ওয়ার্ডস অফ গড

ওয়ার্ডস অফ গড

আমার মা ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতি। তিনি যখন ছোট ছিলেন, তখন কঠিন কঠিন সব বই পড়তেন এবং এক সময় নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। তিনি ছিলেন খুবই সুন্দরি আর স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে নিজ থেকে যোগদান করতেন। তার এলাকার সবাই তাকে ভালবাসত। তিনি যখন মেরুদন্ড টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেন তখন তাকে শীতকালে লেকে দাঁড়ানো আভিজাত্যপূর্ণ বকের মত দেখাত। তার ছিল বুদ্ধিপূর্ণ এক জোড়া চোখ, যা ধুলোহীন চশমার ভেতর দিয়ে পুরো দুনিয়া চেয়ে চেয়ে দেখত।

আমার মায়ের যদি একটা অসঙ্গতি থেকে থাকে তাহলে সেটা ছিল তিনি তার পোষা বিড়াল আর ক্যাক্টাসের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। যে কারনে, একবার আমাদের বাড়ির বিড়ালটাকে চেপে ধরে মাটিতে পুঁতে তার উপর পানি ঢেলে দিয়েছিলেন। আবার আরেকবার একটা ক্যাক্টাস গাছকে বিড়াল ভেবে মুখের সাথে ঘষতে শুরু করেছিলেন। ফলাফল যা হয়েছিল তা হল তার মুখ ছিলে কেটে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল।

আমার বাবা আর ভাই আমার মায়ের এরকম রহস্যজনক কর্মকাণ্ড দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করত কেন তিনি এমন করতেন। অন্য সব ক্ষেত্রে বুদ্ধিমতি আমার মা তাদের প্রশ্ন উপেক্ষা করে বিড়ালের খাবারের একটা ক্যান খুলে অনড় ক্যাক্টাস গাছের উপর ঢেলে দিতেন।

এর সব কিছুই হয়েছিল আমার দোষে। আমি একটা ভুল করে ফেলেছিলাম আর সেজন্য আমি দুঃখিত।

***

যখন আমি অনেক ছোট ছিলাম, আমাকে প্রায়ই বলা হত যে আমার কণ্ঠ খুবই সুমধুর। নিউ ইয়ার্স কিংবা গ্রীষ্মের বুদ্ধিস্ট সোল ফেস্টিভ্যালের সময় আমরা যখন নানু বাড়ি যেতাম, তখন আমাদের সব আত্মীয়, যাদের সাথে বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া দেখা হত না, তারা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আমি খুব একটা সামাজিক ধরনের ছিলাম না কিন্তু তারা কয়েকটা ড্রিঙ্ক নিতেন, আমি তাদের কৌতুকে হাসতাম আর তাদের কথায় মনোযোগ দিচ্ছি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কথা বলতাম। এমনকি ভাব নিতাম যে তাদের বুঝতে কষ্ট হওয়া গ্রাম্য উচ্চারন বুঝতে কোন কষ্টই হচ্ছে না।

“তুমি আসলেই একটা ভাল ছেলে,” আমার খালা আমাকে বললেন, আমি উত্তরে মলিন একটা হাসি হাসলাম। সত্যি কথা হচ্ছে আমি মোটেও কোন ভাল ছেলে ছিলাম না। আমার হৃদয় ছিল পঁচন ধরে কুঁচকে যাওয়া। আমি সেফ অভিনয় করতাম।

আমার আত্মীয়রা আমাকে যত ভাল ভাল কথাই বলতেন না কেন আমি কখনো খুশি হতে পারতাম না। সবসময় বিরক্ত বোধ করতাম, আমার শুধু ইচ্ছে করত কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু আমার ভয় ছিল যদি আমি আমার আত্মীয়দের থেকে পালিয়ে যাই তাহলে তাদের সাথে আমার সব সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। যদিও তারা কি বলতেন তাতে আমার কোন আগ্রহ ছিল না কিন্তু তারা আমার কাছ থেকে যে উষ্ণ প্রতিক্রিয়া আশা করতেন তা দেয়া ছাড়া আমার কাছে কোন উপায় ছিল না। ‘

সে সময়ে নিজের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা ছিল। সেফ চাইতাম, লোকজন আমাকে ভাল মনে করুক তাই অর্থহীন একটা হাসি মুখের সাথে ঝুলিয়ে রাখতাম। কিন্তু আসলে আমি ছিলাম ঘৃণ্য।

“তোমার কণ্ঠ যেন সঙ্গীতের মত, একদম স্ফটিকের মত স্বচ্ছ,” একজন কমবয়সি যুবতী আত্মীয় আমাকে বলেছিল। আমার নিজের কানে আমার কণ্ঠ বিকৃত আর জঘন্য শোনাত, মনে হত কোন জানোয়ার মানুষের অনুকরন করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

আমার কণ্ঠের শক্তি ব্যবহার করার প্রথম স্মৃতি যেটা আমার মনে আছে, তখন আমি প্রথম গ্রেডে পড়ি। ক্লাসের শিক্ষা কার্যক্রম অনুযায়ী আমাদেরকে মর্নিং গ্লোরি চাষ করতে হচ্ছিল। আমাদের রোপণ করা চারাগুলো স্কুলের বাইরের দেয়ালের সাথে সারি করে রাখা থাকত। আমার মর্নিং গ্লোরিটা ছিল বেশ বড়-সেটার সবুজ লতা পাতাগুলো আলতো করে ঠেক দেয়া কাঠিটাকে জড়িয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছিল। এর চওড়া পাতায় জমে থাকা শিশির বিন্দু সকালের সূর্যের আলোকে আকর্ষণ করত। আর এর নরম, পাতলা, অর্ধস্বচ্ছ পাপড়িগুলোর রঙ ছিল লালচে বেগুনী বর্ণের।

কিন্তু আমার মর্নিং গ্লোরিটা ক্লাসের মধ্যে সেরা ছিল না। আরেকটা ছিল আমারটার চেয়েও বড় আর আরো বেশি সুন্দর। আমার তিন সিট সামনে একটা ছেলে বসততা যে ছিল একজন দ্রুত দৌড়বাজ। নাম ছিল ইয়ুচি। ও ছিল অনেক প্রাণবন্ত, সারাক্ষণ বকবক করেই যেত, থামত না। আমি মাঝে মাঝে ওর সাথে কথা বলতাম, তবে আমার আগ্রহ ওর কথার চেয়ে ওর অভিব্যক্তির কিভাবে পরিবর্তন হয় তার উপর বেশি ছিল। ও ক্লাসে বেশ জনপ্রিয় ছিল, আর আমার মনে হত সেটার কারন সুকানো ছিল ওর অভিব্যক্তির মধ্যে। যখনই আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম, ভাল করে ওর চেহারা খেয়াল করতাম। আমিও ওর মত একই রকম প্রতি মুহূর্তে অভিব্যক্তি বদলাতে চাইতাম, যেটা মনে হত ওর ভেতর থেকে বুদবুদের মত ফুটত।’

যাইহোক, আমার মনে হয়েছিল ওর এই অভিব্যক্তির পরিবর্তন ইচ্ছাকৃত ছিল না। কিংবা আমার মত চমৎকার ছেলে হওয়ার মত কোন ইচ্ছা থেকেও ওগুলোর উৎপত্তি ছিল না। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু মনের ভেতর আমি নিজেকে ইয়ুচির চেয়ে ছোট বোধ করতাম।

আমার ক্লাসমেটরা সবাই ইয়ুচি আর আমার কথায় মজা পেত। সে হয়ত বন্ধুত্বপূর্ণ কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা শুরু করল আর আমি এর সাথে সরস কিছু একটা যোগ করলাম। ও আমাদের এই ছোট খেলাটা উপভোগ করত, আর প্রতিবার এক গাল হেসে “হেই হেই!” বলে উঠত। কিন্তু আমার কখনো মনে হয়নি ও আমার একজন সত্যিকারের বন্ধু। আমি শুধু নকল একটা হাসি মুখে ধরে রেখে ওর সম্ভাষণের সাথে তাল মিলিয়ে মজার কিছু একটা উত্তর দিতাম।

তো ইয়ুচির মর্নিং গ্লোরিটা ছিল ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে সুন্দর। টিচার যখনই ওর ফুলের প্রশংসা করতেন, আমার খুবই খারাপ লাগত। আমার মনে হত যেন আমার ভেতর থেকে একটা নোংরা প্রাণী চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করতে চাইছে। বলাবাহুল্য ঐ নোংরা প্রাণীটা ছিল আমার আসল রূপ।

একদিন সকালে আমি অন্যদিনের চেয়ে একটু আগে স্কুলে পৌঁছেছিলাম। ক্লাস রুমে তখন কেউই ছিল না। চারদিক নিস্তব্ধ। নিজের মুখোশটা কিছুক্ষণের জন্য খুলে রেখে সহজ হলাম।

ইয়ুচির টব কোনটা তা সহজেই বুঝতে পারছিলাম। অন্য সব চারাগুলোর থেকে সেটা মাথা উঁচু করে ছিল। আমি টবটার দিকে উবু হয়ে ফুলটার দিকে তাকালাম, পাপড়িগুলো মাত্র মেলতে শুরু করেছে। আমি আমার পেটের নিম্নংশে জমে থাকা অন্ধকারের শক্তির উপর মনোনিবেশ করলাম।

“তুই খসে পড়বি…তুই মরে যাবি আর পঁ-চে…”

আমি দুহাত একসাথে করে শরীরের সমস্ত পেশির সব শক্তি আমার কণ্ঠের উপর নিবদ্ধ করলাম। মাথার ভেতর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল আর টের পেলাম আমার নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রক্তের ফোঁটাগুলো কংক্রিটের মেঝের উপর রঙের মত লাল গোল গোল দাগ সৃষ্টি করছিল।

আর অমনি চারা গাছটার কান্ড আর মাথা ঝুলে পড়ল।যেন মাথাটা এক কোপে কেটে ফেলা হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পর, ইয়ুচির মর্নিং গ্লোরি কুঁচকে গিয়ে নোংরা বাদামি বর্ণ ধারণ করল। কিন্তু তাতেও ইয়ুচি গাছটা ফেলল না, ওখানেই রেখে দিয়েছিল। খুব শিগগিরি ফুলটা থেকে বিচ্ছিরি গন্ধ ছড়াতে লাগল। বাজে গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে আজবাজে পোকা এসে ওখানে হাজির হল। নোরা টবটার মধ্যে খুঁয়োপোকার মত কিলবিল করতে লাগল। টিচার ঠিক করলেন মরা গাছটা ছুঁড়ে ফেলে দেবেন, আর ইয়ুচি কাঁদতে শুরু করল। আর আমার মর্নিং গ্লোরি ক্লাসের মধ্যে সেরা স্থান দখল করল।

আমার ভাল মুডটা আধা ঘন্টার জন্য বজায় ছিল। এর পর আমি আর সেটা নিতে পারছিলাম না। কেউ আমার ফুল সম্পর্কে ভাল কিছু বললে আমার মনে হচ্ছিল কান চেপে বসে থাকি।

যে মুহূর্তে আমি ইয়ুচির ফুলের টবের জাদু করেছিলাম সে মুহূর্ত থেকে আমার নিজের মর্নিং গ্লোরিটা একটা আয়নার রূপ ধারন করেছিল। আমার ভেতরে থাকা নোংরা প্রানিটাকে প্রতিফলিত করছিল, যা দেখতে আমার সহ্য হচ্ছিল না।

***

আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না কেন ইয়ুচির ফুলটা আমার ইচ্ছা মেনে নিয়ে মৃত্যুবরণ করল। ঐ সময়ে আমি প্রথম গ্রেডে পড়তাম কিন্তু আমার কণ্ঠের ক্ষমতা আবছাভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। যদি বাচ্চাদের কেউ আমার উপর ভয়ানক রেগে যেত তাহলে তাদেরকে শান্ত করার ক্ষমতা আমার ছিল। মতের অমিল ধরণের কিছু ঘটলে, আমি তখন ছোট একটা বাচ্চা ছিলাম যদিও কিন্তু আমি অন্যদেরকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতে পারতাম। এমনকি বড়রাও আমার সামনে মাথা নত করে বো করত।

ধরা যাক একটা ফড়িং, বেড়ার রেলিঙের উপর বিশ্রাম করছে, সাধারণত আপনি যদি হাত বাড়িয়ে ওটাকে ধরতে যান তাহলে সে দ্রুত পাতলা ডানাগুলো নেড়ে উড়াল দেবে। কিন্তু আমি যদি ওটাকে হুকুম করি

নড়ার জন্য, তাহলে ফড়িংটা একদম শক্ত হয়ে জমে যাবে-এমনকি আমি যদি ওর পা কিংবা ডানা টেনে ছিঁড়ে ফেলি তবুও।

ঐ সময়ে, প্রথম গ্রেডে থাকতে, আমার মনে আছে যে, আমি প্রায়ই আমার কণ্ঠের ক্ষমতা ব্যবহার করতাম। তখন থেকে আমি আমার এই ক্ষমতা অনেক মানুষের উপর বহুবার ব্যবহার করেছি, এমন অনেকের উপর যাদেরকে আমি কিনা চিনতামও না।

ইলিমেন্টারি স্কুলের শেষ বর্ষে একটা বিশাল আকারের কুকুর আমাদের এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। কুকুরটা তার বাড়ির গেটের পেছনে লুকিয়ে থাকত আর সামনে দিয়ে কোন পথচারী গেলেই ঘেউ ঘেউ করে উঠত। সে লাফ দিয়ে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করত যতক্ষণ না গলার সাথে লাগানো ভারি চেইনটা তাকে টেনে ধরত। চেইনের টানে কলারটা গভীরভাবে গলার উপর বসে পড়ত। জন্তুটা নিজের শ্বদন্তগুলো বেচারা পথচারীদের উপর বসানোর জন্য মরিয়া হয়ে ছিল। কুকুরটার সম্ভবত কোন ধরনের চর্মরোগ ছিল, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লোম উঠে চামড়া বের হয়ে থাকত। আর এর চোখগুলো ক্রোধে আগুনের মত জ্বলতে থাকত। কুকুরটা এলাকার মধ্যে বেশ পরিচিত ছিল, আর আমরা একজন আরেকজনের সাহস পরীক্ষা করতাম ওর কত কাছে যেতে পারে সেটার বাজি দিয়ে।

একদিন আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমাকে দেখে সে এমনভাবে গর্জন ছাড়ল মনে হল যেন ভুমিকম্প হচ্ছে। ঐদিন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার।

“তুই আমার উপর চিল্লা-বি না…”

বিস্ময়ে কুকুরটার কানগুলো কেঁপে উঠল, চোখগুলো বড় বড় করে সে চুপ করে গেল।

“তুই আমার হুকুম মান্য করবি। তুই আ-মা-র কথামত চলবি…আ-নু-গ-ত্য…”

আমার মনে হচ্ছিল মাথার ভেতর যেন আতশবাজি ফুটছিল। একই সাথে নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ফুটপাথের উপর পড়তে লাগল। স্বীকার করছি আমি আমার বন্ধুদের কাছে নিজেকে জাহির করতে চাইছিলাম। আমি দেখাতে চাইছিলাম যে আমি এই ভীতিকর কুকুরটাকে একটা নিরীহ খেলার সামগ্রীতে পরিণত করতে পারি।

ছেলেমানুষি ব্যাপার হলেও পরিকল্পনাটা ঠিকমতই কাজ করেছিল। আমি যা চাইছিলাম, কুকুরটা তাই করছিল। থাবা তুলে আমার হাতের উপর দেয়া, ডিগবাজি দেয়া, ইত্যাদি। আর ক্লাসমেটদের মধ্যে আমি দলের নেতা বনে গেলাম।

প্রথম প্রথম ব্যাপারটা আমাকে আনন্দিত করেছিল। আস্তে আস্তে আমার অনুশোচনা হতে লাগল। এসব কি করছি আমি? একজন সুপারহিরো সাজার চেষ্টা করছি? বাস্তবে তো আমি একটা গোল্ডফিস শান্ত করার সাহসও রাখিনা। অন্য লোককে ঘোল খাওয়ানোর জন্য আমার অপরাধবোধ হচ্ছিল।

সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার ছিল কুকুরটার চোখগুলো। আমার ক্ষমতা ব্যবহারের আগে কুকুরটার চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলত। এখন ওকে নিরীহ দেখায়। কুকুরটার লড়াকু আত্মাটা আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। ওর চোখের দিকে তাকালে, যেগুলো, একসময় ছিল হিংস্র আর এখন কাঁদোকাঁদো কোন ছোট কুকুর শাবকের মত, দেখার পর আমার নিজেকে নিজেই গালি দিতে ইচ্ছা হয়।

এমনিতে আমার কণ্ঠের ক্ষমতা মনে হয় অসীম, কিন্তু কিছু ব্যাপার আমি খেয়াল করলাম। প্রথমত, শুধুমাত্র জীবিত বস্তুর উপর আমার কণ্ঠ কাজ করে। গাছ আর পোকাও ঠিক আছে। কিন্তু পাথর কিংবা প্লাস্টিকের কোন কিছু আমি চিৎকার করে বাঁকাতে চাইলেও কাজ হয় না।

দ্বিতীয়ত, একবার আমি আমার কণ্ঠ ব্যবহার করে কোন নির্দেশ দিলে তা ফিরিয়ে নেয়া যায় না। একদিন আমার মায়ের সাথে আমার খানিকটা মতের অমিল হয়েছিল। কোন কিছু না ভাবেই আমি ফিসফিস করে বললাম, “তুমি আর বিড়াল আর ক্যা-ক্টা-সের মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারবে না!”

আবাগের বসে কথাটা বলা, এর ফলাফল কি হতে পারে তা আমি তখন বুঝতে পারিনি। মা আমার অনুমতি না নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছিলেন, আর সবকিছু গোছগাছ করার সময় ধাক্কা মেরে আমার প্রিয় ক্যাক্টাসটা ফেলে দিয়েছিলেন। কথাটা বলে আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে তার কাছে তার বিড়াল যতটা পছন্দের, আমার কাছে আমার ক্যাক্টাসটাও ততখানি মূল্যবান।

পরে যখন মাকে তার বিড়ালটাকে ক্যাক্টাসের মত মাটিতে পুঁততে দেখলাম তখন অনুশোচনা হতে শুরু করল। একি করেছি আমি! আমার ব্যাপারটা আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমার পছন্দ মত কিছু না হলে আমার কষ্ঠ ব্যবহার করে মানুষের মাথা আউলিয়ে দেয়া অবশ্যই অপরাধের মধ্যে পড়ে।

তাই আমি মায়ের উপর আবার আমার ক্ষমতা ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম যাতে তিনি বিড়াল আর ক্যাক্টাসের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন। কিন্তু তিনি আর কখনোই তা পারলেন না।

আমার কণ্ঠ শুধু যে মানুষের মনে পরিবর্তন আনতে পারত তাই নয়, তাদের শরীরের উপরও প্রভাব ফেলতে পারত। আমি পশুপাখির উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতাম, যেভাবে অনেক বছর আগে মর্নিং গ্লোরির উপর ফেলেছিলাম।

হাই স্কুলে ওঠার পরেও আমি আমার বড়দের মাথা খাওয়ার স্বভাব গেল না। আমি আমার এই বদঅভ্যাসটা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। আর আমার কাছে এটা ছিল আমার কাপরুষতার প্রমাণ। আমি সবসময় মানুষের সাথের মিথস্ক্রিয়াকে ভয় পেতাম, যেন ডিমের খোসার উপর হাঁটছিলাম, ভয় পেতাম যে আমার কোন কাজ তাদের চোখে আমার মূল্য ধূলিসাৎ করে দিবে। কখনো কারো সাথে কথা হলে মনে হত লোকটা মনে হয় আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমার মনে হত তারা বোধহয় অন্য কোথাও গিয়ে অন্যদের সাথে আমার খুঁত নিয়ে হাসাহাসি করছে। আমি দুনিয়ার ব্যাপারে এতটা ভীত সন্ত্রস্ত ছিলাম যে এর সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম না। এ কারনে মনের সত্যিকারের অনুভূতিগুলোকে ঢাকার জন্য আমি মুখের উপর নকল হাসির মুখোশ পরে থাকতাম। এর পেছনে যে শ্রম খরচ হত সেটাও আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলত।

আমার বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। তিনি ছিলেন ঐ ধরনের মানুষ যার চেহারা দেখলে খাড়া গিরিখাতের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যেখানে কিনা কোন গাছপালা শেকড় বসাতে পারে না। তিনি তার দুই পুত্রের দিকে উপর থেকে এমনভাবে নিচের দিকে তাকাতেন যে আমার মনে হত স্বর্গীয় কিছুর দিকে তাকাচ্ছি। সবকিছুর ব্যাপারে তার ছিল কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি আর যা তার পছন্দ হত না তার পেছনে এক বিন্দু সময় খরচ করার ধৈর্য তার ছিল না। একবার তিনি যদি কোন কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে জিনিসটা মূল্যহীন, তাহলে তিনি সেটার প্রতি পুরোপুরি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন। তার কাছে তখন সেটার মূল্য কোন কীটপতঙ্গের থেকে ভিন্ন কিছু মনে হত না।

বাবাকে না জানিয়ে আমি একটা ইলেক্ট্রনিক গেম কিনেছিলাম। ছোট সস্তা একটা জিনিস। এরকম খেলনা যে কোন ইলিমেন্টারির স্কুলে পড়া বাচ্চার কাছেই থাকে। জিনিসটা আমার হাতের তালুর সমান বড় ছিল খুব বেশি হলে। আমার বাবার কম্পিউটার গেমস সম্পর্কে উঁচু ধারণা ছিল না। এবং তিনি যখন জিনিসটার খোঁজ পাবেন, তখন অবশ্যই আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট হবেন। আমি শুধু দৃশ্যটা কল্পনা করেই অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

আমার ছোট ভাই বাবার কথামত চলত। তার গেম খেলার প্রয়োজন হলে গেম সেন্টারে যেত। ওর যদি পড়াশুনা করার ইচ্ছা হত তাহলে এক বসাতে পেন্সিল ফুরিয়ে ফেলার মত পড়াশুনা করতে পারত। বাবা-মায়ের অসন্তুষ্টি ঘটালে ও এভাবে তার মূল্য চুকাতে পারত। অবশ্য ওকে কখনো কোন অসন্তুষ্টির সামনে পড়তে হয়নি যদিও। কিন্তু আমি অমন ছিলাম না। আমি আমার বাবার থেকে মনোযোগ আর একটুখানি ভালবাসা পাওয়ার জন্য জানপ্রান দিয়ে পড়াশুনা করতাম। কার কাছে আপনি জানতে চাইছেন তার উপর নির্ভর করে, লোকজন আমাকে সাধারণত আমাকে দেখে হাসি খশি প্রাণবন্ত একটা বালক মনে করত। অবশ্যই সেটা বাইরের রূপ ছিল।

একদিন আমি আমার রুমে বসে গোপনে আমার গেম খেলছিলাম। কোন আওয়াজ না দিয়ে হঠাৎ করে বাবা দরজা খুলে রুমে ঢুকলেন। একদম কোন পুলিশ অফিসার যেভাবে দরজায় লাথি দিয়ে ক্রাইম সিনে প্রবেশ করে সেরকম। তিনি আমার হাত থেকে গেমটা কেড়ে নিয়ে ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন।

“আচ্ছা তাহলে তুমি এই কাজ করছিলে!” তিনি রাগী কণ্ঠে আমাকে বললেন।

কাজুয়া যদি গেমটা খেলত তাহলে বাবা কিছু বলতেন না। দ্বিতীয় সন্তান তার আদর্শে বড় হবে এরকম ধ্যান ধারণা আমার বাবার ছিল না। যে কারনে তার বড় সন্তানের প্রতি, আমার প্রতি তার প্রত্যাশা ছিল বেশি, সেই সাথে রাগটাও ছিল বেশি।

সাধারণত আমি হয়ত কেঁদে ফেলতাম আর তার কাছে মাফ চাইতাম। কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমি হয়ত তার প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করেছিলাম, কিংবা হয়ত মনে হয়েছে আমি আক্রমণের মধ্যে পড়েছি। যেটাই হোক, আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম যে আমার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। আমার ভাই যা খুশি করতে পারে অথচ আমার ক্ষেত্রেই যত সব নিষেধাজ্ঞা। আমার মনে হচ্ছিল এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র আমি একটা গেম খেলতে চাইছিলাম সেজন্য। কোন কিছু চিন্তা না করেই আমি বাবার বাম হাত আঁকড়ে ধরলাম। মরিয়াভাবে আমি আমার গেমটা ফেরত পেতে চাইছিলাম। এমনিতে আমি হয়ত আমার আনুগত্যর মুখোশ পরে চুপ করে বসে থাকতাম, জীবনে এই প্রথম বার আমি বাবার বিরুদ্ধে লড়াই করলাম। তিনি বাম হাতে শক্ত করে গেমটা ধরে থাকলেন, ছাড়লেন না। আমি আমার কণ্ঠের শক্তি ব্যবহার করে বললাম : “ঐ আ-ঙু-ল-গুলো! খসে পড়বে!”

কয়েক মুহূর্তের জন্য আমাদের মধ্যের দূরত্বটা আমার কণ্ঠের কম্পনে ভরে গিয়েছিল। আমার মাথার ভেতরে রক্তনালিগুলোর টানটান অবস্থা অনুভব করতে পারছিলাম। গেমটা ঠাস করে মেঝেতে পড়ে গেল। তারপর এক এক করে আমার বাবার হাতের আঙুলগুলো মেঝেতে খসে পড়ে গড়িয়ে আমার পায়ের কাছে এসে থামল। পুরো পাঁচটাই, একদম নিখুঁতভাবে তার হাতের জয়েন্ট থেকে খুলে গিয়েছিল। আঙুলহীন হাতটা থেকে রক্ত ছিটকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরো মেঝে উজ্জ্বল লাল রঙ ধারণ করেছিল। আমার নাক থেকেও রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।

বাবা চিৎকার করতে শুরু করলেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি তাকে নির্দেশ দিলাম যে যথেষ্ট হয়েছে, মুখ বন্ধ কর। এবং তিনি থামলেন। কণ্ঠ থেমে যাওয়ায় তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল, ব্যথায় এবং আতংকে। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তিনি তার আঙুলহীন বাম হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

আমার বমি বমি লাগছিল। একগাদা রক্ত বের হল আমার নাক থেকে। মাথা ঘোরাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে যাব। বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিত। আঙুলগুলোকে জায়গামত ফিরিয়ে আনার আর কোন উপায় ছিল না। একবার কথা বলে ফেললে তা আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না।

বাবাকে অজ্ঞান করে ফেলা ছাড়া আমার সামনে আর কোন উপায় ছিল না, যতক্ষণ না কিছু একটা ভেবে বের করতে পারছি। “ঘুমাও!” তাকে নির্দেশ দিলাম। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম যে আমার কণ্ঠের ক্ষমতা লোজন সংজ্ঞাহীন থাকলেও তার উপর কাজ করে। জেগে থাকা অবস্থায় আমার ক্ষমতা ব্যবহার করার ব্যাপারটা আমাকে আরো নার্ভাস করে তুলত, তাই তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়াটাই আমার কাছে সহজ মনে হয়েছিল।

বাবা মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায় আমি তার কানে ফিসফিস করে বললাম, “বাম হাতের ক্ষতগুলো ঠিক হয়ে যাবে,” আর “তুমি যখন জেগে উঠবে তখন আমার রুমে যা যা ঘটেছে সব কিছু ভুলে যাবে।” প্রায় সাথে সাথেই তার বাম হাতের ক্ষতের উপর যেখানে আঙুল ছিল, সেখানে পাতলা নতুন চামড়া গজাল। সাথে সাথে রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেল।

আমাকে আমার বাবাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে তার বাম হাতে আঙুল থাকার বিষয়টা পুরোপরি স্বাভাবিক। আমাকে এর চেয়ে বেশিই করতে হবে যাতে অন্য কেউ তার বাম হাত দেখে অস্বাভাবিক কিছু মনে না করে।

এটা কিভাবে করব তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলাম। সামনে থাকা কাউকে সরাসরি নির্দেশ দিয়ে পরিবর্তন আনতে পারি আমি, কিন্তু দুনিয়ার বাকি সবাইকে কি করে বোঝাব?

মাথায় একটা বুদ্ধি এল, আমি এই কথাগুলো বললাম:

“পরবর্তীবার যখন তুমি চোখ খুলবে, তুমি তোমার হাতের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করবে যে হাতটা আগে থেকে এরকমই ছিল। আর সবাইকে বোঝাৰে যে হাতের এই বিকলাঙ্গতা একদম স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।”

. এভাবে আমি বাবার হাতের প্রতি অন্য লোকজনের প্রতিক্রিয়া। সামলাতে পারব। আমি হাতটাকে নির্দেশ দিলাম, “স্বাভাবিক হাতের মত আচরণ কর।”

তারপর রুমের রক্ত পরিস্কার করলাম। খসে পড়া আঙুলগুলো টিস্যু পেপারে মুড়ে ডেস্কের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলাম। আবার জামাকাপড়েও রক্ত লেগে ছিল। আমার পরিবারের সদস্যদের নির্দেশ দিলাম যেন রক্ত খেয়াল না করে।

বাবাকে রুম থেকে বের হতে সাহায্য করলাম। হলওয়ে থেকে কাজুয়ার সাথে দেখা হল। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হল ওর চোখে বিস্ময় দেখতে পেলাম। বাবাকে এভাবে সাহায্য করা আমার জন্য বিরল ঘটনা বটে। খোলা দরজা দিয়ে কাজুয়া আমার রুমের মধ্যে উঁকি দিল। গেমটা মেঝের উপর পড়ে ছিল। ও হাসি চেপে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।

ডিনারের সময় খেতে গিয়ে বাবার কিছু সমস্যা হচ্ছিল। আঙুলহীন বাম হাত দিয়ে তিনি ভাতের বাটি ঠিক মত ধরতে পারছিলেন না। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে তাকে কাজটা করার সময় একদম স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। আঙুল ছাড়া তার হাতটা একদম মসৃণ আর গোল দেখাচ্ছিল। বাজি ধরে বলতে পারি আমার পরিবারের আর কেউ বাবার এই বিকলাঙ্গতা সম্পর্কে জানতও না।

আমি খেয়াল করলাম আমার ভাই কাজুয়া ঘৃণার দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছিল। ও হচ্ছে ঐ ধরণের যারা মনে করে পৃথিবীটা বখে যাওয়া ছেলেপেলে দিয়ে ভর্তি। ও আর আমি একই হাই স্কুলে পড়তাম, আমি শুধু এক ক্লাস, উপরে ছিলাম। ওর জীবন যেরকম ছিল সেরকম জীবন আমার পক্ষে সম্ভবই ছিল না।’

স্কুলে আমার ভাই তার বন্ধুদের সাথে হাসি ঠাট্টা করতে করতে করিডোর দিয়ে হাঁটত। আসল বন্ধুরা এভাবে চলাফেরা করে। আর এসব দেখে আমার নিজেকে আরো একাকী মনে হত। আমার টিচাররা মনে করতেন যে আমি খুবই হাসিখুশি একজন মানুষ যে কিনা ক্লাসে যে কোন রকম মজা করতে পারে। কিন্তু সত্যি কথা হল, এমন কেউ ছিল না যাকে আমি সত্যিকারের বন্ধু বলতে পারতাম। অনেকেই আমাকে পছন্দ করত, হয়ত। কেউ কেউ হয়ত আমাকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও মনে করত। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় না, এরকম কেউ ছিল, যার কাছে আমি যা তা চাইতে পারতাম। আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে যারা দাবি করত, তারা আমাকে অনেক কাছ থেকে চেনে, তারাও আমার দিকে এমনভাবে তাকাত যেন কোন অদ্ভুত কিছু দেখছে।

আমার ভাই আসলেই একটা ভাল ছেলে ছিল। আমার মত না। মিথ্যা হাসি দিয়ে নিজেকে লুকানোর প্রয়োজন ছিল না ওর। নিজে যা তাতেই ও সন্তুষ্ট ছিল। বন্ধুদের সাথে সহজভাবে চলতে পারত। সহজভাবে বললে ও অনেক বেশি সুস্থ আর পূর্ণ মানুষ ছিল যা আমি কোনদিনই হতে পারতাম না।

অদ্ভুত ব্যাপার হল, সবাই কেন জানি আমাকে প্রতিভাবান একজন শিশু বলেই মনে করত। খুব সম্ভবত তাদের এই ধারণা হয়েছিল আমার এই ফালতু খোশামদি মুখোশটা সবসময় পরে থাকার জন্য। এর কারনে যদি আমার ভাই নিজেকে আমার থেকে নিম্নতর মনে করে তার মানে হল আমি ওকে বাজেভাবে নিয়েছিলাম। আমি ওর কাছে এজন্য ক্ষমা চাইতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ওর আমার মধ্যকার সম্পর্কটা এমন ছিল না যে ভোলাখুলি মনের কথা বলা যাবে। স্কুলে যদি কোন কারনে আমাদের চোখাচোখি হত তাহলে আমরা দ্রুত নিজেদের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে এমন ভান করতাম যেন কেউ কাউকে দেখিনি। ব্যাপারটা দুঃখজনক ছিল।

দোষটা আমার ছিল। আমার ধারণা ছিল, ও কোন না কোনভাবে আমার ভেতরের কুৎসিত চেহারাটা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। ও আমার সবকিছু জানত, আমি কতটা কুৎসিত, আমি আমার বাবা-মা আর টিচারদের কথামত চলতে কতটা আগ্রহী ছিলাম, আমার চারপাশের মানুষের কাছ থেকে পয়েন্ট সংগ্রহ করতে যাতে তারা আমাকে তাদের একজন হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। এ নিয়ে কোন কথা বলাটা বেশ জঘন্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত। ও শুধু যা করতে পারত তা হল কোন কথা না বলে শুধু চোখে ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে।

নিজেকে কারো অনগ্রহভাজন করতে পারলে আমার মনে হত নিজের চারপাশে একটা নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ জায়গা সৃষ্টি করতে পেরেছি। আর ঠিক ঐ মুহূর্তেই আমাকে ওর ঐ দৃষ্টির সামনে পড়তে হত। আমাকে ওর কাছে উপহাসাম্পদ মনে হত। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে আমার দুনিয়ায় একটা ফাটল দেখা দিয়েছে আর একটা ব্যান্ডএইড লাগিয়ে সেটা মেরামত করার চেষ্টা করছি।

একবার স্কুলের ভেন্ডিং মেশিনগুলোর কাছে শিক্ষার্থীদের একটা দল জড়ো হয়ে হাউকাউ করছিল। ওদের কারোরই কোন ড্রিঙ্ক কেনার ইচ্ছা ছিল না। আমি মেশিন থেকে কিছু একটা কিনতে চাইছিলাম, কিন্তু ভিড় ঠেলে যেতে ইচ্ছা করছিল না। তাই কাছেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন একটু খালি হবে। আমার মনে হয় আমি তাদেরকে একটু সরে জায়গা দিতে বললেই পারতাম, কিন্তু আমার মাথার ভেতর কিছু একটা ভয় পাচ্ছিল যা তারা না বলবে আর অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাবে। তাই আমি শুধু ভেন্ডিং মেশিনের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কিছু পোস্টার দেখার ভান করছিলাম যেগুলোতে আসলে আমার কোন আগ্রহ ছিল না।

এমন সময় কাজুয়া হাজির হল। বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে ও ভিড় ঠেলে পথ করে মেশিনের কাছে গিয়ে কয়েন ঢালল। সোডার ক্যান হাতে নেয়ার পর ও খেয়াল করল যে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওর হাসি দেখে মনে হল ও চোখের পলকে পুরো পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছে, কেন আমি পোস্টারগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

কাজুয়া জানত। ও জানত যে ওর বড় ভাই, যাকে সবাই বন্ধুত্বপূর্ণ আর জনপ্রিয় বলে জানে, পড়াশুনায় মনোযোগী বলে জানে, সেটা আসলে সাজানো বিভ্রম মাত্র। কাজুয়া আমার সম্পর্কে সবকিছু জানত, আমার ক্ষুদ্র হৃদয় আর এর মিথ্যে হাসি, যার একটাই উদ্দেশ্য ছিল-আর তা হল সবাই যাতে আমাকে পছন্দ করে। আর ও আমার সব বিকারগ্রস্থ কাপুরুষতার কথা জানত, যে আমার এইটুকু সাহসও নেই যে কিছু ছেলেমেয়েকে “এক্সকিউজ মি বলে ভেন্ডিং মেশিন পর্যন্ত যাব।

এক সময় এমন হল যে বাসায় হোক বা স্কুলে, আমার ছোট ভাইয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ও আমি ঘামতে থাকতাম। আমি কাজুয়াকে নিয়ে প্রচন্ড আতংকে ভুগতাম কারন ও আমার আসল রূপ জেনে বসে আছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ওর চোখে আমি ওর বড় ভাই ছিলাম না, বরং মাটির তৈরি কোন নোংরা মূর্তির মত কিছু একটা,ছিলাম যার উপর খালি থুথু ছিটানো যায় আর ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকানো যায়।

কাজুয়ার সাথে কথা বলার কিছু সুযোগ এসেছিল, কিন্তু যখনই আমরা একসাথে টেবিলে বসে নাশতা করতে বসতাম তখনই আমার পাকস্থলীর ভেতর মোচড় দিয়ে উঠত। আমার মনে হত ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে পুড়ে যাচ্ছি, আমার হাতগুলো ঘামতে থাকত, চপস্টিক হাত থেকে পিছলে যেতে চাইত। এরপরেও কমেডি সিনেমার কোন অভিনেতার মত আমি হেসে আমার বাবা-মাকে সম্ভাষণ জানাতাম, প্রবল উদ্যমে নিজের নাশতা শেষ করতাম। অনেক দিন ধরে এরকম.চলছে তবুও এখনো আমি প্রায় যা খাই সবই বমি করে উগড়ে দেই।

আমার রাতগুলো নিঘুম কাটে, খিচুনি হয়। শান্তি হয় এরকম কোন স্বপ্ন আমি দেখি না। চোখের পাতা বন্ধ করলে অনেক মানুষের চেহারা দেখতে পাই। আমার ভাইয়ের মত তারা সবাই আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি কান্নাকাটি করি, বুদ্ধিস্ট মন্ত্র জপ করি, আমার পাপ মোচনের জন্য। মাঝে মাঝে যখন আমি চোখ খুলে দিবাস্বপ্ন দেখি তখন হাজার হাজার চোখ আমার রুমের মধ্যে ভেসে ভেসে আমাকে অভিযুক্ত করে। তখন আমার ইচ্ছা হয় মরে যেতে।

কিংবা আরো ভালো হত যদি সারা পৃথিবীতে একা আমি বেঁচে থাকি, তাহলে এই যন্ত্রণা আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে না। প্রত্যেকটা মানুষ আমার কাছে ভীতিকর। যে কারনে আমাকে এইসব নোংরা কাজ করতে হয়েছে, মানুষ যাতে আমাকে পছন্দ করে। আমার প্রতি লোকজনের ঘৃণা, আমার দিকে নিচু দৃষ্টিতে তাকানো এসবই অনেক কষ্টদায়ক ছিল, আর এর থেকে পালানোর জন্য আমি আমার এই কুৎসিত ক্ষুদ্র পশুটাকে হৃদয়ের মাঝে বন্দি করে রেখেছিলাম। পৃথিবীতে যদি কোন মানুষ না থাকত, শুধু যদি আমিই থাকতাম, তাহলে জীবন আমার জন্য অনেক সহজ হত।

আমার উচিত কাউকে আমাকে দেখতে না দেয়া। কেউ যেন আমার দিকে কষ্টদায়ক হাসি না হাসে বা অসম্ভষ্টি নিয়ে তাকায়। তাই আমি চিন্তা করছিলাম কি করে আমি পৃথিবীর সবার মন থেকে আমার চেহারা মুছে ফেলতে পারি।

এই আইডিয়াটা কেমন?

“এখন থেকে এক মিনিট পর, তোমার চোখে আমার কোন প্রতিফলন হবে না!’ আমি এই কথাটা প্রথমে কাউকে একজনকে বলব। তারপর এই কথাটা বলব : “তোমার চোখগুলো, যেগুলো আমাকে আর দেখতে পায় না, অন্য কারো সাথে যখন চোখাচোখি করবে তখন এই কথাগুলো তাকে হস্তান্তর করবে।”

সহজ ভাষায় বললে, যে লোক আমার কণ্ঠ শুনে প্রথম আমাকে দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলবে, সে যখন অন্য কারো সাথে দৃষ্টি বিনিময় করবে তখন সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও আর আমাকে দেখতে পাবে না। ঐ দ্বিতীয় ব্যক্তিটি যখন অন্য আরেকজনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করবে তখন তৃতীয় ব্যক্তিটিও আমাকে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এরকম চলতে চলতে একসময় পুরো দুনিয়ার সামনে আমি অদৃশ্য হয়ে যাব। কেউ আমাকে দেখতে পাবে না। আর তখন আমি চিরকালের জন্য শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হব।

এই পরিকল্পনাটা শুরু করার আগে আমাকে অবশ্য নিজেকে এর থেকে বাইরে রাখার জন্য কোন একটা উপায় বের করতে হবে। নাহলে আমি আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে পাবো না।

যখন আমি অনুভব করলাম কিসব জিনিস আমাকে সুখি করে তুলছে, তখন নিজের উপর ঘৃণা হতে লাগল।

তারপর এক রাতে কুকুরটা মারা গেল। মানে বলতে চাইছি, ঐ কুকুরটা, যেটার উপর ইলিমেন্টারি স্কুলে থাকতে বন্ধুদের সামনে জাহির করার জন্য আমার কণ্ঠের জাদু দেখিয়েছিলাম। কুকুরটার কথা আমি কখনো ভুলতে পারিনি, আমাকে দেখলেই ওটার চোখে যাবতীয় ভীতি এসে ভর করত।

যখন আমার বাবা-মা আমাকে কুকুরটার মৃত্যুসংবাদ জানাল, আমি ঐ বাসাটায় গিয়েছিলাম যেখানে কুকুরটা থাকত। কুকুরটার মালিক আমাকে চিনতেন, ওর মৃতদেহটা আমাকে দেখিয়েছিলেন। একসময় যেটাকে বিশাল আর ভয়ংকর মনে হত সেটা তখন নিশ্চল হয়ে পেভমেন্টের উপর পড়ে ছিল। আমি কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। আমাকে কাঁদতে দেখে কুকুরের মালিক একা সময় কাটানোর জন্য কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে গিয়েছিলেন।– “ আমি আমার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে, আমার গভীর থেকে উঠে আসা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে, কুকুরটাকে নির্দেশ দিলাম বেঁচে উঠতে। কিন্তু কুকুরটার জীবন ফিরে এল না। রাতের বাতাসে শুধু ওর পিঠের পশমগুলো এদিক ওদিক উড়ছিল। আর কিছুই হল না। যদিও আমার কথাগুলো কোন একটা সংকেতের আশায় আমার মনের গহীনের বাসনাকে সন্তুষ্ট করেছিল কিন্তু কুকুরটার জীবনটা ফিরিয়ে আনতে পারেনি।

আর শুধু সেটাই নয়। কুকুরটার জীবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টাটা আমার হৃদয় বিদারক কষ্ট থেকে সৃষ্ট ছিল তা নয়। আমার মনে হয়, অবচেতনভাবে আমি চাইছিলাম নিজের পাপের বোঝাটাকে হালকা করতে, সামান্য একটু হলেও।

***

এক রাতে আমি আমার বেডরুমের মাঝামাঝি একটা ছেনি হাতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। আমার পুরো শরীর ঘেমে গোসল হয়ে গিয়েছিল আর আমি ক্রমাগত বকে যাচ্ছিলাম, “আমি দুঃখিত। আমি দুঃখিত।” আমি হয়ত ছেনিটা দিয়ে কবজি কেটে ফেলতাম, কিন্তু শেষ সময়ে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমার কাঠের ডেস্কটার উপর তাকিয়ে দেখি ছেনির খোঁচায় একটা আঁচড় পড়েছে। ডেস্কের একটা অংশ আমার চোখের পানি দিয়ে ভিজে ছিল। মুখ আরো নামিয়ে আনতেই একটা বাজে গন্ধ নাকে এল, পঁচন ধরা মাংসের মত গন্ধ।

ডেস্কের ডয়ার খুলে দেখি ভেতরে টিসুতে পেঁচিয়ে রাখা আঙুলগুলো। ওগুলোর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেকদিন ফেলে রাখায় ওগুলোর রঙ কালচে হতে শুরু করেছিল। আঙুলগুলোর গিঁটগুলোতে গাঢ় লোম দেখে মনে পড়ল যে ওগুলো আমার বাবার আঙুল। আমার কণ্ঠের ক্ষমতা আমাকেই ভুলিয়ে দিচ্ছিল যে আমি কি করেছি।

পঁচতে থাকা আঙুলগুলো বাইরে নিয়ে উঠোনে একটা গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেললাম। কিন্তু তারপরেও ডেস্ক থেকে বাজে গন্ধটা গেল না। বরং যত দিন যেতে লাগল গন্ধটা মনে হল বাড়তেই থাকল। মনে হচ্ছিল ভয়ারের ভেতরে কোথাও যেন অন্য জগতের সাথে কোন সংযোগ আছে, আর ঐ মাংস পঁচা গন্ধটা সেই অন্ধকার থেকে ক্রমাগত উদিারিত হচ্ছিল।

আমি খেয়াল না করলেও সময়ের সাথে ডেস্কের উপর আঁচড়ের চিহ্নও। বাড়তে থাকল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দশটারও বেশি ছেনি দিয়ে আঁচড় কাটার দাগ দেখা গেল। এসবের কোন স্মৃতি আমার জানা ছিল না।

***

সকাল। চোখ খুলে দৈনন্দিন যন্ত্রণায় ফিরে এলাম।

যে মানুষটা পরিবার আর ক্যাক্টাসের জন্য নাশতা বানাচ্ছে, যে মানুষটা আঙুলহীন হাত দিয়ে খবরের কাগজ চেপে ধরে আছে যাতে বাতাসে পাতাগুলো উড়ে না যায়, তাদেরকে আমার মানুষ মনে হত না। মনে হত কোন পুতুল যেগুলো নড়াচড়া করতে পারে। যে মানুষটা ট্রেনে করে স্কুলে যাওয়ার সময় আমার টিকেট চেক করে, যে মানুষটা আমার পাশের সিটে বসে থাকে, যে মানুষগুলো স্কুলের হলওয়েতে আমাকে পাশ কাটিয়ে যায়, তাদের কাউকেই আমার জীবিত প্রাণী মনে হয় না। তারা স্রেফ কোন বস্তু, চিন্তাশক্তিহীন, অনেকটা ধাক্কাধাক্কি করা বিলিয়ার্ড বলের মত। শুধু এদের তৃকগুলো যত্ন করে বানানো, আর ভেতরের বাকি সব কিছু বানানো যন্ত্রপাতির জঙ্গল।

কিন্তু তারপরেও, আমার একটাই কাজ ছিল আর তা হল ক্রমাগত হেসে যাওয়া আর আমার অভিনয় চালিয়ে যাওয়া যাতে তারা আমাকে ছেড়ে না যায়। যে মানুষটা আমার নাশতা বানিয়েছে, তাকে তা করার জন্য কতটা ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সেটা যে আমি বুঝেছি তা পুরোটা খেয়ে। খাওয়ার সময় তার সাথে ব্যাখ্যা করতে হবে, বলতে হবে কতটা মজার ছিল খাবারটা, আর এমনভাবে বলতে হবে যেন কণ্ঠে সন্তুষ্টির ছোঁয়া থাকে। যখন ট্রেনে চড়ি, পুরো যাত্রাপথের টিকেট যেন অবশ্যই কাটা হয় তা ভুললে চলবে না আর কন্ডাক্টর যখন আমার কমিউটার পাশ দেখতে চাইবেন তখন একজন আদর্শ যাত্রির মত তা বের করে দেখাতে হবে। ক্লাসেও আমাকে পরিবর্তিত হতেই হবে, আমি যে ক্লাসেরই একজন সে বিষয়ে কোন অজুহাত চলবে না। তাই কেউ দয়া করে সবার শেষে আমাকে বাছাই কোর না, বরং আমি চাই ফুলদানিতে যত্ন করে রাখা ফুলের মত হতে। আর আমি ফুল দিয়ে এত চতুরভাবে সাজাব যে, সবাই ধরে নেবে এসব আমার ব্যক্তিত্বরই স্বাভাবিক অংশ। কেউ চিন্তাও করবে না, এসব কোন পরিকল্পনার অংশ।

আমার হৃদয় এতটাই শূন্য হয়ে গিয়েছিল যে মুখে সবসময় একটা উজ্জ্বল হাসি ধরে রাখা আমার জন্য বেশ সহজই ছিল। আর এই পুরোটা সময় আমার ভাইয়ের প্রতি আমার ভীতি শুধু বাড়ছিলই। এমন কি আমি যদি নাও কল্পনা করি যে সারা পৃথিবীর সব মানুষ এসে ঐ ছোট খুলিটার ভেতর বসে আছে আর দুনিয়ার সব চিন্তা করছে, তারপরও কাজুয়াকে ভয় লাগত আমার, শুধু ওকে। অন্য মানুষদের নিশ্বাসের শব্দ আর আমার কানে এসে পৌঁছাত না কিন্তু ওর ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল।

কাজুয়া কখনো সরাসরি কিছু বলেনি, কিন্তু আমার মধ্যে কোন সন্দেহ ছিল না যে ওর মুখের ঠাণ্ডা হাসিটা আমার নির্বুদ্ধিতাকে উৎসর্গ করে হাসা। ওইটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আতংকিত করে তুলত। ভুতের মত আমার পিছু পিছু অনুসরণ করত, আমাকে নির্যাতন করত। এরকম সময়ে আমি এমনকি স্কুলের সিঁড়িতে ওঠার সময়ও আশেপাশে তাকিয়ে দেখতাম কেউ নেই অথচ তারপরও আমার মনের ভেতর আমি নিজের চুল ছিড়তাম আর দেয়ালের একটার পর একটা লাথি মেরে যেতাম। আমার ভাইকে এতটা ঘৃণা করার পরও আমি আমার নিজের সামনে দাঁড়াতে পারতাম না।

এখন পর্যন্ত আমার মনে হয় কাজুয়াই আসলে আমার সমস্ত যন্ত্রণার মূল। এইসব অনুভূতিগুলো ওকে খুন করার ইচ্ছাটাকে প্রবল করে তুলছিল।

***

ক্যাসেট প্লেয়ারের স্টপ বাটন চেপে থামিয়ে আবার রিওয়াইন্ড করে শুরুতে নিলাম। এই গল্পটা বারবার শুনতে গিয়ে আমি আমার কাঁপুনি থামাতে পারি না। কান্নায় চোখ ঘোলা হয়ে আসে। শরীরের সব শক্তি ছেনিটার উপর একত্র করে ডেস্কের উপর আরেকটা আঁচড় কাটি।

আমি ঘামছিলাম, ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলাম। জানালার বাইরে অসীমে প্রসারিত হতে থাকা নিরব দুনিয়ার কথা কল্পনা করি। ঝড়ো হাওয়ার মাঝে পুতিময় গন্ধ নাকে এসে লাগে। ব্যাক্টেরিয়া মাংস পচাচ্ছে, বাতাসে ছড়াচ্ছে অশুভ গন্ধ।

নিজের ভেতরে গোল পাকাতে থাকা আবেগুগুলোকে দমাতে না পেরে বিছানার কিনারায় এসে বসি, ছেনিটাকে দুহাতে সজোরে আঁকড়ে ধরে বাহু দুটোর মধ্যে নিজের মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠি।

***

অবশেষে যখন মাথার ভেতরটা পরিস্কার হল, আমি দেখলাম তখনও বিছানার কিনারায় বসে আছি, ছেনিটা পড়ে আছে কোলের উপর। ঝটকা দিয়ে ওটা মেঝেতে ফেলে দিলাম, যেন কোন পুঁয়োপোকা আমার জিন্সে উঠেছিল। ডেস্কের দিকে তাকিয়ে দেখি আঁচড়ের দাগের সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বিশের কম হবে না।

আমার মনে হল ওগুলো সম্ভবত আমি নিজেই করেছি, কিন্তু আমার সেরকম কোন কিছু করার কথা মনে নেই।

আমার মনে হচ্ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা আমি ভুলে যাচ্ছি, আর সেকারনে অস্বস্তি লাগছিল। কেউ কি আমার স্মৃতি ওলটপালট করেছে? পড়ে থাকা ছেনিটার দিকে তাকালাম, ওটার তীক্ষ্ণ ফলাটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা মনে আসি আসি করার চেষ্টা করছিল, এমন কিছু যা কিনা লোকজনকে তাদের শেষ সীমায় নিয়ে যেতে পারে।

ডিনারের ঠিক পরের কথা। লিভিং রুমের কার্পেটে শুয়ে কাজুয়া টিভিতে বেজবল খেলা দেখছিল। এক হাত মাথার পেছনে দিয়ে উঁচু করা, আরেক হাত দিয়ে স্ন্যাক্স নিয়ে খাচ্ছিল। পা দুটো বিভিন্ন দিকে ছড়ানো। কয়েক মিনিট পর পর সে ওগুলোকে ভাঁজ করে আবার সোজা করে, এরকম বার বার চলছে। নিশ্বাসে সাথে বুক উঠা নামা করছে।

ওকে খুন করতে হবে। এই চিন্তাটাই আমার মাথায় এসেছিল। আমি আমার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসলাম আর অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলাম। বরাবরের মত ডেস্কের থেকে বাজে গন্ধ। ভেসে আসছিল। আমার হাত দুটো ভয়াবহ কাঁপছিল। উত্তেজনা নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কাজ হচ্ছিল না।

নিজেকে বার বার বলছিলাম যে ওকে খুন করতে আমার এক সেকেন্ডের জন্যও ইতস্তত করা উচিত নয়। এটা যদি আমাকে দিয়ে না হয় তাহলে আমার কোন মূল্য নেই। ওর ইস্পাতের মত দৃষ্টি একদম আমার মাংস ভেদ করে ভেতরটা দেখতে পায়, আর আমি যতই চেষ্টা করি না কেন ওর ঐ উপহাসের হাসি আমার মন থেকে সরাতে পারি না। আমি আমার চোখগুলো টেনে বন্ধ করে হাত দিয়ে কান চেপে রাখলাম। কিন্তু ঐ যে ও আছেই, আঙুল উঁচিয়ে আমার কুৎসিত হৃদয়টাকে ঘাঁটছে।

শান্তি অর্জনের জন্য আমার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল নিজেকে এমন এক দুনিয়াতে সরিয়ে নেয়া যেখানে আর কারো অস্তিত্ব নেই। অথবা ওকে আমার দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া।

কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত হল। রুম থেকে বেরিয়ে কাঁচকোঁচ শব্দ করা হলওয়ে দিয়ে নিচে নামার সময় আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। ভাইয়ের রুমের দিকে যাচ্ছিলাম। ওর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হলের লাইট আমার সামনে আমার ছায়া ফেলছিল। ছায়াটা যে এখনো মানুষের মত দেখতে তা খেয়াল করে একটু অবাকই লাগল।

দরজায় কান লাগিয়ে নিশ্চিত হলাম যে ও ঘুমাচ্ছে। ঠাণ্ডা ভোর নবটা চেপে ধরে কোন শব্দ না করে দরজাটা খুললাম। দম চেপে ফাঁক দিয়ে পিছলে রুমের ভেতর ঢুকে পড়লাম, পেছনে দরজাটা খোলা থাকল। ভেতরটা অন্ধকার ছিল কিন্তু তাতে সমস্যা নেই। হল থেকে আসা আলো আমার দেখতে পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

ও একদম মরার মত ঘুমাতে পারে। কম্বলগুলোকে সব একসাথে বড় একটা বলের মত লাগছিল দেখতে। আরো কাছে গিয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যে ওর চোখগুলো বন্ধ আছে আর ও ঘুমিয়ে আছে। রুমের মধ্যে আলো ঢুকলেও আমার শরীরে বাধা পেয়ে ওর মুখের উপর ছায়া ফেলছিল। আমি আমার মুখ ওর কানের কাছে নিয়ে মৃত্যু সম্পর্কিত কিছু কথা ফিসফিস করে বলতে যাচ্ছিলাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে ও নড়ে উঠল আর বিছানাটা কড়কড় শব্দ করল। আস্তে করে জেগে উঠে ও হালকা গোঙানির মত শব্দ করল আর চোখ জোড়া খুলল। প্রথমে খোলা দরজার দিকে তাকাল তারপর ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার উপর চোখ পড়ল।

“কি করছ তুমি এখানে?” মুখে নিরীহ একটা হাসি নিয়ে সে প্রশ্ন করল। আমি আমার দু হাত দিয়ে ওর গলা চেপে ধরলাম। ওর কাঁধগুলো অনেকটা মেয়েদের মত সরু। ও অবাক হয়ে উঠে বসল। আমি আমার সমস্ত শক্তি আমার কণ্ঠে জমা করে বললাম, “তুমি ম-র-বে-এ-এ!”

ওর চোখগুলো ভয়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছিল, ওর সরু আঙুলগুলো সাহায্যর জন্য বাতাসে হাত নাড়াল কিন্তু কিছুই পেল না। এই আগে আমি যখনই আমার শক্তি ব্যবহার করেছি, সবসময় মাথার মধ্যে বিস্ফোরনের মত অনুভূতি হয়েছে। এইবার কিছুই হল না। এমনকি আমার নাক দিয়ে রক্তও গড়িয়ে পড়ল না।

ওর গলা থেকে আমার হাত দুটো সরিয়ে নিলাম। অদ্ভুত কোন কারনে ও কাশলও না, ঢোঁক গিলল না। ও আমার দিকে এগিয়েও এলো না। শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল, যেন সবকিছু কোন ধরনের স্বপ্ন ছিল। আমি ওর এই আচরণ কোন কিছুর সাথে মেলাতে পারলাম না। রুম থেকে বের হওয়ার সময় ফিরে দেখি ও গভীর, শান্তিময় ঘুম ডুবে আছে।

যে কোন মুহূর্তে আমার মাথাটা ফেটে পড়বে বলে মনে হচ্ছিল। আমি এমনভাবে ছুটে আমার রুমে ফিরে এলাম যেন আমার ভেতরে কোন সুইচ উলটে গিয়েছে। ডেস্কের উপর তাকিয়ে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার দেখতে পেলাম, যেটা আমি আগে ওখানে খেয়াল করিনি। ছোট আর সস্তা ধরনের একটা ক্যাসেট প্লেয়ার। পাশে একগাদা ব্যাটারি রাখা। ক্যাসেট প্লেয়ারটা ঐ ধরনের ছিল যেগুলো কিনা শুধুই ব্যাটারিতে চলে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন ওটা এখানে আগে দেখিনি, ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হচ্ছিল।

প্লেয়ারে একটা টেপ ভরে রাখা ছিল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল টেপে যাই রেকর্ড করা থাকুক না কেন, আমার সেটা শোনা ঠিক হবে না। অনেকটা যেন কোন গোপন নির্দেশ আমার ব্রেনের গভীরে ঢুকিয়ে রাখা ছিল। কিন্তু আমার আঙুল সোজা প্লে বাটনে চাপ দিল। নিজেকে সামলাতে পারিনি।

প্লাস্টিকের স্বচ্ছ অংশটা দিয়ে টেপটাকে ঘুরতে দেখতে পাচ্ছিলাম। স্পিকারগুলো দিয়ে আমার নিজের কষ্ঠ ভেসে এল। উত্তেজিত আর কাঁপাকাপা কণ্ঠ।

***

ব্যাপারগুলো জটিল রূপ ধারন করেছে।

ঠিক কত বার আমি এই টেপ প্লে করে শুনেছি? এমনকি, এখন যখন আমি এই কথাগুলো রেকর্ড করছিলাম, তখনো অবাক হয়ে ভাবছিলাম।

তুমি নিশ্চয়ই কয়েকদিন পরের কিংবা কে জানে হয়ত কয়েক বছর পরের আমি, যে আমাকে শুনছ।

তাতে কিছু আসে যায় না। এই টেপ যখন শুনছ, তখন সম্ভবত তোমার কিছুই মনে নেই তোমার সাথে কি ঘটেছে। কারন হল আমি এই টেপে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা রেকর্ড করে রাখছি যাতে তুমি সবকিছু ভুলে যাও, আর আমি চাইছি এমন একটা জীবন শুরু করতে যেখানে আমি অনেক বিষয় এড়িয়ে যেতে চাই।

সে কারনে এই টেপটা প্রস্তুত করেছি। যাতে ভবিষ্যতের আমি, যে সবকিছু ভুলে একটা সাধারণ জীবন কাটাচ্ছে, জানতে পারে যে, সে অতীতে কী কী করেছে।

হঠাৎ করে এই টেপটা চালাতে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছা কেন হল সেটার পেছনেও একটা কারন আছে। কারন আমি এই মেসেজের শেষে কথাগুলো রেকর্ড করে রেখেছিঃ “তোমার যদি কখনো কাউকে খুন করার ইচ্ছা হয়, অথবা আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে, তাহলে তুমি তোমার ডেস্কের উপর ক্যাসেট প্লেয়ারটা দেখতে পাবে, আর এর ভেতরে রাখা টেপটা শুনতে চাইবে।”

তুমি যখন এই টেপটা শুনছ, তখন আমি জানি না তুমি কাকে খুন করতে চাইছিলে না নিজেকে নিজে খুন করতে চাইছিলে কিনা।

কিন্তু আসল কথা হল, তুমি যেহেতু এই টেপ শুনছ তারমানে এ দুটোর কোন একটা অবশ্যই ঘটেছে। আর এর দ্বারা প্রমানিত হয় যে তুমি একটা শান্তিপূর্ণ, সুখি জীবন কাটাতে পারছ না, যার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে।

কিন্তু কিছু কথা আছে যা তোমাকে আমার বলা দরকার। কাউকে খুন করতে হবে বা নিজেকে খুন করতে হবে এরকম মনে হওয়ার একদমই কোন প্রয়োজন তোমার নেই। কারনটা একদমই সরল, অনেক দিন আগেই, বস্তুত সবাই চলাফেরা বন্ধ করে দিয়েছে। তোমার বাবা, তোমার মা, তোমার ভাই, তোমার সব ক্লাসমেট আর টিচারেরা, যাদের সাথে তোমার কখনো দেখাই হয়নি তারাও, কেউই আর জীবিত নেই। পুরো পৃথিবীতে সব মিলিয়ে হয়ত হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ বেঁচে আছে।

তোমার কি মনে আছে, একবার চিন্তা করেছিলে কিভাবে দুনিয়ার সবার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায়? মনে আছে তাই না?

কুকুরটা যেদিন মারা গেল তার পরের দিন সকালে আমি আমার জঘন্য হাসিটা মখে টেনে নাশতা করতে নিচে গিয়েছিলাম। কাজুয়া, বরাবরের মত ওর চোখ ডলছিল, কিন্তু সেখানে ছিল। মা ওর সামনে এক প্লেট ডিম ভাজা এনে রেখেছিল। বাবা ভুরু কুঁচকে পত্রিকার পাতায় ডুবে ছিল। পাতা উল্টানোর সময় পত্রিকাটা আমার হাতের সাথে ঘষা খাচ্ছিল। টিভিতে একটা পরিস্কারকের বিজ্ঞাপন হচ্ছিল যেটা দিয়ে সবকিছু নাকি সহজেই পরিস্কার করা যায়। হঠাৎ করে আমি এর কোন কিছু আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি তাদের সবাইকে মেরে ফেলার সদ্ধান্ত নিলাম।

আমি এই কথাগুলো ব্যবহার করেছিলাম: “এক ঘণ্টার মধ্যে তোমাদের ঘাড়ের উপরের সব কিছু খসে পড়বে।”

এর সাথে পরবর্তী নির্দেশটা যোগ করলাম : “যখন তোমাদের মাথাগুলো মাটিতে খসে পড়বে, সেটা সবার জন্য সংকেত হবে একই নির্দেশ মেনে নেয়ার।”

অবশ্যই আমি এর সাথে আরো কথা যোগ করেছিলাম যাতে আমি নিজেকে এর থেকে রক্ষা করতে পারি। আমি আরো কিছু কথা বললাম ওদের স্মৃতি বদলানোর জন্য। আমি তাদেরকে বললাম আমার কণ্ঠ যে শুনেছে তা ভুলে যেতে আর তাদেরকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করলাম।

ওদেরকে কথাগুলো বলার এক ঘণ্টা পরে আমি স্কুলে ছিলাম। হঠাৎ কাজুয়ার রুমে হৈচৈ শোনা গেল। কি হচ্ছে দেখার জন্য আমি সেখানে গেলাম আর দেখতে পেলাম আমার ভাইয়ের মাথা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, রক্তের ছোটখাট একটা পুকুর সৃষ্টি হয়েছে। সব শিক্ষার্থী আর টিচার সবাই ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল।

জাদুর মাথাটার যা করার কথা, যারা যারা দৃশ্যটা দেখেছিল তারা সবাই এক ঘণ্টার মধ্যে মারা যাবে। চিৎকার করতে থাকা ছেলেপেলেদের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমি আমার বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তাদের একই পরিণতি হয়েছে, যেখানেই থেকে থাকুক কেন তারা।

এক ঘণ্টা পর যারা কাজুয়ার মাখা মাটিতে পড়া অবস্থায় দেখেছিল তারা সবাই একসাথে নিজেদের মাথা হারাল। ধুপ ধুপ করে পুলিশ আর আশেপাশের লোকজনের সামনে সেগুলো খসে পড়ল। এবার কোন চিৎকার হয়নি, শুধু কিছু ভারি জিনিস হাত থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। মাথা খসে পড়ার দৃশ্য আরো লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।

ভয় আর বিভ্রান্তি মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ল। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে টিভি ক্যামেরা এসে মুন্ডুহীন দেহগুলোর ছবি দুনিয়া জুড়ে ব্রডকাস্ট করল। আর আমার কথাগুলো ইলেক্ট্রিক্যাল সাতের মাধ্যমে প্রায় পুরো মানব জাতির মাথা কেটে ফেলল।

সেই সন্ধ্যায় শহরটা একদম নীরব হয়ে ছিল। নীরবতার মধ্যে অস্ত যাওয়া সৰ্যটা লম্বা ছায়া ফেলছিল। আশেপাশের এলাকার মধ্যে দিয়ে আমি হাঁটছিলাম। সবকিছু থেকে লাল আর কাঁচা গন্ধ ভেসে আসছিল। অনেক মানুষ সোজা হয়ে চুপচাপ শুয়ে ছিল। অবাক ব্যাপার হল, পশুপাখি আর কীটপতঙ্গও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। মুন্ডুহীন অনেক কুকুর-বিড়াল, গুবরে পোকা আর মাছিও মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলাম।

শহরের মধ্যে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছিল, বিভিন্ন জায়গা থেকে কালো ধোঁয়া উড়ছিল। টিভিতে প্রায় কিছুই দেখাচ্ছিল না। কয়েকটা দৃশ্য দেখেছিলাম যেখান সংবাদ পাঠকদের মাথা তাদের ডেস্কের উপর পড়েছিল।

এক পর্যায়ে সমস্ত শহরের সমস্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। পাওয়ার প্লান্টগুলো চালানোর মত লোকজন না থাকায় অতিরিক্ত লোড নিতে পারে ওগুলো সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম সারা পৃথিবীতে একই অবস্থা চলছে।

শহরের মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে পুরো দুনিয়াতে আমিই একমাত্র মানুষ যে বেঁচে আছে। চিন্তাটা আমাকে বিষণ্ণ করে তুলছিল। এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে কেউ না কেউ পা ছড়িয়ে পড়ে ছিল।

একজন নিথর ডাইভারকে দেখলাম যার শরীরে মাথা আছে, ক্রাশ করা একটা গাড়ির হুইলে উপর মাথা দেয়া। গাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। এই কেসে, আমি ভাবলাম, এক্সিডেন্টটা নিশ্চয়ই লোকটা কোন খসে পড়া মাথা দেখার আগে ঘটেছিল।

রাতের শান্তিপূর্ণ আকাশে তারা ফুটতে লাগল। একটা পথচারী ব্রিজের উপর বসে আমি উপরে তাকিয়ে ছিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হল মেয়েটাকে দেখার আগ পর্যন্ত চিন্তায় এমনভাবে ডুবে গিয়েছিলাম যে কোন কিছু টেরই পাইনি।

তারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছোট ছোট পায়ের শব্দ কানে আসছিল। আর সেই সাথে কোনখান থেকে কেউ একজন সাহায্য চাইছিল। ব্রিজের উপর থেকে একটা জ্বলন্ত গাড়ির আগুনের আলোতে আমি দেখলাম একটা বাচ্চা মেয়ে আগুনের বিপদজনক রকমের কাছে চলে গিয়েছে। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে আমি ওকে ডাকলাম। সে যখন আমার দিকে তাকাল তখন ওর মুখে স্বস্তির অভিব্যক্তি দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছিল যেন অনেক দিন সে কোন মানুষের কণ্ঠ শুনতে পায়নি।

ঐ মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম কেন মেয়েটার ধরে এখনো মাথাটা ছিল। কারন সে অন্ধ ছিল।

আমার কাছে এই মেয়েটাকে মনে হচ্ছিল যেন কোন দুর্ভাগ্য। আমি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। লজ্জা একটা সোত আমার পুরো হৃদয়টা ছেয়ে ফেলল। আর পুরো দুনিয়াটা আগের মত হল না।

অনেকদিন পর্যন্ত আমি ভুগেছিলাম। পুরো পৃথিবী মৃত আর পঁচতে থাকা লাশে ভরে ছিল। আমার তীব্র অনুভূতি হচ্ছিল যে আমি আর এই পৃথিবীটাকে সহ্য করতে পারছি না।

আমি ঠিক করলাম আমাকে সবকিছু ভুলে যেতে হবে। আমি ঠিক করলাম বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি আমাকে অন্ধ হয়ে যেতে হবে। আমাকে এমন একটা বিভ্রমের মধ্যে ঢুকে যেতে হবে যেখানে দুনিয়াটা স্বাভাবিকভাবে চলছে, ঠিক আগের মত। টেপের শেষে আমি এই কথাগুলো রেকর্ড করলাম।

“প্রতিবার তুমি ছেনি দিয়ে ডেস্কের উপর একটা আঁচড় কাটার পর সেই অবস্থায় ফিরে যাবে যেখানে তুমি স্বাভাবিক একটা পৃথিবীতে বাস করছিলে। তুমি তোমার মত খেয়ে যাবে, ঘুমাবে, বাঁচার জন্য যা যা করতে হয় করবে, কিন্তু এসব সম্পর্কে কিছুই মনে থাকবে না। তোমার মনে হবে যেন তোমার জীবন যেমন ছিল বরাবর সেরকমই চলছে।”

আমার রুমের ডেস্কটা শুধ এর বাইরে ছিল। “তোমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় ডেস্কের ব্যাপারটা ধরতে পারবে না।” অন্যভাবে বললে, আমি ভাবছি আমি একটা সাধারণ জীবন কাটাচ্ছি, কিন্তু বাস্তবের সাথে আমার একমাত্র সংযোগ থাকবে আমার ডেস্কটার মাধ্যমে।

এই টেপটা শোনার পর তোমার হয়ত প্রবল অনুতাপ হবে। তুমি হয়ত ভাবছ তুমি যদি সবকিছু ভুলে যেতে পারতে আর এই টেপ শোনার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারতে। যদি সেটাই মনে হয়ে থাকে তাহলে ছেনিটা দিয়ে ডেস্কের উপর আরেকটা আঁচড় কাটো, তাহলে হয়ত তোমার ভাল লাগতে পারে।

ডেস্কটা তোমার স্বপ্নের অংশ নয়। ডেস্কের উপরের আঁচড়ের সংখ্যার অর্থ তুমি এর আগে কতবার এই টেপটা শুনেছ আর তোমার স্মৃতি মুছে ফেলেছ।

***

এরপর ঐ জাদুর কথাগুলো চলল। যা বুঝলাম, তা হলো অতীতের আমি টেপটা ব্যবহার করে আমার নিজের স্মৃতি বদলে দিয়েছে। আমি ডেস্কের সামনে বসে মাথা নিচু করে ফোঁপাতে থাকলাম। ছেনির আঁচড়গুলো থেকে কিংবা হয়ত ড্রয়ারের ভেতর থেকে, যেখানে আলো পৌঁছাতে পারে না, একটা অদ্ভুত ভ্যাপসা বাজে গন্ধ ভেসে আসছিল। বাইরের সত্যিকারের দুনিয়া থেকে শুধু এই গন্ধটাই আমার দুনিয়ায় এসে পৌঁছাতে পারছিল, ডেস্কের এই ড্রয়ার দিয়ে।

আমি বিছানার কিনারায় গিয়ে বসলাম আর অসংখ্য চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এমন একটা পৃথিবী যার উপরিভাগ পঁচতে থাকা লাশে ভারি হয়ে আছে, সেখানে আমি একমাত্র মানুষ যে এখনো স্কুলে যাচ্ছে, আসছে, এখনো স্কুলের ইউনিফর্ম পরছে। রেল গেটে আমি এখনো আমার কমিউটার পাশ দেখাই, পুরো ট্রিপের ভাড়া দেয়ার প্রমাণ। অবাক হয়ে ভাবলাম স্কুলের দিকে হেঁটে যাওয়া, ট্রেনে চড়ার ভান করা, স্কুলের গেটের দিকে যাওয়া, সব জায়গায় নিশ্চয়ই আমাকে মাটির উপর পড়ে থাকা নরম দেহগুলো মাড়াতে হয়েছে। আমি নিশ্চয়ই সেই অপরিস্কার ক্লাসরুমে ঢুকেছি, মুখে নকল হাসি নিয়ে যা কিনা আমাকে অন্যদের ঘৃণা থেকে দূরে রাখত। আমি নিশ্চয়ই কল্পনা করছি টিচার এখনো আমার বখাটে ক্লাসমেটদের দিকে চিল্লিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকে থামানোর জন্য। আসলে সত্য হল আমি আমার স্কুল ডেস্কে বসে ছিলাম যেখানে অন্য সবাই মরে গিয়েছে। আমার চুল বড় হয়ে গিয়েছে, চোখের দৃষ্টি শূন্য, মুখে তখনো নকল হাসি, আমাকে দেখতে মানুষের চেয়ে বেশি বন্য কোন জন্তুর মতই লাগছে।

দরজায় একটা টোকা পড়ল। আমি উত্তর দিলাম। মা দরজা খুললেন, হাতে একটা ক্যাক্টাস।

“তুমি এখনো জেগে আছ? তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পর,” তিনি বললেন, মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। তাকে দেখে জীবিত মনে হলেও আমি জানি যে তার লাশ অন্য কোথাও পড়ে আছে।

পুরো দুনিয়ায় আমিই একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। এ কথা চিন্তা করতেই কিছু নাম না জানা অনুভূতি আমার ভেতরে বুদবুদের মত ফুটতে থাকল, থামাতে পারছিলাম না।

“তুমি কাপছ কেন? তুমি কাঁদছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”

আমি মাথা নাড়লাম, বিড়বিড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। আমি যদি কেঁদে থাকি তাহলে সেটা অসুস্থতার জন্য নয়। বরং আমার শান্তির জন্য। অবশেষে আমি এমন একটা দুনিয়ায় পৌঁছাতে পেরেছি যা আমি অনেকদিন থেকে চাইছিলাম। যেখানে আমি একদম একা। এটা উপলদ্ধি করতে পেরে আমার শান্তি লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *