১.০৫ আমেদে ফ্লরেঁসের দ্বিতীয় নিবন্ধ

৫. আমেদে ফ্লরেঁসের দ্বিতীয় নিবন্ধ

আমেদে ফ্লরেঁসের দ্বিতীয় নিবন্ধ ল্যক্সপানসিয়ঁ ফ্রাঁসেঈ-এর ১৮ জানুয়ারি সংখ্যায় বেরিয়ে ছিলো।

বারজাক মিশন
[নিজস্ব সংবাদদাতার প্রতিবেদন ]

দাউহেরিকো, ১৬ই ডিসেম্বর। আমাদের অভিযানের প্রথম দিনই, জঙ্গলের মাঝখানে, রাত্রিবেলায় লণ্ঠনের টিমটিমে আলোয় ব’সে প্রথম প্রতিবেদন পাঠাবার পর, আমাদের পথচলার দিনগুলো বেশ আনন্দেই কেটেছে, অতএব তার কোনো বৃত্তান্তই নেই।

দোসরা ডিসেম্বর আমরা শিবির তুলেছিলুম ভোর পাঁচটায়, আর আমাদের সারি –এখন তো আরো-একজন অতিরিক্ত সদস্যা তার-কদম-কদম বেরিয়ে পড়েছিলো। একটা গাধার পিঠ থেকে বোঝা নামিয়ে অন্যদের পিঠে তা ভাগাভাগি ক’রে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো, যাতে মলিক তার ওপর চড়তে পারে। একেবারেই ছেলেমানুষ এই মলিক, না-না, ছেলেমানুষ নয়, কচিমেয়ে, সে এর মধ্যেই রাতের মারপিটের কথা ভুলে গিয়েছে। সব-তাতেই তার খিলখিল ক’রে উচ্ছল হাসি, যেন একটা ঝর্নার মতো অবিরল উপচে পড়ছে।

তারপর থেকে আমরা আমাদের নির্দিষ্ট পথেই চলেছি, ছক-অনুযায়ীই এখনও অব্দি রাস্তা বেশ ভালো, সহজগম্য; লোকের গায়ের রং আর দারিদ্র্যপীড়িত শীর্ণ লাঞ্ছিত গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে না-গেলে আমরা ভাবতে পারতুম হয়তো কোনোদিনই ফ্রান্‌স ত্যাগ করিনি।

আমরা যে-অঞ্চলটার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেটা সমতল-কোথাও হয়তো সামান্য নেমে যায় জমি, কোথাও অর্ধমনস্ক পাহাড় উঠে উত্তরদিগন্তে—কিন্তু এ ছাড়া ধূ-ধূ করে সব —যত-দূর চোখ যায় স্থগিতবৃদ্ধি বেঁটেখাটো উদ্ভিদে ভরা জমি, ঝোপঝাড় অথবা ঘাসে ভরা, দু-তিন গজের বেশি লম্বা হবে না, এখানকার লোকে বলে বুশ, ঝোপ। এখানে-সেখানে গজিয়েছে গাছপালা, শীর্ণ—সংখ্যায় কমই খুব, গরমের দিনে সাভানায় দাবানল জ্বলে ওঠে, আর আগুন গাছপালা খেতে খুবই ভালোবাসে—সেইজন্যেই বড়ো-গাছ বুঝি গজাতেই পারেনি কোথাও। মাঝে-মাঝে অবশ্য চাষের জমি পড়ে পথে, খামার, লুগান বলে এদের স্থানীয় ভাষায়, সেগুলো দেখা দিলেই বোঝা যায় তারপরেই অন্তত কয়েকটা লম্বা-লম্বা গাছ চোখে পড়বে। আর তখনই আমরা এসে পৌঁছুই কোনো গ্রামে। আর গ্রামগুলোর নামও ভারি উদ্ভট শোনায় আমাদের কানে : ফঙ্গুম্বি, মানুফুরু, কাফু, উসু—ইত্যাদি। আমি হাল ছেড়ে দিই। যেমন সবাই নাম দেয় ফ্রাসে, তেমনি-কোনো নাম কি এরা দিতে পারে না—তাহলে বরং আমরা অভ্যস্ত নামধাম শুনে আহ্লাদ পেতে পারতুম! বোধকরি না-বললেও চলবে মিশনের নেতা সবচেয়ে দুঃস্থ দারিদ্র্যলাঞ্ছিত গ্রামগুলোয় গিয়ে গাঁওবালাদের মধ্যে শোরগোল তুলে দেন—তাঁর প্রফুল্ল আনন আর উপঢৌকনগুলো বেশ সাড়াই তোলে। কিন্তু তাঁর আড়ালে বোদ্রিয়ের গিয়ে চেষ্টা করেন উলটোরকম সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগান করতে। এবং যা-যা সিদ্ধান্ত করেন তা যে পরস্পরের একেবারে উলটো হয় তা বোধহয় বলার দরকার নেই— দুজনেই ফিরে আসেন সমান-হৃষ্ট, মুখে একই পরিতোষের ভাব। ফলে সকলেই খুব-খুশি। এর চেয়ে নিখুঁত অবস্থা আর কীই-বা হ’তে পারে।

আর আমরা? আমরা কখনও পেরিয়ে যাই নদী. অন্যসময় বা নদীর তীর ধ’রেই চলি। নদীদের নামগুলোও আমার জিভে জড়িয়ে যায়। এক উপত্যকা থেকে অন্য উপত্যকায় চলে যাই, তফাৎ কিছুই চোখে পড়ে না, কোনো তুলকালাম রোমাঞ্চকর আগ্রহ এর মধ্যে খুঁজে পাবে কে?

যখনই খাতা খুলে সংক্ষেপে দু-একটা খুঁটিনাটি লিখে রাখার চেষ্টা করি, দেখতে পাই সমকালীন ইতিহাসের কানে-কানে যে ফিশফিশ ক’রে কোনো গোপন কথা বলবো, সে-রকম কিছুই নেই। শেষটায় ছয়ই ডিসেম্বর মঁসিয় সাঁৎ-বেরা-ক্রমেই প্রায় জিগরি দোস্তই হ’য়ে উঠছেন আমার-বললেন আমাকে প্রফুল্ল করার জন্যে তাঁর একটা ফন্দি ভেঁজে নেয়া উচিত। আর আমোদ যদি জোটে, তাহ’লে আশা করি পাঠকেরাও তার ভাগ পেয়ে যাবেন।

সেদিন সন্ধেবেলায় আমরা একটা গাঁয়ের কাছেই ছাউনি ফেলেছিলুম- অন্যগুলোর মতো অমন নামকাওয়াস্তে দুঃস্থ গ্রাম নয়, নাম উলিয়া। যথাসময়ে আমি আমার তাঁবুতে ঢুকেছি, সারাদিনের ধকলের পর আমার একটু বৈধ অধিকার জন্মেেেছ ঘুমের ওপর। গিয়ে দেখি সাঁৎ-বেরা, গায়ের জামা খোলা, একটা গেঞ্জি আর প্যান্ট পরনে, বাকি সব বসন এদিক-ওদিক, এলোমেলো, ধুলোয় লোটাচ্ছে। বিছানা পাতা। প্রথমে দেখে মনে হ’তেই পারে তাঁর মনোবাসনা বুঝি আমারই তাঁবুতে ঘুম লাগাবার। ঢোকবার মুখটায় থমকে দাঁড়াই আমি, আমার এই অপ্রত্যাশিত অতিথি কী করেন, তা-ই দেখবার জন্যে।

আমাকে দেখে সাঁৎ-বেরা যে খুব-একটা অবাক হন, তেমন মনে হয় না। তা সে-কথা যদি ওঠেই তবে জনান্তিকে ব’লে রাখি, তাঁকে আমি কখনোই চমকাতে বা অবাক হ’তে দেখিনি। ভারি ব্যস্তমস্ত, একটু যেন অস্বস্তিও আছে, কেবলই উশখুশ করছেন, সবকিছু হাড়ে দেখছেন, একবার তো আমার কিট-ব্যাগেও হাত ঢুকিয়েছেন, সেটা খুলে তারপর ভেতরের সবকিছু ছত্রখান ক’রে ছিটিয়ে ফেলেছেন মাটিতে। কিন্তু যা খুঁজছিলেন তা বোধহয় পাননি—আর তাতে যেন একটু উত্যক্তও বোধ করেছেন। আমার দিকে ফেরেন তিনি, আমাকে দেখে বিন্দুমাত্র বিস্মিত বা বিচলিত না হ’য়ে। বেশ দৃঢ়সুরে বলে ওঠেন : ‘অন্যমনস্ক লোকজন আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি না। ভারি হাড়জ্বালানে লোক হয় এরা।’ আমি একটুও সংকোচ না-ক’রেই বলি : ‘সত্যি হাড়জ্বালানেই। কিন্তু আপনার আবার হঠাৎ কী হ’লো, সাঁৎ-বেরা?’

‘আচ্ছা, একবার ভাবুন তো,’ তিনি বলেন, ‘আমার পাজামা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই হতচ্ছাড়া ৎশুমুকিটা সেটা এর আগের বারে যেখানে থেমেছিলুম, সেখানেই ফেলে রেখে এসেছে।’

আমি ইঙ্গিত করি : ‘যদি অবশ্য আপনার নিজের কিট-ব্যাগটায় পাজামাটা না-থাকে-

‘আমার, কিট-ব্যাগে…?’

‘এ কিট-ব্যাগটা অবশ্য আমার, মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা, ঠিক যেমন এই তাঁবু এবং ঐ চিত্তাকর্ষক বিছানাটাও আমার!

সাঁৎ-বেরা তাঁর বিস্ফারিতলোচনে বিস্ময় ফোটান – সম্ভবত জীবনে এই প্রথমবার। হঠাৎ বুঝতে পেরে যান তাঁর ভুলটা, হুড়মুড় ক’রে মাটি থেকে ছাড়া- জামাকাপড় তুলে নিয়ে তাঁবু থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় যেন মনে হয় তাঁকে বুঝি একদল হিংস্র জন্তু তাড়া করেছে। আমি গিয়ে ধপ ক’রে গা এলিয়ে দিই বিছানায়,

কুণ্ডলি পাকিয়ে যাই আরামে।

সত্যি, সাঁৎ-বের্যার কোনো তুলনা হয় না! ভুলোমন লোক নাকি উনি একেবারেই সইতে পারেন না!

পরদিন, সাতই ডিসেম্বর, আমাদের সকালবেলার কুচকাওয়াজের পর আমরা সবে টেবিল সাজিয়ে বসেছি, দেখি কতগুলো নিগ্রো একটু-দূর থেকে আমাদের হাঁ হাঁ করে দেখছে। কাপ্তেন মার্সেনে দুজন সেপাইকে বলেন ওদের ঢিট ক’রে দিয়ে আসতে; তারা চটপট কেটে পড়ে, কিন্তু খানিক বাদেই ফের এসে উদয়

হয়।

‘হঠিয়ে দাও স্থানীয় লোক, অমনি আবার স্বস্থানেই, দল বেঁধে সব হাজির,’ ডাক্তার শাতোনে ভেবেছেন বর্তমান অবস্থায় একটু অদলবদল ক’রে পুরোনো প্রবচনই লাগসই হবে। বিষয়ের সঙ্গে কোনো সংগতি থাকুক চাই না-থাকুক, তড়বড় ক’রে পুথির বুলি শোনাতে তাঁর বোধহয় দারুণ-ভালো লাগে। যার যা রুচি।

এবার পাঠানো হয়েছে মোরিলিরেকে, সরেজমিন তদন্দ ক’রে আসতে। সে ফিরে এসে শোনায়, এই কালোরা আসলে বেনে আর ভূতের ওঝা, গুনতিতে দশজন হবে তারা, তাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই, তারা শুধু তাদের বেসাতি বেচতে চায় আমাদের কাছে—অনুমতি দিলে একটু আমোদও জোগাবে।

রুপোর বাসন সব বাক্সে পোরো!’ মঁসিয় বারজাক ভাবেন যে খুব বুঝি রসিকতা হ’লো। ‘তারপর সব কটাকে খাবার ঘরে আসতে বলো!’

তো, কালোরা এলো দল বেঁধে, বিদঘুটে সব রং চং মেখে সেজেছে এরা। তাদের মধ্যে কারিগর আছে, ছত্রিশ রকম পণ্য বানাতে পারে-থালা, বাটি, গয়নাগাটি, বেতের ঝুড়ি, কাঠ দিয়ে বা লোহা দিয়ে বানানো মূর্তি বা অন্য শিল্পদ্রব্য; অস্ত্রশস্ত্রও ফিরি ক’রে বেড়ায় এরা, কাপড়ের থান, আর কোলা বাদাম— যা কিনে আমরা প্রচুর পরিমাণে ভাঁড়ারজাত ক’রে রাখি। এই কোলা নাটের মাহাত্ম্য বুঝি আমরা, ডাক্তার শাতোনে একে বলেন মিতব্যয়ীর খাদ্যভাণ্ডার, একটু নুনের বদলে এত কোলা নাট পেয়ে তিনি বেজায়-খুশি, আমরা যে-অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছি, নুন সেখানে দুর্লভ-বলা যায়, অমূল্য। উপকূল থেকে যত-ভেতরে ঢুকবো ততই মূল্যবান হ’য়ে উঠবে নুন, তাই আমরা বড়ো-বড়ো নুনের চাঙ্গড় নিয়ে এসেছি। কেনাকাটার পর আমরা ডেকে পাঠিয়েছি ডাইনিপুরুদের – আর বলেছি ওদের চমৎকার গানগুলোর মধ্যে যেটা সবচেয়ে-চমৎকার সেটাই গেয়ে শোনাতে।

নিগ্রোভূমির এই চারণরা সেখানে ছিলো সংখ্যায় মাত্র দুজন। একজনের হাতে একটা গিটার! কী অদ্ভুত যে গিটার!…একটা কালাবাশ অর্থাৎ লাউয়ের খোল, শুকনো, লম্বালম্বি তার ওপর গেছে বাঁশের সরু কঞ্চি, তিনখানা, প্রত্যেকটার সঙ্গে লাগানো বনবেড়ালের নাড়ি শুকিয়ে বানানো তার। অন্য ওঝাটির হাতে এক বাঁশি, একটা নলখাগড়ার নলের দু-পাশে দুটো ছোট্ট লাউয়ের খোল। … বাস, শুরু হ’য়ে গেলো জলসা। দ্বিতীয় ওঝার পরনে শুধু-একটা নেংটি, সে নাচ জুড়ে দেয়, অন্য ওঝার গায়ে একটা জামা আছে, সে ব’সে-ব’সে ঝমঝম ক’রে তার গিটার বাজায়, আর সঙ্গে-সঙ্গে কণ্ঠবর্ণে ভরপুর নানা অদ্ভুত আওয়াজ ক’রে, ভেতরে কোথাও-একটা ছন্দও আছে তার-আর সম্ভবত এই সংগীতে গুণকীর্তন করা হয়েছে চাঁদ, সূর্য আর হাজার তারার-এবং বোধহয় মাদমোয়াজেল মোরনাসেরও।

একজনের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি, অন্যজনের অদ্ভুত কণ্ঠ্যনাদ আমাদের সঙ্গে যে তল্পিবাহকেরা ছিলো তাদেরও মধ্যে চুলবুল তুলে দিলে; তারা পাতের খাওয়া ছেড়ে, দল বেঁধে গিয়ে এমন-একটা ব্যালেনাচের আসর জমিয়ে দিলে, খুব কম করে বললেও যাকে বলা যায় অসাধারণ।

আর তাদের দৃষ্টান্ত দেখে উদ্বুদ্ধ হ’য়ে, আমরাও বাসনকোশন তুলে নিয়ে কাঁটা-আর চামচে দিয়ে ঝনঝন ক’রে বাজাতে শুরু ক’রে দিই, মঁসিয় দ্য সাঁৎ- বেরা উৎসাহের আধিক্যে একটা চিনেমাটির রেকাবিই ভেঙে ফ্যালেন, আর দু- আধখানা ঝনঝন ক’রে করতালের মতো বাজাতে-বাজাতে একটা বিদঘুটে ফান্দাঙ্গো জুড়ে দেন, যার সঙ্গী হয়েছিলো এই-অধমও।

এবং মঁসিয় বারজাঁক—কথাটা ফাঁস ক’রে দেবার দুঃসাহস আমার হবে কি?- নিজে সব সংযম হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে, একটা তোয়ালেকে মাথায় পাগড়ির মতো জড়িয়ে নেন, আর এমনকী মঁসিয় বোদ্রিয়ের, উত্তরপ্রদেশের সেই মাননীয় সাংসদ মুখে একটা ঘোমটা প’রে নেন-এবং দুই সাংসদের জুটিতে এমন-একটা আতিশয্যের নাচ শুরু হ’য়ে যায় যার তুলনা কোথায় মিলবে, কে জানে।

কিন্তু সব চমৎকার জিনিশই একসময় শেষ হ’য়ে যায়। পাঁচ মিনিটের হল্লাগোল্লার পর হা-ক্লান্ত হ’য়ে আমরা থেমে পড়ি আর মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস হাসতে-হাসতে পেটে খিল ধরিয়ে ফ্যালেন, শেষটায় তাঁর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে।

এই বিশেষ দিনটির সন্ধেবেলাতেই যে নিম্নস্বাক্ষরকারী, আমেদে ফুঁরেস, একটু অপরিণামদর্শী হঠকারী যুবক হ’য়ে যায়, সেটা কুবল ক’রে এই এখানে আমার মাঝে-মাঝেই মনে হয়, বোধহয় সাংবাদিক হবারই ফল, পেটের কথা মুখে চেপে রাখতে পারি না, পরের কথা আড়ি পেতে না-শুনে পারি না।

তো, সেদিন সন্ধ্যায়, দৈববশেই নিশ্চয়ই, আমার তাঁবুটা মাদমোয়াজেল মোরনাসেরই তাঁবুর পাশে খাটানো হয়েছিলো। সব শুয়ে পড়বার আয়োজন করছি এমন সময় পাশের তাঁবুতে কথাবার্তার আজওাজ শুনতে পেলুম। কানে হাত চাপা দেবার বদলে আমি বরং কান পেতে কথাগুলো শুনে নিয়েছি। একে পাপ বলতে হয়, বলুন।

মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস তাঁর পরিচারক তোঙ্গানের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তোঙ্গানে কেমন জবড়জং বিদঘুটে ইংরেজিতে জবাব দিচ্ছিলো-যা আমি পাঠকদের সুবিধের জন্যেই শাদাসিধে ভাষায় তর্জমা ক’রে দেবো। কথা শুনে মনে হ’লো আলোচনাটা বেশ-কিছুক্ষণ ধ’রেই চলেছে। তোঙ্গানেকে নিশ্চয়ই তার জীবনকাহিনী শোনাতে বলেছেন মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস কান পেতে শুনি, তিনি জিগেস করছেন : ‘তোমার মতো একজন আশান্তি কী ক’রে…?’

তার মানে! তোঙ্গানে তবে বাম্বারা নয়?! আমি তো স্বপ্নেও তা ধরতে পারতুম না।

‘সেনেগলে গিয়ে দোভাষী আর গাইড হ’লো? তোমাকে চাকরিতে বহাল করবার সময় একবার আমাকে বলেছিলে বটে, তবে সব কথাই আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছি!’

বিভ্রম হবে হয়তো আমার, আবার নাও হতে পারে, কেননা আমার মনে হ’লো তিনি সত্যি কথা বলছেন না। তোঙ্গানে উত্তর দেয় : ‘কাপ্তেন ব্লেজ .. ‘ ব্লেজন? নামটা যেন চেনা-চেনা। কিন্তু কোথায়, কী উপলক্ষে শুনেছি? শুনতে-শুনতেই আমি স্মৃতির ভেতরটা হাড়াই।

‘সেই অভিযানে আমিও অংশ নিচ্ছিলাম,’ তোঙ্গানে ব’লে চলে, ‘এমন সময় ইংরেজরা এসে আচমকা চড়াও হয়, আর আমাদের তাগ ক’রে গুলি ছুঁড়তে শুরু ক’রে দেয়।’

‘তুমি কি জানো কেন ওরা গুলি ছুঁড়েছিলো?’

‘কারণ কাপ্তেন রেজন বিদ্রোহ করেছিলেন। তিনি সবখানেই লুঠতরাজ চালাচ্ছিলেন, খুনোখুনিতেও পেছ-পা হননি।

‘সেটা কি সত্যি কথা?’

‘খুব-সত্যি। তাঁরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে ছারখার ক’রে দিচ্ছিলেন। নারীপুরুষ ছেলেবুড়ো কাউকেই রেহাই দিচ্ছিলেন না…’

‘আর এ-সব নৃশংস কাজ করবার হুকুম দিয়েছিলেন কাপ্তেন রেজন?’

‘না,’ উত্তর দেয় তোঙ্গানে। আমরা কখনও তাঁকে চোখেও দেখিনি। অন্য শাদা-আদমিটি এসে পৌঁছুবার পর থেকে তিনি একবারও আর তাঁবু থেকেই বার হননি। ঐ শাদা-আদমিই কাপ্তেনের নাম ক’রে তাঁর বকলমে হুকুম দিচ্ছিলো।’

‘সে কি অনেকদিন তাঁর সঙ্গে ছিলো, এই অন্য শাদা-আদমি?’

‘হ্যাঁ, বহুদিন হবে–অন্তত পাঁচ-ছ মাস।’

‘তার সঙ্গে মোলাকাৎ হয়েছিলো কোথায়?’

‘ঝোপে। জঙ্গলে।’

‘আর কাপ্তেন ব্লেজন তক্ষুনি তাঁকে আদর ক’রে ডেকে নেন?’

‘তারপর একবার এঁর-ওঁর কাছছাড়া হননি তাঁরা। যতদিন-না কাপ্তেন ব্লেজন তাঁবু থেকে বেরুনোই বন্ধ ক’রে দিলেন।

‘আর তার পর থেকেই বুঝি সব নিষ্ঠুর লুঠতরাজ শুরু হ’য়ে যায়?’

‘তোঙ্গানে বোধহয় দোনোমনা করে একটু। আমি ঠিক জানি না।‘

‘কিন্তু ঐ শাদা-আদমি? তোমার মনে আছে? তার নাম? ‘

ঠিক সেইমুহূর্তে বাইরে একটা আওয়াজ হওয়ায় তোঙ্গানের গলার স্বর চাপা প’ড়ে যায়। সে-যে কী উত্তর দিয়েছিলো, আমার জানা নেই। তাছাড়া পরের কথায় আমার নাক গলাবারই বা দরকার কী? আর যা-ই হোক, এ-বৃত্তান্ত সাম্প্রতিক নয় মোটেই। কাজেই আমার তাতে তেমন-কোনো আগ্রহই ছিলো না।

‘তা ইংরেজরা তোমাদের দিকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করার পর কী হলো?’

‘আমাকে ডাকারে যখন কাজে নিয়েছিলেন, তখনই সে-কথা আপনায় আমি, বলেছিলাম।’ তোঙ্গানে উত্তর দেয়, ‘আমি আর অন্য-কয়েকজন—আমরা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমরা প্রাণপণে ছুটে জঙ্গলে পালিয়ে যাই। আবার যখন ফিরে যাই, দেখি যেখানে যুদ্ধ হচ্ছিলো, সেখানে কেউ নেই—শুধু মৃতেরা প’ড়ে আছে। আমি কয়েকজনকে কবর দিই, আমারই বন্ধুবান্ধব ছিলো তারা। আর মাসাকেও কবর দিই –কাপ্তেন ব্লেজনকেও।’

একটা অস্ফুট চাপা আর্তনাদই যেন কানে আসে আমার।

‘তারপর,’ তোঙ্গানে সবিস্তারে বলে, ‘আমি এ-গাঁ ঘুরতে-ঘুরতে শেষটায় নাইজার নদীর তীরে পৌঁছে যাই। শেষটায় টিমবা চ’লে আসি, সেখানে তখন সবে ফরাশিরা ঢুকতে শুরু করেছে। পুরো পাঁচবছর লেগেছিলো আমার সারাটা পথ পেরুতে। টিমবাটুতে গিয়ে আমি দোভাষীদের দলে যোগ দিই—তারপর একদিন সেনেগল চ’লে আসি। পরে কী হ’লো, আপনি তো জানেন। আপনার সঙ্গে তো সেখানেই দেখা হ’লো।’

একমুহূর্ত চুপ ক’রে থেকে মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস শুধোন : ‘কাপ্তেন ব্লেজন তাহ’লে মারা গেছেন?’

‘হ্যাঁ, মিসিবাবা।’

আর তুমিই নিজের হাতে তাঁকে কবর দিয়েছো।’

‘হ্যাঁ, মিসি।’

‘তাহ’লে তুমি জানো তাঁর গোরটা কোথায়?

তোঙ্গানে হেসে ফ্যালে। ‘হ্যাঁ, জানি। আমি চোখ বন্ধ ক’রেও সেখানে যেতে পারবো।’

তারপর একটুক্ষণ কোনো কথা নেই। তারপর শুনি : ‘শুভরাত্রি, তোঙ্গানে।’

‘শুভরাত্রি, মিসি,’ ব’লে নিগ্রোটি তারপর তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে চ’লে যায়।

মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েন তারপর। আমিও আর সময় নষ্ট না-ক’রে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু লণ্ঠনটা নেবাতে-না-নেবাতেই আমার স্মৃতি ফিরে আসে।

ব্লেজন? কী হয়েছে আমার? নামটা শুনে আমি চিনতে পারিনি কেন? মাথাটা কোথায় গেছে? কী-একটা দুর্দান্ত খবর পাবার সুযোগই না হারিয়েছি আমি!

আমি তখন দিদেরোতে ছিলুম। আর যদি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিবিলাস ক্ষমা ক’রে দেন—আমি কাগজের মালিককে ব’লেও ছিলুম একেবারে সরাসরি অকুস্থলে গিয়ে আমি বিদ্রোহী কাপ্তেনের সাক্ষাৎকার নিতে চাই। মাসের পর মাস সম্পাদক খরচের কথা তুলে কেবলই টালবাহানা করেছেন। শেষটায় অনেক তা-না-না-না ক’রে যখন রাজি হয়েছেন, তখন বড্ড-দেরি হ’য়ে গেছে। বোর্দো থেকে ঠিক যখন জাহাজে উঠবো, আমি শুনতে পাই যে কাপ্তেন ব্লেজন খুন হ’য়ে গেছেন।

এখন এ-সবই তো পুরোনো কাশুন্দি, সাত-বাসি বৃত্তান্ত। আপনারা হয়তো জিগেস করতে পারেন, তাহলে হঠাৎ আমি এই অপ্রত্যাশিত কথোপকথনটা শোনাতে চাচ্ছি কেন?…সত্যি বলতে, আমিও নিজেও জানি না, কেন চাই।

আটই ডিসেম্বর, আবারও আমি আমার নোটবইতে সাঁৎ-বেরার নাম দেখতে পাই। না, সত্যি, ইনি অনবসাদ-এই সাঁৎ-বেরা।

আমরা আমাদের প্রাতঃকালীন কিস্তির মাত্র দু-ঘণ্টা সাঙ্গ করেছি, হঠাৎ দেখি সাঁৎ-বেরা ফেটে পড়েছেন ভাষাবিহীন নিনাদে এবং তাঁর অশ্বপৃষ্ঠে প্রায় লাফাতেই শুরু ক’রে দিয়েছেন। আমরা ব্যাপার-কিছু না-জেনেই, হাসির রোগ ধরার মতোই, হাসতে শুরু ক’রে দিয়েছি—কিন্তু এ-কী, সাঁৎ-বেরা, তিনি তো হাসছেন না, বরং বেদনাহত ভঙ্গিতে পা রেখেছেন মাটিতে, আর শরীরের সেই অংশে হাত বুলোচ্ছেন যে-অংশ কাজে খাটিয়ে আমরা সাধারণত উপবেশন করি—দুর্বোধ্য- সমস্ত অঙ্গবিক্ষেপ করতে শুরু ক’রে দিয়েছেন দেখে আমরা হুড়মুড় ক’রে তাঁর কাছে জিগেস করেছি : আব্বার কী ঝামেলা বাধলো?’

‘বঁডশিগুলো…!’ প্রায় কাঁদো-কাঁদো ভঙ্গি বেচারার।

বড়শি? কিন্তু তা থেকে আমরা বুঝবো কী, ছাই? শুধু পরে, ক্ষয়ক্ষতি কিঞ্চিৎ সারাইয়ের পরই, আমরা বুঝতে পেরেছি, তিনি কী বলতে চাচ্ছিলেন।

নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাননি যে, আমরা যখন কোনোক্রি ছাড়বার তোড়জোড় করছি। সাঁৎ-বেরা তাঁর মাসির হম্বিতম্বি শুনে মাসি, না কি ভাগ্নি? – তড়িঘড়ি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে ছুটে এসেছিলেন, চটপট একগাদা বঁড়শি ঢুকিয়েছিলেন পকেটে। স্বভাবতই এ নিয়ে, দ্বিতীয়বার আর-কিছু তিনি ভুলেও ভাবেননি। এবার ঐ তথাকথিত বঁড়শিগুলোই তাদের বেমালুম ভুলে যাবার জন্যে প্রতিশোধ নিয়েছে। একটু বেকায়দায় নড়তে গিয়ে বঁড়শিগুলো— অন্তত তিনটে—জম্পেশ ক’রে ঢুকে পড়েছে ঘোড়সোয়ারের নধর পশ্চাদ্দেশে।

ডাক্তার শাতোনের মধ্যস্থাতেই অবশেষে সাঁৎ-বেরা ছাড়ান পেয়েছেন। ছুরি দিয়ে তিন-তিনবার খুঁচিয়েই তাদের বার করা গেছে, কিন্তু ডাক্তার সেইসঙ্গে এক অবিশ্রাম ধারাবিবরণী দেবার হাত থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। আর তিনি হো-হো ক’রে হেসে ওঠেন, যেন এ খুবই মজার ব্যাপার।

‘যে-কেউ এই বঁড়শিগুলোয় বিঁধবেই, বঁড়শিগুলো তিন-তিনটে কামড় দিয়েছে!’ যে-জায়গাটায় শল্য ফুঁড়েছেন সেটা নিরীক্ষণ করতে-করতেই তিনি বলেছেন।

উত্তরে সাঁৎ-বেরা শুধু বলেছেন, উঃফ্-রে!

ব্যবচ্ছেদ শেষ হবার পর রুগির অকুস্থলে ব্যানডেজ বেঁধে দেয়া হয়েছে, এবং তারপর রুগি আবার উঠেছেন ঘোড়ার পিঠে, তারপর দু-দিন ধ’রে ঘোড়ার পিঠে কী-যে তেড়াবেঁকা নাজেহাল বসতে হয়েছে তাঁকে।

বারোই ডিসেম্বর আমরা এসে পৌঁছেছি বোরোনিয়া! এও অন্য-সব ছোটো গাঁয়ের মতোই হ’তো, যদি-না এর গ্রামপ্রধান হতেন বিশেষ-অমায়িক এক মজাদার লোক। গ্রামপ্রধান একেবারেই তরুণ, সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ, বড়োজোর সতেরো- আঠারো বছর বয়েস, বিস্তর রংদার অঙ্গভঙ্গি করেন, আর কৌতূহলী-কেউ অতিরিক্ত কাছে ঘনিয়ে এলেই শপাং ক’রে কষান চাবুক। আমাদের দেখেই তিনি ছুটে আসেন, একটি হাত বুকে, অন্য হাত দূরে-প্রসারিত, বন্ধুতার হাজার জবান মুখে, আর এই বন্ধুতার প্রতিদানে আমরা তাঁকে উপঢৌকন দিই লবণ, বারুদ আর দুটো ক্ষুর। এই দুর্লভ ঐশ্বর্য দেখবামাত্র তিনি ঊর্ধ্ববাহু হ’য়ে নৃত্য জুড়ে দেন।

কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিশেবে তিনি হুকুম দিয়ে দেন গ্রামের বাইরে আমাদের জন্যে কতগুলো খড়ের বাংলো তৈরি ক’রে দিতে, যাতে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত না-হয়। আমার বাংলোটার দখল নিতে গিয়ে দেখি, গাঁয়ের লোকে দুরমুশ পেটা ক’রে মাটি সমান ক’রে দিয়ে শুকনো ষাঁড়ের চামড়া দিয়ে তা ঢেকে দিচ্ছে। আমি জিগেস করি এই ফরাশ পাতার বিলাসব্যসন কেন। তারা উত্তরে জানায়, শাদা শূককীটেরা যাতে মাটি ফুঁড়ে বেরুতে না পারে, সেইজন্যেই এই ব্যবস্থা। আমি তাদের এত-খাতিরদারি দেখে সুক্রিয়া জানাই এবং কয়েকটা কানাকড়ি বখশিশ দিই তাদের। তারা খুশিতে ফেটে পড়ে-

কী ক’রে যে তাদের ধন্য-ভাব প্রকাশ করবে তা ভেবেই পায় না!

তেরোই ডিসেম্বর, সকালবেলাতেই, কোনো ঘটনা-অঘটনা ছাড়াই আমরা তিম্বো এসে পৌঁছুই। এই জনপদ, এ-যাবৎ যত গ্রামের মধ্য দিয়ে গেছি, তাদের মধ্যে সবার সেরা : পুরো গাঁটাই তাতা অর্থাৎ মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা, তার ওপাশে কাঠের একটা পাটাতন ফেলা, একটি চক্রাকার পথের মতো সেটা তাতাকে ঘিরে আছে। তিম্বোর তাতা -আসলে তিন-তিনটে গ্রামকে ঘিরে আছে—একটা গ্রাম থেকে আরেকটা গ্রামের মাঝখানে চষা জমি, খেতখামার, আর নয়তো গাছপালার সার—জমিতে গৃহপালিত পশুরা চরে বেড়ায়। প্রতিটি গ্রামেই রোজ বাজার বসে। তবে সবচেয়ে-বড়োটায় সপ্তাহে একবার ক’রে হাট বসে।

প্রতিটি চারটে কুঁড়েবাড়ির মধ্যে একটায় কোনো লোক থাকে না। সেটা ভরা থাকে জঞ্জালে আবর্জনায়। রাস্তাঘাটও আবর্জনায় ভর্তি। সম্ভবত ঝাড়ুদারদের বড্ড- অভাব এখানে। শুধু যে নোংরাই তা নয়, ভারি দুঃস্থ, অভাবগ্রস্ত এই গ্রামগঞ্জ। ছোটোছেলেমেয়েরা কাঠির মতো, টিংটিঙে, অস্থিসার, আবর্জনা হাড়ায় উচ্ছিষ্টের জন্যে।

তিম্বো যেহেতু অন্য-সব গ্রামগঞ্জের চাইতে বৃহদায়তন এবং গুরুত্বপূর্ণ, আমরা তাই সেখানে দুটো দিন কাটিয়ে দিই-তেরোই আর চোদ্দই ডিসেম্বর। খুব-যে ক্লান্ত ছিলুম তা নয়, তবে তল্পিবাহকরা এবং গাধারা বোধহয় অবসন্ন হ’য়ে পড়েছিলো।

সেই আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আমরা কেউ-কেউ, তাতাব ঘেরের মধ্যেই একটু- আধটু ঘুরতে বেরিয়েছি—তবে যা দেখেছি তার বিবরণ যে-কোনো ভ্রমণবৃত্তান্তেই পেয়ে যাবেন। আমি তো আর ভৌগোলিক নই, অতএব ভুগোলের বই লেখা আমার ধাতে নেই।

চোদ্দ তারিখে আমরা বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। আমাদের পথপ্রদর্শক মোরিলিরে অন্তর্ধান করেছে। সারাদিন তাকে হন্যে হ’য়ে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু কোথাও তার কোনো পাত্তা মেলেনি। মেরিলিরে যেন কর্পূরের মতো হাওয়ায় উবে গিয়েছে।

কিন্তু আশ্বস্ত হ’তে পারেন আপনারা। পনেরো তারিখে যখন ছাউনি তুলে বেরুবো, দেখি সে যথাস্থানে এসে হাজির। মঁসিয় বারজাক তাকে অন্তর্হিত হ’য়ে যাবার কথা জিগেস করলে, সে বলেছে, কই, সে তো একবারও ছাউনি ছেড়ে বেরোয়নি, বরং প’ড়ে-প’ড়ে সারাদিন ঘুমিয়েছে। আমরা যেহেতু শিবিরের ভেতরটা ছাড়া অন্য-সবখানেই তাকে খুঁজে বেড়িয়েছি, তাই ঠিক বুঝতে পারিনি সে সত্যিকথা বলছে কি না। হয়তো বলতে চায় না, নাবিকদের মতো হয়তো বন্দরে নেমেছিলো, অর্থাৎ এখানকার কোনো তরুণীর বাড়ি গিয়েছিলো। যাক- গে, সে ওর নিজের ব্যাপার-আমাদের কী!

তিম্বো ছেড়ে পনেরোই ডিসেম্বর ভোরবেলায় আমরা, তাই, যথাসময়েই বেরুতে পেরেছি। এবং সারাদিন পথ চলেছি আমরা-আমাদের নিজস্ব ক্রম অনুযায়ীই। শুধু এটা বলা উচিত হয়তো, ঘোড়ার খুরের খটখট আর শোনা যায়নি, তিম্বো ছাড়াতেই আমরা এসে পড়ছি কাঁচারাস্তায়—অর্থাৎ এতক্ষণে সত্যিকার অভিযাত্রীদলের মতোই আমরা অজানার মধ্যে ঢুকতে চলেছি।

আরো-একটা বদল : চারপাশের দৃশ্যও ক্রমশ বৈচিত্রপূর্ণ হ’য়ে উঠছে—আর ও-রকম একঘেয়ে ভাবটা নেই, চড়াই-উৎরাই বেয়েই চলতে হচ্ছে আমাদের। তিম্বো ছাড়িয়ে আসতেই বেশ-উঁচু একটি টিলায় উঠতে হয়েছে আমাদের, তারপর ওপাশে গিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে হয়েছে। টিলাটার পরেই বিস্তীর্ণ উপত্যকা, তারপর আরেকটা টিলা—সেটা একেবারে দাউএরিকো গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছেছে— তার পাশেই রাত কাটাবার জন্যে আমরা তাঁবু খাটিয়েছি।

দু-দিনের বিশ্রামে সবাই বেশ চাঙ্গা বোধ করছিলো ব’লেই আমরা অন্যদিনের চাইতে দ্রুত চলতে পেরেছি, যখন এই গ্রামটায় এসে পৌঁছেছি তখন সন্ধে মাত্ৰ ছ-টা

খুবই সমাদার পেয়েছি এখানে। খোদ মোড়ল এসে আমাদের স্বাগত জানিয়ে নানারকম উপহার দিয়েছে। মঁসিয় বারজাক তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

‘আমি যখন এ-লা-শ্যাপেল গিয়েছিলুম, তখনও কেউ আমায় এমন ক’রে অভ্যর্থনা করেনি,’ বেশ হৃষ্ট—এবং তুষ্ট-স্বরে বলেছেন মঁসিয় বারজাক। ‘এমনই যে হবে, তা আমি জানতুম। ভব্যতা-শিষ্টাচার-দেশকালের বালাই রাখে না। একবার শুধু কথা বললেই বোঝা যায় অচেনা লোকরাও কত ভব্য, শিষ্ট।’

ঠিকই বলেছেন বটে, তবে মঁসিয় বোদ্রিয়ের নাছোড়া অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে শুধু তাঁর মাথা নেড়েছেন।

নাড়লে কী হবে, মোড়ল কিন্তু যথেষ্ট আপ্যায়ন করেছে আমাদের, অমায়িকভাবে। গাঁয়ের সেরা বাংলোগুলো আমাদের জন্যে ছেড়ে দিতে চেয়েছে, তার নিজের বাড়ির দুয়ার সে অবারিতভাবে খুলে দিয়েছে আমাদের সুন্দরী সঙ্গিনীকে। এই সাদর অভ্যর্থনা সত্যি আমাদের অন্তর স্পর্শ ক’রে গেছে, মনে হয়েছে আমাদের বাকি পথটাও হয়তো এমনি সুমধুর হবে—যতক্ষণ-না মলিক, মাদমোয়াজেল মোরনাসের কাছে এসে, দ্রুতস্বরে চাপা-গলায় বলেছে :

‘আপনি যাবেন না, মিসি! গেলেই মরবেন!

স্তম্ভিত হ’য়ে তার দিকে তাকিয়েছেন মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস। আমি যে কান পেতে শুনছিলুম, সে-তো সাংবাদিকের অধিকারেই, কিন্তু কাপ্তেন মার্সেনে কেন উৎকৰ্ণ হ’য়ে কথাগুলো শুনছিলেন—এ-রকম আড়িপাতা তো তাঁর কাজ নয়। গোড়ায় তাঁকেও একটু অবাক দেখিয়েছে, তারপরেই তিনি মনস্থির ক’রে ফেলেছেন।

তক্ষুনি মোড়লের বাড়াবাড়ি আপ্যায়নের অবসান ঘটিয়ে, তাকে বিদেয় ক’রে দিয়ে, এখানেই ছাউনি ফেলতে হুকুম দিয়েছেন। তাঁর ব্যবস্থাপনার সপ্রতিভতা দেখে আমার মনে হয়েছে, আমাদের সুরক্ষার ব্যবস্থাটা সর্বাঙ্গীন। তবে তাঁর হুঁশিয়ারি দেখে খটকা লেগেছে বৈকি! কাপ্তেন এ-দেশেই কাজ করেন, মলিক যে বিপদের বার্তা ব’য়ে এনেছে সেটাকে তিনি কি আমল দিয়েছেন? তিনি কি বিশ্বাস করেন, বিপদ হ’তে পারে? …তাহ’লে…

তাছাড়া এটারও ফয়সালা ক’রে ফেলা উচিত। কে ঠিক : মঁসিয় বারজাক, না মঁসিয় বোদ্রিয়ের? হয়তো কালকেই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যাবে। তবে আপাতত আমি হকচকিয়ে গেছি।

আমেদে ফ্লরেঁস