ইজ্জত

ইজ্জত

ভাঙা ভাঙা গলায় ধীরে ধীরে ভদ্রলোক বললেন, ‘তুমিই তো বোধহয় সমরেশ, তাই না? আমাকে বোধহয় তুমি চিনতে পারলে না?’ ভদ্রলোকের জিভে কোনো জড়তা আছে, কথাগুলো জড়ানো, অস্পষ্ট।

সমরেশ ভদ্রলোককে আপাদমস্তক ভালো করে দেখল। শীর্ণদেহ, বৃদ্ধ, মাথার চুল সব সাদা, ডান হাতের একটা মোটা বেতের লাঠির ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে নিজেকে খাড়া রেখেছেন। সঙ্গে একটি ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে, সম্ভবত কাজের লোক, তাঁর বাঁ হাতটি ধরে আছে। পরনে থান আর গরদের পাঞ্জাবি— তা থেকে সেন্টের মৃদু সুবাস আসছে বেমানান ভাবে। ভদ্রলোকের মুখে ক্লিষ্ট ক্লান্তি, বোধহয় দোতলায় সিঁড়ি ভেঙে ওঠার জন্য।

এঁকে কোনোদিন দেখেছে বলে মনে করতে পারল না সমরেশ। মাথা নেড়ে বলল, ‘আজ্ঞে না, চিনতে পারলুম না। ভেতরে এসে বসুন।’

ভদ্রলোক বাঁ পা’টা টেনে টেনে ঘরের ভেতর ঢুকলেন। একটা সোফার ওপর সঙ্গীটির সাহায্যে বসতে বলতে বললেন, ‘আমি তোমার বড়দার সঙ্গে পড়তুম এক ক্লাসে, এক ইস্কুলে। কলেজেতে একসঙ্গে পড়েছি, অবশ্য আলাদা আলাদা বিষয়ে।’

বিস্মিত কণ্ঠে সমরেশ বলল, ‘আপনি আমার বড়দার সঙ্গে একসঙ্গে পড়েছেন?’

সমরেশের বিস্মিত হওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ সমরেশের বড়দা যদিও ওর চেয়ে দশ বছরের বয়েসে বড়ো, তবু এখনও প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছতে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিকেই যথেষ্ট দেরি আছে। আর এই বৃদ্ধ তো মনে হয় তাঁর চেয়েও অন্তত পঁচিশ বছরর বড়ো।

ভদ্রলোক ম্লান হাসলেন, বোধহয় সমরেশের মনের কথাটা বুঝতে পেরেই। বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়তো ওর কাছে আমার নামও শুনে থাকতে পার। আমার নাম অরবিন্দ আচার্য।’

একটা সোফায় বসতে যাচ্ছিল সমরেশ, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়াল। বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘আপনি অরবিন্দ আচার্য?’

‘হ্যাঁ, কিংবা বলতে পার তার ধ্বংসাবশেষ। তোমার বড়দা খেলত সেন্টার ফরোয়ার্ডে, আর আমি খেলতুম সেন্টার হাফ। দারুণ বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে। এখন আমাকে দেখলে তা আর বিশ্বাস হয় না, না?’

সমরেশ নীরবে মাথা নাড়তে লাগল, ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লাগবে।

এই অরবিন্দ আচার্যের শুধু নামই শোনেনি সমরেশ, এক সময় ইনি ছিলেন ওর উপাস্য হিরো। ভবানীপুরের আচার্যবাড়ির ছেলে অরবিন্দ চেহারায়, কথাবার্তায়, লেখাপড়ায়, খেলাধুলায় হিরো হবারই উপযুক্ত ছিলেন। সিল্কের পাঞ্জাবি পরে যেমন সাহিত্যের আসর জমাতে পারতেন, তেমনি ‘ভবানীপুর ইয়ংস’-এর লাল-কালো জার্সি পরে সারা মাঠে বিপক্ষ দলকে ব্যস্ত রাখতে পারতেন। সেই প্রাণচঞ্চল, ক্ষুরধার অরবিন্দ আচার্য ইনি? ধ্বংসাবশেষই বটে, ভীষণ অথচ করুণ।

সমরেশের চিন্তায় বাধা দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি শেষ তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলুম তোমার বড়দার বিয়েতে, তাই না? তখন তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছ কি? হওনি। আর আজ এতদিন বাদে তোমাকে দেখলুম। আমিও কিন্তু তোমাকে চিনতে পারতুম না, নেহাত ঠিকানাটা জানা ছিল, তাই সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললুম। এখন শোন, একটা কাজের কথা বলি। আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি, এসেছি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। একটা বিপদে পড়েছি যে, ওঁর একটু সাহায্য চাই। করবেন কিনা সেটা অবশ্য উনিই বিবেচনা করবেন।’

সমরেশ বলল, ‘নিশ্চয়ই করবে। আপনি বিপদে পড়েছেন আর সাহায্য করবে না? দাঁড়ান আমি এক্ষুনি ওকে ডেকে আনছি।’

দময়ন্তী শোবার ঘরে চুল বাঁধছিল, সমরেশ গিয়ে ওকে খবর দিয়ে ফিরে এল। অরবিন্দ আচার্যের সামনে এসে বলল, ‘আমি আপনাকে আগে অনেক বারই দেখেছি। আমাদের বাড়িতে, খেলার মাঠে, দাদার কলেজের থিয়েটারে। কিন্তু আপনার এখন এরকম…!’

সমরেশ সংকোচে কথাটা শেষ করতে পারল না। অরবিন্দ হাসলেন, বললেন, ‘আমার এরকম দশা কী করে হল, জিজ্ঞেস করছ? সেরিব্রাল থ্রমবোসিস। মহাভারত পড়নি? সত্যবানের হয়েছিল— সাবিত্রী তাকে বাঁচায়। আমায় বাঁচিয়েছিলেন ডাক্তার সুভাষ গুহ।’

‘কিন্তু মাথার চুলগুলো সব পেকে গেল কী করে?’

‘ওরকম হয়। সন্ন্যাসরোগ হয়েছিল, চেহারাটাও সন্ন্যাসী মার্কা করে দিয়ে গেল। এখন বনে গেলেই হয়। নেহাত শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তা না হলে হয়তো তাই যেতুম।’ বলতে বলতে অরবিন্দের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, কম্পিত কণ্ঠে স্পষ্ট বেদনার আভাস।

সমরেশ আর কথা বাড়াল না। দময়ন্তী এসে ঢোকা পর্যন্ত গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে দুজনেই চুপ করে বসে রইল।

নমস্কার ও প্রাথমিক পরিচয় আদান-প্রদানের পর সমরেশ বলল, ‘বলুন অরবিন্দদা, কী আপনার বিপদ!’

কিছু সময় চুপ করে রইলেন অরবিন্দ। তারপর বললেন, ‘শুনেছি, এরকম ক্ষেত্রে নাকি সমস্ত কথা বিস্তারিতভাবে বলতে হয়। কিন্তু ঘটনাটা সামান্য, তাই সংক্ষেপে বলছি। আমার কাহিনিটি শুনে হেসো না তোমরা, শুধু মনে রেখো, আমি কিন্তু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছি এ ঘটনাটি নিয়ে।

‘ভবানীপুরে আমাদের বাড়িটা তোমরা দেখেছ কিনা জানি না। শরৎ বোস রোড আর ধ্যানেশ মিত্তির রোডের মোড় থেকে একটু পশ্চিম দিকে গেলে শ্যামাচরণ গাঙ্গুলী লেন পাবে। তার তৃতীয় বাড়িটা আমাদের। মান্ধাতার আমলের বাড়ি, আমার ঠাকুরদার বাবা বানিয়েছিলেন।

আমাদের ঠিক পাশের বাড়িটার কথাও তোমাদের বলি। সেটাও আমাদের বাড়িরই প্রায় সমসাময়িক, কেবল অনেক বেশি ভাঙাচোরা। গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে ও-বাড়িতে কেউ থাকেনি। আর যেভাবেই হোক হানাবাড়ি বলে একটা বদনামও রটে গেছে। বাড়িটা নিজেই একটা ভূতের মতো প্রায় এক বিঘে জমির ওপর জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমার শোবার ঘর থেকে বাড়িটার উত্তর দিকের দেওয়ালটা চোখে পড়ে। ওদিকটা আগে ছিল অন্দরমহল। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব জানলা, আমি তো জন্ম থেকে দেখে আসছি— বন্ধ। শুনেছি, লোকে বলে মাঝে মাঝে রাত্তিরবেলা নাকি জানলাগুলোর ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যায়, গানবাজনা ভেসে আসে, তবে আমি কোনোদিন সেরকম কিছু দেখিওনি, শুনিওনি।

মাসখানেক আগে হঠাৎ একদিন দেখি, আমার ঘরের ঠিক উলটো দিকে একটা জানলা খোলা। বাইরে আলো, ঘরের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কাজেই ভেতরটা কিছু দেখবার জো নেই। অবিশ্যি তখন আমি দেখবার চেষ্টাও করিনি। ভেবেছিলুম, পুরোনো জানলা কবজা-টবজা ভেঙে গিয়ে খুলে গেছে। কিন্তু রাত্তির বেলা দেখি জানলাটা বন্ধ। তাতে আমার কেমন সন্দেহ হল। কোনো লোক এল নাকি ও-বাড়িতে?’

দময়ন্তী এখানে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার শোবার ঘর কি একতলায়?’

‘না, দোতলায়। ও-বাড়িটাও দোতলা, তারই ওপরতলার একটা জানলা খোলা ছিল।’

‘বাড়ির অন্যান্য জানলা-দরজা একটাও খোলা ছিল না?’

‘না। এই আমার চাকর পঞ্চানন বা পঞ্চা, ও বাড়ির চারদিকে কাঁটাঝোপ মাড়িয়ে দেখে এসেছে যে, অন্য কোনো জানলা বা সদর দরজা খোলা নয়।’

দময়ন্তী বলল, ‘বেশ, তারপর?’

‘তার পরদিন দেখি, আবার জানলা খোলা। আমি বেকার লোক, তার ওপর অসুস্থ। আমার সারাদিনই প্রায় ঘরের মধ্যে, বাইরের জগতের সঙ্গে সংস্রবহীন অবস্থায় কাটে। এহেন লোকের কৌতূহলটা একটু বেশি হয়। আমারও তাই। ইজিচেয়ারে বসে মাঝে মাঝেই তাকাই ওদিকে, যদি কারোর সাক্ষাৎ পাই। ভূত কখনই নয়, ভূতে আমি বিশ্বাসও করি না। তবে নতুন কোনো প্রতিবেশী হতে পারে। কিন্তু, কাকস্য পরিবেদনা। কেউ জানলায় এসে দাঁড়ায় না।’

‘আপনাদের দুটো বাড়ির মধ্যে দূরত্ব কত?’ দময়ন্তী আবার প্রশ্ন করল।

‘তা প্রায় ষাট ফুট হবে।’

‘আপনার দৃষ্টিশক্তি কীরকম? চশমা নেই?’

‘দৃষ্টিশক্তি আমার ভালোই। চশমা একটা আছে বটে, সেটা রাত্রিবেলা বই পড়বার সময় ব্যবহার করি, অন্য সময় খালি চোখেই দেখি। তবে, চোখ ভালো-খারাপ যাই হোক না কেন, ষাট ফুট দূরে একটা জানলায় একটা মানুষ এসে দাঁড়ালে, সেটা বুঝতে পারব ঠিকই। তা ছাড়া, আমি একবার একটা দূরবিনও ব্যবহার করেছিলুম। সে-কথাই বলছি পরে।

তার পরদিন আবার সেই ব্যাপার। রাত্রিবেলা জানলা বন্ধ, দিনেরবেলা খোলা। কে খোলে? পঞ্চা ইতিমধ্যে রিপোর্ট করে গেছে যে, সদর দরজা দিনেরবেলাতেও বন্ধ। কোন অসাধু লোক এসে আশ্রয় নিল কি? চোর-ছ্যাঁচোড় বা জেলপালানো কয়েদি নয় তো? খালি বাড়ি পেয়ে এসে জুটেছে!

আমার একজোড়া খুব শক্তিশালী দূরবিন আছে, কিন্তু সেটা ব্যবহার করতে পারছি না; কারণ কোনো উদ্বাস্তু পরিবার যদি এসে ওখানে আশ্রয় নিয়ে থাকে আর তাদের সঙ্গে যদি মেয়েছেলে থাকে, তাহলে তো বিপদ। ওরা যদি দেখতে পায় তো কেলেঙ্কারি করে ছাড়বে। তবু দূরবিনটা বের করে বালিশের পাশে রাখলুম। যদি কখনো সুযোগ আসে তো ব্যবহার করা যাবে।

দিন চার-পাঁচেক পরেই সুযোগ এসে গেল। সেদিন, মানে গত ষোলোই হঠাৎ দুপুরবেলা আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি এসেছিল, মনে আছে? আমি পঞ্চাকে বললুম তাড়াতাড়ি সমস্ত জানলা বন্ধ করে দিয়ে শুধু দক্ষিণের একটা জানলা অল্প একটু খুলে রাখতে। তারপর আমি দূরবিন হাতে একটা চেয়ার টেনে জানলার সামনে বসলুম। বসে চোখে দূরবিন লাগাতেই যা দেখলুম, তাতে পিলে চমকে উঠল।’

‘কী দেখলেন?’ সমরেশ উদ্বিগ্ন।

‘দেখলুম একটা লোক ওই ঘরের অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে জানলাটা টেনে বন্ধ করল। এক লহমার জন্য তার মুখ আমি দেখতে পেলুম। অতি কদাকার সে মুখ— মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল, ঘন লোমশ ভুরুর নীচে ধূর্ত কুতকুতে চোখ, থ্যাবড়া নাক, মোটা মোটা ঠোঁট আর সবমিলিয়ে একটা হিংস্র পাশবিকতা।’

‘অত দূর থেকে এক লহমায় আপনি অত সব দেখতে পেলেন?’ হাসি চেপে দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, পেলুম। কারণ দূরত্বটা তো তখন কয়েক ইঞ্চি মাত্র। আর অমন মুখ এক লহমায় দেখার পক্ষেই যথেষ্ট। তুমি ভাবছ, সব আমার অলস মস্তিষ্কের কল্পনা, না? কিন্তু সত্যি তা নয়। আমার মস্তিষ্ক যা নথিভুক্ত করেছে, তা একদম বাস্তব; কল্পনার ছিটেফোঁটাও নেই। যা হোক, আমি এটুকু স্থির নিশ্চয় হলুম যে আমার একজন প্রতিবেশী এসেছেন এবং তিনি যেমন অশরীরী নন, তেমনি খুব সুবিধের লোকও নন। তবে আমি আপন মনে আছি, তিনিও আপন মনে আছেন হয়তো। তাই আমি আর উচ্চবাচ্য করলুম না। তবু লক্ষ করলুম, সকাল আটটা থেকে নটার মধ্যে জানলা খোলে আর সন্ধে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এই খোলা-বন্ধটা হয় খুব আস্তে আস্তে এবং কাউকে দেখা যায় না জানলায়। সম্ভবত কোনো দড়ি বা আঁকড়ার সাহায্যে তা করা হয়। সেদিন হঠাৎ বৃষ্টি এসেছিল বলেই, আস্তে আস্তে করা যায়নি, প্রতিবেশীমশাইকে দৌড়ে জানলার কাছে আসতে হয়েছিল।

সাত-আটদিন এরকম চলার পর খেলাটা বন্ধ হল। যথাপূর্বং জানলা বন্ধই রইল। অমন একজন সুদর্শন প্রতিবেশীকে বাড়িতে এনে খাওয়াতে পারলুম না বলে আফশোস রয়ে গেল। তার দিন সাতেক পরেই আমার ঘরে চোর এল।’

‘কী সর্বনাশ!’ সমরেশ অস্ফুট স্বরে বলল।

‘হ্যাঁ, তবে চোর ঘরে ঢুকতে পারেনি। আমার ঘুম খুব পাতলা। অসুখের পর থেকে এরকম হয়ে গেছে। জানলায় একটা আওয়াজ হতেই ঘুম ভেঙে গেল, পঞ্চাকে ডাকলুম, বেল বাজালুম। চোরটা ধুপ করে নীচের বাগানে লাফিয়ে পড়ে চম্পট দিল।

এর চার-পাঁচদিন পরে আবার চোর এল। প্রথমবারে এসেছিল শেষ রাতে, এবার এল রাত দুটো নাগাদ। এবারেও প্রথমবারের মতোই বেচারি সফলকাম হতে পারল না।

তার দুদিন পরে আবার। এবার রাত একটা। জানলা খুলে ফেলে ভেতরে লাফিয়ে পড়তে যাবে, এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি ওই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে বোধহয় এমন চিৎকার করেছিলুম যে নীচ থেকে পদমবাহাদুর পর্যন্ত ছুটে এসেছিল। চোরটা অবশ্য তৎক্ষণাৎ জানলা টপকে পালায়, পঞ্চা আর পদম তাকে তাড়া করেও ধরতে পারেনি।’

অরবিন্দ চুপ করে রইলেন। উনি আরও কিছু বলবেন এই আশায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সমরেশ প্রশ্ন করল, ‘তারপর কী হল?’

‘তারপর আমি তোমাদের কাছে এলুম। ভাবলুম, পুলিশে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। তারা আমায় নিয়েই টানাহ্যাঁচড়া করবে। অসুস্থ লোক, মরেই যাব হয়তো। দময়ন্তীর নাম শোনা ছিল, মনে হল, আমার এই বিপদে যদি কেউ সাহায্য করতে পারে তো সে দময়ন্তী।’

দময়ন্তী বলল, ‘কিন্তু আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’

অরবিন্দ বলল, ‘তোমার কী মনে হচ্ছে জানি না, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সামনের বাড়ির যে লোকটা আড়াল থেকে আমায় লক্ষ করত, সেই হচ্ছে চোর। এবং সে একজন জেল পালানো সাংঘাতিক চোর। আমি শক্তিহীন, অসুস্থ লোক। কতদিন তাকে ঠেকাব বলো দেখি? একথা জেনেই সে আমাকে তার আক্রমণের যোগ্য পাত্র বিবেচনা করেছে। যদি তাকে বারংবার বাধা দিই, তাহলে সে হয়তো আমাকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না। এত আটঘাট বেঁধে সে যখন নেমেছে, তখন এটাই স্বাভাবিক, তাই নয় কি?

‘এখন তোমরা আমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পার, সেটাই বলছি। তোমরা একবার সামনের বাড়িটায় যাও। উত্তর দিকের তেতলায় চারটে ঘর আছে, তার পুব দিক অর্থাৎ শ্যামাচরণ গাঙ্গুলী লেনের দিক থেকে দ্বিতীয় ঘরটায় সেই লোকটা থাকত। সেখানে এখনও নিশ্চয়ই তার থাকার কিছু না কিছু চিহ্ন পড়ে আছে। দময়ন্তী তা থেকে অনায়াসে তার পরিচয় বের করতে পারবে এবং অবিলম্বে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারবে। তোমাদের খরচ-খরচা যা হবে…’

দময়ন্তী হেসে ফেলল। বলল, ‘খরচার কথা বাদ দিন। আপনি তো বললেন, সে-বাড়ির আগগোড়া বন্ধ। আমরা ঢুকব কী করে?’

‘তা আমি কী করে বলব?’ অরবিন্দ অধৈর্য কণ্ঠে বললেন, ‘তা জানলে আর তোমার কাছে আসব কেন? আমিই তো পঞ্চাকে পাঠিয়ে লোকটাকে বাড়িতে ডেকে আনতে পারতুম।’

সমরেশ বলল, ‘ঠিক, ঠিক, ওসব খুব বড়ো সমস্যা হবে না। শিবেনকে বলে সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলব।’

অরবিন্দের মুখের ছায়া কেটে গেল। বললেন, ‘বেশ, বেশ, তাহলে কতদিন বাদে টেলিফোন করব? খবরটা জানতে হবে তো। আর, শিবেন কে?’

সমরেশ বলল, ‘শিবেন আমার বাল্যবন্ধু, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের বড়ো অফিসার। এসব ব্যাপারে ও-ই আমাদের মুরুব্বি।’

অরবিন্দ আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘পুলিশ? আমার পুলিশ সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। তারা যে সংবাদটুকুর প্রয়োজন, সেটুকু ছাড়া অন্য সব ব্যাপারে নাক গলায় এবং যে দোষী তাকে বাদ দিয়ে অন্য নিরীহ লোককে থানায় পুরে রাখে। ওদের সংশ্রব যত এড়ানো যায় ততই ভালো।’

‘না, না, শিবেন সেরকম নয়। যাতে আমাদের আপত্তি বা অসুবিধে, তা ও কখনোই করবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

‘বেশ, তাহলে ভালই।’ অরবিন্দের ভাঙা গলা ব্যাঙের ডাকের মতো শোনাল : ‘আমার পাশের বাড়ির ওই চোর বাসিন্দাটিকে ধরে জেলে পোরা ছাড়া অন্য ব্যাপারে নাক না গলালেই হল। আমি ডাল দিয়ে ভাত খাই কি না, সন্ধেবেলা কী করি… ইত্যাদি আমার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ব্যাপারে যেন তদন্ত না হয়। আশা করি আমার এইটুকু অনুরোধ তোমরা রাখবে।’

অসন্তুষ্ট মুখে দময়ন্তী অরবিন্দের উদ্ধত উপদেশ শুনছিল। বলল, ‘কিন্তু যদি দেখা যায় যে চোর আপনার পরিবারেরই কেউ, তাহলে কী হবে? তদন্ত কি বন্ধ করে দেওয়া হবে?’

ক্রুদ্ধ রক্তবর্ণ চোখে দময়ন্তীর দিকে তাকালেন অরবিন্দ। হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকে গর্জন করে উঠলেন, ‘ঈশ্বর রণদেব আচার্যের পরিবারে কোনদিন চোর জন্মায়নি, জন্মাবেও না।’ বলতেই হঠাৎ তাঁর ক্রুদ্ধ চোখের ওপর একটা করুণ মিনতির অপ্রত্যাশিত ছায়া পড়ল। গলা নামিয়ে আনত চক্ষে বললেন, ‘আমার ওপর তুমি রাগ করেছ, না? আমার মাথার ঠিক নেই, কখন কী বলতে কী বলে ফেলি, তা কি ধরতে আছে? দেখ, একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা কর। ভবানীপুরের আচায্যিবাড়ির বয়স একশো আট বছর। মুকুন্দপুরে আমাদের ভদ্রাসনে এখন গভর্নমেন্ট কলেজ হয়েছে, হোস্টেল হয়েছে, তাতেও কাজে লেগেছে বাড়িটার অর্ধেক। তা, সে বাড়িটার বয়সও প্রায় শ’ দুয়েক বছর হবে। কাজেই আমাদের বাড়ির প্রতি ইট-কাঠে, আমাদের প্রতি রক্তকণায় কত ইতিহাস, কত ঘটনা, কত বিচিত্র বিবরণ যে লুকিয়ে আছে, তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে? সেইসব ঘটনার সবগুলোই যে প্রীতিকর তা নয়, তাদের অনেকগুলোই অপ্রীতিকর, হয়তো বা বর্ণনা কিংবা প্রকাশেরও অযোগ্য। তা হলেও সেই সমস্ত ঘটনা, প্রীতিকর বা অপ্রীতিকর, পতন বা উত্থান, নীচ বা মহান— সমস্ত মিলেই তো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ইতিহাস?

‘এমন কিছু লোক আছে যারা কৃমিকীটের মতো কেবল আবর্জনা খোঁজে। সাধারণ লোকের কাছে তারা যায় না, কারণ সেখানে তো স্তূপীকৃত ইতিহাস নেই— যার ভেতর থেকে টেনে বের করা যাবে উত্তেজক নোংরামো। আমাদের মতো অসাধারণ পরিবার দেখলে তারা তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই আমাদেরও সসংকোচে দূরে থাকতে হয়— বাঁচিয়ে চলতে হয় আমাদের ইতিহাস, আমাদের ইজ্জত।’

দময়ন্তী বিতৃষ্ণ চিত্তে অরবিন্দের কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল, একটা লোকের কাতর আর্ত মিনতিও যে কতদূর স্পর্ধিত আর অহংকৃত হতে পারে, এ বোধহয় স্বকর্ণে না শুনলে বিশ্বাস করা যেত না। কিন্তু এমন সব ভয়ানক অসাধারণ লোকেরা কেন যে নেহাত সাধারণ চোরের পাল্লায় পড়েন, কে জানে?

অরবিন্দ তখনও বলে চলেছেন, ‘একজন অসহায়, অথর্ব, পঙ্গু লোককে তুমি সাহায্য কি করবে না, দময়ন্তী? আমি বেশিদিন আর বাঁচব না ঠিকই, কিন্তু এমনভাবে আমি মরতে চাই না। শুধু একটু খোঁজ করে দেখ। যদি কিছু বের করা সম্ভব না হয়, তাহলেও আমি এটুকু সান্ত্বনা পাব যে আমার জন্য কিছু করা হয়েছিল। শুধু তার জন্যেই আমি তোমাকে জীবনের বাকি কটা দিন আশীর্বাদ জানাব।’

সমরেশ তার প্রাক্তন পূজনীয় হিরোকে এহেন কাকুতি-মিনতি করতে দেখে খুব নরম হয়ে পড়েছিল। বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অরবিন্দদা, দময়ন্তী নিশ্চয়ই সাহায্য করবে আপনাকে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

দময়ন্তী অপ্রসন্ন চোখে সমরেশের দিকে তাকাল বটে, কিন্তু খুব একটা রাগও করতে পারল না। বলল, ‘আচ্ছা, অরবিন্দবাবু, আমরা একবার না হয় চেষ্টা করে দেখব। এখন কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে। কতকগুলো বিষয় পরিষ্কার করা দরকার।

প্রথমত আপনি বললেন— আপনার পাশের বাড়ি আপনি জন্মাবধি বন্ধ দেখে আসছেন; অথচ তার উত্তর দিকে চারটে ঘর আছে, আপনি জানলেন কী করে? বাইরের জানলায় সার দেখে তো জানা যায় না ভেতরের ঘরের সংখ্যা কত?’

অরবিন্দ খানিকক্ষণ ঘোলাটে দৃষ্টিতে দময়ন্তীর দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর জড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি ওদিকে চারটে ঘর— সেটা সত্যি না-ও হতে পারে।’

‘আচ্ছা। দ্বিতীয়ত, আপনার বাড়ির দক্ষিণ দিকের ঘরের সংখ্যা কত?’

‘তিন। একদম ধারেরটায় আমি থাকি, মাঝেরটায় থাকে পঞ্চা ওর বুড়ি মা-কে নিয়ে, আর শেষেরটা তালাবন্ধ— আমার বোন আর ভগ্নীপতি মাঝে মাঝে এলে ও-ঘরে থাকে।’

‘আপনার ঠিক নীচে একতলায় কে থাকেন?’

‘একতলাটা শরৎ বোস রোডের হিমালয়ান টি-কনসার্নের চায়ের গুদোম। রাত্রে কেউ থাকে না। ওদের দারোয়ান পদমবাহাদুর থাপা ওই গুদোম আর আমার বাড়ি দুটোই পাহারা দেয়। দিনেরবেলা একটা বুড়ো স্টক কিপার থাকে। সে আবার মাঝে মাঝে কাজ না থাকলে ওপরে এসে আমার সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করে। তবে সে লোকটা পাজি, অত্যন্ত ইতর। আমি নেহাত নিঃসঙ্গ, তাই ওকে সহ্য করি।’

‘আচ্ছা, আপনার বাড়িতে মোট ঘর কটা?’

‘বারোটা। কেন? চোর এল কেবল আমার ঘরে, তার সঙ্গে বাড়ির বাকি কটা ঘরের কোনো সম্পর্ক আছে কি?’ কাষ্ঠ হেসে অরবিন্দ বললেন, গলায় সুস্পষ্ট বিরক্তি।

‘আছে। দেখুন, কিছু মনে করবেন না, আপনি যদি আমার সাহায্য চান, তাহলে কিন্তু আপনাকেও আমাকে সাহায্য করতে হবে। আপনি যদি আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ হন, তাহলে আমার বোধহয়, আমাদের আলাপ-আলোচনার এখানেই সমাপ্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ দময়ন্তী শান্ত ঠান্ডা গলায় বলল।

বিমর্ষ মুখে অরবিন্দ বললেন, ‘না, না, আমি তোমার সমস্ত প্রশ্নেরই জবাব দেব, শুধু, দেখ, যেন খুব ব্যক্তিগত প্রশ্ন না হয়।’

‘দেখা যাক। আচ্ছা, আপনি বললেন, আপনার বাড়িতে ঘরের সংখ্যা বারো। সে কি একতলায় ছটি আর দোতলায় ছটি?’

‘হ্যাঁ।’ অসহায়, ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন অরবিন্দ।

‘দোতলার উত্তর দিকের ঘরগুলোতে কে থাকেন?’

‘সে তিনটে ঘর একটা আলাদা ফ্ল্যাট। তা ছাড়া আমার পাশের বাড়ি থেকে তো সে ঘরগুলো দেখাও যায় না।’

‘তা না যাক। তবু আমার জানা দরকার আপনার অব্যবহিত প্রতিবেশী কে। ভাড়াটে আছে?’

‘না, ও-ফ্ল্যাটে থাকেন আমার স্ত্রী।’

‘আপনার স্ত্রী?’ স্তম্ভিত দময়ন্তী কোনো রকমে বলল। এরকম একটা সম্ভাবনার কথা ও ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেনি।

‘হ্যাঁ, আর কিছু জানবার আছে তোমার?’ অরবিন্দের ভাঙা গলায় আবার ব্যাঙ ডেকে উঠল, তবে এবার যেন বিষণ্ণ ব্যাঙ।

দময়ন্তী অল্প সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, এটাই শেষ। আপনার ঘরে কি কোনো মূল্যবান জিনিস আছে?’

অরবিন্দ বাঁ হাতটা তুলে তার পেছন দিকটা দময়ন্তীর দিকে ফিরিয়ে বললেন, ‘এই দুটো আংটির মোট দাম এখন চার হাজার টাকা, আর যে পিংক মার্বেল-টপ টেবিলে আমার ওষুধ থাকে তার দাম হাজার আড়াই হবে। এছাড়া আরও কিছু টুকিটাকি আছে বেশি দামের মধ্যে।’

সমরেশ চট করে মুখ তুলে পঞ্চার দিকে তাকাল। সদ্যোজাতশ্মশ্রু সে মুখ ভাবলেশহীন। অরবিন্দ বোধহয় সমরেশের মনের ভাব বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘পঞ্চা ছেলেটি বুদ্ধিমান। ও জানে আমার যা আছে, তার তুলনায় এগুলো কিছুই নয়, আর যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে তাকে সযত্নে লালনপালন করাই শ্রেয়। তাই না রে পঞ্চা?’

পঞ্চার মুখ পূর্ববৎ ভাবলেশহীন।

‘নে তোল আমাকে। আর কতক্ষণ এঁদের বিরক্ত করবি? আচ্ছা, দময়ন্তী, আমি তাহলে এখন চলি। দেখ, তোমরা যদি কিছু করতে পার। আর তোমার ওই বাচ্চা ঝি-টি যে আমাকে চা দিয়ে গেল, তাকে আমার ধন্যবাদ জানিও, আর বোলো যে আমার কুত্রাপি কিছু খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ।’

.

শিবেন বলল, ‘আগাগোড়া আদিখ্যেতা।’

সমরেশ মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না। দেখ, তুই যাই বল না কেন, যে চোর দুবার বাধা পেয়েও তৃতীয়বার আসে তাকে কিছুতেই সাধারণ চোর বলা চলে না।’

‘কেন চলবে না? আসলে এসব বড়োলোকি ভণ্ডামো। বাড়িতে চোর এসেছে, থানায় খবর না দিয়ে এসেছেন নাটুকেপনা করতে। গিন্নিটি তো বুঝতে পারছি ভিন্ন হেঁশেল। সেটা লুকোনোর জন্য এত মশকরা করবার দরকার কী? পুলিশের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, চোর ধরতে গিয়ে বউ ধরবে। আর তোরই বা কীরকম আক্কেল? দাদার বন্ধু শুনে গলে গেলি? ভাগিয়ে দিতে পারলি না?’

সমরেশ বলল, ‘যা বুঝিস না, তা নিয়ে বকবক করিস না। অরবিন্দ আচার্যকে তুই দেখেছিস আগে, তার টপ ফর্মে? দেখলে আর একথা বলতিস না। একটা মুমূর্ষু হাতিকে দেখলে যদি তোর দুঃখ না হয়, বুঝব তুই একটা হৃদয়হীন পাষণ্ড। কিন্তু হাতি হাতিই, মরবার সময়ও তার গজদন্তর গৌরব ক্ষুণ্ণ হয় না।’

শিবেন হাত নেড়ে বলল, ‘তোর হাতির নিকুচি করেছে। যেমন তোর মোটা বুদ্ধি, উপমা দিতে হলেও হাতি নিয়েই টানাটানি করিস। এই তোদের মতো লোকেদেরই কমিউনিস্টরা বলে স্যাঁতসেঁতে পাতি বুর্জোয়া।’

দময়ন্তী হাসতে হাসতে বলল, ‘না, না, ওর মোটেই দোষ নেই। ভদ্রলোককে তো আমারও বেশ খারাপই লেগেছিল। কিন্তু ওঁর মধ্যে এমন একটা আকর্ষণী শক্তি আছে যে, যদি কিছু অনুরোধ করেন তো কিছুতেই না বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে, আমিই রাজি হয়ে গিয়েছিলুম।’

‘বেশ করেছিলেন।’ শিবেন বলল, ‘এখন যাবেন নাকি চোর ধরতে?’

‘হ্যাঁ, যাব। শুধু চোর ধরতে নয়, আমার মনে হচ্ছে, এর মধ্যে আরও ব্যাপার আছে। অনেকগুলো জায়গায় খটকা লাগছে। যেমন ধরুন, প্রথমত, ভদ্রলোকের যে চিৎকারে একতলা থেকে দারোয়ান দৌড়ে আসে, তাতেও পাশের ফ্ল্যাট থেকে তাঁর স্ত্রী আসেন না? ধরে নিলুম, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোনোরকম সম্পর্ক নেই, সেক্ষেত্রে এই স্ত্রীটি একই বাড়িতে একটা পুরো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন কী করে? এবং কেন? আচার্যবাড়ির বিশাল সম্পত্তির ওপর কি তাঁর কোনো অধিকার আছে? অথবা, পঙ্গু স্বামীটি মরে গেলে সমস্ত সম্পত্তিটি অধিকার করবেন, এই আশায়ই কি তিনি এক বাড়িতে অবস্থান করছেন? ভদ্রলোককে তাঁর স্ত্রী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলুম না, পারলে সুবিধে হত।

‘দ্বিতীয়ত, পাশের বাড়িটি যদিও বাহ্যত তালাবন্ধ, কিন্তু অরবিন্দবাবু তার ভেতরে গেছেন এবং তার ভেতরটা ভালো করেই জানেন। হয়তো ছেলেবেলায় খেলতে গিয়ে পাঁচিল টপকে বা অন্য কোনোভাবে ভেতরে ঢুকে সব দেখেছিলেন। কিন্তু আজ সে-কথা প্রকাশ করতে তিনি কুণ্ঠিত হচ্ছে কেন?

‘তৃতীয়ত পঞ্চা ছেলেটি কে? আপাতদৃষ্টিতে সে অরবিন্দবাবুর চাকর। অথচ, ভীরু প্রকৃতি সাবধানি অরবিন্দ তার সামনেই অসংকোচে তাঁর মূল্যবান জিনিসপত্রগুলো দেখান, তাদের হদিশ দেন, এটাই বা কীরকম? স্বর্ণডিম্বপ্রসবিনী হংসকে লালনপালন করা কর্তব্য হতে পারে, কিন্তু সে হংস বেচারিকে যে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়েছিল, সে ইতিহাস কি তাঁর জানা নেই? আর লক্ষ করে দেখেছি, পঞ্চা ছেলেটি কক্ষনো হাসে না। কেন?

‘চতুর্থত, পুলিশের প্রতি তাঁর এত অ্যালার্জির কারণ কি শুধুই নিজের ভাঙা হাঁড়িটা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা? যেখানে তিনি মৃত্যুভয়ে কাতর সেখানেও, তাঁর যে ইজ্জত আর নেই, তার জন্য নিজের প্রাণরক্ষায় সমস্ত রকম সাবধানতা অবলম্বন করার অনিচ্ছাটাও কেমন যেন অস্বাভাবিক, তাই না?’

অসহায় মুখে সমরেশ বলল, ‘ভয়ানক কঠিন প্রশ্নমালা, তার ওপর সবগুলো কমপালসারি। নে রে শিবেন, টেবিল-চেয়ারগুলো ভাঙতে শুরু কর। যুগধর্মকে অস্বীকার করিসনি।’

শিবেন বলল, ‘চুপ কর। এই এতগুলো প্রশ্ন থেকে আপনি কী সন্দেহ করেন, বৌদি?’

‘কিছুই না, আবার অনেক কিছু। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ যে, চোর আসাটা এখানে কোনো একটা বড় ঘটনা নয়। তার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।

‘দেখুন, ক্যাশ টাকা আজকাল বড়ো কেউ বাড়িতে রাখে না। ভদ্রলোক থাকেন একা, চাকর আর তার বুড়ি মাকে নিয়ে। যদি স্ত্রী থাকতেন তো গয়নাপত্র কিছু থাকবার সম্ভাবনা ছিল। তাও নেই। আড়াই হাজার টাকার টেবিল আর চার হাজার টাকার আংটি, এসব চুরি করার জন্য চোর উলটোদিকের ভূতুড়ে বাড়িতে অন্ধকারে বসে বসে দিনের পর দিন গোয়েন্দাগিরি করছে, আর বাধার পর বাধা পেয়েও আবার ঘুরে আসছে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। অবিশ্যি চোরেদের মনস্ত্বত্ত্ব আমার ভালো জানা নেই, তাহলেও কেমন যেন মনে হচ্ছে, চোরের উদ্দেশ্য স্রেফ চুরি করাই নয়, অন্য কিছু।’

‘আপনার সন্দেহ, অরবিন্দের গৃহিণী স্বামীটিকে সাবাড় করবার জন্য লোক লাগিয়েছে, তাই না?’ শিবেন প্রশ্ন করল।

‘এরকম একটা সন্দেহ যে আমার হচ্ছে না, তা নয়। তবে জোর করে কিছুই বলা যায় না। যেটুকু জেনেছি, তাতেই তো সন্দেহভাজন লোক অনেকগুলো। ওঁর স্ত্রী ছাড়াও, পঞ্চানন আছে, পদম আছে, আছে একতলার বুড়ো স্টক-কিপার।’

‘তাহলে আপনি এখন কী করতে চান?’

‘চোরটার পরিচয় চাই অথবা যে লোকটা উলটো দিকের বাড়িতে বসে ছিল, তার। একথাটা আমার মনে দৃঢ়মূল হয়েছে যে অরবিন্দ আচার্য নামক আত্মাভিমানী, অকালবৃদ্ধ, নিঃসহায় লোকটি এক ঘোরতর বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সাহায্য করতে চাই। এজন্য নয় যে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে তাই, বরং তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা ঘৃণ্য জীব বলে আমার সন্দেহ হচ্ছে, সেই জন্য। আপনি আমাদের সাহায্য করবেন তো?’

‘করতেই হবে।’ শিবেন সনিশ্বাসে বলল, ‘তা আমাকে কী করতে বলেন?’

‘আপনাকে একবার ওই ভূতুড়ে বাড়িটাতে সরেজমিনে তদন্তে যেতে হবে। আচার্যিমশায় ঠিকই বলেছেন, পুবদিকের দ্বিতীয় ঘরটায় নিশ্চয়ই কোনো চিহ্ন বা সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে।’

‘বেশ, তাহলে আগামী শনিবার বিকেল নাগাদ যাওয়া যাবে। আপনারা রেডি হয়ে থাকবেন, আমি এসে নিয়ে যাব।’

দময়ন্তী শঙ্কিত মুখে বলল, ‘আমার যাওয়ার কি কোনো দরকার আছে? আপনি গেলেই তো যথেষ্ট। সঙ্গে না হয় সমরেশকেও নিয়ে যাবেন।’

ঘনঘন মাথা নাড়ল শিবেন। বলল, ‘সে হবে না। যেতে আপনাদের দুজনকেই হবে। তা ছাড়া, সেই ভূতের বাড়িতে আমি একা যাব? নৈব, নৈব চ। জানেন তো, পুলিশ হলে কী হয়, আমার আবার ভীষণ ভূতের ভয়।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে দময়ন্তী বলল, ‘সে কি আর আমারই নেই?’

দুই বন্ধু একসঙ্গে সশব্দে ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল। অপ্রস্তুত হয়ে রেগে গেল দময়ন্তী। চোখ পাকিয়ে সমরেশকে বলল, ‘চুপ কর। তোমার মতন অমন লোহার মতো শক্ত শক্ত হাত-পা হলে আমিই কি ভূতকে ভয় পেতুম নাকি? আর রাত্রিরবেলা তেমন তেমন জায়গায় পড়লে ওই পিলে চমকানো হাসি বেরিয়ে যাবে, বুঝেছ স্যার?’

সমরেশ হাসতে হাসতেই বলল, ‘সব বুঝেছি। শুধু বুঝতে পারছি না যে, এতসব রহস্যের তুমি সমাধান করবে কী করে! অরবিন্দদা তো গণ্ডি কেটে চোরের পরিচয় রহস্যটুকুর মধ্যেই তোমাকে বিচরণ করতে বলে গেছেন। তার বাইরে যাবে কি করে?’

দময়ন্তী গম্ভীর হয়ে বলল, ‘দেখা যাক। চোরকে যদি ধরতে পারি, তাহলে হয়তো তার সঙ্গে আরও অনেক রহস্যেরই সন্ধান পাওয়া যাবে।’

শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, যেমন কান টানলে মাথা আসে।’

.

শনিবার বিকেলে দুয়ার দেশে ধুতি পাঞ্জাবি শোভিত শিবেন দেখা দিল, পেছনে সুসজ্জিতা রমলা। সমরেশ খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল, ‘এ কী ? চোর ধরতে যাবি বলে এসেছিস, না বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে? বৌটাকে বগলদাবা করে আনলি কেন আবার?’

রমলা বলল, ‘এ যে রীতিমতো অপমান! অতিথিকে কোথায় সম্বর্ধনা করবেন, তা না বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে দিলেন? আপনার গিন্নি কোথায়? যাই, তার কাছে ফরিয়াদ করে আসি।’ বলে সমরেশের পাশ কাটিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকল।

শিবেন বলল, ‘লাইট হাউসে চারটে টিকিট কেটে এনেছি, বুঝলি? গোয়েন্দাগিরিতে তো বড়োজোর দশ মিনিট সময় লাগবে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে অনন্তর মোগলাই পরোটা খেয়ে সোজা লাইটহাউস। কী বলিস?’

‘এতে আর বলবার কী আছে?’ সমরেশ উজ্জ্বল মুখে বলল, ‘শুধু গোড়ায় ওই গোয়েন্দাগিরিটুকু না থাকলেই সর্বাঙ্গসুন্দর হত। ভেবেছিলুম শনিবারের বিকেলটা ভূতুড়ে বাড়ির শতাব্দীর পুরোনো ধুলো খেয়েই কাটবে, কিন্তু তার সঙ্গে মোগলাই পরোটা, আহা…’ বলতে বলতে ভাবের ঘোরে উঠে গিয়ে রেকর্ড প্লেয়ারে মুনাব্বর হোসেন খাঁ-র একটা বৃন্দাবনী সারং বসিয়ে দিল।

একটু পরেই দময়ন্তী আর রমলা বসবার ঘরে এসে ঢুকল। দময়ন্তীর প্রসাধন শেষ। রমলা আসাতে যে ও খুব পুলকিত হয়েছে, সেটা ওর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কর্তব্যবোধ জিনিসটা এমনই যে খুব সযত্ন রক্ষিত বাগানেও অবধারিত আগাছার মতো সেটা মাথা তুলে দাঁড়ায়। তারই তাড়নায় দময়ন্তী বলল, তোমার খাঁ সাহেবকে একটু থামাও বাপু। শিবেনবাবুর সঙ্গে একটা জরুরি কথা সেরে নিই, তারপর বেরোব।’

শিবেন বলল, ‘আহা, খাঁ সাহেব চলুক না, তার সঙ্গে আপনার জরুরি কথাটাও চলুক।’

দময়ন্তী বলল, ‘আচ্ছা বেশ। মানে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমরা যে ইনভেস্টিগেশনে যাচ্ছি, সেটা হবে কীভাবে? মানে শ্যামাচরণ গাঙ্গুলী লেনের বাড়িটায় যেসব সূত্রের সন্ধানে যাচ্ছি, তার জন্য তো বাড়িটার ভেতরে ঢোকা দরকার। সেটা হবে কী করে? আপনি যে পোশাকে এসেছেন, তাতে তো পাঁচিল টপকানো সম্ভব নয়।’

শিবেন বলল, ‘পাঁচিল টপকানোর কোনো প্রয়োজনই হবে না। ভেবেছেন কী? আমি কি এতদিন চুপ করে বসে ছিলুম? এই দেখুন, সিংহদরজার চাবি আমার পকেটে।’ বলে পকেট থেকে একটা বোম্বাই সাইজের চাবি বের করে দেখাল।

সমরেশ বলল, ‘বাঃ, বাঃ! ভালো দিয়েছিস। কোত্থেকে পেলি চাবিটা?’

‘খোদ মালিকের কাছ থেকে, আবার কোত্থেকে! পুলিশের অসাধ্য কি কোনো কাজ আছে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল বাড়িটার বর্তমান মালিক চম্পালাল হীরালাল নামে একজন মাড়োয়ারি ভদ্রলোক। বছর খানেক হল বাড়িটা কিনেছেন। তাঁর কাছ থেকেই আনা গেল।

এই চম্পালাল হীরালাল কিন্তু মোটেই হোঁতকা মোটা, কপালে লাল সিঁদুরের ফোঁটা কাটা মাড়োয়ারি নন, রীতিমতো আলোকপ্রাপ্ত, আগাগোড়া সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়া আধুনিক মাড়োয়ারি। পার্ক স্ট্রিটে এঁর অফিস, তাতে আবার সুন্দরী বিড়ালাক্ষী রিসেপশনিস্ট। ইনি পরেন ফ্লেয়ার্স, যান ক্যালকাটা ক্লাবে আর অতিথি এলে, বিশেষত যদি পুলিশ হয়, তো অফার করেন ‘কিং অব কিংস।’

‘কীসের ব্যবসা ভদ্রলোকের?’ সমরেশ জিজ্ঞেস করল।

‘অনেক কিছুর।’ কেমিক্যালস, কাগজ, কোল্ড স্টোরেজ ইত্যাদি। ইদানীং নেমেছেন বাংলা সিনেমা প্রযোজনায়। কিছুদিন আগে যে ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো’ বলে সিনেমা এসেছিল, ইনি ছিলেন তার প্রযোজক।’

দময়ন্তী বলল, ‘তাই নাকি? রমু, তুই তো বাংলা সিনেমার এনসাইক্লোপিডিয়া। ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো’ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত কর।’

রমলা বলল, ‘আমি আবার কী বলব! শিবেনকেই জিজ্ঞেস কর না।’

শিবেন স্তম্ভিত। বলল, ‘আমি! আমি কী বলব?’

‘কেন?’ রমলা কটকট করে বলল, ‘মনে নেই তোমার? সেই যে গত বছর তোমার জন্মদিনে গিয়েছিলুম? রাত্রে ফিরে এসে সে কী কাতরানি! বিছানায় শুয়ে সে কী ছটফটানি! চোখে দেখা যায় না।’

দময়ন্তী শঙ্কিত হয়ে বলল, ‘সে কী রে! কী হয়েছিল?’

‘প্রেমজ্বর! সংস্কৃতে পড়িসনি, সে-যুগে নায়করা সব নায়িকাদের দেখে কেউ উন্মাদ হয়ে হাত পা ছুড়তেন, কেউ ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়তেন, কেউ কেউ আবার মরেও যেতেন? ওই সব স্বেদ, স্তম্ভ, মূর্ছার ব্যাপার আর কী! ওঁর তাই হয়েছিল। এমনিতে তো আমার পাশে শুলেই ঘঁৎ ঘঁৎ করে নাক ডাকে, সেদিন সারারাত ওঁর দীর্ঘশ্বাসের ঠেলায় ঘুমোতে পারি নে! এতদিন ভাবতুম সংস্কৃত কাব্যে যত সব বাড়াবাড়ির ব্যাখ্যান, সেদিন বুঝলুম মোটেই তা নয়।’

সমরেশ পুলকিত মুখে শিবেনের দিকে ঘুরে বসল। বলল, ‘ব্যাপারটা কী বন্ধুবর? একটু খুলে বলতে হচ্ছে।’

শিবেন মিটিমিটি হাসছিল। বল, ‘সেই বইটাই ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো’ নাকি? আমি তো নামটা ভুলেই গিয়েছিলুম। অতি ওঁচা বই। তবে হ্যাঁ, মনে আছে একজন সহনায়িকা ছিল বটে! একেবারে চরিত্র- ধ্বংসকারী চেহারা। যাকে বলে, শ্রোণীভারাদলস গমনা স্তোকনম্রা…’

দময়ন্তী বলল, ‘থাক থাক। নায়িকা কে ছিল?’

‘ভুলে গেছি। কে ছিল গো?’

দময়ন্তী বলল, ‘নায়িকা কে ছিল ভুলে গেছেন, অথচ সহনায়িকাকে মনে আছে? আশ্চর্য তো?’

‘থাকবে না? বললুম যে চরিত্র-ধ্বংসকারী…’

‘তা সেই মহিলার নামটা মনে আছে?’

‘না, তাও ভুলে গেছি।’

‘হুঁ, নামটা জোগাড় করতে পারেন?’ দময়ন্তীর গলাটা গম্ভীর শোনাল।

‘পারি। আপনি কি একেবারে গোড়া থেকেই ”সার সে লা ফম” শুরু করলেন নাকি? সে যাক গে, এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা জানিয়ে রাখি। চম্পালাল হীরালালের কাছ থেকে চাবি জোগাড় করতে আমাকে একটা মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে। তদন্ত করতে যাচ্ছি বললে কীরকম তার ভাব হবে জানি নে তো, সেই জন্যে বলেছি যে আমার এক প্রযোজক বন্ধুকে নিয়ে ওই বাড়িটা দেখাতে চাই, তিনি পুরোনো আগাছা জঙ্গলে ভরা অথচ শহরের মধ্যে একটা বাড়ি খুঁজছেন লোকেশন শ্যুটিংয়ের জন্য। হীরালাল শুনে উৎসাহিত হয়ে চাবিটা দিয়ে দিয়েছেন। তা আমরা এখন যে যাচ্ছি, যদি দৈবাৎ ওখানে হীরালালের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তো সমরেশ হবে সেই প্রযোজক। তুই তাপ্পি দিয়ে ম্যানেজ করত পারবি তো?’

সমরেশ তেজের সঙ্গে বলল, ‘আলবত।’

.

শিবেনের সাদা ফিয়াট ধ্যানেশ মিত্তির রোড থেকে বাঁ দিকে ঘুরে শ্যামাচরণ গাঙ্গুলী লেনে ঢুকল। গাড়ির গতি কমই ছিল। আরও কমিয়ে শিবেন ট্যুরিস্ট গাইডের মতো ঘোষণা করল : ‘এই যে আমাদের ডান দিকে দ্বিতল গৃহটি দেখা যাচ্ছে, সেটিই হচ্ছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ আচার্য-ভবন, বর্তমানে শ্রীল শ্রীযুক্ত অরবিন্দ আচার্য্যের বাসভূমি। …উঃ, তোমাদের বকবকানি একটু থামাবে?’

দময়ন্তী আর রমলা পেছনের সিটে বসে বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল, শিবেনের কথা আর ধমক শুনে ঘাড় ফিরিয়ে ডান দিকে তাকাল।

ফুটপাথের শেষে ঢালাই লোহার ফুট আষ্টেক উঁচু রেলিং থেকে প্রায় পঁচিশ ফুট দূরে আচার্য-ভবন। রেলিংয়ের ভেতর দিয়ে বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়, কারণ চারদিকে যদিও যথেষ্ট জমি, কিন্তু কোথাও কোনো গাছ বা হেজ কিচ্ছু নেই। কেবল অযত্নরক্ষিত রুক্ষ মাঠ আর তার ওপর গাদা করা ভাঙা চায়ের পেটি কোথাও, কোথাও বা ইট-পাটকেল। এসব সত্ত্বেও বাড়িটা কিন্তু মনকে নাড়া দেয়। তার বর্তমান মালিকের মতোই— এক কালে রাজসিক বাড়িটা এখন অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অকরুণ প্রকৃতির খুনি আঙুলের থেকে নিজেকে বাঁচাবার নীরব লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়িটার ফসাড কলোনিয়াল ঢঙের। মাটি থেকে দোতলার ছাদ পর্যন্ত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড থাম আর খিলেন করা রঙিন কাচ বসানো বিশাল বিশাল দরজা-জানলা নিয়ে তার অতীত আভিজাত্যের আর ঐশ্বর্যের সাক্ষ্য বহন করে হাস্যকর অহংকারে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। গেট বন্ধ, কিন্তু তালা দেওয়া নেই। কোনো লোকজনের কোথাও চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না।

শিবেনের গাড়ি আরও দক্ষিণে এগিয়ে যে বাড়িটার সামনে দাঁড়াল সেটাও প্রায় তার প্রতিবেশীর মতোই প্রাচীন, তেমনি অযত্নরক্ষিত, তেমনি বিশাল, কেবল চারপাশের জমিটা আরও বেশি জঙ্গলাকীর্ণ আর তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো গাছ। তফাত আরো একটা আছে। আচার্য ভবনের মতো এর সামনে কোনো থাম-টাম নেই, একেবারে চাঁচাছোলা ওপরে নীচে দুসার রং ওঠা জানলার সারি কেবল। সে জন্যই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, সমস্ত বাড়িটারই কেমন যেন বিষণ্ণ দম আটকানো ভাব।

সমরেশ বলল, ‘এই তোর জহরলাল পান্নালালের বাড়ি? বাপরে, এ যে আগাপাশতলা হানাবাড়ি রে!’

শিবেন বলল, ‘জহরলাল পান্নালাল নয়, চম্পালাল হীরালাল। আর হানাবাড়ি নয় তো কী? চারদিকে তাকিয়ে দেখ, এ-রাস্তায় প্রায় সব কটি বাড়িই তো অমনি— একেকটা মিউজিয়াম পিস। তার মধ্যে ইনি আবার একেবারে খাতায় নাম লেখানো হানাবাড়ি।’

রমলা শঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ‘ওর মধ্যে আমাদের যেতে হবে?’

মাথা নেড়ে শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, যেতে হবে। কারণ অরবিন্দ আচার্য যৌবনে ফুটবল খেলতেন আর কাব্যি করে কথা বলতে পারতেন।’ বলতে বলতে শিবেন ডান ডিকে গাড়ি ঘোরাল। সমরেশ নির্বিকার, কথাটা গায়েই মাখল না।

ফুটপাথের ধারে দাঁত বের করা ইটের দেওয়ালের মাঝখানে প্রবেশপথ। দুপাশে প্রকাণ্ড দুটো ভগ্নপ্রায় থাম, তাদের গায়ে নানা রকমের গাছ অপ্রতিহত ভাবে বংশবৃদ্ধি করছে। ফটক-টটক কিচ্ছু নেই। শিবেনের গাড়ি সেই দরজাহীন সিংহদরজার মধ্য দিয়ে ভেতরে ঢুকে চোরকাঁটায় ঢাকা মাঠের ওপর দাঁড়াল।

বাড়িটার চারদিকের জমিটা অপরিষ্কার হলেও মূল দরজার সামনেটা বেশ পরিচ্ছন্ন। চৌকো পাথর বসানো চত্বরটা যেন মাত্র কিছুক্ষণ আগেই কেউ পরিষ্কার করেছে।

দময়ন্তী ভুরু কুঁচকে চারদিকে তাকাল। স্বগতোক্তি করল, ‘মনে হচ্ছে, চম্পালাল হীরালাল বাড়িটা বাসোপযোগী করতে শুরু করে দিয়েছেন।’ বলে গাড়ি থেকে নেমে সাবধানে মাঠের ওপর দাঁড়াল।

সূর্য অনেকক্ষণই মধ্যগগন ছেড়ে পশ্চিমে পা বাড়িয়েছেন। বাড়িটার ছায়া দীর্ঘ হয়ে সামনের ফুটপাথের দিকে এগোচ্ছে। শিবেন সকলকে নিয়ে সেই ছায়ায় এসে দাঁড়াল।

পাড়াটা অসম্ভব নির্জন। অনেক দূরে শরৎ বোস রোডে ডবলডেকার বাসের শব্দ মাঝে মাঝে শোনা যায় বটে, কিন্তু মনে হয় সময় যেন এখানে ঊনবিংশ শতাব্দী পার হয়ে আর অগ্রসর হত পারেনি। একই জায়গায় থেকে থেকে কেমন স্যাঁৎসেঁতে হয়ে গেছে, পচন ধরেছে ভেতরে— একটু চেষ্টা করলেই তার দুর্গন্ধও যেন পাওয়া যায়। এই বিকেলবেলাতেই ছমছম করছে হাওয়া, আর পাঁচটা মড়িঘরের মতোই।

চারদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে চাবি বের করল শিবেন। বলল, ‘দেখি, তালা খোলে কিনা এই চাবিতে।’

দময়ন্তী বলল, ‘ভয় নেই, ঠিক খুলবে।’

দরজা থেকে কিছুটা দূরে চত্বরের ওপরে তিনজন দাঁড়িয়ে পড়ল, শিবেন এগিয়ে গিয়ে লকের ফুটোয় চাবি গলাতে ঝুঁকে পড়ল সামনে। কিন্তু লকে চাবি লাগাতে পারল না। ওর হাতটা যতই দরজার দিকে এগোতে লাগল, দরজার পাল্লাটা নিঃশব্দে ততই পিছিয়ে যেতে লাগল। এবং সেই খোলা পাল্লার ভেতর ঝুঁকে থাকা শিবেনের চোখে পড়ল একজোড়া লোমশ জুতোবিহীন পা।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াল শিবেন। দরজার ফাঁকে একটি মানুষ— অবশ্য যদি তাকে মানুষ বলা যায়! বেঁটে, কিন্তু অসম্ভব পেশিবহুল চওড়া শরীর, মাংসল মুখ, মাথায় শুয়োরের কুঁচির মতো খোঁচা খোঁচা চুল আর পরনে একটি খাকি হাফপ্যান্ট আর বটলগ্রিন রঙের হাতকাটা গেঞ্জি। মোটা মোটা ঠোঁট ফাঁক করে লোকটা দন্তবিকাশ করল— সেটা হাসি না দাঁত খিঁচানো ঠিক বোঝা গেল না। তবে তার এফেক্টটা হল ভয়ঙ্কর, আনন্দজনক কোনোমতেই নয়।

শিবেন সহজাত প্রবৃত্তিতে আক্রমণ আশঙ্কা করে একলাফে পিছিয়ে এসে দৃঢ়বদ্ধ মুষ্টিতে দাঁড়াল, ওর গলার শিরা ফুলে উঠেছে, দপদপ করছে উত্তেজনায়।

এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার আকস্মিকতায় পেছনের তিনজনের অবস্থা খুব উল্লসিত হবার মতো কিছু নয়। দময়ন্তী গলার মধ্যে সজোরে নিশ্বাস টানার শব্দ করে বিদ্যুৎবেগে সমরেশের প্রকাণ্ড পিঠের আড়ালে চলে গেছে আর রমলা সমরেশের একটা হাত জড়িয়ে ধরে ক্রমাগত ‘ভূ…ভূ…ভূ…’ করে চলেছে, ‘ত’ টা কখন আসবে তার ঠিক নেই। এ অবস্থায় সমরেশ অবশ্য প্রায় কদমতলায় কেষ্টঠাকুরটির মতোই শোভমান হয়েছে, কিন্তু রাসলীলার মধ্যিখানে হঠাৎ নন্দ ঘোষকে সদলবলে সেদিক আসতে দেখলে কেষ্ট ঠাকুরের যেমন মুখভঙ্গি হত, বিস্ফারিত চোখে সমরেশের মুখেও তেমনি বিস্ময় আর আতঙ্ক।

লোকটি বলল, ‘রাম, রাম।’

ভূতের মুখে রাম নাম শুনে রমলা সমরেশের হাত ছেড়ে ‘ভূ…ভূ…ভূ…’ ছেড়ে ‘তু…তু…তু…’ করতে আরম্ভ করল। ওর অবশ্য করণীয় ছিল ‘তুম কোন হ্যায়’ জাতীয় কোনো প্রশ্ন, কিন্তু বুকের ধড়ফড়ানির ঠ্যালায় বক্তব্যটা গুছিয়ে রাখা যাচ্ছিল না।

প্রশ্নটা কমপ্লিট করল শিবেন। প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কাটা কেটে যাওয়াতে ও এখন ক্রুদ্ধ।

লোকটা ভোজপুরি বাংলায় বলল, ‘আমার নাম নাগেশ্বর সিং। হীরালালবাবু আমাকে ভেজিয়ে দিয়েছেন এখানে আপনাদের দেখভাল করবার জন্য। আপনারা ভেতরে এসে বসুন, আমি চা বানিয়ে ফেলেছি, এক্ষুনি লাগিয়ে দেব।’ বলে বিনীত ভঙ্গিতে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল।

ততক্ষণে সমরেশের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে দময়ন্তী। এবার সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হীরালালবাবু কি আসছেন?’

‘আসতে পারেন। কোনো ঠিক নেই।’

‘তুমি হীরালালবাবুর কাছে কী কাজ কর?’

‘আমি ওঁর দারোয়ান। আর্মি থেকে ডিসচার্জ হয়ে ওঁর কাছে আছি। এ-বাড়িটা মেরামত হয়ে ঠিকঠাক হলে আমি এ-বাড়ির দারোয়ান হয়ে আসব, এরকম ঠিক আছে।’

বাড়ির বাইরেটা যেমন সাদামাঠা, ভেতরটা কিন্তু সেরকম নয়। দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথমে একটা চওড়া প্যাসেজ, তার দুপাশে দুটো মস্ত বড়ো ঘর। ঘর দুটো তালাবন্ধ, কিন্তু কাচের দরজার ভেতর দিয়ে দেখা যায় তাদের দেওয়ালে নানা জটিল কারুকার্য।

চওড়া প্যাসেজটা গিয়ে শেষ হয়েছে বাড়ির ভেতরে একটা প্রশস্ত উঠোনে। শ্বেতপাথরে বাঁধানো উঠোনটা ঘিরে তিনদিকে বাড়িটার চওড়া বারান্দা, ওপরে সবুজ রং করা কাঠের ঝিলিমিলি আর নীচে কারুকার্য-করা ঢালাই লোহার রেলিং। বারান্দার গায়ে সার সার ঘর, সব কটাই তালাবন্ধ। কেবল পশ্চিম দিকে প্রায় বারো ফুট উঁচু পাঁচিল, তার মাঝখানে একটা চওড়া দরজা।

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ায়, পাঁচিলের ছায়া ভরে ফেলেছে উঠোনটা। তার মধ্যে একটা বেতের টেবিলের চারদিকে গোটা ছয়েক চেয়ার পাতা। নাগেশ্বর সিং তার অতিথিদের এনে বসাল সেখানে। বলল, ‘আগে চা খেয়ে নিন, তারপর ঘুরে ফিরে দেখবেন।’ বলে উত্তর দিকের বারান্দায় এককোণে গিয়ে উবু হয়ে বসল। রেলিং-এর ফাঁকে সেখানে একটা জনতা স্টোভ, কিছু অ্যালুমিনিয়ামের আর কাচের বাসনপত্র আর একটা গুটোনো বিছানা দেখা গেল।

রমলা গুটিশুটি হয়ে একটা চেয়ারে বসে বলল, ‘কী দরকার বাপু চা খাবার? আমার একটুও ভালো লাগছে না। এই দময়ন্তী, চল চলে যাই।’

দময়ন্তী বলল, ‘দাঁড়া না, যাবি ‘খন। ভালো তো আমারও লাগছে না। কিন্তু কয়েকটা জিনিস জেনে যাওয়া দরকার মনে হচ্ছে।’

রমলা বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চটপট সেরে নে সেগুলো। তারপর চল কেটে পড়ি।’

দময়ন্তী তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে একবার চারিদিক তাকাল, তারপর উচ্চকণ্ঠে বলল, ‘নাগেশ্বর! আমরা আসবার আগে কি তুমি সারা বাড়ি পরিষ্কার করেছ নাকি?’

বারান্দার কোণ থেকে উত্তর এল, ‘জি হাঁ। পরিষ্কার তো মাঝে মাঝেই করি। হীরালালবাবু মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসেন, তখন পরিষ্কার করতেই হয়।’

রমলা প্রশ্ন করল, ‘বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসেন কেন?’

‘খানাপিনা হয়, গানবাজনা হয়।’

সমরেশ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘হুঁঃ! বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসেন কেন? কোন আক্কেলে এরকম একটা প্রশ্ন করলে? বিয়ে তো কম দিন হয়নি, এখনও এরকম একটা অপাপবিদ্ধ ভঙ্গি করলে চলবে কেন?’

প্রত্যুত্তরে রমলা সমরশেকে একটা ভেংচি কেটে আবার বিমর্ষ মুখে চুপ করে বসে রইল।

‘তুমি কি সব ঘরই পরিষ্কার কর?’ দময়ন্তী আবার প্রশ্ন করল।

একটু নীরবতা, তারপর উত্তর এল, ‘জি হাঁ। সারা বাড়িই করতে হয়। কার কখন কোন ঘরের দরকার হয়, বলা তো যায় না।’

রমলা নিম্নকণ্ঠে পুনরায় যোগ দিল, ‘থাকে কী করে ঘরের মধ্যে? বাইরের দিকের জানলাগুলো তো কোনোদিন খোলা হয় বলে মনে হয় না।’

শিবেন বলল, ‘অনাবশ্যক প্রশ্ন। এদিকের দরজার ওপরে দ্যাখো, প্রকাণ্ড স্কাইলাইট। সেটি খোলা থাকলে ঘরের মধ্যে হাওয়া চলাচলের কোনো অভাব হয় না। তা ছাড়া দরজার তলায় ফিকসড ল্যুভর লাগানো, কাজেই ঘরের হাওয়া কোনো সময়েই দূষিত হয়ে উঠতে পারে না।’

দময়ন্তী বলল, ‘কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছেন? আমাদের বাড়ির ভেতরে কোন সূত্র খুঁজে দেখতে যাওয়াটা সম্পূর্ণ বরবাদ হয়ে গেল। কিছুই পাওয়া যাবে না।’

শিবেন বলল, ‘হুঁ, তাইতো মনে হচ্ছে। দাঁড়ান, আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে, সেটা চেক করে নি। আচ্ছা নাগেশ্বর, গত মাসে তুমি বা তোমার ভাই-বেরাদর কেউ কি ওপরের ওই ঘরটায় কিছুদিন ধরে একনাগাড়ে ছিলে?’

বারান্দার কোণে বাসনপত্র নাড়াচাড়া করার ঠংঠঙানি বন্ধ হয়ে গেল। দীর্ঘ নীরবতার পর দ্বিধাজড়িত ছোট্ট উত্তর এল, ‘না, হুজুর।’

চারজনে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। দময়ন্তী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘নাগেশ্বর, তোমার জল ফুটতে তো দেরি আছে, আমরা ততক্ষণ বাড়ির বাইরেটা একবার ঘুরে দেখে আসি!’

নাগেশ্বর বলল, ‘পাঁচ মিনিট দেরি করুন। জল এক্ষুনি ফুটে যাবে। আমি সঙ্গে না থাকলে, যদি কোনো বিপদ-আপদ হয় তো বাবু আমাকে শেষ করে ফেলবেন।’

রমলা জিজ্ঞেস করল, ‘বিপদ-আপদ? কী বিপদ-আপদ, নাগেশ্বর?’

‘চারদিকে ঝোপঝাড়, সাপউপ থাকতে পারে! তা ছাড়া, জানেন তো, এ বাড়িটার নানা বদনাম।’

‘কোনো চিন্তা নেই তোমার, আমরা খুব সাবধানে থাকব।’ বলে দময়ন্তী রওনা দিল। ওর পেছনে বিমর্ষ মুখে রমলা, তারপর বাকি দুজন।

.

বাড়িটার চারদিকে একটা চক্কর মেরে ওরা এসে উত্তর দিকের দেওয়ালের নীচে দাঁড়াল। ওদের সামনে প্রায় তিরিশ ফুট চওড়া বড়ো বড়ো ঘাস আর কাঁটাঝোপে ঢাকা জমির পর আট ফুট উঁচু পাঁচিল আচার্য-বাড়ির সীমানা নির্দেশ করছে। পাঁচিল বরাবর কতগুলো রঙ্গন, কামিনী আর করবী ফুলের গাছ থাকায় পাঁচিলটা প্রায় চোখেই পড়ে না।

দময়ন্তী নীরবে শিবেনকে ওর সামনের জমিটা দেখাল। ঘাসের মধ্যে অস্পষ্ট সরু একটা পায়ে চলার পথ, দুটো ঝুপসি রঙ্গন গাছের তলা থেকে বেরিয়ে ঘুরে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেছে।

শিবেন পথটা ভালো করে নিরীক্ষণ করে বলল, ‘হুঁ, মনে হচ্ছে, ওখানে যেন একটা দরজা আছে। ওই রঙ্গন গাছদুটোর আড়ালে ঢাকা পড়েছে।’

দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, এবং আরও মনে হচ্ছে, পথটায় লোক চলাচল থাকলেও খুব বেশি ব্যবহৃত হয় না বা সম্প্রতি হতে আরম্ভ করেছে। অর্থাৎ এই দুই বাড়ির মধ্যে যাতায়াত আছে। কবে থেকে?’

শিবেন বলল, ‘হীরালাল বাড়িটা কিনেছেন বছরখানেক হল। এমন তো হতে পারে যে, তার আগে বাড়িটা যখন পরিত্যক্ত ছিল, তখন হয়তো কেউ আসত।’

‘তা হতে পারে।’ দময়ন্তী বলল, ‘তবে পথটা এখনও ব্যবহার হয়। যাকগে, চলুন, দরজাটা দেখ আসি।’

‘নীরবে ওরা পাঁচিলটার দিকে এগোল। রঙ্গন গাছদুটোর চার-পাঁচ গজের মধ্যে আসতেই হঠাৎ ঘটাং করে একটা লোহার দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল এবং তারপরেই একটা হুড়কো লাগানোর আওয়াজ।

শিবেন দ্বিরুক্তি না করে একলাফে এগিয়ে গিয়ে মাথা নীচু করে গাছ-দুটোর পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাকি কজন দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল।

গাছ-দুটোর ডালপালার মধ্য দিয়ে একটা শুঁড়িপথের মতো, মাথা খাড়া করে চলা যায় না। পথের শেষে পলেস্তারা বিহীন পাঁচিলের গায়ে একটা লাল রঙের লোহার ছোটো দরজা। এদিকটায় কোনো হুড়কো লাগানোর ব্যবস্থা নেই। দরজাটা বহু পুরোনো, কিন্তু রংটা সাম্প্রতিক।

শিবেন কোমরে দু-হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখেশুনে বলল, ‘যা দেখলেন আর যা শুনলেন, তাতে কী বুঝলেন বৌদি?’

দময়ন্তী হেসে বলল, ‘আর যা শুঁকলুম, তার কথা জিজ্ঞেস করবেন না?’

সমরেশ বলল, ‘ঠিক, ঠিক! একটা খুব মৃদু সুগন্ধ। পাচ্ছিস না তুই?’

এক বুক নিশ্বাস টেনে শিবেন বলল, ‘হুঁ পাচ্ছি। কীসের গন্ধ?’

দময়ন্তী বলল, ‘ল্যাভেন্ডার। ও কথা থাক, কীসের গন্ধ তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ও আমাদের লাইন। এখন বলুন, কী বুঝলেন।’

শিবেন বলল, ‘চলুন বাড়ির ভেতরে যাওয়া যাক। তারপরে আলোচনা করা যাবে।’

সমরেশ বলল, ‘একজন মহিলা আসছিলেন, আমাদের দেখে পালালেন। এটুকু ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, তিনি কার কাছে আসছিলেন? নাগেশ্বরের কাছে? ল্যাভেন্ডার মেখে নাগেশ্বরের কাছে? ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি নয়?’

‘মোটেই না’, শিবেন বলল, ‘আজকাল ফুটপাথে সেন্ট বিক্রি হয়। এমন কিছু দাম নয়। পদমবাহাদুরের বৌ হয়তো আসছিল একটু চিনি নিতে।’

দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘তাহলে আমাদের দেখে পালাবে কেন? দ্বিতীয়ত, সেন্টটা ফুটপাতের সস্তা সেন্ট নয়— অত্যন্ত দামি। আমার কথায় আস্থা রাখতে পারেন, কারণ বললুম যে ওটা আমাদের লাইন।’

শিবেন বলল, ‘বেশ, তা না হয় রাখলুম। এখন ভদ্রমহিলা কে বলে আপনার মনে হয়?’

‘পদমবাহাদুরের বৌ হতেও পারে, সে হয়তো মিসেস আচার্যর সেন্ট গোপনে মেখে থাকে। মিসেস আচার্য হতে পারেন, অন্য কোনো মহিলাও হতে পারেন। সেটা ও-বাড়িতে ঢুকতে না পারলে বোধহয় সঠিক জানা যাবে না।’

শিবেন বলল, সে আশার গুড়ে তো বালি। যাক, চা খাওয়া তাড়াতাড়ি সারুন, তারপর চলুন যাওয়া যাক। ওপরের ঘরগুলো যখন দেখলেনই না, তখন খামোখা এখানে সময় নষ্ট করে লাভ কী? অরবিন্দ আচার্যের চোর ধনে-পুত্রে লক্ষীলাভ করুক আর নরকে যাক, আমরা আর তা নিয়ে মাথা ঘামাই কেন? তার চেয়ে লাইটহাউসের সিনেমাটা অনেক জরুরি।’

সমরেশ চায়ের কাপে প্রকাণ্ড একটা চুমুক লাগিয়ে বলল, ‘ঠিক, ঠিক, তবে আমার একটা প্রশ্নের জবাব চাই। তুমি কি মনে কর যে, নাগেশ্বরই অরবিন্দদার ওপরে নজর রেখেছিল? আর আজ ও-বাড়ি থেকে এ-বাড়িতে একজনের গমনাগমনের যে চিহ্ন দেখতে পেলুম, তার সঙ্গে ওই নজর রাখার কি কোনো যোগসূত্র আছে?’

শিবেন বলল, ‘বাঃ, বাঃ।’ ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারের মুখে একেবারে অপরাধবিজ্ঞানীর ভায়রাভাইয়ের মতো কথাবার্তা শুনছি যে! ব্যাপারটা কী?’

সমরেশ দাঁত খিঁচিয়ে কী যেন একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওর কথায় বাধা পড়ল। সদর দরজার কাছে একটা বিনীত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এই যে, আপনারা এসে গেছেন? আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমার একটু দেরি হয়ে গেল।’

সবাই একসঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে বক্তার দিকে তাকাল। তাঁর মুখটা প্রথমে দেখা গেল না, কারণ তাঁর পেছনে প্রকাণ্ড দরজাটার বাইরে পৃথিবী সূর্যাস্তের আভায় লাল হয়ে রয়েছে আর সেই রক্তাভ পশ্চাদপটে তাঁকে দেখাচ্ছে একটা দীর্ঘাকৃতি কালো ছায়ার মতো।

রমলা বিড়বিড় করে বলল, ‘একদিনে একটা মানুষ কত সইতে পারে?’

ভদ্রলোক যখন প্যাসেজ পার হয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন, তখন তাঁকে স্পষ্ট দেখা গেল। দীর্ঘদেহ, গৌরকান্তি, চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, পরনে সাদা চকচকে কোনো অত্যন্ত দামি কাপড়ের বেলবটম ট্রাউজার্স আর ঊর্ধ্বাঙ্গে— গোলাপি আর নীল রঙের ফুলকাটা হাওয়াই শার্ট। বয়েস চল্লিশ কী তার বেশিই হবে, তবে সেটা চাপা দেবার আপ্রাণ প্রয়াসটা চোখে পড়ে।

শিবেন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন, আসুন, হীরালালবাবু। আপনার আবার দেরি কী? আপনি তো আসবেন বলেননি?’

খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে বুকের ওপর দু হাত জোড় করে অতিথিদের কাছে এগিয়ে এলেন হীরালাল। বললেন, ‘বলার তো দরকার করে না। বাড়িতে অতিথি আসছেন আর আমি আসব না, এ কি হয়? কি বলেন?’ বলে সহাস্যে রমলার দিকে তাকালেন।

রমলা অবাক হয়ে ভদ্রলোককে পর্যবেক্ষণ করছিল। চমকে উঠে হেঁ হেঁ করে হাসল।

দময়ন্তী বলল, ‘আপনি তো ভারি চমৎকার বাংলা বলেন!’

হীরালাল হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বলেন কী? আমি তো বাঙালিই। আমরা তিনপুরুষ কলকাতার লোক। সিনিয়ার কেমব্রিজ পরীক্ষায় বাংলা আমার একটা সাবজেক্ট ছিল, ভালো নম্বর পেয়েছিলুম। সে-কথা থাক। শিবেনবাবু, আপনার বন্ধুদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবেন না?’

শিবেনের মুখে বিদ্যুতের মতো একটা দুষ্টুমির হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল। গম্ভীর গলা করে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে মিস্টার সমরেশ দত্তগুপ্ত, ইনিই প্রযোজক। ইনি মিসেস দত্তগুপ্ত। আর ইনি? ইনি হচ্ছেন এঁর নায়িকা। এঁর নামটা যেন কী দিয়েছ, সমরেশ?’ বলে ঝপ করে সমরেশকে চোখ মারল।

সমরেশের মুখের একটা রেখারও পরিবর্তন হল না। তৎক্ষণাৎ বলল, ‘ঠিক মনে পড়ছে না, বোধ হয় আম্রপালী-টালি গোছের কিছু হবে। তাই না, নেত্যকালী?’ বলে অর্ধ্ব-নীমিলিত চোখে রমলার দিকে তাকাল।

রমলা প্রথমে বিস্মিত, তারপর বিব্রত, তারপর স্তম্ভিত, তারপর ক্রুদ্ধ, তারপর আরও ক্রুদ্ধ হয়ে অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরির মতো মুখ করে বসে রইল। কোনো জবাবই দিল না।

হীরালাল রমলার মুখের দিকে তাকিয়ে বোদ্ধার হাসি হাসলেন। বললেন, ‘আপনার আগের নামটি বলে ফেলেছেন উনি, তাতে আপনি কিছু মনে করবেন না। নৃত্যকালী নামটা তো কিছু খারাপ নয়। তবে আম্রপালী নামটি আপনাকে এত চমৎকার মানিয়েছে যে তা বলার নয়। আপনার প্রথম বই বুঝি?’

রমলা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার দুই বন্ধুর দিকে তাকাল, কোনো জবাব দিল না। এটা যদি সত্য বা ত্রেতা যুগ হত, তাহলে দুই বন্ধু এতক্ষণে দুটো ছাইয়ের গাদায় পরিণত হত, সন্দেহ নেই।

সমরেশ বলল, ‘ওর মুখ দেখে বুঝছেন না যে এটা ওর প্রথম বই? মুখ দিয়ে কথাটি বেরোচ্ছে না, এমন লাজুক মেয়ে।’

‘তা তো বটেই, তা তো বটেই। তা বাড়িটা দেখেছেন, সমরেশবাবু? পছন্দ হয়েছে?’

সমরেশ একটু চিন্তা করে বলল, ‘দেখুন, বাড়িটা অতি চমৎকার, তবে আমি যেরকম চাইছিলুম, এটা ঠিক সেরকম নয়— মানে ঘরগুলোর কনফিগারেশন আমার স্ক্রিপ্টের সঙ্গে মেলে না। তবে তাতে অবশ্য বড় যায় আসে না। যদি অন্য বাড়ি না পাই তো আমার স্ক্রিপ্টটাই একটু পালটে নেব না হয়।’

সমরেশের কথা শুনে শিবেন আর দময়ন্তী চমৎকৃত। হীরালাল বললেন, ‘ঠিক কীরকম বাড়ি আপনার চাই বলুন, আমার সন্ধানে যদি থাকে তো জানাতে পারি।’

হাত নেড়ে সমরেশ বলল, ‘না, না, সে আমরা ঠিক খুঁজে বের করে নেব। শিবেন যখন আছে, তখন ও অনেক খোঁজ দিতে পারবে। পুলিশ তো! তবে আমি আপনার কাছে অন্য একটা সংবাদ চাই। আপনার ‘এবার অবগুণ্ঠন খোল’ ছবিটায় যিনি সহনায়িকা ছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে আর কী! আমার একজন ওই রকম সহনায়িকা দরকার।’ বলে পুনরায় অর্ধ্বনিমীলিত চোখে রমলার দিকে তাকাল।

হাস্যবিগলিত হীরালালের মুখটা হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল। হিমশীতল কণ্ঠে বললেন, ‘কে? বকুল? কেন, তার সম্বন্ধে আপনারা জানেন না কিছু? অন্তত শিবেনবাবুর তো জানা উচিত।’

প্রত্যেকে কান খাড়া করে উঠে বসল। শিবেন সাবধানে বলল,’কই, আমি তো জানি না কিছু!’

হীরালাল একবার সকলের মুখের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকালেন, তারপর তাচ্ছিল্যভরে বললেন, ‘তেমন কিছু নয়। শি ওয়াজ মার্ডার্ড।’

দময়ন্তী আঁতকে উঠে বলল, ‘মার্ডার্ড! বলেন কী?’

‘হ্যাঁ, বছরখানেক আগে পাঞ্জাব এক্সপ্রেসের একটা ফার্স্ট ক্লাস কুপের মধ্যে দুটো ট্রাঙ্কের মধ্যে ওকে পাওয়া যায়।’

শিবেন তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে হীরালালের কথা শুনছিল, বলল, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বকুল সাঁতরা, হাওড়ায় বাড়ি ছিল। সে-ই আপনার ছবিতে সহনায়িকা ছিল?’

ওপরে নীচে মাথা নাড়ল হীরালাল। বললেন, ‘হ্যাঁ, খুন হয়ে গেল, নইলে ওকে দিয়ে অনেক কাজ হত আমার।’

‘খুন হল কেন? স্বভাবচরিত্র ভালো ছিল না বুঝি?’ খুব ভালোমানুষের মতো জিজ্ঞেস করল সমরেশ।

‘স্বভাবচরিত্র?’ বলে হীরালাল বোধ হয় অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদ্রুপমিশ্রিত একটা তিক্ত হাসি হাসলেন। বোঝা গেল, অনেক ঘাটের জল খাওয়া হীরালালের অন্তত মেয়েদের এই দুটি সদগুণের ওপর একদমই আস্থা নেই। ‘স্বভাবচরিত্র ভালো না হলে খুন হবে কেন? তা নয়। আসলে কেন যে খুন হয়েছিল তা কেউই জানে না। পুলিশ চেষ্টা করছে, দেখা যাক ভেতরের খবর বের করতে পারে কি না। তবে মেয়েটার একটা দোষ ছিল। লোভ বড্ড বেশি ছিল। আর সেই জন্যেই বোধহয় দুটো ট্রাঙ্কের মধ্যে সমাপ্তিটা হল!’

হীরালাল তাঁর শেষ কথাটা ঠিক কী উদ্দেশ্যে বললেন বোঝা গেল না। যদি রসিকতার সঙ্গে বলে থাকেন, তার ফলটা অন্য রকমই হল। কেউ হাসল না, রমলা দু হাতে মুখ ঢাকল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হীরালাল আপন মনে হেসে উঠলেন। বললেন, আমি একটা গাধা। অতিথিদের এমন সব অপ্রীতিকর কথা শোনাচ্ছি, যা কক্ষনো কাউকে শোনানো উচিত নয়। আসুন প্লিজ আম্রপালী, আমরা অন্য আলোচনা করি। এই তো আপনার প্রথম বই? ভয় ভয় করছে নিশ্চয়ই। কিচ্ছু ভয় পাবেন না। নায়ক যদি অভিজ্ঞ আর ওস্তাদ হন তো তিনিই সব কায়দা করে ঠিক করে দেবেন। আপনার নায়ক কে, মিস আম্রপালী?’

মিস আম্রপালী আঙুল তুলে শিবেনকে দেখিয়ে দিল।

‘মিস্টার সেন! বলেন কী?’ অট্টহাসি হেসে উঠলেন হীরালাল : ‘পুলিশের কাজ করতে করতে একেবারে নায়ক? তারপর শেষ জীবনে আত্মজীবনী লিখবেন, ‘যখন ডিটেকটিভ ছিলুম’— অ্যাঁ? তা পরিচালক কে হচ্ছেন?’

মিস আম্রপালীর নীরব আঙুল এবার দেখাল দময়ন্তীকে।

তৎক্ষণাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন হীরালাল : ‘আপনি পরিচালক? বাঃ, বাঃ, বাঃ! তবে তো বই দারুণ জমবে। ভয়ানক জটিল একটা রহস্য থাকবে নিশ্চয়ই, মিসেস দত্তগুপ্ত?’

‘তার মানে?’ তিনজনে প্রায় একসঙ্গে প্রশ্ন করল।

‘তার মানে রহস্যসন্ধানী মিসেস দময়ন্তী দত্তগুপ্ত যার পরিচালক, তাঁর স্বামী প্রযোজক, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের মিস্টার শিবেন সেন সস্ত্রীক যার নায়ক-নায়িকা, সেই ছবিতে জটিল রহস্য থাকবে না তো কি আমার ছবিতে থাকবে? সেই কথাই বলছিলুম আর কী!’

বলতে বলতে আবার সশব্দে হেসে উঠলেন হীরালাল। বাকি চারজন স্তম্ভিত, কিন্তু আগে থেকে মহড়া দেওয়া না থাকলেও প্রায় তৎক্ষণাৎ একসঙ্গে দুই বন্ধু সেই অট্টহাসিতে যোগ দিল। তা না হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।

.

রমলা বলল, ‘উঃ, কী ভীষণ ঘোড়েল লোকটা। কেমন কায়দা করে বুঝিয়ে দিল যে তোকে ও আগাগোড়াই চিনত!’

চিন্তিত মুখে দময়ন্তী বলল, ‘হুঁ। কিন্তু লোকটা অভিনয় করল, না শিবেনবাবুর কথাটা সত্যি বিশ্বাস করেছে, বুঝতে পারলুম না তো। যদি বিশ্বাস করে না থাকে, তাহলে এই চালটার উদ্দেশ্য কী? আমার বাপু ভালো ঠেকছে না। প্রথমে ওই ল্যাভেন্ডারের গন্ধ আর তারপর বকুল সাঁতরার কথা, সবমিলিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। এই সমরেশ, কী তোমার বন্ধু ওখানে ওই লোকটার সঙ্গে বকর বকর করছে? হাত নেড়ে ডাকো তো ওকে, বল চলে আসতে।’

সমরেশ গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ‘দিব্যি জুত করে ভেতরে বসে আছ, ঝামেলা করছ কেন? শিবেন ঠিকই আসবে। বেকার সময় নষ্ট ও করে না।’

সূর্য কিছুক্ষণ হল অস্ত গেছে। বাড়ির পেছনে পশ্চিম আকাশে ঘন নীল আর বেগুনি রঙের আলো-আঁধারে অন্ধকার নেমে আসছে। বাড়ির ভেতরে নাগেশ্বর হয়তো কোনো আলো জ্বালিয়েছে, কিন্তু বাইরে তার চিহ্ন মাত্র নেই। আবছা অন্ধকার প্রবেশপথের সামনে শিবেন আর হীরালালের ছায়ামূর্তি দুটো গুজুর গুজুর করে কথা কইছে।

একটু বাদে ওদের পরস্পরকে নমস্কার করতে দেখা গেল, তারপর শিবেন একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে গাড়ির কাছে এগিয়ে এল। হীরালাল কিন্তু এলেন না, স্বস্থানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাবখানা এমন যে অতিথিরা বিদায় নিলেই অ্যাবাউট টার্ন করে বাড়ির ভেতর ঢুকে যাবেন।

সামনের সিটে উঠে বসল দুই বন্ধু। সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘কী এত রহ্যসালাপ হচ্ছিল?’

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে শিবেন বলল, ‘তেমন কিছু নয়। আমাকে একটু তৈল মর্দন করছিল আর কী। বাবুর বেশ কয়েক লক্ষ টাকার মাল এক্সসাইজ আর কাস্টমস ধরেছে। এখন কাকে ধরাধরি করতে হবে, সে-বিষয়ে খোঁজখবর হচ্ছিল। আমিও একটু বাজিয়ে নিলুম। তবে বাবু গভীর জলের মাছ, ওপরে উঠতে সময় নেবেন।’

‘গভীর জলের মাছ কীরকম?’

‘স্মাগলার, আবার কি!’ বলতে বলতে শিবেন সাবধানে গাড়িটা গেটের বাইরে বের করল।

গাড়িটা তখনও ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামেনি, হঠাৎ পেছনের সিট থেকে দময়ন্তী চিৎকার করে উঠল, ‘শিবেনবাবু, দেখুন—দেখুন, ওই গাড়িটা কার?’

আঁতকে উঠে ঘচাং করে ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ফেলল শিবেন। কার্বের ধারে পার্ক করা সাদা রঙের ফিয়াটটা এক নজর দেখে বলল, ‘ওটাই তো হীরালালের গাড়ি। কী এমন বৈশিষ্ট্য দেখলেন গাড়িটায় যে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়লেন?’

‘না, তেমন কিছু নয়’, দময়ন্তী পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়ল : ‘গাড়িটার রংটা দেখেছেন?’

‘দেখেছি। এতে হয়েছে কী?’

‘কিছু নয়, দুটো রহস্যের সমাধান হয়ে গেল।’ কিছুটা আত্মগতভাবে বলল দময়ন্তী।

‘রহস্যের সমাধান হয়ে গেল!’ সমরেশ অবাক, ‘অরবিন্দদার চোর ধরে ফেলেছ? হীরালালবাবু নাকি?’

‘না, না, চোর নয়। অন্য রহস্য, সামান্য ব্যাপার।’

ইতিমধ্যে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চিন্তিত মুখে শিবেন আবার চাবি ঘুরোতে যাবে, সমরেশ বাধা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়া, ওই বুড়িকে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের সঙ্গে ওর কোনো প্রয়োজন আছে?’

আচার্যবাড়ির দিক থেকে একজন বৃদ্ধাকে যথাসম্ভব দ্রুতবেগে ওদের দিকে আসতে দেখা গেল বটে। ‘আপনাদের বাবু একবার ডাকতিছেন।’ গাড়ির জানলা ধরে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল বুড়ি।

‘কে বাবু?’ সমরেশের প্রশ্ন।

‘আমাদের আচার্যিবাবু। ওই জানলা দিয়ে আপনাদের দেখলেন কিনা।’

‘তুমি কে?’

‘আমি পঞ্চাননের মা।’

‘পঞ্চা কোথায়?’

‘পাইলে গেছে।’

.

মাটি থেকে দোতলার ছাদ পর্যন্ত লম্বা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড একসারি থামের পর শ্বেতপাথরের বাঁধানো সিঁড়ি। তারপর প্রকাণ্ড দরজা। দরজার ওপর একপাশে কাঠের ফলকের ওপর সাদা রং দিয়ে লেখা, ‘হিমালয়ান টি কনসার্ন— গোডাউন।’ দরজার পর চওড়া লম্বা প্যাসেজ বাড়ির একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। ঢুকেই ডান দিকে সিঁড়ি, বেশ প্রকাণ্ড, শ্বেতপাথরে বাঁধানো। একতলার সব কটা ঘরই এখন তালাবন্ধ। গোডাউন বন্ধ, তবে তাদের ভেতর থেকে চা-পাতার তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে।

সিঁড়ির মুখে একজন চন্দ্রবদন নেপালী খাকি হাফপ্যান্ট আর হাত কাটা জালিদার গেঞ্জি গায়ে টুলের ওপর বসে ছিল। শিবেনকে সদলবলে ঢুকতে দেখে সপ্রশ্ন মুখে উঠে দাঁড়াল।

পঞ্চার মা বলল, ‘এঁদের ছেড়ে দাও গো। বাবু ডেইকেচেন।’

নেপালি সরে দাঁড়াল বটে, কিন্তু মুখের প্রশ্ন গেল না। শিবেন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম পদমবাহাদুর?’

‘জি।’

‘পঞ্চা কোথায় গেছে তুমি জান?’

‘জি না।’ যেমন সোজা প্রশ্ন তেমনি সোজা উত্তর।

‘আচ্ছা, শোনো, তুমি এখানেই থাকো, বুঝেছ? আমি পুলিশের লোক, তোমাকে দরকার হতে পারে।’

পদমবাহাদুর ভাবলেশহীন চোখে শিবেনের ধুতি-পাঞ্জাবি পর্যবেক্ষণ করল, পুলিশের কথাটা তেমন বিশ্বাস করল বলে মনে হল না।

দময়ন্তী বলল, ‘চলুন শিবেনবাবু, ওপরে যাওয়া যাক।’

সিঁড়িটা ঘুরে দোতলায় উঠে একতলার মতোই একটা চওড়া প্যাসেজে গিয়ে পড়েছে। তার সামনেই একটা সমচতুষ্কোণ বারান্দা রঙিন কাচের জানলা দিয়ে ঢাকা। সেখানে একটা রট আয়রনের টেবিল আর গুটি কয়েক চেয়ার। তারপর প্যাসেজের দুধারে সারি সারি দরজা। কিন্তু বাঁ দিকের আর ডান দিকের দরজাগুলোর মধ্যে একটা ব্যতিক্রম সহজেই চোখে পড়ে। ডান দিকের দরজাগুলোর বাইরে বড় বড় রঙিন প্রিন্টের সুদৃশ্য পর্দা আর বাঁ দিকেরগুলোর কোনো পর্দা-টর্দার বালাই নেই। ডান দিকের সব কটা দরজাই বন্ধ আর বাঁ-দিকের সব কটাই খোলা।

একতলার চা-পাতার গন্ধ দোতলার সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত ধাওয়া করে এল, কিন্তু তারপরেই ডান দিকের প্রথম দরজাটার কাছে আসতেই আবার সেই ল্যাভেন্ডারের মৃদু স্নিগ্ধ সুবাস পাওয়া গেল। সেই গন্ধে সকলেরই গতি একটু শ্লথ হয়ে পড়ল। পর্দাটা থিরথির করে কাঁপছিল, সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে সকলে একবার সেদিকে তাকাল। তারপর এগিয়ে গেল।

বাঁ দিকের প্রথম ঘরটায় একটা বেতের চেয়ারে অসহায় বিষণ্ণ মুখে বসে ছিলেন অরবিন্দ আচার্য। ওদের দেখে একবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, তারপর হাত নেড়ে সামনের বেতের চেয়ার ক-টা দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন।’

দময়ন্তী চট করে ঘরের ভেতরটা দেখে নিল। বিরাট ঘর। দক্ষিণ দিকে মেঝে থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত উঁচু বিশাল বিশাল তিনটে জানলা, তাদের ভেতর দিয়ে পাশের বাড়ির একটা পাশ ও সামনের প্রাঙ্গণটা দেখা যায়। জানলা তিনটের মেঝে থেকে তিন ফুট গরাদ দেওয়া, তার ওপরটা ফাঁকা। ওই পথেই তাহলে চোর এসেছিল। জানলাগুলোর সামনে আড়াআড়িভাবে একটা নীচু খাট পাতা, পাশে সেই গোলাপি মার্বেলের টেবিল, খাটের পেছনে জলের কুঁজো। পুব দিকের দেওয়ালে দেওয়াল আলমারি, তার কাচের পাল্লার ভেতরে অসংখ্য কাপ, মেডেল অযত্নে পড়ে পড়ে মরচে ধরছে। পশ্চিমের দেওয়ালেও অনুরূপ আলমারি, তবে তার পাল্লাটা কাঠের, ভেতরে কী আছে দেখা যায় না। এছাড়া, ঘরে ছ-সাতটা বেতের চেয়ার, অন্য আসবাবপত্র কিছু নেই, এমনকী একটা আয়নাও নেই। স্পষ্টত, এ-ঘরে কোনো মেয়েলি হাতের স্পর্শ পড়ে না।

অরবিন্দ দময়ন্তীর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিটা লক্ষ করলেন। বললেন, ‘কী দেখছ? এই হল গে আমার সেলুলার জেল।’ বলে হাসির একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। ‘যাক সে কথা। আপনিই বোধ হয় মিস্টার শিবেন সেন? নমস্কার। আর ইনি আপনার স্ত্রী?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘বেশ, বেশ। তা তোমাদের কেন ডেকে এনেছি জান না বোধহয়?’

‘শুনলুম, পঞ্চা নাকি পালিয়ে গেছে?’ সমরেশ জিজ্ঞেস করল।

গলা নীচু করে অরবিন্দ বললেন, ‘পালায়নি, কিডন্যাপড।’ শেষ শব্দটি ইংরিজিতে বললেন বোধহয় এই জন্য যাতে পঞ্চার মা বুঝতে না পারে। তবে, পঞ্চার মা ঘরের এক কোণে বসে ঢুলছিল, কোনো কথা তার কানে ঢুকছিল বলে মনে হল না।

সকলের বিস্মিত মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে অরবিন্দ আবার বললেন, ‘পঞ্চার অদৃশ্য হওয়াটা একটা পুরোনো ঘটনার অংশমাত্র। আসলে, আমার গলার চারদিকে ফাঁসটা বেশ টাইট হয়ে বসছে, এবার শেষ টানটা পড়লেই হয়।’

শিবেন বলল, ‘আপনি যে সন্দেহ করছেন আপনার কেউ ক্ষতি করবার চেষ্টা করছে, সেটা কীরকম ক্ষতি?’

ম্লান হেসে অরবিন্দ বললেন, ‘আমার মতো অসহায় মানুষের একটি মাত্র ক্ষতিই করা যেতে পারে, শিবেনবাবু।’

দময়ন্তী বলল, ‘দেখুন, এরকম ভাসা ভাসা উত্তর-প্রত্যুত্তরে কেবল সময় নষ্টই হবে। যদি আপনার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে বলে আপনার সন্দেহ তাকে ভাঙতে চান, তাহলে আমার কয়েকটি প্রশ্নের আপনাকে স্পষ্ট জবাব দিতে হবে। সেসব প্রশ্নের সবগুলো আপনার মনঃপূত হবে না। হয়তো অনেকগুলোই আপনাকে বিব্রত করবে। কিন্তু …’

বাধা দিয়ে অরবিন্দ বললেন, ‘তুমি প্রশ্ন কর মা, আমি যথাসাধ্য উত্তর দেব। নিরন্তর এই সংশয় আর আতঙ্ক আমার আর সহ্য হচ্ছে না। প্রথম যখন বুঝতে পারি আমার জীবন সংকট, ভেবেছিলুম বাধা দেব না। আমার কেই বা আছে? আমার এ জীবন রাখাও যা, না রাখাও তাই। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, শহিদ হবার মতো মনের জোর আমার নেই। যতবার ওই বাইরের পৃথিবীটার দিকে তাকাই, মনে হয় পঙ্গু হলেও এ জীবন মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারোর অধিকার নেই সেই মহামন্ত্রের উপলব্ধি থেকে আমাকে বঞ্চিত করে। মশাও তো তার অন্ধকার সঙ্ঘরামে জেগে বসে জীবনের স্রোত ভালোবাসে, গলিত স্থবির ব্যাঙ আর দুই মুহূর্ত ভিক্ষে চায়। যাকগে, শোন এবার পঞ্চাননের অন্তর্ধান কাহিনী। অ পঞ্চাননের মা, এখানে বসে ঘুমিয়ো না তো বাছা, নিজের ঘরে যাও। দরকার হলে বেল বাজাব, শুনতে যদি পাও তো এস।’

অরবিন্দের কথা বলার ঢঙটি নাটকীয়, যেন পার্ট মুখস্থ বলছেন। এককালে যে ইনি সাহিত্যসভায় অবধারিত মধ্যমণি হতেন, অনায়াসে তা এখনও বোঝা যায়। এ প্রতিভা জন্মগত, কোনোদিন যাবার নয়।

তন্দ্রাজড়িত পায়ে পঞ্চাননের মা গৃহান্তরে গেলে, যেন একটা গোপন রহস্য বলছেন এমনভাবে অরবিন্দ বললেন, ‘আফিমের মৌতাত। সন্ধে হয়েছে তো। যাক, শোন এবার বলি।’

কিন্তু বলা হল না। ঘরের বাইরে বারান্দায় দুজোড়া পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। দুটোই ভারী এবং দ্রুত। একটু পরেই দরজা ঠেলে পদশব্দের অধিকারী দুজন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন কিংবা আবির্ভূত হলেনও বলা চলে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ঘর ল্যাভেন্ডারের গন্ধে ম-ম করে উঠল।

প্রথমজন মহিলা। বয়স চল্লিশের ওপর, কিন্তু লম্বা চওড়া আঁটসাঁট গড়ন। চওড়া কবজি, চওড়া কাঁধ— অনেকটা মেমসাহেবের মতো। পরনে দগদগে লাল সিল্কের শাড়ি আর স্লিভলেস সাদা ব্লাউজ। ব্লাউজের যে অংশটুকু কাঁধের ওপর ন্যস্ত রয়েছে তার মধ্যে থেকে বেরিয়েছে থামের মতো হাত। গায়ের রং অত্যন্ত ফর্সা, কিন্তু কেমন যেন ফ্যাকাশে সাদা। মুখের প্রতিটি রেখা নিখুঁত, টিকালো নাক, স্পষ্টা পাতলা ঠোঁট, বিশাল চোখ, কিন্তু সবমিলিয়েও ভদ্রমহিলাকে সুন্দরী বলা যায় না। যৌবনে কীরকমটি ছিলেন বলা সম্ভব নয়, কিন্তু বর্তমানে ও মুখে লাবণ্যের ছিটেফোঁটাও নেই। সমস্ত মুখে একটা উদ্ধত, অহঙ্কৃত বিরক্তি, যেন সকলকে ধমকাতে আর আদেশ করতেই তিনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন।

দ্বিতীয়জন পুরুষ। ওঁর সঙ্গিনীটি ঘরে ঢুকেই সকলের মনে যে ভয়মিশ্রিত সম্ভ্রম জাগিয়ে তুলেছিলেন, সেটি হালকা করবার জন্যই যেন তিনি একগাল স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে এগিয়ে এলেন। প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হবে ভদ্রলোকের, কিন্তু শরীরে একবিন্দু অতিরিক্ত মেদ নেই। পেশিবহুল দীর্ঘ দেহ, গৌরবর্ণ, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। চোখ দুটি চঞ্চল, সরস। ওঁর সঙ্গিনীটির একমাত্র বিকীরিত মাধুর্য যেখানে ল্যাভেন্ডার সেন্টের গন্ধ, সেখানে ভদ্রলোকের সর্বাঙ্গ দিয়েই যেন স্নিগ্ধ সরসতা ঝরে পড়ছে।

ভদ্রলোক ঘরের বাইরে থেকেই বলতে বলতে ঢুকছিলেন, ‘কী হে আচার্যবংশাবতংশ, তোমার খাস চাকরের খোঁজ খবর কিছু পাওয়া গেল?’ ঘরে ঢুকে চারজন নবাগতকে দেখে বিব্রত হয়ে চুপ করে গেলেন।

ভদ্রমহিলা ইতিমধ্যে নিজেকে খাটের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে জিজ্ঞাসু নেত্রে একবার অরবিন্দ আর একবার অতিথিদের দিকে তাকাচ্ছিলেন।

অরবিন্দ বললেন, ‘না, মশায়, পাওয়া আর গেল কই? আর তাই তো এঁদের ডেকে আনলুম। এই যে, ইনি হচ্ছেন শ্রীমতী দময়ন্তী দত্তগুপ্ত, এঁর কথা তো আগেই বলেছি। ইনি শ্রী সমরেশ দত্তগুপ্ত। এঁরা মিস্টার ও মিসেস সেন, সমরেশবাবুর বন্ধু।’

ভদ্রমহিলা চোখ পাকিয়ে দময়ন্তীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন, তারপর গলার মধ্যে ‘হুঁঃ’ জাতীয় একটা অসন্তুষ্টির শব্দ করে বিরক্ত মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। সামান্য একটু ভদ্রতা করে তাঁর বিরক্তি গোপন করবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করলেন না।

ইতিমধ্যে অরবিন্দ দময়ন্তীকে নবাগত দুজনের পরিচয় দিচ্ছিলেন, ‘ইনি আমার দিদি, অমৃতপ্রভা রায়চৌধুরী আর ইনি মিস্টার অমৃতপ্রভা রায় চৌধুরী ওরফে বিনয়ভূষণ।’

বিনয়ভূষণ সার্থকনামা। পরিচয় করানো মাত্র বিনীত মধুর হেসে সকলকে নমস্কার করলেন, তারপর সকৌতুকে দময়ন্তীকে দেখতে লাগলেন। অমৃতপ্রভা কিন্তু নমস্কারের ধার দিয়েও গেলেন না। মোটা, ক্রুদ্ধ গলায় অরবিন্দকে সম্বোধন করে বললেন, ‘খোকা, তোমার ছেলেমানুষি কি কোনোদিনও যাবে না? তুমি যে কবে বড়ো হয়ে উঠবে, তা জানি না। তুমি কেন এখনও এই সামান্য কথাটা বুঝতে পারছ না যে তোমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি? সেক্ষেত্রে…’

সকলের সামনে ভর্ৎসিত হয়ে একটু রেগেই গেলেন অরবিন্দ। বললেন, ‘সেক্ষেত্রে কী? আমার কোন কাজটা ছেলেমানুষি দেখলে তুমি?’

‘সেটাও তোমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, তবে তুমি বুঝবে? আমি তোমাকে বলেছিলুম একজন অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য নিতে, আর তুমি ধরে এনেছ এদের?’

অরবিন্দ আরও রেগে গেলেন। রক্তবর্ণ চোখে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দিদির দিকে, যদিও সেই দৃষ্টির সামনে দিদি কিছুমাত্র বিচলিত হলেন বলে মনে হল না। তারপর নীচু গলায় বললেন, ‘এঁরা আমার অতিথি অমু, অন্তত এঁদের অসম্মান কোরো না।’

‘আমি এঁদের অসম্মান করতে যাব কেন? এঁদের তো কোনো দোষ নেই। এঁদের ডেকে এনেছ তুমি, দোষ তোমার। আমি সেই কথাই তোমাকে বলছিলুম যে তোমার ঘটে যদি কিছুমাত্র বুদ্ধি থাকত আর যদি আমার কথা ঠিকমতো শুনতে তাহলে আজ তোমার এই দুরবস্থা হত না। এঁদের পাওনাকড়ি কী আছে, মিটিয়ে দাও, দেখছি আমাকেই বেরোতে হবে লোকের সন্ধানে।’

দময়ন্তী উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আচ্ছা, অরবিন্দবাব, আমরা তাহলে চলি। আশা করি, আমাদের আর প্রয়োজন নেই।’

শিবেন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঁচা গেল বউদি। চলুন, যাওয়া যাক।’

চোখ বুজে স্থির হয়ে আত্মসংবরণ করছিলেন অরবিন্দ। হঠাৎ চোখ খুলে বললেন, ‘দময়ন্তী, তুমি যদি চলে যাও, আমি আজ রাত্রের মধ্যেই আত্মহত্যা করব, স্থির জেনো। এ ঘর আমার, আমি তোমাকে ডেকে এনেছি, আমি তো তোমাকে যেতে বলিনি। আমি তো তোমাকে অসম্মান করিনি। অন্যে কী বলল, তার জন্যে তুমি আমার ওপর রাগ করতে পার না। পার কি? যে অপরাধ আমি করিনি, তার জন্যে কি তুমি আমাকে শাস্তি দেবে দময়ন্তী?’

দময়ন্তী বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর পরিত্যক্ত চেয়ারটায় বসে পড়ল। দেখাদেখি শিবেনও বসে পড়ল। এর আগে একদিন দময়ন্তী অরবিন্দের এমন একটা আকর্ষণী শক্তির কথা বলেছিল যে-জন্যে উনি কোনো অনুরোধ করলে কিছুতেই তাতে না বলা যায় না, সেই শক্তি যে কী শিবেন এখন তা বুঝতে পারল। দময়ন্তী যতক্ষণ চিন্তা করছিল, ততক্ষণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিবেন প্রার্থনা করছিল যেন ও ‘না’ না বলে।

দময়ন্তী আবার বসে পড়ায় অরবিন্দ আর বিনয়ভূষণ, দুজনেই নির্ভেজাল খুশির হাসি হেসে উঠলেন। অরবিন্দ বললেন, ‘বাঁচালে মা। এবার বল তোমার কী প্রশ্ন আছে। সাধ্যমতো আমি সব উত্তর দেব।’

অমৃতপ্রভা যথাপূর্বং বিরক্ত মুখে বসে ছিলেন। বাধা দিয়ে বললেন, ‘প্রশ্ন আবার করবার কী আছে? ওই মাগিটা…’

এই গ্রাম্য, অশিষ্ট শব্দটির অভিঘাতেই বোধহয় এই প্রথম বিনয়ভূষণের মুখে কথা ফুটল। অতি মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ‘আহা, একটু চুপ করো না! এঁদের কথা বলতে দাও।’

ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল। অমৃতপ্রভার চোখ দুটো মুহূর্তের মধ্যে টকটকে লাল হয়ে ফুলে উঠল, মনে হল যেন তারা কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। গলার শিরাগুলো দপদপ করে উঠল, তারপর একটা প্রাণঘাতী চিৎকার, ‘চুপ কর অপদার্থ, ছোটোলোক, ইডিয়ট! যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা। আমাদের কথার মধ্যে তুমি কথা বলতে আস কোন সাহসে? কী বোঝ তুমি? গর্দভ।’

বিনয়ভূষণের মুখে একটা কষ্টকৃত ক্ষীণ, ক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠল। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘আমি গাধা, বুঝি নে কিছু? আমি বলে একটা ডবল এম এ…’

‘ইঁ…ইঁ…ইঁ…ইঁ…’ করে চিৎকার করতে করতে খাট থেকে প্রায় উঠে দাঁড়ালেন অমৃতপ্রভা। সাইক্লোনের মধ্যে নারকেল গাছের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘ডবল এম এ?’ আমার গুষ্টির পিণ্ডি। দুটো বই পড়ে যেন দুনিয়ার মাথা কিনে নিয়েছ, না? কী মূল্য আছে তোমার আর তোমার বাবার যত পোকাধরা, ছাতাপড়া বইয়ের? রাস্তায় টান মেরে ফেলে দিলে তো ঘেয়ো কুকুরটাও ছুঁয়ে দেখবে না। ঘটে তো আসলে গোবর! দুবেলা খাবারটুকুও তো জোটাবার মুরোদ নেই, আবার এম-এ? জানোয়ার হয়ে জন্মেছ, জানোয়ার হয়েই থাক।’

এই চিৎকারের মধ্যে কখন যেন অরবিন্দ দুহাতে কান ঢেকে ফেলেছেন, মুখ নীচু। অমৃতপ্রভা দম নেবার জন্য থামতেই, মুখ তুলে বললেন, ‘সমরেশ, তুমি আমাকে একটু ধরে তুলতে পারবে? এখানে এরা ঝগড়া করুক, আমরা চল অন্য কোথাও যাই। ময়দানে বোধহয় বেশ নিরিবিলি হবে, তাই না?’ রাগে ওঁর গলার স্বর অল্প অল্প কাঁপছে।

অমৃতপ্রভা ধপ করে আবার খাটের ওপর বসে পড়লেন। প্রায় স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘তোমার রাগ করার তো কোনো কারণ দেখি না। আমরা ঝগড়া করতে যাব কোন দুঃখে? ঝগড়া হয় সমানে সমানে, এটা তো তা নয়। ছোটোলোকদের মাঝে মাঝে জানিয়ে দিতে হয় যে, তারা ছোটোলোকই। এটা তাই।’

দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অরবিন্দবাবু, আপনি আমাকে সাহায্য করতে ডেকেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে এত গণ্ডগোল হবে জানলে আমি আসতুম না। যা হোক, আপনার চাকর যে হারিয়ে গেছে বলে আপনার বিশ্বাস, তাকে খুঁজে বের করবার জন্য পুলিশে খবর দিন। অন্যান্য সমস্যাগুলো না হয় পরে কোন সুবিধেজনক সময়ে বিবেচনা করা যাবে।’ বলে উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করল।

অরবিন্দ হাত তুলে বললেন, ‘দাঁড়াও!’ তারপর একটু দম নিয়ে বললেন, ‘এর মধ্যে আমি তোমাকে থাকতে বলতে পারি না ঠিকই, কিন্তু পঞ্চা হারায়নি, তাকে চুরি করা হয়েছে— এ-কথাটা নিশ্চিত জেনে যাও। হারাবার ছেলে পঞ্চা নয়, আর সে কোনোমতেই পালাবে না। সে পালাতে পারে না। তাকে নির্ঘাত সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার মা সন্ধ্যে হলেই আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। পদম ডাকলে আসে, সর্বক্ষণ আমার খিদমতগিরি করার তার কথা নয়, আসল কথা, আমাকে সম্পূর্ণ বেআব্রু করে রসিয়ে রসিয়ে শেষ করার চক্রান্তের এটা একটা অংশ মাত্র। তার শেষ কোপটা পড়বারও খুব আর দেরি নেই, কারণ এক্সপার্ট চাকর পেতে সময় লাগে ঠিকই, কিন্তু খুব বেশি লাগে না।’

দময়ন্তী উঠে দাঁড়িয়েছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘পঞ্চানন পালাতে পারে না, এ-বিষয়ে আপনি এত স্থির নিশ্চয় হচ্ছেন কী করে? আমি তো সংসার করি, আমি জানি, চাকরদের যতই মাইনে দিন, যতই তোয়াজ করুন, ওরা পালাবেই।’

‘পঞ্চা আর পাঁচটা চাকরের মতো নয়, দময়ন্তী। একটা কারণে ও আমার কাছে এতই কৃতজ্ঞ যে ওর পক্ষে পালানো সম্ভব নয়। আমাকে ছেড়ে ও যেতে পারে না।’

‘কেন?’

খুব বিনীত হাসি হাসলেন অরবিন্দ। বললেন, ‘সে সামান্য ব্যাপার। তেমন কিছুই নয়।’

অন্যকে সাহায্য করার ব্যাপারে যিনি বিনয়ে বিশদভাবে কিছু বলতে অনিচ্ছুক, তাঁকে আর প্রশ্ন করা চলে না।

‘আচ্ছা, আমরা তাহলে আজ চলি।’ বলল দময়ন্তী। তারপর সদলবলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

.

বারান্দায় বেরিয়ে সমরেশ প্রকাণ্ড একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘বাপ! মনে হচ্ছিল যেন রোমে বসে আছি।’

‘রোমে? সে কি, কেন, রোম কেন?’ তিনজনে প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করল।

‘রোমে নয়তো কী? একেবারে কলসিয়ামের ভেতর, অসহায় গ্ল্যাডিয়েটর বিনয়ভূষণকে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমার তো প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি ভদ্রমহিলা তাঁর সোয়ামিটিকে ধরে কামড়ে দেন।’

‘কেন? এখন কেন?’ শিবেন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘তখনি বলিনি শালারা ছোটোলোক?’

কথা বলতে বলতে ওরা সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল। বাঁ দিকের শেষ দরজাটার কাছে আসতেই সুদৃশ্য পর্দার আড়াল থেকে একটি সুশ্রাব্য নারীকণ্ঠ শোনা গেল, ‘শুনুন।’

চারজনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। নারীকণ্ঠের অধিকারিণী এবার বাঁ হাতে পর্দাটা উঁচু করে সরিয়ে দর্শন দিলেন। কেতাদুরস্ত ভাবে বললেন, ‘দয়া করে আপনারা একটু ভেতরে এসে বসবেন কি? আপনাদের সঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে চাই।’

মহিলাকে দেখে চারজনেরই চক্ষুস্থির, শিবেন আর সমরেশের তো ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা।

সীতাকে দেখে রাবণরাজা নাকি বলেছিলেন, ‘নহি রূপোপমান্যা তবাস্তি শুভদর্শনে।’ সমরেশের ঠিক সেই কথাই মনে হল। অবিশ্যি অতুলনীয় রূপ সত্ত্বেও ঠিক শুভদর্শনা বলা উচিত নয় এঁকে! বরং ‘অখিল মানসস্বর্গে অনন্তরঙ্গিনী স্বপ্নবাসিনী’ বলা চলে। মানে, এঁকে অসংকোচে বলা যায়, ‘ইচ্ছা করিয়াছে, সবলে আঁকড়ে ধরি এ বক্ষের কাছে, সমুদ্র মেখলা পরা তব কটিদেশ।’

জ্বলন্ত আগুনের মতো রূপ, লালসার লেলিহান শিখা। ফিগারটি যা তৈরি করেছেন, তাতে সন্দেহ থাকে না যে তাঁর আদর্শ টুইগি বা মিয়া ফারো নয়, আদর্শ জেন ম্যানসফিল্ড বা সোফিয়া লোরেন। কাছ থেকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, অস্বস্তি হতে থাকে।

অস্বস্তি চারজনেরই হচ্ছিল, অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন কারণে। পুরুষ দুজনের কারণ তো বলাই বাহুল্য, তাদের তো ততক্ষণে বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা, রক্তধারা বেজায় নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। মেয়েদের অস্বস্তির কারণ ভদ্রমহিলার পোশাক। উনি যে শাড়িটা পরেছেন সেটা কেন পরেছেন সেটা গবেষণার বিষয়, লজ্জা নিবারণের জন্যে তো কখনই নয়। সেই স্বচ্ছ, প্রায় অদৃশ্য আবরণের তলায় ওঁর ঊর্ধ্বাঙ্গের যে স্বল্পবাসটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তার উদ্দেশ্যও বোধ হয় লজ্জানিবারণ নয়, উদ্ধত উপচিত যৌবন একটু সামলে-সুমলে আটকে রাখা।

বিলোল কটাক্ষে সমরেশের প্রকাণ্ড শরীরটা আপাদমস্তক লেহন করে মৃদু হেসে ভদ্রমহিলা আবার বললেন ,’ভেতরে আসবেন কি?’

তৎক্ষণাৎ সমরেশের সর্বাঙ্গে ফোসকা পড়ে গেল, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বেরোল না। পাশ থেকে শিবেন চিঁ চিঁ করে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’ তারপর বোধহয় নিজের বিবেক সাফসুতরো রাখার জন্য পূর্ববৎ চিঁ চিঁ করে দময়ন্তীকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলেন, বউদি?’

মৃদু হেসে দময়ন্তী বলল, ‘বেশ তো, চলুন।’

আই-এফ-এ শিল্ডের খেলায় ছোটো টিমের লেফট হাফ যেমন বড়ো টিমের দুঁদে রাইট আউটের সঙ্গে লেপটে যায়, রমলা তেমনি চট করে পোজিশন নিয়ে শিবেনের সঙ্গে সেঁটে গেল।

ভদ্রমহিলা পর্দাটা একহাতে উঁচু করেই সরে একদিকের দরজার পাল্লায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন। প্রথমে দময়ন্তীই ঘরে ঢুকল, তারপর লেজুড় লেফট হাফকে নিয়ে শিবেন এবং সবশেষে সমরেশ। ভদ্রমহিলা আর তাঁর সামনের দরজার পাল্লার মধ্যে যতটা ফাঁক ছিল, প্রথম তিনজন তার মধ্যে দিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই গলে গেল, কিন্তু সমরেশের বেলা তা হল না। মহিলার দূরতম বিন্দুর সঙ্গে টক্কর খেয়ে সমরেশ টাল খেতে খেতে ধপ করে গিয়ে একটা বড়ো সোফায় বসে পড়ল।

কিছুক্ষণ দম নিয়ে সমরেশ নিজের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করল।

ওপাশের ঘরগুলোর মতোই এটিও বিশালাকৃতি, তবে সুন্দরভাবে সাজানো। ঘরের কর্ত্রীর যে একটা বিশিষ্ট রুচি আছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়, যদিও রুচিটা যেন একটু কেমনধারা। আসবাবাপত্র বলতে দুটো প্রায় ফুট সাতেক লম্বা পুরু গদিমোড়া কৌচ, তার ওপর নরম জাজিম পাতা, একটা বড়ো ও দুটো ছোটো সোফা— নরম আর সুখপ্রদ। মেঝেয় পশমের গালিচা আর একধারে একটা ককটেল ক্যাবিনেট। ক্যাবিনেটের ওপর তিন-চার রকমের গেলাসের সেট আর তলায় কাচের পাল্লার ভেতর নানা রকম ছোটোবড়ো বোতলে দিশি-বিলিতি পানীয়ের সমারোহ। দেওয়ালে একধারে অ্যাঁগারের ‘উৎস’-এর প্রকাণ্ড রিপ্রোডাকশন— একজন দিগবসনা সুন্দরী কাঁধের ওপর রাখা ভৃঙ্গার থেকে জল ঢালছেন আর অন্যধারে বট্টিচেলির ‘ভিনাস’— ইনিও তাঁর সঙ্গিনীটির মতোই বিবসনা, কেবল তাঁর বিশাল কেশদামে দিয়ে লজ্জানিবারণের কিঞ্চিৎ প্রয়াস পেয়েছেন। মোট কথা, সমস্ত ঘরটাই কেমন যেন মসৃণ, নরম, সুখপ্রদ আর অশ্লীল। এ-ঘরের কর্ত্রী যে, সংস্কৃতে যাকে বলে পুরন্ধ্রী, তা নন তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। পুরাকালে বিদিশা-টিদিশায় মুখ্য নাগরিকাদের সংকেতগৃহ বোধহয় এইরকম করেই সাজানো থাকত।

ইতিমধ্যে গৃহকর্ত্রী দরজার ছিটকিনি বন্ধ করে একেবারে পর্যাপ্ত পুষ্প-স্তবকাবনম্রা সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতার মতো অতিথিদের কাছে এসে গেছেন। সমরেশকে পুনরায় একটা মর্মভেদী দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করে বললেন, ‘কী খাবেন বলুন। ড্রিংকস? ঠান্ডা না গরম? য়্যু নেম ইট অ্যান্ড আই হ্যাভ ইট’। গলা দিয়ে যেন মধু ঝরে পড়ছে।

সমরেশ দ্বিতীয়বার নয়ন-বাণে বিদ্ধ হয়ে বড়োই কাহিল হয়ে পড়েছিল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘আমি এক কাপ কফি খাব।’

‘আপনারা?’ বলে ভদ্রমহিলা শিবেন ও আপাতত অবিচ্ছেদ্য লেফট হাফের দিকে তাকালেন।

শিবেন একবার তৃষ্ণার্ত চোখে ককটেল ক্যাবিনেটের দিকে তাকাল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমরাও কফি।’ তারপর লেফটহাফের দিকে চেয়ে শহিদের হাসি হাসল।

দময়ন্তী একটা সিঙ্গল সোফায় বসে তার উঁচু হাতল আর নরম গদির মধ্যে প্রায় ডুবে গিয়েছিল, শুধু মাথাটুকু জেগে ছিল হাতলের ওপর। সেখান থেকে মিষ্টি হেসে বলল, ‘আমিও তাই।’

ভদ্রমহিলা যেন বিস্মিতই হলেন : ‘সবাই কফি খাবেন?’ তারপর গলা উঁচু করে বললেন, ‘লছমি, পাঁচ কফি বানাও।’

ভেতর থেকে জবাব এল। ভদ্রমহিলা এবার নিশ্চিত হয়ে ধপ করে সমরেশের পাশে বসে পড়লেন। সমরেশ অসহায় দৃষ্টিতে একবার সকলের দিকে তাকাতে গিয়ে একপাশে সোফার হাতলের ওপর দময়ন্তীর মুখটুকু চোখে পড়তেই থমকে গেল। ওর চোখ দুটো অকৃত্রিম কৌতুকে ঝকঝক করছে, ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি— একদৃষ্টে চেয়ে আছে। দেখেই সমরেশের সমস্ত মাথাটা হঠাৎ একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, ‘ঠিক হ্যায়, চ্যালেঞ্জ নিলুম।’ তারপর মুখ ঘুরিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে গৃহকর্ত্রীর দিকে তাকাল।

গৃহকর্ত্রীও তাঁর বিশাল চোখ দুটি ভুলে নির্দ্বিধায় সমরেশের চোখের দিকে তাকালেন। মানুষের— বিশেষত কোনো মহিলার চোখের দৃষ্টি যে এত আদিম এবং ক্ষুধার্ত হতে পারে, সমরেশের তা জানা ছিল না। ওর পূর্ণদৃষ্টির সামনে একবারও সেই চোখে নত হল না, কম্পিত হল না। অন্য সময় হলে এ অবস্থায় সমরেশ কী করত বলা যায় না, কিন্তু এখন চ্যালেঞ্জ নেওয়া হয়ে গেছে, অন্তত পালিয়ে যাওয়া চলে না। কাজেই নিম্নকণ্ঠে— কিন্তু যাতে সবাই শুনতে পায়, বলল, ‘আই ক্যাদার চাটুয্যে নো জু গার্ডেন।’

কথাটা বলা মাত্র অন্য তিনজন উৎকণ্ঠিত, উদগ্রীব দর্শকের গলা দিয়ে এক-এক রকম অদ্ভুত শব্দ বেরোল— যেন চেপে রাখা উত্তেজনাটা ভেঙে-চুরে বেরিয়ে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে আবহাওয়াটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

গৃহকর্ত্রী ব্যাপারটা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন বলে মনে হল না। উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আই বেগ ইওর পার্ডন।’

পরিষ্কার গলায় সমরেশ বলল, ‘বলছিলুম আমার নাম সমরেশ দত্তগুপ্ত, আর ওঁরা আমার বন্ধু শিবেন সেন আর তার স্ত্রী, আর উনি…’

‘আপনার স্ত্রী মিসেস দময়ন্তী দত্তগুপ্ত। পরিচয় করানোর কোন দরকার নেই। আমি আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম।’

‘কিন্তু আপনার পরিচয় তো এখানও পেলুম না।’ সমরেশ নিশ্চিন্ত, নির্ভয়।

‘আমার পরিচয়?’ ভদ্রমহিলা স্তম্ভিত, প্রায় অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালেন, কিন্তু সকলেরই ভাবলেশহীন মুখ দেখে থেমে বললেন, ‘ও, আমি ভেবেছিলুম ওদিকে আমার পরিচয় আপনাদের দেওয়া হয়ে গেছে। যাক, আমার নাম রেবেকা আচারিয়া। এ-বাড়িতে আমাকে অনেকে রেবা নামে জানে। আমার বিয়ের পর শ্বশুরমশায় আমাকে এই নাম দেন, তারপর থেকে শ্বশুরবাড়িতে আমার এই নামটাই প্রচলিত।’

শিবেন বলল, ‘আপনার নামটা অন্যরকম বলেই জিজ্ঞেস করছি, কিছু মনে করবেন না। আপনি কি— মানে, বাঙালি নন?’

‘বাঙালি বলতে আপনি কী বোঝেন আমি জানি না, তবে আমার মধ্যে ইউরোপীয় রক্ত আছে। আমার দাদামশায় ছিলেন কুলতলার জমিদার স্যার প্রতাপনারায়ণ মল্লিক আর দিদিমা ছিলেন ইংল্যান্ডের লর্ড পরিবারের মেয়ে। স্যার প্রতাপ ক্রিশ্চান হয়েছিলেন, বিলেতেই থাকতেন। তাঁদের মেয়ে, অর্থাৎ আমার মা, অপূর্ব রূপসি ছিল। লণ্ডনের উঁচু সমাজের অনেক বড়ো বড়ো লর্ডের ছেলের মুণ্ডু ঘুরিয়ে শেষপর্যন্ত বিয়ে করল আমার বাবাকে। রক্তের ভারতীয় প্রভাব যাবে কোথায়? আমার বাবাও অবিশ্যি দুর্দান্ত সুপুরুষ ছিলেন। অমন সুপুরুষ আমি জীবনে খুব বেশি দেখিনি।’ বলে আবার সতৃষ্ণ চোখে সমরেশকে বিদ্ধ করলেন।

সমরেশ পাত্তা দিল না। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার বাবা কী করতেন?’

‘আমার বাবা ছিলেন উত্তর বাংলার নয়নপুরের জমিদার— যদিও স্থায়ী ভাবে কলকাতায়ই থাকতেন।’

‘আপনার মাকে বিয়ে করবার জন্য উনিও কি ক্রিশ্চান হয়েছিলেন? দময়ন্তী প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ, ক্রিশ্চান হয়েছিলেন বটে, তবে পরে আর্য-সমাজের মাধ্যমে হিন্দু হয়েছিলেন। কেন হয়েছিলেন জানি না, বোধহয় সম্পত্তি পাওয়ার ব্যাপারে কোনো সুবিধে হয়েছিল।’

‘আপনার বাবা-মা বেঁচে আছেন?’

‘বাবা মারা গেছেন, মা বেঁচে আছেন।’

‘কোথায় থাকেন আপনার মা?’

‘আপাতত আছেন রাঁচিতে। বাবার মৃত্যুর পর এত মদ খেতেন যে সামলাতে পারেননি।’ নির্বিকার মুখে বলে গেল রেবেকা।

‘আপনি মদ খান নাকি?’ সমরেশের নির্ভীক প্রশ্ন।

‘নিশ্চয়ই। তবে ভয় পাবেন না, মার মতো আমি অসংযমী নই।’

‘আপনি খান কেন? আপনার স্বামী তো বেঁচে আছেন!’ পুনরায় সমরেশ।

রেবেকা আত্মগতভাবে বলল, ‘আমার স্বামী?’ বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর কিছুটা অন্যমনস্কভাবে বলতে আরম্ভ করল, ‘দেখুন, আপনারা এতক্ষণ আমাকে আমার সম্বন্ধে অনেক প্রশ্নই করলেন। এর দরকার ছিল না। কারণ আপনাদের যে-কথা বলার জন্য ডেকেছিলুম, আমার বিশ্বাস, তা শুনলেই আপনারা সব প্রশ্নেরই উত্তর পাবেন।

‘আপনারা জানেন কিনা জানি না, পশ্চিমবাংলায় জমিন্দারস অ্যাসোসিয়েশন বলে একটা সংস্থা আছে। মাঝে মাঝে ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে তার আসর বসে। এমনি একটা পার্টিতে আমার শ্বশুর ঈশ্বর জগদীশ আচারিয়া আমাকে দেখে তাঁর পুত্রবধূ বলে নির্বাচন করেন এবং সেখানেই আমার বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব ঠিকঠাক করে ফেলেন।’

দময়ন্তী বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘উনি কি আপনার দাদামশায়ের কথা বা আপনার বাবার ক্রিশ্চান হবার কথা জানতেন?’

‘হ্যাঁ, জানতেন, কিন্তু আমাকে দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে সেগুলো বিবেচনার মধ্যে আনেননি। ওঁর বয়স যদি ষাটের ওপর না হত, তাহলে হয়তো পুত্রবধূ না করে নিজেরই বধূ করে ফেলতেন।’ বলে নিজের রসিকতায় নিজেই এমন একটা হাসি হাসল— যা শ্বশুরের প্রতি সম্মান বা শ্রদ্ধার ইঙ্গিত বহন করে না।

বিরক্ত মুখে দময়ন্তী চুপ করে রইল। আর কোনো প্রশ্ন আসছে না দেখে রেবেকা শুরু করল : ‘আমার তখন বয়স সতেরো, সেন্ট ক্যাথারিনে ইন্টার মিডিয়েট পড়ি আর আমার স্বামীর বয়স তখন বত্রিশ— বাহ্যত কিছুই করেন না। দেহমনের মিলনের জন্যে পনেরো বছরের বয়সের তফাতটা এমন কিছুই নয়, কিন্তু অনেকগুলো কারণে আমাদের ক্ষেত্রে মিলনটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আমার স্বামী আমাকে বাড়ি থেকে প্রায় বেরই করে দিতেন, নেহাত আমার শ্বশুরের জন্য সেটা সম্ভব হয়নি।

‘আমার স্বামী যে কোনো নিরিখেই ছিলেন অপদার্থ। অথচ আত্মম্ভরিতা এবং অহঙ্কারের সীমা ছিল না। লোকে অপদার্থ হলেই নীচ হয় না, কিন্তু অপরিসীম ইগো তাঁকে মাঝে মাঝে ইতরের পর্যায়ে টেনে আনত।

‘বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম, অরবিন্দ আচারিয়ার স্ত্রী হিসেবে জীবন কাটানো আমার সাধ্যাতীত। চলেই আমি যেতুম, পারিনি আমার শ্বশুরের জন্য। সেই বৃদ্ধ আশা করেছিলেন আমি তাঁর ছেলেকে সুস্থ, সৎ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারব। সেটা যখন পারলুম না, তখন উনি আমাকে দোষ দিলেন না— দিলেন ছেলেকে। এ জন্যে নয় যে তিনি একজন খুব র‌্যাশনাল লোক ছিলেন, বরং এ জন্যে যে তিনি আমাতে পুরোপুরি ইনফ্যাচুয়েটেড হয়েছিলেন।’

সোফার ভেতর থেকে দময়ন্তীর হিমশীতল কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আপনার শ্বশুরের প্রতি আপনার তো খুব একটা শ্রদ্ধা আছে বলে মনে হচ্ছে না মিসেস আচার্য!’

‘একেবারেই না। আমার স্বামীটি ওয়াজ ওনলি এ চিপ অব দি ওল্ড ব্লক— যাকে বলে বাপকা বেটা। যাক, ভদ্রলোক মারা গেছেন, তাঁর আত্মার শান্তি হোক। উনি যখন দেখলেন ছেলে সৎপথে তো ফিরলই না, অবশ্য ফেরা তখন সম্ভবও ছিল না, উলটে সে যে তার বউকেই বাড়ি থেকে বের করে দেবার তাল করছে, তখন ভদ্রলোক একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলেন। উইল করে উনি বাড়ির এ অংশটা আমাকে দিয়ে গেলেন, ও অংশটা ছেলেকে আর একতলার মালিকানা দুজনকেই একসঙ্গে। আমাদের মৃত্যুর পর একে একে এ অংশগুলো যাবে আমার ননদের ছেলে বিদ্যুৎপ্রকাশের হাতে।

‘ভালো কথা। আমার বিয়ের দুবছর বাদে যখন আমার শ্বশুরের মৃত্যু হল, তখন এ-বাড়ির এ অংশটার আইনসংগত মালিক হলুম আমি। তখন বাবা মারা গেছেন, মা অর্ধ-উন্মাদ, আত্মীয়স্বজনদের বাবাই ত্যাগ করেছিলেন, এ অবস্থায়, স্বভাবতই আমি ঠিক করলুম যে আমি এখানেই থাকব। এবং তখন থেকেই শুরু হল যত গণ্ডগোল।

‘আমার স্বামী আর ননদের চিরকালই চক্ষুশূল ছিলুম আমি, আর আমিও এঁদের ভণ্ডামি আর ইতরামো সহ্য করতে পারতুম না। কিন্তু এখন সম্পর্ক দাঁড়াল সাপে-নেউলে। আমাকে তাড়ানোর জন্য ওঁরা উঠে পড়ে লাগলেন, কত চেষ্টা করলেন, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। কলকাতায় আমারও কিছু প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধব আছেন, তাঁরা অকাতরে সাহায্য করেছেন এবং এখনও করেন।

‘গত দশ বছরে নানারকম চেষ্টা হয়েছে, গুন্ডা লাগানো, অষ্টপ্রহর খোল বাজিয়ে সংকীর্তন, অশ্রাব্য গালিগালাজ, উড়ো চিঠি, কী নয়? কিছুতেই আমাকে নড়াতে পারেনি। কিন্তু এইবারে শুনেছি নাকি একটা নতুন রকম কী শুরু হয়েছে। এর আগেরগুলো ছিল সোজা সরল ব্যাপার, বুঝতে আমার কষ্ট হয় নি, তবে এবারে অনেক ঘুরপথে খুব রহস্যময় কিছু একটা ঘটছে— আমি ঠিক আঁচ করতে পারছি নে। ও ঘরে নাকি মাঝে মাঝে চোর আসছে অথচ কিছু চুরি যাচ্ছে না। হীরালালবাবুর বাড়ি থেকে নাকি একটা গুন্ডা ও ঘরের দিকে নজর রাখছে, কেন রাখছে তা কেউ জানে না। এবং এসমস্ত নাকি করাচ্ছি আমি, উদ্দেশ্য, মিস্টার আচারিয়াকে খুন করা।

‘এখন, একটা লোককে খুন করা বড়ো সহজ ব্যাপার নয়, আর অন্য একজনকে তার ষড়যন্ত্রকারী বলাও বড়ো ছোটো অভিযোগ নয়। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমাকে সাবধানে থাকতে হয়। কিন্তু এ-ব্যাপারটা যে লাইনে চলছে তাতে আমি কীভাবে সাবধান হব বুঝতে পারছি না। কাজেই আমি স্থির করলুম, মিসেস দত্তগুপ্তকে সবকথা খুলে বলব। ভেবেছিলুম, ওরা আমার নামে সবাইকে যা বলে তা আপনাদেরও বলবে, তাহলে সে-কথাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমার জবানবন্দি দেওয়াটা সহজ হবে। তা যখন হল না, তখন আমাকে এতগুলো কথা বলতে হল, হয়তো আপনারা বিরক্ত হলেন। যা হোক, আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, এই চোর আসা, নজর রাখা বা খুনখারাবি— এসব কিছুই আমি জানি নে, এদের কোনোটার সঙ্গেই আমার কোনোরকম সম্পর্ক নেই। এবার বলুন মিসেস দত্তগুপ্ত, আপনার কি কোনো প্রশ্ন আছে?’

‘আছে।’ সোফার ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘আপনার শাড়িজামা আপনি শেষ কখন বদল করেছেন?’

রেবেকা কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে রইল, তারপর রাগত হেসে বলল, ‘আপনারা আসার মিনিট দুয়েক আগে। আপনারা বোধহয় আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করলেন না, না?’

‘করেছি। আপনি কী পারফিউম ব্যবহার করেন? ল্যাভেন্ডার?’

‘হ্যাঁ।’

‘হীরালালবাবুর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?’

‘অনেক দিনের। উনি সুদূর অতীতে কোনো সময়ে অমৃতদির প্যারামুর ছিলেন, আপাতত বন্ধু। অমৃতদির মাধ্যমেই আমার সঙ্গে পরিচয়।’

‘হীরালালবাবু সিনেমার প্রযোজক আপনি জানেন?’

‘জানি।’

‘বকুল সাঁতরা বলে কাউকে আপনি চিনতেন?’

‘মিসেস দত্তগুপ্ত, আপনার এসব প্রশ্নের উদ্দেশ্য কী আমি জানি না, যদি পরিষ্কার করে বলেন তো উপকৃত হই।’ রেবেকার গলা তখনও রাগত, ‘আমি আপনাদের ডেকে এনেছিলুম আমার সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করব বলে। তার জন্যে আপনাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতেও প্রস্তুত ছিলুম। কিন্তু আপনি যেসব প্রশ্ন করছেন, সেগুলো আমাদের মূল সমস্যাগুলোর সঙ্গে কি কোনোভাবে জড়িত? পাশের ঘরে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তার সঙ্গে আমার পারফিউম বা একটি মৃতা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল কিনা, ইত্যাদি প্রশ্নের কি কোনো সম্পর্ক আছে?’

‘আছে মিসেস আচার্য। আপনি জানেন কিনা জানি না, মূলত আমি রহস্যসন্ধানী নই, পেশাদার ডিটেকটিভ তো নয়ই, আমি ইতিহাসের অধ্যাপিকা। একজন ঐতিহাসিক তাঁর উপাদান সংগ্রহ করেন ভাঙা বাসনের টুকরো বা ছেঁড়া একচিলতে কাগজ থেকেও, কোনো কিছুই তাঁর কাছে অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত নয়। আমিও স্বভাবতই সেইভাবেই এগিয়ে থাকি, এই আর কী!’

হতাশ ভাবে কাঁধ নাচিয়ে রেবেকা বলল : ‘বেশ, আপনার যা খুশি প্রশ্ন করুন।’

‘হীরালালবাবুর সঙ্গে অমৃতপ্রভার অবৈধ সম্পর্ক ছিল বলে আপনি যা বললেন, তার কোনো প্রমাণ কি আপনার কাছে আছে?’

‘না। শ্বশুর মশায়ের মুখে শুনেছি, অমৃতদি পাশের বাড়িতে রীতিমতো লীলা চালাচ্ছিলেন হীরালালের সঙ্গে, ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরমশায়ই বিয়ে দিয়ে দেন। তারপর উনি শুধরে যান— অন্তত এই ব্যাপারে।’

‘হীরালাল কি তখনই ওই বাড়িটার মালিক?’

‘না। বাড়িটা পরিত্যক্তই ছিল। দুজনে ওটাকে কাজে লাগিয়েছিলেন, এই পর্যন্ত।’

‘বিনয়বাবু কেমন লোক? কী করেন উনি?’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রেবেকা, তারপর বলল, ‘উনি লোক খুব ভালো। দোষের মধ্যে ওঁর টাকা- পয়সা বেশি নেই, সেজন্য দিবারাত্র স্ত্রীর কাছে গঞ্জনা শোনেন। উনিও কিন্তু জমিদারের ছেলে, তবে ওঁদের জমিদারি ছিল কুষ্টিয়ায়, পার্টিশানের পর সব কিছু ওখানেই থেকে যায়। বিনয়ভূষণ তখন এম এ পাশ করে জমিদারি দেখাশোনা করছিলেন— ভারতে এসে বুদ্ধি করে আর্মিতে যোগ দেন।’

‘উনি কি তখন বিবাহিত?’

‘না। বিয়ে কিছুদিন পর হয়েছিল। ভারতে পালিয়ে আসবার পর বিনয়বাবুর প্রথম প্রথম খুব কষ্ট গিয়েছিল। বিয়ের পর আবার আর্মিতে যে মাইনে পেতেন, তাতে নাকি স্ত্রীর খরচা মেটাতে পারতেন না। শ্বশুর ভরতুকি দিতেন আর মেয়েকে নিজের কাছে রাখতেন।

‘রিটায়ার করার পর উনি কিছুদিন প্রফেসারি করেছিলেন, কিন্তু অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। শ্বশুরমশাই মৃত্যুর আগে প্রচুর সম্পত্তি মেয়ের নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন, এখন তাতেই ভালোভাবে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বেচারি ভদ্রলোক, স্ত্রীর খোঁটা খেতে খেতে বোধহয় অস্থির হয়ে গেলেন।

ভদ্রলোকের কিন্তু অনেক গুণ ছিল জানেন? ভালো ছবি আঁকতে পারতেন, চমৎকার সেতার বাজাতেন, সাহিত্যে অগাধ জ্ঞান ছিল, আবার কর্নেল চৌধুরী হিসেবে আর্মিতেও যথেষ্ট সুনাম কিনেছিলেন। কেবল টাকার অভাবে আর স্ত্রী অত্যাচারে ভদ্রলোক শুকিয়ে গেলেন।’

‘হীরালালবাবুর সঙ্গে বিনয়বাবুর পরিচয় আছে? থাকলে সম্পর্ক কেমন?’

‘পরিচয় আছে জানি, সম্পর্ক কেমন তা জানি না।’

‘আপনার সঙ্গে বিনয়ভূষণের সম্পর্ক কেমন?’

‘উনি আমাকে পছন্দ করেন।’

‘আপনার স্বামী বললেন যে তাঁর চাকর পঞ্চা তাঁকে ফেলে পালাতে পারে না। কেন জানেন?’

‘কারণ, আমি যদ্দূর জানি, পঞ্চা একজনকে খুন করেছিল এবং তার সমস্ত প্রমাণ মিঃ আচারিয়ার কাছে আছে। তার ওপর পঞ্চা হাঁপানিতে ভোগে, ও জানে যে ও বেশিদিন পালিয়ে বা লুকিয়ে থাকতে পারবে না। সেই জন্য মিস্টার আচারিয়ার ক্রীতদাসগিরি করে।’

শিবেন বলে উঠল, ‘এ যে ব্ল্যাকমেল!’

দময়ন্তী বলল, ‘ঠিক তাই। আচ্ছা মিসেস আচার্য, আপনার স্বামীর কবে থ্রম্বোসিসের স্ট্রোক হয়?’

‘ওঁর স্ট্রোক হয়নি।’

‘সে কী! তবে যে পক্ষাঘাত?’

‘ওটা সিফিলিটিক প্যারালিসিস।’

সকলে স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে বসে রইল। রেবেকা আবার প্রশ্ন করল : ‘এবার বলুন মিসেস দত্তগুপ্ত, আমি কী করব?’

‘কিচ্ছু করবেন না। গ্যাঁট হয়ে বসে থাকুন।’

.

১০

শিবেন বলল, ‘সিনেমার তো বারোটা বেজে গেল। তা হোক, তবু চারটে সিনেমার দাম উঠে গেছে। বাপস, এক শনিবারের পক্ষে যথেষ্ট করমুক্ত প্রমোদ।’

রমলা জিজ্ঞেস করল, ‘এত যে প্রমোদ হল তার থেকে বুঝলে টা কি?’

উত্তর দিল সমরেশ, ‘বুঝলুম, এ-বাড়িটাকে একটা মস্ত বড় বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেওয়া উচিত। এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপ— প্রতি ইঁট কাঠে বিষ।’

দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘হুঁ! কেমন যেন মনে হচ্ছে পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে, যবনিকা পতনের আর বোধহয় বেশি দেরি নেই।’

শিবেন চাবি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল, ‘অর্থাৎ? আপনি সন্দেহ করছেন ব্যাপারটা নেহাতই নোংরামো নয়? এর মধ্যে আরও ব্যাপার আছে?’

‘আছে।’ উত্তরটা দময়ন্তী দিল না, দিল অন্য একটি কণ্ঠস্বর। সবাই চমকে উঠে ফিরে তাকিয়ে দেখল, কখন যেন নিঃশব্দ পদসঞ্চারে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন অমৃতপ্রভা। ‘ব্যাপার আছে। তবে আপনারা ওই মেয়েছেলেটার ঘরে গিয়েছিলেন কি সেই ব্যাপারের সন্ধানে, না নোংরামোর খোঁজে?’

শিবেন এগিয়ে এল। কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘আপনি বোধহয জানেন না মিসেস রায়চৌধুরী, আমি পুলিশ। কীসের খোঁজে, কার কাছে, কখন আমি যাতায়াত করে থাকি, তার কৈফিয়ৎ আমি সাধারণ লোককে দিতে বাধ্য নই। আপনি দয়া করে নিজের চরকায় তেল দিন, তাহলে আপনারই মঙ্গল।’

অমৃতপ্রভার কণ্ঠস্বর এক পর্দা উঠল, ‘আমাদের কীসে মঙ্গল, তা আপনাকে বোঝাতে হবে না। কী জানেন আপনি? জানেন, ওই হারামজাদির প্রতি রাত্রে একটা পুরুষ হলে চলে না, তিন-চারজন দরকার হয়? তখন যে কী হল্লা হয়, তার খবর রাখেন?’

সমরেশ চোখ কপালে তুলে বলল, ‘বলেন কী? অর্জি?’

অমৃতপ্রভার গলা আর এক পর্দা উঠল, ‘অর্জি নয়তো কী? আমার ভাইটাকে তার নিজেরই বাড়ি থেকে তাড়ানোর কম চেষ্টা করেছ? মাতলামো, বেলেল্লাপনা, বদমায়েশি, কী নয়? নিজের স্ত্রী পাশের ঘরে বেশ্যাবৃত্তি করছে, এটা কতদিন একজন সহ্য করতে পারে?’

সমরেশ পূর্ববৎ জিজ্ঞেস করল, ‘বেশ্যাবৃত্তি? বলেন কী? টাকা-পয়সা নিয়ে?’

আর এক পর্দা উঠল, ‘টাকা-পয়সা নিয়ে ছাড়া কি? সুযোগসুবিধে, গহনাপত্র— এসব তো আছেই। হীরালালের মতো ছেলেকে পর্যন্ত ছলাকলায় ভুলিয়েছে। শুনতে পাচ্ছি, হীরালাল নাকি ওকে সিনেমায় চান্স দেবে। হীরালালকে আমি খুন করে ফেলব।’

দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তা আপনি পারেন।’ তারপর শিবেনের দিকে চেয়ে বলল, ‘চলুন শিবেনবাবু, যাওয়া যাক। আমাদের আর এখানে প্রয়োজন নেই।’

.

১১

পরদিন রোববার। সমরেশ বাজার করে এসে হাত মুখ ধুচ্ছিল, এমন সময় দরজার ঘণ্টি বেজে উঠল। বাথরুম থেকেই দময়ন্তীর অপ্রসন্ন গলা শোনা গেল, ‘কী প্রয়োজন আপনার, বলুন?’

সমরেশ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বসবার ঘরে এসে ঢুকল। দরজায় কৃতাঞ্জলিপুটে বিনয়ভূষণ বিনীত হাস্যে দাঁড়িয়ে। বললেন, ‘আমার অপরাধ নেবেন না দয়া করে। আমি দূত মাত্র। আর জানেন তো, দূত অবধ্য?’ শ্যালকের মতো অতটা না হলেও ইনিও বেশ বাক্যবাগীশ।

সমরেশ হেসে বলল, ‘আপনাকে কেউ বধ করবে না, এ গ্যারান্টি আপনাকে দেওয়া হল। আপাতত কী সংবাদ সেটুকু জানা যাক।’

বিনয়ভূষণ অনাহূতই ঘরের মধ্যে ঢুকে এলেন। একটা সোফায় বসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই যে বলি। তা আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন!’

দময়ন্তী পূর্ববৎ অপ্রসন্ন মুখে বলল, ‘এখন এই সকালবেলায় তো আমার বসবার সময় নেই। আমার রান্না আছে। আপনি বরং সমরেশের সঙ্গে কথা বলুন।’

বিনয়ভূষণের হাসিটা একটু ক্ষীণতর হল বটে, কিন্তু একেবারে মিলিয়ে গেল না। বললেন, ‘না, না,সে তো বটেই। এখন তো কাজেরই সময়। তবে আমি খুব অল্প সময় নেব।’

‘বেশ, তাহলে চট করে সেরে ফেলুন।’

‘দেখুন, আমার সংবাদ প্রেরক দুজন। একজন আমার শ্যালক, অপরজন গৃহিণী। শ্যালক আপনাদের জানাতে বলেছেন যে, গতকাল রাত্রে আবার চোর এসেছিল এবং তিনি সেটা টের পান আজ ভোরবেলা ঘরের জানলা খোলা দেখে। আমি বেরোনো পর্যন্ত কোনো জিনিস খোয়া গেছে বলে জানা যায়নি, আমার স্ত্রী এখনও সব কিছু মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছেন। ভালো কথা, পঞ্চা চলে যাওয়ায় অন্য একটি ভালো চাকর না-পাওয়া পর্যন্ত আমরা ওই বাড়িতেই আছি।’

এই পর্যন্ত বলে বিনয়ভূষণ চুপ করে শ্রোতা দুজনের মুখের দিকে তাকালেন, বোধহয় কোনো প্রশ্ন আশা করেছিলেন। কিন্তু দুজনেরই নির্বিকার মুখ দেখে আবার শুরু করলেন, ‘দ্বিতীয় সংবাদ পাঠিয়েছেন আমার স্ত্রী এবং তার দায়িত্ব আমার তো নয়ই, আমার শ্যালকেরও সম্ভবত নয়।’

বাধা দিয়ে দময়ন্তী বলল, ‘তাহলে সেটা আপনার স্ত্রী এসে বললেই ভালো হত না?’

‘আমার স্ত্রী এসে বলবেন না। আর যেহেতু আমি তাঁর অর্ধ্বাঙ্গ এবং তাঁরই অর্থে পালিত, অতএব তিনি আমাকেই পাঠালেন। আমি বলা আর তাঁর বলা একই ব্যাপার।’

দময়ন্তী হতাশ হাসি হেসে বলল, ‘আচ্ছা, আপনার শ্বশুরবাড়ির সবাই তো তাঁদের ইজ্জৎ নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত। আপনি তেমন নন বোধহয়, তাই না?’

ম্লান হেসে ভদ্রলোক বললেন, ‘ওদের টাকা আছে, তাই ওদের ইজ্জৎ আছে। আমার টাকা নেই— থাকলে কী হত বলা যায় না।’

‘বেশ, আপনার স্ত্রীর কী বলবার আছে, বলে ফেলুন তাহলে।’

‘হ্যাঁ। উনি আপনাদের জানাতে বলেছেন যে, যদিও গতরাত্রের চোর আসা নিয়ে তাঁর ভাই খুবই ভয় পেয়ে গেছেন, তথাপি আচার্য পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে তিনি আপনাদের ওপর আর এই ঘটনার দায়িত্বভার রাখতে দিতে চান না। আজ পর্যন্ত এই তদন্ত চালানোর জন্য যা টাকা-পয়সা আপনাদের খরচ হয়েছে, সেটুকুর একটা বিল দিলে তাঁর ভাই তৎক্ষণাৎ সেটা মিটিয়ে দেবেন।’

দময়ন্তী রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল। বলল, ‘আপনার স্ত্রীকে বলে দেবেন, আমি প্রফেশনাল ডিটেকটিভ নই। পরিচিত বা অসহায় কেউ বিপদে পড়লে, তাকে একটু সাহায্য করি মাত্র। আমি যদি আগে জানতুম যে, অরবিন্দবাবুর আপনার স্ত্রীর মতো একজন সহায় আছেন, তাহলে আমি ও-বাড়ির ত্রিসীমানা মারাতুম না।’

ছদ্ম-বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করলেন বিনয়ভূষণ। বললেন, ‘আপনি কী নেন না? হায় হায়! সেটা আগে জানলে তো আমার গিন্নিই আপনাকে বাড়ির ত্রিসীমানা মাড়াতে দিতেন না। যদি বলতেন, আমার ফি চার হাজার টাকা, তাহলে নির্ঘাৎ বসবার জন্য চৌকি এগিয়ে দিতেন, এমনকী এক গেলাস শরবতও হয়তো কপালে জুটে যেত।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন।

বিনয়ভূষণ বিদায় নিয়ে চলে গেলে দময়ন্তী বলল, ‘আজ পর্যন্ত যত কটা কেস করলুম, এরকম নোংরা আর অর্থহীন কেস একটাও পাইনি। অরবিন্দবাবুর চোর যে-উদ্দেশ্যেই যাতায়াত করুক না কেন, আমি আর তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার রীতিমতো গা-ঘিনঘিন করছে।’

সমরেশ সর্বান্তকরণে কথাটা সমর্থন করল।

.

দ্বিতীয় পর্ব

.

তার পরের দিন দোসরা অক্টোবর। সমরেশের আদেশ ছিল বেলা আটটার আগে যেন ওকে ডাকা না হয়। কিন্তু হায়, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।

সকাল সাতটার সময় টেলিফোনটা তীক্ষ্ন ব্যাকুল শব্দে বেজে উঠল। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এল দময়ন্তী। সমরেশ বিছানা থেকে হেঁকে বলল, ‘যে-ই ফোন করে থাক, আমার হয়ে তাকে খুবসে গালাগাল করে দিয়ো।’ বলে পাশ ফিরে পুনরায় ঘুমোতে গেল।

কিন্তু দময়ন্তীর আর্তনাদ শুনে আর ঘুমোনো গেল না। ‘কে? রেবেকা আচার্য?’ দময়ন্তী যেন কথাগুলো ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছিল টেলিফোনটার ভেতরে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আসুন।’ বলে শেষ করল।

খাটের ওপর উঠে বসেছিল সমরেশ। জিজ্ঞেস করল, ‘কে ফোন করেছিল? রেবেকা আচায্যির কি হয়েছে?’

দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বলেছিলুম না, তোমার আচায্যিবাড়ির পাপের ঘড়া পূর্ণ হতে আর বেশি দেরি নেই? বোধহয় শেষ অঙ্কের অভিনয় শুরু হয়ে গেল। রেবেকা খুন হয়েছে, রাইফেলের গুলিতে। পুলিশ তোমার অরবিন্দদা-কে গ্রেপ্তার করেছে, অকাট্য প্রমাণ নাকি পাওয়া গেছে। শিবেনবাবু আসছেন। এলে বিস্তারিত শোনা যাবে। আর জামাকাপড় পরে তৈরি থাকো। আমাদের নাকি যেতেই হবে।’

পনেরো মিনিটের মধ্যে শিবেনের জিপ এসে গেল। ততক্ষণে সমরেশ রেডি, দময়ন্তী প্রায় রেডি।

সমরেশ বলল, ‘ওই বাড়িটাতে তুই আবার আমাদের যেতে বলিস?’

‘কী করব?’ শিবেন বলল, ‘অরবিন্দ আচার্য আমাদের অনুরোধ করেছেন তোর গিন্নিকে নিয়ে যাওয়ার এবং তদন্তে অংশগ্রহণ করবার। আমরা অফিসিয়ালি সে অনুরোধ অনুমোদন করেছি।’

‘বেশ করেছ, মানে, ডুবিয়েছ।’

শোবার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল দময়ন্তী। বলল, ‘ভালোই করেছেন শিবেনবাবু। এর শেষটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা জানার বেশ কৌতূহল ছিল। চলুন, যাওয়া যাক।’

.

গাড়িতে উঠে দময়ন্তী বলল, ‘এটা কীরকম হল শিবেনবাবু? এরকম তো কথা ছিল না!’

শিবেন বলল, ‘আপনার তদন্তে কী বেরোবে জানি না, কিন্তু আমার এখন ধারণা যে কথাটা গোড়াগুড়ি এরকমই ছিল। এর আগে আপনি একদিন প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, পাশের ঘরে স্বামী বিকট আর্তনাদ করলেও স্ত্রী আসেন না কেন আর অরবিন্দ আচার্যের পুলিশের প্রতি অদৃষ্টপূর্ব অ্যালার্জিই বা কেন? এর উত্তর আমার বোধহয় প্রথমত স্বামী আদৌ চিৎকার করেননি, দ্বিতীয়ত, এই জটিল দীর্ঘায়িত ষড়যন্ত্র থেকে পুলিশের ছায়া পর্যন্ত যত দূরে রাখা যায়, ততই ভালো।

‘ওই হতভাগার পেয়ারের অরবিন্দদার কথাবার্তা শুনে আমি প্রথমেই বলেছিলুম যে এসব আদিখ্যেতা। আমি খুন হলুম, আমি খুন হলুম, বলে চ্যাঁচামেচি করে সাধারণ লোকের দৃষ্টিটা অন্যদিকে নিয়ে গেলুম, আর সকলের সহানুভূতিতে ঘোলাটে দৃষ্টির সুযোগ নিয়ে নিজেই একটা প্রাণ নষ্ট করে ফেললুম। এরকম ঘটনা আমাদের দেখা আছে। আসলে চোর-ফোর সব ভাঁওতা।’

‘ঘটনাটা কী ঘটেছে?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।

‘রেবেকা আচায্যি নিহত হয়েছেন। আজ সকাল ছটার সময় পঞ্চার মা পাশের বাড়ির অর্থাৎ হীরালালের বাড়ির কম্পাউন্ডের ভেতরে যায় কিছু ফুল পাড়তে— এদিকে তো গাছপালা বলতে কিছু নেই। তখন দুই বাড়ির মাঝে লোহার দরজাটার মুখে রেবেকাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে। রাইফেলের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে, রাত দুটো থেকে তিনটের ভেতরে। রাইফেলটা পাওয়া গেছে অরবিন্দদার ঘরের ঠিক নীচে, মাটির ওপর।’

‘আঙুলের ছাপ?’

‘কিছু নেই। অরবিন্দের ঘরে পাওয়া গেছে একজোড়া দস্তানা আর একটা টেলিস্কোপিক সাইট।’

‘অরবিন্দ কী বলছেন?’

‘বলছেন যে উনি কিছুই জানেন না।’

‘রাইফেলটা কার?’

‘ওঁদেরই। বয়েস কালে ভাইবোন দুজনেই ভালো শ্যুটার ছিলেন।’

‘আচ্ছা? এটা তো জানা ছিল না। বোনটিও তো বাড়িতেই আছেন। উনি কী বলেন?’

‘উনিও কিছুই জানেন না।’

‘হুঁ। হীরালালের বাড়িটা চেক করেছেন?’

‘না তো! ও-বাড়ি তো তালাবন্ধ। বলেন তো চাবিটা আবার আনিয়ে নিই?’

‘হ্যাঁ, নিন।’

‘গুলিটা কীভাবে ঢুকেছে?’ সমরেশ প্রশ্ন করল।

‘ওপর থেকে নীচে, মানে, গলার একটু নীচ দিয়ে ঢুকে কোমরের কাছে বেরিয়ে গেছে।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কেউ কোনো শব্দ শোনেনি?’

‘নাঃ! অরবিন্দ নাকি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, অমৃতপ্রভা না কি মোষের মতো ঘুমোন আর বিনয়ভূষণ মাঝরাতে শব্দ একটা শুনেছিলেন বটে, তবে ওঁর মনে হয়েছিল ওটা রাস্তায় টায়ার ফাটার শব্দ, তাই পাত্তা দেননি।’

‘গুলিটা পাওয়া গেছে?’

‘হ্যাঁ। ফোরেনসিক ল্যাবেরটরিতে ব্যালিটিক এক্সপার্টের কাছে পাঠানো হয়েছে রাইফেল আর গুলি দুটোই।’

সমরেশ বলল, ‘আচ্ছা, ভালো কথা, সেদিন তুমি হীরালালবাবুর বাড়ি দেখে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললে, দুটো রহস্যের সমাধান হয়ে গেল, কী রহস্য?’

দময়ন্তী হেসে বলল, ‘ওঃ, তেমন কিছু নয়। দেখলে না, শিবেনবাবুর গাড়ি আর হীরালালবাবুর গাড়ি দুটোই এক মডেলের সাদা ফিয়াট। দূর থেকে দেখলে তফাত বোঝা যায় না। তাইতে বুঝলুম, যিনি আসছিলেন তিনি হীরালালের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলেন, নাগেশ্বরের সঙ্গে নয় আর তাঁর ভ্রমের কারণ শিবেনবাবুর গাড়ি, এই আর কী।’

শিবেন বলল, ‘মহিলাটি কে বলে আপনার মনে হয়? ল্যাভেন্ডার তো দেখলুম ও-বাড়ির সব কটি মহিলাই মেখে থাকেন।’

দময়ন্তী বলল, ‘অরবিন্দবাবুর ঘর থেকে পাঁচিলের দরজাটা দেখা যায়, কারণ ওদিকে কোনো গাছপালা নেই, আর উনি সারাদিন জানলায় বসে। এ অবস্থায় মহিলাটি কে হতে পারেন, সেটা তো বুঝতেই পারছেন?’

‘বুঝলুম’, শিবেন বলল, ‘রেবেকা’। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে গাড়ি চালাতে লাগল।

.

আচার্য ভবনের সদর দরজার সামনে চত্বরের ওপর একটা মৃতদেহ সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে শোয়ানো হয়েছে। পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছেন মুহ্যমান অরবিন্দ। বাড়ির মূল চাতালে ওঠবার চওড়া সিঁড়ির একধারে বসে আছেন প্রস্তরমূর্তিবৎ অমৃতপ্রভা, যদিও তাঁর বিশাল চক্ষুদ্বয় মাঝে মাঝেই ভাঁটার মতো বনবন করে ঘুরে যাচ্ছে সকলের ওপর দিয়ে, আর অন্যপাশে বসে আছেন বিনয়ভূষণ, আর একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। এছাড়া আছে পদমবাহাদুর, কিছু সেপাই, দারোগা ইত্যাদি।

শিবেন জিপ থেকে নেমে বলল, ‘মৃতদেহ স্পট থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে, কারণ ওখানে তো বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। তবে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না বউদি, সব অ্যাঙ্গেলেই ছবি তোলা আছে।’

দময়ন্তী ততক্ষণে নেমে পড়েছে। বলল, ‘ঠিক আছে, তাতে কোনোই অসুবিধে হবে না।’

‘আপনি ডেডবডি পরীক্ষা করতে চান?’ শিবেন জিজ্ঞেস করল।

মাথা নাড়ল দময়ন্তী। বলল, ‘নাঃ! কী হবে?’

চিন্তিত মুখে বেশ কিছুক্ষণ নীরবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দময়ন্তী, তারপর চটকা ভেঙে বলল, ‘শিবেনবাবু, হীরালালবাবুকে একবার টেলিফোন করে আসতে বলবেন?’

শিবেন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে একজন কনস্টেবলকে ডেকে কী সব বুঝিয়ে বলল। ইতিমধ্যে স্থানীয় দারোগা এগিয়ে এসেছেন, শিবেনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার উনি কি কাউকে জেরা করবেন?’

‘করবেন নাকি বউদি?’ শিবেন প্রশ্ন করল।

‘করব। তবে তার আগে আপনাদের নেওয়া জবানবন্দিগুলো যদি একবার দেখতে পেতুম তো ভালো হত।’

শিবেনের আদেশে রাইটার কনস্টেবল তাড়াতাড়ি জবানবন্দির খাতাটা এগিয়ে দিল।

.

প্রথমে শ্রী অরবিন্দ আচার্য। পিতার নাম ঈশ্বর জগদীশ আচার্য, বয়স বিয়াল্লিশ। নিয়মিত রোজগার বাড়িভাড়া আর মুকুন্দপুরের কিছু জমিজমার আয়। হ্যাঁ, নিহত মহিলাটি আমার স্ত্রী। আমাদের দশ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। ওঁর নাম রেবা, পিতা ঈশ্বর সুরপতি চৌধুরী। না, কাল আমার সঙ্গে ওঁর কোনোরকম কথাবার্তা হয়নি, প্রকৃতপ্রস্তাবে গত ন বছর ধরেই ওঁর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। বাক্যালাপ তো ছিলই না। উনি আলাদা থাকতেন। ওঁর রোজগারও ছিল এই বাড়িভাড়া, অন্য কোনো আয় ছিল কিনা বলতে পারব না। আমাদের সম্পর্কছেদের কারণ পারস্পরিক মানসিকতার তফাত, তবে উনি এ-বাড়িতে থাকতেন আমার বাবার উইলের জোরে। বাবা তাঁর পুত্রবধূকে স্নেহ করতেন, তাই এরকম ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন এবং আমিও তাতে কোনো আপত্তি করিনি। না, ওঁর স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল তা আমার জানা নেই। উনি গভীর রাত্রে পাশের বাড়িতে কেন যাচ্ছিলেন, তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, আমার শোবার ঘরের জানলা দিয়ে ওঁকে গুলি করে মারা সম্ভব, কিন্তু আমি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আমার বাবার উইলের জোরে উনি এ-বাড়িতে বসবাস করছেন বলে আমার বিরক্তির বা উষ্মার কারণ হবেন কেন? সম্পত্তি? রেবার মৃত্যুর পর তো স্বাভাবিক ভাবেই আমার বাবার সম্পত্তি তাঁর দৌহিত্রের কাছেই ফিরে যাচ্ছে। অস্বস্তি? কিছু নয়। সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের লোকেরা কি পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকে না? তারা কি পরস্পরকে খুন করে থাকে? হ্যাঁ, রাইফেলটা আমার, আমি এককালে বেঙ্গল শ্যুটিং ক্লাবের মেম্বার ছিলাম। ওটা ওখানে কী করে গেল, আমার তা জানা নেই। হ্যাঁ, এই দস্তানা জোড়া আমার, শীতকালে আমার হাত-পা ফোলে, তখন দস্তানা আর গরম মোজা পরে থাকা ডাক্তারের আদেশ। হ্যাঁ, চিনি, এটা রাইফেলের টেলিস্কোপ। আমার খাটের নীচে কী করে গেল, তা আমি কী করে বলব? এটা থাকে আমার ওয়ার্ডরোবে, সেখানে রাইফেলটাও থাকত। হ্যাঁ, আমি ভালো করেই ভেবে দেখেছি। আমি কাল সারা রাত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছি, কোনো কিছুই শুনিনি।

দ্বিতীয়, শ্রীমতী অমৃতপ্রভা রায়চৌধুরী। স্বামীর নাম বিনয়ভূষণ রায়চৌধুরী, ঠিকানা গোবিন্দ মিত্রের গলি, শ্যামবাজার। আমি অরবিন্দের দিদি। গত কয়েকদিন যাবৎ আমরা এ-বাড়িতে আছি আমার ভাইকে দেখাশোনা করবার জন্য, কারণ ওর চাকর পালিয়ে গেছে। সাহায্য করবার কেউ না থাকলে ওর খুব অসুবিধে হয়। হ্যাঁ, ওর সঙ্গে রেবার কোনো সম্পর্ক ছিল না তা আমি জানি, তবে সম্পর্ক না থাকার কারণ আমার মনে নেই। মনে না থাকাই স্বাভাবিক, কারণ সে প্রায় দশ বছর আগেকার কথা, কোনো একটা কারণে মনোমালিন্য হয়েছিল হয়তো, যার ফলে সম্পর্ক ছেদ হয়। পরে ছেদটা থেকেই যায়, কারণটা মনে থাকে না। ডিভোর্স হয়নি, তার কারণ তখনও হিন্দু কোড বিল পাশ হয়নি, যখন হয় তখন আমার ভাই শয্যাশায়ী। আমার বাবা উইল করে এ-বাড়ির অর্ধেক রেবাকে দিয়ে যান— সম্ভবত উনি রেবাকে খুব স্নেহ করতেন। রেবার মৃত্যুর পর এ-বাড়ি কে পাবে আমি জানি না, উইল আমি দেখিনি। রেবার স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল, তা আমি কেমন করে জানব? আমার সঙ্গেও ওর কোনো সম্পর্ক ছিল না। রেবা মদ্যপান করত কিনা, আমি জানি না। রেবার শোবার ঘরে আমি কোনোদিন ঢুকিনি, কাজেই ওর ঘরে জোড়া খাট কেন, তা আমার জানবার কথা নয়। হ্যাঁ, রাইফেলটা আমি চিনি, ওটা আমার বাবার ছিল। হ্যাঁ, আমি আর আমার ভাই, দুজনেই রাইফেল চালাতে জানি। না, কাল রাতে আমি কোনো শব্দই শুনিনি, আমার ঘুম অত্যন্ত গভীর। না, গত তিরিশ বছর আমি রাইফেল চালাইনি। শ্বশুরঘর করতে গিয়ে কোনো মেয়ে রাইফেল চালায়, একথা কখনও শুনেছেন? হ্যাঁ, আমার একটি ছেলে আছে, সে গত বছর খড়গপুর থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। না, চাকরি পায়নি, ওকে বিলেত পাঠানোর চেষ্টা হচ্ছে।

তৃতীয়, শ্রী বিনয়ভূষণ রায়চৌধুরী। পিতা ঈশ্বর বিমলভূষণ রায়চৌধুরী, বয়স আটচল্লিশ। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, কিছুদিন অধ্যাপনাও করেছিলেন। এখন ব্যাঙ্কে কিছু টাকা আছে আর পেনশনের আয়ে চলে যায়। না, রেবাকে আমি ভালো চিনতুম না। মাঝে মাঝে দেখেছি, এই পর্যন্ত। আশা করি বুঝতেই পারছেন, শ্যালকের পরিত্যক্ত স্ত্রীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার সম্ভাবনা কম ছিল। হ্যাঁ, আমি রাইফেল চালাতে পারি। হ্যাঁ, কাল রাত্রে একটা দড়াম করে শব্দ শুনতে পেয়েছিলুম, তবে মনে হয়েছিল রাস্তায় কোনো গাড়ির টায়ার ফাটল, তাই…। হ্যাঁ, সেনাবাহিনীতে ছিলুম, আর টায়ার ফাটার আওয়াজ আর রাইফেলের আওয়াজের তফাত বুঝিনে? কিন্তু আধো ঘুমের মধ্যে শব্দটা শুনেছিলুম, তাই ভালো বুঝতে পারিনি। তখন কত রাত খেয়াল করিনি।

চতুর্থ শ্রীযজ্ঞেশ্বর আদক। পিতা ঈশ্বর জগন্নাথ আদক, ঠিকানা গৌরাঙ্গ ঘাট, বজবজ। বয়স একান্ন। হ্যাঁ, মৃতাকে আমি চিনি, চিনি মানে মুখ চিনি, আর কী। না, কোনোদিন ওঁর সঙ্গে আমার বাক্যালাপ হয়নি। হ্যাঁ, আমি জানতুম উনি আচার্যবাবুর স্ত্রী, তবে ওঁদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল না, তাও জানতুম। আচার্যবাবু সন্দেহ করতেন যে ওঁর চরিত্র ভালো ছিল না, সেই জন্য সম্ভবত ওঁদের মধ্যে মেলামেশা ছিল না। একথা আমাকে কেউ বলেননি, আমার একরকম ধারণা। মিসেস আচার্যর বাড়িতে লোকজন কারা আসতেন বা না আসতেন, তা নজরে রাখার কথা আমার কোনোদিনই মনে হয়নি। সারাদিন ওই গুদোমের অন্ধকার ঘুপচির মধ্যে বসে থাকি, পাঁচটা বাজলে বাড়ি চলে যাই। আমি জানিনে কিছুই। না, আমি জীবনে কোনোদিন বন্দুক ছুঁইনি।

পঞ্চম শ্রীপদমবাহাদুর থাপা। পিতা বীরবাহাদুর থাপা। বয়স আটত্রিশ। হ্যাঁ, আমি রাইফেল চালাতে জানি। আমি কয়েক বছর গুর্খা রেজিমেন্টে ছিলাম। মিসেস আচার্যকে আমি চিনতুম,খুব ভালো লোক ছিলেন। আমার স্ত্রী লছমী তাঁর কাছে কাজ করত। উনি মাঝে মাঝে পাশের বাড়ি যেতেন। কেন যেতেন আমি জানি না। কাল উনি কখন গেছেন আমি জানি না, লক্ষ করিনি। সন্ধ্যে ছটার পর আদকবাবু ঘরে তালা লাগিয়ে চলে গেলে পর আমি গাড়িবারান্দার নীচে টুল পেতে বসি। না, কাল আমি সারারাত ছিলুম না। আটটার সময় ছুটি নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম, ফিরি রাত বারোটায়। আমায় ছুটি দিয়েছিলেন বড়দিদি। হ্যাঁ, মিসেস আচার্যর বাড়িতে লোকজন আসতেন, তাঁদের আমি চিনি না। কেউ কেউ রাত্রিবেলাও আসতেন, কখন যেতেন তার কোনো ঠিক ছিল না। না, কাল রাত্রে আমি কোনো শব্দ শুনিনি।

ষষ্ঠ, লছমী। স্বামীর নাম শ্রীপদমবাহাদুর থাপা। বয়স আটাশ। আমি মিসেস আচার্যর কাছে কাজ করতুম। উনি খুব ভালো মনিব ছিলেন। খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন, ভালো গান গাইতেন, ভালো সেতার বাজাতেন। ওঁর অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল, তাঁরা মাঝে মাঝে আসতেন, তবে তাঁদের আমি বড়ো একটা দেখিনি, তাঁদের সামনে আমার বেরোনো নিষেধ ছিল। তা ছাড়া রাত নটার পর আমার ছুটি হয়ে গেলে আমি নীচে চলে যেতুম, ঘরে গিয়ে রান্না করতুম। না, কাল বিশেষ কোনোই ঘটনা ঘটেনি, কারোর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটির কথাও আমি জানি না। হ্যাঁ, উনি রোজই মদ্যপান করতেন, সাধারণত সন্ধ্যেবেলা। মাঝে মাঝে বেসামালও হতে দেখেছি। হ্যাঁ, উনি মারা যাওয়াতে আমার খুবই দুঃখ হয়েছে।

.

দময়ন্তী খাতা বন্ধ করল। শিবেনকে জিজ্ঞেস করল, ‘পঞ্চুর মাকে জেরা করেননি কেন?’

শিবেন বলল, ‘জেরা করতে গিয়েছিলুম, কিন্তু সে এমন বদ্ধ কালা আর এমন উলটোপালটা কথা বলে যে সেসব আর টুকিনি। তার দিন-রাত্তির, উত্তর-দক্ষিণ, কোনো জ্ঞানই নেই।’

দময়ন্তী চিন্তিত গম্ভীর মুখে সাদা চাদরে ঢাকা মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ বলে উঠল, ‘শিবেনবাবু, রেবেকার পায়ে জুতো নেই কেন? নাকি খুলে রেখেছেন?’

শিবেন বলল, ‘জুতো ছিল না, বোধহয় খালি পায়েই গিয়েছিলেন। নিঃশব্দে যেতে হয়েছিল তো!’

‘পায়ের দিকের চাদরটা একটু সরান তো?’

চাদরটা সরাতে একজোড়া মরালশুভ্র পা অনাবৃত হল। দময়ন্তী এক নজর পায়ের তলাটা দেখে শিবেনকে বলল, ‘দেখুন।’

শিবেন দেখে গম্ভীর হল। বলল, ‘হুঁ, পায়ের তলাটা ময়লা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা তো নয়। আচ্ছা, এ তো হতে পারে,গুলি খেয়ে পড়ার পর পা থেকে জুতোজোড়া খুলে যায় এবং কোনো কুকুর সেটা মুখে করে অন্যত্র নিয়ে গেছে।’

‘হতে পারে।’ দময়ন্তী বলল, ‘একটু খুঁজে দেখবেন?’

‘দেখছি।’ বলে শিবেন একজন কনস্টেবলকে ডেকে কীসব আদেশ করল।

দময়ন্তী ততক্ষণে নীচু হয়ে চাদরটা আর একটু ওপরে তুলে দিয়েছে। বলল, ‘দেখুন’।

‘কী?’ শিবেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘শাড়িটা।’

‘শাড়িটার কী হয়েছে? গাঢ় সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ি।’

‘তা তো বটেই। শাড়িটা উলটো করে পরা রয়েছে।’

‘সে কী? আমি তো বুঝতে পারিনি!’

‘হ্যাঁ, এটাও আমার লাইন তো। আপনার পক্ষে বোঝা একটু কঠিন।’

‘বেশ, তা না হয় হল। কিন্তু এর থেকে আপনি কী অনুমান করছেন? তাড়াতাড়িতে উনি উলটো করে শাড়ি পরেছেন, এটা হতে পারে তো?’

‘পারে হয়তো।’ দময়ন্তী মৃদু হাসল।

খড়খড় করে মেন গেটটা খোলবার শব্দ হল। একটা সাদা ফিয়াট ভেতরে ঢুকে একটু এগিয়ে এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে নেমে এলেন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা চম্পালাল হীরালাল।

দময়ন্তী, সমরেশ আর শিবেন, তিনজনে একসঙ্গে গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। হীরালাল সহাস্যবদনে বললেন, ‘ব্যাপার কী মিস্টার সেন? হঠাৎ এরকম জরুরি তলব কেন? আপনারা তিনজনেই উপস্থিত, শ্যুটিং সংক্রান্ত কিছু নাকি?’

শিবেন মাথা নাড়ল। বলল, ‘শ্যুটিংই বটে! কাল রাত্রে মিসেস আচার্য ওয়াজ শট টু ডেথ।’

‘না!’ আর্তনাদ করে উঠলেন হীরালাল। ‘এ হতে পারে না, মিস্টার সেন, এ হতে পারে না।’

‘আমি দুঃখিত মিস্টার হীরালাল।’ শিবেন বলল, ‘মিসেস আচার্যর মৃতদেহ ওখানে রাখা আছে, একবার দেখে আসতে পারেন।’

হীরালাল ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন কিছুটা। মুখের আর্ত-ভাবটা আর নেই, তার জায়গায় একটা শীতল, কঠিন গাম্ভীর্য, চোখ দুটো ছোটো হয়ে এসেছে, চিবুক ঢুকে গেছে ভেতরে, চোয়ালের দুপাশ থরথর করে কাঁপছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিম্ন কণ্ঠে ভদ্রলোক যেন নিজেকে শোনাবার জন্য বললেন, ‘নাঃ, আমি দেখতে চাই না। ওই মাগি! ওই কুত্তি আমার জীবনটা বরবাদ না করে দিয়ে ছাড়বে না। আমি প্রতিশোধ নেব। আমি জানি কী করে এর প্রতিশোধ নিতে হয়।’ প্রতিটি শব্দের সঙ্গে ঝরে পড়ছে বিষাক্ত অসহায় ঘৃণা আর ক্রোধ।

তিনজন শ্রোতারই কান একদম খাড়া। দময়ন্তী যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আপনি কার কথা বলছেন, হীরালালবাবু? আপনি কার ওপরে প্রতিশোধ নিতে চান?’

দময়ন্তীর কণ্ঠস্বর কানে যেতেই যেন হ্যাঁচকা টানে সম্বিৎ ফিরে পেলেন হীরালাল। সজোরে গলা খাঁকারি দিয়ে সাময়িক উত্তেজনাটার শেষটুকু পর্যন্ত যেন বের করে দিয়ে বললেন, ‘কীসের প্রতিশোধ? ও একটা কথার কথা বললুম মিসেস দত্তগুপ্ত, ও কিছু নয়। আসলে আমার মাথার ঠিক ছিল না, কাল রাত্রে একটু অধিক পান হয়ে গেছে তো, কী বলতে কী বলে ফেলেছি। তা ছাড়া, আমার পরের ফিলমটায় মিসেস আচার্যর নামার কথা, সব ঠিকঠাক, কদিন পরেই কাজ আরম্ভ হচ্ছে, এখন এই ঘটনায় সমস্ত জিনিসটাই ওলোটপালোট হয়ে গেল। অনেকগুলো টাকার ব্যাপার তো! তা, এই এত সব কারণে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলুম।’

ইতিমধ্যে কখন যেন বিনয়ভূষণ ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঘটনার আকস্মিকতার আঘাতে তাঁর দীর্ঘ শরীরটা সামনে ঝুঁকে পড়েছে, সমস্ত মুখে বেদনার স্পষ্ট ছবি।

হীরালালের কথা শেষ হতেই সকলের চোখ পড়ল বিনয়ভূষণের ওপর। চারজনেই কিছুক্ষণ নতমস্তকে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর হীরালালের ভগ্নকণ্ঠে প্রশ্ন শোনা গেল, ‘এটা কীরকম হল, বিনয়? বকুল গেল, রেবাও?’

বিনয়ভূষণ খুব নীচু গলায় বললেন, ‘কপাল, হীরু, সবই কপাল।’ ওঁর চোখে জল চিকচিক করছে।

.

যজ্ঞেশ্বর আদকের অফিস ঘরটা প্রকাণ্ড, যে কোনো বড়ো কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বুকও ঈর্ষায় কাতর করে তোলবার মতন। কিন্তু আসবাবপত্রগুলো মোটেই আনন্দজনক নয়।

দময়ন্তী খুব সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বয়সের গাছপাথরহীন চেয়ারটা পর্যবেক্ষণ করল, তারপর ছারপোকার অবস্থান সম্পর্কে প্রায় নিঃসন্দেহ হওয়া সত্ত্বেও হতাশ হয়ে বসে পড়ল। ওর সামনের টেবিলটা চেয়ারটার চেয়েও বয়সে বড়ো, প্রায় প্রাগৈতিহাসিক বলা চলে, তার ওপর একখণ্ড কাচের নীচে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী মায় যিশুখ্রিস্টের ছবি পর্যন্ত চাপা দেওয়া আছে। ঘরে আরও দুটি চেয়ার আর একটা নড়বড়ে টুল। সমরেশ বিরাগপূর্ণ দৃষ্টিতে টুলটা দেখে ওর প্রকাণ্ড শরীরটা একটা চেয়ারেই প্রতিষ্ঠিত করল। শিবেন দাঁড়িয়ে রইল।

প্রথমে ডাকা হল হীরালালকে।

হীরালাল দময়ন্তীর উলটো দিকের চেয়ারটা অধিকার করে বসে সকলের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন। বললেন, ‘হাউ থ্রিলিং! নিন মিসেস দত্তগুপ্ত, আপনার জেরা শুরু করুন।’

‘মিসেস রেবেকা আচার্যকে আপনি কতদিন চেনেন?’ দময়ন্তী শুরু করল।

‘ওর বিয়ের পরদিন থেকেই।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ আচার্য পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বহু দিনের। অরবিন্দের বাবা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন, বোধহয় তাঁদের বাবারাও ছিলেন।’

‘আর আপনি কি অরবিন্দের অন্তরঙ্গ বন্ধু?’

‘না। আমাদের দুজনের একটা বিষয়ে চমৎকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে— আমি ওকে দুচক্ষে দেখতে পারি না, আর ও-ও আমাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না।’ বলে হাসলেন হীরালাল।

‘কেন?’

‘আমি মনে করি অরবিন্দ পণ্ডিতন্মন্য, বাকসর্বস্ব, অহংকারী, অকর্মণ্য, গণ্ডমূর্খ। আর সেও বোধহয় আমার সম্বন্ধে এই কথাই ভাবে। ও আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোটো, কিন্তু ওর প্রতি স্নেহ বা প্রীতি দুটোর কোনোটাই আমার কিছুমাত্র নেই।’

‘বিনয়ভূষণকে আপনি কতদিন চেনেন?’

‘বিনয় আর আমি সমবয়সি, এক কলেজে পড়তুম। আমার বাবা-ই অমৃত আর বিনয়ের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন।’

‘রেবেকাকে কে খুন করে থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’

‘রেবেকার বহু সন্দেহজনক চরিত্রের বন্ধুবান্ধব ছিল। ও যদিও লেখাপড়া জানত, বাজনা জানত, যথেষ্ট কালচারড ছিল, তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে একগাদা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জুটিয়ে এনে ফুর্তি করত। ও ছিল বলতে পারেন এক ধরনের স্কিজোফ্রেনিয়াক। তা, ওর সেই বন্ধুরা যে কেউ খুন করতে সিদ্ধহস্ত না হলেও পিছপা নয়।’

‘পুলিশ সন্দেহ করছে, অরবিন্দবাবু হত্যাকারী। আপনার কী মনে হয়, উনি এরকম কাজ করতে পারেন?’

‘কেন পারবে না? না পারার আছেটা কী?’

‘কাল রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন?’

‘কাল রাত্রে? কত রাত্রে? ধরুন, সন্ধ্যায় ছিলুম সামুরাই বারে, হুইস্কি খাচ্ছিলুম। সঙ্গে ছিল রাজেশ ওয়াধওয়া। সেখান থেকে গেলুম মিস্টার অ্যালেন বেকারের বাড়ি। সেখানে ডিনার খেলুম। সেখান থেকে আমি আর অ্যালান গেলুম মিস প্রিয়া কাপাডিয়ার বাড়ি, সেখানে একটা লেট নাইট পার্টি ছিল। রাত আড়াইটে নাগাদ মনে আছে আমি হুইস্কি খাচ্ছি, তারপরে আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন বেলা প্রায় আটটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শিবেনবাবুর তলব পৌঁছল।’

‘আপনাকে কারা বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল?’

‘আমার জানা নেই। আমার স্ত্রী বলতে পারবেন।’

‘আপনার দুজন সহনায়িকা যে পর পর নিহত হলেন, এর মধ্যে কি কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছেন আপনি? মানে, আপনার কোনো শত্রু এরকম কাজ করতে পারে বলে কি আপনার মনে হয়?’

‘হুম! এটা একটা নতুন কথা বললেন আপনি। আমার মাথায়ও চিন্তাটা আদৌ আসেনি। তা, এখন তো আপনাকে কিছু বলতে পারছি না। পরে চিন্তা করে জানাব খন। মানে, আমার শত্রুর সংখ্যা তো বড়ো কম নয়!’

‘বেশ, এবার আপনাকে শেষ একটা প্রশ্ন করব, উত্তরটা এড়িয়ে যাবেন না। রেবেকার মৃত্যু সংবাদ শুনে যে মহিলাটির কথা চিন্তা করে আপনি জ্বলে উঠেছিলেন, তিনি কে?’

অস্বস্তির হাসি হেসে উঠলেন হীরালাল। বললেন, ‘ওই দেখ, উত্তেজনার মাথায় কী বলতে কী বলে ফেলেছি, ঠিক কানে গেছে সেটা? আসলে, ব্যাপারটা সেরকম কিছুই নয়। মানে, আমার স্ত্রীর কথা বলছিলুম আর কী।’

‘আপনার স্ত্রী?’

‘হ্যাঁ, আমার স্ত্রী। উনি আমায় অভিশাপ দিয়ে রেখেছেন, যে ওঁর ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের ওপর যদি আমার দুর্বলতা কিছু জন্মায়, তবে সে মেয়েটা নির্ঘাৎ মারা যাবে। এখন ব্যাপার হচ্ছে, আমি সিনেমা লাইনের লোক, মাঝে মাঝে দুচারটে মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো সুন্দরীর সান্নিধ্যে আসতেই হয়। বুঝতেই পারছেন, বয়স হয়েছে, হৃদয়ের তেমন তেমন জোর তো আর নেই। কাজেই কখনো কখনো সান্নিধ্যটা ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। সব সময়েই যে আমারই দোষ তা নয়, অন্যপক্ষেরও অনুমোদন থাকে। তা আমার স্ত্রী সতিসাধ্বী মহিলা, তাঁর অভিশাপ পর পর দুবারই লেগে গেল। সেই জন্যেই ওঁকে গালাগালি করছিলুম আর কী।’

‘হুঁ! আচ্ছা, এ প্রসঙ্গে তাহলে কিন্তু আর একটা প্রশ্ন এসেই যায়। বকুল সাঁতরা আর রেবেকা, এরা দুজন ছাড়া আর কেউ কি আপনার হৃদয়-দৌর্বল্যের কারণ হয়েছিলেন? যদি হয়ে থাকেন, তাঁদের বেলাতেও কি আপনার স্ত্রীর অভিশাপ ফলে গিয়েছিল?’

‘দেখুন, হৃদয় আমার খুবই দুর্বল। এঁরা দুজন ছাড়া আর কেউ সেখানে প্রবেশ করেনি বললে ভয়ানক মিথ্যেবাদী বলে বাজারে আমার বদনাম হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, এঁদের দুজনের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক, যাকে বলে, বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। এতটা ঘনিষ্ঠতা আর কারোর সঙ্গেই হয়নি।’

দ্বিতীয় এল পঞ্চাননের মা। সে চেয়ারে বসল না, টেবিলের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে রইল। দময়ন্তী অনেক অনুরোধ করল, কিন্তু সে ভাবলেশহীন মুখে চুপ করে রইল।

‘তুমি কতদিন এ-বাড়িতে কাজ করছ?’ দময়ন্তী উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন করল।

‘আজ্ঞে?’

‘তুমি কতদিন কাজ করছ?’ শিবেনের চিৎকার বোধহয় শরৎ বোস রোডেও শোনা গেল।

‘আজ্ঞে?’

হতাশ হয়ে শিবেন বলল, ‘দেখলেন তো বউদি, বললুম না বদ্ধ কালা? শুনলেও বোঝে না কিছু।’

দময়ন্তী বলল, ‘হুঁ, কিন্তু গত শনিবার মোটেই বদ্ধ কালা ছিল না। ঠিক আছে, কথা যদি নাই বলে তাহলে পঞ্চা যে খুন করেছিল সেটা লালবাজারে জানাতেই হয়।’

পঞ্চার মা-র শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল, তারপর হাউমাউ করে বিকট কান্না, ‘ওগো, তোমাদের পায়ে পড়ি, অমন কথা বলো নি গো। আমি এখন কী করি রে বাবা, কোথায় যাই রে!’

দময়ন্তী বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন বলো তো, কে তোমাকে কালা-বোবা সেজে থাকতে বলেছে?’

‘দাদাবাবুগো। আমায় বলেছে কোনো কথাটি না কইতে। কইলে পঞ্চাকে ধরিয়ে দেবে বলেছে। আমি কোনো কথাটি কইতে পারব নি দিদিমণি, আমায় কইতে বোলো নি গো।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছ, তুমি যেতে পার।’

তৃতীয় এল পদম।

‘তুমি কাল রাতে বারোটায় বাড়ি ফিরে গাড়িবারান্দার নীচে বসে ছিলে, না ঘরে চলে গিয়েছিলে?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।

পদম নীরব।

‘জবাব দাও।’

শিবেনের পুলিশি ধমকেও কোনো কাজ হল না।

‘তুমি কি আচার্যবাবুর কাছ থেকে কোনো মাইনে পাও?’ দময়ন্তী আবার প্রশ্ন করল।

পদম নীরবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।

‘তুমি কাজে ফাঁকি দিলে কে তোমাকে গালাগালি করেন? আচার্যবাবু, না তাঁর বোন?’

‘দুজনেই।’ অস্ফুট স্বরে জবাব এল।

‘ঠিক আছে। তুমি যাও।’

.

‘এবার কাকে ডাকব, বউদি?’ শিবেন জিজ্ঞেস করল।

‘আর কাউকে আপাতত নয়।’

‘ব্যস?’

‘ব্যস!’

‘তাহলে বলুন এবার, কাকে সন্দেহ করলেন?’

‘সব্বাইকে।’

‘কীরকম?’

‘অরবিন্দ, অমৃতপ্রভা, বিনয়ভূষণ, পদম, লছমী, হীরালাল মায় যজ্ঞেশ্বর আদক।’

‘বলেন কী? একমাত্র পঞ্চাই বাদ দেখছি।’

‘যা বলেছেন, একমাত্র পঞ্চাই বাদ।’ দময়ন্তী গম্ভীর হল।

‘কেন? পঞ্চা বাদ কেন?’

‘কারণ পঞ্চানন বোধহয় বেঁচে নেই।’

‘আপনার তাই মনে হয়? আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।’

‘আপনার মনে হয় ওকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন অরবিন্দ? কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলেছেন, গোলমাল মিটে গেলেই আবার সে উদয় হবে?’

‘ঠিক তাই।’

সমরেশ বলল, ‘দ্যাখ, তুই যে একেবারে স্থির নিশ্চিত হয়ে বসে আছিস যে অরবিন্দদাই খুনি, সেটা বোধহয় খুব ঠিক হচ্ছে না। ওঁর ঘরের নীচেই বন্দুক, ওঁর ঘরের নীচেই মৃতদেহ, ওঁর খাটের নীচে দস্তানা, আর রাইফেলের টেলিস্কোপিক সাইট, সমস্ত জিনিসগুলোই বড়ো স্পষ্টভাবে অরবিন্দদাকেই নির্দেশ করছে না? অরবিন্দ আচার্য গাধা নন, খুনখারাবি করতে গেলে আর একটু সাবধান হতে পারতেন না কি? আমার তো মনে হচ্ছে, কেউ এই খুনের দায়িত্বটা ওঁর ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করছে।’

শিবেন বলল, ‘তুই ঠিকই বলেছিস। শুধু তুই কেন, তোর চেয়েও গবেট কেউ থাকলে সেও এ-কথাই চিন্তা করত। তিনিও জানেন যে তার মতো সকলেই এ অবস্থায় চিন্তা করবে যে, খুনটা কেউ ওঁর ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করছে। কাজেই নিজেই নিজের খাটের নীচে দস্তানা আর টেলিস্কোপ রেখে, বন্দুকটা জানলার নীচে ফেলে আর চোরের গালগল্প তৈরি করে এরকম একটা সিচুয়েশন তৈরি করেছেন। সফলও হয়েছেন বলতে হবে কারণ তোরই দৃষ্টি যখন ওঁর ওপর থেকে সরে কোনো অদৃশ্য আততায়ীর দিকে যাচ্ছে, তখন তো অন্যে পরে কা কথা। কী বলেন, বউদি?’

‘আমি কিছুই বলি নে’, দময়ন্তী বলল, ‘আমি তো বললুম, আমি সকলকেই সন্দেহ করি। আমার সামনের সূত্রগুলি নির্দেশ করছে যে, সকলেরই একসঙ্গে বা আলাদা আলাদা ভাবে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য যথেষ্ট মোটিভ আছে। আরও সূত্র না পেলে আমি আপনার মতো স্থির নিশ্চয় হতে পারছি না, এমনকী কোনো থিয়োরিও খাড়া করতে পারছি না।’

‘আর একটু বিশদ করে বলুন। সবাইকে সন্দেহ করছেন কেন?’

‘প্রথম ধরুন, অরবিন্দবাবু। তাঁর গিন্নির ওপর মারাত্মক আক্রোশ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু কতগুলো কারণে তাঁর সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ হতে পারছি না। প্রথমত, সমরেশ যে কারণগুলো বলল, সেগুলো। দ্বিতীয়ত, গত আট বছরে তিনি গৃহিণীকে ঘর ছাড়া করবার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কখনো প্রাণে মারবার চেষ্টা করেননি, রেবেকার সাক্ষ্যও তাই বলে। আজ হঠাৎ কী ঘটল যে আমাকে ডেকে এনে, স্টেজ সাজিয়ে, ঘরের সামনে বন্দুক আর খাটের নীচে দস্তানা ফেলে, এত ঘোরপ্যাঁচ করে তিনি কর্মটি করতে গেলেন? তৃতীয়ত, তাঁর ইগো পর্বতপ্রমাণ, কিন্তু তিনি উন্মাদ নন, বরং যথেষ্ট স্থিরমস্তিষ্ক। হঠাৎ রাগের বশে খুন করবেন, তা তো ননই, বরং বলব তিনি ঠিক খুন করবার টাইপই নন। আর রেবেকা যাই বলে থাক না কেন, তাঁর অসুস্থতা সন্ন্যাসরোগজাতই, সিফিলিস থাকতে পারে কিন্তু সিফিলিটিক প্যারালিসিস-এর একটা লক্ষণ স্মৃতিভ্রংশ— তা তাঁর মোটেও নেই। তাঁর সঙ্গে আমাদের প্রথম দিনের সাক্ষাৎকারেই স্পষ্ট বোঝা গেছে তাঁর অতীতের স্মৃতি মোটেই ম্লান হয়নি। কাজেই এহেন একটা অসুস্থ লোকের পক্ষে চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট দূরের একটা মুভিং অবজেক্টকে গুলি করে মারা আমার সম্ভব বলে মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, তাঁর একজন শাগরেদ থাকতে পারে, তিনি অমৃতপ্রভা, বিনয়ভূষণ, পদম, যজ্ঞেশ্বর, যে কেউ হতে পারেন।

‘এর পর ধরুন, অমৃতপ্রভা। ভয়ানক পসেসিভ মহিলা, হীরালালকে এখনও তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি বলে মনে করেন। সেই হীরালালের সঙ্গে রেবেকার মাখামাখি দেখে তাঁর মাথায় যে খুন চেপে গেছে, সে-কথা তো তিনিই বলেছেন। কিন্তু এই ইতরপ্রকৃতি, তপ্তমস্তিষ্কের মহিলা ঠান্ডা মাথায় খুন করেছেন নানারকম প্যাঁচালো প্ল্যান করে, বিশেষত তাঁর ভাইকে এর মধ্যে জড়িয়ে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

তৃতীয়ত, বিনয়ভূষণ। ভদ্রলোক স্ত্রীর অন্নে প্রতিপালিত, তাঁর ছেলে পাশ করে বেকার বসে আছে, এ অবস্থায় রেবেকাকে খুন করলে ইনডাইরেক্টলি তাঁর লাভ। রেবেকার সম্পত্তি তাঁর ঘরেই তো যাচ্ছে।’

সমরেশ বলল, ‘বিনয়ভূষণের রক্তে যদি নরহত্যা করবার এলেমই থাকত, তাহলে বহুদিন আগেই তিনি গিন্নিকে গলা টিপে মেরে ফাঁসি গিয়ে গাজি হতেন।’

দময়ন্তী বলল, ‘ঠিক কথা। এর পর ধরুন হীরালাল। তাঁর সঙ্গে রেবেকার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। এখন, প্রেমের ব্যাপার, অবশ্য একে যদি প্রেম বলেন, সেখানে কোথায় কী গেরো হয়ে আছে, কে জানে? সেই গেরোর ফেরেই হয়তো এই হত্যাকাণ্ড। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটা প্রেম কি? হীরালাল গত আট বছর ধরেই রেবেকাকে চেনেন, তার প্রতি লোভও হয়তো তাঁর ছিল, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা হয়েছে সম্প্রতি, তাও সম্ভবত রেবেকারই আগ্রহাতিশয্যেই, কারণ হীরালাল তাকে সিনেমায় নামাবেন। অতএব এই ঘনিষ্ঠতা যতটা ব্যবসায়িক, ততটা হৃদয়ঘটিত নয়। তাহলে রেবেকাকে খুন করে হীরালালের লাভ কী? আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি যে, বকুল সাঁতরাও একই অবস্থায় নিহত হয়। বকুল আর রেবেকার একমাত্র যোগসূত্র কি হীরালাল?

‘তবে, একটা খটকা লাগছে এই যে, মূলত হীরালাল স্মাগলার, সিনেমার প্রযোজনা করে কালো টাকা সরাবার একটা রাস্তা। এখন, লোকে খুন করে চূড়ান্ত মানসিক অব্যবস্থায়, যদি পাগল, পারভার্ট বা পেশাদার খুনি না হয়। এক্ষেত্রে প্রেমটা যদি বাদ দেওয়া যায়, তাহলে আর কী কারণ থাকতে পারে, যাতে অব্যস্থিতচিত্ত হয়ে হীরালাল তার ব্যবসার বাইপ্রোডাক্ট সিনেমার দু-দুজন সহনায়িকাকে খুন করবে?’

সমরেশ বলল, ‘মনোবিদ্যার তুমি কতটুকু জান আমি জানি না, কিন্তু ওই যে পারভার্ট বললে না, হীরালাল তো সেরকম কিছু হতে পারেন? শুনেছি, অনেক লোক এদিকে বাইরে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, অথচ ভেতরে কোনো বিশেষ অবসেশন বা আবেশে ভোগেন। এই আবেশ যে শুধু যাকে বলে রিরংসা বা ঈর্ষা থেকে উদ্ভূত হয় তা নয়, অনেক সময় এগুলো সহজাতও হতে পারে। যেমন ধর, জ্যাক দি রিপার। সে কেবল বেশ্যা খুন করে বেড়াত। কিংবা ধর, বস্টন স্ট্র্যাংগলার। সে কেবল বুড়ি মারত।’

শিবেন বাধা দিয়ে বলল, ‘তুই বলতে চাইছিস যে, হীরালালের ওই আবেশ না কী বললি, সেটা কেবল সিনেমার সহনায়িকাদের ওপর? দ্যাখ, ইয়ার্কির একটা সীমা আছে। আপনি ওর লেকচারে কান দেবেন না তো বউদি। বলুন, হীরালালের পরে আর কে?’

মৃদু হেসে দময়ন্তী আবার শুরু করল, ‘এর পর ধরুন, পদম আর যজ্ঞেশ্বর। পদম তো রাইফেল চালাতেই জানে, যজ্ঞেশ্বরও হয়তো জানেন তবে মিথ্যে কথা বলছেন। এখন, রেবেকার যেরকম ক্ষুধার্ত, জ্বলন্ত নারীত্ব ছিল, যার আঁচ সমরেশ কিছুটা পেয়েছিল, তাতে তার পক্ষে এদের মাঝে মাঝে নিজের শয্যায় ডেকে নেওয়া অসম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে একটা তীব্র হৃদয়ঘটিত নাটক গড়ে ওঠাই সম্ভব। আমরা হয়তো সেই নাটকেরই শেষ অঙ্কের অভিনয় দেখলুম। এখন, এই থিয়োরিটায় কল্পনার পরিমাণ এবং হয়তোর সংখ্যা এত বেশি যে আরও খোঁজ খবর না করলে কোনরকম স্থির সিদ্ধান্তে আসা চলে না।’

দময়ন্তী চুপ করল। শিবেন অনেকক্ষণ ধরে মাথা নীচু করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে নিজের বুটের ডগাটা পর্যবেক্ষণ করল, তারপর বলল, ‘চমৎকার! দিব্যি একজনকে খুনি সাব্যস্ত করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলুম, আপনি সর্বাংশে আমার মগজটা গুবলেট করে দিলেন। এখন মনে হচ্ছে, গুষ্টি শুদ্ধু সবাইকে গ্রেপ্তার করে লকআপে পুরে দিই।’

সমরেশ বলল, ‘করলে খুব অন্যায় করবি না। আমার বিশ্বাস, আমাদের যতই গুবলেট হোক না কেন, এরা প্রত্যেকেই কিন্তু জানে কে খুনি। দ্যাখ না, প্রত্যেকের জবানবন্দি কারকম চাপা চাপা! রেবেকাকে প্রায় চিনতুমই না, তার স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে কিছুই জানি না। যত সব ন্যাকামো। পাশের ঘরে থাকেন অথচ কিছু জানেন না, এহেন স্টেটমেন্ট যখন সকলেই করছে, তখন মনে হচ্ছে, এরা সব কিছু জানে এবং প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে এর সঙ্গে জড়িত। তুই সব কটাকে ধরে লকআপে ঢুকিয়ে দে, ঠান্ডি দাওয়াইও দিতে হবে না, সুড়সুড় করে কথা বেরিয়ে আসবে, দেখিস।’

হঠাৎ ঘরের বাইরে একটা চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল, ‘আমায় ছেড়ে দাও, যাও তুমি!’ গলা অরবিন্দের।

শিবেন তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিল, কিন্তু দরজার কাছে বাধা পেল। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন অরবিন্দ, তাঁর জরাগ্রস্ত মুখ বর্ণনাতীত ঘৃণায় বিকৃত। তাঁর গলায় চাপা কর্কশ গলায় ব্যাঙ ডেকে উঠল, ‘সমরেশ! তোমাদের এখানে ডেকে আনা হয়েছিল আমার স্বার্থরক্ষার জন্য, আমার পরিবারের সবাইকে জেলে ঢোকানোর পরামর্শ দিতে নয়। শিবেনবাবু, এঁদের আমার প্রয়োজন নেই, আপনি এঁদের যেতে বলুন।’

‘আপনার প্রয়োজন না থাকতে পারে, আমাদের আছে।’ অরবিন্দের কথার পিঠে বলল শিবেন, ‘আপনি ওঁকে আসতে বলেছিলেন তদন্তে অংশগ্রহণ করবার জন্য, আপনার স্বার্থরক্ষার জন্য নয়। এবং শুধু আপনি নন, আমরাও রাষ্ট্রের তরফ থেকে ওঁকে অনুরোধ করেছি প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করতে আমাদের সাহায্য করতে। এতে যদি আপনার স্বার্থ রক্ষিত না হয়, তার জন্য ওঁকে এখান থেকে চলে যেতে বলতে পারি না। স্বার্থরক্ষার জন্য বহু উকিল বা পেশাদার উকিল রয়েছে, আপনি তাদের সাহায্য নিতে পারেন।’

ব্যাঙ এবার আরও ক্রুদ্ধ। গর্জন হল, ‘এটা আমার বাড়ি শিবেনবাবু।’

শিবেন অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, ‘এক্ষেত্রে সেটা একটা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় তথ্য, অরবিন্দবাবু।’

অরবিন্দ রক্তাক্ত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালেন, সে-দৃষ্টিতে অসহায় জিঘাংসা ঝরে পড়ছে। তারপর যখন পেছন ফিরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন, দময়ন্তী মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘বাইরে আপনার সঙ্গে কে ছিলেন, অরবিন্দবাবু?’

অরবিন্দ নাটকীয় ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন। ব্যঙ্গ আর ঘৃণা মিশ্রিত কুৎসিত হাসিতে বিকৃত মুখে বললেন, ‘সে কী, মিসেস ডিটেকটিভ! সেটা আপনি এখনও বুঝে উঠতে পারেননি? তাহলেই হয়েছে আপনার এই হত্যাকাণ্ডের মীমাংসা!’ বলে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

শিবেন চিৎকার করে বলল, ‘সেটা বার করা কঠিন হবে না, মিস্টার আচার্য।’ বলে একলাফে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ফিরে এল পরমুহূর্তেই।

‘কে ছিল সঙ্গে?’ সমরেশ জিজ্ঞেস করল।

‘যজ্ঞেশ্বর আদক। বুড়োর দোস্ত।’

দময়ন্তী শূন্য দৃষ্টিতে সামনে চেয়ে বসে ছিল। শিবেন প্রশ্ন করল, ‘এবার কী করতে চান?’

‘রেবেকার জুতোজোড়ার খোঁজ চাই আর রেবেকা আর বকুল সাঁতরার অতীতের যতটা সম্ভব ডিটেলের।’

‘বেশ তাই হবে। আপাতত তাহলে বাড়ি যাই, চলুন।’

.

‘জুতোজোড়া পাওয়া গেছে বউদি।’ একটা সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখিয়ে শিবেন ঘোষণা করল।

‘কই, দেখি!’ দময়ন্তী শিবেনের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতর থেকে একজোড়া মেয়েদের জুতো বার করল। জুতোই, চটি নয়। উঁচু হিলওয়ালা, যেরকম মেমসাহেবরা পরে থাকে। জুতোটার ওপরে লাল স্ট্র্যাপ, হিলটা সাদা চামড়া দিয়ে মোড়া।

‘কোথায় পেলেন?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।

‘বাড়ির বাইরে ফুটপাথের ধারে ডাস্টবিনের পেছনে পড়ে ছিল। কুকুরে টেনে নিয়ে গেছে যে বলেছিলুম, অন্যায় কিছু বলিনি। কাল খুঁজে পাইনি, কারণ বাড়ির বাইরে তো আর খুঁজিনি। আজ একজন কনস্টেবল হঠাৎ দেখতে পায়। এই দেখুন, এই স্ট্র্যাপটাকে কীভাবে চিবিয়েছে ব্যাটা কুকুর।’

দময়ন্তী বলল, ‘হুঁ, জুতোটা খুব দামি, সম্প্রতি কেনা হয়েছিল। আচ্ছা, এটা যে রেবেকার জুতো সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত?’

‘একদম। লছমী আইডেনটিফাই করেছে।’

‘বেশ। এই স্ট্র্যাপটা কুকুরে চিবিয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু দুটো জুতোরই পেছনের স্ট্র্যাপগুলো সোলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে সেলাই ছিঁড়ে, লক্ষ করেছেন? কেন?’

‘দেখেছি। ব্যাপারটা সন্দেহজনক তা ঠিক, কিন্তু মেয়েদের জুতো তো হরবখত ছিঁড়ছে। আমাদের পাড়ার মুচিটা তো দেখি প্রায় মেয়ে খদ্দেরদের জন্যেই টিঁকে আছে।’

হাসল দময়ন্তী। বলল, ‘আর হিলের পেছনে এই লম্বা লম্বা আঁচড়ের দাগ? এগুলো তো কুকুরের দাঁতের দাগ নয়।’

‘না, তা নয়।’ শিবেন গম্ভীর হল। জুতোজোড়া ভালো করে উলটেপালটে দেখে বলল, ‘আপনি বলতে চাইছেন, কেউ মৃত রেবেকার বগলের নীচে হাত দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে সরিয়েছিল? তাইতে এই আঁচড়ের দাগ আর ছেঁড়া স্ট্র্যাপ? কিন্তু কোথায়? যেখানে বডি পড়ে ছিল, সেখানে তো কোনোরকম টানাহ্যাঁচড়ার দাগ পাইনি।’

‘ওখানে পাওয়ার সম্ভানা কম।’ দময়ন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘দেখি, রেবেকার ফোটোগুলো, এনেছেন?’

‘হ্যাঁ, এই যে।’ শিবেন একটা ব্রিফকেস থেকে একটা পেটমোটা সাদা খাম বের করল।

প্রথম ফোটোটা হীরালালের বাড়ির দিক থেকে তোলা। চিৎ হয়ে পড়ে আছে রেবেকা, চোখ দুটো খোলা, প্রাণহীন। তার শরীরের আধখানা পাঁচিলের দরজার এপাশে, পা দুটো ওপাশে। দ্বিতীয় ছবিটা অরবিন্দের বাড়ির দিক থেকে তোলা, বাঁ হাটুটা সামান্য ভাঁজ করে পাশে ছড়ানো বোঝা যাচ্ছে।

শিবেন বলল, ‘কিছু বুঝলেন ছবিগুলো দেখে?’

‘বুঝলুম।’ দময়ন্তী বলল।

শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, রেবেকা অভিসার শেষে বাড়ি ফিরছিল। দরজা খুলে নিজের বাড়ির কম্পাউন্ডে ঢোকা মাত্র ওপর থেকে গুড়ুম। গুলির ধাক্কায় উলটে পড়ে গেল মেয়েটা, পা থেকে জুতো খুলে গেল। মোটামুটি বলা যায় এরকম?’

‘বলা হয়তো যায়, কিন্তু তার আগে বলুন হীরালাল কাল যা যা বলেছেন তার সবই কি সত্যি?’

গম্ভীর হয়ে শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, সত্যি। হীরালাল পরশু রাত্রে ওখানে ছিল না।’

‘তাহলে রেবেকা অত রাত্রে কার কাছ থেকে ফিরছিল?’

শিবেন অনেকক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর নিতান্ত অনিচ্ছায় বলল, ‘নাগেশ্বর?’

দময়ন্তী জবাব দিল না, চিন্তিত মুখে চুপ করে রইল।

অফিস থেকে ফিরে সমরেশ নিমীলিত চোখে ফুলকপির শিঙাড়া চিবুতে চিবুতে কথোপকথন শুনছিল। এখন মুখ না খুলে আর পারল না। বলল, ‘দেখ শিবেন, রেবেকার মধ্যে দুটো ভাগ ছিল আমরা জানি, যাকে হীরালাল বললেন স্কিজোফ্রেনিয়া। একটা ভাগ শিক্ষিত, মার্জিত রুচি, রসিক। অন্য ভাগটা বন্য, ক্ষুধার্ত, ওভারসেক্সড। হয়তো দ্বিতীয় ভাগেরই প্রভাব ছিল বেশি। এখন, বিশ্বামিত্র খিদের জ্বালায় কুকুরের মাংস খেতে গিয়েছিলেন ঠিকই, তাই বলে যতই ক্ষুধার্ত হোক না কেন, রেবেকা নিত্যি অভিসারে গিয়ে নাগেশ্বরের সঙ্গে ইয়ে করবে, এটা ভাবা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, তাই নারে?

শিবেন বলল, ‘সত্যি কথা। তবে কেবল নাগেশ্বর কেন, অন্য কেউও তো হতে পারে? হীরালালের কোনো বন্ধুবান্ধব। হীরালালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে, এই মওকায় অন্য কেউ হয়তো ঘনিষ্ঠতা করে নিচ্ছে নাগেশ্বরকে হাত করে।’

‘অর্থাৎ তুই বলতে চাইছিস, নাগেশ্বর ঘুষ খেয়ে তার মনিবের বাড়িটাকে কুঞ্জবনে পরিণত করে তার দরজায় পাহারা দিচ্ছে? এটা ভাবাও একটু বাড়াবাড়ি। কারণ, নাগেশ্বর এখনও টেম্পোরারি, পার্মানেন্ট হবে যখন এ-বাড়িতে পাকাপাকি বসবাস আরম্ভ করবে। তা ছাড়া হীরালালও কখন যে তার কুঞ্জকুটিরে ভাবাকুললোচনাদের সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হবেন বলা শক্ত। এ অবস্থায় নাগেশ্বর কখনো এ-ধরনের রিস্ক নিতে পারে না। এটা যদি কোনো শর্ট ডিউরেশন-এর কাজ হত তো একটা কথা ছিল।’

মাথা নেড়ে সমরেশের কথা সমর্থন করল দময়ন্তী। বলল, ‘এর পর দ্বিতীয় প্রশ্ন। বন্দুকধারী আততায়ী, অর্থাৎ অরবিন্দ, দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার জানলায়। আমরা দেখেছি, দরজাটায় পৌঁছোতে হলে রীতিমতো একটা সুঁড়িপথের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাহলে সবুজ শাড়ি পরা রেবেকা দরজার কাছাকাছি আসার অনেক আগেই আততায়ীর দৃষ্টিপথ থেকে আড়ালে চলে গেছে। তাহলে প্রায় কুড়ি গজ দূর থেকে আততায়ীকে সবুজ শাড়ি পরা রেবেকাকে অন্ধকার দরজার সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্র গুলি করতে হয়, তাই না?’

‘কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন বউদি, অরবিন্দ চ্যাম্পিয়ান শ্যুটার আর অস্ত্রটা টেলিস্কোপিক রাইফেল।’

‘ভুলিনি, কিন্তু এও ভুলিনি যে তখন রাত প্রায় দুটো। আচ্ছা, আমরা যদি কল্পনা করি যে দুজন লোক মৃতা রেবেকাকে ধরাধরি করে দরজা পর্যন্ত নিয়ে এনে ফেলেছে, ওর হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে ঝুলছে বলে কম বেশি তিন ফুট চওড়া দরজার ওপাশে নেওয়া যায়নি আর সেই জন্যে তাড়াহুড়োয় ওখানেই ফেলে গেছে, তাহলে ব্যাপারটা অনেক বেশি সম্ভাব্য হয় না?’

সমরেশ বলল, তা হয়। তবে ঘটনাটা বড্ড সোজা আর সাধারণ হয়ে যায়।’

‘হবে নাই বা কেন? সব ঘটনাই জটিল করে ভাবতে হবে, তার কী মানে আছে? রাইফেল দিয়ে গভীর রাতে প্রায় শব্দভেদী গুলি ছুড়লুম, রাইফেল থেকে টেলিস্কোপ খুললুম, রাইফেলটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলুম আর টেলিস্কোপ আর দস্তানা খাটের নীচে লুকিয়ে রাখলুম যাতে সেগুলো পুলিশের হাতে পড়ে— সমস্ত অপারেশনটাই ভয়ানক জটিল হয়ে যাচ্ছে না?’

শিবেন কাষ্ঠ হাসি হাসল। বলল, ‘অরবিন্দ আচার্যকে চিনতে আপনার দেরি আছে বউদি। এইসব বনেদি ইলাস্ট্রাস পরিবারের ছেলেরা যে কতদূর জটিল হতে পারে, সে-সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণা নেই। যাক, আপনার কথায় বুঝতে পারছি, আপনার মনে হয় হত্যাকাণ্ড হীরালালের বাড়িতে হয়েছে, তাই না? রেবেকাকে কেউ হীরালালের নাম করে ডেকে পাঠাল, রেবেকা এসে বাড়ির ভেতর উঠোনে দাঁড়ানো মাত্র হত্যাকারী দোতলার বারান্দা থেকে গুলি করল, তারপর মৃতদেহটা শাগরেদের সাহায্যে টানতে টানতে এনে পাঁচিলের দরজার গোড়ায় ফেলে রেখে গেল, এই আপনার বক্তব্য?’

দময়ন্তী স্মিতমুখে ওপরে-নীচে মাথা নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ, প্রায় এই রকমই। এই ফোটোগ্রাফটা দেখে হত্যাকাণ্ডটা কোথায় হয়েছিল, সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় বটে।’

শিবেন বলল, ‘বেশ, তাই যদি হয়, তাহলে নাগেশ্বরকে হয় হত্যাকারী নয়তো তার সহকারী বলে প্রায় নিঃসন্দেহে চিহ্নিত করা যায়। তাহলে ঘটনার দিন নাগেশ্বরের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ নিতে হয়, কী বলেন? নাকি ওকে অ্যারেস্ট করে ফেলব প্রথমেই। বাড়িটাতে গিয়ে তো কোনো লাভ হবে না, কারণ সূত্রগুলো নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলেছে।’

দময়ন্তী বলল, ‘খোঁজখবরটা আগে নিয়ে নেওয়াই ভালো। যদি আজ পর্যন্ত ও পালিয়ে গিয়ে না থাকে, তাহলে কালও পালাবে না।’ বলতে বলতে দময়ন্তী খামটা থেকে আর একটা ফোটো বের করল। ‘আরে, এটা আবার কার ছবি?’ দময়ন্তীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে সমরেশও ছবিটার ওপর ঝুঁকে পড়ল।

ছবিটি একটি মেয়ের। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অনিন্দ্যসুন্দর দেহলতা, বহে সকল আকাঙক্ষার পূর্ণতা,’ এ মেয়েটিরও তাই। টাইট কুর্তি-পাজামা পরে পায়ের ওপর আলগোছে পা রেখে সেতার বাজাচ্ছে, যৌবন যেন ফেটে পড়ছে। পেছনে একটা বিছানার চাদর ঝুলিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড করা হয়েছে, চাদরটা আবার একপাশে ছেঁড়া। সামনে একটা ফুলদানিতে একগুচ্ছ ফুল।

শিবেন বলল, ‘ইনিই বকুল সাঁতরা, শকুন্তলা নামে সিনেমায় নেমেছিলেন। হাওড়ায় বাড়ি। বাবা হাওড়ার বুকিং ক্লার্ক, পাঁচ ছেলে তিন মেয়ে। অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। বকুল ছিল সবচেয়ে বড়ো। লেখাপড়া হয়নি, তবে গান বাজনায় ভালো ছিল। টাকার জন্য সিনেমায় নেমেছিল। রূপ তো ছিলই, আর হীরালাল যা বলতেন, লোভও বেশি ছিল।’

দময়ন্তী একদৃষ্টে ছবিটা দেখছিল। যখন চোখ তুলে তাকাল, তখন ওর দৃষ্টি এক অদ্ভুত রহস্যময় আলোয় উজ্জ্বল। সমরেশ ও দৃষ্টি চেনে। চাপা উত্তেজিত গলায় বলল, ‘কী হল? ছবিটায় কিছু পেলে?’

‘পেলুম।’ দময়ন্তী সনিশ্বাসে বলল, ‘যেন ওর মনের গুরুভার জটিলতাটা কেটে গেছে।

‘কী?’

‘একটা যোগসূত্র। বকুল, রেবেকা, নাগেশ্বর সবার। শিবেনবাবু, নাগেশ্বরকে বোধহয় আপনাকে এক্ষুনি আটকে ফেলতে হবে। আর অরবিন্দ আচার্যকে দিতে হবে স্পেশাল প্রোটেকশন, কারণ এর পরের আঘাতটা বোধ হয় ওঁর ওপর আসবে।’

শিবেন কী যেন বলবার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ক্রিং ক্রিং করে টেলিফোন বেজে উঠল। শিবেন তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরল, ‘হ্যাঁ, আমি শিবেন সেন কথা বলছি।’ তারপর কিছুক্ষণ অত্যন্ত গম্ভীর নীরবতার শেষে ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ বলে ফোনটা রেখে দিল। দময়ন্তীর দিকে ফিরে বলল, ‘আপনার সন্দেহই ঠিক। পঞ্চা নিহত হয়েছে। ওর মৃতদেহ রামপুরের কাছে রেললাইনের ধারে পাওয়া গেছে।’

দময়ন্তীর মুখ কঠিন হয়ে উঠল। বলল, ‘আর দেরি করা ঠিক নয়, শিবেনবাবু। এক্ষুনি নাগেশ্বরকে গ্রেপ্তার করা দরকার। নাগেশ্বরই যে অরবিন্দের ঘরের দিকে নজর রেখেছিল, সে তো প্রথম দিন ওর কথাতেই বুঝতে পেরেছিলুম, কিন্তু দেখছি আমার সন্দেহটা ঠিক যে তার লক্ষস্থল শুধু অরবিন্দই ছিলেন না, ছিল পঞ্চাও।’

শিবেন আবার টেলিফোন তুলে নিল। একটা নম্বর ডায়াল করতে করতে বলল, ‘লোকাল থানার ওসিকে চিঠি পাঠাচ্ছি, আমিও যাচ্ছি। আপনারাও চলুন বউদি, শেষটা দেখা যাক।’

দময়ন্তী বলল, ‘চলুন। তবে নাগেশ্বর কিছু শেষ নয়, প্রায় শেষ বলতে পারেন।’

.

গাড়ি চালাতে চালাতে শিবেন বলল, ‘হুম। এখন মনে হচ্ছে বটে যে, অরবিন্দকে আর যাই হোক, পঞ্চার মৃত্যুর জন্য দায়ী করা চলে না। আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, কোনো উপায়েই তাঁর পক্ষে পঞ্চাননকে খুন করে রামপুরে ফেলে রেখে আসা সম্ভব নয় যদি না কোনো শাগরেদ না থাকে। কিন্তু এর তো কোনো মোটিভ নেই। লোকটা অসুস্থ সন্দেহ নেই, আর তার মতো পক্ষাঘাতগ্রস্তের কাছে একজন পুরোনো ট্রেনড চাকরের দাম লাখ পয়জারের চেয়েও বেশি। এখন, যদি অন্য কেউ পঞ্চাকে হত্যা করেই থাকে, তাহলে চোর আসাটাও সত্যি বলতেই হয় যে চোর যেভাবেই হোক, বারংবার বাধা পেয়েও অরবিন্দের ঘরে সন্দেহজনক বস্তুগুলো প্লান্ট করতে আর রাইফেলটা চুরি করতে বদ্ধপরিকর। যেন, তাকে আদেশ করা হয়েছে যে, তুমি ধরা না পড়ে এই মালগুলো অমুক অমুক জায়গায় রেখে আসবে, আর সে-ও, এমনকি পঞ্চার বাধা ভেদ করবার জন্য তাকে নিঃশেষে সরিয়ে দিয়েও, সেগুলো রাখবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

পেছনের সিট থেকে দময়ন্তী বলল, ‘এর মধ্যে একটা বিশেষ প্যাটার্ন আছে, লক্ষ করেছেন?’

আত্মগতভাবে শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, আছে বটে।’ তারপর হঠাৎ ওর কানদুটো প্রচণ্ড উত্তেজনায় আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠল। ও গাড়ির গতি কমাতে কমাতে একেবারে রাস্তার বাঁ দিকে দাঁড় করিয়ে ফেলল। পেছন ফিরে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘বউদি, আপনার যোগসূত্রটা বোধহয় বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কেন? কেন? কীসের জন্য?’

শান্ত গলায় দময়ন্তী বলল, ‘ইজ্জৎ!’

.

১০

হীরালালের বাড়ির ভেতরে গাড়িটা ঢোকাবার মুখেই বাধা পাওয়া গেল। আর একটা সাদা ফিয়াট দাঁড়াল পথ আটকে। ভেতরে হীরালাল। দময়ন্তী বলল, ‘যাক, ভালোই হল, হীরালালবাবুকে পাওয়া গেল। ওঁকে আর খবর দেবার দরকার হবে না।’

ইতিমধ্যে হীরালাল গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন। বললেন, ‘কী ব্যাপার, আপনারাও কি নাগেশ্বরের খোঁজে নাকি? দারোগা শৈলেন কর্মকার তো এখনও ভেতরে বসে আছে। আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে বুঝি? আপনারা কি শেষপর্যন্ত নাগেশ্বরকে খুনি ঠাওরালেন?’

শিবেন বলল, ‘ভেতরে চলুন হীরালালবাবু, কথা আছে।’

গাড়ি দুটো পার্ক করা হল, নেমে এল সবাই। দময়ন্তী বলল, ‘নাগেশ্বরকে খুনি ঠাওরানোতে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে, হীরালালবাবু?’

‘না, না, আমার আপত্তির কী আছে? আপনারা কী হিসেবনিকেশ করেছেন, তা তো আর আমার জানা নেই।’

‘নাগেশ্বর কোথায়?’

‘দেশে গেছে?’

‘বকুল সাঁতরা মারা যাওয়ার পরেও কি এমনি দেশে গিয়েছিল?’

‘ও মাঝে মাঝেই দেশে যায়, আবার দিন চার-পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে আসে।’

‘ওর দেশ কোথায়, জানেন?’

‘জানি, আরা জেলার হাসানাবাদ গ্রামে।’

শিবেন চট করে ওসি কর্মকারকে কতগুলো কী নির্দেশ দিল।

হীরালাল কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, ‘যাক, আমার চাকর নাগেশ্বরকেই রেবার খুনি বলে সাব্যস্ত করলেন। কিন্তু কেন খুন করল, সেটা জানতে পারি কি? নাকি সেটা এখনও সাব্যস্ত করে উঠতে পারেন নি?’

‘কেন খুন করল, সে-বিষয়ে আপনি কিছু আলোকপাত করতে পারেন না?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।

‘আমি? আমি কী করে করব? আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তো আর খুন করেনি?’

‘ঠিক জানেন আপনি যে, আপনার সঙ্গে কোনো পরামর্শ হয়নি? পুলিশ কিন্তু অন্যরকম সন্দেহ করছে। আপনারই দুজন সহনায়িকা খুন হলেন, একটা খুন আপনারই বাড়িতে হল, আর আপনি কোনোই আলোকপাত করতে পারছেন না? পুলিশের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কঠিন।’ শিবেন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

গুম হয়ে গেলেন হীরালাল। বিড়বিড় করে বললেন, ‘এটা কি বলা বাহুল্য নয় যে, আমার সঙ্গে সত্যিই কোনো পরামর্শ হয়নি? হলে কি আমি আমার বাড়ির ধারে কাছে এই খুন হতে দিতুম?’

‘নাগেশ্বর কেন আর্মি থেকে ডিসচার্জড হয়েছিল জানেন?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।

‘আগে জানতুম না, সম্প্রতি জেনেছি। ওর বিরুদ্ধে নাকি নানারকম অভিযোগ ছিল— চুরি, আর গোটাকতক চোরাগোপ্তা খুনের। কিন্তু একটাও প্রমাণ করা যায়নি। শেষপর্যন্ত কী একটা সামান্য কারণে ওকে তাড়িয়ে দেয়।’

‘নাগেশ্বর যে অরবিন্দের ঘরে চুরি করতে ঢুকেছিল, সেটাও কি সম্প্রতি জেনেছেন?’

‘আজ্ঞে না, এই মুহূর্তে জানলুম। অরবিন্দের সেই ফেমাস চোর কি নাগেশ্বর নাকি? আর একটু খোলসা করে বললে ভালো হয়।’

শিবেন বলল, ‘চলুন, অরবিন্দবাবুর কাছে যাওয়া যাক। রাত বেশি হয়নি, হয়তো বিরক্ত হবেন না। ডিটেলস ওঁর মুখ থেকে শোনাই ভালো হবে। আপনার গাড়ি এখানেই থাক, আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। শৈলেন, তুমিও আমাদের সঙ্গে এস।’

.

১১

আচার্য ভবনের গেট হাঁ-করে খোলা। বাড়ির ভেতরে একতলার চত্বরের সামনে একটা আলো জ্বলছে, আর সব অন্ধকার। প্রথমে মনে হয়েছিল জনমানব কেউ নেই, কিন্তু চত্বরের কাছে এগুতে দেখা গেল একজন দীর্ঘকায় প্রস্তরমূর্তিবৎ মানুষ সদর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি অমৃতপ্রভা। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু কোনো ইন্দ্রিয়ই কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। এতগুলো লোকের একসঙ্গে হেঁটে আসার শব্দও অনেকক্ষণ শুনতে পাননি। যখন পেলেন, চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যে একটা আনুষঙ্গিক আতঙ্কে ওঁর চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল। যেন একটা চিৎকার এক ঢোঁকে গিলে ফেলে স্খলিত কণ্ঠে বললেন, ‘এ কী! আপনারা? মানে এত রাত্রে?’

শিবেন বলল, ‘আমরা অরবিন্দবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

প্রশ্নটা যেন বেশ কিছুক্ষণ বুঝতে পারলেন না অমৃতপ্রভা, তারপর একটা প্রচণ্ড আবেগে ওঁর সমস্ত মুখটা ভেঙেচুরে বিকৃত হয়ে গেল। গলার মধ্য থেকে হাহাকার বেরিয়ে এল, ‘খোকা? খোকা আর বেঁচে নেই। মরে গিয়েছে— আত্মহত্যা করছে!’ বলে মাটির ওপর বসে পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন।

বাকি পাঁচজন এই বিস্ময়ের ধাক্কায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সেই বাঁধভাঙা কান্নার ফাঁকে ফাঁকে যেসব অসংলগ্ন কথা বেরিয়ে আসতে লাগল, সেগুলি জোড়াতাড়া দিলে বক্তব্যটা দাঁড়ায় এই যে, এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী শিবেন আর দময়ন্তী নামক দুজন ভণ্ড তপস্বী, আর কাউকে না পেয়ে তারা খোকাকেই তার স্ত্রীর হত্যাকারী সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল, সেই পর্বতপ্রমাণ নির্বুদ্ধিতার পরিণাম এই আত্মহত্যা। কারণ কোনো ভদ্রসন্তান এই কুৎসিত অভিযোগের কাদা গায়ে মেখে প্রাণধারণ করতে পারে না, ইত্যাদি।

দময়ন্তী প্রস্তুরকঠিন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি এরকমই আশঙ্কা করেছিলুম। দেরি হয়ে গেল।’

কান্নার ধমকটা একটু কমলে শিবেন বলল, ‘মৃতদেহটা কোথায় আছে, মিসেস রায়চৌধুরী? আমাদের নিয়ে চলুন, পুলিশ হিসেবে আমাদের কর্তব্য করতে দিন।’

অমৃতপ্রভা ওঠবার কোনো লক্ষণই প্রকাশ করলেন না। গেটের দিকে একবার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার নতুন করে কান্না জুড়লেন।

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘বিনয়ভূষণবাবু কোথায়, মিসেস রায়চৌধুরী?’

‘ডাক্তার ডাকতে গেছেন।’ অমৃতপ্রভা কোনোরকমে বলতে বলতেই সামনের কাঁচে ডাক্তারের পাশে লাল ক্রস লাগানো একটু পুরোনো সিঁত্রো গাড়ি বেশ জোরে গেট দিয়ে ঢুকে চত্বরের ওপর ঘুরে এসে ব্রেক কষে দাঁড়াল।

গাড়ির চালক, যিনি সম্ভবত ডাক্তার, যখন গাড়ির আলো নেভানো, ইঞ্জিন বন্ধ করা প্রভৃতিতে ব্যস্ত, তখন গাড়ির পেছনের সিট থেকে নেমে এলেন বিনয়ভূষণ। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ কী! আপনারা? কে খবর দিল আপনাদের? হীরু, তুমিই কি এঁদের নিয়ে এসেছ নাকি?’

কাতর মুখে হীরালাল নীরবে মাথা নাড়লেন।

শিবেন বলল, ‘মিসেস রায়চৌধুরী, আপনি ডাক্তারবাবুকে ওপরে নিয়ে যান। মিস্টার রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের একটু কথা আছে।’

বিনয়ভূষণকে দেখে অমৃতপ্রভার কান্না বন্ধ হয়ে গেছিল, এখন শিবেনের কথায় সজল চোখে আবার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আগুন জ্বলে উঠল : ‘আপনাদের কথা… আচ্ছা, আপনারা কি মানুষ? ওপরে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, আমরা ডাক্তার নিয়ে যাচ্ছি, আর ঠিক তখুনি ওঁকে পথ আটকে আপনাদের কথা বলবার দরকার হয়ে পড়ল? আমাদের কি এখন কথা শোনবার মতো মানসিক অবস্থা?’

শিবেন বিনীতভাবে বলল, ‘আপনি যান না, ডাক্তারবাবুকে নিয়ে ওপরে চলে যান। কিন্তু বিনয়বাবুকে আমাদের পক্ষে যেতে দেওয়া ঠিক সম্ভব হচ্ছে না।’

‘কেন? যেতে দেওয়া সম্ভব নয় কেন? আমি ওপরে যাব না, ওঁকে না নিয়ে আমি যাব না। আমি জানতে চাই, কী এমন আপনাদের কথা মিস্টার সেন?’

‘কথাটা খুব বড়ো কিছু নয়, মিসেস রায়চৌধুরী।’ শিবেন পূর্ববৎ বলল, ‘আমাদের বক্তব্য হচ্ছে যে মিসেস রেবেকা আচার্য, মিস বকুল সাঁতরা আর পঞ্চাননকে খুন করার ষড়যন্ত্র এবং সেই হত্যাকাণ্ডে যোগদান করবার অভিযোগে আমরা আপনার স্বামীকে গ্রেপ্তার করছি। মিস্টার আচার্যকেও উনি খুন করেছেন কিনা আমরা জানি না, সেটা তদন্তসাপেক্ষ। আপাতত যে কটি অভিযোগ আছে তাই যথেষ্ট। ওঁকে এই মুহূর্তেই এখান থেকে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে।’

অমৃতপ্রভার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল, থরথর করে কেঁপে উঠে অসহায় মুখে বিনয়ভূষণের দিকে তাকালেন। বিনয়ভূষণ কিন্তু প্রায় বিকারহীন, যদিও মুখে কোনো কথা বেরোচ্ছিল না। ডাক্তার ভদ্রলোক স্তম্ভিত নেত্রে এই নাটক দেখছিলেন, এখন কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি এখন কী করব, মিস্টার সেন?’

‘আপনি তো বোধহয় এঁদের পারিবারিক ডাক্তার— ডাক্তার সুভাষ গুহ, তাই না? আপনি ওপরে চলে যান। মৃতদেহ পরীক্ষা করুন, গেলাস টেলাসগুলো ছোঁবেন না। যাবার সময় আমাকে রিপোর্ট দিয়ে যাবেন। এঁকে চালান করে দিয়ে আমরা নীচেই আপনার জন্য অপেক্ষা করব, তারপর ওপরে যাব।’

‘বেশ, ঠিক আছে।’ বলে ডাক্তার গুহ কম্পিত পদে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।

ডাক্তারের থেকে চোখ ফিরিয়ে শিবেন আবার বিনয়ভূষণের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। এতক্ষণ অচঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিনয়ভূষণ অনেকটা মিলিটারি অ্যাটেনশন-এর ভঙ্গিতে। শিবেন মৃদু হেসে বলল, ‘ওয়েল কর্নেল রায়চৌধুরী, আমরা যেতে পারি?’

একটা ফ্যাকাশে নিষ্প্রাণ হাসিতে বিনয়ভূষণের মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। বললেন, ‘নিশ্চয়। তবে, যে অভিযোগগুলো করলেন, সেগুলো প্রমাণ করতে পারেন? কী লাভ আমার এদের খুন করে? কেনই বা খুন করব?’

দময়ন্তী শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আপনার ইজ্জৎ যারা নষ্ট করেছিল, তাদের আপনি চরম শাস্তি দিয়েছেন, বিনয়ভূষণবাবু। আমি সত্যিই দুঃখিত। আপনি উচ্চশিক্ষিত, সূক্ষ্ম রসবোধ আছে আপনার, অথচ আপনাকেই এই পৈশাচিক নারকীয় পথটা বেছে নিতে হল। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থাভাবে এমন এক স্ত্রীর কুক্ষিগত হয়ে পড়তে হল আপনাকে, যার প্রচণ্ড আত্মাভিমান আর অহংকারের বাধা ভেদ করে হৃদয়ের যোগাযোগ আর করে উঠতে পারলেন না। কিন্তু তখনই কি আপনি তার বয়ঃসন্ধির কীর্তিকলাপের কথা জানতেন? আশা করি, না, কারণ, তা যদি হয় তাহলে বলতে হয় তার হৃদয়ের চেয়ে তার সম্পত্তির দিকেই আপনার নজর ছিল গোড়া থেকেই এবং সেক্ষেত্রে আপনাকে ভদ্রলোক বলতে বাধে। আমার বিশ্বাস, আপনি জানতে পেরেছেন তখন, যখন ঘরে-বাইরে অপমানিত হয়েও আপনি স্ত্রীকে সহ্য করছিলেন, হয়তো তাঁকে আপনার সহ্যও হয়ে গিয়েছিল। সেটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ ছেলেবেলায় যে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটিয়েছেন, সেটা ফিরে পেতে গেলে, এছাড়া অন্য রাস্তা ছিল না। বাইরের লোক মনে করত আপনার আত্মসম্মানবোধ নেই, ইজ্জৎ একেবারে খুইয়ে বসে আছেন।

‘তারা ভুল মনে করত। আপনার আত্মসম্মান বোধ ছিল অন্যত্র।

‘আপনার প্রথম প্রেম ছিল বোধহয় রেবেকা, তাই না? প্রাণচঞ্চল, শিক্ষিত, সুন্দরী মেয়েটি আপনার কাছে সেতার শিখতে গিয়ে আপনার হৃদয় অধিকার করেছিল। আপনি বন্ধু হীরালালের বাড়িতে গোপনে তাকে সেতার শেখাতেন এবং …। সে যাই হোক, অধিকারের ব্যাপারটা বোধহয় বাহ্যত উভয়তই ছিল, অন্তত আপনার তাই মনে হয়েছিল। রেবেকাকে আপনি চিনতে পারেননি অথবা চিনতে চাননি। রেবেকা আর যাই হোক না কেন, আপনার সুপ্ত প্রচণ্ড অহংকার বোধটাকে জাগিয়ে দিয়েছিল, সন্দেহ নেই।’

অমৃতপ্রভা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এইবার বাধা দিলেন। ভেজা ভেজা, ভাঙা ভাঙা, কম্পিত গলায় বললেন, ‘কী সব গালগল্প ফেঁদে বসেছেন, মিসেস দত্তগুপ্ত? এই কি এর সময়? আমার ভাই…’

বিনয়ভূষণের কথায় ওঁর স্খলিত কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল, ‘তুমি চুপ কর। ওঁকে বলতে দাও।’ কথাগুলো প্রাণহীন, উদাস, অন্যমনস্ক। এই প্রথম বিনয়ভূষণ স্ত্রীকে বাধা দিয়েও পার পেয়ে গেলেন, নির্দয় বাক্যবাণে আচ্ছন্ন হলেন না।

দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, যা বলছিলুম। আপনার মনের মধ্যে যে আত্মসম্মান জেগে উঠল, তারই সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠল আত্মপ্রত্যয়। সেই আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গেই আপনি এগিয়ে গেলেন আপনার অপর ছাত্রী বকুল সাঁতরার দিকে এবং জয়ও করলেন তাকে। অন্তত আপনার তাই মনে হয়েছিল, যদিও বকুল সাঁতরাকেও আপনি চিনতে পারেননি।

‘চিনতে পেরেছিলেন হীরালালবাবু। উনি আমাদের বলেছিলেন, বকুলের লোভ ছিল বড্ড বেশি। আজ বোধহয় রেবেকা সম্বন্ধেও সেই কথাই বলবেন। একথা প্রায় সন্দেহাতীত ভাবে সত্য যে ওরা আপনার কাছে এসেছিল আপন স্বার্থে, অর্থের লোভে আর জৈবিক ক্ষুধার তাড়নায়। আপনি যাদের জয় করেছিলেন বলে অহংকারে স্ফীত হয়েছিলেন, তারা বিজিত হবার জন্যই প্রস্তুত হয়েছিল।

‘হীরালালবাবু যখন সিনেমা প্রযোজনা আরম্ভ করলেন, আপনিই বকুলকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে, যাতে সুন্দরী বকুল আরও পয়সা রোজগার করতে পারে, এত পয়সা, যা সেতার বাজিয়ে বা গান গেয়ে রোজগার করা যায় না।

‘এটাই আপনার কাল হল। লোভী বকুল অসংকোচে তুলে দিল নিজেকে হীরালালের হাতে। সেটা আবিষ্কার করে আপনার মানসিক অবস্থা কী হয়েছিল অনুমান করতে পারি। আপনার নবজাগ্রত আত্মপ্রত্যয় খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।

‘কিন্তু তারপরেই এল ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় আঘাত। রেবেকাও সিনেমায় কেরিয়ার করার লোভে এগিয়ে গেল হীরালালবাবুর দিকে। হীরালালবাবু সুবোধ গোপাল, তিনি যাহা পান, তাহাই খান।’

হীরালাল আপত্তি করার জন্যই বোধহয় মুখ খুলেছিলেন, কিন্তু আবার কী ভেবে চুপ করে মাথা নীচু করে ফেললেন।

দময়ন্তী বলে চলল, ‘এইবার আপনার চোখে অন্ধকার দেখার পালা, আপনার ইজ্জৎ ধুলোয় লুটোচ্ছে। ঈর্ষা বড়ো ভয়ঙ্কর জিনিস, ক্রোধের মতো সেও মানুষকে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য করে দেয়। কিন্তু ক্রুদ্ধ লোককে দেখলে চেনা যায়, অসূয়াগ্রস্ত লোক আর পাঁচজনের মতোই ব্যবহার করে। সে ছুরি চালায় গোপনে, ক্রুদ্ধ লোকের মতো হাত-পা ছুড়ে নয়। আপনিও এই ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে ছুরি চালালেন, খুন করালেন বকুলকে। আপনার আদেশ পালন করল স্বভাব অপরাধী, সৈন্যবাহিনী থেকে বিতাড়িত নাগেশ্বর। সে আপনার রেজিমেন্টেই ছিল, সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। প্রতিদানে আপনি বন্ধু হীরালালকে বলে তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। অবশ্য এখানে আমার সন্দেহ আছে, হয়তো তার আগেই নাগেশ্বরের চাকরি হয়ে গিয়েছিল।

‘যা হোক, আপনি আশা করেছিলেন, বকুলের বীভৎস মৃত্যুর কথা শুনে রেবেকা ইঙ্গিতটা ধরতে পারবে, সামলাবে নিজেকে। কিন্তু উলটে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী সরে যাওয়াতে সে আরও উদ্দাম হয়ে উঠল। ওই বাড়ির বহুব্যবহৃত কেলিকুঞ্জ, যেখানে অরবিন্দ থেকে আরম্ভ করে এ-বাড়ির সকলেই অভিসারে গেছেন, সেখানে কিন্তু এবার আপনি অপাঙক্তেয়, ইংরেজিতে যাকে বলে লেফট আউট ইন দ্য কোল্ড।

‘ঈর্ষার আগুন, অপমানিত ইজ্জৎ এবার ফেটে পড়ল। রেবেকাকে আপনি ও-বাড়িতে কী বলে আবার নিয়ে গিয়েছিলেন আমি জানি না, হয়তো বলেছিলেন একটা শেষ বোঝাপড়া করতে চান। কিন্তু রেবেকার এই যাওয়াটাই শেষ যাওয়া হল। নাগেশ্বর দোতলার বারান্দা থেকে গুলি করে মারল ওকে। এর আগেই অবশ্য নাগেশ্বর অরবিন্দের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপানোর ব্যবস্থা করে রেখে এসেছে।’

হীরালাল প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি যে এত কথা বললেন, সেগুলো প্রমাণ করতে পারবেন?’

দময়ন্তী বলল, ‘প্রমাণ করার দরকার হবে না, হীরালালবাবু। বকুল আর রেবেকা যে বিনয়ভূষণবাবুর কাছে সেতার শিখত, ওঁদের মধ্যে যে গাঢ় সম্পর্ক ছিল, তা যে শুধু গুরু-শিষ্যার নিকষিত হেম নয়, নাগেশ্বর যে ওঁর একই রেজিমেন্টে ছিল, প্রভৃতি অনেক কিছুই প্রমাণ করা যাবে এবং তার থেকে সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্সও খাড়া করা যাবে, কিন্তু আমি জানি তার দরকার হবে না। কারণ, বিনয়ভূষণ স্বাভাবিক বা সাধারণ অপরাধী নন— উনি শিক্ষিত, রুচিশীল ভদ্রলোক। এতদিন যে তীব্র মোহে নেশাগ্রস্ত হয়েছিলেন, আজ সেই নেশা কেটে গেছে। আজ উনি নিজের মুখোমুখি হয়েছেন। আমি নিশ্চিত, উনি নিজেই সব কথা স্বীকার করবেন।’ বলে দময়ন্তী সোজা বিনয়ভূষণের চোখের ভেতর তাকাল।

বিনয়ভূষণ সম্মোহিতের মতো নিষ্পলক চোখে স্থাণুবৎ দময়ন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। ওঁর মনের মধ্যে যে কী প্রচণ্ড আবেগের উত্তাল আলোড়ন চলেছে তা বোধহয় একমাত্র জানতে পারল দময়ন্তী। আমাদের মনের জানলা আমাদের চোখ— দময়ন্তী সেই জানলায় কী দেখল সেই জানে।

বাকি সকলে চরম উত্তেজনায় নিষ্পন্দ হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের সচকিত করে বিনয়ভূষণ বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, দময়ন্তী। আমি সবই স্বীকার করব। চলুন মিস্টার সেন, আমরা যাই।’

‘না, না, না, না!’ বিকট চিৎকার করে অমৃতপ্রভা দড়াম করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। একবারও সেদিকে না তাকিয়ে ভাবলেশহীন মুখে সামনে এগিয়ে গেলেন বিনয়ভূষণ।

.

১২

হীরালাল বললেন, ‘নাঃ, দেখছি আমার কোম্পানির পাবলিসিটি অ্যান্ড সেলস ম্যানেজারের পোস্টটা আপনাকেই দিতে হবে। বিনয়কে আপনি যেভাবে কথায় ঘায়েল করলেন, অবিশ্বাস্য।’

সমরেশ বলল, ‘হুঁ, হুঁ, আবার সেই ইজ্জতে সুড়সুড়ি। ওতেই কাজ হল। সে-কথা যাক। হ্যাঁ রে শিবেন বিনয়ভূষণ সব কথা স্বীকার করেছেন? নাগেশ্বরকে ধরতে পেরেছিস?’

শিবেন বলল, ‘নাগেশ্বরের ঠিকানা বিনয়ভূষণ দিয়েছেন, তাকে ধরতে ফোর্স গিয়েছে। তবে বিনয়ভূষণের স্বীকার করা না-করায় বোধহয় আর কিছু যাবে আসবেনা।’

সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘কেন, কেন?’

‘কারণ, কাল রাত্রে গ্রেপ্তার হয়েছেন আর আজ বেলা দুটোর সময় সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এত মানসিক উত্তেজনা সইতে পারেননি। বাঁচবেন কিনা বলা শক্ত।’

সবাই দুঃখিত মুখে চুপ করে রইল। সমরেশ বলল, ‘না, বাঁচাই ভালো। শাস্তি যথেষ্ট পেয়েছেন। একজন শিক্ষিত ভদ্রসন্তান যখন খুন করে, তখন যে সে কী ভীষণ মানসিক বেদনার থেকে তা করে, আমি তো তা কল্পনাই করতে পারি না।’

শিবেন বলল, ‘তোর আর কল্পনা করে কাজ নেই। এখন বলুন তো বউদি, আপনার বিনয়ভূষণকে প্রথম সন্দেহ হল কী করে?’

দময়ন্তী বলল, ‘আদৌ আমার কারোর ওপরেই সন্দেহ হয়নি। ব্যাপারটা গোলমেলে সন্দেহ ছিল না, কিন্তু চোর আসার জন্য বাড়ির কাউকে দোষী ঠাওরানোর মতো যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে ছিল না।

‘গত শনিবার বিনয়ভূষণ যখন এসে বললেন, তাঁর শ্যালকের ঘরে চতুর্থবার চোর এসেছে, অথচ কিছুই খোয়া যায়নি, তখন আমার সামনে সমস্ত ঘটনাটা আরও ধোঁয়াটে হয়ে গেল। এ কেমন চোর? সাধারণ চোর কখনো সাত-আটদিন ধরে একটা ঘর ওয়াচ করে চুরি করতে আসে না, বরং ঘুরঘুর করে বাড়ির চারদিকে অনুসন্ধান চালায় ঢোকার, পালাবার পথ ঠিক করবার জন্য। তারপর একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার বাধা পেয়ে একই জায়গায় চতুর্থবার চুরি করতে আসবার মতো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চোর শুধু কলকাতায় কেন, সারা পৃথিবীতে বিরল। আর যদিই বা এল, কিছুই চুরি করল না, এটাই বা কেমন, বিশেষত যেখানে প্রধান বাধা বাড়ির চাকরটা পর্যন্ত অনুপস্থিত? স্পষ্টতই, এটা করা হচ্ছে কোনো উদ্দেশ্যসাধনের জন্য, চুরি করবার জন্য নয়। কী সেই উদ্দেশ্য? উদ্দেশ্য এক লক্ষ হতে পারে, কিন্তু সেটা বোঝা না গেলেও এর মধ্যে একটা জিনিস আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। সমস্ত ধোঁয়াটে অন্ধকারে সেটাই একমাত্র আলোর শিখা।

‘সেটা হচ্ছে, এর একটা বিশেষ প্যাটার্ন, যার কথা আপনাকে সেদিন বলছিলুম। যত বাধাই আসুক না কেন, সব ভেঙে চুরে আমার আরব্ধ কাজ আমি করবই, অনেকটা করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গের মতো। সাধারণ লোক বলবে এটা পাগলামি, ফৌজিরা বলবে এটাই স্বাভাবিক। প্যাটার্নটা আসলে মিলিটারি। এদিকে হীরালালবাবুর বাড়িতে প্রথম ভিজিটেই আমার মনে সন্দেহ হয়েছিল, অরবিন্দের দিকে দৃষ্টি রাখত নাগেশ্বর। সে পল্টনের লোক— মিলে গেল।

কিন্তু মিলিটারির লোক তখনই মিলিটারি, যখন সে আদেশ পায়, তার আগে পর্যন্ত কিন্তু সে সাধারণ লোকের মতোই ব্যবহার করে, চিন্তা-ভাবনা করে। আদেশ পেলেই সে মেশিন, ওই করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। এই আদেশ দিল কে? মনে পড়ল বিনয়ভূষণ কর্নেল ছিলেন। এই আমার প্রথম সন্দেহ গিয়ে পড়ল বিনয়ভূষণের ওপর।

কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিলুম না, বিনয়ভূষণের এবম্বিধ আচরণের কারণ কী? প্রথমটা ভেবেছিলুম, অরবিন্দ বোধহয় মারা পড়বেন, যখন রেবেকা নিহত হল, ওর মৃতদেহের ফোটোটা দেখলুম, ওর জুতো দেখলুম, বিনয়ভূষণের ওপর আমার সন্দেহ দৃঢ়তর হল।

আমি যে অরবিন্দকে সন্দেহ করিনি, তার কারণ রেবেকার উলটো করে পরা শাড়ি আর জুতোর পেছনে স্ক্র্যাচ। স্পষ্টতই হত্যাকাণ্ড অরবিন্দের ঘরের নীচে হয়নি এবং মৃত রেবেকাকে সরাতে গিয়ে ওর শাড়ি আর জুতো খুলে গিয়েছিল। আমি হৈ-চৈ করাতে জুতোটা পরদিনই আমাদের পাইয়ে দিলেন বিনয়ভূষণ ঠিকই, কিন্তু শাড়িটার বেলা আর কিছু করবার ছিল না। অন্ধকারে সবুজ সিল্কের শাড়ি সযত্নেই পরিয়েছিলেন, কেবল সোজা-উলটো বুঝতে পারেননি।’

সমরেশ বলল, ‘দিনের আলোতেও বুঝতে পারতেন কিনা সন্দেহ। অন্তত আমি তো পারতুম না।’

দময়ন্তী বলল, ‘ঠিক কথা। তোমাদের পারা কঠিন। আর একটা কথা জেনে রেখে দিন শিবেনবাবু, যত তাড়া থাক, ঝড়-বৃষ্টি-ভূমিকম্প শুক্কুরবারের আকাশ যাই হোক না কেন, এমনকী ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখেও যদি যেতে হয়, কোনো মেয়ে কক্ষনো উলটো করে শাড়ি পরে ঘর থেকে বেরোবে না। কাজেই রেবেকা জীবিত অবস্থায় উলটো শাড়ি পরেছে, এটা হতে পারে না। অতএব, ওর মৃত্যুর পর এটা করা হয়েছে। আপনি অরবিন্দের বিপক্ষে কেসটা যেভাবে সাজিয়েছিলেন, তাতে অথবা অন্য কোনো ভাবেও অরবিন্দের পক্ষে এটা করা অসম্ভব ছিল।

‘যা হোক, তবু আমি বিনয়ভূষণকে ঠিক ছবির মধ্যে আনতে পারছিলুম না। যদিও আমার মন বলছিল, ওখানেই সমস্যার সমাধান রয়েছে। আসলে হীরালালবাবু এর মধ্যে ঢুকে গিয়ে জট পাকিয়ে দিয়েছিলেন। কাল রাত্রে বকুলের ফোটোটা দেখেই বিদ্যুৎচমকের মতো সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বকুলের হাতের সেতারটাই মনে করিয়ে দিল যে, কর্নেল বিনয়ভূষণ রায়চৌধুরী একজন প্রথম শ্রেণির সেতার বাদক ছিলেন। রেবেকাও ছিল তাই। তবে তার পক্ষে ভালো বাদক হওয়া এ-বাড়িতে আসার আগে অসম্ভব ছিল, তার বাপের বাড়ির ইঙ্গ-বঙ্গ বা শুধু ইঙ্গ-আবহাওয়া তার অনুকূল ছিল না। এইবার আমার সামনে হীরালাল, নাগেশ্বর, বিনয়ভূষণ, বকুল, রেবেকার জটিল ল্যাবিরিন্থটা জট খুলে পথ দেখিয়ে দিল। মনে হল, শিক্ষিত, বড়োঘরের ছেলে বিনয়ভূষণের কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই, কোনো ইজ্জৎ নেই, এ হতে পারেনা। সিধে পথে সেই বোধ বিকশিত হতে পারেনি, কারণ সেখানে অমৃতপ্রভার পাথর চাপা রয়েছে, কাজেই সে বেরিয়েছে বাঁকা পথে, গোপনে আর এই হত্যাকাণ্ডগুলো তারই অবধারিত চিহ্ন। আমার অনুমান যে ভুল হয়নি, তার প্রমাণ আমরা কাল রাত্রেই পেয়েছি। বকুল আর রেবেকাকে কর্নেলের ছাত্রী কল্পনা করতেই যে নিশ্ছিদ্র গল্পটি তৈরি হল, তা মিলে গেল অক্ষরে অক্ষরে।’

‘আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, অরবিন্দও নিহত হয়েছেন?’ শিবেন প্রশ্ন করল।

‘না, আমার বোধ হয় এটা আত্মহত্যা, অমৃতপ্রভা যা বলেছেন তা ঠিকই। আমার বিশ্বাস অরবিন্দ সন্দেহ করেছিলেন বা হয়তো নিশ্চিতই জানতেন এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক কে এবং কেন? তা না হলে, পঞ্চার মা-কে কোনোরকম বাক্যস্ফূর্তি না করতে ইনস্ট্রাকশন দিতেন না। তবে সেইসঙ্গে একথাও বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি আসল অপরাধীকে চিনতে বেশি দেরি করব না। তাঁর পরিবারের পক্ষে সেই চূড়ান্ত লজ্জা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হবার আগেই উনি নিজেকে সরিয়ে দিলেন। শুধু অরবিন্দ কেন, কেউই তার আপন ভগ্নীপতিকে খুনের দায়ে ফাঁসিকাঠে চড়তে দেখতে চায় না।’

সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, ঈর্ষার বশে বিনয়ভূষণ হীরালালকে মারবার চেষ্টা করলেন না কেন?’

‘কারণ উনি খুব ভালো করেই জানতেন, হীরালাল জাল পেতে তাঁর নায়িকাদের ধরেননি, তাঁরা নিজেরা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, লোভের বশবর্তী হয়ে ওঁর ঘাড়ে গিয়ে চড়েছেন। হীরালালবাবু ভদ্রলোক, মহিলাদের উনি অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা অপছন্দ করেন!’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমরেশ বলল, ‘হুঁ! কিন্তু দুঃখ হয় যখন ভাবি যে বিনয়ভূষণের মতো এরকম একজন গুণী লোক হয়তো এভাবে সর্বনাশের অতলে তলিয়ে যেতেন না, যদি একটু স্ত্রীর মন পেতেন, একটা শান্ত, স্নিগ্ধ গৃহকোণ পেতেন, দুদণ্ড ঘরে শান্তি পেতেন। খুনই যদি করলেন, তো ওঁর করা উচিত ছিল ওই তাড়কা রাক্ষুসি অমৃতপ্রভাকে।’

অন্যমনস্কভাবে দময়ন্তী বলল, ‘তা কেন? অমৃতপ্রভা আইনত ওঁর স্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু উনিও তো তাঁকে ভালোবাসতেন না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *