১০. ডাক্তার হাঁটছিলেন বেশ একটু জোরে

ডাক্তার হাঁটছিলেন বেশ একটু জোরে জোরে। মনের মধ্যে উত্তাপ যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। ওষুধ ঠিক হয়ে গিয়েছে, সে ওষুধ তিনি নিজে তৈরি করে দেবেন। এ দেশেরই সুলভ কয়েকটা জিনিস দিয়ে তৈরি মুষ্টিযোগ। সে কিন্তু ওদের বলবেন না। সংসারে যা সুলভ তার উপর মানুষের আস্থা হয় না। তা ছাড়া এ বলেও দেবেন না। কখনই বলবেন না। এবং একদিনে এই হিক্কা থামিয়ে দিয়ে ওদের দেখিয়ে দেবেন, কী বিচিত্ৰ চিকিৎসা এবং ওষুধ তার আছে। পথ চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। সেতাবকে একবার দেখে গেলে হত। তাহলে কিন্তু ফিরতে হয়, অন্যমনস্কভাবে পথ হাঁটতে হাঁটতে সেতাবের বাড়ির গলিটা ফেলে এসেছেন। থাকবুড়োর জ্বর আজ নিশ্চয় ছেড়ে গিয়েছে। একলাই বোধহয় ছকের উপর দাবার ঘুটি সাজিয়ে বসে আছে। কাল সকালে বরং দেখে যাবেন। এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে এই ওষুধটা তৈরি করে দিতে হবে।

–জীবন মশায়, না কে গো? ওগো জীবন মশায়! পাশের গলি থেকে মেয়েলি গলায় কে ডাকলে।–শোন গো! দাঁড়াও!

দাঁড়ালেন জীবন মশায়। গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়া বিধবা। নবগ্রামের নিশি ঠাকরুন। বিখ্যাত নিশি ঠাকরুন। গ্রামের এ কালের ছেলেরা আড়ালে আবডালে নিশি ঠাকরুনকে বলে—মিসেস শেরিফ অব নবগ্রাম। গ্রামের মধ্যে অসীম প্ৰতাপ নিশি ঠাকরুনের।

নিশি ঠাকরুন এসেই প্রশ্ন করল—বলি হাগো, একে, মানে রনবাবুর ছেলেকে দেখে এলে? কেমন দেখলে বল তো?

জীবন মশায় প্রমাদ গনলেন। কণ্ঠস্বর শুনে তিনি নিশি ঠাকরুনকে অনুমান করতে পারেন নি। কিন্তু অনুমান করা উচিত ছিল, কারণ এই গলিতে এমনভাবে আধিপত্য খাটানো কণ্ঠস্বরে আর কে ডাকবে? নিশি ঠাকরুন এই গলিতে নিজের দাওয়ার উপর বসে থাকে এবং যাকে দরকার তাকেই ডেকে তার প্রয়োজনীয় সংবাদটি সংগ্রহ করে।

জীবন ডাক্তার সংক্ষেপে বললেন–অসুখ কঠিন বটে, তবে হাল ছাড়ার মত নয়। আমি যাই নিশি, ওষুধ দিতে হবে।

—আঃ, তবু যদি মশায়, তোমার ঘোড়া থাকত! দাঁড়াও না।

–ওষুধ দিতে হবে নিশি।

–তা তো বুঝছি। সঙ্গে লোকও দেখেছি। ওরে লোকটাতুই এগিয়ে চল, ডাক্তার যাচ্ছে। আমার মামাতো ভাইয়ের মেয়েটা বড় ভুগছে। পেটের ব্যানো কিছুতেই সারছে না। একবার দেখে যাও মশায়। এই সব হালের ডাক্তারদের পাল্লায় পড়ে এককাড়ি টাকা খরচ করলাম কিছুতে কিছু হল না। তা তুমি তো আর এ গা মাড়াও না। একেবারে আমাদিকে ছেড়েছ। বলি–অ–নীহার, শুনছিস?

—ডাকতে হবে না, চল দেখেই আসি। ওরে দাঁড়া তুই পাঁচ মিনিট।

বাড়ির মধ্যে ঢুকেই নিশি প্রায় পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বললে—ঠিক করে বল দেখি মশায়, রতন মাস্টারের ছেলে বাঁচবে না মরবে?

অবাক হলেন না জীবন মশায়। নিশি ঠাকরুনের স্বভাবই এই। পৃথিবীর গোপন কথাগুলি ওর জানা চাই। জেনে ক্ষান্ত হবে না, প্রচার করে তবে তৃপ্ত হবে।

গম্ভীর কণ্ঠে জীবন মশায় বললেন, আমি তোমাকে লুকিয়ে কথা বলি নি নিশি। নাড়িতে কিছু বুঝতে পারি নি।

–না পার নি! তুমি জীবন মশায়, তুমি বুঝতে পার নি, তাই হয়? লোকে বলে জীবন মশায় রোগীর নাড়ি ধরলে মৃত্যু রোগে মরণ পায়ের চুটকি বাজিয়ে সাড়া দেয়! লুকোচ্ছ তুমি।

এবার ডাক্তার ভ্ৰকুটি করে উঠলেন। নিশি এতে নিরস্ত হল কিন্তু ভয় পেলে না, বললে–আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। ওই হয়েছে। এখন ওললা ও নীহার! বলিযাস কোথায় লা?

—কী পিসি? নীহার এতক্ষণে উত্তর দিলে ঘরের ভিতর থেকে। একটুখানি দরজা খুলে উঁকি মারলে মেয়েটি। সঙ্গে সঙ্গে আচারের গন্ধ পেলেন জীবন মশায়। মেয়েটি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে আচার খাচ্ছিল। আমাশয় পেটের অসুখের ওটা একটা উপসর্গ। রোগটা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। নইলে অনিষ্টকারক বস্তুতে রুচি কেন?

মেয়েটি বেরিয়ে এল।

শীর্ণ কঙ্কালসার বাসি অতসী ফুলের মত দেহবর্ণ একটি কিশোরী। মাথায় সিন্দুর। বয়সে কিশোরী হলেও সন্তানের জননী হয়েছে।

জীবন মশায় চমকে উঠলেন। সর্বাঙ্গে যেন কার ছায়া পড়েছে।

নিশি ঠাকরুন বললে, গৰ্ভসূতিকা হয়েছে। দুটি সন্তান। সব ভেসে যাবে মশায়। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কেঁদে ফেললে নিশি।

দুটি সন্তান। কত বয়স? চোদ্দ? দুটি সন্তান? ডাক্তার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলে।

চোখ মুছে মুহূর্তে সহজ হয়ে নিশি বললে–পূর্ণ বারতে প্রথম সন্তান হয়েছে। নেকটানেকটি বিয়েন—চোদ্দ বছরে কোলেরটি। চাঁদের মত ছেলে মশায়, কী বলব তোমাকে, চোখ জুড়িয়ে যায়।

চাঁদ নয় যম। মাকে খেতে এসেছে। বাপের মূর্তিমান অসংযম। সমস্ত অন্তরটা তিক্ত হয়ে উঠেছিল জীবন ডাক্তারের। এইসব অনাচারীর সাজা হয় না? পরক্ষণেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। ডাক্তার। বাবা বলতেন—রোগী যখন দেখবে বাবা, তখন কোনো কারণে তার ওপর ক্রোধ বা ঘৃণা কোরো না, করতে নাই। তিনি বলতেন, মানুষের হাত কী বাবা? মানুষ তো ক্রীড়নক।

তাঁর অ্যালোপ্যাথিক শাস্ত্রের গুরু রঙলাল ডাক্তার বলতেন মানুষ বড় অসহায়। তার অন্তরে পশুর কাম, ক্ৰোধ, লোভ; অথচ পশুর দেহের সহনশক্তি তার নাই! ওদের ওপর রাগ কোরো না! করতে পার, অধিকার অবশ্যই তোমার আছে। কিন্তু তা হলে চিকিৎসকবৃত্তি নিতে পার না।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন–এতদিন কী করছিলে নিশি?

—এই এটা-সেটা। তা ছাড়া সূতিকা তো হয় মশায়, এমন হবে কী করে জানব বল? তারপরে এই দিন কতক হালের ডাক্তারদের দেখলাম, ওরা আবার নানান কথা বলে। এই লম্বা খরচের ফর্দ। সে আমি কোথায় পাব?

—হুঁ। বলেই থেমে গেলেন ডাক্তার।

নিশির কথা তখনও ফুরোয় নি–বাঈয়ের কবচ, দেবতার ওষুধ, অনেক করেছি।

তা বুঝতে পেরেছেন ডাক্তার। গলায় এক বোঝা মাদুলি। হাতে ন্যাকড়ায় বাধা জড়িপুষ্প। কিন্তু কী করবেন? ডাক্তারই বা কী করবেন? আছে একমাত্র ওষুধ। কবিরাজি–সূচিকাভরণ।

পারবে? জল বারণ। খাওয়াতে পারবে নিশি?

–জল বারণ? নিশিও চমকে উঠল। কী বলছ মশায়?

–হাঁ! জল বারণ। দেখি আর একবার হাতখানি খুকি!

মরণ-রোগক্লিষ্টা খুকি—মুখে কাপড় দিয়ে হাসে। দুই সন্তানের জননী সে–সে নাকি খুকি? ডাক্তারও হাসেন। সঙ্গে সঙ্গে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। একমাত্র উপায় বিষ। বিষম। রোগের বিষজ ঔষধ! নাড়িতে পদধ্বনি শুনছেন তিনি।

নিশি মিথ্যা বলে নি। মরণের পায়ে এদেশের মেয়েদের চুটকি থাকলে তার ঝুমঝুম বাজনাও শুনতে পেতেন ডাক্তার। লোকে বলত, কেমন বাপ, কেমন শিক্ষা দেখতে হবে! বাপ ছিলেন গুরু, তিনি ছিলেন এই নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যায় প্রায় সিদ্ধপুরুষ। দীক্ষার নি ব্যাকরণ পাঠ আরম্ভের পর যেদিন হাতে-কলমে নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যায় শিক্ষা দিয়েছিলেন সে দিনটিও ছিল অতি শুভ দিন। বৈশাখী অক্ষয় তৃতীয়া।

এই বৃদ্ধ বয়সেও সেদিনের কথাগুলোকে মনে হচ্ছে যেন কালকের কথা। স্পষ্ট মনে পড়ছে সব। পথ চলতে চলতে মশায় ভাবছিলেন কথাগুলি।

***

হিক্কার ওষুধ তৈরি করে ওষুধ খাওয়ার প্রণালী পালনের নিয়ম কাগজে লিখে রতনবাবুর লোকের হাতে দিয়ে জীবন মশায় আয়ুর্বেদ-ভবনের দাওয়ার উপর বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। নিশি ঠাকরুনের কথা কয়টিই আবার মনে পড়ল।

চাকর ইন্দির এসে কোটা বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াল।

ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকালেন। ভাবছিলেন রতনবাবুর ছেলে বিপিনের হিষ্কার কথা। বোধ করি কাল ভোর নাগাদ হিক্কার উপশম হবে। কমে আসবেই। কী বলবে প্রদ্যোত ডাক্তার?

—তামাক খান। আর মা বললেন– চায়ের জল ফুটছে।

অর্থাৎ বাড়ির ভিতর যাবার জন্যে আতর-বউ বলে পাঠিয়েছেন। কোটি হাতে নিয়ে ডাক্তার বললেন–চা বরং তুই নিয়ে আয়। এখন আর উঠতে পারছি না।

—এই খোলাতে বসে থাকবেন? আকাশে মেঘ ঘুরছে। বৃষ্টি নামবে কখন!

আকাশের দিকে চাইলেন ডাক্তার। শ্রাবণের আকাশে এক স্তর ফিকে মেঘের নিচে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ঘুরছে, এক যাচ্ছে এক আসছে। গতি দেখে ডাক্তারের মনে হল—বৃষ্টি আসবে না। বললেন, বেশ আছি। বৃষ্টি আসবে না।

তবু দাঁড়িয়ে রইল ইন্দির। ডাক্তারের মনে পড়ল, বাজারের খরচ চাইছে ইন্দির।

নিয়ম হল ডাক্তার কল থেকে ফিরে টাকাগুলি আতর-বউয়ের হাতে দিয়ে থাকেন। আজকাল ডাক্তার ব্যবসা প্রায় ছেড়েছেন। এককালে কুড়ি পঁচিশ ত্রিশ টাকা দৈনিক পকেটে নিয়ে ফিরতেন। এখন কোনোদিন চার টাকা কোনোদিন ছয় কোনোদিন বা দু টাকা। এক একদিন কল আসে না। আবার বেশি দূরের কল যাতে টাকা বেশি তাতে ডাক্তার নিজেই যান না। আজ ডাক্তার আতর-বউকে টাকা দেন নি। পরান শেখের বাড়ি থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়ার পরই আতর-বউয়ের সঙ্গে কলহ বেধেছিল। তারপর কিশোর এসে ডেকে নিয়ে গেল রতনবাবুর বাড়ি। ডাক্তার ইতিমধ্যেই জামা খুলে খালি গা করে বসেছিলেন। জামাটা ইন্দিরের হাতে তুলে দিলেন। বললেন–পকেটে টাকা আছে দেখ–

—চার টাকা।

–দিগে আতর-বউকে। আমাকে আর বিরক্ত করিস নে।

–আর দুটো কল্কে সেজে রেখে যাই?

—যা, তাই যা। তুই বড় বেশি বকিস।

আকাশের দিকে চেয়ে কথা বলছিলেন ডাক্তার। দেখছিলেন আকাশের মেঘইন্দিরের কথার দিকে ছিল কান, মুখে তার জবাবও দিচ্ছিলেন কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরছিল বিপিনের হিক্কার কথা, প্রদ্যোতের কথা, নিশির কথা। লোকে বলে জীবন মশাই নাড়ি ধরলে মরণ পায়ের চুটকি বাজিয়ে সাড়া দেয়। কেমন বাপ, কেমন শিক্ষা!

***

সেদিন ছিল বৈশাখের অক্ষয় তৃতীয়া। পুত্রের দীক্ষার জন্য এই প্রথম শুভ দিনটিই নির্বাচন করেছিলেন জগৎমশায়। একান্তে নিৰ্জন ঘরে পুত্রকে কাছে বসিয়ে তিনি যেন তার চৈতন্যকে প্রবুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সেদিন। বাড়িতে বলে রেখেছিলেন যেন কেউ তাদের না ডাকে, কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না করে।

জীবন অল্পস্বল্প নাড়ি দেখতে জানতেন। চিকিৎসকের বাড়ির ছেলে। বাল্যকালে খেলাচ্ছলে খেলাঘরে বৈদ্য সেজে বসে সঙ্গী সাথীদের হাত দেখতেন, কাদামাটি, ধুলো কাগজে মুড়ে ওষুধ। দিতেন। জীবনের মা পর্যন্ত নাড়ি দেখতে জানতেন। সেদিন বাপ তাকে প্রথম পাঠ দিয়ে নাড়িতত্ব বুঝিয়ে মৃত্যুর কাহিনী বলে আয়ুর্বেদ-ভবনে যেসব রোগীরা এসেছিল তাদের কয়েকজনের নাড়ি নিজে পরীক্ষা করে ছেলেকে বলেছিলেন, দেখ–এর নাড়ি দেখ।

রোগীকে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে অন্যদিকে যেদিকে ওষুধ পাওয়ার ব্যবস্থা সেই দিকে। পাঠিয়ে দিয়ে জীবনকে রোগীর নাড়ির বৈশিষ্ট্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এই ছিল জগত্মশায়ের শিক্ষার ধারা।

আয়ুর্বেদ-ভবনের কাজ শেষ করে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি রোগীকে রোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখে বাড়ি ফেরার পথে বলেছিলেন বাবা, যে চিকিৎসক নাড়িবিজ্ঞানে সিদ্ধিলাভ করতে পারে তার সঙ্গে মৃত্যুকে সন্ধি করতে হয়। মৃত্যুর যেখানে অধিকার সেখানে মৃত্যু বলে—আমার পথ ছেড়ে দাও। এ আমার অধিকার। আর যেখানে তার অধিকার নাই সেখানে ভুলক্রমে উঁকি মারলে চিকিৎসক বলেন-দেবী, এখনও সময় হয় নাই, এক্ষেত্রে তোমাকে স্বস্থানে ফিরতে হবে।

কারণ এমন চিকিৎসকের রোগনির্ণয়েও ভ্রান্তি ঘটে না, ঔষধ নির্বাচনেও ভুল হয় না। মৃত্যু যেমন অমোঘ, পঞ্চম বেদ আয়ুর্বেদের স্রষ্টা ব্ৰহ্মার সৃষ্টি ভেষজ এবং ওষধির শক্তিও তেমনি অব্যৰ্থ। যে ব্রহ্মার কুটিকুটিল দৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হল মৃত্যুর, সেই ব্ৰহ্মারই প্ৰসন্ন দৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হয়েছে ভেষজের। ব্ৰহ্মা এই শাস্ত্র দিয়েছিলেন দক্ষ-প্রজাপতিকে, দক্ষের কাছ থেকে এই শাস্ত্র পেয়েছিলেন অশ্বিনীকুমারেরা, তাদের কাছ থেকে পেলেন ইন্দ্ৰ, ইন্দ্র দিলেন ভরদ্বাজ আর দিবদাস ধন্বন্তরিকে। এইখানে আয়ুৰ্বেদ দু ভাগে ভাগ হয়েছে। ধন্বন্তরি শল্যচিকিৎসার ভাগ। পেয়েছিলেন। তারপর পুনর্বসু এবং আত্রেয়। তারপর অগ্নিবেশ। আচার্য অগ্নিবেশ রচনা করেছিলেন অগ্নিবেশ সংহিতা। এই সংহিতা থেকেই চরক সংহিতার সৃষ্টি। পঞ্চনদ প্রদেশের মনীষী চরক এই সংহিতাকে নতুন করে সংস্কার করেছিলেন। চরক হলেন চিরজীবী। কথা বলতে বলতেই পথ চলছিলেন পিতাপুত্রে। চলেছিলেন গ্রামান্তরে। জগন্মশায় সচরাচর গাড়ি পালকি ব্যবহার করতেন না। বেশি দূর হলে তবে গরুর গাড়ির এবং তাড়াতাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন হলে তবে ড়ুলিতে চাপতেন। সেদিন ছেলেকে দেখিয়েছিলেন ঠিক আজকের ওই নিশির ভাইঝির মত একটি রোগিণী। ঠিক এমনি। কিশোরী মেয়ে, বড়জোর ষোল বছর বয়স সে আবার দুই সন্তানের পর তৃতীয়বার সন্তানসম্ভবা ছিল।

সেদিকে ফিরবার পথে জগৎমশায় বলেছিলেন–নির্দিষ্ট আয়ুর কথা শাস্ত্রে আছে। কিন্তু কর্মফলে সে আয়ুরও হ্রাসবৃদ্ধি আছে। ব্যভিচার করে মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ করে আনে মানুষ। এসব ক্ষেত্রে তাই—অথচ–।

চুপ করে গিয়েছিলেন জগৎমশায়, বোধহয় সংশয় উপস্থিত হয়েছিল নিজের মনে। একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, এক এক সময় শাস্ত্রবাক্যে সংশয় জাগে, জীবন। আমাদের শাস্ত্রে বলে স্বামীর পাপের ভাগ স্ত্রী গ্রহণ করে না। কিন্তু এক্ষেত্রে কী বলব? এক্ষেত্রে স্বামীর অমিতাচারের ফল ভোগ করছে মেয়েটা, সেই হেতুতেই ওকে যেতে হবে অকালে।

আবার খানিকটা চুপ করে থেকে বলেছিলেন-হয়তবা প্রাক্তন জন্মান্তরের কর্মফল ওই মেয়েটার—তার ফলেই স্বল্পায়ু হয়েই জন্মেছিল। তাই বা কে বলবে?

সেদিন জীবন মশায়ও ওই কথাতেই বিশ্বাস করেছিলেন। মনে মনে নিজের ভাগ্যবিধাতাকে। প্ৰণাম জানিয়েছিলেন। তাকে পরিত্রাণ করেছেন তিনি। মঞ্জরী স্বাস্থ্যবতী বটে, কিন্তু বয়স তো বার বৎসর। কে বললে—মঞ্জরীর ঠিক এই পরিণতি হত না?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আজ বৃদ্ধ জীবন মশায় আকাশের দিকে চাইলেন আবার। এক বিচিত্ৰ হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। দাড়িতে হাত বুলালেন। আকাশে রক্তসন্ধ্যা দেখা দিয়েছে। গাঢ় লাল হয়ে উঠেছে দিগন্তবিস্তৃত মেঘস্তর। তার নিচে বকের সারি উড়ে চলেছে। হঠাৎ এতক্ষণে চোখে পড়ল সামনে ঢাকা রয়েছে চায়ের বাটি। ইন্দির কখন রেখে গিয়েছে। অতীত কথা স্মরণ করতে গিয়ে চায়ের কথা মনে হয় নি। ইন্দির নিশ্চয় কথা বলেছিল, খেয়াল করে দেবার চেষ্টাও সে নিশ্চয় করেছিল কিন্তু সে তিনি স্মরণ করতেই পারছেন না।

থাক। আজ চা থাক।

অতীত কালের কথার একটা নেশা আছে। বড় মনোরম বর্ণবিন্যাস। চোখে পড়লে আর ফেরানো যায় না। বিশেষ করে যেখানটার কথা মনে পড়ছে এখন সেখানটা যেন ওই আকাশের রক্তসন্ধ্যার বর্ণচ্ছটার মতই গাঢ়।

পথে তিনি ভাগ্যবিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এলেন—মঞ্জরীর বন্ধন থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য। আর বাড়ি ফিরেই দেখলেন–।

আবার হাসলেন এবং বার কয়েক দাড়িতে হাত বুলোলেন। হা কর্ম-পাক নিয়ে যিনি চক্র রচনা করেন তিনি যেমন চক্রী তেমনি রসিক।

***

সেদিন তৃতীয় প্রহরের শেষে তারা বাড়ি ফিরেছিলেন। মা বসে ছিলেন, তাঁরা ফিরে এলে ভাত চাপিয়ে দেবেন। অবশ্য সে দিক দিয়ে বিশেষ অনিয়ম হয় নি। চিকিৎসকের খাওয়া তৃতীয় প্রহরেই ঘটে।

মুখ-হাত ধুয়ে ভিজে গামছা পিঠে বুলিয়ে জগৎমশায় বললেন––জীবনকে কুলকর্মে দীক্ষা দিয়ে আজ আমি নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু জীবনের মা, তোমার মুখ এমন কেন?

কেমন?–যেন খুব চিন্তান্বিত মনে হচ্ছে। কিছু ভাবছ?

কী ভাবব? জীবনের মা কথাটা উড়িয়ে দিলেন যেন।–তা বটে। কী ভাববে! মেয়েদের ভাবনা অলঙ্কারের, মেয়ের বিয়ের, ছেলের বিয়ের। সুতরাং দুটোর একটা ভাবতে পার।

হাসলেন জীবনের মা। উঠে গিয়ে উনানে চড়ানো বকনোর ঢাকা খুলে হাতায় ভাত তুলে টিপে দেখতে বসলেন।

জগত্মশায়ের মনটা সেদিন প্রসন্ন ছিল—নির্মেঘ শরৎকালের আকাশের মত। তিনি প্রসন্ন। হেসে বললেন– কী, উত্তর দিলে না যে?

পিছন ফিরেই মা উত্তর দিলেনকী বলব? তুমি অন্তৰ্যামী। ভাবছি না বললেও বলছ–ভাবছ। তা হলে তুমিই বলে দাও কী ভাবছি?

জীবনের অভিভূত ভাবটা তখনও কাটে নি। তার মাথার মধ্যে তখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বাপের গম্ভীর মৃদুস্বরের কথাগুলি।

অভিভূত ভাবটা আকস্মিক একটা আঘাতে কেটে গেল। জীবন চমকে উঠল।

খাওয়াদাওয়ার পর ছোট রেকাবিতে হরীতকীর টুকরো নামিয়ে দিয়ে জীবনের মা বললেন–তুমি অন্তৰ্যামীই বটে। তামাসা তোমাকে আমি করি নি। কঁদী থেকে চিঠি নিয়ে দুপুরে লোক এসেছে। জানি না কী লেখা আছে, তবে কে চিঠি পাঠিয়েছে, তার নাম জেনে আমার ভাবনা হয়েছে। না ভেবে থাকতে পারি নি আমি। নবকৃষ্ণ সিংহ চিঠি লিখেছে—এই দেখ।

চিঠিখানি পড়লেন জগদ্বন্ধু মশায়। চমকিত হয়ে জীবন উদ্বিগ্নচিত্তে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মুখ দেখে কিছু অনুমান করতে পারলে না। জগদ্বন্ধু মশায় চিঠি শেষ করে স্থির দৃষ্টিতে বৈশাখের উত্তপ্ত আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন।

মনে পড়ছে জীবন ডাক্তারের।

সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছিল। তৃতীয় প্রহরের শেষ পাদ। পূর্বদুয়ারী ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন : সামনে পশ্চিমদুয়ারী একতলা রান্নাঘরের চালার উপর দিয়ে, আচার্য ব্রাহ্মণদের বাড়ির উঠানের বকুল গাছের মাথার উপর দিয়ে রৌদ্রদগ্ধ বৈশাখী আকাশ যেন পোমগ্ন রুদ্রের অর্ধনিমীলিত তৃতীয় নেত্রের বহ্নির ছটায় ক্লিষ্ট নিথর। দিকে দিগন্তরে কোথাও ধ্বনি শোনা যায় না। বাতাসও ছিল না সেদিন। মনে হয়েছিল, বোধহয় সন্ধ্যার দিকে কালবৈশাখীর ঝড় উঠবে। পশ্চিম দিগন্তে আয়োজন হতে আরম্ভ হয়েছে। জীবন ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারও বুকে বোধহয় ঝড় উঠবে মনে হয়েছিল। কী লিখেছে নবকৃষ্ণ সিংহ? মঞ্জরী, হয়ত মঞ্জরীর মা—এরা যে ওই দেউলিয়া অভিজাত ঘরের বর্বর ছেলেটার মোহে মুগ্ধ তাতে তার সন্দেহ নাই। বঙ্কিম মঞ্জরী সম্পর্কে তো নাই-ই, কোনো সন্দেহই নাই। তাকে নিয়ে তারা খেলা করেছে। তাই বা কেন? সে নিজেই মূৰ্খ বানর তাই তাদের বাড়ি গিয়ে বানর-নৃত্য করেছে—তারা উপভোগ করেছে। বানর-নৃত্য নয়—লুক-নৃত্য। মঞ্জরী মধ্যে মধ্যে তাকে ভালুকও বলত। ভালুক নাচই সে নেছেছে। ভালুক আর বানরে প্রভেদই বা কী? দুটোই জানোয়ার-দুটোই নির্বোধ! কিন্তু কী লিখেছে নবকৃষ্ণ সিংহ? মিথ্যা কদর্য অভিযোগ! কী করবে জীবন? ভগবান সাক্ষী, কিন্তু ভগবান তো সাক্ষি দিতে আসেন না। তিনি তো বলবেন না প্রাণ দিয়ে ভালবাসা। যদি অপরাধ হয় তবে জীবন অপরাধী। নইলে সে কোনো অপরাধ করে নাই। সে মৃত্যুদণ্ড প্রতীক্ষারত আসামির মতই অপেক্ষা করে রইল।

মশায় দৃষ্টি নামিয়ে বললেন––জীবনের মা! তাঁর কণ্ঠস্বর গম্ভীর।

চিন্তিত মুখেই জীবনের মা প্রতীক্ষা করছিলেন। সাগ্রহে তিনি বললেন–বল! শোনবার জন্য তো দাঁড়িয়েই আছি।

–জীবনের বিবাহের আয়োজন কর।

–কার সঙ্গে? ওই মেয়ের সঙ্গে? নবকৃষ্ণ সিংহের মেয়ের সঙ্গে?

–হ্যাঁ, দিতেই হবে বিবাহ। নবকৃষ্ণ সিংহ লিখেছেন—এই ঘটনায় এখানে তাঁর কন্যার দুর্নাম রটেছে চারিদিকে। ওই যে কুৎসিত প্রকৃতির ছেলেটিসে তার কন্যা মঞ্জরীকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নানারকম মন্তব্য করেছে। বলেছে—ঘটনার দিন সে নাকি জীবনকে আবীর দেবার ছলে মঞ্জরীর অঙ্গে হাত দিতে দেখেছে।

মা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন––জীবন!

মাকে এমন মূর্তিতে কখনও জীবন দেখে নাই।

মা আবার বললেন–,বল, আমার পায়ে হাত দিয়ে বল–

জীবন সেদিন যেন নবজন্ম লাভ করেছে—বাপের সাহচর্যের ফলে, তাঁর অন্তরের স্পর্শে। সে উঠে এসে পায়ে হাত দিয়ে বললে–আমি তার কপালে আবীর দিয়েছি। আর কোনো দোষে দোষী নই আমি।

মশায় বললেন–কর কী জীবনের মা? ছি! বিবাহের আয়োজন যখন করতে বলছি, তখন ও-সব কেন? জীবন মনে মনে মেয়েটিকে কামনা করে। এক্ষেত্রে কি শপথ করায়? ছি! বিবাহের আয়োজন কর।

—সে কী? কোষ্ঠী দেখাও। নিজে মেয়ে দেখ। তারপর কথাবার্তা দেনাপাওনা–

–কিচ্ছু না, এক্ষেত্রে ওসব কিছু না। ছক এই চিঠির সঙ্গে আছে। ওটা আমি ছিঁড়েই দিচ্ছি, কী জানি যদি বাধার সৃষ্টি করে; আর দেনা-পাওনাই বা কী? কী লিখেছেন তিনি জান? লিখেছেন, আপনাদের বংশের উপাধিই হইয়াছে মহাশয়। মহাশয়ের বংশ আপনার। আপনি নিজে ও অঞ্চলে বিখ্যাত চিকিৎসক। আপনার পুত্র ডাক্তারি পড়িবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। এ অবশ্যই আমার বামন হইয়া চাঁদ ধরিবার বাসনা। কিন্তু যেরূপ ক্ষেত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে আপনি প্রত্যাখ্যান করিলে আমার কন্যাকে গঙ্গার জলে ভাসাইয়া দিতে হইবে।

—আর কোনো কথা নয়। আয়োজন কর। বৈশাখে আর এক-দিনে বিবাহ হয় না। না। জ্যৈষ্ঠ মাসে জ্যেষ্ঠপুত্রের বিবাহ দেশাচারে নিষিদ্ধ। প্রথম আষাঢ়েই বিবাহ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *