২১. ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে উঠে

একবিংশ পরিচ্ছেদ

আয়নাই ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে উঠে প্রথম দেখতে পেয়েছিল। তাঁর চেঁচামেচিতে পরে অবশ্য আরও অনেকে ছুটে এল। নতুন ঝি-ই সর্বাগ্রে। গায়ে মাথায় কাপড় জড়াতে জড়াতে এসে দাঁড়াল সে। বাকি যারা এল তারপর, তারা ওর এই আগমনের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করল না। কোন্‌খানা থেকে উঠে এল সে তা তো নয়ই। ওরই নিশ্চয় আগে ঘুম ভেঙ্গেছে–এই কথাই বুঝল সকলে।

আয়না ভেবেছিল অন্য ব্যাপার। আরও খারাপ কিছু ভেবেই অমন চেঁচিয়ে উঠেছিল। শয্যাশায়ী রুগীকে ঐভাবে চৌকাঠের ওপর মুখ থুবড়ে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখলে সাধারণত যা মনে হয় আগে–তাই মনে হয়েছিল তার। কিন্তু গায়ে হাত দিয়ে একটুখানি আশ্বস্ত হ’ল সে। গা তখনও গরম। একেবারে প্রাণটা বোধহয় যায় নি এটা ঠিক। তবু, ভয়ানক একটা যে কিছু ঘটেছে তাতেও সন্দেহ নেই। এমনভাবে দাঁতে দাঁত লেগে ভিরমি যেতে স্বর্ণকে কখনও দেখে নি আয়না, এই দুতিন মাসে একদিনও

আয়নার চেঁচামেচিতে হরেনকেও এসে দাঁড়াতে হ’ল। কিছু দেরি ক’রেই এল সে এইমাত্র ঘুম ভেঙ্গেছে সেটা জানাবার জন্য। ব্যাপারটা শুনে বলল, ‘তাই তো–বিছানা ছেড়ে এখানেই বা এল কী করে? কলঘরেটরে যাবার চেষ্টা করেছিল নাকি?…তাহ’লে তো বড় অন্যায় কথা। বাড়ির সব জায়গায় রোগ ছড়িয়ে বেড়ানো তো ঠিক নয়?’

জীবেনই ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলে তাকে, ‘আচ্ছা, সেসব নিকেশ পরে নিলেও চলবে। আগে ডাক্তারবাবুকে খবর দেবার ব্যবস্থা করো তো!’

অগত্যা ডাক্তারের কাছেও যেতে হ’ল।

ডাক্তার এসে পরীক্ষা ক’রে দেখে ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন।

‘কোন শক্-টক্ লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। হার্টের যা অবস্থা–এটা খুব খারাপ হ’ল।…কিন্তু কী করে হ’ল কেউ জানেন না আপনারা?’

হরেনের সুগৌর মুখ অকারণেই লাল হয়ে উঠল। বার দুই ঢোক গিলে বলল, ‘সেটা আমরা ঠিক–।’ মানে আমি তো এ ঘরে থাকি না আজকাল। মাঝরাত্রে উঠে কখন যে। আয়না মানে আমাদের পুরনো ঝি অবিশ্যি ছিল–তবে জানেন তো–সার্ভেন্টরা য়্যাজ এ ক্লাস ইরেস্‌পন্‌সিবল্।’

ডাক্তারের চেষ্টায় কিছু পরেই জ্ঞান হল স্বর্ণর, কিন্তু কী ক’রে যে এমন হ’ল তা জানা গেল না। সে কিছুই বলতে চাইল না। তার নাকি কিছুই মনে নেই। কেন উঠে অমনভাবে দোরের দিকে গিয়েছিল তাও বলতে পারল না। কথা কইলও না বিশেষ। দুই একটা কথা বলার পরই সেই যে ক্লান্তভাবে চোখ বুজল আর খুলল না কিছুতেই। এমন কি তার এত প্রত্যাশিত, এত পথ-চাওয়া স্বামী তার ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে–তাও যেন দেখতে পেল না সে।

বোধ হয় তার উপস্থিতি টের পেয়েই আরও দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরল।

ডাক্তারও বেশি কথা বলাতে চাইলেন না। ওদেরও বারণ করলেন বেশি প্রশ্ন ক’রে বিরক্ত করতে। এরকম ফিটের পর অপরিসীম ক্লান্তি আসে, সেইটেই স্বাভাবিক। এখন বরং যেটা সর্বাগ্রে দরকার, সেইটেই করুক তারা–কিছু গরম পানীয় বা পথ্য এনে দিক।

কিন্তু সেইখানেই একটা বড় ররকমের গণ্ডগোল বাধল। কিছুই খেতে চাইল না সে– একবিন্দু কিছু মুখে তুলতে রাজি হ’ল না। তার এক কথা–’আমার কিছু ভাল লাগছে না– আমাকে একটু ঘুমোতে দাও তোমরা, তোমাদের পায়ে পড়ি!

প্রথমে ঝি পরে জা-দেওররা এল। অনুরোধ অনুযোগ–শেষে কিছু ধমক-ধামকও করল তারা। এমন কি স্বয়ং শাশুড়ীও, প্রাণপণে নিজের শুচিতা ও স্বাস্থ্য বাঁচিয়ে, বাইরে থেকে নাকি-সুরে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ ক’রে গেলেন। কিন্তু স্বর্ণ সেই যে দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে ছিল–এদিকে ফিরলও না, কথাও বলল না। খেলও না কিছু।

আরও একটা বিচিত্র ব্যাপার–এই উপলক্ষে বাড়ির প্রায় তাবৎ লোকই এল খাওয়ার জন্য উপরোধ-অনুরোধ, পীড়াপীড়ি করল, কেবল যার সর্বাগ্রে আসবার কথা সেই হরেনই–একবারও এল না বা কেন তার স্ত্রী কিছু খাচ্ছে না–এ প্রশ্ন করল না। বরং সে যেন চেষ্টা করেই একটু আড়ালে আড়ালে রইল। ভাইয়েরা ডাকতে গেলে বলল, ‘তোমরা সবাই বলছ তাতে যখন খাচ্ছে না, আমি বললেই কি খাবে? তা নয়, এইসব অসুখে মাঝে মাঝে একটা অকারণ অভিমান হয়। এই ধরনের মনোভাব থেকেই ফিটটাও হয়েছে। এখন আর বেশি বকিয়ে লাভ নেই, বরং খানিকটা ঘুমোতে দাও, ঘুম ভাঙ্গলে মাথা ঠাণ্ডা হ’লে আপনিই খাবে!’

হরেন নিজেও সেদিন বাড়িতে খেল না। দেরি হয়ে গেছে, এই অজুহাতে তাড়াতাড়ি স্নান ক’রে এক গ্লাস শরবৎ খেয়ে বেরিয়ে গেল। অত্যন্ত নাকি জরুরি কাজ আছে অফিসে, কী সব হিসেবের গোলমাল হয়েছে ক্যাশে–সাহেবরা আসবার আগে সেটা ঠিক ক’রে ফেলতে হবে–অকারণেই সবাইকে শুনিয়ে কৈফিয়ৎ দিয়ে গেল।

কিন্তু খানিকটা ঘুমিয়ে উঠেও অবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি হ’ল না। কোন খাদ্যই– জল ছাড়া অন্য কোন পানীয়ও মুখে তুলতে রাজি হ’ল না স্বর্ণ। এমন কি কোন ওষুধও না। যাকে বলে দাঁত দিয়ে থাকা–তাই রইল সে।

জা-দেওরদের মধ্যে জীবেনই চিরদিন বৌদির একটু বেশি অনুগত, আজও সে টানটা তার সম্পূর্ণ যায় নি। অফিসের ফেরৎ বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে ওর এই কঠোর উপবাসের কথা শুনে অফিসের পোশাকসুদ্ধই বৌদির ঘরে এসে ঢুকল। ঝিকে সরিয়ে দিয়ে একেবারে কাছে এসে প্রশ্ন করল, ‘বলি মতলবটা কি বল তো বৌদি, তুমি কি আত্মহত্যে করতে চাও?’

এবার কথা বলল স্বর্ণ, ওর দিকে মুখও ফেরাল। দেওরের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘বাঁচব না বেশিদিন–এটা তো ঠিক? সে তোমরাও বুঝছ, আমিও বুঝছি। মিছিমিছি এই পেরমায়ুটা অনত্থক কটা দিন টেনে বাড়িয়ে লাভ কি? নিজেরও দগ্ধানি- তোমাদেরও জ্বালাতন। আমি বিদেয় হ’লে তোমার দাদা একটা বিয়ে করতে পারবে সে তবু ভাল। তার দুদ্দশা আমি আর চোখে দেখতে পারছি না ঠাকুরপো। তাই–যেতেই যেকালে হবে–যাওয়াটা একটু শিগির শিগির করতে চাই।…কটা দিন কোন মতে একটু চোখ-কান বুজে থাকো–তারপর আমারও পোড়ানির শেষ, তোমরাও সব দায়ে নিশ্চিন্তি! আর কারুর জন্যে ভাবতে বসতে হবে না!’

কী বুঝল জীবেন, কে জানে। খানিকটা চুপ ক’রে থেকে বলল শুধু ‘যার দুর্দশা বরাতে আছে তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না বৌদি। পাঁকের মাছ পাঁকেই ভাল থাকে। কিন্তু তুমি শুধু দাদার কথাই ভাবছ কেন, ছেলেমেয়েগুলোর কথাও ভাবো। একটা সত্মা এসে ঘাড়ে চেপে বসলে কি ওরা মানুষ হবে–না বাঁচবেই কেউ?’

আমি আর কারুর কথাই ভাবব না ঠাকুরপো’, স্বর্ণ দৃঢ়স্বরে বলে, ‘সোয়ামী পুত্তুর- সংসার সবেতে আমার ঘেন্না হয়েছে। এবার আমি ছুটি চাই তোমাদের কাছে শুধু। ব্যাগত্তা করি আমাকে ছেড়ে দাও!’

জীবেন এবার চুপ ক’রে গেল। ভাল মানুষ স্বর্ণর এ চেহারা, কণ্ঠের এ দৃঢ়তা তার কাছে একেবারে নতুন। সে হাত-পা নেড়ে চেঁচায়, কথায় কথায় ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, পীড়াপীড়ি ক’রে বকে-ঝকে লোককে খাওয়ায়; খাওয়া নিয়ে ‘ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া ক’রে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে–সেই স্বর্ণই জীবেনের পরিচিত। সেই সরল, স্নেহ-কোমল মানুষটার এই রূপান্তর কতখানি আঘাতে সম্ভব হয়েছে–তা বুঝেই আর বৃথা কথা বাড়াতে চাইল না সে। এ আঘাত যার কাছ থেকে এসেছে সে নিজে এসে ক্ষমাপ্রার্থনা না করলে, অনুতাপে প্রতিশ্রুতিতে এই নিদারুণ বেদনা মুছে নেবার চেষ্টা না করলে–কোন লাভ হবে না অপর কারুর অনুরোধ-উপরোধ পীড়াপীড়িতে। তার চেয়ে দাদা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল। সে এলে তাকে বুঝিয়ে বলে, প্রয়োজন হয় তো জোর করেই তাকে এ ঘরে পাঠাবে। তার জন্যে দরকার হ’লে তাকে ভয় দেখাতেও পশ্চাদ্‌পদ হবে না জীবেন। নতুন ঝি সম্বন্ধে দাদার দুর্বলতাটা বাড়িসুদ্ধ সবাইকার চোখেই দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে। জীবেনের অনুমান, বৌদির আজকের এই আচরণের সঙ্গে সেই অশোভন পক্ষপাতের কোন নিগূঢ় যোগাযোগ আছে। ঐ দিক দিয়েই হরেনকে জব্দ করতে হবে, লোক-লজ্জা কেলেঙ্কারির ভয় দেখিয়ে! …

.

কিন্তু শেষ পর্যন্ত অত কিছু করতে হ’ল না। তার আগেই সন্ধ্যার সময় একেবারে অপরিচিত একটি আগন্তুক এসে উপস্থিত হ’ল ওদের বাড়িতে, ওদের জীবনে।

কেউই তাকে চিনত না এ বাড়িতে। কেউই দেখে নি। দামি সাহেবী পোশাক-পরা রীতিমতো সম্ভ্রান্ত চেহারার একটি ভদ্রলোক মোড়ের মাথায় প্রকাণ্ড একটা গাড়ি থেকে নেমে হরেনবাবুর বাড়িটা কোন্ দিকে খোঁজ করছেন–এ খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ বাড়ি পৌঁচেছিল। স্বর্ণরই বড় ছেলে ভুতু ইস্কুল থেকে ফুটবল খেলে ফিরছিল, সে-ই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে এসে মেজকাকাকে খবরটা দিলে। সে স্পষ্ট শুনেছে হরেনবাবুর নাম–তবে তার সাহস হয় নি এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দেবার বা সঙ্গে ক’রে ডেকে আনবার। অতবড় গাড়ি থেকে অমন ফিটফাট দামি পোশাক পরে যে নেমেছে–সে ভুতুর সঙ্গে কথা কইবে বা ভুতু কথা কইলে জবাব দেবে–এমন ভরসা তার হয় নি। ওদের সঙ্কীর্ণ চার হাত গলি, তার মধ্যে গাড়ি ঢুকবে না, কিন্তু বাইরের যে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়েছে সেও যথেষ্ট চওড়া নয়। ও গাড়ি সাকে-শিবপুরের সব রাস্তাতেই বেমানান। তাই শুধু গাড়িখানা দেখতেই বহুলোক জড়ো হয়েছে সেখানে–ভুতু সে খবরটাও দিল কাকাকে।

জীবেন শুনে কৌতূহলী হয়ে বাইরে যাচ্ছে–এমন সময় সদরে কড়া নড়ে উঠল। সে ভদ্রলোক এসেছেন।

জীবেন দেখল ভুতুর বর্ণনা আদৌ অতিরঞ্জিত নয়। সে নিজেও একটু শৌখিন, মোটামুটি ভালো চাকরিই করে–পোশাক-আশাকের দর সম্বন্ধে তার ধারণা অনেকটা নির্ভুল। ভদ্রলোকের গায়ে যে পোশাক–সত্যিই তার দাম অনেক। লোকটি যে অবস্থাপন্ন তাতে কোন সন্দেহ নেই। দেখতেও বেশ সুপুরুষ, বয়স জীবেনের চেয়ে কমই হবে–যদিচ এই বয়সেই ছোকরা এমন একটা শান্ত গাম্ভীর্য আয়ত্ত করেছে যে দেখামাত্র সম্ভ্রমের উদ্রেক হয় মনে–বেশ সমীহ ভাব জাগে।

মিনিটখানেক দুজনেই দুজনকে চেয়ে দেখল নীরবে। তারপর জীবেন যেন একটু সাহস সঞ্চয় ক’রে প্রশ্ন করল, ‘কাকে চাই আপনার?’

‘এটা কি হরেনবাবুর বাড়ি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘হরেনবাবু বাড়িতে আছেন?’

‘না। আপনি কোথা থেকে আসছেন?’

‘বলছি। তিনি কখন ফিরবেন বলতে পারেন?’

রাত বারোটা-একটার আগে নয়, দুটো-আড়াইটেও হ’তে পারে।’

একটু হাসির ভঙ্গি ক’রে উত্তর দিল জীবেন।

‘ও, তাই নাকি?…তা অত রাত্রে তো আর–। তাঁকে অন্য কোন্ সময় বাড়িতে পাওয়া যায়?’

‘সকালে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত।’

একটুখানি চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবলেন ভদ্রলোক, তারপর বললেন, ‘আচ্ছা বুঁচি–মানে হরেনবাবুর স্ত্রী কেমন আছে বলতে পারেন?…একটু–একটু ভালর দিকে কি?’

জীবেন ক্রমেই বেশি বিস্মিত হয়ে উঠছে।

‘মধ্যে একটু ভালর দিকেই গিয়েছিল কিন্তু আবার এই দিনকয়েক হ’ল–।…আজ তো খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। কিন্তু–আপনি, মানে আপনাকে তো চিনতে পারছি না ঠিক?’

‘আমি ওর সম্পর্কে ভাই হই। ওকে বললেই চিনতে পারবে। আপনার চেনবার কথা নয়, আপনার দাদারও–হরেনবাবু আপনার দাদা তো?–চাক্ষুস চেনেন না আমাকে, পরিচয়ে চেনেন হয়ত, বুঁচি মানে স্বর্ণলতার মুখে শুনে থাকবেন।…আমি একটু ওকে দেখতে চাই, আসলে ওকে দেখতেই আমি এসেছি–ওর এই অসুখের খবর শুনে। আপনি আপনার বৌদিকে গিয়ে বলুন যে, তার অরুণদা এসেছে–তার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’

আজ কি আর চমকের শেষ হবে না?–জীবেন ভাবে। তার বৌদির ভাই বলতে এতাবৎ কাল যাদের দেখে আসছে–ময়লা খাটো কাপড় আর কোঁচকানো সস্তা দামের ছিটের জামা পরা কতকগুলি নিরক্ষর গ্রাম্য ছোকরা–তাদের সঙ্গে এই সুবেশ সুশ্রী কেতাদুরস্ত ভদ্রলোকটির কোন সম্পর্ক আছে, তা কেউ একগলা গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে বললেও বিশ্বাস করা শক্ত।

‘কিন্তু এখন তো তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না, বৌদির শরীর খুব খারাপ, –এখন কথাবার্তা বলা উচিত নয় তার পক্ষে’, এইটেই বলতে যাচ্ছিল জীবেন, হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, যে অসহ্য গুমোট আবহাওয়া চলছে, তাতে বাইরের এই দমকা বাতাস লাগলে কিছু উপকারই হ’তে পারে। বাপের বাড়ির লোককে দেখলে কিছু নরম হয়ে পড়বেই–আর এখন সেইটেই সবচেয়ে দরকার।

সে বাইরের ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বেলে দিয়ে বললে, ‘আপনি বসুন একটু–আমি দেখছি তিনি জেগে আছেন কি না!’

.

স্বর্ণ বহুক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাসই করতে পারল না কথাটা, ‘কী বলছ তুমি! অরুণদা! কিন্তু তা কেমন ক’রে হবে–সে যে বহুকাল দেশ-ভুঁই ছাড়া। সেই আমার বের পরদিন উধাও হয়েছে–আজ অদি আর কোন খবর নেই। সে কি বেঁচে আছে এখনও? বেঁচে থাকলে এতকালের মধ্যে আমার উদ্দিশ নিত না একবারও?…না, না, নিশ্চয়ই তুমি ভুল শুনেছ ঠাকুরপো, আর কাউকে খুঁজছে দেখগে যাও, অন্য কোন অমুক বাবুর বৌকে খুঁজতে এসেছে, লোকে এই বাড়ি দেখ্যে দিয়েছে!’

‘কিন্তু তোমার নাম বলছে যে মায় তোমার ডাক-নাম সুদ্ধ!’

নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই স্বর্ণর স্তিমিত নিঃশেষিতপ্রায় সত্তায় যেন একটা বৈদ্যুতিক ক্রিয়া ঘটিয়েছিল। এখন তার প্রতিক্রিয়া শুরু হ’ল। দুর্বল দেহে সামান্য উত্তেজনাই যথেষ্ট–এ তো একটা ঢেউয়ের মতো এসে পড়েছে সংবাদটা! অরুণদা মানেই তার বাল্যের কৈশোরের সহস্র স্মৃতি। বাপের বাড়িতে সকলের আদরে প্রশ্রয়ে প্রতিপালিত হওয়া, সর্বত্র সমস্ত ব্যাপারে অখণ্ড প্রতাপ, তার বিয়ে, উৎসব সমারোহ–কত কী আশার স্বপ্ন দেখা সেই প্রাণোচ্ছল দিনগুলি–একসঙ্গে যেন ভীড় ক’রে ঢুকতে চাইছে তার মাথায়। ঐ ছেলেটিও–মুখচোরা লাজুক ভীরু ছেলেটি–স্বর্ণর স্নেহচ্ছায়াপ্রত্যাশী, একান্তভাবে নির্ভরশীল অসহায় অনাথ ছেলেটি। যাকে খুঁজে আনতে হ’ত বাঁশবন ডোবার ধার থেকে, জোর ক’রে ধরে না খাওয়ালে যে খেত না।…সে সব স্মৃতি–বিশেষ করে আজকের এই মোহভঙ্গের ও সর্বপ্রকার আশাভঙ্গের দিনে রক্তে যেন কী এক অদ্ভুত বেদনাভরা, চাঞ্চল্য জাগিয়েছে, সে চাঞ্চল্য তার দুর্বল বুকে গিয়ে সজোরে আঘাত করছে। বুকের মধ্যে কী একটা তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে।…

সে প্রাণপণে বুকটা চেপে ধরে চোখ বুজে পড়ে রইল কিছুক্ষণ, আগের মতোই স্থির নিশ্চল হয়ে।…

তার সেই যন্ত্রণাবিকৃত বিবর্ণ মুখের দিকে চেয়ে জীবেন ভয় পেয়ে যায়, বলে, ‘তবে থাকগে। আমি বলে আসি বরং অন্য একদিন আসতে, আজ তোমার শরীর ভাল নেই —

‘উঁহু, উঁহু, চোখ বুজে বুজেই ইঙ্গিতে নিরস্ত করে স্বর্ণ–কিন্তু তখনও কোন কথা বলতে পারে না।’

ফলে জীবেনও বিপন্নমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। কী করবে, কী করা উচিত ভেবে পায় না। এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও নিরাপদ নয়; একটু আগেই এ ঘরে এত ঘন ঘন আসার জন্য স্ত্রীর কাছে বকুনি খেয়েছে।’ছেলেমেয়েগুলোকে সুদ্দু না মজালে তোমার চলছে না বুঝি? চোদ্দবার ঘরে ঢুকে ঐ রুগীর গায়ের ওপর ঢলাঢলি না করলে বুঝি আর বৌদির ওপর সোহাগ জানানো হয় না? যার পরিবার সে কত ঢুকছে ঘরে?’ ইত্যাদি। তখন কাপড়-জামা বাইরে ছেড়ে রেখে ভাল ক’রে গা-হাত-পা ধুয়ে তবে ঘরে ঢুকতে পেয়েছিল। এখন আবার এ ঘরে এতক্ষণ থাকতে দেখলে হয়ত বাড়ি মাথায় করবে। আর কিছু নয়–কথাগুলো স্বর্ণর কানে না ওঠে, এই ভয় জীবেনের। মেয়েদের এ সব বিবেচনা নেই, কিন্তু পুরুষদের কাছে এগুলো লজ্জা ও পরিতাপের কারণ হয়ে ওঠে।

কিন্তু বেশিক্ষণ তাকে দাঁড়াতে হ’ল না আর, স্বর্ণ একটু সামলে নিয়েই চোখ খুলে বলল, ‘আচ্ছা, যে লোকটা এসেছে–কেমন দেখতে বল দিকি? পোশাক-আশাক কেমন দেখলে?’

সুন্দর চেহারা। আর পোশাকও খুব দামি, ভাল সাহেববাড়ির স্যুট মনে হ’ল। বিরাট গাড়ি করে এসেছে–

-–’ধ্যুস!’ হতাশভাবে মুখে একটা শব্দ করে স্বর্ণ, ‘ও তবে অন্য কেউ। এক কাপড়ে বেরিয়ে গেছল সে, তিন কুলে কেউ নেই,–কোথায় দাঁড়াবে, কী খাবে তারই ঠিক ছিল না সে অত পয়সা কোথায় পাবে?’

‘তা কি বলা যায়! যুদ্ধের বাজারে পয়সা উড়ছে। কে কনে দিয়ে কী ধরে নিচ্ছে তা কেউ জানে না। তবে অত কথায় দরকারই বা কি, ডেকেই আনি না, চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যাক।’

‘আনবে? কিন্তু আমার এই ব্যায়রামের মধ্যে আনা ঠিক হবে?…তাকে বলেছ আমায় এই রোগ ধরেছে?’

‘সে সব জানে। জেনেই দেখতে এসেছে। অন্তত তাই তো বললে।’

‘জানে? জেনে দেখতে এসেছে?…কিন্তু তা কী করে হবে? সে কি এ রাজ্যিতে ছিল? কে জানে বাপু আমার মাথার মধ্যে যেন সব গুল্যে যাচ্ছে!…তা আনো না হয় তাকে ডেকে। ভুল হয় তো চলেই যাবে। বুঝব আমার নামে পাড়া-ঘরে আরও লোক আছে।…কিন্তু তিন-তিনটে নাম কি মিলে যেতে পারে এমন করে?’…

।।২।।

অরুণ ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াতে জীবেনের ইঙ্গিতে আয়না একটা টুল এগিয়ে দিল বিছানার কাছাকাছি। অরুণ কাছে এসেই দাঁড়িয়েছিল কিন্তু টুলটা দেখতে পেল না। সে তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল বিছানার দিকে–অথবা বিছানার ওপর শাড়িতে-জড়ানো যে কঙ্কালটা পড়ে আছে, তার দিকে।

ঘরে ষাট বাতির আলো, ভেতরের ঘর বলে ঠুসি পরাবার দরকার হয় নি–বেশ জোরালোভাবেই এসে পড়েছে ওদের ওপর, দুজনেই দুজনকে কাছ থেকে দেখছে–তবু কেউ-ই যেন চিনতে পারছে না কাউকে। চিনতে পারার হয়ত কথাও নয়, কারণ দুজনেরই সেই শেষ দেখার পর অবিশ্বাস্য রকমের পরিবর্তন ঘটেছে।

অরুণদা বলতে সেই ওর বিয়ের দিনের চেহারাটাই মনে আছে স্বর্ণর। ফরসা সে বরাবরই, কিন্তু সে যে এত ভাল দেখতে তা একবারও মনে হয় নি তখন। হয়ত অত রোগা ছিল বলেই বোঝা যেত না। আসলে অরুণের চেহারার কোন বৈশিষ্ট্য অত লক্ষও করে নি স্বর্ণ কখনও। যে মানুষটা শুধু আত্মীয়, তেমন নিকট-সম্পর্কের কেউ নয়, যে আরও অনেকের মধ্যে একজন হয়ে মিশে থাকে, কখনও সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে না, তার চেহারা ঠিক কেমন তা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না বোধহয়। অত কাছাকাছি ছিল বলে ভাল করে তার মুখচোখের দিকে তাকিয়ে দেখার কথা মনেও হয় নি কোনদিন।

কিন্তু তবু, আদল একটা মনে আছে বৈকি! স্বর্ণ এখন এই গৌরবর্ণ বলিষ্ঠ দীর্ঘাকৃতি সুপুরুষ মানুষটার মধ্যে সেই ভীরু লাজুক ছেলেটির আদলই খুঁজতে লাগল প্রাণপণে। মানুষে মানুষকে চেনে বেশির ভাগই চোখ দেখে, কিন্তু তাও যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে সদা-সঙ্কোচ-বিনম্র চাহনির চিহ্নমাত্রও নেই এই স্থির আত্মপ্রত্যয়ী দৃষ্টিতে।…

পরিবর্তন হয়েছে স্বর্ণরও।

আজকের এই রুগ্ন কঙ্কালসার প্রায়-মধ্যবয়সী স্ত্রী লোকটির মধ্যে সেদিনের সেই প্রাণচঞ্চলা বালিকাটিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে অরুণের একেবারে চিনতে না পারার কথা নয়। কারণ সে তার আপাত-নত চোখে সেদিন স্বর্ণকে খুঁটিয়েই দেখেছিল। শুধু স্বর্ণকেই দেখেছে বোধ করি জীবনে, অপর কোন মেয়ের দিকে কোনদিন তাকাবার ইচ্ছা বা প্রয়োজন বোধ করে নি। তাই স্বর্ণের দেহের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য তার পরিচিত। বিশেষত ওর ঐ কটা চোখ–সে চোখ আজ কোটরগত হ’তে পারে কিন্তু তার বর্ণান্তর ঘটা সম্ভব নয়।

অবশেষে চিনতে পারল দুজনেই।

দুজনেরই দুজনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে দুই চোখ জ্বালা করে জল ভরে এল। দুজনের অবশ্য দুই ভিন্ন কারণে। স্বর্ণর বহু স্মৃতি বহু বেদনা নিঙড়ানো জল এ। তার অশ্রুর উৎস অতীতে। অরুণের অশ্রুর উৎস বর্তমানে। স্বর্ণর এই পরিণাম দেখেই তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। ওর চোখেও ছিল সেই বিয়ের আগের দিনগুলোর স্মৃতি। সর্বশেষ স্মৃতি, বিয়ের সময়কারই। গোলগাল গড়নের স্বাস্থ্যবতী মেয়েটির ছবিই এতকাল মনে ছিল তার। সেই চেহারাটাই মনে করে রাখার চেষ্টা করেছে সে, সেই চেহারারই স্বপ্ন দেখেছে অবসর সময়ে। সে স্বাস্থ্য ও লাবণ্যর এমন পরিবর্তন হতে পারে তা কখনও ভাবে নি।…

বহু কষ্টে গলার কাছের ঠেলে-ওঠা ডেলাটাকে দমন করে স্বর্ণ প্রায় চুপিচুপি বলে, ‘এতদিন পরে মনে পড়ল তাহলে বুচিকে অরুণদা! ও, কী কষ্টটাই দিয়েছিলে আমাদের তুমি। বাব্বাঃ। তোমার মনে এত ছিল তা কে জানত, তাহলে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে জোর করে সঙ্গে নিয়ে আসতুম শ্বশুরবাড়ি!…কতদিন ভেবেছি তোমার কথা, দুপুর-বেলা একা কাজকর্ম করে বেড়াতে বেড়াতে, কিম্বা রাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলেই তোমার কথা মনে পড়ত। কেবলই মনে হ’ত যে কোথায় আছ, কী করছ–মাথার ওপর একটু আচ্ছাদন জুটছে কিনা, দুবেলা খেতে পাচ্ছ কিনা–এই সব কথা।…মনে হ’ত তুমি বুঝি এখনও তেমনি মুখ-চোরাই আছ। কেউ খেতে না দিলে তো খেতে না কোনদিন, তাই, মনে হ’ত হয়ত কোনদিনই পেট ভরে খেতে পাচ্ছ না।…সত্যি, বললে বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, এই কদিন বিছানায় পড়ে পড়ে বহুবার তোমার কথা ভেবেছি। ভেবেছি যাবার দিন তো ঘনিয়ে আসছে–মরবার আগে যদি জানতে পারতুম যে, তুমি বেঁচে আছ, তা’হলে নিশ্চিন্তি হয়ে মরতে পারতুম!‘

কথাগুলো বলতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। থেমে থেমে আস্তে বলতে হল স্বর্ণকে। একে দুর্বল শরীর তায় সারাদিন অনাহার–কথা কইতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে ওর তখন।

অরুণেরও উত্তর দিতে সময় লাগল। এ-কথা শোনবার কখনও আশা করে নি সে। এ তার সুদূর কল্পনারও অতীত। দুরাশা–একান্তই দুরাশা। তাই তার পক্ষে উত্তর দেওয়া আরও কঠিন। সে স্বর্ণর দিকেও চাইতে পারল না আর, জলটা বাইরে যদি উপচে পড়ে তো সে বড় লজ্জার কথা হবে। ওপাশের পিকদানিটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে প্ৰাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে লাগল।

স্বর্ণই কথা বলল আবার, ‘হ্যাঁ অরুণদা, তুমি নাকি আমার এই ব্যায়রামের খবর পেয়ে দেখতে এসেছ?–ঠাকুরপো বলছিল? তুমি আমার অসুখের খবর পেলে কি করে?…এ টহরনে ছিলে নাকি তুমি?’

এবার অরুণ উত্তর দিল, ‘আমি যেখানেই থাকি, তোমার খবর ঠিক পৌঁছয় আমার কাছে। তোমার কোন খবর আমার অজানা নেই।’

আরও অনেক কিছু বলতে পারত সে। বলতে পারত যে, ‘আমার একটা চোখ ও একটা কান, মন আর মাথার আধখানাও আমি সর্বদা তোমার কাছেই রেখে দিই। আমার গোচরসীমার বাইরে তুমি একটুখানির জন্যেও যেতে পারো নি কোনদিন। আমি দূরে থাকলেও আমার একটি অতন্ত্র সত্তা দিনরাত তোমার কাছে প্রহরায় থাকে।’ কিন্তু নাটক করা তার কোনকালেই অভ্যাস নেই, আজও পারল না। হৃদয়াবেগ সে দমনই করল বহু চেষ্টায়।

‘ওমা, তাই নাকি!…কী হবে মা। অথচ তোমার একটা খবরও দাও নি কখনও! কী ছেলে বাবা তুমি। ধন্যি, পাষাণ প্রাণ তোমার!’

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘যাক, তবু যে এখনও এলে দয়া করে সে-ও ভাল। নইলে মরবার আগে শেষ-দেখাটাও হত না। এ তবু নিশ্চিন্তি হয়ে মরতে পারব।’

অরুণ কেন গলাটাকে কিছুতে আয়ত্তে আনতে পারে না? নিজের ওপরই রাগ হয়ে যায় তার। এত চেষ্টা করেও গলার মধ্যেকার কাঁপনটাকে সংযত করতে পারে না কেন?…

বেশ খানিকটা পরে, প্রায়-বিকৃত কণ্ঠে বলে, ‘তোমাকে মরতে দিচ্ছে কে এরই মধ্যে? তোমাকে আমি জোর করে বাঁচিয়ে রাখব–সারিয়েও তুলব!’

সেই পুরাতন হাসি ফুটে ওঠে স্বর্ণর মুখে, আর সেই সময়েই চকিতে অরুণের মনে হয়–যাকে সে চিনত, যে তার পরিচিত, এ সেই পুরনো বুঁচি।

স্বর্ণ হেসে বলে, ‘কত গেল রথারথী, সেওড়া গাছে চক্কবত্তী।…তুমি আমাকে বাঁচিয়ে তুলবে? তবেই হয়েছে। বলি মন্তরতন্তর, দৈব ওষুধষুধ কিছু জানো নাকি? নাকি ঝাড়ফুঁক শিখেছ? এত জোরের সঙ্গে কথা বলছ?’

অরুণ এ বিদ্রূপের কোন উত্তর দেয় না। বোধ করি এর অন্তর্নিহিত ব্যঙ্গটা ওকে স্পর্শও করে না। সে সহজ শান্তকণ্ঠে বলে, ‘আমি পাহাড়ের ওপরে ভাওয়ালী স্যানাটোরিয়ামে ঘর ঠিক করেছি, তোমাকে নিয়ে যাব সেখানে। সেই জন্যেই এসেছি আজ, হরেনবাবুকে বলতে। খরচপত্র সব আমি জমা করে দিয়েছি–তাঁর কোন অসুবিধে বা অমত হবে বলে মনে হয় না। তা আজ তো আর দেখা হ’ল না, কাল সকালে এসেই দেখা করব। সময়ও নেই বেশি হাতে, ওদিকে সব ব্যবস্থাই করে রেখেছি, পরশুর ট্রেনে রিজার্ভেশন করা আছে।…হরেনবাবুর এতে আপত্তি হবার কথাও নয়–উনি তো অনেক চেষ্টা করেও এখানে বেড যোগাড় করতে পারেন নি কোন হাসপাতালে, এটা যখন পাওয়া গেছে, তখন নিশ্চয় খুশিই হবেন উনি।…টাকাকড়ি ওখানে যা কিছু ওঁর নামেই জমা দিয়েছি। উনি যদি যেতে চান–তিনটে বার্থই রিজার্ভ করেছি আমি, কাঠগুদাম পর্যন্ত।’

ঠিক এ উত্তরের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না স্বর্ণ। তার মুখে ব্যঙ্গের হাসিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সে জায়গায় ফুটে উঠল একটা সুগভীর বিস্ময়। অনেকক্ষণ অবাক হয়ে অরুণের মুখের দিকে চেয়ে থেকে আবারও সেই আগের মতো চুপি-চুপি বলল, ‘তুমি আমার জন্যে হাসপাতালে ঘর ঠিক করেছে? তুমি আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে? নিজের খরচায়?…কেন, কেন এ ছিষ্টি করতে গেলে অরুণদা, আমার যে আর মোটে দেরি নেই মারবার! বাঁচতেও আমি চাই না যে। বাঁচায় আমার ঘেন্না হয়ে গেছে চিরদিনের মতো। আমি যে–আমি আজ মরব বলেই সারাদিন ওপোস করে পড়ে আছি যে। আমার জন্যে অনত্থক কেন এত পয়সা খরচ করতে গেলে অরুণদা! ছি ছি। কেন এসব করলে তুমি!’

এবার অরুণ ভরসা করে আবার ওর চোখের দিক চাইল। তেমনি শান্তস্বরে বলল, ‘কিন্তু ইচ্ছে করলেই মরতে পারো তুমি–এমন কথাই বা কে তোমার মাথায় ঢোকাল! যা খুশি তুমি করবে, আর আমরা চুপ করে বসে দেখব সবাই, এ তুমি ভাবলে কী করে!…তুমি সুখে থাকবে, ভাল থাকবে–এই আশা করেই তোমাকে এখানে পাঠিয়েছিলুম, ধরে রাখার চেষ্টা করি নি। সেইজন্যেই এতকাল সরে ছিলুম, কখনও সামনে আসবার চেষ্টা করি নি। তোমার সুখের পথে, শান্তির পথে আমার দুর্ভাগ্যের ছায়া না কোনদিন পড়ে, ভগবানের কাছে নিত্য এই প্রার্থনাই করেছি দিনরাত। কিন্তু তাই বলে দুঃখের দিনেও সরে থাকব, এত সহজে তোমাকে ছেড়ে দেব–এ তুমি মনে ক’রো না একবারও। এবার জোর করেই ধরে রাখব তোমাকে–দরকার হয় তো। এত সহজে রেহাই পাবে না আমার হাত থেকে।’

এবার আর চোখের জল বাধা মানে না স্বর্ণর। দুই চোখের কোল উপচে দরদর ধারে ঝরে পড়ে। এ কতকটা কৃতজ্ঞতার অশ্রু। আনন্দেরও। এখনও তার প্রাণের এত মূল্য আছে তাহলে কারুর কাছে! পৃথিবীর সবাই তাহলে স্বার্থপর নয়, নির্মম নয়–অকৃতজ্ঞ নয়। এখনও অন্তত এমন একটি লোক আছে যে কোন প্রতিদানের আশা না রেখেই তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতে চায়! তার সুখের জন্যই তাকে রাখতে চায়!

অরুণকে পৌঁছে দিয়েই, ওরা পরস্পরের পরিচিত এইটুকু জেনে নিশ্চিন্ত হবার পরই, জীবেন বেরিয়ে গিয়েছিল। শুধু আয়না ওধারের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে ছিল এদের দিকে! অরুণ তাকে ইঙ্গিতে প্রশ্ন করল, ‘কিছু খেয়েছে ও?’ আয়নাও ঘাড় নেড়ে জানাল, ‘না কিছুই মুখে দেয় নি।’

অরুণ তখন–স্বর্ণ শুনতে পায় এমনভাবেই–বলল, ‘ওকে দুধ না হর্লিকস্ কি দেবে গরম করে দাও দিকি। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

আয়না ত্রস্তেব্যস্তে গরম জলের সন্ধানে ছুটল। ধরে যেন প্রাণ এল তার…সারাদিন তারও খাওয়া হয় নি। বুড়ো মানুষ সমস্ত দিন অনাহারে কান্নাকাটি করে অবসন্ন হয়ে পড়েছিল।

অরুণ এবার স্বর্ণর দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, ‘সত্যি সত্যিই তুমি খাও নি সারাদিন?…এ পাগলামি তোমার ঘাড়ে চেপেছিল কেন? ও মানুষটাকেও তো খেতে দাও নি দেখছি!’

‘ওসব কথা এখন থাক অরুণদা’, অশ্রুবিকৃতকণ্ঠে উত্তর দেয় স্বর্ণ, সজল চোখে একটু হাসি ফোঁটাবারও চেষ্টা করে, ‘এখন আর ওসব কথা বলব না। ভাবও না।…অন্য কথা বলো। তোমার কথা।…আচ্ছা, তাহলে মেজঠাকুরপো যা বলছিল তাই সত্যি? তুমি খুব বড়লোক হয়েছে?…খু-উ-ব? অনেক পয়সা হয়েছে তোমার?’

‘কে বললে এসব কথা? এত সব আবার কবে শুনলে? তবে যে বলছিলে আমার খবর পাও নি—’

‘মেজঠাকুরপো বলছিল এই মাত্তর। তুমি নাকি এত বড় মটরগাড়ি করে এসেছ যে, রাস্তার লোক জড়ো হয়ে গেছে? আমার ছেলেও দেখে এসেছে–ভুতু। এত এত পয়সা কী করে কামালে অরুণদা? চাকরি করছ বুঝি আজকাল মোটা মাইনের?’

দূর পাগল! চাকরি করে কি কেউ বড়লোক হয়? যত বড় চাকরিই করুক। ও গাড়ি আমার নয়–যে সাহেবের সঙ্গে কাজ করি, তাঁরই গাড়ি।’

‘সাহেবের সঙ্গে কাজ করো? সে আবার কী কাজ!’

একটুখানি চুপ করে থেকে অরুণ বলে, ‘সে এক রকমের ব্যবসাই। এই যুদ্ধের নানা জিনিস যোগানো গভর্নমেন্টকে। আমি আর কী করে করব। ম্যাকগ্রেগার ডানকান কোম্পানির বড় সাহেব একা গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন, আসানসোলের কাছে য়্যাকসিডেন্ট হয়–এক লরীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে। সে লরী পালিয়ে আসে, গাড়ি-সুদ্ধ পাশের খানায় পড়ে ছিলেন সাহেব! আমি সাইকেল করে আসছিলাম ঐ পথে–ঐ অবস্থা দেখে গাঁয়ের লোকজন ডেকে সাহেবকে গাড়ি থেকে বার করে কোনমতে একটা গাড়ি যোগাড় করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেই আলাপ সাহেবের সঙ্গে। আমার ওপর তাঁর একটা মায়াই পড়ে যায় বোধহয় ঐ ব্যাপারে। তাছাড়া বিশ্বাসী লোকও খুঁজছিলেন একজন–অনেকদিনই ওঁর এই সাপ্লায়ের কাজে নামার ইচ্ছা ছিল কিন্তু চাকরি করে সোজাসুজি তো আবার কারবার করতে পারেন না, তাই আমাকে অংশীদার করে নিলেন। উনিই তদ্বির করে অর্ডার যোগাড় করেন, টাকাও ওঁর–আমি শুধু খাঁটি; লেখাপড়ার কাজ, মাল তৈরি করানো, ঠিক সময়ে পৌঁছে দেওয়া, এই সবই আমার। খুবই পরিশ্রমের কাজ, অন্য লোকও ছিল না। এতদিন পরে আমিই আর একটি ছেলেকে যোগাড় করে নিয়েছি, বিশ্বাসী ছেলে–সে অনেকটা বুঝে নিয়েছে। তাই তো এখন কদিনের ছুটি পেয়েছি। নইলে তোমার সঙ্গে যাওয়াও হয়ে উঠত কিনা সন্দেহ। এখন আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে দিন-পনেরো-কুড়ি থেকেও আসতে পারব।’

ইতিমধ্যে আয়না এক কাপ হর্লিকস না কি একটা পানীয় তৈরি করে নিয়ে এসেছে। স্বর্ণ আর কোন আপত্তি করল না এবার, অরুণের মুখের দিকে চেয়ে একটু অপ্রতিভভাবে হেসে সেটা খেয়ে ফেলল ভালমানুষের মতো। তারপর অভ্যাস-মতো আয়নাকে একটা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘এবার তুমি দয়া করে মুখে কিছু দিয়ে কেদাত্ত করো আমাকে।…হ’ল তো গেলানো– আজকের মতো প্রাণটা তো ধরে রাখা গেল, এবার নিজের প্রাণটা বাঁচাও গে।’

আয়না চলে গেলে অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইল।

স্বর্ণ যেন এখনও ব্যাপারটা ঠিক ধারণা করতে পারছে না। বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। পাহাড়ের ওপর হাসপাতালে যাবে সে, সেখানে গিয়ে ভাল হয়ে উঠবে? কিন্তু এ রোগ কি ভাল হয়? ভাল হওয়া সম্ভব? সত্যি সত্যিই তাকে সারিয়ে তুলতে পারবে অরুণদা?

আচ্ছা, এত জায়গা থাকতে পাহাড়ের ওপরই বা হাসপাতাল করতে গেল কেন? সেখানের হাওয়া ভাল বলে? কী রকম হাওয়া সেখানকার? এই হাওয়াই তো–হ্যাঁওয়া কি আবার দুরকম আছে নাকি?…সে পাহাড় কতদূর তাই বা কে জানে। কোন্ দিক দিয়ে যেতে হয়, রেলগাড়িতে যাওয়া যায় নাকি সবটা? পাহাড়ে তো নাকি হেঁটে উঠতে হয়, সে কি পারবে অতটা হাঁটতে! মরুক গে, সে-ই বা ভেবে মরছে কেন। অরুণদা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবে। পাহাড়ে যেতে পারবে, সেইটেই বড় কথা। এতখানি বয়স হ’ল, পাহাড় কখনও দেখল না সে–ছবিতে ছাড়া। চোখে দেখে নি, তবু আকর্ষণও কম নয়। ছবিতে দেখেই তার বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। চেয়ে থাকতে থাকতে. মনে হয়, এই সবুজ গাছ- পালায় ঢাকা আকাশ-ছোঁয়া মাটির ঢিপিগুলোর মধ্যে না জানি কি এক গভীর রহস্য আছে লুকিয়ে। কে জানে, বুঝি ঐসব জায়গাতেই দেবতারা থাকেন, মুনি-ঋষিরাও বোধ হয় ওখানে তপস্যা করেন বসে। সে শুধু তাঁদেরই জায়গা। আবার মনে হয় তাই বা কেন, শুনেছি তো পাহাড়ের ওপর এখন বড় বড় শহর হয়েছে, রেলগাড়ি যায়, মটরগাড়ি যায়– বড়-লোকরা গরমের সময় যায় হাওয়া খেতে। হরেনও একবার গিয়েছিল, জষ্টি মাসে শাল- দোশালা, গরম কোট, লেপ নিয়ে গেল। ভারি হাসি পেয়েছিল স্বর্ণর সে সময়, এই গরমে গরম জামা। মেজ জা তাকে বুঝিয়েছিল, পাহাড়ে শহর যে সব খুব উঁচুতে, সেইজন্য বারোমাস ঠাণ্ডা। শীতকালে সেখানে ঘাসের ওপর শিশিরগুলো সুদ্ধ জমে বরফ হয়ে থাকে।

কিন্তু ওসবই তার কাছে গল্প-কথার দেশ হয়েছিল এতকাল। ছবিতে দেখা কল্পলোক মাত্ৰ। সে সব দেশ দেখার সুযোগ কখনও হয় নি, হবে বলেও মনে হয় নি। আজ এই মরণের দিকে পা করে–যমের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে বুঝি সেই সুযোগ এল তার জীবনে। কিন্তু যাওয়া কি হবে শেষ পর্যন্ত? পৌঁছতে কি পারবে সেখানে? কিছুতেই যে বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা।

কোথাও কখনও যেতে পায় নি সে। বাইরে যাবার মধ্যে একবার বড় নন্দাইয়ের দেশে গিয়েছিল। দক্ষিণ দেশ না কি আছে সেইখানে। গঙ্গাসাগর যাবার পথে পড়ে বুঝি। তাও তাঁরা বারোমাস সেখানে কেউ থাকেন না, এই ঠাকুরুন-বাড়ির কাছে টালিগঞ্জ বলে কি এক জায়গা আছে–সেইখানেই তাঁদের বাড়িঘর, কি এক কারখানা–সেইটেই আসল বাড়ি। দেশে যান কদাচিৎ কখনও। সেবার পুজোর পালা পড়েছিল বলে গিয়েছিলেন। সবাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই যা যাওয়া–জন্মের মধ্যে কম্ম’।

আর কখনও কোথাও বেরোতে পারে নি। বাপের বাড়ি তাই যেতে দিত না এরা। নমাসে ছমাসে, ক্রিয়াকর্ম পড়লে তবে। তাও এক রাতের বৈ দু রাত নয়। এ বাড়িতে ঢুকে পর্যন্ত এই চার দেয়ালে ঘেরা কৌটোর মধ্যে বন্ধ আছে। একটা বড় রাস্তার কি গাড়িঘোড়া মানুষজনের পর্যন্ত মুখ দেখতে পায় না। সামনে পাঁচ হাত চওড়া ইঁট-বাঁধানো গলি, রিক্সাই আসতে চায় না। ওদিকে বড় রাস্তা, সে-ই বা কতটুকু, দুখানা গাড়ি দুদিক থেকেই এলেই সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। সামনে তবু এই যা একটু ফাঁকা–পিছনে রমাদের তিন তলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মতো। দুপাশেও তিনতলা না হোক, ওদের মতোই দুতলা বাড়ি এক-একটি মোতায়েন আছে। হাওয়া-বাতাস বলতেই বিশেষ কিছু নেই। অবকাশের মধ্যে এই এক ফালি উঠোন আর ছাদ। আকাশ দেখতে হ’লে হয় ছাদে উঠতে হয়, নয়তো উঠোনে নামতে হয়। জন্মাবধি সে গাছপালা, বাঁশঝাড়, পুকুর দেখে মানুষ–গাছপালা ছাড়া যে বাড়ি হয়, তাই তো জানত না। এখানে এসে চারিদিকে এ ইঁটের পাঁচিল দেখে হাঁপিয়ে উঠত প্রথম প্রথম। তারপর অবশ্য সবই সয়ে গেছে, একটু একটু করে সইয়ে নিতে হয়েছে–এই চার দেয়ালের বাইরে যে বিশাল বিস্তৃত বসুন্ধরা পড়ে আছে, তার কথা আর মনেও পড়ে না বোধহয়, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তেইশ ঘণ্টাই। এই দোতলা বাড়ির মোট সাতখানা ঘরেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে ওর জগৎ।

তবু এক এক সময় হঠাৎ মনে পড়ে যায় বৈকি।

কোন নতুন ক্যালেন্ডারে কি ছেলে-মেয়েদের পড়ার বইতে ছবি দেখলে মধ্যে মধ্যে মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় যে পৃথিবীতে সবুজ শস্যে ভরা মাঠ আছে, ঘন গাছপালায় ভরা বাগান আছে, পুকুর আছে ডোবা আছে, খানা-খন্দ আছে। সেই সব মুহূর্তগুলোতে ওদের বাগানের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তের সেই গো-হাড়গেলে ভরা পগার এবং বাঁশবনের ধারে শিয়ালের গর্তও ভাল লাগে। মন লোভাতুর হয়ে ওঠে সেই বিশেষ গন্ধটার জন্যে, সেই ছায়াঘন স্নিগ্ধ ভূমিখণ্ডটুকুর জন্যে। সন্ধ্যাবেলা–এক একদিন বা বেশ বেলা থাকতেই–কুড়ি পঁচিশটা শিয়াল এসে জড়ো হয় ওদের রান্নাঘরের নর্দমাটার ধারে, এক একটা নির্ভয়ে এগিয়ে আসে দরজা পর্যন্ত, একেবারে গায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। সে সময় ভয় ভয় করত, এখন ঐসব বেদনাবিধুর স্মৃতিমন্থর মুহূর্তগুলিতে তাদেরও পরম বন্ধু বলে মনে হয়।

আরও মনে হয়। দেখে নি সে, তবে কল্পনা করতে পারে। পাহাড় পর্বত নদী সমুদ্র– নিজের মতো ক’রে একটা ছবি খাড়া ক’রে নিয়েছে মনে মনে। নিঃসীম নীল সমুদ্র –ছবি দেখে তাকে ধারণা করা যায় না, তবু সে চেষ্টাও করে মধ্যে মধ্যে। পাহাড়ের ছবি অবশ্য দেখেছে অনেক। দার্জিলিঙের খুব একখানা বড় ছবি বাঁধানো আছে মেজ ঠাকুরপোর ঘরে। অনেকদূরে পশ্চিমে কোথায় সিম্‌লে পাহাড় আছে তার কতকগুলো পোস্টকার্ডে ছাপা ছবি দেখেছে সে, কে যেন পাঠিয়েছিল–হয়ত এখনও প্যাটরার মধ্যে খুঁজলে কাপড়ের তলায় পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও নানান পাহাড়ের ছবি চোখে পড়ে মধ্যে মধ্যে। বায়স্কোপে গিয়েও দেখেছে সে।–পাহাড়ের ছবি ঝরনার ছবি। কোন্ দেশে পাহাড়ে বরফ জমে, তাতে সব মেয়েরা পায়ে কাঠ বেঁধে খেলা করে–একবার দেখেছিল ছবিতে।

সেসব ছবি সেসব দৃশ্য ঐ উন্মনা মুহূর্তগুলোতে যেন একসঙ্গে ভিড় ক’রে মনের পর্দায় ফুটে ওঠে আর তারই মায়া যেন দুর্নিবার আকর্ষণে টানতে থাকে ওকে। মনটা ছটফট ক’রে ওঠে–একটু ফাঁকায়, দুটো গাছপালার মধ্যে–আর কিছু না হোক নীল আকাশের তলায় গিয়ে দাঁড়াবার জন্যে।…

সেই দুর্লভ সুযোগ আজ এতদিন পরে হঠাৎ এসে সামনে দাঁড়িয়েছে ওর–একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে।…কিন্তু তবু, এমনভাবেই কি যেতে চেয়েছিল সে? এমনি রুগ্ন অসহায় ভাবে,–সকলের অস্পৃশ্য হয়ে, ঘৃণিত অবজ্ঞাত বিস্তৃষ্ণার পাত্র হয়ে? স্বামী-পুত্র-কন্যা– সকলকে ছেড়ে? …

একেই বুঝি বলে অদৃষ্টের পরিহাস। নইলে এই পরম ঈপ্সিত ক্ষণে, এই চার- দেয়ালে-ঘেরা, শ্বাসরোধকরা সংসারটার আকর্ষণ এমন দুর্নিবার বলে মনে হবে কেন? তাকে ছেড়ে যেতে মনের মধ্যেকার বেদনার তন্ত্রীগুলোতে এমন টান পড়বে কেন?

কানে গেল, অরুণদা আস্তে আস্তে বলছে, ‘অত ভাবছ কেন? বড়জোর দু তিন মাস, তার মধ্যেই সেরে গিয়ে আবার তোমার ঘরকন্নার মধ্যে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু এখানে থাকলে কিছুতেই তোমাকে বাঁচাতে পারব না। লক্ষ্মীটি, তুমি আর অমত ক’রো না!’

স্বর্ণ শিউরে ওঠে। অরুণদা কি অন্তর্যামী? এমন ক’রে মনের নিভৃত কথা টের পায় কি ক’রে?…ওর অসুখের খবরই বা তাকে কে দিলে!…নিশ্চয় কোন সন্ন্যিাসী-টনিসীকে ধরে কোন দৈবক্ষমতা পেয়েছে অরুণদা, এত পয়সাও তাই থেকে। ওসব সায়েব-টায়েব বাজে কথা।…

কিন্তু সে যাই হোক–অরুণদা উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। দীন উৎসুক চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। যেন ও দয়া ক’রে সেরে উঠে তাকে কৃতার্থ করবে।…

সে কণ্ঠস্বরে অকারণ জোর দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ–ঘরকন্নার ভাবনায় তো আমার ঘুম হচ্ছে না একেবারে। সংসারে আমার ঘেন্না ধরে গেছে–এককড়ার টান নেই কারও ওপর আর।…কিন্তু তুমি এই ঘাটের মড়ার বোঝা ঘাড়ে তুলছ–সেই কথাই ভাবছি। হয়ত বাঁচাতেও পারবে না শেষ পর্যন্ত, মিছিমিছি এই খরচান্ত আর ব্যতিব্যস্ত হওয়া!’

আস্তে আস্তে বলল অরুণ, ‘ওসব আর না-ই ভাবলে এখন, ওসব ভাবার সময় ঢের পড়ে রইল সামনে। এখন চলো তো!’

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে স্বর্ণ বলল, ‘আমি তো বেঁচে যাই। এদিকে বাঁচব কিনা জানি না, মনে মনে বাঁচি অন্তত। কতদিনের শখ আমার পাহাড় দেখার।’

তারপর একটু সলজ্জ হেসে বলে, ‘খুব উঁচু পাহাড়–হ্যাঁ অরুণদা? আচ্ছা, কত উঁচু হবে?’

॥৩॥

এই দুটো দিন মনে মনে যে ছবিই এঁকে থাকুক স্বর্ণ, কল্পনার রাশ যতই ছেড়ে দিয়ে থাকুক, এমনটি কখনও ভাবতে পারে নি। চমক শুরু হয়েছে সেই যাত্রার গোড়া থেকেই, সে চমক যেন শেষ হচ্ছে না। ছেলেমেয়েদের ছেড়ে আসার কষ্ট তো ছিলই, প্ৰাণপণেই তাদের অশ্রুছলোছলো অসহায় ঈষৎ-ভীতার্ত দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে রেখেছিল, প্রাণপণেই চেষ্টা করেছিল বড় মেয়ে রেবার চাপা কান্নার আওয়াজটা না শুনতে। কান চেপেও ধরেছিল দু-হাতে। স্বামীর জন্যে মন কেমন করার কথা নয়–যদিও হরেন আসবার সময় অনেক মিষ্টি কথা বলেছিল, অনেক সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিল স্ত্রীকে, সঙ্গে যে তারই যাওয়া উচিত–একথা বারবারই স্বীকার করেছিল–বিস্তর পরিতাপ ও দুঃখ প্রকাশও করেছিল যে, এ সময়েও, এই বিপদ জেনেও শালারা ছুটি দিলে না,–কিন্তু সেদিকে কান দেয় নি স্বর্ণ, কোন জবাব দেবারও চেষ্টা করে নি; ঐ বানানো মিষ্টি কথাগুলো তার নীরবতার প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে চাবুকের মতো গিয়ে বক্তার মুখেই বাজবে–এটুকু জ্ঞান তার ছিল; তবু তার জন্যেও মন-কেমন করেছে বৈকি। অনেকদিনের সম্পর্ক যে! ও তো কখনও অন্য কারও কথা ভাবে নি কোনদিন, অন্য কাউকে চায় নি; ঐ একটি মাত্র লোককেই একান্ত আপন জ্ঞানে আঁকড়ে ধরেছিল সেই মিলনের প্রথম দিনটি থেকে। বরং কোনদিক থেকেই সে এই রূপবান কান্তিমান শিক্ষিত ভদ্র স্বামীর উপযুক্ত নয়, এই ভেবে সঙ্কোচই বোধ করেছে চিরকাল, নিজেকে অপরাধী ভেবেছে অকারণেই। অনেক বেশি সেবা দিয়ে, অনেক বেশি ভক্তিতে প্রেমে আত্মত্যাগে, নিজের রূপ গুণ বিদ্যার দৈন্য ঢেকে দেবার চেষ্টা করেছে। আজ হরেন যা-ই ক’রে থাকুক–ওর মনে সে-ই একেশ্বর যে। এতকাল পরে সেই স্বামীকে ছেড়ে যেতে–দীর্ঘকাল, হয়ত বা চিরদিনের জন্যই–মনে বেজেছিল বৈকি!

এমন কি, ঐ যে খাঁচার মতো বন্দীশালার মতো তার শ্বশুরবাড়ি–সেটা ছেড়ে যেতেও কষ্ট হয়েছিল তার। অনেক শখের, অনেক সাধনার সংসার তার, আবাল্য-স্বপ্ন-দেখা নিজস্ব ঘর-কন্না; তার নিজের বাড়ি, স্বামী-শ্বশুরের ভিটা। নিজের হাতে গুছোনো হেঁশেল; পাঁচফোড়নের কৌটো, হিংয়ের শিশিটি পর্যন্ত নিজের হাতে সাজানো, এ বাড়ির প্রতিটি ছোটখাটো বস্তুর সঙ্গেই তার আত্মার বন্ধন, প্রাণের যোগাযোগ। সে এ বাড়িতে আসার পর প্রত্যেকটি ছবি-টাঙ্গানো পেরেক-পোঁতার ইতিহাসও তার মুখস্থ। এর ইট-কাঠ-দোর জানালা, নোনাধরা দেওয়ালের গর্তগুলোও যেন তার বহুকালের পুরনো বন্ধু… তার আপনজন। এদের ফেলে যেতে কষ্ট হবার কথাই তো।

তবু সে খুব দুর্বল হয়ে পড়ে নি। যে নিবিড় অভিমান সে পুত্র-কন্যা আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছেড়ে এমনভাবে এক কথায় অরুণের সঙ্গে অজানা জগতে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে পা বাড়াতে রাজি হয়েছিল–সেই অভিমানই কতকটা বর্মের কাজ করেছিল এই দুঃসহ বিচ্ছেদ-বেদনা থেকে আত্মরক্ষা করতে। যে-আঘাত খেয়েছে সে তার এই এতকালের বুকের রক্ত দিয়ে গড়া সংসার থেকে, অতিপ্রিয় তার এই বিশ্বসংসার-থেকে-বিচ্ছিন্ন-হওয়া নিজস্ব জগৎ থেকে, তার এই জগতের সর্বাধিক প্রিয় ও সর্বাধিক আপন মানুষটির কাছ থেকে–সেই আঘাতই যেন কর্মের আচ্ছদে পরিণত হয়ে তাকে রক্ষা করল এই শেষ মুহূর্তে, তাকে একেবারে ভেঙ্গে পড়তে দিল না।

কিন্তু কষ্ট যতই হোক, তার জন্য খুব বড় রকমের একটা দৈহিক প্রতিক্রিয়া হ’তে পারল না–বোধ করি তার জীবনে একেবারে অপ্রত্যাশিত এই অভিনবত্বর জন্যেই। অথচ এই প্রতিক্রিয়ারই খুব ভয় করেছিল অরুণ। তার জন্যে তার এক ডাক্তার বন্ধুকে স্টেশনে থাকতে বলেছিল, আপৎকালে যে যে ওষুধ কাজে লাগতে পারে তাও কিছু কিছু সঙ্গে নিয়েছিল। মায় ইঞ্জেকশনের একটা সিরিঞ্জ নিতেও ভোলে নি। কিন্তু সে সব কিছুরই বিশেষ প্রয়োজন হ’ল না। প্রতিক্রিয়ার পরেও প্রতিক্রিয়া আছে, বোধ করি তাইতেই সঞ্জীবিত হয়ে উঠল স্বর্ণ।

যে মূল্যবান গাড়ি করে তাকে স্টেশনে নিয়ে আসা হ’ল, সে গাড়িই কখনও চোখে দেখে নি স্বর্ণ। দু-একবার ট্যাক্সিতে না চড়েছে সে তা নয়, কিন্তু সে-সব গাড়ির সঙ্গে এ গাড়ির তুলনাই হয় না। এত বড় যে ‘মটর’ গাড়ি হয় তা-ই জানা ছিল না কখনও। স্বচ্ছন্দে তাতে শুয়ে আসা চলে, আর শুয়েই এল সে। অরুণ সযত্নে সস্নেহে নিজে হাতে বিছানা পেতে তাকে শুইয়ে দিল ভেতরে, সে আর জীবেন ড্রাইভারের পাশে বসল। এতটা বয়সের মধ্যে কেউ তাকে এমন যত্ন ক’রে বিছানা পেতে শুইয়েছে বলে মনে পড়ে না। তার মা কাকী যতই ভালবাসুক–এত করবার তাদের অবসরই ছিল না।

সেইটুকু উপভোগ করতে করতেই হাওড়া স্টেশন। বড় একটা হেলানো আধশোয়া চেয়ারে ক’রে এনে তাকে একেবারে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় চড়ানো হ’ল। এর আগে কখনও সেকেন্ড ক্লাসেই চড়ে নি সে, একবার অর্ধোদয় না কী একটা যোগে সে হাওড়ায় গঙ্গা নাইতে এসেছিল বাপের বাড়ি থেকে, খুব ভীড় দেখে ছোটকা ওদের একটা ইন্টার ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। টিকিট বদলানো হয় নি, এমনিই চড়েছিল। ছোটকা বলেছিল, এ ভীড়ে আর কেউ টিকিট দেখবে না। তবু সেদিনও ইন্টার ক্লাসের গদীআঁটা বেঞ্চি চোখেই দেখেছিল, ভীড়ের মধ্যে আর বসবার সুযোগ মেলে নি।…এ নাকি সে সবের চেয়ে ঢের বেশি ভাড়ার গাড়ি, একেবারে ফার্স্ট ক্লাস। অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখল স্বর্ণ। পিঠের দিকে ঠেস দেবার জায়গাটা পর্যন্ত গদীআঁটা, মায় মাথার জায়গায় বালিশের মতোই খানিকটা উঁচু করা। আয়নাই কত গণ্ডা। কলঘরের মধ্যেও আয়না। আবার সেখানে এতটুকু একরত্তি একটা পাখা। বেঞ্চির পাশে পাশে জলের গেলাস রাখার কেমন সব আংটা পরানো দ্যাখো। বসে বসে এত ছিষ্টিও তো করেছে বাপু! ভাড়া বেশি নেয় অমনি নয়। এখানে বসবার পর সুখসোমন্দা কত সব তকমা-আঁটা আঁটা লোক সেলাম ক’রে গেল।…

তাও, এ কামরা নাকি একেবারে রিজার্ভ করা। কেউ উঠবে না আর এতে। অনেক টাকা দিয়ে অরুণদা এই ব্যবস্থা করেছ। অরুণের সেই ডাক্তার বন্ধু (মিলিটারী পোশাক আঁটা সায়েবদের মতো একেবারে–হুঁবহু! মাগো, প্রথমটা তো তাকে দেখে ভয়ই হয়েছিল স্বর্ণর) ওকে শুইয়ে দেবার পর পরীক্ষা করে দেখে বলল, ‘কোন ভয় নেই, শি ইজ অল রাইট। হাউএভার, আমি একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে যাচ্ছি, প্রিকশন নেওয়া ভাল।’

যা যত্ন করেই ইঞ্জেকশন দিল লোকটা। একটুও লাগল না, কিছু না। বরং আরামে যেন ঘুমিয়ে পড়ল স্বর্ণ একটু পরে। গাঢ় ঘুম–রাত্রে অরুণ খাওয়ার জন্যে ডেকে না তুললে সে বোধহয় সকাল পর্যন্ত ঘুমোতে পারত। খাবারও এনেছে বটে–একরাশ। গরম থাকা বোতল–ঐ রকম আজকাল তার দেওররাও কিনেছে সব, ঘরে ঘরে–তাতে ঝোলের মতো কী একটা। দিব্যি খেতে, সূপ না কী যেন একটা নাম বললে। তার সঙ্গে ফলের রস সন্দেশ–আরও কত কি। নিজে তো খেলে না কিছুই, স্বর্ণ খুব রাগারাগি করতে একটুখানি কি মুখে দিলে–এই পর্যন্ত। আবার বলে, ‘তুমি বকাবকি না করলে আমার খাওয়া হ’ত না তা তো জানোই; খাওয়ার অব্যেসটাই চলে গেছে যে!’

এত আরাম জন্মে অবধি পায় নি কখনও। এত আরাম এত সুখ যে মানুষ ভোগ করে তাই জানত না সে। মন-কেমন করতে লাগল ছেলেমেয়েগুলোর জন্যে। ওদের বাপও পয়সা রোজগার করছে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের সুখে রাখবার কথা ভাবেও না একবার।… মা বাবা, অভাগা ভাইগুলোর জন্যেও মন কেমন করতে লাগল। ওরা এসব জানতেও পারল না কোন দিন। ফার্স্ট ক্লাস কামরার ভেতরে ঢুকে চেহারাটাও দেখতে পেল না। পাবেও না বোধহয় কোনদিন।

স্বর্ণ যেন হাত-পা মেলে এই যাত্রার প্রতিটি স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে করতে চলল। এ যেন একটা সুখস্বপ্ন। ভোর হ’তে না হতে কোথা থেকে সব তমা-আঁটা উর্দিপরা বেয়ারা এসে কেমন খাবার-দাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। অবশ্য এসব খাবার প্রিয় নয় ওর কোনদিনই। আধকাঁচা ডিমের চেহারা দেখলেই গা-কেমন করে–তবু, মচমচে রুটির ওপর মাখিয়ে অরুণদা যখন নিজে হাতে দিলে, তখন আর ‘না’ বলতে পারল না। বোতল থেকে হর্লিক্স বার করে গুলে দিলে–এক গেলাস। আবার এক ঘণ্টা না যেতে যেতে ফলের রস সন্দেশ। মাগো, এত কেউ খেতে পারে নাকি? বিশেষ এই মরা পেটে। খাওয়া যদি এতই সহজ তুমি খাচ্ছ না কেন ঠাকুর?…ছেলেটা চিরদিনের পাগল।

সে সুখ-স্বপ্ন একটানা দীর্ঘ ছন্দে তাকে টেনে নিয়ে চলল। একটা বৈচিত্র্য থেকে আর একটা বৈচিত্র্যে। বিলাসের একটা উপকরণ থেকে আর একটায়। সারাদিন এইভাবে চলার পর রাত্রে কী একটা ইস্টিশানে নামতে হ’ল তাদের। এও কী এক বড় ইস্টিশান। তাদের হাওড়ার মতো না হ’লেও বেশ বড়। কত লোকজন। বোরখা পরা-পরা মেয়েছেলের দল। ঘেরাটোপ পরানো আলোতে যেন ভূতের মতো দেখাচ্ছে তাদের। বেরিলি না কী যেন বললে জায়গাটার নাম।…আবার সেই রকম হেলানো চেয়ার এল, তাকে ঢেকেঢুকে মুড়েসুড়ে কচি ছেলের মতো শুইয়ে দিলে অরুণ। ওখান থেকে নেমে আর একটা গাড়িতে চড়তে হ’ল। এ নাকি ছোট গাড়ি, কিন্তু স্বর্ণর তো মনে হ’ল না তা। এ তো দিব্যি সেই আগের গাড়ির মতোই, ছোট আবার এর কোন্‌খানটায়? কে জানে বাপু, বলছে যখন তখন ছোট হবে নিশ্চয়ই–ওরা কত জানে শোনে, ওদের চোখে অনেক জিনিস ধরা পড়ে যা অপরের চোখে পড়ে না–কিন্তু এও তো বেশ। শুল তো বেশ আরামেই, হাত পা মেলে।

রাত পোয়াতেই আবার সেই রকমারি খাওয়া। মুখ হাত ধোবার জলটি পর্যন্ত অরুণদা এগিয়ে দিচ্ছে। গামলাই এনেছে একটা তার জন্যে। এমন আরামে থাকলে এক মাসেই কোলা ব্যাং হয়ে যাবে যে। খাওয়া-দাওয়ার পরেই নামতে হ’ল–এই ইস্টিশানই নাকি এ লাইনের শেষ। এখান থেকে মোটরে যাওয়া। বাসেই যেতে হয়, আর তাতে নাকি বড় কষ্ট। অনেক দূরে পথ তো। তার জন্যে নাকি একটা গোটা বাসই ভাড়া করতে চেয়েছিল অরুণদা দেড়শ’ টাকা দিয়ে, ওর সায়েব বারণ করেছে। সেই সায়েবই তার কে এক বড় মিলিটারী সায়েব বন্ধুকে বলে আলাদা একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মালপত্তর- একটা কি জীপগাড়ি এসেছে আজকাল এই যুদ্ধের হিড়িকে–তাইতে চাপল ও আর অরুণ অন্য এক গাড়িতে। শুয়ে যাবার ব্যবস্থা রয়েছে দিব্যি। এ রুগী যাবারই গাড়ি, আগেও দেখেছে স্বর্ণ। পাড়ায় ‘ওলামার দয়া হ’লে এ গাড়ি তাদের ওখানেও আসে হাসপাতালের গাড়ি, কী সব কড়া ওষুধের গন্ধ গাড়ি-ময়। তা হোক, স্বর্ণর এসব গন্ধ খারাপ লাগে না। এবার ক্যাম্বিশের খাটে ক’রে তুলল তাকে, সেই খাটসুদ্ধই শুইয়ে দিল। ভেতরে শুধু অরুণ রইল,-পাখা জলের জায়গা আর ওষুধের ব্যাগ নিয়ে।

কী পথ তা কিছু দেখতে পেল না স্বর্ণ, দুদিকঢাকা গাড়িতে শুয়ে শুয়ে যাওয়া–তবে পথটা যে অনবরত এঁকে-বেঁকে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারল। সে জন্যেই বোধ হয়, মাঝে খুব কষ্ট হয়েছিল ওর, হয়ত ভিরমিই যেত যদি না ব্যাপারটা চট্ ক’রে বুঝে নিয়ে অরুণদা তাড়াতাড়ি কী একটা ঝাঁঝালো ওষুধ নাকের কাছে ধরত। তাতেই হুঁশ ফিরল আবার, একটু বলও পেল যেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা কি ওষুধও খাইয়ে দিল অরুণদা। তারপর আর বিশেষ কষ্ট টের পায় নি।

রাত্রির স্বপ্ন ভাঙ্গে প্রভাতের রূঢ় বাস্তব আলোয়, স্বপ্নের সুখ সত্যকার জীবনে মেলে না সাধারণত। কিন্তু এ যাত্রায় স্বর্ণর ভাগ্যে যেন অঘটনই ঘটছে কেবল। পথের সেই দীর্ঘ সুখ- স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটল নতুন এক স্বপ্নের মধ্যেই। এসে যেখানে পৌঁছল সে, সেও এক স্বপ্নের দেশ। এ যদি হাসপাতাল হয় তো স্বর্গের চেয়ে হাসপাতালই ভাল। গাড়ি থেকে চারদিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে গেল একেবারে। সব দুঃখ দুশ্চিন্তা দুর্বলতা এমন কি সন্তান-বিচ্ছেদ- বেদনা পর্যন্ত নিমেষে দূর হয়ে গেল। এ কোথায় এল সে? এমন জায়গা যে হয় তাই যে জানা ছিল না তার কোনদিন। পাহাড়ে না আসুক, পাহাড়ের ছবি সে ঢের দেখেছে, তার ঘরেই কত গণ্ডা টাঙ্গানো আছে–তবু সে যে এমন তা তো ভাবতে পারে নি কোন-দিন!

গাঢ় সবুজ গাছপালার আস্তরণে ঢাকা এই এত বড় বড় পাহাড়, চারিদিকে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঝাউয়ের বন, ওপরে ঘন নীল আকাশ (এমন নীল আকাশ তো পোড়ার শিবপুরে কি মৌড়ীতে থাকতে একদিনও নজরে পড়ে নি, আকাশও কি আলাদা আলাদা হয়?)–নিচে রূপোর পাতের মতো নদী। কোশী নদী না কি যেন বললে! একটুখানি নদী কিন্তু তারই কি বিক্রম। তুলোর পাঁজ ধুনতে ধুনতে চলেছে যেন–এমন রাশি রাশি সাদা ফেনা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তবে বোঝা যায় ওগুলো তুলো নয়। আসলে পাহাড়ি নদী নামছে নিচের দিকে, জল তীরবেগে ছুটছে–পথে যে অসংখ্য নুড়ি পাথর (পরে জেনেছিল স্বর্ণ নুড়ি নিহাৎ নয়, ওগুলো এক-একটার ওজন একশ মণ পর্যন্ত হবে!) পড়ছে তাতেই ঘা খেয়ে ফেনা কাটছে ওগুলো। বাপ রে কী তোড় জলের, বোধহয় একটা কুটো পড়লেও এখনই খান খান হয়ে যাবে।

কিন্তু নদী অনেক দূর, ঝাউগাছগুলো বড় কাছে, বড় আপন। অরুণদা বলছে ওর নাম পাইন। নাম যাই হোক–ভারি চমৎকার কিন্তু গাছগুলো, কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত ফল ওর, যেন কাঠের খেলনা। আর ওর ডালে কী শনশনে হাওয়া। সে হাওয়া মুখে লাগলেই মনে হয়, বয় বুঝি বেঁচে গেলুম–আর কোন ভয় নেই।

মুখেও বলে সে কথা, অরুণের দিকে চেয়ে বলে, ‘না অরুণদা, মনে হচ্ছে আমি বেঁচেই যাব এ-যাত্রা। শাশুড়ী বলেন–শিব-অসাধ্য রোগ বৌমা, এ তো সারবার নয়, একটা প্রাচিত্তির ক’রে ফ্যালো।…কিন্তু এ তো শুনেছি শিবেরই দেশ, এদেশে বোধহয় বেঁচে যায় এ রুগীও। মনে হচ্ছে এই বাতাসেই সেরে উঠব এবার, ওষুধও খাওয়াতে হবে না। শিবঠাকুর বাঁচাবেন বলেই বোধহয় টেনে এনেছেন তোমাকে দিয়ে!’

হাসতে হাসতেই বলে কিন্তু দুচোখের কোণে একটু যেন জলও চিকচিক করতে থাকে সেই সঙ্গে। সেই জল কি এসে পড়ে সুদূর সংসারের স্মৃতিতে, বেদনায়,–না কি নির্মম অকৃতজ্ঞতার আঘাতে? কিম্বা অরুণের প্রতি স্নেহে-কৃতজ্ঞতায়, সেই সঙ্গে ঈষৎ লজ্জাতেও?…কেন যে আসে তা সে নিজেও বোঝে না। কিন্তু বলতে বলতে বুঝি কৃতজ্ঞতাটাই প্রবল হয়ে ওঠে। বলে ‘ধন্যি ছেলে বাবা তুমি! এতও খবর রাখো, এত ছিষ্টিও জানো।…তুমি যদি লেখাপাড়াটা না ছাড়তে তা’হলে আজ জজ-ম্যাজেস্টার হ’তে পারতে। আমি তো বরাবর বলে এসেছি–তুমি না পারো হেন কাজ নেই। কী যে দুর্বুদ্দি হ’ল তোমার তখন! কিন্তু এ যে অসুমর খরচের ব্যাপার দেখছি সব, সত্যি এত পয়সা হয়েছে তোমার?…তোমার বোনাই যা লোক, মুখে যা-ই বলুক, এক পয়সা দেবে না তোমাকে–তা বলে রাখছি।…তুমি মিছিমিছি একগাদা টাকা দেনায় জড়িয়ে পড়বে না তো?’

অরুণও হাসল এবার। স্বর্ণর শীর্ণ মুখ আর কোটরাগাত চক্ষুর চিক্‌চিকিনির দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই বলল, ‘পড়লুমই বা–তাতে তোমার দেনাটা শোধ হবে তো খানিকটা। সেইটুকুই লাভ।’

‘আমার আবার ছাই দেনা!’ অভ্যস্ত ঝঙ্কার কণ্ঠে ফুটে ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা করে, ‘আমার কাছে আবার কবে কি ধার করলে তাই শুনি!…ও সেই সাতটা টাকার কথা বলছ?…ভাগ্যিস ওটা নিয়ে গেছলে, কী ভাগ্যিস যে ওটুকু সুবুদ্ধি তোমার হয়েছিল–নইলে সত্যিই বলছি– আমার মুখে আর অন্নজল যেত না।…আচ্ছা, কেন অমন ক’রে চলে গেলে অরুণদা বল তো? আমার বে হ’ল বলে–?…তোমার কি মনে হ’ল আমি না থাকলে তোমার ক্ষোয়ার হবে, কেউ দেখবে না?…তা এই যে পথে পথে ঘুরলে, কে তোমাকে অত দেখল বাপু?…না, না, কাজটা ভাল করো নি!’

আবার কি মনে ক’রে বলে, ‘নাকি আমার জন্যে খুব মন কেমন করেছিল? ঠিক ঠিক বল তো। আজও আমি ভেবে পাই নে কথাটা!…তা দুটো দিন অপেক্ষা করলে না কেন, আমি তো আটদিনের মাথাতেই এসে পড়লুম। চাই কি আর একটা বছর কাদায় গুণ ফেলে থাকলে, আমি শ্বশুরবাড়িতে পুরনো হয়ে গেলে–আমার কাছেই গিয়ে থাকতে পারতে!’

‘ওকথা এখন থাক বুঁচি, ও তোমাকে বোঝাতে পারব না। তুমি এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। ওসব কোন কিছু ভাবতে হবে না তোমাকে। সব ভাবনা চিন্তা মন থেকে তাড়িয়ে দাও একেবারে!

স্বর্ণ হেসে উঠল যেন আপন মনেই ‘হি হি, তুমি সেই বুঁচি নামই ধরে রাখলে চিরকাল! তা মন্দ নয় কিন্তু, আগে আগে শ্বশুরবাড়িতে কেউ ও নাম ধরলে লজ্জা করত, মনে হ’ত কী বিচ্ছিরি নাম। কিন্তু এখন বেশ ভাল লাগে, মনে হয় সেই ছেলেবেলায় ফিরে গেছি। ও নাম ধরে তো এখানে বড় একটা কেউ ডাকে না আর!’

.

চিকিৎসার এই রাজকীয় ব্যবস্থাতে যে ‘অসুমর’ টাকা খরচ হচ্ছে সেটা তার সহজ বুদ্ধিতে বুঝেছিল স্বর্ণ, কিন্তু তবু আন্দাজটা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে নি। যখন তা পৌঁছল তখন ব্যাকুলতার সীমা রইল না।

অরুণ বেশিদিন থাকতে পারবে না, ওখানে কাজের ক্ষতি হচ্ছে। এখানে দিন পনেরো থেকে সব বন্দোবস্ত ক’রে চলে যাবে–এ আগে থাকতেই বলা ছিল। একমাস দেড়মাস অন্তর এসে খবর নিয়ে যাবে এর পর। অবশ্য হরেনের আসবার কথা, ছুটি পেলেই সে আসবে এখানের গেস্ট হাউসে মাসখানেক কাটিয়ে যাবে–বার বার বলে দিয়েছে সে। তারও ‘চেঞ্জ’ হবে, স্বর্ণরও খোঁজখবর করা হবে। বড় মেয়েকেও নিয়ে আসবে সে। কিন্তু সে কথায় স্বর্ণ বা অরুণ কেউই বিশেষ ভরসা রাখে নি। স্বর্ণ বলেছে, ‘আমি একাই বেশ থাকব অরুণদা, তুমি মাঝে মাঝে এসো সময় মতো–তাতেই আমার হবে। তাও কাজের ক্ষেতি ক’রে তোমাকেও আসতে বলি না। এখানে তো এত লোকজন, আমার দিব্যি চলে যাবে!’

অবশ্য তার যাতে কোনরকম অসুবিধা না হয় সেজন্যে অরুণ করেছেও ঢের। বেশি টাকা দিয়ে ‘কট’ বা আলাদা ঘর ঠিক ক’রে দিয়েছে। পরিচর্যার জন্যে যত না হোক, সর্বদা কাছে কাছে থাকার জন্যে সঙ্গিনী হিসেবে একজন নার্সও বন্দোবস্ত ক’রে দিয়েছে। একেবারে তিন মাসের মতো সমস্ত খরচ–মায় নার্সের মাইনে সুদ্ধ আগাম জমা করে দিয়েছে। ওষুধপত্রের জন্যেও আনুমানিক একটা টাকা গচ্ছিত ক’রে দিয়েছে আপিসে অর্থাৎ সে বা অপর কেউ না এলেও যাতে চিকিৎসার কোন ত্রুটি না হয়, চিঠি লিখে জানিয়ে তবে ব্যবস্থা করার প্রয়োজন না হয়।

এই নার্সের মুখেই খরচের বিপুলতার প্রথম একটা আভাস পেল স্বর্ণ। নার্স বাঙালি নয়, যুক্তপ্রদেশের মেয়ে–স্বর্ণর হিসেবে খোঁট্টা–তবে এর আগেই সে আর এক বাঙালি মহিলার পরিচর্যা ক’রে কিছু কিছু বাংলা শিখেছিল, কিছুটা সেই বিদ্যেয় আর কিছুটা আকারে ইঙ্গিতে ইশারায় কথাবার্তার কাজ চালিয়ে নিতে পারে। তার কাছেই শুনল, এই যুদ্ধের মধ্যেই কী একটা ওষুধ বেরিয়েছে এই রোগের নাকি সেই ইঞ্জেকশন এখনও বাজারে খুব বেরোয় নি, অনেক কাণ্ড ক’রে যোগাড় করতে হচ্ছে–যা আসছে সরকার মিলিটারীদের জন্যেই কিনে নিচ্ছেন। অরুণ নাকি বহুলোককে ধরে অনেক বেশি দাম দিয়ে সেই ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা করেছে। এমনিতেই নাকি তার দাম অনেক, এক-একবার যেটুকু ফোঁড়া হয় তারই দামে নাকি একটা ছোট সংসারের এক মাসের খরচ চলে যায়। নার্স আশার অনুমান, আশি নব্বই টাকার কম পড়ছে না এক-একটা ইঞ্জেকশন।

কিন্তু শুধু তো এই ওষুধ নয়–অন্য অন্য ব্যাপারেও কি খরচ কম হচ্ছে! নার্সের মাইনে, এখানকার খাই-খোরাকী, ঘর-ভাড়া–সব খরচেরই একটা আঁচ পেল স্বর্ণ। শুনে প্রথমটা অবাক হয়ে গেল সে, বিশ্বাসই হ’তে চাইল না তার। বিশ্বাস হবার কথা নয়, এ তার কাছে রূপকথার মতোই আজগুবি একটা অঙ্ক। এত টাকা কেউ কারও জন্যে খরচ করে–তা সে জানবে কী করে? এত টাকা যে কোন সাধারণ লোক–রাজামহারাজা বা সাহেবসুবো ছাড়া–রোজগার করতে পারে তা-ই যে জানে না সে। জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত শুনে আসছে যে একটা টাকার অনেক দাম, সাত হাত মাটি খুঁড়লেও একটা পয়সা মেলে না। এ লড়াইয়ের বাজারে অনেকে নাকি অনেক টাকা রোজগার করছে তা সে শুনেছে, হরেন ও নাকি বিস্তর টাকা কামাচ্ছে–কিন্তু সে কি এত?

অনেক ভাবল সে। তারপর–তার জানাশুনো প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তার সঙ্গে মিলিয়ে এবারের এই আসবার ব্যবস্থাটার খরচটাও আন্দাজ করবার চেষ্টা করল। সেও তো কম নয়, রাজরাজড়ার মতোই তো এসেছে সে। যে শুধু পথেই এত টাকা খরচ করতে পারে, তার পক্ষে এ খরচাই বা অস্বাভাবিক কিসের?

বিশ্বাস হবার পর আরও আকুল হয়ে উঠল সে। এ কী করছে অরুণদা, অরুণদা কি পাগল হয়ে গেল না কি! এ যে দেউলে হবার মতলব তার। তার মতো একটা সামান্য মেয়েছেলে–তার নিজের বোন কি আপন কেউ নয়–নিতান্তই নিষ্পর একজন, তার জন্যে এ কি বাড়াবাড়ি কাণ্ড করছে ও!…সে আর স্থির থাকতে পারল না; এই বারো চোদ্দ দিনেই অনেকটা জোর পেয়েছে পায়ে, কাউকে না ধরেও হেঁটে বাইরে বেরোতে পারে–তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে গিয়ে খুঁজে বার করল অরুণকে। বাগানের এই অংশটা অরুণের বিশেষ প্রিয়, থাকলে এখানেই থাকবে তা সে জানত।

অরুণের সামনে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘এ কী করেছ অরুণদা, তুমি নাকি আমার জন্যে মাসে ছ-সাতশো টাকা খরচের ব্যবস্থা করেছ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? নাকি মতিচ্ছন্ন ধরল তোমাকে? তুমি কী এমন লাট- বেলাট দরের মানুষ যে এই খরচটা করছ। শেষে কি একটা অখদ্যে অবদ্যে মেয়েছেলের জন্যে দেউলে হবে তুমি! বলি মতলবটা কী তোমার?’

অরুণের সুগৌর মুখে বুঝি একটা রক্তাভা খেলে যায় মুহূর্তকালের জন্যে। কিন্তু সে স্থির শান্তভাবেই বলে, ‘কে বললে তোমাকে এসব কথা? ওসব গালগল্পে কান দাও কেন?

ওগো মশাই, আমি আর সেই সেকালের কচি খুকীটি নেই, আর দুদিন বাদে আমার মেয়েরই বে দেবার বয়স হয়ে যাবে। আমাকে থাতামুতো দিয়ে চুপ করাবার চেষ্টা ক’রো না। ছ সাতশ কি হয়ত আরও বেশিই খরচ করছ। এখানে আনতেই তো হাজার বারোশো টাকা খরচ করেছ তুমি–আমি কি কিছু বুঝি না!’

সেই ছেলেবেলাকার মতোই চাপা কৌতুকে অরুণের দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে, ‘বাবা, তোমার এত বুদ্ধি! ইস!’

‘না না, হাসি-তামাশার কথা নয়। এর একটা বিহিত না হ’লে আমি অনখ করব বলে দিলুম। তার চেয়ে তুমি আমাকে যেখানকার মানুষ সেইখানে রেখে এসো–যা হবার তা হবে। আমার জন্যে তোমাকে ফতুর হ’তে দোব না কিছুতেই!

এবার অরুণও গম্ভীর হয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে স্বর্ণর দুটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘বুঁচি, তোমার জন্যে ফতুর হ’তে না পারলে আমার ও টাকারই যে কোন দরকার নেই! কোনদিন তোমার কাজে লাগতে পারে এই ভেবেই তো আমার রোজগার করা। নইলে আর আমার কে আছে বলো! কার জন্যে টাকা। যদি তোমার কোন উপকার করতে পারি তবেই যে আমার বেঁচে থাকারও সার্থকতা!…তুমি এর জন্যে কিছুমাত্র কিন্তু বোধ করো না, কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হয়ো না। এতে আমারই উপকার হচ্ছে, তোমার কিছু নয়!…আমার জন্যে এটুকু সহ্য করতে পারবে না তুমি?’

আর যা-ই হোক, ঠিক বোধ হয় এ উত্তরের আশা করে নি স্বর্ণ। হঠাৎ সেও যেন আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল। অনেকক্ষণ চুপ ক’রে বসে থাকবার পর আস্তে আস্তে হাত দুটো অরুণের হাতের মধ্যে থেকে টেনে নিয়ে বললে, ‘ছোট কাকী একবার বলেছিল আমাকে, বিশ্বাস করি নি। অনেকদিন পরে–রেবা পেটে সাধ খেতে গেছলুম যেদিন, সেইদিন তোমার কথা উঠতে বলেছিল কথাটা। বলেছিল, ‘ওলো নেকী, সে আসলে তোকে ভালবেসেছিল। বোধহয় মনে ছিল, লেখাপড়া শিখে ভাল চাকরি করতে পারলে তোর সঙ্গে বের কথা তুলবে। তোর বে হয়ে যাওয়াতেই মনটা ভেঙ্গে গেল–একদিক পানে চলে গেল সব ছেড়েছুঁড়ে। আর কার জন্যে কী–এই ভাবল বোধহয়।’…আমি ছোট কাকীর কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলুম সেদিন! আজ দেখছি–আমি শুধু নেকাই নই, কানাও।…কিন্তু আজ এই মরণপানে পা ক’রে মিথ্যে লজ্জা করব না, সোজাসুজি বলছি, কী দেখে তুমি আমাকে ভালবাসতে গেলে অরুণদা, তোমার চেহারা ভাল–আর একটা দুটা পাস ক’রে যেমন তেমন চাকরিতে বসতে পারলেও কত গণ্ডা ভাল ভাল মেয়ে এসে তোমার পায়ে লুটোত। আমার মধ্যে তুমি কী এমন দেখলে!…তোমার জীবনটা আমার জন্যে নষ্ট হয়ে গেল ভাবলে যে আমার লজ্জার শেষ থাকবে না অরুণদা!’

একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে চেপে নিয়ে প্রায় চুপি চুপি উত্তর দিল অরুণ, ‘নষ্ট হ’ল তা তোমাকে কে বললে, বুঁচি, এই তো কাজে লাগল। আর কী দেখলুম তোমার মধ্যে? সেও তুমি বুঝবে না। যে দেখে তার চোখ না পেলে অপরে বুঝবে কী ক’রে কে কার মধ্যে কী দেখল!

আর কথা কথা বাড়াল না স্বর্ণ, দুই চোখ রগড়ে মুছে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

।।৪।।

ভাল ক’রে সেরে উঠতে প্রায় ছ মাস লাগল স্বর্ণর। এইটেই যথেষ্ট দীর্ঘ সময় কিন্তু অরুণ আরও দুমাস জোর করে ওখানেই রাখল। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছিলেন যে, এই সুস্থ এবং স্বাভাবিক হয়ে ওঠার কালটা অন্য কোন স্বাস্থ্যকর স্থানে গিয়ে কাটাতে। উদয়পুর, ওয়ালটেয়ারের নামও করেছিলেন তাঁরা। স্বর্ণরও–প্রথম দিককার এই স্বর্গপুরী ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল, কিন্তু উপায় নেই বুঝেই, সেও চুপ করে ছিল। হাসপাতালে অনেক অভিভাবক, অনেক রক্ষাকবচ আছে–অন্যত্র কে তাকে নিয়ে থাকবে? অরুণের পক্ষে দুতিন মাস একনাগাড়ে থাকা সম্ভব নয়, শোভনও নয় সেটা। ওদের কারুর এখনও দুর্নামের বয়স যায় নি।

এই সময়টুকুর মধ্যে কিন্তু অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। যদিও স্বর্ণ অনেক দিন পর্যন্ত সে খবর পায় নি। অরুণ পেতে দেয় নি–ইচ্ছে করেই। সুবিধেও হয়েছিল অনেকটা, চিঠিপত্র ওখান থেকে বিশেষ কিছু আসত না। দেবেই বা কে, দেবার মধ্যে ভুতু আর রেবাই যা দেয় মধ্যেমিশেলে এক-আধখানা। হরেন একখানাই মাত্র চিঠি দিয়েছিল এখানে–ছুটি নেবার জন্যে খুবই চেষ্টা করছে সে, পেলেই মাসখানেকের জন্যে ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসবে–মাত্র–এইটুকুই বক্তব্য ছিল তাতে। স্বর্ণ সে চিঠির উত্তর দেয় নি–ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা তার অন্তরের পাত্র ছাপিয়ে উঠেছে স্বামীর একটির পর একটি মিথ্যাচরণে–হরেনও আর লেখে নি। কিন্তু ছেলেমেয়ের চিঠিতেও এসব খবর পায় নি স্বর্ণ–অরুণ তাদের বারণ করে দিয়েছিল। যা সাংঘাতিক রোগ, উদ্বেগের কারণ ঘটলে যতটা যা এগিয়েছে আরও হয়ত বেশি পিছিয়ে যাবে।

একেবারে শেষের দিকে শুনল সব। তাও একবারে নয়, দুবারে।

স্বর্ণর শাশুড়ী মারা গিয়েছেন–সে এখানে আসার মাস তিনেক পরেই। কল-তলায় পড়ে গিয়ে নাকি তাঁর কোমরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না; মা কান্নাকাটি করাতে ছেলেরা কথা দিয়েছিল যে এ-রে করে হাড় ঠিকভাবে বসিয়ে প্লাস্টার করা পর্যন্তই সেখানে রাখা হবে, তারপর বাড়িতে নিয়ে এসে নার্স রেখে দেবে, সে-ই দেখাশুনো করবে, কোন অসুবিধে হবে না তাঁর। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে নার্স বিরল, যদি বা পাওয়া যায়, অনেক টাকা দিতে হবে। সে টাকা কে কতটা দেবে এই ঠিক করতে করতেই কয়েকদিন কেটে গেল। হরেনই সবটা দিতে পারত কিন্তু তার টিকি পর্যন্ত দেখতে পাওয়াই ভার। তাছাড়া মা যখন তার একার নয় তখন সে সবটা দেবেই বা কেন? শেষে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠে কড়া চিঠি লিখতে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে হ’ল কিন্তু নার্স রাখা আর হয়ে উঠল না। বুড়ি ঝি আয়না স্বর্ণর ছেলেমেয়ের মায়া কাটিয়ে কোথাও যেতে পারে নি, সে-ই অগত্যা কিছু কিছু সেবার ভার নিলে। তার হাতে খেতেও হ’ল হরেনের মাকে এবং দিব্যি চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেন তিনি যে, যে-কাপড়ে সে ময়লা পরিষ্কার করছে সেই কাপড়েই ভাত এনে তাঁকে খাওয়াচ্ছে। সে বুড়োমানুষ, ছেলেমেয়ে সামলে বারবার স্নান করা বা কাপড় কাঁচা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হরেনের মা প্রথম প্রথম এ নিয়ে কান্নাকাটি ছেলেদের গালিগালাজ করেছিলেন, একদিন না খেয়েও ছিলেন অনেকক্ষণ–কিন্তু কোন ছেলেই তাতে বিচলিত না হওয়াতে শেষে অবস্থাটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য বেশিদিন এ- ভোগান্তি সহ্য করতে হয় নি তাঁকে। আয়নার দ্বারা সেবার স্থূল কাজগুলো চলত, শুশ্রূষা যাকে বলে তা চলত না। সে শিক্ষা তার ছিল না, তাকে কেউ বলে দেয় নি। একভাবে শুয়ে থাকার ফলে বেডসোর হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত নাকি পেটও ছেড়ে দিয়েছিল। যাইহোক, খুব বেশিদিন ভুগতে হয় নি, পড়ে যাওয়ার মাত্র আড়াই মাসের মধ্যেই ছুটি পেয়ে গেলেন। তবে কখন যে তিনি মারা গেছেন তা কেউ জানে না, মরার সময় ছেলেদের হাতের জলও পান নি। বিকেলে চা দিতে গিয়ে আয়না দেখেছে যে মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছেন বৃদ্ধা!

এই প্রথম খবর।

শাশুড়ী সম্বন্ধে প্রীতি বা স্নেহ থাকার কথা নয় স্বর্ণর মনে, তবু খবরটা শুনে তার কষ্টই হয়েছিল। বিশেষ করে শেষদিনগুলোর অসহায় অবস্থার কথা ভেবে। স্বর্ণর মন স্বাভাবিকভাবেই স্নেহপ্রবণ ও সহনশীল–তাই কখন যে সে শাশুড়ীকে ক্ষমা করেছে মনে মনে, তা সে নিজেই বুঝতে পারে নি, এখন বুঝতে পারল। কাউকে দেখাবার প্রয়োজন নেই এখানে–যে চোখের জল অজস্রধারায় ঝরে পড়ল তার চোখ দিয়ে, তা নির্ভেজাল দুঃখেরই প্রকাশ।

কিন্তু আরও সাংঘাতিক খবর তার জন্যে তোলা ছিল। সেটা পেল আরও কদিন পরে, তার দুমাসের এই শেষ মেয়াদও শেষ হয়ে যাবার মাত্র দিনসাতেক আগে। অবশ্য ঘটনাটাও খুব পুরনো নয়, যদিও তার সূত্রপাত হয়েছে অনেক আগে থাকতেই। সে ইতিহাসও প্রীতিপদ হবে না বলেই তখন জানায় নি অরুণ।–স্বর্ণ চলে আসার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে হরেন, মদ ও আনুষঙ্গিক অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আরও। কাউকে গোপন করার চেষ্টা মাত্রও করত না সেসব কথা। প্রকাশ্যেই নতুন ঝিয়ের সঙ্গে ‘ঘর’ করতে শুরু করে, এমন কি স্বর্ণর শাড়ি-গহনাও তাকে কিছু কিছু বার করে দেয়। ছেলেমেয়েদের বলে দেয় তাকে নতুন মা বলে ডাকতে। কিছু দিন পরে পরে, যখন সে গৃহিণীপদে বেশ কায়েম হয়ে বসেছে, যথেচ্ছ হুকুম চালাচ্ছে সকলের ওপর এবং সংসারের খরচপত্র করছে–তখন নাকি উচ্ছ্বাসের বশে আলমারী সিন্দুকের চাবিও তার হাতে তুলে দিয়েছিল হরেন। হয়ত ঠিক উচ্ছ্বাসেও নয়–মদের ঝোঁকেই দিয়ে থাকবে–তারপর ভুলে গিয়েছিল কিম্বা আর ফিরিয়ে নেবার প্রয়োজন মনে করে নি। সে যাই হোক, ঝিটি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করে নি, স্বর্ণর সমস্ত গহনা এবং নগদ হাজার দুই টাকা নিয়ে সে একদিন সরে পড়েছে–সঙ্গে নিয়ে গেছে জীবেনদের নতুন ছোকরা চাকরটিকে ছেলেটা ফুট-ফুটে দেখতে, মাত্র আঠার উনিশ বছর বয়স তার। ঝিয়ের থেকে বয়সে অনেক ছোট। সম্ভবতঃ টাকার লোভ দেখিয়েই তাকে টেনে নিয়ে গেছে।

হরেন তার এই নতুন গৃহিণীকে ভালবেসেছিল কিনা কে জানে, তবে তাকে বিশ্বাস করেছিল অনেকখানি–এটা ঠিক। এই ঘটনায় তাই আর্থিক ক্ষতির চেয়ে সম্ভবত অপরাধবোধটাই বেজেছিল, আত্মভিমান যা লেগেছিল। এই শ্রেণীর লোকদের বুদ্ধির অভিমানটাই প্রবল হয়, সেই অভিমানে আঘাত লাগলে মর্মান্তিক বাজে।…কারণ যাই হোক, এই নিরুদ্দেশের ঠিক দুটি দিন পরেই তার একটা ‘স্ট্রোক্’ হ’ল। কোন বিলিতী হোটেলে একা বসে বসে মদ খাচ্ছিল, সেইখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। প্রথমটা মাতাল অবস্থা ভেবে নাকি তারাও অতটা খেয়াল করে নি, ঝাঁকানি দিয়ে প্রকৃতিস্থ করার চেষ্টা করেছে। শেষে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়াতে ভয় পেয়ে এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাইতেই তবু রক্ষা, বাড়িতে পাঠালে কেউ ডাক্তার ডাকত কিনা সন্দেহ, এমনই সকলে বিরূপ হয়ে উঠেছিল।

হাসপাতালে অনেক চেষ্টায় জ্ঞান যদি বা হয়েছে, পক্ষাঘাতের ভাবটা এখনও যায় নি। সমস্ত বাঁ দিকটা অনড় অসাড় হয়ে আছে। কথাও কইতে পারছে না ভাল করে–কথা এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে, খুব মন দিয়ে না শুনলে বুঝতে অসুবিধা হয়। বাড়িতে নিয়ে এসেছে এখন, জীবেনই দেখাশুনো করছে, চিকিৎসাও চলছে–তবে ডাক্তাররা আশা-ভরসা খুব একটা দিতে পারছেন না। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, এই অবস্থাই এখন চলবে দীর্ঘকাল। তাও কোনদিনই একেবারে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ।…

স্যানাটোরিয়ামের মধ্যে নয়, বাইরে বেড়াতে বেরিয়ে একটা পাহাড়ে-পথের ধারে ঝরা পাইন পাতার ওপর বসে শুনছিল খবরটা। সেটা অপরাহ্নকাল, সামনের পাহাড়গুলোর তলায় তলায় ইতিমধ্যেই অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, বহু নিচে নদীর রজতরেখাটা পর্যন্ত অস্পষ্ট ঝাপসা হয়ে এসেছে অনেকখানি। কিন্তু সেদিকে চোখ ছিল না স্বর্ণর, সে চেয়ে ছিল সামনের বড় পাহাড়টার চুড়োয় তখনও যে সূর্যরশ্মিটুকু লেগে আছে–তারই দিকে। একফালি একটু রোদ একেবারে সেই চুড়োরও মাথাটায়–আর নিচে অতল গভীর রহস্যময় অন্ধকার। অন্ধকারটাকে মনে হচ্ছে তরল কোন পদার্থ, নিচে থেকে পাত্র ভরে ক্রমে ক্রমে ওপরে উঠছে।

আজ প্রথম মনে হ’ল ওর, সন্ধ্যা ওপর থেকে নামে না, নিচে থেকে ওঠে। দিনের বেলা যেন সে ঐ নিচেকার গহন অরণ্যের ঝোপে ঝাড়ে ছায়ায় আত্মগোপন করে থাকে, দিনের দৃষ্টি সরে গেলেই একটু একটু করে মাথা তোলে, ভরসা পেয়ে ওপরে উঠে আসে। তা হোক, তবু সে নিচেরই জিনিস, সে সব সৌন্দর্যকে বিলুপ্ত করতে পারে, একাকার করতে পারে–তার সৌন্দর্যসৃষ্টির কোন ক্ষমতা নেই, তার কোন নিজস্ব রূপ নেই। যেটুকু দিনের আভাস এখনও প্রকাশিত রয়েছে ঐ সুদূর শিখর-চূড়ায়, তা যেমন মনোহার, তেমনি মহিমাময়। এতদূর থেকেও যেন ওর প্রতিটি পত্রপল্লবের ঝলমলানি দেখা যাচ্ছে, তাদের শাখাপ্রশাখার ছায়া আলাদা আলাদা বেছে নেওয়া যাচ্ছে।…

অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে সেদিকে চেয়ে রইল স্বর্ণ। স্বামী সাংঘাতিক অসুস্থ, হয়ত বা মৃত্যুপথযাত্রী–না হ’লেও চিরদিনের মতো পঙ্গু পরপ্রত্যাশী হয়ে থাকবে। ব্যথা পাবারই কথা, ব্যথা পেলও সে প্রথমটা। ওর প্রথম প্রতিক্রিয়াটা হয়েছিল তীব্র ব্যথার। বুকের মধ্যেটা মুচড়ে উঠেছিল যেন, ইচ্ছে হয়েছিল পাখা মেলে সেই মুহূর্তে উড়ে চলে যেতে স্বামীর বিছানার পাশে। আহা, কে-ই বা তার সেবা করছে, কে-ই বা মুখে জল দিচ্ছে! উঠে বসা স্নান করা তো দূরের কথা–নিজে নিজে কিছু খাওয়ারও শক্তি নেই। প্রাকৃতিক কাজগুলোর জন্যে পরের অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে থাকতে হয়েছে, হয়ত তার জন্যে মুখনাড়া খাচ্ছে কত লোকের। তাও হয়ত শেষ অবধি কেউ করছে না ঠিক সময়ে–ময়লা মেখে পড়ে থাকতে হচ্ছে। মেয়ে করছে অবশ্য, রেবা অনেকটা ওর মতোই হয়েছে–কিন্তু তার কীই বা বয়স, সে কি গুছিয়ে করতে পারছে রুগীর সব কন্না! শুয়ে থেকে থেকে যদি হরেনেরও তার মায়ের মতো শয্যাক্ষত হয়ে যায়! বাপ্ রে, অবস্থা ভাবলেই যে বুকের মধ্যেটা হাহাকার ক’রে ওঠে!…

কিন্তু সে ঐ প্রথম কিছুক্ষণই।

তারপরই একটা বিরাট ঔদাসীন্য বোধ করল ও। এমন কখনও বোধ করে নি এর আগে করবে তা কখনও ভাবে নি, নিজের মনোভাবে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল খানিকটা পরে।

মনে হ’ল ওর কী মাথাব্যাথা? ও-ই তো মরতে বসেছিল, এখনও সে আশঙ্কা একেবারে দূর হয়ে গেছে কিনা কে জানে, হয়ত এখনও সে মৃত্যু একেবারে ওকে ছেড়ে যায় নি, ওর দেহের মধ্যেই কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে! যেদিন একেবারে প্রত্যক্ষ মরণের সামনা-সামনি এসে দাঁড়িয়েছিল সেদিন ওর দিকেই বা কে তাকিয়েছিল? নিষ্করুণ অবহেলায় নির্মম ঔদাসীন্যে শুধু নয়–মর্মান্তিক আগ্রহের সঙ্গেই সেদিন ওকে বিদায় দিয়েছিল ওর আপনজনেরা। ওকে সরাতে পেরে বেঁচে গিয়েছিল যেন।…না, সংসার থেকে বিদায়ই নিয়ে এসেছে সে; সংসারও তাকে বিদায় দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। তবে আবার কেন? স্বামী, শ্বশুরবাড়ি, এমন কি ওর ছেলেমেয়ে–সবই যেন কোন সুদূর পূর্বজন্মের কথা। এজন্মে তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। এ ওর নবজন্ম। সে জন্মের ঋণ সে শোধ দিয়েছে সংসারকে–কড়ায় ক্রান্তিতে। দেহপাত করে বুকের রক্ত দিয়ে–বলতে গেলে সমস্ত জীবন দিয়েই। এখন এ জন্মের ঋণটার কথাই ভাববে সে।

সে ঋণ তার সামনে বসা এই লোকটার কাছে। সাধারণ ঋণ নয়–যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার ঋণ, একাগ্র মৃত্যুজয়ী ভালবাসার ঋণ। শুধু পয়সা দিয়ে, সামর্থ্য দিয়ে নয়, করুণা বা অবহেলায় নয়–সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে, যেন যথা-সর্বস্ব পণ ক’রে লোকটা লড়াই করেছে যমের সঙ্গে, স্বর্ণর ভাগ্যদেবতার সঙ্গে। এমন নিখুঁত যত্ন এমন আন্তরিকতা কখনও দেখে নি সে, আর কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ। প্রতিটি সত্তা সজাগ রেখে তার কথা ভেবেছে যেন লোকটা! শুধু তার কথাই ভেবেছে, আর কিছু নয়। অথচ কীই বা তার মূল্য, ওর কাছে সে কতটুকু। রূপবান কান্তিমান, বিত্তশালী ঐ লোকটা ইচ্ছা করলে রাশিরাশি সুন্দর মেয়ে দুপায়ে জড়ো করাতে পারে–সে জায়গায় স্বর্ণ তো কীটাণুকীট। তবুও তাকেই সর্বাগ্রগণ্য করে রেখেছে সারা জীবন, আজও সে-ই তার কাছে সর্বাধিক।

না, স্বর্ণও আর কারও কথা ভাববে না, ওর কথা ছাড়া।…

অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে বলল সে, ‘তুমি অন্য কোন কথা বলো অরুণদা; ওসব কথা ভাল লাগছে না। শুনে লাভই বা কি, যে কাঠ খাবে সে আঙ্গরা বমি করবে, এ তো জানা কথা। তার জন্যে কে কী করবে আর।’

অরুণ চমকে উঠল যেন। স্বর্ণর কাছ থেকে এ উত্তর আশা করে নি আদৌ। ওর প্রাণ মমতায় ভরা, সকলের জন্যেই ওর টান–এই জানত সে। সেও চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, ‘অন্য কথা আর কি বলো! এবার তো ফেরার কথা। পরশু সোমবারের পরের সোমবার ভাল দিন আছে, সেদিন গাড়িরও ব্যবস্থা করতে পারব, সেইদিনই যাব ভাবছি। ওদিকে ট্রেনেও ঐদিন রিজার্ভ ক’রে রাখবার কথা বলে এসেছি আমার বন্ধু আর-টি-ও বচ্চন সিংকে। করে রাখবে নিশ্চয়।’

‘কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে, এখান থেকে?

খুব শান্ত, খুব সহজভাবে প্রশ্ন করে স্বর্ণ।

আবারও চমকে ওঠে অরুণ। রীতিমতো থতমত খেয়ে যায়। এ বিষয়ে যে কোন প্রশ্ন কি দ্বিধার অবকাশ আছে–তা জানা ছিল না তার একেবারেই। সে হতভম্বের মতো খানিকটা তাকিয়ে থাকে স্বর্ণর মুখের দিকে, তারপর আমতা আমতা করে বলে, ‘কেন বাড়ি?…মানে, বাড়ি ফিরবে তো এবার?’

‘বাড়ি!’ একবার মাত্র শব্দটা উচ্চারণ করে চুপ করে যায় স্বর্ণ আবার। তারপর তার কটা চোখের স্থিরদৃষ্টি অরুণের চোখের ওপর রেখে আগের মতোই শান্ত সুরে বলে, ‘আগে বোকা ছিলুম বলে বুঝতে পারি নি–এখনও বোকা, তবু মোটা কথাগুলো বুঝতে পারি। আমার জন্যেই তুমি জীবনটা মাটি করলে–এখনও আমার জন্যে জীবনপাত করছ। তুমি আমাকে ভালবাসো–সেটা লুকিও না। আমি জানি,এখন পরিষ্কার সব দেখতে পাই। তুমিই আমাকে ভালবাসো শুধু এ পৃথিবীতে–আন্ত্রিক ভালবাসা–এমন ভাল কেউ আমাকে বাসে নি! কেউ কোনদিন এমনভাবে আমার কথা ভাবে নি তোমার মতো। আমিও আর কারও কথা ভাবব না। কেন ভাবব, সে আমি তো মরেই গেছি। আমাকে মরা বাঁচিয়েছ তুমি, এখন তোমারই ষোল আনা জোর।…বাড়ি বলো ঘর বলো–আমার কাছে সবই এখন তুমি।…তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে চলো। যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবো। তোমার ঝিগিরি করলেও আমার সুখ। আর ঘর করতে চাও–সে আমার ভাগ্যি বলে মানব।’

শুনতে শুনতেই বিবর্ণ রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল অরুণের মুখ, এখন এই সায়াহ্নবেলার পাহাড়ি শীতেও তার ললাটের কোলে কোলে ঘাম দেখা দিল। সমস্ত শরীর কাঁপছে তার কাঁপছে বুকের মধ্যেও। সে বার-দুই মুখ খুলতে চেষ্টা করল কিন্তু একটা শব্দও বেরোল না গলা দিয়ে।

কী বলবে তাও বোধহয় বুঝতে পারল না। বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা, এ অকল্পিত সৌভাগ্যে তার বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুতেই। এ কি সত্যিই স্বর্ণ বলছে কথাগুলো–না আর কেউ? না কি তার এতদিনের নিভৃত স্বপ্নই ভুল শোনাচ্ছে তাকে–তার নিজের কলুষিত কামনা?…মাথার মধ্যে এমন ক’রে সব তালগোল পাকাচ্ছে কেন? বুকের মধ্যেই বা কিসের ঢেউ এসব? সে কি এবার পাগল হয়ে যাবে নাকি?…

‘কী হ’ল, কথা কইছ না যে? বাক্যি হরে গেল নাকি তোমার? নাকি আমার সঙ্গে ঘর করতেই সাহসে কুলোচ্ছে না? রোগটা এখনও সারে নি ভাবছ?…বেশ তো বাপু, না হয় তোমার ঘরে ঢুকব না, কাছে যাব না, দূর থেকেই সেবা করব। তোমার কাছে–তোমার বাড়িতে থাকতে পারলেই আমার ঢের।’

না, ভুল হয় নি তার কিছুমাত্র। ঠিকই শুনেছে অরুণ। জীবন ধন্য হয়ে গেছে তার। আশার অতীত সিদ্ধি মিলেছে, এ জন্মের সাধনা শেষ হয়েছে, সার্থক হয়েছে।

এবার কথা বলতে পারল সে। তার মানসিক অবস্থার পক্ষে আশ্চর্য রকম শান্তভাবেই বলল, ‘তোমার অসুখের ভয় আমার একটুও নেই স্বর্ণ।…অসুখ তোমার সেরে গেছে ডাক্তাররা সমস্ত রকম পরীক্ষা করে দেখেছেন।…আর না সারলেও সে ভয় আমার নেই, কোনদিনই ছিল না। তোমাকে পেয়ে, তোমার জন্যে মরেও আমার সুখ।…সে কথা নয়, আমি ভাবছি তোমার কথাই!‘

‘আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না আর। দোহাই তোমার!…এবার একটু নিজের কথাটা ভাবো দিকি!

‘কিন্তু তোমাকে বাদ দিয়ে আর কোন কথাই যে নেই ভাববার মতো।…তুমি যা দিতে চাইছ–একদিনের জন্যেও যদি তা সম্ভব হ’ত–তা হ’লে আর কোন দুঃখ থাকত না আমার জীবনে, সেই মুহূর্তে মরে গেলেও আমার সুখ ছিল। কিন্তু তোমার এতটুকু দুঃখের কারণ ঘটিয়ে স্বর্গসুখও আমার বিষ লাগবে যে!’

‘আমার দুঃখটা তুমি আবার এর মধ্যে কোথায় দেখলে তাই শুনি! এ তো আমি স্বেচ্ছাসুখে যেতে চাইছি তোমার সঙ্গে। বাড়ির কথা বলছ-আমার আবার বাড়ি কোথায়? ও বাড়ি তো আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়ে বেঁচেছে। তারা তো আমাকে চায় নি–অসুখটা হ’তে শিঁটিয়ে ছিল সবাই। সকলে নিজের কথা ভেবেছে, আমার কথাটা কেউ

ভেবেছে কি? এক তুমিই ভেবেছ! ওদের সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক কি?…তাছাড়া যার জন্যে বাড়ি–তার সঙ্গেই তো সম্পৰ্ক ঘুচে গেছে! তার নাম শুনলে এই গলা অবদি বিষে তেতো হয়ে যায় সবটা।…না, ও বাড়িতে আর আমি যাবো না!’

‘কিন্তু তোমার ছেলেমেয়ে? তাদের কথাটা ভাবছ না কেন?’

প্রশ্নটা করে শান্তভাবেই–কিন্তু সমস্ত প্রাণটা যেন তার ঔৎসুক্যে আগ্রহে–কী একটা ঐকান্তিক আশায় তার ঠোঁটের কাছে এসে অপেক্ষা করতে থাকে প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে।

‘ছেলেমেয়ে!’

একমুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে যায় যেন স্বর্ণ। আর সেই মুহূর্তকালের নীরবতাতেই নিজের বিপুল আশা ও অন্তহীন আকাঙ্ক্ষার মৃত্যুদণ্ড শুনতে পায় তার সামনের ঐ লোকটি। আর কিছু শুনতে চায় না অরুণ, আর কিছু শোনবার প্রয়োজনও থাকে না। তার উত্তর সে পেয়ে গেছে।

কিন্তু স্বর্ণ তখনই আবার কথা শুরু করে, কণ্ঠস্বরে অস্বাভাবিক জোর দিয়েই যেন বলে, ‘ছেলেমেয়েও তো তার। আমার দাদামশাই বলতেন, বংশ তো নয় বেউড় বাঁশের ঝাড়। বেউড় বাঁশের ঝাড়ে বেউড় বাঁশই ফলে। বেইমানের ঝাড়ের কথা ভেবে আমার ইহকাল পরকাল খোয়াতে গেলুম কী দুঃখে? ওদের কথা আর আমি ভাবব না। এই কমাসে ভুলেই তো গেছি, আর কেন?…আমি মরে গেলেও যা হত এখনও তাই হবে। বড় হবেই একরকম ক’রে। যাদের ঝাড় তারাই দেখবে। আমি গেলেই কি আর মানুষ করতে পারব?

‘তা হয় না স্বর্ণ!’ বুকের সে ঢেউ-ওঠা বন্ধ হয়েছে। কয়েক মুহূর্তের বাদশাহী ঘুচে গেছে চিরকালের মতো। অল্প কিছুক্ষণের জন্যে যে আশাটা উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল সে এখন ঠাণ্ডা মাটির নিচে সমাধিস্থ। সহজ স্বাভাবিক সুবুদ্ধি, দূর-দৃষ্টির পথ অবারিত হয়েছে আবার মাথার মধ্যে। তাই বেশ দৃঢ়কণ্ঠেই কথাগুলো বলতে পারল অরুণ, ‘তা হয় না স্বর্ণ তোমার ছেলেমেয়ে তোমারই। যে ঝাড়ই হোক তোমারই রক্তমাংস দিয়ে তৈরি তারা তাদের কথা আজ না ভাবো–দুদিন পরে ভাবতেই হবে। তাদের ভোলা সম্ভব নয় তোমার পক্ষে। দায়িত্বও অত সহজে এড়াতে পারবে না!

‘আমি ম’লে–তাদের কী হ’ত? তারা কি বাঁচত নানা বড় হ’ত না?

‘বড়ও হ’ত–বাঁচতও। কিন্তু তুমি ম’লে তাদের মাথা হেঁট হ’ত না, চিরদিনের মতো একটা লজ্জা একটা কলঙ্কের বোঝা চাপত না।…ছেলেমেয়েদের এত বড় সর্বনাশ আর নেই; মায়ের নাম মুখ উঁচু ক’রে যদি না বলতে পারে–তাহলে জীবনটাই তাদের মাটি হয়ে যাবে। নিজের সন্তানরা চিরকাল অভিসম্পাত করতে থাকবে–এ কি তুমি সইতে পারবে? আর সে শাস্তি কেনই বা দেবে তুমি তাদের, তারা তো এখনও পর্যন্ত তোমার কাছে কোন অপরাধ করে নি। তুমি ম’লে তোমার স্মৃতি তারা পূজো করত, অন্তত করবার চেষ্টা করত, তোমার নামটার সঙ্গে হয়ত একটা ব্যথাও জড়ানো থাকত তাদের মনে–কিন্তু এতে তো তোমাকে শুধু ঘেন্নাই করবে তারা। সে তুমি কি সইতে পারবে? আজকের এই অভিমানের মিথ্যে পর্দাটা যখন থাকবে না তখন তুমিই সেখানে ফিরে যাবার জন্যে মাথা কুটবে, অথচ সে পথ তখন বন্ধ হয়ে যাবে তোমার কাছে চিরকালের মতো। ভাল ক’রে ভেবে দ্যাখো কথাটা।’

‘সে যা-ই হোক, ‘তোমার মুখ চেয়ে সব সইতে পারব।’

পাগলের মতো একটা ঝোঁক দিয়ে দিয়ে বলে কথাগুলো, বলতে বলতেই তার দুচোখ জ্বালা ক’রে জল ভরে ওঠে।

‘কিন্তু আমি কার মুখ চেয়ে তোমার সে দুঃখ সইব বলো। তোমার মুখ চেয়েই তো আমি আছি। তোমার সুখেই আমার সুখ। তাছাড়া তুমিও সে পারবে না। আমার সম্বন্ধে কৃতজ্ঞতাবোধ এখন বলছ কথাগুলো–কিন্তু এ সাময়িক। সন্তানের সঙ্গে যোগ চিরকালের–নাড়ির, আত্মার। সে অত সহজে অস্বীকার করা যায় না।…যখন সে ব্যথা জাগবে মনে, অথচ যখন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার পথ থাকবে না, তখন আমিও তোমার কাছে বিষ ঠেকব।…এ-কূল ও-কূল দুকূলই যাবে তোমার।’

‘তাহলে–তাহলে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না–তুমি, তুমিও আমাকে ত্যাগ করলে!’

আর্তনাদের মতো শোনায় প্রশ্নটা, হাহাকারের মতো মনে হয়।

আর সে হাহাকার উচ্চতর হাহাকারেরই সৃষ্টি করে শ্রোতার মনে, সে আর্তনাদ ব্যাকুলতার প্রতিধ্বনি তোলে। স্বর্ণর এ হাহাকার সাময়িক কিন্তু ওর মনের এ হাহাকার বুঝি কোনদিনই শান্ত হবে না।

বর্তমানের লোভ বড় বেশি। মনে হয় এই হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা শুধুই মূঢ়তা। দূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানের এ স্বর্গ হারানোর কোন অর্থ নেই। তবু বিচলিত হয় না অরুণ, লোভ জয়ই করে। কারণ ভবিষ্যৎটা সুদূর হ’লেও স্পষ্ট–অন্তত তার কাছে। সে প্রাণপণে নিজেকে সংযত ক’রে উত্তর দেয়, ‘আমি তোমাকে ত্যাগ করি নি স্বর্ণ, তোমাকে ত্যাগ করা মানে ইহজন্মই ত্যাগ করা। কিন্তু আমি জানি, তুমি এখন যেটা ভাবছ দুদিন পরে সেটা ভাববে না, আজকের এ ঝোঁক যখন কেটে যাবে তখন আমাকেই তুমি দুষবে। অভিমানের কুয়াশাটা কেটে গেলে নিজের মনের চেহারাটা তুমি দেখতে পেতে, যেটা আমি পাচ্ছি। তাই এত বড় সৌভাগ্য মেনে নিতে ভয় পাচ্ছি, এ দুর্লভ বরও মাথা পেতে নিতে পারছি না।…তুমি বাড়িতেই ফিরে যাও স্বর্ণ, আমি জানি শুধু ছেলেমেয়ে নয়–স্বামীর টানও তোমার কম নেই। হরেনবাবু তোমারই মুখ চেয়ে আছেন–তাঁর সেবা তোমাকেই করতে হবে। কর্তব্য বলে নয়–তুমি চাও বলেই। স্বামীর প্রতি ছেলেমেয়েদের প্রতি সব কর্তব্য শেষ ক’রে–ছেলের বৌ যেদিন অপমান করবে, সেদিন সব দেনা-পাওনা শোধ ক’রে আমার কাছে চলে এসো। ততদিন পর্যন্ত এমনি আগ্রহ নিয়েই অপেক্ষা করব।’

‘ততদিন যদি বাঁচি–তবে তো। বাঁচলেও সে তো বুড়ি হয়ে যাবার কথা। তুমিও তো বুড়ো হয়ে যাবে!’

‘হোক না। তখনই আমাদের বেশি দরকার হবে পরস্পরকে। দুজনে কোন তীর্থে চলে যাবো। তখন তো আর কোন কলঙ্কের ভয় থাকবে না!’

চুপ ক’রে যায় স্বর্ণ। কিন্তু তার দুটি চোখের কোল বেয়ে কূল ছাপিয়ে অজস্র জল ঝরে পড়তে থাকে ধারায় ধারায়। মনে হয় তার এ কান্নার বুঝি শেষ হবে না। সে দিক থেকে প্রাণপণে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে থাকে অরুণ।

অনেক–অনেকক্ষণ পরে আবার কথা বলে স্বর্ণ, প্রায় চুপি চুপিই বলে–যেন কতকটা নিজেকে শুনিয়েই, ‘কিন্তু সেখানে গিয়ে কি আর টিকতে পারব? মনের অগোচর পাপ নেই–তোমার কাছে লুকোতেও পারব না–আমিও যে তোমাকে এ কমাসে ভালবেসে ফেলেছি অরুণদা। মানুষকে ভালবাসলে ভোলা যায়–দেবতাকে ভালবাসলে সে ভালবাসা আর ফেরানো যায় না। তুমি দেবতা–তোমাকে যে মন দিয়েছি সে মন যে তোমারই সঙ্গে থাকবে। সেখানে গিয়ে যদি তোমার কথাই ভাবি–পাপ হবে না? তুমিই বলে দাও না, কী ক’রে থাকব সেখানে?’

‘হয়ত পাপ হবে, হয়ত কষ্ট হবে–তবু আমার জন্যে না হয় সেটা সইলেই, আমার ঘরে এলে আরও বেশি পাপ হ’ত, আরও বেশি কষ্ট হ’ত।…আমার মন তো এতকাল ধরে তোমার কাছে পড়ে রয়েছে, তাতেও তো আমি কাজকর্ম সব ক’রে গেছি। দেবতা আমি নই স্বর্ণ, মানুষই। মানুষ বলেই–এইমাত্র যে কথাটা বললে তাতে আমার মন ভরে গেছে, আমার এতদিনের ভালবাসা সার্থক হয়েছে। নাই বা পেলুম তোমার রক্তমাংসের ঐ শরীরটাকে, সে আশা তো করিও নি কখনও–তোমার মনটা যদি পেয়ে থাকি সে-ই আমার বড় লাভ। তুমি আমাকে সুখী করেছ–এই জোরেই তুমি সংসারে থাকতে পারবে। আমি তোমাকে অহরহ সেই আশীর্বাদই করব আজ থেকে।’

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে পাহাড়ের শিখরেও। অন্ধকারে সব যেন লেপে মুছে একাকার হয়ে যায়, আর কিছুই দেখা যায় না স্পষ্ট ক’রে। আকাশের তারাগুলো জ্বলে শুধু মাথার ওপরে, তারই একটা অস্পষ্ট আভা এসে পড়ে ওদের মুখেচোখে।

পকেট থেকে টর্চটা বার ক’রে অরুণ বলে, ‘চলো এবার ফিরি। দেরি হয়ে গেছে– হাসপাতালের ফটক বন্ধ হয়ে যাবে হয়ত। তোমারও ঠাণ্ডা লাগছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *