৩৫. কাজ মিটে গেল

৩৫

যে কাজের জন্য ভুবনমণি দিনের পর দিন বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে, সেই কাজ মিটে গেল বেশ সহজেই। সবকিছুই হল পরিকল্পনামাফিক। কুলপি গ্রামে এসে জাহাজের গা বেয়ে লোহার নোঙর নামল, ডেকে শুরু হল সমবেত হরিনাম। কুলপির ঘাট থেকে বেশ কিছু জিনিসপত্র ও রসদ জাহাজে ওঠানোর থাকে, খালাসিদের সেই ব্যস্ততার ফাঁকে সৌরেন্দ্র তাদের সন্তর্পণে বের করে নিয়ে এল জাহাজ থেকে।

তাদের বলতে ভুবনমণি আর লোপামুদ্রা।

দোতলা থেকে নামার আগে দয়াময়ী সতর্ক প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছিল শূন্য ওয়ার্ডের বাইরে। যাতে নবকিশোরের বুড়ি পিসিমা হরিনাম শুনে এসে খোঁজ করলে সে নির্দ্ধিধায় বলতে পারে, ‘ও ঘুমিয়ে পরেচে পিসিমা! সারাদিন বড্ড ধকল গেচে তো। কাল সকালে দ্যাকা হবে’খন। আপনি যান, শুয়ে পড়ুন।’

ভুবনমণির গলায় কী যেন দলা পাকাচ্ছিল। সৌরেন্দ্রর পিছু পিছু এগনোর আগে সে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল দয়াময়ীকে।

‘দিদি, তুমি এত কিছু করছ!’

‘ধুর মুখপুড়ি, কী আবার করলুম?’ দয়াময়ী বলতে বলতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা লোপামুদ্রাকে বুকে জড়িয়ে নিল, ‘আর ছ’মাস আগে যদি এমন সাহস বুকে আনতে পারতুম, তাহলে আমার ওই মেয়েটাকে হারাতাম না রে!’

লোপামুদ্রা বয়সের তুলনায় একটু বেশিই সরল। সে এত জটিলতা কিছুই বুঝছে না। কিছুক্ষণ আগে পিসিমাকে দেখে যে প্রচণ্ড পুলক তার মধ্যে জেগেছিল, তাতে আবার ভাঁটা পড়ছে দয়াময়ীর কাছে থেকে চলে যাচ্ছে বলে।

দয়াময়ীর হাতের আঙুলটা ধরে সে বলে, ‘তুমিও চলো না বড়দিদি, আমাদের সঙ্গে। পিসিমা আমি আর তুমি। কী মজাই না হবে!’

দয়াময়ী কাঁপা গলায় বলল, ‘তুই যা মা। মনে রাখিস, তোর বাপ অনেক সাধ করে মেয়েপণ্ডিতের নামে তোর নাম রেকেচিল। পণ্ডিত তোকে হতেই হবে। তোর এই মুখ্যু দিদি যেকানেই থাকুক, ঠিক খবর পাবে! প্রাণভরে আশিব্বাদ করবে তোকে!’

বলতে বলতে দয়াময়ী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

গলা বুজে আসছিল ভুবনমণিরও। দয়াময়ী যে এই ষড়যন্ত্রে জড়িত, তা বুঝতে কারুর কোনো কষ্টই হবে না। জোর করে সঙ্গী হওয়া থেকে শুরু করে, কৌশলপূর্বক লোপামুদ্রার দেখভাল করা দাসীকে না নিয়ে আসা, সবকিছুই খুব সহজে দুইয়ে দুইয়ে চার করে দেবে। যে মানুষ আদরের আতিশয্যে স্ত্রীকে খুন করতে পারে, সে এত বড় অপরাধের শাস্তিস্বরূপ দয়াময়ীকে কী করবে, ভাবলেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসছিল ভুবনমণির।

কিন্তু দয়াময়ীর এক কথা। তিনি কিছুতেই যাবেন না। যে পাপ তিনি পরোক্ষে করেছেন এতগুলো বছর, বাকিবছরগুলো নাকি তার প্রায়শ্চিত্ত করবেন নীলাচলে বাবা জগন্নাথের পায়ের কাছে বসে। যত যাই হয়ে যাক, তিনি আর ফিরবেন না।

সৌরেন্দ্র এবার আর তাড়া না দিয়ে পারে না, ‘আমার মনে হয় আর দেরি করা ঠিক হবে না। নবকিশোর দত্ত নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলে মুশকিল হয়ে যাবে!’

জাহাজ থেকে ঘাটে নামতে হয়েছিল অত্যন্ত সতর্কতায়। একজন খালাসির মুখোমুখি পড়তে সৌরেন্দ্র বলেছিল নিকটবর্তী এক আত্মীয়ার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যাওয়ার কথা।

সে খালাসি কোনো উচ্চবাচ্য না করে উঠে গিয়েছিল খোলের মধ্যে।

যদু আর মধু অপেক্ষা করছিল একটা অন্ধকার গাছের তলায়। বাড়ি এখানে হলেও দুজনেই কলকাতায় থেকে পড়ে। দ্বারকানাথের ‘অবলা ব্যারাক’ এ তাদের অহরহ যাতায়াত। তাদের মা ব্যতিক্রমী মহিলা, রক্ষণশীল পরিবারের কূলবধূ হয়েও গোপনে সমর্থন করেন ব্রাহ্মধর্মকে। পাশে থাকেন ছেলেদের।

সৌরেন্দ্র চাপাস্বরে বলল, ‘কাল সকালেই বাবামশাই আসবেন ওদের নিয়ে যেতে।’

‘আচ্ছা সৌরেন্দ্রদা। এলাম তবে!’

ভুবনমণি চলে যেতে যেতেও পিছু ফেরে। সকালের প্রশ্নটা আবার করে উদগ্রকণ্ঠে, ‘আপনি কবে আসবেন?’

সৌরেন্দ্র হাসে, ‘বললাম যে! বালেশ্বর পৌঁছেই ফিরব। যদি সবকিছু ঠিক থাকে।’

‘ঠিক থাকবে না কেন?’ ভুবনমণির ঠোঁটদুটো কেমন যেন কেঁপে ওঠে, ‘আপনার কত কাজ আছে বলুন তো? আইন যে পাশ করাতেই হবে!’

সৌরেন্দ্র একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। লোপামুদ্রাকে নিয়ে যদু আর মধু ততক্ষণে এগিয়ে গিয়েছে কয়েক পা। কুলপি গ্রামের এই ঘাট যেন হঠাৎই একটু বেশিই নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে।

জ্যোৎস্না রাতে অতি বড় নিরস ব্যক্তিরও মনে ভাব জাগে। তাই সৌরেন্দ্ররও যেন কেমন ঘোর লেগে যায়। বলে, ‘তার আগে আরেকটা আইনকে ঘরে আনতে চাই ভুবন।’

‘কী আইন?’

সৌরেন্দ্র সরাসরি তাকায় তার বীরনারী-র দিকে। গলা একটুও কাঁপে না তার। বলে, ‘সেই যে সেদিন বলেছিলে? বিদ্যাসাগর মশাইয়ের১৫ আইন?’

ভুবনমণি লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলে। কী বলবে বুঝতে না পেরে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘কেন?’

সৌরেন্দ্র একইরকম নীচু লয়ে বলে, ‘তুমি আমাকে একদিন বলেছিলে না, আমাদের সমাজে নারাচের মতো অস্ত্রের বড় প্রয়োজন! ক্ষুরধার আর সাহসী। তেমন একজনের সাক্ষাৎ পেয়েছি যে!’

ভুবনমণির মুখ থেকে বাক্য সরছিল না। কিন্তু তার পায়ের পাতাদুটো একে অপরের সঙ্গে ঘর্ষণে উষ্ণ হয়ে উঠছিল।

সৌরেন্দ্র ওর নরম হাতের ওপর হাত রাখে। ফিসফিস করে বলে, ‘গিয়েই দিদিকে সব বলব ভুবন। আমার বীরনারীকে নিজের চোখে দেখছি। এবার তার পাশাপাশি গোটা জীবনটা চলে ধন্য হতে চাই।’

ভুবনমণি হাঁটতে থাকে। ভুলেও পেছন ফিরে তাকায় না। তাকালে যদি সে আর ফিরতে না পারে, সেই ভয়ে সোজা এগিয়ে চলে সে। কিন্তু নিজের ইন্দ্রিয়কে সে সংবরণ করতে পারে না।

তার চোখ দিয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। সেই অশ্রু পরম আনন্দের!

সৌরেন্দ্র যতটা সম্ভব স্বাভাবিক লয়ে হেঁটে উঠে এল জাহাজে। প্রথম শ্রেণির ওয়ার্ডগুলোয় এখনো নৈশভোজের ব্যস্ততা। নারী-পুরুষ পৃথকভাবে খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে একদিকে। সেখানে টিমটিম করে জ্বলছে অনেকগুলো লণ্ঠনের আলো।

দয়াময়ী দাঁড়িয়ে ছিল তার ঘরের সামনেই। সৌরেন্দ্রর সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে ইঙ্গিতে জানতে চায় সব কিছু ঠিকমতো মিটেছে কিনা।

সৌরেন্দ্র দাঁড়ায় না। ইশারায় সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে আসে পুরুষদের ওয়ার্ডে। নবকিশোর দত্তের সঙ্গে তার বিকেলেই প্রাথমিক আলাপ হয়েছে। সৌরেন্দ্র নিজের পরিচয় দিয়েছে জমিদারপুত্র হিসেবে। যা সত্যি তো বটেই।

নবকিশোর দত্তকে এখন যে করেই হোক অনেকক্ষণ আটকে রাখতে হবে।

নবকিশোর তার ঘরের জাজিমে বসে মদ্যপান করছিলেন। জানলা দিয়ে ভেসে আসা নদীর ঠান্ডা হাওয়া আর সুরা—এই দুই কারণে তাঁর চোখদুটো ইতিমধ্যেই রক্তাভ হয়ে উঠেছে। তাঁর থেকে সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে গণেশ, তার হাতে একটি থেলো হুঁকা।

সামনে বসে আছেন এক ব্রাহ্মণ। শ্মশ্রুগুম্ফবিহীন, মুণ্ডিত মস্তক, নিরাবরণ ঊর্ধাঙ্গ। নাকের ওপর সযত্নে আঁকা রসকলি। গৌরকান্তি দেহে শুধু শোভা পাচ্ছে একগোছা উপবীত।

সৌরেন্দ্রর মনে পড়ল, তারা যখন শেষমুহূর্তে এসে জাহাজে উঠছিল, ইনি ছিলেন ওদের একদম পেছনে।

ব্রাহ্মণ নবকিশোর দত্তের কোনো একটা প্রশ্নের উত্তরে শ্রীচৈতন্যের কথা বলছিলেন।

‘চৈতন্যদেবের প্রকৃত নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টের বাসিন্দা। চৈতন্যদেবের পিতা জগন্নাথ মিশ্র অধ্যয়ন ও সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চার জন্য শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে আসেন।’

নবকিশোর দত্ত বলেন, ‘আচ্ছা ঠাকুরমশাই, নিমাইপণ্ডিত নাকি খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন?’

‘হ্যাঁ ।’ ব্রাহ্মণ ইতিবাচক মাথা নাড়লেন, ‘প্রকাণ্ড শরীর শুদ্ধ কাঞ্চন বরণ, আজানুলম্বিত ভুজ কমললোচন। সুপুরুষ নিমাইপণ্ডিত মাত্র কুড়িবছর বয়সে টোল খুলে বসেন। তর্কশাস্ত্রে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তে। কিন্তু গয়ায় পিতার পিণ্ডদান করতে গিয়ে তিনি সাক্ষাৎ পান ঈশ্বর পুরীর। তারপর থেকেই তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। বাংলা ত্যাগ করে তিনি চলে যান শ্রীক্ষেত্রে।’

সৌরেন্দ্র শুনতে শুনতে পাশে বসে পড়েছিল। হঠাৎ বলল, ‘শ্রীচৈতন্য যখন পুরী গিয়েছিলেন, তখনও কি এপথে জাহাজ চলত?’

ব্রাহ্মণ হাসলেন। বললেন, ‘তার আগে চলত। কিন্তু সেইসময় পর্তুগিজ বোম্বেটেদের উৎপাতে জলপথ খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। চৈতন্যদেব পুরী গিয়েছিলেন পদব্রজে। তখন প্রধান যাত্রাপথ বলতে ছিল জগন্নাথ সড়ক। রাজধানী গৌড় থেকে শ্রীক্ষেত্র অবধি। কিন্তু সেই পথে উড়িষ্যা রাজার পথকর আদায়ের জন্য ‘দানী’-রা দাঁড়িয়ে থাকত। তীর্থযাত্রীদের ওপর তাদের অত্যাচার লেগেই থাকত। তার ওপর তখন উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের সঙ্গে বাংলার হুসেন শাহর যুদ্ধ চলছে। সেই সুবাদেও জগন্নাথ সড়কে সেনাদের হামলা হত। এতকিছুর জন্যই মনে হয় চৈতন্যদেব ওই পথে না গিয়ে শিয়াখালা হয়ে পৌঁছেছিলেন তমলুক। শ্রীমুরারি গুপ্তের কড়চায় আছে,

‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য দেবনদ পার হৈঞা

উত্তরিলা তমোলিপ্তে সেয়াখালা দিয়া।।’

তমোলিপ্ত অর্থাৎ তাম্রলিপ্ত। মেদিনীপুরের অরণ্য হয়ে তিনি পুরী পৌঁছেছিলেন।’

‘বাহ বাহ!’ নবকিশোর দত্ত দরাজ হাসলেন। গণেশের হাত থেকে হুঁকোটা নিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘তা ঠাকুরমশাই, আপনি একটু এই ক’দিন আমাদের চৈতন্যের কথা শোনান না। পাপী মনে একটু পুণ্য হয় তবে! আপনাকে দেখেই মনে হয় সাক্ষাৎ সিদ্ধপুরুষ। বড় চেনা লাগে। মনে হয়, কোথাও যেন দেখেছি!’

ব্রাহ্মণের নাম পূর্ণচন্দ্র ন্যায়রত্ন। তিনি নবদ্বীপনিবাসী। পুরুষোত্তমধামে তীর্থে যাচ্ছেন। প্রথম শ্রেণীর পুরুষ ওয়ার্ডের একইদিকে রয়েছেন তিনি, নবকিশোর দত্ত আর সৌরেন্দ্র। নিজেদের কামরার বাইরের খোলা অংশে বসে এখন তাঁরা উপভোগ করছেন সন্ধ্যার গঙ্গাকে।

ডেকের ওইপ্রান্তে বসেছে হরিনামের আসর। খোলকরতাল সহযোগে সেখানে চলছে কীর্তন।

ব্রাহ্মণ স্মিতমুখে বললেন, ‘হরিহরয়ে নমঃ! বিশ্বচরাচরে সবাই চেনা, সবাই আপনার দত্তমশাই! উঁচুজাত নিচুজাত, হিঁদু-মুসলমান বলে কিছু হয় না। সবাই কাছের জন।’

‘গলায় পৈতে নিয়ে ইকি কতা কন ঠাকুরমশাই!’ বিস্ময়ে নবকিশোর দত্তের চোখদুটো গোলগোল হয়ে ওঠে, ‘গরুখেকো মোছলমান কাছের জন?’

‘তা নয়তো কী?’ পূর্ণচন্দ্র ন্যায়রত্ন মাথা দোলালেন, ‘স্বয়ং শ্রীচৈতন্য বলে গিয়েছেন, মুচি যদি ভক্তিসহ ডাকে কৃষ্ণধনে, কোটি নমস্কার করি তাহার চরণে। তিনি যবন হরিদাসকে কোল দিয়েছিলেন, সত্যবাঈ, লক্ষীবাঈয়ের মতো পতিতাকে সৎপথে এনেছিলেন, শূদ্র রাম রায় তাঁর আদেশে করেছিলেন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা। সকলেরই তো চামড়ার নীচে বইছে লাল রক্ত দত্তমশাই! পার্থক্য শুধু মনুষ্যত্বে। যা সবার ঊর্ধ্বে! আর তাতেই হয় তফাত!’

নবকিশোর দত্ত এবার চুপ করে রইলেন। বোঝাই যাচ্ছে, ব্রাহ্মণের এতটা মুক্তমনা বক্তব্য তিনি ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারছেন না। নিমাই পণ্ডিতের প্রতি তাঁর একটা কৌতূহল ছিল, সেই আগ্রহেই তিনি এই বৈষ্ণব ব্রাহ্মণের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছিলেন। কিন্তু মুসলমান, শূদ্র, পতিতা সবাই আপন, এ আবার কেমনতর কথা! তাঁকে মূর্খ পেয়ে উল্টোপাল্টা বলছে নাকি ফোঁটাকাটা বামুনটা?

নাহ, ধনঞ্জয় বাক্যবাগীশ এখানে থাকলে এখুনি তর্কে ছিনভিন্ন করে দেবেন ব্যাটাকে। পালানোর পথ পাবে না তখন।

রঙ্গ দেখার জন্য নবকিশোর দত্ত বললেন, ‘যাই। একটু হরিনাম শুনে আসি ডেক থেকে। ওদিকের ওয়ার্ডে আবার আমার গুরু ঠাকুর ধনঞ্জয়পণ্ডিতও রয়েচেন কিনা, তাঁকেও ডেকে আনি। তিনিও পণ্ডিতমানুষ, দুজনের মধ্যে জমবে ভালো।’

সৌরেন্দ্র প্রমাদ গুনল। যদু-মধুর হাতে ভুবনমণিদের সে তুলে দিয়ে এসেছে একদণ্ডও হয়নি। এরমধ্যেই নবকিশোর দত্ত গিয়ে স্ত্রীদের না পেলে হুলুস্থুলু বেঁধে যাবে। যেভাবেই হোক, আজ রাতটা তাঁকে এখানেই আটকে রাখতে হবে।

সে দ্রুত বলল, ‘এখন ওদিকে আপনার না যাওয়াই ভালো দত্তমশাই!’

‘কেন?’ নবকিশোর দত্ত বিস্মিতচোখে তাকালেন।

‘না মানে ওদিকে সব মাজননীরা রয়েছেন তো, কথকঠাকুররা ঈশ্বরকথা কইছেন, আপনি গেলে লজ্জা পাবেন হয়ত!’ সৌরেন্দ্র বলল।

‘হ্যাঁ তা ঠিক। আমার পরিবাররাও তো ওকানেই রয়েচেন এখন। ঠিক আছে।’ নবকিশোর দত্ত তাঁর ভৃত্যের দিকে তাকালেন, ‘গণেশ, যা তো। পণ্ডিতমশাইকে ডেকে আন। বলবি আমি ডাকচি।’

গণেশ নিষ্ক্রান্ত হতেই পূর্ণচন্দ্র হাসলেন। বললেন, ‘আমি হলাম গিয়ে পূর্ণচন্দ্র। অর্থাৎ কিনা শুক্লপক্ষের চাঁদ দত্তমশাই। আমি সবাইকে গিলে ফেলি নিজের জ্যোতির মধ্যে। তাই আমাকে তর্কে হারানো অত সহজ নয়।’

‘হে হে, সে তো বটেই!’ নবকিশোর কান এঁটো করা হাসি হাসলেন, ‘তবে কিনা আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, পণ্ডিতদের তর্ক দেকতে বেশ লাগে!’

সৌরেন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এতক্ষণের চাপা উত্তেজনায় তার এবার বেশ ক্লান্ত লাগছে। লঘুপায়ে সে এগিয়ে গেল ডেকের দিকে। যেদিকে হরিনাম হচ্ছে, সেদিকে নয়। ডেকের বিপরীত প্রান্তে, যেখানে মজুর স্থানীয় লোকেরা বসে গুলতানি করছে, সেদিকে।

খোলা আকাশে মিটমিট করছে নক্ষত্ররা। ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে পদচারনা করতে করতে সৌরেন্দ্র কেমন ভাবাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আলগোছে গিয়ে দাঁড়ায় ডেকের রেলিঙে ভর দিয়ে। চোখ বুজে স্বাদ নিতে থাকে নৈশ প্রকৃতির।

ঘাড়ের কাছে কিছু একটা সুড়সুড় করায় দেখে একটা লম্বা চুল সেখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে। ওর মনে পড়ে যায়, সকালে ভুবনমণির টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাওয়া। নরম হাতে চুলটা নিজের হাতে নেয় ও। এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতিতে ওর মনটা ভরে ওঠে।

ভুবনমণিরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে যদু-মধুর বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে? হঠাৎ করেই ভুবনমণির পানপাতার মতো মুখখানা মনে পড়ে ওর। কী শান্ত, সরল মুখ, অথচ সেই মুখের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে কতটা দৃঢ়তা। শত প্রতিকূলতাতেও ভুবনমণি ঠিক রক্ষা করতে পেরেছে তার ভাইঝিকে।

অদূরে মাঝিমাল্লারা তাদের আঞ্চলিক গান জুড়েছে। সেই গানের আমেজে সৌরেন্দ্র নিজের চিন্তাজগতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ চমক ভাঙল এক মনুষ্যকণ্ঠে।

প্রায়ান্ধকার ডেকে ঠিক পাশ থেকে কেউ যেন তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘ওদের কোথায় রেখে এলেন?’

সৌরেন্দ্র চমকে উঠল। প্রাণপণ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে করতে সে তাকালো।

একটা লোক। লোক না বলে যুবক বলাই ভালো। সারা গায়ে কালিঝুলি মাখা, পরিশ্রান্ত চেহারা। কথাবার্তায় শিক্ষিতের ছাপ। কিন্তু সব ছাপিয়ে যা নজরে পড়ে, তা হল লোকটার চোখ।

অন্ধকারে সেই দুটো যেন জ্বলছে।

সৌরেন্দ্র গলা স্বাভাবিক রেখে বলে, ‘কাদের রেখে এলাম? কী বকছেন? কে আপনি?’

যুবকটি আরো একটু এগিয়ে লণ্ঠনের কাছাকাছি আসে। তারপর ফ্যাসফেঁসে স্বরে বলে, ‘ওই দুজন মেয়েমানুষকে দেখলাম তো! আপনার পিছু পিছু জাহাজ থেকে নামল। আর আপনি ফিরে এলেন একা।’

সৌরেন্দ্র ঘাবড়াল না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা সে আয়ত্ত করেছে অনেকদিন হল। শান্তস্বরে বলল, ‘তাই নাকি? তা লোকের হাঁড়ির খবর রাখেন, কই আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!’

যুবক এবার সামান্য থামল। তারপর বলল, ‘আমি সামান্য খালাসি। এই জাহাজে সদ্য কাজে ঢুকেছি। কিন্তু আমি নবকিশোর দত্তকে চিনি। সধবা মেয়েমানুষটা কি ওর বউ?’

সৌরেন্দ্র খুব সন্তর্পণে চারদিকে দেখল। এদিকটা অন্ধকার, সেভাবে কেউ দেখছে না। তার নিজের নিয়মিত ব্যায়াম করা পেটানো শরীর, রোগাপাতলা এই যুবককে এক ধাক্কায় ডেক থেকে নীচে ফেলে দিলে ঝপ করে একটা শব্দ হবে। কেউ টের পাবে না।

কিন্তু মুশকিল হল, জাহাজ তো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটা ঠিক হ্যাচোর প্যাঁচর করে উঠে পড়বে। তখন চারপাশে আরোই লোকজানাজানি হয়ে যাবে।

তার চেয়ে একে কৌশলে হাত করতে হবে।

সৌরেন্দ্র কোমরের আড়ালে লুকনো গেঁজেতে হাত দিল। আপাতত পাঁচটাকা দিয়ে একে ঠান্ডা করা যাক।

টাকাটা বের করে হাতে গুঁজে দিতে যাবে, এমন সময় ছেলেটা একটা আশ্চর্য কথা বলল।

‘নবকিশোর দত্তের মতো পাষণ্ডর হাত থেকে ওর বউটাকে রক্ষা করে আপনি খুব ভালো কাজ করলেন।’

সৌরেন্দ্র চমকে তাকাল।

‘মানে?’

ছেলেটা যেন ওকে আর দেখতে পাচ্ছিল না, আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছিল, ‘নব দত্ত আমার মতো বেজন্মার চেয়েও খতরনাক। আমার মতো বহেনচোদের চেয়েও বেশি খতরনাক!’

সৌরেন্দ্র আর কিছু প্রশ্ন করতে পারল না। তার আগেই ছেলেটা বিড়বিড় করতে করতে সরে গেল ডেকের অন্যদিকে। কাঁধের ঝোলা থেকে বের করল একদিস্তে কাগজ। তারপর সেগুলো একটা একটা করে উড়িয়ে দিতে লাগল শূন্যে।

জ্যোৎস্না রাতে সেই সাদা কাগজগুলো হাওয়ায় ভেসে ভেসে ছড়িয়ে পড়তে লাগল জলের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজের সামনের কালো জলটার ওপর মনে হল যেন শয়ে শয়ে শ্বেতশুভ্র রাজহাঁস খেলা করছে।

সৌরেন্দ্র এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে, ‘এই। কী করছ? এগুলো উড়িয়ে দিচ্ছ কেন? কীসের কাগজ এগুলো?’

ছেলেটা জলচোখে তাকাল ওর দিকে। কেমন অদ্ভুত হেসে বলল, ‘মিথ্যা কাগজ। ডুবে যাওয়াই ভালো।’

৩৭

রাতের অন্ধকারে পারামারিবো’র ঘাট যেন কোনো প্রেতপুরী। কেউ কোথাও নেই, শুধু বালির ওপর সমুদ্রের নোনা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে নিজের খেয়ালে।

কৃষ্ণসুন্দররাও প্রেতাত্মার মতোই চুপিচুপি উঠে বসলেন ওলবা’র ছোট জাহাজে। আসার সময়ে যে জাহাজ ছিল, তার চেয়ে এই জাহাজ আয়তনে প্রায় অর্ধেক। কর্মচারীও সাকুল্যে আট দশজন কৃষ্ণাঙ্গ।

তা ছোট হোক, ঠিকমতো পৌঁছলেই হল।

এই জাহাজ যখন ওলন্দাজরা এখানে ফেলে দিয়েছিল, কেউ ভাবেনি, একে মেরামতি করে আবার কাজে ফেরানো সম্ভব। কিন্তু সুরিনামের আদি বাসিন্দারা তা করে দেখিয়েছে। ওলবা’র নেতৃত্বে এই রসদভর্তি জাহাজ এখন সাগরপাড়ি দিয়ে যাবে প্রাচ্যে। তবে কলকাতায় নয়। তার গন্তব্য দক্ষিণের কালিকট।

তা হোক। দেশ তো একই। কালিকট থেকে কলকাতা আসা আর কী এমন ব্যাপার!

তোতারাম, পরেশ কৈবর্ত, বিনয়রা সব উত্তেজনায় ফুটছে। সবার অলক্ষে প্রায় পঞ্চাশজনের দল চুপিচুপি বেরিয়ে এসেছে নিজেদের কোঠাবাড়ি ছেড়ে। তারপর হেঁটেছে অনেকখানি। ক্লান্তি আসেনি।

জাহাজ যখন বন্দর ছেড়ে বেরোচ্ছে, তখন একবার নেমে গিয়ে ওলবা’র হাত দুটো চেপে ধরলেন কৃষ্ণসুন্দর। কেউ কারুর ভাষা বোঝেন না।

তবু ওলবা তাঁর লৌহকঠিন দেহে চেপে ধরল বাঙালি এই ব্রাহ্মণকে। তার ভাষাতেই বোধ হয় বলল, ‘শুভ যাত্রা বন্ধু! ভালো থেকো।’

দিব্যসুন্দর তো বটেই, ব্রহ্মময়ীরও উচ্ছ্বাস যেন ফেটে পড়ছিল। আসার সময় সকলে এসেছিলেন মৃতপ্রায় পশুর মতো, স্বদেশের প্রত্যাবর্তনের আনন্দে এখন উদ্দীপনা ফুটে বেরোচ্ছে সবার মধ্যে থেকে।

জাহাজ চলতে শুরু করতেই তোতারাম মনের আনন্দে জুড়ে দিল একটা গান। তার আঞ্চলিক টানে সেই গানের কথা কিছু বোঝা যায় না, তবু সবাই তাকে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর চামেলি বলে মেয়েটা খনখন করে ওঠে, ‘আ মরণ! মিনসে’র এসব কী গান হচ্চে? একি গান না কোবতে?’

তোতারাম কটমট করে তাকায় তার দিকে। চামেলি তাতে পরোয়া করে না। নিজের অতীতজীবনে ফেলে আসা স্মৃতির অতল থেকে তুলে আনে গান, উবু হয়ে বসে সুরেলা গলায় গাইতে থাকে সে।

‘যখন প্রাণ ছিলে প্রাণে কত মসলা দিতেম পানে

আর কি আমার সেদিন আছে, চুনের ভাঁড় শুকায়ে গেছে।’

তথাকথিত ভদ্র ও পতিত সবরকম মানুষই রয়েছে এই দলে। কিন্তু এই কয়েকমাসে তাদের মধ্যে ঘুচে গিয়েছে সব ব্যবধান। তাই গানের শ্লীল অশ্লীল বিচার না করে সবাই মেতে ওঠে তাল মেলাতে।

কয়েকটা মেয়ে পালিয়ে আসার সময় কোঁচরে ভরে নিয়েছে অনেকক’টা ছোট ছোট করে কাটা আখ। তারা এখন সবার মধ্যে বিতরণ করছে সেই আখ। এর মধ্যেই ঘোষণা করেছে, সমুদ্রযাত্রার প্রতিদিন রান্না করবে তারাই। আখের খেতে জল তোলার কাজ করে করে তারা ক্লান্ত।

দিব্য দৌড়ে বেড়াচ্ছিল গোটা জাহাজে। একবার ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘দিদিরা কি জানে বাবা, আমরা আসচি?’

কৃষ্ণসুন্দর হাসিমুখে বললেন, ‘নারে। তুই গিয়ে চমকে দিবি নাহয়।’

‘হ্যাঁ , আমি চমকে দেব।’ দিব্যর বেশ পছন্দ হল কথাটা। আবার ছুটতে ছুটতে সরে গেল অন্যদিকে।

ব্রহ্মময়ী বললেন, ‘আচ্ছা, অপা আর লোপা কত বড় হয়েছে বলো তো?’

কৃষ্ণসুন্দর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সবকিছু অনুকূলে থাকলে তারা হয়ত এখন কলকাতার কোনো ইশকুলে পড়ছে। দ্বারকাই ভর্তি করে দিয়েছে। ভুবনকেও।’

ব্রহ্মময়ী আলোকিত মুখে বললেন, ‘আচ্ছা, ওরাও কি ওই দ্বারকার বউয়ের মতো ডাক্তার হবে গো?’

‘কেন নয়?’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘আমি তো তাই চেয়েছিলাম। আমার মেয়েরা যেন নিজেরা শিক্ষিত হয়। অন্দরমহলের মতো জড়পুঁটুলি হয়ে থাকুক, এ তো আমি কখনোই চাইনি কৃষ্ণা! তাই তো ওদের অমন নাম দিয়েছিলাম! তাই তো নিজের সাধ্যমাতো বিদ্যাদান করেছিলাম।’

‘কিন্তু শাস্ত্রে নাকি বলে, মেয়েদের স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করা পাপ?’ ব্রহ্মময়ী প্রশ্ন করলেন, ‘তবে ওরা কী করে মানুষের চিকিৎসা করবে গো? পাপ হবে না?’

কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘তুমি যা বলছ, তা আমাদের বৈদিক শাস্ত্র নয় কৃষ্ণা। মনুসংহিতার শ্লোক।

বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।

ন স্বাতন্ত্র্যে কর্তব্যং কিঞ্চিৎ গৃহেংপি।।

নারী বালিকাই হোক, যুবতীই হোক, বৃদ্ধাই হোক, গৃহমধ্যে হলেও সে স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করতে পারবে না।

বেদপরবর্তী যুগে বেদ যখন শ্রুতি থেকে পরিণত হয়েছিল স্মৃতিতে, তখন মনুসংহিতার মতো অনেক অপভ্রংশ রচিত হয়েছিল। এগুলো রচয়িতার নির্দেশ মাত্র। প্রকৃত শাস্ত্র নয়। আমি মানি না এই অযৌক্তিক অনুশাসন কৃষ্ণা। আমার আদর্শ বৈদিক যুগের ঋষি গার্গী। যিনি ভরাসভায় যুক্তির জালে পরাস্ত করেছিলেন যাজ্ঞবল্ককে।’

‘হুম।’ ব্রহ্মময়ী স্বামীর কথায় সায় দেন, ‘আমাদের মেয়েদুটো পণ্ডিত হবে, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। নাগো!’

‘সবই বাবা বিশ্বনাথের আশীর্বাদ কৃষ্ণা! নাহলে যেখানে মানুষ এই নির্বাসন থেকে ফিরতেই পারে না নিজের দেশে, সেখানে আজ আমরা এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাচ্ছি!’

ব্রহ্মময়ী অস্ফুটে বললেন, ‘আমার তো মনে হয়, ওই ওলবা-ই ঈশ্বররূপে এসেছিল। বাঁচিয়ে দিয়ে গেল আমাদের। ঈশ্বর যে মানুষের মধ্যেই!’

‘ঠিকই বলেছ তুমি!’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন।

অনেকক্ষণ দুজনে জাহাজের ডেকে বসে থাকেন পাশাপাশি। রাতের মিটমিট করে জ্বলতে থাকা নক্ষত্রগুলোও আজ যেন মেতেছে নতুন আনন্দে।

‘তুমি অনেকদিন আগে কী বলেছিলে মনে আছে? মহাভারতে পাণ্ডবরা কত অন্যায়ের শিকার হয়েও শেষে জিতেছিল, কারণ তারা শুভশক্তি।’ ব্রহ্মময়ী স্বামীর আঙুলে নিজের একটা আঙুল জড়িয়ে ধরলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদেরও সেসব অগ্নিপরীক্ষার পালা মিটেছে। এবার থেকে যা হবে, সব ভালো। দেখো তুমি!’

কুলপি পেরিয়ে সাগরে পৌঁছে স্যার জন লরেন্স জাহাজ এখন অকূলসিন্ধুতে। উপকূল থেকে দু-তিনক্রোশ দূরত্বে চলেছে দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে। গাঙ সারেঙ পীতাম্বর মিত্রের কাজ শেষ, সে এখন তার কেবিনে ছোট সারেঙদের সঙ্গে আরাম করছে। বঙ্গোপসাগর থেকে বেঁকে মহানদী হয়ে কটক বন্দর পর্যন্ত জাহাজ চালানোর দায়িত্ব এখন প্রধান ক্যাপ্টেন জন আরভিং-এর ওপর।

ক্যাপ্টেন আরভিং ভালো মানুষ। সাহেব হলেও নেটিভদের সঙ্গে বেশ আমুদে ব্যবহার। সৌরেন্দ্র তাঁর সঙ্গে আলাপ করছিল। পরিস্থিতি কী হবে, জানা নেই। তাই আগে থেকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করে রাখা ভালো।

যদিও তার সতর্ক মন ছিল পুরুষ ওয়ার্ডের দিকে। নবকিশোর দত্ত এখনো কিছু টের পাননি।

ক্যাপ্টেন আরভিং অত্যন্ত দক্ষ নাবিক। প্রথম জীবনে ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে, তারপর নানা দেশের নানা জাহাজ কোম্পানির হয়ে কাজ করে প্রৌঢ় বয়সে এসেছেন ভারতবর্ষে। প্রাচ্যের এই দেশ তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। আর কয়েকবছর পরেই অবসর নেওয়ার সময় এসে যাবে, তখন নাকি তিনি এই দেশেরই কোনো পাহাড়ে গিয়ে বাসা বাঁধবেন।

‘আপনার স্ত্রী পরিবার?’ সৌরেন্দ্র ইংরেজিতে প্রশ্ন করেছিল।

‘ওসবের ধার মাড়াইনি ইয়ং ম্যান!’ আরভিং তাঁর শ্বেতশুভ্র দাড়ির ফাঁক দিয়ে অল্প হেসেছিলেন, ‘আমাদের মতো নাবিকদের জীবন তো সরু তারের ওপর দিয়ে হাঁটার মতো। একটু এদিক ওদিক তো জীবন শেষ। শুধু শুধু কেন একটা মেয়ের অকালে জীবনটা ধূসর করে দেব?’

সৌরেন্দ্র আরো কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই কথোপকথনে ছেদ পড়েছিল। কারণ একটা দেশীয় স্টোকার উত্তেজিত অবস্থায় এসে ওদের পাশ দিয়েই সটান ঢুকে গিয়েছিল কন্ট্রোল রুমে।

ক্যাপ্টেন আরভিং-এর অনুপস্থিতিতে কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে তখন সেকেন্ড অফিসার মিঃ স্মিথ। তিনি দীর্ঘদিন আছেন এদেশে, বাংলা ভাষাও রপ্ত করেছেন বেশ।

আরভিং-এর পিছু পিছু কৌতূহলী সৌরেন্দ্র ডেক ছেড়ে কন্ট্রোল রুমে ঢুকতেই মিঃ স্মিথ বললেন, ‘ক্যাপ্টেন! রামু বলছে, পশ্চিমের বাতাস আরো জোরদার হচ্ছে। ওয়াটার লেভেলও বাড়ছে।’

‘হুম।’ ক্যাপ্টেন আরভিং ভ্রূ কুঁচকোলেন। কিন্তু তেমন চিন্তান্বিত হলেন না। একটু ভেবে বললেন, ‘কাছাকাছি থাকা লাইট ভেসেলের সিগন্যাল ফলো করো। তারপর সেভাবে এগিয়ে গিয়ে খালাসিদের বলো, জাহাজের হসারগুলোকে টেনে ধরে কোনো খাঁড়ির মধ্যে আপাতত ঢুকিয়ে রাখতে। হাওয়াটা কমুক, তারপর দেখা যাবে।’

নির্দেশ পেয়েই রামু নামক স্টোকারটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলে গেল।

সৌরেন্দ্র জিজ্ঞেস করল, ‘লাইট ভেসেল কী?’

‘লাইট হাউজ কী, তা জানো?’ ক্যাপ্টেন আরভিং পালটা প্রশ্ন করলেন।

‘হ্যাঁ মানে।’ সৌরেন্দ্র আমতা আমতা করল, ‘ওই সমুদ্রের মাঝখানে লম্বা টাওয়ার থাকে, সেখান থেকে আলো ছড়ায়।’

ক্যাপ্টেন আরভিং হাসলেন, ‘কিছুটা ঠিক বলেছ। তবে লাইট হাউজের কাজ আলো ছড়ানো নয়। সমুদ্রের মধ্যে অনেক চোরাগোপ্তা বিপজ্জনক স্থান থাকে, যেখানে জাহাজ বা নৌকা গিয়ে পড়লে বিপদ। হয়ত কোথাও রয়েছে কোন ডুবোপাহাড় বা বিপদসঙ্কুল বালির চর। লাইট হাউজ সেখানে অনেকটা ট্র্যাফিক সিগন্যালের মতো কাজ করে, সাবধান করে জাহাজের নাবিকদের। আবার সমুদ্রের কোনো কোনো জায়গায় জল এতটাই গভীর থাকে, যে লাইট হাউজ বানানো যায় না। তখন সেখানে ছোট কোনো জাহাজকে স্থিরভাবে ভাসিয়ে রাখা হয়, সে-ই ওই জায়গায় লাইট হাউজের কাজ করে। তাকে বলে লাইট ভেসেল।’

সৌরেন্দ্র মন দিয়ে শুনছিল। ক্যাপটেন থামতেই ও বলল, ‘সমুদ্রে বাতাস যে ক্রমশ বাড়ছে, সেটা কি চিন্তার?’

‘তুমি কি বিবাহিত?’ একেবারে অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন করলেন ক্যাপ্টেন আরভিং।

বাতাস বাড়ার সঙ্গে ওর বিবাহের কী সম্পর্ক, তা বুঝতে পারল না সৌরেন্দ্র। তবে, কথাটা শোনামাত্রই ওর চোখের সামনে ভুবনমণির মুখটা ভেসে উঠল।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ভুবনমণির এতক্ষণে দ্বারকানাথের সঙ্গে বজরায় কলকাতার দিকে যাত্রা করার কথা। কথা আছে, বাড়িতে পৌঁছে গেলে দ্বারকানাথ একখানা টেলিগ্রাম করে দেবেন। সৌরেন্দ্রও পৌঁছে যাবে দিনদুয়েকের মধ্যে। তারপর ব্রাহ্মসমাজের কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর উপস্থিতিতে কাজটা ভালোয় ভালোয় মিটলেই শান্তি।

তারপর ও আর ভুবনমণি, দুজনে মিলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে সমাজ সংস্কারের কাজে। আহ, ভাবতেই কি শান্তি!

ক্যাপ্টেন আরভিং ওর দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে ও বাস্তবে ফিরে এল। দুপাশে মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

ক্যাপ্টেন স্মিতমুখে গাঢ়চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন ওর দিকে। তারপর বললেন, ‘না বলতে এত সময় নিলে মানে বিবাহ না হোক, প্রেমিকা তো কেউ নিশ্চয়ই আছে। তাই না?’

সৌরেন্দ্র প্রায় পিতৃতুল্য একজন মানুষের সঙ্গে এমন আলাপচারিতায় অভ্যস্ত নয়। সে আরক্ত মুখখানি নামিয়ে ফেলল। ওর মনে পড়ল, ভুবনমণির সেই চুলটা ওর ফতুয়ার ভাঁজে লুকনো রয়েছে।

আরভিং বললেন, ‘না না লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি ছাড়া গরু বলে সবাই যে হবে তেমন তো কোনো মানে নেই। শোনো, বাতাস বাড়াটা অতটা চিন্তার নয়, কিন্তু সেই বাতাস যদি ঝড় তোলে, তবে তো মাঝসমুদ্রে অবশ্যই চিন্তার!’

নবকিশোর দত্তর কাছে তার স্ত্রী নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ যখন পৌঁছল, তখন সূর্যদেব একেবারে মধ্যাহ্নগগনে। নব দত্তের বুড়িপিসিমা মধ্যাহ্নভোজের পর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললেন, ‘অ লব, তোর বউ কিন্তু ঘরে নাই।’

‘ঘরে নেই মানে?’

নবকিশোর দত্ত তখন সবেমাত্র ডেক থেকে এসে বসেছেন নিজের ঘরে। বাতাসের তেজ ক্রমে বাড়ছে, ডেকেও অল্পবিস্তর জল ঢুকতে শুরু করেছে। তাই ডেক ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে। গোটা জাহাজেই একটা উৎকণ্ঠার ভাব।

‘ঘরে নাই মানে নাই।’ বুড়িপিসিমা খনখনিয়ে বললেন, ‘কাল রাত থেকে যতবার গেচি, বড়বউ তাড়িয়ে দিয়েচে। আমার তকনই সন্দ হয়েচিল। এখন দেকি ঠিক তাই। ও লব, তোর বউ ভেগেচে।’

‘অন্য ঘরগুলোয় দেকেচ?’

‘ঘর, হরিনামের আসর কোতাও দেকতে বাকি নেই।’ বুড়িপিসিমা হাত নেড়ে বললেন, ‘তোর বউ গোটা জাহাজের কোত্থাও নাই।’

‘এসব কী কথা দত্তমশাই?’ ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকান ধনঞ্জয় পণ্ডিত, ‘ওদিকে আমার আশ্রমে যে চলছে এত আয়োজন! এত উপাচার! সব যে মিথ্যা হয়ে যাবে তবে!’

‘কিচ্চু মিথ্যে হবে না পণ্ডিতমশাই, আপনি দাঁড়ান!’ ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন পুরুষসিংহ নবকিশোর দত্ত। ছুটে গিয়েছিলেন মহিলা ওয়ার্ডে। একাই।

তাঁর ছায়াসঙ্গী গণেশ তখন ছিল না। খালাসিরা কীভাবে ডেকে ঢুকতে থাকা জল বের করছে, ওদিকে দাঁড়িয়ে গণেশ তাই দেখছিল সোৎসাহে। সে জানতেও পারল না এদিকের ঘটনা।

বীরপুঙ্গব নব দত্ত লোপামুদ্রার শূন্য ঘরে একবার উঁকি দিয়ে গিয়েই সোজা চলে গিয়েছিলেন দয়াময়ীর ঘরে। সজোরে টেনে ধরেছিলেন তার চুলের মুঠি।

‘নষ্ট মাগি, তোর পেটে পেটে এই ছিল বলে অমন হ্যাংলা কুকুরের মতো এলি? নতুন বউ কোতায় বল শিগগির?’ উত্তেজনায় নবকিশোর হাঁপাচ্ছিলেন।

দয়াময়ী শান্ত স্থিরকণ্ঠে বলল, ‘জানিনে।’

‘জানি নে মানে? তোকে আজ শেষ করে ফেলব।’ এলোপাথাড়ি হাত চালাতে চালাতে নবকিশোর দত্ত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁর প্রথমা পত্নীর ওপর।

দয়াময়ী কোনো উত্তর দেয়নি। তার খোঁপা খুলে চুল এলিয়ে পড়েছিল, পরনের কাপড় অর্ধেক খুলে লুটোচ্ছিল কেবিনের মেঝেতে। চোখের ঠিক ওপরেই প্রচণ্ড আঘাতে সে প্রায় কিছু দেখতে পাচ্ছিল না।

তবু তার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরচ্ছিল না। বহুবছর পর সে আবারও নীরবে সহ্য করছিল স্বামীর অত্যাচার। রক্তাক্ত ধরিত্রীর মতো নীরবে গ্রহণ করছিল সব যাতনা।

কেবিনের দরজা ভেজানো, কেউ করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলে খুব সজাগ না হলে টেরও পাবে না ভেতরে কী হিংসালীলা ঘটে চলেছে।

কিন্তু বেশিক্ষণ তাকে সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে হল না।

নবকিশোর যখন প্রবল আক্রোশে দু-হাতে দয়াময়ীর গলা টিপে ধরেছেন, দয়াময়ীর চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে বাইরে, অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে গালের কোনা বেয়ে, ধীরে ধীরে দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে আসছে, হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে নবকিশোর দত্ত থেমে গেলেন।

তারপর কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়লেন কেবিনের মেঝেতে।

দয়াময়ী হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসল। সভয়ে দেখল, যে সাত্ত্বিক উপবীতধারী ব্রাহ্মণ সন্ধ্যে বেলা ডেকে বসে কৃষ্ণকথা শোনাতেন, তাঁর হাতে ধরা ধারালো ছুরি। তা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। আর সেই ছুরির জোরালো আঘাতে প্রায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে নবকিশোর দত্তের পিঠ থেকে বুক।

‘ও মাগো!’ দয়াময়ীর মুখ দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে এল।

কিন্তু ব্রাহ্মণ তাতে বিচলিত হলেন না। দয়াময়ীকে তিনি যেন দেখতেই পেলেন না, এগিয়ে এসে মুমূর্ষু নবকিশোরের বুকে কোপাতে লাগলেন তাঁর ছুরিটা।

তাঁর মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। বরং রয়েছে এক অমানুষিক নির্লিপ্তি।

সৌরেন্দ্র যখন ঘরে ঢুকল, তখন নবকিশোর দত্তের প্রাণবাবু বেরিয়ে গিয়েছে। দয়াময়ী ও বাকি স্ত্রীদের বৈধব্যের দিকে ঠেলে দিয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন পরপারে।

গোটা কেবিন ভেসে যাচ্ছে রক্তে। বিরাজ করছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। দয়াময়ী বিস্ফারিত নয়নে থেবড়ে বসে রয়েছে মাটিতে।

শুধু পূর্ণচন্দ্র ন্যায়রত্ন নিজের মনে বিড়বিড় করছিলেন। তাঁর মতো উপবীতধারীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল ম্লেচ্ছ সমস্ত শব্দ।

‘বলেছিলাম না তোকে? শুক্লপক্ষেই পূর্ণচন্দ্র হয়। আমার ভাইয়ের তুই এত ক্ষতি করেছিস, তোকে বাঁচিয়ে রাখা গুনাহ হত দত্তজি! বহত বড়া গুনাহ! তাই তোকে জাহান্নামে পাঠাতেই হল। খুদা হাফিস!’

৩৯

নবাব সুলতানখানার ছাদ থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেলেন। ইদানীং ছাদে বসে তিনি মগ্ন হয়ে যেতেন কোন ভাবনায়। পারিষদদের পাঠিয়ে দিতেন নীচে, আকাশে উড়ন্ত পাখি আর দূরের নদীর ঠান্ডা হাওয়ার পালে ভর করে কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন।

তাই সিঁড়ি থেকে পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ কেউ টের পেল না। সিঁড়ির নীচেই পাহারারত দারোয়ান যখন ছুটে এল, হাঁকডাকে সবাইকে জড়ো করল, ততক্ষণে নবাব চেতনা হারিয়েছেন। নাক দিয়ে গড়াচ্ছে তাজা রক্ত, ঠোঁটের একপাশে ফেনা।

গোটা একটা দিন পর তাঁর চেতনা ফিরে এল বটে, কিন্তু শরীরের বাঁ পাশটায় আর কোনো সাড় নেই। সেদিকটা যেন অকেজো হয়ে গিয়েছে জন্মের মতো।

মেটিয়াবুরুজের হাকিমরা তো বটেই, আসগর আলী খোঁজখবর নিয়ে হাজির করল একজন সাহেব ডাক্তারকেও। সে ডাক্তার এসেই নবাবের বুক, পেট সব টিপে টিপে দেখল। নবাবের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলেও তিনি কিছু বললেন না। শুধু মলিন চোখদুটি বুজে পড়ে রইলেন চুপচাপ।

ডাক্তারটা একটা অদ্ভুতদর্শন যন্ত্র কিছুক্ষণ চেপে রইল নবাবের ক্লান্ত বক্ষদেশে, যন্ত্রের অন্যপাশের দুটো মুখ লাগাল নিজের কানে। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াল।

আসগর আলী নিজের কাগজ পড়ার বাতিকের জন্য বাংলা ইংরেজি দুই ভাষাই বেশ পড়তে পারে। কিন্তু এর আগে কখনো সে কোনো শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে কথা বলেনি। বেশ আড়ষ্টতার সঙ্গে সে নবাবের অবস্থা জিজ্ঞাসা করল।

ডাক্তার অল্প কথায় বুঝিয়ে দিল, অবস্থা ভালো নয়। নবাবের হৃদপিণ্ড যে কোনো মুহূর্তে কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। কোনোভাবেই যেন তিনি উত্তেজিত না হয়ে পড়েন। সে আবার পরের দিন আসবে।

খবরটা যেন উল্কার গতিতে ছড়িয়ে পড়ল গোটা মেটিয়াবুরুজে। চিড়িয়াখানার পশুপাখিগুলোও যেন কী এক অশনি সংকেতের পূর্বাভাসে চুপ হয়ে গেল। কবিদের মুশাইরা বন্ধ হয়ে গেল, মেয়েদের রেওয়াজ, নাচের তালিম থেমে গেল।

সমুদ্রের বেপরোয়া ঢেউয়ের মতো সবাই ছুটে যেতে লাগল সুলতানখানার দিকে। তাদের মধ্যে কেউ হয়ত নবাবের মুতআ বেগম। বহুবছর আগে কোনো এক ভালোবাসার রাতে সে নবাবের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে ধন্য হয়েছিল। কেউ হয়ত দূরদেশ থেকে আসা কোনো সঙ্গীতজ্ঞ, যার প্রতিভা একমাত্র কদর পেয়েছে মেটিয়াবুরুজে এসে। কেউ আবার পাখির খেলা দেখায়, নবাবই তার রুটিরোজগার।

মুতআ বেগমদের সংখ্যাই প্রায় দু-আড়াইশো। তারা সবাই এসে ভিড় করলে তো নবাবের শরীর আরো খারাপ হয়ে পড়বে।

খাজাঞ্চি আসগর আলী আর নবাবের অন্যতম অমাত্য ফারুক শাহ হাল ধরল। দ্রুতগতিতে সুলতানখানার মূলদ্বার বন্ধ করে দেওয়া হল। নবাবের বৈধপুত্রদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন কমর কদ্র। কিন্তু তিনি রীতিমতো ইংরেজ ভক্ত, যা নবাবের আদর্শের একেবারে বিপরীত। তাই পিতার সঙ্গে তাঁর বিশেষ সদ্ভাব নেই। থাকেনও বাইরে। তাঁকে তড়িঘড়ি খবর পাঠানো হল।

নবাব গোটা দিন শুয়ে থাকেন। কেমন এক তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় দিন কাটে তাঁর। মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করতে থাকেন। সেই প্রলাপে ঘুরে ফিরে আসে লক্ষ্নৌ, তাঁর প্রথম জীবন, তাঁর মা আউলিয়া বেগম। কখনো তিনি দেখতে পান শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রথম যৌবনের কোনো বেগম, নরম হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তাঁর মাথায়।

এইভাবে তিনদিন কেটে গেল। অবস্থার উন্নতি অবনতি কিছুই নেই। সেদিন সকালে খুশনবিস হাফিজ নুরুল্লা আর তবলচি মীর্জা জাফর উদাস নয়নে বসে ছিল নবাবের শয়নকক্ষের বাইরে।

বিশাল বারান্দা থেকে নীচের রাস্তায় চোখে পড়ছিল, একে একে কবুতরবাজ বিদায় নিচ্ছে। সবাই যেন বুঝেই গিয়েছে, নবাব আর বেশিদিন নেই। আর নবাব না থাকলে মেটিয়াবুরুজও থাকবে না, এই সহজ সমীকরণ সকলের কাছেই এখন পরিষ্কার।

মীর্জা জাফর বলল, ‘কী করবি, কিছু ভেবেছিস?’

‘কীসের কী?’

‘নবাবের ইন্তেকালের পর আমাদের কী হবে?’

‘তোর আর কি। যে কোনো মেহফিলে তুই ডাক পাবি।’ হাফিজ নুরুল্লা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘লেকিন মেরা ক্যায়া হোগা। খুশনবিস আর কৌন চাহতে হ্যায়!’

মীর্জা জাফর কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল।

সিঁড়ি বেয়ে একটা মেয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। আদাব ঠুকে কণ্ঠে বলল, ‘হুজৌরকো একবার দেখনা চাহতি হু।’

‘এখন দেখা হবে না। নবাব বিমার হ্যায়।’ হাফিজ নুরুল্লা বলল।

মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘পতা হ্যায়। ইসি লিয়ে একবার দেখ না চাহতি হু।’

‘বললাম তো, হবে না। বাদমে আও।’

মেয়েটা তবু গেল না। চুপচাপ বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে রইল।

হাফিজ নুরুল্লা আরো কর্কশ কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। এখন গোটা এলাকাতেই কোনো কিছুর ঠিক নেই। সবাই দিশেহারা। নাহলে একটা উটকো মেয়ের নবাবের অন্দরমহল পর্যন্ত আসার ক্ষমতা হয় না। দাঁড়িয়ে আছে থাক, একটু পরে নিজে থেকেই চলে যাবে। ওরা দুজনে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে উপস্থিত হল আসগর আলী। তার মুখ থমথমে, কপালে গভীর ভাঁজ। নবাবের শয়নকক্ষে প্রবেশের আগে সে বলল, ‘এক জেনানা ডাক্তার হ্যায় শহরমে। ডেকে আনব?’

‘জেনানা ডাক্তার?’ হাফিজ নুরুল্লা আর মীর্জা জাফর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তাবড় তাবড় হাকিম থেকে সাহেব ডাক্তার, কেউ কিছু করতে পারছে না, সেখানে একজন মেয়েমানুষ কী করবে?

হঠাৎ ভেতর থেকে এক ভৃত্যের আর্তনাদ শোনা গেল।

আসগর আলী, মীর্জা জাফর আর হাফিজ নুরুল্লা দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকল।

নবাবের জ্ঞান ফিরে এসেছে। আজ সকালে এই প্রথম। একদৃষ্টে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন দরজার দিকে।

আসগর আলী ছুটে গেল প্রভুর কাছে। তার বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠছে। নবাবের মুখের একেবারে কাছে গিয়ে বলল, ‘তকলিফ হচ্ছে হুজৌর?’

নবাব উত্তর দিলেন না। শুধু চোখের কোণ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

অস্ফুটে দূরে কাউকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘উয়ো কহা গয়া রে?’

সবাই চমকে তাকিয়ে দেখল, সেই মেয়েটা কখন যেন সবার অলক্ষে এসে উপস্থিত হয়েছে ঘরে। নবাব তার দিকেই চেয়ে রয়েছেন।

মেয়েটা পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। ওড়নাটা মুখে চেপে ধরে বলল, ‘কৌন?’

নবাব চোখের পলক ফেললেন। কথা বলতে যেন তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে, এইভাবে থেমে থেমে বললেন, ‘উয়ো চন্দরনাথ! তেরা আশিক?’

মেয়েটা কোনো উত্তর দিতে পারল না। তার যে চোখদুটো সবসময় সুরমায় রঞ্জিত থাকে, সে দুটো আজ প্রসাধনহীন। নীরবে অশ্রুপাত হতে লাগল।

নবাব উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। অনেক কষ্টে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন উল্টোদিকের জানলার দিকে।

বললেন, ‘সব মুঝে ছোড়কে চলা যাতা হ্যায়। আব ম্যায় ভি চলা যাউঙ্গা!’

আসগর আলী ছলছলে চোখে নবাবের হাতদুটো জড়িয়ে ধরল, ‘না হুজৌর, আপনি কোথাও যাবেন না। খোদা কসম, আপনি ভালো হয়ে যাবেন। আবার মেহফিল বসবে মেটিয়াবুরুজে, মুর্গবাজি হবে!’

নবাবের কানে যেন প্রবেশ করল না কোনো কথা। তিনি চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে দিলেন বিছানায়, গুনগুন করে নিজের বহুকাল আগে লেখা একটা গান গাইতে লাগলেন,

‘দারও দিয়াও পার হজরত সে নজর করতে হ্যায়

খুশ রহো আহিলে ওয়াতন হাম তো সফর করতে হ্যায়।’

আমরা বাসনা নিয়ে তাকিয়ে থাকি দেওয়াল আর দরজার দিকে। নাগরিকরা তোমরা খুশি থেকো। আমি চললাম সফরে।

সাহেব ডাক্তার যখন তার অদ্ভুতদর্শন যন্ত্র নিয়ে মেটিয়াবুরুজে উপস্থিত হল, ততক্ষণে মেটিয়াবুরুজ তার আখতার পিয়াকে হারিয়েছে।

লক্ষ্নৌয়ের শেষ নবাব বিলীন হয়ে গিয়েছেন পঞ্চভূতে।

গ্রীষ্মকাল, তবু কুলপি গ্রামে দুদিন ধরে টানা বৃষ্টি। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো বাতাস বেশি বৃষ্টি কম নয়, একেবারে বর্ষাকালের মতো মুষলধারে বৃষ্টি। কাদা প্যাচপেচে হয়ে রয়েছে গোটা গ্রাম।

ভুবনমণি বহুদিন পর শহুরে পাকাবাড়ি ছেড়ে মাটির একচালা ঘরে শুয়েছিল। মধ্যরাতে বজ্রপাতের শব্দে ঘুমন্ত লোপামুদ্রা তাকে বারবার জড়িয়ে ধরছিল। অবশেষে ভোররাতে ছোট্ট পায়রার মতো নিশ্চিন্ত আশ্রয় নিয়েছিল পিসিমার উষ্ণ বুকে।

যদু মধুর বাবার এই গ্রামে কিছু জমিজিরেত আছে। অবস্থা খুব সচ্ছল না হলেও দরিদ্র বলা যায় না। মাটির বাড়িটিতে দুটো বড় ঘর, একখানা নিকনো উঠোন। যদু মধুর মা শুয়েছিলেন ভুবনমণি আর লোপামুদ্রাকে নিয়ে। আর পুত্রদের নিয়ে তাদের বাবা শুয়েছিলেন অন্যঘরে।

পূর্বদিকের আকাশ যখন ফরসা হল, তখন ভুবনমণির ঘুমটা ভেঙে গেল। আর জেগে ওঠামাত্রই তার মনে হল, আর মাত্র একদিন।

তারপরেই সৌরেন্দ্র এসে পৌঁছবে কলকাতার বাড়িতে। এই সতেরোবছরের জীবনে ঘটে যাওয়া সব দুঃস্বপ্ন থেকে চিরকালের মতো মুক্তি পাবে ও, সৌরেন্দ্রর হাত ধরে।

কে কী বলল, সে আর পরোয়া করে না। মনের মানুষের হাত ধরে শুরু করবে নতুন জীবন।

ভাবতেই ও কেমন কেঁপে উঠল।

অদ্ভুত! যে মানুষটা একই বাড়িতে তার সঙ্গে এতকাল রইল, তার পুনরাগমনের কথা মনে পড়লেই কেন তার বুকটা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে, তা সে জানে না।

একদিন নেহাতই ঝোঁকের মাথায় সে সৌরেন্দ্রকে বলে ফেলেছিল, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইনের কথা। অতকিছু ভেবে বলেনি।

কিন্তু সৌরেন্দ্র তা এতদিন মনে রেখে দিয়েছে!

আনমনে ঘুমন্ত লোপামুদ্রার গায়ে চাদরখানা ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে সে মাথায় অনেকখানি ঘোমটা টেনে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল।

সারা রাতের ভারীবর্ষণের পর বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট পুকুরটা জলে টইটম্বুর করছে। তাতে ওদিকের ঘাট থেকে হুস-হাস করে জাল ছুড়ছে দুটো লোক।

ভুবনমণি সামান্য সরে এল। পাশের কুঁড়েঘরটা এখান থেকে দেখা যায়, সেখানে উবু হয়ে বসে একটা ছোট্ট মেয়ে। বয়স আড়াই-তিন হবে। পরম মমতায় সে একটা ছাগলছানাকে ঘাস খাওয়াচ্ছে।

খাওয়ানোর সময় সে কচিস্বরে বকাবকি করছে, ‘খা মুনু। খা। নইলে কিন্তু খুব বকব।’

দেখতে দেখতে ভুবনমণির হিমানীর কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটা এখন কী করছে, কে জানে! যা দস্যি হয়েছে, নতুন বউদিদি ভরামাসের পোয়াতি, তাঁর পক্ষে এখন ওর পেছন পেছন ছোটা খুবই অসুবিধার।

যদু মধুর মা শয্যাত্যাগ করেছিলেন অনেক আগেই। এখন এসে বললেন, ‘চিঁড়ে মেখেছি মা। খাবি চল। ওদের বাবা পুকুর থেকে একটা বড় রুই ধরেছেন, দুপুরে রাঁধব’খন।’

ভুবনমণি বলল, ‘আমাদের জন্য দুপুরের রান্না আর করতে হবে না মা। আমার নতুন দাদা তার আগেই এসে নিয়ে যাবেন যে!’

‘ওমা!’ যদু-মধুর মায়ের অন্নপূর্ণার মতো মুখটা নিভে গেল, ‘আমার কাছে এট্টু ভাত খেয়ে যাবিনি?’

ভুবনমণি হেসে এগিয়ে গেল, জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি তো সবই জানো মা। কী বিপদের মধ্যে রয়েছে আমার এই ভাইঝি। সব মিটুক, তোমার কাছে এসে ক’দিন থেকে যাব।’

কিন্তু ভোর গড়িয়ে সকাল, সকাল গড়িয়ে দুপুর। কিন্তু দ্বারকানাথ তাঁর বোনদের নিতে এলেন না।

যদু-মধুর মা ভারি স্নেহময়ী মহিলা, বললেন, ‘ব্যস্ত মানুষ। হয়ত কোনো কাজে আটকে গিয়েচেন। চিন্তা করিস নে মা, দেকবি কাল নিশ্চয়ই আসবেন।’

কিন্তু ভুবনমণির নতুন দাদা পরেরদিনও এলেন না।

কী ব্যাপার, তিনি কি এত বড় কাজটা ভুলে গেলেন নাকি? ভুবনমণি কিছুই বুঝতে পারে না। খালি আকুল চোখে ঘরবার করে। তার মনে হয়, একছুটে চলে যায় কলকাতায়, যে করেই হোক!

লোপামুদ্রার অবশ্য কোনো হেলদোল নেই। এতদিন পর পিসিমাকে কাছে পেয়ে সে ভীষণ খুশি। সারাক্ষণ ভুবনমণির বক্ষলগ্না হয়ে সে গল্প শুনতে চাইছে।

কিন্তু ভুবনমণি ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠে। তার যেন সময় কাটতে চায় না।

নতুন দাদা আসছেন না কেন?

আর ওদিকেই বা কী হচ্ছে? দয়াদিদি কেমন আছেন? নিজের শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় নবকিশোর দত্ত কী করছে, ভাবলেই যে তার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসছে।

আর সৌরেন্দ্র?

তার মুখটা মনে পড়ামাত্র সপ্তদশী ভুবনময়ীর বুকের ভেতরটা কেমন দুলে উঠল। সৌরেন্দ্র কেমন আছে? হিসেবমতো সৌরেন্দ্রর আজ শহরে ফেরার কথা।

তাই তাকেও যে আজ ফিরতেই হবে!

কিন্তু কোথায় নতুন দাদার বজরা?

যদু-মধু নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারল না। কলকাতায় তাদের কলেজে এখনো ছুটি চলছে বলে তারা দেশে এসেছে। শহরের খবর কোথা থেকে পাবে?

উৎকণ্ঠা ধীরে ধীরে পরিণত হয় অবসাদে। অবসাদ পরিণত হয় মৌনব্রতে। অব্যক্ত বেদনায় চোখ ফেটে জল চায় বেরিয়ে আসতে।

তিনদিনের দিন দুপুরবেলা ভুবনমণি ভারাক্রান্ত মুখে বসেছিল খিড়কি দরজার লাগোয়া পুকুরঘাটে। তার কোমর ছাপানো চুল এখন খোলা, বসন আলুথালু। অন্যমনস্ক চোখে সে ছোট ছোট মাটির ঢেলা ছুড়ছিল পুকুরে। সেগুলো গোলাকার তরঙ্গ সৃষ্টি করেই আবার পরিণত হচ্ছিল শান্ত সলিলধারায়।

লোপামুদ্রা ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘ও পিসিমা, বজরা এসেচে, বজরা!’

ভুবনমণি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। ক্লান্ত চোখে যেন হঠাৎ ঝকমক করে উঠল আশার আলো!

যাক! অবশেষে এসেছেন নতুন দাদা।

দ্রুতপায়ে সে ছুটে যায় বাড়ির ভেতরে।

অবাক চোখে দেখে, গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছেন গগনচন্দ্র হোম। একা। মুখচোখ যেন বড় মলিন।

‘দাদা আপনি!’ ভুবনমণি বিস্ময় চাপতে পারে না, ‘নতুন দাদা বুঝি খুব ব্যস্ত? তাই আপনাকে পাঠিয়েছেন?’

গগনচন্দ্র কোনো কথা বলেন না। শুধু বলেন, ‘তৈরি হয়ে নাও ভুবন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। বেলাবেলি পৌছতে হবে শহরে।’

ভুবনমণি কিছুই বুঝতে পারে না। তবু কেন কে জানে, কথাও বাড়ায় না। নিজের যৎসামান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে যদু-মধুর মা’কে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে লোপামুদ্রাকে নিয়ে গগন হোমের আনা বজরায় চড়ে বসে।

কুলপির ঘাট ছেড়ে বজরা যখন ভেসে চলেছে, তখন গগনচন্দ্র অস্ফুটে বলেন, ‘হিমানী আর নেই ভুবন! পরশু রাতেই সে চলে গেছে। বাবামশাই আর বউঠান পাগলপ্রায়।’

ভুবনমণির বুকে শেলের মত কথাগুলো বিঁধলেও সে যেন অবাক হয় না। সম্ভবত এমনই কিছু দুঃসংবাদের প্রত্যাশা করছিল সে। যেদিন অসুস্থ হিমানীকে ছেড়ে সে এসেছিল জাহাজে চড়ার জন্য, সেদিনই যেন তার মন অশনিসংকেত দিয়েছিল। বলেছিল, কোনদিনও আর কোলে নিতে পারবে না ওর আদরের হিমুকে। ঠিক যেমন অপা ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, হিমানীও তেমনই যেন চলে যাবে।

ভুবনমণির গলায় কী যেন দলা পাকাতে থাকে। কোনো কথা না বলে স্থিরনয়নে সে তাকিয়ে থাকে গগনচন্দ্রের দিকে।

গগনচন্দ্র কাঁপা গলায় বলেন, ‘তার ওপর, সৌরেন্দ্র যে জাহাজে করে পুরী রওনা দিয়েছিল, সেটারও কোনো খোঁজ নেই। আজ দুদিন হল। বঙ্গোপসাগরে প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়েছে নাকি। আমরা বারবার ফেরিঘাটে খোঁজ নিচ্ছি, কিন্তু পোর্ট অফিস থেকে কিছুই বলতে পারছে না। জাহাজটা নাকি কটকে পৌঁছয়ইনি।’

ভুবনমণি এবারও কোন কথা বলে না। তার বুকের ভেতরটা তোলপাড় হতে থাকে। মনে হয়, বুঝি শিরা ফেটে রক্ত ছলকে পড়বে শরীর থেকে। কিন্তু তার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বেরোয় না।

মরামাছের মতো নিষ্প্রাণ তাকিয়ে থাকে দূরের নদীর দিকে।

গগনচন্দ্র বলেন, ‘ভুবন। শুনছ?’

ও উত্তর দেয় না। ঝাপসা চোখে দেখে, নদীর অনেক ওপর দিয়ে একটা চিল উড়ে যাচ্ছে ডানা মেলে। উড়তে উড়তে সে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একসময় সে পুরো হারিয়ে যায় দৃষ্টিপথ থেকে।

ভুবনমণি চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে যায় মাটিতে।

নদীতে বজরা চলার ছপছপ শব্দ ছাড়া বিশ্বচরাচরে আর কিছু শোনা যায় না।

৪১

একইদিনে হাওড়ার চাঁদপাল ঘাট থেকে ছেড়েছিল তিনটি জাহাজ। স্যার জন লরেন্স যাত্রীবাহী হলেও গডিভা ও রিট্রিভার ছিল মালবাহী জাহাজ। প্রায় তিনদিন পর বিধ্বস্ত অবস্থায় বন্দরে ফিরে এল গডিভা।

কিন্তু তার দুই সঙ্গী রিট্রিভার আর স্যার জন লরেন্স আর কোনদিনও ফিরে এল না।

কলকাতা বন্দরের পক্ষ থেকে অনেক অনুসন্ধান চালান হল। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত হওয়া যে নিম্নচাপকে ম্যাকমিলন জাহাজ কোম্পানি ব্যবসায়িক স্বার্থে অবজ্ঞা করেছিল, সেই নিম্নচাপ শক্তি বাড়িয়ে সেদিন পরিণত হয়েছিল বিধ্বংসী এক ঘূর্ণিঝড়ে। যে ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছিল জলদেশ, ঢেউ আছড়ে পড়েছিল ডাঙাতেও। হুগলী নদীতে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে স্ট্র্যান্ড রোডও প্রায় ভেসে গিয়েছিল।

দিনচারেক পর একজন মানুষকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হল মাঝসমুদ্র থেকে। নিপ্যল নামে কলকাতা বন্দরের একটি অনুসন্ধানকারী জাহাজই তাকে একটা বয়ায় দড়ি বেঁধে উদ্ধার করল।

লোকটা কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। প্রায় গোটা দিনটা সে হাসপাতালে কাটিয়ে তারপর কিছুটা স্বাভাবিক হল বটে, কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে তার মুখে যে আতঙ্ক ফুটে উঠছিল, তা যেন কিছুতেই উধাও হচ্ছিল না।

পোর্ট অফিসার তড়িঘড়ি তার জবানবন্দী নিতে পৌঁছে গেলেন।

লোকটার নাম আবদুল লতিফ। তার কাজ ছিল রিট্রিভার জাহাজের বয়লারে কয়লা চালান দেওয়া। সে-ই বোধ হয় জন লরেন্স ও রিট্রিভার জাহাজের একমাত্র জীবিত মানুষ।

কাঁপা কাঁপা গলায় আবদুল লতিফ বলল, কুলপি ছেড়ে সাগরের দিকে যাওয়া পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কীভাবে হঠাৎ মধ্যাহ্নে পুঞ্জীভূত হল একরাশ কালো মেঘ। কীভাবে সেই মেঘ দেখতে দেখতে ছেয়ে ফেললো গোটা আকাশটাকে!

‘বিশ্বাস করেন বাবু, আমাগো জাহাজের ক্যাপ্টেন হেমার সাহেব অনেক চেষ্টা করসিলেন। কিন্তু ভাইগ্য যদি বিরূপ হয়, ক্যামনে কী হইব! ইঞ্জিনের ঘরে হু-হু কইরা জল ঢুকতাসিল, তারপর একটার পর একটা পাইপ ভাঙতি লাগল। শ্যাসে মোটরেও জল ঢুকি গেল। আমরা অনেক চেষ্টা করেও রুখতি পারলাম না। জাহাজটা একখান ঝিনুকের খোলার মতো দু-টুকরা হইয়া গেল। আমি খাড়ায়ে ছিলাম ইঞ্জিনের ঘরে, সেখানেও জলের তোড় আইসা আমারে ভাসাইয়া লইয়া গেল। তারপর সমুদ্দুরে ভাসছিলাম। কতক্ষণ জানি না। ওই জাহাজ বয়া না ছুড়লি এতক্ষণে আল্লাহর কাছে চলি যেতাম বাবু!’

পোর্ট অফিসার প্রশ্ন করেন, ‘আর তোমার জাহাজের বাকিরা?’

আবদুল লতিফ হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে, ‘আমি কাউকেই দেখিনি বাবু! সব মইরা গেছে। সব!’

‘আর স্যার জন লরেন্স জাহাজ? চোখে পড়েছে একবারও?’

আব্দুল লতিফ কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘না বাবু! কেউ নাই। লরেন্স জাহাজের রামু আমারে চাচা বলত বাবু! বড় ভালোবাসত আমারে। আহা, তার বউডা পোয়াতি। সব মইরা গেছে! আল্লাহর এইডা কেমন বিচার বাবু?’

কথাটা ভুল নয়। পরেরদিন থেকেই কলকাতামুখী জাহাজের নাবিকরা খবর পাঠাতে লাগলেন, শয়ে শয়ে লাশ দেখা গিয়েছে মোহনায়। ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে সেগুলো জাহাজের পাশ দিয়ে।

একটা লাশ শনাক্ত করা গেল। নাবিকমহলে সুপরিচিত ক্যাপ্টেন আরভিং-এর মৃতদেহ সেটি।

এছাড়া ভাসছে আরো অজস্র মৃতদেহ। যেগুলোর সিংহভাগই মহিলাদের।

সেইসব মহিলাদের লাশ যারা পুণ্য লাভের আশায় পাড়ি দিয়েছিল পুরুষোত্তম ধামের উদ্দেশ্যে।

যে সাড়ে সাতশো যাত্রী নিয়ে স্যার জন লরেন্স পাড়ি দিয়েছিল নীলাচলের দিকে, তাদের নিয়ে সে আর কোনোদিনও ফিরে এল না। জলের অতলে চিরকালের মতো তলিয়ে গেল দয়াময়ী, সৌরেন্দ্র, চন্দ্রনাথ।

ধনঞ্জয় পণ্ডিতের অসীম পুণ্য তাঁকে অকালমৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারেননি। সঙ্গীসাথি সমেত সলিলসমাধি হল তাঁরও।

ভাইয়ের প্রতি হওয়া অন্যায়ের চূড়ান্ত প্রতিশোধ নিয়ে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেন পূর্ণচন্দ্র ন্যায়রত্ন ওরফে বুলবুল মিয়াঁ ওরফে শুক্লসুন্দরও। যিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেন ধর্মের অযৌক্তিক অনুশাসনকে। যিনি বিশ্বাস করতেন একটি মাত্র ধর্ম—মনুষ্যত্বে। যিনি কোনো ভেদাভেদ ছাড়াই বড় করছিলেন কন্যাকে।

কয়েকদিন সামান্য হইচই চলল ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোতে। নিয়মমাফিক বেরোল গভর্নরের দুঃখপ্রকাশ। কিছু সম্ভ্রান্ত গৃহকর্তা তাঁদের বাড়ির মহিলাদের প্রয়াণে শোকবার্তা পাঠালেন প্রথমসারির কাগজগুলোয়।

তারপর একদিন সব থেমে গেল। সাড়ে সাতশো প্রাণ গেলেও তারা সবাই প্রায় নেটিভ, তাদের নিয়ে ইউরোপিয়ান কাগজের অত মাথাব্যথা নেই।

কিছু মৃত যাত্রীর আত্মীয়স্বজন আদালতে ম্যাকমিলন জাহাজ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করল। নিজেদের মুনাফার জন্য কোম্পানি স্যার জন লরেন্স জাহাজের ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি যাত্রী নিয়েছিল, এই ছিল তাদের অভিযোগ।

কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কাউকে পাওয়া গেল না। কেউই যে জীবিত নেই। মামলাকারীরা সবাই মৃতদের আত্মীয়স্বজন। তায় নেটিভ। তাদের সাক্ষ্যের মূল্য কতটুকু?

আদালত সবদিক দেখে তাই কোম্পানিকে দায়ী না করে দোষ চাপাল মৃত ক্যাপ্টেন আরভিং-এর ওপরে। কোম্পানির কোনো দোষ নেই, ক্যাপ্টেনের অবিবেচনার জন্যই নাকি জাহাজ ডুবেছিল। দু-কূল রক্ষা হল।

বাংলা কাগজগুলো বেশ কিছুদিন ধরে ছেয়ে যেতে লাগল নানা হৃদয়বিদারক সংবাদে। কে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী-শিশুপুত্র হারিয়েছেন, কার মায়ের তীর্থে যাওয়ার কথা না থাকলেও শেষ মুহূর্তে মত পরিবর্তন করে চেপেছিলেন ওই জাহাজে, এইসব খবরে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলল তারা।

প্রচুর জ্যোতিষীর বক্তব্য মুদ্রিত হল, যারা গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান কষে দেখিয়ে দিলেন যে এই জাহাজযাত্রা কতটা অশুভ ছিল। হাওড়ার জগন্নাথঘাটে মৃতদের স্মরণে লাগানো হল স্মৃতিফলক। হাটখোলার দত্তবাড়ির গৃহকর্তা সস্ত্রীক ছিলেন সেই অভিশপ্ত জাহাজে, দত্তপাড়ার গলিতেও খোদিত হল শোকবার্তা।

তারপর ধীরে ধীরে একদিন সবাই ভুলে গেল সেকথা।

ভুলতে পারল না শুধু একজন।

মশাট গ্রামের সপ্তদশী ভুবনমণি।

লোপামুদ্রাকে রক্ষা করার কঠিন সংকল্প তার সফল হয়েছে। নব দত্তের গ্রাস থেকে সে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে ভর্তি করেছে বিদ্যালয়ে। দ্বারকানাথের বাড়িতে বেড়েছে আরো এক সদস্যা। কিন্তু বিনিময়ে ভুবনমণি হারিয়েছে অনেক কিছু।

সে তার না হওয়া সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল এমন এক মানুষের হাত ধরে, যে বিলীন হয়ে গিয়েছে সেই জাহাজডুবিতে। সে হারিয়ে গিয়েছে, যে তাকে গৃহলক্ষ্মী নয়, দেখতে চেয়েছিল ‘বীরনারী’র রূপে।

ভুবনমণি এখন নারাচ বাণের মতোই ধারালো, তার যুক্তি, বুদ্ধি, সিদ্ধান্তের শাণিত প্রয়োগে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু একইসঙ্গে সে পাষাণপ্রতিমা। হাসি যেন তার মুখ থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছে।

‘নির্ভীক নারী’র দায়িত্ব এখন সে নিজের কাঁধে একা তুলে নিয়েছে। পাশাপাশি সামলাচ্ছে আরো অনেক কিছু। সমাজের একটি মেয়েও যাতে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, একটি মেয়েকেও যেন অকালে না ঝরে যেতে হয়, সেইজন্যই অব্যাহত রয়েছে তার লড়াই। পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষদের সে পরাজিত করবেই।

ঠিক সৌরেন্দ্রর মতোই সে জ্বালাময়ী ভাষায় আজ লেখে, সহবাস সম্মতি আইন দেশের জন্য কতটা প্রয়োজন! মেয়েদের শিক্ষা, মেয়েদের স্বাধীনতা একটা সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য কতটা দরকার।

পাশাপাশি সে প্রাইভেটে এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকে সাহায্য করছেন ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার এবং দ্বারকানাথ-কাদম্বিনী।

এখন তার একটাই ইচ্ছা, নতুন বউদিদির মতো, সৌরেন্দ্রর মতো একদিন সেও ‘ডাক্তার’ হবে।

এখনো সে মধ্যরাতে সিক্তনয়নে আশায় বুক বাঁধে, সৌরেন্দ্র ফিরে আসবে। একদিন ঠিক ফিরে আসবে। হতেই তো পারে, সৌরেন্দ্র একা বেঁচে ছিল সেই ঝড়ে। সেই বিদেশি গল্পে পড়া রবিনসন ক্রুশোর মতো।

হিমানী মারা যাওয়ার পর কাদম্বিনী এখন অনেক ধীর, স্থির। তাঁর চতুর্থ সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র জন্ম নিয়েছে একমাস আগে। তাঁকে বাড়িতে রেখে তিনি এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিলাতযাত্রার।

যে অন্যায়ের জন্য তিনি বঞ্চিত হয়েছেন শল্যচিকিৎসা থেকে, যে অজ্ঞতাই হয়ত তাঁর শিশুকন্যার মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ, তিনি তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে এখন মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত। দেশ তাঁকে উপযুক্ত ডিগ্রি না দিক, বিদেশ থেকে তিনি ডিগ্রি নিয়ে এসে লোককে দেখিয়ে দেবেন। করবেন শল্যচিকিৎসা আর তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন করছে বিধুমুখী আর দ্বারকানাথ।

বিধুমুখী ও উপেন্দ্রকিশোরের সদ্য পুত্রসন্তান হয়েছে। অনিন্দ্যকান্তি সেই শিশুর চোখদুটোয় খেলা করে অসামান্য এক দ্যুতি।

কাদম্বিনী তার নাম রেখেছেন সুকুমার। ডাক নাম তাতা।

লক্ষ্নৌয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ গতমাসে পরলোকগমন করেছেন। জীবনের শেষ কয়েকমাস নাকি তাঁর কেটেছিল তীব্র অবসাদে, একাকীত্বে।

তাঁর অবর্তমানে উল্কার গতিতে এখন নিলাম হয়ে যাচ্ছে তাঁর সাধের চিড়িয়াখানার জন্তুজানোয়াররা। শুধু চিড়িয়াখানা নয়, তাঁর সবকিছুই উধাও হচ্ছে খুব দ্রুত। ইতিমধ্যেই কয়েকটি প্রাসাদ কিনে ফেলেছে বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে কোম্পানি। আর নবাবের নিজস্ব প্রাসাদ সুলতানখানা ভেঙে ফেলে নাকি সেখানে বসবে জুট মিল, এমনই খবর।

কলকাতার বুকে যে একটুকরো লক্ষ্নৌ ধিকধিক করে জ্বলছিল, নবাব চলে যেতে সেই অস্তিত্বটুকু অতি দ্রুত মুছে ফেলতে ব্রিটিশ সরকার অতিতৎপর। প্রেমিক আখতার পিয়াকে কেউ মনে রাখেনি।

আসগর আলী থেকে কাফি খাঁ, মোতিবিবি থেকে খুশনবিস হাফিজ নুরুল্লা, এরা ধীরে ধীরে আস্তানা গুটিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে কে জানে।

কলকাতা তা নিয়ে ভাবিত নয়।

আরো একজন সেই কালান্তক জন লরেন্স জাহাজডুবিকে ভুলতে পারেনি। সে কলকাতার এক যুবক কবি। ঠাকুরবাড়ির কনিষ্ঠ পুত্র। আবেগপ্রবণ, মরমী।

আজও সে দ্বারকানাথের অবলাব্যারাকে যায়। আজও সেখানে বসে গল্পের আসর। বন্ধু উপেন্দ্রকিশোরের বেহালার সঙ্গে আজও সে গান গায়।

কিন্তু কোথায় যেন কেটে গেছে তাল। আসরের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে তার চোখ দিয়ে ঝরে অশ্রু। তখন তার গলা ধরে আসে, অন্যদিকে তাকিয়ে অভিব্যক্তি লুকনোর চেষ্টা করে প্রাণপণ।

কিছু শিক্ষিত যুবক ওই দুর্ঘটনার পর থেকেই ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি তুলছে, অবিলম্বে কলকাতা থেকে পুরী রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। রেলপথ কি শুধু ইংরেজদের সুবিধার জন্য? যে তীর্থস্থানে প্রতিবছর পাঁচ লক্ষ মানুষ পুণ্যার্জনে যান, স্বদেশী বলে তাদের প্রাণের কি কোনো মূল্যই সরকারের কাছে নেই?

ক্রমাগত বিক্ষোভে ইদানীং সরকার যেন নড়ে চড়ে বসছে।

রবি সর্বান্তকরণে সমর্থন করে তাদের।

শতচেষ্টাতেও সে যে ভুলতে পারেনি তার স্বল্পসময়ে পাওয়া প্রাণের বন্ধুকে। যে তাকে সবসময় দেখাত নতুন আশার আলো।

চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলা বন্ধুর জন্য ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সে লিখেছে তার সিন্ধুতরঙ্গ কবিতা।

জল বাষ্প বজ্র বায়ু

লভিয়াছে অন্ধ আয়ু

নূতন জীবনস্নায়ু দানিছে হতাশে।

দিগ্মদিক নাহি জানে,

বাধাবিঘ্ন নাহি মানে,

ছুটেছে প্রলয়পানে আপনারই ত্রাসে!

হেরো মাঝখানে তারই আট শত নরনারী

বাহু বাঁধি বুকে

প্রাণে আঁকড়িয়া প্রাণ,

চাহিয়া সম্মুখে।।

লেখকের কথা

বছরদুয়েক আগে এক অলস ছুটির দুপুরে জাতীয় গ্রন্থাগারের পুরনো সংবাদপত্র বিভাগে হঠাৎ করেই আবিষ্কার করি একটি চমকপ্রদ খবর।

১৮৮৭ সালের ২৫শে মে হাওড়ার চাঁদপাল ঘাট থেকে স্যার জন লরেন্স নামক একটি জাহাজ প্রায় সাড়ে সাতশো যাত্রী নিয়ে পুরী রওনা হয়েছিল। তখনও পুরী রেলপথে সংযুক্ত ছিল না। তীর্থযাত্রীদের হাওড়া থেকে জলপথে বালেশ্বর হয়ে যেতে হত কটক। সেখান থেকে পদব্রজে নীলাচলধাম।

ম্যাকমিলন কোম্পানির সেই স্যার জন লরেন্স জাহাজ ওই সময়ে হয়ে উঠেছিল সংবাদমাধ্যম ও জনসাধারণের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। জাহাজটির বিশালাকার আয়তন, বিলাসবহুল পরিকাঠামো ও আরো নানা চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অভিজাত সম্প্রদায় তো বটেই, অনেক সাধারণ মানুষও দামি টিকিট কেটে চড়ে বসেছিল তাতে।

জাহাজটির পরিণতি হয় মারাত্মক। বঙ্গোপসাগরে হঠাৎ পুঞ্জীভূত হওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে এবং জাহাজ কোম্পানির মুনাফার লোভে সামর্থের চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রীগ্রহণের লোভে জাহাজটি ডুবে যায়। সাড়ে সাতশো যাত্রীর মধ্যে কারুরই আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন অধিকাংশই অভিজাত পরিবারের মহিলা।

মোহনার দিক থেকে ভেসে আসতে থাকে তাঁদের একের পর এক লাশ। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয়, এতোগুলো প্রাণের সলিলসমাধি ঘটলেও হয়ত ‘নেটিভ’ বলেই সংবাদমাধ্যমে তেমন তোলপাড় হয়নি। আদালতে জাহাজ কোম্পানি সব দোষ চাপায় মৃত নাবিকের ওপর, কেস ধীরে ধীরে ধামাচাপা পড়ে যায়।

তবে, এই দুর্ঘটনার পরেই পুরী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে ব্রিটিশ সরকার উদ্যোগী হয়।

ঘটনাটি পড়ে আমি বেশ উৎসাহিত হয়ে পড়ি। খোঁজখবর নিয়ে হাওড়ার জগন্নাথ ঘাটে, আবিষ্কার করি একটি ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতিফলক। অতগুলো মানুষের স্মরণে দুর্ঘটনাটির অব্যবহিত পরেই লাগানো হয়েছিল সেটি। এছাড়া হাটখোলা দত্তপাড়ার গলির মধ্যে একটি বাড়ির দেওয়ালেও এখনো দৃশ্যমান গৃহকর্তার সস্ত্রীক মৃত্যুর শোকফলক।

আমার খুব আশ্চর্য লাগে এই ভেবে, যে বিশ্বখ্যাত টাইটানিক জাহাজের ভরাডুবির পঁচিশ বছর আগেই অনুরূপ ঘটনার সাক্ষী ছিল কলকাতা শহর। অথচ ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত এই কালো অধ্যায়। তখন থেকেই এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি উপন্যাস রচনার আকাঙ্ক্ষা জাগে আমার।

নারাচ একটি পৌরাণিক অস্ত্র। মহাভারতে উল্লেখিত এই লৌহপ্রহরণে ধরাশায়ী করা যেত একাধিক মানুষ অর্থাৎ ‘নর’কে। সেই থেকেই নারাচ। এই উপন্যাসে নারাচ অস্ত্রের মতোই শাণিত ও ক্ষুরধার কিছু অত্যাচারিত মানুষের সব হারিয়েও বারবার উঠে দাঁড়ানোর লড়াকু সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে।

আমার এই উপন্যাস উনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপটে রচিত। উনবিংশ শতক নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষ তথা বাংলার নবজাগরণের উন্মেষকাল। দুরন্ত সেই সময়ে একদিকে যেমন বাবুসমাজের অধঃপতন, যথেচ্ছ বিলাসিতা, অন্ধ পাশ্চাত্য-অনুকরণ, প্রজাশোষণ, তেমনই অন্যদিকে কিছু যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষের ধর্ম ও সমাজকে সংস্কৃতির মোড়কে নবরূপে প্রণয়নের চেষ্টা। রক্ষণশীলতার সঙ্গে প্রাণপণ সংগ্রামে জাতির অগ্রগতির প্রবল তাগিদ।

বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতক নিয়ে কাজ হয়েছে প্রচুর। প্রতিটি কাজই অসামান্য গবেষণা ও সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ। কিছু কিছু রচনা নিজগুণে কালোত্তীর্ণ সাহিত্যে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু, অধিকাংশ রচনারই ক্ষেত্র যেন বিশেষ কিছু আবর্তেই সীমাবদ্ধ।

নবজাগরণ, সমাজ সংস্কার এইসব বহু-আলোচিত দিক ছাড়াও সেই যুগে অবধারিত ভাবেই ছিল কিছু প্রান্তিক মানুষ। যাদের হয়তো ইতিহাস ভুলে গিয়েছে।

‘নারাচ’ সেই প্রান্তজনদের অব্যক্ত সংগ্রাম তুলে ধরার একটি প্রয়াস। গোটা বিশ্বজুড়ে দাস ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও শ্রমিক যোগান দেওয়ার তাগিদে সেইসময়ে হাজার হাজার মানুষকে চালান করা হয় ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে, আখচাষের মজুর হিসাবে। পাঁচবছরের Indenture-এর চুক্তি থাকলেও সেই পাঁচবছর তাঁদের পরাধীন করে রাখে আমৃত্যু। ‘নারাচ’-এ তুলে ধরতে চেয়েছি তাঁদের অমানুষিক জীবন আলেখ্য।

অন্যদিকে লক্ষ্নৌয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ কলকাতায় এসে মেটিয়াবুরুজে গড়ে তুলেছেন একটুকরো লক্ষ্নৌ। কিন্তু তার সেই আনন্দনগরী যেন কলকাতা শহরে বড় ব্রাত্য।

সমান্তরালে রমরমিয়ে চলছে অষ্টমবর্ষে গৌরীদানের সেই নিয়ম। হিন্দু ধর্ম হাঁসফাঁস করছে কুসংস্কার ও জরাজীর্ণ অপভ্রংশজাত শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে। মেয়েরা অসম্ভব বঞ্চিত, ব্রাত্য, অবহেলিত। প্রতিবছর নীরবে অকালকুসুমের মতো ঝরে যাচ্ছে অপরিণত নাবালিকারা, স্বামীর ধর্ষণে। রক্ষণশীল সমাজ তা নিয়ে নিরুত্তর। পরকালের দোহাই দেখিয়ে সহবাস সম্মতি আইন তাঁরা কিছুতেই পাশ হতে দেবেন না। হিন্দু শাস্ত্রে বিবাহ বা সহবাসে মেয়েদের কোনো সম্মতির অধিকারই নাকি নেই।

কিন্তু প্রকৃত শাস্ত্র কী? চতুর্বেদ নাকি বেদোত্তর যুগের সংহিতাগুলি? প্রাচীন বৈদিক যুগে নারীর যে সহজাত অধিকার ছিল, তা পরবর্তীকালে খর্ব হল কেন? এই কাহিনির মাধ্যমে আমি সেই উত্তর অন্বেষণের চেষ্টা করেছি।

এমনই নানারকম তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত ঘটনাবলীর পরিকাঠামোয় গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস, যা ওই সময়ের পটভূমিকায় কিছু মানুষের গদ্যগাথা। কাহিনির প্রয়োজনে এসেছেন তরুণ রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর বা প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক ডঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি একের পর এক প্রতিকূলতাকে জয় করে ডাক্তার হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ ছিলেন অসম্ভব দৃঢ়চেতা এক কর্মবীর, যার জীবনের ধ্যানজ্ঞান ছিল প্রান্তিকদের উন্নয়ন। সেই তাগিদে তিনি বারবার ছুটে গিয়েছেন আসামের চা-বাগানের দুর্দশাগ্রস্থ কুলিদের মাঝে, নিজের জীবনের প্রায় পুরোটাই নিয়োজিত করেছেন নারীশিক্ষাপ্রসারে, নারীদের উন্নয়নে।

এরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রবাদপ্রতিম, আমাদের মনিষীসম। কিন্তু উপন্যাসের প্রয়োজনে তাঁদের রক্তমাংসের চরিত্র হিসাবে গড়ে তুলতে ঐতিহাসিক সত্যতার পাশাপাশি আমাকে নিতে হয়েছে কল্পনার আশ্রয়। তবে, প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই আমি তাঁদের চারিত্রিক গঠন বা সময়পট থেকে বিচ্যুত হইনি। দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর অকালমৃতা কন্যা হিমানীকে শুধুমাত্র গল্পের প্রয়োজনে জ্যেষ্ঠা হিসেবে দেখানো হয়েছে।

মহাভারতে কুরুক্ষেত্রে ওঘবতী নদীর তীরে শরশয্যায় শুয়ে পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘যে আচরণ অন্যে তোমার প্রতি করুক তা তুমি চাও না, সেই আচরণ তুমিও অন্যের প্রতি কোরো না। এই হল ধর্ম।’ কিন্তু সেই ধর্মের সংজ্ঞা আজ অন্য। সচেতনভাবেই আমি এই উপন্যাসে ধর্মকে খুব কম গুরুত্বপূর্ণ দেখিয়েছি। চন্দ্রনাথের জন্মসূত্রে মুসলমান হয়েও ব্রাহ্মণপুত্র হিসাবে বেড়ে ওঠা, মেটিয়াবুরুজের ধর্মমুক্ত আবহাওয়া, অন্যদিকে শুক্লসুন্দরের ধর্মান্তর ও ধর্ম সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের মাধ্যমে দিতে চেয়েছি মনুষ্যত্বই ধর্মের বার্তা।

পাঠকের পড়তে পড়তে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যে কোন চরিত্রগুলি বাস্তবিক এবং কোনগুলি কল্পনাপ্রসূত। যে কোনো উপন্যাসের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন একটি নিটোল কাহিনির, যার সহজ স্রোতে প্রবহমান হতে হয় বেশ কিছু চরিত্রের। কৃষ্ণসুন্দর, ব্রহ্মময়ী, তোতারাম, চন্দ্রনাথ বা ভুবনমণি এমনই কয়েকটি চরিত্র।

উপন্যাসটি শেষ হয়ে গিয়েছে ১৮৮৭ সালে। পড়ে মনে হতে পারে, তাদের আরো কিছু পরিণতির প্রয়োজন ছিল। হয়ত পাঠকমনে রয়ে যাবে অতৃপ্তির রেশ। কৃষ্ণসুন্দর ও ব্রহ্মময়ী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারলেন কিনা, মেটিয়াবুরুজের মোতির কী হল, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন জাগতে পারে তাঁদের মনে। সহবাস সম্মতি আইন পাশ হয় আরো পরে, ১৮৯১ সালে। ফুলমণির হৃদয়বিদারক ঘটনাটিও ঘটে সেই বছরের প্রথম দিকে, যদিও উপন্যাসের স্বার্থে মামলাটিকে স্যার জন লরেন্স জাহাজডুবির সমসাময়িক করা হয়েছে।

এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ‘নারাচ’-এর পরবর্তী খণ্ড দেবে, এই আশা রাখি।

এই ধরনের উপন্যাসের বিশালত্বের জন্য তথ্যভারাক্রান্ত হয়ে পড়ার ভয় থেকেই যায়। অধিকাংশ তথ্যই এত কৌতূহলোদ্দীপক এবং সংবেদনশীল যে গ্রহণ বা বর্জনের মাঝে পড়ে বড় দিশেহারা লাগে। যতদূর সম্ভব সচেতন থেকেছি সেই ব্যাপারে। সাফল্যের বিচার পাঠক করবেন।

ঋণী অনেকের কাছেই। জাতীয় গ্রন্থাগারের কর্মী শ্রী সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে দিনের পর দিন পুরনো নথিপত্র ঘাঁটতে ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের সন্ধান পেতে সাহায্য করেছেন।

ডঃ কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্তমান উত্তরসূরি শ্রী রাজীব গঙ্গোপাধ্যায় ও শ্রীমতী দীপান্বিতা গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। তাঁরা আমাকে অনেকভাবে সমৃদ্ধ করেছেন সাধ্যাতীত আন্তরিকতায়।

অগ্রজপ্রতিম লেখক শ্রী কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং শ্রী ঋজু গঙ্গোপাধ্যায় আমার পাণ্ডুলিপিটি অসীম ধৈর্যের সঙ্গে পড়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন এবং তাঁদের মূল্যবান মতামত দিয়ে আমায় ঋদ্ধ করেছেন।

শ্রী রাজা ভট্টাচার্য, আমার অগ্রজ, তাঁর উর্দু ভাষার ওপর সুনিপুণ দখলে আমার মেটিয়াবুরুজের সংলাপগুলিকে আরো সুললিত করেছেন। পূর্ববঙ্গীয় আঞ্চলিক ভাষায় একই ধরনের সাহায্যে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশী চিত্রপরিচালক শ্রী শাহ জাহান সৌরভ।

সবশেষে কৃতজ্ঞতা জানাব আমার জীবনসঙ্গী সুরজিৎকে, যে আমার প্রতিটি সৃষ্টিরই প্রথম পাঠক এবং যার স্বভাবসুলভ ধারালো এবং নির্দয় কাটাছেঁড়ায় নারাচ আরো নিখুঁত হয়েছে।

‘নারাচ’ লেখার সময় আমি যে সমস্ত গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি, ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে তার একটি প্রায় সম্পূর্ণ তালিকা উৎসাহী পাঠকদের জন্য নীচে দেওয়া হল।

 ১. মনুসংহিতা

 ক) স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ দূষণম—২য়/২১৩

 খ) শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণ্যে যাত্যধোগতিম।

 জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মাণ্যাদেব হীয়তে।।—৩য়/১৭

 গ) নাস্তি স্ত্রীরাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।

 নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।।—৯ম/১৮

 ঘ) বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।

 ন স্বাতন্ত্র্যেণ কর্তব্যং কিঞ্চিৎ গৃহেং।।—৫ম/১৪৭

 ২. অত্রিসংহিতা/১৯৮

 ৩. যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা

 ৪. ভট্টিকাব্যম

 ৫. বৃহৎদারণ্যকোপনিষদ

 ৬. গৃহ্যসূত্র

 ৭. গৌতম ধর্মসূত্র

 ৮. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র

 ৯. বৈদিক সংকলন, ডঃ উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 ১০. আদর্শ সংস্কৃত সহায়িকা, যুধিষ্ঠির গোপ

 ১১. বৈদিক ব্যকরণ, তপন ভট্টাচার্য

 ১২. বৈদিক সাহিত্য প্রসঙ্গ, সোমদত্তা চক্রবর্তী

 ১৩. অন্নদামঙ্গল, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র

 ১৪. মহারাষ্ট্র পুরাণ, কবি গঙ্গারাম দত্ত। বাংলায় বর্গী আক্রমণের বর্ণনা দিতে ১৭৫১ সালে রচিত।

 ১৫. Chains of Servitude—Bondage and Slavery in India, Patnaik, Utsa patnaik, Manjari Dingwaney, 1985

 ১৬. Gender, Slavery and Law in Colonial India, Indrani Chatterjee, 1999

 ১৭. Slavery in British India, D.R. Banaji—1933

 ১৮. A New System of Slavery, The Export of Indian Labour Overseas, Hugh Tinker, 1974

 ১৯. Calcutta in Slavery Days—H.A. Stark

 ২০. বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

 ২১. কালজয়ী কাদম্বিনী, ডঃ সুনীতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 ২২. বাংলার নারী জাগরণ, প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়

 ২৩. শ্রীযুক্তবাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবন বৃত্তান্ত, পণ্ডিত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি

 ২৪. অবলাবান্ধব, দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী, নারায়ণ দত্ত

 ২৫. কলিকাতা দর্পণ ১ম ও ২য় খণ্ড, রাধারমণ মিত্র

 ২৬. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী

 ২৭. সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ব্রজেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়

 ২৮. ভারত ইতিহাসে নারী, প্রাচীন ভারতে নারী, সুকুমারী ভট্টাচার্য

 ২৯. দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় (সাহিত্য সাধক চরিতমালা), ব্রজেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়

 ৩০. উনিশ শতকের সামাজিক প্রেক্ষিতে বাঙালি মহিলা চিকিৎসক, সোমা বিশ্বাস

 ৩১. উনিশ শতকে বাঙালি নারী চিকিৎসকদের আগমন ও তজ্জনিত পরিবর্তনসমূহ, ইন্দ্রাণী লাহিড়ী

 ৩২. মহিলা ডাক্তারঃ ভিনগ্রহের বাসিন্দা, চিত্রা দেব

 ৩৩. Kadambini and the Bhadralok, Malavika Karlekar— Economic and Political Weekly

 ৩৪. Colonial Women—Medicine and Medical Education in Bengal—1884-1940—Srila Chatterjee

 ৩৫. The Entry of women into Medicine—Encyclopedia Jrank—org.

 ৩৬. Changing Role of Women in Bengal 1859-1905—Berthik Meridith

 ৩৭. অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ, দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়

 ৩৮. বাঙালীর গান, দুর্গাদাস লাহিড়ী

 ৩৯. Songs about the King of Awadh—William Crooke, 1911

 ৪০. Oudh under Wajed Ali Shah—G.D.Bhatnagar, 1968

 ৪১. History of Urdu Literature—T. Graham Bailey—1932

 ৪২. Historic Lucknow, Sidney Hay—1939

 ৪৩. The Private Life of an Eastern King, William Knighton— 1921

 ৪৪. Sorrows of Akhtar, Wajid Ali Shah, Translation by Abdul Wali—1926

 ৪৫. Muslims of Calcutta, M.K.A. Siddiqui

 ৪৬. The Raj, The Indian Mutiny and The Kingdom of Oudh 1801-1859—John Pemble

 ৪৭. বাংলা দেহতত্ত্বের গান, সুধীর চক্রবর্তী

 ৪৮. ছড়ায় মোড়া কলকাতা, পূর্ণেন্দু পত্রী

 ৪৯. পুরনো কলকাতার কথাচিত্র, পূর্ণেন্দু পত্রী

 ৫০. ব্রাহ্মসমাজে চল্লিশ বৎসর, শ্রীনাথ চন্দ্র

 ৫১. ক্রুশবিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ, বিজন ঘোষাল

 ৫২. কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা, মহেন্দ্রনাথ দত্ত

 ৫৩. ধর্মের উৎস সন্ধানে, ভবানীপ্রসাদ সাহু

 ৫৪. সেকালের কলিকাতার যৌনাচার, মানস ভাণ্ডারী

 ৫৫. সঞ্জীবনী, কানাইলাল চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদনা)

 ৫৬. The Indian Problem—Behramji Malabari

 ৫৭. The Life and Life-work of Behramji M. Malabari, Dayaram Gidumal, 1892

 ৫৮. India—Forty Years of Progress and Reform / Being a Sketch of the Life and Times of Behramji M. Malabari—Rustomji Pestonji Karkaria, 1896

 ৫৯. B. M. Malabari / Rambles with the Pilgrim Reformer—Sardar Jogendra Singh

 ৬০. নীলাচল অভিসার, ব্রহ্মচারী অচ্যুতানন্দ প্রামাণিক

 ৬১. লোকায়ত শ্রীচৈতন্য, তুহিন মুখোপাধ্যায়

 ৬২. বাঙালীর চৈতন্যলাভ, প্রবীর সেন

 ৬৩. ব্রাহ্ম পাবলিক ওপিনিয়ন

 ৬৪. দ্য বেঙ্গলি

 ৬৫. সংবাদ প্রভাকর, ১৮৮৭

 ৬৬. সমাচার দর্পণ, ১৮৮৭

 ৬৭. The Statesman—1887

 ৬৮. Daily Telegraph, UK—1887

 ইত্যাদি।

1 Comment
Collapse Comments
নিশির শিশির June 29, 2023 at 8:33 am

Good novel

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *