০৫. কাব্যের ক্রমবিকাশ

পঞ্চম অধ্যায় – কাব্যের ক্রমবিকাশ

আদিম শিকারির ও খাদ্যসংগ্রহকারীর চিৎকারে হল কবিতার জন্ম, মানুষ যখন নিজেকে পরিবর্তন করে প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করতে চাইল। প্রকৃতির মধ্যে মানুষ নিজেকে নিক্ষেপ করত সচেতন হয়ে, কারণ যা সামাজিক তা সচেতন হবেই। সকলে একসঙ্গে মিলিত না হলে শিকার করা বা খাদ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হত না। এই আদিম যুগে মানুষের অন্তর থেকে তাই উৎসারিত হত প্রকৃতির অনুকৃতি (Mimicry)।

তারপর মানুষ নিজেকে ছেড়ে প্রকৃতিকে নিজের উদ্দেশ্যসাধনের উপযোগী করে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করল। পশুপালন, ফসল উৎপাদন প্রভৃতি আরম্ভ হল। সমাজের রূপ অবশ্য তখনও বিশেষ বিভেদ—ম্লান হল না, সংঘ—সৌন্দর্য বজায় রইল। সে—যুগের কাব্য তাই রূপ গ্রহণ করল প্রার্থনায়, স্তবস্তোত্রে, মিলিত সংঘ—সংগীতে।

প্রকৃতি সমাজের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হয়ে সমাজে করল বিভেদ সৃষ্টি, ক্রমে দুটি পরস্পর—বিরোধী অংশে সমাজ গেল বিভক্ত হয়ে। শ্রমবিভাগের ফলে হল সমাজবিভেদ। গ্রাম্য ও কৃষি সভ্যতার ফলে একদল হল শাসকশ্রেণি, আর—একদল হল গোলামশ্রেণি। প্রকৃতি বনাম মানুষের সংগ্রাম পরিবর্তিত হল মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্রামে। ধর্মসংগীত রূপান্তরিত হল মহাকাব্যে ও গল্পে এবং নূতন কাব্যের উপাদান হল ন্যায়—অন্যায়, আনন্দ ও প্রেম। ব্যক্তিগতভাবে মানুষ এই সর্বপ্রথম নিজেকে ব্যক্ত করল কাব্যের মধ্য দিয়ে এবং গীতিকবিতার জন্ম হল।

ধনতান্ত্রিক সমাজ হল তার পরের পর্যায়, বুর্জোয়া শ্রেণি হল শাসকশ্রেণি। ধনতন্ত্রের ক্রমোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণির পরিবর্তন, পরিবেষ্টনের বৈপ্লবিক প্রগতি ও কাব্যের ক্রমবিকাশ বিশেষভাবে প্রণিধেয়।

ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রারম্ভে হল প্রাথমিক সঞ্চয়ের (Primitive Accumulation) কাল, মোটামুটি ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময় বুর্জোয়া শ্রেণির শক্তি সঞ্চয়ের সময়, কারণ রাষ্ট্র তখনও বুর্জোয়া—রাষ্ট্র হয়নি, বা বুর্জোয়া শ্রেণি এমন রাজনৈতিক প্রতিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি, যার মধ্যে আত্মপ্রকাশ পরিপূর্ণভাবে সম্ভব। সুতরাং এই সময়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা—জনিত বিশৃঙ্খলা থাকা খুবই স্বাভাবিক। এই সময় প্রত্যেক বুর্জোয়ার মনের মধ্যে এই ভাবই জাগ্রত রইল যেন তার স্বাধীনতাকে চারদিক থেকে নিয়মকানুন দ্বারা শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছে, এবং জীবনের সৌন্দর্য ও স্বাধীনতা একমাত্র আত্মাকাঙ্ক্ষার উচ্ছৃঙ্খল প্রকাশ দ্বারাই লভ্য। তাই এই কালের মনোভাব হল বিদ্রোহী। ব্যক্তিগত ইচ্ছা—আকাঙ্ক্ষা অন্য সব ইচ্ছাকে অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বেহিসেবি হল, এবং তার বহিঃপ্রকাশ হল আত্মদৃঢ়তা ও আত্মসবলতার মধ্যে। এলিজাবেথীয় যুগের জীবনধর্ম হল বিপ্লবী, কারণ সামন্ততন্ত্রের কাঠামোকে ধূলিসাৎ করে ধনতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে হলে প্রয়োজন স্বেচ্ছাচারী সম্রাটের মতো শক্তির প্রয়োগ। সেইজন্য এলিজাবেথীয় কাব্যের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল রাজকীয় আত্মসংকল্প, বলিষ্ঠ বুর্জোয়ার আত্মপ্রতিজ্ঞা, এবং তার লক্ষ্য ছিল যাবতীয় প্রচলিত বিধিনিষেধকে বিলীন করে নিজের জয়বার্তা ঘোষণা করা।

মার্লো, চ্যাপমান, গ্রিন, বিশেষ করে শেক্সপিয়র এই প্রাথমিক ধনতান্ত্রিক যুগের আত্মম্ভরী মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। লিয়র, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, অ্যান্টনি, ট্রয়লাস, ওথেলো, রোমিও, কোরিওলেনাস—শেক্সপিয়রের নাটকের প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে শুধু একটি সুরই ঝংকৃত হয়, এবং সে—সুর হচ্ছে নায়কের ব্যক্তিত্বকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করবার অদম্য সংকল্প। বদান্যতার যুগকে নূতন বুর্জোয়া শ্রেণি সসম্মানে বিদায় দিয়েছে, সে—গুণের আজ আর কোনো আকর্ষণ নেই, তাই ফলস্টাফ ও আর্মাডো প্রভৃতি চরিত্রের অবতারণা। শেক্সপিয়র তাঁর সমসাময়িক সমাজকে যে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর ট্র্যাজেডি রচনার উৎকর্ষ থেকে। করুণা ও ভয় সংমিশ্রিত মনোভাব জাগ্রত করা ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য, শুধু তা—ই নয়, ট্র্যাজেডি “effects a Katharsis of them”, এবং শেক্সপিয়রের শিল্পমাহাত্ম্য হচ্ছে এই ট্র্যাজেডি রচনার সাফল্যের মধ্যে। আরিস্ততল (Aristotle) ‘Katharsis’ শব্দ বিশুদ্ধীকরণ (Purification) অর্থে ব্যবহার করেননি। সংগীতের দৃষ্টান্ত দিয়ে আরিস্ততল বলেছেন, যেকোনো উদ্দীপক সংগীতের গুণ হচ্ছে উদ্দীপ্ত মানুষকে প্রশান্তি ও আনন্দ দান করা—‘‘By the administration of like emotion… excessive emotion is purged away, and the process is accompanied by feelings of pleasure.” মনের মধ্যে সমভাব উদ্রিক্ত হয়ে অতিরিক্ত ভাব নিষ্কাশিত হয় এবং আনন্দানুভূতি জাগে। মিলন তাঁর ‘Samson Agonistes’—এর ভূমিকায় আরিস্ততলের Katharsis—এর ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে লিখেছেন যে ট্র্যাজেডির লক্ষ্য হচ্ছে : “…to be of power by raising pity and fear, or terror, to purge the mind of those and such like passions, that is to temper and reduce them to just measure with a kind of delight, stirred up by reading or seeing those passions well imitated.” ট্র্যাজেডিয়ান হিসাবে শেক্সপিয়রের মহত্ত্ব ও সাফল্য এইখানে। তৎকালের বুর্জোয়া শ্রেণির অহংসর্বস্বতা, আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য প্রচেষ্টা, ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে যাবতীয় বাধাবিপত্তির প্রতি তাচ্ছিল্যভাব—এইসব শেক্সপিয়রের নায়কদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কোথাও এই ‘অহম’ বহির্জগতের সঙ্গে বিভক্ত হয়ে সংগ্রামরত, যেমন হ্যামলেটে; কোথাও উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে এই ‘অহম’—এর প্রতিষ্ঠা, যেমন ম্যাকবেথে; কোথাও প্রেমের সাহজিক ধর্মপালনে, যেমন ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ ও ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপাট্রায়’। নিজের ইচ্ছার ও সংকল্পের উপর নিজের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিনায়কত্বই প্রত্যেকটি চরিত্রের করুণান্ত পরিণতির কারণ, অর্থাৎ ট্র্যাজিক, এবং তৎকালের বুর্জোয়া শ্রেণির মনে এই সমভাব উদ্রেক করে, Katharsis—এর ফলে আনন্দ দান করতে হলে ট্র্যাজেডির সাহায্য ব্যতিরেকে উপায় ছিল না। শেক্সপিয়র মহৎ শিল্পী ছিলেন এবং সমসাময়িক সমাজের অন্তরে প্রবেশ করবার মতো তাঁর গভীর দৃষ্টি ছিল। শেক্সপিয়র সেইজন্যই ট্র্যাজেডিয়ান এবং তাঁর শ্রেষ্ঠতাও ট্র্যাজেডির মধ্যে।

শেক্সপিয়রের নাটকের চরিত্রগুলির আর—একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের কর্মমুখরতা ও গতিশীলতা। প্রত্যেকটি চরিত্র ‘নায়ক’ (Hero) নামের যোগ্য। তাদের জীবন ঐতিহাসিক জীবন, সত্য ও প্রাণবন্ত জীবন। জীবনের স্পন্দন প্রত্যেকটি চরিত্রের সংগ্রাম, বিরোধ ও দ্বন্দ্বের ভিতরে অনুভূত হয়। নিঃসন্দিগ্ধ ওথেলো পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভেনেশিয়ান সেনেটরের কন্যা ডেসডেমোনাকে বিবাহ করল। কিন্তু ক্যাসিওর লেফটেন্যান্ট পদের ঈর্ষায় জর্জরিত আয়াগোর বৈরিতাকে জয় করতে না পেরে ওথেলো প্রিয়তমা ডেসডেমোনাকে সন্দেহ করে হত্যা করল এবং নিজের ধ্বংসকে নিজেই আহ্বান করল। ওথেলোর চরিত্র এখানে জীবন্ত, পরিবেষ্টনসাপেক্ষ। মায়ের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিহিংসা—তাড়িত হ্যামলেট নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধ্বংস করল। কোর্ডেলিয়াকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে উদ্ভ্রান্ত পিয়র ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রির মধ্য দিয়ে পরিশেষে কারাগারে মৃত্যুকে বরণ করল। ব্রিটেনের লুপ্ত ঐশ্বর্য ও সৌভাগ্য পুনরুদ্ধার করবার দায়িত্ব রইল জোনারিলের স্বামী এলরানির উপর। রাজসিংহাসনকামী ম্যাকবেথ সত্যই যখন শুনল যে প্রেতদের কথামতো বির্নাম বন এগিয়ে আসছে, তখনও সে শত্রুর কাছে নিজেকে দান করেনি। ম্যাকডাফের সুমুখে যখন ম্যাকবেথ শুনল যে সে “untimely ripped from his mother” তখনও সে হতাশ হয়ে জানু নত করেনি, ঘোরতর সংগ্রাম করে মৃত্যুকে বরণ করেছে। এইভাবে শেক্সপিয়রের নাটকের প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে বাধাবন্ধনহীন ব্যক্তিত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে, এবং সে—প্রকাশ উচ্ছৃঙ্খল নয়, পরিবেষ্টনের ঘাতপ্রতিঘাতে ক্রিয়াশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল। তাদের কার্যকলাপ, তাদের ধ্বংস, মৃত্যু, সবকিছুই সেইজন্য করুণ মনে হয়, গরিমা কোথায় যেন তারই মধ্যে আত্মগোপন করে থাকে। হেজলিট শেক্সপিয়র—সৃষ্ট চরিত্রের সঙ্গে চসারের (Chaucer) চরিত্রের তুলনা প্রসঙ্গে এই কথাই বলেছেন।

Chaucer’s characters are sufficiently distinct from one another, but they are too little varied in themselves, too much like identical propositions. They are consistent, but uniform, we get no idea of them from first to last, they are not placed in different lights, no rare their subordinate traits brought out in new situations : they are like portraits or physiognomical studies, with the distinguishing features marked with inconceivable truth and precision, but that preserve the same unaltered air and attitude. Shakespeare’s are historical figures, equally true and correct, but put into action, where every nerve and muscle is displayed in the struggle with others, with all the effect of collision and contrast, with every variety of light and shade…

In Chaucer we perceive a fixed essence of character. In Shakespeare there is a continual composition and decomposition of its elements, a fermentation of every particle in the whole mass, by its alternate affinity or antipathy to other principles which are brought into contact with it. Till the experiment is tried we do not know the result, the turn which the character will take in its new circumstances. (Italics লেখকের)

 (William Hazlitt—The Characters of Shakespeare)

”চসারের চরিত্রগুলির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও কোনো বৈচিত্র্য নেই। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের সম্বন্ধে কোনো ধারণা গড়ে ওঠে না। বিভিন্ন কোণ থেকে তাদের উপর আলোকসম্পাত করা হয় না, ফলে তারা বহুবর্ণ—রঞ্জিত একটি সমগ্র চিত্র না হয়ে প্রতিকৃতি হয়। শেক্সপিয়রের চরিত্রগুলি ক্রিয়াশীল, তাদের প্রত্যেকটি শিরা ও পেশি পরস্পর সংগ্রামরত, বিচিত্র আলোছায়ার মধ্যে তাদের প্রকাশ। চসারের চরিত্রের একটি নির্দিষ্ট গুণ আছে, কিন্তু শেক্সপিয়রের চরিত্রের প্রত্যেকটি উপকরণের অবিরাম সংযুক্তি ও বিয়োজনের ফলে আমরা পরীক্ষা না শেষ হওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারি না কোন চরিত্র কোন অবস্থায় কী রূপ গ্রহণ করবে।”

নূতন সমাজের শিল্পীদের আজ বুর্জোয়া সমাজের শিল্প—সম্রাট শেক্সপিয়রের এই দৃষ্টি দিয়ে চরিত্রকে উপলব্ধি করতে হবে। বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষের বিকৃত রূপ প্রকাশ করে কোনো সার্থকতা নেই, বাস্তবের মধ্যে পরিপূর্ণ মানুষকে রূপায়িত করতে হবে। আজ ধ্বংসোন্মুখ বুর্জোয়া সমাজে যাঁরা নূতন যুগের পূর্বাচলের দিকে চেয়ে আছেন সেইসব শিল্পীদের চরিত্রসৃষ্টির কৌশল শিখতে হবে অতীতের নবীন জীবন্ত বুর্জোয়া সমাজের শেক্সপিয়র প্রমুখ শিল্পীদের কাছ থেকে। সত্যকার বিপ্লবী যিনি তিনি প্রাচীনকে কখনো অবজ্ঞা কররেন না, সেখান থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করেন ভবিষ্যতের জন্য, কারণ এ—যুগে যা প্রাচীন তা সে—যুগে নবীনের সম্ভাবনাতেই সমুজ্জ্বল ছিল।

এই প্রাথমিক সঞ্চয়ের কাল কেটে গিয়ে এল বুর্জোয়া সমাজের পরিবর্তনের যুগ। বুর্জোয়া শ্রেণি এখন স্বতন্ত্র উৎপাদক—শ্রেণি এবং রাজার যে একাধিপত্য একদিন তার প্রাণশক্তির জন্য প্রয়োজন হয়েছিল, আজ আর তা হল না। আজ রাজা হল বুর্জোয়া—বিরোধী। কোর্ট এখন অন্যায়ের কেন্দ্রস্থল, জীবনের পূতিগন্ধ সেখান থেকেই নির্গত হয়। মানুষের দুরভিসন্ধি ও ক্লিন্নাচার সেখানে মোলায়েম আইনের পোশাক পরিয়ে ঢেকে রাখা হয়। ডোনে (Donne), ক্রশ (Crashaw), হেরিক (Herrick) হার্বাট প্রমুখ সেকালের কবিদের কাব্যও সেইজন্য নিভৃত কোণের সলজ্জ অথচ গর্বিত মনের অভিব্যক্তি।

এই পরিবর্তনের কাল ক্রমে বিপ্লবে রূপ নিল। পার্লামেন্ট ও স্বাধীনতার বুলি আওড়িয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। সে—যুগ হল সশস্ত্র বিদ্রোহ ও অন্তর্বিপ্লবের যুগ, এবং সে—যুগে ইংল্যান্ডের প্রথম বিদ্রোহী কবি হলেন মিলটন (Milton)। মিলটনের ভাব ও রচনানীতি উভয়ই হল বিপ্লবী। বুর্জোয়া শিল্পীর এই সচেতন বৈপ্লবিক মনোভাব মিলটনের ‘Paradise Lost’—এ সুন্দরভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে। মিলটনের স্টাইলও সেইজন্য মহান ও তেজস্বী হলেও সচেতন, এবং সচতেন বলেই বৈদগ্ধ্যপূর্ণ। শয়তানের কণ্ঠ থেকে যে—বাণী উৎসারিত হয়েছে সে হচ্ছে পূর্ণ স্বাধীনতাকামী সচেতন বুর্জোয়া শ্রেণির বাণী, বিপ্লবী শিল্পীর মর্মোৎসারিত শৃঙ্খলমুক্তির বাণী।

 ….Hail horrors, hail

 Infernal worls, and thou profoundest Hell,

 Receive thy new possessor : one who brings

 A mind not to be chang’d by place or time,

 The mind is its own place, and in itself

 Can make a Heav’n of Hell, a Hell of Heav’n.

 What matter where, if I be still the same,

 And what I should be, all but less than he

 Whom thunder hath made greater? Here at least

 We shall be free; th’ Almighty hath not built

 Here for his envy, will not drive us hence :

 Here we may reign secure, and in my choice

 To reign is worth ambition, though in Hell :

 Better to reign in Hell, than serve in Heaven.

 (Paradise Lost : Book 1)

তারপর এল কৃষি—ধনতন্ত্রের (Agricultural Capitalism) যুগ। কারখানা নয়, ভূমি তখনও প্রধান অবলম্বন। বুর্জোয়া শ্রেণি ঠিক স্বাবলম্বী হতে পারেনি। মূলধন রয়েছে, কিন্তু তেমনভাবে শ্রমজীবী শ্রেণি নেই। শ্রমজীবীদের সংখ্যা অল্প। কৃষক ও অন্যান্য শ্রমিকেরা ঠিক তখনও শ্রমজীবীর স্তরে পৌঁছোয়নি। শ্রমজীবীর সংখ্যা কম হওয়াতে বুর্জোয়া শ্রেণি ভাবল যে শ্রমের মূল্য বাড়তে পারে, সেইজন্য প্রয়োজন হল আইনকানুনের সাহায্য নিয়ে শ্রম ও শ্রমমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এইভাবে বুর্জোয়া শ্রেণি ভূমির মালিকদের ছায়াতলে নিজেদের মুক্তির পথ সুগম করতে আরম্ভ করল। ধনতন্ত্র তখনও বহির্মুখী হয়নি, অর্থাৎ পুরোপুরি প্রাথমিক রক্ষণের (conservation) স্তর অতিক্রম করে তখনও ধনতন্ত্র এমন সীমায় পৌঁছোয়নি যখন “it cannot exist without constantly revolutionising the means of production.” ঠিক এই সময়েই কবি পোপের (Pope) আবির্ভাব এবং পোপের কাব্যে ম্যানুফ্যাকচারের যুগে “bourgeoisified aristocracy”—র সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণির সন্ধির আদর্শ ব্যক্ত হয়েছে। পোপের কাব্যেও সেইজন্য ঠিক কাব্যরস নেই, প্রাথমিক বুর্জোয়াশিল্পীদের সেই স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী উদবেল নেই, শুধু নীরস মুক্তি, সুতীক্ষ্ন বিদ্রুপ ও প্রভুগোষ্ঠীর চাটুতা আছে।

পোপ সম্বন্ধে হেজলিট অতি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন :

His Muse was on a peace-establishment, and grew some-what effeminate by long case and indulgence. He lived in the smiles of fortune, and basked in the favour of the great. In his smooth and polished verse we meet with no prodigies of nature, but with miracles of wit, the thunders of his pen are whispered flatteries its forked lightnings pointed sarcasms, for the gnarled oak, he gives us the soft myrtle : for rocks and seas, and mountains, artificial grass-plants, gravel walks, and tinkling rills, for earthquakes and tempests, the breaking of a flower-pot, or the fall of a china jar; for the tug and war of the elements, or the deadly strife of the passions, we have ‘Calm contemplation and poetic case.”

—William Hazlitt : Lectures on the English Poets

এরপরে এল শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution), অর্থাৎ ধনতন্ত্রের বিস্ফোরণকাল। বৈজ্ঞানিক প্রগতি সমস্ত বন্ধনকে ছিন্ন করে ধনতন্ত্রের প্রসারে সহায়তা করল। এই মেদস্ফীত ধনতন্ত্রকে একটি দেশের চতুঃসীমানার মধ্যে বন্দি রাখা সম্ভব হল না, পৃথিবীব্যাপী সে ছড়িয়ে পড়ল শ্বাসপ্রশ্বাসের স্ফূর্তির জন্য। ভূমির মালিকেরা এই নূতন বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। যন্ত্র ও বাইরের সাম্রাজ্যের কাঁচামাল মূলধনকে যে প্রচুর প্রসারশক্তি দিয়েছে, ভূমির আভিজাত্য তাকে প্রতিরোধ করতে পারবে কেন? প্রতিযোগিতার ফলে যন্ত্র তার দাস শ্রমজীবী শ্রেণিকে সৃষ্ট করেছে, সুতরাং শ্রমমূল্য সম্বন্ধে বুর্জোয়া শ্রেণির দুশ্চিন্তার বা পরমুখাপেক্ষিতার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজন সমস্ত বাধাবিপত্তিকে ধূলিসাৎ করে ধনতন্ত্রের অবাধ জয়যাত্রার শঙ্খধ্বনি করা। বুর্জোয়া শ্রেণি পুনরায় তাই নিজেরাই সৃষ্ট ভ্রমের চারদিকে ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করল। মানুষের সাম্য, মানুষের স্বাধীনতা, মানুষের স্বাভাবিক মহত্ত্ব পুনরায় দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণার প্রয়োজন হল। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মানুষের মধুর সম্বন্ধকে বিকৃত করল অর্থের আদানপ্রদান, হিসাবনিকাশ। মানুষিক সম্বন্ধ হল ‘allous cash-nexus’, প্রত্যক্ষ প্রীতির সম্বন্ধ দূর হয়ে গেল। ভারতবর্ষ বুর্জোয়া সভ্যতার সে—স্তর না অতিক্রম করলেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অন্তর থেকে এই ভাবই সুস্পষ্ট উৎসারিত হয়েছে। এই কালের ইংল্যান্ডের কবিদের মনোভাব রবীন্দ্রনাথের ভাষা প্রয়োগ করে ব্যক্ত করা যায়।

শুধু দিন যাপনের****শুধু প্রাণধারণের গ্লানি,

 সরমের ডালি,

নিশি নিশি রুদ্ধ ঘরে****ক্ষুদ্রশিখা স্তিমিত দীপের

 ধূমাঙ্কিত কালি,

লাভ ক্ষতি টানাটানি,****অতি সূক্ষ্ম ভগ্ন অংশ ভাগ

 কলহ সংশয়,

সহে না সহে না আর****জীবনেরে খন্ড খন্ড করি,

 দণ্ডে দণ্ডে ক্ষয়।

 (বর্ষশেষ)

কিটস কি তাঁর ‘Ode to Nightingle’—এর মধ্যে এই একই অভিযোগ জানাননি? তাঁর Darkling—কে সম্বোধন করে তিনি কি বলেননি “To thy high requiem become a sod”—যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :

”শ্যেন সম অকস্মাৎ ছিন্ন ক’রে ঊর্ধ্বে লয়ে যাও পঙ্ককু হ’তে,

মহান্ মৃত্যুর সাথে মুখোমুখী করে’ দাও মোরে বজ্রের আলোতে”—

এই সময়ে ইংল্যান্ডে কাব্যে একদিকে যেমন মানবতার, স্বাধীনতার ও সাম্যের কাল্পনিক সুর ঝংকৃত হয়েছে, শৃঙ্খলিত মনের বৈপ্লবিক কামনা ধ্বনিত হয়েছে, তেমনি আর—একদিকে অনুরণিত হয়েছে ‘পঙ্ককুণ্ড’ থেকে পরিত্রাণের ইচ্ছা, নৈরাশ্যের বিলাপ। ওয়ার্ডসওয়ার্থ (Wordsworth), বায়রন (Byron), শেলি (Shelley), কিটস (Keats) প্রমুখ কবিরা একদিন যে—সুরে গান গেয়েছিলেন, আজও ঠিক সেই সুর তীব্রতর হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে, একদিকে স্টিফেন স্পেনডর (Stephen Spender), ডে—ল্যুইস (Day-Lewis) ও আর একদিকে এলিয়ট (T. S. Eliot), অডেন (W. H. Auden), পাউন্ড (Ezra Pound) প্রমুখ কবিদের মধ্যে। প্রভেদ শুধু সুরের গ্রামের, মূলসুরের নয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে পোপ ও প্রাক্তন ফরাসি কবিদের প্রভাবে ইংরেজি কাব্য প্রাণহীন হয়ে পড়েছিল। তখন এই জড়তা দূর করবার জন্য প্রয়োজন ছিল কোনো উত্তেজক প্রেরণার, এবং এই প্রেরণা জুগিয়েছিল ফরাসি বিপ্লব—কালীন প্রতিবেশ। এই সময়কার ইংল্যান্ডের কবিদের বলা হয় লেক স্কুল, এবং ওয়ার্ডসওয়র্থ একরকম নেতা ছিলেন এই স্কুলের।

This school of poetry had its origin in the French revolution, or rather in those sentiments and opinions which produced that revolution, and which sentiments and opinions were indirectly imported into this country in translations… From the impulse it thus received, it rose at once from the most servile imitation and tamest commonplace, to the utmost pitch of singularity and paradox… The change in the belles-letters was as complete, and to many persons as starling, as the change in politics, with which it went hand in hand. There was a mighty ferment in the heads of statesmen and poets, kings and people.

—W. Hazlitt : Lectures on the English Poets

ওয়ার্ডসওয়র্থের কাব্যপ্রতিভা এই যুগেই প্রস্ফুটিত হয়। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সে ছিলেন এবং সেই সময় কয়েকজন ফরাসি বিপ্লবী নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সামাজিক অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ার্ডসওয়র্থ বিদ্রোহ করেন, এবং যা কিছু সাধারণ, মানুষ থেকে গাছ, ফুল, পাখি পর্যন্ত সব, তাঁর সহানুভূতি আকর্ষণ করে। কিন্তু ফরাসি বিপ্লব যখন ‘Terror’—এ পরিণত হয় তখন ওয়ার্ডসওয়র্থ সামাজিক সংস্কারেও বিশ্বাস হারান এবং বিমূর্ত সমাজ ও মানুষের চিন্তায় মগ্ন হন। ‘Incidents on Salisbury Plain’—এর প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরোধিতা থেকে তিনি ‘The Borderers’ ট্র্যাজেডির মধ্যে তাঁর নৈরাশ্যকে প্রকাশ করেন। এই ট্র্যাজেডি রচনাকালে তিনি ভ্রাম্যমাণ জীবন শেষ করে শান্তিতে ডোরসেটশায়ারে তাঁর ভগ্নী ডরোথির সঙ্গে দিন যাপন করছিলেন। ডরোথির ‘vehemence of affection’ ও প্রকৃতিপ্রিয়তা ওয়ার্ডসওয়র্থের দৃষ্টি ও অন্তরকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে, কৃষকের, রাখালের সরল জীবনযাত্রার দিকে। তিনি প্যাস্টোরাল কবিতা রচনা শুরু করলেন। তারপর রেসডাউন থেকে আলফকসডেনে গিয়ে কোলরিজের সান্নিধ্যে তিনি কাব্যরচনায় যথেষ্ট উৎসাহিত হন। কোলরিজের তুরীয় ভাব (Transcendentalism), বার্কলের আদর্শবাদ, স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদ প্রভৃতির নিত্য আলোচনা ওয়ার্ডসওয়র্থের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি মানসিক শক্তি ও মানুষের উপর বিশ্বাস ফিরে পান। এই সময় ওয়ার্ডসওয়র্থ ‘Recluse’, কোলরিজের ভাষায় ‘the first great philosophical poem in existence’ রচনা করেন। ‘The Prelude’; ‘The Excursion’; ‘Lyrical Ballads’ প্রভৃতি এই সময়েই রচিত হয়। দৈনন্দিন জীবনের অতিতুচ্ছ ঘটনাও তাঁর দৃষ্টি এড়াত না এবং তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু ছিল গ্রামে ও তার আশপাশে বিক্ষিপ্ত। কোলরিজ গেয়েছেন ‘The Ancient Mariner’, ওয়ার্ডসওয়র্থ রচনা করেছেন ‘Goody Blake’ ও ‘Simon Lec’—র গাথা। ওয়ার্ডসওয়র্থের ব্যালাডগুলিকে কোলরিজ ‘Corporeal’, ‘Matter-of-fact’ বলে দুঃখ করেছেন, এবং তাঁর দুঃখের কারণও আছে। ওয়ার্ডসওয়র্থের সারল্য তখন কাব্যিক গণ্ডি ছাড়িয়ে এত দূর বিজ্ঞানের গণ্ডিতে গিয়ে পড়েছিল যে তিনি নিজেই সে—সময় কবিতাকে “The history and science of the feelings” বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন ওয়ার্ডসওয়র্থের কাব্যের বৈশিষ্ট্য ছিল শুধু সরল ও তরল আনন্দোচ্ছ্বাস—“He never wrote with such glee”—প্রকৃতি ও মানুষ ছিল তাঁর আনন্দের উৎস। প্রিয় বন্ধু ও অনুরক্তা ভগ্নীর সান্নিধ্যে তিনি সে—সময় আরও বেশি প্রেরণা পেয়েছিলেন, যার জন্য “He could afford to suffer with those he saw suffer” এবং “he was bold to look on painful things”—আনন্দই তাঁর কবিতার একমাত্র গুণ ছিল এবং কবিকে তিনি বলতেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুখী। লেগুই বলেছেন :

Had he died then, in his thirty-sixth year, having lived as long as Byron and much longer than Shelley or Keats, he would have left a fame almost as high as he was to attain, though of a different character. His freshness of thought and style being taken together, his works would have stamped him as one of the most daring among the poets of his day. The sedate and sometimes conventional moralising which has been associated with his name comes into existence in his later productions. —E. Legouis on William Wordsworth in the Cambridge History of English Literature Vol. XI

১৮০৫ সালের পর থেকে ওয়ার্ডসওয়র্থের জীবনে ও কাব্যে পরিবর্তন দেখা যায়। এই পরিবর্তনের কারণ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দুইই। নেপোলিয়নের রাজ্যলাভের পর মানুষের আশা—আকাঙ্ক্ষার গ্লানিময় পরিণতিতে তিনি বিশ্বাস করলেন, সামাজিক বিপ্লবের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা হারালেন। বহির্জগতের এই অবনমিত পরিবেষ্টন এবং স্ত্রী মেরি হাচিনসনের ধীর স্বভাব, পুত্রকন্যার মৃত্যু প্রভৃতি নানা ব্যাপারে ওয়ার্ডসওয়র্থের ভিতরের স্ফুলিঙ্গ নিভে গেল। ডরোথির সেই আবেগময় স্নেহ নেই, কোলরিজের সেই গভীর শ্রদ্ধা ও ঘনিষ্ঠতা নেই। তাই একদিন কোলরিজের ‘Dejection’ কবিকার প্রত্যুত্তরে তিনি যে আশাবাদী ‘Leech-Gatherer’ রচনা করেছিলেন, তার পরিবর্তে সেদিন অভিনন্দন জানালেন কঠোর কর্তব্যকে, দেবতার ‘নিষ্ঠুর কন্যাকে’ এবং বললেন “Thee I now would serve more strictly, if I may”,—তাঁর সৌন্দর্যবোধ, আনন্দ, প্রেম সমস্তই ‘কর্তব্যের’ কাছে মাথা হেঁট করল।

Flowers laugh before thee on their beds,

And fragrance in thy footing treads;

Thou dost preserve the Stars from wrong,

And the most ancient Heavens through thee are fresh

and strong.

শেষে আত্মার অবিনশ্বরতায়, দেবতার স্বর্গরাজ্যে ওয়ার্ডসওয়র্থের কাব্য সমাধিস্থ হল। একদিন পৃথিবীর যে—শ্যামলতা, মানুষের ও প্রকৃতির যে স্বাভাবিক সারল্য ও সৌন্দর্য, জীবনের স্বচ্ছ আনন্দ ও প্রেম; যৌবন তাঁর সামনে খুলে ধরেছিল, আজ তার অবসান হয়েছে এবং তাঁর ভাবধারা ও কাব্যের এই বিকাশের জন্য দায়ী রাজনৈতিক পরিবেষ্টন ও ব্যক্তিগত কারণ দুইই।

The evolution of his ideas, which made his old age diametrically opposed to his youth, can be traced, step, accounted for by outward circumstances and earnest meditations… it is a progress from poetry to prose, from bold imaginings to timorousness, from hope to mistrust, from life to death. (Ibid. Vol. XI. Chap. V.)

ওয়ার্ডসওয়র্থের এই যুগকে দু—ভাগে ভাগ করা যায়—ওয়ার্ডসওয়র্থ, কোলরিজ ও স্কট (১৭৯৮—১৮০০) এবং শেলি, কিটস ও বায়রন (১৮১৬—১৮২০)। হারফোর্ড (C. H. Herford) বলেছেন।

Politically, the earlier group were bitter opponents of the Revolution; Wordsworth and Coleridge were even ‘renegades’. The later group were all Liberals; in Byron and Shelley the spirit of the Revolution first entered poetry. The liberty which Wordsworth adored was from the first rather the condition in which men observe morality without outer interference, than that in which they follow the bent of passion without restraint; and both he and Coleridge, after their bitter disillusions, learned to look on political laws, as such, with the idealising sympathy of Burk. But with Shelley and Byron, liberty is a vehement and politically anarchical outpouring of individuality into action, an ideal more egoistic in Byron, in Shelley more spiritual and humane. The counterpart in poetry of this political individualism was the self-assertion of the artist.

(C. H. Herford : The Age of Wordsworth)

রাজনীতির দিক থেকে ওয়ার্ডসওয়র্থ ও কোলরিজ ছিলেন বিপ্লব—বিরোধী, এবং বায়রন ও শেলি উদার কবি, তাঁদের কাব্যে বিপ্লবের সুর ঝংকৃত হয়েছিল। ওয়ার্ডসওয়র্থের স্বাধীনতা ছিল মানুষের নৈতিক জীবনের প্রহরী, মানুষের অন্তরের অদম্য আবেগ নয়। রাজনৈতিক নিয়মের প্রতি ওয়ার্ডসওয়র্থ ও কোলরিজের সেইজন্য বার্কের মতো আদর্শবাদী সহানুভূতি ছিল। কিন্তু বায়রন ও শেলির কাছে স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে ক্রিয়ার মধ্যে ব্যক্তিত্বের দুর্দমনীয় প্রকাশ। এই প্রকাশ বায়রনের কাছে ছিল একান্ত ব্যক্তিক, শেলির কাছে ছিল মানুষিক। কাব্যে এই ব্যক্তিবাদ মূর্ত হয়ে ওঠে কবির আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্যে।

অভিজাত শ্রেণির শক্তিক্ষয় সম্বন্ধে সচেতন হয়েও বায়রন তাঁর অহংকার ও আত্মম্ভরিতা বর্জন করতে পারেননি। সেইজন্য বায়রনিজম—এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শ্লেষ ও ভাবপ্রবণতা। অভিজাত সমাজকে তিনি নির্মমভাবে বিদ্রুপ করেছেন, তাঁর ‘Don Juan’—এর মধ্যে তার সাক্ষ্য রয়েছে, কিন্তু বুর্জোয়া সমাজের স্বাধীনতাকে তিনি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর সমাজবিদ্রোহ তাই শৃঙ্খলিত মনের আস্ফালন মাত্র, শরতের মেঘের মতো শুধু গর্জে গর্জে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে, বর্ষণ সম্ভব হয়নি। এই বিদ্রুপ ও আকাশস্পর্শী আত্মগরিমার স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে নৈরাশ্য ও মৃত্যুচিন্তা, ‘The Island’ ও ‘Age of Bronze’—এর মধ্যে তার পরিচয় রয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল দাম্ভিক মন মৃত্যুর কাছে আয়ু ভিক্ষা চাইল। বায়রন লিখলেন :

 If thou regretest thy life—why live?

 The land of honourable death

 Is here—up to the field and give

 Away thy breath.

শেলির মনের প্রসার ছিল বায়রনের চেয়ে শতগুণ বেশি, তাই ব্যক্তিগত জীবনের নৈরাশ্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আঠারো বৎসরের শেলির ‘Queen Mab’—এর সুর তাই পরে উচ্চতর গ্রামে ধ্বনিত হয়েছে ‘Prometheus Unbound’, ‘Epipsychidion’, ‘Ode to West Wind’ ও ‘Triumph of Life’—এর মধ্যে। গতিশীল, পূর্ণ স্বাধীনতাকামী বুর্জোয়া শ্রেণির অন্তরের আকাঙ্ক্ষা ও জীবনের আদর্শ অনুরণিত হয়েছে শেলির কাব্যে, সেইজন্য শেলির কাব্যের বিশেষ গুণ হচ্ছে গতিশীলতা। বায়রনের উচ্ছ্বাস বুদ্বুদের মতো বিলীন হয়ে যায়, যে অন্তরনির্ঝর তার উৎস সেখানেই আবর্ত সৃষ্টি করে, ফুঁপিয়ে—ফেনিয়ে সে অন্তর্ধান করে। শেলির কাব্য প্রচণ্ড অন্তরাবেগের মূর্ত বাণী, যে—বাণী অন্তর থেকে উৎসারিত হয়ে অযুতধারায় বিশাল মানবসমুদ্রে মিলিত হয়। স্বাধীনতার চিন্তায় আত্মহারা বুর্জোয়া শ্রেণি নিজের স্বার্থের সঙ্গে শ্রেণি—নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির স্বার্থকে অভিন্ন ভাবতে কুণ্ঠিত হয়নি। শেলি ঠিক তাঁর যুগের এই মনোভাবের আদর্শ প্রতীক ছিলেন, সেইজন্য তাঁর কাব্যে যে—স্ফূর্তি, যে—স্পন্দন, যে—আবেগ, যে—অতিক্রমণীয়তা দেখতে পাওয়া যায় তা অন্যের কাব্যে পাওয়া যায় না। Indian Serenade—এ শেলি বলছেন :

 Oh lift me from the grass!

 I die! I faint! I fail!

‘Ode to West Wind’-এ বলছেন :

 Oh, lift me as a wave, a leaf, a cloud!

 I fall upon the thorns of life! I bleed!

Epipsychidion-এ বলছেন :

  Woe is me!

 The winged words on which my soul would pierce

 Into the height of Love’s rare universe,

 Are chains of lead around its flight of fire—

 I pant, I sink, I tremble, I expire!

—কিন্তু এসব হচ্ছে শেলির ব্যক্তিগত বিলাপ। নিজের দুঃখের পরিবর্তে যখন শেলি মানুষের দুঃখের, মানুষের পরাধীনতার সংগীত রচনা করেন, তখন ক্লান্ত, ক্লিষ্ট শেলির কণ্ঠে ভবিষ্যতের ভেরীর শব্দ ধ্বনিত হয় :

 Scatter, as from an unextinguished hearth
 Ashes, and sparks, my words among mankind!
 Be through my lips to unawakened earth
 The trumpet of a prophecy! (Ode to West Wind)

—এবং নিপীড়িত মানবতাকে আহ্বান করে বলেন :

 Rise like Lions after slumber
 In unvanquishable number—
 Shake your chains to earth like dew
 Which in sleep had fallen on you—
 Ye are many—they are few. (The Mask of Anarchy)

বায়রন “a portion of the storm” হতে চেয়েছিলেন তার “fierce and far delight”—এর জন্য, হারফোর্ডের ভাষায় “to be the comrade of its ruinous splendour”, কিন্তু শেলি সে—উদ্দেশ্যে ঝড়ের সহযাত্রী হতে চাননি। ঝড়ের যে ভয়াল রুদ্রমূর্তি, তার ধ্বংসের যে তাণ্ডবলীলা, তারই কমরেড হওয়া ছিল বায়রনের অভিলাষ, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শেলি ‘West Wind’—কে সম্বোধন করে বলেননি :

 যেখানে নিক্ষেপ কর হৃতপত্র, চ্যুত পুষ্পদল,
 ছিন্নভিন্ন শাখা,
 ক্ষণিক খেলনা তব, দয়াহীন তব দস্যুতার
 লুণ্ঠনাবশেষ,
 সেথা মোরে ফেলে দিয়ো অনন্ত—তমিস্র সেই
 বিস্মৃতির দেশ।

শেলি চ্যুত পত্রের মতো পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে চেয়েছিলেন নূতন জীবন সৃষ্টির জন্য—‘to quicken a new birth’—খনিক খেলনার মতো নির্মম ঝটিকা—দস্যুর লুন্ঠনাবশেষের সঙ্গে কোনো বিস্মৃতির দেশে বিলীন হয়ে যাবার জন্য আবেদন করেননি। তাই যে—দস্যু শীতের হৃতপত্র ও ছিন্নভিন্ন শাখা নিয়ে দৌরাত্ম্য করে তাকে আহ্বান করে তিনি বলেছিলেন :

 …O, Wind
 If Winter comes, can Spring be far behind?

পেটি—বুর্জোয়া, সংগ্রামক্লিষ্ট কিটসের কাছে বুর্জোয়া সমাজ অন্যরূপে প্রতিভাত হল। প্রকৃতির বুকে যখন তিনি আশ্রয় চাইতেন, তখনও পৃথিবীর দুঃখকষ্ট—বেদনাকে তিনি ভুলতে পারতেন না। কাব্যের অলস পাখায় ভর দিয়ে কিটস এ—পৃথিবীর বেদনাম্লান পরিবেষ্টন ছেড়ে নিজের সৃষ্ট এক অলৌকিক মায়াময় রূপকথার দেশে যাত্রা করতেন। Endymion—এর জন্য Moon—এর গড়া, প্রিয়ের জন্য Lamia—র গড়া সে—পৃথিবী, নাইটিংগেল যেখানে মুক্তকণ্ঠে—‘with full-throated ease’—গান করে, সেখানেই কিটস চলে যেতে চান, সুরা পান করে যদি না হয়, ব্যাকাসের সঙ্গী হয়ে যদি না হয়, তাহলে কাব্যের সোনালি পাখায় ভর দিয়ে, কারণ এই বাস্তব পৃথিবী দত্নর্বিষহ, জঘন্য। কিন্তু তবু কিটস যে হতভাগ্য এবং এ—পৃথিবীকে তিনি ছাড়তে চাইলেও বাস্তব যে তাঁকে বারবার ডেকে ফিরিয়ে আনে, সে—সম্বন্ধেও তিনি সচেতন। নাইটিংগেলের মধুর সংগীতে তাঁর যে—তন্দ্রা এসেছিল, তন্দ্রার ঘোরে তিনি যে রঙিন স্বপ্নের দেশে বিচরণ করছিলেন, শুধু ‘forlorn’ কথাই তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনল এ—জগতে, আবার জীবনের দুঃখ, যন্ত্রণা, গ্লানি, সবকিছুর পীড়াদায়ক স্মৃতি তাঁর মনের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসল, তিনি বললেন, “Do I wake, or sleep?”

বুর্জোয়া শ্রেণি প্রত্যেক পদে পদে তার স্বাধীনতা ও সাম্যের দাবির জন্য আরও জটিলতর প্রতিযোগিতা, সামাজিক ভেদ ও পরাধীনতা সৃষ্টি করে। এই ভ্রমের অনুগামী হয়ে সে নিজের ভিত্তিকে ক্রমেই শিথিল করতে থাকে, এবং শ্রেণির দিক থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে, নূতন উৎপাদনশক্তির সৃষ্টি করে, শ্রমজীবী শ্রেণির চেতনা ও সংখ্যা বৃদ্ধি করে, প্রতিযোগিতার ফলে শ্রেণিভুক্তদেরও উচ্ছেদ শুরু হয়। প্রচলিত সামাজিক সম্বন্ধ ধ্বংস হলে মানুষের স্বাভাবিক স্বাধীনতা ও শ্রেষ্ঠতা বিকশিত হয়ে উঠবে, বিপ্লবী বুর্জোয়া শ্রেণির এই যে বিশ্বাস এরই প্রতিচ্ছায়া হচ্ছে আদর্শবাদ। কাব্যে এই আদর্শবাদ বিভিন্নরূপে ওয়ার্ডসওয়র্থ, বায়রন, শেলি ও কিটসের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল, সমাজের শ্রেণিরূপ এঁদের কারও দৃষ্টিগোচর হয়নি, এবং সেইজন্যই এঁরা নিজেদের সৃষ্ট ভ্রমের পিছনে ঘুরেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে রীতি ও ভাবের দিক থেকে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনও এনেছিলেন।

কিটস, বায়রন প্রভৃতির মধ্যে যে—নৈরাশ্যের আভাস পাওয়া গিয়েছিল, পরে টেনিসন (Tennyson), ব্রাউনিং (Browning), সুইনবার্ন, আর্নল্ড প্রমুখ কবিদের কাব্যে সে—মনোভাব আরো তীব্রতর হয়ে অভিব্যক্ত হয়। টেনিসনের ‘In Memoriam নৈরাশ্যের ও ব্যর্থতার চূড়ান্ত নিদর্শন। এই নৈরাশ্যের স্তর অতিক্রম করে বুর্জোয়া কাব্য ‘art for art’s sake’—এর স্তরে পৌঁছয়। বুর্জোয়া অর্থনীতির পণ্যরীতি (Commodity-fetishism) কাব্যে ‘আর্টের খাতিরে আর্ট’—এ রূপ গ্রহণ করে। এঙ্গেলস বলেছেন :

Anarchy reigns in social production. But commodity production, like all other forms of production, has its own laws, which are inherent and inseparable from it; and these laws assert themselves in spite of anarchy, in and through anarchy… they assert themselves, therefore, apart from the producers and against the producers, as the natural laws of their form of production, working blindly. The product dominates the producers.” (Engles : Anti-Duhring)

আদিম যুগে উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য যখন নির্ধারিত হত সামাজিক প্রয়োজনের দিক থেকে, তখন কাব্যেরও উৎকর্ষ যাচাই করা হত গোষ্ঠীজীবনের উপর তার প্রভাব কতখানি তা—ই দিয়ে। কিন্তু ধনতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থায় দ্রব্য উৎপাদন করা হয় উদ্দেশ্যহীনভাবে মার্কেটের জন্য, যে—মার্কেটের নিয়মকানুন উৎপাদকের অজানা। সামাজিক জীবনের উপর পণ্যের প্রভাব বিচার করা অসম্ভব, এবং এই অবস্থায় একান্ত সহায়হীন হওয়া ভিন্ন মানুষের উপায় নেই। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ”The product dominates the producer’’—কাব্যের ক্ষেত্রে ‘Art dominates the artist”.—অর্থাৎ বাস্তব জগৎ থেকে কাব্যজগৎ সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে গেল। শিল্প হবে শিল্পের খাতিরে, সমাজ বা মানুষের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

বুর্জোয়া অর্থনীতির দ্রুত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প ও অন্য দেশে Sur-realism—এ পৌঁছোল, কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণির মন্থরগতির জন্য ইংল্যান্ড ঠিক একই ছন্দে অগ্রসর হতে পারেনি। পুঁজিপতিদের মূলধন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে নূতন জীবন পেল, এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ কিছুকাল বুর্জোয়া শ্রেণির আওতায় পালিত হয়ে সোনালি স্বপ্নে মশগুল হয়ে রইল। জর্জিয়ান কবিদের মঞ্জুল ছন্দের শঞ্জন এই স্বপ্নাবেশের পরিচায়ক। কিন্তু গত মহাযুদ্ধের পর বুর্জোয়া শ্রেণির এই বসন্তকাল কেটে গেল, এবং অর্থনৈতিক সংকট তার কদর্য রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি কাব্যও প্রতীকের দিকে, Sur-realism—এর দিকে অগ্রসর হল। কিন্তু সুর—রিয়্যালিস্টদের হয় প্রত্যাবর্তন করতে হবে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিজম—এর শিবিরে, আর তা না হলে এগিয়ে যেতে হবে বিপ্লবী শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে। মাঝপথে থমকে থাকবার উপায় নেই। ইংরেজি কাব্য সম্প্রতি সুর—রিয়্যালিস্ট নৈরাজ্যের দিকে না ফিরে, সমস্ত উদারনৈতিক শ্রেণির সঙ্গে একত্রে শ্রমজীবী শ্রেণির নেতৃত্বে বিশাল গণফ্রন্টের (People’s Front) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইংল্যান্ডে অডেন (W. H. Auden), ডে—ল্যুইস (C. Day-Lewis), স্টিফেন স্পেন্ডর (Stephen Spender) প্রভৃতির কাব্যে এই বৈপ্লবিক প্রগতির নির্দেশ পাওয়া যায়। ফ্রান্সে জিদ (Andre Gide), রোলাঁ (Romain Rolland), আরাগোঁ (Aragon) প্রভৃতির মধ্যে এই বৈপ্লবিক গতি আরও সুস্পষ্ট।

শ্রমজীবী শ্রেণির প্রতি বুর্জোয়া শিল্পীর তিন রকমের সম্বন্ধ স্থাপিত হতে পারে। তিনি শ্রমজীবী শ্রেণির বিরোধী হতে পারেন, তার সঙ্গে সন্ধি করতে পারেন, বা একাত্মও ভাবতে পারেন। বিরোধী হবার পথ একমাত্র প্রাচীনের দিকে উন্মুক্ত, কিন্তু সেখানে প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে উপায় নেই, যার ফলে স্পেংলারিয়ান শিল্প সৃষ্টিই সম্ভব।* বুর্জোয়া শিল্পী সন্ধি করতে পারেন, যেমন ফ্রান্সে জিদ, রোলাঁ এবং ইংল্যান্ডে স্পেন্ডর, ডে—ল্যুইস প্রভৃতি শিল্পীরা করেছেন। বুর্জোয়া শ্রেণি কোনো উচ্চতর সমাজ গড়তে পারেন না, একমাত্র ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রই তাঁরা গড়তে পারেন। শ্রমজীবী শ্রেণি ভিন্ন বৃহত্তর ও উচ্চতর সমাজগঠনের ক্ষমতা আর কারও নেই। বুর্জোয়া শিল্পী বিপ্লবী হয়ে শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে যোগদান করতে পারেন। কিন্তু বিপ্লবী বুর্জোয়া শিল্পীরা সহযাত্রী হতে চান, শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হতে চান না। বর্তমান বুর্জোয়া সমাজের প্রতি তাঁদের শুধু ধ্বংসমূলক মনোভাবই জাগতে পারে, কোনোকিছু গঠনমূলক তাঁরা ভাবতে পারেন না। উদ্দীপ্ত ভাষায় বিপ্লবের জয়গান তাঁরা গাইবেন, কারণ বিপ্লবের প্রলংকর রূপ কল্পনা করতেও তাঁদের ভালো লাগে। কিন্তু তাহলেও এই বিপ্লবী বুর্জোয়া শিল্পীদের ভূমিকা মিথ্যা নয়, যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁদের ধ্বংসের গানই শেষ গান, সমাজের জঠরস্থ যে—বিপ্লবের কাল্পনিক রূপের মোহে তাঁরা আত্মহারা, তারই ভূমিসাৎ হবার এই হচ্ছে প্রশস্ত ও শেষ সময়। সেইজন্য শ্রমজীবী শ্রেণি সর্বান্তঃকরণে আজ তাঁদের অভিনন্দন জানাবে। শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ এই বুর্জোয়া শিল্পীদের মধ্যে যাঁরা বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাঁদের কাব্যে বা সাহিত্যে যে সত্যকার সাম্যবাদী সমাজের বাস্তব রূপ ফুটে উঠবে তা—ও সম্ভব নয়। তোতাপাখির মতো সাম্যবাদের ‘বুলি’ হয়তো তাঁরা আবৃত্তি করবেন, সত্যকার কাব্যরসের কিছু অভাবও তাঁদের ঘটতে পারে, কিন্তু তাতে আমরা আক্ষেপ করব না। কারণ এ—দ্বন্দ্ব তাঁদের থাকবেই, এ—ত্রুটিও ঘটবে, যতদিন না তাঁরা সহানুভূতির গণ্ডি পার হয়ে সাম্যবাদী সমাজের বাস্তব রূপ সম্বন্ধে সচেতন হন। এ—সচেতনতা একমাত্র বিপ্লবের পর সংগ্রামের মধ্যেই লভ্য। এখন এই বুর্জোয়া শিল্পীরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করে তাঁদেরই শ্রেণি—ভাইদের শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে সন্ধির জন্য আহ্বান করুন। বিপ্লবের এই কাল্পনিক সংগীতের সার্থকতা আছে। আদিম কাব্যের প্রেরণায় মানুষ যেমন দল বেঁধে মাঠে যেত, কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য, আজও তেমনি কাব্যের সেই প্রেরণা মানুষের মনে সঞ্চারিত হবে বিপ্লবকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য। আদিমের এই আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আজকে বিপ্লবী কবিরা ভবিষ্যতের প্রশস্ত পথে জয়যাত্রা করুন। শ্রমজীবী শ্রেণি তাঁদের যোগ্য অভিনন্দন জানাতে কুণ্ঠিত হবে না।

…….

* ”সংস্কৃতি সংকটের রূপ” শীর্ষক অধ্যায় দ্রষ্টব্য

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *