২১. চমকে উঠল সে

চমকে উঠল সে। তার পাঁজরে খোচা মেরেছে পাশের লোকটি। বিড়ি খাবে। তার দেশলাই চাই। দেশলাই রাখে না শুভদীপ, তার ধূমপানের অভ্যাস নেই।

সে পাশ ফিরে শোয় এবং চোখ বন্ধ করে। আর মানসে ভেসে ওঠে সমুদ্র। সুনীল সুবিস্তৃত সমুদ্র। দশমীর সকালে কোণার্কের সমুদ্রপারে গিয়েছিল তারা। কোণার্ক শহর থেকে অনেকটা পথ। তারা রিকশা নিয়েছিল। তার মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে বসেছিল পাশাপাশি সমুদ্রের বালুচরে।

কোণার্কের বেলাভূমি স্নানের উপযুক্ত নয়। তাই ভিড় কম। ছোট ছোট দোকান। মাঝে মাঝে শঙ্খধ্বনি তুলছে শঙ্খের ফিরিওয়ালা। আর তারা জলের দিকে চেয়ে বসে আছে। কী অসামান্য সমুদ্র! কী গভীর! কী নীল। বড় বড় ঢেউ উঠছে না, কিন্তু সমুদ্র নিজেই শুধু জলের অপার্থিব সৌন্দর্যে তাদের বিমুঢ় করে দিল। তার মনে হল, এ সৌন্দর্য অনুপম।

যত দূর চোখ যায় গাঢ় নীল জলরাশি। ফুঁসে উঠছে না। যেন চিরশান্ত। চিরতৃপ্ত। অতুলনীয় প্রসন্নতায় পৃথিবীর গভীরতমকে স্পর্শ করেছে। সংযত লহর তুলে দিগন্তে সুনীল আকাশকে ভালবেসে করেছে আলিঙ্গন।

কথার প্রয়োজন নেই, তারা স্তব্ধ হয়ে আছে। আর বহুক্ষণ পর চন্দ্রাবলী বলছে, এমন এই নীল যেন ঈশ্বর তাঁর বিপুল মসীপাত্র উপুড় করে ঢেলেছেন। এক সমুদ্র নীলে তিনি লিখে চলেছেন চিরকালের মহাকাব্য। এই লিখন ফুরোবার নয়। সমুদ্র থেকে যাবে। শুধু বদলে যাবে মানুষেরা। এক দল যাবে। আসবে আরেক দল। আর বার বার লিখিত হবে মানুষ।

সারাদিন সমুদ্রপারে থেকে বিকেলে ফিরেছিল তারা। বনপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরেছিল। শহরে ফিরে দেখেছিল বিসর্জনের শোভাযাত্রা চলেছে। কিছুক্ষণ শোভাযাত্রা দেখে তারা অতিথিনিবাসে ফিরে আসে। আর চন্দ্রাবলী তার মুখোমুখি হয়। প্রশ্ন করে, এবার কি তারা বিয়ে করতে পারে না? এভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো, এই লোকভয়, এই মিথ্যাচার আর কত দিন?

সে তখন অন্যান্য বারের মতোই ধমকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল চন্দ্রাবলীকে। কিন্তু চন্দ্রাবলী থামেনি। সে তখন যুক্তির পর যুক্তির পর যুক্তি সাজাতে থাকে। সে বিচ্ছেদ পেয়ে গিয়েছে বলে, তার সঙ্গীত বিদ্যালয়ে আয় বাড়িয়েছে বলে, এত দিন এত ঘনিষ্ঠতার কথা, তার মা হওয়ার গভীর ইচ্ছার কথা বলে আর বিবাহকে অনিবার্য করে তুলতে চায়।

শুভদীপ তাদের গৃহে স্থান অকুলানের কথা বলে তখন। আর চন্দ্রাবলী বলে সে সানন্দে অপেক্ষা করবে সুসময়ের জন্য, শুধু তাদের বিবাহ নিবন্ধীকৃত হোক।

তখন শুভদীপ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে সংযম। এত দিন সেকথা সে বলতে পারেনি, বলতে পারেনি যে মোটা বেঁটে, কালো, গোল, কদাকার মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে পারে না–তা-ই বলে ফেলে জোর গলায় বলে ফেলে এবং একটি বিপুল ক্রন্দনের জন্য অপেক্ষমাণ হয়ে যায়।

কিন্তু চন্দ্রাবলী ক্রন্দনে আশ্রয় নেয় না। মৃত মৎস্যের মতো স্তব্ধ, অপলক চেয়ে থাকে তার দিকে। তারপর শুকনো গলায়, ভাবলেশহীন, এক অরুণেশের কথা বলে। অরুণেশ তার সহপাঠী। ভালবেসেছিল তাকে প্রেম নয়। মাঠে-ঘাটে ঘোরাফেরা নয়। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল যখন সে স্নাতকপাঠ শেষ করে ঘরে বসে, আর অরুণেশ স্নাতকোত্তর পর্ব ছাড়িয়ে গবেষণা শুরু করেছে। আপত্তির ছিল না কিছুই। শুধু অরুণেশ নমঃশূদ্র ছিল। বাবা রাজি হননি বিয়ে দিতে।

চাকরি নিয়ে রিয়াধে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসেছে অরুণেশ। বিয়ে করেনি। কারণ তার সংকল্প ছিল অন্য কারওকে বিয়ে না করার।

সে তো অপেক্ষা করেই আছে এত কাল, তবু দ্বাদশীর সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে বলে এসেছে চন্দ্রাবলী। এবার অরুণেশুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে আর কোনও বারণ রইল না। রইল না পিছুটান কোনও।

নির্ভার হয়ে ছিল শুভদীপ। হালকা। ফুরফুরে। মনে মনে হেসেছিল সে। এ জগতে প্রত্যেকেরই ভালবাসার মানুষ জুটে যায়। মা মাঝে মাঝে বলে, কোনও বেমানান নারী-পুরুষ দেখলেই বলে, যার যেথা মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডােম।

তারা অতএব একটুও স্পর্শ না করে শুয়ে ছিল সারা রাত।

অব্যক্ত চিরবিচ্ছেদ লিখিত হয়েছিল দুজনের মধ্যে। সেই রাত্রেই। হাওড়া ইস্টিশানে নেমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার মুহূর্তে চন্দ্রাবলী তাকে বলে, অরুণেশ–তার চোখ দুটি সুন্দর জানিয়েছে। মেদ নয়, মাংস নয়, ত্বক নয়–ওই চোখে ডুবে,সুরেলা কন্ঠে চেপে কান, একটি সহজ মনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে মন, জীবন কাটিয়ে দেবে অরুণেশ।

আর সেই রাত্রি থেকে তার অসহ্য কষ্ট শুরু হয়। অসহ্য যন্ত্রণা। কেউ যেন তার কোনও দেহাংশ কেটে নিয়ে গেছে। চন্দ্রাবলী আসবে না আর। চন্দ্রাবলী ডাকবেনা আর। গান শোনাবেনা। বলবেনা স্বপ্নের কথা। শুনবে না শুভদীপ যত কথা বলে। তার কষ্টে সান্ত্বনা হবে না। হতাশায় জ্বালবে আশার প্রদীপ। সে তখন কুঁকড়ে যায়। দাঁতে কামড়ে ছিঁড়ে নেয় ত্বক। নিজেকে দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে ফেলে। সে টের পায় সুতীব্র আবেগ। সুতীব্র ভালবাসা। টের পায় এ বন্ধন ছিঁড়ে ফেলা অসম্ভব। পারবে না। পারবে না সে। চন্দ্রাবলীকে দেওয়া সমস্ত তার বুকে ফিরে ফিরে লাগে, আর সে, একা, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে একা একা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়।

সে চেষ্টা করেছিল। সংযত হতে চেষ্টা করেছিল। এক দিন, দু’ দিন, তিন দিন। চতুর্থ দিন সে ভোরবেলা ছুটে যায়। চন্দ্রাবলীর বাসস্থানে ছুটে যায় আলুথালু, অবিন্যস্ত; আরক্ত চোখ। আর চন্দ্রাবলীকে দেখামাত্র সে প্রবল কান্নায় পড়ে। পারবে না সে। চন্দ্রাবলীকে ছেড়ে থাকতে পারবে না জানায়।

এবং চন্দ্রাবলী ফিরিয়ে দেয় তাকে। অসম্ভব পাথুরে নিমোহে ফিরিয়ে দেয়। এত নিরাবেগ, এত নিস্পৃহ সে কখনও ছিল না আগে।

সে যখন পাগলের মতো, কিংবা মাতালের মতো, কিংবা কঠিন রোগাক্রান্ত মানুষের মতো টলতে টলতে চলেছে তখন, কী মনে করে চন্দ্রাবলী ফিরে ডেকেছিল তাকে। বড় আশা নিয়ে সে ফিরে তাকিয়েছিল। চন্দ্রাবলী তখন তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরে ফিরে যায়। এবং বেরিয়ে আসে কার্ড হাতে। অরুণেশের কার্ড। ঠিকানা ব্যাঙ্গালোর।

সেই থেকে ক্রুদ্ধ সে। সেই থেকে চন্দ্রাবলী ঠগ ও প্রবঞ্চক। প্রতারক ও মিথ্যেবাদী। সেই থেকে সে তাকে তীব্র ঘৃণা করে। এখন, সেই মেয়েটিকে তার বড় প্রয়োজন, সেই চন্দ্রাবলীকে বড় প্রয়োজন। মেদ নয়, মাংস নয়, ত্বক নয়, এমনকী সুরেলা কণ্ঠ ও সুন্দর চোখজোড়াও নয়। তার দরকার একটি সহজ মন। তার মনের সঙ্গে মিশিয়ে নেবার জন্য একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখা মন।

কিন্তু সে ঘৃণা করে। সে ঘৃণা করে তাকে। যে বলেছিল তাকে ছাড়া বাঁচবে না এবং অনায়াসে বাঁচবার পথ করেছে ভিন্নতাকে ঘৃণা করে। সেইদিন থেকে ঘৃণা করে। এবং নিজের একাকী অস্তিত্বের মৃত্যু অপেক্ষা করে নিরন্তর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *