২০. রমেশ সম্পর্কে আলোক-সম্পাত

২০

কিন্তু পাঁচু ভাদুড়ী রমেশ সম্পর্কে শিবনাথের কাছে আরো কিছু আলোক-সম্পাত করল।

‘মশাই, ওর পরামর্শমত কাজ করবেন না। ঘোড়েল লোক, আপনাকে, ডুবিয়ে মারবে।’

শিবনাথ ঢোক গিলে চুপ করে কথাগুলি শুনল।

‘ওর চা কাঠ ছাড়া অন্য ব্যবসা আছে। ও যে কতখানি শঠ, পাপী, তা দিনে দিনে টের পাবেন, সবুর করুন দেখবেন।’

বিকেলে রায়সাহেবের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার আগে মুখটা ভাল করে কামিয়ে নেবার মতলবে শিবনাথ সেলুনে ঢুকেছিল এবং কথায় কথায় পারিজাত ওরা কেন লোক প্রশ্ন করার সময় শিবনাথ রমেশের কথাটা তুলল।

‘মশাই চোরের সঙ্গে চোরের দোস্তি’। পাঁচু বলল, ‘ও তো ওর দলের লোককে আপনার মনিব করতে চাইছে।’

‘রমেশের বুঝি অনেক পয়সা আছে?’ শিবনাথ প্রশ্ন করল। প্রসঙ্গটা সে অন্যদিকে ঘোরাতে চেষ্টা করল।

‘রাতদিন চুরি করলে পয়সা হবে না কেন?’ পাঁচু শিবনাথের গালে সাবান ঘষতে ঘষতে বলল, ‘রায়সাহেব আর তার ছেলে রাতদিন চুরি করছে, ও-ও চুরি করছে। ওরা করছে পুকুর চুরি, আর রমেশ করছে খানা ডোবা।’ একটু থেমে থেকে পরে পাঁচু আবার বলল, ‘যত সব চিটিংবাজ, ওদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে আপনার কিছুই সুবিধে হবে না, আমি হলপ করে বলতে পারি। মদ খাই, কিন্তু মশাই সৎভাবে রোজগার করে খাই। ওরা অসদুপায়ে পয়সা কামিয়ে আপনার আমার সর্বনাশের চেষ্টা করছে।’

শিবনাথ আর কিছু প্রশ্ন করল না। কেবল সামনের কালো ফ্রেম বাঁধানো আরশির বুকে পাঁচুর কালো ঠোঁট-কাটা মুখটা রাগে বিদ্বেষে কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে দেখতে লাগল। ঠোঁট কবে কাটা গেছে শিবনাথের এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয়নি এবং কোনদিন করা হবে না, একটাও মনে মনে সে ধরে রেখেছিল।

‘অমলটা ভাড়া দিতে পারছে না বলে ওর ওপর অত্যাচার করছে। বলাইটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। দেখেছেন তো।’

শিবনাথ বলাই বা অমল সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করল না।

‘আপনি যেতে পারেন দেখা করতে, কিন্তু গিয়ে দেখুন সম্মানে ঘা দিয়ে ওরা কথা বলছে। এই রমেশই একদিন আপনাকে ঘা দিতে থাকবে, বলে রাখলাম। আরো দু’দিন মিশুন না।’

এক গালে সাবান মাখান শেষ ক’রে আর এক গাল ধরল।

‘কতক্ষণ বসেছিলেন ওর দোকানে?’ ভ্রূকুঞ্চিত করে পাঁচু হঠাৎ প্রশ্ন করতে শিবনাথ চমকে উঠল।

‘দশ-পনরো মিনিট। চা খেতে যতক্ষণ।’ শিবনাথ আধঘণ্টা সময় গোপন করল। পাঁচু বলল, ‘আমি ওর দোকানে যাওয়া-আসা করি, এটা সে পছন্দ করছে না, তার কারণ আমি তার সব বৃত্তান্ত জেনে ফেলেছি।’

একটু চুপ থেকে পাঁচু বলল, ‘নিজের ঘা ঢাকতে পাপ লুকোতেও আমার বদনাম গেয়ে বেড়াচ্ছে, আমার নাকি ভেনারেল ডিজিজ।’

ক্ষুরটাও রাগে কাঁপছিল, শিবনাথ গাল দিয়ে তা অনুভব করল।

পাঁচু বলল,–’পাজি-বদমায়েস তুই, আমার নামে বদনাম গাইতে আসিস। আমি যা করি দেখিয়ে করি, যা খাই তা লেবার করে খাই। লোকের মাথায় বাড়ি মারি না।

ক্ষুরটা প্রায় শিবনাথের গালে বসে গিয়েছিল। সবগুলো দাঁত বার করে ঠোঁটকাটা পাঁচু হঠাৎ হাসল : ‘ভয়ের কিছু নেইও আপনার লাগবে না। আমার হাতে আপনি মরবেন না।’

দুটো গাল বেশ পালিশ করে কামিয়ে দিয়ে পাঁচু শিবনাথের মুখে পাউডার মাখাল তারপর চুলটাতে চিরুনি বুলোল। ‘কিছু পুঁজি থাকে তো দুটো দিন সবুর করুন। আমি ওপরের দু’খানা কামরাই ভাড়া নিচ্ছি সামনের মাস থেকে। আপনি দোকান-টোকান একটা কিছু খুলে দিন। এই পায়ে-ধরা তোষামোদি করতে যাবেন না। ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। আর, সম্মান নেই।’ কাজ শেষ হয়ে গেছে। শিবনাথ উঁচু চেয়ারটা থেকে নেমে দাঁড়াল। হঠাৎ ভিতরে এসে ঢুকল বিধু মাস্টার। এক মাথা চুল, দাড়ির জঙ্গল গালে।

অসৎ এবং সৎ লোকের তফাতটা দেখাতে পাঁচু যথার্থ লোক হাতের কাছে পেয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ সে মাস্টারের দিকে একটা আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই ধরুন না আমাদের আর এক ভাড়াটে বিধুবাবু। একটা শিক্ষিত লোক। ইস্কুলের মাস্টার, মান্যগণ্য ব্যক্তি। রমেশ চণ্ডালটা ওকেই কি বাগে পেলে কম অপমান করে! বলুন না মাস্টার মশাই। সেদিন একটা টাকা ধার চাওয়ার পর রমেশ আপনাকে কি সব শোনাল।’

‘ছেড়ে দাও ভাই পাঁচু। মূর্খ আর পশু সমান। আমি রমেশটাকে একটা মানুষের মধ্যেই ধরি না। ওর আবার কথা কি, কি তার মূল্য। আস্ত ছাগল।’

শিবনাথ তৎক্ষণাৎ কাটতে পারল না। কিন্তু চুপ করে রইল। তাদের দুজনের কথায় যোগ দেবে না ঠিক করে আর কিছু প্রশ্ন করল না।

মাস্টার শিবনাথের দিকে তাকাল।

‘মশাই, হ্যাভস এন্ড হ্যাভ নট্স-এর লড়াই চলেছে এখন। বিদ্বান মূর্খের প্রশ্ন আজ অবান্তর। ক্লাশ থ্রি’র বিদ্যে নিয়ে ও আমাকে অপমান করবে না তো কি? চুরি-চামারি করে দুটো পয়সার মালিক হয়েছে যখন

একটু চুপ থেকে মাস্টার আবার বলল, ‘কিন্তু করুক না অপমান পাঁচু ভায়াকে। সৎপথে থেকে রীতিমত ম্যানুয়েল লেবার করে ভাল রোজগার করছে, ভবিষ্যতে আরো করবে। যদি ড্রিঙ্ক করে আর না ওড়ায় তো পাঁচুও এই ক্যানাল সাউথ রোডের কাছাকাছি জায়গা কিনে বাড়ি করতে পারে, সেই ক্ষমতা রাখে।’

‘রমেশ জায়গা কিনছে নাকি?’ কৌতূহল দমন করতে পারল না বলে নয়, একেবারে চুপ থাকাটা প্রতিপক্ষকে সমর্থন করার অর্থ দাঁড়াতে পারে চিন্তা ক’রে শিবনাথ মুখ খুলল। যদিও রমেশের কাছ থেকে এ-ধরনের ইঙ্গিত সে আগেই পেয়েছে।

কিন্তু বিধু মাস্টার বা পাঁচু শিবনাথের প্রশ্নের উত্তর দিল না।

‘শেখরকেও কিছু করতে পারবে না ও।’ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বিধু মাস্টার বলল, ‘ওষুধের নামে জল খাইয়ে হারামজাদা দু’হাতে রোজগার করছে বেশ।’ কথা শেষ করে মাস্টার হাসল।

‘অসতের শাস্তি আছে, দেখুন না আপনারা। কথায় বলে পাপ বাপকে ছাড়ে না।’

মাস্টার বা শিবনাথ কারো দিকে না তাকিয়ে পাঁচু ক্ষুর, বুরুশ ও নিজের হাত ধুয়ে পরিষ্কার করল। তারপর রাস্তার দিকে চোখ রেখে ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল।

.

রাস্তায় বেরিয়ে দুটো কথা জানতে না পেরে শিবনাথের ভয়ানক আফসোস হ’ল এবং হাসিও পেল।

মাস্টার হ্যাভস-এর দলে রমেশ, শেখর ডাক্তার এবং ভাল অর্থে পাঁচুকে ফেলেছে। হ্যাভ নটস-এর দলে ফেলেছে অমলকে, বলাইকে এবং নিজেকে।

বাড়িতে বাকি ছ’ঘর কোন্ দলে পড়ে? কে. গুপ্ত বেকার সুতরাং নটস-এর দলে। কিন্তু বিমল, কমলা নার্স, প্রীতি-বীথির বাবা ভুবনবাবু, প্রমথদের পরিবার এবং শিবনাথ?

শিবনাথ আর একদিন মাস্টারকে কথাটা জিজ্ঞাসা করবে। করবে কি। লোকটার সঙ্গে বেশি কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। ওর মুখের উৎকট্ পচা গন্ধটা প্রায়ই এসে নাকে লাগে বলে।

তারপর হাসি পেল মাস্টারের গালভরা পুরু দাড়ির কথা ভেবে। আজ কি ও মুখটা কামাবে, সেই মতলবেই সেলুনে ঢুকল? কিন্তু শিবনাথের মনে হ’ল না শনিবারের আধখানা স্কুল তাড়াতাড়ি শেষ করে হন্তদন্ত হয়ে বিধু মাস্টার দাড়ি কামাবার তাগিদে পাঁচুর দোকানে এসে ঢুকছে। বরং শিবনাথ যখন বেরিয়ে আসে, তখন পাঁচুর সঙ্গে মাস্টারকে আর একটা বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনায় ডুবে যেতে দেখেছে। ওপরের দুখানা ঘর নিয়ে পাঁচু কি করছে। ‘দোতালায় দোকান খুলে এতল্লাটে সুবিধে নেই। চাল ডাল কি মনোহারী দ্রব্য তো নয়ই, চায়ের দোকানও সুবিধা হবে না। ভাতের হোটেল মন্দ হবে না, কিন্তু সেই হিসেবে কামরা দুটো খুবই ছোট। কাজেই–’

‘পরিবার নিয়ে লোকে থাকবে সেই হিসেবে ভাড়া দিতে বলছেন আপনি?’ পাঁচু মাথা নেড়ে জানিয়েছে সেই লাইনেই সে চিন্তা করছে না। দু’মাস ভাড়া ঠিক পাওয়া যাবে। তারপর আরম্ভ হবে নটখটি। ‘হারামী’ ব্যাবসা। তার চেয়ে পাঁচু ঘর খালি ফেলে রাখবে, তবু ডেকে এনে সে-ধরনের ভাড়াটে বসাবে না। তা-ছাড়া বড় রাস্তার ওপর ঘর। উঠতি জায়গা। এখন এসব ঘর অন্যভাবে খাটাবার সময় এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করবার মতলবে কেউ যদি ভাড়া নিতে সাহস না পায়, পাঁচু গ্রাহ্য করবে না। তার অন্যরকম ইচ্ছা আছে।

‘কি শুনি না?’ চোখ দুটো বড় করে মাস্টার মশায়কে পাঁচুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেছে। ‘আমার কাছে তুমি ডিসক্লোজ করতে পার পাঁচু।’নীরব থেকে পাঁচু যখন সিগারেট টানছিল বেশ একটু অধৈর্য হয়ে হাত নেড়ে মাস্টার বলছিল, –’গরুগাধা ঠেঙ্গিয়ে মানুষ করার লাইনে আমি আছি সত্য, কিন্তু তোমাদের বলব কি ভাই, যতক্ষণই করি, ততক্ষণই করি, পড়াই, জাতির ভবিষ্যৎ বংশধরদের চোখে জ্ঞানাঞ্জন শলাকা ফুটাই। কিন্তু কি হয় তাতে, কি হল? এদেশে এই সেক্রিফাইসের কোনো মূল্য নাই। ষোল বছর মাস্টারি করে ক টাকা মাইনে পাচ্ছি আজ? তাই বলছিলাম, ওই যখন পড়ানো তখনই, তাছাড়া অন্য সময় ঘোড়ার ডিম; আমি এ-বিষয়ে চিন্তাও করি না। বরং বিজনেসের লাইনে মাথাটা একটু আধটু খেলাতে চেষ্টা করি। কিন্তু ক’রে করব কি। আমার পুঁজি নেই। কি মশাই, আপনাকে বলিনি ছেলেটাকে দিয়ে বেগুন কপির ব্যবসা করবার কথা ছিল?’ মাস্টার শিবনাথের দিকে একবার চোখ ফিরিয়ে পরে আবার পাঁচুর দিকে তাকিয়েছে। ‘মমতা সাধনার পড়াশুনা যে বেশিদিন চালাতে পারব, সেই ভরসাও পাচ্ছি না। অথচ মাথায় তো এক একটি তাল খেজুর গাছ হয়ে উঠল। আমার মনে হয় ছেলেদের চেয়ে মেয়ে সন্তানের গ্রোথ বাংলাদেশে বেশি। আপনার কি মনে হয়?’

আবার শিবনাথের দিকে চোখ ফিরিয়েছিল বিধু। শিবনাথ কিছু মন্তব্য করেনি। ‘তাই এক এক সময় যখন চিন্তা করি মাথা গরম হয়ে যায়। যাকগে– ‘পাঁচুর চুল কাটার যন্ত্রপাতিগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে মাস্টার বলছিল, ‘ওপরের দু’খানা ঘর রেখে বেশ বুদ্ধিমানের কাজ করেছে ভায়া। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম যদি আর কোনো ব্যবসা বা দোকান– টোকান স্টার্ট দাও তো বড় ছেলেটাকে ঢুকিয়ে দিই। তোমার সঙ্গে থেকে কাজ করুক, শিখুক। কি,–না আমার অত সম্মানবোধ নেই। কেন থাকবে। এদিনে থাকা উচিত নয়। কথায় বলে ডিগনিটি অব লেবার। কাগজে দেখছেন তো জহরলাল আজকাল বক্তৃতা দিতে শুরু করেই ম্যানুয়েল লেবার’

‘ম্যানুয়েল লেবার’ বলে চীৎকার করছেন। এটার ওপর আমারও শ্রদ্ধা আছে। দিন দিন যেমন বেকার সমস্যা বাড়ছে, কায়িক শ্রম ছাড়া আমাদের উপায় কি। তা ছাড়া পয়সা রোজগার নিয়ে কথা, কি বলেন আপনি?’

শিবনাথ নীরব হেসে মাথা নেড়েছে।

পাঁচু একটু অবাক হয়ে মাস্টারের কথা শুনছিল। ‘ছুরি-কাঁচি হাতে নিতে ছেলে রাজী হবে তো?’

‘হবে কি না-হবে জানি না। কিন্তু রাজী ছিলাম। রাজী হবে না গিন্নী। ও-ই তো সংসারটাকে ডোবালে আমার।

পাঁচু হাসল।

‘তবে আর একথা বলে লাভ কি?’

‘আহা’, প্রবল বেগে মাথা নেড়ে মাস্টার তৎক্ষণাৎ পাঁচুকে বোঝাতে চেষ্টা করল, ‘সেই জন্যই তো তোমায় জিজ্ঞেস করছিলাম, ছুরি-কাঁচি হাতে নিতে লজ্জা করে, কিন্তু দাঁড়িপাল্লা হাতে নিতে তো লজ্জা করবে না! যদি তাতেও রাজী না থাকো তো একজনের পিঠে আমি পায়ের খড়ম ভাঙব না? তখন তোমরা দেখবে। তাই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে ওপরের দু’খানা ঘর নিয়ে কি ধরনের ব্যবসায় হাত দেবার মতলব করছে ভায়া।

‘এখনো পাকাপাকি কিছু ঠিক করিনি। দেখা যাক্।’ সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ফেলে পাঁচু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে কি যেন চিন্তা করছিল।

ঘোলাটে অপরিচ্ছন্ন চোখ তুলে মাস্টার অত্যন্ত উৎসুকভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু পাঁচু কিছুতেই আসল মতলব প্রকাশ করল না। হয়তো শিবনাথকে এখানে দেখে ইতস্ততঃ করছে চিন্তা করে শিবনাথ দোকান থেকে বেরিয়ে পড়েছিল।

আলাপের এই পর্যন্ত শুনে এসেছে সে।

কিন্তু তারপর যে বিধু মাস্টার শেভ করার কথা তুলবে ভরসা করতে পারছিল না শিবনাথ।

পাঁচুর দোকানের সামনের কাঁচা নর্দমা থেকে একটা ঢাউস মাছি উড়ে এসে বিধু মাস্টারের গালের পুরু গালিচার ওপর চেপে বসেছিল।

তা-ও তখন খেয়াল ছিল না মাস্টারের। দৃশ্যটা মনে পড়ে শিবনাথ হাঁটা অবস্থায় হাসল দু’ তিনবার। এসব কথা চিন্তা করে সে খালপারের পিচঢালা ছায়ায় ঢাকা রাস্তাটায় হাঁটল কতক্ষণ। আজ শিবনাথের মন হাল্কা বেশি এই কারণে যে, আগের এক কাপ চায়ের দাম এবং আজকের চায়ের দাম সব সে মিটিয়ে দিয়ে এসেছে। এবং দু’দিনের দাড়ি কামানোর পয়সা। পঞ্চাশ টাকা হাতে তুলে দেবার পর শিবনাথ চাকরীর সন্ধানে ঘোরাফেরা করতে বেরোচ্ছে বলে দু’টো টাকা স্ত্রীর কাছে চেয়ে নিয়েছিল।

শহরে একবার যাবে কিনা ভাবছিল শিবনাথ। শিবনাথের ইচ্ছা করছিল না। ইচ্ছা হচ্ছিল তার খালের বুকের খেলনার টুকরোর মত নীলচে ঢেউগুলো ভেঙে কাঠবোঝাই খড়বোঝাই দু’টো বিশালকৃতি নৌকার গড়িমসি করে শহরের দিকে এগোতে থাকার দৃশ্য দেখে।

কিন্তু দাঁড়িয়ে দেখা তার হ’ল না।

.

ঘেচাং করে কালো রঙের বড় একটা গাড়ি তার প্রায় শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল গোলাপের কুঁড়ির মতন ফুটফুটে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। বলতে গেলে প্রায় একসঙ্গে এতগুলো শিশু প্রকাশিত হওয়ার প্রচ্ছন্ন বেদনা সহ্য করার পর বাংলাদেশের একটি মেয়ে এমন জীবন্ত সুন্দর থাকে কি করে, সেদিন চিন্তা করল শিবনাথ পারিজাতের স্ত্রী পারিজাতের পাশে দাঁড়িয়ে। বাচ্চাগুলোকে জলের ধারে পাঠিয়ে দিয়ে কাঠ ও খড়ের বৃত্তান্ত শুনে উৎসাহে বৈশাখী চাঁপার অগ্নিময় বিভা নিয়ে জ্বলছিল মেয়েটি।

পড়ন্ত রোদের আভায় টলমল করছিল দেহের যৌবন। তার চেয়ে ক্ষীণকায় পারিজাত। কিন্তু প্রফুল্ল। শিবনাথের কানের গোড়ায় একটা দু’টো চুল সাদা হয়ে গেছে, পারিজাতের তা-.. ও না। অত্যন্ত কচি, অফুরন্ত সজীবতা প্রতিটি চুলে।

খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল শিবনাথ, একসময় সঙ্কোচে একটু সরে দাঁড়াল। শিবনাথের মনে হল যেন বৃষ্টিধোয়া সদ্যফোঁটা কদম ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল তার চারপাশে।

মনিব ও মনিব-পত্নীকে দেখে নৌকার মাঝিরা চিনল। স্ফীতকায় নৌকা দু’টো দাঁড়িয়ে পড়েছিল খালের মাঝখানে।

তারপর নৌকা আবার চলতে লাগল।

শিশুরা জল ছুঁড়ে কলরব করতে করতে ফিরে এল।

পারিজাতগিন্নী যেন এতক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে বলছিলেন, ‘চলো চলো, আর পারি না। এদের নিয়ে কি একটু সময় একা থাকা যায়। আমার সব সুখ দস্যির দল কেড়ে নিয়েছে। চলে চলো গাড়ির গর্তে। তারপর গিয়ে ঢুকব তোমার হোটেলখানায়। আমি বলছি এখুনি ওদের পাঠিয়ে দাও একটা কনভেন্টে। আমি দিনকতক হাড় জুড়িয়ে বাঁচি। এরাও মানুষ হোক।’ পারিজাত হেসে গিন্নীর ক্লান্তি উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল। ‘একটা ডজ গাড়ি কেনা হচ্ছে কালপরশু। আর ভাবনা নেই। কাউকে সঙ্গে দিয়ে ওদের এখন থেকে বড় গাড়িতে বিকালে বেড়াতে পাঠাতে পারবে। ছোটটাকে নিয়ে বেরুব আমি আর তুমি। যতক্ষণ ইচ্ছা দু’জন একলা থাকতে পারব।’

মা ঘাড় ঘুরিয়ে দস্যিদের গাড়ির ভিতর ভব্য হয়ে বসা পরীক্ষা করছিলেন। তাই শিবনাথ স্বামীর সান্ত্বনার প্রতিক্রিয়ার ছায়াটা তাঁর মুখে দেখতে পেল না। গাড়িটা চলে যাওয়ারও অনেকক্ষণ পর শিবনাথ গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল। একটা মোষের গাড়ি যাচ্ছে তার গা ঘেঁষে। শিবনাথ আর দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটতে লাগল।

২১

রাত্রে প্রস্তাব শুনে রুচি চুপ ক’রে বসে রইল। তার ব্যবসা করা ছাড়া এ দিনে উপায় নেই। শিবনাথ বউবাজারের বন্ধুর দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিল। ঘর অন্ধকার।

মোহিত চাকরি ক’রে করত কি! সামান্য ফেরিওয়ালা থেকে এখন গাড়িবাড়ির মালিক। বন্ধু বেশ্যা নিয়ে থাকে, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি, এসব প্রকাশ করল না যদিও শিবনাথ। রুচি বলল, ‘হয়তো ছোট ব্যবসাও আরম্ভ করতে যে পুঁজি দরকার, মোহিতের সেটা ছিল, তাই ব্যবসাতে নামতে পেরেছিল। তোমার সে পুঁজিও নেই।’

মঞ্জুর কানে দুটো রিং এবং রুচির গাত্রাভরণের শেষ চিহ্ন গলার বিছা-হারটা। কিন্তু শিবনাথ মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহস পেল না। একটু সময় চুপ থেকে বলল, ‘না, এখন পুঁজি যোগাড় করা এখানে শক্ত। দিনকতক না গেলে, না থাকতে পারলে কারো কাছে লোন্-ফোনও পাওয়া যাবে না।’

‘তার চেয়ে এখন যদি জোটাতে পার দু’একটা ট্যুইশানিই করতে থাকো দেখি দু’একমাসের .মধ্যে! আমি আর একটা চাকরির দরখাস্ত ক’রে এসেছি আজ।’

‘কোথায়?’ শিবনাথ ঢোক গিলল। অন্ধকারে স্ত্রীর চেহারা দেখল না। ‘কোথায়?’

অবার সে প্রশ্ন করল।

‘আর একটা ইস্কুলে।’

‘অ, তোমার ইস্কুলের দিকেই ঝোঁক বেশি।’ শিবনাথ হাসল না। হাসির মতন গলার শব্দ হ’ল। ‘কোন্ স্কুলে?’

রুচি তৎক্ষণাৎ কথা কইল না।

শিবনাথও চুপ ক’রে গেল।

‘সম্মান রেখে স্কুল ছাড়া আর কোথাও মেয়েরা চাকরি করতে পারে না, কেউ পারছে না, কতদিন তো বক্তৃতা করেছ। এদিকেও। মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের বাসায়। না কি এখানে এসে মত বদলেছে তোমার?’

কথাটা সত্য বলে শিবনাথ অভিযোগ অস্বীকার করতে পারল না। একটু সময় চুপ থেকে পরে গলার সুর নরম ক’রে বলল, ‘আশ্চর্য, আমি তো সে-কথাই বলছি। স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও তোমার চেষ্টা করার প্রবৃত্তি হবে না। মরে গেলেও না। আমি এখনো বলছি। সেখানে বুঝি মাইনে বেশি? কত?’

‘কুড়ি টাকা বেশি।’

‘খুব ভাল। হবে কি?

‘তা বলা যায় না। চাকরি যাওয়া এবং চাকরি হওয়ার অনিশ্চয়তা এক।’

‘আমি জানি।’ শিবনাথ বলল, ‘তবু ধরা যাক সেই চাকরি তোমার হয়েই গেছে। ভালই হবে। আমি ভেবেছি একটা দু’টো ট্যুইশানি করব। এখানে ভালো লোক, বড়লোক অনেক আছে। ভাল পয়সা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াতে মাস্টার রাখে। আজ বিকেলে একটা খবর পেয়েছি। রমেশ রায় আমাকে বলল, পারিজাত-গিন্নী একজন প্রাইভেট টিউটর খুঁজছে।’

‘দেখা করতে গিয়েছিলে কি?’ রুচি প্রশ্ন করতে শিবনাথ তৎক্ষণাৎ বলল, ‘যাব।’ কাল আমার জামা-কাপড় ধুয়ে আসবে। ভাল পোশাক ছাড়া ওদের সামনে যেতে লজ্জা করে রীতিমত। কত বড়লোক!’

ব’লে শিবনাথ পারিজাতরে সংসারের উচ্ছলতা, স্বাস্থ্য, শ্রী ও সমৃদ্ধির একটি আলেখ্য রুচির সামনে তুলে ধরল।

সন্ধ্যার পর বেড়ানো শেষ করে দ্বিতীয়বার যখন সে রমেশের দোকানে খেতে গিয়েছিল, রমেশ তৎক্ষণাৎ একটা চিঠি লিখে নিজের নামটা তলায় বড় ক’রে সই ক’রে পারিজাত-গিন্নীর কাছে পাঠাতে চেয়েছে। শিবনাথ কাল যাবে বলে এসেছে। ওখানে তার হয়ে যাবে।

রুচি আর কথা বলল না।

শিবনাথ বলল, ‘এখন আমার ইচ্ছা ওই ভাল ট্যুইশানিটা যদি পেয়ে যাই এবং তোমারও সেটা হয়ে যায় তো শহরের দিকে আপাততঃ ঘর না খুঁজে ক’দিন কষ্টে-সৃষ্টে এই টিনের ঘরেই চালিয়ে যাব।’

একটু অবাক হয়ে রুচি প্রশ্ন করল, ‘তারপর?’

‘অতিরিক্ত ঘরভাড়া বাবদ যে টাকাটা যেত সেটা হাতে জমবে। বছর-খানেকের মধ্যেই ওটা ছোটো-খাটো একটা পুঁজি হয়ে দাঁড়াবে। আমার তো মনে হয়, আমি একটা দোকান– টোকান খুলে বসতে পারব। তাই করা উচিত। মানে বিজনেস্ ছাড়া বুদ্ধিমানেরা এখন অন্য কিছুর চেষ্টাই করছে না।

কিসের দোকান খোলার মতলব শিবনাথের মাথায় এসেছে রুচি প্রশ্ন করলে না যদিও। এবং বাকি রাত সে আর কথাই বলল না। শিবনাথের ঘুম পাচ্ছিল না। ছোট্ট ঘরের অন্ধকার মেঝেয় পায়চারি করতে করতে সে ভাবছিল, কাল বিকালে পারিজাতের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা। ওদের কথা উঠতেই এখন এই ঘরের গুমোট অন্ধকারেও শিবনাথের নাকে লাগল সদ্য বৃষ্টি-ধোয়া টাকা কদমের গন্ধটা।

এই গন্ধ তেল, স্নো, পাউডার, সাবান, আতর, এসেন্সে নেই। এ-গন্ধ থাকে ছেলেমেয়েদের জন্মের পরে কদমের মত অটুট-স্বাস্থ্য যুবতীর দেহে। বেগবতী নদীর মত দীপ্তিশালিনী দীপ্তি রায়ের গায়ের মধ্যেও এই গন্ধ এসে বাসা বেঁধেছে। যদি বলতে পারত শিবনাথ রুচিকে শান্তি পেত।

কিন্তু সেই শান্তির পথ রুদ্ধ ক’রে দিয়ে কমলাক্ষী গার্লস স্কুলের সেকেন্ড টিচার ঘুমোচ্ছে ক্লান্ত অবসন্ন। শিক্ষিকার ক্লান্তি, অবসন্নতা ভাঙাতে বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে এক সময় অন্ধকারে হঠাৎ দাঁড়িয়ে শিবনাথ চিন্তা করল পারিজাত এখন কি করবে। যদি দীপ্তি ঘুমিয়ে পড়ে তো স্ত্রীকে জাগাতে পারিজাত কোন্ ‘মেথড্’ অবলম্বন করবে। ওর যখন পয়সার অভাব নেই। স্ত্রীর অফুরন্ত যৌবন শেষ করতে ও যখন কোনো পন্থাই আর বাকী রাখছে না। তবু শেষ হচ্ছে কই। শিবনাথ মনে মনে হাসল আর ঈর্ষা করল অদৃশ্য দম্পতিকে।

.

কেবল বারো নম্বর না।

এগারো নম্বর ঘরেও আর একজন রাত জেগে পায়চারি করছিল।

কে. গুপ্তর স্ত্রী সুপ্রভা।

বেবি সন্ধ্যার পর আর বাড়িই ফেরেনি, কাজেই সন্ধ্যার চা-টুকু খাওয়া হয়নি সুপ্রভার। পায়চারি করতে করতে কি যেন নিজের মনে বিড়বিড় করছিল। সুপ্রভার মনে হচ্ছিল ওর জ্বর হয়েছে। নিজের নিশ্বাস নিজের কাছে গরম ও ভারী ঠেকছিল। একটু বাতাস লাগবে আশায় দরজার ছিটকিনি তুলে চৌকাঠের বাইরে গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে চুপ ক’রে থাকে। কেউ নেই। উঠোনটা অন্ধকার। কিন্তু কেউ থাকলেও সুপ্রভা কথা বলত না। এ বাড়িতে এসে কারো সঙ্গে কথা না ব’লে কে. গুপ্তর গিন্নী নিজের আভিজাত্য রক্ষা করেছে। সর্বস্ব হারিয়েও। যেন ওর কী আছে এখনো হারায়নি, এমন একটা ভাব ওর চোখে-মুখে দেখছে সবাই। অবশ্য সব সময় তারা তাকে দেখতে পেত না। বস্তির লোককে বার বার তার অসামান্য সুন্দর মুখখানা দেখাতেও ঘৃণা করে বৈকি।

তাই সুপ্রভা আঠারো ঘণ্টা শুয়ে ঘুমিয়ে কাটায়। আগে বই পড়ার অভ্যাস ছিল। এখন তা গেছে। এখন রামায়ণ কি মহাভারতের মত একটা কিছু সময় সময় পড়তে খোঁজে। কিন্তু মনে মনেই খোঁজা হয়। এ বাড়ির কাউকে কোনদিন ও জিজ্ঞেস করেনি সে-সব বই কারো ঘরে আছে কিনা। রামায়ণ মহাভারতের অভাবে অগত্যা হাত বাড়িয়ে একটা কাঠের বাক্সের ওপর থেকে বেবির ইস্কুলের পাঠ্য বাংলা বইখানা টেনে নিয়ে রমেশ দত্তের ‘সংসার’ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃত রচনাটা পড়ে। সেই তালগাছ ঘেরা কালো দীঘির জলে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় মেয়েকে তীরে দাঁড় করিয়ে জননীর স্নান করা, সর্বাঙ্গ শীতল করা আর জল থেকে মাথা তুলে তালপাতার সাঁই সাঁই শব্দ শোনা। বৈশাখের শুকনো খটখটে বাতাস

পড়া হয়ে গেলে সুপ্রভা বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে।

তাকিয়ে থেকে চিন্তা করে, মনে করতে চেষ্টা করে বেবি কোনদিন এই অংশটা পড়েছিল কিনা। কিন্তু সুপ্রভার মনে হয় পড়েনি। এ বইয়ের প্রথম গল্পটা সবে শুরু করেছিল। তা-ও শেষ হয়নি। তারপর আর বই খোলা হয়নি। বইটা তাই এখনো নতুন আছে। একদিন চাকর বাঞ্ছাকে দিয়ে সুপ্রভা বেবির সবগুলো বইয়ের মলাট লাগিয়ে দিয়েছিল। এবং প্রত্যেকটি মলাটের ওপর সুপ্রভা তার দামী ফাউন্টেন পেন দিয়ে বেবির পুরো নাম লিখে দিয়েছিল।

আর একটাও অবশ্য বই নেই ঘরে। রুণু; বেবি, কি স্বামীর, কারোর না।

এখানে আসার আগে ঘরের সমস্ত কাগজপত্র বই ওজন দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। এটাই দেয়নি বিক্রি করতে, ভীষণ আপত্তি করেছিল বেবি। বাপ-মার সঙ্গে ঝগড়া। সেই বই সকলের সঙ্গে বস্তিতে চলে আসে। এখন অবশ্য কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপর কে. গুপ্তর রং-চটা অ্যাশ-ট্রে, একটা শূন্যগর্ভ চশমার খোল ও রুণুর কুড়িয়ে পাওয়া শ্বেতপাথরের একটা ভাঙা প্যাগোডার পিছনে শুয়ে থাকা বইটার দিকে ভুলেও বেবি তাকায় না। ভুলে গেছে এমন একটা বই তার ছিল। ওপরে মার হাতের লেখা ওর ইস্কুলের নাম কুমারী শুভ্রা গুপ্ত।

কিছুদিন পর ইস্কুলের জন্যে রাখা নামটাই বেবির মনে থাকবে কি। সুপ্রভা চিন্তা করে। তারপর আলস্যের হাই ভেঙ্গে বইটা বাক্সের ওপর যেমন-তেমন ক’রে রেখে দিয়ে চায়ের তৃষ্ণায় কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ছট্‌ফট্ করতে থাকে আর মাঝে মাঝে কান পেতে শোনে ওরা এল কিনা।

রুণু বেবি ঘরে ফিরলে সুপ্রভা আর এক মিনিট জেগে থাকতে চায় না। অনেকদিনই তেলের অভাবে ঘরে আলো জ্বলে না। কাজেই আলো নেভানোর দরকার হয় না। দরজার পাল্লা দু’টো ভেজিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেই হ’ল।

যেন বেবির ঘরে ফেরাতক চায়ের তৃষ্ণা। তারপর সেই তৃষ্ণা চলে যায়। যেমন রুণুর ওলকপি কি দু’টো বেগুন লোকের ক্ষেত থেকে কুড়িয়ে আনার অপেক্ষায় অনেক রাত জেগে থেকে সুপ্রভা জঠরের মধ্যে জেগে ওঠা ক্ষুধার কামড় গায়ের মাংস পর্যন্ত চিবিয়ে খাচ্ছে অনুভব করে।

তারপর রুণু ফিরে এলে আর সেই ক্ষুধার কামড় থাকে না। এমন কি ছেলে যদি থলে ভর্তি ক’রে বেগুন কি কপিও নিয়ে আসে, সুপ্রভা সেগুলো আর এত রাত্রে সিদ্ধ করতে বসে না। ওরা নুন দিয়ে কাঁচা ওলকপি খেতে পারে ব’লে নিজের জন্য সে আর কিছু সিদ্ধ করে না। যেন রুণুর ছায়া দেখে তার ক্ষুধার ধার মজে যায়। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। রুণু বেবি তার ঘুম।

আজ এত রাত অবধি একটিকেও ফিরতে না দেখে সুপ্রভা ছট্‌ফট্ করছিল। শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজার পাল্লা খুলে বাইরে মুখ বাড়িয়েছে। কান পেতে আছে উঠোনে পায়ের শব্দ জাগে কিনা।

আর জেগে আছে ন’নম্বর ঘর।

সেই রাধাবাজারের ঘড়ির দোকানের প্রাক্তন কর্মচারী। আলসার ও বাত ব্যাধিগ্রস্ত ভুবন। প্রীতি-বীথির বাবা। বহুকাল ঘড়ির দোকানে কাজ ক’রে ভুবনের সময়জ্ঞান এ বাড়ির সকলের চেয়ে বেশি প্রখর। এখনো আছে। নানারকম ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যা নেবার পর থেকে সময়ের আন্দাজ যেন আরো নির্ভুল হয়েছে।

ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ হুট্‌ ক’রে কোন কারণে ঘুম ভেঙ্গে যেতে ভুবন অন্ধকারে বিড় বিড় করছিল। ‘রাত বারোটা বাজে, আমি বেশ টের পাচ্ছি, উঠোনেও আর লোকজন নেই ঘরে ফিরে সবাই দোরে খিল দিচ্ছে। বীথিটাই এলো না।’

‘আশ্চর্য, তুমি ওর চাকরির পয়লা দিন থেকেই শুরু করেছ। যেমন করেছিলে প্রীতির বেলায়। কেমন এখন জব্দ তো! ওর পিছনে বেশি লেগেছিলে বলেই তো আমার মনে হয় তোমার আফিং-এর মাত্রা এক তোলা থেকে সেই যে রাগ ক’রে মেয়ে আধ তোলায় নিয়ে এসেছিল পয়সায় কুলোতে পারছে না বলে, আজও সেই রাগেই ও আর বাড়াচ্ছে না। দৈনিক এক তোলা কেন দুই তোলাও তোমার জন্যে এখন খরচ করতে পারে। কিন্তু তোমার মেয়ের আর ইচ্ছে নেই তোমাকে সুখ দেওয়া। তোমার শাস্তি পাওয়া উচিত।’

‘আহা, আমি কি ওরা বেশি রাত্রি বাইরে থাকে ব’লে সে সব কিছু বলতে চাইছি নাকি। না, ওরা আমার সেই ধরনের মেয়ে। আমি বলছিলাম, বাইরে হিম পড়ছে। তাছাড়া, ট্রাম বাস তো বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে। বোধ করি, অনেক জায়গায় গেছে বন্ধ হয়ে। তাছাড়া, ক্ষুধাও তো পায়। সেই কখন চাকরির আট ঘণ্টা ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরে ছাই-ভস্ম যাহোক একটা কিছু মুখে পর্যন্ত না দিয়ে আবার বেরুল। কোথায় গেল। সারাদিনের অভুক্তই বলা চলে মেয়েটাকে। সেই ভাবনায় তো কাঁদছিলাম। বাপ হয়ে মন মানে না।’

কিন্তু স্বামীর এই দুঃখ প্রকাশকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না ক’রে বীথির মা বাড়ির আর পাঁচটা জাগ্রত লোককে শুনিয়ে বলল, ‘সিনেমার নেশা ওর ছোটবেলা থেকে নেই। রেস্টুরেন্টে ওর খেতে ভীষণ ঘৃণা। সাহিত্য কি সংস্কৃতি সম্মেলন-টম্মেলন ছাড়া ও কোনো সভা-টভা পছন্দ করে না। তুমি সব জান। জেনেও এমন বাড়াবাড়ি করছ যখন তখন তার ফল কী হবে জান। বীথিকে বলে রেখেছিলাম, চাকরি হলে, তোর বাবার আফিং-এর নাড়ি, তোর টাকা থেকে একপো করে দুধ রেখে দিস্। রাগ ক’রে তাও করবে না। মনের কষ্টে।

শুনে ভুবনের মনেও কম কষ্ট হ’ল না। বাড়ীর পাঁচটা ঘুমন্ত লোককে জাগিয়ে তোলার মতন গলা বড় ক’রে বলল, ‘কী মুশকিল! কী ভীষণ লোক তুমি। আমি কি আমার মেয়ের ঘরে ফেরা তক দুশ্চিন্তা করব না? ট্রাম বাসের আক্সিডেন্ট আছে। রায়ট রাহাজানি তো শহরে এবেলা ওবেলা। আমার বীথির মুখখানা না দেখা তক আমি নিশ্চিন্তে ঘুমতে পারব কেন।’

‘বেশ এক ঘুম তো ঘুমিয়ে উঠেছ।’ প্রীতি-বীথির মা গলাটাকে এতটুকু মোলায়েম হতে, গলতে না দিয়ে রাগের ভঙ্গিতে বলছিল, ‘এক বাটি দুধ সুজি খেয়ে সন্ধ্যাসন্ধ্যি যে সুখের ঘুমটি তোমার নিজের চাকরি নেই অবস্থায়ও ঘুমিয়ে উঠেছ, একবার সেই জন্যে মেয়েদের কাছে এতটুকু কৃতজ্ঞতা না থেকে কি করে কেবল তাদের চালচলতির নিন্দা করছ, এইটেই আমি রাতদিন অবাক হয়ে ভাবি। তোমার হ’ল কি। আলসারে আমবাতে তোমার মগজটা এখনো খেতে পারছে না কেন, কোন জন্মের মত নষ্ট করে দিচ্ছে না চোখ কান। গায়ের শুকনো মাংস নিয়ে টানাটানি করে আর লাভ কি? কলে কাজ সারুক। একবারে সব শেষ হয়ে যাক। মেয়ে দু’টোও হাড় জুড়িয়ে বাঁচুক। আমিও বাঁচি। আমারও আর সুখের বন্ধনে এখানে আটকা থেকে নর্দমার পচা গন্ধ শুঁকতে ইচ্ছা নেই, চলে যাব সেওড়াফুলি না হয় কদমতলায়।’

সেওড়াফুলি ভুবনের স্ত্রীর মাসির বাড়ি, কদমতলায় থাকে দূর-সম্পর্কিত এক খুড়ি। ঝগড়াঝাঁটি বাধলেই স্ত্রী যখন স্থানান্তরে সরে পড়ার বাসনা জানায় ভুবন চুপ করে এবং তখন তাকে সবচেয়ে বেশি অসহায় অথর্ব মনে হয়।

আর জেগে আছে প্রভাতকণা।

স্বামীকে মাঝখানে দাঁড় না করিয়ে সরাসরি সে গলা বড় ক’রে বাড়ির লোকদের শোনায়, ‘বেশ তো, সুধীরের সঙ্গে আমার মেয়ের ভাব; হ্যাঁ,–সুধীরের সঙ্গেই আমি মেয়ে বিয়ে দেব। দূর-সম্পর্কের মামা। আমার জ্যাঠশ্বশুরের মেজ মেয়ে কামদার মামাতো ভাই। সেই সুবাদে আমার মামাতো ভাই। সেই সুবাদে হ’ল সুনীতির মামা। বিয়ে হ’লে নিন্দের কিছু থাকে না। সুধীর? ওর বাবা শিলচরে মদের দোকান দিয়ে লাখপতি। বালিগঞ্জে জায়গা কিনছে। সুধীর তোদের পাঁচজনের কথায় এবাড়ি আসবে আর আসবে না, কেমন? বড় যে সব নিন্দে- চর্চা শুরু হয়েছে ওকে আর ‘আমার মেয়েকে জড়িয়ে—’

একটু সময় কান পেতে থাকলে বোঝা যায় ঘরের এমাথা ওমাথা পায়চারি ক’রে প্রভাতকণা গত রাতের ঝগড়ার জের এ রাতে টেনে এনে একলা বকবক করছে। এক সঙ্গে চার পাঁচটা কলেরা কেসের খবর পেয়ে বেলা দু’টোয় শেখর সেই যে ওষুধের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে পাগলাডাঙ্গায় ছুটে গেছে, কখন ফেরে ঠিক নেই। হয়ত রাত দু’টো বাজবে। সুনীতি খেয়েদেয়ে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে আছে। এখন স্বামী ফেরা তক এই দীর্ঘ অবসর আর কোনোরকমে কাটাবার সুবিধা না পেয়ে প্রভাতকণা পায়চারি ক’রে কালকের টিপ্পনিগুলোর একটা একটা ক’রে জবাব দিয়ে চলছিল।

কিন্তু কোনো ঘর থেকে আর উত্তর নেই। যেন সব মরে আছে, সবাই ঘুমে অচৈতন্য। কিন্তু এটা অসম্ভব। বাকি এগারো ঘরের কেউ না কেউ রাত্রির এক সময়ে জেগে থাকে। অভিজ্ঞতায় তা জেনে রেখেছে বলে প্রভাতকণা নিশ্চিন্ত হয়ে গলাটা উঠোনের দিকের জানালার কাছে ধরে রেখে আর পালিশ ভাষা না, নিজস্ব খরখরে শব্দগুলো প্রয়োগ ক’রে যে-ই জেগে থাকুক, শুনিয়ে বলল, ‘হুঁ, আমার মাইয়্যার তিন কুড়ি বছর অইচে। ত’গ গোষ্ঠীর জন্মের আগে সুনীতির জন্ম কিনা। সেই বুঝ নিয়া তোরা সুখে থাক। আমার সুনীতির বিয়্যা অয় কি না অয় চোখে দেখবি। এই ফাল্গুনে। তোদের গোষ্ঠীর নাকের সামনে দিয়া আমার মাইয়্যা বরের হাত ধইর‍্যা এখান থন যাবে।’

.

আর শব্দ হচ্ছিল কমলার ঘরে। ঘরের ভিতর না, ঘরের দরজার মাথায় ঝুলানো তালাটার শব্দ। বাতাসের বাড়ি খেয়ে তালাটা কখনো লাগছিল চৌকাঠে, কখনো পাল্লার গায়ে। আর ঠকাস্ ঠকাস্ শব্দ করছিল।

যেন কমলার হয়ে ওর ঘরের তালাটাই প্রভাতকণার কথার জবাব দিয়ে চলেছে। আমি মাইয়্যার বিয়া দিমু।’

‘বিয়েকে আমি কাঁচকলা দেখাই।’

‘আমার মেয়ের বিয়ের বয়স কিছু পার হয়ে যায় নি।’

‘বিয়ের বয়েসকে আমি বুড়ো আঙুল দেখাই।’ যেন তালাটা ঠকাস্ ঠকাস্ ক’রে কথা কয়। অর্থাৎ আজ সারাদিন এভাবেই কমলা প্রভাতকণাকে জব্দ করেছে। ডিউটি শেষ ক’রে সকালে ঘরে ফিরে কমলা গত-রাত্রির ঝগড়াটা শোনে। অর্থাৎ বীথির কথা শুনে ডাক্তারনী কমলাকেও জড়িয়েছে এবং তার বন্ধু শিশিরকে। সেই বীথিকে নিয়ে শেয়ালদার রেস্টুরেন্টে ব’সে খাওয়া নিয়ে।

কমলা সব শুনে কোনো কথাই বলেনি। তৎক্ষণাৎ বাজারে গিয়ে এক দোকানের টেলিফোন তুলে শিশিরকে ডেকেছে। বস্তির ঘরে এসে কমলার সঙ্গে এক পাতে বসে দুপুরবেলা মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাবার নিমন্ত্রণ রইল শিশিরবাবুর। কমলা জ্যান্ত মুরগি না আনিয়ে বাইরে থেকে কাটা-মুরগির মাংস এনে ঘরের দরজা বন্ধ করে স্টোভে রান্না করল। সারাদিন স্নান ছিল না। আলুথালু চুল। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি চোখের কোনায়। সায়া শাড়ি ঢিলেঢালা ক’রে পরা। যত না শিশিরের সঙ্গে বসে মাংসভাত খেল তার চেয়ে হাসল বেশি শব্দ ক’রে, বাড়ির বাকি এগারোটা ঘরকে যেন শুনিয়ে শুনিয়ে হাসল। তারপর খাওয়া সেরে মুখ ধুয়ে সেই ভর দুপুরে দরজায় খিল দিল।

সারা দুপুর ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে দু’জনে এক সঙ্গে বসে চা খেল। কমলা পাতকুয়ায় স্নান করতে গেল। কমলার তুলে আনা জল দিয়ে শিশিরবাবু কমলার ঘরের সামনে রকে বেতের মোড়ার ওপর বসে সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুলেন।

তারপর সাজসজ্জা ক’রে দুজনে সিনেমা দেখতে বেরিয়ে গেছে। আজ রাত্রে কমলার ডিউটি নেই। ঘরে ফেরাও নেই। সেই আবার কাল সকালে। হেসে শুনিয়ে গেছে সে প্রীতি বীথি ও বাড়ির অন্যান্য সখীদের। বন্ধ দরজার গায়ে ঠকাস্ ঠকাস্ করে তালাটা প্রভাতকণাকে এখন আবার যখন তা-ই জানিয়ে দিচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি খুশি হচ্ছিল প্রীতি বীথির মা। ভুবন- গিন্নী। ভুবনের সঙ্গে ঝগড়া ক’রে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বীথির মা। তালার খটখটানি শুনে আবার গায়ে-পায়ে শক্তি ফিরে পেল। চীৎকার করে ব’লে উঠল ‘প্রীতি-বীথির দরকার ছিল ওদের বাপ, মা বেঁচে না থাকা। আর, এক দঙ্গল ভাই-বোন। গোষ্ঠীর আহার যোগাড় করতে বেরিয়ে মেয়ে দু’টো খেটে খেটে মরতে বসেছে। কী দরকার ছিল। আমার তো মনে হয়, ওরা যদি কমলার মত বাপ-মা মরা মেয়ে হতো তো অনেক বেশি সুখে জীবন কাটাতে পারত। আমি তাই-চাই। চাইছি। তখন মরে গিয়েও সুখ পাব।’

‘একটা বয়েস হলে মেয়েদের সকাল সকাল ঘরে ফেরার সামাজিক দিকটাও দেখতে হবে। ওদের বিয়ের প্রশ্ন আছে। চাকরি করছে বলে তুমি বিয়েটা এখন থেকেই বাদ দিতে পার না যেন কমলার তালার মত ঠকাস্ ঠকাস্ করে ভুবনের কথাগুলোকে ঠাট্টা ক’রে উড়িয়ে দিয়ে শেষটায় প্রীতি-বীথির মা শোনায়, ‘দেখছ না, মেয়ের বিয়ে বিয়ে ক’রে ঘরে ঘরে কত বাপ মা মাথার চুল ছিঁড়ছে। পারছে কি? পারছে না। কপালের লেখা না থাকলে বিয়ে হয় না। হয়তো যার সাত জন্মে আর বিয়ে হবে বলে তোমরা ভাবতে পারছ না, এই কমলার বিয়ে হয়ে যাবে আগে। বাড়ির সব মেয়ের আগে। এই শিশিরবাবুই বিয়ে করবেন। যুদ্ধের আমল থেকে ডাক্তার। পরিবার আছে। থাক না পরিবার। পরিবার থাকা সত্ত্বেও মানুষ আবার বিয়ে করে। যে ক্ষমতা রাখে।’

হয়তো রাতজাগা বীথির মার এই উক্তিগুলি শুনে সুনীতির মা, শেখর-গিন্নী, প্রভাতকণা শেষটায় উত্তেজিত হয়ে সুনীতির দূর সম্পর্কীয় মামা সুধীরের সঙ্গে সুনীতির এই ফাল্গুনেই বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বড় গলায় ঘোষণা করে বসল, আর সুধীরের বাবার বিত্তবৈভব বর্ণনা করে এগারোটা ঘরকে শোনাল, যতক্ষণ না কলেরা কেস দেখা সেরে শেখর ডাক্তার ঘরে ফিরল। রাত তখন দেড়টা।

২২

আর রাত জেগে রাগে খনখন করছিল মল্লিকা। বস্তুতঃ মাঝে মাঝে এমন একটা কাণ্ড করে রমেশ যে মল্লিকার চীৎকার ক’রে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।

এই এত রাতে একটা বড় রুই মাছের মুড়ো পাঠিয়ে দিয়েছে আর সরু চাল। ‘মুড়িঘণ্ট রান্না হবে’, কর্তা লোক দিয়ে বাড়িতে খবর পাঠিয়েছে।

এত রাত্রে মাছের মাথা দেখে মল্লিকার মাথা গরম হয়ে গেছে।

‘বলি খেতে সখ তো দিনের বেলায় পাঠালেই হয়। এখন আমি রাত দুপুরে মুড়িঘণ্ট চড়াই। বুড়ো হতে চলল জিহ্বা কমছে না। দিনকে দিন লক্‌লকিয়ে বাড়ছেই বাড়ছে। মা–মা আমি কোথায় যাই। এই তো দুপুর বেলা চিংড়ি বাঁধাকপি হ’ল, মুগডাল রাঁধলুম ভেটকির কাঁটাটা দিয়ে, আর বেগুন দিয়ে মাছ। ওমা এর মধ্যেই ভুলে গেছে এত খাওয়া! এ্যাঁ, এখন আবার রুই-মুড়ো আর সরু আতপ চালের ঘণ্ট।’ একটু সময় থেমে মল্লিকা আবার বলছে, ‘বুঝলাম, কিন্তু এই ঠাণ্ডার রাত্রে বঁটি দিয়ে এতবড় মুড়ো এখন ফাঁক করে কে! আমার এই সংসার ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।’

মল্লিকা যখন আর্তনাদ ক’রে উঠল, শোনা গেল যেন আর এক ঘর থেকে প্রমথর দিদিমা বলল, ‘কাটারি দিয়ে ফাঁক কর হিরুর মা, বঁটি দিয়ে সুবিধে হবে না।

একটা ঘরের সাড়া পেয়ে মল্লিকা আরো উত্তেজিত হয়ে উঠল।

‘দিদি কাণ্ডটা দ্যাখো না এসে একবার। আমি কি এই ঠাণ্ডার রাত্রে একটু লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে পারব না। অ্যাঁ, এত জ্বালাতন আমার কপালে। একটু সুখ নেই!’

‘দিদি, তোমাকে একজন দিচ্ছে তাই পাচ্ছ খাচ্ছ, দশদিক থেকে তোমার আসছে। বলছ জ্বালাতন। এবাড়ি কেন, এ পাড়ায় গিয়ে জিজ্ঞেস কর মাসে ক’বেলা ক’জন মাছের মুখ দেখছে। আর আমি তো দেখি রুই কই ভেট্‌কি আর ডিম মাংস তোমার ঘরছাড়া হয় না। মিছে বললাম?’ প্রমথর দিমিমার কথায় মল্লিকা আর সাড়া দেয় না। যেন কাটারি দিয়ে মুড়োটা দুফাঁক করল। ঘ্যাচাং করে শব্দ হল।

একটু পর আবার গলা শোনা গেল। ‘তা না হয় রাঁধলুম বাড়লুম, সময়ে ঘরে ফিরলেই হয়। না সেই রাত দুটো। কী কাজ, কেমন কারবারী হতে পারে একটা লোক যে মাসের মধ্যে দেড়দিনও সময়মত খাওয়াশোয়া হয় না।’

একথায় বাড়ির লোক আর কেউ সাড়া দেয়নি।

‘এমনি তো বুকে একটু কফ জমে বেশি ঠাণ্ডা পড়লে। ডাক্তার ঠাণ্ডাটা না লাগে আমাকে বার বার বলছে, কিন্তু পারলাম না তো কয়ে কয়ে রাত-বেরাতে এই শীতের মধ্যে না বেরোতে, ঘোরাঘুরি না ক’রে একটু ঘরে বসিয়ে রাখতে, কী মানুষ! ‘

এবারও বাড়ি নীরব।

মল্লিকা কড়াইয়ের গরম তেলে মাছের মুড়ো ছেড়ে দিয়েছে বোঝা গেল।

‘হোক নিউমোনিয়া ব্রঙ্কাইটিস। আমি পারব না। আমার গায়ে আর এত বল নেই। অসুখ হলে দেব হাসপাতালে পাঠিয়ে। তখন দেখা যাবে।’’

আশ্চর্য, প্রমথর দিদিমা আর কথাই বলছে না। মল্লিকার ভীষম রাগ হয় এবার। দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে : ‘যা যা, যত আপদ এসে জুটবে। কেন, আর ঘর দেখতে পাও না, মুখপুড়ি। গরম খুন্তি দিয়ে চোখ গেলে দেব।’

বোঝা গেল বিড়ালটাকে বকা হচ্ছে।

‘মাছ দুধের গন্ধে হারামজাদী পাগল হয়ে ওঠে। আমার ঘর ছাড়া তোমার ঠাই নেই কোথাও–যা যা মুখপুড়ি।’

ঝন্ করে খুন্তির আওয়াজ হয়। যেন বিড়ালটাকে লক্ষ্য ক’রে ছুঁড়ে মারা হয়েছে।

‘কপি-পাতা খা গে, বেগুনের বোঁটা চিবিয়ে খাগে, মুলো শাক গিলে পেট ঠাণ্ডা কর গে। মাছ! মাছ খেতে দুপুর রাতে মল্লিকার ঘরে হারামজাদীর মরতে আসা চাই।’

আতপ চাল আর মাছের মুড়ো টগবগ করে কড়াইতে ফুটছে। প্রথমে মল্লিকার ঘর বারান্দা, তারপর সারা উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে মুড়িঘণ্টের সুবাস। একটু পর শোনা যায় শিলনোড়ার প্রচণ্ড শব্দ ক’রে রমেশগিন্নী এলাচ দারুচিনি পিষছে গরম মশলার। যেন প্রমথর দিদিমার ওপর রাগ করে শিলনোড়ার শব্দ করছে বেশি। ঘুমিয়ে পড়েনি বুড়ি, মল্লিকা ঠিক জানে। অথবা ঘুমিয়ে পড়লে, কেবল প্রমথদের ঘর কেন, বাড়ির বাকি দশটা ঘর জেগে উঠুক এরকম একটা আক্রোশ, অদ্ভুত মানসিক আস্ফালন নিয়ে দু’হাতে ষোলটা সোনার চুড়ির রিনঝিন্ শব্দ তুলে নোড়াটা জোরে শিলের বুকে ঘষতে লাগল ও। আর রাত বাড়তে লাগল।

না, বোঝা গেল পাঁচুর ঘরও জেগে আছে। একটু আগে টলতে টলতে ভাদুড়ী ঘরে ফিরেছে। এসেই ওয়াক্ ওয়াক্ করে ঘরের মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছে। বৌ পিতলের ডাবর নিয়ে ছুটে আসার আগেই ভাদুড়ী ওই কর্ম করেছে। যদিও নতুন কিছু না। কিন্তু রাত দুপুরে হাত দিয়ে বমি কাঁচতে হবে দেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে যশোদা ককিয়ে উঠেছে। ‘আমায় একটু বিষ দিতে পার গো কেউ, আমি খেয়ে মরে যাই। এই জ্বালা আমি কতকাল পোহাব!’

‘এই দ্যাখো, আ-হা-হা তুমি করছ কি, বাড়ির লোক জেগে উঠবে, মাইরি তোমার পায়ে পড়ি মাইরি…এই শোন শোন…’

যশোদা কান্না থমিয়ে চুপ করে।

‘কি বলো।’

‘মাইরি, আমি তোমার পা ছুঁয়ে বলছি, কাল তোমায় মুর্শিদাবাদী শাড়ি কিনে দেব।’

‘ছাই দিয়েছ।’ মুখটা বাঁকা করে ঘুরিয়ে নেয় যশোদা।

পাঁচু বমি করলে যশোদা এমন চীৎকার আরম্ভ করে আর এত সব বাজে কথা বলতে আরম্ভ করে দেয় যে বাড়ির লোক হা-হা করে ছুটে আসে। মাতাল মদ খেয়ে এসে আজ আবার বৌ ঠ্যাঙ্গাচ্ছে। বৌটাকে মেরে ফেলল, তোমরা সব বেরিয়ে এসো। ছেলে বুড়ো বৌ ঝি কাঁচা ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে পাঁচুর ঘরে ঢুকতে চায়। যশোদাকে রক্ষা করতে পাঁচুকে তারা রীতিমত কিলঘুষি খামচি মারতে আসে। তার কারণ নেশাগ্রস্ত লোকটাকে এখন মারলেও বিশেষ কিছু এসে যাবে না। এমন কি এই অবস্থায় লোকটাকে পুলিসে দেবার ক্ষমতা পর্যন্ত তাদের থাকে।

এই ব্যাপারকে পাঁচু বেশ ভয় করে।

অথচ অন্য সময় বৌকে মেরে দেখেছে কারো ঘর থেকে হাঁচি কি কাশিটিও শোনা যায় না। যশোদা চীৎকার করে তখনও কী না বলে। কিন্তু জানালা খুলেও কেউ দেখে না বৌকে পাঁচু লাঠি মারল কি দা দিয়ে কোপাচ্ছে। তখন কারোর ছুটে গিয়ে বাধা দেওয়া বা দুটো কথা বলা পাঁচুর পারিবারিক জীবনে হস্তক্ষেপ করার সামিল হয়ে দাঁড়াবে। তাই সব চুপ।

এ ধরনের ঘটনার অভিজ্ঞতা পাঁচুর অনেক আছে এবং মদের মুখে বৌকে মারতে গিয়ে সে এ-বাড়িতে বেশ বিপদে পড়েছে। তারপর সাবধান হয়ে গেছে।

এখন কথায় বলে অভ্যাস, বাইরে মদ খেয়ে এসে ঘরে বমি করতে না হয় সেজন্যে গ্লাসে মদ ঢালবার আগে ছিপি খুলে কয়েক ফোঁটা ওষুধ ঢেলে নেয়। দেশী বিলাতী দুটোতেই এ ওষুধে কাজ দেয়। পাঁচুর কথায় বলতে গেলে বেলেঘাটার কোনো ‘শালার’ ডিসপেন্‌সারীতে এ ওষুধ পাওয়া যায় না। তাই মানে একদিন সময় ক’রে কোলকাতায় গিয়ে এক সাহেবের দোকান থেকে সে ওষুধটা কিনে নিয়ে আসে। এক শিশিতে একমাস যায়। ইদানীং খাওয়াটা একটু বেশি হচ্ছিল এবং ওষুধও সেই পরিমাণে বেশি খরচ হয়েছে। কাল থেকে আর ওষুধ নেই। আজ সময় করে একবার তার চৌরঙ্গী যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অথচ সন্ধ্যার দিকে খাওয়াও নিতান্ত মন্দ হ’ল না। পাঁচুর নারকেলডাঙ্গার এক ফ্রেন্ড নিজের একটা কাজ হাসিল করতে এসে পুরো দুটো পাঁইট খাইয়ে গেছে ধাপার বাজারের অশ্বিনীর মদের দোকানে।

পারতপক্ষে অবশ্য পাঁচু ধারে কাছে, কি পাড়ার লোক এক আধজনের যাওয়া আসা আছে এমন দোকানে যায় না। তার প্রিয় আড্ডা খালধারের দোকান। খেয়ে বেরিয়ে এসে ব্রীজের হাওয়াটা গায়ে লাগায় এবং সেখানে দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট টানে, তারপর, পা, সজুত আছে যখন বোঝে, একটা রিক্সা ডেকে–বা কোন কোন দিন হেঁটে বাড়ি ফেরে।

গত দু’মাসের মধ্যে পাঁচু ঘরে ফিরে বমি করেনি। তাই চেঁচামেচি কম হয়েছে। হয়ইনি একরকম।

আজ ওষুধ না থাকার দরুন এই কাণ্ডটা ঘটল। তা ছাড়া ওই ধাপার বাজারের সুরেনটার কাঁকড়া ভাজা আর ফুলকো চচ্চড়ি। বহুকাল ওপাড়ার এসব জিনিস খায় না পাঁচু। ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু রাধেশটা জোর করে তাকে খাওয়াল। শেষটায় এতবড় একটা ইলিশমাছের মুড়ো ভাজা। সুরেন শালা এত লঙ্কাবাটা মিশিয়েছিল ফুলকো চচ্চড়িতে, বমি করার পরও গলা জ্বালা করছিল।

‘আমায় এক গ্লাশ জল দাও।’ অনেকদিন পর হঠাৎ এতগুলি বমি করে একটু নিস্তেজ অবসন্ন হয়ে পড়েছিল পাঁচু। তাই গলাটা নরম শুনে যশোদা আর চীৎকার করল না। কুঁজো থেকে একটা কাঁচের গ্লাসে জল গড়িয়ে পাঁচুর মুখের সামনে এনে ধরল। সুবোধ ছেলের মত পাঁচু গ্লাসটা যশোদার হাতে ধরা অবস্থায় গলা বাড়িয়ে বেশ সাবধানে এক চুমুকে সবটা খেয়ে ফেলল।

যেন জল খেয়ে বেশ সুস্থ বোধ করল।

তা ছাড়া এতগুলি ভাজাভুজি নিয়ে বেরিয়েছে বলে প্রায় সবটা মালই পেট থেকে উঠে এসেছে।

যেন আর কোন নেশাই রইল না, পাঁচু একটু হাল্কা বোধ করল।

‘গামছাটা দাও।’

যশোদা নিজের কাপড়ের আঁচল তুলে পাঁচুর হাতে তুলে দেয়। পাঁচু আঁচলটা দলা পাকিয়ে– তাই দিয়ে মুখ মোছে। যশোদা দেখে খুশি হয়। নেশা করা লোকের হঠাৎ নেশা নেই দেখতে পেলে সবাই খুশী জানা আছে বলে যশোদার মুখের দিকে তাকিয়ে পাঁচু হেসে ফেলল। গলাটা বেশ বড় করে বলল, মাইরি বলছি। কাল আমার শহরে অনেক কাজ। ফেরার সময় একটা মুর্শিদাবাদী আনবই।’

বমিটা কোনরকমে হাত দিয়ে কেচে তুলে জায়গা পরিষ্কার করে যশোদা ভাতের থালা এনে পাঁচুর সামনে রাখল। একে ওষুধ ছাড়া এতগুলো খেয়ে এসে ঘরময় বমি ছড়িয়েও হাঙ্গামাটা বাধতে বাধতে থেমে গেছে তাতে খুশী, তার ওপর নতুন আলু দিয়ে রাঁধা পুরো একবাটি কাছিমের মাংস থালার পাশে দেখে পাঁচু আহ্লাদে চীৎকার করে উঠল।

‘আরে করেছ কি তুমি, এত সব খাব। আমার তো ভাল ক্ষিদে নেই। অর্ধেকটা মাংস তুলে নাও।’

‘আমার আছে। আমার জন্যে রাখেছি। না রেখে কি আর তোমায় দিলুম।’

‘বেশ তো, আছে, আরো খানিকটা তুলে নাও। রেখে দিও। সকালে পান্তাভাত দিয়ে বাসি মাংস খেও। ঠাণ্ডার সময়। নষ্ট হবার ভয় নেই

বাটি থেকে খানিকটা তুলে রাখে যশোদা।

‘আজ বুঝি খুব খারাপ জিনিস খেয়েছ। সেরকমই তো গন্ধ পেলাম বমির।’

‘তোমার মাথা খারাপ হয়েছে গিন্নী, তোমার নাক নষ্ট হয়ে গেছে।’ পাঁচু প্রচণ্ড শব্দ করে হাসল। যখন নেশা থাকে না নেশার কথা বাড়ির এগারোটা ঘরকে শুনিয়ে বড় গলায় বলতে পাঁচু একটুও দ্বিধা করে না। দিশী ছোটলোকের খাদ্য, ও ভদ্দর লোকে খায় কখনো। আর খায় যারা ধার করে মদ খায়। কেন আমার কি রোজগারে ইয়ে পড়েছে নাকি..হা-হা’, ঘর কাঁপিয়ে হাসল পাঁচু। ‘হোয়াইট লেবেল, বুঝলে, একটা বোতল কিনতে চল্লিশটা টাকা বেরিয়ে গেল।’

‘ওই কর, ছাই-ভস্ম খেয়ে টাকা নষ্ট করছ তো আমার শাড়ি গয়না আর হবে কি দিয়ে?’

‘হবে হবে’,…পাঁচু ভাদুড়ী আবার গলা নরম করে স্ত্রীকে প্রবোধ দেয়। ‘তোমার জন্যে টাকা না রেখে কি আর আমি মদ খাই, না ইয়েতে যাই। কালীমার দিব্যি, কাল শালা মুর্শিদাবাদী না কিনে আমি এক ফোঁটা গলায় ঢালব না।’

‘আচ্ছা খাও, খাও। খেতে তো আমি বারণ করছি না। কিন্তু তুমি ইয়েতে যাওয়াটা একবার বন্ধ করো তো। স্বাস্থ্যটা খারাপ হচ্ছে একবার দেখছ না, তাছাড়া লোকে বলে কি!’

এবার পাঁচু শব্দ করে হাসল। এবং বাড়ির আর পাঁচটা ঘর শুনছে বলে মোটেই গ্রাহ্য না করে গলাটা বরং আরো একটু চড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার কাছে ঢাকচাক নেই গিন্নী, আমি কি তোমায় বলিনি আগে।’

চুপ করে রইল যশোদা।

‘তাই বলছিলাম, মেহনত করে রোজগার করি, দু’পাঁচ টাকা স্ফূর্তির জন্যে ব্যয় করবই। কোনো শালাকে আমি কেয়ার করি নাকি?’ একটু থেমে পাঁচু টেনে টেনে হাসে : ‘আরে গিন্নী আমি তো মন্দ আছিই। ইয়ে বাড়ি যাই’। কিন্তু সন্ধ্যার পর অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে যাওয়া- আসা করে এমন ঢের ঢের লোকও আছে! বলো তো আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি।’

‘কে কে শুনি না।’ গলার স্বর উচ্চগ্রামে তুলে দিয়ে যশোদা হেসে প্রশ্ন করে।

কিন্তু পাঁচু মাথা নাড়ল।

‘পাগল হয়েছ, নাম বলব না, নাম বলি আর আমার মাথায় লাঠি পড়ুক।

‘আহা’ তুমি আমার কাছে চুপি চুপি বল না, আমি কি আর সেটা বাইরে প্রকাশ করছি, না চিংড়িঘাটা বেলেঘাটার ঘরে ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করছি, এমন করছ কেন গা, আমার কি একটু জানতে ইচ্ছা করে না।’

যশোদা অভিমান করছে দেখে পাঁচু কথা না বলে কেবল থুতনিটা তুলে ইঙ্গতে রমেশের ঘর দেখিয়ে দিয়ে কাটা ঠোঁট বিস্ফারিত করে টেনে টেনে হাসে। ‘মাছের মুড়ো’

‘মাছের মুড়ো’ করে চীৎকার করে মল্লিকা তখনও বাড়ি মাথায় করছিল। কিন্তু যশোদার হাসির তোড়ে সেই চীৎকার ভেসে গেল, ডুবে গেল। ‘বাইরে থেকে ভদ্দরলোক, কত নাম ডাক, বুঝবার জো আছে কিছু? একাদশী ঠাকুর ডুব দিয়ে জল খায়, অ্যা, এত গুণ তাঁর পেটে পেটে, তুমি আমায় য়্যাদ্দিন না বলে থাকতে পারলে কি করে গো!’ বাইরে থেকে দেখা গেল না কিন্তু মনে হল যেন আহ্লাদের আতিশয্যে যশোদা স্বামীর দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে।

‘এটা ভাল গিন্নী, এটা আমি অপছন্দ করি না।’ হেসে কচ্ছপের নরম হাড় কুড়মুড় করে চিবোচ্ছিল পাঁচু।

কান পাতলে বোঝা যায় আরো লোক জেগে আছে। বিমলের গলা। বৌকে ধমকাচ্ছে। পুজোর সময় সুন্দর একখানা ধনেখালি কিনে দিয়েছিল। সেই শাড়ি বৌ এর মধ্যেই যেন কিসের খোঁচা লাগিয়ে ছিঁড়েছে। ‘অ্যা, আমি যে শাড়ি কিনতে কিনতে ফতুর হয়ে গেলাম।’ প্রথমে দুঃখ প্রকাশ, তারপর ক্রোধগর্জন : ‘বলি কত বড়লোকের ঝি তুমি যে বছরে তিন জোড়া করে কাপড় লাগাচ্ছ, অ্যাঁ, বল তুমি কি ইচ্ছে করে এসব করছ নাকি, পরীক্ষা করছ ভাতার কত শাড়ি কিনে দিতে পারে একবার দেখি? যাও আশেপাশে আরো ঘর আছে, গিয়ে জিজ্ঞেস কর ক’মাস অন্তর কে ক’খানা শাড়ি পরতে পায়।

যেন হিরণ ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।

‘পুজোর সময় তো কেনা হয়নি, ভাদ্রমাসে এ শাড়ি কেনা হয়েছে।’

‘ঐ ভাদ্র আর আশ্বিন একই, লাটসাহেবের ঝি।’ বিমল স্বরটাকে আরো বিকৃত করে তুলল। ‘ভাদ্র মাসে কেনা হয়েছে বলে কাপড়খানা এর মধ্যেই ফালি ফালি করে ফেলতে হবে, বলি তোমার চার ছ’মাসও একখানা শাড়ি টেঁকে না। আর এদিকে দিনকে দিন কাপড়ের বাজার আগুন হচ্ছে। আমি এখন কাকে বোঝাই, কাকে গিয়ে বলি আমার ঘরের এ-অবস্থা।’ একটু থেমে থেমে বিমল পরে শেষ করল, ‘এসব মেয়েমানুষকে লোহার জালি পরতে দেওয়া উচিত, নয়তো চট।’

হিরণের কান্না বা কথা আর শোনা যায় না।

আর গোলমাল হচ্ছিল তিন নম্বর ঘরে।

প্রথমে চাপা রকমের, তারপর গোলমালটা বেশ বড় হয়ে উঠল। যেন দরজার ভেজানো পাল্লা ভেদ করে কথাগুলো ছিটকে এসে উঠোনে পড়ছিল।

‘অম্বলের বেদনা, স্রেফ্ অম্বলের ব্যথা ওটা, আমি বলছি।’

‘অম্বলের ব্যথা কি তলপেটে হয়? আমার তো মনে হয়—’

‘তোমার অনেক কিছুই মনে হয়। তোমার তো আর মনে হওয়ার সময় অসময় থাকে না। বলি আট মাসে কবে তুমি হাসপাতালে গেছ? বড়খোকা থেকে আরম্ভ করে সাধনা মমতা সন্তু নন্তু সুবু সমীর সুধা এই সেদিনের আন্না পর্যন্ত ঠিক দশ মাস পড়তে তবে হাসপাতালে যাওয়া হয়েছে। এ-যাত্রা আটমাস না পেরোতেই বলছ–’

‘আট মাস কে বলল। ন’ মাস পূর্ণ হতে আর দশদিন বাকি। তোমার কি আর দিন মাসের হিসাব মনে থাকে। গাধা গরু ছাগল ভেড়া নিয়ে রাতদিন কারবার যার, তার এসব মনে থাকবার কথা নয়। শাস্ত্রের বচন।’ কথা শেষ করে লক্ষ্মীমণি আবার যন্ত্রণায় আঃ উঃ করছিল।

‘তা ন’মাসেই কবে তুমি হাসপাতালে গেছ, তোমার আর দশটি সন্তানের মধ্যে কোটি দশমাস না পড়তে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, আমায় একটি একটি করে দৃষ্টান্ত দেখাও তো।’

বিধু মাস্টারের চীৎকারে ঘরের চাল কাঁপছিল।

‘এ্যাঁ, তুমি কি আমায় সকল রকমে বিপদে ফেলতে চাইছ নাকি। এতকাল তবু ধরাবাঁধা একটা সময় ছিল, নিয়ম ছিল। এখন যে আর্লি ইয়ে করতে আরম্ভ করেছ। আমি দাঁড়াই কোথায়। না কি একেবারে খরচপত্র ছাড়াই এ-যাত্রা পরিষ্কার হয়ে আসতে পারবে ভেবে রেখেছ, নাকি বড় যে সোহাগ করে শোনাচ্ছ অম্বলের না অন্যরকম পেইন। এদিকে একটা এক্সট্রা ট্যুইশনি নিলাম। টা মাস পুরলে তো টাকা পাব নাকি তার আগেই চামেলীর মা–উঃ আমি কোথায় যাই, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে তোমার কাজকারবার দেখলে।’

লক্ষ্মীমণি আর কথা বলছে না। কিন্তু অন্য একটা ঘরে এক বর্ষীয়সীর গলা শোনা গেল। যেন বিধুমাস্টারের রাগের আগুনে ঠাট্টার ঠাণ্ডা জল ছিটিয়ে দিতে হেসে বলছে, ‘তা ন’মাস না পেরোতে যদি বেদনা ওঠে তো করা কি, বলি আমার কথা শুনছেন সাধনার বাবা, এবছর সব কিছু সকাল সকাল,–দেখচেন তো মাঘ মাসের শুরুতে কেমন গরম পড়ল, গায়ে আর কাঁথাকম্বল ওঠে না, আর আর বছর ফাল্গুন মাসেও আমের গুটি দেখতে পাই না, কাল দেখলাম পুকুর পাড়ের গাছটায় পাতা দেখা যায় না-–’

বুড়ির কথা শেষ হবার আগে আর একটা ঘর থেকে কে বলে উঠল, ‘হুঁ, দিদি বলছেন আমের গুটি, কোথায় সেই চৈত্রের শেষে শুরু হবার কথা, চিরকাল বেলেঘাটা চিংড়িঘাটায় যা দেখে এলাম, এবছর এখন থেকেই শীতলার কৃপা আরম্ভ, ঘোলপাড়া ধুবিতলায় তো শুনলাম রোজ দু’জন চারজনের ক’রে হ’চ্ছে, একজন নাকি মারাও গেল।’

‘হ হ, এবছর সবই সকাল সকাল, বাঁধাকপিতে এর মধ্যেই পোকা পড়েছে, ফুলকপি ফুরিয়ে গেল, নিতাই কাল এসে বলছে ধাপার বাজারে পুঁই আর ডাঁটাশাকের ছড়াছড়ি দিদিমা এখন থেকেই। তাই বলছিলাম সাধনের বাবাকে, লক্ষ্মীমণি এ-যাত্রা সকাল সকাল হাসপাতালে যাবে।’ কথা শেষ করে বর্ষীয়সী খনখনে গলায় হাসছিল।

বিধুমাস্টার অবশ্য এসব কথায় যোগ দেয়নি। চুপ ছিল। এবং আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যখন দেখল স্ত্রী একেবারে নীরব হয়ে গেছে, আস্তে প্রশ্ন করল, ‘কেমন, এখন কেমন মনে হচ্ছে?’

‘মনে হচ্ছে যেন ব্যথাটা এখন নেই।’

‘নেই।’ মাস্টার রাগ করল না, যেন আশ্বস্ত হয়ে গলাটা আবার চড়িয়ে দিল। ‘আমি বলিনি? অম্বল, স্রেফ্ অম্বলের পেইন, তা ছাড়া আর কিচ্ছু না। কেমন?’

অপর পক্ষের হুঁ হাঁ কিছু বোঝা গেল না।

এবার বিধুমাস্টার খুশী হয়ে হেসে ঘরের চালা কাঁপিয়ে তুলল। ‘এতগুলো সন্তানের মা আজও কোন্টা কিসের ব্যথা টের পাও না অবাক লাগে, হা–হা–’

শিবনাথ দরজায় দাঁড়িয়ে শুনল সব। মনে মনে হিসাব করে দেখল সে প্রায় সবগুলো ঘরই জেগে আছে। কথা বলছে হাসছে কাঁদছে ঝগড়া করছে রাঁধছে খাচ্ছে, খাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘুমের উদ্যোগ করছে। বুঝি রমেশ রায়ও ইতিমধ্যে ফিরল। দূরে কোথায় পেটা ঘড়িতে একটার বেল্ বাজতে শোনা যায়। অন্ধকার উঠোনের দিকে তাকিয়ে উঠোন ঘিরে দাঁড়ানো ঘরগুলো শিবনাথকে আবার হ্যাভ-নটদের মনে পড়িয়ে দেয়। পাঁচু ভাদুড়ীর সেলুনে বিধুমাস্টারের সেই কথা। এবং ‘থাকা’ ও ‘না থাকা, নিয়েই সবগুলো ঘর এতক্ষণ বকর বকর করল। একটি ছাড়া।

একটা ঘরের বাসিন্দারা সেই সন্ধ্যা সাতটা থেকে চুপ মেরে আছে। ঘরে কিছু মাত্র আওয়াজ নেই।

খাওয়া-দাওয়া দুপুরে যদি বা কিছু হয়েছে, সন্ধ্যার দিকে আর হবে না। বাড়ির সবাই জানে। তা হলেও ওঠা-বসা চলা-ফেরা করা, কাশি কি ধমক-টমক দিতেও অমলকে শোনা গেল না আজ। কালও এমন ছিল না। আজ একেবারে চুপ করে আছে।

কিরণ তো জানেই রাগী খুঁতখুঁতে সদা-অসন্তুষ্ট সন্দিগ্ধচরিত্র দুর্বল ভীরু বেকার সব জায়গায় বিফল হয়ে ঘরে-ফেরা স্বামী অন্ততঃ তার ওপর দুটো একটা কথা চালায়, হুকুম শাসন করে এবং কিছু না পেয়ে শেষটায় কুঁজো থেকে একটা ঘটি জল গড়িয়ে ঢকঢক ক’রে সেটা গলায় ঢেলে হয়তো একটা আত্মসমর্পণের ভাব নিয়ে মেঝের ছেঁড়া মাদুরের ওপর শোয়া কিরণের পাশে আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ে। আগের সেই তেজ বিক্রম নেই। আজকাল তাই করছিল। কিন্তু আজ তাও করল না। সারাদিন সে বাইরেই গেল না। কিরণ কি অমলকে কেউ দরজা খুলে একবারও বাইরে আসতে দেখেনি। গুম হয়ে ঘরের ভিতর শুয়ে বসে কাটাচ্ছে তারা, বেশ বোঝা গেল। এখন সন্ধ্যার পরও ঘরের ভিতরটা গুম মেরে ছিল।

কাল পারিজাতের দারোয়ান জিনিসপত্র টেনে উঠোনে বার করে দিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হুকুম করবে, কথাটা ভেবে অন্ধকার উঠোনটাও যেন এইবার গুম রইল। কেবল সেই চুপ ক’রে থাকা ঘুমিয়ে থাকা বারোঘরের মাঝখানের মস্ত উঠোনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খটাস্ খটাস্ আওয়াজ করে কমলার দরজার তালাটা নাড়াচাড়া করতে লাগল।

২৩

ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত না।

সকাল বেলায় মদন ঘোষ এসে অমলকে ডেকে বলে গেল যেন সে ও তার পরিবার সব জিনিসপত্র নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

বেরিয়ে এসে বৌকে নিয়ে উঠোনে দাঁড়াতে বা অন্য ঘরে আশ্রয় নিতে সে পারবে কি না সেকথা উল্লেখ করল না বাড়িওয়ালার সরকার।

‘এটা সরকারের মুখের ভদ্রতা, বুঝলেন না, আসলে যখন জিনিসপত্র নিয়ে ঘর থেকে বেরোবে, তখন সোজা আঙুল দেখিয়ে বলবে রাস্তায় নেমে যাও। অর্থাৎ তখন আর একচোট অপমান করার সুযোগ হাতে রেখে মদন ব্যাটা এই বজ্জাতিটুকু করে গেল।’

মন্তব্যটা ঠিক কে করল বোঝা গেল না। দেখা গেল বেশ ভিড় জমেছে বাড়ির প্রত্যেকটা ঘরের দরজায় বারান্দায়। গলা বাড়িয়ে মুখে বাড়িয়ে সব। নিজেদের ঘরের সামনের লাগোয়া উঠোনে নেমে এসে অপেক্ষা করছিল কেউ কেউ।

মদন ঘোষ বলে গেছে যদি জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা না হয়ে থাকে, তবে সে দারোয়ানকে দিয়ে দু’টো কুলি পাঠিয়ে দেবে।

হাত চালিয়ে ওরা সব ঠিক করে দেবে। ‘অর্থাৎ অমলকে তাড়াতাড়ি ঘরখানা ছেড়ে দিতে সাহায্য করতে মদন দারোয়ান পাঠাচ্ছে।’

একজন কে মন্তব্য করল এবং মন্তব্য শেষ না হতে হনহন করে দু’টো কুলিকে সঙ্গে নিয়ে দারোয়ান ছুটে এলো।

দারোয়ান যে দেখতে একটা খুব ভীষণ দর্শন তা না। বরং কপালে তুলসীর মাটির ছিটা, সিঁদুরের ফোঁটা, রামনাম মুখে, খড়ম পায়ে, আটা দুধ খাওয়া রামসিং এর ঠাণ্ডা মিঠে চেহারা দেখলে কথা বলতে ইচ্ছা করে। এ বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত এমনি রাস্তায় দেখা হলেই রামসিং-এর সঙ্গে কথা কয়। কিন্তু এখন দেখা গেল রামসিং-এর হাতে লাঠি, গায়ে খাকি উর্দি, পায়ে নাগরা। অর্থাৎ এখন সে কেবল দারোয়ান না, জমিদারের পাইক। পরোয়ানা নিয়ে এসেছে অবাঞ্চিত বাসিন্দাকে বস্তি থেকে উৎখাত করতে।

অবশ্য খুব একটা হাঁকডাক করল না সে। মনে হল বিড়বিড় ক’রে এখনও সীতারাম আওড়াচ্ছে। আঙুল দিয়ে দশ নম্বর ঘরটা কুলিদের দেখিয়ে দিয়ে রামসিং চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

বাড়ির সবগুলো মানুষের চোখে-মুখে কৌতূহল বিস্ময়। কেননা জেদী একরোখা বোকা বেকার অমল মদন ঘোষের কথামতো তখনো জিনিসপত্র ঘর থেকে বার করেনি। যেন তার বার করার ইচ্ছা নেই। দরজায় পাল্লা ভেজানো।

খোট্টা কুলি দুটো বারান্দায় উঠে ‘বাবু’, ক’রে দু’বার হাঁকল। ভিতর থেকে সাড়া না পেয়ে তারা কড়া ধরে নাড়া দিতে অমল দরজা খুলল।

অমলের চেহারা দেখে সকলের বুক টিপটিপ করছিল।

উষ্কোখুষ্কো চুল। চোখ দুটো লাল। গায়ে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি এবং বৌয়ের একটা ছেঁড়া শাড়ি লুঙ্গি ক’রে পরা। সকলে অবাক হয়ে দেখল, একটা লাঠি হাতে নিয়ে সে ঘরের দরজা আলগাচ্ছে। অমল যে প্রকৃতিস্থ নয়, হাবে ভাবে সেটা খুব বেশি প্রকাশ পাচ্ছিল। সত্যি সে বেপরোয়া হয়ে দরজার পাল্লা আটকাবার কাঠটাকে অবলম্বন করে ঘর সামলাতে রুখে দাঁড়াবে, কেউ কল্পনা করতে পারেনি। ‘সাহস রাখে।’ বাড়ির লোকদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল। ‘মরদ’। কেউ কেউ বলল।

‘তা না করে করবে কি। ঘরে বিয়ে করা বৌ আছে। উপোস থাকুক আর যা-ই করুক, বৌয়ের সম্মান বাঁচাতে লোকের মাথায় বাড়ি দিতে অমল পিছপা হবে না, আমরা জানতাম।’

মন্তব্য শুনে আর একজন হেসে ঘাড় নাড়ল। ‘মদন ঘোষ সেজন্যেই দারোয়ান আর কুলি পাঠিয়েছে। আমাদের তো ইচ্ছা ওর মাথায় যদি অমল দু’ঘা বসিয়ে দিত, কাজের মত কাজ হত।’

‘কে কাকে ঘা বসায় মশাই, আগে দেখুন, ওখানে কি কাণ্ডখানা হচ্ছে।’

‘এই শালা তোদের মাথা ভেঙে দেব যদি আমার ঘড়াটা ভাঙে। রাসমণির বাজার থেকে আট আনা পয়সা দিয়ে আমি নতুন ঘড়া কিনেছি।’

সবাই চোখ তুলে দেখল কুলিটা ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র টেনে টেনে এনে বারান্দায় রাখছে। অমল তেমনি কাঠটা উঁচিয়ে আছে। লাফাচ্ছে, চিৎকার করছে কিন্তু ঘা বসাতে পারছে না।

‘দিক না বসিয়ে একটা খোট্টার মাথায়।’ একজন বলতে আর একজন রীতিমত ভেংচি কেটে উত্তর করল : ‘ত কি করে পারবে মশাই, আপনারা কি ওকে সাপোর্ট করবেন। আপনারা দূরে থেকে দাঁড়িয়ে ঠাট্টাই করতে পারবেন। দিন না সকলে দুটো করে টাকা। আপনারা কিছু চাঁদা দিলে ওর প্রায় দু’মাসের ঘরভাড়া হবে। এখনকার মত তো লোকটা অপমানের হাত থেকে বাঁচুক। বাকি টাকা সে আস্তে আস্তে দিয়ে যাবে। বাড়িওয়ালাকে জানালেই চলবে।’

‘আমাদের কারোর একটা পয়সা দেবার ক্ষমতা নেই। আমাদের সংসার খরচ আছে, ঘরভাড়া দিতে হয়, খেটে খাই, কেউ বসে খাই না। পারেন তো আপনিই সবটা দিয়ে দিন না। আপনার মোটর গাড়ি আছে, সোনার ব্যান্ড ঘড়িতে, জামার সোনার বোতাম। নিশ্চয়ই বিত্তশালী।’

সকলেই চারু রায়ের মুখের দিকে তাকাল।

অর্থাৎ অমলকে বাড়িওয়ালা দারোয়ান পাঠিয়ে বাড়ি থেকে উঠিয়ে দিচ্ছে এই দৃশ্য দেখতে মুদি বনমালী, কে. গুপ্ত এবং তার বন্ধু চারু রায় বাড়ির ভিতর ছুটে এসেছে। চারু রায়ের হাতে একটা ক্যামেরা। ফিতে বাঁধা কালো চশমা চোখে, যা অন্য সময় দেখা যায় না।

বিধু মাস্টার, ডাক্তার, পাঁচু, রমেশ রায়, এখন কি লাঠিতে ভর দিয়ে রুগ্ন ভুবন পর্যন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসেছে।

চারু রায় পরামর্শ দিতে সবাই একসঙ্গে প্রতিবাদ করছিল। ‘ভাড়াবন্ধ হলে আমাদের ও উঠতে হবে, তখন আপনি এসে আমাদের সাহায্য করবেন কি না জানি না।’

বেশ সরস গলায় রমেশ রায় বলল, ‘একমাস দিলুম। তারপর? তারপর যদি ওর চাকরি না হয়, তখন কে চালাবে? আবার আসবেন আপনি? মশাই, অনেক হিতোপদেশ দেয়া যায় দূর থেকে। একবার এবাড়িতে এসে থেকে দেখুন না। মশাই, অনেক জটিলতাময় আমাদের বস্তিবাসীর জীবন। পরোপকার করা এত সোজা না।’

‘আপনারা কি কোনদিন ওর ভাল চেয়েছেন? উপদেশ দিয়েছেন, অথচ শোনেনি, এমন হয়েছে কি যে জিনিসটাকে খুব বাঁকা করে ধরে নিচ্ছেন?’

‘নিশ্চয়ই করেছি। আলবৎ ওকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ওর বৌ আমাদের স্থানীয় কলে ফ্যাক্টরিতে কাজ পায়। আমরা স্থানীয় লোক। পাঁচজন গিয়ে মালিকদের বললেই হয়। কিন্তু তা সে করবে না। প্রতিজ্ঞা করেছে, কিছুতেই বৌকে চাকরি করতে দেবে না। এই করে করে নিজে তো মরেছেই, কচি মেয়েটাকে পর্যন্ত মারতে বসেছে। খাওয়া নেই দু’জনের কদিন একবার জিজ্ঞেস করুন না।’

সকলেই আবার অমলের ঘরের দিকে তাকাল। আধ-পোড়া সিগারেটটা ঠোঁট থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কে. গুপ্ত বনমালী এবং চারু রায়, অমলের পাশে কিরণকে দেখতে পেল।

কিরণ আর ঘরের ভিতর ছিল না। সব জিনিস ওরা ঘর থেকে টেনে বার করার আগে সে বেরিয়ে এসে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। আজকালকার মেয়ে, তাই ঘোমটা বলতে নাক পর্যন্ত ঢাকা কাপড়। কিরণের সুন্দর কপাল দেখা যাচ্ছিল, টিকালো নাক আর ভ্রমরের পাখার মত পাতলা মিশমিশে কালো ভুরু ঘেরা চোখ

যেন বাড়ির সবগুলো পুরুষ একসঙ্গে ঢোক গিলল।

‘তা যদি সে না চায় বৌকে ফ্যাক্টরিতে পাঠাতে, তো সেটাও আমি দোষের দেখি না। কেন চাইবে, ও পুরুষ, ডার্লিংকে এ-বয়সে ঘরের বাইরে যেতে দিতে কষ্ট পায়। পাওয়া উচিত।’

কেউ এ কথার উত্তর দিল না। চুপ করে সব চারু রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাণ্ডটা দেখতে লাগল। চারু রায় পকেট থেকে মনিব্যাগ বার করল। তারপর একটা লাফ দিয়ে অমলের সামনে গিয়ে বলল, ‘আমি তো এসব জানি না, আমার ফ্রেন্ড কে. গুপ্তর মুখে শুনলাম। তা দেখুন মশাই, এই টাকাটা এখন নিন, দারোয়ানের হাতে দিয়ে বলুন–আপনার জিনিসপত্র ছেড়ে দিক।’

চারুর হাতে নতুন করকরে নোট।

অমল ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে যেমন চারু রায়কে দেখছিল, তেমনি মাথার কাপড়টা ঠেলে খোঁপা পর্যন্ত সরিয়ে দিয়ে অবাক উৎসুক চোখে কিরণ টাই-স্যুট পরা পরিচ্ছন্ন কালো ফিতে-আঁটা চশমা-পরা উপকারী ভদ্রলোকটিকে দেখছিল।

চারু রায় কিরণের দিকে আর একবারও তাকাচ্ছিল না। অমলের দিকে মুখ ফেরানো।

‘আপনি এখন এই ঘর ছেড়ে দিন। খুঁজলে আরো সস্তামতন ঘর পাওয়া যায় এদিক-ওদিক। সেখানে চলে যান। তারপর দেখা যাক। আজ আমি কলকাতায় ফিরে গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের রিং করে জিজ্ঞেস করব। আপনার নাম তো জানাই রইল। একটা চাকরি আপনাকে জুটিয়ে না দেওয়াতক্ নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।’

অমল কথা বলল না। কিরণ মাটির দিকে তাকিয়ে। ভ্রূ দু’টি স্তব্ধ। চুপ্ করে যেন কি ভাবছে বোঝা গেল।

চারু অমলের হাতে নোট ক’খানা গুঁজে দিল। দিয়ে একটা নতুন সিগারেট ধরায়। কেন গুপ্তের দিকে তাকিয়ে কি বলে বোঝা যায় না, অত্যন্ত নিচু গলা। গণ্ডগোল হচ্ছে শুনে বাড়ির সরকার মদন ঘোষ ইতিমধ্যেই ছুটে এসেছিল।

সরকারের হাতে দু’মাসের ভাড়া তুলে দেওয়া মাত্র কুলিরা অমলের জিনিসপত্র ছেড়ে দিল।

যেন কোথায় ঘর ঠিক করা ছিল। টাকা পেতে এখানকার ঘর ভাড়া চুকিয়ে এই পরিবেশ পরিত্যাগ করতে অমলও এক সেকেন্ড দেরি করল না। একটা লোক ডেকে জিনিসপত্র তার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে বৌয়ের হাত ধরে সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। কে. গুপ্ত এবং বনমালীকে সঙ্গে নিয়ে চারু রায়ও উঠোন ছেড়ে চুপচাপ রাস্তায় নেমে গেল।

তোমাদের সকলের মুখে কে. গুপ্তর ফ্রেন্ড জুতো মেরে গেল।’

চুপ ক’রে সবাই দাঁড়িয়ে আছে দেখে বিধু মাস্টার মন্তব্য করল। মুখটা বিকৃত ক’রে শেখর ডাক্তার বলল, ‘শুনেছি ছাত্র পিটিয়ে মাস্টারগুলো কদিন পর গাধা বনে যায়। তোমার কথা শুনে এখন তাই পরিষ্কার চোখে দেখছি।’ বলে ডাক্তার মাস্টারের দিকে না তাকিয়ে শিবনাথের দিকে তাকায়।

‘কি বলেন মশাই, আমরা কে, আমাদের সঙ্গে অমলের সম্পর্ক কি। বরং বলা চলে বাড়িওয়ালার মুখের উপর ইয়ে মারা হ’ল। দারোয়ান কুলি পাঠিয়ে জাঁক ক’রে অমলকে রাস্তায় নামানোর প্ল্যান ভেস্তে গেল।’

শিবনাথ মৃদু হেসে মাথা নাড়ল।

‘কিন্তু এই পরোপকারীটি কে? হঠাৎ অমলের জন্যে তাঁর কেঁদে ওঠার কারণটা কি? রমেশ রায় উত্তরের আশায় সকলের মুখের দিকে তাকায়। পাঁচু মুখ ঘুরিয়ে কাটা ঠোঁট বাঁকা করে কি ভেবে যেন হাসে, লক্ষ্য ক’রে রমেশ আরো উত্তেজিত হয়ে উঠল।

‘তা যেখানেই চাঁদ যাক, আমি আমার রেস্টুরেন্টের পাওনা টাকা আদায় না ক’রে ছাড়ছি না। ইচ্ছে ছিল আজই এখনই লেংটা করিয়ে হারামজাদার পরনের কাপড়খানা খুলে রেখে দিই। জিনিসপত্র ছাই কি আছে চোখে তো দেখলাম। ভাঙা কড়াই আর ফুটো ঘটি একটা। ইশ এতগুলো টাকা আমার’–রাগে দুঃখে রমেশ দাঁত কিড়মিড় করছিল।

কিন্তু দেখা গেল তার দুঃখে সহানুভূতি জানাতে সেখানে বড় কেউ দাঁড়িয়ে নেই। পাঁচু সকলের আগে সরে পড়েছে। বিধু যেন এসব কথায় কান নেই, শেখরের উক্তি শুনে অত্যন্ত অপমান বোধ ক’রে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করতে করতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেছে। অমল চলে যাওয়ার পর ভুবন লাঠি ভর দিয়ে কষ্ট করে আর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন বোধ করে নি। রমেশের মন্তব্য শুনে হুঁ-হাঁ কিছু না বলে শেখর ডাক্তারও রুগীর বাড়ি যাবার তাড়া আছে জানিয়ে সরে পড়ল। রমেশের পাশে বলাই এবং শিবনাথ ছাড়া আর কেউ রইল না।

উঠোনের আর একদিকে দাঁড়িয়ে মেয়েরা জটলা করছিল। দশ নম্বর ঘরের লোকেরা এভাবে রক্ষা পাবে, তারা একটু আগেও ভাবতে পারে নি। ঘরের দরজা এখনো খোলা পড়ে আছে। হয়তো ঝাঁটপাঁট দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে পরে মদন ঘোষ এসে দরজায় তালা দেবে। নতুন ভাড়াটে আসছে কি না, কবে আসছে এবং ভাড়াটেরা কোথা থেকে আসবে ইত্যাদি আলোচনা এখনো আরম্ভ হয়নি। সেটা পরে হবে, অমল, তার বৌ কিরণ, অমল ও কিরণের উদ্ধারকর্তা চারু যায়, এমন কি কে. গুপ্তকে নিয়ে তাদের কথা হাসি টিপ্পনি ও রসিকতা শেষ হচ্ছিল না। ‘মাতালের বন্ধু মাতাল ছাড়া আর কিছু হবে না, তুমি খোঁজ নিয়ে দেখগে’, ঝগড়াঝাঁটি ভুলে গিয়ে সুনীতির মা বীথির মাকে বোঝাচ্ছিল, ‘হুট করে পকেট থেকে এতগুলো টাকা বার করে দিলে, বলি বিষয়খানা কি!’

‘অমলকে চাকরি দেবে শুনিয়ে গেল তো!’

‘চাকরি গাছের ফল না দিদি।’ মল্লিকা মাথা নেড়ে বলছিল, ‘আমার বলাটা ঠিক না, কিন্তু না বলে পারলাম না, কিরণের কপালে অনেক দুঃখ আছে। তোমরা দেখো।’

‘আহা আমি-তো আর কিছু ভাবছি না,’ প্রমথর দিদিমা হাত নেড়ে পাশে দাঁড়ানো হিরুর মাকে বোঝায়, ‘যেখানে গেছে যদি সুখে থাকে থাকুক, কথায় বলে কুকুর বিড়ালটা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে বুকটা খালি খালি ঠেকে, দশ নম্বরের দিকে যেন তাকাতে পারছি না। এমন কষ্ট হচ্ছে।’

সকলেই অমলের ছেড়ে-যাওয়া শূন্য ঘরের দিকে আর একবার চোখ ফেরায়।

‘মারধর করত, তা হলেও বৌটাকে খুব ভালবাসততা ছোঁড়া।’ বর্ষীয়সী মন্তব্য করল। ‘ওই ভালবাসাই তো হতভাগার মরণ হ’ল গো।’ হেসে লক্ষ্মীমণি প্রমথর দিদিমাকে বোঝায় : ‘আর মুখপুড়ির রূপও দিদি! আমাদের মেয়েদেরই দেখলে গা ছমছম করে। চব্বিশ- পঁচিশ বছর বয়স খুব হবে। দেখলে আঠারোর বেশি মনে হয় না। উঠতি বয়স। আজও সেই উঠতি বয়সের লকলকে এক একটা আগুনের শিখা যেন ছুঁড়ির হাত পা, আঙুল, ঘাড়, গলা, কোটা না!

‘ছোঁড়ার কেবল ভয় ওর বৌকে কে বুঝি ছিনিয়ে নেয়।’ প্রমথর দিদিমা দন্তহীন মাড়ি বার করে হাসল। ‘সেদিন ফিরিওয়ালার হাতের সঙ্গে কিরণের হাত ঠেকেছিল কি? আহা কী মার না মারল বৌটাকে ধরে।’

‘এ দু’দিন মারধর বন্ধ ছিল।’

দু’দিন কি ও ওর মধ্যে ছিল! ঘর ছাড়তে হবে লোটিশ পাবার পর মুখখানা শুকিয়ে আমসী হয়ে গেছল।’

‘দিদি বলছেন ভাল।’ মল্লিকার কথায় লক্ষ্মীমণি সায় দিতে পারল না। ‘ছোঁড়া গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ালেও যখন মারবার বৌকে ধরে মারবে। তা না। মুখ কালো করার অন্য কারণ আপনাদের তো জানায়নি। শনিবার রাত্রে কিরণ আমাকে কথাটা বলল।’

‘কি, কি শুনি?’

কৌতূহলী মুখগুলি লক্ষ্মীমণিকে দেখছিল।

‘ছেলেপিলে হবে কিরণের।’ লক্ষ্মীমণি ফিক্ করে হাসল।

ভুরু দুটো কপালে তুলে দিয়ে প্রভাতকণা আর্তনাদ ক’রে উঠল। ‘বলেন কি দিদি! এই বেকার অবস্থায়! ভাল হাতেই মরতে বসেছে দু’টিতে।’

‘আহা, সুনীতির মার কথা শুনলে রাগ ধরে! ঈশ্বর দিলে করবে কি? মানুষের হাত আছে নাকি!’ রাগ প্রকাশ না করে লক্ষ্মীমণি খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়ে। পড়ল না। জঠরে তারও সন্তানের ভার ছিল।

‘হুঁ’, রমেশগিন্নী মানে মল্লিকা টিপ্পনি কাটল : ‘দিদির জানবার কথা বটে। ফি বছর হাসপাতালে যাচ্ছে আর ফিরে এসে ঈশ্বরের সঙ্গে কোঁদল করছে কিনা।’

কিন্তু লক্ষ্মীমণি তখনো হাসি থামায় নি। ঠোঁটের অদ্ভুত একটা ইঙ্গিত ক’রে প্রভাতকণার নাদুসনুদুস হাতের মাংসে আঙুলের গুঁতো বসিয়ে বলছিল, ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা দিদি, ঈশ্বরের ইচ্ছা, হি-হি।’

এই লক্ষ্মীমণি আগের রাত্রে অম্বল না কিসের অসহ্য বেদনায় অস্থির হয়ে ছট্‌ ফট্ করছিল। এখন দেখলে বিশ্বাস হয় না, কেউ করবে না বিশ্বাস। বলাই ও রমেশ রায় একসঙ্গে উঠোন থেকে বেরিয়ে যাবার পরও একমিনিট একলা উঠোনে দাঁড়িয়ে শিবনাথ লক্ষ্মীমণির কথাবার্তা শুনে ঠোঁট টিপে হাসল। লক্ষ্মীমণি ও আরও কয়েকটি বর্ষীয়সী কথা বলছিল, মার পাশে দাঁড়িয়ে মুখে কাপড় গুঁজে সুনীতি। যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে উঠোনের মাটি দেখছিল। পূর্ণযৌবনা কুমারী। হাসি গোপন করে মা ও মাসিদের (এ বাড়িতে কুমারী ছাড়া মার বয়সের প্রত্যেক স্ত্রীলোককে মাসি ডাকা হয়) সন্তান হওয়ার তত্ত্বালোচনা শুনছে। কাজে বেরিয়ে গেছে বলে কমলা, প্রীতি, বীথি এবং রুচিকে দেখা গেল না। এসব আলোচনা শুনলে ওরা কি বলত চিন্তা করতে করতে শিবনাথ নিজের কাজে রাস্তায় চলে এল।

২৪

বনমালীর দোকানের সামনে চারু রায় ও কে. গুপ্তকে দেখে গেল। শিবনাথের ইচ্ছা ছিল আড্ডাটা এড়িয়ে যাবে। কিন্তু পারল না। কে. গুপ্ত তার জামার হাতা চেপে ধরল। ‘মশাই, সেজেগুজে কোথায় বেরোচ্ছেন। বসুন না। না হয় আপনারা কাজের লোক, আমরা অকম্মার ঢেঁকি। কিন্তু লোক নেহাত খারাপ নই। অমলের কত বড় একটা উপকার করে দিলাম। একবার জিজ্ঞাসা করুন না বনমালীকে। দশ টাকায় ঘোলপাড়ায় কেমন ঘর পেয়েছে। ইলেকট্রিক আলো শীগির আসছে। টিনের বেড়া, টিনের চাল। গরমের সময় গরম বেশি লাগবে। তা লাগলেও জলের বন্দোবস্ত এখানকার চেয়ে ঢের ভাল। আর ঘরখানাও ছোটর মধ্যে চমৎকার। জানালা মোটে একটা। তাহলেও–’

‘এসোসিয়েশনটা খারাপ।’ চারু রায় ভ্রূ কুঞ্চিত করল। শিবনাথ লক্ষ্য করল চারু রায়ের কপালে স্বেদবিন্দু। যেন এতক্ষণ কি গম্ভীরভাবে চিন্তা করছিল। পর পর অনেকগুলো সিগারেট খাওয়া হয়েছে। জুতোর আশেপাশে ছড়ানো পোড়া টুকরোর সংখ্যা দেখে শিবনাথ অনুমান করল। এখনও একটা মুখে জ্বলছে।

‘এসোসিয়েশন বলতে তুমি কি বোঝ আমি জানি না।’ কে. গুপ্ত বিশেষ সন্তুষ্ট নয় চারুর কথা শুনে। ‘কেন খোট্টা-বস্তি বলে সে? রিক্সাওলা ঠেলাওলারা আশেপাশে আছে এতে আপত্তি?’ নাকে শব্দ করে গুপ্ত হাসল। ‘এখানকার মানুষগুলো কি শুনি? চোর, বেশ্যা, সিফিলিটিক পেশেন্ট, আর আমার মতন পাঁচুর মতন মাতাল আর বনমালীর মতন রমেশের মতন খুনি নিয়ে তো পাড়ার এসোসিয়েশন, কি বলেন মশাই।’ প্রথমে শিবনাথ এবং পরে বনমালীর দিকে তাকায় গুপ্ত। ‘কথাটা মিথ্যা বললাম বনমালী?’

‘না না,-খুনিকে খুনি বলবে তাতে রাগ করার আছে কি।’ গুপ্তর কথায় রাগ করেনি প্রতিপন্ন করতে বনমালী হেসে মাথাটা দু’বার নেড়ে একজন খদ্দেরকে বিদায় করতে পেঁয়াজ ও লঙ্কা ওজন শেষ করে তাড়াতাড়ি বার্লির ডিবে খুলল।

চারু রায় বলল, ‘চমৎকার চা তৈরি করে দিলে কিরণ।

‘গুণী মেয়ে বাবা, গুণী মেয়ে।’ গুপ্ত বলল, ‘অদৃষ্টের বিপাকে পড়ে তো এই দশা হয়েছ। তা এর মধ্যেই জিনিসপত্র গুছিয়ে বসতে পেরেছে তুমি দেখে এলে?’

চারু মাথা নাড়ল। ‘বসতে পেরেছে মানে বসিয়ে দিয়ে এসেছি। বাজারে গিয়ে এটা-ওটা কেনাকাটা করে পর্যন্ত দিয়ে আসতে হ’ল।

‘তুমি মহাত্মা লোক।’ মৃদু হাসল গুপ্ত। ‘কিন্তু সাবধান রায়, এখনি মোক্ষম কথাটি ছাড়তে যেও না, অমলটা ভীষণ গোঁয়ার।’

‘পাগল।’ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে চারু আকাশের দিকে মুখ তুলল। ‘আগে অমলের একটা কাজ জুটিয়ে দিই, তারপর ধীরে-সুস্থে কথাটা না হয়–’

‘তাই।’ বনমালী সায় দেয়। ‘এখন সিনেমা-টিনেমার কথা বলতে গেলে রাগী লোক কি করতে কি করে বসে বুঝলেন না?’

চারু মাথা নাড়ল। চুপ করে সিগারেট টানল কতক্ষণ। তারপর আড়চোখে শিবনাথের দিকে একবার তাকিয়ে পরে কে. গুপ্তকে প্রশ্ন করল, ‘আর কার ওপর নোটিশ হয়েছে ঘর ছাড়বার বললে না তো তখন?’

‘বলাইর ওপর, আমার ওপর।’ গুপ্ত হাত বাড়িয়ে বন্ধুর সিগারেটের টিন থেকে সিগারেট তুলল। ‘আমাকে রোজই আলটিমেটাম দিয়ে যাচ্ছে পারিজাতের লোক।’

‘তা তুমি যে এখনো বড় টিকে আছ!’ চারু মৃদু হাসল, ‘আন্য রকম বন্দোবস্ত হয়েছে নাকি রায় সাহেবের ছেলের সঙ্গে? যাওয়া-আসা আছে?’

‘আমি প্রস্রাব করতেও পারিজাতের কুঠিতে যাব না’ মাটিতে থুথু ফেলল গুপ্ত। ‘মদন ঘোষের মুখে শুনেছে কে. গুপ্তর একটা এম-এ ডিগ্রী আছে। গত মাসে বলে পাঠিয়েছিল বাচ্চাদের জন্যে একজন প্রাইভেট টিউটার পাচ্ছে না। আমাকে দিয়ে হবে কি না।’

‘তা নাও না তুমি ওটা।’ সোৎসাহে বনমালী মাথা নাড়ল। ‘এমনি তো বসে আছ। ঘরভাড়াটা মাপ পাবে, আর তার ওপর মাস মাস নগদ কিছু নগদ কিছু দেবেও নিশ্চয়। পারিজাতের তো পয়সার অভাব নেই। ‘

পরামর্শ শুনে কে. গুপ্ত হঠাৎ কোন কথা বলল না।

‘আমি এখন উঠি গুপ্ত।’ চারু উঠে দাঁড়ায়।

‘আচ্ছা।’ গুপ্ত মাথা নাড়ল। ‘আবার কবে আসছ?’

‘আসব। কবে কখন তার কিছু ঠিক নেই। হয়তো কালই আবার আসছি। আসতে হবে।’ চারুর ঠোঁটে সূক্ষ্ম অর্থব্যঞ্জক হাসি শিবনাথের চোখে এড়াল না।

‘চলি মশাই।’শিবনাথের দিকে তাকিয়েও চারু মাথা নাড়ল। শিবনাথ হেসে ঘাড় কাত করল। অদূরে সুপুরি গাছের গুঁড়ি ঘেষে চারুর হলদে টু-সীটার দাঁড়িয়ে। সেদিকে যেতে যেতে চারু শিস দেয়।

‘উদ্যোগী পুরুষ।’ বন্ধু দূরে সরে যেতে কে. গুপ্ত হেসে বনমালীর দিকে তাকায়।

‘কাপ্তান লোক।’ বনমালী হাসে। ‘তা তোমার বন্ধু এমনটি না হয়ে যায়।’

‘মায়া-কানন ছবিতে আজকের সিনটাও থাকবে নাকি?’ শিবনাথ হঠাৎ প্রশ্ন করতে কে. গুপ্ত চমকে উঠল।

‘কোন্ সিন্, কিসের সিন্?’

‘এই যে অমল আর তার স্ত্রীকে বাড়িওয়ালার লোক এসে অপমান করছিল।’ শিবনাথ হাসে। ‘হুঁ’।’ গুপ্ত এবার গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বার করল। ‘বলেছি তো মশাই,–আগুন, এপিডেমিক, বলাৎকার, রাহাজানি, খুন, জখম, উচ্ছেদ, উৎপীড়ন বস্তিজীবনের কিছুই বাদ দিচ্ছে না চারু। খাওয়া নেই ঘুম নেই, রাতদিন এ পাড়ায় ঘুরঘুর করছে কি ও সাধে! ছবির মালমশলা যোগাড় করছে।’

শিবনাথ প্রকাণ্ড এক ঢোক গিলে চুপ করে রইল। কিন্তু গুপ্ত চুপ ছিল না। যেন চারুর সামনে বনমালীর প্রস্তাবের যোগ্য উত্তর দিতে ইতস্তত করছিল। চারু চলে যেতে খুব এক হাত নিলে বনমালীর ওপর।

‘আমি বসে আছি কি ঘাস কাটছি তাতে তোর কি? চারু আমার বন্ধু হলেও এখানে সে তৃতীয় ব্যক্তি, কি বলেন আপনি?’ চকিতে শিবনাথকে দেখে কে. গুপ্ত বনমালীর দিকে ঘাড় ফেরাল। ‘আমার ইচ্ছা নেই, তাই পারিজাতের ছেলেমেয়েদের ভালতে আমি সাহায্য করছি না। কী হবে লেখাপড়া শিখিয়ে শুয়ারের বাচ্চাগুলোকে। গলা পর্যন্ত খায়, খাটপালঙ্কে ঘুমোয়। বেশ আছে। বাপের টাকায় এখন ঘি-দুধ খাচ্ছে, বড় হলে মদ খাবে, মেয়েমানুষ পুষবে। সাবেককালে এই করত সব পয়সাওলা ঘরের ছেলেরা। দেশ ঠাণ্ডা থাকত, শান্তি ছিল ঘরে ঘরে। এখন শালারা লেখাপড়া শিখেই আরম্ভ করে রাজনীতি, ইলেকশন ফাইট, ধুয়া ধরে সোশ্যাল রিফর্মেশন, সার্ভিস ফর হিউম্যানিটিজ সেক্।’

‘মানে লোকের মাথায় বাড়ি দেবার যত ফন্দিফিকির আছে সব শেখে, তুমি বলছ?’ ইংরেজী শব্দগুলো না বুঝলেও বনমালী আন্দাজ করে নেয়।

‘আলবৎ। সংক্ষেপে বনমালীর প্রশ্নের জবাব দিয়ে কে. গুপ্ত তৎক্ষণাৎ শিবনাথের দিকে তাকিয়ে। ‘মশাই, ব্রিটিশের আমলে ‘ড্রাই-ডে’ কথাটা শুনেছেন কখনো?’

‘না।’ শিবনাথ কে. গুপ্তর চেহারা দেখে হাসে।

‘হাসবেন না। আরে আহাম্মক, তোরা যে রিফর্মেশন বলতেই সকলের আগে মঙ্গলবারটাকে শুকনো ক’রে দিলি এত লাভ কি হল?’

‘ঐ একটা দিন অত্যন্ত তোমাদের পয়সাটা জলে গেল না এই লাভ, তা ছাড়া হপ্তায় একদিন গলা শুকনো রাখলে আস্তে আস্তে যদি তোমাদের স্বভাব পাল্টায়।

‘স্বভাব পাল্টায়।’ বনমালীর কথা শুনে কে. গুপ্ত গর্জন করে উঠল। ‘খুব খবর রাখিস কি না। খোঁজ নিয়ে দ্যাগে ছ’ দিনে যে পরিমাণ মদ বিক্রী হয় তার আট গুণ বেশি কাটে ঐ ড্রাই-ডেতে। রিফর্মেশন!’ কথা শেষ করে কে. গুপ্ত শিবনাথের দিকে মুখ ফেরায়। কোন কথা না বলে শিবনাথ মৃদুমন্দ হাসে।

‘মশাই, এ তল্লাটে এসে বাসা নিয়েছি যেদিন সেদিনই আমি এখানকার ইতিবৃত্ত শুনলাম। রায়সাহেবের আমলে আনাচে-কানাচে পাঁচ-সাতটা ঘর ছিল। কমজোরি কেরোসিনের ডিবের মত টিমটিম করে জ্বললেও খেয়ে পরে এক রকম সুখেই তারা কাটাচ্ছিল, পারিজাত এসে সবগুলোকে খেদিয়ে দিয়েছে। কারণ? পাবলিক ওম্যান পাড়ায় থাকলে আমি আপনি খারাপ হয়ে যাব–হা-হা।’

‘অত মন খারাপ করছ কেন, একটা পয়সা খরচ করে খেয়া পার হয়ে খালের ওপারে চলে যাও, ডজন ডজন মিলবে। দ্যাখোনি সন্ধ্যাবাতি জ্বলতে তোমার মেনকা রস্তারা গলির মুখে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানে।

বনমালীর কথায় কান ছিল না, শিবনাথের চোখে চোখ রেখে কে. গুপ্ত বলল, ‘এখন পারিজাতের বাচ্চারা লেখাপড়া শিখে আবার কোন্ রিফর্মেশনে হাত দেবে সেই ভয়েই মশাই আমি সারা হয়ে যাচ্ছি। আমি করব ওদের ট্যুইশনি–রাম! এ যে নিজের পায়ে কুড়োল মারার সামিল হবে, কি বলেন মশাই?’

শিবনাথ কিছু বলল না।

‘তোমার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে গুপ্ত।’ হিসেবের খাতা থেকে মুখ তুলে বনমালী একটা বিড়ি ধরায়। ‘তা নোটিশ যখন হয়ে গেছে, এ মাসে না হোক সামনের মাসে মদন ঘোষ তোমাকে তুলে দেবে ঠিকই। তখন কি করবে,–না কি ঘোলপাড়ায় ঘরটায় ঠিক করা আছে, কিরণদের বস্তিতে ঘর খালি আছে কিনা খোঁজ নিয়েছ?’

যেন এবারও বনমালীর কথায় কান দেবার বিশেষ ইচ্ছা নেই, মুখের এমন ভাব করে কে. গুপ্ত ওপরের দিকে তাকাল। ‘সে যেদিন মদন লোকজন নিয়ে তুলতে আসবে সেদিন ঠিক করা যাবে। আমার শালা পারিজাতের খোঁয়াড়, ঘোলপাড়ার ঘর, গাছতলা আর তোর দোকানের সামনের এই ভাঙা বেঞ্চি সব সমান।’

শিবনাথ একটি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। সূর্য ডুবে গেছে। গাছের মাথাগুলো কালো। ইস্কুল সেরে রুচি এখন বাড়ি ফিরবে। মনে পড়তে শিবনাথ চট্ করে উঠে দাঁড়ায়।

‘আহা, বসুন না।’গুপ্ত আবার শিবনাথের হাত চেপে ধরল। ‘কি এমন হাজারটা কাজ ফেলে এসেছেন যে একটু বসে গল্পসল্প করার সময় হয় না আপনার। কেন আমার সঙ্গে আড্ডা মারছেন মহিষী এসে দেখতে পেলে রাগ করবেন? তাঁর কি এখুনি ফেরার সময় হল?’

‘না না, তা না।’মনে মনে বিরক্ত হলেও শিবনাথ সেটা মুখে প্রকাশ করল না। ‘একটু কাজেই বেরোচ্ছি, সন্ধ্যার পর এসে আবার গল্প করা যাবে।

গুপ্ত শিবনাথের হাত ছেড়ে দেয়।

‘তবে শুনুন।’হাত ছেড়ে দিয়ে চোখের ইঙ্গিতে শিবনাথকে তার মুখটা একটু কাছে সরিয়ে আনতে অনুনয় করে! শিবনাথ গুপ্তর মুখের কাছে গলা বাড়িয়ে দেয়। ‘বলুন।’

‘আনা চার-ছ পয়সা ধার দিতে পারেন?’

‘ছ’ আনা হবে না।’ শিবনাথ পকেটে হাত ঢোকায়। ‘আনা তিনেক দিতে পারি।’

‘তাই দিন তাতেই চলবে।’ খসেখসে স্বর কে. গুপ্তর। কিছু মুড়ি মুড়কি আর এক পেয়ালা চা দিয়ে শালাকে ঠাণ্ডা করা যাক। সেই সকাল থেকে কিছু পড়েনি আর এমন কাঁইকুঁই করছে।’ নিজের পেটের ওপর হাত রেখে কে. গুপ্ত এবার গুজ গুজ করে হাসল : ‘দিন তিন আনা, দ্যাটস এনাফ্। এর বেশি দিতে না পারলে কথা কি।’

শিবনাথ কথা বলল না। কে. গুপ্তর প্রসারিত হাতের তেলোয় একটা দু’আনি ও দুটো ডবল ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তার দিকে পা বাড়াল।

‘তা, বুঝলেন মশাই, সন্ধ্যার পর একবার আসুন।’ গুপ্ত পিছন থেকে ডাকল, শিবনাথ তাকায় না, ঘাড় কাত করে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।

‘তোমার ওই সোনার চারু বন্ধুর কাছ থেকে এক আধটা টাকা ধার চেয়ে নিয়ে এবেলা চারটি ভাতটাত খাওয়ার ব্যবস্থা করলেই পারতে, চিনাবাদাম আর মুড়কি চালাবে কত!

‘তুই চুপ কর, তুই থাম গাছা। চারুর কাছে এখন আমি ভাতের পয়সা চাই। কাফে-ডি- রিওতে বসে বারো বছর এক সঙ্গে গ্লাস টেনেছি কি না। মুদির আর বুদ্ধি হবে কত?’

বনমালী চুপ করে রইল।

‘বন্ধু কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তি, কথাটা মনে রাখবি। ওর কাছে দু আনা চার আনা কি টাকাটা আধুলিটা ধার চাওয়া যায় না।’

‘তাও বটে। মোটা কমিশন পাবে অমলের গিন্নী যদি এক আধটা বইয়ে নামে। এখন আর খুচরো ধার-ফার চেয়ে হাত কালো করে লাভ নেই।’

কে. গুপ্ত কিছু বলল না।

কেননা, হঠাৎ দূরে রুচিকে দেখা গেছে। এক হাতে একটা ব্যাগ আর এক হাতে মেয়ের হাত ধরা। যে-হাতে ব্যাগ সেই হাতে দুটো কমলালেবু।

দোকানের সামনে দিয়ে শিবনাথের স্ত্রী যতক্ষণ পর্যন্ত হেঁটে রাস্তাটা পার হয় এবং বাড়িতে ঢোকে ততক্ষণ কে. গুপ্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

‘অত তাকিয়ে দেখছ কি, গিলে খাবে নাকি।’ বনমালী এক সময় হিসাবের খাতা থেকে মুখ তোলে।

কে. গুপ্ত দোকানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল।

‘কি বললি?’

‘বলছিলাম তুমি তো তাকাও, কিন্তু খুকির মা-টি একদিনও তোমার দিকে চোখ ফেরাল না। সোজা অন্দরে চলে যায়।’

গুপ্ত কথা বলল না।

‘বেশি লেখাপড়া জানা মেয়ে কি না তাই অহংকার মনে মনে।’ বনমালী বলল, ‘আমাদের বিশেষ ভাল চোখে দেখেন না। তোমাকে ভাবে রাস্তার একটা মুদির বন্ধু। অর্ডিনারী লোক।’

‘বেশ তো, আমিও ওর চোখে কিছু স্পেশ্যাল হতে চাইনে।’ কে. গুপ্ত পায়ের কাছ থেকে বন্ধু চারু রায়ের ফেলে দেওয়া পোড়া সিগারেটের একটা বড় টুকরো কুড়িয়ে নেয়। সেটা মুখে গুঁজে বলে, ‘দে দেশলাই।’

ইস্কুলের মাস্টারনী তার আবার অত দেমাক।’ এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে গুপ্ত বলল, ‘আমি মহিলার রূপযৌবন না, লক্ষ্য করছিলাম আজ চেহারাখানা।’

‘কি ব্যাপার।’ বনমালী ফিসফিস করে উঠল। ‘কিছু হয়েছে নাকি?’

‘মহাশয়টি বেকার।’

কে? তার স্বামী? এই যে এখানে এতক্ষণ বসে ছিল, শিবনাথবাবুটি?’

‘হ্যাঁ, মহারাজ হ্যাঁ, পরশু দিন কথাটা বেরিয়ে পড়েছে। এতকাল ঢাকা-চাপা ছিল। তা বেকারি কে কতকাল ঢাকতে পেরেছে। পরশু রাত্রে দু’জনে রীতিমত ঝগড়া, কথা কাটাকাটি। বেশি রাত করে বাড়ি ফিরলে বেবির মা আমার ঘরে ঢোকা বন্ধ করে দেয় জানিস তো। পরশু রাত্রে বারান্দার শুয়ে শুয়ে সব শুনলাম। ওদের ঘরের চৌকাঠের কাছে আমার মাথাটা ছিল।’

‘কিন্তু ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে তো মনে হয় না যে উনি ইয়ে হয়েছেন?’

‘এসব লোক ডেঞ্জারাস, বুঝলি। কে. গুপ্ত অনেকটা নিজের মনে হাসল। ‘এরা মুখে তা কখনো প্রকাশ করে না।’

‘তাই বলো।’বনমালী সায় দেয়। ‘আমি বলি এই আদমি খুন করতে পারবে। এ্যাঁ, দু’বেলা এখানে আসছে বসছে গল্প করছে, মুখ দিয়ে একদিন বার করল না যে চাকরিটি নেই। কই তুমি তো পারনি। প্রথম দিনই তো সব খুলে বললে।’

‘বৌ একটাতে লেগে আছে কিনা তাই যা এখনো ঢেকে রাখতে পারছে।

‘কাল যদি বৌয়ের ওটা যায়?’

কে. গুপ্ত মাথা নাড়ল। ‘গেলেও ভান করবে যায়নি।’

‘লাভ কি’, বনমালী বলল, ‘ওরা না বলে, দু-চার ছ’দিন কি ধরো এক মাস, রকম সকম দেখে কারো তো আর বুঝতে বাকি থাকে না?’

‘তা না থাকলেও মুখ দিয়ে এটা প্রকাশ না করার মধ্যে একটা বাহাদুরি আছে বলে ওরা মনে করে–হা-হা।’ গুপ্ত এবার জোরে জোরে হাসল। ‘অমল ঢাকতে পারেনি, বলাই পারছে না, আমি শৰ্মা এক বেলাও পারলাম না, কিন্তু উনি পারবেন, ওঁর স্ত্রী পারবেন, এক নম্বর ঘরের, কি নাম হারামজাদীর?–কমলা পারবে, ভুবনবাবুর মেয়েরাও হয়তো পারতে পারে,–কিন্তু আজ বিধু মাস্টারের চাকরি যাক, দেখবি কাল সকালে পায়খানার কি নর্দমার পিছনের শ্যাওড়া গাছটায় ওর শরীরটা ঝুলছে।

‘তোমরা সব বলদ কি না, তুমি, অমল, বিধু মাস্টার।’বনমালী দোকানে সন্ধ্যাদীপ দেখায় : ‘হরি বোল্ বোল্ হরি, শ্রী প্রেমানন্দে হরি হরি বোল্ হরি।’ কাঠের ক্যাশবাক্সের গায়ে মাথাটা তিনবার ঠকাস ঠকাস ঠেকিয়ে ধূপদানিটা হাত থেকে নামিয়ে বনমালী কথাটা শেষ করলে; ‘ওরা বেশী সেয়ানা, অতি চালাকের দল, ঠেকতে ঠেকতেও চলে যায়, পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়ায়।’

‘যা বলেছিস।’ শব্দ না করে কে. গুপ্ত হাসল। অন্ধকার। তা হলেও দেখা যাওয়ার মতন একটা দাঁতও গুপ্তর আস্ত ছিল না। স্পিরিটে সবগুলোর মাথা ক্ষয়ে গেছে। মাটিতে থুথু ফেলে বলল, ‘আমি বলদের বাড়া। না হলে কি আর একটি বেকারের কাছে চা-মুড়ির পয়সা চাই। যাকগে–তুই যে ধানাই-পানাই নানান কথা শুনিয়ে আমায় ভুলিয়ে রাখছিস, এক আধটা পাঁইট হবে নাকি। আজ সাত দিন বকে বকে গলা শুকিয়ে গেল,–কই তোর তো কোন সাড়া পাচ্ছি না।’

ঝিঁঝি ডাকছিল। তা হলেও বনমালীর গলাটা কম স্পষ্ট ছিল না।

‘বাজার মন্দা গুপ্ত, বাজার খারাপ। দেখছো তো বেচাকেনার অবস্থা। আমার আরো একটা মোটা টাকা লোকসান হয়েছে অন্য ব্যাপারে। শালা ব্যবসার কারবারের আগা পাছা কিছু বুঝবে না, তবু হাত লাগায়। বখরা পাব আমি। আরে আশ্বিনের আগে পিঁয়াজ পচবে না, আমায় তুই শেখাবি? আমি তো জানি তোর বাণিজ্যের অংশীদার হয়ে ঘরের টাকা আমি খালের জলে ফেললাম ধাপার মাঠের বিষ্ঠায়। হাঁসের গুয়ের বুদ্ধি নেই তোর মাথায়, তুই করবি হাঁসের ডিমের কারবার।’

কবে কার সঙ্গে ডিমের ব্যবসায় টাকা ঢেলে বনমালী বড় রকমের মার খেয়েছে, সেই সম্পর্কে প্রশ্ন করা নিরর্থক ভেবে গুপ্ত উঠে দাঁড়াল।

‘তোমার ইচ্ছা হয় খাওয়াবে, না হয় খাওয়াবে না। বললাম। হাতি পা ভেঙে তোমার দুয়ারের সামনে হেঁট হয়ে পড়েছে, দেখতেই তো পাচ্ছ। তাই বলে তো আর–’

অস্পষ্ট এবং বেশির ভাগ ইংরেজী শব্দ ছিল বলে বনমালী শেষের দিকের কথাগুলো বুঝল না। তা ছাড়া শুনলও না আর তেমন কিছু। কে. গুপ্ত রাস্তায় নেমে কবিতা আওড়ায় :

Nothing is so beautiful
as spring-
When weeds, in wheels, shoot
long and lovely and lush-

‘কে? কে?’

গুপ্তর পিছনে লোক হাঁটছিল।

তারা বলাবলি করছিল, ‘নাম কি, কোথায় থাকে?’

‘থাকে এখানকার একটা বস্তিতে। ইংরাজীতে ফার্স্ট ক্লাস এম-এ।

‘এই অবস্থা কেন?’

বেকার।’

‘ব্যবসাট্যাবসা করতে পারছে না, টুকিটাকি অর্ডার সাপ্লায়ের কাজ? মাস্টারি? হ্যাঁ কোটটা একেবারে ছেঁড়া।’

বস্তুত কথাগুলো শুনেও গুপ্ত পিছনের দিকে তাকায় না। খালি পা। দু’দিন এখন খালি পায়েই চলাফেরা করছে। সেদিন ডোমপাড়ায় আগুন দেখতে গিয়ে ছেঁড়া চটির একটি খুইয়েছে। বনমালী বলছে যে রমেশ রায়ের কুকুরটা তার একপাটি চটি মুখে নিয়ে গেছে সে দেখেছে। কিন্তু গুপ্ত বনমালীর কথায় বিশ্বাস করে না। গুপ্তর সন্দেহ জুতোও ওরা সরিয়ে ফেলে ইত্যাদি। পিছনের লোকটি তার সঙ্গীকে বলছিল ‘পুঁথি-পড়া বিদ্যা, প্র্যাক্টিক্যাল নলেজ নেই, বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক হয়তো কোনোকালেই ছিল না, সুখের চাকরি করত, আজ বেকার হয়ে আর একটা কিছু জোটানোর মত ফন্দিফিকির মাথায় আসছে না, তাই এ-দুরবস্থা।’

লোক দুটিকে এগিয়ে যাবার পথ দিতে কে. গুপ্ত সরু রাস্তার একপাসে সরে বাসকের জঙ্গল ঘেঁষে একটু সময় দাঁড়ায়। ঝিঁঝির ডাকের মতন পুরনো মামুলি একঘেয়ে বচন আওড়াতে আওড়াতে ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার পর জঙ্গল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আবার হাঁটতে লাগল। ‘ননসেন্স।’ গুপ্ত নিজের মনে বিড়বিড় করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *