• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

দ্য ইডিয়ট প্রেসিডেন্ট – দানিয়েল আলার্কোন

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » অনুবাদ » দ্য ইডিয়ট প্রেসিডেন্ট – দানিয়েল আলার্কোন

নাটকের কলেজ থেকে পাস করে দুই মাসের জন্য আমি একটা থিয়েটারের সঙ্গে ছিলাম। নাম ডিসিয়েম্বার। যুদ্ধের অস্থির সময়ে গড়ে ওঠা এই থিয়েটারটাকে সুপ্রতিষ্ঠিতই বলা যায়। লড়াইয়ের ক্ষেত্রগুলোতে দুঃসাহসিক সব ভ্রমণের মাধ্যমে নাটককে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য এর খ্যাতি ছিল। যুদ্ধের সময় এটি শহরের রাস্তায় রাস্তায় রাতভর শো করত। আমার প্রজন্মের থিয়েটারের ছাত্রদের কাছেও এই শোগুলো ছিল কিংবদন্তির মতো। আমার অনেক ক্লাসমেটই দাবি করত, শিশু অবস্থায় এ রকম একটা-দুইটা প্রদর্শনীতে তারাও উপস্থিত ছিল।
যুদ্ধের এক দশকের বেশি সময় পরও ডিসিয়েম্বার অপেশাদার অভিনেতাদের একটা ঢিলেঢালা সংগঠন হিসেবে টিকে ছিল। এই অভিনেতারা মাঝেসাঝে শো করার সুযোগ পেত। বেশির ভাগ সময়ই মানুষের বাড়িতে, যেখানে বাড়ির মেহমানেরাই কেবল দর্শক হতো। মজার ব্যাপার, শহরের বাইরে ভ্রমণ করাটা এখন অনেক নিরাপদ হলেও ডিসিয়েম্বার কখনোই বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি। তাই ডিসিয়েম্বারের নতুন ট্যুরের খবর যখন এল তখন আমি খুব উৎসাহ নিয়ে অডিশন দিলাম। সুযোগটা বিরল ছিল, এবং অবাক কাণ্ড, আমি টিকেও গেলাম। সেই ট্যুরে আমরা ছিলাম কেবল তিনজন। আমি; কোঁকড়া চুলের একজন অভিনেতা, যার নাম হেনরি এবং বেঁটে কালোমত এক লোক, যে আমার কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছিল পাতালারগা হিসেবে এবং যে আর কখনোই তার আসল পরিচয়টুকু দেওয়ার কষ্ট স্বীকার করেনি। এদের দুজনের ভেতর একটা দুঃসম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। সুদূর কোনো অতীতে তানিয়া নামে পাতালারগার এক কাজিনকে হেনরি বিয়ে করেছিল এবং তারপর তালাক দিয়েছিল। তানিয়া সম্পর্কে তারা একধরনের শ্রদ্ধামিশ্রিত ফিসফিসানির স্বরে কথা বলত, আবহাওয়া বিষয়ে কথা বলতে গেলে প্রতিবেশী কৃষকেরা যে ধরনের স্বর ব্যবহার করে, সে রকম। এদের বন্ধুত্বের আয়ু মোটামুটি আমার নিজের বয়সের সমান ছিল এবং এদের সঙ্গে ঘোরাঘুরির সুযোগ পেয়ে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, অভিজ্ঞ লোকজনের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারার জন্য এ খুব ভালো একটা সুযোগ পাওয়া গেল।
বেশির ভাগ নাটক লিখত হেনরিই। এই ট্যুরের জন্য আমরা বেছে নিয়েছিলাম তার লেখা প্রহসন দ্য ইডিয়ট প্রেসিডেন্ট। যদিও এ নাটকের গূঢ় রাজনৈতিক বক্তব্য খুব পরিষ্কার, তার পরও এতে হাসিঠাট্টার কোনো অভাব ছিল না। এক উদ্ধত, আত্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রপ্রধান আর তার চাকরের চমকপ্রদ নানা ঘটনা নিয়ে এ নাটক। প্রতিদিন প্রেসিডেন্টের চাকর বদল হতো। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে তাদের নেতার সেবা করে সম্মানিত বোধ করার সুযোগ দেওয়া। সেবা বলতে প্রেসিডেন্টকে পোশাক পাল্টাতে সাহায্য করা, তাঁর চুল আঁচড়ে দেওয়া, তাঁর চিঠি পড়ে দেওয়া ইত্যাদি। প্রেসিডেন্ট ছিলেন খুবই খুঁতখুঁতে এবং সব সময় চাইতেন সবকিছুই একটা প্রোটোকল মেনে চলুক। যদিও এই প্রোটোকল ছিল আহাম্মকিতে ভরা। তাই কোন কাজটা কীভাবে করা উচিত—নতুন চাকরকে এই শিক্ষা দিতেই দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় হয়ে যেত।
আমার চরিত্রটা ছিল আহাম্মক প্রেসিডেন্টের আহাম্মক পুত্র, অ্যালিও। আমার তারুণ্যভাস্বর অভিনয়প্রতিভার সঙ্গে এই রোলটা খুব ভালো যাচ্ছিল এবং রিহার্সালের সময়গুলোতে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই আমি এই নির্বোধ বয়ঃসন্ধিকালীন চরিত্রটার প্রেমে পড়ে গেলাম।
অ্যালিও ছিল অহংকারী এক গাধা আর ফিচকে চোর। অশেষ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পিতার গর্বের ধন। নাটকের চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সে ছিল অ্যালিও ও সেদিনের চাকরের মধ্যকার অন্তরঙ্গ আলাপ। প্রেসিডেন্ট তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন আর অ্যালিও নিজের আনুগত্যের মুখোশ খসিয়ে ফেলে চাকরের কাছে স্বীকার করছে যে পিতাকে হত্যা করার কথা সে অনেকবারই ভেবেছে, সাহসে কুলায়নি। ফলে চাকরও উৎসাহ পেল—কেন পাবে না, একে সে একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের মানুষ, প্রেসিডেন্টের ধ্বংসাত্মক সব খেয়ালের শিকার, তার ওপর সারাটা দিন পার করেছে প্রেসিডেন্টের হাতে নানাভাবে নাকাল হয়ে। অ্যালিওর সন্দেহকে সত্য প্রমাণিত করে চাকর স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মানুষের দুর্গতি ইত্যাদি বিষয়ে মুখ খুলল। সে একপর্যায়ে এ-ও স্বীকার করল, হ্যাঁ, দেশের স্বার্থে প্রেসিডেন্টকে মেরে ফেলার বুদ্ধিটা খারাপ না। অ্যালিও এতক্ষণ চাকরের সব কথায় সায় দেওয়ার ভান করছিল। চাকরের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই সে নিজ হাতে হতবাক চাকরকে কতল করল, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে। এরপর লাশের পকেট থেকে মানিব্যাগ, হাত থেকে ঘড়ি এবং আংটি খুলে নিয়ে নিজের পকেটে ঢোকাল আর প্রেসিডেন্ট যে ঘরে ঘুমোচ্ছেন তাঁর দিকে যেতে যেতে চিৎকার করতে লাগল, ‘বাবা, আরেকজন! কাল আমাদের আরেকজন চাকর লাগবে!’ এখানেই নাটক শেষ।
পাতালারগা, হেনরি এবং আমি মার্চের শুরুর দিকে রাজধানী ছাড়লাম, আমার যেদিন একুশ বছর হলো তার পরের দিন। সমুদ্রের পারজুড়ে তখন গ্রীষ্ম; উষ্ণ আর আর্দ্র আবহাওয়া। আমরা একটা বাসে চেপে বিষুবীয় পর্বতগুলোর দিকে গেলাম। এই অঞ্চলে পাতালারগার জন্ম। এর আগে আমি কখনো এদিকটায় আসিনি, এবং আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম এসব জায়গায় আর কখনো আসাও হবে না আমার। সে সময় আমার জীবনের সবকিছু—যত সিদ্ধান্ত আমি নিতাম কিংবা নিতে ব্যর্থ হতাম—একটা ভবিতব্য দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হতো। তা হলো, খুব শিগগির আমি এই দেশ ছাড়ছি। বছরটা শেষ হওয়ার আগেই ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকা ভাইয়ের কাছে আমার যাওয়ার কথা। আমার ভিসা পাওয়ার কাজকর্ম চলছিল, দেশ ছাড়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার। এইভাবে বাঁচাটা আসলে চমৎকারই ছিল। সব ধরনের নিগ্রহকে মোকাবিলা করার জন্য এটা আমাকে একটা গোপন শক্তি জোগাত। এমন একটা আত্মবিশ্বাস যে এ সবকিছুই তো সাময়িক। আমরা নাটক করছিলাম ছোট ছোট শহর আর গ্রামে, একটা বিষণ্ন উপত্যকার চূড়ায় এবং নিম্নভাগে, তীব্র, হিম বর্ষার ভেতর, যে ধরনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই ছিল না। প্রতিটি শহরেই আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হতো। প্রতি রাতেই শোর শেষে দর্শকেরা দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাত। মনে হতো, আমাদের পরিশ্রম আর চেষ্টা সার্থক। কখনো কখনো গ্রাম বলতে ছিল মাত্র কয়েক ঘর মানুষ, সীমানাহীন হলুদাভ ধূসর শস্যের প্রান্তরে কয়েকটা ছোট ছোট ফোঁটা যেন। সব মিলিয়ে আমাদের দর্শক এক ডজনের বেশি না, গ্রাম্য সরল চেহারার জনা কয়েক কৃষক, দীর্ঘসময় জুড়ে রোগগ্রস্ত কৃষাণী এবং তাদের অপুষ্ট শিশুরা। নাটক শেষে এই শিশুরা হেনরির কাছে চলে আসত। তার চোখের দিকে সরাসরি না তাকিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলত, ‘থ্যাংক ইউ, মি. প্রেসিডেন্ট।’
শীত আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। দুই সপ্তাহে আমার ওজন দুই কিলো কমে গেল, এবং এক রাতের বিশেষ রকম উদ্যমী পারফরমেন্সের পর আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। একটু সামলে ওঠার পর আমাদের শহর থেকে কিছুটা দূরে এক কক্ষবিশিষ্ট একটা বাড়িতে দাওয়াত করে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই ঠান্ডায় নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন ধারালো ছুরি গিলছি। মনে হচ্ছিল, ঘাড় থেকে আমার মাথাটা খসে পড়বে আর আন্দিজের ভয়াল আকাশে ভেসে বেড়াবে। কিন্তু সেই পার্টিতে সবাই ছিল ভীষণ রকম সেবাপরায়ণ। আমাকে খাওয়াতে এবং মাতাল করতে তাদের বিশেষ মনোযোগ ছিল। মদ শেষমেশ কাজে এল এবং ঝিমুতে বেশ আরাম বোধ হলো। একপর্যায়ে আমি যখন আবার নীল হতে শুরু করেছি, বাড়ির কর্তা, মোটাসোটা বেঁটে এক লোক, নাম সায়েতানো, আমাকে জিজ্ঞেস করল, জ্যাকেট লাগবে নাকি। আমি উৎসাহী হয়ে মাথা নাড়ালাম। তিনি উঠে রেফ্রিজারেটরটার কাছে গেলেন এবং খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন খুঁজতে লাগলেন, সম্ভবত কোনো স্ন্যাক্স। আমি ভাবলাম, তিনি আমাকে নিয়ে মজা করছেন। হেনরি এবং পাতালারগাকেও মুখ টিপে হাসতে দেখলাম। কিন্তু সায়েতানো ভেজিটেবল ড্রয়ারটা খুলে ভেতর থেকে এক জোড়া উলের মোজা বের করে আনলেন। আমার দিকে সেগুলো ছুড়ে দিয়ে তিনি যখন ফ্রিজের দরজাটা আরেকটু খুললেন, আমি বুঝলাম রেফ্রিজারেটরটা আসলে ওয়্যারড্রোব হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। মাখনের ট্রেতে রাখা হয়েছে হাতমোজা, ভেতরের দেয়ালের সঙ্গে পেরেক আঁটা একটা কাঠ থেকে ঝুলছে সোয়েটার আর জ্যাকেট। কেবল তখনই আমার চোখে পড়ল, ঘরের তাকে বেশ কিছু পচনশীল খাবারদাবার রাখা। এই শীতে তাদের পচার কোনো সুযোগ নেই।
পরের সপ্তাহগুলো এভাবেই চলল। আবহাওয়া ভালো থাকলে সকালবেলা আমরা এক শহর থেকে পরের শহরে যাত্রা করতাম লক্কড়ঝক্কড় বাসে কিংবা আলুবোঝাই কোনো ট্রাকের পিঠে। একটা ঘোড়ার গাড়ি চলবার মতোও চওড়া ছিল না রাস্তাগুলো, আর প্রায়-প্রায়ই আমার চোখ যেত ক্ষয়ে পড়তে থাকা পাহাড়ের চূড়াগুলোয়। মৃত্যু বাদে অন্য কোনো চিন্তা করতে নিজেকে তখন বাধ্য করতে হতো। পাতালারগা ও হেনরি চোখ বুজে কোনো গভীর শান্তির স্বপ্নে ডুবে থাকত। তারা সময়টা উপভোগ করছিল, সন্দেহ নেই। আর আমি চেষ্টা করছিলাম, কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
ট্যুরের একেবারে শেষের দিকে আমরা সান জার্মান নামে এক শহরে গিয়ে পৌঁছালাম। এটা ছিল এক আমেরিকান খনিজ কোম্পানির প্রত্যন্ত শাখা। শহরজুড়ে ছিল শ খানেক ঘরবাড়ি, যেগুলোকে দেখলে মনে হয় কোনো পর্বতের গা থেকে বাতাস তাদের ভাসিয়ে এনেছে। প্রথম দিনটা আমি হোটেল থেকে বেরোতেই পারলাম না। যেন কোনো রোলার কোস্টারে চড়েছি এমনভাবে সারাটা দিন বিছানার একটা প্রান্ত খামচে ধরে পড়ে থাকলাম। সান জার্মান খুব ছোট একটা জায়গা, দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। কিন্তু পাতালারগা আর হেনরি বিছানার পাশে বসে শহরের নানা আশ্চর্যজনক জায়গার বিষয়ে তাদের নিজেদের বানানো গল্প বলে আমাকে উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা চালাল। পাতালারগা বলল, ‘তোমাকে উঠতেই হবে। এই শহরটা দেখতেই হবে।’ তাদের কথায় আমল দিলাম না আমি। বরং একটু একা থাকতে চাইলাম। আমাকে একা রেখে তারা বেরিয়ে পড়ল। আমি চোখ বুজলাম এবং পরের কয়েক ঘণ্টা নড়তেও পারলাম না। কেবল মরিয়া হয়ে আমার নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করলাম।
হেনরি আর পাতালারগা যখন ফিরল, দেখে মনে হলো, তারা খুব খেপে আছে। তাদের বুটে লেগে থাকা কাদার গন্ধ আমি টের পাচ্ছিলাম। ‘তুমি বলো’। ‘তুমিই বলো না’। আমি তাদের খুনসুঁটি শুনতে পাচ্ছিলাম। ‘কেউ একজন বলতেছ না কেন…’, আমার চিৎকার করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এতই দুর্বল ছিলাম, মনে হলো, কোনো হার্টের রোগী হাঁসফাঁস করে মিনতি করছে। দুজনের কেউ একজন আমার বিছানায় বসল। হেনরি। সে জানাল, দুঃসংবাদ। পরের রাতে আমাদের প্রথম শো হওয়ার কথা, কিন্তু কোথায় যেন কী একটা হয়েছে, এই এলাকার কোথাও বিদ্যুৎ নেই, আলো নেই। এবং এটা সাময়িক কিছু না। শহরে যেটুকু বিদ্যুৎ অবশিষ্ট আছে সেটুকু যাচ্ছে খনির আরেক প্রান্তে আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারদের বাড়িগুলোতে। ‘যদি দেখতে তারা কীভাবে থাকে’, হেনরি বলল। সে বর্ণনা করল উঁচু কাঁটাতারের ওপারে ইঞ্জিনিয়াররা কীভাবে আমেরিকান জীবন হুবহু অনুসরণ করে যাচ্ছে। আরামদায়ক সাবআর্বান ঘরবাড়ি, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, বেসবল খেলার মাঠ।
হেনরিকে হতাশ দেখাচ্ছিল। সে কথা বলছিল একটানে এবং আমি তার গলায় তিতে ভাব টের পাচ্ছিলাম। বলা হয়েছিল শ্রমিকদের উদ্দেশে শো করার জন্য আমাদের একটা জায়গা দেওয়া হবে। শ্রমিক, শ্রমিক—যে নিঃস্বার্থ, সাহসী, শ্রদ্ধাভাজন মানুষগুলোর জন্য আমরা টিকে আছি। দুই শিফটের শ্রমিকদের জন্য আমাদের একটি করে শো করার কথা। আমাদের বিকেলের পারফরমেন্স নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু ডে-শিফটের শ্রমিকেরা তাতে আসতে পারবে না। আমরা যদি রাতে শো করি তাহলে তা হবে অন্ধকারে, অথবা শুধু ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য। ‘বেজন্মা ইঞ্জিনিয়ারের দল’, হেনরির ক্রোধ স্পষ্ট হচ্ছিল, ‘সারা দিন শালারা মদ খায় আর রাতের বেলায় খনির ভেতর ঢোকে শ্রদ্ধেয় শ্রমিকদের পিঠে চাবুক চালায়।’
শুনে মনে হচ্ছিল ইঞ্জিনিয়াররা ভূ-স্বামী আর শ্রমিকেরা ক্রীতদাস। ‘সত্যিই এতটা খারাপ নাকি লোকগুলো?’, আমি সন্দেহ প্রকাশ করলাম। পাতালারগা হেনরিকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আর কখনো ওর সামনে এভাবে বলব না। ওর বাবাও একজন ইঞ্জিনিয়ার।’ ‘চুলোয় যাক, হেনরি গজগজ করতে থাকল।
সে রাতে সান জার্মানের অন্ধকার রাস্তায় তারা আমাকে প্রায় পিঠে করে নিয়ে বের হলো। আমার মাথা থেকে শুরু করে সারা শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল পায়ের নিচে মাটি টলমল করছে। কাদায় ভর্তি রাস্তা ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম। নাটকের জন্য হেনরি লম্বা সাদা একজোড়া গ্লোভস্ পরত। কিন্তু ঠান্ডার কারণে নাটক বাদে অন্য সময়ও সে সেগুলো পরে থাকত। গ্লোভসগুলো ছিল সাটিনের তৈরি, পাতলা, খুব একটা গরমও না বোধহয়। কিন্তু দেখতে খুব আকর্ষণীয় লাগত। আমি খেয়াল করছিলাম, পাতালারগা হিংসুকের মতো সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
একপর্যায়ে সে গ্লোভসগুলো দেখিয়ে বলল, ‘ওগুলা আমাকে দাও।’
হেনরি তার হাত ওপরে তুলল। সাদা, চকচক করতে থাকা আঙুলগুলো নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘এগুলা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আই অ্যাম দ্য প্রেসিডেন্ট। গ্লোভস্ আমিই পরব।’
আমরা কোনোমতে সান জার্মানের একমাত্র রেস্টুরেন্টটা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলাম। একটা কেরোসিনের বাতিতে, কেরোসিনের স্টোভে রান্না করা খাবার খেলাম। সবকিছুর স্বাদ এবং গন্ধই কেরোসিনের মতো লাগল। এত কিছুর পরও, পেটে কিছু খাবার আর চা যাওয়ার পর নিজেকে একটু সুস্থ লাগল। আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ার একটু আগে কয়েকজন খনিশ্রমিক তাদের হেলমেট হাতে ভেতরে ঢুকল। অন্ধকারের মধ্যেও পাতালারগা তাদের চিনতে পারল, তার পূর্বরাজনীতির সূত্রে। তারা আমাদের টেবিলে এসে বসল এবং ফিসফিসানির স্বরে আন্ডারগ্রাউন্ডের অবস্থা নিয়ে কথা বলতে থাকল। আগের চেয়ে অবস্থা কিছু ভালো হয়েছে। ভালো ভেন্টিলেশন, উন্নত নিরাপত্তাব্যবস্থা। শিফট এখন চৌদ্দ ঘণ্টা থেকে দশ ঘণ্টায় নেমে এসেছে।
‘কিন্তু নো ইলেকট্রিসিটি, তাই না?’
শ্রমিকেরা মাথা নাড়ল। তাদের মুখ শক্ত, পোড় খাওয়া। ‘বিদ্যুৎ আসবে, আর খনির ভেতর আলো যথেষ্টই’, বলতে বলতে একজন শ্রমিক একটা সুইচ চাপল আর তার হেলমেটের সঙ্গে লাগানো হেডল্যাম্পটা জ্বলে উঠল। রেস্টুরেন্টের একটা দেয়াল উজ্জ্বল আলোয় ঝলসে উঠল। সুইচটা বন্ধ করে সে তার হেলমেটে টোকা দিয়ে বলল, ‘হ্যালোজেন।’ পাতালারগা জানতে চাইল, ‘তোমাদের সবারই আছে নাকি একটা করে?’ শ্রমিকেরা মাথা নাড়ল। দেখলাম, আমার সহঅভিনেতারা মুচকি মুচকি হাসছে।
পরের রাতে কম্বল দিয়ে তৈরি বিশাল একটা তাঁবুর ভেতর পঞ্চাশজন খনিশ্রমিকের হেডল্যাম্পের সমন্বিত আলোয় আমরা দ্য ইডিয়ট প্রেসিডেন্ট মঞ্চস্থ করলাম। সাজঘরটা ছিল তাঁবুর খানিক বাইরে। সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা তিনজন শীতে কাঁপছিলাম। কেন জানি আমরা একটু বেশি রকম উত্তেজিত ছিলাম। দর্শকদের দিকে কিছুক্ষণ পর পর আড়চোখে তাকাচ্ছিলামও।
তাঁবু যখন দর্শকে ভরে উঠল, বাইরের চেয়ে তুলনামূলক উষ্ণ মঞ্চে আমরা ঢুকে পড়লাম। দৃশ্যটা ছিল দম আটকানোর মতো। দর্শকেরা গাদাগাদি করে বসে আছে টায়ারের তৈরি ধ্যাড়ধ্যাড়ে চেয়ারে, তাদের মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। হেনরি আর পাতালারগার দিকে তাকিয়ে দেখি তাদেরও নার্ভাস দেখাচ্ছে। আমি তাদের স্টেজ ছেড়ে দিয়ে একটু সাইডে বসে পড়লাম। তারা দুজন শুরু করল। কাঁপতে থাকা কাঁধ আর দুশ্চিন্তায় চিমসে হয়ে যাওয়া মুখাবয়ব নিয়ে হেনরি তার ইডিয়ট প্রেসিডেন্টের ভেক ধরল। তার এই বেশটার মধ্যে ছিল এলোমেলোমিতে ভরা এক ধরনের কাঠিন্য, যেন প্রেসিডেন্সির শেষ দিনগুলোতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন অথবা লা মোনেদার চারপাশে পাহারারত ট্যাংকগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকা আইয়েন্দে। হেনরি তার ধাঁধাগ্রস্ত চাকরকে আজব সব হুকুম দিতে দিতে মঞ্চ কাঁপাতে লাগল। আর পাতালারগার চেয়ে কাউকে কোনো দিন এতটা ‘ধাঁধাগ্রস্ত’ মনে হওয়া সম্ভব না। গোটা নাটকটা আমার মুখস্থ ছিল, তাই পুরো সময় আমি মনোযোগ দিয়ে খনিশ্রমিকদের হেডল্যাম্পগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সবগুলো হেডল্যাম্প মিলে সাদা আলোর একটা স্বচ্ছ ধারা তৈরি করেছিল, যা একটু পর পর সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে এক অভিনেতার মুখ থেকে আরেক অভিনেতার মুখে গিয়ে পড়ছিল। আমার পালা যখন এল পুরো আলোটা এসে পড়ল আমার মুখে। আমার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা পাতালারগা হঠাৎ অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ছায়ার ভেতরেও দেখা যাচ্ছিল, সে মুচকি হাসছে।
নাটকটার শেষের দিকে আমরা একটু ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেলাম। হেনরির একটা সংলাপে দর্শকের হাসার কথা। কিন্তু দেখি, কারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। বুঝতে পারলাম, আমরা আর দর্শকদের ধরে রাখতে পারছি না। আলোগুলো উপর-নিচ করছে, অথবা ডানে-বাঁয়ে, এদিক-ওদিক এবং একটা সময় আমরা ঝাপসা আলোয় অভিনয় করতে লাগলাম, ভোর হওয়ার আগে যে আলোটা পাওয়া যায় তেমন একটা আলো। আর কখনো এতটা সহজে দর্শকের মন বুঝতে পারিনি আমি; দর্শকদের প্রতিক্রিয়া এতটা দ্রুত এবং সরাসরি আর কখনো ধরতে পারিনি। আলোর ঘাটতি আমাদের চাগিয়ে তুলল। আমরা আবার ভালো করতে শুরু করলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁবু আবার হাসির তোড়ে কাঁপতে লাগল। মঞ্চে আলো এল। এবং একবিন্দু অহংকার না করে বলতে পারি, ঘুমন্ত প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে শেষ লাইনটা আমি ছুড়ে দিয়েছিলাম পুরোপুরি আলোকোজ্জ্বল এক মঞ্চে, সান জার্মানের খনিশ্রমিক আর তাদের মাথার হ্যালোজেন বাতিগুলোর পূর্ণ মনোযোগ আর সহযোগিতায়। যবনিকা বলে কিছু ছিল না, অথবা ধীরলয়ে নিভে আসার মতো কোনো স্টেজলাইট। নাটক শেষ হওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, আলোয় ভাসতে লাগলাম, আর আনন্দে। কেনই বা ভাসবো না?
এর কয়েক সপ্তাহ পর আমি বাড়ি ফিরে আসি। এর পর মাঝেসাঝে পাতালারগা কিংবা হেনরির সঙ্গে কিছু পাড়ার নাটক করা হয়েছে। যখনই তাদের কারও সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কোনো নাটকে, বারে, কিংবা রাস্তায়—আমরা পরস্পর আলিঙ্গন করেছি আর কথা বলেছি সান জার্মানের সেই রাতের পারফরমেন্স নিয়ে। আমি জানতাম, আমার মতো তারাও সে রাতের অভিনয় মনে রেখেছে, যদিও তারা অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ই ভুলে গেছে। তার মধ্যে একটা হলো আমার নাম। কোনো রকম লজ্জা কিংবা দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই তারা আমাকে ডাকত অ্যালিও বলে। যদিও এ ব্যাপারটায় আমি কখনো গা করিনি।… (সংক্ষেপিত)

——————–
দানিয়েল আলার্কোন
দানিয়েল আলার্কোনের জন্ম ১৯৭৭ সালে, পেরুর রাজধানী লিমায়। তিন বছর বয়স থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে। এ পর্যন্ত বের হওয়া তাঁর দুটি উপন্যাস ওয়ার বাই ক্যান্ডেললাইট এবং লস্ট সিটি রেডিও। লিমা থেকে ছাপানো পত্রিকা এতিকেতা নেগ্রার তিনি সহযোগী সম্পাদক। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলের সেন্টার ফর ল্যাটিন আমেরিকান স্টাডিজে ভিজিটিং স্কলার হিসেবেও কাজ করে থাকেন। তাঁর ‘দ্য ইডিয়ট প্রেসিডেন্ট’ গল্পটি অ্যালিস সিবল্ড সম্পাদিত দ্য বেস্ট আমেরিকান শর্ট স্টোরিজ-২০০৯ এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
——————

অনুবাদ: তানিম হুমায়ুন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৮, ২০১০

Category: অনুবাদ
Previous Post:আজ খুব সকালে – পেদ্রো মাইরাল
Next Post:বেকারিতে হামলা – হারুকি মুরাকামি

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑