1 of 2

৩০. পাখিরা যেমন

পাখিরা যেমন শক্ত ফলের গায় নখের দাগ রেখে যায় তেমনি হয়তো ইয়ুথ হোস্টেলের একটা দেওয়ালে ক্রুদ্ধ প্রাণীদের আফসোস আঁকা হয়ে আছে। ওরা ভেবে পাচ্ছিল না এটা ঠিক কোন প্রাণী! রাত্রে চোখে দেখার উপায় ছিল না। চাপা গর্জনে ক্ষোভ গলছিল। এত ওপরে বাঘ আসতে পারে কিনা তা-ও ওরা বুঝতে পারেনি। সকাল যখন দশটা তখন থাবা বলে ক্লি আর যাই হোক প্রাণীগুলোর শরীর বিশাল নয়। ওয়াংদে পর্যন্ত যা বোঝাতে চাইল হিন্দী এবং নেপালিতে মিশিয়ে তাতে প্রাণীটির নাম আবিষ্কার করা মুশকিল হল। তবে ওয়াংদের মতে ব্যাপারটা কিছু ভয়াবহ নয়। মানুষের রক্তের গন্ধে ওদের উত্তেজনা হয় ঠিকই কিন্তু ধমক দিলে পালিয়েও যায়। সাহেবরা যদি কাল রাত্রে গলা তুলে ধমকাতেন তাহলে ওরা এত সাহস পেত না।

আজ সকালে ওয়াংদে তাদের ঘুম ভাঙিয়েছে চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে। আনন্দ বিস্ময়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। একটি সরল হাসি সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে মার্জনা প্রার্থনা করতে পারে তা ওয়াংদেকে না দেখলে বোধহয় কোনদিন জানা হত না। কাল রাত্রেই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই নিয়ে খামোকা ঝামেলা করার কোন মানে হয় না। লোকটা বেশি মদ খেয়ে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে, তাদের রাতের খাবার এবং জ্বালানী কাঠ এনে দেয়নি কিন্তু এখনও অনেকটা পথ সামনে পড়ে আছে। তবে আনন্দ তাকে সতর্ক করে দিল এরকম যেন আর না হয়।

সকাল দশটা অবশ্যই রওনা হবার পক্ষে উপযুক্ত সময় নয়। কিন্তু কাল রাত্রে ওই প্রাণীগুলোর থেমে যাওয়া এবং রাত্রের আকাশবাণীর শেষ খবর পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর যখন ঘুম এল তখন প্রায় মৃতদেহের মত পড়েছিল ওরা। এই কদিনের প্রতিনিয়ত মানসিক উত্তেজনা, শারীরিক পরিশ্রম এবং এখানকার শীতল আবহাওয়া ওদের সমস্ত সতর্কতা মুছে দিয়েছিল। এরকম ঘুম বোধহয় অনেককাল বাদে ওরা ঘুমিয়েছে। যদি ওয়াংদে না ডাকত তাহলে সকাল দশটাতেও রওনা হওয়া যেত না। তবু ওয়াংদে বলেছে যদি জোর পা চালানো যায় তাহলে ফালুটে পৌঁছবার আগে সন্ধ্যে নামবে না।

সকাল দশটাতেও আজ সান্দাকফু কুয়াশায় ঢাকা। সামনের পাহাড়গুলো অদৃশ্য, একফোঁটা রোদ নেই। ওপরের বাংলোগুলোর পাশ কাটিয়ে ওরা যখন নির্জনে চলে এল তখন কোন মানুষ চোখে পড়েনি। কিন্তু জিপটা এখনও আছে। সুদীপের খুব ইচ্ছে ছিল যাতে জিপের মালিক আর ফিরে যেতে পারে তার একটা ব্যবস্থা করা। কিন্তু আনন্দ আপত্তি করেছিল। এটা নিছকই ব্যক্তিহত্যা হবে। আর এই ঘটনাই পুলিশকে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেবে তারা এখানে এসেছে। ওয়াংদেই সাক্ষী দেবে। গতরাত্রের শেষ খবরেও তাদের কথা কিছু বলেনি। তার মানে নিশ্চয়ই পুলিশ হাত গুটিয়ে নেয়নি। একজন মন্ত্রী মারা যাওয়ার পর ওরা তা করতেও পারে না। কিন্তু যেটা সত্যি সেটা হল তাদের নিয়ে কোন খবর তৈরি হচ্ছে না যা পরিবেশন করা যায়।

আকাশটা মাথার ওপর অনেকটা নেমে এসেছে, পায়ের তলার মাটি যেন অনেক উঁচুতে এইরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল হাঁটতে হাঁটতে। ওয়াংদে যাচ্ছে আগে আগে। তার পিঠে যে বোঝ সেটার দিকে তাকিয়ে কল্যাণের মনে হল সে মরে যেত এত উঁচুতে এই ওজন বইতে হলে। ওয়াংদের ঠিক পেছনে ছিল সুদীপ, তারপর কল্যাণ। জয়িতা আর আনন্দ হাঁটছিল শেষে, পাশাপাশি। আনন্দ বলল, আমরা খুব লাকি যে আজ ফালুটে কোন ট্রেকার যাচ্ছে না।

জয়িতা কোন কথা বলল না। যদিও চারপাশে গভীর কুয়াশা তবু তার খুব ভাল লাগছিল। গতকাল জিপে আসার সময় আর যাই হোক এইভাবে পাহাড়ের মধ্যে থাকা হয়নি। যদি আকাশ পরিষ্কার থাকত তাহলে নিশ্চয়ই আরও ভাল লাগত কিন্তু এই বা খারাপ কি! স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে যাওয়া! মাঝে মাঝে সামনের বন্ধুরা মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়। যদিও আনন্দের পরিকল্পনামত তারা ফিরে আসবে অবস্থা শান্ত হলেই, কিন্তু জয়িতার মনে হচ্ছিল এই পথে আর হাঁটা হবে না। হয়তো কোনকালেই কলকাতায় যাওয়া হবে না তাদের। অন্তত এই মুহূর্তে সেই কারণে তার কোন আফসোস নেই। কলকাতা তাকে কিছুই দেয়নি। ওর বয়সের নব্বইভাগ মেয়েই কোন না কোন উপায়ে জীবনটাকে ভাল লাগায়। ঈশ্বর তাকে যে শরীর দিয়েছেন তা কোন পুরুষকে বোধহয় কোনদিন আকর্ষণ করবে না। কিন্তু উলটো দিকে কেন হল না কিছু? সমস্ত শারীরিক অর্থে যখন সে একজন মেয়ে, তখন কোন পুরুষকে তার প্রেমিক হিসেবে পেতে ইচ্ছে হয়নি কেন? মাঝে মাঝে তাই নিজেকেই খুব দুর্বোধ্য লাগে জয়িতার।

এখন এই আকাশের মধ্যে হেঁটে যাওয়া চমৎকার লাগছিল। কাল রাত্রের পরে শীতের সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের একটা সমঝোতা হয়ে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কোথাও অনাবৃত নেই। গ্লাভস পরার পর যে অস্বস্তিটা ছিল সেটাও এখন কেটে গেছে। জয়িতা সামনের দিকে তাকাল। কল্যাণ একা একা হাঁটছে। কাল রাত্রে ও সুদীপের সঙ্গে যে কাণ্ডটা করল সেটা নিয়ে আর কথা হয়নি। কিন্তু সুদীপ নিশ্চয়ই সহজে ভুলতে পারবে না। সুদীপের ওপর কল্যাণের একটা চাপা ঈর্ষা ছিল বলে অনুমান করত জয়িতা। অথচ ব্যাপারটার কোন প্রমাণ ছিল না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট বলে সুদীপ এড়িয়ে যেত ওর অনেক কিছু। কিন্তু কাল কল্যাণের হঠাৎ কেন মনে হল সুদীপ পালিয়ে যেতে পারে? এত তাড়াতাড়ি যদি অবিশ্বাস ঢুকে যায় প্রত্যেকের মনে তাহলে বিপর্যয় আসতে বাধ্য। জয়িতা ভেবেছিল আনন্দ এই নিয়ে কথা বলবে। মাঝে মাঝে আনন্দটাও কেমন অচেনা হয়ে যায়। ও যেন ব্যাপারটা দ্যাখেইনি এমন ভাব করে আছে। কিন্তু আজ সকালেও তো কল্যাণ সুদীপের সঙ্গে সহজ গলায় কথা বলছে না। জয়িতা জোরে পা চালাল। রাস্তা সমতল নয়। মাঝে মাঝে ওপরে উঠতে রীতিমত হাঁপাতে হচ্ছে। জয়িতা কল্যাণের পাশে পৌঁছে হাসবার চেষ্টা করেই সামলে নিল। এখন তো মুখের বেশির ভাগ ঢাকা। হাসলে কেউ বুঝতেই পারবে না। কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। খানিকটা পথ পাশাপাশি হেঁটে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোর কেমন লাগছে?

মহাপ্রস্থানের পথে যাচ্ছি। তুই দ্রৌপদী, একজন পাণ্ডব মিসিং। আমি, নকুল না সহদেব বুঝতে পারছি না। কোনদিন বেঁচে ফিরে আসব ভেবেছিস? নেভার! এই পাহাড়েই আমাদের জমে মরতে হবে। এসব বললে তো তোরা আমাকে দলবিরোধী বলবি! যত দোষ তো আমার। কল্যাণ কথা শেষ করে ভার মেশা ছিল হঠাৎ আলাপের পরামর্শ নহর মধ্যেই শিশু মুখ ফেরাল। শেষ শব্দগুলো বেশ ভার মেশা ছিল।

জয়িতা ওর কনুই-এ হাত রাখল, তুই নিজেকে হঠাৎ আলাদা করে ভাবছিস কেন?

ভাবব না? চমৎকার! যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে আনন্দ সুদীপের পরামর্শ নিচ্ছে। অনেকসময় তো সুদীপ নিজেই আমাদের ওপর হুকুম চালাচ্ছে। আমি যে দলে আছি সেটা ওরা গ্রাহের মধ্যেই নিচ্ছে না। যেন আমার কোন ভূমিকাই থাকতে পারে না। এসব তোর চোখে পড়ে না, না?

সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলে তো মুশকিল হবে। ওরা তো আমাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করে না।

তোর কথা আলাদা।

আলাদা কেন?

কল্যাণ জবাবটা দিতে গিয়েও থমকে গেল। জয়িতা জানত ও কি বলতে পারে। মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হলেও সে প্রকাশ করল না। জবাবটার জন্যে চাপও দিল না। পশ্চিমবাংলার বেশির ভাগ মানুষের মনই কল্যাণের মানসিকতায় গড়া। এখনও ট্রামে বাসে উঠলে তারা বলে থাকে, ভিড় বাসে কেন যে মেয়েছেলে ওঠে! মেয়েছেলে শব্দটা শুনলেই শরীর গুলিয়ে ওঠে। শব্দটার সমস্ত শরীর জুড়ে অপমান।

সান্দাকফুতে সন্ধ্যেবেলায় যে চকচকে তুষার পড়েছিল সকাল দশটায় তার হদিস ছিল না পায়ের তলায়। কিন্তু আড়াই কিলোমিটার হাঁটার পর ওরা বরফ পেয়ে গেল। এর মধ্যেই বিশ্রামের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল চারজনের। বড় পাথরের আড়াল দেখে ওয়াংদে স্টোভ জ্বালাল। কল্যাণ বেঞ্চির মত পড়ে থাকা একটা পাথরে ধপ করে বসে পড়তেই সুদীপ বলল, বসিস না। বইতে পড়েছি পাহাড়ে ট্রেকিং-এর সময় বসলে আরও বেশি ক্লান্তি লাগে।

কল্যাণ কাঁধ নাচাল। তারপর জয়িতার দিকে তাকাল। এই তাকানো যে অর্থবহ তা বুঝতে অসুবিধে হল না জয়িতার। কিন্তু এসবে আমল না দিয়ে ও এগিয়ে গেল সামনে। এখন বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে হবে। আঃ দারুণ! ছোটবেলা থেকে কত ইংরেজি বই-এ এইরকম হাঁটার কথা সে পড়ে আসছে। সাইবেরিয়ার কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প থেকে একজন এর চেয়ে আরও ভয়াবহ বরফের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছিল একুশ দিন। সেই বর্ণনা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তার সামনে এখন যে কুয়াশায় ঢাকা বরফ পড়ে আছে তাকে দেখে অবশ্য খুব নিরীহ মনে হচ্ছে।

সে ফিরে আসতেই কল্যাণ বলল, এখান থেকে সাপ্লাই পেলে কলকাতায় সস্তায় আইসক্রিম বিক্রি করা যেত। প্রাকৃতিক আইস উইদ ক্রিম।

সুদীপ শুনে বলল, তোর কলকাতায় একটা ঘাসের দোকান খোলা উচিত ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণের গলা চড়ল, আমি তোর সঙ্গে কথা বলছি না। কেউ গায়ে পড়ে আমাকে জ্ঞান দিলে আমি কিন্তু বেশিক্ষণ সহ্য করব না।

সুদীপ অত্যন্ত অবাক গলায় বলল, হোয়াটস্ দিস! আমি তোর সঙ্গে ঠাট্টা করতে পারব না?

না। তোর ঠাট্টা, তোর হুকুম, এসব আমি মানতে বাধ্য নই।

ও। সারাটা পথ কিন্তু তোর বোঝা আমিই বয়ে এলাম। ঠিক আছে, তোর যখন কোন কম্‌প্লেক্স কাজ করছে তখন আর কিছুই বলব না। কিন্তু তার আগে আমি জানতে চাই কমপ্লেক্সটা কি?

কল্যাণ কোন জবাব দিল না। সুদীপ এগিয়ে গেল ওর কাছে, কল্যাণ, আমার প্রশ্নের জবাব দে।

খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আনন্দ এবং কাছাকাছি জয়িতা ওদের দেখছিল। চট করে যে উত্তেজনাটা তৈরি হয়েছে তার জন্যে জয়িতা ভীত হয়ে পড়ল। সে আনন্দর দিকে তাকাতে আনন্দ নিষেধ করল ইঙ্গিতে কিছু না বলতে। কল্যাণ একপাশে মাথা ঘুরিয়ে বসে আছে। সুদীপ কিছুক্ষণ ওর সামনে দাঁড়াল। তারপর ডান হাত আলতো করে কল্যাণের কাঁধে রেখে বলল, সরি। তোকে যদি হার্ট করে থাকি তাহলে দুঃখিত। বলে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে। জয়িতা লক্ষ্য করল কল্যাণ তার বসার ভঙ্গি পালটাল না।

এইসময় ওয়াংদে ওদের চা দিয়ে গেল। ধোঁয়া উঠছে অথচ চুমুক দেবার পর মনে হল ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। নিজের মগে চুমুক দিয়ে ওয়াংদে বলল, আজ যদি ফালুটে পৌঁছাতে হয় তাহলে আর একটু জোরে পা চালাতে হবে। মনে হচ্ছে আজ রোদ উঠবে না এবং সন্ধ্যে নামবে আগেই। ও কথাগুলো বলল আনন্দকে। লোকটা নিজেই বুঝে নিয়েছে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ঘড়িতে যখন তিনটে তখন জয়িতার মনে হল আর এক পা-ও হাঁটতে পারবে না। ছেলেরা কেউ কিছু বলছিল না বটে কিন্তু একমাত্র সুদীপ ছাড়া বাকী দুজনও বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল। এমন নয় ওরা সমস্তটা পথে বরফ পেয়েছে। কিন্তু চড়াই উত্রাই ক্রমাগত ভাঙতে ভাঙতে মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর আর বাতাস নেই, থাই থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রচণ্ড বেদনা ওঠানামা করছে। ওয়াংদে আর সুদীপ এগিয়ে গিয়েছিল। কুয়াশায় ওদের দেখা যাচ্ছে না। আনন্দ চিৎকার করতে সুদীপের নাম পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আনন্দ কল্যাণকে বলল, আমার গলায় লাগছে, তুই ডাক।

কল্যাণের অবস্থা তখন বেশ কাহিল। নাকের ডগায় কোন সাড়া নেই। দাঁড়িয়ে থাকতেও ওর কষ্ট হচ্ছিল। জয়িতা মুখের কাছে আনন্দর অনুকরণে দুটো হাত নিয়ে ডাকতে যাচ্ছিল কিন্তু কল্যাণকে এড়িয়ে হাত নেড়ে আনন্দ তাকে নিষেধ করল। কল্যাণ চিৎকার করল সামনের ঘন নীল কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সুদীপের নাম ধরে নয়। ওয়াংদের সাড়া পাওয়া গেল বেশ দূর থেকে। জয়িতা অবাক চোখে কল্যাণের দিকে তাকাল। এই সময়েও মানুষ কি করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তা বিস্ময়েরই ব্যাপার। আর মিনিট দুয়েক অপেক্ষার পর কুয়াশার আড়াল ভেদ করে ওয়াংদে বেরিয়ে এল, লোকটাকে একটুও ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে না। ওর পিঠের বোঝা যেন কিছুই নয়। আনন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে ফালুট পৌঁছাতে আর কতক্ষণ সময় লাগবে? সে বুঝে গিয়েছিল দূরত্ব সময় দিয়ে মাপলে তবু এদের কাছ থেকে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

ওয়াংদে একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, এইভাবে হাঁটলে আরও এক ঘণ্টা। কিন্তু মনে হচ্ছে ফালুটে যাওয়া আজ সম্ভব হবে না।

কথাগুলো একই সঙ্গে বিস্মিত এবং আনন্দিত করল আনন্দকে। নিজেদের অক্ষমতার কথা সে কিভাবে ওয়াংদেকে বলবে তাই ভাবছিল, কিন্তু ওয়াংদে সেটাই সহজ করে দিল। বরং সে একটু কৌতূহলী হবার ভান করে জিজ্ঞাসা করল, কেন? মাত্র তো এক ঘণ্টার পথ বলছ!

কল্যাণ এই সময় বলল, অসম্ভব। ইম্পসিবল। আমার পক্ষে আর এক পা-ও হাঁটা সম্ভব নয়। যদি যেতে চাস তো আমাকে ফেলে রেখে তারা চলে যা।

ওয়াংদে বলল, আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই মনে হচ্ছে অন্ধকার নেমে আসবে আজ। সাহেবরা খুব খারাপ সময় পছন্দ করেছেন এখানে আসার জুন্যে। তাও যদি আমরা সকাল আটটার মধ্যে বের হতে পারতাম তাহলে এতক্ষণ পৌঁছে যেতাম। তাছাড়া ওই সাহেব আজকে আর যেতে পারবেন না।

কোন্ সাহেব? ওয়াংদের কথাটা ধরতে পারল না আনন্দ।

যে সাহেব আমার সঙ্গে হাঁটছিলেন। পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন। জোর কপাল নইলে খাদে চলে যেত শরীর। পায়ে চোট লেগেছে। আমি এতক্ষণ সাহেবের পা ম্যাসেজ করছিলাম।

আনন্দ দেখল কল্যাণ এগিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। সুদীপের খবরটায় যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল সেটা আচমকা থিতিয়ে গেল। জয়িতাও কল্যাণের পেছনে হাঁটছিল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল আর চলা সম্ভব নয় অথচ খবরটা শোনামাত্র শরীরের ক্লান্তি চাপা পড়ে গেল। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জয়িতা সতর্ক করার জন্যে বলল, কল্যাণ, বাঁ দিক ঘেঁষে হাঁট।

কল্যাণ কি বলল বোঝা গেল না। কিন্তু জয়িতা চিৎকার শুনতে পেল ওর। সুদীপের নাম ধরে তিনবার ডাকল কল্যাণ। অনেকগুলো সুদীপ ছড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে পাহাড়ে পাহাড়ে। সেটা মিলিয়ে গেলে সুদীপের গলা পাওয়া গেল। সেটা লক্ষ্য করে খানিকটা খাড়াই পথ ভাঙার পর ওরা সুদীপকে দেখতে পেল। রাস্তার পাশে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে। ওর দুটো পা সামনের দিকে ছড়ানো। কল্যাণ বাকি অংশটুকু কোন রকমে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

খাদটা কেমন দেখা হল না। পড়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু পড়লাম না। সুদীপ হাসল।

ইয়ার্কি রাখ তো! কোথায় লেগেছে তোর? কল্যাণ ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসল।

গোড়ালিতে। সিরিয়াস কিছু নয়। ভাঙলে তো মালুম হত।

তোকে আমি বিশ্বাস করি না। নিজেকে নিয়েও তুই ঠাট্টা করতে পারিস। উঠে দাঁড়া।

কেন?

আমি দেখতে চাই তোর পা কতটা জখম।

তুই দেখতে চাস? থ্যাঙ্কস। আমি বলছি তো গোড়ালিটাই একটু মচকেছে। ব্যান্ডেজ বাঁধলে ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় আমি পা বের করতে পারব না। নো, নেভার।

জয়িতা ওদের কথা শুনছিল। কল্যাণের এই উত্তাপ ওকে চমৎকৃত করছিল। কোন্ কল্যাণ সত্য এইটেই অবশ্য তার মাথায় ঢুকছিল না। কল্যাণ তার এক হাতে ততক্ষণে সুদীপকে দাঁড় করিয়েছে। ডান পায়ের ওপর ভর রেখে দাঁড়িয়েছে সুদীপ কল্যাণকে ধরে। বাঁ পা সে তুলে রেখেছে খানিকটা ওপরে। তারপর ধীরে ধীরে পায়ের পাতা মাটিতে রেখে চাপ দিল। ওর মুখের দিকে তাকাল জয়িতা অভ্যেসে। চোখ এবং নাক ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গোড়ালি মাটিতে রাখতে গিয়েই সরিয়ে নিল সুদীপ। শব্দ করে হাসল, ভোগাবে বলে মনে হচ্ছে। লিডার কোথায়?

আনন্দ আর ওয়াংদে এসে পড়ল তখনই। আনন্দ সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, পড়লি কি করে?

পেছল ছিল, বুঝতে পারিনি। গোড়ালিটাকে একটু রেস্ট দেওয়া দরকার। সুদীপ পায়ের পাতা নামাল।

ব্যথা আছে?

চাপ দিলে লাগছে।

আনন্দ ওয়াংদেকে বলল, কি করা যায়? আমাদের এখানেই থাকতে হবে, তবু কোথায় টাঙাবে? ওয়ংদে মুখ ঘুরিয়ে যেন পাহাড়টাকে জরিপ করল। তারপর বোঝাগুলো নামিয়ে দ্রুতপায়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

জয়িতা আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে তাঁবু ফেলে থাকা যাবে? রাত্রে তো আরও ঠাণ্ডা বাড়বে।

সুদীপ হাসল, লাস্ট নাইট টুগেদার।

আনন্দ মাথা নাড়ল, আমি তো কিছু ভেবে পাচ্ছি না। এনিওয়ে আমি চাইছিলাম না ফালুটের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে থাকতে। ওখানেও আমাদের টেন্ট ফেলতেই হত। আর সেটা ওয়াংদের কাছে যুক্তিপূর্ণ বলে নিশ্চয়ই মনে হত না। সুদীপের পায়ে চোট না লাগলেও এখানে থাকার জন্যে ওয়াংদেকে বলতেই হত।

ঠিক তখনই ওয়াংদে ফিরে এল প্রসন্ন মুখে। এসে জানাল পাশেই একটা চমৎকার থাকার ব্যবস্থা আছে। সাহেবরা ধীরে ধীরে উঠে গেলে সে মালপত্র নিয়ে যাবে। সকাল থেকে হাঁটার পথে ওরা দুটো গ্রামের পাশ কাটিয়ে এসেছে বটে কিন্তু এই নির্জন জায়গায় মনুষ্যবসতি আছে বলে কল্পনা করা যায় না। খবরটা কল্যাণকে খুশী করল। আর জয়িতা লক্ষ্য করল প্রাথমিক যে উত্তেজনা এবং উদ্বেগ কল্যাণকে সুদীপের কাছে ছুটিয়ে এনেছিল সেটা কেটে যাওয়ার পর ও আবার আগের মত শীতল হয়ে গিয়েছে সুদীপ সম্পর্কে।

জয়িতার কাঁধে হাত রেখে সুদীপ ওদের পেছন পেছন হাঁটছিল একটা পা আধা-ঝুলিয়ে, শুধু আঙুলের ডগায় যতটা ভার রাখা যায়। এতে ওর কষ্ট হচ্ছিল বেশ, গতিও কমে যাচ্ছিল। হঠাৎ সুদীপ বলল, তুই কাছে আসার পর যেন শরীরটা চাঙ্গা হয়ে গেল।

মানে? সুদীপের ভর রাখার জন্যেই জয়িতা তাকে প্রায় জড়িয়ে চলছিল।

মানুষের শরীরের উত্তাপ বোধহয় সবার সেরা। তোর মনে হচ্ছে না?

সুদীপের এই প্রশ্নটার কোন উত্তর দিতে পারল না জয়িতা। হঠাৎ ওর মনে হল এই মুহূর্তেও সে সুদীপের কাছে একটি মানুষমাত্র। মানুষী নয়। এবং কি আশ্চর্য, সে নিজেও তো মোটেই উত্তপ্ত হচ্ছে না।

ঠিক গুহা বলা চলে না, পাহাড়ের শরীরের কিছুটা অংশ ভেতরে ঢুকে থাকায় মাথার ওপর বেশ ছাদ হয়ে আছে, দুপাশে চমৎকার দেওয়াল। ওয়াংদে এটাকে আবিষ্কার করেছিল এর আগেই। অন্য শেরপাদের মুখ থেকে খবর পেয়ে আরও একবার সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচবার জন্যে কয়েকজন ট্রেকারকে এখানে নিয়ে এসেছিল। মাথার ওপর জল পড়বে না, তিনদিক থেকে হু হু হাওয়া ছোবল মারবে না, এরকম জায়গায় এর চেয়ে আর কি কাম্য হতে পারে? শেষ পনেরো ফুট উঠতে সুদীপের কষ্ট হয়েছে বেশ। ওয়াংদেও হাত লাগিয়েছিল।

দিনের আলো নিবে গেছে বেশ কিছুটা আগেই। এর মধ্যে কিছুটা কায়দা করা হয়েছে বয়ে আনা তবু দুটো দিয়ে। একটাতে পাথরের ওপর বিছিয়ে বসেছে ওরা গা ছড়িয়ে। অন্যটা দিয়ে আনন্দ আর ওয়াংদে অনেক চেষ্টার পর সামনের খোলা দিকটা ঢাকতে পেরেছে। এখনও হাওয়া ওই দিক দিয়ে বইছে না, তেমন জোর বইলে ওটা কতক্ষণ থাকবে বলা মুশকিল। কিন্তু এর ফলেই জায়গাটা বেশ ঘর ঘর হয়ে গিয়েছে। এটা স্যাতসেঁতে গন্ধ থাকলেও খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ানোর চাইতে হাজারগুণ ভাল।

সমস্ত পাহাড় জুড়ে গাছ আছে, সুতরাং কাঠের অভাব নেই। কিন্তু ভিজে ভিজে সেই কাঠ আগুনকে আর তোয়াক্কা করছে না। আনন্দ তাদের আস্তানার বাইরে দাঁড়িয়ে ওয়ংদের উদ্যম লক্ষ্য করছিল। অনেক চেষ্টার পর বেচারা কিছু কাঠ থেকে ধোঁয়া বের করতে পেরেছে মাত্র। কিন্তু দুপাশে দুটো পাথর রেখে সে অন্য কটে আনা কাঠগুলোকে সেঁকে নিচ্ছে যেমন করে এখনও শিককাবাব বানায়। সেই প্রবচন, যেখানেই ধোঁয়া সেখানেই আগুন এক্ষেত্রে সত্যি কিনা সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু লোকটার উদ্যম দেখে সত্যি অবাক হয়ে যাচ্ছিল আনন্দ। এতটা পথ হেঁটে এসেছে বোঝা কাঁধে চাপিয়ে, সবচেয়ে পরিশ্রান্ত হবার কথা ওরই। অথচ সামান্য ক টা টাকার জন্যে এখনও যে কাজ করে যাচ্ছে তাতে বিন্দুমাত্র আলস্য নেই।

কি তাড়াতাড়ি রাত হয়ে গেল, না?

আনন্দ মুখ ফিরিয়ে দেখল জয়িতা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা এমনিতেই বোগা, এখন যেন আরও রোগা দেখাচ্ছে অত গরম জামাকাপড়েও সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। আনন্দ ওর কাঁধে হাত রাখল, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, না? আসলে আমরা তো এই রকম পরিবেশে ঠিক অভ্যস্ত নই, তাই।

অভ্যস্ত হয়ে যাব ঠিক। ওয়াংদে কাঠ সেঁকছে এখনও?

গোটা রাত পড়ে আছে সামনে। ভেতরে কিরকম ঠাণ্ডা এখন?

একই রকম। শুধু হাওয়াটাই নেই। জয়িতা উত্তর দিয়ে চারপাশে তাকাল। শুধু কাঠ জ্বালানোর ছাড়া কোন শব্দ নেই, এমন নিস্তব্ধ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় করে। জয়িতার মনে হচ্ছিল বড় রকমের কিছু হবে বলেই এখন এই থম্ ধরা ভাব।

ওরা ভেতরে চলে এল। মোমবাতিটা স্থির হয়ে জ্বলছে পাথরের ওপরে। আর তাকে ঘিরে কিলবিল করছে অদ্ভুত সব পোকা। বোধহয় জীবনে প্রথমবার আলো দেখে বেরিয়ে এসেছে ফাটল থেকে। কল্যাণ তার বিছানায় সেঁধিয়ে পড়ে ছিল চুপচাপ। সুদীপ জুতো খুলে ফেলেছে। খুব সন্তর্পণে মোজা খোলার চেষ্টা করছিল, জয়িতা এগিয়ে গেল, তুই থাম, আমি খুলছি।

সুদীপ সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল পা এগিয়ে দিয়ে, সেবা পেতে আমার কোন আপত্তি নেই। কখনও পাইনি তো, তবে দেখি। খগেনবাবুর ছেলে করে দিস না।

খগেনবাবুর ছেলে জয়িতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করতেই কল্যাণ সশব্দে হেসে উঠল। সেটা সংক্রামিত হল আনন্দতেও। জয়ি চা খেপে গিয়ে বলল, তুই আগে রহস্যটা পরিষ্কার কর, না হলে আমি হাত দেব না।

কল্যাণ বলল, ওঃ মাঝে মাঝে সুদীপটা–। শোন, লোকে বলে বাপের নাম খগেন করে দিস না। আর ও বলল খগেনবাবু ছেলে করে দিস না। অর্থাৎ এমন ব্যথা দিস না যা ওকে বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়বে। কথাটা অন্যভাবে শুনলাম বলে হাসি পেল।

বাট হোয়াই খগেন বাবু? তার নামটা কেন ব্যবহার করা হয়? জয়িতা ঠোঁট কামড়াল।

তা আমি জানি না ভাই। চিরকাল শুনে এসেছি ওই নাম। হয়তো লোকটা খুব গবেট ছিল।

সুদীপ বলল, কিংবা অত্যন্ত শয়তান।

জয়িতা মাথা নাড়ল, এটা কোন জোকই নয় যে অমন হাসতে হবে। আর তুই তো তোর বাবার নাম ভুলতেই চাইছিলি সুদীপ। বেশ ফুলেছে।

শেষ দুটো শব্দ জয়িতা বলেছিল মোজা সরিয়ে। কিন্তু তার আগের কথাগুলো সুদীপকে মোটেই আহত করল না। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে বসে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, দূর! কিছুই হয়নি। আমরা তো বাজে এনেছি?

আনন্দ চটপট করে ওষুধের বাক্সটা খুলে ওপর থেকে ব্যান্ডেজ তুলে ছুঁড়ে দিল জয়িতাকে। যতটা সম্ভব কাছাকাছি ব্যান্ডেজ বাঁধল জয়িতা। আর তখনই তাঁবুর একটা দিক সন্তর্পণে সরিয়ে আগুন হাতে ঢুকল ওয়াংদে। এর মধ্যেই সে কাঠে আগুন ধরাতে পেরেছে। আস্তানার মুখের দিকে একটা ধার ঘেঁষে তিনটে ঘোট পাথরের খাঁজে সে জ্বলন্ত কাঠ রেখে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর আবার বেরিয়ে গেল বাইরে।

এখন বেশ আলো হয়ে গেছে ভেতরে। জয়িতা কাঠের কাছে এসে উবু হয়ে বসল। আনন্দ চাপা গলায় বলল, এই লোকটা এত করছে অথচ ওকে তো কালই কাটাতে হবে, কি বলে কাটাই সেটাই এখন ভাবতে হবে।

কল্যাণ বলল, কেন? কাটাবি কেন? ও না থাকলে এখানে আমরা মরে যাব।

আনন্দ গম্ভীর মুখে বলল, ও থাকলেই আমাদের মরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি

কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল। জয়িতা আনন্দকে বোঝার চেষ্টা করছিল। আনন্দ হাসল, কথাটা বোধহয় খুব উলটো শোনাচ্ছে কিন্তু ভেবে দ্যাখ ওয়াংদেকে না কাটালে আমরা এখান থেকে যেতে পারব না। ও যাদের সঙ্গে সঙ্গে আসে তারা সবাই বেরিয়ে আবার মানেভঞ্জনে ফিরে যায়। চারজন বাঙালি এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় থেকে যেতে চাইছে—ব্যাপারটা ওয়াংদের মাথায় কিছুতেই ঢুকবে না। সেটা খুব স্বাভাবিকও। ফলে ও ফিরে গিয়ে গল্পটাকে ছড়িয়ে দেবে দার্জিলিং পর্যন্ত। বস, আর দেখতে হবে না। এখানে আমরা একসঙ্গে প্রকৃতি আর পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতে পারব না।

কল্যাণ চুপচাপ শুনছিল, তাহলে?

আনন্দ বলল, ওয়াংদেকে ভুল বুঝিয়ে কাটাতে হবে। কিভাবে কাটাব সেটাই–।

আগে ভেবে আসা উচিত ছিল। আমরা মনে হচ্ছে ভুল জায়গায় এসেছি। কল্যাণ বলল।

মোটেই নয়। ম্যাপ বলছে আরও কিছুটা এগিয়ে বাঁ দিকে গেলেই নেপাল বর্ভাব। বর্ডার পার হলেই গ্রাম। সেখানে ভারতীয় পুলিশের কোন এক্তিয়ার নেই। আর পুলিশ বলতে তো এই ফালুটের ক্যাম্পের কয়েকজন। আমরা যদি আরও ভেতরে ঢুকে যাই তা হলে ভারতীয় পুলিশের নাগালেব বাইরে চলে যাব। অতএব জায়গা নির্বাচনে ভুল করিনি। আনন্দ প্রতিবাদ করল। ঠিক তখন আবার ওয়াংদে ঢুকল ভেতরে। ওর হাতে চায়ের মগ। প্রত্যেকের হাতে সেগুলোকে ধরিয়ে দিয়ে সে আবার বেরিয়ে গেল।

সুদীপ চুপচাপ শুনছিল পা ছড়িয়ে। চায়ের মগ হাতে নিয়ে বলল, আর একেই বলে আরাম!

জয়িতার মাথায় কিছুক্ষণ থেকেই একটা মতলব ঘুরছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে সে বলল, দুটো ব্যাপার করা যেতে পারে। কাল সকালে উঠে ওয়াংদের সঙ্গে একটা ঝগড়া এমনভাবে লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে যাতে ও নিজেই রেগেমেগে আমাদের ছেড়ে চলে যায়।

সুদীপ বলল, খুব সহজ হবে না। ও যদি কল্যাণ হত, তাই করতো। কিন্তু যার মুখে হাসি খোদাই হয়ে আছে সে ঝগড়া করলেও হাসবে।

কল্যাণ এবার আনন্দর দিকে তাকাল, শুনলি? এর মধ্যে আমি আসছি কি করে?

আনন্দ সত্যিই বিরক্ত গলায় বলল, আঃ সুদীপ! হ্যাঁ, জয়িতা তোর দ্বিতীয় ব্যাপারটা কি?

জয়িতা কাঁধ নাচাল, সোজা ব্যাপার। আমরা ওয়াংদেকে বলব ফালুটে যাওয়ার আগে একটা নেপালি গ্রাম দেখতে চাই। ওটা যদি ওর রুটের বাইরে হয় তা হলে চাইলে এক্সট্রা টাকা দেব। ও থাকলে সুবিধে এই যে পথ চিনতে সহজ হবে। বর্ডার পার হয়ে আমরা ওকে স্পষ্ট জানিয়ে দেব। ও ফিরে গিয়ে রিপোর্ট করলে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। পুলিশ তো ওখানে পৌঁছাতে পারবে না।

কল্যাণ বলল, চমৎকার। এটাই খুব ভাল প্ল্যান।

আনন্দ ঠিক বুঝতে পারছিল না। সে বলল, পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে ওয়াংদে কিভাবে রিঅ্যাক্ট করে তার ওপরে। পুলিশ হয় তো ওখানে যেতে পারবে না আইনত কিন্তু আমরাও তো আর কলকাতায় ফিরতে পারব না। ওরা তো সমসময় লক্ষ্য রাখবে আমরা কখন ফিরি। রাস্তা তো একটাই।

চা হয়েছিল বাইরে, কিন্তু এবার ওয়াংদে ভেতরে উনুন জ্বালাল। আজকের মেনুও খিচুড়ি। বোধহয় ওয়াংদে খিচুড়ি বানাতে স্পেশালিস্ট। ঠাণ্ডার দাঁত আরও ধারালো হচ্ছে। সেই সঙ্গে উঠে আসছে রাজ্যের পোকামাকড়। মোমবাতিটা ছোট হয়ে এলেও কাঠের আগুনের আলো আছে পর্যাপ্ত। আনন্দ ঘড়ি দেখল। কলকাতায় এখন সন্ধ্যে হব হব, অথচ এখানে মনে হচ্ছে মধ্যরাত। ওয়াংদে চাপা সুরে গান শুরু করল। নেপালী শব্দ কিন্তু সুরে হিন্দী ফিমের অবদান আছে। জয়িতা ওর পাশে বসে বলল, তুমি তো খুব সুন্দর গান করো। সঙ্গে সঙ্গে ওয়াংদে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল, মিঠো মিঠো ইয়াদ কিসকো, ঘড়ি ঘড়ি দিলমে আয়ো, ইন্দ্রানীকো ইয়ো রাত মা–। গেয়েই আচমকা চুপ করে হাসতে লাগল। আর তখনই দূরে কোথাও সেই জান্তব ডাকটা শুরু হল। গতরাত্রে ওরা এই ডাক শুনেছিল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল ওয়াংদে। তার মুখ চোখ উত্তেজিত। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে সে পাজা করে কাঠ এনে ফেলতে লাগল ভেতরে। জিনিসপত্র যা ছিল সব নিয়ে এল এক এক করে।

আনন্দ ওর উত্তেজনা দেখে জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

ওয়াংদে বলল, ওদের ধমক দিলে ভয় পায় ঠিকই কিন্তু কেউ কেউ তো না-ও পেতে পারে। মুশকিল হল, সারারাত জেগে বসে থাকতে হবে। ওরা দিন না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে নড়বে না। আগুন জ্বেলে রাখতে হবে সারারাত।

কল্যাণ জানতে চাইল জন্তুগুলো মানুষ খায় কিনা?

ওয়াংদে বলল, যে কোন জন্তুর চেয়ে মানুষের মাংসই তো সবচেয়ে খেতে ভাল।

ডাকগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ওয়াংদে তাঁবু দিয়ে তৈরি দরজার দুপাশে কাঠ জ্বালল। এই আগুন যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ ওদের সাহস হবে না। লোকটা সকালবেলায় খুব তাচ্ছিল্য করেছিল বটে কিন্তু এখন মোটেই তা মনে হচ্ছে না।

খিচুড়ি ফুটছে। তার গন্ধেই আরাম এবং ঘুম আসছিল। আর সেসব ছাপিয়ে আচমকা ভয় ওদের গ্রাস করল। ডাকটা এবার খুব কাছাকাছি। হয়তো মুখ বার করলেই মুখোমুখি হতে হবে।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ওয়াংদে, ওদের সংখ্যা কত?

ওয়াংদে বলল, এক ডজন, দুই ডজনও হতে পারে।

ওরা ঠিক করল ভয় পাওয়া নয়, ভয় দেখাতে হবে। সুদীপ উঠতে চাইছিল কিন্তু আনন্দ বাধা দিল। রিভলভারটা ঠিক করে ও জয়িতাকে বলল টর্চ নিতে।

তাঁবুর একটা পাশ সরিয়ে আনন্দ মাথা বের করতেই জন্তুগুলোকে দেখতে পেল। বাইরে ওয়াংদে যে আগুন জ্বেলেছিল তা নিবিয়ে আসেনি। যদিও তেজ নেই বললেই চলে তবু তারই আলোয় ওদের দেখা যাচ্ছিল। বেশ কিছুটা তফাতে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে বসে আছে বেশ কয়েকটা। ওদের দেখতে নেকড়ের মত কিন্তু আরও বীভৎস চেহারা। আনন্দকে দেখে যেটা উঠে দাঁড়াল তার দাঁতগুলো ওই আধা-অন্ধকারেও চকচক করছে। সঙ্গে সঙ্গে গোঁ গোঁ শব্দ শুরু হল। যেন সামনেই শিকার দেখতে পেয়ে খুব খুশী হয়েছে ওরা। আনন্দ একেবারে সামনেরটাকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল। টপ করে জন্তুটা পড়ে গেল মাটিতে। আর শব্দটা হাজারগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ে পাহাড়ে। চকিতে আর যারা ছিল তারা উধাও হয়ে গেল অন্ধকারে। জয়িতা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আলো জ্বালব?

আনন্দ বলল, না থাক। মনে হচ্ছে ধারে কাছে নেই।

তাঁবুটাকে আবার ঠিকঠাক করে ওরা ভেতরে আসতেই কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, দেখলি?

আনন্দ বলল, হ্যাঁ। মনে হচ্ছে নেকড়ে। বিগ সাইজ। একটা মরেছে। কিছুক্ষণ বিরক্ত করার সাহস পাবে না। আমাদের একসঙ্গে ঘুমালে চলবে না। ঘণ্টাতিনেক সবাইকে পাহারা দিতে হবে। জয়িতা সুদীপ আমি কল্যাণ। ঠিক আছে।

হঠাৎ প্রত্যেকের নজরে পড়ল ওয়াংদে আতঙ্কিত চোখে আনন্দর রিভলভারের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখে হাসি নেই। চোখাচোখি হতে মুখ নামিয়ে নিল ওয়াংদে। ওরাও এ নিয়ে আর কথা বলল না। বোঝাই যাচ্ছিল জন্তুটাকে মারা ওয়াংদে পছন্দ করেনি।

 

ভোরবেলায় পাহারায় ছিল কল্যাণ। আনন্দ যখন ওকে উঠিয়ে শুতে যায় তখন বাইরে একমাত্র বাতাসের ছাড়া কোন শব্দ নেই। কাঠের আগুন নিবে এসেছিল। কিন্তু কাঠকয়লার দপদপানি উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ঠিক তার পাশেই শুয়েছিল ওয়াংদে। বা হাতে রিভলভার ধরে বসে বসে ঢুলহিল কল্যাণ। হঠাৎ তাকিয়ে দেখল ওয়াংদে নেই। সে চারপাশে চোখ বোলাল। প্রথমে ভাবল ওয়াংদে হয়তো প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে গিয়েছে। প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর সে উঠল। ধীরে ধীরে তাঁবুর মুখ সরিয়ে দেখল অন্ধকার পাতলা হয়ে গিয়েছে। ওয়াংদের কোন চিহ্ন নেই। রিভলভার রেখে সে টর্চ জ্বালল। কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, এমন কি আনন্দ যে জন্তুটাকে মেরেছিল তাকেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বেশ নার্ভাস হয়ে সে সঙ্গীদের ঘুম ভাঙাল।

জয়িতাই আবিষ্কার করল ওয়াংদে চুপচাপ চলে গিয়েছে। কারণ তার সঙ্গে যে পুঁটলিটা এনেছিল সেটা নেই। ওরা ভেবে পাচ্ছিল না লোকটা কেন না বলে চলে গেল। গতরাত্রে আনন্দ গুলি করার পর থেকে লোকটা একটাও কথা বলেনি। খিচুড়ি রান্না করে সবাইকে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল। ওরা অনুমান করেছিল জন্তুটাকে গুলি করার সঙ্গে ওর এই মন খারাপ জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই কারণেই যে না বলে চলে যাবে তা অনুমানে ছিল না।

আলো ফুটলে আনন্দ আর জয়িতা তাঁবু সরিয়ে বেরিয়ে এল। সারারাতের জমা হিম এখন সর্বত্র। যেখানে জন্তুটা পড়েছিল সেখানে এখনও চাপ রক্ত। আর একটু এগোতে খানিকটা রক্তমাখা হাড় দেখতে পেল ওরা, অর্থাৎ মৃত সঙ্গীকে সাবাড় করেছে ওরা। জয়িতা কয়েকবার ওয়াংদের নাম ধরে ডাকল। লোকটা কি মানেভঞ্জনে ফিরে যাবে একা একা শুধু জন্তুটাকে মারা হয়েছে এই অপরাধে? তারপরেই মনে হল ও তো ফালুটেও যেতে পারে। এই রাস্তায় কেউ বন্দুক নিয়ে আসে না। ওদের চালচলন দেখে কি সন্দেহ হয়েছে ওয়াংদের? ও কি ফালুটের পুলিশফাঁড়িতে গিয়েছে খবর দিতে?

মিনিট দশেকের মধ্যে ওরা তৈরি হয়ে নিল। সুদীপের পায়ের ফোলা এখন কম। ভাঙেনি। তাতে সে নিশ্চিত। ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় জুতায় পা ঢোকানো সম্ভব হলে দেখা গেল সে গোড়ালি উঁচু করে চলতে পারছে। ওয়াংদে যে মাল বইছিল তা যতটা পারে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল ওরা। আপাতত যেটা অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে তা ফেলে যেতে হল। জয়িতা লক্ষ্য করল কল্যাণ তার ডান হাত কাজে লাগাচ্ছে। এখন যেন প্লাস্টারটাই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর ওরা দূরে কিছু বসতি দেখতে পেল। ওটাই যে ফালুট তাতে সন্দেহ নেই। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। ওরা আর একটু এগোতেই বাঁ দিকে একটা পায়ে চলা পথ পেয়ে গেল। ফালুটকে এড়াতে ওরা সেই পথ ধরল। বোঝা পিঠে নিয়ে ওদের হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল। রাস্তাটা সরু এবং পাহাড়ের শরীর ঘুরে ঘুরে এগিয়েছে। সুদীপ বারে বারে পিছিয়ে পড়ছিল। প্রায় ঘণ্টাতিনেক যাওয়ার পর যখন আবার কুয়াশা নেমে এল হু হু করে তখন ওরা একটা কাতরানি শুনতে পেল। পথের পাশের একটা পাথরের আড়ালে লোকটা শুয়ে আছে। বেশ বয়স্ক। দেহাতি নেপালি কিংবা লেপচা। ওদের দেখে অবাক হয়ে তাকাল।

আনন্দ তাকে হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

লোকটা উত্তর দিতে পারল না। শুধু ইঙ্গিতে দূরের পাহাড় দেখাল। জয়িতা আবিষ্কার করল লোকটার শরীর বেজায় গরম। অর্থাৎ জ্বর ওকে কাবু করেছে এবং একটি বিশাল গলগণ্ড রয়েছে ওর। ওরা দুজনে কোনমতে লোকটাকে তুলে ধরল। এই সকালে লোকটা এখানে কি করে এল বুঝতে পারছিল না ওরা। লোকটা ওদের কোন কথাই বুঝতে পারছে না মনে হল। কিন্তু আনন্দ আর জয়িতা যখন ওর দুটো হাত কাধে নিয়ে হাঁটা শুরু করল তখন ও যেন কৃতজ্ঞ হল। বারবার সামনের দিকে পথনির্দেশ করতে লাগল উত্তেজিত হয়ে।

সুদীপ যেন নিজের মনে বলল, ওর না আমাদের, কপালটা কার ভাল বুঝতে পারছি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *