2 of 3

০৬৭. আজ শচীনের চেহারার মধ্যে

আজ শচীনের চেহারার মধ্যে একটা দুর্যোগের পূর্বাভাস ছিল। ফরসা মুখ লাল টকটক করছে কোনও অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায়। চুল অবিন্যস্ত। চোখের দৃষ্টিতে নীরব হুংকার। কৃষ্ণকান্ত আর বিশাখা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করে বসে রইল। শচীন সাইকেলটা স্ট্যান্ডে তুলল একটা হিংস্র ঝটকায়। তারপর অতি দ্রুত পায়ে ভিতর বাড়ির দিকে চলে গেল।

কৃষ্ণকান্ত দিদির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, কোথায় গেল বল তো!

বিশাখা খুব স্তিমিত গলায় বলে, বোধহয় বউদির খোঁজ করতে।

কৃষ্ণকান্ত খুবই বুদ্ধিমান। সে যতই ব্রহ্মচর্য করুক আর স্বেচ্ছা-নির্বাসনে বাস করুক, ঘটনার আঁচ সে ঠিকই পায়। তাই, প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে বলল, তুই বরং যা ছোড়দি। গিয়ে শচীনদাকে জিজ্ঞেস কর কাকে খুঁজছে।

দাসী-চাকররাই বলবে। আমার যাওয়ার কী?

বিশাখা বিবশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। শচীন এই এস্টেটের উকিল হলেও বাইরের লোক। এ বাড়ির অন্দরমহলে হুটহাট ঢুকে যাওয়ার অধিকার তার নেই। তার ওপর শচীন কেন অসময়ে এসে হাজির হয়েছে তাও জানে বিশাখা। সব মিলিয়ে তার ভিতরেও একটা রাগের ঝাঁঝ উঠছিল। কিন্তু বেশি কিছু করার সাধ্য তার নেই। বাবা যদি একটু কঠিন ধাতের মানুষ হত তবে শচীনের এত বাড় হতে পারত না।

কৃষ্ণকান্ত এবার একটু চাপা গলায় বলে, শচীনদা একটু রেগে আছে মনে হচ্ছে।

কেন রেগে আছে তা বিশাখা অনুমান করতে পারে। ভিতরকার ঘটনা সে সবটা জানে না ঠিকই, কিন্তু বউদির এই যে হঠাৎ বরিশাল যাওয়া এটা যে এমনি নয়, ভিতরে যে আরও একটু কিছু আছে তা বুঝতে তার অসুবিধে হয় না। শচীনকে ফাঁকি দিয়েই গেছে বউদি। মুখের গ্রাস সরে যাওয়ার খবর পেয়ে এখন জখমি বাঘের মতো এসেছে শচীন। কী কেলেঙ্কারি হয় কে জানে! কৃষ্ণকান্তর কথার জবাবে শুধু বলে, হ্যাঁ, খুব তেজ হয়েছে। দারোয়ান দিয়ে গলাধাক্কা দেওয়ালে ঠিক হত।

কৃষ্ণকান্ত বলে, যাঃ, কী যে বলিস!

ঠিকই বলি। বাবা ওরকম মেনিমুখো বলেই এসব কেলেঙ্কারি হচ্ছে। অন্য কোনও জমিদারবাড়ি হলে ওকে ঘাড়ধাক্কা তো দিতই, বাড়ির বউকেও চুলে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত।

কৃষ্ণকান্ত কোনও কথা বলল না। কৃষ্ণকান্ত যে চুপ করে রইল তার কারণ একটাই। ভিতরে ভিতরে সে নিজের বয়সকে ছাড়িয়ে একটু বেশি পরিণত হয়ে উঠেছে। সে তার ছোড়দির মতো সহজে উত্তেজিত হয় না। প্রতিক্রিয়ার বদলে তার ভিতরে শুরু হয় বিচার বিশ্লেষণ এবং সমাধানের চেষ্টা। বউদির সঙ্গে যে শচীনদার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা শোনা আছে তার। অনেক ভেবে সে এই সমস্যার কোনও সমাধান খুঁজে পায়নি। একথাও ঠিক যে, তার বাবা নিরীহ, বড়দা কনককান্তি ব্যক্তিত্বহীন এবং সে নিজে ছেলেমানুষ। সেই কারণেই এই প্রায় অভিভাবকহীন পরিবারের কোনও রক্ষাকবচ নেই।

কৃষ্ণকান্ত ছোড়দির দিকে একদৃষ্টে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, তুই তো খুব ঝগড়ুটে। এখন গিয়ে ঝগড়া করতে পারিস না?

ঝগড়া! বিশাখা অবাক হয়ে বলে, কার সঙ্গে?

কেন, শচীনদার সঙ্গে।

ঝগড়া করব কেন?

তুই তো ঝগড়ার কথাই বলছিস এতক্ষণ। এখন যা না গিয়ে ঝগড়া করে আয়।

আমার বয়ে গেছে। যে যার কর্মফল ঠিক ভুগবে। ভগবান তো আছেন।–এই বলে বিশাখা উঠে গেল।

শচীনের মুখোমুখি হওয়ার কোনও ইচ্ছা ছিল না বিশাখার। তবু একবার শচীনের রাগে গনগনে মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছিল। বুকের জ্বালা খানিকটা জুড়োয় তা হলে।

দোতলায় উঠবার সিড়ির গোড়ায় যখন বিশাখা প্রথম ধাপটায় পা তুলেছে তখন শচীন নেমে এল ঝড়ের বেগে। সামনে বিশাখাকে দেখেই একটু থমকে গেল।

বিশাখা দেখল, শচীনকে একদম অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। যেন-বা উন্মাদেরই দৃষ্টি তার চোখে।

শচীন তাকে ধমকের স্বরে জিজ্ঞেস করে, চপলা কোথায়?

বিশাখার আপাদমস্তক এই প্রশ্নে জ্বলে যায়। এই পুরুষটির প্রতি তার কিছু দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল বটে, কিন্তু তার আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। উপরন্তু লোকটার বেহায়া নির্লজ্জপনা দেখে তার ভিতরটা আরও গরম হয়ে গেল।

বিশাখা পালটা প্রশ্ন করে, আপনি কার হুকুমে ওপরে গিয়েছিলেন?

তার মানে? হুকুমটা আবার কার কাছ থেকে নিতে হবে? তোমার কাছ থেকে নাকি?

বাইরের লোক হয়ে আপনি যখন-তখন ভিতরবাড়িতে ঢুকবেন কেন?

আমার দরকার ছিল।

কী দরকার তা আমার জানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আপনি পুরুষমানুষ, একটু লজ্জাবোধ থাকলে কখনওই আপনি মেয়েদের অন্দরমহলে ঢুকতেন না।

ছোট মুখে বড় কথা মানায় না, বিশাখা। যাক, এ তর্ক হেমকান্তবাবু ফিরলেই হবে। আমি জানতে চাই চপলা বরিশাল গেল কেন। তুমি বলতে পারো?

আমার বউদিকে নাম ধরে ডাকার সাহস করে থেকে হল?

যবে থেকেই হোক, জবাবটা তোমার জানা আছে?

জানলেও বলব কেন? আপনি কে?

কথা কাটাকাটি বেশ উচ্চগ্রামে উঠে যাওয়ায় সিঁড়ির মুখে দাস-দাসীদের উকিঝুকি শুরু হয়ে গেল। বিশাখা যথেষ্ট তপ্ত বোধ করছে ভিতরে-ভিতরে।

শচীন বরং কিছু অপ্রস্তুত। এ বাড়ির মেরুদণ্ডহীন কর্তার আমলে সে-ই প্রকৃতপক্ষে এস্টেটের কর্ণধার হয়ে দাড়িয়েছে। তার দৌলতেই জমিদারির ডুবুডুবু নৌকো এখনও কোনওক্রমে টিকে আছে। এ বাড়ির কেউ তার মুখের ওপর কথা বলবে এটা ভাবাই যায় না। কিন্তু বলছে। এবং খুব অন্যায্য কথাও বলছে না। কিন্তু শচীনের ন্যায্য-অন্যায্য বিচারবোধ ক্রিয়াশীল নয়। তার মাথায় এখন ঝড়। চপলা ছাড়া তার পৃথিবী অন্ধকার। বিশাখার মুখে এরকম ন্যায্য কথাবার্তা শুনে সে দিশা হারিয়ে ফেলে বলে, আমি কে তা জানো না? আমি নইলে তোমাদের ভিটেয় ঘুঘু চরত তা জানো?

জানি। আপনি উকিল। বাবা আপনাকে এস্টেটের কাজ দেখার জন্য মাইনে দিয়ে রেখেছেন। সোজা কথায় আপনি আমাদের কর্মচারী। আপনার কী অধিকার বাড়ির বউ কোথায় গেছে তা আমার কাছে জানতে চাওয়ার?

শচীন এটা সহ্য করতে পারল না। একদম বেহেড হয়ে গিয়ে সে বলল, সরিয়েছ! তোমরাই চপলাকে সরিয়েছ! কিন্তু পারবে বাঁচাতে? চপলা আমার। আমি যেমন করে পারি তাকে দখল করবই। দেখি তোমরা কী করতে পারো।

যে রাগ ও হতাশা বহুকাল ধরে বিশাখার ভিতরে মাথা কুটে কুটে একটা বেরোবার পথ খুঁজছিল আজ সে পথ পেয়ে গেছে। বিশাখা ফুসে উঠে বলল, খুব আসকারা পেয়ে গেছেন তাই না? কিন্তু এর ফল আপনাকে ভোগ করতে হবে। হেমকান্ত চৌধুরীকে আপনি যত নিরীহ ভাবেন তত নিরীহ যে তিনি নন সেটা আমিই বুঝিয়ে দেব আপনাকে। বাবা বরিশাল থেকে ফিরুন, তারপর বুঝবেন।

কী বুঝব? কী করবে তোমরা আমার?

লেঠেল দিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে দেব। ভিটেছাড়া করব। আর কখনও এ বাড়িতে ঢুকবেন না। যান!

এর জবাবে উকিল শচীনের মুখে কোনও কথা এল না। কিন্তু তার ডান হাতটা নিজের অজান্তেই ওপরে উঠে গেল…

তারপর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আচমকা একটা চড় এসে ফেটে পড়ল বিশাখার বাঁ গালে।

অবিশ্বাস, দুর্বোধ্যতা এবং মানসিক বিকলতার দরুন চড়টাকে আসতে দেখেও বিশাখা নড়েনি। চড়টা বাঁ গালে পড়তেই সে চোখে অন্ধকার দেখল। দুলে উঠল শরীর। বিশাখা উবু হয়ে বসে পড়ল মেঝের ওপর।

মাগো!

যে-কোনও কাপুরুষের পক্ষে এ সময়ে পালিয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু শচীন পালাল । খুব অবিশ্বাসের সঙ্গে সে কিছুক্ষণ নিজের ডান হাতের চেটোটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর তাকাল কুঁজো হয়ে থাকা বিশাখার দিকে।

দাস-দাসীরা ছুটে আসছিল বিশাখাকে ধরে তুলতে।

তাদের অবাক করে দিয়ে শচীন নিজেই শেষ ধাপটায় নেমে নিচু হয়ে পাঁজাকোলায় তুলে নেয় বিশাখাকে। নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসে। ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানায়।

বিশাখার তেমন কিছু হয়নি। একটা চড় আর কতটাই বা মারাত্মক? তবে তার দুই চোখে বিশ্বের বিস্ময়। তার নিজের মা-বাবাই তাকে কখনও মারেনি। পিঠোপিঠি ভাই কৃষ্ণকান্ত কখনও-সখনও কিলটা চড়টা দিলেও সে নিতান্তই খুনসুটি। সত্যিকারের মার জীবনে সে এই প্রথম খেল। তাও এক পরপুরুষের হাতে।

দু’জনেই ভীষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে দু’জনের দিকে। ঘরে লোকজনের ভিড় হয়ে যাচ্ছিল। শচীন একটু চমকাল কেন যেন।

তারপর বিশাখার দিকে চেয়ে বলল, আমারই ভুল হয়েছিল।

শুধু এইটুকু বলেই শচীন ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে এসে সাইকেলে উঠে চলে গেল।

তিন দিন শচীন আর এমুখো হল না।

তিন দিন বিশাখারও কাটল এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। বাঁ গালটা ফুলে লাল হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু সে জ্বালা জুড়োতে দেরি হয়নি। জ্বালা মনের মধ্যে। তিন দিন ভাল করে দিনরাত ঠাহর করতে পারল না সে। অনুভব করতে পারল না তার চারদিককার বাস্তবতা। টের পেল না সে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, না কি জেগে আছে। এত অপমান সয়ে মানুষ বেঁচে থাকে কী করে? এত অপমান একজনকে করতেই বা পারে কী করে আর-একজন?

রঙ্গময়ী সবই জানে। কিন্তু সে উচ্চবাচ্য করে না। শুধু লক্ষ রাখে আর বাড়ির অন্যান্যদের ইশারায় তফাত থাকার নির্দেশ দেয়। বিশাখা তিনটে দিন চলল পুতুলের মতো রঙ্গময়ীর নির্দেশে। খেতে বললে খেল, স্নান করতে বললে করল। যেনবা ঠিক বুঝতে পারছে না সে আসলে কী করছে। কথা প্রায় ছিলই না তার মুখে।

তিন দিনের দিন ভোরবেলা উঠে রঙ্গময়ী লক্ষ করল, বিশাখাব মুখ-চোখ একটু স্বাভাবিক। রাতে ঘুম হয়েছে। চোখের কোল ভরাট।

রঙ্গময়ী একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

দুপুরবেলা খেতে বসে একটু ঠাট্টা-তামাসাও করল বিশাখা রঙ্গময়ীর সঙ্গে। তারপর দুজনে ঘরে এসে মুখোমুখি বসল।

বিশাখা হঠাৎ বলল, কী গো মনুপিসি, কী ভাবছ?

কই, কিছু তো ভাবছি না।

ভাবছ না কেন? একটু ভাবো।

কী ভাবব?

আমার কী করা উচিত একটু ভেবে বলো তো! গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ব, না কি বিষ খাব?

বালাই ষাট। তুই ওসব করতে যাবি কেন?

অপমানটা তো দেখলে।

নিজের চোখে দেখিনি, তবে শুনেছি।

এর পরেও বেঁচে থাকতে বলো!

বেঁচে থাকবি না কেন? পাগল নাকি?

পাঁচজনকে মুখ দেখাব কী করে?

সে যদি দেখায় তোর দেখাতে দোষ কী?

সে তো ছেলে। ছেলেদের তো সবই মানায়, মনুপিসি।

তোকে বলেছে! পুরুষমানুষ হয়ে একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে লোকে তাকে দুয়ো দেবে? তার নিজেরও কি কম লজ্জা!

ওর কি লজ্জা বলে কিছু আছে!

রঙ্গময়ী কথাটার জবাব চটজলদি দেয় না। একটু চুপ করে থেকে বলে, শুনেছি, তিন দিন জলস্পর্শ করেনি।

বিশাখা কথাটা শুনে চুপ করে থাকে। বুকের মধ্যে কেমন এক অচেনা ব্যথা চিনচিন করতে থাকে। কেমন অদ্ভুত লাগে একটা সিরসিরে ভাব।

অনেকক্ষণ বাদে সে বলে, জলস্পর্শ করেনি কেন?

তা কী করে বলব? তবে মনে হয় প্রায়শ্চিত্ত করছে।

আর প্রায়শ্চিত্ত করে কী হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। শহরে ঢি ঢি পড়ে যায়নি এতক্ষণে?

রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলে, দূর বোকা! দাস-দাসীরা কানাকানি করবে সে তত ঠেকানোর উপায় নেই। তবে লোক জানাজানি হয়নি। হবেও না। শহরে এখন অন্য সব সাংঘাতিক কাণ্ড হচ্ছে। কে কাকে চড় মারল তা নিয়ে কে মাথা ঘামাবে?

কী কাণ্ড, মনুপিসি?

রেললাইনের ধারে গুদাম থেকে বিদেশি কাপড় বের করে আগুন লাগানো হল সেদিন। গুলিগোলা চলেছে। ধরপাকড় হল কত। আহা!

কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের ঘটনা মোটেই স্পর্শ করল না বিশাখাকে। সে আনমনা হয়ে রইল। একটা হাই আসছিল, সেটা চেপে বন্ধ করে বলল, আমার বড় ঘেন্না হচ্ছে নিজের ওপর।

কেন হবে? দোষ তো শচীনের। তুই তো অন্যায় কিছু বলিসনি।

ঠিক বলেছি বলছ?

নিশ্চয়ই। এই সত্যি কথাগুলো কারও মুখ থেকে বেরুনো দরকার ছিল।

বিশাখা একথা শুনে একটু উজ্জ্বল হল। বলল, ঠিক বলছ?

ঠিক বলছি না তো কী? আমি পরস্য পর, নইলে ক্যাট ক্যাট করে কিছু কথা ওর মুখের ওপর বলতে আমারও ইচ্ছে করেছে কতবার।

বিশাখা বলে, আমি ভাবছিলাম কাজটা হয়তো ভীষণ অন্যায় হয়ে গেল। বাবা হয়তো ফিরে এসে সব শুনে আমার ওপর রাগ করবে।

রাগ করলেই হল? সে নিজে তো কিছু পারেনি করতে। মুখচোরা মানুষ, চোখের ওপর এসব ঘটনা দেখেও চোখ বুজে থেকেছে। দোষ তো তারই।

বিশাখা চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, শচীনবাবু বোধহয় আর আমাদের কাজ করবেন , না?

না করলেই মঙ্গল। এইভাবেই যদি ভালয়-ভালয় ব্যাপারটা মিটে যায় তবে খুব ভাল।

বিপাশা মাথা নেড়ে বলল, না মনুপিসি, তাতে ভাল হয় না।

কেন হয় না?

আমার একটা কলঙ্ক থেকে যায়। লোকে বলবে, আমি ঝগড়া করে শচীনকে তাড়িয়েছি।

লোকের আর খেয়ে বসে কাজ নেই। তুই রাখ তো।

বিশাখা মাথা নেড়ে বলে, না মনুপিসি, আমার লজ্জা করছে।

ওমা! লজ্জা কীসের?

ঝগড়া করেছি যে! সেই লজ্জা। আমি চাই না উনি এভাবে কাজ ছাড়ুন।

রঙ্গময়ী একটু চুপ করে থেকে বলে, কথাটা খুব মন্দ বলিসনি। শচীনের ইদানীংকার ব্যবহার দেখে রাগ হয় বটে, কিন্তু ছেলেটা খারাপ ছিল না। তোর বাবার জমিদারি যেতেই তো বসেছিল। ছেলেটা প্রাণপাত করে কিছু সামাল দিয়েছে। ওকে তাড়ানোটা ঠিক নয়। কিন্তু কী আর করবি?

শচীনবাবু কি এখনও আমার ওপর রেগে আছেন?

রঙ্গময়ী হেসে ফেলে। তারপর বলে, রেগে আছে বলে তো মনে হয় না। চড় মেরে সে-ই তো কোলে করে তোকে দোতলায় তুলে নিয়ে এসেছিল। রাগের লক্ষণ তো নয়।

ধ্যাৎ! কী যে বলো না! যাও—

রঙ্গময়ী হেসে বলে, কথাটা তো সত্যি। তুই যত নিজের ঘাড়ে অপমান নিচ্ছিস সে নিয়েছে তার দশগুণ। তাই তো বলছিলাম, তুই গলায় দড়ি দিবি কেন?

সারাটা দুপুর বিশাখার কাটল ফের অন্যরকম এক ঘোরের মধ্যে। চড় খাওয়ার অপমান বুক থেকে নেমে গেছে। এখন সে ভাবছে শচীন তাকে কোলে করে দোতলায় তুলেছিল। শচীন তিন দিন জলস্পর্শ করেনি। যত ভাবছে তত বুকের চিনচিন ব্যথাটা নাড়া খাচ্ছে। অস্ফুট এক ব্যথা। বড় অদ্ভুত। বড় সুখদায়ক।

চারদিনের দিন হেমকান্ত বরিশাল থেকে একা ফিরলেন।

একা যে বাবা? বউদি কোথায়? বিশাখা বাবাকে প্রায় হাত ধরে গাড়ি থেকে নামাতে নামাতে প্রশ্ন করে।

বউমা কলকাতা চলে গেল।

সে কী! ওখান থেকেই?

হ্যাঁ। কিছুতেই ফিরতে চাইল না।

কেন বলো তো!

বলছিল ছেলেমেয়েদের ইস্কুল খুলে গেছে। কনকেরও অসুবিধে হচ্ছে।

বিশাখা সহর্ষ বিস্ময়ে চেয়ে রইল বাবার মুখের দিকে। বুকটা দুরদুর করছে। বউদি যে অতিশয় বুদ্ধিমতী সে বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সেই বুদ্ধি যে প্রলয় ঘটায়নি, সংসারে আনেনি ভাঙচুর এবং কলঙ্ক তাইতে ভারী হালকা বোধ করল বিশাখা। তার মনে হল, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

চতুর্থ দিন বিশীর্ণ শরীরে কাছারি-ঘরে বিকেলে এসে বসল শচীন। তার উজ্জ্বল কান্তি কিছুটা ম্লান। মুখ অসম্ভব গম্ভীর।

হেমকান্ত সন্ধের পর তাকে ডেকে পাঠালেন।

এই যে শচীন, এদিককার সব খবর ভাল তো!

ভালই। শশীর মামলায় উকিল দিতে পারলেন?

শশীর মামলা তার বাবা লড়বে। কলকাতা থেকে এক ব্যারিস্টারও আসবেন শুনেছি। আমাদের তরফের যা বক্তব্য তা পেশ করার জন্য একজন ভার নিয়েছেন। আমার বেহাইয়ের বন্ধু। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই।

আমিও যাব একবার?

যাবে?

যাব বলেই তো ভাবছি।

ইচ্ছে হলে যেয়ো।

আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

কী কথা? মামলা-মোকদ্দমা এখন অনেক বেড়েছে। এস্টেটের কাজ দেখার জন্য যদি একজন পাকা লোক দেখে নেন তো ভাল হয়।

তোমার বদলে? —হেমকান্ত কিছু বিস্মিত হয়ে উঠে বসেন।

হ্যাঁ। আমার একটু অবকাশ দরকার।

হেমকান্ত ফাঁপরে পড়ে বলেন, কথাটা কী জানো! লোক পাওয়া খুব সোজা নয়। এমনি যারা পাকা লোক তারা সৎ বড় একটা হয় না। আমার অবস্থা তো জানোই। নিজে কিছু দেখাশোনা করতে পারি না। তোমাকে পেয়ে ভেবেছিলাম আর সমস্যায় পড়তে হবে না।

আমি গোড়া বেঁধে দিয়ে যাচ্ছি। আপনিও একটু চোখ রাখবেন। হয়ে যাবে।

কেন শচীন, তোমার কি পোষাচ্ছে না?

শচীন জিব কেটে বলে, ছিঃ ছিঃ, তা নয়। পয়সার জন্যে আপনার কাজ করছিলাম না। স্নেহ করেন, তাই।

স্নেহ তো এখনও করি।

করেন?–বলে শচীন হঠাৎ হেমকান্তের চোখে চোখ রাখে।

হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, না করার কারণ কী?

শচীন সঁতে ঠোঁট চেপে বলে, স্নেহ না করার অনেক কারণ আছে। তবু যদি করেন তবে বুঝি যে আপনি সত্যি অনেক উঁচুদরের মানুষ।

হেমকান্ত লজ্জা পেয়ে বলেন, আরে কী যে বলো! ছেলেমানুষ।

শচীন আবেগের সঙ্গে বলল, আমার অপরাধের সীমা নেই। কিন্তু সব তো বলা যাবে না। বুদ্ধিভ্রংশ তো মানুষেরই হয়।

তা হয় বটে। কিন্তু ব্যাপারটা কী বলবে?

আজ্ঞে বলব। তবে তার উপযুক্ত সময় আছে। এখন নয়।

তা হলে আমার এস্টেটের কাজটা করবে তো!

করব। তবে আমি কয়েক দিন ছুটি চাই।

কেন?

মা আর বাবাকে নিয়ে কাশী হরিদ্বার যাব।

বেশ তো, যাও।

বেশিদিন নয়। ততদিন কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন?

পারা যাবে। এখন বর্ষা সবে শেষ হয়েছে। টিমে সময়। পারব। যাও।

শচীন হঠাৎ আজ হেমকান্তকে একটা প্রণাম করে বলল, আমার যেতে দু-তিন দিন দেরি আছে। রোজই আসব। আপনি কাছারিতে আমার সঙ্গে একটু যদি বসেন তো সব বুঝিয়ে দিয়ে যেতে পারি।

সে হবেন। তোমার শরীরটা তো ভাল দেখছি না।

ও কিছু নয়।

জ্বরজ্বারি হয়নি তো!

না। বেশ আছি।

হেমকান্ত খুশি হলেন। খুব খুশি। তার বউমা কলকাতা গেছে। শচীন যাচ্ছে হরিদ্বার আর কাশী। বেশ। লক্ষণ তো খুবই ভাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *