• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

সিন্দাবাদের ধান্ধাবাজি

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » বিশেষ রচনা » সিন্দাবাদের ধান্ধাবাজি

থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে মালয়েশিয়ার সীমান্তের কাছের শহর ইয়ালা। একসময় অঞ্চলটি মালয় সুলতানদের শাসনে ছিল। এখানকার মুসলমানেরা পাখি পোষে। সুলতানি আমল থেকেই তারা নববর্ষের দিনে ভোরে মেতে ওঠে জেব্রাঘুঘুর গানের প্রতিযোগিতা নিয়ে। সে রকম একটি নববর্ষ অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন মঈনুস সুলতান

সবুজ পাখি একজোড়া টেবিলের ওপর টিয়া পাখি টিংটিং করে চালাচ্ছে দুটি মিনিয়েচার রিকশা। বিগত জামানায় কৈতররা ডাকহরকরার কাজ করত বটে, টিয়া পাখিদের রিকশা চালানোর তো কোনো নজির নেই। বিষয়টিকে কেয়ামতের আলামতের মতো মনে হয়! ক্রমশ গুজরে যাচ্ছে আখেরি জামানা। হয়তো আশপাশের কোনো পদ্মপুকুরে কাছিম-কাতলা মিলেমিশে নাও বাইছে। জিনালের সঙ্গে পর্যটনের মুশকিল হচ্ছে, সে না শুনবে আমার সুচিন্তিত বকোয়াস, না দেখতে দেবে কোনো কিছু রিয়েলি ইন্টারেস্টিং। সে আমাকে হাত ধরে টেনে অন্যদিকে কদম বাড়ায়। তার পা ফেলার স্টেপ হয়ে উঠছে অস্থির ও ছন্দময়, তার মনে বোধ করি থোকা থোকা কচুরিপানার মতো স্যাঁতসেঁতে সব ডিপ্রেশন রূপান্তরিত হচ্ছে হাওয়া লাগা ঊর্মিমালায়। তার চলাচলে ফিরে এসেছে খোশমেজাজি রিদম। সে আরেক দফা হাত ধরে টানলে তার হ্যাটে জড়ানো জেসমিন ফুলের গন্ধ যেন হাওয়ায় পাল তোলে। আমি টিয়াপঙ্খি রিকশাওয়ালীদের ছেড়ে আজকের পর্যটন-সাথি গুলেবাকাওলির দিকে নজর দেই।
আমরা এসেছি ইয়ালায় জেব্রাডাব বলে একধরনের বাদামি ধূসর ঘুঘুর গানের কনটেস্ট দেখতে। ইয়ালা শহর থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে মালয়েশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি। এখানে একটি তেঁড়াবেঁকা পাহাড় আছে, দেখতে অনেকটা মাছের জালের মতো। থাই ভাষায় জালের প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘ইয়ালোর’। একসময়, সে বহুদিন আগে, এ অঞ্চল ছিল মালয় সুলতানদের তাঁবে। তখন থেকে মুসলমানদের আবাদ ইয়ালায়। পাখি পুষছে তারা আরও আগে থেকে। তাদের পরদাদার পূর্বপুরুষেরা যখন সাতিল আরব থেকে পাল তুলে মালাক্কা প্রণালিতে চলে আসে তখনো তাদের সঙ্গে ছিল পিঞ্জরায় পোষা সিগাল বা সিন্ধুচিল। সওদাগর সারেংরা যখন বেফানা হয়ে বারদরিয়ায় দিশেহারা, তাদের সিগালরা তখন উড়ে উড়ে তালাশ করত দ্বীপ। সুতরাং ইয়ালার মুসলমানরা যে জেব্রাডাব (এটি কোথাও কোথাও মেরবাক বলেও পরিচিত) নামের ধূসর বাদামি ও ফিকে গোলাপিতে মেশা ঘুঘু পুষবে তাতে তাজ্জবের কিছু নেই। এ জেব্রাঘুঘু তাদের শ্রুতিতে হরবকত ছড়ায় কোরান তেলাওয়াত ও আজানের শিরিন আওয়াজ। সুলতানি আমল থেকেই তারা নববর্ষের দিনে বাদ ফজর মেতে ওঠে জেব্রাঘুঘুর কাকলির কনটেস্ট নিয়ে।
সকালবেলা রোদ চড়ার আগেই আমি ও জিনাল চলে এসেছি কনটেস্টের ময়দানে। বাঁশের খুঁটিতে দড়ি টাঙিয়ে তৈরি করা হয়েছে ত্রিভুজাকৃৃতির কলকাকলির জলসা। তামেশগির শ্রোতারা এখনো তেমন জমেনি। মাত্র আড়াই শ ঘুঘুর এন্ট্রি হয়েছে। আয়োজকেরা আশা করছেন, দুপুরের আগেই জমা হবে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ শ পিঞ্জিরা। পিঞ্জিরাগুলো ঝুলছে দড়িতে। অনেক লম্বা লম্বা বাঁশের আগায় আটকানো আজদাহা বা ড্রাগনের দীর্ঘ সব লেঙ্গুড় পতপত করে উড়ছে আসমানে। পোষা পঙ্খিদের গানের মায়ায় কোনো বেয়াড়া বাজ নেমে এসে ভেজাল না বাধায় তার জন্য ওড়ানো হচ্ছে আজদাহার টকটকে লাল লেঙ্গুড়। পিঞ্জিরাগুলো এখনো সাটিনের পর্দা দিয়ে ঢাকা। কোনো কোনো পাখাল মই বেয়ে তাদের পিঁপড়ার ডিম, ঘাসের বীজ আর সূর্যমুখি ফুলের রেণু চটকিয়ে তৈরি গুল্লি খাওয়াচ্ছেন। একটি পিঞ্জিরার নিচে গোল টুপি মাথায় মোল্লা আতশি কাচ দিয়ে ম্যাচবক্সের মতো ছোট্ট অজিফা থেকে তেলাওয়াত করে শোনাচ্ছেন বোধ করি কনটেস্টে খোশনসিবের প্রত্যাশায়। বেশ কিছু মেম ট্যুরিস্টও এসে জুটেছে। শর্টস পরে খোলা কাঁধ ঊরুতে রোদ মেখে তারা বক্ষবন্ধনীর খোপে রোদচশমা গুঁজে সিরিয়াসলি কলকাকলি শুনছে, আর থেকে থেকে আকুলিবিকুলি করছে কখন পর্দার ঝাপটা ওঠে, তবে না ক্যামেরা খিঁচার মওকা আসবে।
বার্ড ওয়াচিংয়ের কিছু শৌখিন ধাত জিনালের আছে। জেব্রাঘুঘুর কাকলিতে তার ইন্টারেস্ট জেনুইন। সে যখন বছর দেড়েক আগেও যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাস, চ্যাপেল হিল বা ভরমান্টের কোনো স্টেজে কস্টিউম পরে নাচত তখন শো শুরু হওয়ার আগে কিছুক্ষণ চোখ মুদে ওয়াকম্যানে জেব্রাঘুঘুর গান শুনত। নৃত্যের আগে কখনো কখনো তার মনে হতো, পদ্মের পাতায় জলের মতো দোদুল্যমান। কাকলির আবেশ ছড়ানো ঝঙ্কার দোলাচলে দীর্ণ মনকে নিয়ে আসত কনসেনট্রেশনের শান্ত স্থির বিন্দুতে। গোড়ালিতে সার্জারির পর ব্যথার দংশনে যখন তার পায়ের মাসোলে খুব করে জিলকাতো, তখনো তাকে দেখেছি উষ্ণমণ্ডলীয় পাখির কাকলির সিডি শুনে পেইন ম্যানেজ করতে।
জেব্রাঘুঘুর জলসায় এসে জিনালকে খানিক বিভ্রান্ত দেখায়। মনে হয় এতগুলো পাখিকে খাঁচায় পুরে রাখা তার পছন্দ হচ্ছে না। একটু অস্থিরতা নিয়ে সে ঘুরে ঘুরে কাঠে কারুকাজ করে তৈরি খাঁচাগুলোর রং ও ডৌল-তসবির দেখে। স্পোর্টস শুয়ের পুরু পেডিং লাগানো জুতা পরে খুব সাবধানে সে হাঁটছে। আজ সে পরেছে টাইডাই সিল্কে সূর্যমুখির ছিঁটে দেওয়া সানড্রেস। তার চলাচলে অঙ্গারে প্রচ্ছন্ন আগুনের মতো নৃত্যের ভঙ্গি যেন মৃদু মৃদু আভা ছড়ায়। না, ময়ূরে তার মন ভরেনি, টিয়াপঙ্খির কেরদানিতেও উস্কে ওঠে না তার উৎসাহ। সে আমাকে নিয়ে এসে দাঁড়ায় গোঁট পাকানো পাখির জলসা থেকে একটু দূরের নিরিবিলিতে। এখানে প্রকাণ্ড সিরামিকের টবে রাখা ডালপালাসহ আস্ত একটি গাছ। তার ডালায় বসে আশ্চর্য সুন্দর একজোড়া ছোট্ট সবুজ পাখি। তাদের মাথা ও বুকের পালকে লালচে রঙের মোলায়েম আভা। সুঁচালো ঠোঁটে পাখি দুটি তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। হাওর বিল বনানী যেমন নিঃশব্দে ডাকে পরিবেশ বিজ্ঞানীকে, তেমনি পাখি দুটি দূর পাহাড়ের স্বপ্ন হয়ে ধরে রাখে জিনালের মনোযোগ। আমি সাতপাঁচ ভেবে দিগন্তে আবছা হয়ে ফোটা মাছের জাল পাহাড়ের দিকে তাকাই। তারপর জেলেরা যেভাবে জাল ফেলে সে রকম সাবধানতায় আলতো করে তার নিরাবরণ কাঁধে হাত রেখে লিভিং টুগেদারের প্রস্তাব দেই। ‘চাইলে মাসকাবারি একটা কটেজ ভাড়া করা যায়। এ সবুজ পাখি দুটিকে খাঁচায় করে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় কটেজের বাগিছায়। হয়তো এরা ফিরিঙ্গিপানি গাছের ডালে বসে গান করবে সাঁঝবেলা।’
‘দ্যাট ইজ সার্টেনলি অ্যা পসিবিলিটি’ বলে সে আবার ঠোঁট গোল করে ইমিটেইট করে জেব্রাঘুঘুর কলতান।
বেলা একটু গড়ালে আমরা আবার ফিরি পাখপাখালির জলসায়। পিঞ্জিরার পর্দা তোলা হয়েছে। মোল্লা ঘুরে ঘুরে মই বেয়ে দোয়া-দরুদ পড়ে পাখিদের ফু দিচ্ছেন, যদি তাতে তাদের কলতানে বরকত হয়। একজন বাতের রোগী এসেছেন হুইলচেয়ারে বসে। দুজন হাঁপানি রোগীও তাক করে বসে আছেন ছাতার নিচে। এসব পাখি নানা টিউনে হরেক কিসিমের গান করে। কিছু কিছু বিরল গান নির্ভর করে জলবায়ু, আকাশের মেঘ ও বহমান লিলুয়া বাতাসের ওপর। বায়ু খরবেগে বইলে কিছু কিছু পাখি বিচিত্র স্বরে ছড়িয়ে দেয় সুরেলা ঝংকার। বৎসরের প্রথম দিন যদি নসিবে লেখা থাকে, যদি জেব্রাঘুঘুর গালায় বেজে ওঠে সে সুরেলা কাকলির বিরল মঞ্জীর, আর কোনো বিশেষ অসুখে শয্যাশায়ীর শ্রবণে যায় সে ধ্বনি; ইয়ালার মানুষ বিশ্বাস করে, তাতে উপশম হবে ভোগান্তিদীর্ণ ব্যাধি ও জিল্লতির। গানের প্রতিযোগিতা কিন্তু এখনো শুরু হয়নি। মাথায় গামছা বাধা কজন জাজ ঘুরে ঘুরে সমস্ত কিছুর তাদারক করছেন। তাঁরা নোট করছেন পাখিদের লেজের শেইপ, পালকের মসৃণতা ও চোখের নীলাভ, লালচে কিংবা পিঙ্গল বর্ণ। এসবের সমাহার বিশ্লেষণ করে নির্ণয় করতে হবে পাখিদের জাতকুল, যার ওপর নির্ভর করে সঙ্গীতের মান। তারপর পুরস্কার বিতরণী—ফার্স্ট প্রাইজ টেলিভিশন, থার্ড প্রাইজ ভিসিআর ইত্যাদি।
জাজদের চোখমুখ সিরিয়াস হয়ে ওঠে। একজন খুট করে টেপের বাটন অন করেন, একটি ঘুঘু ‘আ উ উ কো..উহ কো উহ’ করে কলতানের বউনি করে। জিনাল ফিক করে হেসে বলে, ‘এটা গান নয়, জেব্রাঘুঘু স্রেফ বলছে, আই অ্যাম ফাইন, তবে আরেকটু আদার দিতে পার না?’ ‘তা তুমি পাখির কথাবার্তা তর্জমা করতে শিখলে কখন?’ ‘দ্যাটস্ ইজি, আমার কাছে কাকলির যে টেইপগুলো আছে তাতে পাখি কী বলছে তার পরিষ্কার তর্জমা দেওয়া আছে।’ পাখাল সঙ্গে সঙ্গে মই বেয়ে পাখিকে কিছু পোকামাকড় অফার করলে মনে হয় জিনালের আন্দাজ সাচ্চাও হতে পারে। ইতিপূর্বে খেঁকশিয়ালের জবান নিয়ে রিসার্চ করছেন এ ধরনের স্কলারের সঙ্গেও আমার দেখা হয়েছে, সুতরাং জিনালের পাখির লবজ অনুবাদ করার টেলেন্টে আমি ঘাবড়ে যাই না একেবারে। সে খোশমেজাজি হয়ে উঠছে, লিভিং টুগেদারের সম্ভাবনা আমার মধ্যে একটু এক্সাইটমেন্ট ছড়ায়। খানিক দূরে আরেকটি পাখি কলতান করলে সে ওদিকে ছুটে যায়। সূর্যালোক ছড়ানো মিহি সিল্কের আভরণে তার শরীর অ্যাক্যুরিয়ামে মাছের মতো যেন সাঁতার কাটে। এ পাখিটি গাইছে, ‘ও য়া বু..কু উ কু উ কু উ’। দ্রুত ছোটায় জিনালের একটু হাঁপ ধরেছে। সে তা সামলে বলে, পাখি গাইতে শুরু করেছে, ‘কাম টু মি, আই অ্যাম সো হ্যাপি নাও।’ আমি ‘ওয়াও ওয়াও’ বলে তার বাকতাল্লায় শরিক হই। এ পাখিকে ঘিরে কজন মুণ্ডিতমস্তক গেরুয়া পরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। তারাও এসেছেন পয়মন্ত কিছু পাখির তালাশে। গানের প্রতিযোগিতার পর তারা অনন্য কিছু ঘুঘু কিনে নিয়ে যাবেন। নববর্ষের দিনে মন্দির চত্বরে পিঞ্জিরা খুলে তাঁদের আসমানে উড়িয়ে দেবেন।
আসমান আবার মেঘলা হয়ে এসেছে, আজ তেমন গরম পড়েনি, তার পরও জিনাল হাঁপিয়ে ওঠে। পায়ে সার্জারির পর তার রিকভারি খুব স্লো। তার ওপর থাইল্যান্ডের জলবায়ুর আর্দ্রতা, ট্রাভেলিংয়ের স্ট্রেস তো আছেই। আমি দুটি কোকের ক্যান কিনে পাখির জলসা ছেড়ে তাকে নিয়ে একটু নিরিবিলিতে চলে আসি। টাইলস্ বসানো ড্রাগনের মূর্তির নিচে বাঁধানো সিমেন্টে বসি। জিনাল হ্যাট থেকে জেসমিনের মালা খুলে আঙুলে জড়ায়। বোস্টনের এক স্টেজ রিহারসেলে নৃত্যের সঙ্গে অ্যাক্রোবেটিকসের মুভমেন্ট জুড়তে গিয়ে বেলেন্স হারিয়ে সে পায়ের গোড়ালি ভাঙে। তার বয়স আটাশের ওপর। দেহের ফ্লেক্সিবিলিটি কমে আসছে, তার ওপর ড্যান্স পারফরমেন্সে হররোজ নতুন কিছু করার প্রেশার। খুব তিতকুটে মেজাজে জিন অ্যান্ড টনিকের সঙ্গে একটি জয়েন্ট ফুঁকে রিহারসেল দিচ্ছিল। পারফরমেন্স নিয়ে ড্যানসিং ট্রুপের ডাইরেক্টারের সঙ্গে তার একটু খেঁচাখেঁচিও চলছিল। গোড়ালি ভেঙে হাসপাতালে যেতেই ডাইরেক্টার টিন এজার ড্যান্সার দিয়ে তার রোল ফিলাপ করেছে। পা-ও সম্পূর্ণ ভালো হয়নি। এ বয়সে স্টেজে ফিরে যাওয়ার উপায়ও নেই। অন্য কিছুতে জড়িয়ে পড়ার আগে প্রয়োজন তার বিশ্রামের। তাই খানিক চেঞ্জের জন্য সস্তার দেশ থাইল্যান্ডে আসা।
যুক্তরাষ্ট্রে আমার হরবকত কাজকামের ধান্ধায় থাকতে হয়। পড়াশোনা, চাকরিবাকরি, কামাই উপার্জন ও হরেক রকমের অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখার প্রেশারে আমার জিন্দেগিতেও চলছে উস্তমখুস্তম। থাইল্যান্ডে কদিনের জন্য বেড়াতে এসে মনে হচ্ছে, এখানকার ঢিমে তালের জিন্দেগি তো বহুত খুব, বিলকুল স্ট্রেস ফ্রি। আমেরিকাতে ফিরে যাওয়ার দরকারই বা কী? জিনাল একটি জয়েন্ট রোল করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ পর আমার প্রস্তাবের সরাসরি জবাব দেয়, ‘ইয়েস, লিভিং টুগেদার ইজ সার্টেনলি পসিবল। লেটস্ ট্রাই ইট্।’ ক্রমাগত পেইনকিলার ড্রাগ নেওয়ার জন্য তার চোখে ঝকঝক করে নীল দ্যুতি। আমার প্রপোজলে কাজ হচ্ছে দেখে অবচেতনের কোথায় যেন একটি কার্পাস ফেটে চারদিকে উড়ে যায় সফেদ তুলা। তাকে আরও চেতিয়ে দিতে গিয়ে আমি বলি, ‘আমরা এমন একটি দেশে থাকব যা এ যুগেও শাসন করেন একজন রাজা। জাস্ট থিংক অ্যাবাউট দিস্। পকেটে যা রেস্ত আছে তা দিয়ে চিয়াংমাই বা কাঞ্চনাবুড়িতে একটি কটেজ ভাড়া করা যেতে পারে। আমরা কিনে নিতে পারি কটি বড়সড় সিরামিকের গামলা যাতে হররোজ ফুটানো যাবে নীল পদ্ম।’ ‘হাউ অ্যাবাউট দিস গ্রিন বার্ড কাপল্? দে কস্ট ওনলি টুয়েন্টি টু ডলারস। শ্যাল উই বাই দেম?’ বলে সে আমার হাতে জয়েন্ট পাস করে।
আমি যখন তাকে কাঞ্চনাবুড়ি বা চিয়াংমাইতে লিভিং টুগেদারের বিষয়ে ধুনফুন বোঝাচ্ছি ঠিক তখনই ছায়ামূর্তির মতো ড্রাগন চত্বরে এসে হাজির হন এক শকস্। ঝ্যালঝেলে স্যুট পরা এ ব্যক্তিকে দেখায় বাংলা সিনেমার খলনায়কের চেয়ে এককাঠি সরেস। তাঁর মুখের দিকে একনজর তাকিয়েই বুঝতে পারি—তাঁর বাড়ি স্বদেশের ছাগলনাইয়া বা বরইকান্দি হাওয়া বিচিত্র না। একটু আগে তাঁকে পাখপাখালির জলসায় পর্যটক মেম সাহেবদের অ্যাপ্রোচ করে কিছু গছাতে দেখেছি। তিনি তাঁর ছ্যারাবেরা করে বাঁধা টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে বলেন, ‘মিয়া ভাই দেশি না? মেমের লগে একটু আলাপ করায়া দেন তো?’ ‘তা কী সমাচার? আপনি কি পাখির সিংগিং কনটেস্টের সঙ্গে জড়িত আছেন?’ ‘আরে না, আমি আউয়া-জাউয়া মানুষ, পাখপাখালি কাউয়া দিয়ে আমি কী করুম? এই নিজের ধান্ধায় থাকি। সুযোগ পাইলে মেম ক্যাচ্ করি। তারপর তাদের কাপড়চোপড় ড্রেস কামিজের বন্দোবস্ত করে দেই, এদের কাপড়চোপড় পিন্দাই আরকি।’ ‘তা আপনি এদের কাপড়চোপড় পিন্দনের বন্দোবস্ত করবেন কেন? এরা কি ন্যাংটা উবস্তর? কেইসটা কী?’ ‘কথা বাড়ায়েন না দেশি, বছরের পয়লা দিন, এখনো বউনি হয়নি, আল্লারে আল্লা, এরা কী যে পরে! বেবাক দেখা যায়। লন, আপনার মেমের হাতে কার্ডটা দেন। একটু কায়কারবারের কতাবার্তি কই।’ কার্ডে লেখা ‘সিন্দবাদ ড্রেস, ওরিয়েন্টাল গাউন, কাশ্মীরী কুর্তি ও জয়পুরি কাফতান কনসালটিং সার্ভিস।’
ভদ্রলোক একটি অ্যালবামে কুর্তা, কামিজ, কাফতান পরা ইন্ডিয়ান মডেল কন্যাদের ছবি জিনালকে দেখান। জিনালও আগ্রহ নিয়ে তা দেখতে শুরু করলে তিনি আড়চোখে আমার দিকে তাকান। তাঁর চোখেমুখে ফোটে সিঁড়িতে পড়ে থাকা পাপোশের মতো ছ্যাছড়ানো কর্কশ অভিব্যক্তি। তিনি অনুনয় করে বলেন, ‘আমার নাম শফিকুর রহমান সিন্দাবাদ। আমি কোনো টাউট-বাটপার না। আপনার মেমরে ক্যাচ্ করছি বলে কোনো প্যাঁচ লাগাইয়েন না দেশি। আল্লার কিরা, আইজ বছরের পয়লা দিন, এখনো বউনি হয় নাই। উনারে লইয়া চলেন আমার দোকানে। কাচের চুড়ি, জামদানি, ওড়না যা চান সস্তায় দেব।’ জয়েন্টে শেষ টান দিয়ে জিনালের বুঝি একটু নেশা হয়েছে। সেও কামিজ, শাল, শাড়ি দেখতে চায়।
শফিকুর রহমান সিন্দাবাদের দোকান কাছেই। তিনি মসজিদের পেছন দিকের দোতালার আন্ধার কামরায় থাকেন। তাঁর বিছানার ওপর রাখা শাড়ি, কামিজ, দোপাট্টা, চুড়ি ও আগরবাতির প্যাকেট। পর্দার আবডালে একখানা আয়নাও আছে, আর আছে দেয়ালে ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকা থেকে কেটে লাগানো সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবি, যেখানে থাই প্রিন্সেস সিরিনডন পুষ্পস্তবক অর্পণ করছেন। পর্দার আড়ালে গিয়ে জিনাল কুর্তি ও কামিজ ট্রাই করে। ঠিকমতো ফিট না হলে, সিন্দাবাদ সাহেব কাঁচি হাতে সেলাইয়ের মেশিনে বসে কাটছাঁট করতে করতে বলেন, ‘দেশি, আমেরিকা যাওনের তিনবার ট্রাই দিছি, কিচ্ছু হয় না, আপনার মেমরে একটু কন না আমারে একখান কারেকটার সার্টিফিকেট দিতে।’ তিনি একটি খাতা বের করে আমার হাতে দেন। তাতে এর আগের কিছু কিছু ট্যুরিস্ট মেমদের লেখা কমেন্ট আছে। আমি জিনালকে বললে সে এখানে আসার ইমপ্রেশন নিয়ে কমেন্ট লিখতে রাজি হয় কিন্তু সে বুঝতে পারে না উনি আমেরিকাতে যাবেন কেন। সিন্দাবাদ সাহেব জানতে চান, আমি আমেরিকাতে গিয়েছিলাম কেন। ‘তা একসময় গিয়েছিলাম তো বটে, এখন ভাবছি থাইল্যান্ডে বসবাস করব।’ ‘তা কামকাজের কিছু জোগাড় হইছে দেশি?’ ‘না, আমরা এখন কামকাজের কোনো ধান্ধা করতেছি না, চিয়াংমাইয়ের ওদিকে হয়তো কিছু দিন বার্ডওয়াচিং করব।’ ‘বার্ড ওয়াচিং! তা, আপনেরা পাখি দেখবেন কেন? এতে ফায়দা কী?’ আমি কোনো জবাব না দিয়ে থাকুমুকু করলে তিনি বলেন, ‘মেম সাহেব জোটাইছেন, এইবার থাইল্যান্ড আইসা পঙ্খিমঙ্খি করতাছেন, ভালোই। বঙ্গললনা বিবাহ করলে আপনের খবর অইয়া যাইতো কিন্তু!’
তাঁর প্রতিক্রিয়ায় আমি হাসি। তিনি গজগজ করে বলেন, ‘হেল্প করবেন না ঠিক আছে, দেশি বলে কথাটা কইছেলেম, জাইন্না রাখেন—আমার নাম সিন্দাবাদ, নসিবে আমার অ্যাডভেঞ্চার লেখাই আছে। তিনবার ট্রাই নিছি, একবার না পারিলে দেখ শতবার, এই কথাটা সিন্দাবাদে কইছেলো না? আমিও ট্রাই কইরাই যামু, তারপর যা আছে কুলকপালে।’ ‘তা সিন্দাবাদ নামটা কি আপনি নিজেই নিছেন?’ ‘আরে না, আমার মায়ের দূর সম্পর্কের এক নানা তার সমন্ধি, খুব লেখাপড়া জানা লোক, তাইনে কাজি ছেলেন, বই পইড়া আমার নাম দেছেলেন সিন্দাবাদ।’ ‘কাজি সাহেব কি আরব্য উপন্যাস থেকে আপনার নাম দিছিলেন?’ ‘না না, বইটার নাম কী যেন ছেলো, এখন মনে পড়তাছে, ঠাকুরমার ঝুলি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেহা।’ ‘আপনি ঠিক জানেন ঠাকুরমার ঝুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা?’ ‘লেখাপড়া কম করছি, একটু আউয়া-ঝাউয়া মানুষ বইল্যা আমারে এনকার করেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররে আমি চিনি না? কুষ্টিয়াতে উনার জমিদারি ছেলো। লালন ফকিরের গান উনি খুব পছন্দ করতেন। খানচার ভেতর অচিন পঙ্খি শুইন্যা ফকিররে একটা ভাগলপুরি গাই বকশিশ করছিলেন। ফকির জেন্দা ছিলেন মবলগ এক শ তেইশ বছর। এসব কথা পুঁথিপত্র পত্রিকাতে লেহাই আছে।’ ভাগলপুরি গাইয়ের বিষয় আগে কখনো শুনিনি, তথ্যটি আচানক। লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী সাহেব এ ব্যাপারে অবগত আছেন কি না কে জানে।
আমি আলোচনার মোড় ঘোরানোর জন্য বলি, ‘তা আপনি থাইল্যান্ডে আসলেন কীভাবে?’ ‘সে আরেক কিসসা। আমার নসিবে পয়লা থেকেই সিন্দাবাদের মতো সমুদ্রযাত্রা লেহা আছে। চিটাগাং থেকে ট্রলারে করে আন্দামান দ্বীপে আসি। আন্দামান থেকে সেইলা কইরা বারো-তেরো দিন দরিয়ায় ভাসি। আমাদের অনেকের ডাইরিয়া হইছিলো, সবকিছু মনে নাই। থাই কোস্টাল গার্ড আমাদের ট্রলার আটকায়। আমাগো ডলারমলার কাইড়া নিয়া ট্রলারখানরে দড়ি দিয়া বাইন্ধা উল্টা দিকে তাদের জলসীমার বাইরে নিয়া পেট্রোলের ড্রামগুলান সিজ কইর্যা ভাসাইয়া দেয়। পুঙ্গিরপুতেরা পানির ড্রামগুলানও কানা কইরা দেয়। বুঝলেন দেশি, সঙ্গীসাথি বেশ কয়জনা গরমে নোনাপানি খাইয়া মারা গেছে। তিন-চাইর দিন পর আমরা লাইফবোটে চইড়া আবার অ্যাটেম নেই। আমার হুঁশগুশ কিছু ছেলো না। থাইল্যান্ডের এক মাছের ট্রলার আমারে উদ্ধার করে ওষুধ-পানি দিয়া বাঁচায়।’
সিন্দাবাদ সাহেব দম নেন। উনি কাটছাঁট করাতে জিনালের কুর্তি ফিট হয়েছে। সে এবার হাতে কগাছি চুড়ি পরছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘বছরের পয়লা দিন আইলেন, আপনাগোরে কোনো খাতির জমা করতে পারলাম না। কাইল আবার আহেন। আমার দাওয়াত রইল। বিরিয়ানি খাওয়ামু। থাইল্যান্ড আওনের আরও কেসসা আছে। সেটা কমু। আর আমি কাঞ্চিভরমের একখান অরজিনাল শাড়ি এনার জন্য জোগাড় কইর্যা রাখুম। দামের জন্য চিন্তা কইরেন না। আরেকটা ছোট্ট কথা, দেশি, এনারে দিয়া আমার জন্য এমবেসিতে কিছু করান।’ ‘জিনালের ক্ষমতা আছে কি না জানি না, তবে আমি কথা বলে দেখব।’ সিন্দাবাদ সাহেবের চোখেমুখে রোজাদার মিসকিনের দিলে ইফতার প্রাপ্তির সম্ভাবনার মতো আশ্বাস ফুটে ওঠে।
কুর্তি চুড়িতে জিনালের মন ভরেছে, তবে হাঁটাহাঁটিতে তার পায়ের গোড়ালি ফুলে জিলকাচ্ছে। সে আমার কাঁধে হাত রেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। পাখির জলসা এখনো শেষ হয়নি। আমরা আবার ড্রাগন চত্বরে এসে নির্জনে বসি। জিনাল বিমর্ষ হয়ে পায়ের পেইন ম্যানেজ করছে, ‘উইল উই গেট দ্য গ্রিন বার্ড কাপল? এতক্ষণে সবুজ পাখি দুটি বিক্রি হয়ে যায়নি তো?’ পারফর্মারের স্মৃতিতে স্টেজের রঙিন আলোর মতো জিনালের চোখে যেন ভাসে দুটি পাখির সবুজ ছায়া। আমি চোখ মুদে রই। খুব গভীরে কোথায় যেন একটি স্ক্রিনে আন্দামান সমুদ্রে দোদুল্যমান একটি লাইফবোট। তার প্লাস্টিকের গলুইয়ে বসে কিচিরমিচির করতে করতে দুটি সবুজ পাখি ভেসে যায় বারদরিয়ার দিকে।

সিন্দাবাদের ধান্দাবাজি

থাইল্যান্ডে কদিনের জন্য বেড়াতে এসে মনে হচ্ছে, এখানকার ঢিমে তালের জিন্দেগি তো বহুত খুব, বিলকুল স্ট্রেস ফ্রি। আমেরিকাতে ফিরে যাওয়ার দরকারই বা কী? জিনাল একটি জয়েন্ট রোল করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ পর আমার প্রস্তাবের সরাসরি জবাব দেয়, ‘ইয়েস, লিভিং টুগেদার ইজ সার্টেনলি পসিবল। লেটস্ ট্রাই ইট্।’ ক্রমাগত পেইনকিলার ড্রাগ নেওয়ার জন্য তার চোখে ঝকঝক করে নীল দ্যুতি। আমার প্রপোজলে কাজ হচ্ছে দেখে অবচেতনের কোথায় যেন একটি কার্পাস ফেটে চারদিকে উড়ে যায় সফেদ তুলা। তাকে আরও চেতিয়ে দিতে গিয়ে আমি বলি, ‘আমরা এমন একটি দেশে থাকব যা এ যুগেও শাসন করেন একজন রাজা। জাস্ট থিংক অ্যাবাউট দিস্। পকেটে যা রেস্ত আছে তা দিয়ে চিয়াংমাই বা কাঞ্চনাবুড়িতে একটি কটেজ ভাড়া করা যেতে পারে। আমরা কিনে নিতে পারি কটি বড়সড় সিরামিকের গামলা যাতে হররোজ ফুটানো যাবে নীল পদ্ম।’ ‘হাউ অ্যাবাউট দিস গ্রিন বার্ড কাপল্? দে কস্ট ওনলি টুয়েন্টি টু ডলারস। শ্যাল উই বাই দেম?’ বলে সে আমার হাতে জয়েন্ট পাস করে।
আমি যখন তাকে কাঞ্চনাবুড়ি বা চিয়াংমাইতে লিভিং টুগেদারের বিষয়ে ধুনফুন বোঝাচ্ছি ঠিক তখনই ছায়ামূর্তির মতো ড্রাগন চত্বরে এসে হাজির হন এক শকস্। ঝ্যালঝেলে স্যুট পরা এ ব্যক্তিকে দেখায় বাংলা সিনেমার খলনায়কের চেয়ে এককাঠি সরেস। তাঁর মুখের দিকে একনজর তাকিয়েই বুঝতে পারি—তাঁর বাড়ি স্বদেশের ছাগলনাইয়া বা বরইকান্দি হাওয়া বিচিত্র না। একটু আগে তাঁকে পাখপাখালির জলসায় পর্যটক মেম সাহেবদের অ্যাপ্রোচ করে কিছু গছাতে দেখেছি। তিনি তাঁর ছ্যারাবেরা করে বাঁধা টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে বলেন, ‘মিয়া ভাই দেশি না? মেমের লগে একটু আলাপ করায়া দেন তো?’ ‘তা কী সমাচার? আপনি কি পাখির সিংগিং কনটেস্টের সঙ্গে জড়িত আছেন?’ ‘আরে না, আমি আউয়া-জাউয়া মানুষ, পাখপাখালি কাউয়া দিয়ে আমি কী করুম? এই নিজের ধান্ধায় থাকি। সুযোগ পাইলে মেম ক্যাচ্ করি। তারপর তাদের কাপড়চোপড় ড্রেস কামিজের বন্দোবস্ত করে দেই, এদের কাপড়চোপড় পিন্দাই আরকি।’ ‘তা আপনি এদের কাপড়চোপড় পিন্দনের বন্দোবস্ত করবেন কেন? এরা কি ন্যাংটা উবস্তর? কেইসটা কী?’ ‘কথা বাড়ায়েন না দেশি, বছরের পয়লা দিন, এখনো বউনি হয়নি, আল্লারে আল্লা, এরা কী যে পরে! বেবাক দেখা যায়। লন, আপনার মেমের হাতে কার্ডটা দেন। একটু কায়কারবারের কতাবার্তি কই।’ কার্ডে লেখা ‘সিন্দবাদ ড্রেস, ওরিয়েন্টাল গাউন, কাশ্মীরী কুর্তি ও জয়পুরি কাফতান কনসালটিং সার্ভিস।’
ভদ্রলোক একটি অ্যালবামে কুর্তা, কামিজ, কাফতান পরা ইন্ডিয়ান মডেল কন্যাদের ছবি জিনালকে দেখান। জিনালও আগ্রহ নিয়ে তা দেখতে শুরু করলে তিনি আড়চোখে আমার দিকে তাকান। তাঁর চোখেমুখে ফোটে সিঁড়িতে পড়ে থাকা পাপোশের মতো ছ্যাছড়ানো কর্কশ অভিব্যক্তি। তিনি অনুনয় করে বলেন, ‘আমার নাম শফিকুর রহমান সিন্দাবাদ। আমি কোনো টাউট-বাটপার না। আপনার মেমরে ক্যাচ্ করছি বলে কোনো প্যাঁচ লাগাইয়েন না দেশি। আল্লার কিরা, আইজ বছরের পয়লা দিন, এখনো বউনি হয় নাই। উনারে লইয়া চলেন আমার দোকানে। কাচের চুড়ি, জামদানি, ওড়না যা চান সস্তায় দেব।’ জয়েন্টে শেষ টান দিয়ে জিনালের বুঝি একটু নেশা হয়েছে। সেও কামিজ, শাল, শাড়ি দেখতে চায়।
শফিকুর রহমান সিন্দাবাদের দোকান কাছেই। তিনি মসজিদের পেছন দিকের দোতালার আন্ধার কামরায় থাকেন। তাঁর বিছানার ওপর রাখা শাড়ি, কামিজ, দোপাট্টা, চুড়ি ও আগরবাতির প্যাকেট। পর্দার আবডালে একখানা আয়নাও আছে, আর আছে দেয়ালে ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকা থেকে কেটে লাগানো সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবি, যেখানে থাই প্রিন্সেস সিরিনডন পুষ্পস্তবক অর্পণ করছেন। পর্দার আড়ালে গিয়ে জিনাল কুর্তি ও কামিজ ট্রাই করে। ঠিকমতো ফিট না হলে, সিন্দাবাদ সাহেব কাঁচি হাতে সেলাইয়ের মেশিনে বসে কাটছাঁট করতে করতে বলেন, ‘দেশি, আমেরিকা যাওনের তিনবার ট্রাই দিছি, কিচ্ছু হয় না, আপনার মেমরে একটু কন না আমারে একখান কারেকটার সার্টিফিকেট দিতে।’ তিনি একটি খাতা বের করে আমার হাতে দেন। তাতে এর আগের কিছু কিছু ট্যুরিস্ট মেমদের লেখা কমেন্ট আছে। আমি জিনালকে বললে সে এখানে আসার ইমপ্রেশন নিয়ে কমেন্ট লিখতে রাজি হয় কিন্তু সে বুঝতে পারে না উনি আমেরিকাতে যাবেন কেন। সিন্দাবাদ সাহেব জানতে চান, আমি আমেরিকাতে গিয়েছিলাম কেন। ‘তা একসময় গিয়েছিলাম তো বটে, এখন ভাবছি থাইল্যান্ডে বসবাস করব।’ ‘তা কামকাজের কিছু জোগাড় হইছে দেশি?’ ‘না, আমরা এখন কামকাজের কোনো ধান্ধা করতেছি না, চিয়াংমাইয়ের ওদিকে হয়তো কিছু দিন বার্ডওয়াচিং করব।’ ‘বার্ড ওয়াচিং! তা, আপনেরা পাখি দেখবেন কেন? এতে ফায়দা কী?’ আমি কোনো জবাব না দিয়ে থাকুমুকু করলে তিনি বলেন, ‘মেম সাহেব জোটাইছেন, এইবার থাইল্যান্ড আইসা পঙ্খিমঙ্খি করতাছেন, ভালোই। বঙ্গললনা বিবাহ করলে আপনের খবর অইয়া যাইতো কিন্তু!’
তাঁর প্রতিক্রিয়ায় আমি হাসি। তিনি গজগজ করে বলেন, ‘হেল্প করবেন না ঠিক আছে, দেশি বলে কথাটা কইছেলেম, জাইন্না রাখেন—আমার নাম সিন্দাবাদ, নসিবে আমার অ্যাডভেঞ্চার লেখাই আছে। তিনবার ট্রাই নিছি, একবার না পারিলে দেখ শতবার, এই কথাটা সিন্দাবাদে কইছেলো না? আমিও ট্রাই কইরাই যামু, তারপর যা আছে কুলকপালে।’ ‘তা সিন্দাবাদ নামটা কি আপনি নিজেই নিছেন?’ ‘আরে না, আমার মায়ের দূর সম্পর্কের এক নানা তার সমন্ধি, খুব লেখাপড়া জানা লোক, তাইনে কাজি ছেলেন, বই পইড়া আমার নাম দেছেলেন সিন্দাবাদ।’ ‘কাজি সাহেব কি আরব্য উপন্যাস থেকে আপনার নাম দিছিলেন?’ ‘না না, বইটার নাম কী যেন ছেলো, এখন মনে পড়তাছে, ঠাকুরমার ঝুলি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেহা।’ ‘আপনি ঠিক জানেন ঠাকুরমার ঝুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা?’ ‘লেখাপড়া কম করছি, একটু আউয়া-ঝাউয়া মানুষ বইল্যা আমারে এনকার করেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররে আমি চিনি না? কুষ্টিয়াতে উনার জমিদারি ছেলো। লালন ফকিরের গান উনি খুব পছন্দ করতেন। খানচার ভেতর অচিন পঙ্খি শুইন্যা ফকিররে একটা ভাগলপুরি গাই বকশিশ করছিলেন। ফকির জেন্দা ছিলেন মবলগ এক শ তেইশ বছর। এসব কথা পুঁথিপত্র পত্রিকাতে লেহাই আছে।’ ভাগলপুরি গাইয়ের বিষয় আগে কখনো শুনিনি, তথ্যটি আচানক। লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী সাহেব এ ব্যাপারে অবগত আছেন কি না কে জানে।
আমি আলোচনার মোড় ঘোরানোর জন্য বলি, ‘তা আপনি থাইল্যান্ডে আসলেন কীভাবে?’ ‘সে আরেক কিসসা। আমার নসিবে পয়লা থেকেই সিন্দাবাদের মতো সমুদ্রযাত্রা লেহা আছে। চিটাগাং থেকে ট্রলারে করে আন্দামান দ্বীপে আসি। আন্দামান থেকে সেইলা কইরা বারো-তেরো দিন দরিয়ায় ভাসি। আমাদের অনেকের ডাইরিয়া হইছিলো, সবকিছু মনে নাই। থাই কোস্টাল গার্ড আমাদের ট্রলার আটকায়। আমাগো ডলারমলার কাইড়া নিয়া ট্রলারখানরে দড়ি দিয়া বাইন্ধা উল্টা দিকে তাদের জলসীমার বাইরে নিয়া পেট্রোলের ড্রামগুলান সিজ কইর্যা ভাসাইয়া দেয়। পুঙ্গিরপুতেরা পানির ড্রামগুলানও কানা কইরা দেয়। বুঝলেন দেশি, সঙ্গীসাথি বেশ কয়জনা গরমে নোনাপানি খাইয়া মারা গেছে। তিন-চাইর দিন পর আমরা লাইফবোটে চইড়া আবার অ্যাটেম নেই। আমার হুঁশগুশ কিছু ছেলো না। থাইল্যান্ডের এক মাছের ট্রলার আমারে উদ্ধার করে ওষুধ-পানি দিয়া বাঁচায়।’
সিন্দাবাদ সাহেব দম নেন। উনি কাটছাঁট করাতে জিনালের কুর্তি ফিট হয়েছে। সে এবার হাতে কগাছি চুড়ি পরছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘বছরের পয়লা দিন আইলেন, আপনাগোরে কোনো খাতির জমা করতে পারলাম না। কাইল আবার আহেন। আমার দাওয়াত রইল। বিরিয়ানি খাওয়ামু। থাইল্যান্ড আওনের আরও কেসসা আছে। সেটা কমু। আর আমি কাঞ্চিভরমের একখান অরজিনাল শাড়ি এনার জন্য জোগাড় কইর্যা রাখুম। দামের জন্য চিন্তা কইরেন না। আরেকটা ছোট্ট কথা, দেশি, এনারে দিয়া আমার জন্য এমবেসিতে কিছু করান।’ ‘জিনালের ক্ষমতা আছে কি না জানি না, তবে আমি কথা বলে দেখব।’ সিন্দাবাদ সাহেবের চোখেমুখে রোজাদার মিসকিনের দিলে ইফতার প্রাপ্তির সম্ভাবনার মতো আশ্বাস ফুটে ওঠে।
কুর্তি চুড়িতে জিনালের মন ভরেছে, তবে হাঁটাহাঁটিতে তার পায়ের গোড়ালি ফুলে জিলকাচ্ছে। সে আমার কাঁধে হাত রেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। পাখির জলসা এখনো শেষ হয়নি। আমরা আবার ড্রাগন চত্বরে এসে নির্জনে বসি। জিনাল বিমর্ষ হয়ে পায়ের পেইন ম্যানেজ করছে, ‘উইল উই গেট দ্য গ্রিন বার্ড কাপল? এতক্ষণে সবুজ পাখি দুটি বিক্রি হয়ে যায়নি তো?’ পারফর্মারের স্মৃতিতে স্টেজের রঙিন আলোর মতো জিনালের চোখে যেন ভাসে দুটি পাখির সবুজ ছায়া। আমি চোখ মুদে রই। খুব গভীরে কোথায় যেন একটি স্ক্রিনে আন্দামান সমুদ্রে দোদুল্যমান একটি লাইফবোট। তার প্লাস্টিকের গলুইয়ে বসে কিচিরমিচির করতে করতে দুটি সবুজ পাখি ভেসে যায় বারদরিয়ার দিকে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৯, ২০১০

Category: বিশেষ রচনা
Previous Post:জলবৃত্তান্ত – শিকোয়া নাজনীন
Next Post:রথ

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑