গহন গভীরে

গহন গভীরে

এক

এখন ঘড়িতে আন্দাজ রাত সাড়ে বারোটা৷ চারপাশে ঝিঁঝিঁর মতো হরেকরকমের পোকারা তাদের নৈশপার্টি আরম্ভ করে দিয়েছে, আরো অনেক বিচিত্র শব্দে জায়গাটা ছমছম করছে৷

হিসেবমতো দেখতে গেলে রানার জন্মদিন ইতিমধ্যেই আরম্ভ হয়ে গেছে, ও কুড়ি পেরিয়ে একুশ বছরে পড়ে গেছে৷ কিন্তু আজকের দিনের শুরুতেই যে এমন এক বিতিকিচ্ছিরি পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি৷

সত্যি বলতে কি, ঘটনার প্রেক্ষিত এবং ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে এই ঠান্ডাতেও রানার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল৷ ও নিশ্চিত, এমন অবস্থায় ফোর্সের কেউ কখনো এর আগে পড়েনি৷

আর পড়লেও বেঁচে ফিরে আসেনি৷

স্কুলজীবনে একবার যেন পড়েছিল ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মদিন আর মৃত্যুদিন এক, রানার দুম করে এখন সেটা মনে পড়ে গেল৷

মনে হওয়ামাত্র ও জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, না না, ও বিধান রায় হবে না, কিছুতেই না! ট্রেনিং-এ শেখানো বুলিগুলো মনে মনে আউড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, ‘কিচ্ছু হয়নি, রানা! শান্ত হও৷ তুমি জওয়ান, দেশসেবায় নিয়োজিত হয়েছ, এমন অবস্থা হতেই পারে৷ আগে স্ট্র্যাটেজিটা ঠিক করে নাও, দেখবে আস্তে আস্তে ঠিক ম্যাচটা বের করে নিয়েছ৷’

সেই কোন সকালে ডিউটিতে বেরিয়ে পড়েছিল, পনেরো ঘণ্টা প্রায় হতে চলল৷ নিয়মমতো এতক্ষণে রানার ব্যারাকে ফিরে ওডোমস মেখে ঘুমোনোর কথা৷ কিন্তু হঠাৎ খবর এল এই চত্বরে নাকি নতুন জঙ্গি নেতা ঘাঁটি গেড়েছে, রাতের টিমকে তৎক্ষণাৎ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল জঙ্গলের আরেক দিকে, আর জরুরি তলবে রানাদের এই দিকটায় ডিউটি এক্সটেন্ড করে টহল দিতে বলা হল৷ ওদের ডিফেন্সের ভাষায় এই এক্সপিডিশনের নাম আমবুশ ডিউটি৷

জন্মদিন হোক আর মৃত্যুদিন৷ প্রাণবায়ু পুরোপুরি বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওদের ডিউটি থেকে রেহাই নেই, মনে মনে ভাবল রানা৷

মনটা ওর রোজই খারাপ থাকে৷ আজ যেন উত্তেজনার মাঝে একটু বেশিই তেতো হয়েছিল৷ আসলে তিক্ততার চেয়েও এবার একটা অবসাদ এসে গ্রাস করছিল ওকে, এভাবেই কি জীবনের সবচেয়ে গোল্ডেন সময়টা শেষ হয়ে যাবে?

একটু আগেও ও দলের সঙ্গেই ছিল৷ দু’পাশের ঝোপগুলোয় আলতো টোকা মেরে, উপরদিকে খেয়াল রাখতে রাখতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে রানাদের পুরো ট্রুপটা এগোচ্ছিল৷ মোট দেড়শোজন ছিল আজকের নাইট ডিউটিতে৷ পাঁচজন করে সাবট্রুপ তৈরি করে পর পর এগোতে হয়, আমবুশ ডিউটির নিয়মমতো সেই প্রতি পাঁচজনের একজন হয় লিডার, তার হাতে থাকে ওয়াকিটকি, প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্য৷ রানাদের সাবট্রুপে ওয়াকিটকিটা ছিল মহারাষ্ট্রের অজিত বলে ছেলেটার হাতে৷

ট্রেনিং-এ কড়া নির্দেশ ছিল, প্রতিটা জওয়ান শুধু তার সামনের আর পেছনের জওয়ানের দিকে খেয়াল রাখবে, আর এভাবেই পুরো ট্রুপকে চলতে হবে, ভুলেও যেন কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়৷ কিন্তু জন্মদিনে বাড়ির বাইরে থাকার অবসাদেই কিনা কে জানে, কখনো যা হয়নি, আজ তাই হল৷ রানা ছিল গোটা ব্যাটেলিয়নের একদম শেষে, নিজের অন্যমনস্কতার কারণেই হয়তো সে বারবার পিছিয়ে পড়ছিল, ওর সামনের নীতীশ বলে ছেলেটা দু’বার ওয়ার্নও করেছিল, ‘ঠিকসে ফলো করো, রানা!’

তবু ও দলছুট হয়ে পড়ল৷ কী যে ভাবছিল কে জানে, হঠাৎ ভয়হিমের কুচি শিরদাঁড়া দিয়ে গলতে গলতে ও অনুভব করল সামনে-পেছনে কেউ নেই৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারে রানা একাই চলছে৷

শীতের গভীর রাতে ছত্তিশগড়ের মাওবাদী অধ্যুষিত বস্তার জেলার পাণ্ডববর্জিত এই ঘন অরণ্যে একাকী দলছুট হলে যে কোনো মানুষেরই স্নায়ুর চাপ একলাফে বেড়ে যাওয়ার কথা৷ কিন্তু রানা একটু থমকে গেলেও অতটা ভয় যেন ওকে গ্রাস করতে পারল না৷ আসলে জীবনের প্রতি সুদীর্ঘ সময় ধরে বাড়তে থাকা ডিপ্রেশন সেই ভয় পাওয়ার বোধটাকে হয়তো মেরে ফেলেছে রানার মনের অবচেতনে৷

আর তাছাড়া এখন চিৎকার করেও টিমকে খোঁজার উপায় নেই, জঙ্গিরা আরো সহজে রানার অস্তিত্ব টের পেয়ে যাবে৷

ঘন অন্ধকারে ওর চোখটা এর মধ্যেই সয়ে গিয়েছিল৷ কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বন্দুকটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রানা হাতড়ে হাতড়ে একটা ছোট ঢিবির ওপর বসে পড়ল৷ ডিউটিতে বেরোনোর সময় নিয়মমাফিক বাইনোকুলার, জল, ফার্স্ট এইড বক্স, আরো কিছু টুকিটাকি পিঠের ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছিল৷ ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে জল খেল অনেকটা৷

তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজের মনেই হু-হু করে কেঁদে ফেলল৷ ভয়ের চেয়েও বেশি একবস্তা হতাশা যেন এসে গ্রাস করল রানাকে৷

এভাবে কোনো মানুষ বাঁচতে পারে? পাহাড়-জঙ্গল কেটে সমতল বানানো প্রত্যন্ত এলাকায় রানাদের ব্যারাক৷ যতদূর চোখ যায়, ছোট ছোট পাহাড়, রুক্ষ পাথর আর জঙ্গল৷ ধু ধু করছে নিস্তব্ধতা৷ তার মধ্যে ওরা প্রায় তিনশোজন জওয়ান পড়ে থাকে৷ নেটওয়ার্কের অবস্থা এত খারাপ, ইন্টারনেট তো ছেড়েই দিক, চাইলে বাড়ির লোকের সঙ্গে কথাও বলা যায় না৷ কানেকশনই পাওয়া যায় না৷ ব্যারাক থেকে বেরিয়ে প্রায় পাঁচশো মিটার এগিয়ে একটা চেকপোস্ট আছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়৷ তার জন্যও লাইন পড়ে যায়, পাঁচ মিনিটের বেশি কথা হলেই পেছনের জওয়ানের তাড়া আসে৷

কী পাচ্ছে ওরা সবাই এখান থেকে?

নিজের মনকে নিজেই রানা প্রশ্নটা করল, কিন্তু মন ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই আচমকা কী একটা যেন প্রায় চোখ বরাবর ধেয়ে আসতে লাগল সামনের দিক থেকে৷ অন্ধকার হলেও ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় সেই আগন্তুকের দ্রুত জানান দিল, রানা সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে শরীরটাকে নিচু করে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঁ-দিকের ঝোপটায়৷ হলদে হয়ে যাওয়া শুকনো পাতার নরম ঢিবির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে আশপাশের খসখস শব্দে গোটা জঙ্গলের নৈঃশব্দ্যটা যেন এক মুহূর্তে খানখান হয়ে গেল ওর কাছে৷

আর লাফ দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে জিনিসটা রানার কান ঘেঁষে চলে গেল সামনের দিকে৷

ও উপুড় হয়ে পড়ে মাথার টুপিটাকে সোজা করেই হাতের বন্দুকটাকে তাক করে লাফিয়ে উঠে বসল৷

আর রানাকে দুয়ো দিয়ে কিনা কে জানে, কান ঘেঁষে চলে যাওয়া ওই ছোট্ট বুনো পাখিটা ডানা ঝাপটে গিয়ে বসল সামনের গাছের ডালটায়৷ ও বন্দুকটা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে পাখিটার দিকে আলতো করে টর্চের আলো ফেলল৷ ছোট্ট একটা নাম-না-জানা পাখি, রানাদের ওখানকার চড়ুই পাখির মতো আকৃতির, কিন্তু রংটা খুব সুন্দর৷ গাঢ় লাল রঙের উপর সাদা ছিটে, গলার রংটাও অন্যরকম, অন্ধকারে সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না৷ টর্চের সরু আলোতেও সে ভয় পেল না বিশেষ, সন্দেহপূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইল রানার দিকে৷

রানা মুগ্ধ চোখে পাখিটাকে দেখছিল৷ এই অঞ্চলে ও রয়েছে প্রায় বছরখানেক হতে চলল, এখানকার বায়োডাইভারসিটি এমনিতে প্রচুর৷ অচেনা সব পাখি, অদ্ভুত প্রজাতির বেবুন চোখে পড়ে প্রায়ই৷ কিন্তু এত উজ্জ্বলরঙা পাখি কখনো দেখেনি ও আগে৷ তাছাড়া রাতে সাধারণত পাখিরা ওড়েই না, পেঁচা জাতীয় কিছু নিশাচর ছাড়া৷ কিন্তু এর চোখ অন্ধকারে যেন আরো জ্বলজ্বল করছে৷

ওর হঠাৎ প্রীতির কথা মনে পড়ে গেল৷ প্রীতি ছিল রানার মেদিনীপুরের বাড়িতে পোষা ছোট্ট বদরি পাখি৷ স্কুল লাইফে ও বলিউড নায়িকা প্রীতি জিন্টার খুব ভক্ত ছিল৷ ঘরের দেওয়ালের একটা ইঞ্চিও বাদ দিত না, সব জায়গায় প্রীতি জিন্টার ওই টোল-পড়া গালের ছবি আটকে রাখত৷ রাসপূর্ণিমার মেলায় গিয়ে ওই পাখিটা দেখে ওর ভারী পছন্দ হয়ে গিয়েছিল৷ সাধারণত পাখি লোকে জোড়ায় কেনে, কিন্তু রানা শুধু একটা পাখিই কিনে এনেছিল, অত সুন্দর দেখে নাম দিয়েছিল প্রীতি৷ পাখির নাম প্রীতি শুনে অনেকে হাসত, কিন্তু রানা পাত্তা দিত না মোটেই৷

প্রীতি রানার জীবনে বেশ লাকি ছিল৷ ও আসার মাসদুয়েকের মধ্যেই সি আর পি এফ এ জওয়ান হিসেবে জয়েন করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা বাড়িতে চলে এসেছিল৷ পড়াশুনোয় আহামরি কিছু না হলেও রানা খুব খারাপও ছিল না, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক দুটোই ফার্স্ট ডিভিশনে উৎরে গিয়েছিল৷ কিন্তু মামারা ছোট থেকে বোঝাতেন, ‘রানা, বারো ক্লাস হয়ে গেলেই আর্মিতে ঢুকে যাবি৷ প্রথম জীবনটা একটু কষ্ট করে কাটিয়ে নিলেই তারপর সবেতে সুবিধা মিলবে৷ টাকা, সম্মান, সব৷ তোর মায়ের দুঃখও ঘুচবে৷’

নিম্নবিত্ত পরিবার, বাবা ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন৷ মাকে পাড়ার প্রাইমারি ইস্কুলে রান্না করে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাতে হত৷ তাই রানাদের আসল অভিভাবক ছিলেন দুই মামা৷ ওদের সমস্ত আপদে-বিপদে তাঁরাই পাশে থাকতেন৷ তাই মামাদের কথা শুনতে শুনতে জীবনে নিজের কিছু লক্ষ্য স্থির করার আগেই আর্মিতে ঢোকাটাই যেন ওরও লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷

কিন্তু এখন পেছনে ফিরে তাকালে ও ভাবে, কোনোভাবেই কি জীবনের ওই সময়টা আরেকবার মুছে ফেলে শুরু করা যায় না?

যদি সেই সুযোগ পাওয়া যেত? একবার?

গ্র্যাজুয়েশনটা করে ফেললে ছোটখাট কোনো চাকরিই কি জুটত না? তবু তো একটা সিভিলিয়ান জীবন পেত! বাড়ির লোকের সাহচর্য, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, মায়ের গন্ধ, বাড়ির আচার!

এই রুক্ষ ঠান্ডায় জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে গাল-কপাল-হাত-পা সব ফেটে গেছে, তার মধ্যে চোখের জল পড়লে খুব জ্বলবে, তবু ও কিছুতেই কান্নাটাকে আটকাতে পারল না৷

ওই ছোট্ট পাখিটাও কত মুক্ত, কত স্বাধীন!

আর ওরা?

শুকনো পাতার ঝোপের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সামনের মাটিতে নিষ্ফল একটা ঘুঁসি মেরে রানা আবার কেঁদে ফেলল৷ দেশের রক্ষাকারী, দেশপ্রেমিক, এইসব তকমা নিয়ে হিরো হওয়ার সাধ ঘুচে গেছে, ঘুঁসি মারতে মারতে চিৎকার করে উঠল, আমি বাড়ি ফিরতে চাই! চা-আ-আ-আ-ই!

আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাই!

চা-আ-আ-আ-ই!

কেউ উত্তর দিল না৷ শুধু চিৎকারটাকে প্রতিধ্বনি করে এই নিষ্ঠুর জঙ্গল বারবার রানার কানেই ফিরে ফিরে এসে যেন আঘাত করতে লাগল৷

রানা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত দেহে থেবড়ে বসে পড়ল৷ দু’দিন হয়ে গেল মায়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি, সকাল থেকেই মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল৷ ইচ্ছাটা হওয়া মাত্রই কান্নার দমকের মাঝেই হাসি পেল৷ উনিশ নম্বর ব্যাটেলিয়নের গুরমিত বলে পাঞ্জাবি ছেলেটার বাবা মারা গিয়েছিল আগের মাসে৷ সাবস্টিটিউট সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায়নি বলে ওকে কিনা ছুটি দেওয়া হল চারদিন পর৷ ততদিনে সব কাজ শেষ হয়ে গেছে৷ আর রানা কিনা জন্মদিনে ছুটি পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে?

স্বপ্ন দেখার মতো কল্পনা এখনো অবশিষ্ট আছে ওর মনে?

একেকটা বিশাল বিশাল ঘরে ত্রিশজন করে ওরা শক্ত-সমর্থ জোয়ান ছেলে নিজেদের ক্যাম্প খাটগুলোয় ফাঁকা সময়ে শূন্য দৃষ্টিতে শুয়ে থাকে, না আছে টিভি, রেডিওর মতো কোনো বিনোদন, না আছে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ, না আছে কোনো বৈচিত্র্য! কাঁহাতক কয়েকটা লক্ষবার দেখা সিনেমার সিডি আর মোটা দাগের রসিকতায় নিজেদের মধ্যে মেতে থাকা যায়! হাইজিনের অবস্থাও তথৈবচ, তিনশোজন জওয়ানের জন্য তিনটে মাত্র টয়লেট, ব্যারাকের আনাচে-কানাচে জমা জল জমে মশার প্রকোপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর আদর্শ জন্মস্থান৷ এই তো, আগের মাসেই দুজন জওয়ানের ম্যালেরিয়া হল, কোনোমতে রক্ষা পেয়েছে এই যাত্রা৷

মাসের পর মাস সেই এক রুটিন, জঙ্গলের ভেতরে ভেতরে টহলদারি৷ লম্বা লম্বা শালগাছের সারির মধ্যে গভীর জঙ্গলে বন্দুক কাঁধে ওরা ঘুরে বেড়ায়৷ কোনো জঙ্গলের গভীরে মাওবাদীরা ঘাঁটি গেড়েছে কিনা, নতুন কোনো উস্কানিমূলক পোস্টার পড়ল কিনা, সেই দিকে নজর রাখতে হয়৷ ওদের ভাষায় এই সব নজরদারির নানারকম নাম৷ যখন কোনো একটা জায়গায় জঙ্গিরা রয়েছে বলে পাক্কা খবর থাকে, সেটা হল আমবুশ ডিউটি, অন্য সময় এক মোর্চা থেকে অন্য মোর্চায় রুটিন টহলদারি হল ‘পেট্রোলিং’৷

আমবুশ ডিউটি এমারজেন্সি হলেও বিপদের আশঙ্কা অবশ্য দুটোতেই৷

সারাটা দিন এমনও হয়, ব্যারাকে ফেরার আগে অবধি কেউ টিমের বাইরের অন্য কারুর মুখ অবধি দেখল না৷ দৈবাৎ যদি আশপাশের গ্রামের কোনো কাঠুরিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, ওরা হাতে চাঁদ পেলেও তারা তেমন সাড়া দিতে চায় না৷ এখানকার গ্রামবাসীরা জওয়ানদের শত্রু মনে করে৷ মাওবাদীরা ওদের এমনই মগজধোলাই করেছে৷ সরকারের নিয়মমতো একেকটা টিমকে দশটা করে গ্রামের ওয়েলফেয়ারে সাহায্য করার নির্দেশ রয়েছে৷ ওরা মাসে একটা করে দিন গ্রামগুলোয় গিয়ে ক্যাম্প করে, মাওবাদীদের সংস্রব ত্যাগ করতে বলে, হিংসার হাত ছেড়ে শান্তির কথা ভাবতে বলে, সরকার ওদের জন্য কত ভাবছে সেগুলো বোঝায়, ওদের জামাকাপড়, শীতে কম্বল, বাসনকোসন, কখনো কখনো ফলমূল বিতরণ করে৷

ওরা সার বেঁধে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে গোঁজ হয়ে শোনে৷ ছেলেরা ঘেমো গায়ে হাঁটু মুড়ে বসে থাকে, মেয়েরা বাচ্চা কোলে লম্বা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ রানারা বস্তা খুলে কাপড়চোপড়, থালা, বাটি, গ্লাস বের করে ওদের দেয়৷ ওরা আগে কী করবে বুঝতে পারত না, দরিদ্র, ক্ষুধার্ত অথচ সন্দেহজনক চোখে এ ওর দিকে চাওয়াচাওয়ি করত৷ এখন একজন-দুজন করে এসে নিয়ে যায়, বাচ্চাদের একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে দেয় ফল নেওয়ার জন্য৷

এত করেও ওরা কিন্তু রানাদের শত্রুই ভাবে৷ ভারত সরকারের জওয়ানদের কাছ থেকে জিনিসগুলো নিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা মাওবাদীরা যখন রাতের অন্ধকারে বাড়ি আসে, তাদের দিয়ে দেয়৷ কতবার ক্যাম্পের সিলমোহর দেওয়া চাদর সংঘর্ষে মৃত মাওবাদীর গায়ে উদ্ধার হয়েছে, ওদেরই দেওয়া বাসন গ্রামবাসীরা জঙ্গিদের দিয়েছে, তারপর সেই বাসনের মধ্যে ‘ইউটেনসিল বোমা’ তৈরি করে মাওবাদীরা জওয়ানদের দিকে ছুঁড়েছে৷

মাওবাদীরা আসলে ওদের বোঝায়, সরকার এবং সরকারের তরফে জওয়ানরা সবাই ওদের শত্রু৷ সরকার নাকি ওদের ভালো চায় না, সব ব্যাপারে, সমস্ত সুযোগ-সুবিধাতে ওদের বঞ্চিত করে রেখেছে৷ কোন দূরের গ্রামে জওয়ানরা আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, কার ক্ষেত বন্দুক দেখিয়ে লুঠ করেছে, সেই সব অতিরঞ্জিত অর্ধসত্য খবর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলে ওদের ঘৃণা আরো বাড়িয়ে দেয়৷

এই অঞ্চলটায় মাওবাদীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তার একটা কারণ হল জায়গাটার ভৌগোলিক সুবিধা৷ একদিকে জঙ্গলে মোড়া কংকার পাহাড়, অন্যদিকে ধামতাড়ি মালভূমি৷ মাঝখান থেকে ইন্দ্রাবতী নদী বয়ে গেছে জঙ্গলের বুককে প্রায় দু’ভাগে চিরে৷ পুরো জায়গাটাতেই জনঘনত্ব বেশ কম, বেশ কয়েক কিলোমিটার অন্তর অন্তর একেকটা ছোট গ্রাম, বাকি পুরোটাই পাহাড়ি জঙ্গল৷ লুকিয়ে থাকা থেকে শুরু করে গোপন আস্তানা বাঁধা, দুটোই খুব সহজ৷ জঙ্গিদের প্রতাপ তাই দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে৷

মাঝে এই উত্তেজনা একটু স্তিমিত হয়েছিল, দৈনন্দিন রুটিন টহলদারিতেই কাজ চলে যাচ্ছিল৷ কিন্তু মাসখানেক আগে ওদের নতুন নেতার আগমনে আবার নজরদারি বেড়েছে৷ সাধারণত এই তল্লাটের উপজাতি বা জঙ্গি, কারুর কাছেই শিক্ষার আলো তেমন পৌঁছয় না, অর্ধশিক্ষা আর আংশিক আবেগে ভর করে এরা রক্তক্ষয়ী হিংসা, সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়৷ কিন্তু এই নেতাটার সম্পর্কে ইতিমধ্যেই যা তথ্য এসে পৌঁছেছে, তা রীতিমতো চমকপ্রদ৷ দুর্গেশ সিং-এর বয়স আন্দাজ পঁচিশ, এখানকার ছেলে হলেও তার পড়াশোনা দিল্লিতে, ম্যানেজমেন্টে স্নাতক সে, পাঁচটা ভাষা গড়গড়িয়ে বলতে পারে৷ তারপরেও কেন সে গ্রামে ফিরে এসে এই বিদ্রোহের পথ বেছে নিল, এ ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার! শুধু নেতৃত্ব দেওয়াই নয়, সে নাকি তার দলকে দেশ-বিদেশের সমাজ, অর্থনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষাও দিতে শুরু করেছে৷

তার চেয়েও বিস্ময়ের, সে দলের ভার নেওয়ার পরেও কোনোরকম বিদ্রোহমূলক পোস্টার পড়েনি, বা নিজের শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টাও করেনি৷ ফলে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে রানাদের কমান্ড্যান্ট এখনো পরিষ্কার নয়৷

আপাতত তাই যে কোনোদিনের আসন্ন সংঘর্ষের দিকে তাকিয়েই কাটে জওয়ানদের জীবন৷ দৈবাৎ দূরের শহরে কোনো মন্ত্রী বা ভি আই পি এলে তাদের সিকিউরিটির জন্য তিন-চারজন জওয়ানকে দু-তিনদিনের জন্য চাওয়া হয়৷ কে যাবে, তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়৷ একটা দিন, কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরের মানুষের সংসর্গ পাওয়া, শহরের নাগরিক স্বাদের লোভে ওদের অন্তরাত্মা ব্যাকুল হয়ে ওঠে৷ বাধ্য হয়ে অ্যাসিসট্যান্ট কমান্ডান্টকে হস্তক্ষেপ করে জওয়ান বাছাই করতে হয়৷

মানুষের কান্নাও অন্যের অ্যাটেনশন চায়৷ চোখের জলও অন্যের সহমর্মিতা না পেলে অশ্রু হয়ে বেরোতে চায় না৷ রানারও তাই হল৷ একা একা আর কাঁহাতক কাঁদা যায়, আস্ফালন করা যায়!

একটু পরে চোখের জল মুছে রানা শুকনো পাতার ঝোপ থেকে নেমে দাঁড়াল৷

এত বড় জঙ্গলে রানা হারিয়ে গেছে৷ একাকী৷ ডিফেন্সের ভাষায় যেটা প্রচণ্ড বিপজ্জনক৷ কোনো জওয়ানকে একা পেলে জঙ্গিরা মুহূর্তে তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে দ্বিধা করবে না৷ তাছাড়া বন্য পশু, সাপের আক্রমণের ভয় তো আছেই৷

প্রাথমিক বেপরোয়া ভাবটা কেটে যেতে এবার রানার বেশ ভয় করতে লাগল৷ হাতের কলাশনিকভ রাইফেলটা শক্ত করে ধরে সামনে এদিক-ওদিক চলে যাওয়া অজস্র শুঁড়িপথের কোনোটা ধরে এগোবে, নাকি ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে সকাল হওয়া অবধি এখানেই কোথাও লুকিয়ে থাকবে, ও ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না৷

আর ঠিক এমন সময়ই ওর কানে এল সেই অদ্ভুত শব্দটা৷

একটা চাপা অথচ সুস্পষ্ট গলায় কে যেন কী বলছে৷ একটানা একঘেয়ে লয়ে৷ বন্দুকটা হাতে শক্ত করে ধরে আরো একবার কান পেতে ও বুঝতে পারল, আওয়াজটা আসছে ওর বাঁ-দিক ঘেঁষে আড়াআড়ি যে ঘন ঝোপটা শুরু হয়েছে, ঠিক সেই দিক থেকে৷

দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে রানা একদম তাড়াহুড়ো করল না, হঠাৎ করে টর্চও ফেলল না, কিছুটা উবু হয়ে বন্দুকটা সামনের দিকে তাক করে প্রায় নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল৷ দু’পা করে এগোয়, সামান্য থেমে উপরের লম্বা লম্বা গাছের দিকে তাকিয়ে নেয়৷ অনেক সময় মাওবাদীরা গাছের উপর লুকিয়ে থাকে, একা কোনো জওয়ানকে পেলেই শেষ করে দেয়৷

প্রায় তিনশো মিটার যাওয়ার পর ঝোপটা এতই দুর্ভেদ্য হয়ে উঠল যে প্রায় অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক৷ রানা বিশেষ অবাক হল না৷ ছত্তিশগড়ের জঙ্গলের ভেতরে এমন গভীর অরণ্যও আছে, যেখানে দিনের বেলাও সূর্যের আলো ঢোকার পারমিশন পায় না৷

গলায় ঝুলতে থাকা হুইসেলটা আরেকবার পরখ করে নিয়ে রানা ভেতরে ঢুকতে শুরু করল৷ বাঁশি বাজানো সেফ নয় নিজেকে গোপন রাখতে হলে, তবু বলা যায় না কখন প্রয়োজন পড়তে পারে৷ তুমুল বিপদের মাঝেও এক অতিমানবীয় দুঃসাহস যেন রানার উপর ভর করতে লাগল৷ নিজের মনেই নিজেকে ও বোঝাচ্ছিল, ভেতরে যদি মাওবাদীদের কোনো গোপন ডেরার সন্ধান পেয়ে কমান্ড্যান্টকে রিপোর্ট করতে পারে, তবে এখান থেকে ট্রান্সফারটা একটু তাড়াতাড়ি হলেও হতে পারে৷

যত এগোচ্ছিল, কণ্ঠস্বরটা ততই স্পষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কী কথা বলছে বুঝতে পারছিল না৷ শুধুই কেউ একজন যে তীব্র কষ্টে চাপাস্বরে গোঙাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছিল৷ রানা নিজের মনে চিন্তা করছিল৷ কোনো জঙ্গি? কিন্তু খুব সম্প্রতি তো ওদের উপর কোনো অ্যাটাক করার খবর নেই৷

তবে ইনজিওরড কে হল?

রানাদের কেউ নয় তো?

ও আরেকটু এগিয়ে একটা গাছের লতাপাতা সন্তর্পণে সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিল৷ আধো আলো আধো অন্ধকারে চোখটা একটু সয়ে যেতে দেখল, একটা লোক ঝোপের মধ্যে আধশোয়া হয়ে পড়ে রয়েছে, চাপা গোঙানিটা তার কাছ থেকেই আসছে৷

ও এগিয়ে লোকটার কাছে গেল৷ লোকটা প্রায় অচৈতন্য, মুখের এক পাশ দিয়ে সাদা ফেনা গড়িয়ে পড়ছে বুকের ওপর, তার মধ্যেই লোকটার মুখ দিয়ে তীব্র কষ্ট থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে ক্রমাগত৷

রানা আর দেরি করল না৷ লোকটার বেশভূষা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে গ্রাম্য কোনো লোক নয়, জওয়ানদেরও কেউ নয়৷ ও ঝোপের মধ্যে থেকে পাঁজাকোলা করে লোকটাকে তুলে নিয়ে বাইরের দিকে নিয়ে আসতে লাগল৷

লোকটার পিঠের নীচে হাত দিয়ে চাগাড় দেওয়ামাত্র লোকটা দারুণ আঘাতে যেন চমকে উঠল, অনেক কষ্টে রক্তবর্ণ চোখ মেলে তাকাল রানার দিকে, আর রানার হাতটাও যেন ছ্যাঁক করে উঠল৷ লোকটার গায়ের তাপমাত্রা প্রচণ্ড বেশি, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর৷

লোকটাকে কোলে করে ঝোপের বাইরে নিয়ে এসে সেই শুকনো পাতার ঝোপটার ওপর শোয়াল, আর তারপর টর্চ জ্বেলে আসল ব্যাপারটা দেখে আঁতকে উঠল৷ ওর নিজের দুটো হাত রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে, লোকটাকে আলতো উপুড় করে চমকে উঠে দেখল, পিঠে একাধিক গভীর ক্ষত৷ গভীরতা এতটাই যে দেখেই বুঝতে পারল, ইতিমধ্যেই প্রচুর রক্তপাত হয়ে গেছে৷ লোকটাও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে৷

রানা ক্ষতটাকে ভালো করে পরীক্ষা করতে লাগল৷ বুলেট থেকে হওয়া ইনজুরি এটা নয়, তাহলে গর্ত হত, এটা ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে৷ মাওবাদীদের বিষমাখানো তিরও নয়, অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও তির-ধনুক ওরা এখনো কিছুক্ষেত্রে ব্যবহার করে৷

রানা নিজের মনেই মাথা নাড়ল৷ না, তাও হবে না৷ আদিবাসী জঙ্গিদের বিষমাখানো ফলা হলে এতক্ষণ বেঁচে থাকা অসম্ভব, আর এত রক্তপাতও হবে না৷

ছুরি দিয়েই ফালাফালা করা হয়েছে লোকটাকে৷

রানা ওর পিঠের ব্যাগটা টেনে খুলল, রক্ত দ্রুত বন্ধ করার একটা পাউডার ব্যাগের ফার্স্ট এইড কিটেই থাকে, সেটা দিয়ে পুরো ক্ষতস্থানটা ঢেকে দিল৷ লোকটা আর কোনো সাড়াশব্দ করছে না৷ মরে গেল নাকি?

রানা নাকের কাছে হাত নিয়ে গেল, না৷ খুব ধীরে হলেও শ্বাস পড়ছে৷

একটু গরম দুধ খাওয়াতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত৷ কিন্তু দুধ আর এখানে কোথায়! রানা নিজেই তো রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে৷ আর কোনো একটা শুঁড়িপথ ধরে এগিয়ে চললেও এখান থেকে রানাদের ব্যারাক অনেক দূর, অন্ধকারে জঙ্গলের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যেতে পারে আর তাছাড়া, এতটা লোকটাকে কাঁধে করে নিয়ে গেলেও বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ৷ এত রক্তপাত হয়েছে৷

ইমিডিয়েটলি রক্ত দেওয়া গেলে যদি কিছু করা যেতে পারে৷

কিন্তু কে বা কারা করল লোকটার এই অবস্থা?

রানার গায়ে হঠাৎ কাঁটা দিয়ে উঠল৷ এটা কোনো ফাঁদ নয় তো? আশপাশেই হয়তো শত্রুরা কৌতুকভরে লক্ষ করছে ওর শেষ মুহূর্তের অভিব্যক্তি!

রানা স্নায়ুর ওপর নিজের দখল হারিয়ে ফেলার আগেই গলায় ঝুলতে থাকা হুইসেলটা বাজাতে গেল৷ এতে একেবারে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া হবে৷ যদি আশপাশে সত্যিই দুর্গেশ সিং-এর দল থাকে, তবে এই এক হুইসেলেই রানার ভবলীলা সাঙ্গ হবে, আর যদি তা না হয়, তবে দলছুট হয়ে গেলেও রানার টিম হয়তো খুব বেশিদূর এখনো যায়নি, তাদের হদিশ পাওয়া যাবে৷

কিন্তু লোকটা রানার মনের কথা বুঝতে পারল কি না কে জানে, হঠাৎ তার চোখদুটো খুলে গেল, তীক্ষ্ণচোখে তাকাল রানার দিকে৷

লাল টকটকে চোখের মর্মভেদী সেই দৃষ্টি!

কয়েক মুহূর্ত সেইভাবে চেয়ে থাকার পর লোকটার চোখের ভাষা বদলে গেল, কাতর চোখে ইংরেজিতে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘প্লিজ সেভ আস! আ-আমাদের ওরা মেরে ফেলবে!’

‘কারা মেরে ফেলবে?’

লোকটার যন্ত্রণায় মুখ-চোখ কুঁচকে যাচ্ছিল, অতিরিক্ত ব্লিডিং-এ চোখ বুজে আসছিল আস্তে আস্তে, ‘মু-মুরিয়ারা! আমরা বাঙালি, কলকাতা থেকে আসছি৷ ছুরি মেরেছে পেছন থেকে, একটু দূরেই রয়েছে ওরা, আর একটু দেরি হলেই আমাদের গোটা টিমকে ওরা…এমনিতেই প্রচুর পিটিয়েছে…!’ বলতে বলতে ওর ঘাড়টা একদিকে হেলে গেল, চোখ দুটোও ধীরে ধীরে বুজে গেল৷

রানা আবার লোকটার নাকের কাছে হাত দিল, খুব ধীরে শ্বাস পড়ছে৷ লোকটা আবার জ্ঞান হারিয়েছে৷

ও আর দেরি করল না৷ ‘কলকাতা থেকে আসছি’ বলাটা ওর সক্রিয়তা যেন আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল৷ শরীরে যতখানি জোর আছে, সবটুকু দিয়ে হুইসেলটা ও বাজিয়ে দিল৷

দুই

নির্জন অরণ্যের মধ্যে লতাপাতার প্রাকৃতিক বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে মধ্যরাতে কেউ যদি আকাশের তারাদের নিরন্তর লুকোচুরি দেখতে থাকে, একটা সময়ের পর মহাকাশের রহস্যের গোলকধাঁধায় সে হারিয়ে যাবেই৷ জাগতিক চিন্তা, দুশ্চিন্তা, সুখ-দুঃখ ভুলে ক্ষণিকের জন্য হলেও সে বুঁদ হয়ে যাবে আকাশে৷

ডাঃ সঞ্জয় কিস্কুরও সেটাই হল৷ শার্ট-প্যান্ট-সোয়েটার পরে একটা পা অন্য হাঁটুর উপর তুলে দিয়ে তিনি নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই হারিয়ে গিয়েছিলেন৷

সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা, বাঁ উরুর ওপরদিকের অংশটা তো রীতিমতো ফুলে রয়েছে, ভ্রূ’র উপরে ধারালো আঘাতে অনেকটা অংশ কেটে গিয়েছিল, এখন দপদপ করছে৷ তবু শারীরিক যন্ত্রণাকে টপকে তিনি যেন প্রকৃতিপ্রেমে নিজেকে নিমজ্জিত করছিলেন ধীরে ধীরে৷ অন্য কারুর আশ্চর্য লাগলেও ডাঃ কিস্কুর ক্ষেত্রে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার৷ যারা ওঁকে চেনে, তারা জানে, তীব্র বিপদেও সম্পূর্ণ অন্য কোনো ক্ষেত্রে বুঁদ হয়ে যাওয়ার প্রতিভা তাঁর রয়েছে৷

হঠাৎ ডাঃ কিস্কুর মাথার পেছন দিয়ে কার ছুটে আসার খচরমচর শোনা গেল৷ শুকনো পাতা নির্দয়ভাবে মাড়িয়ে কেউ ছুটে আসছে৷

ডাঃ কিস্কু তাতেও চমকালেন না৷ দূরের আকাশে ওটা কি কালপুরুষ? হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে! ওই তো পায়ের কাছে জ্বলজ্বল করছে লুব্ধক৷ প্রথম যখন মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে পা রেখেছিলেন, ফার্স্ট ইয়ারের নিঃসঙ্গ জীবনে শতাব্দীপ্রাচীন হোস্টেলের ছাদে উঠে যেতেন তো এই লুব্ধকেরই টানে৷ সতীর্থদের ইশারায় ইঙ্গিতে ‘সাঁওতাল’ হওয়ার স্থূল রসিকতায় মোড়া তাঁর বন্ধুহীন জীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল তখন এই লুব্ধক৷ তাঁর কান্নাহাসি, দুঃখ-সুখের একমাত্র নীরব শ্রোতা৷

সহসা তিনি মাথার বাঁ-পাশ থেকে শুনতে পেলেন, ‘ডাক্তারবাবু! শিগগিরই চলুন৷’

‘এখনই চলব কেন, চয়ন! ভোর হোক! এখন গেলে তো আবার ওদের হাতে পড়তে পারি!’ ডাঃ কিস্কু শান্তভাবে বললেন৷

চয়ন অধৈর্যভাবে বলল, ‘না ডাক্তারবাবু, এখনই পালাতে বলছি না৷ স্যারের জ্ঞান ফিরে এসেছে৷ কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই৷ আ-আমার খুব ভয় করছে ডাক্তারবাবু! আপনি প্লিজ আমার সাথে একবার চলুন স্যারের কাছে৷’

ডাঃ কিস্কু এইবার একটু চিন্তিতভাবে কালপুরুষ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চয়নের দিকে ফেললেন, ‘জ্ঞান ফিরে এসেছে? কিন্তু, যা ইঞ্জেকশন দিয়েছি, তাতে তো এত তাড়াতাড়ি…!’

চয়ন অসহায়ভাবে বলল, ‘উঠে সেই একই কথা বিড়বিড় করছেন৷ চোখের চাউনি, হাবভাব একদম ভালো লাগছে না ডাক্তারবাবু! বিপুলদাকেও তো দেখতে পাচ্ছি না৷ কোথায় যে গেল৷ আপনি প্লিজ চলুন!’

ভালো লাগবে কী করে, চয়ন? আমিও তো এদের মতো আদিবাসীই, নেহাত পড়াশুনো, মেধার জোরে আজ তোমাদের সফিস্টিকেটেড সোসাইটিতে স্থান পেয়েছি৷ তবু কি আমার পদবি শুনলেই তোমাদের মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ফুটে উঠতে দেখি না? একটা গ্রামের মানুষজন তাদের সোজা বিশ্বাসে তোমাদের অতিথিজ্ঞানে সেবা করল, আর তোমরা কিনা তাদের সেই সারল্যের সুযোগ নিয়ে…! ডাঃ কিস্কু মনে মনে কথাগুলো তেতোভাবে আউড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘আসলে আমাদের সবার মধ্যে তোমার স্যারের আঘাতটাই তো সবচেয়ে গুরুতর, সেই শকটা মনে হয় কাটিয়ে উঠতে পারছেন না! চলো গিয়ে দেখি৷’

দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে গোপনে শব্দ কম করে হাঁটা বেশ কঠিন ব্যাপার৷ আজ সকাল আর রাতের কি বিস্তর ফারাক, ডাঃ কিস্কু ভাবলেন৷ সকালটা শুরু হয়েছিল মুরিয়াদের মোড়লের বাড়ির দাওয়ায় বসে ছাগলের খাঁটি দুধ আর ভুট্টাদানা দিয়ে৷ মুরিয়াদের মতো ট্রাইব এই ছত্তিশগড়ে আরো অনেক আছে৷ কিন্তু ওদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে থাকার হারমোনি, জীবনকে পুরো অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার উদারতা, আর এইজন্যই বহু যুগ ধরে বিদেশেও এই উপজাতি গবেষণার বিষয়৷

ডাঃ কিস্কুর কাছে একের পর এক রুগি আসতেই থাকছিল৷ বেচারাদের হাতুড়ে কবিরাজ, গুণিন, ঝাড়ফুঁকই ভরসা, গলায় স্টেথো ঝোলানো ডাক্তার দেখলে ভক্তিশ্রদ্ধা তো হবেই৷ মাথায়, গলায়, বুকে নানারকমের গয়না পরা বাচ্চা কোলে মেয়েদের ধুম পড়ে গিয়েছিল৷ ব্লাউজহীন হাঁটু অবধি শাড়িতে তারা একে একে ভিড় করছিল৷ এদের ভাষা অনেকটা দক্ষিণ ভারতীয় কন্নড়, তেলেগুর মতো, তাই হিন্দি জানা কিছু মুরিয়া ডাঃ কিস্কু আর ওদের মাঝে দোভাষীর কাজ করছিল৷

তার মধ্যেই চয়ন আর ওর প্রোফেসর মোড়লের সঙ্গে গল্প জুড়েছিলেন৷ আর জার্নালিস্ট বিপুলবাবু পুরোটা রেকর্ড করছিলেন৷

কিন্তু সত্য অন্বেষণের তাগিদের কাছে কি মানুষের গোপনীয়তাও তুচ্ছ? আর মানুষের গোপনতম নগ্নতাকে দুনিয়াসুদ্ধ লোকের কাছে প্রকাশ করে দেওয়ার মধ্যে কিই বা সত্য আবিষ্কারের বাহাদুরি?

ডাঃ কিস্কু রেডিয়াম বসানো রিস্টওয়াচে সময় দেখলেন, রাত পৌনে একটা৷ খেয়ে-দেয়ে যখন শুয়েছিলেন তখন পাক্কা সাড়ে ন’টা বাজছিল, স্পষ্ট মনে আছে তাঁর৷ মোড়লের ডানহাত পেঠুল বলে লোকটা এসে ওঁদের শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল৷ দুপুরের অত বড় অন্যায়ের পরেও অতিথি আপ্যায়নে ত্রুটি ছিল না এতটুকু৷ শুধু অন্যদিনের মতো আর ঝকঝকে দাঁত বের করে সেই নিষ্পাপ হাসিটা আজ আর উপহার দেয়নি৷ তারপর কামাট বলে খাবার দিতে আসা ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে পারা ছেলেটা ফিসফিস করে জানিয়েছিল মুরিয়াদের গ্রামে দুমদাম শাস্তি হয় না, কাল সকালে মোড়ল এর বিচার করবেন৷

এর পরেও বলা হবে এরা অসভ্য জাতি? এরা অসভ্য? না যারা লুকিয়ে অন্তরঙ্গ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে ছড়িয়ে দিতে চায় আন্তর্জালে, তারা অসভ্য?

এইসব ভাবলেই মাথাটা গরম হয়ে ওঠে ডাঃ কিস্কুর৷ তিক্ত গলায় বললেন, ‘সবই তো ঠিকঠাক চলছিল, চয়ন৷ ঘোটুল নিয়ে ডকুমেন্টারি, বিপুলবাবুর স্কুপ, এরই মধ্যে কেন এই বাড়াবাড়িটা করতে গেলে তোমরা!’

‘বিশ্বাস করুন, ডাক্তারবাবু!’ জঙ্গলের বিচিত্র সব পোকামাকড়ের ডাক ছাপিয়ে চয়নের বিষাদগ্রস্ত গলা পাওয়া গেল, ‘আমি চাইনি এটা করতে৷ স্যারই বললেন, পৃথিবীতে কেউ যা কখনো পারেনি সেটা আমরা…! বিদেশি একটা চ্যানেল প্রচুর টাকার অফার…!’ চয়নের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল৷

সামনেই দাঁড়িয়ে ডাঃ সান্যাল৷ ডাঃ পরমেশ সান্যাল৷ গালের বীভৎস ক্ষতস্থানের রক্ত তখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, বাঁ কনুইয়ের নীচ থেকে হাতের যে অংশটি তিরতির করে দুলছে, সেটা যে রক্তমাংসের ভেতরে ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে, তা বোঝার জন্য ডাক্তারবদ্যির দরকার পড়ে না৷ ডাঃ কিস্কু যে ন্যাকড়াটা দিয়ে মাথার অন্যদিক বেঁধে দিয়ে এসেছিলেন একটু আগে, সেখানটা ভিজে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে বাইরে৷

অন্ধকারেও চয়নের মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটে গোটা দৃশ্যটা দেখে অজানা ভয়ে শরীর যেন হিম হয়ে আসে৷

চয়ন বলতে যাচ্ছিল, ‘একি স্যার! আপনি উঠে এতটা কী করে চলে এলেন? খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই?’

প্রোফেসর সান্যাল উত্তর না দিয়ে চোয়াল সামান্য ফাঁক করে হাসলেন৷ চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, ঢুলুঢুলু৷ কেমন যেন সুর করে বললেন, ‘মরা মানুষের আবার কষ্ট কি হে, চয়ন? কবিগুরু কী বলে গিয়েছিলেন মনে নেই?’ চোখদুটি মুদিত করে আবৃত্তি করতে লাগলেন ডাঃ সান্যাল,

‘‘আজিকে হয়েছে শান্তি, জীবনের ভুলভ্রান্তি সব গেছে চুকে৷

রাত্রিদিন ধুকধুক, তরঙ্গিত দুঃখ-সুখ, থামিয়াছে বুকে৷

যত কিছু ভালো-মন্দ, যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব, কিছু আর নাই৷

বলো শান্তি, বলো শান্তি, দেহ-সাথে সব ক্লান্তি, হয়ে যাক ছাই!’’

‘হয়ে যাক ছাই’ শব্দটির ওপর একটা দীর্ঘশ্বাস আরোপ করে প্রোফেসর সান্যাল হাসলেন, ‘আমার তো শরীরটা খুব হালকা লাগছে৷ আর কোনো চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, টাকার জন্য হেদিয়ে মরা নেই, কোন জার্নাল লবিবাজি করে আমার পেপারটাকে চেপে দিল তাই নিয়ে ছটফটানি নেই, পায়রার মতো শান্তি এখন! কী সব যমদূত, চিত্রগুপ্তের গল্প শুনেছিলুম যে? কই তাদের তো কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই?’

চয়ন ডাঃ কিস্কুর দিকে একঝলক চেয়ে ফিসফিস করল, ‘সেই একই কথা! ডাক্তারবাবু, স্যারের কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? নাকি স্যারই ঠিক, আমরা সত্যিই মরে গেছি! আমরা কি সবাই এখন ভূত, স্যার?’

ডাঃ কিস্কু কোনো উত্তর দিলেন না৷

শুধু চারপাশে কবরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা নিশ্চল গাছগুলোর চারপাশে অশরীরী প্রেতাত্মার মতো ঘুরে ঘুরে প্রোফেসর সান্যাল সুর করে আবৃত্তি করতে লাগলেন,

‘‘সব তর্ক হোক শেষ, সব রাগ সব দ্বেষ, সকল বালাই

বলো শান্তি, বলো শান্তি, দেহ-সাথে সব ক্লান্তি

পুড়ে হোক ছাই!’’

তিন

‘মুরিয়া তো এদিককার একটা ট্রাইব!’ মারুফ বলে দাড়িগোঁফ কামানো ছেলেটা পরিষ্কার হিন্দিতে বলল৷

‘ট্রাইব? কই আগে কখনো নাম শুনিনি তো!’ রানা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল৷

‘আপনি কী করে শুনবেন?’ মারুফ ঝকঝকে হেসে রানার দিকে তাকাল, ‘কঙ্কার পাহাড়ের নীচ থেকে বস্তার জেলা শুরু হয়েছে, মাঝখান দিয়ে বইছে ইন্দ্রাবতী নদী৷ এই নদীরই তীরে অজস্র জঙ্গল, পাহাড়, তাদের মধ্যে অনেক ধরনের আদিবাসী উপজাতি বসবাস করছে বহু বছর ধরে৷ যেমন ধরুন গন্দ, অবুঝমারিয়া…!’

‘হ্যাঁ, এদের নাম তো শুনেছি৷ গন্দদের গ্রামে একবার আমরা ক্যাম্পও করেছিলাম৷ আর অবুঝমার পাহাড়েই তো অবুঝমারিয়ারা থাকে৷’ রানা বাধা দিয়ে বলল, ‘কিন্তু মুরিয়া বলে তো…!’

‘ওরা একটু আলাদা থাকে৷ ইন্দ্রাবতী নদীর উত্তরে তিনটে গ্রাম আছে৷ তার মধ্যে নারায়ণপুর আর কোন্ডাগাঁও বলে গ্রামদুটোয় ওরা থাকে৷’ মারুফ একটু থামল, ‘ওরা অন্য ধরনের উপজাতি৷ বাইরের লোকের সঙ্গে তেমন মেশে না৷’

রাত প্রায় দেড়টা বাজে৷ কাঠের দরমা দেওয়া একচালার টালির এই বাড়িটাকে আশ্রয়স্থল বলাটা হয়তো অতিশয়োক্তি হয়ে যাবে, তবু পাণ্ডববর্জিত এই জঙ্গলে মুমূর্ষু লোকটাকে আর কোথায়ই বা নিয়ে আসতে পারত রানা! ব্যারাকে নিয়ে যেতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যেত৷ নেহাত ওর বাঁশির শব্দ শুনে মারুফ বলে এই ছেলেটা ছুটে এল তাই৷

ওর আবার মনে পড়ল, ঘন জঙ্গলের মধ্যে গভীর রাতে ও হারিয়ে গেছে৷ দলের থেকে আকস্মিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গভীর রাতে শত্রুভূমিতে একা একা পথ খোঁজা আর যেচে হাঁড়িকাঠে মাথা এগিয়ে দেওয়া একই ব্যাপার৷ তবু এতদূরে ওর মাতৃভাষায় কাউকে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে ও আর নিজেকে সামলাতে পারেনি, হুইসেল বাজিয়ে দিয়েছিল৷ যদি কারুর সাহায্য পাওয়া যায়, যদি রানাদের দলের একটা সাবট্রুপও এদিকটা এসে থাকে!

কিন্তু না, রানাদের দলের কেউ আসেনি৷ ওরা সম্ভবত অনেক দূরে চলে গেছে৷ পাঁচ-ছ’বার বাঁশির আওয়াজের পর রানা থেমে গিয়েছিল৷ তারও বেশ কিছুক্ষণ পর ছুটতে ছুটতে মারুফ বলে এই ছেলেটা এসেছিল৷

প্রথমে রানা যখন বুঝল যে, এ জওয়ানদের কেউ নয়, তখন মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল৷ ছেলেটা তার মানে হয় এখানকার কোনো গ্রামের লোক, নয়তো জঙ্গিদের কেউ৷ দুটোতেই সমান বিপদ, এখানকার গ্রামবাসীরা জওয়ানদের শত্রু মনে করে৷

কিন্তু না৷ মারুফ বলে এই ছেলেটা কাছের একটা গ্রামের ঠিকই, কিন্তু সে নাকি ছুটিতে বাড়ি এসেছে, থাকে বাইরে৷ কাজেই জওয়ানদের প্রতি তার বিদ্বেষ অতটা নেই বলেই মনে হল৷

প্রথমে রানা শঙ্কিত চোখে তাকিয়েছিল, ‘কিন্তু তুমি এত রাতে জঙ্গলের মধ্যে কী করছ?’

‘স্যার আমি…মানে!’ মারুফ মুখ নিচু করেছিল৷

রানা মুমূর্ষু লোকটার কথা ভেবেও কড়া চোখে মারুফের দিকে তাকিয়েছিল৷ মারুফের হিন্দি একদম স্পষ্ট, এখানকার গ্রাম্য টান নেই, ‘কী করছিলে বলো?’

মারুফ লজ্জিত মুখে রানার দিকে তাকিয়েছিল, ‘ইয়ে স্যার মানে…একটু দূরে একটা বাঁশের ডেরা আছে৷ আমি সেখানে অপেক্ষা করছিলাম৷ ওখান থেকে আপনার বাঁশির আওয়াজ শুনে ছুটে এলাম৷’

‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি৷ কিন্তু এত রাতে জঙ্গলের মধ্যে বাঁশের মাচায় কার জন্য অপেক্ষা করছিলে? কে আসবে?’ রানা হাতের বন্দুকটাকে সোজা করে মারুফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিল৷

‘না স্যার, আ-আসেনি৷ বাড়িতে মনে হয় কোনো কাজে আটকে গেছে৷ কিন্তু আসার কথা ছিল৷ যদি এখন গ্রামে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়ে যাই? তাই ওখানেই বসেছিলাম৷ ভেবেছিলাম ভোর হলে চলে যাব৷’ মারুফ ভয়ার্ত চোখে রানার দিকে তাকিয়েছিল৷

মুখ দেখে রানার মনে হল না ছেলেটা মিথ্যা কথা বলছে৷ তবু প্রশ্ন করল, ‘আসার কথাটা কার ছিল?’

‘সুহানার৷ আমাদের গ্রামের সরপঞ্চের মেয়ে৷ আমি ছুটিতে বাড়ি এলে আমরা এখানে আর কি একটু দেখা…৷’ মারুফ অধোবদন হয়ে বলল, ‘আসলে স্যার আমার বাবা গরিব, জমি আছে অল্প৷ ওর বাবা তো সরপঞ্চ, মেনে তো নেবেই না উল্টে জানতে পারলে আমাদের বাড়িতে…!’

সেই একই বস্তাপচা বলিউডি সিনেমার গল্প৷ রানা আর সময় নষ্ট করতে চাইছিল না, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ তোমার ওই বাঁশের কেল্লাতেই আপাতত নিয়ে যাই চলো একে৷’

প্রেমপিরিতের সৌভাগ্য ওর এখনো হয়নি, তবে এইসব জায়গার সরপঞ্চ অর্থাৎ মোড়লের প্রতাপ প্রচণ্ড, তার মেয়ের সঙ্গে গোপনে প্রেম করাটা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার, মারুফের অবস্থা রানা অনুভব করতে পারছিল৷ এদিককার জাতপাত-ধর্মের জটিলতা প্রচুর, মেয়েদের বাড়ি থেকে ছেলেকে পিটিয়েছে, বা ছেলেদের বাড়ির সঙ্গে মেয়েদের বাড়ির প্রকাশ্যে মারামারি, প্রায়ই এইরকম সব খবর শোনা যায়৷

মারুফ আবার বলল, ‘স্যার, দেখুন! লোকটা আবার বিড়বিড় করছে!’

ওরা আহত লোকটাকে মাটিতে ছেঁড়া বস্তাজাতীয় একটা কিছুর উপর শুইয়ে রেখেছিল৷ মারুফ কোথা থেকে কিছু কাপড় পেয়ে তা দিয়ে লোকটার পিঠের গভীর ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে চলা রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিল৷ ওর আর মারুফের টর্চের আলোয় লোকটার যন্ত্রণাকাতর মুখটা দেখে খুব অসহায় লাগছিল৷ কিন্তু এত রাতে ওই আহত দেহটাকে নিয়ে রানাদের প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের ব্যারাকের দিকে হাঁটার চেষ্টা করা বাতুলতা৷ তাছাড়া তাতে বিপদ বাড়বে বই কমবে না৷

লোকটা অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিল৷ মারুফের কথা শুনে রানা লোকটার মুখের দিকে তাকাল৷

হ্যাঁ, লোকটার আবার জ্ঞান ফিরে এসেছে৷

কিন্তু এত প্রবল রক্তপাতের পর কি আর বাঁচতে পারে কেউ?

কিন্তু লোকটার চোখ আবার খুলে গেল, সেই একই ধরনের লাল টকটকে চোখ, রানার দিকে পরিষ্কার কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ দুটো যেন মিনতি করে উঠল, ‘ওদের বাঁচান! আমি আর বাঁচব না৷ আমার এখানে সময় নষ্ট না করে ওদের বাঁচান, প্লিজ! তিনজনকেই ওরা মেরে ফেলবে৷ প্লিজ!’ শেষ শব্দতে যেন গর্জন পরিণত হল আকুতিতে৷

‘ওরা মানে মুরিয়ারা?’ রানা লোকটার গলায় একটু জল ঢেলে দিল বোতল থেকে, ‘একটু যদি খুলে বলেন৷ মুরিয়ারা আপনাদের মারছে কেন? কী করেছেন আপনারা? আপনারা কারা?’ লোকটার এক একটা শব্দ উচ্চারণ করতে বুকটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিল, তবু ও থামাল না৷

অন্য কোথাও যদি বড় কোনো বিপর্যয় চলতে থাকে?

লোকটা মনের অসীম জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল, ‘আমাদের চারজনের একটা টিম গিয়েছিলাম মুরিয়াদের গ্রামে৷’

‘আপনারা মানে কারা?’ রানা জিগ্যেস করল৷

লোকটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে তার সংজ্ঞা চলে যাবে৷ তবু সে দাঁতে দাঁত চিপে বলল, ‘অ্যানথ্রোপলজিস্ট ডাঃ পরমেশ সান্যাল, ওঁর এক ছাত্র, নাম চয়ন৷ এছাড়া আমি আর সঞ্জয়বাবু৷ সঞ্জয় কিস্কু ডাক্তার, এছাড়া আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন৷’

‘আর আপনি? আপনি কী করেন?’

‘সাংবাদিক৷ কলকাতার একটা কাগজের অফিসে চাকরি করি৷ আমার নাম বিপুল, বিপুল সমাদ্দার৷ ওদের সঙ্গে জুটেছিলাম এক্সক্লুসিভ স্কুপের আশায়…!’ শেষ কথাটায় লোকটার মুখ বেঁকেচুরে গেল৷

‘মুরিয়ারা কেন মারছে আপনাদের? ওরা তো কাউকে অ্যাটাক করে না শুধু শুধু!’ মারুফ পাশ থেকে বলে উঠল৷

লোকটা এবার অতিকষ্টে বলে উঠল, ‘ঘো-ঘোটুল!’

রানা বলতে যাচ্ছিল, ‘কি?’

কিন্তু তা বুঝতে পেরেই বোধহয় মারুফ রানাকে ইশারায় থামিয়ে দিল৷

‘ঘোটুল বন্ধ করতে গিয়েছিলেন ডাঃ সান্যাল৷ সেটা ওরা প্রথমে বোঝেনি, আমরা বলেছিলাম এমনি উৎসব দেখতে এসেছি৷ কি-কিন্তু চয়ন যখন ঘোটুলের ভেতর হাতে-নাতে ধরা পড়ল, ওরা হঠাৎ রাতের বেলা লাঠিসোঁটা নিয়ে…!’ লোকটা প্রকাণ্ড শব্দে হাঁপাচ্ছিল, ‘আ-আপনারা ওদের তিনজনকে বাঁচান প্লিজ! লাঠি দিয়ে পেটানোর পর আমরা রাতের অন্ধকারেই কোনোরকমে বেরিয়ে গ্রামের বাইরের নদীর ঝোপে আশ্রয় নিই, আমি…আমি আর প্রোফেসর কথা বলছিলাম, প্রোফেসর খুব উন্ডেড ছিলেন৷ তারপর উনি একটু হালকা হবেন বলে চোখের আড়াল হতেই আমাকে একা পেয়ে হঠাৎ পেছন থেকে…! ওদের বাঁচান! হয়তো এখনো মুরিয়াদের হাতে ওরা…৷’

‘কোনখানে ওরা লুকিয়ে রয়েছে আরেকবার বলুন?’ মারুফ ঝুঁকে পড়ল৷

‘কোন্ডাগাঁও, মানে মুরিয়াদের গ্রাম, ওটা শুরুর আগে যে নদীটা পড়ে, সেখানেই তাড়া করে এসেছিল…ছুরি দিয়ে কুপিয়েছে, আমি কোনোমতে অন্ধকারে তাড়া খেয়ে এখানে…!’

‘আঁক’ করে একটা অস্ফুট শব্দ হয়েই লোকটা আবার নিস্তেজ হয়ে গেল৷

লোকটা তৃতীয়বারের জন্য জ্ঞান হারিয়েছে৷ আর কি এই জ্ঞান ফিরবে?

রানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারুফের দিকে তাকাল, ‘কিছুই তো বুঝলাম না!’

মারুফ রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় একটু তাড়াতাড়ি করলে হয়তো আমরা বাকি তিনজনকে বাঁচাতে পারব৷ মুরিয়াদের অঞ্চলে গিয়ে ঘোটুল নিয়ে ঝামেলা করা মানে মৌমাছির চাকে হাত দেওয়া৷’

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না৷ ঘোটুল ঘোটুল করছ, সেটা কী জিনিস?’

বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার যেন ছোটবেলায় পড়া দৈত্যের মতো গিলতে আসছে৷ এই সুবিশাল জঙ্গলের কোন প্রান্তে পড়ে রয়েছে ও, তা ঈশ্বরই জানেন৷ তবে, সুবিধা একটা, মারুফ বাইরে কর্মসূত্রে থাকলেও এখানকারই ছেলে, যে রাতের অন্ধকারে গোপন অভিসারের জন্য গহীন বন বেছে নেয়, সে যে ভোরের আলো ফুটলে ওকে সঠিক রাস্তা বাতলে দিতে পারবে, তা একরকম নিশ্চিত হওয়াই যায়৷ ততক্ষণে বরং এই ব্যাপারটাকে তলিয়ে দেখা দরকার, তাতে তিনটে প্রাণ উদ্ধার করা যেতে পারে৷ সঙ্গে দ্রুত ট্রান্সফারটাও৷

ঘরের এক কোণে জরাজীর্ণ একটা তক্তা জাতীয় কিছু রয়েছে৷ মারুফ সেটার নীচে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে যেটা নিয়ে এল, সেটা দেখে রানা চমকে উঠল৷

মারুফের হাতে একটা বেশ ধারালো ছুরি৷ বেশ চওড়া বাঁটের, টর্চের আলোতে ঝকমক করছে৷

রানার মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠতে দেখে মারুফ হাসল, ‘ভয় পাবেন না স্যার৷ জঙ্গলে মানুষ হয়েছি তো, রাতবিরেতে বেরোতে গেলে নিতেই হয়৷’ বলেই ও ব্যস্ত গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় স্যার, আমাদের ওই তিনজনকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করা উচিত৷ আমি মুরিয়াদের গ্রাম চিনি, গ্রামে ঢোকার মুখের ওই নদীটাও৷ আপনি যাবেন?’

রানাদের ব্যাগে প্রচণ্ড যন্ত্রণা থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য ঘুমোনোর ইনজেকশন থাকে৷ বিপদে সহকর্মীকে ইনজেকশন পুশ করার ট্রেনিংও রপ্ত করতে হয়েছে ওদের৷ তেমনই একটা ইনজেকশন লোকটাকে দিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল৷ মারুফ আগেই শক্ত করে ক্ষতস্থানগুলো ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল৷

মারুফ বাঁশের ঘর থেকে বেরিয়েই বলল, ‘লোকটা আহত হওয়ার পর এই অবস্থায় এখানে এসেছে, তার মানে জায়গাটা খুব দূরে হবে না মনে হয়৷’

‘ওই যে বলল কি গাঁও?’

‘হ্যাঁ৷ এখান থেকে পনেরো মিনিট দক্ষিণে গেলেই মুসি নদী, তারপরই শুরু হচ্ছে মুরিয়াদের গ্রাম কোন্ডাগাঁও৷’ মারুফ একটু থামল, তারপর বলল, ‘স্যার, মুরিয়ারা সারা পৃথিবীর কাছে একটা বিস্ময়ের জিনিস, ওই ঘোটুলের জন্য৷’

‘ঘোটুলটা কী?’

মারুফ পা বাড়াল, ‘চলুন, যেতে যেতে বলছি৷ সাবধানে আসবেন, এদিকে জোঁকের উপদ্রব আছে৷ সাপখোপ এই ঠান্ডায় খুব একটা নেই, তবে বলা যায় না৷’

দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে থাকলেও একটা সময় চোখ তার মধ্যেও আলো খুঁজে নেয়৷ মারুফের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে যখন আশপাশের গাছগুলোকে সেই আলোয় রানা দেখতে পাচ্ছিল, জঙ্গিদের ভয় মনে টোকা মারলেও মনকে তখন ও বোঝাচ্ছিল, তিনটে মানুষকে উদ্ধার করতে পারলে ট্রান্সফার বাঁধা৷ নিদেনপক্ষে যদি শিলিগুড়ি বা পুরুলিয়া পোস্টিংটাও পাওয়া যায়!

সত্যিই! মানুষ বড় বিচিত্র! কতগুলো প্রাণের জীবন-মৃত্যুর দড়ি টানাটানির মাঝেও রানা কেমন নিজের স্বার্থের কথা ভাবছে!

আসলে সব মানুষই স্বার্থপর৷ কেউ কম৷ কেউ বা বেশি৷

‘মুরিয়া উপজাতি বহু আগে গন্দ লোকেদের মধ্যেই ছিল, কিন্তু মুরিয়াদের কিছু বিচিত্র প্রথার জন্য ওরা আলাদা হয়ে যায়৷ মুর কথার অর্থ শিকড়৷ মুরিয়ারা অন্যান্য আদিবাসী উপজাতির মতো যাযাবর নয়, তারা এক জায়গায় সেটলড, তাই হয়তো এই নাম৷’ অন্ধকারেও মারুফের হাসি শুনতে পেল, ‘আসলে যখন এই দুনিয়া ছেড়ে বাইরে প্রথম পড়তে গিয়েছিলাম, তখন বেশ কৌতূহল ছিল যে বাইরের দুনিয়া এদের কী চোখে দেখে৷ তখনই পড়েছিলাম৷ আমি নিজে অবুঝমারিয়া উপজাতির মানুষ, আমাদের সঙ্গে মুরিয়াদের তেমন সদ্ভাব নেই, আবার বিশাল ঝামেলাও নেই৷ যারা যাদের মতো থাকে৷

‘মুরিয়াদের গ্রামের একদম বাইরে ওই মুসি নদীর পাড়ে বেশ লম্বা একটা মাটির বাড়ি আছে, তার মধ্যে কোনো আসবাবপত্র নেই, খাট, বিছানা বা জামাকাপড় রাখার জায়গা কিচ্ছু নেই৷ তাতে কেবল সার দিয়ে খালি ঘর রয়েছে৷ ওটাকেই বলে ঘোটুল৷ মুরিয়া গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ছেলেমেয়েরা শৈশব পেরোলেই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওই ঘোটুলে, সেখানেই তারা পুরো কৈশোরকালটা থাকে৷’

‘এরকম হোস্টেল টাইপ ব্যাপার তো শহরেও আছে৷ এটা কী এমন ব্যাপার?’ একটা গাছের ডালে রানার বন্দুকের বাঁটটা আটকে গিয়েছিল, সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে ও প্রশ্ন করল৷

‘স্যার, ঘোটুলে গ্রামের সমস্ত কিশোর এবং কিশোরীদের খুশিমতো যৌনাচারে উৎসাহ দেওয়া হয়৷ মুরিয়ারা এক ধরনের পানীয় খায়, সালফি বলে, সেই সালফি খেয়ে ওই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে নাচগান করে, রাইলা বলে ওদের একটা নাচের উৎসবও আছে৷ যে যার সঙ্গে খুশি শারীরিক মিলনে জড়িয়ে পড়ে, এমনকি গ্রুপ সেক্সও চলে৷ পৃথিবীর খুব কম প্রজাতির মধ্যেই এমন খোলাখুলিভাবে বিয়ের আগে যৌনতার নজির আছে৷’

‘আর গ্রামের বড়রা কিছু বলে না?’ রানা অবাক৷

‘বলবে আবার কী! তারাই তো পাঠায়৷ ঘোটুল প্রথা ওদের একটা ঐতিহ্য৷ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে৷ ওদের মতে এতে সেক্সের প্রতি ছুঁৎমার্গ ছোটবেলাতেই চলে যায়, হিংসা বা অধিকারবোধ থাকে না৷ পরে বিয়ের পর মানিয়ে নিতেও সুবিধা হয়৷ কোনো ভুলভাল চিন্তাভাবনাও আসে না৷ এমনিতে মুরিয়ারা বেশ পরিণত বয়সেই বিয়ে করে, কিন্তু জীবনের একদম প্রথম ভাগে এই অভিজ্ঞতাটা ওদের সকলকে অর্জন করতে হয়৷ ঘোটুলে কোনো ভালোবাসার মধ্যে জড়ানো যাবে না, এক সঙ্গীর সঙ্গে পর পর তিনরাত শোওয়া যাবে না, গর্ভধারণ বা কোনো যৌনরোগ এড়ানোর জন্য জঙ্গলের এক ধরনের গাছের শিকড় রোজ তুলে আনতে হবে, এইসব বড়রাই নিয়ম করে দেয়৷’

রানার মুখে কথা সরছিল না৷ আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে বহুবিবাহের চল আছে সেটা ও জানত, কিন্তু এরকম যথেচ্ছ যৌনাচার, তাও আবার কিশোর বয়সে, এমন কখনো ও আগে শোনেনি৷

মারুফ বলছিল, ‘ঘোটুলে থাকা বাচ্চা ছেলেদের বলে চেলিক আর মেয়েদের মোতিয়ারি৷ চেলিকদের একজনকে নেতা করা হয়, সে সবাইকে রোজকার কাজ ভাগ করে দেয়৷ সারাদিন ঘোটুল পরিষ্কার রাখা, গোবরজল দিয়ে নিকোনো, রান্নাবান্না, তাকে বলে সর্দার৷ তেমনই মেয়েদের দলের নেত্রীকে বলে বিলোসা৷ প্রায় দশ-বারো বছর এভাবে নিয়মের মধ্যে কাজ করে, প্রচুর যৌন অভিজ্ঞতা অর্জন করে ওরা বেরিয়ে আসে ঘোটুল থেকে৷’

‘কিন্তু এটা তো…মানে জিনের দিক থেকেও ঠিক নয় মনে হয়! মানে অসুখ-বিসুখ…!’

‘একদমই তাই৷ ব্রিটিশ সময়ে বহু সাহেব এই মুরিয়াদের মধ্যে থেকে গেছেন, এই ঘোটুলের বিচিত্র সব কাজকর্ম তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে৷ একজন সাহেব, তিনিও মনে হয় ওই ডাঃ সান্যালের মতো বিজ্ঞানীই ছিলেন, তিনি তো সারাজীবন এখানেই থেকে গিয়েছিলেন৷ উনিই বলতে গেলে মুরিয়াদের অদ্ভুত এই প্রথা নিয়ে বই লিখে সারা পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন৷ তারপর অনেক চ্যানেল, অনেক মিডিয়া এসেছে, ঘোটুল দেখেছে, ওদের অনেকভাবে বুঝিয়েছে, কিন্তু মুরিয়াদের এই প্রথা কেউ বন্ধ করতে পারেনি৷’

‘এরাও কি সেই ব্যাপারেই…?’

‘হতে পারে৷ তবে মুরিয়াদের এই ঘোটুল নিয়ে বিদেশ থেকেও অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এসেছে৷ কিন্তু ওদের হিংস্র হয়ে ওঠার কোনো খবর আমার কাছে অন্তত নেই৷ জানি না, গিয়ে বুঝতে পারব কী ব্যাপার৷’

মারুফ কথা শেষ করেই আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল, সাবধানী গলায় বলল, ‘কিছু একটা জন্তুর চোখ সামনে জ্বলজ্বল করছে৷ বাঘ এদিকটায় তো নেই বলেই জানি, ভালুক কি?’

রানা দুরুদুরু বুকে বন্দুকটা তাক করতেই মারুফ চাপা গলায় ধমকে উঠল, ‘বন্দুক নামান৷ টর্চের আলো নিভিয়ে দিন৷ আপনারা শহুরে লোকেরা খুন করা ছাড়া কিছু জানেন না, না! বনের কেউ অকারণে আক্রমণ করে না৷’

রানা থতমত খেয়ে বন্দুকটা নামিয়ে নিল৷ মারুফের দেখাদেখি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়৷ এক একটা সেকেন্ডকে যেন মনে হচ্ছে এক একটা সুদীর্ঘ ঘণ্টা৷ পায়ে হাঁটু পর্যন্ত গামবুট থাকলেও তা ভেদ করে যেন জঙ্গলের পোকামাকড় হানা দিচ্ছে ওর চামড়ায়৷ নাকি সেটাও মনের ভুল?

বেশ কিছুক্ষণ পরে জ্বলজ্বলে চোখদুটো ডানদিকে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল৷ মারুফ তবু আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর বলল, ‘চলুন৷ চোখের উচ্চতা দেখে হরিণ মনে হচ্ছিল৷ চলে গেছে৷’

রানা হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তোমরা আমাদের এত ঘৃণা করো কেন? আমরা তো তোমাদের ভালো চাই৷ সরকার তোমাদের জন্য কতরকম ওয়েলফেয়ার স্কিম এনেছে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ, বড়দের হাতের কাজ…৷’

‘থামুন স্যার!’ মারুফের শ্লেষজড়ানো গলা শোনা গেল, ‘সরকারের ওই দেওয়া হচ্ছে কেমন জানেন? ইংরেজরা যেমন আমাদেরই কাঁচামাল সস্তায় কিনে নিয়ে দেশীয় উৎপাদন বন্ধ করে বিদেশে সেই দিয়েই জিনিস বানিয়ে চড়াদামে আমাদের কিনতে বাধ্য করত, আর আমরা কেরানি হয়ে, ওদের চাকরগিরি করে ওদের প্রভু ভাবতাম, এখনো সরকার আমাদের সঙ্গে সেটাই করে৷ স্বাধীনতার পর থেকে কী করেছে ভারত সরকার আমাদের জন্য?’

রানা মনে মনে একটু থমকে গেল৷ মারুফ ছেলেটা রীতিমতো শিক্ষিত৷ ও নিজে এত কিছু জানে না৷ বলল, ‘তোমাদের দুর্গেশ সিং এইসব শেখাচ্ছে বুঝি?’

‘দুর্গেশ সিং? তাকে চিনলেন কী করে?’ মারুফ বলল৷

‘বাহ! ওই দুর্গেশ সিং-এর জন্যই তো আজ আমাদের স্পেশাল ডিউটি৷ সে নাকি এদিকেই কোথাও ঘাঁটি গেড়েছে৷ সে লোকজনকে বোঝাচ্ছে তাদের অধিকার৷ চেনো?’

‘নাহ! আমি তো বাইরে থাকি৷ এসেছি দু’মাসের ছুটিতে৷ চিনি না৷ তবে নাম শুনেছি৷ সে অন্য জঙ্গিনেতাদের মতো খালি রক্ত ঝরানো লড়াইতে বিশ্বাসী নয়, অশিক্ষার মধ্যে বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে আইসিস বানাতে চায় না সে, সে এখানকার মানুষের সত্যিকারের উন্নয়ন চায়, শিক্ষায়-দীক্ষায়-সচেতনতায়৷’

‘বাইরে কী কর তুমি?’

‘তেমন কিছু না৷ রাইপুরে একটা কমপিউটার সেন্টারে পড়াই আর চাকরির পরীক্ষা দিই৷’ মারুফ হঠাৎ থেমে গেল, ‘দূরে কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’

ও সামনে তাকিয়ে দেখল, জঙ্গলের শুঁড়িপথ বেয়ে কখন একটা সরু নদীর তীরে উপস্থিত হয়েছে ওরা৷ এই গভীর রাতেও ও বেশ দেখতে পাচ্ছে নিঝুম নিকষ কালো জলের ঢেউতে তিরতির করে দোলা দিয়ে যাচ্ছে এখানকার আদিম বাতাস৷ নদীর গায়ে যেন লেপটে রয়েছে রাতের আকাশ, চাঁদের ছায়া পড়েছে নদীর জলে৷ সব মিলিয়ে ছমছমে হলেও কাব্যিক পরিবেশ৷

কিন্তু রানা কাব্যের ছিটেফোঁটাও অনুভব করতে পারল না, শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া যেন জ্যাকেট ভেদ করে ওর অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল৷

নদীটা বেশ সরু, নদী না বলে খাঁড়ি বলাই ভালো, অনায়াসে এক মিনিটে সাঁতরে পার হয়ে যাওয়া যায়৷ কিন্তু এই রাতে সেটা ভেবেই রানার কাঁপুনি আরো বেড়ে গেল৷

চার

‘চয়ন হয়তো বুঝতে পারছে না, কিন্তু আপনি? একজন ডাক্তার ছিলেন আপনি, ডাঃ কিস্কু! আপনি কী করে এরকম ছেলেমানুষি করছেন?’ প্রফেসর সান্যালের রক্তলাল চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছিল, ‘মৃত্যু কোনো তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়, মৃত্যু একটা প্রসেস, ডাক্তার! যখনই মৃত্যুর সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের সার্কিটগুলো শাটডাউন হতে শুরু করে, আমরা আস্তে আস্তে বাইরের জগত সম্পর্কে আনকনশাস হয়ে পড়তে থাকি৷ এখন আমাদের ক্ষেত্রে কী হয়েছে’ প্রোফেসর সান্যাল প্রাণপণে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন, ‘প্রচণ্ড প্রহারের ফলে আমাদের আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে, তাই আপনারা বুঝতে পারছেন না উই অল আর ডেড নাউ!’

চয়ন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, শেষ কথাগুলো শুনে নিজের চেহারার দিকে ও তাকাল৷ সারা শরীরে লাঠির আঘাতে প্রচণ্ড ব্যথা৷ মাথা তো যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু, কিন্তু…সেই ব্যথা তো ও বিলক্ষণ অনুভব করতে পারছে! বিহ্বল অবস্থায় নিজের গালের খোঁচা খোঁচা সদ্য গজিয়ে ওঠা দাড়িগুলোয় হাত বোলায় ও, সত্যিই কি ওরা সবাই মরে গেছে? হরর ফিল্মে দেখা সেই প্রেতাত্মাগুলোর মতো ওরাও কি বুঝতে পারছে না যে প্রাণটা আর নেই? প্রত্যেকেই এক একটা কায়াহীন ছায়ামাত্র?

প্রোফেসর সান্যাল আধা অন্ধকারে টলতে টলতে এগিয়ে এলেন চয়নের দিকে, ওর জামার পকেট থেকে বেরিয়ে থাকা সকালের প্রাতরাশের সময়ের দেওয়া কলাটা টেনে নিয়ে একটানে ফেলে দিলেন দূরে, ‘কিসের খাওয়া, চয়ন? কতবার বলছি তোমায়, উই আর ডেড! ফ্যাক্ট এটা, অ্যাকসেপ্ট করো৷ তুমি, বিপুল—তোমরা কেউই কি সত্যিই বুঝতে পারছ না? নাকি বুঝেও হজম করতে পারছ না?’

ডাঃ কিস্কু একদৃষ্টিতে প্রোফেসর সান্যালের দিকে চেয়েছিলেন, ‘বিপুল কোথায়, প্রোফেসর?’

‘বিপুল ইজ ডেড!’ আশপাশের লম্বা লম্বা নাম-না-জানা গাছগুলোও যেন থরথরিয়ে কেঁপে উঠল প্রোফেসর পরমেশ সান্যালের গর্জনে, ‘বিপুল, চয়ন, আপনি, আমি, আমরা সবাই মৃত, ডাঃ কিস্কু! এটাকে মানতে শিখুন৷ ওই শয়তান মোড়ল যতই আমাদের সুবিচারের নাটক করুক, তলে তলে ও-ই নির্ঘাত ঘোটুলের গুন্ডাগুলোকে পাঠিয়েছিল, জানত ওরা মারলে কেউ নিন্দেও করবে না, আবার সাপও মরবে!’

ক্রমাগত তীব্র চিৎকারে আর মনে হয় স্নায়ু চাপ সহ্য করতে পারল না, ডাঃ সান্যালের মাথার উপরিভাগ দিয়ে আবার রক্তপাত শুরু হয়েছে, শেষের দিকটা বিড়বিড় করতে করতে প্রোফেসর সান্যাল পাশের একটা গাছ কোনোমতে ধরতে পারলেন, জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই অস্ফুট একটা আওয়াজ এল, ‘এবার শুধুই শান্তি, চয়ন!’

ঘড়িতে পাক্কা আড়াইটে৷ সারাদিনের অনিদ্রা, শারীরিক নির্যাতন, দুশ্চিন্তা এখন প্রবলভাবে প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে শরীরের ওপর, বিশেষত চোখ দুটো যেন লঙ্কাগুঁড়োর মতো জ্বলছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যথাও যেন তার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে৷

তার মধ্যেও ডাঃ কিস্কু একদৃষ্টিতে প্রোফেসর সান্যালের দিকে দেখছিলেন৷

চয়ন চিন্তিত মুখে তাকাল, ‘কী হচ্ছে বলুন তো, ডাক্তারবাবু? ব্রেনে কোনো মেজর ইনজুরি হয়েছে কি? নাকি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে স্যারের, এত ব্লিডিং এর জন্য! আসলে ওরা সবচেয়ে বেশি অ্যাটাক তো স্যারকেই করেছিল৷ স্যার তো তখনই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন, আমরা এখানেও তো নিয়ে এলাম ধরাধরি করে৷ তারপর থেকেই জ্ঞান এলে এই সব বকছেন৷’

ডাঃ কিস্কু একটা নিঃশ্বাস ফেললেন৷ গ্রামের ছেলে হলেও বেশিক্ষণ অন্ধকার তিনি সহ্য করতে পারেন না৷ তার মধ্যে ঘোটুলের চেলিকদের অকস্মাৎ মারধরে জামার বেশ কয়েকটা জায়গা ছিঁড়ে যাওয়ায় সেখান দিয়েও পোকামাকড় ঢুকছে, কামড়াচ্ছে৷ সেই অস্বস্তিতেই কি ডাঃ কিস্কুর এত বিরক্তি লাগছে?

তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল, কৈশোরে কখনো খুব চাপে পড়লেই গলা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার এক পন্থা তিনি প্রয়োগ করতেন৷ কে শিখিয়েছিল সেটা আজ আর মনে নেই, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে একটু রিলিভড হতে চাইলে এর চেয়ে ভালো দাওয়াই আর নেই৷

কথাটা মনে পড়তেই তিনি নাক বন্ধ করে ফুসফুসের একদম অন্তঃস্থল থেকে বায়ু গ্রহণ করার চেষ্টা করলেন৷ আসলে কৈশোর বয়সটাই বড় চঞ্চল, আবেগপ্রবণ, হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আদর্শ হলেও তাতে রাজনীতির রঙ থাকে না৷ এই যেমন ওঁদের মারাত্মক অন্যায়েও মোড়ল ধৈর্য ধরে পরের দিন সকালে শাস্তির সময় ধার্য করেছিলেন, কিন্তু ঘোটুল সর্দারের কিশোর টিম চেলিক বাহিনীর ছেলেদের সেই তর সইল না৷ ওদের প্রধান টার্গেট ছিল চয়ন, কিন্তু অন্ধকারে সম্ভবত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চরম আঘাতটা হানল প্রোফেসর সান্যালের ওপর৷

কিন্তু বিপুল বলে সেই জার্নালিস্টটা যখন ওদের সঙ্গেই কোনোমতে ওই মাটির ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে এই নদীর তীরের জঙ্গলে এসেছিল তখনো তার যে আঘাত মারাত্মক ছিল, এমন তো স্মরণে আসছে না৷ বরং অচৈতন্য প্রোফেসরকে পাহারা দিতে সে পাশেই বসে পড়েছিল৷ ডাঃ কিস্কু আর চয়ন গিয়েছিলেন নদী থেকে কিছুটা ঠান্ডা জল আনতে, যদি সেই জলের ঝাপটা দিয়ে সান্যালের জ্ঞান ফেরে৷

কিন্তু ফিরে আসার পর থেকেই বিপুল উধাও! আর প্রোফেসর সান্যালের ভুলভাল বকা শুরু হয়েছে৷

তবে কি, তবে কি তিনি যেটা আশঙ্কা করছেন সেটাই?

চয়ন সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ডাঃ কিস্কু বললেন, ‘চয়ন, আমার মনে হয় প্রোফেসর সান্যালের পেছনে আমাদের আর সময় নষ্ট না করাই ভালো৷’

চয়ন অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকাল, ‘মানে! কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!’

ডাঃ কিস্কু অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে একজন বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন, ডাঃ জুলস কোটার্ড৷ উনি এতটাই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন যে ওঁকে নিয়ে সিনেমাও হয়েছে৷ নাম শুনেছ?’

চয়ন খানিক অধৈর্য হয়ে পড়ল, ‘ডাক্তারবাবু, ভোরের আলো ফুটতে আর খুব বেশি দেরি নেই৷ মুরিয়ারা এমনি খুব হিংস্র না হলেও ওই ঘোটুলের ছেলেগুলো উত্তেজনার বশে আবার হামলা চালাতে পারে৷ আমাদের উচিত নদীর দিকে এগিয়ে থাকা, একটু আলো দেখা দিলেই যে ভাবে হোক এই এলাকা থেকে পালানো৷ এখন ওইসব ইতিহাসের গল্প থাক না, ডাক্তারবাবু! স্যারকে নিয়ে কী করব তাই বলুন! আপনি কি কড়া কোনো ইনজেকশন দেবেন?’

‘লাভ নেই৷’ ডাঃ কিস্কু মাথা নাড়লেন, ‘আমি যেটা সাসপেক্ট করছি তোমার স্যারের যদি সেটাই হয়, তাহলে বলব আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালানো উচিত, চয়ন!’

‘আপনি প্লিজ একটু খোলসা করে বলবেন?’ চয়নের এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল৷ সে মধ্যবিত্ত ঘরের জ্যেষ্ঠ সন্তান, অনেক কষ্টে এখনো পি এইচ ডি-টা চালিয়ে যাচ্ছে, প্রোফেসর সান্যাল একটু খ্যাপাটে গোছের ঠিকই, কিন্তু দেশে-বিদেশে ওঁর রেকমেন্ডেশনের দাম সাংঘাতিক, কাজেই থিসিস সাবমিট না হওয়া পর্যন্ত স্যারের এইসব পাগলামি ওকে সহ্য করতেই হবে৷ একবার বিদেশে পোস্ট ডকের একটা ভালো ফেলোশিপ জোগাড় করে ফেলতে পারলে…! আর কোথা থেকে এলেন এই আদিবাসী ডাক্তার, চয়নকে কি তিনি এতই বোকা ভাবেন যে সোনার ডিম পাড়া হাঁস ফেলে চয়ন পালাবে? উঁহু, মুরিয়াদের ওখানে আড়ি পাতা হয়েছে বলে খুব দরদ! শালা এরা নিজেরা তফশিলি কোটায় মেডিক্যাল, ইজিনিয়ারিং পড়ে মুখে বড়বড় কথা বলে, আমাদের মতো জেনারেল ক্যাটেগরিতে ফাইট করতে হলে প্যান্ট হলুদ হয়ে যেত৷

ডাঃ কিস্কুর কথায় ওর চটকা ভেঙে গেল, ‘চয়ন, প্রোফেসর সান্যালের পকেটে ওটা কী উঁকি মারছে দেখো তো?’

পাঁচ

রানা অস্থির হয়ে মারুফের মুখের দিকে তাকাল, ‘এটাই কি সেই মুসি নদী?’

‘হ্যাঁ৷’ মারুফ দূরে হাত তুলল, ‘ওপারে দেখতে পাচ্ছেন?’

নদীটা সরু হলেও ওপাশে জঙ্গল শুরু হয়েছে, তাই ও প্রথমে ঠিক ঠাহর করতে পারল না৷ তারপর ভালো করে পরখ করতে দেখল, বহু দূরে যেন কয়েকটা আলোর ফুলকি ঘোরাফেরা করছে৷ দ্রুতলয়ে সেগুলো কাছাকাছি আসছে, আবার মুহূর্তের মধ্যে সরে যাচ্ছে৷

‘কী ওগুলো? মশাল?’

মারুফ মাথা নাড়ল, ‘মশাল ঠিক নয়, ছোট ছোট এক ধরনের লাঠি, তার গোড়ায় আগুন৷ মুরিয়ারা ওভাবেই নাচে৷ রাইলা নাচ৷ ওই যে দেখুন, পাশেই বড় বড় মাটির ঘর৷ ওই হল ঘোটুল৷’

পাশে যে মাটির ঘর রয়েছে সেটা বুঝতে না পারলেও বড় বড় কুঁড়েঘর জাতীয় কিছু রয়েছে সেটা ও আন্দাজ করতে পারল, ‘এই এত রাতেও ওরা নাচছে খোলা আকাশের নীচে?’

‘রাতেই তো মজা, স্যার৷ সালফি খেয়ে কোমর জড়িয়ে নাচবে, বেশ নেশা হবে, তারপর যে যার সঙ্গে খুশি ঢুকে পড়বে ঘোটুলের একেকটা ঘরে৷’ মারুফ লঘু স্বরে কথাগুলো বলে এগিয়ে গেল নদীটার দিকে৷

একি রে বাবা! এ মক্কেল কি নদীর জলে সটান নেমে যাবে নাকি? এদিককার ছেলে, এদের কিছুতেই বিশ্বাস নেই৷ জলে ঝাঁপানো থেকে শুরু করে কাউকে কোপানো, সবেতেই এরা সমান পটু৷ রানার আবার একটু আগের সন্দেহটা মাথায় ফিরে এল৷ একটা দলছুট জওয়ানকে একা পেয়ে মেরে-টেরে ফেলবে না তো?

পরক্ষণেই এই থিওরিটা নাকচ করে দিল৷ মেরে ফেলার হলে আগেই মারত, খামোখা এতদূর নিয়ে আসবে কেন? আর তাছাড়া… ভেতরের ভিতু ছেলেটাকে কড়া ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতে দিতে নিজেই নিজেকে বলল, দেশের জওয়ান বলে কথা! যেখানে তিন-তিনটে মানুষের প্রাণ বিপন্ন, সেখানে ভয়? ছি ছি, তোমার নাম না আবার রানাপ্রতাপ? অমন বীরের নাম তবু এত ভিতু? কী লজ্জার ব্যাপার! কপাল ভালো তাও এখানে পোস্টিং, আর যারা সিয়াচেনে মাইনাস তাপমাত্রায় লড়ছে?

কথাটা মনে হতেই রানা গা ঝাড়া দিয়ে মারুফের দিকে ছুটে গেল, ‘সাঁতরে পার হবে নাকি? চলো চলো! বেশি দেরি করে লাভ নেই৷ ওই জঙ্গলটা তো?’

মারুফ বলল, ‘না না, নদীতে নেমে জামাকাপড় ভেজাতে হবে না, স্যার৷ ছোটবেলায় এদিকে আসতাম বন্ধুদের সঙ্গে, মোটামুটি চিনি৷ কাছেপিঠেই নদীটা খুব সরু হয়ে গেছে, চড়া পেরিয়ে অনায়াসে চলে যাওয়া যাবে৷ আসুন তো, পাড় বরাবর হাঁটি৷’

বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না৷ একশো মিটার মতো যাওয়ার পরেই চাঁদের আলো পড়ে জ্বলজ্বল করা চড়াটা চোখে পড়ল৷ একেই সরু নদী, তায় জলও বিশেষ নেই, চড়াটা বেশ জাঁকিয়েই বসেছে৷ সহজেই ওরা পার হয়ে গেল৷

নদীর এপারে এসে দূরের আলোগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ এবার স্পষ্ট দেখতে পেল, কয়েকটা মাথা নিজেদের মধ্যে এগিয়ে আসছে, সরে সরে যাচ্ছে, নৃত্যভঙ্গি বুঝতেও অসুবিধা হল না৷ পাশের ঘোটুল নামক ওই ঘরগুলোও বেশ পরিষ্কার দেখতে পেল এখন৷

‘এদিক দিয়ে আসুন৷’ মারুফের ফিসফিসে ডাকে চমকে উঠল৷ ও একটা ঝোপের মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে৷

রানার বুকটা আবার ছ্যাঁৎ করে উঠল৷ হঠাৎ আবার একটু আগে একফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়া ভয়টা যেন গলাটাকে চেপে ধরল রানার, এই মারুফ ছেলেটা কে? বলছে বাইরে থাকে, কিন্তু এই জঙ্গলের সব গলিঘুঁজি চেনে? মুরিয়াদের কেউ নয় তো? রানা আড়ে আড়ে মারুফের দিকে তাকাল, দিব্যি শার্ট-প্যান্ট পরা, দাড়িগোঁফ কামানো ভদ্রসভ্য চেহারা৷ ছোটবেলায় ঘোটুলে গিয়ে ওইসব কাণ্ডকীর্তি করেছে কিনা বোঝার কোনো উপায় নেই৷

‘স্যার, আমার মনে হয়, এই জঙ্গলের মধ্যে লোকগুলোকে দিশাহীনভাবে না খুঁজে আগে মুরিয়াদেরই গিয়ে জিগ্যেস করাটা বরং বুদ্ধিমানের কাজ হবে৷’ মারুফ ঝোপে ঢুকতে গিয়েও পিছিয়ে এল, টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখল, ‘ওদের নাচ এবার শেষ হবে৷’

‘কিন্তু মুরিয়ারাই তো ওদের মেরেছে৷ আমরা ওদের খুঁজছি শুনলে তো উল্টে বিপদ আরো বাড়বে, হয়তো ওই তিনটে লোক এখন প্রাণভয়ে লুকিয়ে রয়েছে৷’

মারুফ সায় দিল, ‘হ্যাঁ, এটা ঠিকই বলেছেন৷ কিন্তু, মুরিয়ারা শান্তিপ্রিয়, তাছাড়া আমি মুরিয়াদের কয়েকজনকে চিনি৷ আপনি আমার সঙ্গে আছেন, ওরা কিছু বলবে না৷ আসুন আমার সঙ্গে৷’

দূর থেকে দেখে অন্ধকারে প্রচণ্ড গভীর মনে হলেও অতটা ঘন লাগল না ঢোকার পর৷ বোঝা যাচ্ছে এই পথে কম হলেও মনুষ্য চলাচল আছে৷ টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখতে গেল, রাত প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে, কিন্তু সঙ্গে মারুফ হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘টর্চটা নেভান৷ মুরিয়ারা এইভাবে ওদের জগতে ঢোকা একদমই পছন্দ করে না৷’

পছন্দ যখন করে না, তখন আমরা যাচ্ছিই বা কেন, মনে মনে ভাবল রানা৷ প্রাথমিক যে ঝোঁকের বশে, ঠিকমতো উদ্ধার করে এখান থেকে দ্রুত ট্রান্সফারের আশায় যে ঝুঁকিটা ও নিয়ে ফেলেছে, এখন সেই উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে এসেছে, বোকামিই করেছে বলে ওর মনে হচ্ছে৷ একে দলছুট হয়ে রয়েছে, তার ওপর এই বিপদসংকুল অঞ্চলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ভাবলেই ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে গলায় ঢকঢক করে ঢালল রানা৷

আর্মি বা পুলিশ জাতীয় ডিপার্টমেন্টে কাজ করার এই একটা অসুবিধা, ভয়ে ভেতরটা জড়সড় হয়ে গেলেও বাইরের লোকের সামনে প্রকাশ করা যায় না৷ কেমন লজ্জা লাগে৷ যতই ও মেদিনীপুরের সজলপুর গ্রামের সেই লাজুক বিল্টু ওরফে রানাপ্রতাপ জানা হোক না কেন, এই উর্দি গায়ে চড়ালেই যেন রানার ভয় পাওয়া মানা৷

কিন্তু মারুফ ছেলেটা যেন আজ দুঃসাহসিক অভিযানের শেষ দেখেই ছাড়বে এমন পণ করেছে৷ পথটা গিয়ে যেখানে শেষ হল, অন্ধকারেও বুঝতে পারল, এটাই সেই মুরিয়াদের ঘোটুলের পেছন দিক৷

সার দিয়ে দিয়ে প্রায় পঞ্চাশেরই বেশি মাটির ঘর সরলরেখায় গড়ে উঠেছে৷ বোঝাই যাচ্ছে এটা মুরিয়াদের গ্রামের একদম বাইরের দিক৷ এই ঘোটুলগুলোই গ্রামের বাউন্ডারির কাজ করছে৷ প্রতিটা মাটির বাড়ি বেশ লম্বা- চওড়া, আর চারপাশে অদ্ভুতভাবে কাঠের এবড়ো-খেবড়ো টুকরো দিয়ে বেড়া তোলা, অনেকটা শহরের অভিজাত বাড়িগুলোর পাঁচিলে কাচের টুকরো গুঁজে দেওয়ার মতো কৌশল যেন!

প্রতিটা ঘোটুল প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু, জানলাবিহীন, একদম উপরে একটা ছোট গর্তে মশাল জ্বলছে ধিকিধিকি৷

মনে হল যেন আদিম কোনো বুনো রাজার রাজত্বে ঢোকার আগে ওরা দাঁড়িয়ে আছে৷ একপাশে মুসি নদী, তাতে চাঁদের আলো ঝলমল করছে, পাশ দিয়ে জঙ্গল এসে মিশেছে এই ঘোটুলে৷

রানা এবার কি করা উচিত বুঝতে পারছিল না৷ হঠাৎ মারুফ একটা কাণ্ড করল৷ হাতের দুটো মধ্যমাকে অদ্ভুতভাবে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে একটা শিস দেওয়ার মতো শব্দ করল৷

একবার, দু’বার৷ পর পর চারবার৷ তারপর ইশারায় রানাকে চুপ করে থাকতে বলল৷

রানা মিনিট দুয়েক চুপ করে থেকে ফিসফিস করে বলে ফেলল, ‘কী করছ এসব, মারুফ?’

মারুফ কিছু বলার আগেই বাঁ দিকের একটা ঘোটুলের বাইরে যেন সতর্ক পদচারণার শব্দ পেল৷ হালকা কুয়াশামাখা অন্ধকারে রানা দেখল কেউ একজন এদিকে আসছে৷

রানা কাঁধের বন্দুকটাকে শক্ত করে ধরল৷

ছায়াটা বড় হতে হতে রানাদের দিকে এগিয়ে এল, তারপর মারুফের দিকে সোজা এগিয়ে এল৷ অদ্ভুত একটা অঙ্গভঙ্গি করে অবোধ্য ভাষায় কিছু বলল৷

মারুফও তার উত্তর দিল সেই ভাষাতেই৷

কথোপকথন বেশ কয়েক মিনিট চলার পর মারুফ রানার দিকে ফিরল৷ ওর গলার স্বরে বেশ রুক্ষতা, ‘কেসটা যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততটা নয়, স্যার!’

‘কীরকম?’ রানা প্রশ্নটা করেই তাকাল ছায়ামূর্তিটার দিকে৷ এতক্ষণে সে অনেকটাই স্পষ্ট৷ এই হালকা শীতেও তার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, খালি বুকে গলা বেয়ে ঝুলছে লতাপাতায় বানানো অদ্ভুত একটা মালা, মাথায় পাগড়ি, তবে সেই পাগড়িতেও লতাপাতার উপস্থিতি চোখে পড়ল৷ শরীরের নিম্নাংশে ধুতির মতো করে পরা একফালি কাপড়৷ বয়স আন্দাজ ত্রিশ হবে৷

রানা একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলল৷ যাক, মুরিয়ারা জামাকাপড় পরে, ওই আন্দামানের জারোয়াদের মতো নয়৷

মারুফ চাপা অথচ কেটে কেটে বলল, ‘শহুরে মানুষদের আমরা যেমন চিরকাল বিশ্বাস করে ঠকেছি, এটাও তাই৷ চারজনের একটা দল এসেছিল ঘোটুল, রায়লা নাচ এইসব দেখার নাম করে৷ বলেছিল মুরিয়াদের জীবনযাপন দেখবে, সঙ্গে ডাক্তার রয়েছে, সবার চেক-আপও করে দেবে৷ মুরিয়ারা নিজেদের নিয়ে থাকতে ভালোবাসে, তবু এদের মোড়ল রাজি হয়েছিল, একসপ্তাহ যত্নে রেখেছিল৷’

‘তারপর?’

‘তারপর আবার কী?’ গর্জে উঠল মারুফ, ‘যুগ যুগ ধরে যেভাবে শিক্ষিত আধুনিক মানুষের কথায় এরা বিশ্বাস করে ঠকেছে, এবারেও সেটাই হয়েছে৷ প্রথমে ওদের ডাক্তার সবাইকে দেখছিল, আর টুকটাক ছবি তুলছিল৷ কিন্তু তারপর দলের একটা বুড়ো হেড আর তার ছাত্র ছিল, তারা ঘোটুলের মধ্যে গিয়ে ঘরদোর দেখার নাম করে ছেলেমেয়েদের বোঝাতে শুরু করল যে ওরা এগুলো ঠিক করছে না৷ এমনকি গ্রামের বড়দের লুকিয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে মগজ-ধোলাই করছিল৷’

‘সেটা যদি করেও থাকে, মুরিয়াদের ভালোর কথা ভেবেই তো করেছে, বাচ্চা বয়সে ওইসব থেকে কতরকম রোগ…!’ রানা বলতে গেল৷

কিন্তু মারুফ এক ঝটকায় রানাকে থামিয়ে দিল, ‘আরে স্যার থামুন৷ আমাদের ভেতরের কাজকর্মে আপনারা একদম মাথা গলাতে আসবেন না৷ জঙ্গলের নিয়ম আলাদা মনে রাখবেন৷ এখানকার মানুষের মধ্যে কোনো নোংরামি নেই৷ যাই করুক, তার মধ্যে কোনো প্যাঁচ-পয়জার নেই, বুঝেছেন? মুরিয়ারা বিশ্বাস করে এতে ছোট থেকে ছেলেমেয়েদের মন উদার হয়, এটাও এক ধরনের সেক্স এডুকেশন৷ আপনাদের শহুরে হোটেল-নাইটক্লাব এখানে নেই৷’

রানা একটু ভড়কে গেল মনে মনে৷ মারুফ এতক্ষণ বেশ খাতির করে কথা বলছিল৷ হঠাৎ করে এতটা উগ্রতা দেখাচ্ছে কেন?

মারুফ বলে চলল, ‘আর তাছাড়া, ওরা ওভাবে বাধা দিচ্ছিল বলেও মুরিয়ারা কিছু করেনি, মুখে বারণ করেছিল শুধু৷ কিন্তু গতকাল দুপুরে ওই বুড়োর ছাত্রটা কৌশলে ঘোটুল দেখার নাম করে ভেতরে গিয়ে ভিডিও ক্যামেরা লুকিয়ে রেখে আসে৷’

‘ভিডিও ক্যামেরা! কেন?’ রানা এবার সত্যিই স্তম্ভিত৷

‘সেটা আপনারাই জানেন৷ আপনারা হলেন গিয়ে সভ্যসমাজের প্রতিভূ, তাই অসভ্য জাতির গোপন দৃশ্য দুনিয়ায় ফাঁস করে কীভাবে বাহবা কুড়নোর মতলব ভেঁজে রেখেছেন তা ওরা কী করে জানবে?’ মারুফ বলল, ‘ঘোটুলের সিক্রেট শুনলে বা পড়লেও ভেতরে কী হয় কেউ জানে না, হয়তো বিদেশি কোনো চ্যানেলকে কয়েক লক্ষ টাকা দামে বিক্রি করে দেওয়ার প্ল্যান হয়েছিল৷’

একটু আগে ছায়ামূর্তি হিসেবে আবির্ভ)ত হওয়া পাগড়ি পরা ছেলেটা হিন্দি সম্ভবত বুঝতে পারছিল না, তবু মারুফের ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে সেও ক্রুদ্ধ আহত চোখে রানার দিকে তাকাল৷

যেন রানাও ওই চারজনেরই একজন, একই দোষে দোষী৷

‘মারুফ, সবাই একরকম নয়৷’ এতক্ষণ পরে ক্রমাগত অভিযোগের বিরুদ্ধে পালটা অভিযোগ করল রানা, ‘শহরের লোক মানেই খারাপ নয়, ঠিক যেমন তোমাদের গ্রামের সবাই ভালো নয়৷ ভালো-খারাপ সব জায়গাতেই আছে৷ এইসব কথা ছাড়ো৷ এখন ওরা কোথায় জিজ্ঞাসা করো৷ হাতে সময় নেই বেশি৷ আমরা এর মধ্যেই অনেক দেরি করে ফেলেছি৷’

মারুফ এবার চুপ করল৷ ওই ছেলেটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা চালানোর পর বলল, ‘ঐ চারজনকে প্রথমে কিছুই করা হয়নি৷ মুরিয়ারা আদিবাসী হলেও সুসংবদ্ধ, ওদের যা শাস্তি ধার্য করার, মোড়লই করে৷ কিন্তু কয়েকজন ঘোটুলের চেলিক, মানে ছেলেপুলের একটা দল ওদের সর্দারের নেতৃত্বে গিয়ে ওদের কুঁড়েতে রাতের বেলা গিয়ে লাঠি দিয়ে পেটায়৷ কাঁচা বয়স তো, উত্তেজনা সামলাতে পারেনি৷’

‘তারপর?’

ইতিমধ্যে ও খেয়াল করেনি, পাগড়ি পরা ছেলেটার পেছনে এসে আরো চার-পাঁচজন জুটেছে৷ প্রত্যেকেরই খালি গায়ে লতাপাতার মালা ঝুলছে, মাথায় বিচিত্রদর্শন পাগড়ি৷ সবাই বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে মারুফের দিকে৷

এরা কি আস্তে আস্তে দল ভারী করছে নাকি?

‘তারপরের ব্যাপারটা এরা ঠিক বলতে পারছে না, তারপর থেকে ওই চারজনকে আর পাওয়া যায়নি৷’

‘তা কী করে হবে?’ রানা বলল, ‘প্রথমে কুঁড়েতে হামলা চালানোর পর ওই আহত অবস্থায় ওরা জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, তারপর আরো একবার ওদের ওপর হামলা চালানো হয়, আর এবার আর লাঠি নয়, ছুরি দিয়ে নৃশংস ফালাফালা করে দেওয়া হয়েছে৷’

মারুফ ওদের ভাষায় রানার বক্তব্য তর্জমা করে দিতেই মুরিয়া ছেলেগুলোর চোখ বড় বড় হয়ে উঠল৷ অভিযোগ অস্বীকার করার অভিব্যক্তি সব ভাষাতেই সম্ভবত একই রকম, তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে অনর্গল কী যেন বলে যেতে লাগল ওরা৷

মারুফ রানার দিকে ফিরল, ‘ওরা বলছে চেলিকদের যে দল অতর্কিতে কুঁড়েতে হামলা করেছিল, তাদের তারপর আর ঘোটুল থেকে বেরোতেই দেওয়া হয়নি৷ তাই দ্বিতীয়বার হামলার প্রশ্নই ওঠে না৷’ সবচেয়ে প্রথমে মারুফের আহ্বানে ডাক দিয়ে আসা যুবকটির দিকে ইশারা করে ও বলল, ‘রাঠি হল ঘোটুলের কেয়ারটেকার, ও কাউকে তারপর বাইরে বেরোতে দেয়নি বলছে৷ তাছাড়া ছুরির চল এখানকার কিশোরদের মধ্যে নেই, তাদের হাতে শুধু লাঠিই দেওয়া হয়৷’

‘কিন্তু ওই বিপুল বলে জার্নালিস্টটার আঘাতগুলো…!’ রানার কথাগুলো মাঝপথেই অসম্পূর্ণ হয়ে রয়ে গেল কারণ অকস্মাৎ একটা পাশবিক চিৎকার আকাশের বুক চিরে কর্ণকুহরে প্রবেশ করে যেন ওদের বুকগুলো হিম করে দিল৷ এমনই সেই আর্তনাদের করুণ প্রাবল্য, যে সেই পরিত্রাহি মর্মভেদী চিৎকারে সাধারণ পরিবেশেও মানুষের রক্ত জল হয়ে আসে, আর এই নিশুতি রাতে নদীর পাড়ে তো কথাই নেই!

একটানা নিরবচ্ছিন্ন সেই আর্তনাদ নয়, কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দমক দিয়ে যেন কারুর কণ্ঠনালী থেকে বেরোচ্ছে সেই তীক্ষ্ণ কষ্ট, কান্না৷ আওয়াজটা আসছে ওদের বাঁ-পাশের জঙ্গলের মধ্য থেকে৷

কিছু কিছু সময় এমন আসে, যে মুখে কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না৷ শুধু ছুটে যেতে হয়৷ ওরাও তাই করল৷ রানা, মারুফ সহ পাশে দাঁড়ানো পাঁচ-ছ’জন মুরিয়া, প্রত্যেকেই ছুটে গেল জঙ্গলটার মধ্যে৷ চিৎকার শুনতে শুনতে উৎসস্থল আবিষ্কার করতে ওদের লাগল ঠিক আড়াই মিনিট৷

এখন ঠিক সাড়ে চারটে বাজে৷ সারারাতের ক্লান্তি ভেঙে সূর্যদেব পূর্বাকাশে এখনো দেখা না দিলেও তাঁর আগমনের পূর্বছটায় আলোকিত হয়ে উঠেছে আকাশ৷ রাত্রির মালিন্য ঘুচে গিয়ে সবে শুরু হচ্ছে নতুন একটা দিন৷ তারই মধ্যে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের মাঝের দৃশ্যটা দেখে ওদের শরীরের রক্তও যেন বিস্ময়ে আতঙ্কে চলাচল বন্ধ করে দিল৷

একটা পঁচিশ-ছাব্বিশের তরুণ মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে সামনের ঝোপে, তার সারা শরীর কে যেন তীব্র আক্রোশে ফালাফালা করে দিয়েছে, বাঁ দিকের চোখ উপড়ে উঠে এসেছে গালের কাছে, ঠোঁটের উপরিভাগ টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে কেউ৷ তবু সে বেচারার প্রাণবায়ু এখনো নির্গত হয়ে তাকে রেহাই দিচ্ছে না, তার হূদয়বিদারী আর্তনাদে জঙ্গল কেঁপে কেঁপে উঠছে৷

‘মাই গড!’ রানার মুখ কুঁচকে গেছে আতঙ্কে বিস্বাদে, ‘কে এরকম অবস্থা করল এর?’

‘প্লিজ সেভ মি!’ হঠাৎ উপর দিকে মানবস্বর ভেসে আসতেই রানা ওর বন্দুকটা তাক করল আকাশের দিকে, ডালপালা ভেদ করে উপরের বিশাল গাছটার একটা ডালে কোনোমতে জাপটে বসে রয়েছেন এক ভদ্রলোক, ‘আমাকে মারবেন না, আমি নিজেকে বাঁচাতে এখানে উঠে বসে আছি৷ উনি সবাইকে মেরে ফেলছেন, প্লিজ সেভ মি!’

‘কে? কার কথা বলছেন? কে মারছে সবাইকে?’ পরিষ্কার ইংরেজিতে কথাটা বলে মারুফ সবেমাত্র এগিয়ে যাচ্ছিল ক্ষতবিক্ষত তরুণটির দিকে, এমন সময় যা ঘটল, তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না৷

রানা তো নয়ই, লাঠি হাতে মুরিয়ারাও নয়৷

শুয়ে থাকা বীভৎসভাবে আহত যুবকটির ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাছটার আড়াল থেকে অতর্কিতে বেরিয়ে এল এক প্রৌঢ়, তার শরীর-স্বাস্থ্য দেখলে বোঝা যায় যে সে যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কেউ, কিন্তু এই মুহূর্তে তার মুখের জিঘাংসা ভরা আক্রোশ দেখে যে কারুর ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে৷ চোখের তারা দুটো তার যেন আর যথাস্থানে স্থির নেই, বনবন করে ঘুরছে উত্তেজনার আবেগে, সারা শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে, ডান হাতে ধরা রক্তমাখা ছুরিটা নিয়ে সে উল্কার গতিতে এগিয়ে এল সবচেয়ে আগে দাঁড়িয়ে থাকা রানার দিকে, বিকৃত উচ্চারণে বলল, ‘এত মিথ্যে কেন? কোনো মড়া দ্বিতীয়বারের জন্য মরে না, মরতে পারে না, কিন্তু সে মানতে না চাইলে তাকে মারতে হয়!’ মুখ দিয়ে শব্দগুলো নির্গমনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছুরিটা সে লম্বভাবে বসিয়ে দিতে গেল রানার বুকের বাঁদিকে৷

মুহূর্তে সেই ধারালো ছুরির ফলা রক্তমাংস ভেদ করে বিদীর্ণ করে দিত রানার হূদপিণ্ড, কিন্তু তার আগেই জঙ্গলের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে একটা রিভলভারের আওয়াজ আর গুলি ওই প্রৌঢ়কে ভূতলে ধরাশায়ী করে দিল৷

প্রৌঢ় আকস্মিক আক্রমণে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, অকৃত্রিম বিস্ময়ভরা চোখে টলতে টলতে মাটিতে পড়ে যেতে যেতে বলল, ‘উই আর ডেড অর অ্যালাইভ?’

অমোঘ মৃত্যু অচিরেই এসে তাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল৷

রানা থরথর করে কাঁপছিল, সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে অল্পের জন্য বাঁচার অভিজ্ঞতা ওর এই প্রথম৷ তারই মধ্যে আতঙ্কে ঝাপসা হয়ে আসা চোখে ও দেখল মারুফের হাতের রিভলভার থেকে একটু আগেই আগুনের মতো বেরিয়ে আসা গুলির জায়গায় এখন শুধুই ধোঁয়া!

মারুফের কাছে রিভলভারও রয়েছে?

ছয়

ভোর সাড়ে পাঁচটা৷ সূর্য সবে উদিত হয়েছে আকাশে, ভোরের নরম আলোয় ওরা সবাই মুসি নদীর পাড়ে চুপ করে বসেছিল৷ বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেহ-মনে৷ কারুরই কথা বলার আর মেজাজ নেই৷

রাঠি বলে ঘোটুলের কেয়ারটেকারটা মাটির ভাঁড়ে করে কিছু একটা পানীয় আনিয়েছে ছেলেগুলোকে দিয়ে, ওটাই সম্ভবত ওদের সালফি৷ অনেকটা সিদ্ধিজাতীয়, গন্ধটা একটু কড়া৷ তাতেই চুমুক দিচ্ছিল রানা৷ রাঠি অনেকবার বলেছে ওদের গ্রামে যাওয়ার জন্য, কিন্তু ও রাজি হয়নি৷ নিজের নাগরিক কলুষতা নিয়ে ও আর প্রবেশ করতে চায় না কোনো সরল আদিবাসী জীবনযাপনে৷

প্রোফেসর সান্যাল আর চয়নের মৃতদেহটা একটা চাদর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, রানা একটু পরে ব্যারাকে গিয়ে খবর দেবে, তারপর ট্রুপ নিয়ে এসে ওগুলো রেসকিউ করবে৷

রানা মারুফের দিকে তাকাল, ‘তুমি আমার সঙ্গে ব্যারাক অবধি যাবে তো? রাস্তা চিনব কী করে নাহলে?’

মারুফ হাঁটু দুটো মুড়ে তার মধ্যে মুখ গুঁজে দূরের নরম সূর্যের দিকে তাকিয়েছিল, কোনো উত্তর দিল না৷ সম্ভবত রানার প্রশ্ন ওর কানে যায়নি৷

ডাঃ কিস্কু হাত-পা ছড়িয়ে বসেছিলেন, ‘কোটার্ড ডিল্যুশন খুব বিরল একটা মানসিক রোগ, যাতে রুগির মনে হতে থাকে তার কোনো জীবন্ত অস্তিত্বই নেই৷ প্রচণ্ড বড় দুর্ঘটনা বা আঘাত পেলে এই রোগের রুগিদের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা বাসা বাঁধে যে সে মরে গেছে৷ এখনো অবধি বিশ্বে হাতে গোনা এই কেস পাওয়া গেছে৷ ব্রিটেনের এক ভদ্রলোক তো একটা মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টের পর প্রায় দু’বছর এই ধারণা নিয়ে থাকতেন, শেষে মারা যান৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রুগির আশপাশের লোকেরা তাকে বুঝিয়েছে যে তুমি মরোনি, বেঁচে আছ, কিন্তু সেই ধারণা পাল্টায়নি৷ অনেক ক্ষেত্রে রুগি ইচ্ছে করে উপবাস শুরু করেছে, মরে যখন গেছিই, খাব কেন এই ধারণা থেকে৷ এইভাবে ক্রমাগত স্টারভেশনের পর তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছে৷ অনেকে তাই এটাকে ‘ওয়াকিং কর্পস সিনড্রোম’ও বলেন৷’

‘কী সাংঘাতিক রোগ! মানে চলন্ত শব হয়ে ওঠে এরা৷’ রানার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল কথাগুলো৷

‘হ্যাঁ৷ শারীরিকভাবে জীবন্ত, কিন্তু মনের দিক থেকে এরা একেকটা শবদেহ৷ নিজেদের এরা আস্তে আস্তে বাড়ির মধ্যে বন্দি করে ফেলে, ভাবে শরীর থেকে মৃতদেহের দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, চামড়া গলে গলে পড়ছে৷ সবটাই আসলে মানসিক হ্যালুসিনেশনের চূড়ান্ত ফেজ৷’

‘তাই বলে মানুষকে খুন করবে?’ মারুফ বলে উঠল৷

‘প্রোফেসর সান্যালের ক্ষেত্রে আসলে এটা আরো চরম আকার ধারণ করেছিল আমাদের সবার বিপরীত মতের জন্য৷ এই কয়েকদিন আমি ওঁর সঙ্গে ছিলাম, এমনিতেই ভদ্রলোক ছিলেন বদমেজাজি, খিটখিটে ধরনের৷ ঘোটুলের ছেলেরা সবচেয়ে বেশি ওঁকেই মেরেছিল, জ্ঞান ফিরে আসার পর তাঁর মধ্যে যে শুধু কোটার্ড ডিল্যুশন দেখা দিল তাই নয়, ওঁর বদ্ধমূল ধারণা হল আমি, চয়ন, বিপুলবাবু এরা সবাই হয় মিথ্যে কথা বলছি, অথবা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না যে সবাই মরে গেছি৷ প্রথমে বিপুলবাবুকে ওঁর কাছে রেখে আমি, চয়ন এদিকটা এসেছিলাম, তার মধ্যে সম্ভবত বিপুলের সঙ্গে ওঁর কথা- কাটাকাটি শুরু হয়, প্রোফেসর সান্যাল প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন যে উনি, বিপুল দুজনেই মৃত৷ স্কিৎজোফ্রেনিয়ার চরম ভার্সন দেখা দিল ওঁর মধ্যে, উনি নিজেকে ঠিক প্রমাণ করার জন্য বিপুলবাবুকে আক্রমণ করে বসলেন৷ সম্ভবত উনি বিপুলবাবুকে খুন করে দেখাতে চাইলেন যে মৃত মানুষকে বারবার মারা যায় না৷’

‘কিন্তু বিপুলবাবু আমাদের বলেছিলেন প্রোফেসর সান্যাল টয়লেট বা ওরকম কোনো কারণে একটু আড়াল হয়েছিলেন, তখনই পেছন থেকে কেউ…!’ রানা বলল৷

‘এই ধরনের সায়কিয়াট্রিক পেশেন্টদের কাজগুলো প্রচণ্ড অপ্রত্যাশিত এবং আচমকা হয়৷ বিপুলবাবু মনে হয় বুঝতেই পারেননি, ঘোটুলের ছেলেরা নয়, একটু আগের তর্কের জেরে প্রোফেসর সান্যালই পেছন থেকে ওঁকে অ্যাটাক করেছিলেন৷’ ডাঃ কিস্কু জোরে একটা শ্বাস ছাড়লেন৷

‘আপনারা ফিরে এসে কিচ্ছু বুঝতে পারেননি?’ মারুফ জিজ্ঞাসা করল৷

‘আমি আর চয়ন ফিরে এসে বিপুলবাবুকে দেখতে পেলাম না, কিন্তু মাথাতেও আসেনি যে এমন ভয়ংকর কিছু হতে পারে৷ তখনো প্রোফেসর সান্যাল ওই একই কথা বকে চলেছিলেন বলে আমি সাময়িক একটা ঘুমের ইনজেকশন দিই৷ কিন্তু তাতেও বিশেষ কাজ হয় না৷ শেষে আমি যখন সন্দেহ করতে থাকি প্রোফেসর সান্যাল কোটার্ড ডিল্যুশনে আক্রান্ত হয়েছেন, রক্তমাখা ছুরিটা চোখে পড়ে ওনার পকেটে, তখন আমি শিওর হয়ে চয়নকে বলি পালিয়ে যেতে৷ কারণ, আমি বুঝতে পারছিলাম প্রোফেসর সান্যাল হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠবেন৷ কিন্তু স্যারের প্রতি ভালোবাসা থেকেই হোক বা অন্য কিছু, চয়ন আমার কথা শোনেনি, উল্টে আবার বোঝাতে যায় প্রোফেসরকে৷’

‘আর তখনই উনি আক্রমণ করেন?’ রানা বলল৷

‘হ্যাঁ, চয়নের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ক্রমেই বাড়ছিল, আমি চয়নকে বাঁচাতে চেষ্টা করি প্রথমে, কিন্তু প্রোফেসর সান্যালের গায়ে তখন অসুরের শক্তি, পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন, গায়ের সব শক্তি দিয়ে চয়নকে কুপিয়ে যাচ্ছিলেন৷ আমি গ্রামের ছেলে, আর কোনো উপায় না দেখে পাশের গাছটায় উঠে পড়ি৷ প্রোফেসর সান্যালের হাঁটুতে যে আর্থারাইটিস ছিল সেটা আমার জানা ছিল৷ তারপরের ঘটনা তো আপনারাই স্বচক্ষেই দেখলেন৷’ ডাঃ কিস্কু এতক্ষণ একটানা বলে থামলেন৷

‘কী অদ্ভুত, কী সাংঘাতিক রোগ!’ মারুফ বলল৷

‘হ্যাঁ৷ একে মুরিয়াদের গ্রামের বিপদ, তার ওপর আচমকা এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার, আপনারা আরো একটু আগে এলে হয়তো চয়ন বেঁচে যেত!’ ডাঃ কিস্কু আফসোসে মাথা নাড়লেন৷

* * *

চমকের তখনো সামান্য বাকি ছিল৷ রাঠি এসে ডাঃ কিস্কুকে আবার ওদের গ্রামেই নিয়ে গেল৷ হাজার হোক, ডাক্তারবাবু অনেকের উপকার করেছেন এই ক’দিনে৷ মারুফ আর রানার পেছন পেছন চারজন মুরিয়া কিশোর এল৷ নদী পার হয়ে যেখান থেকে অজস্র শুঁড়িপথ বেঁকেচুরে গেছে বিভিন্ন দিকে, সেইখানে দাঁড়িয়ে মারুফ বলল, ‘স্যার, এরা আপনাকে আপনার ব্যারাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে৷ আর বিপুলবাবুর বডিটাও প্রোফেসরদের বডির পাশেই রাখা থাকবে, আপনি লোক নিয়ে আসুন৷ ভালো থাকবেন৷’

রানা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল, তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল মারুফের দিকে, ওর হাতদুটো জড়িয়ে বলল, ‘এক মিনিট৷ তুমি… আপনিই দুর্গেশ সিং, তাই না?’

মারুফ একটুও চমকাল না৷ মৃদু হেসে বলল, ‘আমি ছত্তিশগড়ের সব ট্রাইবের মানুষদের শিক্ষিত করতে চাই স্যার, তারা নিজের অধিকার বুঝুক, কিন্তু সেটা অবুঝের মতো নয়, সচেতন নাগরিকের মতো৷ ভালো থাকবেন৷ আর কোনো দরকারে ওই বাঁশের মাচায় এসে দাঁড়াবেন, আমি ঠিক হাজির হয়ে যাব৷’

ছত্তিশগড়ের মাওবাদী অধ্যুষিত বস্তার জেলার ঘন অরণ্যের মাঝে রানা দাঁড়িয়ে রইল, আর দুর্গেশ সিং ও তার দু-তিনজন সাঙ্গোপাঙ্গ তার রিভলভারটাকে পকেটে গুঁজে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের মাঝে৷

রানা এক মুহূর্ত থমকাল, দুর্গেশ সিংহের খোঁজ কি ওকে বাড়ির কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারবে? দিতে পারবে সেই বহুকাঙ্ক্ষিত ট্রান্সফার?

পরের মুহূর্তেই সজোরে মাথা নেড়ে সেই ভাবনাটাকে ঝেড়ে ফেলে দিল ও৷ দুর্গেশ সিং থাকুক তার কাছের মানুষদের শিক্ষিত করে তোলার ব্রত নিয়ে, পেছনে মুরিয়াদের গ্রাম থাকুক তাদের ঐতিহ্য ঘোটুল নিয়ে৷

ও না হয় স্মৃতিটুকুই আঁজলা ভরে নিয়ে চলুক!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *