নীলকান্তপুরের হত্যাকাণ্ড

নীলকান্তপুরের হত্যাকাণ্ড

‘আপনি কি ডাক্তার অরিজিৎ বোসের নাম শুনেছেন?’ প্রশ্ন করল শিবেন।

দময়ন্তী মাথা নাড়ল।

‘না, শোনবারই কথা। ভদ্রলোক পাগলের ডাক্তার, মানে মনস্তত্ত্ববিদ। ডাক্তারি করেন গড়িয়া ছাড়িয়ে নীলকান্তপুর বলে একটা জায়গায়। ওখানেই ওঁর চেম্বার এবং নার্সিং হোম। চলে বেশ ভালোই। যাঁরা এ ব্যাপারে খোঁজখবর রাখেন বা রাখতে বাধ্য হন, তাঁদের কাছে ডাক্তার বোস অপরিচিত নন। সম্প্রতি একটা খুব বিচ্ছিরি ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছেন। কাগজে খুব ছোটো করে বেরিয়েছিল, আপনার নজরে পড়েছে কিনা জানি না।’

দময়ন্তী ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি সেই স্ত্রীকে খুন করার দায়ে ডাক্তার গ্রেপ্তার— সেই ব্যাপারটা? সে খবরটায় তো নাম ধাম কিছুই ছিল না, কেবল গড়িয়ার কাছে বলে একটা উল্লেখ ছিল।’

‘ঠিক বলেছেন। সেই ঘটনাটাই। একবার ব্যাপারটা দেখবেন নাকি?’

‘কী হয়েছিল? আপনারা তো তদন্ত করছেনই।’

‘তা করছি। তদন্ত শেষও হয়ে গেছে। কিন্তু তদন্তের ফলাফলটা মোটেই আমার পছন্দ হচ্ছে না। কোথায় যেন একটা গোলমাল ঠেকছে।’

‘কেন?’

‘আসলে আপনি যদি ভদ্রলোককে দেখেন, আপনার কিছুতেই বিশ্বাস হবে না যে তিনি স্ত্রীকে খুন করতে পারেন। হাসবেন না। জানি মানুষের বাইরের চেহারা বা চালচলন দেখে কল্পনাও করা যায় না যে তার ভেতরে কী লুকিয়ে আছে। এত বছরের অভিজ্ঞতার পর বাইরের রূপ দেখে ভোলবার পাত্র আর আমি নই। কিন্তু এত বছরের অভিজ্ঞতায় আবার কেমন একটা ইনটুইশনও গজিয়ে গেছে। কাউকে অপরাধী নয় বলে মনে হলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি সেটা ভুল হয় না।’

‘ঘটনাটা গোড়া থেকে বলবেন?’

সমরেশ এতক্ষণ লম্বা হয়ে ডিভানের ওপর শুয়ে সিগারেট টানছিল। বলল, ‘হ্যাঁ, বেশ বিশদভাবে বলবি।’

.

শিবেন শুরু করল, ‘প্রথমে ডাক্তার বোসের চেহারার একটা বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন। ভদ্রলোক পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, রোগাটে গড়ন, গায়ের রং ফ্যাকাশে, বড়ো বড়ো চোখ, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, মাথায় টাক, বয়েস পঁয়তাল্লিশ। কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে বিলেতে যান, ফিরে আসেন দশ বছর বাদে। সে আজ প্রায় বছর বারো হল। এখনও কিন্তু বিলেতের গন্ধ যায়নি। সবসময় সুট পরে থাকেন। কথা বলেন খুব আস্তে আস্তে, শান্তভাবে।

‘এসবের কোনোটাই অবশ্য তাঁর খুনি হওয়ার পথে কোনো বাধা নয়। বাধাটা অন্যত্র। আপনি যদি ওঁর সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে বুঝবেন, ভদ্রলোকের সর্ববিষয়ে পাণ্ডিত্য অসাধারণ, অত্যন্ত বিনীত, নম্র, ভদ্র ব্যবহার, সরল সাদাসিধে কথাবার্তা এবং স্থির বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব— এমন লোক যখন অপরাধী হয়, তখন তাকে চট করে ধরে ফেলা যায় না।

‘সে যাই হোক, আমি এবার আসল ঘটনাটা বলি।

‘বিলেত থেকে ফিরে ভদ্রলোক কেয়াতলার কাছে একটা ক্লিনিক খুলে বসেছিলেন বছর বারো আগে। চলেনি। বেশ অর্থকষ্টে পড়েছিলেন তখন। এইসময় তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় ডাক্তার বীথিকা মিত্রের। লাভ ম্যারেজ নয়, সম্বন্ধ করে বিয়ে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ বীথিকার সঙ্গে কারুর লাভ হওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। ভদ্রমহিলা মারা গেছেন, তাঁর সম্বন্ধে এরকম মন্তব্য করা হয়তো আমার উচিত নয়। তবে না করেও পারছি না। এঁর সম্পর্কে পরে আরও বলব। তার আগে ডাক্তার বোসের কথাটা বলে নিই।

‘বীথিকার সঙ্গে বিবাহের পর অরিজিৎ বোসের ভাগ্য ফিরতে আরম্ভ করে। তার একটা কারণ অবশ্যই বীথিকার টাকা। তাঁর বাবা অন্নদা মিত্র তখন কলকাতার বিখ্যাত বড়োলোকদের একজন। তিনি জামাইয়ের ক্লিনিক সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিলেন প্রচুর খরচা করে। তার অন্য কারণ, অন্নদা মিত্র ও তাঁর পরিবারের সমাজে বিশেষ করে ডাক্তার মহলে ইনফ্লুয়েন্স। এইসব কারণে এবং নিজের হাতযশে বছর পাঁচেকের মধ্যেই অরিজিৎ তাঁর কর্মক্ষেত্রে খুব সুনাম অর্জন করেন। এবং, বলাই বাহুল্য, অনেক টাকাও রোজগার করেন। সেই টাকায় বছর সাতেক আগে নীলকান্তপুরে কয়েক বিঘে জমি কিনে প্রজ্ঞা মনবিশ্লেষণ কেন্দ্র বলে একটা ছোটোখাটো মেন্টাল হসপিটাল আর গবেষণা কেন্দ্র খুলে বসেন। আজ ওখানে আছে একটা নার্সিং হোম যেখানে জনা তিরিশেক রুগি থাকতে পারে, একটা ক্লিনিক, একটা লাইব্রেরি, একটা রিসার্চ সেন্টার ইত্যাদি। এ ছাড়া আছে নার্সেস কোয়ার্টার্স, আর একটা ছোটো পোলট্রি। স্বামী-স্ত্রী থাকতেন হাসপাতালেই একটা ফ্ল্যাটে।

‘এই ফ্ল্যাটের বেডরুমে বীথিকাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় গত চোদ্দোই জানুয়ারি সন্ধ্যেবেলা। ভদ্রমহিলার কলকাতায় আসবার কথা ছিল। রওনা হবার আগে সাজগোজ করে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছিলেন। লিপস্টিকে পটাসিয়াম সায়ানাইড লাগানো ছিল। মৃত্যুর সময় কেউ কাছে ছিল না।

‘এবার ভদ্রমহিলার কথা বলি। ধলা কুৎসিত কাকে বলে জানেন? ভদ্রমহিলা ছিলেন তাই। যেমন ফর্সা, তেমনি কুৎসিত। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা, ঘোড়ার মতো মুখ, আর তেমনি স্বভাব। প্রজ্ঞা কমপ্লেক্সের একজনও ভদ্রমহিলাকে পছন্দ করত না। সবাই তাঁকে সহ্য করত একমাত্র অরিজিতের জন্যে। বড়ো ডাক্তারবাবুর প্রতি প্রত্যেকের লয়ালটি প্রশ্নাতীত।

‘এমন মহিলাকে খুন করতে খুব একটা চমকপ্রদ মোটিভের দরকার হয় না। কিন্তু অরিজিৎ যদি খুনি হয়েই থাকেন, তাহলে তাঁর যে মোটিভ আমরা তদন্ত করে দেখতে পাচ্ছি, সেটা কিন্তু অত্যন্ত চমকপ্রদ। সে সম্পর্কে একটু বিশদভাবে বলা দরকার।

‘অরিজিৎ আর বীথিকার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের পাশবই চেক করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে গত বছরের এপ্রিল মাসে এবং তার আগের বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি খুব মোটা অঙ্কের টাকা জমা পড়েছে সেখানে। কোত্থেকে যে সেই টাকাগুলো এল, তার খোঁজ করতে গিয়ে আমরা দেখি যে উভয় ক্ষেত্রেই সেই টাকা এসেছে দুজন সুস্থ হয়ে যাওয়া অর্থশালী রুগির সম্পত্তি থেকে। এই দুজন মৃত্যুর আগে তাঁদের সম্পত্তির একটা বেশ বড়ো অংশ ডাক্তার অরিজিৎ আর বীথিকা বোসকে দান করে গেছেন। তাঁদের উভয়েরই উইলের বক্তব্য ছিল যে তাঁদের পরিবারের লোকেরা ষড়যন্ত্র করে সম্পত্তি বেদখল করার অসদুদ্দেশ্য নিয়ে তাঁদের পাগল বানিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। সেখানে থাকার সময় অরিজিৎ আর বীথিকার নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতার মধ্যে তাঁরা স্বর্গসুখ উপভোগ করেছেন এবং বুঝেছেন যে তাঁদের সত্যিকার আপনার জন ওই দুজন— শয়তান নিকটাত্মীয়েরা নয়। অতএব, তাঁদের সম্পত্তির সিংহভাগ ওই দুজনকেই তাঁরা দান করে গেছেন।

‘এরকম ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। কিন্তু, আমাদের যেখানে খটকা লাগল তা হচ্ছে যে দুজনেই হাসপাতাল থেকে বেরোনোর ঠিক ছ-মাসের মাথায় মারা গেছেন এবং দুজনেরই মৃত্যুর কারণ এক— কী এক ধরনের জন্ডিস। তখন আরও খোঁজ করে জানা গেল, এরকম আরও একজন বড়োলোক রুগি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার ছ-মাসের মধ্যে মারা যান, একই কারণে। তবে তিনি কোনো উইল করে যাননি বা যেতে পারেননি। এখানে আমরা একটা ফাউল প্লে সন্দেহ করি এবং ডাক্তার বোসের কেস উঠলে এই সন্দেহটার ওপর একটা খুব জোরদার আলোচনা হবে আদালতে।

‘এরপর যে ব্যাপারটা আমাদের নজরে পড়ে, তা হচ্ছে যে গত বছরের অগাস্ট মাস থেকে ওই জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে বড়ো বড়ো চেক কেটে অনেক টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। সেই টাকা তোলেন বীথিকা। কেন, তা ডাক্তার অরিজিৎ বোসের অজানা। তার কারণটা অনুমান করা কিন্তু কঠিন নয়। আমরা জানি যে অন্নদা মিত্র মশাইয়ের মৃত্যুর পর গত পাঁচ বছরে তাঁর দুই ছেলে, রাজমোহন আর রাজকুমার তাঁর বিশাল ব্যবসা লাটে তুলে দিয়ে আপাতত দেউলিয়া হবার উপক্রম করেছে। ওই টাকাগুলো যে ভাইদের প্রতি বোনের সামান্য উপহার তাতে সন্দেহ থাকে না।

‘অতএব, পুলিশের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে ডাক্তার অরিজিৎ বোস একটি সাক্ষাৎ শয়তান। তিনি ষড়যন্ত্র করে বড়োলোক রুগিদের সরিয়ে দিয়ে তাদের সম্পত্তি দখল করেছিলেন। বীথিকা তাঁর ওপর বাটপাড়ি করে নিজের ভাইদের সেই টাকা বিলিয়ে দেওয়ায় ক্ষেপে গিয়ে তিনি তাঁকে খুন করে বসেছেন।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার বিশ্বাস যে এই সিদ্ধান্ত ভুল, তাই না?’

‘হ্যাঁ, তাই বটে।’

‘কেন? স্রেফ বড়োলোকের সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত ধারণা থেকে, না অন্য কোনো কারণ আছে?’

‘আছে। প্রথমত লিপস্টিকে সায়ানাইড মাখিয়ে রাখার পেছনে একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। এটা হঠাৎ রাগের মাথায় করা কাজ নয়। তাহলে এমন বোকার মতো ষড়যন্ত্র করার কী দরকার ছিল? আগেই বলেছি, ডাক্তার বোস শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু মোটেই গাধা নন। বিশেষত, পুলিশ নিজেই যেখানে তাঁকে ধুরন্ধর শয়তান বলে প্রমাণ করার চেষ্টায় আছে।

‘দ্বিতীয়ত, সম্পত্তিগুলো যদি শয়তানি করেই আদায় হয়ে থাকে, তাহলে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো মামলামোকদ্দমা হয়নি কেন? আত্মীয়স্বজনরা যদি কনটেস্ট করত, তাহলে হয়তো জিতে যেতেও পারত।

‘তৃতীয়ত, রাজমোহন আর রাজকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো ছিল। এখনও আছে। তারা এমনিতে যতই অপদার্থ হোক, অরিজিৎকে দুজনে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে এবং ভালোবাসে। তাদের টাকা নেবার জন্যে বীথিকার লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন, অরিজিতের মামলা চালাবার সব দায়িত্ব নিয়েছে এই দুই ভাই।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘দুই ভাই কী বলছে, তারা বোনের কাছ থেকে কোনো টাকা পায়নি?’

‘হ্যাঁ। পুলিশ অবশ্য তাদের কথা বিশ্বাস করছে না।’

‘অর্থাৎ আপনি বলছেন বীথিকার আর একটা গোপন জীবন ছিল এবং সেখানেই রয়েছে তার মৃত্যুর সমাধান, এই তো?’

শিবেন সহাস্যে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, একেবারে ঠিক ধরেছেন।’

‘তাহলে আপনি নিজে বীথিকা সম্পর্কে আর যা যা জানেন, যা আপনার ডিপার্টমেন্টের সহকর্মীরা জানে না, সেগুলো একটু বলুন।’

শিবেন মাথা নেড়ে বলল, ‘আশ্চর্য! আপনি কী করে বুঝলেন যে আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু জানতে পারি?’

‘খুব সহজে। প্রথম থেকেই বীথিকার সম্পর্কে আপনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আপনি তাঁকে তাঁর মৃত্যুর আগে থেকেই জানতেন।’

‘ঠিকই। বীথিকা মিত্রকে আমি অনেকদিন থেকেই জানি। মানে তার বিয়ের আগে থেকেই। আমার পিসিমার বাড়ি অবিনাশ ঘোষ রোডে। সেই পাড়াতেই অন্নদা মিত্তিরের অরিজিন্যাল বাড়ি। পরে বালিগঞ্জে উঠে গিয়েছিলেন। তখন বীথিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মহা পাজি মেয়ে ছিল বীথিকা। ওই তো চেহারা, অথচ ঠমকে মাটিতে পা পড়ত না। পাড়াশুদ্ধ সকলের সঙ্গে ঝগড়া, কেউ দু-চক্ষে দেখতে পারত না। ওদিকে আবার নিমফোম্যানিয়াকও ছিল। পাড়ার দুই হ্যান্ডসাম দাদার পেছনে লেগেছিল, তারা কেঁদে কূল পায় না। শেষ পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় এক সহপাঠীর সঙ্গে ভাগলবা। অন্নদা মিত্তির খুঁজে পেতে তাদের ধরে নিয়ে এলেন পুরীর এক হোটেল থেকে। তারপর পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার অরিজিৎ বোসের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন।’

‘বীথিকা কি তাঁর বাবার সবচেয়ে ছোটো মেয়ে ছিলেন?’

‘ছোটো মেয়ে তো বটেই, একটিই মেয়ে। আদর দিয়ে মাথা খেয়েছিলেন অন্নদা মিত্তির।’

‘বীথিকার কোনো ছেলেপুলে হয়নি?’

‘না।’

‘কাউকে অ্যাডপ্ট করেছিলেন বা দত্তক নিয়েছিলেন?’

‘না।’

‘ডাক্তার অরিজিৎ বোসের আত্মীয়স্বজন কে কে আছেন? মানে, নিকট আত্মীয়?’

‘ওঁর বাবা আছেন, সুজিত বোস, একসময় তারাচাঁদ বিদ্যাপীঠের হেডমাস্টার ছিলেন। ওঁর মা মারা গেছেন অনেক বছর আগে। এক দাদা আছেন, অভিজিৎ, বসিরহাট মিউনিসিপ্যালিটিতে ওভারসিয়ারের চাকরি করেন। এক বোন আছেন, বিয়ে হয়ে গেছে, থাকেন দুর্গাপুরে বা আসানসোলে কোথাও। তাঁকে এ ব্যাপারে কেউ ডাকেনি।’

‘কেন?’

‘প্রয়োজন মনে করেনি, তাই।’

‘আশ্চর্য।’ বলে দময়ন্তী চুপ করে গেল।

শিবেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, ‘আচ্ছা, বেশ, অরিজিতের বোনকে না ডাকাটা হয়তো অন্যায়ই হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব এখনও পাইনি। ব্যাপারটা আপনি দেখবেন, না দেখবেন না?’

দময়ন্তী হেসে ফেলল। বলল, ‘ঠিক আছে, দেখব। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, সন্দেহ নেই। তবে কি জানেন, অরিজিৎকে আপনি যতটা ধোয়া তুলসীপাতা ভাবছেন, ততটা তিনি নন। বীথিকাকে তিনি টাকার লোভে বিয়ে করেছিলেন।’

শিবেন হাত নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের ডিপার্টমেন্টও সেই কথাই বলছে। টাকার লোভে বিয়ে করেছিলেন, টাকার লোভে খুন করেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, এই সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। আপনি একবার অরিজিতের সঙ্গে কথা বলুন, তাহলেই আমি কী বলতে চাইছি, তা বুঝতে পারবেন।’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, আমি এখনই অরিজিতের সঙ্গে কথা বলতে চাই না। আমি চাই ওঁর বোনের সঙ্গে কথা বলতে। ব্যবস্থা করতে পারবেন?’

শিবেন হাত উল্টে বলল, ‘ঠিক আছে। ব্যবস্থা করা যাবে। আগামী রোববার বিকেলবেলা ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আসব এখানে।’

সমরেশ কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন দেখতে রে ভদ্রমহিলাকে?’

শিবেন বিরক্ত গলায় বলল, ‘কে জানে কেমন। দেখেছি নাকি কোনোদিন?’

.

রোববার বিকেল বেলা অতিথি এলেন চারজন। শিবেন, একজন মহিলা, একজন ইউনিফর্ম-পরা পুলিশ অফিসার এবং একজন নিতান্ত সাদাসিধে ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোক। ভদ্রমহিলা মোটের ওপর সুন্দরী, তবে বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে। মাথার চুলে পাক ধরেছে, মুখের বলিরেখায় সংসারের পোড়-খাওয়া চিহ্ন, পরনে একটি লালপাড় ধূসর রঙের ধনেখালি শাড়ি আর লাল রঙের ব্লাউজ। পুলিশ অফিসারটি প্রকাণ্ড লম্বা-চওড়া, মাথায় টাক, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাসিখুশি মুখ, কিন্তু চোখ দুটি সজাগ ও তীক্ষ্ন। ভদ্রলোকটির বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি, মাথার বেশিরভাগ চুলই পাকা, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, শীর্ণ মুখে উদবেগ ও আশঙ্কা।

শিবেন পরিচয় করিয়ে দিল, ‘ইনি ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর হেমন্ত কুমার সরকার, এই কেসটার চার্জে আছেন। ইনি ডাক্তার অরিজিৎ বোসের ছোটো বোন মিসেস অলকা ঘোষ আর ইনি এঁর স্বামী শ্রীবিকাশচন্দ্র ঘোষ। বিকাশবাবু বার্নপুরে মডার্ন স্টিল কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন।’

শিবেন থামতেই হেমন্ত সরকার বললেন, ‘দেখুন, গত বুধবার শিবেনদার সঙ্গে আপনার যে কথাবার্তা হয়েছে, তার কিছু কিছু আমি শুনেছি। মিসেস ঘোষকে জেরা না করা সত্যিই আমাদের ভুল হয়েছিল। এখন, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমি আপনার জেরার সময় উপস্থিত থাকতে চাই।’

হেমন্ত সরকারের কথা শুনে দময়ন্তী একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘উপস্থিত আপনি অবশ্যই থাকতে পারেন। তবে মিসেস ঘোষকে আমি কিন্তু জেরা করবার জন্যে ডাকিনি। আমার উদ্দেশ্য ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলা, কয়েকটা কথা ওঁর কাছ থেকে জানা।’

সরকার হেঁ হেঁ করে হেসে বললেন, ‘না, না, মানে হ্যাঁ, তাই তো, কথাই তো বলবেন। মানে, আই অ্যাম সরি, জেরা করাটা আমার ঠিক বলা উচিত হয়নি। মানে, ওই কথাই আর কী—’

দময়ন্তী হেসে ফেলল। বলল, ‘হ্যাঁ, কথাই। আমরা বলি, আপনি শুনুন। তবে, তার আগে একটু জলযোগ না করলে তো চলবে না।’

.

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার দাদা ডাক্তার অভিজিৎ বোসের যখন বিয়ে হয়, তখন কি আপনার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মিসেস ঘোষ?’

অলকা মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়েছিল। অনেক আগেই হয়েছিল। ছোড়দার বিয়ে তো ওর বেশ বেশি বয়সেই হয়। বোধ হয় পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে।’

অ্যাকাউন্ট্যান্ট বিকাশচন্দ্র শুধরে দিলেন। বললেন, ‘না, চৌত্রিশ বছর বয়সে। তোমার ছোড়দার বিয়ে হয়েছিল আমাদের বিয়ের সাত বছর বাদে।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে আবার অলকাকে প্রশ্ন করল, ‘আমাদের দেশের স্ট্যান্ডার্ডে এটা বেশি বয়েস সন্দেহ নেই, কিন্তু এত বয়স পর্যন্ত উনি বিয়ে করেননি কেন?’

অলকা চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘দেখুন, আমরা নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবার। অভাব অনটনের মধ্যে মানুষ হয়েছি। বাবা ছিলেন স্কুলটিচার, কতই-বা আর মাইনে পেতেন। ছোড়দা এই দারিদ্র্য সহ্য করতে পারত না। ওর মধ্যে অনেক উচ্চাশা ছিল, অনেক বড়ো হবার স্বপ্ন দেখত। কাজেই বিলেত থেকে ফিরে যখন প্র্যাকটিশ জমাতে পারল না, তখন অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিল। বিয়েই করবে না স্থির করেছিল।’

‘প্র্যাকটিস জমল না কেন?’

‘ছোড়দা যে লাইনে স্পেশালাইজড করেছিল, সে লাইনে পসার জমানো সে সময় বড়ো সহজ ছিল না। এমনিতেই পাগলের ডাক্তারের কাছে কজন রুগি আর যায়? তার ওপর ছোড়দা তখন নতুন ডাক্তার, ওকে চেনেই বা কে, জানেই বা কে?’

‘আপনার ছোড়দার বিয়ের গল্প কিছু বলুন।’

অলকা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘ছোড়দার বিয়ে হবার খবর আমি বার্নপুরে পাই। বাবা চিঠি লিখেছিলেন। সেটা পড়ে জানা গেল যে, বীথিকার সঙ্গে বিয়ে পাকাই হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে পরামর্শ করার সময় ওঁরা পাননি, কারণ অন্নদাবাবুর চাপে পড়ে খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু শেষ করে ফেলতে হয়েছে। মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন বাবা, ছোড়দা আর বড়োবউদি। বাবা ওখানেই কথা দিয়ে দিয়েছেন। আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন আশীর্বাদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে। আশীর্বাদের দু-দিন পরেই বিয়ে।

‘আমার খুব দুঃখ আর অভিমান হয়েছিল। কিন্তু না গিয়ে তো পারি না। আমার বড়ো ছেলের বয়স তখন চার বছর— ওকে নিয়ে আমরা দুজনে বসিরহাটে বড়দার বাড়িতে গিয়ে উঠলুম। বাড়িতে ঢুকে দেখি চারদিক থমথম করছে। উঠোনে বড়দা গম্ভীর মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আর বারান্দায় বাবা একটা মোড়া পেতে প্রচণ্ড রাগী রাগী মুখ করে বসে আছে। আমরা ঢুকতেই বড়দা আমাকে আর বড়োখোকাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিল আর ওকে বলল ওখানে থাকতে।

‘রাত্রে ওর কাছে সব কথা শুনলুম। শুনে আমার ভীষণ কান্না পেল। ও বলল, বড়দা নাকি খবর এনেছে যে বীথিকার স্বভাবচরিত্র ভালো নয়। কেবল ভালো নয় বললে কম বলা হয়— বেশ খারাপই বলা উচিত। ছোড়দার ঘাড়ে ওই মেয়েকে চাপানো মানে তার সর্বনাশ করা। কিন্তু বাবা এই কথা শুনে ক্ষেপে লাল হয়ে গেছে; বাবা বলছে, এসব দুষ্টু লোকের রটনা। বড়োলোকের মেয়েদের নামে পাড়ার বখাটে ছেলেরা এসব কথা বলেই থাকে। যতই যাই হোক না কেন, বীথিকা একজন পাশ করা ডাক্তার; সে কখানো খারাপ হতে পারে না। এই কথায় বড়দার খুব আঁতে ঘা লাগল। দুঃখে, অপমানে প্রতিজ্ঞা করে বসল যে ছোড়দার বিয়েতে কোনোরকম অংশই নেবে না। শেষ পর্যন্ত, আমরা দুজনে অনেক বলে কয়ে বড়দাকে রাজী করাই।’

দময়ন্তী বলল, ‘আপনার বড়োবউদি আপনাকে কী বললেন? এ ব্যাপারে ওঁর মতামত কী ছিল?’

‘বড়োবউদি বাবার পক্ষেই ছিল। কারণ বড়োবউদির এক মামা এই সম্বন্ধ এনেছিলেন। তিনি আবার অন্নদাবাবুর অফিসে চাকরি করতেন। শুনেছি অন্নদাবাবু খুব বিশ্বাস করতেন ওঁকে।’

‘তারপর কী হল? আপনারা আশীর্বাদে গেলেন?’

‘হ্যাঁ, গেলুম। সে এক এলাহি ব্যাপার হয়েছিল। আর, বাবাকে সে কী খাতির! আমার তো বেশ বাড়াবাড়ি বলেই মনে হল। সেই প্রথম ছোটোবউদিকে দেখি। ওই তো ঘোড়ার মতো মুখ, সেটা আবার বেঁকিয়ে বসেছিল। দেখে, ছোড়দার জন্যে দুঃখই হল।’

‘আপনার ছোড়দা কোনো আপত্তি করেননি?’

‘না। প্রথমে বলেছিল যে বিয়েই করবে না। এই সম্বন্ধটা যখন এল, তখন কিন্তু কোনো আপত্তি করল না। বলল, বাবা যা বলবেন, তাই হবে। আসলে অন্নদাবাবুর টাকা দেখে মাথা ঘুরে গেছল। আজ তার শাস্তি ভোগ করছে।’

অলকার কথা শুনে বিকাশচন্দ্র অসন্তুষ্ট মুখে মাথা নাড়লেন। বোঝা গেল স্ত্রীর কথা তাঁর পছন্দ হয়নি। দময়ন্তী সেট লক্ষ্য করল। বলল, ‘আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলবেন মিস্টার ঘোষ?’

বিকাশ বললেন, ‘দেখুন, আমার মতে ছোড়দার কিন্তু খুব একটা দোষ ছিল না। আপনি সে সময়টার কথা ভাবুন। বিলেত থেকে ফিরে পসার জমাতে পারেনি। দাদার অভাবের সংসারে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে বসেছেন। বিলেত ফিরে যাবেন সে সংগতি পর্যন্ত নেই। সে যে কী ভয়ঙ্কর অবস্থা! সে অবস্থায় ছোড়দার সিদ্ধান্ত খুব একটা অন্যায় হয়েছিল বলে তো আমার মনে হয় না।’

অলকা বললেন, ‘তাই বলে টাকার জন্যে বিয়ে করবে?’

‘কেন করবে না? টাকার জন্যে লোকে খুন করে, আর বিয়ে করবে না? ব্যাপারটা অন্তত বেআইনি তো নয়। আর রোমান্স? ওসব ছাড়ো তো! অন্নচিন্তা চমৎকারা, কাতরে কবিতা কুতঃ?’

‘থাক, তোমাকে আর সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতে হবে না। তাহলে, আশীর্বাদ থেকে ফিরে এসে ব্যাজার মুখে বসেছিলে কেন? কেন বলেছিলে যে ছোড়দার কপালে দুঃখ আছে?’

‘সেটা অন্নদাবাবুর টাকার জন্যে নয়। ছোটোবউদির চেহারার জন্যে।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, চেহারায় কী দেখলেন?’

‘দেখুন, ছোটোবউদিকে আপনি এখন শুধু ফোটোগ্রাফে দেখতে পাবেন, কাছ থেকে নয়। সেজন্যে ওঁর কতগুলো বৈশিষ্ট্য আজ আর আপনার জানা সম্ভব নয়। কেবল আমার কথায় আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। ভদ্রমহিলা বাঙালি মেয়েদের তুলনায় খুব লম্বা ছিলেন। আর ওঁর সবকিছুই ছিল খুব বড়ো বড়ো। যেমন, হাতের সাইজ, পায়ের সাইজ। মুখটা তো… সে যাই হোক, নাক-কানও খুব বড়ো বড়ো ছিল। চুল আর চোখ ছিল কটা। হাতে বড়ো বড়ো লোম। আমাদের শাস্ত্রে বলে, এ ধরনের মেয়েরা সংসারে অশান্তি আনার জন্যেই জন্মায়।’

‘আপনি একথা বিশ্বাস করেন?’

‘না, করি না। তবে, আমার ছেলের সঙ্গে এ ধরনের চেহারার মেয়ের বিয়ে আমি স্বেচ্ছায় দেব না।’

‘চমৎকার! আচ্ছা মিসেস ঘোষ, গত এগারো বছরে ডাক্তার বোস, মানে আপনার ছোড়দা, আপনার কাছে তাঁর বিবাহিত জীবন সম্পর্কে কিছু বলেছেন? কোনো দুঃখের কথা বা আনন্দের কথা?’

অলকা মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘না, কিচ্ছু না। বলার তেমন সুযোগও হয়নি। বিয়ের পর ছোড়দা কেয়াতলাতেই থাকত। বাবাকে সে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা কোনোদিনও বলেনি। আর, বাবা তো বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই মারা গেলেন। তারপর থেকে আমাদের মধ্যে তেমন আর কোনো সম্পর্ক রইল না। ছোড়দা বা ছোটোবউদি কোনোদিনও কোনোরকম যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেনি। তবে, কোনো নেমন্তন্ন বাড়িতে দেখা হলে খুব ভালো ব্যবহার করত। ওই পর্যন্তই। আসলে, আমরা গরিব আর ছোড়দা দারিদ্র্য সহ্য করতে পারত না। তারপরে তো ওরা নীলকান্তপুরে চলে গেল। তখন থেকে দেখাশুনোও বন্ধ হয়ে গেল।’

‘আপনার ছোটোবউদির মৃত্যুসংবাদ কীভাবে পেলেন?’

‘বড়দার চিঠিতে। বিস্তারিত খবর পাই বড়োবউদির চিঠিতে।’

‘আচ্ছা, আপনার ছোড়দার স্বভাবের একটা দিক আপনার কথায় জানতে পারছি যে উনি দারিদ্র্য সহ্য করতে পারতেন না। এ ছাড়া অন্য কোনোদিক আপনার মনে পড়ে?’

‘ছোড়দা খুব সাজগোজ করতে ভালোবাসত। অভাবের সংসারে দামি জামাকাপড় পেত না, কিন্তু অপরিষ্কার বা ইস্ত্রি না করা জামা কখনো পড়ত না। সবসময় ফিটফাট থাকত। তাই বলে আপনি যদি ভাবেন যে খুব স্টাইল করে কায়দা মেরে হাঁটাচলা করত, তা কিন্তু মোটেই নয়। কক্ষণো জোরে কথা বলত না, জোরে হাসত না, অসভ্য বা খারাপ কথা বলত না, অকারণে আড্ডা মারত না।’

বিকাশ বললেন, ‘আমিও একটু বলতে চাই। আমি অবশ্য ছোড়দাকে খুব বেশিদিন কাছ থেকে দেখিনি। আমাদের যখন বিয়ে হয়, উনি তখন বিলেতে। ফিরে আসার দেড় বছরের মধ্যেই ওঁর বিয়ে হয়। এর মধ্যে যেটুক দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে যে ওঁর মতো মেন্টাল ডিসিপ্লিন বাঙালিদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। ওঁর সময়ের নড়চড় হয় না, কথার নড়চড় হয় না। ব্যবহার অত্যন্ত মার্জিত, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বা গায়েপড়া নয়। আমরা কাছাখোলা বাঙালি, উনি পাক্কা সাহেব।’

সমরেশ বলল, ‘অর্থাৎ বাঙালিসুলভ চপলতা আর প্রলাপেতে সফলতা ওঁর মধ্যে একেবারেই ছিল না, এই তো?’

‘ঠিক বলেছেন। তবে কি জানেন, একটা ব্যাপার আমার খুব খারাপ লাগত। স্ত্রীকে খুশি রাখার জন্যেই হোক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করাটা ওঁর উচিত কাজ হয়নি। উনি যে কী কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন, সে কথা ছোড়দা ছাড়া বেশি ভালো করে আর কে জানতে পারে?’

অলকা বললেন, ‘বাবা তাঁর কৃতকর্মের ফল ভোগ করে গেছেন।’

দময়ন্তী বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, ওঁদের যে কোনো ছেলেপুলে হয়নি, তা নিয়ে কোনো দুঃখ বা মনোকষ্টের কথা কি কখনো জানতে পেরেছেন?’

অলকা মাথা নেড়ে বলল, ‘না, কখনো নয়।’

‘আপনার বড়দার সন্তান আছে?’

‘আছে, একটি ছেলে। ভালো নাম সুরজিৎ, ডাকনাম গালু। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, ফাইনাল ইয়ার।’

‘এই সুরজিতের সঙ্গে তার কাকিমার কীরকম সম্পর্ক ছিল?’

‘কোনো সম্পর্ক ছিল না। কোনোদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন করেনি পর্যন্ত।’

‘রাজমোহন বা রাজকুমারকে আপনারা চেনেন?’

‘ছোড়দার দুই শালা তো? মুখ চিনি। ওই পর্যন্ত।’

‘আচ্ছা বিকাশবাবু, আপনার কি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে? বা ক্যাশ সার্টিফিকেট?’

বিকাশ একটু চমকে উঠলেন। বললেন, ‘ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, বার্নপুরের স্টেট বাঙ্কে, তবে তাতে গেয়ে বেড়াবার মতো কিছু নেই। ক্যাশ সার্টিফিকেটও আছে— হাজার টাকার।’

‘ইন্সিওরেন্স করাননি?’

‘করিয়েছি। তিরিশ হাজার টাকার। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় না করলেই বোধ হয় ভালো ছিল। কোয়ার্টারলি প্রিমিয়াম দিতে প্রাণ বেরিয়ে যায়।’

‘আপনার সন্তান ক-টি?’

‘দুটি। বড়োটি ছেলে, এবার মাধ্যমিক দেবে। ছোটোটি মেয়ে, ক্লাস সিক্সে পড়ে।’

.

অলকা আর বিকাশ চলে গেলে আর এক প্রস্থ চা এল। হেমন্ত সরকার শিবেনকে সম্বোধন করে বললেন, ‘স্যার, এই যে কথাবার্তা হল, এতে কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্তে ভুল আছে প্রমাণিত হল না।’

শিবেন বলল, ‘কীরকম?’

‘অরিজিৎ বোসের চরিত্র যা তার বোনের মুখেই শুনলুম, তাতে তো তাকে খুব একটা আদর্শ পুরুষ বলে মনে হল না। যে দারিদ্র্য সহ্য করতে পারে না, টাকার লোভে বিয়ে করে গরিব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে, তার পক্ষে অসদুপায়ে বড়োলোক রুগি মেরে তাঁর সম্পত্তি আত্মসাৎ করা বা অতিরিক্ত খরচ-করা স্ত্রীকে খুন করা কি খুব কঠিন বা অসম্ভব কাজ?’

‘না, তা হয়তো নয়। কিন্তু, আমার দুটো প্রশ্নের জবাব দাও তো হেমন্ত। প্রথম, যে লোক অত্যন্ত শিক্ষিত এবং ডিসিপ্লিন্ড, সে বিষ দিয়ে তার বউকে মেরে বিষ-মেশানো লিপস্টিকটা সরিয়ে ফেলল না কেন এবং দ্বিতীয়, এমনভাবে খুন করল না কেন যাতে সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয়? মনে রেখ, লোকটা ডাক্তার, সে নাকি বাড়ি ফিরে যাওয়া রুগিকে রিমোট কন্ট্রোলে এমনভাবে মেরেছে যাতে সেটা যে খুন সে বিষয়ে কেবল সন্দেহই করা যায়, কিছুই প্রমাণ করা যায় না।’

‘হয়তো রাগের মাথায় খুন করে বসেছে। হয়তো সময় পায়নি।’

‘না হেমন্ত, হয়তো হয়তো করে একজনের মাথায় খুনের দায় চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়! তোমার কাছে সব প্রশ্নের অভ্রান্ত উত্তর থাকতে হবে, কোনো কিছুই হয়তো বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলবে না।’

হেমন্ত কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা দিল দময়ন্তী। প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, এই যে দুজন বা তিনজন রুগি মারা গেছেন, এঁদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন?’

হেমন্ত বললেন, ‘হ্যাঁ, নিয়েছি।’ বলে পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে সেটা খুলে বলতে লাগলেন, ‘প্রথম যাঁর বাড়িতে আমরা গিয়েছিলুম, তাঁর নাম ঈশ্বর ভোলানাথ চক্রবর্তী। বয়েস হয়েছিল ছাপ্পান্ন। ভোলানাথের মস্ত ওষুধের দোকান রাজেন্দ্রলাল অ্যাভিনিউতে, শ্যামবাজারে প্রকাণ্ড বাড়ি, গোবিন্দপুরে বিশাল জমি আর ব্যাঙ্কে অনেক টাকা। কিন্তু নিকটাত্মীয় বলতে এক দূর সম্পর্কের ভাগনে আর দূরতর সম্পর্কের এক মামাতো ভাই। এরা দুজনেই ভোলানাথের পয়সায় মানুষ বা অমানুষ। দ্বিতীয়, রানি নির্ঝরিণী দেবী, বয়েস ষাট। বাংলাদেশের কোনো স্টেটের রানি ছিলেন। থাকতেন বিদ্যাসাগর রোডে। রাজত্ব না থাকলে কী হবে, এঁর কলকাতায় দুটো বড়ো বড়ো বাড়ি, আর গয়না, শেয়ার আর ব্যাঙ্ক ব্যালান্স মিলিয়ে অনেক সম্পত্তি ছিল। এঁর দুই মেয়ে, দুজনেই বিয়ে হয়ে তাদের স্বামীদের সঙ্গে বিদেশে। যেটুকু জানতে পেরেছি, এদের দুজনের কারুর সঙ্গেই নির্ঝরিণী দেবীর সদ্ভাব ছিল না। গত সাত-আট বছরে এরা একবারও মাকে দেখতে আসেনি। দেখাশুনো করত ওঁর এক ভাগনি আর তার স্বামী। এরা দুজনের কেউই খুব সুবিধের লোক ছিল না। আর, তৃতীয় জনের নাম ঈশ্বর শম্ভুচন্দ্র ধাড়া। এঁরও বয়েস হয়েছিল ষাট। ইনিও প্রথমজনের মতো ব্যবসায়ী, তবে ছেলেপুলে নাতি-নাতনি নিয়ে বিশাল সংসার। থাকতেন বজবজে। স্ত্রী মারা যাবার পর মাথা খারাপের মতো হয়েছিল। তখন ছেলেরা তাঁকে নীলকান্তপুরে রেখে আসে। বছর খানেক মাত্র ছিলেন। অন্য দুজন অবশ্য অনেক বেশিদিন ছিলেন। এঁদের মধ্যে ভোলানাথ উইল করে প্রজ্ঞা মনবিশ্লেষণ কেন্দ্রকে গোবিন্দপুরের জমি আর ডাক্তার বোসেদের সাড়ে চার লক্ষ টাকা দান করে গিয়েছিলেন। রানি নির্ঝরিণী তাঁর বোস্টমঘাটার বাড়িটা প্রজ্ঞাকে এবং ডাক্তার বোসেদের তিন লক্ষ টাকা দান করে গিয়েছিলেন। শম্ভুচন্দ্র অবশ্য কিছু দিয়ে যাননি।’

‘তিনজনেই একই রোগে মারা গিয়েছেন বলছেন। কী রোগ?’

‘জন্ডিস। আমাদের ধারণা ওষুধের সঙ্গে ওই রোগের জীবাণু শরীরে ঢোকানো হয়েছিল।’

‘সেরকম কোনো ওষুধের সন্ধান কি এঁদের বাড়িতে পেয়েছেন?’

‘না। তবে, একটা আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করেছি।’

‘যথা?’

‘এঁরা তিনজনেই মৃত্যুর আগে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেতে আরম্ভ করেছিলেন।’

‘ভোলানাথ আর নির্ঝরিণী দেবী দুটো উইলেই সাক্ষী হিসেবে নিশ্চয়ই একজন করে ডাক্তার আছেন? উনি কি হোমিওপ্যাথি করতেন?’

‘না। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানরা সাক্ষী হিসেবে সই করেছেন। এবং সেই কারণেই আদালতে উইল দুটোর বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করা যায়নি। উভয় ক্ষেত্রেই উইল স্বহস্তে লেখা, ডাক্তার সাক্ষী, অতএব উইলকর্তা যে সুস্থ শরীরে প্রফুল্লচিত্তেই উইল করেছেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেবার কোনো সম্ভাবনাই নেই।’

‘এঁরা বাড়ি ফিরে আসার পর প্রজ্ঞা মনবিশ্লেষণ কেন্দ্রের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল কি?’

‘ছিল। প্রথম ছ-মাস পনেরো দিনে একবার এবং তার পরের দু-মাস মাসে একবার করে তাঁদের ওখানে নিয়ে যেতে হত চেক-আপের জন্যে।’

‘আচ্ছা, এঁরা হোমিওপ্যাথি কি কোনো বিশেষ ডাক্তারের কাছে করাতেন? আপনার বর্ণনায় বোঝা যাচ্ছে, এঁরা তিনজনেই প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ। এঁরা কি ডাক্তারের চেম্বারে যেতেন, না ডাক্তার বাড়িতে আসতেন? যদি চেম্বারে যেতেন, তাহলে তখন কি তাঁদের সঙ্গে কেউ যেত?’

হেমন্ত মাথা চুলকে বললেন, ‘এ প্রশ্নগুলো অবশ্য আমরা করিনি। তবে যদি আপনি চান, তাহলে কালই আপনাকে সব জানিয়ে দেব।’

দময়ন্তী বলল, ‘শুধু এই ক-টা প্রশ্ন নয়, আরও আছে। কে এঁদের হোমিওপ্যাথের কাছে যেতে উপদেশ দিয়েছে বা ডাক্তার ঠিক করে দিয়েছে? উইল করবার আগে উইলের বয়ান এঁরা নিকটাত্মীয়দের জানিয়েছেন না জানাননি? জন্ডিসে অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে এঁদের ব্যবহার বা চালচলনে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে কিনা? মৃত্যুর আগে, এঁদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কোনো তুমুল ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়েছে কি না?’

হেমন্ত মৃদু হেসে খাতা বন্ধ করে বললেন, ‘আপনার শেষ প্রশ্নটার উত্তর আমার জানা আছে। এঁরা তিনজনেই প্রচণ্ড খিটখিটে স্বভাবের ছিলেন এবং প্রায় প্রত্যেক দিন ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত।’

দময়ন্তী বলল, ‘আপনি তো একথাটা জেনেছেন এঁদের আত্মীয়দের কাছ থেকে। বাড়ির ঠাকুর, চাকর বা ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন না। হয়তো নতুন তথ্য পাবেন।’

‘আসল কথা কি জানেন, আমরা এই রুগিদের বাড়িতে গেছি তাঁদের মৃত্যুর প্রায় দু-বছর বাদে। তাঁদের মৃত্যু যে অস্বাভাবিক, সে কথাটা কিন্তু সন্দেহের পর্যায়ে আছে, কোনো প্রমাণ নেই। এমনকী কেউ সেরকম অভিযোগও আমাদের কাছে করেননি। কাজেই, বাড়ির লোকেদের আমরা বেশি খোঁচাখুঁচি আর করিনি; দেখি, এবার একটু নাড়াচাড়া দিয়ে কিছু বেরোয় কি না।’

.

হেমন্ত বিদায় নেবার পর শিবেন বলল, ‘কি মনে হচ্ছে বউদি? ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং নয়?’

দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘নিশ্চয়ই, খুব ইন্টারেস্টিং।’

‘কি ধারণা হল আপনার? অরিজিৎ বোসই খুনি?’

‘আপাতত, সেরকম মনে হওয়ার তো কারণ দেখছি না। তবে, অনেক জায়গায় খটকা আছে। সেগুলোর সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো একেবারেই ঠিক হবে না।’

.

পরদিন হেমন্ত এলেন একটু রাত্রের দিকে, সঙ্গে একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত নিরীহদর্শন ভদ্রলোক। শিবেন এসেছিল আগেই। বসে বসে চা খাচ্ছিল আর সমরেশের সঙ্গে দাবা খেলছিল।

হেমন্ত আগন্তুক ভদ্রলোকের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এঁর নাম শ্রীবিবেকানন্দ ধাড়া, থাকেন বজবজে। এঁর বাবার নাম ঈশ্বর শম্ভুচন্দ্র ধাড়া। আজ যখন এঁদের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্যে যাই, তখন কথায় কথায় আপনার নাম এসে পড়ায় ইনি নিজেই আপনার সঙ্গে কথা বলবেন বলে আমার সঙ্গে চলে এলেন।’

দময়ন্তী হেসে বলল, ‘তা বেশ তো। সে তো ভালো কথা। বলুন আপনার কী বলবার আছে!’

বিবেকানন্দ নতমস্তকে চিন্তিত মুখে বসেছিলেন। বললেন, ‘দেখুন, আজ থেকে প্রায় বছর দেড়েক আগে আমার বাবার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ ইনফেকটিভ হেপাটাইটিস, যেটা নাকি এক ধরনের জন্ডিস। আমরা জানি যে জন্ডিস একটা খারাপ অসুখ, আমাদের ওদিকে মাঝে মাঝেই দেখা দেয় আর আমার বাবা তখন ষাট বছরের বৃদ্ধ। কাজেই তাঁর মৃত্যু কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে আমাদের কখনোই মনে হয়নি। এই ঘটনার প্রায় বছর খানেক বাদে যখন পুলিশ আমাদের বাড়িতে আসে, তখন আমরা বিরক্তই হয়েছিলুম এবং আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে আমাদের অকারণে কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু, তারপর গত ছ-মাস ধরে আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি এবং আমার মনে কতগুলো সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এই সন্দেহগুলো নিয়ে অবশ্যই আমার পুলিশের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু কি জানেন, ওঁরা চলেন বাঁধাধরা রাস্তায়, আমার প্রশ্নগুলো ঠিক যেভাবে গ্রহণ করা উচিত, হয়তো তাঁরা সেভাবে নেবেন না, এই ভেবে আমি চুপ করেছিলুম। আজ যখন ওঁরা এলেন এবং আপনার নাম করলেন, তখন আমি চলেই এলুম। আপনি যদি দয়া করে আমার কথাগুলো শোনেন।’

দময়ন্তী বলল, ‘নিশ্চয়ই শুনব বিবেকানন্দবাবু। এঁরা থাকলে আপনার বলতে কোনো আপত্তি নেই তো?’

বিবেকানন্দ একটু চিন্তা করে বললেন, ‘না, আপত্তি নেই, যদি আমি যা বলব তা রেকর্ড করা না হয়।’

হেমন্ত মাথা নেড়ে বললেন, ‘আপনার কোনো কথা রেকর্ড করা হবে না, আপনি নির্ভয়ে বলুন। এমনকী আমি কোনো নোটও নেব না। এই আমার কলম বন্ধ করলুম।’

বিবেকানন্দ ম্লান হাসলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে। বলছি। দেখুন বজবজে আমাদের বহু পুরুষের বসবাস। জমিজমা আছে, টাকাপয়সাও কম নেই। মস্ত যৌথ পরিবার আমাদের। আমার বাবা এ বাড়ির মেজোকর্তা? বড়োকর্তা আমাদের জ্যাঠামশাই, আশির কাছাকাছি বয়েস, কিন্তু এখনও শক্তসমর্থ আছেন, দোর্দণ্ডপ্রতাপ তাঁর। আমার বাবা ছিলেন এমনিতে চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু রেগে গেলে তাঁর কোনোরকম জ্ঞানগম্যি থাকত না। তখন তাঁকে কেউ সামলাতে পারত না, এমনকী জ্যাঠামশাই পর্যন্ত না। একমাত্র আমার মা পারতেন! তাঁর একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব ছিল যার সামনে সবাইকে নম্র হতে হত। বছর চারেক আগে তাঁর মৃত্যু হয়। তারপর থেকে বাবা একেবারে পালটে যান। যেভাবেই হোক, তাঁর ধারণা হয়েছিল যে মার মৃত্যুর জন্যে তিনিই দায়ী। তা ছাড়া, মা চলে যাওয়ায় ওই বিশাল সংসারেও তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করতে থাকেন। ফলে, ক্রমশ তিনি নিজেকে সমস্ত কাজকর্ম থেকে গুটিয়ে নেন, বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেন এবং সকলের সঙ্গে কথা বলাও প্রায় বন্ধ করে দেন। আমার স্ত্রীকে নাকি একবার বলেছিলেন যে এইভাবে তিনি প্রায়শ্চিত্ত করছেন। এরপর থেকে আস্তে আস্তে তাঁর মধ্যে মাথাখারাপের লক্ষণ দেখা দিতে থাকে। তখন আমরা কয়েক জন মানসিক রোগের ডাক্তারকে দেখাই এবং পরে তাঁদেরই একজনের রেকমেন্ডেশনে বাবাকে নীলকান্তপুরে ভরতি করে দিয়ে আসি। উনি ওখানে ছিলেন বছর খানেক। তারপর ডাক্তার বোস ওঁকে সুস্থ বলে সার্টিফিকেট দেওয়ায় আমরা ওঁকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসি।

‘বাড়িতে আসার পর তিনি কিন্তু ভালোই ছিলেন। অসংলগ্ন কথা বা চালচলন একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকী তিনি কাজকর্মও করতে শুরু করেছিলেন। হঠাৎ ওঁর একবার পেটের অসুখ করল। আমরা ডাক্তার ডাকলুম। উনি বললেন, ‘হোমিওপ্যাথি করবেন, অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ওঁর বড্ড কড়া লাগে। এটা আমাদের একটু আশ্চর্য লাগল, কারণ অসুস্থ হবার আগে পর্যন্ত উনি হোমিওপ্যাথি দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না, হোমিওপ্যাথদের ঠগ জোচ্চোর ইত্যাদি বলে গালাগাল করতেন। তবু, ব্যাপারটা আমরা খুব একটা সিরিয়াসলি নিইনি, কারণ বয়েস হলে অনেক লোকেরই অনেকরকম ধারণা পালটে যায়। তখন আমরা আমাদের পাড়ার সবচেয়ে নামকরা হোমিওপ্যাথকে নিয়ে এলুম। বাবা তাঁকে দেখাতে অস্বীকার করলেন। বললেন, ওঁর চেনা একজন ডাক্তার আছেন, তাঁকেই তিনি দেখাবেন। ডাক্তারের নাম রজার ওয়ালটন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, বসেন পার্ক সার্কাসে। এটাও আমাদের খুব অদ্ভুত লাগল। ব্যবসা সূত্রে আমাদের মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতে হয় বটে, কিন্তু ওঁর অসুখেরও অনেক আগে থেকেই এদিকে আসা বন্ধ ছিল। তাহলে এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হোমিওপ্যাথের সঙ্গে ওঁর পরিচয়ই বা হল কখন আর আস্থা গড়ে ওঠবারই বা সময় হল কখন? যাহোক, তবু আমরা তাঁকে বাধা দিইনি, তার একটা কারণ ছিল বাধা দিলে না আবার হিতে বিপরীত হয়।

‘এই ডাক্তারের কাছে উনি বার পাঁচ-ছয় গিয়েছেন। তারপর হঠাৎ একদিন উনি আমাদের অর্থাৎ ওঁর ছেলে-মেয়েদের ডেকে পাঠালেন। বললেন, আমি উইল করতে চাই, তোমরা ডাক্তার প্রামাণিক, আমাদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান আর অ্যাডভোকেট নিতাই মল্লিককে খবর দাও। এঁরা দুজনেই আমাদের বাড়ির খুব কাছেই থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এঁরা দুজনেই এসে উপস্থিত হলেন। বাবা তখন এঁদের সামনে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজে স্বহস্তে একটা উইল লিখলেন। তারপর সেটা নিতাইকাকার হাতে দিয়ে বললেন, পড়ো, পড়ে সাক্ষীর জায়গায় সই করো। নিতাইকাকা উইলটা পড়লেন, পড়ে ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর সেটা ডাক্তারকাকার হাতে দিয়ে বললেন, তুমি অন্যায় করছ শম্ভু, ভয়ানক অন্যায় করছ। ডাক্তারকাকাও সেই কথাই বললেন। তখন জানা গেল, বাবা তাঁর ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সমস্ত টাকা, সব শেয়ার আর আচিপুরের দু-বিঘে ধানজমি নীলকান্তপুরের হাসপাতালকে লিখে দিয়েছেন। সেটা যদি এমনি করতেন তাহলে মানবিকতার খাতিরে হয়তো মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু, সেইসঙ্গে এরকম কাজ করার কারণ হিসেবে তিনি তাঁর ছেলে-মেয়েদের দায়ী করেছেন। বলেছেন, তিনি নাকি কখনোই পাগল ছিলেন না। সম্পত্তির লোভে আমরা তাঁকে পাগল বানিয়েছি, অতএব তার শাস্তিস্বরূপ তিনি তাঁর স্বোপার্জিত সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন আমাদের। ওঁর প্রকৃত বন্ধু নাকি নীলকান্তপুরের ডাক্তার বোসেরা।

‘নিতাইকাকা কিন্তু সাক্ষীর জায়গায় তক্ষুনি সই করলেন না। বললেন, আমি এক্ষুনি এই কাগজে সই করছি না। আগে সমস্ত ব্যাপারটা আমাকে খতিয়ে দেখতে হবে। তুমি যা দান করতে চাইছ, সেটা করবার সত্যি সত্যি তোমার কোনো অধিকার আছে কিনা সেটা বিচার করে তারপর যা করবার করা যাবে। আমি আইনের লোক হয়ে এমন একটা দলিলে সই করতে পারি না যেটা আদালতে গ্রাহ্য নাও হতে পারে।

‘বাবা অনেক পেড়াপেড়ি করলেন, কিন্তু নিতাইকাকা টললেন না। ডাক্তারকাকাও ওঁকেই সমর্থন করলেন। তারপর কাগজটা নিয়ে দুজনে উঠে পড়লেন। সেদিন রাত্রি থেকেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর সুস্থ হননি। ওঁর মৃত্যুর পর নিতাইকাকা আমাদের বলেছিলেন যে কেউ ওঁকে এই উইল করবার জন্যে ব্রেন ওয়াশ করেছিল। আমাদের নামে ওইসব খারাপ কথা লেখবার একটা কারণ হচ্ছে যে আমরা মামলা করতে গেলে আদালতের সহানুভূতি বা অনুকম্পা আমাদের বিরুদ্ধে যাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি হত। কিন্তু, রহস্য হল যে এরকম ব্রেন ওয়াশ করল কে?

‘এ ছাড়া, আর একটা রহস্য হল, উনি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেতেন গোপনে। এক একবারে পাঁচ-ছ শিশি ওষুধ আনতেন, প্রত্যেকটি শিশি শেষ হওয়া মাত্র ভেঙে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতেন। এটা যে কেন করতেন, তার কারণ তখনও বুঝিনি, আজও জানি না।

‘এখন ব্যাপার হচ্ছে, এই রহস্যগুলোর কোনোটাই খুব ভয়ঙ্কর রকমের কিছু নয়। সবগুলো মিলিয়ে দেখলে মনে হয় কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল আছে। হয়তো, বাবার মৃত্যুটা যতটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে, ততটা সম্ভবত নয়।’

বিবেকানন্দ চুপ করলেন। দময়ন্তী গভীর মনোযোগ দিয়ে ওঁর প্রতিটি কথা শুনছিল। এখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘রজার ওয়ালটনকে আপনি দেখেছেন?’

‘আমি দেখিনি। আমাদের ড্রাইভার রতন দেখেছে। সে বলেছে, সেই সাহেব ডাক্তার নাকি বেঁটেখাটো, চোখে নীল কাচের চশমা, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সবসময় সুট বুট পরে থাকেন। বয়েস চল্লিশের ওপরে।’

‘আপনি দেখেননি কেন? ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাননি কখনো?’

‘না। উনি সাধারণত সপ্তাহের মাঝে কোনোদিন দুপুরবেলা যেতেন। তখন আমাদের সকলেরই কাজকর্ম থাকে। আর রতন আমাদের বহুদিনের লোক, ছোটোবেলা থেকে আমাদের পরিবারে মানুষ, সে আমাদেরই একজন বলতে পারেন। কাজেই, ওর সঙ্গে যাওয়ায় কারুরই কোনো অসুবিধে বা আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না।’

হেমন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘বেঁটে, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সুটেড বুটেড— আগে বলেননি তো?’

‘আপনি তো আমার কাছে সাহেব ডাক্তারের চেহারার বর্ণনা চাননি।’

‘সে কথা ঠিক। কিন্তু আপনি তো ডাক্তার অরিজিৎ বোসকে দেখেছেন। তাঁর চেহারার সঙ্গে এই বর্ণনার কি অস্বাভাবিক মিল নয়?’

‘হ্যাঁ, মিল আছে ঠিকই। কিন্তু ডাক্তার অরিজিৎ বোসকে রতনও দু-একবার দেখেছে। সাহেব ডাক্তার আর অরিজিৎ বোস এক লোক হলে ও ঠিক বুঝতে পারত।’

‘ছাই পারত! টাক মাথায় উইগ পরলে আর চোখে নীল কাচের চশমা লাগালে একটা মানুষের চেহারা আমূল পালটে যেতে পারে, সে কথা জানেন?’

দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘সাহেব ডাক্তারের ঠিকানা জানেন?’

বিবেকানন্দ বললেন, ‘বাড়ির ঠিকানা তো জানি না। চেম্বারের ঠিকানা জানি। চোদ্দো নম্বর রহিম ওসমান লেন।’

‘আচ্ছা, যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আপনার বাবা খেতেন, সেগুলো কখনো দেখেছেন?’

‘দেখেছি। ছোটো ছোটো শিশি ভরতি জলের মতো ওষুধ। মনে হয় মাদার টিংকচার হবে।’

‘আপনার বাবা বাড়ি ফিরে আসার পর নীলকান্তপুর থেকে কেউ দেখা করতে এসেছে কখনো?’

‘না, কখনো নয়।’

‘এমন কোনো লোক এসেছে, যাকে আপনারা কেউ চিনতেন না?’

‘সেটা তো বলা কঠিন। উনি বাইরের ঘরে থাকলে অনেক লোকই আসত ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাদের কেউ চেনা, কেউ-বা নয়। তা ছাড়া, সবসময় তো ওঁর সঙ্গে লোক থাকত না।’

‘উনি মর্নিং ওয়াক করতেন?’

‘করতেন। সেটা ওঁর থেরাপির একটা অঙ্গ ছিল। খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে যেতেন। ঘণ্টা দেড়েক বাদে ফিরে আসতেন।’

‘সঙ্গে কেউ যেত না?’

‘প্রথম প্রথম যেত। পরে, উনি একাই যেতেন। অত ভোরে কেউ উঠতে চাইত না। উনিও একা যাওয়াই পছন্দ করতেন।’

‘উনি কি হাসপাতালে যাওয়ার আগেও মর্নিং ওয়াক করতেন?’

‘করতেন।’

‘এ উইল লেখার অব্যবহিত আগে কি আপনাদের সঙ্গে ওঁর কোনোরকম ঝগড়া হয়েছিল?’

‘হয়েছিল। আমার ছোটো ভাইয়ের স্ত্রীকে খুব বকাবকি করেছিলেন তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলায়। ছোটো ভাই তার প্রতিবাদ করে। বাবা তাকে রাগের মাথায় কতগুলো এমন কথা বলেন, যেগুলো বলা তাঁর উচিত হয়নি। তখন আমি এবং আমাদের ছোটো বোন তার প্রতিবাদ করি। তখন তিনি রাগে দিশেহারা হয়ে আমাদের এই বলে শাসান যে আমাদের সকলকে উনি এমন শাস্তি দেবেন যা নাকি আমরা কোনোদিনও ভুলতে পারব না।’

‘তাহলে তো ওঁর উইল করা এবং তাতে আপনাদের বঞ্চিত করা খুব একটা রহস্যময় ব্যাপার বলে তো মনে হয় না। ওঁর দিক থেকে ব্যাপারটা যুক্তিপূর্ণ বলা চলে, তাই না।’

‘না, ঠিক তা বলা চলে না। আগেই বলেছি, রেগে গেলে ওঁর কোনো জ্ঞান থাকত না। কাজেই, এরকম ঝগড়া ঘন ঘন না হলেও মাঝে-মধ্যে হতই। সেদিন এমন কিছু হয়নি যাতে এই উইল লেখা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তবু সেটা যদি মেনে নেওয়া যায়, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে উইলের বয়ানটা উনি এমনভাবে লিখলেন কী করে যাতে সেই উইল আদালতে কনটেস্ট করা কঠিন হয়। উনি আইন যে ভালো জানতেন তা বলা যায় না আর এমন কিছু লেখাপড়াও শেখেননি যে নিজে নিজেই অমন ভাষায় একটা উইল লিখে ফেলবেন।’

‘কতদূর লেখাপড়া করেছিলেন?’

‘ম্যাট্রিক পাশ করেননি। খুব সম্ভব ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিলেন।’

‘আপনারা ভাই-বোন কজন? তাঁরা কে কী করেন?’

‘পাঁচজন। তিন ভাই, দু-বোন। এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সে শ্যামপুকুরে থাকে। ছোটো বোনের বিয়ে বাকি। আমি বড়ো। পারিবারিক ব্যবসা দেখি; মেজো ভাই আর্মিতে আছে— অফিসার। ছোটো ভাই দীননাথ কলেজে পড়াত। ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।’

.

বিবেকানন্দ চলে গেলে হেমন্ত বিজয়গর্বে শিবেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, এই রজার ওয়ালটন আর অরিজিৎ বোস যে একই ব্যক্তি, সে বিষয়ে আর আপনার কোনো সন্দেহ আছে?’

শিবেন ভাবলেশহীন মুখে সিগারেট টানতে টানতে বলল, ‘আছে, প্রচুর সন্দেহ আছে। আগে আইডেন্টিফাই করাও, তারপর নিঃসন্দেহ হওয়া যাবে।’

দময়ন্তী এই বাক্যালাপে বাধা দিয়ে বলল, ‘হেমন্তবাবু, আপনার অন্য দুটো বাড়িতে ইনভেস্টিগেশনের ফলাফল তো আমাকে জানালেন না?’

হেমন্ত আবার ব্যাগ খুললেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, এই যে। রেজাল্ট খুব ইন্টারেস্টিং। প্রথমে ধরুন, নির্ঝরিণী দেবী। ইনিও এক সাহেব হোমিওপ্যাথের কাছে যেতেন। পার্ক সার্কাসে। ডাক্তারের নাম অবশ্য ওঁর ভাগনির মনে নেই। গাড়িতে যেতেন। ড্রাইভার বলল, রাস্তার নাম রহিম ওসমান লেন। ওঁকে যে কে এই ডাক্তারের নাম রেকমেন্ড করেছিল তা কেউ জানে না। উইল করবার আগের দিন রাত্রে ভাগনি আর তার হাজব্যান্ডের সঙ্গে ওঁর তুমুল ঝগড়া হয়েছিল ঝি, চাকর আর ড্রাইভারের সামনে। উইলে সই আছে সলিসিটার হৃদয়রঞ্জন গাঙ্গুলি আর ডাক্তার প্রতাপ ভাদুড়ির। আপনি তো জানেন, দুজনেই খুব বিখ্যাত লোক, অত্যন্ত ব্যস্ত। এঁদের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু একদিনের নোটিসে দেখা করা সম্ভব হয়নি। যদি বলেন তো কাল একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।

‘এরপর ভোলানাথ চক্রবর্তী। ইনি ওঁর ভাগনের সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যেতেন। একই ডাক্তার, একই ঠিকানা। ডাক্তার রুগি দেখতেন একা, তখন কাছে কেউ থাকত না। এঁর একটা ইনফরমেশন বেশ অদ্ভুত। ডাক্তারের চেম্বারে ওঁরা যখন যেতেন, তখন সেখানে একমাত্র একজন বেয়ারা গোছের লোক ছাড়া অন্য কোনো রুগি কখনো দেখা যেত না। এর কারণ হিসেবে ভোলানাথ অবশ্য বলতেন যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রুগিরা আসে, সাহেব ডাক্তার তো, কাউকে অপেক্ষা করতে হয় না।’

দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘বেশ, এই ডাক্তারের ব্যাপারটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। কেবল এই রজার ওয়ালটনটি কে সেটা জানা প্রয়োজন। সে ব্যাপারে কি কোনো খোঁজখবর নিয়েছেন?’

‘লোক পাঠিয়েছি আজ। রিপোর্ট কাল পাওয়া যাবে।’

‘উইলে কার কার সই আছে?’

‘ভোলানাথের উকিল সহদেব রায় আর ডাক্তার বিমল দাশগুপ্তের। সহদেব রায়ের সঙ্গে দেখা করেছি। উনি বললেন, ”এরকম উইল করে ভোলাবাবু উচিত কাজই করেছেন।” দেখলুম, ওঁর দুজন গলগ্রহের ওপরেই ভদ্রলোক মহা খাপ্পা। বিশেষত ভাগনেটির ওপর। বললেন, সে নাকি একটা ক্রিমিন্যাল, সোশ্যাল প্যারাসাইট, আরও কত কী! ওকে যা দিয়েছেন, তাও দেওয়া উচিত হয়নি।’

‘ভাগনে কী করে?’

‘কিছুই করে না। বড়োলোক মামা থাকলে করবার দরকারই বা কী?’

‘তাহলেও একটু ডিটেলস জেনে বলবেন? ভোলানাথের মামাতো ভাই আর নির্ঝরিণীর ভাগনীজামাই সম্পর্কেও একটু খোঁজখবর চাই।’

হেমন্ত প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। বললেন, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই— সেইরকম ব্যাপার? ঠিক আছে, বলছেন যখন খোঁজখবর নেওয়া যাবে। কাল বাদে পরশু আসব। তার পরদিন ছুটি আছে। একটু সন্ধ্যে করেই আসব।’

দময়ন্তী মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

.

শিবেন ধরাচুড়ো পরেই ঘরে ঢুকল। বলল, ‘অফিস থেকে সোজা আসছি, বাড়ি যাইনি। হেমন্তও এখনই আসবে। আর রমলার আমার ওপর অর্ডার আছে আজ রাত্রে আপনাদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। রাত্রের খাওয়াটা আজ ওখানেই।’

দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘আমি জানি। রমলা দুপুরবেলা ফোন করেছিল।’

শিবেন সমরেশকে বলল, ‘তুই আবার অফিস থেকে ফিরে একগাদা জলখাবার খেয়ে রাখিস নি তো? তোর জন্যে রমলা স্পেশাল মাংসের বন্দোবস্ত করেছে। না খেলে তোর কপালে দুঃখ আছে।’

সমরেশ বলল, ‘স্পেশাল মাংস? সর্বনাশ! ভাগ্যিস কাল অফিস নেই।’

বলতে বলতেই হেমন্ত এসে উপস্থিত হলেন। ধপাস করে সোফায় বসে খাতা খুলে ফেললেন। বললেন, ‘আপনি যা যা জানতে চেয়েছিলেন, তার প্রায় সমস্ত ইনফরমেশনই জোগাড় করে এনেছি। কোনটা দিয়ে শুরু করব, বলুন?’

দময়ন্তী বলল, ‘ডাক্তার রজার ওয়ালটন, আর কে?’

‘ডাক্তার রজার ওয়ালটন ভাগলবা। তাঁর কোনো পাত্তাই নেই, চেম্বারে তালা ঝুলছে। বাড়িওলার কাছে এখনও দু-মাসের ভাড়া জমা আছে, তারপর সে নোটিশ দেবে, বলেছে। কিন্তু দেবে কাকে? রজার সাহেব তাকে নিজের যে ঠিকানা দিয়েছিলেন, সেটা একেবারেই ভুয়ো। ওরকম কোনো ঠিকানা কলকাতা শহরে নেই।’

‘বাড়িওলার নাম কী? কোথায় থাকে?’

‘নাম আবদুল লতিফ নুরুদ্দিন, ওই চোদ্দো নম্বর রহিম ওসমান লেনেই থাকেন। তিনতলায়। ডাক্তারের চেম্বার দোতলায়। একতলায় অনেকগুলো দোকান।’

‘দোতলাটা কি পুরোটাই ডাক্তার ভাড়া নিয়েছিলেন?’

‘না, আধখানা। সেদিকে দুটো ঘর। অন্যদিকে একটা অফিস আছে।’

দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘ওই ডাক্তার সম্পর্কে বাড়িওলা কী বলল?’

‘বলল যে বছর তিনেক আগে এক ভদ্রলোক ওর কাছে এসে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নেন। এক দালাল ওঁকে নিয়ে এসেছিল। তখন ওকে বলা হয়েছিল যে এই ডাক্তার বিলেত থেকে পাশ টাশ করে কলকাতায় ফিরে এসে চেম্বার খুলে বসতে চান। সপ্তাহে দু-চারদিন বসবেন। এক বছরের ভাড়া অগ্রিম দেন। ব্যস, এই পর্যন্ত। ডাক্তারকে বাড়িওলা দু-চারবার দেখেছে, সামান্য দু-একটা কথা হয়েছে, তার বেশি কিছু নয়।’

‘বেশ, এবার ভোলানাথ আর নির্ঝরিণীর আত্মীয়দের কথা বলুন।’

‘প্রথমে বলছি নির্ঝরিণীর ভাগনি আর স্বামীটির কথা। ভাগনির নাম মঞ্জুলা, খুব চাপা স্বভাবের, কথা কম বলেন, কিন্তু চোখের দৃষ্টি দেখলে বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়। আমার তো মনে হয়েছে, নিঃশব্দে হেন কর্ম নেই যা ওই মহিলা করতে পারেন না। খুনখারাপি পর্যন্ত। বয়েস তিরিশের ওপর, কিন্তু কমবয়সি বলে মনে হয়। সোজা কথায়, আমি কখনো গায়ে পড়ে ওই মহিলার সঙ্গে কাজিয়া করতে যাব না, এই বলে দিলুম।’

‘লেখাপড়া? কোনো কাজকর্ম করতেন বা করেন?’

‘বি এ পাশ। কাজকর্ম কিছু করেন না। স্বামী আর মামী, এই নিয়েই আছেন।’

হেমন্তর রসিকতায় কেউ হাসল না। দময়ন্তী বলল, ‘এবার স্বামীটির কথা বলুন।’

‘হ্যাঁ, স্বামীর নাম পঙ্কজ রায়চৌধুরি, কিন্তু খুব একটা সার্থকনামা বলা চলে না। বরং উলটোটাই বলা যায়। পূর্ববঙ্গের কোনো জমিদার বংশে জন্ম। এখন মোটামুটি মামিশাশুড়ির অন্নদাস। লেখাপড়া শেখেননি। নানারকম ব্যবসা করতে গিয়ে ক্রমাগত লসই খেয়েছেন। আপাতত পুরোনো গাড়ি কেনা-বেচার ব্যবসা করছেন, তবে সেটাও টলটলায়মান। নানারকম নেশা আছে বলে মনে হল। নানারকম রোগও নিশ্চয়ই আছে। ফলে, চল্লিশ বছর বয়েসে দেখলে মনে হয় যেন পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেন।

‘এরপর আসছি ভোলানাথের মামাতো ভাইয়ের কথায়। এঁর নাম সোমনাথ ভট্টাচার্য। বয়েস তিরিশের একটু ওপরে হবে। নবকার্তিকের মতো চেহারা। এককালে পাড়ায় মস্তান বলে বেশ সুনাম বা দুর্নাম ছিল, কয়েক বার হাজতবাসও করেছেন। শুনেছি ইদানীং মতিগতি একটু ফিরেছে। কাজেকর্মে মন হয়েছে, চালচলন কিছু সভ্যভব্য হয়েছে।’

‘কী কাজ করেন ইনি?’

‘ওষুধের ব্যবসা করেন। কিছুদিন দাদার দোকানে বসেছিলেন, সেখান থেকেই বোধ হয় আইডিয়া পান। তারপর এখন কয়েকটা ছোটো-বড়ো কোম্পানির এজেন্ট। তারাতলা অঞ্চলে একটা গোডাউনও ভাড়া নিয়েছেন। মোটের ওপর নেহাত মন্দ নেই। তবে শুনেছি দাদার মতোই চণ্ডাল রাগ, ক্ষেপে গেলে মানুষ থাকেন না।’

‘ভদ্রলোকের গাড়ি আছে?’

‘আছে। একটা পুরোনো অ্যাম্বাসাডার। তবে বেশ ভালো কন্ডিশন। এই গাড়ি নিয়েই ডাক্তারের কাছে বড়োমামাকে নিয়ে যেতেন ওঁদের ভাগনে।’

‘এরপর ভাগনের কথা বলুন।’

‘ভাগনেটি তার ছোটোমামার মতোই পাড়ার মস্তান ছিল, কিন্তু তার থেকে আর কোনোরকম পদোন্নতি হয়নি, এখনও তাই রয়ে গেছে। শ্যামল রায়কে পাড়ার সবাই যথাসাধ্য এড়িয়ে চলে। কয়েক বার হাজতবাসের অভিজ্ঞতা আছে, মামার জোরে ছাড়া পেয়ে এসেছেন এতদিন। কাজকর্ম কিছুই করে না। মাঝখানে সিনেমায় নেমেছিল, সুবিধে হয়নি।’

‘বয়েস কত এর? চেহারা?’

‘এরও বয়েস তিরিশের কাছাকাছি। সোমনাথের চেয়ে সামান্য ছোটো হবে। চেহারা সোমনাথের মতো অত সুন্দর না হলেও কাছাকাছি।’

‘একবার হৃদয়রঞ্জন গাঙ্গুলি আর ডাক্তার প্রতাপ ভাদুড়ির সঙ্গে কথা বলবেন? ওঁরা কী বলেন জানতে পারলে ভালো হত।’

‘ঠিক আছে। তাই হবে। তবে দু-একদিন দেরি হতে পারে।’

.

গাড়িতে উঠে শিবেন বলল, ‘যাওয়ার পথে একবার চোদ্দো নম্বর রহিম ওসমান লেনটা ঘুরে যাব নাকি?’

দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘তাহলে তো খুব ভালোই হয়।’

‘তা তো বুঝতেই পারছি। হেমন্তর দেখা যে আপনার খুব একটা পছন্দ হয়নি তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই।’

‘না, না, তা নয়। হেমন্তবাবুর কাজ তো কিছু খারাপ নয়। তবে কি জানেন, যে যুগে রাজারা কান দিয়ে দেখতেন, সে যুগেও তাঁরা কিন্তু মাঝে মাঝেই ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়তেন স্বচক্ষে রাজ্যের অবস্থা দেখবার জন্যে।’

‘হুঁ, তা তো বটেই। কিন্তু, কি জানেন? এত রাতে ওখানে কোনো লোকজন পাওয়া যাবে কিনা বা বাড়ির দরজা খোলা পাওয়া যাবে কিনা, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।’

সমরেশ বলল, ‘এত রাত মানে? সবে তো সাড়ে নটা। এটা কি একটা রাত হল?’

শিবেন বলল, ‘তোর কাছে হয়তো হল না। কিন্তু অনেকের কাছেই এটা অনেক রাত।’

কিন্তু গাড়ি যখন রহিম ওসমান লেনে পৌঁছল, তখন দেখা গেল যে শিবেনের সন্দেহ নিতান্তই অমূলক। রাস্তাটা লেন বটে, কিন্তু মোটেই কোনো সরু এঁদো গলি নয়। যথেষ্ট চওড়া। অনেক দোকান, তাদের বেশিরভাগই বন্ধ। কিন্তু পানের দোকান, চায়ের দোকান আর রেস্টুরেন্টগুলো খোলা, রাস্তায় অনেক লোক আর প্রচুর শব্দ যার বেশিরভাগই আসছে একটা ফুটপাথের ক্যাসেটের দোকানের তারস্বর স্পিকার থেকে।

চোদ্দো নম্বর বাড়িটা তিনতলা। মাঝখানে সিঁড়ি, দু-পাশে ফ্ল্যাট। একতলার একদিকে একটা দর্জির দোকান, অন্যদিকে একটা পাম্পসেট এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির শোরুম। দুটোই বন্ধ। দোতলার পুরোটাই অন্ধকার। তিনতলার আলো জ্বলছে। একতলার সিঁড়ির দরজাটা খোলা।

শিবেন বাড়ির সামনে গাড়ি রাখল।

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়ির ভেতরে এখন ঢোকাটা বোধ হয় উচিত হবে না, না?’

শিবেন মাথা নাড়ল। বলল, ‘না। উচিত হবে না। তার ওপর, আবার ইউনিফর্ম পরে আছি। এটার আবার একেকজনের ওপর একেকরকমের এফেক্ট হয়, জানেন তো?’

দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘তা আর জানি না? তার ওপর, হেমন্তবাবু কালই এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছেন। কাজেই, আজকে বোধ হয় আমাদের ফিরে যাওয়াটাই শ্রেয় হবে। তবে, জায়গাটা কেমন সেটা জানবার ইচ্ছে ছিল, সেটা জানা গেল।’

সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘জায়গাটা কেমন, মানে?’

‘মানে নির্জন বা অন্যরকম, এই আর কী!’

এই কথার মধ্যে একজন প্রৌঢ় মুসলমান ভদ্রলোক আস্তে আস্তে গাড়িটার দিকে এগিয়ে এলেন। ভদ্রলোক বেঁটেখাটো, দোহারা চেহারা, মাথাজোড়া টাক, মুখে কাঁচা-পাকা চাপ দাড়ি, পরনে গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামা।

নীচু হয়ে শিবেনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাউকে খুঁজছেন কি? ওঃ, আপনি দেখছি পুলিশ।’

শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, আমি পুলিশই বটে। আচ্ছা, ওই বাড়িতে বাড়িওলা যিনি থাকেন, তাঁকে আপনি চেনেন? তাঁর নাম বোধ হয় আবদুল লতিফ নুরুদ্দিন।’

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, ‘চিনি। আমিই আবদুল লতিফ। কী ব্যাপার বলুন তো? আপনারাও কি ওই ওয়ালটনের সম্পর্কে খোঁজখবর করতে এসেছেন নাকি? কী করেছে কি লোকটা?’

আবদুল লতিফ হয়তো আরও প্রশ্ন করতেন, কিন্তু তার আগেই গাড়ির তিনজন আরোহী বেরিয়ে এসে তাঁকে নমস্কার করায় তা আর পারলেন না। দময়ন্তীর পরিচয় পেয়ে তিনি যে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেছেন তা তাঁর মুখের অবস্থা দেখেই পরিষ্কার বোঝা গেল। মিনমিন করে বললেন, ‘চলুন, বাড়ির ভেতরে যাই।’

দময়ন্তী বলল, ‘না, না, এখন আপনাকে আর বিরক্ত করব না। শুধু যদি দয়া করে ডাক্তার ওয়ালটনের সম্পর্কে কিছু বলেন।’

আবদুল লতিফ বললেন, ‘কী আর বলব? ওকে আমি দেখেছি বোধ হয় সাত-আট বারের বেশি নয়। রোজ তো আসত না, মাঝে মাঝে আসত। রুগি প্রায় ছিলই না। হয়তো অন্য কোথাও সে লোকটার চেম্বার ছিল। তবে আমার এখানে চেম্বারে ভিড় টিড় কখনো দেখিনি। ওর একটা বেয়ারা ছিল, ববি রোজারিও, নূরপুরে বাড়ি, সে আমাকে মাঝে মাঝে ভাড়া দিয়ে যেত।’

‘আপনি কি কখনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন?’

‘বলেছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে বা এই ফুটপাথে।’

‘কোনো অস্বাভাবিক কিছু কখনো লক্ষ করেছেন কি? চেহারায় বা চালচলনে বা কথাবার্তায়?’

‘নাঃ, কিচ্ছু না। তবে সাধারণ অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের তুলনায় লোকটা বেশ ভদ্র আর মার্জিত ছিল। অবশ্য, তা তো হবেই— শত হলেও ডাক্তার তো।’

‘শুনেছি লোকটা খুব বেঁটে ছিল। তাই কি?’

‘না, না, মোটেই বেঁটে ছিল না। এই সমরেশবাবুর তুলনায় হয়তো বেঁটে, আমাদের তুলনায় একেবারেই নয়। কে বলেছে আপনাদের?’

‘ওর রুগি শম্ভুচন্দ্র ধাড়ার ড্রাইভার।’

‘ওঃ রতন? ও তো বলবেই। তাকে দেখেননি বুঝি? তালগাছের মতো লম্বা।’

‘রতনকে আপনি চেনেন?’

‘চিনি না? শম্ভুবাবুকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকিয়ে দিয়ে আমার কাছে এসে বসত আর দুনিয়ার আষাড়ে গপ্পো জুড়ে দিত। আচ্ছা, এই ডাক্তারটা কী করেছে? খুনটুন করেছে নাকি?’

‘সেইটে তো সঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আপনার কি ধারণা, লোকটা খুন করতে পারে?’

‘পারে। লোকটাকে আমার ভালো লাগত না। খুব হাসিখুশি ছিল ঠিকই, কিন্তু হাসিটা পরিষ্কার ছিল না। আসলে কি জানেন, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর চোখে কালো চশমা দেখলেই যেন কেমন কেমন মনে হয়।

.

খাওয়াদাওয়ার পর শিবেনের বসার ঘরে কথা হচ্ছিল। শিবেন বলল, ‘একটা জিনিস বোঝা গেল যে ডাক্তার ওয়ালটন সমরেশের চেয়ে খাটো, আবদুল লতিফের চেয়ে লম্বা। অর্থাৎ পাঁচ চার থেকে পাঁচ এগারোর মধ্যে। কিন্তু পাঁচ আট থেকে পাঁচ এগারো বাদ দেওয়া যেতে পারে, কারণ রতন যতই তালগাছের মতো লম্বা হোক না কেন, এরকম হাইটের লোকেদের সে কখনোই বেঁটে বলবে না। আমার ধারণা রজার সাহেবের উচ্চতা পাঁচ চার থেকে পাঁচের মধ্যে। বড়োজোর মেরে কেটে সাড়ে পাঁচ।’

সমরেশ বলল, ‘ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কালো চশমা, অপরিষ্কার হাসি, সবসময় সুটবুট পরা। নির্ঘাত ছদ্মবেশ। তুমি কি বলো?’

দময়ন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘হতে পারে। তবে আমি কিন্তু সে কথা ভাবছি না। আমার আশ্চর্য লাগছে যে রহিম ওসমান লেন বেশ একটা জনবহুল জায়গা আর ডাক্তার ওয়ালটন আবদুল লতিফ সাহেবের সঙ্গে সিঁড়িতে বা ফুটপাথে দেখা হলে হেসে হেসে কথা বলেছেন।’

শিবেন আর সমরেশ মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর শিবেন বলল, ‘আর কী কী ব্যাপারে আপনার আশ্চর্য লাগছে?’

দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘লক্ষ করে দেখুন, যে দুজন তাঁদের সম্পত্তি নীলকান্তপুরকে দান করে গেছেন এবং আর একজন যিনি তা করতে যাচ্ছিলেন, তাঁদের কেউই কিন্তু তাঁদের আশ্রিতদের ঘরছাড়া করেননি যদিও তাঁদের ওপর রাগের বশেই এঁদের উইল করা।

‘ভোলানাথ, নির্ঝরিণী বা শম্ভুচন্দ্র— এঁদের কারুর সঙ্গেই বাড়ি ফিরে আসার পর নীলকান্তপুরের বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। যেটুকু ছিল, সেটা তাঁদের আত্মীয়দের সামনেই ছিল, কোনো গোপনীয়তা ছিল না। অথচ, কেউ এঁদের ডাক্তার ওয়ালটনের নাম রেকমেন্ড করেছিল। কীভাবে করেছিল?’

শিবেন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কি ধারণা যে এই ওয়ালটনই এঁদের আত্মীয়ের বিরুদ্ধে কুচিন্তা, উইল করার কুযুক্তি আর বিষাক্ত ওষুধ সাপ্লাই করত?’

‘হ্যাঁ, আমার ধারণা অনেকটা সেরকমই বটে। কিন্তু কে এই রজার ওয়ালটন? কে হতে পারে? আচ্ছা, নূরপুরে ববি রোজারিওর সন্ধান চালানো যায়?’

‘যায়। কালই লোক পাঠাচ্ছি। লোকাল থানায়ও খবর নিচ্ছি। যদিও সুবিধে বিশেষ হবে বলে মনে হয় না।’

‘আমারও মনে হয় না। একবার আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করা যাবে?’

‘যাবে। চলুন, কাল ভোলানাথের বাড়ি যাওয়া যাক। রোববার আছে, ভাইটিকে হয়তো পাওয়া যাবে। ভাগনের অবশ্য যাঁহা রোববার তাঁহা অন্যান্য দিন। সকালবেলাই যাওয়া যাবে।’

‘বেশ, তাই চলুন।’

শিবেন মাথা চুলকে বলল, ‘আর একটা কথা বলব?’

‘বলুন।’

‘খুব লম্বা কোনো মেয়েকে ছেলেদের পোশাক পরালে তাকে তখন কিন্তু বেঁটে পুরুষমানুষ বলে মনে হয়।’

দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, তাই হয় বটে।’

.

শ্যামবাজারে ভোলানাথ চক্রবর্তীর বাড়ি। মাঝখানে উঠোন ঘিরে চারদিকে অসংখ্য ঘর নিয়ে তিনতলা বাড়ি। একতলাটা গোডাউন, উঠোন জুড়ে প্যাকিং বাক্সের সমারোহ। দোতলাটা সম্পূর্ণ আর তিনতলায় আংশিক ভাড়া। বাকি অংশটায় থাকতেন ভোলানাথ। সেখানে পাঁচটা ঘর। একটা বসবার, বাকি চারটে শোবার।

বসবার ঘরটা প্রকাণ্ড, স্যাঁতসেঁতে আর একটু অন্ধকার। একদিকে মাত্র দুটো জানলা এতবড়ো ঘরের পক্ষে যথেষ্ট আলো-হাওয়া ঢোকাতে পারে না। মেঝেয় অতি প্রাচীন একটা কার্পেট, তার ডিজাইন আজ কারুর বোঝা দুঃসাধ্য, কতকাল যে পরিষ্কার হয় না কে জানে! দেওয়ালে কতগুলো অতি প্রাচীন ছবি। তাদের অবস্থাও ওই কার্পেটেরই মতো, কার বা কীসের ছবি বোঝবার উপায় নেই। ঘরের একপাশে একটা অতি প্রাচীন অতিকায় সোফাসেট আর মার্বলটপ সেন্টার টেবিল, অন্যপাশে একটা আইভরি ইনলেড টেবিল ঘিরে পাঁচটা উঁচু ব্যাকরেস্টওলা কারুকার্য করা চেয়ার।

অতিথি তিনজন এই চেয়ারেই বসেছিল, সাহস করে সোফায় আর বসে উঠতে পারেনি। বাকি দুটো চেয়ার দখল করে বসেছিল ভোলানাথের মামাতো ভাই সোমনাথ আর ভাগনে শ্যামল। এদের দুজনেরই পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা। হেমন্ত ঠিকই বলেছিলেন, দুজনেই অত্যন্ত সুদর্শন, তবে শ্যামল উদ্ধত, দুর্বিনীত আর সোমনাথ দৃশ্যত শান্ত, ঠান্ডা মাথার লোক।

শ্যামল বলছিল, ‘কেন আপনারা বারবার আমাদের বিরক্ত করছেন, বলুন তো? বড়োমামা মারা গেছে জন্ডিসে, ডাক্তার দাশগুপ্ত যতই ফালতু ডাক্তার হোক না কেন, কোনোরকম গোলমাল থাকলে ঠিক ধরতে পারত। কিন্তু সেও ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছে চুপচাপ।’

সোমনাথ বলল, ‘তুই চুপ কর শ্যামল। আচ্ছা, ব্যাপারটা কী বলবেন? ছোড়দা মারা গেছে অনেকদিন হল। তারপর থেকে অনেক বার আপনারা এসেছেন, আমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন কিন্তু খোলসা করে একবারও বলছেন না যে কেন এসব করছেন। কখনো বলছেন, ছোড়দার মৃত্যু নাকি স্বাভাবিক নয়, মানে কেউ তাকে খুন করেছে। হাস্যকর কথা। ডাক্তার বলেছে স্বাভাবিক মৃত্যু, মৃতদেহ দাহ করা হয়ে গেছে, এখন এসব কথা বলার কোনো মানে হয়? আবার কখনো বলছেন, ডাক্তার মিসেস বোসের মার্ডারের সঙ্গে ছোড়দার মৃত্যুর সম্পর্ক আছে! সেটা আরও হাস্যকর কথা, কারণ ছোড়দা মারা গেছে ওই মার্ডারের বহু আগে। তাহলে সেই মার্ডারের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকে কীভাবে?’

শিবেন বলল, ‘দেখুন, আপনার আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হওয়া অন্যায় নয়। আসলে কি জানেন, অনেকগুলো রহস্য জট পাকিয়ে রয়েছে। আপনাদের একটু সাহায্য পেলে সেই জট ছাড়াতে আমাদের একটু সুবিধে হয়।’

‘আর কীভাবে আপনাদের সাহায্য করব বলতে পারেন? আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর তো আমরা দিয়ে দিয়েছি! আরও কিছু বাকি আছে?’

‘সামান্য কিছু বাকি আছে।’ বলল দময়ন্তী, ‘আপনাদের কয়েকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলে কোনো আপত্তি থাকবে কি?’

‘নিশ্চয়ই থাকবে। নীলকান্তপুর না ধাপধাড়া গোবিন্দপুর কোথায় এক মহিলা ডাক্তার খুন হলেন, আর তাঁর মেন্টাল হোমের এক মৃত রুগির আত্মীয় হয়ে আমাকে পার্সোনাল প্রশ্নের জবাব দিতে হবে— এটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’

দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ, তা যে হচ্ছে না, তা নয়। ঠিক আছে। আমাদের ফিরে যাওয়াটাই বোধ হয় এখন বাঞ্ছনীয়। কেবল, যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করতে চাই। ইচ্ছে হলে উত্তর দেবেন, না হলে দেবেন না।’

সোমনাথ গম্ভীর মুখে বলল, ‘প্রশ্ন আপনি নিশ্চয়ই করবেন এবং উত্তরও আমাকে দিতেই হবে। উত্তর দিতে রিফিউজ করলে হয়তো আমাকেই খুনি বলে সন্দেহ করতে শুরু করবেন।’

দময়ন্তী হাসতে হাসতেই মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, না, ব্যাপারটা অতদূর গড়াবে না। যাই হোক, আমার প্রশ্নটা হল, একতলায় একটা গোডাউন থাকতেও আপনি তারাতলায় একটা গোডাউন ভাড়া নিয়েছেন কেন?’

উত্তর দিল শ্যামল। বলল, ‘এ বাড়ির গোডাউনগুলো বড়োমামার ছিল। ছোটোমামা যখন ব্যবসা শুরু করে, বড়োমামা তখন ওকে ওটা ব্যবহার করতে অ্যালাউ-ই করল না। তাই তো…

.

গাড়িতে উঠে শিবেন বলল, ‘এখানকার কাজ তো বেশ তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। যাবেন নাকি বিদ্যেসাগর রোডে এখনই? বেশি দূরে তো নয়। যেতে বড়োজোর দশ মিনিট লাগবে।’

দময়ন্তী সম্মতি জানাল।

বিদ্যাসাগর রোড বেলগাছিয়ায়। বেশ চওড়া রাস্তা, দু-পাশের বাড়িগুলো অনেক জমি নিয়ে তৈরি। একমাত্র ঢোকার মুখে একটা প্রকাণ্ড ফ্ল্যাটবাড়ি ছাড়া বাকি সবগুলোই বেশ সুদৃশ্য।

রানি নির্ঝরিণীর বাড়িটা দোতলা, সামনে বাগান, পেছনের অনেকটা জমি আছে। গেটের থামে শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা আছে, ‘এস্টেট অফ মহারাজা অফ হিরাগঞ্জ।’

‘হিরাগঞ্জটা আবার কোথায়?’ সমরেশ জিজ্ঞাসা করল।

শিবেন গাড়ির দরজা লক করতে করতে বলল, ‘ইস্ট পাকিস্তানে কোথাও ছিল। খুব সম্ভব রাজশাহীতে।’

নুড়ি পাথর ছড়ানো রাস্তা দিয়ে কড়মড় আওয়াজ করতে করতে তিনজনে ভেতরে ঢুকল। শব্দ শুনে একতলার বারান্দায় যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনি অভ্যাগতদের দেখে খুব একটা পুলকিত হয়েছেন বলে মনে হল না। ভদ্রলোক হাড়-জিরজিরে রোগা, গালভাঙা, চোখ গর্তে বসা, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, অনেকটা ছাগলের মতো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে একটা আধময়লা গেঞ্জি আর গোলাপি রঙের স্লিপিং পাজামা। দময়ন্তীর সর্বাঙ্গে একটা অশ্লীল দৃষ্টি বুলিয়ে মুখ বেঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কে আপনারা? কী চান?’

শিবেন সকলের পরিচয় দিল। তাতে ভদ্রলোকের মুখের বিরক্তি আরও ঘনীভূত হল। বললেন, ‘মেয়েছেলে গোয়েন্দা? সঙ্গে পুলিশ। তা, আমার সঙ্গে কি? এই সাতসকালে?’

শিবেন বলল, ‘আমরা আপনার মামিশাশুড়ির মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু খোঁজখবর নিতে এসেছি পঙ্কজবাবু।’

‘আবার কীসের খোঁজখবর। হয়ে গেছে তো একপ্রস্থ। যত্ত ঝামেলা! মশাই, আমার মামিশাশুড়ি অনেকদিন হল স্বর্গে গেছেন। নিজেও বেঁচেছেন, আমাদেরও বাঁচিয়েছেন। আবার তাঁকে নিয়ে টানাটানির কি দরকার?’

‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ জনান্তিকে বলল সমরেশ।

কথাটা কিন্তু কানে গেল ভদ্রলোকের। বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। বাঃ, দাদা। আপনার তো দেখছি দিব্যি কবিতা টবিতা আসে, অ্যাঁ! পুলিশের হৃদয়ে কাব্যি? ভাবাই যায় না।’ বলে একগাদা হলদে এবড়োখেবড়ো দাঁত বের করে হাসলেন।

সমরেশ বলল, ‘আমি মশায় পুলিশ টুলিশ নই। আমি হচ্ছি এই মহিলার দরোয়ান।’

‘দারোয়ান? বলেন কি? ভাগ্যবান লোক মশাই আপনি, খাসা চাকরিটা জোগাড় করেছেন। যদি কখনো ছাড়ার কথা ভাবেন তো আমাকে খবর দেবেন, আমি হচ্ছি একজন ক্যান্ডিডেট।’ বলে পুনরায় হলদে দন্তবিকাশ করলেন।

দময়ন্তী এই বাক্যালাপে বাধা দিল। বলল, ‘আমরা কি ভেতরে গিয়ে কথাবার্তা চালাতে পারি?’

বিনয়ে অবনত হয়ে পঙ্কজ বললেন, ‘বিলক্ষণ! ভেতরে আসবেন বই কী। মহিলাদের পঙ্কজ রায়চৌধুরি কক্ষনো বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে না। তার ওপর সঙ্গে পুলিশ। ধুলো পায়ে বিদেয় করলে যে কী আতান্তরে পড়ব তা কি আর আমি জানি না ভেবেছেন?’

শিবেন আরক্ত মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিল দময়ন্তী। নিঃশব্দে তিনজন পঙ্কজের পেছনে পেছনে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ড্রইংরুমটা অনেকটা বাংলা সিনেমায় যেরকম দেখা যায়, সেইরকম। একটা চওড়া সিঁড়ি, তার গোড়ায় সোফাসেট পাতা, সিঁড়ির রেলিংয়ের পাশে একটা স্ট্যান্ডার্ড ল্যাম্প, মাথার ওপরে একটা দর্শনীয় ঝাড়লণ্ঠন। সোফাসেটের মাঝখানে সেন্টার টেবিলের ওপর একটা দিশি হুইস্কির বোতল আর একটা গেলাস শোভা পাচ্ছে। গেলাসে তখনও কিছু তরল পদার্থ বিদ্যমান।

পঙ্কজ অতিথিদের সোফায় বসিয়ে পুনশ্চ হলদে দাঁত বের করে বললেন, ‘হেঁ হেঁ, মানে, সক্কালবেলাতেই মদ্যপান করছিলুম, সে কথা যেন ভেবে বসবেন না। আসলে, কাল রাতে একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল কিনা, তাই তার খোঁয়াড়ি ভাঙছিলুম আর কী।’ বলে একটা চেয়ার টেনে একপাশে বসলেন। তারপর অলসভাবে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘বলুন, কীভাবে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি।’

দময়ন্তী বলল, ‘আমরা আপনাকে এবং আপনার স্ত্রীকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। তার উত্তর পেলে উপকৃত হব।’

পঙ্কজ নাটকীয়ভাবে মুখে বিষণ্ণ ভাব এনে বললেন, ‘অবশ্য, অবশ্য। তবে প্রশ্নগুলো কি আমাদের একসঙ্গে করবেন? আমাকে আলাদা আড়ালে করতে হত না?’

দময়ন্তী নির্বিকার মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনাকে আলাদাই প্রশ্ন করা হবে। আমরা আড়ালে কোথায় যেতে পারি, বলুন, সেখানেই যাওয়া যাবে। আমাদের প্রশ্নগুলো আপনার স্ত্রীর না শোনাই বাঞ্ছনীয়।’

এইবার পঙ্কজের মুখে অকৃত্রিম উদবেগের ছায়া পড়ল। বললেন, ‘কেন? আমার মামিশাশুড়ির মৃত্যুর সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক, অ্যাঁ, যে সে সম্বন্ধে কথা আমার স্ত্রী শুনতে পাবে না? এ ব্যাপারে আমাকে ফাঁসানোর ধান্দা? বটে?’

‘ফাঁসানো মানে? কীভাবে ফাঁসানো?’

পঙ্কজ ব্যাকুলভাবে এদিক-ওদিক তাকালেন। ‘না, মানে, ফাঁসানো মানে…’

বাধা এল সিঁড়ির ওপর থেকে। একটা নারীকণ্ঠ হিসহিস করে উঠল, ‘চুপ করো, গাধা কোথাকার! মদ খেলে মাথা ঠিক রাখতে পারো না তো খাও কেন? একদম মুখ না খুলে চুপ করে বসে থাকো।’

সেই কথার ছোবলে পঙ্কজের সমস্ত শরীরটা যেন কুঁকড়ে গেল। নারীকণ্ঠের অধিকারিণীটি এবার তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন। ইনি অবশ্যই মঞ্জুলা রায়চৌধুরি, নির্ঝরিণীর ভাগনি। আঁটসাট শরীর, গৌরবর্ণা, সুন্দরী। নীচে নামার আগে একটু প্রসাধনও করে নিয়েছেন মনে হচ্ছে। কিন্তু চাপা পাতলা ঠোঁটে এবং ছোটো ছোটো চোখে এমন একটা ঠান্ডা কাঠিন্য যে মনে হয় না যে কেউ কখনো সাহস করে এর সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি করবার চেষ্টা করতে পেরেছে।

মঞ্জুলা দময়ন্তীর সামনে দাঁড়িয়ে একটু অবজ্ঞার ভঙ্গিতে নীচু গলায় বললেন, ‘আপনার নাম আমি শুনেছি। আপনি যা জিজ্ঞেস করার আমাকে করতে পারেন। আমি মঞ্জুলা রায়চৌধুরি, হীরাগঞ্জ এস্টেটের আমিই উত্তরাধিকারিণী।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনার মামিমার মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয়, তাঁকে যে খুন করা হয়েছে, সেকথা কি আপনার জানা আছে?’

‘পুলিশ সেইরকমই বলেছে বটে। প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আমি জানি না!’

‘আপনার মামিমা পার্ক সার্কাসে এক হোমিওপ্যাথের কাছে যেতেন। কে তাঁকে নাম রেকমেন্ড করেছিল?’

‘আমি জানি না।’

‘সেটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। রানি নির্ঝরিণীকে আপনারা দেখাশুনো করতেন, নিশ্চয়ই একজন না একজন সবসময়েই তাঁর কাছে থাকতেন। অথচ কে তাঁকে একজন কলকাতায় সদ্য-আসা ডাক্তারের নাম জানাল, সেটা আপনারা জানেন না?’

‘মামিমার কাছে সবসময়েই আমি বা আমার স্বামী বসে থাকতুম, আপনার এ ধারণা ভুল। মামিমার একজন নাইট নার্স আর একজন আয়া ছিল। আমাদের পক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর কাছে বসে থাকা সম্ভব ছিল না।’

‘তা তো বটেই। আচ্ছা, এই নার্স বা আয়া আপনি কোত্থেকে পেয়েছিলেন? প্রজ্ঞা মনবিশ্লেষণ দিয়েছিল কি?’

‘না। আয়াটিকে পেয়েছিলুম আমাদের পাড়ার এক নার্সিং হোম থেকে।’

‘কী নাম সেই নার্সিং হোমের? ঠিকানা জানেন?’

‘জানি। এই রাস্তার মুখে একটা বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি আছে, নাম বাসবদত্তা। তার দোতলায় একটা নার্সিং হোম আছে, নাম ড. তালুকদার’স ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোম।’

‘বেশ। আর নার্স? তাকে কোথায় পেয়েছিলেন?’

একটু চিন্তা করলেন মঞ্জুলা। তারপর বললেন, ‘আমার ঠিক মনে নেই। অনেকদিন আগেকার কথা। আমাদের কোনো বন্ধু বোধ হয় দিয়েছিলেন।’

‘আপনাদের কি অনেক বন্ধু?’

‘আছেন কয়েক জন।’

‘তাঁদের মধ্যে কে হতে পারেন? মনে করতে পারছেন না?’

‘না।’

‘আপনি কি শম্ভুচন্দ্র ধাড়া বা ভোলানাথ চক্রবর্তীকে চিনতেন?’

‘না।’

‘আপনাদের বাড়িতে যে আয়া কাজ করতেন, তার নাম কী?’

‘যদ্দূর মনে পড়ে লীলা হালদার।’

‘আপনাদের ড্রাইভার যে আপনার মামিমাকে পার্ক সার্কাসে নিয়ে যেত, তার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’

‘না, তাকে আমরা বিদেয় করে দিয়েছি।’

‘তার ঠিকানা জানেন?’

‘না।’

‘আপনার মামিমা যে উইল করে গেছেন, আদালতে তার বিরুদ্ধে কোনোরকম মামলা করবেন না?’

‘না, করে কোনো লাভ নেই। উনি আটঘাট বেঁধেই উইল করেছেন। পায়ে পা দিয়ে উইল করার আগের দিন প্রচণ্ড ঝগড়া করেছেন। উকিল আর ডাক্তার দিয়ে সাক্ষীর সই করিয়েছেন। যা গেছে, তা তো গেছেই। মামলা করতে গেলে যা আছে, সেটুকুও যাবে।’

‘আপনার কি মনে হয় যে এই উইল করার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করছে?’

‘না। আমার তা মনে হয় না। উনি যা করেছেন তা সচেতনভাবেই করেছেন। অন্য কেউ ষড়যন্ত্র করে করিয়েছে, তা হতে পারে না।’

‘আপনি কি আপনার মামিমাকে খুব শ্রদ্ধা বা ভক্তি করতেন?’

প্রশ্নটা শুনে পঙ্কজ গলার মধ্যে হেঁচকির মতো একটা শব্দ করলেন, মঞ্জুলা কোনো কথাই বললেন না।

.

অতঃপর ড.: তালুকদার’স ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমে শ্রীমতী লীলাবতী হালদার। মোটাসোটা কালোকোলো মহিলা, বয়েস তিরিশ থেকে পঞ্চাশ যা-খুশি হতে পারে। তার অনর্গল বাক্যস্রোতের ভেতর থেকে যে কটি তথ্য বের করা গেল, তা হচ্ছে— এক, পঙ্কজ রায়চৌধুরি একটি অত্যন্ত পাজি বদমাশ লোক। দুই, তাঁর স্ত্রী মঞ্জুলা একটি অত্যন্ত পাজি বদমাশ মহিলা, তিন, ওঁদের ড্রাইভার হরিপদ একটি অত্যন্ত পাজি বদমাশ লোক এবং চার, রানি নির্ঝরিণী একটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, চিন্তার বাইরে পাজি বদমাশ মহিলা। এইসব ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বাইরে আর কিছুই লীলাবতীর কাছ থেকে জানা গেল না। এমনকী নাইট নার্স সম্পর্কেও নয়।

বাসবদত্তা থেকে বেরিয়ে শিবেন গাড়ির চাবিটা সমরেশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুই চালা। বউদি, আপনি সামনে বসুন। আমি পেছনের সিটে বসে একটু চিন্তা করি।’

‘তুই চিন্তা করবি?’ বলে সমরেশ হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল।

শিবেন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘চুপ কর, পাজি বদমাশ কোথাকার!’

দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘কী চিন্তা করছেন, বলুন।’

‘দেখুন, দুটো কথা আমার কাছে আজকের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট হল। প্রথমত, যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের কেউই তাঁদের আত্মীয়দের কাছে খুব একটা শ্রদ্ধা বা ভক্তিভাজন ছিলেন না। শম্ভুচন্দ্র ছাড়া বাকি দুজন বাইরের লোকের কুপরামর্শ ছাড়াই আলাদা আলাদাভাবে তাঁদের আত্মীয়দের হাতে নিহত হতে পারতেন। যদিও, নিঃসন্দেহে এঁদের তিনজনের মৃত্যুর মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে এবং সেই যোগসূত্র নীলকান্তপুরে সৃষ্ট হয়ে ডাক্তার রজার ওয়ালটনের ভেতর দিয়ে এসেছে। অথচ, ডাক্তার ওয়ালটনের সঙ্গে নীলকান্তপুরের কী সম্পর্ক সেটা এখনও সঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, এই তিনজনকেই ডাক্তার ওয়ালটনের নাম রেকমেন্ড করার সুযোগ যে কেউ ইচ্ছে করলেই পেতে পারত। শম্ভুচন্দ্র মর্নিংওয়াক করতেন, নির্ঝরিণীর নাইট নার্স ছিল, ভোলানাথের বাড়িভরতি ভাড়াটে, একতলায় গোডাউন, লোকজনের আসা-যাওয়ার অন্ত নেই। কিন্তু সেই সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করল কে? ডাক্তার অরিজিৎ বোস? বীথিকা? দুজনে একসঙ্গে? না, অন্য কেউ? এই তিনজনের মধ্যে আমি কমন ফ্যাক্টর এঁদেরই দেখতে পাচ্ছি— অরিজিৎ, বীথিকা আর রহস্যময় রজার ওয়ালটন।’

‘নীলকান্তপুরকে দেখতে পাচ্ছেন না?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’ বলতে বলতে শিবেন চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘শম্ভুচন্দ্রের মর্নিংওয়াকের কথা ভাবছেন, তাই না?’

দময়ন্তী নীচু গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। আর রহিম ওসমান লেনের ভিড়ের কথাও ভাবছি।’

এরপর সারা রাস্তা আর কেউ কোনো কথা বলল না।

.

‘আজ বিকেলে কী করছেন?’ জিজ্ঞেস করল শিবেন।

গাড়ি থেকে নামতে নামতে দময়ন্তী বলল, ‘আপনি কী করছেন? যদি অসুবিধে না হয় তো যাবেন নাকি একবার নীলকান্তপুরে? ট্রেনে যাব, গাড়ি চালানোর কোনো দরকার নেই।’

শিবেন হাসল। বলল, ‘ট্রেনে যাওয়ার দরকার নেই, গাড়িতেই যাব। গাড়ি চালাতে আমার কোনো কষ্ট হয় না, ভালোই লাগে। আর, রমলাকেও নিয়ে আসব।’

দময়ন্তী আর সমরেশ একসঙ্গে বলে উঠল, ‘নিশ্চয়ই। সে তো খুব ভালো কথা।’

.

বিকেল বেলা শিবেন আর রমলা এসে দেখল দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বসে আছে। সমরেশ বলল, ‘বিকাশবাবু এসেছিলেন। তোরা আসার একটু আগে গেলেন।’

শিবেন বলল, ‘বিকাশবাবু আবার কে?’

‘মনে নেই তোর? সেই যে ডাক্তার অরিজিৎ বোসের ভগ্নীপতি, আসানসোলে থাকেন।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিকাশ ঘোষ। তা, তিনি কী মনে করে? কি ব্যাপার বউদি? গোপনীয় কিছু নয় তো?’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘আপনার কাছে নয়, তবে আপনার ডিপার্টমেন্টের কাছে গোপনীয়। ভদ্রলোক পুলিশকে কতগুলো কথা বলেননি। সেগুলো আমাকে বলতে এসেছিলেন।’

‘পুলিশকে বলেননি কেন?’

‘পারিবারিক কেচ্ছা। সব কথা কি পুলিশকে বলা যায়?’

‘কথাগুলো কী?’

‘প্রথমত, বীথিকার চরিত্র সত্যিই ভালো ছিল না। প্রথম দিন আপনি আমাদের বলেছিলেন যে বীথিকা নিমফোম্যানিয়াক ছিল, বিকাশবাবুও সেই কথাই বললেন। অন্নদা মিত্তির আশা করেছিলেন যে বিয়ের পর স্বভাব শুধরোবে, কিন্তু তা হয়নি। বিয়ের পরেও নানারকম কুকীর্তি করেছে। অরিজিৎ নাকি দু-একবার বাধা দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে উলটো ফল হয়েছে। বীথিকা লজ্জিত তো হয়ইনি, উলটে ওঁকে অপমান করেছে। প্রজ্ঞা কেন্দ্রের টাকাটা দিয়েছিলেন অন্নদা মিত্র, কাজেই সেই জোরটা তার ছিল।’

‘বিকাশবাবু এসব কথা জানলেন কী করে?’

‘সে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। আজ থেকে মাস আষ্টেক আগে অরিজিৎ বিকাশবাবুকে গোপনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল বিকাশবাবুকে প্রজ্ঞার একটা চাকরি দেওয়া। সেইসময় বিকাশবাবু কয়েক বার নীলকান্তপুরে গিয়েছিলেন। সেখানেই এইসব কথা জানতে পারেন।’

‘কে বলেছিল এসব কথা? ডাক্তার অরিজিৎ বোস?’

‘না। প্রজ্ঞা কেন্দ্রের স্টাফ নার্স। তাঁর আর অন্য কয়েক জনের নাম আমি লিখে নিয়েছি। আজ তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যাবে।’

‘অরিজিৎ নিজের ভগ্নীপতিকে গোপনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কেন? প্রকাশ্যে ডাকতে কোনো বাধা ছিল?’

‘ছিল বোধ হয়। বিকাশবাবু তা জানতে পারেননি।’

‘চাকরিটা হয়নি?’

‘না। বিকাশবাবুর ধারণা, বীথিকা বাধা দিয়েছিল।’

‘যাদের নাম বিকাশবাবু করেছেন, তারা কারা?’

‘ডাক্তার মিসেস স্বপ্না চৌধুরি, প্রজ্ঞা ল্যাবরেটরির সুপারিনটেন্ডেন্ট, মদনমোহন কাঞ্জিলাল, প্রজ্ঞার হেডঅফিসের বড়োবাবু, মিসেস রাধিকা মৌলিক, স্টাফ নার্স আর দরোয়ান ব্রজনন্দন শুক্লা।

‘ও ব্বাবা, এ যে অনেক লোক! সময় লাগবে তো অনেক।’

‘প্রত্যেকের জন্যে দু-মিনিট, তাহলে হবে?’

.

গড়িয়া থেকে যে রাস্তাটা নীলকান্তপুরে গেছে, তার ওপরেই প্রজ্ঞা মনবিশ্লেষণ কেন্দ্র, নীলকান্তপুরের আধমাইলটাক আগেই। কেন্দ্রের চারদিকে প্রায় দশ ফুট উঁচু কাঁটাতার লাগানো ইটের পাঁচিল। রাস্তার ওপরে যে টিনের পাত লাগানো আট ফুট চওড়া গেট আছে, তার ওপর দিয়ে কেবল দুটো বাড়ির ছাদটুকু ছাড়া জায়গাটার আর কিছুই দেখা যায় না। গেটের দু-পাশে থামের মাথায় দুটো মস্ত আলো আর তাদের ওপর ইংরেজিতে আর বাংলায় লাল রঙের অক্ষরে প্রজ্ঞা মনবিশ্লেষণ কেন্দ্রের নাম লেখা।

শিবেনের ফিয়াট গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। সমরেশ বলল, ‘ঢুকতে দেবে তো রে?’

শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেবে। আসার আগে ফোন করে দিয়েছি।’

রমলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, পাগলরা কি ভেতরে এমনি ঘুরে বেড়ায়? মানে, ছাড়া?’

সমরেশ বলল, ‘তাতে তোমার কী? ওঁরা তো আর তোমাকে কিছু বলতে যাচ্ছে না। জানো না, পাগলরা পাগলদের কিছু বলে না?’

ঠিক তক্ষুনি শিবের হর্ন বাজাল বলে রমলা কী বলল তা আর শোনা গেল না। গেটটা অবশ্য তৎক্ষণাৎ খুলে গেল। খাকি ইউনিফর্ম পরা ফর্সা মোটাসোটা একজন দরোয়ান বাইরে বেরিয়ে এসে হাত নেড়ে গাড়ি ভেতরে ঢোকার ইশারা করল।

শিবেন আস্তে আস্তে গাড়ি গেটের ভেতরে ঢোকাল। দেখা গেল, গেটের বাঁ-দিকে সাদা রং করা একটা লম্বাটে দোতলা বাড়ি। একতলার সামনে ঢাকা বারান্দা আর পর পর সবুজ পর্দা ঝোলানো দরজা, কোনোটার মাথার ওপরে লেখা রিসেপশন, কোনোটার ওপরে আউট পেশেন্টস ডিপার্টমেন্ট, কোনোটা অফিস, কোনোটা ডিসপেন্সারি, ইত্যাদি। গেটের ডানদিকে একটা সুন্দর বাগান; নানারঙের মৌসুমি ফুলের বাহার সেখানে, মাঝখানে একটা পাথরের ফোয়ারাও আছে। তার পেছনে হলুদ রঙের একটা লম্বা তিনতলা বাড়ি, তার মাঝখানে বেশ বড়ো একটা গাড়িবারান্দাওলা ঢোকার দরজা, তার দু-পাশে আর ওপরে সার সার গ্রিল লাগানো জানলা। গাড়িবারান্দার ওপর দিয়ে মাধবীলতার ঝাড় তুলে দেওয়া হয়েছে। আর গেটের সামনে একটা খেলার মাঠ, তার চারপাশে নানারকম দোলনা, স্লিপ ইত্যাদি শোভা পাচ্ছে এবং মাঝখানে পাশাপাশি দুটো ব্যাডমিন্টন কোর্ট। এই মাঠের পেছনে আর একটা সাদা দোতলা বাড়ি। এই বাড়িটা অন্য দুটো বাড়ির চেয়ে স্বতন্ত্র। কারণ অন্য দুটো আধুনিক, ওটা প্রাচীন, যদিও অত্যন্ত ভালো অবস্থায় রাখা আছে। খিলেন করা দরজা জানলা, কারুকার্য করা থাম, কাঠের ঝিলমিল বাড়িটাকে একটা গাম্ভীর্য দিয়েছে যা বাকি দুটো বাড়িতে অনুপস্থিত।

শিবেন গাড়িটা বাঁ-দিকের বাড়িটার সামনে দাঁড় করাল। বারান্দায় দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। একজন খুব লম্বা, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, মুখে তদ্রূপ চাপ দাড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে ট্রাউজার্স আর শার্ট। অন্যজন মাঝারি, অত্যন্ত রোগা, টাকমাথা, পরনে খদ্দরের ধুতি আর পাঞ্জাবি। দুজনে তাড়াতাড়ি নেমে এলেন অতিথিদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে।

চাপদাড়ি বললেন, ‘নমস্কার। আমার নাম মদনমোহন কাঞ্জিলাল, আমি এখানকার অফিস-ইন-চার্জ। আর এঁর নাম রজতকান্তি শীল, এখানকার গার্ডেন সুপারভাইজার।’

শিবেন প্রতি নমস্কার করে সকলের পরিচয় দিল।

মদনমোহন দময়ন্তীকে বললেন, ‘আপনার কথা আমি শুনেছি। কিন্তু, আপনাকে এমপ্লয় করল কে? বড়ো ডাক্তারবাবু কি? আমি কিন্তু কোনোরকম ইন্সট্রাকশন পাইনি।’

জবাবটা দিল শিবেন। বলল, ‘দেখুন, ওঁকে কেউই এমপ্লয় করেনি। আমাদের বিশেষ অনুরোধে উনি এই কেসটা দেখতে রাজি হয়েছেন। বলতে পারেন যে উনি আমাদের কনসালট্যান্ট।’

মদনমোহন চিন্তিত মুখে বললেন, ‘তাহলে ওঁর ফি পেমেন্ট করবে কে? গভর্নমেন্ট না প্রজ্ঞা মনবিশ্লেষণ?’

শিবেন মৃদু হেসে বলল, ‘সে ব্যাপারে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই। ফি যে-ই দিক, প্রজ্ঞাকে দিতে হবে না।’

মদনমোহনের মুখের মেঘ কিছুটা কেটে গেল। বললেন, ‘তাহলে তো ভালোই। কি জানেন, আমি তো স্পেসিফিক অর্ডার ছাড়া কোনো টাকাপয়সা ডিসবার্স করতে পারি না। বুঝতেই পারছেন, চাকরি করতে হয়। তা যাকগে সেকথা। এখন বলুন ম্যাডাম, আমরা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি।’

দময়ন্তী বলল, ‘আমি জায়গাটা একটু ঘুরে দেখতে চাই, বিশেষ করে ডক্টর ঘোষের বাড়িটা। আর, কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। এই এঁরা।’ বলে কয়েকটা নাম লেখা একটা কাগজ মদনমোহনের হাতে দিল।

কাগজটায় চোখ বুলিয়ে মদনমোহন বললেন, ‘আজ তো ছুটির দিন। ডক্টর স্বপ্না চৌধুরি আর মিসেস মৌলিক তাঁদের কোয়ার্টার্সে আছেন কিনা কে জানে! যান তো রজতবাবু, একবার দেখে আসুন এঁরা আছেন কিনা। থাকলে একবার এখানে আসতে বলুন। আর, ওহে বৃজনন্দন, একবার এদিকে এসো তো। ইনি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলবেন।’

দময়ন্তী রজতকে বলল, ‘আপনি যাঁদের ডাকতে যাচ্ছেন, তাঁদের বলবেন যে আমি দু-মিনিটের বেশি কারুর কাছ থেকে নেব না।’ তারপর মদনমোহনকে বলল, ‘বৃজনন্দন আসতে আসতে আপনাকে দু-চারটে প্রশ্ন করে নিই, কেমন?’

মদনমোহন তার চাপদাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বেশ, করুন।’

.

মদনমোহনের কাছে জানা গেল যে প্রজ্ঞার প্রায় সৃষ্টি থেকেই তিনি এখানে আছেন। এর আগে ছিলেন অন্নদা মিত্রের শ্যামপুকুরের ছাপাখানায়। সেখানেই ছোটো থেকে বড়ো হয়েছেন। লেখাপড়ায় ম্যাট্রিক পাশ, কিন্তু অন্নদাবাবু ওঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। প্রজ্ঞায় আডমিনিস্ট্রেশন আর অ্যাকাউন্টস দেখার ভার অন্নদাবাবুর রেকমেন্ডেশনেই বড়ো ডাক্তারবাবু ওঁকে দিয়েছিলেন। বীথিকাকে উনি জন্মাতে দেখেছেন। ভালো মেয়ে ছিল, তবে খামখেয়ালি— বড়োলোকের মেয়েরা যেমন হয় আর কী! আর খুব বদরাগী। তবে আনন্দ ফুর্তি করতে ভালোবাসত। বড়ো ডাক্তারবাবু অবশ্য সেটা পছন্দ করতেন না, তাই বলে দুজনরে মধ্যে কক্ষনো ঝগড়াঝাঁটি হত না। বড়ো ডাক্তারবাবু আবার একটু গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন কিনা। হ্যাঁ, বীথিকার কিছু কিছু ছেলে বন্ধু ছিল, তারা কিন্তু মোটেই সুবিধের লোক ছিল না। না, মদনমোহন তাদের নাম-ধাম জানেন না, জানার চেষ্টাও করেননি। তবে বীথিকাকে এ ব্যাপারে সাবধান করার কথা তিনি কখনো ভাবেননি। তিনি সামান্য কর্মচারী, এসব তাঁর এক্তিয়ারের বাইরে। আর, বিকাশ ঘোষ বলে কাউকে তিনি চেনেন না।

.

মিসেস রাধিকা মৌলিক লম্বা-চওড়া মাঝবয়সি মহিলা। তাঁর কথাবার্তা অত্যন্ত প্রাঞ্জল। তিনি বললেন যে বীথিকা একটি নষ্ট মেয়েমানুষ ছিল। বড়ো ডাক্তারবাবুর মতো দেবতুল্য লোককে দিনের পর দিন কী অপমানটাই না করেছে। সে অপমান অন্য কেউ হলে সহ্য করত না। না, না, তার মানে এই নয় যে বড়ো ডাক্তারবাবু খুনি। অমন কাজ উনি কখনোই করতে পারেন না। কখনোই নয়। এই সম্পত্তির মালিক ছিল বীথিকা, তাই অত দাপট আর দেমাক দেখাতে পারত। হ্যাঁ, ছেলে-বন্ধু ছিল বই কী! না থাকলে নষ্টামি করবে কী করে! যত সব হাড়হাভাতে শয়তান! একটা যেত আর একটা আসত। কে জানে তাদের নামধাম কী? তাদের দিকে তাকাতে প্রবৃত্তি হত না। না, বিকাশ ঘোষ বলে কাউকে তিনি চেনেন না। ভোলানাথ চক্রবর্তীকে মনে নেই। রানি নির্ঝরিণীকে মনে আছে। রুগিদের সম্পর্কে ভালো-খারাপ কিছু বলতে নেই। শম্ভুচন্দ্র ধাড়াকেও মনে পড়ে না। কতরকম রুগি যে উনি দেখেছেন ওঁর তিন বছরের চাকরিতে।

.

ব্রজনন্দন শুক্লার বাড়ি উত্তরপ্রদেশে। গত পাঁচবছর সে এখানে আছে। মালকিন ভালো লোক ছিলেন। যেদিনই অনেক রাত করে ফিরতেন, সেদিন অনেক টাকা দিতেন গেট খুলে দেবার জন্যে। গাড়ি নিজেই চালাতেন। কখনো কখনো খুব সকালেও বেরিয়ে যেতেন। কত সকালে? ছটা-সাতটা হবে। সঙ্গে লোক থাকত কখনো, কখনো একা। কে লোক তা অবশ্য সে দেখেনি। না, তাদের চেনবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ব্রজনন্দনের সাধারণত রাত্রিবেলা আর ছুটির দিন ডিউটি পড়ে। দিনের ডিউটি দেয় অন্য লোক।

.

ডক্টর স্বপ্না চৌধুরিকে বেশ কালোই বলা যায়, কিন্তু হাবভাবে আর কথাবার্তায় একেবারে পাক্কা মেমসাহেব। বয়েস ত্রিশের ওপারেই হবে, কিন্তু সেটা কম দেখানোর একটা আগ্রহ এবং চেষ্টা লক্ষ্য না করে পারা যায় না। ডক্টর চৌধুরি বললেন যে বীথি ওয়াজ এ ভেরি নাইস গার্ল। হ্যাপি গো লাকি। জীবনটা উপভোগ করতে ভালোবাসত। সেজন্যে অনেকে ওর সম্পর্কে খারাপ কথা বলত। বাট শি কুডন্ট কেয়ার লেস। অ্যান্ড হোয়াই শুড শি? হার হাজব্যান্ড ওয়াজ এ গ্রাম্পি রামগড়ুরের ছানা। এ গুড ম্যান, ইয়েস। কিন্তু বেশি ভালো আবার ভালো নয়। দুজনের ছিল দু-রকমের চরিত্র। তাই বলে একটা চরিত্র ভালো আর অন্যটা খারাপ, এরকমের কথা যারা বলে তারা ঠিক করে না। ড. চৌধুরি কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে বিলেতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বেশ কয়েকটা ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। এখানকার রিসার্চ ডিপার্টমেন্টটা উনি চালান। এই ডিপার্টমেন্টটাই ছিল বীথিকার আন্ডারে। বীথিকা পাগলের ডাক্তার ছিল না, ছিল প্যাথলজিস্ট। তা ছাড়া রিসার্চে ওর একটা ফ্লেয়ার ছিল। সেই কারণে, একটা ওয়েল ইকুইপড ল্যাবরেটরি এখানে গড়ে তুলেছিল। নানারকম ড্রাগস নিয়ে এখানে কাজকর্ম হয়। কয়েক জন রিসার্চ স্কলার আছেন। প্রত্যেকেই কোয়ালিফায়েড ডাক্তার। তাঁরা এখানে থাকেন না, কলকাতা থেকে যাতায়াত করেন। হ্যাঁ, নানারকম বিষ নিয়েও কাজকর্ম হয়। না, পটাসিয়াম সায়ানাইড নিয়ে কখনো কাজ হয়নি। না, রুগিদের ওপর কখনো এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয় না। আর সবশেষে ড. চৌধুরি জানালেন যে ড. অরিজৎ বোস ওয়াজ পারফেক্টলি কেপেবল অফ কিলিং হিজ ওয়াইফ অর এনিবডি এলস ফর দ্যাট ম্যাটার। ওঁর মধ্যে একটা স্ট্রীক অফ সেডিজিম ছিল। অবশ্য, তার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ তিনি পাননি, তবে এটা তাঁর বদ্ধমূল ধারণা। হ্যাঁ, বিকাশ ঘোষ বলে একজনের সঙ্গে এখানে পরিচিত হয়েছিলেন। সুবিধের লোক নয়। বীথিকা তাকে দেখে বেশ আপসেট হয়ে পড়েছিল। শি কাইন্ড অফ থ্রু হিম আউট অফ দিস প্লেস।

.

ড. চৌধুরির সঙ্গে বাক্যালাপ শেষ হবার পর দময়ন্তী বীথিকার শোবার ঘরটা দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করল। মদনমোহন পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করে বললেন, ‘আমার কি সঙ্গে যাবার দরকার আছে?’

দময়ন্তী বলল, ‘নিশ্চয়ই। আপনি না গেলে কী করে হবে?’

মদনমোহন ম্লান হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘এই কাজটা করতে আমার একদম ভালো লাগে না, জানেন? ওই ঘরটায় যতবার যাই, সেই ভয়ঙ্কর দিনটার কথা মনে পড়ে। ভালো লাগে না।’ বলে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা পেরিয়ে রাস্তায় নামলেন। সামনে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ‘ওই যে, খেলার মাঠের ওপারে বাড়িটা দেখছেন, ওটাই বীথিকার বাড়ি ছিল।’

রমলা জিজ্ঞেস করল, ‘সমস্ত বাড়িটা নিয়েই থাকতেন? এটা তো মস্ত বাড়ি!’

‘না। সমস্ত বাড়িটা নিয়ে থাকতেন না। একতলায় আছে স্পেশাল ওয়ার্ড। ডাক্তার বোসেরা থাকতেন দোতলায়।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘স্পেশাল ওয়ার্ড মানে?’

‘সাধারণ ওয়ার্ডের থেকে আলাদা এই আর কী! থাকার বন্দোবস্ত, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি একটু ভালো। পারসোনালাইজড সার্ভিস।’

‘এখানে থাকতে গেলে কি বেশি পয়সা দিতে হয়?’

‘হয়, তবে সবক্ষেত্রে নয়। এ ব্যাপারটা ডাক্তার বোসের মর্জির ওপর নির্ভর করে।’

‘এই ওয়ার্ডটা কি প্রজ্ঞার গোড়া থেকেই ছিল?’

‘না। আগে ওখানে লাইব্রেরি ছিল। পরে লাইব্রেরিটা উঠে আসে আমার অফিসের দোতলায়।’

‘এই ওয়ার্ডটা তৈরি করার কোনো বিশেষ কারণ ছিল কি?’

‘ছিল। অনেক রুগি জেনারেল ওয়ার্ডে থাকতে চাইতেন না। অনেকের স্পেশাল ট্রিটমেন্টের দরকার হত। কোনো কোনো রুগি আইসোলেশন পছন্দ করতেন। এইসব কারণে।’

‘কতদিন চালু হয়েছে এই ওয়ার্ডটা?’

‘বছর তিনেক হবে।’

কথা বলতে বলতে খেলার মাঠ পার হয়ে সকলে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। মদনমোহন বললেন, ‘প্রজ্ঞা এই বাড়িতেই প্রথম খোলা হয়েছিল। পুরোনো বাড়ি, সারিয়ে টারিয়ে অনেক ধুমধাম করে উদ্বোধন করা হয়েছিল। অন্নদাবাবু আর তাঁর দুই ছেলে এসেছিলেন, কলকাতা থেকে নামকরা গাইয়েরা এসেছিলেন। কত আনন্দ উদ্দীপনার মধ্যে সব শুরু হয়েছিল। তখন কে জানত যে আজ তার এই অবস্থা হবে। বড়ো ডাক্তারবাবুর অনেক প্ল্যান ছিল, উনি আস্তে আস্তে সেগুলো চালু করছিলেন। সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি বসিয়েছেন, রুগিদের বিজ্ঞানসম্মত রিক্রিয়েশনের ব্যবস্থা করেছেন, জেনারেল ওয়ার্ডে আজ চল্লিশ জন রুগির চিকিৎসা হচ্ছে। সব হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে!’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রকাণ্ড দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।

ঢুকেই একটা হলঘর। লাল কার্পেটে মোড়া, একপাশে একটা আধুনিক সোফাসেট, অন্যপাশে একটা লম্বাটে টেবিল, রিসেপশনিস্টের জন্য। দেওয়ালে দুটো বড়ো অয়েল পেন্টিং, একটা যীশুর জন্মের, অন্যটা লুম্বিনিতে বুদ্ধের জন্মের। বেশ একটা শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। ঘরটার তিনদিকে তিনটে দরজা। দুটোর ওপর লেখা ‘স্পেশাল ওয়ার্ড’, অন্যটার ওপর লেখা ‘প্রাইভেট’।

মদনমোহন চাবি দিয়ে প্রাইভেট দরজাটি খুললেন। ভেতরে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। দোতলায় দু-দিকে দুটো ফ্ল্যাট। একটার দরজায় অরিজিৎ আর বীথিকার নেমপ্লেট, অন্যটায় কিছু নেই।

মদনমোহন অরিজিতের ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে বললেন, ‘বড়ো ডাক্তারবাবু এইদিকে থাকতেন। ওই ফ্ল্যাটটা গেস্টদের জন্যে।’

দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘গেস্ট কীরকম? এখানে কী ধরনের গেস্ট থাকতেন?’

‘অনেকেই থাকতেন। বড়ো ডাক্তারবাবু বা বীথিকার বন্ধুবান্ধবেরা মাঝে মধ্যে এসে থাকতেন। কখনো কখনো বিদেশি স্পেশালিস্টরাও আসতেন। কখনো কখনো রুগিদের কোনো আত্মীয়ও থেকে যেতেন এমার্জেন্সির সময়।’

‘আচ্ছা, নীচে স্পেশাল ওয়ার্ডে এখন কজন রুগি আছেন?’

‘এখন একজনও নেই। তবে জেনারেল ওয়ার্ডের একজন আসতে চাইছেন। বড়ো ডাক্তারবাবু নেই, কাজেই কেউ ডিসিশন নিতে পারছেন না।’ বলে মদনমোহন একটা দরজা খুলে ধরে বললেন, ‘আসুন। এটা বীথিকার শোবার ঘর ছিল।’

ঘরটা বেশ বড়ো। একপাশে একটা জোড়াখাট, তার ওপর ঝালর দেওয়া চকমকে বেডকভার পাতা। অন্যপাশে প্রকাণ্ড বড়ো ড্রেসিং টেবিল আর তার অতিকায় আয়না। ড্রেসিং টেবিলের ওপর অসংখ্য প্রসাধনের জিনিসপত্র সাজানো। একদিকে দুটো ওয়ার্ডরোব, বেশ বড়ো। সেগুলোর পাশে বাথরুমে যাওয়ার দরজা। খাটের পাশে দুটো চেয়ার আর একটা ছোটো টেবিল।

দময়ন্তী ঘুরে ঘুরে সব দেখল। বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল। ওয়ার্ডরোব দুটো খুলে দেখল। তারপর মদনমোহনকে প্রশ্ন করল, ‘দুটো ওয়ার্ডরোবই তো দেখছি বীথিকার! অরিজিৎবাবুর জামাকাপড় কোথায় থাকত?’

মদনমোহন কিঞ্চিৎ বিপন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘ইয়ে, মানে, ওঁর ওয়ার্ডরোবটা আছে ওই কোণের ঘরটায়।’

‘সেটা একবার দেখে আসি?’

‘চলুন।’ বলে মদনমোহন সবাইকে নিয়ে দীর্ঘ করিডরের অন্য প্রান্তে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন।

এই ঘরটা আগেরটার তুলনায় অনেক ছোটো। একটা সিঙ্গল খাট, একটা আলমারি, একটা টেবিল আর গোটাদুয়েক চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাবপত্র নেই। দময়ন্তী এই আলমারিটাও খুলে দেখল। তারপর মদনমোহনকে বলল, ‘চলুন, আমার দেখা হয়ে গেছে।’

.

গাড়িতে উঠে দময়ন্তী শিবেনকে জিজ্ঞেস করল, ‘ড্রেসিং টেবিলে বীথিকার সবরকমের প্রসাধনের জিনিস দেখলুম, দেখলুম না কেবল লিপস্টিক। সেগুলো কি আপনারা নিয়ে গেছেন?’

শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ। ফরেনসিকে দেওয়া হয়েছিল।’

‘কটা লিপস্টিক ছিল?’

‘একগাদা। ত্রিশ-চল্লিশটা তো হবেই।’

‘হুঁ, তাই হবে। বীথিকার সবকিছুই দেখছি অতিরিক্ত বেশি। অসংখ্য শাড়ি, অসংখ্য জুতো, অজস্র ব্যাগ। অদ্ভুত!’ বলে কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, শিবেনবাবু, প্রথমে বোধ হয় রানি নির্ঝরিণী মারা যান, তাই না? তারপর ভোলানাথ, সবশেষে শম্ভুচন্দ্র?’

‘হ্যাঁ, তাই বটে। এই মারা যাওয়ার পারম্পর্যটা কি খুব দরকারি?’

‘হ্যাঁ। খুব দরকারি।’

‘আপনি কী করে বুঝলেন?’

‘এই, সকলের কথাবার্তায়। আচ্ছা, একটা ব্যাপার লক্ষ করলেন যে বিকাশ ঘোষকে মদনমোহন চিনতে পারলেন না, কিন্তু ডক্টর স্বপ্না চৌধুরি পারলেন?’

‘হ্যাঁ। স্বপ্না চৌধুরি দেখলুম তাঁর মালকিনের অত্যন্ত গুণমুগ্ধ।’

‘এবং খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হয়তো একই কলেজ থেকে পাশ করেছেন, সামান্য দু-এক বছরের ফারাক থাকলেও থাকতে পারে। আগামী রবিবার আমরা আবার এঁর বাড়িতে যাব। ইতিমধ্যে এঁর সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর নিলে ভালো হয়।’

‘ব্যাপারটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে এসেছে মনে হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ, প্রায়। তবে প্রমাণ চাই, শিবেনবাবু। নিশ্ছিদ্র প্রমাণ না হলে এই নিরেট শয়তানির দেওয়ালটা ভাঙা যাবে না।’

.

পরের মঙ্গলবার সন্ধ্যেবেলা শিবেন এল। বলল, ‘ডাক্তার স্বপ্না চৌধুরি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি। খুব ইন্টারেস্টিং কিছু নয়, তবে নেহাত ফেলনাও নয়।’

দময়ন্তী আর সমরেশ একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘কীরকম?’

‘ডাক্তার চৌধুরি আর বীথিকা এক ক্লাসে পড়তেন। বীথিকা একবছর ফেল করেছিল। ডাক্তার চৌধুরি বিয়ের আগে ছিলেন সান্যাল, ডাক্তার হিরন্ময় সান্যালের মেয়ে। বুঝতেই পারছেন, স্বপ্না আর বীথিকা, দুজনেই মস্ত পয়সাওলা পরিবারের মেয়ে। স্বপ্নার দু-বার বিয়ে হয়েছিল, দু-বারই বিচ্ছেদ হয়েছে। বিলেত থেকে ফেরার পর ভাইদের সঙ্গে গোলমাল বেঁধেছিল। তখন বীথিকা ওঁকে নীলকান্তপুরে নিয়ে যায়। এই পর্যন্ত। এবার বলুন, এর থেকে কী বুঝলেন?’

‘বিশেষ কিছু নয়। কেবল এইটুকু মনে হচ্ছে যে স্বপ্না বীথিকার অনেক গোপন কথা জানতেন যা সম্ভবত আর কেউ জানত না।’

‘আচ্ছা বীথিকার ভাইদের সঙ্গে কথা বলতে চান না?’

‘না। আপনারা যা জেরা করেছেন, তাই যথেষ্ট। ওদের কাছ থেকে আর বিশেষ কিছু জানা যাবে বলে মনে হয় না। ওরা ওদের ভগ্নীপতিকে শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত আর বীথিকা ওদের বোন। এ অবস্থায় ওরা দুজনকেই আড়াল করে কথা বলবে। সেটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা, নূরপুরে ববি রোজারিওর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল?’

‘নাঃ! ভুয়ো নাম বা ভুয়ো ঠিকানা।’

দময়ন্তী বলল, ‘হুঁ, আমিও তাই অনুমান করেছিলুম।’

‘আপনার আর কিছু জানবার নেই?’

‘আছে। রানি নির্ঝরিণী, ভোলানাথ আর শম্ভুচন্দ্রের মৃত্যুর সঠিক সময়গুলো বলবেন?’

‘নির্ঝরিণী মারা যান গত বছরের আগের বছর জানুয়ারি মাসে। ভোলানাথ মারা যান গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আর শম্ভুচন্দ্র গেছেন গত বছর ডিসেম্বরে, বীথিকা মারা যাওয়ার মাসখানেক আগে।’

‘আর গত বছরের আগস্ট মাস থেকে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়, তাই না?’

‘হ্যাঁ, তাই।’

.

দময়ন্তী আর কোনো প্রশ্ন করল না। চুপ করে বিষণ্ণ মুখে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, ‘বড়ো নোংরা ব্যাপার। নোংরা ষড়যন্ত্র। কিন্তু প্রমাণ কোথায়? সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সও নেই। একমাত্র উপায় সম্মুখ যুদ্ধ।’

সমরেশ পুলকিত মুখে বলল, ‘উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু কার সঙ্গে?’

দময়ন্তী শিবেনকে বলল, ‘কাল সন্ধ্যেবেলা বিবেকানন্দের ছোটো ভাইকে ধরে আনতে পারেন? যদি আসতে না চায়, অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসবেন। ওয়ারেন্ট নিয়ে যাবেন।’

শিবেন ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। বলল, ‘তাই হবে।’

.

বিবেকানন্দ ধাড়ার ছোটোভাই বিশ্বানন্দ ডিগডিগে রোগা, গর্তে বসা চোখ, ভাঙা গাল, ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ— এককথায় যাকে বলে চোয়াড়ে চেহারা। বয়েস তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। ঘরে ঢুকেই খোলা গলায় চিৎকার জুড়ে দিলেন, ‘আমাকে এখানে জোর করে ধরে আনার অর্থ কী? এ কি মগের মুলুক? দেশে আইনকানুন নেই? দাদা এক্ষুনি উকিল নিয়ে এসে পড়বে, তখন মজা টের পাবেন আপনারা।’

দময়ন্তী অবিচলিত গলায় বলল, ‘নিশ্চয়ই, তবে আপনি কতটা মজা টের পাবেন সেটা নির্ভর করছে আপনি কতটা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চান তার ওপরে। একটি হত্যাকাণ্ডে কোনোরকমভাবে লিপ্ত থাকার কি শাস্তি, আপনি তা জানেন?’

‘কী? কী? কোন হত্যাকাণ্ড? আ-আমি কোনো হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত নই।’

‘আলবত লিপ্ত! কে আপনাকে দশ হাজার টাকা দিয়েছিল? যা দিয়ে আপনি কলেজের তহবিল থেকে সরানো টাকা পুরিয়ে দিয়েছিলেন? সে টাকা তো আপনি ঘোড়ার খুরে উড়িয়েছিলেন।’

‘কে? কে? এসব কথা কে বলেছে আপনাকে? বাজে কথা। যে বলেছে সে মিথ্যে কথা বলেছে। পারবেন আদালতে এসব কথা প্রমাণ করতে?’

‘নিশ্চয়ই পারব। আমার কাছে এমন সাক্ষ্য প্রমাণ আছে যা দিয়ে আপনি যে সেই টাকার বিনিময়ে আপনার বাবাকে ডাক্তার রজার ওয়ালটনের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেই ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খেয়েই আপনার বাবার মৃত্যু হয়েছিল, তাও আমি প্রমাণ করতে পারব। দীননাথ কলেজের প্রিন্সিপাল দয়া করে আপনার চুরি ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু দেশের আইন আপনার এই নরহত্যায়, বিশেষ করে পিতৃহত্যায়, সাহায্য করতে ক্ষমা করবে না।’

‘বা-বাজে কথা সব! আমি আমার বাবাকে মারিনি। বাবা জন্ডিসে মারা গিয়েছিলেন।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু ডাক্তার রজার ওয়ালটনের দেওয়া জন্ডিসের জীবাণুমিশ্রিত ওষুধ খেয়েই যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল—’

দময়ন্তী কথাটা শেষ করতে পারল না। বিশ্বানন্দ আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘রজার ওয়ালটন কী ওষুধ দেবে তা আমি কী করে জানব?’

‘আলবত জানতেন! নইলে রজার ওয়ালটনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন কেন? সেই লোকটার সঙ্গে কী করে পরিচয় হয়েছিল আপনার?’

‘আমার কোনো পরিচয় ছিল না। চিনতুমই না ওকে।’

‘কে তাহলে ওর নাম-ঠিকানা দিয়েছিল আপনাকে?’

‘মিস্টার কামতাপ্রসাদ শর্মা বলে এক অবাঙালি ভদ্রলোক। রেসের মাঠে পরিচয় হয়েছিল।’

‘সে আপনাকে কেবল বলেছিল যে আপনার বাবাকে রজার ওয়ালটনের নাম করতে আর তার কাছে একদিন নিয়ে যেতে, আর তাহলেই আপনার গচ্চা যাওয়া টাকাটা সে পুরোটা দিয়ে দেবে, তাই না?’

‘হ্যাঁ, অনেকটা তাই বটে। আমি কেবল কথায় কথায় তাকে বলেছিলুম যে বাবা হোমিওপ্যাথি করাতে চান, কিন্তু কোনো ডাক্তার পছন্দ হচ্ছে না।’

‘আপনাকে যখন কামতাপ্রসাদ টাকা দিতে গেল, আপনার মনে হল না যে এর পেছনে কোনো নোংরা ব্যাপার থাকতে পারে?’

‘শর্মাজি আমাকে বলেছিলেন যে রজার ওয়ালটন খুব ভালো ডাক্তার, কিন্তু পসার জমাতে পারছেন না। তাই কেউ রুগি নিয়ে গেলে উনি খুশি হয়ে তাকে কিছু দিয়ে থাকেন। তা ছাড়া, তখন আমার টাকার ভীষণ দরকার ছিল।’

‘তা তো বুঝতেই পারছি। তাই বলে, কিছু দেওয়া মানে দশ হাজার টাকা?’

‘রেসের মাঠে আপনি গেছেন কোনোদিন? গেলে বুঝবেন যে ওটা ওখানে এমন একটা বিরাট বড়ো অঙ্কের কোনো ব্যাপার নয়।’

‘ওই কামতাপ্রসাদের ঠিকানা আপনি জানেন?’

‘নাঃ! রেসের মাঠে কত লোকের সঙ্গে আলাপ হয়, সকলের ঠিকানা কি মনে রাখা সম্ভব? তবে শুনেছি ভদ্রলোক বম্বেতে থাকেন, বোধ হয় সেখানেই ফিরে গেছেন।’

ঠিক এইসময় বিবেকানন্দ সঙ্গে সম্ভবত তাঁর উকিলকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। দময়ন্তী তাঁদের স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘আপনার ভাইকে নিয়ে যেতে পারেন বিবেকানন্দবাবু। আমাদের আলোচনা যা হবার তা হয়ে গেছে। তবে আপনাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল। সেগুলো দয়া করে শুনে যাবেন।’

.

‘তুমি এই বিশ্বানন্দ বেটাচ্ছেলেকে সন্দেহ করলে কীভাবে?’ সমরেশ জিজ্ঞেস করল।

শিবেন হাত নেড়ে বলল, ‘সন্দেহ করাটাই তো স্বাভাবিক। আমাদেরও করা উচিত ছিল। কিন্তু বিশ্বানন্দ ধাড়ার কথাটা একবারও খেয়াল হল না! আশ্চর্য! তবে, এই লোকটার এত খবর আপনি পেলেন কোত্থেকে?’

‘দীননাথ কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ডক্টর অজিত চট্টোপাধ্যায় আমার প্রোফেসর ছিলেন। তাঁকে একটা ফোন করে সব খবর জোগাড় করেছি। তবে, কেউ চেনা না থাকলে আপনাকে বলতুম খোঁজখবর করবার জন্যে। বুঝতেই পারছেন, ভেতরে লোক না থাকলে ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে যেতে পারত। রিমোট কন্ট্রোলের একটা সীমা আছে তো।’

শিবেন মাথা নেড়ে বলল, ‘তা তো বটেই।’

‘মোটেই তা তো বটেই না।’ সমরেশ হাত-পা ছুড়ে বলল, ‘তা তো বটেই মানে কী? আমি জানতে চাই বিশ্বানন্দ ধাড়াকে কেন এবং কী প্রকারে তোমার সন্দেহ হইল? তার অপর দুই ভ্রাতাকে কেন হইল না?’

দময়ন্তী বলল, ‘বড়োভাই নিজেই তাঁর বাবার মৃত্যুর পেছনে কোনো রহস্য আছে— এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। মেজোভাই মিলিটারি, বাড়িতে আসেন না। ছোটোভাই প্রোফেসারি ছেড়ে দাদার ব্যবসায় যোগ দিচ্ছেন। এঁদের মধ্যে ছোটোভাইটিকেই সন্দেহ হবে না তো কার ওপরে হবে? যদি আমার সন্দেহ অমূলক প্রমাণিত হত, তখন জাঠতুতো ভাইদের সম্পর্কে খোঁজ নিতুম। তবে আমি প্রায় নিশ্চুত ছিলুম যে আমার ভুল হয়নি।’

‘কিন্তু: ভাইদের মধ্যে একজন কেন? রজার ওয়ালটনের নাম তো যে-কেউ সাজেস্ট করতে পারত? শম্ভুচন্দ্র তো দরজা বন্ধ করে বসে থাকতেন না। তাঁর কাছে অনেক লোক দেখা করতে আসত। তাদের মধ্যে যে-কেউ তা করতে পারত।’

‘তা যে করতে পারত না, তা নয়। কিন্তু সেটা একটু কঠিন ব্যাপার হত।’

‘কেন?’

‘তাহলে ষড়যন্ত্রটা সম্বন্ধে একটু বলা দরকার। যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, তারা দেখেছিল যে বড়োলোক খিটখিটে প্রায় উন্মাদ বৃদ্ধ লোকেদের আত্মীয়স্বজন তাঁদের দীর্ঘজীবনের চেয়ে মৃত্যু কামনাই বেশি করে থাকে। সরাসরি খুন হয়তো করতে চায় না বা পারে না, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে খুব ছোটোখাটো অন্যায় কাজ করতে বড়ো একটা আপত্তিও করে না। এক্ষেত্রে দেখ, তারা কী করছে? তাদের আত্মীয়দের এক হোমিওপ্যাথের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। তাতে তাদের বিবেকদংশন হবার কোনো কথাই নয়। কিন্তু, যে উপায়ে তাদের সেই কাজটা করানো হচ্ছে, তাতে তাদের মনে একটা সন্দেহ বা সংশয় হবার কথা। তারা কেবল সেই জায়গাটায় চোখ বন্ধ করে থাকছে। ধরো, আজ যদি তোমাকে কেউ বলে যে তোমার স্ত্রীর টেবিলে এই ফুলের তোড়াটা রেখে এসো, তার জন্য তোমাকে দশ হাজার টাকা দেব তাহলে প্রথমেই তোমার সন্দেহ হওয়া উচিত যে এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ভয়ঙ্কর গণ্ডগোল আছে। সেই সন্দেহটাই এঁরা চেপে রেখেছেন।’

‘তার মানে, পঙ্কজ রায়চৌধুরি যে হঠাৎ তেরিয়া হয়ে বলেছিলেন, আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা, সেটা এই অপরাধবোধেরই বহিঃপ্রকাশ?’

‘ঠিক তাই। পঙ্কজ পেঁচি মাতাল। মামিশাশুড়ির তহবিল থেকে মদের টাকা খুব সহজে বেরোত বলে মনে হয় না। আজ যদি ছপ্পর ফুঁড়ে সেই টাকা আসে, তাহলে একজন হোমিওপ্যাথের কাছে তাঁকে নিয়ে যেতে আপত্তির তো কোনো কারণ নেই।’

শিবেন বলল, ‘দুজনেই সমান। সন্দেহ করতে গেলে দুজনকেই একসঙ্গে এবং আলাদা আলাদা ভাবে করা উচিত। তাই না, বউদি?’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ, তাই।’

সমরেশ মাথা চুলকে বলল, ‘কিন্তু নিকট আত্মীয়দেরই জড়াতে হবে কেন? বাইরের লোকও তো লাগানো যেত।’

‘তা যেত। কিন্তু ষড়যন্ত্রটায় টাইমিং এবং পারম্পর্য— দুটোই খুব জরুরি ছিল। কাছের লোক না হলে, এটা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুব বেশি।’

‘তাহলে এই তিনটে হত্যাকাণ্ড এবং বীথিকার মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কটা কোথায়?’

‘সেইটে জানতে গেলে, আরও সাক্ষ্য প্রমাণ দরকার। স্রেফ অনুমানের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। শিবেনবাবু, কাল একবার পঙ্কজ রায়চৌধুরিকে বাজিয়ে আসবেন?’

‘আসব। আপনার যাবার দরকার নেই, ব্যাপারটা আমি বুঝে গেছি। কেবল, সমরেশের শেষ প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। আর, আমার এখনও বিশ্বাস যে বীথিকা এবং রজার ওয়ালটন একই ব্যক্তি।’

দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘হতে পারে। আর হ্যাঁ, একটা কথা। বিবেকানন্দ, বিশ্বানন্দ, পঙ্কজ, সোমনাথ আর শ্যামল, এদের প্রত্যেকের একটা করে ফোটো জোগাড় করতে পারেন?’

‘পারি। কাল না পেলেও পরশু পাবেন।’

.

শিবেন এল একটু রাতের দিকে। বলল, ‘সেই একই ব্যক্তি। শ্রীযুক্ত কামতাপ্রসাদ শর্মা। বিশ্বানন্দের বেলায় রেসের মাঠে, পঙ্কজের বেলায় শুঁড়িখানায়। কিপটে মাগি যা হাতখরচা দিত, তাতে বাংলা খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেসল মশায়, কেউ যদি স্কচ খাওয়ায়, খাঁটি স্কচ, স্কটল্যান্ডে তৈরি, তাহলে তার অনুরোধ না রাখা কি ভদ্দরলোকের কাজ? আর, সামান্য অনুরোধ— এক বেচারি ডাক্তার বিলেত থেকে ফিরে পসার জমাতে পারছে না, তার কাছে রুগি পাঠানো। এর মধ্যে অন্যায়টা কী আছে?’

দময়ন্তী হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি এরকমই সন্দেহ করেছিলুম। ফোটো এনেছেন?’

‘ধাড়া ব্রাদার্স আর পঙ্কজের ছবি এনেছি। সোমনাথ আর শ্যামলের ছবি পাবেন কাল। এখন রেডি নেই।’

‘সোমনাথ আর শ্যামল কী বলল?’

‘আপনি তো ওদের জেরা করতে বলেননি, তাই কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তবে, ফোটো চাওয়ায় খুব ক্ষেপে গেছে। বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে দু-চার কথা শুনিয়ে দিল। কাল বিকেলে গিয়ে নিয়ে আসতে বলেছে।’

.

সোমনাথ ভট্টাচার্য আর শ্যামল রায়, দুজনেই সন্ধ্যের একটু আগেই উপস্থিত। সমরেশ ঠিক তক্ষুনি অফিস থেকে ফিরেছে। অ্যাপায়ন করে দুজনকে বসবার ঘরে বসাল। একটু আলাপচারি করবার চেষ্টা করল, কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। দময়ন্তী যখন ঘরে ঢুকল, তখন তিনজনেই গম্ভীর মুখে নীরবে বসে আছে।

সোমনাথ সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘আমাদের ছবি চেয়েছেন কেন?’

দময়ন্তী বলল, ‘আপনাকে সে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই। আপনার ইচ্ছে হলে দেবেন, না হলে দেবেন না।’

সোমনাথের মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল। সমরেশের মনে হল, ঠিকই বলেছিলেন হেমন্ত সরকার, চণ্ডাল রাগ।

অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করল সোমনাথ। বলল, ‘কৈফিয়ত চাইছি না। জানতে চাইছি কী আমাদের অপরাধ যে আপনাকে আমাদের ছবি দিতে হবে?’

দময়ন্তী বাঁকা হেসে বলল, ‘কে বলেছে আপনাকে যে কেবল অপরাধীদেরই ছবি সংগ্রহ করি আমি? দেওয়ালে ওই যে ছবি ঝুলছে, ওঁকে চেনেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’

‘বাজে বকবেন না।’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সোমনাথ, ‘আপনার কি ধারণা আমরা ছোড়দাকে খুন করেছি? ডাক্তার দাশগুপ্তের সার্টিফিকেট ভুয়ো?’

দময়ন্তী পূর্ববৎ বলল, ‘আপনার এসব প্রশ্নের জবাব দিতেও আমি বাধ্য নই। তবে হ্যাঁ, আপনারা যদি নিজেদের উপকার চান, তাহলে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন।’

‘কী প্রশ্ন?’

‘ডাক্তার রজার ওয়ালটনের নাম আপনাদের কে দিয়েছিল?’

সোমনাথ এই প্রশ্নের জবাব দিতে যেতেই শ্যামল তাকে বাধা দিতে গেল। কিন্তু সোমনাথ হাত নেড়ে বলল, ‘তুই চুপ করে বসে থাক! সোমনাথ ভট্টাচার্য কাউকে ভয় পায় না। হ্যাঁ, ডাক্তার রজার ওয়ালটনের নাম দিয়েছিলেন একজন অবাঙালি ভদ্রলোক।’

‘তার সঙ্গে কোথায় আলাপ হয়েছিল আপনার?’

‘তারাতলায়। আমার গোডাউনের পাশে একটা ফ্যাক্টরি আছে। উনি সেখানে আসতেন। ওখানেই আলাপ।’

‘উনি কত টাকা দিয়েছিলেন আপনাকে?’

‘এক পয়সাও না।’

দময়ন্তী ধমকে উঠল, ‘মিথ্যে কথা!’

হঠাৎ শ্যামল রায় উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মুখ সামলে কথা বলবেন বলে দিচ্ছি। মেয়েছেলে বলে রেয়াত করব ভাববেন না। আমি শ্যামল রায় ক্ষেপে গেলে জানোয়ার।’

‘ক্ষেপে না গেলে কোনো ইতর বিশেষ হয় বলে তো মনে হয় না।’ অবিচলিত গলায় বলল দময়ন্তী।

‘যা বলেছেন।’ পেছন থেকে বলল শিবেন। একটু আগে এসে ঢুকেছে। ‘চুপ করে বসো তো হে ছোকরা! এটা তোমার পাড়ার গলি নয়। বেশি গোলমাল করলে এক্ষুনি চালান করে দেব। আর, এবার একেবারে লালবাজার।’

সোমনাথ নীচু গলায় বলল, ‘বসে পড় শ্যামল, ঝামেলা করিসনি। এই নিন, ছবি চেয়েছিলেন, দিয়ে গেলুম। আর কিছু করতে হবে কি?’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, আপাতত এতেই হবে। কেবল, আমার প্রশ্নের জবাব এখনও পাইনি। কত টাকা দিয়েছিলেন কামতাপ্রসাদ?’

‘সে সময়ে বাজারে আমার একটা লোন ছিল, সেটা শোধ করে দিয়েছিলেন। আমাকে না জানিয়েই করেছিলেন।’

‘কত টাকা?’

সোমনাথের মুখ আবার লাল হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার এ প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। আয় শ্যামল।’

.

কথা হচ্ছিল পরদিন সন্ধ্যেবেলা।

দময়ন্তী বলল, ‘দারুণ দেখতে কিন্তু মামা-ভাগনেকে।’

শিবেন হাসল। বলল, ‘যা বলেছেন। ফিল্মস্টার ফিল্টস্টার চেহারা। ভাগনেটি কেন যে সিনেমায় সুবিধে করতে পারল না, কে জানে!’

এই আলোচনা আর এগোতে পারল না। দরজায় বেল বেজে উঠল। সমরেশ দরজা খুলে দিতে যিনি ঘরে ঢুকলেন, তিনি শ্রীমতী মঞ্জুলা রায়চৌধুরি, এয়ারেস টু দি এস্টেট অফ দি লেট মহারানি নির্ঝরিণী দেবী অফ হিরাগঞ্জ।

ঘরে ঢুকেই মঞ্জুলা দময়ন্তীকে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ জরুরি কথা আছে।’

দময়ন্তী বলল, ‘বলুন।’

‘এদের সামনেই বলব?’ বলে বাকি দুজনের মুখের দিকে দেখে বললেন, ‘আচ্ছা, বলছি; গতকাল আপনি এই এঁকে আমার স্বামীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আমার স্বামী মাতাল, ওঁর বুদ্ধিশুদ্ধির ঠিক নেই। উনি এঁকে যা বলেছেন, সব বাজে কথা, মিথ্যে কথা। ওঁকে কেউ ওই অ্যাংলো ডাক্তারের কথা বলেনি। আমার মামিমাকে কে এর খবর দিয়েছিল, তা আমাদের জানা নেই।’

দময়ন্তী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ভয় দেখানো ফোনটা কবে পেয়েছেন? কাল রাত্রেই না আজ?’

মঞ্জুলা বিস্ফারিত চোখে বললেন, ‘কে? কী? কীসের ফোন?’

‘কামতাপ্রসাদ সম্পর্কে কোনো কথা বললে কাকে খুন করা হবে? আপনার স্বামীকে না আপনাদের দুজনকেই?’

মঞ্জুলা কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে রইলেন। তারপর শিউরে উঠে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘আ-আ-আমি জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না।’ বলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সমরেশ বলল, ‘হীরাগঞ্জের এরারেস খুব ভয় পেয়েছেন দেখছি।’

দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘হুঁ। আর ক্ষেপে গেলে জানোয়ার শ্যামল রায়ও পেয়েছে।’

শিবেন বলল, ‘তাই দেখলুম বটে। এই কামতাপ্রসাদটাই বা কে? দু-দুটো গাঁইগোত্রহীন লোক— রজার ওয়ালটন আর কামতাপ্রসাদ শর্মা। আরও বাড়বে না কি?’

দময়ন্তী গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। বলল, ‘সে সম্ভাবনা তো দেখছি না।’

‘এখন তাহলে কী কর্তব্য?’

‘কাল সকালেই একবার ডাক্তার মিসেস স্বপ্না চৌধুরির সঙ্গে দেখা করতে হবে। নয়তো দেরি হয়ে যেতে পারে।’

‘কত সকালে?’

‘যত সকালে সম্ভব। ধরুন সাড়ে ছ-টায় এখান থেকে রওনা হব।’

‘তাই হবে। সঙ্গে লোকজন নেব?’

‘হ্যাঁ। প্লেন ড্রেসে। পারলে আজ রাত্রেই প্রজ্ঞা যেন ঘিরে ফেলা হয়। কারা ঢুকছে বা বেরুচ্ছে, সেদিকে যেন নজর রাখে। আর প্রয়োজন হলে যেন এগিয়ে আসতে পারে। গুলি চালাতে হতে পারে।’

শিবেন শান্ত গলায় বলল, ‘বেশ, সব ব্যবস্থা করা যাবে।’

.

শিবেনের ফিয়াট যখন প্রজ্ঞার সামনে পৌঁছল, তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, বড়ো রাস্তায় লোকজনের চলাচল ভালোরকম শুরু হয়ে গেছে। প্রজ্ঞার গেটের উলটোদিকে একটা প্রাইভেট বাস দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় সেটার চাকা পাংচার হয়ে গেছে, সারানোর কাজ চলছে। গেটের পাশে গাছের তলায় চারজন দেহাতি লোক পুঁটুলি মাথায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তারা ওই বাসের যাত্রীও হতে পারে, আবার সাধারণ পথিকও হতে পারে।

শিবেন এদের দেখিয়ে বলল, ‘এরা আমাদের লোক। বাসের ভেতরে কয়েকজন আছে। প্রজ্ঞার পেছনের ক্ষেতের ভেতরেও আছে। মোটামুটি চারদিকেই ঘেরা আছে। কজনকে সামলাতে হবে মনে করেন?’

দময়ন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘একজনকেই। সেই নাটের গুরু।’

শিবেন একটু হতাশ হল বলে মনে হল। তারপর হর্ন বাজাল। গেট খুলে দিল বৃজনন্দন। গাড়ির ভেতরে ইউনিফর্ম পরা শিবেনকে দেখে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়াল।

শিবেন গাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ডাক্তার স্বপ্না চৌধুরির কোয়াটার্স কোনটা?’

বৃজনন্দন নীরবে ডানদিকের বড়ো বাড়িটার দিকে আঙুল দেখাল। শিবেন গাড়িটা সেইদিকে ঘুরিয়ে গাড়িবারান্দার নীচে এনে দাঁড় করাল। একজন নার্স তখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন। শিবেন তাকে স্বপ্না চৌধুরির কোয়াটার্সের কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি তিনতলার ছাদে চলে যেতে বললেন। সেখানে পেছন দিকে দুটো ফ্ল্যাট আছে। তারই একটা ডাক্তার চৌধুরির।

তিনজনে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল। বাঁ-দিকের ফ্ল্যাটের দরজায় বড়ো বড়ো করে লেখা ‘ড. এস চৌধুরি’। শিবেন বেল বাজাল।

দরজাটা খুলতে একটু দেরি হল। ড. চৌধুরি একটা হালকা সবুজের ওপর গাঢ় সবুজ রঙের বড়ো বড়ো ছোপ দেওয়া পা পর্যন্ত লম্বা ড্রেসিং গাউনের কোমরের দড়ি বাঁধতে বাঁধতে দরজা খুলে দিলেন। ভদ্রমহিলার চোখ দুটো ফোলা ফোলা, অল্প লাল, মনে হল সারা রাত ঘুমোননি। অতিথিদের দেখে মুখে হাসি টেনে বললেন, ‘একী, আপনারা এত সকালে?’ কিন্তু কথার সুরে খুব একটা বিস্ময় ফুটে উঠল না। তারপর একটু থেমে বললেন, ‘আসুন, ভেতরে আসুন।’

বসবার ঘরটা খুব একটা বড়ো নয়। একগাদা আসবাবপত্রে ভরতি। একটা সোফাসেট, গোটা পাঁচেক চেয়ার, একটা ইজিচেয়ার, দুটো বড়ো বড়ো বইয়ের আলমারি, একটা শো-কেস, একটা রেফ্রিজারেটার, কী নেই! ভদ্রমহিলা সবাইকে সোফায় বসিয়ে নিজে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর খুব নীচু গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘আমি কি আপনাদের কোনো সাহায্য করতে পারি?’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘পারেন। ডক্টর বীথিকা বোসের হত্যাকারী যে কে তা এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। তার পরিচয় প্রকাশ করতে আমাদের সাহায্য করলেই আমরা কৃতজ্ঞ হব।’

স্বপ্না সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ‘আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। আমি তো আপনাদের আগেই বলেছি যে বীথিকার মার্ডারার তার হাজব্যান্ড অরিজিৎ।’

‘আপনি যখন একথা আমাদের বলেছিলেন আপনি তখন খুব সম্ভব সে কথাই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এখনও তা করেন কি? বোধ হয় না। অতএব, আমাদের কাছে সত্য প্রকাশ করে বলুন। তাতে আপনারও উপকার হবে, কারণ হত্যাকারীকে আশ্রয় দেওয়া বা তার পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা করাও আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ। তা ছাড়া, কৃতজ্ঞতা বোধ বলেও একটা জিনিস আছে। আপনি ভুলে যাবেন না যে বীথিকা আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল, আপনার বিপদের দিনে আপনাকে আশ্রয় দিয়েছিল, সাহায্য করেছিল।’

স্বপ্না কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘অরিজিৎ মার্ডারার নয়— একথা মনে করবার কোনো কারণ আছে কী? স্ত্রীর ঘরে ঢুকে তার লিপস্টিকে বিষ মাখিয়ে রেখে আসার সুযোগ তারই সবচেয়ে বেশি ছিল, তাই না?’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, তা নয়। এবং আপনিও সে কথা জানেন। অরিজিৎ সম্ভবত অনেকদিনই তার স্ত্রীর ঘরে ঢোকেননি। আমরা তাঁদের আলাদা ঘর দেখে এসেছি।’

‘তাহলে বীথিকাকে কে মেরেছে? আপনি কী বলতে চান?’

‘আমি বলতে চাই বীথিকাকে মেরেছে তার প্রেমিক এবং শয্যাসঙ্গীদের একজন। তিনি যে কে তা আপনি জানেন। আপনিই সম্ভবত তাকে বীথিকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বীথিকার মৃত্যুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও, তার মৃত্যুর বেশ কিছুটা দায়িত্ব কিন্তু আপনার ওপর বর্তায়।’

স্বপ্না প্রবল বেগে মাথা নেড়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘না, না, না। আমি এ ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না। আমাদের অনেক কমন ফ্রেন্ড ছিল। তাদের কে কী করেছে, তার জন্যে আমি কেন দায়ী হব?’

‘দায়ী হবেন, কারণ আপনি তার পরিচয় জেনেও তাকে আড়াল করে রাখতে চাইছেন।’

‘বিশ্বাস করুন—’ কাতর গলায় বললেন স্বপ্না, ‘আমি ইচ্ছে করে কাউকে আড়াল করতে চাইছি না।’

‘খুব সম্ভব আপনার কথাই সত্যি। সোমনাথ কি আপনাকে খুন করে ফেলার ভয় দেখিয়েছে?’

স্বপ্না বিস্ফারিত চোখে দময়ন্তীর দিকে তাকালেন। সে চোখে অবিমিশ্র আতঙ্ক। কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

শিবেন তখন উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ডক্টর চৌধুরি, আমাকে একবার আপনার ফ্ল্যাটটা সার্চ করে দেখতে হবে। যদি ওয়ারেন্ট দেখতে চান, তাও দেখাতে পারি।’

স্বপ্না কোনো কথা বলার আগেই হঠাৎ নীচে একটা গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ পাওয়া গেল। ফিয়াট গাড়ি।

শিবেন চমকে উঠে বলল, ‘আমার গাড়ি! এ ফ্ল্যাট থেকে বেরুবার অন্য রাস্তা ছিল?’ বলে এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে বিদ্যুদ্বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেল। বাকি তিনজন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল পেছনে পেছনে।

ওপর থেকে দেখা গেল শিবেনের গাড়ি বেশ জোরে চলেছে গেটের দিকে। বৃজনন্দন গেটটা খুলে দিয়েছে। গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ার বেশি দেরি নেই। শিবেন তখন কোমর থেকে পিস্তল বের করে শূন্যে দু-বার গুলি ছুড়ল। সঙ্গে সঙ্গে গেটের ওপারে নানারকম কার্যকলাপ শুরু হয়ে গেল। গাছের নীচে যারা ঘুমোচ্ছিল, তারা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে গেটের সামনে চলে গেল। কিন্তু শিবেনের গাড়িটা আসতে দেখে একটু ইতস্তত করে পাশে সরে দাঁড়াল। তখন শিবেন আবার দু-বার গুলি ছুড়ল। তখন বাসের লোকেদের একজন ওপরে তাকিয়ে শিবেনের ইউনিফর্ম পরিহিত মূর্তি দেখতে পেয়ে চিৎকার করে কী একটা বলল সামনে থাকা সঙ্গীদের। কিন্তু তখন তাদের কিছু করবার নেই। গাড়িটা তাদের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসে তখন প্রায় বড়ো রাস্তায় উঠে পড়েছে। তার ঠিক সামনে তখন বাসটা।

হঠাৎ বাসের ভেতর থেকে একঝলক গুলি ছুটে এল। ফিয়াটটা মাতালের মতো টলে উঠে একপাশে বেঁকে সামনে মুখ থুবড়ে পড়ল।

শিবেন কাতরে উঠে বলল, ‘গেল, আমার নতুন গাড়িটা গেল!’

ইতিমধ্যে শিবেনের লোকেরা গাড়িটা ঘিরে ফেলেছে। দুজন ড্রাইভারের দিকের দরজা খুলে একজনকে টেনে বের করল। তার শার্টে রক্তের ছোপ আর দেখে মনে হল হয় অজ্ঞান নয়তো মরে গেছে। অন্যদিকের দরজা খুলে আর একজনকে বের করা হল। তার ঘাড়টা একদিকে এমনভাবে বেঁকে গেছে যে সন্দেহ থাকে না যে তার শরীরে আর প্রাণ নেই।

সমরেশ বলল, ‘দুজন ছিল দেখছি। ডানদিকেরটা তো সোমনাথ, মরেনি বোধ হয়, তবে জোর চোট পেয়েছে। অন্যটা কে? শ্যামল?’

‘না।’ বললেন স্বপ্না, ‘ওটা একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গুন্ডা, নাম রজার ওয়ালটন।’

.

সমরেশের অর্কিড রোডের ফ্ল্যাটের বসবার ঘরে কথা হচ্ছিল। দময়ন্তী বলল, ‘বীথিকার খুন হওয়ার ব্যাপারে প্রথমেই যে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে সেটা হচ্ছে খুন করার পদ্ধতিটা। লিপস্টিকে তার স্বামী বিষ মিশিয়ে রেখেছিল বলে পুলিশ ধরে নিয়েছিল। তার মানে এটা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে খুন করা নয়। বেশ ধীরে ধীরে করা যেন হত্যাকারীর কাছে সময়ের কোনো মূল্যই নেই। অর্থাৎ, হত্যাকারী বীথিকাকে মেরে ফেলতে চায়, কিন্তু সে যখন খুশি মরুক, তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে লিপস্টিকে বিষ মাখিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে। তাও যদি বীথিকার একটা কি দুটো লিপস্টিক থাকত! হত্যাকারী জানে যে তার অগুন্তি লিপস্টক; তাদের সবগুলোই সে ব্যবহার করে এবং তার মতো খামখেয়ালী মেয়ে কখন কোনটা করে সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই কারুর সঙ্গে পরামর্শ করে না। তার মানে, এটা ভেবেচিন্তে খুন করা। তাই যদি হবে, যদি তার পতিদেবতাই তাকে খুন করে থাকবে, তাহলে সে লিপস্টিকটা পুলিশ আসার আগেই সরিয়ে ফেলল না কেন? বড়ো ডাক্তারবাবু খুব ভালো করেই জানতেন যে মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা একটা লিপস্টিক তুলে নিয়ে তিনি যদি ড্রেসিং টেবিলের ওপর অসংখ্য লিপস্টিকের সঙ্গে রেখে দিতেন, তাহলে কেউ কোনো প্রশ্নই করত না। আর পুলিশও কোনোদিন ধরতে পারত না বীথিকার ঠোঁটে লেগে থাকা পটাসিয়াম সায়ানাইড এসেছে লিপস্টিক থেকে। আসলে, এই সমস্ত ঘটনাটা একটা জিনিসই প্রমাণ করে যে হত্যাকারী চেয়েছিল যখন বীথিকা মারা যাবে তখন সে যেন অনেক দূরে থাকে। এই লোক তার স্বামী হতে পারে না। তাহলে সে কে?

‘শিবেনবাবু প্রথমেই বলেছিলেন যে বীথিকার স্বভাবচরিত্র ভালো ছিল না, সে নিমফোম্যানিয়াক ছিল। তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যেকোনো প্রেমিকই তার খুনের জন্যে দায়ী। সে কে হতে পারে?

‘এখানে এসে বাঁশবনে ডোম কানা। বীথিকার ভালোবাসার লোকের অভাব ছিল না। কাকে ছেড়ে কাকে ধরা যাবে? তা ছাড়া, তাদের সকলের পরিচয় কে জানে? জানতে পারে দুজন, বৃজনন্দন আর মদনমোহন কাঞ্জিলাল। কিন্তু দুজনের কেউই এ ব্যাপারে কিছু জানাবে না, কারণ এরা দুজনেই তাদের অন্নদাত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ। এরা দুজনেই বীথিকার চরিত্রের খারাপ দিকটার প্রতি চোখ বন্ধ করে রেখেছেন।’

হেমন্ত সরকার বললেন, ‘কিন্তু ডাক্তার অরিজিৎ বোসকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ ছিল।’

‘নিশ্চয়ই ছিল। ভদ্রলোকে একদিকে পাক্কা সাহেব, অন্যদিকে টাকার জন্যে নিজের বিবেক জলাঞ্জলি দিতে একেবারেই অপারগ নন। টাকার জন্যে যিনি নিজের আত্মীয়স্বজন, এমনকী নিজের বাবাকেও ত্যাগ করতে পারেন, তিনি যে স্ত্রী লক্ষ লক্ষ টাকা ওড়াচ্ছেন তাঁকে খুন করতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। কিন্তু বীথিকাকে সরিয়ে দেবার উদ্দেশ্য যদি তার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া হয়, তাহলে তাঁর কি উচিত ছিল না হত্যার চিহ্নগুলো সরিয়ে দিয়ে নিজের ওপর থেকে সব সন্দেহ উঠিয়ে নেওয়া? তা যদি তিনি না করেন, তাহলে বলতে হবে হয় তিনি ভয়ানক বোকা, নয়তো এমন সুপার চালু যে পুলিশ আমি যেভাবে চিন্তা করছি ঠিক সেইভাবে চিন্তা করবে এটা ধরে নিয়েছেন। ডাক্তার অরিজিৎ বোসের পক্ষে এই দু-রকমের কোনোটাই হয়তো ঠিক স্বাভাবিক নয়। এ ছাড়াও ধরে নিতে হয় যে তিনি ছিলেন সুপার অভিনেতা। অন্নদাবাবু আর তাঁর দুই ছেলে বীথিকার স্বভাবচরিত্র কেমন তা খুব ভালো করেই জানতেন। তাঁদের পক্ষে বীথিকার স্বামীর মনে তার প্রতি কোনো গভীর প্রেম থাকবে এটা আশা করা অসম্ভব। তাঁদের অরিজিৎকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও রাজমোহন আর রাজকুমারের তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রমাণ করে যে তারা অরিজিতের ভেতরে তাদের বোনের প্রতি কোনোরকম জিঘাংসায় কণামাত্র চিহ্নও দেখতে পায়নি কোনোদিন।

‘এটা আরও প্রমাণ করে যে বীথিকার ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নেওয়া টাকার প্রাপক তারা নয়। তাহলে অন্য এক ব্যক্তির উপস্থিতি প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ, শিবেনবাবুর যে সন্দেহ যে বীথিকার জীবনের অন্ধকারময় দিকটাই তার মৃত্যুর কারণ, সেটাই সঠিক।’

হেমন্ত বললেন, ‘এমন তো হতে পারে যে ওই টাকাগুলোর জন্যে দুই শালা আর ভগ্নীপতি মিলে এই কাণ্ডটা করেছে?’

‘না, তা হতে পারে না। কারণ, সেক্ষেত্রে খুনটা তাড়াতাড়ি সারতে হত। অনন্তকাল বসে থাকার মতো সময় দেওয়া যেত না। যদি বীথিকার অজান্তে টাকাটা ওঠানো হয়ে থাকত, তাহলে সেটা ধরা পড়ে যাওয়ার আগেই কাজটা সেরে ফেলা দরকার ছিল।

‘বেশ, এবার তাহলে আমরা আসছি ভোলানাথ, শম্ভুচন্দ্র আর নির্ঝরিণীর ব্যাপারটায়। এঁরা কীভাবে মারা গিয়েছেন সেটা আমরা সবাই জানি। এঁরা একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নীলকান্তপুরে চিকিৎসার জন্যে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে দুটো অবসেশন বা স্থির বিশ্বাস এঁদের সুস্থ হয়ে আসা মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক, এঁদের আত্মীয়রা এঁদের শত্রুপক্ষ এবং দুই, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা অ্যালোপ্যাথির চেয়ে ভালো। এ দুটোর কোনোটই খুব কঠিন কর্ম ছিল না। এঁদের নিকটাত্মীয়রা যে কী পদার্থ তা তো আমরা দেখেছি। আর মানসিক চিকিৎসায় কিছু ওষুধ বা শক থেরাপি জাতীয় কিছু ব্যবস্থা আছে যা রুগিদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। অতঃপর এঁদের আত্মীয়দের দুর্বলতাগুলো দেখে নিয়ে সেটা কাজে লাগিয়ে এঁদের এক বিশেষ হোমিওপ্যাথের কাছে পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হয়। এই হোমিওপ্যাথ তাঁদের কীভাবে উইল করতে হবে, কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে ইত্যাদি ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে তাঁদের হাতে হেপাটাইটিসের জীবাণুযুক্ত বিষের শিশি তুলে দেয়।

‘এঁরা তিনজনে পরস্পরের পরিচিত ছিলেন না, তিনজন প্রজ্ঞাকে প্রচুর টাকা দান করে গেছেন— যেটা অনেকেই দিয়ে থাকেন, তিনজনই পরিণত বয়সে হেপাটাইটিসেই মারা গেছেন যেটা নিতান্ত একটা স্বাভাবিক ঘটনা। অথচ এই ঘটনাগুলোর মধ্যে যে একটা গোলমাল আছে এবং তাদের যোগসূত্র যে নীলকান্তপুর— পুলিশ এটা আবিষ্কার করাতেই এই নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রটা ফাঁস করে দেওয়া সম্ভব হল।’ বলে দময়ন্তী সপ্রশংস দৃষ্টিতে হেমন্ত সরকারের দিকে তাকাল। হেমন্ত একটা গ্রাম্ভারি হাসি হাসলেন বটে, কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

দময়ন্তী বলে চলল, ‘এখন প্রশ্ন দুটো। এক, কে এই রুগিদের মনে অবসেশন ঢুকিয়েছেন, বীথিকা না অরিজিৎ? দুই, কে এই রজার ওয়ালটন? বীথিকা, অরিজিৎ না সম্পূর্ণ অন্য কোনো লোক? প্রথমে এক নম্বর প্রশ্নটা দেখা যাক। অরিজিতের টাকার প্রতি প্রলোভনের কথা আমরা জানি। বরং, বীথিকার কথাই জানি না। সে বড়োলোকের মেয়ে, তার লোভ না থাকারই কথা। কাজেই, সন্দেহটা স্বভাবতই অরিজিতের ওপরেই পড়ে। এখন, এই ডোনেশন আর ডোনারের মৃত্যু— এ ব্যাপারটার শুরু গত বছরের আগের বছর জানুয়ারি মাসে। অর্থাৎ বছর আড়াই আগে। আমরা দেখলুম, ডাক্তার মিত্রদের বাড়ির একতলায় স্পেশাল ওয়ার্ড উঠে আসে বছর তিনেক আগে। অর্থাৎ, এই সময় থেকেই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। এই ওয়ার্ড ধনী রুগিদের জন্যে। খোঁজ নিলে দেখবেন, এই তিনজনই ওই ওয়ার্ডে ছিলেন। এটা কিন্তু একটা সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করায়। তা হচ্ছে, স্পেশাল ওয়ার্ড বাড়ির নীচে উঠে আসার আগে পর্যন্ত, বীথিকার সঙ্গে রুগিদের দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। সে পাগলের ডাক্তার ছিল না, সে চালাত ল্যাবরেটরি। মাঝে মাঝে ঘুরে দেখত হয়তো। অথচ অরিজিতের সঙ্গে রুগিদের আগেও যে সম্পর্ক ছিল, তখনও তাই রইল। উনি যদি রুগিদের মগজ ধোলাই করতে চাইতেন, সেটা অনেক আগেই করতে পারতেন। স্পেশাল ওয়ার্ড নিজের কোয়ার্টারের একতলায় উঠে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার ছিল না। তাহলে, এই সম্ভাবনাটা জোরদার হয় যে মগজ ধোলাই-এর ব্যাপারটা বীথিকার কীর্তি, অরিজিতের নয়।

‘এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন, কে এই রজার ওয়ালটন? এই প্রশ্নের জবাব আছে রহিম ওসমান লেনে। জনাকীর্ণ এই রাস্তা যেখানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা মোটেই অপরিচিত বা অপ্রতুল নয়। সেখানে অরিজিতের মতো গম্ভীর প্রকৃতির ব্যস্ত ডাক্তার মাথায় পরচুলো পরে আর চোখে কালো চশমা পরে আবদুল লতিফ নুরুদ্দিনের সঙ্গে একগাল হেসে কথা বলবেন আর তাঁর মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না, এটা কখনো সম্ভব? অরিজিতের সমস্ত পরিচিতরাই, মানে যাঁরা তাঁকে ছোটোবেলা থেকে দেখছেন বা যাঁরা তাঁকে কর্মক্ষেত্রে দেখেছেন, তাঁরা সকলেই একটা কথা বলেছেন যে তিনি গম্ভীর প্রকৃতির, হাসি ঠাট্টার মধ্যে থাকেন না আর স্বপ্নার ভাষায় তিনি রীতিমতো রামগড়ুরের ছানা সদৃশ্য লোক— তাঁর পক্ষে এহেন অভিনয় কখনো সম্ভব হতে পারে না। আর লম্বা বীথিকা পরচুলো পরে নকল গোঁফ-দাড়ি লাগিয়ে বেঁটে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাজতে পারে, কিন্তু তার পক্ষেও দিনের পর দিন নুরুদ্দিনকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হত কি? তার ওপর ববি রোজারিওকেও মনে রাখতে হবে। সে কিন্তু নীলকান্তপুর বা অন্নদাচরণ মিত্রের পরিবেশের সঙ্গে মেলে না। অতএব, প্রবলতম সম্ভাবনা হচ্ছে যে রজার ওয়ালটন রজার ওয়ালটনই। অর্থাৎ, একজন শতকরা এক-শো ভাগ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, যিনি কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগতের বাসিন্দা।

‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রজার ওয়ালটনকে কেউ এই কাজে লাগিয়েছিল। বীথিকা একা লাগিয়ে থাকতে পারে বা সে তার প্রেমিকের সঙ্গে একসঙ্গে এই কাজ করে থাকতে পারে। বীথিকার নানারকমের লোকের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল, তাদের কেউ অপরাধ জগতের সঙ্গে পরিচিত থাকতে পারে। অর্থাৎ:, একটা ব্যাপারে সন্দেহ থাকে না যে এই ষড়যন্ত্রে যে বীথিকার সঙ্গী ছিল তার একটা ক্রিমিন্যাল রেকর্ড ছিল বা আছে। সে কে হতে পারে?

‘এইখানেই আমার সন্দেহ হল সোমনাথের ওপর। তার তিনটে কারণ আছে। প্রথম কারণ, আমি আপনাদের আগেই বলেছিলুম যে এই ষড়যন্ত্রটা একটা নিরেট শয়তানি। সাধারণ মস্তিষ্ক থেকে এহেন প্যাঁচালো অথচ ক্ষুরধার বুদ্ধি বেরোয় না। এ বুদ্ধি একজন স্বাভাবিক অপরাধীর। আমরা এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে যুক্ত যত লোকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তার মধ্যে এহেন ব্যক্তি আছেন দুজন, সোমনাথ আর শ্যামল। বাকিরা কেউ মাতাল, কেউ রেসুড়ে, কিন্তু ক্রিমিন্যাল নয়।

‘দ্বিতীয় কারণ, সোমনাথ আর শ্যামল, দুজনেই অসাধারণ সুদর্শন। শিবেনবাবু একেবারে প্রথম দিন আমাদের বলেছিলেন যে বীথিকা নিমফোমেনিয়্যাক ছিল তো বটেই, তার ওপর হ্যান্ডসাম পুরুষ দেখলে তাদের পেছনে লাগতে দেরি করত না। সে কথাটা আমার মনে ছিল।

‘তৃতীয় কারণ, সোমনাথ ওষুধের ব্যবসা করত এবং সেই সূত্রে তার নীলকান্তপুরে যাতায়াত ছিল, কেবল রুগির আত্মীয় হিসেবে নয়। সে যদি কেবল রুগির আত্মীয় হিসেবে ভিজিটিং আওয়ারে যেত, তাহলে তার বীথিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তো দূরের কথা, পরিচিত হবারই সম্ভাবনা অনেক কম থাকত। স্বপ্নার সঙ্গে কথা বলে আমার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল যে ল্যাবরেটরির ওষুধের সাপ্লায়ার হিসেবে সোমনাথের সঙ্গে তার পরিচয় হয়, হয়তো ঘনিষ্ঠতাও হয় এবং সেই তাকে তার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আজ বোঝা গেছে যে আমার ধারণাটা ঠিকই ছিল।’

সমরেশ এইখানে বাধা দিল। বলল, ‘কিন্তু সোমনাথই কেন? এ তো বীথিকার অন্য যেকোনো প্রেমিক, আর অপরাধপ্রবণতা থাকা সম্ভব, এই ষড়যন্ত্র করতে পারত।’

‘তা যে পারত না, তা নয়। কিন্তু এই মৃত্যুর ঘটনাগুলো এতই ঘড়ির কাঁটার মতো অবধারিত ভাবে ঘটেছে যে এতে ভেতরের লোক যুক্ত নেই— এটা ভাবা অত্যন্ত কঠিন। তারা স্বেচ্ছায় থাকতে পারে অথবা তাদের কেউ ব্যবহার করেছে, তাও হতে পারে। এটা যদি মেনে নেওয়া যায়, তাহলে সোমনাথের ওপরেই সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়।

‘এ ছাড়া, আরও দুটো বিষয় আছে। প্রথম, যাঁরা উইল করেছেন, তাঁরা কিন্তু তাঁদের আশ্রিতরা, যাদের ওপর তাঁদের প্রচণ্ড রাগ, তাদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেননি। অস্থাবর সম্পত্তি হয়তো দান করেছেন, কিন্তু কাউকে ভিটেমাটি ছাড়া করেননি। এটা তাঁরা মগজ ধোলাইয়ের ফলেই করেছেন, আপন বুদ্ধিতে করলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত। এতে প্রমাণ হচ্ছে যে যারা মগজ ধোলাই করেছে, হয় তারা এই রুগিদের আত্মীয়, নয়তো রুগির আত্মীয়রা গোলমাল করলে তাদের আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা এড়াতে সচেষ্ট। এ ব্যাপারে পরে বলছি।

‘দ্বিতীয়, প্রথমে মারা গেছেন নির্ঝরিণী, সেটা স্টেট কেস বলে ধরে নিতে পারি। তারপর গেছেন ভোলানাথ, এটাই মূল লক্ষ্য। অতঃপর শম্ভুচন্দ্র, এটা দুটো সাফল্যের পর তৃতীয় প্রচেষ্টা। এটা যদি ঠিক হয়, তাহলে সোমনাথ শ্যামল কম্বিনেশনকে কিছুতেই বাদ দেওয়া যায় না।

‘এইবার সম্মুখ যুদ্ধ। বিশ্বানন্দকে ডেকে এনে কড়কানো হল। তার পরদিনই ধরা হল পঙ্কজকে। অথচ, সোমনাথকে কিছু বলা হল না, কেবল ছবি চাওয়া হল। এটা ইচ্ছে করেই করেছিলুম যাতে সোমনাথের টনক নড়ে। তাই হল। পরদিন সোমনাথ, শ্যামল দুজনেই এসে হাজির হল। এসে এমন ভান করল যেন তাদের কেউ ভয় দেখিয়েছে। এই ভানটার প্রয়োজন ছিল। কারণ, তার পরেই ফোনে ভয় দেখানো হল মঞ্জুলাকে এবং বিশ্বানন্দকেও। এঁরা ফটো দেখে চিনে ফেলতে পারেন তাই এই সাবধানতা।’

শিবেন জিজ্ঞেস করল, ‘সোমনাথই কি কামতাপ্রসাদ?’

‘না। খুব সম্ভবত, শ্যামল। সে এখন স্বীকার করবে বলে আমার ধারণা। সে সিনেমায় অভিনয় করত, মেকআপ নিতে অভ্যস্ত ছিল। তা ছাড়া অনেকগুলো টাকা ক্যাশে হাতবদল হচ্ছে, সেটা একেবারে নিজের লোক ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে করানো যুক্তিযুক্ত নয়।’

‘তার মানে, আপনার ছবি চাইবার আসল উদ্দেশ্য ছিল সোমনাথকে জানিয়ে দেওয়া যে কামতাপ্রসাদের ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ, তাই। সে যখন মঞ্জুলা আর বিশ্বানন্দকে ফোন করে জানতে পারে যে আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেছি এবং মামা-ভাগনের সঙ্গে সজোরে ধমকে কথা বলায় তার মনে কোনো সংশয় রইল না যে আমাদের সমস্ত সন্দেহ তারই ওপরে।

‘মঞ্জুলার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হল যে খুব তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা শেষ করে আনার সময় হয়েছে। বিশ্বানন্দ আর মঞ্জুলা ভীরু মেরুদণ্ডহীন। তারা ভয় পেলে মুখ খুলবে না। কিন্তু, আরও একজন আছে যে মুখ খুলতে পারে যদি সে জানতে পারে যে তার প্রাণের বন্ধুকে খুন করেছে সোমনাথ। সে— স্বপ্না চৌধুরি। তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে পিঠে বন্দুক না ঠেকালে তাকে ভয় দেখানো কঠিন।’

সমরেশ বলল, ‘বেশ, এ পর্যন্ত দিব্যি বোঝা গেল। কিন্তু আমার আসল প্রশ্নটার জবাব এখনও পেলুম না। বীথিকাকে মারার দরকারটা কী ছিল? বেশ তো চলছিল। দিব্যি বড়োলোক রুগিদের হাপিস করে দিয়ে তাদের টাকা ঘরে তোলা হচ্ছিল। এক হতে পারে, বীথিকা অরিজিৎকে ডিভোর্স করে সোমনাথের ঘাড়ে চড়ার তালে ছিল। তাহলে অবশ্য তাকেও হাপিস করে দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, ব্যাপারটা তা নয়। বীথিকার মৃত্যুর জন্যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী হচ্ছেন তার ননদাই শ্রীবিকাশচন্দ্র ঘোষ।’

সবাই সমস্বরে বলল, ‘তার মানে?’

‘তার মানে বুঝতে হলে, আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে। এই ষড়যন্ত্রটা আদৌ শুরু হল কীভাবে, সেটা অনুমান করা দরকার। সোমনাথ ভোলানাথের আশ্রিত এবং তাঁর খিটখিটে মেজাজের জন্যে পদে পদে অপমানিত ছিল। ভোলানাথকে চিরতরে সরিয়ে দেবার ইচ্ছে নিশ্চয়ই তার অনেকদিনের। কিন্তু সে জানত যে ভোলানাথ ঘুঘু লোক, তাঁর উইলে যে কাকে কী দেওয়া আছে তা জানা দুঃসাধ্য। যখন বীথিকার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক স্থাপিত হল, তখন দেখা গেল যে এরকম একটা ষড়যন্ত্র করা সম্ভব যাতে সে তিনটে উদ্দেশ্য সফল করতে পারে— এক, ভোলানাথের স্থাবর সম্পত্তি দখল করতে পারে; দুই, তার অস্থাবর সম্পত্তি বকলমে হস্তগত করতে পারে; তিন, ভোলানাথকে সরিয়ে দিতে পারে।’

সমরেশ বলল, ‘এত ঝামেলা করার কি দরকার ছিল? মগজ ধোলাইয়ের ব্যাপার তো? ভোলানাথকে দিয়ে সব সম্পত্তি সোমনাথকে লিখিয়ে নিয়ে তাঁকে চন্দ্রবিন্দু করে দিলেই ঝামেলা মিটে যেত।’

‘না, একেবারেই মিটত না। উকিল মহাদেব রায় আর ডাক্তার বিমল দাশগুপ্তের কথাগুলো ভেবে দেখ। তাঁদের মক্কেল যে উইল করেছেন, তাতে কিন্তু তাঁদের মনে কোনো সন্দেহই জাগেনি, তুমি যেরকম বলছ সেরকম হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত। আর যদি কোনো কারণে হেপাটাইটিসের বিষ কাজ না করত এবং রুগির মৃত্যু না হত, তাহলে এ ব্যাপারে একটা খোঁজখবর শুরু হতই। সোমনাথ সেই ঝুঁকি নিতে পারত না। উকিল আর ডাক্তারদের বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ যিনি একবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, তাঁর স্বহস্তলিখিত উইল একমাত্র গ্রাহ্য হতে পারে যদি তাতে এই এঁদের সাক্ষী হিসেবে সই থাকে। তখন আর সেটাকে কোনো সন্দেহ করার প্রশ্ন ওঠে না বা সেটা চ্যালেঞ্জও করা যায় না।

‘এখন, ষড়যন্ত্রটা যখন সফল হল, বীথিকা তার প্রেমিককে মোটা টাকা সরিয়ে দিতে লাগল এবং সোমনাথের ব্যবসা বেশ ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু হল, তখন অরিজিৎ বিকাশ ঘোষকে নীলকান্তপুরে নিয়ে এলেন। বীথিকা যে টাকা সরাচ্ছে সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। বীথিকাকে এ ব্যাপারে কিছু বলার ক্ষমতা বা প্রবৃত্তি কোনোটাই তাঁর ছিল না। অথচ রুগিদের ডোনেশনের টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠেকানো দরকার। অতএব বিকাশ ঘোষের ডাক পড়ল। বিকাশ অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং অরিজিতের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই টাকা কোথায় যাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করার জন্যে তাঁর চেয়ে উপযুক্ত লোক আর কে আছে বিশেষত যেখানে কাঞ্জিলালের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা।

‘বীথিকা কিন্তু ব্যাপারটা তৎক্ষণাৎ হৃদয়ঙ্গম করল। সে পত্রপাঠ বিকাশকে তাড়িয়ে দিল এবং সোমনাথের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসল। সোমনাথের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ল। যে টাকাটা তারা দুজনে সরিয়েছে, সেটা সাদা টাকা হিসেবেই ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে। অতএব, যদি সেটা কোনো ভুয়ো কোম্পানির নামেও গিয়ে থাকে, তাহলেও পুলিশের পক্ষে ইনভেস্টিগেশন করে সোমনাথ পর্যন্ত এসে পৌঁছনো অসম্ভব নয়। আর তখন বৃহত্তর বিপদের সম্ভাবনা। সোমনাথ ভালো করেই জানে যে কোনো ষড়যন্ত্রই একেবারে নিশ্ছিদ্রভাবে সুরক্ষিত হতে পারে না। তার ওপর তার হাতে তিন তিনটে মৃত্যুর দায়।

‘তখন সে কি করতে পারত? তারা যেখানে টাকাটা সরিয়েছিল, প্রথমে সেটার সমস্ত চিহ্ন বিলোপ করা। তার সহজতম রাস্তা ছিল ডাক্তার অরিজিৎ বোসকে খুন করা। আমার বিশ্বাস এই দ্বিতীয় কর্মটি করতে গিয়ে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ, অরিজিতের সঙ্গে বীথিকার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি থাকেন আলাদা। কখন আসেন, কখন যান, কোনো হিসাব বীথিকার জানা নেই। অতএব, তাঁকে খুন করতে গেলে প্রত্যক্ষভাবে করতে হয়। সেটা ওই জায়গায় সম্ভব নয়।

‘এ ছাড়া, আর একটা সম্ভাবনা আছে যেটা আমার ধারণা সবচেয়ে প্রবল। তা হচ্ছে, বীথিকার কাজ ছিল রুগিদের মগজ ধোলাই করে বোস-দম্পতিই যে তাদের একমাত্র শুভানুধ্যায়ী এবং হোমিওপ্যাথ যে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা, এই দুটি ধারণা তাদের মনে ঢোকানো। রুগিদের কীভাবে মৃত্যু হত, সেটা হয়তো সে জানত না। আর টাকার যখন বৃষ্টি হচ্ছে, তখন কেই-বা তার খবর রাখে? এইটাই যদি ঘটনা হয়, তাহলে অরিজিৎকে খুন করতে বীথিকার অস্বীকার করাই স্বাভাবিক।

‘অতএব, বীথিকার চিহ্নও বিলোপ করার ব্যবস্থা করা হল। সেই তো এই ষড়যন্ত্রের একমাত্র সাক্ষী। সোমনাথেরও কোনো তাড়া নেই। সে জানত যতদিন সে বীথিকার সঙ্গে ভালোবাসার খেলা চালাবে ততদিন কোনো ভয় নেই। বীথিকা মুখ খুলবে না। এমনকী বীথিকা যদি তাকে কখনো তাড়িয়েও দেয়, তাহলেও হয়তো সে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবে না, কারণ সেক্ষেত্রে তারও ফেঁসে যাবার সম্ভাবনা। কিন্তু তাই বলে তো তাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। স্ত্রীয়াশ্চরিত্রং— কখন যে কী করে বসে?’

সমরেশ দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘যা বলেছ। ডাক্তার অরিজিৎ বোস নিশ্চয়ই অনেক পাগলকে সুস্থ করে তুলেছেন, কেবল নিজের ঘরের পাগলটিকে চিকিৎসা করে উঠতে পারলেন না। বীথিকার নিমফোম্যানিয়া যদি সারাতে পারতেন, তাহলে হয়তো এতগুলো বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটত না। তবে, কে জানে, হয়তো এ রোগের কোনো চিকিৎসাই নেই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *