১৯. অবস্থা ভাল নয়

অবস্থা ভাল নয়। মস্তিষ্কে রোগাক্রমণ ঘটেছে বাবার। ডান পাশ অসাড় হয়ে গেছে। হেঁটে-চলে অন্তত প্রাতঃকৃত্য করতে যেত, সেটুকুও পারবে না আর। মা কাঁদছে। রোজই কাঁদছে গিনগিন করে। শুচু নিরন্তর মায়ের সঙ্গে আছে। অভয় দিচ্ছে। আর শুভদীপ আজও পর্যন্ত শুচুর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। তারা যেমন, সেই চোখে-মুখে কথা বলে বুঝে নিত সব, নিজস্ব ভাষায়, সেই ভাষাকেই শুভদীপএড়িয়ে যাচ্ছে প্রাণপণে।

দেবনন্দনের সঙ্গে সে স্বাভাবিক আছে। যদিও সে জানে, এই স্বাভাবিকতা আগের মতো নয়। হবেও না কখনও। কিন্তু এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে তার গাম্ভীর্য আলাদা করে কারও চোখে পড়ছে না।

জরুরি বিভাগের সাধারণ শয্যায় আছে তাদের বাবা। চারদিন জ্ঞান ছিল না। এখন মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। চিনতে পারছে না কারওকেই। চোখ দুটি ঘোর ঘোর। দু’সপ্তাহ সম্পূর্ণ কেটে গেলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে, মনে করছেন ডাক্তার।

চব্বিশ ঘণ্টা কারওকে নয় কারওকে মোতায়েন থাকতে হচ্ছে। থাকতে হবে পুরো চোদ্দো দিন। আজ চতুর্থ দিন সবে।

পরপর তিন দিন সারাদিন সারারাত্রি সে এই হাসপাতালেই ছিল। বিশ্বদীপ রাত্রে যোগ দিয়েছিল তার সঙ্গে। অসুবিধা হচ্ছে তার। তবু সে বিশ্বদীপকে কাজে বেরুতে দিয়েছে। তাদের ছোট সংস্থা। এ রকম দরকারে ছুটি আটকায় না। মাইনে কেটে নেয় অবশ্য।

দিনের সময়টায় দেবনন্দনও তার সঙ্গে ছিল। মাকে আর শুচুকেও সেই নিয়ে এসেছে। ফেরত নিয়ে গেছে। দেখতে যাবার সে রকম কড়াকড়ি নেই। নির্ধারিত সময় আছে একটা। কিন্তু প্রহরীকে দিনে একবার পাঁচ-দশ টাকা দিয়ে রাখলে সারা দিনে যতক্ষণ খুশি, যতবার খুশি যাওয়া যায়।

প্রতিদিন আসা শুচুর স্বাস্থ্যের পক্ষে ঠিক নয়। কিন্তু শুনছে না সে। কাল থেকে সে-ও অল্প-স্বল্প কাজে বেরুবে ঠিক করেছে। মাইনেটা বাঁচবে অন্তত। চার-পাঁচ ঘণ্টা কাজ করে সোজা হাসপাতালে চলে আসবে।

আজ রাত্রে হাসপাতালে সে একা। কাল থেকে সে আর বিশ্বদীপ একদিন অন্তর করে থাকবে। সকাল থেকে দেবনন্দন। দুপুর নাগাদ সে এসে থেকে যাবে রাত এগারোটা পর্যন্ত। তার থাকার পালা থাকলে আর ফিরে যাবে না।

কাজ নেই তেমন কিছু। শুধু সারাক্ষণ সতর্ক থাকা। যদি কোনও প্রয়োজন হয়। আর মাঝে মধ্যেই ওষুধ কিনতে যাওয়া। আর ওষুধ কিনতেই তাদের মাস খরচের টাকা দ্রুত শেষ হয়ে আসচ্ছে। সঙ্গে সি টি স্ক্যান ইত্যাদি পরীক্ষার খরচ আছে। প্রাথমিকভাবে সেভিংস অ্যাকাউন্টের সব টাকা তুলে নিয়েছিল তারা। কিন্তু এখন অব্রিও প্রয়োজন। আজ দেবনন্দনকে হাসপাতালে রেখে সে এসেছে-ত্র বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। দশ হাজার ও বিশ হাজার টাকার দুটি বিনিয়োগপত্র আছে তাদের। শেষ সম্বল। সে ভাবছে, দশ হাজার টাকার পত্রটি ভাঙিয়ে নেবে আপাতত।

কিন্তু তার প্রস্তাব শুনেই নাকচ করে দেয় মা। তাকে অন্যভাবে যোগাড় করার চেষ্টা দেখতে বলে।

মায়ের ইশারা বুঝতে পারে সে। এবং বুঝেই, ঋণ নেবার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়। ঋণ নিলে শুধতে হবে। কীভাবে শুধবে তারা? অতএব সে ঘোষণা করে–যতক্ষণ নিজেদের একটিও টাকা আছে, ততক্ষণ ঋণ নেবে না কোথাও।

মা তখন, শুচুর সামনেই, দেবনন্দনের প্রস্তাব দেয়। দেবনন্দন ঘরের ছেলে–এ ভাবেই উপস্থাপিত করে মা। তার কাছ থেকে ঋণ নিলে মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। আস্তে আস্তে শোধ দিলেই চলবে।

শুচু মুখ নিচু করে থাকে। হ্যাঁ বা না বলতে পারে না। মাকে সমর্থন করতে পারে না, নাকচও করতে পারে না। দেবনন্দনের ওপর ওর পূর্ণ অধিকার। কিন্তু দেবনন্দনের অর্থের ওপর ও কোনও অধিকার ফলিয়ে। নেবার চেষ্টা করে না। খাঁচায় বসে সুবল ডানা ঝাপটায়। দু’একবার শুচুকে ছোলা দিতে, লংকা দিতে অনুরোধ করে। এবং চুপ করে যায়। শুচুকে দেখলে, তার পাত্র পরিপূর্ণ থাকলেও সে বার বার ছোলা ও লংকা দাবি করে। একবার কোনও ক্রমে খাঁচার দরজা খুলে যায়। তখন সে উড়ে গিয়েছিল। দু’একবার আকাশে ঘুরে ফিরে সে প্রত্যাবর্তন করে আবার। সেদিন ছাদে বসে সে এই কথাগুলোই বলেছিল। শুচু, ছোলা দে, লংকা দে। শুচু ছোলা দে, লংকা দে।

শুভদীপ শুচুকে দেখে। মাকেও দেখে। তারপর থেমে থেমে কেটেকেটে কঠিন কণ্ঠে বলে, বাবার উপার্জন করা অর্থ বাবার চিকিৎসায় ব্যয়িত হবে। তাদের কারও অধিকার নেই ওই অর্থ অন্যভাবে খরচ করার।

শুচুর কৃতজ্ঞ চোখ সে দেখতে পায়। আর মা তখন আমারি খুলে দশ হাজার টাকার বিনিয়োগপত্র বার করে ছুড়ে দেয় তার দিকে। সে মায়ের এই ক্রোধকে শান্ত মনে গ্রহণ করতে পারে। পারে শুধু শুচুর কৃতজ্ঞ চোখ দুটির জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *