০৭. চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে পৌঁছিয়া

চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে পৌঁছিয়াই শ্যামা ঠাকুরাণী দেখিলেন, পাড়ার অনেকেই সেখানে সমবেত হইয়াছেন। তিনি কোন প্রকার ভূমিকা না করিয়া একেবারে অতি কঠার স্বরে চণ্ডী বাবুকে আক্রমণ করিলেন; বলিলেন “আচ্ছা বলি চণ্ডীচরণ, তুমি এমনই কি গাঁয়ের মাতব্বর হয়ে বসেছ, যে কাউকে কিছু না বলে এমন কাজটা করে বস্‌লে।”

চণ্ডী বাবু বলিলেন “কৈ, আমি ত কিছুই করি নাই।”

“কর নাই? তোমার বোন বড় জমিদার, তা জানি; কিন্তু তাই ব’লে সে যে আমাদের গাঁয়ের এই কলঙ্কটা দশ গাঁয়ে ছড়িয়ে দিতে গেল, আর তুমি তাতে কথাটাও বল্‌লে না, এ কি ভাল হোলো ?”

চণ্ডী বাবু বলিলেন “আমি কেন তা করতে যাব? দিদি ওদের নিয়ে গেলেন, তাতে আমার হাত কি? আমি নিষেধ করবারই বা কে? তবুও এঁদের জিজ্ঞাসা কর, আমি আপত্তি করেছিলাম কি না।”

“তুমি আপত্তি কর্‌লে, আর তোমার বাড়ীর বৌকে মেয়েকে তারা জোর করে নিয়ে গেল! কাকে বোকা বোঝাও তুমি চণ্ডীচরণ! আমার বয়স এই ষাট পার হয়ে গেল; তোমাদের হাটহদ্দ সবই আমি জানি। তোমার দিদি বড়মানুষ আছেন, বেশ কথা । তিনি তাঁর নিজের দেশে, নিজের জমিদারীতে গিয়ে তাঁর ক্ষমতা দেখান। আমাদের গাঁয়ের বৌকে তিনি অমন করে নিয়ে যাবার কে? তাই বল ত শুনি? আর, তুমি এর ভিতর না থাক্‌লে, সে যতবড় লোকই হোক না কেন, এমন কাজ করতে পারে?”

ভট্টাচার্য্য মহাশয় দেখিলেন বেগতিক; তিনি বলিলেন “সে যা হবার তা হয়ে গিয়েছে; এখন এ অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার কি হবে, তাই বল। আমরাই কি জানি যে, তার। আজ ভোরেই ওদের নিয়ে চলে যাবে। কা’ল রাত্রে ঐ রকম একটা কথা হয়েছিল বটে; কিন্তু তার ত কোন মীমাংসাই হয় নাই। চণ্ডীর এ কাজটা যে গর্হিত হয়েছে, এ কথা বল্‌তেই হবে। তাদেরও বিবেচনা করা উচিত ছিল।”

শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “সে ত ঠিক্‌ কথা। আমাদের গাঁয়ের বৌ দোষ-ঘাট করে থাকে, আমরাই তার শাস্তি দেব, আমরাই তার ব্যবস্থা করব; তারা কোথাকার কে যে, গাঁয়ের বৌকে এমন করে নিয়ে যায়। এতে যে তোমাদের একেবারে মাথা কাটা গেল, তা বুঝতে পেরেছ।”

একটী যুবক সেখানে দাঁড়াইয়া ছিল; তাহার আর সহ্য হইল না; সে বলিল “কাজটা অন্যায়ই বা কি হয়েছে? তোমরা ব্যবস্থা করলে, সেই বৌটাকে তাড়িয়ে দেবার। তাঁরা দয়া করে তাকে আশ্রয় দিয়ে নিয়ে গেলেন। এতে তাঁদের অপরাধটা কি হোলো।”

শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “তাড়িয়ে দেবে না, কি মাথায় করে নাচ্‌বে। চুপ কর্‌, তোরা ছেলে-মানুষ, এ সব কথার তোরা কি বুঝবি। কত বড় অপমানটা হোলো জানিস্‌।”

যুবকও ছাড়িল না; বলিল “আর সেই নিরপরাধা বৌটীকে বাজারে দাঁড় করিয়ে দিলে ভারি আমাদের মান বাড়ত। যে অপরাধ করল, তার কোন শাস্তির কথা নেই, কথা হোলো কি না, যারা শত বিপদ, শত লাঞ্ছনার ভয় না করে, সেই অনাথাকে আশ্রয় দিল, তাদিকে কেমন করে নির্য্যাতন করা যায়, তারই ব্যবস্থা।”

শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “জানিস্‌ নে, শুনিস্‌ নে; মাঝের থেকে মোড়োলী করতে আসিস্। এই যে শ্যামা বামণী দেখ্‌ছিস, এর কাছে কিছুই ছাপা নেই। ও বৌটা ঐ রকমই বজ্জাত ছিল। আমি আর কি না জানি; তবে গাঁয়ের বৌ, তাই এতদিন চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। হয় না হয়, ঐ ত কালাচাঁদ বসে আছে, ওকে জিজ্ঞাসা কর্‌। আসল কথা ত জানিস্‌নে এতকাল গেল, কালাচাঁদ কিছু করল না; আর কা’ল রাত্তিরে, পাশের বাড়ীতে দশ গাঁয়ের লোক জমা, সেই সময় বৌকে আক্রমণ করতে গেল; এও কি বিশ্বাসের কথা।”

আর একটা যুবক বলিল “সে কি কথা পিসিঠাকরুণ, আমরা যে সেখানে উপস্থিত ছিলাম, আমরা যে স্বচক্ষে দেখেছি।”

“ছাই দেখেছিস্। আসল কথা ত তোরা বুঝলিনে। আমি শোনা মাত্র ওসব বুঝে নিয়েছি; আর আমি সবই জানি কি না। হয় না হয় জিজ্ঞাসা কর ঐ কালাচাঁদকে।”

যুবক বলিল “ওঁকে আবার কি জিজ্ঞাসা করব। তোমরা বিচার না কর, সে ভার আমরাই নেব।”

শ্যামা ঠাকরুণ বলিলেন “তোর যে ভারি আস্পর্দ্ধা দেখেছি রে রেমো! দুই পাতা ইংরেজী পড়ে দেখ্‌ছি বাপ-দাদাকেও মানিস্ নে । এই বুঝি তোদের লেখা-পড়া শেখা। আমরা দশজন বুড়েবুড়ি কথা বলছি, তার মধ্যে তোরা কথা বলতে আসিস্ কেন?”

রাম বলিল “অন্যায় দেখলেই কথা বলতে হয়। গোরাচাঁদ দাদার স্ত্রীকে এ গাঁয়ের কে না জানে। তাঁর মত সতী লক্ষ্মী গাঁয়ে কয়জন আছে? আর তোমরা কি না তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক দিতে যাচ্ছ। আর যে এমন পাপের কাজটা করল, তাকে কিছু বল্‌ছ না। এ আমরা সইব না, তাতে যিনি যা বলুন।” শ্যামা ঠাকরুণ দেখিলেন ষে, এই যুবকদের সঙ্গে তিনি পারিয়া উঠিবেন নাা; তখন একটু ধীর ভাবে বলিলেন “আচ্ছা, তোরা যে এত গোল করছিস্, কিন্তু ব্যাপারটা কি, তা একবার ঐ কালাচাঁদকে জিজ্ঞাসা করেছিলি।”

“ওঁকে আবার কি জিজ্ঞাসা করব। আমরা যে তখন বাড়ীর উপর ছিলাম, আমরা যে সব দেখেছি।”

“দেখ্‌লেই ত হয় না, শুন্‌তেও হয়। আমি ত ছিলাম না তখন; কিন্তু কি হয়েছিল, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ঐ গোরার বৌটার স্বভাব-চরিত্র ভাল ছিল না; তা তোমরা না জান্‌তে পার, আমি জানি। কালাচাঁদ তাই জানতে পেরে কা’ল তাকে শাসন করতে গিয়েছিল। এই হোলো ব্যাপার। বৌটা তাই এই সোর-গোল করে নিজের সাফাই দেখাল। নইলে কালাচাঁদ কি এমন কাজ করতে পারে? তার স্বভাব ভাল না, তা সকলেই জানে; কিন্তু এই যে এতকাল গেল, এর মধ্যে তোমরা কেউ বল্‌তে পার যে, ও কোন দিন কোন গেরস্তর বৌঝির দিকে কু-নজরে চেয়েছে। এ সব খেলা বুঝতে তোমাদের অনেকদিন লাগ্‌বে। তা, সে কথা যাক্‌, তোমরা ত অনেক প্রবীণ লোকই এখানে রয়েছ, তোমরা যে কোন কথাই বল্‌ছ না? এখন কি ছেলেদের হাতে সব বিচার-আচার ফেলে দেবে? তাই যদি তোমাদের অভিপ্রায় হয়, তা হ’লে আর আমাকে ডাকা কেন?”

এইবার একটী যুবক খুব জোরের সঙ্গে বলল, “দেখ শ্যামা পিসি, তুমি কিছু মনে কোরো না, কিন্তু তুমি যা বল্‌লে, তার একটা কথাও সত্য নয়, এ আমি খুব বল্‌তে পারি। ও বাড়ীর বড় বৌয়ের স্বভাব মন্দ ছিল, এমন কথা গাঁয়ের কেউ কখন বল্‌তে পারবে না। আজই তোমার মুখে শুনলাম। এ কথা আমরা বিশ্বাস করিনে। কর্ত্তাদের যা ইচ্ছা হয়, তাঁরা করতে পারেন; আমরা কিন্তু বলছি, আমরা কালাচাঁদ মুখুয্যের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখব না; আর পারি ত, তাকে এই গাঁ-ছাড়া করব। এমন একটা ভয়ানক পাপের কাজ যে কর্‌ল, তোমরা তাকে নির্দোষী বল্‌তে চাও; আর যার কোন দোষ নেই, যে সতী-সাধ্বী, তার নামে তোমরা মিথ্যা কলঙ্ক দিতে চাও৷ তাঁকে ওঁরা নিয়ে গিয়ে ছেন, বেশ করেছেন; নইলে তোমরা তাঁর কি অবস্থা করতে, তা তোমাদের ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এতকাল যা হবার হয়েছে, এখন আর আমরা এ সব হতে দিচ্ছি নে৷”

বুড়া গাঙ্গুলী মহাশয় এতক্ষণ কোন কথাই বলেন নাই। যুবকের এই তেজের কথা শুনিয়া তিনি বলিলেন “তা হলে এ গ্রামে আমাদের কথা থাক্‌বে না? তোমরাই কর্ত্তা হয়ে বস্‌বে না কি?”

যুবক বলিল “আমরা কর্ত্তা হতে চাইনে; আপনার ন্যায়-মত যা করবেন, আমরা ঘাড় পেতে তা স্বীকার করব; কিন্তু আমরা অন্যায়ের প্রশ্রয় দেব না।”

গাঙ্গুলী মহাশয় বললেন “তা হ’লে বাপ-বেটায় ঝগড়া আরম্ভ হবে দেখ্‌ছি।”

চণ্ডী বাৰু সেই যে গোড়ায় দুই একটী কথা বলিয়াছিলেন, তাহার পর এতক্ষণ কিছু বলেন নাই। তিনি গত রাত্রেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, এবার লেখা-পড়াজানা যুবকের দল শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে; তাহারা, যাহা উচিত তাহার জন্য লড়িবে। এখন যুবকদের মুখে সেই ভাবের কথা শুনিয়া তাঁঁহার সাহস হইল; তিনি বলিলেন “কার কথায় সমাজ চল্‌বে, তা বল্‌তে পারিনে; কিন্তু ছেলেরা যা বল্‌ছে, তার একটী কথাও ত অন্যায় নয়। গোরার স্ত্রীর সম্বন্ধে যে কথা বলা হোলো, আমি তার প্রতিবাদ করছি। আমি বল্‌ছি, তার কোন অপরাধ নেই; তার চরিত্র খুব ভাল ছিল, এ কথা আমিও সহস্র বার বল্‌তে পারি। কালু যে কাজ করেছে, তার জন্য তার বিশেষ দণ্ড হওয়া উচিত। তা না করে, তাকে নির্দোষী প্রমাণ করবার জন্য যে কথা হচ্চে, আমি তার মধ্যে নেই। আমি কালুর সঙ্গে কোন সম্বন্ধ রাখৰ না আমার দিদি যা করেছেন, বেশ করেছেন; নইলে সে হতভাগিনী আজ মেয়েটী নিয়ে যে পথে দাঁড়াত! আমার কথা আমি বললাম, এখন এর জন্য তোমরা আমাকে যা করতে চাও, করতে পার। গাঁয়ে দলাদলি ছিল না, এখন না হয় একটা দলাদলিই হবে। তোমরা কালুকে নিয়ে থাক, আমি সমাজে একঘরে হয়েই থাকব; তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।”

যুবকেরা কোলাহল করিয়া উঠিল “কে চণ্ডী বাবুকে একঘরে করে, দেখা যাবে। আমরা সবাই ওঁর দিকে।”

শ্যামা ঠাকুরাণী রাগে অধীর হইয়া বলিলেন “বেশ, আজ থেকে আমিই একঘরে। আমি আর তোমাদের কিছুর মধ্যে নেই! এত অপমান! যাদের বাপ-কাকাদের জন্মাতে দেখলাম, তারাই কি না সুমুখে দাড়িয়ে অপমান করে! ডেকে এনে অপমান করে! আচ্ছা দেখা যাবে, চণ্ডী মুখুয্যের কেমন তেজ!” এই বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন।

2 Comments
Collapse Comments

Wow, Amr priyo ekta boi, Onek bar porechi ,
Jolodor Sen er,

*Ovagi,
*Uttsho
*Dukkhini

uponnash gulu upload diben

এখানেই শেষ? পরের এপিসোড এর জন্য অপেক্ষা করছি। ধন্যবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *