০১. ওরা বলে এসপ্ল্যানেড, আমরা বলি চৌরঙ্গী

চৌরঙ্গী

উৎসর্গ
আমার সাহিত্যজীবনের প্রযোজক, পরিচালক ও সুরকার শ্ৰীশঙ্করীপ্রসাদ বসুকে।
–শংকর

চৌরঙ্গী লেখবার প্রথম অনুপ্রেরণা যাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম সেই শ্রদ্ধেয় বিদেশি এখন পরলোকে। জীবিত এবং মৃত, দেশি এবং বিদেশি, পরিচিত এবং অপরিচিত অনেকে প্রকাশ্যে এবং নেপথ্যে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাদের সকলের উদ্দেশে আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার রইল।
–শংকর ১০ জুন, ১৯৬২

Our life is but a winters day : Some only breakfast and away; Others to dinner stay and are full fed; The oldest man but sups and goes to bed; He that goes sounest has the least to pay.
–A. C. Maffen

 

০১.

ওরা বলে—এসপ্ল্যানেড্‌। আমরা বলি—চৌরঙ্গী। সেই চৌরঙ্গীরই কার্জন পার্ক। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরটা যখন আর নড়তে চাইছিল না, তখন ওইখানেই আশ্রয় মিলল। ইতিহাসের মহামান্য কার্জন সায়েব বাংলাদেশের অনেক অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন। সুজলা-সুফলা এই দেশটাকে কেটে দুভাগ করবার বুদ্ধি যেদিন তার মাথায় এসেছিল, আমাদের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস নাকি সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে তো অনেক দিন আগেকার কথা। বিশ শতকের এই মধ্যাহ্নে মে মাসের রৌদ্রদগ্ধ কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আমি ইতিহাসের বহুধিকৃত সেই প্রতিভাদীপ্ত ইংরেজ রাজপুরুষকে প্রণাম করলাম; তার পরলোকগত আত্মার সদ্গতি প্রার্থনা করলাম। আর প্রণাম করলাম রায় হরিরাম গোয়েঙ্কা বাহাদুর কে টি, সি আই ই-কে। তার পায়ের গোড়ায় লেখা-Born June 3, 1862. Died February 28, 1935.

 

আমাকে মনে আছে কি? অনেক দিন আগে কাসুরে এক অপরিণত-বুদ্ধি বালক বিভূতিদার হাত ধরে রামকেষ্টপুর ঘাট থেকে অম্বা স্টিমারে গঙ্গা পেরিয়ে হাইকোর্ট দেখতে এসেছিল। সায়েব ব্যারিস্টারের কাছে চাকরি পেয়েছিল সে। ছোকাদার স্নেহ পেয়েছিল। জজ, ব্যারিস্টার, মক্কেল সবার ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে সে প্রাণভরে বাবুগিরি করেছিল, আর দুটি বিস্মিত চোখ দিয়ে এক অপরিচিত জগতের রূপ রস গন্ধ উপভোগ করেছিল।

দুঃখ আর দৈন্যের অন্তহীন মরুভূমির মধ্যে বিশ্বপ্রেমিক বিদেশির মরূদ্যানে আশ্রয় পেয়ে, আমার ক্লান্ত প্রাণ অকস্মাৎ অতীতকে ভুলে গিয়েছিল। ভেবেছিল, এ আশ্রয় বুঝি চিরকালের। কিন্তু সংসারের সদা-সতর্ক অডিটররা হিসেবে ভুল ধরার জন্য সর্বদাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমারও ভুল ধরা পড়তে দেরি হলো না। সায়েব চোখ বুজলেন। মরূদ্যানের তবু আমাদের মতো অভাগাদের কল্যাণে, সামান্য ঝড়েই ধ্বংস হয়ে গেল। আবার চলো। ফরওয়ার্ড মার্চ—বিজয়ী বিধাতার হৃদয়হীন সেনাপতি পরাজিত বন্দিকে হুকুম দিলেন। প্রাণ না চাইলেও, আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মনটাকে ক্লান্ত দেহের ঠেলাগাড়িতে চড়িয়ে আবার যাত্রা শুরু করতে হলো। Onward! Dont look back-সামনে সামনে। পিছনে তাকিও না।

আমার পিছনে এবং সামনে কেবল পথ। যেন রাত্রের অন্ধকারে ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের অচেনা সরাইখানায় আশ্রয় পেয়েছিলাম। এখন ভোরের আলোয় পথকে আবার ঘর করেছি। হাইকোর্টের বাবুরা এসেছিলেন। চোখের জল ফেলেছিলেন। ছোকাদা বলেছিলেন, আহা, এই বয়সে স্বামী হারালি! একেবারে কাঁচা বয়েস।

আমি কিন্তু কাদিনি। একটুও কাঁদিনি। বজ্রাঘাতে আমার চোখের সব জল যেন ধোয়া হয়ে গিয়েছিল।

ছোকাদা কাছে ডেকে বসিয়েছিলেন। শিখের দোকান থেকে চা আনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বুঝি ভাই, সব বুঝি। কিন্তু এই পোড়া পেটটা যে কিছুই বুঝতে চায় না। সামান্য যা হয় কিছু মুখে দে, শরীরে বল পাবি।

ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে সেই আমার শেষ চা-খাওয়া। ছোকাদা অবশ্য বলেছিলেন, ভাবিস না, এই পাড়াতেই কিছু একটা জুটে যাবে। তোর মতো বাবুকে কোন সায়েবের না রাখতে ইচ্ছে হয় বল? তবে কিনা এক স্ত্রী থাকতে, অন্য কাউকে নেওয়া। সবারই তো বাবু রয়েছে।

জোর করে কথা বলা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু সেদিন চুপ করে থাকতে পারিনি। জোর করেই বলেছিলাম, ছোকাদা, আমি পারব না। চাকরি পেলেও এ-পাড়ায় আর থাকতে পারব না।

ছোকাদা, অর্জুনদা, হারুদা সবাই সেদিন আমার দুঃখে অভিভূত হয়েছিলেন। বিষণ্ণ ছোকাদা বলেছিলেন, আমাদের দ্বারা তো হল না। যদি কেউ পারে তো তুই পারবি। পালিয়ে যা—আমরা জানব এই সর্বনাশা গোলকধাঁধা থেকে অন্তত একজনও বেরিয়ে যেতে পেরেছে।

ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, আমিও টিফিন কৌটো সমেত কাপড়ের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পশ্চিম আকাশের বিষণ্ণ সূর্য সেদিন আমার চোখের সামনেই অস্ত গিয়েছিল।

 

কিন্তু তারপর? সেদিন কি আমি জানতাম, জীবন এত নির্মম? পৃথিবী এত কঠিন, পৃথিবীর মানুষরা এত হিসেবি?

চাকরি চাই। মানুষের মতো বেঁচে থাকবার জন্যে একটা চাকরি চাই। কিন্তু কোথায় চাকরি?

ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট হাতে কয়েকজন পরিচিতের সঙ্গে দেখা করেছি। প্রচুর সহানুভূতি দেখিয়েছেন তারা। আমার আকস্মিক ভাগ্যবিপর্যয় তাদের প্রাণে যে কত আঘাত দিয়েছে তাও জানিয়েছেন। কিন্তু চাকরির কথাতেই আঁতকে উঠেছেন। বলেছেন, দিনকাল বড়ই খারাপ। কোম্পানির ফাইনান্সিয়াল অবস্থা হ্যাপি নয়। তবে ভেকান্সি হলে নিশ্চয়ই খবর পাঠাবেন।

আর এক আপিসে গিয়েছি। ওঁদের দত্ত সায়েব এক সময় বিপদে পড়ে আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আমারই অনুরোধে সায়েব বিনা ফিতে তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

কিন্তু দত্ত সায়েব দেখা করলেন না। স্লিপ হাতে বেয়ারা ফিরে এল। সায়েব আজ বড়ই ব্যস্ত। দেখা করতে না পারার জন্য স্লিপের উপর পেন্সিলে আফসোস প্রকাশ করেছেন। এবং আগামী কয়েক সপ্তাহ যে তিনি কর্মব্যস্ত থাকবেন এবং যথেষ্ট ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার সুমধুর সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারবেন না, তাও জনিয়ে দিয়েছেন।

বেয়ারা বলেছিল, চিঠি লিখিয়ে। লজ্জার মাথা খেয়ে চিঠি লিখেছিলাম। বলা বাহুল্য, উত্তর আসেনি।

আরও অনেক আবেদনপত্র পাঠিয়েছি। পরিচিত, অপরিচিত, বক্স নম্বর, অনেকের কাছেই আমার গুণাবলীর সুদীর্ঘ বিবরণ পেশ করে পত্র দিয়েছি। কিন্তু সরকারি পোস্টাপিসের রোজগার বৃদ্ধি ছাড়া তাতে আর কোনো সুফল হয়নি।

হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করিনি কোনোদিন। সামান্য যা পুঁজি ছিল তাও শেষ হয়ে এল। এবার নিশ্চিত উপবাস।

হা ঈশ্বর! কলকাতার হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টারের শেষ বাবুর কপালে এই লেখা ছিল?

 

ফেরিওয়ালার কাজ পাওয়া গেল অবশেষে। ভদ্রভাষায় নাম সেলসম্যান। ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট বিক্রি করতে হবে আপিসে। কোম্পানির নাম শুনলে শ্রদ্ধায় আপনার মাথা নত হয়ে আসবে। ভাববেন, ম্যাগপিল অ্যান্ড ক্লার্ক কোম্পানিটি বার্মাশেল, জার্ডিন হেন্ডারসন বা অ্যান্ড্রু ইউলের সমপর্যায়ের। কিন্তু এই কোম্পানির কর্ণধার এম জি পিল্লাই নামক মাদ্রাজি ছোকরার দুটো প্যান্ট ও একটা নোংরা টাই ছাড়া আর বিশেষ কিছুই ছিল না। ছাতাওয়ালা লেনের এক অন্ধকার বাড়ির একখানা ঘরে তার ফ্যাক্টরি, আপিস, শো রুম, মায় শোয়ার এবং রান্নার ঘর। এম জি পিল্লাই ম্যাগপিল হয়েছেন। আর ক্লার্ক সায়েব? উনি কেউ নন, ম্যাগপিলের ক্লার্ক!

তারের পাকানো ঝুড়িগুলো আমাকে বিক্রি করতে হবে। টাকায় চার আনা কমিশন। প্রতি ঝুড়িতে চার আনা। সে যেন আমার কাছে স্বর্গ।

কিন্তু তাও বিক্রি হয়নি। ঝুড়ি হাতে আপিসে আপিসে ঘুরেছি, আর বাবুদের টেবিলের তলায় তাকিয়েছি। অনেকে সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন, ওখানে কী দেখছো?

বলেছি, আজ্ঞে, আপনার ছেঁড়া-কাগজ ফেলবার ঝুড়িটা।

সেটা জরাজীর্ণ দেখলে কি আনন্দই যে হয়েছে। বলেছি, আপনার ঝুড়িটার আর কিছুই নেই। একটা নতুন নিন না, স্যর। খুব ভালো জিনিস। একটা কিনলে দশ বছর নিশ্চিন্ত।

বড়বাবু ঝুড়িটার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেছেন, কন্ডিশন তো বেশ ভালোই রয়েছে। এখনও হেসে-খেলে বছরখানেক চলে যাবে।

বড়বাবুর মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে থেকেছি। কিন্তু আমার মনের কথা তিনি বুঝতে পারেননি। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছে, ঝুড়িটার

হয় হেসে-খেলে আরও বছরখানেক চলে যাবে। কিন্তু আমার? আমার যে আর একদিনও চলতে চাইছে না।

কিন্তু বলার ইচ্ছে থাকলেই চার্নক সায়েবের এই আজব শহরে সব কিছু বলা যায় না। তাই নীরবে বেরিয়ে আসতে হয়েছে।

স্যুট-পরা, টাই-বাঁধা বাঙালি সায়েবদের সঙ্গেও দেখা করেছি। জুতোর ডগাটা নাড়তে নাড়তে সায়েব বলছেন, ভেরি গুড। ইয়ং বেঙ্গলিরা যে বিজনেস লাইনে এন্টার করছে এটা খুবই আশার কথা।

বলেছি, আপনাকে তাহলে কটা দেব, স্যর?

স্যর আমার দিকে তাকিয়ে একটুও দ্বিধা না করে বলেছেন, আমার ছটা দরকার। কিন্তু দেখবেন আমাদের শেয়ারের কথাটা যেন ভুলে যাবেন না।

ছটা ঝুড়ি বিক্রি করে আমার দেড় টাকা লাভ। বিক্রির টাকা পেয়ে, সেই দেড় টাকা হতে নিয়ে বলেছি, ছটা ঝুড়িতে আমার এই থাকে স্যর। আপনার যা বিচার হয় নিন।

সিগারেট টানতে টানতে সায়েব বলেছেন, অন্য কারুর কাছে পারচেজ করলে ইজিলি থার্টি পারসেন্ট পেতাম। তা হাজার হোক আপনি বেঙ্গলি, সুতরাং টোয়েন্টিফাইভই নিলাম। এই বলে পুরো দেড়টা টাকাই আমার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছেন। তারপর দুঃখ করেছেন, আমাদের জাতের অনেষ্টি বলে কিছু নেই। এর মধ্যেই বেশ এক্সপার্ট হয়ে উঠেছেন তো। কী করে বললেন যে ছটা ঝুড়িতে আপনার দেড় টাকার বেশি থাকবে না? আমরা কি grass-এ মুখ দিয়ে চরি?

কোনো উত্তর না দিয়েই সেদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। অবাক হয়ে এই অদ্ভুত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থেকেছি।

আশ্চর্য। এই পৃথিবীকেই একদিন কত সুন্দর বলে মনে হয়েছিল আমার। এই পৃথিবীতেই আমি একদিন মানুষকে শ্রদ্ধা করতাম। বিশ্বাস করতাম, মানুষের মধ্যেই দেবতা বিরাজ করেন। হঠাৎ মনে হল, আমি একটি গর্দভ। সংসারের সংখ্যাহীন আঘাতেও আমার শিক্ষা হয়নি। আমার জ্ঞান-চক্ষু কি কোনোদিন উন্মীলিত হবে না? না না, অসম্ভব। আমাকে চালাক হয়ে উঠতেই হবে।

সত্যিই আমি চালাক হয়ে উঠলাম। এক টাকার ঝুড়ির দাম বাড়িয়ে পাঁচ-সিকে বলেছি। যিনি কিনলেন তাকে বিনা দ্বিধায় চার আনা পয়সা দিয়ে বলেছি, কিছুই থাকে না, স্যর। যা কম্পিটিশনের মার্কেট। টিকে থাকার জন্যে উইদাউট মার্জিনেই বিজনেস করছি।

মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছি বটে, কিন্তু তাতে কোনো কষ্ট হয়নি আমার। শুধু মনে হয়েছে, স্বার্থান্ধ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, আমি একা। আমাকে নিজের বুদ্ধি দিয়ে, চালাকি করে বেঁচে থাকতে হবে, পথ তৈরি করতে হবে, এবং এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের কোনো আনন্দের আয়োজনে আমরা নিমন্ত্রিত অতিথির সমাদর পাব না, সুতরাং প্রয়োজন মতো জোর করেই ভাগ বসাতে হবে।

সেই সময়েই একদিন ডালহৌসি স্কোয়ারের একটা আপিসে গিয়েছিলাম।

মে মাসের কলকাতা। রাস্তার পিচ পর্যন্ত টগবগ করে ফুটছে। দুপুরের রাজপথ মধ্যরাতের মতো জনমানবহীন। শুধু আমাদের মতো কিছু হতভাগা তখনও যাতায়াত করছে। তাদের থামলে চলবে না। তারা এ-আপিস থেকে ও-আপিসে যাচ্ছে, আর ও-আপিস থেকে এ-আপিসে আসছে, যদি কোথাও কিছু জুটে যায়।

ঘামে গায়ের জামাটা ভিজে উঠেছিল—যেন সবেমাত্র লালদীঘিতে ড়ুব দিয়ে উঠে এসেছি। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। পথের ধারে ঘোড়াদের জল খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে দেখলাম। কিন্তু আমাদের জন্য কিছু নেই। বেকার ক্লেশ নিবারণ তো আর পশু ক্লেশ নিবারণ সমিতির দায়িত্ব নয়, সুতরাং তাদের দোষ দিতে পারিনি।

একটা বড় বাড়ি দেখে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। সামনেই লিফ্ট। লিফটে উঠে হাঁপাচ্ছি। গেট বন্ধ করে লিফটম্যান হাতল ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু হঠাৎ তার নজরে পড়ল, আমার হাতে দুটো ঝুড়ি। এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়েই অভিজ্ঞ লিফ্টম্যানের বুঝতে বাকি রইল না আমি কে। সুতরাং আবার হাতল ঘুরল, লিফ্ট আবার স্বস্থানে ফিরে এল।

আঙুল দিয়ে সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়ে লিক্টম্যান আমাকে বের করে দিয়েছিল। এবং তার আগে জানিয়ে দিয়েছিল, এই লিষ্ট কেবল সায়েব এবং বাবুদের জন্যে। তোমার মতো নবাববাহাদুরদের সেবা করবার জন্যে কোম্পানি আমাকে মাইনে দিয়ে রাখেনি।

সত্যিই তো, আমাদের মতো সামান্য ফেরিওয়ালার জন্যে কেন লিফট হতে যাবে? আমাদের জন্যে তো পাকানো সিঁড়ি রয়েছে, হেঁটে হেঁটে উপর-তলায় উঠে যাও।

তাই করেছি। কোনো অভিযোগ করিনি—নিজের অদৃষ্টের কাছেও নয়। ভেবেছি, সংসারের এই নিয়ম। উপরে উঠবার লিষ্ট সবার জন্যে নয়।

দিনটাই খারাপ আজ। একটাও বিক্রি হয়নি। অথচ তিন আনা খরচ হয়ে গিয়েছে। এক আনা সেকেন্ড ক্লাশের ট্রামভাড়া, এক আনার আলু-কাবলি। তারপর আর লোভ সামলাতে পারিনি। বেপরোয়া হয়ে এক আনার ফুচকা খেয়ে ফেলেছি। খুব অন্যায় করেছি। ক্ষণেকের দুর্বলতায় এক আনা পয়সা উড়িয়ে দিয়েছি।

আপিসে ঢুকে টেবিলের তলায় তাকিয়েছি। সব টেবিলের তলায় ঝুড়ি রয়েছে। দরজার গোড়ায় এক প্রৌঢ়া মেমসায়েব কাজ করছিলেন। আমাকে দেখেই বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাই?

বললাম, ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট। ভেরি গুড ম্যাডাম। ভেরি স্ট্রং, অ্যান্ড ভেরি ভেরি ডেউরেবল।

কিন্তু বক্তৃতা কাজে লাগল না। মেমসায়েব তাড়িয়ে দিলেন। ক্লান্ত পা দুটোকে কোনোরকমে চালিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

আপিসের দরজার সামনে বেঞ্চিতে বসে ইয়া গোঁফওয়ালা এক হিন্দুস্থানি দারোয়ান খৈনি টিপছিলেন। মাথায় তার বিরাট পাগড়ি। পরনে সাদা তকমা। বুকের কাছে ঝকঝকে পিতলের পাতে কোম্পানির নাম জ্বল জ্বল করছে

দারোয়ানজি আমাকে পাকড়াও করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, একটা ঝুড়ি বিক্রি করলে আমার কত থাকে।

বুঝলাম দারোয়ানজির আগ্রহ আছে। বললাম, চার আনা লাভ থাকে।

ঝুড়ির দাম জিজ্ঞাসা করলেন দারোয়ানজি। এবার আর বোকামি করিনি। সোজাসুজি বললাম, পাঁচ সিকে।

দারোয়ানজি আমার হাতের ঝুড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। সুযোগ বুঝে নিবেদন করলাম, খুব ভালো মানা, একটা কিনলে দশ বছর নিশ্চিন্ত থাকা যাবে।

ঝুড়িটা হাতে করে দারোয়ানজি এবার আপিসের ভিতরে ঢুকে গেলেন। মেমসায়েব বললেন, আমি তো বলে দিয়েছি ঝুড়ির দরকার নেই। দারোয়ানজি কিন্তু ছাড়বার পাত্র নন। সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, ঘোষবাবুর ঝুড়ি নেই। মিত্তিরবাবুর ঝুড়ি ভেঙে গিয়েছে। বড়সায়েবের ঝুড়িরও রং চটে গিয়েছে। ইস্টক মে ভি দো চারঠো রাখনে কো জরুরৎ রয়েছে।

সুতরাং মেমসায়েবকে হার মানতে হল। আমার একসঙ্গে ছটা ঝুড়ির অর্ডার মিলল।

প্রায় লাফাতে লাফাতে ছাতাওয়ালা লেনে ফিরে এসেছি। আধ ডজন তারের ঝুড়ি এক সঙ্গে বেঁধে, মাথায় করে আপিসে চলে এলাম। দারোয়ানজি বাইরেই বসেছিলেন। আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন।

ঝুড়িগুলো স্টকে পাঠিয়ে দিয়ে, মেমসায়েব বললেন, টাকা তো আজ পাওয়া যাবে না। বিল বানাতে হবে।

ফিরে আসছিলাম। দারোয়ানজি গেটে ধরলেন। রুপেয়া মিলা?

বোধহয় ভেবেছেন, আমি ভাগ না দিয়েই পালাচ্ছি। বললাম, আজ মিলল না।

কাহে? দারোয়ানজি আবার উঠে পড়লেন। সোজা মেমসায়েবের টেবিলে। কথাবার্তায় প্রচুর অভিজ্ঞতা দারোয়ানজির। বললেন, মেমসাব, গরিব আদমী। হরেক আপিস মে যানে পড়তা।

এবার আমার ডাক পড়ল। দারোয়ানজি বীরদর্পে বললেন, পেমেন্টে করোয়া দিয়া। একটা ভাউচারের কাগজ এগিয়ে দিয়ে দারোয়ানজি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি সই করতে জানি কিনা। সই না জানলে টিপসই লাগাতে পারি।

আমাকে ইংরেজিতে সই করতে দেখে দারোয়ানজি রসিকতা করলেন, আরে বাপ, তুম আংরেজি মে দস্তখত্ কর দিয়া?

টাকাটা হাতে করে বেরিয়ে এলাম। দারোয়ানজিদের আমার চেনা আছে। কমিশনের ভাগ দিতে হবে। এবং সে ব্যবস্থা তো আমি আগে থেকেই করে রেখেছি।

দারোয়ানজি আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমিও প্রস্তুত ছিলাম। দেড় টাকা ওঁর দিকে এগিয়ে বললাম, এই আমার কমিশন। যা ইচ্ছে হয়…।

সঙ্গে সঙ্গে এমন যে হতে পারে আমার জানা ছিল না। দারোয়ানজির সমস্ত মুখে কে যেন কালি ছিটিয়ে দিল। আমার বেশ মনে আছে, বিশাল বনস্পতির মতো ওঁর দীর্ঘদেহটা হঠাৎ কাঁপতে আরম্ভ করল। রাগে, অপমানে সমস্ত মুখ কুঞ্চিত হয়ে উঠল।

আমি ভাবলাম, বোধহয় ভাগ পছন্দ হয়নি। বলতে যাচ্ছিলাম, বিশ্বাস করুন, দারোয়ানজি, ছটা ঝুড়িতে আমার দেড় টাকার বেশি থাকে না।

কিন্তু আমার ভুল ভাঙল। শুনতে পেলাম, দারোয়ানজি বলছেন, কেয়া সমঝা তুম?

দারোয়ানজিকে আমি ভুল বুঝেছি। কেয়া সমঝা তুম? তুমকো দেখকে হামারা দুখ হুয়া।…তুমি ভেবেছো কি? পয়সার জন্য তোমার ঝুড়ি বিক্রি করে দিয়েছি! রাম রাম!

সেদিন আর চোখের জল থামিয়ে রাখতে পারিনি। পৃথিবী আজও তাহলে নিঃস্ব হয়নি। দারোয়ানজির মতো মানুষরা আজও তাহলে বেঁচে আছেন!

দারোয়ানজি আমাকে কাছে বসিয়েছিলেন। ভাঁড়ে করে চা খাইয়েছিলেন। চা খেতে খেতে আমার পিঠে হাত রেখে দারোয়ানজি বলেছিলেন, খোকাবাবু, ভয় পেও না। স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার নাম শুনেছ? যাঁর ব্রোঞ্জমূর্তি লাট সায়েবের বাড়ির সামনে রয়েছে? তিনিও তোমার মতো একদিন অনেক দুঃখ পেয়েছিলেন।

দারোয়ানজি বলছিলেন, বাবুজি, তোমার মুখে চোখে আমি সেই আগুন দেখতে পাচ্ছি। তুমিও একদিন বড় হবে, স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার মতো বড়।

দারোয়ানজির মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থেকেছি। চোখের জলকে তখনও সংযত করতে পারিনি।

যাবার আগে দারোয়ানজি বলেছিলেন, মনে রেখো, উপরে যিনি রয়েছেন, তিনি সর্বদাই আমাদের দেখছেন। সৎপথে থেকে তাঁকে সন্তুষ্ট রেখো। তাকে ঠকিও না।

সেদিনের কথা ভাবতে গেলে, আজও আমি কেমন হয়ে পড়ি। সংসারের সুদীর্ঘ পথে কত ঐশ্বর্য, কত চাকচিক্যের অন্তহীন সমারোহই তো দেখলাম। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, সুখ, সম্পদ, স্বাচ্ছন্দ্য আজ আমার আয়ত্তের বাইরে নয়। সমাজের যাঁরা প্রণম্য, ভাবীকালের জন্য যারা বর্তমানের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন; শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্যের মাধ্যমে যাঁরা আমাদের যন্ত্রণাময় যুগকে ব্যাধিমুক্ত করার সাধনা করেছেন, তাদের অনেকের নিকটসান্নিধ্যলাভের বিরল সুযোগও আজ আমার করায়ত্ত। কিন্তু ক্লাইভ বিল্ডিংয়ের অখ্যাত আপিসের সেই অখ্যাত দারোয়ান আজও আমার আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে রইলেন। সেই দীর্ঘদেহী পশ্চিমা মানুষটির স্মৃতি কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারলাম না।

 

ওঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে মনে হল দায়োয়ানজী আমাকে বিশ্বাস করলেন, অথচ আমি মিথ্যেবাদী, আমি চোর। প্রতিটি ঝুড়ির জন্য আমি চার আনা বেশি নিয়েছি। আমি তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখিনি।

ডালহৌসি থেকে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এসেছি চৌরঙ্গীর কার্জন পার্কে। যাদের আপিস নেই, অথচ আপিস যাবার তাগিদ আছে; যাদের আশ্রয় নেই, অথচ আশ্রয়ের প্রয়োজন আছে; সেই সব হতভাগ্যের দুদণ্ডের বিশ্রাম স্থল এই কার্জন পার্ক। সময় এখানে যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এখানে গতি নেই, ব্যস্ততা নেই, উৎকণ্ঠা নেই। সব শান্ত। ঘাসের ঘনশ্যাম বিছানায় গাছের ছায়ায় কত ভবঘুরে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে। এক জোড়া কাক স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার কাঁধে চুপচাপ বসে আছে।

যাঁদের অকৃপণ দাক্ষিণ্যে কার্জন পার্ক তৈরি হয়েছিল, মনে মনে তাদের প্রণাম জানালাম, কার্জন সায়েবকেও বাদ দিলাম না।

আর স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা? মনে হল, তিনি যেন আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

তাঁর পদতলে বসে আমার ঠোঁট থর থর করে কেঁপে উঠল। হাত জোড় করে সভয়ে বললাম, স্যর হরিরাম, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার কোনো দোষ নেই। ক্লাইভ স্ট্রিটের এক স্বল্পবুদ্ধি নিরক্ষর দারোয়ান আমার মধ্যে আপনার ছায়া দেখেছে। আমার কোনো হাত ছিল না তাতে। বিশ্বাস করুন, আপনাকে অপমান করার কোনো অভিসন্ধিই ছিল না আমার।

কতক্ষণ একভাবে বসেছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আপিসের ফাঁকিবাজ ছো্করা কেরানির মতো সূর্যও কখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের দপ্তর গুটিয়ে ফেলে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছেন। শুধু আমি বসে আছি।

আমার কী আছে?

আমি কোথায় যাব?

 

হ্যাল্লো স্যর। হঠাৎ চমকে উঠলাম।

আমারই সামনে অ্যাটাচি কেস হাতে কোট-প্যান্ট-পরা এক সায়েব দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গায়ের রং আমার থেকেও কালো। (মা নিতান্ত স্নেহবশেই আমাকে উজ্জ্বল শ্যাম বলতেন।)

অ্যাটাচি কেসটা দেখেই চিনেছি। বায়রন সায়েব। পার্কের মধ্যে আমাকে ঘুমোতে দেখে বায়রন সায়েব অবাক হয়ে গিয়েছেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বায়রন সায়েব বললেন, বাবু!

বায়রন সায়েবের আশ্চর্য হয়ে যাবারই কথা। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে আমার প্রতিপত্তি এক সময় তিনি তো নিজের চোখেই দেখেছেন।

সেই দিনটার কথা আজও ভুলিনি। বেশ মনে আছে, চেম্বারে বসে টাইপ করছিলাম। এমন সময় অ্যাটাচি কেস হাতে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। আবলুস কাঠের মতো রং। কিন্তু সে রংয়েরও কেমন একটা জেল্লা আছে—ঠিক যেন ধর্মতলা স্ট্রিটে চার-আনা-দিয়ে-রং-করা সু।

সায়েব প্রথমেই আমাকে সুপ্রভাত জানালেন। তারপর আমার বিনা অনুমতিতেই সামনের চেয়ারে এমনভাবে বসে পড়লেন, যেন আমাদের কতদিনের আলাপ। চেয়ারে বসেই পকেটে হাত ঢোকালেন, এবং এমন এক ব্র্যান্ডের সিগারেট বার করলেন যার প্রতি প্যাকেট সেই দুর্মূল্যের বাজারেও সাত পয়সায় বিক্রি হত।

সিগারেটের প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, একটা ট্রাই করে দেখুন।

আমি প্রত্যাখ্যান করতেই হা-হা করে হেসে উঠলেন। এই ব্রান্ড বুঝি আপনার পছন্দ হয় না? আপনি বুঝি খুব ফেথফুল? একবার যাকে ভালোবেসে ফেলেন, তাকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেন না!

প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, উনি বোধহয় ওই সিগারেট কোম্পানির সেলসম্যান। কিন্তু, আমার মতো অরসিকের কাছে রস নিবেদন করে যে লাভ নেই, এই বক্তব্যটি যখন পেশ করতে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি আবার মুখ খুললেন, কোনো কে আছে নাকি?

কে? আমরাই তো অন্য লোকের কাছ থেকে কে নিয়ে থাকি। আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে, বায়রন সায়েব নিজেই বললেন, যে কোনো পারিবারিক বা ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের প্রয়োজন হলে আমাকে পাওয়া যেতে পারে।

বায়রন আরও বললেন, এনি কেস্। সে কেস্ যতই জটিল এবং রহস্যময় হোক না কেন, আমি তাকে জলের মতো তরল এবং দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ করে দেব।

আমি বললাম, আমার হাতে এখন কোনো কেস্‌ নেই।

টুপিটা মাথায় চড়িয়ে বায়রন উঠে পড়লেন। দ্যাটস্ অল রাইট। দ্যাটস অল রাইট। কিন্তু কেউ বলতে পারে না—কবে, কখন আমাকে দরকার পড়বে। তোমার দরকার না পড়ুক, তোমার ফ্রেন্ডদের দরকার পড়তে পারে।

সেই জন্যই বায়রন সায়েব আমাকে একটা কার্ড দিলেন। ওঁর নাম লেখা আছে–B. Byron, your friend in need. টেলিফোন নম্বর : তার পাশেই লম্বা দাগ। কিন্তু কোনো নম্বর নেই।

বায়রন বললেন, টেলিফোন এখনও হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে হবেই। সেই জন্যে জায়গা রেখে দিয়েছি।

বায়রন বলেছিলেন, হবে, ক্রমশ আমার সব হবে। শুধু টেলিফোন কেন, গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, মস্ত আপিস হবে। বাবু, ইউ ডোন্ট নো, প্রাইভেট ডিটেটিভ তেমন ভাবে কাজ করলে কী হতে পারে; তোমাদের চিফ জাস্টিসের থেকেও সে বেশি রোজগার করতে পারে।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ! এতদিন তো এঁদের কথা শুধু বইতেই পড়ে এসেছি। বর্ণ-পরিচয়ের পর থেকেই কৈশোরের শেষ দিন পর্যন্ত এই শখের গোয়েন্দাদের অন্তত হাজারখানেক কাহিনি গোপনে এবং প্রকাশ্যে গলাধঃকরণ করেছি। ছাত্রজীবনে যে নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে ব্যোমকেশ, জয়ন্ত-মানিক, সুব্রত-কিরীটি ও ব্লেক-স্মিথের পুজো করেছি, তার অর্ধেকও যদি যাদব চক্রবর্তী, কে পি বসু, আর নেসফিল্ডের সেবায় ব্যয় করতাম, তাহলে আজ আমার এই দুর্দশা হত না। কিন্তু এতদিন কেবল আমারই মনোরাজ্যে এই সব সত্যানুসন্ধানী রহস্যভেদীরা বিচরণ করতেন। এই মরজগতে—এই কলকাতা শহরেই যে তারা সশরীরে ঘোরাফেরা করেন তা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।

পরম বিস্ময় ও শ্রদ্ধা সহকারে বায়রন সায়েবকে আবার বসতে অনুরোধ করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, চা পানে আপত্তি আছে কি না।

একবার অনুরোধেই উনি রাজি হলেন। চা-এর কাপটা দেড় মিনিটে নিঃশেষ হয়ে গেল। বিদায় নেবার আগে বায়রন বললেন, আমাকে তা হলে ভুলো না।

আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গোয়েন্দাদের আবার কাজের জন্য লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াতে হয় নাকি? আমি তো জানি, গোয়েন্দা যখন ভোরবেলায় লেক প্লেসের বাড়িতে টোস্ট এবং ওমলেট সহযোগে চা খেতে খেতে সহকারীর সঙ্গে গল্প করতে থাকেন, তখন হঠাৎ টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বাজতে আরম্ভ করে। একটু বিরক্ত হয়েই নরম সোফা থেকে উঠে এসে রহস্যভেদী টেলিফোন ধরেন। তখন তাকে শিবগড় মার্ডার কেস্ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। নিহত রাজাবাহাদুরের বিধবা মহিষী কিংবা তার একমাত্র কন্যা নিজে করুণ কণ্ঠে রহস্যভেদীকে অনুনয় করেন, এই কেল্টা আপনাকে নিতেই হবে। টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আপনি যা চাইবেন তাই দেব।

কিংবা কোনো বর্ষামুখর শ্রাবণ সন্ধ্যায় যখন কলকাতার বুকে দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসে। ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে যায়, বাইরে বেরোবার কোনো উপায় থাকে না; তখন আপাদমস্তক রেন্ কোট চাপা দিয়ে কোনো অজ্ঞাত পরিচয় অতিথি রহস্যভেদীর ড্রইং রুমে ঢুকে পড়েন। মোটা অঙ্কের একটা চেক টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আগন্তুক তার রহস্যময় অতীতের রোমাঞ্চকর কাহিনি বর্ণনা করতে আরম্ভ করেন। একটুও বিচলিত না হয়ে, রহস্যভেদী বার্মা সিগারের ধোঁয়া ছেড়ে ঠান্ডা মাথায় বলেন, পুলিসের কাছে গেলেই বোধহয় আপনার ভালো হত।

আগন্তুক তখন চেয়ার থেকে উঠে পড়ে তার হাত দুটি ধরে করুণ কণ্ঠে বলেন, প্লিজ, আমাকে নিরাশ করবেন না।

কিন্তু বায়রন সায়েবের একি অবস্থা? নিজেই কাজের সন্ধানে বেরিয়েছেন।

ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের আদালতী কর্মক্ষেত্রে কত বিচিত্র মানুষের আনাগোনা। ভেবেছিলুম বায়রন সায়েবকে সাহায্য করতে পারব। আমারই অনুরোধে আমারই কোনো পরিচিত জনের রহস্য ভেদ করে বায়রন সায়েব হয়তো ভারত-জোড়া খ্যাতি অর্জন করবেন। তাই তাকে বলেছিলাম, মাঝে মাঝে আসবেন।

বার্নিশ করা কালো চেহারা নিয়ে বায়রন সায়েব আবার টেম্পল চেম্বারে এসেছিলেন। এবার ওঁর হাতে কতকগুলো জীবনবীমার কাগজপত্র। প্রথমে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। সামান্য কয়েক মাসের চাকরি-জীবনে আমাকে অন্তত দুডজন এজেন্টের খপ্পরে পড়তে হয়েছে। আড় চোখে বায়রন সায়েবের কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের কর্তব্য স্থির করছিলাম। কিন্তু বায়রন যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন। চেয়ারে বসে বললেন, ভয় নেই, তোমাকে ইন্সিওর করতে বলব না।

লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ দিয়েই বায়রন বললেন, ডিটেকটিভের কাজ করতে গেলে অনেক সময় বহুরূপী হতে হয়। ইন্সিওরের দালালিটাও আমার মেকআপ। .

বায়রন সায়েবের জন্য চা আনিয়েছে। চা খেয়ে উনি বিদায় নিয়েছেন।

সত্যি আমার লজ্জা লাগত। যদি ওঁর কোনো উপকার করতে পারতাম তাহলে বিশেষ আনন্দিত হতাম। কিন্তু সাধ থাকলেই সাধ্য হয় না, কোনো কাজই জোগাড় করতে পারিনি। ছোকাদাকে বলেছিলাম, আপনাদের কোনো এনকোয়ারি থাকলে বায়রনকে দিন না।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছোকাদা বলেছিলেন, তোমার হালচাল তো সুবিধে মনে হচ্ছে না, ছোকরা। ওই টেসসা সায়েবের জন্য তোমার এত দরদ কেন? খুব সাবধান। এলিয়ট রোডের ওই মালেদের পাল্লায় পড়ে কত ছোকরার যে টুয়েলভ-ও-ক্লক হয়ে গিয়েছে তা তো জানেন না।

ছোকাদার কথায় কান দিইনি। বায়রনকে বলেছি, আমার লজ্জা লাগে। আপনি কষ্ট করে আসেন অথচ কোনো কাজ দিতে পারি না।

বায়রন আশাবাদী। হা-হা করে হাসতে হাসতে বলেছেন, কে যে কখন কাকে সাহায্য করতে পারে কিছুই বলা যায় না। অন্তত আমাদের লাইনে কেউ বলতে পারে না।

এই সামান্য পরিচয়ের জোরেই বায়রন সায়েব কার্জন পার্কে আমার ক্লান্ত অবসন্ন দেহটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হ্যাল্লো বাবু! হোয়াট ইজ দি ম্যাটার?

উত্তর না দিয়ে, স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার মূর্তির দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলাম। বায়রন সায়েব কিন্তু ছাড়লেন না। আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন। আমাকে না-জিজ্ঞেস করেও এবার বোধহয় সব বুঝতে পারলেন। বললেন, দি ইজ ব্যাড়। ভেরি ব্যাড়।

মানে?

মানে, বি এ সোলজার। সৈন্যের মতো ব্যবহার করো। এই আনফ্রেন্ডলি ওয়ার্ল্ড-এ আমাদের সবাইকে লড়াই করে বাঁচতে হবে। ফাইট টু দি লাস্ট।

বায়রন সায়েবের দেহের দিকে এতক্ষণে ভালো করে নজর দিলাম। বোধ হয় ওঁর দিনকাল একটু ভালো হয়েছে। ধপধপে কোট-প্যান্ট পরেছেন। পায়ে চকচকে জুতো।

জীবনের মূল্য সম্বন্ধে অনেক সারগর্ভ উপদেশ বায়রন সায়েব হুড় হুড় করে বর্ষণ করলেন। হয়তো ভেবেছেন, খেয়ালের বশে জীবনটাকে খরচ করে ফেলার সর্বনাশা অভিসন্ধি নিয়েই আমি এখানে বসে রয়েছি।

উপদেশ বস্তুটি কোনো দিনই আমার তেমন সহ্য হয় না। ঈষৎ তিক্ত কণ্ঠে বললাম, পাষাণ-হৃদয় স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা কে-টি, সি-আই ই-র চোখের সামনে ওই গাছটাতে অনেক অশান্ত প্রাণ চিরদিনের শান্তি লাভ করেছে। খবরের কাগজে নিশ্চয় দেখে থাকবেন। কিন্তু ভয় নেই, মিস্টার বায়রন, আমি ওই রকম কিছু একটা করে বসব না।

আমার দার্শনিক উত্তরের উপর বায়রন সায়েব কোনো গুরুত্বই আরোপ করলেন না। নিজের মনেই বললেন, চিয়ার আপ। আরও খারাপ হতে পারত। আরো অনেক খারাপ হতে পারত আমাদের।

দূরে পিতলের ঘড়া থেকে এক হিন্দুস্থানি চা বিক্রি করছিল। বায়রন সাহেব হাঁক দিয়ে চা-ওলাকে ডাকলেন। আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু তিনি শুনলেন না। পকেট থেকে ডাইরি খুলে বললেন, এক কাপ শোধ করলাম। এখনও বিয়াল্লিশ কাপ পাওনা রইল।

চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ফর্সা কোট প্যান্ট আছে?

বললাম, বাড়িতে আছে।

বায়রন সায়েব আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। তাহলে আর ভাববার কিছু নেই। সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। না-হলে আজই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে কেন?

আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বায়রন সায়েব বললেন, সবই বুঝবে। সময় হলে সবই বুঝতে পারবে। শাজাহান হোটেলের মেয়েটাকে আমিই কি প্রথমে বুঝতে পেরেছিলাম!

কথা থামিয়ে বায়রন সায়েব ঘড়ির দিকে তাকালেন। কতক্ষণ লাগবে? বাড়ি থেকে কোট প্যান্ট পরে এখনই ফিরে আসতে হবে।

কোথায় যেতে হবে?

সে সব পরের কথা। এক ঘন্টার মধ্যে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার স্ট্যাচুর তলায় তোমাকে ফিরে আসতে হবে। পরের প্রশ্ন পরে করবে, এখন হারি আপ-কুইক্‌।

 

চৌরঙ্গী থেকে কিভাবে সেদিন যে চৌধুরী বাগানে ফিরে এসেছিলাম ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। তাড়াতাড়ির মাথায় চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে অনেকের পা মাড়িয়ে দিয়েছি। বাসের প্যাসেঞ্জাররা হাঁ হাঁ করে উঠেছেন। কিন্তু আমি বেপরোয়া। কিল-চড়-ঘুষি খেয়েও বাসে উঠতে প্রস্তুত ছিলাম।

দাড়ি কামিয়ে এবং সবেধন নীলমণি স্যুটটি পরে যখন কার্জন পার্কে ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। চৌরঙ্গীর রাত্রি ইতিমধ্যেই মোহিনী রূপ ধারণ করেছে। চোখধাঁধানো নিয়ন আলোর ঝলকানিতে কার্জন পার্ককেও যেন আর-এক কার্জন পার্ক মনে হচ্ছে। দুপুরে যে কার্জন পার্কের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল সে যেন কোথায় উবে গিয়েছে। বহুদিনের বেকার ছোকরা যেন হঠাৎ হাজার-টাকা-মাইনের-চাকরি পেয়ে বান্ধবীর সঙ্গে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে।

কাব্য বা কোটেশন কোনোটারই ভক্ত নই আমি। কিন্তু অনেকদিন আগে পড়া কয়েকটা কবিতার লাইন মনে করবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। এই কার্জন পার্ক দেখেই সমর সেন লিখেছিলেন :

আজ বহুদিনের তুষার স্তব্ধতার পর
পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ।
তাই বসন্তের কার্জন পার্কে
বর্ষার সিক্ত পশুর মতো স্তব্ধ বসে
বক্ৰদেহ নায়কের দল
বিগলিত বিষণ্ণতায় ক্ষুরধার স্বপ্ন দেখে
ময়দানে নষ্টনীড় মানুষের দল।
ফরাসি ছবির আমন্ত্রণে, ফিটনের ইঙ্গিতে আহ্বানে
খনির আগুনে রক্ত মেঘ সূর্যাস্ত এল।

দেখলাম, মালিশওয়ালা, বাদামওয়ালা, চাওয়ালারা দল বেঁধে পার্কের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে। ধোপভাঙা স্যুটে আমাকেও যে আর বেকারের মতো দেখাচ্ছিল না, তার প্রমাণ হাতে-নাতে পেলাম। মালিশওয়ালা কাছে এগিয়ে এসে বললে, মালিশ সাব।

না, বলে এগিয়ে যেতে, মালিশওয়ালা আরো কাছে সরে এসে চাপা গলায় বললে, গার্ল ফ্রেন্ড সা? কলেজ গার্ল-পাঞ্জাবি, বেঙ্গলি, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান…। তালিকা হয়তো আরও দীর্ঘ হত, কিন্তু আমি তখন বায়রন সায়েবকে ধরবার জন্য উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি। আমার জন্য অপেক্ষা করে করে হয়তো তিনি এতক্ষণে চলে গিয়েছেন। হয়তো চিরদিনের জন্য একটা অমূল্য সুযোগ আমার হাতছাড়া হয়ে গেল।

না। বায়রন সায়েব চলে যাননি। স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার পায়ের তলায় চুপচাপ বসে আছেন। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে ওঁর কালো দেহটা যেন একেবারে মিশে গিয়েছে। ওঁর সাদা শার্ট আর প্যান্টটা যেন কোনো অদৃশ্য মানুষের লজ্জা নিবারণ করছে।

আমাকে দেখেই বায়রন সায়েব উঠে পড়লেন। বললেন, তুমি যাবার পর অন্তত দশটা সিগারেট ধ্বংস করেছি। ধোঁয়া ছেড়েছি আর ভেবেছি, ভালোই হল। তোমারও ভালো হবে, আমারও!

কার্জন পার্ক থেকে বেরিয়ে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিকে বাঁ দিকে রেখে সেন্ট্রাল এভিন ধরে আমরা শাজাহান হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি।

হাঁটতে হাঁটতে বায়রন সায়েবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে তার কোনো উপকারই করতে পারিনি। হঠাৎ মনে হল, আমি ভালোভাবে চেষ্টাও করিনি। অনেক অ্যাটর্নির সঙ্গেই তো আমার পরিচয় ছিল—সায়েব ব্যারিস্টারের বাবুর অনুরোধ উপেক্ষা করা তঁাদের পক্ষে বেশ মুশকিল হত। কিন্তু নিজের সম্মান রক্ষার জন্য সেদিন কারুর কাছে মাথা নত করিনি। আর আজ বায়রন সায়েবই আমার জীবনপথের দিশারি। বায়রন সায়েব বললেন, তোমার চাকরি হবেই। ওদের ম্যানেজার আমার কথা ঠেলতে পারবে না।

ওই শাজাহান হোটেল—বায়রন দূর থেকে দেখালেন।

কলকাতার হোটেলকুলচূড়ামণি শাজাহান হোটেলকে আমিও দেখলাম। গেটের কাছে খান পঁচিশেক গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও গাড়ি আসছে। দারোয়ানজি বুকে আট-দশখানা মেডেল ঝুলিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আর মাঝে মাঝে গাড়ি-বারান্দার কাছে এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিচ্ছেন। রাতের পোশাক-পরা এক মেমসায়েব টুপ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। তার পিছনে বো-টাই পরা এক সায়েব। লিপস্টিক মাখা ঠোঁটটা সামান্য বেঁকিয়ে ঢেকুর তোলার মতো কায়দায় মেমসায়েব বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। সায়েব এতক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মেমসায়েব সেটিকে নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। দারোয়ানজি সেই সুযোগে বুটের সঙ্গে বুট ঠুকে সামরিক কায়দায় সেলাম জানালেন। প্রত্যুত্তরে ওঁদের দুজনের মাথাও স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো একটু নড়ে উঠে আবার স্থির হয়ে গেল।

দারোয়ানজি এবার বায়রন সায়েবকে দেখতে পেলেন। এবং বিনয়ে বিগলিত হয়ে একটা ডবল সাইজের সেলাম ঠুকলেন।

ভিতরে পা দিয়েই আমার মানসিক অবস্থা যা হয়েছিল তা ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে। হাইকোর্টে সায়েবের দৌলতে অনেক বিলাসকেই দেখেছি। হোটেলও দেখেছি কয়েকটা কিন্তু শাজাহান হোটেলের জাত অন্য। কোনো কিছুর সঙ্গেই যেন তুলনা চলে না।

বাড়ি নয়তো, যেন ছোটখাটো একটা শহর। বারান্দার প্রস্থ কলকাতার অনেক স্ট্রিট, রোড, এমনকি এভিন্যুকে লজ্জা দিতে পারে।

বায়রন সায়েবের পিছন পিছন লিফটে উঠে পড়লাম। লিফট থেকে নেমেও তাকে অনুসরণ করলাম। কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। মে মাসের সন্ধ্যায় যেন ডিসেম্বরের শীতের নমুনা পেলাম।

বায়রন সায়েবের পিছনে পিছনে কতবার যে বাঁ দিকে আর ডান দিকে মোড় ফিরেছিলাম মনে নেই। সেই গোলকবাঁধা থেকে একলা বেরিয়ে আসা যে আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল তা নিশ্চিত। বায়রন সায়েব অবশেষে একটা দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন।

বাইরে তকমা পরা এক বেয়ারা দাঁড়িয়েছিল। সে বললে, সায়েব কিছুক্ষণ হল ফিরেছেন। কিচেন ইন্সপেকশন ছিল। ফিরেই গোসল শেষ করলেন। এখন একটু বিশ্রাম করছেন।

বায়রন মোটেই দমলেন না। কোঁকড়া চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর বেয়ারাকে বললেন, বলো বায়রন সায়েব।

মন্ত্রের মতো কাজ হল। বেয়ারা ভিতরে ঢুকে চার সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে এল। বিনয়ে ঝুঁকে পড়ে বললে, ভিতর যাইয়ে।

শাজাহান হোটেলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা মার্কোপোলোকে এই অবস্থায় দেখবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। একটা হাতকাটা গেঞ্জি আর একটা ছোট্ট আন্ডার প্যান্ট লাল রংয়ের পুরুষালি দেহটার প্রয়োজনীয় অংশগুলোকে কোনোরকমে ঢেকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। বস্ত্রস্বল্পতা সম্বন্ধে ওঁর কিন্তু কোনো খেয়াল নেই, যেন কোনো সুইমিং ক্লাবের চৌবাচ্চার ধারে বসে রয়েছেন।

কিন্তু আমাকে দেখেই মার্কোপোলো আঁতকে উঠলেন। এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি, বলতে বলতে উনি তড়াং করে বিছানা থেকে উঠে আলমারির দিকে ছুটে গেলেন। ওয়ারড্রোব খুলে একটা হাফপ্যান্ট বের করে তাড়াতাড়ি পরে ফেললেন। তারপর পায়ে রবারের চটিটা গলিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। দেখলাম সায়েবের গলায় মোটা চেনের হার; হারের লকেটটা কালো রংয়ের, তাতে কী সব লেখা। বাঁ হাতে বিরাট উল্কি। রোমশ বুকেও একটা উল্কি আছে; তার কিছুটা গেঞ্জির আড়াল থেকে উঁকি মারছে।

ভেবেছিলাম বায়রন সায়েবই প্রথম কথা পাড়বেন। কিন্তু ম্যানেজারই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন। সিগারেটের টিনটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো খবর আছে নাকি?

বায়রন মাথা নাড়লেন। এখনও নেই। একটু থেমে আবার বললেন, কলকাতা একটা আজব শহর, মিস্টার মার্কোপোলা। আমরা যত বড় ভাবি কলকাতা তার থেকে অনেক বড়।

মার্কোপোলোর মুখের দীপ্তি এবার হঠাৎ অর্ধেক হয়ে গেল। বললেন, এখনও নয়? আর কবে?—আর কবে?

পুরনো সময় থাকলে ওঁর হতাশায় ভরা কণ্ঠ থেকে কোনো রহস্যের গন্ধ পেয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়তাম। কিন্তু এখন কোনো কিছুতেই আমার আগ্রহ নেই; সমস্ত কলকাতা রসাতলে গিয়েও যদি আমার একটা চাকরি হয়, তাতেও আমি সন্তুষ্ট।

আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বায়রন এবার কাজের কথাটা পাড়লেন। আমার পরিচয় দিয়ে বললেন, একে আপনার হোটেলে ঢুকিয়ে নিতেই হবে, আপনার অনেক কাজে লাগবে।

শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন, কোনো উপায় নেই। ভাড়া দেবার ঘর অনেক খালি আছে, কিন্তু চাকরি দেবার চেয়ার একটাও খালি নেই। স্টাফ বাড়তি।

এই উত্তরের জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছিলাম। বহুবার বহু জায়গায় ওই একই কথা শুনেছি। এখানেও না শুনলে আশ্চর্য হতাম।

বায়রন কিন্তু হাল ছাড়লেন না। চাবির রিঙটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, কিন্তু আমি জানি তোমার ভেকান্সি হয়েছে।

অসম্ভব, ম্যানেজার চিৎকার করে উঠলেন। সবই সম্ভব। পোস্ট খালি হয়েছে। আগামী কালই খবর পাবে। মানে?

মানে অ্যাডভান্স খবর। অনেক খবরই তো আমাদের কাছে আগাম আসে। তোমার সেক্রেটারি রোজি…।

ম্যানেজার যেন চমকে উঠলেন-রোজি? সে তো উপরের ঘরে রয়েছে।

গোয়েন্দাসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বায়রন বললেন, বেশ তো, খবর নিয়ে দেখো। ওখানকার বেয়ারাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করো, গতকাল রাত্রে মেমসাহেব নিজের ঘরে ছিলেন কিনা।

মার্কোপোলোরও গোঁ চেপে গিয়েছে। বললেন, ইমপসিবল। চিৎকার করে তিনি তিয়াত্তর নম্বর বেয়ারাকে ডেকে পাঠালেন।

গত রাত্রে তিয়াত্তর নম্বরের নাইট ডিউটি ছিল। আজও সন্ধ্যা থেকে ডিউটি। সবেমাত্র সে নিজের টুলে বসেছিল। এমন সময় ম্যানেজার সায়েবের সেলাম। নিশ্চয়ই কোনো দোষ হয়েছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।

ম্যানেজার হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন কাল সারারাত সে জেগে ছিল কি।

তিয়াত্তর নম্বর বললে, ভগবান উপরে আছেন হুজুর, সারারাত জেগে ছিলাম, একটিবারও চোখের দুটো পাতা এক হতে দিইনি।

মার্কোপোলোর প্রশ্নের উত্তরে বেয়ারা স্বীকার করলে, ৩৬২-এ ঘর সারা রাতই বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল। বোর্ডে সারাক্ষণই সে চাবি ঝুলে থাকতে দেখেছে।

মৃদু হেসে বায়রন বললেন, গতরাতে ঠিক সেই সময়েই চৌরঙ্গীর অন্য এক হোটেলের বাহাত্তর নম্বর ঘরের চাবি ভিতরে থেকে বন্ধ ছিল।

মানে? মার্কোপোলো সভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

মানে, সেই ঘরে শুধু রোজি নয়, আরও একজন ছিলেন। তিনি আবার আমার বিশেষ পরিচিত। আমারই এক ক্লায়েন্টের স্বামী! এসব অবশ্য আমার জানবার কথা নয়। কিন্তু মিসেস ব্যানার্জি আমাকে ফি দিয়ে লাগিয়ে রেখেছেন। তার স্বামী কতদুর এগিয়েছেন, তার রিপোর্ট আজই দিয়ে এলাম—নো হোপ! কোনো আশা নেই। আজ সন্ধ্যায় আপনার সহকারিণী এবং ব্যানার্জি দুজনেই ট্রেনে চড়ে পালিয়েছেন। পাখি উড়ে গিয়েছে। সুতরাং এই ছেলেটিকে সেই শূন্য খাঁচায় ইচ্ছে করলেই রাখতে পারেন।

আমি ও ম্যানেজার দুজনেই স্তম্ভিত। বায়রন হা-হা করে হেসে উঠলেন। খবর দেবার জন্যই আসছিলাম, কিন্তু পথে আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

এরপর মার্কোপোলো আর না বলতে পারলেন না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও জানালেন, রোজি চাকরি ছাড়েনি, দুদিন পরে সে যদি আবার ফিরে আসে…।

তখন ইচ্ছে হলে একে তাড়িয়ে দিও। বায়রন আমার হয়েই বলে দিলেন।

শাজাহান হোটেলের সর্বেসর্বা রাজি হয়ে গেলেন। আর আমারও চাকরি হল। আমার ভাগ্যের লেজার খাতায় চিত্রগুপ্ত নিশ্চয়ই এই রকমই লিখে রেখেছিলেন।

———-
* এই লেখকের ‘কত অজানারে’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *