এ ফেয়ারি টেল (গল্প)

এ ফেয়ারি টেল (গল্প)

সারা দিনের কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে নদীর ধারে তার কুঁড়েঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল ফেরিঘাটের বৃদ্ধ মাঝি। নদীটা বড়। তার উপর সম্প্রতি প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। মাঝরাতে হঠাৎ এক প্রবল চিৎকারে ঘুম থেকে আচমকা জেগে উঠল মাঝি। বুঝল জনকতক পথিক নদী পার হওয়ার জন্য তাকে ডাকছে। 

কুঁড়ের দরজা খুলেই অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠল মাঝি। অবাক হয়ে দেখল ঘাটের কাছে বাঁধা তার নৌকোর পাশে দুজন পরী নাচছে। বড় সুন্দর সে নাচ। পরী দুটি ছিল পথিকদের সঙ্গে। তারা মানুষের মতো গলায় মাঝিকে বলল, যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি তাদের পর করে দিতে হবে। 

মাঝিও দেরি না করে নৌকো ছেড়ে দিল। পথিকরা দুর্বোধ্য ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিল আর হাসছিল। মাঝে মাঝে নাচানাচি করছিল আর তাতে নৌকোটা দুলছিল। মাঝি বলল, এতে নৌকো উল্টে যেতে পারে। কিন্তু এ কথা তারা হেসে উড়িয়ে দিয়ে আরও বেশি দাপাদাপি শুরু করে দিল। 

যাই হোক, অবশেষে নৌকো নদীর ওপারে গিয়ে ভিড়ল। পথিকরা তখন কতকগুলো সোনার টাকা নৌকোর পাটাতনে ফেলে দিয়ে বলল, এই নাও তোমার পারিশ্রমিক। 

মাঝি বলল, তোমাদের সোনার টাকা ফিরিয়ে নাও। এতে তোমাদেরও বিপদ ঘটতে পারে। আমারও বিপদ হতে পারে। একটুকরো সোনা যদি কোনওরকমে নদীর জলে পড়ে যায় তাহলে নদী আমাকে ও আমার নৌকোটাকে গ্রাস করে ফেলবে। 

পথিকরা বলল, আমরা যা একবার দিই তা ফিরিয়ে নিই না। 

মাঝি তখন সোনার টাকাগুলো কুড়িয়ে তার টুপির মধ্যে ভরে নিয়ে বলল, এগুলো তাহলে আমি নদীর ধারে মাটিতে পুঁতে ফেলব। 

এমন সময় পরী দুজন নৌকো থেকে নেমে চলে যাচ্ছিল। মাঝি বলল, তোমরা আমার পারের কড়ি দিয়ে যাও। 

পরীরা বলল, যে লোক সোনা নেয় না সে লোকের কোনও মজুরি পাওয়া উচিত নয়। 

মাঝি বলল, পৃথিবীর মাটিতে জন্মানো ফল ছাড়া আমি কিছু নিই না। আমাকে তিন রকমের ফল দিতে হবে। আমার পারের কড়ির বদলে। 

পরীরা বলল, পরে দেব। এই বলে তারা চলে গেল। মাঝিও নৌকো ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিল, কিন্তু নদী পার না হয়ে সেই দিকের তীর ঘেঁষে নিচে নেমে যেতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর নদীর ধারে একটা পাহাড় দেখতে পেল। আরও দেখল পাহাড়ের মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড খাদ। মাঝি সেই খাদের ভিতর সোনার টাকাগুলো সব ছুঁড়ে দিল। তারপর নৌকো ঘুরিয়ে সে চলে গেল। 

সেই খাদের ভিতর এক মায়াবী রাক্ষসী থাকত। সোনার প্রতি তার খুব লোভ ছিল। সে সোনার টাকাগুলো একে একে সব গিলে ফেলল। তার সঙ্গে সঙ্গে তার গা দিয়ে এক জ্যোতি বার হতে লাগল। কোথা থেকে এই সোনা এল তা জানার জন্য গুহা থেকে বেরিয়ে পড়ল রাক্ষসী। যে দিকে যে পথে সে যেতে লাগল, তার গা থেকে বার হওয়া আলোর ছটায় আলোকিত হয়ে উঠল রাত্রির সে অন্ধকার পথ। সে আলোর ছটায় গাছের পাতাগুলো পান্নার মতো সবুজ ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। রাক্ষরী যদিও পাহাড় আর শুকনো প্রান্তর ভালোবাসে, তথাপি সে জলাশয়ের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত যেতে লাগল। অবশেষে সে সেই পরী দুজনের দেখা পেল। সুন্দর পরীদের দেখে তাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা হলো।

রাক্ষসী পরীদের জিজ্ঞাসা করল কোথা থেকে সোনার টাকাগুলো এসেছে তার সন্ধান তারা দিতে পারে কি না। সে বলল, আমি যখন আমার পাহাড়ের খাদের ভিতর বসেছিলাম তখন মনে হলো স্বর্গ থেকে একরাশ সোনার টাকা ঝরে পড়ল আমার মুখে। 

পরীরা বলল, এই কথা? আচ্ছা এই নাও। এই বলে তারা যতই গা নাড়া দিতে লাগল ততই সোনার টাকা ঝরে পড়তে লাগল। সে টাকা সংখ্যায় এত বেশি যে রাক্ষসী তা খেয়ে শেষ করতে পারছিল না। সেই সব সোনার টাকা খেয়ে আরও বেড়ে গেল রাক্ষসীর দেহগ্রাত্রের উজ্জ্বলতা। এদিকে পরীদের সেই হতে আলোর ছটা কিছুটা ম্লান হয়ে গেল। যাই হোক, রাক্ষসী বলল, তোমরা আমাকে অনেক দিয়েছ, কি বর চাও বলো। 

পরীরা বলল, সুন্দরী পদ্ম কোথায় থাকে বলতে পার? তুমি আমাদের তার প্রাসাদে এখনি নিয়ে চলো। 

এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাক্ষসী বলল, এ বর তো এত তাড়াতাড়ি দান করতে পারব না। পদ্মা থাকে নদীর ওপারে। এই দুর্যোগপূর্ণ রাত্রিতে নদীর পার হওয়া সম্ভব নয়।

পরীরা বলল, দুষ্ট নদীটা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু ও আমাদের মাঝে এক ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। কিন্তু মাঝিকে ডাকো। 

রাক্ষসী বলল, মাঝি এপারের লোককে নিয়ে যাবে ওপারে। কিন্তু ওপারের লোককে যাকে একবার পার করেছে তাকে সে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। তবে আগামী কাল দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলে আমি নিজেই তোমাদের পার করে দেব। 

পরীরা বলল, কিন্তু দিন দুপুরে তো আমরা পার হই না, বা কোথাও যাওয়া-আসা করি না। 

রাক্ষসী বলল, তাহলে কাল সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করো। তাহলে তোমরা এক দৈত্যের ছায়ার উপর ভর করে নদী পার হতে পারবে। 

পরীরা বলল, তা কি করে সম্ভব? 

রাক্ষসী বলল, নিকটেই এক রাক্ষস বাস করে। তার দেহটা এমনই দুর্বল ও অশক্ত যে সে তার হাত দিয়ে একটা তৃণখণ্ডও তুলতে পারে না। তার ছায়াই সব কাজ করে। তাই সে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সন্ধের সময় দৈত্য নদীর ধারে এলে তার ছায়ার উপর তোমরা চেপে বসলেই সে তোমাদের পার করে দেবে। 

তখন পরীরা ও রাক্ষসী আপন আপন জায়গায় চলে গেল। রাক্ষসী তার পাহাড়ের খাদের ভিতরে গিয়ে এক সুড়ঙ্গপথ দিয়ে আরও গভীরে যেতে লাগল। অন্ধকারে তার গায়ের আলোকছটায় পথ চিনে চিনে সম্প্রতি সে এই সুড়ঙ্গটাকে আবিষ্কার করেছে। সেই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে গুঁড়ি মেরে গিয়ে একটা অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছল রাক্ষসী। দেখল মার্বেল পাথরের এক বিরাট মন্দির চত্বরের ওপর এক বিশাল সোনার মূর্তি। দেখল কোনও এক রাজার প্রতিমূর্তি। দেহটা বিশাল হলেও মাথাটা ছোট। 

রক্ষসীকে দেখে প্রতিমূর্তিটি জীবন্ত মানুষের মতো কথা বলতে লাগল।

রাক্ষসীকে বলল, সোনার থেকে দামী কি?

রাক্ষসী উত্তর করল আলো।

রাজা জিজ্ঞাসা করল, আলোর থেকে স্বচ্ছ কি?

রাক্ষসী বলল, কথা। 

কথা বলতে বলতে রাক্ষসী আর এক জায়গায় চোখ পড়তে দেখল রূপোর এক প্রতিমূতি। এটিও কোনো এক রাজার। তার মুকুট ও রাজদণ্ড মূল্যবান ধাতু দিয়ে সজ্জিত। মূর্তিটির পিছনের দেওয়ালের ছিদ্র দিয়ে আলো আসছিল। তাতে রাক্ষসী আর একটি পিতলের তৈরি প্রতিমূর্তি দেখতে পেল। কিন্তু পরে আর একটি মূর্তি দেখতে পেল। 

রাক্ষসীর কি মনে হলো সে চতুর্থ প্রতিমূর্তিটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু এমন সময় একটি বাতি হাতে এক বৃদ্ধ কৃষক কোথা থেকে সেখানে এসে হাজির হলো। তাকে দেখে সোনার রাজমূর্তিটি বলে উঠল, এখানে আমাদের আলো আছে। 

তুমি আবার আলো নিয়ে এলে কেন? 

বৃদ্ধ বলল, তুমি তো জান আমি কোনও অন্ধকারকে আলোকিত করতে পারি না।

রূপোর রাজমূর্তিটি বলল, আমার রাজ্য কখন ধ্বংস হবে?

বৃদ্ধ লোকটি বলল, অনেক দেরি আছে।

পিতলের রাজমূর্তি বলল, আমার কখন উত্থান ঘটবে?

বৃদ্ধ বলল, খুব শীঘ্রই।

রূপোর রাজা বলল, আমি কার সঙ্গে মিলিত হব?

বৃদ্ধ বলল, তোমার বড় ভাই-এর সঙ্গে?

রূপোর রাজা বলল, ছোট ভাই-এর কি হবে?

বৃদ্ধ বলল, তার মৃত্যু ঘটবে।

চতুর্থ রাজমূর্তিটি বলল, আমি কিন্তু এখনও ক্লান্ত হয়ে উঠিনি। 

ইতিমধ্যে রাক্ষসী গোটা মন্দিরটা ঘুরে চতুর্থ রাজার কাছে গিয়ে দেখল তার সুন্দর মুখে বিষাদ জমে রয়েছে। মূর্তিটি কি ধাতুতে তৈরি তা ঠিক বোঝা গেল না। তবে মনে হলো সোনা, রূপো আর পিতল অর্থাৎ যে তিনটি ধাতু দিয়ে তার তিন ভাই-এর মূর্তিগুলো গঠিত সেই তিন ধাতুর মিশ্রণে ও সমন্বয়ে তার প্রতিমূর্তিটি গড়া। তবে গঠনকার্যে কিছু ত্রুটি থাকায় ধাতুগুলো ঠিকমতো মিশ্রিত হয়নি। 

সোনার রাজা বৃদ্ধকে বলল, তুমি কতগুলো ধাঁধা বা রহস্য জান?

বৃদ্ধ বলল, তিনটি।

রাজা বলল, কোনটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

বৃদ্ধ বলল, যেটি আগেই প্রকাশিত হয়েছে?

পিতলের রাজা তখন বলল, তুমি ওটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবে?

বৃদ্ধ উত্তর করল, চতুর্থ ধাঁধাটি না জানা পর্যন্ত পারব না।

চতুর্থ রাজা বলল, আমি গ্রাহ্য করি না তোমাদের। 

রাক্ষসী বলল, আমি চতুর্থ ধাঁধাটি জানি। রাক্ষসী বৃদ্ধের কাছে গিয়ে তার কানে কানে কথাটা বলল। 

বৃদ্ধ হঠাৎ চিৎকার করে গম্ভীর গলায় বলল, সময় হয়ে গেছে। 

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কথাটার তীব্র প্রতিধ্বনি চারদিকে শোনা যেতে লাগল। প্রতিমূর্তিগুলো কাঁপতে লাগল। তখন বৃদ্ধ লোকটি পশ্চিম দিকে ও রাক্ষসী পূর্ব দিকে চলে গেল। 

বৃদ্ধ বাতি হাতে যেদিকেই যেতে লাগল সেদিককার সব পাথর সোনা, সব গাছ রূপো আর সব জীবজন্তু মূল্যবান ধাতুতে পরিণত হয়ে উঠল। কিন্তু তার বাতির আলো অন্য কোনও আলোর কাছে কাজ করে না। শুধু এক নরম আলো বিকীরণ করে। বৃদ্ধ তাঁর কুঁড়েঘরে ফিরে দেখল তার স্ত্রী বসে বাসে কাঁদছে। তার স্ত্রী বলল, তোমাকে আজ বাইরে যেতে দিয়ে কি ভুলই না করেছি। 

বৃদ্ধ বলল, কি হয়েছে? বৃড়ি বলল, দুজন পরী এসে আমাদের দেওয়ালে যে সব সোনা ছিল তা সব তুলে নিয়েছে। পরে তারা গা ঝাড়া দিতে কিছু সোনার টুকরো তাদের গা থেকে ঝরে পড়ে আর তাই থেকে একটা টুকরো আমাদের প্রিয় কুকুর খেয়ে ফেলতেই সে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। এতে আমার মনে দারুণ দুঃখ হয়। এমন জানলে আমি তাদের ঘাটের মাঝিকে তাদের ঋণ শোধের দায়িত্ব নিতাম না। 

বৃদ্ধ বলল, ঋণটা কি?

বুড়ি বলল, তিনটে পিঁয়াজ আর তিনটে করে দুরকমের ফুল। 

বৃদ্ধ বলল, তুমি তোমার কথামতো তাদের কাজ দেবে। ওরা সাধ্যমতো আমাদের উপকার করবে। 

বুড়ি বলল, আমি কাল সকালেই নদীর ধারে মাঝিকে তা দিয়ে দেব। 

বৃদ্ধের ঘরের ভিতর এতক্ষণ যে আগুন জ্বলছিল তা নিবিয়ে যেতে বৃদ্ধ তার বাতিটা আবার জ্বালল। সেই রহস্যময় বাতির আলোয় চারদিকের পাথরের দেওয়ালগুলো সব সোনা হয়ে গেল। আর তাদের মরা কুকুর হয়ে উঠল অতি মূল্যবান এক উজ্জ্বল ধাতু। বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে বলল, একটি ঝুড়িতে এই মূল্যবান পাথরটি আর ফুলগুলো সাজিয়ে তুমি পদ্মের কাছে চলে যাও। রাক্ষসীর পিঠে নদীর ওপারে গিয়ে তুমি চলে যাবে সুন্দরী পদ্মের প্রাসাদে। যে পারথটিকে একবার ছুঁলেই আমাদের কুকুর আবার প্রাণ ফিরে পাবে। পদ্মকে বলবে, তার দুঃখের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তার সব বিপদ সব দুঃখ সুখে পরিণত হবে। 

বুড়ি তার ঝুড়িতে সব কিছু সাজিয়ে সকাল হতেই বার হয়ে পড়ল তার কুঁড়ে থেকে। এ ঝুড়িতে মরা কোনও জীবজন্তু একেবারে হালকা হয়ে যায়। কিন্তু কোনও টাটকা শাকসজী ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। বুড়ির তাই ঝুড়ি মাথায় পথ হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। নদীর কাছাকাছি যেতেই বুড়ি দেখল, সেই দৈত্যটা নদীর জল থেকে উঠে আসছে। সে বুড়ির কাছে এসে তার ঝুড়ি থেকে একটা করে ফুল খেয়ে ফেলল। 

বুড়ি একান্তে ভাবল তার বাগানে গিয়ে ফুলগুলো আবার নিয়ে আসবে। কিন্তু ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় কেটে গেল। এদিকে ফেরিঘাটের মাটিও এসে গেল। মাঝির নৌকোতে এক পথিক ছিল। মাঝিকে দেখে বুড়ি বলল, সেই পরীদের ঋণ মেটাতে এসেছি। এই নাও তোমার জিনিস। কিন্তু মাঝি দুটি করে ফুল দেখে রেগে গেল। বুড়ি অনুনয় বিনয় করে বলল, এখন থেকে নয় ঘণ্টার মধ্যে আমি বাড়ি থেকে বাকি ফুলগুলো এনে দেব। কিন্তু মাঝি বলল, নদীর ভাগ না নিয়ে আমি এর থেকে কিছু নিতে পারব না। তুমি তাহলে নদীর জলে তোমার হাত ডুবিয়ে শপথ করো, তুমি বাকি ফুল এনে দেবে যথাসময়ে। 

বুড়ি তাই করল। কিন্তু জল থেকে হাতটি বার করে আনতে দেখল তার ফর্সা হাতটা কালো হয়ে গেছে। মাঝি বলল, তুমি ঋণ শোধ করে দিলেই হাতটা আবার সাদা হয়ে উঠবে। না দিলে ঐ রকমই রয়ে যাবে চিরকাল। 

বুড়ি বলল, না, আমি ঋণ শোধ করে দেব। এই বলে সে ঝুড়ি নিয়ে চলে গেল। ফুল না থাকায় ঝুড়িটা খুব হালকা বোধ হচ্ছিল। সে নদীর ধার দিয়ে যেতে যেতে দেখল মাঝি যে যুবক পথিককে নদী পার করে এনেছিল সেই যুবকটি নদীর বালুচরের উপর দিয়ে কোথায় হেঁটে চলেছে। যুবকটি দেখতে খুব সুন্দর। তার সঙ্গে কথা বলার অনেক চেষ্টা করল বুড়ি। কিন্তু যুবকটি হেঁটে যেতে লাগল। অবশেষে বুড়ি তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে হাঁটাতে পেরে উঠবে না। আমি সবুজ রাক্ষসীর সাহায্যে নদী পার হয়ে সুন্দরী পদ্মের কাছে যাব। 

এ কথা শুনে যুবক বলল, আমিও যাব সেখানে। কিন্তু কি উপহার নিয়ে যাচ্ছ? 

বুড়ি বলল, আমি আমার গোপন কথা কিছুই বলব না যদি তুমি তোমার কথা না বল। 

বুড়ি প্রথমে তার সব কাহিনী বলতে যুবকটি ঝুড়ি থেকে পাথরের মপকে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। সে বলল, আমারও একদিন রাজ্য ছিল, ধনদৌলত ছিল। কিন্তু এখন আমার কিছুই নেই। আমি একেবারে নিঃস্ব। 

কিন্তু তার নিজের জীবনকাহিনীর কথা কিছু বলল না। বুড়ির কৌতূহল কিন্তু মিটল না। যুবকটি বরং বুড়ির কাছে জানতে চাইল, বাতি হাতে সেই বৃদ্ধ লোকটি কে, সেই রহস্যময় বাতির আলোর অর্থ কি এবং তার দুঃখের শেষ কি করে হবে। 

কথা বলতে বলতে দূরে নদীর উপর এক বিরাট সেতু দেখতে পেল তারা। সেতুটা সূর্যের আলোয় অতিশয় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এত উজ্জ্বল বস্তু কখনও তারা দেখেনি। 

তারা পান্নার মতো সবুজ ও উজ্জ্বল সেতুর উপর দিয়ে নদী পার হয়ে লাগল। কিন্তু ওপারে না পৌঁছুতে সেতুটা সেই সবুজ রাক্ষসীর চেহারায় পরিণত হলো। সে তখন তার পিঠে করে তাদের ওপারে পৌঁছে দিল। তারা ধন্যবাদ দিল রাক্ষসীকে। 

এখান থেকে ওরা যাবে পদ্মের প্রাসাদে। তারা সেখানে কোনও লোক চোখে না দেখলেও কাদের ফিসফিস কথা কানে এল তাদের। বুঝল আরও জনকতক লোক পদ্মের কাছে যাবে সন্ধের সময়। 

ঝুড়ি নিয়ে বুড়ি সন্ধে হতেই পদ্মের বাগানে চলে গেল একা। সে দেখল পদ্ম বীণা সহযোগে গান গাইছে আর গানের সুরের যাদুতে মাতাল হয়ে উঠছে চারদিকের বাতাস, হ্রদের জলে ঢেউ জাগছে। বুড়ি বলল, তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তার থেকে তুমি এখন অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছ পদ্ম। 

পদ্ম নিজের প্রশংসা মোটেই শুনতে চাইল না। সে বলল, আমার একটি ছোট পাখি ছিল। আমার বীণার উপর বসে গান করত। একটু আগে সে মারা যায়। তার কবর থেকে আর একটি গাছ গজিয়ে উঠবে আমার বাগানে। আমি যাদের ভালোবাসি তাদের মৃতদেহ কবর দিয়ে তার উপর একটি গাছের চারা বসাই। 

বুড়ি বলল, সে কোনও দুঃখ ও বিপর্যয়ের অবসান হবেই। তারপরেই আবার সুখ। কোনও চিন্তা নেই। আমি তাহলে চলি। নদীকে আমার প্রতিশ্রুত ফুলগুলো এনে না দিলে আমার হাতটা এমনি কালো আর ছোট রয়ে যাবে। 

যাবার সময় ঝুড়ি থেকে সেই পাথরটা বার করে বলল, এটা আমার স্বামী উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছে তোমাকে। আমাদের কুকুর মপ পাথর হয়ে গেছে। একে তুমি জীবন দান করে নিজের কাছে রেখে দেবে। এ তোমাবে বড় আনন্দ দেবে। আমরা। তাতেই সুখী হব। 

পদ্ম বলল, তুমি তাহলে আমার পাখিটিকে নিয়ে যাও। তোমার স্বামীকে বলে এর মৃতদেহটিকে পাথরে পরিণত করে দেবে। পরে আমি একে জীবন দান করে আবার পাখিতে পরিণত করব। তখন এই পাখি আর তোমাদের মপ আমার কাছে থেকে আমাকে আনন্দ দান করবে। 

বুড়ি ঝুড়ি মাথায় করে চলে যেতেই সবুজ রাক্ষসী এসে হাজির হলো। এসে পদ্মকে বলল, মন্দির নির্মিত হয়ে গেছে। 

পদ্ম বলল, কিন্তু সে মন্দির নদীর উপরে দাঁড়িয়ে নেই কেন?

রাক্ষসী বলল, আমি রাজাদের সঙ্গে দেখা করেছি ও কথা বলেছি। 

পদ্ম বলল, কখন তারা জানাবে?

রাক্ষসী বলল, আমি নিজের কানে এক আকাশবাণী শুনেছি, সময় হয়ে গেছে। আর দেরি নেই। 

পদ্মের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এমন সময় তার তিনজন সহচরী এসে প্রস্তুত হয়ে উঠল তার সেবার জন্য। পদ্ম তখন সেই পাথরটার উপরে ঝুঁকে কি করতেই মপ বেঁচে উঠল। মপকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠল পদ্ম। চমৎকার দেখতে কুকুরটা। তাকে কোলে নিয়ে মাঝে মাঝে বুকে চেপে ধরে চুম্বন করতে লাগল। মপকে পেয়ে বেশ খুশিমনে খেলা করছিল পদ্ম। কিন্তু হঠাৎ সেই বিষণ্ণ যুবকটি এসে পড়ায় বাধা পেল পদ্ম। যুবকের হাতে ছিল সেই বাজপাখিটা যে পদ্মের ছোট পাখিটাকে আজই হত্যা করে। 

যুবকের হাতে বাজপাখিটিকে দেখেই রেগে গেল পদ্ম। বলল, ও পাখি নিয়ে এখানে আসা তোমার উচিত হয়নি। 

যুবক বলল, এর জন্য আমার পাখিকে দোষ না দিয়ে তোমার ভাগ্যকে দোষ দেওয়া উচিত। 

এদিকে পদ্মের আদর পেয়ে মপের সাহস বেড়ে যাচ্ছে। সে আরও আদর চাইতে লাগল পদ্মের কাছে। পদ্মও তার ঘাড়ে-মাথায় হাত বোলাতে লাগল। এবার হাততালি দিয়ে মপকে যেতে বলল পদ্ম। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছুটে গিয়ে ফিরিয়ে আনল। তারপর তাকে কোলে নিয়ে বসিয়ে বুকের উপর চেপে ধরে ঠোঁট দিয়ে চুম্বন করতে লাগল। 

যুবকটি তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল বিস্ময়ে। সে বলল, আমি তোমার জন্য সর্বস্বান্ত হয়েছি। আমাকে কি এই দৃশ্য দেখতে হবে? সামান্য একটা ইতর প্রাণী তোমার ভালোবাসা, তোমার বুকের স্বর্গ আর চুম্বন আলিঙ্গনের মাধুর্য লাভ করেছ তা আমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে? আমি কি তাহলে ঐ মাধুর্য লাভ হতে বঞ্চিত হয়ে নদীতীরের নির্জন পথ ধরে অজানার দিকে চলে যাব? না তা যাব না, তোমার বুকে যদি পাথর থাকে তাহলে আমি সে পাথরে পরিণত হব। তোমার স্পর্শে যদি মৃত্যু থাকে তাহলে আমি সেই মৃত্যু লাভ করব। 

এই বলে পদ্মের দিকে এগিয়ে গেল যুবকটি। পদ্ম হাত বাড়িয়ে নিষেধ করতে লাগল। কিন্তু যুবকটি তা শুনল না। অবশেষে পদ্মকে জোর করে স্পর্শ করতেই যুবকটির প্রাণহীন দেহটি ঢলে পড়ল মাটিতে। শোকে-দুঃখে চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল পদ্মর। তার সহচরীরা তাকে হাতির দাঁতের চেয়ারে বসিয়ে বীণা বাজিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে লাগল। রাক্ষসী বলল, বাতি হাতে সেই বৃদ্ধকে ডেকে পাঠাও। এখনও আশা আছে। 

এমন সময় ঝুড়ি মাথায় সেই বুড়ি এসে হাজির হলো। বলল, নদীর কাছে আমি ঋণী বলে মাঝি বা দৈত্য আমাকে নদী পর করতে চাইছে না। এদিকে আমার হাতটা আরও কালো ও ছোট হয়ে যাচ্ছে। 

রাক্ষসী বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে, কোনও চিন্তা নেই। তুমি তোমার স্বামীকে পাঠিয়ে দাওগে। তুমি যাও, সেই পরীদের দেখতে পাবে। চোখে না দেখলেও তাদের কথা শুনতে পেয়ে অনুরোধ করবে। তারা অথবা দৈত্য তোমাকে নদী পার করে দেবে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে একটি বাজপাখি দেখতে পেল রাক্ষসী। তার লালচে পাখাগুলো সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। তারপরেই বাতি হাতে সেই বৃদ্ধ এসে হাজির হলো। তাকে দেখে পদ্ম বিশেষ খুশি হলো। বলল, এত তাড়াতাড়ি কেমন করে তুমি এলে? 

বৃদ্ধ বলল, আমার হাতের বাতি যখন নিভে আসে তখন আমি বুঝতে পারি কোথাও আমার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আর তখনি আমি আকাশে মুখ তুলে তাকাই। দেখি একটি বাজপাখি আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

যাই হোক, বাতি হাতে বৃদ্ধ একটি উঁচু পাথরের উপর বসে রাক্ষসীকে বলল, তুমি সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে মৃতদেহকে ঘিরে থাকো। পদ্মের মৃত পাখিটাকেও ওই কুণ্ডলীর মধ্যে এনে দাও।

ইতোমধ্যে বুড়ি একটি ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিল। বৃদ্ধ তার বাতির আলো কুণ্ডলীপরিবৃত যুবকের মৃতদেহের উপর ফেলতে লাগল। কিন্তু রাত্রি ঘন হয়ে ওঠায় তখন কিছু হলো না। এমন সময় পরীরাও এসে হাজির হলো। রাত্রিতে শুধু পরীরা। ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। বৃদ্ধের বাতির আলো ছাড়াও পদ্ম আর পরীদের গা থেকে জ্যোতি বার হচ্ছিল। সকাল হতে একটি মিছিল করে সার দিয়ে সবাই নদীর দিকে এগিয়ে চলল। প্রথমে পরীরা, পরে ঝুড়ির ভিতর মৃতদেহ ও সেই মৃত পাখিটা ভরে তাই মাথায় করে বৃদ্ধা প্রতিবেশিনী রাক্ষসী, বাতি হাতে বৃদ্ধ, সুন্দরী পদ্ম আর তার সহচরীরা। 

রাক্ষসী সেতুর রূপ ধারণ করে ওদের সবাইকে নদী পার দিল। নদীর ওপারে গিয়ে রাক্ষসী বলল, আমি নিজের জীবন দিয়ে ওদের বাঁচাব। তারপর পদ্মকে বল, তোমার দুটি হাতে একটি মৃতদেহের উপর আর একটি হাত আমার উপর রাখো। 

পদ্মর একটি হাতের স্পর্শে যুবক ও তার সেই পাখিটি বেঁচে উঠল। যুবক উঠে দাঁড়াল। তবে তার স্মৃতি তখনও ফিরে আসেনি। আর একটি হাতের স্পর্শে রাক্ষসীর অসংখ্য মূল্যবান ধাতুর টুকরো ঝুড়িতে ভরে ভাসিয়ে দেওয়া হলো নদীর জলে। 

এরপর বৃদ্ধ পরীদের বলল, আমি তোমাদের সেই মন্দিরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব। তোমাদের কাছে আছে মন্দিরের চাবিকাঠি। তোমরা চাবি খুলে দিলে আমরা প্রবেশ করব তার মধ্যে। 

ওরা গিয়ে দরজা খুলে মন্দিরের ভিতরে ঢুকতেই সোনার রাজা বলে উঠল, কোথা হতে আসছ তোমরা? 

বৃদ্ধ তার বাতি হাতে বলল, পৃথিবী হতে।

রূপের রাজা বলল, কোথায় যাবে তোমরা?

বৃদ্ধ উত্তর করল, পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি।

পিতলের রাজা বলল, কি চাও তোমরা আমাদের কাছে?

বৃদ্ধ বলল, তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি। 

চতুর্থ রাজা কি বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সোনার রাজা বলল, তোমরা চলে যাও। আমার এ সোনা তোমাদের জন্য নয়। 

এরপর তারা রূপোর রাজার কাছে গেল। রাজা বলল, আমি তোমাদের খাওয়াতে পারব না। তোমরা অন্য কোথাও যাও। 

এরপর তারা চতুর্থ রাজার কাছে যেতে রাজা জিজ্ঞেস করল, কে বিশ্বকে শাসন করবে? 

বৃদ্ধ উত্তর করল, যে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। 

রাজা বলল, তাহলে সে হচ্ছে আমি। বৃদ্ধ বলল, সময়ে হয়ে গেছে। কিন্তু পরেই দেখা যাবে। 

পদ্ম তখন চতুর্থ রাজার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে তাকে চুম্বন করল। হে দয়ালু পিতা, তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। এই বলে মূর্তিটাকে জড়িয়ে ধরল পদ্ম। গোটা পৃথিবীটা কেঁপে উঠল। গোটা মন্দিরটা ভয়ঙ্করভাবে দুলতে লাগল। যুবকটি ভরে বুড়িকে জড়িয়ে ধরল। 

এবার ওরা বুঝতে পারল মন্দিরটা একটা বিরাট জলজাহাজের মতো এগিয়ে চলেছে। বৃদ্ধ বলল, আমরা নদীর উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা শীঘ্রই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছব। 

মন্দিরের কড়িবরগাগুলা ভেঙে পড়তে লাগল। যুবককে তার পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিতে লাগল বৃদ্ধ। বুড়ির কাছে ছিল পদ্ম। হঠাৎ গুপ্ত পাহাড়ে ধাক্কা লাগা জাহাজের মতো আটকে গেল চলমান মন্দিরটা। ওরা অন্ধকারে বুঝতে পারল এটা কুঁড়েঘরের সামনে এসে পড়েছে ওরা। ঘরটা ভিতর থেকে বন্ধ। একটা বাতি জ্বলছে ঘরের ভিতরে। 

দরজা খুলে গেলে দেখা গেল সেখানে ফেরিঘাটের মাঝি রয়েছে। বৃদ্ধ তার বাতির আলো দেখাল। যুবক একটি জায়গায় বসল। পদ্মকে বসাতে হলো অন্য জায়গায়। বৃদ্ধা বলল, আমার হাতটা কালো হয়ে রইল। ছোট হতে হতে এটা এবার উবে যাবে।

বৃদ্ধ বলল, সকালের আলো ফুটে উঠতেই নদীতে স্নান করে আসবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। 

বৃদ্ধা ভয়ে ভয়ে বলল, নদীর ঋণ শোধ করা হয়নি। স্নান করলে আমার গোটা দেহ কালো হয়ে যাবে। 

বৃদ্ধ বলল, সব ঋণ শোধ হয়ে গেছে। 

সকাল হতে প্রথম সূর্যের আলো ফুটে উঠতেই বৃদ্ধ চিৎকার করে বলল, ‘জ্ঞানবিদ্যা, রূপ আর শক্তি-এই তিনটি জিনিসই পৃথিবীকে চালায়। এই তিনটি শব্দের নাম করার সঙ্গে সঙ্গে সোনার, রূপোর ও পিতলের তিনজন রাজা উঠে একে একে। কিন্তু চতুর্থটি মাটির তলায় ঢুকে গেল। 

এরপর বৃদ্ধ লাঠি হাতে যুবককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। পিতলের রাজার সামনে এসে থামল ওরা। রাজা যুবককে বলল, বাঁ হাতে এই অস্ত্র ধারণ করো। ডান হাতটি মুক্ত রাখো। 

পরে ওরা রূপের মূর্তির কাছে গেছে মূর্তিটি তার হাতে রাজদণ্ডটি দিয়ে বলল, তুমি আমার সব ভেড়া অর্থাৎ গবাদি পশুগুলো গ্রহণ করবে ও বেড়াবে। 

সোনার রাজা তার গলায় ওক পাতার মালা পরিয়ে দিয়ে বলল, সব সময় মহানকে বরণ করে নেবে।

এবার বৃদ্ধ লক্ষ্য করল, তিন রাজার কাছ থেকে অস্ত্র, রাজদণ্ড আর মালা-এই তিনটি জিনিস পেয়ে যুবকটির দেহমনে একটি বিরাট পরিবর্তন এসেছে। অস্ত্র ও রাজদণ্ড লাভ করে সে দেহে পায় প্রচুর শক্তি। আর মনে পায় দৃঢ়তা। আর ওক পাতার মালাটি গলায় পরার সঙ্গে সঙ্গে মুখখানি হয়ে ওঠে অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল। এবার সে হারানো স্মৃতি ফিরে পায়। 

যুবকটি তখন আবেগের সঙ্গে বলে ওঠে, হে আমার প্রিয়তমা পদ্ম, তোমার খণ্ড অন্তরের সূচিতা ও ভালোবাসার থেকে পৃথিবীতে অন্য কি আকাক্ষার বস্তু থাকতে পারে? 

এরপর বৃদ্ধের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, হে আমার প্রিয় বন্ধু, আর একটি শক্তির কথা ভুলে গেছ তোমরা। তা হলো প্রেমের শক্তি। 

এই বলে যে অবগুণ্ঠিত পদ্মকে আলিঙ্গন করল। পদ্মের গাল দুটো লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। বৃদ্ধ হাসিমুখে বলল, প্রেম শাসন করে না, তবে নিয়ন্ত্রিত করে। 

এতক্ষণ ওরা লক্ষ্য করেনি। এবার ওরা দেখল নদীর ধারে এক বিরাট সেতু নির্মিত হয়েছে। নদীর বুক থেকে স্তম্ভ গড়ে উঠে সে সেতুকে ধারণ করে আছে। তার উপর দিয়ে জলস্রোত এগিয়ে আসছে। অসংখ্য নরনারী এপারের সেই মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের নতুন রাজা ও রানিকে অভিবাদন জানাতে আসছে। 

বৃদ্ধ বলল, সেই রাক্ষসীর স্মৃতির প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা নিবেদন করো। কারণ সেই তোমাদের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন দান করে। এই নদীর সেতুও গড়ে উঠেছে তারই প্রচেষ্টায়। 

রানির মোট তিনজন সহচরী ছিল। একজন তার হাতির দাঁতের চেয়ার, একজন পাখা আর একজন বীণা ধারণ করে থাকত। অবশ্য আর একজন নূতন যুবতী সহচরীকে দেখা গেল। 

আর সে হচ্ছে সেই বৃদ্ধা। এখন যুবতীতে পরিণত হয়ে উঠেছে হঠাৎ। বাতি হাতে বৃদ্ধা তা দেখে বলল, তুমি এখন যুবতী হয়েছ, আগে আমার স্ত্রী ছিলে। এখন তুমি যে কোনও যুবককে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করতে পার আজকের এই শুভদিনে। 

যুবতী বলল, তুমি বুঝতে পারছ না তুমি নিজেও তো যুবক হয়ে উঠেছ। 

এদিকে সূর্য ক্রমশ আকাশের উপরে উঠতে লাগল। সেই বিরাট আকাশদৈত্যটা সেতুর উপর দিয়ে যেতে যেতে হাত দিয়ে সূর্যটা আড়াল করায় তার বিশাল হাতের কালো ছায়ায় অস্বস্তি অনুভব করছিল চলমান জনতা। অনেকে ভয়ে নদীর জলে পড়ে যাচ্ছিল। তাই দেখে নূতন রাজা দৈত্যকে আক্রমণ করার জন্য তরবারি নিষ্কাশন করতে যাচ্ছিল। কোমর থেকে কিন্তু বৃদ্ধ তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, ওর সময় হয়ে এসেছে। এখনি ওর ছায়া চিরতরে অপসারিত হবে। 

সত্যিই দৈত্যটি হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে গেল পথের উপর। তার বিপুলকার মৃতদেহটার চারদিকে ভিড় জমে উঠল কৌতূহলী মানুষের। 

অবশেষে জনতা নূতন রাজা ও রানিকে দেখার জন্য মন্দিরের দিকে আসতে লাগল। রাজা ও রানিকে দর্শন করে ফিরে যাবার পথে জনতা অবাক চোখে দেখল তাদের পথে সোনার টুকরো ঝরে পড়ছে। শুধু একবার নয়, পথের কয়েক জায়গায় কয়েকবার এই ঘটনা ঘটল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *