1 of 2

২৯. ঘোড়ার নালের মত রাস্তাটায় বাঁক

ঘোড়ার নালের মত রাস্তাটায় বাঁক নিয়ে জিপটা দাঁড়াল পি ডবলু ডি বাংলোর সামনে। বৃষ্টির আড়াল ভেদ করে দৃষ্টি যাচ্ছিল না। বারংবার কাচ পরিষ্কার করেও আনন্দ আবছা দেখছিল। জিপটা দাঁড়িয়ে আছে অন্তত শখানেক গজ দূরে। কেউ নামছে না। হয়তো অতিরিক্ত ঠাণ্ডা আর বৃষ্টি ওদের ইতস্তত করাচ্ছে।

সুদীপ আনন্দর পেছনে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করছিল। জিজ্ঞাসা করল, পুলিসের গাড়ি বলে মনে হচ্ছে তোর? এখানকার পুলিশের গাড়ি কেমন তাও জানি না।

আনন্দ মাথা নাড়ল, কিছুই বুঝতে পারছি না।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কি করব এখন?

সুদীপ বলল, তৈরি হতে হবে। এতদুরে এসে আমরা ধরা দিতে পারি না। একটা জিপে পাহাড়ি রাস্তায় আর কটা পুলিশ থাকতে পারে। আমরা চার্জ করব।

জয়িতা লাফিয়ে নিচে নামল। তারপর আনন্দর বয়ে আনা ব্যাগটা সন্তর্পণে খুলতে লাগল। কল্যাণের চোয়াল শক্ত হল, আমাকে একটা গ্রেনেড দে, আমি বাঁ হাতে ছুঁড়তে পারব।

কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না। সুদীপ তার রিভলবারটা বের করল। এই মুহূর্তে ভেতরের শীত বাইরের ঠাণ্ডাটাকে যেন আচমকা সরিয়ে দিল। জানলা থেকে আর একবার চোখ সরিয়ে আনন্দ বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না সরাসরি সংঘর্ষে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। এখনও কেউ জিপ থেকে নামেনি। সংঘর্ষে গেলে কারও বুঝতে অসুবিধে হবে না আমরা এই অঞ্চলে এসেছি। ওরা আরও ফোর্স পাঠাবে। জায়গাটাকে ভাল করে চেনার আগেই আমাদের কোণঠাসা হতে হবে।

কল্যাণ ফিসফিস করে বলল, তুই কি করতে চাইছিস?

সংঘর্ষের চেয়ে পালানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

পালানো? এই রাত্রে? মানে রাত না হলেও অন্ধকার হয়ে এসেছে তো। তাছাড়া আবহাওয়া দেখতে পাচ্ছিস? এত ঠাণ্ডা বৃষ্টি আমি জীবনে দেখিনি। বাইরে বের হলেই মরে যাব। অসম্ভব। এই বৃষ্টিতে কোথায় পালাব? কল্যাণ আঁতকে উঠল।

জয়িতা চুপচাপ শুনছিল। তার একটা হাত বুকের ওপর দ্বিতীয়টা চিবুকে। কল্যাণের কথা শেষ হলে সে স্বাভাবিক গলায় বলল, পালিয়ে কি লাভ হবে আনন্দ? পুলিস তো বুঝে নেবে আমরা এই তল্লাটেই আছি। আমাদের যে মাল বইছে সে-ই তো বলবে। তাছাড়া আর একটা লোক এখানে আমাদের দেখেছে। ওরা বুঝবে আমরা একটু আগেই এখান থেকে পালিয়েছি। এই ওয়েদারে খুব বেশি দূরে আমরা যেতেও পারব না।

সুদীপ মাথা নাড়ল, ও ঠিকই বলছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা আপাতত আমাদের বাঁচাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছিস কিছু?

আনন্দ খানিকক্ষণ দেখার চেষ্টা করল। ঝাঁপসা থেকে আরও ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীটা। এখন তিন হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ছে না। ঠাণ্ডা বাড়ছে সেইসঙ্গে। সে হাল ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, অসম্ভব। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সাদা সাদা কিছু পড়ছে। বোধহয় তুষার।

তুষার? চিৎকার করে উঠল জয়িতা, রিয়েলি? সে ছুটে এল কাঁচের জানলার কাছে। তারপর এক হাতে আনন্দকে ঠেলে সরিয়ে মুখটা নিয়ে গেল কাচের কাছে। অনেক চেষ্টা করেও সে বাইরের পৃথিবীটাকে আবিষ্কার করতে পারল না। বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে সে ঘুরে দাঁড়াল, আমি তুষাব পড়া দেখব। এত গল্প পড়েছি যে আজ চোখে দেখতে না পেলেও! ও দরজার দিকে পা বাড়াল।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল কল্যাণ, এদিকের দরজা খুলিস না!

জয়িতা ওর দিকে হতাশ হয়ে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। কল্যাণ বিড়বিড় করল, একেই শালা হু হু করে হাওয়া ঢুকছে তার ওপর উনি চলছেন সামনের দরজা খুলতে। প্রাণে যদি অত পুলক জাগে তো পেছনের দরজায় যাও।

কাঁধ নাচাল জয়িতা। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে পেছনের দিকে চলে এল। ভেজানো দরজাটা খুলতেই নাকে পোড়া গন্ধ এবং ঠাণ্ডা বাতাস লাগল। দরজাটা বন্ধ করে সে কয়েক পা এগোতে হিহি কাঁপুনি শরীর দখল করল। কিন্তু ততক্ষণে তার চোখ বিস্ফারিত। কড়াইতে খিচুড়ি শুকিয়ে পুড়ে প্রায় কয়লা হয়ে গেছে। এখন ওই পদার্থটি পৃথিবীর কোন প্রাণী মুখে তুলতে পারবে না। উনুনের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে ওয়াংদে। দেখলেই বোঝা যায় তার কোন ইশ নেই। মাথার পাশে দিশি মদের বোতলটা কাত হয়ে পড়ে, তাতে তলানিটুকুও নেই। জয়িতা একবার ভাবল ওকে ডাকবে। কিন্তু অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে তাতে কোন লাভ হবে না। সে ধীরে ধীরে বাইরের দিকে এগোল। এই দরজা থাকা না থাকা সমান। চিরুনির মত হাওয়া ঢুকছে ভেতরে। পেটে মদ এবং পাশে উনুন থাকায় লোটার ঠাণ্ডা লাগছে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে এখানে দাঁড়ানো অসম্ভব। জেদ চেপে গিয়েছিল যেন জয়িতার। বিদেশী অনেক উপন্যাসেই তুষার পড়ার কথা থাকে। কিন্তু আমাদের এই ভারতবর্ষে পাহাড়, বরফ, সমুদ্র, মরুভূমি থাকা সত্ত্বেও লেখকরা শুধু শহর অথবা সমতলের গ্রাম নিয়েই ব্যস্ত। আর একটু চোখ তুলে কারও তাকানোর অবকাশ হয় না। অবশ্য জয়িতায় বাংলা পড়া খুব বেশি নয়। কিন্তু বিদেশী উপন্যাস তাকে তাড়িয়ে নিয়ে এল বাইরে। আর দরজা খুলেই সে হতভম্ব হয়ে গেল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে অদ্ভুত ব্যাপার, এতক্ষণ পাওয়া বৃষ্টির শব্দটা এখন শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু হাওয়ার দাপট বেড়েছে। সুঁচ লাগানো চাবুকের মত হাওয়া এসে আঘাত করল ওর মুখে। যন্ত্রণায় সে প্রায় লাফিয়ে ঘরে ফিরে এল। দরজাটা বন্ধ করতে করতে মনে হল হাত এবং মুখে কোন সাড়া নেই। টলতে টলতে সে উনুনের মধ্যে ঢুকে পড়ল যেন। কাঠ শেষ হয়ে আসায় আগুন নেই কিন্তু উত্তাপ আছে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর তার শরীরে রক্ত স্বাভাবিক হল। সে তাকিয়ে দেখল আর কাঠ আছে কিনা। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও চোখে পড়ল না। ভেতরের ঘরের দরজা বন্ধ করে সে বন্ধুদের দিকে তাকাল, শুয়ে পড়। পুলিসের বাবার সাধ্য নেই এই অবস্থায় এখানে হেঁটে আসে। তবে আজ রাত্রে কারও ভাগ্যে খাওয়া জুটবে না। খিচুড়ি পোড়া কয়লা হয়ে গেছে আর আমাদের ঠাকুর মাল খেয়ে বেহুঁশ। লোকটাকে দেখে আয়, কি আরামে আছে এখন, ঠাণ্ডা-ফাণ্ডা টেরই পাচ্ছে না।

সুদীপ কথাটা শোনামাত্র উঠে দাঁড়াল, সেকি? সত্যি বলছিস?

জয়িতা ওর দিকে একবার উপেক্ষার দৃষ্টিতে তাকাল! তারপর আনন্দকে বলল, একটা রাত না খেয়ে কাটালে কিছুই হবে না, কি বলিস!

কথাটা শেষ হওয়ামাত্র সুদীপ বেরিয়ে গেল। তারপর ঠিক তীরের মত ছিটকে এল ঘরে, বাপস কি ঠাণ্ডা! এখন কি হবে? ও তো আজ রাত্রে উঠে দাঁড়াতেও পারবে না। আমি যদি তখন মদ খেতে নিষেধ করতাম!

কল্যাণ বলল, আমার খুব খিদে পেয়েছে। না খেলে ঘুমই আসবে না।

সুদীপ হাসল, তুই বরং এক কাজ কর। ধরা দিলে পুলিশরা নিশ্চয়ই খাওয়াবে। ওদের কাছে নিশ্চয়ই খাবার-দাবার আছে।

আনন্দ কোন কথা না বলে আবার জানলায় ফিরে গেল। একটু একটু করে আলো ফুটছে। তীব্র হাওযা এভারেস্টের মাথা থেকে নেমে আসা মেঘগুলোকে দার্জিলিং-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটু আগে যে ঘন অন্ধকার নেমেছিল তা চটপট সরে যাচ্ছে। কিন্তু আর একটা বিস্ময়! সান্দাকফুর দৃশ্যমান অংশে সাদা তুষারের চাদর পড়ে আছে এখন। পেঁজা তুলোর মত তুষার পড়ছে এখানে। এবার জিপটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল সে। ওর গায়েতেও সাদাটে ভাব। অনেকটা আলো ফোঁটার পর সান্দাকফু যেন ছবি হয়ে গেল। আনন্দ মুখ না ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, জয়িতা, তুই তুষার দেখতে পেয়েছিস? হতাশ গলায় উত্তরটা জয়িতা জানাতেই সে ডাকল, চটপট চলে আয়।

শুধু জয়িতা নয়, সুদীপের সঙ্গে কল্যাণ পর্যন্ত আনন্দর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল যেন। সুদীপ বলল, গ্র্যান্ড! ভারতবর্ষে আছি বলে মনে হচ্ছে না।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, জিপটা থেকে কেউ নেমেছে?

এখনও নামেনি। এখন যেভাবে ওয়েদার ভাল হয়ে যাচ্ছে তাতে ওদের এখানে আসতে কোন অসুবিধে হবে না। অবশ্য এলে আমরা দেখতে পাব। আনন্দ জানাল। জয়িতা কোন কথা বলছিল না। সে মুগ্ধ হয়ে তুষার পড়া দেখছিল। ঠিক তখনই জিপের সামনের দরজা খুলে গেল! একটা লোক লাফিয়ে নেমে ছুটে গেল বাংলোর দিকে। লোকটার আপাদমস্তক মোড়া। আনন্দ নিচু গলায় ঘোষণা করল, লোকটা নিশ্চয়ই ড্রাইভার।

লোকটা যে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে তা বোঝা গেল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে সে আবার ফিরে গেল জিপের কাছে। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল এবং জিপটাও নড়ল না। আনন্দ বলল, ওরা জানে না যে চৌকিদার এখানে নেই। নিশ্চয়ই ওরা এবার দরজাটার তালা ভাঙার চেষ্টা করবে। আমি শুধু ভাবছি কটা লোক আছে গাড়িটায়? আর ঠিক তখনই জিপটা সামান্য ব্যাক করে এদিকে বাঁক নিল। দৃশ্যটা দেখা মাত্র ওরা উত্তেজিত হল। কল্যাণ ছুটে গিয়ে ব্যাগ থেকে একটা গ্রেনেড তুলে নিল। আনন্দ ইশারায় ওকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করল। জিপটা এবার চোখের আড়ালে চলে গেল। ওপাশে ডি আই বাংলো রয়েছে। যদি পুলিশ হয় তাহলে ওখানে গেলে নির্ঘাত খুঁজে বের করবে তাদের হদিশ। আনন্দ ঠিক করল ইয়ুথ হোস্টেলের দরজার কাছে এসে জিপ থেকে পুলিশগুলো নামমাত্র চার্জ করবে। সিদ্ধান্তটা বন্ধুদের জানাল সে। গাড়ি থেকে নামার আগে পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে। ওরা যদি ডি আই বাংলোয় থেকে যায় তত মন্দের ভাল।

মন্দের ভাল শব্দ দুটো পছন্দ হচ্ছিল না সুদীপের। কারণ ডি আই বাংলোর ওপাশে ঠিক কি হচ্ছে তা এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। এমনও হতে পারে আপাতত যেটাকে ভাল মনে হচ্ছে আনন্দর সেটা একটা বিরাট মন্দের প্রস্তুতি। ওরা যদি ডি আই বাংলোতে গিয়ে খবরাখবর নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পায়ে হেঁটে এখানে আসে? নিজেকে ওই দলের অফিসার-ইন-চার্জ হিসেবে ভাবলে তো সে এই রকমই করত। গাড়ি নিয়ে কেউ সশস্ত্র শত্রুর মোকাবিলা করতে আসে না। সময় যাচ্ছে। এখন ক্রমশ ঠিকঠাক সন্ধ্যে এগিয়ে আসার কথা কিন্তু আলো আরও স্পষ্ট হচ্ছে। সুদীপ আর ধৈর্য রাখতে পারছিল না। ব্যাগের ওপর রাখা কানঢাকা উইন্ড চিটারটা তুলে নিয়ে দ্রুত পরে ফেলতেই জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছিস?

বাইরে। সুদীপ গ্রেনেড এবং রিভলবারটা সঙ্গে রাখল। তারপর আনন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি একটু ঘুরে আসছি।

আনন্দর কিছু বলার আগেই কল্যাণের ঠাণ্ডা গলা শোনা গেল, না! তুই যাবি না।

সুদীপ অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। যদিও সে কোন শব্দ উচ্চারণ করল না কিন্তু মুখচোখে প্রশ্নটা স্পষ্ট। কল্যাণ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আমরা চারজনেই একসঙ্গে এই ঘরে থাকব।

বাট হোয়াই? সুদীপ অবাক শুধু কল্যাণের কথায় নয়, তার বলার ধরনেও।

তাই কথা ছিল। কল্যাণ চোখে চোখ রাখতে চাইছিল না।

আমি বুঝতে পারছি না তুই কি বলতে চাইছিস! আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?

আমি জানি না। কিন্তু পুলিশ অ্যাটাক করলে তুই সেটা পারিস বাইরে গেলে, আমরা পারব না। একসঙ্গে মুখোমুখি হওয়া ভাল। কল্যাণ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল। হঠাৎ মনে হল সান্দাকফুর শীতল অপরাহে যে ঠাণ্ডা বাতাস সমস্ত উপত্যকায় বয়ে যাচ্ছে তার থেকে বহুগুণ শীতলতম অনুভূতি ওই শব্দগুলো থেকে ছিটকে এল।

ওঃ গড! ইউ ডোন্ট বিলিভ মি কল্যাণ। সুদীপের গলা থেকে একটা কাতর শব্দ বেরিয়ে এল। কল্যাণ কোন উত্তর দিল না। চুপচাপ ভাল হাতটায় গ্রেনেড নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। তোরা? তোদেরও কি একই ধারণা? সুদীপ আনন্দর দিকে তাকাল। আনন্দ হাসল। তার চোখ কল্যাণের ওপর ঘোরাফেরা করছিল। তারপর ধীরে ধীরে সে ওর কাছে এগিয়ে গেল, আমি বুঝতে পারছি না তুই এত নার্ভাস হয়ে পড়েছিস কেন?

নার্ভাস! কল্যাণ কাঁধ ঝাঁকাল।

অবশ্যই নার্ভাস। খুব ভয় পেলে মানুষ অনেক সময় নিজেকেও অবিশ্বাস করে। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই তুই সুদীপের সঙ্গে এই ধরনের—! দ্যাখ কল্যাণ, কেউ যদি পালাতে চায় তো তাকে আমরা ধরে রাখতে পারব না। আমি এখনও বলছি, ওয়েলকাম! সে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারে। আমরা ধরে নেব যে-কটা বাধা আমরা পেরিয়েছি সে-কটাই তার নার্ভের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সান্দাকফু ছাড়াবার পর আর কোন সুযোগ কেউ পাবে না। কল্যাণ, তুই যদি ফিরে যেতে চাস তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই। কথাটা শেষ করে আনন্দ ইঙ্গিত করল জয়িতাকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে।

কল্যাণের মুখ অন্যরকম হয়ে গেল, আমাকে চলে যেতে বলছিস কেন? হাসল কল্যাণ, চলে আমি যাবই বা কোথায়! সবকটা দরজা তো জেলখানার দিকেই শেষ হয়েছে। আমি ভয় পাই না নিজের জনন্য আনন্দ, কিন্তু ওদের ওই ক্লাসটাকে আমি বিশ্বাস করি না। এবার সোজাসুজি সুদীপের দিকে তাকাল কল্যাণ।

আমাকে তুই বিশ্বাস করিস না? সুদীপ তখনও স্বাভাবিক হতে পারছিল না।

তোকে নয়, যে ক্লাস থেকে তুই এসেছিস সেই ক্লাসটাকে।

সুদীপ এগিয়ে এল কল্যাণের সামনে, এখানে আমি একাই আছি। অ্যান্ড লিন, আমি কোন ক্লাসের প্রতিনিধি হয়ে এখানে আসিনি। আর তাই যদি বলিস, বিখ্যাত সব মানুষ চিরকাল বলে গেছেন মধ্য বা নিম্নবিত্তরাই চিরকাল সুবিধেবাদী। তুই নিজে যে ক্লাস থেকে এসেছিস সেই ক্লাসটার কথা আগে চিন্তা কর। তুই সুবিধেবাদী নস?

আমি? হ্যাঁ, সুবিধে পেলে কে না ছাড়ে বল।

সুদীপ ঝুঁকে কল্যাণের প্লাস্টার করা হাতটা খপ করে ধরল, আমাকে বিশ্বাস করার দরকার নেই, আনন্দকে করতে হবে। সেটাই ঠিক হয়েছিল কলকাতায়। নইলে আমি তোকে বিব্রত করব। ও কে। সুদীপ সোজা হয়ে দাঁড়াল। কল্যাণের প্লাস্টারের রঙ এর মধ্যে বেশ নোংরা হয়ে গেছে। সুদীপ সেদিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ওটাকে আর বয়ে বেড়িয়ে কি লাভ! আনন্দ, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরছি। অবশ্য ততক্ষণ যদি বাইরে থাকা যায়। আমার মনে হয় ওরা জিপ নিয়ে আসবে না। সাবধানে থাকবি।

গ্লাভস দুটো হাতে গলিয়ে ও পেছনের দরজা খুলে হাঁটতে হাঁটতে দেখল ওয়াংদে তখনও পড়ে আছে। লোকটার নেশা না ভাঙানোই ভাল। সে দ্বিতীয় দরজাটা খুলতেই সোঁ সোঁ হাওয়ার অস্তিত্ব টের পেল। একটু সময় নিল সে। ঠাণ্ডাটা সইবার অবস্থায় এলে সে চটপট বাইরে বেরিয়ে এল। এই দিকটা সান্দাকফুর বাংলোগুলোর উলটো দিকে। ওপাশ থেকে কারও নজরে আসবে না। সুদীপ দৌড়ে যেতে গিয়ে পিছলে পড়তে পড়তে কোনরকমে সামলে নিল। জুতোর তলায় চকচকে বরফ ঝরা কাচের মত ছড়ানো। শ্যাওলা পড়া উঠোনের চেয়েও পিছল। একটু ঝুঁকে সে এক টুকরো বরফ তুলে নিল। এখনও পাতলা, ফিনফিনে। সে চারপাশে তাকাল। একটা পায়ে চলা পথ রয়েছে নিচে যাওয়ার। ওপাশে আর একটা চলে গেছে যেটা দিয়ে গেলেই সবার সামনে প্রকাশিত হতে হবে। প্রকাশিত শব্দটা নিয়ে খেলল সে মনে মনে। এখন হিমালয়ের সব মুখ ঘোমটার আড়ালে। এমন কি কাছাকাছি পাহাড়গুলোতেও গাঢ় কুয়াশা নেমে পড়েছে। হয়তো আরও কিছুক্ষণ পরে পায়ের তলার সব ঘাস বরফের আড়ালে চলে যাবে। এরকম একটা অপ্রকাশিত প্রকৃতিতে কল্যাণ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এমন ভাবে যে বুকের মধ্যে এখনও পাথরটা চেপে রয়েছে। জয়িতা ভাঙতে চায়নি, কিন্তু যেটুকু ইঙ্গিত পেয়েছিল তাতে সুদীপের মনে হয়েছে কল্যাণের হাতে মারাত্মক কিছু হয়নি। যা হয়েছে তা ভাল করে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধলেই চলে যেত। হাড়ে একটু চাপ আর কয়েকটা লিগামেন্ট ছেড়ার জন্যে যদি কল্যাণ জোর করে ডাক্তারকে দিয়ে প্লাস্টার করিয়ে নেয় তাহলে অনেক সুবিধে। ডাক্তার কি বলেছিল তা রামানন্দ রায় এবং কল্যাণ ছাড়া কেউ জানে না। রামানন্দ মেয়েকে কতটা কি বলেছেন সেটা জয়িতা হয়তো ভদ্রতায় বলবে না। কিন্তু অত তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেল, কল্যাণও আর হাতের ব্যথার কথা বলল না, ব্যাপারটায় খটকা লাগে। তখন তো যে কোন মুহূর্তে পুলিশের খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। হাতে প্লাস্টার থাকায় নিশ্চয়ই কল্যাণ খানিকটা সুবিধে পেত। তাছাড়া তারপর থেকে তো ওকে কোন ঝুঁকিতে যেতে হচ্ছে না। সুদীপ চোখ বন্ধ করল। সে কি খুব ছোট হয়ে যাচ্ছে? হিমালয়ের এত ওপরে এসে এইরকম চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্যে কি এক ধরনের নীচতা কাজ করে না?

যেন ব্যাপারটাকে ঝেড়ে ফেলার জন্যেই সুদীপ একটা সিগারেট ধরাল। কল্যাণ যতক্ষণ সরাসরি বিপদ না ডেকে আনছে ততক্ষণ ওকে বন্ধু ভাবাই ভাল। কিন্তু এদিকে সময় বেশী নেই। বড় জোর মিনিট তিরিশের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে। সুদীপ হাঁটা শুরু করল। যতটা পারে ঝোপঝাড়ের আড়াল ব্যবহার করতে লাগল সে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর পি ডর ডি বাংলোটা নজরে পড়ল। এখন অদ্ভুত মায়াবী এক আলো নেমেছে পৃথিবীতে। বিষণ্ণ শব্দটার শুরুতেও যদিও বিষ তবু তাতে জ্বালা থাকে না। এই আলোয় মন আরও বিষণ্ণ হয়ে যায়।

মিনিট তিনেক হাঁটার পর ও ডি আই বাংলোর সামনেটা দেখতে পেল। সবকটা দরজা বন্ধ। ওখানে কোন মানুষ আছে কিনা বোঝা অসম্ভব। সেটা অবশ্য ইয়ুথ হোস্টেলের দিকে তাকালেও মনে হবে। সতর্ক ভঙ্গিতে সে আরও একটু এগোতে বাংলোর পেছনদিকটা নজরে এল। জিপ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত শখানেক গজ দূরে রয়েছে বাংলো। কেউ যদি খুঁটিয়ে না দেখে তাহলে সুদীপকে আবিষ্কার করতে পারবে না। অন্তত চলিশ গজ ফাঁকা জায়গা পার হলে একটা বড় পাথরের আড়াল পাওয়া যাবে। কিন্তু বাইরে যখন কেউ নেই তখন এই সুযোগটা নেওয়াই ভাল। সুদীপ দৌড়োল। দু-তিনবার পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে সে পেীছে গেল পাথরটার আড়ালে। এইটুকু দৌড়তেই নিঃশ্বাস দ্রুত হয়েছে। নাক মুখ দিয়ে বাষ্প বের হচ্ছে। শালা সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেব—মনে মনে আর একবার উচ্চারণ করল সে। তারপর একটু স্থির হয়ে বাংলোটার দিকে তাকাল। আর তখনই এপাশের দরজাটা খুলে গেল। আপাদমস্তক ওভারকোটে মুড়ি দিয়ে একটি লোক বেরিয়ে এল। লোকটার দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ বলে দেয় স্বাস্থ্য ভাল। হাঁটার ভঙ্গিতে হুকুম করার চরিত্র আছে। লোকটার পিছু পিছু আর একজন বেরিয়ে এল। এই লোকটাই ড্রাইভার। তার হাতে লোহার শিক গোছের কিছু। ওরা পি ডর ডি বাংলোর দিকে হাঁটছিল। সুদীপ চোখ রাখল। খানিকটা ওপরে উঠে লোক দুটো সুন্দর বাংলোর দরজায় পৌঁছে গেল। ওরা তালা ভাঙছে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর লোকটা সফল হল। তারপর দুজনেই ভেতরে ঢুকে গেল। সুদীপ ডি আই বাংলোর দিকে তাকাল। কেউ আসছে না ওখান থেকে। এবার জিপের দিকে ভাল করে তাকাতে সে শক্ত হল। এটার গায়ে সরকারি লেবেল লাগানো। ড্রাইভারটা দৌড়ে দৌড়ে ফিরে আসছিল। ওর গায়ে শীতবস্ত্র আছে ঠিকই তবে অন্য লোকটির মত নয়। ড্রাইভারটা এসেই জিপের পেছনের দিকের ঢাকনা খুলে ফেলে গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। একভাবে এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। সুদীপ, আবিষ্কার করল তার গায়েও সাদাটে ভাব এসেছে। তুষার পড়ছে সমানে।

এই সময় ড্রাইভারের সঙ্গে সেই লোকটা বেরিয়ে এল যার সঙ্গে ওয়াংদে কথা বলেছিল। ওদের দুজনের হাতেই চেলাকাঠের বোঝ। সেগুলোকে জিপের পেছনে ওরা তুলে দিল দুবারে। তারপর লোকটা ভেতরে চলে গেলে সুদীপ চমকিত হল। মেয়েদের পোশাক বুঝতে অসুবিধে হল না। মেয়ে দুটি লম্বা, শীতে অত্যন্ত কাবু বোঝা যাচ্ছিল। কোনরকমে দরজা থেকে বেরিয়ে এসে জিপে উঠে বসল। ড্রাইভার এবার গাড়িটাকে চালিয়ে নিয়ে গেল পি ডর ডি বাংলোর দরজার গায়ে। মেয়ে দুটো মুরগীর মত ছটফটিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। জিনিসপত্র ভেতরে চালান করে দিয়ে ড্রাইভার বোধ হয় হুকুমমত গাড়ি নিয়ে ফিরে এল ডি আই বাংলোতে। অর্থাৎ যারা এসেছে তারা ডি আই বাংলোতে থাকতে চায়নি। সুদীপ নিঃশ্বাস ফেলল। বহুৎ বরাতজোর থাকায় তারা পি ডর ডি বাংলোর দরজা খোলা পায়নি। কিন্তু একটা ব্যাপারে এখন নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, এরা পুলিশ নয়। অর্থাৎ আজকের রাতটা আরামে না হোক স্বস্তিতে কাটানোনা যাবে। এই সময় আর কোন মানুষের পক্ষে নীচ থেকে আসা সম্ভব নয়। সুদীপ এবার আড়াল ছাড়ল। তারপর খুব স্বাভাবিক পায়ে হেঁটে চলে এল ডি আই বাংলোর দরজায়। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কয়েকবার শব্দ করার পর ওয়াংদের পরিচিত লোকটা সেটা খুলল। কোন ভূমিকা না করে ভেতরে ঢুকল সুদীপ। মনে হচ্ছিল আর মিনিট পাঁচেক থাকলেই শরীর জমে যেত। লোকটাও সেটা বুঝতে পারল। দরজা ভেজিয়ে জিজ্ঞাসা করল হিন্দীতে, বলুন!

সুদীপ বোঝাবার চেষ্টা করল, আমরা আজ বিকেলেই এসেছি। ইয়ুথ হোস্টেলে আছি। কিন্তু ওয়াংদে, যে আমাদের সঙ্গে এসেছে সে নেশা করে পড়ে আছে। খাবার তৈরি করতে পারেনি। এখানে কি কিছু খাবার পাওয়া যাবে? আর আমাদের কিছু কাঠ চাই। ওখানে কাঠ নেই।

লোকটা মন দিয়ে শুনল। একটা কালি পড়া হ্যারিকেন জ্বলছে বাংলোয় আর যারা আছে তাদের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছিল না। শীত মানুষকে চিরকালই নিস্তব্ধ করে দেয়। লোকটা এবার জিজ্ঞাসা করল, সাহেবরা তো চারজন। আমি দশখানা রুটি আর সবজি দিতে পারি। কাঠ ও খাবারের জন্যে লাগবে কুড়ি টাকা আর দশ-তিরিশ টাকা, কাঠের জন্যে আরও দশ, মোট চল্লিশ। সাহেব রাজী?

সুদীপ যেন মুক্তি পেল। দ্রুত ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিক আছে। কিন্তু কতক্ষণ সময় লাগবে?

লোকটা হাসল। ওর মুখে দিশি মদের গন্ধ বের হচ্ছিল ভুরভুর করে। ড্রাইভারটাও ধারে কাছে নেই। হাসি নিয়েই লোকটা বলল, শিলিগুড়ি থেকে পুলিশের সাহেব এসেছেন একটু আগে। ওঁরা খাবেন ভেবে আটা মেখেছিলাম। পরে শুনলাম সাহেবরা খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ওটাই আপনাদের জন্যে করে দেব। আধা ঘণ্টা টাইম চাইছি। সাহেব চলে যান আমি পেীছে দেব। সাহো. র কি মদ চাই? দিশি বিলিতি দুই আমার কাছে আছে।

সুদীপ এক মুহূর্ত ভাবল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, বিলিতি কি আছে?

রম। ছোট বোতল আশি টাকা। সাহেবের চাই?

সুদীপ মাথা নাড়তেই লোকটা ভেতরে চলে গেল। এখানে টুরিস্টরা এলেই কি মদ খায়? ওর মনে হল মদ কিনে লোকটাকে পয়সা পাইয়ে দেওয়াটা ভালই হল। ও ওদের টুরিস্ট ভাববে। জিপটা তাহলে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে মহিলা রয়েছে যখন তখন নিশ্চয়ই অন ডিউটিতে নেই। মদের বোতলটা নিয়ে সুদীপ বলল, তুমি যখন খাবার দিতে যাবে তখন এর টাকাটা নিয়ে নিও। অবশ্য আমাকে যদি বিশ্বাস কর।

লোকটা হাসল, বিশ্বাস তো করতেই হয়। আমাকে টাকা না দিয়ে কেউই সান্দাকফু থেকে পালিয়ে যেতে পারে না। গণেশের কাছে আমি তিনশো টাকা পাই, টাকা দিচ্ছিল না, অসুখ হয়ে গেল। সাহেবরা কি এখানে এই প্রথম এলেন?

হ্যাঁ। ওই বাংলোটা কি খুব ভাল? তোমাদের পুলিশ সাহেব ওখানে চলে গেলেন তাই বলছি।

ওটা ইন্দিরা গান্ধীর জন্যে তৈরি হয়েছিল। যেসব সাহেব মেয়ে নিয়ে এখানে ফুর্তি করতে আসেন তারা সবাই চান ওই বাংলোয় থাকতে। ঠাণ্ডা ঢোকে না, ভাল ফায়ার প্লেস, নরম বিছানা—কত আরাম। এই সাহেব তালা ভেঙেও ঢুকে গেল সেই আরামের জন্যে।

সাহেবের সঙ্গে কারা এসেছেন?

এদের কি কোন পরিচয় থাকে সাহেব! কেউ ওদের পাঠিয়েছে, সাহেবকে আনন্দ দিতে। কারও কারও তো একজন মেয়ে পাশে থাকলে একা লাগে তাই দুজন এসেছে। কথাগুলো বলে হঠাৎ যেন সচেতন হল লোকটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, আমি কিন্তু এসব কথার একটাও বলিনি। কোথাও আমার এইসব কথা বললে আমি অস্বীকার করব। এই জন্যেই মা বলত ভগবান চোখ দিয়েছে দেখবার জন্যে, কান দিয়েছে শোনার জন্য, আর মুখ দিয়েছে খাবার জন্যে। কেন যে ভূলে যাইআফসোসের ভঙ্গিতে কয়েকবার মাথা নেড়ে লোকটা বলল, কথাটা যে কেন ভুলে যাই! ঠিক আছে, আমাকে দরজাটা বন্ধ করতে হবে। খাবার তৈরি করতে হবে। ঠিক আছে!

ইঙ্গিতটা বুঝেই বেরিয়ে এল সুদীপ। বাইরের আলো আরও মরে এসেছে। এখন প্রায় সন্ধ্যা। পৃথিবীর অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে দিনের চলে-যাওয়া এক পলক দেখল সুদীপ। এখন সেই তেজী বাতাসটা নেই। কিন্তু কাঁপুনি দেওয়া ঠাণ্ডা উঠে আসছে পৃথিবীর গভীর থেকে, আকাশের ছাদ গড়িয়ে। মদের বোতলটা হাতে নিয়ে দৌড়াল সুদীপ। এর মধ্যে পায়ের তলার তুষারগুলো বরফের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপে বিশেষ ধরন নেওয়ার পর আর পা পিছলে যাচ্ছে না। সে ক্রমশ উঠে এল পি ডর ডি বাংলোর দরজায়। পায়ের তলায় বরফ থাকলে কিভাবে দৌড়াতে হয় তার কায়দাটা আবিষ্কার করে সে আপ্লুত হল। তারপর সমস্ত উপত্যকার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঢালু হয়ে নিচে গড়িয়ে যাওয়া সান্দাকফুকে এই বিশেষ জায়গা থেকে এখন অপরূপ দেখাচ্ছিল। রাত আসছে নিচ থেকে কালো পোশাকে ঢাকা ডাইনির মত হামাগুড়ি দিয়ে। মাথা নাড়ল সুদীপ। ঠিক হল না। রাতকে কোন বাঙালি কবি কালো খামের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সান্দাকফু সেই খামের মধ্যে ঢুকে আছে।

রঙিন বাংলোটা পৃথিবীর সব নির্জনতা নিয়ে চুপচাপ। সুদীপ দরজাটার কাছ থেকে সরে এল। প্রতিটি জানলার ভেতরে ভারী পর্দা। তিনটে মানুষ ভেতরে আছে অথচ কোন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না, কোন শব্দও! প্রথম প্রথম সুদীপ সাবধান হবার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু তারপর মনে হল যে লোকটা এখানে মেয়েদের সঙ্গে আরাম করছে সে নিশ্চয়ই সতর্ক প্রহরী হবে না। বাড়িটার শরীর ধরে সুদীপ পেছনের দিকে চলে এল। মূল বাংলোর পেছনেই বোধ হয় চৌকিদার-এর থাকার জায়গা। সেটা মোটেই মজবুত নয়। কাঠের নড়বড়ে দরজাটায় একটা জোরে চাপ দিতেই খুলে গেল। ভেতরটা অন্ধকার। একটা স্যাতসেঁতে গন্ধ। মাথা ঢুকিয়েও ফিরে আসতে গিয়ে থমকে গেল সুদীপ। মানুষীর গলা কানে আসছে। বোধ হয় কয়েকটা বন্ধ দরজা পার হয়ে আসায় গলার শব্দ প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার অবস্থায়। কিন্তু দুটো হাসি একত্রিত হওয়ায় তাকে চিনতে অসুবিধে হল না।

তিনবার আছাড় খেয়ে সুদীপ ইয়ুথ হোস্টেলের দরজায় যখন ফিরে এল তখন তার শরীর প্রায় নীরক্ত। বোধ হয় জানলা দিয়ে নিয়ত লক্ষ্য রাখায় আনন্দ দরজা খুলেছিল। ওর ওপর নির্ভর করে সুদীপ ঘরে ফিরে এল। ফায়ারপ্লেসের আগুন নিবু নিবু, তবু তার ওপর হামলে পড়ল সুদীপ। জয়িতা ওর উইন্ডচিটারটা খুলে নিতে চাইছিল, এটা খোল। সাদা ভূত হয়ে গেছিস। কোন রকমে সেটা থেকে মুক্ত হয়ে হাত এবং মুখে রক্ত ফিরে পাওয়ার পর সুদীপ দেখল আনন্দ মদের বোতলটা চোখের সামনে তুলে দেখছে। আগুনের পাশে বসে পড়ে সুদীপ হাসল, ওটা চৌকিদারের কাছ থেকে কিনতে হয়েছে। লোকটার সঙ্গে ভাব জমছিল হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল। শোন, কোন পুলিশ আমাদের সন্ধানে আসেনি। ওই গাড়িটা একজন শৌখিন পুলিশ অফিসারের। তিনি দুজন উর্বশীর সঙ্গে এই বাংলোয় এসেছেন আরাম করতে। সুতরাং কল্যাণ, তোর এবার শান্ত হওয়া উচিত।

জয়িতা চাপা গলায় বলল, সুদীপ! ডোন্ট স্টার্ট দ্যাট। ও-কে!

কথাটা শোনার পর সব থেকে স্বস্তিতে এসেছিল কল্যাণ। এবং সুদীপের খোঁটাটা সে গায়ে মাখল। সে অনেকক্ষণ থেকে ট্রাঞ্জিস্টারে কান রাখছিল। এখনও কোন স্টেশন খোলেনি যার ভাষা সে চেনে। অদ্ভুত সব গলা আসছে কাঁটা ঘোরালে। হয়তো লাসা কিংবা পিকিং বা ওইরকম কোন রেডিও স্টেশন ধরা পড়ছে ওতে। সেটা দেখে কল্যাণকে আনন্দ বলল, তোকে বললাম কলকাতা এখান থেকে ধরা যাবে না। ব্যাটারি নষ্ট করছিস।

কল্যাণ বোধ হয় ইতিমধ্যেই বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। ট্রাঞ্জিস্টারকে সরিয়ে বলল, তোদের খিদে পায়নি?

জয়িতা বলল, পাচ্ছে, কিন্তু স্টকে হাত দেব কিনা ভাবছি।

সুদীপ বলল, একটু ওয়েট কর। খাবার আসছে।

কোত্থেকে? জয়িতা হাসল।

হাসি নয়, তোদের জন্যে আর কত করব বল! খাবার আসছে, কাঠ আসছে আগুন জ্বালার জন্যে। মোট একশ কুড়ি টাকা লাগবে। রেডি করে রাখ। লোকটাকে দরজা থেকে বিদায় করতে হবে।

চারজনের খাবারের দাম এখানে একশ কুড়ি? প্রায় চিৎকার করে উঠল কল্যাণ।

ওইটে সুদ্ধ। মদের বোতলটা দেখাল সুদীপ, যে লোকটার সঙ্গে ওয়াংদে কথা বলেছিল সেই দিয়ে যাবে। মিনিট দশেক অপেক্ষা কর।

জয়িতা ওর পাশে বসল, থ্যাঙ্কস। লোকটা অন্তত টাকার জন্যে আসবে, কি বল্? তুই কখনও মদ। খেয়েছিস সুদীপ?

মদ! হাসল সুদীপ, স্কুলের মেয়ের মত কথা বলিস না। একটু আগেও তো খেলাম।

ওঃ, ওই খাওয়ার কথা বলছি না। বেশ নেশা করার মতন খাওয়া, খেয়েছিস?

না। চান্স পাইনি বলব না, ইচ্ছে হয়নি।

সুদীপ কথা শেষ করামাত্র আনন্দ বলল, কারও যদি খুব ঠাণ্ডা লাগে তাহলে অল্প খেয়ে দেখতে পারিস। নেশা করার কথা মাথা থেকে তাড়া।

সুদীপ উঠল। ওয়াংদের রেখে দেওয়া জলের জাগ আর গেলাস নিল। মদের বোতলটা আনন্দ এগিয়ে দিতে সেটাকে একটু চেষ্টার পর খুলে ফেলল। তারপর গেলাসে ঢালতে গিয়ে থামল, ভারতবর্ষের জনসাধারণ যদি জানতে পারে চারটে ছেলেমেয়ে দেশের মানুষের যারা শত্রু, তাদের ধ্বংস করতে চেষ্টা করার পর মদ খেয়েছে তাহলে তারা কি ভাববে?

জয়িতা বলল, অর্ধেক মানুষ ছি ছি করবে আর অর্ধেক চুপ করে থাকবে।

আনন্দ বলল, এখানে কোন দর্শক নেই। তোর শীত করলে তুই খাবি। দ্যাটস অল।

সুদীপ ঘ্রাণ নিয়ে মুখ বিকৃত করল, কুৎসিত গন্ধ। খেলেই বমি হয়ে যাবে। স্টিল আই অ্যাম ট্রাইং।

জয়িতা বলল, যদি দুনম্বরী মাল হয়! সান্দাকফুতে বিষাক্ত মদ খেয়ে উগ্রপন্থীর মৃত্যু-খবরের কাগজে হেডিং হবে।

সুদীপ কোন কথা না বলে জল মিশিয়ে খানিকটা মুখে ঢালল। তারপর চোখ বন্ধ করে বলল, কান গরম হয়ে যাচ্ছে, বুক জ্বলে গেল। আঃ, বেশ আরাম লাগছে এখন। তোরা খেতে পারিস।

কল্যাণ খেল না। সে কারণ দেখাল তার ঠাণ্ডা লাগছে না। কিন্তু তার চোখ তিনজনের ওপর ঘুরছিল। ও বুঝতে চাইছিল কেউ মাতাল হচ্ছে কিনা। এমন সময় জয়িতা বলল, দূর? আমার যে একটুও নেশা হচ্ছে না। মনে হল ওষুধ খেয়ে গা গরম করলাম।

কল্যাণ খুব হতাশ হল। এবং তখন তার মনে হল একটু খেয়ে দেখলে হত! এখন আর চাওয়া যায়। কেন যে মাঝে মাঝে স্রোত থেকে সরে দাঁড়াবার ভূত চাপে মাথায়—! তখনই দরজায় শব্দ হল। সুদীপ উঠে সোজা পায়ে দরজা খুলে ভেতরের ঘরে চলে গেল। তারপর চিৎকার করল, আনন্দ, টাকাটা নিয়ে আয়।

শব্দটা শোনামাত্র টাকা বের করেছিল আনন্দ। মদ পেটে যাওয়ার পর সত্যি শীতটা উবে গেছে যেন। সে বেরিয়ে এসে ওয়াংদেকে একবার দেখল। তারপর দ্বিতীয় দরজার কাছে এসে টাকাটা এগিয়ে ধরল।

কাঠের বোঝা নামিয়ে খাবারের পাত্র হাত বদল করে লোকটা হাসল। একটাও কথা না বলে টাকাটা নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

সকালের জন্যে কিছু কাঠ রেখে ওরা ফিরে এল ঘরে। ফায়ারপ্লেসে কাঠ খুঁজে ব্লোয়ারটা ব্যবহার করার পর আগুন জ্বলল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে উত্তাপ এবং আলো উজ্জ্বল হল। ঠিক গুনে গুনে দশখানা রুটি। আর সবজি বলতে যে বস্তুটি তাতে আর যাই থাক কোন স্বাদ নেই। ওরা দুটোর বেশি রুটি গিলতে পারল না। ফায়ারপ্লেসের আগুনের সামনে বসে দুটো করে রুটি হাতে নিয়ে একই পাত্র থেকে সবজি তুলে খাচ্ছিল ওরা। কোথাও কোন শব্দ ছিল না এতক্ষণ। শুধু কাঠ ফাটছিল আগুনে। আনন্দ বলল, কিসের শব্দ হচ্ছে বল তো?

ওরা কান পাতল। দূর থেকে একটা ডাক ভেসে আসছে। প্রথমে কুকুরের চিৎকার বলে মনে হচ্ছিল। তারপর কুকুরের সঙ্গে পার্থক্যটা ধরা পড়ল। ডাকগুলো কাছে এসে থমকে গেল। না, কুকুর নয়। আরও ভয়ঙ্কর কিছু। এইসব জায়গায় শেয়াল হায়েনার আসার কথা নয়। এত উঁচুতে এবং ঠাণ্ডায় আসবে কি করে ওরা? হঠাৎ সুদীপের মনে পড়ল তুষার-নেকড়ের কথা। ওরা সেই হিংস্র তুষার-নেকড়ে নয় তো? সে উঠে দরজাটা বন্ধ আছে কিনা দেখতে গেল বাইরের ঘরে। দুটো দবজা দেখে ঘরে এসে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছুটে গেল এমন ভঙ্গিতে যে সঙ্গীরা চমকে উঠল। বিছানা থেকে ট্রাঞ্জিস্টারটা তুলে নিয়ে সে বোম টিপল। সঙ্গে সঙ্গে আকাশবাণী শিলিগুড়ির সংবাদ পাঠকের গলা ভেসে এল, মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন কেন্দ্র যদি রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তাহলে এরপরে তিনি জনসাধারণের সাহায্য চাইবেন।

প্রতিদিন যেসব বস্তাপচা সংবাদ পরিবেশিত হয় বিভিন্ন নেতার সংলাপ হিসেবে আজকের সংবাদে তার ব্যতিক্রম কিছু ছিল না।

চারজন উগ্রপন্থী সম্পর্কে আকাশবাণী নীরব রইল। অবশ্য কল্যাণ ভাবছিল যদি আগে থাকে, তখন ট্রানজিস্টার খোলা হয়নি। এবং তখনই নখের শব্দ পাওয়া গেল। কেউ বা কারা বাইরের দেওয়াল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *