1 of 2

১২. ঘুম ভাঙল একটু বেলা করে

ঘুম ভাঙল একটু বেলা করে। জয়িতা তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে চারপাশে তাকাল। এবং তখনই মনে পড়ল সুদীপের কথা। সুদীপ এই বাড়িতে কাল রাত্রে ছিল। সুদীপের ঘর থেকে নিজের ঘরে ফিরে আসার সময় তাকে টেলিফোনটা ধরতে হয়েছিল। রামানন্দ রায় ফোন করেছিলেন। রাতের ট্রেন ধরে ভোরে কলকাতায় পৌঁছাবেন জানিয়েছিলেন। নিজের অজান্তেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছিল। রাতটুকু নিশ্চিন্তে কাটবে। যদি প্রয়োজন হয় কাল ভোরেই সুদীপকে নিয়ে কোথাও বেরিয়ে যাবে। এইরকম একটা ভাবনা মাথায় এসেছিল। যে ছেলে দুমদাম কথা বলে, কাউকে কেয়ার করে না, মা মারা গেলেও যে সহজভাবে নেয় তাকেই মাঝরাত্রে একা কাঁদতে হয় যখন তখন খুব স্বাভাবিক লাগে। সুদীপ না কাদলে যে জয়িতার অস্বস্তি থেকে যেত। এই নিয়ে কোন কথা ওর সঙ্গে বলা যাবে না, বলা উচিত হবে না।

জয়িতা মুখচোখে জল দিয়ে হাউসকোট পরেই ঘরের বাইরে চলে এল। এবং তখনই রামানন্দ রায়কে দেখতে পেল। সোফায় বসে রামানন্দ সিগারেট খাচ্ছেন। রাত্রি জাগরণের ছাপ চোখমুখে। এখনও বাইরের পোশাক ছাড়েননি। পায়ের আওয়াজ শুনে রামানন্দ মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। জয়িতা হাসবার চেষ্টা করল, গুড মর্নিং।

রামানন্দ নীরবে মাথা নাড়লেন। জয়িতা কয়েক পা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল, কখন ফিরলে?

রামানন্দ আবার মেয়ের দিকে তাকালেন পূর্ণদৃষ্টিতে, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, এই তো

জয়িতা এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, কাল তোমরা কেউ ছিলে না। আমার এক বন্ধু, সুদীপ, তুমি দেখেছ ওকে, কাল রাত্রে এখানে ছিল কারণ ওর কোথাও থাকার জায়গা ছিল না।

কেন?

অসুবিধে ছিল।

ওর বাড়িতে অসুবিধে হল কেন?

ওটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার।

তুমি জানো না?

জানি।

রামানন্দ মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মা কি কোন খবর দিয়েছেন?

না। তারপর বলল, সুদীপ আজই চলে যাবে, তোমাকে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না।

আমি দুশ্চিন্তায় নেই। তবে আমরা যখন তোমাদের বয়সে ছিলাম তখন এইভাবে বাড়ি ছেড়ে অন্য কারও বাড়িতে রাত কাটানোর স্পর্ধা দেখাতে পারতাম না। তাছাড়া তুমি এখন আর ছোট নও, আমাদের অনুপস্থিতিতে সমবয়সী একটি ছেলেকে রাত্রে থাকতে দেওয়াটা অনেকের চোখেই শোভন বলে ঠেকবে না, এইটে তোমার বোঝা উচিত ছিল।

তুমি কি ইঙ্গিত করছ?

আমি কোন ইঙ্গিত করছি না। যা বাস্তব তাই বলছি।

আমরা বন্ধুরা কেউ কাউকে কখনই বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না। তোমার এই সবাই কি বলছে তা কেয়ার করি না আমি। তাছাড়া তোমাদের বেলায় যখন এই সবাই চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারে তখন আমার ক্ষেত্রে চোখ খুলতে নিষেধ করো।

রামানন্দ দুহাতে মুখ ঢাকলেন। অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল জয়িতা। একটু সময় লাগল তার নিজেকে সামলাতে। শেষ পর্যন্ত রামানন্দ উঠলেন, তোর ওপর আমার বিশ্বাস আছে খুকী। আমরা যা করছি সেটা না করলে অস্তিত্ব রাখা যাবে না। অন্ধদের রাজত্বে গিয়ে চোখ খোলা রাখলে দলচ্যুত হতে হবে। কিন্তু বেসিক্যালি আমি তো-আমি তো কিছু মনে করিস না, আই লাভ ইউ, আর তাই হঠাৎ ভয় হল, আমি তোর মাকে হারিয়েছি, তোকে হারাতে ভয় হয়।

রামানন্দ আর দাঁড়ালেন না। নিজের ঘরের দিকে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বাবা ডাক শুনে স্থির হলেন। জয়িতা বলল, আমি কোন অন্যায় করছি না।

মাথা নাড়লেন রামানন্দ, আমি তোকে বিশ্বাস করি।

বিশ্বাস কর? তাহলে তোমাকে বলতে হয়–।

কি?

না, এখন না। সময় হলেই তোমাকে জানিয়ে যাব।

জানিয়ে যাবি? কোথায়?

জয়িতা এবং রামানন্দ পরস্পর চোখের দিকে তাকালেন। রামানন্দর কাতর চোখে বিস্ময়। জয়িতার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ছেলেবেলায় একটা গল্প সে প্রায়ই শুনতো। রামানন্দ সাংসারিক কাজ একদম করতে পারতেন না। তখন ওদের এই বাড়ি ছিল না, এই অবস্থাও নয়। সেই সময় জয়িতা যখন দুবছরের শিশু তখন মাঝরাত্রে প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল হামের ফলে। রামানন্দ রায় সেই মেয়েকে দুহাতে আঁকড়ে সারারাত ঘরে পায়চারি করেছিলেন। মেয়ের মলমূত্র সস্নেহে পরিষ্কার করেছেন, ক্লান্ত স্ত্রীকে ঘুমুতে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এ থেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে তিনি স্নেহপ্রবণ সাংসারিক পিতা ছিলেন। তখন রামানন্দ রায়ের সীমিত আয় ছিল, গাড়ি ছিল না। কিন্তু এই ঘটনার কথা বারংবার ব্যবহার করে করে নিজের গৌরব জাহির করার যে চেষ্টা তা শুধুই বিরক্তি উৎপাদন করত। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে সেই মানুষটাকে দেখতে পেল জয়িতা। যার কিছু নেই অথচ সবকিছু থাকার বাতাবরণ যাকে সৃষ্টি করতে হচ্ছে।

জয়িতা মাথা নাড়ল, আমাকে জিজ্ঞাসা করো না এখন।

রামানন্দ বিস্মিত হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, ও! খুকী, তোর বিবেকে যা সত্যি তাই করিস। এইভাবে কোনদিন তোর সঙ্গে কথা বলিনি, আবার বলার সুযোগ হবে কিনা জানি না। নিজের কাছে যদি তুই ঠিক থাকিস তাহলে কারও কাছে কৈফিয়ত দেবার দরকার নেই। তোর বন্ধুকে চলে যেতে বলে আমাকে ছোট করিস না। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি। রামানন্দ আর দাঁড়ালেন না। তিনি অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত জয়িতা তাকিয়ে থাকল। এই মানুষটার কাছে মা কি পায়নি? কোন অভাববোধ থেকে মা এই শেকড়হীন জীবনটাকে আঁকড়ে ধরলেন? নাকি এই মুহূর্তের রামানন্দ রায়কে সীতা রায় চেনেন না? অথবা রামানন্দ রায় তার এই মুখটাকে অজস্র মুখোশের ভিড় থেকে বেশির ভাগ সময় খুঁজেই পান না বলে সীতা রায় স্রোতটাকেই বেছে নিয়েছেন। কে জানে!

তোমার চা। শ্রীহরিদাকে চায়ের কাপ আর কাগজ রাখতে দেখল জয়িতা। শ্রীহরিদা দাঁড়াল, চা ঠাণ্ডা করো না। তোমার বন্ধুকেও চা দিয়েছি। সে শুয়ে আছে।

মাথা নাড়ল জয়িতা। সুদীপ নির্ঘাৎ এখনও ক্লান্ত। শ্রীহরিদা চলে গেলে সে চায়ে চুমুক দিল। এবং ঘুম থেকে ওঠার পর এই প্রথম তার ভাল লাগল। বাগডোগরার ফ্লাইটটা বিকেলে আসে। ততক্ষণ আর নতুন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না এই বাড়িতে। খবরের কাগজটা টেনে নিল সে। ভাজ খুলতেই সোজা হয়ে বসল জয়িতা। জীবনে প্রথমবার মেরুদণ্ডে বরফের স্পর্শ পেল যেন সে। প্রথম পাতায় ছবি ছাপা হয়েছে। বাড়িঘর ঝাঁপসা, আগুনের শিখা লকলক করছে। কোন মানুষের চেহারাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এমন কি জয়িতা নিজেও জায়গাটাকে ভাল করে চিনতে পারা তো দূরের কথা সম্পূর্ণ অচেনা লাগছিল তার কাছে। তার পাশেই বড় অক্ষরে হেডলাইন, প্যারাডাইস ভস্মীভূত। জয়িতা রিপোর্টটা খুঁটিয়ে পড়ল।

পর মধ্যরাত্রে ডায়মন্ডহারবার রোডের একটি প্রমোদনিবাসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়ে গিয়েছে। শেষরাত্রে এই অগ্নিকাণ্ডের খবর আমাদের অফিসে আসে। দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি দমকল আপ্রাণ চেষ্টা করছে আগুন নিবিয়ে ফেলতে, কিন্তু ততক্ষণে প্রচুর ক্ষতি হয়ে গেছে। পুলিশসূত্রে জানা যায় একাধিক ব্যক্তি ডাকাতির উদ্দেশ্যে ওই প্রমোদনিবাসে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে প্যারাডাইসের মালিক এবং দুজন কর্মীকে হত্যা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। প্যারাডাইস নামক ওই প্রমোদনিবাসটি সরকারের অলক্ষ্যে মধুকুঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। ওই অগ্নিকাণ্ডের ফলে ঠিক কতজন অগ্নিদগ্ধ কিংবা আহত হয়েছেন তা জানা যায়নি। কারণ সেইরাত্রে যারা মধুকুঞ্জের মধু আস্বাদন করতে গিয়েছিলেন তারা কেউ প্রকাশ্যে আসতে চাইছেন না। অনুমান সংখ্যাটি দশের কম নয়। ডাকাতরা তাদের কাজ শেষ করে নির্বিঘ্নে গা-ঢাকা দেয়। প্রকাশ, সেই রাতেই ডায়মন্ডহারবার রোডের একটি পেট্রলপাম্প থেকে গাড়ি চুরি হয় এবং অনুমান ডাকাতরা সেই গাড়ি ব্যবহার করেছে। পুলিশ সন্দেহ। করছে ডাকাতরা স্থানীয়। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে এই ডাকাতি তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায় ডাকাতদের সংখ্যা বেশি ছিল না, এবং তারা প্রত্যেকেই তরুণ। প্যারাডাইসের ক্রিয়াকলাপ আশেপাশের গ্রামের মানুষ কখনই ভাল চোখে দ্যাখেনি। তথাকথিত ডাকাতি হোক বা না হোক এই কাজ প্যারাডাইসকে চিরকালের জন্যে খুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে অনেকেই খুশী, যদিও মৃত্যুর খবরে কেউ আনন্দিত হননি। পুলিশ বলেছে, অপরাধীরা দু-একদিনের মধ্যে ধরা পড়বেই কারণ তদন্ত খুব দ্রুত এগোচ্ছে।

ধীরে ধীরে কনকনানিটা স্থির হল। কোথাও তার কথা লেখা হয়নি। একটি মেয়েও যে ওই দলে ছিল তা রিপোর্টে বলা হয়নি। কেউ কি পুলিশকে এই খবরটা দেয়নি? ক্রমশ নিজেকে বেশ হালকা মনে হচ্ছিল তার। কিন্তু তারপরেই মনে হল এটা একটা চাল হতে পারে। পুলিশ তাদের নিশ্চিন্ত করতে চায় বলেই খবরটা বেমালুম চেপে গেছে। শেষের লাইনটা খুব অস্বস্তিকর। পুলিশ কি কোন সূত্র খুঁজে পেয়েছে? যদি ওরা আনন্দর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাহলে! যে হালকাভাবটা এসেছিল তা আচমকাই চলে গেল। কাগজটাকে ভাজ করে ঠোঁট কামড়াল জয়িতা। কাল সারা দিন এবং রাত্রে এই ব্যাপারটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়নি সে। অথচ কাগজটা পড়ামাত্র ওইসব চিন্তা মাথা তুলল। সে চা শেষ করে কাগজটা নিয়ে সুদীপের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

শুয়ে শুয়ে সুদীপ সিগারেট খাচ্ছিল। জয়িতাকে দেখে উঠে বসল, এখনই বের হব?

তোর যা ইচ্ছে। আমি তোকে যাওয়ার কথা বলতে আসিনি।

আমি একটু বাদে বের হব। মালগুলো নিয়ে তো ঘোরা যাবে না, এগুলো এখানে রাখা যাবে? মানে তোদের যদি কোন অসুবিধে না হয়?

তোদের তোদের করছিস কেন?

আই অ্যাম সরি। তোর বাবা মা ফিরেছেন?

বাবা এসেছে।

আমার কথা জানেন?

হ্যাঁ। বললেন, তার কোন আপত্তি নেই তোর এখানে থাকতে, যদি আমার বিবেক পরিষ্কার থাকে। আজকের কাগজ। জয়িতা কাগজটা ছুঁড়ে দিল। দিয়ে দেখল সুদীপের মাথার একদিক বেঢপ ফুলে উঠেছে।

কাগজের ভাজ খুলতে খুলতে সুদীপ বলল, তোর বাবা তো দেখছি চমৎকার ভদ্রলোক। কখন যে এরা ঘ্যাম ব্যবহার করে আর কখন যে জালি হয়ে যায় তা শালা অনুমান করাই মুশকিল। আই বাপ, একি রে, একদম হেডলাইন। সুদীপ এবার গম্ভীর হয়ে কাগজটা পড়া শুরু করল। শেষ লাইন অবধি খুঁটিয়ে পড়ে কাগজটাকে সরিয়ে রেখে সে মন্তব্য করল, কোন কাজ হল না।

মানে?

আনন্দ চেয়েছিল এইসব ঘটনা থেকে কাগজগুলো এমন মাতামাতি করবে যে সাধারণ মানুষ ধরতে পারবে ব্যাপারটা। একটার পর একটা ঘটনা ঘটাবো আমরা আর সাধারণ মানুষের অসাড় হয়ে যাওয়া বোধটায় টান লাগবে। এই সো-কলড ডেমোক্রেসিতে অর্থবান মানুষদের ব্যভিচার করাই সবচেয়ে সুবিধে। যত রকমের অন্যায় করেও আইনের দোহাই দিয়ে তারা পার হয়ে যায়। ঠিকঠিক পয়েন্টে ঘা দিয়ে ওদের মুখোশ খুলে দিলে মানুষ নিজেরাই এগিয়ে আসবে। কিন্তু পরশুর ঘটনাটা কাগজ কিভাবে লিখেছে দেখেছিস? যেন আমরা সত্যি ডাকাতি করতে গিয়েছিলাম! কি ডাকাতি করলাম তা লেখেনি!

তুই একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস।

কি কথা?

আমরা সবে একটা ঘটনা ঘটালাম। পুলিশ কিংবা সাংবাদিকদের কোন সুযোগ নেই জানার, কারা করেছে কি জন্যে করেছে? আমরা কোন সূত্র রেখে আসিনি। কাগজে কোথাও লেখেনি আমার কথা, আই মিন দলে মহিলা ছিল সেইকথা। অর্থাৎ হয় পুলিশ চেপেছে নয় ওরা টোটাল ইনফরমেশন পায়নি। কিন্তু আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটলে জনসাধারণ জেনে যাবেই। রিপোর্টটায় পরিষ্কার বলা আছে প্যারাডাইসে মধুচক্র ছিল। পাবলিক নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটায় খুব কষ্ট পাবে না।

জয়িতার কথা শেষ হওয়ামাত্র সুদীপ শুয়ে পড়ল। জয়িতা অবাক হল, কি ব্যাপার?

ঘুম পাচ্ছে। খুব টায়ার্ড লাগছে।

একটা অ্যাকশন করেই–!

না, নিজের সঙ্গে লড়াই করে। তুই বুঝবি না। আমাকে যখন যেতে হবে ডেকে দিস।

তোর যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ থাক।

বাঃ, হঠাৎ এই বাড়ির ওপর তোর কর্তৃত্ব এসে গেছে মনে হচ্ছে! আনন্দ ফোন করবে, বলবি বিকেলের আগে আমি ফ্রি হব না, অবশ্য কোন জরুরী ব্যাপার থাকলে আলাদা কথা। সুদীপ পাশ ফিরে শুতেই জয়িতা উঠে এল। এই মুহূর্তে ওর মনে হল সুদীপ ঠিক আগের মতন নেই। কাল রাত্রে যাকে কাঁদতে শুনেছে সে এখনও সুদীপকে ছেড়ে যায়নি, কিংবা আর একটা ব্যাপার হতে পারে—আমরা যেসব মানুষকে বাইরের জীবনে নিয়মিত দেখে থাকি, যাদের সঙ্গে বন্ধু হয়ে অথবা কর্মসূত্রে মিশি তাদের একটাই চেহারা আমাদের কাছে ধরা পড়ে। তারা যখন নিজের শোওয়ার ঘরে ফিরে যায় তখন তাদের আচরণ সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই থাকে না। সুদীপকে তো বাইরে থেকেই সে দেখে এসেছে। ছটফটে, টিজ করতে ভালবাসে, কোন কিছুই গায়ে মাখে না, চক্ষুলজ্জার ধার ধারে না। এইরকম ছেলেও হয়তো বাড়িতে চুপচাপ গম্ভীর, একা একা থাকতেই ভালবাসে। জয়িতা মাথা নাড়ল, কখনও কখনও একাকী নিজেকেই বিরক্তিকর মনে হয়। সুদীপ দুই ভুমিকায় থেকে নিজেকে ব্যালেন্স করে।

রামানন্দ রায় বাইরে নেই। কাগজটাকে টেবিলের ওপর রেখে পা বাড়াবার আগেই টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই আনন্দর গলা শুনতে পেল, নম্বর জিজ্ঞাসা করছে। জয়িতা বলল, তোকে ডিজিট চিনিয়েছিল কে? মাসিমা? ঠিক শিখিয়েছিলেন। বল্ কি বলবি।

আনন্দ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল, তারপর বলল, পারিস। শোন, সুদীপ কাল ঠিকঠাক ছিল তো?

ঠিকঠাক মানে? জয়িতার গলাটা করকরে হয়ে উঠল আচমকা।

কোন অসুবিধের কথা জিজ্ঞাসা করছি।

অসুবিধের সম্ভাবনা থাকলে আমি ওকে ডেকে আনতাম না।

ওইভাবে কথা বলছিস কেন?

জয়িতা নিজেকে সামলালো। কেন যে ফট করে রাগ হয়ে যায়। সে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলবার চেষ্টা করল, ওয়েল, ঠিক আছে, কি বলবি বল।

আনন্দ চট করে কথা বলল না। যেন সময় নিয়ে কি বলবে স্থির করল, জয়িতা, তোকে একটা কথা শেষবার জিজ্ঞাসা করছি, আমাদের সম্পর্কে কোন অসুবিধে আছে?

না। নেভার। হঠাৎ এই প্রশ্ন?

তাহলে চটজলদি ভুল বুঝছিস কেন?

আই অ্যাম সরি। আসলে একটু আগে বাবার সঙ্গে–, মেজাজটা ভাল ছিল না। তারপর তুই যখন জিজ্ঞাসা করলি, ঠিকঠাক শব্দটা উচ্চারণ করলি তখন, রিয়েলি আই অ্যাম সরি। হ্যাঁ, সুদীপ ভালই ঘুমিয়েছে। একটু আগে কথা বলেছি। ও আবার ঘুমাচ্ছে।

তোর বাবা কি টের পেয়েছেন?

সুদীপকে বাবা দেখেছেন।

দূর, সুদীপের কথা বলছি না, টাকাটার কথা!

ওটা মায়ের ডিপার্টমেন্ট। শী হ্যাজ নট কাম ব্যাক।

ও। আমি সকালে বেরিয়ে যাচ্ছি। অ্যারেঞ্জমেন্ট করে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। ইউ ক্যান মিট আফটার দ্যাট। কোন অবস্থাতেই আজ ঠাকুরপুকুরে যাওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু কাল যেতেই হবে। সুদীপ আজ কোথায় থাকবে তোরা ঠিক করে নে। আর সন্ধ্যেবেলায় বসুশ্রী কফিহাউসে মিট করবি। অ্যারাউন্ড সিক্স। সুদীপকে বলবি ও যদি পারে যেটা যোগাড় করবে বলেছে যেন করে রাখে। হয়তো আজই দরকার হবে। ও কে?

কি আছে। কল্যাণ কোথায়?

ওর বাড়িতেই। কাগজ দেখেছিস?

হ্যাঁ। আনন্দবাজার।

টেলিগ্রাফটা দেখিস। স্বর্গে কি কি হত তার ডিটেলস ছেপে দিয়েছে। ওরা মন্তব্য করেছে যে বা যারাই কাজটা করুক তারা আইনের চোখে অন্যায় করেছে, কিন্তু গ্রামবাসীরা আশীর্বাদ বলে যদি মনে করে তাহলে দোষ দেওয়া যায় কি? দ্যাটস অল, তাই না? আনন্দর গলায় খুশীর সুর। সকাল থেকে এই প্রথমবার ভাল লাগল জয়িতার।

 

ট্রামে উঠেই সুদীপ টের পেল। দুজন ভদ্রলোক খবরটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। একজন বললেন, পুলিশ লাইসেন্স দিয়েছে ওরা মধুচক্র চালিয়েছে, এতে দোষ কিসে? কলকাতায় তো কয়েক হাজার প্রস কোয়ার্টারস আছে তা নিয়ে তো হৈ-চৈ করেন না। বেশ্যাবৃত্তি কি আইনসম্মত?

ওই বৃত্তিটা আইনসম্মত কিনা সে বিষয়ে যাত্রীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা গেল। কারোর কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। কেউ একজন বলল বেআইনি হলে ওরা বিধান রায়ের সময়ে মিছিল করে গিয়েছিল কি করে? সুদীপ লক্ষ্য করল, কি চটপট মানুষ প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে যায়। শেষ পর্যন্ত একজন বলল, না মশাই, ডাকাতরা যে দু-তিনজনকে খুন করেছে তাতে আমি একটুও দুঃখিত নই। মধুচক্রে সেদিন যারা ছিল, মানে যারা আহত হয়েছে তাদের নাম কাগজগুলো এড়িয়ে গেছে, কেন?

আর একজন বলল, আপনি এই ডাকাতি নরহত্যাকে সাপোর্ট করছেন?

এবার লোকটি জবাব না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। প্রথম লোকটি বলল, যাই বলুন, আমার সব পড়েটড়ে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা পলিটিক্যাল অথবা পুরোনো ঝগড়া। ওই প্যারাডাইসের অ্যান্টিপার্টি হয়তো করেছে।

পলিটিক্যাল কথাটা বললেন কেন? আপনি জানেন ওই অঞ্চলে কোন উগ্রপন্থী কার্যকলাপ বন্ধ। তাছাড়া যারা এতকাল উগ্রপন্থী হিসেবে চিহ্নিত ছিল তারা এখন নরম হয়ে গেছে।

কিন্তু ডাকাতদের উদ্দেশ্য কি ছিল?

আলোচনা এখন সেই বিষয়ে চলল। আনন্দ যা চাইছে তাই কি হতে যাচ্ছে? আঙুলে কানের পাশের ফোলা জায়গাটা স্পর্শ করল সুদীপ। জয়িতার চাপে ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা টেডভ্যাক নিয়ে ওষুধ লাগাতে হয়েছে। ব্যান্ডেজটা নিশ্চয়ই খুব দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে। কিরকম, তাকে কি ডাকাত ডাকাত মনে হবে কারও? ও যদি এখন এই মুহূর্তে চিৎকার করে বলে, দেখুন মশাই আমিই একজন ডাকাত যাদের কথা আপনারা বলছেন তাহলে এই ট্রামের লোকগুলো কি তাকে বিশ্বাস করবে?

ধর্মতলায় নেমে হাঁটতে লাগল সুদীপ। এখন প্রায় এগারোটা। অফিসযাত্রীদের ভিড় এখন চারপাশে। সাধারণত দশটায় অফিসগুলো চালু হওয়ার কথা। কিন্তু ট্রামে-বাসে বারোটা পর্যন্ত অফিস-টাইম শব্দটা চালু থাকে। সুদীপের সামনেই একটি মধ্যবয়সী লোক হাতে রেক্সিনের ছোট ব্যাগ নিয়ে হাঁটছিল। এগুলোকে টিপিক্যাল কেরানিব্যাগ বলা হয়। ওপর থেকে টিফিনবাক্সটার সাইজ পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত সময় যেন ওর সামনে পড়ে আছে এমন ভঙ্গিতে লোকটি হাঁটছিল।

বহুতল বাড়িটার সামনে এসে সুদীপ লক্ষ্য করল লোকটি সেখানেই ঢুকছে। সামনেই লম্বা কাউন্টার। সেখানে কেউ নেই। লিফটের সামনে বিরাট লাইন। লোকটি লাইনের শেষে দাঁড়াতেই সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা রেইড করে যারা গয়নাগাটি নিয়ে আসেন তাদের ডিপার্টমেন্টটা কোথায়?

লোকটি ছোট চোখে তার দিকে তাকাল। তারপর বলল, লাইনে দাঁড়ান, বলে দেব।

রাক্ষসের পেটেও বোধহয় এত জায়গা থাকে না, লিফটে দাঁড়িয়ে মনে হল সুদীপের। ভাগ্যিস সব ফ্লোরে থামছে না! হঠাৎ সুদীপ শুনল, নেমে ডানদিকে। বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক পা এগিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল তার। পুরো ধর্মতলাটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দোতলা বাসগুলোকেই ছোট দেখাচ্ছে, মানুষজন লিলিপুট। অনেক উঁচু থেকে দেখলে বোধহয় এইরকম সুন্দর দেখায়।

খুঁজে খুঁজে অফিসটাকে বের করল সুদীপ। অফিসার ভদ্রলোক চমৎকার। বসতে বলে প্রশ্ন করলেন, অবনী তালুকদার আপনার কে হন?

উনি আমার বাবা। আমার মা মারা গিয়েছেন। আপনারা মায়ের গহনাগুলো নিয়ে এসেছিলেন। বাবা বলছেন তিনি সেগুলো এখনও ফেরত পাননি। কথাটা সত্যি কিনা জানতে এসেছি।

বাবার কথা অবিশ্বাস করছেন কেন?

করার কারণ আছে।

দেখুন, এটা অবনীবাবু এবং সরকারের ব্যাপার। এক্ষেত্রে আপনি থার্ড পার্টি। আপনাকে আমরা আইনত জানাতে পারি না। ওঁর অ্যাসেসমেন্ট কোথায় হয় জানেন?

না, উনি আমাকে বলেননি। কিন্তু সোনাগুলো তো আমার মায়ের।

হতে পারে। তবে যেহেতু ওইসব আনডিসক্লোজড ওয়েলথ অবনীবাবুর বাড়িতে পাওয়া গিয়েছে এবং সত্যিকারের কোন মালিক যদি প্রমাণ দেখাতে না পারেন তাহলে আমরা অবনীবাবুর সম্পদ হিসেবেই ধরব। আয়কর আইনে যা যা ব্যবস্থা নেবার তা নেওয়া হবে। তবে আমি আপনাকে আনঅফিসিয়ালি জানাচ্ছি, কিছু কিছু জিনিস আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। ডিটেলস জানতে চাইলে আপনাকে পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করতে হবে।

 

অফিসারের কাছ থেকে বাবার যেখানে অ্যাসেসমেন্ট হয় সেখানকার ঠিকানা নিয়ে সুদীপ বাইরে বের হল। কয়েকতলা ভেঙে নির্দিষ্ট তলায় আসতেই ও থমকে দাঁড়াল। অবনী তালুকদার হেঁটে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে ফাইল বগলে একটা লোক। লোকটা যেন কিছু চাইছে আর অবনী ঘাড় নেড়ে খুব সম্মতি দিয়ে যেতে যেতে একটা ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন। দরজার ওপরে টাঙানো ফলক থেকে নাম পড়ল সুদীপ। গতকাল অবনী তালুকদারকে যে অবস্থায় সে দেখে এসেছিল তাতে একবারও মনে হয়নি আজ উনি সুস্থ হয়ে মামলা করতে আসতে পারেন। একটু বাদেই সেই ফাইলবাহক বেরিয়ে এল। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটি জিজ্ঞাসা করল, আজকে কেস আছে?

সুদীপ মাথা নেড়ে না বলতে লোকটি বিরক্ত হল, তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

আমার বাবা ভেতরে গেছেন তাই।

বাবা? অবনীবাবু আপনার বাবা?

হ্যাঁ।

অহো, নমস্কার নমস্কার। আপনাদের কেসটা খুব কঠিন তবে ছাড় পেয়ে যাবেন। আমাদের এই সাহেবের মনটা নরম। একটু চেপে ধরলেই হয়ে যাবে। আমি তো বললেই ফাইল এনে দিই। লোকটি কৃতার্থ হয়ে হাসল।

আমাদের বাড়িতে যে সার্চ হয়েছিল তার ফাইলটা কোথায়? সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল সুদীপ।

ও বাবা, ওই ফাইল সাহেবের আলমারিতে। সাহেব ছাড়া কেউ হাত দেয় না। বসুন না। কথা বলতে বলতে আর একজনকে দেখেছিল, লোকটি এবার সেইদিকে ছুটল।

সুদীপ একটু ইতস্তত করল। তারপর আলতো করে দরজায় চাপ দিতেই অবনী তালুকদারের গলা শুনতে পেল, না রায়সাহেব, সৎভাবে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। আপনি একটু রাজী হয়ে যান দেখবেন অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

আপনি কি বলতে চাইছেন?

উই ক্যান ওয়ার্ক টুগেদার। অবনী তালুকদারের কণ্ঠস্বর রহস্যময়।

অফিসার কিছু বলতে গিয়ে গলা তুললেন, কে, কে ওখানে?

সুদীপ দরজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকতেই ভদ্রলোক উত্তেজিত হলেন, না বলে ঢুকলেন কেন? কে আপনি?

সুদীপ দেখল অবনী তালুকদারের মুখ সাদা হয়ে গেছে। এমন অবাক বোধহয় জীবনে হননি তিনি। সে হেসে বলল, আপনি বলে দিন আমি কে।

অবনী ঠোঁট চাটলেন, আমার ছেলে। তার গলার স্বর ফ্যাসফেসে শোনাল।

ও। অফিসার ইঙ্গিত করলেন একটা চেয়ার দেখিয়ে বসার জন্যে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন অবনী তালুকদার, স্যার, আজকে আমি চলি। আমাকে আর একটা ডেট দিন।

কেন? হঠাৎ ডেট চাইছেন? আমি কেসটা আর ঝুলিয়ে রাখতে চাই না।

প্লিজ স্যার! তুমি—তুমি, একটু বাইরে দাঁড়াবে?

কেন? সুদীপ হাসল।

ঠিক আছে স্যার। আমি পরে দেখা করব। কাগজপত্র তুলে অবনী তালুকদার বাইরে বেরিয়ে যেতেই সুদীপ তাকে অনুসরণ করল। সেই জানলাটা যেখান থেকে সুন্দর কলকাতা দেখা যায় সেখানে। পোঁছে অবনী উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করলেন, এখানে এসেছ কেন? কি চাই?

আপনিই আসতে বলেছিলেন।

আমি? কই কখন? হোয়াট ড়ু ইউ ওয়ান্ট?

আমার মায়ের গহনা।

উঃ, সেটা এদের কাছে আছে, এদের কাছে চাও।

তাই তো চাইতে এসেছি।

ওয়েট। তুমি ওখানে গিয়ে কি বলবে?

যা জানি।

কি জানো? ড়ু য়ু নো আমার সবচেয়ে বড় শত্রু তুমি?

এ ব্যাপারে আমি কি করতে পারি। আমি আপনার কাছ থেকে কোন সাহায্য চাই না। আমার মা-বাপের বাড়ি থেকে যে সম্পত্তি নিয়ে এসেছিলেন তা-ই চাইছি। কারণ টাকার আমার খুব প্রয়োজন। আপনি চিন্তা করবেন না।

এতদিন তো টাকার দরকার ছিল না। ছাত্র হিসেবে তোমার যা খরচ তা আমি দেব। তুমি হোস্টেলে গিয়ে থাকে। ব্যাপারটা হচ্ছে তোমার মায়ের গয়না কবে এরা ছাড়বে জানি না। দোজ আর আনডিসাসড ওয়েলথ।

কার?

মানে?

ওসব তো আপনার নয়। আমার মায়ের। আপনার আনডিসকোসড ওয়েলথ হবে কেন?

আমার কাছে পাওয়া গেছে যখন তখন আমার। তোমার মার নাম ওতে লেখা নেই। নট ইভন এনি পেপার। তোমার মায়ের বাবা কোথেকে কিনেছিলেন প্রমাণ নেই।

তার মানে মায়ের সম্পত্তি আপনারই হয়ে যাচ্ছে! চলি।

দাঁড়াও। কত টাকা দরকার তোমার?

অন্যসব ছেড়ে দিচ্ছি। আটটা কুড়ি ভরি ওজনের সাপের দাম কত হবে? কমপক্ষে সোওয়া তিন লক্ষ টাকা। আমাকে এক লক্ষ দিলেই হবে। সুদীপ শাত মুখে বলল।

কি? এক লক্ষ? মামারবাড়ি? ব্ল্যাকমেইলিং? পুলিশে দেব তোমাকে শুয়ার।

 

মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। চাপা গলায় বলল সুদীপ। সে দেখছিল কয়েকজন দাঁড়িয়ে পড়েছে ওদের কথাবার্তা শুনতে। কিন্তু এখন ঠিক কি করা যায় তা ওর মাথায় আসছিল না।

অবনী তালুকদার খুব কষ্টে নিজের উত্তেজনা সামলে বললেন, ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাঙ্গুয়েজ শেখাচ্ছ আমাকে! এক হাজারের বেশি এক পয়সা দিতে পারব না। ওই নিয়ে চিরজীবনের জন্যে দূর হয়ে যেতে হবে।

আমি চলি। আপনি যখন সহজে মুক্তি চাইবেন না তখন সেই ব্যাগটার কথাও আমাকে বলতে হবে।

শোন, ঠিক কত হলে চলবে তোমার?

এক লক্ষ।

অত টাকা আমি কোথায় পাব? দেখছ না এরা সব সিজ করে নিয়েছে?

তা হলে লিখে দিন আমার মায়ের গহনাগুলো আপনি নেবেন না। সেগুলোর একটা লিস্ট দিন।

ঠিক আছে। তুমি সামনের রবিবারে দেখা করো।

না, আজ। বিকেল চারটের মধ্যেই টাকা দরকার। কিভাবে দেবেন সেটা আপনার ব্যাপার।

তুমি কাল রাত্রে কোথায় ছিলে?

আপনার জানার কোন প্রয়োজন আছে?

আমি তোমার বাবা। রাগ করে তো অনেক কথাই বলতে পারি। তোমার মা আমাকে কোনদিন শান্তি দেয়নি। ঠিক যে প্লেজার চাই তা ওর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমি আমার মত থাকতে চেয়েছি সবসময়। বেশ, চারটের সময় এসো। আমি যা পারব দিয়ে দেব। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সি ইওর ফেস আফটার দ্যাট!

একা একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সুদীপের বুকের ভেতরটা কেমন করতে লাগল। একটা যন্ত্রণা, সেটা ঠিক কি কারণে তা সে জানে না, নিঃশ্বাস ভারী করে তুলেছিল। কোন নির্দিষ্ট মানুষের জন্যে নয়, এমন কি নিজের জন্যেও নয়, অদ্ভুত শূন্যতা যে কতখানি ভারী হয়ে যন্ত্রণা ছড়ায় তা এর আগে সে কখনই টের পায়নি। চারটে বাজতে ঢের দেরি, তবু সে বাড়ির দিকে চলল। মায়ের ঘরটা তাকে চুম্বকের মত টানছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *