২.০৪ ২৬শে মার্চ থেকে ৮ই এপ্রিল

৪. ২৬শে মার্চ থেকে ৮ই এপ্রিল

আমেদে ফ্লঁরেস যেমন লিখেছেন তাঁর নোটবইতে, হ্যারি কিলারের সঙ্গে ওই চমকপ্রদ সাক্ষাৎকারের পর ছ-জন কয়েদি খুবই বিপন্ন ও বিচলিত বোধ করেছেন, ক্ষুদ্ধ এবং ক্রুদ্ধও। ঐ দুজন হতভাগ্য আফ্রিকির মৃত্যু এবং তদুপরি দৃশ্যটির ভয়াবহ পরিসমাপ্তি তাঁদের একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। এ-রকম কোনো লোক জন্মায় কী ক’রে, যারা এমনই নৃশংস যে অকারণেই মৃত্যু ছড়িয়ে দিয়ে এমন জঘন্য আমোদ পায়? শুধু তুচ্ছ-একটা খেয়াল চরিতার্থ করবার জন্যে, শুধু তার জঘন্য ক্ষমতাকে দেখাবার জন্যেই সে কিনা খামকা এই দুজন মানুষকে মের ফেললো!

তৎসত্ত্বেও তাঁদের জন্যে বেশ পছন্দসই বিস্ময়ই অপেক্ষা করছিলো। হ্যারি তাঁদের একমাস সময় দিয়েছে সব ভেবে দেখবার জন্যে, কিন্তু তাঁদের মনোভাব প্রসন্ন ক’রে তোলবার জন্যে ভেবেছে তাঁদের একটু আরামে রাখলেই তাঁরা খুশি হ’য়ে যাবেন। কারণ যা-ই থাক না কেন, তাঁদের কুঠুরির দরজায় আর তালা পড়েনি, ইচ্ছেমতো গ্যালারিটায় ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তাঁদের। আর গ্যালারিটা হ’য়ে উঠেছে তাঁদের কমনরুম, সকলের মেলবার জায়গা, যেখানে গিয়ে যতবারখুশি পরস্পরের সঙ্গে দেখা করা যায়।

গ্যালারির একপ্রান্ত থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে সরাসরি তার ওপরতলায়! সেখানকার বুরুজের ওপর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ওঠবারও স্বাধীনতা আছে তাঁদের। উষ্ণ মণ্ডলের এই প্রচণ্ড রোদ্দুরের জন্যে ভরদুপুরে সেখানে গিয়ে পায়চারি করার ইচ্ছে অবশ্য কারুই ছিলো না, কিন্তু সন্ধেবেলায় রোদ্দুর প’ড়ে গেলে সেখানে গিয়ে খোলা হাওয়ায় কাটাতে বেশ ভালোই লাগে তাঁদের–সন্ধের পর যতক্ষণ-ইচ্ছে থাকা যায় সেখানে, তা নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করে না।

এমন-অবস্থায় দৈনন্দিন জীবনযাপন তেমন জ্বালায় না : স্বাধীনতা নেই, ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত—এরই মধ্যে, তবু, যতদূর সম্ভব খুশি থেকেছেন তাঁরা। তাঁদের যাঁর যাঁর কুঠুরি, গ্যালারি, আর এই অলিন্দ প্রায় একটা সত্যিকার স্বয়ংসম্পূর্ণ অ্যাপার্টমেন্টের মতো, শুধু গ্যালারির ওপাশের দরজাটা সবসময়েই বন্ধ থাকে ব’লে বাস্তব খোঁচা লাগায় মনে, কারণ এই বন্ধ দরজার ওপাশেই আছে তাঁদের পাহারা, সশস্ত্র শাস্ত্রীর দল। তাদের কথাবার্তার আওয়াজ তাদের অস্ত্রশস্ত্রের ধুমধাড়াক্কা ঝনঝন আওয়াজ বারে-বারেই তাঁদের মনে করিয়ে দেয় এ-দরজা পেরুনো চলবে না।

ঘরকন্নার কাজের দায়িত্বে আছে ৎশুমুকি, আর তার ফুর্তি আর উৎসাহের কোনো কমতি নেই। তবু যখন খাবারদাবার নিয়ে আসে, শুধু তখনই তাকে চোখে দেখা যায়। কিংবা যখন সে তাদের ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে সাফ করে, বিছানায় চাদর পালটায়, সবকিছু ঝাড়পৌঁছ করে, তখনও। একদিক থেকে ভালোই : তাকে দেখলেই মেজাজটা কেমন বিগড়ে যায়। এই হতভাগাই, অন্তত আংশিকভাবে, তাঁদের এই দশার জন্যে দায়ী।

দিনের বেলায় একে-অন্যের সঙ্গে দেখা ক’রেই কাটে, কিংবা গ্যালারিটায় পায়চারি ক’রে। তারপর সূর্যাস্তের সময় তাঁরা উঠে আসেন অলিন্দে, প্ল্যাটফর্মে, যেখানে ৎশুমুকি মাঝে-মাঝে এমনকী তাঁদের রাতের খাবারও নিয়ে আসে।

চৌকো, প্রায় বর্গক্ষেত্রের মতোই বুরুজটা, যেখানটায় বেশ খানিকটা সময় তাঁরা আড্ডা দিয়ে কাটান। রাজভবনের পশ্চিম কোণটায় এই বুরুজের দুই পাশ চওড়া অলিন্দটাকে প্রায় যেন দখল ক’রেই নিয়েছে। ভেতরে বসানো ‘কতগুলো চত্বর এটাকে ছোটো-ছোটো খোপের মতো নানা টুকরোয় ভাগ ক’রে রেখেছে। এগুলো পেরিয়েই তাঁদের যেতে হয়েছিলো মাঝখানটার ঐ মিনারটায় যাবার জন্যে-সেই যেখানে সাইক্লোস্কোপ আছে। এর দুই বাইরের মুখের মধ্যে একটা প্রায় এপ্ল্যানেডের ওপর উঠেছে-এই এপ্ল্যানেডের একপাশে রাজভবন, অন্যপাশে কারখানা, আর রাঙানদীর কাছে একটা মস্ত দেয়াল সেটাকে আরেকটা দিকে আটকে দিয়েছে—অন্য মুখটা এই রাঙানদীর দেয়ালটার দিকেই এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে আছে— নদীর ওপারে, উঁচুতে, প্রায় নব্বুই ফিট।

অতএব এখান থেকে পালাবার আশাটা তাঁদের আক্ষরিকভাবেই জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। তাছাড়া সাইক্লোস্কোপের পাহারার নমুনাটা কেমন, সেটা তো হ্যারি কিলার সেদিন তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বুরুজ থেকে অলিন্দে গিয়েও তাঁদের কোনো লাভ হ’তো না-যদি কৌশুলি, হর্ষচরিত এবং ব্ল্যাকগার্ডদের চোখে ধুলো দিয়ে সেখানে যাওয়াও যেতো; অবশ্য সেটা সম্ভব হ’তো না—কারণ এই তিনদল লোক অনবরত সেখান দিয়ে যাতায়াত করছে। আর এপ্ল্যানেডের চারপাশেও তো দেয়াল-অনধিগম্য, পরাক্রান্ত, উচ্চশির—সেখান দিয়ে পালাবার চেষ্টা ক’রেও কোনো লাভ নেই। একমাত্র আশা জোগাতে পারে রাঙানদী, কিন্তু বন্দীদের কাছে কোনো ডিঙি নৌকো অব্দি নেই, আর নব্বুই ফিট উঁচু থেকে ঐ নদীতে তাঁরা নামবেনই বা কী ক’রে?

প্ল্যাটফর্মটার ওপর থেকে তাকিয়ে দেখেছেন তাঁরা রাঙানদীকে। ভাঁটিতে, বা উজানে—দু-দিকেই নদীটা দিয়ে ঘন গাছপালার আড়ালে ঢাকা প’ড়ে গেছে—মাত্র দশ বছর আগেই নাকি রোয়া হয়েছে গাছগুলো, অথচ কেমন ফনফন ক’রে বেড়ে উঠেছে এর মধ্যেই! শুধু জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত বাগানটা বাদে-রাজভবনের দেয়াল সেটাকে আড়াল ক’রে রেখেছে- গোটা ব্ল্যাকল্যাণ্ডই ছড়িয়ে আছে তাঁদের চোখের সামনে। এখান থেকে তিনটে অংশকেই দেখা যায়, উঁচু-উঁচু দেয়াল দিয়ে পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা করা : উপবৃত্তাকার সব রাস্তা, একই কেন্দ্রে গিয়ে শেষ হয়েছে; পশ্চিমের সব ঘরবাড়ি, পুবের সব ঘরবাড়ি-এ-দু জায়গায় গোরাদের সংখ্যা খুবই কম, তাদের বেশি দেখা যায় কেন্দ্রে, পালে পালে, ভোরবেলায়, বিশাল- এক জনতা—তারপর তারা যে-যার কাজে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

তাঁদের দৃষ্টি পৌঁছে যায় কারখানাতেও, কিন্তু দূর থেকে যতটুকু দেখা যায়, তা থেকে এই দ্বিতীয় শহরটা সম্বন্ধে কোনো আন্দাজই করা যায় না। একটা শহরের মধ্যে আরেকটা শহর—প্রথমটার মধ্যেই দ্বিতীয়টা—কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে যেন এদের কোনো যোগাযোগই নেই।

কী বানায় এই কারখানা, যার ওপরে বিশাল-উঁচুতে গেছে একটা চোঙ, যে- চোঙ থেকে একবারও কোনো ধোঁয়া ওঠে না, তারপর রাজভবনের মতোই একটা মিনার আছে কারখানারও, তারপর প্রায় আরো-একশো গজ উঁচুতে ঐ মিনার থেকেই উঠে গেছে একটা খুঁটি-প্রথমবার এখানে নেমেই এই দুর্বোধ খুঁটিটা চোখে পড়েছিলো আমেদে ফ্লরেঁসের। কী মানে হয় ঐ সব বিশাল-বিশাল অট্টলিকার, রাঙানদীর পাশেই যারা উঠে গেছে, যাদের অনেকগুলো চাপড়া-চাপড়া ঘাস দিয়ে ঢাকা। সবচেয়ে-বড়ো যেটা তার মধ্যে মাছে হাটবাজার আর ফলবাগান—কিন্তু অন্যগুলো কেন আছে? আর ঐ ওপরে ওটার ওপর ধাতুর পাত আটকানো কেন? আর কেনই বা তার নিচে, ঐ চওড়া আর গভীর ট্রেন্‌চ? আর বাস্তবিকই, ঐ দেয়ালটাই বা কেন—কারণ এর একদিক যায়নি রাঙানদীর দিকে, অন্যদিকটা যায়নি এপ্ল্যানেডের দিকে—যার পর শুরু হয়েছে উন্মুক্ত জমির বিস্তার? কেউ নিশ্চয়ই এই ছোট্ট শহরটার নিজের প্রতিরোধব্যবস্থাকে জোরালো করতে চেয়েছিলো বাইরের পৃথিবীর সব যোগাযোগ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দিতে চেয়েছিলো। পুরো জিনিশটাই ভারি দুর্বোধ্য, কেমন যেন প্রহেলিকাই একটা।

শুমুকিকে জিগেস ক’রে ঐ দ্বিতীয় শহরটার কোনো নাম জানা যায়নি – সে তার কোনো নাম নাকি শোনেনি। ‘কাজের বাড়ি,’ শুধু এই কথাটাই সে বলেছে, কেমন ভয়ে-ভয়ে, যেন এর সঙ্গে কোনো আতঙ্ক আর কুসংস্কার জড়িয়ে আছে। তাছাড়া, হ্যারি কিলারের শেষতম রংরুট হিশেবে, সে কিছুই খুব-একটা বোঝে না, আর কেন যে ঐ আতঙ্ক তার, তাও সে স্পষ্ট ক’রে গুছিয়ে বলতে পারেনি :

হয়তো আতঙ্কই এই শহর সম্বন্ধে সকলকে এমন গুটিয়ে রেখেছে। নিশ্চয়ই রাজভবনের মুখোমুখি যে-দেয়ালটা উঠে গেছে, তার আড়ালে অন্য-কোনো শক্তি লুকিয়ে আছে। কিন্তু কী তার প্রকৃতি, এই শক্তির। কোনোদিন কি তাঁরা এই দুর্বোধ্য ধাঁধাটার মীমাংসা করতে পারবেন? আর, তারপর, সেই শক্তিকে লাগিয়ে দিতে পারবেন নিজেদেরই কাজে?

জেন রেজনের স্বাধীনতা সকলের চাইতে বেশি। হ্যারি কিলারের হুকুমে ৎশুমুকি তাকে জানিয়েছে যে সে ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি যেতে পারবে, কেউ তাকে বাধা দেবে না, আর তার নিরাপত্তারও কোনো ভয় নেই-না রাজভবনে, না-বা এপ্ল্যানেডে। তাকে শুধু মানা ক’রে দেয়া হয়েছে রাঙানদী পেরিয়ে সে যেন কোথাও না-যায়, আর তা সে যেতোও না কখনও, কারণ কাল ব্রিজের ওপর চব্বিশ ঘণ্টাই থাকে মেরিফেলোদের কড়া পাহারা।

বলাই বাহুল্য, জেন অবশ্য কিছুতেই এই বাড়তি স্বাধীনতার সুবিধেটুকু নেয়নি। যা ঘটে ঘটুক, সে তার দুঃসময়ের সাথীদের সঙ্গেই থাকবে সবসময়। সেও তাদেরই মতো, আরো-একজন বন্দিনী, এটা অবশ্য ৎশুমুকিকে প্রচণ্ড অবাক ক’রে দিয়েছে। তার ভূতপূর্ব মালকিনের চোখের সামনে সে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছে কতটা শানদার তার এই সৌভাগ্য।

‘আপনি কয়েদখানায় থাকবার উপযুক্ত নন,’ ভাঙা-ভাঙা কথায় সে জানিয়েছে জেন ব্লেজনকে। ‘আপনি যখন সর্বেসর্বাকে বিয়ে করবেন, দারুণ হবে। তিনি আপনাকে কত তুবাব দেবেন।’

কিন্তু জেন ব্রেজন ৎশুমুকির কোনো কথা কানেই নেয়নি।

যখন গ্যালারিতে বা বুরুজে পরস্পরের সঙ্গে আড্ডা দেন না, তখন বন্দীরা যে যাঁর রুচিমতোই সময় কাটান।

বারজাকের একটু আত্মম্ভরিতাই দেখা গিয়েছে : ভাবখানা, কেমন কড়কে দিয়েছি হ্যারি কিলারকে। তাতে সবাই তাঁকে যেভাবে তারিফ করেছেন, তাতে দেমাকে তিনি বেশ ফুলেই উঠেছেন : মনে-মনে ঠিক করেছেন, আরো-প্রশংসা পেতে হবে তাঁকে, তাই ফলাফল যা হয় হোক, তিনি হ্যারি কিলারের কাছে ককখনো মাথা নোয়াবেন না। সমস্ত অনুভূতিই তাঁর ভেতর থেকে বাগাড়ম্বর ও জমকালো বক্তৃতা হিশেবে বেরিয়ে আসে। আর সেই থেকে তিনি মহড়া দিয়ে চলেছেন, কেমন ক’রে এই স্বৈরাচারীকে প্রথম সুযোগেই তিনি দু-চারটে মনের কথা শুনিয়ে দেবেন। কেবলই পালিশ করেছেন তিনি তাঁর শানদার বুলি, অনবরত পরিমার্জনায় চমৎকার জেল্লা খুলেছে তাদের : আরেকবার আসুন না সে, তার অসাধু প্রস্তাব নিয়ে, তারপর তিনি দেখিয়ে দেবেন কাকে বলে ভাষার কেরামতি।

সাঁৎ-বের‍্যাঁ সেরে উঠতেই ডাক্তার শাতোনের চাকরি গেছে : দেখাশুনো করবার মতো আর-কোনো রুগিই তাঁর নেই। আর সাঁৎ-বেরাও মহাফাপরে পড়েছেন – তাঁর মাছ ধরার নেশার কী হবে, এখানে? দুজনেই তাই তাঁদের বেশির ভাগ সময় কাটান জেন ব্লেজনের সঙ্গে আর তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন। গ্লেনর কালের বন্দী, নিঃসঙ্গ বাবার কথা মনে পড়লেই জেল ব্লেজন ভারি ব্যাকুল হ’য়ে ওঠে, যদিও তার মনে হয় এখন সে ফিরে যেতে পারলে তার বাবার ঐ সান্ত্বনাহীন হতাশা অনেকটাই ঘোচাতে পারবে। কেমন ক’রে সে গিয়ে বাবাকে জানাবে যে জর্জ ব্লেজন নির্দোষ ছিলো—সে তার স্বদেশের সঙ্গে বেইমানি করেনি। অকাট্য কোনো প্রমাণ অবশ্য এখনও হাতে পায়নি, তবে যতটুকু প্রমাণ পাওয়া গেছে, পেছন থেকে ছুরি খেয়ে মরার ঐ ঘটনাই প্রমাণ ক’রে দেবে, সম্ভবত সে কোনো দোষ করেনি।

আমেদে ফ্লরেঁস তাঁর সময়ের অনেকটাই কাটান তাঁর নোটবইয়ের লেখাগুলো ঘষামাজা ক’রে। একদিনও বাদ যায় না যেদিন তিনি তাঁর পেশাদার দায়িত্বটা পালন করেন না। যদি কোনোদিন আবার তিনি ইওরোপের মাটিতে পা দিতে পারেন, তাহ’লে ভেতরকার সব খুঁটিনাটি সমেতই বারজাক মিশনের কথা সবাই জেনে যাবে।

আর মঁসিয় পঁসাঁ—তিনি কিছু বলেনও না-শুধু তাঁর ঐ মোটাখাতায় মাঝে- মাঝে কী-সব যেন টুকে রাখেন, সব নাকি পরিসংখ্যান-আর অবসর কাটান অদ্ভুত সব ত্রৈরাশিকের অঙ্ক ক’যে-একেকটা এমন-সব জটিল ত্রৈরাশিক যে অদীক্ষিতের কাছে তা মনে হ’তে পারতো চৈনিক হেঁয়ালির মতোই দুর্বোধ্য।

কিন্তু একসঙ্গে যখন আড্ডা দেন বন্দীরা, তখন তাঁদের আলোচনার বিষয় ঘুরে ফিরে একটাই বুড়ি ছুঁয়ে যায়। নিজেদের অবস্থা নিয়ে মাথা তো ঘামানই, কিন্তু হ্যারি কিলার সম্বন্ধে তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা থেকে তাঁরা একফোঁটাও নড়তে পারেন না : প্রথম দর্শনেই হ্যারি কিলার তাঁদের ওপর যে-ছাপ ফেলেছিলো, সময় তা মোটেই হ্রাস করতে পারেনি।

‘আচ্ছা, লোকটা কে হ’তে পারে?’ জিগেস করেছেন মঁসিয় বারজাক।

ইংরেজ,’ জেন ব্লেজন বলেছে, ‘ওর উচ্চারণ শুনেই বোঝা যায় ও ইংরেজ।’

ইংরেজ বটে, না-হয় মেনেই নিলুম,’ মঁসিয় বারজাক বলেছেন, ‘কিন্তু তাতেই খুব কিছু জানা হয় না। এটা ঠিক যে, এ কোনো সাধারণ লোক নয়। একটা শহর গড়েছে সে নিজের হাতে, মরুভূমিটাকে রূপান্তরিত ক’রে দিয়েছে উর্বর জমিতে, শতাব্দীর পর শতাব্দী যেখানে কোনো জল ছিলো না সেখানে সে জল এনে দিয়েছে-আর সব কি না মাত্রই দশ বছরের মধ্যে! তাতেই বোঝা যায় কোনো- এক দুর্দান্ত প্রতিভা তার বিশাল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানবুদ্ধিকে কাজে খাটাচ্ছে। এটা কি সম্ভব যে এই স্বৈরাচারের এমন আশ্চর্য প্রতিভা আছে?’

আমার কাছে ব্যাপারটা আরো জটপাকানো মনে হয়,’ আমেদে ফ্লরেঁস বলেছেন, আমার মনে হয় হ্যারি কিলার বদ্ধপাগল।’

‘বদ্ধপাগল নয়, অর্ধোম্মাদ,’ তাঁকে শুধরে দিয়েছেন ডাক্তার শাতোনে, তবে সে একজন অর্ধোম্মাদ মোদোমাতাল-আর সেটাই ব্যাপারটাকে ভয়াবহ ক’রে তুলেছে।’

‘এই দুই সদগুণ একসঙ্গে আছে বলেই,’ আমেদে ফ্লঁরেস বলেছেন, ‘ইনি একেবারে ধ্রুপদী জাতের স্বৈরাচারী-প্রবৃত্তির দাস, ভাগ্য যাকে অসীম ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু যে তার অপচয় করেছে বখাটে, ডেঁপো ছোঁড়ার মতো। একটুও বিরোধিতা সহ্য করতে পারে না ব’লেই কোনোকিছু মাঝামাঝি নেই তার কাছে—দপ ক’রে জ্ব’লে ওঠে, দব ক’রে নিভে যায়, আর মানুষের প্রাণ সম্বন্ধে তার অপরিসীম তাচ্ছিল্য-সে-সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা তার নেই!’

‘আফ্রিকায় এমনতর জীবের কোনো অভাব নেই,’ ডাক্তার শাতোনে একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন, ‘আফ্রিকায় যারা আসে, তারা এইজন্যেই আসে যে ইওরোপে তারা বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি, তাছাড়া নিগ্রোদের তো তারা মানুষ ব’লেই মনে করে না। ফলে, তাদের মতে, তাদের সারাক্ষণ নিকৃষ্ট লোকদের মধ্যেই থাকতে হয় –আর তাতে নিজের দম্ভও বেড়ে যায়, যা-খুশি তা-ই হুকুম করা যায় এদের, আর ইওরোপের লোকেরা দু-হাতে পয়সা কামায়, লাটসাহেবি করে; চরিত্রের দৃঢ়তাও নেই এদের, কোনো আদর্শেরও বালাই নেই—ফলে নিজেদের একেকজন কেউকেটা ভাবতে শুরু ক’রে দেয় এরা। উপনিবেশগুলোর একটা মস্ত ব্যাধিই হ’লো স্বৈরাচার-যেহেতু কৈফিয়ৎ চাইবার কেউ নেই। হ্যারি কিলার শুধু এদেরই মধ্যে একটু বাড়াবাড়ি ক’রে ফেলেছে—অন্য গোরাদেরও সে এতটা নিকৃষ্ট ভাবে যে কাউকে কোনো পরোয়াই করে না।’

‘আমি কিন্তু আবারও বলছি, লোকটা ডাহাউন্মাদ,’ আমেদে ফ্লঁরেস আলোচনায় ইতি টেনে দিয়েছেন, ‘আর উন্মাদকে কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের কথা সে বেমালুম ভুলেই গিয়েছে-অথচ পাঁচমনিট পরেই সে যে আমাদের সব্বাইকে খুন ক’রে ফেলবার হুকুম দিতে পারে, এ-সম্ভাবনাটাও আমি উড়িয়ে দিতে পারি না।’

৩রা এপ্রিল অব্দি অবশ্য নতুন-কিছুই ঘটেনি, এবং আমেদে ফ্লরেঁসের আশাবিহীন অনুমানটাও ফ’লে যায়নি। ৩রা এপ্রিল কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দুটি ঘটনা ঘটেছে। বেলা তিনটে নাগাদ বন্দীরা মলিককে এসে হাজির হ’তে দেখে যেমন অবাক হয়েছেন, তেমনি খুশিও হয়ে উঠেছেন। জেন ব্লেজনকে দেখেই সে ছুটে এসে তার মালকিনের হাত চেপে ধ’রে কৃতজ্ঞতার বশে চুমু খেয়েছে—জেন ব্লেজন ও তাকে দেখে খুবই নাড়া খেয়ে গেছে।

জানা গেছে, অন্য বন্দীদের মতো হেলিবিমানে ক’রে আনার বদলে, এই আফ্রিকি বালিকা এসেছে, আরো চোদ্দজন লোক ও রক্ষিদলের সেই দুই গোরা সার্জেন্টের সঙ্গে, মরুভূমি পেরিয়ে, পথে থেমে বিশ্রাম করতে-করতে। তার সঙ্গে বিশেষ ভালো ব্যবহারও করেনি কেউ—কিন্তু দুর্ব্যবহারের ধরনটা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্নই করেননি। এই প্রশ্নও করেননি, তোঙ্গানের কোনো খবর সে রাখে কি না। তার দুঃখ থেকে মনে হয়েছে তোঙ্গানের ভাগ্যে কী হয়েছে তা বোধহয় সে কিছুই জানে না।

মলিক আসার দু-ঘণ্টা পরে ঘটেছে দ্বিতীয় ঘটনাটা—সম্পূর্ণ অন্যরকম। তখন আন্দাজ পাঁচটা হবে, ৎশুমুকি ছুটে এসেছে গ্যালারিতে। ভীষণ উত্তেজিতভাবে হাঁফাতে-হাঁফাতে সে বলেছে হ্যারি কিলার তাকে হুকুম করেছে মাদমোয়াজেল মোর্‌নাসকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে যেতে-প্রভু তাকে এখনই হবু-পত্নী ব’লে গণ্য করতে শুরু করেছে।

বন্দীরা সবাই একবাক্যে প্রস্তাবটা উপেক্ষা করেছেন—উপেক্ষাই শুধু নয়, উড়িয়েই দিয়েছেন প্রায়। ৎশুমুকি বহুবার অনুনয় করেছে, কিন্তু কোনো ফল হয়নি, শেষটায় বাধ্য হ’য়ে তাকে ফিরে যেতে হয়েছে। সে চ’লে যাবার পর তাঁরা হ্যারি কিলারের এই অদ্ভুত আমন্ত্রণ নিয়ে উত্তেজিতভাবে নানান আলোচনা করেছেন। এই একটা বিষয়ে আর-কোনো দ্বিমত নেই—তাঁদের সঙ্গিনীকে কোনো অছিলাতেই তাঁদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হ’তে দেয়া চলবে না।

‘আপনাদের সবাইকে আমার ধন্যবাদ জানাই,’ জেন ব্লেজন তাঁদের বলেছে, ‘যেভাবে আমাকে আপনারা চারপাশ থেকে ঘিরে ধ’রে বাঁচিয়েছেন তার জন্যে আমার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। তবে এটা ভাববেন না যে জানোয়ারটার সঙ্গে একা দেখা হলে আমি আত্মরক্ষা করতে পারবো না-সে তো আর অমর অজর অভেদ্য নয়। এরা যদিও আপনাদের খুব-সাবধানে খানাতল্লাশ করেছে, কিন্তু মেয়ে ব’লে আমাকে খানাতল্লাশ করবার কথা ভাবেনি–এবং এই অস্ত্রটা আমার কাছে আছে এখনও।’ ব’লে, জেন তাদের দেখিয়েছে সেই খঞ্জরটা, যেটা সে তার দাদার কবরে পেয়েছিলো, এবং এখন যেটা সে তার জামাকাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। আরো বলেছে, ‘এটা ঠিক জানবেন, দরকার হ’লে এটা কেমন ক’রে ব্যবহার করতে হয়, তা আমি জানি।

সবে জেন ফের খঞ্জরটা তার জামাকাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, অমনি আবার ৎশুমুকি এসে হাজির, ভয়ে সে ঠকঠক ক’রে কাঁপছে। মাদমোয়াজেল মোরনাসের উত্তর শুনে হ্যারি কিলার নাকি রোষে ক্ষিপ্ত হ’য়ে উঠেছে, এক্ষুনি তাকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে যাবার জন্যে হুকুম দিয়েছে। সে যদি ফের এই প্রস্তাব উপেক্ষা করে, তাহ’লে নাকি ছ-জন বন্দীকেই এক্ষুনি ফাঁসিতে লটকে দেয়া হবে।

এখন আর দ্বিধার কোনো সময় নেই, তার সঙ্গীদের সে অযথা এই বিপদের মধ্যে এনে ফেলেছে ব’লে তাঁদের সব আপত্তি সত্ত্বেও যেতে রাজি হয়েছে। তাঁরা এমনকী জোর ক’রেই তাকে আটকে রাখবার চেষ্টা করেছেন। অমনি ৎশুমুকি চীৎকার ক’রে কী বলেছে, আর তৎক্ষণাৎ জনা-বারো শাস্ত্রী ঘুরে ঢুকে তাঁদের পিঠমোড়া ক’রে আটকে রেখেছে-আর সেই ফাঁকে জেন ব্লেজন ৎশুমুকির সঙ্গে চ’লে গিয়েছে।

সে-রাতে সে আটটার আগে ফেরেনি। তিনঘণ্টার এই অদর্শনে সবাই কেমন মুষড়ে পড়েছিলেন, সাঁৎ-বেরা তো কাঁদতেই শুরু ক’রে দিয়েছিলেন–তাঁরই কষ্টটা স্বভাবতই সবচেয়ে-বেশি ছিলো। তাকে ফিরতে দেখেই সবাই একসঙ্গে ব’লে উঠেছেন : ‘তো?’

‘তো, সব চুকে গেছে আপাতত,’ জেন ব্লেজন তখনও থরথর ক’রে কাঁপছিলো।

‘আপনাকে ওভাবে হঠাৎ ডেকে পাঠিয়েছিলো কেন?’

‘এমনি। তার খেয়াল। আমাকে নাকি একবার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলো। গিয়ে দেখি সে ততক্ষণে ঢকঢক ক’রে মদ গিলতে শুরু করেছে—সেটাই নাকি তার দস্তুর, ততক্ষণে প্রায় আদ্ধেক মাতাল সে। আমাকে সে বসতে বললে, আর তার নিজস্ব ধরনে আমার তারিফ ক’রে বললে, আমাকে নাকি তার ভারি মনে ধরেছে, আমার মতো বউই সে চেয়েছে চিরকাল। তারপর শুরু ক’রেছে তার ক্ষমতার গুণকীর্তন, আর কত ধনদৌলৎ তার আছে তা নিয়েও জাঁক দেখাতে সে ভালেনি। তাকে বিয়ে করলে এ-সবই নাকি আমার হবে।

‘আমি চুপচাপ তার সব হাম্বড়া বাকতাল্লা শুনে নিয়েছি, তারপর বলেছি সে তো আমাদের একমাস সময় দিয়েছে সব দিক বিবেচনা ক’রে দেখতে, সে-একমাস তো এখনও উৎরোয়নি, সবে তো একটা সপ্তাহই মাত্র কেটেছে। শুনে আশ্চর্য লাগতে পারে বটে, সে কিন্তু তাতে মোটেই চ’টে যায়নি, আমার বরং মনে হয় এই পাগলটার ওপর আমার হয়তো বেশ প্রভাব আছে। সঙ্গে-সঙ্গে সে রাজি হ’য়ে গিয়ে বলেছে, হ্যাঁ, আমাদের মনস্থির ক’রে নেবার জন্যে একমাস সময়ই দেবে, তবে একটা শর্তে : প্রত্যেকটা বিকেল আমায় গিয়ে তার সঙ্গে কাটাতে হবে…’

‘তাহ’লে তোকে আবার সেখানে যেতে হবে একা-একা?’ কেমন ক্ষুদ্ধ স্বরে ব’লে উঠেছেন সাঁৎ-বেরা।

‘হ্যাঁ, যেতে হবে, আর সেটা খুব জরুরি, জেন ব্লেজন উত্তর দিয়েছে, ‘তবে আমার মনে হয় না তাতে আমায় খুব-একটা ঝুঁকি নিতে হবে—যদি এই প্রথম বিকেলটা থেকে কিছু বোঝা যায়, সাতটার আগেই সে বেহেড মাতাল হয়ে গেছে, আর আমার কাজ হয়েছে স্রেফ তার পাইপটা ধরিয়ে দেয়ার আর গেলাশটা ফাঁকা হ’লেই সেটা আবার ভ’রে দেয়া-যতক্ষণ-না জানোয়ারটা নাক ডাকতে শুরু ক’রে দিয়েছে। আর তখনই আমি আপনাদের কাছে ফিরে এসেছি।’

তারপর থেকে, সত্যিই, রোজই তাকে যেতে হয়েছে হ্যারি কিলার সকাশে, রোজই বেলা তিনটে নাগাদ হ্যারি কিলারের এত্তেলা এসেছে আর তাকে গিয়ে রাত আটটা অব্দি তার সঙ্গে থাকতে হয়েছে। রোজ তার বুলেটিন অনুযায়ী, চুক্তিটা বেশ-শান্তিপূর্ণভাবেই বহাল আছে। রোজই বিকেলগুলো তাকে একইভাবে কাটাতে হয়। গিয়ে প্রথমে দেখতে পায় তার কৌশুলিদের সঙ্গে সে আলোচনাসভায় ব’সে আছে, আর তাদের যে-সব হুকুম-টুকুম দিয়েছে তাতে তার প্রখর বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় পাওয়া গেছে। তার সে-সব নির্দেশে নতুন-কোনো বৈশিষ্ট্যই থাকে না–সে-সব শুধু শহরের শাসনকাজ সম্বন্ধে-আর খেতে-খামারে যা কাজ হচ্ছে তার একটা খতিয়ান নেয়াও সেই পরামর্শসভার কাজ। বাস্তবিক, ব্ল্যাকল্যান্ড সরকারের শাসনকাজের সঙ্গে কোনো রহস্যই জড়ানো থাকতো না, যদি-না মাঝে-মাঝে সে ঝুঁকে প’ড়ে তার কোনো কৌশুলির কানে-কানে ফিশফিশ করে নানারকম নির্দেশ দিতো, হয়তো একান্ত-গোপনীয় কোনো খবর—জেন যার সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারেনি।

পরামর্শসভা সবসময় কাঁটায় কাঁটায় চার ঘণ্টা ধ’রে চলতো। তারপর সবাই একে-একে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো, ঘরে থাকতো শুদু জেন ব্লেজন আর হ্যারি কিলার। কিন্তু সেও শিগগিরই কিছুক্ষণের জন্যে উধাও হ’য়ে যেতো। হররোজ, প্রতিটি দিন, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে-চারটের সময় একটা ছোটো দরজা দিয়ে সে যেন কোথায় চ’লে যেতো, এই দরজাটার চাবি সে ককখনো কাছছাড়া করতো না। কোথায় যে যেতো, সে-সম্বন্ধে জেন বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানে না।

প্রথম তিনদিন জেন অপেক্ষা করেছিলো কখন সে ফিরে আসে-আর সে ঐ দরজা দিয়ে উধাও হ’য়ে যাবার কয়েক মুহূর্ত পরেই তার কানে এসে পৌঁছুতো অদ্ভুত-সব শব্দ, যেন কাউকে নির্যাতন করা হচ্ছে কোথাও, আর সে থেকে-থেকে কেবলই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছে। এ-রকম অন্তত পনেরো মিনিট ধ’রে চলতো, তারপর, আধঘণ্টাটাক কেটে যাবার পর ঐ ছোটো দরজাটা দিয়ে আবার এসে ঘরে ঢুকে পড়তো হ্যারি কিলার হৃষ্ট ও প্রফুল্ল। জেন তখন ধরিয়ে দিতো তার পাইপ, ভ’রে দিতো তার গেলাশ, আর সে ঢকঢক ক’রে মদ গিলে ক্রমেই বেহুঁশ হ’য়ে পড়তো।

শুধু প্রথম তিনদিনই জেন ওভাবে তার ফিরে-আসার অপেক্ষা করেছিলো, কিন্তু ক্রমেই দূরের ঐ-সব আর্তনাদ এমন অসহ্য হ’য়ে উঠতো যে তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করতো-কিছুতেই সে যে নিদারুণ নিপীড়নের কষ্ট লাঘব ক’রে দিতে পারছে না, এই বোধটা তাকে কুরে কুরে খেতো। ফলে সে এটাই একটা রীতি বানিয়ে নিয়েছিলো যে আধঘণ্টার ঐ অনুপস্থিতির সময়টা ও-ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাজভবনে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াবে। দু-একদিনের মধ্যেই, সব কর্মচারী, কৌশুলিরা, কালো দাসদাসীরা, আর কর্তব্যরত মেরিফেলোরা (হর্ষচরিতেরা) তাকে চিনে ফেলে তাকে বেশ সমীহই করতে শুরু ক’রে দিয়েছিলো।

প্রত্যেক সন্ধেতেই এমন-একটা সময় আসতো তখন পাঁড়মাতাল হ্যারি কিলারের জীবন নির্ভর করতো জেন ব্লেজনেরই দয়ার ওপর। তার দুর্ভাগা দাদার কাছ থেকে একমাত্র যে-উত্তরাধিকারটা সে পেয়েছে, সেই খঞ্জরের এক আঘাতেই যেন হ্যারি কিলারকে সহজেই খুন ক’রে ফেলতে পারতো। কিন্তু সে তো করেনি। কোনো লোক, যার আত্মরক্ষা করার কোনো সামর্থ্য নেই, সে যতই দুঃসহ হোক না কেন, তাকে মেরে ফেলার কথা সে ভাবতেই পারে না। আর, তাছাড়া, কী-ই বা লাভ হ’তো তাকে ওভাবে খতম ক’রে? হ্যারি কিলার মারা গেলেও ঐ

দস্যুদল তো থেকেই যাবে, যারা গালভরা একটা নাম দিয়েছে নিজেদের-কৌশুলি! তাছাড়া তো আছেই বিকট ঐ ব্ল্যাকগার্ডেরা, আর উৎকট ঐ মেরিফেলোরা-আর আরো যে কত চোর বাঁটপাড় খুনে গুণ্ডা!

তাতে বন্দীদের দশার কোনো উন্নতি তো হ’তোই না, বরং হ্যারি কিলারের মৃত্যুতে আরো অবনতি হ’তো। গোটা শহরের মধ্যে এই হ্যারি কিলারই হয়তো একমাত্র লোক, দুর্লভ-সব মুহূর্তে, যার মধ্যে দেখা যেতো ক্ষুরধার বুদ্ধির ঝিলিক- যে হয়তো সব দিক বিবেচনা ক’রে একদিন দয়ার মাহাত্ম্যও বুঝতে পারতো! জেন ব্লেজনের সঙ্গীরাও এ-বিষয়টায় সম্পূর্ণ একমত : না, অযথা হ্যারি কিলারকে এখন খুন ক’রে কোনো লাভই নেই।

তবে আরো ভালো একটা ছক হয়তো কষা যেতে পারে। স্বৈরাচারের বিশ্বাস যেহেতু তার ওপর বর্তেছে, তখন খোদ হ্যারি কিলারকেই কি কোথাও ফাঁদে ফেলে বন্দী ক’রে রাখা যেতে পারে। তাহ’লে বাস্তবিক এমন-একজনকে জামানত পেয়ে যাবেন তাঁরা, যাতে এদের সঙ্গে সমানে-সমানে যুঝতে পারবেন।

অবশ্য এ-ছকটাকে কাজে খাটাতে যাবার বিষম মুশকিল আছে কতগুলো। হ্যারি কিলারকে তাঁরা আটক করবেন কী ক’রে, যখন তাঁরা নিজেরাই বন্দী। রাজভবনে সবসময়েই রক্ষী আর পাহারার ভিড়-তাছাড়া তাঁদের ওপরও একদল শাস্ত্রী সারাক্ষণ নজর রেখে যাচ্ছে। আর যদি-বা এই মুশকিলটা কোনোরকমে কাটিয়ে ওঠা যায়, তাহ’লেও যে তাঁদের কোনো লাভ হবে তারই বা ঠিক কী। ব্ল্যাকল্যাণ্ডের লোকেরা যদি এই একনায়কের অপসারণে খুশি হ’য়ে উঠে তার হাত থেকে মুক্তির জন্যে তাঁদের সঙ্গে কোনো রফা করতে রাজি না-হয়? আর যদি-বা তা না-হয়, যদি আপোষেই সব মীমাংসা ক’রে নেবার একটা কথা পাকা হয়, তাঁরা কী ক’রে জানবেন যে এই নরাধমগুলো সে-কথা রাখবে? এ-রকম কোনো জটিল সমস্যার সমাধান করা অত সহজ কাজ নয়।

এ-ছকটা ছাড়াও, জেন ব্লেজন মনে-মনে আরো একটা পরিকল্পনা ভেঁজে রেখেছিলো—আর সেটা সে একদিন খুলেও বলেছে তার সঙ্গীদের। হ্যারি কিলারের ঐ নিয়মিত অনুপস্থিতি তার কৌতূহল আর দয়া-দুইকেই উশকে দিয়েছে। রোজ সন্ধেয় ও-কার আর্তনাদ ভেসে আসে বন্ধ দরজাটার ও-পাশ থেকে? হ্যারি কিলার যখন বেহেড মাতাল হ’য়ে বেহুঁশ প’ড়ে থাকে, তখন অনেকবারই তার মনে হয়েছে চাবিটা নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে ওপাশে গিয়ে দ্যাখে, কে আছে। এতদিন অবশ্য সে কিছুতেই সাহস জোটাতে পারেনি, শেষমুহূর্তে ভয় পেয়ে পেছিয়ে এসেছে। সে কোনোক্রমে চেপে রেখেছে কৌতূহলটা।

এইভাবে এক-এক ক’রে পাঁচ দিন কেটে গেছে। অবশেষে এসেছে ৮ই এপ্রিল। ….সেদিন রাত নটার একটু বাদে, বন্দীরা সবাই, এমনকী মলিক শুদ্ধু, বুরুজের ওপরকার সেই প্ল্যাটফর্মটার ওপর জেন রেজনকে সেদিনকার খবরের বুলেটিনটা জানবার জন্যে প্রশ্ন করেছেন—এবং জেনও জানিয়েছে, এ-দিনটাও অন্যান্য দিনের মতোই একইভাবে কেটেছে। নিচে প্ল্যাটফর্মের তলায় দাঁড়িয়ে আছে ৎশুমুকি, তার হাতের কাজকর্ম সেরে ফেলছে, তারপর সে রাতের মতো বিদায় নেবে।

শুক্লপক্ষেরই গোড়ার দিক হবে, কিন্তু আকাশে ঝুলে আছে রাশি-রাশি বাদলমেঘ, একটু পরেই বোধহয় ঝমঝম ক’রে বৃষ্টি পড়বে, রাতটা কী রকম ঘুটঘুটে আঁধারে যেন দমবন্ধ ক’রে আছে, বৃষ্টি পড়ার আগে যেমন হয়। প্ল্যাটফর্মের ওপর ভ’রে আছে নিবিড় ছায়ায়—তার ওপর রাঙানদীর ওপারের মিটমিটে আলো এসে পৌঁছোয় না।

হঠাৎ কী যেন ওপর থেকে পড়েছে শানের ওপর, ঝুপ ক’রে একটা ভোঁতা ও ভারি আওয়াজ হয়েছে। বন্দীরা এতটাই আঁৎকে উঠেছেন যে আপনা থেকেই তাঁদের সব কথাবার্তা বন্ধ হ’য়ে গেছে। কোত্থেকে এলো শব্দটা? কীই বা পড়লো অমন ক’রে? কিছুই তাঁরা অন্ধকারে ঠাহর করতে পারছিলেন না।

প্রথমে সংবিৎ ফিরে পেয়েছেন আমেদে ফ্লঁরেসই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছেন রহস্যময় জিনিশটাকে, যেটা ওভাবে এসে পড়েছে। মস্ত একটা নুড়ি, একটা মোটাসুতোর গায়ে বাঁধা, যার অন্যপ্রান্তটা রেলিঙের ওপর দিয়ে গিয়ে ওপাশে রাঙানদীতে পড়েছে।

কী মানে হ’তে পারে এই রহস্যময় ঢেলাটার? কোনো ফাঁদ নয়তো? না কি এই ব্ল্যাকল্যাণ্ডেও তাঁদের কোনো অজানা বন্ধু আছে, যে তাঁদের কোনো খবর পাঠাতে চায়? উত্তরটা জানতে হ’লে শুধু ঐ মোটাসুতোটা ধ’রে টান দিতে হবে- তবে অন্যপ্রান্তটায় কোনো খবর আটকানো থাকতেও পারে। আমেদে ফ্লরেঁস তক্ষুনি সুতোটা ধ’রে টান লাগিয়েছেন, কিন্তু ডাক্তার শাতোনেরও সাহায্য চাইতে হয়েছে তাঁকে। দড়ি তো নয়, সুতো, নিচে যে-ভার আছে, তার সুতোটাকে বরং আঙুলের ফাঁক দিয়ে নিচেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। উঁহু, কোনো চিঠি হ’তেই পারে না, অন্যকিছু।

অবশেষে সুতোটার অন্যপ্রান্তের নাগাল পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে এবার একটা রশি বাঁধা। সুতোটাকেও যেমন ক’রে টেনে তুলেছেন, রশিটাকেও তাঁরা তেমন ক’রেই টান লাগিয়েছেন। টেনে এনে দেখেছেন রশিটা লম্বায় অন্তত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ গজ তো হবেই; এ-যাবৎ দড়িটা টেনে তুলতে কোনো অসুবিধে হয়নি, এবার যেন একটু উলটো টানই পড়েছে, যেন দড়িটা কোনো-কিছুর সঙ্গে বাঁধা-না কি অন্যদিক থেকেও অন্যকেউ টান দিচ্ছে? একটু হকচকিয়েই গেছেন তাঁরা, কী করবেন গোড়ায় বুঝে উঠতে পারেননি।

‘রশিটা বেঁধে রাখুন,’ আমেদে ফ্লরেঁস পরামর্শ দিয়েছেন,–’যেইই এই রাশিটা এখানে পাঠিয়ে থাকুক, শিগগিরই বুঝতে পারবো তার মলব কী

রশিটা বেঁধে নেবার পর যেই টান-টান হ’য়ে গেছে, অমনি আর-কেউ নিশ্চয়ই সেটা বেয়ে উঠেছে, আর বন্দীরা নিচের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে তাকে দেখবার চেষ্টা করেছেন। পরক্ষণেই দেখতে পেয়েছেন, কে-এক মানুষ তরতর ক’রে দেয়াল বেয়ে উঠে আসছে।

অজানা আগন্তুক তারপরেই রেলিঙ ডিঙিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে নেমেছে-আর স্তম্ভিত বন্দীদের মাঝখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

গলার স্বর সাবধানে নিচু রেখেই, তাঁরা একসঙ্গে অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠেছেন ‘তোঙ্গানে!’