• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

মায়াকোভিস্কর শেষ বছর

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » অনুবাদ » মায়াকোভিস্কর শেষ বছর

ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মায়াকোভিস্কর জীবনের শেষ বছরটি ছিল ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ। প্রেম ছিল তাঁর লিলিয়া ব্রিকের সঙ্গে। শেষ বছরটিতে তিনি ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার প্রেমে পড়েন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। মায়াকোভিস্কর মৃত্যুর আট বছর পর, ১৯৩৮ সালে পোলানস্কায়া মায়াকোভিস্ক সম্পর্কে লিখেছিলেন। সেটি ছাপা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে, ভাপরোসি লিতেরাতুরি সাময়িকীতে। তার কিছু অংশ এখানে ছাপা হলো।

মায়াকোভিস্কর শেষ বছর
ভেরোনিকা পোলানস্কায়া
রুশ থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর

ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯২৯ সালের ১৩ মে, রেসের মাঠে। ওসিপ মাক্সিমোভিচ ব্রিক তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। লিলিয়া ব্রিকের স্তিকিলয়ান্নিয়ে গ্লাজ চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুবাদে তাঁর স্বামী ওসিপের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল। মায়াকোভিস্ককে দেখলাম—সাদা ওভারকোট আর ক্যাপে ঢাকা দীর্ঘদেহী মানুষ, হাতের ছড়িটি ইচ্ছেমতো ঘোরাচ্ছেন আর দরাজ গলায় অবিরত একাই কথা বলে যাচ্ছেন। বিশাল মানুষটির সঙ্গে কী করে কথা বলব বুঝতে না পেরে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর মাঝে মাঝে আমাকে আমার থিয়েটার পর্যন্ত পৌঁছে দিত সে। গল্প করত বিদেশের। ছিটেফোঁটা কথাবার্তার মধ্যেও বুঝতে পারতাম, নিখুঁত শিল্পীর চোখে সে দেখছে সবকিছু, অনুভব করতাম তার ভাবনার গভীরতা।
পশ্চিমা জগতের কথা যেভাবে বলত মায়াকোভিস্ক, সেভাবে আগে আমাকে কেউ বলেনি। আমাদের দেশের জন্য উপকারী কী কী দেখেছে, সে কথা জানাত। বলত ওদের সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির কথা। পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ, মানুষে মানুষে অসাম্যের কথাও বলত।
এ রকম বড় মাপের একজন মানুষের সঙ্গে হাঁটছি, এ কথা ভেবে গর্বে আমার বুক ভরে উঠত। আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। অনুভব করতাম, আমি খুব সুখী, অবচেতনে আমি যে তাকে ভালোবাসি, বুঝতে পারতাম। খুবই চাইতাম, এই মানুষটি আমার জীবনের ভেতরে ঢুকে যাক। একদিন সে তার বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ করল।
তার ল্যুবিয়ানকার বাড়িতে যাওয়ার পর সে তার সব বই দেখাল আমাকে। মনে আছে, একটি আলমারি ভর্তি ছিল পৃথিবীর নানা ভাষায় মায়াকোভিস্কর অনুবাদ বই। আমাকে সে বইগুলোও দেখাল। নিজের কবিতা পড়ে শোনাল। অসাধারণ সুন্দর আবৃত্তি করত মায়াকোভিস্ক। তার গলায় শব্দগুলো বাঙ্ময় হয়ে উঠত, বাক্যের এমন সব জায়গায় সে জোর দিত যে কবিতার মানেই বদলে যেত। অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পীর অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল তার মধ্যে। এর আগে যারা আমাকে বই থেকে মায়াকোভিস্কর কবিতা পড়ে শুনিয়েছে, তাদের আবৃত্তি শুনে কবিতার আসল অর্থ বুঝতে কষ্ট হতো, কিন্তু যখন মায়াকোভিস্কর মুখ থেকে শুনলাম, তখন বুঝতে পারলাম এই কবিতা কেন এই ছন্দে লেখা হয়েছে। তার কণ্ঠ ছিল ভরাট এবং নিচু। এই কণ্ঠ সে ইচ্ছেমতো ওঠানামা করাতে পারত। কবিতার মধ্যে হাস্যরস বা ব্যঙ্গ থাকলে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে তা সে তুলে ধরতে পারত।
‘আমার কবিতা কি আপনার ভালো লাগছে, ভেরোনিকা ভিতোলদোভ্না?’ ইতিবাচক উত্তর পেয়ে সে হঠাৎ করেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে সে একেবারে শিশুদের মতো রাগ করল, তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। যাও! আর কোনো দিন তোমার হাতও ধরব না!’
এরপর আমি প্রতিদিন তার ল্যুবিয়ানকার বাড়িতে যেতাম। মনে আছে, একদিন দুজনে ল্যুবিয়ানকা থেকে আমার বাড়ির দিকে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ সে পথচারীদের অবাক করে দিয়ে শুরু করল ‘মাজুরকা’ নৃত্য! সে নাচতও খুব ভালো।
শিশুদের খুব ভালোবাসত। শিশুরাও ‘মাইয়াক চাচা’র সঙ্গ পছন্দ করত। ছোট্ট বিষয়েও সে একেবারে শিশুদের মতো মাথা ঘামাত। একবার দেখলাম, ওয়াইনের বোতলে জড়ানো কাগজের লেবেল তুলে ফেলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। হাত দিয়ে খুঁটে তুলতে না পেরে রেগে যাচ্ছে নিজের ওপর। একসময় পানিতে ডুবিয়ে ভিজিয়ে সহজে লেবেলটা তোলার বিষয়টি ‘আবিষ্কার’ করে শিশুদের মতো খুশি হয়ে উঠল। খুঁতখুঁতে ছিল খুব। দরজা খুলত হাতে গ্লাভস জড়িয়ে।
প্রায় প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা, ছয়টার দিকে তার বাড়ি যেতাম। সেখান থেকে যেতাম থিয়েটারে। ১৯২৯-এর বসন্তে আমার স্বামী ইয়ানশিন চলচ্চিত্রের কাজে কাজান গিয়েছিলেন। দিনকয়েক পর আমারও সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। এই একটি সপ্তাহ আমি আর মায়াকোভিস্ক কাটিয়েছি স্বাধীন জীবন। প্রায় পুরো সময়টাই আমরা একে অন্যের কাছাকাছি থেকেছি। সেটাই ছিল তার প্রতি আমার ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ সময়। তখন ভেবে খুব কষ্ট পেতাম যে মায়াকোভিস্ক কেন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবছে না। তখন সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে আমি সুখী হতাম।
ইয়ানশিন মায়াকোভিস্কর ল্যুবিয়ানকার বাড়ির বিষয়ে কিছুই জানত না। আমরা গোপনে দেখা করতাম। মায়াকোভিস্ক, আমি আর ইয়ানশিন একসঙ্গেও ঘুরে বেড়াতাম, যেতাম থিয়েটারে, রেস্তোরাঁয়।
আমি ওকে আদুরে নাম (ভালোদিয়া) ধরে ডাকতাম না বলে খুব চটে যেত মায়াকোভিস্ক। আমরা দুজন যখন একসঙ্গে থাকতাম, তখন ‘তুমি’ করে কথা বলতাম, অন্যদের সামনে ‘আপনি’। দুজন একসঙ্গে থাকার সময়টুকুতেও আমি তাকে ‘ভালোদিয়া’ বলে ডাকতাম না। মায়াকোভিস্ক রাগ করে বলত, আমাকে কোনো নামেই ডাকতে হবে না তোমার!
মায়াকোভিস্ক বলত, আমাদের সম্পর্ক অনেকদূর এগোলেও আমি এখনো তোমাকে আমার বাগদত্তা কুমারী মেয়ে বলেই মনে করি। একদিন সে নিজের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু বলল আমাকে। একেবারে বালক বয়সে কীভাবে মস্কোতে এসেছিল, পকেটে পয়সা না থাকায় কতবার হেঁটে পাড়ি দিতে হতো দূর পথ! খুব দরদ দিয়ে বলত মায়ের কথা। বলত, ওর প্রিয় খাবারগুলো রান্না করে মা ওর পথ চেয়ে বসে থাকেন। নিজেকে অভিশাপ দিত, মায়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় দেখা করতে পারত না বলে। নির্দিষ্ট দিনে মায়াকোভিস্ক মায়ের জন্য টাকা পাঠাত। টাকা পাঠাতে দেরি হলে খুব কষ্ট পেত। দেখলাম ওর ডায়েরিতে লেখা আছে, ‘মাকে অবশ্যই টাকা পাঠাতে হবে’, কিংবা শুধুই ‘মা’।
শুরুতে ব্রিকদের (লিলিয়া ব্রিক, ওসিপ ব্রিক) সঙ্গে তার সম্পর্কের ধরনটা আমি বুঝতে পারতাম না। তারা তিনজন একই সঙ্গে থাকত, আমি বুঝতেই পারতাম না এই দুজনের মধ্যে লিলিয়া ব্রিকের স্বামী কোনজন। একদিন ওসিপ ও লিলিয়া লেনিনগ্রাদে বেড়াতে গেল। আমি মায়াকোভিস্কর সঙ্গে ওই বাড়িতে গেলাম। ইয়ানশিনও তখন মস্কোতে ছিল না। মায়াকোভিস্ক রাতে তার সঙ্গে থাকার জন্য অনুরোধ করল আমাকে। আমি বললাম, ‘কাল সকালে যদি লিলিয়া ফিরে আসে? আমার পরিচয় জানতে চায়?’
মায়াকোভিস্ক বলল, ‘ও বলবে, নোরাচকার সঙ্গে থাকছ আজকাল? অভিনন্দন।’
আমি বুঝলাম, লিলিয়ার কথা বলতে গেলেই সে বিষাদাক্রান্ত হয়। বুঝলাম, লিলিয়া ব্রিক সব সময়ই তার কাছে ছিল এবং আছে প্রথম কাছের মানুষ হিসেবে। তবে তার প্রতি মায়াকোভিস্কর ভালোবাসা এখন অতীতের বিষয়।
মায়াকোভিস্কর মৃত্যুর পর যখন লিলিয়া ব্রিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল—দুটো ব্যাপারে কোনো দিন আমি ভালোদিয়াকে (মায়াকোভিস্ক) ক্ষমা করব না। একটি হলো, প্রবাস থেকে ফিরে আমাকে কিছু না জানিয়ে নতুন কবিতাগুলো সে অন্যকে উৎসর্গ করেছে। দ্বিতীয়টি, আমার উপস্থিতিতে ও আপনার দিকে তাকিয়ে থাকত, আপনার পাশে বসত, আপনাকে স্পর্শ করত।

২.
একেবারেই মনে করতে পারি না, নববর্ষ আমরা একসঙ্গে নাকি আলাদাভাবে পালন করেছিলাম। আমাদের সম্পর্ক দিনের পর দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। আমার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই সে উত্তেজিত হয়ে উঠত, মানুষের সামনেই চিৎকার করত। ভীষণরকম বিমর্ষ, নীরব আর অধৈর্য হয়ে উঠছিল সে।
এ সময় আমার পেটে ওর সন্তান। গর্ভপাত করালাম, কিন্তু তা মানসিকভাবে আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলল। আমি মিথ্যে ও প্রেমের দ্বৈততা আর বহন করতে পারছিলাম না। ইয়ানশিন আমাকে দেখতে এসেছিল হাসপাতালে। আবার মিথ্যে বলতে হলো। এ যন্ত্রণা সহ্য করা কঠিন।
এ সময় আমি জীবনের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। বিশেষ করে শারীরিক সম্পর্ক একেবারেই সহ্য করতে পারছিলাম না। মায়াকোভিস্ক কোনোভাবেই তা মেনে নিতে পারছিল না। আমার শারীরিক শীতলতা ওকে রাগিয়ে দিচ্ছিল। এই কারণেই আমাদের ঝগড়া বেড়ে গেল।
সে সময় আমার বয়স ছিল খুবই কম, তাই আমি মায়াকোভিস্ককে অভয় দিয়ে বলতে পারিনি যে কিছুদিন আমাকে সময় দিলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মায়াকোভিস্ক তা বুঝতে চাইত না। ও হয়ে উঠল কাঠিন্যের প্রতিমূর্তি। যেকোনো তুচ্ছ ব্যাপারেই রেগে আগুন হতো।
আমি এত কিছুর পরও তাকে ভালোবাসতাম, তার মানবিকতার মূল্য দিতাম, তাকে ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ, তা বুঝতাম। সে না থাকলে একাকিত্বে ভুগতাম, কিন্তু যখনই তার সামনে আসতাম, যখনই সে চিৎকার করতে শুরু করত, তখনই মনে হতো এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার উপায় নেই। এখন অতীতের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে পারি, বুঝতে পারি, এই যন্ত্রণাদায়ক ঘটনাই আমাদের জীবনে খুব বড় ভূমিকা রেখেছে। এ সময়ে ইয়ানশিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ এবং মায়াকোভিস্কর সঙ্গে জীবন গড়ার ব্যাপারে আমার দ্বিধা বেড়ে যায়।
আমি বুঝলাম একজনকে বেছে নিতে হবে। ইয়ানশিনের সঙ্গে তখন আমার দূরত্ব বাড়ছিল। আমি মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলাম। আমাদের ছিল বন্ধুতার সম্পর্ক। আমাকে একটি ছোট্ট বালিকা হিসেবেই দেখত ইয়ানশিন। আমার জীবন বা কাজের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না ওর। মায়াকোভিস্কর সঙ্গে পুরো ব্যাপারটাই আলাদা। এটা ছিল সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ, ভালোবাসার সম্পর্ক। সে-ই আমার ভেতরের মানুষটাকে বাইরে এনেছে। আমাকে মানুষ করেছে। যদিও আমার বয়স ছিল মাত্র ২২, তার পরও আমি তৃষ্ণার্তের মতো তার কথা শুনতাম, তার ভাবনা, তার কষ্ট বোঝার চেষ্টা করতাম। তবে সত্যি, আমি ভয় পেতাম তার চরিত্রের ধরন।
৩০ সালের গোড়ার দিকে ইয়ানশিনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য বারবার বলতে লাগল মায়াকোভিস্ক। বলল আমি যেন ওর বউ হই, আমি যেন থিয়েটার ছেড়ে দিই।
১৩ ও ১৪ এপ্রিলের কথা বলার চেষ্টা করি।
তার আগে ১২ এপ্রিল।
মায়াকোভিস্কর জন্য গাড়ি এসেছিল। সে বাড়ি ফিরবে, আমাকে নামিয়ে দেবে আমার বাড়িতে। গাড়িতে আমরা আমেরিকান খেলা (ইংলিশ) খেলছিলাম। যে প্রথমে রাস্তায় দাঁড়িওয়ালা লোক দেখবে, সেই বলে উঠবে ‘দাঁড়ি’। এ সময় আমি দেখলাম লেভ আলেক্সান্দ্রোভিচ তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন। বললাম, ‘দেখো, লেভ আসছেন।’
মায়াকোভিস্ক বলল, ‘না, ওটা লেভ নয়।’
বললাম, ‘ঠিক আছে, ওটা যদি লেভ হয়, তাহলে ১৩ আর ১৪ এপ্রিল আমাদের মধ্যে আর দেখা হবে না।’
‘তাই সই।’
আমরা গাড়ি থামিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেলাম লোকটির কাছে। লেভ আলেক্সান্দ্রোভিচ আমাদের এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে বিস্মিত হলেন।
আমার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে মায়াকোভিস্ক বলল, ‘ঠিক আছে। তোমাকে কথা দিচ্ছি সামনের দু দিন তোমার সঙ্গে দেখা করব না। ফোন তো করতে পারব?’
‘চাইলে করতে পার। তবে না করাই ভালো।’
সে কথা দিল, এই দু দিন সে বিশ্রাম করবে, ডাক্তারের কাছে যাবে। সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ছিলাম। এ সময় তার ফোন। বলল, এখন মন খুব ভালো। লিখছে। বুঝতে পারছে অনেক বিষয়েই সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দু দিন দূরে থাকা দুজনের জন্যই মঙ্গল।
১৩ এপ্রিল দিনের বেলায় আমাদের আর দেখা হয়নি। দুপুরে খাওয়ার সময় সে ফোন করেছিল। বলেছিলম ১৪ তারিখ রেসের মাঠে যেতে। আমি বলেছিলাম, রেসের মাঠে আমি যাব ইয়ানশিনের সঙ্গে। কারণ আগেই সেখানে যাওয়ার ব্যাপারটা আমরা ঠিক করে নিয়েছি। বললাম, আমরা যেহেতু দু দিন দেখা করব না বলে কথা দিয়েছি, তাই আমাকে যেন সে দেখতে না আসে। সে জানতে চাইল, ‘আজ বিকেলে আমি কী করব।’ বললাম, ‘এখনো ঠিক করিনি।’
বিকেলে ইয়ানশিনের সঙ্গে আমি কাতায়েভের ওখানে গেলাম। দেখি, মায়াকোভিস্ক সেখানে হাজির। ভীষণ বিমর্ষ লাগছিল তাকে। আকণ্ঠ মদ গিলেছে, মাতাল। আমাকে দেখেই বলল, ‘আমি জানতাম, তোমরা এখানে আসবে।’
আমি খুব রাগ করলাম। আমার গন্ধ শুঁকে শুঁকে এখানেও এসে হাজির হয়েছে! আর সে রাগ করল এখানে আসব না বলেও এসেছি বলে। অনেক মানুষের সামনে আমরা খুবই বোকার মতো উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলাম। কথাগুলো তারা বেশ আগ্রহ নিয়ে গিলছিল। ইয়ানশিন সবকিছু দেখছিল এবং একটা স্ক্যান্ডাল করার জন্য তৈরি হচ্ছিল।
মায়াকোভিস্কর ডায়েরিতে আমরা একে অন্যের প্রশ্নের জবাব দেওয়া শুরু করলাম। আমরা পরস্পরকে বোকার মতো অপমানজনক কথাবার্তা লিখে চলেছিলাম। এরপর মায়াকোভিস্ক অন্য ঘরে চলে গেল। একটি চেয়ারে বসে আবার শ্যাম্পেন খেতে শুরু করল। আমি তার কাছে গেলাম, পাশে চেয়ার টেনে বসলাম, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। সে বলল, এখন সবার সামনে তিনি ইয়ানশিনকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দেবে। আমার সঙ্গে খুবই নিষ্ঠুর ব্যবহার করতে শুরু করল সে। এই অবমাননায় যখন পুড়ে যাচ্ছি, তখনই হঠাৎ মনে হলো আমার সামনে একজন অসুখী মানুষ বসে আছে, যেকোনো সময় যে একটি দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দিতে পারে। সে রকম কিছু করলে এই মানুষদের সামনে তার মান-সম্মান বলে কিছু থাকবে না।
আমি শান্ত হয়ে তাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে বললাম, সে আরও চটে গেল। সে রিভলবার বের করল। আমাকে মেরে ফেলবে বলে শাসাল। আমার মাথায় ঠেকাল পিস্তলের মুখ। আমি বুঝলাম, আমার উপস্থিতি তাকে আরও উত্তেজিত করে তুলছে। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলাম। সে হঠাৎ খুব শান্ত হয়ে আমাকে বলল, ‘নোরকোচকা, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন। আপনি খুব খুব খুব ভালো…যখন আমরা টেবিল ঘিরে বসেছিলাম’, হঠাৎ, ‘হায় ইশ্বর!’
আমি বললাম, পৃথিবীটা কি উল্টে গেল! মায়াকোভিস্ক ইশ্বরকে ডাকছে! ‘আপনি ইশ্বরে বিশ্বাস করেন নাকি!’
‘এখন আমি নিজেই জানি না, কিসের ওপর আমার বিশ্বাস!’ কথাটা আমার মনে গেঁথে গেছে। কথার ধরনে বুঝলাম, শুধু আমার ওপর রাগ থেকেই তার মনের অবস্থা এমন নয়। বিষয়টি অনেক জটিল। এ সময় সে নিজের শিল্পভাবনার শক্তি নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিল। তার প্রতি সমসাময়িকদের বিকারহীন মনোভাব তাকে রক্তাক্ত করছিল।
আমি আর মায়াকোভিস্ক আগে আগে হাঁটছিলাম। সে মাঝে মাঝেই ইয়ানশিনকে ডাকছিল, ‘মিখাইল মিখাইলোভিচ!’—‘জি, বলুন।’—‘না, পরে বলব।’ আমি বারবার বলছিলাম, ইয়ানশিনকে যেন সে কিছু না বলে। কাঁদলাম। তখন সে বলল, কাল সকালে সে আমাকে দেখতে চায়। পরদিন সাড়ে দশটার সময় আমার নাটক ছিল। আমি বললাম, আটটার দিকে মায়াকোভিস্ক এসে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবে।
১৪ এপ্রিল। সকাল সাড়ে আটটায় ট্যাক্সিতে করে মায়াকোভিস্ক এল আমাকে নিতে। তাকে দেখে খুবই অসুস্থ মনে হচ্ছিল।
সূর্য সেদিন উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছিল। অসাধারণ এপ্রিলের সকাল। বসন্ত।
‘কী অসাধারণ! দেখো, কি আশ্চর্য এক সূর্য! আজ আবার তুমি উল্টোপাল্টা কথা বলা শুরু করবে না তো? এসো, ওসব তিক্ততা একদম ভুলে যাই।’
সে বলল, ‘এখন সূর্য দেখার মতো মন নেই আমার। বোকামি আর করব না। আমি জানি যা চাই, তা মায়ের কারণে করতে পারব না। আর কারও জন্যই আমার কিছু করার নেই। বাদ দাও, বাড়ি গিয়ে কথা বলব।’ আমি বললাম, ‘সাড়ে দশটার সময় আমার মহড়া। খুব গুরুত্বপূর্ণ মহড়া। এক মুহূর্তও দেরি করা চলবে না।’
আমরা ল্যুবিয়ানকায় নামার পর মায়াকোভিস্ক ট্যাক্সিকে অপেক্ষায় থাকতে বলল। আমি দ্রুত চলে যাব, এই ভাবনা আবার তার রাগ ফিরিয়ে আনল। ও বলতে লাগল, ‘আবার ওই থিয়েটার! আমি থিয়েটার ঘৃণা করি। চুলোয় যাক থিয়েটার। বাদ দাও ওসব! আমি তোমাকে মহড়ায় যেতে দেব না।’
এই বলে চাবি দিয়ে দরজা আটকে চাবিটা রেখে দিল পকেটে। আমি ডিভানে বসলাম। আমার কাছে এসে মাটিতে বসে সে কাঁদতে লাগল। আমি ওর ওভারকোট আর ক্যাপ খুলে দিলাম, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, ওকে শান্ত করার জন্য কথা বলতে শুরু করলাম।
এ সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বই নিয়ে এসেছেন একজন (লেনিন রচনাবলি)। আমাদের এ অবস্থায় দেখে দ্রুত বইগুলো রেখে তিনি চলে গেলেন।
পায়চারি করা শুরু করল সে, মনে হচ্ছিল দৌড়াচ্ছে। বলতে লাগল, আমি যেন এই মুহূর্ত থেকে এই বাড়িতে থাকতে শুরু করি, ইয়ানশিনের সঙ্গে কোনো কথারই দরকার নেই। এই মুহূর্ত থেকে যেন মহড়ায় যাওয়া বন্ধ করি। সে নিজেই থিয়েটারে গিয়ে বলে আসবে; আর ইয়ানশিনকে সে বলবে, আমাকে এখান থেকে যেতে দেবে না। আমি যেন এখন থেকে তার ঘরটাকেই আমার ঘর মনে করি। এখন থেকে আমাকে নিয়েই তার সব ভাবনা আবর্তিত হবে। আমাদের বয়সের পার্থক্য যেন আমার মনে ভয় না ধরায়, কারণ সে তো তরুণ আর আমুদে। গতকাল যা ঘটেছে, এই জীবনে তার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। গতকাল আমরা দুজনেই বোকার মতো আচরণ করেছি। সে নিজে গতকাল খুব বাজে আচরণ করেছে, নিজেকেই নিজে ক্ষমা করতে পারছে না। এ বিষয়ে আমরা আর ভাবব না। ভাবব, ও ধরনের কিছুই ঘটেনি আমাদের জীবনে। গতকাল আমরা ডায়েরির পাতায় যেসব পরস্পর অপমানকর কথা লিখেছিলাম, ইতিমধ্যেই সে সব সে ছিঁড়ে ফেলেছে।
আমি বললাম, আমি তাকে ভালোবাসি, তার সঙ্গেই থাকব। কিন্তু ইয়ানশিনকে কিছু না বলে এখন থেকেই ওর বাড়িতে থাকতে পারব না। আমি জানি ইয়ানশিন আমাকে ভালোবাসে, এ অবস্থায় তাকে এভাবে ছেড়ে আসা উচিত হবে না। মানবিক কারণেই আমি আমার স্বামীকে সম্মান করি ও ভালোবাসি, এভাবে আমি তাকে ছেড়ে চলে আসতে পারি না। আর থিয়েটার আমি ছাড়ব না। ও কি বুঝতে পারছে না, এখন যদি আমি থিয়েটার ছেড়ে দিই, তাহলে আমার জীবনে যে শূন্যতা আসবে, তা পূরণ করার কোনো পথ নেই? থিয়েটার ছেড়ে দিয়ে শুধু একজন মানুষের বউ হয়ে জীবন যাপন করা সম্ভব নয়, মানুষটি মায়াকোভিস্কর মতো খ্যাতিমান হলেও না। আমি এখন মহড়ায় যাব, সেখান থেকে বাড়ি ফিরব, ইয়ানশিনকে সব বলব, তারপর বিকেলে সারা জীবনের জন্য মায়াকোভিস্কর কাছে ফিরে আসব।
মায়াকোভিস্ক আমার কথা মেনে নিল না। সে চাইল, আমি যেন এখনই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই, আর এখন না নিলে এ বিষয়ে পরে আর কথা হবে না।
আমি আবার বললাম, ‘এ রকম করতে পারি না আমি।’
‘অর্থাৎ মহড়ায় যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ, যাচ্ছি।’
‘ইয়ানশিনের সঙ্গে দেখা করবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ও আচ্ছা! তাহলে এখনই বেরিয়ে যাও। এক্ষুনি বেরোও।’
বললাম, ‘আমার মহড়া শুরু হতে এখনো দেরি আছে। ২০ মিনিট বসে তারপর যাব।’
‘না, না, এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ তোমাকে আর দেখতে পাব না?’
‘জানি না।’
‘অন্তত পাঁচটার সময় আমাকে ফোন করো!’
‘করব, করব, করব।’
দ্রুত সে চলে গেল টেবিলের কাছে, কাগজ উল্টেপাল্টে কী সব খুঁজল। কিছু ছিঁড়ল। আমি বুঝতে চাইলাম কী ছিঁড়ছে, কিন্তু এমনভাবে বিশাল দেহটা দিয়ে আগলে রেখেছে টেবিলটা, কিছুই দেখতে পেলাম না।
এখন আমার মনে হয়, ক্যালেন্ডার থেকে সে ১৩ ও ১৪ তারিখ দুটি ছিঁড়ে ফেলেছিল।
এরপর ঝুড়ির মধ্যে কী যেন খুঁজল, তারপর সেটা বন্ধ করে দ্রুত পায়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল ঘরময়।
আমি বললাম, ‘আমাকে বিদায় জানাবে না?’
ও আমার কাছে এল। চুমু দিল। তারপর খুবই আদুরে গলায় বলল, ‘না বালিকা, একা যাও…আমাকে নিয়ে দুচিন্তা কোরো না।’
এরপর হেসে বলল, ‘আমি তোমাকে ফোন করব। ট্যাক্সিভাড়া আছে?’
‘না।’
আমাকে বিশ রুবল দিল।
‘সত্যিই আমাকে ফোন করবে?’
‘করব, করব।’
আমি ঘর থেকে বের হলাম। কয়েক পা এগিয়েছি মাত্র, এমন সময় গুলির শব্দ। আমার পা কেঁপে উঠল, আমি চিৎকার করে উঠলাম এবং হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে লাগলাম করিডোর ধরে। ঘরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, ঢোকার জন্য অনেকটা সময় ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু আসলে আমি ঢুকেছি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। তখনো ঘরে গুলির ধোঁয়া।
মায়াকোভিস্ক পড়ে ছিল কার্পেটের ওপর, দু হাত দু দিকে ছড়ানো। রক্তে ভেজা বুক। মনে আছে, আমি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলছিলাম, এটা কী করলে, কী করলে এটা!
তার চোখদুটি ছিল খোলা, আমার দিকে স্থির হয়ে ছিল তার চোখ, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি মাথাটা তুলতে চাইছিলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি কিছু একটা বলতে চান, কিন্তু ততক্ষণে তার চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেছে। তার মুখ, ঘাড় ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লালাভ। মাথাটা পড়ে গেল মাটিতে, চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকল।
ছুটে এল মানুষ। কেউ ফোন করল, কেউ আমাকে বলল, ‘দৌড়ে যান, একটা অ্যাম্বুলেন্স খুঁজে আনুন।’
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দৌড়ে নামলাম নিচে, আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। সিঁড়িতেই একজন বললেন আমাকে, ‘দেরি হয়ে গেছে। বেঁচে নেই।’
১৪ এপ্রিলের এই দুর্ঘটনা আমার জন্য ছিল এতটাই অপ্রত্যাশিত যে তা আমাকে নিঃশেষিত করে দিয়েছে।

ডিসেম্বর ১৯৩৮

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৩, ২০১০

Category: অনুবাদ
Previous Post:আন্দালুসীয় ঠাকুর
Next Post:সাপ্তাহিক মেন্যু প্ল্যান

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑