১২. কত অগ্রহায়ণ পার করে

কত অগ্রহায়ণ পার করে এসেছে তারা। কত শীত ঋতু। কিন্তু এ রকম সকাল তাদের উঠোনে, তাদের ঘরে, পরিবারে আসেনি কখনও। কী আশ্চর্য প্রসন্ন এ সকাল! কী সুন্দর! ঘুম থেকে উঠে উঠোনে দাঁড়াতেই তার মনে হল—আজকের রোদুর খুব খুশি। পাঁচিলের পলেস্তারা খসে যাওয়া ইট থেকে যেন আভা বেরোচ্ছে। কলতলাটা কী আশ্চর্য পরিচ্ছন্ন। যেন এক বালতি সুখ এসে ধারাস্নান রচনা করছে কলের তলায়। আকাশ কী রকম আনন্দ-আনন্দ! পাখিরা কীরকম আনন্দ-আনন্দ। সুবল রোজকার মতোই বলছে, হরে হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ, বলছে তাকে ছোলা দেওয়া হোক, লংকা দেওয়া হোক, উঠোনের কোণে শালিক-চড়ুই কিচকিচ করছে, এধার থেকে ওধারে উড়ে যাচ্ছে কাক। সবই হুবহু রোজকার মতো কিন্তু যেন রোজকার মতো নয়। সুবলের এই ডাকের মধ্যে জীবনের এক গাঢ় ইঙ্গিত যেন আছে। কাক-শালিক-চড়ুইয়ের আনাগোনা আর ডাকাডাকির মধ্যে যেন আছে প্রাণের আশ্চর্য ব্যাখ্যা।

তাদের ঘরগুলিতে তোরঙ্গ থেকে ভাল বিছানার চাদর, টেবিল-ঢাকনা বার করে পেতে দেওয়া হয়েছে। ফুলদানিতে বড় বড় রজনীগন্ধার ছড়া। জিনিসে ঠাসা ঘর তাদের, সেজে উঠেছে নতুন সাজে। কী সুন্দর লাগে একটু সাজালে-গোজালে! যেন অগ্রহায়ণের সাজ-পরা রোদুবই আধখানা ঢুকে পড়েছে ঘরে। ফুলদানি থেকে রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে। কাকে যেন খুঁজে ফিরছে একা একা। বিশ্বদীপ সানাইয়ের ক্যাসেট চালিয়ে দিল আর তক্ষুনি সারা বাড়ি ভরে গেল হুলুধ্বনিতে। আর রজনীগন্ধার গন্ধ মিশে গেল সুরে। তার একাকীত্ব ঘুচল। যেনঞতক্ষণ সুরেরই আরাধনা করছিল সে।

তাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেবার জন্য তাড়া লাগাল মা। বাজার করতে হবে। নটা নাগাদ এসে পড়বে দেবনন্দন। তারা শিবানী মায়ের মন্দিরে যাবে।

সকাল-সকাল স্নান সেরে নিয়েছে মা। কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়েছে বড় করে। চুল খুলে দিয়েছে। সেই চুল ঠাকুরের চুলের মতো ছড়িয়ে আছে পিঠময়। লাল পাড় সাদা খোল সুতির শাড়ি পরেছে মা। সন্ধেবেলায় পরবে কোরা রঙের ওপর লালপাড় ধনেখালির তাঁত।

মা জিগ্যেস করেছিল তাকে, কত টাকা সে খরচ করতে পারবে। সে না ভেবেই ঝলছিল সাড়ে তিন হাজার টাকা। সঠিকভাবে ধরলে তিন হাজার আটশো আঠারো টাকা। মা অবাক তাকিয়েছিল। আর তার হাত উঠে গিয়েছিল কপালে। সে মনে মনে সেই দুই ব্যক্তিকে ধন্যবাদ দিয়েছিল আবার। হয়তো তাঁদের সঙ্গে কোনও দিনই আর দেখা হবে না তার।

মা একটু ভেবেছিল তখন, সংসারের হিসেব রাখতে রাখতে মা এমন পাকা হিসেবি। মনে মনে দ্রুত যোগ-বিয়োগ করে নিতে পারে। ব্যাঙ্কের সেভিংস অ্যাকাউন্টে মাত্র দু’ হাজার পড়ে আছে। তার থেকে এক হাজার তুলে ফেলতে চায় মা। শুচুর জন্য একটা ভাল রেশমি শাড়ি কিনে দিতে বলে।

সে আর বিশ্বদীপ মিলে কিনে এনেছে শাড়ি। হলুদ জমি। লালের ওপর সোনালি জরির কাজ করা পাড়। এ ছাড়া ফুলিয়ার তাঁতও নিয়েছে একখানা। লালজমি। সোনালি চওড়া পাড়। তারা দু’জন কতখানি শাড়ি পছন্দ করতে পারত তার ঠিক ছিল না। শুচুই পরামর্শ দেয় মিঠুকে সঙ্গে নেবার জন্য। মা জানে না মিঠুর কথা। অতএব মিঠু বাইরে থেকে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এবং মিঠুরই পরামর্শে তারা কিনে নেয় শাড়ির সঙ্গে রং মেলানো ব্লাউজ ও শায়া ইত্যাদি। আজ বিকেলেও সঙ্গে যাবে মিঠু। কারণ বাবাকে আগলানোর জন্য মা থাকবে বাড়িতে। মা যায়েম। দেবনন্দনের সহচর হিসেবে সঙ্গে যাবে শ্যামলিম আর প্রণয়।

দেবনন্দনের জন্য পাজামা-পাঞ্জাবি কিনেছে সে সঙ্গে ভাই আর বাবার জন্য। আর মায়ের শাড়িখানা। সব কিনতে তার বেরিয়ে গেছে বারোশো টাকা। মিঠু সঙ্গে ছিল বলে তারা একটু খাওয়া-দাওয়াও করেছে বাইরে। সব মিলিয়ে আরও গিয়েছে দেড়শো। তার জন্যও একটি পাঞ্জাবি পছন্দ করে জোর করছিল মিঠু। তার ভাল পাঞ্জাবি আছে। আকাশি রং। গলায় কাঁথার কাজ করা। চন্দ্রাবলী দিয়েছিল তাকে। জিনসের ওপর পাঞ্জাবি চন্দ্রাবলীর প্রিয় পোশাক ছিল। আজ সেই পোশাকই পরে যাবে সে। যদিও আরও বেশি শীত পড়লে সে জিনস পরবে না স্থির করেছিল কিন্তু আজকের দিন ব্যতিক্রম। আজ সে সমস্ত সুন্দরের মধ্যে দিয়ে যাবে।

সে বাজার যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তাকের ওপর তোলা ঠাকুরের পটের কাছে দাঁড়িয়ে ফুল সাজাচ্ছিল মা। আজ একটু বেশি ফুল পড়েছে। মায়ের পায়ের কাছে বসে চন্দন ঘষছিল শুচু। ঠাকুরের জন্য। শাড়ি পরেছে শুচু আজ। তারও পিঠময় ছড়ানো কালো চুল। ভেজা। টিপ পরেছে কপালে। নতুন করে শ্রী লেগেছে তার মুখে। নতুন করে লাবণ্যময়। তার চোখ দুটি বড় বড় লাগছে। থেকে থেকে হাঁপ ছাড়ছে সে। চন্দন ঘর পরিশ্রম সহ্য করতে পারছে না। বিশ্বদীপ শুচুকে সরিয়ে নিজে চন্দন ঘষতে বসে যাচ্ছে তখন। আর মা হাঁ-হাঁ করছে। গেল-গেল করছে। বিশ্বদীপ স্নান করেনি। আর বিশ্বদীপ হাসছে। হাসতে হাসতে গঙ্গাজল এক গণ্ডুষ হরলিকসের বোতল থেকে নিয়ে দিয়ে নিচ্ছে মাথায়। আর মা শান্ত হয়ে যাচ্ছে। গঙ্গাজলে সব পবিত্র হয়ে যায়।

শুচুর দিকে তাকিয়ে তীব্র কষ্ট হল তার। নিজেদের অক্ষমতায় যন্ত্রণা হতে থাকল। বেনারসি শাড়ি নেই, গয়না নেই, আলোকসজ্জা নেই, একশো লোকের নিমন্ত্রণ নেই তাদের বোনের বিয়ে হচ্ছে। একটিমাত্র বোন তাদের ন্যাড়া করে বিদায় দিচ্ছে তারা।

তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করে সে। ব্যাগ নিয়ে, টাকা নিয়ে বাজারে বেরিয়ে যায়। মা তার পিছু ডাকে এবং একটি ফর্দ ধরিয়ে দেয়। তারা ছাড়াও আজ অতিরিক্ত তিনজন। দেবনন্দন, শ্যামলিম, প্রণয় সকলেই চেনা। সকলেই এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করে। তবু আজ তারা বিশেষ অতিথি। বাবা আজ স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছে পাশের ঘরে। ছোট ঘরে। দেবনন্দনের বাড়িতে আজ রান্না-বান্না নেই। তাই সে, মায়ের সাহায্যের জন্য নদামাসিকে পাঠিয়ে দিয়েছে এ বাড়ি। টাকা কাঁচাবার জন্য মা কোনও ঠিকে-ঝি পর্যন্ত রাখেনি। সমস্তটাই নিজে করে একা সামলায়।

বাজারের পথে যেতে যেতে শুচুর কথা সে ভাবতে থাকে আবার। শুচুকে কিছুই দিতে পারল না তারা। একজোড়া নতুন চটি পর্যন্ত না।

একটি পাথরে হোঁচট খায় সে। আর তার মধ্যে দেখা যায় স্ববিরোধ। বিদায়েই কি। শুচু তো থাকবে এ পাড়াতেই। তারই প্রিয় বন্ধুর বাড়ি। শুচু চাইলেই এ বাড়িতে চলে আসবে। তারাও যেতে পারবে ইচ্ছে করলেই। আর বিয়ে তো একটা অতি সাধারণ ব্যাপার। যৌনতার আইনগত স্বীকৃতি। তার সঙ্গে এত জিনিসপত্র, দ্রব্যাদি জড়িয়ে দেওয়া কেন!

নিজেকে শাসন করে সে। প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী–এমনই সে মনে করত নিজেকে। অথচ ইদানীং, প্রতিদিনই সে আবিষ্কার করছে, সে নিজে গতানুগতিক ধ্যানধারণার বাইরে নয়। চিরাচরিত রীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তারও আবেগ এবং অস্তিত্ব। কেন দিতে হবে বেনারসি? কেন দিতে হবে গয়না? কেন দিতে হবে খাট-পালঙ্ক?

তবু, এইসব ভাবনা ছাপিয়ে আবার অন্য ভাবনা এসে পড়ে। দিন ফিরলে সে শুচুকে অনেক কিছু গড়িয়ে দেবে এমন সংকল্প এসে যায়। আর চারদিন বাদে কাজে যোগ দেবে বিশ্বদীপ। হয়তো সে দাঁড়ালে তাদের দিন ফিরবে।

তাকে অনেক উপহার দিত চন্দ্রাবলী। আর মহুলি কিছুই দিত না। শুধু তাকে জিগ্যেস করত সে কোন রং পছন্দ করে। কোন রং চায়। সে বলত। পরদিন মহুলি সেজে আসত সেই সব রঙে। টিপ থেকে শুরু করে, চুলের ক্লিপ, ব্যাগ, সালোয়ার কামিজ, জুতো–সব এক রঙের। তার চোখ ধাঁধিয়ে যেত। সে মুগ্ধ চোখে তাকাত মহুলির দিকে। মহুলি তাকে আহ্বান করত। সে একটা অদ্ভুত আবেগে ছটফট করত তখন। দিশেহারা লাগত তার। মহুলির বুকে মুখ ঘষত সে। কামিজের ওপর দিয়ে কামড়ে ধরত স্তন। মহুলি চুল খামচে ধরত তার। তার হাত যোনি স্পর্শ করতে চাইত। ঠিক সেই মুহূর্তে মহুলি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিত তাকে। কেউ এসে যেতে পারে বলে ভয় দেখাত। সে তখন কাতর, বড় কাতর হয়ে তাকিয়ে থাকত মহুলির দিকে। সুন্দরী মহুলি সৌন্দর্যে অপার্থিব হয়ে উঠত তখন। আর সে, জানে না কেন, মনে মনে চন্দ্রাবলীকে বকে উঠত। যেন চন্দ্রাবলীর দোষেই সে মহুলিকে পেতে পারছে না পুরোপুরি। এবং যেহেতু মহুলি উপহার দেয় না তাকে, কিন্তু চন্দ্রাবলী দেয়, সেহেতু উপহার না দেওয়াকেই সে মনে করত ন্যায্য এবং এক-একদিন টানা একঘন্টা চন্দ্রাবলীকে উপহার নিয়ে বকাবকি করত।

চন্দ্রাবলীর মুখে ছায়া পড়ত তখন। অন্ধকার মুখ হয়ে উঠত গাঢ় অন্ধকার সহ্য করতে করতে একসময় ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠত সে, উপহার আসলে অভিব্যক্তি। ভালবাসার অভিব্যক্তি। ভালবাসার মধ্যে পাবার জন্য কাঙালপনা যতখানি আছে, তার দ্বিগুণ আছে দেবার আর্তি।

প্রেম-ভালবাসার ভাবনায় বড় বেশি ডুবে থাকত কালোকাকার মেয়েটা।

মাছের বাজারের হাঁক-ডাক কানে এল তার। আর, এতদিনের মধ্যে, এই প্রথম, বড় মাছ কিনবে বলে সে মাছের বাজারে এসে দাঁড়াল বুক ফুলিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *