১৪. নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়

এক এক সময় নিজেকে আমার খুব স্বার্থপর মনে হয়। আমার কর্ম-জীবনের সঙ্কীর্ণ পৃথিবীতে যারা একদিন পদার্পণ করেছিল তাদের সুখ-দুঃখের এই সুদীর্ঘ বিবরণ আমার ভালো লাগলেও লাগতে পারে; কিন্তু তার মধ্যে পাঠক-পাঠিকাদের কেন টেনে আনলাম? আবার ভাবি, ফোকলা চ্যাটার্জি, মিসেস পাকড়াশী, মিস্টার আগরওয়ালার গতায়াত কিছু আমার পৃথিবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের সঙ্গে সবার পরিচয় হওয়াই ভালো।

এক এক সময় আবার অন্য চিন্তা মনের মধ্যে জট পাকিয়ে যায়। শাজাহান হোটেলে প্রতিদিন অতিথিদের যে জোয়ারভাটা খেলে, তাদের কোনো পরিচয় তো আমার রচনায় রেখে যেতে পারলাম না। যাদের অতি নিকট থেকে দেখলাম, যাদের সুখদুঃখের সঙ্গে আমার সুখদুঃখ জড়িয়ে গিয়েছিল, কেবল তাদের কথাই লিখলাম। অথচ যে বিশাল জীবনস্রোত প্রতিদিন আমার বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে প্রবাহিত হল, দর্শকের আসর থেকে তাকে কেবল দেখেই গেলাম, তার সংবাদ পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিলাম না। অনাগত কালে কোনো বিরল-প্রতিভা হয়তো বঙ্গভারতীর সেই অতি প্রয়োজনীয় অভাব দূর করবেন। তার লেখনীস্পর্শে পান্থশালার বহু মানুষের কলধ্বনি অতীতের গর্ভ থেকে উদ্ধার পেয়ে বর্তমানের কাছে ধরা দেবে, তীব্র ঘৃণাদায়ক অসুন্দরের মধ্য থেকে সাহিত্যের পরমসুন্দর ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করবেন। কাউন্টারে সেদিন কোনো কাজ ছিল না। চুপচাপ বসে বসে এই সব কথাই ভাবছিলাম। এমন সময় বোসদার হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। বোসদা হেসে বললেন, কী এত ভাবছ?

বললাম, কেমন অবাক হয়ে যাচ্ছি। এই হোটেলে কোনোদিন যে ঢুকতে পারবতা স্বপ্নেও ভাবিনি; অথচ অন্দরে ঢুকে এই সামান্য সময়ের মধ্যেই নিজের অজ্ঞাতে কখন আমার সত্তা শাজাহানের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।

বোসদা আবার হাসলেন।তোমরা যে সব সায়েব হয়ে গিয়েছ-পূর্বজন্মে বিশ্বাস করো না। না হলে বলতাম, আমি এখানে আরও কয়েকবার এসেছি। এই হোটেলের প্রতিটি ঘরের সঙ্গে আমার জন্মজন্মান্তরের পরিচয় রয়েছে।

হয়তো তাই। আমি বললাম, হয়তো আমিও এখানে আগে এসেছিলাম। হয়তো এমনিভাবেই কোনো বিষণ্ণ নয়না করবী গুহকে আমি দেখেছিলাম। হয়তো আরও কত কনি এবং সাদারল্যান্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।

আরও কতজনের সঙ্গে হয়তো পরিচয় হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি, বোসদা খাতা লিখতে লিখতে বললেন। তবে এইটুকু বলতে পারি, আমাদের চোখের সামনেও অনেক অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সৃষ্টি হয়, কিন্তু আমরা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে নিজের কাজেই মত্ত থাকি, তার খেয়াল করি না।

আমি ঠিক বুঝতে না পেরে, বোসদার মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা হাসতে হাসতে বললেন, মাঝে মাঝে আমি ১৮৬৭ সালের কথা ভাবি। আমাদের নয়, অন্য হোটেলের কথা। কিন্তু আমাদেরই মতো কোনো এক রিসেপশনিস্টের চোখের সামনে নিশ্চয় তা ঘটেছিল। সেদিনের সেই রিসেপশনিস্টও নিশ্চয় আমাদেরই মতো খাতার মধ্যে ড়ুবে ছিল, এবং পায়ের শব্দে চমকে উঠে আগন্তুককে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। একি! এমন অতিথি তো সাহেবি হোটেলে কখনও দেখা যায় না! ভদ্রলোকের গায়ে উড়নি, ভিতরে পৈতে দেখা যাচ্ছে, পায়ে লাল চটি। হয়তো রাস্তা চিনতে না পেরে নেটিভ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এখানেই ঢুকে পড়েছেন। কিংবা, যা দিনকাল, কিছুই বলা যায় না। হয়তো পণ্ডিতও বার-এ বসে ফরাসি দেশের দ্রাক্ষাকুঞ্জের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করতে চান!

রিসেপশনিস্ট নিশ্চয়ই তার অভ্যস্ত কায়দায় সুপ্রভাত জানিয়েছিল এবং পণ্ডিতের সুগম্ভীর ইংরিজি উত্তরে অবাক হয়ে গিয়েছিল। আই ওয়ান্ট টু সি মিস্টার… পণ্ডিত বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই চিরাচরিত প্রথা মতো রিসেপশনিস্ট ভিজিটরস স্লিপ এগিয়ে দিয়েছিল। গোটা গোটা অক্ষরে পণ্ডিত সেখানে নাম লিখে দিয়েছিলেন। স্লিপের দিকে তাকিয়ে, আমরা যেভাবে আজও উত্তর দিই, ঠিক সেইভাবে সেদিনের হোটেল-রিসেপশনিস্ট নিশ্চয় উত্তর দিয়েছিল, ও মিস্টার ডাটু! যিনি সবে বিলেত থেকে এসেছেন? জাস্ট এমিনিট!

রিসেপশনিস্ট নিশ্চয়ই এই ব্রাহ্মণকে জানতনা।কেনইবা এসেছেন?হয়তো বা সামান্য সাহায্যের আশায়। রিসেপশনিস্ট তবুও তাকে বসতে বলেছিল। আরও কয়েকজন ভদ্রলোক হোটেলের নতুন অতিথির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এসেছিলেন।

লাউঞ্জে এসে অতিথি অন্য সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন, কিন্তু পণ্ডিতকে দেখে দুহাতে গলা জড়িয়ে মুখ চুম্বন করলেন এবং আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে বুকে চেপে ধরে ক্রমাগত চুম্বন ও নৃত্য করতে লাগলেন। অপ্রস্তুত পণ্ডিত বলতে লাগলেন, আরে করো কি, করো কি, ছাড়ো। বোসদা এবার থামলেন। আমাদের হোটেলের কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাইকেল মধুসূদন ও বিদ্যাসাগরের সেই দৃশ্যের কথা চিন্তা করলে আজও রিসেপশনিস্ট হিসাবে আমার দেহে এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আমাদের এই শাজাহানেও এমনই কত নাটকীয় মুহূর্তে আমরা হয়তো উপস্থিত ছিলাম, কিন্তু খেয়াল করিনি। তবে মধুসূদনের হোটেলের সেই রিসেপশনিস্টকে আমি হিংসে করি। অসংখ্যের মধ্যে এতদিন পরে আজও তাকে আমরা মনে রেখেছি। আর সবাই বিস্মৃতির অতলগর্ভে কোথায় তলিয়ে গেল, যেমন আমরাও একদিন যাব।

বোসদার হাত ধরে আমিও ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই হারিয়ে যাওয়া মধ্যাহ্নে ফিরে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে মাইকেল মধুসূদন এবং ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আর ভাবছিলাম আজও আমার চোখের সামনে যে-সব ঘটনা ঘটছে, কে জানে তারাও একদিন হয়তো ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে।

বোসদা নিজের মনেই চিন্তা করছিলেন। বললেন, কোথায় যেন পড়েছিলাম ইতিহাসের দুটো অংশ—একটা ফলাও করে লেখা হয়, ছাপা হয়। আর একটা চিরদিনই অলিখিত থেকে যায়। সবাই তা জানে, অথচ কেউই তা প্রকাশ করতে সাহস করে না। আমরা বোধহয় আমাদের চোখের সামনে সেই দ্বিতীয় অধ্যায়ের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করছি।

আমি বললাম, কিছুই বুঝতে পারছি না, বোসদা।

বোসদা উত্তর দিলেন, এই স্যাটা বোসও পারে না। বইতে বলছে-ইতিহাসের চরিত্রগুলো সত্য, আর ঘটনাগুলো মিথ্যা। আর উপন্যাসে, গল্পে, নাটকে চরিত্রগুলো মিথ্যা, কিন্তু ঘটনাগুলো সত্য।

আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বোসদা নিজেই প্রতিবাদ তুললেন, কথাটা নির্ভেজাল সত্য নয়, কিছুই অতিশয়োক্তি আছে। কিন্তু এও ঠিক যে, সমাজের সব সত্য ইতিহাসের বইতে পাওয়া যায় না।

হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। বোসদা বললেন, এতক্ষণ য়ুনিভার্সিটির হে অফ দি ডিপার্টমেন্টের মতো লেকচার দিচ্ছিলাম! ভগবানের সহ্য হল না। মনে করিয়ে দিলেন যে,আমিশাজাহান হোটেলেরহরিদাস পাল রিসেপশনিস্ট।

টেলিফোন ধরে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, স্যাটা বলছি।…নিশ্চয়ই, আপনার কোনো চিন্তা নেই, আপনি চলে আসুন।

টেলিফোন নামিয়ে বোসদা খাতা খুললেন। খাতায় একটা ঘর বুক করলেন।

বললাম, এখন কে আসছেন?

বোসদা বললেন,এমন একজন যাঁর এই কলকাতাতেই ফ্যাশনেবল পল্লিতে বাড়ি আছে, সে-বাড়ির অনেক ঘর খালি পড়ে রয়েছে। তবু তিনি আসতে চান। এই রাত্রের আশ্রয়ের জন্য সামান্য হোটেল-কেরানির পায়ে পড়তেও তিনি রাজি আছেন।

ব্যাপার কী? আমি প্রশ্ন করলাম।

বিপুলা এ-পৃথিবীর কতটুকু জানি! বোসদা মাথা নাড়লেন। তার নাম শুনলে, কত লোক এখনি এই হোটেলে ছুটে আসবে। আমরা সবাই তাকে চিনি।

একটু পরে আবার টেলিফোন বেজে উঠল। আমি ফোন ধরতেই পুরুষালি গলায় এক ভদ্রলোক বললেন, আজ রাত্রে কোনো ঘর পাওয়া যাবে?

বোসদা আমার হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে বললেন, আপনার নাম? তারপর এক মিনিট চুপ করে থেকে বললেন, স্যরি, কোনো উপায় নেই।

টেলিফোন নামিয়ে দিতেই আমি ওঁর দিকে তাকালাম। কারণ আজ আমাদের কয়েকটা ঘর খালি রয়েছে। অথচ বোসদা বেমালুম বললেন, কিছুই খালি নেই।

 

মাত্র কিছুক্ষণ পরেই যাঁকে শাজাহান হোটেলের কাউন্টার এসে দাঁড়াতে দেখলাম, রূপালি পর্দায় ছাড়া অন্য কোথাও তাকে যে দেখব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তিনি চিত্রজগতের উজ্জ্বল তারকা শ্রীলেখা দেবী। সিনেমার পত্র-পত্রিকায় তার বহু মন-কেমন-করা ছবি আমি দেখেছি। আমাদের হোটেলে কিন্তু মাত্র একবার তার নাম বোসদার মুখে শুনেছিলাম। কোন এক পার্টিতে ফোকলা চ্যাটার্জি এই সুন্দরীশ্রেষ্ঠার গায়ে বমি করে দিয়েছিলেন। পার্টির মধ্যেই শ্রীলেখা দেবীকে উঠে গিয়ে শাড়ির আঁচল ধুয়ে বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল। ঘেন্নায় তার তখন ফেন্ট হবার মতো অবস্থা! ফোকলা চ্যাটার্জি ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়েছিলেন, শ্রীলেখা দেবী, কিছু মনে করবেন না।নতুন ককটেল ট্রাই করতে গিয়ে আমার এই অবস্থা হল। ব্যাটারা ককটেলের নাম দিয়েছে ফিল্মস্টার কিন্তু ও-সব

দেখতেই ভালো, কাছে আনতেই বমি হয়ে গেল, কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না।

শ্রীলেখা দেবী কিন্তু শোনেননি। সোজা বলে দিয়েছিলেন, ফোকলা যে পার্টিতে থাকবে সেখানে তিনি যাবেন না। বেচারা ফোকলাকে সেই থেকে ফিল্ম পার্টিতে কেউ নেমন্তন্ন করে না।

ফোকলা দু একবার আমাকে বলেছেন, কী হাঙ্গাম বলুন দেখি মশাই। মানুষের শরীর বলে কথা, মাঝে মাঝে গা বমি বমি করবে না? অথচ শ্রীলেখা দেবীর ধারণা, আমি ইচ্ছে করেই ওঁর গায়ে বমি করে দিয়েছিলাম। আপনার সঙ্গে তো জানা-শোনা আছে, ওঁকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?

ফোকলা চ্যাটার্জি তখন নেশার ঘোরে ছিলেন। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলেছিলেন, ঠিক হ্যায় মশায়, এ শর্মার নাম ফোকলা চ্যাটার্জি। মাল খেতে না ডাকলে হয়তোবমি করতে পারব না। কিন্তু কুলকুচি? কোন দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনাদের দেবীর মুখে কুলকুচির জল ছড়িয়ে দেব, মুখের সব পাউডার তখন ধুয়ে বেরিয়ে গিয়ে আসল রূপ বেরিয়ে পড়বে, আর একটিও কন্ট্রাক্ট পাবে না।

ফোকলা চ্যাটার্জি সেদিন বিশ্বাস করেননি, কিন্তু শ্রীলেখার দেবীর সঙ্গে আমার সত্যিই পরিচয় ছিল না। আজ প্রথম দেখলাম। বোসদা ওঁকে নমস্কার জানালেন। তারপর খাতা দেখে ওঁর ঘরের নম্বর বলে দিলেন।

শ্রীলেখা দেবী বলেছিলেন, আমাকে একটা কাপড় কিনে দিতে পারেন? এত রাত্রে? দোকানপাট তো সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বোসদা বললেন।

শ্রীলেখা দেবী বললেন, এক বস্ত্রে বেরিয়ে এসেছি। কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি।

চিত্রজগতের ইতিহাসে আমার এক বিশিষ্ট অবদান আছে। তাদের প্রখ্যাত অভিনেত্রীর জন্যে আমি ধর্মতলা স্ট্রিটের এক পরিচিত দোকানের দারোয়ানকে জাগিয়ে প্রায় মধ্যরাত্রে শাড়ি কিনে এনেছিলাম। অতি সাধারণ শাড়ি। কিন্তু তাই পেয়েই শ্রীলেখা দেবী যেন ধন্য হয়ে গিয়েছিলেন।

রাত্রে ছাদে বসেছিলাম। বোসদা বলেছিলেন, শ্রীলেখা দেবী জীবনে অনেক শাড়ি পরেছেন, তার অনেক শাড়ি থেকে দেশের ফ্যাশন তৈরি হয়েছে, কিন্তু এই শাড়িকে তিনি কোনোদিন ভুলবেন না।

বোসদা আরও বলেছিলেন, ভাবছি, এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা নোট বইতে লিখে রাখব। যদি কোনোদিন আত্মজীবনী লিখি কাজে লেগে যাবে! এই সত্যসুন্দর বোস সেদিন বো-টাই আর স্যুট ছেড়ে দিয়ে ধুতি পাঞ্জাবি চড়িয়ে রাতারাতি সাহিত্যিক বনে যাবে। দলে দলে গুণমুগ্ধ ভক্ত এই আদিঅকৃত্রিম স্যাটা বোসের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেবে।

লেখেন না কেন? আমি অভিযোগ করেছি।

লিখে কিছুই করা যাবে না। বোসদা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনেছি, লেখার জোরে পৃথিবীর কত পরিবর্তনই না হয়েছে, সভ্যতা বারেবারে লেখকের ইঙ্গিতেই নাকি মোড় ফিরেছে। আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না। লেখার জোরে এই অন্ধ, বোবা, বৈশ্য সভ্যতার কিছুই করা যাবে বলে মনে হয় না। মাইক দিয়ে চিৎকার করো, মহাভারতের মতো আড়াই সেরি বই লিখে ফেললা, হাজার পাওয়ারের বাতি দিয়ে দোষের উপর আলো ফেলো, তবুও কিছু হবে না।

আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছিলাম। সত্যসুন্দরদার মধ্যে এমন একটা হতাশ মন যে এমন ভাবে লুকিয়ে আছে, তা জানতাম না। সত্যসুন্দরদা শাজাহানের ছাদ থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন; বললেন, আকাশের দিকে এমনভাবে যুগ-যুগান্ত ধরে তাকিয়ে থাকলে একদিন হয়তো উত্তর পাওয়া যেতে পারে—আমরা কেন এমন, অন্তরের ঐশ্বর্য বিসর্জন দিয়ে সমাজের তথাকথিত সেরাদের অনেকে কেন এই বার এবং ক্যাবারেতে ভিড় করে।

বোসদা আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়েই বললেন,যুগযুগান্ত ধরে মানুষ অভাব-অনটনকে জয় করার সাধনা করে এসেছে। সে ভেবেছে প্রতিদিনের জীবনধারণের সমস্যা সমাধান করলে তবেহয়তে পরম নিশ্চিন্তে একদিন আপন আত্মার উন্নতির সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু কী হল? যাদের জীবনধারণের দুশ্চিন্তা নেই, যাদের অনেক আছে, তারাই অন্তরে নিঃস্ব হয়ে শাজাহানের রঙিন আলোয় নিজেদের হাস্যকর করে তুলছে। রিডিকুলাস, রিডিকুলাস, বোসদা নিজের মনেই বললেন।

স্তম্ভিত আমার তখন কথা বলবার সমার্থ্য নেই। বোসদা বললেন, আলড়স হাক্সলে এক বইতে ভারতবর্ষ ভ্রমণের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন। বোম্বাই-এর কোন হোটেলে বই-এর দোকানে তিনি এক বিশেষ শাস্ত্র সম্বন্ধে অজস্র বই দেখেছিলেন। Rows of them anddozens of copies of each. অথচ হোটেলে যে ওই-বিষয়ে উৎসাহী ডাক্তারা বই কিনতে আসেন এমন নয়। হালে লিখলেন, সাধারণ লোকরাই ওই সব বই কেনে। Strange, strange phenomenon! Perhaps it is one of the effects of climate.

বোসদা বললেন, আমিও ভেবেছিলাম জল-হাওয়ার দোষ। কিন্তু পরে ভেবেছি হাক্সলে সায়েবের নিজের দেশই বা কম যায় কীসে? এ প্রশ্নের কী উত্তর জানি না। তবে ডি এইচ লরেন্সের লেখায় এর সামান্য উত্তর পেয়েছি, পুরো নম্বর দিলেও তাকে পাশ নম্বর দেওয়া যায় : the God who created man must have a sinister sense of humour, creating him a reasonable being yet forcing him to take this ridiculous posture, and driving him with blind craving for this ridiculous performance.

বোসদাকে আজ যেন বলার নেশায় পেয়েছে।কোনো সহজ উত্তর বোধহয় নেই। জীবনের প্রশ্নপত্র অসংখ্য ছেলে-ঠকানো কোশ্চেনে বোঝাই। ওসব বোঝবার চেষ্টা করতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হবে। তার থেকে শ্রীলেখা দেবীর কথা শোনো।

আপনি শুতে যাবেন না? আমি প্রশ্ন করলাম।

যাব। তুমি তো নাইট ডিউটি দিতে নীচেয় যাচ্ছে। সুতরাং জেনে রেখে দাও।শ্রীলেখা দেবীর স্বামী রাত্রে হয়তো হাজির হতে পারেন। উনিই তখন ফোন করেছিলেন। ভদ্রলোকও একটা ঘর চাইছিলেন। আমি বলে দিলাম, ঘর খালি নেই। ভদ্রলোককে বিশ্বাস নেই। ওঁর ভয়ে বেচারা শ্রীলেখা দেবীর জীবনে একটুও শান্তি নেই। উনি বলেছেন, তোমার সুন্দর মুখের গর্বে তুমি ফেটে পড়ছ। তোমার ওই মুখে আমি অ্যাসিড ঢেলে দেব। বলা যায় না হয়তো রাত্রে হাজির হতে পারেন। যদি আসেন, কিছুতেই ঢুকতে দেবে না।

বোসদা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মনে হল অন্ধকারে কে যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

ছায়ামূর্তিকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রথম যে একটু ভয় পেয়ে যাইনি তা নয়। একটু পরেই বোঝা গেল, ছায়ার মালিক মার্কোপোলোর বেয়ারা মথুরা সিং। মথুরাকে কোনোদিন আমাদের খোঁজে ছাদে উঠে আসতে দেখিনি। মথুরা মুখ শুকনো করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।

সে আমাদের সেলাম করলে। বললে, বাবুজি, আপনারা এখনও ঘুমিয়ে পড়েননি?

গুমোবার উপায় নেই মথুরা, আমার রাত ডিউটি।

মথুরা বললে, ঘুমিয়ে পড়লে আপনাদের ডেকেতুলতে হত। এমন ব্যাপার কখনও তো হয়নি।

আমরা মথুরার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনলাম, মার্কোপোলো সেই যে সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়েছেন, এখনও ফেরেননি।

হঠাৎ আজ বেরোলেন কেন? মথুরাকে প্রশ্ন করলাম।

আজ যে ডেরাই ডে বাবু। কোথা থেকে গিয়ে সায়েব ধেনো খেয়ে আসবেন। কিন্তু বাবু, এতদিন থেকে দেখছি, কখনও এত রাত্রি করেননি।মথুরা সিং মুখ শুকনো করে বললে।

সত্যসুন্দরদাও যেন চিন্তিত হয়ে উঠলেন। বললেন, সায়েব তত বেশ ফ্যাসাদ বাধালে দেখছি। তা জিমি সায়েবকে খবর দিয়েছ? তিনিই তো শাজাহান হোটেলের দুনম্বর, যদি কিছু করবার থাকে, তাকেই করতে হবে।

মথুরা সিং মানুষ চেনে। সেবিষণ্ণ মুখে হাসল। আস্তে আস্তে বললে, আমরা ছোট চাকরি করি হুজুর, আমাদের বলা উচিত নয়। জিমি সায়েবকে আপনারা তো চেনেন, ম্যানেজার সায়েবের কোনো ক্ষতি হলে উনি সবচেয়ে খুশি হবেন।

বোসদা গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, তুমি যাও। দেখি কী করা যায়।

মথুরা চলে যেতে বোসদা বললেন, মথুরার মানুষ চিনতে বাকি নেই। জিমিটাকে ঠিক বুঝে নিয়েছে। লোকটার অন্তহীন লোভ। বেয়ারাদের কাছ থেকে পর্যন্ত টিপসের ভাগ নেয়। কেউ সাহস করে বলতে পারে না, এখনই চাকরি খেয়ে নেবে। মার্কোপোলো বুঝেও কিছু বলেন না—হাজার হোক পুরনো লোক, ওঁর অনেক আগে থেকে হোটেলে চাকরি করছে। মার্কোপোলোর আর ঠিক আগেকার উদ্যম নেই। ক্রমশ কেমন হয়ে পড়ছেন। দিনরাত চুপচাপ বসে থেকে কী সব ভাবেন। আর সেই সুযোগে জিমিটা পুকুর চুরি আরম্ভ করে দিয়েছে। একজন কিছুটা খবর রাখে, সে হল রোজি। কিন্তু তাকেও জিমি হাতের মুঠোর মধ্যে রেখে দিয়েছে।

আমি বললাম, বিদেশ বিভুয়ে ভদ্রলোক একা পড়ে রয়েছেন। একটা কিছু করা দরকার। হাজার হোক আমাদের নিজেদের শহর।

বোসদা বললেন, তুমি নীচে চলে যাও। উইলিয়ম ঘোষ এতক্ষণে নিশ্চয় কেটে পড়েছে। তুমি কাউন্টার সামলাগে যাও। আর একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক। হয়তো এখনই ফিরে আসবেন।

আপনি তো এখনই ঘুমিয়ে পড়বেন। তারপর যদি দেখি সায়েব তখনও ফিরছেন না? আমি প্রশ্ন করলাম।

বোসদা হেসে ফেললেন। আমি ঘুমোচ্ছি না। ঘুমটা আমার কাছে অটোমেটিক সুইচের মতো। সুইচ যতক্ষণ না টিপছি শ্রীমানের সাধ্য কি আমার ঘাড়ে এসে চাপে। তুমি যাও।

আমি নীচেয় নেমে এলাম। উইলিয়ম ঘোষ কখন বেয়ারাকে বসিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে গেছে।

এখন রাত অনেক। শাজাহান হোটেলও কলকাতার শান্ত সুবোধ শিশুদের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাউন্টারে কেবল আমি জেগে রয়েছি। আর কলকাতার কোথাও শাজাহানের ম্যানেজার মার্কোপোলো নিশ্চয়ই জেগে রয়েছেন। তিনি কোথায় গেলেন? ড্রাই-ডেতে বেআইনি মদ গিলে কি শেষ পর্যন্ত পুলিসের হাতে পড়লেন? মদ খাওয়াটা অন্যায় নয়; কিন্তু মাতাল হওয়া বেআইনি। রিজার্ভেশনের খাতার দিকে তাকালাম। আজ রাত্রে কোনো অতিথির বিদায় নেবার কথা নেই। রাত্রের অন্ধকারে কয়েকজন নতুন অতিথি কিন্তু আসছেন। দমদম হাওয়াই অফিস থেকে ফোন এসেছে যে, তাদের আসতে সামান্য দেরি হবে। ঠিক এই মুহূর্তে দূর দেশের বিদেশি যাত্রীদের নিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে অতিকায় বিমান কলকাতার দিকে এগিয়ে আসছে।

হাওয়াই অতিথিরা যখন এলেন, তখন মুসাফির রাত্রি কলকাতার রহস্যময় পথে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার চোখে কোথা থেকে ঘুম এসে জড়ো হতে শুরু করেছে। ব্যাগ রাখবার শব্দে চমকে উঠলাম। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ঘুমোনো গুরুতর অপরাধ। তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে উঠে দেখলাম, সুজাতা মিত্র।

এয়ার হোস্টেসের আসমানি রংয়ের শাড়ি পরে সুজাতা মিত্র আমার দিকে, তাকিয়ে মৃদু হাসছেন। বললেন, বেচারা।

আমি লজ্জা পেয়ে, সোজা হয়ে উঠে শুভরাত্রি জানালাম। সুজাতাও হেসে বললেন, এখন সুপ্রভাত বলুন। মণিবন্ধের ঘড়িটা সুজাতা মিত্র আমার দিকে এগিয়ে ধরলেন।

হাওয়াই হোস্টেসমিমিত্রের সঙ্গীরা খাতায় সই করে ভিতরে চলে গেলেন। সুজাতা মিত্র তাদের বললেন, ডোন্ট ওয়ারি। আমি একটু পরেই যাচ্ছি।

সুজাতা মিত্র বললেন, আপনার অবস্থা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। লজ্জা পেয়ে আমি বললাম, মিস্ মিত্র, আমার মোটেই ঘুম পাচ্ছে না। টানা টানা চোখ দুটো আরও বড় করে সুজাতা মিত্র পরম স্নেহে বললেন, আহা রে। আমাকেও কাস্টমারের মতো খাতির করে কথা বলতে হচ্ছে।

আমি খাতার দিকে তাকাতে তাকাতে বললাম, আপনাকে এবার খুব ভালো ঘর দিয়েছি, মিস্ মিত্র। রুম নাম্বার দুশো তিরিশ। গতবার রাত্রে এসে আমাদের মিস্টার বোসের ঘরে থেকে আপনি শাজাহান সম্বন্ধে যে খারাপ ধারণা করেছিলেন, এবার তা নষ্ট হয়ে যাবে।

হাওয়াই হোস্টেস সুজাতা সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারেন। আমার মতো একজন অপরিচিত সামান্য হোটেল কর্মচারীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতেও তার কোনো আপত্তি নেই। অথচ শাজাহানে তার সমগোত্রীয়া আরও অনেককে তো দেখেছি। তাদের হাইহিলের ঠোকরে শাজাহানের মাটি কম্পমান।

সুজাতামি আমার কথায় যে একটু রাগ করেছেন, তা বোঝা গেল।বললেন, হোটেলে যে বেশিদিন কাজ করেননি, তা তো আপনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে এসব প্রফেশন্যাল কথা এমন কায়দাদুরস্তভাবে কেমন করে শিখলেন?

আমার বেশ ভালো লাগছিল।ওঁর আন্তরিকতা অজ্ঞাতেই মনকে স্পর্শ করে। হেসে বললাম, এত অল্প সময়ের মধ্যেই যে কাজ শিখতে পেরেছি, তার একমাত্র কারণ মিস্টার স্যাটা বোস।

সুজাতা মিত্র আমার কথা শেষ করতে দিলেন না। হাসতে লাগলেন। বললেন, অদ্ভুত নাম তো।

বোসদার বিরুদ্ধে কেউ সামান্য ব্যঙ্গ করলেও আমার মনে লাগে। কোথাকার একটা হাওয়াই জাহাজের মেয়ে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, ভাবতেও আমার রাগ হচ্ছিল। বললাম, ওঁর আসল নাম তো স্যাটা নয়। হোটেলে কাজ করতে করতে নামটা অমন বেঁকে গিয়েছে। সত্যসুন্দর বোস, কুলীন কায়স্থ।

সুজাতা মিত্র প্রখর বুদ্ধিমতী। আমার মুখ দেখেই সব বুঝে নিলেন। ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে রেখে বললেন, আপনাদের এই হোটেল তা হলে তো মোটেই নিরাপদ জায়গা নয়। কোথায় সত্যসুন্দর আর কোথায় স্যাটা। আপনি খুব সাবধান। কোন্ দিন দেখবেন আপনিও হয়ে গিয়েছেন সাঁকো। সায়েবরা হয়তো আপনাকে স্যাংকে বলে ডাকতে আরম্ভ করেছেন।

আমি ছেলেমানুষীর বশে রেখে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বটে। কেউ আমার নামে হাত দিয়ে দেখুক না। তখন তার একদিন কি আমার একদিন।

সুজাতা মিত্র হাসতে হাসতে বললেন, আপনার দাদাটি তত বেমালুম নিজের নামটা হাতছাড়া করলেন।

আমি রেগে বললাম, বেশ করেছেন। তাঁর নিজের নাম, তা নিয়ে তিনি যা খুশি করবেন, তাতে কার কী?

সুজাতা মিত্র বললেন, সেবারে আপনাদের কিন্তু খুব ভুগিয়ে গিয়েছিলুম। ভাবলে এখনও আমার লজ্জা লাগে।

হয়তো সুজাতামিত্র আরও কথা বলতেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি একটু গম্ভীর হয়ে উঠলেন। বোসদা যে কখন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি।

বোসদা প্রথমে বললে, আরে, আপনি! এই ছেলেটা রাতদুপুরে আপনাকে বকিয়ে বকিয়ে মারছে তো। বকতে পেলে শ্রীমান আর কিছুই চায় না।

সুজাতা মিত্র বললেন, উনি নিজেকে আপনার সুযোগ্য শিষ্য বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করেন। অনেক ঠোঁটের ভদ্রতা আপনার কাছ থেকে শিখেছেন। সে-রাত্রে আপনি নিজের ঘর খুলে দিয়ে আমাকে থাকতে দিলেন; আর এখন কি না আপনার শিষ্য ভদ্রতা করে বলছেন, নিশ্চয়ই আপনার কষ্ট হয়েছিল, এবারে ভালো ঘর দিচ্ছি।

সত্যসুন্দরদা এবার অবাক কান্ড করে বসলেন। সত্যসুন্দরদা যে কোনো মেয়েকে এমন কথা বলতে পারেন, তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। সত্যসুন্দরদা গম্ভীরভাবে বেমালুম বলে দিলেন, অথচ তার জন্যে পরের দিন আপনি একটা থ্যাংকসও দিয়ে যাননি।

প্রত্যুত্তরে সুজাতা মিত্রের মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা আজও আমার মনে আছে। যেন ভোরের সূর্য সাদা বরফের পাহাড়ের উপর প্রথম আলোর রেখা ছড়িয়ে দিল। সুজাতাদি বললেন, ধন্যবাদ ইচ্ছে করেই দিইনি। যারা নিজের ঘর খুলে অচেনা অতিথিকে শুইয়ে দিয়ে সারারাত জেগে থাকে, তারা নিতান্তই গোঁয়ার, না-হয় বোকা। তাদের ধন্যবাদ দেবার কোন মানে হয় না।

সুযোগ পেয়ে, আইন বাঁচিয়ে, গোয়ার, বোকা, আহাম্মক এতগুলো গালাগালি দিয়ে দিলেন! বোসদা বললেন।

আমাদের দিকে না তাকিয়েই সুজাতা মিত্র বললেন, চমৎকার বানাতে পারেন তো। আহাম্মক কথাটা কেমন উড়ে এসে জুড়ে বসল।

এবার আমাকে উদ্দেশ করে সুজাতা মিত্র বললেন, সেদিন যাবার সময় ধন্যবাদ দেবার জন্য উপরে গিয়েছিলাম। আপনারা কেউ ছিলেন না। এখন দেখছি ভালোই হয়েছিল। আপনাদের মতো লোকের ধন্যবাদ প্রাপ্য নয়। আপনারা সত্যি তার যোগ্য নন।

বোসদা বললেন, আই অ্যাম স্যরি, আপনি যে আমাকে খুঁজেছিলেন, জানতাম না।

আমার তখন বোসদার উপর রাগ হয়ে গিয়েছে। সুজাতাদির পক্ষ দিয়ে বললাম, কী করে জানবেন? দিনরাত হয় ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার, ব্যাংকোয়েট, না-হয় টেবিল বুকিং, ফ্লোর শো নিয়ে ড়ুবে থাকলে অন্য জিনিসের খবর রাখবেন কী করে?

সুজাতা মিত্র বললেন, আপনাদের চোখে কি ঘুম নেই?

বোসদা সুযোগ ছাড়লেন না। উত্তর দিলেন,সাদী বলেছেন, ভালো লোকরা যাতে জ্বালাতন না হন, সেই জন্যে ঈশ্বর দুষ্টদের চোখে ঘুম দিয়েছেন।

সুজাতা মিত্র গম্ভীরভাবে বললেন, রাত্রে কি দুজনকেই জেগে থাকতে হয়?

আমি বললাম, বোসদার জাগবার কথা নয়। কিন্তু আমাদের ম্যানেজারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বোসদা আমাকে বললেন, ভাবছিলাম থানায় খবর দেব। কিন্তু তাতে অনেক গণ্ডগোল হবার সম্ভাবনা। তাছাড়া এইমাত্র মথুরা সিং-এর সঙ্গে আবার কথা বলে এলাম। শুনলাম, দু-একদিন আগে বায়রন সায়েব এসেছিলেন। দুজনের মধ্যে অনেক কথা হয়েছে। একবার ওঁর সঙ্গে তুমি দেখা করে এসো। আমি যেতে পারতাম, কিন্তু বাড়ি চিনি না। একা-একা এত রাত্রে খুঁজে বের করা বেশ শক্ত হবে। তার থেকে তুমি একটা ট্যাক্সি জোগাড় করবার চেষ্টা করো। আমি তোমার ডিউটি দেখছি।

সুজাতা মিত্র চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিলেন। বললেন,আমি একটা কথা বলব? যদি আপত্তি না করেন, তাহলে আমাদের এয়ার লাইনের গাড়িটা নিয়ে যান। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। ও নিশ্চয়ই গাড়ির ভিতর শুয়ে আছে।

 

রাত্রের অন্ধকারে জনহীন পথে কোনোদিন কলকাতার রূপ দেখেছেন কি? দুরন্ত ট্রাম বাস শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ে কখন কলকাতাকে শান্ত করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে দুএকটা ট্যাক্সি হয়তো দেখা যায়, কিন্তু তাদের মধ্যে কারা? কলকাতার কোনো সাহিত্যানুরাগী ট্যাক্সিওয়ালা আত্মজীবনী লিখলে হয়তো তা জানা যাবে।

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যু থেকে আমাদের গাড়ি চৌরঙ্গীতে এসে পড়ল। রাতের নিয়ন আলোগুলো কলের পুতুলের মতো তখনও জনহীন চৌরঙ্গীর রঙ্গমঞ্চে আপনমনে অভিনয় করে চলেছে। কোন এক দুর্বার আকর্ষণে ড্রাইভারকে ডান দিকে গাড়ির মোড় ঘোরাতে বললাম। কার্জন পার্কের লোহার বেড়ার মধ্যে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা তখন ইনসোমনিয়াগ্রস্ত শ্ৰেষ্ঠীপতির মতো প্রভাতের প্রতীক্ষায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা আমাকে দেখেও দেখলেন না। এই প্রাচীন নগরীর গোপনতম রহস্যমালা যেন তার হৃদয়হীন ধাতবচক্ষুর কাছে কবে ধরা পড়ে গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার নীরস কঠিন দেহে একবিন্দু স্নেহ বা কারুণ্য আবিষ্কার করতে পারলাম না।

কে জানে কেন, পৃথিবীর কোনো মানুষকে আমি এত ভয় করি না। আমার অন্তরের কোথাও তিনি কোনো অজ্ঞাত কারণে সারাক্ষণ উপস্থিত রয়েছেন। নিদ্রাহীন, তৃষিতপ্রাণ হরিরাম দিনে দিনে আরও কঠিন ও কর্কশ হয়ে উঠছেন। তার বিরক্ত চোখের দিকে দুর থেকে তাকালে মনে হয়, স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা বাহাদুর কে-টি সি আই ই তার সকল অপ্রিয় অভিজ্ঞতার জন্যে পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে আমাকে দায়ী করে বসেছেন। দুনিয়ার যত দুর্বিনীত নিম্নমধ্যবিত্ত তাকে অবহেলা এবং অপমান করবার জন্যেই যেন দল বেঁধে আমাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী খাড়া করেছে, গাড়ি চালিয়ে রাতের অন্ধকারেও তাকে বিরক্ত করতে পাঠিয়েছে।

হয়তো আরও অনেকক্ষণ ছেলেমানুষের মতো স্যর হরিরামের সঙ্গে আমার নীরব কথাবার্তা চলত। কিন্তু এরোপ্লেন কোম্পানির বাস ড্রাইভার আমাকে সাবধান করে দিলে। বললে,বাবুজি, এখানে এত রাত্রে কেউ আসবেন নাকি?

বললাম, না। চলো আমরা এবার এগিয়ে যাই। আমাদের এলিয়ট রোডের দিকে যেতে হবে।

কার্জন পার্ককে বাঁ দিকে রেখে গাড়ি আবার পূর্ব দিকে মোড় ফিরল। স্যর সুরেন ব্যানার্জি যেন মনুমেন্টের তলায় সমবেত লক্ষ লক্ষ জনতাকে উদ্দেশ করে বক্তৃতা করছিলেন। মাইক খারাপ হয়ে গিয়ে তিনি যেন মুহুর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং সেই সামান্য সময়ের মধ্যেই ধৈর্যহীন অকৃতজ্ঞ শ্রোতার দল মিটিং ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। অবহেলিত এবং অপমানিত সুরেন্দ্রনাথ হতাশায় অকস্মাৎ প্রস্তরে রূপান্তরিত হয়েছেন।

কর্পোরেশন স্ট্রিট পেরিয়ে গাড়ি এবার ওয়েলেসলি স্ট্রিটে পড়ল। আমার আবার বায়রন সায়েবের কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয় না। দুএকবার দূর থেকে শাজাহানের ব্যাংকোয়েট রুমে তাকে দেখেছি; কিন্তু ইশারায় তিনি কথা বলতে বারণ করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই কোনো শিকারের পিছনে তিনি গোপনে ছুটছেন, হয়তো কাউকে নিঃশব্দে ছায়ার মতন অনুসরণ করছেন। বার-এ এক বোতল বিয়ার নিয়েও তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছি। কিন্তু তিনি আমাকে দেখেও দেখেননি। আমি যে তাকে চিনে ফেলি, এবং তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলি তা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না।

তবু অন্য সময়ে তার খোঁজ নেওয়া আমার উচিত ছিল। অন্তত তার বাড়িতে এসে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেসব কিছুই হয়ে ওঠেনি। শাজাহান যেন বিশাল হাঁ করে আমার সর্বস্ব গ্রাস করে ফেলেছে। আমার কোনো পৃথক সত্তা যেন শাজাহানের ক্ষুধা থেকে রক্ষা পায়নি।

ড্রাইভার বললে, কোন দিকে বাবু?

আমি বললাম, তুমি সোজা চলো, সময়মতো আমি দেখিয়ে দেব।

ড্রাইভার বললে, বাবুজি, জায়গা ভালো নয়। এত রাত্রে গাড়ি দেখলে এখানে অনেক রকম সন্দেহ করে।

আমি বললাম, অনেকদিন আগে এখানে এসেছিলাম দিনের আলোয়। পরিষ্কার মনে করতে পারছি না। আর একটু এগোলে হয়তো গলিটা চোখে পড়বে, তখন চিনতে পারব।

 

শেষপর্যন্ত গলিটা সত্যিই চিনতে পারলাম। সুজাতা মিত্র দয়া না করলে এত রাত্রে ট্যাক্সি চড়ে এখানে আসতে আমার সাহস হত না। হাওয়াই কোম্পানির গাড়িটা কিন্তু গলির মধ্যে ঢুকল না। নেমে পড়ে আমি বায়রন সায়েবের বাড়ির দিকে এগোতে লাগলাম।

একটা টর্চ আনা উচিত ছিল। রাস্তার আলোগুলো পাড়ার ছোকরাদের গুলতির লক্ষ্যস্থল হিসেবে কখনও দীর্ঘ জীবন লাভের সুযোগ পায় না। প্রায় হাতড়াতে হাতড়াতে যেখানে এসে পৌছলাম, সেটাই যে বায়রন সায়েবের বাড়ি তা ভাঙা নেমপ্লেটটা দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না। একটু দূরে একটা রাস্তার আলো অব্যর্থ লক্ষ্যসন্ধানী এলিয়ট রোড বয়েজদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তখনও যেন কীভাবে টিকে রয়েছে।

বায়রন সায়েবের দরজা বন্ধ। ভিতরেও কোনো আলো জ্বলছেনা। এত রাত্রে তাকে ডেকে তোলা কি উচিত হবে? গঙ্গনাম স্মরণ করতে করতে কলিং বেলটা টিপে ধরলাম।

কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না। হয়তো ভিতরে কেউ নেই। একটু ফাঁক দিয়ে আবার বোম টিপলাম।

ভিতরে কে এবার একটু নড়ে চড়ে উঠলেন। তারপর নারীকণ্ঠে ইংরিজি অশ্লীল গালাগালি কানে ভেসে আসতে লাগল : তুমি যেখানকার জঞ্জাল সেখানে গিয়ে থাকো। মাঝরাতে আমাকে জ্বালাতন করতে এসেছ কেন?

আমি ভয়ে জড়োসডো হয়ে দাঁড়ালাম। ভদ্রমহিলা তখন আর এক রাউন্ড ফায়ারিং করছেন। লজ্জা করে না মিনসে, রোজগার করে তো উল্টে যাচ্ছ, আবার রাতেও জ্বালাতন। যাও, ডাস্টবিনে পারিয়া ডগদের সঙ্গে শুয়ে থাকোগে যাও। সারাদিন আমি খেটে মরব, তোমার ভাতের জোগাড় করব, আবার রাতেও খারাপ মেয়েদের মতো জেগে থাকব, সে আমি পারবনা। তুমি দুর হও, দুর হও।

ততক্ষণে সত্যিই আমি ভয় পেয়েছি। মার্কোপোলো তখন মাথায় উঠেছেন। পালাব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই ভিতর থেকে দরজা খোলার শব্দ হল। দরজা খুলেই ঝটা মারতে গিয়ে ভদ্রমহিলা চমকে উঠলেন। স্বামীর বদলে আমাকে দেখে হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলেন।

কী হয়েছে? কী হয়েছে বলো। আমার স্বামীর নিশ্চয় কোনো বিপদ হয়েছে। ওগো, কতবার তোমাকে বলেছি তোমাকে ডিটেকটিভগিরি করতে হবে না। এই পোড়া দেশে ও-সব চলবে না। ওর থেকে তুমি খবরের কাগজ ফেরি করো,

হয় বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকো। আমি যতক্ষণ চাকরি করছি ততক্ষণ তোমার কীসের ভাবনা?

অন্য পল্লি হলে এতক্ষণে সেই কান্না শুনে প্রতিবেশীরা ঘরের দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে আসতেন। কিন্তু এই আধা-সায়েব পল্লিতে ও-সব বড় একটা হয় না। একজনের প্রাইভেসিতে আর একজন মরে গেলেও মাথা ঢোকান না।

মিসেস বায়রন কাতরকণ্ঠে জানতে চাইলেন, আমি পুলিসের লোক, না হাসপাতালের লোক। এত রাত্রে এই দুজন ছাড়া যে আর কেউ তার কাছে আসতে পারে তার্তার কল্পনারও অতীত। বললেন, কোথায় আমার স্বামী আছে বলল, আমি এখনই যাচ্ছি।

আমি এবার কোনোরকমে বললাম, আমি পুলিস বা হাসপাতালের প্রতিনিধি নই। আমি হোটেলের লোক। আমাদের সায়েব মিস্টার মার্কোপোলোকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই খোঁজ করতে এসেছি।

ও! তাই বলল, শ্রীমতী বায়রন আবার নিজমূর্তি ধারণ করলেন। তুমি সেই মোটকা সায়েবের কথা বলছ তো, যে মাঝে মাঝে আমাদের জন্যে স্যান্ডউইচের প্যাকেট নিয়ে আসে। সেমিনসেই তো যত নষ্টের গোড়া। আমাকে বের করে দিয়ে দুজনের গুজ গুজ করে কথাবার্তা চালায়। আমার স্বামী বলেন, ওঁর মক্কেল। আমি কিন্তু বাপু শিকারি বেড়ালের গোঁফ দেখলে চিনতে পারি। সব বাজে কথা। আসলে ওঁর সঙ্গী। দুই সাঙাতে মিলে সেই যে বেরিয়েছে, কোথায় কোন চুলোয় গিয়ে পড়ে আছে কে জানে।

শ্ৰীমতী বায়রন তখনও অশ্লীল গালাগালি বর্ষণ করে চলেছেন। কিন্তু আমার মনে সাহস ফিরে এসেছে। বায়রন সায়েব এবং মার্কোপোলোর তাহলে একটা হদিস পাওয়া গিয়েছে।

শ্ৰীমতী বায়রন বিরক্ত হয়ে বললেন, ও-সব ন্যাকামো ছাড়ো, আমার স্বামী এখন কোথায় আছেন বলো।

আমি বললাম, মিস্টার বায়রন কখন আসবেন, কিছু বলে গিয়েছেন?

কিছু বলে যাননি। ওই মিনসে আসতেই বেরিয়ে গিয়েছে। মুখে আগুন। তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বললে আমার পেট ভরবে না। এই বলে শ্রীমতী বায়রন দড়াম করে আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।

 

হোটেলে ফিরতেই সত্যসুন্দরদা বললেন, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। শুধু শুধু রাত্রে কষ্টভোগ করলে। মার্কোপোলো ফিরে এসেছেন। সঙ্গে মিস্টার বায়রনও ছিলেন। তিনিই ওঁকে ধরে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে, বেয়ারাদের হাতে জমা দিয়ে চলে গেলেন।

মার্কোপোলো কাউন্টারের সামনে একবার থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। যেন এই হোটেলের তিনি এক নতুন আগন্তুক, এখানকার কিছুই চেনেন না, জানেন না। সত্যসুন্দরদা প্রশ্নকরেছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন, আমাদের সকলের দুশ্চিন্তার সংবাদও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু যে মার্কোপোলো সারাদিন হোটেল মাথায় করে রাখেন, প্রতিটি খুঁটিনাটির খবর না নেওয়া পর্যন্ত নিজেই নিশ্চিন্ত হতে পারেন না, রাতের অন্ধকারে তিনি কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে সত্যসুন্দরদার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। তারপর প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তোমরা সারারাত জেগে থাকো?

সত্যসুন্দরদা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আপনিই তো ডিউটি চার্টে সই করেন।

মার্কোপোলো হতাশায় মাথা নেড়েছিলেন। বলেছিলেন, ইউজলেস। কোনো মানে হয় না। দুনিয়ার সব লোক যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন এমনভাবে বোকার মতো আসর জাগিয়ে রাখবার কোনো মানে হয় না।

মার্কোপোলোর দৃষ্টি এবার সুজাতা মিত্রের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি কিছু বলবার আগেই বোসদা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভদ্রমহিলা হাওয়াই জাহাজের কর্মী, আমাদের অতিথি। মার্কোপোলো সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। আরও কথা বলবার ইচ্ছা ছিল বোধহয়, কিন্তু শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।

মিস মিত্র বললেন, আমার খুব মজা লাগছিল। প্রতিদিন মাটি থেকে অনেক উঁচুতে মেঘের আড়ালে কত লোককেই তো দেখি। কিন্তু আপনাদের এইখানে আরও অদ্ভুত সৃষ্টির আনাগোনা। ইচ্ছে হয়েছিল, একবার আপনাদের ম্যানেজারকে বলি, রাত্রি আর নেই।

বোসদা প্রথমে হাসলেন, তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ওঁর জীবনে এখনও রাত্রির অন্ধকার জমা হয়ে রয়েছে। ওঁর জন্যে সত্যিই কষ্ট হয়।

সুজাতা মিত্রকে তখনও কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যে একটু অবাক হয়ে যাইনি এমন নয়। বোসদা বললেন, আপনাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার গাড়িটা দিলেন, নিজেও এতক্ষণ জেগে রইলেন।

সুজাতা মিত্র আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার গুরুদেব এখন আবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। দেখুন যদি ওঁকে সাহায্য করতে পারেন!

আমি হেসে বললাম, ওটা ধন্যবাদ জানানোর একটা ফর্ম।

সুজাতা মিত্রের পিছনের বেণীটা এবার সাপের মতো দুলে উঠল। বললেন, ফর্মাল লোকদের আমরা তেমন পছন্দ করি না।

বোসদা কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, বচ্ছরকার দিন এইভাবে গালাগালি দিচ্ছেন। এই জন্যেই প্যাসেঞ্জাররা দেশি হাওয়াই হোস্টেস পছন্দ করেন না।

বটে! যদি পছন্দই না করত তা হলে আরও নতুন মেয়ে নেওয়া হচ্ছে কেন?

তা হলে বোঝা যাচ্ছে নতুন যারা ঢুকেছে তারা অনেক ভদ্র এবং ভালো। বোসদা সকৌতুক উত্তর দিলেন।

এ তো উকিলদের মতো কথা বললেন। এখানে আসবার আগে কি আদালতে প্র্যাকটিশ করতেন?

আদালতের কথা তুলবেন না। এ বেচারার মন খারাপ হয়ে যায়। আদালতের সঙ্গে একদিন এর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আমাকে দেখিয়ে বোসদা বললেন।

আমি এবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। সুজাতা মিত্রের টানা-টানা দুটো চোখে ঘুমের মেঘগুলো জড়ো হবার চেষ্টা করছে; কিন্তু কিছুতেই তেমন সুবিধে করতে পারছে না। বোসদাও বোধ হয় এবার তা লক্ষ্য করলেন। বললেন, আই অ্যাম স্যরি। অনেক রাত্রি হয়েছে। এতক্ষণ ধরে আপনাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।

একটাও পোর্টার কাছাকাছি ছিল না। সুজাতা মিত্র নিজেই সুটকেসটা তুলে নিতে যাচ্ছিলেন। আমি আড়চোখে বোসদার দিকে তাকালাম। বোসদা আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে, তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলেন। সুজাতা বোধহয় একটু অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু বোসদা আমাকে ড়ুবিয়ে দিলেন। বললেন, ছোকরাকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনি ব্যাগ বইছেন তো হয়েছে কী? কিন্তু শ্রীমান আমার দিকে এমন কটমট করে তাকাল, যেন আমার মতন এমন সমর্থ কুলি থাকতে কোনো মহিলা তার ব্যাগ বইবেন, তা সে সহ্য করবে না।

সুজাতা মিত্র এবং বোসদা দুজনেই এবার সলজ্জভাবে আমার দিকে তাকালেন। তারপর শাজাহানের দ্বারপ্রান্তে আমাকে একলা প্রহরী রেখে দুজনেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

 

শাজাহানের নিস্তব্ধ রাত্রি এখন আমার পরিচিত হয়ে গিয়েছে। উনিশ শতকের এই প্রাচীন পান্থশালা আমার নিঃসঙ্গ মুহূর্তে এখন আমাকে আর বিস্মিত করে না। পরিচয়ের অন্তরঙ্গতম পর্যায়ে এসে এই প্রাচীন প্রাসাদ তার কোনো রহস্যই প্রিয়বন্ধুর কাছে গোপন রাখেনি।

কিন্তু সে তো কেবল এই প্রাসাদপুরীর ইট কাঠ পাথরের কথা। এই নাট্যশালার প্রতি প্রকোষ্ঠে, ঠিক এই মুহূর্তেই কত নাটকের শুরু এবং শেষ অভিনীত হচ্ছে, কে তার খোঁজ রাখে? সে-রহস্য সত্যিই যদি কোনো নিস্পৃহ সত্যানুসন্ধানীর চোখে ধরা দিত, তাহলে পৃথিবীর সাহিত্য অসীম ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হয়ে আমাদের জ্ঞানচক্ষুকে উন্মীলিত করতে সাহায্য করত।

রাত্রের এই কর্মহীন মুহূর্তের সবচেয়ে বড় কাজ বোধহয় ছড়ি হাতে করে ঘুমকে তাড়ানো, তাকে কাছে আসতে না দেওয়া। তাই চিন্তার এই বিলাসিতাটুকু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মেনে নিতে হয়। কিংবা হয়তো শাজাহনের অশরীরী আত্মা বিংশ শতাব্দীর এই আলোকোজ্জ্বল অন্ধকারে আর কাউকে না পেয়ে বেচারা রিসেপশনিস্টের উপর ভর করে, এবং তার চোখের সামনে অতীতের সোনালি সুতোয় এক নয়নাভিরাম চিন্তার জাল বুনতে শুরু করে।

এমন সময় হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। হ্যালো রিসেপশন? আমি শ্রীলেখা দেবী কথা বলছি।

শ্রীলেখা দেবী কি রাত্রে ঘুমোননি? হয়তো নিজের ঘরদোর ছেড়ে হোটেলে রাত্রি কাটাতে এসে অস্বস্তি বোধ করছেন।

শ্রীলেখা দেবী বললেন, আমার সম্বন্ধে আপনার কাছে কী ইস্ট্রাকশন আছে?

আজ্ঞে, কাউকে আপনি কত নম্বর ঘরে আছেন বলব না। এবং আপনার স্বামী যদি আসেন তাকে যেন তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

শ্রীলেখা দেবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। প্রশ্ন করলেন, কেউ কি আমার খোঁজ করতে এসেছিল?

এখন রাত্রি রয়েছে, এ-সময়ে কেউ হোটেলে আসে না।

বাজে কথা বলবেন না। হোটেলের কতটুকু দেখেছেন আপনি? মিস্টার স্যাটা বোসকে জিজ্ঞাসা করবেন। এর আগে যতবার রাগ করে চলে এসেছি, আমার স্বামী ততবার এই সময়ে এখানে এসেছেন।

এবার আমার অবাক হবার পালা। শ্রীলেখা দেবী বললেন, আপনি বাইরে একটু খোঁজ করে দেখুন তো। আমি ফোনটা ধরে রইলাম।

কাউন্টার থেকে বেরিয়ে দেখলাম, চিত্তরঞ্জন অ্যাভির উপরেই গরদের পাঞ্জাবি এবং পায়জামাপরা এক ভদ্রলোক কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ইনিই যে শ্রীলেখা দেবীর স্বামী তা সিনেমা রিপোর্টারদের ক্যামেরার কল্যাণে এদেশের কাউকে বলে দেবার প্রয়োজন নেই। বললাম, আপনি কাকে চান? ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন। আমি তো মশাই আপনার হোটেলে ঢুকিনি।

কোম্পানির রাস্তায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছি, তবু গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে এসেছেন?

ফিরে গিয়ে টেলিফোনে খবরটা শ্রীলেখা দেবীকে জানালাম। শ্রীলেখা দেবী এই সংবাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। এই খবর না পেলেই তিনি আশ্চর্য হতেন, হয়তো হতাশায় ভেঙে পড়তেন।

শ্রীলেখা দেবী বললেন, ওঁকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিতে পারেন। আমি আমাদের অসুবিধার কথা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই শ্রীলেখা দেবী বললেন, কিন্তুর কোনো প্রশ্ন নেই, আপনি ডবল রুমের চার্জ করবেন।

টেলিফোন নামিয়ে রেখে, আবার বাইরে গেলাম। ভদ্রলোক তখনও একটা থাম ধরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, এক্সকিউজ মি, বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ভিতরে আসুন।

ভদ্রলোক তার রক্তচক্ষু এবার আমার দিকে ঘোরালেন।ধন্যবাদ। ভিতরে যাবার কোনো প্রয়োজন হবে না।

এবার জানালাম, শ্রীলেখা দেবী তাকে ঘরে যেতে বলেছেন। আমি তাকে শ্রীলেখা দেবীর ঘর চিনিয়ে দিতে পারি।

যথেষ্ট হয়েছে,ভদ্রলোক উদাসীনভাবে বললেন। পকেট থেকে দেশলাই বের করে ভদ্রলোক এবার একটা বিড়ি ধরালেন। চিত্রজগতের অসামান্য তারকার স্বামীকে বিড়ি ধরাতে দেখে আমি সত্যিই একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

স্ত্রীধন্য ভদ্রলোক তাঁর রাতজাগা ঘোলাটে চোখ দুটো দিয়ে আমাকে গিলে খাবার চেষ্টা করছেন। বললেন, স্বভাবটা একটুও পাল্টাতে দিইনি। দুগগাকে নিয়ে যখন কলকাতায় এসেছিলাম, তখন দুজনে ছোট শাজাহানে খেয়ে গিয়েছি। অত সস্তায় কোথাও খেতে পাওয়া যেত না। তখনও বিড়ি খেতাম, আর এখনও আমি সেই বিড়ি খাই। দুগগাই আপনাদের শ্রীলেখা দেবী হয়েছেন, ছোট শাজাহান ছেড়ে বড় শাজাহানে এসে উঠেছেন। আমার কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ভদ্রলোক কিছুতেই ভিতরে আসতে রাজি হলেন না। সেই থেকে এই চারটে পর্যন্ত যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, তা হলে আরও কিছুক্ষণ আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হবে না। ভদ্রলোক মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

কাউন্টারে ফিরে আসতে আসতেই শুনলাম টেলিফোনটা আবার বাজছে। শ্রীলেখা দেবীর দেরিও সহ্য হচ্ছে না।হ্যালো, ওঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন?

বলতে হল, উনি আসতে রাজি হচ্ছেন না।

শ্রীলেখা দেবী আর কালবিলম্ব না করে টেলিফোন নামিয়ে দিলেন। আমি মনে মনে বললাম, এ আবার কী ব্যাপার? এই একবস্ত্রে গৃহত্যাগ, আবার রাত না কাটতেই নাটক!

তবে লোকটা কেমন অদ্ভুত ধরনের। চোখ দুটো দেখলে সত্যিই ভয় লাগে।

শ্রীলেখা দেবী যে এখনই নিজের ঘর ছেড়ে কাউন্টারে নেমে আসবেন তা আমার স্বপ্নের অগোচর ছিল। মেক-আপের বাইরে শ্রীলেখা দেবীর সেই মূর্তি আজও আমি ভুলিনি। চুল-টুল উস্কোখুস্কো। মুখেও রাতের সব ক্লান্তি জড়ো হয়ে রয়েছে। যেন স্টুডিওর সেটে কোনো হৃদয়বিদারক দৃশ্যে তিনি অভিনয় করছেন।

শ্রীলেখা দেবী বললেন, আমার ভয়-ভয় করছে। আপনি আমার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত একটু আসুন না। বলা যায় না, হয়তো সঙ্গে করে অ্যাসিড নিয়ে এসেছে আমার মুখ পুড়িয়ে দেবে।

এমন অবস্থায় হোটেলের কর্মচারীরও কাঁদতে ইচ্ছা করে। হয়তো পুলিস কেসে জড়িয়ে শ্রীঘর বাস করতে হবে। বেশ ভয় করছিল। বছরের কোনো চাঞ্চল্যকর ফৌজদারি মামলার প্রথম অঙ্ক হয়তো আমারই চোখের সামনে অভিনীত হতে চলেছে।

একবার শ্রীলেখা দেবীকে বারণ করলাম। এমন সময় বাইরে না গেলেই নয়?

শ্রীলেখা কোনো উত্তর দিলেন না। সোজা দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। আমাকে বাধ্য হয়ে তার পিছন পিছন চলতে হল।

দরজার কাছে গিয়ে শ্রীলেখা দেবী আমাকে আর যেতে বারণ করলেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম শ্রীলেখা দেবী তার স্বামীর দিকে এগিয়ে গেলেন। তার স্বামী রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শ্রীলেখা দেবী এবার স্বামীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওঁদের মধ্যে যে কী কথা হল, তা দুর থেকে আমার বোঝা সম্ভব ছিল না। হঠাৎ মনে হল শ্রীলেখা দেবী ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আর তার বিব্রত স্বামী তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন।

ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আরও বোঝবার আগেই দেখলাম ওঁরা দুজনেই কাঁদতে কাঁদতে একটা গাড়ির মধ্যে গিয়ে উঠলেন। কোনো কথা বলে, শ্রীলেখা দেবীর স্বামী গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছেন।

রাস্তার সামনে দিয়ে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পরে আমার যেন সম্বিৎ ফিরে এলো। হঠাৎ খেয়াল হল, বিলের টাকা দেবে কে? শ্রীলেখা দেবী পেমেন্ট করেননি।

ভয় হল, এই এক রাত্রির দাম হয়তো আমার মাইনে থেকেই কাটা যাবে। কারণ বিল আদায়ের দায়িত্ব আমার। বিল চাইবার কথা ওই অবস্থার মধ্যে আমার মনে একবারও উঁকি মারেনি।

মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এদিকে আলোর রেখা রাস্তার উপরে এসে পড়তে শুরু করেছে।

কালী, কালী, ব্রহ্মময়ী, মা আমার-ন্যাটাহারিবাবু গঙ্গাস্নানের জন্যে নীচেয় নেমে এসেছেন।

আমাকে দেখেই বললেন, মা-গঙ্গায় ড়ুব দেবার অভ্যেসটা করুন। না হলে পাপের অ্যাসিডে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাবেন। এই যে নিত্যহরি ভটচাজ এত পাপ ঘেঁটেও আজও মাথা উঁচু করে বালিশ বগলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা কেবল এই মাদার গ্যাঞ্জেসের জন্যে। রোজ এই নোংরা বডিটা ধুয়ে কেচে পরিষ্কার করে নিয়ে আসছি। কত ময়লা লাগবে লাগুক না।

আমি চুপ করে রইলাম। নিত্যহরিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, গরিব বামুনের কথা বাসি না হলে মিষ্টি লাগবে না। মা জননীকেও কতবার বলেছিলাম, যাই করো মা, সকালে মা-গঙ্গাকে একটা পেন্নাম ঠুকে এসো। তা মা আমার কথা শুনলেন না। ইংরেজি শেখা গেরস্ত ঘরের মেয়ে কপালদোষে পাপস্থানে এসেছিল।

ন্যাটাহারিবাবু চোখ দুটো হঠাৎ ধ ধ করে জ্বলতে আরম্ভ করল। আমি কে বলুন তো মশাই? সাতকুলে তোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, শুধু লিনেন সাপ্লাই করেছি। তা বাবা, থেকে থেকে আমাকেই স্বপ্নে দেখা দেওয়া কেন?

হয়তো আপনি তাকে ভালোবাসতেন, তিনিও হয়তো আপনাকে ভালোবাসতেন, আমি বললাম।

ন্যাটাহরিবাবুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল, তার সযত্নে ঢাকা বেদনাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। এত বোকা জাত, মশাই দুনিয়ায় দেখিনি। বিষ খাওয়া কী কথা গো? আমার বউ-সে মাগিও বিষ খেয়ে মরেছিল। রাত্রে বাড়ি ফিরিনি বলে। মাকে বলেছিলুম-শিখ পাঞ্জাবিতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, মা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু বউ আমার বিশ্বাস করলে না। বললে, তোমার মুখে কিসের গন্ধ? বললাম, অনিয়নের গন্ধ।

অনিয়ন? সে আবার কী?বুদ্ধিমতী মেয়ে বোকার মতো প্রশ্ন করলে। রেগে বললাম, অনিয়ন মানে পেঁয়াজ, বাপ তো তোমায় কিছুই শেখায়নি।

তখনও মুখে আমার ভকভক করে দেশি মালের গন্ধ ছাড়ছে। আমার নিজেরই বমি আসবার উপক্রম। বুদ্ধিমতী মেয়ে, ছোটবেলা থেকে অনিয়ন দেখে আসছে, সব বুঝতে পারলে। তারপর ওদের এক অস্ত্র। আমাকে সংশোধন করবার একটা সুযোগও দিলে না। দুনিয়ার মেয়েদের মশায় আর কোনো ক্ষমতা নেই, শুধু বিষ খেতে জানে।

সেই থেকেই ভুগছি। সেই মহাপাপে বাউনের ছেলে সোপার ময়লা দুহাতে ঘেঁটে মরছে। আরও খারাপ হত, হয়তো মাথায় বজ্রাঘাত হত, কিন্তু মা-গঙ্গা রক্ষা করছেন।

ন্যাটাহারিবাবু এবার নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলেন। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। আমার হাতটা তিনি জোরে চেপে ধরলেন। করুণভাবে, পরম স্নেহে বললেন, খুব সাবধান, বাবা। কার কপালে ভগবানের অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট গুপ্ত সায়েব যে কী লিখে রেখেছেন, কেউ জানে না।

ন্যাটাহারিবাবু বিদায় নিলেন। অস্বস্তিতে আমার মন ভরে উঠল। এতদিনে ন্যাটাহারিবাবুকে যেন চিনতে পারলাম। এক সুদীর্ঘ দুঃস্বপ্নের রাত যেন আমি কোনোরকমে পেরিয়ে এলাম। কিছুতেই আর কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ইচ্ছা করছিল না।

বেয়ারাকে ডেকে তুলে বললাম, তুমি একটু পাহারা দাও, আমি আসছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *