০৫. মিসেস শেলবি

৫. মিসেস শেলবি

সেদিন রাতে মিস্টার আর মিসেস শেলবি তাঁদের শোবার ঘরে ফিরে এসেছেন। মিস্টার শেলবি বড় একটা চেয়ারে আরাম করে গা এলিয়ে বসে বিকেলের ডাকে আসা চিঠিগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। মিসেস শেলবি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জট পাকিয়ে যাওয়া বিনুনিটা আস্তে আস্তে খুলছেন। হঠাৎ এলিজার কথাগুলো মনে পড়ে যাওয়ার স্বামীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আচ্ছা আর্থার, ওই লোকটা কে?’

‘ওর নাম হ্যালি। আমার পরিচিত।’ চিঠি থেকে চোখ না তুলেই মিস্টার শেলবি জবাব দিলেন।

‘হ্যালি! কই, ওর নাম তো কখনো শুনি নি? কী করে লোকটা? এখানে কেন এসেছিল?’

‘গতবার যখন ন্যাচস্-এ ছিলাম ব্যবসায়িক কাজেই ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল।’

‘আর সেই সূত্রেই ও তোমার সঙ্গে এখানে দেখা করতে এসেছে, খাওয়া-দাওয়া করেছে?’

শেলবি কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেন। ‘আমিই ওকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। ওর সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কাজ ছিল।’

স্বামীর মনোভাব লক্ষ করেই মিসেস শেলবি প্রশ্ন করলেন, ‘লোকটা কি দাস- ব্যবসায়ী?’

‘কী করে বুঝলে?’ শেলবি অবাক হয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন।

‘এমনিই বলছি। বিকেলে এলিজা কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, তুমি বৈঠকখানায় একজন দাসব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলছ। ও শুনেছে তুমি নাকি ওর হ্যারিকে তার কাছে বিক্রি করে দিতে চাইছ।’

‘ও বলেছে বুঝি?’ হালকাভাবে কথাটা বলেই শেলবি খুব মন দিয়ে একটা চিঠি পড়ার ভান করলেন। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই তিনি বুঝতে পারতেন চিঠিটা উল্টো দিকে ধরা রয়েছে।

চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মিসেস শেলবি বললেন, ‘আমি এলিজাকে বলেছি ও নিয়ে অত মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি সাধারণত চাকর-বাকরদের কখনো বিক্রি করো না। বিশেষ করে অমন একটা অসভ্য লোকের কাছে তো নয়ই।’

‘এতোদিন আমি নিজেও তাই ভাবতাম, এমিলি। নিজের মনকে প্রস্তুত করে নিয়ে শেলবি বললেন, ‘কিন্তু কিছুদিন ধরে আমার ব্যবসার অবস্থা এমন খারাপ যাচ্ছে যে দু- একটা চাকরকে না বেচে আমার আর কোনো উপায় নেই।’

‘ওই জানোয়ারটার কাছে? অসম্ভব! তুমি ঠাট্টা করছ না তো, আর্থার?’

‘না, এমিলি। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই তোমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি টমকে বিক্রি করতে রাজি হয়েছি।’

মিসেস শেলবি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, ‘কী বলছ তুমি! আমাদের টমকে? ছোটবেলা থেকে যে তোমাকে মানুষ করেছে। অমন বিশ্বাসী, এতো দিনের পুরনো একটা চাকরকে তুমি বিক্রি করে দেবে! অথচ তুমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে মুক্তি দেবে। আমিও বহুবার তাকে সে কথা বলেছি। এখন আমি আর কিছুই অবিশ্বাস করতে পারছি না, আর্থার! আমার ধারণা তুমি হয়তো এলিজার একমাত্র সন্তান হ্যারিকেও বিক্রি করে দিতে পারো।’

‘তুমি যখন সবই জানতে পেরেছ, তখন আর তোমার কাছে লুকিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি টম আর হ্যারি, দুজনকেই বিক্রি করে দিতে রাজি হয়েছি। কিন্তু একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না এমিলি; সবাই প্রতিদিন যে কাজ করছে শুধু আমার বেলায় তুমি এমন একটা ভাব করছ যেন আমি কত অপরাধী।’

‘কিন্তু আরো অনেকে তো ছিল? যদি নিতান্তই বিক্রি করতে বাধ্য হও, তবে অন্য কাউকে না বেচে ওদের দুজনকে বিক্রি করতে গেলে কেন?’

‘যেহেতু ওদের দুজনকে বিক্রি করে বেশ দাম পাওয়া যাবে, অন্য কাউকে বেচলে সে দাম পাওয়া যেত না। লোকটা এলিজার জন্যও অনেক টাকা দিতে চেয়েছিল।’

‘আচ্ছা শয়তান তো।’

‘কিন্তু আমি তোমার কথা ভেবেই রাজি হই নি।’

‘ধন্যবাদ, আর্থার!’ বেদনায় মিসেস শেলবির গলার স্বর ভারী হয়ে উঠল। ‘কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো, টমের মতো এমন মহৎ হৃদয় আর একজন বিশ্বাসী চাকরকে ছেড়ে দিতে সত্যিই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি জানো না, আমাদের জন্যে ও নিজের জীবনকেও বিসর্জন দিতে পারে।’

‘আমি জানি, এমিলি। কিন্তু এ-ছাড়া সত্যিই আমরা আর অন্য কোনো উপায় ছিল না।’

‘কিন্তু আমি এখন ওদের কাছে কেমন করে মুখ দেখাব? কেমন করে বলব যে এতদিন যে শিক্ষা দিয়েছি সে সবই ভুল ভালোবাসা আর মানবতার কোনো মূল্য নেই …সামান্য কটা টাকার কাছে সে সবই তুচ্ছ, অর্থহীন!’ মিসেস শেলবির মসৃণ চিবুক বেয়ে নেমে এসেছে অশ্রুধারা।

‘এতদিন আমি এলিজাকে বুঝিয়েছি খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসী মা হিসেবে তার কর্তব্য হ্যারির প্রতি যত্ন নেয়া, তার হয়ে প্রার্থনা করা, তাকে মানুষ করা। আমি ওকে বহুবার বলেছি টাকার চাইতে মানুষ অনেক বড়। সেই এলিজার বুক থেকে এতটুকন দুধের বাচ্চাকে ছিনিয়ে নিয়ে আমরা যদি অসভ্য একটা লোকের কাছে বিক্রি করি, তাহলেই বা অন্যান্য চাকরবাকররা আমাদের কী ভাববে আর আমিই বা কেমন করে ওদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব তুমি বলো?’

‘সত্যিই আমি দুঃখিত এমিলি, যদিও তোমার ভাবনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত নই, তবু তোমার অনুভূতিগুলোকে কিছুতেই শ্রদ্ধা না করে পারছি না। এইসব কারণেই আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই নি, কিন্তু এখন না বলে পারছি না। সত্যিই এ-ছাড়া আমার আর অন্য কোনো উপায় ছিল না। হয় ওদের দুজনকে বিক্রি করতে হতো, নয়ত সমস্ত সম্পত্তি হাত ছাড়া হয়ে যেত। হ্যালি আমার বন্ধকী সম্পত্তি অধিকার করার জন্যেই এখানে এসেছিল। ওর প্রস্তাবে রাজি না হলে সম্পত্তির সঙ্গে প্রতিটা চাকর-বাকরকেও হারাতে হতো।’

মিসেস শেলবি এতক্ষণ বজ্রাহতের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন, স্বামীর শেষ কথাগুলোয় দুহাতে মুখ ঢেকে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘হা ঈশ্বর এখন আমি কী করব! এ পাপ! এমন জানলে আমি কোনোদিনই কোনো ক্রীতদাস রাখতাম না। অন্তত এলিজার ছেলেটাকে বাঁচানো যেত …’

‘থাকলেও কোনো লাভ হতো না, এমিলি। আমার সই করা দলিল এখন রয়েছে হ্যালির হাতে। লোকটার যে কী লোভ তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না। টাকার জন্যে ও নিজের মাকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে পারে।’

‘উঁঃ, মানুষ যে কী করে এতো নিষ্ঠুর হতে পারে!

‘এমিলি, এখন আর ওসব ভেবে কোনো লাভ নেই। হ্যালি কাল সকালে এসে ওদের দুজনকে নিয়ে যাবে। আমি খুব ভোরে উঠে ঘোড়ায় চড়ে কোথাও চলে যাব। তুমিও এলিজাকে নিয়ে গাড়িতে করে দূরে কোথাও বেড়াতে যেও। ওর অসাক্ষাতেই ব্যাপারটা ঘটা ভালো।’

‘না না, এই অমানুষিক বর্বরতার মধ্যে তোমরা আর আমাকে টেনো না! আমি বরং গিয়ে টমের সঙ্গে দেখা করব। চরম বেদনার মুহূর্তে ওরা দেখুক আমিও ওদের সঙ্গে রয়েছি, ওদের ব্যথাকে অনুভব করতে পারছি। আর এলিজার কথা ভাবতেই আমার বুকের ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠছে! আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি, আজ আমরা যে অপরাধ করলাম, এর জন্যে ঈশ্বর আমাদের কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারবেন না।’

মিস্টার আর মিসেস শেলবি ভাবতেই পারেন নি যে অলক্ষে দাঁড়িয়ে কেউ ওঁদের কথাবার্তা শুনবে।

সেদিন একটু তাড়াতাড়িই মিসেস শেলবি এলিজাকে রাতের মতো বিদায় দিয়েছিলেন। কিন্তু এলিজা নিজের ঘরে ফিরে না গিয়ে পিছনের দিকের বারান্দা থেকে ওঁদের শোবার ঘরের দরজায় কান পেতে রেখেছিলেন। ছেলের প্রতি উদ্বিগ্ন মনই তাকে এই গর্হিত কাজ করতে বাধ্য করেছিল।

রাতের নিস্তব্ধতায় ওঁদের কোনো শব্দই তার কান এড়িয়ে যায় নি। তাই বিহ্বল আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে সে একসময় চোরের মতো নিঃশব্দ-পায়ে ফিরে এল। তার নম্র- লাজুক চেহারায় তখন এমন অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটে গেেেছ যে, হঠাৎ দেখলে কেউ তাকে চিনতেই পারবে না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এলিজা নিজের ঘরে প্রবেশ করে সোজা বিছানার দিকে এগিয়ে গেল, বিছানায় ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে সে বলল, ‘সোনামণি, ওঁরা তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছেন! তবু তোমার মা যেভাবে হোক তোমাকে বাঁচাবেই!’

তার চোখে জলের কোনো চিহ্ন নেই। যেন হৃদয়ের উৎসধারা থেকে যদি এখন কিছু ঝরে পড়ে তা অশ্রু নয়, রক্তের ফোঁটা।

দ্রুত হাতে এক টুকরো কাগজ টেনে নিয়ে এলিজা লিখল, ‘মাননীয়া গৃহকত্রী, অনুগ্রহ করে আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না, বা অকৃতজ্ঞ ভাববেন না। আজ রাতে কর্তার সঙ্গে আপনার আলোচনা আমি সবই শুনেছি। আমার প্রিয় সন্তানকে বাঁচাবার জন্যেই এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আপনি আমাকে দোষী করবেন না! আপনার মহানুভবতার জন্যে ঈশ্বর আপনার নিশ্চয়ই মঙ্গল করবেন।’

কাগজটা ভাঁজ করে তার ওপর মিসেস শেলবির নাম লিখে চিঠিটা সে টেবিলের ওপর রেখে দিল। তারপর টানা খুলে কয়েকটা পোশাক বার করল। পোশাকগুলো বড় একটা রুমালে জড়িয়ে পুঁটলিটা শক্ত করে বেঁধে নিল কোমরের কাছে। বিহ্বল সেই আতঙ্কের মুহূর্তেও এলিজা হ্যারির প্রিয় খেলনাগুলো নিতে ভুলল না। ওর সব চাইতে প্রিয় ছিল রঙিন একটা টিয়া। এলিজা বহুকষ্টে ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে সেই রঙিন কাঠের টিয়াটা হ্যারির হাতে দিল। হ্যারি জড়ানো চোখে টিয়াটিকে নিয়ে খেলতে লাগল। এই অবকাশে এলিজা পোশাক পাল্টে গায়ে একটা শাল জড়িয়ে নিল। তারপর হ্যারির কোট আর টুপি হাতে মাকে বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ, মা?’

‘চুপ চেঁচিও না; সবাই শুনতে পাবে।’ চাপাস্বরে এলিজা বলল, ‘একটা দুষ্টু লোক আমার হ্যারিসোনাকে তার মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেবার মতলব করেছে। কিন্তু তার মা তাকে কিছুতেই ছিনিয়ে নিতে দেবে না। তাই জামা-কাপড় পরে আমরা অনেক দূরে পালিয়ে যাব, যাতে সেই দুষ্টু লোকটা আর ধরতে না পারে।’

কথা বলতে বলতেই এলিজা ছেলের পোশাক পরানো শেষ করে তার কোটের বোতামগুলো ভালো করে এঁটে দিল, কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘একদম শব্দ করবে না!’ তারপর ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরের বারান্দার দিকের দরজা খুলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

বাইরে শীতের হিমরাত্রি। আকাশে ঝলমল করছে অজস্র নক্ষত্র। এলিজা ছেলের গায়ে শালটা ভালো করে জড়িয়ে দিল। অজানা একটা আতঙ্কে হ্যারি মায়ের গলাটা আঁকড়ে ধরে চুপটি করে পড়ে রইল।

বারান্দার শেষপ্রান্তে প্রকাণ্ড একটা নিউফাউন্ডল্যান্ড কুকুর শুয়ে ছিল। এলিজার পায়ের পায়ের শব্দ পেতেই সে চাপা গর্জন করে উঠল। এলিজা মৃদুভাষায় তাকে ধমক দিল, ‘এই ব্রুনো, চুপ!’

কুকুরটা তখন লেজ নাড়তে নাড়তে নিঃশব্দে ওদের অনুসরণ করল।

একটু পরে এলিজা টম চাচার কুঠরির সামনে এসে পৌঁছল এবং খুব আস্তে আস্তে জানালার সার্সিতে টোকা দিল।

নৈশ-উপাসনার জন্যে টমের বরাবরই শুতে বেশ দেরি হয়। সেদিনও টম বা তার স্ত্রী তখনো কেউ ঘুমোয় নি।

‘কে?’ তাড়াতাড়ি পর্দা সরিয়ে ক্লো জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল। ‘ওমা লিজি এতো রাত্রিতে কী ব্যাপার? সঙ্গে ব্রুনোও রয়েছে দেখছি!’

দরজা খুলে দিতেই মোমবাতির আলোর একটা রেখা গিয়ে পড়ল পলাতকার বিস্ফারিত দুটো চোখ আর তার ম্লান মুখখানার ওপর।

ওকে দেখে টম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল, ‘কী হয়েছে, লিজি! তুমি কি অসুস্থ?’

‘টম চাচা ক্লো কাকি-হ্যারিকে নিয়ে আমি পালিয়ে যাচ্ছি। কর্তা ওকে বেচে দিয়েছেন।’

‘বেচে দিয়েছেন!’ দুজনে প্রায় একইসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল।

‘হ্যাঁ, টম চাচা। শুধু হ্যারি নয়, তার সঙ্গে ওঁরা তোমাকেও একজন দাস-ব্যবসায়ীর কাছে বেচে দিয়েছেন। আমি নিজে দরজায় কান পেতে শুনেছি। কাল ভোরে মনিব ঘোড়ায় চড়ে কোথাও চলে যাবেন আর সেই সময় লোকটা তোমাদের নিতে আসবে।’

এতক্ষণ টম স্বপ্নাবিষ্টের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে এলিজার কথাগুলো শুনছিল। কিন্তু কথাগুলো বোধগম্য হতেই সে চেয়ারে বসে পড়ল, মাথাটা নুয়ে এল বুকের কাছে।

‘ঈশ্বর আমাদের কৃপা করুন!’ আর্তস্বরে ক্লো বলে উঠল। ‘না না, এ কখনো সত্যি হতে পারে না! ও কী এমন অন্যায় করেছে যে কর্তা ওকে বেচে দেবেন?’

টম চাচা কোনো অন্যায় করে নি। উনি তার জন্যে বেচেন নি। উনি বা গিন্নিমা আমাদের কাউকেই বেচতে চান না। গিন্নিমা চোখের জলে অনেক কাকুতি মিনতি করছিলেন, কিন্তু কর্তা বললেন যে এ-ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই। লোকটার কাছে কর্তার এতো দেনা হয়েছে যে টম চাচা আর হ্যারিকে বিক্রি না করলে কর্তার ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি, এমন কি সমস্ত চাকর-বাকররাও ওই ব্যবসায়ী লোকটার খপ্পরে গিয়ে পড়ত। কর্তার কোনো ইচ্ছে ছিল না, শুধু ওই শয়তান লোকটার জন্যেই উনি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। আর গিন্নিমার কথা শুনলে তোমাদের চোখ ফেটে জল আসত! আমি জানি এভাবে হ্যারিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না…এ অন্যায়…কিন্তু আমি মা, আমার বুক থেকে কেউ ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, আমি কেমন করে সহ্য করব বলো?’

‘টম তুমিও পালিয়ে যাও’, ক্লো বলল। ‘না হলে নদীর ওপারে নিয়ে গিয়ে তোমাকে না খেতে দিয়ে সারাদিন খাটিয়ে খাটিয়ে মেরে ফেলবে। তোমার তো যখন যেখানে খুশি যাবার ছাড়পত্র আছে, তুমিও বরং লিজির সঙ্গে পালিয়ে যাও। এখনো সময় আছে, আমি তোমার জিনিসপত্তর সব গুছিয়ে দিচ্ছি।’

ধীরে ধীরে মাথা তুলে বিষণ্ণ অথচ স্থির দৃষ্টি মেলে টম স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল। ‘তা হয় না ক্লো। আমি যাব না। লিজি যাক। ওর যাবার অধিকার আছে। কিন্তু আমি যেতে পারি না। শুনলে না, কর্তা বলেছেন, আমাদের না বেচলে ঘর-বাড়ি, জায়গা-জমি, এমন কি চাকর-বাকররাও সব ওই লোকটার খপ্পরে গিয়ে পড়বে? ইচ্ছে না থাকলেও উনি একাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তুমি ওঁকে দোষী করো না ক্লো। বরং আমি চলে যাবার পরেও উনি তোমার আর বাচ্চাগুলো …’

এই পর্যন্ত বলে টম আর কিছু বলতে পারল না। শয্যায় নিদ্রাতুর সন্তানগুলোর দিকে তাকিয়ে তার বুক গভীর বেদনায় ভরে ওঠে। দুহাতে মুখ ঢেকে সে অস্ফুট যন্ত্রণায় ঢুকরে ওঠে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে টুপটাপ করে ঝরে পড়তে থাকে অশ্রুধারা।

এলিজা বলল, ‘আজ বিকেলে আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখনো আমি ব্যাপারটা স্পষ্ট জানতাম না। সেও খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। আজই আমাকে বলছিল আর কয়েক দিনের মধ্যে সে কানাডায় পালিয়ে যাবে। যদি পারো একটু কষ্ট করে তাকে একটা খবর দিও। দেখা হলে বলো কেন আমি পালিয়েছি। আরো বলো যে আমিও কানাডায় যাবার চেষ্টা করব। তাকে আমার ভালোবাসা জানিও। আর তার সঙ্গে যদি আমার কখনো দেখা না হয়…চকিতে মুখ ফিরিয়ে এলিজা কান্নার নিরুদ্ধ আবেগকে চেপে রাখার চেষ্টা করল, তারপর ধরা-ধরা গলায় কোনোরকমে বলল, ‘তাকে বলো যে পরলোকে যেন তার দেখা পাই। আর ব্রুনোকে ঘরের ভিতরে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও, যাতে আমার পিছন পিছন না যায় বেচারি! সত্যি, সত্যি, ওর জন্যেও আমার মায়া হচ্ছে। চোখের জলে পরস্পরের কাছ থেকে শুভেচ্ছা আর বিদায় জানিয়ে এলিজা হ্যারিকে বুকে চেপে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

৬. প্রস্তুতি

সেদিন রাতে তর্ক-বিতর্কে অনেকখানি সময় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পরের দিন সকালে মিস্টার আর মিসেস শেলবির ঘুম ভাঙল স্বাভাবিকের চাইতে বেশ খানিকটা বেলায়।

‘কী ব্যাপার, আজ এলিজার কী হলো!’ বারবার ঘণ্টি বাজিয়েও এলিজার কোনো সাড়া না পেয়ে মিসেস শেলবি অবাক হয়ে ভাবলেন।

মিস্টার শেলবি সাজগোজ করার বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষুর শান দিচ্ছেন, এমন সময় দরজা ঠেলে একটি নিগ্রো কিশোর গরম জলের পাত্র নিয়ে ভিতরে ঢুকল।

মিসেস শেলবি তাকে বললেন, ‘অ্যান্ডি, এলিজার ঘরে গিয়ে দেখ তো ও কী করছে। ওকে বলবি সকাল থেকে আমি অনেকবার ডেকেছি।’ তারপর ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি নিজের মনেই বললেন, ‘বেচারির আবার অসুখ-বিসুখ করল কিনা তাই বা কে জানে!

একটু পরেই অ্যান্ডি যখন ফিরে এল, বিস্ময়ে তার চোখের মণি দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

‘লিজির ঘরের টানাগুলো সব খোলা, জিনিস-পত্তর চারদিকে ছড়ানো। আমার মনে হয় ও পালিয়েছে।’

‘আমারও তাই মনে হয়।’ মিসেস শেলবির চোখ দুটো যেন সুখে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল, ‘ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, উনি যেন ওকে সাহায্য করেন।’

‘বোকার মতো বলো না।’ শেলবি চটে উঠলেন, ‘ও যদি সত্যিসত্যিই পালিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমার অবস্থাটা কী দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখেছ? হ্যালি প্রথম থেকেই লক্ষ করেছিল আমি হ্যারিকে বিক্রি করতে ইতস্তত করছি। ও ভাববে আমিই বুঝি ষড়যন্ত্র করে এলিজাকে সরিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা আমার পক্ষে সত্যিই অপমানকর।

দাড়ি না কামিয়েই শেলবি দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

তারপরই ছুটোছুটি, চিৎকার-চেঁচামেচি, দরজা-জানালা খোলা আর বন্ধ হওয়ার শব্দ। চাকর-বাকররা সব এলিজাকে চারদিকে খুঁজছে। একমাত্র ক্লো, যে হয়তো এ ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করতে পারত, এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিজেকে নীরব রেখে প্রাতরাশের কাজে ব্যস্ত রয়েছে, যেন সে কিছুই জানে না। সবসময় হাসিখুশি থাকত যে মুখখানা, আজ তাতে ঘনিয়ে উঠেছে বিষাদের গাঢ় ছায়া। ব্যাপারটা ও আগেই আঁচ করতে পেরেছিল, তাই পালিয়েছে।

অবশেষে হৈ-হট্টগোলের মধ্যেই হ্যালি এসে হাজির হলো। গায়ে অশ্বারোহীর পোশাক, পায়ে কাঁটাওয়ালা বুট, হাতে ঘোড়ায় চড়ার চাবুক। সব শুনে তার মেজাজ হয়ে উঠল একেবারে তিরিক্ষি। দাঁতে দাঁত ঘষে, চাবুক দোলাতে দোলাতে সে বলল, ‘শয়তান দুটোকে ধরতে পারলে একবার দেখাতাম মজা! ‘

‘ওদের তুমি আর ধরতে পারবে না চাঁদ। ঝকঝকে সাদা দাঁতে হাসতে হাসতে অ্যান্ডি এমন ভাবে কথাগুলো বলল যাতে হ্যালি শুনতে না পায়।

‘কী ব্যাপার, মিস্টার শেলবি …’ রীতিমতো উত্তেজিতভাবে ভিতরের বসার ঘরটায় ঢুকে হ্যালি বলল, ‘মনে হচ্ছে দাসিটা বাচ্চাটাকে নিয়ে কেটে পড়েছে?’

‘আঃ আস্তে, মিস্টার হ্যালি! এখানে আমার স্ত্রী রয়েছেন?’

‘ক্ষমা করবেন, ম্যাডাম। সত্যিই আমি দুঃখিত।’ মিসেস শেলবিকে অভিবাদন জানাল। ‘কিন্তু যা শুনছি, কথাটা কি সত্যি?’

‘হ্যাঁ! সম্ভবত আগে থেকে বুঝতে পেরে ও বাচ্চাটাকে নিয়ে পালিয়েছে।’

‘নাঃ, এ বছর দেখছি ব্যবসার অবস্থাটা সত্যিই একেবারে শোচনীয়।’

‘ক্ষতি তোমার চাইতে আমারও কিছু কম হয় নি, হ্যালি। তুমি হারিয়েছে বাচ্চাটাকে, আর আমি হারিয়েছি এলিজাকে।’ অনুযোগের সুরে শেলবি বললেন। কিন্তু এখনো সময় আছে, মিছিমিছি মেজাজ খারাপ না করে একটু শান্ত হয়ে বসো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি এ ব্যাপারে যতরকম সাহায্যের প্রয়োজন আমি করব। আগে প্রাতরাশটা সেরে নাও, তারপর আমার ঘোড়া, কুকুর আর চাকর-বাকর নিয়ে মেয়েটার খোঁজে গেলেই চলবে।’

প্রাতরাশের টেবিল সাজানো হয়েছে কিনা দেখার জন্যে মিসেস শেলবি উঠে পড়লেন। ততক্ষণ টমকে বিক্রি করে দেয়ার খবর, বিশেষ করে এলিজার পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ, আশেপাশের প্রতিটি বাড়ি, এমন কি ক্ষেতে খামারেও ছড়িয়ে পড়েছে। কেননা এ ধরনের ঘটনা সচরাচর এ তল্লাটে বড় একটা ঘটে না।

এলিজাকে খুঁজে বার করার প্রধান দায়িত্ব পড়ল স্যামের ওপর। সবাই তাকে কালো স্যাম বলে ডাকে। সব নিগ্রোরাই কালো। স্যাম আবার তাদের চাইতে তিনগুণ কালো। সবসময়ই হাসিখুশি আর ফুর্তিবাজ। আস্তাবলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে নিজের মনেই বলতে লাগল, ‘দেখব এবার আমার নাকের ডগা দিয়ে কে পালায়!’

‘হেই স্যাম … স্যাম …’ ছুটতে ছুটতে এসে অ্যান্ডি বলল, ‘আমি যদি লিজিকে খুঁজে বার করতে না পারি, সবাই বলবে ব্যাটা কালো নিগ্রোটা নিগ্রোটা কোনো কম্মের নয়।

‘কিন্তু তুই কী বললি ভেবে দেখেছিস একবার?’ অ্যান্ডি চোখ বড় বড় করে তাকাল। ‘মিসেস চান না লিজি ধরা পড়ুক।’

‘হ্যাঁ, তোকে বলেছে।’

‘মাইরি, বলছি, তুই বিশ্বাস কর!’

‘তুই কেমন করে জানলি?’

‘সকালে যখন কর্তার জন্যে দাড়ি কামানোর জল নিয়ে গিয়েছিলাম, মিসেস বললেন, ‘দেখত অ্যান্ডি, লিজি কী করছে?’ আমি যখন এসে বললাম যে ও পালিয়েছে, ওঁর মুখ দেখে মনে হলো উনি যেন খুব খুশি হয়েছেন। নিজের মনেই বিড়বিড়, করে বললেন, ‘ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, উনি যেন ওকে সাহায্য করেন।’ তাই বলছিলাম তুই যদি এখন সত্যিসত্যিই লিজিকে ধরার চেষ্টা করিস, মিসেস কিন্তু তোর ওপর খুব রেগে যাবেন।

‘যা বাব্বা, কর্তা বলছে লিজিকে ধরা চাই … গিন্নিমা লিজিকে ধরতে মানা করছেন।’ দার্শনিকের ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে স্যাম বলল, ‘এখন আমি কেমন করে বুঝব রুটির কোন পিঠটাতে মাখন মাখানো রয়েছে।’

‘কিন্তু তুই তো জানিস, মিসেস লিজিকে কত ভালোবাসেন। উনি চান না লিজির ছেলেটা হ্যালির মতো বদমাইস কোনো লোকের হাতে গিয়ে পড়ুক। একটু আগেই উনি নিজে আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, ‘লিজিকে খুঁজে বার করার জন্যে এতো তাড়াহুড়া করার কোনো দরকার নেই। তোরা যত দেরি করবি, ওর পক্ষে ততই মঙ্গল।’

‘উনি তোকে তাই বলেছেন বুঝি?’

অ্যান্ডি স্যামের বুকে হাত ছুঁয়ে বলল, ‘মাইরি বলছি, তুহি বিশ্বাস কর!’ তবু বীরত্ব দেখানোর ভঙ্গিতে স্যাম হাসতে হাসতে বলল, ‘হুঁ বাব্বা, আমার নাকের ডগা দিয়ে কেউ পালাবে, না, তা হবে না!’

স্যামের ভঙ্গি দেখে মনে হলো এ ব্যাপারে ওর অসীম উৎসাহ এবং রীতিমতো গর্বের সঙ্গে ও যেভাবে বিল আর জেরিকে আস্তাবল থেকে ঝড়ের বেগে ছুটিয়ে এনে উঠোনে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিল, মনে হলো। কেউ আর ওকে থামাতে পারবে না। কাজেই অন্য একটা খুঁটিতে বাঁধা রয়েছে হ্যালির ভারি সুন্দর দেখতে কুচকুচে কালো ঘোড়াটা। ঘোড়াটা যেমন তেজি, তেমনি অসম্ভব ছটফটে—কিছুতেই এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

‘হো হো হো!’ স্যাম তার কাছে গিয়ে আদর করে ডাকতেই ঘোড়াটা মসৃণ গ্রীবা বেঁকিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিত তাকাল তার দিকে, ‘এতো ছটফট করলে কি হয়? দাঁড়া, আমি তোর জিনটা ঠিক করে দিচ্ছি।’

সামনেই প্রকাণ্ড একটা বিচগাছ ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার সুচালো তিনকোণা ফলগুলো ছড়িয়ে রয়েছে মাটিতে। সবার অলক্ষ্যে একটা বিচফল তুলে নিয়ে স্যাম ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেল, তারপর আদর করে ঘোড়াটার গায়ে গলায় আস্তে আস্তে চাপড় মারতে লাগল, যেন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। জিনটাকে ঠিক করে বসানোর ছলে সে বিচফলটাকে এমনভাবে জিনের নিচে রেখে দিল, যাতে সামান্য একটু চাপ পড়লেই ঘোড়াটা অস্বস্তি বোধ করবে, অথচ পিঠে কোনো ক্ষতচিহ্ন থাকবে না?’

অ্যান্ডিকে ডেকে সে বলল, ‘দেখ তো, জিনটা এবার ঠিক মতো বসানো হয়েছে কিনা?’

এমন সময় মিসেস শেলবিকে সামনের বারান্দায় দেখা গেল। ইশারায় উনি স্যামকে কাছে ডাকলেন, ‘কী, তোরা এখনো যাস নি?’ বেশ জোরে জোরেই মিসেস শেলবি বললেন, ‘আমি যে অ্যান্ডিকে দিয়ে পাঠালাম তাড়াতাড়ি করতে।’

‘আমাদের হয়ে গেছে গিন্নিমা।’

‘তাহলে আর মিছিমিছি দেরি করিস না, বেরিয়ে পড়। মিস্টার হ্যালিকে পথ দেখিয়ে তোদের সাহায্য করতে হবে।’ তারপর গলার স্বর নামিয়ে এনে উনি বললেন, ‘গত সপ্তাহে জেরি একটু খুঁড়িয়ে চলছিল। ওকে খুব সাবধানে রাখিস, বাবা। আর ঘোড়াটাকে একদম জোরে ছোটাস না।’

মনিবানির কথাগুলোর প্রকৃত অর্থ বুঝতে স্যামের একটুও অসুবিধে হলো না। অহেতুক জোর দিয়েই সে বলল, ‘আপনি কিচ্ছু ভাববেন না, গিন্নিমা। আমি ঠিক মিস্টার হ্যালিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।’

বিচ গাছের ছায়ায় ফিরে এসে স্যাম কুনই দিয়ে অ্যান্ডিকে গুঁতো দিল। ‘এবার দেখ না কী রকম মজাটা ঘটে!’

দুজনেই চাপা হাসিতে লুটিয়ে পড়ল।

এমন সময় হ্যালি বারান্দায় বেরিয়ে এল। চমৎকার এক পেয়ালা কফির প্রভাবে তার মেজাজ তখন কিছুটা গা-ঝাড়া। হাসতে হাসতে তাকে নিচে নেমে আসতে দেখেই স্যাম আর অ্যান্ডি মাথায় চড়িয়ে নিল তালপাতার বিশাল দুটো টুপি।

ওদের তৎপরতা দেখেও হ্যালি তাড়া লাগাল, ‘জলদি এখন আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলে চলবে না।’

‘না, হুজুর।’ স্যাম হ্যালির হাতে লাগাম তুলে দিয়ে চাবুকটা এগিয়ে দিল। অ্যান্ডি তখন অন্য ঘোড়া দুটোকে খুঁটি থেকে খুলছে।

হ্যালি সবে জিনের ওপর চড়ে বসেছে কিনা সন্দেহ, তেজি ঘোড়াটা হঠাৎ স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠল, মনিবকে ছিটকে ফেলে দিল কয়েক হাত দূরে শুকনো ঘাসের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় চওড়া কানওয়ালা তালপাতার টুপিটা ঘঁষে গেল ঘোড়াটার চোখে। এতে তার রুক্ষ মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয়ে উঠল। নিমেষে প্রচণ্ড এক ধাক্কায় স্যামকে মাটিতে উল্টে ফেলে দিয়ে পেছনের পা দুটো বারকয়েক শূন্যে ছুড়ল, তারপর মুখের হ্রেষাধ্বনিতে মাঠ ভেঙে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল সামনের বন-বাদাড়ের দিকে।

অ্যান্ডি ইতোমধ্যে বিল আর জেরিকে খুলে দিয়েছিল। কী ভেবে তারাও হ্যালির ঘোড়াটার পেছন পেছন তীরবেগে ছুটতে শুরু করে দিল। ঘোড়াগুলোকে ধরার জন্য স্যাম আর অ্যান্ডি চিৎকার করতে করতে ছুটছে … কুকুরগুলো ভয়ঙ্করভাবে ডাকছে … মাইক, মোস, অ্যান্ডি, ফ্যানি, মিস্টার শেলবির অন্যান্য চাকর-চাকরানিরা তখন চারপাশে ভিড় জমিয়ে তামাশা দেখছে—উল্লাসে কেউ চেঁচাচ্ছে, কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউবা হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।

মাঠটা প্রায় আধমাইল লম্বা, তারপর চারদিকেই ক্রমশ ঢালু হতে হতে মিশে গেছে দূরে অরণ্যে। যেন বিপুল আনন্দে অচেনা অরণ্যের টানে ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে অনেক দূরে চলে গেল, তারপর এক সময় স্থির হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু স্যাম যখন চিৎকার করে তাকে ধরতে গেল, ঘোড়াটা অমনি ঘুরে একলাফে কয়েক হাত দূরে ছিটকে গেল। তার মসৃণ বলিষ্ঠ পেশিতে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। স্যাম আবার তাকে ধরতে গেল, অমনি দুজনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ধরা ছোঁয়ার খেলা। স্যাম যত চেঁচাচ্ছে, ঘোড়াটা যেন ততই মজা পেয়ে তাকে নিয়ে সারা মাঠময় ঘুরছে।

এদিকে হ্যালি নিষ্ফল আক্রোশে ছটফট করছে, আর সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই ধমকাচ্ছে। মিস্টার শেলবি বারান্দা থেকে বৃথাই চেঁচিয়ে ওদের পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন। মিসেস শেলবি নিজের ঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে এই মজার দৃশ্যটা উপভোগ করে মুচকি মুচকি হাসছে, পরক্ষণেই ভাবছেন হতভাগ্য মেয়েটির অদৃষ্টে কী লেখা আছে কে জানে।

অবশেষে বেলা যখন প্রায় বারোটা, স্যাম জেরির পিঠে চড়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে হ্যালির ঘোড়াটাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। ঘোড়াটার অবস্থা তখন রীতিমতো কাহিল। ঘামে ভিজে উঠেছে সারা দেহ, ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে, চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে।

‘আমি ধরেছি হুজুর!’ বুক ফুলিয়ে স্যাম বলল, ‘আমি ছাড়া আর অন্য কেউ আপনার ঘোড়াটাকে ধরতে পারত না।’

তোমার জন্যেই এই কাণ্ডটা ঘটেছে।’ চাপা গলায় হ্যালি গর্জে উঠল। আর কেউ হলে এমনটা ঘটত না।’

‘আমি? এ আপনি কী বলছেন, হুজুর!’ স্যাম যেন গাছ থেকে পড়ল। ‘আমারই জন্যে যদি এমন কাণ্ডটা ঘটবে, তাহলে মিছেমিছি ঘেমে নেয়ে মাঠময় ছুটোছুটি করে মরতে যাব কেন আপনিই বলুন?’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এমনিতেই আমাদের তিন ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর একটুও দেরি না করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়।’

‘কী বলছেন, হুজুর! আপনি কি আমাদের আর ঘোড়াগুলোকে মেরে ফেলতে চান নাকি? এখন একটু বিশ্রাম না নিলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারব না … ঘোড়াগুলোও বড্ড ঘেমে গেছে। তার ওপর জেরিটা যেভাবে খোঁড়াচ্ছে, ডলাই-মলাই না করে এমনি যদি এই অবস্থাতে ওকে নিয়ে যাই, গিন্নিমা কিন্তু ভীষণ রাগ করবেন। আমার মনে হয় হুজুর, একটু বিশ্রাম করে, খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা যদি বের হই তবু ওকে ঠিক ধরতে পারব। কেননা লিজি কোনোকালেই তেমন জোরে হাঁটতে পারে না।’

এমন সময় মিসেস শেলবি বারান্দা পেরিয়ে এসে হ্যালিকে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ জানালেন। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হ্যালির আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে উপায় ছিল না। ফলে মিসেস শেলবির সঙ্গে হ্যালিকে ভিতরে বসার ঘরটায় প্রবেশ করতে দেখে স্যাম ইশারায় অ্যান্ডিকে ডাকল, তারপর পরস্পরের গা টিপে দুজনে হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।

ঘোড়াগুলোকে আস্তাবলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে স্যাম অ্যান্ডিকে বলল, ‘মনে হচ্ছে আজ আমাদের কপালে খাওয়াটা বেশ ভালোই জুটবে।’

৭. মা ও ছেলে

টমের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর এলিজার চাইতে নিঃসঙ্গ আর বিধুর কোনো মানুষকে কল্পনা করা বা মানসিক অবস্থার বর্ণনা দেয়া সত্যিই খুব কঠিন।

এ পৃথিবীতে তার নিজের বলতে যেটুকু ছিল সেই নীড় ছেড়ে, এতদিনে যাদেরকে বন্ধুর মতো ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত, তাদের স্নেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজ সে কেবলই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। এতদিনের পরিচিত যত স্মৃতি একে একে যেন ভিড় করে আসছে। সেই গৃহকোণ, যেখানে সে এতদিন বাস করে এসেছে, কেটেছে তার শৈশব আর কৈশোরের অনাবিল দিনগুলো। সেই গাছের ছায়া, যার নিচে সে খেলা করেছে। সেই নিরালা উপবন, যেখানে উতলা সন্ধ্যায় সে স্বামীর সঙ্গে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছে : এইরকম আরো কত না অজস্র স্মৃতি। এখন নক্ষত্রখচিত এই হিমেল রাত্রি যেন তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভর্ৎসনার সুরে বলছে, ‘এ তুমি কী করছ, এলিজা! তোমার ঘর- দোর সংসার ফেলে কেউ এভাবে চলে যায়?’

কিন্তু অজানা ভয় আর বিপদের আশঙ্কার চাইতে একমাত্র সন্তানের প্রতি তার ভালোবাসা অনেক বেশি গভীর, অনেক প্রবল। তাই হ্যারিকে বুকের ওপর নিবিড় করে আঁকড়ে ধরে সে যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে চলেছে। অন্য সময় এলিজা তাকে কোল থেকে নামিয়ে হাঁটিয়েই নিয়ে যেত। কিন্তু এখন আর মুহূর্তের জন্যে সে ভরসা পেল না, পাছে হ্যারিকে কেউ তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়।

তুষার ছাওয়া পথে ত্রস্ত পায়ের চাপে যখনি কোনো শব্দ হচ্ছে, আতঙ্কে তার বুক কেঁপে উঠছে, আর প্রতিটি ছায়ার সামান্যতম নড়াচড়ায় তার রক্তের স্রোত যেন হিম হয়ে আসছে। তবু একএক সময় সে অবাক হয়ে ভাবছে এতো শক্তি সে পেল কোথা থেকে? কেননা গলা জড়িয়ে থাকা ছেলেটার ভার তার কাছে মনে হচ্ছে পালকের মতো হালকা। আর অজানা ভয়ে শিউরে ওঠার প্রতিটা ক্ষণেই মনে হচ্ছে একটা অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে সাহস যুগিয়ে চলেছে। তাই সারাক্ষণ শুকনো ঠোঁটে সে মনে মনে প্রার্থনা করছে, ‘হে ঈশ্বর, তুমি আমাদের রক্ষা কর!’

ঘুমে হ্যারির দুচোখের পাতা যখন বুজে আসছিল। প্রথমটায় ভয়ে আর উত্তেজনায় তার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কিন্তু মা যখন তাকে বুঝিয়ে বলল যে সে যদি কেবল শান্ত হয়ে থাকে তাহলে তাকে নিশ্চয়ই বাঁচাতে পারবে, হ্যারি তখন মার গলাটা আঁকড়ে ধরে চুপটি করে পড়ে রইল। শুধু ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, আমি কি জেগে থাকব?’

‘না, বাবা। তোমার যদি ঘুম পেয়ে থাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোও।’

‘কিন্তু মা, আমি ঘুমিয়ে পড়লে সেই লোকটা যদি আমাকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে যায়?’

‘না, বাবা। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। ঈশ্বর আমাদের নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন!’

‘তুমি ঠিক বলছ, মা?’

‘হ্যাঁ, সোনা।’

হ্যারি পরম নিশ্চিন্তে মার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

বিহ্বল একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে এলিজা মনিবের খামারবাড়ি, জমির সীমানা আর জঙ্গল পেরিয়ে এল, একের পর এক অতিক্রম করে গেল তার যত পরিচিত দৃশ্যাবলি। তবু তার চলার বিরাম নেই, শিথিলতা নেই হাঁটার গতিতে। এমনিভাবে মাইলের পর মাইল সে হেঁটে চলল। অবশেষে পুবের আকাশে যখন ধরল রাঙা আলোর ছোপ, পরিচিত সবকিছুকে পেছনে ফেলে সে পাকা রাস্তায় উঠল।

আগে মনিবানির সঙ্গে ওহিও নদীর ধারের একটা গ্রামে সে বেশ কয়েকবার এসে ছিল। ফলে গ্রাম থেকে নদীর তীর পর্যন্ত পথটা তার বেশ ভালোই চেনা। তাই মনে মনে পরিকল্পনা করেছে নদী পেরিয়ে প্রথমেই সে ওপারে পালিয়ে যাবে, তারপর তার অদৃষ্টে কী আছে একমাত্র অন্তর্যামীই জানেন।

ভোরের আকাশ রাঙিয়ে যখন সূর্য উঠল, ক্রমে ক্রমে রাজপথ দিয়ে একটা দুটো করে গাড়ি-ঘোড়া চলতে শুরু করল, এলিজার হঠাৎ তখন খেয়াল হলো, তার অবিন্যস্ত বেশবাস, রুক্ষমূর্তি, ত্রস্ত পথচলা লোকের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলতে পারে। তাই হ্যারিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে এলিজা জামা-কাপড় ঠিক করে নিল, অবগুণ্ঠনটাকে ভালো করে বসিয়ে নিল মাথার ওপর, তারপর হ্যারির হাত ধরে যতটা জোরে হাঁটলে কারো মনে সন্দেহ জাগবে না ততটা জোরেই হাঁটতে লাগল। এলিজার পুঁটলিতে কিছু কেক আর কয়েকটা আপেল ছিল। একসময় সে পুঁটলি থেকে একটা আপেল বার করে রাস্তার ওপর গড়িয়ে দিল আর হ্যারি সেটাকে ধরার জন্যে দৌড়ে গেল। এমনিভাবে দুজনে আরো মাইলখানেক পথ পেছনে ফেলে এল।

একটু বেলা বাড়ার পর ওরা দুজনে একটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল। জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসছে পাহাড়ি নদীর মৃদু কুলকুল শব্দ। হ্যারি তখন খিদে আর তেষ্টায় একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছিল। বেড়া ডিঙ্গিয়ে এলিজা ছেলেকে নিয়ে নদীর ধারে বড় একটা পাথরের আড়ালে গিয়ে বসল, যাতে চট করে কারুর নজরে না পড়ে। তারপর পুঁটলি থেকে কেক বার করে ছেলের হাতে দিল। কিন্তু মা কিছু খাচ্ছে না দেখে হ্যারি যখন একহাতে মার গলাটা জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে তার আধখাওয়া কেকটা মার মুখের দিকে নিয়ে গেল, এলিজা আর কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, কান্নায় বুজে এল তার গলার স্বর, ‘না না, আমাকে দিতে হবে না, তুমি খাও সোনামণি।’

‘নদীর ওপারে নিরাপদ কোনো জায়গায় তোমাকে নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি কি খেতে পারি? নাও, তাড়াতাড়ি কর। এখনো আমাদের অনেক পথ হাঁটতে হবে।’

দুজনে আবার শুরু করল পথ চলা। পরিচিত সবকিছুকে পেছনে ফেলে ওরা এখন অনেক দূরে চলে এসেছে। এলিজা আর হ্যারি দুজনেই দেখতে ঠিক শ্বেতাঙ্গদের মতো, ভালো করে লক্ষ্য না করলে ওরা যে নিগ্রো সেটা স্পষ্ট বোঝাই যায় না। ফলে ওদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সন্দেহ করার কেউ কোনো সুযোগই পেল না। দুপুরে খাওয়া- দাওয়া আর একটু বিশ্রামের জন্যে একজন চাষির খামার বাড়িতে আশ্রয় নিল, তারপর আবার পথ চলতে শুরু করল।

সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক আগে ওরা পৌঁছে গেল ওহিও নদীর ধারের সেই গ্রামটায়। ক্লান্ত শ্রান্ত এলিজার পা দুটো তখন ক্ষতবিক্ষত, তবু তার হৃদয় সংকল্পে দৃঢ়।

প্রথমেই তার চোখ পড়ল ওহিও নদীটার ওপর। নদীটা এলিজার আর ওপারের মুক্তির মধ্যে দিয়ে আপন মনে বয়ে চলেছে।

সবে বসন্তের শুরু। ঘোলা জলে নদীটা ফুলে ফেঁপে রয়েছে। তাতে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে বড় বড় সব তুষারের চাঁই। কেন্টাকির দিক থেকে ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া তুষার ছাওয়া তীরটা অনেকখানি বেঁকে একেবারে নদীর মধ্যে গিয়ে পড়েছে এবং দুপার থেকে নদীটাকে এমনভাবে ঢেকে ফেলেছে যে ওহিওর জলধারা প্রায় চোখে পড়ে না বললেই চলে। তুষারের বড় বড় চাঙড় ভরা নদীটাকে এখন মনে হচ্ছে এবড়ো-খেবড়ো বিশাল একটা ভেলার মতো।

নদীর এই অবস্থা দেখে এলিজা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। সে স্পষ্টই বুঝতে পারল এর মধ্যে দিয়ে খেয়া নৌকা চালানো সম্ভব নয়। খোঁজ খবর নেবার জন্যে নদীর ধারে যে ছোট সরাইখানাটা ছিল, এলিজা সেই দিকে এগিয়ে গেল।

সরাইখানার যিনি মালিক, সেই ভদ্রমহিলা রাতের রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এলিজার করুণ কণ্ঠস্বর শুনে উনি ফিরে তাকালেন। ‘কী ব্যাপার, কিছু বলছ বাছা?’

‘ওপারে যাবার কোনো খেয়া নেই?’

‘না, খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে।’

‘ওঃ।’

এলিজার ম্লান মুখ আর হতাশ চোখের দৃষ্টি দেখে ভদ্রমহিলা ব্যথিত হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ওপারে যেতে চাও কেন? কারুর কি অসুখ-বিসুখ করেছে? তোমাকে দেখে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।’

নদীর ওপারে আমার বড় ছেলে রয়েছে। তার অবস্থা খুব খারাপ। কাল রাতে খবর পেয়েই আমি এতখানি পথ হেঁটে এসেছি খেয়া ধরব বলে!’

‘সত্যিই বড় দুর্ভাগ্যের কথা!’ ভদ্রমহিলার মনে মাতৃস্নেহ উদ্বেল হয়ে উঠল।

‘তোমার জন্যে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে।’

তারপর জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উনি কাকে যেন ডাকলেন। একটু পরেই চামড়ার বহির্বাসপরা একটা লোককে দেখা গেল। তার হাত দুটো কালি ঝুলিতে ভরা। ওকে দেখে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আচ্ছা সোলেমন, তুমি কি জানো সেই লোকটাকে পার করার জন্যে আজ মাঝি কি খেয়া নিয়ে আসবে?’

‘ও বলেছে, সুবিধে হলে আপ্রাণ চেষ্টা করে দেখবে।’

‘আজ একটা লোকের ওপারে যাবার কথা আছে। রাত্তিরে সে এখানে খেতে আসবে। যদি সম্ভব হয় তুমিও তার সঙ্গে ওপারে যেতে পারবে। তুমি বরং ততক্ষণ এখানে একটু বিশ্রাম কর। বাঃ, তোমার ছেলেটাতো ভারি সুন্দর দেখতে!’

ভদ্রমহিলা একটা কেক হ্যারির হাতে দিলেন।

ক্লান্তি আর ভয়ে হ্যারি কাঁদছিল। এলিজা বলল, ‘আহা, বেচারির খুব কষ্ট হয়েছে। এমনিতে হাঁটার অভ্যেস নেই, তার ওপর আমি আবার ওকে দৌড় করিয়ে এনেছি।’

‘পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে ওকে শুইয়ে দাও।’

দরজা খুলে ভদ্রমহিলা ছোট একটা শোবার ঘর দেখিয়ে দিলেন। এলিজা হ্যারিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ তার হাত দুটো ধরে চুপচাপ বসে রইল। একটু পরেই হ্যারি ঘুমিয়ে পড়ল। এলিজার মনে স্বস্তি নেই। তার শিরায় শিরায় যেন আগুনের হলকা বইছে। ধরা পড়ার আগে যেভাবেই হোক তাকে নদীর ওপারে পৌঁছতেই হবে। বড় বড় তুষার-চাঙ্গড় ভরা ওহিওর ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ জলধারার দিকে এলিজা ব্যাকুল আগ্রহে তাকিয়ে রইল।

এদিকে মিসেস শেলবি হ্যালিকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানানোর সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে একটুও দেরি হবে না এবং হ্যালিকে শুনিয়ে শুনিয়ে সেইমতো চাকর- বাকরদের নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু মনিবানির মনের ভাব বুঝতে পেরে ওরা যতটা সম্ভব দেরি করেই খাবার পরিবেশন করল, যাতে এলিজার সন্ধানে বের হতে যত দেরি হবে এলিজা ততই নির্বিঘ্নে পালাতে পারবে।

খাওয়া-দাওয়ার পর মিস্টার শেলবি টমকে বৈঠকখানায় ডেকে পাঠালেন।

‘টম’, মিস্টার শেলবি কোমলস্বরে বললেন, ‘আমি তোমাকে এই ভদ্রলোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি এবং এই মর্মে একখানা খৎ লিখে দিয়েছি যে উনি যখনই চাইবেন তখনি তোমাকে উপস্থিত হতে হবে, নইলে আমাকে এক হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। উনি অন্য একটা কাজে আজ চলে যাচ্ছেন। সুতরাং আজকের দিনটা তুমি যা খুশি তাই করতে পার।’

মৃদুভাষে টম বলল, ‘ধন্যবাদ, হুজুর।’

‘কিন্তু খবরদার’ আঙুল উঁচিয়ে হ্যালি শাসাল। ‘অন্যান্য নিগ্রোদের মতো তুমিও যদি চালাকি শুরু করো, তাহলে কিন্তু তোমার মনিবকেই তার খেসারত দিতে হবে। পাই পয়সাটি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমি ওঁকে ছাড়ব না। আসলে কি জানো, আমি নিগ্রোদের একদম বিশ্বাস করি না। একটু আলগা পেলেই ওরা বান মাছের মতো পিছলে যায়।

‘কর্তা’, একেবারে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে টম মিস্টার শেলবিকে বলল, ‘আমার যখন আট বছর বয়স, আপনার মা, মাননীয়া গৃহকর্ত্রী আপনাকে আমার কোলে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘টম, এই তোর নতুন মনিব; একে তুই যত্ন করিস।’ তখন আপনার বয়স এক বছরেরও কম। এখন আপনাকে জিজ্ঞেস করি, সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমি কি আপনার কোনো কথা অমান্য করেছি? আপনার মতের বিরুদ্ধে যাবার কোনোরকম চেষ্টা করেছি?’

‘না টম, তুমি তা কখনো করো নি।’ মিস্টার শেলবি খুব বিচলিত বোধ করলেন। ওঁর চোখের কোণে তখন টলটল করছে দু-ফোঁটা অশ্রু। ‘সত্যি বলতে কি আমরা আবার তোমাকে ফিরিয়ে আনব। তারপর হ্যালির দিকে ফিরে অনুরোধ করলেন, ‘আপনি শুধু অনুগ্রহ করে একটু জানাবেন কার কাছে টমকে বিক্রি করলেন।’

‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই’, হ্যালি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। ‘এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’

.

বেলা দুটো। স্যাম আর অ্যান্ডি ঘোড়া তিনটেকে নিয়ে ফিরে এল। বিশ্রাম নিয়ে উপযুক্ত আহার পেয়ে ঘোড়াগুলো তখন রীতিমতো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

ঘোড়ার পিঠে উঠতে গিয়ে হঠাৎ হ্যালির কী খেয়াল হলো, স্যামকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তোদের মনিবের কোনো কুকুর নেই?’

‘অনেক কুকুর আছে, হুজুর।’ বিজয়ীর ভঙ্গিতে স্যাম বলল, ‘এই তো ব্রুনোই রয়েছে। তার গর্জন শুনলে আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদের নিগ্রোদের প্রত্যেকেরই একটা করে কুকুরছানা আছে।’

‘ওগুলো কুকুরছানা নয়, ইঁদুরের বাচ্চা।’

‘না হুজুর, গন্ধ শুঁকে ওরা চোরও ধরতে পারে।

‘কিন্তু তোদের মনিবের পালিয়ে যাওয়া নিগ্রোকে খুঁজে বার করার মতো নিশ্চয়ই কোনো শিকারি কুকুর নেই?’

‘কেন, এই তা আমাদের ব্রুনোই রয়েছে, স্যার …’

‘চুলোয় যাক তোদের ব্রুনো! নে নে, এখন চটপট ঘোড়ায় ওঠ।’ হ্যালি তাড়া লাগাল।

ইশারায় স্যাম অ্যান্ডির গা টিপল। অ্যান্ডি কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারল না। ব্যাপারটা লক্ষ করে চাবুক উঁচিয়ে হ্যালি ক্রদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।

গম্ভীর গলায় স্যাম বলল, ‘এই অ্যান্ডি, ইয়ার্কি মারিস না! দেখছিস না আমরা কত বড় একটা কাজ করতে যাচ্ছি?’

এরপর তিন জনেই ঘোড়ায় চড়ে বসল। মিস্টার শেলবির জমির সীমানার শেষপ্রান্তে এসে হ্যালি বলল, ‘নদীতে যাবার সোজা পথটাই ধরব। মনে রাখিস এখানকার কোনো পথই আমার অজানা নয়।’

‘নিশ্চয়ই’, স্যাম সায় দিল। ‘মিস্টার হ্যালি কিন্তু ঠিক জিনিসটাই আঁচ করতে পেরেছেন। কিন্তু স্যার, নদীতে যাবার তো দুটো রাস্তা আছে। একটা খারাপ, আর একটা ভালো, কোন রাস্তায় যাব?’

অ্যান্ডি অবাক হয়ে স্যামের মুখের দিকে তাকাল, কেননা কথাটা সে এই প্রথম শুনল। কিন্তু পরক্ষণেই রহস্যটা বুঝতে পেরে সে স্যামকেই সমর্থন করল। স্যাম বলল, ‘আমার মনে হয় লিজি খারাপ পথটা ধরেই গেছ। কেননা ওপথে স্বাভাবিকভাবে লোক চলাচল করে না বললেই চলে।

হ্যালি তেমন চতুর না হলেও, তার সন্দেহপ্রবণ মন, বিশেষ করে এ রকম একটা জটিল পরিস্থিতিতে, স্বাভাবিকভাবেই ইতস্তত না করে পারল না। তাই নিজের মনেই ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে অনেকটা স্বগত স্বরে সে বলল, ‘তোরা যদি মিথ্যেবাদী না হতিস, তোদের কথা আমি একবারেই বিশ্বাস করতাম!’

স্যাম দমে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ঠিক আছে কর্তা, আপনার যা ইচ্ছে তাই করবেন। আপনার যদি মনে হয়, বড় রাস্তা দিয়েই চলেন। আমাদের কাছে দুটো পথই সমান। তবে আমার মনে হয় বড় রাস্তা ধরে যাওয়াই ভালো।’

হ্যালি আগেরই মতো স্বগত স্বরে বলল, ‘আমার মনে হয় মেয়েটার পক্ষে নির্জন রাস্তা ধরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’

‘তাহলে তাই চলেন।’

‘কতক্ষণে সেই রাস্তাটায় পড়তে পারব?’

‘এই তো একটু আগে’, অ্যান্ডির দিকে চোখ ঠেরে স্যাম বলল। ‘আমার কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় হুজুর, খারাপ রাস্তাটা ধরে যাওয়া উচিত নয়। এ পথে আমি কখনো যাই নি। তাছাড়া রাস্তাটা এতো নির্জন যে আমরা যেকোনো সময় পথ হারিয়ে ফেলতে পারি। তখন যে কী হবে একমাত্র ঈশ্বর জানেন।’

‘তা হোক। আমি খারাপ রাস্তা ধরেই যাব।’

‘আমি নিজে যাই নি বটে, তবে শুনেছি রাস্তার মাঝে মাঝে খাঁড়ির ঠিক মুখে বেড়া দেয়া আছে। তাই না, অ্যান্ডি?’

অ্যান্ডি রীতিমতো মুশকিলে পড়ল। সে ‘হ্যাঁ’ বলবে না ‘না’ বলবে কিছুই বুঝতে পারল না। তাই সে বুদ্ধি করে এমন দু-একটা শব্দ ব্যবহার করল, যাতে হ্যাঁ বা না দুই-ই বোঝায় না।

হ্যালির মনে হলো তার খারাপ রাস্তাটা ধরেই যাওয়া উচিত। কেননা স্যামের মুখ দিয়ে ওই রাস্তাটারই কথা প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল। এখন সে কথা ঘোরাবার জন্যে বারবার ভালো রাস্তাটার গুণ আর খারাপ রাস্তাটার দোষ বর্ণনা করছে। সুতরাং কিছু দূর যাবার পর সামনে খারাপ রাস্তাটা দেখতে পেয়েই হ্যালি সেই দিকে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। স্যাম আর অ্যান্ডি তাকে অনুসরণ করতে লাগল। রাস্তাটা সত্যিই খুব পুরনো। এক সময়ে নদীতে যাবার এটাই একমাত্র পথ ছিল, কিন্তু নতুন একটা পাকা সড়ক হওয়ায় পথটা বহুকাল আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে এবং চাষিরা সত্যিই চলাচলের জন্যে মাঝে মাঝে জুলি কেটে বেড়া দিয়ে রেখেছে।

অ্যান্ডি না জানলেও স্যামের কাছে পথটা অজানা ছিল না। তাই সে অনুগত ভৃত্যের মতো হ্যালিকে অনুসরণ করছিল আর থেকে থেকে কেবলই অনুযোগ করছিল, ‘উঃ, কী জঘন্য পথরে বাবা! এমনপথে কোনো মানুষ যেতে পারে। তার ওপর জেরির একটা পায়ে আবার চোট রয়েছে।

একেই পথটা খারাপ, তার ওপর স্যামের অনুযোগে হ্যালির মেজাজ আরো বিগড়ে যাচ্ছে। তাই প্রায়ই সে স্যামকে ধমক লাগাচ্ছে, ‘খবর্দার শয়তানি করবি না। আমি তোদের হাড়ে হাড়ে চিনি। তোরা কিছুতেই আমাকে এপথ থেকে ফেরাতে পারবি না সুতরাং গজগজ না করে মুখ বুজে চল।’

‘হুজুরের যা ইচ্ছে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলে স্যাম অ্যান্ডিকে চোখ টিপল। অ্যান্ডি বেচারিকে অতিকষ্টে হাসি চেপে রাখতে হচ্ছে।’ তাই শুনে হ্যালি উত্তেজিত হয়ে উঠছে, কিন্তু খারাপ রাস্তার জন্যে জোরে ঘোড়া ছোটাতে পারছে না। এমনিভাবে ঘণ্টাখানেক চলার পর তারা বেশ বড় একটা খামারবাড়িতে এসে পৌছল। খামারবাড়িটা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত, সেখানে কেউ থাকে না। তারা স্পষ্টই বুঝতে পারল এখান থেকে সোজা যাবার আর কোনো উপায় নেই, কেননা পথটা মাঠের মধ্যে এই খামারবাড়িতে এসেই শেষ হয়েছে। স্যাম বলল, ‘হুজুরকে কি আমি এ কথা আগে বলি নি? আমরা এই অঞ্চলে জন্মেছি, এখানেই বড় হয়েছি। এখানকার পথঘাট আমাদের ভালোই জানা।’

হ্যালি ধমকে উঠল, ‘উল্লুক, এ কথা তুই আমাকে আগে বলিস নি কেন?’

‘এ আপনি কী বলছেন হুজুর!’ চোখ বড় বড় করে স্যাম অবাক হবার ভান করল। ‘পথটা যে খারাপ আমি তো আগেই বলেছিলাম? আপনি কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করেন নি।

কথাটা অবশ্য একদিক থেকে সত্যি। তাই কোনোরকমে রাগ সামলে রেখে হ্যালি আবার রাজপথের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। স্যাম আর অ্যান্ডি সকৌতুকে তাকে অনুসরণ করল।

এমনিভাবে নানান কারণে একের পর এক দেরি হতে থাকায় নদীর ধারের সেই গ্রাম্য সরাইখানার ছোট ঘরটায় হ্যারিকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে হ্যালি সদলবলে সেখানে পৌঁছল। আনমনে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে এলিজা বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। স্যাম ছিল সবার আগে হ্যালি আর অ্যান্ডি ছিল কিছুটা পেছনে। ফলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এলিজার মূর্তিটা স্যামের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে নি। চোখের পলক পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালপাতার টুপিটাকে মাথা থেকে খুলে স্যাম এমনভাবে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল যে এলিজা হঠাৎ চমকে উঠে সেখান থেকে সরে গেল। আর ঠিক তখনি ওরা তিন জন জানালার সামনে দিয়ে তীরবেগে সরাইখানার সামনের দরজার দিকে ছুটে গেল।

সেই মুহূর্তে কোনো অমানুষিক শক্তি যেন ভর করল এলিজার দেহে। ঘরের একটা দরজা ছিল নদীর দিকে। চকিতে হ্যারিকে তুলে নিয়ে সেই দরজা দিয়ে সে নদীর দিকে ছুটে গেল। ছুটতে ছুটতে নদীর পাড়ের নিচে অদৃশ্য হয়ে যাবার সময় পলকের জন্যে হ্যালি তাকে স্পষ্ট দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে স্যাম আর অ্যান্ডিকে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে হ্যালি ছুটল নদীর দিকে। সেই মুহূর্তে ওকে দেখে মনে হলো ত্রস্ত কোনো হরিণীর পেছনে ছোটা ভয়ঙ্কর একটা শিকারি কুকুরের মতো। এলিজা ছুটছে। প্রাণপণে ছুটছে। বিহ্বলতার সেই মুহূর্তে মাটিতে তার পা ঠেকছে কিনা সন্দেহ। কয়েক পলকের মধ্যেই সে একেবারে জলের কিনারে এসে পড়ল। তার ঠিক পেছনেই হ্যালি, স্যাম আর অ্যান্ডি। এলিজা হঠাৎ ভয়ার্তকণ্ঠে চিৎকার করে খরস্রোতা নদীতে ভাসমান একটা তুষার পিণ্ডের ওপর লাফ দিল। প্রকৃতিস্থ কোনো মানুষ হলে কোনোদিনই এ কাজ করতে সাহস পেত না। কিন্তু এলিজা তখন মানসিক ধৈর্য হারিয়ে ফেলে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হ্যালি, স্যাম আর অ্যান্ডি তীরে দাঁড়িয়ে এলিজার কাণ্ড দেখে হাত তুলে চিৎকার করে উঠল। সবুজ শেওলাপড়া তুষারের বিশাল চাঁইটা এজিলার ভারে সহসা চিড় খেয়ে দুলে উঠল। এলিজা কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও ওটার ওপর দাঁড়িয়ে রইল না, তুষারের চাঁইটা ঘুরে স্রোতে ভেসে যাবার আগেই সে সামনেই অন্য আর একটাতে লাফিয়ে পড়ল। এমনিভাবে লাফিয়ে পিছলে ডিঙিয়ে একটা তুষারপিণ্ড থেকে আর একটা তুষারপিণ্ডের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে। পা থেকে জুতো মোজা আগেই খুলে গেছে, ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ছুঁইয়ে পড়ছে শুভ্র তুষারের ওপর। এলিজা কিন্তু সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না, কিংবা কিছু অনুভবও করছে না। সে অস্পষ্ট একটা স্বপ্নের মধ্যে দিয়েই সে ওহিওর অন্যপারে গিয়ে পৌছল আর দেখল কে যেন তাকে ডাঙায় টেনে তোলার জন্যে সাহায্য করছে।

‘তুই যেই হোস না কেন, বড় সাহসী মেয়ে তো!’ লোকটা স্তব্ধ বিস্ময়ে এলিজার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা কঠিন শপথ করল।

আগন্তুকের কণ্ঠস্বরে চোখ তুলে তাকিয়ে এলিজা লোকটাকে চিনতে পারল। এক সময়ে মিস্টার শেলবির বাড়ির কাছেই ভদ্রলোকের জমিজমা ছিল। ‘মিস্টার সাইমস! আপনি আমাকে রক্ষা করুন … ‘দয়া করে আমাকে কোথাও লুকিয়ে রাখুন।’ সজলচোখে এলিজা মিনতি করল।

‘কী ব্যাপার, তুমি শেলবির বাড়িতে কাজ করতে সেই মেয়েটা না?’

‘হ্যাঁ, মিস্টার সাইমস। তিনি আমার সন্তান, এই শিশুটাকে ওই লোকটার কাছে বেচে দিয়েছেন!’ কেন্টাকির পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যালির দিকে নির্দেশ করে এলিজা বলল, ‘একে বাঁচাবার জন্যে আমি পালিয়ে এসেছি।

‘সত্যিই তুই বড় সাহসী মেয়ে। এমন সাহসী যারা আমি তাদের পছন্দ করি।’

নদীর খাড়া পাড় থেকে মিস্টার সাইমস এলিজাকে ওপরে উঠে আসতে সাহায্য করলেন। ‘তোর জন্যে কিছু করতে পারলে সত্যিই আমি খুশি হতাম। কিন্তু আমার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তোকে নিয়ে যেতে পারি। তুই বরং এক কাজ কর! ওইখানে যা। সেটাই তোর পক্ষে সবচাইতে ভালো হবে।’ রাস্তা থেকে একটু দূরে, গ্রামের ভেতরে, সাদা রঙের বেশ বড় একটা বাড়ি দেখিয়ে মিস্টার সাইমস বললেন, ‘ওরা লোক ভালো। কোনো ভয় নেই, ওরা তোকে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। তাছাড়া এই ধরনের কাজে ওরা অভ্যস্ত। যদি কোনো অসুবিধে হয় বলিস, আমি তোকে পাঠিয়েছি।

‘আপনাকে ধন্যবাদ, মিস্টার সাইমস। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।’

‘না না, ওসব কথা বলিস না। আমি তোকে কোনো সাহায্যই করতে পারলাম না।’

‘আপনি আমার যা উপকার করলেন, একমাত্র ঈশ্বরই তা জানেন’, আন্তরিকতার সঙ্গেই এলিজা বলল।

‘নারে, পাগলি মেয়ে, না।’ এলিজার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বৃদ্ধ সাইমস বললেন, ‘তোর স্বাধীনতা তুই নিজে অর্জন করেছিস এবং তোকেই তা চিরকালের জন্যে আগলে রাখতে হবে। এর চাইতে বড় আমি আর কারুর কাছ থেকে কিছু আশা করি না।

এলিজা হ্যারিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দ্রুতপায়ে সেই বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল আর বৃদ্ধ সাইমস ওর গমন পথের দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলেন। ওপারে দাঁড়িয়ে হ্যালি স্তম্ভিত হয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। তাই গাছপালার আড়ালে এলিজা সম্পূর্ণ অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, তারপর স্যাম আর অ্যান্ডির দিকে ফিরে বলল, ‘সত্যিই ভাবা যায় না!’

স্যাম বলল, ‘যাই বলুন হুজুর, কাজটা ও কিন্তু ভারি অদ্ভুতভাবে করল!

‘মেয়েটার ভেতরে নির্ঘাৎ সাতটা শয়তান আছে!’ হ্যালি তখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারে নি। ‘বনবেড়ালের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এ-রকম ভয়ঙ্কর একটা নদী পার হয়ে গেল।’

‘বাপরে বাপ, সে কী যে সে লাফ!’ এমনভাবে কথা বলে স্যাম হাসতে লাগল যে হাসতে হাসতে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

‘এই উজবুক, দাঁড়া, তোর হাসি আমি বার করে দিচ্ছি!’ চাবুক উঁচিয়ে হ্যালি হুঙ্কার ছাড়ল। কিন্তু ধরতে পারার আগেই স্যাম আর অ্যান্ডি পিছলে সরে গেল, তারপর ছুটতে ছুটতে সোজা ঘোড়ার পিঠের ওপর।

‘বিদায় হুজুর।’ গম্ভীর গলায় স্যাম বলল, ‘গিন্নিমা হয়তো এতক্ষণ আমাদের কথা ভেবে ভেবে সারা হচ্ছেন। তাছাড়া লিজিকে খোঁজার জন্যে আশা করি কর্তার আর আমাদেরকে দরকার হবে না। চল অ্যান্ডি, এবার আমরা ফিরে যাই।’ এই বলে স্যাম অ্যান্ডির পাঁজরায় খোঁচা মারল, তারপর ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। দূর থেকে অস্পষ্ট ভেসে আসছে তাদের মিলিত হাসি আর ঘোড়ার খুরের শব্দ।

৮. সেনেটর বার্ড

সাইমস সাদা রঙের যে বড় বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছেন, এই বাড়িটা মিস্টার বার্ড নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সেনেটরের। খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো ঘর। ভেতরের বসার ঘরটা চুলার তাপে উত্তপ্ত, এই চরম শীতে দারুণ আরামদায়ক। টেবিলের ওপর রাখা ঝকঝকে চায়ের কাপ আর পেয়ালা পিরিচে লাল একটা আভা পড়ে ঝিকমিক করছে। কিছুটা রোগার ওপর ছিপছিপে চেহারায় মিসেস বার্ড যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি তিনি মিষ্টি স্বভাবের। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর তার আশ্চর্য মিষ্টি আর সুরেলা কণ্ঠস্বর। কয়েক দিনের অনুপস্থিতির পর স্বামীকে কাছে পেয়ে মিসেস বার্ড যে খুশি হয়েছেন, সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল।

‘তোমার শরীর ভালো আছে তো জন?’

‘শরীর আমার এমনিতে খুব ভালোই আছে মেরি, শুধু অসম্ভব ক্লান্তি, আর মাথাটা সামান্য ধরে আছে। আমার মনে হয় তোমার হাতের এক কাপ চা পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ হাসতে হাসতে মিস্টার বার্ড বললেন।

কাপে চা ঢেলে মিসেস বার্ড সবে যখন স্বামীর দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন, বহুদিনের পুরোনো চাকর কুজো এসে বলল, ‘মা, একবার যদি রান্নাঘরে আসেন খুব ভালো হয়।’

‘চলো যাচ্ছি।’

মিসেস বার্ড প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কুজোর সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। মিস্টার বার্ড চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবলেন নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে।

একটু পরেই দরজার ওপাশ থেকে স্ত্রীর কণ্ঠস্বর শোনা গল, ‘জন! জন! এদিকে একবার এসো না।’

খবরের কাগজটা রেখে দিয়ে মিস্টার বার্ড ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। রান্নাঘরে গিয়ে তিনি যে দৃশ্য দেখলেন অবাক না হয়ে পারলেন না। কৃষাঙ্গী একটি তরুণী দুটো চেয়ারের ওপর মূর্ছিত হয়ে পড়ে রয়েছে। বরফের কণায় ভরা ছিন্নভিন্ন পোশাক, একটা পায়ে জুতো নেই, মোজা দুটোই ছেঁড়া, ক্ষতবিক্ষত পায়ের গোড়ালি থেকে রক্ত ঝরছে। সুন্দর, অসম্ভব করুণ, অথচ পাথরে খোদা ওর আশ্চর্য মুখখানা ভালো করে লক্ষ করার পর মিস্টার বার্ড বুঝতে পারলেন এ মেয়েটি নিগ্রো। কিন্তু মানুষ কতো ক্লান্ত আর মরিয়া হলে তবেই এমন অবস্থা হতে পারে। কথাটা ভাবতেই মিস্টার বার্ড শিউরে উঠলেন। করুণায় ভরে উঠল তাঁর সারা মন। বজ্রাহাতের মতো দরজার সামনেই তিনি নির্নিমেষ চোখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর স্ত্রী আর নিগ্রো পরিচারিকা ডিনা মেয়েটির মূর্ছা ভাঙাবার চেষ্টা করছে। অদূরে বুড়ো কুজো শিশুটাকে কোলের ওপর বসিয়ে পা থেকে জুতো মোজা খুলিয়ে হাত দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে তার হিম হয়ে যাওয়া পায়ের পাতা দুটো গরম করার চেষ্টা করছে।

‘বেচারি মেয়েটার অবস্থা সত্যিই খুব কাহিল’, সস্নেহে ডিনা বলল। ‘আলো দেখেই বোধহয় ও এখানে এসেছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল একটু আগুন পোয়াতে পারবে কিনা। আমি সবে ওকে জিজ্ঞেস করতে যাব কোথা থেকে আসছে, তার আগেই দেখি আগুন পোয়াতে পোয়াতে হঠাৎ মূর্ছা গেল। হাত দুটো তো দেখে মনে হচ্ছে কখনো ভারি কাজ করতে হয় নি।

কিছুক্ষণ শুশ্রূষার পর এলিজা ধীরে ধীরে চোখ মেলল। তার উদাস সেই কালো চোখের দৃষ্টিতে কোনো অভিব্যক্তি নেই। কিন্তু পরক্ষণেই যন্ত্রণার ম্লান রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল তার সারা মুখে, চকিতে ছিটকে উঠে বেদনার্ত স্বরে সে বলল, ‘হ্যারি। আমার হ্যারি কোথায়? ওরা কি তাকে নিয়ে গেছে?’

হ্যারি তখনই কুজোর কোল থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।

‘ও, আমি এখানে!’ হ্যারির নরম চুলের মধ্যে মুখ ঢুবিয়ে এলিজা পরম তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করল।

‘বেচারি ‘

মিসেস বার্ডের অস্ফুট ধ্বনিতে চকিতে মুখ তুলে এলিজা বলল, ‘আপনি আমাদের রক্ষা করুন, ম্যাডাম। এই শিশুটিকে কিছুতেই ওদের ছিনিয়ে নিতে দেবেন না।’

‘ভয়, নেই, এখানে তোমার কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।’ আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে মিসেস বার্ড বললেন।

‘ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’ কথাটা বলেই এলিজা দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। হ্যারি বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মিসেস বার্ড নানাভাবে সান্ত্বনা দিয়ে তাকে শান্ত করলেন। আগুনের কাছেই তার জন্যে একটা শয্যা পেতে দেওয়া হলো। এলিজা অবিলম্বে হ্যারিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ল।

মিস্টার এবং মিসেস বার্ড আবার সেই ভেতরের বসার ঘরটাতে ফিরে এসেছেন।

দুজনেই তখন নিজের নিজের ভাবনায় মগ্ন। মিসেস বার্ড তাঁর ফেলে রাখা বোনার কাঁটা দুটো তুলে নিলেন, মিস্টার বার্ড চোখ বুলিয়ে চললেন খবরের কাগজটার ওপর একসময়ে কাগজটা সরিয়ে রেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়েটা কে কিছু জানতে পেরেছ?’

‘ঘুম ভাঙলেই জানতে পারব।’

‘আমার মনে হয় ওর কিছু গরমের পোশাক লাগবে।’

‘একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।’ বুনতে বুনতেই মিসেস বার্ড জবাব দিলেন।

বেশ কিছুক্ষণের জন্যে নেমে এল নিটোল নিস্তব্ধতা।

ঘণ্টা দুয়েক পরে ডিনা এসে জানাল মেয়েটির ঘুম ভেঙেছে। সে গিন্নিমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

‘চলো, যাচ্ছি।’

মিস্টার এবং মিসেস বার্ড দুজনেই রান্নাঘরে গেলেন।

আগুনের ধারে ছোট একটা টুলে বসে এলিজা গনগনে শিখাটার দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে রয়েছে। আগের উন্মত্ত ভাবটা কেটে গিয়ে এখন তাকে অনেক বেশি শান্ত আর করুণ দেখাচ্ছে।

‘তুমি আমাকে ডাকছিলে?’ কোমলস্বরে মিসেস বার্ড জিজ্ঞেস করলেন। ‘আশা করি এখন তোমার নিশ্চয়ই একটু ভালো লাগছে।’

জবাবের পরিবর্তে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলিজা কাতর চোখে এমনভাবে তাকাল যে ভদ্রমহিলার চোখে জল এসে গেল। উনি বললেন, ‘তোমার এখানে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা তোমার বন্ধু। কোত্থেকে আসছ, কী চাও বলো?’

‘আমি কেন্টাকি থেকে আসছি।’

‘কখন বেরিয়েছিলে?’ এবার মিস্টার বার্ডই প্রশ্ন করলেন।

‘কাল রাত্তিরে।’

‘তুমি এখানে কেমন করে এলে?’

‘বরফের ওপর দিয়ে নদী পেরিয়ে।’

‘বরফের ওপর দিয়ে নদী পেরিয়ে!’ ঘরের প্রতিটি মানুষই একসঙ্গে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল।

‘হ্যাঁ, ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করেছেন।’ মৃদু অথচ দৃঢ়ভাবে এলিজা ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল। ‘ওরা ছিল আমার ঠিক পেছনেই। তাই এভাবে পালিয়ে আসা ছাড়া আমার আর অন্য কোনো উপায় ছিল না।’

‘কিন্তু এখন নদীর চেহারা যে কী ভয়ঙ্কর আপনি ভাবতেও পারবেন না, মা!’ ভয় জড়ানো স্বরে কুজো বলল। ‘বরফের চাঁইগুলোতে এখন ভাঙন ধরেছে। বড় বড় চাঙড়গুলো ফাটছে, ঘুরছে, তারপর তীরের মতো স্রোতের বেগে ভেসে যাচ্ছে।’

‘জানি’, মৃদুস্বরে এলিজা বলল। ‘নদীটা যে পেরিয়ে আসতে পারব, আমি নিজেই ভাবতে পারি নি। কিন্তু তখন আমার মরা বাঁচার কথা একবারও মনে পড়ে নি। ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করেছেন। লোকে জানে না যে নিজে থেকে চেষ্টা করলে ঈশ্বর কতো সাহায্য করেন

মিস্টার বার্ড জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি ক্রীতদাসী?’

‘হ্যাঁ, স্যার। আমি একজন কেন্টাকিবাসীর ক্রীতদাসী।’

‘তিনি কি তোমার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন?

‘না, স্যার। মনিব হিসেবে তিনি সত্যিই খুব দয়ালু।’

‘তাহলে তোমার মনিবানি কি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন?’

‘না, স্যার। তাঁর মতো মিষ্টি স্বভাবের মহিলা এ পৃথিবীতে আর কেউ আছেন কিনা আমার জানা নেই। ‘

মিস্টার বার্ড খুবই অবাক হলেন।

‘তাহলে তাঁদের অমন সুন্দর আশ্রয় ছেড়ে বিপদের এতো ঝুঁকি নিয়ে তুমি পালিয়ে এলে কেন?’

মিসেস বার্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে এলিজা ম্লানস্বরে বলল, ‘কোনো মা ছাড়া আমার ব্যথা আর কেউ বুঝতে পারবে না। আমার এই একটাই মাত্র সন্তান। আমার গর্ব, আমার শোকের সান্ত্বনা। একে ছাড়া একা আমি একটা রাতও কাটাতে পারব না। আমার মনিব একে অন্য একটা লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন জানতে পেরে আমি ছেলেটাকে বুকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। মনিবের দুজন চাকরকে সঙ্গে নিয়ে সেই দাস- ব্যবসায়ীটা আমার পেছনে তাড়া করেছিল। ছুটতে ছুটতে আমি নদীর জলে বরফের ওপর লাফিয়ে পড়ি। তারপর কী করে যে নদী পেরিয়ে এসেছি আমি নিজেই জানি না, শুধু এইটুকু জানি একটা লোক আমাকে ডাঙায় টেনে তুলেছিল।’

এলিজার কথায় তখন অনেকেরই চোখে জল এসে গিয়েছিল।

একটু বিরতির পর মিস্টার বার্ড আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে তুমি কেন বলছিলে যে তোমার মনিব খুব দয়ালু?’

‘আমার মনিব সত্যিই খুব দয়ালু। কিন্তু দেনার দায়ে উনি বাধ্য হয়েছিলেন আমার ছেলেটাকে বিক্রি করে দিতে। মনিবানি অনেক আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না।’

‘তোমার স্বামী নেই?’

‘আছে, কিন্তু সে অন্য একটি লোকের ক্রীতদাস। তার মনিবটি খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির। মনিবটি তার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে। তাকে শাসিয়ে রেখেছে খুব শিগগিরই দক্ষিণ দেশে বিক্রি করে দেবে। আমার মনে হয় তাকে আর কোনোদিনও দেখতে পাব না।’

শান্ত, ম্লানস্বরে কথাগুলো বললেও এলিজার দীর্ঘায়ত কালো চোখ দুটোর দিকে তাকালে স্পষ্টই বোঝা যায় তার বুকের অতলে কোথায় যেন একটা চাপা ক্ষোভ জমে রয়েছে।

মিসেস বার্ড জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন তুমি কোথায় যেতে চাও?’

‘কানাডায়। কিন্তু আমি জানি না জায়গাটা কোথায়। ওটা কি এখান থেকে অনেক দূরে?

—তুমি যতটা ভাবছ, তার চাইতে অনেক অনেক দূরে। তবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চয়ই ভেবে দেখব তোমাকে কতটা সাহায্য করতে পারি। ডিনা, আজ রাতের জন্যে তোমার ঘরে ওর একটা বিছানা করে দাও। তারপর কাল সকালে উঠে দেখা যাবে কী ব্যবস্থা করা যায়।’

স্বামী স্ত্রী দুজনে আবার বসার ঘরটায় ফিরে এলেন। মেয়েটার ব্যাপারে দুজনেই যে বিচলিত বোধ করছেন সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল। পায়চারি থামিয়ে মিস্টার বার্ড এক সময় বললেন, ‘যেভাবে হোক আজ রাতেই ওকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। লোকটা নিশ্চয় দলবল নিয়ে কাল সকালেই এখানে হানা দেবে। মেয়েটা একা হলে হয়তো লুকিয়ে রাখা অসুবিধে হতো না, কিন্তু ওই বাচ্চাটাকে সামলে রাখা মুশকিল হবে। দরজা জানালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে কখন উঁকি-ঝুঁকি মারবে, তখন দুই জনেই ধরা পড়ে যাবে। আমার মনে হয় আজ রাতেই ওদের সরিয়ে ফেলা দরকার।’

কিন্তু জন, এতো রাত্তিরে সেটা কেমন করে সম্ভব? আর তুমি ওদের নিয়ে যাবেই বা কোথায়?’ মিসেস বার্ড উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।

‘তুমি কিছু ভেব না, মেরি ওসব আমার বেশ ভালোই জানা আছে।’

কালক্ষেপণ না করে মিস্টার বার্ড আবার তার বুটজোড়া পায়ে গলাতে শুরু করলেন। মিসেস বার্ড স্পষ্টই বুঝতে পারলেন—স্বামী যখন একবার মনস্থির করে ফেলেছে, তখন আর কোনো শর্তেই তাকে ফেরানো যাবে না। তাই মিছিমিছি চেষ্টা না করে তিনি বরং স্বামীকে বাইরে বেরুনোর পোশাক পরতে সাহায্য করলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলাবন্ধটা ভালো করে আঁটতে আঁটতে মিস্টার বার্ড বললেন, ‘ভ্যানক্রম্প নামে আমার একজন পুরনো মক্কেল আছে। ওই লোকটাও কেন্টাকির। সেখানে তার যত ক্রীতদাস- দাসী ছিল, সবাইকে মুক্তি দিয়ে সে এখানে একটা জায়গা কিনেছে। জায়গাটা এখান থেকে সাত মাইল দূরে পাহাড়ের ওপারে একটা জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে যদি মেয়েটাকে একবার নিয়ে যেতে পারি তাহলে আর কোনো ভয় থাকবে না। কেননা ওদিকে তেমন একটা কেউ যায় না। তবে মুশকিল হচ্ছে এই রাতে আমি ছাড়া আর কেউ সেখানে গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবে না।

‘কেন, কুজো তো খুব ভালো গাড়ি চালাতে পারে?’

‘নিশ্চয়ই কুজো ভালো চালাতে পারে। কিন্তু রাস্তাটা খুব খারাপ। এতো বাঁকা, চড়াই- উৎরাই আর খানাখন্দে ভরা যে অচেনা লোকের পক্ষে এখন গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। হিসেবে একটু ভুলচুক হলেই নির্ঘাত মৃত্যু। আমি বহুবার ও পথে ঘোড়ায় চড়ে গেছি, তাই রাস্তা আমার জানা। ফলে আমাকেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

‘তবু তুমি কুজোকে সঙ্গে নিয়ে যাও। ওইরকম একটা ভয়ঙ্কর পথে একা যেও না, লক্ষ্মীটি!’ মিসেস বার্ড মিনতি করলেন।

‘নিশ্চয়ই আমি কুজোকে সঙ্গে নিয়ে যাব। আর ভেবেছি ফেরার সময় অন্যপথে ফিরব, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। তাই ফিরতে আমার একটু দেরি হবে। তুমি যেন আবার আজেবাজে কিছু ভাবতে বসো না।’

‘আচ্ছা গো, আচ্ছা। আমার কথা তোমাকে এখন ভাবতে হবে না। দাঁড়াও, আমি তোমার ওভারকোটটা এনে দিচ্ছি।

ওভারকোটটা এনে মিসেস বার্ড নিজেই স্বামীকে পরিয়ে দিলেন।

‘আমি কুজোকে গাড়িটা জুততে বলছি। তুমি বরং মেয়েটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো। আর যদি পার ওর সঙ্গে কিছু গরম জামা কাপড়ও দিয়ে দিও।’

প্রস্তুতিপর্ব মিটতে খুব একটা সময় লাগল না। মাথায় বনেট আর জড়ানো শাল গায়ে এলিজাকে দরজার সামনে দেখা গেল। মার কাঁধে মাথা রেখে হ্যারি ঘুমিয়ে একেবারে কাদা হয়ে রয়েছে। অন্ধকারেই মিস্টার বার্ড ওদের তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠতে বললেন, তারপর নিজে গিয়ে বসলেন চালকের আসনে। কুজো দাঁড়িয়ে রইল পাদানিতে। বিদায়ক্ষণে মিসেস বার্ড এলিজার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। এলিজা গাড়ির মধ্যে থেকে ঝুঁকে সুন্দর নরম হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে জড়িয়ে ধরল, কালো চোখের আয়তদৃষ্টি মেলে তাকাল মমতাময়ী মূর্তিটার দিকে—কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও সে কোনো কথা বলতে পারল না, কেবল কান্নায় ফুলে ফুলে ওঠা ঠোঁট দুটো মৃদু নড়ে উঠল। অবশেষে অশেষ কৃতজ্ঞতায় ভরা এমন বেদনার্ত দৃষ্টিতে ঊর্ধ্বপানে সে তাকাল, যেকোনো মানুষের পক্ষে সে চোখের ভাষা ভোলা সম্ভব নয়। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে সে গাড়ির অন্ধকার কোণে নিজেকে হারিয়ে দিল। মিসেস বার্ড দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। গাড়িটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল।

রাস্তাটা যে কী ভীষণ খারাপ তা একটু পরেই বোঝা গেল। সমতলভূমির তুলনায় পাহাড়ি পথটা অনেক বেশি সংকীর্ণ আর পঙ্কিল। তুষারে খানা-খন্দগুলো এমনভাবে ভরে রয়েছে, যে ওপর থেকে অন্ধকারে বোঝবার কোনো উপায় নেই। ফলে প্রতি মুহূর্তেই গাড়িটা হেলছে, দুলছে, ঢাকা থেকে বিশ্রী একটা ক্যাচ-কোঁচ শব্দ উঠছে। অবস্থা সব চাইতে সঙ্গীন হয়ে উঠছে যখন কোনো একটা চাকা গভীর গর্তের মধ্যে পড়ছে। গাড়িটা তখন এমনভাবে একপাশে হেলে পড়ছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি উল্টে যাবে। কখনো কখনো ঘোড়ার পা এমনভাবে কাদার মধ্যে বসে যায় যে বেচারিরা টেনে তুলতেই পারছে না। যদিও কুজো পেছনের পাদানি থেকে ঘোড়াগুলোকে পরিচালনা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তবু সম্ভবত ভয় পেয়ে ঘোড়াগুলো একেবারে সিঁটিয়ে রয়েছে। হ্যারি ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করেছে। যখনই গাড়িটা একপাশে হেলে পড়ছে, দুজন দুজনের গায়ে আছড়ে পড়ছে, যখনই লাফিয়ে কোনো গর্ত পেরোবার চেষ্টা করছে, পেছনের আসনে দুজনে ছিটকে লাফিয়ে উঠছে। একবার তো মিস্টার বার্ড আর কুজোকে গাড়ি থেকে নেমে দুজনের যৌথ প্রচেষ্টায় পেছনের একটা চাকাকে গভীর গর্ত থেকে টেনে তুলতে হলো। আর একবার মিস্টার বার্ডের মাথা থেকে ছিটকে পড়া টুপিটাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তবে পাওয়া গেল। অন্ধকারে পিছল পাহাড়ি বাঁকগুলো সত্যিই বিপজ্জনক। এমনিভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা চলার পর, নানান দুর্ঘটনা এড়িয়ে ওরা যখন গন্তব্যে পৌঁছল, তখন প্রায় নিশান্তিকা। ঘোড়া দুটো রীতিমতো হাঁফাচ্ছে, ক্লান্ত শান্ত হয়ে হ্যারি আবার ঝিমিয়ে পড়েছে মার কোলের মধ্যে। নামার পর দেখা গেল গাড়িটা বিশাল একটা খামার বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়ির মালিক বৃদ্ধ জন ভ্যান ট্রাম্পকে জাগিয়ে তোলার জন্যে তেমন একটা কিছু ডাকাডাকি করতে হলো না। দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন, ছ’ফুটেরও ওপর লম্বা বিশাল চেহারার ছোটখাটো একটা দৈত্য বললেও চলে। গায়ে পশুর লোমের তৈরি শিকারির লাল কামিজ, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া পাকা চুল, গালে কয়েক দিনের না-কামান দাড়ি। সব মিলিয়ে এক নজরেই বোঝা যায় জন ভ্যান ট্রম্প অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এককজন মানুষ, যাঁর চেহারাটাই শুধু বিশাল নয়, হৃদয়টাও মহৎ।

লণ্ঠনের আলোটা তুলে ধরে মিটমিটে চোখে এমন রহস্যময় ভঙ্গিতে উনি আগন্তুকদের মুখের দিকে তাকালেন যে এমনটা ঘটবে তিনি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এবং সত্যিই, মিস্টার বার্ডকে ঘটনাটা তেমন বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলার কোনো প্রয়োজনও হলো না।

সেই বুড়োটা তার সাত ছেলেকে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।

‘আশা করি হতভাগ্য এই মেয়েটা আর তার বাচ্চাটাকে সেই শয়তান লোকটার হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবেন।’

‘আশা রাখি পারব।’

‘বলা যায় না, হয়তো কালই সেই লোকটা দলবল নিয়ে এসে হাজির হতে পারে।’

হাসতে হাসতে ভ্যান ট্রম্প বললেন, আমার ‘সাতটা ছেলে’। প্রত্যেকেই আমার মতো ছয় ফুটের ওপর লম্বা, চেহারাতেও কেউ কারুর চাইতে কম নয়। যদি ওদের সঙ্গে দেখা হয় বলবেন সেই বুড়োটা তার সাত ছেলেকে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।

‘ধন্যবাদ, মিস্টার ভ্যান ট্রাম্প।’

গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়া হ্যারিকে নিয়ে এলিজা কোনোরকমে তার ক্লান্ত শ্রান্ত দেহটাকে বাইরে বার করে আনল। বৃদ্ধ লণ্ঠনের আলোটা তার মুখের ওপর ফেলতেই বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, নিজের অজ্ঞাতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল বেদনাসূচক অস্ফুট কয়েকটা ধ্বনি। রান্নাঘর সুসংলগ্ন ছোট একটা শোবার ঘরের দরজা খুলে উনি এলিজাকে ভেতরে যাবার ইঙ্গিত করলেন, তারপর লণ্ঠনটাকে রান্নাঘরের টেবিলের ওপর এমনভাবে রাখলেন যাতে শোবার ঘরটা স্পষ্ট দেখা যায়!

‘এখানে তোমার কোনো ভয় নেই, মা। আশেপাশের যারা আমাকে চেনে, তারা খুব ভালো করেই জানে—আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে একটা মাছিও গলতে পারবে না। উনুনের ওপরকার তাকে সাজিয়ে রাখা সারি সারি রাইফেলগুলোর প্রতি উনি নির্দেশ করলেন। ‘তাছাড়া এসব ব্যাপারে আমি খুবই অভ্যস্ত। সুতরাং এটাকে তুমি নিজের বাড়ি মনে করেই এখন ঘুমিয়ে পড়।’ দরজাটা উনি পেছন থেকে সন্তর্পণে বন্ধ করে দিলেন। ‘মেয়েটা সত্যিই রূপসী আর স্বভাবটাও খুব নম্র। আমি জানি এই ধরনের মেয়েরা নিতান্ত বাধ্য না হলে কখনো বাড়ি থেকে পালায় না।’

মিস্টার বার্ড সংক্ষেপে ওর পালিয়ে আসার কারণ বর্ননা করলেন। বৃদ্ধ ভ্যান ট্রাম্প প্ৰায় মাঝপথেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি, মিস্টার বার্ড। এসব আমাকে আর কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না। সন্তানকে বাঁচাবার জন্যে যেকোনো মার পক্ষে এমন কাজ করাটাই স্বাভাবিক। আর ওরাও যে বুনো একটা হরিণীর পেছনে একপাল নেকড়ের মতো তাড়া করে ফিরবে, সেটাও অসম্ভব কিছু নয়। তবু মেয়েটাকে এখানে রেখে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

‘আমি আপনাকে খুব ভালো করেই জানি মিস্টার ভ্যান ট্রম্প। আর সেই জন্যেই একটুও দ্বিধা না করে এতখানি পথ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমি এখানে ছুটে এসেছি।’

‘আমার মনে হয় ভোরের আলো ফুটে না ওঠা পর্যন্ত আপনিও এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে যান।’ আন্তরিকভাবেই বৃদ্ধ ভ্যান ট্রম্প আহ্বান জানালেন। ‘আমি বরং স্ত্রীকে ডেকে দিচ্ছি, ও নিশ্চয়ই আপনার জন্যে একটা শয্যা করে দিতে পারবে।’

‘না না, অসংখ্য ধন্যবাদ! ওকে আর কষ্ট করে ডাকার কোনো দরকার নেই। আমাকে এই রাতেই ফিরে যেতে হবে।’

‘তাহলে চলুন আপনাকে একটা সোজা পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। যে পথে এসেছেন তার তুলনায় এই পথটা অনেক ভালো আর সময়ও বাঁচিয়ে দিতে পারবে বেশ খানিকটা।’

এবার কুজোই গাড়িটা চালানোর দায়িত্ব নিল, মিস্টার ভ্যান ট্রাম্প লণ্ঠন তুলে তাকে নির্দেশ দিতে লাগলেন। খামার বাড়ি অতিক্রম করে পথটা পাহাড়ের পিছনের ঢাল বেয়ে সোজা নিচের দিকে নেমে গেছে। এবং অল্পক্ষণের মধ্যে সত্যিই তাঁরা প্রায় সমতল ভূমিতে নেমে এলেন। সেখান থেকে এবার কোন দিকে যেতে হবে, পথের নিশানা বাতলে দিয়ে বৃদ্ধ ভ্যান ট্রম্প বিদায় জানালেন। মিস্টার বার্ড দশ ডলারের একটা নোট বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অনুগ্রহ করে এটা মেয়েটিকে দিয়ে দেবেন

‘ও, আচ্ছা … ঠিক আছে। বিদায়, মিস্টার বার্ড।

‘বিদায়, মিস্টার ভ্যান ট্রাম্প।’

৯. অজানার পথে

টম চাচার কুঠরির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক টুকরো মেঘলা আকাশ। তখনো ভালো করে ভোর হয় নি। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সমস্ত পরিবেশটা শোকতপ্ত মানুষের হৃদয়ের মতো কেমন যেন বিষণ্ণ। উনুনের সামনে ছোট টেবিলটায় ক্লো-চাচি পরিষ্কার একটা শার্ট ইস্ত্রি করছে আর মাঝে মাঝেই হাত দিয়ে চোখের জল মুছছে।

কোলের ওপর বাইবেলখানা খুলে রেখে টম চুপচাপ বসে রয়েছে। কিন্তু আজ তার পড়ায় কিছুতেই মন বসছে না, বারবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ছে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েগুলোর ওপর। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও, মনটা তার অসম্ভব কোমল আর ছেলেমেয়েদের ভালোও বাসে হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে। এ সময়ে উঠে ধীরে ধীরে শয্যার পাশে ছেলেমেয়েদের দিকে সে করুণ চোখে তাকিয়ে রইল, যেন বলতে চাইছে—‘এই শেষ, আর কোনোদিনও দেখা হবে না।’

ক্লো আর কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, টেবিলের ওপর বসে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

‘তবু যদি জানতে পারতাম ওরা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, লোক কেমন, তোমার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করবে, তাহলে নাহয় কথা ছিল … কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছুই জানতে পারলাম না! গিন্নীমা তো বলছেন দু-এক বছরের মধ্যেই তোমাকে আবার ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু তার আগেই ওরা হয়তো তোমাকে খাটিয়ে খাটিয়ে মেরে ফেলবে। আর কোনোদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে কিনা ঈশ্বরই জানেন।

‘কিন্তু ক্লো, এখানে যে ঈশ্বর, যেখানে যাচ্ছি সেখানে সেই একই ঈশ্বর রয়েছেন।’

‘নিশ্চয়ই রয়েছেন। কিন্তু তবু কত ভয়ঙ্কর সব ঘটনাই তো ঘটে।’

‘আমরা কিন্তু কেউই ঈশ্বরের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে পারি না, ক্লো।’ স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেবার জেন্যই টম বলল। ‘তবু তো ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ যে শুধু আমাকেই বিক্রি করা হয়েছে তোমাকে বা ছেলেমেয়েদের নয়। যা ঘটার শুধু আমারই ঘটবে, কিন্তু তোমরা এখানে নিরাপদে থাকতে পারবে। আমি জানি বিপদে জগদ্বীশ্বর আমাকে সাহায্য করবেন।’

বুকের অতলে বিষণ্ণতার প্রচ্ছন্ন একটা রেশ থাকলেও টমের নিটোল বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে কিন্তু তার আভাসটুকুও ধরা পড়ল না। টম এমনই এক ধরনের মানুষ, যার হৃদয় দুঃসাহসী কোনো পুরুষের মতো বিশাল, যে প্রিয়জনদের মুখ চেয়ে নিজের দুঃখকে হাসি মুখে সহ্য করতেও প্রস্তুত।

কিন্তু চিরকালই যে হাসিখুশি, সেই ক্লো-চাচির ধৈর্যের বাঁধ আজ ভেঙে গেছে। তাই কাঁদতে কাঁদতেই বেদনাহত স্বরে সে বলল, তবু আমি বলব, কর্তার উচিত হয় নি তোমাকে এভাবে বিক্রি করে দেওয়া। তুমি কোনো অন্যায় করো নি, কোনোদিন একটি বারের জন্যেও মুখের ওপর ‘না’ বল নি। নিজের বউ, ছেলেমেয়ের মুখের দিকে না তাকিয়ে তুমি গায়ের রক্ত জল করে ওঁর জায়গা জমি ব্যবসাপত্তর দেখাশোনা করেছ। ওনার উচিত ছিল অনেকদিন আগেই তোমাকে মুক্তি দেওয়া। তা না করে, কাউকে কিছু না জানিয়ে উনি আজ তোমাকে অচেনা একটা লোকের কাছে বিক্রি করে দিলেন। এখন তো দেখছি ঈশ্বর তোমার চাইতে ওঁকেই বেশি সাহায্য করছেন।

‘ক্লো’, টমের বুকের ভেতর থেকে কে যেন আর্তনাদ করে উঠল, ‘তুমি যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো, তাহলে ও কথা আর একবারও উচ্চারণ করো না! বলা যায় না, হয়তো আমাদের দুজনের এই শেষ দেখা। তবু আমি তোমাকে মিনতি করছি—মনিবের বিরুদ্ধে তুমি আমাকে কিছু বলো না। ছেলেবেলা থেকে আমি ওঁকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। ওঁকে আমি খুব ভালো করেই জানি। আজ ওঁর ব্যবহার তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত আমরা যেভাবে বেঁচেছি, উনি না চাইলে কোনোদিন কি সেভাবে বেঁচে থাকাটা সম্ভব হতো? আমি জানি নিতান্ত বাধ্য না হলে উনি কখনই এ কাজ করতেন না।’

‘হয়তো তোমার কথাই ঠিক, তবু আমি বলব উনি কাজটা ঠিক করেন নি।’

‘মাথার ওপর ঈশ্বর আছেন, যিনি সবকিছুই দেখছেন। ওঁর দৃষ্টি এড়িয়ে এ পৃথিবীতে কোনোকিছুই ঘটে না।’

‘কথাটা ঠিক, তবু মেয়েমানুষের মন তাতে স্বস্তি পায় না। অবশ্য এখন আর কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই’ ক্লো-চাচি উঠে পড়ল। ‘তোমার প্রিয় কয়েকটা খাবার বানিয়ে রেখেছি। সারা দিনে পেটে কিছু পড়বে কিনা কে জানে।’

সেদিনের জন্যে মিসেস শেলবি ক্লো-চাচিকে ছুটি দিয়েছিলেন। তাই আগের দিন রাত থেকে সে স্বামীর সবচাইতে প্রিয় খাবারগুলো বানিয়ে রেখেছিল, রান্না করেছিল সবচেয়ে ভালো মুরগিটা। উনুনের ওপরকার তাকে সাজানো ছিল যে রহস্যময় বোয়েমগুলো, বিশেষ কোনো উৎসব ছাড়া সেগুলোকে পাড়ার কথা কেউ কোনোদিন ভাবতেই পারত না, আজ ক্লো নির্দ্বিধায় সেগুলোকে নামিয়ে আনল।

টম খেতে বসল বটে, কিন্তু তার খাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। তাই একরকম না খেয়েই সে উঠে পড়ল। খাবারের অবশিষ্টাংশ শেষ করল তার ছেলেমেয়েরা। ইতিমধ্যেই তারা ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল এবং সুস্বাদু খাবারের মোহে ব্যাপারটার গুরুত্ব তেমন অনুভব করতে পারে নি। তাদেরই একজন একসময়ে হঠাৎ বলে উঠল, ‘মিসেস শেলবি আসছেন।’

‘উনি কিছুই করতে পারবেন না। মিছিমিছি এসে কী লাভ’, ক্লো নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল।

মিসেস শেলবি ঘরে ঢুকলেন। ক্লো ওঁর জন্যে একটা চেয়ার পেতে দিল। আজ তার ব্যবহার ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছুটা রুক্ষ। কিন্তু মিসেস শেলবি সেসব কিছু লক্ষই করলেন না। এখন ওঁকে রীতিমতো ম্লান আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।

‘টম, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি …’ কথাটা উনি শেষ করতে পারলেন না, কান্নার আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল কণ্ঠস্বর। রুমালখানা চেপে ধরলেন দাঁতের ফাঁকে।

এবার ক্লোও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ভেতরের চাপা ক্ষোভটা যেন অশ্রুবিন্দু হয়ে টুপটাপ টুপটাপ ঝরে পড়তে লাগল মাটিতে।

‘টম’, একসময় নীরবতা ভেঙে মিসেস শেলবিই প্রথম বলে উঠলেন, ‘তোমাকে দেবার মতো আমার কিছুই নেই। আর সামান্য কিছু টাকাপয়সা যদি তোমাকে দিইও, ওরা কেড়ে নেবে। কিন্তু ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে আমি শপথ করছি—তুমি যেখানেই যাও না কেন, আমি তোমার খোঁজ খবর নেব এবং আর্থিক অবস্থা একটু স্বচ্ছল হলেই আবার তোমাকে ফিরিয়ে আনব। তুমি মন খারাপ করো না, ঈশ্বরের ওপর আস্থা রেখ।’

ছোটদের মধ্যে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘মিস্টার হ্যালি আসছেন!‘

এবং তার কথা শেষ হতে না হতেই দরজায় একটা লাথির শব্দ শোনা গেল, খোলা দরজার সামনে দেখা গেল হ্যালির রুক্ষ মূর্তিটাকে। একেই শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তার ওপর ভোর-রাত থাকতে এতখানি পথ তাকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে হয়েছে, ফলে তার মেজাজ রয়েছে বিগড়ে।

চড়া গলায় বলল, ‘এই নিগার, তৈরি হয়েছিস?’ তারপরেই মিসেস শেলবিকে দেখে টুপি খুলে অভিবাদন জানাল।

টম প্রস্তুত হয়েই ছিল। কোনো কথা না বলি স্ত্রীর গুছিয়ে দেওয়া ভারী পেটরাটা সে কাঁধে তুলে নিল। তারপর নুতন মনিবের পেছন পেছন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ক্লো তার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে অদূরে দঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

মিসেস শেলবি হ্যালির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং এমন আগ্রহ ভরে উনি কথাগুলো বলছিলেন যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হ্যালিকে তার জবাব দিতে হচ্ছিল। মিসেস শেলবির প্রকৃত ইচ্ছে ছিল টমের বিদায়ক্ষণটিকে যতটা সম্ভব বিলম্বিত করে রাখা। ইতিমধ্যে বাড়ির অন্যান্য চাকর-বাকররা সব গাড়ির সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। শুধু প্রধান পরিচারক হিসেবে নয়, তাদের অভিভাবক হিসেবেও তারা টমকে যে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করত—তাদের সহানুভূতি আর বেদনা জড়ানো মুখগুলো না দেখলে কোনোদিনই বিশ্বাস করা যেত না। মেয়েরা আর ছোটরা নীরবে চোখের জল ফেলছে। সবচেয়ে আশ্চর্য—ক্লো-চাচির চোখে তখন এক ফোঁটাও জল নেই।

চাকর-বাকারদের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে হ্যালি গাড়ির কাছে পৌঁছে টমকে বলল, ‘এই, ওঠ।’

টম গাড়িতে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হ্যালি আসনের তলা থেকে একজোড়া বেড়ি বার করে টমের পায়ে পরিয়ে দিল। এতে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ মনে মনে খুবই আঘাত পেল।

মিসেস শেলবি বারান্দা থেকে বললেন, ‘আমি আপনাকে সুনিশ্চিতভাবে এই আশ্বাস দিতে পারি মিস্টার হ্যালি, আপনার এই সাবধানতা অবলম্বনের কোনো প্রয়োজন নেই।

‘সত্যি বলতে কী, জানেন ম্যাডাম, একবার এখান থেকে পাঁচশো ডলার খুইয়েছি, এখন আমি আর নতুন করে কোনো বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজি নই

টম চাপাস্বরে ক্লোকে বলল, ‘যাবার সময় মাস্টার জর্জের সঙ্গে দেখা হলো না। মনটা সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। তুমি ওকে আমার ভালোবাসা জানিও।

দু-তিন দিন আগে কয়েকজন বন্ধুরা মিলে জর্জ কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। টমের এই দুর্ভাগ্যের কথা সে বিন্দুবিসর্গও জানে না। মিস্টার শেলবিও কী যেন একটা ব্যবসায়িক কাজে খুব ভোরে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আর যাই হোক, তাঁর সব চাইতে পুরনো আর বিশ্বস্ত ক্রীতদাস টমের বিদায়ক্ষণে উপস্থিত থাকার মতো মনের জোর তাঁর ছিল না। তাই আগে থাকতেই তিনি মনে মনে পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। এমন সময়ে গ্রাম থেকে ফিরবেন যখন সমস্ত ব্যাপারটা মিটে যাবে।

গাড়িতে উঠে হ্যালি ঘোড়ার পিঠে চাবুক চালাল। গাড়িটা চলতে শুরু করল। বিষণ্ণ চোখে, অথচ মাথা উঁচু করে টম শেষবারের মতো চারদিকে তাকাল।

ধূলিধূসর পথে গাড়িখানা ছুটে চলেছে। পথের দুধার থেকে এক-এক করে মিলিয়ে যিাচ্ছে টমের পরিচিত দৃশ্যাবলি। এ সময়ে মিস্টার শেলবির জমির সীমানা পেছনে ফেলে গাড়িখানা রাজপথে উঠল। তাপরেও প্রায় মাইলখানেক পথ দিয়ে হ্যালি হঠাৎ একটা কামারশালার সামনে গাড়িটা দাঁড় করাল। পুরনো একজোড়া হাতকড়া বার করে কামারশালায় নিয়ে গিয়ে বলল, ‘এদুটো একটু বাড়িয়ে দাও তো, হে। ওই লোকটার কব্জির তুলনায় বড্ড ছোট হচ্ছে।’

.

চোখ তুলে তাকাতেই কামার অবাক হয়ে গেল। ‘এ যে দেখছি শেলবিদের টম! আশা করি মিস্টার শেলবি ওকে নিশ্চয়ই বিক্রি করেন নি?’

‘হ্যাঁ, করেছে।’ হ্যালি চটে উঠল।’

‘সত্যি, এ স্বপ্নেও ভাবা যায় না! তবে আমি আপনাকে জোর করে বলতে পারি স্যার, ওকে হাতকড়া পরাবার কোনো দরকার হবে না। ওর মতো সৎ আর বিশ্বস্ত লোক …‘

‘রাখো তো বাপু তোমার সৎ আর বিশ্বস্ত। ওরাই সবার আগে চোখে ধুলা দিয়ে খুব সহজে সটকে পড়ে। যার জন্যে পায়ে বেড়ি থাকা সত্ত্বেও হাতকড়াটা না পরানো পর্যন্ত আমি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। তুমি আর মিছিমিছি সময় নষ্ট না করে হাতকড়াটা বাড়িয়ে দাও তো দেখি।’

দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে টম বিষণ্ন মুখে চুপচাপ বসে রয়েছে। হঠাৎ সে ঝড় উড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসা ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেল এবং বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝে ওঠার আগেই মাস্টার জর্জ ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে তার গলাটা জড়িয়ে ধরল, তারপর গভীর আবেগে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

‘এটা অত্যন্ত হীন, নীচ কাজ! যে যাই বলুক, আমি পরোয়া করি না। আমি স্পষ্টই বলব—এ অত্যন্ত হীন, জঘন্য অপরাধ! আমি যদি বড় হতাম, ওঁরা কোনোদিনই এ কাজ করতে পারতেন না।’ বেদনায় ক্ষোভে জর্জ শেলবির গলার স্বর তখন কাঁপছে।

‘মাস্টার জর্জ, তুমি এসে খুব ভালোই করেছ। যাবার সময় তোমার সঙ্গে দেখা হয় নি বলে আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল।’

নাড়াচাড়ায় সামান্য একটু শব্দ হতেই জর্জের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল টমের পায়ে পরানো বেড়ি দুটোর ওপর।

‘এ কী! দাঁড়াও, আজ আমি বুড়ো শকুনটাকে মেরেই ফেলব।’

প্রচণ্ড ক্ষোভে ঘুসি পাকিয়ে তেড়ে যাবার আগেই টম জর্জের হাত ধরে টান দিল। ‘না না, জর্জ; লক্ষ্মীটি…শান্ত হও, আমার কথা শোনো। তুমি যদি লোকটাকে চটিয়ে দাও তাহলে আমার সত্যিই কোনো উপকার হবে না, বরং আরো ক্ষতিই হবে।’

‘বেশ, তোমার মুখ চেয়েই আমি ওকে কিছু বললাম না। কিন্তু সত্যিই বল তো, ব্যাপারটা কি অপমানকর নয়? তুমি বিশ্বাস করো টম চাচা, এসবের আমি কিছুই জানতাম না। বাড়িতে আমাকে কেউ কিছু বলে নি। লিঙ্কনদের সঙ্গে না গেলে আমি এমনটা কখনো ঘটতে দিতাম না। সমস্ত বাড়ি একেবারে লণ্ডভণ্ড করে তবে দিতাম।’

‘সেটা কিন্তু সত্যিই করা উচিত হতো বলে আমার মনে হয়, মাস্টার জর্জ।’

তুমি যাই বলো, আমি কিছুতেই ছেড়ে কথা কইতাম না! তাছাড়া এটা সত্যিই লজ্জাকর।’

‘ছিঃ, মাস্টার জর্জ … লক্ষ্মীটি, এমন করো না। তোমার সঙ্গে হয়তো আমার আর কখনো দেখা হবে না …’

‘না না, ওকথা বলো না, টম চাচা!’ দোকানের দিকে পিছন ফিরে জর্জ অদ্ভুত রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল। ‘টম চাচা, তোমার জন্য আমি এই ডলারটা নিয়ে এসেছি।’

‘এটা আমি তোমার কাছ থেকে নেওয়ার কথা কখনো ভাবতে পারি না, মাস্টার জর্জ।

‘কিন্তু এটা তোমার নিতেই হবে। আমি ক্লো চাচিকে বলেছি, ক্লো চাচি বলেছে এটার মধ্যে একটা ছেঁদা করে শক্ত সুতো দিয়ে তোমার গলায় বেঁধে দিতে, তাহলে আর কেউ দেখতে পাবে না। নাহলে জানতে পারলে ওই শকুনটা তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। সত্যি, ইচ্ছে করছে শয়তানটাকে একেবারে গুলি করে মেরে ফেলতে!’

‘না মাস্টার জর্জ, না; এতে আমার কোনো লাভ হবে না।’

‘তুমি জানো না, টম চাচা; আমার কিছুতেই রাগ যাচ্ছে না।’ কথা বলতে বলতেই জর্জ টমের গলায় ডলার সমেত সুতোটা বেঁধে দিল। ‘নাও, এবার তোমার কোটের বোতমটা এঁটে দাও। এটা যখনই তোমার নজরে পড়বে, মনে পড়বে আমি তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। ক্লো-চাচিকেও বলেছি তোমার কোনো ভয় নেই। বাবা যতদিন না তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি তাঁকে একেবারে অতিষ্ঠ করে ছাড়ব।’

‘না মাস্টার জর্জ, তুমি বাবাকেও এ সম্পর্কে কিছু বলো না।’

‘কেন, টম চাচা, এর মধ্যে খারাপের তো কিছু নেই?’

‘হয়তো নেই। কিন্তু আমি চাই তুমি খুব ভালো ছেলে হও। মার কথা শুনবে, দুরন্তপনা করবে না। একটা জিনিস মনে রেখ, ঈশ্বর সব ভালো জিনিসই দুবার করে দেন, কিন্তু মা দেন জীবনে মাত্র একবার। তুমি যদি একশো বছরও জীবিত থাক, তাহলে তোমার মার মতো অমন ভালো মানুষ আর একজনও দেখতে পাবে না। তুমিই তাঁর একমাত্র আশা-ভরসা, তাঁর সন্তান। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি—তুমি ঠিক তাঁর মতোই সুন্দর আর ভালো ছেলে হয়ে ওঠো, যাতে বাবা মা একদিন তোমার জন্যে গর্ববোধ করতে পারেন।’

‘তুমি দেখো টম চাচা, কথা দিচ্ছি, আমি সত্যিই খুব ভালো হব।’

জর্জের সুন্দর কোঁকড়ানো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে টম বলল, ‘এই তো লক্ষ্মী ছেলের মতো কথা। আর গুরুজনদের কখনো অশ্রদ্ধা করো না।’

‘কিন্তু তাঁরা যদি কোনো অন্যায় করেন?’

‘না জর্জ, তবু তুমি তাঁদের কখনো অমান্য করো না।’

এমন সময় হ্যালি কামারশালা থেকে হাতকড়া নিয়ে ফিরে এল।

তাকে দেখেই জর্জ বড়দের মতো গম্ভীর গলায় বলে উঠল, ‘এই যে সাহেব, শুনছেন। আপনি টম চাচার সঙ্গে যে ধরনের ব্যবহার করেছেন, আমি বাবা মার কাছে গিয়ে সব বলে দেব।’

নিতান্ত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতেই হ্যালি জবাব দিল, ‘স্বচ্ছন্দে গিয়ে বলতে পার।’

‘সারা জীবন ধরে জন্তু-জানোয়ারের মতো মানুষ কেনা-বেচা করতে আপনার লজ্জা করে না? আমার তো মনে হয় কাজটা সত্যিই জঘন্য।’

‘তোমার পূর্বপুরুষরা যখন ক্রীতদাস কেনা-বেচা করত তখন যদি দোষের না হয়ে থাকে, আমার বেলাতেই বা তা দোষের হতে যাবে কেন? তাছাড়া তোমার বাবা যখন বেচলেন তখন কোনো দোষের হলো না, আর আমার কেনার বেলাতেই যত দোষ!

‘বড় হলে এ কাজ আমি কখনো করব না। নিজেকে একজন কেন্টাকিবাসী হিসেবে ভাবতে আমার সত্যিই লজ্জা করছে।’ কথাগুলো বলে জর্জ সোজা গিয়ে তার ঘোড়ায় উঠল, তারপর পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘বিদায়, টম চাচা!’

‘বিদায়, মাস্টার জর্জ!’ প্রশংসার চোখে তাকিয়ে টম সস্নেহে জবাব দিল। ‘জগদীশ্বর তোমার মঙ্গল করুন!’

জর্জ ঘোড়া ছুটিয়ে দিতেই টমের সামনে থেকে তার সুকুমার মুখখানা অদৃশ্য হয়ে গেল। তার ঘোড়ার খুরের শব্দ যতক্ষণ শোনা গেল, টম নির্নিমেষ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল, যেন ঘোড়ার খুরের ওই শব্দটাই টমের প্রিয় আবাসভূমির শেষ স্মৃতিচিহ্ন। এক সময়ে সেই শব্দটাও মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার বুকের কাছে তখনো রয়েছে একটা উষ্ণ স্থান, যেখানে কিশোরের নরম দুটো হাত বেঁধে দিয়েছে ওই ডলারটাকে। বুকের ওপর সেই জায়গাটা টম হাত দিয়ে নিবিড় করে স্পর্শ করল।

গাড়িতে উঠে হ্যালি টমের হাতে হাতকড়া দুটো পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন তোকে যে কথাটা বলতে চাই খুব ভালো করে মন দিয়ে শুনে রাখ—তুই যদি বাঁকা পথে যাস, আমিও বাঁকা পথ ধরব। কেননা নিগারদের সবরকম চালাকিই আমার জানা আছে, আমার চোখে তুই ধুলো দিতে পারবি না। তবে আমার সঙ্গে তুই যদি ভালো ব্যবহার করিস, আমিও তোর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব। কেননা আমি সাধারণত নিগারদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না। কী বললাম বুঝতে পেরেছিস?’

কোনো কথা না বলে টম নীরবে শুধু ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *