০৮. ঐন্দ্রিলার খবর পাওয়া যায় নি

অষ্টম পরিচ্ছেদ

বহুকাল ঐন্দ্রিলার কোন খবর পাওয়া যায় নি। হাজার হোক মায়ের প্রাণ। মধ্যে মধ্যে শ্যামার বুকের মধ্যেটায় হু-হুঁ করে ওঠে বৈকি। অস্থির হয়ে ওঠেন। সে অস্থিরতা আর কেউ লক্ষ্য না করলেও কনক করে। তবু সে যখন বলে, ‘কী হবে মা ও পাগলের ওপর রাগ করে থেকে। একটা চিঠি লিখে দিন, চলে আসুক। মিছি-মিছি লোক হাসিয়ে আর দরকার নেই।’ তখনই আবার কঠিন হয়ে ওঠেন শ্যামা, বলেন, ‘না বৌমা, আর না। স্বেচ্ছায় এরেবেরে আর ঐ ঝগড়া ঘরে আনব না। লোক যা হাসবার তা তো হেসেছেই, আপ্ত-পরে কোথাও কি আর জানাজানি হ’তে বাকি আছে যে মেয়ে আমার রাঁধুনীগিরি করে খাচ্ছে! থাক ও, যখন তেজ কমবে তখন আপনিই আসবে।’

কিন্তু ঐন্দ্রিলাও আসে না। তারও বোধহয় জেদ, মা না ডাকলে সে আসবে না। তবে সে যে সুখে নেই তা কনক জানে। এর ভেতর বহু বাড়ি বদল করল সে। কোথাও বেশিদিন টিকতে পারে না। শ্যামারা বলেন ঝগড়ার জন্যে–কনক জানে যে সবক্ষেত্রে তা নয়। অন্য কারণও আছে। আর হয়ত সেইটেই প্ৰবল।

আসে না সে, কিন্তু চিঠি লেখে। বিশেষ করে ঠিকানা বা মনিব বদলের সময়। কনককেই লেখে। শাশুড়ীর হুকুম নেই বলে কনক উত্তর দিতে পারে না। তবু ঐন্দ্রিলা চিঠি দিয়ে যায়। কেন, কিসের আশায়–তা কনক বোঝে। যদি কোনদিন এদের দরকার পড়ে, যদি কোনদিন এরা ডাকে। তাই ঠিকানাটা সর্বদা জানিয়ে রাখা। তবে সে চিঠিতে ভেতরের কোন কথা থাকে না। থাকা সম্ভব নয়, এক পয়সার পোস্টকার্ডে লেখা খোলা চিঠি। ভিতরের কথাটা অনুমান করে কনক। অবশ্য ভিত্তিও একটা আছে বৈকি। মধ্যে একবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য এসেছিল কান্তির অসুখের খবর পেয়ে। শ্যামাকে প্রণামও করেছিল কিন্তু শ্যামা শুধু একটি শুষ্ক কুশল প্রশ্ন ছাড়া আর কিছু বলেন নি, সীতার কথাও জিজ্ঞাসা করেন নি। অন্তত সে দিনটা থেকে যেতেও বলেন নি। একেবারেই নিরাসক্ত উদাসীন ছিলেন। সেই সময়ই দু-চার মিনিটের জন্যে রান্নাঘরে এসে কনকের সঙ্গে দুটো কথা বলে গিয়েছিল। ওকে দেখেই রান্নাঘরে এসে ঢুকেছিল কনক, না জানি কি বাধবে এখনই। তবে বাধে নি কিছু বাধতে পারত অনায়াসেই–কারণ ঐটুকু সময়ের মধ্যেই কান্তির প্রতি সমবেদনা উপলক্ষ্য করে অনেক বাঁকাবাঁকা কথা শুনিয়ে গিয়েছিল ঐন্দ্রিলা। কিন্তু এ পক্ষ থেকে কোন উত্তর না আসাতেই কলহটা জমতে পারে নি। শ্যামা একেবারে পাথরের মতো নীরব ছিলেন।

শ্যামার ধৈর্যে শুধু কনক নয়, ঐন্দ্রিলা সুদ্ধ অবাক হয়ে গিয়েছিল। কেমন ভয়ও হয়ে গেল তার। মানুষের কাছ থেকে দয়ামায়া পাবার আশা থাকে, পাথরের কাছে যে কোন ভরসাই নেই। বলেছে সে যথেষ্ট। বিঁধিয়ে বিঁধিয়েই বলেছে : ‘হবে না। হতেই হবে যে। আমি যে জানি। ঐ উনি, উনি যতিদন আছেন–কারুর ভাল হবে না আমাদের বংশে। এক হতেই এ বংশের সর্বনাশ হবে। ঐ যে সর্বস্বখাকী ভালখাকী বসে আছেন, সব্বাইকে খেয়ে, সকলের সব্বনাশ করে তবে উনি যাবেন। লোভ, লোভ যে প্রবল। মেয়েছেলের অত লোভ কি ভাল? অতি লোভেই সব গেল। বড়লোক শুনেই অমনি ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তাদের বাড়ির অন্নদাস করে। কী, না ছেলে লেখাপড়া শিখে তালেবর হয়ে আসবে। খুব হ’ল তালেবর বিদ্বান। জজ ব্যারিস্টার হয়ে এল একেবারে। এখন শুধু লাইনের টাকা বাজিয়ে তোলার ওয়াস্তা। তা তো নয়–নিজের খরচটা তো বাঁচল–আর যদি সে মাগীর নজরে পড়ে যায়–কিছু বাগিয়ে আনতে পারে! ঐ পয়সার লোভেই সব যাবে ওর। তা নইলে জ্বলজ্যান্ত জামাইটা চলে গেল–পয়সার আন্ডিলের ওপর বসে আছে–তবু একটা আধলা বার করলে না। বলতে গেলে বেঘোরে মরে গেল জামাইটা। মেয়ের চুড়ি বাঁধা রেখে তবে টাকা বার করলে। ও কি মানুষ! চামার! চামারেরও অধম। ও চশমখোর মেয়েমানুষের মুখ দেখলেও মহাপাপ হয়।’ ইত্যাদি–

কনক সেদিন খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল শ্যামার ধৈর্য দেখে। পাথরও তেতে ওঠে এসব কথায়–কিন্তু শ্যামা দুটি ঠোঁট ফাঁক করলেন না। ওঁর রকম সকম দেখে মনে হ’ল যে এ সব কথা তাঁর কানেই যায় নি। অথবা আর কারুর কথা বলছে সে, অপরিচিত অন্য কোন লোক সম্বন্ধে।

ঐন্দ্রিলা অনেকক্ষণ একতরফা চেঁচামেচি করে বকে শ্রান্ত হয়ে এক সময় চুপ করে গিয়েছিল। তারপর আর বেশিক্ষণ থাকেও নি। থাকতে পারে নি। একটুখানি চুপ করে বসে থেকেই আস্তে আস্তে উঠে গিয়েছিল। নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল–শ্যামাকে বলে বা প্ৰণাম করে যেতেও সাহসে কুলোয় নি।

সেই দিনই গোটাকতক কথা ঐন্দ্রিলা বলে গিয়েছিল কনককে। খুলে কিছু বলে নি– সম্মানে বড় হ’লেও বয়সে ঢের ছোট কনক–যেটুকু আভাসে ইঙ্গিতে বলা যায় তাই বলেছে। তবে তা থেকে অনুমান করতে বাধে নি বাকিটা। যেখানে গেছে ঐন্দ্রিলা সেইখানেই প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে–ওর মেজাজ বা শাণিত রসনা নয়––অগ্নিশিখার মতো ওর রূপ। প্রথম যেখানে গিয়েছিল–মহার সেই কে কুটুমের বাড়ি–সেখানে সেই প্রবীণ উকিলবাবুটিও সামলাতে পারেন নি নিজেকে। সাত আটটি সন্তানের পিতা তিনি– পঞ্চাশের অনেক ওপরে তাঁর বয়স। তবু তাঁকে অনেকটা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলছিল ঐন্দ্রিলা, তাঁর সদ্য-বিবাহিত বড় ছেলেটিও লুব্ধ হয়ে উঠল।–এবং সেটা তার স্ত্রীর নজর এড়াল না।… সেখান থেকে সে বাড়ির গৃহিণী নিজেই উদ্যোগী হয়ে ওঁদের এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠালেন। সেও সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। সেখানে আবার বাড়ির বড় জামাই ঘন-ঘন যাওয়া আসা আরম্ভ করলেন। একদিন গোপনে এক চিঠি পাঠালেন যে, ঐন্দ্রিলা যদি রাজি থাকে, ওকে তিনি বিধবাবিবাহ করতে সম্মত আছেন। আলাদা বাসা ভাড়া করে ওকে নিয়েই থাকবেন, এ স্ত্রীর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবেন না। ইত্যাদি–। ঐন্দ্রিলা অনেক ভেবে চিঠিখানা বাড়ির গৃহিণীর হাতে দিল। ও ভেবেছিল যে এতে করে সে যে খাঁটি এইটেই প্রতিপন্ন হবে। কিন্তু হ’ল হিতে বিপরীত। গৃহিণী ভাবলেন যে, ও-ই ফাঁদ পেতে তাঁর জামাইকে ভুলিয়েছে, মেয়ের সর্বনাশ করছে। তাছাড়া তিনিও স্বামী নিয়ে ঘর করেন। হাতের কাছে এমন বিপদ থাকা ঠিক নয়। ফলে তিনি এমনই কিচিকিচি শুরু করলেন যে, ঐন্দ্রিলা পালিয়ে যেতে পথ পেল না।

এইভাবে ইতিমধ্যেই চার-পাঁচ জায়গা বদল করেছে সে। সর্বত্রই প্রায়–এক কারণ কোথাও বেশিদিন থাকা সম্ভব হয় নি। কাজ পেয়েছেও সে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু কনকের মনে হয় সে-ও ঐ কারণেই। কারণ রাঁধুনী চাকর বহাল করেন বাড়ির পুরুষেরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। মেয়েরা হলে ঐন্দ্রিলার মতো মেয়েকে চাকরি দেবার কথা ভাবতে পারত না।

এসব কথা শাশুড়ীকে বলতে পারে নি কনক। সঙ্কোচে বেধেছিল। বলেছিল সে হেমকে। বলেছিল, ‘তুমি উদ্যুগী হয়ে মাকে বলে চিঠি লেখাও। কী করছ তোমরা, শেষে কী একটা কেলেঙ্কারি হবে! তোমাদের বাড়ির মেয়ে হয়ে রাঁধুনীগিরি করছে এই তো এক লজ্জার কথা, তার ওপর যদি নষ্ট হয়ে যায় মুখ দেখাতে পারবে?’

কিন্তু হেমও রাজি হয় নি। যদিও সে ইদানীং একটু সমীহ করতেই শুরু করেছিল কনককে–বিশেষত কান্তির ব্যাপারটার পর থেকে–কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার কথায় সায় দিতে পারল না। বলল, ‘তুমি বুঝছ না, মা ঠিকই বলেছেন, এখন যেচে নিয়ে এলে আর রক্ষে থাকবে না। মাথায় চড়ে নাচবে একেবারে। তার ওপর যদি ঘুণাক্ষরেও কানে যায় যে আমিই সুপারিশ করেছি তাহ’লে তো কথাই নেই। এখন তবু আমাকে একটু ভয় করে– তখন তাও করবে না। কী দরকার যেচে অশান্তি ঘাড়ে করবার। তুমি যা ভাবছ অত কিছু হবে না, খেঁদি সে মেয়ে নয়। ওর আর যাই দোষ থাকুক, এক হরিনাথ ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের দিকে কখনও তাকায় নি সে, আর তাকাবেও না। ওকে নষ্ট করবে জীবন থাকতে, এমন পুরুষ মানুষ জন্মায় নি এখনও। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

এরপর আর কনকের কথা কওয়া যায় না। কীই বা বলবে সে? যাদের মেয়ে যাদের বোন তাদের চেয়ে কি আর সে বেশি বোঝে?

.

কনক যা ভেবেছিল–বিপদ সেদিক দিয়ে কিছু না এলেও অন্য দিকে থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে এসে পড়ল।

ফাল্গুনের শেষের দিকে হঠাৎ একদিন ঐন্দ্রিলার মেজ দেওর শিবু এসে হাজির হ’ল, হাতে একখানা লাল কালিতে লেখা চিঠি। তখন সন্ধ্যা হয় হয়, পাতা কুড়নো শেষ করে সবে পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন শ্যামা। শিবু হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে এসে প্রণাম করল। খাটো কাপড় পরনে–তবু তাই-ই টানাটানি করে গুছিয়ে গায়ে দিতে দিতে পরিহাসের সুরে প্রশ্ন করলেন শ্যামা, ‘কী গো, কি মনে করে? বেটার বিয়ে দিচ্ছ নাকি?’

চারদিক ঘোর-ঘোর হয়ে এলেও চিঠির লাল কালিটা তার নজর এড়ায় নি।

শিবুও হাসিমুখেই জবাব দিল, ‘বেটার নয়, বেটির।’

‘বেটির! তার মানে?’

বেটার বিয়ে হবারও কথা নয়–কারণ শিবুর বড়ছেলের বয়স ন-দশের বেশি হবে না, কিন্তু বেটি আরও অসম্ভব, একেবারেই এই সর্বশেষ সন্তানটি মাত্র ওর মেয়ে–তার বয়স এক পুরেছে কিনা সন্দেহ। তাই সংশয়ে উদ্বেগে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠ।

‘ভায়ের মেয়ে আর নিজের মেয়ে কি আলাদা?’ শিবু তখনও হাসিমুখেই বলে, ‘আপনার সীতারই বিয়ে।’

ততক্ষণে কনক এসে রান্নাঘরের দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে দিয়েছে–অভ্যস্ত আতিথেয়তায় শ্যামাকেও বলতে হয় ‘বসো বাবা’, কিন্তু সেটা সত্যিই যন্ত্রচালিতের মতো বলেন তিনি। তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে উঠছে। ঘরে গিয়ে এই খাটো এবং ভিজে কাপড়টা ছেড়ে আসবার কথাও তাঁর মনে পড়ে না। ওর ঐ অতি-সপ্রতিভ হাসি-হাসি মুখ দেখবার সঙ্গে সঙ্গে, কে জানে কেন, তাঁর মনে হয়েছিল যে খবর ভাল নয়, খুব ভাল কোন উদ্দেশ্যে শিবু আসে নি এখন সেই সংশয়টাই সমর্থিত হয় ওর কথায়

তিনি তেমনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই পর-পর প্রশ্ন করে যান, ‘সীতার বিয়ে? সে কী? কোথায়– কে ঠিক করলে? খেঁদি কোথায়? ছেলে কী করে?

প্রশ্নগুলোর কোন প্রত্যক্ষ উত্তর না দিয়ে শিবু ভারিক্কি চালেই বলল, ‘যোগাযোগ একটা আপনাদের আশীর্বাদে হয়ে গেল আব্বুই মা, তাই আর দেরি করলুম না। বিয়ে যেকালে আমাদেরই দিতে হবে, এ দায়ে যখন আর কেউ ঘাড় পাতবে না, সেকালে আমাদেরই ভেবে- চিন্তে ঠিক করা ছাড়া উপায় কি বলুন! ভায়ের সঙ্গে পরামর্শ করলুম, মায়ের মত নিলুম –আর বেশি লোককে জানাবার কি খবর দেবার তো সময়ও হ’ল না; এই মাসের শেষ তারিখ পেরিয়ে গেলে এখন দু-মাস আর বিয়ের দিন নেই। সামনে চোত মাস, বোশেখে পড়ছে মলমাস! পাত্র বলেছে এই তারিখেই বিয়ে দিতে হবে, আমরা না দিই অপর মেয়ে তার হাতে আছে। সে আর অপেক্ষা করতে পারবে না। ভাল পাত্তর হাত ছাড়া করে এর পর আবার কোথায় খুঁজে বেড়াব বলুন, আমাদের তো আর এথির জোর নেই–কাজেই না বলতে ভরসা হল না। অগত্যা ঐ তারিখেই রাজি হতে হ’ল। তা ধরুন কালকেই বিয়ে।’

‘কাল বিয়ে? সে কি! আর তোমরা আজ আমাদের জানাতে এসেছ? মামা জানল না, দিদিমা জানল না–আমরা এতটুকু মেয়ে থেকে মানুষ করলুম–তার বিয়ে ঠিক করে ফেললে তোমরা আমাদের না জানিয়েই? এ কেমন ধারা কথাবার্তা বাছা, কিছু তো বুঝছি না!’

মনের কুটিল সংশয় আর কণ্ঠে চাপা থাকে না, রাখার চেষ্টাও করেন না শ্যামা। শিবুরও এবার নিজমূর্তি প্রকাশ পায়। সে বলে, ‘হ্যাঁ, মানুষ আপনারা করেছেন তা ঠিক, তেমনি আবার সব দায়িত্ব চুকিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন এটাও তো ঠিক! কৈ, এই তো এতকাল বৌদি পরের বাড়ি দাসীবৃত্তি করছে বলতে গেলে–মেয়ে তো আমাদের ওখানে পড়ে, এই তো ধরুন আধ ঘণ্টার রাস্তা–কৈ মামা দিদিমা একদিনের তরেও খবর নিতে গেছে বলে তো জানি নি!’

কেন খবর নিতে যাব বাবা। সুখসমন্দা সে আমাদের না বলে-কয়ে মেয়ে নিয়ে চলে গেছে, আমাদের মত না নিয়েই–আমরা যাব সেধে তার খবর নিতে! আমরা কি যেতে বলেছি–না তাড়িয়ে দিয়েছি?’

‘সে স্বেচ্ছায় গেছে!’ খুব ভালমানুষের মতোই সায় দেয় শিবু, ‘তবেই দেখুন! এই তো আপনার কথাতেই প্রকাশ পাচ্ছে, মেয়ের মা তাহ’লে চায় না যে মেয়ে আপনাদের দায়িত্বে থাকে। যে-কোন কারণেই হোক, মেয়ে সরিয়ে নিয়ে গেছে সে। এক-আধ-দিন রাগের মাথায় করার তো কথা নয়–ধরুন হয়েও গেল তো অনেকদিন। এর মধ্যে বহুবার এসেছে গেছে। ইচ্ছে করলেই আবার আপনাদের কাছে রেখে যেতে পারত। আজকালকার যা দিনকাল, পরের ঝক্কি কেউ যেচে স্বেচ্ছাসুখে ঘাড়ে করতে চায় না এটা তো বোঝেন। বিশেষ বিয়ের ব্যাপার, খরচার কথা। তবে আমাদের ঘাড়ে যেকালে ফেলে দিয়ে গেছে, সেকালে আমাদেরই সে ভার বইতে হবে, বংশের মেয়ে ফেলে দেওয়া তো চলবে না, দুর্নাম হ’লে তো আমাদেরই হবে, বলবে, অমুকের মেয়ে, অমুকের নাত্নী। তা আমাদের দায় যখন আমাদেরই বইতে হবে, কেউ ভাগ নিতে আসবে না–তখন অপরের মতামত নিতে যাব কেন বলুন, আর এর জন্যে এত কৈফিয়তই বা কিসের?’

বেশ বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে শিবু, বোঝা যায় যে সে প্রস্তুত হয়েই এসেছে।

বোধহয় এই-ই প্রথম, অপমানিত হয়েও চুপ করে যেতে হ’ল শ্যামাকে, দেবার মতো উত্তর একটাও খুঁজে পেলেন না। তাঁর নিজের যুক্তিতেই তাঁকে নিরুত্তর করে দিয়েছে শিবু। যার মেয়ে,–যে তার মেয়েকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে গেছে–কৈফিয়ত চাইতে গেলে সে-ই চাইতে পারে একমাত্র। ওঁদের যে অধিকার, অভিভাবাকত্বের দাবি, সে তো তা স্বীকার করে নি, তবে কিসের জোর ওঁদের?

চুপ করেই রইলেন শ্যামা। শুধু অপমানে আর দুঃসহ ক্রোধে কানের মধ্যেটা যেন ঝাঁ- ঝাঁ করতে লাগল।

সে ক্রোধ এদের ওপরও ততটা নয়–যতটা তাঁর নিজের মেয়ের ওপর। কী লগ্নেই ঐ মেয়ে জন্মেছিল তাঁর। শুধু জ্বলে আর জ্বালিয়েই গেল সকলকে। নিজের মন্দ-ভাগ্যের আগুনে শুধু নিজেই জ্বলল না, শুধু তাঁদেরই জ্বালাল না, বোধ করি নিজের সন্তানের ও আজীবন দাহের কারণ হ’ল সে আগুন। কে জানে এদের কী মতলব, বিয়ে একটা সাধারণ ব্যাপার, বরং ঠিক হ’লে আগে তাঁদেরই জানাবার কথা, খরচের একটা মোটা অংশ দাবি করার কথা। অবস্থা খারাপ নয় এদের এটা ঠিক, তবু এতও ভাল নয় যে একটা মেয়ের বিয়ে টেরও পাবে না। এরাই যে এদের অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী বড়ভাইয়ের চিকিৎসার খরচের বিনিময়ে বিষয়টা লিখিয়ে নিয়েছিল সে কথা তো তিনি ভোলেন নি!

অথচ–অথচ এক্ষেত্রে কিছুই করবার নেই তাঁদের। কোন প্রতিকার হাতে নেই। সে সমস্ত পথ সেই হতভাগা নির্বোধ মেয়ে নিজেই ঘুচিয়ে দিয়ে গেছে!

এরপর আর তাঁর পক্ষে এ প্রসঙ্গ তোলা সম্ভব নয়–অথচ ভেতরে ভেতরে যে তিনি ছটফট করছেন খবরের জন্যে–এ তাঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারল কনক। সে এবার মাথার কাপড়টা একটু টেনে দিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল। এর আগে সে কোনদিন শিবুর সঙ্গে কথা বলে নি, তবে সম্পর্কে ছোট ননদের দেওর, কথা কওয়া আটকায়ও না। সে সামান্য একটু ইতস্তত ক’রে মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘মেজঠাকুরজি কবে এলেন? ভাল আছেন তো তিনি?

ছোট ও সহজ প্রশ্ন। স্বাভাবিকও। কিন্তু সহজ ও স্বাভাবিক ব’লেই বোধ হয়–শিবু যেন বেশ একটু বিব্রত হয়ে উঠল। তার উত্তর দেওয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল যে কঠিন কঠিন প্রশ্নের জন্যই তৈরি হয়ে এসেছিল সে–এ ধরনের প্রশ্নর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। ঘাড় মাথা চুলকে বললে, ‘না–ব্যাপারটা কি জানেন বৌদি–মানে এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক হ’ল, বলতে গেলে চার-পাঁচদিনের মধ্যেই দু-পক্ষের দেখাদেখি দেনাপাওনা সব কিছুই ঠিক করতে হ’ল কিনা–। কাল পাকা দেখা শেষ ক’রেই বৌদিকে চিঠি দিয়েছি–কাছেই তো– এই বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর, কঘণ্টারই বা পথ, আজই সকালে সে চিঠি পেয়ে গেছে নিশ্চয়, আজ রাত্তিরের ট্রেনে যদি রওনা হয়–কাল ভোরেই এসে পৌঁছতে পারবে।’

‘অ। ঠাকুরঝি এখনও জানেন না।… তা ছেলেটি কী করে?’

করে–মানে করবার খুব দরকার হয় না। বিস্তর জমিজমা বিষয়সম্পত্তি। এই কাছেই ডোমজুড়ে বাড়ি–ধানজমিটমি নিয়ে যা আছে তাতে একটা বড় গেরস্ত বেশ চলে যায়।’

কনক নাছোড়বান্দা। সে খুব শান্ত সুরেই প্রশ্ন ক’রে যায়–একটার পর একটা; ‘তা লেখাপড়াটড়া–মানে এমনিই জিজ্ঞেস করছি, কৈফিয়ৎ চাইছি যেন ভাববেন না– ‘

‘না না, কী আশ্চর্য। কি যে বলেন! তা নয়–তবে কী জানেন, অতটা খোঁজ করি নি। মানে কথাটা আপনাকে খুলেই বলি–ঠিক প্রথম পক্ষে কাজটা হচ্ছে না। এটি দ্বিতীয়পক্ষ। তা নইলে ঘর থেকে মোটা টাকা বার ক’রে কাজ করতে পেরে উঠব কেন বলুন? দ্বিতীয়পক্ষ বলেই খরচাপত্র বিশেষ লাগছে না। অথচ অগাধ সম্পত্তি, যা শোনা গেল স্বভাবচরিত্রও ভাল–মানে সব দিক দিয়েই–বুঝলেন না, পাত্রের মতো পাত্র। কেবল ঐটুকু খুঁতের জন্যে কি আর কিন্তু করা ঠিক হ’ত?’

বলতে বলতে শেষের দিকে বেশ একটু যেন উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে শিবু। বোধ হয় বলার ভঙ্গিতে এবং গলার আওয়াজেই পাত্র সম্বন্ধে এঁদের সমস্ত সংশয় সে দূর করতে চায়।

কিন্তু শ্যামা আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পূর্বের অপমান ভুলে গিয়েই আবারও কথা কইতে হ’ল তাঁকে। সীতাকে তিনি সত্যিই ভালবাসতেন। যেখানে তার মঙ্গল অমঙ্গলের প্রশ্ন, ভবিষ্যতের প্রশ্ন– সেখানে মান অপমান অত মনে রাখা সম্ভবও নয়। তিনি আবারও প্রশ্ন ক’রে বসলেন, ‘তার মানে, মেয়ের মাও জানে না যে তার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।… ঐটুকু একরত্তি মেয়েকে একটা দোজবরের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছ, হয়ত বা বুড়োর হাতেই দিচ্ছ, কে জানে–তা মেয়ের মার মতটাও কি একবার নেওয়া দরকার ছিল না বাবা?’

‘অবিশ্যি। অবিশ্যি। দরকার ছিল বৈকি!’ শিবুর গলা আবার মিষ্ট ও শাণিত হয়ে ওঠে (ওর কথা শুনতে শুনতে কনকের ‘মিছরির ছুরি’ কথাটা মনে পড়ে যায়) ‘তবে কি জানেন আঁবুই মা, আমাদের ওপর মেয়ের ভার ছেড়ে দিয়ে যখন সে নিশ্চিন্তি আছে–তখন আমরা মেয়ের শুভাশুভটাই তো আগে ভাবব–তার মায়ের মতামতটা ঢের পরের কথা।’

বলতে বলতেই একেবারে উঠে দাঁড়ায় সে।

কনক ব্যস্ত হয়ে উঠে, ‘ও কি, ও কি–উঠছেন কি, দাঁড়ান, একটু অন্তত মিষ্টি মুখে দিয়ে যান–’

‘না, বৌদি, ঐটি মাপ করতে হবে। বুঝতেই তো পারছেন, সব জায়গা ঘুরতে ঘুরতে আসছি–পেটে আর তিল থোবার জায়গা নেই–’

‘তা কি হয়। শুভকর্মে নেমন্তন্ন করতে এসেছেন–একটু কিছু মুখে না দিয়ে গেলে যে মেয়েটার অকল্যাণ হবে ভাই! একটুখানি দাঁড়ান–’

সে ছুটেই ভেতরে চলে যায়। আজ তার বুকে বল আছে অনেকখানি। বড়বাজারের দিকে কী একরকম আকের গুড় উঠেছে–পশ্চিমে নাকি ঐরকম গুড়ই চলে–বড় বড় ডেলা পাকানো, দামেও নাকি ওয়ারা–অথচ খেতেও ভাল, সস্তা পেয়ে অনেকখানি কিনে এনেছে হেম গত সপ্তাহে। তাই দেখে শ্যামাও দিলদরিয়া হয়ে দুটো নারকেল বার ক’রে দিয়েছেন, আজ দুপুরে নিজেই নাড়ু পাকিয়ে রেখেছে কনক।

সে ঘরে চলে গেলে হাতের চিঠিটা দাওয়ায় নামিয়ে রেখে শ্যামাকে উদ্দেশ ক’রে শিবু বলল, ‘কাল আপনারা সবাই যাবেন দয়া ক’রে–দাঁড়িয়ে থেকে কাজটা উদ্ধার করিয়ে দেবেন। মা বলে দিয়েছেন অনেক ক’রে–কোন দোষত্রুটি অপরাধ নেবেন না, মেয়েছেলে সঙ্গে নেই বলে যেন ত্রুটি ধরবেন না। তাঁর তো আসবার উপায় নেই–বাতে পঙ্গু, আমার স্ত্রী সাতমাস অন্তঃসত্ত্বা। এক আমার ছোট ভায়ের স্ত্রী, বৌমা ভরসা–সব কাজ তাকেই করতে হচ্ছে, বুঝছেন তো? এইসব বিবেচনা ক’রে ক্ষ্যামা-ঘেন্না ক’রে নেবেন–যেন অভিমান ক’রে বসে থাকবেন না। মা একশবার বলে দিয়েছেন।’

‘তা তো হয় না বাবা। গায়ে ময়লা মাখলে যমে ছাড়ে না।’ শ্যামা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘এ সব সামাজিক কাজ, অপারগ বললে চলে না। বিশেষত পাড়া-পড়শি হ’লেও না হয় কথা ছিল, এ কুটুম্বস্থল। বৌমার যাওয়ার কথা তো ওঠেই না– তুমি এসেছ যেকালে, হেম কান্তি যেতে পারত! কিন্তু বাবা কাল বিয়ে আজ শুকনো নেমন্তন্ন করতে এসেছ, সে তার বড় মামা, ছ’মাসের মেয়ে এনে সে-ই খাইয়ে পরিয়ে এত বড়টা করেছে–সে যে যেতে রাজি হবে বলে আমার মনে হয় না।’

দেখুন–সে যা আপনারা ভাল বোঝেন। বাপ-মরা মেয়ে, কাকারা কোনমতে বিয়ে দিচ্ছে, সেখানে গিয়ে যদি দাঁড়ানো কর্তব্য মনে করেন তো যাবেন। কী আর বলব। মা যা বলে দিয়েছেন তাও বললুম। এখন আপনাদের অভিরুচি।’

নিস্পৃহ উদাসীনভাবে বলে শিবু।

ইতিমধ্যে একটা রেকাবীতে চারটে নারকেল নাড়ু আর এক গ্লাস জল এনে সামনে ধরেছে কনক।

‘উঁহু উঁহু বৌদি, মাপ করবেন– একটা, একটার বেশি কোনমতেই চলবে না। ভাববেন চাল দেখাচ্ছে তাই, নইলে বলতাম আধখানা। একটা আমার হাতে তুলে দিন।’

‘আপনিই নিন না তুলে যা নেবেন।’ রেকাবীটা দাওয়ার ওপর নামিয়ে দেয় সে। আলগোছে, অতি সন্তর্পণে একটা নাড়ু তুলে মুখে ফেলে হাতটা শুধু ধুয়ে নিল সে গেলাসের জলে, জল খেল না।

শ্যামা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ভরসন্ধ্যায় সন্ধ্যা জ্বলার আগে কুটুমের ছেলে বাড়ি থেকে যাওয়া উচিত নয়, কনকেরও সন্ধ্যা দেখাবার আগে এই রাক্ষসী-বেলায় খেতে দেওয়া অন্যায় হয়েছে–এসবই মনে হল তাঁর, কিন্তু কাউকেই কিছু বলতে পারলেন না। শুধু দেহ নয়, মনেরও যেন আর কিছু ভাববার বা স্থির করার শক্তি ছিল না।

.

হেম বাড়ি আসতে কনকই তাকে খবরটা দিল। শ্যামা তখনও গুম্ খেয়ে বসে আছেন। মেয়েটার জন্যে দুশ্চিন্তা তো বটেই–অপমানের জ্বালাটাও ভুলতে পারছেন না, বার বার অপমান ক’রে গেল বলতে গেলে–অথচ তিনি কিছুই করতে পারলেন না, ভাল রকম একটা জবাব পর্যন্ত দিতে পারলেন না।

কনকেরও মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল খুব। এ বাড়িতে আসার পর ঐ মেয়েটাই ছিল তার প্রধান অবলম্বন। তার সঙ্গে বকে, তার সঙ্গে গল্প ক’রেই তবু একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচত সে। সীতাকে ওদের বাড়িতে ফেলে রাখাটা কখনই তার পছন্দ হয় নি, অনেকবার সে এখানে আনবার কথা তুলেছেও–কিন্তু এঁরা সেধে আনতে রাজি হন নি, ও পক্ষের নরম হয়ে ফিরে আসারই অপেক্ষা করছিলেন। আর আনতেই হ’ল না–একেবারে পরের বাড়িতেই চলে গেল মেয়ে।

তা যাক। নিজের ঘর-বর পাচ্ছে ভালই। কিন্তু কেমন সে ঘর-বর সেই তো দুশ্চিন্তা। ব্যাপারটা কি বোঝা যাচ্ছে না ব’লেই তো ভাবনা। দোজবরে বিয়ে এমন কিছু নতুন ঘটনা নয়, আখছারই হচ্ছে। অল্পবয়সী দোজবরে হ’লে বলবারও কিছু নেই। কিন্তু এ বর কেমন তা কে জানে! কত বয়স, ও পক্ষের ছেলেমেয়ে কিছু আছে কিনা–কিছুই তো জানা গেল না। হয়ত ভাল পাত্রই, মিথ্যেই ওরা ভেবে মরছে, কিন্তু–কনকের মনে বার বার এই প্রশ্নই জাগতে লাগল–তাহ’লে এত লুকো-ছাপার কী আছে! তাদের না হয় না জানাল, মেয়ের মাকে মাত্র একদিন আগে চিঠি দেওয়া হ’ল কেন? এটাই যে মস্ত গোলমেলে ঠেকছে।

হেমও সমস্ত শুনে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ! তারপর বলল, ‘তা আমি আর কি করব বল! আমার আর কী করবার আছে!’

কনক ব্যাকুল হয়ে উঠল, ‘ওমা, তা বলে কিছুই করবে না? একটু খোঁজ-খবরও নেবে না–কী পাত্তর, কী বিত্তান্ত ‘

‘নিয়ে লাভ? যদিই ধরো পাত্র শুনি খুব খারাপ–আমি কি বিয়ে বন্ধ করতে পারব? মিছিমিছি ছুটোছুটি করে লাভ কি?’

‘বিয়ে বন্ধ করার কোন উপায় নেই? তুমি তো মামা, তেমন বুঝলেও বিয়ে বন্ধ করতে পারবে না? তাই কখনও হয়!’

‘তুমি আইন-কানুন জান না–কী বুঝবে! তুমি গিয়ে বোঝাও গে পুলিশকে। আমি কি করে বিয়ে আটকাব বলো! এক থানা-পুলিশ করা ছাড়া কোন উপায় নেই। তা তারা যদি বলে মেয়ের মা কোথায়–তার কী মত? তখন? তাঁকে তো চেনো। তিনি যদি এসে বলেন, বেশ করব আমার মেয়ে এই পাত্তরে দেব–তখন? তখন তো সে থানা পুলিশ তারা করবে আমাদের নামে! মানহানির মামলা ক’রে বসবে তারা। সে আমি পারব না।’

‘থানা-পুলিশ না-ই করলে। পাড়ার লোকজনকে বলে কিছু করা যায় না?’ ভয়ে ভয়ে বলে কনক।

‘অত হ্যাঁঙ্গামা কে করে বলো! আত্মীয়-কুটুম্বর ব্যাপার। পাড়ার লোক মনে করবে কোন আচা-আচির ব্যাপার আছে। তারপর তারা আমাদের চেনে না–ওদের সঙ্গে এতকাল বাস করছে।… আর আমাদের অত ছিষ্টি করার দরকারই বা কি? আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে যখন নিয়ে গেছে তখন আমাদের কী দরকার ওর মধ্যে মাথা গলাবার যাচ্ছিও না–কিছুই না! মিটে গেল! যার মেয়ে যে সোহাগ করে রেখে গেছে ওখানে, সে বুঝুক!’

অগত্যা কনককে চুপ ক’রে যেতে হয়। সে আর কি বলবে, তার কতটুকু ক্ষমতা, কতটুকু জোর। শুধু সেই নিরুপায় নিরপরাধ মেয়েটার ভবিষ্যৎ চিন্তা ক’রে চোখ ছলছল করতে থাকে তার।

কনক অনুচ্চ কণ্ঠে বললেও দালানের ভেতর থেকে শ্যামা সবই শুনেছেন, হেমের জবাবও। তিনিও আর কিছু বললেন না, শুধু বেশ শব্দ ক’রেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ল তাঁর। এ তাঁরই ভাগ্যের দোষ, যেখানে একটু সম্পর্কও আছে–কেউ সুখী হবে না, কেউ শান্তি পাবে না।

মুখে যা-ই বলুক, শেষ পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়ার পর হেম বেরিয়ে পড়ে একবার। এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে তা কনক প্রশ্ন করে না, বুঝতেই পারে সে। নিশ্চয় মহাদের বাড়িই যাচ্ছে। ডোমজুড়ে ওদের সব কে চেনা লোক আছে, আত্মীয় কেউ থাকা ও বিচিত্র নয়। ওরা হয়ত জানলেও জানতে পারে পাত্রের খবর।…

কিন্তু সেখানেও কোন সুবিধা হ’ল না। তারাও কিছু জানে না। সেখানে শিবু গিয়েছিল আরও রাত্রে–আটটা নাগাদ। এখান থেকে সেরে ও-পাড়ায় গিয়েছিল! বোধ হয় শ্যামার কথাটা স্মরণ করেই–ওখানে আর মেয়েদের কথা তোলে নি–কিংবা সেই রকমই কথা ছিল–শুধু পুরুষ কজনকে নিমন্ত্রণ করেছে, তাও কুঁচো-কাঁচা নয়, তিন কর্তা আর বড় চার- পাঁচটি ছেলেকে নাম ক’রে ক’রে বলেছে। মিনিট পাঁচেকের বেশি নাকি থাকে নি, মেজকর্তাই সামনে ছিল, তাকেই বলে চলে এসেছে। তাকেও ছেলের নাম-ধাম কিছু জানায় নি। কৌশলে এড়িয়ে গেছে। অবশ্য তারও অতটা তখন মনে হয় নি, বিয়েটা যে তাড়াতাড়ি সারা হচ্ছে, মামাদের জানানো হয় নি–এ-সব কিছু জানবার কথা নয় তার। মহা সে সময় বাড়ি ছিল না, সে থাকলে হয়ত জোর ক’রে জেনে নিতে পারত। ওর অত মান-অপমানের বালাই নেই, চেঁচিয়ে হাট বাধাত, জামা ধরে টেনে বসানোও বিচিত্র নয় তার পক্ষে–কিন্তু এমনই অদৃষ্ট, আজই সে গিয়েছিল পাড়ায় কাদের বাড়ি আনন্দ নাডু ভাজতে। ফিরে এসে খবর পেয়ে হায় হায় করছে–কিন্তু এখন আর উপায় কি?

রাত বারোটা নাগাদ হেম ফিরে এসে যখন এই খবর দিল তখনও এ দুটি স্ত্রী লোক জেগে বসে। শ্যামা তখনও জল খান নি, তাঁর আর খাওয়া হবেও না। কনক একবার ভাতের সামনে বসেছিল বটে–কতকটা শ্যামার ভয়েই–কিন্তু কিছুই খেতে পারে নি। খাওয়ার কোন প্রবৃত্তিই ছিল না। সীতাকে যে সে এতটা স্নেহ করে– তা এর আগে সে নিজেও কোনদিন বুঝতে পারে নি।

শ্যামা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। যাবার আগে শুধু কনককে উদ্দেশ্য ক’রে বললেন, ‘তুমি আর মিথ্যে এ নিয়ে মন খারাপ ক’রো না বৌমা, ভাল বিয়ে ওর হবে না, হ’তে পারে না; সে আমি বেশ জানি। আমার ঝাড় যে! যেখানে আমার এক ফোঁটা রক্তও আছে, সেখানে কেউ কোনদিন সুখী হবে না। মিছিমিছি ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।’

এ সান্ত্বনা যে তিনি কাকে দিয়ে গেলেন–কনককে না নিজেকে–তা বোঝা গেল না, তবে তা কতকটা যেন বিলাপের মতোই শোনাল। তেমনি করুণ তেমনি অসহায়।

।।২।।

পরের দিন আর এ প্রসঙ্গ কেউ তুলল না। শ্যামা রাত্রের মধ্যে সম্পূর্ণ সামলে নিয়েছেন নিজেকে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই কাজকর্ম করে যেতে লাগলেন। কোথাও যে কোন উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা বা দুঃখ–কি পরিতাপের কোন কারণ আছে তা তাঁর মুখের দিকে চেয়ে কিম্বা কাজকর্মের ও কথাবার্তার সহজ-স্বচ্ছন্দতায় কোনমতেই বোঝার উপায় নেই। শুধু তাঁর চোখের দিকে চেয়ে অস্বাভাবিক রক্তিমা দেখে কনক বুঝতে পারল যে, তিনি সারারাত ঘুমোন নি, হয়ত বসেই কাটিয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু কনক অত পোড় খায় নি এখনও–সংসারে সে এখনও শ্যামার তুলনায় নবাগত। তাই তার প্রাণটা ছটফট করতেই লাগল। সারা দুপুর ঘর-বার করল সে একবারও শোওয়া তো দূরের কথা, স্থির হয়ে বসতে পারল না পর্যন্ত। ইদানীং কে জানে কেন, কিছুদিন ধরেই শরীরটা ভার-ভার লাগছে। যখন-তখন শুয়ে পড়তে ইচ্ছা হয়– সেজন্যে শাশুড়ী পছন্দ করেন না জেনেও, দুপুরে সে ঘুমোয় একটু করে। শ্যামা অত লক্ষ করেন নি–সে নিজেও বলতে পারে নি কিন্তু কিছুদিন যাবৎই সে লক্ষ্য করছে যে খাওয়ার ব্যাপারেও নানারকম রুচিবিকার ঘটছে তার। পাঁচজনের সংসারে সে মানুষ। অনেক দেখেছে। এর থেকে যা সন্দেহ হওয়া উচিত তারও তা হয়েছে–তবে সে কথা সে কাকে বলবে তাই ভেবে পায় না।

কিন্তু আজ সেই দুপুরের সকল-শরীর-আচ্ছন্ন-করা দুচোখের পাতা-ভারী-হয়ে-আসা ঘুমও কোথায় চলে গেল। বরং দুপুর গড়িয়ে যত বেলা পড়ে আসতে লাগল, ততই তার অস্থিরতাও বাড়তে লাগল। ওর মনে মনে খুব একটা আশা ছিল যে, আজ সকালে মেজ ঠাকুরঝি নিশ্চয় এসে পড়েছে–সুতরাং দুপুরে কি বিকেলের মধ্যে এখানেও আসবে একবার। বিয়ে যদি খুব অবাঞ্ছিত হয় তো সে এমনি মেনে নেওয়ার মেয়ে নয়। হৈ-চৈ চেঁচামেচি ঝগড়াঝাঁটি করে বিয়ে বন্ধ করতে চাইবে নিশ্চয়ই এবং সেজন্যেও ওদের সাহায্য চাইতে আসবে। আর মনোমত হ’লেও এসে ওদের নিয়ে যাবে জোর করে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে–জীবনের ঐ একটা অবলম্বন–তার বিয়েতে ভাই-ভাজকে বাদ দিতে দেবে না কিছুতেই। কিন্তু এক সময় যখন অপরাহ্ণ শেষ হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, তবু কারুরই দেখা কি কোন খবর মিলল না, তখন যেন ওর চোখে জল এসে গেল। তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে প্রণাম করার সময় মনে মনে বলল, ‘ঠাকুর, ওর শুভ করো। অনাথা মেয়ে বাপকে দেখল না, তার স্নেহ পেল না, আদর কী বস্তু তা-ই জানল না কখনও–এখন বিয়েটা যেন ওর ভাল হয়। ঘর-বরে যেন সুখী হয় ও।’

বোধ হয় এই প্রার্থনার ফলেই মনে একটু জোর এল। ভাবল, ‘সত্যি, কেনই বা আমরা এতটা কু ভাবছি। ওর কাকাদের কী স্বার্থ খারাপ বিয়ে দিয়ে? অনাথা একরত্তি মেয়ে–হাজার হোক নিজেদের ভাইঝি জেনেশুনে কি তার অনিষ্ট করতে পারে!

একটু সুস্থির হয়ে সে রান্নায় মন দিল। বাইরে কে এসেছে–বোধ হয় বন্ধকী জিনিস ফেরৎ নিতে–দেখল তার শাশুড়ী সুদের হিসেব নিয়ে তকরার জুড়ে দিয়েছেন। তাতে আরো বল পেল যেন। উনিও নিশ্চয়ই ভাল বুঝছেন, নইলে কি আর তুচ্ছ এক পয়সার হিসেব নিয়ে এত বকাবকি করতে পারেন? হাজার হোক ওঁরই নাতনী–সে তো পর, তো পর, পরের মেয়ে।

রাত্রে হেম এসেও আশ্বাস দিল খানিকটা, ‘অত ভাবছই বা কেন–কী আর এমন অনিষ্ট হবে? দোজবরে বিয়ে তো কতই হচ্ছে। আর কিছু না–হয়ত বয়সটাই একটু বেশি–সেইজন্যেই কথাটা চেপে চেপে যাচ্ছে, বিস্তারিত কিছু বলছে না। তা আর কী করা যাবে বলো। বিষয়-সম্পত্তি–যা বলছে যদি সত্যিই অত থাকে–তাহলে অন্তত খেয়ে-পরে তো সুখে থাকবে। হোক গে বয়স বেশি, ওতে এমন কিছু এসে যাবে না। মেয়েরা অতটা ঠিক মাথা ঘামায় না বয়স নিয়ে–আমি দেখেছি।’

‘কী করে দেখলে তুমি, মেয়েদের মনের মধ্যে সেঁদুচ্ছ নাকি আজকাল?’

মনটা স্বামীর আশ্বাসে হাল্কা হয়ে এসেছে অনেকটা, তাই একটু কৌতুক করার লোভ সামলাতে পারে না কনক।

হেম কিন্তু দমে না। বলে, ‘তা কেন, আমাদের অফিসের এক বন্ধুর বোন, এই নাকি ঠিক ষোল বছর বয়স। আর দেখতেও–যারা যারা দেখেছে অফিসের–সকলেই একবাক্যে বলে, ডানাকাটা পরী একেবারে। মেমেদের মতো রং। সে ওর দাদা–আমাদের অফিসে যে কাজ করে–গুরুচরণকে দেখেই বোঝা যায়। গুরু অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলে চারদিক আলো হয়ে ওঠে এমন রং। সেই মেয়ের এক সম্বন্ধ এল–পঞ্চান্ন বছরের বুড়ো, তবে অগাধ পয়সার মালিক, শ’বাজারের রাজাদের দোউত্তর কিন্তু ওদের চেয়ে অবস্থা ভাল–রাণাঘাট-নদেয় বিস্তর জমিদারী আছে, উড়িষ্যার একটা মহল থেকে নাকি বছরে থোক আট-দশ হাজার আয়। বুড়োর এক ছেলে এক মেয়ে, তাদের ছেলেপুলে হয়ে গেছে– নাতি-নাত্নী–জাজ্বল্যমান সংসার। বুড়ো নাকি কবে কোথায় দেখেছিল ঐ মেয়ে, বলে পাঠাল এরা যদি রাজি থাকে তো হীরের সেট দিয়ে আশীর্বাদ করবে। এক লাখ টাকার গয়না আর এক লাখ টাকা নগদ দেবে বিয়ের দিন। তা গুরু গুরুর মা কেউ রাজি হয় নি কিন্তু মেয়ে নাকি বেঁকে বসল, ঐ বরেই আমি বিয়ে করব। কার হাতে না কার হাতে তোমরা দেবে, চিরকাল কাঁচের চুড়ি পরে বাসন মেজে দিন কাটাব, তোমাদের অবস্থা তো আমি জানি–এমনি কুলীকাবারী ছাড়া জুটবে না, হয়ত মদ খাবে, ধরে ধরে ঠ্যাঙাবে। না, অত পয়সা আমি ছাড়তে পারব না। সেই বিয়ে হয়ে গেল–মেয়েও নাকি খুব সুখী, একটা ছেলেও হয়েছে। এদেরও ভাল হয়েছে অবশ্য, পয়সা দুহাতে ঢেলে দিচ্ছে বাপের বাড়িতে।’

কনক অবাক হয়ে যায়, বলে, ‘কে জানে বাবা! স্বেচ্ছায় ষোল বছরের মেয়ে পঞ্চান্ন বছুরে দোজবরকে বিয়ে করলে! কী জানি, হবে হয়ত। কার মনে কি আছে, কে জানে! তাও এক ঘর ছেলেপুলে! তা তারা কি বলে, একে মানে-গণে?’

‘সে নাকি এর কথায় ওঠে-বসে, মানে ঐ ছেলে। হবে না কেন, এতকাল ঠাকুর-চাকর ছাড়া মেয়েদের যত্ন কাকে বলে তা তো কখনও জানত না। আর এ হ’ল গে গরিবের মেয়ে–নিজে হাতে চিরকাল সব করেছে, এক একদিন শখ করে এটা-ওটা রান্না করে, ছেলে-বৌকে বসিয়ে খাওয়ায়–তারা গলে গেছে একেবারে।’

‘তা ভাল।’ বলে চুপ করে যায় কনক। সে তখন মনে মনে অন্য কথা ভাবছে। হেমেরও তো কত বয়সের তফাৎ তার সঙ্গে–অনেকটাই বড় সে কনকের চেয়ে। কৈ, কখনও তো সে কথা মনে হয় না তার। অবশ্য হেমের চেহারা দেখলে বয়সটা বোঝা যায় না এটাও ঠিক। এখনও একবার বিয়ে দিয়ে আনা যায়।… যাগে বাপু, যার সঙ্গে যার বিয়ে হয় হোক, মনের মিল হলেই হল। দোজবরেই হোক, তেজবরেই হোক, মেয়েটা যেন সুখী হয়।

.

রাত্রির আহরিত আশ্বাসটুকু যেন স্বপ্নের মতোই রাত্রিশেষে বাস্তব দিগন্তে মিলিয়ে যায়। নিশীথের কুসুম যেন ভোরের আলো ভাল করে ফোটবার আগেই শুকিয়ে ওঠে।

তখনও হেম অফিসে বেরোয় নি–মহা এসে হাজির। ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে এসেছে সে। ওরা ফিরেছে অনেক রাত্রে–বারোটারও পরে, নইলে তখনই আসত। এই ক’ঘণ্টা রাত যে কী করে কাটিয়েছে তা সেই জানে।

পোড়ার রাত কি পোয়াতে চায়? কী বলব–রাত তো নয়, অনন্ত শয্যে একেবারে! ইচ্ছে হচ্ছিল দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দিই। কোনমতে ভোরের পেছনে তাই একটু আলোর ছ্যাঁকা লাগতেই বেরিয়ে পড়েছি। কারুক্ষে বলেও আসে নি–খুঁজে মরবে হয়ত, মরুক গে। তবে হ্যাঁ–অরুণ দেখেছে। ঐ এক ছেলে, রাত থাকতে উঠে বইখাতা নে গিয়ে বাগানে বসবে, কখন সূর্যিদেবের একটু দয়া হবে আলো দেবে একটু। মুয়ে আগুন!’

ধৈর্যচ্যুতি ঘটে হেমের, অফিসের বেলা হয়ে যাচ্ছে তার।

‘তা বলি কী মতলবে এসেছ সেইটে আগে বলো না।’

‘বলছি, বলছি। তবে মোদ্দা আমি বাপু যাই নি সে আমি আগে থাকতে বলে রাখছি। মেয়ে-নেমন্তন্ন যে-কালে হয় নি, সে-কালে যাবই বা কেন! হোক গে বোনঝির বে, অত বড় গুষ্টিটার একটা মান-ময্যেদা আছে তো গা? বিনি নেমন্তন্নয় যাওয়া যায় না। তা আমি না যাই–তিন কত্তাই গিয়েছিল। আর বুড়ো ন্যাড়া, ওরা–বড়বড় ছেলেরা সব্বাই গিয়েছিল। ভুল হবার যো নেই। ও গুষ্টির বড় সাফ চোখ, যা একবার দেখবে একেবারে ফটক তুলে নেবে মনের ভেতর। ভুল হয় নি। সকলেই একবাক্যে বলেছে কথাটা!

‘তবে তুমি বকে মরো গে–আমার গাড়ির সময় হয়ে গেল। আমি যাই।’

‘ও বাবা’ এ যে একেবারে ঘোড়ার ওপর জীনষা দেখতে পাই। আমিও সংসার ফেলে এসেছি। অসুমর কাজ পড়ে সেখানে। আমার কাজ কেউ করে দেবে না, সে যেন মনে ভেবো নি, উল্টে এতটি চিপ্‌টেন ঝাড়বে’খন।’

তারপর সত্যি সত্যিই হেম বেরিয়ে যায় দেখে বলে উঠল, ‘ঐ সীতিটার বরের কথা বলছি গো। ওকে নাকি কোথা থেকে এক ধোঁককেশো ঘাটের মড়া ধরে বিয়ে দিয়েছে ওরা। তার নাকি এক পা ঘাটে এক পা খাটে–এই অবস্থা। খুব কম হ’লেও নাকি সীতির ঠাকুর্দার বয়িসী হবে। বে করতে বসে নাকি অনাব্রত খক্ খক্ করে কেশেছে আর সাঁই সাঁই ক’রে হাঁপিয়েছে। তাই এত লুকোছাপা–বুঝলে? তাই আমাদের কাউকে বলে নি বে- তে।… নিশ্চয় ঐ ঘাটের মড়ার কাছ থেকে এত-টি টাকা গুণে নিয়েছে। কাকা তো নয়, কসাই সব। মেয়েটাকে বেচে মোটা টাকা ঘরে পুরেছে।’

অপ্রত্যাশিত কিছু নয়–বরং জানাই কতকটা। এমনি যে একটা কিছু হবে ধারণাই তো করেছিল এরা, তবু কিছুক্ষণের জন্যে সকলেই স্তব্ধ হয়ে গেল। হেমও সদরের বাইরে একটা পা দিয়েছিল বেরোবে বলে–সে সেই অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে গেল।

একটু বেশি বয়স হবে হয়ত–এই ভেবেছিল এরা। বড় জোর চল্লিশ। কিন্তু ঠিক এতটা–। এ কি মানুষ পারে সত্যি-সত্যিই? কনক ঘাড় নাড়ে নিজের অজ্ঞাতেই, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা।

অনেকক্ষণ পরে কতকটা আড়ষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন শ্যামা, ‘তা খেদী–খেঁদী কিছু বললে না? এই বিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে সে?’

যেন খুব একটা কৌতুককর কিছু ঘটেছে কিম্বা কারুর কোন বাহাদুরীর বিবরণ দিচ্ছে এইভাবে দুটি বুড়ো আঙ্গুল মার মুখের কাছে নেড়ে বললে, ‘আসে নি–আসে নি। খেঁদি কোথায় যে বলবে? সেদিকে একেবারে মূলেই হাভাত।… তাকে খবরই দেয় নি ওরা। বাজে কথা। চিঠি দিয়েছে না হাতি। মিথ্যে কথা ও-সব। দেবে কোন্ ভরসায়, তাকে ওরা চেনে না?… ছেলেরা তো গিয়ে শুরুতেই সেই খোঁজ করেছে–মেজমাসী কোথায়? তা বুড়ী ডাইনী সুর টেনে টেনে কৈফেৎ দিয়েছে, কী জানি, কেন এখনও এসে পৌঁছল না। চিঠি তো দেওয়া হয়েছিল–আসার তো কথা আজ সকালবেলাই। এল না কেন বাপু, আমরাও তো তাই ভাবছি। এসে দশ-কথা আমাদের শোনাবে হয়ত–কিন্তু এখন বে বন্ধই বা করা যায় কী ক’রে বলো!… এই সব। বদমাইশি নাকে কান্না। পাজীর পা ঝাড়া ওরা! মেয়েটার হক্কের পাওনা ফাঁকি দিয়ে নিয়েও আশ মেটে নি, চিরজন্মের মতো সব্বনাশ করাটা বাকি ছিল–সেইটে ক’রে নিশ্চিন্তি হ’ল।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মহাশ্বেতা বোধ করি একটা জুৎসই উত্তরের আশাতেই উৎসুক নেত্রে চেয়ে রইল এদের মুখের দিকে।

কিন্তু সে উত্তর আসতে অনেকক্ষণ দেরি হ’ল আরও।

খানিকটা শুধু আরও চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে হেম নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। আর দেরি করলে গাড়ি ধরা যাবে না, এমনিও হয়ত শেষের দিকটা ছুটতে হবে। যা হবার তা যখন হয়েই গেছে, এখন আর কোনমতেই তা যখন ফেরানো যাবে না, তখন মিছি-মিছি আর অফিস কামাই করে লাভ কি?

ঘরে বসে তো আরও মন খারাপ করা শুধু শুধু।

শ্যামা তারপরও কিছুক্ষণ চুপ ক’রে রইলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘তা আমরা আর কী করব বলো! যার মেয়ে সে যদি সব জেনেশুনে, ওদের চিনেও কসায়ের হাতে জবাই হবার জন্যে ওদের ঘরেই মেয়ে তুলে দিয়ে যায়, আমাদের আর কী করবার আছে!’

‘ওমা!’ মহাশ্বেতা হাত-পা নেড়ে এক পাক নেচে নেয় যেন, ‘ওমা, তা বলে চুপ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? এর একটা প্রিতিকারের চেষ্টা করবে না? বলি তোমার নানী তো গা। মামা দিদিমা বেঁচে থাকতে এমনি কাণ্ডটা করবে ওরা?’

‘তুই থাম দিকি! সক্কালবেলা! দুর্গা দুর্গা।… তোর ঐ পিত্তিজ্বলানো কথা শুনলে আমার হাড় জ্বালা করে। আমরা কি প্রতিকার করব লা? আমাদের কি করবার এক্তার আছে? যার মেয়ে সে আমাদের কোন এক্তার মেনেছে? ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে যাব আমরা কোন্ আইনে? আর এখন করবার আছেই বা কি? বিয়েটা কি আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে? না কি আমরা ঢাল-তরোয়াল নিয়ে গিয়ে ওদের কাঁচা মাথাগুলো কচাকচ কেটে আনব? বিয়ে যে আর ফিরবে না তা ওরা বিলক্ষণ জানে, জেনেশুনে হিসেব করেই এ কাজ করেছে। ওরা তোমার চেয়ে ঢের বেশি সেয়ানা তা জেনো।

ধমক খেয়ে খানিকটা চুপ করে থাকে মহাশ্বেতা। বোকার মতো কনকের মুখের দিক চেয়ে ফিক করে হেসে ফেলে একটু। তারপর কতকটা শূন্য পানে চেয়ে বলে, ‘তাহলে আর কী করব। যে যার তো নিজের কাজে লেগে গেলে। আমিও বাড়ি যাই। সেখানে হয়ত এতক্ষণে তুলক্রাম কাণ্ড হচ্ছে, খোঁজাখুজি শুরু হয়ে গেছে। অরুণ বেরিয়ে আসতে দেখেছে বটে–তা তাকে কেউ জিজ্ঞেসও করবে না। আর সে যা পোড়া ছেলে–নিজে থেকে বলবেও না। বই-খাতা যদি হাতে পেয়েছে তাহলে আর জ্ঞানগম্যি নেই, কোনদিকে চেয়ে দেখবেও না, কী ক্ষিদে পেলে বলবে না যে ভাত দাও। মুয়ে আগুন!’

॥৩॥

একটা ক্ষীণ আশা কনকের মনে ছিল যে পাত্রপক্ষ থেকে বৌভাতে তাদের বলতে আসবে। বরের তরফ থেকে বলতে গেলে মেয়ের বাপের বাড়ির পরই মামার বাড়ি ধরে– ন্যায্যমতো ওদের আগে বলা উচিত। আর তারা খোঁজ করলে কি এরা ঠিকানা দেবে না–না সঙ্গে লোকই দেবে না? আর তো গোপন করার কোন প্রয়োজন নেই। ওদের মতলব তো সিদ্ধই হয়ে গেছে।

কিন্তু কেউই কিছু বলতে এল না। নিয়মমতো যেটা বৌভাত–ফুলশয্যের দিন–সেটা কেটে গিয়েও দুদিন চলে গেল। কোন খবরই পাওয়া গেল না মেয়েটার। চারদিনের দিন সন্ধ্যের সময় একেবারে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকল ঐন্দ্রিলা।

‘ওগো এ আমার কী হ’ল গো! ওগো তোমরা থাকতে আমার মেয়ের এই সব্বনাশটা হ’ল গো। ওগো তোমরা কেউ একবার গিয়ে দেখলে না!’

শ্যামা তখন সবে স্নান ক’রে এসে ঘরে কাপড় ছাড়ছিলেন, তিনি ছুটে বেরিয়ে এলেন।’থাম, থাম। চুপ কর। ও কি করছিস? ভসন্ধ্যেবেলা অমন মড়াকান্না তুলছিস কিসের জন্যে? গেরস্তর অকল্যেণ–সে মেয়েটারও অকল্যেণ।… চুপ, চুপ

কিন্তু মাকে দেখে ঐন্দ্রিলা আরও যেন হাহাকার করে উঠল।

‘ও মাগো, এ আমার কী হল মা! ওমা, আমার যে ঐ একটা মেয়ে মা! আমি যে ওর ওপর ভরসা করেই বুক বেঁধে ছিলুম মা। তোমরা থাকতে আমার এ সব্বনাশ কী করে হ’ল মা।’

‘চুপ। চুপ!’ একটু ধমকই দিয়ে ওঠেন শ্যামা এবার, ‘নিজের সর্বনাশ তো তুমি নিজেই করেছ মা। মাঝখান থেকে আর এদের মাথাটি খাচ্ছ কেন–এখন এই ভরসন্ধ্যেবেলা কান্নাকাটি ক’রে! এখন বলছ আমরা থাকতে–! আমরা কী করব শুনি! মেয়েকে নড়া ধরে নিয়ে যাবার সময় হুঁশ ছিল না! আমরা কি তাড়িয়ে দিয়েছিলুম, না নিয়ে যেতে বলেছিলুম? টেনে নিয়ে গিয়ে তাদের ঘরে তুলে দিলে কে? তুমিই তো তাদের গার্জেন করে দিয়ে গেছ বাছা। এখন আমাদের কাছে এসে কাঁদলে কী হবে? আমরা কি করব? আমাদের জানিয়েছে তারা, না মত নিয়েছে!

‘ওগো, আমি না হয় চিরদিনের অজ্ঞান, আমি না হয় অন্যায় করেছি–তোমরা গিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে এলে না কেন! তোমরা যদি জোর করে এনে রাখতে তা হ’লে তো আর এ সব্বনাশটি হ’ত না!’

‘হ্যাঁ–তা আর নয়! তারপর তুমি এসে উল্টে আমাদের নামে থানা-পুলিশ করো! কার হুকুমে আমার মেয়েকে নিয়ে এলে তোমরা–একথা বললে আমরা কোথায় দাঁড়াতুম? তোমার তো গুণে ঘাট নেই মা। আসলে এ সর্বনাশের জন্যে দায়ী তোমার স্বভাব। তোমার ঐ স্বভাবের জন্যেই চিরকাল জ্বলবে আর জ্বালাবে। তোমার পাপেই তোমার মেয়ের এই হাল হ’ল!’

কনক ততক্ষণে ছুটে এসে ঐন্দ্রিলার হাত ধরে দাওয়ায় বসিয়েছে। ওর এই চিৎকার আর মড়কান্না শুনে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে পড়েছে এতক্ষণে–এবার হয়ত ভিড় করে এসে বাড়িতে ঢুকবে। লোক-জানাজানি কেলেঙ্কারি আর কিছু বাকি থাকবে না।

সে মিনতি করে বলে, ‘চুপ করুন, চুপ করুন ঠাকুরঝি। ছিঃ, অমন ক’রে কি কাঁদতে আছে। কী এমন হয়েছে। আর যা হবার তা তো হয়েই গেছে, সে হওয়া তো আর ফিরবে না। মিছিমিছি মেয়েটার আরও বেশি অকল্যেণ করছেন কেন। স্থির হোন একটু।’

সে ছুটে গিয়ে একটা চুম্‌কি ঘটি ক’রে জল এনে ওর চোখে-মুখে দিতে থাকে। মাথাতেও দেয় খানিকটা থাবড়ে থাবড়ে।

‘আর কি কল্যেণ হবে ভাই। আর কি বাকি আছে কিছু? ওরা যে আর কোন সব্বনাশটা করতে বাকি রাখে নি তোমাদের সীতার!

কান্না একেবারে বন্ধ হয় না, কিন্তু কনকের সহানুভূতির স্পর্শে হাহাকারটা কমে আসে একটু একটু ক’রে।

একটু একটু করে সব খবরও পাওয়া যায় তার মুখ থেকেই।

চিঠি পেয়েছে ঐন্দ্রিলা বিয়ের পরের দিন। সে যাদের কাছে কাজ করে তাঁরা ডাকের মোহর দেখেছেন। বিয়ের দিনে মোহর পড়েছে এখানকার। তার মানে সেইদিনই সকালে ফেলা হয়েছে–যাতে ও বিয়ের দিন না পৌঁছতে পারে।

ওকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক হ’ল তাতেই কেমন কেমন বোধ হয়েছিল ওর। নানারকম সন্দেহ মনে দেখা দিয়েছিল তখনই। তবে এতদূর কল্পনাও করতে পারে নি। ওর দেওররা যে ঠিক এতখানি অমানুষ তা ও জানত না।

মন খারাপ খুবই হয়েছিল। একটা মেয়ে–তার বিয়েটাও চোখে দেখতে পেলে না। আবার মনকে বুঝিয়েছে যে ওর যা হুতোশুনে বরাত, না দেখেছে ভালই হয়েছে। ওর নজরেই ক্ষতি হ’ত হয়ত। আরও একটা আশ্বাস মনে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল যে, দাদা আছে, মা আছে, তারা নিশ্চয় দেখেশুনেই মত দিয়েছে। মামাদের যে জানানোও হয় নি–এ যে একেবারে ওর ধারণার বাইরে। এক-একবার এও ভেবেছে যে হয়ত বিয়ে-বাড়িতে গিয়ে নানা রকম অশান্তি বাধাবে কি ঝগড়াঝাঁটি করবে সেই ভয়ে দেরি করে খবর দিয়েছে ওকে

যাই হোক–চিঠি পেয়েই রওনা দিয়েছে ও। সেইদিনই। মনিবরা বারণ করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন–একা মেয়েছেলে রাত্রের ট্রেনে গিয়ে কাজ নেই। একদিন সবুর করুক বরং–কে চেনাশুনো লোক কলকাতা যাচ্ছে খোঁজ ক’রে দেখে তার সঙ্গে যাবার ব্যবস্থা ক’রে দেবেন তাঁরা। বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন আর এত তাড়া কি? কিন্তু ঐন্দ্রিলা সেই একদিনও অপেক্ষা করতে পারে নি।

এখানে এসে ওর আরও মন খারাপ হয়ে গেছে–ফুলশয্যার কোন আয়োজন নেই দেখে। দেওরদের জিজ্ঞাসা করেছে, তারা এড়িয়ে গেছে। শেষে শাশুড়ীকে গিয়ে চেপে ধরায় তিনি বলেছেন, ‘গায়েহলুদ ফুলশয্যা গায়ে গায়ে কাটান গেছে–ফুলশয্যের তত্ত্ব পাঠানো হবে না।’

খুবই মন খারাপ হয়ে গেল ওর। যতই গায়ে গায়ে কাটান দেওয়া হোক, এমন তো অনেক বিয়ে দেখেছে–নিয়মকর্ম যেটুকু, একটু ফুল, দুখানা কাপড়, একটু ক্ষীর মুড়কি– এও যাবে না, সে আবার কীরকম কথা?

তখনই পাড়ায় বেরিয়ে পড়েছে–ঘাট থেকে মুখ হাত ধুয়ে আসবার অছিলায়। পাড়ায় যাদের যাদের বাড়িতে গেছে ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সকলে যেন এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছে। বিব্রত হয়ে উঠেছে যেন ওকে দেখে। বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই কথাটা চাপা দেবার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত পাড়ার দাশু মজুমদারের গিন্নীর কাছে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করতে তিনি বলেছেন, ‘বাপু, বুঝতেই তো পারছ, এক পাড়ায় বাস করি, আর তোমার শাশুড়ীর যা মুখ, সাধ করে কে ঝগড়া টেনে আনবে বলো ওদের সঙ্গে। দুটি ঠোঁট ফাঁক করলেই বিপদ।… তাছাড়া পাড়াঘরে তো কাউকে বলে নি–আড়াল আবড়াল থেকে যা ছেলেরা দেখেছে। সেসব কথা না শোনাই ভাল। তা তুই-বা এর-ওর কাছে গিয়ে মিথ্যে মাথা খুঁড়ছিস কেন, চলে যা না। নিজে গিয়ে দেখে আয়!’

‘কিন্তু ঠিকানা জানি না যে কাকীমা।’ ঐন্দ্রিলা বলেছে।

আর একটু ইতস্তত ক’রে তিনি ঠিকানাটাও বলে দিয়েছেন। গ্রামের নাম, পাত্রের নাম শুধু। আর গ্রামটা ডোমজুড়ের কাছেই–এইটুকু। এর চেয়ে বেশি ঠিকানা নাকি কেউ জানে না। ওরা কাউকেই বলে নি–ওর দেওররা।

তখনই বেরিয়ে পড়েছে ঐন্দ্রিলা। গাড়ির কাপড় ছাড়া হয় নি, মুখে একটু জলও পড়ে নি। আঁচলেই টাকা কটা বাঁধা ছিল তাই রক্ষে। বাড়িতে গেলেই ওকে আটকে ফেলবে– এটা ও এর মধ্যেই বুঝে নিয়েছিল বেশ।

অজানা অচেনা পথ। প্রতি-হাত লোককে জিজ্ঞাসা ক’রে ক’রে যাওয়া, গাড়ি-ঘোড়ার ব্যবস্থাও জানা নেই কিছু–তবু হাল ছাড়ে নি।

একবার ভেবেছিলুম দিদির বাড়ি গিয়ে বুড়ো কি কেষ্ট কাউকে সঙ্গে নিই–আবার ভাবলুম মিছিমিছি আরও দেরি হয়ে যাবে। তাছাড়া তারাও হয়ত পথ-ঘাট চেনে না। দিদি খাওয়ার জন্যে পেড়াপীড়ি করবে গেলেই, ওখানেই দুপুর গড়িয়ে যাবে, যাওয়াই হবে না শেষ পর্যন্ত। তখন আমার জেদ চেপে গেছে–ওদের ফুলশয্যে বৌভাত কেমন হয় দেখতে হবে। ঘর-বরও দেখব নিজের চোখে। তাই অমনিই বেরিয়ে পড়লুম, তখনই। এদেশ ওদেশ ঘুরে পরের বাড়ি চাকরি ক’রে ক’রে আগের চেয়ে সাহস বেড়ে গেছে তো, সেয়ানাও হয়েছি অনেকখানি, শেষ পর্যন্ত তাই খুঁজে বারও করলুম! কিন্তু কী দেখতে গেলুম বৌদি, কী দেখলুম গিয়ে। এ দেখতে এক কাণ্ড ক’রে কেন গেলুম!’

আবারও হু-হুঁ করে কেঁদে ওঠে ঐন্দ্রিলা।

কনক তখন একহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে আর এক হাতে মাথায় বাতাস করছে, ‘চুপ করুন, চুপ করুন ঠাকুরঝি। স্থির হোন। কেঁদে তো আর কোন ফল হবে না। মিছিমিছি আরও বেশি অকল্যেণ করছেন কেন তার!’

জামাইবাড়ির কাছাকাছি যখন এসে পৌঁচেছে তখন আর সন্ধ্যের বেশি দেরি নেই। আবছা হয়ে এসেছে চারদিক। পথে যাকেই বাড়ি জিজ্ঞাসা করেছে জামাইয়ের নাম সে-ই উত্তর দিয়েছে–কিন্তু মুচকি হেসেছে একটু। তবু তখনও ঐন্দ্রিলা মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে যে বিয়েবাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করেছে, বিশেষ দোজবরের বিয়ে, তাই ওরা হাসছে। সে হাসির কোন গূঢ় অর্থ আছে তা মনে করে নি একবারও।

বরং অন্য চিন্তাই দেখা দিয়েছে মনে।

বিনা নিমন্ত্রণে কর্মবাড়ি যাওয়া উচিত নয়, জামাইবাড়ি তো এমনিই যাওয়া অনুচিত– এসব কথা এতক্ষণ একবারও মনে হয় নি ঐন্দ্রিলার। একেবারে ওদের পাড়ায় পৌঁছে তার কেমন লজ্জা-লজ্জা করতে লাগল। গাড়ির কাপড়, এমনিতেই আধময়লা হয়ে গিয়েছিল, তার-ওপর সারাদিনের ‘রহটে’ এখন তো রীতিমতো কালোই দেখাচ্ছে, গায়ের চাদরটাও ফুটোফুটো–কবেকার হরিনাথের দরুন চাদর এটা–তার ওপর ময়লাও হয়েছে যৎপরোনাস্তি। এই অবস্থায় জামাইবাড়ি যাওয়া–ছি! কী মনে করবে ওরা। বেশি নিমন্ত্রিত কেউ না এলেও ঘরের লোকজনও তো আছে। তাছাড়া জামাই প্রথম দেখবে শাশুড়ীকে– কী ভাববে। মেয়েরও একটা লজ্জার কারণ।

ফিরেই আসছিল। দু’চার পা এসেও ছিল কিন্তু তাতেও ঠিক মন সরল না। এতদূর এসে এত কাণ্ড করে জামাইকে না দেখেই চলে যাবে? যার জন্যে আসা। তার চেয়ে বরং একটু আড়াল থেকে ঘর-বর দেখে চলে আসবে।

সেই ভেবেই আর একটু এগিয়ে একেবারে ওদের বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখল সামনের বাগানে অনেক লোক জড়ো হয়েছে, বেশ একটা হৈ-চৈও হচ্ছে। প্রথমটায় একটু আশ্বস্তই হয়েছিল। ভেবেছিল বৌভাতেরই ভিড় এটা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই অন্য খটকা লাগল। আলো নেই কেন? এত লোক যেখানে নিমন্ত্রিত সেখানে অন্তত দুটো গ্যাসের আলো ভাড়া করা হয়নি–এ যেন কেমন ঠেকছে। একটা হ্যারিকেন শুধু দূরে বসানো আছে, যেখানটায় বেশি জটলা সেখানটায় কিছুই নেই। এ যেন বড় বেশি অস্বাভাবিক মনে হ’ল তার।

তখন আর একটু এগিয়ে গেল। ওরা নিজেদের গোলমালে ব্যস্ত, তাছাড়া বেশ ঘোরঘোরও হয়ে এসেছে, তাকে অত কেউ লক্ষ করবে না। কাছে যেতেই বুঝল ব্যাপারটা। উৎসবের আনন্দ-কোলাহল নয়–দাঙ্গা, মারপিট। অতি কুৎসিত ইতর কলহ একটা। দুই দলে বিবাদ হচ্ছে, পাড়ার লোক এসেছে মধ্যস্থতা করতে।

সেই গালিগালাজ ও কটূক্তির বিপরীত-মুখী অবিরাম বর্ষণের মধ্যে থেকে আসল ঘটনাটা যখন বুঝতে পারল, ঐন্দ্রিলা, তখন কিছুকালের জন্য তার হাত-পা পাথর হয়ে গেল। বুকের স্পন্দন থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য।

এইখানে বিয়ে হয়েছে সীতার! এই বিয়ে!

চিনতেও পারল সবাইকে। সীতার বর–আর তার ওপক্ষের ছেলেমেয়ে সকলেই ছিল সেখানে। যে জোয়ান জোয়ান চারজন ছোকরা এদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে খুন করবে বলে শাসাচ্ছে–তারা জামাইয়েরই ছেলে। তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে তাদের বড় ভগ্নিপতি এবং তার বড় ছেলে। সেও সতেরো আঠারো বছরের ছোকরা। ওর জামাইয়ের দিকে শুধু আছে আর একটি জামাই। সে কলকাতার লোক, ঝগড়া-বিবাদ পছন্দও করে না–এর মধ্যে থাকতেও চায় না। সে পেরেও উঠছে না তাই ওদের সঙ্গে।

আশপাশের দু’একজনকে প্রশ্ন ক’রে এই বিবাদের ইতিকথাও জানতে পারল ঐন্দ্রিলা। এই বিয়ের কথা শুনেই নাকি বুড়োর (তারা সকলেই বুড়ো বলে উল্লেখ করছে, জামাইয়ের নাম উমেশ সে একজনের মুখেও শুনল না, ছেলেরাও বাবা বললে না কেউ, তারাও বুড়ো বলতে লাগল) ছেলেরা রুখে উঠেছিল, ভয় দেখিয়েছিল যে এ তারা কখনও সহ্য করবে না–তাদের জাজ্বল্যমান সংসার, তাদের মা মারা গেছে এখনও ছমাস হয় নি–সে জায়গায় এসে বসবে কে এক হাঘরের মেয়ে–হ্যাঁঘরে ছাড়া বুড়োকে মেয়ে দেবেই বা কে?–এ তারা দেখতে প্রস্তুত নয়। এ বিয়ে তারা বন্ধ করবেই, দরকার হয় তো দাঙ্গাহাঙ্গামা মারপিটেও তারা পিছ-পা হবে না। বুড়োর ঠ্যাং ভেঙ্গে ফেলে রাখা খুবই সোজা–কিন্তু তাও তারা করবে না, বিয়ের আসরে গিয়ে হট্টগোল বাধিয়ে পাড়ার লোক ডেকে বে-ইজ্জৎ করবে, থোঁতা মুখ ভোঁতা ক’রে ফিরে আসতে হবে।

বুড়ো সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল ওদের এই শাসানিতে। অথচ বিয়েরও এমন লালসা যে কোন অগ্রপশ্চাৎ ভাববারও শক্তি ছিল না। সে তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য তারা যা বলেছে তাতেই রাজি হয়েছে, বাড়িঘর জমিজমা বিষয়সম্পত্তি যেখানে যা ছিল সব ঐ ছেলেদের নামে দানপত্র ক’রে রেজেস্ট্রি ক’রে দিয়েছে। তখন ভেবেছিল যে ষোলআনা অধিকার পাবার পর যার সম্পত্তি তাকে আর তার বৌকে একেবারে ফেলবে না, দুটো ভাতকাপড় দেবেই। অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরেও দিতে বাধ্য হবে। তার জীবদ্দশাতে তো কোন ভয়ই নেই–মরার পরও বিধবাটাকে কি আর দুটো ভাত দেবে না? হয়ত বিধবার কথাটা মোটে ভাবেই নি, তার কাছে নিজের তখনকার প্রয়োজনটাই বড় হয়ে উঠেছিল সব চেয়ে।

সব হিসেব কিন্তু বানচাল হয়ে গেল যখন কাল নতুন বৌ সুদ্ধ এসে দেখল যে তার নিজের বাড়িতে আর তার ঢোকবার অধিকার নেই, সে দরজা ওদের মুখের ওপরই বন্ধ হয়ে গেল। তখন গালিগালাজ শাপশাপান্ত যা করবার বুড়ো যথেষ্টই করেছে কিন্তু ছেলেরা গ্রাহ্যও করে নি। বহু রাত অবধি কনে-বৌকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে অন্ধকারেই। যে বন্ধুকে অভিভাবক বা বরকর্তা মতো ক’রে নিয়ে গিয়েছিল, সে বেগতিক দেখে আগেই সরে পড়েছে। তখন এক প্রতিবেশীর হাতে পায়ে ধরে বাকি রাতটা তার বাড়ির সদর-ঘরে কাটিয়েছে। তাদের তখন খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেছে–তাছাড়া তারা অন্য জাতও বটে–সুতরাং রাত্রের আহারও জোটেনি কারুর

আজ সকালে উঠে যথেষ্ট ছুটোছুটি করেছে বুড়ো। কিন্তু আত্মীয়স্বজন কেউই গা করে নি; পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা সাফ জবাব দিয়ে দিয়েছে। কে এ ঝগড়ায় নাক গলাবে। ‘ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন’–-এত বড় একটা জিনিস ঘাড়ে নিচ্ছে যে সে কী বলে বিষয়সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়ে বসে থাকে! ঐ নাত্নীর বয়সী মেয়েটার কত বড় সর্বনাশ সে করছে সেটা খেয়াল ছিল না?

কারুর কাছ থেকে সহানুভূতিসূচক একটি কথাও শোনে নি বুড়ো। তখন চোখে অন্ধকার দেখেছে। শেষ পর্যন্ত বড় ছেলের শ্বশুর এবং ছোট জামাইয়ের কাছে কান্নাকাটি ক’রে হাতে পায়ে ধ’রে তাদের টেনে এনেছে মধ্যস্থতা করতে। বুড়ো ভেবেছিল যে নিজের শ্বশুরের কথা বড় ছেলে কিছুতেই ঠেলতে পারবে না। আর সে নরম হলে দল ভেঙ্গে যাবে অন্য ছেলেরাও জুৎ করতে পারবে না তখন।

মধ্যস্থ দুজনকে নিয়ে ঐন্দ্রিলার মেয়ে-জামাই একটু আগেই এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ছেলেরা কোন কথা এবং কারুর কথা শুনতেই রাজি নয়। শ্বশুর আছে শ্বশুর আছে ঘরে আছে–এসব ব্যাপারে নাক গলাতে আসে কেন? ও বাপকে তারা কিছুতেই এ-বাড়ি ঢুকতে দেবে না। তারা ওকে বাপ বলে মানতেই রাজি নয়। ও তো বদ্ধ পাগল। মাথা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে ধোঁককেশো বুড়োর–নইলে এ কাজ কেউ করে? গঙ্গাপানে পা হয়েছে, খাটে উঠলেই হয় এখন–সে কিনা একটা নাতনীর বয়সী কেন–নাতনীর চেয়েও বয়সে ছোট মেয়েকে বিয়ে ক’রে নিয়ে এল! এখন ওদের বাড়ি ঢুকতে দেওয়া মানেই তো একটা বিধবার আজীবন খোরপোষের ভার ঘাড়ে নেওয়া। সে কাজে যেতে তারা প্রস্তুত নয়।

এই নিয়েই এখনও তকরার চলছে। বুড়োর বলতে গেলে দুদিন অনাহার, তার ওপর সকাল থেকে ছুটোছুটি ঘোরাঘুরি–তার আর সত্যিই তখন মাথার ঠিক নেই। নিজের আত্মজদেরই যে কুৎসিত ভাষায় ইতরের মতো গাল দিচ্ছে, তা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। ছেলেরাও অবশ্য কম যাচ্ছে না। সেদিক দিয়ে অন্তত তারাও যে বাপেরই বেটা তা প্রমাণ করে দিচ্ছে।

বিবাদ অনেক দূর গড়িয়েছে। আস্তে আস্তে সে ইতিহাস সংগ্রহ করতে ও বুঝতে ঐন্দ্রিলার সময় লেগেছে বেশ খানিকটা। ইতিমধ্যে কখন যে সে আরও সামনে এগিয়ে গিয়েছে তা নিজেই টের পায় নি। সীতা এতক্ষণ কোনদিকে মুখ তুলে তাকায় নি, ঘাড় হেঁট করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যাদের বাড়িতে ছিল সারাদিন, তারা ভাত খাওয়াতে সাহস করে নি বামুনের মেয়েকে–জলখাবার খাইয়েছিল সামান্য কিছু। তার খাবার অবস্থাও ছিল না। উদ্বেগে দুশ্চিন্তায়, আশাভঙ্গের বেদনায় সে যেন জড় হয়ে গিয়েছিল। জড় হয়ে গিয়েছিল বলেই বোধহয় রক্ষা, নইলে তার পাগল হয়ে যাবারই কথা। এখনও এই সমস্ত অপরিচিত লোকের মধ্যে এই অতি-ইতর আবহাওয়ায় সে আরও কতকটা ভয়েই কাঠ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ একসময়, যেন একটা দীর্ঘনিশ্বাস বুকের মধ্যে আটকে যাওয়ায়, হাঁপিয়ে উঠে মুখ তুলতেই মায়ের দিকে চোখ পড়ে গেল তার। সে ‘মাগো’ বলে চিৎকার করে ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে অজ্ঞান হয়ে গেল।

ঐন্দ্রিলা প্রথমটা ভেবেছিল সীতা বুঝি মরেই গেল। তাছাড়া তারও এতক্ষণের ধৈর্যের বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে তখন, কোন মতেই আর আত্মসম্বরণ করা সম্ভব নয়। সে মাটিতে আছড়ে পড়ে কেঁদে কেটে মাথা খুঁড়ে গালাগাল দিয়ে চিৎকার করে এক প্রলয় কাণ্ড বাধিয়ে তুলল। তাতেই কিন্তু চাকা ঘুরে গেল শেষ পর্যন্ত। অনেকেরই এবার মনে হ’ল, সত্যিই তো, ঐ একফোঁটা মেয়ের কী দোষ! অভিভাবকদের পাপে ও এত শাস্তি পায় কেন? সে কেন এত সহ্য করবে? বিশেষ ঐন্দ্রিলার কথা থেকে যখন সকলে জানতে পারল যে মেয়ের মাকে না জানিয়ে, তার মত না নিয়েই এ বিয়ে দেওয়া হয়েছে–অনাথা আশ্রয়হীনা বিধবার একমাত্র সন্তানকে ওরা ষড়যন্ত্র করে বিয়ে দিয়েছে–তখন সহানুভূতিটা পুরোপুরি এদের দিকে এসে পড়ল। কে একজন ছুটে গিয়ে ঘটি ক’রে জল এনে সীতার মুখে মাথায় ঝাপ্‌টা দিতে লাগল। একজন মহিলা এসে ঐন্দ্রিলাকে মাটি থেকে তুলে মুখ-চোখ মুছিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।

এইবার পাড়ার লোকরা অনেকেই বুড়োর ছেলেদের ওপর রুখে উঠল। এ কী অন্যায় কথা!‘যার ধন তার ধন নয় নেপোয় মারে দই!’ বুড়ো খুবই খারাপ কাজ করেছে সত্যি কথা–তবু তারই বিষয় সম্পত্তি–এইভাবে তার কাছ থেকে সব সম্পত্তি হাতিয়ে এখন তাকেই এমন করে লাঞ্ছনা করা! নিজের বাড়িতে সে ঢুকতে পারবে না! আর ঐ দুধের মেয়েটা কাল থেকে না খাওয়া না দাওয়া–পরের বাড়ি পড়ে আছে–ওর ওপরই বা অকারণ এ প্রহারী কেন? যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে–এখন এদের বাড়ি ঢুকতে দাও, মেয়েটার একটু শোবার ব্যবস্থা ক’রে দাও। বুড়ো যদি এ আহাম্মকী না ক’রে পুলিশ ডেকে তোদের তাড়িয়ে দিত–তা হ’লে তো এরই যথা-সর্বস্ব। তখন তোরা দাঁড়াতিস কোথায়, খেতিস কি?… এখনও যদি তাদের অল্পে চৈতন্য না হয় তো বুড়োকে নিয়ে ওরা থানায় গিয়ে ডায়রী করিয়ে ছেলেদের নামে মামলা করাবে। ভয় দেখিয়ে যে দানপত্র করা হয়েছে সে দানপত্রের কোন মূল্যই নেই। কোন আদালত তা মানবে না।

এই ওষুধেই ছেলেরা অনেকটা নরম হয়ে এল। এভাবে ঐন্দ্রিলা গিয়ে পড়ে কেঁদে জিতবে তা তারা ভাবে নি। হাতের উদ্যত লাঠি এবার নামল সকলকারই। কেবল মেজ ছেলে মুখ গোঁজ ক’রে বলল, ‘জমি-জমাই না হয় লিখে দিয়েছে, হাতের নগদ টাকাগুলো তো ফুরোয় নি। বুড়ো অন্য বাড়ি একটা কিনে দিক না তার ছুক্রী মেয়ে-মানুষকে!

এতেও চারিদিক থেকে সকলে ধমকে উঠল।’এ কী অভদ্র কথাবার্তা! ব্রাহ্মণের মেয়ে, দস্তুরমতো নারায়ণ অগ্নিসাক্ষী ক’রে বিয়ে করে এনেছেন তোমাদের বাবা– তার সঙ্গে এ রকম অশোভন আচরণ করা অত্যন্ত অন্যায়।’

কিন্তু সে কথা চাপা পড়ে গেল আর একটি সংবাদে। উমেশের যে বন্ধু বরকর্তা সেজেছিল এ বিবাহে (সম্ভবত মোটা টাকা খেয়েই) এবং বিয়ে দিইয়ে নিয়ে এসেছিল কাল–আবহাওয়া অনুকূল দেখে সে এবার এগিয়ে এল, ‘সে টাকা কি আর আছে বাবা জীবনধন, তার আর একপয়সাও নেই। সে টাকা থাকলেও তোমার বাবা এতক্ষণ বাড়ি ঠিক ক’রে বায়না ক’রে ফেলতেন। তিনিও কম জেদী মানুষ নন। নিহাৎ কারে পড়েই তোমাদের চোট খাচ্ছেন।’

শুধু জীবনধনেরই নয়, উপস্থিত সকলেরই কৌতূহল সরব হয়ে উঠল।

তখন তিনি সবিস্তারে সে ইতিহাসটুকু বিবৃত করলেন। আর তখনই ঐন্দ্রিলা জানতে পারল যে সীতার ভাগ্যে আশা বা ভরসা বলতে কোথাও কিছু আর অবশিষ্ট নেই।

সীতার ছোট কাকা ভোলা নাকি কী ফাটকা খেলতে গিয়ে আফিস থেকে হাজার-দুই টাকা ভেঙ্গে বসেছিল। এ কাজ নাকি ইতিপূর্বেও সে অনেকবার করেছে, কোনটায় হেরেছে কোনটায় জিতেছে–অফিসের টাকা যথাসময়ে পুরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এবার ক্রমান্বয়ে লোকসান হওয়ায় দেনার অঙ্ক বেড়েই গেছে, শোধ দেবার কোন উপায় করতে পারে নি সামনেই অডিট্–কথাটা আর চাপা থাকবে না বুঝে চোখে অন্ধকার দেখল। কিন্তু অত টাকা কোথা থেকে যোগাড় হবে–কে তাকে দেবে? এজমালি সম্পত্তি, বখ্া হয় নি, সে সম্পত্তি বাঁধা দিতে বা বিক্রি করতে গেলে অন্য ভাইয়ের সই চাই। ভাই তা দিতে রাজি হয় নি। এই যখন অবস্থা–এক পা বাইরে এক পা জেলে–তখনই কার মুখে শুনল উমেশের কথা! সে দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ের জন্যে মেয়ে খুঁজছে, বয়স পঞ্চান্নর কম নয় এবং তার হাতে অনেক টাকা।

শোনামাত্র সে উমেশের এই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে! সোজাসুজি প্রস্তাব করে যে তিন হাজার টাকা পেলে এবং ওরা যদি বিবাহের যাবতীয় ব্যয় বহন করতে রাজি থাকে তো সে উমেশের সঙ্গে নিজের ভাইঝিরই বিয়ে দিতে পারে। পাছে এতগুলো টাকা খরচ শুনে ও তরফ ভয় পায় সেই জন্যে প্রস্তাব করার সঙ্গে সঙ্গে কৌশলে মেয়েটিকে দেখাবারও ব্যবস্থা করে। মায়ের মতো অত রূপসী না হোক– সীতা লাবণ্যবতী মেয়ে। গৌরাঙ্গী নয়–তেমনি কালোও নয়, মাজা-মাজা রঙ। মুখশ্রী পেয়েছে সে বাপের কাছ থেকে– সর্বোপরি অল্প বয়স, তখন তার প্রথম কৈশোর। এ বয়সে কুৎসিত মেয়েকেও ভাল দেখায়। উমেশের মাথা ঘুরে গেল। সে এই প্রস্তাবেই রাজি হয়ে পড়ল। কথা হ’ল যে পাকা দেখার দিন দু’হাজার এবং বিয়ের দিন এক হাজার টাকা সে ভোলার হাতে দেবে এবং মেয়ের গহনা কাপড় বাসনপত্র ও খাওয়া-দাওয়ার যাবতীয় বাজার ক’রে পাঠাবে। গহনা কত দেবে তা ভোলা জিজ্ঞাসা করে নি–তার অত মাথাব্যথাও ছিল না। সেইটেই বরং উমেশ কম দিয়েছিল। কারণ অত টাকা তার হাতে সত্যিই ছিল না। সে ভেবেছিল যে তার প্রথমা স্ত্রীর দু’একখানা গহনা ভেঙ্গে নতুন ক’রে গড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বাতাসে খবর পেয়েই তার ছেলেরা আগে সে বাক্সটি আত্মসাৎ করেছিল। সুতরাং কয়েকগাছা পালা চুড়ি এবং একগাছি সরু হার ছাড়া কোন গহনা সে দিতে পারে নি। বাকি সব খরচটাই কিন্তু ভোলা আদায় করে নিয়েছে, বলতে গেলে ওর কান ম’লে।

এইখানেই ঐন্দ্রিলা উমেশের ঐ বন্ধুর মুখ থেকে প্রথম জানল যে, শিবু আগে এ প্রস্তাবে রাজি হয় নি–বরং খুবই বেঁকে দাঁড়িয়েছিল। শেষে ভোলা পুরো একটি দিন নিরঙ্কু পড়ে থেকে মাকে দলে টানতে মা কান্নাকাটি ক’রে মেজছেলের হাতেপায়ে ধরে তাকে রাজি করিয়েছিলেন। তাও শেষ পর্যন্ত একটি হাজার–অর্থাৎ বাড়তি টাকার সবটাই তাকে গুণে দিতে হয়েছিল। জেলটা বাঁচল এবং আপাতত চাকরিটাও রইল–ভোলার এইটুকুই নীট লাভ।

এই ইতিহাস শুনে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত হয়ে রইলেন কিছুকাল। এতখানি মূর্খতা ও উন্মত্ততা তাঁদের ধারণার বাইরে। একে ধিক্কার দিয়েও লাভ নেই, নিঃশ্বাসের অপচয় অতিরিক্ত কামোন্মত্ততায় লোকটা শুধু এই মেয়েটারই সর্বনাশ করে নি, নিজেও সৰ্বস্বান্ত হয়ে বসে আছে। যতকাল বাঁচবে এদের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে–এদের হাত- তোলায় থাকতে হবে। মামলা-মোকদ্দমা করে যে নিজের বিষয় ফিরিয়ে নেবে–তারও খরচ আছে, সে টাকাটাও হাতে রাখে নি। মেয়েটাকে কী করে পাবে তা-ই শুধু ভেবেছে– কী ক’রে পালন করবে তা পর্যন্ত চিন্তা করে নি।

কে একজন পিছন থেকে বললেন, ‘মেয়েটারই বরাত। নইলে এমন তো কখনও শুনি নি।

উপস্থিত সকলেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সেই কথাটারই সমর্থন করলেন। কী আর করবেন তাঁরা? কী আর করবার আছে এক্ষেত্রে?

যাইহোক–চারিদিক থেকে উমেশকে লক্ষ করেই চাপা এবং স্পষ্ট ধিক্কার উঠলেও– তার ছেলেরা এবার বাড়ির প্রবেশপথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হ’ল। উমেশ ঘাড় হেঁট করে নববধূকে নিয়ে অবশেষে তার নিজের ঘরে গিয়ে উঠল

তারপর অবশ্যই কর্তব্যকর্মে কোন ত্রুটি ঘটে নি। উমেশের বড়ছেলের বৌ এসে হাতজোড় করে ভেতরে যেতে বলেছে, ‘যা হবার হয়েছে, এখন সন্তান মনে ক’রে মাপ করুন, দয়া ক’রে ভেতরে চলুন। স্নান-টান করে একটু কিছু মুখে দিন।’

বলা বাহুল্য ঐন্দ্রিলা ওদের বাড়ি ঢোকেনি। সেও হাতজোড় করে বলেছে, ‘তোমরা যেতে বলেছ এই আমার যথেষ্ট হয়েছে ভাই। কিন্তু জামাইবাড়িতে যাওয়া আমাদের বংশের নিয়ম নয়–সে আমি পারব না। এখানে যদি কোন ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক দয়া ক’রে একটু আশ্রয় দেন তো রাতটা কাটিয়ে ভোরেই আমি চলে যাব।

তবুও ওরা অনুনয় বিনয় করেছিল কিন্তু ঐন্দ্রিলা কিছুতেই রাজি হয় নি। উমেশের সেই বন্ধুটি অতটা না বুঝেই, একবার বলেছিল তার বাড়ি যেতে কিন্তু তাকে মুখের ওপরই বলে দিয়েছে সে, ‘আপনার বাড়ি যাব? আপনি বলছেন কোন্ মুখে? আপনার সাহস তো কম নয়। আপনি জেনেশুনে সেই কসাইয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আমার মেয়ের এই সৰ্বনাশ করেছেন–আপনার ভিটেতে পা দিলেও পাপ হবে আমার। ব্রাহ্মণের নিষ্পাপ কুমারী মেয়ে–সাক্ষাৎ ভগবতী–কুমারী পূজো না করলে মার পূজো হয় না। টাকা খেয়ে সেই কুমারী মেয়ের সর্বনাশ করলেন আপনি–এর ফল তোলা রইল, মনে থাকে যেন। মা সর্বমঙ্গলা এর বিচার ঠিকই করবেন। আমি যাব, হাঁ যাব বৈকি–যদি কোনদিন শুনি আপনার ভিটে থেকে জোড়া মরা বেরোচ্ছে, সেইদিন আনন্দ করতে আপনার বাড়ি যাব। তার আগে নয়!’

এর পর আর সে ভদ্রলোকের সাহস হয় নি কিছু বলতে। মুখ কালি করে চলে গেছেন। পালিয়ে গেছেন বলাই উচিত বরং।

পাড়ার অপর একটি বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা এসে তখন ওর হাত ধরে নিজের বাড়িতে টেনে নিয়ে গেছেন। সেখানে গিয়ে স্নান করেছে, আহ্নিকও করেছে কিন্তু একটু গুড়ের সরবৎ ছাড়া কিছুই খেতে রাজি হয় নি। তাঁদের বাড়িশুদ্ধ সকলে মিলে অনুরোধ করেছিলেন — একটু কিছু খাবার জন্যে। কিন্তু ঐন্দ্রিলা এক কথাতে সমস্ত অনুরোধ এড়িয়ে গেছে, ‘খাব তো নিশ্চয়, এত খেয়েও যখন পোড়া পেটের খিদে মেটে নি, তখন খেতে তো হবেই। কিন্তু আজ সত্যিই মুখে রুচবে না মা কিছু। আমার বড়সাধের সন্তান, ওর মুখ চেয়েই সব দুঃখ ভুলেছিলুম এতদিন, সেই মেয়ে আজ ঐ হেঁপোরুগী বুড়োর পাশে শুয়ে ফুলশয্যা করছে–তা জেনে আর এ গলা দিয়ে কিছু নামবে না। এ অনুরোধ করবেন না আপনারা।’

অগত্যা তাঁদের চুপ করে যেতে হয়েছে। সারারাত বসে কেঁদেছে ঐন্দ্রিলা সেদিন– দুটি চোখের পাতা বুজতে পারে নি এক মুহূর্তের জন্যেও। শেষ পর্যন্ত সে ভেবেছিল মেয়েকে জোর করে নিয়ে চলে যাবে, কিন্তু যে ভদ্রমহিলা ওকে টেনে এনেছিলেন তাঁদের বাড়ির সকলেই বারণ করলেন, এ কাজ করতে। গিন্নি বললেন, ‘দ্যাখ্ মা–তুই আমার মেয়ের বয়িসী, তুই-তোকারি করছি কিছু মনে করিস নি।–যা হয়ে গেছে তা আর কিছুতেই ফিরবে না। এ ইিঁদুর বিয়ে, এতে তালাক দেওয়া নেই, তবু যতদিন আছে অদৃষ্টে–সোয়ামীর ঘর করে নিক। টেনে নিয়ে গিয়েই বা কী রাজ-ঐশ্বর্য তুই দিতে পারবি মা ওকে? আর তা দিলেও–খেতে পরতে না হয় দিলি–ভাতার তো দিতে পারবি না। তার চেয়ে যা হবার হোক, তুই চলে যা। বরাতে থাকলে ঐ ঘরই দীর্ঘদিন করতে পারবে। এই যে আমার সইয়ের মেয়ে প্রভা, তার বিয়ের আটদিনের মধ্যে জামাইয়ের যক্ষ্মাকাশ ধরা পড়ল–তবু প্রভা আমার দশ বছর ঘর ক’রে সিঁথেয় সিঁদুর নিয়েই চলে গেল ড্যাং ড্যাং করে। আর তা যদি না-ই হয়, সে বরাত যদি না-ই ক’রে থাকে–মেয়েটা এখানে থাকলে, গোবেচারা ভালমানুষ কচি মেয়েটার দিকে চাইলে–ছেলে-বৌদের তবু মায়া পড়বে। ভবিষ্যতের কথাটা ভেবে দ্যাখ্। আর যতই হোক, এখনও না হয় তেমন সোমত্ত হয় নি, দুমাস পরেই হবে, তাকে সোয়ামীর ঘর ঘুচিয়ে কোথায় তুলবি বল? কতক্ষণ পাহারা দিবি? দিনরাত তো আর চোখে চোখে রাখতে পারবি নি। শেষে কি একটা কেলেঙ্কার বাধিয়ে বসবি! না না, ওসব মতলব ছাড়। যেমন একা এসেছিস একাই ফিরে যা।’

মায়ের মতো–ওর নিজের মায়ের চেয়েও বয়সে বড় ভদ্রমহিলার আন্তরিকতাপূর্ণ কথা ঐন্দ্রিলার বড় ভাল লাগল। বুঝলও সে। ওদিকে আর যাবার চেষ্টা না করে তাঁকে প্রণাম করে একাই ফিরল।

ওখান থেকে ফিরে সে ওদের সম্পর্কে এক নন্দাইয়ের কাছে গিয়েছিল মাকড়দায়। তিনি কিছুই জানতেন না, শুনে অবাক হয়ে গেলেন। বিশ্বাসই করতে চান নি প্রথমটায়। ঐন্দ্রিলা অনেক ক’রে দিব্যি গেলে বলতে তবে বিশ্বাস হ’ল তাঁর।

সে ভদ্রলোক নাকি এক বড় উকিলের মুহুরী। সেইজনেই গিয়েছিল ঐন্দ্রিলা তাঁর কাছে পরামর্শ চাইতে। কিন্তু তিনি বিশেষ আশাভরসা দিতে পারেন নি। বলেছেন এ ধরনের মামলা দাঁড় করানো শক্ত। টাকা খেয়ে কাকারা এ কাজ করেছে তার প্রমাণ কি? কোন লেখাপড়া তো নেই। হিন্দু বিয়ে নাকচ করাতে গেলে ঢের কাঠখড় পোড়াতে হবে। হাইকোর্টের এ ধারে কিছু হবে না। তাও, নাবালক মেয়ে ফুলে এনে বিয়ে দিয়েছে অভিভাবককে না জানিয়ে, প্রমাণ করতে প্রাণান্ত হবে। কারণ ঐ কাকাদের কাছে দীর্ঘকাল আছে, মাও এখানে আসা-যাওয়া করে–এটা প্রমাণ হয়ে যাবে সহজেই, সুতরাং ফোলানোর কেস টিকবে না, তাছাড়া লুকিয়েও দেয় নি। পাঁচটা আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণও করেছে। এ কেস হাইকোর্ট পর্যন্ত ঠেলতে অগাধ পয়সা খরচ হবে তাও ধোপে টিকবে কিনা সন্দেহ। আর–শেষ মোক্ষম কথা একটি বলেছেন তিনি–যদিই বা মামলা করে এবং জেতে–ঐ দাগী মেয়ে এনে আবার বিয়ে দিতে পারবে ঐন্দ্রিলা?

অর্থাৎ সর্বশেষ যেটুকু আশা মনে টিকিয়ে রেখেছিল–সেটুকুও আর রইল না।

দীর্ঘ ইতিহাস বিবৃত করতে সময় লাগল যথেষ্ট। এর মধ্যেই হেম এসে গেছে একসময়। আজকাল সে বড় একটা গোবিন্দদের বাড়িও যায় না–শনিবার ছাড়া, ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে আসে। আজ বরং একটু বেশি সকাল ক’রেই ফিরেছে। আগের ট্রেনটা পেয়ে গিয়েছিল। এসে নিঃশব্দেই ওর পিছনে বসে পড়েছে–অনর্থক কথা বলবার চেষ্টা করে নি। কাহিনীর অর্ধেকেরও বেশি শুনেছে সে। বাকিটা অনুমান ক’রে নিতে আটকায় নি।

সে এবার আস্তে আস্তে–এই প্রথম প্রশ্ন করল, ‘তোর শ্বশুরবাড়ি আর গেলি নি?’ ঐন্দ্রিলা রাগ ক’রে সেবার চলে যাবার পর এই প্রথম কথা কইল সে ওর সঙ্গে।

ঘাড় নাড়ল ঐন্দ্রিলা। গিয়েছিল সে। কাল সেই নন্দাইয়ের বাড়ি কাটিয়ে আজ ভোরেই পৌঁচেছিল ওখানে। ইচ্ছে ক’রেই সে সময় গিয়েছিল। অফিস বেরোবার একটু আগে–সে সময়টা স্নান আহার করার কথা–হিসেব করে ঠিক সেই সময়টায়ই পৌচেছিল। কিন্তু সম্ভবত, দূর থেকে ওকে আসতে দেখেই ভোলা পিছনের দোর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। শিবু অতটা বুঝতে পারে নি, সে একেবারে সামনে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার বুকের পাটাও বেশি। সে ঝেড়ে জবাব দিয়েছে।’আমাদের কাছে রেখে গিয়েছিলে, আমরা যা ভাল বুঝেছি সেই মতো বে দিয়েছি।’ টাকার কথাও সোজাসুজি অস্বীকার করেছে সে। বলেছে, ‘মিথ্যে কথা। হয় তুমি বানিয়ে বলছ, নয় তো তোমার পাগলামি কাণ্ডকারখানা দেখে তারাই ক্ষেপিয়ে দিয়েছে আরও ইচ্ছে করে। অত নগদ টাকা তার হাতে থাকলে আর ভাবনা ছিল না। তাছাড়া কী এমন ফেনা পাত্তর। অত বিষয়সম্পত্তির যার তার কি মেয়ের অভাব হয়! দুপায়ে জড়ো করতে পারত সে। আর তোমার মেয়েই বা কী এমন রূপসী নুরজাহান যে তার জন্যে পয়সা লুটিয়ে দেবে। তবে হ্যাঁ–ঐ বিষয়সম্পত্তি দেখেই দিয়েছিলুম, সত্যি কথা। সে তোমার মেয়েরই জন্যে। সে-ই সুখে থাকবে বলে। তা সে যে সব ছেলেদের নামে লিখে দিয়ে বসে আছে–কেমন ক’রে জানব বলো। তবে ও যা তোখড় লোক, ঠিক সব বাগিয়ে নেবে আবার। তোমার তো পয়সার জোর নেই এক কানাকড়িরও, ও বিয়ে না হ’লে কী বিয়ে দিতে তুমি? একটা কুলিকাবারি বিড়িওলা দেখে বিয়ে দিতে হ’ত। মাতাল নেশাখোর–এই জুটত শেষ পর্যন্ত। এ তো তবু নামকরা ভদ্দরলোক একটা–সাতখানা গাঁয়ের লোক চেনে। মেয়েও তোমার সুখে থাকবে দেখো। বুড়ো বয়সের বৌ, হাতের তেলোয় রাখবে। বলি আট বছরের মেয়ে দুগ্‌গা–শখ ক’রে বুড়ো শিবকে বিয়ে করেন নি?’

এইসব অবান্তর কথা বলে গেছে এলোপাতাড়ি। মুখ খোলবার অবকাশই পায় নি ঐন্দ্রিলা। অবশ্য তারপর আর দাঁড়াতে পারে নি বেশিক্ষণ। সে যখন মুখ ছুটিয়েছে-, শাপশাপান্ত শুরু করেছে–তখন অফিসের নাম ক’রে বেরিয়ে গেছে না খেয়েই। ভাত বাড়া ঘরের মধ্যে দেখেছে সে। কিন্তু ভাত খেয়ে যেতেও সাহসে কুলোয় নি শিবুর।

‘আর তোর শাশুড়ী মাগী?’ হেম জিজ্ঞাসা করলে।

‘সে কি আর বেরোল নাকি? আমাকে দেখেই ঘরে খিল দিয়েছিল–সেই খিল দিয়েই বসে রইল। ক্যাট ক্যাট করে যা মুখে এল শোনালুম। গাল দিলুম, মন্যি দিলুম–সব হজম করলে বসে বসে। শেষে শিবুর বৌটা এসে পায়ের ওপর আছড়ে পড়ল, বলে, ও দিদি, চুপ কর দিদি, আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি ঘাট মানছি–দিদি, পাঁচটা কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে বাস করি–ওদের মুখের দিকে চাও একটু। ওরা তো কোন অপরাধ করে নি! ওর কান্না দেখেই চুপ করলুম। আর কীই বা করব, গাল দিলে কি আর মেয়ের বে ফিরবে? তাছাড়া, পাড়ার অনেকে ছুটে এসেছিল তো চেঁচামেচি শুনে, তারাও থামিয়ে দিলে–মজুমদার-গিন্নী জোর ক’রে টেনে নিয়ে গেল নিজের বাড়ি। অগত্যা চুপ ক’রে যেতে হ’ল। বুঝতেই তো পারছি, পয়সা খেয়ে ওরা যে-কালে এই কসাইয়ের কাজ করেছে, সে কালে গাল-মন্দ খাবার জন্যে তৈরি হয়েই আছে। ওতে কিছু হবে না। এখন কিসে একটা বিহিত হয়, তোমরা যুক্তিপরামর্শ ক’রে সেইটে বল। পুলিশে যাব একবার? ওদের নামে এই সব কথা যদি লিখিয়ে দিয়ে আসি? পুলিশ কিছু করবে না?’

অনেক আশা, অনেক আগ্রহ নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে আছে ছোট বোন। তাকে নিরুৎসাহ করতে মন চায় না। তবু ঘাড় নাড়তেই হয় হেমকে।

‘নাঃ!… ও তোর ননদাই যা বলেছে তাই ঠিক। আশা কম–আর লড়তে গেলেও বিস্তর টাকার খেলা। অর্থবল লোকবল দুই-ই চাই। আমাদের ও কোনটাই নেই। পড়ে মার খাওয়া ছাড়া আমি তো আর কোন উপায় দেখি না।’

‘কোন উপায় নেই? কী বলছ দাদা?’ প্রশ্ন নয়–যেন আর্তনাদ করে ওঠে ঐন্দ্রিলা, ‘তাহলে মেয়েটা ঐ ভাবে জ্যান্তে মরা হয়েই থাকবে চিরকাল? কোন বিহিত হবে না?’

চুপ করে থাকে হেম। কী বলবে, কী বোঝাবে ওকে!

প্রাণপণে কটি মুহূর্ত হতাশাকে ঠেকিয়ে রেখে শেষ বিন্দু আশা আঁকড়ে ধরে থাকে ঐন্দ্রিলা উত্তরের অপেক্ষায়। কিন্তু দাদার নিরুত্তর স্তব্ধতায় সে আসা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গুঁড়িয়ে পড়ে যায়।

আর একবার হাহাকার ক’রে কেঁদে ওঠে। আর একবার নিজের অদৃষ্টকে ধিক্কার দেয়। এদের ওপর দোষারোপ করে, ওদের গালাগালি ও অভিসম্পাত দিতে থাকে, মেয়ের বৈধব্য কামনা করে। এ বিবাহিত জীবনের চেয়ে সে ভাল। না হয় মা মেয়ে একসঙ্গেই একাদশী করবে। সে ঢের ঢের ভাল। তারপর একসময় আবার দৈহিক শ্রান্তিতেই চুপ করে।

শান্তির মতো সান্ত্বনা আর নেই। বুঝে এরাও চুপ করে থাকে। ওর মিথ্যা অভিযোগেরও উত্তর দেবার চেষ্টা করে না কেউ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *