• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

নোবেল বক্তৃতা ২০০৯: সাহিত্য শব্দ ও দুষ্টচক্র – হেরটা মুয়েলার

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » অনুবাদ » নোবেল বক্তৃতা ২০০৯: সাহিত্য শব্দ ও দুষ্টচক্র – হেরটা মুয়েলার

প্রতিদিন সকালে আমি রাস্তায় নামার আগে আমার মা বাড়ির ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতেন, ‘রুমাল সঙ্গে আছে তো?’ আমার সঙ্গে রুমাল থাকত না। ভেতরে গিয়ে রুমাল নিয়ে আসতাম। কখনো রুমাল নিয়ে বেরোতাম না। মায়ের প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকতাম। মা আমার প্রতি সকালবেলায় কতটা খেয়াল রাখতেন, রুমালে তার প্রমাণ মিলত। দিনের বাকি অংশটা আমি নিজের মতো চলতাম। ‘রুমাল সঙ্গে আছে তো?’—এ প্রশ্ন পরোক্ষে ভালোবাসার জানান দিত। ভালোবাসার প্রকাশ আরও সরাসরি হলে তা বিব্রতকর হয়ে উঠত। কৃষকেরা তেমন আচরণ করে না। প্রশ্নের ছদ্মাবরণে ভালোবাসা। এভাবেই শুধু তা বলা যেত, হুকুমের সুরে বা চতুর কৌশল প্রয়োগের মতো করে। প্রতি সকালে আমি ফটকে যেতাম প্রথমবার রুমাল ছাড়া আর দ্বিতীয়বার রুমালসহ। এরপর রাস্তার ওপর উঠতাম। সঙ্গে রুমাল থাকা মানে মাও সঙ্গে থাকা।
২০ বছর পর শহরে অনেক দিন আমি একা থেকেছি। একটি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় অনুবাদকের কাজ করতাম। সকাল পাঁচটায় বিছানা ছাড়তাম, সাড়ে ছয়টায় কাজ শুরু হতো। এভাবে দুই বছর কাটে। তৃতীয় বছরে এর অবসান ঘটে। এক সপ্তায় তিন দিন সকাল সকাল লম্বা, মোটাসোটা আর জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল চোখের এক লোক আমার অফিসে হাজির হয়। সে ছিল কমিউনিস্ট রুমানিয়ার গুপ্তচর বিভাগ সিকিউরিটেটের সদস্য। প্রথমবার এসে সে আমাকে গালাগাল করে চলে যায়।
দ্বিতীয়বার তার উইন্ডব্রেকার (বাতাস টেকানোর জন্য জোব্বা) খুলে আলমারিতে রেখে এসে বসে। সেদিন বাড়ি থেকে কিছু টিউলিপ এনে ফুলদানিতে রেখেছিলাম। লোকটি আমার দিকে তাকাল। দেখে সে আমার প্রশংসা করল। তার কণ্ঠস্বর ছিল চতুরতাপূর্ণ। আমি অস্বস্তি বোধ করলাম। তার প্রশংসায় আপত্তি জানিয়ে বললাম, আমি টিউলিপগুলোকে বুঝতে পারি, কিন্তু মানুষকে পারি না। তখন সে অসন্তোষের সুরে বলল, টিউলিপগুলো আমার যতটা চেনা তার চেয়ে সে আমাকে বেশি চেনে। আলমারি থেকে জামাটা নিয়ে সে চলে গেল।
তৃতীয়বার সে এসে বসল, কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার চেয়ারে সে তার ব্রিফকেস রাখল। সেটা মেঝেতে রাখার সাহস হলো না আমার। সে আমাকে নির্বোধ বলে গালি দিল। বলল, আমি একটা কাজচোর, নোংরা মেয়ে, আশ্রয়হীন রাস্তার কুকুরের মতো। টিউলিপগুলোকে সে ডেস্কের কোনার দিকে ঠেলে দিল। ডেস্কের ওপর কাগজ-কলম রেখে চেঁচিয়ে উঠে আমাকে লিখতে বলে। দাঁড়িয়ে থেকেই তার কথামতো আমি আমার নাম, জন্মতারিখ, ঠিকানা লিখি। এরপর যা ঘটে তা আমি কাউকে বলব না, আমার প্রিয়তম বন্ধুকেও না…এরপর আসে সেই ভয়াবহ শব্দ: ‘কোলাবরেজ’—আমি সহযোগিতা করছি। আমি লেখা থামাই। কলম রেখে আমি জানালার কাছে যাই। ধুলোময়, আস্তরণহীন, খানাখন্দে ভরা রাস্তা আর কুঁজো হয়ে থাকা বাড়িগুলোর ওপর চোখ যায়। সবার ওপরের এই সড়কের নাম স্ট্রাডা গ্লোরেই—মহিমা সড়ক। এ সড়কের এক পত্রহীন তুঁতগাছে একটা বিড়াল বসে ছিল। ছিন্ন কানের এ বিড়ালটি কারখানার বিড়াল। আর বিড়ালটির ওপরের দিকে সকালের সূর্য একটা হলুদ ঢাকের মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছিল। আমি বললাম, ‘আমার চরিত্র এসবের উপযুক্ত নয়।’ বাইরের রাস্তাকে আমি বললাম। ‘চরিত্র’ শব্দটি গোয়েন্দা পুলিশের সেই সদস্যকে উন্মত্ত করে দেয়। সে কাগজটি ছিঁড়ে টুকরো করে মেঝেতে ফেলে দেয়। তারপর হয়তো সে বুঝতে পারে তার ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিকে দেখাতে হবে, সে আমাকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছে; সে তখন নুয়ে, ছেঁড়া টুকরোগুলো তুলে তার ব্রিফকেসে ভরে নেয়। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে, পরাজিত বোধ করে। সে টিউলিপসহ ফুলদানিটি দেয়ালে ছুড়ে মারে। ভেঙে পড়ার সময় গুঁড়ো হওয়ার শব্দ শোনা যায়, যেন বাতাসেরও দাঁত আছে। ব্রিফকেস বগলদাবা করে শান্ত কণ্ঠে সে বলে, ‘একসময় এ জন্য তোমার দুঃখ হবে, নিজে নিজে তুমি অতল সাগরে ডুববে।’ স্বগতোক্তির মতোই যেন আমি বলি, ‘আমি যদি সই করি, তাহলে নিজের সঙ্গে বসবাস করা আর সম্ভব হবে না আমার, আর আমাকে তা একা হয়ে করতে হবে। তাই তুমি যদি করো, ভালো।’ ততক্ষণে খোলা দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে গেছে। আর বাইরে স্ট্রাডা গ্লোরেইয়ের কারখানার বিড়ালটি গাছ থেকে লাফিয়ে দালানের ছাদের ওপর চলে গেছে। গাছের শাখা তখনো ট্রাম্পলিনের মতো নড়ছিল।
পরদিন আমাদের দ্বন্দ্বের পরীক্ষা শুরু হলো। তারা আমাকে কারখানা থেকে বের করে দিতে চায়। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় পরিচালকের কাছে রিপোর্ট করতে হয়। সেদিন শ্রমিক ইউনিয়নের প্রধান ও দলের সম্পাদক উভয়ই তাঁর অফিসে ছিলেন। আমার মা যেমন প্রতিদিন বলতেন, ‘রুমাল সঙ্গে আছে তো?’, তেমনি পরিচালক এখন প্রতি সকালে প্রশ্ন করেন, ‘নতুন কোনো চাকরি মিলল?’ আমি একই জবাব দিই, ‘আমি কোনো চাকরি খুঁজছি না, এই কারখানা আমার পছন্দ, অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই কাজ করতে চাই।’
এক সকালে কাজে এসে দেখি, আমার মোটা কলেবরের অভিধানগুলো আমার অফিসের বাইরে হলরুমের মেঝেতে পড়ে আছে। আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি, এক প্রকৌশলী বসে আছে। সে আমাকে ঘরে ঢোকার আগে দরজায় টোকা দেওয়ার কথা বলে। এটি এখন আমার জায়গা, সে বলল। আমি বাড়ি যেতে পারলাম না, কৈফিয়তহীন কোনো অনুপস্থিতি আমাকে চাকরিচ্যুত করার অজুহাত তৈরি করবে। আমার আর কোনো অফিস রইল না, এখন কাজে আসাটাই আমাকে নিশ্চিত করা জরুরি; কোনো অবস্থাতেই এতে ব্যর্থ হওয়া চলবে না।
স্ট্রাডা গ্লোরেই দিয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে তাকে সব খুলে বললাম। সে তার ডেস্কের এক কোনা আমার জন্য ছেড়ে দিল। কিন্তু এক সকালে তার দপ্তরের বাইরে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘আমি তোমাকে আমার অফিসে ঢুকতে দিতে পারব না। সবাই বলছে তুমি ইনফরমার।’ হয়রানির বিস্তার ঘটল, আমার সহকর্মীদের মধ্যে গুজব ছড়ানো হলো। এটিই ছিল সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার। হামলার মোকাবিলায় আত্মরক্ষা করা যায়, কিন্তু কুত্সার বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকে না। যেকোনো কিছু ঘটার, এমনকি মৃত্যুর জন্যও আমি প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। কিন্তু এই বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনার সঙ্গে আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলাম না। কোনো প্রস্তুতিই একে সহনীয় করে তুলতে পারল না। কুত্সা মানুষের জীবনকে পঙ্কিলতায় ভরে দেয়। দম বন্ধ করা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়, কারণ আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ এতে থাকে না।
এখন প্রতিদিন কাজে যাওয়া নিশ্চিত করা দরকার, কিন্তু আমার কোনো অফিস নেই, আমার বন্ধুও তার অফিসে আর ঢুকতে দিতে পারছে না। আমি সিঁড়ির পথে দাঁড়ালাম, সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না কী করব। কয়েকবার সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম, নামলাম। হঠাত্ আমি আবার মায়ের ছোট্ট শিশুটি হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে রুমাল ছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার সিঁড়ির ওপর আমি সেই রুমাল সমান করে পেতে দিলাম। রুমালের ওপর বসলাম। মোটাসোটা অভিধানগুলো হাঁটুর ওপর রেখে আমি হাইড্রোলিক মেশিনের বর্ণনা অনুবাদ করলাম। আমি তখন এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জুতসই উপায়ের খোঁজে, আমার অফিস একটি রুমাল। দুপুরের খাবারের সময় বন্ধু সিঁড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আগে তার অফিসে বা তারও আগে আমার অফিসে আমরা দুজন যেমন একসঙ্গে খেতাম তেমনি একসঙ্গে খেলাম। কারখানা চত্বরে লাউড স্পিকার থেকে ভেসে এল শ্রমিকদের সমবেত কণ্ঠের গান। সব সময়ের মতো জনগণের সুখ-শান্তির কথা আছে তাতে। খাওয়া শেষে বন্ধু আমার অবস্থা নিয়ে কাঁদল। আমি কাঁদিনি। শক্ত থাকতেই হতো। অনেক দিন। কয়েক সপ্তাহ, যে সপ্তাহগুলোর কোনো শেষ নেই, আমার চাকরিচ্যুতির আগ পর্যন্ত।
ছোটবেলায় বাড়িতে রুমাল রাখার একটা দেরাজ ছিল আমার। এর দুটি পাট ছিল, প্রতি পাটে তিনটি তাক। বাম পাশে রাখা হতো পুরুষের রুমাল, বাবা ও দাদার। ডান পাশে রাখা হতো মহিলাদের রুমাল, মা ও দাদির। মাঝখানে শিশুর রুমাল, আমার রুমাল এখানে থাকত।
দেরাজটি ছিল রুমালের আঙ্গিকে আমাদের পরিবারের পোর্ট্রেট। পুরুষের রুমাল সবচেয়ে বড়। তাতে কোনার দিকটা বাদামি, ছাইরঙা বা বর্দু ওয়াইনের রঙে ঘন ডোরাকাটা। মহিলাদের রুমাল আকারে ছোট আর কোনার দিকে হালকা নীল, লাল বা সবুজ রং। শিশুর রুমাল সবচেয়ে ছোট: সীমানা নির্দেশক রেখাহীন চারকোনাকৃতির সাদা রঙের কাপড়ের ওপর ফুল বা জীবজন্তুর ছবি আঁকা। প্রতিদিন যেগুলো ব্যবহূত হতো, সেগুলো থাকত সামনের সারিতে। আর ছুটির দিন রোববারে ব্যবহারের রুমাল রাখা হতো পেছনের সারিতে। পরনের কাপড়ের সঙ্গে মিলিয়ে রোববার রুমাল নিতে হবে, সেটা দৃশ্যমান না হলেও এর ব্যতিক্রম করা চলবে না।
আমরা নিজেরাসহ বাড়ির কোনো কিছুই রুমালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। রুমালের ব্যবহার সর্বজনীন—সর্দিতে নাক আংশিক বন্ধ হওয়া; নাক থেকে রক্ত ঝরা; হাত, কনুই বা হাঁটুতে আঘাত লাগা; কান্নার সময় বা কান্না চাপতে কামড়ে ধরার জন্য রুমালের দরকার হয়। মাথাব্যথায় ঠান্ডা পানিতে রুমাল ভিজিয়ে কপালে দেওয়া; সূর্যের তাপ বা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথায় বাঁধা; কিছু স্মরণে আনতে স্মৃতিকে চাগিয়ে তুলতে রুমালে গিঁট দেওয়া; ভারী ব্যাগ বহনের জন্য হাতে মোড়ানো; ট্রেন যখন স্টেশন ছেড়ে যায় তখন প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে রুমাল দোলানো; সবখানে রুমালের ব্যবহার। গ্রামে কেউ মারা গেলে মৃতের চিবুক বরাবর রুমাল বেঁধে দেওয়া হয়, পেশিগুলো শক্ত হতে শুরু করলে তার মুখ যেন বন্ধ থাকে। নগরে কোনো মানুষ রাস্তার পাশে ঢলে পড়লে, পথচারীদের কেউ রুমাল বের করে তার মুখ ঢেকে দেবে, যেন সেই রুমাল মৃতব্যক্তির শান্তির প্রথম জায়গা হয়ে ওঠে।
রুমানিয়ায় জন্ম নেওয়া জার্মান কবি ও অনুবাদক অস্কার পাস্টিয়রের সঙ্গে পরে আমি একদিন দেখা করি। তাঁকে সোভিয়েত শ্রমশিবিরে পাঠানো নিয়ে একটি লেখা তৈরির উদ্দেশ্যে আমি গিয়েছিলাম। তিনি জানান, এক রাশিয়ান বৃদ্ধা তাঁকে সাদা সুতি কাপড়ে তৈরি একটি রুমাল দেন। সেই বৃদ্ধা বলেন, তুমি ও আমার সন্তান উভয়ই হয়তো সৌভাগ্যবান, তুমি শিগগির বাড়ি ফিরে যাবে, আমার সন্তানও বাড়ি ফিরবে। তাঁর সন্তান অস্কার পাস্টিয়রের সমবয়সী। তাঁর মতোই বাড়ি থেকে অনেক দূরে। সে ছিল দণ্ডিতদের নিয়ে গঠিত ব্যাটালিয়নে। এক টুকরা কয়লার বিনিময়ে সামান্য খাবারের আশায় অস্কার পাস্টিয়র এক আধপেটা ভিক্ষুকের মতো বৃদ্ধার বাড়িতে কড়া নেড়েছিলেন। বৃদ্ধা তাঁকে গরম স্যুপ খেতে দেন। এমন সময় তাঁর নাক থেকে বাটিতে পানি পড়তে দেখে তিনি রুমালটি দেন। কেউ এই রুমাল কখনো ব্যবহার করেনি। রেশমি সুতোয় সেলাই করা গাছ ও গোলাপের নকশা তোলা এ রুমালটির সৌন্দর্য ভিক্ষুককে একই সঙ্গে আকর্ষণ ও আহত করে। অস্কার পাস্টিয়রের মধ্যে বৃদ্ধা এক অপার্থিব ভিক্ষুক ও পথ হারানো এক শিশুকে দেখতে পান। অস্কার পাস্টিয়রের কাছেও সেই বৃদ্ধা ছিলেন দুই সত্তার সম্মিলন: অজানা এক রাশিয়ান নারী আর উদ্বিগ্ন এক মা, যে প্রশ্ন করে, ‘রুমাল সঙ্গে আছে তো?’
এ গল্প শোনার পর নিজের মনে প্রশ্ন জাগে: ‘রুমাল সঙ্গে আছে তো?’ এ প্রশ্ন কি সব জায়গার জন্য প্রযোজ্য? পর্বত থেকে পর্বতে, বৃক্ষহীন বিরান প্রান্তরে, সব সীমানা পেরিয়ে এর দেখা পাওয়া যাবে; দণ্ডিত আর শ্রমশিবিরের বিশাল সাম্রাজ্যে বহু পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে কি পারবে এই প্রশ্ন—‘রুমাল সঙ্গে আছে তো?’ এ প্রশ্ন থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব? কাস্তে-হাতুড়ি দিয়েও কি রেহাই মিলবে না?
অস্কার পাস্টিয়র যুগল মা ও যুগল ছেলের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেই রুমাল রেখে দিয়েছেন। শ্রমশিবিরে পাঁচ বছর কাটানোর পর সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে আসেন। এই সুতির সাদা রুমাল ছিল তাঁর আশা ও ভয়। আশা ও ভয় চলে গেলে মানুষ মরে যায়।
শৈশবকালে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে একর্ডিয়ান বাজানো শিখতে হয়েছিল। একর্ডিয়ানের স্ট্র্যাপগুলো আমার তুলনায় অনেক লম্বা ছিল। আমার কাঁধ থেকে যেন পিছলে না যায়, সে জন্য একর্ডিয়ান শিক্ষক একত্র করে আমার কাঁধে রুমাল দিয়ে বেঁধে দিতেন।
ক্ষুদ্র বস্তুগুলোই, তা ট্রামপেট, একর্ডিয়ান বা রুমাল যা-ই হোক না কেন, জীবনের অসদৃশ বস্তুগুলোকে সংযুক্ত করে—এ কথা কি আমরা বলতে পারি? বস্তুগুলোর অবস্থান একটি কক্ষপথে আর সেখান থেকে বিচ্যুতি প্রকাশ করে পুনরাবৃত্তির এক বিন্যাস। এটি এক দুষ্টচক্র। আমরা তা বিশ্বাস করতে পারি, কিন্তু বলতে পারি না। তবু যা বলা যায় না তা লিখে ফেলা যায়। লেখার কাজ ঘটে নীরবে, মাথা থেকে হাত পর্যন্ত শ্রম লাগে। মুখ বাদ পড়ে। স্বৈরতন্ত্রের সময়ে আমি অনেক কথা বলেছি, কারণ আমি ট্রাম্পেট বাজাতে চাইনি। এসব কথা সাধারণত আমার জন্য পীড়াদায়ক ফল বয়ে এনেছিল। কিন্তু লেখা শুরু হয় নীরবে, সিঁড়ির ওপর, যেখানে আমার পরিস্থিতি এমন ছিল যে বলতে পারার চেয়ে বেশি কথা বলার বাস্তবতা আমাকে মেনে নিতে হয়েছিল, যা ঘটছিল তা আর কথায় প্রকাশ করা যাচ্ছিল না। সর্বোচ্চ বাইরের অনুষঙ্গই পাওয়া যেত, ঘটনাকে সার্বিকভাবে তুলে আনা সম্ভব ছিল না। শুধু লেখার সময় আমার মাথার ভেতর নিঃশব্দে শব্দের দুষ্টচক্রের মধ্য থেকে আমি বলতে পারতাম। মৃত্যুর মতো আতঙ্কে থেকে আমি জীবনের বাসনাসহকারে সাড়া দিয়েছিলাম। শব্দের এক ক্ষুধাসহকারে। আমার পরিস্থিতিকে কেবল শব্দের ঘূর্ণি আঁকড়ে ধরতে পারত। মুখে যা উচ্চারণ করা যেত না তা-ই লিখে ফেলা যেত। ঘটনার পিছু ছুটতে ছুটতে শব্দ ও তার নিষ্ঠুর বৃত্তে আটকে গেছি, আমার অভিজ্ঞতার বাইরে একেবারে নতুন কিছুর উত্থানের আগে পর্যন্ত নিস্তার নেই। বাস্তবের সমান্তরালে শব্দের নির্বাকতা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কোনো প্রকৃত মাত্রার প্রতি শ্রদ্ধাহীনভাবে, সবচেয়ে জরুরি বিষয়কে সংকুচিত করে এবং তাত্পর্যহীন ঘটনাকে টেনে বড় করে চলে এ সক্রিয়তা।
আমার মনে হয়, বস্তু তার উপাদান চেনে না, ইশারা তার অনুভূতি চেনে না, শব্দ চেনে না তার উচ্চারণের মুখ। কিন্তু আমাদের নিজস্ব অস্তিত্বের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই বস্তু, ইশারা ও শব্দ আমাদের প্রয়োজন। যত বেশি শব্দ ধারণ করা যায়, আমরা ততই মুক্ত হয়ে উঠি। যখন আমাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন আমাদের অস্তিত্ব্বের জানান দিতে চেষ্টা করি ইশারায়, নানা বস্তুর মাধ্যমে। এগুলো ব্যাখ্যা করা অধিকতর দুরূহ, সন্দেহ জাগাতে অনেক সময় লাগে। অপমানকর অবস্থাকে এক ধরনের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় পাল্টে দিতে এগুলো সহায়ক। এমন বদল সহজে সন্দেহ তৈরি করে না।
রুমানিয়া ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন আগে এক ভোরে আমার মায়ের খোঁজে এক গ্রামপুলিশ আসে। মা তখন ফটকের কাছেই ছিলেন, ‘রুমাল সঙ্গে আছে তো?’ না, তাঁর সঙ্গে ছিল না, ভেতরে গিয়ে একটি রুমাল নিলেন। স্টেশনে পৌঁছানোর পর পুলিশ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠল। তার চেঁচামেচি বোঝার মতো রুমানিয়ান ভাষায় দখল মায়ের ছিল না। মাকে আটকে রেখে সে পুলিশ বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে অফিস ছেড়ে চলে গেল। মা সেখানে সারাটা দিন কাটালেন। প্রথম কয়েক ঘণ্টা পুলিশের ডেস্কে বসে কাঁদলেন। তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত পায়চারি করলেন এবং পরে তাঁর অশ্রুভেজা রুমাল দিয়ে আসবাবপত্র ধুলামুক্ত করতে লাগলেন। এরপর ঘরের কোণে রাখা পানিভর্তি বালতি ও দেয়ালের আংটায় ঝোলানো তোয়ালে নামিয়ে মেঝে মুছলেন। এ গল্প শোনার সময় আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে জানতে চাই—এভাবে কেমন করে তুমি তার অফিস সাফ করতে পারলে? কোনো অস্বস্তি বোধ না করেই মা বললেন: সময় কাটানোর জন্য একটা কিছু করতে চাচ্ছিলাম, আর অফিসটা এত নোংরা ছিল। সেদিন পুরুষের বড় মাপের রুমাল নেওয়াটা বেশ কাজে এসেছে।
তখনই শুধু আমি উপলব্ধি করতে পারলাম এই অতিরিক্ত, স্বতঃপ্রবৃত্ত অবমাননার মধ্য দিয়ে তিনি আটকাবস্থার মধ্যেও নিজের কাছে কিছুটা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থা তৈরি করতে পেরেছিলেন।
স্বৈরতন্ত্র যেসব মানুষকে তার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত করেছে, তাদের জন্য একটি বাক্য যদি আমি বলতে পারতাম—যে বাক্যে থাকবে রুমাল শব্দটি। অথবা একটি প্রশ্ন: ‘রুমাল সঙ্গে আছে তো?’
এমন কি হতে পারে যে রুমালের বিষয়ে প্রশ্নটি কখনো রুমালের বিষয়ে ছিল না, ছিল মানুষের তীব্র একাকিত্ব বিষয়ে?

[সংক্ষেপিত]
হেরটা মুয়েলার

অনুবাদ: আহসান হাবীব
সূত্র: প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০০৯

Category: অনুবাদ
Previous Post:হালদা নদীতে মাছে ডিম ছেড়েছে – মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Next Post:গজল – নবাব আহসান উল্লাহ

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑