• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

জন্মদিনের শ্রদ্ধা – শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » বিশেষ রচনা » জন্মদিনের শ্রদ্ধা – শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

‘শহীদ জননী’ বলে জাহানারা ইমামকে যথেষ্ট বড় করা হয় কিনা জানিনে। কারণ, তাহলে তাঁর নিজের চেয়ে কৃতিত্ব বেশি দেওয়া হয় তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানকে। সন্তানের পরিচয়ে তাঁর পরিচয়। কিন্তু আসলে তাঁর নিজের কৃতিত্ব ও অর্জনের জন্যেই তিনি প্রখ্যাত।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনের মাধ্যমে দুর্বল স্মরণশক্তির অধিকারী বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট ফের মনে করিয়ে দেওয়ার সাফল্য কিছু কম নয়। জিয়াউর রহমান আর এরশাদের ফৌজি শাসনে মূলধারা থেকে সরে যে-বাংলাদেশ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল, সেখান থেকে সেই ধারাকে আবার মূলের দিকে ফিরিয়ে আনার যে-সফল সংগ্রাম তিনি করেছিলেন, সেই কৃতিত্ব কোনো শহীদের চেয়ে কম নয়। তিনি শহীদ হননি, তিনি ছিলেন একটি সংগ্রামের সফল সেনাপতি। মৃত্যুশয্যা থেকেও তিনি তাঁর সৈনিকদের, স্বাধীনতার সমর্থনকারী বাঙালিদের আহ্বান জানিয়েছিলেন অসমাপ্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। তিনি লিখেছিলেন যে আমাদের লক্ষ্য অর্জন না-হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থেকে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, ‘জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’
কিন্তু এটা তাঁর ব্যক্তিত্ব ও অবদানের একটা দিক মাত্র। তিনি কেবল স্বাধীনতার ইতিহাস লেখেননি, সত্যিকার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আহ্বানও জানাননি। তাঁর প্রকাশনার জন্যও তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
যুদ্ধের আগে তিনি লেখিকা ছিলেন বলে শুনিনি। লেখার চেষ্টা হয়তো করেছিলেন। তাঁর প্রথম বই অন্য জীবন (১৯৮৫) আমি পড়িনি। কিন্তু পরের বছর যে-গ্রন্থটি প্রকাশ করেন—একাত্তরের দিনগুলি (১৯৮৬)—উপন্যাস নয়, কাব্য নয়, নিতান্তই ডায়েরি তা। বইয়ের নামটি যেমন অতি অনাড়ম্বর, লেখার ভঙ্গিও তেমনি সহজ, সরল, নির্মেদ, কিন্তু সাবলীল। লিখেছেন প্রধানত নিজের কথা, অথচ নৈর্ব্যক্তিক। যেন অন্য কেউ হয়ে নিজেকে দেখেছেন। একটা দৃষ্টান্ত দিই।
অসুস্থ স্বামী হাসপাতালে আছেন, হাসপাতালে চরম অব্যবস্থা। ১৩ ডিসেম্বর রাতের কথা।
আমি এ কে খানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেশিনটা? মেশিনটা লাগাচ্ছেন না কেন?’ শরীফের বুকে হাতের চাপ দিতে দিতে একজন ডাক্তার বললেন, ‘লাগাব কী করে? হাসপাতালের মেইন সুইচ বন্ধ। ব্ল্যাকআউট যে।’
‘হাসপাতালের মেইন সুইচ বন্ধ রেখে ব্ল্যাকআউট? এমন কথা তো জন্মে শুনিনি! তাহলে মরণাপন্ন রোগীদের কী উপায় হবে? লাইফসেভিং মেশিন চালানো যাবে না?’
১৪ ডিসেম্বর:
শরীফকে বাসায় আনা হয়েছে সকাল ১০টার দিকে। মঞ্জুর, মিকি—তাঁরা দুজনে ওদের পরিচিত ও আত্মীয় পুলিশ অফিসারকে ধরে গাড়িতে আর্মড পুলিশ নিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা পিকআপ জোগাড় করে হাসপাতাল থেকে ওকে নিয়ে এসেছেন।
সকালবেলায় প্লেনের আনাগোনা একটু কম ছিল। আজ কারফিউ ওঠেনি। তবু আমাদের গলিটা কানা বলে, খবর পেয়ে সব বাড়ির লোকেরা এসে জড়ো হতে পেরেছে।
হাসপাতালের দুর্গতি, পিকআপ জোগাড়ের কসরত, পাড়ার লোকেদের কথা—সবই বলেছেন, খালি স্বামী যে মারা গেছেন, সেই মর্মান্তিক খবরটা দেননি পাঠককে। এর থেকে নৈর্ব্যক্তিক, এর থেকে নির্লিপ্ত লেখা কি সম্ভব? আরও একটা জিনিস লক্ষ করি। বাক্যগুলো ছোট ছোট। শব্দগুলো আটপৌরে। অন্তত অলংকৃত ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির কোনো চেষ্টাই নেই। মনে হয়, কোনো ভাষা ছাড়াই সব কথা বলে গেছেন। একাত্তরের দিনগুলি একটি অসাধারণ সাহিত্যকীর্তি, একটি অসাধারণ ইতিহাস, একটি অসাধারণ অনুপ্রেরণা।
অন্য কিছু না-লিখলেও চলত। কিন্তু মুখের ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পরেও তিনি গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন অনেকগুলো। জীবন মৃত্যু, বুকের ভিতরে আগুন, নাটকের অবসান, দুই মেরু, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, প্রবাসের দিনলিপি—অনেকগুলো বই লিখেছেন তিনি। ১৯৯১ সালে তিনি সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়ে তিনি বড় হয়েছেন, না পুরস্কারটা বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করেছে, বলা কঠিন। কারণ বহু অজ্ঞাত লোকই এই পুরস্কার পেয়েছেন।
জাহানারা আপার সঙ্গে শেষবার দেখা হয় লন্ডনে। সিরাজ ভাই (বিবিসির) একদিন বললেন, ‘প্রফেসর, জাহানারা আপাকে দেখতে যাবেন?’ আমি সাধারণত অপরিচিত জায়গায় যেতে কুণ্ঠা বোধ করি। কিন্তু জাহানারা আপার কথা শুনে রাজি হয়ে গেলাম। পশ্চিম লন্ডনের যে-বাড়িতে সিরাজ ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন, সেটি তাঁর ছেলের বাড়ি। ভাবলাম, ছেলের সঙ্গে দেখা করে তারপর যাবেন জাহানারা আপার সঙ্গে দেখা করতে। ঠিক সেই সময়ে এক ভদ্রমহিলা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। খুব ছোট ছোট চুল। চোখে চশমা। সিরাজ ভাই ‘বুবু’ বলে সম্বোধন করলেন। আমি আমার স্বাভাবিক সংকোচ ও লজ্জার কারণে এই অপরিচিত ভদ্রমহিলাকে এড়াতেই চেষ্টা করলাম। কিন্তু হঠাত্ তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো: এ চোখ তো আমি চিনি! আরে এই তো জাহানারা আপা! তিনিও চিনতে পেরে মুহূর্তের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।
এককালের সেই সুন্দরী, সপ্রতিভ, অভিজাত, সুভাষিণী জাহানারা ইমাম! যাঁকে লোকে বলত ঢাকার সুচিত্রা সেন! অতি বড় কল্পনাবিলাসীও সেই জাহানারা ইমামের সঙ্গে ক্যারসারে আক্রান্ত, জিভের একটা অংশ কেটে বাদ দেওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া এই মহিলার কোনো মিল খুঁজে পাবে না। কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, সেই চোখ ছাড়া। কথাবার্তার মধ্যে এক সময়ে আমি বললাম, আপা, আপনার একাত্তরের দিনগুলি অসাধারণ বই হয়েছে। আপনি কী অসাধারণ ভারহীন ভাষায় লিখেছেন! মনেই হয় না কোনো ভাষায় লেখা। মনে হয় যেন কান্নার মতো স্বতঃস্ফূর্ত, শব্দহীন ভাষায় লেখা। ভাষাহীন ভাষাই মনের কথা পাঠকের মনের কাছে পৌঁছে দেয়। জাহানারা আপা বললেন, ‘ভাই, তুমি এই কথাগুলো লেখো না কেন কোথাও!’ বললাম, ‘লিখব।’ বিশ বছর পরে সেই কথা লিখছি আজ।
প্রথম যে-ক্লাসটি হয়েছিল, যদ্দুর মনে পড়ে, মুনীর স্যারের, তাতে তিনি হাজির ছিলেন কি না, মনে নেই। নিজেকে নিয়ে তখন এতই বিব্রত যে, অন্যদিকে তাকানোর সময় হয়নি। যেদিনের কথা পষ্ট মনে আছে, সেদিন ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। উনি এসেছিলেন কয়েক মিনিট দেরি করে। তাই দরজায় দাঁড়িয়ে খানিকটা হাসি-হাসি মুখ করে, খানিকটা বিব্রত হওয়ার ভঙ্গিতে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন। অবাক হলাম তাঁর স্মার্ট ভঙ্গি দেখে। আর সেই সঙ্গে অনুমতি চাওয়ার বাক্যটা শুনে। আমরা তো চিরদিন ‘মে আই কাম ইন স্যার’ই বলেছি। কিন্তু উনি বললেন, ‘আসতে পারি?’ আরও একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম—ভারী সুদর্শন তিনি।
ওই দিনের কথা মনে থাকলেও, তখন পরিচয় হয়নি। পরিচয় হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ পরে, টিউটরিয়াল ক্লাসে। আমাদের এই ক্লাসে আমরা ছিলাম মোট আটজন। সাতজন মেয়ে আর আমি একা পুরুষ। এই সাতজনের মধ্যে একজন জাহানারা ইমাম। এ অবস্থায় অন্য পুরুষেরা সম্ভবত খুশিই হতেন। কিন্তু আমি বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমি কোনো দিন মেয়েদের সঙ্গে একত্রে লেখাপড়া করিনি—স্কুলে নয়, কলেজেও নয়। তা ছাড়া, বাড়িতেও দ্বিতীয় কোনো মহিলাকে দেখিনি। সুতরাং এতজন মহিলার মধ্যে গ্রামের ছেলে আমি, খুবই বিব্রত হয়েছিলাম।
প্রথম টিউটরিয়াল হয়েছিল মুনীর স্যারের সঙ্গে। পুরোনো কলাভবনের দোতলায় ওঠার একটাই সিঁড়ি ছিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ দিকের প্রথম রুমে টিউটরিয়াল। মেয়েরা সেই ঘরে আগে থেকে ঢুকে তাঁদের পরিচয়কে আরও ঘনিষ্ঠ করে নিচ্ছিলেন। আমি ঢুকতে ভরসা পেলাম না, ভারি লজ্জা করছিল। তাই ওই ঘর থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মুনীর স্যারকে আসতে দেখে ক্লাসে ঢুকলাম তাঁর পেছনে পেছনে। মুনীর স্যার নিশ্চয় মনে মনে অট্টহাস্য করেছিলেন, কিন্তু মুখে হাসেননি। আর আমি যে লজ্জা ও সংকোচের কারণে শিক্ষকের পেছনে পেছনে ক্লাসে ঢুকেছিলাম, সেদিনই মেয়েরাও তা হয়তো বুঝতে পারেননি। কিন্তু অচিরেই পেরেছিলেন। কারণ দু-এক দিনের মধ্যে আবার ক্লাসরুমে ঢুকেছিলাম নীলিমা আপার (ইব্রাহিম) পেছনে পেছনে। সাতজন মেয়ের ক্লাসে একজন পুরুষ ঢুকল একজন মহিলা শিক্ষকের পেছনে পেছনে—এমন ঘটনা এর আগে হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। কিন্তু সেই প্রথম হলেও শেষ নয়, এর পরেও আমি নীলিমা আপার পেছনে পেছনে ঢুকেছিলাম। আমার সহপাঠিনীরা এরপর প্রথমে কনফার্মড, তারপর রি-কনফার্মড হয়েছিলেন যে আমি পুরুষজাতির কুলাঙ্গার, নারী-অধিক পুরুষ।
এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে আমাকে রক্ষা করার জন্য যিনি এগিয়ে এলেন, তিনি জাহানারা আপা। নিজের থেকে এসেই আলাপ করেছিলেন আর তাঁকে আপা বলার কথাও বলেছিলেন। জাহানারা আপা আমাদের বারো/চৌদ্দ বছর আগে কলকাতার লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেছিলেন। ঘরসংসারও করেছিলেন। তারপর শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা। ১৯৬১ সালে তিনি আবার নতুন করে এমএ পড়তে এলেন। আমরা যারা তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম, সবাই তাঁকে আপাই বলতাম। আর তিনিও বড় বোনের মতোই স্নেহমেশানো মিষ্টি ব্যবহার করতেন আমাদের সঙ্গে।
আমি ছিলাম বিজ্ঞানের ছাত্র। তারপর রসায়নে অনার্স ছেড়ে দিয়ে যখন বিএ পড়তে গেলাম, তখন বলতে গেলে কলেজে যাইইনি। পরীক্ষায়ও বাংলাতেই সবচেয়ে কম মার্ক পেয়েছিলাম। কিন্তু এমএ পড়তে গিয়ে আমি বাংলাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিলাম। টিউটরিয়ালে নীলিমা আপার দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু মুনীর স্যারের দৃষ্টি একটু বেশিই কেড়েছিলাম। জাহানারা আপা আমাকে তাই বেশ খাতির করতে শুরু করেন। দু-একবার আমার টিউটরিয়ালের খাতাও নিয়েছেন।
ছেলেদের মধ্যে আরেকজনের সঙ্গে জাহানারা আপার পরিচয় ছিল। তাঁর নাম মীর্জা হারুনুর রশিদ। মুর্শিদাবাদের ছেলে। জাহানারা আপার মূল বাড়িও মুর্শিদাবাদে। যদিও সরকারি চাকুরে বাবার সঙ্গে অনেক বছরই কেটেছিল পূর্ব বাংলার জেলাগুলোতে। মুর্শিদাবাদের সূত্র ধরেই একবার জাহানারা আপা আমাদের দুজনকে নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর বাসায় যেতে। বললেন, এলিফ্যান্ট রোডে একটা বাড়ির ওপরে দেখো একটা ছোট বিমান। ওইখানে। আমরা গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। সেখানেই দেখি তাঁর দুই ছেলে রুমি আর জামিকে। আট-দশ বছর বয়স। ফুটফুটে সুন্দর চেহারা। একজনের চোখে চশমা অথবা দুজনেরই।
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে আমাদের পরীক্ষা হয়ে যায়। আমি ঢাকা থেকে নির্বাসিত হই মফস্বলে। তারপর জাহানারা আপার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়েছিল বলে মনে নেই। এমনকি, কী করে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় দেখা হলো, তাও ভুলে গেছি। কিন্তু তিনি নিজের থেকেই এসেছিলেন পার্ক সার্কাসে জাস্টিস মাসুদের যে-ফ্ল্যাটে আমরা থাকতাম, সেখানে। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণে আমি সেখানে গিয়েছিলাম ‘বিদ্যাসাগর বক্তৃতামালা’ দেওয়ার জন্য। আর জাহানারা আপা গিয়েছিলেন কলকাতার সঙ্গে পুরোনো স্মৃতিগুলো মিলিয়ে নিতে। ১৯৭১ সালের অগস্ট মাসে তিনি হারিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জ্যেষ্ঠপুত্রকে। এর অল্প পরেই—যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগে হারান স্বামীকে। যাঁকে তিনি বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে। যাঁর সঙ্গে ভালোবাসার সেই প্রথম দিনগুলোতে কলকাতায় বেড়িয়েছিলেন অনেক। সেই সব জায়গা ঘুরে ঘুরে স্মৃতির মানচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে গিয়েছিলেন। এমনকি, হয়তো মনের মধ্যে ক্ষীণ আশাও ছিল যে কলকাতায় মিলতে পারে রুমির কোনো খবর।
একদিন তাঁকে বললাম, ‘জাহানারা আপা, যাবেন জর্জদার সঙ্গে দেখা করতে?’ জর্জদা মানে দেবব্রত বিশ্বাস। আমার বাবার থেকে বছর দুয়েকের ছোট, কিন্তু সবার মতো আমিও তাঁকে জর্জদা বলতাম। আর তিনিও খুব স্নেহ করতেন আমাকে। ১৯৮০ সালের অগস্ট মাসে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ অক্ষুণ্ন ছিল। জর্জদার বাড়িতে যেতে রাজি হয়ে গেলেন জাহানারা আপা। একদিন সকালের দিকে এলেন আমাদের ফ্ল্যাটে। সেখান থেকে না-জানিয়েই চলে গেলাম জর্জদার বাড়িতে।
জর্জদা থাকতেন রাসবিহারি এভিনিউর ছোট্ট একটি ভাড়াটে বাড়িতে। চৌকি বাদ দিলে সামান্যই জায়গা বাকি থাকত সেই ঘরে। সেই একচিলতে জায়গার মধ্যে আবার জর্জদার ইজি চেয়ার আর রাজ্যের জিনিসপত্র এলোমেলো করে রাখা—ব্যাচেলরের ঘরের অবস্থা যেমন হয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও জাহানারা আপাকে দেখে জর্জদা বিব্রত হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। ‘ইনি কেডা?’ বলে সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন। আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম। তাঁর স্বভাবসুলভ কিশোরগঞ্জি ভাষাতেই জর্জদা আলাপ করতে থাকলেন। যথাসময়ে অনন্ত চা-ও নিয়ে এল। সেদিন তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। ক্লান্ত ছিলেন। সামান্য জ্বরও ছিল। কিন্তু জাহানারা আপাকে দেখে সে কথা বলতে পারছিলেন না।
একটু পরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গান হুনবেন?’ জাহানারা আপা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ স্বাস্থ্য ভালো না-থাকায় নিজে গেয়ে শোনালেন না। বরং কদিন আগে উনি আমার জন্য যে-গানগুলো রেকর্ড করেছিলেন, সেই গানই বাজিয়ে শোনালেন। প্রথম গানটা ছিল ‘কাছে ছিলে দূরে গেলে/ দূর হতে এসো কাছে।’ জাহানারা আপার জন্য দুঃখের গান।
চার-পাঁচটা গানের পর একটা গান ছিল ‘অসীম ধন তো আছে তোমার তাহে সাধ না মেটে/নিতে চাও তা আমার হাতে কণায় কণায় বেঁটে।’ আমরা দুজনই নীরবে গান শুনছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, জাহানারা আপা ভাবাবেগে অভিভূত হচ্ছিলেন। তারপরের গানটা যখন বাজতে শুরু করল: ‘এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে!’ জাহানারা আপা সেটা আর নিতে পারলেন না। তিনি কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়লেন। এ গান যেন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়েই লিখেছিলেন। স্নেহ-ভালোবাসা, ছোট পরিবার, প্রভাব-প্রতিপত্তি, টাকা-পয়সা নিয়ে জাহানারা আপা ছিলেন পরিপূর্ণভাবে সুখী। তারপর কোথা থেকে ঝড় এসে তাঁর সাজানো বাগান একেবারে তছনছ করে দিয়েছিল। কোন অদৃশ্য শক্তি যেন ক্রূর রঙ্গে তাঁকে ভিখারি সাজিয়েছিলেন।
জাহানারা আপাকে কাঁদতে দেখে জর্জদা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বুঝতে পারলেন না, কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন। জ্বর সত্ত্বেও হার্মোনিয়াম টেনে নিয়ে বললেন, ‘আরে ওসব গান থাক! জানেন, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন কী গান করতাম? এই বলে শুরু করলেন ‘কারার ঐ লোহ কপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট!’ সেবার জর্জদার গলা একটানা অনেক দিন খুব ভালো ছিল। বোধহয় হাঁপানিও কম ছিল। যখন গাইলেন ‘হা হা হা পায় রে হাসি’ তখন সেটাকে হাহাহা মনে হলো না, তার মধ্যে সত্যিকারের হাসিও শোনা যাচ্ছিল, যেমন খানিকটা শোনা গিয়েছিল তাঁর গাওয়া চিত্রাঙ্গদার ‘হা হা হা বালকের দল’ গানে। ‘হা হা হা পায় রে হাসি’ অমন করে বঙ্গদেশে একজনই গাইতে পারতেন—তিনি দেবব্রত বিশ্বাস। কিশোর কুমারেরও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, কিন্তু গলায় দেবব্রতের জোর ছিল না। গান গাওয়া ছাড়াও হাসির গল্প শুনিয়েছিলেন জর্জদা, যতক্ষণ না জাহানারা আপা খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছিলেন। এই গান রেকর্ড করার জন্য জর্জদাকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তিনি ‘হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল’কে বলবেন বলে কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই গান তাঁর গলায় রক্ষা পায়নি।
সেই ১৯৭৩ সালে রাজশাহীতে ফিরে আসার পর, জাহানারা আপার সঙ্গে ঢাকায় আর দেখা হয়েছিল কি না, মনে পড়ছে না। অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হলো বিভুঁয়ে। তার পরও আর দেখা হয়নি। ৩ মে তাঁর জন্মদিন। সেই উপলক্ষে আর পাঁচজন বাঙালির মতো তাঁর অমর স্মৃতি আমারও মনে পড়ছে।

গোলাম মুরশিদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০

Category: বিশেষ রচনা
Previous Post:কাঁঠালের কাঠি কাবাব
Next Post:মৃত্যুজয়ী স্বপ্নের প্রতিমা – পিয়াস মজিদ

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑