• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১৮. জীবন দত্ত ডাকে গেলে

লাইব্রেরি » তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় » আরোগ্য-নিকেতন (১৯৫৩) » ১৮. জীবন দত্ত ডাকে গেলে

জীবন দত্ত ডাকে গেলে আতর-বউ ঘুম পেলে ঘুমকে বলেন-চোখের পাতায় অপেক্ষা কর, এখন চোখে নেমো না। সে আসুক, তারপর। শুয়ে শুয়েও জোর করে জেগে থাকেন। চোখের পাতা ঢুলে নেমে আসে, আতর-বউ জোর করে চোখ মেলেন,পাশ ফেরেন, রাধাগোবিন্দ বলে। ইষ্টনাম করেন; বেশি ঘুম পেলে উঠে বসে পানদোক্তা খান—মধ্যে মধ্যে নন্দকে তিরস্কার করেন; নন্দকে নয়, মন্দর নাকডাকাকে বলেন, নাক মানুষের ডাকে; কিন্তু তাই বলে এমনি করে। ডাকে? শিঙের ডাক হার মানে! শুধু শিঙের ডাক? মনে হচ্ছে কেউ যেন করাত দিয়ে দরজা কাটছে! নন্দ, অ-নন্দ। শুনছি, একটু কম করে নাক ডাকা বাপু। পাশ ফিরে শো।

জীবন দত্ত এলেই এসব সমস্যার সমাধান হয়। তিনি কোনোদিন জিজ্ঞাসা করেন—কেমন। দেখে এলে গো? কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করেন না, নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়েন এবং আধ মিনিটের মধ্যেই তাঁর নিজের নাক ডাকতে শুরু করে।

নন্দ উঠে হাতমুখ ধোবার জল দেয়, হাতমুখ ধুয়ে ইষ্ট স্মরণে বসেন, তারপর খাবারের ঢাকা খুলে খেতে বসেন। নন্দ তামাক সাজে, হুঁকো-কন্ধে হাতে দিয়ে নন্দও গিয়ে শুয়ে পড়ে; খেয়ে উঠে মশায় তামাক খান—আর ভাবেন। রোগের কথা। কোনোদিন মৃত্যুর কথা। যেদিন রোগী মারা যায়—সেদিন ফিরে এসে চিকিৎসাপদ্ধতির কথাটা ভেবে দেখেন, ত্ৰুটি মনে হলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন; না-হলে মৃত্যুর কথাই ভাবেন। তারপর গোবিন্দ স্মরণ করে শুয়ে পড়েন। যেদিন ডাক থাকে না, সেতাবের সঙ্গে দাবা খেলে কাটে, সেদিন ভাবেন-দাবার চালের কথা। একটার আগে কোনোদিন ঘুমানো হয় না। আজ বাজে বোধহয় দুটো—আড়াইটে।

***

পরদিন ঘুম ভাঙতে দেরি হল।

প্রথমেই মনে হল—গণেশ ভটচাজের মেয়েটির কথা। কেমন আছে? ডাকতে গেলেন। নন্দকে জিজ্ঞাসা করবেন গণেশ ভটচাজের বাড়ির কেউ এসেছে কি না। কিন্তু পরক্ষণেই সাধারণের চেয়ে আয়তনে বড় তার মাথাটি বার বার নানা বলে যেন দুলে উঠল। এবং গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে উঠলেন–জয় গোবিন্দ পরমানন্দ।

হাত জোড় করে জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন–নমঃ বিবস্বতে ব্ৰহ্মণভাস্বতে বিষ্ণুর্তেজসে জগৎসবিত্রে সূচয়ে সবিত্রে কর্মদায়িনে—নমঃ!

মৃত্যুধ্রুব এই পৃথিবীতে এত চঞ্চল হলে চলবে কেন?

মুখহাত ধুয়ে চা খেতে বসলেন। তামাক সেজে দিয়ে নন্দ কোটি বাড়িয়ে ধরল। বললে–আজকে আট-দশ জন রুগী এসেছে।

হুঁকোয় টান দিয়ে মশায় বললেন– নবগ্রামের কেউ এসেছে? গণেশ ভটচাজ?

—না তো।

–হুঁ। মশায় ক্ষুণ্ণ হলেন একটু। কাল রাত্রি বারটা পর্যন্ত তিনি গণেশের জন্য বসে ছিলেন, ওই প্রদ্যোত ডাক্তারের রূঢ় কথা শুনে এলেন, আর আজ একটা খবরও দিলে না? বেশ বুঝলেন—মেয়ে ভাল আছে। উৎকণ্ঠা কমে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গিয়েছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি।

নন্দ বললে—চেঁচামেচি করছে সেই বামুন, দাঁতুঠাকুর।

–কেন? কাল তো তাকে এক সপ্তাহের ওষুধ দিয়েছি?

—সে আবার এসেছে। গাঁজা না খেয়ে তার ঘুম হয় নাই। বলছে হয় গাঁজা খেতে বলুক, নয় ঘুমের ওষুধ দিক। এসে থেকে চেঁচাচ্ছে।

—চেঁচাক। পরান খাঁ এসেছে?

–না। এখনও আসে নাই। এইবার আসবে। বার কয়েক হুঁকোয় টান দিয়ে হুঁকোটা নর হাতে দিয়ে মশায় উঠে দাঁড়ালেন, বললেন– রোগীদিকে বসতে বলবি। আমি এখন যাব-—একবার মহাপীঠে মহন্তকে দেখতে।

নন্দ মাথা চলুকে বললে—তা ওদিকে একবার দেখে ওষুধপাতি লিখে দিয়ে গেলেই তো হত। পরান খাঁ গাড়ি নিয়ে আসবে, সেই গাড়িতেই পথে গোঁসাইকে দেখে আসতেন।

মশায় জবাব দিলেন না। শুধু ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে পকেটে স্টেথোসকোপটা পুরে পুরনো জুতো জোড়াটা পরতে লাগলেন। নন্দ গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল—যত বেগারের কাজ; সক্কালে বিনি পয়সায় রুগী দেখা! এমন করলে রুগী আসবে কেন? হুঁ। এই করেই এমন হয়। সেই মিত্তিরিবাবু বলে গিয়েছিল—মহাশয় লোকের কথা—সে কি মিছে হয়?

মোয় হাসলেন। মনে পড়েছে। প্রৌঢ় জমিদার গৌরহরি মিত্তিরের কথা বলছে নন্দ। নন্দ ছিল তখন সেখানে, শুনেছিল।

***

আরোগ্য-নিকেতনে তখন সে কী ভিড়! চল্লিশ পঞ্চাশ ষাট জন রোগী!

জগৎ মশায়ের মৃত্যুর পর আরোগ্য-নিকেতনের দৈন্যদশা এসেছিল। সে দৈন্যদশাকে জীবন দত্ত তখন কাটিয়ে আবার সমৃদ্ধি ফিরিয়ে এনেছেন। রঙলাল ডাক্তারের কাছে শিক্ষা শেষ করে তখন তিনি অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি, মুষ্টিযোগ—তিন ধারার ওষুধ নিয়ে চিকিৎসা করেন। গুরু রঙলাল রহস্য করে বলেছিলেন-ট্রাইসিকেলে চেপে চল তুমি। সে ট্রাইসিকল তার ভাগ্যগুণে এখনকার মোটরগানো তিন চাকার ভ্যান হয়ে উঠেছিল।

আরোগ্য-নিকেতন নাম তখন হয়েছে। তিন-তিন জন লোক খাটত। অ্যালোপ্যাথি ওষুধের কম্পাউন্ডার ছিল শশী। শশী বলত রম্‌রম্‌ প্র্যাকটিস।

মদ খেলে বলতে–জীবন মশায়ের প্র্যাকটিস—শা–; পানসী রে বাবা, পানসীর মত চলছে-সন্ সন্ সন্ সন্।

মদ হতভাগা অল্প বয়স থেকেই খায়। নবগ্রামের বামুনবাড়ির ছেলে। ওর দৌরাত্ম্যে ভাইনাম গ্যালাসিয়া, মৃতসঞ্জীবনী লুকিয়ে রাখতে হত। কোনোক্রমে পেলেই বোতলে মুখ লাগিয়ে খেয়ে নিত খানিকটা। বলত–রঙলাল দি সেকেন্ড।

জীবন মশায়ের আকাঙ্ক্ষার কথা না জেনেই বলত।

বাড়িয়ে বলত। সে আকাঙ্ক্ষা তাঁর পূর্ণ হয় নি। রঙলাল ডাক্তারের স্থান পূর্ণ করবার সাধ্য বা ভাগ্য তার নয়; রঙলালের স্থান পূর্ণ হয় না। তবুও কতকটা পূর্ণ করেছিলেন-কীর্নাহারের নবীন ডাক্তার। সদর শহরে অবশ্য তখন একজন প্রতিভাবান ডাক্তার এসেছেন; গোকুল ডাক্তার। মেডিক্যাল কলেজের সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র। আশ্চর্য মানুষের ভাগ্য, এমন ডাক্তারেরও শেষ পর্যন্ত দুর্নাম হয়েছিল। লোকে বলত গোকুল ডাক্তার ছুঁলে রোগী বাঁচে না। গোকুল ডাক্তারও তাঁকে সম্মান করতেন। নাড়িতে কী পেলেন—সে কথা জিজ্ঞাসা করে মন দিয়ে শুনতেন।

নবগ্রাম অঞ্চলে তখন তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

জগৎ মশায়ের মৃত্যুর পর এখানে তিন জন ডাক্তার এসে বসেছিল। দুর্গাদাস কুণ্ডু প্রথম পাসকরা ডাক্তার। দুর্গাদাস তাকে উপহাস করে বলত ঘাসপাতা জড়িবুটির চিকিৎসক।

তারপর হরিশ ডাক্তার। হরিশ তাকে মানত। কিশোরের অসুখের সময় ডায়াগনোসিসে তার কাছে ঠকে তার শিক্ষা হয়েছিল।

আর এসেছিল এক পাগল। খেতু বাড়ুরী। সে নিজে বলতকে. এম. ব্রারোরী, হোমিওপ্যাথ। ভাল লোক, সরল লোক, কিন্তু পাগল। চুরোট খেত, চায়না-কোট পরত। বলত ওদিকে হরিশ ডাক্তার, এদিকে আমি, মাঝখানে দত্তটা চাপা পড়ে মারা গেল। ওকে আর কেউ ডাকবে? নাড়ি দেখে কেমন আছে—এর জন্যে ওকে কে ডাকবে? ফুঃ!

দুর্গাগাস কুণ্ডু সর্বপ্রথম এসেছিল—চলেও গিয়েছিল সর্বপ্রথম। বলে গিয়েছিল—জানতাম না এটা গরুভেড়ার দেশ। ঘাসপাতা জড়িবুটিতে এদের অসুখ সারে। অ্যালোপ্যাথি বিলিতি ওষুধ খাটে না।

এরপর বাড়ুরীও পালাল। ছিল শুধু হরিশ। নবগ্রামের ব্রজলালবাবু চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি স্থাপন করলেন, সেখানে চাকরি পেয়ে থাকতে পেরেছিল। মাইনে ছিল তিরিশ টাকা।

জীবন দত্ত তখনই হলেন মশায়। আয় কত মনে নাই। হিসেব নাই। দিনরাত্রিতে বিশ্রাম ছিল না। আরোগ্য-নিকেতনে রোগী দেখতে বেলা তিনটে বেজে যেত।

হিন্দু, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, শূদ্ৰ, মুসলমান, পুরনো মহুগ্রামের খয়েরা, পশ্চিম পাড়ার শেখেরা, ব্যাপারিপাড়ার ব্যাপারিরা, মীরপাড়ার মিয়ারাও এসেছেন গরুর গাড়ি করে। ড়ুলি এসেছে, গাড়ি এসেছে, পালকি এসেছে। সেদিন পাঁচ ক্ৰোশ উত্তর থেকে এসেছিলেন সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশের এই গৌরহরী মিত্র মহাশয়। খোলা দরজার ভিতর দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে পালকিতেই শুয়ে ছিলেন।

তিনিই সেদিন আরোগ্য-নিকেতনে প্রথম এসেছিলেন। কিন্তু জীবনমশায় শেষত্রে কলে গিয়েছিলেন নবগ্রামে। ওই নিঃস্ব জমিদার রায়চৌধুরীদের এক শরিকের বাড়ি। বৃদ্ধ গৌরাঙ্গ রায়চৌধুরী অকস্মাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সন্ন্যাস রোগ। তাকে দেখেই ওঁর কর্তব্য শেষ হয় নি, তার জীবন থাকতে গঙ্গাতীরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাতেও থাকতে হয়েছিল। বৃদ্ধকে পালকিতে গঙ্গাতীরে রওনা করে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। এবং প্রথমেই দেখেছিলেন মিত্র মহাশয়কে। তাঁর কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন।

–অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে আপনাকে। কিন্তু কী করব? আমাদের এখানকার প্রবীণ জমিদার, প্রাচীন জমিদারবংশ।

সংক্ষেপে বিবরণটুকুও বলতে হয়েছিল।

মিত্র হেসে বলেছিলেন-দত্ত মহাশয়। না, দত্ত আর নয়, আপনি এবার আপনাদের পৈতৃক শুদ্ধ মহাশয়ত্বের অধিকারী হয়েছেন। এ অবশ্য আপনারই যোগ্য কাজ। কিন্তু এদিকেও একটু লক্ষ্য রাখবেন। দূরদূরান্তর থেকে আসে সব, এরাই আপনার লক্ষ্মীর দূত। কষ্ট পেলে অবহেলা করলে ততদিনই আসবে যতদিন আর একজনকে না পাবে।

জীবন মহাশয়ের মনে একটু লেগেছিল। কথাটা লাগবার মতই কথা। তিনি বলেছিলেন অবহেলা আমি করি না। সে করলে আমার পাপ হবে, সে সম্পর্কে আমি অবহিত। কষ্ট লাঘবের চেষ্টাও আমি সাধ্যমত করি।

তাও করতেন। বেলা বেশি হলে—রোগীদের শরবত সাগু বার্লি দিতেন। আরোগ্য নিকেতনের পাশে তখন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সাহায্য নিয়ে কুয়ো করিয়েছিলেন।

বাতাসা পাটালি চিড়ে মণ্ডার দোকানও একটা বসত তখন।

মশায় আরও বলেছিলেন—আর পসারের কথা। সে ভগবানের দয়া, গুরুর শিক্ষা আর আমার নিষ্ঠা। সবচেয়ে বড় কথা-ভাগ্য। যতদিন থাকবার ততদিন থাকবে। এখন বলুন, আপনার কষ্টের কথা বলুন। কী কষ্ট: যিনি দেখেছিলেন তিনি কোনো ব্যাধি বলেছেন?

মিত্র বলেছিলেন—একটু নিরালা হলে ভাল হয়।

ওই নন্দই ছিল ঘরে। মশায় নন্দকে বাইরে যেতে ইশারা করেছিলেন। নিরালায় বলেছিলেন-কন্যার বাড়ি যাচ্ছি। শেষ বয়সে তারই স্কন্ধে ভার হয়ে পড়তে হল। বিষয়-সম্পদ সব গিয়েছে মামলায়। স্ত্রী গিয়েছেন। এটা ওটা করেই চালাচ্ছিলাম, মদ্যপান করি প্রচুর। আত্মহত্যা করতে পারি না ভয়ে। কন্যা নিয়ে যাচ্ছে, আমারও না গিয়ে উপায় নাই। পথে বের হয়ে ভাবলাম আপনাকে একবার দেখিয়ে যাই। কতদিন বাঁচব বলতে পারেন? আপনার নাড়িজ্ঞানের প্রশংসা শুনেছি। দেখুন তো আমার হাতটা।

দমে গিয়েছিলেন ডাক্তার। বলেছিলেন আমার সে শক্তি নাই। সে শক্তি কদাচিৎ কারও শোনা যায়। রোগ নাই

—রোগ আছে। লিভার বেদনা। মাথায় গোলমাল হয়।

–ও মদ্যপানের ফল। মদ্যপান করলে বাড়বে। ছাড়লে কমে যাবে। নীরবে দুটি টাকা রেখে গৌরহরি উঠলেন। জীবন বললে—আমাকে মাফ করবেন। ফি আমি নিতে পারব না। বাড়িতে এই আরোগ্য-নিকেতনে ফি নেওয়া আমাদের পূর্বপুরুষের নিষেধ আছে।

—কোনো গরিব রোগীকে টাকা দুটো সাহায্য হিসেবে দিয়ে দেবেন। আমি তো ফি না দিয়ে দেখাই না। দীর্ঘাকৃতি গৌরবর্ণ ঈষৎ কুজ মানুষটি ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিলেন। স্পষ্ট মনে। পড়ছে তার ছবি। এরপরই এসেছিলেন আর এক অভিজাত বংশের সন্তান-ঠাকুরপাড়ার মিঞা।

–আদাব গগা ডাক্তার।

–আদাব আদাব, বসুন। কী ব্যাপার?

এককালে মিঞা সাহেবেরা ছিলেন এ অঞ্চলের অধিপতি–নবাব। খেতাব ছিল ঠাকুর। তারা নাকি যোগী বংশ। মুসলমান সমাজের গুরু। কিন্তু পরবর্তীকালে সম্পদে বৈভবে বিলাসে। হয়েছিলেন ভ্ৰষ্ট। তখন সর্বস্বান্ত। শুধু তাই নয়—বংশধারা পর্যন্ত ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছিল।

একটু চুপ করে থেকে মৃদুস্বরে মিঞা বলেছিলেন—গায়ে যে চাকা-চাকা দাগ দেখা দিচ্ছে। মশায়। পিঠে জানতে—এই দেখেন পায়ের ডিমিতে একটা হয়েছে।

পাজামাটা তুলে দেখালেন মিঞা সাহেব।

–হুঁ! সাড় আছে?

–উঁহুঁ।

ডাক্তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান। চোখে পড়ে—কানের পেটি নাকের ডগা ঈষৎ লাল হয়েছে। বংশের অভিশাপ! সেই ব্যাধি! তাতেই মৃত্যু হয়েছে কয়েকজনের। দুজন এখনও ভুগছেন।

–ডাক্তার!

–বলুন ঠাকুরসাহেব।

—বলেন?

–কী বলব? বংশের রোগ বলেই মনে হচ্ছে। আপনি সময় থেকে চিকিৎসা করান। আমাদের এখানে ওষুধ নাই। তৈরি করতে অনেক খরচ। আপনি কলকাতা থেকে ওষুধ আনিয়ে। ব্যবহার করুন।

—তাই লিখে দেন ডাক্তার।

উঠলেন মিঞা সাহেব।

ড়ুলি করে এসেছেন নারায়ণপুরের ভটচাজ মশায়। বহুমূত্র হয়েছে। বহুমূত্র, বাত, নবজ্বর, পুরনো জ্বর, গ্ৰহণী, অতিসার। প্ৰহ্লাদ বাণী এসেছে। দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল। ডাকাত। জেলখাটা আসামি।

—কী রে, তোর আবার কী?

–আর কী ডাক্তারবাবু–জল-ঘা।

–আবার? জল-ঘা অর্থাৎ উপদংশ। এবার বোধহয় প্রহাদের পঞ্চমবার।

মাথা চুলকে প্ৰহ্লাদ বলে—যে গরু অখাদ্যি খায়, সে কি ভুলতে পারে মশায়?

হাসলেন ডাক্তার।

নবগ্রামের বড়কর্তার বাড়ি যেতে হবে, ডাক আছে। তার ছোট ছেলের চতুর্থবার প্রমেহ দেখা দিয়েছে।

তাঁর বাবার কথা মনে পড়ত। তিনি বলতেন জীবনে আয়ু আর পরমায়ু কথা দুটো শুধু কথার মারপ্যাচ নয় বাবা। ওর অর্থ হল নিগৃঢ়। দীর্ঘ আয়ু হলেই পরমায়ু হয় না, আর আয়ু স্বল্প হলেই সেটা পরমায়ু হয় না এমন নয়। যার জীবন পবিত্র পরমানন্দময়, পরমায়ু হল তার। নইলে বাবা শক্তি চর্চা করেও মানুষ দীর্ঘায়ু হয়। রোগকে সহ্য করে, এমনকি জয় করে।

কথাটা তিনি এই প্রহ্লাদ সম্পর্কেই বলেছিলেন। প্রথমবার উপদংশের আক্রমণে প্রহ্লাদ চিকিৎসা করায় নি। এটা ওটা মলম ব্যবহার করেছিল। দ্বিতীয়বার এসেছিল জগৎ মশায়ের কাছে। সেই উপলক্ষেই বলেছিলেন। প্রহ্লাদ সেবার বলেছিল—লোকে দেখাতে বলছে, তাই। নইলে–ও আপুনিই ভাল হয়।

প্ৰহ্লাদ আজও বেঁচে আছে। আজও লাঠি খেলে বেড়ায়। আজও মাটির উপরে বাহু ঠুকে আছাড় খেয়ে পড়ে।

প্ৰহ্লাদ বলত—তবে চিকিৎসাতে তাড়াতাড়ি সারে। তা ওষুধ দেন।

তখন ইনজেকশন ওঠে নি। ওষুধ নিয়ে টাকা দিয়ে প্রণাম করে চলে যেত প্ৰহ্লাদ। এক টাকা ফি-ও দিত।

ডাক্তার বলতেন—ও কী রে? ফি কেন? বাড়িতে আমি ফি নিই কবে?

—এই দেখেন, বদ্যিপেনামী না দিলে রোগ যে দেহ ছাড়ে না! আর তো দোব না!

এতকালের খাতার মধ্যে প্রদের নামে বাকি হিসাব নেই।

তারপর একের পর এক আসত রোগী। আমাশয়, জ্বর, ম্যালেরিয়া, রেমিটেন্ট, টাইফয়েডও দু-একটা আসত; গ্রহণী, তা ছাড়াও কত রোগ। এক এক রোগীর তিন-চারটে রোগে মিশে সে এক জটপাকানো জটিল ব্যাপার। তাঁর বাবা বলতেন—শাস্ত্ৰে আছে সকল বিকারের অর্থাৎ রোগের আবিষ্কার আজও হয় নি। যদিও কোনো রোগ নতুন মনে হয় তবে তার নাম জান না। বলে সংকুচিত হবে না, লজ্জিত হবে না। লক্ষণ দেখে তার চিকিৎসা করবে। এ যুগে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে ল্যাবরেটরি হয়েছে। সে যুগে তাদের সে সুযোগ ছিল না।

তারপর আরম্ভ হত পাইকিরি দেখা। এ নামটা শশীর আবিষ্কার।

রোগীরা এলে—কার কী অসুখ জেনে কম্পাউন্ডারেরা দুই ভাগে ভাগ করে রাখত। সহজ রোগীদের আলাদা করে একদিকে বসত। অবশ্য অবস্থাপন্ন মান্যগণ্য রোগীদের রোগ সহজই হোক আর কঠিনই যোক তাদের দেখার কাল ছিল প্রথমেই।

পাইকিরি দেখার সময় ডাক্তার এসে বাইরে দাওয়ার উপর বসতেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। গোপাল কম্পাউন্ডার। রোগী দেখে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন বলতেন—সে লিখত। শশীর উপর। তিনি নির্ভর করতে পারতেন না। অন্যমনস্ক শশী কী লিখতে কী লিখবে কে জানে? তা ছাড়া লেখার পর শশী নিজেই পড়তে পারত না কী লিখেছে। ডাক্তারকেই এসে জিজ্ঞাসা করতকী বলেছেন বলুন তো! লেখাটা ঠিক পড়তে পারছি না।

আরোগ্য-নিকেতনে তখন তিন জন কম্পাউন্ডার। শশী, গোপাল, আর কবিরাজি বিভাগে ছিল বাপের আমলের বুড়া চরণদাস সিং। নীরবে ঘরের মধ্যে বসে শুঠ আমলকী চূর্ণ করত, মোদক পাকাত, পুরিয়া বাঁধত।

ডাক্তার বলে যেতেন-কুইনিন সালফেট ১০ গ্রেন, অ্যাসিড সাইট্রিক ২০ গ্রেন, ম্যাগসালফ ১০ গ্রেন, স্পিরিট এনেসি ৫ ফোঁটা, জল।

–আগে এক ডোজ ক্যাস্টর অয়েল খাইয়ে দাও।

সে যেত। আর একজন আসত। আমাশয়। অনেক দিনের। ডাক্তার ডাকতেন—সিংমশায়। চরণদাস এসে দাঁড়াত।

—একে রেসা খাদ্‌মে দেবেন তো। ওটা তাদের মুষ্টিযোগ।

–তোমার কী?

–সুয্যিফোড়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে মাথা ধরা শুরু হয় সূর্যাস্তের পর ছাড়ে। এর মধ্যে ভীষণ যন্ত্ৰণা।

জীবন দত্ত আবার ডাকতেন—সিংমশায়! সুযিফোড়ের মুষ্টিযোগ বলে দিয়ে নতুন রোগীর দিকে মন দিতেন। হঠাৎ চকিত হয়ে উঠতেন।

তিন দিন অল্প জ্বর, মাথায় যন্ত্রণা। একজুরী। জিভ দেখিজিভ দেখেই ডাক্তার সতর্ক হয়ে বসেনদেখি, নাড়ি দেখি। নাড়ি ধরে চোখ বোজেন। ও হাতটা দেখি।

–হুঁ, এস তো বাপু, টেবিলের উপর শুয়ে পড় তো। পেটটা দেখি। ঝাঁপ আছে কি না?

–হুঁ!।

—তুমি বাপু সাবধানে থাকবে। তোমাকে দুদিন ঘোরাবে বোধহয়। বুঝেছ?

নাড়িতে যেন শক্ত রোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। স্পষ্ট বিকাশ এখনও হয় নি। তবে মনে। হচ্ছে। জিভ পেটও তাই সমর্থন করছে। টাইফয়েড।

গোপাল, কাগজ আন। প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতেই ডাক্তার বললেন–দেখো, দুবার জ্বর ওঠানামা করে কি না। লক্ষ্য রেখো।

–আজ্ঞে না। জ্বর তত নাই। ওই একভাবে–সুতোর সঞ্চারে–

—না না! ভাল করে লক্ষ্য কোরো। ভাত–মুড়ি—এসব খেয়ো না। সাগু খাবে। সাগু। দুধ? উঁহুঁ–দুধ খেয়ো না। আর নিজে এমন করে এসো না। বুঝেছ? হ্যাঁ, ঘোরাতে পারে দুদিন।

ব্যস। এইবার গ্রামের কটি রোগীর বাড়ি যেতে হবে। তারপর নবগ্রাম। সাহাদের বাড়িতে একটা নিউমোনিয়া কেস, সুবর্ণবাবুর ছেলের রেমিটেন্ট ফিবার, রমেন্দ্রবাবুর ছোট ছেলের প্রমেহ, নেপালের স্ত্রীর সূতিকা। কেউ ফি দেবে কেউ দেবে না। যারা দেবে, তাদেরও দু-একজনের বাকি থাকবে।

এ ছাড়া পথে আরও কত জন কত বাড়ি থেকে তাকে ডাকত।—মশায়, একবার আমার ছেলেকে দেখুন। ছেলে কোলে নিয়ে পথের ধারেই দাঁড়িয়ে থাকত দু-একজন। কারও কারও বাড়ি যেতে হত। বৃদ্ধ, শয্যাশায়ী যারা—তারা পথের ধারে দাঁড়ায় কী করে?

—মশায়, একবার যদি আমার মাকে দেখে যান!

মনে পড়ছে, সেদিন সেতাব তাকে যোগী বাঁড়ুজ্জেকে দেখতে ডেকেছিল।

জীবন, একবার বাপু যোগী বাড়জ্জেকে দেখে যা। ছেলেপুলে নাই, আমাকেই বললে যোগী–যদি জীবন মশায়ের সঙ্গে দেখা হয় বোলো, একবার যেন দেখে যান আমাকে। চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির ওষুধে তো কিছু হল না।

সেতাব নেপাল এরা দুজনে এইসব রোগীদের পৃষ্ঠপোষক ছিল। ওরা তার জন্যে প্রতীক্ষা করে থাকত।

জীবন দত্ত হাসিমুখেই যেতেন। ওদের বলতেন—বলিস বুঝলি, খবর দিয়ে বলিস। আমি দেখে যাব।

নেপাল খবর আনত–হরিহর ডোম খুব ভুগছে। চল একবার যাবি। গোপলা বাউরির মায়ের জ্বর, তাকেও একবার দেখে যাবি চল।

হরিহরের অসুখ ভাল হলে তার কাছে একটা পাঁঠা আদায় করবে নেপাল। সে জীবন দত্ত জানতেন। এবং সেই পাঠাটা নিয়ে চাল ডাল ঘি মসলা তরিতরকারি নেপাল নিজে দিয়ে একদিন ফিস্ট করবে। জীবন দত্তকে দিতে হবে-মাছ-মিষ্টি।

বাড়ি ফিরতে অপরা। পকেটে টাকায় আধুলিতে দশ-বার টাকা। ফি ছিল তখন এক টাকা। দিনান্তে ফি একবার। দ্বিতীয়বারের ফিয়ের রেওয়াজ ছিল না। জামাটা খুলে দিতেন। আতর-বউকে। ছেলে বনবিহারী মেয়ে সুষমা এসে দাঁড়াত।

–বাবা পয়সা!

জীবন দত্ত ফেরবার পথে আধুলি ভাঙিয়ে নিয়ে ফিরতেন। তার মধ্যে পয়সা কিছু থাকতই। বনুর চারটি, সুষমার দুটি। বনু নিত ডবল পয়সা, বলত, বড় পয়সা নোব। সুষমার ছোটবড় বিচার ছিল না; দুটি হলেই সন্তুষ্ট হত। ছেলে আর মেয়ে। নোট-বইটা খুে লিখে রাখতেন–রমেন্দ্রবাবুর বাড়ির ফি বাকি রইল।

বাড়ির বাইরে তখন আরোগ্য-নিকেতনের সম্মুখে বামনি গায়ের শেখেদের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে। কৃষ্ণপুরের লোক এসেছে। কায়স্থপ্রধান সমাজ কৃষ্ণপুর। মিত্রদের বাড়ির চিঠি নিয়ে এসেছে—দত্ত মহাশয়, একবার দয়া করিয়া আসিবেন। আমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের একজ্বরী জ্বর। রাঘবপুরের কবিরাজ দেখিতেছিলেন কিন্তু কিছু হইতেছে না। ইতি সুরেশচন্দ্র মিত্র।

 

গৌরহরি মিত্তিরের কথাটি নন্দ মনে করে রেখেছে। যখন-তখন বলে। জীবনমশায় হাসলেন; আসলে ওটা নর ক্ষোভ। সেকালের আরোগ্য-নিকেতনের গৌরবের যে ওরাও অংশীদার ছিল। পাওনাও হত অনেক। সেকালে ছিল কাঠের কলবাক্স। যেখানে মশায় পায়ে হেঁটে যেতেন সেখানে নন্দ বা ইন্দির যেত কলবাক্স মাথায় নিয়ে। কারুর বাড়ি দু আনা কারুর বাড়ি চার পয়সা প্রাপ্য হত ওদের। আজ বলতে গেলে সময়মত ওরা মাইনেই পায় না।

দিন যায়, ফেরে না। দিনের সঙ্গে কাল যায়। কালের সঙ্গে গতকালকার নূতনের বয়স বাড়ে, পুরনো হয়, জীৰ্ণ হয়, যা জীর্ণ তা যায়। তাঁর খ্যাতিও গিয়েছে। তাতে আক্ষেপ নেই, কিন্তু দুঃখ একটু হয় বৈকি। উপেক্ষা সহ্য হয় না। তাকে উপেক্ষা করলেও তিনি দুঃখ পেতেন। না। এ যে বিদ্যাকে উপেক্ষা!

–আসুন। তাকে আহ্বান জানালে মোহান্তের শিষ্য ভোলানাথ। পথের উপর দাঁড়িয়ে আছে। মহাপীঠের চারিপাশের বনভূমির একটি বিচিত্ৰ গন্ধ আছে। কত রকমের ফুল এবং বিচিত্রগন্ধা লতা যে আছে এর মধ্যে! অনন্তমূলের রাজ্য বললে হয়।

ভোলানাথ বললে, সকাল থেকে আপনার জন্যে তাগাদা লাগিয়েছে বুড়ো। ডাক মহাশয়কে। নাড়ি দেখুক!

Category: আরোগ্য-নিকেতন (১৯৫৩)
পূর্ববর্তী:
« ১৭. শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি
পরবর্তী:
১৯. সন্ন্যাসী »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑