৫১-৬০. দিল্লি পৌঁছালাম

৫১.

দিল্লি পৌঁছালাম এবং সোজা রেলস্টেশনে হাজির হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ওয়েটিংরুমে মালপত্র রাখলাম। গোসল করে কিছু খেয়ে নিয়ে মালপত্র দারোয়ানের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টিকিট কিনে নিয়েছি। রাতে ট্রেন ছাড়বে। অনেক সময় হাতে আছে। আমি একটা টাঙ্গা ভাড়া করে জামে মসজিদের কাছে পৌঁছালাম। গোপনে গোপনে দেখতে চাই মুসলমানদের অবস্থা। পার্টিশনের সময় এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল এই দিল্লিতে। দেখলাম, মুসলমানদের কিছু কিছু দোকান আছে। কারও সাথে আলাপ করতে সাহস হচ্ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে লালকেল্লায় গেলাম। পূর্বেও গিয়েছি, হিন্দুস্তানের পতাকা উড়ছে। ভিতরে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। মুসলমানদের অনেক দোকান ছিল পূর্বে, এখন দু’একটা ছাড়া নাই। বেশি সময় থাকতে ইচ্ছা হল না। বেরিয়ে আসলাম, আর একটা টাঙ্গা নিয়ে চললাম এ্যাংলো এ্যারাবিয়ান কলেজের দিকে, যেখানে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ কনভেনশনে যোগদান করেছিলাম।

নতুন দিল্লিও ঘুরে দেখলাম। নতুন দিল্লি এখন আরও নতুন রূপ ধারণ করেছে। ভারতবর্ষের রাজধানী। শত শত বৎসর মুসলমানরা শাসন করেছে এই দিল্লি থেকে, আজ আর তারা কেউই নাই। শুধু ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর রয়ে গেছে। জানি না যে স্মৃতিটুকু আজও আছে, কতদিন থাকবে! যে উগ্র হিন্দু গোষ্ঠী মহাত্মা গান্ধীর মত নেতাকে হত্যা করতে পারে, তারা অন্য সম্প্রদায়কে সহ্য করতে পারবে কি না? এই দিল্লিতেই মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। খোদা শহীদ সাহেবকে রক্ষা করেছিলেন। নাথুরাম গডসের সহকর্মী মহাত্মা গান্ধী হত্যা মামলার সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দিতে এই কথা স্বীকার করেছিল।

আমি রাতের ট্রেনে চড়ে বসলাম। আমার সিট রিজার্ভ ছিল। দ্বিতীয় শ্রেণীতে আরও তিনজন ভদ্রলোক ছিলেন। কারও সাথে আলাপ করতে সাহস হল না। একটা কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলাম। তখনও ভারতবর্ষে মাঝে মাঝে গোলমাল চলছিল। তবে মহাত্মাকে হত্যা করার পর কংগ্রেস সরকার বাধ্য হয়েছিল সাম্প্রদায়িক আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার কর্মীদের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। মহাত্মা গান্ধী যে মুসলমানদের রক্ষা করবার জন্য জীবন দিলেন তার জন্য তাঁর ভক্তদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তারা মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি দুইজন প্যাসেঞ্জার নেমে গেছেন, একজন আছেন। তিনি পশ্চিম বাংলার লোক। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? আমি সত্য কথাই বললাম। লাহোর থেকে এসেছি, পূর্ব বাংলায় যাব। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। ভদ্রলোক বললেন, “আমার বাড়িও বরিশাল জেলায় ছিল। এখন চাকরি করি দিল্লিতে।” অনেক আলাপ হল, পূর্ব বাংলার মাছ ও তরকারি, পূর্ব বাংলার আলো-বাতাস। আর জীবনে যেতে পারবেন না বলে আফসোস করলেন, কেউই নাই তার এখন বরিশালে। ভদ্রলোক আমাকে হাওড়ায় নেমে যেতে বললেন, “আপনি আমার বাড়িতে রাতে থাকতে পারেন, কোনো অসুবিধা হবে না।” আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, “কাল সকালে চলে যেতে হবে, সেজন্য রাতটা এক বন্ধুর বাড়িতে থাকব।”

কোথায় যাব ভাবলাম? হোটেলে থাকব না। বন্ধু খন্দকার নূরুল আলমের বাসা চিনি, তার কাছেই যাব। নূরুল আলমের বাড়ি পার্ক সার্কাসে আসলাম। ওর ভাই বাসায় আছে, আলম নাই, বাইরে গেছে। আমাকে খুব যত্ন করে গ্রহণ করল। কিছু সময়ের মধ্যে নূরুল আলম এল। আমাকে পেয়ে কত খুশি। একসাথে খেলাম, তারপর বেড়ালাম। আলম বলল, “কি করি একেবারে একা পড়ে গেছি। বন্ধুবান্ধবও নাই, ঢাকা যেয়েই বা কি হবে? টাকা নাই যে ব্যবসা করব? চাকরি তো নূরুল আমিন সাহেবরা দিবে না, কারণ আমি তো শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের দলের লোক ছিলাম। আমি তাকে কিছুই বলতে পারলাম না, কারণ আমি তাকে আসতে বলব কি অধিকারে। আমারই তো কোনো ঠিক নাই, আগামীকালই জেলের ভাত কপালে থাকতে পারে। তবে নূরুল আলম বলল যে, সে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার অফিসে একটা চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছে।

টেলিফোন করে জানলাম সকাল এগারটায় খুলনার ট্রেন ছাড়ে, প্রায় সন্ধ্যায় বেনাপোলে পৌঁছে এবং রাত দশটায় খুলনা পৌঁছে। ইন্টারক্লাস টিকিট কাটলাম। কারণ বেনাপোলে আমাকে পুলিশের চোখে ধুলা দিতে চেষ্টা করতে হবে। পূর্ব বাংলা সরকারও খবর রাখে আমি দু’একদিনের মধ্যে পৌঁছাব। গোয়েন্দা বিভাগ ব্যস্ত আছে, আমাকে গ্রেফতার করবার জন্য। আমিও প্রস্তুত আছি, তবে ধরা পড়ার পূর্বে একবার বাবা-মা, ভাইবোন, ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই। লাহোর থেকে রেণুকে চিঠি দিয়েছিলাম, বোধহয় পেয়ে থাকবে। বাড়ির সকলেই আমার জন্য ব্যস্ত। ঢাকায়ও যাওয়া দরকার, সহকর্মীদের সাথে আলাপ করতে হবে। আমি গ্রেফতার হওয়ার পর যেন কাজ বন্ধ না হয়। কিছু অর্থের বন্দোবস্তও করতে হবে। টাকা পয়সার খুবই অভাব আমাদের। আমি কিছু টাকা তুলতে পারব বলে মনে হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কয়েকজন ভক্ত আছে, যাদের আমি জানি, গেলে একেবারে ‘না’ বলতে পারবে না। রানাঘাট এসে গাড়ি থামল অনেকক্ষণ। ভারতবর্ষের কাস্টমস অফিসাররা গাড়ি ও প্যাসেঞ্জারদের মালপত্র তল্লাশি করল, কেউ কোনো নিষিদ্ধ মালপত্র নিয়ে যায় কি না? আমার মালপত্রও দেখল। সন্ধ্যা হয় হয়, ঠিক এই সময় ট্রেন বেনাপোল এসে পৌঁছাল। ট্রেন থামবার পূর্বেই আমি নেমে পড়লাম। একজন যাত্রীর সাথে পরিচয় হল। তাকে বললাম, আমার মালগুলি পাকিস্তানের কাস্টমস আসলে দেখিয়ে দিবেন, আমার একটু কাজ আছে। আসতে দেরিও হতে পারে। অন্ধকার দেখে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। এখানে ট্রেন অনেকক্ষণ দেরি করল। গোয়েন্দা বিভাগের লোক ও কিছু পুলিশ কর্মচারী ঘোরাফেরা করছে, ট্রেন দেখছে তন্নতন্ন করে। আমি একদিক থেকে অন্যদিক করতে লাগলাম। একবার ওদের অবস্থা দেখে ট্রেনের অন্য পাশে গিয়ে আত্মগোপন করলাম। ফাঁকি আমাকে দিতেই হবে। মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তাঁরা জানেন, লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।

মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও সহকর্মীরা জেল অত্যাচার সহ্য করছেন। তাঁদের জন্য মনটাও খারাপ। কিছু করতে না পারলেও তাঁদের কাছে যেতে পারলে কিছুটা শান্তি তো পাব। ট্রেন ছেড়ে দিল, আস্তে আস্তে ট্রেন চলছে, আমি এক দৌড় দিয়ে এসে ট্রেনে উঠে পড়লাম। আর এক মিনিট দেরি হলে উঠতে পারতাম কি না সন্দেহ ছিল। ট্রেন চলল, যশোরেও হুশিয়ার হয়ে থাকতে হবে। রেলস্টেশনে যে গোয়েন্দা বিভাগের লোক থাকে, আমার জানা আছে। যশোরে ট্রেন থামবার কয়েক মিনিট পূর্বেই আমি পায়খানায় চলে গেলাম। আর ট্রেন ছাড়লে বের হয়ে আসলাম। একজন ছাত্র আমার কামরায় উঠে বসে আছে। আমি পায়খানা থেকে বের হয়ে আসতেই আমাকে বলল, “আরে, মুজিব ভাই।” আমি ওকে কাছে আসতে বললাম এবং আস্তে আস্তে বললাম, “আমার নাম ধরে ডাকবা না।” সে ছাত্রলীগের সভ্য ছিল, বুঝতে পেরে চুপ করে গেল। অনেক যাত্রী ছিল, বোধহয় কেউ বুঝতে পারে নাই। আর আমাকে তখন বেশি লোক জানত না। ছাত্রটি পথে নেমে গেল।

খুলনার অবস্থা আমার জানা আছে। ছোটবেলা থেকে খুলনা হয়ে আমাকে যাতায়াত করতে হয়েছে। কলকাতায় পড়তাম, খুলনা হয়ে যেতে আসতে হত। রাত দশটা বা এগারটায় হবে এমন সময় খুলনায় ট্রেন পৌঁছাল। সকল যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে আমার পাঞ্জাবি খুলে বিছানার মধ্যে দিয়ে দিলাম। লুঙ্গি পরা ছিল, লুঙ্গিটা একটু উপরে উঠিয়ে বেঁধে নিলাম। বিছানাটা ঘাড়ে, আর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম। কুলিদের মত ছুটতে লাগলাম, জাহাজ ঘাটের দিকে। গোয়েন্দা বিভাগের লোক তো আছেই। চিনতে পারল না। আমি রেলরাস্তা পার হয়ে জাহাজ ঘাটে ঢুকে পড়লাম। আবার অন্য পথ দিয়ে রাস্তায় চলে এসে একটা রিকশায় মালপত্র রাখলাম। পাঞ্জাবিটা বের করে গায়ে দিলাম। রিকশাওয়ালা গোপালগঞ্জের লোক, আমাকে চিনতে পেরে বলল, “ভাইজান না, কোথা থেকে এইভাবে আসলেন।” আমি বললাম, “সে অনেক কথা, পরে বলব। রিকশা ছেড়ে দাও।” ওকে কিছুটা বলব, না বলে উপায় নাই। গোপালগঞ্জের লোক, কাউকেও বলবে না, নিষেধ করে দিলে।

আমার এক ভাই ছিল, সে খুলনায় চাকরি করত। তার বাসায় পৌঁছালাম, ঠিকানা জানতাম। রিকশাওয়ালাকে দিয়েই আমার মামাকে খবর দিলাম। মামা খুব চালু লোক। সকাল ছয়টায় জাহাজ ছাড়বে। মামাকে জাহাজ ঘাটে পাঠিয়ে দিয়ে তার নামে প্রথম শ্রেণীতে দুইটা সিট রিজার্ভ করালাম যাতে অন্য কেউ আমার কামরায় না উঠে। আমার এক বন্ধু ছিল, জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করত, তাকে খবর দিলাম। সে বলল যে, জাহাজ ছাড়বার ঠিক দুই মিনিট আগে যেন আমি জাহাজে উঠি। জাহাজে ওঠার সাথে সাথে সে জাহাজ ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করবে। জাহাজ ঘাটেও গোয়েন্দাদের আমদানি আছে। দুঃখের বিষয় কুয়াশা পড়ায় জাহাজ আসতে দেরি হয়েছিল এবং ছাড়তেও দেরি হবে, প্রায় এক ঘন্টা অর্থাৎ সকাল সাতটায়। মহাবিপদ! ছয়টায় তো একটু অন্ধকার থাকে, সাতটায় সূর্য উঠে যায়। মামা পূর্বেই মালপত্র নিয়ে উঠে কামরা ঠিক করে রেখেছে। আমি কাছেই এক দোকানে চুপটি করে বসেছিলাম। খুলনার গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা আমাকে চিনে। মামার সাহায্যে আমি প্যান্ট, কোট ও মাথায় হ্যাট লাগিয়ে অন্য রূপ ধরেছি। যখন দুইটা সিঁড়ি টেনেছে আর দুইটা বাকি আছে, আমি এক দৌড় দিয়ে উঠে পড়লাম। দেখলাম আমার বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে। উঠার সাথে সাথে ওই দুইটা সিড়িও টেনে নিল এবং জাহাজ ছেড়ে দিল। দুইজনের চোখে চোখে আলাপ হল, আমি আমার চক্ষু দিয়েই কৃতজ্ঞতা জানালাম।

এবার আশা হল, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব। আমি কামরাতেই শুয়ে রইলাম। খাবার জিনিস কামরায় আনিয়ে নিলাম। আমি যে জাহাজে উঠেছি অনেকে দেখে ফেলেছে। এই জাহাজই গোপালগঞ্জ হয়ে বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জ যায়। গোপালগঞ্জের লোক অনেক ছিল। গোপালগঞ্জ টাউনে জাহাজ যায় না, তিন মাইল দূরে মানিকদহ নামক স্থানে নতুন ঘাট হয়েছে সেখানে থামে। নদী ভরাট হয়ে গেছে। মানিকদহ ঘাটে যখন জাহাজ ভিড়েছে, তখন আমি জানালা দিয়ে চুপটি করে দেখছিলাম। ঘাট থেকে রহমত জান ও ইউনুস নামে দুইজন ছাত্র, যারা খুব ভাল কর্মী—আমার চোখ দেখেই চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠেছে। আমি ওদের ইশারা করলাম, কারণ খবর রটে গেলে আবার পুলিশ গ্রামের বাড়িতে যেয়ে হাজির হবে। রহমত জান ও ইউনুস বরিশাল কলেজে পড়ে। এই জাহাজেই বরিশাল যাবে। ওরা সোজা আমার কাছে চলে এল। জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। আমি ওদের বললাম, “তোমরা চিনলা কেমন করে?” ওরা বলে, “ও চোখ আমাদের বহু পরিচিত।” আমি বললাম, “পুলিশ খবর পেলে রাস্তায় গ্রেফতার করতে চেষ্টা করতে পারে।” ওরা বলে, “ভাইজান, এটা গোপালগঞ্জ; এখান থেকে ইচ্ছা না করলে ধরে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নাই।” গোপালগঞ্জের মানুষ বিশেষ করে ছাত্র ও যুবকরা আমাকে ভাইজান’ বলে ডাকে। এমনও আছে, ছেলেও ভাইজান’ বলে, আবার বাবাও ভাইজান’ বলে ডাকে। গোপালগঞ্জ থেকে আমার বাড়ির নিকটবর্তী জাহাজ ঘাটে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সন্ধ্যার সময় আমাদের জাহাজ ঘাট পাটগাতি পৌঁছালাম। নৌকায় প্রায় এক ঘণ্টা লাগবে। বাড়িতে পৌঁছালাম, কেউ ভাবতেও পারে নাই আমি আসব। সকলেই খুব খুশি। মেয়েটা তো কোল থেকে নামতেই চায় না, আর ঘুমাতেও চায় না। আব্বাকে বললাম সকল কথা। বাড়িতে পাহারা রাখলাম। বৈঠকখানায় রাতভর লোক জেগে থাকবে, যদি কেউ আসে আমাকে খবর দেবে। আমাদের বাড়ি অনেক বড় এবং অনেক লোক। এখন গ্রেফতার হতে আমার বেশি আপত্তি নাই। তবে ঢাকা যাওয়া দরকার একবার। বেশি দিন যে বাড়ি থাকা চলবে না, তা আব্বা ও রেণুকে বুঝিয়ে বললাম। বোধহয় সাত-আট দিন বাড়িতে রইলাম। বললাম, “বরিশাল হয়ে জাহাজ যায়, এ পথে যাওয়া যাবে না; আর গোপালগঞ্জ হয়েও যাওয়া সম্ভবপর নয়। পথে গ্রেফতার করে ফেলতে পারে। আমি গোপালগঞ্জের দুই ঘাট পরে জাহাজে উঠব। তারপর কবিরাজপুর থেকে নৌকায় মাদারীপুর মহকুমার শিবচর থেকে জাহাজে উঠব। দু’একদিন আমার বড়বোনের বাড়িতে বেড়িয়ে যাব।” বড়বোনের বাড়ি শিবচর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল পথ। রেণু বলল, “কতদিন দেখা হবে না বলতে পারি না। আমিও তোমার সাথে বড়বোনের বাড়িতে যাব, সেখানেও তো দু’একদিন থাকবা। আমি ও ছেলেমেয়ে দুইটা তোমার সাথে থাকব। পরে আব্বা যেয়ে আমাকে নিয়ে আসবেন।” আমি রাজি হলাম, কারণ আমি তো জানি, এবার আমাকে বন্দি করলে সহজে ছাড়বে না। নৌকায় এতদূর যাওয়া কষ্টকর। আমরা বিদায় নিয়ে রওয়ানা করলাম। দুইজন কর্মীও আমার সাথে চলল। একজনের নাম শহীদুল ইসলাম, আরেকজনের নাম সিরাজ। ওরা স্কুলের ছাত্র ছিল, আমাকে ভীষণ ভালবাসত। এখন দুইজনই ব্যবসায়ী। শহীদ আজও আমাকে ভালবাসে এবং রাজনীতিতে আমাকে অন্ধভাবে সমর্থন করে। সিরাজ অন্য দল করলেও আমাকে শ্রদ্ধা করে। এরা কবিরাজপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল এবং রাতভর পাহারা দিয়েছিল। শীতের দিন ওরা এক কাপড়ে এসেছিল। রেণু নিজের গায়ের চাদর ওদের দিয়েছিল।

আমরা বোনের বাড়িতে পৌঁছালাম, একদিন দুই দিন করে সাত দিন সেখানে রইলাম। ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে। আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর রেণুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে। আমি রেণুকে বললাম, “এতদিন একলা ছিলে, এখন আরও দুজন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোনো আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন? আমার টাকার বেশি দরকার নাই। শীঘই গ্রেফতার করে ফেলবে। পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না। তোমাদের সাথে কবে আর দেখা হয় ঠিক নাই। ঢাকা এস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। মেজোববানের বাসায়ও জায়গা খুব কম। কোনো আত্মীয়দের আমার জন্য কষ্ট হয়, তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব।”

 

৫২.

রাতে রওয়ানা করে এলাম, দিনেরবেলায় আসলে হাচিনা কাঁদবে। কামাল তো কিছু বোঝে না। শিবচরে জাহাজ আসে না, চান্দেরচর যেতে হবে, প্রায় দশ মাইল। আমার বড়বোনের দেবর, আমারও বিশিষ্ট বন্ধু ও আত্মীয় সাইফুদ্দিন চৌধুরী সাহেব আমাকে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমা দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিল না। সবই তো ওকে বলেছি। রাতে নৌকা ছেড়ে সকালে চান্দেরচর স্টেশনে পৌঁছালাম। জাহাজ ছাড়তে দেরি আছে। আমার এক সহকর্মীর বাড়ি নিকটেই। তাকে খবর দিলাম, তার নাম সামাদ মোড়ল। সামাদ খবর পেয়ে ছুটে এল। তাদের বাড়ি নিয়ে খাবার জন্য অনেক অনুরোধ করল, কিন্তু সময় ছিল না। ফেরি স্টিমার তারপাশা পর্যন্ত যায়; তারপর আবার তো গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ মেল স্টিমারে উঠতে হবে। তারপাশা পৌঁছে শুনলাম, মেল কিছু সময় হল ছেড়ে গেছে। ফলে সারা দিন আমাদের থাকতে হল। অনেক রাতে আর একটা জাহাজ আসবে তাতে যেতে পারব। উপায় নাই,

জাহাজ ঘাটের প্লাটফর্মে বসে থাকতে হবে।

পরের দিন সকালবেলায় মুন্সিগঞ্জ পৌঁছালাম। জাহাজে একজন ছাত্রলীগ কর্মীর সাথে দেখা হয়ে গেল। সে সবকিছু জানত, তার কাছে আমাদের দুইজনের মালপত্র দিয়ে বললাম, “১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে শওকত মিয়ার কাছে চুপ করে পৌঁছে দিতে। নারায়ণগঞ্জ দিনেরবেলায় নামলে আর ঢাকা যেতে হবে না, সোজা জেলখানায়। পরোপকারী শওকত মিয়া যেন আমার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করে রাখে। আর যদি পারে সন্ধ্যার সময় যেন নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়িতে আসে। খান সাহেবের বড় ছেলে শামসুজ্জোহাকেও খবর দিতে বোলো। সন্ধ্যায় যেন সে বাড়িতে থাকে।”

আমরা মুন্সিগঞ্জে নেমে মীরকাদিম হেঁটে আসলাম। সেখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার একটু পূর্বে নৌকায় নারায়ণগঞ্জ রওয়ানা করলাম। সন্ধ্যার পরে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে রিকশা নিয়ে সোজা খান সাহেবের বাড়িতে পৌঁছালাম। জোহা সাহেব খবর পায় নাই, তার ছোট ভাই মোস্তফা সরোয়ার তখন স্কুলের ছাত্র। আমাকে জানত। তাড়াতাড়ি জোহা সাহেবকে খবর দিয়ে আনল। আমরা ভিতরের রুমে বসে বসে চা-নাশতা খেলাম। খান সাহেবের বাড়ি ছিল আমাদের আস্তানা। ক্লান্ত হয়ে এখানে গেলেই যে কোনো কর্মীর খাবার ও থাকার ব্যবস্থা হত। ভদ্রলোকের ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু প্রাণটা ছিল অনেক বড়। জোহা সাহেব এসেই ট্যাক্সি ভাড়া করে আনল, আমাদের তুলে দিল। শওকত মিয়ার জন্য একটু দেরিও করেছিলাম। আমরা ঢাকায় রওয়ানা করার কয়েক মিনিট পরে শওকত মিয়াও নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছাল এবং আমাদের চলে যাবার খবর পেয়ে আবার ঢাকায় ছুটল। আমরা পথে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে রিকশা নিয়ে মোগলটুলী পৌঁছালাম। দেখি আমাদের মালপত্র পৌঁছে গেছে। শওকত মিয়াও এসে পৌঁছে গেছে। শওকত মিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মুজিব ভাই, কি করে লাহোরে পৌঁছালেন, আর কি করে ফিরে এলেন, বলুন শুনি।” আমি বললাম, “প্রথমে বলেন, মওলানা সাহেব ও হক সাহেব কেমন আছেন? কে কে জেলে আছে। আওয়ামী লীগের খবর কি?” শওকত মিয়া যা বলল তাতে দুঃখই পেলাম, কিন্তু অখুশি হলাম না।

আওয়ামী লীগে যে ভদ্রলোকদের মওলানা সাহেব কার্যকরী কমিটির সভ্য করেছিলেন তাঁদের মধ্য থেকে প্রায় বার-তেরজন পদত্যাগ করেছেন ভয় পেয়ে। যারা অনেক দিনের পুরানা নেতা ছিলেন, তারা শুধু পদত্যাগই করেন নাই, বিবৃতি দিয়ে পদত্যাগ করেছেন, যাতে গ্রেফতার না হতে হয়। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেব সদস্য হওয়ার পরপরই একদিন মওলানা সাহেব ও আমাদের সাথে আলাপ করলেন এবং বললেন, “আমি আর্থিক অসুবিধায় আছি। এডভোকেট জেনারেলের চাকরিটা নিচ্ছি। আমার পক্ষে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আপাতত আমি সদস্য থাকব না। তবে আমার দোয়া ও সমর্থন রইল। আমরা তার অসুবিধা বুঝতে পারলাম। তিনি কষ্ট করে সভায়ও একদিন এসেছিলেন। এই সময় দেখা গেল আওয়ামী লীগে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব, আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, আলী আহমদ খান এমএলএ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, নারায়ণগঞ্জের আবদুল আউয়াল, আলমাস আলী ও শামসুজ্জোহা এবং আমি ও আরও কয়েকজন রইলাম, যাদের নাম আমি মনে করতে পারছি না।

শওকত মিয়া আমার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করেছে। রাতে সেখানে কাটালাম। দিনে ঘরে থাকি, রাতে সকলের সাথে দেখা করি। কি করা যায় সেই সম্বন্ধে পরামর্শ করি। মানিক ভাই মোগলটুলীতেই আছেন, কি করবেন, ঠিক করতে পারছেন না। আবদুল হালিমও আমাকে কয়েকদিন রাখল ওর বাড়িতে। কয়েকজন ভদ্রলোক ওয়াদা করেছিলেন কিছু টাকা বন্দোবস্ত করে দিবেন। একদিন রাতে হঠাৎ আমার এক বন্ধু বড় সরকারি কর্মচারীর বাড়িতে পৌঁছালাম, আমাকে দেখে তো অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভয় পাওয়ার লোক ছিলেন না। আমাকে খুবই ভালবাসতেন। তিনি আমাদের অবস্থা জানতেন, তার সহানুভূতিও ছিল আমাদের উপরে। তাড়াতাড়ি চলে এলাম, এভাবে পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছা হল না, আর ভালও লাগছিল না। আমি আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিনকে বললাম, তোমাদের কাছেই থাকব। তারা তখন আলী আমজাদ খান সাহেবের পুরানা বাড়ি খাজে দেওয়ানে নিচের তলায় থাকত। আমি চলে আসলাম ওদের কাছে। দিনভর বই পড়তাম, রাতে ঘুরে বেড়াতাম। ঠিক হল, আরমানিটোলা ময়দানে একটা সভা ডাকা হবে। আমি সেখানে বক্তৃতা করব এবং গ্রেফতার হব। যখন সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, দু’একদিনের মধ্যে সভা ডাকা হবে, দুপুরবেলা বসে আছি, দেখি পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করেছে। দুইজন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী সাদা পোশাক পরে ভিতরে আসছেন। আমি যে ঘরে থাকি, সেই ঘরে এসে দরজায় টোকা মারলেন। আমি বললাম, ভিতরে আসুন। তারা ভিতরে আসলে বললাম, “কয়েকদিন পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষায় আছি। বসুন, কিছু খেয়ে নিতে হবে। এখন বেলা দুইটা, কিছুই পাই নাই। খাবার আনতে গেছে।”

হামিদ খাবার আনতে গিয়েছিল হোটেল থেকে, পুলিশ দেখে খাবার নিয়ে ভেগে গেছে। ভদ্রলোকেরা কতক্ষণ দেরি করবে? হামিদ যখন আর আসছে না, জালালও বাইরে গেছে, কখন ফিরবে ঠিক নাই তাই আলী আমজাদ খান সাহেবের বড় ছেলে হেনরীকে খবর দিলাম। হেনরী ছুটে এসেছে। আমি যে কিছুই খাই নাই, একথা শুনে বাড়িতে যেয়ে খাবার নিয়ে আসল। কিছু খেয়ে নিলাম। হেনরীর ছোট ভাই শাহজাহান, বোধহয় সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, সেও এসেছে এবং তার মামুকে গালাগালি করতে শুরু করেছে। তার মামা এই বাড়ির দোতলায় থাকত। শাহজাহান বলতে লাগল, “আর কেউ পুলিশকে খবর দেয় নাই, মামাই দিয়েছে। বাবা বাড়িতে আসুক ওকে মজা দেখাব।” শাহজাহান আমাকে খুব ভালবাসত, সময় পেলেই আমার কাছে ছুটে আসত। আমি যখন পুলিশের গাড়িতে উঠে চলে যাই, শাহজাহান কেঁদে দিয়েছিল। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। শাজাহানের ঐ কান্নার কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নাই। পরে খবর পেয়েছিলাম, ওর মামাই টাকার লোভে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিল। আলী আমজাদ সাহেব ও আনোয়ারা বেগম ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আমাকে লালবাগ থানায় নিয়ে আসল। দুইজন আইবি অফিসার আমাকে ইন্টারোগেশন করতে শুরু করল। প্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সে পর্ব চলল। আমি বললাম, “আওয়ামী লীগ করব। আমি লাহোর গিয়েছিলাম কি না? কোথায় ছিলাম? কি কি করেছি? ঢাকায় কবে এসেছি? বাড়িতে কতদিন ছিলাম? ভবিষ্যতে কি করব? সোহরাওয়ার্দী সাহেব কি কি বলেছেন? এইসব প্রশ্নে যে কথা বলার সেইটুকু বললাম, যা বলবার চাই না সে কথার উত্তর দিলাম না। আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখাল এবং সন্ধ্যার পরে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেল। রাতে আমাকে থানায় রাখল। জালাল আমার সুটকেস ও বিছানা থানায় পৌঁছে দিল। সন্ধ্যার পরে আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, আতাউর রহমান খান সাহেব, আমার বিয়াই দত্তপাড়ার জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী এমএলএ আমাকে দেখতে থানায় এসেছিলেন। রাতে জনাব সিদ্দিক দেওয়ান, বোধহয় তখন ইন্সপেক্টর ছিলেন, বাড়ির থেকে বিছানা, মশারি এনে দিলেন। আমার বিছানাও এসে গিয়েছিল, কোনো অসুবিধা হয় নাই। তিনি ও অন্যান্য পুলিশ কর্মচারী আমার সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করেছিলেন, যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তার দিকে সকলেই নজর দিয়েছিলেন।

 

৫৩.

পরের দিন দুপুরবেলায় আমাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিল। আমি জেলে আসার পরে শুনলাম, আমাকে ডিভিশন দেয় নাই। সাধারণ কয়েদি হিসাবে থাকতে হবে। তখনও রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য কোনো স্ট্যাটাস দেওয়া হয় নাই। যাকে ইচ্ছা ডিভিশন দিতে পারে সরকার, আর না দিলে সাধারণ কয়েদি হিসাবে জেল খাটতে হবে। সাধারণ কয়েদিরা যা খায় তাই খেতে হবে। দুপুরে কিছুই পেলাম না। আমাকে হাজতে রাখা হয়েছে সাধারণ কয়েদিদের সাথে। আরও দুই তিনজন রাজনৈতিক কর্মীও সেখানে ছিল। তারা আমাকে তাদের কাছে নিয়ে রাখল। রাতে ওদের সাথেই কিছু খেলাম, কারণ খুবই ক্ষুধা পেয়েছিল। মওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেব পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে আছেন। তাদের ডিভিশন দেওয়া হয়েছে। আমাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই বলে তাঁদের কাছে রাখা হয় নাই।

খুব ভোরে একজন জমাদার সাহেব এসে বললেন, “চলুন আপনাকে অন্য জায়গায় নিতে হবে। আমি বললাম, “কোথায় যেতে হবে বলেন, তারপর যাব।” তিনি বললেন, “আপনার ডিভিশন অর্ডার এসে গেছে রাতেই। মওলানা সাহেবের কাছে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে। এর বেশি আমি জানি না। আমি অন্যদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। যে দুই তিনজন রাজনৈতিক কর্মী সেখানে ছিল তাদের নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে নাই। মামলা আছে, দুই একদিনের মধ্যে জামিন পেয়ে যাবে বলে আশা করে। আমি মওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবের কাছে এলাম। একই রুমে আমরা থাকব। শামসুল হক সাহেবের কাছে বিছানা করলাম, কারণ আমি সিগারেট খাই। মওলানা সাহেবের সামনে সিগারেট খাই না।

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি জেলে আসলাম। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হয়েছে। আমার তিনবার জেলে আসতে হল, এইবার নিয়ে। মওলানা সাহেবের কাছে সকল কিছুই বললাম। মওলানা সাহেব এক এক করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব কি বলেছেন? পীর মানকী শরীফের মতামত কি? মিয়া সাহেব রাজনীতি করবেন কি না? নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন হবে কি না? হলে, কতদিন লাগবে? লাহোরে কোথায় ছিলাম? ঢাকার খবর কি? মওলানা সাহেবের কাছে শুনলাম, আমাদের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব, আবদুর রব, ফজলুল হক বিএসসি ও আমি আসামি। আবদুর রব ও ফজলুল হককে জামিন দিয়েছে। নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে নাই, তাই তারা বাইরে আছে। মামলা শুরু হয় নাই, কারণ আমাকে গ্রেফতার করতে পারে নাই। নাজিরা বাজারে পুলিশের সাথে ১১ই অক্টোবর তারিখে যে গোলমাল হয় তার উপর ভিত্তি করেই মামলা দায়ের করেছে।

যে কামরায় আমরা আছি সেখানে আমরা তিনজন ছাড়াও কয়েকজন ডিভিশন কয়েদি আছে। এদের কয়েকজনের বিশ বৎসর জেল, আর কয়েকজনের অল্প শাস্তি হয়েছে। এদের আর্থিক অবস্থা ভাল বলে সরকার ডিভিশন দিয়েছে এবং এরাও আমাদের মত খাট, মশারি, বিছানা, সাদা কাপড় পায়। এদের মধ্যে একজন ম্যানেজার আছে, সে আমাদের বাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা এবং দেখাশোনা করে। আমাদের দিন ভালভাবেই কাটছিল। শামসুল হক সাহেব আমার উপর খুব রাগ করেছিলেন। কারণ, কেন আমি শোভাযাত্রা করতে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শোভাযাত্রা না করলে তো গোলমাল হত না। আর আমাদের জেলে আসতে হত না এই সময়।

শামসুল হক সাহেব মাত্র দেড় মাস পূর্বে বিবাহ করেছিলেন। হক সাহেব ও তাঁর বেগম আফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। একে অন্যকে পছন্দ করেই বিবাহ করেছিলেন। আমাকে বেশি কিছু বললে আমি তাকে বউ পাগলা’ বলতাম। তিনি ক্ষেপে আমাকে অনেক কিছু বলতেন। মওলানা সাহেব হাসতেন, তাতে তিনি আরও রাগ করতেন এবং মওলানা সাহেবকে কড়া কথা বলে ফেলতেন। মওলানা সাহেবের সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়ম ছিল। শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে বিপদ হত। এক ঘণ্টার কমে কোনো নামাজই শেষ করতে পারতেন না। এক একটা সেজদায় আট-দশ মিনিট লাগিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে বসে থাকতেন।

আমাদের মামলা শুরু হয়ে গেছে, পনের দিন পর পর কোর্টে যেতে হত। কোর্ট হাজতের বারান্দায় আমাদের চেয়ার দেওয়া হত। তাড়াতাড়ি আমাদের আবার পাঠিয়ে দিত।

অনেক সহকর্মী আমাদের সাথে দেখা করতে আসত। ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রায় তারিখেই আসত। আতাউর রহমান সাহেব আমাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতেন। যেদিন হক সাহেবের সাথে তার বেগম দেখা করতে আসতেন, সেদিন হক সাহেবের সাথে কথা বলা কষ্টকর হত। সত্যই আমার দুঃখ হত। দেড় মাসও একসাথে থাকতে পারল না বেচারী। একে অন্যকে যথেষ্ট ভালবাসত বলে মনে হয়। আমি বেগম হককে ভাবী বলতাম, ভাবী আমাকেও দু’একখানা বই পাঠাতেন। হক সাহেবকে বলে দিতেন, আমার কিছু দরকার হলে যেন খবর দেই। আমি ফুলের বাগান করতাম। তাদের দেখা হবার দিনে ফুল তুলে হয় ফুলের মালা, না হয় তোড়া বানিয়ে দিতাম। হক সাহেব জেলের আবদ্ধ অবস্থা আর সহ্য করতে পারছিলেন না।

তিনি এক নতুন উৎপাত শুরু করলেন। রাতে বারটার পরে জিকির করতেন। আল্লাহু, আল্লাহু করে জোরে জিকির করতে থাকতেন। এক ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত। অনেক সময় মধ্যরাতেও শুরু করতেন। আমরা দশ-পনেরজন কেউই ঘুমাতে পারতাম না। প্রথম কয়েকদিন কেউ কিছু বলে নাই। কয়েদিরা দিন কাজ করে। তারা না ঘুমিয়ে পারে না। মওলানা সাহেবের কাছে গোপনে নালিশ করল এবং বলল এবাদত মনে মনে করলেও তো চলে, আমরা ঘুমাতে পারছি না। মওলানা সাহেব হক সাহেবকে বললেন, মনে মনে এবাদত করতে। হক সাহেব শুনলেন না। আমার খাট আর হক সাহেবের খাট পাশাপাশি। আমার পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে তিনি শুরু করতেন। আধ ঘণ্টা মাত্র ঘুমিয়েছি, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। আর শুনতে পাই, কানের কাছে হক সাহেব জোরে জোরে জিকির করছেন। কি করব? আমার তো চুপ করে অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় নাই। যখন আরম্ভ করেন একটানা দশ-পনের দিন পর্যন্ত চলে। একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পরে হক সাহেবকে বললাম, “এভাবে চলবে কেমন করে? রাতে ঘুমাতে না পারলে শরীরটা তো নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি রাগ করে বললেন, “আমার জিকির করতে হবে, যা ইচ্ছা কর। এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। আমি তখন কিছুই বললাম না, কিছু সময় পরে বললাম, রাতে যখন জিকির করবেন আমি উঠে আপনার মাথায় পানি ঢেলে দেব, যা হবার হবে। তিনি রাগ করলেন না, আস্তে আস্তে আমাকে বললেন, “বুঝতে পারছ না কিছুই, আমি সাধনা করছি। একদিন ফল দেখবা।” কি আর করা যাবে নীরবে সহ্য করা ছাড়া! হক সাহেবের শরীর খারাপ হয়ে চলেছে।

আমরা যখন জেলে তখন এক রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল, কলকাতা ও ঢাকায়। কলকাতায় নিরপরাধ মুসলমান এবং ঢাকায় ও বরিশালে নিরপরাধ হিন্দু মারা গেল। কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছিল যে, শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবকে কলকাতায় হত্যা করেছে। আর যায় কোথায়! মুসলমানরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের অনেক লোককে গ্রেফতার করে আনল ঢাকা জেলে। আমরা যেখানে থাকি সেই পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডেই এদের দিনেরবেলায় রাখত। আমার মনে হয়, সাত-আটশত লোককে গ্রেফতার করেছে। আমি তাদের সাথে বসে আলাপ করতাম। সকলেই অপরাধী নয়, এর মধ্যে সামান্য কিছু লোকই দোষী। সাধারণত দোষী ব্যক্তিরা গ্রেফতার বেশি হয় না। রাস্তার নিরীহ লোকই বেশি গ্রেফতার হয়। তাদের কাছে বসে বলি, দাঙ্গা করা উচিত না; যে কোনো দোষ করে না, তাকে হত্যা করা পাপ। মুসলমানরা কোনো নিরপরাধীকে অত্যাচার করতে পারে না, আল্লাহ ও রসুল নিষেধ করে দিয়েছেন। হিন্দুদেরও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তারাও মানুষ। হিন্দুস্তানের হিন্দুরা অন্যায় করবে বলে আমরাও অন্যায় করব—এটা হতে পারে না। ঢাকার অনেক নামকরা গুণ্ডা প্রকৃতির লোকেদের সাথে আলাপ হল, তারা অনেকেই আমাকে কথা দিল, আর কোনোদিন দাঙ্গা করবে না। জানি না, তারা আমার কথা রেখেছে কি না? তবে কয়েকজন যে আমার খুবই ভক্ত হয়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ আমি জেল থেকে বের হয়ে পেয়েছি। এরা আমাকে রীতিমত ভক্তি করতে শুরু করেছে। আপদে বিপদে আমার পাশেও দাঁড়িয়েছে বিপদ ঘাড়ে নিয়ে। জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে এদের মেলামেশা পছন্দ করছিল না। একদিন সকালে আমাদের এখান থেকে নিয়ে গেল নতুন বিশ নম্বর সেলে। সেলগুলি খুবই ভাল ছিল, নিচতলায় দশটা সেল, আর উপরে দশটা সেল। মওলানা সাহেব দোতলায় একটা সেল নিলেন। আমাকে পাশের সেলে থাকতে বললেন। হক সাহেব আমার পাশের সেলে থাকবেন ঠিক করলেন এবং বললেন, “খুব ভাল হয়েছে। এখন আমি রাতভর জিকির করব, কেউ কিছু বলতে পারবে না। আমি ভাবলাম, মহাবিপদ! তাকে বললাম, “হয় আপনি উপরে থাকেন, না হয় আমি উপরে থাকব। আমার পাশের সেল থেকে যদি শুরু করেন, তবে ঘুমের কাজ হয়েছে।” হক সাহেব রাগ করে নিচে চলে গেলেন এবং এক পাশের একটা সেল নিলেন। আমি তাকে অনেক অনুরোধ করলাম, মওলানা সাহেবও বললেন, কিছুতেই শুনলেন না। এখন থেকে তিনি আরও জোরে জোরে জিকির করতে লাগলেন। আর তার উৎপাতে আমরা ঘুমাতে পারি না।

কয়েকদিন পরে হাজী দানেশ সাহেবকে ঢাকা জেলে এনে আমাদের সাথে রেখেছে। দুই দিন পরেই আবার তাঁকে আমাদের কাছ থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হল। কারণ, সরকারি হুকুমে আমাদের সাথে কাউকেও রাখা চলবে না। বিশেষ করে সরকারের মতে যারা কমিউনিস্ট, তাদের সাথে তো রাখা চলবেই না। তাহলে আমরা যদি কমিউনিস্ট হয়ে যাই! জেলের মধ্যে আরও দুই-তিন জায়গায় রাজনৈতিক বন্দিদের রাখা হয়েছে, আলাদা আলাদা করে। এই প্রথম আমি সেলে থাকি। জেলের মধ্যে জেল, তাকেই বলে সেল’। প্রায় দুই মাস পরে যখন দাঙ্গার আসামিরা প্রায়ই জামিন পেয়ে বাইরে গেছে, আর যে সামান্য কয়েকজন আছে তাদের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড থেকে চার নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়েছে তখন আমাদের আবার পুরানা পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হল।

তিনতলা বিরাট দালান। তিনতলায় ছোট ছোট ছেলেদের রাখে। আর দোতলার একপাশে আমরা থাকি, একপাশে জেলের অফিস। নিচের তলায় গুদাম। জেলে যে সমস্ত জিনিস তৈরি করে কয়েদিরা, তা এখানেই রাখে। পূর্ব বাংলার একমাত্র কম্বল ফ্যাক্টরি ঢাকা জেলের ভিতরে। কয়েদিরা সুন্দর সুন্দর কম্বল তৈরি করে। দর্জিদের একটা দল আছে। প্রায় একশত লোক কাজ করে এই দর্জি দফায়। পুলিশ, চৌকিদার ও সরকারের অন্যান্য বিভাগের ইউনিফর্ম এখানে তৈরি হয়। ঢাকা জেলের কাঠের মিস্ত্রিরা ভাল ভাল খাট, টেবিল, চেয়ার তৈরি করে। এখানে বেতের কাজও হয়। একজন ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট এই সকল কাজের দায়িত্ব নিয়ে আছেন। এই ডিপার্টমেন্টকে কয়েদিরা এক কথায় ‘এএসডি’ বলে থাকে। আমি নিচে বেড়াতাম এবং এই সমস্ত জিনিস দেখতাম। দোতলা থেকে নামলেই এই গুদাম। এর পাশেও একটা অফিস।

আমি একটা ফুলের বাগান শুরু করেছিলাম। এখানে কোনো ফুলের বাগান ছিল না। জমাদার সিপাহিদের দিয়ে আমি ওয়ার্ড থেকে ফুলের গাছ আনাতাম। আমার বাগানটা খুব সুন্দর হয়েছিল। এই ওয়ার্ডের দেয়ালের পাশেই সরকারি প্রেম ছিল। এটা জেলের একটা অংশ। ভিতরে দেওয়াল দিয়ে বাইরে একটা দরজা করে দেওয়া হয়েছে। প্রেসের শব্দ পেতাম, কিন্তু প্রেস দেখতে পারতাম না। সকালবেলা যখন কর্মচারীরা আসতেন এবং বিকালে ছুটির পর যখন যেতেন আমি জানলা দিয়ে তাদের দেখতাম। ওদের দেখলেই আমার মনে হত যে ওরা বড় জেলে, আর আমরা ছোট্ট জেলে আছি। স্বাধীন দেশের মানুষের ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই, এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে?

পাকিস্তানের নাগরিকদের বিনা বিচারে বৎসরের পর বৎসর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ছয় মাস পর পর একটা করে হুকুমনামা সরকার থেকে আসে। ইংরেজ আমলেও রাজনৈতিক বন্দিদের কতগুলি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হত, যা স্বাধীন দেশে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বন্দিদের খাওয়া-দাওয়া, কাপড়চোপড়, ঔষধ, খবরের কাগজ, খেলাধুলার সামগ্রী এমনকি এদের ফ্যামিলি এলাউন্সও দেওয়া হত ইংরেজ আমলে। নূরুল আমিন সাহেবের মুসলিম লীগ সরকার সেসব থেকেও বন্দিদের বঞ্চিত করেছেন। সাধারণ কয়েদি হিসাবে অনেককেই রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক বন্দিরা দেশের জন্য ও আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করছে, একথা স্বীকার করতেও তারা আপত্তি করছেন। এমনকি মুসলিম লীগ নেতারা বলতে শুরু করেছে, বিদেশী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেল খাটলে সেটা হত দেশ দরদীর কাজ। এখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জেল খাটছে যারা, তারা হল রাষ্ট্রদ্রোহী’। এদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। ইংরেজের স্যার’ ও ‘খান বাহাদুর উপাধিধারীরা সরকার গঠন করার সুযোগ পেয়ে আজ একথা বলছেন।

জনাব লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব নূরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এদের আমলে যে নির্যাতন ও নিপীড়ন রাজনৈতিক বন্দিদের উপর হচ্ছে তা দুনিয়ার কোনো সভ্য দেশে কোনোদিন হয় নাই। রাজনৈতিক বন্দিরা যাতে কারাগারের মধ্যে ইংরেজ আমলের সুযোগ-সুবিধাটুকু পেতে পারে তার জন্য অনেক দরখাস্ত, অনেক দাবি করেছে কিন্তু কিছুতেই সরকার রাজি হল না। বাধ্য হয়ে তাদের অনশন ধর্মঘট করতে হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিন রাজনৈতিক বন্দিরা অনশন করে, যার ফলে ঢাকা জেলে শিবেন রায় মারা যান। যারা বেঁচেছিলেন অনেকের স্বাস্থ্য চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেকে পরে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। অনেকের মাথাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে তাঁদের অবস্থা কি হয়েছিল তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝতে পারবেন না।

১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে খাপড়া ওয়ার্ডের কামরায় বন্ধ করে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর গুলি করে সাতজনকে হত্যা করা হয়। যে কয়েকজন বেঁচেছিল তাদের এমনভাবে মারপিট করা হয়েছিল যে, জীবনের তরে তাদের স্বাস্থ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন জেলে অত্যাচার চলেছিল, রাজনৈতিক বন্দিরাও তাদের দাবি আদায়ের জন্য কারাগার থেকেই অনশন ধর্মঘট করছিল। রাজনৈতিক বন্দিদের অনেক পরিবারের ভিক্ষা করেও সংসার চালাতে হয়েছে। নিয়তিই বলতে হবে। কারণ যারা ইংরেজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন তাঁদের অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্বাধীন দেশের জেলে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। লিয়াকত আলী। খান তার কথা রাখবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যারা আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল করবে তাদের ‘শের কুচাল দেহে’—কথা তিনি ঠিকই রেখেছিলেন। মাথা ভাঙতে না পারলেও মাজা ভেঙে দিয়েছিলেন, জেলে রেখে ও নির্যাতন করে। আমরা তিনজনই এর প্রতিবাদ করেছিলাম। মুসলিম লীগ সরকারের ইচ্ছা থাকলেও আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হয় নাই। কারণ, কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীর কিছুটা সহানুভূতি ছিল বলে মনে হয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষও আমাদের কষ্ট হোক তা চান নাই। আমীর হোসেন সাহেব সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন ঢাকা জেলে। আমাদের যাতে কোন কষ্ট না হয় তার দিকে নজর রাখতেন। মওলানা সাহেব ও আমাকে আমীর হেসেন সাহেব সপ্তাহে একদিন দেখতে আসলেই আমীর হোসেন সাহেবকে অনুরোধ করতাম যাতে অন্য রাজনৈতিক বন্দিদের কষ্ট না হয়। এদেরও অনেক অসুবিধা ছিল। কারণ, সরকার জেলের ভিতরও গোয়েন্দা রেখে খবর নিত। সেই ভয়েতে এরা কিছুই করতে চাইতেন না। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পরে লিয়াকত আলী খান সময় ক্ষমতার মালিক হয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। তার হুকুম মত প্রাদেশিক সরকারের নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের উপর। সীমান্ত প্রদেশ ও বাংলার জেল তখন রাজনৈতিক বন্দিতে প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে।

 

৫৪.

আমরা আওয়ামী লীগ গঠন করার সাথে সাথে যে ড্রাফট পার্টি ম্যানিফেস্টো বের করেছিলাম, তাতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা থাকায় লিয়াকত আলী খান আরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলা সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও যে উদারতা দেখিয়েছিল দুনিয়ার কোথায়ও তাহার নজির নাই। প্রথম গণপরিষদে পূর্ব বাংলার মেম্বার সংখ্যা ছিল চুয়াল্লিশজন। অর পাত্রাব, সিন্ধু, সীমান্ত ও বেলুচিস্তান নিয়েছিল আঠাশজন। পূর্ব বাংলার কোটার চুয়াল্লিশজন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দাদের ছয়জন মেম্বার পূর্ব বাংলা নির্বাচিত করে দেয়। কেউই আপত্তি করে নাই। আমরা সংখ্যাগুরু থাকা সত্তেও রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিকে করা হয়। আমাদের সদস্যরা বা জনগণ আপত্তি করে নাই। কিন্তু যখন দেখলাম, শিল্প কারখানা যা কিছু হতে চলেছে সবই পশ্চিম পাকিস্তানেই গড়ে উঠতে শুরু করেছে, আর কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া পূর্ব বাংলার আর কেউ কোথায়ও নাই, বিশেষ করে বড় বড় সরকারি চাকরিতে পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা শুরু হয়ে গেছে।

লিয়াকত আলী খান বাঙালি ও পাঞ্জাবি সদস্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখে শাসন করতে চাইছিলেন, কারণ তিনি রিফিউজি। তাঁকে বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয়েছিল আমলাতন্ত্রের উপরে—যারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের। এই সকল বড় বড় কর্মচারী সকলেই মুসলমান ছিলেন। পূর্ব বাংলার জনগণ নিজের গ্রামের হিন্দু ও বড় কর্মচারীকে বিশ্বাস না করে মুসলমান হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মচারীদের বিশ্বাস করেছিলেন। তার ফল হল, বাংলার মুসলমানকে ভাই বললে কি হবে, তারা তাদের নিজের অংশকে গড়তে সাহায্য করতে লাগল, বাংলাদেশকে ফাঁকি দিয়ে।

১৯৫০ সালে গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন ডাকা হয়েছিল ঢাকায়। পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজ, আওয়ামী লীগ সদস্যরা, বিশেষ করে—আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন আহমদ আরও অনেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জনাব হামিদুল হক চৌধুরী তখন মন্ত্রিত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনিও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান অবজারভার তখন তিনি বের করেছেন। এতে অনেক সুবিধা হয়েছিল। গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন থেকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হল। লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসলে এক প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে দেখা করলেন এবং তাঁকে পূর্ব বাংলার দাবির কথা জানালেন। জনাব লিয়াকত আলী খান এই আন্দোলনকে ভাল চোখে দেখলেন না। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও চুপ থাকার মত নেতা নন। তিনি জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি একটা দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন। করাচিতে একদল যুবক মোহাজের কর্মী তাঁর সাথে দেখা করে আওয়ামী লীগ গঠন করতে অনুরোধ করলেন। পাঞ্জাব ও সিন্ধের রাজনৈতিক কর্মীরা এগিয়ে আসলেন। নবাব মামদোতের দলও লিয়াকত আলী খানকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। জনাব গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। তাকে অর্থমন্ত্রী করার ফলে আমলাতন্ত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর সাথে সাথে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল হয়ে একটা শক্তিশালী সরকারি কর্মচারী গ্রুপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্ব বাংলায় জনাব আজিজ আহমদ চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। সত্যিকার ক্ষমতা তিনিই ব্যবহার করতেন। জনাব নূরুল আমিন তার কথা ছাড়া এক পা-ও নড়তেন না।

 

৫৫.

আমরা দিন কাটাচ্ছি জেলে। তখন আমাদের জন্য কথা বলারও কেউ ছিল বলে মনে হয় নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেব লাহোর থেকে একটা বিবৃতি দিলেন। আমরা খবরের কাগজে দেখলাম। আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও চলছে। শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে মওলানা সাহেব ও আমি খুব বিপদে পড়লাম। তার স্বাস্থ্যও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় বাইশ পাউন্ড ওজন কম হয়ে গেছে। তারপরও রাতভরই জিকির করেন। মাঝে মাঝে গরমের দিন দুপুরবেলা কম্বল দিয়ে সারা শরীর ঢেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকতেন। মওলানা সাহেব ও আমি অনেক আলোচনা করলাম। আর কিছুদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। দু’একদিন আমার ওপর রাগ হয়ে বলে, “আমাকে না ছাড়লে বন্ড দিয়ে চলে যাব। তোমার ও ভাসানীর পাগলামির জন্য জেল খাটব নাকি?” একদিন সিভিল সার্জন আসলে মওলানা সাহেব ও আমি শামসুল হক সাহেবের অবস্থা বললাম। তার যেভাবে ওজন কমছে তাতে যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে। তিনি বললেন, সরকার আমার কাছে রিপোর্ট না চাইলে তো আমি দিতে পারি না অথবা হক সাহেব দরখাস্ত করলে আমি আমার মতামত দিতে পারি। শামসুল হক সাহেব এক দরখাস্ত লিখে রেখেছিলেন, আমি ওটা দিতে নিষেধ করলাম, তিনি আমার কথা রাখলেন। তিনি আর একটা লিখলেন মুক্তি চেয়ে, স্বাস্থ্যগত কারণে। যদিও দুর্বলতা কিছুটা ধরা পড়ে, তবুও উপায় নাই। সিভিল সার্জন সাহেব সত্যিই তাঁর শরীর যে খারাপ হয়ে পড়েছিল তা লিখে দিলেন। পাঁচ-সাত দিন পরেই তার মুক্তির আদেশ আসল। তিনি মুক্তি পেয়ে চলে গেলেন। ভাসানী সাহেব ও আমি রইলাম। কোর্টে হক সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হত। সরকার ভাবল, হক সাহেবের মত শক্ত লোক যখন নরম হয়েছে তখন ভাসানী এবং আমিও নরম হব। আমার মেজোবোন (শেখ ফজলুল হক মণির মা) ঢাকায় থাকতেন, আমাকে দেখতে আসতেন। আমি বাড়িতে সকলকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম, তবুও আব্বা আমাকে দেখতে আসলেন একবার।

একদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কোর্টে যেয়ে দেখি মানিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পরে মানিক ভাই বললেন, “নানা অসুবিধায় আছি, আমাদের দিকে খেয়াল করার কেউই নাই। আমি কি আর করতে পারব, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কি বলেন?” আমি বললাম, “মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন? আমাদের দেখবারও কেউ বোধহয় থাকবে না। আমি জানতাম মানিক ভাই চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছেন। ছেলেমেয়েদের পিরোজপুর রেখে তিনি একলাই ঢাকায় আছেন। মানিক ভাই কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, “না, যাব না আপনাদের জেলে রেখে।”

মওলানা সাহেব সাপ্তাহিক ইত্তেফাক কাগজ বের করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ বের হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ টাকা কোথায়? মানিক ভাইকে বললেন, কাগজটা তত বন্ধ হয়ে গেছে, যদি পার তুমিই চালাও। মানিক ভাই বললেন, কি করে চলবে, টাকা কোথায়, তবুও চেষ্টা করে দেখব। আমি মানিক ভাইকে আমার এক বন্ধু কর্মচারীর কথা বললাম, ভদ্রলোক আমাকে আপন ভাইয়ের মত ভালবাসতেন। কলকাতায় চাকরি করতেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের বাসিন্দা নন তবুও বাংলাদেশকে ও তার জনগণকে তিনি ভালবাসতেন। আমার কথা বললে কিছু সাহায্য করতেও পারেন। মানিক ভাই পরের মামলার তারিখে বললেন যে, কাগজ তিনি চালাবেন। কাগজ বের করলেন। অনেক জায়গা থেকে টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল। নিজেরও যা কিছু ছিল এই কাগজের জন্যই ব্যয় করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে কাগজটা খুব জনপ্রিয় হতে লাগল। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা তাঁকে সাহায্য করতে লাগল। এ কাগজ আমাদের জেলে দেওয়া হত না, আমি কোর্টে এসে কাগজ নিয়ে নিতাম এবং পড়তাম। সমস্ত জেলায় জেলায় কর্মীরা কাগজটা চালাতে শুরু করল। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের কাগজ হিসাবে জনগণ একে ধরে নিল। মানিক ভাই ইংরেজি লিখতে ভালবাসতেন, বাংলা লিখতে চাইতেন না। সেই মানিক ভাই বাংলায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলামিস্টে পরিণত হলেন। চমৎকার লিখতে শুরু করলেন। নিজেই ইত্তেফাঁকের সম্পাদক ছিলেন। তাকে ছাত্রলীগের দুই-তিনজন কর্মী সাহায্য করত। টাকা পয়সার ব্যাপারে আমার বন্ধুই তাঁকে বেশি সাহায্য করতেন। বিজ্ঞাপন পাওয়া কষ্টকর ছিল, কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য কোথায়? আর সরকারি বিজ্ঞাপন তো আওয়ামী লীগের কাগজে দিত না। তবুও মানিক ভাই কাগজটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন একমাত্র তার নিজের চেষ্টায়।

১৯৫০ সালের শেষের দিকে মামলার শুনানি শেষ হল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যে রায় দিলেন, তাতে মওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবকে মুক্তি দিলেন। আবদুর রউফ, ফজলুল হক ও আমাকে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল। শাস্তি দিলেই বা কি আর না দিলেই বা কি? আমি তো নিরাপত্তা বন্দি আছিই। মওলানা সাহেবও জেলে ফিরে এলেন, কারণ তিনিও নিরাপত্তা বন্দি। আতাউর রহমান সাহেব, কামরুদ্দিন সাহেব ও আরও অনেকে মামলায় আমাদের পক্ষে ছিলেন। আমাকে ডিভিশন দেওয়া হয়েছিল। আপিল দায়ের করলেও আমাকে খাটতে হল। কিছুদিন পরে আমাকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল, কারণ গোপালগঞ্জে আরও একটা মামলা দায়ের করেছিল। মওলানা সাহেবের কাছে এতদিন থাকলাম। তাঁকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হল। কিন্তু উপায় নাই, যেতে হবে। আমি সাজাও ভোগ করছি এবং নিরাপত্তা বন্দিও আছি। ঢাকা জেলে আমাকে সুতা কাটতে দিয়েছিল। আমি যা পারতাম তাই করতাম। আমার খুব ভাল লাগত। বসে বসে খেতে খেতে শরীর ও মন দুইটাই খারাপ হয়ে পড়ছিল। আমাকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে খুলনা মেলে নিয়ে চলল। খুলনা মেল বরিশাল হয়ে যায়। বরিশালে আমার বোন ও অনেক আত্মীয় আছে। বেশি সময় জাহাজ বরিশালে থামে না, আর কাউকে পেলামও না। একজন রিকশাওয়ালাকে বলেছিলাম, আমার এক খালাতো ভাই, জাহাঙ্গীরকে খবর দিতে। জাহাঙ্গীরকে সকলে চিনে। জাহাজ ছাড়ার সময় দেখি ছুটে আসছে সাইকেল নিয়ে। সিঁড়ি টেনে দিয়েছে। দাঁড়িয়েই দুই মিনিট আলাপ করলাম। ও বলল, এই মাত্র খবর পেয়েছে। জাহাজ ছেড়ে দিল। আমার বাড়ির স্টেশন হয়েই যেতে হয়। আমার বাড়ি থেকে তিন স্টেশন পরেই গোপালগঞ্জ অনেক রাতে পৌঁছে। পাটগাতি স্টেশন থেকে আমরা ওঠানামা করি। আমাকে সকলেই জানে। স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের বাড়ির খবর কিছু জানেন কি না? যা ভয় করেছিলাম তাই হল, পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হল না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে আর কাউকেও খবর দিলাম না। কিছুদিন পূর্বে রেণু লিখেছিল, ঢাকায় আসবে আমাকে দেখতে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নাই। অনেক রাতে মানিকদহ স্টেশনে পৌঁছালাম। সেখান থেকে কয়েক মাইল নৌকায় যেতে হয় গোপালগঞ্জ শহরে। আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন বন্দুকধারী পুলিশ, একজন হাবিলদার, আর তাদের সাথে আছেন দুইজন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী, একজন দারোগা আর একজন বোধহয় তার আর্দালি বা বডিগার্ড হবে। আমরা শেষ রাতে গোপালগঞ্জ পৌঁছালাম। আমাকে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হল। পুলিশ লাইন থেকে আমার গোপালগঞ্জ বাড়িও খুবই কাছাকাছি। বাড়িতে কয়েকজন ছাত্র থাকে, লেখাপড়া করে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অফিসও আমার বাড়িতে। আমার মন খারাপ, আর ক্লান্তও ছিলাম। একটা খাট আমাকে ছেড়ে দিল। খুব যত্ন করল। তাড়াতাড়ি আমার বিছানাটাও করে দিল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা উঠে হাত মুখ ধুয়ে প্রস্তুত হতে লাগলাম। খবর রটে গেছে গোপালগঞ্জ শহরে। পুলিশ লাইনের পাশেই শামসুল হক মোক্তার সাহেব থাকেন, তাঁকে সকলে বাসু মিয়া বলে জানেন। তাঁর স্ত্রীও আমাকে খুব স্নেহ করেন, তাঁকে আমি শাশুড়ি বলে ডাকতাম, আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়াও হতেন। ভদ্রমহিলা অমায়িক ও বুদ্ধিমতী। আমার জন্য তাড়াতাড়ি খাবার পাঠালেন। দশটার সময় আমাকে কোর্টে হাজির করল। অনেক লোক জমা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, আমাকে থানা এরিয়ার মধ্যে রাখতে। পরের দিন মামলার তারিখ। গোপালগঞ্জ সাবজেলে ডিভিশন কয়েদি ও নিরাপত্তা বন্দি রাখার কোনো ব্যবস্থাই নাই। কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল, আমাকে হেঁটে যেতে হবে। অন্য কোনো ব্যবস্থা নাই। কারণ, তখন গোপালগঞ্জে রিকশাও চলত না। অনেক লোক আমার সাথে চলল। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমি পরিচিত। এখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছি, মাঠে খেলাধুলা করেছি, নদীতে সাঁতার কেটেছি, প্রতিটি মানুষকে আমি জানি আর তারাও আমাকে জানে। বাল্যস্মৃতি কেউ সহজে ভোলে না। এমন একটা বাড়ি হিন্দু-মুসলমানের নাই যা আমি জানতাম না। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সাথে আমার পরিচয়। এই শহরের আলো-বাতাসে আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছে। নদীর পাড়েই কোর্ট ও মিশন স্কুল। এখন একটা কলেজ হয়েছে। ছাত্ররা লেখাপড়া ছেড়ে বের হয়ে পড়ল, আমাকে দেখতে। কিছুদূর পরেই দু’পাশে দোকান, প্রত্যেকটা দোকানদারের আমি নাম জানতাম। সকলকে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে করতেই থানার দিকে চললাম।

থানায় পৌঁছালেই দারোগা সাহেবরা আমাকে একটা ঘর দিলেন, যেখানে স্বাধীনতার পূর্বে রাজনৈতিক কর্মীদের নজরবন্দি রাখা হত। এই মহল্লায় আমি ছোট সময় ছিলাম। তখন নজরবন্দিদের সাথে আলাপ করতাম ও মিশতাম। আমি ছোট ছিলাম বলে কেউ কিছু বলত না। আজ ভাগ্যের পরিহাস আমাকেই সেই পুরানা ঘরে থাকতে হল, স্বাধীনতা পাওয়ার পরে!

থানার পাশেই আমার এক মামার বাড়ি। তিনি নামকরা মোক্তার ছিলেন। তিনি আজ আর ইহজগতে নাই। আবদুস সালাম খান সাহেবের ভাই। আবদুর রাজ্জাক খান তার নাম ছিল। অনেক লেখাপড়া করতেন, রাজনীতিও তিনি বুঝতেন। তাঁকে সকলেই ভালবাসত। এই রকম একজন নিঃস্বার্থ দেশসেবক খুব কম আমার চোখে পড়েছে। কোনোদিন কিছু চান নাই। আমি তার উপর অনেক সময় অন্যায় করেছি, কিন্তু কোনোদিন রাগ করেন নাই। সালাম খান সাহেব ও তিনি আপন ভাই ছিলেন না, সৎ ভাই ছিলেন। কিন্তু কেউ বুঝতে পারত না কোনোদিন। সালাম সাহেব যখন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছিলেন, তিনি দল ত্যাগ করেন নাই। একজন আদর্শবাদী লোক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে গোপালগঞ্জ এতিম হয়ে গেছে বলতে হবে। লোকে তাকে খুব ভালবাসত ও বিশ্বাস করত। সরকারি কর্মচারীরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। তাকে লোকে রাজা মিয়া বলে ডাকত। আমি রাজা মামা’ বলতাম। কোর্ট থেকে বাড়িতে খবর দিয়েছে। আমার খাবার তার বাড়ি থেকেই থানায় আসবে। থানায় পৌঁছাবার পূর্বেই আমার নানী ও মামী খবর দিলেন, খাবার প্রস্তুত, গোসল হলেই খবর দিতে। আমি থানার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দেখি মামী ও নানী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সালাম দিলাম। থানার দুই পাশের রাস্তায় অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখতে। আমি বাইরে এসে সকলকে আদাব করলাম। তারপর সকলকেই শুভেচ্ছা জানিয়ে যে ঘরে থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে সেই ঘরে চলে যাই। বাড়ি থেকে লোক এসেছিল, সকল খবর নিলাম।

বহুদিন সূর্যাস্তের পরে বাইরে থাকতে পারি নাই। জেলের মধ্যে এক বৎসর হয়েছে, সন্ধ্যার পরে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। জানালা দিয়ে শুধু কিছু জ্যোৎস্না বা তারাগুলি দেখার চেষ্টা করেছি। আজ আর ঘরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। বাইরে বসে রইলাম, পুলিশ আমাকে পাহারা দিচ্ছে। পুলিশ কর্মচারী যিনি রাতে ডিউটি করছিলেন, তিনিও এসে বসলেন। অনেক আলাপ হল। বাইরে থেকে দু’একজন বন্ধুবান্ধবও এসেছিল। অনেক রাতে শুতে যেয়ে দেখি, ঘুমাবার উপায় নাই। এক রুমে আমি আর এক রুমে ওয়্যারলেস মেশিন চলছে। খট খট শব্দ; কি আর করা যাবে। আবার বাইরে যেয়ে বসলাম। পরে যখন। আর ভাল লাগছিল না, শুতে গেলাম। বাইরে শোবার ইচ্ছা করছিল, কিন্তু উপায় নাই। গোপালগঞ্জের মশা নামকরা। একটু সুযোগ পেলেই আর রক্ষা নাই। ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম, অনেক বেলা করে উঠলাম। কোর্টে পরের দিন হাজিরা দিলাম, তারিখ পড়ে গেল। কারণ, ফরিদপুর থেকে কোর্ট ইন্সপেক্টর এসেছেন। তিনি জানালেন, সরকার পক্ষের থেকে মামলাটা পরিচালনা করবেন সরকারি উকিল রায় বাহাদুর বিনোদ ভদ্র। তিনি আসতে পারেন নাই। এক মাস পরে তারিখ পড়ল এবং আমাকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে রাখবার হুকুম হল। আমাকে ফরিদপুর যেতে হবে, সেখান থেকেই মাসে মাসে আসতে হবে, মামলার তারিখের দিনে।

গোপালগঞ্জ মহকুমা যদিও ফরিদপুর জেলায়, কিন্তু কোন ভাল যাতায়াতের বন্দোবস্ত নাই। খুলনা থেকে গোপালগঞ্জে রোজ দুইবার জাহাজ আসে। বরিশাল থেকেও গোপালগঞ্জ সরাসরি জাহাজে যাওয়া যায়। গোপালগঞ্জ থেকে জাহাজে রওয়ানা করলাম মাদারীপুর। সিন্ধিয়াঘাট নামে একটা স্টেশনে নেমে রাতে সেখানে থাকতে হবে। পরের দিন সকালে লঞ্চে যেতে হবে ভাঙ্গা নামে একটা স্থানে; সেখান থেকে ট্যাক্সিতে যেতে হবে ফরিদপুর। পুরা দেড় দিন লাগে। সন্ধ্যায় সিন্ধিয়াঘাট পৌঁছালাম, এখানে একটা ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের ডাকবাংলো আছে। তিন নদীর মোহনায় এই ডাকবাংলোটাও তিন নদীর পাড়ে। আমি ডাকবাংলোয় রাত কাটাব ঠিক করলাম, পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মচারীরা রাজি হল, কারণ কোথায় রাখবে? এটা একটা বন্দর, ডাকবাংলোর চৌকিদার আমাকে জানত। একটা কামরায় একজন কর্মচারী থাকে আর একটা কামরা আমাকে দেওয়া হল। পাশের গ্রামেও আমার কয়েকজন ভক্ত ছিল। তারা খবর পেয়ে ছুটে আসল। চৌকিদারকে খাবার বন্দোবস্ত করতে বললাম, সিপাহিরাও তাকে সাহায্য করল। কোরবান আলী ও আজহার নামে দুইজন কর্মীর বাড়ি ডাকবাংলোর কাছেই। তারা পীড়াপীড়ি করতে লাগল, তাদের ওখানে খেতে। আমি বললাম, আমার তো কোন আপত্তি নাই। তবে যাওয়া উচিত হবে না তোমাদের বাড়িতে। কারণ যারা আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে সরকারের কাছে খবর গেলে তাদের চাকরি থাকবে না। বাড়ি থেকে তরকারি পাক করে দিয়েছিল। অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে রইলাম নদীর দিকে মুখ করে। নৌকা যাচ্ছে আর নৌকা আসছে। পুলিশদের বললাম, “আমার জন্য চিন্তা করবেন না, ঘুমিয়ে থাকেন। আমাকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেও যাব না। তারা সকলেই হেসে দিয়ে বলল, “আমরা তা জানি, আপনার জন্য আমরা চিন্তা করি না।”

বেশি সময় বসতে পারলাম না, কোথাও সাড়া শব্দ নাই। মাত্র এগারটা বাজে, মনে হল সারা দেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু দু’একখানা নৌকা চলছে, তার শব্দ পাই।

ভোরবেলা উঠলাম, নয়টা-দশটার সময় মাদারীপুর থেকে লঞ্চ আসে। সেই লঞ্চেই ভাঙ্গা যেতে হবে। লঞ্চ এল, আমরা উঠে পড়লাম। অনেক লোকের সাথে পরিচয় হল। ভাঙ্গায় একটা দেওয়ানি আদালত আছে। এখানে আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই ওকালতি করেন। ভাঙ্গার কাছেই নূরপুর গ্রাম। ওখানে আমার ফুপুর বাড়ি। আদালতের ঘাটেই লঞ্চ থামে। ভাই খবর পেয়ে এলেন, দেখা হল। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে চললাম। ফুফাতো ভাইয়েরা খবর পায় নাই। ট্যাক্সি ঠিক করে ফরিদপুর রওয়ানা করলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাতে জেলে আমাকে নাকি গ্রহণ করবে না। আমাকে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হল। তার একটা রুম-বোধহয় ক্লাবঘর হবে, সেখানে আমার থাকার বন্দোবস্ত করা হল। রিজার্ভ ইন্সপেক্টর যিনি ছিলেন, তিনি এসে আমার যাতে কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে তাঁর লোকদের নজর রাখতে বললেন। আমি কাউকেও খবর দিলাম না। অনেকে আমাকে দেখতে আসল। যদিও ফরিদপুর শহরে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রয়েছে। কিন্তু আমার জন্য কারও কোনো কষ্ট হয়, তা আমি কোনোদিন চাই নাই। সকালবেলা চা-নাশতার ব্যবস্থা করেছিল পুলিশ লাইনের সিপাহিরা। আমাকে খেতেই হল। মনে মনে ভাবলাম, আপনারা আমাকে ভালবাসেন। যাদের সাথে একসাথে কাজ করলাম, আমার মত কর্মী হয় না’ এমন কত কথাই না বলেছে পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে। তারা আজ আমাকে বিনা বিচারে জেলে তো রেখেছেই, আমার যাতে শাস্তি হয় তার জন্য চেষ্টা করতে একটুও ক্রটি করছে না। তাদের কাছে বিদায় নিয়ে ফরিদপুর জেলে আসলাম। জেল কর্তৃপক্ষ পূর্বেই ডিআইজি থেকে খবর পেয়েছে। জেলগেটে পৌঁছালাম সকালবেলা। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেব অফিসে। ডেপুটি জেলার সাহেবের কামরায় বসলাম। আমার কাগজপত্র দেখলেন। বললেন, আপনার তো সাজাও আছে তিন মাস। আবার নিরাপত্তা আইনেও আটক আছেন। বললাম, বেশি দিন সাজা নাই, এক মাসের বেশি বোধহয় হয়ে গেছে।

আমাকে কোথায় রাখা হবে তাই নিয়ে আলোচনা করলেন। বোধহয় টেলিফোনও করেছিলেন। কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দিও একটা ওয়ার্ডে আছেন। আমাকে সেখানে রাখা হবে, না আলাদা রাখতে হবে? শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের একটা কামরা খালি করতে হুকুম দিলেন, শুনলাম। আমার বাক্স, কাপড়, জামা তল্লাশি করে দেখা হল। আমি চুপ করে বসে আছি। একজন জমাদার এসে আমাকে বলল, আপনি এই কামরায় আসেন। আমি সেই কামরায় গেলে, সে এসে আমার পকেটে হাত দিল। আমি তাকে বললাম, “আপনি আমার গায়ে হাত দেবেন না। আপনি আমাকে তল্লাশি করতে পারেন না। আইনে নাই। জেলার সাহেব বা ডেপুটি জেলার সাহেব দরকার হলে আমাকে তল্লাশি করতে পারেন।” আমি রাগ করেই কথাটা বললাম, বেচারা ঘাবড়িয়ে গেছে। আমি বললাম, “কার হুকুমে আপনি আমার শরীরে হাত লাগালেন, আমি জানতে চাই!” একথা বলে ডেপুটি জেলারকে বললাম, “ব্যাপার কি? আপনি হুকুম দিয়েছেন?” ডেপুটি জেলার তাকে যেতে বললেন এবং আমাকে বললেন, “মনে কিছু করবেন না। ও জানে না। ডেপুটি সাহেবকে বললাম, “দেখুন কি আছে আমার কাছে। সিগারেট, ম্যাচ ও রুমাল আছে।” তিনি লজ্জা পেয়েছিলেন। আমাকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

 

৫৬.

আমি এই প্রথম ফরিদপুর জেলে আসলাম। হাসপাতালটা দোতলা। একতলার একটা রুমে আমি একাকী থাকব। অন্য রুমগুলিতে রোগীরা আছে। বারান্দা আছে, বাইরে বসতে পারব এটাই আমার ভাল লাগল। নিজের জেলা, কিছু কিছু চেনাশোনা লোক আছে। আমাকে একটা ফালতু দিয়েছিল, আমার খেদমত করার জন্য। আমার খাবার আসবে রাজনৈতিক বন্দিদের ওয়ার্ড থেকে। তারা পাঁচ ছয়জন আছেন শুনলাম। বই আমার কাছে যা আছে তাই সম্বল। খবরের কাগজ দিতে বললাম। হাসপাতালের সামনে সামান্য জায়গা ছিল, একটা ফুলের বাগানও ছিল, তাকে যাতে আরও ভাল করা যায় তার ভার নিলাম। সময় তো কাটাতে হবে, ভালই লাগছিল।

রাজনৈতিক বন্দিদের সাথে আমার দেখা হবার উপায় নাই। জেল বেশি বড় না হলেও তারা যেখানে থাকে সেখান থেকে দেখাশোনা হওয়ার উপায় নাই।

আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি তরজমাও পড়েছি।

জেলার সাহেব নিজে এসেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো অসুবিধা হলে তাকে বলতে। দিনেরবেলা জেলের ভিতর আমি ঘুমাতে চাই না। তবুও আজ ঘুমিয়ে পড়লাম, কারণ ক্লান্ত ছিলাম। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে একটু হাঁটাচলা করলাম। সন্ধ্যার সময় তালা বন্ধ করে দিল। পাঁচজন কয়েদি পাহারা থাকবে আমার কামরায় এবং ফালতু থাকবে আমার কাজকর্ম করার জন্য। কয়েদি পাহারাদাররা দুই ঘণ্টা করে এক একজন পাহারা দিত, কামরার ভিতর থেকে। সিপাহি বাইরের থেকে জিজ্ঞাসা করবে, আর পাহারাদাররা চিৎকার করে বলবে, “জানলা বাতি ঠিক আছে।” কয়জন কয়েদি আছে তাও বলবে। আমি বলেছিলাম, “চিৎকার করতে পারবেন না, সিপাহিরা জিজ্ঞাসা করলে আস্তে বলবেন, আমার ঘুমের যেন অসুবিধা না হয়।“ আমার এখানে চিৎকার কম করলে কি হবে, অন্যান্য ওয়ার্ডে ভীষণ চিৎকার করে। ভাগ্য ভাল ওয়ার্ডগুলি দূরে ছিল। তা না হলে উপায় থাকত না।

আমাকে একা রাখা হত শাস্তি দেওয়ার জন্য। কারাগারের অন্ধকার কামরায় একাকী থাকা যে কী কষ্টকর, ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না। জেল কোডে আছে কোনো কয়েদিকে তিন মাসের বেশি একাকী রাখা চলবে না। কোনো কয়েদি জেল আইন ভঙ্গ করলে অনেক সময় জেল কর্মচারীরা শাস্তি দিয়ে সেলের মধ্যে একাকী রাখে। কিন্তু তিন মাসের বেশি রাখার হুকুম নাই।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কিছু সময় হাঁটাচলা করে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম, এমন সময় একজন আধবুড়া কয়েদি, সেও হাসপাতালে ভর্তি আছে, আমার কাছে এল এবং মাটিতে বসে পড়ল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বাড়ি কোথায়? বললেন, “বাড়ি গোপালগঞ্জ থানায়, ভেন্নাবাড়ী গ্রামে, নাম রহিম।” আমি বললাম, আপনার নামই রহিম মিয়া? রহিম মিয়া নামে তাকে সকলেই জানে। এত বড় ডাকাত গোপালগঞ্জ মহকুমায় আর পয়দা হয় নাই। তার নাম শুনলেই লোকে ভয় পেয়ে থাকত। রহিম মিয়া চুরি বেশি করত। তবে বাধা দিলে ডাকাতি করত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “রহিম মিয়া আপনিই না আমাদের বাড়িতে চুরি করে সর্বস্ব নিয়ে এসেছিলেন।” রহিম মিয়া কোন কথা না বলে চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে আমার মা, বড়বোন এবং অন্যান্য বোনদের সোয়াশ’ ভরি সোনার গহনা এবং আমার মার নগদ কয়েক হাজার টাকা চুরি হয়ে যায়। আব্বা তখন গোপালগঞ্জ ছিলেন। আমাদের বাড়ির দুই চারশত বৎসরের ইতিহাসে কোনোদিন চুরি হয় নাই। এই প্রথম চুরি। রহিম মিয়া আস্তে আস্তে বললেন, “হ্যা আমি চুরি করেছিলাম। আমি বললাম, “আমাদের বাড়িতেও সাহস করে এলেন কি করে? আমাদের ঘরে বন্দুক আছে। অনেক শরিকদের বাড়িতে বন্দুক আছে। এত বড় বাড়ি, কত লোক।” সে বলল, “গ্রামের লোক এবং আপনাদের বাড়ির লোক সাথে ছিল। আমরা দুই দিন পরে খবর পেয়েছিলাম, আমাদের এক প্রজা, আমাদের গ্রামের মানুষ-অনেক দিন আমাদের বাড়িতে কাজ করেছে, সে তখন কেরায়া নৌকা চালাত, তার নিজের নৌকায় রহিম ও তার দলকে নিয়ে আসে। চুরি হওয়ার তিন দিন পরে সে আমাদের বাড়িতে এসে ঘটনার কথা স্বীকার করে। মালপত্র ধরা না পড়ার জন্য মামলায় কিছু হল না। থানার এক দারোগাই ওকে নষ্ট করেছিল। রহিমকে ধরতে পারলে গহনা কিছু পাওয়া যেত। অনেক দিন তাকে ধরতে পারে নাই। আব্বা লড়েছিলেন থানার দারোগার বিরুদ্ধে, সে জন্য দারোগা সাহেবের অনেক বিপদে পড়তে হয়েছিল। তখনকার পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট দারোগার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।

রহিম বলতে লাগল তার ইতিহাস। আজ অনেক দিন জেলে আছে। বলল, “আপনাদের বাড়িতে চুরি করে যখন কিছু হল না, তখন ঘোষণা করলাম, লোকে বলে চোরের বাড়িতে দালান হয় না, আমি দালান দেব। দেশের লোক বুঝতে পারল। কিছুদিন পরে আর একটা ডাকাতি করতে গেলাম বাগেরহাটে। সেখানে ধরা পড়লাম। অনেক টাকা খরচ করে জামিন নিয়ে দেশে এলাম। তারপর আরেকটা ডাকাতি করতে গেলাম, গোপালগঞ্জের উলপুর গ্রামের রায় চৌধুরীদের বাড়িতে ডাকাতি করে ফিরবার পথে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করল। তাদের জানা ছিল আমি কোন পথে ফিরব। এ মামলাটায় জামিন নিলাম, তারপরে আবার ডাকাতি করতে গেলাম আর এক জায়গায়। সেখানেও ধরা পড়লাম, আর জামিন পেলাম না। সকল মামলা মিলে আমার পনের-ষোল বৎসর জেল হয়েছে। পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে দমদম জেলে ছিলাম। সেখান থেকে রাজশাহী, তারপর ফরিদপুর জেলে এসেছি। জানেন, জীবনে ডাকাতি বা চুরি করতে গিয়ে আমি ধরা পড়ি নাই, কিন্তু আপনাদের বাড়ি চুরি করার পর যেখানেই গেছি ধরা পড়েছি। জেলে বসে চিন্তা করে দেখলাম, আপনাদের বাড়ি আমাদের পুণ্যস্থান ছিল, সেখানে হাত দিয়ে হাত জ্বলে গেছে। আপনার মা’র কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে বোধহয় পাপমোচন হত।” আমি বললাম, “রহিম মিয়া, আমার মা ও আব্বা বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। কারণ আমাদের সর্বস্ব গেলেও কিছু হত না কিন্তু আমার বিধবা বড়বোনের গহনাই বেশি ছিল। সে একটা ছেলে ও একটা মেয়ে নিয়ে উনিশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিল।” বলল, “আর জীবনে চুরি করব না। আরও কয়েক বৎসর খাটতে হবে। শরীর ভেঙে গেছে।” আমাকে অনুরোধ করল, কিছু দরকার হলে বলতে, কারণ তার গলায় ‘খোকর’ আছে। তার মধ্যে সোনার গিনি রাখা আছে। আমি বললাম, কোনো প্রয়োজন নাই। মনে মনে বললাম, “হ্যাঁ, সোনার গিনি থাকবে না, তো থাকবে কি? সোয়া শত ভরির গহনা তো সোজা কথা না!” আরও বলল, ফরিদপুর জেলের অনেককে কিনে রেখেছে, কেউ তাকে কিছু বলবে না। ভাবলাম, কেন কিছু বলে না বুঝতে আর বাকি নাই। রহিম মিয়া হাসপাতালে প্রায়ই ভর্তি হয়ে থাকত। শরীর স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সময় পেলেই আমার কাছে আসত। সুখ-দুঃখের অনেক কথাই বলত। আমার মনে হচ্ছিল, বোধহয় একটা পরিবর্তন এসেছে ওর মনে।

জেলার ছিলেন সৈয়দ আহমেদ সাহেব। তিনি সকল সময় আমার খোজখবর নিতেন। কোন কিছুর অসুবিধা হলে বলতে অনুরোধ করতেন। যদিও সরকার কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল করতে নিষেধ করেছেন, তথাপি ফরিদপুর জেলে তখনও ঘানি ঘুরিয়ে তেল করা হচ্ছিল। আমি জেলার সাহেবকে বললাম, “এখনও আপনার জেলে মানুষ দিয়ে ঘানি ঘুরান?” তিনি বললেন, “কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। গরু কিনতে দিয়েছি।” কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

ঢাকা ও ফরিদপুর জেলে অনেক বড় চোর ও দুর্ধর্ষ ডাকাতের সাথে আলাপ হয়েছে। কারও কারও গলার মধ্যে খোকর’ (মানে গর্ত) থাকে। তার মধ্যে লুকিয়ে টাকা সোনার আংটি, গিনি রাখে। দরকার হলে সেগুলি দিয়ে জিনিসপত্র কিনে আনায়। একটু ভালভাবে থাকার জন্য কিছু কিছু খরচও করে। আমার কাছে সিগারেটের কাগজও চেয়ে নিয়েছে অনেকে। একবার ঢাকায় এক কয়েদিকে বললাম, “আমাকে খোকরের কেরামতি দেখালে কাগজ দিব, নতুবা কাগজ দিব না।” বলল, “দেখাব আপনাকে একটু দেরি করেন।” সিপাহি একটু দূরে গেলে বমি করার ভান করল, তাতে একটা কাঁচা টাকা বের হয়ে আসল। বললাম, “হয়েছে আর দরকার নাই। বুঝতে পেরেছি।”

 

৫৭.

এক মাস পার হয়ে গেল। আবার গোপালগঞ্জ যাবার সময় হয়েছে। আমাকে সন্ধ্যার পূর্বে গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মচারী আর বন্দুকধারী সিপাহিরা জেলগেট থেকে নিয়ে গেল। রাতে আমাকে পুলিশ লাইনে থাকতে হল, কারণ ভোর পাঁচটায় ট্যাক্সি ধরে ভাঙ্গায় যেতে হবে। অত ভোরে জেল থেকে কয়েদি নেওয়া সম্ভবপর নয়। পুলিশ লাইনের পাশেই আমার এক বন্ধুর বাড়ি। তাকে খবর দিলে সে আসল আমার সাথে দেখা করতে। অনেকক্ষণ আলাপ করলাম, সে রাজনীতি করে না। তাই কেউ কিছু বলল না। রাতে পুলিশ লাইনের ক্লাবেই ঘুমালাম। খুব ভোরে ভাঙ্গায় রওয়ানা করলাম। ভাঙ্গায় যেতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগত। দুইটা ফেরি নৌকা পার হতে হত। রাস্তাও খুব খারাপ ছিল। আমার দু’একজন আত্মীয়স্বজন উপস্থিত ছিল! তারাই খাবার বন্দোবস্ত করল। লঞ্চ বেশি দেরি করবে না। আমরা লঞ্চে উঠে বসলাম, সিন্ধিয়া ঘাটে বিকালে পৌঁছালাম। রাত এখানে কাটাতে হবে। আমি বললাম, কি দরকার সিন্ধিয়া ঘাটে নেমে, চলুন মাদারীপুর যাই। সেখান থেকেই তো রাত এগারটায় জাহাজ ছাড়বে। ভোররাতে সিন্ধিয়া ঘাট থেকে ওঠা বড় কষ্টকর। সিপাহিরা আপত্তি করল না। অনেকদূর উল্টা যেতে হয়। বিকালে মাদারীপুর পৌঁছালাম। জাহাজ ঘাটেই ছিল। আমি জাহাজে উঠে সকলের খাওয়ার কথা বাটলারকে বলে দিলাম। সিপাহিরা বলল, কেন এত খরচ করবেন। ঘাটেই হোটেল, জাহাজ ছাড়তে অনেক দেরি, ওখানেই খেয়ে নিব। মাদারীপুর ঘাটে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা দেরি হবে। আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা খবর পেল। অনেকে আসল। কিছু সময় আলাপ করলাম, কে কেমন আছে। আমাকে অনেকগুলি মিষ্টি কিনে দিল। সকলকে খেতে দিতে বাটলারকে বললাম। রাত এগারটায় জাহাজ ছাড়ল। আমি এখন স্বাধীন মানুষ-যদিও পুলিশ পাহারায়, তবু কম কিসে, বাইরের হাওয়া তো পাচ্ছি।

সকাল আটটায় হরিদাসপুর স্টেশনে নেমে নৌকায় গোপালগঞ্জ পৌঁছালাম। সঙ্গের পুলিশদের আমাকে থানায় নিয়ে যেতে বললাম। তাহলে আমাকে রেখে যেখানে হয় তারা যেতে পারবে। গোপালগঞ্জ যেয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা, মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল। এরাও এইমাত্র বাড়ি থেকে এসে পৌঁছেছে। গোপালগঞ্জ থেকে আমার বাড়ি চৌদ্দ মাইল দূরে। এক বৎসর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাচিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনে না আর বুঝতে পারে না, আমি কে? মা কাঁদতে লাগল। আব্বা মাকে ধমক দিলেন এবং কাদতে নিষেধ করলেন। আমি থানায় আসলাম, বাড়ির সকলে আমাদের গোপালগঞ্জের বাসায় উঠল। থানায় যেয়ে দেখি এক দারোগা সাহেব বদলি হয়ে গেছেন, তার বাড়িটা খালি আছে। আমাকে থাকবার অনুমতি দিল সেই বাড়িতে।

তাড়াতাড়ি কোর্টে যেতে হবে। প্রস্তুত হয়ে কোর্টে রওনা করলাম, এবার রাস্তায় অনেক ভিড়। বহু গ্রাম থেকেও অনেক সহকর্মী ও সমর্থক আমাকে দেখতে এসেছে। কোর্টে হাজির হলাম, হাকিম সাহেব বেশি দেরি না করে সাক্ষ্য নিতে শুরু করলেন। পরের দিন আবার তারিখ রাখলেন। আমি আমার আইনজীবীকে বললাম অনুমতি নিতে, যাতে আমার মা, আব্বা, ছেলেমেয়েরা আমার সাথে থানায় সাক্ষাৎ করতে পারেন। তিনি অনুমতি দিলেন। গোপালগঞ্জের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী এবং যিনি ফরিদপুর থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা আমাকে বললেন, বাইরের লোক দেখা করলে অসুবিধা হবে। আপনার আব্বা, মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা দেখা করলে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি আমাদের কর্মী ও অন্যান্য বন্ধুদের থানায় যেতে নিষেধ করলাম, কারণ এদের বিপদে ফেলে আমার লাভ কি? কোর্টেই তো দেখা হয়েছে সকলের সাথে। থানায় ফিরে এলাম এবং দারোগা সাহেবের বাড়িতেই আমার মালপত্র রাখা হল। আব্বা, মা, রেণু খবর পেয়ে সেখানেই আসলেন। যে সমস্ত পুলিশ গার্ড এসেছে ফরিদপুর থেকে তারাই আমাকে পাহারা দেবে এবং মামলা শেষ হলে নিয়ে যাবে। আব্বা, মা ও ছেলেমেয়েরা কয়েক ঘন্টা রইল। কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসল না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধহয় ভাবত, এ লোকটা কে?

পরের দিন সকালবেলা আবার দেখা হল, আমি কোর্ট থেকে ফিরে আসার পরেই আমাকে রওয়ানা করতে হল। বিকালবেলা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে চড়ে সন্ধ্যার পরে সিন্ধিয়া ঘাট পৌঁছালাম। রাত এখানেই কাটাতে হবে। রাতে ডাকবাংলোয় রইলাম। রাতটা ভালভাবেই কেটেছিল। খাওয়া-দাওয়া ভাল ছিল না। তবে বাড়ি থেকে কিছু খাবার দিয়েছিল। খুব সকালবেলা লঞ্চ ধরলাম। সিন্ধিয়া ঘাটেও কয়েকজন কর্মী দেখা করেছিল। লঞ্চ দেরি করে নাই বলে আজ সন্ধ্যার সময়ই ফরিদপুর পৌঁছাতে পেরেছি। আমাকে রাতেই জেলে পৌঁছে দিল। জেলে শুধু তালা আর চাবি। গেটে তালা, ওয়ার্ডে তালা, কামরায় তালা। বাইরে থেকে তালা দেওয়া ঘরে রাত কাটাতে হবে। এইভাবে মামলার জন্য তিন চার মাস আমাকে যাওয়া-আসা করতে হল ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত। প্রত্যেক তারিখেই আমার বাড়ির সকলের সাথে দেখা হয়েছে। ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়া-আসা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই সরকারের কাছে আমি লিখলাম, আমাকে বরিশাল বা খুলনা জেলে রাখলে গোপালগঞ্জ যাওয়া-আসার সুবিধা হবে। সোজা খুলনা বা বরিশাল থেকে জাহাজে উঠলে গোপালগঞ্জ যাওয়া যায়। কোনো জায়গায় ওঠানামা করতে হয় না। সরকার সেইমত আদেশ দিল, বরিশাল বা খুলনায় আমাকে রাখতে। কর্তৃপক্ষ আমাকে খুলনা জেলে পাঠিয়ে দিলেন। রাজবাড়ী, যশোর হয়ে খুলনা যেতে হল।

খুলনা জেলে যেয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কোনো জায়গাই নাই। একটা মাত্র দালান, তার মধ্যেই কয়েদি ও হাজতি সকলকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। আমাকে কোথায় রাখবে? একটা সেল আছে, সেখানে ভীষণ প্রকৃতির কয়েদিদের রাখা হয়। জেলার সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন ভিতরে। বললেন, “দেখুন অবস্থা, কোথায় রাখব আপনাকে, ছোট জেল।” আমি আবার রাজনৈতিক বন্দি হয়ে গেছি। সাজা আমার খাটা হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস জেল দিয়েছিল। অন্য কোনো রাজনৈতিক বন্দিও এ জেলে নাই। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কর্তৃপক্ষ আমাকে পাঠাল কেমন করে এখানে! বোধহয় ছয়টা সেল, সেলগুলির সামনে চৌদ্দ ফিট দেওয়াল। একদিকে ফাঁসির ঘর, অন্যদিকে বত্রিশটা পায়খানা। সমস্ত কয়েদিরা ঐখানেই পায়খানা করে। যে তিন-চার হাত জায়গা আছে সামনে সেখানেও দাঁড়াবার উপায় নাই দুর্গন্ধে। খাবারেরও কোনো আলাদা ব্যবস্থা করা যাবে না, কারণ উপায় নাই। একটা সেলে আমাকে রাখা হল আর হাসপাতাল থেকে ভাত তরকারি দিবে তাই খেতে হবে, রোগীরা যা খায়। বাড়ি থেকে কিছু চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট আমাকে দিয়েছিল। তাই আমাকে খেয়ে বাঁচতে হবে। আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। আমি জেলার সাহেবকে বললাম, “আপনি লেখেন ওপরে। এখানে জায়গা নাই। আমার এখানে থাকা চলবে না। আর যদি রাখতে হয়, থাকার ভাল ব্যবস্থা করতে হবে।”

কয়েকদিনের মধ্যে আবার মামলার তারিখ। জাহাজে উঠে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে গোপালগঞ্জ পৌঁছে দিবে। এই কয়েকদিনের মধ্যেই আমার শরীর অনেকটা খারাপ হয়ে গেছে। একদিন আমাকে জেল অফিসে ডেকে পাঠানো হল। সিভিল সার্জনরা জেলা জেলের এক্স-অফিসিও সুপারিনটেনডেন্ট। এখন খুলনায় মোহাম্মদ হোসেন সাহেব সিভিল সার্জন। তিনি জেল পরিদর্শন করতে এসে আমার কথা শুনে আমাকে অফিসে নিয়ে যেতে বললেন। আমি যেয়ে দেখি তিনি বসে আছেন। আমাকে বসতে বললেন তার কাছে। আমি বসবার সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনি কেন জেল খাটছেন।” আমিও উত্তর দিলাম, “ক্ষমতা দখল করার জন্য।” তিনি আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ক্ষমতা দখল করে কি করবেন?” বললাম, “যদি পারি দেশের জনগণের জন্য কিছু করব। ক্ষমতায় না যেয়ে কি তা করা যায়?” তিনি আমাকে বললেন, “বহুদিন জেলের সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে। অনেক রাজবন্দির সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। অনেকের সাথে আলাপ হয়েছে, এভাবে কেউ আমাকে উত্তর দেয় নাই, যেভাবে আপনি উত্তর দিলেন। সকলের ঐ একই কথা, জনগণের উপকারের জন্য জেল খাটছি। দেশের খেদমত করছি, অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না বলে প্রতিবাদ করেছি, তাই জেলে এসেছি। কিন্তু আপনি সোজা কথা বললেন, তাই আপনাকে ধন্যবাদ দিলাম।” তারপরে আমার সুবিধা অসুবিধার কথা। আলোচনা হল। তিনি আমাকে বললেন যে, তিনিও উপরের কর্মকর্তাদের কাছে রাজবন্দিদের অসুবিধার কথা লিখেছেন। শীঘ্রই উত্তর পাবার আশা করেন। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাও বললেন। জেল অফিসের পিছনে সামান্য জায়গা ছিল। বিকালে ওখানে আমি হাঁটাচলা করতাম। জেলার সাহেব হুকুম দিয়েছিলেন। এই অন্ধকূপের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জানালা নাই, মাত্র একটা দরজা, তার সামনেও আবার দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। রাজশাহীর একজন সিপাহির ডিউটি প্রায়ই ওখানে পড়ত। চমত্তার গান গাইত। সে আসলেই তার গান শুনতাম।

 

৫৮.

আমি গোপালগঞ্জে আসলাম, মামলা চলছিল। সরকারি কর্মচারীরা সাক্ষী। সকলেই প্রায় বদলি হয়ে গেছে। আসতে হয় দূর দূর থেকে, এক একজন এক একবার আসেন। আমি জেল থেকে যাই আর সরকারি উকিল ও কোর্ট ইন্সপেক্টর ফরিদপুর থেকে আসেন। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। বললাম কিছু ডিম কিনে দিতে, কারণ না খেয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। এক মাসে শরীর আমার একদম ভেঙে গিয়েছে। চোখের অবস্থা খারাপ। পেটের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। বুকে ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেছি। রেণু আমাকে সাবধান করল এবং বলল, “ভুলে যেও না, তুমি হার্টের অসুখে ভুগেছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল।” ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কি করা যায়। হাছ আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু আব্বা বলে দেবে কামালও ‘আব্বা’ বলতে শুরু করেছে। গোপালগঞ্জ থানা এলাকার মধ্যে থাকতে পারি বলে কয়েক ঘন্টা ওদের সাথে থাকতে সুযোগ পেতাম। কিছুদিন পরে দুইজন সাথী পেলাম। নূরুন্নবী নামে একজন রাজনৈতিক বন্দি রাজশাহী থেকে এসেছে, কোর্টে হাজিরা দিতে। কারণ তার বিরুদ্ধে একটা মামলা আছে খুলনা কোর্টে। রাজশাহীতে যখন রাজবন্দিদের উপর গুলি করে তখন সে ওখানেই ছিল। গুলির আঘাতে তার একটা পা ভীষণভাবে জখম হয় এবং ডাক্তার সাহেবরা পা টা কেটে ফেলে দেয়। তাকে এখন এক পায়ে হাঁটতে হয়। অল্প বয়স, সুন্দর চেহারা, জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে, কিন্তু মুক্তি দেয় নাই। তার বাড়ি বর্ধমান।

কিছুদিন পরে ঢাকা জেল থেকে কৃষক নেতা বিষ্ণু চ্যাটার্জি এলেন, পায়ে ডাণ্ডা বেড়ি দেওয়া অবস্থায়। তার সাজা হয়েছে একটা মামলায়। এখন একজন সাধারণ কয়েদি। আর একটা মামলা খুলনা কোর্টে আছে। তার বিচার শুরু হবে। সদা হাসি খুশি মুখ, কোনো দুঃখ নাই বলে মনে হল। একদিন বললেন, “দুঃখ তো আর কিছু নয়, এরা আমাকে ডাকাতি মামলার আসামি করল!” বিষ্ণু বাবুকে ডিভিশন দেয় নাই। তাই কয়েদির কাপড় তাকে পরে থাকতে ও কয়েদির খানা খেতে হয়। নূরুন্নবী সকল সময়ই মুখটা কালো করে থাকত। জীবনের তরে খোড়া হয়ে গিয়েছে এই তার দুঃখ। তার কাছ থেকে রাজশাহী জেলের অত্যাচারের করুণ কাহিনী শুনলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও একজন ইংরেজ কর্মচারী কি নির্দয়ভাবে গুলি চালাতে হুকুম দিয়েছিল এবং তাতে সাতজন স্বাধীনতা সগ্রামী রাজনৈতিক বন্দি সকলে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা বেঁচে আছে তাদের অবস্থাও শোচনীয়। কারণ, এমনভাবে তাদের মারপিট করেছে যে জীবনে কিছুই করবার উপায় নাই।

প্রায় তিন মাস হয়েছে খুলনা জেলে এসেছি। নিরাপত্তা আইনের বন্দিরা ছয় মাস পর পর সরকার থেকে একটা করে নতুন হুকুম পেত। আমার বোধহয় আঠার মাস হয়ে গেছে। ছয় মাসের ডিটেনশন অর্ডারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন অর্ডার এসে খুলনা জেলে পৌঁছায় নাই। জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে কোন হুকুমের ওপর ভিত্তি করে জেলে রাখবেন? আমি বললাম, “অর্ডার যখন আসে নাই, আমাকে ছেড়ে দেন। যদি আমাকে বন্দি রাখেন, তবে আমি বেআইনিভাবে আটক রাখার জন্য মামলা দায়ের করে দিব।” জেল কর্তৃপক্ষ খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট ও এসপির সাথে আলাপ করলেন, তারা জানালেন তাঁদের কাছেও কোন অর্ডার নাই যে আমাকে জেলে বন্দি করে রাখতে বলতে পারেন। তবে আমার ওপরে একটা প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল, গোপালগঞ্জ মামলার। কাস্টডি ওয়ারেন্ট নাই যে জেলে রাখবে। অনেক পরামর্শ করে তারা ঠিক করলেন, আমাকে গোপালগঞ্জ কোর্টে পাঠিয়ে দিবে এবং রেডিওগ্রাম করবে ঢাকায়। এর মধ্যে ঢাকা থেকে অর্ডার গোপালগঞ্জে পৌঁছাতে পারবে। আমাকে জাহাজে পুলিশ পাহারায় গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল। গোপালগঞ্জ কোর্টে আমাকে জামিন দিয়ে দিল পরের দিন। বিরাট শোভাযাত্রা করল জনগণ আমাকে নিয়ে। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। রাতে বাড়িতে পৌঁছাব। আমার গোপালগঞ্জ বাড়িতে বসে আছি। নৌকা ভাড়া করতে গিয়েছে। যখন নৌকা এসে গেছে, আমি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা করব ঠিক করেছি এমন সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর ও গোয়েন্দা কর্মচারী আমার কাছে এসে বলল, “একটা কথা আছে। কোনো পুলিশ তারা আনে নাই। আমার কাছে তখনও একশতের মত লোক ছিল। আমি উঠে একটু আলাদা হয়ে ওদের কাছে যাই। তারা আমাকে একটা কাগজ দিল। রেডিওগ্রামে অর্ডার এসেছে আমাকে আবার গ্রেফতার করতে, নিরাপত্তা আইনে। আমি বললাম, “ঠিক আছে চলুন”। কর্মচারীরা ভদ্রতা করে বলল, “আমাদের সাথে আসতে হবে না। আপনি থানায় চলে গেলেই চলবে।” কারণ, আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলে একটা গোলমাল হতে পারত। আমি সকলকে ডেকে বললাম, “আপনারা হৈচৈ করবেন না, আমি মুক্তি পেলাম না। আবার হুকুম এসেছে আমাকে গ্রেফতার করতে। আমাকে থানায় যেতে হবে। এদের কোনো দোষ নাই। আমি নিজে হুকুম দেখেছি।” নৌকা বিদায় করে দিতে বললাম। বাক্সে কাপড়চোপড়, বইখাতা বাধা ছিল সেগুলি থানায় পৌঁছে দিতে বললাম। কয়েকজন কর্মী কেঁদে দিল। আর কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, “না যেতে দিব না, তারা কেড়ে নিয়ে যাক।” আমি ওদের বুঝিয়ে বললাম, তারা বুঝতে পারল। গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার সাহেব খুবই ভদ্রলোক ছিলেন। তাকে আমি বললাম, আপনি আমার সাথে চলুন, তা না হলে ভাল দেখায় না, কোনো গোলমাল হবে না। বাড়িতে আবার লোক পাঠালাম। রাতেই লোক রওয়ানা হয়ে গেল। আগামীকালই বোধহয় আমাকে অন্য কোন জেলে নিয়ে যাবে। নিষেধ করে দিয়েছিলাম, কেউ যেন না আসে, আমাকে পাবে না।

রাতে আবার থানায় রইলাম। থানার কর্মচারীরাও দুঃখ পেয়েছিল। সতের-আঠার মাস পরে ছেড়ে দিয়েও আবার গ্রেফতার করার কি কারণ থাকতে পারে? পরের দিন লোক ফিরে এসে বলল, রাতভর সকলে জেগেছিল বাড়িতে, আমি যে কোনো সময় পৌঁছাতে পারি ভেবে। মা অনেক কেঁদেছিল, খবর পেলাম। আমার মনটাও খারাপ হল। আমার মা, আব্বা ও ভাইবোন এবং ছেলেমেয়েদের এ দুঃখ না দিলেই পারত। আমি তো সরকারের কাছে বন্ড দেই নাই। আমাকে মুক্তি দিল কেন? হুকুমনামা সময়মত আসে নাই কেন? আমার তো কোনো দোষ ছিল না? এই ব্যবহার আমার সাথে না করলেই পারত। অনেক রাত পর্যন্ত লোকজন থানায় রইল। আমিও বসে রইলাম। ভাবলাম, অনেক দিন থাকতে হবে কারাগারে। দুই দিন গোপালগঞ্জ থানায় আমাকে থাকতে হল। ঢাকা থেকে খবর আসে নাই আমাকে কোন জেলে নিবে। আমার শরীর খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল খুলনা জেলে থাকার সময়। এ ঘটনার পরে আরও একটু খারাপ হল।

 

৫৯.

দুই দিন পরে খবর এল, আমাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যেতে। আমি ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। এবার আমাকে রাখা হল রাজবন্দিদের ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডে দুইটা কামরা; এক কামরায় পাঁচজন ছিল। আরেক কামরায় গোপালগঞ্জের বাবু চন্দ্র ঘোষ, মাদারীপুরের বাবু ফণি মজুমদার ও আমি। এই দুইজনকে আমি পূর্ব থেকেই জানতাম। ফণি মজুমদার পূর্বে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন। ইংরেজ আমলে আট-নয় বৎসর জেল খেটেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পরেও রেহাই পান নাই। বিবাহ করেন নাই। তাঁর বাবা আছেন পাকিস্তানে, পেনশন পান। ফণি বাবু দেশ ছাড়তে রাজি হন নাই বলে তিনিও দেশ ছাড়েন নাই। হিন্দু-মুসলমান জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তাকে ভালবাসত। কেউ কোন বিপদে পড়লে ফণি মজুমদার হাজির হতেন। কারো বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে ফণি মজুমদারকে পাওয়া যেত। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সরকার যাদের কমিউনিস্ট ভাবতেন, তারা আছে এক কামরায়। আমরা তিনজন কমিউনিস্ট নই, তাই আমরা আছি অন্য কামরায়।

চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সমাজকর্মী। জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মত একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোনো ব্যতিক্রম হত না। জুতা পরতেন না, খড়ম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে একজন সরকারি কর্মচারী অতি উৎসাহ দেখাবার জন্য সরকারকে মিথ্যা খবর দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করায় এবং তার শাস্তি হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব গোপালগঞ্জে এসে ১৯৪৮ সালে সেই কর্মচারীকে বলেছিলেন, চন্দ্র ঘোষের মত মানুষকে গ্রেফতার করে ও মিথ্যা মামলা দিয়ে পাকিস্তানের বদনামই করা হচ্ছে।

চন্দ্র ঘোষ শাস্তি ভোগ করে আবার নিরাপত্তা বন্দি হয়েছেন। আমি গোপালগঞ্জের লোক, আমি সকল খবরই রাখতাম। মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের আন্দোলন আমি বেশি করেছি এই সমস্ত এলাকায়। দেশের মুসলমান, হিন্দু সকলেই ভালবাসত চন্দ্র ঘোষকে। তাঁর অনেক মুসলমান ভক্তও ছিল। তফসিলী সম্প্রদায়ের হিন্দুরাই তার বেশি ভক্ত ছিল। গোপালগঞ্জের কিছু সংখ্যক তফসিলী সম্প্রদায়ের হিন্দু পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল, এমনকি কিছু সংখ্যক নমশূদ্র হিন্দু কর্মী আমাদের সাথে সিলেটে গণভোটে কাজ করেছিল। চন্দ্র ঘোষ একটা মেয়েদের হাইস্কুলও করেছিলেন। আমিও অনেক সরকারি কর্মচারীকে বলেছিলাম, এ ভদ্রলোককে অত্যাচার না করতে। কারণ, তিনি কোনোদিন রাজনীতি করেন নাই। সমাজের অনেক কাজ হবে তার মত নিঃস্বার্থ ত্যাগী সমাজসেবক দিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, এদের ব্যবহার করা দরকার। কে কার কথা শোনে! সরকারকে খবর দেওয়া হয়েছিল, হিন্দুরা আইন মানছে না। হিন্দুস্থানের পতাকা তুলেছে। চন্দ্র ঘোষ এদের নেতা। শীঘ্রই আরও আর্মড পুলিশ পাঠাও, আরও কত কি, খোদা জানে! কিন্তু আমি জানি, সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। গোপালগঞ্জে মুসলমানদেরও শক্তি কম ছিল না। সে রকম হলে মুসলমানরা নিশ্চয়ই বাধা দিত। যদি এ সমস্ত অন্যায় করত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বেধে যেত। তেমন কোনো কিছুই হয় নাই। চন্দ্র ঘোষের গ্রেফতারে হিন্দুরা ভয় পেয়েছিল। বর্ণ হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গের দিকে রওয়ানা করতে শুরু করেছে। যা সামান্য কিছু আছে, তাও যাবার জন্য প্রস্তুত। তাঁকে গ্রেফতারের একমাত্র কারণ ছিল সরকারকে দেখান, দেখ আমি কিভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ দমন করলাম। পাকিস্তানকে রক্ষা করলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি ফরিদপুর জেলে আসলাম, স্বাস্থ্য খারাপ নিয়ে। এসেই আমার ভীষণ জ্বর; মাথার যন্ত্রণা, বুকে ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। চিকিৎসার জটি করছেন না জেল কর্তৃপক্ষ, তবুও কয়েকদিন খুব ভুগলাম। রাতভর চন্দ্র বাবু আমার মাথার কাছে বসে পানি ঢেলেছেন। যখনই আমার হুশ হয়েছে দেখি চন্দ্র বাবু বসে আছেন। ফণি বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন আমার জন্য। তিন দিনের মধ্যে আমি চন্দ্র বাবুকে বিছানায় শুতে দেখি নাই। আমার মাথা টিপে দিয়েছেন। কখনও পানি ঢালছেন, কখনও ওসুধ খাওয়াচ্ছেন। কখনও পথ্য খেতে অনুরোধ করছেন। না খেতে চাইলে ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। আমি অনুরোধ করতাম, এত কষ্ট না করতে। তিনি বলতেন, “জীবনভরই তো এই কাজ করে এসেছি, এখন বুড়াকালে কষ্ট হয় না।” ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্র বাবু ও ফণি বাবু দেন নাই, কারণ সেখানে কে দেখবে? অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিরাও আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। কয়েকদিন পরেই আমি আরোগ্য লাভ করলাম। কিন্তু খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম বলে গোপালগঞ্জে মামলার দিনে যেতে পারি নাই। বাড়ির সকলে এসে ফিরে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে নৌকায় আসতে হয় ও গোপালগঞ্জে থাকতে হয়, নানা অসুবিধা। আমি গোপালগঞ্জ না যাওয়ায় আব্বা খুব চিন্তিত হয়ে পরে টেলিগ্রাম করেছিলেন।

 

৬০.

এদিকে জ্বর থেকে মুক্তি পেলেও হার্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে। চোখের অসুখ বেড়েছে। পেটে একটা বেদনা অনুভব করতাম। এইভাবে আরও এক মাস কেটে গেল। গোপালগঞ্জ মামলার তারিখে আবার সেই পুরানা পথ দিয়ে যেতে হল। এবার যেন সিন্ধিয়া ঘাট ডাকবাংলোকে আমার আরও ভাল লাগল। অনেক দিন পরে রাতে ঘরের বাইরে আছি। কত কথাই না মনে পড়ল। ১৯৪৫ সালে এই জায়গাটায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে নিয়ে একরাত কাটিয়েছিলাম। আমার বন্ধু ও সহকর্মী মোল্লা জালালউদ্দিন আমার সাথে ছিল। এখান থেকেই পরের দিন নৌকায় তাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যায়। ফরিদপুরের জালাল ও হামিদ আমার সাথে পাকিস্তানের আন্দোলনে কাজ করেছে।

সন্ধ্যার পরে অনেক লোক আমাকে দেখতে আসল। এটা একটা ছোট্ট বন্দর। কয়েকজন ছোটখাটো সরকারি কর্মচারী এখানে থাকতেন। তাঁরাও অনেকে আমার শরীর খারাপ গুনে দেখতে আসলেন। কিছু সময় আলাপ করার পরে একে একে সকলে বিদায় হলেন। ভয় তো কিছুটা আছে, যদি গোয়েন্দারা রিপোর্ট দেয়।

এর মধ্যে একটা ঘটনাও ঘটে গেছে। মাদারীপুরের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মচারী রিপোর্ট দিয়েছে যে, আমি যখন মাদারীপুরে জাহাজে ছিলাম তখন লোক দেখা করেছে। আমার সাথে। তাই যারা আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসত তারা এখন ভয় পেয়ে গেছে। তারা আমাকে অনুরোধ করেছে যাতে আমি বাইরের লোকের সাথে বেশি আলাপ না করি। আলাপ তো করব না সত্য, কিন্তু যারা আমাকে দেখতে আসে তাদের বাধা দেই কেমন করে? আলাপ তো শুধু এইটুকু আসসালামু আলাইকুম, ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন? আপনারা কেমন আছেন?’ তারা ভুলে গেছেন, এটা আমার জেলা, এখানে আমার আত্মীয়স্বজন অনেক। রাজনীতি করেছি এ জেলায়। আমি প্রায় সকল থানায়ই পাকিস্তানের জন্য সভা করেছি, অনেকে আমাকে জানে। অন্ততপক্ষে বিশ-ত্রিশজন আর্মড পুলিশ দিয়ে আমাকে পাঠান উচিত ছিল। সোজা সরকারি লঞ্চ দিয়ে ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ এবং গোপালগঞ্জ কোর্ট থেকে ফরিদপুর আনা নেয়া করা দরকার ছিল। এদের দোষ দিয়ে লাভ কি? যতদূর পারা যায় আমি নিজেই চেষ্টা করি, যাতে এই গরিবদের চাকরির ক্ষতি না হয়।

বেশি সময় বাইরে বসে থাকা উচিত না, আবার জ্বর হলে আর উপায় থাকবে না। ভোররাতে আবার জাহাজ ধরতে হবে, যদিও ঘাট একদম কাছে। গোপালগঞ্জ পৌঁছালাম। এবারও বাড়ি থেকে সকলে এসেছে। দুই তিনটা বড় নৌকা নিয়ে এসেছে। সকলেই আমার শরীরের অবস্থা দেখে চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছিল। মা তো চিল্কার করে কাঁদতে শুরু করলেন। কোর্ট থেকে ফিরে এলাম বিকালে। আগামীকাল আবার তারিখ পড়েছে। কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেবকে বললাম, “দেরি করছেন কেন? সমস্ত সাক্ষী হাজির করেন।” গোপালগঞ্জের পুরানা এসডিও সাক্ষী ছিলেন। তিনি তো আসলেনই না, তখন বোধহয় চট্টগ্রামে ছিলেন। না এসে ভদ্রলোক ভালই করেছেন, কারণ একটা গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। লোক খুব ক্ষেপেছিল।

এক আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম, গোপালগঞ্জের পুরানা পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেব সাক্ষী দিতে এসেছেন। বোধহয় এখন ঢাকায় বদলি হয়েছেন। গোপালগঞ্জে তাঁর নাম ছিল খুব, সাধু কর্মচারী হিসাবে। ঘুষ খেতেন না। তিনি সাক্ষী দিতে উঠে একটা মিথ্যা কথাও বললেন না, যা সত্য, যা দেখেছেন তাই বললেন। আমি যে জনগণকে শান্তভাবে চলে যেতে বলেছিলাম, সেকথাও স্বীকার করলেন। সরকারি উকিল ভদ্রলোক খুব চটে গেছেন দেখলাম। কিন্তু বলা তো হয়ে গেছে। আর হাকিম সাহেবও লিখে ফেলেছেন, এখন আর উপায় কি? আমি বুঝলাম, মামলায় বোধহয় কিছু হবে না, তবে ঘুরতে হবে আরও কিছুদিন। পাকিস্তানে এ রকম পুলিশ কর্মচারীও আছে, যারা মিথ্যা কথা বলতে চান না। আমাদের দেশে যে আইন সেখানে সত্য মামলায়ও মিথ্যা সাক্ষী না দিলে শাস্তি দেওয়া যায় না। মিথ্যা দিয়ে শুরু করা হয়, আর মিথ্যা দিয়ে শেষ করতে হয়। যে দেশের বিচার ও ইনসাফ মিথ্যার উপর নির্ভরশীল সেদেশের মানুষ সত্যিকারের ইনসাফ পেতে পারে কি না সন্দেহ।

আবার পরের মাসে তারিখ পড়ল। আমি আগের মত থানায় ফিরে এলাম। দুই দিন সকাল ও বিকালে সকলের সাথে দেখা হল। রাজা মামা ও মামী কিছুতেই অন্য কোথাও খাবার বন্দোবস্ত করতে দিলেন না। মামী আমাকে খুব ভালবাসতেন। নানীও আছেন সেখানে। আমার খাবার তাঁদের বাসা থেকেই আসত। বাড়ি থেকে যারা এসেছিল তাদের মধ্যে মেয়েরা মামার বাড়ি, আর পুরুষরা নৌকায় থাকতেন। রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?” কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হল উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাচু ও কামাল ওদের মা’র কাদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, “খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?” পরের দিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *