থাকতে ফুলগুলোকে খুব ভালোবাসত বলে, তার মৃত্যুর পর যেন ওরা সেই ভালোবাসা শতগুণ বাড়িয়ে ফেরত দিচ্ছে মাকে। মনটা অন্য রকম হয়ে যায় এর কম একটা দৃশ্যের মুখোমুখি হলে। সেই ‘অন্য রকম’ যে কেমন, বর্ণনা করা যায় না! বেলা বাড়ে। নদীগামী মানুষের আনাগোনাও বাড়ে। দুপুরের দিকে নদীর ঘাটে লোকজনের আনাগোনা একটু বেশি থাকলেও বেলা পড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার নির্জন হয়ে যেতে থাকে। পড়ন্ত বিকেলে, যখন একজন মানুষও আর থাকে না নদীর ঘাটে, তখন অকল্পনীয় এক নৈঃশব্দ্য আর নির্জনতায় ছেয়ে যায় চারপাশ। এমন নির্জনতার জন্ম এই পৃথিবীতে হয় না! এমনিতেই বাড়িটা খালি। কেউ থাকে না। একলা-নির্জন বাড়িটা বুকে অসীম শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশে কোনো বাড়িঘরও নেই। সব মিলিয়ে এই নৈঃশব্দ্য, এই নির্জনতা বড় বুকে বাজে। মা নির্জনতা পছন্দ করত, তার জন্য এই জায়গাটিই বড় চমৎকার। এখানে এলে, জীবনানন্দকে মনে পড়ে—‘ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম—পউষের রাতে—; কোনোদিন আর জাগব না জেনে; কোনোদিন জাগব না আমি—কোনোদিন জাগব না আর…’।
বড় সুন্দর এই নির্জনতা, এই নৈঃশব্দ্য, এই কবিতার পঙিক্ত; কিন্তু বেদনাময়!

৭.
মায়ের কাছে এলে আসা হয় আপার কাছেও। আপা, হঠাৎ করেই, চলে গিয়েছিল মায়ের আগেই। মা অসুস্থ ছিল বলে আমাদের সবারই একটু-আধটু প্রস্তুতি ছিল। মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন, কিন্তু যে মৃত্যু ধীরে ধীরে আসে তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার খানিকটা সময় মেলে। মায়ের ব্যাপারটাও সে রকম ছিল। চিকিৎসকেরা শেষ কথা বলে দেওয়ার পরও মা প্রায় বছরখানেক বিছানায় পড়ে রইল, আর আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকলাম তার চলে যাওয়ার। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। দুঃসহ এই প্রস্তুতি ও অপেক্ষা। কিন্তু কেউই আপার চলে যাওয়ার কথা ভাবেনি। এমন হঠাৎ গেল আপা যে হতভম্ব হয়ে বসে থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার রইল না। সন্তানের লাশ নাকি মা-বাবার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু। মাকে দু-দুবার সেই বোঝা বইতে হয়েছে। এর আগে আমার ভাইয়েরও মৃত্যু হয়েছিল এমন হঠাৎ করে। তারপর আপা। আপা বা ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। বাবা অনেক আগেই চলে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে ভারী বোঝাটি তাকে বইতে হয়নি। মাকে এসব নানা দুর্যোগ পোহাতে হলো। অবশ্য আপা চলে যাওয়ার মাস দেড়েকের মাথায় মা-ও গেল। এত এত মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া মানে এক লাফে বয়স বেড়ে যাওয়া। আমারও তা-ই হলো। বয়স বাড়ল, অভিজ্ঞতা বাড়ল, কিন্তু জগৎটা শূন্য হয়ে গেল।
আমি ক্রমেই নিজেকে বন্দী করে ফেললাম ঘরের ভেতর। কোথাও যাই না, কারও সঙ্গে কথা বলি না, কোনো কিছুতেই আমার কোনো অংশগ্রহণ নেই।
জানি, লাবণ্যকেও একই রকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ওর ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে হঠাৎ করে। শুনেছি, কিন্তু শোনা পর্যন্তই, কিছু বলা হয়নি। ওই ঘটনার পর ওর সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল বলার চেয়ে বলা ভালো, আমি তাকে দেখেছিলাম, সে আমাকে দেখেছে কি না জানি না। দূর থেকে দেখলাম, তার অনিন্দ্য-সুন্দর মুখটিতে বীভৎস মৃত্যুর কালো ছাড়া পড়েছে। ঠোঁটের কোণে সেই আশ্চর্য মিষ্টি হাসিটি নেই। আমি কেবল দেখিই। কাছে গিয়ে কিছু বলা হয় না। কী বলব? নিজেকে দিয়েই তো বুঝি, এ ধরনের মৃত্যুর মুখোমুখি যারা হয়, তাদের অভিজ্ঞতার বয়স এক দিনেই ১০০ বছর বেড়ে যায়! অভিজ্ঞতাহীন মানুষের সহানুভূতি-বাক্যমালা তাদের কাছে হাস্যকর লাগে!
কথা হয় না বলে জানা হয় না, কেমন আছে লাবণ্য। ওর অবস্থাও কি আমার মতো হলো? এ রকম বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, নৈঃশব্দ্যপ্রিয়! ওর পক্ষে অবশ্য নিঃসঙ্গ থাকা কঠিন। ওকে ঘিরে সবসময় বহু মানুষের ভিড়, তারা সবাই বিশিষ্ট। আর আমি সামান্য গল্পকার, ওকে নিয়ে একটা গল্পও লিখতে পারি না! তবু, তার প্রেমে পড়ে আছি, পড়েই থাকি। আর ওর জন্য এই প্রেম নিয়ে একা-একা রাত জাগি।
জানি, সবকিছুর পরও মানুষ নিঃসঙ্গই। লাবণ্যও। যত কাণ্ডই ঘটুক তাকে নিয়ে, যত মানুষই ঘিরে থাকুক তাকে, তার নিঃসঙ্গতাকে স্পর্শ করতে পারে না কেউ, জানি!
নির্ঘুম রাতে একা একা বসে ভাবি, আমার মতো লাবণ্যও এখন এ রকম নিঃসঙ্গ হয়ে নির্জনতার ভেতর জেগে বসে আছে! যোগাযোগহীন হয়েও এ রকম করে ভাবতে আমার ভালো লাগে আমার।

৮.
আমি এসব নির্জনতা, নৈঃশব্দ্য, একাকীত্ব, অপ্রকাশিত প্রেম আর ভালো লাগা নিয়ে বেঁচে থাকি! মনে হয়, মৃত্যু-মুহূর্তের স্টেটমেন্ট-টা একটু বদলে দেওয়া যায়—‘টেল দেম, আই হ্যাভ হ্যাড এ পেইনফুল লাইফ, বাট আই হ্যাড এনজয়েড ইট!’

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০১০

Category: বিশেষ রচনা
Previous Post:যুদ্ধাপরাধীর বিচার: জাহানারা ইমামের চিঠি—আসিফ নজরুল
Next Post:থাই চলচ্চিত্রকার অ্যাপিচাটপং ভিরাসেথাকুলের সাক্ষাৎকার

Reader Interactions

Comments

  1. Sayan pal

    June 19, 2023 at 10:22 pm

    পুরোটা পড়া হলো, তবে অবশ্যই পড়বো । তাড়াহুড়ো করে যেটুকু পড়লাম, অসাধারণ ❤️ আমাদের বেঁচে থাকা গুলো অনেকটা এক ।

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑