০২. দুপুর

দুপুর

দুই লক্ষ লোকের বসতিস্থল এই কলোনিটা কোন পরিকল্পনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে নি। পশ্চিমবঙ্গে এটাই প্রথম জবরদখল কলোনি। প্রথমে, আদিতে, এখানে জায়গা ছিল জমিদারের, কয়েকটা ফুলবাগান, অসংখ্য ডোবা ও পুকুর, কয়েকটি ছোট গ্রাম।

সাতচল্লিশ সালের পর জনসংখ্যার চাপে অঞ্চলটার ম্যাপ পালটে গেল। মাঠ, বাদা, নারকেল বাগান, ধানক্ষেত, গ্রাম সব গ্রাস করে। গড়ে উঠল কলোনি।

এ অঞ্চল থেকে চিরকাল বিরোধীপক্ষ ভোট পেয়েছে। সেইজন্যই বোধহয় সরকার এখানে একটি পাকা রাস্তা, স্বাস্থ্য চিকিৎসাকেন্দ্র, পর্যাপ্ত সংখ্যায় নলকপ, একটি বাস রটে, কিছুই করেন নি। যাঁরা এই দু’দশকে অবস্থা ফিরিয়ে ধনী হয়েছেন তাঁরাও কিছুই করেন নি।

এতদিনে সি. এম. ডি. এ. তৎপর হয়েছে বলে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে।

এখন ত আর কোন অশান্তি নেই, কোন ভয় নেই। এখন আর হঠাৎ দোকানবাজারে ঝাঁপ পড়ে না, বাড়িকে বাড়ি দরজা বন্ধ হয় না, উধবাসে ছুটে পালায় না রিকশাচালক, নেড়িকুকুর, পথচারী। এখন আর সহসা শোনা যায় না বোমা ফাটার শব্দ, মার-মার, হইহই-হল্লা, মরণতের গোঙানি, ঘাতকের উল্লাস।

এখন আর ছুটে যায় না কালোগাড়ি, হেলমেট পরা পুলিশ ও মিলিটারি বন্দকে উঁচিয়ে তাড়া করে বেড়ায় না কোন আর্ত কিশোরকে। এখন আর চোখে পড়ে না ভ্যানের চাকায় দড়ি দিয়ে বাঁধা জীবন্ত শরীর খোয়ায় আছড়াতে আছড়াতে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।

এখন রাস্তায় রাস্তায় রক্ত, কোন মায়ের কণ্ঠে আত বিলাপ অনুপস্থিত। দেওয়ালের লেখাগুলি পর্যন্ত মুছে গেছে নতুন লেখার নিচে। অনেক, অনেক দিন বাঁচুন কমরেড—মজুমদার। বিপ্লবী তোমাকে ভুলব না—পল্লীর কিশোরদের নিঠর ঘাতকের ক্ষমা নেই -সব লেখা চাপা পড়ে গেছে বিজয়ীর উদ্ধত জয় বন্দনার নিচে।

এখন আর মরতে মরতে কোন কিশোর-কাঠ চেঁচিয়ে স্লোগান দেয় না। আড়াই বছরের বিশৃঙ্খলা, যা এখানকার জীবনের সশস্থল নিয়মকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল, তার কোন চিহ্ন নেই।

সুখী ও শান্তিপ্রিয় পরিবারগলি আবার ফিরে এসেছে। এখন দেখা যায় চালের অবাধ চোরাই কারবার, অহোরাত্র সিনেমার ম্যারাপ, নররপী দেবতার মন্দিরের সামনে মুক্তিকামী জনতার উন্মত্ত ভিড়।

সে দিনের ঘাতকরা এখন আংরাখা বদল করে নতুন পরিচয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একটা অধ্যায়ে পর্ণচ্ছেদ পড়েছে। দাঁড়ি। এখন মহোপন্যাসের নতুন অধ্যায় শুরু।

শুধু সরু পথগলির মোড়ে মোড়ে স্মৃতিফলকগুলো শরীরের ঈশ্য জায়গায় কুৎসিত ক্ষতচিহ্নের মত নিরন্তর স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে সব স্মৃতিফলকে সমু-বিজিত-পার্থ-লালটুদের নাম নেই। ব্রতীর নাম ত থাকবেই না। ওর নাম, ওদের নাম শুধু কয়েকটি হৃদয়ে বেঁচে আছে। হয়ত।

সমুদের বাড়িতে বসেছিলেন সুজাতা। ভল্‌ট থেকে গয়না আনা হয়ে গেছে। গয়না তাঁর ব্যাগে। নীপ্য, বিনি, তুলি, ব্রতীর ভাবীবউ, চারজনের জন্যে একসময়ে গয়নাগুলো ভাগ করা হয়েছিল।

নীপা ও বিনিকে যা দেবার তা দিয়ে দিয়েছেন।

তুলি বলে, ব্রতীর ভাগের গয়নাগুলো ওকে দেওয়া উচিত।

নীপার মেয়ে, জ্যোতির ছেলের নামে কিছু রেখে সবই হয়ত তুলিকেই দিয়ে দেবেন। সুজাতা নিজে কোনদিনই হাতে সরু বালা, কানে ফুল, গলায় একটা সর হার ছাড়া কিছু পরেন না। ব্রতী হবার পর থেকে রঙিন শাড়ি পরেন নি।

এ এখন তাঁর চেহারা ক্লান্ত, বিধস্ত, সমুর মা ওঁর সামনে বসে নীরবে কাঁদছিলেন। রোগা, কালো মুখ ভেসে যাচ্ছিল চোখের জলে। এক বছরে ওঁর চেহারা আরো জীর্ণ হয়ে গেছে। পরনে ময়লা মোটা থান।

বড় জীণ সমুদের বাড়ি, খোলার চালে শ্যাওলা, বেড়ার দেওয়াল ভাঙা, পিসবোডের তালিমারা। তবু আজ দুবছর ধরে একমাত্র এখানে এলেই সুজাতা শান্তি পান। মনে হয় নিজের জায়গায় এলেন।

প্রথমবার ওঁকে দেখে সমুরে দিদি কেঁদে ফেলেছিল। এবার ওঁকে দেখেই ওর ভুঁরু কুঁচকে গেল। সমুর মত্যুর পরেই ওর বাবা মারা যান। তখন থেকে সমুর দিদিকেই উদয়াস্ত ছেলে পড়িয়ে সংসার চালাতে হয়েছে। চিতার আগুনে শরীরের স্নেহ পদার্থ পড়ে যায়। সংসারের আগনে সমুর দিদি পড়ে ঝলসে গেছে। এখন ওর চোখে-মুখে রক্ষতা, রাগ। সমু ওকেই মেরে রেখে, গৈছে। ও বাড়ির একমাত্র ছেলে ছিল। ও ভাল কলেজে পড়বে বলে সমুর দিদিকে ওদের বাবা পড়ার খরচ দেন নি। ও নিজের পড়ার খরচ ছেলে পড়িয়ে চালাত।

ওঁর দিকে রুক্ষ চোখে তাকিয়ে কথা না বলে সমুর দিদি বেরিয়ে গেল। সুজাতা বুঝলেন ওই এখন সংসারের কত। ও আর চাইছে না সুজাতা ওর ভায়ের কথা মনে করিয়ে দিতে বছর বছর এখানে আসেন। বড় অসহায় মনে হল নিজেকে। ওর দিকে সকাতরে তাকালেন। বলতে ইচ্ছে হল, এই আসা যাওয়ার দোরটা বন্ধ কর না। বলতে পারলেন না। সমুর দিদি বেরিয়ে গেল।

সমুর মা কাঁদছিলেন। সুজাতা চুপ করে বসেছিলেন।

অরা কয় কাইন্দনা মা! হেয় আর কি ফিরিব? কয় তুমি ত তবু নি ভাল আছ। পার্থের মায়ে, দিদি, পার্থরে হারাইল। আবার পাথের ভাইটা দেহেন হেই অইতে ঘরে আইতে পারে না। হেয়া গিয়া রইছে তার মাসির বারি, কুনখানে বা।

এখনো ফেরেনি?

না দিদি। যারা গেল তারা ত গেলই। যারা জীউটুকু ধইরা আছে, তারাও কুন-অ-দিন ঘরে ফিরব না। ও বিধির কি বিধান তাই কয়েন দিদি।

সমুর মা কাঁদতে লাগলেন।

প্রথমবার, একবছর পরতে, এখানে আসার আগে খুব ইতস্তত করেছিলেন সুজাতা। সমুর মা তখন ক’মাস হল বিধবা হয়েছেন।

পাড়ায় ঢুকে সমুর নাম বলতে লোকজন, পাড়ার ছেলেরা অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়েছিল। প্রথমটা কেউ বলতে চায়নি। শেষে একজন বলেছিল, দেখেন গিয়া। ওই বারিধান।

সুজাতার দামী সাদা শাড়ি, অভিজাত চেহারা, কাঁচাপাকা চুলঘেরা প্রৌঢ় মখের বনেদীয়ানা দেখে সমুরে মা হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন।

আমি ব্রতীর মা।

একথা বলতেই, সমুরে! বলে মহিলা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সুজাতাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন উনি, আপনার পোলায় ত দিদি! ডাইকা জীবনডা দিল। অ ত আইছিল সমুগো সাবধান করতে। তা হেয় জানছিল সমু তারা চাইরজন পারায় আইয়া পড়ছে, বুঝি রাতটুকু কাটব না অগো। আইয়া যখন ব্রতী জিগাই সমু কোথা? আমি এট্টা কথা কইয়া চইলা যা, আমি বললাম রাতে নি! কোলোনি দিয়া যাইতে পারবা ধন? রাতটুকু এহানে থাহ, বিয়ান না আইতে যাইও বারি। ত অদের নি রাতটুকু কাটল? হেদিন দিদি এহানে আমার এই অতটুনি ঘরে সমু পার্থ আর ব্রতী জরাজরি কইরা শুইয়া রইল।

কোন ঘরে?

এই ঘরে। ঘর আর কই দিদি? মাইয়া গেল বোনদের নিয়া দাওয়ায়। ওই দাওয়াটুকু বেরায় ঘেরা, হেখানে রইল। এই ঘরে অরা রইল। আমি যাইয়া জানলায় বইয়া রইলাম, কে আসে দ্যাখব।

এখানে ছিল ব্রতী?

হ দিদি। হেয় আছিল দরিদ্র দোকানী, পুঞ্জি আছিল না। বাজারে একখানা খাতা, পেনসিল, ছেলেটের দোকান দিছিল। এই ঘরখানা, তা কত কষ্টে তুলেছিল। তা পোলারা এক কোণে রইল। সমুরে বাপেও জাগা, বিয়ান না আইতে অদের তুইলা দিব। ঐকোণে আমার ছিরা মাদরে শুইয়া অগো কত কথা, কত হাসি। দিদি, ব্রতীর হাসিখান আমার চক্ষে ভাসে গো। সোনার কান্তি পোলা আপনার।

ব্রতী এখানে আসত?

কত! আইত, বইত, জল দেন মাসিমা, চা দেন, কেমন ডাইকা কইত।

ব্রতী এখানে আসত! এখানে এসে চা খেত, গল্প করত, সময় কাটাত!

সমুর মাকে, ওদের ঘর, দেওয়ালে ক্যালেণ্ডার কাটা ছবি, ভাঙা পেয়ালা, সব যেন নতুন চোখে দেখেছিলেন সুজাতা।

ব্ৰতী তাঁর রক্তের রক্ত, যাকে জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর প্রাণসংশয় হয়েছিল, যে তাঁর কাছে ক্ৰমশঃ অবোধ্য হয়ে গিয়েছিল, অচেনা, তার সঙ্গে সুজাতার যেন নতুন করে পরিচয় শুর হয় সেই মুহূর্ত থেকে।

স্বপ্নে ত তিনি কতবার ব্রতীকে দেখতে পান। নীল শার্ট পরেছে ব্রতী, চুল আঁচড়াচ্ছে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে ব্রতী।

গভীর অভিনিবেশে দেখে নিচ্ছে তাঁর মুখ।

কত বিনিদ্র রাতের শেষে, যখন শুধু শারীরিক ক্লান্তিতে অবসন্ন সুজাতার চোখের পাতাকে পরাজিত করে ঘুম নামে, তখন ব্রতী সিঁড়ির নিচু থেকে ওঁর দিকে তেমনি গভীর চোখে চেয়ে থাকে। সুজাতা বলেন, ব্রতী তুই যাস না। ব্রতী চেয়ে থাকে। সুজাতা বলেন, আয় ব্রতী উঠে আয়। ব্ৰতী চেয়ে থাকে। কথা বলে না, ঠোঁটে হাসি থাকে না তখন।

কিন্তু এখানে ব্রতী কথা বলত, হাসত, বলত মাসিমা, চা করন, জল দিন আগে।

সমুর মা বলেছিলেন, আমি বলতাম—তুমি কেন এমন কইরা হকল জলাঞ্জলি দিতেছ ধন! কি নাই তোমার? সভাউজ্জ্বল বাপ, বিদ্বান মা। হে কইত না কিছু। শুধা হাসত। আর হাসিখানা আমার চক্ষে নি ভাসে দিদি।

তখনই বুকে ধাক্কা লেগেছিল সুজাতার। ব্রতীর হাসি, সেই আশ্চর্য হাসি। তিনি ভেবেছিলেন সব স্মৃতি তাঁর একলার। ব্রতী সমুরে মার বুকেও স্মৃতি রেখে গেছে তা তিনি জানতেন না কেন?

ব্রতী সেদিন বাড়িতেই ছিল। সারাদিন কি যেন সব লিখেছিল তেতলায় বসে; পরে সুজাতা দেখেছেন দেওয়ালে স্লোগান লেখার বয়ান সব। সে সব কাগজ ওর তল্লাসী করবার সময়ে নিয়ে যায়, এখন বাড়ীতে নেই।

এখন বাড়িতে আছে ব্রতীর স্কুলের ও কলেজের বই, খাতা, প্রাইজের বই, সোনার মেডেল, দাজিলিঙে বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবি, দৌড়বার জতো, খেলার কাপ! ব্রতীর জীবনের কয়েকটা বছরের স্মারক। সব মনে আছে সুজাতার, মা প্রাইজ পাব, তুমি যাবে না? ব্রতীর পাড়ার পার্কে গিয়ে বালক সংঘে ভতি হওয়া। গর্বভরে ছেলেদের সঙ্গে ড্রাম আর বিউগল বাজিয়ে স্বাধীনতা দিবসে রাস্তা দিয়ে মাচ করা, ফটেবল জিতে কাপ এনেছিল কিন্তু পা ভেঙে এসেছিল।

যে সময় থেকে বদলে যেতে শর; করে সেই বছরখানেকের বই, কাগজ, ইস্তাহার, বিপ্লবের আহান লেখা কাগজ, পত্রিকা, কিছু, বাড়িতে নেই। সব ওরা ঝেঁটিয়ে নিয়ে গেছে। সুজাতা শুনেছেন ওগুলো জালিয়ে দেওয়া হয়।

সারাদিন বাড়িতে ছিল ব্রতী। ব্যাঙ্ক থেকে সুজাতা ফিরে ওকে বাড়িতে দেখে খুব অবাক হন। পরে বুঝেছেন সারাদিন ও একটা টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। ও জানত সমরা ফিরে যাবে। জানত, সমুদের নিষেধ করে পাঠানো হয়েছে। সমুদের নিষেধ জানাতে যে যায়, সে যে সমুদের কাছে যাবে না, পাড়ায় গিয়ে খবর দেবে, তা ব্রতী বোঝে নি। ফোন পেয়ে তবে বুঝেছিল সর্বনাশ হয়েছে।

এই করেই মরেছিল ওরা। বহুজনকে বিশ্বাস করে। যাদের বিশ্বাস করেছে তাদের কারো কারো কাছে চাকরি,নিরাপত্তা, সুখী জীবনের প্রলোভন বড় হতে পারে তা ব্রতীরা বোঝে নি। বোঝে নি, প্রথম থেকেই বহুজন ওদের ফাঁস করে দেব বলেই দলে ঢোকে। ব্রতীর বয়স কম ছিল। একটা বিশ্বাস ওকে, ওদের অন্ধ করে দিয়েছিল। ওরা বোঝে নি যে-ব্যবস্থার সঙ্গে ওদের যুদ্ধ, সে-ব্যবস্থা জন্মের আগেই বহুজনকে ভ্রূণেই বিষাক্ত করে দেয়। সব তরুণ আদর্শ-দীক্ষিত নয়, সবাই মত্যুকে ভয় করে না, এমন নয়, এ কথা ব্রতীরা জানত না। তাই ব্রতী ভেবেছিল খবর গেছে, সমুরা সতর্ক হবে, টেলিফোনেও জানাবে সব ঠিক আছে।

যখন সারাদিন গেল, সন্ধ্যা হল, শীতের সন্ধ্যা কলকাতায় তাড়াতাড়ি আসে তখন বোধহয় ব্রতী ভেবেছিল খবর আসবার হলে এসে যেত এতক্ষণ। দুপর অব্দি যখন ফোন এল না তখন ওর মনে উদ্বেগ হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, সন্ধ্যা এল। সুজাতা ফিরে এলেন।

কিরে আজ বেলোসনি?

না।

কেন?

কেন আর, এমনি। চল না, চা খাবে চল না।

একসঙ্গে চা খেলেন সুজাতা। ব্রতী বসেছিল দরজার দিকে পেছন ফিরে। ওর গায়ে ছিল একটা পুরোনো শাল। অনেকদিনের শাল। নীলচে রঙ, আগাগোড়া ফুটো ফুটো। ব্রতী শীতের ময়ে ওটা গায়ে জড়িয়ে থাকত বাড়িতে। সুজাতাও বলতেন, ওটা ছাড় না বাপু, আরেকটা গায়ে দে।

ব্রতী বলত, বেশ ওম হয়, হেম বলে।

সেই শালটা গায়ে; চুলটা আঁচড়ানো নেই, ব্রতীর পেছনে দরজা খোলা। দরজা দিয়ে দেখা যায় উঠোনের ওপারে পাঁচিল, বাসন মাজার কলতলা।

চা খাওয়ার সময়ে ব্রতী অনেকদিন পর বিনির সঙ্গে খুনসুটি করেছিল। ব্ৰতী কয়েকদিন আগে বন্ধুদের সঙ্গে দীঘা গিয়েছিল। পরে সুজাতা জেনেছেন ও দীঘা যায় নি। জেনেছেন, খড়্গপুর স্টেশনেই পলিশ গিজগিজ করছিল। দীঘার পথে বাস থামিয়ে থামিয়ে হেলমেট পরা এম. পি. উঠছিল। টর্চ ফেলে মুখ দেখছিল যাত্রীদের। কোন কোন গ্রামের সামনে বাস স্লো-মোশানে যেতে বাধ্য হয়। দুধারে, পথের দুধারে অন্ধকারে বেয়নেট উঁচিয়ে পাহারাদার দাঁড়িয়েছিল। ব্রতী দীঘা যায় নি।

সুজাতা তখন তো জানেন না। বিনিও জানে না। বিনি ওকে দীঘার কথা জিগ্যেস করছিল।

ব্রতী বলল, দীঘা একটা বাজে জায়গা। যেমন থাকার অসুবিধে তেমনি খাওয়ার।

আহা আমার মাসতুতবোন গিয়েছিল। সে ত সে কথা বলল না?

তোমার বোন ত!

আর তোমার বুঝি অচেনা? তোমার প্রাণের বন্ধু দীপকের সঙ্গে ও টেনিস খেলে জান না? খুব ত আড্ডা মারতে যাও দীপকের বাড়ি?

আমি কি চিনি তোমার বোনকে?

সুজাতা বললেন, নাই বা চিনলি। গেছলি যখন তাকিয়েও দেখেছিস।

কেন?

খুব সুন্দর সে।

কি যে বল? তোমার চেয়ে সুন্দর?

বিনি অমনি বলল, মা, ব্ৰতী কিন্তু তোমায় তেল দিচ্ছে। নিশ্চয় ওর কোন মতলব আছে।

কি যে বল বিনি? ওর কি এখন সিনেমার টাকা দরকার হয়, হাতখরচ? মাকে খুশি করবার কোন দরকার নেই ওর। মাকেই দরকার নেই।

না এটা কি বললে মা?

বিনি বলল, তুমি আচ্ছা বোকা মা! আমি হলে ও যেমন ন্যাশনাল স্কলারশিপের টাকাগুলো পেত অমনি বাগিয়ে নিতাম।

অত সোজা নয় বৌদি, দাদাকে জিগ্যেস করে দেখ।

কেন, দাদাকে জিগ্যেস করব কেন?

দাদাটা হাঁদা ছিল। খরচ করে ফেলত হাত খরচের টাকা। আমার পইতের টাকা থেকে ওকে ধার দিতাম। কিন্তু টাকায় টাকা সুদ আদায় করতাম।

সুজাতার কেন মনে হয়েছিল ব্রতী ওঁকে এড়িয়ে গেল? উনি বলেছিলেন, মাকে তোর দরকার হয় নাকি? জানতে চাস কখনো মার কথা? দিন নেই, রাত নেই, শুধু বেরিয়ে যাস। বলিস কাজ আছে।

কাজ থাকে যে।

বাবা রে বাবা! এখনই এত কাজ? তোমার দাদার মত যখন সিরিয়াস কাজ করবে তখন কি হবে?

ব্রতী বলেছিল, আমি সিরিয়াস কাজ করি না তোমায় কে বলল?

সিরিয়াস কাজ মানে ত আড্ডা মারা।

আড্ডা মারা একটা সিরিয়াস কাজ নয়?

জানি মশাই জানি। আরো একটা জানি।

কি জান?

নন্দিনীর সঙ্গে আড্ডা মারা সবচেয়ে সিরিয়াস কাজ।

নন্দিনীর সঙ্গে আড্ডা মারি তোমায় কে বলল?

বলবে আবার কে মশাই? আমি বঝি নন্দিনীর ফোন ধরি না মাঝে মধ্যে?

ব্ৰতী হেসেছিল। নিঃশব্দে হাসত ও। চোখ হাসত মখ জ্বলজ্বল করত ওর। হেসেই ও চিরদিন উত্তর দেবার দায় এড়িয়ে যেত।

চল মা, লুডো খেলি ওপরে।

বিনি আবার বলেছিল, মা, ব্রতীর নিশ্চয় কোন মতলব আছে আজ।

তুমিও চল।

না বাবা। তুলির সঙ্গে কোথায় যেতে হবে। না গেলে মেজাজ করবে।

ইচ্ছে না করলে যাও কেন?

ব্রতী মৃদু গলায় বলেছিল।

সুজাতা আর ব্রতী ওপরে লুডো খেলছিলেন। লুডো খেলতে খেলতে সুজাতা বলেছিলেন, ব্রতী, নন্দিনা কে রে?

একটি মেয়ে।

আমাকে একদিন দেখাবি?

দেখতে চাইলে দেখাব।

দেখতেই ত চাইছি।

দেখলে চোটে যাবে।

কেন?

খুব সাধারণ দেখতে।

তাতে কি?

বসের ভাল লাগবে না।

বাবাকে ব্রতী ‘বস্‌’ বলত আড়ালে। ওর জ্ঞান হওয়া থেকে বাবার মুখে ‘আমি এ বাড়ির বস্‌। আমি যা বলব তাই হবে এ বাড়ীতে’ কথাটা ব্রতী কয়েক লক্ষবার শুনেছে।

না লাগল।

মা, তুমি কি জান বস, পাঁচটার পর কোথায় যায়? রোজ রোজ?

হঠাৎ সুজাতার সন্দেহ হয়েছিল, ব্রতী দিব্যনাথের সঙ্গে টাইপিস্‌ট মেয়েটির মেলামেশার কথা জানে।

এ কথা কেন হঠাৎ, ব্রতী?

এমনি। জান?

ও কথা থাক ব্রতী।

ব্রতী কিছুক্ষণ মন দিয়ে খেলেছিল। তারপর বলেছিল মা আমার জন্যে কি তোমার মনে খুব কষ্ট?

কিসের কষ্ট ব্রতী?

বল না?

কোন কষ্ট নেই ব্রতী।

মাঝে মাঝে মনে হয় হয়ত আছে। দাদাকে নিয়ে, দিদি ছোড়দিকে নিয়ে ত তোমার কোন কষ্ট নেই।

সুজাতা কথা বলেন নি। মিথ্যে বা মন রাখা কথা সুজাতা কখনো বলতে পারেন নি।

কই, কিছু বললে না ত?

কষ্টে থাকা কাকে বলে ব্রতী?

কষ্টে থাকলে তাকে বলে কষ্টে থাকা।

সবাই কি আমার মনের মত হবে? ওরা ওদের মত হয়েছে। ওরা সুখী থাকলে আমি খুশি।

ওরা কি সখী?

তাই ত বলে।

আশ্চর্য!

কি আশ্চর্য?

তুমি এত প্যাসিভ কেন মা?

না হয়ে উপায় কি বল? ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে আমাকে প্যাসিভ করেই রাখা হয়েছিল যে। তোর বাবা…তোর ঠাকুমা…

দিব্যনাথ সুজাতাকে প্রথম তিন ছেলেমেয়ের ব্যাপারে সাধারণতম অধিকারও খাটাতে দেননি সব। তাঁর মার হাতে ছিল। স্ত্রীকে পদানত না করেও মাকেও সম্মান দেওয়া যায় তা দিব্যনাথ জানতেন না। স্ত্রীকে পদানত রাখবেন, মাকে রাখবেন মাথায়, এই ছিল তাঁর নীতি।

সুজাতার আত্মসম্মান ও অভিমান ছিল খুব বেশী। বিয়ের পরেই তিনি বুঝেছিলেন, এ সংসারে তিনি নিজেকে যত নেপথ্যে রাখবেন, তাতেই অন্যের সখ। এই ‘অন্য’ বলতে তিনি দিব্যনাথ ও শাশুড়িকে বুঝতেন। জ্যোতি, তুলি, নীপা, তিনজনেই মাকে দেখেছিল অত্যন্ত গৌণ ভূমিকায়। তারাও ওঁকে উপেক্ষা করে বড় হয়েছে। তাই ওরাও সুজাতার মনে একদিন ‘অন্য’ দলে চলে যায়।

অবশ্যই দিব্যনাথ সুজাতার মনের এইসব অতল ব্যথার খোঁজ রাখতেন না। স্ত্রীর প্রতি তিনি বিশেষ আসক্ত বা বিশেষ উদাসীন, কোনোটাই ছিলেন না। স্ত্রী স্বামীকে স্বাভাবিক নিয়মে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, মানে। স্বামীকে স্ত্রীর শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আনুগত্য পাবার জন্যে কোন চেষ্টা করতে হয় না। দিব্যনাথ মনে করতেন বাড়ি করেছেন, চাকরবাকর রেখেছেন, যথেষ্ট কতব্য করেছেন। বাইরে মেয়েদের নিয়ে ঢলাঢলি করবার কথা গোপন করতেও চেষ্টা করতেন না দিব্যনাথ। তাঁর ধারণা ছিল, তাঁর সব অধিকারই আছে।

তা বলে তিনি অবিবেচক নন। তাঁর ফার্মে মোটা টাকা আসতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সুজাতাকে কাজ ছেড়ে দিতে বলেন।

সুজাতা কাজ ছাড়েন নি। ওটা তাঁর দ্বিতীয় বিদ্রোহ।

দিব্যনাথ জানতেন তাঁর ছেলেমেয়েরা বাবার চরিত্রদৌর্বল্যের কথা জানে। তাতেও তিনি লজ্জিত হতেন না। কেননা তাঁর প্রথম তিন ছেলেমেয়ে তাঁকে মানে, তাঁর সব আচরণকে পুরুষজনোচিত মনে করে, তা তিনি জানতেন।

তিনি জ্যোতিকে বলেছিলেন,

তোমার মা এ বিট পাজলিং। কাজ ছাড়বেন না কেন? উনি ত, যাকে বলে ইচিং ফর ইনডিপেনডেনস, সে টাইপের ওম্যান নন। ফ্যাশন করে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মতও নন। তবে উনি কাজ ছাড়বেন না কেন? আশ্চর্য!

তুমি মাকে বলেছ?

বললাম, এখন ত আর দরকার নেই। এখন কাজ ছাড়। সংসার দেখ-টেখ। মাও ত মারা গেছেন? বললেন, যখন ছেলেমেয়ে ছোট ছিল সংসার দেখলে ভাল হত, তখনও আমার কোন কাজ ছিল না। আমাকে কোন দায়িত্ব নিতে দেওয়া হয়নি। এখন তোমার ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে। সংসার নিয়মেই চলে। এখন আমার প্রয়োজন এখানে আরো কম।

সুজাতাকে দিব্যনাথ বুঝতে পারেন নি। সুজাতা যাকে বলে উগ্র স্বাধীনচেতা মহিলা, তা নন। আবার ফ্যাশনেবল চাকরি করে যে সব ফ্যাশনেবল মহিলারা গাড়ি চালিয়ে কলকাতা চষে ফেলেন, সুজাতা তাও নন।

সুজাতা শান্ত, স্বল্পভাষী, পোষাকে-আশাকে সেকেলে। বাড়ির গাড়ি পারতপক্ষে চড়েন। ট্রামে চড়ে ব্যাঙ্কে যান, ট্রামে ফেরেন। বাড়ি থেকে বেরোন না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেন না। বাড়ি ফিরে একটু বই পড়েন, টবের গাছে জল দেন, ছোট ছেলেকে পেলে একটু গল্প করেন।

কাজ-না ছাড়া সুজাতার দ্বিতীয় বিদ্রোহ। প্রথম বিদ্রোহটা সুজাতা ব্রতীর দুবছর বয়সে করেন। দিব্যনাথ কিছুতেই ওঁকে পঞ্চমবার ‘মা’ হতে বাধ্য করতে পারেন নি।

দিব্যনাথ বেজায় খেপে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিয়ে করলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই একটা ডিউটি থাকে। তোমার আপত্তিটা কোথায়?

সুজাতা রাজী হন নি।

তুমি আমাকে ডিনাই করছ।

তুমি তোমার ফুলফিলমেন্টের জন্যে একা, আমার ওপর কোনদিনই নিভর কর নি।

কি বলতে চাও?

যা বলছি তা তুমি জান, আমিও জানি।

দিব্যনাথ আগে, সুজাতা যখন পরপর মা হয়ে চলেছিলেন, তখনো নিয়মিত অন্য মেয়েদের সাহচর্য করতেন। এরপর থেকে তা আরো বাড়িয়ে দেন। কিন্তু সেটা যদি ফাঁদ হয়, সুজাতা সে ফাঁদে ধরা দেন নি।

কিন্তু ব্রতীর মৃত্যুর আগের দিন সুজাতা ব্রতীর সঙ্গে কথা বলতে এসব কথা বলেন নি। এখন মনে হয় জানত, সবই জানত ব্রতী, সবই বুঝত। সেজন্য মার ওপর ওর সব সময়ে চোখ থাকত। সুজাতার অসুখ হলে দশ বছর বয়সেও ব্রতী খেলা ছেড়ে চলে আসত। বলত, তোমার মাথায় বাতাস করব?

দিব্যনাথ বলতেন মিলকসপ। মেয়েমাক ছেলে। নো ম্যানলিনেস।

ব্রতীই প্রমাণ করে দিয়ে গিয়েছে ব্রতী কি দিয়ে গড়া ছিল, কত শক্তি আর সাহস দিয়ে।

সেদিন ব্রতী ওঁর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বসেছিল। তারপর বলেছিল, খেলা থাকি। এস না, গল্প করি আজ?

দাঁড়া, কি রাঁধবে বলে আসি।

ছোড়দি নেই?

না। তুলি টোনির একজিবিশন নিয়ে ব্যক্ত। একবার শুধু এসে বিনিকে নিয়ে যাবে।

তাও ত বটে!

কাল কি খাবি, বল?

হঠাৎ?

কাল তোর জন্মদিন না?

বাব্বা, জন্মদিন তোমার মনে থাকে?

থাকে না?

আমার ত থাকে না।

আমার ভুল হয় কখনো?

কাল নিশ্চয়ই তুমি পায়েস করবে?

এখন ত শুধু একটু পায়েস করি।

দাঁড়াও, কি খাওয়া যায় ভাবি।

মাংস খেতে চাস না যেন।

কেন, বস বাড়িতে খাচ্ছে?

হ্যাঁ।

কর না যা হয় একটা।

সুজাতা নিচে যাচ্ছেন, এমন সময় ফোন বাজল। ব্রতী ফোন ধরেছে দেখে উনি নিচে গেলেন।

উনি উপরে এলেন। দেখলেন। ব্ৰতী নীল শার্ট আর প্যান্ট পরে চুল আঁচড়াচ্ছে।

কি হল?

একটু বেরোতে হচ্ছে, গোটা কয়েক টাকা দাও ত।

কোথায় বেরোচ্ছিস?

একটু কাজে। টাকা দাও।

এই নে। কখন ফিরবি?

ফিরব…ফিরব…দাঁড়াও।

ব্রতী দেখে নিল প্যান্টের পকেটে কি কি আছে। একটা কাগজ ছিঁড়ে ফেলল কুচিয়ে।

কোনদিকে যাচ্ছিস?

কোন বিশেষ আশঙ্কা না করেই সুজাতা এই স্বাভাবিক প্রশ্নটা করেছিলেন। কেননা, কলকাতায় তখন একটা অন্য অবস্থা চলছে। বুড়োরা-প্রৌঢ়রা-চল্লিশ পেরনো লোকেরা যে কোন জায়গায় যেতে পারে। কিন্তু তরুণদের কাছে তখন কলকাতার অনেক জায়গাই নিষিদ্ধ অঞ্চল।

তখন সেই আড়াইবছরে কি হত না হত কলকাতার পরন্যে কাগজ ঘাঁটতে গিয়ে দেখে কি সুজাতা কম অবাক হন এই ক’দিন আগে?

সে সময় তাঁর মনে হত, কেবলি মনে হত, সব যেন উল্টোপাল্টা। ব্রতী যখন জীবিত, ব্রতীও যে চরম দণ্ডে দণ্ডিতদের দলে।

তা যখন জানেন না সুজাতা, তখনো রোজ কাগজে এক একটা ঘটনার কথা পড়তেন আর শিউরে উঠতেন।

সে সময় আবার তাঁর বাড়িতে কেউ কাগজের ভাঁজই খলত না। বলত কাগজ খুললেই দেখা যাবে কতজন মরেছে, কি ভাবে মরেছে, তার বীভৎস সব বর্ণনা।

দেখলেই সকলের খারাপ লাগত তাই সুজাতা আর ব্রতী ছাড়া কেউ কাগজ পড়ত না।

কাগজ দেখতেন সুজাতা, ব্যাঙ্কে বেরোতেন। কেন মনে হত। কলকাতা একটা রং সিটি? মনে হত সেই ময়দান—ভিক্টোরিয়া। মেমোরিয়াল-মেট্রো-গান্ধীর মতি-মনুমেন্ট, সব আছে, তবু এটা কলকাতা নয়? এ কলকাতাকে তিনি চেনেন না জানেন না।

কাগজ খুলে পরে দেখেছিলেন, যে ভোরে তাঁর ঘরে টেলিফোন বাজে, সেদিনও হাপুর বাজারে সোনার দর চড়েছিল, ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বহন করে ভারতীয় হাতির বাচ্চা দমদম থেকে টোকিওতে উড়ে গিয়েছিল, কলকাতায় বিদেশি ছবির উৎসব হয়েছিল, সচেতন শহর কলকাতা সচেতন ও সংগ্রামী শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা ভিয়েৎনামে বর্বরতার প্রতিবাদে আমেরিকান কনসলেটের সামনে রেড রোডে, সুরেন ব্যানার্জি রোডের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন।

সব কিছু ঘটেছিল। কলকাতায় তাপমান যন্ত্রে যা যা স্বাভাবিক সব। যে জন্যে কলকাতা ভারতের সবচেয়ে সচেতন শহর।

এতেই ত বোঝা যাচ্ছে কলকাতা সেদিনও স্বাভাবিক ছিল। শুধু ব্রতী ভবানীপুর থেকে দক্ষিণ-যাদবপরে যেতে পারছিল না, বারাসত থেকে আটটি ছেলে প্রথমে ফাঁস বাঁধা হয়ে জ্ঞান হারিয়ে, তারপর গুলি খেয়ে লাশ না হয়ে বেরোতে পারছিল না। পূর্ব কলকাতায় পাড়ার আবাল্য চেনা ছেলের রক্তাক্ত মৃতদেহ রিকশায় বসিয়ে, তাশা ও ড্রাম বাজিয়ে, যুবকেরা কি যেন পুজোর বিসর্জন মিছিলে প্রতিমার আগে আগে নেচে নেচে যাচ্ছিল।

কলকাতায় সচেতন ও সংগ্রামী নাগরিকদের কাছে সেটা অস্বাভাবিক মনে হয়নি।

কলকাতায় লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা ঠিক তার একবছর তিনমাস বাদে বাংলাদেশের সহায় ও সমর্থনকল্পে পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড় করে ফেলেছিল। নিশ্চয় তারাই ঠিকপথে চিন্তা করেছিল, সুজাতার মত মায়েরা ভুল পথে চিন্তা করেছিলেন? পশ্চিমবঙ্গের তরণের শহরে এ পাড়া থেকে ও পাড়া যেতে পারে না এতে তাদের সংগ্রামী বিবেক এতটুকু পীড়িত হয় নি যখন, তখন নিশ্চয় তারাই যথার্থ?

পশ্চিমবঙ্গের তরুণদের জীবন বিপন্ন, এটা নিশ্চয় কোন গুরত্বপর্ণ ঘটনা নয়? যদি গুরত্বপূর্ণ ঘটনা হত, তাহলে কি মিছিল শহর কলকাতার সংগ্রামী শিল্পী-সাহিত্যিক-বদ্ধিজীবীরা তা নিয়ে কলম ধরতেন না?

সমুর শরীরে তেইশটা আঘাত ছিল, বিজিতের শরীরে ষোলটা। লালটুর নাড়ির পাক খুলে লালটুকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে কোন পৈশাচিকতা নেই।

যদি থাকত, তা হলে ত কলকাতার কবি ও লেখক ওপরের পৈশাচিকতার সঙ্গে এপারের পৈশাচিকতার কথাও বলতেন। যখন তা বলেন নি, যখন কলকাতার প্রত্যহের রক্তোৎসবকে উপেক্ষা করে কবি ও লেখক শুধু ওপারের মরণ যজ্ঞের কথাই বলেছেন, তখন নিশ্চয়ই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীই নিভুল? সুজাতার দৃষ্টিভঙ্গী নিশ্চয় ভুল? নিশ্চয়। কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিল্পী এরা ত সমাজের সম্মানিত সভ্য, স্বীকৃতি পাওয়া মুখপাত্র, দেশের প্রতিভূ।

সুজাতা কে? তিনি ত শুধু মা। যাদের হাজার হাজার হৃদয়ে এই প্রশ্ন আজও কুরে কুরে খাচ্ছে, তারা কে? তারা শুধু মা!

ব্রতী যখন নীল শার্ট পরে অভ্যাসমত হাত দিয়ে দুদিকের চুল সমান করে নিয়ে বেরিয়ে যায়, সুজাতা জিগ্যেস করেছিলেন, কোথায় যাচ্ছিস?

ব্রতী এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়েছিল। তারপর হেসে বলেছিল, আলিপুর! দেরি হলে জেন, রণুদের বাড়ি থেকে গেছি। চিন্তা কর না।

ব্রতী তখনি জানে ভয়ংকর বিপদ ঘটে গেছে। যাকে খবর দিতে বলা হয়েছিল সে সমুদের খবর দেয় নি। কোন খবর না পেয়ে পূর্বপরিকল্পনা মত সমরা পাড়ায় ফিরে গেছে।

ব্রতী তখনো জানে না ছেলেটি সমুদের খবর দেয় নি কিন্তু পাড়ায় খবর দিয়েছে সমুরা আসবে।

তাই ব্রতী ভেবেছিল রাতেভিতে যদি সমুদের সাবধান করে দিয়ে পাড়া থেকে বের করে আনতে পারে। পারবে বলে বিশেষ আশা করেনি, ভেবেছিল পারলেও পারতে পারে।

অথচ এমন স্বাভাবিক গলায় এমন সহজে ও বলেছিল, চিন্তা কর না–যে সুজাতা নিশ্চিন্ত না হয়ে পারেন নি।

খুব নিরাপদ রণরে বাড়ি যাওয়া।

খুব নিরাপদ মিলি মিত্তির, যিশ মিত্তিরের ছেলে রণুর বাড়ি। রণু আর ব্রতী এক কলেজের ছেলে নয়, একসঙ্গে এক স্কুলে পড়েছে। রণু ওদের সমাজের বিদ্রোহী বলে পরিচিত। রণু ছাত্রজীবনেই পপ গানের দল দিয়ে কাব্যারেতে গায়, বিদ্রোহী রণু সমাজকে বিশ্বাস করে না বলে সায়েবদের সঙ্গে মারিহুয়ানা খায়, কিন্তু রণু নিরাপদ।

রণুর সঙ্গে রাত কাটালে ব্রতীর কোন বিপদ নেই। সুজাতা বলেছিলেন, হেমকে বলিস দরজা বন্ধ করে দেবে। বলিস কিন্তু।

বলব।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে ব্রতী হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে সুজাতা মুখ তোলেন। উনিও বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিলেন। দেখলেন ব্রতী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। খুব গভীর অভিনিবেশে ওঁর মুখ দেখছে।

মার মন, মার মন, এসব বাজে কথা। কই, কোন আশঙ্কা ত হয়নি সুজাতার মনে? মার মন আগে থেকে বিপদ জানতে পারে তাই যদি সত্য হবে, তবে ত সুজাতার মনে তখনি বিপদের আশঙ্কা হত।

হয়নি, কিছুই হয়নি।

পরে সুজাতা জেনেছিলেন দেড়বছর হল রণুর সঙ্গে ব্রতীর কোন যোগাযোগ নেই। এমন কোন বন্ধও নেই, যার সঙ্গে ব্রতীরও দেখা হয়, রণুরও দেখা হয়। ব্ৰতী ওঁকে সত্যি কথা বলে নি।

ঘুমোলে সুজাতার শরীর সপ্ত থাকে, চেতনা জেগে থাকে, প্রখর হয়। স্বপ্নে কত সময়ে সুজাতা সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকেন, ব্রতী নিচে। স্বপ্নে সুজাতা জানেন ব্রতী রণুর বাড়ি যাবে না, সমুদের বাঁচাতে যাবে। তাই আকুল হয়ে সুজাতা ছুটে যেতে চান, হাত ধরে টেনে আনতে চান ব্রতীকে। ফিরে আয় ব্রতী, বলতে চান।

বলতে পারেন না সুজাতা। স্বপ্নে ওঁর পা পাথর হয়ে জমে থাকে, ব্রতী ওঁর মুখ দেখতে থাকে, অপেক্ষা করতে থাকে, তারপর যখন ব্রতীর গলায় পেটে আর বুকে নীল শার্টের ওপর তিনটে গোল দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, মুখের চেহারা পালটে যেতে থাকে মাথার পেছন থেকে ঘাড় বরাবর ছুরির দাগ ফুটে ওঠে, তখন সুজাতার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম যখনি ভাঙে তখনি সেই মায়া প্রহেলিকা অদ্ভুত বিভ্রম যেন এতক্ষণ ব্রতী ছিল এখনি বেরিয়ে গেল।

না, ব্ৰতী চলে যাবার সময়ে তাঁর মনে কোন আশঙ্কা হয় নি, সেরাতেও তিনি দিব্যনাথকে হজমের ওষধ দেন। সুমন কেঁদে উঠতে বাইরে এনে ভোলান। হেমকে মনে করিয়ে দেন, কাল ব্রতীর জন্মদিন। এক লিটার দুধ কিনে আনতে ভুল না হেম। পায়েস হবে।

খুব স্বাভাবিক, দৈনন্দিন ঘটনা সব।

সুজাতা কি জানতেন, রাত বারোটা না বাজতেই সমুদের বাড়ির সামনে ভিড় জমে গিয়েছিল? পাড়ার প্রবীণ প্রবীণ ভদ্রলোকেরা চিৎকার করে বলেছিলেন, বের করে দিন ওদের?

সমুর মার কাছে যখন প্রথমবার গিয়ে দাঁড়ান সুজাতা, সমুদের ধরে বসেন, তখন ওঁর মনে হয় এটা একটা স্বাভাবিক পরিবার, এ পরিবারের লোকজনের মানসিক প্রতিক্রিয়াও স্বাভাবিক।

সুজাতা বোঝেন, তাঁর লেখাপড়া, স্বচ্ছচিন্তা, চিন্তাকে বেধ্যবাণীতে প্রকাশ করার ক্ষমতা আছে বলে তিনি যেসব কথা চিন্তা করেন, সমুর মা স্বল্প লেখাপড়া, সামান্য বিদ্যাবুদ্ধি, চিন্তাকে বোধ্যবাণীতে প্রকাশ ক্ষমতার একান্ত অভাব নিয়ে ঠিক এক কথাই চিন্তা করেন।

তাঁর যা মনে হয়েছিল, সমুর মা সেই কথা বলে কেঁদে ওঠেন, মাইরা ক্যান ফালাইল দিদি? তাগারো যদি এট্টা অঙ্গ খতা কইরাও জীয়াইয়া থইত। তবু ত জানতাম সমু আমার বাইচা আছে। আর নয় নাই দ্যাখতাম চক্ষে। নয় জেলেই থইত? তব ত জানতাম অ আমার বাইচা আছে! আমি কুন অপরাধ করছিলাম কন?

সমুর দিদি বলেছিল, কাইন্দনা মা গো। হেয় ত আর ফিরব না। হেয় ত তোমার বুকে লাথি মাইরা চইলা গেছে। মা গো! আমাগো মখ চাইয়া বুক বন্ধ।

মনেরে ত বলি কাইন্দা ফল নাই। মন বঝে না।

কাইন্দা জীবন ক্ষয় কইরা কি অইব মা?

তরা ঠিকেই কইস। আমি দিদি যে আবাগী জমদঃখী। আমার দুঃখে শিয়ালকুকুর কান্দে। কবে বা বিয়া দিচ্ছিল বাপে। হেয় লিখিপরি তেমন শিখে নাই। বারির বরো। তারেই সংসার দেখতে অইত। দেশে নি তব ধানজমি আছিল। এখানে ত কিছই আছিল না দিদি? তেমন মানুষ নয় যে ধাউরামি ধান্দা কইরা কপাল ফিরাইব! এহানেও যে দঃখ হেই দুঃখ আছিল?

সুজাতা সমুর মার প্রত্যেকটি কথা বুঝতে পারছিলেন।

এহানে মাইয়াপলা হকলটিরে লিখিপরি শিকায়। আইজকাল ত লিখিপরি ছারা চলে না দিদি! তা সমুর লিগ্যা হেয়ার কুন-অ খরচ লাগে নাই। বছর বছর বত্তি পাইছে। বৃত্তি পাইছিল বইলাই ত ওই কলেজে গিয়া ভতি হইল। কারা তারে অমন পথে নিল, কারা বা তারে মরতে শিখাইল; কত বলছি অ সম! কি বা করস? যাইস কোথা বাইর হইয়া? পোলায় বলত, মা ডরাও ক্যান? আমি মন্দ কাজ করি না। তখন বুঝি নাই।

সমুর দিদি জিগ্যেস করেছিল, মাসিমা চা খাইবেন?

দাও একটু।

সমুর মা বলেছিলেন, ওই মাইয়া কলেজ ছাইরা শুধু ছাত্র পরায় আর টাইপ শিখে। পরেরডারে তার মাসি লইয়া গিছে। তবু ত আর দুটো আছে? ছাত্র পরাইয়া চাইরডা প্যাট পরেনি কি সোজা দিদি?

সমুর দিদি চা এনেছিল। এ রকম পেয়ালায় সুজাতা কখনো চা খান নি।

হকলই অদৃষ্ট। নয় ত পোলা জয়ান আইল। পরা হ্যায কইরা চাকরি করব, বাপমায়েরে ভাত দিব, দিদির বিয়া অইবে, তা আমার মাইয়ার কপালে নি সিন্দরে উঠব কুন-অ-দিন?

ও রকম ভাববেন না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়। একদিন ওর বিয়ে হয়ে যাবে।

কথাটা সুজাতা আন্তরিকভাবেই বলেছিলেন। অথচ কথাটাকে সমুর মা অন্যভাবে নিয়ে জ্বলে উঠতে পারতেন। জ্বলে উঠলে দোষ দেওয়া যেত না। অভিভাবক নেই, পয়সা নেই, সাহায্য করবার মানুষ নেই, সমুরে মা মেয়ের বিয়ে দেবেন একদিন, এ কথা বললে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দেওয়া হয়।

সমুর মা জ্বলে উঠেন নি। সুজাতার হাত ধরে বলেছিলেন, হেই কথাই কয়েন দিদি।

তারপর, কি ভেবে বলিছিলেন, ক্যান বা আইছিল তারা? চারোজন ত পারার বাইরেই আছিল। ক্যান বা আইছিল মরতে। ক্যান বা আপনার পোলা হেই হকলডিরে সাবধান করতে আইল? আপনার ত আরেক পোলা আছে। হেয়ারে বকে লইয়া তার দুঃখ ভোলবেন। আমার ওই একো পোলা! ছডকালে টাইফাটে মইরা যায় সম! কি কইরা বাচাইছিলাম অরে! হে কি এই অইব বইলা?

ব্রতীরও ক্লাস টেনে থাকতে জণ্ডিস হয়। ভুগে ভুগে ব্রতী কি রোগা, কি হলদে হয়ে গিয়েছিল। ওজনে মেপে মশলা ছাড়া রান্না। করে দিতে হত ব্রতীকে। ও যা খেত না, সুজাতাও তা খেতেন না তখন মুরগীর মাংস ছাড়া অন্য মাংস খাওয়া নিষেধ ছিল ব্রতীর। সেই সময়ে সুজাতা যে মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন আর খান নি কোনদিন।

অন্য ছেলে কটি কি কাছেই থাকত?

হকলডির বারিই এ পারা ও পারা। তা বিজিতের মারে অর দাদা লইয়া গিছে কানপুর। পার্থার মা থাইকাও নাই৷ রুগাভুগামীনষে, হেয় কি এই চোট সামলাইতে পারে? হেয় বিসনা লইছে। এট্টা পোলা যমরে দিল, ছুডটা দেশান্তরী। হে ফিরলে নাকি কাইট্টা ফালাইব।

পার্থর ওই একটি ভাই?

হ দিদি! পার্থর মায়ে উঠে না, খাই না, লয় না, খালি কয় আমার পোলা দডারে আইনা দে। য্যান পাগল পাগল অইছে দিদি? মাইয়া মানুষের প্রাণ কাছিমের জান, মরলে মাগী বাচে অহন।

আরেকটি ছেলে ছিল?

লালটু? লালটু মায়েরে জালাইয়া যাই নাই। হেয় মায়ের আগেই মরছিল। লালটু জন্ম অবাইগা। বাপ গিয়া বরা বয়সে বিয়া বসল। খ্যাপা-ক্ষ্যাপ্ত অইয়া লালটু আইল বনের বারি। তার নাগাল পোলা এ তল্লাটে আছিল না। পরায় য্যামন ভাল, শরীলে তেমনি জয়ান, কলোনির হকল ভাল কাজে হে আগে ঝাঁপ দিয়া পরত।

কাছেই থাকত?

দুখান পল্লী বাদে। লালটু-পার্থ-বিজিত-সমু হকলডি ছিল একোরকম। অরা থাকতে পারায় কুন-অ মন্দ কাজ কইরা মন্দ কথা কইয়া কেউ পার পায় নাই। লালটুই ত হল পোলাডিরে খ্যাপাইয়া লাচাইয়া ওই পথে নিছিল দিদি? তা অবাইগা নিজেও গেল গিয়া।

সুজাতার মনে হয়েছিল লাশঘরে তিনি কয়েকটি শব দেখেছিলেন, শ্মশানে দেখেছিলেন কয়েকটি মানুষের মাথা কোটাকুটি, কান্না শুনেছিলেন।

তখন ওই শবদেহ, ওই শোকার্ত নরনারী, ওদের সঙ্গে তিনি কোথায়, কোন আঙ্কিক নিয়মে এক, তা বোঝেন নি। এখন বুঝতে পারলেন, মত্যুতেই ব্রতী ওদের সঙ্গে এক হয়ে শুয়েছিল না, জীবনেও ব্রতী ওদের সঙ্গে এক ছিল।

ব্রতীর জীবনের যে অধ্যায়টুকু ওর নিজের তৈরি করা, সেখানে ও সম্পূর্ণতম, সে অধ্যায়ে এই ছেলেগলি ওর নিকটজন। তাঁর নয়। আমার ছেলে, আমার ভাই, এগুলো ব্রতীর জন্ম থেকে নিদিষ্ট কতকগুলো সংজ্ঞা।

কিন্তু নিজের মত, নিজের বিশ্বাস, নিজের আদর্শ নিয়ে ব্রতী যে নিজস্ব পরিচয় তৈরি করেছিল, যে ব্রতীকে সষ্টি করেছিল, সে ব্রতী মাকে যতই ভালবাসক, মা তাকে যতই ভালবাসনে, তাকে চিনতেন না। এই ছেলেরা সুজাতার অচেন যে ব্রতী, তাকেই চিনত।

তাই ওরা এবং ব্রতী জীবনে একাত্ম ছিল, মত্যুতেও সুজাতা। তাই তাদের সঙ্গেই একাত্ম, যারা এই ছেলেগলির শোক হৃদয়ে বহন করছে।

ব্ৰতীর মৃত্যুর পর একটি বছর, যতদিন না সুজাতা সমুদের বাড়ি আসেন ততদিন তিনি নিজের শোকের মধ্যে নিজে যেন বন্দী হয়েছিলেন।

সমুর মার অকুণ্ঠ বুকফাটা বিলাপ শুনে, ছেলেগুলির কথা শুনে, তবে সুজাতা বুঝলেন ব্রতী তাঁকে, তাঁর নিঃসঙ্গ শোকের একাকিত্বে রেখে চলে যায় নি। তাঁর মতো আরো বহুজনের সঙ্গে তাঁকে এক করে, আত্মীয় পাতিয়ে দিয়ে গেছে।

কিন্তু কেমন করে সুজাতা সেই বহুজনের মধ্যে দিয়ে মুক্তি পাবেন? তিনি যে ধনী, অভিজাত, অন্যশ্রেণীর মানুষ? এর তাঁকে গ্রহণ করবে কেন?

সমুর মা বলেছিলেন, লালটু কাজ কাজ কইরা পাগল হইয়া বেরাইছে। এট্টা কাজও পায় নাই। খ্যাপা-ক্ষ্যাপ্ত হইয়া থাকত, হেই অইতে অর মনে এত জ্বালা উঠত।

এবারও সমুর মা কাঁদছিলেন। সুজাতা ওঁর হাতে হাত বোলাচ্ছিলেন।

এক বছরে সমুদের ঘরটা আরো জীর্ণ, ঘরে দারিদ্র্যের চিহ্ন আরো প্রকট, সমুর মা বোধহয় এমন কাপড় পরেছিলেন যা পরে সুজাতার সামনে আসা যায় না। সুজাতা আসতে ভেতরে গিয়ে কাপড় ছেড়ে এলেন। এ কাপড়টা যদি এত ছেঁড়া, তালিমারা, জীর্ণ হয়, তাহলে এর আগে সমুর মা কি পরেছিলেন?

এবার ঘরের একদিকে চাল নেমে এসেছে, খুঁটি দিয়ে ঠেকো দেওয়া হয়েছে। তক্তপোশটা ঘরে দেখলেন না সুজাতা। মেঝেতে ইটের ওপর তক্তা পাতা। সম্ভবত বারান্দায় আর রান্না হয় না এখন। ঘরের কোণেই ছোট উনেন, উপুড় করা হাঁড়ি, দু একটা বাসন।

সমুরে মার চেহারা আরো শীর্ণ বিধস্ত। দুভার্গ্যের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করলে যেমন হতাশ্বাস, হালছাড়া দশা হয়, তাঁকে তেমনই দেখাচ্ছে। কোন কোন ফুটপাতে পড়ে থাকা মানবকে নর্দমার বেড়ালছানা, রোঁয়া-ওঠা কাগের বাচ্চার চেহারায় এই রকম করে আসন্ন, নির্মম মত্যুর পূর্বাভাস এসে পড়ে।

অথচ সমুরে দিদির চেহারা আরো এক রোখা, উদ্ধত, ক্রুদ্ধ। এক বছরে ওকে নিশ্চয় নখে দাঁতে যুদ্ধ করে চলতে হয়েছে, তাই ও জলে পড়ে এমনি করে খাঁক হয়ে গিয়েছে। সুজাতা ক্ষুধিত, তৃষিত চোখে সমুর মাকে দেখতে লাগলেন, এই ঘরটাকে। মন বলে দিচ্ছে এখানে আর আসা হবে না। আর সমুর মার কাছে বসে তিনি অনুভব করবেন না তিনি একা নন। আগামী সতেরই জানুআরি কি করবেন সুজাতা? গত সতেরই জানুআরি থেকে আজ পর্যন্ত, একবছর ধরে জানতেন তাঁর যাবার, গিয়ে বসবার একটা জায়গা আছে। কিন্তু আজ নিঃশব্দে তাঁকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে গেল সমুর দিদি। বুঝিয়ে দিয়ে গেল এখানে সুজাতা অবাঞ্ছিত।

তাই সুজাতা আকুল, ক্ষুধিত চোখে দেখতে লাগলেন ঘরটাকে, সমুর মাকে। এই ঘরেই জীবনের শেষ ক’টা ঘণ্টা কাটিয়েছিল ব্রতী, সমুর মার পাতা সামান্য বিছানায় শুয়েছিল। সমুর মা সুজাতার ছেলেকে শেষ মুহূর্তের কিছুক্ষণ আগে অবধি কাছে পেয়েছিলেন।

সমুর মা বলেছিলেন, আপনে বেথা পাইছেন, তাই আসেন। আমি ত দিদি! চক্ষ থাকতে কানা, পা থাকতে লেংরা। আচ্ছা। দিদি মাইয়া কয়, অ সমুর দিদি বইলা কেও অরে কাম দিব না। এ কি সইত্য?

কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে তা সুজাতা কেমন করে জানবেন? যারা ছিল বিশ্বাসহীন তারা বর্তমানে নেই। কিন্তু তাদের পরিবারগুলো ত আছে। তাদের বিষয়ে নীতি ছিল অলিখিত, কিন্তু কার্যকরী। তাদের পরিবারগুলোর বিষয়েও কোন অলিখিত নীতি আছে?

সে সময়ে আড়াই বছর ধরে বরানগর কাশীপুরকে শোধিত কররার সময় পর্যন্ত এদের বিষয়ে সকলে নীরব থাকবার অলিখিত নীতি অনুসরণ করছিল। জাতীয় কার্যকলাপে, টোকিওতে হাতি —মেট্রোয় চিত্রোৎসব—ময়দানে শিল্পী-সাহিত্যিক—রবীন্দ্রসদনে কবিপক্ষ—এই সব কিছুর পেছনে এক সপরিকল্পিত মনোভাব কাজ করছিল।

বিচলিত হবার দরকার নেই, কেননা তেমন গুরত্বপূর্ণ কিছুই ঘটে নি। কয়েক হাজার ছেলে নেই বটে, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। আর কোন মা’র একথা মনে হয় কিনা কে জানে, কিন্তু সুজাতার সেদিনও মনে হত, আজও মনে হয়, কেবল পশ্চিমবঙ্গে তরুণরা আজ তাড়িত, ত্রস্ত, বধ্য। তবু তার চেয়ে অনেক গুরত্বপূর্ণ ঘটনা অন্যত্র ঘটেছে। ওদের অস্তিত্ব, যন্ত্রণা, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে অবিচল বিশ্বাস, সবকিছু, সমগ্র জাতি ও রাজ্য সেদিন অস্বীকার করেছিল।

সুজতার সবচেয়ে যাতে ভয় করে আজকাল, তা হল এই যে অস্বীকার করে সমস্ত রাজ্যজুড়ে সবাই স্বাভাবিকতার ভান করছিল, সেটা কারো কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। এই স্বাভাবিকতা যে কি ভয়ংকর, কি পাশব, কি হিংস্র, তা সুজাতা মর্মে মর্মে জানেন। ব্রতীরা জেলে মরছে, পথে মরছে, কালো ভ্যানের তাড়া খাচ্ছে, উন্মত্ত জনতার হাতে মরছে, সমস্ত জাতির যারা বিবেকস্বরূপ, তারা কেউ ব্রতীদের কথা বলছে না। সবাই এই একটি ব্যাপারে চুপ করে আছে।

তাদের এই স্বাভাবিকতা সুজাতার কাছে ভয়ংকর লাগে। ভয় করে, যখন দেখেন তারা নিজেদের স্বাভাবিক, বিবেকবান ও সহৃদয় মনে করছে। বাইরে তাদের দূরদৃষ্টি বহুদূর প্রসারিত, ঘরে সেই দৃষ্টি অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট, ঝাপসা।

কয়েক হাজার দেশের ছেলেকে উপেক্ষা কর। উপেক্ষা কর পুরোপুরি। তাতেই তারা অনস্তিত্ব হয়ে যাবে। জেলে আর ধরছে না? হাজার হাজার ছেলের খবর জানা যাচ্ছে না? ইগনোর কর। তাতেই তারা অনস্তিত্ব হয়ে যাবে।

কিন্তু তাদের পরিবারবর্গ? তাদেরও কি উপেক্ষা করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নীতি সাব্যস্ত হয়েছে?

সুজাতা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। বললেন, আমি ত দেখুন কাজ করছি।

আপনাদের লগে আমার মাইয়ার কথা দিদি! আপনার চিনাজানা কতডি! দেহেন না, সকলডি নাম উঠল। ব্রতীর নাম কাগজে উঠল না। আমার দিদি! না আছে জানাচিনা, না আছে টাকার জোর!

সুজাতা জানতেন সমুর মার মনে এই ব্যবধানবোধ আসবে। প্রচণ্ড আঘাত, নিদারুণ শোক, কাঁটাপকেরে ও শ্মশানে তাঁদের দুজনকে এক করে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সে সাম্য চিরস্থায়ী হতে পারে না। সময় শোকের চেয়ে বলশালী। শোক তীরভূমি, সময় জাহ্নবী। সময় শোকের ওপর পলি ফেলে আর পলি ফেলে। তারপর একদিন প্রকৃতির অমোঘনিয়ম অনুযায়ী, সময়ের পলিতে চাপা পড়া শোকের ওপর ছোট ছোট অঙ্কুরের আঙুল বেরোয়।

অঙ্কুর। আশার-দঃখের-চিন্তার-বিদ্বেষের।

আঙুলগুলো ওপরে ওঠে, আকাশ খামচায়।

সময় সব পারে। সময়ের প্রবল প্রতাপের কথা ভাবলে সুজাতার ভয় হয়। হয়ত একদিন আসবে যেদিন ব্রতীর মুখ আবছা হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে আসবে সুজাতার চেতনায়, পুরানো ফোটোর মতন। হয়ত একদিন সুজাতা সকলের কাছে ব্রতীর নাম সহজে করবেন, কাঁদবেন যখন তখন।

সময় সব পারে। দুবছর আগে তাঁকে আর সমতুর মাকে শোক এক করে দিয়েছিল! সমীকরণের সে অঙ্ক সময়ের হস্তক্ষেপে মছে গেছে। শোকের প্রচণ্ড আঘাতে সুজাতা ও সমুর মার শ্রেণী ব্যবধান ঘুচে গিয়েছিল।

সময় বয়ে গেছে, তাই সুজাতা, সমুর মার মনে শ্রেণী বিভক্ত হয়ে গেছেন।

সুজাতা জিগ্যেস করলেন, সমীরণের দিদি কি পাস করেছে?

ফাস্‌পাট দিছিল। ছেকেন পাট দিলে অগ্রেজুয়েট অইত। তয় টাইপ শিখতে আছে। হেও ত অর্ধেক দিন যাইতে চায় না। কয় কাপর নাই, জামা নাই, চটি কিনতে পয়সা নাই, যামুনা আমি। কয় তোমাগ্যে লিগ্যা এমন কইরা জীবন দিতে পারব না। রাগের কথা দিদি। মাইয়া অকর্তব্য নয়।

মনে হয় না সমীরণের জন্যে ওর কোন অসুবিধে হবে। তবু আমি দেখব, কাজের খোঁজ পেলে জানাব।

কয়েন কি দিদি। ভাল একখান টিউশন অর ছুইট্টা গেল। চল্লিশ টাকা পাইত। ছাত্রের বাপে কইল, না না তোমারে আমি রাখতে পারব না। তোমার ভাই আছিল হেই দলে। হ দিদি, সত্য কই।

সবাই ত একরকম নয়।

দ্যাখবেন দিদি। তবে হে এট্টা বরো কাম করছে। ছুডো দুডারে দিয়া দিছে গরমেন্টের বোডিঙে। বাপ না থাকলে অরা অনাথ আশ্রমে নেয়।

ভালই করেছে।

মাইয়া কয় দিদি! ব্রতীর মায়ে যে আহে এহানে, এ লিগ্যা কতজন জিগায় কত কথা। যারা তাগোরে মারছে, তাদের মধ্যে একজন ত কইয়া বইল, ব্রতীর মায়ে তর মায়ে হকলডি কি জোট বাধতে আছে? ছুঁচার গর্তে হাতির পা পরে ক্যান? মাইয়া ত ডরাইয়া মরে। অ রাতেভিতে ফিরে ছেলে পরাইয়া, দোকান বাজার করে, অগোরে ডয়ার। অগো প্রসাধ্য কাম নাই।

ওরা—ওরা মানে–?

হ দিদি! হেইগুলান। এহনত তারা হকলডি দল পালটাইছে। তাগোর-কুন-অ শাস্তি অইল না। অহন বক ফুলাইয়া চলে ফিরে, আবার কয় কি মাইয়ারে, হেই! তর ভাইয়ের, ছাদ্দ করলি না। ক্যান? ভাল কইরা খাইতাম! পিচাশ দিদি! ওই চায়ের দোকানে বইয়া থাকে।

সুজাতার মনে হল তিনি মোড়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে সাইকেল রিকশা নিয়ে চলে আসেন, কখনো ত ডাইনে বাঁয়ে চেয়ে দেখেন নি। চায়ের দোকানে যারা বসে তারাই কেউ কেউ ব্রতীর হত্যাকারী? এখনো তারা নির্বিবাধে ঘোরে, সমুরে দিদিকে নির্মম ব্যঙ্গ করে, হা হা করে হাসে? এ কোন শহরে বাস করছেন তিনি, যেখানে এ সবও ঘটে, আবার সংস্কৃতি-মেলা, রবীন্দ্র-মেলা, সব পর পর হয়ে চলে নিয়ম মত?

দল এবং ঝাণ্ডা বদলালেই ঘাতকেরা নিষ্কৃতি পায়। এদিকে জেলের পাঁচিল শুধু উঁচু হয়, পাঁচিলে পাঁচিলে ওয়াচ টাওআর বসে, সব এক সঙ্গে চলেছে, চলেছে, কিন্তু আর কতদিন?

সমুর মা বললেন, আপনে ত দিদি ভাগ্যমানী? যার পোলা আছে হে একডারে লইয়া আরেকডারে ভোলতে পারে। তারে বকে লইয়া হেয়ারে ভোলেন দিদি? আমার ত বুকের পাঁজরা খইসা গেছে। আমার বুকের চিত্য, চিতায় না উঠলে নিব না।

সুজাতার বলতে ইচ্ছা হল, সমুর মার মত বুক ফাটা অকুণ্ঠ, অতি বিলাপ করতে পারলে তিনি বেচে যেতেন। কিন্তু তিনি যদি সমুরে মাকে বলেন, ব্রতীর জন্যে তিনি বকে পাষাণ বহন করছেন, ভাল করে কাঁদতে পর্যন্ত পারেন নি, তা হলে সমুর মা তাঁকে অস্বাভাবিক ভাববেন! ব্রতীর খবর পেতে না পেতে যারা সে খবর চাপা দিতে ছুটে যায়, তাদের সামনে ব্রতীর জন্য কাঁদতে পারেন নি সুজাতা, তাঁর গলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমুর মা তা বঝবেন না।

সমুর মা, বাবা যে তখন সে সব কথা কিছুই ভাবেন নি?

রাত যখন বারোটাও বাজে নি…দস্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন মনে হয় সব….রাত তখন বারোটাও বাজেনি, সমুদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল ওরা। একজন একজন করে লোক জমতে দেখেই সমুর মা ফুঁপিয়ে উঠে মুখে হাত চাপা দিলেন। সমুর বাবা অসহায় কাতরভাবে বললেন, কি করি অহন! যাই দেখি গিয়া পাছ, দয়ার দিয়া নি পলান যায়…

সমু আস্তে বলল, লাভ নাই বাবা। অরা ওদিকও ঘেরছে। আমি সারা পাইছি।

বের করে দিন ওদের। চাপা হিংস্র গলা।

—বাবুর গলা না? সমুর বাবা বললেন।

বের করে দিন! হিংস্র গলা।

লয় ত ঘরে আগুন দিমু! বাইর হইয়া আয় সমু।

বাপের বেটা হইস ত বাইর হ।

সমু ঘাড় ফিরিয়ে বলল, আমি যদি আগে বাইরাই; অরা আমায় আগে লইব! তর একজনও পলাইতে পারবি না?

বাইর—হ–!

ব্রতী তখন সমুকে বলেছিল, লাভ নাই সমু! তুই একা যাবি কেন? একসঙ্গে যাব।

দুঃস্বপ্ন…স্বপ্ন সব।

ব্রতী আগে উঠল। জানলার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, গাল দেবেন না, আমরা আসছি। অপেক্ষা করুন।

হালায় আরেক মালরে জটাইছে। বাইর হ ঘটির পোলা। বাইর হ।

যাইস না সমুরে-এ-এ-এ-এ!

কাইন্দনা মা। বাবা, তুমি মারে দেহ, আমরা বাইরাই। লয় ত অরা ঘরে আগুন দিব!

বিজিত পাজামা শক্ত করে বেধেছিল, হাত বুলিয়ে চুল আঁচড়ে নিয়েছিল। পাথ কখনোই বেশি কথা বলত না। এ সময়ে পার্থ বলল, চল, বিজিত।

বিজিত আর পাথের কাছে টিপছুরি ছিল, সমু আর ব্রতী ছিল নিরস্ত্র। ওরা উঠে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে ধরে স্লোগান দিতে দিতে দরজা খুলে ফেলে।

তর আগে আমি মরুম, বলে সমুর বাবা এগিয়ে যান, কিন্তু সমু তাঁকে ঠেলে ফেলে দেয়। স্লোগান দিতে দিতে ওরা বেরোয়, বাইরে অন্ধকার, বাইরে অনেকগুলো ঘটেঘটে আধার মুখে হা-হা হাসি ও উল্লাসে, চীৎকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া তাদের হাসি, বাড়ি বাড়ি আলো নিভে যাচ্ছে, দরজা জানালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, চমকে সরে যাচ্ছে ভয়চকিত মুখ, ওদিকে আকাশ পানে চুই-ই করে ছুড়ে দেওয়া শিস, চুমকুড়ি দুর্গাভাসানে যেমন হয়, ওদের গলায় স্লোগান। বিজিত আর পাথস্লোগান দিতে দিতে ছরি সোজা করে ধরে ছুটে গেল, কার গলায় মারছে রে! আর্তনাদ—হালা চাক্কু চালাস? কে বলল, ল হালাদের। স্লোগান তিনটে গলায় বিজিতের গলায় আগেই কে একজন দক্ষ নিপুণতায় ফাঁস দেয়–স্লোগান-স্লোগান—স্লোগান—জিন্দাবাদ যুগে যুগে জীও!– জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। যুগ যুগ জীও! ভয়ংকর গণ্ডগোল–স্লোগান সহসা থেমে গেল। সমবেত ঘাতকেরা দূরে চলে যাচ্ছে–গুলির শব্দ—খট খট খট শীতের থমকা বাতাসে বারুদের গন্ধবাতাসে বারদের গন্ধ-অন্ধকারে মুখগুলো চলে গেল—হো হো হো করে—সমুর বাবা চীৎকার করে বুক চাপড়ে পড়ে গেলেন— সমুরে! দাদা গো! বোনদের আর্তনাদ-সমুর মা আর কিছু জানেন না। অজ্ঞান। অন্ধকার। অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার।

সমুর মা কেমন করে বুঝবেন, সুজাতা কেন কাঁদতে পারেন না? কেমন করে বিশ্বাস করবেন ও বাড়িতে ব্রতীর নামই কেউ পারতপক্ষে উচ্চারণ করে না? কেমন করে ভাববেন ব্রতীর নাম যাতে কাগজে না ওঠে সে জন্যে ব্রতীর বাবা কি আকুল ছোটাছুটি। করছিলেন?

কেননা সমুর বাবা নিজেকে বাঁচাবার কথা ভাবেন নি, ভাবা যায় তাও তিনি জানতেন না। যারা ভাবে, ভাবতে পারে, তাদের সঙ্গে সমুর বাবা—হেয় আছিল দরিদ্র দোকানী—পুঁজি আছিল না—সমুর বাবার কোন পরিচয় হয় নি কোনদিন। দিব্যনাথরা আর সমুর বাবারা এদেশে দুই মেরুতে বাস করেন।

সমুর বাবা তখন ভেবেছিছেন থানা পুলিসের দ্বারস্থ হলে সব চুকে যাবে। ভয় পেয়ে পালাবে সবাই। ছটে হাঁপিয়ে, কোনমতে তিনি থানায় গেলেন। এ সময়ে থানা রাতে দিনে দীপান্বিত–চলেন ছার, এহন গ্যালেও পোলায় বাঁচব-হয়ত বা হাসপাতালে লইতে লাগবে চলেন ছার, পায়ে ধরি আপনার।

কিন্তু থানার বাবু বয়সে না হলেও অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ। সমুর বাবা যখন নামগুলো করেন আততায়ীদের, ভীষণ ধমকে ওঠেন তিনি। সমুর বাবা বড় অসহায় জীব—এ সংসারে কেঁচো কেন্নোর মত—সবাই পায়ে দলে চলে যায়—তিনি ভয়ে চুপ করে যান, আবার ডুকরে ওঠেন—আমি দেখছি স্বচক্ষে—গলা শুনেছি।—না, গলা শোনেন নি। চলেন ছার।—যাবে, ভ্যান যাবে। সে সময় সমুর বাবা হঠাৎ ওই থানায় আরেকজন বাবাকে দেখে চিনতে পারেন ও ডুকরে কেঁদে পা ধরেন। তারপর কোন একসময়ে ভ্যান আসে। সমুর বাবা ভ্যানে চড়ে বসেন। কলোনীতে ঢুকতে না ঢুকতে তিনি পাগলের মত, সম! সারা দেও বাপ। সমুরে! বলে খাবি খেতে থাকেন। আশ্চর্য, ভ্যানকে নির্দেশও দিতে হয় না। ঠিক ফুটবলের মত মাঠে চলে যায় ভ্যান। দুর থেকে ভ্যানের আলো পড়তে ছিটকে সরে যায়, কারা যেন পালাতে থাকে। দর থেকে ভ্যানের আলোর থাবায় ধরা পড়ে কতকগুলো মখে, মানুষ, ভ্যান তখন কেন যেন খুব ধীরে নামিয়ে আনে গতিবেগ। ভ্যান যখন পৌঁছয় তখন আর কেউ থাকে না, সকলেই পালিয়ে যাবার সুযোগ পায়। কাছে যেতে ভ্যান থামে ও ভ্যানের আলো জলতে থাকে বিজিতের ওপর। সমুর বাবা টর্চের আলো যার যার ওপর পড়ে তাকেই দেখেন ও চেঁচাতে থাকেন। তারপর, সমু বলতে গিয়ে তিনি ঢলে পড়েন মাটিতে। দেখেন সমুর পা ধরে আগে নিয়ে যাচ্ছে ওরা, ভ্যানের হাঁ খিদেয় বড় হচ্ছে। সমকে গিলে নেয়। সমুর মাথা কিসে ঠকল। অজ্ঞান হয়ে যেতে সমুর বাবা বলতে যান—আর মাথা বাঁচাইয়া! বলতে পারেন না। তখন সোয়া তিনটে। এত তড়িঘড়ি কোনদিন ভ্যান আসে নি।

তারপর সব চুকেবুকে গেলে তিনি আবার থানায় যান। তাঁর জবানবন্দী লেখাই হয় নি জানেন। থানাবার কথা লালবাজারে বলতে যান। কিছুতে কোন লাভ হয় না। হা ভগবান! এ দেশে বিচার নাই রে! বলে তিনি ফুটপাতে মাথা কাটেন। তাঁর শালার ছেলে তাঁকে ধরে ধরে বাড়ি আনে।

সমুর মা কেমন করে বুঝবেন সুজাতার কথা? তিনি যদি বলেন, ব্রতী, একমাত্র ব্রতীই তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ত, তাঁর ঘাড়ে হাত রেখে কথা বলত, বলত আমার পিঠে সাবান দিয়ে দাও, মা! হেম আবার ঠাণ্ডা চা দিয়েছে, আজ ব্যাঙ্কের পর আমি আর তুমি সিনেমায় যাব, মা! আজই খাতাটা ফেরত দেব-নোটটা কপি করে দাও। সমুর মা ভাববেন, এ রকম ত সব ছেলে সব মাকেই বলে। এতে বিশেষ করে বলবার কি আছে?

সুজাতা যদি বলেন, তিনি যে মাটি ছাড়া—শেকড় ছাড়া জীবনবিচ্যুত সমাজে বাস করেন, সে সমাজে নগ্ন শরীর লজ্জার নয়, সহজ আবেগ লজ্জার। যদি বলেন, সে সমাজে মা-ছেলে, বাপ-ছেলে, স্বামী-স্ত্রী প্রতিটি সম্পক বিষিয়ে গেলেও কেউ কাউকে মারে না, বুক ফাটিয়ে কাঁদে না, সকলে সকলের সঙ্গে মধুর ও মার্জিত ব্যবহার করে চলে, তা হলে সমুর মা বুঝতেই পারবেন না সুজাতা কি বলছেন! ভাষাটা বাংলা হলেও, ভাষার অন্তরের বক্তব্য সমুর মা বুঝবেন না।

সুজাতা যদি বলেন, ব্রতীকে, তাঁর মত সন্তানকে বোঝাবার জন্যেই তিনি এখানে আসেন : তাও সমুর মা বুঝবেন না। সুজাতা যদি বলেন, ব্ৰতী যখন বদলে যেতে শুরু করে; সে কিছু কিছু বই পড়ে বা বলি শুনেই বদলে যায় নি। সমুর মত দরিদ্র বাপমার সন্তান, লালটুর মত ভাগ্যপ্রহৃত অপমানিত যবেক, এদের এবং অন্যান্য মানুষদের জীবনের জালা নিজের রক্তমাংসে অনুভব করেই ব্রতী বদলেছিল। জীবনই তাকে বদলে যেতে বাধ্য করে। তাই সে নিজের নিদিষ্ট জীবন ত্যাগ করে। সে জীবনে থাকলে ব্রতী বিলেত যেত, ফিরত, বিরাট চাকরি করত, সমাজের ওপরতলায় উঠে যেত অতি সহজে, বিনা চেষ্টায়।

সে কথাও সমুর মা বুঝবেন না। কেননা সমুর মা এখনি বললেন, আপনের পোলার মুখখান আমার মনে লরে চরে দিদি। যাগে কিছু নাই, তার খ্যাপা-ক্ষ্যাপ্ত হয়। সম ছডকাল অইতে কইত, ক্যান, আমরা কি ভিখারী যে যা হক্কলে পাইবার কথা তাই ভিক্ষা কইরা চাইয়া নিম, আর লাথ থাম? কিন্তু ব্রতীর ত হkল আছিল দিদি! হে ক্যান বা মরতে আইছিল?

ওদের সাবধান করতে এসেছিল?

আপনে ত জানতেন পোলা কুন পথ লইছে। আপনে অরে সাবধান করেন নাই?

সমুর মা জানেন না তিনি আজ বিজয়িনী, কেননা তিনি জানতেন সমু কি করছে। সুজাতার উন্নতগ্রীবা, অভিজাত চেহারা, মণিবধে ঘড়ি, দামী তাঁতের কাপড় থাকতে পারে। কিন্তু সমুর মা জানেন না সুজাতা কয়েক হাজার জননীর মধ্যে বহুজনের কাছে পরাজিত, কেননা তিনি জানতেন না ব্ৰতী কি করছে।

কি জয়ে, কি পরাজয়ে সুজাতা মিথ্যে কথা বলতে পারেন না।

ব্রতী জানত।

সুজাতা বললেন, আমি জানতাম না।

জানলে কি দিদি! পোলারে কেউ মরতে পাঠায়?

সুজাতা উঠে দাঁড়ালেন।

আবার আসবেন দিদি। আপনার লগে কথা কইয়া বরো শান্তি।

সুজাতা জানালেন, তিনি আর আসবেন না।

চলি।

সহসা সমুর মার গায়ে হাত রাখলেন সুজাতা। বললেন, আপনার কাছে আমার অনেক কৃতজ্ঞতা রইল।

আর কৃতজ্ঞতা! দুঃখী বুকের দুঃখীর ব্যথা।

আজ, শেষ বিদায়ের মুহূর্তে সুজাতার সমুর মাকে খুব দামী কিছু দিতে ইচ্ছে হল, ইচ্ছে হল, নিজের ভেতরকার নিজের শোকসৃষ্টি কারাগার থেকে একটা কিছু দিয়ে যান সমুর মাকে। তাই, যে কথা তিনি উচ্চারণ করতে পারেন না, সেই কথাটা আজ বললেন, যেদিন ওরা মারা যায়, তার পরদিন ব্রতীর জন্মদিন ছিল। ও, সতেরই, কুড়ি পেরিয়ে একুশে পড়ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *