1 of 2

২১. জয়িতা দরজায় দাঁড়িয়ে

জয়িতা দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, তোকে দেখে শরৎচন্দ্রের নায়কের কথা মনে আসছে।

ওরা যে কখন নিঃশব্দে ওপরে উঠে এসেছে টের পায়নি আনন্দ। সে সতরঞ্জিতে চিৎ হয়ে শুয়ে জানার দিকে তাকিয়েছিল। সেখান দিয়ে এক ফালি জ্যোৎস্না থিয়েটারের আলোর মত ঘরে ঢুকেছে। কথা শুনে সে উঠে বসে বলল, সেকি রে। তুই শরৎচন্দ্র পড়েছিস?

কিছু কিছু। সব ভাল লাগেনি। তুই আমাকে কি ভাবিস ব তো? প্যান্ট পরি বলে বাংলা সাহিত্য পড়ব না! যতসব অদ্ভুতুড়ে আইডিয়া। ঘরটা কিন্তু খারাপ নয়। হ্যাটস অফ টু সুদীপ! ঘরে ঢুকে সোজা জয়িতা চলে গেল জানলার কাছে, আরে ব্বাস! ওটা পুকুর নাকি রে! ফ্যান্টাস্টিক! জানলা দিয়ে পুকুর, এ তো রবীন্দ্রনাথের কবিতা।

আনন্দ বলল, জানলার সামনে দাঁড়ানো নিষেধ। দিনের বেলায় তো অবশ্য। আয় কল্যাণ। কল্যাণ চটি খুলে সতরঞ্জিতে বসতেই আনন্দ ওর হাতের রঙ সাদা এবং গলা থেকে কিছু ঝুলছে দেখতে পেল। সে জিজ্ঞাসা করল, হাড় ভেঙেছে?

ভাঙে নি, চিড় ধরেছে। কি ঝামেলা বল তো!

কোথায় নিয়ে গিয়েছিল তোকে, নার্সিং হোমে?

হ্যাঁ। রামানন্দ রায় লোকটা কিন্তু ভাল। বেশি কথা বলেন না যদিও তবু আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেছেন। ওঁর বন্ধুই ডাক্তার। তাকে বললেন বাথরুমে পড়ে গিয়ে এই অবস্থা। ভদ্রলোক সেটা বিশ্বাসও করলেন। রামানন্দ রায় আমাকে কোন প্রশ্ন করলেন না যাওয়া-আসার পথে। কল্যাণ জানাল, কিন্তু এই হাত নিয়ে কিছুই করতে পারছি না, কোন কাজে লাগব না–।

কল্যাণ! আনন্দ ওকে থামাল, তোর অবস্থা আমাদের যে কোন একজনের হতে পারত।

এই সময় সুদীপ উঠে এল। কল্যাণ যেখানে বসেছিল সেখান থেকে ছাদটা, পরিষ্কার জ্যোৎস্নায় মাখামাখি ছাদটাকে দেখতে কোন অসুবিধে হচ্ছিল না। সুদীপ সেই জ্যোৎস্না মাড়িয়ে এল। এসে বলল, বুড়ি আমাদের জন্যে রাত্রের রুটি করছে।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ওরা এসেছে বুড়ি জানেন?

সুদীপ বলল, জানতো না। আমিই বলে দিলাম। মায়ের ব্যাপারে অবনী তালুকদারের ওপর বুড়ির খুব রাগ ছিল! সেটাকেই ক্যাশ করলাম। বললাম মা মারা যাওয়ার পর বাবা বোধহয় আবার কিছু করবে তাই আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। আমার এই বন্ধুরা আমাকে এত ভালবাসে যে সঙ্গে এসেছে। আমি যে এসেছি তা বাবা জানলে আর রক্ষে থাকবে না। বুড়ি শুনে ক্ষেপে গেল খুব! বলল, কাকপক্ষী ছাড়া কেউ টের পাবে না। তবে বন্ধুদের বাড়িতে কি জানানো হয়েছে? আমি বলেছি ওরা সবাই হোস্টেলে থাকে।

আনন্দ হাসল, তোর কি মনে হয় বুড়ি এই গল্প বিশ্বাস করেছেন? আমি মনে করি না।

করুক বা না করুক যদি আমাদের তাড়িয়ে না দেয় তো ঠিক আছে। এই জয়ী, তুই ওই জানলার সামনে যাবি না। অসুবিধে আছে। সুদীপ জোর গলায় বলল।

শুনেছি। জয়িতা জবাব দিল কিন্তু সরলো না।

কি শুনেছিস? ওখানে দাঁড়ালে তোর চিত্ত চঞ্চল হবে। পুকুরের ধারে প্রেমের দৃশ্য দেখা যায়।

জয়িতা ঘুরে দাঁড়াল, তুই প্রেম বুঝিস?

তোর চেয়ে বেশি। তিন-তিনটে মেয়ে আমাকে প্রপোজ করেছে জানিস।

জয়িতা এবার সতরঞ্জিতে টান টান শুয়ে পড়ল, সত্যি, বাংলা দেশের মেয়েদের কি দুরবস্থা, তোকেও তারা প্রপোজ করে। আসলে সেইসব মেয়ে বোধহয় প্রেম করা ছাড়া কিছু জানে না।

কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল, তুই কখনও কোন ছেলেকে ভালবেসেছিস?

কেন বাসব না? তুই আনন্দ সুদীপকে তো ভালই বাসি। আজ আসবার সময় মনে হচ্ছিল রামানন্দ রায়কেও ভালবেসেছি। ভালবাসা এক কথা আর প্রেম আর এক জিনিস। তুই জিজ্ঞাসা কর আমি কারও প্রেমে পড়েছি কিনা? না পড়িনি। অবশ্য আমাকে মেয়ে বলে ছেলেরা চট করে ভাবতেও পারে না। আর কেন জানি না ভাই আমার সেই ফিলিংসটাই আজ অবধি এল না। সুদীপ, দৃশ্য দেখে চিত্তচঞ্চল হবে তোর, আমার নয়। শুয়ে শুয়েই সিগারেট ধরালো জয়িতা।

সুদীপ একটু উষ্ণ গলায় বলল, কথা শুনলে মাইরি অ্যালার্জি বের হয়। চিমটি না কেটে কথা বলতে পারিস না? তোর চুল ছাঁটল কে?

জয়িতা উঠে বসল, তোর প্যান্ট বানায় কে?

আনন্দ এবার হেসে উঠল, ঠিক আছে। আর নয়। আমার একটু সিরিয়াস কথা আছে।

সুদীপ একটু রাগত ভঙ্গিতে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে একপাশে রাখতে লাগল। ট্রাঞ্জিস্টারটার বোতাম টিপতেই চমৎকার শব্দ হল। তারপর ঘড়ি দেখে সেটাকে বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করল, মোমবাতি জ্বালাতে হবে? কারও এখন অসুবিধে হচ্ছে?

আনন্দ বলল, না। বেশ তো দেখতে পাচ্ছি। জয়িতা, আমরা সারাদিন এখানে, ওদিকে কোন নতুন খবর আছে?

জয়িতা বলল, আছে। সারাদিন আমি ফ্ল্যাট থেকে বের হইনি। বলতে গেলে টানা সাতঘণ্টা ঘুমিয়েছি। বিকেলে মা এসে বললেন, সারা কলকাতায় নাকি তোলপাড় হচ্ছে বড়বাজার নিয়ে। আমরা যাই বলি না কেন তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না ওরকম দুর্দান্ত ব্যাপার আমাদের পক্ষে করা সম্ভব। তার ধারণা আমি যা করছি তা চেপে যাচ্ছি। যাক, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার তোদের শুনে দরকার নেই।

এই সময় সুদীপ বলে উঠল, এখন থেকে আমাদের কারও কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার নেই।

আনন্দ চাপা গলায় বলল, আঃ সুদীপ। তারপর?

সুদীপকে একবার দেখে নিয়ে জয়িতা বলতে লাগল, বিকেলে বাবা বাড়িতে ফিরে এল। লালবাজার নাকি উঠে পড়ে লেগেছে আমাদের ধরবার জন্যে। ওর এক পুলিস অফিসার বন্ধু বলেছে যে তারা অপরাধীদের খোঁজ পেয়েছে। ধরতে পারলে একটা সংগঠিত উগ্রপন্থী দলের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া সম্ভব হবে। বাবা বলল যদি আমাদের সঙ্গে ওই ঘটনার কোন যোগাযোগ থাকে তাহলে অবিলম্বে সতর্ক হওয়া দরকার। আমার এক কাকা আছে চণ্ডীগড়ে। তার কাছে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিল বাবা। আমি জানালাম আমাদের ব্যবস্থা করাই আছে। আপাতত ঠিকানা জানাতে পারছি না। প্রয়োজন হলে জানাব। বাবা আমাদের এখানে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল আমি রাজী হইনি। কল্যাণকে নিয়ে যখন লিফটে নামছি তখন জানতাম না পুলিস অত তাড়াতাড়ি আমাদের ওখানে পৌঁছে যাবে। লিফট থেকে বের হতেই দেখলাম দুটো পুলিস-ভর্তি জিপ ঢুকল গেট দিয়ে। আমরা কোন রকমে ওদের কঁকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোদের কেউ ফলো করেনি?

না! সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত, তাই না কল্যাণ?

কল্যাণ বলল, হ্যাঁ। আমরা পৃথিবী ঘুরে এসেছি। প্রথমে ট্যাকসি নিয়ে গেছি যাদবপুর। সেখানে আর একটা ট্যাকসি নিয়ে যোধপুর পার্কের ভেতর দিয়ে লেক গার্ডেন্স হয়ে ফাঁড়ি পেরিয়ে এলাম। এত ঘুর পথে কেউ ফলো করলে দেখা যেতই। এখানে বাথরুম কোথায়? মানে টয়লেট?

সুদীপ হাসল, বাথরুম বললেই চলবে। আমাদের বাঙালিদের এইটেই অসুবিধে হয়। আয়।

ওরা বেরিয়ে গেলে আনন্দ জয়িতাকে বলল, সুদীপের কথায় কিছু মনে করিস না।

দূর! ওর কথার কোন দাম আছে নাকি! ফালতু বকে।

জয়িতা আজ থেকে আমাদের আর কোন নিশ্চিত জায়গা থাকল না। তোর মন পরিষ্কার তো? একশ ভাগ। নেক্সট অ্যাকশন কবে?

একটু সময় দে। একটু ভেবেচিন্তে করতে হবে। আগের দুটো উত্তেজনায় করে ফেলেছি। কোন ক্ষতি তেমনভাবে হয়নি বটে কিন্তু যে কোন মুহূর্তেই হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এই রিস্কটা আর নেওয়া চলবে না।

কিন্তু সময় দিলে যদি ওরা আমাদের ধরে ফেলে?

চান্স কম। আমরা যদি নতুন কোন ভুল না করি তাহলে ওদের অনেক সময় লাগবে।

জয়িতা কোন কথা বলল না। তার সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল। সে চারপাশে তাকিয়ে একটা অ্যাশট্রে খুঁজল। না পেয়ে কোণা থেকে একটা পুরোনো কৌটো টেনে এনে সেটাকেই অ্যাশট্রে বানাল। সুদীপরা ফিরে এল। কল্যাণ বলল, এই রকম জ্যোৎস্না অনেকদিন দেখিনি।

আনন্দ কথা শুরু করল, আমরা এই যে জায়গাটা পেয়েছি তা যে খুব নিরাপদ আমি মনে করি না। কিন্তু যদি আমরা সতর্ক হই তাহলে কিছুদিন থাকতে পারব। আমার প্রস্তাব, সুদীপ ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে যাবে না। দিনের বেলায় তো বটেই রাত্রেও ছাদে ঘোরাফেরা করা ঠিক হবে না। অন্তত দিন সাতেক স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে থাকতে হবে সবাইকে।

কেউ কোন কথা বলল না। আনন্দ আবার বলল, রেসকোর্সে অ্যাকশন করতে যাওয়া এই মুহূর্তে বোকামি হবে। তবে সুদীপ কাল রেসকোর্সের সেক্রেটারিকে টেলিফোন করে হুমকি দিবি। এবং সেই সঙ্গে খবরের কাগজগুলোকেও জানাবি। নেক্সট রেসের দিন তার কি প্রতিক্রিয়া হয় জেনে সেই বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিস আমার খবর পেয়েছে। আজ জয়িতার সন্ধান পেল। বুঝতে পারছি না সীতা রায় ওদের কি বলবেন! যদি সত্যি কথা বলেন তো ওদের উৎসাহ বেড়ে যাবে।

কল্যাণ বলল, সীতা রায় কিছু বলবেন না।

আনন্দ মাথা নাড়ল, শোন, এখন থেকে কোন অনুমানের ওপর চলবি না। না বলেন তো ভালই, বললে যা হবে তার জন্যে নিজেদের প্রটেক্ট করতে হবে। আপাতত আমরা এখানে থাকি। সুদীপ দ্যাখ কে আসছে!

শোনামাত্র সুদীপ চট করে দরজায় চলে এল। আনন্দ দেখল কল্যাণ এবং জয়িতা যতটা সম্ভব ভেতরে সরে যাচ্ছে। চেহারাটা স্পষ্ট হলে সে নিঃশ্বাস ফেলল। সন্তর্পণে বুড়ি এগিয়ে আসছেন। দরজার সামনে সুদীপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রায় ফিসফিসে গলায় প্রশ্ন করলেন, ওমা তোমরা এখানে ভূতের মতন বসে আছ? একটা হ্যারিকেন লাগবে বলনি কেন?

সুদীপ হাসার চেষ্টা করে সহজ গলায় বলল, আমাদের সঙ্গে মোমবাতি আছে, আপনি চিন্তা করবেন।

বুড়ি হাসলেন, কি ছেলেরে বাবা! বাপের ভয়ে বন্ধুদের নিয়ে অন্ধকারে বসে আছে! কিন্তু এবার আমাকে উদ্ধার করো। আমি নটার মধ্যে শুয়ে পড়ি। ঘুম আসে না তবু শুয়ে শুয়ে ঠাকুরের নাম জপি। খাবে চল।

সুদীপ বলল, এত তাড়াতাড়ি! দুপুরে এত খেয়েছি যে একটুও খিদে পাচ্ছে না। আচ্ছা ঠিক আছে! চলুন আমাদের রুটি তরকারি নিয়ে আসি ওপরে। আপনি কাজ শেষ করে শুয়ে পড়ুন, আমরা খিদে পেলে খেয়ে নেব।

বুড়ির কপালে ভাঁজ পড়ল। এতক্ষণ যে চাপা গলায় কথা বলছিলেন তা বিস্মৃত হলেন, আমার সমস্ত বাড়িটা সকড়ি করবে তোমরা?

সুদীপ দ্রুত মাথা নাড়ল, না না। খেয়েদেয়ে ভাল করে ধুয়ে দেব।

প্রস্তাবটা মনঃপূত হল না বুড়ির। এইসময় সুদীপ বলল, আর একটা কথা। কিছু টাকা রাখবেন আপনি? আমাদের জন্যে তো খরচ বাড়ছে।

একি কথা! ছি ছি ছি, কদিন এই গরিবের বাড়িতে আছ আর আমি হাত পেতে টাকা নেব? ইচ্ছে হলে আলু পটল কিনে এনো কিন্তু ওইটুকু ছেলের কাছ থেকে টাকা নিতে পারব না। ও হ্যাঁ, আমার এক ভাড়াটের বউ জিজ্ঞাসা করেছিল কারা এসেছে? বউটা নাকি তোমাদের জানলা দিয়ে দেখেছে। তা আমি বললাম আমার মামাতো ভাই-এর ছেলে আর তার বন্ধু। বউটার স্বভাবচরিত্র ভাল নয়, তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বলবে না। আমার বাড়িতে কে এসেছে তাতে তোর কি বাপু! চলে এসো, খাবার নিয়ে যাও। এ কি রকম ব্যাপার বুঝি না! বুড়ি তরতর করে ফিরে যেতে যেতে আবার দাঁড়ালেন। কিছু ভাবলেন তারপর মাথা নেড়ে বললেন, না, থাক।

সুদীপ আগ্রহী হল, থাকবে কেন, বলুন না। কিছু হয়েছে?

না, কি আর হবে! বুড়ি সলজ্জ ভঙ্গিতে তাকালেন, বলছিলাম কি, যখন দিতে চাইলে তখন আমার একটা উপকার করো। ধর্মতলার দিকে কোন দোকানে নাকি হাজার খুব ভাল ওষুধ পাওয়া যায়। আমাকে একজন নামটা লিখে দিয়েছিল, এদিকে কোন দোকানে নেই। তাই এনে দিও কয়েক কৌটো। জলে ভিজে ভিজে পায়ে এত হাজা হয়ে গেছে না বড় কষ্ট হয়। কথা শেষ করে বুড়ি আর পড়লেন না। সুদীপ তাকে অনুসরণ করল।

জয়িতা ফিরে এসে দরজার দিকে মুখ করে বসল, কোন কোন মানুষের চাহিদা কত কম হয়, তাই না? এত জিনিস থাকতে হাজার ওষুধ। হাজা ঠিক কি?

কল্যাণ বলল, হাতপায়ে, আঙুলের ফাঁকে হয়। দিনরাত জল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঘা-এর মত হয়ে যায়। গ্রামের মানুষদের বেশি হয় শুনেছি।

আনন্দ বলল, কিন্তু আমি ভাবছি এই মানুষগুলোর কথা। এইসব বিধবা পিসীমা, মাসীমা, দিদিমারা বাঙালির কতটা সহায় ছিল। খুব দ্রুত এঁরা চলে যাচ্ছেন। আমাদের পরের জেনারেশন এদের কথা শুধু বইতেই পড়বে।

জয়িতা বলল, এঁদের চলে যাওয়াই উচিত। বাপ মা শিক্ষিত করতে চায়নি, বিয়ে দিয়েছে কিন্তু স্বামী মারা গেলে নিজের পায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা দেয়নি। এমন একজন মেয়ের এইভাবে বেঁচে থাকার প্রশ্ন ওঠে না। সংসারের সেবায় লাগবে বলে একদলকে কেন চিরকাল স্যাক্রিফাইস করতে হবে! ওঁরা হলেন পুরুষশাসিত সমাজের পুতুল।

আনন্দ বলল, মানলাম। সত্যি কথাই বলেছিস। কিন্তু এইসব সরল মন আর স্নেহের চেহারাটা তো আর দেখা যাবে না। এইটেই বলছিলাম। জয়িতা, ট্রাঞ্জিস্টারটা দে।

আনন্দ ঘড়ির দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। সে ঠিক সময়ে সুইচ অন করল। কয়েক সেকেন্ড বাজনার পর ঘোষিকা ঘোষণা করলেন এবার খবর হবে। ওরা সবাই উৎসুক হল। কানাডায় শিখদের বিষয়ে ভারত সরকারের প্রতিবাদ সেদেশের সরকার বিবেচনা করছেন। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট দেশদ্রোহিতা সহ্য করবেন না বলে জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন ডায়মন্ডহারবারের প্যারাডাইস এবং বড়বাজারের অন্তর্ঘাতের পিছনে একটি দলই কাজ করছে। এবার সংবাদ পাঠক বিশদে গেলেন। কল্যাণ বলল, ওরা। তাহলে সবকিছু ঠিকঠাক জানতে পারছে। এদেশের পুলিস ইচ্ছে করলেই সব জানতে পারে। ইচ্ছেটা করে না সব সময় এই যা।

খবর হচ্ছিল। প্রথমে যে বিষয় জানানো হচ্ছিল তা তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। ওরা উৎসুক ছিল কখন সংবাদ পাঠক ওদের প্রসঙ্গে আসবেন। এই সময় সুদীপ ফিরল দুটো বড় সসপ্যান নিয়ে। ওগুলোকে মাটিতে নামিয়ে সে আনন্দকে ডাকল, চল, জল আর থালা নিয়ে আসি। একা অত আনতে পারব না।

আনন্দ ইশারা করল একটু অপেক্ষা করতে। এবং তখনই ট্রাঞ্জিস্টার তাদের প্রসঙ্গে এল, আজ বিকেলে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন সম্প্রতি কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলে যে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ হয়েছে তা একটি দলই করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এই দুটি ঘটনার বিশদ বিবরণ প্রমাণ করে কোন ডাকাতদল অথবা ব্যক্তিগত লাভের জন্যে এই কাজ করা হয়নি। কলকাতা পুলিস এর মধ্যে যেসব সূত্র পেয়েছে তা থেকে জানা যাচ্ছে এই দলটির সঙ্গে নকশালদের সম্পর্ক নেই। কিন্তু নকশাল-পরবর্তী উগ্রচিন্তার সমর্থকরাই এটা করছে। প্যারাডাইস কিংবা ওষুধ কোম্পানি যদি বেআইনি কাজ করে থাকে তাহলে তার ব্যবস্থা নিতে সরকার তৎপর। কোন ব্যক্তিবিশেষ বা দল যদি আইন হাতে তুলে নেয় তা কখনই বরদাস্ত করা হবে না। অনুমান করা হচ্ছে এই দলটি অত্যন্ত সংগঠিত। জনসাধারণকে সরকার সম্পর্কে বিভ্রান্ত করাই এদের উদ্দেশ্য। কোন বিদেশী শক্তির মদৎ এদের পেছনে আছে কিনা তা খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। রেসকোর্স বন্ধের হুমকির মোকাবিলা করার জন্যে এর মধ্যেই যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, যারা এই কাজদুটো করেছে তাদের কঠোর হাতে মোকাবিলা করা হবে। তিনি আশ্বস্ত করেন, পুলিস এর মধ্যেই নির্দিষ্ট সূত্র পেয়ে গেছে। দু-একদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার সম্ভব হবে। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরে কলকাতার পুলিস কমিশনার নাগরিকদের উদ্দেশ্যে জানান যে ওই দলের সদস্যরা সবাই কলকাতার একটি নামী কলেজের ছাত্র। একজন ছাত্রীও এদের সঙ্গে আছে। এরা প্রত্যেকেই শিক্ষিত পরিবারের সন্তান। কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এদের কোন সংযোগ নেই।

সংবাদ পাঠক অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়াতে ট্রাঞ্জিস্টারটা বন্ধ করল আনন্দ। সুদীপ মন্তব্য করল, যাক, যোল কলা পূর্ণ হল। ওদের আর কিছু জানতে বাকি রইল না। আমি ভাবছি, শ্রীযুক্ত বাবু অবনী তালুকদার পুলিসকে আমার সম্পর্কে কি বিবৃতি দিয়েছেন! চল আনন্দ।

আনন্দ কোন কথা না বলে সুদীপকে অনুসরণ করল।

এখন জ্যোৎস্না আরও সাদা। ঘরের ভেতরটা বেশ পরিষ্কার। হঠাৎ কল্যাণ বলল, ফেরার পথ বন্ধ।

চমকে উঠল জয়িতা। সে দেখল কল্যাণ অদ্ভুত চোখে বাইরের পৃথিবী দেখছে। জয়িতার খুব রাগ হচ্ছিল। সে চাপা গলায় ডাকল, কল্যাণ।

কল্যাণ তাকাল, ভুল বুঝিস না! আসলে কি জানিস, কখনও বাড়িতে আলাদা করে যত্ন পাইনি। কেউ আমাকে খাতির করেনি কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হত ওরা সবাই আমার নিজের লোক। কোন যুক্তি নেই তবু। আসলে একটা সংস্কার। ফিরে গেলেও কোন লাভ হবে না। তবু ছেড়ে দে এসব কথা।

জয়িতা কিছু বলল না। কিন্তু তার মন বলছিল কল্যাণ অস্থির হয়েছে। কখন কি করবে তা বোঝা অসম্ভব। সে শুনেছিল নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি সেন্টিমেন্টের শিকার বেশি হয়। কল্যাণ সম্পর্কে তার একটা অস্বস্তি শুরু হল। কিন্তু এখনই কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলবে না বলে ঠিক করল।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সুদীপ ফোলানো বালিশ বের করে দিল। পাশের ছোট খুপরিতে এক বালতি জল রাখা হয়েছে কল্যাণ আর জয়িতার জন্যে। এখন পৃথিবীর কোথাও কোন শব্দ নেই। আনন্দ কল্যাণ সুদীপ পাশাপাশি শুয়ে পড়ল বালিশ মাথায় দিয়ে। মুখে জল দিয়ে দ্রুত ফিরে আসছিল জয়িতা। ছাদ, আশেপাশের গাছপালা এবং স্নিগ্ধ আকাশের দিকে চোখ পড়তে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তেই সে একটা ঘোরের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল যেন। সারাটা আকাশ থেকে মায়াবী স্বপ্ন চুইয়ে চুঁইয়ে নামছে পৃথিবীর বুকে। ওই জ্যোৎস্নায় এমন একটা জাদু আছে যা সে কোনদিন এমন করে দ্যাখেনি। অনেকক্ষণ তার কেটে গেল একই ভাবে দাঁড়িয়ে। নিজেকে যেন জোর করে সে ফিরিয়ে নিয়ে এল ঘরে। পাশাপাশি তিনটি পুরুষ শুয়ে আছে। তিনজনই তার বয়সী। পুরুষ! নিজেই হেসে ফেলল জয়িতা। ওদের সে এই প্রথম পুরুষ বলে ভাবল, ভাবনাটা এল কেন? সে দরজাটা ভেজিয়ে এক পাশে চলে এল। তার ঠিক কাছেই সুদীপ শুয়ে আছে। জয়িতা উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল। শক্ত মেঝেতে প্রথমেই শরীরে অস্বস্তি এল। কখনও এমন বিছানায় শোয়নি সে। কখনও কি তিনটি পুরুষের পাশে শুয়েছিল? হঠাৎ সে নিজের ওপর রেগে গেল। নিম্নমধ্যবিত্ত মানসিকতা নিয়ে একটু আগে কল্যাণ যে কথাটা বলেছিল তা তাকে আহত করেছিল। কিন্তু সে নিজেও তো মহিলাদের টিপিক্যাল মানসিকতার শিকার হচ্ছে! তার এই ভাবনার কথা বন্ধুরা জানলে অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার হবে। সে তো সব সময় বলে থাকে বন্ধুদের সঙ্গে তার কোন ফারাক নেই।

ঘুম আসছিল না। জয়িতার বন্ধ চোখের পাতায় রামানন্দ রায় বারংবার এসে দাঁড়াচ্ছিলেন। এতদিনের দেখা মানুষটার চেহারা এই দুদিনে কি দ্রুত বদলে গেছে। মুখটা মুছতে চেষ্টা করতেই তার সেই দৃশ্যটি চোখে এল। সীতা রায় রামানন্দ রায় পরস্পর কাছাকাছি এসে গেছেন। হয়তো কয়েকদিন, কিংবা কয়েক সপ্তাহ কিন্তু এই আসাটা কি আরামদায়ক!

হঠাৎ সুদীপের গলা কানে এল, এই জয়ী, চিৎ হয়ে শো।

কেন?

মা বলতো উপুড় হয়ে শুলে বোবায় ধরে।

জয়িতা চিৎ হল। এবং তখনই সে আবিষ্কার করল, সে একা নয়, তার অন্য তিন বন্ধুর কারও চোখে আজ রাত্রে ঘুম আসছে না।

 

সকালে উঠে একটা স্টোভ, চায়ের সরঞ্জাম আর কাগজ কিনে নিয়ে এল সুদীপ। এই কেনাকাটা সে পাড়ার দোকান থেকে করল না। কিনে আনবার সময় এমনভাবে প্যাক করেছিল যাতে পাড়ার কেউ তার জিনিসগুলো দেখতে না পায়। কিন্তু স্টোভ জ্বালতে কেরোসিন দরকার। ওটা না পেলে সমস্যাটা থেকেই যাবে। বাজারে একজন বলেছিল ব্ল্যাকে ব্যবস্থা হতে পারে। রাজী হওয়ার কথা মনেই আসেনি। তিনটে খবরের কাগজ কিনেছে সুদীপ। হকারটা চেঁচাচ্ছিল জোর খবর জোর খবর বলে। তাড়া থাকায় খুলে দেখার অবসর পায়নি সে। হাজার ওষুধটা এখানেই পেয়ে গেল।

বাড়িতে ফিরতেই দেখল বুড়ি গজর গজর করছে। তাকে দেখামাত্র সব ভুলে গিয়ে চিৎকার শুরু হল, আমি সারাদিন উঠোনে ঝাট দিচ্ছি আর কোন নবাবপুর ওপর থেকে সিগারেট ফেলেছে এখানে, অ্যাঁ! এসব করলে এখানে থাকা চলবে না।

সুদীপ মুখ তুলে ছাদের দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ওরা কেউ নিশ্চয়ই অ্যাশট্রেটা খালি করেছে। ব্যাপারটাকে সামাল দিতে সে বলল, কেউ তো ইচ্ছে করে ফেলেনি, নিশ্চয়ই কাক পাখির কাণ্ড ওটা। আমি দেখছি যেন আর না হয়।

 

কাক? আমাকে কাক দেখাচ্ছ? এ বাড়ির কাক অত শয়তান নয়। চাকরিবাকরি নেই, পরের পয়সায় কত সিগারেট খেয়েছে দ্যাখো বুড়ির গজর গজর আবার শুরু হল।

সুদীপ একটু দাঁড়িয়ে থাকল তারপর জিনিসগুলো মাটিতে রেখে ওষুধটা বের করে বলল, আপনি কি এই ওষুধটার কথা বলছিলেন?

বুড়ির মুখ বন্ধ হল। সন্দেহের চোখে সুদীপের হাতের দিকে তাকালেন তিনি। তারপর কাছে এসে বললেন, কি ওষুধ?

হাজার। কাল রাত্রে খাবার দেওয়ার সময় যেটার কথা আপনি বলেছিলেন।

সত্যি? ওই ওষুধ এটা? শুনেছিলাম ধর্মতলা ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না। লোকেরা এত মিছে কথা বলে না! বড় কষ্ট হয়, বুঝলে? দেখি এ দিয়ে যদি কিছু উপকার হয়। বেঁচে থাক বাছা, তোমার বাবা তো কোনদিন কিছু আঙুল তুলে দেয়নি, তুমি দিলে! বুড়ি এমন ভঙ্গিতে ওষুধ নিলেন যেন দুহাত পেতে অমৃত নিচ্ছেন।

সুদীপ বলল, আমি এখনই উঠোনটা ঝাট দিয়ে পরিষ্কার করছি। আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।

থাক। আর কাজ বাড়াতে হবে না। ওগুলো কি? কি নিয়ে এলে?

এই কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস। আপনার কাছে একটু কেরোসিন তেল হবে?

ওমা, ও জিনিস কারও কাছে থাকে নাকি? দোকানে এলে দ্যাখো না রাত থাকতে কত লোক লাইন দেয়। কেরোসিন দরকার কেন?

আপনার জন্যে একটা স্টোভ এনেছিলাম।

স্টোভ? ও মাগো! ওসব আমি ধরাতে জানি না। স্টোভ ফেটে এ-পাড়ার দুটো বউ পুড়েছে। না না, ওসব বাদ দাও, ফেরত দিয়ে এস।

ফেরত তো নেবে না। বিক্রী করার সময় বলে দিয়েছে। ঠিক আছে, ওপরে নিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধুর আবার ঘন ঘন চায়ের নেশা হয় কিনা! চা-পাতাও কিনে এনেছি।

ও, চায়ের নেশা! কিছুই আর বাদ নেই দেখছি। তা স্টোভটা এনেছিলে কার জন্যে? বন্ধুর নেশা মেটাবে বলে না আমার জন্যে? বলতে বলতে বুড়ি কান খাড়া করল। পেছনের দিকের দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। বুড়ি ওখান থেকেই চিৎকার করলেন, কি চাই, অ্যাঁ?

আপনার বাজার এসে গেছে। ওপাশ থেকে একটি নারীকণ্ঠে জবাব এল। শোনামাত্র বুড়ি সেদিকে চলে গেলেন। সুদীপ লক্ষ্য করল ওদিকের দরজার হুড়কোটা খুলতেই সেই মেয়েটি প্রসন্ন মুখে এদিকে ঢুকল যাকে গতকাল সে পুকুরের ধারে গাছের তলায় দেখেছে। ওপর থেকে দেখার ফলে যত ছোট মনে হচ্ছিল তত কম বয়স নয়। মেয়েটি ঢুকেই আড়চোখে সুদীপকে দেখে নিল। তারপর ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি মিশিয়ে বুড়িকে বলল, এই নিন, আলু আর ডিম। দোকানী জিজ্ঞাসা করছিল, দিদিমা হঠাৎ ডিম আনতে বললেন, খাবে কে? আমি বললাম কুটুম এসেছে।

কুটুম আবার কি? ভাই-এর ছেলে কুটুম হতে যাবে কোন দুঃখে! পয়সা ফেরেনি?

না। চল্লিশ পয়সা বেশি লেগেছিল, ওটা আর দিতে হবে না। ওই বুঝি আপনার ভাইপো?

স্পষ্টতই বুড়ি বিরক্ত হলেন। মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। এবার আমাকে কাজ করতে হবে। ছেলেমানুষ, এতদিন বাদে এল তাই ভাবলাম মাছ না থোক ডিম খাওয়াই। ওসব তো রান্না অনেককাল হল করিনি। যাও যাও, আমার গল্প করার সময় নেই।

মেয়েটি যাওয়ার জন্যে পেছন ফিরেই আবার ঘুরে দাঁড়াল, আপনার ভাইপোর যদি পিসীর হাতে খাওয়ার বায়না না থাকে তাহলে আমিই রেধে দিতে পারি।

ঠিক আছে ঠিক আছে। না পারলে তোমাকে বলবখন।

জায়গা তো ভাল, জলেও স্বাদ আছে। দেখবেন ভাইপোর স্বাস্থ্য ভাল হবে। যেখানে ছিল সেখানে বুঝি পুকুর গাহাগাহালি ছিল না?

কেন?

বাড়ির পাশেই পুকুর, কত রকমের গাছ। সারাদিন তাকিয়ে বসে থাকলেই সময় কেটে যায়। তাই না? অদ্ভুত হাসিটা ছড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি বিদায় নিল।

দরজায় হুড়কো দিয়ে বুড়ি চাপা গলায় বললেন, ছেনাল ছেনাল! স্বামী বেঁচে থাকতেও লোভ মেটে। পাড়ার ছেলেদের মাথা চিবোচ্ছে। তা তুমি এখানে সঙের মত দাঁড়িয়েছিলে কেন? খবরদার, ও মিশতে চাইলেও পাত্তা দেবে না।

কে উনি?

ভাড়াটের বউ। স্বামীটি দেবতুল্য মানুষ। বাচ্চাকাচ্চা হয়নি আর ইনি এই করে বেড়াচ্ছেন। তা তখন কি বলছিলে? আছে একটিন। অনেকদিন হয়ে গেল। পচেটচে যায় কিনা তাও জানি না। ওতে যদি কাজ চালাতে পার তো দ্যাখো।

এতক্ষণে মনটা ভাল লাগল সুদীপের। সে জিজ্ঞাসা করল, ডিম আলু আনাতে ওদের বলতে গেলেন কেন? তাছাড়া ডিমের কোন দরকার ছিল না!

বেশি কথা বলতে এসো না তো! এ-পাড়ার দোকানগুলো ডাকাত। বাজারে গিয়ে কিনলে অন্তত দশ পয়সা সস্তা পাওয়া যায় বলে ভাড়াটেকে বললাম। এই রকম বেহায়া মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি গো। বুড়ি নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। তারপর ওপাশ দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে একটা প্রায় মরচে পড়া টিন বের করে বারান্দায় রাখলেন।

সুদীপ সেটাকে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল প্যাকেটটা হাতে নিয়ে। বাড়ির পাশেই পুকুর, কত রকমের গাছ। সারাদিন তাকিয়ে বসে থাকলেই তো সময় কেটে যায়! মেয়েটি তাকে শুনিয়েই কথাগুলো বলেছে। কেন? ও কি গতকাল জানলায় তাকে দেখেছে? সেই ছেলেটার সঙ্গে যখন অন্তরঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল গাছের তলায় তখনও কি তার চোখ ছিল জানলায়?

আনন্দ ডায়েরি লিখছিল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে কল্যাণ বসে আছে। আর জয়িতার হাতে বই। পায়ের শব্দে তিনজনেই সোজা হল। সুদীপ হেসে বলল, তোরা যেভাবে বসেছিস, যেন কারও বাড়িতে বেড়াতে এসেছিস। পুলিস যদি আমার বদলে উঠে আসতো তাহলে কিছুই করতে পারতিস না। যাক, চায়ের প্রব্লেম সলভড়। স্টোভ এবং কেরোসিন এসে গেছে। আনন্দ, তুই নিচ থেকে এক বালতি জল নিয়ে আয়।

জয়িতা বই রেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সুদীপ দেখল বইটার নাম ফিউচার শক। সে জয়িতাকে প্যাকেটটা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, জীবনে স্টোভ ধরিয়েছিস?

জয়িতা গম্ভীর মুখে বলল, জীবনে তো কত কি করিনি! এভাবে রাতও কাটাইনি! সে প্যাকেট খুলে স্টোভ বের করে ঘরের কোণায় নিয়ে গিয়ে ধরাবার তোড়জোড় করছিল।

আনন্দ বলল, পুলিস এখানে এলে আমাদের কিছুই করার নেই সুদীপ, একমাত্র লাফিয়ে নিচে পড়া ছাড়া। বুড়ি চেঁচাচ্ছিল কেন?

তোরা ওপর থেকে অ্যাশট্রের সিগারেট নিচে ফেলেছিস? খুব খচে গিয়েছিল।

আনন্দ কোন কথা না বলে জল আনতে গেল। সুদীপ কল্যাণকে খবরের কাগজগুলো দিয়ে বলল, তোর ডিউটি নিচু গলায় কাগজগুলো পড়ে শোনানো। জয়ী ওর মধ্যে চা চিনি দুধ আছে। দ্যাখ মনে করে চামচ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। কিন্তু তুই এর আগে চা করেছিস?

ঠিক তখনই কল্যাণ অস্ফুট চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ!

ওরা দুইজন চমকে তাকাল। কল্যাণের সামনে খবরের কাগজের প্রথম পাতাটা খোলা। সে মুখ তুলে বলল, আমাদের ছবি ছাপা হয়েছে।

এক লাফে ওর পাশে চলে এল সুদীপ। স্টোভ ছেড়ে ছুটে এল জয়িতাও। বড় বড় অক্ষরে হেডলাইন, চার বন্ধু না পেছনে আরও শক্তিশালী সংগঠন? প্যারাডাইস এবং বড়বাজারের জাল ওষুধ কোম্পানিতে যে দলটি আক্রমণ চালিয়েছিল কলকাতার পুলিস তাদের হদিশ পেয়েছে। এই চারজনই কলকাতার নামী কলেজের ছাত্রছাত্রী। এখন পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে কোন কেস পুলিসের খাতায় নেই। বস্তুত এদের দাগী আসামী বলা দূরের কথা, শেষ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সূত্রে অবশ্যই মেধাবী এবং কৃতী বলতে হয়। এই চারজনই এসেছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। চারজনই বাড়ি থেকে পলাতক। পুলিস সন্দেহ করছে এদের পিছনে কোন শক্তিশালী সংগঠন কাজ করছে। যেসব অস্ত্র এরা অপারেশনের সময় ব্যবহার করেছে তা বিদেশী শক্তির উপহার হওয়াও বিচিত্র নয়। চারজনের পারিবারিক পার্থক্যের জন্যেই পূর্ব পরিচয় থাকা সম্ভব নয়। কলেজেই এরা পরিচিত হয়েছিল। সেই সামান্য সূত্রে এরা একত্রিত হয়ে অপারেশনে নেমেছে তা পুলিস বিশ্বাস করে না। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন এই ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কাজ স্পষ্টতই দেশদ্রোহিতা। তিনি কোনভাবেই বরদাস্ত করতে পারেন না। পুলিসকে অবিলম্বে এদের গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়েছেন। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে দেখা গেছে প্যারাডাইসে সরকারেব অগোচরে দুর্নীতি এবং পাপাচার হত থানার নাকের ডগায় বসে, বিখ্যাত বা খ্যাতিহীন বড়লোকেরা সেখানে যেতেন গোপন অভিসারে, বড়বাজারের মোহনলালের কারখানায় যে জাল ওষুধ তৈরি হত তাতে সন্দেহ নেই, টেলিফোনে প্রাপ্ত সংবাদসূত্রে ব্রাবোর্ন রোডের গুদামে যেসব ওষুধ পাওয়া গেছে তা যে মোহনলালের তৈরি জাল ওষুধ এবং এসবের ধ্বংস করার চেষ্টা মানে জনসাধারণের এবং রাষ্ট্রের উপকার করা, কিন্তু আইন নিজেদের হাতে নিয়ে শক্তি প্রয়োগ করার এই প্রচেষ্টা সরকার কিছুতেই সমর্থন করতে পারেন না। কলকাতার পুলিশ কমিশনার আশা করেন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীরা ধরা পড়বে। তবু জনসাধারণের কাছ থেকে সহযোগিতা কামনা করে তিনি ওই চারজনের ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্যে পাঠিয়েছেন।

এরপরে তাদের চারজনের চারটি ছবি পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। নিচে তাদের নাম লেখা। ওরা লক্ষ্য করল ছবিগুলো তিন চার বছর আগে তোলা। নিজেদের বালক বালিকা বলে মনে হচ্ছে। এগুলো পুলিস নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছে। একমাত্র কল্যাণ এবং জয়িভার বর্তমান চেহারার সঙ্গে ছবির বেশ মিল আছে।

এই সময় আনন্দ জল নিয়ে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

সুদীপ কাগজটা ওর সামনে রাখল। আনন্দ যতক্ষণ কাগজটা পড়ছিল ততক্ষণ কেউ কোন কথা বলছিল না। সে বাকি কাগজগুলো পাশাপাশি বিছিয়ে দেখল প্রতিটিতেই তাদের ছবি ছাপা হয়েছে। একটি কাগজে লেখা হয়েছে, চার ডাকাত, একজন কলকাতার ফুলনদেবী? রিপোর্টরটি প্রচুর কল্পনার রঙে জয়িতাকে রাঙিয়েছেন। দুটো ঘটনায় তার ভূমিকা নিয়ে যা লিখেছেন তা সত্যিই লোমহর্ষক ব্যাপার। কিন্তু চারটে কাগজই তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে। শেষ পরীক্ষায় কে কত নম্বর পেয়েছিল তাও বক্স করে পাঠকদের জানানো হয়েছে। ইংরেজি কাগজটা অবশ্য পাশাপাশি আর একটা রিপোর্ট ছেপেছে। কাগজটি লিখেছে, এই দুটো ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানবার জন্যে আমরা কলকাতার বিভিন্ন মানুষের কাছে যাই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্টতই তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি দুষ্কৃতকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার এবং চরম শাস্তি চান। কলকাতার পুলিস কমিশনার ঘটনা দুটিকে উগ্রপন্থীদের ক্রিয়াকলাপ বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি নিশ্চিত যে পুলিস কয়েকদিনের মধ্যেই এদের গ্রেপ্তার করতে পারবে। বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের একজন কর্তা বলেন, নকশাল আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই দুটি ঘটনা ঘটেছে শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ। কোন ব্যবসায়ী যদি অসৎ হন তার জন্য আইন আছে। পূর্বাঞ্চলের শান্তি নষ্ট করে এই আক্রমণের তিনি নিন্দা করেছেন। রেসকোর্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন বিখ্যাত শিল্পপতি বলেন, রেস রাজার খেলা। এর একটা আলাদা সম্মান আছে। এদেশে সবরকম আন্দোলনের সময়েও কেউ রেস বন্ধ করতে চায়নি। একজন কংগ্রেস নেতা একবার এখানে সত্যাগ্রহ করবেন বলে হুমকি দিলেও পরে তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন। একজন অফিসযাত্রী কিন্তু ঘটনা দুটোর জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এ রকম ঘটনা হোক আমরা মনে মনে চাই কিন্তু করতে সাহস পাই না। মধুচক্র বা বেআইনি ব্যবসা এবং জাল ওষুধ তৈরি করে আইনের সাহায্যে যারা চিরকাল পার পেয়ে যায় তাদের এইভাবেই শাস্তি দেওয়া দরকার। কলকাতার এক গৃহবধু বলেন, ঠিক করেছে ওরা। নকশালরা তো পুলিস মারতো আর গলা ফাটাতো, কাজের কাজ কি করেছে? এরা তবু একটা জাল ওষুধের কারখানা ধ্বংস করেছে। আর প্যারাডাইস না কি বলে, ওখানে ওসব হত? ছি ছি ছি! গরমেন্ট কিছু বলত না? ঠিক করেছে পুড়িয়ে দিয়ে। একটি তরুণ ছাত্র কফিহাউসে বসে তার প্রতিক্রিয়া জানান, দারুণ ব্যাপার। জানি না এর পেছনে কোন রাজনৈতিক দল আছে কিনা, কিন্তু এই দুটো ঘটনায় অনেকে নড়ে বসবেন। জানি এরা ধরা পড়বে কিন্তু ব্যাপারটা অনেককেই ভাবাবে। যদিও সবকটি রাজনৈতিক দল এই ধরনের কাজকে নিন্দা করেছেন কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে সাধারণ মানুষের কাছে এরা যেন সমর্থন পাচ্ছে।

সুদীপ বলল, এই ব্যাপারটাই তো আমরা চেয়েছিলাম।

কল্যাণ বলল, তা হোক কিন্তু আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম।

জয়িতা উঠে স্টোভ জ্বালাচ্ছিল, ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ধরা পড়ে গেলাম মানে?

আমাদের ছবি ছাপা হয়েছে, পাবলিকই তো ধরিয়ে দেবে। কল্যাণের গলায় হতাশা ফুটে উঠল।

আনন্দ একটু উঁচু গলায় বলল, কল্যাণ, আমরা এখনও ধরা পড়িনি। এবং যতক্ষণ তা না পড়ি ততক্ষণ হতাশ হওয়ার কোন মানে হয় না। এখন শুধু দেখতে হবে আমরা এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি তা পুলিসের পক্ষে জানা সম্ভব কিনা।

সুদীপ বলল, পাড়ার লোক ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব কারও জানা সম্ভব নয়। আমরা সতর্ক থাকব যাতে পাড়ার লোকজন তোদের দেখতে না পায়। আমার এই ছবির সঙ্গে এখনকার চেহারার কোন মিল নেই। অতএব আমি নিজেকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি না।

আনন্দ বলল, অগত্যা তাই করতে হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। এমন একটা শেলটার চাই যেখানে কোনভাবে পুলিস পৌঁছতে পারবে না।

কল্যাণ জবাব দিল, তাহলে হিমালয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে।

আনন্দ ওর দিকে মুখ ফেরাল, আমি সেই কথাই ভাবছিলাম।

ঠিক তখনই নিচে মানুষের কথাবার্তা শোনা গেল। বুড়ি চিৎকার করে কাউকে কিছু বলছেন। যিনি লক্ষ্য তিনি চাপা গলায় কিছু জবাব দিতে চাইছেন। ওরা চারজন চুপ করে গেল। ইঙ্গিতে ওদের বসতে বলে সুদীপ হাঁটু মুড়ে ছাদে চলে এল। তারপর ধীরে ধীরে কার্নিসের কাছে পৌঁছে সাবধানে উঁকি মারল উঠোনের দিকে। হাতে কয়েকটা খাম নিয়ে বুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন অবনী তালুকদার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *