২.০৪ ইরোকোয়া গোষ্ঠী

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ইরোকোয়া গোষ্ঠী

একটি ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীকে তার সদর্থক উপাদানের সাহায্যে বর্ণনা করা মুশকিল। যদিও আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নানাভাবে বিভক্ত হওয়ার জন্যে তাদের পরিবেশই দায়ী।

প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব একটি নাম ও কথ্য ভাষা আছে, আছে সর্বোচ্চ সরকার এবং বিশেষ একটা এলাকা, তারা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করে। যতগুলো কথ্য ভাষা আছে ততগুলো গোষ্ঠী দেখা যায়। ভাষায় পার্থক্যটা সম্পূর্ণভাবে না আসলে গোষ্ঠীদের বিভেদটাও সম্পূর্ণ হয়

। আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে গোষ্ঠীগত বিভেদগুলো এক লোকসমষ্টি থেকে হয়েছে। যে জায়গায় তারা বাস করত সেখান থেকে সরে গিয়ে বা বিভক্ত হয়ে পৃথক একটা কথ্য ভাষা গ্রহণ করে তারা স্বাধীনভাবে বসবাস করতে শুরু করে।

আমরা আগেই দেখেছি ভ্রাতৃত্ব সংগঠন সামাজিক সংগঠন হিসেবেই ছিল প্রয়োজনীয় যতটা না ছিল সরকারি সংগঠন হিসেবে। এদিক থেকে গণ, গোষ্ঠী ও মিত্রসংঘ ক্রমশ ধাপে ধাপে সরকারি সংগঠন হিসেবে এগিয়ে গেছে। একটা গণ সংগঠিত সমাজে মিত্রসংঘ হতে পারে না, যতক্ষণ না ভিত্তি হিসেবে আসছে গোষ্ঠী। এই উন্নয়নের ধারা ন্যায়সঙ্গত উন্নয়ন। ঠিক এইভাবেই আমরা দেখি গণ সংগঠন না থাকলে গোষ্ঠী সংগঠন হতে পারত না, ভ্রাতৃত্ব সংগঠন না থাকলে অবশ্য কিছু এসে যায় না। এই পরিচ্ছেদে আমি দেখাব একই সমষ্টির মাঝ থেকে কীভাবে এইসব অসংখ্য গোষ্ঠী গঠিত হয়েছে। তারপর দেখাব কী কারণে তারা নানা অংশে বিভক্ত হত। আর এই ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীর মূল চরিত্র কী, যা তাকে সংগঠনের চরিত্র দিয়েছে।

নিজস্ব ভাষা ও এলাকা থাকায় এই গোষ্ঠীবদ্ধ বহু আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের জাতি বলে আখ্যা দেবার মতো, যদিও এত অল্প লোকসংখ্যা নিয়ে জাতি হয় না। গোষ্ঠী আর জাতি সমার্থক হতে পারে না। গণ সংগঠিত লোকসমষ্টির মধ্যে জাতি গঠিত হতে পারে না। যতক্ষণ না গোষ্ঠীগুলো একত্রিত হয়ে এক সরকারি আওতায় এসে এক জনসমষ্টিতে পরিণত হচ্ছে ততক্ষণ জাতি হতে পারে না, যেমনটি আমরা দেখি চারটি এথেনীয় গোষ্ঠী এ্যাটিকা জাতি গঠন করেছিল, তিনটি ডোরিয়ান গোষ্ঠী গঠন করে স্পার্টা-জাতি এবং তিনটি ল্যাটিন এবং সাবাইন গোষ্ঠী রোম-জাতি গড়ে তোলে। সংঘ বা ফেডারেশান গড়ে ওঠে যখন গোষ্ঠীরা স্বাধীনভাবে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় থাকে। কিন্তু জাতি গঠিত হওয়া মানে একত্রে মিশে যাওয়া, যদিও ভিতরে গণ ও গোষ্ঠী সংগঠনের টান কিছুটা থেকে যায়। মিত্রসংঘ অনেকটা জাতির কাছাকাছি, কিন্তু পুরো এক নয়। গণ সমাজের ক্ষেত্রে অন্যান্য সকল সংগঠনের নাম নির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হওয়া উচিত।

একটি ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠী কয়েকটা গণ নিয়ে গঠিত, তারা বিয়ের সম্পর্কে সম্পর্কিত, আর তারা সবাই এক ভাষায় কথা বলে। বাইরের কোনো লোকের কাছে গোষ্ঠীটাই প্রথম দৃশ্যমান হয়, গণ নয়। এমন কোনো গোষ্ঠী বিরল যেখানে ভিন্ন ভাষাভাষী গণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যখন সে ধরনের কোনো গোষ্ঠী দেখা যায় বুঝতে হবে দুর্বল কোনো গোষ্ঠী সবলের সাথে মিশে এক হয়ে গেছে, যেমন মিসৌরীর সাথে অটোর মিশ্রণ। মিসৌরীরা হেরে যাবার পর এটা ঘটে। আদিবাসীদের বেশির ভাগই ছিল গোষ্ঠীবদ্ধ, এই গণ সমাজে সরকারের ধারণা বড় ধীরে ধীরে এগিয়েছে। খুব অল্প লোকের মধ্যে এই ধারণা দেখা দিয়েছিল যারা মিত্রসংঘে মিলিত হয়েছিল এবং এক্ষেত্রে তারা একটি বড় ভাষার খুব কাছাকাছি ছিল। আমেরিকার কোনো অংশের গোষ্ঠীদের একাঙ্গীভবন হয়ে জাতি গঠিত হতে দেখা যায় নি।

সব সময় তাদের মধ্যে পৃথক হবার একটা মনোভাব দেখা যেত, তাই তারা এদিকে বেশি অগ্রসর হতে পারত না। ভাষার পার্থক্যের জন্যও এদিকে বাধা আসত, আর ভাষা তাদের সামাজিক জীবনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোনো ভাষা যার বেশ শব্দমালা ও ব্যাকরণবদ্ধতা আছে তা কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। তাই লোকেরা ভিন্ন জায়গায় সরে গেলেই তাদের মধ্যে ভাষার পার্থক্য সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত এই জনসমষ্টি পৃথক হয়ে যেত। এটা অবশ্য অল্প সময়ে হয় নি এর জন্যে হাজার বছর লেগেছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে যত সব ভাষার সৃষ্টি হয়েছে তা একই ভাষা থেকে তিনটি জাতিতত্ত্বমূলক যুগবিভাগে সৃষ্টি হয়েছে।

নূতন নূতন গোষ্ঠী ও গণ স্বাভাবিকভাকেই সব সময় সৃষ্টি হত। কারণ আমেরিকা মহাদেশ দুটি ছিল বিশাল। পদ্ধতিটা খুবই সোজা। প্রথমে ঘন জনবসতি থেকে কিছু লোক অন্যত্র সরে যায়। কারণ সেখানে হয়তো ভালো খাবারদাবার পাওয়া যায়, এমনি বছর বছর লোক যেতে থাকে এবং আসল জায়গা ছেড়ে নূতন জায়গায় আর এক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। আগের গোষ্ঠীর সাথে তখন তাদের সম্পর্ক কেটে গেছে। এই অনেক দিনের ছাড়াছাড়িতে, আত্মীয়তা বোধও কমে গেছে এইভাবে নূতন গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। সর্বজনীনভাবে প্রায় সব জায়গাতেই এটা ঘটেছে। কোনো গ্রামে লোকজন বেশি হয়ে গেলে তারা নদীর কূল ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার নূতন একটা গ্রাম গড়ে তোলে। এইভাবে নূতন নূতন আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারসম্পন্ন গণ সৃষ্টি হয়েছে, পরস্পর পরস্পরকে রক্ষার জন্যে তারা মিত্রসংঘের সাহায্যে একজোট বেঁধে থাকে। শেষে তাদের কথ্য ভাষায় কিছুটা পার্থক্য দেখা যায় এবং এইভাবে একটা সম্পূর্ণ গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়।

কী ধারায় গোষ্ঠীরা একে অপরের থেকে পৃথক হয় তা উদাহরণ দিয়ে দেখানো যেতে পারে। পৃথক হবার ব্যাপারটা তাদের ঐতিহ্য এবং বিভিন্ন গণের ভাষার মাধ্যমে জানা যায়। যখন একটা গোষ্ঠী থেকে আর একটা গোষ্ঠী সৃষ্টি হয় তখন তা সমান গণ নিয়ে সৃষ্ট হয় এবং তারা একই ভাষায় কথা বলে। বহু শতাব্দী পরও তারা একই সংখ্যার গণ নিয়ে বসবাস করে। তাই দেখা যাচ্ছে হিউরন, যাদের এখন ওয়ানডট বলে তাদের ছটা গণ সেনেকা ইরোকোয়াদের ছটি গণের নামেই চলছে, প্রায় চার শ বছর পৃথক হয়ে যাবার পরও। পটাওয়াটটামিদের আটটা গণ ঠিক ওজিবওয়াদের আটটি গণের নামে, কিন্তু পূর্বোক্তদের ছয়টি এবং পরবর্তীদের চৌদ্দটি গণের নামে কোনো মিল নেই। এতেই বোঝা যাচ্ছে এরা পৃথক হবার পর নূতন গণ সৃষ্টি হয়েছে। গণগুলো গোষ্ঠী ও তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া গোষ্ঠীকে বুঝতে সাহায্য করে।

নিম্নোক্ত উদাহরণটি নিম্ন বর্বর যুগের অবস্থা থেকে নেওয়া হয়েছে। যখন এই গোষ্ঠীগুলো অর্থাৎ মিসৌরী গোষ্ঠীগুলো আবিষ্কৃত হয় তারা মিসৌরী নদীর প্রায় এক হাজার মাইলেরও বেশি জায়গা জুড়ে ছিল। শুধু এই নদীর তীরে নয়, এর শাখানদী কানসাস ও প্ল্যাটে এবং আইওয়ার ছোট ছোট নদীগুলোর তীরেও ছিল। এই আটটি গোষ্ঠী মিসিসিপির পশ্চিম তীর থেকে শুরু করে আরকানসাসব্যাপী ছিল। এদের ভাষা দেখে বোঝা যায় শেষের গোষ্ঠীগুলো সৃষ্টি হবার আগে এরা তিনটে গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। প্রথম, পুঙ্কা ও ওমাহা, দ্বিতীয়, আইওয়া, ওটাওয়া এবং মিসৌরী, তৃতীয়, কাও, ওসাজে ও কুয়াপ্পা। নিঃসন্দেহে এরা একটা গোষ্ঠী থেকে সৃষ্টি হয়েছে, কারণ তারা এখনো ডাকোটীয় ভাষায় কথা বলে। তাই গোষ্ঠীগুলো বুঝতে ভাষা পাঠও একটা অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এক জায়গা থেকে তারা যত নদীর উজান বা ভাটির দিকে নেবে গেছে তাদের ভাষাও ক্রমশ বদলাতে শুরু করে এবং একসময় স্বাধীন একটা গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়। এই পৃথক হওয়া কোনো দুর্যোগের ফল বা মনোমালিন্যের ফল নয়, আসলে বিরাট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার ফল। মিসৌরী গোষ্ঠীর পুঙ্কা থেকে কুয়াল্লাদের দূরত্ব প্রায় পনের শ মাইল। বাকি ছটা গোষ্ঠী এদের মধ্যে অবস্থিত। এরা সম্পূর্ণভাবেই রিভার গোষ্ঠী।

আর একটা উদাহরণ নেওয়া যায় সুপেরিয়র হ্রদের গোষ্ঠীগুলো থেকে। ওজিবওয়া, ওটাওয়া[১] এবং পটাওয়াটটামি গোষ্ঠীগুলো আসলে এক গোষ্ঠী থেকে সৃষ্ট। ওজিবওয়ারা হল মূল গোষ্ঠী, কারণ তারা হ্রদে মাছ ধরার সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গাতেই আছে। তা ছাড়া অন্যের সামনে তারা নিজেদের বলে “বড় ভাই”। এদিকে ওটাওয়ারা বলে “মেজ ভাই” আর পটাওয়াটটামিরা বলে “ছোট ভাই”। প্রথমে শেষোক্ত গোষ্ঠীটি পৃথক হয়, পরে হয় ওটাওয়ারা। এদের ভাষার ব্যাপারটা লক্ষ করলেই বোঝা যায়, কারণ প্রথমোক্তর সাথে এদের পার্থক্যটা বড় বেশি।

১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে যখন আবিষ্কৃত হয় ওজিবওয়ারা ছিল সুপেরিয়র হ্রদের মুখের কাছে র‍্যাপিডস-এ, এখান থেকে তারা হ্রদের দক্ষিণ তীর ধরে ওনটোনাগোন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। হ্রদের উত্তর-পূর্ব তীর এবং হিউরোন হ্রদের দিকে সেন্ট মারি নদী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অবস্থা মাছ ধরা ও শিকারের জন্যে খুবই অনুকূল হয়। তারা এর ওপর প্রধানভাবে নির্ভর করে, কারণ তারা ভুট্টা ও অন্যান্য চাষের ব্যবহার জানত না।[২] উত্তর আমেরিকায় এটা আর কারো মধ্যে দেখা যায় নি। একমাত্র ব্যতিরেক হল কলম্বিয়া উপত্যকা। এই সুবিধার জন্যে তাদের লোকসংখ্যা প্রচুর বাড়ে, যার ফলে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং নূতন নূতন গোষ্ঠীর জন্ম দেয়। পটাওয়াটটামিরা ওপর মিশিগান ও উইসকনসিন অঞ্চলে বসতি করে ছিল। ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে দেখা যায় ডাকোটারা তাদের ঐ অঞ্চল থেকে হটিয়ে দিচ্ছে। ওটাওয়ারা, যারা মূলত ছিল কানাডার ওটাওয়া নদীর তীরে এই একই সময় তারা পশ্চিম দিকে যেতে শুরু করে এবং বসবাস শুরু করে জর্জিয়ান উপসাগরীয় অঞ্চল, ম্যানিটোউলিন দ্বীপপুঞ্জ এবং ম্যাকিনও অঞ্চলে, এখান থেকে তারা দক্ষিণে যাত্রা শুরু করে যায় নি মিশিগান পর্যন্ত। মূলত এরা একই লোকজন এবং একই গণের অধিকারী এবং এরা বিরাট অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়। জায়গায় জায়গায় মূল অঞ্চল থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার দূরত্ব, এইসবের জন্যে এরা আবিষ্কৃত হবার আগেই নানা উপভাষার সৃষ্টি করে এবং স্বাধীন গোষ্ঠীসমূহের জন্ম দেয়।

এই তিনটি গোষ্ঠী একসময় মিত্রসংঘ স্থাপন করে, যাকে বলে “ওটাওয়া মিত্রসংঘ”। এদের মিত্রসংঘ আত্মরক্ষাত্মক ও আক্রমণাত্মকও বটে, তবে ইরোকোয়াদের মতো অত ঘনিষ্ঠ নয়।

পূর্বে আরো কয়েকটা গোষ্ঠী ওজিবওয়াদের থেকে আলাদা হয়েছিল, তা হল মায়ামি গোষ্ঠী এবং তারা বসবাস করে মধ্যে ইলিনয় ও পশ্চিম ও পশ্চিম ইণ্ডিয়ানায়। এই একই মূল থেকে আর একটি শাখার সাক্ষাৎ পাই তারা পরে আবার তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, এরা হল পিওরিয়া, কাশকাসকিয়া, উইও ও পিয়ানকেশ। মায়ামি ও ওজিবওয়াদের ভাষার সাথে এদের ভাষার মিলটা সবচেয়ে নিকটতর। পরে মিল দেখা যায় ক্রী[৩] গোষ্ঠীর সাথে। সব গোষ্ঠীগুলো এই সুপেরিয়র হ্রদের পাশ থেকে অন্যান্য তীর ধরে গড়ে উঠেছে। এ থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হয় যে স্বাভাবিক আহাৰ্যবস্তুর সাথে জনবসতি গড়ে ওঠার একটা প্রগাঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সম্ভবত নিউ ইংল্যাণ্ডের ডেলাওয়ার, ম্যারিল্যাণ্ড, ভার্জিনিয়া ও ক্যারোলিনা এ্যালগোনাকিনরা এক জায়গা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম ভাষা থেকে পৃথক হতে অবশ্য কয়েক শতাব্দী লেগে গেছে।

ওপরের উদাহরণ থেকে বোঝা যায় তাদের আসল গোষ্ঠী থেকে সরে গিয়ে কেমন করে গোষ্ঠীগুলো গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক শাখা গোষ্ঠী যেন একটা সামরিক দল, বেরিয়েছে জায়গা দখল করতে। প্রথমে তাই তারা মূল গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ রাখে। যেসব ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠী একই ভাষায় কথা বলে তারা সাধারণত পাশাপাশি থাকে। পৃথিবীর সমস্ত ভাষাভাষী অধিবাসীদের জন্যেও এ কথা সত্য। কারণ কোনো জনসমষ্টি আসল গোষ্ঠী থেকে সরে গিয়ে তার পাশেই থাকে। যাতে কোনো বিপদের সময় মূল গোষ্ঠীর সাহায্য নিতে পারে বা বিশেষ কোনো বিপর্যয়ে আশ্রয় পায়।

কোনো জায়গায় প্রাকৃতিক আহার্যদ্রব্যের সম্ভাবনা থাকলে অতিরিক্ত লোকেরা গোষ্ঠী ছেড়ে অতি উৎসাহের সাথে স্থানান্তরে যায়।[৪] উত্তর আমেরিকায় এ রকম প্রাকৃতিক প্রাচুর্যময় জায়গা ছিল কম। তিনটি জায়গা বিশেষভাবে সমৃদ্ধ ছিল। প্রথম হল কলম্বিয়া উপত্যকা যব ইত্যাদি শস্য চাষের পূর্বেই এই অঞ্চল বিশেষ ঐশ্বর্যে পূর্ণ ছিল। দ্বিতীয়, সুপেরিয়র হ্রদ ও হিউরন অঞ্চল এবং মিশিগানের মাঝের উপদ্বীপ যা ওজিবওয়াদের আদি বাসস্থান ও বহু ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীর জন্মস্থান। তৃতীয় হল মিননেসোটা হ্রদ অঞ্চল, যা ডাকোটা গোষ্ঠীর জন্মস্থান। বেশ কিছু কারণে বোঝা যায় ডাকোটারা দখল করার আগে এটা মিননেসোটা এ্যালগোনকিনদের অংশ ছিল। যব ইত্যাদি শস্যের চাষ শুরু হবার পর দেখা যায় অল্প এলাকা অনেক লোককে ধারণ করতে পারে এবং লোকেরা এ এলাকায় বসবাস করতে পারে। নিম্ন বর্বর যুগে উদ্যান-কৃষি প্রায় সমস্ত গোষ্ঠীতে দেখা গিয়েছিল এবং সবার অবস্থার বেশ উন্নতি ঘটে। তারা কৃষিবিদ্যাহীন গোষ্ঠীদের সাথে উত্তর আমেরিকার প্রচুর এলাকা দখল করেছিল এবং এই মহাদেশে তাদের অবস্থার অধিবাসীরা পূরণ করে।[৫]

বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ভাষা সৃষ্টির পেছনে গোষ্ঠীদের পারস্পরিক যুদ্ধকেও দায়ী করতে হবে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠীরা সবচেয়ে বেশি যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। যেমন, ইরোকোয়া ও এ্যালগোর্কিন গোষ্ঠীদের মধ্যে যুদ্ধ দেখা যায়, আবার দেখা যায় ডাকোটা ও ইরোকোয়াদের মধ্যে। এদিকে ডাকোটা ও এ্যালগোকিনরা বেশ সদ্ভাবে বসবাস করত, কারণ তাদের মধ্যে ভাষাগত ও অন্যান্য মিল ছিল। অন্যরকম হলে তারা পাশাপাশি থাকতে পারত না। কিন্তু সবচাইতে বিশ্রী ধরনের উদাহরণ হল ইরোকোয়ারা, এরা তাদের শাখা- গোষ্ঠী এরি, নিউট্রাল নেশান, হিউরন ও সুসকুয়েহানকদের বিরুদ্ধে লড়ে। ভাষাগত মিল থাকলে যুদ্ধ অবশ্য কম হবার কথা, তবু এক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম।

একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মোট লোকসংখ্যা নির্ভর করত সেই অঞ্চল কতটুকু খাবার তাদের দিতে পারে। যখন মাছ আর শিকার করে জীবন যাপন করতে হত তখন একটা ছোট গোষ্ঠীর জন্যেও বিরাট এলাকার প্রয়োজন হত। শস্যজ আহার এর সাথে যুক্ত হবার পর সে জায়গা কোনো গোষ্ঠীর জন্যে বেশ বড় হয়ে দাঁড়ায়। সাতচল্লিশ হাজার বর্গমাইল নিয়ে নিউ ইয়র্ক কখনোই পঁচিশ হাজারের বেশি লোকসংখ্যা নিয়ে থাকে নি, এদের মধ্যে ছিল ইরাকোয়া, এ্যালগনকিন, এরি ও নিউট্রাল নেশান। গণ ভিত্তিক ব্যক্তিগত সম্পর্কের সরকারের পক্ষে বিপুলসংখ্যক লোককে পরিচালনা করা মুশকিল, অবশ্য তারা যদি দূরে দূরে থাকে এটা সম্ভব।

মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোর সব জায়গাতে অবশ্য লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে গোষ্ঠীর বিভাজন ঘটে নি। পুয়েবোরা একই নদীর তীর ধরে নূতন নূতন গোষ্ঠী গঠন করে বাস করত। প্রতিটি গোষ্ঠী মিলে মিত্রসংঘ গড়ে সরকার রচনা করে। এক নিউ মেক্সিকোতে ছিল সাতটা ভাষা। ১৫৪০-১৫৪২ সনে করোনাডো যখন অনুসন্ধান চালায় বহু গ্রাম দেখতে পায়, কিন্তু গ্রামগুলো ছিল খুব ছোট ছোট। সেখানে কিবোলা, টুকায়ান, কুভিরা এবং হেমেজ-এর ছিল সাতটা করে গ্রাম, আর টিগুয়েক্স[৬]-এর ছিল মোট বারোটা গ্রাম, সবার মধ্যে কিছুটা ভাষাগত ঐক্য ছিল। প্রতিটি দল মিত্রসংঘে আবদ্ধ ছিল কি না সে তথ্য আমরা পাই নি। যখন আবিষ্কৃত হয় সাতটা মোকি পুয়েবলো গ্রাম কিন্তু মিত্রসংঘে আবদ্ধ ছিল।

বিভক্ত হবার প্রক্রিয়াটা আমরা ওপরে তুলে ধরেছি। হাজার হাজার বছর ধরে আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে এই প্রক্রিয়া চলে এসেছে। শেষ পর্যন্ত এক উত্তর আমেরিকা প্রায় চল্লিশটা ভাষাভাষী দলে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রায় প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষা সমানসংখ্যক গোষ্ঠী কর্তৃক কথিত হত। আমেরিকান গোষ্ঠীদের কার্যাবলি ঠিক যেন এশিয়া-ইউরোপের গোষ্ঠীদের কার্যাবলির পুনরাবৃত্তি। কারণ তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল এক রকম।

এসব পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায় আমেরিকার গোষ্ঠী সংগঠন খুব সহজ-সরল ছিল। গ্যানোয়া পরিবারে কয়েক শ বা হাজারখানেক লোক হলেই একটা গোষ্ঠী গঠিত হত।

নিম্নে এই গোষ্ঠী সংগঠনের কার্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল :

১। একটি এলাকার ওপর আধিপত্য ও একটি নাম থাকা।

২। একটি কথ্য ভাষার ব্যবহার যা অন্য গোষ্ঠীতে হুবহু দেখা যায় না।

৩। গণ কর্তৃক প্রধান বা সাকেম নির্বাচনের পর তাদের প্রতিষ্ঠিত করা।

৪। এইসব প্রধান ও সাকেমকে পদচ্যুত করার অধিকার।

৫। একটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও তার পুজো।

৬। সমস্ত প্রধানদের নিয়ে পরিষদ গঠন করে একটি সর্বোচ্চ সরকার গঠন।

৭। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন গোষ্ঠীপ্রধান রাখা।

উপরোক্ত শিরোনাম সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

। একটি এলাকার ওপর আধিপত্য ও একটি নাম গ্রহণ

কোনো গোষ্ঠীর নিজস্ব এলাকা বলতে বোঝায় তারা যে অঞ্চলে বসবাস করে, শিকার ও চাষবাসের জন্যে যতটুকু জায়গা ব্যবহার করে, এ ছাড়া তারা যতটুকু জায়গা অপরের হস্তক্ষেপ থেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। এই এলাকা ছাড়া কিছু জায়গা থাকে যা দুই গোষ্ঠীকে পৃথক করে রাখে, তারা যদি দুই ভিন্ন কথ্য ভাষায় কথা বলে, কিন্তু যখন প্রায় একই কথ্য ভাষায় কথা বলে তখন জায়গার সীমানা নির্ধারণের জন্যে তেমন কোনো বাধাধরা গণ্ডি থাকে না। এক্ষেত্রে তাদের অঞ্চলের বিশেষ কোনো সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।

পরে অবশ্য গোষ্ঠীগুলো বিশেষ বিশেষ নাম গ্রহণ করে পৃথকভাবে চিহ্নিত হতে থাকে। বেশির ভাগ জায়গাতে এটা অবশ্য অজানিতে ঘটে, নাম গ্রহণটা সব সময় ঠিক ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবে হয় নি। সেনেকা গোষ্ঠী নিজেদের বলত “বড়-পাহাড়-বাসী” (নুন ডা-ওয়া-ও- নো), টুস্কারোরা গোষ্ঠী বলত, “জামা-পরা-অধিবাসী” (ডুস-গা-ও-ওয়ে ও-নো), সিসেটন গোষ্ঠী বলত, “জলাভূমির বাজার” (সিসসে-টো-ওয়ান), ওগালালারা বলত “তাঁবুবাসী” (ও-গা-লাল-লা), ওমাহারা বলত “উজানবাসী” (ও-মা-হা), আইওয়ারা বলত ধুলো নেকো’ (পা-হো-চা), মিনিটারিরা বলত “দূরবাসী” (এ-ন্যাট জা), চিরোকিরা বলত “মহৎ জন “ (সা-লো-কি), শওনিরা বলত “দক্ষিণবাসী” (সা ওয়ান-ওয়াকি), মোহেগানরা নিজেদের বলত “উপকূলবাসী” (মো-হে-কুন-উক), স্লেভ লেকের ইণ্ডিয়ানরা নিজেদের বলত, “নিচুভূমিবাসী” (এ- চাও-টিন-নে)। এ ছাড়া মেক্সিকোর গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে সোচিমিলকোরা নিজেদের বলত, “পুষ্পবীজ জাতি”, চালাকানরা নিজেদের বলত “আননবাসী”, টেপানেকানরা নিজেদের বলত “সেতুবাসী”, টেজকুকান বা কুলহুয়ারা নিজেদের বলত “রা জাতি” এবং টালাস্কালনরা নিজেদের বলত “দাড়িঅলা’। যখন উত্তর ইউরোপীয় উপনিবেশ আমেরিকায় সৃষ্টি হতে থাকে অনেক গোষ্ঠী নিজেরাই যে নাম নিত তা নয়, বরং অন্য গোষ্ঠীরা তাদের ভিন্ন নামে ডাকত। তাই ইতিহাসে অনেক গোষ্ঠীর নাম আছে যা সেই গোষ্ঠীর লোকের কাছে অজ্ঞাত।

। একটি কথ্য ভাষার অন্তর্ভুক্ত হওয়া

কোনো গোষ্ঠী আর তার কথা ভাষা অবিচ্ছেদ্য ব্যাপার। এর অন্যথা হলে একে ব্যতিক্রম হিসেবে নিতে হবে। বর্তমানে বারোটা ডাকোটা দল পৃথক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে কারণ তারা তাদের সাংগঠনিক স্বার্থের দিক থেকে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল। আমেরিকানদের প্রাগ্রসরতার দরুন তাদের পৃথক হওয়াটা অনেকটা বাধ্য হয়ে ঘটে। তারা আগে এমনভাবে সংযুক্ত ছিল যে মিসৌরির টিটন নামে একটা নূতন ভাষার সৃষ্টি হয়। মিসিসিপির ইসাউনটি হল এদের আসল ভাষা। কয়েক বছর আগে ছাব্বিশ হাজার লোকের গোষ্ঠী চেরোকীদের সাক্ষাৎ মেলে যারা একই ভাষায় কথা বলে। এক ভাষায় কথা বলে এত বিপুলসংখ্যক লোক আর কোথাও দেখা যায় নি, অবশ্য জর্জিয়ার পাহাড়ি জেলায় ভাষায় কিছুটা হেরফের ঘটেছে, তবে ভাষা হিসেবে পৃথক ভাবার মতো নয়। এমনি আরো কিছু তথ্য আছে, তবে গোষ্ঠীরা ভাষায় সুসংবদ্ধ একক। ওজিবওয়ারা সংখ্যায় প্রায় পনের হাজার যারা একই ভাষায় কথা বলে। ডাকোটারা সংখ্যায় পঁচিশ হাজার এবং এরা দুটি কথ্য ভাষায় কথা বলে। গোষ্ঠী হিসেবে এরা অস্বাভাবিকভাবে বড়। অন্যান্য জায়গায় দু হাজারের বেশি লোক দেখা যায় না।

। গণ কর্তৃক প্রধানসমূহ ও সাকেমসমূহ নির্বাচনের পর তাদের প্রতিষ্ঠিত করা

ইরাকোয়াদের মধ্যে একজন প্রধান নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় না, প্রধানদের পরিষদ তাকে যতদিন না অভিষিক্ত করে। গণের প্রধানদের নিয়ে গোষ্ঠী পরিষদ এবং এই পরিষদ গোষ্ঠীপ্রধানকে গোষ্ঠীর স্বার্থ ও সম্পত্তি সব বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু মিত্রসংঘ সৃষ্টি হবার পর সাকেম এবং গণপ্রধানদের বুঝে নেবার ক্ষেত্রে গোষ্ঠী পরিষদের জায়গায় মিত্রসংঘ পরিষদ এই ভার নেয়। মেক্সিকোর উত্তরে যেসব গোষ্ঠী ছিল তাদের মাঝে সাকেম পদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত করা হত। এই ব্যাপারটা ছিল প্রায় সর্বজনীন।

অবশ্য দেলাওয়ারদের প্রতিটি গণে একটা সাকেম (সা-কেমা) পদ ছিল এবং গণের মধ্যে এই পদটি উত্তরাধিকার সূত্রে নির্ণীত হত। এ ছাড়া ছিল দুজন সাধারণ প্রধান এবং দুজন সামরিক প্রধান, এইভাবে তিনটি গুণে মোট পনের জন প্রধান নিয়ে গোষ্ঠী পরিষদ গঠিত হয়। ওজিবওয়াদের মধ্যে অনেক সময় কোনো গণের প্রধান মূল ভূমিকা নিত। প্রতি গণে একটি করে সাকেম এবং কিছু সাধারণ প্রধান ছিল। কোন গণের লোকসংখ্যা খুব বেশি হলেও ব্যবস্থা ছিল এমনি। প্রধানদের সংখ্যার অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা সীমা ছিল না। প্রধান বা সাকেমের ক্ষেত্রে ঠিক কী নিয়ম ছিল এই তথ্য সগ্রহ করা সম্ভব হয় নি।

। সাকেম ও প্রধানদের পদচ্যুত করার অধিকার।

যে গণের সাকেম ও প্রধান এই অধিকার প্রধানত সেই গণের হাতে ন্যস্ত ছিল। কিন্তু গোষ্ঠী পরিষদের হাতেও ছিল সেই একই ক্ষমতা। বরং গণের ক্ষমতার চেয়ে কিছুটা বেশি, এমনকি গণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তা কাজ করতে পারে। আদিম যুগে এবং বর্বর যুগের নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে একজনকে প্রায় সারা জীবনের জন্যে পদাভিষিক্ত করা হত অভিষিক্ত করা হত যতদিন ভালোভাবে কাজ করতে পারে। কয়েক বছর হিসেবে পদের মেয়াদ সম্বন্ধে তখনো মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। তাই স্বায়ত্তশাসনের জন্যে এই অধিকার ভীষণ জরুরি ছিল। এই অধিকার সব সময় গণের হাতে ছিল এবং ছিল গোষ্ঠীর হাতেও। মানুষের মনে সর্বোচ্চ ক্ষমতার একটা ধারণা খুব অস্পষ্টভাবে ছিল, যা কোনো দিন সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয় নি।

। একটি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং তার উপাসনা

বর্বরদের মতো আমেরিকান ইণ্ডিয়ানরা ছিল এক ধর্মবিশ্বাসী জনসমষ্টি। গোষ্ঠীরা বিশেষ বিশেষ ভ্রাতৃত্বে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করত। তাদের উপাসনা হত নাচ এবং খেলার মাধ্যমে। অনেক সময় এক মাস আগে উৎসবের কথা জানিয়ে দেওয়া হত যাতে সবাই তৈরি হতে পারে। আদিবাসীদের ধর্ম সম্বন্ধে ভবিষ্যতের অনুসন্ধানকারীর কাজ রয়েছে প্রচুর। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও তুলনামূলক ধর্মীয় পাঠের জন্যে এইসব তথ্য তার কাজে সাহায্য করবে। এই উপাসনা অনেক গোষ্ঠীতে ঔষধি-ভবন (মেডিসিন লজ) কেন্দ্র করে হত।

তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস কোনো নির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণায় ব্যাপ্ত ছিল না বরং স্কুল কুসংস্কার কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। বেশির ভাগ গোষ্ঠীতে ছিল বস্তুপুজো এবং অগ্রসরমান গোষ্ঠীগুলোতে ঝোঁক ছিল বহু-ঈশ্বরবাদের দিকে। ইরোকোয়ারা একটি শুভ ও একটি অশুভ ভৌতিক শক্তি বিশ্বাস করত। এরপর ছিল বিভিন্ন ভৌতিক শক্তি, আত্মার অবিনশ্বরতা, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস, ইত্যাদি। এই মহা-শুভশক্তি ও মহা-অশুভশক্তিকে মানুষের আকারে কল্পনা করা হত। অশুভশক্তি হল হে-নো, বজ্রের ভৌতিক রূপ হল গা-ওহ, বায়ুর ভৌতিক রূপ, এ ছাড়া তিন বোন যারা যব, শিম, ও মটরসুঁটির ভৌতিক ক্ষমতা। এ ছাড়া ছিল নানা রকম গাছ ও ঝরনার ভূত। এদের ক্ষমতা সম্বন্ধে তেমন বেশি কল্পনা করা হয় নি।

বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে প্রতিমা উপাসনা ছিল অজ্ঞাত।[৭] আজটেকদের ব্যক্তিক দেবতা ছিল এবং তাদের মূর্তি মন্দিরে পূজার জন্যে রাখা থাকত। এদের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্য পেলে দেখানো যেত যে কীভাবে তা সামান্য বিশ্বাস থেকে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে। আমেরিকান আদিবাসীদের ধর্মীয় উৎসবে উপাসনার মাধ্যম হিসেবে নাচ ছিল অবিচ্ছেদ্য। পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে নাচ সম্বন্ধে এমন পরিকল্পিত উন্নয়ন ঘটে নি। আমেরিকান বর্বরদের প্রতিটি গোষ্ঠীতে দশ থেকে ত্রিশটা নাচের ধারা আছে। প্রতিটি ধরনের নাচের আছে নিজস্ব নাম, গান, বাদ্যযন্ত্র, তাল, পোশাক-পরিচ্ছদের বিশিষ্টতা। এদের মধ্যে সমর নৃত্য সব গোষ্ঠীতে সাধারণ। বিশেষ কোনো নাচ আবার কোনো গণের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। নাচ দেখাশোনার জন্যে বিশিষ্ট লোক নিযুক্ত করা হয়। ডাকোটা, ক্রী, ওজিবওয়া, ইরোকোয়া এবং পুয়েবলোদের নাচের তাল, বাজনা ও পোশাকের পরিকল্পনা প্রায় এক চরিত্রের। আজটেকদের নাচের পরিকল্পনাও প্রায় এদের মতো। সমগ্র আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে বিশ্বাস এবং উপাসনার সাথে নাচ সরাসরিভাবে জড়িত এবং উপাসনার অন্যতম একটি মাধ্যম।

। প্রধানদের পরিষদের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সরকার গঠন।

গণের মধ্যে পরিষদের একটা স্বাভাবিক ভিত্তি আছে কারণ তাদের লোক নিয়েই এই পরিষদ গঠিত। গণ সমাজে পরিষদ বিশেষ একটা চাহিদা মেটায়। গণকে তুলে ধরছে তার প্রধানরা, প্রধানদের গঠিত পরিষদ গোষ্ঠীর প্রতিমূর্তি। এই সংগঠন সামাজিক পদ্ধতিতে একটি স্থায়ী বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং গোষ্ঠীর ওপর এর একটা কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়, যদিও পরিষদ জনসাধারণের মতামত তুলে ধরত। ব্যাপারটা দেখতে (অলিগাকি। স্বল্প কয়েকজনের শাসন বলে মনে হলেও আসলে এই সরকার হচ্ছে প্রতিভূ-মাধ্যমে গণতন্ত্র। এইসব প্রতি সারা জীবনের জন্যে নির্বাচিত হলেও এদের পদচ্যুত করার ক্ষমতা গণের ছিল। মানবজাতির প্রারম্ভেই গণতন্ত্র তার মূল নিহিত করে। এই গোষ্ঠী সংগঠনেও তার বীজ রয়েছে, পরে যা একটা বিরাট আদর্শের জন্ম দেয়।

পরিষদের কাজ হল গোষ্ঠী-স্বার্থ রক্ষা করা। পরিষদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করে গোষ্ঠীর উন্নতি ও অস্তিত্ব। অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধের জন্যে এসব প্রশ্নের মূল্য ছিল অপরিসীম। যে কোনো লোক জনস্বার্থের সাথে জড়িত পরিষদকে এমন প্রশ্ন করতে পারত। এমনকি কোনো মহিলাও তার নির্বাচিত কোনো বক্তার মুখ দিয়ে তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারত। কিন্তু একমাত্র পরিষদই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। ইরোকোয়াদের মধ্যে নিয়ম ছিল কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে সবাই একমত হতেই হবে। এই প্রথা সর্বজনীন ছিল কি না আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

সামরিক কার্যে যোগ দেওয়া না দেওয়া ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত। যাদের সাথে কোনো শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় নি তত্ত্বগতভাবে তেমন প্রতিটি গোষ্ঠী ছিল একে অপরের সাথে যুদ্ধ-সম্পর্কে সম্পর্কিত। যে কোনো লোক সেনাদল তৈরি করে অন্য কোনো গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালাবার অধিকারী ছিল। কেউ এমনিতর পরিকল্পনা গ্রহণ করে লোকদের

জানিয়ে দেয় এবং স্বেচ্ছাসেবক চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়। এই পদ্ধতির ফলে অন্তত জনপ্রিয়তার একটা পরীক্ষা হয়ে যায়। সে সফল হলে দল তৈরি করে প্রস্তুত হতে থাকে। কোনো গোষ্ঠী আক্রান্ত হলে তেমনিভাবে প্রতিরোধের জন্য দল গড়ে তোলে। এমনি এক জন সেনাপতি ও কয়েক জন সেনাপতি-পরিষদ নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে প্রতিটি ভাতৃত্বের নিজস্ব সেনাপতির অধীনে লোকেরা যুদ্ধ করত। আজটেক ও টলাস্কুলাদের সব ভ্রাতৃত্বের নিজস্ব পোশাক ও পতাকা ছিল পৃথক।

যুদ্ধের ক্ষেত্রে গোষ্ঠী ও মিত্রসংঘ সংগঠন হিসেবে ছিল দুর্বল। আজটেক ও ইরাকোয়া গোষ্ঠীগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে শক্রর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ছিল খুব দক্ষ। যেসব গোষ্ঠী বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে ছিল যাদের মধ্যে ইরোকোয়াও পড়ে, এদের যোদ্ধা দল যখন-তখন যুদ্ধে যাত্রা করত, এমনকি দূর অঞ্চলেও যেত। তারা যুদ্ধযাত্রাকালে শস্যচূর্ণ ও শুকনো মাছ কোমরবন্ধের থলিতে বেঁধে দূরদূরান্তে গিয়ে আক্রমণ চালাত। প্রত্যাবর্তনের পর তাদের আবার আনুষ্ঠানিকভাবে সমাদরে গ্রহণ করা হত। এই যুদ্ধযাত্রার জন্যে পরিষদের কোনো অনুমতি নেওয়া হত না বা তার প্রয়োজনও ছিল না।

গোষ্ঠী পরিষদের যুদ্ধ ঘোষণা ও শান্তি স্থাপনের ক্ষমতা ছিল। স্বাধীন গোষ্ঠীদের মধ্যে আদান-প্রদানের ব্যাপারে বিজ্ঞ লোকদের শুভেচ্ছা মিশন পাঠানো হয়। এই ধরনের কোনো শুভেচ্ছা মিশনের যখন অন্য গোষ্ঠীতে যাবার প্রয়োজন হয় যে গোষ্ঠীতে যায় তারা বেশ জাঁকজমকের সাথে এদের গ্রহণ করে।

। কোনো কোননা ক্ষেত্রে গোষ্ঠীতে মহা-প্রধান নিযুক্ত করা

কোনো কোনো ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীতে সাকেঁদের মধ্য থেকে একজন মহা-প্রধান নিযুক্ত হয়। এই পদ পাবার ফলে তার মান বেড়ে যায়। এই পদের বিশেষ করে প্রয়োজন হয়ে পড়ে যখন গোষ্ঠীতে পরিষদ থাকে না। এই পদের তেমন কিছু কাজ থাকে না। যদিও পরিষদ সর্বেসর্বা অবশ্য খুব কম সময় তার অধিবেশন চলে, এক্ষেত্রে একজনকে নিযুক্ত করা উচিত যে সমস্ত গোষ্ঠীর প্রতিভূ হবে। অবশ্য পরিষদ তার কাজে অনুমতি দিলে তবেই। মহা-প্রধান নিযুক্ত হবার এটাই একমাত্র ভিত্তি, লেখক অন্য কোনো কারণ দেখতে পায় নি। এর কাজ এত সামান্য যে একজন হাকিমের কাজও তা নয়। অনেক লেখক একে রাজা বলেছেন, আসলে তা হাস্যকর। এমনকি তাদের নির্বাহী হাকিম পদ সৃষ্টির ক্ষমতাও ছিল না। ইরোকোয়া গোষ্ঠীর কোনো মহা-প্রধান ছিল না এবং তাদের মিত্রসংঘেও কোনো নির্বাহী অফিসার ছিল না।

ইণ্ডিয়ান প্রধানদের এই পরিষদের নিজের গুরুত্ব যতটা না তার চেয়ে দেখার হল যে বর্তমান পৃথিবীর পরিষদ, কংগ্রেস ইত্যাদির বীজ তখনই বপন করা হয়। এটা অনুধাবন করার বিষয়।

সরকার ধারণার জন্ম সেই আদিম অবস্থায় গণের মধ্যে জন্মলাভ করে। গণ সমাজ থেকে রাজনৈতিক সমাজে আসা পর্যন্ত তিনটি বড় পর্যায় দেখা যায়। প্রথম পর্ব গণ কর্তৃক গোষ্ঠীতে প্রধানদের পরিষদ গঠন। এখানে সরকার একটি ক্ষমতাবিশিষ্ট, অর্থাৎ শুধু পরিষদনির্ভর সরকার। বর্বর যুগের নিম্ন পর্বে এই স্তর ছিল। দ্বিতীয় পর্ব হল প্রধানদের পরিষদ ও সেনাপতিদের নিয়ে সরকার। একটি বেসামরিক, অন্যটি সামরিক কার্য সমাধা করে। এই দ্বিতীয় পর্ব গোষ্ঠীদের মিত্রসংঘ গঠনের মধ্যেই দেখা গিয়েছিল, বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে এবং মধ্য পর্বে তা পুরো চেহারা গ্রহণ করে। মূল সেনাপতির পদ পরে জন্ম দিয়েছে রাজা, সম্রাট বা রাষ্ট্রপতির। তৃতীয় পর্ব হল জাতির সাধারণ পরিষদ প্রধানদের পরিষদ ও সামরিক নেতা। প্রায় গোষ্ঠীতে এটা শুরু হয় বর্বর যুগের উচ্চ পর্যায়ে। উদাহরণত বলা চলে হোমারের যুগের গ্রিক গোষ্ঠীসমূহ এবং রোমিউলাসের সময়কার ইটালির গোষ্ঠীসমূহ। জাতি হিসেবে বিপুল জনসংখ্যার দেয়াল দিয়ে ঘেরা শহরে বসবাস, গো-মহিষের পাল সম্পদ হিসেবে অনেকের হাতে জমে…এইভাবে জনতার পরিষদ সরকারের একটা বড় উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানদের পরিষদ যা এখনো আছে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে জনসাধারণের কাছে তা অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। জনতার পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় না বরং সিদ্ধান্ত অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করে। সরকার ব্যবস্থায় তার অবস্থা স্থায়ী। পরিষদ শুধু কোনো আইন বা নীতি নির্ধারণ করে, একমাত্র জনতার পরিষদ তা অনুমোদন করতে পারে। এখানে সরকারের তিনটি অংশ দেখা যাচ্ছে, যথা, পূর্বনির্ধারণকারী পরিষদ, জনতার পরিষদ ও সেনাপতি। রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা আসা পর্যন্ত এই ব্যবস্থা ছিল–যেমন এথেন্সে দেখা যাচ্ছে প্রধানদের পরিষদ রূপ নিচ্ছে সেনেটে এবং জনতার পরিষদ হল এক্লেসিয়া বা পপুলার এসেমব্লি। এই একই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে দেখা যায় দুটি হাউসে, এক, সাধারণ-পরিষদ, দুই বিধানমণ্ডল। সেইভাবে পূর্বের সেনাপতির মধ্যে ছিল বর্তমান রাষ্ট্রপতির বীজ।

গোষ্ঠী ব্যবস্থায় দেখছি লোকসংখ্যা কম, খুব তেমন একটা ক্ষমতাশালী সরকার নয়, তবু পরিপূর্ণ সুসংবদ্ধ সমাজ। বর্বর যুগের নিম্ন পর্বের চিত্র আমরা পাই, মধ্য বর্বর যুগে যার কিছুটা বদল ঘটে, লোকজন বাড়ে এবং অবস্থা কিছুটা উন্নত, কিন্তু গণ সমাজ তখনো চলছে, কোনো মৌল পরিবর্তন ঘটে নি। রাজনৈতিক সমাজ তখনো অসম্ভব ব্যাপার। গণ মিলে গোষ্ঠী সংগঠন তখনো ঠিকই রয়েছে। কিন্তু মিত্রসংঘ নিশ্চয় ঘটতে শুরু করে। যেমন মেক্সিকো ভেলিতে দেখা যায় অনেক জনসংখ্যা নিয়ে একটি সরকার ব্যবস্থায় তারা থাকছে। কিন্তু তারা গণ সংগঠন বাদ দেয় নি এবং রাজনৈতিক সমাজে পৌঁছতে পারে নি। গণ সমাজে রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা স্থাপন করা অসম্ভব। রাষ্ট্র জনসংখ্যার ওপর নির্ভর না করে নির্ভর করবে অঞ্চলের ওপর এবং গণ তার একক হবে না, বরং শহর হবে তার রাজনৈতিক একক। মার্কিন ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে সেই অভিজ্ঞতা ও সময়ের প্রয়োজন যার ফলে তাদের সমাজে মৌল পরিবর্তন আসবে। তা ছাড়া গ্রিক ও রোমানদের মতো মানসিক উৎকর্ষ লাভের প্রয়োজন, যারা পূর্বপুরুষের কাজের ধারার ওপর সত্যতা স্থাপন করে।

পরবর্তী পরিচ্ছেদে আমরা দেখব গোষ্ঠীদের মিত্রসংঘ, যার মধ্যে গণ, গোষ্ঠী ও ভ্রাতৃত্বের নূতন সম্পর্ক। দেখব মানবজাতির পরিবেশ ও প্রয়োজনে গণ সংগঠনে খাপ খাইয়ে থাকার ব্যবস্থা। দেখব সেই বর্বর অবস্থায় তারা কেমন করে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

১। ওটা-ওয়া।

২। এখন যেসব নমুনা দেখা যায় তা থেকে বোঝা যায় ওজিবওয়ারা মাটির নল, কলসি এবং জালা তৈরি করেছিল। নানা সময়ে স্যাউন্ট সেন্ট ম্যারি অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে ইণ্ডিয়ানদের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে, যা তাদের পূর্বপুরুষের তৈরি বলে তারা চিনতে পারে।

৩। পটাওয়াটটামি এবং ক্রী-রা সমানভাবে একবিন্দু থেকে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পটাওয়াটটামির পৃথক হয়ে যাবার পর সম্ভবত ওজিবওয়া, ওটাওয়া এবং ক্রী-বা একই ভাষাভাষী ছিল।

৪। প্রেইরি তৃণভূমি ও জঙ্গল থাকায় এখা, তুমি ও জঙ্গল থাকায় এখানে প্রচুর শিকার পাওয়া যেত। প্রেইরি অঞ্চলে কামাল নামে এক প্রকার মূল প্রচুর পাওয়া যেত যা থেকে রুটি তৈরি হত। গ্রীষ্মকালে পাওয়া যেত জামজাতীয় ফল। এদিক থেকে জায়গাটার তেমন মাহাত্ম্য ছিল না, যে জন্য এই অঞ্চল নামকরা ছিল তা হল কলম্বিয়া নদী ও অন্যান্য নদীর স্যালমন মাছ। এই সব নদীর তীরে তারা লক্ষ লক্ষ লোক বসবাস শুরু করে এবং এক এক ঋতুতে প্রচুর মাছ পেতে থাকে। তারা মাছ শুঁটকি করে সারা বছরের খাবার হিসেবে জমিয়ে রাখত। তা ছাড়া শীতকালের জন্যে ঝিনুকও ছিল ভালো খাবার। এর সাথে যোগ হয়েছিল মনোরম আবহাওয়া, টেনেসি ও ভার্জিনিয়া অঞ্চল পর্যন্ত। শস্যের ব্যবহার না জানলেও এইসব অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে এই জায়গা ছিল স্বর্গস্বরূপ।

৫। মনে হয় কলম্বিয়া উপত্যকা গ্যাননীয়া পরিবারের মূল বাসভূমি ছিল। সেখানে তারা দলে দলে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দুই মহাদেশের প্রচুর অঞ্চল দখল করে। এই ধারণার পেছনে দুটো কারণ দেখা যায়, এক, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, দুই, ভাষা। মূল প্রেইরি ভূমির উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃতি প্রায় পনের শ মাইল, আর পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় হাজার মাইল, এটাই ছিল প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরীয় উপকূল অঞ্চলের লোকদের মধ্যে প্রধান বাধা। তাই মনে হয় মূল দলটি কলম্বিয়া থেকে প্যাটাগোনিয়ার দিকে স্থানান্তর গ্রহণ করে, ফ্লোরিডার দিকে যায় নি। যেসব কারণ জানা গেছে তা থেকে বলা যায় এই অঞ্চল ছিল ওদের আদি বাসভূমি তবে এর সাথে আরো কিছু কারণ যোগ করতে পারলে বাপারটার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায়।

ভুট্টার চাষ যে তাদের মধ্যে খুব একটা পরিবর্তন ঘটায় তা নয়, তারা স্থানান্তরে যেতেই থাকে, যদিও ভুট্টা প্রগতির পথে সহায়ক হয়। আমেরিকার এই শস্য ঐ অঞ্চলের নিজস্ব বীজ কি না তা জানা যায় নি। তবে মধ্য আমেরিকার নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল নানা রকম শস্য ও ফলের জন্যে বিখ্যাত তাই মনে হয় এই অঞ্চলেই ঐ শস্য পাওয়া গেছে। মধ্য আমেরিকায় যদি শস্যের ব্যবহার শুরু হয়ে থাকে, প্রথমে তা গেছে মেক্সিকোয়, তারপর নিউ মেক্সিকো এবং মিসিসিপি উপত্যকা এবং পূর্ব দিকে আটলান্টিক তীরাঞ্চল। মূল জায়গায় যতটা ফলন হত অন্যান্য অঞ্চলে তার চেয়ে কম হওয়াটা স্বাভাবিক। এর পর সমগ্র ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীতে যে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়বে ধারণা করা যায়। কিন্তু কলম্বিয়া উপত্যকা থেকে তা নিউ মেক্সিকোর বেশি অঞ্চলে ছুড়ায় নি। যদিও দেখা গেছে ওপর মিসৌরীর মিনিটারি ও মাস্তানদের মধ্যে চাষবাস উত্তরের লাল নদী অঞ্চলের শাইয়ানদের মধ্যে দেখা গেছে, কানাডার সিমকো হ্রদ অঞ্চলের হিউরনদের মধ্যে দেখা গেছে, কেনেবাকের আবোকিদের মধ্যে এবং মোটামুটি মিসিসিপি থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত প্রায় সব গোষ্ঠী চাষের কাজ জানত। কলম্বিয়া উপত্যকা থেকে স্থানান্তর গমনকারী দলগুলো তাদের পূর্বপুরুষের রাস্তা ধরে মেক্সিকো এবং নিউ মেক্সিকোর ইণ্ডিয়ানদের ওপর চাপ দেয়। ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলোকে ইসধুমাসের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়। এইসব স্থানাছুত গোষ্ঠীরা তাদের সঙ্গে করে প্রগতির বীজ বহন করে নিয়ে যায়। এমনি বারবার বিভিন্ন দল উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ায় দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর অংশ তাই ক্রমশ উন্নতি করতে থাকে। ফলে সারা দক্ষিণ আমেরিকা এক সময় উন্নতি লাভ করে। দক্ষিণ আমেরিকা ছিল অনুন্নত, কিন্তু এই প্রক্রিয়ার ফলে তারা ক্রমশ এগিয়ে যায়। পেরুর যে উপকথা চালু আছে ম্যানকো ক্যাপাক ও মামা ওয়েলো সম্বন্ধে, যারা সূর্যের ছেলেমেয়ে, ভাই-বোন এবং স্বামী-স্ত্রী, এই কাহিনী দেখে মনে হয় যে একটি গ্রামীণ ইণ্ডিয়ান দল দূর দেশ থেকে ঐ অঞ্চলে যায়, এরা সরাসরি উত্তর আমেরিকা থেকে গেছে এমন নাও হতে পারে, তবে এরা একত্রিত হয়ে নিম্ন শ্রেণীর গোষ্ঠীদের বিশেষ করে আগুদের উন্নত জীবনব্যবস্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করে, ভুট্টা ও গাছ লাগানোর ভান দান করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় ঐ উপকথায় ঐ দলের কথা বাদ পড়ে গেছে, মনে রাখা হয়েছে শুধু সেই দলের নেতা ও তার স্ত্রীর কথা।

৬l “Coll. Ternaux-Compans”, IX. pp. 181-183.

৭। গত শতাব্দীর শেষের দিকে সেনেকা-ইরোকোয়ারা এলেঘানি নদীর পারে একটি গ্রামে কাঠের মূর্তি স্থাপন করে এবং একে ঘিরে নাচে ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে। আমাকে জানান উইলিয়াম পার্কার, তিনি প্রতিমাটাকে নদীতে ভাসতে দেখেন। এটা কোন দেব-দেবীর মূর্তি তা অবশ্য তিনি জানাতে পারেন নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *