৪. মাথা থেকে গলা অবধি

মাথা থেকে গলা অবধি ঢাকা কালো মাস্কটা খুলে নিতেই হাঁউমাউ করে উঠল ভজন ‘আমি কিচ্ছু করিনি স্যার, মাইরি বলছি। চুরি ছেন্তাই দাঙ্গা মারপিট কিচ্ছু না। আমি একদম সাধাসিধে ছেলে স্যার। টাকাটা বাগানে কুড়িয়ে পেয়েছি স্যার। আমাকে ছেড়ে দিন স্যার।’

অন্ধকার ঘরের কোণ থেকে একটা ভরাট কণ্ঠে ধমক ভেসে আসে, ‘চোপ। একদম চেঁচামেচি করবি না। যা যা প্রশ্ন করব, তার ঠিকঠাক উত্তর দিবি। তাহলে তোকে যেমন তুলে আনা হয়েছে, ঠিক তেমন ছেড়ে আসা হবে। আর যদি চালাকি করেছিস তো গলা কেটে ডাইনিজলায় ভাসিয়ে দেব। মনে থাকে যেন।’

ভজন আবার হাঁউমাউ করে উঠতে যাচ্ছিল, কাঁধে একটা ভারি হাতের চাপ পড়তে চুপ করে গেল সে।

‘তারপর ভজনবাবু, ভূপেন দারোগা থানায় কী বলল?’

ভজনের গলা দিয়ে স্বর ফুটল না। গলার স্বরটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে না?

‘বলল এসব ডায়েরি ফায়েরি নিয়ে বিরক্ত করলে তোকে লক আপে চালান করে দেবে, তাই তো?’

‘ভূপেন দারোগার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি স্যার। আমি গরিব লোক স্যার। মারধোর করে পয়সাকড়ি কিচ্ছু পাবেন না স্যার…’

‘আহ, শাট আপ, একটাও বাড়তি কথা বলবি না। স্যার স্যার করে মাথা খারাপ করে দিল একেবারে।’

‘আচ্ছা স্যার।’ ভজন মিইয়ে যায় একেবারে।

‘একটা কথা বল তো ভজন, টাকা পয়সা নিয়ে মানুষ কী করে?’

আচমকা এরকম একটা দার্শনিক প্রশ্ন আশা করেনি ভজন। সে মাথা চুলকোতে গিয়ে আবিষ্কার করল যে তার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা।

‘আজ্ঞে ভালো খায় দায়, বই টই কেনে, ঘুরতে টুরতে যায়।’

‘হুম। আর অনেক অনেক টাকাপয়সা পেলে?’

‘আজ্ঞে অনেক অনেক ভালো খায় দায়, অনেক অনেক বই কেনে, অনেক অনেক ঘুরতে টুরতে যায়।’

বলতে বলতে চারিদিকে একবার তাকিয়ে নেয় ভজন। যে জায়গাটায় ওকে এনেছে সেটা একটা অন্ধকার ঘর। মুখের ওপর একটা লাইট ফেলা আছে বলে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আন্দাজে মনে হল যে লোকটা প্রশ্ন করছে সেটাই লিডার। বাকি আরও দুজন আছে, সে দুটো নির্ঘাত এর স্যাঙাৎ হবে।

‘তা ভজন, এমন অনেক অনেক টাকাপয়সার খবর চেপে রাখাটা যে ভালো কথা নয় সেটা তোকে কেউ কোনওদিন বলে দেয়নি?’

ভজন চুপ করে থাকে।

এবার লোকটা সামনে এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ভজনের সামনে বসে, ‘ডায়েরিটা চাই রে ভজন? কোথাও ওটা?’

লোকটাকে দেখে ভজন এত অবাক হয়ে গেল যে কিছুক্ষণ মুখে কথা ফুটল না। তারপর তুতলে তুতলে বলল, ‘আ আ আপনি?’

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাক চিনতে পেরেছিস দেখে ভালো লাগল। বিস্তারিত আলাপ পরিচয় না হয় পরে একদিন হবে। আপাতত ডায়েরিটার খোঁজ না পেলে যে চলছে না ভজনবাবু।’ বলে ঝুঁকে এল লোকটা, ‘ওটা চাই, এখনই।’

ভজন শুকনো গলায় বলল, ‘আমার ঝোলায় আছে।’

লোকটা ঠাস করে একটা চড় কষাল ভজনের গালে। ‘সেটা পেলে কি তোকে এখানে বসিয়ে রাখার প্রয়োজন হত মর্কট? তোর কি মনে হয়, আমি তোর সঙ্গে ইয়ার্কি করছি?’

থাপ্পড়টা খেয়ে একেবারে বুঝভুম্বুল হয়ে গেল ভজন। জন্মাবধি তার গায়ে কেউ হাত তোলেনি। থাপ্পড়ের তো প্রশ্নই ওঠে না। গালটা জ্বালা করছিল তার, অপমানে চোখ ফেটে জল আসছিল। সে ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘মাইরি বলছি, ডায়েরিটা আমার ঝোলাতেই আছে। না বিশ্বাস হলে দেখে নিন।’

লোকটা উঠে গেল। তারপর ঝোলাটা এনে উপুড় করে ফেলল ভজনের কোলে। ঝরঝর করে ভিতরের জিনিসগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল চারিদিকে। তার মধ্যে ডায়েরিটার কোথাও কোনও চিহ্ন নেই।

ভজন বেকুবের মতো চেয়ে রইল সেদিকে। লোকটা কঠিন গলায় বলল, ‘কী রে ভজন, ডায়েরিটা দেখতে পাচ্ছিস কোথাও?’

ভজন শূন্য চোখে সেদিকে চেয়ে রইল। এত কষ্ট করে সামলে সুমলে রাখা ডায়েরিটা নেই? কিন্তু কীভাবে?

পেছন থেকে কে যেন ভজনের চুল টেনে ধরল সজোরে। সামনের লোকটা শীতল খুনে গলায় বলল, ‘বেশি চালাকি শিখেছিস, না রে ভজন? মনে করানোর অনেক উপায় আমাদের জানা আছে কিন্তু। সেসব দেখতে চাস নাকি?’

ভজনের চোখে জল চলে এল। সেই অবস্থাতেই সে বলল ‘মাইরি বলছি স্যার। ডায়েরিটা নিয়ে ভূপেন দারোগার কাছে গেছিলাম। আসার সময়েও সেটা ঝোলাতেই ছিল।’

‘তারপর সেটা ঝোলা থেকে কর্পূরের মতো উবে গেল, তাই না?’

ভজন ছলছল চোখে সামনের লোকটার দিকে চেয়ে রইল। লোকটা সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের স্যাঙাত দুটোকে বলল, ‘এর হাত দুটো খুলে দে। এক গ্লাস জলও দিস। মনে হচ্ছে ছোকরা সত্যি কথাই বলছে।’ তারপর ভজনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তারপর ভজনবাবু, ভালো করে গুছিয়ে বল তো, ভূপেনের ওখান থেকে বেরোবার পর কী কী হল?’

জলের গ্লাসটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করল ভজন। তারপর পুরোটা খুলে বলল। ট্রেনের সেই লোকটার সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে তার ওপর ‘কাদের যেন’ ঝাঁপিয়ে পড়া অবধি।

লোকটা খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ভজনের দিকে। তারপর বলল, ‘লোকটাকে কেমন দেখতে?’

লোকটার শীতল খুনে চোখ দেখে ভয় করছিল ভজনের। তবুও তার মধ্যেই থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে যথাসাধ্য বর্ণনা দিল সে।

‘গলার স্বর চেনা মনে হয়েছিল?’

ভজন মাথা নাড়ে। বলে, ‘গলাটা ঘষা ঘষা স্যার। প্রথমবার শুনে চেনা চেনা লাগছিল বটে। কিন্তু কার গলা সেটা সেটা অনেক মনে করেও…’

 পিঠে একটা কিল নেমে আসাতে সামনে মুখ থুবড়ে পড়ল ভজন। উঠে বসতে একটু সময় নিল সে। তারপর হাউমাউ করে বলল ‘জানি না স্যার, মাইরি বলছি। তবে গলাটা রিসেন্টলি শুনেছি, এইটুকু বলতে পারি।’

লীডার গোছের লোকটা একটা ছবি সামনে ধরে ভজনের। জিজ্ঞেস করে, ‘এই লোকটাকে চিনিস ভজন?’

ছবিটা খুব মন দিয়ে দেখে ভজন। তার চোখে যেন ধাঁধা লাগে।

 উদভ্রান্ত মুখে চারিদিকে চাইল ভজন, ‘সে তো বলতে পারব না স্যার। তবে কাছাকাছি দেখতে।’

‘বলতে পারব না শোনার জন্য তো এতদিন ধরে এখানে থানা গেড়ে বসিনি রে ভজন।’ লোকটা ফের এগিয়ে এসে ভজনের মুখোমুখি বসে। ভজন একটা ঢোঁক গিলে বলে, ‘একবার মনে হচ্ছে চিনি। কিন্তু ঠিক করে বলতে পারছি না স্যার। মাইরি বলছি।’

ভজনের পিছনে দাঁড়ানো স্যাঙাতটা বোধ হয় আবার কিছু একটা করার জন্য হাত ওঠাচ্ছিল। লীডার লোকটা থামাল তাকে। তারপর অন্য লোকটাকে বলল, ‘মনে হচ্ছে ভজন সত্যি কথাই বলছে মোহান্তি। আমাদের চিড়িয়া যে সে চিড়িয়া নয়, সে এক আজব যন্তর, অনেক উঁচু দরের জিনিস। নিখুঁত মেক আপ করতে তার জুড়ি নেই, আর অন্তত সাত থেকে আট রকম গলায় কথা বলতে পারে। সে ভজনের চোখে ধুলো দেবে তাতে আর আশ্চর্য কী?’ বলে লোকটা ভজনের দিকে ফিরল, ‘আর ভজনবাবু, একটা কথা বলো তো, যে লোকটা তোমার ঝোলা থেকে হাতসাফাই করে ডায়েরিটা নিয়ে গেল, তাকে হাতের কাছে পেলে তুমি কী করবে?’

ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছিল, সেটা হাতের চেটো দিয়ে মুছে নেয় ভজন। অনেকক্ষণ ধরে একটু একটু করে তার মাথায় রাগ চড়ছিল। সে সিধেসরল ছেলে, জীবনে এত হ্যাঙ্গাম পোহায়নি। তার ঘরে দারিদ্র্যে থাকলেও অসুখ ছিল না। এই কালান্তক ডায়েরি এসে তার জীবনটা একেবারে তছনছ করে দিল। এত হেনস্থা, এত মারধরও কপালে ছিল তার? রাগে ক্ষোভে দুঃখে আর থাকতে পারল না ভজন। ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলল সে।

উঠে দাঁড়ায় লোকটা, তারপর ‘ব্যস ব্যস, এতেই হবে। মোহান্তি লেটস স্টার্ট নাউ। আমার ধারণা আজ রাতেই এই ঘুঘুডাঙার গুপ্তধনের বখেরা মিটে যাবে।’

মোহান্তি একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ওঁর সঙ্গে কি আপনার কথা হয়েছে?’

চওড়া হাসলেন প্রবাল চ্যাটার্জি, ‘হ্যাঁ মোহান্তি, হয়েছে। হি উইল জয়েন আস অ্যাজ ওয়েল। ভজনবাবুকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাক নাকি?’

মোহান্তি আপত্তি করার আগেই ভজন উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আমি যাব। যাবই।’

‘চলুক তাহলে। ভালো টোপ হবে।’

* * *

রাত প্রায় একটা। গ্রামের অন্ধকার মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল একটা জিপ। তার ইঞ্জিনের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছিল ঠান্ডা বাতাসে। জিপ চালাচ্ছে যে মানুষটি, চোখ ছাড়া তার সারা মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। পাশের সিটে বিষ্টুচরণ, ঘন ঘন আঙুল মটকাচ্ছে, তার চোখে মুখে খেলা করছে চাপা উদ্বেগ। সে তুলনায় জিপচালক অনেক স্থির।

খানিক বাদে বিষ্টুচরণ বলল, ‘পার্টনার, কী খবর দিল মাস্টার?’

‘ওরা কোনওভাবে টের পেয়েছে যে আমরা আজই অ্যাকশনে নামব। তাই আর দেরি করেনি। আজ রাতেই কাজ সারতে বেরিয়ে পড়েছে।’

‘কিন্তু ওরা বলতে কারা? তারা আবার এর মধ্যে এল কী করে?’

‘জানি না, অকুস্থলে গেলেই বোঝা যাবে।’

‘আমাদের মাস্টারকে ডেকে নিলে হত না?’

‘মাস্টার জানে। সে আসছে।

‘একটু বেশি রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না?’

‘তা হয়তো যাচ্ছে। কিন্তু এ ছাড়া উপায় কী?’

গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা বড় বড় বটগাছ। তার নীচে জিপটা দাঁড় করাল জিপের চালক। দুজনে নামল জিপ থেকে, তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে চলল গ্রামের ভিতরে।

মিত্তিরবাড়ি পৌঁছতে লাগল মিনিট দশেক। অন্ধকারে জমিদার বাড়িটা যেন থমথম করছে। চারিদিকে একটা ঝড়ের আগের চুপচাপ আভাস। দরজার সামনে একটু থমকে দাঁড়াল বিষ্টু। তার সঙ্গী চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল?’

‘কোথাও কোনও আওয়াজ নেই কেন পার্টনার?’

‘রাতের বেলায় আপনি ঠিক কীসের আওয়াজ আশা করছেন জানতে পারি স্যার?’ অধৈর্য ব্যঙ্গোক্তি ভেসে এল।

‘অন্তত কুকুরের আওয়াজ। গ্রামের ভিতর দিয়ে এতটা রাস্তা এলাম, একটা কুকুরের ডাক শোনা গেল না?’

দাঁত চিপে সঙ্গী লোকটি বললেন, ‘তার মানে ওরা এসে গেছে।’ তারপর কোমর থেকে ছোট কী একটা হাতে তুলে নিল। বিষ্টু বুঝল ওটা কী। বলল ‘আমার সঙ্গে কিন্তু কোনও আর্মস টার্মস কিছু নেই।’

লোকটি চাপা গলায় বলল, ‘অস্ত্র লাগবে না।’

জুতোর ডগাটা দিয়ে সদর দরজায় মৃদু চাপ দিল বিষ্টু। দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল।

কালচে নীল আকাশের বুকে দৈত্যের মতো জেগে আছে মস্ত জমিদারবাড়ি। চারিদিন শুনশান। দুজনে লাফিয়ে উঠে এল বাঁ দিকের বারান্দায়, পা টিপে টিপে এগোতে থাকল।

প্রথম দুটো ঘর নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল দুজনে। কিন্তু থমকাল তৃতীয় ঘরের সামনে এসে। বিষ্টু চাপাস্বরে বললেন, ‘কী হল?’

অন্য লোকটা ফিসফিস করলেন, ‘শোনা যাচ্ছে না?’

চুপ করে নিজের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দটাও আটকাবার চেষ্টা করল বিষ্টু। তারপর নির্ভুলভাবে শুনতে পেল শব্দটা।

ঘরের ভিতর থেকে একটা চাপা গোঙানির শব্দ আসছে। ইংরেজিতে যাকে বলে মাফলড ভয়েস। খুব সতর্ক কান না হলে বোঝা মুশকিল।

উদ্বিগ্ন হয়ে সঙ্গীর দিকে তাকাল বিষ্টু, ‘কেউ আছে মনে হচ্ছে।’

মাথা নাড়ল সঙ্গী লোকটি। দাঁতে দাঁত চিপে বলল, ‘কাউকে বেঁধে রাখা হয়েছে।’ বলেই সামনের দরজাটা হাত দিয়ে খুলতে গেলেন।

তার হাত চেপে ধরলেন বিষ্টু, ‘এ কী করছ পার্টনার? যদি ফাঁদ হয়?’

লোকটি চাপা গলায় বলল, ‘আমাকে ফাঁদে ফেলা অত সহজ না। আপাতত আমি যা করছি চুপচাপ দেখে যাওয়াই ভালো।’

ভজন চুপচাপ বসেছিল ঘরটার ভিতর। তাকে বেশ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে গেছে চেয়ারের সঙ্গে। ফলে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া তার পক্ষে অন্য কিছু সম্ভবও ছিল না। ঘুঘুডাঙার রাজবাড়িতে অনেক বারই এসেছে সে। কিন্তু এই ঘরে সে কখনোই ঢোকেনি। সত্যি কথা বলতে কি যখন তাকে এই ঘরে বেঁধে রাখা হচ্ছিল, তখনই ঘরের মধ্যে থাকা দামি দামি জিনিসপত্তর দেখে তার মাথা ঘুরে গেছিল তার।

চেয়ারে বাঁধা অবস্থাতেই আকাশ পাতাল ভাবছিল ভজন। আজ বিকেল থেকেই তার সঙ্গে যা যা ঘটছে সেটা মাথায় ঢুকছিল না তার। তার মধ্যে ছাই লখাই কাকারও কোনও খোঁজ নেই। ভজনের মনে হচ্ছিল যেন সবাই মিলে তাকে এক ভয়ানক আতান্তরে ফেলে উধাও হয়ে গেছে। বসে বসে সামান্য ঝিমুনি আসছিল ভজনের। হাজার হোক ঝক্কি তো দিনভর কম যায়নি তার ওপর দিয়ে। মাথাটা নেমে এসেছিল বুকের কাছে। এমনকি মন দিয়ে শুনলে ঘুঁড়ুর ঘঁড়ৎ করে নাক ডাকার আওয়াজ অবধি পাওয়া যাচ্ছিল।

এমন সময় কানের কাছে একটা চেনা বিনবিনে স্বর পেয়ে সচকিত হয়ে উঠল ভজন। কে যেন তার মগজের মধ্যে সেঁধিয়ে বলছে, ‘ও রে ভজু, সোনা আমার, ঘুমোলি নাকি বাপধন?’

ভজন আরেকটু হলে লাফিয়ে উঠত প্রায়। কিন্তু লীডার লোকটা বলে গেছে চেপেচুপে থাকতে। তাই সে অন্ধকারের মধ্যেই যতটা সম্ভব দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘বাব্বা, তাহলে শেষমেশ শো দিতে এলে যাই হোক। তা এদ্দিন ছিলে কোথায় কাকা? অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রগড় দেখছিলে?’

লখাই গম্ভীর স্বরে বলল, ‘নিজের কাকার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বল ভজু। পইপই করে শিখিয়েছিলাম না, গুরুজনদের সঙ্গে ভক্তিটক্তি দিয়ে কথা কইবি?’

ভজন ওই অন্ধকারের মধ্যেই তীব্র দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘ভক্তি গ্যয়ি তেল লেনে। বলি সেদিন গুচ্ছের জ্ঞানট্যান দিয়ে সেই যে উধাও হলে, তারপর আজ এখানে কী মনে করে?’

‘দেখ ভজু, খামোখা মাথা গরম করিসনি। এখন কী নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির সময়? গেছিলাম একটু ও পাড়ায় বেড়াতে। তোর বাপের সঙ্গে দেখা হল। গঙ্গাপদ দাদুর সঙ্গেও আড্ডা হল খানিক। রঘুপতি ঠাকুদ্দা তো ছাড়তেই চাইছিলেন না। সে তো জড়িয়ে টরিয়ে ধরে কী আদর কী আদর…’

ভজন তেড়িয়া হয়ে বলল, ‘ইঃ, কচি খোকা আমার, বুড়ো দাদুর কোলে শুয়ে আদর খাচ্ছেন। ইদিকে যে ঝোলা থেকে যে ডায়েরিটা হাপিস করে নিয়ে গেল, তার বেলা কী কচ্ছিলে শুনি?’

এবার অন্য একটা স্বর শোনা গেল, লখাইয়ের থেকে একটু ভারি। ‘সেটা আমরা ভেবেচিন্তেই করতে দিয়েছি রে ভজন। নইলে কাজটা এগোচ্ছিল না। বলি ফুটবল খেলা দেখেছিস তো?’

ভজন তুম্বোমুখে বলল, ‘হ্যাঁ দেখেছি।’

‘সেরা খেলোয়াড় কি সবসময় নিজের পায়ে বল রাখে রে পাগলা? সে খেলায়, সবাইকে দিয়ে খেলায়। খেলাতে খেলাতে টুক করে শেষে গিয়ে গোলটা করে দিয়ে আসে। এটাও সেরকম ধরে নে। ধরে নে বলটা না হয় এখন অন্যদের পায়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তারা খেলতে খেলতে বলটা গোলের কাছে এলেই ফেলেছে প্রায়। এরপর টুক করে গিয়ে পা ছুঁইয়ে জালে জড়িয়ে দিতে হবে, এই যা।’

ভজন গম্ভীরস্বরে বলল, ‘তা খেলাটা এখন কোন পর্যায়ে আছে বেজাকাকা? হাফটাইম হয়েছে?’

‘খেলা শেষ হয়ে এসেছে রে ভজন। এখন এক্কেবারে চোখ কান খোলা রেখে টানটান হয়ে বোস দিকিনি। আজই ফয়সালা হয়ে যাবে কেসটার।’

ফের লখাইয়ের গলা শোনা গেল, ‘শোন ভজন, রঘু ঠাকুদ্দার কাছ থেকে কয়েকটা মন্তর জেনে এলুম বুঝলি। কানটা খোল, চুপিচুপি কয়ে দিই।’

‘কান খোলাই আছে কাকা, আমি হাতি নই যে ইচ্ছেমতো কান খুলতে আর বন্ধ করতে পারব।’

‘ইঃ, ছোঁড়ার ট্যাকট্যাকে কথা শোনো। মনে হয় দুম করে পিঠে কিল বসিয়ে দিই হতচ্ছাড়ার।’

‘আহ, তোরা ফের শুরু করলি? তাড়াতাড়ি কর লখাই। ওরা এসে পড়ল প্রায়।’

কিছুক্ষণ পর দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকল দুটো ছায়া। একজনের হাতে একটা টর্চ। সেটা জ্বলে উঠতেই আলোর রেখা এসে পড়ল ভজনের মুখে। একটা উল্লাসের শব্দ শোনা গেল, ‘বাহ বাহ, এ যে দেখছি ট্রী’তে না উঠেই এক কাঁদি পার্টনার। মক্কেল তো দেখছি এখানেই বডি ফেলেছে।’

দু-জোড়া পায়ের শব্দ এগিয়ে এসে দাঁড়াল ঘুমের ভান করে পড়ে থাকা ভজনের সামনে এসে। বিষ্টুর সঙ্গী চিন্তিতস্বরে লোকটি বলল, ‘এ তো ভালো লক্ষণ নয়।’

‘হোয়াই পার্টনার, হোয়াই?’

‘এ এখানে কেন? একে বেঁধে রেখেই বা গেল কে?’

‘আমার মনে হয় এ বোধহয় ডায়েরিটা হারিয়ে ফেলে দিশেহারা হয়ে এখানে এসে পড়েছে, বুঝলে হে। ব্যাটা ভেবেছে যারা ডায়েরি চুরি করেছে তারা এখানেই আসবে, আর ও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ডায়েরিটা কেড়ে নেবে, হে হে। আর মাস্টার তখন একে দেখতে পেয়ে দুটো রদ্দা মেরে কাবু করে বেঁধে রেখে গেছে।’

‘চিন্তাভাবনা যে খুবই শিশুসুলভ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মাস্টার কই?’

‘হবে কোথাও আশেপাশেই। আপাতত ছোঁড়াকে উদ্ধার করা যাক। হয়তো এই ডায়েরিটার হেঁয়ালির ব্যাপারে কিছু বলতেও পারে। কী বলো?’

কথাগুলো শুনতে শুনতে জমে যাচ্ছিল ভজন। বিষ্টু নয়, তার সঙ্গী লোকটির গলা শুনে। হায় ঈশ্বর! শেষে এই লোকটা? এর কথা তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি!

ঠিক সেই সময়েই মগজের মধ্যে কেমন যেন একটা ধোঁয়াশা মতো ছেয়ে গেল ভজনের। মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে উঠল, তারপর চেতনা টেতনা সবকিছু নিঃসাড়ে শুয়ে পড়তে লাগল। মনে হল তার হাত পা কোন মন্ত্রবলে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। আর তখনই কে যেন সামান্য খোনা গলায় বলে উঠল, ‘ভয় পাসনি নাতি। লখাইয়ের কাছে সব শুনলুম বটে। আমার বংশধরকে তারই বাড়ি থেকে উৎখাত করবে এত সাহস ওই বিষ্টুর? তাই তো সব ছেড়েছুড়ে নেমে এলুম রে খোকা। হাজার হোক তুই আমার রক্ত বটেক। এবার শরীরটা ছেড়ে দে দেখি। বাকি যা করার আমি আর লখাইই করছি। রমেনবাবুমশায় তো এমনি এমনি আমাকে তেনার ডান হাত বানাননি।’

দ্বিতীয় লোকটা একটা ছুরি বার করল পকেট থেকে। তারপর সেটা দিয়ে দড়িগুলো কাটল এক এক করে। দড়ি কাটা শেষ করে বিষ্টুর কাছ থেকে একটা জলের বোতল চেয়ে নিল। তারপর সেখানে থেকে আঁজলা করে জল নিয়ে ভজনের মুখে ছিটিয়ে দিল খানিক।

ভজন অনেক চেষ্টা করে চোখটা খুলল। তারপর সামনের লোকটার দিকে চেয়ে সামান্য অচেনা গলায় বলল, ‘এ কী মাস্টারমশাই, আপনি এখানে?’

গগন মল্লিক পকেট থেকে একটা লাল রঙের ডায়েরি বার করে বাঁকা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ রে ভজন, আমিই। এবার ডায়েরিটার সংকেতের ব্যাপারে সুড়সুড় করে যা জানিস বলে ফেল দেখি। মাস্টার অনেক আশা করে বসে আছে যে।’

* * *

তিনজন লোক নাটমন্দিরের ভিতরে দাঁড়িয়েছিল স্থির হয়ে। তাদের সবার কানে অত্যাধুনিক মাইক্রোফোন বসানো। অতন্দ্র অটল প্রহরীর মতো তারা কান পেতে ছিল পাশের ঘরে ঘটে যাওয়া কথোপকথনের দিকে।

মোহান্তি ‘অস্ফুটে বলল, মাই গড! গগন মল্লিক? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না স্যার।’

প্রবাল চ্যাটার্জি দাঁত চেপে চেপে বলল, ‘বোঝা উচিত ছিল মোহান্তি। ডায়েরিটা খুঁজে পাওয়ার পর ভজন যে দুজনকে সে ব্যাপারে জানিয়েছিল তাদের মধ্যে গগন মল্লিকও ছিল। আমরা বোকা তাই এই সহজ সত্যিটা বুঝতে পারিনি।’

‘কিন্তু মাস্টার? এই মাস্টার আবার কে?’

প্রবাল চ্যাটার্জি কিছু জবাব দেওয়ার আগেই মাইক্রোফোনে অন্য কিছু ভেসে এল। তিনজনে উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন।

‘এটা কী বলছে স্যার?’

ভুরু কুঁচকে গেল প্রবালের, ‘খুব সম্ভবত ডায়েরিতে লেখা সংকেতগুলো বলছে ভজন।’

‘কিন্তু ভাষাটা তো চেনা লাগছে না।’

‘চেনা লাগার কথা মোহান্তি। ওটা কিন্তু বাংলা।’

‘সে কী? শুনে বুঝতে পারছি না কেন?’

‘কারণ ওটা একটু পুরোনো বাংলা। সামান্য মাথা ঠান্ডা করে শুনলেই কথাগুলো বুঝতে পারবে। এমন কিছু শক্ত নয়। তবে চিন্তা অন্য জায়গায়।’

‘কী স্যার?’

প্রবাল চ্যাটার্জি কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই ভেসে এল দরজা খোলার শব্দ। চুপ করে গেল বাকি দুজন।

দরজার বাইরে তিনটে পায়ের শব্দ। ধীরে ধীরে তারা মিলিয়ে গেল। একটু অপেক্ষা করে বেরিয়ে এল এই তিনজন।

‘ওরা কোনদিকে গেল স্যার?’

‘খুব সম্ভবত বুড়োশিবের মন্দিরের দিকে।’

আরও তিনটে পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

* * *

বহুদিন বাদে বুড়োশিবের মন্দিরে আলো জ্বলেছে ফের। মন্দিরের মধ্যে দুটো ছোট কিন্তু শক্তিশালী এল ই ডি ল্যাম্প জ্বলছে। তাতে গর্ভগৃহ আলোয় আলোময়। মন্দিরের বাইরে চার পাঁচটা লোক ঘুরছে। তাদের মধ্যে করিম খাঁ আর হরেকৃষ্ণকে চেনা যাচ্ছে। আর চেনা যাচ্ছে আরেক জনকে, গনুচোর।

মন্দিরের দরজার ঠিক সামনে তিনটে লোক। তাদের মধ্যে একজন মাঝের লোকটিকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘কী হে মিস্টার ভজন, এসব দেখে সেন্টেন্স হরে গেল নাকি? বলি অ্যারেঞ্জমেন্ট তো সব দেখছিস। আজই রমেন্দ্রনারায়ণের লুকিয়ে রাখা হিডেন ওয়েলথের একটা ফাইনাল সলিউশন হয়ে যাবে, বুঝলি। তবে কি না এর ওপরে তোর শেয়ারও তো কম নয়, তাই ট্রুথলি স্পিকিং, তুই একটু হেল্প করলে তোকে আমরা চীট করবো না, ন্যায্য শেয়ারই পাবি।’

ভজন সামান্য অচেনা গলায় বলল, ‘সে তো বটেই, সে তো বটেই। আমরা কত পুরুষ ধরে মিত্তিরবাড়ির নিমক খেয়ে আসছি, তার ধনসম্পত্তি উদ্ধার করায় একটু সাহায্য করব না?’

বিষ্টুনারায়ণ অবাক স্বরে বলল, ‘এ আবার কী বলছে পার্টনার?’

গগন মল্লিক খানিক ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘লক্ষণ ভালো না। এর গলার স্বর পালটে গেল কী করে? গলাটা চেনা চেনা লাগছে না?’

বিষ্টুচরণ একটু রাগতস্বরে বলল হয়ে ‘এসব ভুলভাল স্পিকিং বন্ধ করে ওয়ার্কে লেগে পড় ভজন। ডায়েরিটায় কী বলা আছে কিছু বুঝতে পেরেছিস?’

ভজন একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলল, ‘আমি মুখ্যুসুখ্যু ম্যান স্যার। গগন স্যার সব জানেন, ওনাকেই জিজ্ঞেস করুন। উনিই তো সাত ক্লাসের পর ডেকে বললেন ‘ওরে, মা সরস্বতীকে আর কষ্ট দিসনি। একে ভদ্রমহিলার বয়েস হয়েছে, তার ওপর হার্টও দুর্বল…’

গগন মল্লিক বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘শাট আপ ভজন, কী আজেবাজে বকছিস? সাত ক্লাস কোথায়, তুই তো মাধ্যমিক অবধি পড়েছিস। সাত ক্লাস অবধি পড়েছিল তোর কাকা। সে সব তো তোর জানার কথা নয়।’

বিষ্টুচরণ হাঁ হাঁ করে উঠে বলল ‘আহা, এখন আবার অ্যাংরা-অ্যাংরি কেন পার্টনার। এখন যাকে বলে হেড কুল রেখে কাজ কাজ রেসকিউ করতে হবে। ও বাবা ভজন। এসব বাজে কথা বাদ দিয়ে কাজের কথায় আয় না বাপ।’

গগন মল্লিক ডায়েরিটা বার করে ছড়াটা ফের আবৃত্তি করলেন,

গোপন ধনেরে খোঁজে যে জন ইঙ্গিতে বোঝে

 লীন হয়্যা যায় অজপদে।

কুঞ্জিকায় খোলে দ্বার দ্বারে খোলে কুঞ্জিকার

 সন্ধানী বুঝেন চিত্রপটে।

এর মানে কী?

ভজন বলল, ‘এর মানে হল দরজাটাই চাবি আর চাবিটাই দরজা। ছবি দেখে বুঝতে পারছেন না?’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ যেটা খুলতে হবে, আর যা দিয়ে খুলতে হবে সে দুটো আসলে একই জিনিস।’

‘সে আবার কী রকম কথা?’ অবাক হল বিষ্টুচরণ।

‘এর মানে একটাই দাঁড়ায় বিষ্টুবাবু। গুমঘর বলে কিছু নেই। ওটার কথা রটানো হয়েছিল লোকজনকে ভুল বোঝানোর জন্য। যা আছে তা এমন জায়গায় আছে যেটা সবার সামনেই খোলা পড়ে আছে, আবার নেইও। তার সন্ধান পেতে হলে অজর পায়ে বিলীন হয়ে যেতে হবে।’

‘অজর পায়ে বলতে? অজ মানে তো ছাগল।’ সন্দিগ্ধস্বরে প্রশ্ন করেন গগন মল্লিক।

ভজন হাসিমুখে শিবলিঙ্গের দিকে ইঙ্গিত করল। গগন মল্লিক খানিকক্ষণ ভুরু টুরু কুঁচকে ভজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তাঁর মুখ থেকে ধীরে ধীরে সন্দেহের ভাবটা চলে গেল সহসা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন ‘তাই তো, অজ মানে তো যার জন্ম হয়নি, যে স্বয়ম্ভু, শাশ্বত। শিবের আরেক নাম অজ বটে।’

‘জয় শিবশম্ভো,’ বলে মাথায় হাত ঠেকাল বিষ্টু, তারপর গদগদচিত্তে বলল, ‘জগদানন্দ স্বামী বলেছিলেন বটে। তাহলে কি একটা পূজাপাঠের অ্যারেঞ্জমেন্ট শুরু করতে বলব পার্টনার?’

কথাটার উত্তর দিলেন না গগন মল্লিক। খানিক ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন, তারপর একটা এল ই ডি টর্চ নিয়ে উপুড় হয়ে পড়লেন শিবলিঙ্গের একেবারে গোড়ার দিকে, নিবিষ্ট মনে কী যেন খুঁজতে পাগলেন। বিষ্টুচরণ ভারী আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘ওখানে কী খুঁজছ পার্টনার?’

গগন মল্লিক উত্তর দিলেন না। তিনি মন দিয়ে গৌরীপট্টের নীচের দিকটা দেখছিলেন। খানিকটা দেখে উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘আয়না, একটা আয়না চাই, এক্ষুনি।’

বিষ্টুচরণ ভাবিত মুখে বলল, ‘আয়না পাব কোত্থেকে? যতীনকাকা আর হেমনলিনীদিদি ওয়েক আপ থাকলে না হয় একটা আয়না আস্ক করে আনা যেত। কিন্তু দুইজনের ডিনারেই আজ কড়া করে স্লিপের ওষুধ মিশিয়ে এসেছে গনুচোর। তাঁরা এখন ডেডবডির মতো ঘুমোচ্ছেন যে।’

গগন মল্লিক দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, ‘ইমপসিবল। আপনার কী ধারণা বিষ্টুবাবু, যতীনকাকা আর হেমদি জেগে থাকলে আমরা গিয়ে কী বলতাম? দিদি, একটা আয়না দাও, আমরা তোমাদের বুড়োশিবের মন্দিরে তোমাদের সম্পত্তি চুরি করতে এসেছি?’

বিষ্টুচরণ খানিকটা নিষ্প্রভ হয়ে বলল, ‘সেটাও একটা ফ্যাক্ট বটে। এসবই হচ্ছে গিয়ে মাস্টারের প্ল্যান। বাই দ্য রাস্তা, মাস্টারের কোনও খোঁজ পেলে? তার আসার কথা ছিল না এর মধ্যেই?’

গগন মল্লিক একটু চঞ্চল হয়ে বললেন, ‘সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। হল কী লোকটার?’

এমন সময়ে গনুচোর ফস করে একটা আয়না বার করে বলল, ‘এতে কাজ চলবে স্যার?’

গগন মল্লিক আয়নাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘দৌড়বে, কিন্তু এটা পেলি কোথায় তুই?’

গনুচোর সামান্য লাজুক হেসে বলল, ‘আজ্ঞে ভূপেন দারোগা আজ যখন ক্ষৌরি করে মুখ ধুতে গেছে, তখন ঝেঁপে দিইচি।’

গগন মল্লিক অবজ্ঞার সুরে বললেন, ‘তা সেই হোঁৎকাটা গেল কই? আজ এখানে ঝামেলা পাকাতে আসবে না তো?’

বিষ্টুচরণ বলল, ‘ওই মোষটার ব্যাপারে থিঙ্ক কোরো না পার্টনার, ওটাকে আমার হাতের তালুর মধ্যে ক্যাপচার করে রেখেছি। চাইকি এখন এখানে ডেকে ডিউটিতেও লাগিয়ে দিতে পারি, হে হে হে।’

গগন অবশ্য ততক্ষণে সেঁধিয়ে গেছেন গৌরীপট্ট’র নীচে। মাটিতে আয়নাটা রেখে কী যেন একটা দেখলেন, তারপর উল্লসিতস্বরে চেঁচিয়ে বললেন, ‘মার দিয়া কেল্লা। বিষ্টুবাবু, ডায়েরিটা নিয়ে আসুন আর একটা পেন।’

বিষ্টুচরণ আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি আর পেন? লাস্ট কবে পেন দিয়ে রাইট করেছি…’

গনুচোর একটা পেন বার করে গগন মল্লিকের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নিন স্যার, এটাও ভূপেন দারোগার। কাল যখন একটা ডায়েরি লিখে কোয়ার্টারে গেছে…’

গগন মল্লিক সেটা শুনছিলেন না। গৌরীপট্ট”র নীচের দিকে পাথরে খোদাই ছিল কয়েকটা শব্দ। আপাতদৃষ্টিতে তার কোনও মানে নেই, কিন্তু আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে উঠেছিল একটি অর্থবোধক বাক্য, ‘একে একে স্পর্শ কর ত্রয়ী-ত্রিপুণ্ড্রকে। অক্ষর গণিয়া আর চিত্রটিরে দেখে।’

গগন মল্লিক সেটা পড়তে পড়তে দ্রুত লিখে ফেলছিলেন ডায়েরিতে। লেখা শেষ হলে উঠে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘হরে, করিম, গনু, এক্ষুনি একটা উঁচু টুল আন কেউ, কুইক।’

বিষ্টুচরণ একটু এগিয়ে এসে গগন মল্লিকের কাছে একটু নীচু হয়ে বসলেন। তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে উদগ্রীবস্বরে বলল ‘কিছু বুঝতে পারলে পার্টনার?’

দাঁত চেপে উত্তর দিলেন গগন মল্লিক, ‘ নইলে আর টুল চাইব কেন বিষ্টুবাবু? ট্র্যাপিজের খেলা দেখাতে নিশ্চয়ই নয়।’

বিষ্টুচরণ একটু অপ্রতিভ হয়ে বললেন, ‘তা বটে। কিন্তু এখন টুল পাই কোথায়? ওরে গনু, বাবাসোনা আমার, থানা থেকে যদি একটা…’

গনুচোর কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘টুল তো আর আয়না না পেন নয় কত্তা, যে গেঁড়িয়ে পকেটে করে নিয়ে আসব।’

বিষ্টুচরণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আদেশ করল, ‘হরে, করিম, মিত্তিরবাড়ি থেকে একটা টুল নিয়ে আয় এক্ষুনি, যে করে হোক।’

যে সময়টা হরে আর করিম টুল আনতে নিল, সেই সময়টুকু সতর্ক চোখে চারিদিক দেখে নিলেন গগন মল্লিক। উত্তেজনায় তাঁর বুক কাঁপছিল ধুকধুক করে। বহুদিন ধরে, বহু কষ্টে এত ঘুঁটি সাজিয়েছেন তিনি। আজ তার কিস্তিমাতের দিন।

ব্রজনারায়ণ যেদিন জানতে পারেন যে তাদের মন্দির থেকে চুরি যাওয়া তিনটে সোনার পাতের একটা আছে বিষ্টুচরণের বাড়িতে, সে এসে সেই খবর প্রথম জানিয়েছিলেন তাঁর প্রাণের বন্ধু গগনকে। সেদিনই মনস্থির করেন গগন মল্লিক। ব্রজ মিত্তিরের বাড়ি থেকে পালাল তাঁরই পরামর্শে। এমনকি সে কথা বিষ্টুকে অবধি জানায়নি বেজা, তাকে এমনই বিশ্বাস করত ছেলেটা। যে পাঁচ বছর রতিকান্ত মল্লিকের বংশধরদের খোঁজে দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশের প্রায় পুরোটা চষে ফেলেছে বেজা, সেই পাঁচ বছর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল দুজনের মধ্যে। প্রথমে ল্যান্ডলাইনে, পরে মোবাইলে। বেজা নিয়মিত আপডেট পাঠাত তার বুজুম ফ্রেন্ড গগনাকে। প্ল্যান ছিল বেজা যদি প্রথম দুটো পাত যদি উদ্ধার করতে পারে, অন্তত তাতে কী লেখা ছিল সেটা, তবে ও ফিরে আসার পর বিষ্টুচরণের থেকে কোনও গতিকে তিন নম্বরটা বাগানো হবে। তারপর দুই বন্ধু মিলে উদ্ধার করবেন রমেন্দ্রনারায়ণের গুপ্তধন। সোজা কথায় যাকে বলে ডাবল ক্রস করা।

বেজাকে অবশ্য তারপর সরিয়ে দিতেন গগন। সে প্ল্যানও তাঁর তৈরিই ছিল।

গোপনে দাঁতে দাঁত ঘষলেন গগন মল্লিক। এই হুমদো বদমাশটা বেশি চালাক। ব্যাটা যে হামলা চালিয়ে ব্রজ আর লখাইকে একেবারে মেরেই ফেলবে সেটা ঘূণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেননি তিনি। জানার পর আক্ষেপে নিজেকে রক্তারক্তি করতে বাকি রেখেছিলেন গগন। দোষ তাঁরই। সেদিন অনেক আলোচনার পর তিনিই বেজাকে পাঠিয়েছিলেন বিষ্টুর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসার জন্য। তার যে এই পরিণতি হবে কে জানত?

বেশ একটা ঠান্ডা হাওয়া ভেসে আসছে পশ্চিম দিক থেকে। একটা রাতচরা পাখি ডেকে গেল টি টি টি করে। দূর থেকে ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে। একটু দূরে পাঁচিল ঘেঁষে একটা কালকাসুন্দের ঝোপ, সেখানে থোকা থোকা জোনাকি জ্বলছে। মন্দিরের ভিতর লাইটগুলো অনেক স্তিমিত। বিষ্টুচরণ নীচু গলায় গনুচোরের সঙ্গে কী একটা আলোচনা করছে। সঙ্গী অস্ত্রধারী লোকগুলো সামান্য বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদেশের অপেক্ষায়। ওরা মাস্টারের লোক। মাস্টারের কথা মনে হতে বহুদিন ধরে ভিতরে ভিতরে চেপে রাখা অস্বস্তিটা ফের মাথাচাড়া দিল গগন মল্লিকের। এই লোকটা যে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল কে জানে।

বেজা মারা যাওয়ার পর অনেক ভেবেচিন্তে উনি বিষ্টুচরণের কাছে গিয়ে সব কিছু খুলে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে পুরো ব্যাপারটাই উনি জানেন এবং বেজার অবর্তমানে এই মিশন উনি এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। সেদিন ভারী অবাক হয়েছিল বিষ্টু, তার সেই হতভম্ব থেকে ক্রমে খুশিয়াল হয়ে ওঠা মুখটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে গগনবাবুর। আর তিনি সেরকমই অবাক হয়েছিলেন যেদিন এই মাস্টারের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেয় বিষ্টু। লোকটার পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলেন গগনবাবু। এই মাস্টার লোকটাকে তিনি কোনওদিনই বিশ্বাস করেননি, এখনও করেন না। আর সবথেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে যে এই ব্যাপারে যত কম লোক জড়ায় তত ভালো। যারা আসবে তারা নিশ্চয়ই গুপ্তধনের ভাগ চাইতেই আসবে। আর গগন মল্লিকের থেকে ভালো আর কে জানে যে মিত্তিরবাড়ির গুপ্তধনের ভাগ তিনি কাউকেই দেবেন না? ব্রজকেও দিতেন না। বিষ্টুকেও দেবেন না। আর এই মাস্টার না কে, তাকে দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।

দেড়শো বছর আগে রতিকান্ত মল্লিক যে ধাঁধার সুতো খুলে গেছেন তাকে গুটিয়ে স্বস্থানে ফেরাবেন একমাত্র তিনিই। এই সম্পদ উদ্ধার করে তাকে ভোগ করবেন একমাত্র তিনিই।

হরেকৃষ্ণ আর করিম একটা টুল নিয়ে ফিরে এল। গগন চাপা গলায় বললেন, ‘টুলটা শিবলিঙ্গের গা ঘেঁষে রাখ। আর সব আলো শিবলিঙ্গের মাথার দিকে ফেল। যেখানে, সোনার পাত তিনটে আটকানো ছিল।’

মুহূর্তে তিনটে জোরালো আলোর স্রোত ধেয়ে গেল শতাব্দীপ্রাচীন বুড়োশিব মন্দিরের বিশাল শিবলিঙ্গের মাথার দিকে। যেখানে এককালে শোভা পেত তিন তিনখানি সোনার তৈরি ত্রিপুন্ড্রক। গগন মল্লিক গনুকে আদেশ করলেন ‘একটা ব্রাশ নিয়ে আয় গনু, আর একটা জলে ভেজানো ন্যাকড়া।’

গনু সেসব নিয়ে আসার পর জায়গাটা পরিষ্কার করলেন গগন। তারপর পকেট থেকে একটা আতশকাচ বের করে খুব মন দিয়ে দেখতে লাগলেন।

একটু পরে আবিষ্কার করলেন, শিবলিঙ্গের মাথার দিকে দুটো উল্লম্ব সারিতে পর পর ছ’টা ছিদ্র আছে। উল্লব সারি দুটোর মাঝের দূরত্ব প্রায় ফুট খানেক। প্রথম দুটি ছিদ্রের মধ্যে প্রায় ছ’ইঞ্চির ব্যবধান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছিদ্রের মধ্যে ব্যবধান তিন ইঞ্চির মতো। আবার তৃতীয় ও চতুর্থ ছিদ্রের মধ্যে সেই ছয় ইঞ্চির দূরত্ব। শেষের দুটোও তাই। কীসের ছিদ্র এগুলো?

ভুরু কুঁচকে গেল গগন মল্লিকের। কী যেন একটা ধরি ধরি করেও তাঁর কাছে ধরা দিচ্ছে না।

ঘাড় ঘুরিয়ে ভজনের দিকে তাকালেন গগন। ছেলেটা জ্বলজ্বলে চোখে তাঁর দিকেই চেয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে একটা শেয়ানা হাসি।

‘কী রে ভজন, কিছু সাহায্য করতে পারবি নাকি?’

খ্যাঁক করে হাসল ভজন। তারপর বলল, ‘পারব না কেন। সামান্য কাজ। বুড়ো ঠাকুদ্দা তো সব সুলুক সন্ধান দিয়েই দিয়েছে।’

বুড়ো ঠাকুদ্দা’র ব্যাপারটা বুঝলেন না গগন। তবে সে নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না তিনি। সময় ফুরিয়ে আসছে। তিনি দ্রুত টুল থেকে নেমে বললেন, ‘এসব উদ্ভট শয়তানি রাখ ভজন, কী করতে হবে বল।’

‘ওই সোনার পাত তিনটে চাই।’

‘কেন?’

‘ওগুলো যেখানে ছিল, ফের সেখানেই লাগাতে হবে। তবেই চিচিং ফাঁক হবে।’

মুহূর্তের মধ্যে গগন মল্লিকের চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল। ওগুলো যে সে ছিদ্র নয়। ওতেই সোনার পাত তিনটে আটকানো ছিল কোনও কৌশলে। সেখানে সেই পাত তিনটে ফের আটকাতে হবে। তারপর চাপ দিতে হবে, ছড়াটায় যেমন বলেছে, একে একে স্পর্শ করো ত্রয়ী ত্রিপুন্ড্রকে!

মানে ওই সোনার ত্রিপুণ্ড্রক তিনটেই আসল চাবি, ওরা শুধু গুপ্ত সংকেত লিখে রাখার আধার নয়। কুঞ্জিকায় খোলে দ্বার, দ্বারে খোলে কুঞ্জিকার, সন্ধানী বুঝেন চিত্রপটে! চাবিটাই আসলে দরজা, দরজাটাই আসলে চাবি!

গগন মল্লিক ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘সেই পাত তিনটেই লাগবে? সেম সাইজের তিনটে লোহা বা অন্য ধাতুর পাত এনে লাগালে হবে না?’

ভজন দুলে দুলে বলল, ‘উঁহু। বুড়ো ঠাকুদ্দার হাতের সূক্ষ্ম কাজ। আকারে আর ওজনে বিন্দুমাত্র হেরফের হলে ভেতরের কলকবজা সারাজীবনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে’।

কথাটা বুঝলেন গগন। একদম ওই তিনটে পাতই চাই। নইলে ওই গুপ্তধন উদ্ধার করার আশা বিশ বাঁও জলে। কিন্তু মাথাটা গুলিয়ে গেল তাঁর। তিনি চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘কিন্তু সে তিনটে সোনার পাত এখন পাব কোত্থেকে? শেষেরটা না হয় বিষ্টুর কাছে আছে। বাকি দুটো কোথায় কী করে বলব?’

ঠিক সেই সময়ে পাঁচিলের দিক থেকে কার স্বর ভেসে এল, ‘সে নিয়ে চিন্তা করবেন না গগনবাবু, আমি লখনউ থেকে আসার সময় প্রথম দুটো পাত নিয়েই এসেছি।’

দুটো পা দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এল আলোর মধ্যে। বিষ্টুচরণ উৎফুল্লস্বরে বলে উঠল, ‘এই তো মাস্টার, এতক্ষণে ফীল্ডে নেমেছে তাহলে। বলি এতক্ষণ ছিলে কোথায়? গেম তো শেষ হওয়ার মুখে। পার্টনার তো কেস সলভ করেই ফেলেছে প্রায়।’

গগন মল্লিক মাস্টারের দিকে তাকাচ্ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মাস্টারের হাতে ধরা এক ফুট বাই আধ ফুট আকারের সামান্য বাঁকানো দুটো সোনার পাতের দিকে। তাঁর মুখে বিভিন্ন ভাব খেলে যাচ্ছিল পর্যায়ক্রমে তার মধ্যে আশ্চর্য, অবাক, সংশয় এবং ভয়, সবকটাই ছিল। তাঁর মাথার মধ্যে একটা পাগলাঘণ্টি বেজে উঠছিল উচ্চস্বরে। তাঁর চোখের সামনে যা হচ্ছে, তার মধ্যে ফাঁকি আছে, মস্ত ফাঁকি। কিচ্ছু ঠিকঠাক হচ্ছে না, কিচ্ছু না।

নিজের কোমরে হাত দিলেন গগন।

 বিষ্টুচরণ দু-হাত বাড়িয়ে মাস্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাঁ-হাতে তার কলার ধরে নিজের দিকে টেনে নিলেন গগন। তারপর দৃঢ়পায়ে এগিয়ে আসা প্রৌঢ় মানুষটির দিকে একটা পিস্তল তুলে ধরে তীব্রস্বরে বললেন, ‘আর এগিয়ো না ডাক্তার।’

এগিয়ে আসা লোকটি থেমে গেলেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘এ কী গগনবাবু, আপনি না শিক্ষক। আপনার হাতে পিস্তল কেন?’

পিস্তলটা সোজা তাঁর টার্গেটের কপালের দিকে তাক করলেন গগন। তারপর স্থিরস্বরে বললেম, ‘ডাক্তার এই পাত দু’খানা তোমার হাতে এল কী করে?’

বিষ্টুচরণ অবাক হয়ে বলল, ‘এ আবার কীরকম বিহেভ পার্টনার? মাস্টারের দিকে পিস্তল তাক করেছ কেন?’

দাঁতে দাঁত চেপে গগন মল্লিক বললেন, ‘বিষ্টুবাবু, আপনার মাস্টার নাকি এই লাইনে একেবারে পয়লা নম্বরের এক্সপার্ট, প্রচুর গুপ্তধন উদ্ধার করেছেন, এসব আপনিই আমাকে জানিয়েছেন। ইনি নাকি আপনার পরামর্শেই দাঁতের ডাক্তার সেজে এখানে থানা গেড়েছেন। কিন্তু রতিকান্ত মল্লিকের চুরি করা সোনার পাত দুটো কোন যাদুমন্ত্রে এঁর হাতে এল সেটা কাউণ্ডলি এক্সপ্লেইন করবেন কি?’

এবার একই দিক থেকে তিনটে মানুষ হেঁটে এসে দাঁড়াল সতীশ চাকলাদারের পেছনে। তাদের হাতেও অত্যাধুনিক অস্ত্র। তিনজনের মধ্যে যাঁকে লীডার বলে মনে হয় সেই সুপুরুষ যুবকটি মৃদু হেসে বললেন, ‘যাক, আপনি যে এত সহজেই পুরো গল্পের ফাঁকিটা ধরতে পেরেছেন, সেটা দেখে ভারি ভালো লাগছে গগন বাবু। আপনাকে জানাতে অশেষ আনন্দ বোধ করছি যে মাস্টার নাম নিয়ে যে মানুষটি আপনাদের সব পাপকাজের সঙ্গী হয়েছিলেন, সেই দাঁতের ডাক্তার সতীশ চাকলাদার আসলে লখনউর কিংস জর্জ কলেজের ডেন্টিস্ট্রির প্রফেসর, ডাক্তার রামশরণ গুপ্তা। যিনি রতিকান্ত মল্লিকের রক্তের উত্তরাধিকারী তো বটে, তার ওপর যিনি ব্রজ মিত্তিরের বিশেষ বন্ধুও বটে। ব্রজ মিত্তিরের খুনের খবর পেয়ে নিজেই এখানে চলে এসেছিলেন এই রহস্য উদঘাটন করতে, কাউকে না জানিয়ে। আর বাই দ্য ওয়ে, ভূপেন দারোগা কিন্তু এখন আমাদের দলে। মন্দিরের বাইরেই সে তার দলবল নিয়ে ওয়েট করছে আপনার সাদরে আপ্যায়ন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

থরথর করে হাত কাঁপছিল গগন মল্লিকের। চকিতে বিষ্টুচরণকে নিজের দিকে টেনে নিলেন গগন। তারপর পিস্তলটা তার রগে ঠেকিয়ে উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠলেন, ‘ভুল, সব ভুল। রতিকান্ত মল্লিকের উত্তরাধিকারী বলতে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সে আমি, একমাত্র আমি। বাকি সব মিথ্যেবাদী, জোচ্চর। এই মাস্টার জাল, ওর হাতের ওই পাত সোনার পাত দুখানা জাল। তোরা সব জাল। সব কটা জোচ্চোর। আর তুই কে রে? সেই জালি তান্ত্রিকটা না? আর বাকি দুটো তোর চ্যালাচামুণ্ডা তাই তো? গনু, হরে, করিম, কোথায় তোরা? শুইয়ে দে এই বজ্জাত তিনটেকে। মাথা ফাটিয়ে ভাসিয়ে দে গঙ্গায়।

গনুকে কোথাও দেখা গেল না, এর মধ্যেই সে পালিয়েছে কোথায়। তবে হারে রে রে করে তেড়ে গেল বিষ্টুচরণের দুই পোষা গুণ্ডা। এক ধাক্কায় সতীশ চাকলাদারকে পেছনে সরিয়ে দিলেন প্রবাল চ্যাটার্জি আর তাঁর দুই সঙ্গী। তিনজনে ক্যারাটের পজিশন নিলেন।

তবে তাঁদের আর দরকার হল না। দুই দলের মধ্যে লাঠি হাতে লাফ দিয়ে পড়ল একটা মানুষ।

ভজন।

ভজনের হাতে তার কাকার লাঠিখানা যে কী করে এল সে ভগবানই জানেন। প্রচণ্ড রাগে চোখদুটো জ্বলছে তার। অচেনা গলায় সে বলল, ‘সেবার তো আমার হাত থেকে কোনওমতে বেঁচে গেছিলিস তোরা। আজ কিন্তু পার পাবি না। দেখে যা লখাই সামন্তর লাঠির জোর।’

তারপর যেন তবলা লহরা খেলে গেল ভজনের হাতে। বৃষ্টির মতো লাঠির বাড়ি নেমে আসতে লাগল হরে আর করিমের ওপর। তারা খানিক লড়ার চেষ্টা করেছিল বটে, তবে দেখা গেল যে মাথায় পিঠে দুমাদ্দুম কয়েকটা লাঠির বাড়ি খেতেই তাদের জারিজুরি সব শেষ। শেষে দুটোই মাটিতে পড়ে কোঁকাতে লাগল। এই অবসরে গগন মল্লিক তাঁর পিস্তলটা ভজনের দিকে তাক করতেই প্রবাল চ্যাটার্জির রিভলবার থেকে চকিতে একটা গুলি ছুটে এসে তাঁর হাতের পিস্তলটা ছিটকে ফেলে দিল একদিকে। হ্যান্ডমাইকে ভূপেন আচায্যির কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘সি আই ডির স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ আপাতত এই চত্বরের দখল নিয়েছে। কেউ আইন নিজের হাতে নেবেন না। গগন মল্লিক আর বিষ্ণুচরণ তেওয়ারি, আপনাদের অনুরোধ করা হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আত্মসমর্পণ করতে।’

গগন হাত তুলে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে বিষ্টুচরণ দাঁত ছরকুটে পড়ে আছে মন্দিরের সামনে। বড় বড় সার্চলাইটের আলো এসে পড়ল চারিদিকে। বন্দুকধারী পুলিশের দল মার্চ করে এসে সবাইকে ঘিরে দাঁড়াল।

প্রবাল চ্যাটার্জি সতীশ চাকলাদারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবার?’

সতীশ চাকলাদার ওরফে প্রফেসর রামশরণ গুপ্তা কিছু বললেন না। তিনি হাসিমুখে তাঁর হাতে ধরা পাত দুটো এগিয়ে দিলেন ভজনের দিকে।

ভজনের দিকে তখন তাকানো যাচ্ছিল না। সে তখন আর সেই নরমসরম ছেলেটি নেই। তার চোখ জ্বলছে অঙ্গারের মতো, দাঁত কিড়মিড় করছে, কাঁধ ফুলে উঠেছে থইথই করে, মাথার চুল এলোঝেলো। সে পাত দু’খানি হাতে নিয়ে হুকুম দিল, ‘তিন নম্বর পাতটা তুলে আন কেউ।’

প্রবাল চ্যাটার্জি এগিয়ে এলেন। অজ্ঞান হয়ে থাকা বিষ্টুচরণের কোমর থেকে টেনে বার করলেন একটা একটা ছ্যাৎলা পড়া পুরোনো সোনার পাত। সেটা তিনি ভজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে নম্রস্বরে বললেন, ‘জানি না আমি কার সঙ্গে কথা বলছি, ভজন না লখাই সামন্ত। শুধু এটুকু চাইব, রমেন্দ্রনারায়ণের লুকিয়ে রাখা গুপ্তধনের যেন একটা সদ্বব্যহার হয়।’

ভজন জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল প্রবালের দিকে। তারপর সেই পাতটা টেনে নিয়ে লাফিয়ে উঠল শিবলিঙ্গের সামলে পেতে রাখা টুলের ওপর। তারপর দক্ষ হাতে তিনটে সোনার পাত সেঁটে দিল বুড়োশিবের কপালে।

খটাখট করে কিছু আওয়াজ ভেসে এল রাতের অন্ধকারে। তখনও তিনটে জোরাল এল ই ডি ল্যাম্পের আলো চেয়েছিল সবজেটে ছ্যাৎলা পড়া তিনটে সোনার পাতের দিকে, যে তিনটে পাত প্রায় একশো তিরিশ বছর পর ফিরে এসেছে নিজেদের জায়গায়। সেদিকে একবার সগর্বে তাকাল ভজন, যেন মোনালিসার দিকে চেয়ে আছেন দ্য ভিঞ্চি। তারপর সে সজোরে ধাক্কা মারল তিনটি পাতের ছ’খানি কোণা বরাবর। একের পর এক।

মুহূর্ত খানেকের স্তব্ধতা। তারপর ধীর, অতি ধীর একটা ঘরঘর শব্দ উঠে আসতে লাগল বুড়োশিবের শরীর বেয়ে। সবার বিস্মিত চোখের সামনে গৌরীপট্টটি ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে। ঠিক একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে থামল সেটি। তারই সঙ্গে দু’খানি ফাটল দেখা দিল গৌরীপট্টের ওপরের অংশটির দুধারে, সেই ছ’খানি উল্লম্ব ছিদ্রসারি বরাবর।

তারপর সবার বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে ঘুঘুডাঙার শতাব্দী প্রাচীন বুড়ো শিবলিঙ্গের একটা অংশ দরজার মতো দু-ভাগ হয়ে গেল। আর তার মধ্যে উঁকি দিল প্রায় সমান সাইজের আরও একটি শিবলিঙ্গ। যথেষ্ট সবজেটে ছাতা পড়া অবস্থাতেও এল ই ডি আলোর ঝলকে বোঝা গেল যে তার পুরোটাই সোনার। আর তার গায়ে যে যে সব দামী পাথর বসানো আছে, তাদের ছিটকে আসা আলোয় চারিদিক ঝলমল করে উঠল।

ভজন ঘোলাটে গলায় বলল, ‘এই নিন মশাইয়েরা, রমেন মিত্তিরের গুপ্তধন।’ আর তারপরই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সেই উঁচু টুল থেকে।

* * *

 কফির কাপটা হাতে তুলে নিয়ে প্রবাল চ্যাটার্জি বললেন, ‘সবই তো বুঝলাম প্রফেসর গুপ্তা। কিন্তু ব্রজনারায়ণ মিত্র’র সঙ্গে আপনার শেষমেশ কী কথা হয়েছিল সেটা না জানলে তো পুরো রহস্যটা খোলসা হচ্ছে না।’

কথা হচ্ছিল মিত্তিরবাড়ির উঠোনে বসে। খানপাঁচেক রট আয়রনের চেয়ার পাতা। তাতে প্রবাল চ্যাটার্জি, দেবকান্ত মোহান্তি, যতীন্দ্রনারায়ণ, প্রফেসর গুপ্তা আর ভূপেন আচায্যি বসে। মাঝখানে একটা ওই রট আয়রনেরই ছোট টেবিল। তাতে কফির কাপ আর একটা কাজুর প্লেট রাখা। হেমনলিনী গরম গরম হাঁসের ডিমের বড়া ভাজছেন ভেতরে, সঙ্গে গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগ ডালের খিচুড়ি। তার সুগন্ধে চারিদিক ম ম করছে। তাঁকে সাহায্য করছে ভজন। তার মাথায় মস্ত ব্যাণ্ডেজ। উঁচু টুল থেকে পড়ে যাওয়ার ফল।

একমুঠো কাজু হাতে তুলে নিয়ে প্রফেসর গুপ্তা বলতে শুরু করলেন।

আজ থেকে দেড় বছর আগে। লখনউ। ডিসেম্বরের সন্ধে।

প্রফেসর গুপ্তা কঠিনভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু আপনিই যে সেই জমিদারবাড়ির উত্তরাধিকারী তার প্রমাণ কী?’

ব্রজনারায়ণ মিত্র খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন প্রফেসর গুপ্তার দিকে, তারপর ঠান্ডা গলায় বলেন, ‘আপনি কি এই মুহূর্তে সেই প্রমাণ নেওয়ার অবস্থায় আছেন প্রফেসর গুপ্তা?’

‘আছি বইকি মিস্টার মিত্র।’

‘তাই নাকি?’ একটা বাঁকা হাসি খেলে যায় ব্রজনারায়ণ মিত্তিরের ঠোঁটে, ‘কী রকম আছেন সেটা একটু জানালে এই নাচীজ নিজেকে একটু খুশকিসমত বলে ভাবতে পারে গুপ্তাসাহেব। আমরা কিন্তু সব আঁটঘাট বেঁধেই এসেছি। আবারও জানিয়ে রাখি, এই মুহূর্তে আপনার বাড়ির দখল আমার হাতে। আপনার সব কাজের কাজী লছমন আমাদের হাতে বন্দি। আমরা ভালো করেই জানি যে এই লছমন ছাড়া আপনার কাছের লোক বলে আর কেউ নেই। আপনার স্ত্রী মারা গেছেন বছর দশেক হল, আপনার একমাত্র ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে, তার সঙ্গে আপনার মুখ দেখাদেখি নেই। দুই চারটে ভাতিজা ভাতিজি আছে, তারাও আপনার খোঁজ নেয় না, আপনিও তাদের খোঁজ নেন না। মাঝেসাঝে দুয়েকজন পুরোনো ছাত্র ছাড়া আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসার মতো তেমন কেউ নেই, কী প্রফেসর গুপ্তা, ঠিক বলছি তো?’

প্রফেসর গুপ্তা কিছু বলেন না, স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে থাকেন, তারপর বলেন, ‘তাতেও কিন্তু আমার প্রশ্নটা তামাদি হয়ে যাচ্ছে না মিস্টার মিত্র। আপনিই যে ঘুঘুডাঙার জমিদারবাড়ির উত্তরপুরুষ, তার প্রমাণ কী?’

চকিতে উঠে দাঁড়ান ব্রজনারায়ণ মিত্র, লাফিয়ে আসেন টেবিলের এপারে। বাঁ হাতে প্রফেসর গুপ্তা’র চুলের মুঠিটা ধরে ওয়েবলি স্কটটা ঠেকান কপালের ঠিক মাঝখানে। গনগনে রাগত গলায় বলেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে আপনার ন্যাকামি সহ্য করছি প্রফেসর গুপ্তা, এনাফ ইজ এনাফ।’

প্রফেসর গুপ্তা স্থির চোখে ব্রজনারায়ণ মিত্তিরের দিকে চেয়ে থাকেন। তারপর কাটা কাটা স্বরে বলেন, ‘আমার গায়ে হাত তুলে ভালো করলেন না মিস্টার মিত্র। আমি যদি মনে করি এ ব্যাপারে আপনাকে কিছুই বলব না, তাহলে আপনার পিতৃদেবেরও সাধ্য নেই আমার মুখ খোলানোর। আর আমাকে মেরে ফেললে যে ও দুটো পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকবে না সেটা আশা করি বুঝিয়ে বলতে হবে না।’

মুঠিটা আলগা হল। কিন্তু বন্দুকটা নড়ল না। ঠান্ডা খুনে গলায় ব্রজনারায়ণ মিত্তির বললেন, ‘মুখ খোলানোর অনেক উপায় কিন্তু আমাদের জানা আছে প্রফেসর গুপ্তা।’

ব্রজ মিত্তিরের চোখে চোখ রেখে পিস্তলের নলটা কপাল থেকে সরিয়ে দিলেন প্রফেসর গুপ্তা। তারপর একটু হেসে বললেন, ‘ঠান্ডা হয়ে চেয়ারে বসুন মিস্টার মিত্র। আপনি না একজন পেশাদার গুণ্ডা বদমাশ, না কোনও পুলিশ অফিসার। থার্ড ডিগ্রি বোধহয় সিনেমাতেই শুনেছেন বা দেখেছেন, বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারবেন তো? সেটুকু নার্ভের জোর আছে তো আপনার?’

ব্রজ মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। বন্দুকটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন, ‘বেশ। স্বীকার করলাম যে আমি গুণ্ডা বদমাশও নই, পুলিশও নই। নাউ, প্লিজ লেট মী নো’, কী করে আমাদের পারিবারিক সম্পত্তিটা আপনার খপ্পর থেকে উদ্ধার করতে পারি? মানে সোজা কথায় বলতে গেলে ওই সোনার পাত দুটো কীসের বিনিময়ে আমার হাতে আপনি তুলে দেবেন?’

প্রফেসর গুপ্তা বললেন, ‘দুঃখিত মিস্টার মিত্র। আপনি যদি প্রমাণ করতে না পারেন যে আপনি ঘুঘুডাঙার মিত্তির বাড়ির সন্তান, তাহলে এই আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না।’

‘সে তো আমার পাসপোর্ট বা ভোটার আইডি কার্ড দেখেই মালুম করতে পারবেন।’

দুলে দুলে মাথা নাড়লেন প্রফেসর গুপ্তা। ‘আপনি প্রফেশনাল গুণ্ডা না হতে পারেন, কিন্তু যেভাবে এসব সঙ্গীসাথী জুটিয়ে আমার বাড়িটা দখল করেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে অপরাধ জগতের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ বা ঘনিষ্ঠতা কম নয়। ফলে কী করে বিশ্বাস করব যে আপনার আনা পাসপোর্ট বা ভোটার আইডি কার্ডটা জাল নয়?’

ঘাড়টা দুবার এদিক ওদিক করলেন ব্রজনারায়ণ। কী যেন একটা ভাবলেন, তারপর,

 বললেন, ‘আচ্ছা, তর্কের খাতিরে না হয় তাও মেনে নিলাম। তাহলে আপনিই বলুন ঠিক কীভাবে আমি প্রমাণ করতে পারি যে আমি ওই পরিবারের সন্তান?’

‘এমন কিছু প্রমাণ দাখিল করুন, ট্যাঞ্জিবল বা ইন্ট্যাঞ্জিবল, যা একমাত্র ঘুঘুডাঙার মিত্রপরিবার ছাড়া আর কারও কাছে থাকা সম্ভব নয়। আবারও বলছি, সেটা ট্যাঞ্জিবল বা ইন্ট্যাঞ্জিবল, দুটোই হতে পারে।’

উঠে দাঁড়ালেন ব্রজনারায়ণ। হাত দুটো পেছনে বন্ধ করে সারা ঘর ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তখনও পিস্তলটা তাঁর ডান হাতে ধরা আর তর্জনীটা পিস্তলের ট্রিগারে।

কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন ব্রজনারায়ণ। তারপর চেয়ারে বসে বলেন, ‘ওকে, ঠিক হ্যায়। পুরো গল্পটাই না হয় বলব আপনাকে। যদিও বিষ্টুকে আর গগনাকে আলাদা আলাদা করে কথা দিয়েছিলাম যে এই বিষয়ে আর কেউ জানবে না, তবুও সব কথা বলছি আপনাকে। তবে শুনুন প্রফেসর, কীভাবে আমি এই রহস্যের সন্ধান পেলাম। আশা করি তাতে আপনার সব সন্দেহের নিরসন হবে। কারণ ঘুঘুডাঙার রাজবাড়ির সন্তান ছাড়া এই রহস্যকাহিনী জানা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’

ব্রজ মিত্তিরের ইশারায় বাকিরা ঘরের বাইরে গেল। প্রফেসর গুপ্তা গুছিয়ে বসলেন।

তার পরের আধঘণ্টা একতরফা বলে গেলেন ব্রজ মিত্তিরই। গগন মল্লিকের সঙ্গে স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব, পরে বিষ্টুচরণের সঙ্গে গা ঘষাঘষি, বিষ্টুচরণের থেকে ঘুঘুডাঙার জমিদারবাড়ির শিবলিঙ্গের সোনার ত্রিপুণ্ড্রক চুরির আসল কাহিনী শোনা, সেই ইস্তক প্রাণের বন্ধু গগনার সঙ্গে গোপন আলোচনা, সেই আলোচনা মোতাবেক ঘর ছাড়া হওয়া, সবই খুলে বললেন তিনি। কিচ্ছু বাদ রাখলেন না।

সব শুনে মাথা নাড়লেন প্রফেসর গুপ্তা। বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এতটাই যখন বললেন, বিশ্বাস করে নেওয়া গেল যে আপনিই সেই গুপ্তধনের সার্থক উত্তরাধিকারী। কিন্তু একটা কথা বলুন তো মিস্টার মিত্র, দৈবগতিকে যদি সেই গোপন সম্পদের খোঁজ পেয়েও যান, তবে সেটা নিয়ে কী করবেন আপনি?’

মুহূর্ত খানিক একটা শূন্য দৃষ্টিতে প্রফেসর গুপ্তার দিকে চেয়ে থাকেন ব্রজনারায়ণ। তারপর বলেন, ‘সেটা আমি ভাবিনি প্রফেসর গুপ্তা। আমি এতগুলো বছর কাটিয়েছি ওই গুপ্ত সম্পদ খুঁজে বেড়ানোর নেশায়। পেলে কী করব সেটা নিয়ে কখনই ভাবিনি।’

‘হুম, বুঝেছি। তা আপনার দুই জিগিরি দোস্ত এই সম্পত্তি হাতে পেলে কী করবে সেটা তো অন্তত জানেন আপনি? নাকি তাও জানেন না?’

এই প্রথম একটু অপ্রতিভ দেখায় ব্রজনারায়ণকে। তিনি মাথা চুলকোতে বলেন, ‘তারা দুজনেই ভালো লোক, বুদ্ধিমানও বটে। কিন্তু কথা হচ্ছে আগে তো গুপ্তধনটা হাতে আসুন। তারপরই না হয় বাকিটা দেখা যাবে।’

অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন রামশরণ গুপ্তা। তারপর বললেন, ‘আপনার সারল্য সত্যিই তারিফ করার মতো। আপনার কী ধারণা, আপনার সঙ্গীরা এতই ভালো, এতই সৎ, এতই উদার যে তারা এত ঝক্কি নিচ্ছে গুপ্তধন উদ্ধার করে হাসিমুখে আপনার হাতে তুলে দেবে বলে? তাদের কোনও স্বার্থ নেই?’

একটু অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে বসলেন ব্রজনারায়ণ। তারপর বললেন, ‘ওরা কিন্তু জানে আজকাল এসব গুপ্তধনটন উদ্ধার হলে সেসব গভর্নমেন্টের সম্পত্তি হয়ে যায়।’

রামশরণ গুপ্তা এবার আর অট্টহাসি হাসলেন না। খানিকটা কৌতুকের সঙ্গে ব্যঙ্গ মিশিয়ে বললেন, ‘আপনি কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টর মিস্টার মিত্র, আই মাস্ট সে। আপনি ডেয়ার ডেভিল লোক। পূর্বপুরুষের সম্পত্তি উদ্ধার করার জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছেন। সংগঠন ক্ষমতা ভালো, নইলে এসব অ্যান্টি সোশ্যাল এলিমেন্ট জোগাড় করতে পারতেন না। কথা বার্তায় রসবোধ আছে। কিন্তু বুদ্ধিখানি, মাশাল্লাহ, একেবারে শিশুর স্তরে। আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন আপনার ওই দুই গুণধর দোস্ত গুপ্তধন উদ্ধার করে দেশের সরকারের হাতে তুলে দেবে? সেই জন্যই তারা আপনাকে এত সাপোর্ট দিচ্ছে? ওই সাম তেওয়ারি না কে, সে আপনাকে এইসব সমাজবিরোধী জোগাড় করার জন্য এমনি এমনি টাকা পাঠাচ্ছে? আর ওই গগন, আপনার ছোটবেলার জিগরি দোস্ত, যার উসকানিতে আপনি এই এক্সপিডিশনে নেমেছেন, সে এত কিছু করছে আউট অফ সিম্পল ফ্রেন্ডশিপ? আর ইউ সো নাইভ?’

ব্রজনারায়ণ বিব্রতস্বরে বললেন, ‘আসল প্ল্যানটা তো বললামই।’

‘কোন প্ল্যান? আপনি আর গগনবাবু মিলে ওই তেওয়ারি ডাবল ক্রস করবেন, আর তারপর দুজনে মিলে রমেন মিত্তিরের গুপ্তধন উদ্ধার করবেন তাই তো? হা ঈশ্বর।’

ব্রজনারায়ণ কিছু বললেন না।’

‘আপনার কী ধারণা মিস্টার মিত্র? বিষ্টুচরণ অত নিরীহ লোক? সে আপনার পেছনে এত টাকা ঢালছে এমনি এমনি? তার অন্য কোনও প্ল্যান রেডি নেই?’

‘তাহলে?’ এই প্রথম এই অসহায় শোনায় ব্রজনারায়ণের স্বর।

ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন প্রফেসর গুপ্তা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওয়েল। আরতি শ্রীবাস্তবের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হোক আমিও চাই। তবে সেই দুটো পাত এখনই আপনাকে আমি দিচ্ছি না মিস্টার মিত্র। তাতে কী কী লেখা আছে সেটা একটা ডায়েরিতে কপি করা আছে। সেটা নিয়ে যান। কিন্তু একটা কন্ডিশন আছে।’

‘বলুন।’

‘আমার মন বলছে আমার সাহায্য আপনার দরকার হবেই হবে। আপনি একটা কাজ করতে পারবেন? ঘুঘুডাঙা ফিরে যাওয়ার পর প্রতিদিন আমাকে একটা করে আপডেট দিতে পারবেন?’

‘তাতে লাভ?’

একবার হেসে ফেলেই গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রফেসর গুপ্তা। তারপর বললেন, ‘আমার ঠাকুমা খুব প্রিন্সিপলড মহিলা ছিলেন মিস্টার মিত্র। তিনি যদি স্বর্গ থেকে দেখেন যে তাঁর নাতির সাহায্য নিয়ে উদ্ধার করা সম্পত্তি দেশের কাজে না লেগে দুটো জোচ্চর ক্রিমিনালের পকেটস্ত হচ্ছে, তাহলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে না। অতএব ওইটুকু আমাকে এনশিওর করা আমার কর্তব্য। যদি পর পর তিনদিন আপনার ফোন না পাই, তবে আমাকে সশরীরে ঘুঘুডাঙা উপস্থিত হতেই হবে।’

উঠে দাঁড়ালেন ব্রজনারায়ণ। হাতটা বাড়িয়ে একটা চওড়া হাসি হেসে বললেন, ‘ডান। তাই হবে।’

* * *

‘কিন্তু দুটো বিষয় স্পষ্ট হল না যে।’ প্রশ্ন করলেন যতীন্দ্রনারায়ণ।

‘কোন বিষয়?’

‘হঠাৎ করে সাধুর বেশ ধরতে গেলেন কেন? আর প্রফেসর গুপ্তাকে খুঁজে পেলেন কী করে?’

‘যদি পুলিশ হিসেবে বা সি আই ডি-র ইন্সপেক্টর হিসেবে প্রফেসর গুপ্তা’র খোঁজখবর চালাতাম তাহলে বিষ্টুচরণ অ্যান্ড কোম্পানি আগেই সাবধান হয়ে যেত। তাই সাধুর ভেক নেওয়া। আর এখানে এসেই খোঁজ নিয়েছিলাম রিসেন্ট কে কে এসে এখানে আবির্ভূত হয়েছেন। সতীশ চাকলাদারের ওপর নজর ছিলই। শুধু দুটো জিনিস মিলছিল না। এক, দাঁতের ডাক্তারি। ইউ পি পুলিশও বার বার তাদের রিপোর্টে প্রফেসর রামশরণ গুপ্তা বলে উল্লেখ করেছে। শেষে যখন জানলাম ইনি কিংস জর্জ কলেজের ডেনটিস্ট্রি’র অধ্যাপক তখনই বুঝলাম ইনিই তিনি। দাঁতের ডাক্তারির বদলে অন্য কোনও পেশা নিলে চট করে আইডেন্টিফাই করা অসুবিধা হত।’

একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন প্রফেসর গুপ্তা, ‘আসলে ওই একটা কাজই শিখেছি জীবনভোর, অন্য পেশা নেব কী করে? তাছাড়া ডাক্তারখানায় সমাজের নানা স্তরের লোকজন আসে, খবরাখবর রাখা সুবিধে হয়।’

‘দ্বিতীয়টা হচ্ছে ইনি এত ভালো বাংলা জানলেন কী করে। সেটা খোলসা হওয়ার আগেই দেখি ইনি সাধু সন্দর্শনে এসে উপস্থিত। লুকোনো সিসিটিভি ক্যামেরায় তোলা ভিডিও পাঠিয়ে দিলাম সি আই ডি-র সাইবার ফরেনসিক ল্যাবে। তারা কনফার্ম করল ইনিই তিনি। ব্যস, সেইদিন সন্ধেবেলাতেই আলাপ করা গেল।’

কফি শেষ হয়ে গেছিল। প্রফেসর গুপ্তা পাইপ ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। প্রবাল চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবার বলুন তো প্রফেসর গুপ্তা, আপনি এত ঝরঝরে বাংলা শিখলেন কোথায়?’

প্রফেসর গুপ্তা হেসে বললেন, ‘আমার পড়াশোনা কলকাতায়, মেডিকেল কলেজে। বিয়ে করি আমার সহপাঠিনী এক বাঙালি মেয়েকে। আমার শ্বশুরমশাই এই বিয়েতে একটা শর্তেই মত দিয়েছিলেন যে বাংলা ভাষাটা মাতৃভাষার মতো ঝরঝরে বলতে হবে। শুধু বলতে নয়, আমি বাংলা পড়তে আর লিখতেও পারি। কলকাতায় থাকার সময় নিয়মিত বাংলা বই পড়তাম। পরে কিংস জর্জ কলেজে জয়েন করার পর অবশ্য সে সুযোগ কমে যায়।’

ভূপেন আচায্যি একটা কাজু তুলে নিয়ে বললেন, ‘একটা কথা কিন্তু আমাকে খুব হন্ট করছে স্যার। বলব?’

‘আপনার বিনয়টা আমাকে আজ সকাল থেকেই খুব হন্ট করছে ভূপেনবাবু। বলুন।’

‘কাল গগন মল্লিকের বলা একটা কথা আমার কানে লেগে আছে, ”রতিকান্ত মল্লিকের উত্তরাধিকারী বলতে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সে আমি, একমাত্র আমি। বাকি সব মিথ্যেবাদী, জোচ্চর।” কেন স্যার? গগন মল্লিক হঠাৎ ও কথা বলতে গেল কেন?’

গগলসটা খুলে পকেটে রাখলেন প্রবাল চ্যাটার্জি। বললেন, ‘আমার দৃঢ় ধারণা, রতিকান্ত মল্লিকের বাংলায় থাকার সময় বিয়ের যে কথাটা প্রফেসর গুপ্তা উল্লেখ করলেন সেটা সত্যি। গগন মল্লিক আসলে রতিকান্ত মল্লিকের প্রথম পক্ষের বংশধর। হয়তো ঘুঘুডাঙার জমিদারবাড়ির সোনার ত্রিপুণ্ড্রক চুরির ঘটনার কথা ওদের পরিবারের মধ্যে জেনারেশন টু জেনারেশন চলে এসেছে। তাই গগন মল্লিক বিশ্বাস করতেন যে রমেন মিত্তিরের গুপ্তধনের ওপর ওঁর একটা ন্যায্য দাবি আছে।’

একটা লম্বা শ্বাস ফেললেন ভূপেন দারোগা, ‘সংসারের গতি বড়ই বিচিত্র। গগন মাস্টারের মতো লোক যে শেষে এই কাজ করবে কে ভেবেছিল?’

‘সে তো বুঝলাম দারোগা সাহেব। এখন আপনার গতি কী হবে সেটা নিয়ে কিছু ভেবেছেন?’

ভূপেন আচায্যি গড়ুরহস্ত হলেন, ‘কালই গিন্নীকে দার্জিলিং মেলে তুলে দিচ্ছি স্যার, মেয়েকে নিয়ে আসবে। কলকাতায় আমার শ্বশুরবাড়ি, আর আমার বড় শালী নিবেদিতা স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। এবার থেকে মেয়ে কলকাতায় থেকেই পড়াশোনা করবে। আর গাড়িটা কালই বিষ্টুবাবুর বাড়ির সামনে রেখে এসেছি।’

‘শুধু তাই করলেই হবে? প্রায়শ্চিত্ত বলেও তো একটা ব্যাপার আছে মশাই।’

‘বলুন স্যার, কী করতে হবে?’

‘আপাতত ভজনের দায়িত্বটা নিন। তারপর বাকিটা আমি দেখছি।’

ভূপেন দারোগা নাইনটি ডিগ্রি ঘাড় ঘুরিয়ে হ্যাঁ বলতেই এমন সময় দরজার কাছে একটা গলা খাঁকারির শব্দ পাওয়া গেল। চারজনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন বিশু গুছাইত, নগেন মুহুরি, আর নরহরি চক্কোত্তি দাঁড়িয়ে। বিশু গুছাইত খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘শুনলাম কাল রাতে নাকি যতীনকাকার বাড়িতে একটা মস্ত ঝামেলা হুজ্জোত হয়ে গেছে। তাই ভাবলাম নাগরিক কর্তব্যের খাতিরে একবার খবর নিয়ে যাই।’

নরহরি উদ্বিগ্নস্বরে বললেন, ‘কাকা, যা শুনছি সব সত্যি? শেষপর্যন্ত নাকি রমেন মিত্তিরের গুপ্তধনের খোঁজ পাওয়া গেছে, আর আমাদের গগন আর বিষ্টু নাকি সেসব লুট করতে গিয়ে ধরা পড়েছে?’

‘ঠিকই শুনেছ হে নরহরি। তবে ও জিনিস মস্ত জিনিস, লুট করার নয়। আপাতত পুলিশের জিম্মায় সুরক্ষিত আছে। আর গগন বিষ্টুর খবরটাও সত্যি।’

বিশু গুছাইত একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলল, ‘আমি তো জানতামই গগন মল্লিক ওই রকম লোক। আরে মশাই যারা ওইসব পার্টির হয়ে ভোটে দাঁড়ায় তারা কি আর ভালো লোক হয়?’

দেবকান্ত মোহান্তি ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আপাতত বিষ্টুচরণের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খাতাপত্র নিয়ে তহকিকাত চলছে। একটু আগেই খবর পেলাম সাম গুছাইতের নামে রেগুলার একটা পেমেন্ট যেত বিষ্টুবাবুর অ্যাকাউন্ট থেকে। তা আপনি এই নামে কাউকে চেনেন নাকি মিস্টার…’

বিশু শশব্যস্ত হয়ে বলল, ‘এ হে হে, এই দ্যাখো। একটা জরুরি মিটিং ছিলো, এক্কেবারে ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। চলি যতীনকাকা, কোনও হেল্প লাগলে জানাবেন।’

হেমনলিনী এসে দাঁড়ালেন, ‘খাবার রেডি। এরপর ঠান্ডা হয়ে গেলে কিন্তু বারবার দাঁত খিঁচোতে আসতে পারব না বাপু।’

রামশরণ গুপ্তা লাফিয়ে উঠে সশঙ্কিতস্বরে বললেন, ‘দাঁত? আবার?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *