১০. হেডেস্টাড কুরিয়ার

অধ্যায় ১০

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ৯ শুক্রবার, জানুয়ারি ৩১

হেডেস্টাড কুরিয়ার-এর মতে ব্লমকোভিস্টের প্রথম মাসটি ওই এলাকার সবচাইতে তীব্র শীতের রেকর্ড গড়ে। অবশ্য ভ্যাঙ্গারের মতে ১৯৪২ সালের শীতের পর এটা সবচাইতে বেশি শীতের রেকর্ড। এক সপ্তাহ পরই সে বুঝে গেলো হেডেবিতে থাকতে হলে কি কি পরতে হবে আর কিভাবে চলতে হবে।

মাসের মাঝামাঝি তাপমাত্রা যখন মাইনাস ৩৫ হয়ে গেলো তখন তার সময়গুলো হয়ে উঠলো দুঃসহ। এমনকি লাপল্যান্ডের কিরুনাতে তার মিলিটারি সার্ভিসের সময়টিও এতোটা দুঃসহ ছিলো না।

এক সকালে উঠে দেখে তার পনির পাইপ জমে গেছে। নিলসন তাকে দুটো বড় বড় প্লাস্টিকের কন্টেইনারে করে ধোয়ামোছা আর রান্না করার জন্য পানি দিয়ে গেলেও সেই পানি ছিলো অসহ্য রকমের ঠাণ্ডা। ঘরের ফায়ারপ্লেসে যতোই কাঠ ঢুকাক না কেন ঠাণ্ডার হাত থেকে রেহাই পেলো না সে। বাড়ির পাশে এক ছাউনিতে কাঠ চিড়ে চিড়ে প্রতিদিনের অনেকটা সময় চলে গেলো তার।

কষ্টে দু’চোখ দিয়ে পানি এসে যেতো, ইচ্ছে করতো এক্ষুণি একটা ট্রেন ধরে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে। তবে সেটা না করে আরেকটা সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে রান্নাঘরের টেবিলে বসে বসে কফি খেতো আর পুলিশের রিপোর্টগুলো পড়তো।

তারপর হঠাৎ করেই তাপমাত্রা কমে ১৪ ডিগ্রিতে উঠে এলে পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় হয়ে ওঠে।

*

হেডেবির লোকজনদের চিনতে শুরু করলো মিকাইল। মার্টিন ভ্যাঙ্গার তার কথা রাখলো তাকে নিজের বাড়িতে হরিণের স্টিক খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে। তার মেয়েবন্ধুও তাদের সাথে ডিনারে যোগ দিলো। ইভা খুবই মিশুক, আন্তরিক আর আমুদে এক মহিলা। ব্লমকোভিস্টের কাছে মনে হলো মহিলা দেখতে খুবই আকর্ষণীয়া। একজন ডেন্টিস্ট সে, থাকে হেডেস্টাডে, তবে সপ্তাহান্তে মার্টিনের বাড়িতে এসে তার সঙ্গে থাকে। ব্লমকোভিস্ট জানতে পারলো তারা একে অপরকে অনেক বছর ধরে চিনলেও মাঝবয়সের আগে একসাথে ঘুরতে বের হয় নি। বিয়ে করার কোনো কারণই খুঁজে পায় নি তারা। এমনিতেই বেশ আছে।

“ও আসলে আমার ডেন্টিস্ট,” হেসে বললো মার্টিন।

“আর এই উন্মাদ পরিবারে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই,” মার্টিনের হাটুতে আলতো করে চাপড় মেরে বললো ইভ।।

মার্টিন ভ্যাঙ্গারের ভিলাটা কালো, সাদা আর ক্রোম রঙে ফার্নিশ করা। বাড়িতে ডিজাইনারদের প্রচুর জিনিস রয়েছে যা দেখে ক্রিস্টার মাম উল্লসিত হয়ে উঠতো। রান্নাঘরটি পেশাদার কুকের উপযোগী করে বানানো হয়েছে, লিভিংরুমে চমৎকার একটি স্টেরিও রয়েছে সেইসাথে রয়েছে জ্যাজ মিউজিকের বিশাল এক সংগ্রহ। মার্টিন ভ্যাঙ্গারের টাকা আছে, তবে তার বাড়ি দেখলে বোঝা যায় বিলাসবহুল সব জিনিসের পাশাপাশি তার নিজের রুচিও অনেক উঁচুস্তরের। বেশ কয়েকটি তৈলচিত্র আর বইয়ের সেলফে প্রচুর বইপত্র রয়েছে। সব কিছু দেখে মার্টিন ভ্যাঙ্গারের দুটো প্রিয় জিনিস চিহ্নিত করতে পারলো সে : সঙ্গীত আর রান্না করা। তার ঘরে থাকা ৩০০০টিরও বেশি লংপ্লে আর রান্নাবান্নার আয়োজন দেখে বোঝা যায় কেন তার ভুড়ি বেল্টের বাইরে উপচে পড়েছে।

লোকটা নিজে সরলতা, চতুরতা আর অমায়িকতার এক মিশ্রণ। কর্পোরেট সিইও যে কঠিন সমস্যায় আছে সেটা বুঝতে এমন কোনো বিশ্লেষক হবার দরকার নেই। তারা সবাই যখন ‘নাইট ইন তিউনিশিয়া’ শুনছে তখন তাদের আলাপচারিতা ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশন সংক্রান্ত হয়ে উঠলো। তাদের কোম্পানিটা যে কঠিন সময় পার করছে সেটা মার্টিনও লুকালো না। সে ভালো করেই জানে তার এই অতিথি একজন ফিনান্সিয়াল রিপোর্টার, আর তাদের পরিচয়টাও খুব বেশি দিনের নয় তারপরেও নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভেতরের অনেক কিছু তার সাথে শেয়ার করলো। সম্ভবত সে ধরে নিয়েছে ব্লমকোভিস্ট তার চাচার হয়ে কাজ করছে সেজন্যেই এতোটা খোলামেলা হতে বাধে নি। সাবেক সিইও’র মতো মার্টিনও তাদের ব্যবসার এই বাজে অবস্থার জন্য পরিবারের সদস্যদেরই দায়ি করলো। নিজের পরিবারের এই শত্রুমনোভাবাপন্ন ব্যাপরটায় সে বরং আমোদিত বোধ করলো অনেকটা। ইভা তার কথার সাথে মাথা নেড়ে সায় দিলেও মুখে কিছু বললো না।

দেখা গেলো ব্লমকোভিস্ট যে তাদের পরিবারের ইতিহাস লিখতে এখানে এসেছে সেই গল্পটা মার্টিন বেশ ভালোভাবেই বিশ্বাস করে। কাজকর্ম কেমন এগোচ্ছে সেই খোঁজখবরও নিলো সে। ব্লমকোভিস্ট মৃদু হেসে জানালো তাদের পরিবারে এতো লোকজন যে তাদের নাম মুখস্ত করাটাই তার জন্য কঠিন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইচ্ছে করলে এ কাজে মার্টিনের কাছে সাহায্যের জন্যে আসতে পারে বলেও জানালো সে। কথাবার্তা চলার সময় ব্লমকোভিস্ট দু’দুবার -চেষ্টা করলো হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে বৃদ্ধের যে উন্মাদনা সে বিষয়ে জানতে চাইবে। ভ্যাঙ্গার অবশ্যই মার্টিনকেও তার নিজের থিওরিটায় বিশ্বাসী করেছে। মার্টিনও নিশ্চয় বুঝতে পারছে তাদের পরিবারের ইতিহাস লিখতে হলে হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করতেই হবে। তবে মার্টিন এ বিষেয়ে আলাপ করতে মোটেও আগ্রহী হলো না।

কয়েক পেগ ভদকার সাথে তাদের আলাপ শেষ হলো ঠিক ২টার দিকে। মার্টিনের বাড়ি থেকে তিনশ’ গজ দূরে নিজের ঘরে ফিরে আসতে গিয়ে ব্লমকোভিস্ট টের পেলো অনেকটা মাতাল হয়ে গেছে। রাতটা তার বেশ ভালোভাবেই কাটলো।

হেডেবি’তে ব্লমকোভিস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক বিকেলে তার ঘরের দরজায় নক হলো। সবেমাত্র ছয় নাম্বার পুলিশ ফাইলটা খুলেছিলো পড়ার জন্য, সেটা বন্ধ করে দরজার দিকে পা বাড়াতেই সোনালি চুলের এক মহিলাকে তার ঘরে ঢুকতে দেখলো সে। ঠাণ্ডার কারণে বেশ ভালোমতো সোয়েটার পরেছে মহিলা।

“হাই। মনে হলো আপনার এখানে এসে আপনাকে হ্যালো বলে যাই। আমি সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার।’

তারা করমর্দন করার পর ব্লমকোভিস্ট কফি কাপ বের করলো। সিসিলিয়া হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের মেয়ে, দেখে মনে হচ্ছে খুবই খোলা মন আর মিশুক প্রকৃতির। ব্লমকোভিস্টের মনে পড়লো হেনরিক ভ্যাঙ্গার তার ব্যাপারে বেশ প্রশংসাই করেছিলো। আরো মনে পড়লো ভ্যাঙ্গার তাকে বলেছিলো তার ঘরের ঠিক পাশেই নিজের বাবা থাকলেও তাদের মধ্যে তেমন কথাবার্তা হয় না। কিছুক্ষণ হালকা আলাপচারিতার পর মহিলা জানালো কেন এখানে এসেছে।

“শুনলাম আপনি নাকি আমাদের পরিবারের ইতিহাস নিয়ে একটা বই লিখতে যাচ্ছেন,” বললো সে। “এই আইডিয়াটা ভালো না মন্দ সেটা বুঝতে পারছি না। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম আপনি মানুষ হিসেবে কেমন।”

“হেনরিক ভ্যাঙ্গার আমাকে এ কাজে নিযুক্ত করেছে। সত্যি কথা বলতে কি এটা আসলে তার নিজের গল্প।”

“আমাদের ভালো মানুষ হেনরিক তার নিজের পরিবারের ব্যাপারে পুরোপুরি নিরপেক্ষ আচরণ করে না।”

ব্লমকোভিস্ট মহিলাকে ভালো করে দেখে নিলো, সে কি বলতে চাচ্ছে বুঝতে পারলো না। “ভ্যাঙ্গার পরিবারের ইতিহাস লেখা হোক সেটা কি আপনি চান না?”

“আমি সেটা বলি নি। আর আমি কি ভাবি না ভাবি সেটাতে কিছু যায় আসে না। তবে এতোক্ষণে নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন এই পরিবারের অংশ হওয়াটা সব সময়ের জন্য খুব একটা সুখকর নয়।”

ব্লমকোভিস্টের কোনো ধারণাই নেই ভ্যাঙ্গার কতোটা বলেছে অথবা তার অ্যাসাইনমেন্টের ব্যাপারে সিসিলিয়া কতোটুকু জানে।

আপনার চাচা আমাকে আপনাদের পরিবারের ইতিহাস লেখার জন্য কনট্রাক্ট করেছেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে তার অনেক রকম দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তবে আমি শুধু প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো নিয়েই কাজ করবো।”

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার কাষ্ঠহাসি হাসলো। “আমি যেটা জানতে চাই সেটা হলো : বইটা বের হবার পর কি আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে নাকি অন্য কোনো দেশে অভিবাসী হতে হবে?“

“আমি সেরকম কিছু আশা করছি না,” ব্লমকোভিস্ট বললো। “লোকজন ছাগলের পালের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভেড়াটাকে চিনতে পারবে আর কি।”

“যেমন আমার বাবা?”

“ঐ যে বিখ্যাত নাৎসি, আপনার বাবা?” বললো ব্লমকোভিস্ট।

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের দু’চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো। “আমার বারা আস্ত একটা উন্মাদ। বছরে মাত্র কয়েকবার তার সাথে আমার দেখা হয়।

“আপনি তাকে দেখতে চান না কেন?“

“দাঁড়ান দাঁড়ান-আমাকে কোনো প্রশ্ন করার আগে আপনার কাছ থেকে একটা বিষয় জেনে নিই…আপনি কি আমার বলা কথাগুলো বইতে ব্যবহার করার কথা ভাবছেন? নাকি আমি আপনার সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে যাবো?”

“আমার কাজ হলো আলেকজান্ডার ভ্যাঙ্গিয়ারসাডের সুইডেনে আসার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘটনাবলী নিয়ে একটা বই লেখা। এতে অনেক বছরের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের ঘটনা যেমন থাকবে তেমনি এই সাম্রাজ্যের সমস্যা আর এর সদস্যদের মধ্যে শত্রুতার কথাও থাকবে। এ রকম কাজে দৃশ্যমান নোংরা কিছু বাদ দেয়াটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তবে তার মানে এই নয় যে, আমি বর্তমান কালের কাউকে খারাপভাবে চিত্রিত করবো। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমি মার্টিন ভ্যাঙ্গারের সাথে দেখা করেছি; আমার কাছে তাকে খুবই দয়ালু একজন লোক বলে মনে হয়েছে, আমি তাকে সেভাবেই চিত্রিত করবো।”

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার কোনো জবাব দিলো না।

“আপনার সম্পর্কে আমি যতোটুকু জানি, আপনি একজন শিক্ষক…

“আসলে তারচেয়েও খারাপ কিছু-আমি হেডেস্টাডের প্রিপারেটরি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস।”

“আমি দুঃখিত। আমি জানি আপনার চাচা আপনাকে খুব পছন্দ করে, আপনি বিবাহিত তবে সেপারেশনে আছেন…এই পর্যন্তই আমি জানি। সুতরাং কোনো রকম ভয়ভীতি ছাড়াই আমার সাথে কথা বলতে পারেন। আপনার কোনো কথা আমি বইতে ব্যবহার করবো না। আমি নিশ্চত খুব জলদি আপনার দরজায় গিয়ে কড়া নাড়বো আপনার কাছ থেকে কিছু গল্প শোনার জন্য। তখন সেটা হবে অফিশিয়ালি ইন্টারভিউ। আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন আমার কোনো প্রশ্নের জবাব দেবেন নাকি দেবেন না।”

“তাহলে আপনার সাথে আমি এখন কথা বলতে পারি…মানে আপনারা যাকে বলেন অফ দ্য রেকর্ড?”

“অবশ্যই।”

“তাহলে এটা অফ দ্য রেকর্ড?”

“অবশ্যই অফ দ্য রেকর্ড। হাজার হোক এটা নিতান্তই প্রতিবেশির আগমন ছাড়া আর কিছু না।”

“ঠিক আছে। আপনাকে কি আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

“প্লিজ।”

“এই বইটা হ্যারিয়েটের সাথে কতোটুকু সম্পর্কিত?”

ব্লমকোভিস্ট নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে যতোটুকু সম্ভব স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলো : “সত্যি বলতে কি, আমার কোনো ধারণাই নেই। ওটা নিয়ে হয়তো একটা অধ্যায় লেখা হবে। এটি এমন একটি ঘটনা যা কিনা আপনার চাচার জীবনের উপর মারাত্মক প্রভার ফেলেছিলো।”

“আপনি তো হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করার জন্যে এখানে আসেন নি?”

“আপনার এরকমটি কেন মনে হলো?”

“নিলসন এখানে চারটা বাক্স নিয়ে এসেছিলো। সেগুলো বিগত বছরের হেনরিকের প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশনের কাগজপত্র। হ্যারিয়েটের পুরনো ঘরে আমি এসব জিনিস দেখেছি। ওখানেই হেনরিক এসব রাখতো। এখন সেগুলো নেই।”

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার কোনো বোকা নয়।

“এ ব্যাপারটা নিয়ে আপনি হেনরিকের সাথে কথা বললেই ভালো হয়, আমার সাথে নয়,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “তবে হেনরিক যে মেয়েটার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে অনেক কথা বলেছে সেটা জেনে নিশ্চয় আপনি অবাক হবেন না। আমার মনে হয় এ সংক্রান্ত সংগ্রহ করা ডকুমেন্টগুলো পড়ে দেখাটা খুব ইন্টারেস্টিংই হবে।

সিসিলিয়া আরেকটা কাষ্ঠ হাসি দিলো। “মাঝেমাঝে ভাবি কে বড় পাগল, আমার বাবা নাকি আমার চাচা। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার গল্প আমি তার কাছ থেকে হাজার বার শুনে ফেলেছি।

“তার কি হয়েছিলো বলে মনে করেন?’

“এটা কি ইন্টাভিউয়ের প্রশ্ন?”

“না,” হেসে বললো সে। “আমি একটু কৌতূহলী, এই যা।”

“আমার জানতে ইচ্ছে করছে আপনিও ক্ষ্যাপাটে কিনা। নাকি হেনরিকের গল্পে বিশ্বাস ক’রে বসে আছেন, কিংবা আপনিই কি তার মধ্যে এসব ব্যাপারে আগ্রহ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন কিনা।”

“আপনি মনে করছেন হেনরিক ক্ষ্যাপাটে?”

“আমার কথা ভুল মানে করবেন না। সে আমার দেখা খুবই আন্তরিক আর চিন্তাশীল একজন মানুষ। আমি তার ভক্ত। তবে এই বিশেষ ব্যাপারটায় সে একেবারে বাতিকগ্রস্ত হয়ে আছে।”

“কিন্তু হ্যারিয়েট তো সত্যি নিখোঁজ হয়েছে।”

“এই গল্পটা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে আমার। কয়েক যুগ ধরে আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে এটা। মনে হয় না এটা কখনও থামবে।” আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ফারকোটটা তুলে নিলো সে। “আমাকে যেতে হবে। আপনাকে অবশ্য বেশ ভালো মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। মার্টিনও সেরকম ভাবে। তবে তার বিচার বিশ্লেষণ সব সময় সঠিক হয় না। আপনি যখন খুশি আমার বাড়িতে এসে কফি খেয়ে যেতে পারেন। আপনাকে নেমন্ত্ৰণ দেয়া হলো। সন্ধ্যার পর আমি বাড়িতেই থাকি।”

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,” ব্লমকোভিস্ট বললো। “আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না, ওটা অবশ্য ইন্টারভিউয়ের প্রশ্ন ছিলো না।”

দরজা ঠেলে তার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো মহিলা।

“আমার কোনো ধারণা নেই। আমার মনে হয় ব্যাপারটা নিছক কোনো দুর্ঘটনা, কখনও যদি আমরা সেটা জানতে পারি তো ঘটনাটার সহজ সরলতা দেখে অবাকই হবো।”

ঘুরে তার দিকে হাসলো সে-এই প্রথমবার আন্তরিকতার সাথে। তারপরই চলে গেলো।

এটা যদি সিসিলিয়ার সাথে প্রথম সাক্ষাত হয়ে হয়ে থাকে তো ইসাবেলার সাথে প্রথম পরিচয় পর্বটি এরকম ছিলো না। হেনরিক ভ্যাঙ্গার যেমনটি সতর্ক করে দিয়েছিলো হ্যারিয়েটের মা ঠিক সেরকমই : মহিলা খুবই অভিজাত, তাকে দেখে চল্লিশের দশকের হলিউড তারকা লরেন বাকলের কথা মনে পড়ে যায়। হালকা পাতলা গড়ন আর কালো রঙের পার্সিয়ান কোট, সেইসাথে ম্যাচ করা কাফ। সুসানের ক্যাফেতে যাবার আগে ব্লমকোভিস্টের সাথে এক সকালে তার দেখা হয়ে গেলো। মহিলা লাঠিতে ভর দিয়ে হাটেন। মহিলাকে দেখে বয়স্ক ভ্যাম্পায়ার বলেই মনে হয় এখনও বেশ সুন্দরী তবে বিষাক্ত সাপের মতো ভয়ঙ্কর। ইসাবেলা ভ্যাঙ্গার প্রাতভ্রমণ সেরে সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছিলেন। চার রাস্তার মোড় থেকে তিনি ব্লমকোভিস্টকে ডাকলেন।

“হ্যালো, ইয়াংম্যান। এখানে আসো।”

কর্তৃত্বসুলভ কণ্ঠটা এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। ব্লমকোভিস্ট তার দিকে এগিয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।

“আমি ইসাবেলা ভ্যাঙ্গার,” বললেন ভদ্রমহিলা।

“হ্যালো। আমার নাম মিকাইল ব্লমকোভিস্ট।” সে হাত বাড়িয়ে দিলেও মহিলা সেটা ধরলেন না।

“তুমিই কি সেই লোক যে আমাদের পরিবারের বিভিন্ন ব্যাপারে নাক গলিয়ে বেড়াচ্ছে?”

“আপনি যদি মনে ক’রে থাকেন আমি হলাম সেই লোক যাকে হেনরিক ভ্যাঙ্গার তার পরিবারের ইতিহাস লেখার জন্যে নিয়োগ দিয়েছেন তাহলে ঠিকই ধরেছেন।

“এসব ব্যাপার নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।”

“কোন্ ব্যাপারটার কথা বলছেন? হেনরিক ভ্যাঙ্গার আমাকে যে কাজের জন্যে নিয়োগ দিয়েছেন সেটা?”

“তুমি বেশ ভালো করেই জানো আমি কি বলতে চেয়েছি। আমার ব্যাপারে কেউ নাক গলাক সেটা আমি মোটেও পছন্দ করি না।’

“আমি আপনার ব্যাপারে নাক গলাবো না। আর বাকি বিষয়টা নিয়ে আপনি হেনরিকের সাথে আলাপ করতে পারেন।”

ইসাবেলা তার হাতের লাঠিটা তুলে ধরে সেটার হাতল মিকাইলের বুকে ঠেকালেন। মহিলা খুব বেশি আক্রমণাত্মকভাবে সেটা না করলেও মিকাইল বিস্ময়ে একটু পিছিয়ে গেলো।

“শুধু আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে,” কথাটা বলেই চলে গেলেন ভদ্রমহিলা। ব্লমকোভিস্ট যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, যেনো কমিক বইয়ের কোনো চরিত্রের সাথে এইমাত্র সাক্ষাত হয়েছে তার। এরপরই সে দেখতে পেলো নিজের অফিসের জানালা দিয়ে ভ্যাঙ্গার তার দিকে চেয়ে আছে। তার হাতে একটা কাপ। সেটা একটু তুলে ধরলো সে অনেকটা স্যালুট দেবার ভঙ্গিতে।

প্রথম মাসে ব্লমকোভিস্ট শুধুমাত্র লেক সিলিয়ানে ভ্রমণ করলো। ফ্রোডির কাছ থেকে একটা মার্সিডিজ ধার করে বরফাচ্ছিদত পথ ধরে সোজা চলে গেলো ডিটেক্টিভ মোরেলের কাছে। পুরোটা বিকেল তার সঙ্গেই কাটালো। গাড়ি চালিয়ে মোরেলের কাছে যাবার সময় মনে মনে তার একটা প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলো ব্লমকোভিস্ট, কিন্তু যা দেখতে পেলো সেটা একেবারেই অন্য রকম। জীর্ণশীর্ণ এক বৃদ্ধ, খুবই আস্তে আস্তে নড়াচড়া করে, আর কথা বলে তারচেয়েও আস্তে।

দশটি প্রশ্ন সংবলিত একটি নোটবুক সঙ্গে করে নিয়ে গেলো ব্লমকোভিস্ট। পুলিশ রিপোর্টগুলো পড়ার সময় এই প্রশ্নগুলো তার মনে উঁকি দিয়েছিলো। মোরেল তার সব প্রশ্নের জবাবই এমনভাবে দিলো যে ব্লমকোভিস্টের কাছে মনে হলো সে বুঝি কোনো স্কুলমাস্টার। শেষে নোটবুকটা সরিয়ে রেখে ব্লমকোভিস্ট জানালো এইসব প্রশ্ন করাটা আসলে তার সাথে দেখা করার একটি অজুহাত ছাড়া আর কিছুই না। সে আসলে তার সাথে একটু আলাপ করতে চায়, আর তার কাছে খুবই জরুরি একটা প্রশ্ন আছে : লিখিত রিপোর্টে কি এমন একটা কিছু আছে যা অন্তর্ভূক্ত করা হয় নি? এমন কোনো অনুমাণ যা ইন্সপেক্টর তার সাথে শেয়ার করতে পারেন?

ভ্যাঙ্গারের মতো মোরেলও ছত্রিশ বছর ধরে এই রহস্যটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে গেছে, সেজন্যেই ব্লমকোভিস্ট জানতো লোকটা সহজে এ প্রশ্নের জবাব দেবে না—যেখানে মোরেলের মতো ঝানু গোয়েন্দা ছত্রিশ বছরে কোনো কূলকিণারা করতে পারে নি সেখানে কোত্থেকে এই নতুন লোক এসে জুটেছে তাকে কিনা মূল্যবান তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে হবে! তবে তার মধ্যে আসলে কোনো রকম শত্রু শত্রু ভাব দেখা গেলো না। বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে মোরেল তার পাইপে তামাক ভরে জবাব দিলো।

“হ্যা, অবশ্যই আমার নিজস্ব কিছু আইডিয়াও ছিলো। তবে সেগুলো এতোটাই অস্পষ্ট আর ক্ষণস্থায়ী ছিলো যে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।”

“কি ঘটেছিলো বলে আপনি মনে করেন?”

“আমার ধারণা হ্যারিয়েটকে খুন করা হয়েছিলো। ভ্যাঙ্গার আর আমি এ ব্যাপারে একমত। এটাই একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা। তবে এর পেছনে কি মোটিভ ছিলো সেটা বের করতে পারি নি। মনে হয় মেয়েটাকে নির্দিষ্ট একটা কারণেই খুন করা হয়েছে-ব্যাপারটা হুট করে করা হয় নি, কিংবা ধর্ষণের মতো কিছুও নয়। আমরা যদি মোটিভটা বের করতে পারতাম তাহলে জানতে পারতাম খুনটা কে করেছে।” একটু ভাবার জন্য মোরেল থামলো। “হত্যাকাণ্ডটি হয়তো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে করা হয়েছে। মানে ঐ দুর্ঘটনাটি কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাটি হঠাৎ করেই বাস্তবায়ন করা হয়েছে আর কি। খুনি তার মৃতদেহটি লুকিয়ে রাখে তারপর আমরা যখন তার খোঁজ করতে শুরু করি তখন অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলে সেটা।”

“আমরা এমন একজনের কথা বলছি যার নার্ভ একেবারে বরফের মতোই ঠাণ্ডা।”

“একটা ডিটেইল আছে…হেনরিক ভ্যাঙ্গারের সাথে কথা বলার জন্য হ্যারিয়েট তার ঘরে গিয়েছিলো। আমার কাছে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত আচরণ বলেই মনে হয়েছে-মেয়েটা জানতো হেনরিক তখন একগাদা আত্মীয়স্বজন নিয়ে মহা ব্যস্ত। আমার মনে হয় হ্যারিয়েটের বেঁচে থাকাটা কারোর জন্য মারাত্মক হুমকি ছিলো। হেনরিককে সে হয়তো ওরকম কিছু কথাই বলতে চেয়েছিলো। খুনি হয়তো জেনে গিয়েছিলো মেয়েটা হেনরিককে সে কথা বলে ফেলবে…তো আর দেরি করে নি।”

“হেনরিক তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন?”

“হেনরিক ছাড়াও ঐ ঘরে মোট চারজন লোক ছিলো। তার ভাই গ্রেগর, ম্যাঙ্গাস সিওগ্রেন নামের এক জ্ঞাতিভাই আর হেরাল্ডের দুই সন্তান বার্জার এবং সিসিলিয়া। তবে এ থেকে কিছু ধরে নেয়া যায় না। মনে করুন হ্যারিয়েট জেনে গিয়েছিলো কেউ তাদের কোম্পানির তহবিল তছরূপ করেছে-ধরে নিচ্ছি আর কি। ব্যাপারটা হয়তো সে কয়েক মাস ধরেই জানতো, এক পর্যায়ে হয়তো ঐ ব্যক্তির সাথে ব্যাপারটা নিয়ে তার কথাবার্তাও হয়ে থাকবে। মেয়েটা হয়তো তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছিলো, অথবা তার জন্যে দুঃখিত ছিলো, তার খবরটা ফাঁস করে দেবার ব্যাপারে তার মধ্যে অস্বস্তি কাজ করেছিলো। হঠাৎ করেই হয়তো মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, খুনিকেও সেটা বলে দিয়েছিলো সে। ফলে তাকে খুন করার জন্য লোকটা মরিয়া হয়ে ওঠে।”

“আপনি বলছেন ‘লোকটা’।”

“বইপুস্তক বলে বেশিরভাগ খুনই পুরুষ মানুষ করে থাকে। তবে এটাও ঠিক, ভ্যাঙ্গার পরিবারে কয়েকজন মহিলা আছে যারা খুবই বিপজ্জনক।”

“ইসাবেলার সাথে আমার দেখা হয়েছে।”

“ঐ মহিলা সেরকমই একজন। তবে আরো আছে। সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারও মারাত্মক জিনিস। সারা সিওগ্রেনের সাথে কি আপনার দেখা হয়েছে?”

মাথা ঝাঁকালো ব্লমকোভিস্ট।

“ও হলো সোফিয়া ভ্যাঙ্গারের মেয়ে, হেনরিকের এক জ্ঞাতিবোন। মহিলা খুবই কঠিন এক চিজ। তবে সে মামো’তে থাকে। আমি যতোটুকু জানি ঐ মেয়েটাকে খুন করার কোনো মোটিভ তার ছিলো না।”

“তাহলে তাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া যেতে পারে।”

“সমস্যাটা হলো ব্যাপারটা যেভাবেই খতিয়ে দেখা হোক না কেন আমরা কোনো মোটিভ খুঁজে বের করতে পারি নি। এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

“আপনি তো এই কেসটা নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। এমন কোনো সূত্র কি ছিলো যা খুব একটা খতিয়ে দেখা হয় নি?”

একটু ভাবলো মোরেল। “না। এই কেসে আমি অনেক সময় ব্যয় করেছি। এরকম কিছু আমি খতিয়ে দেখি নি বলে মনে পড়ছে না। মনে হয় না এরকম কিছু আমার সামনে এসেছিলো। আমি পদোন্নতি পেয়ে হেডেস্টাডে চলে যাবার পরও এই কেসটা নিয়ে সময় ব্যয় করেছি।”

“চলে গেছিলেন?”

“হ্যা। আমি আসলে হেডেস্টাডের লোক নই। ওখানে আমি ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কাজ করেছি। পদোন্নতি পেয়ে আমি সুপারিন্টেডেন্ট হই, গাভেলের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে বাকি কর্মজীবন পার করেছি। গাভেলে থাকার সময়ও আমি এই কেসটা নিয়ে কাজ ক’রে গেছি।’

“আমার মনে হয় হেনরিক আপনাকে এ কাজ করতে চাপাচাপি করেছে।”

“সত্য, তবে এটাই একমাত্র কারণ ছিলো না। হ্যারিয়েটের এই গোলকধাঁধাটি আমাকে আজো আকর্ষণ করে। মানে…ব্যাপারটা এরকম : প্রত্যেক পুলিশ অফিসারেরই সমাধানহীন একটি রহস্য থাকে। হেডেস্টাডে থাকার সময় ক্যান্টিনে বসে বসে আমার বৃদ্ধ কলিগদের কতোবারই না শুনেছি রেবেকার কেস নিয়ে কথা বলতে। বিশেষ করে টরটেনসন নামের এক পুলিশ অফিসার ছিলো-অনেক বছর আগে সে মারা গেছে-রেবেকার কেসটা নিয়ে সে বছরের পর বছর ধরে কাজ করে গেছে। ছুটিতে থাকুক আর কাজে থাকুক সে এই কেসটা নিয়েই মাথা ঘামিয়ে গেছে। হেহডেস্টাডের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলেই সে পুরনো এই কেসটা নিয়ে বসে যেতো।”

“ওটাও কি নিখোঁজ কোনো মেয়ের কেস ছিলো?”

খুব অবাক হলো মোরেল। তারপর যখন বুঝতে পারলো ব্লমকোভিস্ট এই দুটো কেসের মধ্যে সংযোগ খুঁজছে তখন হেসে ফেললো সে।

“না। আমি আসলে একজন পুলিশ অফিসারের মন কি রকম হয়ে থাকে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের জন্মেরও আগে রেবেকার কেসটা ঘটেছিলো। চল্লিশের দশকের কোনো এক সময় হেডেস্টাডে এক মহিলাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। এটা অবশ্য অসাধারণ কোনো ঘটনা নয়। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রায় প্রত্যেক পুলিশ অফিসারকেই জীবনে এরকম দুয়েকটি ঘটনার তদন্ত করতে হয়। তবে এই কেসটা খুবই আলোচিত ছিলো। মেয়েটাকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। খুনি মেয়েটার হাত-পা বেধে তার মাথাটা ফায়ারপ্লেসের ভেতর ঢুকিয়ে পুড়ে ফেলেছিলো। মেয়েটা কতোক্ষণ বেঁচে ছিলো, কতোটা যন্ত্রণা ভোগ করেছিলো সেটা বুঝতেই পারছেন।

“হায় ঈশ্বর।”

“ঠিক বলেছেন। একেবারেই পৈশাচিক। মেয়েটাকে খুঁজে পাবার পর টরসটেনসনই প্রথম ডিটেক্টিভ যে কিনা ঘটনাস্থলে যায়। এই খুনটার কোনো কূলকিণারা হয় নি। ওটা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। স্টকহোম থেকে বিশেষজ্ঞ ডেকে আনার পরও সেটার রহস্য সমাধান করা যায় নি। তবে ঐ পুলিশ অফিসার বেঁচে থাকতে কখনও কেসটা নিয়ে হাল ছেড়ে দেয় নি।’

“আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি।”

“আমার রেবেকা কেস হলো হ্যারিয়েট। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা এটাও জানি না মেয়েটা কিভাবে মারা গেলো। এমন কি একটা হত্যাকাণ্ড যে সংঘটিত হয়েছে সেটাও আমরা প্রমাণ করতে পারি নি। তবে আমিও এই কেসটা কখনও ছেড়ে দেই নি।” ভাবার জন্য একটু থামলো সে। “হোমিসাইড ডিটেক্টিভ হওয়াটা এই পৃথিবীর সবচাইতে একাকীত্বের একটি কাজ। ভিক্টিমের আত্মীয়স্বজন হতাশ আর ক্ষুব্ধ থাকে; তবে খুব জলদিই তারা নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। খুব কাছের লোকজনের একটু সময় লাগে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাও ভুলে যায়। জীবন চলতে থাকে আপন নিয়মে। তবে অমীমাংসিত রহস্যটা থেকে যায়, আর শেষ পর্যন্ত একজন ব্যক্তিই ব্যাপারটা নিয়ে দিন রাত মাথা ঘামিয়ে চলে, সেই ব্যক্তিটি হলো ঐ কেসের তদন্তে নিয়োজিত অফিসার।”

.

ভ্যাঙ্গার পরিবারের আরো তিনজন সদস্য হেডেবি আইল্যান্ডে বসবাস করে। গ্রেগরের ছেলে আলেকজান্ডার ভ্যাঙ্গার ১৯৪৬ সালে জন্মায়, একটা কাঠের বাড়িতে সে থাকে। ব্লমকোভিস্টকে ভ্যাঙ্গার আগেই বলেছিলো যে আলেকজান্ডার বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আছে। ওখানে সে প্রিয় মুহূর্ত কাটাচ্ছে : নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আর মাছ ধরা। ঐ সময় আলেকজান্ডারের বয়স ছিলো বিশ, সে ঐ দিন উপস্থিত ছিলো এখানে।

নিজের মা গার্দারর সাথে বসবাস করে আলেকজান্ডার। বিধবার বয়স আশি বছর। ব্লমকোভিস্ট তাকে এখনও দেখে নি। মহিলা বেশিরভাগ সময় শয্যাসায়ী থাকে।

তৃতীয় পারিবারিক সদস্য হলো হেরাল্ড ভ্যাঙ্গার। প্রথম মাসে ব্লমকোভিস্ট তার টিকিটাও দেখতে পেলো না। হেরাল্ডের বাড়ি ব্লমকোভিস্টের বাড়ির সবচাইতে কাছে। সব সময় জানালায় ভারি আর কালো পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। ভেতরে খুব একটা আলো জ্বলতেও দেখা যায় না। কখনও কখনও জানালার পাশ দিয়ে যাবার সময় ব্লমকোভিস্টের কাছে মনে হয় জানালার পর্দা নড়ছে। একবার দেরি করে রাতে ঘুমানোর সময় সে ঐ বাড়ির দোতলায় বাতি জ্বলতে দেখেছিলো। জানালার পর্দা কিছুটা ফাঁক ছিলো তখন, প্রায় বিশ মিনিট ধরে সে অন্ধকার রান্নাঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে কিন্তু তার টিকিটাও দেখতে পায় নি। অবশেষে তীব্র শীতের চোটে বিছানায় ফিরে গেছে ঘুমানোর জন্য। সকালে জানালার পর্দাগুলো আবারো আগের মতে অবস্থায় দেখতে পায় সে।

মনে হয় হেরাল্ড অদৃশ্য কেউ, তারপরও তার উপস্থিতি গ্রামে প্রভাব ফেলে থাকে। ব্লমকোভিস্টের কল্পনায় হেরাল্ড এমন এক শয়তানে পরিণত হয়েছে যে কিনা নিজের চারপাশে সব কিছুর উপর নজরদারী করে বেড়ায় পর্দার আড়াল থেকে। আর নিজের ডেরায় কি আছে না আছে সেটা সবার চোখের আড়ালে রাখতেই যেনো সারা জীবন উৎসর্গ করেছে সে।

হেরাল্ডের বাড়িতে এক কাজের লোক আসে দিনে একবার (সাধারণত বয়স্ক মহিলা)। সাথে করে সে ব্যাগ আর কিছু মালপত্র নিয়ে এসে তার দরজার সামনে রেখে যায়। হেরাল্ড সম্পর্কে নিলসনের কাছে ব্লমকোভিস্ট কিছু জানতে চাইলে সে মাথা ঝাঁকালো। জানালো তার বাড়ির সামনে বরফ জমে গেলে সেটার সাফ করার প্রস্তাব দিয়েছিলো সে কিন্তু হেরাল্ড নিজের বাড়ির ধারে কাছে কাউকে ঢুকতে দিতে রাজি না। হেরাল্ড যখন হেডেবিতে ফিরে এলো সেবার শীতে বরফ জমে তার বাড়ির সামনের জায়গাটা ভরাট হয়ে গেলে নিলসন ট্রাক্টর দিয়ে বরফ পরিস্কার করে দিয়েছিলো, ঐ একবারই তার বাড়ির সীমানায় ঢুকতে পেরেছিলো সে। তবে তার আগমনের শব্দ পেয়েই হেরাল্ড হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে নিলসনকে তার বাড়ির সামনে থেকে চলে যেতে বলে। তার চলে যাবার আগ পর্যন্ত হেরাল্ড দাঁড়িয়ে ছিলো বাড়ির সামনে।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো নিলসন ব্লমকোভিস্টের বাড়ির সামনে জমে থাকা বরফ সাফ করতে পারে নি কারণ তার বাড়ির মেইন গেটটা এতোটাই সংকীর্ণ যে ট্রাক্টর ঢুকতে পারে নি। শ্রমিক দিয়ে কাজটা করানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

.

জানুয়ারির মাঝামাঝিতে ব্লমকোভিস্ট তার আইনজীবিকে জানিয়ে দিলা তার তিনমাস জেল খাটার সময়টা কখন থেকে শুরু করা হতে পারে সেটা যেনো ঠিক করা হয়। ব্যাপারটা দ্রুত শেষ করার জন্য ভেতরে ভেতরে সে খুব অস্থির। কয়েক সপ্তাহ আলোচনা করার পর ঠিক করা হলো ব্লমকোভিস্টকে মার্চের ১৭ তারিখ থেকে ওস্টারসান্ডের রুলাকার জেলখানায় তিনমাসের সাজার মেয়াদ কাটাতে হবে। আইনজীবি তাকে জানালো সাজার মেয়াদটি আরো কমিয়ে আনা যাবে।

“বেশ,” কোনো রকম উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে ব্লমকোভিস্ট বললো।

রান্নাঘরের টেবিলে বসে আছে সে, কোলে সেই বেড়ালটা। এখন প্রতিরাতেই সেটা চলে আসে, তারপর রাত কাটিয়ে চলে যায় সকালে। নিলসনের কাছ থেকে সে জেনেছে বেড়ালটার নাম টিওরভেন। ওটা কারোর বেড়াল নয়, সব বাড়িতেই তার আনাগোনা।

ব্লমকোভিস্ট তার নিয়োগকর্তার সাথে প্রায় প্রতিদিনই দেখা করতে শুরু করলো। কখনও কখনও তাদের আলাপ খুব সংক্ষেপে হলেও প্রায়শই সেটা দীর্ঘ আড্ডায় পরিণত হয়।

তাদের আড্ডার বেশিরভাগ সময়েই ব্লমকোভিস্ট একটা তত্ত্ব হাজির করে আর ভ্যাঙ্গার সেটা বাতিল করে দেয়। নিজের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্লমকোভিস্ট চেষ্টা করে একটু নির্মোহ থাকতে কিন্তু মাঝেমধ্যেই সে বুঝতে পারে মেয়েটার নিখোঁজ হবার কেসটা নিয়ে সে দারুণভাবে ডুবে গেছে। যেনো বুড়োর বাতিকগ্রস্ততা তাকেও পেয়ে বসেছে।

ব্লমকোভিস্ট বার্গারকে আশ্বস্ত করেছে এই বলে যে সে ওয়েনারস্ট্রমের বিরুদ্ধে একটা লড়াই করার কৌশল প্রণয়ন করেছে, তবে সত্য কথা হলো হেডেস্টাডে এক মাস কাটিয়ে দেবার পরও এ নিয়ে সে কিছু ভাবে নি। বরং এই ব্যাপারটা যতোদূর সম্ভব ভুলে থাকার চেষ্টা করে কারণ ওয়েনারস্ট্রমের ঘটনাটি মনে পড়লেই সে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না তখন। মাঝে মাঝে সে ভাবে বুড়োর মতো সেও কি পাগল হয়ে যাচ্ছে কিনা। সাংবাদিক হিসেবে তার সুনাম মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে, আর সেটা পুণরুদ্ধার করার জন্য এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে ভূতের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে সে।

ভ্যাঙ্গারের কাছে মাঝেমধ্যে ব্লমকোভিস্টকে কিছুটা ভারসাম্যহীন ব’লে মনে হলে জানুয়ারির শেষের দিকে বৃদ্ধ এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলো যে সেটা নিজেকেও বিস্মিত করলো। টেলিফোন তুলে স্টকহোমে ফোন করলো সে। বিশ মিনিট দীর্ঘ হলো এই কথোপকথনটি আর সেটা মূলত মিকাইল ব্লমকোভিস্টকে নিয়েই।

.

বার্গারের রাগ কেটে যেতে পুরো একমাস লেগে গেলো। জানুয়ারির শেষের দিকে এক রাতে, ঠিক ৯:৩০ মিনিটে সে তাকে ফোন করলো অবশেষে।

“তুমি কি আসলেই ওখানে থাকতে চাইছো?” এ কথা দিয়ে শুরু করলো সে। কলটা পেয়ে ব্লমকোভিস্ট এতোটাই অবাক হলো যে প্রথমে কোনো জবাবই দিতে পারলো না। তারপর হেসে নিজের গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলো।

“হাই রিকি। তুমি নিজে এখানে এসে থেকে যেতে পারো।”

“আমি কেন? এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকার মধ্যে কী এমন মজা আছে?”

“বরফ পানিতে আমার দাঁতের অবস্থা একেবারে কাহিল হয়ে আছে। পানি লাগলেই দাঁতের ফিলিংগুলোতে ব্যথা করে।”

“এরজন্য তুমি নিজেই দায়ি। তবে স্টকহোমেও খুব ঠাণ্ডা পড়েছে এখন।”

“এবার দুঃসংবাদটা দাও।”

“আমরা আমাদের নিয়মিত বিজ্ঞাপন দাতাদের দুই তৃতীয়াংশ হারিয়েছি। কেউ এসে কিছু বলে নি তবে…”

“আমি জানি। যারা বিপদের সময় আমাদের পরিত্যাগ করছে তাদের একটা তালিকা তৈরি করে রাখো। একদিন তাদের উপর আমি বেশ ভালো একটা রিপোর্ট করবো।”

“মিকি…আমি হিসেব ক’রে দেখেছি, নতুন কোনো বিজ্ঞাপনদাতা যদি জোগার করতে না পারি তাহলে শরৎকালের মধ্যেই আমরা দেউলিয়া হয়ে যাবো।”

“দুঃসময় কেটে যাবে।”

লাইনের অপরপ্রান্তে বার্গার দীর্ঘশ্বাসের সাথে হেসে ফেললো।

“অতো দূরে বসে তুমি এ কথা বলতে পারো না।”

“এরিকা, আমি…”

“জানি। একজন পুরুষ তাই করবে যা তাকে করতে হবে। আর এর সবটাই একেবারে ফালতু। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি দুঃখিত, তোমার মেসেজগুলোর কোনো জবাব দেই নি বলে। মেজাজ খুবই খারাপ ছিলো। আমরা কি আবার শুরু করতে পারি? আমি কি তোমার ওখানে এসে তোমাকে দেখে যাবো?”

“তোমার যখন খুশি চলে আসতে পারো।”

“আমি সাথে করে বড় একটা রাইফেলও নিয়ে আসবো?”

“মোটেও না। এখানে ওসব জিনিস তো আছেই সাথে শিকারী কুকুরও আছে। কবে আসছো তুমি?”

“শুক্রবারের রাতে, ঠিক আছে?”

.

বরফ সরিয়ে দরজা থেকে সংকীর্ণ একটা পথ তৈরি করা হয়েছে, সে জায়গাটা বাদে বাড়ির চারপাশ তিন ফিট বরফে ঢেকে আছে। ব্লমকোভিস্ট সেই সরু পথ ধরে চলে গেলো নিলসনের বাড়িতে। তার কাছে জানতে চাইলো বার্গারের বিএমডব্লিউ গাড়িটা ওখানে পার্ক করা যাবে কিনা। কোনো সমস্যা নেই। তাদের বড়সড় একটি গ্যারাজ আছে সেখানে ওটা রাখা যাবে। ওই গ্যারাজে ইঞ্জিন হিটারও রয়েছে।

বিকেলে রওনা দিয়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে পৌছালো বার্গার। প্রথমে একে অন্যের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো তারা তারপর আলিঙ্গন করলো দীর্ঘ সময় ধরে।

অন্ধকারে আলোকিত চার্চটা ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কনসাম এবং সুসানের ক্যাফে দুটোও বন্ধ হয়ে গেছে এতোক্ষণে। বার্গার তার বাড়ির বিভিন্ন ঘরগুলো দেখার সময় ব্লমকোভিস্ট ডিনার রান্না করে ফেললো।

ভেড়ার মাংসে কাটলেট আর আলু ভাজার সাথে মাখনের সস এবং রেড ওয়াইন। ব্লমকোভিস্ট পত্রিকা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেও বার্গার মিলেনিয়াম নিয়ে কথা বলার মতো মুডে নেই। তার বদলে এখানে ব্লমকোভিস্টের কাজকর্ম আর ভ্যাঙ্গারের সাথে কেমন খাতির হয়েছে সেটা জানতে চাইলো সে। এরপর তারা শোবার ঘরে চলে এলো এটা দেখার জন্যে যে বিছানায় তাদের দু’জনের সংকুলান হবে কিনা।

.

সালান্ডারের সাথে এডভোকেট নিলস বুরম্যানের তৃতীয় মিটিংটা রিশিডিউল করে শুক্রবার বিকেলে করা হলো। এর আগের মিটিংয়ে সালান্ডারকে এক বয়স্ক মহিলা অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো যে কিনা আইনজীবি ভদ্রলোকের সহকারী হিসেবে কাজ করে থাকে। আজকে অবশ্য কাজ শেষ করে মহিলা চলে গেছে। বুরম্যানের মুখ থেকে হালকা মদের গন্ধ পেলো সে। সালান্ডারকে একটা চেয়ারে বসার ইশারা করে ডেস্কের কাগজপত্র ঘাটতে লাগলো, মনে হলো হঠাৎ করেই মেয়েটার উপস্থিতি টের পেয়ে ধাতস্থ হলো ভদ্রলোক।

আরেক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো তাকে। এবার সে সালান্ডারের যৌনজীবন নিয়ে প্রশ্ন করলো-যে ব্যাপারটা নিয়ে কারো সাথে কোনো রকম কথাবার্তা বলার ইচ্ছে তার নেই।

মিটিংয়ের শেষে সালান্ডার বুঝতে পারলো পুরো ব্যাপারটা সে খুব খারাপভাবে সামলিয়েছে। প্রথমে তার প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানায় সে। এতে করে আইনজীবি ভদ্রলোক মনে করলো সালান্ডার লাজুক, মাথামোটা কিংবা লুকিয়ে রাখার মতো কিছু ব্যাপার আছে তার। জবাব পাবার জন্য সে বেশ চাপাচাপি করলো। সালান্ডার বুঝতে পারলো লোকটা জবাব না পেলে তাকে ছাড়বে না তাই সংক্ষেপে বলতে শুরু করলো। এমনভাবে বললো যেনো সেটা তার মনোবৈজ্ঞানিক প্রোফাইলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। ‘ম্যাগনাস’ নামের একজনের কথা জানালো সে তার মতে ছেলেটা একজন কম্পিউটার জিনিয়াস। তার সমবয়সী। বেশ ভালো ব্যবহার করে তার সাথে। তাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়, কখনও কখনও তারা একসাথে রাতও কাটায়। ম্যাগনাস হলো বানানো একটা গল্প। কিন্তু বুরম্যানের ভাবসাব দেখে মনে হলো এ থেকে সালান্ডারের যৌনজীবনের একটা রূপরেখা তৈরি করতে যাচ্ছে সে। কতো দিন পর পর তোমরা সেক্স করো? মাঝেমধ্যে। প্রথম উদ্যোগটা কে নিয়ে থাকে-তুমি নাকি সে? আমি। তুমি কি কনডম ব্যবহার করো? অবশ্যই—এইচআইভি’র ব্যাপারে সে ভালোমতোই সচেতন আছে। তোমার প্রিয় আসন কোনটা? উমমম, সাধারণত আমি পেছন দিক থেকেই বেশি পছন্দ করি। তুমি কি ওরাল সেক্স উপভোগ করো? কী বললেন…কখনও কি পায়ুপথে সেক্স করেছো?

“না। পাছা মারা খাওয়া কোনো মজার জিনিস না-কিন্তু এসব আপনি কেন জানতে চাইছেন?”

এই প্রথম তার মেজাজ বিগড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নীচু ক’রে রাখলো যাতে তার চোখ দেখে তার মনোভাব বোঝা না যায়। মুখ তুলে যখন তাকালো দেখতে পেলো উকিল ভদ্রলোক দাঁত বের ক’রে হাসছে। প্রচণ্ড ঘেন্না নিয়ে লোকটার অফিস থেকে বের হয়ে এলো সে। পামগ্রিন কখনও এ ধরণের প্রশ্ন করতো না। বরং সে সব সময়ই চাইতো সালান্ডার যেনো নিজে থেকে তার সাথে যেকোনো বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলে। তবে সে তা করতো না।

মনে হচ্ছে বুরম্যান আস্ত একটা ঝামেলা হিসেবেই আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।

অধ্যায় ১১

শনিবার, ফেব্রুয়ারি ১ মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারি ১৮

শনিবারের স্বল্প দিনের আলোয় ব্লমকোভিস্ট আর বার্গার ওস্টারগার্ডেনের কাছে ছোট্ট নৌকার এক হার্বারে পায়ে হেটে বেড়াতে গেলো। প্রায় এক মাস ধরে সে হেডেবি আইল্যান্ডে বসবাস করছে কিন্তু আজকের আগে এই এলাকার এতোটা ভেতরে কখনওই আসে নি। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর নিয়মিত তুষার ঝড় তাকে এ কাজ করতে বিরত রেখেছিলো। তবে শনিবারের দিনটি একেবারে রোদ্রৌজ্জ্বল আর আরামদায়ক। যেনো বার্গার সঙ্গে করে বসন্তের আমেজ নিয়ে এসেছে। রাস্তার দু’পাশে স্তুপ করে রাখা বরফের উচ্চতা তিন ফিটের কম হবে না। সামার-কেবিন ছেড়ে আসতেই গভীর বনের ভেতর দিয়ে তারা হাটতে লাগলো। গ্রাম থেকে সোডারবার্গেট পাহাড়টা যতো বড় দেখায় এখানে এসে তারচেয়ে অনেক বেশি- বড় মনে হচ্ছে ব্লমকোভিস্টের কাছে। ভাবলো শৈশবে হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার এখানে না জানি কতোবার খেলাধুলা করেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে। যতো দ্রুত ভাবনাটি এসেছিলো ততো দ্রুতই সেটা মাথা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিলো সে। বনের ভেতর এক মাইল হেটে যেতেই একটা বেড়া দেখতে পেলো তারা। ওস্টারগার্ডেনের ফার্মল্যান্ড এখান থেকেই শুরু হয়েছে। দূরে সাদা কাঠ আর লাল রঙের ফার্মের বিল্ডিংগুলো তাদের নজরে পড়লো। যে পথে এসেছিলো সে পথেই আবার ফিরে গেলো তারা।

এস্টেট হাউজের কাছে আসতেই ভ্যাঙ্গার তাদেরকে উপর তলায় যাবার ইশারা করলে ব্লমকোভিস্ট আর বার্গার একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

“তুমি কি একজন কর্পোরেট লিজেন্ডের সাথে দেখা করতে চাও?” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“সে কি কামড়ায়?”

“শনিবারে কামড়ায় না।”

নিজের অফিসের দরজার সামনে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো ভ্যাঙ্গার। “আপনি নিশ্চয় ফ্রোকেন বার্গার, আপনাকে দেখেই চিনতে পেরেছি,” বললো সে। “আপনি যে হেডেবিতে আসছেন সেটা মিকাইল আমাকে বলে নি।”

বার্গারের অনেক প্রতিভার মধ্যে একটা হলো খুব সহজে মানুষের সাথে মিশে যাওয়া। তাকে আপন করে নেয়া। ব্লমকোভিস্ট দেখেছে তার এই চার্মের প্রভাব পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের উপরেও সমানভাবে প্রযোজ্য। দশ মিনিটের মধ্যে সেইসব বাচ্চারা নিজেরদের মাকে ভুলে তার সাথে মেতে ওঠে। আশির উপরে যেসব পুরুষ আছে তারা যে এর ব্যতিক্রম হবে না সেটা সে ভালো করেই জানে। মাত্র দু’মিনিট পরই বার্গার আর হেনরিক এমনভাবে কথা বলতে লাগলো যে নিজেকে ব্লমকোভিস্টের অপাংক্তেয় ব’লে মনে হতে লাগলো। তারাও যেনো ভুলে গেলো ব্লমকোভিস্ট নামের কেউ তাদের সামনে আছে। মনে হচ্ছে বহুদিন থেকেই তারা একে অপরকে চেনে।

ভ্যাঙ্গারকে অবাক করে দিয়ে বার্গার বলতে শুরু করলো তার প্রকাশক তাদেরকে রেখে পালিয়েছে। বৃদ্ধ জবাবে জানালো সে যতোটুকু পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছে তাতে তো মনে হচ্ছে বার্গারই তাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। তারপর সে বললো, যদি ঘটনা সেরকম নাও হয়ে থাকে তরুণ ব্লমকোভিস্টের জন্য কিছুদিন এই গ্রামীণ এলাকায় থাকাটা বেশ উপকারে আসবে।

পাঁচ মিনিট ধরে তারা ব্লমকোভিস্টের সেই রিপোর্টটা নিয়ে কথা বলে গেলো যার জন্যে তাকে আদালত থেকে সাজা পেতে হয়েছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ শুনে গেলো ব্লমকোভিস্ট। তবে বার্গার যখন বললো সাংবাদিক হিসেবে সে ব্যর্থ হলেও যৌনতার ব্যাপারে মোটেও ব্যর্থ নয় তখন তার ভুরু কপালে উঠে গেলো। এ কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো হেনরিক ভ্যাঙ্গার।

খুবই অবাক হলো ব্লমকোভিস্ট। ভ্যাঙ্গারকে সে কখনই এতোটা প্রাণোচ্ছল আর হাসিখুশি দেখে নি। আচমকাই যেনো লোকটার বয়স পঞ্চাশ হয়ে গেছে-কিংবা ত্রিশ। লোকটা যে রমণীমোহন ছিলো সেটা এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে। তবে স্ত্রী মারা যাবার পর আর বিয়ে করে নি। তার জীবনে অবশ্যই অনেক নারীর আগমন ঘটেছে তারপরও বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ব্যাচেলর জীবনযাপন করছে সে।

কফিতে চুমুক দিয়ে ব্লমকোভিস্ট তাদের কথাবার্তায় আবারো কান পাতলো, সে বুঝতে পারলো এবার তাদের আলোচনা খুব সিরিয়াস একটি বিষয় নিয়ে হচ্ছে-মিলেনিয়াম-এর ভবিষ্যত।

“মিকাইল আমাকে বলেছে আপনারা পত্রিকাটা নিয়ে সমস্যার মধ্যে আছেন।” বার্গার ব্লমকোভিস্টের দিকে তাকালো। “না, সে আপনাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিছু বলে নি। তবে আপনাদের পত্রিকাটি যে আমাদের ভ্যাঙ্গার কর্পোরশনের মতোই সমস্যায় আছে সেটা অন্ধ-কালা লোকেও বুঝবে।’

“এই সমস্যাটি যে আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো সে ব্যাপারে আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী,” বললো বার্গার।

“আমার তাতে সন্দেহ রয়েছে,” ভ্যাঙ্গার বললো।

“কেন?”

“আচ্ছা-আপনাদের ওখানে কতোজন লোক কর্মরত আছে? ছয়জন? একটি মাসিক পত্রিকা যার সংখ্যা ২১০০০, উৎপাদন খরচ, বেতনভাতা, সার্কুলেশন বিলি-বণ্টন, অফিস খরচ…আপনাদের প্রয়োজন ১০ মিলিয়ন ক্রোনার রেভেনিউ।”

“তো?”

“তো আমার বন্ধু ওয়েনারস্ট্রম খুবই প্রতিহিংসাপরায়ণ আর সংকীর্ণমনা এক লোক, সে এতো সহজে ব্যাপারটা ভুলে যাবে না। আপনাদেরকেও সে ক্ষমা করতে পারবে না। বিগত ছয় মাসে আপনারা কতোগুলো বিজ্ঞাপন হারিয়েছেন?’

ভ্যাঙ্গারের কথা শুনে ভুরু কুচকে রইলো বার্গার। দম বন্ধ হয়ে এলো ব্লমকোভিস্টের। মিলেনিয়াম-এর ভবিষ্যত নিয়ে বুড়োর সাথে তার কিছু কথাবার্ত হয়েছে, আর ব্লমকোভিস্টের এখানকার কাজের সাথে পত্রিকাটির যে সম্পর্ক আছে সেটা সে জানে। ভ্যাঙ্গার এখন এরিকাকে জিজ্ঞেস করছে, এক বস আরেক বসকে সুধাচ্ছে আর কি। তাদের মধ্যে যে সিগনাল আদানপ্রদান হচ্ছে সেটা ব্লমকোভিস্ট ধরতে পারছে না। এর কারণ সম্ভবত সে উঠে এসেছে নিতান্তই গরীব একটি পরিবার থেকে, অপরদিকে এরিকার পরিবার খুবই প্রভাবশালী এবং ধনী।”

“আমি কি আরেকটু কফি পেতে পারি?” বার্গার কথাটা বলতেই ভ্যাঙ্গার তার কাপে কফি ঢেলে দিলো। “ঠিক আছে, আপনি তাহলে আমাদের ব্যাপারে ভালোই হোমওয়ার্ক করেছেন। হ্যা, আমরা সমস্যায় আছি।”

“এভাবে কতোদিন টিকতে পারবেন?”

“ছয় মাস চলতে পারবো। বড়জোর আট মাস। এরচেয়ে বেশি চলার মতো ক্যাপিটাল আমাদের কাছে নেই।”

বৃদ্ধলোক উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, তার অভিব্যক্তি দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। চার্চটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

“আপনারা কি জানেন আমি এক সময় সংবাদপত্র ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলাম?” বললো ভ্যাঙ্গার। কথাটা তাদের দু’জনের উদ্দেশ্যেই।

ব্লমকোভিস্ট আর বার্গার একসাথে মাথা ঝাঁকালো। আবারো তিক্তভাবে হেসে ফেললো ভ্যাঙ্গার।

“নরল্যান্ডে আমাদের ছয়টি দৈনিক পত্রিকা ছিলো। ওটা পঞ্চাশ-ষাট দশকের কথা। আইডিয়াটা আমার বাবার ছিলো-তিনি মনে করেছিলেন আমাদের হাতে কিছু মিডিয়া থাকলে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাওয়া যাবে। এখনও আমরা হেডেস্টাড কুরিয়ার-এর মালিক। আমাদের পরিবারে বার্জার নামে একজন ওটার চেয়ারম্যান। হেরাল্ডের ছেলে সে,” ব্লমকোভিস্টের সুবিধার্থে শেষ কথাটা যোগ করলো।

“সেইসাথে স্থানীয় একজন রাজনীতিক,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“মার্টিনও বোর্ডে আছে। সে বার্গারকে সঠিকপথে থাকতে বাধ্য করে।”

“আপনি কেন নিজেদের অধীনে থাকা পত্রিকাগুলো ছেড়ে দিলেন?” জানতে চাইলো ব্লমকোভিস্ট।

“ষাটের দশকে কর্পোরেট রিস্ট্রাকচারিং হয়েছিলো। পত্রিকা প্রকাশ করাটা অনেক দিক থেকেই শখের বিষয়। আমাদেরকে যখন বাজেট কাটছাট করতে হলো তখন সবার আগে খড়গ নেমে এলো সেগুলোর উপর। বিক্রি করে দেয়া হলো পত্রিকাগুলো। তবে আমি জানি পত্রিকা কিভাবে চালাতে হয়…আমি কি একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?”

এই কথাটা এরিকার উদ্দেশ্যে করা হলো।

“আমি মিকাইলকে এ কথাটা জিজ্ঞেস করি নি। তবে আপনি যদি জবাব দিতে না চান দেবেন না। আমি জানতে চাই আপনারা এই চোরাবালি থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পেতে চাচ্ছেন। আপনাদের কাছে কি কোনো গল্প আছে নাকি নেই?”

এবার ব্লমকোভিস্টই অভিব্যক্তিহীন হয়ে পড়লো। কিছু বলার আগে একটু দ্বিধা দেখা গেলো বার্গারের মধ্যে : “আমাদের কাছে একটা গল্প ছিলো। তবে সেটা একেবারে ভিন্ন একটি গল্প।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ভ্যাঙ্গার, যেনো বার্গার কি বলতে চাচ্ছে সেটা সে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে। তবে ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারলো না।

“আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি না।” আলোচনা সংক্ষেপ করা জন্য বললো ব্লমকোভিস্ট। “আমি রিসার্চ করে আর্টিকেলটা লিখেছিলাম। প্রয়োজনীয় সব সোর্সই আমার ছিলো। কিন্তু সবটাই ভেস্তে গেছে।”

“তুমি যা-ই লেখো না কেন সবগুলোরই সোর্স থাকে?”

“থাকে।”

আচমকা ভ্যাঙ্গারের কণ্ঠটা তীক্ষ্ম হয়ে উঠলো। “তুমি যে একটা মাইনফিল্ডের উপর দিয়ে হেটে গিয়েছিলে সেটা আমি বুঝতে পারছি। ষাটের দশকে এক্সপ্রেসেন পত্রিকায় লুন্ডাল ঘটনাটি ছাড়া এরকম কোনো গল্প আমি মনে করতে পারছি না। তোমরা অবশ্য সেই গল্পের কথা শুনেছো কিনা আমি জানি না। তোমার সোর্সও কি একজন গল্পবাজ লোক ছিলো?” মাথা ঝাঁকিয়ে সে বার্গারের দিকে ফিরে শান্ত কণ্ঠে বললো, “আমি এক সময় পত্রিকার প্রকাশক ছিলাম, আবারো সেরকম একজন প্রকাশক হতে পারি। আরেকজন পার্টনার নেবার ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?”

প্রশ্নটা যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, তবে বার্গারকে দেখে মনে হলো না সে খুব অবাক হয়েছে।

“আমাকে আরো খুলে বলুন,” বললো বার্গার।

ভ্যাঙ্গার বললো : “আপনি হেডেস্টাডে কতোদিন থাকবেন?“

“আগামীকালই আমি ফিরে যাচ্ছি।”

“তাহলে আপনি এবং মিকাইল কি দয়া করে আজরাতে আমার সাথে একটু ডিনার করবেন? ৭টার দিকে হলে কি চলবে?”

“ঐ সময়টা হলে আমাদের জন্য ভালোই হয়। আপনার সাথে ডিনার করতে ভালোই লাগবে। তবে আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। আপনি কেন মিলেনিয়াম-এর পার্টনার হতে চাচ্ছেন?”

“প্রশ্নটা আমি এড়িয়ে যাচ্ছি না। ভাবছি এই ব্যাপারটা নিয়ে ডিনারের সময় কথা বলবো। আপনাদেরকে একটি কংক্রিট প্রস্তাব দেবার আগে আমার আইনজীবির সাথে একটু পরামর্শ করে নিতে হবে। তবে সোজা কথায় যদি বলি তাহলে বলতে হয় ইনভেস্ট করার মতো টাকা আমার কাছে আছে। পত্রিকাটি যদি টিকে যায়, মুনাফা করতে শুরু করে তখন আমি সামনে চলে আসবো। তা যদি না হয়—তাতেও কিছু যায় আসে না; এই জীবনে এরচেয়েও অনেক বড় লোকসান আমার হয়েছে।

ব্লমকোভিস্ট কিছু বলতে যাবার আগেই বার্গার তার হাটুর উপর হাত রেখে তাকে বিরত করলো।

“মিকাইল এবং আমি এই সংবাদপত্রটি স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার জন্য অনেক কঠিন সংগ্রাম করেছি।”

“ফালতু কথা। কেউই পুরোপুরি স্বাধীন নয়। তবে আমি ম্যাগাজিনটার ওপর খবরদারি করবো না। আর কি লেখা হলো না হলো সেটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবো না। ঐ বাস্টার্ড স্টেনবেক যদি মডার্ন টাইমস প্রকাশ করতে পারে তাহলে আমি কেন মিলেনিয়াম-এ ফিরে আসতে পারবো না?”

“এর সাথে কি ওয়েনারস্ট্রমের কোনো ব্যাপার আছে?” বললো ব্লমকোভিস্ট।

হেসে ফেললো ভ্যাঙ্গার। “মিকাইল, আমার বয়স এখন আশির উপরে। অনেক কিছুই আছে যা করি নি বলে আমি আজো অনুতপ্ত আর যেসব লোক ঠিকমতো লড়াই করতে পারে না বলেও আমার আক্ষেপ আছে। তবে এই বিষয়টার কথা বলতে গেলে-” বার্গারের দিকে আবার ফিরলো সে। “মানে, এই ইনভেস্টমেন্টটার ব্যাপারে বলছি আর কি। একটা শর্তে আমি সেটা করবো।”

“তাহলে সেটা কি আগে শুনি,” বার্গার বললো।

“মিকাইল ব্লমকোভিস্টকে আবারো প্রকাশকের পদে ফিরে যেতে হবে।

“না,” সঙ্গে সঙ্গে বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আলবৎ,” পাল্টা জবাবে তার মতো করেই বললো ভ্যাঙ্গার। “আমরা যদি একটা প্রেসরিলিজ করে ঘোষণা দেই যে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশন মিলেনিয়াম-এর পেছনে আছে এবং তুমি আবার প্রকাশকের পদে ফিরে এসেছো তাহলে ওয়েনারস্ট্রমের হার্ট অ্যাটাক করবে। আমরা ঠিক এই সিগনালটিই তাকে দিতে পারি—সবাই তখন বুঝবে আমরা পত্রিকাটি অধিগ্রহণ করছি না, এর সম্পাদকীয় নীতিমালায়ও কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এরফলে যেসব বিজ্ঞাপনদাতা সরে যাচ্ছে তারা আবার ফিরে আসার কথা ভাববে। ওয়েনারস্ট্রম কিন্তু সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয়। তারও শত্রু আছে। তোমাদের কাছে অজানা এরকম অনেক নতুন কোম্পানি আছে যারা বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী হবে।”

“এসবের মানে কি?” বার্গার ঘরের দরজাটা বন্ধ করতেই ব্লমকোভিস্ট কথাটা বললো।

“এটাকে তুমি বলতে পারো কোনো ব্যবসায়িক ডিলের আগে অগ্রীম খোঁজখবর নেয়া,” বললো বার্গার। “তুমি কিন্তু আমাকে বলো নি হেনরিক ভ্যাঙ্গার এতোটা সুইটি।”

ব্লমকোভিস্ট তার সামনে এসে দাঁড়ালো। “রিকি, তুমি তাহলে জানতে আজকের এই আলোচনাটি কি নিয়ে হবে।”

“আরে বাচ্চাছেলে। এখন সবেমাত্র ৩টা বাজে, ডিনারের আগে আমি একটু ফুর্তি করতে চাই।”

*

ব্লমকোভিস্ট রেগেমেগে একাকার। তবে এরিকার সামনে কখনওই বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না সে।

এরিকা পরেছে একটা কালো রঙের পোশাক, কোমর সমান লম্বা জ্যাকেট আর পাম্পস, এসব জিনিস সে সুটকেসে করে নিয়ে এসেছে। ব্লমকোভিস্টকে সে জ্যাকেট আর টাই পরতে বলেছিলো। তবে সে পরেছে কালো রঙের প্যান্ট, ধূসর রঙের শার্ট, কালো টাই আর ধূসর একটা স্পোর্ট কোট। ঠিক সময়ে তারা ভ্যাঙ্গারের বাড়িতে পৌছে দেখতে পেলো ডার্চ ফ্রোডি আর মার্টিন ভ্যাঙ্গারও রয়েছে সেখানে। ভ্যাঙ্গার ছাড়া সবাই জ্যাকেট আর টাই পরেছে।

“আশির উপরে বয়স হবার একটা সুবিধা হলো কেউ তোমার পোশাক আশাক নিয়ে সমালোচনা করবে না,” বললো সে। একটা বো টাই আর বাদামি রঙের কার্ডিগান পরেছে হেনরিক ভ্যাঙ্গার।

পুরো ডিনারের সময়টাতে বার্গারকে খুবই প্রাণোচ্ছ্বল দেখালো।

ড্রইংরুমের ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে কগনাক মদ পান করার পর পরই তাদের কথাবার্তা সিরিয়াস হয়ে উঠলো। চুক্তির রূপরেখা ঠিক করার আগে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে আলোচনা করে গেলো তারা।

একটা কোম্পানি গঠন করবে ফ্রোডি যা কিনা পুরোপুরি হেনরিক ভ্যাঙ্গারের মালিকানায় থাকবে। বোর্ডে থাকবে হেনরিক, মার্টিন আর ফ্রোডি। চার বছর পর্যন্ত এই কোম্পানি মিলেনিয়াম-এর আয়-ব্যয়ের মধ্যে যে ফারাক থাকবে সেটার জোগান দিয়ে যাবে। টাকাগুলো ভ্যাঙ্গারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে নেয়া হবে। বিনিময়ে ভ্যাঙ্গারকে ম্যাগাজিনের বোর্ডে সম্মানজনক একটি পদ দেয়া হবে। এই চুক্তিটি হবে চার বছর মেয়াদি, তবে মিলেনিয়াম-এর মালিকেরা চাইলে দু’বছরের মাথায় চুক্তিটা বাতিল করে দিতে পারবে। তবে এ ধরণের আগাম চুক্তি বাতিল করলে সেটা খুব ব্যয়বহুল হবে কারণ ভ্যাঙ্গার যে পরিমাণ টাকা দেবে সেগুলো ফেরত দিতে হবে।

এই সময়ের মধ্যে যদি হেনরিক ভ্যাঙ্গার মারা যায় তাহলে মিলেনিয়াম-এর বোর্ডে তার স্থলাভিষিক্ত হবে মার্টিন ভ্যাঙ্গার। নির্দিষ্ট সময় পর চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলে মার্টিন যদি নিজের পদে থাকতে চায় কিংবা ছেড়ে দিতে চায় সেটা একান্তই তার নিজের ব্যাপার। ওয়েনারস্ট্রমকে ধরাশায়ী করার ব্যাপারে মনে হলো মার্টিনও বেশ আগ্রহী। ব্লমকোভিস্ট ভাবতে লাগলো এদের দু’জনের শত্রুতার আসল উৎস কোনটি।

গ্লাসে মদ ভরে দিলো মার্টিন। ব্লমকোভিস্টের দিকে ঝুঁকে হেনরিক ভ্যাঙ্গার নীচু কণ্ঠে জানালো এই চুক্তির ফলে তার সাথে করা আগের চুক্তিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। দুটো একেবারে আলাদা। ব্লমকোভিস্ট ইচ্ছে করলে বছরের শেষের দিকে প্রকাশক হিসেবে আবার কাজ শুরু করতে পারে।

আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো তাদের এই রি-অর্গানাইজেশনটা মার্চের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে ব্লমকোভিস্ট যখন জেল খাটার মেয়াদ শুরু করবে সেদিনই সমস্ত মিডিয়ায় ঘোষণা করা হবে। এরকম একটা নেতিবাচক ব্যাপারের সাথে রি-অর্গানাইজেশন করাটা পাবলিক রিলেশন্সের দিক থেকে একেবারেই মারাত্মক একটি ভুল, এতে করে কেবল ব্লমকোভিস্টের শত্রুরা অবাক হবে আর সেই সাথে হেনরিক ভ্যাঙ্গারের নতুন ভূমিকাটিই সামনে চলে আসবে। তবে সবাই এর মধ্যে একটা যুক্তিও দেখতে পাবে-মিলেনিয়াম-এর গায়ে হলুদ সাংবাদিকতার যে তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে মুক্তি পাবার এটাই হলো একটা পথ। তাছাড়া এটা আরো ইঙ্গিত করবে যে ম্যাগাজিনটির সাপোর্ট করার মতো বড় প্রতিষ্ঠান আছে যারা প্রয়োজনে নির্মমও হতে পারবে। ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশন হয়তো সমস্যার মধ্যে রয়েছে কিন্তু এটা এখনও সবচাইতে প্রসিদ্ধ শিল্পগোষ্ঠী, প্রয়োজনে তারা যেকোনো শত্রুর মোকাবেলা করতে পিছ পা হবে না।

আলোচনার সবটাই হলো ভ্যাঙ্গারদের সাথে বার্গারের। ব্লমকোভিস্ট কি ভাবছে সেটা কেউ জিজ্ঞেসও করলো না।

রাতে নিজের ঘরে ফিরে এসে এরিকার কোলে মাথা রেখে ব্লমকোভিস্ট তার চোখের দিকে তাকালো।

“তুমি আর হেনরিক ভ্যাঙ্গার কতোদিন ধরে এ নিয়ে আলোচনা করেছো?”

“এক সপ্তাহের মতো হবে,” হেসে বললো সে।

“ক্রিস্টার কি এতে রাজি আছে?”

“অবশ্যই।”

“তুমি আমাকে কেন বলো নি?”

“আরে, এ নিয়ে তোমার সাথে কেন আলোচনা করতে যাবো? তুমি তো প্রকাশক হিসেবে পদত্যাগ করেছো, তুমি সম্পাদকীয় বোর্ড আর ওখানকার সব কাজকর্ম ছেড়েছুড়ে এই জঙ্গলে চলে এসেছো।”

“তাহলে এসবই আমি ডিজার্ভ করি!”

“হ্যা, তা করো,” বললো এরিকা।

“তুমি আসলেই আমার উপর রেগে ছিলে।

“মিকাইল, আমি কখনও এতোটা রেগে যাই নি। নিজেকে পরিত্যাক্ত লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এর আগে তোমার উপর আমি কখনওই এতোটা ক্ষুব্ধ হই নি।” তার মাথার চুল শক্ত করে ধরে তাকে আরো কাছে টেনে আনলো এরিকা।

বার্গার হেডেবি ছেড়ে চলে যাবার পরও ব্লমকোভিস্ট অনেকটা বিরক্ত হয়ে রইলো ভ্যাঙ্গারের উপর। ভ্যাঙ্গার কিংবা তার বিশাল পরিবারের কেউ কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়ুক সেটা সে চায় নি। এক সোমবার হেডেস্টাডের বাস ধরে পুরো বিকেল শহরটা ঘুরে, লাইব্রেরিতে ঢুঁ মেরে আর একটা বেকারিতে কফি খেয়ে কাটিয়ে দিলো। রাতের বেলায় একটা সিনেমা দেখতে ঢুকে পড়লো থিয়েটারে।

এই ভ্রমণটা শেষ করলো হেডেস্টাডের ম্যাকডোনাল্ডে খেয়ে। তারপর একটা বাসে চেপে সোজা ফিরে এলো হেডেবিতে। রান্নাঘরে কফি খেতে খেতে একটা ফাইল বের করে ভোর ৪টা পর্যন্ত পড়ে গেলো একটানা।

এই তদন্তের ব্যাপারে ব্লমকোভিস্টের মনে কতোগুলো প্রশ্ন দিন দিন অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে সেজন্যে আরেকবার ডকুমেন্টগুলো নিয়ে বসেছে। সে নিজে যেসব জিনিস উদ্ঘাটন করেছে সেগুলো যে খুবই বৈপ্লবিক তা বলা যাবে না। এগুলো এমন সব সমস্যা যা কিনা ইন্সপেক্টর মোরেলকেও দীর্ঘদিন ধরে ভাবিয়ে তুলেছে।

শেষ দিকে হ্যারিয়েট বদলে গিয়েছিলো। এটাকে যেকোনো মানুষের বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন হিসেবেও দেখা যেতে পারে। কারণ হ্যারিয়েট বড় হচ্ছিলো। ক্লাসমেট, শিক্ষক আর পরিবারের অনেকেই জানিয়েছিলো যে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতো, সে ক্রমশ নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকতো সেই সময়টাতে।

মাত্র দু’বছর আগে যে মেয়েটা হাসিখুশি আর চটপটে ছিলো সে কিনা নিজেকে সবার কাছ থেকে দূরে দূরে রাখতো। স্কুলে বন্ধুদের সাথে সময় কাটালেও তারা জানিয়েছে মেয়েটা নাকি ক্রমশ শীতল আচরণ করতে শুরু করে দিয়েছিলো। স্কুলের বন্ধুদের এই মন্তব্য মোরেলের কাছে অদ্ভুত মনে হলে সে এই ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো কয়েকজনকে। যে ব্যাখ্যা সে পেয়েছিলো সেটা হলো, হ্যারিয়েট নাকি নিজের সম্পর্কে কথা বলতো না, গালগল্পে অংশ নিতো না, প্রাণ খুলে কথাও বলতো না বন্ধুদের সাথে।

হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার একজন নিবেদিতপ্রাণ খৃস্টান ছিলো-রবিবারের প্রার্থনায় যোগ দিতো, রাতে প্রার্থনা করতো। শেষের দিকে তার মধ্যে ধর্মবিশ্বাস আরো প্রবল হয়ে ওঠে। নিয়মিত বাইবেল পড়তো, চার্চে যাতায়াত করতে শুরু করে সে, তবে হেডেবি আইল্যান্ডের যাজক অটো ফকের দ্বারস্থ হয় নি, যদিও এই যাজক ছিলো ভ্যাঙ্গার পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বরং বসন্তকালে সে হেডেস্টাডের পেন্টেকোস্টাল কংগ্রেশেনে অংশ নেবার চেষ্টা করেছিলো। তবে পেন্টেকোস্টাল চার্চে তার অবস্থান স্বল্পকালীন ছিলো। দু’মাস পরই চার্চের কংগ্রেশন ছেড়ে ক্যাথলিক ধর্মের বই-পুস্তক পড়তে শুরু করে সে।

একজন টিনএজারের ধর্মের প্রতি অন্ধমোহ? হতে পারে, তবে ভ্যাঙ্গার পরিবারে কারোর মধ্যে কখনওই ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায় নি। তার মধ্যে কি ধরণের ভাবনা ছিলো সেটা খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। আগের বছর তার বাবা পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাটি ঈশ্বরের প্রতি তার এই আগ্রহের একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। মোরেল এই উপসংহারে এসেছিলো যে, হ্যারিয়েটের মধ্যে একটা সমস্যা ছিলো, তাকে কিছু একটা ভাবিয়ে তুলেছিলো। ভ্যাঙ্গারের মতো মোরেলও হ্যারিয়েটের অনেক বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলেছে, কার সাথে মেয়েটি তার মনের কথা খুলে বলেছে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে সে।

আনিটা ভ্যাঙ্গারকে নিয়ে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছিলো। হেরাল্ডের এই মেয়েটি হ্যারিয়েটের চেয়ে মাত্র দু’বছরের বড়। ১৯৬৬ সালের গ্রীষ্মকালটা সে হেডেবিতেই কাটিয়েছে, ঐ সময়টাতে হ্যারিয়েটের সাথে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তবে আনিটা গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য দিতে পারে নি। সেই গ্রীষ্মে তারা দু’জন ঘুরে বেড়িয়েছে, সাঁতার কেটেছে, আড্ডা মেরেছে, কথা বলেছে সিনেমা, পপ ব্যান্ড আর বইপুস্তক নিয়ে। আনিটা যখন ড্রাইভিং শিখতে যেতো তখন অনেক সময় হ্যারিয়েটও তার সঙ্গি হতো। একবার তারা এক বাড়ি থেকে এক বোতল মদ চুরি করে মনের আনন্দে পান করে মাতাল হয়েছিলো সেই সময়। কয়েক সপ্তাহ তারা দু’জনে আইল্যান্ডের শেষপ্রান্তে থাকা গটফ্রিড ক্যাবিনেও কাটিয়েছিলো।

হ্যারিয়েটের ব্যক্তিগত ভাবনা আর অনুভূতিগুলো অজানাই রয়ে গেছে। তবে ব্লমকোভিস্ট একটা অসঙ্গতি তার রিপোর্টে টুকে রাখলো : তার ক্লাসমেট আর পরিবারের কিছু সদস্যের কাছে মনে হয়েছিলো হ্যারিয়েট অন্তর্মুখী হয়ে উঠছে। তবে আনিটা ভ্যাঙ্গারের কাছে মনে হয় নি সে অন্তর্মুখী ছিলো। এ ব্যাপারটা নিয়ে সে ভ্যাঙ্গারের সাথে এক সময় কথা বলবে বলে ঠিক করলো।

আরেকটা জোড়ালো প্রশ্ন আছে, মোরেল হ্যারিয়েটের ডেটবুকের নির্দিষ্ট একটা পৃষ্ঠা নিয়ে বিস্ময়করভাবেই অনেক মাথা ঘামিয়েছিলো। নিখোঁজ হবার এক বছর আগে এক ক্রিসমাসে এই চামড়ায় বাধানো বইটা তাকে উপহার দেয়া হয়েছিলো। বইটার প্রথম অর্ধেক হ্যারিয়েটের দিনপঞ্জী হিসেবে বিভিন্ন ধরণের মিটিং, পরীক্ষার তারিখ, হোমওয়ার্ক এ রকম কিছুতে পরিপূর্ণ। এই ডেটবুকের অনেকটা অংশ জুড়েই আছে ডায়রি লেখা। তবে হ্যারিয়েট সেটা মাঝেমধ্যে ব্যবহার করতো। জানুয়ারি মাসে সে খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে যেসব লোকজনের সাথে তার দেখা হয়েছে তাদের সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখেছিলো, আরো লিখেছিলো যেসব সিনেমা দেখেছিলো তার বিবরণ। এরপর স্কুলের শেষ বছরের আগ পর্যন্ত নিজের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আর কিছু লেখে নি। এক নাম না জানা ছেলের কথা উল্লেখ আছে সেখানে।

যে পৃষ্ঠায় কতোগুলো টেলিফোন নাম্বার লেখা আছে সেগুলোই হলো আসল রহস্য। খুবই পরিস্কার হাতে বর্ণানুক্রমে পরিবারের সদস্য, ক্লাসমেট, কয়েকজন শিক্ষক আর পেন্টেকোস্টাল চার্চের কংগ্রেশনে যাদের সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো তাদের নাম্বার লিখেছে সে। একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় পাঁচটি নাম আর ফোন নাম্বার লেখা আছে। তিনটি মেয়ে আর দু’জনের নামের আদ্যক্ষর :

মাগদা-৩২০১৬

সারা-৩২১০৯

আর. জে-৩০১১২

আর. এল-৩২027 মেরি-৩২০১৮

যেসব ফোন নাম্বারের শুরু ৩২ দিয়ে সেগুলো ষাটের দশকে হেডেস্টাডের নাম্বার ছিলো। ৩০ দিয়ে শুরু হওয়া নাম্বারটি হেডেবির কাছের এলাকা নরবিনের। সমস্যাটা হলো মোরেল যখন হ্যারিয়েটের বন্ধুবান্ধবদের এইসব নাম্বার দেখিয়েছিলো তখন তাদের কেউই সেগুলো দেখে চিনতে পারে নি। তাদের কোনো ধারণাই ছিলো না এগুলো কার নাম্বার।

প্রথম নাম ‘মাগদা’ দেখে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিলো। ওটার খোঁজে গিয়ে দেখা গেছে নাম্বারটা পার্কগাটান ১২-এর একটি টেইলারিং শপের। ফোন নাম্বারটি মারগট লুন্ডমার্ক নামের একজনের, তার মায়ের নাম হলো মাগদা। ঐ দোকানে মাঝেমধ্যে মহিলা বসতেন। তবে মাগদার বয়স তখন ছিলো ঊনসত্তুর বছর, আর হ্যারিয়েট নামের কাউকে সে চিনতেও পারে নি। এমন কি হ্যারিয়েট ঐ দোকানে কখনও গিয়েছিলো কিংবা সেখান থেকে কেনাকাটা করেছিলো বলেও কোনো প্রমান পাওয়া যায় নি। সেলাইয়ের কাজে তার কোনো আগ্রহ ছিলো না।

দ্বিতীয় যে নাম্বারটি ‘সারা’ নামে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে সেটা টরেসন নামের এক পরিবারের নাম্বার, যারা কিনা ভাস্টস্টান-এ বসবাস করতো। পরিবারটিতে এন্ডারর্স, মনিকা আর জোনাস এংব পিটার নামের তাদের দুই সন্তান ছিলো। ঐ সময়টাতে তারা ছিলো প্রি-স্কুল বয়সী। ঐ পরিবারে সারা নামের কেউ ছিলো না। এমনকি তারা হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার নামও শোনে নি কখনও, শুধু মিডিয়াতে যখন নিখোঁজ মেয়ে হিসেবে তার নাম প্রচার করা হয়েছিলো তখনই এই নামটা প্রথম শুনেছিলো তারা। হ্যারিয়েটের সাথে তাদের একমাত্র দূরবর্তী সংযোগটি হলো এন্ডার্স, সে বাড়িঘরের ছাদমেরামতকারী ছিলো। কয়েক সপ্তাহ আগে হ্যারিয়েটদের স্কুলের ছাদে টাইল বসিয়েছিলো সে। সুতরাং তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে স্কুলে তাদের সাথে পরিচয় হবার একটা সুযোগ আছে। যদিও ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক নয়।

বাকি তিনটি নাম্বারও তাদেরকে কানাগলিতে নিয়ে গেছে। ‘আর.এল’ আদ্যক্ষরের ৩২০২৭ নাম্বারটি ছিলো রোসমেরি লারসন নামের একজনে, যে মহিলা বেশ কয়েক বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন।

হ্যারিয়েট কেন এইসব নাম আর নাম্বার লিখেছিলো সেটার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে ১৯৬৬-৬৭ সালের গ্রীষ্মকালটায় ইন্সপেক্টর মোরেল যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছিলো।

একটা সম্ভাবনা হলো এইসব ফোন নাম্বার লেখা হয়েছে ব্যক্তিগত কোনো কোড হিসেবে-একজন টিনএজ মেয়ে কিভাবে ভাবতো সেটা মোরেল আন্দাজ করার চেষ্টা করেছিলো। যেহেতু ৩২ সংখ্যা দিয়ে হেডেস্টাডের নাম্বার শুরু হয় তাই বাকি তিনটি নাম্বার সে পুণরায় সাজিয়ে নেয়। ৩২৬০১ অথবা ৩২১৬০ মাগদার ফোন নাম্বার নয়। মোরেল তার সংখ্যাতত্ত্ব প্রয়োগ ক’রে দেখতে পায় এভাবে আরো অনেক নাম্বার নিয়ে কাজ করলে এক সময় না এক সময় সেটা হ্যারিয়েটের সাথে কানেকশান পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সে যদি ৩২০১৬ নাম্বারের বাকি তিন ডিজিটের সাথে এক যোগ করে তাহলে সে পায় ৩২১৭–এটা হেডেস্টাডে অবস্থিত ফ্রোডির অফিসের নাম্বার। তবে এরকম একটি লিংকের কোনো মানে হয় না। তাছাড়া সে এমন কোনো কোড আবিষ্কার করতে পারে নি যা বাকি পাঁচ ডিজিটের কোনো অর্থ বের করতে পারে।

মোরেল তার তদন্তের কাজটি আরো বিস্তৃত করে। ডিজিটগুলো কি কোনো গাড়ির নাম্বারপ্লেট? ষাটের দশকে প্রথম দু’সংখ্যা ছিলো গাড়ির কান্ট্রি রেজিস্ট্রেশন নাম্বার আর তারপর ছিলো পাঁচটি ডিজিট। আরেকটা কানাগলি।

ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক এরপর নামগুলো নিয়ে কাজ করেছিলো। হেডেস্টাডে যতোজন মেরি, মাগদা আর সারা ছিলো এবং সেইসাথে যাদের নামের আদ্যাক্ষর আর.এল অথবা আর.জে দিয়ে তাদের সবার একটা তালিকা করে সে। মোট সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩০৭ জনে। এদের মধ্যে মাত্র ২৯ জনের সাথে হ্যারিয়েটের আসলেই কোনো কানেকশান ছিলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তার ক্লালের এক ছেলে ছিলো যার নাম রোনাল্ড জ্যাকবসন – আর.জে। তেমন একটা জানাশোনা ছিলো না তাদের মধ্যে। আর হ্যারিয়েট প্রিপারেটরি স্কুলে ভর্তি হবার পর থেকে তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগও থাকে নি। টেলিফোন নাম্বারের কোনো লিংকও খুঁজে বের করা যায় নি।

ডেটবুকের সংখ্যার রহস্যটা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।

*

সালান্ডারের সাথে এডভোকেট বুরম্যানের চতুর্থ মোলাকাতটি শিডিউল মিটিং ছিলো না। তাকে বাধ্য করা হয় যোগাযোগ করার জন্য।

ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সালান্ডারের ল্যাপটপটি এমন এক দুর্ঘটনার শিকার হলো যে কাউকে খুন করতে ইচ্ছে করলো তার। নিজের বাইকটা নিয়ে মিল্টন সিকিউরিটিতে গিয়ে গ্যারাজের একটা পিলারের পেছনে সেটা পার্ক করে রাখলো। নিজের ব্যাগটা মেঝেতে রেখে যেই না বাইকটা লক করতে গেলো অমনি একটা গাড়ি ব্যাক-গিয়ারে এসে চলে গেলো তার ব্যাগের উপর দিয়ে। ড্রাইভার কিছুই টের পায় নি, নিশ্চিন্তে সে বের হয়ে যায় গাড়িটা নিয়ে।

ঐ ব্যাগে তার আপেল আই-বুকটা ছিলো। যখন সে এটা কেনে তখন জিনিসটা ছিলো আপেলের সবচাইতে অত্যাধুনিক মডেলের একটি ল্যাপটপ। সালান্ডার সব সময় দামি দামি কম্পিউটার ব্যবহার করে। প্রায়শ সে নিজের কম্পিউটার আপডেট করে নেয়। তার শখের আর খরচের তালিকা করলে এই একটা জিনিসই পাওয়া যাবে।

ব্যাগ খুলেই সে দেখতে পেলো ল্যাপটপটা ভেঙে একাকার। পাওয়ার অন করে কম্পিউটারটা চালানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কোনো শব্দ পর্যন্ত পেলো না। শেষ হয়ে গেছে। ব্রাঙ্কিরকারগাটানে টিমি’স ম্যাকজিসাসে নিয়ে গেলো এই আশায় যে হার্ডডিস্কটা হয়তো বাঁচানো যাবে। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে টিমি মাথা ঝাঁকালো।

“সরি। কোনো আশা নেই,” বললো সে। “এটার জন্যে তোমাকে একটা চমৎকার শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে হবে এখন।”

ল্যাপটপটির এই পরিণতিতে তার মেজাজ বিগড়ে গেলেও এটা মারাত্মক কোনো ক্ষতি বয়ে আনে নি। সালান্ডার সব সময়ই তার সমস্ত ডকুমেন্ট আরেকটা ডেস্কটপ কম্পিউটারে ব্যাকআপ হিসেবে সংরক্ষণ করে। বাড়িতে তার পাঁচ বছরের আরেকটি পুরনো তোশিবা ল্যাপটপও আছে যেটা সে ব্যবহার করতে পারে তবে তার দরকার খুবই দ্রুতগতির আধুনিক একটি মেশিন।

বিকল্প হিসেবে সে যা ভাবলো তাতে অবাক করার কিছু নেই : আপেলের নতুন পাওয়ারবুক G4/1.0, অ্যালুমিনিয়ামের কেস, সঙ্গে ৭৪৫১ প্রসেসর এবং অ্যান্টি ভেক ভেলোসিটি ইঞ্জিন। ব্লুটুথ আর সিডি, ডিভিডি রাইট করার ব্যবস্থাও আছে তাতে।

এই ল্যাপটপটির পর্দা ১৭ ইঞ্চির, রেজুলুশন ১৪৪০ X ৯০০পিক্সেল। বাজারে যতো পিসি আর ল্যাপটপ আছে তাদের মধ্যে এটাই সেরা।

এক কথায় এটাকে ল্যাপটপের রোলস রয়েস বলা যেতে পারে। তবে সালান্ডারের কাছে এটার সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হলো কি-বোর্ডটায় ব্যাকলাইটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। গাঢ় অন্ধকারেও ও এর কি-গুলো স্পষ্ট দেখতে পাবে সে। এর আগে কেন কেউ এটা ভাবে নি?

প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ার মতো এই যন্ত্রটি।

দাম ৩৮০০০ ক্রোনার, সঙ্গে ভ্যাট।

এটাই হলো সমস্যা।

যাইহোক না কেন ম্যাকজিসাসের কাছে নতুন ল্যাপটপের অর্ডার দিয়ে দিলো সে। এখান থেকেই সে তার সমস্ত কম্পিউটার এক্সেসরিস কেনে বলে তারা তাকে একটু বেশি কমিশন দিয়ে থাকে। কতো টাকা তার কাছে আছে সেটা হিসেব করে দেখলো। তার ভাঙা ল্যাপটপের ইন্সুরেন্স বাবদ বেশ কিছু টাকা সে পাবে, তারপরও নতুন একটা কিনতে আরো ১৮০০০ ক্রোনার দরকার। বাড়িতে এক কফি টিনে ১০০০০ ক্রোনার লুকিয়ে জমা করে রেখেছে সে। এ ছাড়া তার কাছে আর কিছু নেই। তার গার্ডিয়ানের কাছে ফোন করে জানালো হঠাৎ করেই তার কিছু টাকার দরকার কিন্তু বুরম্যানের সেক্রেটারি তাকে বললো আজ তার সাথে দেখা করার মতো সময় উকিল ভদ্রলোকের নেই। জবাবে সালান্ডার বললো ১০০০০ ক্রোনারের একটা চেক স্বাক্ষর করতে ভদ্রলোকের বিশ সেকেন্ডের বেশি লাগবে না। তাকে বলা হলো সে যেনো সন্ধ্যা ৭:৩০-এর দিকে অফিসে চলে আসে।

*

ব্লমকোভিস্টের হয়তো ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনের উপর কোনো অভিজ্ঞতা নেই তবে সে ভালো করেই বুঝতে পারছে ইন্সপেক্টর মোরেল অসম্ভব রকমের মেধাবী একজন মানুষ। পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের ফাইলগুলো পড়ে শেষ করার পরও সে দেখতে পেলো ভ্যাঙ্গারের নোটে ইন্সপেক্টরের কথা বার বার উঠে আসছে। তারা দু’জনে বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। ব্লমকোভিস্ট ভাবলো ইন্ডাস্ট্রি জগতের এই মহারথির মতো মোরেলও হ্যারিয়েটের কেসটা নিয়ে মোহাচ্ছন্ন কিনা।

তার মতে কোনো কিছুই মোরেলের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। এই রহস্যের সমাধান পুলিশের রেকর্ডে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে প্রশ্নের কথাই ভাবা হোক না কেন সেটা আগেই তারা করে রেখেছে। সবগুলো সূত্র আর অনুমাণই খতিয়ে দেখা হয়েছে, এমনকি তার মধ্যে কিছু কিছু একেবারেই কষ্টকল্পিত। তদন্তের সবগুলো ফাইল পুরোপুরি পড়ে দেখে নি ব্লমকোভিস্ট কিন্তু তার কাছে মনে হয়েছে যতোই পড়ছে ততোই পুরো কেসটা আরো বেশি জটিল আর ঘোলাটে হয়ে উঠছে। এমন কিছু সে খুঁজে বের করতে পারে নি যা এর আগে তদন্ত কর্মকর্তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। কিভাবে কোন পথে এই তদন্তের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে। তার কাছে মনে হচ্ছে একটাই মাত্র পথ খোলা আছে : এ ঘটনায় জড়িতদের সবার সাইকোলজিক্যাল মোটিভ কি ছিলো সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা।

প্রথমেই হ্যারিয়েটকে দিয়েই সেটা শুরু করতে হবে। কে ছিলো হ্যারিয়েট? বিকেল ৫টার দিকে নিজের রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ব্লমকোভিস্ট দেখতে পেলো সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের দোতলার ঘরে বাতি জ্বলছে। সাড়ে সাতটার দিকে তার ঘরের দরজায় নক্ করলো সে। সবেমাত্র টিভি’তে সংবাদ প্রচার শুরু হয়েছে। গায়ে বাথরোব আর মাথায় হলুদ রঙের তোয়ালে পেচিয়ে মহিলা দরজা খুললো। এই অসময়ে তাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ব্লমকোভিস্ট একটু পিছিয়ে যেতেই মহিলা তাকে বাড়ির ভেতরে লিভিংরুমে বসার জন্যে বললো। কফিমেকার চালু করে দিয়ে দোতলায় চলে গেলো সে কয়েক মিনিটের জন্য। যখন নীচে নেমে এলো দেখা গেলো জিন্স আর চেক ফ্লানেল শার্ট পরে আছে।

“আমি ভাবছিলাম আপনি হয়তো আমার এখানে আসবেন না।”

“আমার আসলে ফোন করে আসা উচিত ছিলো কিন্তু জানালা দিয়ে দেখলাম আপনার ঘরে বাতি জ্বলছে তাই ফোন না করেই চলে এলাম।”

“আপনার ঘরে তো সারা রাতই বাতি জ্বলতে দেখি আমি। মাঝরাতে প্রায়ই হাটতে বের হন। আপনি নি নিশাচর?”

কাঁধ তুললো ব্লমকোভিস্ট। “তাই তো মনে হচ্ছে।” রান্নাঘরের টেবিলে বেশ কয়েকটি টেক্সটবইয়ের স্তুপ দেখতে পেলো সে। “আপনি কি এখনও শিক্ষকতা করেন?

“না, হেডমিস্ট্রেস হিসেবে আমি ক্লাস নেবার সময় পাই না। তবে আমি ইতিহাস, ধর্ম আর সমাজবিজ্ঞান পড়াতাম। এখনও কিছু বছর বাকি আছে।”

“বাকি আছে?”

মহিলা হাসলো। “আমার বয়স ছাপান্ন। খুব জলদি অবসরে চলে যাবো।”

“আপনাকে দেখে তো পঞ্চাশের উপরে বলে মনে হয় না। মনে হয় চল্লিশ।”

“গুল মারছেন। আপনার বয়স কতো?

“চল্লিশের উপরে,” হেসে বললো ব্লমকোভিস্ট।

“তাহলে আপনাকে দেখে বিশ বছর বয়সী বলে মনে হয়। কতো দ্রুতই না সময় চলে যায়।

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার কফি দিয়ে জানতে চাইলো তার ক্ষিদে আছে কিনা। জবাবে সে জানালো অনেক আগেই খাওয়া দাওয়া করে ফেলেছে, কথাটা আংশিক সত্যও বটে। রান্না করার ঝামেলায় যায় নি সে, স্যান্ডউইচ দিয়েই কাজ সেরে নিয়েছে। এখন একটুও ক্ষিদে নেই।

“তাহলে আপনি কেন এসেছেন? ঐসব প্রশ্নগুলো করার সময় তাহলে এসে গেছে?”

“সত্যি বলছি…আমি আপনাকে প্রশ্ন করার জন্য এখানে আসি নি। মনে হলো আপনাকে একটু হ্যালো বলে আসি।”

মহিলা হেসে ফেললো। “আপনার কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তারপর চলে এলেন হেডেবি’তে, হেনরিকের সবচাইতে প্রিয় শখের বিষয়ের উপর যাবতীয় ম্যাটেরিয়াল জোগার করে রাতের ঘুম বাদ দিয়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার রাতেও হেটে বেড়ান এখন…আমি কি কিছু বাদ দিয়েছি?”

“আমার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি।”

“গত সপ্তাহান্তে যে মহিলা আপনার ওখানে এসেছিলো সে কে?”

“এরিকা…মিলেনিয়াম-এর এডিটর ইন চিফ সে।”

“আপনার মেয়েবন্ধু?“

“ঠিক তা নয়। সে বিবাহিত। বলতে পারেন আমি তার ভালো বন্ধু আর খণ্ডকালীন প্রেমিক।”

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো।

“এতো হাসার কি আছে?”

“কথাটা যেভাবে আপনি বললো আর কি। খণ্ডকালীন প্রেমিক। আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে কথাটা।”

সিসিলিয়াকে বেশ ভালোই লাগলো ব্লমকোভিস্টের।

“তাহলে আমিও একজন খণ্ডকালীন প্রেমিক ব্যবহার করতে পারি,” বললো মহিলা।

পায়ের স্লিপার দুটো ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটা পা ব্লমকোভিস্টের হাটুর উপর তুলে দিলো সে। ব্লমকোভিস্ট আলতো করে সেই পায়ের পাতায় হাত বুলিয়ে চললো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার মধ্যে একটু দ্বিধা ছিলো-বুঝতে পারছে অপ্রত্যাশিত কিছুতে জড়িয়ে পড়ছে সে। তবে সতর্কভাবেই সে মহিলার পায়ের পাতায় মেসেজ করতে আরম্ভ করলো আস্তে আস্তে।

“আমি বিবাহিত,” বললো সিসিলিয়া।

“জানি। ভ্যাঙ্গার পরিবারে কেউ ডিভোর্স নেয় না।

“প্রায় বিশ বছর ধরে আমি আমার স্বামীর চেহারা পর্যন্ত দেখি না।”

“কি হয়েছিলো?”

“এটা তোমার জানার দরকার নেই। অনেক দিন ধরে সেক্স করি না…উমমম, তিন বছর তো হবেই।”

“অবাক হলাম।”

“কেন? এটা তো চাহিদা আর যোগানের ব্যাপার। কোনো ছেলেবন্ধু কিংবা বিবাহিত পুরুষে আমার কোনো আগ্রহ নেই, অথবা কোনো পুরুষের সাথে একসাথে থাকার। আমি আমার মতো ভালোই আছি। কার সাথে আমি সেক্স করবো? স্কুলের শিক্ষকদের সাথে? আমার তা মনে হয় না। ছাত্রদের কারো সাথে? বুড়ো মহিলাদের জন্য তো তাহলে রসালো গালগল্পের খোরাক হবে। ভ্যাঙ্গার নামধারীদের ব্যাপারে আবার তাদের আগ্রহ একটু বেশি। এই হেডেবি আইল্যান্ডে আমাদের আত্মীয়স্বজন আর বিবাহিত লোকজন ছাড়া আর কেউ নেই।”

সামনে ঝুঁকে এসে তার ঘাড়ে চুমু খেলো মহিলা।

“আমি কি তোমাকে ভড়কে দিচ্ছি?”

“না। তবে বুঝতে পারছি না এটা ভালো হচ্ছে কিনা। আমি তোমার চাচার হয়ে কাজ করছি। “

“এ কথাটা আমি কাউকে বলবো না। তবে সত্যি বলতে কি, হেনরিক সম্ভবত এ রকম কিছুর বিরুদ্ধে নয়।

তার কোলের উপর উঠে বসলো সিসিলিয়া, গাঢ় চুম্বনে আবিষ্ট করলো তাকে। এখনও তার চুল ভেজা, তা থেকে শ্যাম্পুর গন্ধ ভেসে আসছে। তার ফ্লানেল শার্টের বোতাম খুলতে গিয়ে একটু হোচট খেলো ব্লমকোভিস্ট। তাড়াহুড়া করে সেটা তার কাঁধের দু’পাশ দিয়ে নামিয়ে দিলো সে। কোনো ব্রা পরে নি মহিলা। তার স্তন দুটোতে চুমু খাবার সময় মহিলা তার মাথাটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো।

*

তার ব্যাঙ্ক একাউন্টের স্টেটম্যানটা দেখানোর জন্যে ডেস্ক ছেড়ে উঠে সালান্ডারের পেছনে এসে দাঁড়ালো বুরম্যান-এই একাউন্টা এখন আর তার অধীনে নেই। হঠাৎ করেই পেছন থেকে তার ঘাড়ে আলতো করে মেসেজ করতে শুরু করলো লোকটা, আরেকটা হাত কাঁধের উপর দিয়ে ঢুকিয়ে দিলো তার বুকে। তার বাম স্তনটা মুঠোয় পুরে নিলো সে, যখন দেখতে পেলো মেয়েটা বাধা দিচ্ছে না তখন স্তন মর্দন করতে শুরু করলো বুরম্যান। সালান্ডার একটুও নড়লো না। ডেস্কের উপর লেটার ওপেনারটা যখন সে দেখছে তখন লোকটার নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে তার কাধের কাছে। হাত বাড়ালেই ওটা নিতে পারে সালান্ডার।

তবে সেটা করলো না। বিগত বছরগুলোতে হোলগার পামগ্রিন তাকে শিখিয়েছে মাথা গরম করে কিছু করলে সেটা সমস্যা বয়ে আনে। আর সমস্যা খুব বাজে পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।

এই যৌন নিপীড়ন-আইনের দিক থেকে যেটাকে শ্লীলতাহানি হিসেবে অভিহিত করা হয় সেটা প্রমাণিত হলে দু’বছরের জেল হতে পারে—মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলো। তবে সীমালঙ্ঘন করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। সালান্ডারের কাছে এটা শত্রুপক্ষের শক্তি প্রদর্শন-তাদের আইনগত সম্পর্কের মধ্যেও সে যে এই লোকটার দয়ার উপর বেঁচে আছে, তার যে প্রতিরোধ করার কোনো উপায় নেই এটা যেনো তারই বিশ্রী একটা ইঙ্গিত। লোকটার সঙ্গে যখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার চোখাচোখি হলো সালান্ডার দেখতে পেলো তার আলতো করে ফাঁক হওয়া ঠোঁট দুটো লালসায় পরিপূর্ণ। তার নিজের মুখে অবশ্য কোনো অভিব্যক্তি নেই।

বুরম্যান নিজের ডেস্কে ফিরে এলো।

“তুমি যখন খুশি চাইলেই আমি তোমাকে টাকা দিতে পারি না,” বললো সে। “এতো দামি কম্পিউটার কেন তোমার দরকার পড়লো? কম্পিউটার গেম খেলার জন্য তো অনেক সস্তা কম্পিউটার বাজারে পাওয়া যায়।”

“আগের মতো আমার নিজের টাকা আমি নিজের খুশি মতো খরচ করতে চাই।”

তার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকালো বুরম্যান।

“ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা আমাদেরকে দেখতে হবে। প্রথমে তোমাকে আরো বেশি সামাজিক আর লোকজনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।”

সালান্ডারের অভিব্যক্তিহীন দু’চোখের পেছনে কি ভাবনা কাজ করছে সেটা যদি বুরম্যান বুঝতে পারতো তাহলে তার হাসিটা বদলে যেতো।

“আমার মনে হয় তুমি আর আমি ভালো বন্ধু হতে পারে,” বললো সে। “আমাদের একে অন্যের প্রতি আরো বেশি আস্থা রাখতে হবে। “

মেয়েটা যখন কিছু বললো না তখন সে বলতে লাগলো : “এখন বেশ বড় হয়ে গেছো তুমি। পুর্ণাঙ্গ রমণী হয়ে উঠেছো, লিসবেথ।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“কাছে আসো,” হাত বাড়িয়ে বললো লোকটা।

ডেস্কের উপর রাখা লেটার ওপেনারটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে লোকটার কাছে চলে গেলো সে। পরিণতি। তার হাতটা ধরে নিজের লিঙ্গের উপর রাখলো বুরম্যান। কালো আর মোটা গ্যাবারডিনের প্যান্টের উপর দিয়ে লোকটার উদ্যত লিঙ্গ টের পেলো সালান্ডার।

“তুমি যদি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করো তাহলে আমিও তোমার দিকটা দেখবো।”

অন্য হাতে মেয়েটার ঘাড় ধরে হাটুর কাছে টেনে আনলো, ঠিক তার লিঙ্গ বরাবর সালান্ডারের মুখ।

“এ কাজ তো তুমি এর আগেও করেছো, তাই না?” প্যান্টের জিপার খুলতে খুলতে বললো বুরম্যান।

মুখ ঘুরিয়ে উঠে সালান্ডার দাঁড়াবার চেষ্টা করলেও লোকটা শক্ত করে তাকে ধরে রাখলো। শারিরীক শক্তির দিক থেকে লোকটার সাথে তার পেরে ওঠার কথা নয়। তার ওজন যেখানে মাত্র ৯০ পাউন্ড লোকটার ওজন সেখানে ২১০। দু’হাতে তার মাথাটা শক্ত করে ধরে তার দিকে ঘোরালো।

“তুমি যদি আমার সাথে ভালো আচরণ করো, আমিও তোমার সাথে ভালো আচরণ করবো,” কথাটা আবারো বললো সে। “সমস্যা করলে তোমার বাকি জীবনটা কোনো ইন্সটিটিউশনেই কাটাতে হবে। সেটা কি তুমি পছন্দ করবে?”

কিছুই বললো না সে।

“সেটা কি তুমি পছন্দ করবে?” আবারো বললো কথাটা।

মাথা ঝাঁকালো সালান্ডার।

সে চোখ নামিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করলো বুরম্যান। এটাকে মেনে নেয়ার লক্ষণ হিসেবে দেখলো সে। তারপর তাকে আরো কাছে টেনে আনলো। লোকটার জননেন্দ্রিয় মুখে পুরে ফেললো সালান্ডার। দু’হাতে শক্ত করে তার মাথাটা ধরে প্রবলভাবে নিজের কাছে টেনে আনলো বুরম্যান। এভাবে পুরো দশ মিনিট চললো, তার কাছে মনে হলো দম বন্ধ হয়ে আসছে। অবশেষে যখন তার মোচন হলো তখন এতোটা জোরে তাকে ধরলো যে সালান্ডারের নিঃশ্বাস আর্টকে এলো।

তাকে তার অফিসের বাথরুমটা দেখিয়ে দিলো বুরম্যান। মুখ মুছতে মুছতে যখন বাথরুমের দিকে পা বাড়াচ্ছে তখন রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো সালান্ডার। মুখে টুথপেস্ট নিয়ে কুলি করে লোকটার বীর্যের গন্ধ দূর করার চেষ্টা করলো সে। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখতে পেলো বুরম্যান নিজের ডেস্কে আয়েশ করে বসে বসে কাগজে চোখ বুলাচ্ছে।

“বসো, লিসবেথ,” তার দিকে না তাকিয়েই বললো তাকে। বসে পড়লো সে। অবশেষে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে হাসলো বুরম্যান।

“তুমি এখন বড় হয়েছো, তাই না, লিসবেথ?”

সায় দিলো সে।

“তাহলে তোমাকে বড়দের খেলাও খেলতে হবে,” বললো সে। এমনভাবে বললো যেনো বাচ্চা কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছে। সালান্ডার কোনো জবাব না দিলে লোকটা একটু ভুরু তুললো।

“আমার মনে হয় না আমরা এইমাত্র যে খেলাটা খেললাম সেটা কাউকে বললে ভালো হবে। ব্যাপারটা ভেবে দেখো-তোমার কথা কে বিশ্বাস করবে? তোমার রেকর্ড তো খুব একটা ভালো না। কার কথা বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে করো?”

তারপরও যখন সে কোনো জবাব দিলো না বুরম্যান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকাটা যারপরনাই হতাশ করছে লোকটাকে –তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো বুরম্যান।

“আমরা বেশ ভালো বন্ধু হবো,” বললো সে। “আমার মনে হয় আজকে তুমি আমার সাথে দেখা করে স্মার্টের মতো কাজই করেছো। তুমি সব সময়ই আমার কাছে আসতে পারো।”

“আমার ১০০০০ ক্রোনার দরকার কম্পিউটার কেনার জন্য,” সালান্ডার বেশ দৃঢ়তার সাথে বললো।

ভুরু তুললো বুরম্যান। নাক উঁচু খানকি। আসলেই একটা মাথামোটা মাগি। সে যখন বাথরুমে ছিলো তখনই চেকটা তৈরি করে রেখেছিলো সে। ওটা এবার তার হাতে তুলে দিলো। বেশ্যার চেয়ে এটা ভালো। নিজের টাকাই নিচ্ছে সে। তার দিকে তাকিয়ে উন্নাসিকের মতো হাসলো লোকটা। চেকটা নিয়েই সালান্ডার চলে গেলো।

অধ্যায় ১২

বুধবার, ফেব্রুয়ারি ১৯

সালান্ডার যদি কোনো সাধারণ নাগরিক হোতো তাহলে বুরম্যানের অফিস থেকে বের হয়েই সোজা পুলিশের কাছে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করতো। তার ঘাড়ে লোকটার শক্ত হাতের দাগ, জামা-কাপড়ে লেগে থাকা বীর্য থেকে ডিএনএ টেস্ট করলেই ফেঁসে যেতো উকিল ভদ্রলোক। এমনকি বুরম্যান যদি দাবি করতো যে সালান্ডার এটা স্বেচ্ছায় করেছে কিংবা তাকে প্রলুব্ধ করেছে তারপরেও আইনের চোখে সে দোষী সাব্যস্ত হোতো তার সাথে রাষ্ট্রের যে চুক্তি সেটার বরখেলাপের জন্য। একটা রিপোর্ট করলেই তাকে নারীনির্যাতনের উপর অভিজ্ঞ একজন আইনজীবি দেয়া হোতো সঙ্গে সঙ্গে, এরফলে একটা জিনিস প্রমাণিত হয়ে যেতো-সালান্ডার আসলেই ‘আইনের দৃষ্টিতে অসমর্থ।’

১৯৮৯ সাল থেকে ‘আইনের দৃষ্টিতে অসমর্থ’ টার্মটি আর প্রাপ্তবয়স্কদের বেলায় প্রযোজ্য হয় না।

দুই ধরণের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার প্রটেকশন বা সমাজকল্যাণ সুরক্ষা আছে-ট্রাস্টিশিপ এবং গার্ডিয়ানশিপ।

ট্রাস্টিশিপ মানে স্বেচ্ছায় এমন ব্যক্তির সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসা, যে কিনা প্রাত্যহিক জীবনে নানান ধরণের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেমন বিল দিতে পারছে না, অথবা নিজেকে স্বাস্থ্যকরভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে অক্ষম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাস্টি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কাছের আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের। যদি সেরকম কেউ না থাকে তাহলে ওয়েলফেয়ার কর্তৃপক্ষ নিজেরাই একজনকে এ কাজে নিয়োগ দেয়। ট্রাস্টি হলো এক ধরণের অভিভাবক, তবে আইনের চোখে অসমর্থ ব্যক্তি এক্ষেত্রে নিজের সম্পত্তি কিংবা টাকা-পয়সার ব্যাপারে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখে, অবশ্য এ ব্যাপারে ট্রাস্টির সাথে আলাপ আলোচনা করে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

গার্ডিয়ানশিপ আরেকটু কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এখানে অসমর্থ ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তি আর টাকা-পয়সার নিয়ন্ত্রণ থাকে তার গার্ডিয়ানের উপর। ঠিক করে বলতে গেলে গার্ডিয়ানশিপ মানে হলো অসমর্থ ব্যক্তির সমস্ত আইনী দিক অধিগ্রহণ করা। সুইডেনে ৪০০০ মতো ব্যক্তি গার্ডিয়ানশিপের আওতায় রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক ভারসাম্যহীন, মানসিকভাবে অসুস্থ এবং মাদকাসক্ত লোকজনকে গার্ডিয়ানশিপের অধীনে দিয়ে দেয়া হয়। কিছু লোক শারিরীক আর মানসিকভাবে অক্ষম হওয়ার কারণেও গার্ডিয়ানশিপে চলে যায়। বেশিরভাগ ক্লায়েন্টই বয়সে তরুণ-পয়ত্রিশের নীচে। তাদেররই একজন হলো লিসবেথ সালান্ডার।

কোনো ব্যক্তির নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেয়া-মনে তার ব্যাঙ্ক একাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া-গণতান্ত্রের সবচাইতে বড় ত্রুটি। বিশেষ করে সেটা যখন তরুণদের উপর প্রয়োগ করা হয়। সে কারণেই গার্ডিয়ানশিপের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলাটা স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইসু। অনেক নিয়মকানুনের সাহায্যে গার্ডিয়ান এজেন্সি নামের একটি প্রতিষ্ঠান এসব কাজ তদারকি করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানটি পার্লামেন্টের ন্যায়পালের অধীনে ন্যস্ত।

খুব কড়াকড়িভাবে এই গার্ডিয়ারশিপের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। ইসুটা খুবই স্পর্শকাতর বলে এর বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ কিংবা কেলেংকারি মিডিয়াতে খুব কমই রিপোর্ট করা হয়।

প্রায়শই দেখা যায় ট্রাস্টিয়ার ক্লায়েন্টের সহায়-সম্পত্তি, টাকা-পয়সা মেরে দেয়, তাদের নিজেদের নামে থাকা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিয়ে নিজের পকেট ভরে নেয়। তবে এই দুটো ঘটনা খুব কমই জানাজানি হয়, তার কারণ হয়তো কর্তৃপক্ষ ব্যাপরটা ভালোমতো সামলায়, কিংবা ক্লায়েন্টরা অভিযোগ করার সুযোগই পায় না। আর পেলেও মিডিয়া এবং কর্তৃপক্ষের সমর্থন ছাড়া বেশিদূর এগোতে পারে না তারা।

গার্ডিয়ানশিপ এজেন্সি বার্ষিক মূল্যায়ন করে থাকে। যেহেতু সালান্ডার নিজের সাইকিয়াট্রিক পরীক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো সেজন্যে তার শিক্ষকেরা তাকে ‘গুডমর্নিং’ বলে সম্ভাষণ পর্যন্ত জানাতো না। কর্তৃপক্ষও তাদের সিদ্ধান্ত বদলানোর কোনো কারণ দেখে নি। এর ফলে ‘স্ট্যাটাস কো’ অর্থাৎ স্থিতাবস্থা বজায় ছিলো। বছরের পর বছর তাকে থাকতে হলো গার্ডিয়ানশিপের অধীনে।

পামগ্রিনের অধীনে থাকার সময় সালান্ডার নিজের টাকা-পয়সা নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতো। তার কোনো ব্যাপারে ভদ্রলোক নাক গলাতো না। আর সব মানুষের মতোই তার সাথে ব্যবহার করতো। আবার কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিয়মিত রিপোর্ট আর বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দিতো আইন মোতাবেক। সালান্ডারের নিজস্ব জীবনযাপনে কোনো বিঘ্ন ঘটায় নি ভদ্রলোক। মেয়েটা তার নাক ফুটো করে রিং পরবে নাকি শরীরে টাটু আঁকবে সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার ব’লে মনে করতো সে। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের তাতে নাক না গলানোই উচিত।

পামগ্রিন যতোদিন তার গার্ডিয়ান ছিলো সালান্ডার তার লিগ্যাল স্ট্যাটাস নিয়ে মাথা ঘামায় নি।

আর সব সাধারণ মানুষের মতো নয় সালান্ডার। আইন সম্পর্কে তার মোটামোটি ভালো ধারণাই আছে-এটা এমন একটি বিষয় যা কোনো দিন প্ৰকাশ পায় নি। পুলিশকে সব সময়ই সে অবিশ্বাস করে। তার কাছে পুলিশ মানে এক বৈরিশত্রু যাদের কাজ হলো তাকে গ্রেফতার করা, তাকে অপমাণ করা। শেষবার পুলিশের সাথে তার তিক্ত অভিজ্ঞতাটি হয়েছিলো গত বছর মে মাসে, গোথগাতান থেকে হেটে মিল্টন সিকিউরিটি অফিসে যাচ্ছিলো সে। আচমকা দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক জাঁদরেল রায়ট পুলিশ। একেবারে বিনা উস্কানিতে সেই পুলিশ ব্যাটন দিয়ে তার কাঁধে আঘাত করে বসে। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় সালান্ডারও এর জবাব দেয়-হাতে থাকা কোকাকোলার বোতল ছুড়ে মেরে। পুলিশের লোকটা উল্টো দিকে ঘুরেই ভো দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়। একটু সামনে এগোতেই সে দেখতে পায় পথে একদল লোক বিক্ষোভ মিছিল করছে।

ঐ রকম বানচোত পুলিশদের আস্তানায় গিয়ে নিলস বুরম্যানের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার কথা তার মাথায়ও আসে নি। তাছাড়া সে কী রিপোর্ট করবে? বুরম্যান তার স্তনে হাত দিয়েছে। যেকোনো অফিসার তার ছোটোখাটো বুকের দিকে তাকিয়ে মনে করবে এটা আবার ধরার কী আছে। আর যদি এরকম কিছু সত্যি ঘটে থাকে তাহলে তো তার গর্ব বোধ করা উচিত! তার বুকের দিকেও তাহলেও কেউ হাত বাড়িয়েছে! বাকি থাকে লোকটার লিঙ্গ সাক্ করার ব্যাপারটি বুরম্যানের কথাই ঠিক। লোকে তার কথা বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করবে ঐ বানচোতের কথা। সুতরাং পুলিশের চিন্তা বাদ।

বুরম্যানের অফিস থেকে সোজা নিজের বাড়ি এসে গোসল করে খেয়েদেয়ে লিভিংরুমের ভাঙা সোফায় বসে ভাবতে লাগলো সে।

সাধারণ লোকজন হয়তো ভাববে যেহেতু এই ব্যাপারটা নিয়ে তার মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না, সুতরাং এজন্যে সে নিজেকেই দায়ি মনে করে—তবে এটা হয়তো অন্য কোনো লক্ষণও হতে পারে, মেয়েটি এতোটাই অস্বাভাবিক যে ধর্ষণের মতো ঘটনাতেও সে মানসিকভাবে তেমন আলোড়িত হয় না।

তার পরিচিত সার্কেলটা একেবারেই ছোটো। মফশ্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারের কারো সাথে তার কোনো খাতিরও নেই। সালান্ডারের বয়স আঠারো হতেই সে জেনে গিয়েছিলো তার আশেপাশের প্রায় সব মেয়েই জীবনের কোনো না কোনো সময় নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌনকর্ম করতে বাধ্য হয়েছে। বেশিরভাগ ঘটনার নায়কই হলো একটু বয়স্ক ছেলেবন্ধু। সালান্ডার যতোটুকু জানে এইসব ঘটনার পর মেয়েগুলো কান্নাকাটি করা কিংবা রেগেমেগে আগুন হওয়া ছাড়া আর কিছু করে না। পুলিশের কাছে কখনই রিপোর্ট করে না তারা।

তার কাছে এটা একেবারেই স্বাভাবিক একটি নিয়ম। মেয়ে হিসেবে সে এক ধরণের শিকার। বিশেষ করে যে যদি কালো রঙের পুরনো চামড়ার জ্যাকেট পরে থাকে, নিজের ভুরু ফুটো করে রিং পরে, গায়ে টাট্টু আঁকে আর একেবারেই অসামাজিক থাকে।

এ নিয়ে এতো বিলাপ করার কিছু নেই।

অন্য দিকে, এডভোকেট বুরম্যান যে বিনা শাস্তিতে পার পেয়ে যাবে না সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অবিচার কখনও ভুলতে পারে না সালান্ডার। তার স্বভাবে ক্ষমা করে দেয়ার কোনো বিষয় নেই।

তবে তার লিগ্যাল স্ট্যাটাসের কারণে সে খুব কঠিন অবস্থায় আছে। তাকে ধূর্ত আর খামোখা হিংস্র আচরণের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে সব সময়। এটাই সবার কাছে তার একমাত্র পরিচিতি। তার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগটি আসে এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ার সময়। স্কুলের নার্স অভিযোগ করে সালান্ডার তার এক সহপাঠীকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। এখনও সেই ছেলেটির কথা তার মনে আছে-ডেভিড গুস্তাভসন নামের মোটাসোটা এক ছেলে, তাকে টিটকারি মেরেছিলো সে, তার দিকে কিছু জিনিসও ছুড়ে মারে। খুবই দুরন্ত ছিলো ছেলেটি। সবার উপরে মাতব্বরি করে বেড়াতো। তখন অবশ্য সালান্ডার জানতো না ‘হয়রানি’ শব্দের মানে কি। তবে পরদিন সে স্কুলে গেলে ছেলেটি তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার হুমকি দেয়। ফলে সালান্ডার একটা গলফ স্টিক দিয়ে ছেলেটিকে আবারো আঘাত করে বসে, এবার আরো বেশি রক্তপাতের ঘটনা ঘটে, সেইসাথে তার কেসবুকে নতুন আরেকটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়।

স্কুলে একে অন্যের সাথে মেলামেশা আর সামজিক সম্পর্ক বজায় রাখার যে নিয়ম ছিলো সেটা সব সময়ই তাকে ভুগিয়েছে। সে কেবল নিজেকে নিয়েই থাকতো, তার চারপাশে থাকা কারোর ব্যাপারে কখনও নাক গলাতো না। তারপরও কেউ কেউ তাকে রেহাই দেয় নি। তার দু’দণ্ড শান্তি কেড়ে নিতে ব্যস্ত ছিলো তারা।

স্কুলের মাঝামাঝি সময়ে তাকে বেশ কয়েকবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো ক্লাসের ছেলেদের সাথে মারামারি করার অভিযোগে। তার ক্লাসের শক্ত সামর্থ ছেলেরা খুব দ্রুতই বুঝে গিয়েছিলো এই রোগা মেয়েটার সাথে মারামারি করা মোটেও সুখকর কোনো ব্যাপার নয়। অন্য মেয়েদের মতো সে পিছিয়ে যেতো না, ভয়ে কুকড়ে থাকতো না। নিজেকে রক্ষা করার জন্য ঘুষি মারতে কিংবা হাতের কাছে যা-ই থাকতো সেসব ব্যবহার করতে একটুও দ্বিধা করতো না সালান্ডার। তার মধ্যে এমন একটা ভাব ছিলো যে, লড়াই করে মরতে রাজি আছে সে কিন্তু কোনো রকম মাথা নোয়ানো তার ধাতে নেই।

সব সময়ই সে প্রতিশোধ নিয়েছে।

একবার সালান্ডারকে বেশ শক্তসামর্থ ছেলের সাথে মারামারি করতে দেখা গিয়েছিলো। শারিরীকভাবে তার সাথে ঐ ছেলের কোনো তুলনাই চলে না। প্রথমে কয়েকবার তাকে মাটিতে আছাড় মেরে ফেলে দিয়ে ছেলেটা বেশ মজা পাচ্ছিলো, এরপরও যখন লড়াই করার জন্য উঠে দাঁড়ালো তার গালে জোরে জোরে কয়েকটা চড় মারলো ছেলেটি। এতেও তাকে দমানো যায় নি। যতো শক্তিশালীই হোক আর তারচেয়ে বড় হোক না কেন তাকে আঘাত করতে কোনো দ্বিধা ছিলো না তার মধ্যে। ছেলেটার সাথে সে কোনোভাবেই পেরে উঠছিলো না। ব্যাপারটা দেখতে খুবই পীড়াদায়ক ছিলো। অবশেষে ঐ ছেলে তার মুখে সজোরে একটা ঘুষি মারলে তার ঠোঁট ফেঁটে চৌচিড় হয়ে যায়, অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সালান্ডার। জিমের পেছনে তাকে মাটিতে ফেলে রেখে চলে যায় ছেলেটি। এ ঘটনার পর তাকে দু’দিন বাড়িতে কাটাতে হয়। তৃতীয় দিন সকালে একটা বেসবল নিয়ে সেই ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সে। হাতের কাছে তাকে পেতেই ছেলেটার কানের পাশে আঘাত করে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলে। এই ঘটনার পর তাকে প্রধানশিক্ষকের কাছে হাজির করা হয়। শিক্ষক ঠিক করেন ব্যাপারটা পুলিশকে রিপোর্ট করবেন। এরপর পুরো ঘটনাটি ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট তদন্ত করে দেখে।

তার ক্লাসমেটরা তাকে ছিটগ্রস্ত বলে মনে করতো, তার সাথে ব্যবহারও করা হতো সেরকম। শিক্ষকদের কাছ থেকেও সে খুব একটা সহানুভূতি পেতো না। একেবারেই কম কথা বলতো, ক্লাসে কোনো দিন হাত তোলে নি প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যে। কেউ জানতে পারে নি প্রশ্নের জবাব সে জানে না নাকি অন্য কোনো কারণে জবাব দিতে চাচ্ছে না। তার গ্রেডের অবস্থা দেখে এমনটি মনে হোতো সবার। সন্দেহ ছিলো না যে মেয়েটার সমস্যা আছে। এই কঠিন মেয়ের দায়িত্ব নিতে চাইতো না কেউ। এ কারণে তাকে তার ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকতে দিতো শিক্ষকেরা। তাকে নিয়ে মাথা ঘামাতো না।

মিডলক্লাস স্কুল ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায় সে। যাবার সময় একজন ক্লাসমেট কিংবা বন্ধুকেও বিদায় জানায় নি। মায়ামমতাহীন অদ্ভুত আচরণের এক মেয়ে।

এরপর সে পা দেয় টিনএজ বয়সে। এই সময়টাতে সব বাজে ঘটনা ঘটে, সেসব ঘটনার কথা সে নিজেও ভাবতে চায় না। এলিমেন্টারি স্কুলে যে রেকর্ড ছিলো সেটাই যেনো আরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে। এরপর থেকে তাকে অনেকটা লিগ্যালি…উন্মাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ছিটগ্রস্ত। কোনো ডকুমেন্টেই তাকে একটু আলাদা কিংবা ভিন্ন ধরণের বলে অভিহিত করা হয় নি কখনও। তবে যতোদিন তার গার্ডিয়ান হিসেবে পামগ্রিন ছিলো এটা নিয়ে সে নিজেও খুব একটা মাথা ঘামায় নি। তার কোনো দরকার পড়লে নিজের আঙুলই যথেষ্ট ছিলো।

নিলস বুরম্যানের আবির্ভাবের ফলে অসমর্থ হিসেবে তাকে ডিক্লেয়ার করাটা তার কাছে এক ধরণের সমস্যা আর বোঝা হয়ে ওঠে। যার কাছেই সে যাবে দেখা যাবে আরেকটা গর্তে গিয়ে পড়েছে। আইনী লড়াইয়ে যদি সে হেরে যায় তাহলেই বা তার কি হবে? তাকে কি কেনো ইন্সটিটিউটে পাঠিয়ে দেয়া হবে? লকআপে রাখা হবে? আসলেই কোনো অপশন খোলা নেই তার কাছে।

.

মাঝরাতের দিকে সিসিলিয়া আর ব্লমকোভিস্ট যখন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে আছে তখন তার দিকে স্থির চোখে তাকালো মহিলা।

“ধন্যবাদ তোমাকে। অনেক দিন এসব করি নি। আর তুমিও বেশ ভালোই করেছো।”

হেসে ফেললো সে। এধরণের প্রশংসা সব সময়ই তার কাছে ছেলেমানুষি ব’লে মনে হয়।

“ব্যাপারটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিলো, তবে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।”

“আবারো করতে পারলে খুশি হবো,” বললো সিসিলিয়া। “যদি তুমি করতে চাও তো।”

তার দিকে তাকালো ব্লমকোভিস্ট।

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো তোমার একজন প্রেমিক পুরুষ দরকার?”

“খণ্ডকালীন প্রেমিক,” সিসিলিয়া বললো। “তবে আমি চাই ঘুমিয়ে পড়ার আগে তুমি তোমার নিজের ঘরে ফিরে যাও। সকালে উঠে আমি তোমাকে এখানে দেখতে চাই না। আমাকে ব্যয়াম করতে হবে, চেহারাটাও ঠিক করে নিতে হবে। আজকে আমরা যা করলাম সেটা পুরো গ্রামকে না জানালেই ভালো হয়।”

“জানানোর কথা আমি মোটেও ভাবছি না,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “বিশেষ করে আমি চাই না ইসাবেলা এটা জেনে যাক। সে আস্ত একটা কুত্তি।”

“তোমার সবচাইতে কাছের প্রতিবেশি…তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো।”

“হ্যা। তবে ভাগ্য ভালো যে, তার বাড়ি থেকে আমার সামনের দরজাটা দেখা যায় না। মিকাইল, প্লিজ, একটু সতর্ক থেকো। ব্যাপারটা গোপন রেখো।”

“তাই হবে। চিন্তা কোরো না।”

“ধন্যবাদ তেমাকে। মদ খাও?”

“মাঝে মধ্যে।”

“জিনের সাথে ফ্রুটজুস আছে, খাবে?”

“নিশ্চয়।

গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে সে চলে গেলো নীচতলায়। দুই গ্লাস জিন আর লাইম নিয়ে যখন সে ফিরে এলো দেখতে পেলো ব্লমকোভিস্ট সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার বইয়ের শেলফ দেখছে। তারা টোস্ট করলো।

“তুমি এখানে কেন এসেছিলে?” জানতে চাইলো মহিলা।

“বিশেষ কোনো কারণ নেই। শুধু…”

“তুমি বাড়িতে বসে বসে হেরনিকের তদন্তকাজের ডকুমেন্ট পড়ো। তারপর চলে এলে এখানে। তুমি কিসের খোঁজে আছো সেটা জানাতে হলে কাউকে অতো বুদ্ধিমান হতে হবে না।।”

“তুমি কি তদন্তের ফাইলগুলো পড়েছো?”

“কিছু কিছু পড়েছি। জ্ঞান হবার পর আমি আমার পুরো জীবন এসব দেখে দেখেই কাটিয়ে দিয়েছি। হ্যারিয়েটের রহস্য ছাড়া তুমি হেনরিকের সাথে কোনো আলাপ করতে পারবে না

“কেসটা আসলেই চমকপ্রদ। এটাকে থুলার উপন্যাসের ভাষায় বলে লক্ড- রুম মিস্টেরি। এই ইনভেস্টিগেশনে কোনো স্বাভাবিক যুক্তি অনুসরণ করা হয় নি বলেই মনে হয়। প্রতিটি প্রশ্নেরই জবাব মেলে নি। প্রতিটি ব্লু অনুসরণ করে শেষে কানাগলিতে গিয়ে পৌঁছেছে।

“এটা এমন একটা জিনিস যা নিয়ে লোকে বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে।”

“ঐদিন তো তুমিও এখানে ছিলে।”

“হ্যা। এখানেই ছিলো, আর সবই দেখেছি। সে সময় আমি পড়াশোনা

করার জন্যে স্টকহোমে থাকতাম। ঐ সপ্তাহান্তটি যদি এখানে থাকতে পারতাম ভালোই হোতো।’

“হ্যারিয়েট আসলে কেমন ছিলো? মনে হচ্ছে লোকজন তার সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করে।”

“এটা কি অফ দি রেকর্ড নাকি…?”

“অফ দি রেকর্ড।”

“হ্যারিয়েটের মাথায় কি ঘুরপাক খাচ্ছিলো সেটা আমি ঠিক বলতে পারবো না। তুমি ওর শেষ বছরটা সম্পর্কে জানতো চাইছো, তাই না? একদিন সে ধর্ম নিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লো তো পরদিনই আবার বেশ্যার মতো মেকআপ মুখে লাগিয়ে টাইট সোয়েটার পরে স্কুলে চলে যেতো। এটা নিশ্চিত সে খুব অসুখী ছিলো। তবে যেমনটি বলেছি, আমি এখানে ছিলাম না, শুধু তার সম্পর্কে গালগল্পগুলোই শুনেছি।”

“তার সমস্যাটা কি ছিলো?”

“অবশ্যই গটফ্রিড আর ইসাবেলা। তাদের বিয়েটা একেবারে যা-তা ব্যাপার ছিলো। হয় আলাদা থাকতো না হয় ঝগড়া করতো। শারীরিকভাবে মারামারি জাতীয় কিছু হোতো না-কাউকে আঘাত করার মতো লোক ছিলো না গটফ্রিড। তাছাড়া ইসাবেলাকে সে বেশ ভয়ও পেতো। মহিলা খুবই রগচটা স্বভাবের। ষাটের দশকে গটফ্রিড স্থায়ীভাবে থাকার জন্যে নিজের ক্যাবিনে চলে যায় ইসাবেলা সেখানে কখনও যায় নি। একটা সময় গটফ্রিডকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো, অনেকটা ভবঘুরের মতো। এরপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে পরিস্কার জামাকাপড় পরে আবারো কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করে সে।”

“হ্যারিয়েটকে সাহায্য করার মতো কি কেউ ছিলো না?”

“অবশ্যই ছিলো…হেনরিক। এক পর্যায়ে হ্যারিয়েট তার ওখানেই চলে আসে। তবে ভুলে যেয়ো না সে তখন বিশাল শিল্পসাম্রাজ্যের কর্ণধার। মহা ব্যস্ত এক লোক। বেশিরভাগ সময়ই সে বিদেশে ঘুরে বেড়াতো কাজের প্রয়োজনে। হ্যারিয়েট আর মার্টিনকে খুব একটা সময় দিতে পারতো না। আমি অবশ্য এসব পরে শুনেছি কারণ আমি উপসালা আর স্টকহোমে ছিলাম। আরেকটা কথা শুনে রাখো, আমার বাবা হেরাল্ডের সাথে আমার শৈশবটাও ভালো কাটে নি। সব দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে হ্যারিয়েট কখনও নিজের মনের কথা কারো কাছে খুলে বলে নি। সব সময় ভান ক’রে থাকতো এক সুখী পরিবারে বসবাস করে সে।”

“আত্মপ্রবঞ্চনা।”

“হ্যা। তবে তার বাবা পানিতে ডুবে মারা গেলে মেয়েটা বদলে যায়। সব কিছু যে ঠিকঠাক মতো চলছে এরকম ভান করা বাদ দিয়ে দেয়। তখন পর্যন্ত…আমি জানি না কিভাবে এটা ব্যাখ্যা করবো : খুবই প্রতিভাবান আর বুদ্ধিমতি এক মেয়ে ছিলো। তবে সব মিলিয়ে সাধারণ এক টিনএজারই ছিলো সে। শেষ বছরগুলোতেও সে ক্লাসে সবার সেরা ছিলো, তবে তাকে দেখে মনে হোতো নিষ্প্রাণ এক মেয়ে।”

“তার বাবা কিভাবে পানিতে ডুবে মারা গেলো?”

“একেবারে সাধারণভাবে। নিজের ক্যাবিনের নীচে একটা বাইচ নৌকা থেকে পানিতে পড়ে যায়। তার প্যান্টটা খোলা পাওয়া গেছে, রক্তে প্রচুর পরিমাণে এলকোহলের উপস্থিতিও ছিলো। বুঝতেই পারছো, কি ঘটেছিলো। তাকে খুঁজে পেয়েছিলো মার্টিন।

“এটা তো আমি জানতাম না।”

“খুবই হাস্যকর এটা। মার্টিনকে দেখলে মনে হবে সে খুবই চমৎকার একটি মানুষ। কিন্তু তুমি যদি আমাকে পয়ত্রিশ বছর আগে জিজ্ঞেস করতে তাহলে বলতাম আমাদের পরিবারে যদি কারোর মানসিক চিকিৎসা করাতে হয় সেটা মার্টিনেরই করা উচিত।”

“কেন?”

“হ্যারিয়েটই কেবল সমস্যার মধ্যে ছিলো না। অনেক বছর পর্যন্ত মার্টিনও চুপচাপ, অর্ন্তমূখী আর অসামাজিক স্বভাবের ছিলো। তাদের দুই ভাইবোনেরই খারাপ সময় গেছে। মানে আমাদের সবারই খারাপ সময় গেছে। আমার বাবাকে নিয়েও আমার সমস্যা ছিলো-আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পারছো সে একেবারে বদ্ধ উন্মাদ ছিলো। আমার বোন আনিটা এবং চাচাতো ভাই আলেকজান্ডারের ও ছিলো একই সমস্যা। ভ্যাঙ্গার পরিবারে অল্পবয়সীদের শৈশব খুব একটা ভালো ছিলো না।”

“তোমার বোনের কি হয়েছিলো?”

“ও থাকতো লন্ডনে। সত্তুর দশকে এক ট্রাভেল এজেন্সির চাকরি নিয়ে ওখানে চলে যায়, পরে লন্ডনেই স্থায়ী হয় সে। এমন একজনকে সে বিয়ে করে যাকে এই পরিবারের কারো সাথে কখনই পরিচয় করিয়ে দেয় নি। অবশ্য খুব দ্রুতই তারা সেপারেটেড হয়ে যায়। বর্তমানে সে বৃটিশ এয়ারওয়েজের সিনিয়র ম্যানেজার। আমার সাথে তার সম্পর্ক ভালোই তবে খুব একটা যোগাযোগ হয় না, বছরে দুয়েকবার দেখা হয়। ও কখনও হেডেস্টাডে আসে নি।”

“কেন আসে নি?”

“পাগল এক বাবা, এটাই কি যথেষ্ট নয়?”

“কিন্তু তুমি তো এখানে থাকতে।”

“থাকতাম, তবে আমার ভাই বার্জারের সাথে।”

“রাজনীতিক ভদ্রলোক।

“ঠাট্টা করছো আমার সাথে? বার্জার আমার এবং আনিটার চেয়ে বয়সে বড়। আমাদের মধ্যে খুব একটা ঘনিষ্ঠতা ছিলো না। নিজেকে সে মনে করতো চমৎকার এক রাজনীতিবিদ যেকিনা ভবিষ্যতে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় গেলে পার্লামেন্টে যাবে, হয়তো মন্ত্রীও হবে। সত্যি বলতে কি, জীবনে সর্বোচ্চ যে পদে পৌঁছেছিলো সেটা সুইডেনের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্থানীয় কাউন্সিলর।”

“ভ্যাঙ্গার পরিবারের একটা জিনিস আমি ধরতে পেরেছি, সেটা হলো তোমরা একে অন্যের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করো না

“কথাটা সত্যি নয়। আমি মার্টিন আর হেনরিকের খুবই ভক্ত। আমার বোনের ব্যাপারেও আমি সব সময় ভালো কথা বলি। ইসাবেলাকে আমি ঘৃণা করি আর আলেকজান্ডারকে সহ্যই করতে পারি না। বাবার সাথে আমি কখনও কথাই বলি না। তার মানে ফিফটি ফিফটি হয়ে গেলো। বাজার খারাপ লোক না, বলতে পারো মাথামোটা একজন। তুমি কি বলতে চাচ্ছো বুঝতে পারছি। এভাবে দ্যাখো : তুমি যদি ভ্যাঙ্গার পরিবারের একজন হয়ে থাকো তাহলে তুমি যা মনে মনে ভাববে সেটাই মুখে বলবে। আমরা তাই করি।”

“তা তো ঠিকই। আমিও লক্ষ্য করেছি তোমরা সরাসরি কথা বলো।” তার স্তনযুগল ধরার জন্য ব্লমকোভিস্ট হাত বাড়ালো। “আমি এখানে আসার পনেরো মিনিটেরও কম সময়ে তুমি আমাকে আক্রমণ ক’রে বসেছো।’

“সত্যি বলতে কি, তোমাকে প্রথম যখন দেখলাম তখন থেকেই ভাবছিলাম বিছানায় তুমি কেমন হবে।”

*

জীবনে এই প্রথম কারোর কাছ থেকে উপদেশ নেবার তাগিদ অনুভব করছে সালান্ডার। সমস্যাটা হলো কারো কাছ থেকে উপদেশ নেয়া মানে তাকে সব খুলে বলা। তার মানে দাঁড়ায় নিজের সিক্রেট প্রকাশ করে ফেলা। কাকে বলবে? লোকজনের সাথে খুব সহজে খাতির জমাতে পারে না সে।

তার অ্যাড্রেসবুক ঘেঁটে মাত্র দশ জন লোককে পেলো যাদের সাথে সে কথা বলতে পারে। এদের বেশিরভাগই তার স্বল্প পরিচিত।

প্লেগের সাথে কথা বলতে পারে সে, এই লোকটার সাথে তার সবচাইতে বেশি যোগাযোগ আছে। তবে সে তার বন্ধু নয়। আর লোকটা মোটেই তার সমস্যা সমাধান করতে চাইবে না। প্লেগ বাদ।

এডভোকেট বুরম্যানকে সালান্ডার তার যৌনজীবনের যে গল্পটা বলেছে সেটা আদতে পুরোপুরি ঠিক না। বরং সব সময় সেক্স তার কাছে একটা কন্ডিশন (অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে), সে নিজেই উদ্যোগটা নিয়ে থাকে। পনেরো বছর বয়স থেকে মোট পঞ্চাশজন পার্টনার হয়েছে তার। এর মানে প্রতি বছর পাঁচজন পার্টনার। সেক্সকে উপভোগের জিনিস মনে করা সিঙ্গেল মেয়ে হিসেবে তার জন্যে এটা ঠিকই আছে।

একটা সময় ছিলো সালান্ডার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না। ঐ সময়টাতে মাদক আর মদে ডুবেছিলো, বিভিন্ন ইন্সটিটিউশনের কাস্টডিতে ছিলো সে। বিশ বছর বয়স থেকে মিল্টন সিকিউরিটিতে কাজ করতে শুরু করার পরই নিজেকে স্থির করতে সক্ষম হয় সে। নিজের জীবনের লাগাম যেনো নিজের হাতে চলে আসে তখন থেকে। অন্তত সে এরকমটাই ভাবে।

পাবে কিংবা বারে তার জন্যে কেউ তিন বোতল বিয়ার কিনে দিলেই যে তার সাথে সেক্স করার তাড়না অনুভব করতো সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। আর রাস্তা থেকে নাম না জানা পাড় মাতাল কাউকে বাড়িতে নিয়ে এসে ফূর্তি করার চিন্তা ও বাদ দিয়ে দিলো সে। বিগত এক বছরে তার সেক্স পার্টনার কেবল একজনই ছিলো।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধুবান্ধবদের স্বল্পপরিচিত গ্রুপের লোকজনের সাথেই সেক্স করেছে। সে কোনো সদস্য নয় তবে তাকে গ্রহণ করা হয়েছে কারণ সে সিলা নোরেনকে চেনে। সিলার সাথে পরিচয় সেই টিনএজ বয়স থেকে, যখন সে স্কুল ফাইনাল দেবার জন্য কমভাক্সে ভর্তি হয়েছিলো। পামগ্রিনই ফাইনাল দেবার জন্যে তাগাদা দিয়েছিলো তাকে। সিলার টকটকে লাল চুল, তাতে কালো রঙের স্ট্রিক করা, কালো চামড়ার ট্রাউজার, নাকে রিং, সালান্ডারের মতো তার বেল্টেও প্রচুর সংখ্যক নাটবল্টু লাগানো। প্রথম ক্লাসে তারা একে অন্যের দিকে স্থির চোখে কিছুক্ষণ চেয়েছিলো।

সালান্ডার এখনও জানে না কি কারণে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছিলো। বন্ধু হবার মতো মেয়ে তো সালান্ডার ছিলো না কখনও। তবে সিলা এসব গায়ে মাখতো না। তার নীরবতাকে পাত্তাও দিতো না সে। সাথে করে তাকে বারে নিয়ে যেতো। সিলার মাধ্যমেই সে ‘ইভিল ফিঙ্গার’-এর সদস্য হয়। এই দলটি এন্সকিডির চারজন টিনএজ মেয়ের একটি হার্ডরক ব্যান্ড। দশ বছর পর কোনো এক মঙ্গলবারে তারা একদল বন্ধু কেভারনান-এ ছেলেদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, নারীবাদ, পেন্টাগ্রাম, সঙ্গীত আর রাজনীতি নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা করে। তারা প্রচুর বিয়ার পান করে সেদিন। নিজেদের নামও ঠিক করে নেয় সেইসাথে।

সালান্ডার টের পেলো ঐ গ্রুপে সে নিতান্তই অপাংক্তেয়। খুব কম কথাই সে বলেছিলো। তবে সে যেমনই হোক না কেন তাকে তারা মেনে নেয় নিজেদের দলে। তার যখন ইচ্ছে যেতে আসতে পারতো, কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে বসে বিয়ার পান করলেও তাকে বিরক্ত করা হোতো না। তাকে জন্মদিনের পার্টি আর ক্রিসমাসে আমন্ত্রণ জানানো হলেও খুব কমই যেতো সে।

যে পাঁচ বছর সে ‘ইভিল ফিঙ্গারস’-এর সাথে ছিলো সেই সময়টাতে দলের মেয়েগুলোর মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তাদের চুলের রঙ প্রকট আর কিম্ভুতকিমাকার থেকে স্বাভাবিক হয়ে আসে, পরনের জামাকাপড়ও ফাঙ্কিস্টাইল থেকে সরে আসে। তারা পড়াশোনা আর কাজ করতে আরম্ভ করে, এমনকি দলের একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়ে মা হয়ে যায়। সালান্ডারের কাছে মনে হয় একমাত্র সে-ই কোনো রকম পরিবর্তিত হয় নি।

তবে তারা ঠিকই আনন্দ করে বেড়াতো। ‘ইভিল ফিঙ্গারস’-এর অফিস আর দলের মেয়েদের যেসব ছেলেবন্ধু ছিলো তাদের সংস্পর্শেই কেবল দলীয় ঐক্যের ব্যাপারটা ভালোমতো অনুভব করতে পারতো সালান্ডার।

‘ইভিল ফিঙ্গারস’ তার কথা শুনবে। তারা তার পক্ষেও দাঁড়াবে। তবে তাদের কোনো ধারণাই নেই ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট সালান্ডারকে নন কম্পোস মেনটিস অর্ডার করেছে। সে চায় না ওরা তাকে ভুল বুঝুক। তারাও বাদ।

তারা বাদে তার অ্যাড্রেসবুকে আর একজনও সাবেক ক্লাসমেট নেই। তার কোনো নেওয়ার্ক, সাপোর্ট গ্রুপ কিংবা রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই। তাহলে কার কাছে গিয়ে সে নিজের সমস্যার কথা বলবে?”

একজন লোক অবশ্য আছে। কিন্তু ড্রাগান আরমানস্কিকে নিজের সব কথা খুলে বলবে কিনা অনেক ভেবে দেখলো সে। লোকটা তো তাকে বলেছিলো যখনই সাহায্যের দরকার পড়বে সে যেনো তার কাছে চলে আসে। এ নিয়ে যেনো দ্বিধা না করে। সে জানে লোকটা আন্তরিকভাবেই কথাটা বলেছে।

আরমানস্কি কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে কখনও তার দিকে হাত বাড়ায় নি। নিজের ক্ষমতার উৎকট প্রদর্শনও করে নি সে। তবে তার কাছে সাহায্যের জন্য বলাটা খুবই অস্বাভাবিক দেখাবে। লোকটা তার বস্। এতে করে তার কাছে সে ঋণী হয়ে থাকবে। বুরম্যানের জায়গায় যদি আরমানস্কি তার গার্ডিয়ান হতো তাহলে তার জীবনটা কেমন হতো সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভেবে গেলো সালান্ডার। হেসে ফেললো সে। আইডিয়াটা খারাপ না, তবে আরমানস্কি হয়তো অ্যাসাইনমেন্টটি এতোটাই সিরিয়াসলি নিয়ে নেবে যে তাকে ব্যতিব্যস্ত ক’রে ফেলবে। এটা অবশ্য একটা অপশন হতে পারে।

সে ভালো করেই জানে উইমেন্স ক্রাইসিস সেন্টারের কাজ কি, তবে সেখানে যাওয়ার কথা মোটেও ভাবলো না। তার মতে ক্রাইসিস সেন্টারগুলো ভিকটিমদের জন্য। নিজেকে সে কখনওই ভিকটিম মনে করে না। প্রকারান্তরে একটা উপায়ই তার কাছে বাকি থাকলো-এটাই সে সব সময় করে থাকে-পুরো ব্যাপারটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিজেই সমাধান করবে। এটাই হলো একমাত্র উপায়।

আর এটা এডভোকেট নিলস বুরম্যান আন্দাজও করতে পারবে না।

অধ্যায় ১৩

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ২০-শুক্রবার, মার্চ ৭

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে সালান্ডার নিজেই নিজের ক্লায়েন্ট হয়ে বুরম্যানের ব্যাপারে কাজ শুরু করে দিলো। ১৯৫০ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রলোককে খুবই অগ্রাধিকারের সাথে বিশেষ একটি প্রজেক্ট হিসেবে নিলো সে। দিনে ষোলো ঘণ্টা ব্যয় করলো লোকটার ব্যক্তিগত বিষয়ে তদন্ত করে, এরকম কঠোর পরিশ্রম আগের কোনো তদন্তে সে করে নি। যতো ধরণের আর্কাইভ আর পাবলিক ডকুমেন্ট জোগার করা সম্ভব তা করলো সে। লোকটার পরিচিত বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের ব্যাপারেও খোঁজ নিলো সালান্ডার। তার টাকা-পয়সার কি অবস্থা আর সেইসাথে তার বেড়ে ওঠা এবং ক্যারিয়ারের ইতিহাসও জেনে নিলো।

ফলাফল হতাশাজনক।

একজন আইনজীবি সে, বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, ফিনান্স লয়ের উপর বিশাল আর মূল্যবান একটি বইও আছে তার। কোনো কলঙ্ক নেই তার চরিত্রে। বেশ নামডাকওয়ালা লোক। কখনও তার কোনো বদনাম রটে নি। মাত্র একবার বার অ্যাসোসিয়েশনে তার নামে রিপোর্ট করা হয়েছিলো-দশ বছর আগে একটি ঘুষের লেনদেনে মধ্যস্থতা করার জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয় সে। তার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। কমপক্ষে ১০ মিলিয়ন ক্রোনারের সম্পত্তি আছে। ট্যাক্স ফাঁকির কোনো রেকর্ড বের করা যাবে না। বেশ ভালো পরিমাণের ট্যাক্স দিয়ে থাকে। গ্রিনপিস আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একজন সদস্য সে। হার্ট আর লাঞ্জ ফাউন্ডেশনে প্রচুর ডোনেট করে। মিডিয়াতে খুব একটা উপস্থিত হয় না। তবে বেশ কয়েকবার তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিকবন্দীদের পক্ষে আইনী লড়াই করার জন্য তার নাম মিডিয়াতে এসেছে। ওডেনপ্লানের কাছে আপল্যান্ডসগাটানের একটি বড় অ্যাপার্টমেন্টে বাস করে। ঐ অ্যাপার্টমেন্টের সোসাইটি কমিটির সেক্রেটারি সে। একজন ডিভোর্সি, তবে কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই।

তার সাবেক স্ত্রীর উপর মনোযোগ দিলো সালান্ডার, মহিলার নাম এলেনা। জন্ম পোল্যান্ডে হলেও সারাজীবন সুইডেনেই বাস করেছে। একটা রিহ্যাব সেন্টারে কাজ করে, বুরম্যানেরই এক সাবেক কলিগকে বিয়ে করে বেশ সুখে আছে এখন। কাজে লাগে সেরকম কিছু এখান থেকে পাওয়া যাবে না। বুরম্যানের বিয়েটা চৌদ্দ বছর টিকেছিলো। কোনো রকম বাদানুবাদ ছাড়াই তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।

যেসব তরুণ-তরুণী আইনী সমস্যায় পড়ে তাদের সুপারভাইজার হিসেবেও নিয়মিত কাজ করে বুরম্যান। সালান্ডারের গার্ডিয়ান হবার আগে চারজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের ট্রাস্টি ছিলো সে। প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর আদালতের সিদ্ধান্তে সেইসব ট্রাস্টিশিপের সমাপ্তি হয়। এইসব ক্লায়েন্টদের একজন বুরম্যানের সাথে এখনও কনসাল্ট করে থাকে। তার মানে সেখানে ঘাটাঘাটি করে কোনো দুর্গন্ধ বের করা যাবে না। বুরম্যান যদি তাদের সাথে খারাপ কিছু করে থাকে তাহলে সেটার কোনো প্রমাণ নেই, দৃশ্যত এরকম কিছুর অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। তার ঐসব ক্লায়েন্টদের সবাই ছেলেবন্ধু মেয়েবন্ধু নিয়ে বেশ সুখেশান্তিতে রয়েছে। সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তারা। ভালো চাকরিবাকরি করে। ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে।

ঐ চারজন ক্লায়েন্টের সাথে সে দেখা করে জানিয়েছে একজন সমাজকল্যাণ সেক্রেটারি সে, ট্রাস্টিদের অধীনে ছেলেমেয়েরা কতোটা ভালো থাকে, কি রকম হয় তাদের জীবন এর উপর একটি গবেষণা করছে তারা। তাদেরকে আশ্বস্ত করে বলেছে সবার নাম গোপন রাখা হবে। একটা কোয়েশ্চেনেয়ার তৈরি করে তাদেরকে দিয়েছে জবাব দেবার জন্য। এর মধ্যে এমন প্রশ্নও ছিলো যাতে করে বুরম্যানের অধীনে থাকার সময় তাদের সাথে কোনো অসদাচরণ হয়ে থাকলে সেটা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু না। তেমন কিছু পাওয়া যায় নি।

এই তদন্ত শেষে সালান্ডার সমস্ত কাগজপত্র একটা ব্যাগে ভরে হলের বাইরে যেখানে পুরনো সংবাদপত্র জমিয়ে রাখে সেখানে রেখে দিলো। মনে হচ্ছে বুরম্যানকে ধরা সম্ভব না। লোকটার অতীতে এমন কিছু নেই যে সে ব্যবহার করতে পারবে। তবে সে এটা জানে লোকটা নির্ঘাত একটা বদমাশ। শূয়োরের বাচ্চা। সমস্যা হলো এটা প্রমাণ করার মতো কোনো কিছু তার হাতে এখন নেই।

অন্য আরেকটা অপশন নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সমস্ত কিছু বিশ্লেষণ করে একটা সম্ভাবনাই তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হচ্ছে-নিদেনপক্ষে এটা সত্যিকার অর্থে একটা বিকল্প হতে পারে। তার জীবন থেকে বুরম্যান নামক লোকটাকে উধাও করে ফেলার সবচাইতে সহজ উপায়। সমস্ত সমস্যার অবসান। তিপান্ন বছরের কোনো লোকের হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা ঘটতেই পারে।

তবে সেরকম কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে।

.

খুব গোপনীয়তার সাথেই হেডমিস্ট্রেস সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের সাথে প্রণয় চালিয়ে যেতে লাগলো ব্লমকোভিস্ট। মহিলা তিনটি শর্ত দিয়েছে : তারা যে মিলিত হয়, দেখা করে সেটা যেনো কেউ না জানে; কেবলমাত্র সে তাকে ফোন করলে এবং তার মনমেজাজ ভালো থাকলেই ব্লমকোভিস্ট তার কাছে আসবে; তার ওখানে পুরো রাত কাটানো যাবে না।

মহিলার সুতীব্র আকাঙ্খা ব্লমকোভিস্টকে বিস্মিত আর হতবাক করে দিলো। তার সাথে যখন সুসানের ক্যাফেতে দেখা হয় তখন মহিলা বেশ বন্ধুসুলভ আচরণ করলেও একটু দূরত্ব বজায় রাখে। কিন্তু বিছানায় যখন তারা মিলিত হয় মহিলা একেবারে বুনো আর উদগ্র হয়ে ওঠে। তীব্র কামনায় বন্যজন্তুর মতো আচরণ করে।

তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নাক গলাতে চায় না ব্লমকোভিস্ট, তবে তাকে তো ভ্যাঙ্গার পরিবারের সবার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধা আছে তার মধ্যে আবার এটাও ঠিক মহিলার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানার জন্যে তার মধ্যে আগ্রহেরও কোনো কমতি নেই। একদিন ভ্যাঙ্গারের সাথে আলেকজান্ডার আর বার্জারের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে কথা বলার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলো সিসিলিয়া কাকে বিয়ে করেছে, আর তাদের মধ্যে কি হয়েছিলো।

“সিসিলিয়া? আমার মনে হয় না হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হওয়ার সাথে তার কোনো সম্পর্ক আছে।”

“তার ব্যাকগ্রউন্ড সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন।”

“গ্র্যাজুয়েট করার পর সে এখানে চলে আসে এবং শিক্ষকতা শুরু করে। জেরি কার্লসন নামের এক লোককে সে বিয়ে করে, দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো লোকটা ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনেই কাজ করতো। আমি ভেবেছিলাম তাদের বিয়েটা বেশ সুখেরই ছিলো—মানে শুরুর দিকের কথা বলছি। তবে বেশ কয়েক বছর পর বুঝতে পারলাম তাদের মধ্যে সমস্যা চলছে। তার সাথে বাজে ব্যবহার করতো লোকটা। সেই পুরনো কিস্সা-স্বামী তাকে পেটাতো আর সে এসব কাউকে বলতো না। মুখ বুজে থাকতো। অবশেষে একদিন বেশ পেটালো, একেবারে শোচনীয়ভাবে। হাসপাতালে যেতে হলো তাকে। আমি সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলাম, এখানে, এই হেডেবিতে নিয়ে এলাম তাকে। এরপর থেকে সে আর স্বামীর সাথে দেখা করে না। কোনো রকম যোগাযোগও রাখে না। লোকটাকে আমি আমাদের কোম্পানি থেকে বরখাস্ত করে দেই।”

“কিন্তু তারা তো এখনও বিবাহিত?”

“প্রশ্ন হলো তুমি ব্যাপারটা কিভাবে দেখছো। জানি না ও কেন ডিভোর্স করে নি। তবে আবার বিয়ে করতে মোটেও ইচ্ছুক নয় সে। তাই আমার কাছে মনে হয় ব্যপারটা ডিভোর্সের মতোই হয়ে গেছ।

“এই কার্লসন লোকটা, সে কি কোনোভাবে…”

“…হ্যারিয়েটের ঘটনার সাথে জড়িত কিনা? না, ১৯৬৬ সালে সে হেডেস্টাডে ছিলো না। তখনও সে এই ফার্মে যোগ দেয় নি।”

“ঠিক আছে।”

“মিকাইল, আমি সিসিলিয়াকে খুব পছন্দ করি। তার সাথে তাল মিলিয়ে চলাটা একটু কঠিন তবে আমাদের পরিবারে যে কয়জন ভালো মানুষ আছে সে তাদের একজন।”

*

নিলস বুরম্যানের হত্যার পরিকল্পনা করার কাজে একটা সপ্তাহ ব্যয় করলো সালান্ডার। অনেকগুলো পদ্ধতি বিবেচনা এবং বাতিল করে অবশেষে অল্প কয়েকটি পদ্ধতি মনে মনে ঠিক করে রাখলো। মাথা গরম করে কিছু করা যাবে না।

একটা কন্ডিশন ফুলফিল করতে হবে। বুরম্যানকে এমনভাবে মারতে হবে যেনো ঘুণাক্ষরেও কেউ তাকে সন্দেহ করতে না পারে। পুলিশের তদন্ত কি রকম হতে পারে সেটা আগে মাথায় রাখলো সে। বুরম্যানের ঘটনা তদন্ত করতে গেলে তার প্রসঙ্গ আসবেই। ঘটনার সময় কেবলমাত্র সে-ই উপস্থিত থাকবে। ক্লায়েন্ট হিসেবে সে মাত্র চারবার লোকাটার সাথে দেখা করেছে। সুতরাং লোকটার মৃত্যুর সাথে তার সাবেক কোনো ক্লায়েন্টের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে হবে না পুলিশের কাছে। এ ব্যাপারে তারা কোনো কানেকশান খুঁজে পাবে না। সাবেক মেয়েবন্ধু, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন, কলিগ আর অন্যরাও তো আছে। তাছাড়া ‘র‍্যান্ডম ভয়োলেন্স’ নামেও একটি শব্দ পুলিশের খাতায় রয়েছে, যেখানে ভিকটিমের সাথে খুনির কোনো সম্পর্ক থাকে না, তারা একে অন্যেকে চেনে না।

তার নাম যদি উঠে আসে তাহলে ডকুমেন্ট প্রমাণ করবে সে একেবারে অসহায়, অসমর্থ এক মেয়ে, মানসিকভাবেও যে কিনা পুরোপুরি সুস্থ নয়। মাথামোটা টাইপের। বুরম্যানকে যদি খুব জটিলভাবে হত্য করা হয় যা কিনা কোনো মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ের পক্ষে করা সম্ভব নয় তাহলে সেটা তার জন্যে বেশ সুবিধারই হবে।

অস্ত্র ব্যবহার করার কথা বাদ দিলো সে। অস্ত্র জোগার করা যে খুব একটা কঠিন কাজ তা নয়, তবে অস্ত্রের হদিশ বের করার কাজে পুলিশ খুবই দক্ষ।

ছুরির কথা ভাবলো। যেকোনো হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে সেটা কেনা যেতে পারে। তবে সেটাও বাতিল করে দিলো। একেবারে তার অলক্ষ্যে পেছন থেকে ছুরি চালালে যে লোকটা সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে, কোনো রকম শব্দ করতে পারবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিংবা আদৌ মরবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। বরং তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তার মানে লোকজনের মনোযোগ আকর্ষিত হবে, তার জামাকাপড়ে রক্তও লেগে যাবে, আর সেটা হবে তার বিরুদ্ধে একটি আলামত।

বোমা জাতীয় কিছু ব্যবহার করার কথা ভাবলো সে। তবে সেটা খুবই জটিল আর কঠিন একটি ব্যাপার। বোমা বানানোটা তার জন্যে খুব বড় সমস্যা নয়-কিভাবে মারাত্মক বোমা বানানো যায় সেসব ম্যানুয়াল ইন্টারনেটে ভুরি ভুরি আছে। কিন্তু নিরীহ লোকজনের ক্ষতি না করে বোমা বিস্ফোরণ করাটা খুব কঠিন একটা কাজ। তাছাড়া এতেও যে লোকটা নির্ঘাত মারা যাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তার ফোনটা বেজে উঠলো।

“হাই, লিসবেথ। ড্রাগান বলছি। তোমার জন্য একটা কাজ আছে।”

“আমার হাতে সময় নেই।”

“কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

“আমি ব্যস্ত আছি।”

ফোনটা রেখে দিলো সে।

অবশেষে বিষের ব্যাপারটা তার মনোপুত হলো। এটা বেশ ভালোভাবে কাজ করবে।

ইন্টারনেট ঘেটে কয়েক দিন পার করলো সালান্ডার। বেশ অনেকগুলো জিনিস পাওয়া গেলো সেখানে। তার মধ্যে একটা হলো সবচাইতে ভয়ঙ্কর একটি বিষ-হাইড্রোসিয়ানিক এসিড। সাধারণভাবে লোকে এটাকে প্রুসিক এসিড বলে।

প্রুসিক এসিড বেশ কিছু কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজে ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে ডাই করার কাজও রয়েছে। অল্প কয়েক মিলিগ্রামই একজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। এক লিটার দিয়ে মাঝারি গোছের একটি শহরের সবাইকে মেরে ফেলা যাবে অনায়াসে।

এটা ঠিক এ ধরণের মারাত্মক জিনিস খুবই নিরাপদ আর সুরক্ষিত স্থানে রাখা হয়। বিক্রিও করা হয় বেশ কঠোর নিয়ম মেনে। তবে সাধারণ কোনো রান্নাঘরেই এটা যতো খুশি ততো উৎপাদ করা সম্ভব। কেবল দরকার পড়বে কিছু ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি, সেগুলো মাত্র কয়েকশ’ ক্রোনার ব্যয়ে শিশুদের কেমিস্ট্রি সেটের দোকান থেকে কেনা যাবে। আর এটা বানাতে যেসব উপাদান লাগবে তার বেশিরভাগই গৃহস্থালী জিনিসের দোকান থেকে সংগ্রহ করা যায়। কিভাবে এটা বানানো যায় সেই ম্যানুয়াল রয়েছে ইন্টারনেটে।

আরেকটা অপশন হলো নিকোটিন। এক কার্টন সিগারেট পুড়িয়ে খুব সহজেই সে কয়েক মিলিগ্রাম তরল নিকোটিনের প্রাণঘাতি সিরাপ বানিয়ে নিতে পারবে! তারচেয়ে ভালো জিনিস হলো নিকোটিন সালফেট। অবশ্য এটা করতে গেলে আরেকটু জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এটা চামড়ার বাইরে ব্যবহার করলেও ভেতরে ঢুকে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। তাকে শুধু রাবারের গ্লোভ পরে নিলেই হবে, তারপর ওয়াটার পিস্তলে সেটা ভরে বুরম্যানের মুখে স্প্রে করে দিলেই সব শেষ। বিশ সেকেন্ডের মধ্যে সে অজ্ঞান হয়ে পড়বে আর তার কয়েক সেকেন্ড পর নির্ঘাত মারা যাবে লোকটা। বাঁচার কোনো আশাই থাকবে না।

কি পরিমাণ গৃহস্থালী পণ্য রূপান্তর করে প্রাণঘাতি অস্ত্র বানানো যায় সে ব্যাপারে সালান্ডারের কোনো ধারণাই নেই। বিষয়টা নিয়ে কয়েক দিন ঘাটাঘাটি করে বুঝতে পারলো তার গার্ডিয়ানের বিরুদ্ধে মরণঘাতি একটি অস্ত্র বানানোতে কোনো রকম টেকনিক্যাল বাধার সম্মুখীন হবে না সে।

দুটো সমস্যা আছে : বুরম্যানের মৃত্যুতেও নিজের জীবনের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে না। আর বুরম্যানের স্থলাভিষিক্ত যে হবে সে যে মন্দলোক হবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পরিণতি বিশ্লেষণ করা।

তার দরকার নিজের গার্ডিয়ানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে মুক্ত করা। সারা রাত ধরে নিজের ঘরের সোফায় বসে এই পরিস্থিতিটা নিয়ে ভেবে গেলো সে। শেষ রাতের দিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার আইডিয়াটা বাদ দিয়ে নতুন একটি পরকিল্পনা করলো।

এটা যে খুব ভালো একটি পরিকল্পনা তা বলা যাবে না তবে এতে করে বুরম্যানকে তার বিরুদ্ধে আবারো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার ব্যাপারে প্রলুব্ধ করা হবে।

অন্তত সে তাই ভাবে।

.

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে হেেেডবিতে থাকাকালীন ব্লমকোভিস্ট প্রতিদিন রুটিনমাফিক চলতে শুরু করলো। সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে। এই সময়টাতে নিজের মাথায় নতুন নতুন জিনিস ঢোকায় সে। এরপর আবহাওয়া যাই থাকুক না কেন বেশ কয়েক মাইল হাটতে বের হয়। বিকেলের আগে হয় নিজের ঘরে নয়তো সুসানের ক্যাফেতে আবারো কাজে বসে পড়ে। সকালে কি করেছে, কি লিখেছে সেসব আবার খতিয়ে দেখে সেইসাথে ভ্যাঙ্গারের আত্মজীবনী লেখার কাজ করে। বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত একদম ফ্রি থাকে। মুদি দোকানে গিয়ে হয় কিছু কেনে নয়তো নিজের জামাকাপড় আয়রন করে কিংবা হেডেস্টাডে চলে যায়। সন্ধ্যার ৭টার দিকে ভ্যাঙ্গারের সাথে বসে, তার কোনো কিছু জানার থাকলে জেনে নেয় বৃদ্ধলোকটার কাছ থেকে। রাত ১০টার মধ্যে ফিরে আসে নিজের ঘরে। রাত ১টা কি ২টা পর্যন্ত পড়াশোনা করে। ভ্যাঙ্গারের কাছে থাকা সমস্ত ডকুমেন্ট ঘেটে ঘেটে দেখে কোনো কিছু পাওয়া যায় কিনা।

আত্মজীবনীটা আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। পরিবারের পরিচিতি নিয়ে ইতিমধ্যেই ১২০ পৃষ্ঠা খসড়া লিখে ফেলেছে সে। ১৯২০’র দশকে আছে এখন, সেখান থেকে ধীরে ধীরে এগোবে সামনের দিকে।

হেডেস্টাডের লাইব্রেরির মাধ্যমে ঐ সময় নাৎসিদের কর্মকাণ্ডে উপর কিছু বইয়ের অর্ডার দিলো সে, এরমধ্যে হেলেনি লু’য়ের দ্য সোয়াস্তিকা অ্যান্ড দ্য ওয়াসা শিফ বইটিও রাখা হলো যেখানে জার্মান আর সুইডশি নাৎসিদের ব্যবহৃত প্রতীক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ভ্যাঙ্গার আর তার ভাইদের সম্পর্কে আরো বিশ পৃষ্ঠা খসড়া লিখে ফেললো। ভ্যাঙ্গারকে কেন্দ্রিয় চরিত্রে রেখে কাহিনী এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেইসময় তাদের কোম্পানি কিভাবে পরিচালিত হতো সেটা জানার জন্য কিছু ব্যক্তির তালিকা তৈরি করে রাখলো, এদের সম্পর্কে আরো রিসার্চ করতে হবে। ব্লমকোভিস্ট আবিষ্কার করলো ভ্যাঙ্গার পরিবারের সাথে আইভার ক্রুগার সাম্রাজ্যের বেশ ঘণিষ্ঠতা ছিলো-এটা আরেকটা দিক যা তাকে বিস্তারিত জানতে হবে। আন্দাজ করতে পারলো তাকে আরো ৩০০ পৃষ্ঠা লিখতে হবে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে হেনরিকের কাজটা শেষ করতে চায় সে যাতে করে শরৎকালে আত্মজীবনীটা রিভাইস দিতে পারে।

এসব কাজ এগোতে থাকলেও হ্যারিয়েটের ব্যাপারে তেমন একটা অগ্রগতি হলো না। এই তদন্তের উপর যতো পড়াশোনাই সে করে থাকুক না কেন একটা ছোট্ট তথ্য পর্যন্ত জোগার করতে পারলো না যেটার সূত্র ধরে নতুনভাবে কেসটা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে পারে।

ফেব্রুয়ারির এক শনিবারে রাতের বেলায় ভ্যাঙ্গারের সাথে আলাপের সময় এই বিষয়ে তার অগ্রগতি হচ্ছে না বলে জানালো ব্লমকোভিস্ট। সে যেসব কানাগলি আবিষ্কার করেছে সেগুলো বলে গেলে বৃদ্ধলোকটি ধৈর্য ধরে সব শুনে গেলো চুপচাপ।

“কোনো অপরাধই নিখুঁত হয় না,” বললো ভ্যাঙ্গার। “আমি নিশ্চিত কিছু একটা আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে।”

“আমরা এখনও বলতে পারছি না আসলেই কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছিলো কিনা।”

“কাজ চালিয়ে যেতে থাকো,” ভ্যাঙ্গার বললো। “পুরো তদন্ত শেষ করো।”

“একেবারেই অর্থহীন।”

“হয়তো। তবে হাল ছাড়বে না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ব্লমকোভিস্ট।

“টেলিফোন নাম্বারগুলো,” অবশেষে বললো সে।

“হ্যা।”

“ওগুলোর নিশ্চয় কোনো মানে আছে।”

“ঠিক।”

“কোনো একটা উদ্দেশ্যেই ওগুলো লেখা হয়েছিলো।”

“হ্যা।”

“কিন্তু আমরা সেগুলোর মানে বের করতে পারছি না।”

“না।”

“অথবা আমরা ওগুলো ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছি হয়তো।”

“একদম ঠিক।”

‘ওগুলো কোনো টেলিফোন নাম্বার নয়। ওগুলোর অন্য কোনো মানে আছে।”

“হয়তো।”

আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিকাইল বাড়িতে ফিরে এলো পড়াশোনা করার জন্য।

*

সালান্ডার যখন আবারো ফোন করে জানালো তার কিছু টাকার দরকার তখন এডভোকেট বুরম্যান স্বস্তিবোধ করলো। তার সাথে সাম্প্রতিক একটি মিটিংয়ের শিডিউল বাতিল করে দিয়েছিলো মেয়েটা এই বলে যে তার নাকি জরুরি একটা কাজ ছিলো। এরফলে তার মধ্যে এক চাপা অস্বস্তি বিরাজ করছিলো এ ক’দিন। মেয়েটা কি অকল্পনীয় কোনো সমস্যা বয়ে আনতে যাচ্ছে? তবে যেহেতু তার সাথে মেয়েটা মিটিং বাতিল করেছে তার মানে সে কোনো অ্যালাউন্স পাবে না, আজ হোক কাল হোক তাকে টাকার জন্যে হলেও তার সাথে দেখা করতেই হবে। মেয়েটা যে তার ঐ ব্যাপারটা নিয়ে বাইরের কারোর সাথে কথা বলতে পারে এই চিন্তাটা না করে পারলো না সে।

তাকে একটু কড়া নজরে রাখতে হবে। মেয়েটাকে বুঝতে হবে কে তার দায়িত্বে আছে। তো বুরম্যান তাকে জানিয়ে দিয়েছিলো এবারের মিটিংটা হবে ওডেনপ্লানে তার নিজ বাসায়। কথাটা শুনে ফোনের অপরপ্রান্তে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় সালান্ডার।

তার পরিকল্পনা ছিলো লোকটার সাথে তার অফিসেই দেখা করবে, ঠিক শেষবার যেভাবে দেখা করেছিলো। কিন্তু এখন তাকে সম্পূর্ণ নতুন একটি জায়গায় গিয়ে দেখা করতে হবে। শুক্রবার রাতে ঠিক করা হয়েছে মিটিংটা। রাত ৮টা বাজে বলা হলেও ঠিক ৮:৩০-এ দরজার বেল বাজালো সে। এই আধঘণ্টায় লোকটার অন্ধকার সিঁড়িতে বসে বসে নিজের পরিকল্পনাটি শেষবারের মতো গুছিয়ে নিয়েছে সালান্ডার। বিকল্প কিছু নিয়েও ভেবেছে। নিজের সাহস আর উদ্যম সঞ্চয় করার জন্যেও কিছুটা সময় নিয়েছে সে।

*

৮টার দিকে ব্লমকোভিস্ট তার কম্পিউটারের সুইচ বন্ধ করে গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে নিলো। বাইরে বের হলেও নিজের অফিসের বাতি জ্বালিয়ে রাখলো সে। তারা ভরা আকাশ বেশ উজ্জ্বল, হাড় কাপানো শীত। ওস্টারগার্ডেনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা পেড়িয়ে যেতেই বাম দিকে মোড় নিয়ে সৈকত ধরে এগোতে লাগলো। পথটা একেবারে এবড়োথেবড়ো। আলোকিত বয়াগুলো চোখে পড়ছে। অন্ধকারেও হেডেস্টাড শহরের বাতিগুলো দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। তার দরকার তাজা বাতাস। তবে তারচেয়ে বড় কথা ইসাবেলা ভ্যাঙ্গারের গোয়েন্দা দৃষ্টি এড়ানোটা বেশি জরুরি। একটু ঘুরে ঠিক ৮:৩০-এ এসে পৌছালো সিসিলিয়ার বাড়ির দরজার সামনে। তারা দুজনেই সোজা চলে গেলো তার বেডরুমে।

সপ্তাহে দুয়েকবার তারা দেখা করে। সিসিলিয়া কেবল তার এখানকার প্রেমিকাই হয়ে ওঠে নি, বরং তার কাছেই ব্লমকোভিস্ট সব খুলে বলার মতো সুযোগ পাচ্ছে। তার সাথে তার চাচা হেনরিকের চেয়ে হ্যারিয়েটকে নিয়েই বেশি কথা হয়। ব্যাপারটার গুরুত্ব আছে।

*

শুরু থেকেই পরিকল্পনাটি ভুল পথে এগোতে লাগলো।

বুরম্যান যখন নিজের অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুললো দেখা গেলো লোকটা শুধুমাত্র বাথরোব পরে আছে। দেরি করে এসেছে কেন সেটা জানতে চেয়ে ঝটপট তাকে ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য তাগাদা দিলো এডভোকেট সাহেব। কালো জিন্স আর কালো শার্ট পরেছে সালান্ডার, সেইসাথে বরাবরের মতো চামড়ার জ্যাকেটটা তো আছেই। পায়ে কালো বুট আর ছোট্ট একটা ব্যাগ আছে কাঁধে।

“তোমার কি সময়জ্ঞান কখনও হবে না?” বুরম্যানের এ কথার কোনো জবাব দিলো না সালান্ডার। চারপাশটা দেখে নিলো সে। সিটি জোনিং অফিসের আর্কাইভ থেকে এই অ্যাপার্টমেন্টটার যে প্ল্যান দেখে নিয়েছিলো সেটার সাথে বেশ মিলই আছে। হালকা রঙের কাঠের কিছু আসবাব রয়েছে ঘরে।

“আসো,” এবার একটু আদর করে বললো বুরম্যান। তার কাঁধে একটা হাত রেখে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে নিয়ে গেলো তাকে। কেমন আছো, কি খবর, এসব বলার কোনো বালাই নেই। সোজা বেডরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলো তাকে নিয়ে। কি ধরণের সেবা দিতে হবে তাকে সে ব্যাপারে সালান্ডারের মনে কোনো সন্দেহ নেই।

চকিতে চারপাশটা আবার দেখে নিলো সে। ব্যাচেলরের ঘরে যেমন আসবাব থাকার কথা ঠিক তাই আছে। স্টেইনলেস স্টিলের একটি ডাবলবেড। লো চেস্টের একটি ড্রয়ার, যেটা কিনা বেডসাইড টেবিল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। তারপাশে একটা ল্যাম্প, খুবই মৃদু আলো জ্বলছে সেটা থেকে। একটা ওয়ারড্রব, একাপাশে আবার আয়না লাগানো। বেতের একটা চেয়ার আর আর ঘরের এক কোণে, দরজার কাছে ছোট্ট একটা ডেস্ক। তার হাত ধরে তাকে বিছানার দিকে নিয়ে গেলো বুরম্যান।

“আমাকে বলো এবার কেন তোমার টাকার দরকার হলো। কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি কিনবে?”

“খাবার,” বললো সে।

“অবশ্যই। আরে আমি তো দেখছি বোকার মতো ভেবেছি। তুমি তো শেষ মিটিংটায় আসো নি।” থুতনীটা ধরে মুখটা তুলে তার চোখের দিকে তাকালো সে। “তুমি কেমন আছো?”

কাঁধ তুললো সে।

“আমি শেষবার তোমাকে কি বলেছিলাম ভেবে দেখেছো কি?”

“কিসের কথা বলছেন?”

“লিসবেথ, কোনো রকম বোকামি কোরো না। আমি চাই তুমি আমি বেশ ভালো বন্ধু হবো। একে অন্যেকে সাহায্য করবো।”

কিছু বললো না সে। তাকে চড় মারার একটা ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে হলো বুরম্যানকে। এই নিষ্প্রাণ আচরণ মোটেও ভালো লাগছে না তার কাছে।

“শেষবার আমরা যখন বড়দের খেলা খেলেছিলাম সেটা কি তুমি পছন্দ করেছিলে?”

“না।”

ভুরু তুললো লোকটা।

“লিসবেথ, বেকামি কোরো না।”

“খাবার কেনার জন্য আমার টাকা লাগবে।”

“শেষবার তো আমরা এ নিয়েই কথা বলেছিলাম। তুমি যদি আমার কথা শোনো, আমিও তোমার দিকটা দেখবো। কিন্তু তুমি যদি কোনো রকম সমস্যা সৃষ্টি করো…” তার থুতনীটা শক্ত করে ধরলে সালান্ডার মুখটা সরিয়ে নিলো।

“আমি আমার টাকা চাই। আমাকে কি করতে হবে বলুন?”

“তুমি তো জানোই আমি কি চাই।” তার কাঁধটা শক্ত করে ধরে বিছানার কাছে নিয়ে গেলো সে।

“দাঁড়ান,” সঙ্গে সঙ্গে বললো সালান্ডার। একটু দ্বিধার সাথে থেমে তার দিকে তাকালো সে। জ্যাকেটটা খুলে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে আশেপাশে তাকালো। চেয়ারের উপর জ্যাকেটটা রেখে ব্যাগটা রাখলো টেবিলের উপর। তারপর ইতস্তত করে বিছানার দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আচমকা থেমে গেলো যেনো তার পা দুটো জমে গেছে। তার কাছে এগিয়ে এলো বুরম্যান।

“দাঁড়ান,” আরেকবার বললো কথাটা যেনো লোকটার সাথে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে। “প্রতিবার টাকার দরকার পড়লেই আপনার ঐ লিঙ্গ মুখে নিতে হবে তা হবে না।”

বুরম্যানের মুখের অভিব্যক্তি হঠাৎ করেই বদলে গেলো। সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিলো মেয়েটার গালে। চোখ গোল গোল করে তাকালো সালান্ডার তবে কোনে কিছু করার আগেই তার কাঁধ ধরে সজোরে ছুড়ে মারলো বিছানার উপর। আচমকা এই হিংস্রতায় অবাক হয়ে গেলো সে। উপুড় হয়ে পড়েছে বলে ঘুরে তার দিকে তাকাতে গেলেই লোকটা তাকে বিছানার উপর চেপে ধরলো।

তার সাথে এই লোকটার কোনো তুলনাই চলে না। শারিরীকভাবে সে একেবারেই বেমানান। কেবলমাত্র লোকটার চোখে খামচি দেয়া কিংবা কোনো অস্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া কোনোভাবেই এই লোকটার সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তার সমস্ত পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। তার টি-শার্টটা ছিড়ে ফেললো এডভোকেট বুরম্যান। তীব্র ভয়ের সাথে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে সে বিপদে পড়ে গেছে।

সালান্ডার শুনতে পেলো লোকটা বিছানার ঠিক পাশেই ড্রেসার ড্রয়ার খুলছে, ধাতব কোনো কিছুর টুংটাং শব্দও শুনতে পেলো সে। প্রথমে বুঝতে পারে নি কি ঘটতে যাচ্ছে, এরপরই দেখতে পেলো তার দু’হাতে একটা হ্যান্ডকাফ পরানো হচ্ছে। বিছানার দু’পাশে থাকা পায়ার সাথে সেই হ্যান্ডকাফ দুটো আঁটকে দিলো বুরম্যান। তার পায়ের বুট আর জিন্স প্যান্টটা খুলে ফেলতে লোকটার খুব বেশি সময় লাগলো না। এরপর তার পা-মোজাটা খুলে হাতে দলা পাকিয়ে নিলো সে।

“আমাকে বিশ্বাস করতে হবে তোমায়, লিসবেথ,” বললো বুরম্যান। “এই বড়দের খেলাটা কিভাবে খেলতে হয় সেটা আমি তোমাকে শেখাবো এখন। আমার সাথে যদি ভালোমতো সহযোগীতা না করো তাহলে কঠিন শাস্তি দেবো। আর যদি সহযোগীতা করো তাহলে আমিও তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করবো। আমরা ভালো বন্ধু হয়ে যাবো।”

তার উপর দু’পা ফাঁক ক’রে বসে পড়লো সে।

“তাহলে তুমি অ্যানাল সেক্স পছন্দ করো না,” বললো বুরম্যান।

চিৎকার করার জন্য সালান্ডার মুখ খুলতেই তার মুখের ভেতর মোজাটা ঢুকিয়ে দিলো সে। টের পেলো তার দু’পা ফাঁক ক’রে বেধে ফেলছে লোকটা যাতে করে সে নড়াচড়া করতে না পারে। লোকটা ঘরে কি যেনো খুঁজছে বুঝতে পারলো সালান্ডার তবে তাকে দেখতে পেলো না কারণ তার মুখের উপর টি শার্টটা টেনে পেঁচিয়ে দেয়া হয়েছে। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। এরপরই তার পায়ুপথে সুতীব্র যন্ত্রণার সাথে টের পেলো কি যেনো ঢুকছে। সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার এখনও ব্লমকোভিস্টকে তার বাড়িতে রাত না কাটানোর নিয়মটা অব্যাহত রেখেছে। রাত দুটোর পরই ব্লমকোভিস্ট উঠে কাপড়চোপড় পরতে শুরু করলে মহিলা নগ্ন হয়ে বিছানায় শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসলো।

তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি, মিকাইল। তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগে।”

“আমারও তোমাকে ভালো লাগে।”

তাকে টেনে আবার বিছানায় নিয়ে এইমাত্র পরা শার্টটা খুলে ফেললো সিসিলিয়া। আরো এক ঘণ্টা বেশি থাকতে হলো তাকে।

ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা অতিক্রম করার সময় উপরতলার একটা জানালার পর্দা সরতে দেখলো সে।

.

সালান্ডারকে তার জামাকাপড় পরতে দেয়া হলো। এখন শনিবার, ভোর ৪টা বাজে। জ্যাকেট আর ব্যাগটা নিয়ে দরজার দিকে পা টেনে টেনে এগোলো সে, ওখানেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। গোসল করে চমৎকার জামাকাপড় পরে আছে এখন। ২৫০০ ক্রোনারের একটা চেক ধরিয়ে দিলো তার হাতে।

“আমি তোমাকে তোমার বাড়ি পর্যন্ত গাড়িতে করে দিয়ে আসবো,” দরজা খুলে বললো লোকটা।

অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে তার দিকে তাকালো সালান্ডার। একেবারে বিপর্যস্ত সে। তার মুখটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখাচোখি হতেই লোকটা যেনো ভিমড়ি খেলো। এ জীবনে সে এতোটা ঘৃণার প্রকাশ হতে দেখে নি।

“না,” এতো আস্তে কথাটা বললো যে বুরম্যান তা শুনতে পেলো না। “আমি নিজেই বাড়ি যেতে পারবো।”

তার কাঁধে হাত রাখলো লোকটা।

“তুমি নিশ্চিত?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। আরো শক্ত করে তার কাঁধটা ধরলো বুরম্যান। “মনে রেখো কি বলেছি। পরের শনিবার তুমি এখানে আবার আসবে আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো সালান্ডার। তার চোখেমুখে ভীতি। তাকে চলে যেতে দিলো বুরম্যান।

শনিবার, মার্চ ৮-সোমবার, মার্চ ১৭

অধ্যায় ১৪

তলপেটে ব্যাথা আর পায়ুপথে রক্তপাত নিয়ে পুরো সপ্তাহটা বিছানায় কাটিয়ে দিলো সালান্ডার। বুঝতে পারছে সেরে উঠতে সময় নেবে। লোকটার অফিসে প্রথম যখন তাকে ধর্ষণ করা হলো সেটা থেকে এই ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্নরকম। এটা জোরপূর্বক কিংবা অপমানজন কিছু নয়, এটা একেবারে সিস্টেম্যাটিক পৈশাচিকতা।

বুরম্যানকে যে সে খাটো করে দেখেছিলো সেটা দেরিতে হলেও এখন বুঝতে পারছে।

লোকটা একটু মাতব্বরি করবে সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলো কিন্তু সে যে ভয়াবহ এক মর্ষকামী সেটা তার জানা ছিলো না। রাতের প্রায় অর্ধেকটা সময় জুড়ে তাকে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছিলো। বেশ কয়েক বার তার মনে হয়েছিলো তাকে বোধহয় খুন করে ফেলবে লোকটা। একটা সময় তার মুখে বালিশ চাপা দিয়ে তাকে অজ্ঞান পর্যন্ত করেছে।

সালান্ডার কাঁদে নি।

প্রচণ্ড শারিরীক যন্ত্রণা হলেও তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ে নি। ঐ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে ওডেনপ্লানের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যেতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়। নিজের অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠাটাও ছিলো তার জন্যে বেশ পীড়াদায়ক। গোসল করে গোপনাঙ্গ থেকে রক্ত মুছে নেয় সে, এরপর এক গ্লাস পানি আর দুটো রহিপনোল খেয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে পড়ে থাকে।

রবিবার দিন বেশ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে সে। মাথায় আর তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে তখন। বিছানা থেকে উঠে দু’গ্লাস কেফির আর একটা আপেল খেয়ে নেয়। আবারো বিছানায় ফিরে যাবার আগে দুটো ঘুমের বড়ি খেয়ে নেয় সালান্ডার।

মঙ্গলবারের আগে উঠতে পারবে ব’লে মনে হয় নি তার কাছে। বাইরে গিয়ে বিলি’স প্যান পিজ্জা কিনে এনে দু’টুকরো করে মাইক্রোওভেনে রেখে দেয়। ঐ রাতটা ইন্টারনেট ব্রাউজ করে আর মর্ষকামীতার মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের উপরে লেখা কতোগুলো আর্টিকেল পড়েই সে কাটিয়ে দেয়।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এক মহিলা গ্রুপের এক লেখিকার একটি লেখা থেকে সে জানতে পেরেছে মর্ষকামী অর্থাৎ স্যাডিস্টরা তাদের ‘সম্পর্ক’ বেছে নেয় একেবারে নিখুঁত স্বতঃস্ফূর্ততায়। স্যাডিস্টদের বেশিরভাগ ভিক্টিম হলো তারা যারা কিনা অনন্যোপায় হয়ে স্বেচ্ছায় তাদের কাছে গিয়ে হাজির হয়। এরা বেশি চড়াও হয় পরনির্ভর ব্যক্তিদের উপর।

এডভোকেট বুরম্যান তাকে ভিক্টিম হিসেবে বেছে নিয়েছে।

তার কাছে সব লোকই এমন : তাকে ভিক্টিম হিসেবে বেছে নেয়।

দ্বিতীয় ধর্ষণের এক সপ্তাহ পরের এক শুক্রবারে হর্নস্টাল জেলার এক টাট্টুপার্লারে গেলো সালান্ডার। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিলো বলে শপে আর কোনো কাস্টমার নেই। পার্লারে মালিক তাকে দেখে চিনতে পেরে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

তার পায়ের গোড়ালীতে চিকন ব্যান্ডের মতো সহজ সরল একটি টাট্টু বেছে নিলো সে।

“ওখানকার চামড়া তো অনেক বেশি পাতলা। খুব ব্যাথা পাবে,” টাট্টু আর্টিস্ট বললো তাকে।

“সমস্যা নেই,” জিন্সের প্যান্টটা গুটিয়ে পা’টা বের করে বললো সালান্ডার। “ঠিক আছে। তাহলে একটা ব্যান্ড আকঁবে। তোমার শরীরে তো অনেক টাট্টু আছে। তুমি কি নিশ্চিত আরেকটা আঁকবে?”

“এটা হবে আমার জন্য একটা সুভেনুর।”

.

শনিবার দুপুর ২টায় সুসান তার ক্যাফেটা বন্ধ করে দিলে ব্লমকোভিস্ট সেখান থেকে চলে এলো। সকাল থেকে ল্যাপটপে টাইপিং করে কাটিয়ে দিয়েছে সে। বাড়ি ফেরার আগে কনসাম নামের দোকান থেকে কিছু খাবার আর সিগারেট কিনে নিলো। ফ্রাইড সসেজ আর আলুভাজা জিনিসটা এর আগে তার পছন্দের তালিকায় না থাকলেও এখন এই গ্রামীণ এলাকায় এসে সেগুলো তার প্রিয় হয়ে উঠেছে।

ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা সাতটার দিকে নিজের রান্নাঘরের জানালার সামনে দাঁড়ালো সে। সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার তাকে আজ ফোন করে নি। সিসিলিয়া যখন দুপুরে সুসানের ক্যাফে থেকে রুটি কিনতে গিয়েছিলো তখন তার সাথে হুট করেই দেখা হয়েছিলো। তাকে দেখে কিছুটা উদাস উদাস লাগছিলো তার কাছে। তার কাছে মনে হয় নি আজকের রাতে মহিলা তাকে ডাকবে। ঘরের ছোট্ট টিভি সেটটার দিকে তাকালো সে, ওটা এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয় নি। জানালার সামনে থেকে সরে এসে সু গ্রাফটনের একটি রহস্য উপন্যাস নিয়ে বসে পড়লো ব্লমকোভিস্ট।

.

কথামতো পরের সপ্তাহে বুরম্যানের অ্যাপার্টমেন্টে চলে এলো সালান্ডার। মার্জিতভাবে হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানালো লোকটা।

“আজকে কেমন লাগছে তোমার, ডিয়ার লিসবেথ?”

কোনো জবাব দিলো না সে। তার কাঁধে হাত রাখলো বুরম্যান।

“আমার মনে হয় শেষবার খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে,” বললো সে। “তোমাকে একটু মনমরা দেখাচ্ছে।”

তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসলে লোকটটা সামান্য ভড়কে গেলো। মেয়েটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কথাটা আমাকে মনে রাখতে হবে।

“আমরা কি শোবারঘরে যেতে পারি?” বললো সালান্ডার।

কিংবা বলা যেতে পারে মেয়েটা স্বাভাবিকই আছে…আজকে তার সাথে একটু নরম ব্যবহার করবো। তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। ড্রয়ার থেকে ইতিমধ্যে হ্যান্ডকাফটা বের করে রেখে দিয়েছে সে। বিছানার কাছে পৌছানোর পর বুরম্যানের কাছে কিছু একটা গড়বড় বলে মনে হলো।

মেয়েটাই তার হাত ধরে তাকে বিছানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা যখন তার জ্যাকেটের ভেতর থেকে মোবাইল ফোনের মতো দেখতে একটা জিনিস বের করলো সেটা দেখে অবাক হয়ে থেমে গেলো বুরম্যান। এরপরই তার চোখ দুটো দেখতে পেলো সে।

“বিদায় বলার সময় হয়ে গেছে,” বললো সালান্ডার।

জিনিসটা তার বুকের বাম দিকে ঠেকিয়ে ৭৫০০০ ভোল্ট ফায়ার করলো সে। লোকটার পা দুটো টলে গেলে সালান্ডার নিজের কাঁধে তার পুরো শরীরের ওজনটা নিয়ে সজোরে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিলো তাকে।

.

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের খুব অস্থির লাগছে। ব্লমকোভিস্টকে আর ফোন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তাদের সম্পর্কটা হাস্যকরভাবেই বেডরুম কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। পা টিপে টিপে ব্লমকোভিস্ট সবার অলক্ষ্যে এসে হাজির হয় তার ঘরে। আর সে নিজেও অস্থির টিনএজারদের মতো নিজেকে বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বিগত কয়েক সপ্তাহ তার আচার-ব্যবহার খুব বেশি খামখেয়ালি রকমের হয়ে গেছে।

সমস্যাটা হলো তাকে একটু বেশি পছন্দ করে ফেলেছি, ভাবলো সে। সে আমাকে শেষ পর্যন্ত কষ্ট দেবে। অনেকক্ষণ বসে থেকে ভাবলো ব্লমকোভিস্ট হেডেবিতে না আসলেই ভালো হোতো।

মদের বোতল বের করে দু’গ্লাস মদ পান করে টিভিতে সংবাদ দেখলো সে। বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করলো, কিন্তু খুব জলদি একঘেয়মিতে আক্রান্ত হলো। প্রেসিডেন্ট বুশ কেন ইরাকে বোমা ফেলছে তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে টিভি সংবাদে। টিভি বাদ দিয়ে জিলেট টামাসের দ্য লেজার ম্যান বইটা নিয়ে বসলো রিভিংরুমের সোফায়। কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই সেটা রেখে দিলো। তার বাবার কথা মনে পড়ে গেছে বইটা পড়ে। কি ধরণের ফ্যান্টাসি ছিলো লোকটার?

১৯৮৪ সালে তাদের মধ্যে শেষবার দেখা হয়েছিলো যখন বার্জার আর তার সাথে হেডেস্টাডের উত্তরে খোরগোশ শিকার করতে গিয়েছিলো। বার্জারের সাথে একটি সুইডিশ শিকারী কুকুর ছিলো। হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের বয়স তখন তিয়াত্তুর। সিসিলিয়া ততোদিনে লোকটার পাগলামি অনেকটাই মেনে নিয়েছে। বাবার এই পাগলামি তার পুরো শৈশবকালে আস্ত একটি দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু ছিলো না। বড় হবার পরও এ নিয়ে তার মধ্যে অনেক আক্ষেপ ছিলো।

তখন সিসিলিয়া যতোটা ভঙ্গুর ছিলো আর কখনও ততোটা ছিলো না। মাত্র তিনমাস আগে তার বিয়েটা ডিভোর্সে পরিসমাপ্তি ঘটে। স্বামীর হাতে নির্যাতন…গৃহস্থালী সহিংসতা…একেবারে কমন একটি শব্দ। তার কাছে এটা সীমাহীন একটি অত্যাচার ছিলো। মাথায় আঘাত করা, চড়থাপ্পড় দেয়া, হুমকি ধামকি আর রান্নাঘরের ফ্লোরে ফেলে লাথি মারা…সবই চলতো। তার স্বামীর এই সহিংস আচরণ এতোটা ঘন ঘন হতো যে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো সে।

কিন্তু অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে বাড়তে একদিন এমন পর্যায়ে পৌছে গেলো যে তাকে হাসপাতালে যেতে হলো মারাত্মক আহত হয়ে। একটা কাঁচি দিয়ে তার পিঠে আঘাত করা হয়।

তবে ঘটনা ঘটার পর লোকটা ভয়ে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় নিজে গাড়িয়ে চালিয়ে। ইমার্জেন্সি রুমে এই ঘটানটি নিয়ে অদ্ভুত আর বানোয়াট এক গল্প ফাঁদে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। লজ্জায় নিজের মধ্যে কুকুঁড়ে গিয়েছিলো সিসিলিয়া। বারোটা সেলাই হয় তার পিঠে, হাসপাতালে থাকতে হয় পুরো দুদিন। এরপরই তার চাচা হেনরিক তাকে হাসপাতাল থেকে তুলে নিজের বাসায় নিয়ে যায়। সেই থেকে স্বামীর সাথে তার আর কথা হয় নি।

শরতের সেই দিনে হেরাল্ড ভ্যাঙ্গার বেশ ভালো মুড়ে ছিলো। তার আচরণ অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণই ছিলো সেদিন। কিন্তু বনের ভেতর যেতে যেতে আচমকা তার বাবা চিৎকার করে করে সিসিলিয়ার নৈতিকতা আর যৌনজীবন নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করতে শুরু করে। এমনও কথা বলে যে, তার মতো বেশ্যার পক্ষে কোনো পুরুষ মানুষকে ধরে রাখা যে সম্ভব নয় সেটা নাকি সে ভালো করেই জানতো।

তার ভাই এ সময়টাতে বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলো। ভাবখানা এমন যেনো বাবার সমর্থন দিয়ে বলছে, জানোই তো মেয়েরা কেমন হয়। সিসিলিয়ার দিকে চোখ টিপে হেরাল্ড ভ্যাঙ্গার বলে, একটা ঢিবিতে উঠে এসব বললে নাকি আরো ভালো হয়।

কয়েক সেকেন্ড ভাই আর বাবার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে থেকে সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার বুঝতে পারে তার হাতে গুলি ভর্তি একটি শটগান আছে। চোখ বন্ধ করলো সে। তার কাছে মনে হলো এই মুহূর্তে গুলি করে দু’জনকে খুন করাই একমাত্র পথ খোলা আছে তার জন্য। বন্দুকটা মাটিতে নামিয়ে রেখে তাদেরকে ছেড়ে পার্ক করা গাড়ির কাছে চলে আসে। ঐ প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদেরকে একা রেখে গাড়ি নিয়ে চলে আসে নিজের বাড়িতে। সেই থেকে নিজের বাড়িতে বাবাকে আর কখনও ঢুকতে দেয় নি, সেও কখনও বাবার বাড়িতে পা মাড়ায় নি।

তুমি আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো, ভাবলো সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার। আমি যখন নিতান্তই শিশু ছিলাম তখনই তুমি আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো।

৮:৩০-এ ব্লমকোভিস্টকে ফোন করলো সে।

.

তীব্র যন্ত্রণায় আছে বুরম্যান। তার শরীরের সব মাংপেশী অসাড় হয়ে গেছে। একেবারে প্যারালাইজ হয়ে আছে সে। জ্ঞান হারিয়েছিলো কিনা সেটাও মনে করতে পারলো না। সব এলোমেলো লাগছে। আস্তে আস্তে যখন তার জ্ঞান ফিরে এলো দেখতে পেলো বিছানার উপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দু’হা পা ছড়িয়ে পড়ে আছে সে। তার হাত দুটো হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাধা। পা দুটো এমনভাবে টেনে ফাঁক করে রাখা হয়েছে যে ব্যাথা করছে। শরীরের যে অংশে ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হয়েছিলো সেখানটা পুড়ে গেছে।

সালান্ডার বেতের চেয়ারটা বিছানার কাছে এনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার জ্ঞান ফিরে পাবার আশায়। হাতে সিগারেট আর বুট পরা পা দুটো বিছানার কাণায় তুলে রেখেছে। বুরম্যান যখন কথা বলতে যাবে টের পেলো তার মুখ আঁটকানো। ড্রয়ারের সব কিছু বের করে ফ্লোরে এলোমেলো ছড়িয়ে রেখেছে মেয়েটা।

“তোর খেলনাগুলো খুঁজে পেয়েছি আমি,” বললো সালান্ডার। একটা চাবুক তুলে ধরে মেঝেতে পড়ে থাকা ডিলডো নামের কৃত্রিম জননেন্দ্রিয় আর রাবারের মুখোশের দিকে ইশারা করলো সে। “এটা কিসের জন্যে?” একটা বড় এনাল প্লাগ তুলে ধরে বললো এবার। “না না। কথা বলার চেষ্টা করিস না-তুই কি বলবি সেটা তো আমি শুনতে পাবো না। এটাই কি তুই গত সপ্তাহে আমার উপর ব্যবহার করেছিলি? শুধু মাথা নেড়ে জবাব দে।” তার দিকে একটু ঝুঁকে এলো সে।

বুরম্যান টের পেলো ভয়ে তার বুকটা ধক ধক করছে। মাথা ঘোরাতে শুরু করলো এবার। হ্যান্ডকাফের দিকে তাকালো। মেয়েটা তাকে আঁটকে ফেলেছে। অসম্ভব। সালান্ডার যখন অ্যানাল প্লাগটা তার পাছার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো কিছুই করতে পারলো না সে। “তাহলে তুই একটা স্যাডিস্ট,” নিজের মনেই বললো কথাটা। “লোকজনের ভেতর এসব জিনিস ঢুকিয়ে মজা পাস খুব, তাই না? তার চোখের দিকে তাকালো। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। “কোনো তরল কিংবা জেল ব্যবহার না করে, ঠিক না?”

সালান্ডার তার গালে স্কচপেট লাগিয়ে দিলে বুরম্যান একটা চাপা গোঙানী দিলো।

“ঘোৎ ঘোৎ করা বন্ধ করো,” লোকটার কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে বললো সালান্ডার। “কোনো রকম অভিযোগ করলে আমি তোমাকে কঠিন শাস্তি দেবো।”

উঠে বিছানার অন্য দিকে চলে গেলো সে। চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই বুরম্যানের…করছেটা কি? লিভিংরুম থেকে তার বত্রিশ ইঞ্চির টিভিটা ট্রলিসহ ঠেলে নিয়ে এলো সালান্ডার। মেঝেতে তার ডিভিডি প্লেয়ারটা রেখে তার দিকে তাকালো সে। তার এক হাতে চাবুকটা এখনও আছে।

“আমি কি তোর পূর্ণ মনোযোগ পেতে পারি? কথা বলার চেষ্টা করবি না-মাথা নেড়ে জবাব দে। কি বলেছি বুঝেছিস?” মাথা নেড়েই জবাব দিলো বুরম্যান।

“বেশ।” উপুড় হয়ে তার ব্যাগটা তুলে নিলো সে। “এটা কি চিনতে পেরেছিস?” লোকটা সায় দিলো। “গত সপ্তাহে তোর এখানে যখন এসেছিলাম তখন এই ব্যাগটা আমার সাথে ছিলো। একেবারে দরকারি একটা জিনিস। মিল্টন সিকিউরিটি থেকে এটা আমি ধার করেছি।” জিপটা খুলে ফেললো সে। “এটা হলো ডিজিটাল ক্যামেরা। টিভি৩’র ইনসাইড প্রোগ্রামটা দেখিছিস কখনও? ঐসব জঘন্য রিপোর্টাররা লুকানো ক্যামেরা দিয়ে কিছু জিনিস ধারণ করে থাকে।” ব্যাগের আরেকটা পকেট খুললো।

“ভাবছিস লেন্সটা কোথায়। এটাই হলো এই জিনিসের মহত্ত। ওয়াইড- অ্যাঙ্গেল ফাইবার অপটিক্স। লেন্সটা দেখতে একটা বোতামের মতো দেখায়, কাঁধের স্ট্র্যাপের মধ্যে বসানো থাকে। হয়তো তোর মনে আছে আমাকে অত্যাচার করার আগে আমি এই ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখছিলাম। লেন্সটা যেনো বিছানার দিকে তাক করা থাকে সেভাবেই রেখেছিলাম।”

একটা ডিভিডি বের করে প্লেয়ারে ঢোকালো। এরপর বেতের চেয়ারটা ঘুরিয়ে টিভির দিকে মুখ করে বসলো সালান্ডার। আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে চাপ দিলো রিমোটে। এডভোকেট বুরম্যান দেখতে পেলো সালান্ডারকে সে দরজা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকতে দিচ্ছে।

সময়টা কখন ছিলো সেটা কি বুঝতে পারছিস না?

পুরো ডিভিডিটা দেখালো তাকে। নব্বই মিনিট পর শেষ হলো সেটা। ভিডিওর মাঝখানে একটা দৃশ্যে দেখা গেলো নগ্ন বুরম্যান বিছানার কাছে বসে মদ পান করছে আর হাত পা আঁটকানো উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সালান্ডারের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসছে।

টিভিটা বন্ধ করে টানা বিশ মিনিট বসে থাকলো সে, কোনো কথা বললো না। এমন কি তার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। একটুও নড়লো না বুরম্যান। জমে আছে একেবারে। এরপর উঠে বাথরুমে চলে গেলো সে। ফিরে এসে চেয়ারে বসে যখন কথা বললো তার কণ্ঠটা একেবারে মার্জিত শোনালো।

“গত সপ্তাহে আমি একটা ভুল করেছিলাম,” বললো সে। “ভেবেছিলাম তুই আমাকে দিয়ে আরেকবার ওরাল সেক্স করাবি। তোর ওটা মুখে নেয়া খুবই জঘন্য ব্যাপার তবে এতোটা জঘন্য নয় যে আমি সেটা করতে পারবো না। ভেবেছিলাম তোর এই কাজকারবারের যথেষ্ট প্রমাণ জোগার করতে পারবো যাতে করে প্রমাণ করা যায় তুই আস্ত একটা বুইড়া খাটাশ। কিন্তু তোকে চিনতে একটু ভুল করে ফেলেছিলাম। তুই কতোটা অসুস্থ বদমাশ সেটা বুঝতে পারি নি।

“আমি তোকে সোজাসুজি বলছি,” বললো সে। “এই ভিডিও’তে দেখা যাবে তুই তোর অধীনে গার্ডিয়ান হিসেবে থাকা চব্বিশ বছর বয়সী এক মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েকে ধর্ষণ করছিস। এই ভিডিও যারা দেখবে তারা বুঝবে তুই শুধু বিকৃত যৌনাচারই করিস না বরং তুই একটা স্যাডিস্টও বটে। এই ভিডিওটা দ্বিতীয়বার দেখলাম, আশা করি আর কখনও দেখতে হবে না। বুঝতে পারছিস, নিশ্চয়? আমার ধারণা তোকেই কোনো ইন্সটিটিউটে ভর্তি করতে হবে, আমাকে নয়। সব কথা মনে থাকবে তো?

অপেক্ষা করলো সে। লোকটা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু কাঁপছে। তার জননেন্দ্রিয়তে হালকা করে চাবুক মারলো।

“শুনেছিস কি বলেছি?” চিৎকার করে বললো এবার। সায় দিলো বুরম্যান।

“ভালো। তাহলে এই একই গান গাইবি তুই।”

চেয়ারটা টেনে আরো কাছে এসে তার চোখের দিকে তাকালো।

“এই সমস্যাটা নিয়ে আমরা কি করতে পারি বলে মনে করিস?” তার এ কথার কোনো জবাব দিলো না লোকটা। “তোর কাছে কি এরচেয়ে ভালো কোনো আইডিয়া আছে?” লোকটার বিচি ধরে টান দিলো সে। ব্যাথায় মুখটা বিকৃত হয়ে গেলো তার। “তোর কাছে কি এরচেয়ে ভালো কোনো আইডিয়া আছে?” কথাটা আবারো বললো সে। মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো বুরম্যান।

“ভালো। ভবিষ্যতে যদি তুই এসব নিয়ে কোনো ঝামেলা পাকাস আমি তোকে কী করবো তুই কল্পনাও করতে পারবি না।”

কার্পেটের নীচে সিগারেটটা চাপা দিয়ে রাখলো সালান্ডার। “এরপর থেকে কি হবে বলছি। পরের সপ্তাহে তুই আমার ব্যাঙ্ককে জানাবি আমার একাউন্টটা আমি ছাড়া আর কেউ যেনো অপারেট করতে না পারে। কি বলললাম বুঝেছিস?” মাথা নেড়ে সায় দিলো বুরম্যান।

“ভালো ছেলে। তুই আর আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না। কখনও না। ভবিষ্যতে কেবল আমার দরকার পড়লে তোর সাথে দেখা করবো আমি। আমার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবি।” আবারো সায় দিলো বুরম্যান। সে আমাকে খুন করবে না তাহলে।

“তুই যদি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস তাহলে এই ডিভিডিটা স্টকহোমের সবগুলো পত্রিকা অফিস আর টিভি চ্যানেলে কপি করে পাঠিয়ে দেয়া হবে।”

সায় দিলো লোকটা। এই ভিডিওটা যেভাবেই হোক ওর কাছ থেকে নিয়ে নিতে হবে।

“বছরে একবার গার্ডিয়ানশিপ এজেন্সিতে তুই আমার সম্পর্কে রিপোর্ট দিবি। ওটাতে বলবি আমি একদম স্বাভাবিক আচরণ করছি। আমার জীবনযাপন খুব ভালোমতো চলছে। ভালো কাজ করছি আমি। নিজের আয় নিজে করছি। আমার আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পাচ্ছিস না তুই। ঠিক আছে?”

সায় দিলো সে।

“প্রত্যেক মাসে তুই আমাদের কাল্পনিক মিটিংয়ের একটি রিপোর্ট দিবি। ওখানেই সুন্দর করে লিখবি আমি কতোটা ভালোমতো চলছি। এর একটা কপি আমার কাছে পোস্ট করে দিবি। বুঝেছিস?” আবারো সায় দিলো লোকটা। সালান্ডার খেয়াল করলো বুরম্যানের কপাল বেয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে।

“এক বছর কিংবা দু’বছর পর ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে গিয়ে আবেদন করবি আমার অসমর্থ ঘোষণা করার ডিক্রিটা যেনো প্রত্যাহার করা হয়। এরজন্য যা যা করার সবই করবি তুই। এটা করার সব ক্ষমতা তোর আছে। তোকে এটা করতেই হবে।

সায় দিলো সে।

“তুই কি জানিস কেন তোকে এটা করতে হবে? কারণ এটা করার মতো যথেষ্ট সঙ্গত কারণ রয়েছে। এটা যদি না করিস তবে এই ভিডিওটা সবখানে পৌছে দেয়া হবে।”

সালান্ডারের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে গেলো সে। তার চোখে সুতীব্র ঘৃণার উদগীরণ। সালান্ডার তাকে মেরে না ফেলে যে মারাত্মক একটি ভুল করছে সেটা সে বুঝতে পারছে। এরজন্যে তোকে পস্তাতে হবে, খানকি মাগি। আজ হোক কাল হোক তোকে আমি শেষ করবোই।

“আমার সাথে যদি যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস তাহলে এই একই কাজ করবো আমি।” জিভ বের ক’রে আঙুল দিয়ে কেটে ফেলার অভিনয় করে দেখালো সে। “তোর এই অভিজাত জীবনযাপন আর সেইসাথে তোর সুনাম এবং বিদেশের ব্যাঙ্কে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকাকে বিদায় জানা।”

টাকার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেলো। এই মাগিটা এসব জানলো কি করে…

হেসে আরেকটা সিগারেট বের করলো সালান্ডার।

“তোর এই অ্যাপার্টমেন্ট আর অফিসের বাড়তি চাবি আমি চাই।” লোকটা ভুরু কুচকে ফেললো। তার দিকে ঝুঁকে আবারো মিষ্টি করে হাসলো সে।

“ভবিষ্যতে আমি তোর জীবন নিয়ন্ত্রণ করবো। যখন তুই ঘুমিয়ে থাকবি, আমার আসার কথা কল্পনাও করবি না তখন আমি হুট করে তোর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়বো।” ইলেক্ট্রক শক দেবার যন্ত্রটা তুলে ধরলো সে। “তোকে চোখে চোখে রাখবো আমি। আমি যদি কখনও দেখি অন্য কোনো মেয়েকে নিয়ে আছিস…মেয়েটা তার ইচ্ছেই আসুক আর অনিচ্ছায় আসুক তাতে কিছু যায় আসে না। আমি তোকে…” আবারো জিভ কাটার অভিনয় করে দেখালো তাকে।

“আমি যদি মারা যাই…কোনো দুর্ঘটনা কিংবা অপঘাতে…তাহলে এই ভিডিওর অনেকগুলো কপি জায়গামতো চলে যাবে অটোমেটিক্যালি। সেই সাথে তুই আমার সাথে গার্ডিয়ান হিসেবে কেমন আচরণ করেছিস তার একটা বিবৃতিও জুড়ে দেবো।” একটু থেমে লোকটার মুখের কাছে মুখ এনে বললো, “আরেকটা ব্যাপার। আমাকে যদি আর কখনও স্পর্শ করিস তোকে খুন করে ফেলবো। মনে রাখিস।”

বুরম্যান অবশ্যই তার এই কথাটা বিশ্বাস করলো। মেয়েটার চোখেমুখে দৃঢ়তা দেখেই বোঝা গেলো সেটা।

“মনে রাখবি, আমার মাথা খারাপ। ভয়াবহ ছিটগ্রস্ত আমি। বুঝলি?’

সায় দিলো সে।

তার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকালো সে। “আমার মনে হয় না তুই আর আমি ভালো বন্ধু হবো। তোকে যে আমি মেরে ফেলি নি এজন্যে আমাকে সাধুবাদ জানা। তুই হয়তো ভাবছিস আমার নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হবার একটা উপায় ঠিকই বের করতে পারবি। ঠিক না?

মাথা ঝাঁকালো লোকটা।

“তুই আমার কাছ থেকে একটা উপহার পাবি যাতে করে সব সময় আমার সাথে করা চুক্তির কথা তোর মনে থাকে।”

তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হেসে সালান্ডার বুরম্যানের দু’পায়ের ফাঁকে হাটু গেড়ে বসে পড়লো। বুরম্যান বুঝতে পারছে না মেয়েটা কি করতে যাচ্ছে। আচমকা সুতীব্র এক ভয় জেঁকে বসলো তার মধ্যে।

এরপরই তার হাতে একটা সুই দেখতে পেলো।

প্রাণপণে হাত-পা ছোড়ার চেষ্টা করলো বুরম্যান। সালান্ডার তার বিচিতে হাটু দিয়ে চাপ দিলো তাকে সতর্ক করার জন্য।

“একটুও নড়বি না। সোজা শুয়ে থাক। কারণ এই জিনিসটা আমি প্রথমবার ব্যবহার করছি।’

প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে কাজ করে গেলো সে। কাজ যখন শেষ করলো লোকটা তার গোঙানি থামিয়ে দিলো। তাকে দেখে মনে হলো অসাড় হয়ে আছে।

বিছানা থেকে নেমে এসে একদিকে মাথা উঁচু করে দেখলো সে। নিজের হাতের কাজটা পরখ করে দেখলো ভুরু কুচকে। তার শৈল্পিক প্রতিভা খুব একটা ভালো নয়। অক্ষরগুলো একটু অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। লাল আর কালো রঙ ব্যবহার করেছে সে। লোকটার পেট থেকে লিঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত ক্যাপিটাল লেটারে পাঁচ লাইনের একটা লেখা আছে : আমি একটা স্যাডিস্টিক শূয়োর, বিকৃতরুচির আর ধর্ষণকারী।

সুই আর কালির কার্টিজ দুটো ব্যাগে ভরে রেখে বাথরুমে চলে গেলো হাত ধোয়ার জন্য। বেডরুমে ফিরে আসার পর তাকে বেশ ভালো দেখালো।

“বিদায়,” বললো সে।

একটা হ্যান্ডকাফ খুলে তার পেটের উপর চাবিটা রেখে ডিভিডি আর একগোছা চাবি নিয়ে চলে গেলো সালান্ডার।

.

মাঝরাতে সিগারেট খাওয়ার সময় ব্লমকোভিস্ট তাকে জানালো কিছুদিনের জন্য তাদের আর দেখা হচ্ছে না। অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো সিসিলিয়া।

“মানে?

একটু লজ্জা পেলো সে। “সোমবার থেকে আমার তিনমাসের জেলখাটা শুরু হচ্ছে।”

আর কিছু বলার দরকার হলো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকলো সিসিলিয়া। তার খুব কান্না পাচ্ছে।

.

সোমবার দুপুরে ড্রাগান আরমানস্কির দরজায় সালান্ডার নক করলে সে একটু সন্দিহান হলো। জানুয়ারির শুরুর দিকে ওয়েনারস্ট্রমের উপর তদন্তটি বাতিল করার পর থেকে তার টিকিটাও সে দেখে নি। যতোবার সে তাকে ফোন করেছে সালান্ডার হয় ফোন ধরে নি নয়তো ব্যস্ত আছে ব’লে ফোন রেখে দিয়েছে।

“আমার জন্য কি তোমার কাছে কোনো কাজ আছে?” কোনো রকম হাই হ্যালো ছাড়াই বললো সে।

“হাই। তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো মরে গেছো, কিংবা কিছু হয়েছে।

“কিছু জিনিস সমাধান করতে হয়েছিলো আমাকে, সেটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।”

“প্রায়ই তোমাকে কিছু জিনিস সমাধা করতে হয় দেখছি।”

“এবারেরটা খুব জরুরি ছিলো। এখন তো ফিরে এসেছি। আমার জন্য কি কোনো কাজ আছে?”

মাথা ঝাঁকালো আরমানস্কি। “দুঃখিত। এই মুহূর্তে কাজ নেই।”

শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো সালান্ডার। কিছুক্ষণ পর কথা বলতে শুরু করলো ড্রাগান।

“লিসবেথ। তুমি জানো তোমাকে আমি পছন্দ করি, আর তোমাকে কাজ দিতে পারলে আমার বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু দু’মাস ধরে তোমার কোনো খবর নেই। এদিকে আমার হাতে প্রচুর কাজ। সোজা কথা হলো তুমি নির্ভরযোগ্য নও। তোমার জায়গায় অন্য লোকদের দিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি, এই মুহূর্তে আসলে তোমাকে দেবার মতো কোনো কাজ আমার কাছে নেই

“তুমি কি ভলিউমটা বাড়িয়ে দেবে একটু?”

“কি?”

“রেডিওর কথা বলছি।”

.

…..মিলেনিয়াম ম্যাগাজিন। প্রখ্যাত শিল্পপতি হেনরিক ভ্যাঙ্গার এই পত্রিকার আংশিক মালিক হবার সুবাদে বোর্ড অব ডিরেক্টরেও একটি সিট পাচ্ছেন। আর এই ঘটনাটি ঘটলো ঠিক যেদিন পত্রিকাটির সাবেক প্রকাশক এবং সিইও মিকাইল ব্লমকোভিস্ট আরেক শিল্পপতি হান্স-এরিক ওয়েনারস্ট্রমের মানহানি করার দায়ে তিন মাসের জেল খাটতে শুরু করবেন। মিলেনিয়াম-এর এডিটর ইন চিফ এরিকা বার্গার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন ব্লমকোভিস্ট তার সাজার মেয়াদ শেষ করার পর পুণরায় প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব ফিরে পাবেন।

.

“কি দারুণ খবর,” কথাটা বলেই সালান্ডার দরজার দিকে পা বাড়ালো।

“দাঁড়াও। কোথায় যাচ্ছো?”

“বাড়িতে। কিছু জিনিস চেক ক’রে দেখতে হবে আমাকে। হাতে কোনো কাজ এলে আমাকে ফোন কোরো।”

মিলেনিয়াম-এর সাথে হেনরিক ভ্যাঙ্গারের গাটছড়া বাধার খবরটা লিসবেথ যতোটা ভেবেছিলো তারচেয়ে অনেক বেশি আলোড়ন তুললো মিডিয়াতে। আফটোনব্লাডেট তাদের সান্ধ্যকালীন সংস্করণে খবরটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপলো, সেইসাথে হেনরিক ভ্যাঙ্গারের জীবনের জমকালো অধ্যায় আর তার কর্মজীবনের নানান ঘটনাও তুলে ধরা হলো। এটাও বলা হলো মি: ভ্যাঙ্গার বিগত বিশ বছরে এই প্রথম জনসম্মুখে হাজির হলেন।

রাপোর্ট নামের বিখ্যাত সংবাদ চ্যানেলে এই খবরটাকে তৃতীয় প্রধান শিরোনাম হিসেবে ঠাই দিয়ে তিন মিনিট বরাদ্দ করলো। তারা মিলেনিয়াম-এর অফিসে এরিকা বার্গারের একটি ইন্টারভিউ প্রচার করলো সংবাদটির সাথে। হুট করেই যেনো ওয়েনারস্ট্রমের ঘটনাটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো আবার।

“গত বছর আমরা মারাত্মক একটি ভুল করেছিলাম। যার ফলে ম্যাগাজিনটি মানহানির মামলার শিকার হয়ে আদালত কর্তৃক শাস্তি পেয়েছে। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে খেদ আছে…অনুকূল সময়ে আমরা এই স্টোরিটা নিয়ে আবারো ফলো আপ করবো।”

“ফলো আপ করবেন বলে কি বোঝাতে চাচ্ছেন?” রিপোর্টার জানতে চাইলো।

“মানে আমরা এখন পর্যন্ত যেটা করতে পারি নি সেটা করবো…আমাদের হাতে থাকা পুরো গল্পটি জানাবো পাঠকদেরকে।”

“এটা তো আপনারা আদালতে মামলা চলাকালীন সময়েই করতে পারতেন।

“ঐ সময়ে এটা না করার জন্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। তবে আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অব্যাহত থাকবে।

“এর মানে কি, যে ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যে রায় হয়ে গেছে সেটা আবারো ছাপাবেন?”

“এ বিষয়ে আমি এখন আর কিছু বলবো না।”

“রায় হবার পর আপনি তো মিকাইল ব্লমকোভিস্টকে বরখাস্ত করেছেন।”

“এটা সত্যি নয়। আমাদের প্রেসরিলিজ পড়ে দেখুন। তার একটু বিশ্রামের দরকার আছে। এই বছরের শেষের দিকে আবারো প্রকাশক হিসেবে সে ফিরে আসবে নিজের পদে।”

এরপরই টুকরো একটি রিপোর্টিংয়ে দেখানো হলো ব্লমকোভিস্ট আজ থেকে তার সাজার মেয়াদ খাটতে শুরু করেছে রুলাকার জেলখানায়।

.

এরিকা বার্গারের ইন্টারভিউয়ের সময় সালান্ডার দেখতে পেলো ডার্চ ফ্রোডি তার অফিসের পেছনের দরজা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ভুরু কুচকে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো সে।

.

ঐ সোমবারটায় অন্য কোনো চটকদার খবর ছিলো না বলে ভ্যাঙ্গারের খবরটিই রাত ৯টার সংবাদে চার মিনিট জুড়ে দেখানো হলো। হেডেস্টাডের একটি টিভি স্টুডিও’তে তার একটি ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছিলো, সেটাই প্রচার করা হলো সংবাদে। খবরে বলা হলো প্রায় দু’দশক পর পর্দার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসেছেন এই বিখ্যাত শিল্পপতি। ষাট দশকে প্রধানমন্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে একটি কারখানা উদ্ভোধন করছেন এরকম একটি ছবি আর ফুটেজ দিয়ে তার সংক্ষিপ্ত জীবনীও প্রচার করা হলো। এরপর ক্যামেরা ঘুরলে দেখা গেলো স্টুডিওর সোফায় বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছেন ভ্যাঙ্গার। হলুদ রঙের শার্ট আর সবুজ রঙের টাইয়ের সাথে কালো সুট পরেছেন আজ। বেশ পরিস্কার কণ্ঠে কথা বললেন তিনি। রিপোর্টার তাকে জিজ্ঞেস করলো কি কারণে মিলেনিয়াম-এর অংশীদার হতে আগ্রহী হলেন।

“ম্যাগাজিনটা খুবই চমৎকার একটি পত্রিকা, বিগত অনেক বছর ধরেই আমি এটা নিয়মিত পড়ে আসছি। বর্তমানে এই পত্রিকাটি খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে। অন্যায় আক্রমণের শিকার হয়েছে তারা। এর শত্রুরা সংগঠিতভাবে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একে ধূলোয় মিশিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।

রিপোর্টার অবশ্য এতোটা খোলামেলা বক্তব্য আশা করে নি। তবে সঙ্গে সঙ্গে আন্দাজ করতে পারলো এর পেছনে আরেকটা অকথিত গল্প রয়েছে।

“এই বিজ্ঞাপন বয়কটের পেছনে কারণটা কি?”

“এই ব্যাপারটাই মিলেনিয়াম’কে গভীলভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। তবে আমি পরিস্কার করে বলছি মিলেনিয়াম এ যাত্রায় ভরাডুবির হাত থেকে বেঁচে যাবে।”

“এ কারণেই কি আপনি ম্যাগাজিনটার কিছু অংশ কিনে নিয়েছেন?”

“স্বার্থান্বেষী মহল যদি নিজেদের ক্ষমতার জোরে সত্যি কথা বলতে চায় যারা তাদের কণ্ঠ রোধ করে ফেলে তাহলে সেটা হবে খুবই বাজে একটি ঘটনা।”

ভ্যাঙ্গার এমনভাবে কথা বলছে যেনো মত প্রকাশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমগ্র জীবন কাটিয়ে দিয়েছে সে। রুলাকার জেলে প্রথম রাত কাটানোর সময় ব্লমকোভিস্টও টিভিতে এই অনুষ্ঠানটি দেখে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো। তার সহবন্দীরা কিছু বুঝতে না পেরে তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো কেবল।

সেদিনই রাতের বেলায় জেলের খাটে শুয়ে ব্লমকোভিস্ট ভাবতে লাগলো এরিকা আর ভ্যাঙ্গার ঠিকই বলেছিলো-এই সংবাদটি বেশ ভালোভাবেই মার্কেটিং করা হবে। এখন সে বুঝতে পারছে মিলেনিয়াম সম্পর্কে লোকজনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে শুরু করবে।

পত্রিকাটির প্রতি ভ্যাঙ্গারের সমর্থন আসলে ওয়েনারস্ট্রমের প্রতি এক ধরণের যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। ভবিষ্যতে এই ছয় কর্মচারির পত্রিকাটির সাথে, যার বাজেট ওয়েনারস্ট্রম গ্রুপের একদিনের লাঞ্চমিটিংয়ের সমান, যুদ্ধ করতে নামলে তাদের মাথায় রাখতে হবে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশন তাদের সাথে আছে। এই শিল্পগোষ্ঠী যতোই জৌলুস হারিয়ে থাকুক না কেন এখনও এদের অনেক কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে।

টিভিতে ভ্যাঙ্গারের বক্তব্যটা আসলে যুদ্ধ প্রস্ততি ছাড়া আর কিছু না। ওয়েনারস্ট্রমের জন্য এই যুদ্ধটা হবে খুবই ব্যয়বহুল।

বার্গার অবশ্য খুব সতর্কতার সাথে কথা বলেছে। ব্লমকোভিস্ট যে সাজা পেয়ে বর্তমানে জেলে আছে সেটার সম্পর্কে মুখে কিছু না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের সাবেক প্রকাশক নির্দোষ এবং তাদের কাছে ওয়েনারস্ট্রমের কাহিনীটার আরো অনেক রসদ আছে। মুখে তাকে নির্দোষ না বলেও তাকে পুরোপুরি নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে সে। পত্রিকাটির বিশ্বাসযোগ্যতা যে মোটেও কমে নি সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছে স্পষ্ট করে। আর একজন সৎ সাহসী সাংবাদিকের সাথে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীর বিরোধে জনগনের সহমর্মিতা যে কোন দিকে যাবে সেটা সহজেই অনুমেয়। কারণ লোকজন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুব পছন্দ করে। তবে মিডিয়া এতো সহজে এই গল্প বিশ্বাস না করলেও বার্গার অনেক সমালোচককেই নিবৃত্ত করতে পেরেছে বলা যায়।

এ ঘটনায় যে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হবে তা নয় তবে তারা ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করতে পেরেছে এটুকু অন্তত বলা যায়। ব্লমকোভিস্ট আন্দাজ করতে পারলো ওয়েনারস্ট্রমের জন্য আজকের রাতটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে। তারা কতোটুকু জানে সে বিষয়ে লোকটার কোনো ধারণাই নেই, এমনকি সেটা আন্দাজও করতে পারবে না সে। তবে পরবর্তী চাল দেবার আগে তাকে অনেক ভেবে নিতে হবে, আর সেইসাথে এই বিষয়টাও জেনে নিতে হবে তাকে।

ভ্যাঙ্গার আর নিজের অনুষ্ঠানটি দেখার পর তিক্ত মুখে টিভি আর ভিসিআরটা বন্ধ করে দিলো বার্গার। রাত ২:৪৫ বাজে। ব্লমকোভিস্টকে ফোন করার জন্য অস্থির হয়ে আছে সে। তবে জেলখানায় তার মোবাইল সঙ্গে রাখতে দেবে না বলেই সে মনে করে। অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে দেখে তার স্বামী ঘুমিয়ে আছে। বেশ কিছুটা মদ পান করেছে আজ। এমনিতে সে খুব একটা পান করে না। জানালার পাশে বসে বহু দূরের স্কুরু সাউন্ডের প্রবশেদ্বারের বাতিঘরটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

ভ্যাঙ্গারের সাথে চুক্তি সম্পাদন করতে রাজি হবার পর তারা একান্তে তুমুল বাকবিতণ্ডা করেছে এ নিয়ে। তবে একটা বিষয় নিয়ে এরিকা নিজেও কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে।

“আমি জানি না এখন আমি কী করবো,” ব্লমকোভিস্ট বলেছিলো তখন। “এই লোক আমাকে তার আত্মজীবনী লেখার জন্য ঘোস্ট রাইটার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এখন পর্যন্ত আমি এ কাজে পুরোপুরি স্বাধীন ছিলাম। তার সম্পর্কে কোনো মিথ্যে তথ্য কিংবা কোনো সত্য লুকানোর জন্য সে আমাকে চাপ দিলেই আমি এই কাজটা ছেড়ে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু এখন সে আমাদের মিলেনিয়াম-এর অংশীদার-আর পত্রিকাটি রক্ষা করার একমাত্র ক্ষমতা তারই হাতে। আচমকা আমি এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি যে ইচ্ছে করলেই নিজের নীতিতে অটল থাকতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে।

“তোমার মাথায় কি এরচেয়ে ভালো কোনো আইডিয়া আছে?” জিজ্ঞেস করেছিলো বার্গার। “থাকলে চুক্তিটুক্তি করার আগেই সেটা বলে ফেলো।”

“রিকি, ওয়েনারস্ট্রমের বিরুদ্ধে নিজের ব্যক্তিগত একটি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ভ্যাঙ্গার আমাদেরকে ব্যবহার করছে।

“তাতে কি হয়েছে? ওয়েনারস্ট্রমের বিরুদ্ধে আমাদেরও তো প্রতিশোধ নিতে হবে।”

মুখ ঘুরিয়ে একটা সিগারেট ধরালো ব্লমকোভিস্ট।

বার্গার জামাকাপড় খুলে নগ্ন হয়ে বিছানায় যাবার আগে তাদের মধ্যে এ নিয়ে তর্কবিতর্ক চলেছে। দু’ঘণ্টা পর তার পাশে এসে যখন ব্লমকোভিস্ট শুয়ে পড়ে তখন সে ভান করেছিলো ঘুমিয়ে আছে।

আজ রাতে ডাগেন্স নিটার-এর রিপোর্টারও তাকে একই প্রশ্ন করেছিলো : “মিলেনিয়াম তার নিজস্ব স্বাধীনতা আর নিরপেক্ষতা কিভাবে বজায় রাখতে পারবে?”

“কি বলতে চাচ্ছেন?”

রিপোর্টার বাধ্য হয়ে আরেকবার প্রশ্নটা করলো।

“মিলেনিয়াম-এর একটি অন্যতম লক্ষ্য হলো কর্পোরেট দুনিয়ার দুর্নীতি উন্মোচন করা, এ সম্পর্কে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা। তো ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করতে গেলে এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান কি হবে? তারা কি ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের দুর্নীতিও প্রকাশ করবে?”

অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো বার্গার। এই প্রশ্নটা তার কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিলো।

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন মিলেনিয়াম-এ একজন সুপরিচিত ব্যবসায়ী অংশীদার হবার পর এর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে আসবে?”

“আপনারা এখন ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য তদন্তমূলক রিপোর্ট করতে পারবেন না।”

“এই নিয়মটা কি শুধু মিলেনিয়াম-এর জন্যেই প্রযোজ্য?”

“আপনার কথা বুঝতে পারলাম না?”

“মানে বলতে চাচ্ছি আপনি নিজেও এমন একটি পত্রিকায় কাজ করছেন যার মালিক একটি বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। তার মানে কি আপনাদের পত্রিকার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই? আফটোনব্লাডেট-এর মালিকানা নরওয়ের একটি বড় ইলেক্ট্রনিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের-তার মানে কি ইলেক্ট্রনিক বিষয়ে কোনো রিপোর্ট করার বিশ্বাসযোগ্যতা তাদের নেই? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন সুইডেনের কোনো পত্রপত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেলের পেছনে বড় কোনো ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান নেই?”

“না, আমি সেটা বলতে চাচ্ছি না।”

“তাহলে আমাদের বেলায় কেন এটা বলবেন?” রিপোর্টার হাত তুলে ক্ষান্ত দিলো।

“ঠিক আছে, আমি প্রশ্নটা ফিরিয়ে নিচ্ছি।”

“না। এটা করবেন না। আমি চাই যা যা বলেছি সবই যেনো ছাপা হয়। আপনি আরো যোগ করতে পারেন, ডিএন যদি ভ্যাঙ্গার গ্রুপের উপর একটু বেশি ফোকাস করে তবে আমরাও বনিয়ের গ্রুপের উপর একটু বেশি নজর রাখবো।

কিন্তু এটা নৈতিকতার একটি সমস্যা।

ব্লমকোভিস্ট এখন হেনরিক ভ্যাঙ্গারের হয়ে কাজ করছে, আর এদিকে মি: ভ্যাঙ্গার এমন একটি পজিশনে চলে এসেছে যেখানে ইচ্ছে করলে এক কলমের খোঁচায় মিলেনিয়ামকে ডুবিয়ে দিতে পারে সে। ব্লমকোভিস্ট আর ভ্যাঙ্গার যদি একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হয় তখন কি হবে?

তারচেয়ে বড় কথা-এরিকা নিজের বিশ্বাসযোগ্যতার মূল্য বজায় রাখবে কি করে, কখন সে স্বাধীন আর সৎ এডিটর থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত একজন এডিটরে পরিণত হয়ে উঠবে।

*

সালান্ডার তার ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলো। কোনো কাজ নেই তার হাতে, আর খুব খিদেও পেয়েছে। প্রথমটি নিয়ে সে চিন্তিত নয়। কারণ নিজের ব্যাঙ্ক একাউন্টে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন তার হাতে। কফিমেকারটা চালু ক’রে দিয়ে বড় বড় তিনটি স্যান্ডউইচ বানিয়ে ফেললো সে। লিভিংরুমের সোফায় বসে খেতে খেতে জোগার করা তথ্যগুলো নিয়ে কাজ করতে শুরু করলো সালান্ডার।

হেডেস্টাডের উকিল ফ্রোডি তাকে ব্লমকোভিস্টের উপর তদন্ত করার জন্য ভাড়া করেছিলো। কয়েক সপ্তাহ পর সেই হেডেস্টাডেরই হেনরিক ভ্যাঙ্গার ব্লমকোভিস্টের পত্রিকায় অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হলো ঘটা করে, সেইসাথে জানিয়ে দিলো ম্যাগাজিনটি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ঠিক একই দিনে পত্রিকাটির সাবেক প্রকাশক নিজের সাজার মেয়াদ খাটার জন্য জেলে ঢুকলেন। সব থেকে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো : এরিক ওয়েনারস্ট্রমের সম্পর্কে লেখা ‘খালি হাতে শুরু করে’ নামের দু’বছরের পুরনো একটি ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিকেল। ইন্টারনেটে মনোপলি ফিনান্সিয়াল ম্যাগাজিন নামের একটি নেটম্যাগাজিন থেকে এটা সে পড়েছে। মনে হয় ষাটের দশকে লোকটার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিলো ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের সাথেই।

এই সবগুলো ঘটনার সাথে যে একটা সম্পর্ক রয়েছে সেটা বোঝার জন্য কারোর রকেট সাইন্টিস্ট হবার দরকার নেই। তাদের এইসব কাপবোর্ডে একটা না একটা কঙ্কাল আছে, সালান্ডার আবার কঙ্কাল খুঁজতে খুব ভালোবাসে। তাছাড়া এ মুহূর্তে তার হাতে কোনো কাজও নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *