তারকেশ্বরের নবীন—এলোকেশী

তারকেশ্বরের নবীন—এলোকেশী

আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা।

১৮৭৩ সালের ২৭ মে।

মুক্তকেশী নামে এক নয় বছরের বালিকা বেলা বারোটা নাগাদ তাদের ছোট্ট চাল দেওয়া মাটির বাড়ির দাওয়াতে বসে কাঁচা আম ফালি করে কেটে তাতে বেশ করে কাঁচালঙ্কা মাখাচ্ছিল। জ্যৈষ্ঠ মাস। এবার গ্রামবাংলা আম—লিচুতে ভরে গেছে।

মুক্তকেশীর হঠাৎ মনে হল, এর মধ্যে একটু পাতিলেবু দিলে বেশ হয়! পাতিলেবুর গাছ ওদের নেই, তো কী হয়েছে, পাশের বাড়ির কদলীকে বললেই সে কোঁচর ভরে দিয়ে যাবে এখনই।

মুক্তকেশী সবে দাওয়া থেকে নেমে পাশের বাড়িতে হাঁক দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় পাশের ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল তার জামাইবাবু নবীন। তার হাত—পা থরথর করে কাঁপছে, চোখ রক্তবর্ণ হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে বাইরে, হাতে একখানা বিশাল আঁশবটি, তা দিয়ে ঝরছে টপটপ করে তাজা রক্ত।

নবীন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছিল, কাউকে কিছু বলার মানসিকতা তার ছিল না; কিন্তু পথে শ্যালিকাকে দেখে তার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল, ”মুক্তো, তোর দিদির মাথা আমি কেটে ফেলেছি। রান্নাঘরে গিয়ে দ্যাখ, আমি চললাম ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের কাছে।”

মুক্তকেশীর হাত থেকে পেতলের বাটিটা পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দ তুলে নিকোনো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল আমের ফালিগুলি, সে চোখ বড়োবড়ো করে ছুট লাগাল রান্নাঘরের দিকে, সেখানে গিয়ে কোনোমতে গোবরাটে দাঁড়িয়ে সে যে দৃশ্য দেখল, তাতে আচ্ছা আচ্ছা সাহসী মানুষেরও বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়, নেহাত মুক্তকেশী শক্তমনের মেয়ে, তাই তার শরীরটা শুধু কাঁপতে লাগল।

তার দিদি এলোকেশী বোধ হয় কিছুক্ষণ আগেও মাছ কুটছিল, কিন্তু এখন সামনে পড়ে থাকা আঁশের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে তার আস্ত মাথাটা! এলোকেশীর কোমর ছাপানো যে চুলটা গোটা কুমরুল গ্রামের মেয়েদের ঈর্ষার বস্তু, সেই চুল এলোমেলো হয়ে মাথা থেকে বেরোনো রক্তের মধ্যে ধীরে ধীরে ভিজছে।

সামান্য দূরে মুণ্ডুবিহীন ধড়টা পড়ে আছে। এখনও বোধ হয় সেটা তিরতির করে কাঁপছে।

সব মিলিয়ে বুকের রক্ত ছলকে ওঠার মতো দৃশ্য।

এই হল ১৮৭৩ সালের গোটা বাংলা তো বটেই—সারা দেশে তোলপাড় ফেলা এলোকেশী হত্যা মামলার মোটামুটি সারমর্ম। যে ঘটনায় কেঁপে গিয়েছিল গোটা ব্রিটিশ ভারত। তাবড় তাবড় উকিল, জজব্যারিস্টার থেকে শুরু করে ম্যাজিস্ট্রেট, হাইকোর্টের দপ্তর।

ইতিহাসে এই ঘটনা ‘তারকেশ্বর হত্যা মামলা’ নামে বিখ্যাত। এর বৈশিষ্ট্য হল—হত্যাকাণ্ডকে অতিক্রম করে জনসাধারণ তাদের সহানুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছিল ঘাতকের দিকেই।

কেন?

তা জানতে পুরো কাহিনিটায় যাওয়া যাক।

হুগলী জেলার তারকেশ্বর গ্রামে বাবা তারকনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭২৯ সালে। আটচালা এই মন্দির খুব দ্রুত হুগলী জেলা অতিক্রম করে গোটা বাংলায় জাগ্রত হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই মন্দিরে, কেউ সন্তানলাভের আশায়, কেউ—বা হৃত ধনসম্পত্তি পুনরুদ্ধারের কামনায়।

এই তারকনাথের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন উড়িশা থেকে আসা ব্রাহ্মণ মোহান্তরা। বর্ধমানের রাজা জগত রায়, কীর্তি রায় তারকেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গণ প্রশস্ত করার জন্য মোহান্তদের জমি দান করেন। মোহান্তরা তারকেশ্বর এবং তারকেশ্বর সংলগ্ন প্রচুর গ্রাম সংস্কার করান। মোহন চন্দ্র গিরি, জগন্নাথ গিরি, মায়া গিরির মতো মোহান্তরা হাজার হাজার একর জমির মালিকানা নিয়ে বংশানুক্রমে বলতে গেলে তারকেশ্বরের মুকুটহীন অধিপতি হয়ে ওঠেন।

কিন্তু ভোলানাথের উপাসকের মতো পুণ্যবান পদ পেয়েও তাঁদের বেশিরভাগেরই চরিত্র ছিল অত্যন্ত খারাপ, নানা দোষে দুষ্ট। একজন নয়, গত আড়াই—শো বছরে একাধিক মোহান্তের বিরুদ্ধে উঠেছে নারীকেন্দ্রিক, টাকা তছরুপের মতো গুরুতর অভিযোগ। তেমনই একটা দৃষ্টান্ত হল—এই এলোকেশী হত্যা মামলা।

তারকেশ্বরের পাশেই কুমরুল নামে একটা গ্রাম ছিল। হুগলী জেলার আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মতোই কুমরুলের মানুষজনেদেরও দিন কাটত খুবই দরিদ্রভাবে। কুমরুল গ্রামের সবকিছুই বলতে গেলে ছিল তারকেশ্বরকেন্দ্রিক, বড়ো কিছু কেনাকাটা থেকে শুরু করে দূরে কোথাও যেতে গেলেও কুমরুলবাসীকে তারকেশ্বর যেতে হত।

এই গ্রামেই বসবাস করতেন নীলকমল মুখোপাধ্যায় নামে এক গরীব ব্রাহ্মণ। জমিজমা বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। সামান্য যজমানি করে কষ্টেসৃষ্টে তাঁর দিন কাটত। যে সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ ১৮৭৩ সাল, তার একবছর আগে পর্যন্তও তিনি হরিমোহন মুখোপাধ্যায় নামে একজন বনেদী মানুষের বাড়িতে নিয়মিত পুরোহিত ছিলেন; কিন্তু শরীর উত্তরোত্তর খারাপ হতে থাকায় সেই কাজটিও তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। কাজেই সংসারে অভাব চরমে।

নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। রেখে গিয়েছিলেন একটিমাত্র কন্যা, এলোকেশী। নীলকমল আবার বিয়ে করেছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম মন্দাকিনী। যদিও পরে ইংলিশ সংবাদপত্র এবং আদালতের ব্রিটিশ ক্লার্কগুলো তার নাম লিখেছিল মন্দাকামী, আমরা তাকে আসল নাম মন্দাকিনী নামেই ডাকব।

মন্দাকিনীরও একটি মেয়ে হয়, তার নাম রাখা হয় মুক্তকেশী।

দুই পক্ষের দুই মেয়ে এলোকেশী এবং মুক্তকেশী, দ্বিতীয়া স্ত্রী মন্দাকিনীকে নিয়ে গরীব ব্রাহ্মণ নীলকমলের সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠত, সকাল থেকে উঠে তিনি সারাদিন ঘুরতেন কিছু রোজগারের আশায়।

তখন তারকেশ্বর মন্দিরের প্রধান মোহান্ত ছিলেন মাধব চন্দ্র গিরি, এই মাধব গিরির নারীলোলুপতা ছিল বলতে গেলে সর্বজনবিদিত; আর অন্য অনেক গ্রাম্য রমণীর মতো নীলকমলের স্ত্রী মন্দাকিনীও ছিল মাধব গিরির প্রিয়পাত্রী। প্রায়ই সে তারকেশ্বর মন্দিরে পুজো দেবার অছিলায় গিয়ে মাধব গিরিকে সঙ্গ দিত। পরিবর্তে পেত চাল, ডাল, ফল, কপাল ভালো থাকলে মন্দিরে পাওয়া নতুন কাপড়। দরিদ্র নীলকমল বুঝতেন সবই, মুখে বলতেন না কিছু। তাঁর নিজের সংগতি কতটুকু, তা দিয়ে মন্দাকিনীর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব নয়।

এলোকেশীর একেই মা নেই, তার ওপর সৎ মা। অযত্নে অবহেলায় সে পুঁইডগার মতো বেড়ে উঠতে থাকল। কিন্তু যতই বড়ো হতে লাগল, তার রূপলাবণ্যে যেন আলো করে দিতে লাগল চারপাশ। তার রূপের ছটায় মোহিত হতে লাগল গোটা কুমরুল গ্রাম। তার কোমর পর্যন্ত ছাপানো ঘন কেশরাশি, পানপাতার মতো ঢলোঢলো মুখশ্রী ক্রমেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল।

এলোকেশীর যখন আট বছর পাঁচ মাস বয়স, নীলকমল তড়িঘড়ি তাকে বিয়ে দিলেন নবীন চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক অনাথ যুবকের সঙ্গে। নবীনের পরিবারে কেউ নেই, নীলকমল একটু দোনোমনা করছিলেন, কিন্তু এলোকেশীর ইতিমধ্যেই আট পার হয়ে গেছে, নয় বছর পেরিয়ে গেলে ওই লোকসমাজে ঢি ঢি পড়বে, তাই নীলকমল আর দেরি করতে পারলেন না। ১৮৬৭ সালের এক শুভলগ্নে শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে এলোকেশীর বিয়েটা দিয়েই দিলেন।

নবীন একা মানুষ, সে চাকরি করে কলকাতার এক সরকারি ছাপাখানায়। সারাদিন বাইরে থাকে। কলকাতার মতো বিদেশবিভূঁইয়ে এলোকেশীকে ঘরে একা রেখে অফিস যাওয়ার সাহস তার হল না। এলোকেশী একেই গ্রামের সহজসরল মেয়ে, তায় চোখধাঁধানো সুন্দরী, সারাদিন একা থাকলে যে কোনো অনর্থ বাধবে না, তার নিশ্চয়তা কী!

নবীন বউকে অগত্যা বাপের বাড়িতেই রেখে কলকাতা চলে গেল। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে কিশোরী বউটির কাছে। ছুটিছাটা পেলেই সে চলে আসে কুমরুলে। এলোকেশীর জন্য নিয়ে আসে নতুন ডুরে শাড়ি, রঙিন চুড়ি, মাটির পুতুল। শাশুড়িকেও সে টাকা দিয়ে যায় স্ত্রীর খরচবাবদ। কলকাতার এঁদো গলির বদ্ধ ভাড়াবাড়িতে রাতে একা শুয়ে সে ভাবে, এলোকেশী কী সুন্দরীই না হয়ে উঠছে দিন দিন! নাহ, মাইনেটা একটু বাড়লেই নিয়ে আসবে কলকাতায়, ঘরে তখন একটা বয়স্ক দাসী রাখলেই হবে’খন।

এইভাবেই পাঁচবছর কেটে গেল। এলোকেশী কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পড়ল। তার রূপও পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করল—নবীনও ঘনঘন আসতে শুরু করল শ্বশুরবাড়ি। এখন ফি শনি—রবিবার সে চলে আসে কুমরুলে—বউকে সে বড্ড ভালবাসে। এলোকেশীর মুখটা দেখার জন্য সারা সপ্তাহ সে অপেক্ষা করে থাকে চাতকপাখির মতো।

কিন্তু এতদিন গেল, এলোকেশীর কোনো সন্তান হল না। বিমাতা মন্দাকিনীকে পাড়ার মেয়ে—বউরা ঠারেঠোরে পুকুরপাড়ে বলতে শুরু করল, ”হ্যাঁ গা, এলোর ছেলেপুলে হচ্ছে না কেন?”

”সময় হলেই হবে। সবই বাবা তারকনাথের দয়া।” মন্দাকিনীর মেজাজ গ্রামে সুপ্রসিদ্ধ, তাকে আর কেউ ঘাঁটাতে সাহস পেত না। সে সারাদিনই পড়ে থাকত মাধব গিরির কাছে, সংসারের সব কাজকর্ম বলতে গেলে এলোকেশীকেই করতে হত।

ঠিক এইরকম সময়েই শুরু হল ঘটনার পটভূমি।

তখন সবে শরৎ কাল, কিন্তু এর মধ্যেই গরম যেন বেশ বেড়েছে। সারাদিন কাজের পর এলোকেশী গিয়েছিল বড়োপুকুরে স্নান করতে। অন্যদিন সে বোন মুক্তোকেশীকে সঙ্গে নিয়েই যায়, আজ মুক্তোকে আর ডাকল না। মুক্তোর ঠান্ডার ধাত—এই অবেলায় স্নান করলে শরীর খারাপ করবে। তার চেয়ে ও ঝট করে স্নান করে আসুক, সন্ধ্যের হাওয়ায় ভিজে গায়ে বেশ আরাম হবে।

বড়োপুকুর থেকে যখন এলোকেশী স্নান করে উঠল, তখন সূর্য প্রায় ঢলো—ঢলো, পাখিরা ধীরে ধীরে বাসায় ফেরা শুরু করেছে। ভিজে কাপড়ে এলোকেশী বাড়ি ফিরছিল। গোধূলি রোদের নরম আলোয় তার শরীরের প্রতিটা ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ভেজা শাড়ির ওপর দিয়ে, মেঘের মতো চুল পিঠে লেপটে রয়েছে, সেগুলোর ডগা দিয়ে চুইয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জল।

মাটির কাঁচা পথ ধরে বিড়ালপায়ে এলোকেশী চলছিল। এমন সময় পেছন থেকে টগবগ টগবগ শব্দে ঘোড়ার খুরের শব্দ পেল ও, কিন্তু এই পথে তো ঘোড়া আসে না, এটা তো শুধুই মেয়েদের চলার পথ!

তড়িৎগতিতে এলোকেশী নিজের কাপড়চোপড় ঠিক করার আগেই তড়বড়িয়ে এসে পড়ল একটা প্রকাণ্ড ঘোড়া।

ঘোড়ার পিঠে তারকেশ্বর মন্দিরের প্রধান স্বয়ং মোহান্ত মহারাজ মাধব গিরি।

মাধব গিরি ফিরছিলেন দূরের শহর থেকে। আজ মন্দিরসংক্রান্ত এক মামলার শুনানি ছিল। রায় ধীরে ধীরে মাধব গিরির প্রতিকূলে যাচ্ছিল বলে মেজাজ তাঁর খুবই অসন্তুষ্ট ছিল, সময় বাঁচাতে তাই কুমরুল গ্রামের এই সরু পথ দিয়ে আসছিলেন; কিন্তু হঠাৎ পথমধ্যে এই রত্নটিকে দেখে তিনি হতচকিত হয়ে গেলেন।

আরেকটু হলেই ঘোড়াটা এলোকেশীর ঘাড়ের ওপর পড়তে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে মাধব গিরি লাগাম টেনে ধরলেন। কামে জর্জরিত প্রৌঢ় দেখলেন—সামনের অসাধারণ সুন্দরী মেয়েটির বীণার খোলের মতো নিতম্ব, ভেজা কাপড়ের ওপর দিয়ে কেমন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।

বিস্মিত চোখে তিনি এলোকেশীকে পেরিয়ে গিয়েও একদিকে ঝুঁকে তার মুখের দিকে তাকালেন, আর আরও আশ্চর্য হয়ে গেলেন। আরে এমন একটি সুন্দরী মেয়ে এই গ্রামে থাকে, আর তিনি জানেনই না? এমন দুধে—আলতা গায়ের রং, এমন পূর্ণিমার চাঁদের মতো মুখ, মাধব গিরি হতভম্ব হয়ে গেলেন।

ওদিকে এলোকেশী লজ্জায় রক্তবর্ণ হয়ে উঠছিল। একে এই শতচ্ছিন্ন কাপড়ে তার শরীরের অনেক অংশই দৃশ্যমান হয়ে পড়েছিল, তার ওপর মাধব গিরির এই আচরণে ভয়ে আরও বিব্রত হয়ে পড়ল। এক ছুট্টে সে বাড়ির দিকে পালাতে উদ্যত হল।

এলোকেশীকে মাথা নীচু করে ছুটতে দেখে মাধব গিরির হুঁশ হল। এ মেয়ে যে পালায়, এক্ষুনি গিয়ে দেখতে হবে কোন বাড়ির মেয়ে। মাধব গিরির চাবুকে ঘোড়া চিঁহি হি শব্দে আর্তনাদ করে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল।

এলোকেশী ত্রস্ত হরিণীর মতো যতই পালাক, মাধব গিরি ঠিক অনুসরণ করে বের করে ফেললেন তার বাড়ি। মোহান্ত মহারাজ নিজের মনেই বিড়বিড় করে হিসাব কষলেন, ”নীলকমলের বাড়ি ঢুকল! তার মানে নির্ঘাত মন্দাকিনীর সতীনের মেয়ে।’

মাধব গিরি আর কিছু না—বলে ঘোড়া ছুটিয়ে তারকেশ্বর চলে গেলেন।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা নীলকমল সবে ফিরেছেন খেটেখুটে, আজ কিছুই আর হয়নি বিশেষ, হাত—পা ধুয়ে দাওয়ায় বসে চারটি মুড়ি চিবুচ্ছেন, এমন সময় মোহান্তের খাস ভৃত্য কেনারাম এসে উপস্থিত, ”ও বউ, শিগগিরই চলো, মাধব মহারাজ ডাকছেন তোমায়, মেজাজ খুব খাপ্পা, দেরি কোরো না!”

মন্দাকিনী স্বামীর দিকে একঝলক তাকিয়েই ঘোমটা টেনে বের হয়ে গেল মোহান্তের ভৃত্যের সঙ্গে। নীলকমল একরকম নিরুত্তাপভাবে মুড়ি খেতে লাগলেন। কী বলবেন! গত এক মাস ধরে রোজগারপাতি বলতে কিছুই নেই, নবীনের এলোকেশীর জন্য দিয়ে যাওয়া টাকাও ফুরিয়ে গেছে, সংসার তো চালাচ্ছে মন্দাকিনীই! তাই সব বুঝেও চুপ করে থাকাই শ্রেয়।

মন্দাকিনীর ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। নীলকমল তখনও বাইরের দাওয়াতেই বসেছিলেন, কিন্তু মেয়েদুটো ঘুমিয়ে পড়েছে ভেতরে। মাধব মহারাজের পালকি এসে নিঃশব্দে ঘরের বউকে পৌঁছে দিয়ে গেল দরজায়।

মন্দাকিনী হাত—পা না—ধুয়েই উঠে এল দাওয়ায়, ঘোমটা খুলে স্বামীর দিকে তাকাল, ”ওগো শোনো, যা শুনে এলুম, ঠিকমতো মিটলে খাওয়া পরা তো দূর, আমাদের পাকা ভিটে উঠবে গো!”

নীলকমল স্ত্রীর কাছে সব শুনে চমকে উঠলেন। কাঁপা হাতে উপবীত স্পর্শ করে বললেন, ”না না, সে কী করে হয়! বামুনঘরের মেয়ে কিনা এলোকেশী …ছি ছি! জামাইয়ের কাছে আমি মুখ দ্যাখাবো কী করে!”

মন্দাকিনী ঝংকার দিয়ে উঠল, ”ইহহ! এক আনা রোজগারের মুরোদ নেই, আবার মুখ দ্যাখাবেন কী করে! নবীন জানতে পারলে তবে তো! আমি বলেই এসেছি, শনি—রবিবার এলোকেশী যেতে পারবে না।” পরক্ষণেই সে গলা নামিয়ে ফিসফিস করল, ”আর তুমি কি ভাবছ, রাজি না—হলে মাধব মহারাজ ছেড়ে দেবেন? একবার যখন ওঁর নজর পড়েছে, এলোকেশী আর রেহাই পাবে? কোথায় সরাবে মেয়েকে? কুমরুলসুদ্ধু সারা তারকেশ্বরে ওঁর লোক ওত পেতে রয়েছে, বলা যায় না, হয়তো এখন থেকেই নজর রাখছে আমাদের বাড়িতে।”

”যদি নবীনকে বলি ওকে নিয়ে যেতে?” নীলকমল ঢোঁক গিললেন। ”মরণ!” মন্দাকিনী চাপাকণ্ঠে যতটা সম্ভব ঝাঁঝিয়ে উঠল, ”বলি নবীন কি উড়ে উড়ে নিয়ে যাবে নাকি গো? মোহান্তর লোকেদের চোখ এড়িয়ে পারবে ও নিয়ে যেতে? আর তুমি আমাদের কথা একবারও ভাবছ না? ওকে না—পেলে মুক্তোর কি দশা হবে ভেবে দেখেছ?”

নীলকমল চুপ করে গেলেন। কথাটা মন্দাকিনী ভুল কিছু বলেনি। মাধব গিরির প্রবল প্রতাপ, একবার যখন তাঁর এলোকেশীকে মনে ধরেছে, তিনি তার বিনিময়ে সব ছারখার করে দেবেন।

তার চেয়ে বুদ্ধিমানের মতো সব মেনে নিয়ে নিজেদের আখের গোছানোটাই লাভজনক!

তার পরের দিন পরিকল্পনামাফিক মন্দাকিনী এলোকেশীকে বলল, ”ঝটপট রান্নাবান্না সেরে নে। আজ বাবার থানে যাব।”

”আজ? হঠাৎ?” এলোকেশী অবাক। তার গা—টা এমনিই ম্যাজম্যাজ করছিল, ভেবেছিল কাজকর্ম সেরে একটু জিরিয়ে নেবে।

মন্দাকিনী সৎ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ”হঠাৎ আবার কী! পাঁচ বছর হয়ে গেল, এখনও একটা পেটে ধরলি না, চোদ্দো পুরে পনেরোয় পড়তে চললি! তুই কি ভাবছিস এইরকম চললে জামাই আর তোকে কলকাতা নিয়ে যাবে? দেখবি হয়তো আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে। শিগগির চল, বাবাকে পুজো দিয়ে মোহান্ত মহারাজের কাছে যাব, তিনি তোকে ওষুধ দেবেন, বছর ঘুরতে—না—ঘুরতেই মা হবি।”

”বোন যাবে না?” মুক্তোকেশীর দিকে চেয়ে এলোকেশী বলল। সে সৎমাকে বিলক্ষণ ভয় করে।

”না, মুক্তো বাড়িতে থাকুক; বাবা এলে খেতে টেতে দেবে’খন।” মন্দাকিনীর আর তর সইছিল না। কাজ মিটে গেলে মাধব গিরি তাকে সোনার হাতপদ্ম আর হার দেবেন বলেছেন। তারপর তো টাকাপয়সায় মুড়িয়ে দেবেনই। ইতিমধ্যেই দুটো লোক পাঠিয়ে খবর নিয়েছেন, মন্দাকিনী সময়মতো এলোকেশীকে নিয়ে আসছে কিনা।

উঁহ, কচি মেয়ে দেখেই বুড়োর লালা ঝরছে!

স্নান খাওয়া সেরে মন্দাকিনী নতুন একটা পাটভাঙা শাড়ি যত্ন করে এলোকেশীকে পরিয়ে দিল, গন্ধতেল মাখিয়ে চুলে দুটো বিনুনি বাঁধল। নবীন গেল মাসে কলকাতা থেকে একটা সাবান নিয়ে এসেছিল, তাই দিয়ে ভালো করে মেয়ের মুখ পরিষ্কার করিয়ে নবীনেরই আনা স্নো মাখিয়ে দিল। তারপর গরুর গাড়ি চেপে রওনা দিল তারকেশ্বরের দিকে।

মন্দিরে গিয়ে বাবা তারকনাথকে পুজো দিয়ে মন্দাকিনী এলোকেশীর হাত ধরে গিয়ে হাজির হল মোহান্তর প্রাসাদোপম বাড়িতে। তখন বিকেল হয় হয়। জোয়ান রক্ষীরা মন্দাকিনীকে ভালোই চেনে, তারা অশ্লীল হেসে দুয়ার খুলে দিল।

বেশ কয়েকটা মহল পেরিয়ে মন্দাকিনী এলোকেশীকে নিয়ে হাজির হল অন্ধকার এক খুপড়িতে। আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করা ছিল, মোহান্ত মহারাজের চাকরবাকরেরা বাইরে থেকে হুড়কো টেনে দিল।

এলোকেশীর অনেকক্ষণ থেকেই বুকটা ঢিপ ঢিপ করছিল, এখন এই অন্ধকার ঘরে সামনের বিশাল খাটে মাধব গিরিকে বসে থাকতে দেখে সে চিনতে পারল না, মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে এক পা দিয়ে অন্য পায়ের নখ খুঁটতে লাগল। ওর খুব ভয় করছিল।

মন্দাকিনী নগ্ন গায়ে শাড়িটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে হাতজোড় করল, ”প্রভু, আমার মেয়েটার একটা গতি করে দিন! এবার যে বাঁজা বলে লোকে অপবাদ দেবে।”

মোহান্ত মহারাজ মাধব গিরি আধশোয়া হয়ে বসে গড়াগড়া টানছিলেন। পিদিমের আলোয় এলোকেশীর মুখটা যেন আরও রহস্যময় লাগছে।

আহা, বহুদিন পর একটা কচি মেয়েকে সোহাগ করতে পারবেন। মন্দাকিনীর মতো এইসব বুড়ি মাগিগুলোকে নিয়ে আর রস হয় না।

গড়গড়ার নলটা মুখ থেকে নামিয়ে মাধব গিরি বললেন, ”কোনো চিন্তা নেই। বাবার প্রসাদ খেলে বছর ঘুরলেই কোল আলো করে ছেলে আসবে। তোর নাম কী মা?”

এলোকেশী ভয়ে জড়সড় হয়ে গিয়েছিল। মন্দাকিনীর পুনঃপুনঃ খোঁচায় অস্ফুটে কী বলল শোনাই গেল না।

মাধব গিরি অসন্তুষ্ট হলেন না, বরং লজ্জাশীলা বালিকাটির প্রতি তাঁর আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল। তাঁর আর তর সইল না, চোখ দিয়ে মৃদু ইশারা করলেন, সঙ্গেসঙ্গে মন্দাকিনী ফিসফিস করল এলোকেশীর কানে, ”প্রভু এখন তোকে ওষুধ দেবেন, বাবা তারকনাথের নাম করে খেয়ে নিবি।”

ঘরের চড়া ধুনোয় এলোকেশীর মাথা কেমন ঝিমঝিম করছিল, তবু সে সৎমার হাত চেপে ধরে বলল, ”তুমি কোথা যাও?”

”আমি একটু ভেতর ঘর থেকে আসছি। তুই বোস। আজ রাতে তো আর বাড়ি ফেরা যাবে না, মন্দিরের দালানেই শুয়ে কাটিয়ে দেব দু—জনে।” মন্দাকিনী কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল।

এলোকেশী আর কী বলবে বুঝতে পারল না, চোখ নামিয়ে গায়ে ভালো করে আঁচল পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মাধব গিরি আদরের সুরে বললেন, ”এদিকে আয়। আমার কাছে এসে বোস।”

এলোকেশী একচুলও নড়ল না। ওর ভালো লাগছে না একটুও, মনে হচ্ছে একছুটে বাড়ি চলে যায়। কিন্তু গাঁয়ের মেয়ে, রাস্তাঘাট সে কিছুই চেনে না, তার ওপর বাইরের মুশকো দারোয়ানগুলোর কথা মনে পড়তেই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।

মাধব গিরি আর অপেক্ষা করলেন না, কামজ্বরে তখন তাঁর শরীরের উত্তাপ বাড়ছিল। খাট থেকে নেমে এসে পাশের দেরাজে রাখা একটা ঘটি নিয়ে এগিয়ে এসে এলোকেশীর ঘোমটা তিনি খুলে দিলেন। আলতোভাবে ওর গালে হাত বোলাতে বোলাতে নরম গলায় বললেন, ”বাবার নাম করে এই জলটা খেয়ে নে।”

এলোকেশীর মাথাটা আরও বেশি করে ঝিমঝিম করছিল, তবুও বাবা তারকনাথের নাম করে ঘটির জলটা চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলল। জলের মধ্যে কিছু মিষ্টি গন্ধ পেল ও।

মাধব গিরি আস্তে করে ওকে কাছে টানলেন, ”তুই ভারি ভালো মেয়ে।”

এলোকেশীর মাথাটা কেমন যেন ঘুরছিল। একবার ও জড়ানো গলায় শুধু বলতে পারল, ”মা …!” তারপরেই অচৈতন্য হয়ে পড়ল।

কতক্ষণ ও ঘুমিয়েছিল জানে না, হঠাৎ কিচিরমিচির শব্দে এলোকেশীর ঘুম ভেঙে গেল।

ঘোরটা কাটতেই ও ধড়ফড় করে উঠে বসে দেখল সকাল হয়ে গেছে, কিন্তু এটা তো ওদের কুমরুলের বাড়ি নয়। এই প্রকাণ্ড পালঙ্কে ও কী করে এল?

নিজের দিকে চোখ পড়তেই এলোকেশীর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমের কুচি নেমে গেল। একী কাণ্ড! তার শরীরে যে একটা সুতোও নেই! এতবড়ো সর্বনাশ কি করে হল ওর? —কে করল?

ঘরটার দরজা বাইরে থেকে ভেজানো ছিল। এলোকেশী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে পড়ে থাকা ওর শাড়িটা গায়ে কোনোমতে জড়াল। দুঃখে, কষ্টে ওর চোখ ফেটে জল আসছিল। ওর স্বামী ওকে কত ভালোবাসে, তার এই মান রাখল ও? কী করে মুখ দ্যাখাবে এখন সমাজে?

ওর মাথা কাজ করছিল না, আলুথালুবেশে দরজা দিয়ে বেরোতেই ওকে খপ করে ধরল বাইরে অপেক্ষামান মন্দাকিনী। তার হাতে মস্ত বড়ো একখানা সোনার হার, তাতে খুব সূক্ষ্ম কাজ, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সঙ্গে একটা দামি শাড়ি।

এলোকেশী সৎমাকে দেখে কেঁদে ফেলল, ”মা আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে! আ—আমি কী করব এখন?”

মন্দাকিনী এবার শক্ত হাতে হাল ধরল। আগে থেকে সে প্রস্তুত হয়েই ছিল। এলোকেশীকে টেনে ঘর থেকে বের করে বলল, ”চুপ কর পোড়ারমুখী, কাঁদিস কেন? এই দ্যাখ মহারাজ তোর জন্য কেমন সুন্দর হার আর কাপড় দিয়েছেন। পরের দিন বলেছেন মোটা দুটো বালাও দেবেন, সঙ্গে রুপোর একটা কোমরবিছে। তোর ওই ছা—পোষা বর এসব দেওয়া তো দূর, চোখেও দেখেছে কখনো?”

এলোকেশী তবু কান্না থামাল না, ফুঁপিয়ে যেতে লাগল। পালকি অপেক্ষমান ছিল, মন্দাকিনী আর উচ্চবাচ্য না—করে ওকে নিয়ে কুমরুল গ্রামের দিকে রওনা দিল।

সারাটা পথ এলোকেশী ঝিম মেরে পড়ে রইল।

ইচ্ছায় কী অনিচ্ছায় জানা যায় না, এরপর থেকে এলোকেশী মোহান্ত মহারাজের বাড়িতেই থাকতে শুরু করল। শুধু শনি—রবিবারটুকু মোহান্তর পালকি এসে তাকে কুমরুলের কুঁড়েঘরে নামিয়ে দিয়ে যায়। এলোকেশীর অঙ্গে দামি শাড়ি, গলায়, কানে, হাতে সোনার অলংকারের ঔজ্জ্বল্যে তার সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ে, সঙ্গে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে গরীব ব্রাহ্মণ নীলকমলের ঐশ্বর্যও। নীলকমলের প্রায় ভেঙে—পড়া ভদ্রাসনটিতে মেরামতির প্রলেপ লাগে, ধীরে ধীরে শ্রী ফিরতে থাকে।

এলোকেশী এখন ফি শনিবার ভোরে এসেই বোন মুক্তকেশীকে মহারানির ছবি দেওয়া চকচকে টাকা দেয়, নীলকমলও হৃষ্টচিত্তে থাকেন।

নবীন এখন শ্বশুরবাড়ি আসে বটে, কিন্তু কোথাও যেন একটা ছন্দপতন হয়েছে বলেই তার ধারণা জন্মায়। এলোকেশী যেন এখন আর সেই সহজসরল বালিকাবধূটি নেই, সে এখন রীতিমতো রঙ্গ করে, ছল ভরে কথা বলতে শিখেছে। তার শাড়ি, গয়না সবই ইদানীং নবীনের মনে কৌতূহলের উদ্রেক করে। নবীন অনুভব করে কেটে যাওয়া তালটা, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না, এলোকেশীর বিশ্বরূপার মতো রূপ দেখে সে সব ভুলে যায়।

নিশ্চুপ হৃদয়ে প্রতি রবিবার সন্ধেবেলা সে ফেরত আসে কলকাতায় তার ছোটো ঘরটিতে।

এমন করেই দিন কাটছিল, কিন্তু একদিন সুর কাটল। তখন যতই মোবাইল, ইন্টারনেট না—থাক, মানুষের মুখে মুখে গুজব সহস্রগুণ বর্ধিত ও অতিরঞ্জিত হয়ে অবশেষে পৌঁছোল নবীনের কলকাতার বাসায়।

সে শুনে প্রথমে খানিক হতভম্ব হয়ে গেল, তারপর আগাম কিচ্ছু খবর না—দিয়ে সপ্তাহের মধ্যিখানে হঠাৎ হাজির হল কুমরুল গ্রামে। গিয়ে দেখল একদিকে তার শাশুড়ি রাঁধছেন, অন্যদিকে শ্বশুরমশাই দাওয়াতে বসে তেল মাখছেন, পুকুরে স্নানে যাবেন।

বলাই বাহুল্য, দু—জনেই নবীনকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।

”এলোকেশী কোথায়?” নবীন হাতের বাক্স না নামিয়েই জিজ্ঞাসা করল। গত দু—রাত সে প্রায় ঘুমোতে পারেনি, যতবার এলোকেশীর অপাপবিদ্ধ মুখটা তার মনে ভেসে উঠেছে, ততবারই সে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছে—এলোকেশী অমন মেয়ে নয়, সে একাজ করতেই পারে না। এগুলো সবই মিথ্যে অপবাদ।

নীলকমল জামাইয়ের সামনে কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। মন্দাকিনী মাথায় ঘোমটা দিয়ে উত্তর দিল, ”এলো মন্দিরে গেছে বাবাজীবন। তুমি হাত—মুখ ধুয়ে এসো, খেতে দিই।”

নবীন ছেলে হিসেবে এমনিতে শান্ত হলেও উত্তেজনায় তার মতো পরাক্রম খুব কম যুবকেরই ছিল। এতটুকু না বিচলিত হয়ে একইভাবে সে জিজ্ঞেস করল, ”কোন মন্দিরে গেছে?”

মন্দাকিনী ঢোঁক গিলে বলল, ”বাবা তারকনাথের মন্দিরে।”

নবীন আর দাঁড়াল না, তক্ষুনি সে তারকেশ্বরের দিকে ছুটল। পথে পালকি পাওয়া গেলে ভালো, না—হলে সে পদব্রজেই যাবে সেখানে।

ঘন্টাতিনেক পর নবীন ক্রুদ্ধমুখে মন্দির থেকে ফিরে এল। এলোকেশী মন্দিরে মোটেই নেই।

রাগে জ্বলতে জ্বলতে শ্বশুরের ভিটেতে পা দিয়েই সে এলোকেশীকে দেখতে পেল। মন্দাকিনী ইতিমধ্যেই খবর পাঠিয়ে মোহান্ত মহারাজের বাড়ি থেকে এলোকেশীকে নিয়ে এসেছে।

নবীন বউকে ঘরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ”এসব কী শুনছি তোমার নামে?”

এলোকেশী কোনো কথা বলতে পারল না, শুধু একপাশে রাখা কুলুঙ্গিতে ভর দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে থাকল তার সুন্দর শরীর। যতই দামি গয়না—কাপড়ে মোড়া থাক জীবন, সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তার নিষ্পাপ স্বামীটির তো কোনো অপরাধ নেই। সে তো এলোকেশীকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।

নবীন স্ত্রীর এমন কান্না দেখে আরও কাতর হয়ে পড়ল। কী বলবে বুঝতে না—পেরে বলল, ”চলো কাল সকালেই আমরা কলকাতা চলে যাই।”

এলোকেশী কান্না থামিয়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল স্বামীর দিকে। নীরবে সম্মতি দিল, ”চলো।”

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর অদৃষ্টে লেখা থাকে আর এক। ঘরের ওপাশ থেকে নবীনের কথাটা শুনতে পেয়ে প্রমাদ গুণল মন্দাকিনী। সর্বনাশ! এ যে বাঘের মুখের সামনে থেকে গ্রাস কেড়ে নেওয়া!

সে ত তক্ষুনি স্বামীকে বলে, ”এক্ষুনি চলে যাও তারকেশ্বরে। গিয়ে সব খুলে বলো। নবীন এলোকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে কাল।”

নীলকমল ভেতরে ভেতরে অনেক দিনই মারা গিয়েছিলেন, তবু মৃদুকণ্ঠে বললেন, ”যাবে তো যাক না! ও নিজের বউকে নিয়ে যাবে তাতে আমাদের—।”

স্বামীর কথার মাঝখানে মন্দাকিনী চেঁচিয়ে উঠল, ”তোমার এই বুদ্ধির জন্যই তো সংসারের এই দশা! এলোকেশী চলে গেলে মাধব গিরি আমাদের ছেড়ে দেবেন ভাবছ? সব রাগ এসে পড়বে আমাদের ওপর। ছারখার করে দেবে, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে। তখন মুক্তোকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব শুনি আমি?” একমুহূর্ত দম নিয়ে সে বলল, ”শিগগিরই যাও, গিয়ে বলো। আমরা আমাদের কর্তব্যটা করি, তারপর কী হবে সেটা মহারাজ ঠিক করবেন।”

নীলকমলের মুখে সব শুনে মোহান্ত মহারাজ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন, ”কী! এত বড়ো আস্পর্ধা! আমারই চোখের সামনে দিয়ে কিনা আমারই রাঁড়কে …!”

তক্ষুনি নির্দেশ দিলেন, সব পালকি বেহারা, গরুর গাড়িতে খবর দাও, কাল যেন নবীন বাঁড়ুজ্জে বউ তো দূর, —একটা পিঁপড়েকে নিয়েও না এখান থেকে বেরোতে পারে।

মাধব গিরির দোর্দণ্ডপ্রতাপে প্রতিটা মোড়ে, প্রতিটা তল্লাটে খবর চলে গেল। লোক বসানো হল সব জায়গায়।

ওদিকে সারারাত নবীন আর এলোকেশীর ঘুম নেই একফোঁটাও।

এলোকেশী সেই যে কান্না শুরু করেছে, কেঁদেই চলেছে নিরন্তর। নবীন কী বলবে বুঝতে পারছিল না— শুধু ওর মনে হচ্ছিল, সতীত্ব, বিশ্বাস এইসব পেরিয়েও সমব্যথী হিসেবে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ানোটা বোধ হয় বেশি দরকার। কোনো প্রশ্ন না—করে ও নীরবে এলোকেশীর মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগল।

অবশেষে এল পরের সেই কালান্তক দিন। ১৮৭৩ সালের ২৭ মে।

ভোর হতে—না—হতেই এলোকেশী টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল, নবীন বেরল পালকি বেহারার খোঁজে। এলোকেশীর মুখ ভার, সে সৎমা, সৎবোন তো দূর—বাবার সঙ্গেও পর্যন্ত কথা বলছে না। স্বামীর হাত ধরে এই গ্রাম ত্যাগ করতে পারলেই সে বাঁচে।

দামি শাড়ি, দামি গয়নার শখ তার ঘুচে গেছে।

কিন্তু কী আশ্চর্যের ব্যাপার! গোটা কুমরুল তো বটেই, ক্রোশ খানেক হেঁটে নবীন প্রায় তারকেশ্বর পর্যন্ত পৌঁছে গেল, কিন্তু একটা পালকি চোখে পড়ল না।

কী ব্যাপার! কোথায় গেল সব বেহারা?

নবীন অস্থির চিত্তে ঘুরতে লাগল। ভোরের নরম আলো সরে গিয়ে জ্যৈষ্ঠের তপ্ত রোদের দাবদাহে তার শরীর ক্লান্ত হতে থাকল, তবু কোনো সুরাহা করতে পারল না। দিশেহারা হয়ে সে বাড়ি ফিরে এল।

এলোকেশী প্রস্তুত হয়েই ছিল। স্বামীকে দেখেই বলল, ”বেরোব?”

নবীন উত্তর না—দিয়ে শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করল, ”পালকিগুলো সব গেল কোথায় এখানে?”

নীলকমল শেখানো বুলি আওড়ালেন, ”জানিনা তো!”

নবীন বুঝতে পারল, এই বাড়ি, এই গ্রামের কেউ চায় না এলোকেশী তার সঙ্গে চলে যাক। তার মাথায় উত্তাপের পারদ ক্রমশই চড়ছিল। তবু সে নিজেকে সংবরণ করে আরোও একবার বেরল। নিদেনপক্ষে যদি একটা গোরুর গাড়িও পাওয়া যায়।

কিন্তু কোনো গোরুর গাড়ি যেতে রাজি হল না। নবীন তিনগুণ—চারগুণ অর্থের লোভ দেখিয়েও কিছু করতে পারল না, উলটে মোহান্তের চরদের শেখানো মতো তারা নবীনকে বিদ্রুপ করতে লাগলো, ”মোহান্তের রাঁড়ের রোজগার দিয়ে বাবুয়ানি দেখাচ্ছিস? লজ্জাও লাগে না, নিজের বউকে দিয়ে…?’

ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য নবীন বাড়ি ফিরে এল। ওদিকে এলোকেশী ভেবেছিল আজ হয়তো আর যাওয়া হবে না। সে স্বামীর আহারের জন্য মাছ কুটতে বসেছিল।

নবীনের মাথায় সেই কদর্য বিদ্রূপগুলো আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তার ওপর ভোর থেকে হয়রানি। পাগলের মতো ঘরে ঢুকে আঁশবটিটা সামনে দেখতে পেয়েই সেটা দিয়ে এক কোপ বসিয়ে দিল স্ত্রীর ঘাড়ে, মুহূর্তে এলোকেশীর মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

কেউ কিছু বুঝতে পারার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। নবীনকে গ্রামের কেউ ধরতেও পারল না। তার আগেই ওই অবস্থায় আঁশবটিসমেত সে হাজির হয়েছিল হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে, ”সায়েব, আমি আমার বউকে মেরে ফেলেছি। আমাকে শাস্তি দিন।”

এই সেই ১৮৭৩ সালের বিখ্যাত তারকেশ্বর মামলার তোলপাড় ফেলা কাহিনি, যাকে কেন্দ্র করে আঁকা হয়েছে অজস্র পট, পরিবেশিত হয়েছে সেই সময়ের অসংখ্য নাটক, যাত্রাপালা।

ঘটনার শেষ এখানেই নয়।

ক্ষণিকের উত্তেজনায় নবীন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অপরাধের দায় স্বীকার করলেও; পরে দায়রা আদালতে মামলা ওঠার পর সে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে শুরু করল, ”আমি তো এলোকেশীকে খুন করিনি। কে খুন করেছে আমি জানি না…।” শুধু তাই নয়, উলটে সে মাধব গিরির নামে পালটা মামলা দায়ের করে দিল পরস্ত্রী ধর্ষণের অভিযোগ। সঙ্গে মাধব গিরির চ্যালা কেনারাম, নিজের শ্বশুর নীলকমলকেও সে অভিযুক্ত করল।

আরেকটি আশ্চর্যের ঘটনা ঘটেছিল। এলোকেশী হত্যার ঠিক ছয়দিনের মাথায় সুস্থ স্বাভাবিক মন্দাকিনীর আকস্মিক মৃত্যু হয়। নবীনের পক্ষে উকিল বললেন মোহান্তই সাক্ষীলোপাটের উদ্দেশ্যে মন্দাকিনীকে খুন করিয়েছে।

এই মামলাকে কেন্দ্র করে তখন দিনের পর দিন সরগরম থাকত ভারতীয় এবং ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলি। একজন কুলীন গৃহস্থ কুলবধূর এমন কেচ্ছাকাহিনিতে শুনানির দিনগুলোতে ভেঙে পড়ত আদালত চত্বর।

আইনের ভাষায় এই মামলায় শিকার এলোকেশী এবং অপরাধী নবীন হলেও জনতা ততদিনে নবীনকে নির্দোষ আখ্যা দিয়েছে। যে স্বামী স্ত্রীর এতবড়ো অন্যায়ের পরেও তাকে পরিত্যাগ না—করে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে, সে জনতার চোখে মহান। আসল নষ্টের গোড়া ওই মোহান্ত মহারাজ মাধব গিরি।

জনতার সব রাগ তাঁর ওপর। ব্যাটা ধর্মের নামে জোচ্চেচার, শূলে চড়ানো হোক ওই পাষণ্ডকে!

ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম আলোচিত এই মামলায় সরকারপক্ষের উকিল অর্থাৎ পাবলিক প্রসিকিউটার ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র, আর নবীনের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যারিস্টার মি উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি; যিনি পরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এই মামলাতেই প্রথম একে একে গৃহস্থদের, এমনকী বাড়ির বউদেরও ফৌজদারী আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণের জন্য ডেকে পাঠানো হয়। নবীনের শ্বশুর নীলকমল, শ্যালিকা মুক্তকেশী, প্রতিবেশী হরিনারায়ণ ভট্টাচার্য। এ ছাড়া গ্রামের আরও কিছু মেয়ে—বউ একে একে সাক্ষী দেয়।

নীলকমল এজলাসে দাঁড়িয়ে বললেন, নবীন বাড়ি এসেছিল ১৮৭৩ সালের ২৫ মে। সেইদিন নীলকমল তারকেশ্বর গিয়েছিলেন মোহান্তের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে। ফিরে এসে তিনি নবীন, এলোকেশী এবং বাকিদের বাড়িতেই দেখতে পান। তাঁর বাড়ি থেকে তিনি নিজে ছাড়া গত দু—বছরে কেউ মোহান্তর বাড়ি যায়নি।

নবীন আসামির কাঠগড়া থেকে চিৎকার করে ওঠে, ”মিথ্যে বলছে ধর্মাবতার, আগা—গোড়া মিথ্যে বলছে। আমি যখন কুমরুল পৌঁছোই, তখন উনি বাড়িতেই ছিলেন। এলোকেশী মোটেই ছিল না বাড়িতে।”

জজসাহেব নবীনকে থামান, নীলকমল বলে চলেন, পরদিন ভোরেই তিনি কাজে বেরিয়ে যান, কী হয়েছে তিনি জানেন না।

ওদিকে নীলকমলের প্রতিবেশী হরিনারায়ণ ভট্টাচার্য—সহ পাড়ার আরও কিছু লোক একবাক্যে সাক্ষ্য দিল—ও বাড়ি নষ্ট মেয়ের বাড়ি। মন্দাকিনীও নষ্ট, এলোকেশীও তাই। আগে এলোকেশী ভালো ছিল, সৎমা ওকে খারাপ করেছে।

সরকারিপক্ষের প্রসিকিউটার ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র বললেন, ”তবে তো নবীনের অভিযোগ ধোপেই টেকে না। এলোকেশী আদতে একজন বারবণিতা ছিল, বেশ্যাকে আবার ধর্ষণের অভিযোগ কী করে হয়? মোহান্ত যা করেছে টাকার বিনিময়ে করেছে।”

শোনা যায় তখন পুলিশের হাবিলদারদের থেকে কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ক্রোধে অন্ধ নবীন ছুটে গিয়েছিল সেইদিকে, ”না! আমার স্ত্রী বেশ্যা ছিল না। ওকে জোর করে …!”

কোনোমতে নবীনকে শান্ত করা হয়।

নবীনের শ্যালিকা মুক্তকেশী বলল, ”জামাইবাবু রান্নাঘর থেকে আঁশবটি হাতে বেরিয়ে এসে বলল, ‘তোর দিদির মাথা আমি কেটে ফেলেছি’।”

নবীনের পক্ষের জাঁদরেল আইনজীবী উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি প্রশ্ন তুললেন, ”মুক্তকেশী টাকার লোভে মিথ্যাসাক্ষ্য দিচ্ছে। এত গরিব ব্রাহ্মণ হয়ে নীলকমলের কন্যা মুক্তকেশীর কানে অমন বড়ো সোনার মাকড়ি কী করে এল? কে দিয়েছে? মামলা চালাবার খরচই বা কে জোগাচ্ছে? সাতাশ তারিখে মোহান্ত তারকেশ্বরের সব যানবাহন বন্ধ করে দিয়েছিল কেন?”

এইসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুললেও উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জির কাছে নবীনকে নিরপরাধী প্রমাণ করার কাজটা সহজ হল না। কারণ নবীন এখন অস্বীকার করলেও ঘটনার পরেই একাধিকবার স্বীকারোক্তি করেছে। গ্রামের চৌকিদার রামধন, সেপাই মানিক খাঁ, তারপর হুগলীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কেদারনাথ দাসের কাছে গিয়েও সে স্বীকার করেছিল। এমনকী ঘটনার আটদিন পরে হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে গিয়েও সে হত্যার কথা কবুল করে।

অতঃপর উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি বললেন, ”স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা যেকোনো স্বামীর কাছেই কষ্টের; নবীন রাগের মাথায় তার স্ত্রীকে খুন করেছে। অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় এই হত্যাকে বিবেচনা করা হোক।”

অবিস্মরণীয় এই মামলার সওয়াল জবাব শেষ হলে জজসাহেব এইচ টি প্রিন্সেপ জুরিদের রায় দিতে আদেশ করলেন। তখন আদালতে কয়েক সদস্যের জুরি থাকতেন, যাঁরা নিজেরা আলোচনা করে মামলার রায় দিতেন, সব শেষে জজসাহেব তাতে স্বাক্ষর করতেন।

তখন হুগলী আদালত প্রাঙ্গণ তো বটেই, বাইরেও হাজার হাজার মানুষের ভিড় প্রায় ভেঙে পড়েছে। সবাই চায় নবীন নির্দোষ প্রমাণিত হোক।

দীর্ঘ আলোচনা শেষে জুরি প্যানেল রায় দিল, ”নবীন মুহূর্তের অপ্রকৃতিস্থতায় স্ত্রীকে খুন করেছিল, পরিকল্পিতভাবে খুন করেনি। কাজেই সে নির্দোষ।”

মুহূর্তে আদালতের বাইরে ছড়িয়ে পড়ল উল্লাস। জনসাধারণ নবীনের নামে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করল, সঙ্গে দাবি করতে লাগল এবার মোহান্তকে ধরে আনা হোক।

কিন্তু জজসাহেবের সিদ্ধান্তে সেই উল্লাস বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। জজসাহেব প্রিন্সেপ জুরিদের সিদ্ধান্তে তুষ্ট না—হয়ে মামলা পাঠালেন হাইকোর্টে।

১৮৭৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারত সংস্কারক পত্রিকা লিখল, ”গত ১০ই সেপ্টেম্বর বুধবার হুগলী জেলা শ্রীরামপুর আদালত প্রাঙ্গণ এলোকেশী হত্যা মামলা উপলক্ষ্যে লোকে লোকারণ্য হয়। মোহান্তের দণ্ড হবে সকলে আশা করেছিল কিন্তু না হওয়ায় জনতা দুঃখিত হয়। জজসাহেব মামলাটি হাইকোর্টে পাঠিয়েছেন। কিন্তু উত্তেজিত জনতা এজলাসের ভেতর পর্যন্ত মোহান্তর গায়ে ইট, পাথর ছুড়তে থাকে, এবং ক্রমাগত গালিগালাজ দিতে থাকে। অবশেষে পুলিশ এসে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনে ও মোহান্তকে জনতার আক্রোশ থেকে বাঁচায়।”

পরের মাস অর্থাৎ ২৬ অক্টোবর তারিখে মহারানি বনাম নবীনচন্দ্র ব্যানার্জির মামলাটা উঠল হাইকোর্টে।

বিচারপতি ছিলেন দু—জন—এ জি ম্যাকারসন এবং জি জি মরিম সাহেব। সরকারপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং নবীনের পক্ষে সেই দুঁদে ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি।

কিন্তু এবার রায় হল বিপরীত। বিচারপতি বললেন, ”অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় যদি নবীন পড়েই থাকে, তাই বলে সে আইনকে নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না।”

অতঃপর নবীন দোষী, খুনের দায়ে দণ্ডিত; কাজেই পেনাল কোডের ৩০২ নম্বর ধারা অনুযায়ী তাকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেওয়া হল আন্দামানে।

ওদিকে ১৬ জুন নবীনের অভিযোগের ভিত্তিতেই হুগলী আদালত থেকে মোহান্ত মাধব গিরির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে গিয়েছিল। মাধব গিরি প্রায় দু—মাস ধরে পালিয়ে থেকে থেকে অবশেষে ১ অগাস্ট তারিখে আত্মসমর্পণ করল।

কিন্তু আত্মসমর্পণ করেই সে হঠাৎ বোবা হয়ে গেল, কোনো সাড়াশব্দ দেয় না। শুধু তার হয়ে বড়ো বড়ো সব উকিলেরা দাবার ঘুঁটি সাজাচ্ছে।

দায়রা আদালতে অনেকদিনের জেল আর মোটা অঙ্কের জরিমানা হতেই মাধব গিরি আপিল করল হাইকোর্টে। মোহান্তের পক্ষের আইনজীবীরা ধুয়ো তুললেন নবীন নিজেই একজন আসামি, সে কী করে মামলা দায়ের করেছে? আর মোহান্ত অন্যের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে তার প্রমাণ কোথায়? এলোকেশী নামে মেয়েটা তো নিজেই একটা বেশ্যা!

ইতিমধ্যে ঘটনার জল অনেকদূর গড়িয়েছে। নীলকমল মারা গেছে, নবীনেরও দ্বীপান্তর হয়ে গেছে। মোহান্তের স্বেচ্ছাচারিতায় তারকেশ্বরে তার শত্রুর অভাব ছিল না। এবার তারাই একে একে এগিয়ে আসতে লাগল।

মোহান্তের প্রাক্তন কর্মচারী গোপীনাথ রায় সাক্ষ্য দিল, এলোকেশী মোটেই বারবণিতা নয়। সে লজ্জাশীলা, ভদ্রবাড়ির বধূ। তাকে তার সৎমা ফুঁসলে নিয়ে এসেছিল মোহান্তের কাছে। মোহান্ত তাকে নেশা করিয়ে বশ করে।

উমাচরণ নামে আর একজন বলল, ”মোহান্তর এই রোগ নতুন নয়, সে আগেও গ্রামের মেয়ে—বউদের এমন সর্বনাশ করেছে।”

রামেশ্বর পাত্র নামে এক গ্রামবাসী বলল, ”সে একবার কোনো কাজে মোহান্তর বাড়ি গিয়ে দেখে এলোকেশী লজ্জায় কুঁকড়ে আছে, আর তার সৎমা মন্দাকিনী বার বার তাকে এগিয়ে দিচ্ছে মোহান্তর দিকে।”

অবশেষে মোহান্তর ব্যারিস্টারদের অনেক যুক্তি সত্ত্বেও কোনো কিছু ধোপে টিকলো না। তারকেশ্বর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মোহান্ত মহারাজ মাধব গিরির মোটা জরিমানা সমেত তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করলেন প্রধান বিচারপতি।

জনসাধারণও বহুদিন পরে মোহান্তের শাস্তিতে উল্লাসে ফেটে পড়ল।

তারপর থেকে বহুকাল ধরে কালীঘাটের পটচিত্রে, বটতলার বইতে সচিত্র গল্পাকারে প্রকাশ পেয়েছিল এই কাহিনি। কোথাও নবীন সবে এসেছে শ্বশুরবাড়ি, কোথাও মন্দাকিনী এলোকেশীকে পৌঁছে দিচ্ছে মোহান্তর কাছে, কোথাও মোহান্ত বাচ্চা হওয়ার ওষুধ খাওয়ানোর নাম করে কাছে টানছে এলোকেশীকে, আবার কোথাও নবীনের এক কোপে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে এলোকেশীর মুণ্ড।

তিনটে ঘটনা ছিল প্রধান আলোচ্য—ধর্ষণ, খুন আর মামলার শুনানি। শুধু উনিশখানা হিট নাটক প্লে হয়েছিল কোর্টরুম শুনানির ওপর ভিত্তি করে, যার মধ্যে সুপারহিট নাটক ছিল ‘মোহান্তের এ কি কাজ!’

শুধু মাধব গিরিই নয়, পরবর্তীকালে তারকেশ্বরের আরেক প্রধান মোহান্ত সতীশ গিরিও জড়িয়ে পড়েছিলেন একইরকম যৌন কেলেঙ্কারিতে।

‘বেঙ্গলি’ কাগজ লিখল, এলোকেশীর বাবা নীলকমল মুখোপাধ্যায় মোহান্তের চেয়েও নরাধম, নিজের স্বার্থে তিনি মেয়েকে ভোগ্যবস্তু করেছিলেন। এমনকী ইংরেজদের সংবাদপত্র ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় এই ব্যতিক্রমী মামলার ধারাবিবরণী ছাপা হয়েছিল বহুদিন ধরে। কেদারনাথ সরকারের লেখা তারকেশ্বর সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘তারকমঙ্গল’—এও আছে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা।

আজ এলোকেশী, নবীন, মোহান্ত কেউই নেই। তবু তারকেশ্বরের আনাচে কানাচে গেলে হয়তো শোনা যাবে প্রতারিত স্বামী নবীনের দীর্ঘশ্বাস!

১৮৭৩ সালের এক জ্যৈষ্ঠের সকালে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে সে চাইলেও নরক থেকে পালিয়ে যেতে পারেনি, উলটে সেই অবসাদে মেরে ফেলেছিল প্রিয়তমা মানুষটিকে, শোনা যাবে সেই অস্ফুট হাহাকার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *