০৪. বাবার বন্ধু সুধন্যবাবু

সাড়ে-চারটের সময় বাবার বন্ধু, সুধন্যবাবু এলেন। রিটায়ার করে তিনি এখানেই বাড়ি কিনেছেন। বিকেলের দিকে সুধন্যবাবু মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে গল্প করতে আসেন।

সুধন্যবাবু এলেই বাবার গাম্ভীর্যের মুখোস খসে যায়। বউমার কাছে চায়ের অনুরোধ যায়। তারপর দুজনের সুখ-দুঃখের গল্প শুরু হয়।

সুধন্যবাবুর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করেন, “চিঠিপত্তর পেলে!” চিঠিপত্তর মানে জামাই-এর চিঠি-সুধন্যবাবুর জামাই কানাডায় থাকে।

সুধন্যবাবু বলেন, “জানো ব্রাদার, এখানে তো এতো গরম, কিন্তু উইনিপেগে এখন বরফ পড়ছে। খুকী লিখেছে, রাস্তায় হাঁটা যায় না।”

“ওদের আর হাঁটবার দরকার কী? গাড়ি রয়েছে তো?” দ্বৈপায়নবাব জিজ্ঞেস করেন।

“শুধু গাড়ি নয়—এয়ার কন্ডিশন লিমুজিন। শীতকালে গরম, গরমকালে ঠাণ্ডা। এখানে বিড়লারাও অমন গাড়ি চড়তে পায় কিনা সন্দেহ। জামাইবাবাজী গাড়ির একটা ফটো পাঠিয়েছে, তোমাকে দেখাবো’খন। জানো দ্বৈপায়ন, এমন গাড়ি যে গিয়ার চেঞ্জ করতে হয় না—সব আপনা-আপনি হয়। আর আমাদের এখানে দেশী কোম্পানির গাড়ি দেখো! সেবার খুকী যখন এলো, তখন আমার নাতনী তো ট্যাক্সিতে চড়ে হেসে বাঁচে না। তাও বেছে-বেছে নতুন ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম আমরা।”

“কাদের সঙ্গে কাদের তুলনা করছে, সুধন্য?” দ্বৈপায়ন সিগারেটে টান দিয়ে বলেন। এ-দেশের অর্থনৈতিক ক্রমাবনতি সম্পর্কে দ্বৈপায়নের বিরক্তি ওঁর প্রতিটি কথায় প্রকট হয়ে উঠলো।

সুধন্যবাবু এবার সগর্বে ঘোষণা করলেন, “খুকী লিখেছে, জামাইয়ের মাইনে আরও বেড়েছে। এখন দাঁড়ালো, এগারো হাজার দশো পঞ্চাশ টাকা।” জানো ব্রাদার, গিন্নি তো এখনও সেইরকম সিম্পল আছেন—উনি ভেবেছেন বছরে এগারো হাজার টাকা। বিশ্বাসই করতে চান না, প্রতি মাসে জামাইবাবাজী এতো টাকা ঘরে আনছে। আমি রসিকতা করলাম, “গিন্নি একি তোমার স্বামী যে এগারো শো টাকায় রিটায়ার করবে।”

“আহা বেঁচে থাক, আরও উন্নতি করুক,” দ্বৈপায়ন আশীর্বাদ জানালেন।

সুধন্যবাবু কিন্তু পুরোপুরি খুশী নন। বললেন, “খুকীর অবশ্য সখ নেই। লিখেছে, এমন অভাগা দেশ যে একটা ঠিকে-ঝি পর্যন্ত পাওয়া যায় না। জানো দ্বৈপায়ন, আদরের মেয়েটাকে জমাদারণীর কাজ পর্যন্ত করতে হয়। অবশ্য জামাইবাবাজী হেল্প করে।”

“বলো কী?” দ্বৈপায়ন সহানুভূতি প্রকাশ করেন।

“লোকের বড় অভাব, জানো দ্বৈপায়ন। কত চাকরি যে খালি পড়ে আছে, শুধু লোক পাওয়া যাচ্ছে না বলে।” সুধন্যবাবু সিগারেটে একটা টান দিলেন।

দ্বৈপায়ন কী মতামত দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সিগারেটের ছাই ঝেড়ে তিনি বললেন, “রূপকথার মতো শোনাচ্ছে সুধন্য। বিংশ শতাব্দীতে একই চন্দ্র-সূর্যের তলায় এমন দেশ রয়েছে যেখানে একটা পোস্টের জন্য এক লাখ অ্যাপ্লিকেশন পড়ে, আবার অন্য দেশে চাকরি রয়েছে কিন্তু লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

সুধন্যবাবু বন্ধুর মতো বিস্ময়বোধ করলেন না। বললেন, “তবে কি জানো, দুটোই চরম অবস্থা। যে-দেশে নিজের বাসন নিজে মেজে খেতে হয় সে দেশকে ঠিক সুসভ্য দেশ বলা চলে না।”

হাসলেন দ্বৈপায়ন। “কিন্তু যাদের বাড়িতে বেকার ছেলে রয়েছে তারা বলছে, পশ্চিম যা করেছে তাই শতগুণে ভালো। এদেশে চাকরি-বাকরির যা অবস্থা হলো।”

সুধন্যবাবু বললেন, “ভাগ্যে আমার ছেলে নেই, তাই চাকরি-বাকরির কথা এ-জীবনে আর ভাবতে হবে না।”

“বেঁচে গেছ, ব্রাদার। ছোকরা বয়সের এই যন্ত্রণা চোখের সামনে দেখতে পারা যায় না। অথচ হাত-পা বাঁধা অবস্থা-সাহায্য করবার কোনো ক্ষমতা নেই।” দ্বৈপায়নের কণ্ঠে দুঃখের সুর বেজে উঠলো।

“এই অবস্থায় জামাই-এর মাথায় ভূত চেপেছে,” সুধন্যবাবু, ঘোষণা করলেন, “বিদেশে থাকলে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা বাড়ে তো। লিখেছে, দেশে ফিরে গিয়ে দেশের সেবা করবো। বলো দিকিনি, কি সর্বনাশের কথা!”

কথাটা যে মোটেই সুবিধের নয় এ-বিষয়ে দ্বৈপায়ন বন্ধুর সঙ্গে একমত হলেন।

সুধন্যবাবু বললেন, “সেইজন্যেই তো তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এলাম। জামাই লিখেছে, হাজার টাকা মাইনে পেলে দেশের কোনো কলেজে লেকচারার হয়ে ফিরে যাবো। বাবাজী অনেকদিন ঘরছাড়া, বুঝতে পারছে না ইন্ডিয়াতে এতো লোক যে এখানে মানুষের কোনো সম্মান নেই। মানুষের এই জঙ্গলে মানুষকে যোগ্য মূল্য দিতে ভুলে গিয়েছি আমরা।”

দ্বৈপায়ন বললেন, “মেয়েকে লিখে দাও, জামাইয়ের কথায় যেন মোটেই রাজী না হয়। এখানে এসে ওরা শুধু ভিড় বাড়বে, তিন-চারখানা বাড়তি রেশন কার্ড হবে, অথচ দেশের কোনো মঙ্গল হবে না। তার থেকে ঐ যে বৈদেশিক মুদ্রা জমাচ্ছে, ওতে দেশের অনেক উপকার হচ্ছে।”

সুধন্যবাবুর মনের মধ্যে কোথাও একট লোভ ছিল মেয়েকে অতদরে না রাখার। চাপা গলায় বললেন, “তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, গিন্নির চোখে জল। হাজার হোক একটি সন্তান কোথায় পড়ে রয়েছে। ওঁর ইচ্ছে, মেয়েজামাই ফিরে আসুক—অত টাকা নিয়ে কী হবে? এতো লোক তো এই দেশেই করে খাচ্ছে, গাড়ি চড়ছে, ভালো বাড়িতে থাকছে।”

একটু থেমে সুধন্যবাবু বললেন, “সেদিক থেকে তুমি ভাই লাকি। হীরের টুকরো সব ছেলে। ডোম্বলের আর কোনো প্রমোশন হলো নাকি?”।

দ্বৈপায়ন ছেলেদের সব খবরাখবর রাখেন। ছেলেরা এসে অফিস সম্পর্কে বাবার সঙ্গে আলোচনা করে। দ্বৈপায়ন বললেন, “ভোম্বল এ-বছরেই টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার হবে শুনেছি। ছোকরা নিজের চেষ্টায় সামান্য টাকায় ঢুকেছিল, চাকরিতে এতোটা উঠবে আশা করিনি। কিন্তু বিয়ের পরই উন্নতি হচ্ছে—বউমার ভাগ্য।”

বউমা সম্পর্কে কোথাও কোনোরকম মতদ্বৈধ নেই। সুধন্যবাবু বললেন, “গিন্নি এবং আমি তো প্রায়ই বলি, সাক্ষাৎ লক্ষ্মীকে তুমি ঘরে নিয়ে এসেছে—নামে কমলা, স্বভাবেও কমলা।”

দ্বৈপায়নের থেকে এ-বিষয়ে কেউ বেশি বোঝে না। তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “বড় বউমা না থাকলে সংসারটা ভেসে যেতো ধন্য। আজকালকার মেয়েদের সম্বন্ধে যা সব শুনি?”

পা নাড়াতে নাড়াতে সুধন্যবাবু বললেন, “আজকাল মেয়েরা যে রসাতলে যাচ্ছে তা হয়তো ঠিক নয়। তবে স্বামীরটি এবং নিজেরটি ছাড়া অন্য কিছুই বোঝে না। সুপুরুষ রোজগেরে স্বামীটি যে ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সে আকাশ থেকে বেলুনে চড়ে মাটিতে নেমে আসেনি, অনেক দুঃখকষ্টে পেটে ধরে কেউ যে তাকে তিলতিল করে মানুষ করেছেন এবং তাঁদেরও যে সন্তানের ওপর কিছু দাবি আছে, তা বউদের মনে থাকে না।”

দ্বৈপায়ন বললেন, “এই ডেপুটি ম্যানেজার হবার খবরে বউমা কিন্তু খুব চিন্তিত।”

“সে কি?” অবাক হয়ে গেলেন সুধন্যবাবু। “প্রমোশন, এ তো আনন্দের কথা।”

“প্রমোশন পেলে ভোম্বলকে হেড অফিসে বদলি করে দেবে,” একটু থামলেন দ্বৈপায়ন। “মা আমার কথা কম বলে, কিন্তু বুদ্ধিমতী। কমলা-বিহীন এ-সংসারের কী হবে তা নিশ্চয় বুঝতে পারো।”

“কেন? মেজ বউমা?” সুধন্যবাবু প্রশ্ন করেন।

দ্বৈপায়ন ঝকে পড়েন সামনের দিকে। নিচু গলায় বললেন, “এখনও ছেলেমানুষ। মনটি ভালো, কিন্তু প্রজাপতির মতো ছটফট করে—একজায়গায় মন স্থির করতে পারে না। তাছাড়া কাজলের তো ঘন ঘন ট্রান্সফারের কাজ। আমেদাবাদ পাঠিয়ে দেবার কথা হচ্ছে।”

সুধন্যবাবু কিছু বলার মতো কথা পাচ্ছেন না। দ্বৈপায়ন নিজেই বললেন, “এমনও হতে পারে যে এই বাড়িতে কেবল আমি এবং খোকন রয়ে গেলাম।”

কপালে হাত রাখলেন দ্বৈপায়ন। “আমি আর ক’দিন? কিন্তু সংসারটা গুছিয়ে রেখে যেতে পারলাম না, সুধন্য। প্রতিভার সঙ্গে দেখা হলে বকাবকি করবে। বলবে, দুটো ছেলেকে মানুষ করে, মাত্র একজনের দায়িত্ব তোমার ওপরে দিয়ে এলাম, সেকাজটাও পারলে না?”

চাকরির যে এমন অবস্থা হবে, তা কি কেউ কল্পনা করেছিল?” বন্ধুকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন সুধন্যবাবু। “শুধু তোমার ছেলে নয়, যেখানে যাচ্ছি সেখানেই হাহাকার। হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ নয়, এখন শুনছি বেকারের সংখ্যা লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে কোটিতে হাজির হয়েছে।”

দ্বৈপায়ন শুধু বললেন, “হুঁ।” এই শব্দ থেকে তাঁর মনের সঠিক অবস্থা বোঝা গেলো না।

সুধন্যবাবু বললেন, “এখন তো আর কাজকর্ম নেই—মন দিয়ে খবরের কাগজটা পড়ি। কাগজে লিখছে, এতো বেকার পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। এই একটা ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহে ফার্স্ট হয়েছি—দুনিয়ার কোনো জাত অদর ভবিষ্যতে আমাদের এই সম্মান থেকে সরাতে পারবে না। ইন্ডিয়ার মধ্যে আবার আমরা বাঙালীরা বেকারীতে গোল্ড মেডেল নিয়ে বসে আছি।”

আরামকেদারায় শুয়ে দ্বৈপায়ন আবার বললেন, “হুঁ।”

সুধন্যবাবু বললেন, “জিনিসটা বীভৎস। লেখাপড়া শিখে, কত স্বপ্ন কত আশা নিয়ে লাখ লাখ স্বাস্থ্যবান ছেলে চুপচাপ ঘরে বসে আছে, আর মাঝে মাঝে কেবল দরখাস্ত লিখছে—এ দৃশ্য ভাবা যায় না। সমস্যাটা বিশাল বুঝলে দ্বৈপায়ন। সুতরাং তুমি একলা কী করবে?”

মন তবু বুঝতে চায় না। দ্বৈপায়নের কেমন ভয় হয়, প্রতিভার সঙ্গে দেখা হলে এইসব যক্তিতে সে মোটেই সন্তুষ্ট হবে না। বরং বলে বসবে, তুমি-না বাপ? মা-মরা ছেলেটার জন্যে শুধু খবরের কাগজী লেকচার দিলে!

সুধন্যবাবু বললেন, “সারাজন্ম খেটেখুটে পেনসন নিয়ে যে একটু নিশ্চিন্তে জীবন কাটাবে তার উপায় নেই। ছেলেরা মানুষ না হলে নিজেদের অপরাধী মনে হয়।”

সুধন্যবাবু উঠতে যাচ্ছিলেন। দ্বৈপায়ন বললেন, “এ-সম্বন্ধে তোমার মেয়ে একবার কি লিখেছিল না?”

সুধন্যবাবু আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “একবার কেন? মেয়ে প্রায়ই লেখে। ওখানকার পলিসি হলো—নিজের বর নিজে খোঁজো-–ওন-ইওর-ওন টেলিফোনের মতো। ইচ্ছে হলে বড়জোর বাপ-মাকে কনসাল্ট করো। কিন্তু দায়িত্বটা তোমার। তেমনি চাকরি খুঁজে দেবার দায়িত্ব বাপ-মায়ের নয়! তোমার গোঁফ-দাড়ি গুজিয়েছে, সাবালক হয়েছে–এখন নিজে চরে খাও।”

সোমনাথের কথা সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেলো দ্বৈপায়নের। মনের সঙ্কোচ ও দ্বিধা কাটিয়ে তিনি বললেন, “ভাবছিলাম, খোকনের জন্যে কানাডায় কিছু করা যায় কিনা। এখানে চাকরি-বাকরির যা অবস্থা হলো।”

সুধন্যবাবু কোনো আশা দিতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত দায়সারাভাবে উত্তর দিলেন, “তুমি যখন বলছো, তখন খুকীর কাছে আমি সব খুলে লিখতে পারি। কিন্তু আমি যতদর জানি, প্রতি হপ্তায় কলকাতা থেকে এধরনের অনুরোধ জামাইয়ের কাছে দু-তিনখানা যায়। কানাডিয়ানরা আগে অনেক ইন্ডিয়ান নিয়েছে—এখন ওরা চালাক হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার, ইনজিনীয়ার, টেকনিশিয়ান ছাড়া আর কাউকে কানাডায় ঢোকবার ভিসা দিচ্ছে না।”

দ্বৈপায়ন এই ধরনের উত্তর পাবার জন্যেই প্রস্তুত ছিলেন। কানাডাকে তিনি দোষ দিতে পারেন না। ঢালাও দরজা খুলে রাখলে, কানাডার অবস্থা এ-দেশের মতো হতে বেশি সময় লাগবে না।

তবু মনটা খারাপ হলো দ্বৈপায়নের। সুধন্যর জামাইয়ের বিদেশে যাওয়ার সময় পাসপোর্টের গোলমাল ছিল। সে-গোলমাল দ্বৈপায়নই সামলেছিলেন। খুকীর পাসপোর্ট তৈরির সময়েও দ্বৈপায়নকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। সুধন্য তখন অবশ্য ওর দুটো হাত ধরে বলেছিলেন, “তোমার ঋণ জীবনে শোধ করতে পারবো না।”

বিরক্তিটা সুধন্যর ওপর আর রাখতে পারছেন না দ্বৈপায়ন। মনে হচ্ছে, তিনকাল গিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এখনও তাঁকে সংসারের কথা ভাবতে হবে কেন? দ্বৈপায়নের অকস্মাৎ মনে হলো, পাশ্চাত্ত্য দেশের বাপ-মায়েরা অনেক ভাগ্যবান—তাঁদের দায়দায়িত্ব অনেক কম। মেয়ের বিয়ে এবং ছেলের চাকরি—এই দুটো বড় অশান্তি থেকে তাঁরা বেচেছেন।

সুধন্যবাবু বিদায় নেবার পরও দ্বৈপায়ন অনেকক্ষণ চুপচাপ বারান্দায় বসেছিলেন। বাইরে কখন অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তা দিয়ে অফিসের লোকেরা ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে এসেছে। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি কেবল এ অঞ্চলের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে।

“বাবা, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন?” বড় বউমার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন দ্বৈপায়ন।

সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে সদ্যপ্রসাধিতা শ্রীময়ী বউমাকে দেখতে পেলেন দ্বৈপায়ন।

“এসো মা,” বললেন দ্বৈপায়ন।

“আপনি পান করবেন না, বাবা?” স্নিগ্ধ স্বরে কমলা জিজ্ঞেস করলো।

“এখানে বসে থাকলেই নানা ভাবনা মাথার মধ্যে এসে ঢোকে, বউমা। বড়োবয়সে কিছু, করবার ক্ষমতা থাকে না, কিন্তু ভাবনাটা রয়ে যায়। অথচ কী যে ভাবি, তা নিজেও অনেক সময় বুঝতে পারি না।”

“বাবা, বেশি রাত্রে স্নান করলে আপনার হাঁচি আসে। আপনি বরং ঠাণ্ডা জলে গা মুছে নিন,” শ্বশুরকে কমলা প্রায় হুকুম করলো।

দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করলেন, “মেজ বউমা কোথায়?”

“কাজলের মেজ সায়েব নাইজিরিয়াতে বদলী হয়ে যাচ্ছেন—তাই পার্টি আছে। ওরা দুজন একটু আগেই বেরুলো। ফিরতে হয়তো দেরি হবে।”

দ্বৈপায়ন বললেন, “বিলিতী অফিসের এই একটা দোষ। অনেক রাত পর্যন্ত পার্টি করলে সায়েবরা খুশী হন না।”

কমলা শ্বশুরকে আশ্বাস দিলো, “এবার কমে যাবে। কারণ, নতুন মেজ সায়েব ইন্ডিয়ান।”

“কী নাম?” দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করলেন।

“মিস্টার চোপরা, বোধহয়,” কমলা জানালো।

“ওরে বাবা! তাহলে বলা যায় না, হয়তো বেড়েও যেতে পারে।”

কমলা বললো, “সিধু নাপিতকে কাল আসতে বলে দিয়েছি, বাবা? অনেকদিন আপনার চুল কাটা হয়নি।

“কালকে কেন? পরশ, বললেই পারতে,” দ্বৈপায়ন মদ, আপত্তি জানালেন।

“পরশ, যে আপনার জন্ম বার, কমলা মনে করিয়ে দিলো। জন্ম বারে যে চুল ছাঁটতে নেই, এটা শাশুড়ীর কাছে সে অনেকবার শুনেছে।

দ্বৈপায়ন নিজের মনেই হাসলেন। তারপর বললেন, “চুল ছাঁটার কথা বলে ভালোই করেছো, বউমা। ঠিক সময়ে চুল ছাঁটা না হলে তোমার শাশুড়ী ভীষণ চটে উঠতেন।”

মুখ টিপে হাসলো কমলা। শ্বশুর-শাশুড়ীর ঝগড়া সে নিজের চোখে দেখেছে এবং নিজের কানে শুনেছে। শাশুড়ী রেগে উঠলে বলতেন, “যদি আমার কথা না শোনো তাহলে রইলো তোমার সংসার। আমি চললাম।”

শ্বশুরমশায় বলতেন, “যাবে কোথায়?”

শাশুড়ী ঝাঁঝিয়ে উঠতেন, “তাতে তোমার দরকার? যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাবো।”

বাবার কী সেসব কথা মনে পড়ছে? নইলে উনি অমন অসহায়ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? মায়ের কথা ভেবে বাবা রাতের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

দ্বৈপায়ন নিজেকে শান্ত করে নিলেন। তারপর সস্নেহে বললেন, “ভোম্বলের কোনো খবর পেলে?”

স্বামী টারে গিয়েছেন বোম্বাইতে। কমলা বললো, “আজই অফিস থেকে খবর পাঠিয়েছেন। টেলেক্সে জানিয়েছেন, ফিরতে আরও দেরি হবে। হেড অফিসে কী সব জরুরী মিটিং হচ্ছে।”

দ্বৈপায়ন বললেন, “হয়তো ওর প্রমোশনের কথা হচ্ছে। টেকনিক্যাল ডিভিসনের ডেপটি ম্যানেজার হলে তো অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হবে।”

কমলা চুপ করে রইলো। দ্বৈপায়ন বললেন, “জানো বউমা, আই অ্যাম প্রাউড অফ ভোম্বল। ওর জন্যে কোনোদিন একটা প্রাইভেট টিউটর পর্যন্ত আমি রাখিনি। নিজেই পড়াশুনা করেছে, নিজেই আই-আই-টিতে ভর্তি হয়েছে, নিজেই ফ্রি স্টুডেন্টশিপ যোগাড় করেছে, তারপর চাকরিটাও নিজের মেরিটে পেয়েছে। এগারো বছর আগে যখন তোমার সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক হলো, তখনও ভোম্বল ছিল একজন অর্ডিনারি টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট। আর চল্লিশে পা দিতে-না-দিতে ডেপুটি ম্যানেজার।”

হঠাৎ চুপ করে গেলেন দ্বৈপায়ন। তিনি কি ভাবছেন কমলা তা সহজেই বলতে পারে। সোমনাথের কথা চিন্তা করে তিনি যে হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন, তা কমলা বুঝতে পারছে। যোধপুর পার্কের এই বাড়ির একটা ভবিষ্যৎ কল্পনাচিত্র যে দ্বৈপায়নের মনে মাঝে মাঝে উঁকি মারে তা কমলার জানা আছে।

ছবিটা এইরকম। ভোল বোঘাই বদলি হয়েছে। বউমাকেও স্বামীর সঙ্গে যেতে হয়েছে। যাবার আগে সে বাবাকে নিয়ে যাবার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছে। বাবা রাজী হননি। কাজলও বদলি হয়েছে আমেদাবাদে। আর মেজ বউমা (বুলবুল) তো স্বামীর সঙ্গে যাবার জন্যে এক-পা বাড়িয়েই আছে। তখন এ-বাড়িতে কেবল দ্বৈপায়ন এবং সোমনাথ।

বড় বউমার দিকে অসহায়ভাবে তাকালেন দ্বৈপায়ন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না। সঞ্চয় বলতে তাঁর বিশেষ কিছুই নেই—মাত্র হাজার দুয়েক টাকা। আর পেনসন, সে তো তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর সোমনাথ কী করবে? এ-বাড়িটাও তরি নিজস্ব নয়। দোতলা করবার সময় ভোম্বল ও কাজল দুজনেই কিছু কিছু টাকা দিয়েছে। কাজলের মাইনে থেকে এখনও কো-অপারেটিভের ঋণের টাকা মাসে মাসে কাটছে।

কমলা বললো, “বাবা, আপনাকে একটু হরলিকস এনে দেবে? আপনাকে আজ বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

দ্বৈপায়ন নিজের ক্লান্তি অস্বীকার করতে পারলেন না। বললেন, “কিছুই করি না, তবু আজকাল মাঝে মাঝে কেন যে এমন দুর্বল হয়ে পড়ি।”

কমলা বললো, “আপনি যে কারুর কথা শোনেন না, বাবা। দিনরাত খোকনের জন্যে চিতা করেন।”

দ্বৈপায়ন একটু লজ্জা পেলেন। মনে হলো পুত্রবধুর কাছে তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।

কমলার মধ্যে কি মধুর আত্মবিশ্বাস। সে বললো, “আপনি শুধ-শুধু ভাবেন ওর জন্যে। আমার কিন্তু একটও চিতা হয় না। অত ভালো ছেলের ওপর ভগবান কখনও নির্দয় হতে পারেন না।”

বার্ধক্যের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দ্বৈপায়ন যদি বত্রিশ বছর বয়সের বউমার অর্ধেক বিশ্বাসও পেতেন তাহলে কি সুন্দর হতো। লক্ষ্মী-প্রতিমার মতো বউমার প্রশান্ত মুখের দিকে তাকালেন দ্বৈপায়ন।

ধীর শান্ত কণ্ঠে কমলা বললো, “ওঁর প্রমোশন অত তাড়াতাড়ি হচ্ছে বলে মনে হয় না। আর হলেও, খোকনের বিয়ে না দিয়ে আমি কলকাতা ছাড়ছি না।”

অনেক দুঃখের মধ্যেও দ্বৈপায়নের হাসি আসছে। ভাবলেন, একবার বউমাকে মনে করিয়ে দেন সুজি-রোজগার না থাকলে কোনো ছেলের বিয়ের কথা ভাবা যায় না। আড়াই বছর ধরে সোমনাথ চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক অ্যাপ্লিকেশন তিনি নিজে লিখে দিয়েছেন। প্রতিদিন তিনখানা করে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন তিনি তন্ন তন্ন করে দেখেন। সেগুলোতে লাল পেন্সিলে দাগ দেন প্রথমে। তারপর ব্লেড দিয়ে নিখুঁতভাবে কেটে পিছনে কাগজের নাম এবং তারিখ লিখে রাখেন।

দ্বৈপায়নের মনে পড়ে গেলো আজকের খবরের কাগজের কাটিংগুলো ওর কাছেই পড়ে আছে। কাটিংগুলো বউমার হাতে দিয়ে বললেন, সোমকে এখনই এগুলো দিয়ে দাও।”

বাবার উদ্বেগের কথাও বউমা জানে। আগামীকাল ভোরবেলায় বউমাকে জিজ্ঞেস করবেন, “কাটিংগুলো খোকনকে দিয়েছো তো? ও যেন বসে না থাকে। তাড়াতাড়ি অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দেওয়া ভালো। দুটো অ্যাপ্লিকেশনে আবার তিন টাকার পোস্টাল অর্ডার চেয়েছে।”

কমলা জানে সোমকে ডেকে সোজাসুজি এসব কথা বলতে আজকাল বাবা পারেন না। দুজনেই অস্বস্তি বোধ করে। অনেক সময় বাবা ডাকলেও সোম যেতে চায় না। যাচ্ছি-যাচ্ছি করে একবেলা কাটিয়ে দেয়। কমলাকে দু’পক্ষের মধ্যে ছটোছুটি করতে হয়। কমলা বললো, “সোমকে আমি সব বুঝিয়ে বলে দিচ্ছি। পোস্টাল অর্ডারের টাকাও তো ওর কাছে দেওয়া ঘয়েছে।”

দ্বৈপায়ন তবুও নিশ্চিত হতে পারলেন না। ওঁর ইচ্ছে, সোমনাথ নাইট পোস্টাপিস থেকে এখনই পোস্টাল অর্ডার কিনে আনক এবং আধ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাপ্লিকেশন টাইপ হয়ে যাক, যাতে কাল সকালেই রেজেস্ট্রি-ডাকে পাঠানো যায়।

কমলা বাবাকে শান্ত করবার জন্যে বললো, “দরখাস্ত নেবার শেষ দিন তো তিন সপ্তাহ পরে।”

নিজের অস্বস্তি চেপে রেখে দ্বৈপায়ন বললেন, “তুমি জানো না, বউমা, আজকাল ডাকঘরের যা অবস্থা হয়েছে, গিয়ে দেখবে একটাকা দু’টাকার পোস্টাল অর্ডার ফুরিয়ে গছে। তারপর রেজেস্ট্রি-ডাকের তো কথাই নেই। তিন ঘণ্টার পথ যেতে তিন সপ্তাহ লাগিয়ে দেয়। যারা চাকরির বিজ্ঞাপন দেয় তারাও ছুতো খুঁজছে। লাস্ট ডেটের আধঘণ্টা পরে চিঠি এলেও খুলে দেখবে না—একেবারে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেবে।”

নিজের ইচ্ছে যাই হোক, বউদির অনুরোধ এড়ানো যায় না। কমলা বউদি সোমনাথকে বললেন, “লক্ষ্মীটি সকালবেলাতেই পোস্টাপিসে অ্যাপ্লিকেশনটা রেজেস্ট্রি করে এসো–বাবা শুনলে খুশী হবেন। বুড়ো মানুষ, ওঁকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ?”

চিঠি ও খাম টাইপ করিয়ে সোমনাথ পোস্টাপিসের দিকে যাচ্ছিল। পোস্টাল অর্ডার কিনে ওখান থেকেই সোজা পাঠিয়ে দেবে।

পোস্টাপিসের কাছে সুকুমারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। সুকুমার চিৎকার করে বললো, “কী হে নবাব বাহাদুর, সকালবেলায় কোথায় প্রেমপত্তর ছাড়তে চললে?”

সোমনাথ হেসে ফেললো। “তোর কী ব্যাপার? দু-তিনদিন পাত্তা নেই কেন?”

“তুমি তো মিনিস্টারের সি-এ নও যে তোমার সঙ্গে আড্ডা জমাতে পারলে চাকরি পাওয়া যাবে। নিজের মাথার ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। রাইটার্স বিল্ডিংসের ভিতরে ঢোকা আজকাল যা শক্ত করে দিয়েছে মাইরি, তোকে কী বলবো?”

“মিনিস্টারের সি-এরাই হয়তো চায় না বাজে লোক এসে জ্বালাতন করুক,” সোমনাথ বললো।

“সে বললে তো চলবে না, বাবা। মিনিস্টারের সি-এ যখন হয়েছে, তখন লোকের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। বিশেষ করে আমাদের মতো যারা এম-এল-এর গ্লু দিয়ে এসেছে তাদের এড়িয়ে যেতে পারবে না।”

সুকুমার এবার বললো, “চল তোর সঙ্গে পোস্টাপিসে ঘরে আসি। ভয় নেই তোর অ্যাপ্লিকেশনে ভাগ বসাতে যাচ্ছি না। তুই যেখানে খুশী চিঠি পাঠা, আমি বাগড়া দেবো না।”

এবার সুকুমার বললো, “তোকে কেন মিথ্যে বলবো, গত দু-দিন জি-পি-ওর সামনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরির সাইক্লোস্টাইল করা ফর্ম বেঁচে টু-পাইস করেছি। কেরানির পোস্ট তো, হুড়-হুড় করে ফর্ম বিক্রি হচ্ছে মাইরি। এক ব্যাটা কাপুর তাল বুঝে হাজার হাজার ফর্ম সাইক্লোস্টাইল করে হোলসেল রেটে বাজারে ছাড়ছে। টাকায় দশখানা ফর্ম কিনলুম কাপুরের কাছ থেকে, আর বিক্রি হলো পনেরো পয়সা করে। তিরিশখানা ফর্ম বেঁচে পুরো দেড়টাকা পকেটে এসে গেলো।”

“কাপুর সায়েব তো ভালো বুদ্ধি করেছে,” সোমনাথ বললো।

সুকুমার বললো, “এদিকে কিন্তু কেলেংকেরিয়াস কাণ্ড। বাজারে কেউ জানে না—মিনিস্টারের সি-এর সঙ্গে দেখা না করতে গেলে আমার কানেও আসতো না। পনেরোটা পোস্টের জন্যে ইতিমধ্যে এক লাখ অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছে। সেই নিয়ে ডিপার্টমেন্টে প্রবল উত্তেজনা। টপ অফিসার দরবার মিনিস্টারের সি-এর সঙ্গে দেখা করে গেলো।”

‘তাহলে ওদের টনক নড়েছে। দেশের অবস্থা কোনদিকে চলছে ওরা বুঝতে পেরে ছোটাছুটি করছে,” সোমনাথ খবরটা পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলো।

“দূর, দেশের জন্যে তো ওদের ঘুম হচ্ছে না। ওরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। এক লাখ অ্যাপ্লিকেশন ইতিমধ্যে এসে গেছে শুনে সি-এ বললেন, কীভাবে এর থেকে সিলেকশন করবেন?

“অফিসার বললেন, সিলেকশন তো পরের কথা। তার আগে আমি কী করবো তাই বলুন? প্রত্যেক অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে তিন টাকার ক্রসড্‌ পোস্টাল অর্ডার এসেছে। তিন টাকার পোস্টাল অর্ডার হয় না, তাই মিনিমাম এক টাকার তিনখানা অর্ডার প্রত্যেক চিঠির সঙ্গে এসেছে। তার মানে এক লাখ ইনট, থ্রি অর্থাৎ তিন লাখ ক্রসড্‌ অর্ডারের পিছনে আমাকে সই করতে হবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা দেবার আগে। সব কাজ বন্ধ করে, দিনে পাঁচশোখানা সই করলেও আমার আড়াই বছর সময় লেগে যাবে। অথচ ফাইনানসিয়াল ব্যাপার, সই না করলেও অডিট অবজেকশনে চাকরি যাবে।”

হা-হা করে হেসে উঠলো সুকুমার। বললো, “লোকটার মাইরি, পাগল হবার অবস্থা। বলছে, হোল লাইফে কখনও এমন বিপদে পড়েনি।

কোন ডিপার্টমেন্ট রে?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো। তারপর উত্তরটা শুনেই ওর মুখ কালো হয়ে গেলো। ওই পোস্টের জন্যেই আরো তিন টাকার পোস্টাল অর্ডার কিনতে যাচ্ছে সে।

সুকুমার বললো, “তোর তিনটে টাকা জোর বেঁচে গেলো। ওই টাকায় ফুটবল খেলা দেখে, বাদাম ভাজা খেয়ে আনন্দ করে নে।”

খেলার মাঠের নেশাটা সোমনাথের অনেকদিনের। সুকুমারও ফুটবল পাগল। দুজনে অনেকবার একসঙ্গে মাঠে এসেছে। সোমনাথ বললো, “চল মাঠেই যাওয়া যাক। সুকুমারের আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে। সে কিছুতেই সোমনাথের পয়সায় মাঠে যেতে রাজী হলো না।

সোমনাথের হঠাৎ অরবিন্দের কথা মনে পড়ে গেলো। সুকুমারকে বললো, “শুনেছিস, রত্নার সঙ্গে অরবিন্দের বিয়ে। বাড়িতে একটা কার্ড রেখে গেছে।”

সুকুমার বললো, “আমাকেও একটা কার্ড পাঠিয়েছে ডাকে। শুভবিবাহ মাক কার্ড দেখে বাড়িতে আবার কতরকম টিস্পনী কাটলো। ভেবেছিলাম, অরবিন্দর বিয়েতে যাবোহাজার হোক বর-কনে দুজনেই আমার ফ্রেন্ড। কিন্তু বিয়ে মানেই তো বুঝতে পারিস।”

সোমনাথ চুপ করে রইলো। সুকুমার বললো, “আমি ভেবেছিলাম, খালি হাতেই একবার দেখা করে আসবো। সেই শুনে আমার বোনদের কি হাসি। বললো, “তোর কি লজ্জা-শরম কিছুই রইলো না দাদা? লুচি-মাংস খাবার এতেই লোভ যে শুধু হাতে বিয়ে বাড়ি যেতে হবে?

সোমনাথের বোন নেই। সুতরাং বোনেদের সঙ্গে ভাইদের কী রকম রেষারেষির সম্পর্ক হয় তা সে জানে না।

সুকুমার বললো, “কণাকেও দোষ দিতে পারি না। ওর বন্ধুর বিয়েতেও নেমন্তন্নের চিঠি এসেছিল। উপহার কিনতে পারা গেলো না তাই বেচারা যেতে পারলো না।”

সোমনাথ বললো, “অরবিন্দ ছেলেটার ক্রেডিট আছে বলতে হবে। বেস্ট-কীন-রিচার্ডসের মতো কোম্পানিতে চুকেছে।”

সোমনাথের কথা শুনে সুকুমার ফিক করে হেসে ফেললো। “ক্রেডিট ওর বাবার। আয়রন স্টীল কনট্রোলে বড় চাকরি করেন—ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছেন।”

একটু থৈমে সুকুমার বললো, তবে ভাই আমার রাগ হয় না।”

“কেন?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।

“ওদের ব্যাচে বারোজন ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি নিয়েছে তার মধ্যে অরবিন্দই একমাত্র লোকাল বয়। আর সব এসেছে হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং তামিলনাড়ু থেকে। সব ভাগ্যবানের পিছনে হয় মামা না-হয় বাবা আছেন! অথচ অরবিন্দ বলছিল, “কোনো ব্যাটা স্বীকার করবে না যে দিল্লীতে বড়-বড় সরকারী পোস্টে ওদের আত্মীয়স্বজন আছেন। সবাই নাকি নিজেদের বিদ্যে বুদ্ধি এবং মেরিটের জোরে বেস্ট-কীন-রিচার্ডসে ঢুকেছে। কলকাতার ছেলেদের তো কোনো মেরিট নেই!? জানিস সোমনাথ, এই বেস্ট-কীন-রিচার্ডস যেদিন ঝনঝনওয়ালা কিংবা বাজোরিয়ার হাতে যাবে, সেদিন দেখবি সমস্ত মেরিট আসছে রাজস্থানে ওঁদের নিজেদের গ্রাম থেকে।”

সোমনাথ ও সুকুমার দুজনেই গম্ভীর হয়ে উঠলো। তারপর একসঙ্গে হঠাৎ দুজনেই হেসে উঠলো। সুকুমার বললো, “আমরা আদার ব্যাপারী জাহাজের খোঁজ করে মাথায় রক্ত তুলছি কেন? আমরা তো অফিসার হতে চাইছি না। আমরা কেরানির পোস্ট চাইছি। আর আমার যা অবস্থা, আমি বেয়ারা হতেও রাজী আছি।”

2 Comments
Collapse Comments

জনঅরণ্য উপন্যাসটি অসাধারণ। এভারগ্রিন বাংলা অনেক বিখ্যাত বই আমাদের পাঠকদের নাগালে নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ। শঙ্করের চৌরঙ্গি উপন্যাসটি এই ওয়েবসাইটে আপলোড করলে কৃতজ্ঞ থাকব।

Bangla Library (Administrator) May 20, 2018 at 10:05 am

ধন্যবাদ মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। আমরা চেষ্টা করব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *