• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় পরিচয় – গোলাম মুরশিদ

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রবন্ধ » রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় পরিচয় – গোলাম মুরশিদ

হিন্দু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ—এ কথা সবাই জানেন। হিন্দু, মুসলমান—সবাই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সংগীতের সঙ্গে কোনো পরিচয় থাক, না-ই থাক অথবা যত কমই পরিচয় থাক—মুসলমানরা এটা এত ভালো করে জানেন যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে সারা পৃথিবীতে বাঙালিদের গৌরব বৃদ্ধি করলেও, দীর্ঘকাল তাঁকে নিজেদের কবি বলেই স্বীকার করতে চাননি। এ নিয়ে তর্ক-কুতর্ক সবই হয়েছে সাম্প্রতিক কালেও। কদিন আগে ২ মে শেক্সপিয়ারের জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের যে বাড়িতে, সেই বাড়ি দেখে এলাম। তাঁর বাগানে অন্য আর একজন মাত্র বিখ্যাত মানুষের একটি আবক্ষমূর্তি বসানো আছে। সেটি আমাদের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের। ছয় হাজার মাইল দূরের জোড়াসাঁকো থেকে সুদূর স্ট্র্যার্টফোর্ডে চলে এসেছেন। দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠল। কিন্তু একজন সহযাত্রী, যিনি ৪২ বছর বিলেতে আছেন বলে গর্ব করেন, তিনি বললেন, ‘সামনেরবার এসে ওই মূর্তিটা সরিয়ে ওখানে নজরুলের একটি মূর্তি বসিয়ে যাব।’ কাজেই, রবীন্দ্রনাথ অমুসলমান ছিলেন—বাঙালি মুসলমানদের একটা অংশ এখনো এটা ভুলতে পারেননি।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নিজের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে ততটা নিশ্চিত ছিলেন না। কারণ, বেশির ভাগ মানুষের মতো যে ধর্ম নিয়ে জন্মেছিলেন, সেই পারিবারিক ধর্মমত তিনি চিরকাল আঁকড়ে রাখতে পারেননি। সত্যি বলতে কি, কোনো কিছু নিয়েই তিনি অচল ছিলেন না। গাছ যেমন প্রতি বসন্তে সজ্জিত হয় নতুন পাতায়, তিনও তেমনি নব-নব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তাই বার্ধক্যে পৌঁছে নিজের কথা বলতে গিয়ে এক জন্মদিনে বলেছেন, তিনি হলেন ‘নানা রবীন্দ্রনাথের একখানি মালা।’ তাঁর সম্পর্কে এর মতো সত্য কথা খুব কমই আছে। তাঁর কবিতা, কবিতার বিষয়বস্তু, ছন্দ, স্টাইল; তাঁর গান, গানের সুর ও তাল; তাঁর গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ, গদ্যরীতি; তাঁর সমাজচিন্তা, শিক্ষাদর্শন—প্রতিটি বিষয় সম্পর্কেই এ কথা প্রযোগ্য। এক কথায়, ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’ তিনি সত্যকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন। তার পরও সেই ধ্রুব সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে বলেছেন, সৃষ্টির পথ সরল নয়, সে আকীর্ণ বিচিত্র ছলনাজালে। সেই ছলনার রহস্য উন্মোচন করা অসম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন কলকাতার একটি ব্রাহ্ম পরিবারে। ব্রাহ্মদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। মতাদর্শ অনুযায়ী সেই মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মই আবার বিভক্ত ছিলেন তিন ভাগে। এগুলোর মধ্যে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ছিল সবচেয়ে আধুনিক। আর নাম ও মতাদর্শ উভয় দিক দিয়েই আদি ব্রাহ্মসমাজ ছিল সবচেয়ে প্রাচীন। সেই আদি ব্রাহ্মসমাজেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। ১৮৭০-এর দশকের গোড়ায় এই সমাজের সত্যিকার পরিচয় হলো: ‘উন্নত হিন্দু’ হিসেবে। না ঘাটের, না জলের। সাধারণ হিন্দুরা তাঁদের হিন্দু বলেই মানেন না। অপর পক্ষ্যে, ব্রাহ্মরা নিজেদের বিবেচনা করেন সাধারণ হিন্দুদের তুলনায় ‘উন্নত’ বলে। বস্তুত, ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে তাঁদের গোঁড়ামি কারও তুলনায় আদৌ কম ছিল না। বছর চব্বিশ বয়সের তরুণ রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের কর্মকর্তা হিসেবে যেভাবে তাঁর পক্ষ নিয়ে আর-একজন বিশুদ্ধ হিন্দু—বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে যান, সে তাঁর নিজের ধর্মীয় স্বরূপ সম্পর্কে গোঁড়ামিরই প্রতিফলন।
এখানে সংক্ষেপে বলা দরকার: একটা আনুষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করেন রবীন্দ্রনাথের পিতা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ওপর কোনো দৈববাণী নাজেল হয়নি। তিনি নিজেই ছিলেন ধর্মগ্রন্থের প্রণেতা। প্রধানত বিভিন্ন উপনিষদ থেকে কিছু শ্লোক বাছাই করে এবং কোনো কোনো জায়গায় সেগুলোকে যুগোপযোগী করার উদ্দেশ্যে সম্পাদনা/সংশোধন করে প্রকাশ করেন। তার আগে তিনি এও জেনে নিয়েছিলেন যে, বেদে যা কিছু লেখা আছে, তার সবই অভ্রান্ত কিনা। অভ্রান্ত নয়। না হওয়ারই কথা। আড়াই হাজার বছর আগের ঋষিদের প্রেসক্রিপশনে উনিশ শতকের সমস্যা দূর হবে না—এটা তাঁর কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই তিনি অনুভব করেছিলেন। তা ছাড়া, অন্য দার্শনিকদের ভাবনা দিয়েও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। যেমন—পারস্যের কবি হাফিজ তাঁর ধর্মচিন্তাকে প্রভাবিত করেছিলেন। কতগুলো ব্যাপারে তিনি খুব আধুনিক ছিলেন, কিন্তু তাঁর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অনেকটাই ছিল গোঁড়ামিতে ভরা। তিনি ছিলেন বিশাল এক মহীরুহের মতো। তাঁরই ছায়ায় মানুষ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই প্রভাব এত গভীর ছিল যে, যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন (১৯০৫), তত দিন রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি।
রবীন্দ্রনাথ যদি পারিবারিক ধর্মে অর্থাৎ ঔপনিষদিক ব্রাহ্মধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতেন, তাহলে তাঁকে বলা যেত তিনি আর দশজনের মতোই সাধারণ। কিন্তু না, তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের সীমানা অতিক্রম করেছিলেন অল্পকালের মধ্যেই। নতুন কোনো গুরুর সন্ধান তিনি পাননি অথবা কারও কাছে তিনি দীক্ষাও গ্রহণ করেননি। তা সত্ত্বেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি ধর্মচিন্তা বদলে যেতে আরম্ভ করল। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এর সূচনা হয় যখন তিনি ক্ষুদ্র জোড়াসাঁকো তথা কলকাতার সীমানা পেরিয়ে বৃহত্তর সমাজের মুখোমুখি হলেন, তখন। তখন থেকেই তিনি হূদয় প্রসারিত করে চারদিকে চেয়ে দেখলেন।
জমিদারি সূত্রে তিনি শিলাইদহে বাস করতে আরম্ভ করেন ১৮৯০ সালে। সেখানে গিয়ে দেখলেন, সেখানকার সমাজের চেহারা কলকাতার চেয়ে একেবারে আলাদা। সাধারণ মানুষ ধর্ম বলে যা পালন করেন, তা নাগরিক ধর্ম থেকে ভিন্ন। অনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত। ধর্মমতের সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়ে সেখানে তৈলাধার কি পাত্র, না পাত্রাধার কি তৈল—এ রকমের বিতর্কে কেউ লিপ্ত হয় না। গ্রামের সাধারণ লোকেরা ধর্মগ্রন্থের বিধান অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন না। তাঁদের কাছে ধর্ম মানে পিতৃপুরুষের বিশ্বাসকে অন্ধভাবে পালন করা। ধর্মের প্রধান ভাগই সেখানে অন্ধবিশ্বাস।
কেবল তাই নয়, সেখানেই তিনি লক্ষ করলেন যে দেশ ও সমাজ মানে হিন্দু নয়, তার একটা বড়ো অংশ—কোথাও কোথায় প্রধান ভাগ মুসলমান, যাঁদের ছুঁলে ব্রাহ্মণকে স্নান করতে হয়। যাঁদের ছোঁয়া-লাগা পাত্র ফেলে দিতে হয়, নয়তো নিতে হয় পবিত্র করে। তদুপরি, দেখলেন বাউলদের। কোনো দেবতা নেই তাঁদের। নেই কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। বরং আনুষ্ঠানিকতাকে তাঁরা ধর্ম পালনের প্রধান বাধা বলে গণ্য করেন। তাঁদের কবি বলেন, ‘তোমার পথ ঢাইকাছে মসজিদে, মন্দিরে!’ সেই লোকধর্ম দিয়ে তখনই তিনি প্রভাবিত হলেন কি না, বলা মুশকিল, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি খুলে গেল।
ওদিকে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তখন প্রবল হচ্ছিল। সেকালের জাতীয়তাবাদ মানে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। আরও পেছনে গিয়ে হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করে মূলে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন—মৌলবাদী পরিচয় খোঁজা এবং তাকে জোরদার করার জন্যে আন্দোলন। সে যুগেই ‘সব বেদে আছে’র মনোভাব গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে এই গোঁড়ামির তীব্র বিরোধিতা করলেও, ১৯০০ সালের দিকে তাঁর চিন্তাধারায় বিলক্ষণ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের মতো কয়েকজন ব্যক্তির প্রভাবও পড়ে তাঁর ওপর। সবকিছু মিলে অল্পদিনের জন্যে তিনিও প্রাচীন ভারতের তপোবনে ফিরে গেলেন। ব্রাহ্মদের জাতিভেদ না-মানার আদর্শ পর্যন্ত বিসর্জন দিলেন। কিন্তু এটা ছিল বিদ্যুৎ চমকালে যেমন ক্ষণিকের জন্যে দৃষ্টির বিভ্রম ঘটে, তেমনি। বিশ্বাসে পরিণত হওয়ার আগেই তিনি সেখান থেকে ফিরে এলেন।
অন্যান্য কারণের মধ্যে যা তাঁকে মুক্তি দিতে সাহায্য করেছিল, তা হলো দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু আর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে। দুটোই ঘটে ১৯০৫ সালে এবং এই বছরটাকে বলা যায় তাঁর জীবনের একটা ক্রান্তিকাল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তিনি হিন্দু-গোঁড়ামির যথার্থ স্বরূপ, বিস্তার ও তীব্রতা উপলব্ধি করলেন। জাতিভেদ প্রথা হিন্দু-মুসলমান—এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে-বিভেদের প্রাচীর নির্মাণ করেছিল, তা যে চীনের প্রাচীরের মতো দুর্ভেদ্য ও দুর্লঙ্ঘ্য, তাও তিনি অনুভব করলেন। অনুভব করলেন, বাঙালি সমাজের অর্ধেকের বেশি গড়ে উঠেছে মসলমানদের নিয়ে। তাঁর নতুন-পাওয়া উপলব্ধির ছাপ পড়ল তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়। গানের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে পারি, এর আগে পর্যন্ত তিনি আবদ্ধ ছিলেন প্রধানত ধ্রুপদী বলয়ে। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের সময়ে তিনি স্বদেশি গান ধ্রুপদী সুরে নয়, টপ্পা চালে নয়, লিখলেন সহজ-সরল বাউল সুরে।
জীবনের প্রথম ৪৪ বছর তিনি সাহিত্য, সংগীত, সমাজভাবনা ও ধর্মীয় পরিচয়ে যেখানে সীমাবদ্ধ ছিলেন, সেখান থেকে তিনি সরে এলেন। একে বলতে পারি তাঁর নিজের সীমানা পার হওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনা। তাঁর নতুন মনোজগতে ধর্মীয় পরিচয় হলো গৌণ, সেখানে মুখ্য হয়ে দেখা দিল মনুষ্যত্ব। তাঁর ওই সময়ের লেখা একটি উপন্যাসের চরিত্র—গোরা গ্রামবাংলায় গিয়ে প্রথমবারের মতো স্বদেশের সত্যিকার চেহারা দেখেছিল। গোরার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথও তেমনি সত্যিকার স্বদেশকে দেখেছিলেন শিলাইদহে গিয়ে। এই শিলাইদহে বেড়াতে গেলে (৩০ ডিসেম্বর ১৯০৪ থেকে ২ জানুয়ারি ১৯০৫) সেখানেই তিনি সিস্টার নিবেদিতাকে গোরার গল্প শুনিয়েছিলেন, যদিও তা লিখতে আরম্ভ করেন আরও আড়াই বছর পরে—১৯০৭ সালের জুলাই মাসে। গোরার মতো নিবেদিতাও ছিলেন আইরিশ ও কট্টর হিন্দুত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু তাঁর গোরা শেষ পর্যন্ত উগ্র হিন্দু জাতীয়তা থেকে মুক্তি লাভ করেছিল। ধর্মীয় পরিচয় যে একমাত্র অথবা সবচেয়ে বড়ো পরিচয় নয়, তাঁর মনে এ ধারণা এর আগেই দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছিল। গীতাঞ্জলি, গীতালি, গীতিমাল্যের গানেও তাঁর এই ধারণার প্রতিফলন লক্ষ করি। আর্য-অনার্য, শক-হুন, মোগল-পাঠান সবাইকে তিনি মহামানবের তীরে আহ্বান জানিয়েছেন। সবার হাত ধরে ব্রাহ্মণদের মনকে শুচি করার ডাক দিয়েছেন।
এখানেই রবীন্দ্রনাথ থেমে থাকেননি। ঘরে-বাইরের মধ্যে আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে নেশন বা জাতীয়তাবাদও যে দৃষ্টিকে সংকীর্ণ করে, তৈরি করে মানুষে মানুষে ভেদের দূরত্ব, প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরিষ্কার করে সে কথাও তিনি শুনিয়েছেন দেশে এবং বিদেশে। না আগ্রাসী জাপান, না আঞ্চলিক আমেরিকা, না দর্পিত ব্রিটেন—কেউই তাঁর বক্তব্যকে স্বাগত জানায়নি। নজরুল ইসলাম তখনো আবির্ভূত হননি। ‘মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’—নজরুল এ কথা লেখার এক যুগেরও আগে রবীন্দ্রনাথ এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন। সেই উপলব্ধির ফলেই তিনি ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকেন আনুষ্ঠানিক ধর্ম থেকে—আরও সঠিক করে বলতে হলে বলতে হয়—ধর্মতন্ত্র থেকে।
নিজের এই বিশ্বাসের তিনি সমর্থন পেলেন বাউলদের গানে। বেশ কিছু বাউল গান সংগ্রহ করে ১৯১৫ সালে তিনি প্রবাসীতে প্রকাশ করেছিলেন। অন্যদেরও সংগ্রহ করার উৎসাহ দিয়েছিলেন। বোঝা যায়, তাঁর মনে ধর্ম সম্পর্কে যে নতুন ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল, তারই সমর্থন তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন বাউলদের গানে। এমনকি আজীবন লালিত ঔপনিষদিক দর্শনের সঙ্গেও তিনি এ সময় থেকে বাউলদের একটা সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন। যে সত্যের বাণী তিনি উপনিষদের শ্লোকে শুনতে পেয়েছিলেন, তার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন বাউল গানে। সেই সত্যকে কোনো আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে বাঁধা যায় না। তাঁর ধর্মচিন্তা শাস্ত্রের ভূমি ছেড়ে প্রাণের আকাশে উধাও হলো। শেষ পর্যন্ত তিনি যে ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারলেন, তা মানুষের ধর্ম। সকল মানুষের ধর্ম। কোনো আচার-অনুষ্ঠানের সীমানায় যকে বাঁধা যায় না। শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁকে বঙ্গদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বাউল বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এ দিয়ে তাঁকে একটা তত্ত্বের মধ্যে ধরার চেষ্টা করা হয়, আসলে তিনি সকল ধর্মতত্ত্ব এবং ধর্মতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠেছিলেন। ১৯৩০ সালের আগেই নিজের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে তাঁর মনে এই ধারণা তৈরি হয়েছিল।
এরপর তিনি আরও প্রায় এগারো বছর বেঁচেছিলেন। ইতিমধ্যে বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমানের ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব দেখেছিলেন, দাঙ্গা দেখেছিলেন, রাজনীতির নামে স্বার্থের হানাহানি দেখেছিলেন। বৃহত্তর বিশ্বে দেখেছিলেন জাপানিরা চীনে গণহত্যা চালানো শুরু করেছিলেন অহিংসার বার্তা যিনি প্রচার করেছিলেন—সেই বুদ্ধির মন্দিরে পুজো দিয়ে। হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব দেখে তাঁর হূদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। সভ্যতার সংকট দেখে ঈশ্বরেই তাঁর বিশ্বাস বিচলিত হয়েছিল। দীর্ঘ জীবনে এক জায়গায় তিনি দাঁড়ায়ে থাকেননি সাধারণ মানুষের মতো, বরং সত্যের সন্ধানে ক্রমাগত অন্তহীন পথে চলেছেন। তাঁর এই পথচলা কখনো শেষ হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর প্রায় ৭০ বছর চলে গেছে। কিন্তু তিনি মানবতার যে গান গেয়েছেন, তা অর্থহীন হয়ে যায়নি। বরং আজ যেন আরও বেশি করে সেই মানবতার জয়গান গাইবার দিন এসেছে। তিনি যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন জাতিহীন ধর্মহীন আন্তর্জাতিক মানুষে পরিণত হওয়ার, সে শিক্ষার প্রয়োজন আজ আরও তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বদেশে এবং বিদেশে মানুষ যখন জাতীয় স্বার্থে, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে, ধর্মের নামে ক্ষুদ্র স্বার্থের লোভে হানাহানিতে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, রক্তপাত ঘটাচ্ছে নির্বিচারে, অসহায় মানুষ্যত্ব যখন নিষ্ফলভাবে মাথা কুটছে, তখন সেই প্রগাঢ় অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ এবং শিক্ষা আমাদের পথ চলার সম্বল হতে পারে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৭, ২০১০

Category: প্রবন্ধ
Previous Post:রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি – সুধা সেন
Next Post:বাংলাদেশ-পূর্ব ও উত্তর রবীন্দ্রনাথ – শান্তনু কায়সার

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑