০৫. কৃষ্ণসুন্দর গায়ত্রীমন্ত্র জপ করছিলেন

কৃষ্ণসুন্দর পূবদিকে মুখ করে বসে গায়ত্রীমন্ত্র জপ করছিলেন। দুপুরে ঘণ্টা বাজলে সবাই সারিবদ্ধ হয়ে এসে জড়ো হয় এই খাওয়ার ঘরে। প্রায়ান্ধকার সুবিশাল একখানা কুঠুরি। মাটিতে সরু লম্বা শতরঞ্জি পাতা, সেখানেই বসতে হয় পরপর। প্রতিদিন দশজনের দলকে বেছে নেয় প্রহরীরা। তারাই খাবার পরিবেশন করে।

কৃষ্ণসুন্দর ঋজু হয়ে বসে আহারপাত্রের চতুষ্কোণে মণ্ডল রচনা করছিলেন। পাশে বসে দিব্যসুন্দর পিতাকে গভীরদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল। বাড়িতে তার দিনের অধিকাংশ সময় কাটত মা-দিদি-পিসিমা’র সাহচর্যে। পিতার সঙ্গ সে ততটা পেত না। তাই ডিপোয় আসার পর অন্য যতকিছুই মন্দ হোক না কেন, পিতার সঙ্গে গোটা দিন কাটাতে পারার সুযোগ পেয়ে সে বেশ আনন্দিত।

যদিও ব্রাহ্মণপুত্রের পক্ষে আটবছর বয়সই হল উপনয়নের জন্য আদর্শ সময়, কিন্তু এখনো তার উপনয়ন হয়নি। বিগত কয়েক বছর ধরে চলা দুর্যোগে কৃষ্ণসুন্দর ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। স্থির করেছিলেন শীঘ্রই কোনোমতে আয়োজন করবেন।

কিন্তু সেসব এখন দুরাশা মাত্র! ভাগ্যের দোষে দিব্যসুন্দর হয়ত কোনোদিনই উপবীতধারী হতে পারবে না। কোনোদিনই মন্ত্রোচ্চারণের অধিকারী হবে না।

কৃষ্ণসুন্দর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাটিতে স্বল্প পরিমাণে অন্ন পাঁচভাগে রেখে অস্ফুটে মন্ত্রোচ্চারণ করলেন।

দিব্যসুন্দর বলল, ‘ওই পাঁচটা ভাগ কীজন্য বাবা? ওটা তুমি খাবে না?’

‘না বাবা।’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘খাওয়ার আগে নাগ কূর্ম কৃকর দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়, এই পঞ্চদেবতাকে খাদ্য নিবেদন করে তারপর খাওয়া শুরু করতে হয়।’

কথাটা বলে হাতে এক গণ্ডূষ জল নিয়ে অন্নের ওপর আপোশান করতে করতে তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘অমৃতঃ উপস্তরণমসি স্বাহা!’

ঠিক এইসময় অন্যপাশ থেকে পরেশ কৈবর্ত ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করল, ‘ঠাউরমশাই, একখান কতা ছিল আপনের লগে! যদি অভয় দেন তো নিভ্যয়ে নিবেদন করি আজ্ঞে।’

কৃষ্ণসুন্দর ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। এখানে আসার আগে পর্যন্ত কৈবর্তের সঙ্গে একাসনে বসে কুলীন ব্রাহ্মণের ভোজন কল্পনাতীত বিষয় ছিল। তবে এইসব নিয়ে কৃষ্ণসুন্দরের কোনোদিনই ছুঁৎমার্গ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করেন না ‘দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা’ শ্লোকে।

বিশ্বাস করেন, মনুষ্যত্বই একমাত্র নির্ণায়ক। কর্মই মানুষের পরিচয়।

কিন্তু আহারকালে তিনি যে মৌন থাকেন, সেটুকু তো সবারই জানা।

কৃষ্ণসুন্দর কোনো কথা না বলে পরেশ কৈবর্তের দিকে জিজ্ঞাসুনয়নে তাকালেন।

পরেশ কৈবর্ত আবার আড়চোখে তাকাল অদূরে দাঁড়ানো প্রহরীর দিকে। তারপর চাপা স্বরে বলল, ‘একন বলতি না পারলি আর সময়টো হবেক লাই ঠাউরমশাই! লব দত্তর লজর পড়িছে আপনের বড় মাইয়াডার পানে। এক্কেরে পাকা খপর। মঙ্গলা ওবেলা এসে বলি গেল। মুই সেই থিকা হাঁকপাঁক করতেসি কথাটো বলার জন্যি।’

কৃষ্ণসুন্দরের সুষুম্নাকাণ্ড বেয়ে একটা আতঙ্কের হিমস্রোত নেমে গেল। ‘লব দত্ত’ অর্থে যে নবকিশোর দত্ত তা বুঝতে ওঁর একটুও অসুবিধা হল না।

পরেশ কৈবর্ত রাঢ়ভূমির লোক। একা মানুষ, পরিবার মারা গেছে অনেককাল। কোন এক আড়কাঠির কথায় প্রলুব্ধ হয়ে সেও এসে এই পিঞ্জরে ঢুকেছে। সোজাসরল ধর্মভীরু লোক। কৃষ্ণসুন্দরকে ভক্তি করে। মঙ্গলা নামী মহিলাটি ওদিকের ঘরে থাকলেও পাকা রান্নার হাতের জন্য তাকে মাঝেমধ্যে ডেকে পাঠানো হয় রসুইঘরে।

তার কাছ থেকেই পরেশ সংবাদটা পেয়েছে।

দুশ্চিন্তায় কৃষ্ণসুন্দরের মুখে আর খাবার উঠল না, দ্রুত আচমন করে উঠে পড়লেন।

অপরাহ্নে আরো দুটি রৌপ্যমুদ্রা প্রহরীর হস্তগত হল। ব্রহ্মময়ী এসে কোনোমতে মুখে আঁচলচাপা দিয়ে জানালেন, পরেশ কৈবর্তর কথা নির্ভুল। এজেন্ট নবকিশোর দত্তর যে শুধু অপালার ওপর দৃষ্টি পড়েছে তাই নয়, সকালে দুজন প্রহরী এসে তাকে ডেকেও নিয়ে গিয়েছিল নবকিশোর দত্তর গোলঘরে।

‘গোলঘর’ আক্ষরিক অর্থেই গোলাকার একটি ঘর। ডিপোতে নারী ও পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট দুই প্রকাণ্ড কক্ষ ছাড়াও এই বাড়িতে রয়েছে রন্ধনশালা, শৌচাগার ও প্রহরীদের থাকার ব্যবস্থা। এছাড়া ডিপোর সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই বামহাতে মাঝারি আয়তনের গোলঘর। ডিপোমালিক নবকিশোর দত্ত’র খাস বিশ্রামকক্ষ। দিনে দু’বার ডিপো পরিদর্শনে এসে নবকিশোর দত্ত ওখানেই পারিষদবর্গদের নিয়ে বিশ্রাম করে।

ডিপো’র অন্যান্য কক্ষের মতো গোলঘরও পালা করে পরিষ্কার করতে হয় জাহাজের অপেক্ষায় থাকা ‘গিরমিটওয়ালা’ শ্রমিকদের। সেই উপলক্ষেই কৃষ্ণসুন্দর বারকয়েক গিয়েছেন সেই ঘরে। অবশ্যই মালিকের অনুপস্থিতিতে।

তাঁর স্মরণে এল, ঘরটিতে ঢুকে তিনি কিছুক্ষণ থ’ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কারণ, কলকাতা শহরে আসা ইস্তক যে ক’টি রাত এই ডিপো’র ঘরে তাঁর কেটেছে, সেই ডিপোতেই যে এত বিলাসিতাপূর্ণ কক্ষ রয়েছে, তা তাঁর ধারণাতীত ছিল।

ঘরটি আয়তনে মাঝারিমাপের হলেও গোটা ঘর জুড়ে ছিল নিচু জাজিম-ফরাস বিছানো চৌকি, এদিক ওদিক মখমলে মোড়া তাকিয়া। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল নিঃশেষিত সুরার পাত্র। সেদিন তার কিছুক্ষণ আগেই দলবল নিয়ে নবকিশোর দত্ত গোটা দুপুরটা কাটিয়ে গিয়েছিল, তারই নিদর্শন ছিল চারপাশে।

কৃষ্ণসুন্দর সেই স্মৃতিরোমন্থন করে শিহরিত হয়ে বললেন, ‘তারপর? অপা এসে কী বলল তোমায়?’

ব্রহ্মময়ী কোটরাগত চোখ তুলে তাকালেন স্বামীর দিকে। এই কয়েকদিনে অতিরিক্ত দৈহিক পরিশ্রম, মানসিক যন্ত্রণায় তাঁর শরীর একেবারে ভেঙে গিয়েছে। গায়ের রংটাতেও মরচে ধরে গেছে। বললেন, ‘কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এল। আমাকে কিছু বলেনি। ঠাকুরঝি জিগ্যেস করতে বলেছে। নবকিশোর দত্ত গোলঘরে ছিল ঠিকই, কিন্তু সে বা তার মোসাহেবরা নাকি কিছু প্রশ্ন করেনি। যা কিছু জিজ্ঞাসা করার, করেছে নাকি এক বুড়ো পণ্ডিত।’

‘বুড়ো পণ্ডিত?’ কৃষ্ণসুন্দর কিছুই বুঝতে পারলেন না। বললেন, ‘পণ্ডিত সেখানে কী করছিল?’

ডিপোতে যে নারীদের ওপর নির্যাতন চলে, সে তো সহজেই অনুমেয়। ডিপোর মালিক হিসেবে নবকিশোর দত্ত তার লালসার হাত বাড়াতে চাইছে ব্রাহ্মণকন্যা অপালার দিকে, এই ঘটনায় তাই পরেশ কৈবর্ত থেকে শুরু করে কৃষ্ণসুন্দর চিন্তিত, ভীত হয়ে উঠলেও তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। বরং ডিপোয় আসার পর থেকে যুবতী বোন ও দুই মেয়েকে নিয়ে এই আশঙ্কাতেই কাঁটা হয়ে ছিলেন কৃষ্ণসুন্দর আর ব্রহ্মময়ী। ক্রীতদাসীদের শরীরের ওপর মালিকের অধিকার সেই আদিমযুগ থেকে চলে আসছে। এই যুগে ‘দাস’-এর সংজ্ঞা বদলালেও তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কিন্তু নবকিশোর দত্তের হাত বাড়ানোর কারণ কামচরিতার্থতা নয়।

কৃষ্ণসুন্দরের কন্যার প্রতি তার আগ্রহের কারণের শিকড় প্রোথিত ছিল অনেক গভীরে। সেই কারণ যেমনই বিস্ময়কর তেমনই মর্মান্তিক।

নবকিশোর দত্ত লোকটা আর পাঁচজন শহুরে ব্যবসায়ীর মতোই। কলকাতা শহরে একটু পয়সা হলেই জুড়ি গাড়ি আর বাঁধা মেয়েমানুষ রাখা হল আভিজাত্যের লক্ষণ। নিজের প্রতিপত্তি দেখানোর লড়াইয়ে কে কার রক্ষিতাকে কত বড় বাড়ি করে দিয়েছে, সেই প্রতিযোগিতাও প্রচ্ছন্নভাবে চলে বাবুদের মধ্যে।

নবকিশোর দত্তও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। শোনা যায় তার দুজন রাঁড়, একজন হিন্দু বাঙালি আর অন্যজন মেটিয়াবুরুজের এক মুসলিম লক্ষ্নৌওয়ালি। সে থাকুক, সমস্যা অন্য জায়গায়। নবকিশোর দত্ত জাতে গন্ধবণিক, তার ধর্মপত্নী তিনজন। কিন্তু তিনজনের একজনও তাকে কোনো সন্তান উপহার দিতে পারেনি। এদিকে যত বয়স বাড়ছে, পুত্রসন্তানের জন্য নবকিশোর দত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠছে।

নবকিশোর দত্তর যে দুজন রাঁড়, তারা বাঁধা রয়েছে প্রায় বছরপাঁচেক হতে চলল। তাদেরও কেউ নবকিশোর দত্তর সন্তানের জন্ম দেয়নি। বাড়িতে বউদের যত গঞ্জনাই সহ্য করতে হোক, লোকে আড়ালে-আবডালে নবকিশোর দত্তর নামেই অপবাদ দেয়। বলে, নব দত্ত ঢোঁড়া সাপ, বিষ নেই। না-হলে পত্নী, উপপত্নী সবাই একসঙ্গে তো বন্ধ্যা হতে পারে না।

নবকিশোর দত্তর সারাক্ষণের মোসাহেবরা যতই এই ধারণাকে ভ্রান্ত অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিক, নবকিশোর দত্ত নিজেও মনে মনে নিজের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে বেশ সন্দিহান। তার বয়স এখন পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। শেষ বিবাহটি করেছে বছর তিনেক আগে, কিন্তু সেক্ষেত্রেও কোনো লাভ না হওয়ায় সে অত্যন্ত ভীত। যত বয়স বাড়ছে, ততই পুত্রাভাবে পুন্নাম নরকে গিয়ে যন্ত্রণাভোগ করার ভয় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যাগযজ্ঞ থেকে শুরু করে ঝাড়ফুঁক, ‘পুত্রার্থে’ সে কিছুই বাদ রাখেনি, কিন্তু ফল শূন্য।

অবশেষে মাসখানেক আগে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তাকে এক অব্যর্থ দাওয়াই বাতলেছেন। পণ্ডিতটির নাম ধনঞ্জয় বাক্যবাগীশ। আদৌ গুরুর চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়নসমাপনে অর্জিত উপাধি নাকি তিনি নিজেই নিজের নামের পেছনে উপাধিগ্রহণ করেছিলেন তা জানা যায় না।

তবে ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ নয়। তিনি প্রকৃতই বাকপটু পুরুষ। লোকে বলে, ধনাপণ্ডিত কথার জালে বাঘা বাঘা মোক্তারকে হার মানায়, যুক্তিতে হারিয়ে সূর্যদেবকে পশ্চিমেও উদিত হতে বাধ্য করতে পারে।

গোটা বঙ্গদেশ জুড়ে নবকিশোর দত্তর মতো পুন্নাম নরকের ভয়ে ভীত থাকা পুরুষের অভাব নেই। সেই তালিকায় ছোটবড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে জমিদার—সবাই আছেন। ধনাপণ্ডিতের কাজ হল শাস্ত্রমতে তাঁদের পুত্রসন্তানের জনক হতে সহায়তা করা।

আর এই কাজে তার সাফল্যের হার ঈর্ষণীয়ভাবে বর্ধমান। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গে ঊর্ধমুখী তার সম্মানদক্ষিণাও।

ধনঞ্জয় পণ্ডিতের কাজের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, ‘যস্মিন দেশে যদাচার’। অর্থাৎ, ব্যক্তিবিশেষে তার ধর্মীয় রীতিনীতি, যাগযজ্ঞ সমস্ত কিছু বদলায়। যেমন শোনা যায়, নবদ্বীপের এক ধনী অশীতিপর জমিদারের জন্য তিনি একশো আটখানা ছাগশিশু একটি বিশেষ মাহেন্দ্রক্ষণে বলি দেওয়ার আয়োজন করেছিলেন। আর সেই যজ্ঞের অনতিকাল পরেই অশীতিপর জমিদারের পত্নী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন।

আবার, পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের এক স্থানীয় বণিকের জন্য নিজস্ব বাহিনী নিয়ে টানা তিরিশরাত অতিবাহিত করেছিলেন বণিকগৃহে। সেখানে অষ্টপ্রহর চলেছিল পুত্রেষ্টি যজ্ঞ।

মোট কথা, বীর্যের জোর না থাক, ট্যাঁকের জোর আছে তো? মাভৈঃ! পুত্রসন্তান তবে হবেই।

তা যিনি মা লক্ষ্মীর এমন বরপুত্র, তাঁর নামে অপবাদ তো থাকবেই। অনেকেই তাঁর বা তাঁর শিষ্যদের নামে চারিত্রিক অপবাদ দেয়। ধনাপণ্ডিতের কানে সেসব আসে, কিন্তু তিনি প্রতিক্রিয়াশীল নন। কেবল মিটিমিটি হাসেন আর তামাক সেবন করেন।

নবকিশোর দত্ত তার এক মোসাহেবের কাছে ধনঞ্জয় পণ্ডিতের নামযশ শুনে কালবিলম্ব না করে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর কাছে। ধনঞ্জয় পণ্ডিতের নিবাস বর্ধমানের কালনায়। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ। প্রথমেই বিপরীতদিকে বসে থাকা মানুষটিকে মেপে নেন, বরং বলা ভালো, মাপেন অর্থবলকে। তারপর সেইমতো নিদান হাঁকেন।

নবকিশোর দত্তর ক্ষেত্রে ধনঞ্জয় পণ্ডিত কুষ্ঠী বিচার করে প্রথমেই কিছু খোলসা করেননি। শুধু গম্ভীরকণ্ঠে বলেছিলেন, বৃহস্পতি যতই তুঙ্গে বিরাজমান হোক না কেন, নবকিশোর দত্তর পুত্রভাগ্যে শনিদেব নাকি শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

নবকিশোর দত্ত শুনে কিছুক্ষণ বিস্ময়ে মূক হয়ে গিয়েছিলেন, তারপরই কালবিলম্ব না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ধনাপণ্ডিতের পদমূলে, ‘ওসব আমি কিচু জানিনে পণ্ডিতমশাই। আপনি তিকালজ্ঞ, আপনাকে আমায় উদ্ধার করতেই হবে। নইলে মরার পর নরকে গিয়ে ডান্ডা খাব নাকি?’

ধনাপণ্ডিত নামাবলিটা গায়ে আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি উদ্ধার করার কেউ নই দত্তমশাই। আপনার পুত্রসন্তানলাভ সত্যিই কঠিন। অসম্ভবই বলা যায়।’

‘আজ্ঞে, কোনো উপায়ই কি নেই পণ্ডিতমশায়?’ কাতর নয়নে চেয়ে ছিলেন নবকিশোর দত্ত।

ধনাপণ্ডিত কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ছিলেন। তারপর নিজের সুদীর্ঘ ব্রহ্মশিখাটিকে বাতাসে দুলিয়ে বলেছিলেন, ‘একটা উপায় আছে। কিন্তু সে বড় কঠিন। আপনি কি পারবেন?’

নবকিশোর দত্ত অন্ধকারে ম্লান এক প্রদীপশিখা দেখে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলেন, ‘পারব! পারব পণ্ডিতমশাই। আপনি শুধু বলুন কী করতে হবে। যত খরচ হয় হোক।’

‘খরচের প্রশ্ন নয়।’ ধনাপণ্ডিত বলেছিলেন, ‘আমার কাছে যারা আসে তারা যে খরচের তোয়াক্কা করে না, তা আমি জানি। প্রশ্ন হল সমাজের। সামাজিক ভয়ের। সেই চাপ সামলাতে আপনি কি পারবেন?’

সামাজিক চাপ? নবকিশোর দত্ত একটু থমকে গিয়েছিলেন ধনঞ্জয় পণ্ডিতের কথা শুনে। নবাবের কল্যাণে মেটিয়াবুরুজে চিড়িয়া সাপ্লাই করে তাঁর রোজগার বেশ ভালো। সঙ্গে ডিপোর ব্যবসাতেও আড়কাঠিরা ভালো কাজ করছে। এছাড়া খুচরো ব্যবসাগুলো তো আছেই। ধনাপণ্ডিত যদি হাজার দু’হাজার টাকারও কোনো যজ্ঞ-টজ্ঞ বলেন, নবকিশোর দত্ত পিছপা হবেন না। কিন্তু সামাজিক চাপ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন ইনি?

‘আপনাকে একটা বিবাহ করতে হবে।’

নবকিশোর দত্ত কিছুই বুঝতে পারেননি। বিয়ে করতে হবে, এটা আবার কোনো বড় কথা হল নাকি। সে তো চাইলেই করে ফেলা যায়। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো কন্যাদায়গ্রস্থ গন্ধবণিক পিতা এসে করজোড়ে দাঁড়ায় তাঁর সামনে। কিন্তু তৃতীয় পক্ষ পর্যন্ত এগনোর পর নবকিশোর দত্ত ওদিকে আগ্রহ হারিয়েছেন। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, কেবল ঘরে সতীন বাড়ছে। আরো বিবাহ করার চেয়ে দুটো মেয়েমানুষ বাঁধা রাখা ভালো। ঝুটঝামেলা কম। বাড়িতে ক্যাঁচরম্যাচরেরও ঝঞ্ঝাট নেই।

‘সে আর এমন কি কতা পণ্ডিতমশাই? যবে বলবেন তবেই পাঁজি দেখে…।’

ধনঞ্জয় বাক্যবাগীশ নবকিশোর দত্তকে তখন আর অন্ধকারে না রেখে পুরো বিষয়টা খোলসা করেছিলেন। যে-কোনো কন্যা হলে চলবে না। তিনি যদি দশমবর্ষীয়া একটি কুলীন ব্রাহ্মণতনয়াকে বিবাহ করেন, তবেই পুত্রসন্তানলাভের সম্ভাবনা রয়েছে।

নবকিশোর দত্ত শুনে থ’।

‘কুলীন বামুনের মেয়ে! আমি তো বেনে। আমার সঙ্গে বে দিতে কোন মেয়ের বাপ রাজি হবে?’

‘যদি কেউ সম্মত না হন, তবে আপনারও পুন্নাম নরকযাত্রা কেউ আটকাতে পারবে না দত্তমশাই।’ ক্ষীরের পুলির মতো মিষ্টিসুরে বলেছিলেন ধনাপণ্ডিত, ‘তবে বিবাহ করলেই হবে না অবশ্য। তারপর কী কী করণীয় তা আমি যথাসময়ে বলব। দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। আপাতত একটি সুলক্ষণা কন্যার সন্ধান করুন। পেলে আমায় সংবাদ প্রেরণ করবেন। আজ এই পর্যন্তই।’

নবকিশোর দত্ত মোটা দাগের লোক। সারাজীবন অর্থ উপার্জন ছাড়া কিছু বোঝেননি। জৈবিক চাহিদা তো সব প্রাণীরই থাকে, সেই তাড়নায় তিনটে বিবাহ করেছে। দু’জন রক্ষিতাও রেখেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। নারী-পুরুষের সম্পর্কের মাঝে যে শারীরিক চাহিদা ছাড়াও মানসিক ভাব আদানপ্রদান সম্ভব, তা কোনোদিনও এই গন্ধবণিক প্রৌঢ়ের মাথায় আসেনি। মেয়েদের তিনি তাঁর রপ্তানির জন্তুদের মতই পণ্য ভাবেন। তাই এতগুলি নারীর সংস্পর্শে নিয়মিত থাকা সত্ত্বেও সকলেই তার শয্যাসঙ্গিনী হয়ে রয়ে গিয়েছে। নর্মসঙ্গিনী কেউই হতে পারেনি।

কিন্তু কুলীন বামুনের মেয়ে! যদি কোনো কন্যার শ্বেতি বা বিকলাঙ্গ জাতীয় কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে, সেক্ষেত্রে গোপনে তার দরিদ্র পিতাকে যথোপযুক্ত উৎকোচ দিয়ে হয়ত এই অসবর্ণ বিবাহ করা সম্ভব। ওই একই পদ্ধতিতে সমাজের মুখও নাহয় বন্ধ করা গেল।

কিন্তু পণ্ডিতমশাই সঙ্গে আরেকটি শর্ত জুড়েছেন, ‘সুলক্ষণা’। অর্থাৎ খুঁতহীন। তেমন মেয়ে নবকিশোর দত্ত কোথায় পাবে যার বাপ বেনের হাতে মেয়েকে দিয়ে নিজের জাত খোয়াবে?

উপায় বাতলাল গণেশ, নবকিশোর দত্তর অষ্টপ্রহরের মোসাহেব। তার প্রভাব নবকিশোর দত্তর জীবনে অসীম। শহরে কোথায় ভালো কবিগানের লড়াই হচ্ছে, কোন বেশ্যার বাঁশের মতো সরু কোমরের ঝলকে ঘায়েল হয়ে পড়ছে বড় বড় রাজামহারাজ, কিংবা কোথায় বুলবুলির লড়াইয়ে মুড়িমুড়কির মতো পয়সা ওড়াচ্ছে ধনীর পুত্র, সব সংবাদই গণেশের মারফৎ কানে এসে পৌঁছয় নবকিশোর দত্তর। নিজের হরেকরকম ব্যবসার ক্ষেত্রেও গণেশের সঙ্গে নানা বৈষয়িক আলোচনা করেন তিনি। লোকে অবশ্য বলে, নবকিশোর দত্তর মোসাহেবি করার চেয়ে তাঁর মাথায় কাঁঠাল ভেঙে নিজের আখের গুছিয়ে দিনে দিনে গণেশের ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হচ্ছে, তার দেশের সম্পত্তিও নাকি জাদুবলে দিনদিন বর্ধিত হচ্ছে।

তা সে যাই হোক। লোকের কথায় আর কবে কোন বড়মানুষে কান দিয়েছে! লোকজনের কাজই হল বড়মানুষদের কেচ্ছা শুনে হামলে পড়া।

সেদিন ডিপোর গোলঘরে বিশেষ কেউ ছিল না। নবকিশোর দত্ত বিমর্ষমুখে উদাসনয়নে মদ্যপান করছিলেন। নাতিদীর্ঘ গেলাসে তা বোতল থেকে ঢেলে ঢেলে দিচ্ছিল গণেশ। ডিপোর প্রহরীদের প্রধান রামবিলাস একটু আগেই এসে আজকের সংবাদ দিয়ে গিয়েছে। বিশেষ কিছু সংবাদ নেই, সবকিছু হিসেবমতোই চলেছে। প্রহরীদের কড়া নজরদারিতে কোনো গিরমিটওয়ালা ট্যাঁফোঁ করেনি, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজ, সব মিটেছে নির্বিঘ্নে।

নবকিশোর দত্তর গোমস্তা মধুসূদন তারপর কিয়ৎক্ষণ ধরে লম্বা ফিরিস্তি শুনিয়েছে যে, আগামী সপ্তাহে যে জাহাজ বন্দর ছাড়বে, তাতে কোন কোন গিরমিটকে পাঠানো হবে। দিয়েছে সাপ্তাহিক পাওনাগন্ডার হিসেবনিকেশও।

নবকিশোর দত্ত সেসবই শুনেছেন অন্যমনস্ক হয়ে। গণেশ সেসব লক্ষ্য করে বলেছিল, ‘হুজুর দেখি আজ সারাদিন আকাশপাতাল ভেবেই চলেচেন। কিচুতেই মন নেই।’

‘কী করব গনি, তুই তো সবই জানিস।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন নবকিশোর দত্ত, ‘পণ্ডিতমশাই যদি এর চেয়ে হাজার মণ ঘি দিয়েও যাগযগ্যি করতে বলতেন, চেষ্টাচরিত্তির করে দেখতুম। খুঁতো মেয়ে হলেও একটা কতা ছিল। তাও হবে না। এমন সব শর্ত দিচ্চেন, যে আমার নরকে গিয়ে ডান্ডার বাড়ি খাওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা নেই।’

গণেশ অম্লানবদনে গেলাসে আরেকপ্রস্ত মদ ঢালতে ঢালতে বলেছিল, ‘তা আপনি যদি ইচ্ছে করে ডান্ডা খেতে চান, কে কী করবে কত্তা?’

‘মানে? আমি ইচ্ছে করে চাইছি?’ রক্তাভ নয়নে চাটুকারের দিকে তাকিয়েছিলেন নবকিশোর দত্ত, ‘তুই জানিস, আমি ধনাপণ্ডিতকে কতভাবে অনুরোধ করিচি? অন্যদের বেলা ছাগবলি, আমার বেলা এমনতরো কঠিন আদেশ কেন, তাও জিগ্যেস করিচি। উনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, বললেন, হরিণ ঘাস খায়, তাই বলে সিংহকেও কি তুমি ঘাসের আঁটি ধরিয়ে দেবে দত্তর পো?’

‘হক কতাই তো বলেচেন পণ্ডিতমশাই। আপনি হলেন গে পশুরাজ সিংহ। নবাবের চিড়িয়াখানার সবচেয়ে বড় সিংহটার মতো।’

‘বটে? তুই তবে আমার নরকবাস কামনা করচিস?’

গণেশ আধবিঘত জিভ বের করে বলে, ‘ছি ছি, কত্তামশাই। আপনার নুন খাই, আর আপনারই খেতি চাইব, তেমন মানুষ আমি যে নই, তা আপনি জানেন। আমি বলতে চাইচি, উপায় আপনার চোকের সামনেই রয়েচে, কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্চেন না।’

নবকিশোর দত্ত ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন, ‘মানে?’

দৈবক্রমে ওই সময়েই গোলঘরের বাইরের প্রশস্ত উঠোন পরিষ্কার করছিলেন ব্রহ্মময়ী। সেদিন তাঁর ভাগ্যে পড়েছিল সেই কাজ। গণেশ সেদিকে একঝলক তির্যক দৃষ্টি ফেলে মালিকের দিকে তাকিয়ে ইশারা করেছিল, ‘যেমন মা তেমন মেয়ে। কুলীন বামুন। সুন্দরীও বটে। বয়সও ওই দশ বচ্ছর। কত্তা, এরপরও বলবেন উপায় নেই?’

নবকিশোর দত্ত গণেশের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়েছিলেন বাইরের দিকে। ব্রহ্মময়ীকে তিনি চিনতে পারেননি। গণেশ যে ব্রহ্মময়ীকন্যা অপালার কথা বলছে, তাও তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। প্রতি সপ্তাহে আড়কাঠিরা গোটা দেশ থেকে নানাজাতের লোক ধরে আনছে, তারা কয়েকদিন থাকছে, তারপর জাহাজে উঠে পাড়ি দিচ্ছে ভিনদেশে। এইসব পরিযায়ীদের প্রত্যেককে চেনা সম্ভব নাকি?

তিনি কিছু বলার আগেই গণেশ সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছিল গোটা বিষয়টা। নবকিশোর দত্ত পুরোটা হৃদয়ঙ্গম করে চুপ করে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর দুপাশে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ‘না। এটা সম্ভব নয়।’

‘কেন?’

নবকিশোর দত্ত বলেছিলেন, ‘এরা আমার ব্যবসার মূলধন। মূলধনকে মোটা মুনাফায় বেচা যায়, কিন্তু তার সঙ্গে সংসার করা যায় না।’

গণেশ শুনে চুপ করে গিয়েছিল। আর কিছু বলেনি।

কিন্তু কয়েকদিন পর সব শুনে মোক্ষম উত্তর দিয়েছিলেন ধনঞ্জয় পণ্ডিত নিজে।

‘আপনি সংসারের চেয়েও মহৎ একটি কারণে বিবাহ করবেন দত্তমহাশয়। পুত্রার্থে। পুত্রসন্তান লাভের তুলনায় সংসার বা স্ত্রী অনেক তুচ্ছ একটি বিষয়।’

নবকিশোর দত্ত তবু মৌন হয়ে থাকেন। মেনে নিতে পারেন না পণ্ডিতের যুক্তি। উপপত্নী যাকে খুশি রাখা যায়, তার জাত ধর্ম বিচার সমাজ করে না। কিন্তু কূলবধূ হতে গেলে অনেকগুলি নির্ণায়ক এসে পড়ে। পাত্রীকে শুধু সুন্দরী সুলক্ষণা হলেই হয় না, হতে হয় বিশুদ্ধা। যে মেয়েকে আড়কাঠি তুলে এনেছে, যে নিজের বাসভূমি থেকে হয়ত সাত ঘাট ঘুরে ডিপোয় এসেছে, তার শুদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ আছে।

ধনঞ্জয় পণ্ডিত অকস্মাৎ একটি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কবি বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল পড়েছেন? গন্ধবণিক চাঁদ সদাগরের উপাখ্যান?’

‘পড়িনি। তবে চাঁদ সদাগরের পালাটি জানি। সতীলক্ষ্মী বেহুলা সোয়ামিকে ভেলায় করে স্বর্গে নিয়ে গিয়ে বাঁচিয়েছিল।’ উত্তর দেন নবকিশোর দত্ত। তবে তাঁর পুত্রলাভের সঙ্গে মনসামঙ্গলের সম্পর্ক কী, তা তিনি শত ভেবেও বের করতে পারেন না।

‘দেবী মনসা চাঁদ সওদাগরের ছয়টি পুত্রের প্রাণনাশ করার পর লখিন্দর জন্মায় চাঁদ সওদাগর পত্নী সনকার গর্ভে। লখিন্দরের বিবাহ চাঁদ সওদাগর স্থির করেন উজানিনগরের ব্যবসায়ী সায়াবেনের কন্যা বেহুলার সঙ্গে। অর্থাৎ নিজের ব্যবসায়িক সতীর্থের কন্যার সঙ্গে।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন নবকিশোর দত্তর দিকে, ‘আপনিও তো গন্ধবণিক। চাঁদ সদাগরেরই উত্তরপুরুষ। আপনার মতো গোঁ ধরলে তো বেহুলার সঙ্গে লখিন্দরের বিবাহও হত না, আর স্বর্গ থেকে কেউ লখিন্দরকে ফিরিয়েও আনত না।’

নবকিশোর দত্ত চুপ করে ছিলেন।

ধনঞ্জয় পণ্ডিত বললেন, ‘আপনার ইতিমধ্যেই তিনটি সহধর্মিণী। যারা কেউই গর্ভধারণ করতে পারেননি। আপনার বয়সও এখন পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। সুতরাং এতকাল যা হয়নি, এখন তা হওয়ার সম্ভাবনা দিনদিন হ্ৰাসমান। বয়সের সঙ্গে পুরুষের ঔরসক্ষমতা হ্ৰাস পায়। তবু আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব। আর সেইজন্যই একটি ব্রাহ্মণ গর্ভ নিতান্তই প্রয়োজন।’

এরপর আর তর্ক শোভা পায় না। গোমস্তা মধুসূদন সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কৃষ্ণসুন্দরদের জাহাজে উঠতে এখনো দশদিন মতো বাকি। এই সুযোগে আজ অপালাকে নিজচোখে দেখে গেলেন ধনঞ্জয় পণ্ডিত।

না! কন্যা সুলক্ষণা বটে। যবনদোষ, আপন পিসির বলাৎকার, ডিপোয় বসবাস এইসবের জন্য শুদ্ধিকরণ করে নিলেই চলবে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।

বিবাহে কন্যার পিতার অনুমতি? অপ্রয়োজনীয়। কারণ পিতা নিজেই যখন দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ, তিনি সম্প্রদান করার কেউ নন। অমোঘ বিধান ধনাপণ্ডিতের।

কৃষ্ণসুন্দর তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাটিকে বিদুষী করে তুলতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন অপালা শিক্ষিকা হোক। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিক শিশুদের মধ্যে। সেইজন্য চেয়েছিলেন মুক্তমনা কোনো ঘরে তাকে বিবাহ দিতে।

তাঁর সেই স্বপ্ন ধূলিধূসরিত হয়ে গেল। মাত্র দশ বছর বয়সে অপালার বিবাহ হল পঞ্চাশোর্ধ্ব বণিক নবকিশোর দত্তর সঙ্গে। অসবর্ণ বিবাহ ও জানাজানির ভয় এড়ানোর জন্য ব্রাহ্মণকে মোটা প্রণামি ধরে দিতে হল নবকিশোর দত্তকে। ‘ডিপোর বিয়ে’ বলে কথা, বন্দীরাই বরযাত্রী, বন্দীরাই কনেযাত্রী। না হল পাটিপত্র, না হল দধিমঙ্গল, না হল পানখিল।

নমো নমো করে গাত্রহরিদ্রা, সাতপাক, শুভদৃষ্টি ও সিঁদুর দান। হয়ে গেল বিবাহ।

নামমাত্র সম্প্রদানটুকু ছাড়া কৃষ্ণসুন্দর আর কোনো দায়িত্বই পালনের অধিকার পেলেন না। বিবাহান্তে নবকিশোর দত্তর পালকিতে ওঠার আগে একমাথা সিঁদুর নিয়ে অপালা কেঁদে কেঁদে মায়ের পরনের শতচ্ছিন্ন জীর্ণ কাপড়টি ভিজিয়ে ফেলল। ব্রহ্মময়ী ও ভুবনমণি দু’জনের ক্রন্দন ঢাকা পড়ে গেল দত্তবাড়ি থেকে আসা নহবতের আওয়াজে।

রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ভাষায় বলতে গেলে তখন বাঙালি বধূর চারদিকে শুধুই, ‘শাশুড়ি রাগিণী, ননদী বাঘিনী, সতিনী নাগিনী বিষের ভরা’। ঠিকই তাই। সতিনে ভরা বৈষয়িক বণিকপরিবারের বধূরা তখন শিক্ষার আলো তো দূর অস্ত, সূর্যের আলোটুকুও পেত না। অপালাও তেমনই নবকিশোর দত্তর ডিপো থেকে গৃহে পা রাখল অসূর্যম্পশ্যা অবরোধবাসিনী হয়ে জীবন কাটানোর জন্য। আপাতদৃষ্টিতে সে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেল বটে, কিন্তু আসলে প্রবেশ করল জীবনভর দাসত্বের ঘূর্ণাবর্তে।

নবকিশোর দত্তকে পুত্রবান করার জন্য অচেনা পুরুষের হাতে ক্রমাগত বলাৎকৃতা হতে।

শুধুমাত্র ‘পুত্রার্থে’।

বিবাহের আগের দিন পর্যন্ত কৃষ্ণসুন্দরের শত অনুরোধে ও উৎকোচের লোভেও তাঁকে ব্রহ্মময়ীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হল না। দম্পতির সাক্ষাৎ হল মেয়ে বুক খালি করে চলে যাওয়ার পরের সন্ধ্যায়। তখন গোটা ডিপোয় ক্লান্তির নিস্তব্ধতা।

ব্রহ্মময়ী একটা পিদিম নিয়ে এসেছিলেন। চোখে একফোঁটা জল ছিল না। আদিম অরণ্যের ভেতর প্রকৃতির কোলে সযত্নে লালিত কোনো জলপ্রপাত থেকে সমস্ত জলরাশি একমুহূর্তে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে কল্লোলিনী জলপ্রপাতের যে হাড়গোড়-পাঁজরা বের করা বিশ্রী কাঠামোটা বেরিয়ে পড়ে, তেমনই যেন ব্রহ্মময়ীকে লাগছিল। কোটরাগত চোখ, শুষ্ক ত্বক, কণ্ঠা বেরনো ভগ্নদেহ।

দুজনে মুখোমুখি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তালাবন্ধ গোলঘরের পাশের নির্জন বারান্দাটায়। দুজনের মনেই অবিরাম রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে। দুজনেরই বুকে কান্না জোয়ারের স্রোতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে তীরে, অথচ কারুর চোখে এককণা অশ্রুবিন্দু নেই। নিদারুণ আঘাতে তা যেন শুকিয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ পর কৃষ্ণসুন্দর কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘এই ক’টা দিনে কত কী হয়ে গেল বলো তো কৃষ্ণা! আমাদের মেয়েটা চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেল।’

পিদিমের ম্লান আলোয় ব্রহ্মময়ী কেঁপে উঠলেন। বিবাহের অব্যবহিত পরে কৃষ্ণসুন্দর বলেছিলেন, ‘তোমার নামটা এমন, ছোট করে কিছু ডাকতেও পারব না। ব্রহ্ম বলে তো আর ডাকা যায় না। তাই আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে তোমায় একটা নতুন নাম দিলাম। কৃষ্ণা।’

নেহাতই নবদাম্পত্যের অনুরাগের কথা। তারপর ওইনামে সেভাবে স্ত্রীকে ডাকেনওনি কৃষ্ণসুন্দর। কিন্তু মনের গভীর অন্তরালে নিশ্চয়ই এই সম্বোধন ঠিকই লুকিয়ে ছিল। তাই নিজেদের এই প্রচণ্ড দুঃখের দিনে তা বেরিয়ে এল।

ব্রহ্মময়ী ধরা গলায় বললেন, ‘মেয়েটা সবে দশে পড়েছে। আমাদের ঘরে এত তাড়াতাড়ি শ্বশুরঘরে পাঠায় না। আট-নয়ে বিয়ে হয়ে থাকলেও দ্বিরাগমন হয় তেরো-চোদ্দয়। তুমি বলেছিলে অশুভ নয়, শুভই জেতে। কিন্তু তা হল কোথায়?’

কৃষ্ণসুন্দর ভাঙাগলায় বললেন, ‘ধৈর্য হারিও না কৃষ্ণা! মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবকে কতবছর দুর্যোধনের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল চিন্তা করো। শকুনির কপট পাশাখেলায় রাজ্যহরণ থেকে শুরু করে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, বারোবছরের অজ্ঞাতবাস। কিন্তু শেষে তো শুভশক্তিরই জয় হয়েছিল? শ্রীকৃষ্ণের থেকে তিনলক্ষ অক্ষৌহিণী নারায়ণী সেনা নিয়েও দুর্যোধন জিততে পারেনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। ঈশ্বর হয়ত আমাদেরও এখন তেমনই পরীক্ষা নিচ্ছেন। পঞ্চপাণ্ডবের মতো।’

ব্রহ্মময়ী কোনো উত্তর দিলেন না।

কৃষ্ণসুন্দর ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলেন। গত কয়েকদিন ধরে অনেককে অনুরোধ-উপরোধ কোনোভাবে এই ডিপো থেকে বেরিয়ে মেয়েকে বাঁচানোর জন্য। কেউ সম্মত হয়নি। থানাপুলিশ করেও লাভ নেই, নবকিশোর দত্তর মতো এজেন্টরা অর্থ দিয়ে সবাইকে কিনে রাখে। আর ইনডেনচার তো এখন বৈধ। এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বলপূর্বক কৃষ্ণসুন্দরকে দিয়ে স্বেচ্ছায় আগমনের স্বাক্ষরও ওরা করিয়ে রেখেছে। অনেক ভেবেছেন তিনি। কোন কূলকিনারা করতে পারেননি।

অবশেষে একটা উপায় বের করেছেন। তাতে সাফল্য আসুক বা না আসুক, সর্বোত্তম চেষ্টা তিনি করবেনই।

‘দ্বারকার সঙ্গে একবার যোগাযোগ করার খুব চেষ্টা করছি কৃষ্ণা! তার দয়ার প্রাণ। মেয়েদের দুর্দশা নাকি সে দেখতে পারে না। আমাদের এত বড় দুর্যোগে সে হাত বাড়াবেই। সব লিখে তোতারামকে দিয়ে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছি তাকে।’

ব্রহ্মময়ী প্রথমে বুঝতে পারলেন না। বললেন, ‘দ্বারকা? কে দ্বারকা?’

কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘আমার মায়ের সেই রাঙাদিদির কথা মনে নেই? দুঃসম্পর্কের, আমরা রাঙামাসিমা বলতুম। যার বিয়ে হয়েছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে। সেই যে, যিনি হেঁটে পুরী গিয়েছিলেন। কারুর বারণ শোনেননি।’

ব্রহ্মময়ী এবার চিনতে পারলেন, ‘হ্যাঁ । রাঙামাসিমাকে মনে আছে। ভুবনমণির বিয়েতে শেষ এসেছিলেন। ফর্সা টুকটুকে গড়ন, মুখে পানের খিলি, ঠোঁটদুটো লাল। মুখে হাসি লেগেই থাকত।’

‘সেই রাঙামাসিমার ছেলে দ্বারকা। আমাদের চেয়ে সামান্য ছোটই হবে। যেমন জেদি মা, তেমনই জেদি ছেলে। সে তো এখন এই কলকাতাতেই থাকে। তার বউ প্রথম মেয়ে যে বি এ পাশ করেছে। এখন মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ছে। আমি এত কিছু জানতুম না। আমাদের ঘরে একটা ছেলে থাকে। নাম বিনয়। একটু আধটু লেখাপড়া শিখেছিল। সে দ্বারকার রীতিমতো ভক্ত। যেখানে যে লেখা পায়, গোগ্রাসে গেলে। সে-ই বলল।’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন।

‘বামুন ঘরের বউ ডাক্তারি পড়ছে!’ সাময়িক হলেও শোকের কথা বিস্মৃত হলেন ব্রহ্মময়ী, ‘কি বলো গা!’

‘হ্যাঁ । দ্বারকার স্ত্রীর নাম কাদম্বিনী। সে বিখ্যাত মেয়ে, তার নাম প্রায়ই কাগজে বেরোয়। মেয়েদের মধ্যে প্রথম এন্ট্রান্স পাশ করেছে। বি এ পাশ করেছে। এখন ডাক্তারি পড়ছে। আমরা গাঁয়ে থাকতুম, কিছু খবর পেতুম না। দ্বারকা এই শহরে নাকি একটা মেয়েদের ইস্কুল খুলেছিল। পরে সেটা বেথুন স্কুলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। দ্বারকার স্ত্রী সেই স্কুলেই পড়ত।’ কৃষ্ণসুন্দর ফিসফিস করে বললেন, ‘ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি পাঠিয়েছি তাকে। অপার বিয়ের দিন সকালেই। সে নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পারবে। ভুবনমণি, লোপামুদ্রার জন্য তার হৃদয় নিশ্চয়ই কেঁদে উঠবে। হয়ত অপা মা’কেও…!’

বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখ ছাড়াও উনবিংশ শতকে স্ত্রীশিক্ষা কিংবা সমাজের নারীর অধিকার নিয়ে যারা প্রাণপণ লড়াই চালিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের দ্বারকানাথ অগ্রগণ্য।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে স্ত্রীশিক্ষার চিন্তাভাবনা বাংলায় শুরু হয়। যদিও বেশ কিছু বছর আগে থেকে খ্রিস্টান মিশনারিরা বিচ্ছিন্নভাবে মেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে চলেছিল, তবু একান্ত বাঙালির উদ্যোগে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ১৮৪৭ সালে স্থাপিত হল বারাসতে। পুরোভাগে ছিলেন প্যারীচরণ সরকার, নবীনকৃষ্ণ মিত্র, কালীকৃষ্ণ মিত্র প্রমুখ। এই ভয়ঙ্কর ‘পাপকর্ম’-এর জন্য অনতিবিলম্বে তাঁদের সমাজচ্যুত করা হল এবং কিছুদিন পর স্কুলটা উঠেও গেল।

এর দু’বছর পর মহাসমারোহে স্থাপন করা হল বেথুন স্কুল। সম্পূর্ণ সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত এবং সমাজের মান্যগণ্য অনেক ব্যক্তি দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত। ব্রাহ্ম সমাজেরও অনেক শীর্ষকর্তা পূর্ণসহযোগিতা করলেন সেই স্কুলকে।

কিন্তু লাভের খাতায় একবার চোখ বুলোলে সেখানে শুধুই কালো হতাশা। বেথুন স্কুল শুরু হল একুশটি বালিকাকে নিয়ে। হুগলীর জনাই গ্রামের সেই কুলীন ব্রাহ্মণ পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায়ের মতো বিরুদ্ধদলের লোকদের ক্রমাগত ইন্ধন আর অপপ্রচারে দিনকয়েকের মধ্যেই পালাল ষোলজন। বেথুন স্কুলে পড়তে পয়সা লাগে না, বইয়ের মূল্য দিতে হয় না, এমনকী স্কুলে যাতায়াতের জন্য যে পালকি, সেটিও বিনামূল্যে। কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন বটবৃক্ষের শিকড়ের মতো কুসংস্কার মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন প্রোথিত হয়ে গিয়েছে, যে শিক্ষার্থী আর পাওয়া যায় না। ফলে, প্রতিষ্ঠার উনিশ বছর পরেও সেখানে ছাত্রী মাত্র তিরিশজন।

আর তাছাড়া বেথুন স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থাও উপযুক্ত নয়। প্রধানত উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা সেখানে দুই-তিনবছর করে পড়ে, প্রাথমিক শিক্ষাটুকু কোনোমতে অর্জিত হলেই অভিভাবকরা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যান। মেয়েদের জন্য না আছে কোনো মধ্যশিক্ষার ব্যবস্থা, না কোনো উচ্চশিক্ষা।

এইরকম অবস্থায় দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস, আইনজীবী মনোমোহন ঘোষের মতো কিছু ব্রাহ্মসমাজের মুক্তমনা মানুষ মেয়েদের উচ্চশিক্ষার্থে একটি বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন।

দ্বারকানাথ ছিলেন আদতে পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর জেলার মাগুরখণ্ড গ্রামের লোক। তাঁর বংশ ছিল সুপ্রসিদ্ধ বেঘের কুলীন। বেঘের কুলীনরা মর্যাদাতে সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্যান্য কুলীনরা এঁদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত। অন্যান্য ছেলেদের মতো তিনিও ছাত্রাবস্থায় মেয়েদের হেয় করতেন, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় গড়ে ওঠা সমাজে মেয়েদের অত্যন্ত নীচদৃষ্টিতে দেখতেন।

কিন্তু দুটি ঘটনা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে সারাজীবনের জন্য পাল্টে দিয়েছিল।

এক, কালীপাড়া গ্রামের যে বিদ্যালয়ে দ্বারকানাথ পড়াশুনো করতেন, সেখানে অক্ষয়কুমার দত্তের তৎকালীন প্রেক্ষিতে একটি বৈপ্লবিক বই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হল। অক্ষয়কুমার দত্ত সেই বইতে বহুবিবাহ, বৃদ্ধ ব্যক্তির বিবাহ, বাল্যবিবাহ, স্ত্রীজাতির অশিক্ষা এইসমস্তের কুফল ও কুপ্রভাব এমন বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে তা ছাত্রসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই বই পড়ে দ্বারকানাথের মতো কিছু ছাত্র বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে একটি সভাও গঠন করেছিলেন। প্রাচীনপন্থীরা এতে অত্যন্ত রুষ্ট হলেও এমনকী ওই বিদ্যালয়গৃহ পুড়িয়ে দিতে চাইলেও দ্বারকানাথদের নিরস্ত করা যায়নি।

দুই, দ্বারকানাথের যখন সতেরো বছর বয়স, তখন স্থানীয় একটি ঘটনায় তাঁর অন্তরাত্মা আমূল কেঁপে উঠল। তাঁর পরিচিত এক কুলীন কন্যাকে বিপথগামিনী হওয়ার অপরাধে কন্যারই আত্মীয়স্বজন বিষপ্রয়োগে হত্যা করল। ঘটনার অনুসন্ধানে নেমে তিনি জানতে পারলেন, কুলীন কন্যাকে এইভাবে গোপনে হত্যা মোটেই বিরল নয়। আইনের চোখেও তাদের কোনো সাজা হয় না। আবার একবার মনে করিয়ে দিই, কুলীন কন্যাদের বিবাহ হত বিবাহবিশারদ কুলীনদের সঙ্গে। তাঁদের ‘ভিজিট’ নির্ভর করে শ্বশুরের আর্থিক সঙ্গতির ওপর। কুলীন কন্যারা যৌবনে স্বামীর সঙ্গ, ভালোবাসা কিছুই পেত না। বাল্যবিধবাদের অবস্থাও ছিল অনুরূপ। ফলে তাদের বিপথে গমন ছিল খুবই স্বাভাবিক।

এই দুটি ঘটনায় দ্বারকানাথ উপলব্ধি করলেন, একটি পাখায় ভর করে বিহঙ্গ আকাশে উড়তে পারে না। ‘নারীকে নরকের দ্বার’ করে রাখলে সমাজের উন্নতি কোনোদিনই হবে না। সেইদিন তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, আমৃত্যু নারীজাতির কল্যাণসাধনে ব্রতী হবেন। লড়বেন বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। লড়বেন মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য।

তিনি প্রকাশ করতে শুরু করলেন সম্পূর্ণ মেয়েদের জন্য সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘অবলাবান্ধব’। সম্ভবত বিশ্বে প্রথম মহিলাদের জন্য পত্রিকা।

তখন তিনি ঢাকা শহরের লোনসিং বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। অবলাবান্ধব পত্রিকা অচিরেই পদ্মা পেরিয়ে কলকাতায় এসে সাড়া ফেলে দিল। কলকাতার তরুণ শিবনাথ শাস্ত্রী, অন্নদাচরণ খাস্তগীর, দুর্গামোহন দাসরা তাঁকে ও অবলাবান্ধবকে সাদরে কলকাতায় নিয়ে এলেন। কলকাতায় এসে পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ রচনা থেকে শুরু করে প্রূফ দেখা, লেবেল লেখা, বন্টন করা সমস্ত কিছু দ্বারকানাথ একা হাতে সামলাতে শুরু করলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে অচিরেই ব্রাহ্মসমাজের একটি নারীহিতৈষী অবলাবান্ধব দল গড়ে উঠল।

ওদিকে ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রধান নেতা তখন কেশবচন্দ্র সেন। তিনি ততদিনে প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের জন্য ব্রাহ্মসমাজের অন্তঃপুরে মহিলা বিদ্যালয় খুললেও কখনোই নারী ও পুরুষের একই শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মেয়েদের শিক্ষাকে একেবারে পৃথক দৃষ্টিতে দেখতেন। চাইতেন, মেয়েদের সংসারের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু শিক্ষাদানই যথেষ্ট। তাই বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী মেয়েদের পড়াশুনোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। যৌক্তিকতা নেই অঙ্ক, জ্যামিতি, লজিক, কিংবা অন্যান্য বিষয় পড়ানোরও। ছেলেদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শিক্ষা মেয়েরা পেলে তাদের নারীসুলভ প্রকৃতি নষ্ট হবে। মেয়েরা কৃত্রিম আচরণ, বাহ্যিক বেশভূষায় বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে।

কেশবচন্দ্রের এইধরনের চিন্তাধারায় দ্বারকানাথ, মনোমোহনের মতো ব্রাহ্মসমাজের প্রগতিবাদী গোষ্ঠীর নেতারা ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকেন। অন্যদিকে মিস অ্যাকরয়েড বিলেতে কেশবচন্দ্রের নারীস্বাধীনতা ও শিক্ষা সম্পর্কিত উদাত্ত বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে মেয়েদের শিক্ষায় সাহায্যের জন্য ভারতে এলেন, কিন্তু এসে কেশবচন্দ্রের এই জাতীয় দ্বিচারিতাপূর্ণ বক্তব্যে হতবাক হয়ে গেলেন। কেশবচন্দ্রের রক্ষণশীল মানসিকতায় অচিরেই তাঁর মোহভঙ্গ হল, এবং দ্বারকানাথ, মনোমোহন ঘোষদের মুক্তচিন্তায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

মনোমোহন ঘোষ ছিলেন বিত্তশালী ব্যারিস্টার। প্রধানত তাঁরই অর্থানুকূল্যে দ্বারকানাথ বেনিয়াপুকুর লেনে স্থাপন করলেন ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’। বেথুন স্কুলের মতো প্রাথমিক শিক্ষালয় নয়, একেবারে ছেলেদের বিদ্যালয়ের ধাঁচে পুরোদস্তুর উচ্চশিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে। তৈরি করা হল উপযুক্ত পাঠ্যসূচিও।

দ্বারকানাথের অসীম জীবনীশক্তি। সেইসময় বাংলা ভাষায় অঙ্ক, ভূগোল, স্বাস্থ্যতত্ত্বের ভালো বই নেই। দ্বারকানাথ নিজেই লিখে ফেললেন বেশ কিছু বই।

স্কুলটির দায়িত্ব নিলেন মিস অ্যাকরয়েড। সমাজের নানাস্তর থেকে, নানা অঞ্চল থেকে মেয়েরা পড়তে এলেন সেখানে। এলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্র জগদীশচন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণময়ী বসু। এলেন দুর্গামোহন দাসের দুই কন্যা সরলা ও অবলা। এলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা হেমলতা।

ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষ ভাগলপুরে তাঁর মামাকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন তাঁর কন্যাকেও এই বিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানোর জন্য।

তাঁর মামা ব্রজকিশোর বসু ভাগলপুর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ও মুক্তমনা। তিনি ও তাঁর বন্ধু অভয়চরণ মল্লিক কলকাতারও বহু আগে ভাগলপুরে নারীমুক্তি আন্দোলন ও নারীশিক্ষার সূচনা করেন। ভাগ্নের পত্রে অতি উৎসাহী হয়ে তিনি তাঁর মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়।

অতএব, সুদূর ভাগলপুর থেকে এসে বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ব্রজকিশোরকন্যা কাদম্বিনী। তখন তাঁর বয়স তেরো কি চোদ্দ।

হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় বোর্ডিং স্কুল। মেয়েরা সারা সপ্তাহ বোর্ডিং-এ থাকতেন, সপ্তাহান্তে চলে যেতেন দুর্গামোহন দাসের গৃহে।

দুর্গামোহন দাসও ছিলেন পেশায় আইনজীবী, বিক্রমপুরের লোক। কলকাতায় ওকালতির সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরম্ভ করেন স্ত্রীশিক্ষা ও নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম। তিনি কোনোদিনই হিন্দু রক্ষণশীল সমাজকে পরোয়া করেননি। নিজের বাবা কাশীশ্বর দাসের মৃত্যুর পর অল্পবয়সি বিমাতাকে তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে বিবাহ দিয়েছিলেন নিজের বন্ধু বরিশালের ডাক্তার জগৎ দাশের সঙ্গে।

এই বিধবাবিবাহ সমাজে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল।

পাত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় কাশীতে, দুর্গামোহন আবার চোরের ওপর বাটপাড়ি করে বিমাতাকে ফিরিয়ে এনে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সাহায্যে বিবাহ দেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় লোকে তাঁর গায়ে থুথু ছিটিয়ে ছড়া কাটত, ‘ব্রাহ্ম সমাজের কথা কী বলিব আর/ দুর্গামোহন দিল বিয়া নিজ বিমাতার।’

দুর্গামোহন তাতে পাত্তাও দেননি। একইরকম অবিচল থেকে কয়েকজন কিশোরীকে অতিবৃদ্ধ কুলীনকে বিবাহের হাত থেকে বাঁচান ও তাঁদের তুলে দেন নিজের স্ত্রীর হাতে। এই নিয়েও তাঁকে সহ্য করতে হয় রক্ষণশীল সমাজের দিক থেকে ভয়ঙ্কর প্রতিরোধ।

ঘটনাচক্রে দুর্গামোহন দাশের স্ত্রীর নামও ব্রহ্মময়ী। তাঁর বিয়ে হয়েছিল তিন বছর বয়সে, নয় বছরের দুর্গামোহনের সঙ্গে। কিন্তু বাল্য বিবাহের শিকার হয়েও ব্যতিক্রমীভাবে প্রকৃত অর্থেই তিনি স্বামীর সহধর্মিণী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। দুর্গামোহন স্ত্রীকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন পাশ্চাত্যসমাজের মতো তাঁদের মধ্যেও স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক। বলাই বাহুল্য তাঁর সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল।

হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ের মেয়েরা সপ্তাহান্তে তাঁর বাড়িতে গিয়ে মাতৃস্নেহ পেত। খুব অল্পদিনের মধ্যেই মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষায় উৎকর্ষের পথে এগিয়ে চলেছিল।

কিন্তু বাধা এল অচিরেই। মিস অ্যাকরয়েড ঐতিহাসিক হেনরি বেভারিজকে বিয়ে করে অন্যত্র চলে যেতে নানা জটিলতায় স্কুলটি উঠে গেল।

কিন্তু দ্বারকানাথ দমে যাওয়ার ব্যক্তি নন। তিনমাসের মধ্যে তিনি ওল্ড বালিগঞ্জ রোডে স্থাপন করলেন নতুন একটি মহিলা আবাসিক বিদ্যালয়। ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’। হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ের প্রায় সমস্ত ছাত্রী এসে ভর্তি হলেন এই নতুন স্কুলে এবং কয়েক বছরের মধ্যেই এই স্কুলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। শিক্ষাবিভাগের পর্যবেক্ষক ক্রফটসাহেব পর্যন্ত ঘুরে গিয়ে রিপোর্ট দিলেন, ‘In every sense—the most advanced school in Bengal.’

সরকারি সাহায্য পেয়েও যেখানে বেথুন স্কুল এতবছরেও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর্যায়ে রয়ে গিয়েছে, সেখানে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’-এর ছাত্রীদের ‘পুরুষদের বিষয়’ অঙ্ক, জ্যামিতি, বীজগণিতে ব্যুৎপত্তি, ইংরেজি ভাষায় দখল, ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় নজরকাড়া সাফল্য রক্ষণশীল মানুষদের মূক করে দিল। ১৮৭৭ সালে বিদ্যালয় থেকে পাঁচজন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছাত্রবৃত্তি পাশ করলেন।

প্রথম হলেন কাদম্বিনী।

অতিসংক্ষেপে বিপরীত চিত্রটিও তুলে ধরা প্রয়োজন। বেথুন স্কুলের মতো শিশুকন্যারা নয়, বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে পড়তেন বড় মেয়েরা। তাঁদের এমন প্রগতিতে সমাজের রক্ষণশীল অংশে গেল গেল রব উঠে গেল। ততদিনে ঠাকুরবাড়ির সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী পার্শি রমণীদের আদলে শাড়ি পরার আধুনিক অথচ রুচিশীল পরিচ্ছদের প্রবর্তন করেছেন। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সেইভাবে শাড়ি পরতে শুরু করলে তাদের বেশভূষা, আচার-আচরণ, চরিত্র নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ, নিন্দা, কুৎসার স্রোত বইতে আরম্ভ করল।

বছরকয়েকের মধ্যে একদিকে বেথুন স্কুলের নড়বড়ে অবস্থা, অন্যদিকে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের উজ্জ্বল উন্নতিতে যখন দুটি বিদ্যালয় একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ভাবনা এল, তখনও বিরোধীরা তীব্র সমালোচনা করলেন।

তা সত্ত্বেও মনোমোহন ঘোষের চেষ্টায় সেই উদ্দেশ্য সফল হল। ১৮৭৮ সালে দুটি স্কুল এক হয়ে গেল। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এসে উঁচু ক্লাসে ভর্তি হলেন বেথুন স্কুলে। সবচেয়ে উঁচু ক্লাসে ছিলেন দুজন। কাদম্বিনী ও দুর্গামোহন দাসের জ্যেষ্ঠা কন্যা সরলা। তাঁরা এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

কিন্তু প্রস্তুতি নিলেই তো হল না, পরীক্ষা দেবেন কী করে? তখনও যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নেই, সে যতই যোগ্যতা থাকুক না কেন! এর আগের বছরেই দেরাদুনের চন্দ্রমুখী বসু সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষায় বসার অনুমতি পাননি, বরং কিছু বই উপহার দিয়ে তাঁর পরীক্ষা দেওয়ার বাসনাকে নিরস্ত করা হয়েছে।

কিন্তু দ্বারকানাথ যে অনমনীয়! তাঁর স্কুল থেকে কাদম্বিনী ও সরলাকে তিনি পরীক্ষায় বসিয়েই ছাড়বেন। তিনি ক্রমাগত এই নিয়ে আন্দোলনকারী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন।

অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আর্থার হবহাউসের সদিচ্ছায় সমাজের তীব্র বিরোধের মধ্যেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের জন্য তার দরজা খুলে দিল। তৈরি হল নতুন ইতিহাস।

কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। দুর্গামোহনের সার্থক সহধর্মিণী ব্রহ্মময়ী হঠাৎই মারা গেলেন। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের প্রতিটি মেয়েকে যিনি মায়ের ছত্রছায়ায় আগলে রেখেছিলেন, তাঁর এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় দুর্গামোহন আর তাঁর মেয়েরা খুব ভেঙে পড়ল। পাকেচক্রে এই সময়েই সরলার জন্য একটি ভালো সম্বন্ধ এল। বিলেত থেকে পাশ করে আসা চিকিৎসক ডাক্তার প্রসন্নকুমার রায়। দুর্গামোহন ওই অবস্থায় আর বেশি ভাবতে পারলেন না। এন্ট্রান্স পরীক্ষার মাত্র কিছুদিন আগে সরলার বিয়ে হয়ে গেল।

সে চলে গেল শ্বশুরালয়ে। ফলে ১৮৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বেথুন স্কুল থেকে কাদম্বিনী বসু একাই এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিলেন। মাত্র এক নম্বরের জন্য তিনি প্রথম বিভাগ পেলেন না ঠিকই, কিন্তু ছাত্র বৃত্তি পেয়ে তিনি সমস্ত সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিলেন। রচনা করলেন ইতিহাস।

সেই কাদম্বিনী তারপর একের পর এক ইতিহাস গড়েছেন। পাশ করেছেন এফ এ। বি এ। তাও আবার ‘পুরুষালি’ গণিত বিষয় নিয়ে। তাঁর জন্য বারবার নিয়ম বদলাতে বাধ্য হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর জন্য বেথুন স্কুলে নিয়োগ করতে হয়েছে উপযুক্ত শিক্ষক। সমাজে ঝড় উঠেছে। সনাতনপন্থীরা ‘গেল গেল’ করে মুখ ব্যথা করে ফেলেছেন। অশ্লীল অপবাদ দিয়ে তাঁকে টেনে নামানোর চেষ্টা হয়েছে পাঁকে। তিনি হার মানেননি।

অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডাক্তারি পড়ার। তখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের জন্য মেডিকেল কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করেনি, ফলে দুর্গামোহন দাসের কনিষ্ঠা কন্যা অবলা দাসকে এন্ট্রান্স পাশের পর বাধ্য হয়ে পড়তে চলে যেতে হয়েছে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে। কিন্তু কাদম্বিনী স্থির করলেন তিনি ডাক্তারি পড়বেন কলকাতাতেই। বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জগদ্দল পাথরটাকে ঠেলে সরিয়ে। এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অনুমতি দিতে বাধ্য হল। শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষার একটি শুকনো শব্দের গ্যাঁড়াকলে পড়ে।

তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিয়ম ছিল। ‘কেউ (Any person) বি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে বিনাবেতনে মেডিকেল কলেজে পড়তে পারবেন।’

কাদম্বিনী ও তাঁর শিক্ষক দ্বারকানাথ সওয়াল করলেন, এনি পার্সন মানে বোঝায়, লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ। যেহেতু কাদম্বিনী বি এ উত্তীর্ণা, তাঁকে এই মর্মে ডাক্তারি পড়তে দিতেই হবে।

নিয়মটির খসড়া করার সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কল্পনাও করতে পারেননি যে কোনো মহিলা কোনোদিন ডাক্তারি পড়তে আসতে পারেন। তাই ওই বিশেষ শব্দটির ওপর তাঁরা যথোপযুক্ত সাবধান হননি। সেই অসাবধানতাবশতই কাউন্সিলের সমস্ত সদস্য বিরুদ্ধে থাকা সত্ত্বেও ওই একটা শব্দের জাদুতে কাদম্বিনী পড়ার অনুমতি আদায় করে নিলেন।

ডাক্তারির ক্লাস শুরুর অনতিকাল আগে আরেক দুঃসাহসিক কাজ করলেন বাইশ বছরের কাদম্বিনী। প্রবল প্রতিরোধের মাঝেও নিজে কায়স্থ হয়ে বিবাহ করলেন নিজের শিক্ষক দ্বারকানাথকে।

সম্ভবত সেই বিবাহই বাংলায় প্রথম ‘লাভ ম্যারেজ’।

বুলবুল মিয়াঁ আলো-আঁধারিতে ঢাকা জাফরির পাশে দাঁড়িয়ে তার ছুঁচলো দাড়ি আর পাঁচপানওয়ালি টুপিসমেত মাথাটা দুলিয়ে বলল, ‘কিমাত আউর ভি বাকি হ্যায় হুজৌর!’

‘আউর কিতনা?’

‘আউর প্যাঁয়তিস হাজার রুপয়ে।’

‘আরো পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা?’ খাজাঞ্চি আসগর আলী অভ্যাসমতো খবরের কাগজে মুখ গুঁজে বসে ছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সংবাদপত্রে চোখ বুলোনো তার পুরনো শখ। শুধু এই বাতিকের জন্য সে বাংলা, ইংরেজি পড়তে শিখেছে।

সে মুখ তুলে খেঁকিয়ে উঠল, ‘শরাব পিকে আয়া হ্যায় ক্যা তু? এই তো পিছলি হফতায় পঞ্চাশ হাজার টাকা গুনে গুনে নিয়ে গেলি।’

বুলবুল মিয়াঁ অধোবদন হয়ে তিনবার আদাব ঠুকে বলল, ‘হম ক্যায়া জানে সরকার। দত্তজি নে আউর প্যাঁয়তিস হাজার রূপায়েকি খোয়ায়েশ যাতায়ে যো নবাবকে পাস উয়ো বাকি পড়ে হ্যায়।’

‘তুই আর তোর ওই দত্তজিকে এবার হিড়হিড় করে টেনে আদালতে নিয়ে যাব বুরবক! আংরেজদের ডান্ডার পিটানি খেলে মালুম পড়বে। এক জোড়া ময়ূর বেচে পঞ্চাশ হাজার পেলি, তাও ভুখ মিটছে না। আরে শালে শুয়ার কি আউলাদ!’

নবাব একটু দূরে তাঁর সিংহাসনে বসেছিলেন। পাশে ওস্তাদ জাফর মহম্মদ একটা খেয়াল ধরেছিল। তাকে সারেঙ্গি ও তবলাতে যোগ্য সঙ্গত করছিল পারিষদরা।

অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ এখন ষাটোর্ধ্ব। নিজের মুলুক ছেড়ে এই বঙ্গভূমিতে এসেছেন প্রায় দুই দশক অতিক্রান্ত হতে চলল। এই দীর্ঘসময়ে দেশে রাজনৈতিক পালাবদল যেমন ঘটেছে, ইংরেজদের পায়ের মাটি ক্রমশই আরো মজবুত হয়েছে। কিন্তু নবাব সেদিকে দৃকপাতও করেন না। যেদিন প্রাণাধিক প্রিয় লক্ষ্নৌ ছেড়ে সুবিচারের আশায় কলকাতায় এসেছিলেন, সেদিন মনে ছিল অনেক আশা, হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করার স্বপ্ন। যত দিন গিয়েছে, সেই স্বপ্ন ফিকে হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে ধূসর আকাশে। আর ততই বেশি করে তিনি নিজেকে গানবাজনায় ডুবিয়ে দিয়েছেন।

নবাব চোখ বুজে গভীর মনোযোগের সঙ্গে জাফর মহম্মদের খেয়াল শুনছিলেন। লয় ও তালের সঙ্গে তাঁর বহুমূল্য অঙ্গুরীয়শোভিত আঙুলগুলো তিরতির করে ওঠানামা করছিল।

কিন্তু একটু দূরেই আসগর আলী আর বুলবুল মিয়াঁর উচ্চকিত কথোপথনে তাঁর বারবার তাল কেটে যাচ্ছিল। একসময় বেশ বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘আহ আসগর! ইতনা শোর কিউ?’

আসগর আলী এদিকে ফিরে বলল, ‘গুস্তাকি মাফ কিজিয়ে জাহাঁপনা, লেকিন ইয়ে লোগ হামে বুদ্ধু বনা রহে হ্যায়। পিছলে হফতে মে পাঁচাশ হাজার লেকে এক জোড়ি মৌর দে গয়ে। আব ফিরসে বোল রহা হে কি প্যাঁয়তিস হাজার বাকি হ্যায়। হাম আপকো বোল র‌্যাহে হ্যায় হুজৌর, উয়োহ নবকিশোর দত্ত বহত হি ঝুটা ইনসান হ্যায়।’

নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ সঙ্গীতশ্রবণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্রমশ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলেন। এবার প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ঝুটা উয়ো নেহি, তুম! তোমাকে তো তিন-চারদিন আগেই বললাম, আমি এক জোড়া গিধ লিয়েছি। আজ বুলবুল মিয়াঁ তার কিমাত লিতে এসেছে, সাহি কিয়া হ্যায়। উসকো কিমাত মিটা দো। ইতনি ছোটি সি বাতোমে ইতনা হল্লা মচা রহে হো? গানা শুননে মে দিক্কত হো রহা হ্যায়, শরম আনা চাহিয়ে তুমহে!’

এক জোড়া গিধ! মানে শকুন?

খাজাঞ্চি আসগর আলী কয়েকমুহূর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সম্বিৎ ফিরতেই নবাবের পুনরায় সঙ্গীতে মনোনিবেশের আগেই তড়বড় করে বলল, ‘লেকিন হুজৌর! তহবিল তো খালি। ইস মাহিনেকা পেনশন ভি খতম। অবি ভি হফতাভর বাকি হ্যায় মহিনা খতম হোনে মে।’

‘আহ! উয়ো জয়গা সাহি লাগছে না জাফর। মোহে তড়পত বিতি ঘড়ি পল ছিন ছিন। এই বিতি ঘড়ি’র খানটা ঠিক লাগছে না তোমার।’ ওয়াজেদ আলী শাহ সুর করে ভুলটা ধরিয়ে দিতে দিতে আসগর আলীর বক্তব্যে থেমে গেলেন। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘পেনশন খতম হো গয়ে?’

‘জি হুজৌর!’ আসগর খাজাঞ্চি বলল।

‘হুম।’ ওয়াজেদ আলী সামান্য কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘এক কাম করো। সুলতানখানার দোতলায় পূব দিকের ঘরে দেখবে দো সোনে কা পালংক হ্যায়। উসমে সে এক বেচ দো। প্যাঁয়তিস হাজার আ হি যায়গা! ঠিক হ্যায়? আব যাও। তং মাত করো।’

সুলতানখানার প্রাসাদের দ্বিতলে যে দুটি সোনার পালঙ্ক রয়েছে, সেই দুটিই নবাবের পূর্বপুরুষ অযোধ্যার নবাব সাদত আলীর। তার মধ্যে একটাকে বিক্রি করে সেই টাকায় কিনা কেনা হবে দুটো শকুন?

নবাবের পাগলামির সঙ্গে অষ্টপ্রহর পরিচয় থাকলেও এত বড় অপচয় খাজাঞ্চি আসগর আলী হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিল না। চোখ বড় বড় করে সে প্রথমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নবাবের দিকে, তারপর বৃথা পরিশ্রম বুঝে সহমর্মিতার আশায় তাকাল পাশে বসে থাকা ওস্তাদ ও তার পারিষদদের দিকে।

কিন্তু তার দিকে কারুর দৃষ্টি নেই।

জাফর মহম্মদ আবার নতুন করে সুর ধরেছে,

‘পিয়াবিন গুজর গেয়ি রয়েন মোহেকা

আজ হো নেহি আয়ে পীতম মোরী

মোহে তড়পত বিতি ঘড়ি পল ছিন ছিন…।’

‘আহ!’ বিরক্ত নবাব হাত তুলে থামিয়ে দিলেন, ‘ফিরসে! দোবারা উয়োহি গলতি! এত সুন্দর একটা গান লিখলাম, আমার মহল্লায় একজন কেউ সমঝদার, একজন কেউ গানাওয়ালা নেই যে ঠিক করে গাইতে পারে? কিতনা আফসোস কি বাত হ্যায় ইয়ে!’

জাফর মহম্মদ অপরাধীর ভঙ্গিতে বসে রইল। বাকি সবাই চুপ।

‘হায় আল্লাহ!’ নবাব মাথায় বার দুই তিন মৃদু করাঘাত করলেন, ‘কিউ আখতার পিয়া ইতনা কোশিস কর রহা হ্যায়, জব কোই ইসকো ইয়াদ হি রাখনা নেহি চাহতে?’

বেশ খানিকটা দূরে আরো কিছু নগণ্য গায়কদের ভিড়ে বসে এতক্ষণ গোটা ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করছিল চন্দ্রনাথ। সোনার খাট বেচে শকুন কেনার সহজ আদেশে সেও বাকরুদ্ধ। নবাবের ব্যয়বহুলতার কথা সে এই কয়েকদিনে বিভিন্ন লোকের মুখে শুনলেও চাক্ষুষ করা এই প্রথম।

সপ্তাহখানেক হল সে চুপচাপ নবাবের সঙ্গীতসভায় এসে বসে থাকে। কাফি খাঁ তার চিঠি পড়ে তাকে এই সভায় বসার সুযোগ করে দিতে পেরেছে বটে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত সে কিছুই করতে পারেনি। ভিড়ের মধ্যে রোজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে বসে শুধু প্রত্যক্ষ করেছে নবাবের ক্রিয়াকলাপ।

এই কয়েকদিনে সে কাফি খাঁর কাছে জেনেছে অনেক কিছু। জেনেছে অযোধ্যায় তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়েছে ইংরেজরা। ক্ষতিপূরণবাবদ এখন ইংরেজ সরকারের থেকে নবাব মাসে এক লক্ষ টাকা মাসোহারা পান। জেনেছে সেই ‘পেনশন’-এর টাকাতেই চলে নানা মোচ্ছব।

জেনেছে নবাব বই লিখেছেন পঞ্চাশেরও বেশি। জেনেছে ‘আখতার পিয়া’ ছদ্মনামে তিনি একের পর এক গান লেখেন। তারপর সেই গান শেখান নিজের গায়কদের। এরপর নিজের সৃষ্টি বারেবারে তিনি শুনতে চান। তাতেই তাঁর তৃপ্তি।

যে গানটি জাফর মহম্মদ ঠিক করে গাইতে পারছে না, সেটা নবাব শিখিয়েছেন দু’দিন আগে। চন্দ্রনাথ সেদিনও এখানেই বসে ছিল।

কেউ কোনো সাড়াশব্দ করছে না দেখে সে ভয়ে ভয়ে হাত তুলল। তার স্মৃতিশক্তি প্রখর, একবার শুনলেই তা মনে থেকে যায় বহুদিন।

তিতিবিরক্ত নবাবের এবার দৃষ্টি পড়ে তার দিকে। তিরিক্ষি গলায় বলেন, ‘ক্যা? ক্যা চাহতি হো তুম?’

চন্দ্রনাথ আড়ষ্টভাবে বলে, ‘ওই গানটা গাইব?’

নবাব সামান্যক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বাংলাতেই বলে ওঠেন, ‘গাইবে? বেশ। গাও।’

চন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ায়। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বসে জাফর মহম্মদের ঠিক পাশটায়।

তারপর চোখ বুজে গাইতে শুরু করে,

‘পিয়াবিন গুজর গেয়ি রয়েন মোহেকা

আজ হো নেহি আয়ে পীতম মোরী

মোহে তড়পত বিতি ঘড়ি পল ছিন ছিন

উনকো বিয়ান তন মনমে রম বহো

বিছরত নাহি

মোরী হতচিত শোন

তদলগি সুন্দর পিয়ারে মোরী

মোহসে তদহুই মেরি জিয়াক চৈন।’

‘বহত খুউব!’ নবাব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন, ‘শাবাশ বেটা শাবাশ। যো ইতনি বড়ি বড়ি উস্তাদ নেহি কর পায়া, উয়োহ তুনে করকে দিখায়া। বাহা বাহা। ক্যা নাম ক্যা হ্যায় তেরা?’

লজ্জায় চন্দ্রনাথের কান লাল হয়ে উঠল। সে অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জাফর মহম্মদ গম্ভীরমুখে অন্যদিকে মুখ ফেরায়।

নবাব আবার বলেন, ‘কিরে বেটা? বললি না? কী নাম তোর?’

‘আজ্ঞে চন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। হুজুর!’

‘ভটচায?’ নবাব ভ্রু কুঁচকোন, ‘ইয়ে পণ্ডিতকা অউলদি বেটা কবসে আ গয়া মেরে মহল্লেমে?’

ব্রাহ্মণ যে মেটিয়াবুরুজে একেবারেই বিরল তা নয়, এখানে পৃথক হিন্দুপল্লী রয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ গায়ক সম্ভবত নেই। থাকলেও তাঁদের প্রত্যেককে নবাব চেনেন।

কিছুদূরে বসে মেহগনি কাঠের দরজা মুছছিল কাফি খাঁ। সে এখন বৃদ্ধ হয়েছে। নবাব যখন অযোধ্যার নবাব ছিলেন, তখন থেকে সে রাজকর্মচারী। তারপর মসনদ পাল্টেছে, যমুনা নদী থেকে জল এসে মিশেছে গঙ্গায়। নবাব রাজ্য হারিয়েছেন, নবাবের মা আউলিয়া বেগম পুত্রের প্রতি ইংরেজদের এই অন্যায় অবিচারের বিচার চাইতে ছুটেছেন খোদ বিলেতে। রানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন পুত্রহারা মায়ের আকুতি। লাভ কিছুই হয়নি। বেগম সাহেবার প্যারিসে ইন্তেকাল হয়েছে। সিপাহি বিদ্রোহে নবাব ফোর্ট উইলিয়ামে বন্দী হয়েছেন, মিউটিনি মিটলে নিজের রাজ্য ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে ইংরেজ সরকারের পেনশনে নবাব জাঁকিয়ে বসেছেন মেটিয়াবুরুজে। বিলাসব্যসনে ডুবিয়ে দিয়েছেন নিজেকে, সেই লক্ষ্নৌয়ের দিনগুলোর মতোই।

এই সব কিছুতেই চোখে না পড়া কচি ঘাসের মতো এদিক-সেদিক ছড়িয়ে থেকেছে কাফি খাঁ-এর মতো লোকেরা। যারা যখন যেভাবে প্রয়োজন, পরিবেশের সঙ্গে, নবাবের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে অভিযোজিত করে নিয়েছে নিজেদের।

প্রত্যক্ষ করেছে নানা ঘটনা। ঘাত। প্রতিঘাত।

গত কয়েকদিনে কাফি খাঁ বলবে বলবে করে নবাবের কানে চন্দ্রনাথের কথাটা তুলতে পারেনি, উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে। নিজের বাড়িতেই পৃথক কক্ষে সে রেখেছে চন্দ্রনাথকে। চন্দ্রনাথ নিজেই ঘরের এককোণে দুটো ফুটিয়ে খেয়ে নেয়।

আজ অনুকূল আবহাওয়া পেয়ে কাফি খাঁ এগিয়ে এসে সেলাম ঠোকে, ‘গুস্তাকী মাফ হো খোদাবন্দ। আপনাকে বলতে পারিনি, ইয়ে লেড়কা গাঁও সে আয়া হ্যায়। উয়ো যো বাঙ্গালি উস্তাদ থা, হরেন ভট্ট, উনকা অউলাদ! হরেনজি গুজার গয়ে। ইয়ে ভি শানদার গানা গাতা হ্যায় হুজৌর!’

‘হরেনজির ছেলে!’ নবাবের অভিব্যক্তি মুহূর্তে বদলে যায়। ভালো করে তিনি চন্দ্রনাথকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন, ‘উসকা বেটা ভি থা ক্যা!’

‘জি জাহাঁপনা!’ কাফি খাঁ মুখ নামায়।

‘উয়ো তো মেরা বহত পুরানা দোস্ত থা। হায় আল্লাহ, উয়ো অউর নেহি হ্যায়?’ নবাব নিজের মনেই স্বগতোক্তি করেন। চন্দ্রনাথের দিকে ফিরে বলেন, ‘তুই কী কী বাজাতে পারিস বেটা?’

‘আজ্ঞে, মৃদঙ্গ পারি। সেতারও পারি।’ মৃদুস্বরে উত্তর দেয় চন্দ্রনাথ।

‘হাঁ পারতে তো হবেই। তেরা বাপ যো শানদার কলাকার থা, বাপকা বেটা তো হোনাই পড়েগা।’ নবাব শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ছিলেন, ‘বহত আচ্ছা। এই আসগর, ইয়ে মেরা লাড়কা জ্যায়সা। ইসকো হিন্দু মহল্লামে এক আচ্ছাসা কোঠি দে দো। হিন্দু নকর ভি। উয়ো শান্তিসে সিরফ গানা রেওয়াজ করেগা। কোই তকলিফ নেহি হোনা চাহিয়ে। ঠিক হ্যায়?’

খাজাঞ্চি আসগর আলী করুণ চোখে তার হিসাবের খাতার দিকে তাকায়।

তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে যায়।

দুঃখ ভুলতে চোখ রাখে খবরের কাগজের পাতায়।

কৃষ্ণসুন্দর ফিসফিস করে বললেন, ‘চিঠিটা কি ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে তোতারাম?’

তোতারাম উবু হয়ে বসে নিজের এক পায়ে চুন হলুদ লাগাচ্ছিল। সকাল থেকে সে তিরিশ বালতি জল তুলেছে কুয়ো থেকে। এক মুহূর্ত বিশ্রাম পাওয়া যায়নি, খোদ প্রধান প্রহরী রামবিলাস সমানে দাঁড়িয়ে ছিল একপাশে। হাতে ধারালো বর্শা নিয়ে। একবার থামলেই বর্শার ভোঁতা দিকটার খোঁচা খেতে হচ্ছিল। সেইসময়েই অসতর্কতায় পায়ের একটা অংশ কেটে গিয়েছে, এখন সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।

কৃষ্ণসুন্দরের প্রশ্নে সে বলল, ‘আমি তো দুখীলালরে দিয়াইছি পণ্ডিতমশাই। হেরপর তো আর কিছু জানি না!’

তোতারামও বন্দী, সে এসেছে পূর্ববঙ্গ থেকে। কিন্তু এই কয়েকদিনে সে রামবিলাসের প্রহরীদলের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তার কারণ আর কিছুই নয়, তোতারামের অনির্বচনীয় সিদ্ধি বানানোর প্রতিভা। ফি-রাতে যখন দারোয়ানের দল মৌজ করে বসে গোলঘরের সামনের রোয়াকে, খুশ মেজাজে তারা ডেকে পাঠায় তোতারামকে। তোতারাম সিদ্ধি বানায় পরিমিত বিশেষ সমস্ত অনুপাত দিয়ে। তাতেই সিদ্ধির স্বাদ কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

তারপর বেশ কয়েকদণ্ড সে পদসেবা করে দারোয়ানদের। খুশি হয়ে দারোয়ানরা ‘বহত খুব!’ বলে তার পিঠ চাপড়ে দেয়।

প্রহরীদের সঙ্গে প্রত্যহ এতটা ঘনিষ্ঠতার জন্যই কয়েকজন দারোয়ান তোতারামকে বেশ নেকনজরে দেখে। অপালার বিবাহের দিন তাদেরই একজনের আনুকূল্যে তোতারাম কৃষ্ণসুন্দরের লেখা চিঠি পাঠিয়েছিল দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঠিকানায়। অত্যন্ত গোপনে। তা সে প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল। কোনো সংবাদই নেই আর।

দ্বারকানাথ কি শহরে নেই? নাকি থেকেও ব্যস্ততার জন্য চিঠিটি পড়ার সময় পাননি? নাকি পড়েও নিজের দুঃসম্পর্কের ভ্রাতাটির এই বিপদে নিজেকে না জড়ানোটাই নিরাপদ মনে করেছেন? তাঁর কর্মকাণ্ড শুধুই কি ব্রাহ্ম মহিলাদের জন্য?

‘আর তো মাত্র একদিন বাকি তোতারাম! উত্তর কি আসবে না?’ কৃষ্ণসুন্দর চকিতে চারপাশ দেখে নিলেন।

না, কাছেপিঠে কেউ নেই। সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোলঘরের সম্মুখে।

আজ আর গোলঘরে নবকিশোর দত্ত নেই। পরিবর্তে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে নাকের ওপর চশমা এঁটে গায়ে দোলাই চাপিয়ে বসে রয়েছে বদুডাক্তার।

বদুডাক্তারের আসল নাম কী, সে কোথাকার ডাক্তার তা কেউ জানে না। শুধু ডিপোর সদর দরজায় তার ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়ালেই সবাই বুঝে যায়, ঘাট থেকে পরবর্তী জাহাজ ছাড়ার দিন আসন্ন। সে এসে গদিতে বসলেই সার বেঁধে কুড়িপঁচিশজনকে নিয়ে যাওয়া হয় গোলঘরের সামনে। এক এক করে ঢোকে, একবার পুরুষ, একবার মহিলা। মহিলাদের পরীক্ষার জন্য কোনো ধাত্রী থাকার নিয়ম, কিন্তু বাস্তবে সেসবের বালাই নেই।

বদুডাক্তারও সেসবের তোয়াক্কা করে না। সে নিরাসক্ত প্রকৃতির মানুষ, বান্দাপিছু তাকে কড়কড়ে টাকা গুণে দেয় নবকিশোর দত্ত। একবার করে নিয়মমাফিক চোখ বুলিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া, এই হল তার কাজ। ইনডেনচারড শ্রমিকদের ভিনদেশে কাজ করতে পাঠানোর জন্য লাগে সেই প্রমাণপত্র।

তবে আজ উপবীতধারী সুঠামদেহী কৃষ্ণসুন্দরকে দেখে সে কিছুক্ষণ থমকে ছিল। তারপর বলেছিল, ‘বামুন ঠাকুর? আপনি এখানে এলেন কেমন করে?’

কৃষ্ণসুন্দর দায়সারা উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। ডিপোয় আসার পর থেকে এমন অনেকেরই অকৃত্রিম কৌতূহলের নিরসন করতে হয়েছে তাঁকে। প্রথম প্রথম বিস্তারিত উত্তর দিতেন, এখন আর চর্বিতচর্বণের প্রবৃত্তি হয় না। বিশেষত ফলাফল যখন নিষ্ফল।

কৃষ্ণসুন্দরদের দলের জাহাজে উঠতে বাকি আর মাত্র একদিন। দলের মধ্যে চলছে চাপা ফিসফাস, গুঞ্জন। ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে পোশাক। পোশাক বলতে ব্রিটিশ সেনাদের পরিত্যক্ত লাল ইউনিফর্ম। পুরোনো জুতো। গরম জামা। মহিলাদের জন্য শাড়ি। পশমি জ্যাকেট। পশমি পেটিকোট। জাহাজ ভারত মহাসাগর পেরিয়ে আটলান্টিক ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে পাড়ি দেবে। সুতরাং সেই প্রচণ্ড শীতের সঙ্গে যুঝতে তো হবে।

কৃষ্ণসুন্দরদের দলে মোট নেওয়া হয়েছে পঞ্চাশজনকে। তাদের মধ্যে মহিলা জনাদশেক। শুধু নবকিশোর দত্তর ডিপো থেকে এরা উঠবে জাহাজে। এছাড়া শহরের আরো বেশ কিছু ডিপোমালিকের দলও যাবে।

তোতারাম উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘দ্যাখতাছি আরেকবার দুখীলালের লগে কথা কয়ে। আপনে ভাইবেন না পণ্ডিতমশাই! একটা না একটা ব্যবস্থা হইবই। তোতারাম আপনের লাইগ্যা জান দিয়া দিব।’

কৃষ্ণসুন্দর আর কিছু বললেন না। তাঁর মন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত। নিজের গ্রামে অপমানিত হওয়া, লাঞ্ছিত হওয়া, একঘরে হয়ে বসবাস করার মধ্যে সুখ না থাকলেও একটা নিশ্চয়তা আছে। আছে পিটুলি গোলার মতো সান্ত্বনামিশ্রিত শান্তি। কিন্তু নিজের স্বদেশ থেকে সমস্ত শিকড় উচ্ছেদ করে ভিনদেশে অজানা ভবিষ্যতের জন্য পাড়ি দেওয়ার মধ্যে যে বিষণ্ণতা, যে আতঙ্ক, যে রক্তাক্ত আঘাত, তার সঙ্গে কিছুরই তুলনা চলে না।

আজ তাই গোটা ডিপোয় থমথম করছে শ্মশানসম বিষণ্ণতা।

তোতারাম বলল, ‘আইচ্ছা পণ্ডিতমশাই, আমাগো ভাইগ্যে কোন দ্যাশ পড়ছে আপনে জানেন?’

কৃষ্ণসুন্দর আজ সকাল পর্যন্তও এই প্রশ্নের উত্তর জানতেন না। গত কয়েকদিনে ইতস্তত শুনেছেন নানা দেশের কথা। নবকিশোর দত্ত প্রধানত পাঁচটা দেশের খামারমালিকদের সঙ্গে ব্যবসা করে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী এখান থেকে লোক পাঠায়। কৃষ্ণসুন্দর গ্রামের সামান্য ব্রাহ্মণ। বেদ-বেদান্ত, স্মৃতি এসবই পড়েছেন আশৈশব। ইতিহাস ভূগোল পড়লেও সেগুলোয় জ্ঞানের পরিধি অতি সাধারণ।

জন্মাবধি হুগলি জেলার চৌহদ্দি মাড়ানোর সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনটাই তাঁর হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই ওইসব দেশের নাম তিনি জীবনেও শোনেননি। তবু বারবার শুনে কিছু নাম তাঁর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। জামাইকা। মরিশাস। ফিজি। গায়েনা। এইসব দেশে নাকি গিজগিজ করছে বিশাল বিশাল আখের ক্ষেত। সেখানেই প্রয়োজন অগণিত শ্রমিকের।

কিন্তু আজ সকালে বদুডাক্তারের মুখে যে নামটা শুনেছিলেন, সেটার নাম এর আগে শোনেননি।

ডাক্তার জাতে কায়স্থ, ধর্মভীরু লোক। ‘নীচুজাত’-এর লোকেদের মাঝে উপবীতধারী কুলীন ব্রাহ্মণকে দেখে নিজের অজান্তেই তার কণ্ঠস্বর পাল্টে গিয়েছিল। সে বলেছিল, ‘আপনাকে এখানে কে নিয়ে এল ঠাকুরমশাই? আপনি সুরিনামে গিয়ে কী করবেন? সেখানে তো শুধু ছোটলোকদের কাজ! তাও আবার আখের কলে।’

তখনই কৃষ্ণসুন্দর বুঝেছিলেন, তাঁদের গন্তব্য ‘সুরিনাম’ নামক সেই অজানা পৃথিবী।

মাঝে মাঝে হরিহর নামক সেই আড়কাঠিটির কথা তাঁর খুব মনে পড়ে। ভাবেন, একজন মানুষ শুধুমাত্র অর্থের লোভে কতটা নির্জলা মিথ্যা বলতে পারে। বিকিয়ে দিতে পারে নিজের বিবেক, নিজের মনুষ্যত্ব। এখানে এসে বুঝেছেন, হরিহরের মতো মানুষ বিরল নয় মোটেই। ব্রহ্মময়ীর মুখে শুনেছেন, ওদিকের ঘরে শতকরা তিরিশ জন মেয়েকে আড়কাঠির হাতে বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছে তাদের প্রেমিক। তার মধ্যে বাল্যবিধবাদের সংখ্যাই বেশি। হতভাগিনীরা কোন শৈশব থেকে স্বামীসঙ্গ-বঞ্চিত, সংসারের এককোণে পড়ে থাকা আবর্জনা, যৌবনের অমোঘ টানে একটু প্রেমের কথা, একটু ভালোবাসা পেলেই তারা গলে যায়। কপালে জুটুক ‘কুলটা’, ‘ভ্রষ্টা’ তকমা, ভালোবাসা তো পাবে!

সেই মোহে তারা রাতবিরেতে পালায় প্রেমিকপ্রবরের হাত ধরে। অবধারিতভাবে তাদের অধিকাংশের মোহভঙ্গ হয়। প্রেমিকের শারীরিক ক্ষুধা মিটলেই স্থান হয় বিভিন্ন পতিতাপল্লীতে। মোটা টাকার বিনিময়ে।

আর যে প্রেমিকরা অতিরিক্ত দুঃসাহসী, তারা এসে বেচে দেয় এই আড়কাঠিদের কাছে।

তোতারাম কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে বলল, ‘হরে কৃষ্ণ! এইডা কোন দ্যাশ পণ্ডিতমশাই? জীবনে পয়লাবার নাম শুনলুম।’

‘তুমি যে আঁধারে, আমিও সেই আঁধারেই তোতারাম।’ কৃষ্ণসুন্দর পা বাড়ান ঘরের দিকে। শ্যাওলাভরা পিচ্ছিল উঠোন দিয়ে।

সেখানে একপাশে রাস্তার কুকুর শুয়ে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। অন্যদিকে পিঁপড়ের সারি উঠছে নোনা ধরা দেওয়াল বেয়ে।

এদিক-ওদিক ইতস্তত বসে আছে নানা গ্রাম থেকে আসা মানুষেরা। গ্রামবাংলা থেকে তো আছেই, আছে সুদূর উত্তরপ্রদেশ, আদিবাসী অধ্যুষিত পালামৌ এমনকী বিন্ধ্যাচল থেকে আসা লোকও। কেউ এসেছে টানা সাতদিন হেঁটে, কেউ এসেছে দশদিন হেঁটে।

এসেছে বুকভরা আশা নিয়ে, পেটভরা ভাত, রুটির স্বপ্ন দেখতে দেখতে। তারা বাংলা বোঝে না। জড়ানো টানের হিন্দিতে সবাইকে জিজ্ঞাসা করে বেড়ায়, কোথায় সেই কারখানা যার জন্য তারা এতদূর হেঁটে এল? কোথায় মিলবে সামান্য কাজ করেই অনেক অনেক টাকা আর ভালোমন্দ খাবার?

সব কিছু শুনে জেনে তাদের মোহভঙ্গ হয়। তখন হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে কেউ কেউ।

একটা খ্যাপাটে লোক আছে, তার নাম জিতু। সবাই তাকে জিতুপাগলা বলে ডাকে। তার মুখ গোঁফদাড়িতে ভর্তি। অপরিষ্কার দাড়ি নেমেছে বুক পর্যন্ত। তাতে ভনভন করে পোকা। জিতু পাগলা স্নান করে না। অনেকসময় বসে বসেই পুরীষ ত্যাগ করে। তার কাছে গেলেই গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। অশ্রাব্য গালাগালিতে কান পাতা দায় হয়ে ওঠে। কেউ তার ধারেকাছে ঘেঁষে না তখন।

জিতুপাগলা থেকে থেকেই বিলাপ জুড়ে দেয়, ‘মুই ঘরটো যাব। মুই হেথা থাকবুনি। হুই আবাগির ব্যাটা অক্ত উঠে মরুক!’

তার সেই বিকট বিলাপে বুকের ভেতরটা সবারই শিহরিত হয়ে ওঠে।

নিতান্তই কলিযুগ। তাই ‘আবাগির ব্যাটা’ আড়কাঠির মুখ দিয়ে ‘অক্ত’ ওঠে না, সে দিব্যি মুখের থুতু দিয়ে টাকা গুনতে গুনতে সরে পড়ে পরবর্তী শিকারের ‘অক্ত’ চোষার উদ্দেশ্যে।

কৃষ্ণসুন্দর অন্যমনস্কভাবে ঘরে ঢুকে নিজের বিছানার দিকে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ছুটতে ছুটতে এল দিব্যসুন্দর। সকালবেলা বদুডাক্তারের কাছে পরীক্ষার পর থেকে সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এখন একেবারে ডিপোর সদর থেকে ছুটে এসেছে। হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, ‘বাবা! শীগগিরই চলো। লোপাদিদিকে নিয়ে যাচ্চে। অনেকগুলো লোক এসেচে।’

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’ বিস্মিত কৃষ্ণসুন্দর ছেলের পেছন পেছন দ্রুতগতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। লোপামুদ্রাকে আবার কে কোথায় নিয়ে যাবে?

ঘরের সামনের দালান পেরিয়ে মস্ত উঠোন, তার ওপাশে নবকিশোর দত্তর গোলঘর। সেখানে বদুডাক্তারের আজকের মতো কাজ শেষ হয়েছে। সে বিদায় নিয়েছে। তাই গোলঘরের সামনে আর কোনো ভিড় নেই। কিন্তু একটা হুলুস্থুল শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সেটা আসছে গোলঘরের পাশের সরু কাঁচা রাস্তার ওদিক থেকে।

কাঁচা রাস্তার দুপাশে বাগান। সেখানে হরেক রকম তরিতরকারির চাষ। বন্দিরাই দেখভাল করে। সেই বাগান পেরোলে তবে ডিপোর মূল প্রবেশদ্বার। গোলমালটা আসছে সেখান থেকেই। একটি বালিকার কচিস্বরের আর্তনাদ ভেসে আসছে প্রধানত।

কৃষ্ণসুন্দর রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গিয়ে দেখলেন, যে শিবিকায় চাপিয়ে দিনকয়েক আগে অপালাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শ্বশুরগৃহে, সেই শিবিকাই উপস্থিত হয়েছে আবার।

কিন্তু সেদিনের মতো তার সারা দেহ ফুলে মোড়া নেই, নেই চারপাশের সেই নহবতের দলও। পালকিটা কেমন রক্তশূন্য ওলাওঠার রুগির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রবেশপথের ঠিক বাইরে। পালকির দরজাটা খোলা। ভেতরে বসে রয়েছে এক বয়স্কা পরিচারিকাস্থানীয় মহিলা।

লোপামুদ্রাকে সেই পালকিতে ওঠানোর চেষ্টা করছে দু’জন শক্ত চেহারার প্রহরী। লোপা কিছুতেই মা’কে ছেড়ে পালকিতে উঠবে না, তারই কাতর আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ডিপোয়। মহিলাকক্ষের বেশ কিছু মহিলা উপস্থিত হয়েছে সেখানে। রয়েছেন ব্রহ্মময়ী আর ভুবনমণিও।

ব্রহ্মময়ী আর স্থির থাকতে পারছেন না। তাঁর অবগুণ্ঠন খসে গিয়েছে, কপালের সিঁদুর এলোমেলো, বুকফাটা কান্নায় তিনি ভেঙে পড়েছেন। সমস্ত সঙ্কোচ ত্যাগ করে তিনি পা জড়িয়ে ধরেছেন এক প্রহরীর। কিন্তু সেই নির্দয় প্রহরী সম্পূর্ণ উদাসীন। এক কন্যার বিচ্ছেদবেদনা সামলাতে না সামলাতেই আরেক কন্যার এই অবস্থায় ব্রহ্মময়ী ক্রমশ বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে পড়ছেন।

ভুবনমণি সামলাচ্ছে বউদিদিকে, সঙ্গে বারবার বলছে, ‘ওগো, ওকে তোমরা কোতায় নিয়ে চল্লে? ওইটুকু মেয়ে মা’কে ছেড়ে থাকবে ক্যামন করে?’

কৃষ্ণসুন্দরের মুখে রক্ত এসে জমা হচ্ছিল দ্রুত। তিনি সামনে গিয়ে চিৎকার করলেন, ‘কী ব্যাপার? কী করছ তোমরা? ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

প্রহরীদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল ডিপোর গোমস্তা মধুসূদন। সে কৃষ্ণসুন্দরকে অন্যান্য বন্দির চেয়ে পৃথক নজরে দেখে। পরিস্থিতি শান্ত করার উদ্দেশ্যে সে দ্রুত বলে উঠল, ‘ঠাকুরমশাই, আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলচি।’

‘কী বুঝিয়ে বলবে মধুসূদন?’ কৃষ্ণসুন্দর নিজেকে কিছুতেই আর স্থির রাখতে পারেন না। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে গর্জে ওঠেন, ‘কী শুরু করেছ তোমরা? ক’দিন আগে আমার বড়মেয়েটাকে নিয়ে গেলে, এখন আবার ছোটমেয়ে। ইংরেজ শাসনে দেশে কি আইনকানুন নেই? একে তো বেআইনি ভাবে এতোগুলো লোককে সাগরপার করছ, তারপর একের পর এক মেয়েপাচার?’

গোমস্তা মধুসূদন ধুরন্ধর লোক। সে এমনিতে কৃষ্ণসুন্দরকে সম্মান দেখালেও এইরকম কথায় তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। কৃষ্ণসুন্দরের পিছু পিছু ছুটে এসেছে আরো কিছু বন্দী। তারা একেবারেই অশিক্ষিত, প্রতারিত হয়েছে বুঝেও প্রতিবাদের সাহস তারা সঞ্চয় করতে পারে না। কিন্তু কৃষ্ণসুন্দর শিক্ষিত মানুষ, তাঁর উচ্চকিত বিদ্রোহে অশিক্ষিতদের সাহস জাগ্রত হয়ে উঠতে পারে। অঙ্কুরেই এইসব বিনষ্ট না করতে পারলে মুশকিল। এইজন্য ব্যক্তিগতভাবে সে শিক্ষিত মানুষদের ভুলভাল বুঝিয়ে ডিপোয় নিয়ে আসাটা পছন্দ করে না। কিন্তু মালিক নবকিশোর দত্তর ওসব বাছবিচার নেই। সে খালি মাথা দেখে। ওদেশ থেকে মাথাপিছু টাকা পেলেই হল।

মধুসূদন সবসময়েই পান খায়। পানের রসে তার ঠোঁটদুটো রক্তরঞ্জিত হয়ে থাকে। এখনো পান চিবোতে চিবোতে সে শীতল হাসল। তারপর বলল, ‘বেআইনি। মেয়েপাচার। আইনকানুন। বাবা, পেটে কলকাতার জল পড়তেই ঠাকুরমশাইয়ের মুখে অনেক বুলি ফুটেচে দেখচি। তা ঠাকুরমশাই, আপনি একেনে আইনের কী ব্যত্যয় দেকলেন, এট্টু বুঝিয়ে বলবেন? সরকারের থেকে লাইসেন্স নিয়ে আমরা লোক পাঠানোর ব্যবসা করচি। যারা আসচে, তারা স্বেচ্ছায় আসচে, যারা জাহাজে উঠচে, তারা হলফনামা দিয়ে স্বেচ্ছায় দেশান্তরি হতে যাচ্চে। গিয়ে সেকেনে মোটা টাকা পাচ্চে, খাবার পাচ্চে, কাপড় পাচ্চে। পাঁচবচ্ছর পর ফিরে আসতে পারচে। এরপর আপনি কী বলচেন বেআইনি? তা, আপনি পুলিশের কাচে যাচ্চেন না কেন? আপনার নালিশ পেয়ে তারা এসে আমাদের কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে’খন?’

‘শুনলে অনেক কিছুই স্বর্গ বলে মনে হয় মধুসূদন। এই শোনার লোভেই আজ আমাদের এই খোঁয়াড়ে এসে ঢুকতে হয়েছে। আর পুলিশ থেকে শুরু করে আদালত, সবই যে তোমরা টাকা দিয়ে কিনে রেখেছ, তাও আমার ভালোমতো জানা।’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন, ‘ওসব ছাড়ো। তোমরা আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ সেটা বলো।’

মধুসূদনের চোখদুটো ধূর্ত শিয়ালের মতো দপ করে একবার জ্বলেই আবার নিভে গেল। মুখে হাসিটুকু ধরে রেখে সে বলল, ‘সেইটে বলতেই তো যাচ্চিলাম। কিন্তু আপনি যে কতাগুলো শোনালেন, তারপর আর বলব কিনা ভাবচি। সত্যি কথা বলতে কি বলুন তো ঠাকুরমশাই, আপনার মেয়ে এখন তো আর আপনার সম্পত্তি নয়। আপনি এসে যে কাগজে সই করেচেন, তার চুক্তি অনুযায়ী আপনার মা-বাপই বলুন আর আপনার মেয়ের মা-বাপ সবই এখন হলেন গিয়ে নবকিশোর দত্ত নিজে। তাই আপনাকে বলতে আমরা বাধ্য নই। তবে কিনা আমি আপনাকে ভক্তিছেরেদ্দা করি, তাই বলচি। আপনার বড়মেয়ের মন উচাটন হয়েচে। সে বোনকে দেকবে। তাই নিয়ে যাওয়া হচ্চে। আহা, অতবড় বাড়িতে সবে পা রেকেচে, নিজের লোক কেউ না থাকলে হয়? দু’বোনে মিলে মনের কতা কইতে পারবে’খন।’

‘তার মানে লোপা আমাদের সঙ্গে কাল জাহাজে উঠবে না?’ নিজের শিষ্টতা ভুলে ডুকরে কেঁদে বললেন ব্রহ্মময়ী, ‘আমাকেও নিয়ে চলুন গোমস্তামশাই, আপনার দুই পায়ে পড়ি। আমার দুটো মেয়েকে এখানে রেখে আমি কী করে যাব? আপনাদেরও তো মা-বোন আছে বাড়িতে। আমি গিয়ে বাড়ির এককোণে পড়ে থাকব নাহয়! যা কাজ বলবেন তাই করব।’

মধুসূদন ছদ্মদুঃখী মুখ করে দুপাশে মাথা নাড়ল, ‘তা হয় না মা-ঠাকরুণ। আপনার বড়মেয়ে তো আপনাকে চায়নি। দেকতে চেয়েছে তার বোনকে। আমাদের বাবুর দয়ার শরিল, তাই পালকি পাঠিয়ে দিয়েচেন। সঙ্গে বুড়ি দাইমা’ও। তাছাড়া এরা তো বাচ্চা, এমনিও ওদেশে যেত ফাউ হিসেবে। আপনাদের তো ওকেনে গিয়ে কাজকাম করতে হবে। হুজুর চুক্তিনামা পাঠিয়েও দিয়েচেন। সেটা তো আর অমান্যি করা যায় না। আপনার মাথার দামটা কে মেটাবে তবে?’

কৃষ্ণসুন্দর একফোঁটা বিশ্বাস করলেন না মধুসূদনের কথা। অপালা সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল পিসিমা ভুবনমণির সঙ্গে। মনের কথা বলতে চাইলে সে পিসিমাকেই আগে দেখতে চাইত।

তিনি বললেন, ‘বেশ তো। আমার বোনকে নিয়ে যাও। সে অপালার চেয়ে একটু বড়। তার সঙ্গে মনের কথা জমবে ভালো।’

মধুসূদন আবার মাথা দোলাল।

‘কী যে বলেন ঠাকুরমশাই। আপনি শাস্তর পড়া লোক হয়ে এই কতা কইচেন? গঙ্গাজলের কাজ কি কখনো ভিস্তির জল দিয়ে হয়? আপনিই বলেন। আপনার বোন তো অশুচি। কুলটা। আমরা যে তাকে একেনে রেকেচি এই ঢের। তাকে গেরস্থবাড়িতে নিয়ে গিয়ে দত্তমশাই কি জাত খোয়াবেন নাকি?’

‘কুলটা’ শব্দটা শুনে ভুবনমণির চোখে হু-হু করে জল এসে গেল।

মুখে আঁচলচাপা দিয়ে সে সরে গেল খানিকটা।

এখন তার বয়স ষোলো বছর। শরীরে যৌবন এসেছে কয়েকবছর আগেই। কিন্তু যে সময়ে এসেছে, তার অনেকদিন আগেই তার গায়ে লেগে গিয়েছে ‘বিধবা’র তকমা। আট বছর বয়সে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল হুগলীর হরিপালে। না, অধিকাংশ কুলীনকন্যার মতো তাকে ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’ হতে হয়নি, দাদা অনেক সন্ধান করে তার বিবাহ দিয়েছিলেন চোদ্দো বছরের পাত্রের সঙ্গে। সবাই ভেবেছিল কী সৌভাগ্য তার। নিষ্কন্টকভাবে সে লাভ করতে পেরেছে এক কুলীন কিশোরকে।

কিন্তু তার নিজের কপাল মন্দ, লোকে কী করবে? না-হলে কি আর বিয়ের বছর না পুরতেই ভেদবমি করতে করতে মারা যেতে হয় তার স্বামীকে? ভুবন স্বামীকে চিনল না, স্বামীর সোহাগ কাকে বলে জানল না, কিছু বোঝার আগেই শ্মশানঘাটে আছড়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল তার শাঁখা-পলা। রগড়ে রগড়ে মুছে ফেলা হল সীমন্তের সিঁদুর।

সেই ইস্তক শুরু হল কৃচ্ছসাধন। ভুবনমণি জানল না মিলনসুখ, জানল না কাকে বলে শৃঙ্গাররস। যৌবনের গুপ্তরস উপভোগ করার আগেই সে স্বামী হারাল।

আর তার এতবছর পর নিয়তির অমোঘ দুর্বিপাকে যেদিন সেই রহস্য তার কাছে দুই বিকৃতকাম পাষণ্ড উন্মোচিত করল, তার অনাঘ্রাতা শরীর- পুষ্পকে নিষ্পেষিত করল নিজেদের কামনিবৃত্তিতে, সেদিনের পর থেকে নরনারীর স্বাভাবিক এই শারীরবৃত্তীয় সম্পর্কের কথা মনে পড়লেই তার বিবমিষা হয়।

আতঙ্ক, ভয় একাকার হয়ে বহুরাতে তার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। স্বপ্নের মধ্যেও সেই ভয়ঙ্কর অত্যাচার মনে পড়ে সে চিৎকার করে ওঠে।

সেই একাদশী তিথিতে তাকে যারা পাপের পাঁকে টেনে নামাল, তারা থেকে গেল শুদ্ধ, আর সে হল কিনা কুলটা? ভ্রষ্টা?

কেন? কী দোষ তার? প্রকৃতিই তো মেয়েমানুষকে পেলব করে গড়েছেন, দুই জোয়ান পুরুষের শক্তির সঙ্গে লড়াই করা যে তার পক্ষে অসম্ভব ছিল, তা তো ঈশ্বরই ঠিক করে দিয়েছেন।

তার দোষটা কোথায়?

তবু দোষ তারই হয়। তারই জন্য গ্রামে একঘরে হওয়ার হুমকি পেতে হয় দাদাকে। একরকম তারই জন্য ভিটেমাটি ছেড়ে এই নরকে ঠাঁই নিতে হয়েছে দাদা-বউদিদিদের। তারই জন্য অপা, লোপা সবার এই দুর্দশা।

এর চেয়ে গাঁয়ের পুকুরে সে কলসি দড়ি গলায় বেঁধে ডুব দিল না কেন? নিজের প্রতি অপরিসীম ঘৃণায় মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে ভুবনমণির।

কি যেন নাম ছিল তার বরের? শিবচন্দ্র না কি যেন! এতকাল পর আর মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে শুভদৃষ্টির সময়ের সেই দুই চোখের মিলনটুকু। মনে পড়ে সেই লাজুক কিশোরের ভীরু চাহনি। মনে পড়ে অনাঘ্রাতা এক তাজা ফুল হয়েও বৈধব্যজীবন শুরু করার যন্ত্রণা।

ওর মতো বাল্যবিধবা ডিপোয় অনেকজন আছে। যদিও এখানে এসে ওর ওপর হওয়া সাম্প্রতিক অত্যাচারের কথা কাউকেই বলা হয়নি, তবু সম্ভবত হরিহর আড়কাঠির দাক্ষিণ্যেই গোটা ডিপো জেনে গিয়েছে সেকথা।

যে মেয়ের ইজ্জত একবার গিয়েছে, লোকে ভাবে বুঝি তার ইজ্জত লোটা বড় সহজ। হঠাৎ করেই ভুবনমণি সহজলভ্যা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে পড়েছে সবার কাছে। ফলে আসার পরের দিন থেকেই প্রহরীদের কেউ কেউ কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেছে।

কেউ অন্ধকারে ছুঁয়ে দিয়েছে গোপন অঙ্গ, কেউ আরো বেপরোয়া হয়ে গভীর রাতে ফিসফিসিয়ে ডেকেছে তাকে, ‘উই মাগি, যাবি? ডুরে কাপড় দিমু একখান!’

প্রথম প্রথম ভুবনমণি কেঁদে উঠেছে, ব্রহ্মময়ীর নিষেধ সত্ত্বেও নালিশ জানাতে ছুটে গিয়েছে রামবিলাস দারোয়ানের কাছে। দিনকয়েক পরে বুঝেছে সবাই সমান।

জনাইয়ের পণ্ডিত হোক বা ডিপোর প্রহরী। পুরুষ মানুষ মাত্রেই নারীলোলুপ —এই ঋণাত্মক ধারণা ধীরে ধীরে এখন জাঁকিয়ে বসছে তার মনে।

ডিপোর মহিলামহলে অধিকাংশই অন্ত্যজশ্রেণীর মহিলা। তাদের মধ্যে রয়েছে ধনী ঘরের পরিচারিকা থেকে শুরু করে দেহোপজীবিনীও। তাদের মধ্যে অনেকরকম রঙ্গরসিকতা চলে। সেগুলোর সবই অত্যন্ত স্থূল দাগের ও আদিরসে ভরা কদর্য আলাপ। ব্রহ্মময়ী পারতপক্ষে সেদিকে ঘেঁষেন না। কিন্তু ভুবনমণির খুব ইচ্ছা হয় গিয়ে বসে শোনে সেই কথাবার্তা। ইচ্ছে হয় নিজের মৃত স্বামীকে সেই কল্পকাহিনির নায়ক ভেবে নিজে নায়িকা সাজতে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার মস্তিষ্কে সেই ভয়াবহ স্মৃতি জেগে ওঠে। মনে পড়ে যায় অরণ্যমধ্যে সেই নৃশংস অত্যাচারের কথা। কামেচ্ছা মুহূর্তে উবে যায় তখন, তীব্র আতঙ্কে সেখান থেকে তখন ভুবনমণি উঠে পালায়।

নবকিশোর দত্তর পারিবারিক পালকির ভেতরে বাড়ির দাইমা’র সঙ্গে বসে লোপামুদ্রা যখন ডিপো থেকে বেরোতে শুরু করল, তখন পালকিবাহকদের সমবেত কলরোল হুহুম না—হুহুম না ছাপিয়ে বুকফাটা কান্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়তে লাগল বাতাসে।

ভুবনমণি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখল, কাঁদতে কাঁদতে ব্রহ্মময়ী লুটিয়ে পড়ছেন মাটিতে। তাঁর আঁচল খসে পড়েছে, কেশ আলুথালু।

অন্যদিকে কৃষ্ণসুন্দরকে সজোরে চেপে ধরে রেখেছে ডিপোর দুই প্রহরী। দৃষ্টিপথের ক্রমশ বাইরে চলে যাওয়া পালকিটা দেখতে দেখতে কৃষ্ণসুন্দরের বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে আসছে। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন প্রহরীদের বজ্রমুষ্টি ছাড়াতে, কিন্তু যৌথ বলের সহজ সমীকরণে তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন।

হায়! ছোটমেয়েকে জোর করে নিয়ে যাওয়াতে চট্টোপাধ্যায় দম্পতি এত ভেঙে পড়েছেন, তাঁরা যদি বড়মেয়ের দশাটি জানতেন!

তবে বোধহয় ডিপোর ওই নিশ্ছিদ্র বলয়ের মধ্যেই যে কোনো উপায়ে জীবনের সমাপ্তি ঘটাতেন। কালাপানি পার হওয়ার আর প্রয়োজন পড়ত না।

নবকিশোর দত্ত সামান্য অবস্থা থেকে নিজ পরিশ্রমে বড়লোক। তাঁর আদি বাড়ি গঙ্গার ডানপাড়ের চাণক গ্রামে। ইংরেজরা সেখানে তাদের ব্যারাক বানানোর পর সেগ্রামের নাম হয়েছে ব্যারাকপুর।

মধ্যযুগের কবি বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসামঙ্গল কাব্যে বণিকশ্রেষ্ঠ চাঁদসদাগরের বাণিজ্য যাত্রাকালে যখন একে একে পড়ছে অজয় নদ, উজানী, কাটোয়া, নদীয়া, ফুলিয়া, সপ্তগ্রাম, মুলাজোড়, চাণক, বোধ হয় সেইসময়েই চাঁদসদাগরের কোনো আত্মীয়ের পছন্দ হয়ে গিয়েছিল চাণক নামের সবুজশ্যামল গ্রামটি।

দলের নেতা চাঁদ সওদাগর এগিয়ে চললেন সমুদ্রসঙ্গমে, সেই আত্মীয় নেমে বসতি গড়লেন চাণক গ্রামে। সেই আত্মীয়েরই উত্তরপুরুষ বোধ হয় নবকিশোর দত্তর বংশ।

নবকিশোর দত্তের বাবা বলরাম দত্তের ছিল বেশ কয়েক বিঘা ধানি জমি, তাতে বছরভর চাষ হত। সেই চাষের আয় থেকে সংসারের সঙ্কুলান হয়ে যেত। তাঁর ছোট পরিবার। একটি মাত্র পত্নী, একটি মাত্র পুত্র, ওই নবকিশোর। লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড় আর পেটভর্তি অন্ন, তাতেই দিন চলে যেত হেসেখেলে। দশ-বারো ঘণ্টা অফিসের কলে পেষাই হতে হত না, দিনের বেলা কাজ, আঁধার নামলে বটতলায় একটু বৈঠকি আলাপ, দিনান্তে শান্তির নিদ্রা। এই ছিল গ্রামের সহজ সরল নিরাড়ম্বর জীবনযাত্রা।

বলরাম দত্ত অবশ্য ছিলেন তারই মধ্যে একটু অন্যরকম। পরিবার যতই গঞ্জনা দিক, তিনি দিনরাত পড়ে থাকতেন নিজের পোষা পাখিদের নিয়ে। টিয়া, ময়না, শালিখ, বুলবুলের মতো গ্রামবাংলার পাখি তো ছিলই, মোহনচূড়া, নীলকান্ত, কুচকুচির মতো দুর্লভ পাখিও ছিল তাঁর জিম্মায়। সবধরনের পাখি গৃহস্থঘরের জন্য কল্যাণকর নয়, কিন্তু গ্রামের লোকেদের নিষেধে বলরাম দত্ত কর্ণপাত করতেন না। জমি থেকে যা আয় হচ্ছে হোক, সংসারের দিকে নজর না দিয়ে তিনি দিনরাত পড়ে থাকতেন পাখিদের নিয়ে। তারাই যেন তাঁর পরিবার, তারাই তাঁর বন্ধু। তাদের স্নানভোজনাদি করাতে করাতেই তাঁর দিন কেটে যেত।

এইসময়েই চাণকগ্রামে ঘটল এক চমকপ্রদ ঘটনা। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতা থেকে ষোল মাইল উত্তরে ইংরেজদের ওই ব্যারাকপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি চিড়িয়াখানা। তখন সারা পৃথিবীতে চিড়িয়াখানা মাত্র তিনটি। এমনকী প্রতিষ্ঠিত হয়নি লন্ডনের চিড়িয়াখানাও। ‘জু’ নামটিরও উৎপত্তি হয়নি, চিড়িয়াখানা তখন ‘মিনাজেরি’।

গঙ্গার পাড়ে সুবিশাল হাজার বিঘার ওপর সুদৃশ্য উদ্যান বানিয়েই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, প্রবল উৎসাহে কলকাতায় নিজের বাসভবন অর্থাৎ আজকের রাজভবন থেকে ব্যারাকপুর আসার সুবিধার জন্য বানিয়ে ফেললেন ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড। সংক্ষেপে বিটি রোড। তারপর তামাম ভারতবর্ষ থেকে সংগ্রহ করতে লাগলেন নানা জাতের দুষ্প্রাপ্য পশুপাখি। নিয়োগ করলেন স্থানীয় লোকদের। তারা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে ধরে আনতে লাগল পাখি, বিভিন্ন প্রজাতির বিড়াল, বেজি।

আর এইভাবেই একদিন বলরাম দত্তের বিশাল সংগ্রহের কথা গিয়ে পৌঁছল বড়লাটের কানে।

লর্ড ওয়েলেসলি এবং তাঁর প্রকৃতিবিশারদ সহকারী ফ্রান্সিস বুকানন গুণীর কদর করতে জানতেন। তাঁরা চাণকগাঁয়ের সেই অখ্যাত বণিকের সন্ধান পেয়ে শুধু তাঁর সংগ্রহকেই তুলে নিয়ে এলেন না, পক্ষীসম্বন্ধীয় প্রবল ব্যবহারিক জ্ঞানের বলরাম দত্তকে করে দিলেন পক্ষীদপ্তরের প্রধান পরিচালক।

তখন বলরাম দত্তের বয়স ষাট পেরিয়েছে। জীবন সায়াহ্নে এসে মনের মতো কাজ পেয়ে তিনি মোমবাতির শেষ শিখার মতো জ্বলে উঠলেন। জীবনীশক্তি নিঃশেষিত করে কাজ করতে লাগলেন ব্যারাকপুরের সেই ‘মিনাজেরি’র জন্য। সহকারী করে নিলেন নিজের পুত্রকে। কিশোর নবকিশোর বাবার সাহচর্যে কাজ শিখতে লাগল। পিতা পুত্রকে শেখাতে লাগলেন কীভাবে পাখিদের ভাষা বুঝতে হয়। কীভাবে তাদের শারীরিক কষ্ট উপলব্ধি করতে হয়। কীভাবে তাদের ভালোবাসতে হয়।

কিন্তু, পিতাপুত্রের মানসিক গঠন ছিল একেবারে বিপরীতমুখী। বলরাম ছিলেন আর্থিক বিষয়ে উদাসীন, কিশোর নবকিশোর ঠিক তাঁর উল্টো। বাবার কাছে সে শিক্ষানবিশি করতে লাগল বটে, কিন্তু তার লক্ষ্য বড়লোক হওয়া। ‘বাবু’ হওয়া।

আর তার জন্য চাই টাকা। অনেক টাকা।

তাই লর্ড ওয়েলেসলি বিলেতে ফিরে যাওয়ার পর চিড়িয়াখানার অবস্থা যখন টিমটিমে, বলরাম দত্তের অতিবার্ধক্যের সুবাদে পক্ষীদপ্তরের প্রধান হয়ে তখন যুবক নবকিশোর গোপনে পাচার করতে শুরু করল দুষ্প্রাপ্য পাখি।

কোথায়? কেন, ততদিনে যে গঙ্গার ওপারে গজিয়ে উঠেছে আরেক মঞ্জিল। নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলীর চিড়িয়াখানা।

নবকিশোর দত্ত নির্বিচারে নবাবের শখের চিড়িয়াখানায় পাখি পাচার করতে লাগলেন। দালালিতে সঙ্গত করল বুলবুল মিয়াঁর মতো লোকেরা।

বদলে মিলতে লাগল খাঁটি আকবরি মোহর। ক্রমে মেটিয়াবুরুজের সান্নিধ্য, লক্ষ্নৌয়ের নানা খেলা, মুর্গিবাজি, বটেরবাজি, সর্বোপরি সুন্দরী রমণীর নেশায় তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়তে লাগলেন।

ফলে, ব্যারাকপুরের চিড়িয়াখানাটি যতদিনে পাকাপাকিভাবে উঠে গেল, ততদিনে তাঁর ধনসম্পত্তি ফুলেফেঁপে উঠেছে।

তাঁর মথুর সেন গার্ডেন লেনের সুবিশাল অট্টালিকাটি এখন সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মোটা মোটা থাম, বাইরের প্রবেশদ্বারে গর্জনরত পশুরাজ। সামনে পেছনে মনোরম উদ্যান, মাঝখান দিয়ে কাঁকরের সরু পথ চলে গিয়েছে। দু’পাশে চোখজুড়নো ফুলের সারি।

বৈঠকখানাটিও দেখবার মতো। কোরিনথিয়েম থামে ডেড-ভিনিসন আঁটা বারান্দা, তার নীচে বেলেপাথর বসানো ঘোরানো সিঁড়ি। বৈঠকখানার বিশাল হলটিতে হেলায় ছড়িয়ে রয়েছে সোফা, ঝাড়লণ্ঠন, বহুমূল্য তৈলচিত্র, রঙবেরঙের ফুলদানি, পুতুল।

কিন্তু কথায় বলে, এক পুরুষে ধনী হওয়া যায়, বনেদি হওয়া যায় না। নবকিশোর দত্তর অবস্থাও খানিকটা তেমন। তাঁর অর্থ আছে, কিন্তু কৌলীন্য নেই। বিলাস আছে, কিন্তু আভিজাত্য নেই।

তাই ধনাপণ্ডিতের আদেশ শিরোধার্য করে ব্রাহ্মণকন্যা অপালাকে বিবাহ করে বাড়ি নিয়ে গিয়েও তিনি শেষরক্ষা করতে পারলেন না।

নবকিশোর দত্তের তিনতলা বাড়িটা কলকাতায় জোড়াবাগানের পেছনে, মথুর সেন গার্ডেন লেনে। ব্যারাকপুরের বাস উঠিয়ে দিয়ে তিনি প্রায় তিনদশক হল সাত বিঘার ওপর এই প্রকাণ্ড অট্টালিকাটি নির্মাণ করেছেন। বাড়ির সামনে মনোরম বাগান, পেছনে দিঘী। দিঘী সমেত জমিটা অবশ্য তিনি বিবাহে যৌতুকস্বরূপ পেয়েছিলেন। এই ব্যাপারেও তাঁর বৈষয়িক বুদ্ধির রীতিমতো প্রশংসা করতে হয়।

তাঁর প্রথমা পত্নী দয়াময়ী মৃগীরুগি। গৌরবর্ণা সুন্দরী হলেও যখন তখন তিনি মূর্ছা যান। তবে তিনিই নবকিশোরের জীবনে লক্ষ্মীস্বরূপা। কারণ দয়াময়ীর পিতা জয়চাঁদ মিত্র কলকাতার প্রথম ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের উত্তরপুরুষ।

অমন ধনকুবেরের বংশধর জয়চাঁদ মিত্তিরও অত্যন্ত ধনশালী হবেন, তা তো জানা কথাই। মা লক্ষ্মী তাঁর গৃহে চঞ্চলা নন, অচলা। গ্রামেগঞ্জে তো অগণিত, খোদ কলকাতা শহরেই তাঁর সাত-আটটি বাড়ি, এছাড়া নানারকম ব্যবসা। কিন্তু সমস্যা হল কন্যা দয়াময়ীর অসুখ নিয়ে। মৃগী থাকলে শরীর তো দিনে দিনে ক্ষয়িষ্ণুহয়েই পড়ে, সন্তানাদিও হয় না। স্মৃতিশক্তি হয়ে পড়ে দুর্বল, বাহ্যজ্ঞানলোপ পেতে থাকে।

তাই বিবাহবাজারে মৃগীরুগির একেবারেই চাহিদা নেই। তবে, কন্যার পিতার যথোপযুক্ত কাঞ্চনমূল্যের জোর থাকলে সব চাহিদাই ঊর্ধমুখী হয় বৈকি!

নবকিশোরও সেই পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন প্রথম জীবনে। তাঁর তখন ব্যবসা ক্রমবর্ধমান। ব্যারাকপুর থেকে এসে এসে কাজকর্ম চালানো খুব সমস্যার হয়ে পড়েছিল। নবকিশোরের উচ্চাভিলাষ তাঁকে দ্রুত কোনো অর্থনৈতিক খুঁটির সন্ধান করতে বাধ্য করছিল। এই সময়েই তিনি সংবাদ পেলেন, জয়চাঁদ মিত্তির তাঁর রুগ্না কন্যার জন্য পাত্র খুঁজছেন।

সেই সুবাদে সবদিক বিবেচনা করে নবকিশোর নিজেই প্রস্তাব পাঠালেন জয়চাঁদ মিত্তিরের কাছে।

জয়চাঁদ মিত্র তো হাতে স্বর্গ পেলেন। কায়স্থের সঙ্গে বণিকের বিবাহ ঠিক স্বজাতি না হলেও যথাবিহিত দক্ষিণাদানে বিবাহকালে পুরোহিতের মুখ তিনি বন্ধ করে দিলেন।

বিবাহের সময় যৌতুকস্বরূপ নবকিশোর পেলেন খাস কলকাতার বুকে এই সাত বিঘা জমি, তার ওপর প্রাসাদনির্মাণের মূলধন। এছাড়া স্বর্ণালঙ্কার, অন্যান্য উপহার, নগদ।

তিরিশ বছরের যুবক নবকিশোরকে আর ফিরে তাকাতে হল না। আগের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি মূলধন নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ব্যবসায়।

এর পর নবকিশোর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিবাহ করেছেন প্রকৃতই ‘পুত্রার্থে’। মাতার পীড়াপীড়িতে। লাভ হয়নি। দ্বিতীয়া পত্নী উমাতারা স্বগ্রাম চাণকের এক সচ্ছল বণিককন্যা। বিবাহের সময় তিনি ছিলেন দ্বাদশবর্ষীয়া। তবে সেই বিবাহেরও দশক পুরেছে। পুত্রলাভ হয়নি।

আবারও মাতার পীড়াপীড়িতে নবকিশোর অনেক জ্যোতিষগণনা, তিথিনক্ষত্র মিলিয়ে শেষ বিবাহ করেছেন দুই বছর আগে। এবার পাত্রী ত্রয়োদশবর্ষীয়া, আড়িয়াদহের এক দরিদ্র পিতার দুহিতা। নামটিও ভারি সুললিত, পরেশমণি। কিন্তু বলাই বাহুল্য, তিনিও নবকিশোরকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারেননি। ইতিমধ্যে নবকিশোরের মাতাদেবী দীর্ঘ রোগভোগ ও পুত্রবধূদের সেবায় তৃপ্ত হয়ে স্বর্গলাভ করেছেন। ফলে আর পীড়াপীড়ি করার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। নবকিশোরও ভগ্নমনোরথ হয়ে বিবাহের ভাবনাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন।

ফলে, আমাদের অপালা যখন শ্বশুরগৃহে পদার্পণ করল, তাঁকে শঙ্খে ফুঁ দিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে ঘরে তুলল তারই বড় সতীন দয়াময়ী। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তখনকার দিনে ঘরে ঘরে অমনটি হত। পুত্রবতী হোক আর না হোক, প্রথমা ভার্যার দল সেটিকে অনিবার্য নিয়তি বলে মেনেও নিত। বাৎসরিক নিয়মে তাদের জীবনে বছরে বছরে সতিনসংখ্যা বৃদ্ধি পেত। যৌবন অবসানে যৌবনবতী নবাগতার আঁচলে সিন্দুকের চাবিগাছা বেঁধে দিয়ে গৃহিণীর পদ থেকে অবসর নিতে হত। স্বামীর অধিকার ত্যাগ করে তারা নীরবে সরে যেত ঠাকুরগৃহে।

দয়াময়ীও তাই প্রস্তুত ছিল মানসিকভাবে। স্বামীর অধিকার বা সিন্দুকের অধিকার হারিয়েছে দ্বিতীয়া সতিন আসার পরেই। সুস্থ থাকলে তার দিনের অধিকাংশ সময় কাটে ঠাকুরগৃহেই। তবে সুস্থ থাকেই না প্রায়। ইদানীং সে খুব ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। নিয়মমাফিক কবিরাজমশাই আসেন, যান। তাঁর নিদানে আর কিছু হয় না। দয়াময়ী কখনো সুস্থ থাকে, কখনো বিছানা নেয়। বাড়ির সবাই তার আরোগ্যের আশা ছেড়ে দিয়েছে।

দৈবক্রমে স্বামীর চতুর্থ পাণিগ্রহণকালে সে বেশ সুস্থই ছিল। তাই গৃহে আশ্রিতা দুঃসম্পর্কিত পিসিমা, মাসিমাদের চেয়ে বরণের কাজটা সবাই তার হাতেই অর্পণ করল।

বরণশেষে নববধূ তাকে প্রণাম করতে যেতেই সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কয়েক পা পিছিয়ে গেল।

‘এ কী অসৈরণ গো! শেষে কি বামুনের মেয়ের পেন্নাম নিয়ে নরকে যাব নাকি?’ অস্ফুটে বলল দয়াময়ী।

পাশ থেকে একজন বয়স্থা বললেন, ‘ওমা ওকি কতা বড়বউ? মেয়েমানুষের আবার বামুন কায়েত কি? ও কি আর বামুন আচে নাকি? বে’র সময়ই তো ওর গোত্র পাল্টে গ্যাচে। এখন ও গন্ধবেনের বউ। তুমি ওর বড় দিদি, মায়ের মতন। পেন্নাম না নিলে ওর অকল্যাণ হবে না?’

তা নববধূর অকল্যাণ হয় হোক, দয়াময়ী নিজের অকল্যাণ করতে কিছুতেই রাজি নয়। সে ত্রস্তা হরিণীর মতো বরণডালা নামিয়ে রেখে অন্দরমহলে চলে গেল।

দত্তবাড়ির হালহকিকত আটকে আছে আরো একশো বছর আগে। দত্তবাড়ির মেয়েরা এখনো প্রকৃত অর্থেই অসূর্যম্পশ্যা। পরপুরুষ তো দূরস্থান, নিজের পতিদেবতার সঙ্গেও দিনের বেলা সাক্ষাতের অনুমতি তাদের নেই। পর্দার আড়ালেও নেই তাদের বাইরে বেরনোর সুযোগ।

নিতান্ত কোনো প্রয়োজনে দিবাকালে গৃহস্বামীর অন্দরমহলে আসার প্রয়োজন পড়লে তিনি বাহিরমহল থেকে এসে প্রথমে মাঝমহলের গোমস্তামশাইকে বলবেন। গোমস্তামশাইয়ের এত্তেলা পেয়ে অন্দরমহল থেকে আসবে কোনো দাসী। তারপর সেই দাসীমারফত এসে পৌঁছবে প্রয়োজনীয় বস্তুটি।

নবকিশোরের মাতাদেবী গত হওয়ার পর অন্দরমহলে থাকেন তাঁর তিন পত্নী এবং বেশ কিছু আশ্রিতা বিধবা আত্মীয়া। এছাড়া অগণিত দাসদাসী।

অপালার জন্যও অন্দরমহলে তিনটি প্রশস্ত কক্ষ বরাদ্দ হল। বিশেষভাবে তার জন্য নিযুক্ত করা হল কয়েকটি চাকরানি।

দশমবর্ষীয়া অপালা আর পাঁচজন গ্রাম্যকিশোরীর মতোই সহজ, সরল। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, চোখা নাকমুখ ও সুডৌল গড়ন ‘গুটিপোকা’ টির অচিরেই প্রজাপতি হয়ে ওঠার সংকেত দেয়। বুক এখনো পুরন্ত হয়নি, তবে সেই যুগ্মকুঁড়িতে শীঘ্রই অঙ্কুরোগ্মমের আভাষ।

মশাট গ্রামের আঁকাবাঁকা কৌশিকী নদীটির মতোই সে প্রাণচঞ্চলা। কলকাতায় আসার আগের দিন পর্যন্ত গ্রামের মেঠো আলপথে বান্ধবীদের সঙ্গে ছুটোছুটি করেছে, আদুরগায়ে কোনোক্রমে একটা কাপড় পেঁচিয়ে ছুটে বেড়িয়েছে বাড়ির উঠোনে। বাবার কাছে ঘরের সামনের নিকনো উঠোনে বসে লেখাপড়া শিখেছে। শুধুমাত্র অক্ষরপরিচয় নয়, শিখেছে পাটিগণিত, ভূগোল, ইতিহাস। অধ্যয়ন করেছে বেদের প্রাথমিক স্তর।

জীবনের আকস্মিক এই পরিবর্তনে সে যতটা না মুহ্যমান তার চেয়ে বেশি বিস্মিত। পুতুলবিয়ে, রান্নাবাটি, চু-কিতকিত সে খেলেছে বটে, গ্রামে তার সহচরীদের একে একে বিয়েও হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার নিজের বাবা-মা কেউই তাকে বিয়ে নিয়ে তেমন ওয়াকিবহাল করেননি। তার নিজেরও ধারণা ছিল বিবাহ একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যখন হবার হয়ে যাবে। বিবাহ নিয়ে মানসিক চাঞ্চল্য, রাগ-অনুরাগের বয়স তার হয়নি। ইচ্ছাও নয়।

কিন্তু ডিপো ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় যখন পিসিমা আর মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, তখন তারও ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। এই কয়েকদিন এমনিতেই বাবাকে ও ভাইকে সে দেখতে পায়নি, নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে থাকতে হচ্ছিল সম্পূর্ণ অচেনা এক পুতিগন্ধময় পরিবেশে, তার ওপর যেটুকু বা মা, বোন, পিসির সাহচর্য পাচ্ছিল, সেটুকুও এইভাবে হঠাৎ ছিন্ন হয়ে যেতে ও কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

তাই নবকিশোর দত্তর এক দূরসম্পর্কের অশীতিপর পিসিমা যখন কাছে এসে তার চিবুক তুলে বললেন, ‘তোমার নাম কী মা?’

পরিস্থিতির আকস্মিকতায় অপালা বিস্মৃত হয়ে গেল, যে সে এখন আর মশাট গ্রামের বালিকা নয়, কলকাতার দত্তবাড়ির গৃহবধূ। আর ‘নববধূ’র রীতি অনুযায়ী তার উচিত সর্বক্ষণ চোখ নামিয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে থাকা। তবে তো শ্বশুরগৃহের লোকেরা তৃপ্ত হবে। বলবে, ‘হ্যাঁ । নতুন বউয়ের হায়া-শরম আচে বটে। বাপের ঘর থেকে ভালো শিক্ষেই দিয়েচে।’

অপালা সেসমস্ত ভুলে ডাগর দুটি চোখ মেলে পিসিশ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে অনাবিল হেসে বলল, ‘আমার নাম অপালা।’

পিসিমাতা নববধূর আড়ষ্টতাহীন উত্তরে কিছু রুষ্ট হলেন বটে, কিন্তু তা প্রকাশ করলেন না। নববধূর নামখানিও ঠিকমতো তাঁর কর্ণগোচর হল না। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘অ্যাঁ? অভাগা? এ আবার কেমনতরো নাম হল? অভাগী হলে তবু বুঝতুম।’

আশেপাশে বসে থাকা রমণীরা হেসে এ অন্যের গায়ে লুটিয়ে পড়ল। একটি অল্পবয়সি মেয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘অভাগা নয় গো খুড়িমা, তুমি কানের মাতা খেয়েচ। নতুন বউয়ের নাম হল অবলা।’

পিসিমাতা আশ্বস্ত হতে যাবেন, এমন সময় নিজের নামবিকৃতির জন্য অপালা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, ‘না না অবলা নয়। অপালা। অত্রি মুনির কন্যার নাম ছিল অপালা।’

চারপাশের মহিলাবর্গকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপালা বলল, ‘ওমা। তোমরা জানো না বুঝি? লেখাপড়ায় দারুণ ছিলেন অপালা। একবার পড়লেই সব মুখস্থ হয়ে যেত। আমার বাবা বলেন, আমিও নাকি তেমনই হয়েছি গো।’

দশ বছরের বালিকা অপালা গর্বিত মুখে কথাটা শেষ করে আশা করল, উপস্থিত সবার মুখ হাসিতে ভরে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হল না। বরং সবাই নববধূর কথায় মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

শেষে পিসিমাতাই দন্তহীন তোবড়ানো গালে হাত দিয়ে বললেন, ‘ওমা! নবকিশোর পাশ করা মাগি নিয়ে এয়েচে নাকি বাড়ির বউ করে? সেইজন্যই দেকচি, লাজলজ্জা কিচুই নেই। কেমন মুকে মুকে কতা কইচে!’

‘একি অনাচ্ছিস্টি কাণ্ড গা!’ অপালার দ্বিতীয় সতিন উমাতারার মা-ও জামাতার পুনর্বিবাহ উপলক্ষে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘বাবাজীবন ছেলে ছেলে করে শেষে লেকাপড়া জানা বউ আনলেন ঘরে? শেষে কি আমার মেয়েটারও কপাল পুড়বে নাকি?’

নারীজাতির শিক্ষালাভ মানেই অকালবৈধব্য—এই ভয় বণিকবাড়ির অন্দরমহলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাঁকিয়ে বসে। নবকিশোরের চতুর্থ পত্নী অপালার এই গুপ্ত রহস্য ফাঁস হয়ে যেতেই তাই সবাই কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। উমাতারা, পরেশমণি তো বটেই, অন্দরমহলের অন্যান্য মহিলারাও নিজেদের মধ্যে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করল।

অপালা কিছুতেই বুঝল না, কী অপরাধে শ্বশুরালয়ে পা দেওয়ার দিন থেকেই সে সেখানে দোষী হয়ে পড়ল।

যাইহোক, কালনা থেকে সেদিন বিকেলেই দত্তবাড়িতে এলেন ধনঞ্জয় পণ্ডিত। প্রথমে নদীপথে বজরায়, তারপর দত্তমহাশয়ের এক্কাগাড়ি চেপে। নবকিশোর দত্ত শশব্যস্ত হয়ে তাঁকে মাঝমহলে নিয়ে এসে বসালেন। অবগুণ্ঠিতা অপালাকেও নিয়ে আসা হচ্ছিল অন্দরমহল থেকে, কিন্তু পণ্ডিতমশাই নিরস্ত করে জানালেন, তার প্রয়োজন নেই।

নবকিশোর তাঁকে নিভৃত কক্ষে নিয়ে গিয়ে বসালেন। করজোড়ে বললেন, ‘আজ্ঞে পণ্ডিতমশাই, এবার আমার কী করণীয় যদি অনুগ্রহ করে বলেন। মেয়েটিকে কি আমার কোনো আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেব?’

ধনঞ্জয় পণ্ডিত নাসারন্ধ্রে একটিপ নস্য চালালেন। তারপর সামান্য কেশে বললেন, ‘আত্মীয়ের গৃহে পাঠানোর জন্য কি আপনাকে বিবাহ করতে বলেছিলাম দত্তমশাই? আপনার পত্নী যদি অন্যত্র থাকেন, তবে আপনি পিতা হবেনই বা কী করে? পুত্রসন্তানলাভ তো আরো পরের কথা।’

নবকিশোর বারদুয়েক মাথা চুলকে বললেন, ‘আজ্ঞে পণ্ডিতমশাই, এখন তো তার দশবছর মাত্র বয়স। নিয়ম অনুযায়ী কন্যা যতদিন না তেরো-চোদ্দো বছরের হচ্ছে, সে তো পিত্রালয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মেয়েটির বাপ নিজেই তো দুদিনের মধ্যে দেশান্তরি হয়ে যাবে। তাই আমারই কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে…।’

ধনঞ্জয় পণ্ডিত নবকিশোর দত্তের ওপর যতই বিরক্ত হন না কেন, নবকিশোর অন্যায্য কথা কিছু বলেননি। বিবাহ আট, নয় কি দশবছর বয়সে হলেও যতদিন না রজঃস্বলা হচ্ছে, ততদিন তাকে পিত্রালয়েই থাকতে হয়। যে মাসে কন্যা প্রথম ঋতুমতী হয়, তড়িঘড়ি তাকে পালকিসহযোগে নিয়ে আসা হয় শ্বশুরগৃহে। প্রথম ঋতুতেই গর্ভাধান প্রতিটি স্বামীর শাস্ত্রীয় কর্তব্য।

কিন্তু ধনঞ্জয় পণ্ডিত আবারও বিস্মিত করলেন নবকিশোর দত্তকে। দুই নাসাছিদ্রে ভালো করে দুই টিপ নস্য নিয়ে তিনি জানালেন যে, চতুর্থ পত্নীর রজোদর্শন না হলেও এখন থেকেই নবকিশোরকে স্ত্রীসহবাস করতে হবে। তেমন পরিস্থিতি হলে ঋতুমতী হওয়ার আগেও সহবাস করা যায়।

শাস্ত্রে নাকি তেমনই বিধান রয়েছে।

উৎকৃষ্টায়াভিরূপায় বরায় সদৃশায় চ
অপ্রাপ্তামপি তাং তস্মৈ কন্যাং দদ্যাৎ যথাবিধি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *