• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

জলবৃত্তান্ত – শিকোয়া নাজনীন

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » জলবৃত্তান্ত – শিকোয়া নাজনীন

মেজো ভাই যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে বিরামপুর সোনাকুচি স্টেশন। মৌজা ম্যাপে কবরটা বালিয়াতে ১০-১২ কিলোমিটার দক্ষিণে। মেজো ভাই ভাবে, নদী কি কিউট ফ্যাক্টরির পেটে ঢুকে গেছে? নদীর দিকে মুখ করা ছিল ফ্যাক্টরি। সেটা পুরোটাই এখন ন্যাশনাল হাইওয়ে। এমন মানুষ তো আর নেই যারা কিউট ফ্যাক্টরি দেখে বলে দেবে, কবরটা বাষট্টি সালেও ছিল জান্নার চরে। যেখানে ফ্যাক্টরি হতে গিয়ে আশ্বিন মাসে নদীর পানিতে টান ধরাল। যে মানুষ চৌহাটের বাজারে যায় গুম গ্রাম দিয়ে তার তো আন্দাজে থাকার কথা ঢাল শেষে ঘাস, বালি আর ভেজা পাতা মেশানো ঝুপঝুপ মাটি ঘেঁষেই ছিল কবরটা; যে ধানতারা আর সাটুরিয়া হাটে যেতে পাকুড়গাছের ঝাড়টা দেখেই বলে দেয়, কবরটা কালোমেঘার কাছাকাছিই কোথাও ছিল। এমন মানুষ কি আর বেঁচে আছে, যে বলে দেবে ধলেশ্বরীটা কংশতে মিলেছিল মলিনাহাট, নয়াবাড়ি দিয়ে। তারপর চাঁদের মতো একটা শুকনো মাটির ঢিবি, মেজো ভাই যেমন জানত আকন্দের গন্ধটা আপার কবরের সাথে মিশে আছে সেই বাষট্টি সাল থেকেই। ধুলোতে তখন ভেজা ভেজা গন্ধ থাকত। আকন্দের গন্ধে মৃত্যুর গন্ধ লেগে থাকে, ভেজা মাটি থেকে গন্ধটা তারপর আকাশে ছড়ায়। আপার কবরটা কাঁচা ছিল তখনো। আপার আর কোনো স্মৃতি নেই মেজো ভাইয়ের মনে। আপা মরলে পিপাসায় বুক ফেটে গেলে এক গ্লাস জল খেলেও সেই আকন্দের গন্ধটা পেত মেজো ভাই।
চোখ দুটো আকাশের দিকে খোলা রেখে মরল আপা। সেদিন রোদ উঠল না সারা দিন। আকাশ শুক্রবার মেঘ মেঘ ছিল, সোমবার সকালেও তেমনি আছে। শুক্রবারে আপা নিখোঁজ হওয়ার দিন বৃষ্টি, বাতাসের বেগটা যেমন ছিল তেমনই আছে রোববারে আপা লাশ হওয়ার দিন। সেই রাতে আপার কাপড়ে লাল রক্তের ছোপ আকন্দের ফুল হয়ে ফুটল। লোকে বলল, ধর্ষণ তো জোরজবরদস্তিতে হয় না। পরস্পরের সম্মতিতে ঘটেছিল। ফাল্গুনের ভরা জোছনায় অথবা মেঘঘন ঝোড়ো রাতে একটা ধর্ষণ এমন কী বড় ব্যাপার? সেই কবরের পাশেই আকন্দ ফুটে থাকতে পারে। তো সেই মেয়ে কি ধর্ষণের পরেও জীবিত থাকতে পারে? ধরে নেওয়া যায়, শুক্রবার ঘটনাটা ঘটল, তারপর সারাটা দিন বেঁচে থাকাটা আপার, আকাশের তারাদের দিকবদল দেখাটা কত চেনা। সেই চেনা দৃশ্যটা কি চেনার মতো ছিল তারপর? ঝড়ের তোপে নাকি ধর্ষণের ঘটনায় ভয় পেল লোকে? ইলেকট্রিক আলো, সেনট্রি ঘর, বাঁধ, ক্রান্তির হাটের নির্জনতা, বৃষ্টির ছাঁট, অন্ধকার আকাশ—এসব তো ছিলই ধর্ষণের সময়। যেমন থাকে প্রতিদিন।
বিপদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল তো আসলে শুক্রবার থেকেই, যেদিন নিখোঁজ হলো আপা। ধর্ষণ যে ঘটবেই তা তো বুঝতে পারা গেলই। এ ছাড়া শুক্রবার রাতটা এমন সুমসাম হয় নাকি? এমন তো হতে পারত, বাতাস কমে যেতে পারত। ঝড়-জল আর না বাড়তে পারত। সেই শুক্রবারে নিখোঁজ হওয়ার দিন ঝোড়ো বাতাসের বেগ, আর এই সোমবারে আপা লাশ হয়ে ব্রিজের ওপরে চিত হয়ে পড়ে থাকার সময়ও বাতাসের বেগ এক থাকার অর্থ নিশ্চয়ই এক নয়। সেই অন্ধকার শেষ রাতে ঝুম বৃষ্টিতে স্রোত আরেকটু কম হতে পারত। সে রকম একটা হিসেব তো মেজো ভাইয়ের ছিলই। সেই শুক্রবারের রাতটা আজ থেকে কত দূরে? যত দূরে বাষট্টি সাল? যত দূরে ধলেশ্বরী নদীটা কংশ হয়ে গেল? চাঁদ ডুবে গেল বা সূর্য উঠল যে বিরতিতে সেখানে আলো কি একফোঁটাও কেউ দেখল না?
বাষট্টি সালের স্মৃতির দিকে চেয়ে থাকে মেজো ভাই। সেদিন কি শুক্লপক্ষ ছিল? চিরকালের চেনাজানা শনিবারটা এমন বদলে গেছিল সেদিন! রাতের অন্ধকারের মতো দিনের আকাশ। কোনো তল্লাটে সূর্য ওঠেনি সেদিন। এমনিতে ভারি একঘেয়ে জীবন এখানে। বর্ষায় যেটা নদী, অঘ্রাণে সেটা ফসলি জমি। পরশু আবার ডিক্লেয়ার দেয়, ওটা নদী ছিল না। ফ্যাক্টরির মালিক জমিটা মৌজায় পষ্ট ৩৩ নম্বর দেখিয়ে বেচে দেয়। কিন্তু যখন আবার নদীটা নদী হয়ে ফিরে আসে? জলের স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকে মানুষ। নদীর জমিটা যে কিনেছিল তাকে লোকে বলে, দেখো না প্রতিদিন পাহাড়ের তলা থেকে জল এসে ডাঙায় ফসল ফলাচ্ছে। বাতাস পুব থেকে পশ্চিমে ধেয়ে আসছে। প্রতিদিন শুখা-দোঁআশলা মাটিতে মহীরুহ বাকলের শেকড় জলের ধাক্কায় মাটিতেই ডেবে গিয়ে আরেকবার জলের ওপরে উঠে যাচ্ছে।
কবরটা মাটি-ঢাকা না জল-ঢাকা তা বোঝার উপায় নেই আর। সোজা উল্টো জলের তলার বাঁক ফুঁড়ে গাছগুলো উঁকি দিচ্ছে। অন্ধকারটা আকাশ থেকে ধেয়ে নামছে মাটিতে। আরও অনেকটা সময় ধরে এই অন্ধকারটা গাঢ় রাতের দিকে ঝুঁকবে। মেজো ভাইয়ের আর নদীর দিকে মন নেই। তার হিসাবমতো মৌজায় যেটুকু নদী ছিল, এখন তা হাঁটুজল। মনে হয় শ্রাবণের শেষে শুরু হয়েছিল এই কবর খোঁজা আর এখন অঘ্রাণের দুপুর। কবরটা যেন পৃথিবীর অন্য মাথায়।
সেদিন মাঝরাতে যারা কবর খুঁড়তে গিয়েছিল তারা মাঝরাতেই ফিরে আসছিল। আপার লাশটা হাসপাতালে নিয়ে দলা পাকিয়ে রাখতে হয়েছিল। ঝড়ের রাত ছিল। লাশ কবরে রাখা যাবে না তা কিন্তু বোঝাই যাচ্ছিল। আকাশের দিগন্তে নীরব অন্ধকারের দিকে চেয়েই তা বোঝা যাচ্ছিল। এমনিতে নাড়িভুঁড়ি কলজে পাকস্থলী কিছু ছিল না লাশের পেটে। মর্গ থেকে শুধু চামড়ার খোলসটাই যে দেবে জানা ছিল মেজো ভাইয়েরও। পোস্টমর্টেম এখন মানুষের অচেনা না। ধর্ষণ আরও চেনা। ধর্ষণের পরে মৃত্যু অঘ্রাণের জোয়ারের পর ভাটার মতো স্বাভাবিক। জানত সেটা রমেশ শীলও। মেজো ভাইকে ও বলল, চামড়াটা একদম উদোম ছিল। যদিও রাতের অন্ধকারে রক্তটা কত দূর ছড়াল বোঝা গেল না। ঝড়ের ফাঁক গলে আলো আর আসতে পারল না। মাঝরাতে গোর দেওয়ার জন্য তাই ফ্যাক্টরিতে আনতে হলো লাশ।
কাঁচপুর থানার ওসি, এডিশনাল ডিসি সেদিন ফ্যাক্টরিতে ট্যালকম পাউডার উদ্বোধন করেছেন। সেখানকার ভিড়টা ঠিক ভাঙেনি তখনো। জমি অধিগ্রহণ বিষয়ে কাগজপত্র হলো সেখানেই। ফ্যাক্টরির জমি ফ্যাক্টরিরই থাকবে। রাতের ভেতরেই কাজ শেষ করতে হবে। ডেপুটি কমিশনার মেজো ভাইয়ের চেনা, ডিস্ট্রিক্ট জজ চেনা। এমনকি ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার বিদেশে না থাকলে তাকেও চেনা করে নেওয়া যেত। লাল রঙের ইটের গায়ে কিউট ট্যালকম পাউডারের ব্যানার। যারা বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল তাদের চোখের সামনেই লাশ নামানো হলো। তারা বলল, কবর রেডি। চিপা কবর কাটছে। বর্ষার কবর তো চিপাই হয়। কবরে আঁটানো যাবে কি না…ডেড বডি দেখি তো। চোখের আন্দাজে ডেডবডি মেপে নেয় তারা। ফ্যাক্টরির কর্মীরা বলে, ছয় বাই তিন ইঞ্চি কবরে এই বডি ফিট হবে না। লাশ তো ফুল সাইজ। চুক্তিতেই ছিল, কবরটা চিপা হবে। কারণ ফ্যাক্টরির মানচিত্রে কবর নাই, আর যে কবর একদিন তুলে নিতেই হবে সেই কবর চিপা হলেই কি। মার্ডার কেসের কবর বারবার ভাঙে, ধলেশ্বরীর মতো। অন্তস্রোতে ভাঙে খরস্রোতে ভাঙে। ফ্যাক্টরি তো আর কবরের জায়গা না।
সব জমিরই নিজস্ব ফসলের ইতিহাস থাকে। এই জমিতে ফ্যাক্টরি ফলবে। দেশে ইন্ডাস্ট্রি না হলে লোকে খাবে কী? একজন বলল, আচমকা কেউ মরলে বিপদ। তাই একটা নিজস্ব কবর থাকা উচিত। মেজো ভাই ভাবে, দাদি মারা গেলে আমরা কত কাঁদলামটাদলাম। কিন্তু নিজস্ব কবরের ভাবনাটা কারও মনেই এল না। একদম মৃত্যুদিনের মতো বৃষ্টিভেজা বাদল দিন সেদিন। ছোটবেলা থেকে যে কবরটা চেনা ছিল সেটা তো নিজস্ব না। গ্রামের উত্তর ইষার মকবুল মুন্সী মরলে, মুটেবাড়ির সিতারা বেগম মরলে সবাই জানে, কবর তো ওইটাই হবে।
নিজস্ব কবর কেমন হয়? সেটাতে কি লম্বা লম্বা বুনো ঘাস গজায়? ঝড়-জলে এঁদো-কাঁদার মতো পায়ে বিঁধে যায় যে নীল ফুল সেটা তো কবরেরই ফুল। বড় বড় বাঁশগাছের ছায়া থাকে সেখানে। কিন্তু মেজো ভাই ভাবে, কবরে শোয়ানো মরা মানুষ যে পরিচিত মুখ, তারা যে আর অচেনা নয়। দাদি তো আমাদের ঘরেই থাকত। এই রকম চেনা মানুষ আবার মরে কেমনে।
অথচ ফ্যাক্টরির জমিতে কবর কাটা হলো আপার। আপাও তো এত চেনা। দুপাশে ঘন চুল ছড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকার সময় চেনা। রাতের আঁধারে লাল ডুরে শাড়ি পরে বারবাড়িতে লাল ফুল পেড়ে আনার সময় চেনা। গোসলের পর বাসি কাপড় বদলের মতো চেনাটা এত চেনা। পুরোনো বইপত্রে ধুলো জমে যাওয়ার মতো চেনাটা বুকে চেপে ধরে।
সে রাতে কবরের কথা জানতে চাইল অনেকে। ধলেশ্বরীর স্রোতে কবরের তলাটা ডুবে গেল কি না। মেজো ভাই তখন বর্ষার কথা বলল। অর্জুনগাছের কথা বলল। ছক কাটা কবরে শক্ত মাটির ভেতরে ঘাস না গজানোর কথা বলল। কবরের উদোম অন্ধকারের কথা বলল।
আকাশের দিকে তাকালে যেমন হয়, কোথাও ছাই ছাই অন্ধকার, কোথাও অন্ধকারটা ঠিক ছায়াকে ঘিরে ছায়ারই মতো ছলকায়। সেদিন লাশ নামানো মাত্র ভিড়টা এদিকে আচমকা কুয়াশায় ঢাকা সমতল থেকে ধেয়ে এল। নদী বরাবর কবর কাটা হয়েছিল চৌকোনা। এই মাত্র ডিস্ট্রিক্ট জজের অনুষ্ঠান শেষ হওয়া ভিড়টা ভাঙতে শুরু করছিল। উত্তর গেট দিয়ে ডানে-বাঁয়ে করতে করতে ভিড়টা বেরিয়ে আসে। লাশ দেখে বেড়া গলে এদিকটার মাঠে দাপিয়ে দাপিয়ে আসে ভিড়ের মানুষগুলো। ফ্যাক্টরি থেকে কোনাকুনি ধুনতলা ব্রিজ টপকেও আসা যেত। কিন্তু সেটা ঘুরপথ বলে এই মুহূর্তটাতে পৌঁছাতে তারা দেরি করল না। বৃষ্টিতে কাঁটাঝোপের মতো একদলা হয়ে লাশকে মধ্যখানে রেখে ভিড়টা ক্রমশ বড় হয় সে রাতে। গাছগুলোতে ঝুপসি অন্ধকার নামে। নিজের মনে শুধু কবরের নকশাটা ভাবে। বয়রাগাদী থেকে বেরোতেই ধূপঝোরার মোড়। আর সূর্যোদয়ের ভূগোলে কবরটা আড়াআড়িই থাকছে বরাবর। কিন্তু আরও পুবে যে রাস্তা সিঙরা যেখানে ধলেশ্বরীতে পড়ছে, এলামজানি পড়েছে চণ্ডীগঞ্জে, সেখানেও একই সূর্য উঠছে। সূর্যোদয়ের তো দিকবদল নেই। যত পুবে তাকানো যায় তত চাঁদডোবা অন্ধকারটা নদীর ওপরে উঠে আসে। চারদিকে ফরেস্টের ঝোপ। বুনো শালগাছ। কিউট ফ্যাক্টরির নল, মাঠজঙ্গল, ব্রিজ, কাঁটাতার ঘেরা বাতাসটা, ভেজা ঘাস আর এই গোধূলিলগ্নের মানুষ দেখতে দেখতে এসব কথা মনে আসে মেজো ভাইয়ের।
কবরটা যেখানে ছিল সেখানটা কই?
ভিড়ের আলগা ভাবটা ঝুলে পড়ে এরই মধ্যে। তারা ভেবেছিল, মেজো ভাই ঢুকে পড়বে মালিকের ঘরে। হয়তো নতুন ফ্যাক্টরি হবে। ফ্যাক্টরি হলে সেখানে কাজ করতে এবার ভিনগাঁ থেকেও লোক আসবে। আর ভাবে, কোম্পানির লোক এবার তারাই সাপ্লাই দেবে। ফ্যাক্টরিতে যারা আছে তারা তো থাকলই। এ জায়গায় আরও জনা পঞ্চাশ এমনকি শখানেক কনট্রাকটারকে সাপ্লাইয়ের কাজটাজ দেওয়া যাবে। কিন্তু মেজো ভাইকে উঁচু টিলাতে হেঁটে যেতে দেখে ভিড়টা এদিক-ওদিক জলপ্রান্তর ঘেঁষে তলিয়ে যায়। শুধু বসন্তের দাগওয়ালা লোকটি মেজো ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, ‘ফ্যাক্টরিতে ঢুকবেন না, স্যার? তবে কি লোক্যাল লোক খুঁজতেছেন?’
দূরের চর থেকে কেউ আসবে না এ কাজে। এই ভাটিতে জলপাড় ভাঙবে আবার গড়বে। কিন্তু এতগুলো মানুষের একসঙ্গে দলবাঁধা কোলাহলে নানাবিধ কল্পনা আকস্মিক থেমে যায়। মেজো ভাইকে গেরুয়া রঙের ফতুয়া গায়ে দলা পাকানো ঘন শেওলাতে অগ্নিবহ বালকের মতো হেঁটে যেতে দেখে এই অরণ্যনিবাসে মানুষের ভিড়টা উদ্দশ্যহীন হয়ে পড়ে। ওখানে একটা পাকুড়গাছের ঝাঁপির নিচে ঘন অন্ধকার জল টলটল করে। ওখানে বাঁশঝাড়ের বিস্তারের মাঝে আকাশটা ছোট হতে হতে মাটিতে নেমে আসে। বাষট্টি সালের স্মৃতির ভেতরে শুকনো খড়িকাঠ জ্বলে ওঠে যেন। এই অভ্যস্ত গোধূলিলগ্নে অদৃশ্য ভূখণ্ডটির আচ্ছন্নতার ভেতরে দাঁড়িয়ে মেজো ভাই পূর্ব গোলার্ধের বিন্যাসটা আরেকবার শরীর দিয়ে অনুভব করে। বসন্তের দাগওয়ালা এবার এগিয়ে আসে। চোখগুলো তার কোটরে ঢোকানো।
আপনে কী খুঁজতেছেন?
মেজো ভাই দেখে পায়ের তলায় জলে নামার পথটা। জলের তলা থেকে ঝুরঝুর মাটি জমা হয়েছে। এ চরের সাথে ওর জন্মসূত্রের শৈশব বন্ধন আপার কবরটি না পেয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। জলের টান সে শরীরে অনুভব করে। এই শরীরে এই জলের শেষ স্মৃতি নিয়ে ও বলে, ‘আপনারা তো অনেক দিন নদীটা দেখছেন? ধলেশ্বরী কত দিন ধরে দূরে সরে গেল, মৌজায় যেটা নদী ছিল…।’ নানাবিধ দাগ নম্বর দেওয়া এক টুকরো কাগজ বের করে মেজো ভাই। ‘ঠিক আন্দাজ দেন তো নদীটা কবে ন্যাশনাল হাইওয়ে হলো?’
স্যার, কী বলেন? রমিজ শেখ ৩৩ বছর ধরে ফ্যাক্টরিতে আছে। অষ্টাশি সালের সেটলম্যান্টের সময় নদী মলিনাহাটের ভেতর দিয়ে বইত। মানুষজন গরুবাছুর-সংসার নিয়ে রায়পুর ব্রিজে উঠে গেল সেবার। মেজো ভাই ম্যাপে ৫৫ নম্বর ঢিবিটা দেখায়। হাত দিয়ে আড়াআড়ি আন্দাজ দেয়। স্রোতের তীব্রতা কতটা বেগে প্রত্যেকটা গাছকে জলে টেনে নিতে পারে তা নির্ভর করে স্রোতের সমবেত অভ্যাসের ওপর। আজ এই মেঘের বিকেলে, এই বিরানজমিতে কবরের আন্দাজ পেতে মেজো ভাইকে নদীর ইতিহাসে ফিরে যেতে হয়। মেজো ভাইয়ের মুখের দিকে এতগুলো লোকের নিবিড় ঝুঁকে থাকা, কোঁকড়া চুলে জট-পাকানো, ধুলো থেকে উঠে আসা শরীর। মেজো ভাই ভাবে, এ মানচিত্রের ভেতরে এখন নদীর বয়ে চলাটা, বৃষ্টিটা, এই অরণ্যনিবাসের নির্জনতাটা, এই ভিড়ের গায়ে তামাটে খর্বতাটা সবকিছুই এমনভাবে বদলে গেছে যে এই বদলে যাওয়াটা এই গোধূলিবেলার কয়েকটি মাত্র মুহূর্তজুড়ে বিরাজ করবে। হয়তো অরণ্যের কোনো এক গাছতলায় শ্রাবণ এসেছিল একদিন। অথবা চাঁদডোবা অন্ধকারে অর্জুনগাছের তলায় ছিল কবরটা। নদীর বাঁধের ওপরে আলো-ছায়াতে আদিগন্ত আকাশের পটভূমিতে নদীর ভেতরে বালিয়াড়ি ভেঙে কবরটা উদোম হয়ে গেছিল। এখন এই পুরোনো জলে, বৃষ্টি-বাতাস ঘেরা প্রতিদিনের জীবনযাত্রার জলে জলটা আরও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগেই কবরের একটা অনিশ্চিত হিসাব কষে নিতে চাওয়া কতটা অর্থময়?
ঘন ঘাসে ঢেকে গেছে কাঁটাতারের বেড়া। পুরোনো ছাতা-পড়া বাঁশের বেড়াগুলোও চিত হয়ে ঝিমুচ্ছে। ঘন অন্ধকার সবুজ বুনো ঝোপ আছে শুধু। আকাশ ঢাকা গাছের শন শন শব্দ আছে। ঘুট ঘুট নিকষ কালো ভ্রমরটার নিঝুম ওড়াউড়ি আছে। করলি পোকার খুঁটে খুঁটে কলমি ফুল খাওয়ার শূন্যতা আছে। বিরাট একটা দুপুরের ওপরে ঝিম্ মেরে পড়ে থাকা ঘন নীল আকাশ আছে। কলের কারখানার ঘঁটর ঘঁটর…মানুষের নিবিড় সংলাপ। তার মধ্যে মেজো ভাই একটা ঢালু পথ বেয়ে চলে যায়, পাকুড়ের ঝাঁপি যেখানে তিন শ বছর ধরে আছে। কবরটা যেখানে ছিল সেখানটা নেই। সেখানটা না থাকলে আর কোনখানে কবর থাকে? একটা উঁচু গাছে এমন ভর দুপুরে ছোট তারার মতো আকন্দের ফুল ফুটল কি না, মাটির ওপরে এভাবে মানুষের জীবনের গেঁথে থাকা এতটাই যে মাটি আর মানুষ তো আর আলাদা নেই এখানে। কারখানায় কলের শব্দে শালগাছের ওজনটা বাতাসে দুলে উঠছে। মলিনাহাটের সরু শুকনো খটমটে সড়কে ন্যাশনাল হাইওয়ে। এ পাশটায় শুধু বুনো ঝোঁপ। পাকুড়গাছের ঝাঁপি জলের ওপরে এমন নিশ্ছিদ্র চেপে বসা অথবা অর্জুন-শাল এমনই জবরদখল করে নিত জলকে। মেজো ভাই ভাবে, কবরটা যেখানে ছিল সেখানটাই কি এখন ন্যাশনাল হাইওয়ে? ভারতবর্ষের বর্ধমানে চন্দ্রকেতুগড়ে দিন-রাত মাল নিয়ে যায় ট্রাক যে পথ দিয়ে? অথবা আকাশ থেকে ঝরে পড়া অন্ধকারটা অর্জুনগাছের বাকলে যেখানটায় ছলকায়?
কিন্তু এই মালবাজার আর কাইকারটেক, এই ধানতারা, এই ফ্যাক্টরি, এই মলিনাহাট, ক্ষেতবাড়ি বারবাড়ি, ধলেশ্বরী, এই বাতাস, ভেজা পচা ঘাস, অর্জুন বাকল, আকন্দের গন্ধটা তো আলাদাই। আর এসবের দিকে তাকালে তো কোনটা নদী, কোনটা বনতারা ঘাট, কোনটা বাষট্টি সালের মেঘ আকাশে কোনটা জলরেখা কোনটা স্রোতের সংযোগ, কোনটা ভূখণ্ড বোঝা যাবেই। আর এই বোঝা যাওয়াটা থেকে কি একদিন বোঝা যাবে না কবরটা আসলে কোথায় ছিল?

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৯, ২০১০

Category: গল্প
Previous Post:জীবন ও মৃত্তিকার আবু রুশদ
Next Post:সিন্দাবাদের ধান্ধাবাজি

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑