ওয়ারড্রব

ওয়ারড্রব

রিয়ুজি ওর রুমের দরজাটা খুলে বলে উঠল, “অ্যাই, মিকি, শেষ পর্যন্ত তুমি আসতে পারলে! সুযোগ পেলে একটু আমার রুমে এসে তো? ফোনে তোমার সাথে যে বিষয়ে কথা বলেছিলাম তা নিয়ে আরেকটু কথা বলতে চাইছিলাম।”

রিয়ুজির রুমটা মূল বাড়ি থেকে আলাদা। ওর দরজার ঠিক বাইরেই একটা বাগান। রাতের বেলা ঠাণ্ডা বাতাস এসে রুমের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলে।

মিকি ঐ দরজা দিয়েই এসে ঢুকল। ওর কাঁধ থেকে একটা হালকা কোট ঝুলছিল। নভেম্বরের শীতল রাতের মধ্যে সে সরাসরি ট্রেন স্টেশন থেকে এখানে এসেছে। মেয়েটার ডান হাতে লাল রঙের একটা বড় সুটকেস ধরা। ও মেঝের উপর বসে পড়ল।

“আমি এখনও বাড়ির ভেতর পা ফেলিনি। একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। তোমাদের বাড়িটা একদম পাহাড়ের মাথায়। এতটুকু হেঁটে আসতে গিয়ে আমি এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে আর পা নাড়াতে পারছি না।”

“সুটকেসটা তো বেশ বড়। তুমি কি এই পুরনো বাড়িতে পাকাপাকিভাবে চলে আসার ধান্দা করছ নাকি? আমার অবশ্য তাতে কোন সমস্যা নেই। আর আমি নিশ্চিত যে বাবা-মা এতে খুশিই হবেন। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে একসাথে থাকতে তোমার কেমন লাগবে?”

পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে সুটকেসটায় আলতো ধাক্কা দিয়ে মিকি বলল, “তোমার সাথে দেখা করতে আসার আগে আমার এটা ইশিরোর রুমে রেখে আসার কথা।” ও এমনভাবে রিয়ুজির দিকে তাকাল যেন সে কোন নোংরা জন্তু। বাম হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের সামনে ধরে রাখল। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে ও এরকম করে। রিফুজি হেসে ওকে সোফায় এসে বসার আমন্ত্রণ জানাল।

“বেশি সময় লাগবে না। এখনই তো নয়টা বেজে গিয়েছে।” যেই মাত্র রিয়ুজি কথাটা বলল তখনই ঘড়িতে শব্দ করে নয়টা বাজল। “আমাকে অবশ্য আজকে রাতে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যেতে হবে। তুমি তো বোধহয় এই বাড়িতে দ্বিতীয়বারের মত এলে, তাই না?”

“তৃতীয় বার, যদি বিয়ের দিনটা ধর।”

“ভাইয়ার সাথে তোমার সব কেমন যাচ্ছে? ও কি তোমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে?”

রিয়ুজি দরজার দিকে এগুলো। ও সাইজে ছোটখাট একজন মানুষ, হাঁটেও ছোট ছোট পদক্ষেপে।

“দরজা লক করছো কেন?”

“এটা আমার স্বভাব। এই ওয়ারড্রবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রাখা আছে, তাই আমি সবসময় দরজা লক করে রাখার চেষ্টা করি।”

“কিন্তু রুমটা পরিস্কার রাখার ব্যাপারে তোমার যে একদমই কোন চিন্তা নেই তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দেখে মনে হচ্ছে এখান দিয়ে কোন টাইফুন বয়ে গিয়েছে।”

মিকি রুমের মধ্যে চোখ বুলাল। রুমটা বেশ বড়, কিন্তু সবকিছু এলোমেলো। কাঠের মেঝেতে যেখানে সেখানে জামাকাপড়ের স্তূপ পড়ে আছে। এক কোনায় একটা মরচে ধরা লোহার বিছানা আর একটা কাঠের ডেস্ক-চেয়ার। ডেস্কের উপর একটা পুরোনো টাইপরাইটার। টাইপরাইটারের আশপাশ দিয়ে বইয়ের স্তূপ।

“তুমি কি এখানেই কাজ কর?”

“হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়।”

রুমের মাঝামাঝি একটা লেদারের সোফা সেট রাখা। সেটার আশেপাশে আরো জামাকাপড়। যেখানে খোলা হয়েছে সেখানেই ফেলে রাখা হয়েছে। সোফার পাশে একটা নিচু কফি টেবিল। টেবিলের উপর আধ-খালি কফি কাপ রাখা। ধোঁয়া নেই দেখে মনে হচ্ছিল কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।

“ঐ দরজাটা দিয়ে কি বাইরের ছাউনিতে যাওয়া যায়?” বিছানার পাশের দরজাটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে মিকি জানতে চাইল।

“ঠিক ধরেছ। যা যা ব্যবহার করি না সেগুলো ওখানে নিয়ে রাখি। সবকিছু। আমার বই, ভাইয়ার পেইন্টিংগুলো। দেখতে চাও? ছাউনিটা একজনের থাকার জন্য যথেষ্ট বড়।”

মিকি মাথা নাড়ল। “অন্য কোন সময় দেখব নে।”

রুমটায় একটাই জানালা ছিল, বন্ধ করা। পর্দাগুলো পুরো সরিয়ে দেয়া ছিল যেকারনে রাতের অন্ধকারে জানালাটাকে আয়নার মত দেখাচ্ছে। মিকি ওর নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছে।

“কাঠের ওয়ারড্রবটা। ওটাকে চেনা চেনা লাগছে-ইশিরোর রুমেরটার মত একদম দেখতে, তাই না? দরজার উপর একই রকম কাঠের কাজ করা।”

“আমার বড় দাদি ওগুলো আমার জন্য একটা আর ভাইয়ার জন্য একটা কিনেছিলেন। এই ওয়ারড্রবগুলো লক করা যায়। মাঝে মাঝে অবশ্য লক ঠিকমত কাজ করে না।”

“ওগুলো দেখতে খানিকটা ভুতুড়ে মনে হয় না? বিশাল একটা কালো রঙের বাক্সর মত লাগে। ফুয়ুমির রুমেও কি একটা আছে?”

“না, ফুয়ুমির জন্মের আগেই বড় দাদি মারা গিয়েছিলেন।”

এই পরিবারে দুই ছেলে এক মেয়ে। তিনজনের মধ্যে শুধু ছোট ছেলে, রিয়ুজি এখানে বাবা-মায়ের সাথে থাকে। ও একজন ঔপন্যাসিক।

“ইশিরো কোথায়? ওর তো গতকাল আসার কথা।”

“ও তো বলল একটু হাঁটতে যাচ্ছে। খারাপ হল। এক ঘন্টা আগে পর্যন্ত ও আমার রুমেই ছিল। একটুর জন্য তোমাদের দেখা হল না। ও যখন বেরিয়ে যায় তখন আমি ছাউনিতে ছিলাম। ঐ জায়গাটা এই রুমের চেয়ে একটু বেশি গোছানো। যে কারনে ওখানে বসে পড়াশুনায় মনোযোগ বসাতে আমার কাছে সহজ মনে হয়। ইশিরো ঠিক কখন বেরিয়েছে তা বলতে পারব না, কয়েক মিনিট আগে ছাড়া আমার দরজা লক করার কথা মনে ছিল না।”

নার্ভাসভঙ্গিতে নিজের নখ কামড়াতে কামড়াতে রিয়ুজি লকটা আবার চেক করল ঠিক দিকে মুখ করে আছে কিনা। স্টেরিওটা তুলে সেটায় একটা সিডি ভরল। তারপর সোজাসুজি মিকির সামনে বসে পড়ল। মিউজিকটা একটু বেশিই জোরে বাজছিল কিন্তু রিয়ুজির সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। ওর রুমটা মূল বাড়ি থেকে যথেষ্ট দূরে হওয়ায় অন্য কারোরও বিরক্ত হওয়ার কথা না। মিকি কথাটা বলার আগে এক মুহূর্ত ইতস্তত করল, ওর দৃষ্টি স্থিরভাবে কোন কিছুর উপর ছিল না।

“তো রিয়ুজি, ফোনে যা যা বলেছিলে তা কি আসলেই সত্যি? তোমার সাথে সিয়োরির দেখা হয়েছিল?”

“এক মাস আগে। একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কিছু কাজের ব্যাপারে আমার একটা ইন্টারভিউ ছিল। ও ছিল ওখানের লেখিকা যাকে কাজটা। করার জন্য নেয়া হয়েছিল। প্রথমে আমি বুঝিনি যে ও তোমার পুরোনো বন্ধু ছিল। পরিচয় হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর গিয়ে আমি জানতে পারি যে কলেজে ও তোমার সাথে একই ক্লাসে ছিল। তখন তোমরা বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলে তাই না? যাই হোক, সে যখন এইসব জানতে পারল তখন ওর মুখ শুকিয়ে গেল।”

রিযুজি গভীর দৃষ্টিতে মিকির চেহারার দিকে তাকাল যেন চেহারার রঙের কোন পরিবর্তন হলে তা ধরতে পারে। কিন্তু মেয়েটা চুপ করে ছিল।

“আমি ওকে কারনটা জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম। কিন্তু সে কিছু বলেনি। তবে একদিন আমি জেনে গেলাম। আমরা বারে বসে ড্রিঙ্ক করছিলাম।”

“মাতাল অবস্থায় ও তোমাকে কিছু বলেছে?”

“ও চিত হয়ে বারের টেবিলে পড়ে ছিল। আর গোঙাতে গোঙাতে কোন একটা এক্সিডেন্টের কথা বলছিল।”

মিকি একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

“ও একবার বলেছিল যে তোমরা দুজন একবার একটা গাড়িতে ছিলে আর তুমি সাইকেলে থাকা একটা জুনিয়র হাইয়ের ছাত্রকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলে। তোমরা একে অপরকে বলেছিলে ঘটনাটা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে। আর অন্য কাউকে যেন না বলা হয়। তারপর তুমি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি চলে যাও।”

“আমাদের জানা ছিল না যে ছেলেটা মারা গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম ও হয়ত একটু আহত হয়েছিল।”

“পরদিন যখন খবরটা কাগজে এল, দেখে তোমার কেমন লেগেছিল? তোমার কি অপরাধবোধ হয়েছিল? ভয় হয়েছিল? নাকি স্রেফ দুঃখবোধ করছিলে? আর এরপর থেকে বাকি জীবনটা কি তুমি পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় পেয়ে এসেছ? অনুভুতিটা ঠিক কি রকম ছিল?”

নিয়জি সোফা থেকে উঠে মিকির দিকে তাকাল। ওর চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোন বাচ্চা ছেলে লুকোনো গুপ্তধন পেয়েছে। “আমি চাই তুমি আমাকে সব খুলে বল, প্লিজ।”

“যাতে তুমি ইশিরোকে বলতে পার?”

“বোকার মত কথা বোলনা! তুমি কি এখনো বুঝতে পারোনি? আমি একজন লেখক! আমি তোমার গোপন সব বের করে নিয়ে, তোমার দুর্দশা নিয়ে সেগুলোকে শিল্পে রুপান্তরিত করতে চাই!”

ও ওর হাতগুলোকে ঈগলের নখরের মত বাঁকিয়ে উঁচু কর্কশ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল। ওর কাঁধ ফুলে উঠল, তারপর পিছিয়ে গিয়ে কাউচে ধপ করে পড়ল, যেন ক্লান্ত।

“অবশ্য, আমাকে তোমার এখনই বলতে হবে না।”

মিকি স্টেরিওর কাছে গিয়ে ভলিউমটা ঠিক করার চেষ্টা করল। মিউজিক আরো বেড়ে গেল।

“তুমি নিশ্চয়ই আর কাউকে বলোনি, নাকি?”

“আমি সবাইকে বলার জন্য মারা যাচ্ছি।”

“আমি চাই তুমি কোনদিন কাউকে কথাগুলো বলবে না।”

মিকি শেলফের কাছে গিয়ে পাথরের তৈরি একটা অ্যাষ্ট্রে তুলে নিল। বাড়ি দিয়ে ঔপন্যাসিককে মৃত্যুমুখে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য জিনিসটা একটা নিখুঁত অস্ত্র হতে পারে।

রিয়ুজি মিকির দিকে পেছন ফিরে সোফায় বসে ছিল।

“ইশিরো এসবের কিছুই জানে না তো তাই না?”

“তুমি মনে হয় জানো না, ও যদি জানেও তাহলেও তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার মত লোক ও না। তুমি কি দেখে আমার ভাইয়ের প্রেমে পড়েছিলে বল তো? ও একটু পাগলাটে ধরনের।”

মিকি অ্যাস্ট্রেটা নামিয়ে রাখল।

“পাগলাটে মানে কি বলতে চাইছ?”

“ও একটু উচ্ছন্নে যাওয়া ধরনের। যে কারনে ওর পেইন্টিংগুলো এত ভাল বিক্রি হয়। আমার কাছে ওগুলোকে ভীতিকর মনে হয়। ছাউনিতে যেটা রাখা আছে ওটা গিয়ে দেখ একবার।”

মিকি ছাউনির দরজার দিকে ঘুরল। রিয়ুজি হাসল।

“কিরকম দম্পতি! একজন পাগল আরেকজন খুনি! একদম ক্লাসিক!”

“তা যদি বলতে চাও…”

***

তিন মিনিট পর।

রক্তাক্ত অ্যাস্ট্রেটা মিকির হাত থেকে পিছলে মেঝেতে পড়ার সময় ভারি শব্দ তুলল। রিয়ুজি, যাকে পেছন থেকে আঘাত করা হয়েছিল, তখনো সোফায় বসে আছে। শরীরের উপরের অংশ সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। পেছন থেকে মিকি ওর কাঁধ ধরে পিছনে টেনে আনল যাতে ওর ভারটা সোফার উপর এসে পড়ে। মিকি নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য গভীরভাবে কয়েকবার নিশ্বাস নিল। তারপর নিজের দুহাত মুখের সামনে এনে দেখল। আঙুল দশটা থরথর করে কাঁপছিল।

হঠাৎ করে দরজায় ঠকঠক শব্দ হল। হালকা ধরনের শব্দ, সসপ্যানের উপর ডিম ভাঙার সময় যেরকম শব্দ হয়। মিকি শক্ত হয়ে গেল, দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল।

“রিয়ুজি, ভেতরে আছে তুমি?” রিয়ুজির মায়ের গলা। “ভেতরেই আছ, তাই না? আমি মিউজিক শুনতে পাচ্ছি এখান থেকে। তোমার সম্পাদকের কাছ থেকে ফোন এসেছে।”

মিকি কিছু বলল না, স্টেরিওর দিকে ঘুরে তাকাল। মিউজিক তখন চলছিল।

“সব ঠিক আছে তো? আমি ভেতরে আসছি।”

দরজার নব ঘুরে গেল আর দরজাটাও কেঁপে উঠল। কিন্তু রুমের মৃত মালিক দরজাটা লক করে রেখে ছিল, তাই সেটা খুলল না। রিয়ুজির মা হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলেন। মিকি এতক্ষন ধরে আটকে রাখা দমটা ছাড়ল। কিন্তু ওর অভিব্যক্তি আগের মতই কঠিন হয়ে ছিল। ও গিয়ে স্টেরিওটা বন্ধ হাত কপালের উপর রেখে মাথা ঝাঁকাল।

“এসব কি করে হল?”

লাশটার দিকে তাকাল ও।

“এখানে কি ঘটেছে?”

ও নিজের স্বর নিচু রাখল। চিল্লাচিল্লি করে কোন লাভ নেই।

“আমার ওকে এখান থেকে সরাতে হবে।”

কিন্তু লাশটা কোথায় সরাবে ও?

“ছাতার কোথায় লুকাবো এটা?”

বিশৃঙ্খল রুমটায় এদিক ওদিক তাকাল ও। সবখানে কাপড়-চোপড় পড়ে আছে, পা ফেলার জায়গা পর্যন্ত নেই। ও তাড়াতাড়ি কাপড় সব একত্র করে এক কোণায় নিয়ে জমা করল।

তারপর ওয়ারড্রবটার উপর চোখ পড়ল ওর।

“কাঠের তৈরি কালো একটা ওয়ারড্রব…একজন ঔপন্যাসিকের লাশ রাখার জন্য নিখুঁত একটা সাইজ।”

ও ঠিক করল ওয়ারড্রবটা পরীক্ষা করে দেখবে, কিন্তু দরজাটা খুলতে পারল না। রিয়ুজি বলেছিল, ও রুমের দরজার সাথে সাথে ওয়ারড্রবের দরজাও লক করে রাখে। ওয়ারড্রবের দরজার হাতলের সাথেই একটা সোনালী রঙের চাবির ফুটো।

ও রিফুজির পকেট হাতড়াল। কয়েকটা চাবি পেল। এর মধ্যে একটা ছিল পরনো ধরনের দেখতে, সোনালী রঙের।

“বাজি ধরে বলতে পারি এটাই সেই চাবি,” লকের ভেতর চাবিটা ঢুকিয়ে ঘোরাল সে।

***

দশ মিনিট পর।

মিকি রিয়ুজির লাশটা লুকিয়ে ফেলেছে। ছেলেটা ছোটখাট সাইজের হওয়ায় খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু অনেক কাপড় চোপড় ছিল। রিয়ুজির জন্য জায়গা করতে ওকে কিছু কাপড় সরাতে হল। একগাদা কাপড় তুলে নিয়ে ও রুমের কোণায় বাকি কাপড়গুলোর সাথে নিয়ে রাখল।

বেরিয়ে যাওয়ার সময় ও শেষ বারের জন্য একবার কাপড়ের স্তূপের দিকে তাকাল। নিচের ঠোঁট কামড়ে ও বাম হাতটাকে মুঠি করে রাখল।

দরজাটা বন্ধ করে দিল। লকের ভেতর চাবির শব্দটা স্বাভাবিকের চেয়ে জোরে শোনাল। মিকি রিয়ুজির পকেটে পাওয়া সবগুলো চাবি, বেডরুমের চাবিসহ নিজের সাথে নিয়ে নিল। রুমের মধ্যে শুধু রয়ে গেল একটা ওয়ারড্রব আর তার ভেতরে থাকা মানুষটা।

পরদিন ব্রেকফাস্টের সময়।

মিকি টেবিলে এল। জানালার বাইরে আকাশটা গাঢ় মেঘে অন্ধকার হয়ে ছিল। হয়তো সে কারনেই মনে হচ্ছিল তখনো ঠিক মত ভোর হয়নি। এমন কি লাইটগুলো সব জ্বলে থাকার পরেও রুমের কোণাগুলোতে আলোর অভাব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন পোকার ঝাঁকের মত অন্ধকার ঝুলে রয়েছে, হাত নাড়ালেও সরছে না।

অন্যদিনের চেয়ে তাপমাত্রার পার্থক্যও চোখে পড়ার মত ছিল। মিকি ওর কাঁধ কুঁচকে কেঁপে উঠল। বাড়িটা পুরাতন হওয়ার কারনে এখানে সেখানে ফাঁক ফোঁকর ছিল। যখনই কেউ হেঁটে যেত, মেঝের বোর্ডগুলো একটা আরেকটার সাথে লেগে যে শব্দটা হচ্ছিল তা কানে যন্ত্রণাদায়ক শোনাচ্ছিল।

“মা আমি কি কোন সাহায্য করতে পারি?”

“ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, মিকি, শুধু চেয়ার টেনে বসে পর

মিকি কথা মতই কাজ করল, একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়ল। ওর জন্য খাবার নিয়ে আসতে দেখল।

“মিকি!”

মিকি মাথা ঘুরিয়ে ওর পাশে বসা ফুয়ুমির দিকে তাকাল।

“গতরাতে কখন এসেছ তুমি? আমি তো খেয়ালই করিনি। রাতের বেলা রাস্তাঘাট একদম অন্ধকার হয়ে থাকে। হারিয়ে যাওনি নিশ্চয়ই? জঙ্গলটা বেশ বড়, আর বলার মত কোন স্ট্রিটলাইটও নেই। তোমার কি নিজেকে লিটল রেড রাইডিং হুডের মত মনে হচ্ছিল না?”

কথাগুলো বলার সময় হাসছিল ফুয়ুমি। ওর ত্বকের রঙ কিরকম অস্বাভাবিক নীলচে সাদা দেখাচ্ছিল, অথচ ঠোঁটগুলো গাঢ় লাল।

“হ্যাঁ, আমি ভয় পাচ্ছিলাম কখন একটা নেকড়ে লাফিয়ে বেরিয়ে আমাকে আক্রমণ করে বসে।”

“কিন্তু মিকির নেকড়ে তো লিটল রেড রাইডিং হুডকে আক্রমণ করেছিল যখন সে ওর নানির বাড়িতে গিয়েছিল! তার অর্থ হল, আসল ভয়ের জায়গাটা জঙ্গলে ছিল না, ছিল বাড়িটায়!”

“সেটা তুমি ভালই বলেছ কিন্তু।”

ফুয়ুমি ওর আঙুলের ডগা দিয়ে প্লেটের খাবারটা খুঁচিয়ে দেখল। আঙুলটা এতটাই সাদা যে বিশ্বাস হচ্ছিল না আসলেই ওটার ভেতর দিয়ে রক্ত চলাচল করে কিনা।

“মিকি। তুমি কি কোন কারডিগান বা কিছু পরতে চাও? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক শীত লাগছে তোমার।”

মিকি পাতলা কাপড় পড়ে ছিল।

“না ঠিক আছে। আমার সাথে গরম কাপড় আছে। আমি শুধু পরার কথা চিন্তা করিনি।”

“কে ভেবেছিল রাতারাতি এরকম ঠাণ্ডা পড়ে যাবে?”

ফুয়ুমি ঘুরে শখানেক বছর বয়সি স্টোভটার দিকে তাকাল। স্টোভটা বিশাল, একজনের পক্ষে তোলা অসম্ভব, আর জং ধরা। স্টোভের উপর একটা চায়ের কেটলি রাখা যেটার মুখ থেকে হালকা ধোঁয়া বের হচ্ছিল। জানালাটা পানির ফোঁটায় ঢেকে আছে। ফুয়ুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

“রিয়ুজি নাস্তার জন্য দেরি করে ফেলছে। বাকি সবাই এখানে উপস্থিত। আমি গিয়ে ওকে জাগাচ্ছি।”

সে উঠতে শুরু করলে মিকি ওকে থামাল।

“এখানে আসার সময় আমি ওর দরজায় নক করেছিলাম। কিন্তু দরজা বন্ধ ছিল। ও সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। আমার মনে হয় ওকে ঘুমাতে দেয়াই উচিত। ও নিশ্চয়ই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল।”

একটার পর একটা মিথ্যা কথা।

“তা ঠিক। ও বলেছিল, রাতে ওর এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে। সে-কারনেই হয়ত এতক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছে কিংবা এমনও হতে পারে যে ও হয়ত রাতে বাসায়ই ফেরেনি। যেহেতু ওর দরজা সবসময় লক করা থাকে, তাই ও যে কখন রুমে থাকে আর কখন থাকে না তা আমি বুঝতেই পারি না।”

অতঃপর রিজিকে ছাড়াই নাশতা চলল। নীরবে নাশতা করার সময় সবাই শুনতে পাচ্ছিল যে লিভিং রুমে টেলিফোন বাজছে। মা উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন। কয়েক মুহূর্ত পর ফিরে এলেন।

“কে ফোন করেছিল, মা?” ফুয়ুমি জিজ্ঞেস করল।

“রিয়ুজির বন্ধু। সে জানতে চাইছিল গতরাতে কেন রিয়ুজি যায়নি। ও দুশ্চিন্তা করছিল। আমি ওকে বললাম রিয়ুজি ঘুমাচ্ছে, উঠলে ওকে ফোন করবে।”

“তার মানে মনে হচ্ছে রিয়ুজি কালকে রাতে বাইরে যায়নি। আমার ভয় হচ্ছে ওর কোন অ্যাক্সিডেন্ট হল কিনা,” ফুয়ুমি বলল, নাশতা খাওয়া চালিয়ে গেল। ওকে দেখে মনে হল না তেমন কোন আগ্রহ আছে এ ব্যাপারে, “হয়ত ও আর বেঁচে নেই। কোন ধরনের ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট বা সেরকম কিছু হয়ত।”

“এভাবে বলছ কেন?” মিকি বলল, ওর চপস্টিকগুলো শূন্যে থেমে আছে। ফুয়ুমি মাথা কাত করে মিকির দিকে তাকাল।

“কোন সমস্যা?”

“না…”

“আমি ওর রুমে গিয়ে চেক করে দেখছি।” বাবা বললেন।

“বাবা, এরকম ছোটখাট সবকিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই।” বাবাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে ফুয়ুমি বলল, কিন্তু ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়েছেন তিনি।

“উনি বললেন উনি গিয়ে দেখতে চান, কিন্তু দরজার লকের কি করবেন?” মিকি জিজ্ঞেস করল। ফুয়ুমি উত্তর দিল, “বাবার কাছে অতিরিক্ত চাবি থাকার কথা। তার কাছে ঘরের সবকিছুর অতিরিক্ত চাবি থাকে।”

“তাই নাকি?”

“ঐ দেখ, বাবা ফিরে এসেছে, রিয়ুজিকে কেমন দেখলে? ছিল ওর রুমে?”

“না। আমি ছাউনিটাও ঘুরে এসেছি, পুরোপুরি খালি। অবশ্যই ওর রুমটা বরাবরের মত আস্তাকুড় হয়ে আছে। কাপড়গুলো এক কোনায় স্তূপ করে রাখা। রুমের ভেতর তাহলে ওয়ারড্রবটা রাখার মানে কি? ওর যদি ওটা কাজেই না লাগে, সরিয়ে ফেললেই হয়।”

***

দুই ঘন্টা পর।

মিকি রিয়ুজির রুমে ঢুকে দরজাটা লাগাল। তারপর চারপাশে চোখ বোলাল। আগের রাতের থেকে কোন পার্থক্য চোখে পড়ল না। রুমটা এখনো আগের মত নোংরা।

ও সোফাটার দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে বসে রিয়ুজি তার শেষ নিশ্বাস ফেলেছিল। ও চোখ বন্ধ করে হাতের আঙুলগুলো দিয়ে কপালটা চেপে ধরল, নিজেকে শোনাল এসব নিশ্চয়ই কোন দুঃস্বপ্ন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুলল আর সোফার উপর সাবধানে সূত্র খুঁজতে লাগল।

টেবিলের উপর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের কয়েকটা ফোঁটা দেখা গেল। রিয়ুজির বাবা যখন এসেছিলেন তখন ওগুলো খেয়াল করেননি নিশ্চয়ই। আর কোথাও কোন রক্তের চিহ্ন ওর চোখে পড়ল না। আশ্চর্যজনকভাবে রিয়ুজির খুব কমই রক্তপাত হয়েছিল। ও নখের ঘষায় শুকনো রক্তের একটা বিন্দু তুলে ফেলল। পরেরটা তুলতে যাবে এমন সময় ঠকঠক শব্দ হল দরজায়।

“মিকি, তুমি কি ভেতরে আছ? আমি তোমাকে ঢুকতে দেখেছি। আমাকে ঢুকতে দাও।” ফুয়ুমির গলা। মিকি এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করল, তারপর রিয়ুজির একটা শার্ট তুলে এনে টেবিলের উপর রাখল দাগটা ঢাকার জন্য। তারপর দরজার লক খুলে ফুয়ুমিকে ঢুকতে দিল। ফুয়ুমি ঢুকে রুমের ভেতর চোখ বোলাল।

“ওহ তুমি একা। আমি ভেবেছি রিয়ুজি হয়ত এতক্ষনে ফিরে এসেছে। তুমি এখানে কি করছ মিকি?”

“ইশিরো রিয়ুজির একটা বই চাচ্ছিল। তাই আমি এসেছিলাম সেটা নিতে।”

“ওহ? ভাল কথা ভাইয়া কোথায়?”

“ও একটু বেরিয়েছে। বলল লাঞ্চের আগে ফিরে আসবে।”

মিকি ছাউনির দরজার দিকে এগিয়ে গেল যেখানে রিয়ুজি ওর বইগুলো রাখে। ফুয়ুমিকে দেখে মনে হল না মিকির মিথ্যা বলা ধরতে পেরেছে।

“ভাইয়া আমাকে তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছে। এতকিছু যে যতদিনে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে, মানে বিয়ের দিনে, ততদিনে আমার মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে ভাল করে চিনি।”

“ব্যাপারটা খানিকটা বিব্রতকর।”

“ও আমাকে বলেছে যে তোমার পরিবার অনেক ধনী। ইশ! আমার বাপটাও যদি ডাক্তার হত।”

“আরে বাজে কথা। আমার বাবা খুবই সাধারণ একজন গ্রামের ডাক্তার। আমাদের বাড়িটাও একদম সাধারণ ধরণের।”

“ভাইয়ার সবসময় সবকিছু গুছিয়ে রাখার অভ্যাস, ঘরের কাজে অনেক কষ্ট হওয়ার কথা তোমার। রিয়ুজি একদম উল্টো। ওর রুমের চেহারাটা দেখ! ওর বিয়ে হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। আমরা যখন এখানে আছি, আসো একটু গোছগাছ করার চেষ্টা করি।”

ফুয়ুমি সোজা কাপড়ের স্তূপের দিকে গেল আর একবারে যতটা সম্ভব কাপড় তুলে ওয়ারড্রবের দিকে নিয়ে গেল।

“ফুয়ুমি দাঁড়াও!” মিকি ছাউনি থেকে বেরিয়ে বলল। ও ফুয়ুমির দিকে দৌড়ে গিয়ে ওর হাত থেকে কাপড়গুলো কেড়ে নিল।

“মিকি, কি করছ তুমি? আমরা কাপড়গুলো ওয়ারড্রবে ভরে রাখলে জায়গাটা একটু ভাল দেখাত..।”– “কিন্তু ওটা খোলা যাবে না। ওয়ারড্রবের লকটা নষ্ট। আসলে ওটা মনে হয় লক করা, খুলবে না।” মিকির গলার স্বর বেড়ে গিয়েছিল। ফুয়ুমি ভু কুঁচকে ওর সাদা আঙুলগুলো দিয়ে ওয়ারড্রবের হাতলটা স্পর্শ করল।

“ঠিকই বলেছ। আটকানো। রিয়ুজি নিশ্চয়ই বের হওয়ার সময় চাবিটা সাথে নিয়ে গিয়েছে। আমার মনে হল আমরা যদি একটু পরিস্কার করতে পারতাম তাহলে ও খুশি হত।”

বলতে বলতে ফুয়ুমি টেবিলের উপর থাকা রিয়ুজির শার্টটা তুলে নিয়ে গোল করে পাকিয়ে রুমের কোনায় ছুঁড়ে ফেলল।

“ও যেখানে পারে সেখানেই ওর নোংরা জামা কাপড়গুলো ফেলে রাখে! ছাগল একটা!”

রক্তের দাগগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল।

“মিকি, কি হল? তোমাকে ভয়াবহ দেখাচ্ছে!”

ফুয়ুমি রক্তের দাগগুলো খেয়াল করেনি। মিকির হাতে ফুয়ুমির থেকে নেয়া কাপড়গুলো ছিল।

“কিছু না, আমরা কি যেতে পারি?”

ফুয়ুমি টেবিলে রক্তের দাগ দেখার আগেই ওরা বেরিয়ে গেল। দশ মিনিট পর ফিরে এসে মিকি দাগগুলোর ব্যবস্থা করল। তারপর ছাউনিতে গিয়ে একটা বই তুলে নিল।

***

ঘড়িতে দুপুর বারোটা বাজতেই মিকি ডাইনিং টেবিলে ফিরে এল। রিয়ুজি বাদে সবাই ওখানে উপস্থিত ছিল।

মিকি হঠাৎ থেমে গেল। ফুয়ুমি আর ওর মা মুখ কাছে নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছিল।

“সবকিছু ঠিক তো?”

“মিকি, দেখ! চিঠির বাক্সে এই অদ্ভুত চিঠিটা পেয়েছি।”

মিকি টেবিলের দিকে এগিয়ে ফুয়ুমির বাড়িয়ে দেয়া সাদা কাগজটা হাতে নিল। কাগজটা পড়ে ওর মুখ সাদা হয়ে গেল।

কাগজটায় টাইপ করে লেখা ছিল-”রিয়ুজি ওজিসিম খুন হয়েছে। ওকে ওর রুমের মধ্যেই আঘাত করে খুন করা হয়েছে।”

ফুয়ুমি উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বুকের উপর হাত দুটো ভাঁজ করে রাখল।

“এরকম কিছু কে লিখতে পারে? মা, তুমি কি বাড়ির বাইরে কাউকে বলেছ যে রিয়ুজি উধাও? যে লোক এই চিঠিটা বাক্সে ফেলে গিয়েছে সে নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ির উপর নজর রাখছে। আর এই ‘খুন’ এর ব্যাপারটাই বা কি? এই কথা সে কেন বলল?”

কাগজটা ফিরিয়ে দেয়ার সময় মিকি অসুস্থ বোধ করছিল।

“আমার শরীরটা খারাপ লাগছে।”

ফুয়ুমি ওর মরার মত সাদা হাত মিকির কাঁধে রাখল। মিকির মনে হল কেউ যেন ওর গলার কাছে বরফ দিয়ে স্পর্শ করেছে। কেঁপে উঠল ও।

“চিঠিটায় কোন ডাকটিকেট লাগানো নেই। কেউ নিশ্চয়ই এটা হাতে হাতে ফেলে গিয়েছে। রিফুজি ওর রুমে খুন হয়েছে…ওর রুমটা নিচ তলায় আর বাড়ির থেকে আলাদা। আমাদের চোখে না পড়ে একজন ক্রিমিনালের পক্ষে ওর রুমে ঢোকা খুবই সম্ভব। মিকি, লাঞ্চের পর তোমার সাথে একটু কথা আছে। একা কথা বলব। যেখানে তোমার খুশি। তোমার রুমে হলেই বোধহয় ভাল, মানে ইশিরোর রুমে আরকি। এই ধর আর এক ঘন্টার মধ্যে?”

এক ঘন্টা পর।

ফুয়ুমি রুমের ভেতর ঢুকে চোখ বোলাল।

“অনেকদিন পর ইশিরোর রুমে এলাম। এই ওয়ারড্রবটা একদম রিয়ুজির রুমেরটার মত দেখতে। যখন ছোট ছিলাম তখন মনে হত আমার কেন একটা নেই। অনেক হিংসা হত তখন।”

“দুঃখিত, রুমটা একটু অগোছালো হয়ে আছে।”

কাপড়চোপড় আর লাগেজগুলো রুমের এক কোণায় স্তূপ করে রাখা ছিল।

“রিয়ুজির রুমের সাথে তুলনা করলে এটা অনেক গোছানো। চিন্তা কোর না।”

ফুয়ুমি কিছুক্ষণ দেয়ালে ঝুলানো পেইন্টিংগুলো দেখল, তারপর ডেস্কের সামনে থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। পকেট থেকে সাদা কাগজটা বের করল।

“তোমার কি মনে হয় এই লোক সত্যি বলছে? রিয়ুজি, খুন হয়েছে..?”

“চিঠিটা…ওটাকি আসলেই চিঠির বাক্সে পাওয়া গিয়েছিল?”

“তুমি কি বলতে চাইছ এটা আমি লিখেছি?”

“না না তা বলিনি।”

“এটা আসলেই চিঠির বাক্সে ছিল। আমি ওখানেই পেয়েছি। কিন্তু আমার তোমাকে আরো ইন্টারেস্টিং কিছু বলার আছে। গতরাতে রিয়ুজির সম্পাদক ওকে ফোন করেছিল। মা বলল, মা নাকি নয়টার দিকে ওর দরজায় গিয়ে নক করেছিল। দরজা লক করা থাকলেও ভেতরে মিউজিক চলছিল তখন। তোমার কি মনে হয়?”

“আমার কি মনে হয় মানে…?”

“চিঠিতে লেখা আছে ও ওর নিজের রুমে খুন হয়েছে। শোনো আমার কি মনে হয় তোমাকে বলি। আমার মনে হচ্ছে মা যখন ওর রুমে গিয়েছিল, রিয়ুজি তখন ওখানেই ছিল। আমি অবশ্য নিশ্চিত হতে পারছি না। কিন্তু

আমার মনে হয় না ও মিউজিক চালিয়ে রেখে বাইরে চলে যাবে।”

ফুয়ুমি চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমের মধ্যে পায়চারি করল।

“যদি এই চিঠির দাবি সত্য হয়, হয়ত খুনি খুন করার পর রিয়ুজির লাশ রুমের বাইরে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল, মিউজিক ছেড়ে রেখে। ইশিরো বলেছে ও কাল রাতে আটটা পর্যন্ত রিয়ুজির রুমে ছিল। ওরা কিছুক্ষণ গল্প করে, তারপর ইশিরো বেরিয়ে যায়। যতদূর মনে হচ্ছে রিজিকে শেষ দেখা ব্যক্তিটি হল ইশিরো।”

“তুমি কি বলতে চাইছ ইশিরো একজন ক্রিমিনাল?”

“না, একদমই না কিন্তু আমি জানি যে রিয়ুজির দরজা লক করে রাখার অভ্যাস আছে, আর এই ব্যাপারটাই আমাকে খোঁচাচ্ছে। কারো পক্ষে সোজা ওর রুমে ঢুকে ওকে খুন করা সম্ভব না। প্রথমে তাকে দরজার লক ভাঙতে হবে নয়তো দরজা ভাঙতে হবে। কিন্তু ইশিরো বলল ও যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন রিয়ুজির খেয়াল ছিল না। ও নিশ্চিত না ওর বের হওয়ার পর রিয়ুজি দরজা লক করেছিল কিনা। সুতরাং এমন হতে পারে যে ইশিরো বেরিয়ে যাওয়ার পর রাত আটটা থেকে কিছুক্ষণ দরজাটা লক করা ছিল না। মা নয়টার পরে গিয়ে দরজা নক করে। এর অর্থও হল কেউ একজন ভেতরে ঢুকতে আর বের হতে পেরেছিল। মিকি, তুমি সকালে রিয়ুজির রুমে ছিলে। তুমি বলেছিলে ইশিরো একটা বই চেয়েছিল আর তুমি সেটা নিতে গিয়েছিলে। তুমি আর আমি একসাথেই বের হয়েছিলাম রুম থেকে। দশ মিনিট পর তোমার বইটার কথা মনে পরে আর তুমি ফিরে গিয়ে সেটা নিয়ে আসো, তাই না?”

মিকি মাথা ঝাঁকাল। ঐ সময়ই ও টেবিলের রক্তের দাগগুলো মুছেছিল।

“যে বইটা তুমি এনেছিলে ছাউনি থেকে, সেটা এখন কোথায়? বইটার নাম কি? রিজির লাইব্রেরিটা খুবই ইন্টারেস্টিং, কিন্তু ওখানের কিছু বই নয়….”

“ওহ হ্যাঁ বইটা…কোথায় যেন রাখলাম সেটা?”

“কি হল? অন্য কোথাও রেখেছ?”

“না, আমি নিশ্চিত যে বইটা এখানে নিয়ে এসেছিলাম। আমি নিশ্চিত যে ওটা ওয়ারড্রবে রেখেছিলাম…”

কেবিনেটের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মিকি নিজের পকেট হাতড়াল। ইশিয়োর ওয়ারড্রবটাও রিয়ুজিরটার মতই, লক লাগানো। মিকি একটা পুরাতন সোনালী রঙের চাবি বেছে নিয়ে সেটা চাবির ফুটোয় ঢুকালো তারপর মোচড় দিল।

“কোন সমস্যা?” ফুয়ুমি জিজ্ঞেস করল। মিকিকে দেখে মনে হচ্ছিল ওয়ারড্রবের দরজা খুলতে সারাজীবন লাগাচ্ছে।

“কাজ করছে না। মনে হচ্ছে লকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চাবি ঘুরল, লকটা খোলার কথা কিন্তু দরজাটা আটকে আছে।”

ও হাতলে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে টান দিল, কিন্তু কিছুই হল না।

“হতে পারে…” ফুয়ুমি বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু তারপরেই মুখ বন্ধ করে ফেলল। ওর চোখগুলো বেরিয়ে আসছিল আর ওর অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোন ভয়াবহ খুনের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে।

“কি হয়েছে?”

“কিছু না।” ফুয়ুমি উঠে দাঁড়িয়ে মিকিকে উপেক্ষা করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সে রাতেও মিকি রিয়ুজির লাশ সরানোর কোন সুযোগ পেল না।

***

রিয়ুজির মৃত্যুর পর দ্বিতীয় দিন সকালে বাড়ির প্রায় সবাই ব্রেকফাস্টের সময় জড়ো হল। মিকি শুনতে পাচ্ছিল যে ফুয়ুমি চিঠির বাক্সে দ্বিতীয় আরেকটা চিঠি পাওয়ার খবর সবাইকে জানাচ্ছে। প্রথম চিঠিটার মতই দ্বিতীয়টাও হাতে হাতে করে চিঠির বাক্সে রাখা হয়েছিল। প্রেরকের নাম লেখা নেই।

চিঠিটায় টাইপ করে লেখা ছিল-”রিয়ুজিকে খুন করা হয়েছে একটা অ্যাস্ট্রে দিয়ে।”

ব্রেকফাস্টের পর মিকি ওর রুমে ফিরে গেল যাতে ও আর ইশিরো হলের ভেতর হাঁটাহাঁটি করতে পারে। ওরা দেখল ফুয়ুমি দোতালার হলওয়েতে একটা বাইনোকুলার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল জানালা দিয়ে কিছু একটা দেখছে।

“কি দেখছ?” মিকি জানতে চাইল। ফুয়ুমি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করল চুপ থাকার জন্য।

“আমি ধরার চেষ্টা করছি কে ঐ চিঠিগুলো রেখে যায়। আমি নিশ্চিত যে সে আশেপাশে কোথাও থেকে এই বাড়ির উপর নজর রাখছে।”

কথাগুলো বলার সময় ওর মুখ দেখে বোঝা যাচিল ও খুবই সিরিয়াস। চোখে বাইনোকুলার চেপে দেখছিল।

জানালার বাইরে এক সারি মলিন রঙের গাছ ছিল। মেঘগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। ঠাণ্ডা বাতাসের একটা ঝাপ্টা এসে মিকির মুখে লাগলো, ওর লম্বা চুলগুলো নড়ে উঠল। ওর নাকের নিচের ত্বক ঠান্ডায় লাল হয়ে ছিল, চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছিল ওগুলো যে কোন সময় কান্নায় ফেটে পড়বে।

“তুমি চিঠিগুলোকে অনেক সিরিয়াসলি নিচ্ছ দেখা যাচ্ছে।”

“এমন না যে আমি লেখাগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করছি। আমার কৌতূহলের যদি একটা পাই চার্ট বানাই তাহলে আমি একে ১২০ ডিগ্রী এর মত দিব।”

“কিন্তু যে ব্যক্তি চিঠিগুলো লিখেছে, সে কেন ভাবছে রিয়ুজি ওর রুমেই খুন হয়েছে? সে কি করে জানল যে একটা অ্যাস্ট্রে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে?”

“রিয়জুর রুমে একটা জানালা আছে না? যে কেউ বাইরে থেকে দেখতে পারে। যদি চিঠির লেখক ব্যক্তিটি জঙ্গলের ভেতর থেকে থাকে, তাহলে পাহাড়ের চূড়া থেকে বাড়ির আলোকিত জানালা দেখতে পাবে। তার পক্ষে দেখা কঠিন হবে না, একজন মানুষকে অ্যাস্টে দিয়ে খুন করা হচ্ছে। আমার পক্ষে দৃশ্যটা কল্পনা করতে একদমই কোন সমস্যা হচ্ছে না। যাই হোক, মিকি, তোমার কি কখনো এমন অনুভূতি হয় যে কেউ হয়ত তোমার দিকে তাকিয়ে আছে? মানে তোমাকে লক্ষ্য করছে বা দুর থেকে খেয়াল করছে ধরণের?।”

“তাকিয়ে আছে?” মিকি মাথা নাড়ল।

“তাই বুঝি? তাহলে এটা স্রেফ আমার কল্পনা।”

“ফুয়ুমি, আমার যা মনে হয় সেটা বলি। আমার মনে হয় যে চিঠিগুলো লিখেছে সে এই বাড়িরই কেউ।”

“এই বাড়ির কেউ?”

“হ্যাঁ। আর সেই সাথে, আমার ধারণা যে চিঠিটা লিখেছে সে নিজেই রিজিকে খুন করেছে। অবশ্য যদি ধরে নেই যে রিয়ুজি আসলেই খুন হয়েছে।”

ফুয়ুমি হাসল। “আমি তোমার বক্তব্য বুঝতে পারছি, মিকি। কিন্তু কেন একজন ক্রিমিনাল নিজের অপরাধের কথা চিঠি লিখে জানাতে যাবে? আর তোমার কি আসলেই মনে হয় যে এই পরিবারের কেউ রিজিকে খুন করতে পারে?”

মিকি চুপ করে থাকল। যে কোণ থেকেই দেখা হোক না কেন, কোন যুক্তিরই কোন কারন দেখা যাচ্ছে না। যুক্তিগুলো একটা আরেকটার সাথে খাপ খাচ্ছে না। ওর সাদা কপালে এক বিন্দু ঘাম জমল।

“মিকি, আমার কোন ধারণা নেই কে চিঠিগুলো পাঠিয়েছে, কিন্তু একটা সন্দেহ আছে যে কে রিয়ুজিকে খুন করে থাকতে পারে,” ফুয়ুমি বলল, এবং হাসল। তারপর মুখটা মিকির কাছে এনে বলল, “আর আমার ধারণা তুমিও

সেটা জানো, ঠিক বলেছি না?”

***

লাঞ্চের সময়।

সবাই ডাইনিং টেবিলে এসে জড়ো হলে চিঠির কথাটা উঠল।

“আমার মনে কূ-ডাক দিচ্ছে। আমাদের মনে হয় পুলিশকে জানানো উচিত।”

“কিন্তু কে বিশ্বাস করে যে রিয়ুজি খুন হয়েছে? কাল সকাল পর্যন্ত দেখা যাক আর কোন চিঠি আসে কিনা। তারপর না হয় পুলিশকে জানানো যাবে।”

“বাবা তোমার কাছে এই বাড়ির সব চাবির কপি আছে তাই না? রিয়ুজির রুমের ওয়ারড্রবটার চাবি আছে?”

কথাগুলো বলতে বলতে ফুয়ুমি আড়চোখে মিকির দিকে তাকাল যে, কথাগুলো শুনে ঠোঁট কামড়ে আছে।

“না, আমার মনে হয় না ওয়ারড্রবের কোন অতিরিক্ত চাবি আছে। ও একটা কথা তোমাকে বলতে চাচ্ছিলাম, ফুয়ুমি, কিন্তু তুমি বাড়িতে না থাকায় আর বলা হয়নি। সব চাবির কপি আমি ছয় মাস আগে হারিয়ে ফেলেছি।”

মিকির চেহারা দেখে মনে হল অবাক হওয়াটা লুকানোর চেষ্টা করছে। “আপনি বলতে চাইছেন রিয়ুজির রুমের চাবিও?”

“হ্যাঁ। কোন অতিরিক্ত চাবি নেই। আমার উদাসীনতার কারনে ওগুলো হারিয়েছি। দোষটা আমারই।”

“আপনার কাছে যদি অতিরিক্ত চাবি নাই থাকে তাহলে গতকাল সকালে আপনি কি করে জানলেন যে রিয়ুজি ওর রুমে ছিল না?”

“রুম লক করা ছিল না। আমি ভেতরে গিয়ে দেখেছি।”

এরপর কিছুক্ষণ মিকি চুপচাপ খেল। খাওয়া শেষ হলে ও ফুয়ুমিকে বলল, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। দুটোর সময় রিয়ুজির রুমে এসো, শুধু আমরা দুজন। ঠিক আছে?”

ও যেমনটা আশা করেছিল, ফুয়ুমি মাথা নেড়ে সায় দিল।

“চমৎকার। আমারও তোমাকে জরুরি কিছু কথা বলার আছে।”

দুপুর ১টা ৫৮ মিনিট।

নির্ধারিত সময়ের দুই মিনিট আগে মিকি রিয়ুজির রুমে এসে ঢুকল, যেটা মূল বাড়ির থেকে আলাদা। খুনের রাতের মতই সোফায় গিয়ে বসল। একটু পরপর ওয়ারড্রবের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। নভেম্বর মাস, ঠান্ডার সময়। হিটার জ্বালানো ছিল না। ওর নিশ্বাস বেরিয়ে সাদা ধোঁয়ার মত দেখাচ্ছিল।

ফুয়ুমি দুটোর সময় হাজির হল। ওর পেছনে সবুজ ইউনিফর্ম পরা দুজনকে দেখা গেল। ওদের দেখে মিকি গুটিয়ে গেল।

“এরা কারা?”

“ওরা আমার কলিগ। ওরা আবার একটা জিনিসপত্র সরানোর কোম্পানিতে পার্টটাইম কাজ করে। আমি ওদেরকে বলেছিলাম কিছু বিশাল সাইজের বাতিল জিনিসপত্র সরাতে হবে, তাই ওরা এসেছে আমাকে সাহায্য করতে।”

“বিশাল সাইজের বাতিল জিনিসপত্র?”

ফুয়ুমি মাথা ঝাঁকাল, লোক দুজনের একজন কেবিনেটটার দিকে এগিয়ে গেল। সে তার হাতগুলো ছড়িয়ে ওটার প্রস্থ মাপল। অন্য লোকটা আঙুল দিয়ে ওয়ারড্রবটার দিকে ইঙ্গিত করে ফুয়ুমিকে কোন একটা প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ, এটাই। তোমরা কি এটা বের করে ট্রাকে নিয়ে রাখতে পারবে?”

“কি করছ তুমি?”

ফুয়ুমির ফ্যাকাসে চেহারাটায় হালকা একটা হাসি ফুটল যা ঠিক মত মানাল না।

“বাড়ির সামনে একটা ট্রাক রাখা আছে, ধার করে এনেছি। ওরা দুজন আমার জন্য ওয়ারড্রবটা বয়ে বাইরে নিয়ে যাবে।”

লোক দুটো ওয়ারড্রবের দুপ্রান্তে ধরে সেটাকে তুলল। একজন ফুয়ুমিকে কিছু একটা বলল।

“কি বল? অস্বাভাবিক রকমের ভারি? যেন ভেতরে কোন মানুষের দেহ ভরা আছে? হ্যাঁ ঠিক বলেছ। আমি নিশ্চিত সেটা সঠিক। সাবধানে নিও। ঝাঁকি লাগিও না। আর দয়া করে কোনভাবে এটা ফেলে দিও না যেন, কিংবা উপর নিচ করে ফেলল না।”

লোক দুটো ওয়ারড্রবটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। মেয়ে দুজন পেছন পেছন গেল।

“তো মিকি, তোমাকে এই কথাটাই বলার ছিল। তুমিই কাজটা করেছ। আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পারছ কিসের কথা বলছি আমি।”

“তুমি ভুল করছ।”

“তাহলে আমাকে পুরো সত্যটা কি সেটা বল।”

রিয়ুজির রুমটা মূল বাড়ি থেকে আলাদা। তাই ওয়ারড্রবটা নিয়ে যাওয়ার পর ওরা দরজা দিয়ে বাইরের বাগানটা দেখতে পাচ্ছিল। ট্রাকটা ঠিক বাইরেই পার্ক করা ছিল।

“ট্রাকে ভোলার পর তুমি ওটা নিয়ে কি করবে?”

“আমি ভাবছিলাম পুলিশ স্টেশনের সামনে ফেলে আসব। আইডিয়াটা কেমন?”

ওয়ারড্রবটা একবার ফসকে যাচ্ছিল। “সাবধান!” মিকি চিল্লিয়ে বলল।

“মিকি তোমার কি মনে আছে, গতরাতে যখন আমরা ইশিরার রুমে কথা বলছিলাম? তুমি ওয়ারড্রবটা খুলতে গিয়েছিলে কিন্তু খোলেনি। তুমি জানো কারনটা কি?”

“তুমি মনে হচ্ছে কারনটা জানো?”

“গতরাতে তুমি বলেছিলে যে লকটা নষ্ট, তাই খুলছে না।”

“হ্যাঁ, আমি আজকে সকালেও চেক করেছি, নষ্ট ছিল। জোর দেয়ার স্কুগুলো নেই।” মিকি এমনভাবে বলল যেন অজুহাত দিচ্ছিল, ফুয়ুমি ওর কথা শুনে হাসল।

“কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি ওটা মোটেও নষ্ট ছিল না। তুমি শুধু তোমার ভুল ধরতে পেরেছিলে আর পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বলেছ যে নষ্ট ছিল।”

“আমার ভুল?”

“আহ, বাদ দাও না। আর অভিনয় কোর না যে তুমি কিছু জানো না। গতরাতে ইশিয়োর ওয়ারড্রবে তুমি যে চাবিটা ঢুকিয়েছিলে সেটা ছিল ভুল চাবি। ওটা আসলে ছিল রিয়ুজির ওয়ারড্রবের চাবি, ঠিক বলেছি কিনা? দুটো ওয়ারড্রব দেখতে হুবহু একই রকম, চাবিও দেখতে একই রকম: পুরাতন আর সোনালী রঙের। আমি এটা জানি কারন ছোট থাকতে আমার ভাইয়েরা ওগুলো আমাকে দেখিয়েছিল। কিন্তু দেখতে এক রকম হলেও ওগুলো এক না। চাবিগুলো শুধু যার যার নির্দিষ্ট ওয়ারড্রবই খুলতে পারে।”

লোক দুটো ওয়ারড্রবটা ট্রাকের উপর উঠাচ্ছিল। মিকি আর ফুয়ুমি এক পাশে মুখোমুখি দাঁড়াল।

“গতরাতে তুমি বুঝতে পারানি যে চাবি দুটো মিলিয়ে ফেলেছ। তুমি রিয়ুজির চাবি দিয়ে ইশিয়োর ওয়ারড্রব খোলার চেষ্টা করছিলে। যখন ব্যর্থ হলে, তখন আমি বুঝতে পারলাম কি ঘটেছে। আমার মনে হয় চিঠিগুলো পড়ার পর আমার কিছু ধারণাও হয়েছিল। এরপর আমি চিন্তা করলাম তোমার কাছে কিভাবে রিয়ুজির ওয়ারড্রবের চাবি এলো। আর সেটাই আমাকে ওর ভয়ংকরতম পরিনতির কথা জানিয়ে দিল।”

লোক দুজন একটা দড়ি দিয়ে ওয়ারড্রবটাকে ট্রাকের উপর শক্ত করে বাঁধছিল যাতে নড়াচড়া না করে।

“এই ওয়ারড্রবে যাই লুকানো থাকুক না কেন, তুমিই তা সেখানে ভরেছিলে। এরপর লক করে রেখেছিলে যাতে কেউ জানতে না পারে। তারপর ওয়ারড্রবের চাবি আর রিয়ুজির রুমের চাবি তোমার পকেটে ঢুকিয়ে রাখো।”

ফুয়ুমি লোক দুজনের দিকে ঘুরল। “ধন্যবাদ, অনেক সাহায্য করলে। বাকি কাজ আমিই করতে পারব।”

ফুয়ুমি ধন্যবাদ জানানোর পর তোক দুজন তাদের মাথা বো করে নীরবে চলে গেল। শুধু মিকি আর ফুয়ুমি ওয়ারড্রবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল।

“এখন শুধু তুমি আর আমি আছি, মিকি,” ফুয়ুমি ওর হাতদুটো সামনের দিকে ভাঁজ করে বলল। মিকি মাথা নাড়ল।

“না, আমরা তিনজন আছি।”

ফুয়ুমি এক মুহূর্তের জন্য ওর কথাটা ধরতে পারেনি। তারপরই ওর মুখে ধূর্ত হাসিটা ফিরে এল। “আমি জানতাম। আমি জানতাম যে তুমিই রিয়ুজিকে খুন করেছ, আর ওর লাশটা ওটার ভেতর লুকিয়ে রেখেছ। তুমি লাশটা ওর রুমেই রেখে দিতে চেয়েছিলে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা সরানোর কোন ব্যবস্থা করতে পার।”

“তুমি ভুল করছ! তুমি ভুল বুঝছ! আমি স্বীকার করছি যে দুই রাত আগে আমি রিয়ুজির রুমে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ওকে খুন করিনি।”

“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।”

“আমি তোমাকে বিশ্বাস করাবোটাই বা কিভাবে? আমি নিজেই জানি ব্যাপারটা এপর্যন্ত গড়াল কি করে? ঐ রাতে আসল ক্রিমিনাল সবার দৃষ্টি এড়িয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। আর আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, আমার উপর সব সন্দেহ তো পড়বেই। যে কারনে আমি রিয়ুজির লাশটা লুকিয়েছিলাম। আমার সামনে আর কোন উপায় ছিল না!” এই পর্যায়ে এসে মিকি প্রায় চিল্লাচ্ছিল।

“ঐ রাতে, রিয়ুজি আমাকে ওর রুমে ডেকেছিল কিছু পুরাতন ঘটনা নিয়ে কথা বলার জন্য। মিউজিক জোরে জোরে বাজছিল, আর প্রায় তিন মিনিটের জন্য আমি ছাউনিতে ছিলাম। ও আমাকে বলেছিল যে ইশিয়োর কিছু পেইন্টিং ওখানে রাখা আছে। ছাউনি থেকে যখন আমি রুমে ফিরে আসি তখন ওকে আমি মৃত দেখতে পাই, মাথাটা ফাটা।”

“একটা অ্যাস্ট্রে দিয়ে, যেভাবে চিঠিতে লেখা ছিল?”

“হ্যাঁ ঠিক তাই। একটা রক্তাক্ত অ্যাস্টে টেবিলের উপর পড়েছিল। আমি ওটা হাতে নিয়েছিলাম-যে কারনে আমার হাতের ছাপ ওটার উপর পড়ে গিয়েছিল। অ্যাস্ট্রেটা আমার হাত থেকে পিছলে মেঝেতে পড়ে যায়।”

“তুমি বলছ ও যখন খুন হয়েছে তুমি তখন ছাউনিতে ছিলে?”

“আমি কিছুই শুনতে পাইনি কারন জোরে জোরে মিউজিক বাজছিল। তাই বুঝতে পারিনি কি হচ্ছিল। আমি ওর লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কি করব, এমন সময় তোমার মা এসে দরজায় নক করেন এবং দরজাটা খোলার চেষ্টা করেন। তুমি জানো যে দরজাটা লক করা ছিল, তাই তিনি ঢুকতে পারেননি।”

“কেউ রুমের ভেতর ঢুকতে বা বের হতে পারেনি? তোমার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে-আমি বলছি না তোমাকে আমি এখনই বিশ্বাস করছি বা সেরকম কিছু-তোমার কাহিনী যদি সত্যি হয় তাহলে ক্রিমিনাল এমন কেউ যার কাছে রিয়ুজির রুমে ঢোকার চাবি ছিল। তুমি যে সময়টা ছাউনিতে ছিলে, ঐ ব্যক্তি তখন চুপিসারে দরজার লক খুলে ভেতরে ঢোকে, অ্যাস্ট্রে দিয়ে রিয়ুজির মাথায় বাড়ি মারে, আবারও রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর বাইরে থেকে আবার দরজা লক করে দেয়। ক্রিমিনালকে করতে হলে এসব কিছু করতে হবে।”

“কিন্তু রুমের চাবি তো রিয়ুজির পকেটে ছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যে ক্রিমিনালের কাছে নিশ্চয়ই অতিরিক্ত চাবি ছিল। মৃত লাশের সাথে একা থাকা অবস্থায় আমি যে দায়ী তাকে অভিশাপ দিচ্ছিলাম। কিন্তু পুলিশের কাছে যেতে চাইনি…”

মিকি থামল। ফুয়ুমি ওর মাথা কাত করে প্রশ্ন করল।

“কেন না? তুমি যা বলছ তা যদি সত্যি বলে থাকো, তোমার উচিত ছিল পুলিশকে সব খুলে বলা।”

মিকি দুহাতে ওর মুখ ঢাকল।

“এটাই আমার শাস্তি। এখন আমি আর পুলিশকে বলতে পারব না। আমাকে এই যন্ত্রণা নিয়ে সারাজীবন চলতে হবে…ঈশ্বর আমাকে এই শাস্তি দিয়েছেন, ঈশ্বর রিজিকে খুন করেছেন, আর যন্ত্রণায় ফেলেছেন আমাকে,

আর তিনি ঐ জঘন্য চিঠিগুলো পাঠিয়েছেন…”

“মিকি তুমি ঠিক আছে তো?”

“আমি দুঃখিত। আমার কিছু হয়নি…কোন একদিন হয়ত আমি তোমাকে আসল কারনটা বলতে পারব,” মিকি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল। ওর চোখগুলো লাল হয়ে ছিল। যদিও ও ফুয়ুমির দিকে সরাসরি তাকাচ্ছিল না।

“চল মূল বিষয়ে ফিরে যাওয়া যাক। প্রথমে আমি অতিরিক্ত চাবিগুলোর কথা চিন্তা করেছিলাম, যে কারনে তোমার বাবাকে সন্দেহ হয়েছিল।”

“বাবাকে? হুম ঠিক আছে, কারনটা বুঝতে পারছি। আমি তোমাকে বলেছিলাম যে তার কাছে সব চাবির কপি আছে। কিন্তু তিনি তো বলেছেন দেড় বছর আগে ওগুলো তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। হ্যাঁ, এমন হতে পারে, তিনি নিজেকে সন্দেহ থেকে দূরে রাখতে সেটা বানিয়ে বলতে পারেন। যেটাই হোক না কেন, খুনির কাছে অবশ্যই অতিরিক্ত একটা চাবি রয়েছে।”

“কিন্তু একটা বিষয় আমি বুঝতে পারছি না। গতকাল সকালে, রিয়ুজি যখন ব্রেকফাস্টে এল না, তোমার বাবা ওর রুমে গেলেন দেখতে। আগের রাতে আমি যখন রিয়ুজির রুম থেকে বের হয়েছিলাম তখন আমি ওর চাবি দিয়ে ওর রুম লক করে এসেছিলাম। সুতরাং তোমার বাবার পক্ষে দরজা খুলে ভেতরে দেখা সম্ভব নয় যদি না তার কাছে অতিরিক্ত একটা চাবি থাকে। সকাল পর্যন্ত আমার ধারণা সেটাই ছিল। কিন্তু তার কাছে অতিরিক্ত কোন চাবি নেই। গতকাল সকালে তিনি বলেছেন রিয়ুজির রুমের দরজা লক করা ছিল না। আমি একশত ভাগ নিশ্চিত যে রুম থেকে বের হওয়ার সময় আমি দরজা লক করে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালে দরজাটার লক খোলা ছিল।”

“আমরা যদি ধরে নেই যে বাবার কাছে এখনো অতিরিক্ত চাবি আছে তাহলে…আসলে, লোকটা বাবা নাকি অন্য কেউ সেটা অন্য বিষয়, গভীর রাতে কেন একজনের দরজার লক খোলার প্রয়োজন পড়ল? এমন কি হতে পারে যে তাকে রুমে যেতে হয়েছিল খুনের কোন প্রমাণ সরানোর জন্য? তারপর ফেরার সময় দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছিল…”

“আরও সরল একটা ব্যাখ্যা থাকতে পারে। হয়ত অতিরিক্ত চাবির দরকার ছিল না। তোমার বাবা আসলেই হয়ত সেগুলো হারিয়ে ফেলেছিলেন। এমন তো হতে পারে যে খুনির অতিরিক্ত চাবির কোন প্রয়োজনই পড়েনি।”

“অ্যাঁ?”

“রিয়ুজি যখন আমাকে ওর রুমে ডেকেছিল, খুনি হয়ত ইতিমধ্যেই ওখানে ছিল। রুমের ভেতর। সে আমার ছাউনিতে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, তারপর ঐ সুযোগে রিয়ুজিকে খুন করেছে। তারপর রুমের মধ্যেই আবার লুকিয়ে পড়েছে। এটাই হয়েছে। একদম সহজ ব্যাখ্যা।”

“তারমানে, তুমি বলতে চাইছ তুমি রুমে থেকে অপেক্ষা করছিল কখন তুমি বেরিয়ে যাও?”

“হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি যখন রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম, রিয়ুজির চাবি দিয়ে দরজা লক করে দিলাম, খুনির পক্ষে আর সম্ভব হয়নি বের হওয়ার

সময় দরজা লক করে যাওয়ার। যে কারনে দরজার লক খোলা ছিল।”

“কিন্তু রিয়ুজির রুমে জায়গা কোথায় খুনির লুকানোর জন্য?”

মিকি চুপ করে ওয়ারড্রবের দিকে তাকিয়ে থাকল। ফুয়ুমির চেহারা দেখে মনে হল প্রথমে সে ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। কিন্তু যখন ও বুঝল তখন অস্ফুটে বলে উঠল, “অ্যাঁ? তুমি বলতে চাইছ..?!”

“পুরো রুমের মধ্যে ওটাই একমাত্র জায়গা যেখানে কেউ লুকাতে পারে। সে ওখানে লুকিয়ে ছিল আর আমি ছাউনিতে যাওয়ার পর বেরিয়ে এসেছিল। তারপর অ্যাস্ট্রেটা নিয়ে রিয়ুজির মাথায় বাড়ি মারে। তারপর আবার ওয়ারড্রবে লুকিয়ে পড়ে। এটাই হয়েছে বলে আমার ধারণা।”

“আমি তো ভেবেছি রিয়ুজির লাশ ওয়ারড্রবে লুকানো হয়েছে।”

“আমিও প্রথমে সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু অনেকবার চেষ্টা করেও আমি দরজাটা খুলতে পারিনি। লকের ভেতর চাবি ঢুকিয়ে আমি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু মনে হচ্ছিল সেটা কোথাও আটকে যাচ্ছে, তাই আমি ভেবেছিলাম লকটা নষ্ট। রিয়ুজি বলেছিল যে লকটা মাঝে মাঝে ঝামেলা করে। আমি ভুল করে ভেবেছিলাম যে ও বুঝিয়েছে চাবিটা হয়ত একটু বেঁকে যাওয়ার কারনে মাঝে মাঝে কাজ করে না। কিন্তু আসলে ঐ রাতে হয়ত কেউ একজন ওয়ারড্রবের ভেতর থেকে কিছু একটা করেছিল যে কারনে লকটা কাজ করছিল না। যেহেতু আমি ওটার দরজাটা খুলতে পারিনি তাই আমি ওটার ভেতর লাশটা লুকাতে পারিনি। আশেপাশে তাকানোর পর আমার চোখ পড়ে আমার আনা সুটকেসটার উপর। রিয়ুজি ছোটখাট মানুষ ছিল। তাই আমার মনে হল ওকে সুটকেসে ভরে ফেলা যাক।”

“তাহলে তুমি ওকে খুনের অস্ত্রটাসহ সুটকেসে ভরে ফেলেছিলে?”

“হ্যাঁ, অ্যাস্ট্রেটায় আমার হাতের ছাপ ছিল। অবশ্য সুটকেসে আমার জামাকাপড় ছিল। লাশটা ভরার কোন জায়গা ছিল না। আমি সব কাপড় চোপড় বের করে লাশটা ঢুকাই। কাপড়গুলো রুমে ফেলে যাই।”

“তাহলে ঐ কাপড়গুলো তোমার ছিল? মেয়েদের কাপড়?”

“হ্যাঁ। আমি চাইনি ওগুলো কারো চোখে পড়ক। তাহলে সন্দেহ হত। রুমের কোণায় ইতিমধ্যে কাপড়ের একটা স্তূপ ছিল। আমি আমার কাপড়গুলো নিচে লুকিয়ে ফেলি। সবাই ঘুমানোর পর এসে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হয়নি।”

“সেকারনেই পরদিন সকালে তুমি শুধু পাতলা কাপড় চোপড় পরে ছিলে। বদলানোর মত কোন পোশাক তোমার কাছে ছিল না। এরপর তুমি রিয়ুজির রুমে গেলে তোমার কাপড় চোপড় আনতে, বই ধার করতে নয়। আমি যখন পড়ে থাকা কাপড়চোপড়গুলো ওয়ারড্রবে রাখার জন্য গেলাম তখন তুমি উতলা হয়ে পড়লে। আমার কাছ থেকে ওগুলো কেড়ে নিলে। তোমার এই অদ্ভুত আচরণ নিয়ে অবাক হয়েছিলাম আমি। তুমি ভয় পেয়েছিলে যে কাপড়ের স্তূপের মধ্যে আমি একজন নারীর পোশাকও দেখে ফেলতে পারি। অন্য কথায় বললে, তোমার পোশাক।”

“ঠিক তাই। আমার ব্রা তোমার হাতের কাছ থেকে ঝুলছিল।”

“তাহলে আবারও সেই প্রশ্ন। খুনটা কে করেছে?”

“জানি না। ঐ রাতে, রিয়ুজির রুম থেকে ইশিয়োর বেরিয়ে যাওয়া আর আমার ঢোকার মধ্যবর্তী সময়টায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও দরজাটা লক করা ছিল না। সে সময়ে যে কেউ ঢুকে থাকতে পারে।”

“দাঁড়াও দাঁড়াও। এক মিনিট। তুমি আমি যখন ইশিয়োর রুমে কথা বলছিলাম, তখন তুমি দুই ওয়ারড্রবের চাবির মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছিলে না?”

মিকি মাথা ঝাঁকাল। “সেজন্যই আমি ভেবেছিলাম লকটা নষ্ট। আসলেই ওটা খুলছিল না। খুনের রাতে খুনি ওয়ারড্রবে লুকিয়ে ছিল আর দরজা লাগিয়ে রেখেছিল। আমি চাবির ফুটোয় ঠিক চাবিটাই ঢুকিয়ে ঘুরিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আমি সেটা খোলার চেষ্টা করছি, কিন্তু আসলে সেটা লক করে দিয়েছিলাম। ভেতরে যে ছিল সে সেখানে আটকা পড়ে গিয়েছিল। ওকে লকটা ভেঙে বের হতে হয়েছিল। আর ইশিরোর ওয়ারড্রবের লকটাও যখন নষ্ট দেখা গেল, সেটাও সম্ভবত এই কারনেই হয়েছিল। খুনি পুরোটা সময় ওয়ারড্রবে লুকিয়ে ছিল, আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। খেয়াল করলে দেখবে দুটো দরজার মাঝখানে ছোট একটা ফাঁক আছে। সে হয়ত ফাঁকটায় মুখ চেপে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিল।”

ফুয়ুমির কিছু একটা মাথায় এল। “ঠিক তাই! এটাই ঠিক…লোকটার জানার কোন উপায় ছিল না যে তুমি তার পেছনে লেগেছ কিনা। আর আজকে সবার সামনে তুমি যখন বললে তুমি আমার সাথে কথা বলতে চাও, আর সময় আর জায়গাটাও বললে,..”

“আমি ধরে নিয়েছিলাম লোকটা ওয়ারড্রবে এসে লকাবে।” মিকি হাতের মুঠি দিয়ে ওয়ারড্রবের পাল্লার উপর কিল দিল।

“তারমানে এর ভেতর এখন কোন লাশ নেই, যে আছে সে হল খুনিটা। যে দেখতে এসেছিল তুমি আর আমি কি নিয়ে কথা বলি।”

ফুয়ুমি ওয়ারড্রবের উপর কিল দিল। “কেউ কি ভেতরে আছে? থেকে থাকলে উত্তর দাও। পাল্লায় শব্দ করলেই হবে।”

ফুয়ুমি আর মিকি তাদের হাত ভাঁজ করে ট্রাকের উপর রাখা ওয়ারড্রবের দিকে তাকিয়ে থাকল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সবকিছু নীরব হয়ে থাকল।

তারপর কেবিনেটের ভেতর থেকে একটা টোকার শব্দ ভেসে এল। মেয়ে দুজন একে অপরের দিকে তাকাল।

“কেউ একজন আসলেই ভেতরে আছে!” ফুয়ুমি অবাক হয়ে বলল।

“তুমি কি রিয়ুজিকে খুন করেছ? করলে দুবার টোকা দাও। না করে থাকলে একবার,” মিকি বলল।

দু বার টোকার শব্দ হল। হ্যাঁ।

“তুমি কি চিঠিগুলো পাঠিয়েছ?” ফুয়ুমি জানতে চাইল। হ্যাঁ।

“তুমি কি চিঠিগুলো একারনে পাঠিয়েছ যাতে লাশটা পাওয়া যায় আর সবাই আমাকে খুনি মনে করে?” মিকি জানতে চাইল।

না।

“এসব কি আগে থেকে পরিকল্পনা করা ছিল?” ফুয়ুমি প্রশ্ন করল।

না।

“…এর কারন কি আমার অতীত?” মিকি যন্ত্রণাগ্রস্থ মখে জানতে চাইল।

হ্যাঁ। “রিয়ুজি তোমাকে বলেছিল?” মিকি জানতে চাইল। হ্যাঁ।

“তুমি রিজিকে খুন করতে চেয়েছিলে কারন ও আমার গোপন ব্যাপারটা জানত, আর তুমি আমাকে এর জন্য আরো শাস্তি দিতে চেয়েছিলে?” মিকি প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ। “চল দেখা যাক ভেতরে কে আছে।”

ও কথাটা বলার পর ফুয়ুমি আস্তে করে পাল্লাগুলো খুলল। ওয়ারড্রবের ফাঁক দিয়ে ওর সাথে আমার চোখাচোখি হল। আমার স্ত্রী আর আমার বোনের মুখ থেকে সমস্ত রক্ত সরে গিয়েছিল। ওদেরকে একদম মৃত লাশের মত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *