১৩. চুলে খোঁপা করে রজনীগন্ধার মালা

চুলে খোঁপা করে রজনীগন্ধার মালা জড়িয়ে দিয়েছে নদামাসি। শীর্ণ হাতগুলিতে মা পরিয়ে দিচ্ছে শাঁখা-পলা-নোয়া। তুলিতে আলতা চুবোচ্ছে নদামাসি, এখন শুচুকে পরিয়ে দেবে। ফোলানো-ফাঁপানো লাল জরিপাড় তাঁতের শাড়িতে সমস্ত শীর্ণতা ঢেকে গিয়েছে শুচুর।

পান মুখে পুরে, স্নান সেরে, পাড়হীন গরদের শাড়ি পরে বড় জেঠিমা এলেন পাশের বাড়ি থেকে। মা-ই ডেকে এনেছে। মেয়ের বিয়ে বলে কথা। জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে একটুও না জানালে হয়? বড় জ্যাঠামশাই মরে গিয়ে, জোঠিমাই এখন সকলের বয়ঃজ্যেষ্ঠ। শুচুর কপালে চুমু খেলেন তিনি। শুচু প্রণাম করল। একজোড়া ঝোলানো কানের চুল তিনি পরিয়ে দিলেন শুচুকে। ওতে অনেকখানি সোনা আছে জানাতেও ভুললেন না।

জেঠিমাকে বসতে বলে মা তখন খাটের তলা থেকে টেনে আনল ট্রাঙ্ক। চাবি দিয়ে তালা খুলল। একবার তাকাল নদামাসির দিকে নামাসি শুচুকে আলতা পরাচ্ছে তখন। মা তাড়া লাগাল। মাছ পড়ে আছে। ধুতে হবে। কুটনো কোটা, বাটনা বাটা পড়ে আছে। আসলে স্যায়ের একান্ত সম্ভার নদামাসির সামনে খুলতে পারছেনা মা। যদিও দেবনন্দনের শৈশব থেকেই থেকে গিয়েছে নদামাসি, আর দেবনন্দনের সংসার সামলাবার সমস্ত ভার তারই ওপর, তবু মা নদামাসিকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

নদামাসি এই জটিল ইঙ্গিত ধরতে পারে না। সে সরলভাবেই মাকে ধমকে দেয়। আলতা অর্ধেক পরিয়ে উঠে গেলে এয়োস্ত্রীর অকল্যাণ হয়–সে মনে করিয়ে দেয় মাকে। মা বসে থাকে। কখন নদামাসি চলে যাবে তার জন্য অপেক্ষা করে। জেঠিমা উদাস মুখে পান চিবোন। মায়ের এই আচরণ সমর্থন করছেন কিনা বোঝা যায় না।

আলতা পরানো শেষ হলে নামাসি উঠে চলে যায়। আর একটু পরেই একজোড়া রুপোর মল এনে পরিয়ে দেয় শুচুর পায়ে। দেবনন্দনের বউকে তার আশীর্বাদ। শুচু নেমে প্রণাম করে নদামাসিকে। আর নদামাসি হইহই করে ওঠে। প্রবল আপত্তি জানায়। মলজোড়া দেখে মায়ের মুখ নরম হয়ে যায়। সে তখন শুচুকে সমর্থন করে। আর নদামাসি শুচুর কপালে চুম্বন করে সুখের প্রার্থনা জানাতে জানাতে চলে যায়।

ট্রাঙ্ক থেকে একটি নীল ভেলভেটের বাজ বার করে মা তখন। জেঠিমা স্মৃতি হাতড়ে গড়গড় করে বলে যান কী কী গয়না ছিল মায়ের। প্রশ্ন করেন, সব আছে কি না। মা মাথা নাড়ে। আছে। হাজার অসুবিধাতেও মা গয়নায় হাত দেয়নি। আগলে রেখে দিয়েছে। দুই ছেলের বউ আর শুচুর জন্য। শুচুর বিয়ের জন্য।

এই সব দেখতে-দেখতে শুনতে-শুনতে শুভদীপ আশ্চর্য হয়ে যায়। মা কি তবে ভাবত, স্বপ্ন দেখত, শুচুর বিয়ে হবে!

মা তখন একটি বিছেহার বার করে এবং শুচুর গলায় পরিয়ে দেয়। একজোড়া কাঁকন ও সরু সরু চারগাছা চুড়ি বার করে পরিয়ে দেয় শুচুর হাতে। একটি লাল পাথর বসানো আংটি শুচুর অনামিকার পূরাতে চায়, হয় না। মধ্যমায় পরাতে চায়, হয় না। অবশেষে মায়ের অনামিকায় আংটি শুচুর তর্জনীতে থিতু হয়। মা শুচুর চিবুক তুলে ধরে। শুচু মায়ের চোখের দিকে তাকায়। মা ও মেয়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি লেগে থাকে দীর্ঘক্ষণ। দু’জনেরই মুখ থেকে আস্তে আস্তে খুশি মুছে গিয়ে কারুণ আসে। দু’জনেরই চোখ জলে ভরে যায়। একবার মা ডেকে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুচু। মা তাকে বুকে সাপটে নেয়। দু’জনেই নিরুদ্ধ আবেগে, কান্নায় ফুলে ফুলে ওঠে। শুভদীপ দেখে, চোখে হাত-চাপা দিয়ে বেরিয়ে গেল বিশ্বদীপ। আর জেঠিমারও চোখ ভরে এসেছে জলে। চশমা খুলে ফেললেন তিনি। এক হাত শুচুর পিঠে রাখেন। শুচু ছোট ছিল যখন, কত ভালবাসত জেঠিমাকে,  আর বিমুনি বাঁধার ছলে জেঠিমার রাশিকৃত চুলে জট পাকিয়ে ফেলতবলতে থাকেন তিনি। আর বলতে বলতে তাঁর স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। কত শরিকি ঝামেলা, কত ছোটখাটো স্বার্থের হানাহানি, কত নিলে ও মন কষাকষি–তার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। জেঠিমার মনের মধ্যে শুচুর জন্য এতখানি ভালবাসা ছিলশুভদীপ ভাবতেও পারে না।

তখন নামাসি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে। তারও গাল ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। শুভদীপ স্থির হয়ে বসে থাকে। ভার্বে। কান্না সংক্রামকা শুনেছে সে। কিন্তু এত কান্না কেন! বিয়ে হলেই এত কান্না কেন! হয়তো, যে চলে যাচ্ছে শুধু তার জন্য কান্না নয়। কান্না নিজের জন্য। যারা কাঁদে, তাদের প্রত্যেকেরই, জন্ম থেকে ছাড়িয়ে যাওয়া শিকড় উপড়ে, ছিন্ন করে নিয়ে আসার পুরনো, থিতিয়ে যাওয়া বেদনা নতুন করে মনে পড়ে। তখন, বর্তমানের বেদনা অতীতের কষ্টের সঙ্গে মিশে থৈ-থৈ হয়ে যায়। চকিতে মালবিকা নামে মেয়েটিকে তার মনে পড়ে যায়। মালবিকাদের বিয়ে হবে কখনও। তারা শুধু ছিন্ন নয়, উৎপাটিত এবং ছুড়ে ফেলে দেওয়া।

কান্নার দমক সামলে মা তখন শুচুকে সব বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে আসার জন্য নির্দেশ দেয়। শুচু বড় জেঠিমাকে প্রণাম করে, মাকে প্রণাম করে এবং শুভদীপ কিছু বোঝার আগেই তাকেও প্রণাম করে বসে।

এই প্রথম। এই প্রথম তার বোন তাকে প্রণাম করছে। সে উঠে দাঁড়ায়। নিজের মধ্যেকার শত যুক্তি, শত আলোচনা সত্ত্বেও তার মনে হয়, দাদা হিসেবে বোনকে কিছু দেওয়া উচিত ছিল তার। সে শুচুর দু’ কাঁধে হাত রাখে। নতুন নকশা নেই, পালিশ করা নেই, পুরনো গয়না, তবু তারই আঁচে শুচু যেন বহুগুণ সুন্দরী হয়ে উঠেছে। ওই নীলচে, শীর্ণ, ক্ষার্টে শরীরেও যে এত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে ধারণা ছিল না তারা সে শুচুর গালে হাত রাখে এবং চোখের জল মুছিয়ে দেয়। আর হঠাং বলা নেই, কওয়া নেই, তার নিজের চোখ দিয়েই আশ্চর্য অশ্রু নেমে আসে। গভীর আবেগে শুচুকে জড়িয়ে ধরে হু-হু কেঁদে ফেলে শুভদীপ। এবং মুহূর্তে সামলে নেয়। কারণ তার কান্না শুচুকে আরও বেশি অস্থির করে তুলেছে। এত কান্না ওর স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ হতে পারে। সে চোখ মুছে শুচুকে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়। সকালের ওষুধগুলো খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে। চোখ মুছতে মুছতে আদুরে বালিকার মতো ঘাড় নাড়ে শুচু। সে তখন বাবাকে প্রণাম করে আসার নির্দেশ দেয় শুচুকে। শুচু চলে গেলে সানাই বন্ধ করে অনেক দিন পর সে উল্লাস কশলকরের ভৈরববাহার চালিয়ে দেয়। আর শুনতে পায় মা আর জেঠিমা সংসারের আলোচনা করছে। ট্রাঙ্ক থেকে ভারী ভারী কাঁসার থালাবাটি-গ্লাস বার করছে। মেয়ে-জামাইকে দুপুরবেলা খেতে. দেবে। জেঠিমা মাকে চন্দ্রহারের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন। মা উত্তর দিচ্ছে, সেটি বড়ছেলের বউ পাবে। আর তাহলে জড়োয়ার সেটটা ছোটছেলের বউ পাচ্ছে। উপসংহারে পৌঁছচ্ছেন জেঠিমা। তার পরেই প্রশ্ন করছেন, আজ দুপুরে কী কী রান্না হবে। তিনি শাড়ি-টাড়ি ছেড়ে পরে রান্নায় যোগ দেবেন কিনা। কোথাও আবেগের এতটুকু চিহ্নমাত্র নেই। কষ্টের এতটুকু রেশমাত্র নেই।

দেবনন্দনের আসার সময় হয়ে গিয়েছে। শুভদীপ একবার রাস্তার কাছে দাঁড়ায়। উল্লাস কশলকরের স্বর ভেসে আসছে এ পর্যন্ত। দেবনন্দন সারাদিনের জন্য একটি বড় গাড়ি ভাড়া করেছে। টাটা সুমো। অনেক জন ধরে যাবে। বিশ্বদীপ নিয়ে আসবে তাদের। শুভদীপের চন্দ্রাবলীকে মনে পড়ে যায়। বিয়ে করবার কী অসম্ভব ইচ্ছা যে ছিল তার। আজ যদি চন্দ্রাবলী থাকত, থাকা সম্ভব নয়, তবু যদি থাকত, হৈ-চৈ করে একাই মাতিয়ে রাখত সারা বাড়ি।

একদিন, তারা বসে ছিল জল থেকে চাঁদ উঠে আসা সেই উদ্যানে। জোড়া জোড়া নারী-পুরুষের মধ্যে ঠিক তাদের কাছেই এসে বসল দু’জন। মেয়েটিকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল চন্দ্রাবলী। তার চেনা!তার বহু পুরনো বান্ধবী। কলকল করে উঠেছিল দু’জনেই। চন্দ্রাবলী শুভদীপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বান্ধবীর। বলেছিল, একরছরের মধ্যেই তারা বিয়ে করবে। আইনগত বিচ্ছেদ হয়ে গেলেই। বিচ্ছেদের তখন আবেদন করা হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রাবলীর, বোঝাপড়ার বিচ্ছেদ। বান্ধবীটি এবং তার সহচর অভিনন্দন জানিয়েছিল তাকে সে হেসেছিল বিনিময়ে এবং ভেতরে ভেতরে ক্রুদ্ধ হয়েছিল। নিজেদের জায়গায় ফিরে আসতেই সে চাষ গলায়, কড়াভাবে চন্দ্রাবলীকে বিয়ের স্বপ্ন দেখতে নিষেধ করে দেয়। নিষেধ করে দেয়, যখন-তখন যাকে-তাকে এইভাবে বিয়ের কথা বলে বেড়াতে। চন্দ্রাবলী সরলভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিল তখন, মহুলি বিবাহিত। যেন মহুলি বিবাহিত বলেই শুভদীপের চন্দ্রাবলীকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে আর কোনও বাধা থাকতে পারে না। শুভদীপ তখন ক্রোধের চরমে। দাঁতে দাঁত পিষে আরও একবার সাবধান করেছিল।

ঠিক তখনই বান্ধবীটি তার বন্ধুকে নিয়ে তাদের মুখোমুখি এসে বসেছিল। চন্দ্রাবলীকে একটি গান শোনাতে অনুরোধ করেছিল সে। কারণ তার বন্ধুকে সে অনেকবার গল্প করেছে কত ভাল গায় চন্দ্রাবলী।

চন্দ্রাবলী উদাস হয়ে জলের দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপর গান ধরেছিল। ধরা গলায়।

চলি ম্যায় খোজ সেঁ পিয়াকি। সিটি নহি সোচ রহ জিয়কি?

রহ নিত পাস হি মেরে। ন পাউ যারকো হেরে।

—প্রিয়কে খুঁজে চলেছি। কী করে তাঁকে পাব এ ভাবনা আর গেল না। সে আমার নিত্য সহচর। তবু তাকে চোখে দেখতে পাই না।

বিকল বহু ওরকো ধাঁউ। তব ই নাহ কন্তকো পাঁউ ॥

ধরোঁ কহি ভাঁতিসোঁ ধীরা। গয়ৌ গির হাঁথসে হীরা ॥

–বিহ্বল হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি কেবল। তবু তাকে পাচ্ছি না কোথাও। আর যে ধৈর্য থাকে না। আমার হীরা পড়ে গেল হাত থেকে।

কটি যব নৈনকি ঝাঁঈ। লখে অব গগনমে সাঈ ॥

কবীর শব্দ কহি হ্রাসা। নয়নমে যার কো বাসা ॥

—চোখের পর্দা সরে গেল যেইদিন, দেখি প্রভু রয়েছেন আকাশে, সহস্ৰারে। কবীর বলে, আমার নয়নেই তাঁর বাস। একথা উচ্চারণ করতেও ভয় হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *