উইলেম মেস্তার (উপন্যাস)

উইলেম মেস্তার (উপন্যাস)

প্রথম পরিচ্ছেদ

নাটকটা ভাঙতে দেরি হচ্ছিল। সাজঘরের জানালা দিয়ে মঞ্চের দিকে বারবার তাকাচ্ছিল বারবারা। আজ তার মালিক সুন্দরী মেরিয়ানা এক ছোকরা অফিসারের অভিনয় করে প্রচুর আনন্দ দান করেছে দর্শকদের। কিন্তু মেরিয়ানার জন্য বারবারা অধৈর্য হয়ে পড়েছে অন্য কারণে। মেরিয়ানার গুণে মুগ্ধ ধনী ব্যবসায়ীর পুত্র নৰ্বার্গ একটা প্যাকেট পাঠিয়েছে ডাকে। 

প্যাকেটটা খুলে দেখেছে বারবারা। মেরিয়ানার পুরনো পরিচারিকা হিসেবে এ অধিকার তার আছে। দেখেছে তাতে আছে মসলিনের কাপড়, ক্যালিকোর ছিট আর কিছু ভালো নূতন ধরনের ফিতে আর কিছু টাকা। নবার্গকে নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই বারবারার। কি করে মেরিয়ানার চোখে নৰ্বার্গকে ভালো লাগানো যায়, কি করে তার মনে নৰ্বার্গের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ জাগানো যায় এই চিন্তায় সব সময় কাতর সে। 

খ্রিস্টোৎসবের উপহারের মতো নৰ্বার্গের সব উপহার টেবিলের উপর থরে থরে সাজিয়ে রাখল বারবারা। তারপর উৎকর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল মেরিয়ানার পদধ্বনির। কিন্তু যার জন্য এত কাণ্ড সে একবার ফিরেও তাকাল না এই সব উপহারের পানে। মেরিয়ানা ঘরে ঢুকে আপনার মনে চঞ্চলভাবে পায়চারি করতে লাগল ঘরময়। কোনও দিকে তাকাল না। বারবাবার দিকেও না। বারবারা একবার জিজ্ঞাসা করল, কি বাছা, তোমার শরীর খারাপ করেনি তো? একবার চেয়ে দেখো, নৰ্বাৰ্গ কি পাঠিয়েছে। এতে তোমার ভালো নাইটগাউন হবে। 

মেরিয়ানা বলল, নৰ্বার্গ যখন আসবে তখন তোমরা যা বলবে করব। কিন্তু এখন আমাকে জ্বালিও না। এখন আমি শুধু একমাত্র তাকে ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসে। 

প্রতিবাদে ফেটে পড়তে চাইছিল বারবারা। কিন্তু মেরিয়ানা আদরের ভঙ্গিতে তার বুকটা জড়িয়ে ধরতেই হেসে ফেলল ফোকলা দাঁতে। বলল, এখন পুরুষের পোশাকটা ছেড়ে ফেলো তো বাছা। ও পোশাকে তোমাকে মোটেই মানায় না। 

এই বলে বারবারা মেরিয়ানার পায়ে হাত রাখতেই হাতটা সরিয়ে দিল মেরিয়ানা। বলল, এখন নয়, এখন আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। 

বারবারা বলল, কেউ আসবে? ছোকরা মেস্তার? সেই ব্যবসায়ীর বকাটে নিঃস্ব ছেলেটা? উদারতার একটা আবেগ পেয়ে বসেছে তোমায়। যত সব নিঃস্ব অপদার্থ ছোঁড়াদের সঙ্গে তোমার কারবার বেশি। অবশ্য পরের উপকার করে নাম কেনার মধ্যে একটা মোহ আছে। 

সে কথায় কান না দিয়ে মেরিয়ানা বলল, আমি তাকে ভালোবাসি। দারুণ ভালোবাসি। আমি যদি তার গলাটা এই মুহূর্তে জড়িয়ে ধরতে পারতাম।! আমি যদি তাকে সারাজীবন ধরে রেখে দিতে পারতাম। 

বারবারা শান্তভাবে বলল, সংযত করো নিজেকে। একপক্ষ কালের মধ্যে নবার্গ এসে পড়বে। তার আগে আজ একটা প্যাকেট পাঠিয়েছে সে। 

একপক্ষ কাল অনেক দেরি। তার আগে অনেক কিছু ঘটতে পারে। 

এমন সময় উইলেম মেস্তার মেরিয়ানার ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে বারবারা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে অন্তরে চাপা বিক্ষোভ নিয়ে। 

পরের দিন সকালে মার সঙ্গে দেখা হতে উইলেমকে তার মা বলল, তার এত ঘন ঘন থিয়েটারে যাওয়ার জন্য তার বাবা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছেন তার উপর। অবশ্য আমি নিজেও মাঝে মাঝে যাই। তবু আমি থিয়েটারের ব্যাপারটাকে ঘৃণা করি। এতে আমাদের গৃহকোণের শান্তি অনেকখানি নষ্ট হচ্ছে। 

উইলেম বলল, বাবা আমাকে একথা অনেক আগেই বলেছেন। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো মা, যে কাজ সঙ্গে সঙ্গে টাকা-পয়সা এনে দেয় সে কাজ ছাড়া জীবনে কি কিছু করার নেই আমাদের? অপ্রয়োজনীয় কোনও বস্তুতে যদি কোনও আনন্দ না থাকে তাহলে বাবা কেন এই নতুন বাড়িটা করে ঘরগুলো এমন করে সাজিয়েছেন? আমাদের পুরনো বাড়িটাতে তো বেশ চলে যাচ্ছিল। প্রতি বছর বাবা কি তাঁর ঘরগুলো অলঙ্করণের জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেন না? এসবও থিয়েটারে যাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয়। তার থেকে থিয়েটারে দেখবে একই সঙ্গে আনন্দ ও শিক্ষার উপকরণ অনেক পাওয়া যায়। 

মা বললেন, থিয়েটারে যাও ক্ষতি নেই, তবে বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তোমার বাবা মনে করেন, এতে তোমার মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর তার জন্য দোষ পেতে হচ্ছে আমাকে। আজ হতে বারো বছর আগে একবার আমি তোমাকে পুতুলনাচ দেখাই তখন তার জন্য আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়। 

উইলেম তাড়াতাড়ি বলল, বেচারা পুতুলগুলোকে দোষ দিও না মা। ফাঁকা ফাঁকা বাড়িটার মধ্যে সেই পুতুলনাচ দেখে তখন প্রচুর আনন্দ পাই। গোলিয়াথ নামে একটা বিরাট রাক্ষস সারা রাজ্যটাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছিল। তখন ডেভিড এসে রাজাকে বলল, সে যুদ্ধ করে হারাবে রাক্ষসকে। এর পরেই যবনিকা পতন হলো। আমাদের কৌতূহল আর ধরে না। পরে যখন এই ডেভিড রাক্ষসটাকে মেরে তার মাথাটা রাজার কাছে পাঠিয়ে দিল আর তার মাংসগুলো মাঠে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠি আমরা। তার বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ সুন্দরী রাজকন্যাকে লাভ করে ডেভিড। 

তবে তার চেহারাটা খুবই বেঁটে দেখে একটু হতাশ হয়েছিলাম আমি। 

মা বললেন, আমি জানি, এটা তোমার মনে একেবারে গেঁথে গিয়েছিল পরে তুমি কতবার মোম দিয়ে ডেভিড আর গোলিয়াথের মূর্তি বানিয়ে আলপিন ফুটিয়ে গোলিয়াথকে মারতে। তবে তার জন্য আমাকে অশান্তি ভোগ করতে হয়। 

উইলেম বলল, এর জন্য অনুশোচনা করো না মা। এই পুতুলনাচের কথা ভাবতেও আমার ভালো লাগে। এই কথা বলেই চাবি এনে আলমারি খুলে কাপড়ের পুতুলগুলোকে বার করল উইলেম। তার মনটা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল সেই সূদুর শৈশবে, অনাবিল সুখশান্তি আর সৌন্দর্যে ভরা এক কল্পলোকে। 

স্বভাবত বড় কল্পনাপ্রবণ উইলেম। কোনও বস্তুকে তার ভালো লাগলেই কল্পনার রং-রস দিয়ে তাকে আরও বেশি সুন্দর করে তুলত মনে মনে। প্রথম আলাপেই ভালোবেসে ফেলে সে থিয়েটারের পেশাদার অভিনেত্রী মেরিয়ানাকে। তার স্বাভাবিক নাট্যপ্রীতি নৈশ রঙ্গশালার উজ্জ্বলতা ও ঐশ্বর্যের সঙ্গে মিলে মিশে এই ভালোবাসাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য এর সঙ্গে তার প্রতি মেরিয়ানার আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ ও আগ্রহের নিবিড়তাও একটা মিষ্টি গভীরতা এনে দেয় তার ভালোবাসার মধ্যে। মেরিয়ানা সত্যিই তাকে যেন একটু বেশি খাতির ও আদরযত্ন করত। উইলেমের ভালোবাসার প্রতিদান একটু বেশি করেই দিত মেরিয়ানা। তাকে কাছে পেলে ছাড়তে চাইত না, অধীর আগ্রহে, তার জন্য প্রতীক্ষা করত। তবে উইলেম হয়ত লক্ষ্য করেনি মেরিয়ানার চিন্তায় ও আচরণে একটা গভীর উদ্বেগ উঁকি মারত মাঝে মাঝে। প্রায়ই ভয় হতো মেরিয়ানার তার প্রকৃত অবস্থার কথাটা হয়ত একদিন জেনে ফেলবে উইলেম। 

পূর্বরাগের উচ্ছ্বাসটা উইলেমের মনে কিছুটা থিতিয়ে গেলে ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখল সে। কিন্তু তাতে তার ইচ্ছাটা হয়ে উঠল আরও তীব্র আর সঙ্কল্পটা হয়ে উঠলও আরও অটল। মেরিয়ানার কাছে নিয়মিত যাবার এক পরিকল্পনাও খাড়া করল উইলেম। ঠিক করল সারাদিন কাজকর্ম সারার পর সন্ধ্যার পর বাড়িতে খাওয়ার টেবিলে যথারীতি উপস্থিত থাকবে। বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে খাবে। তারপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে খামারবাড়ি দিয়ে চুপিসারে যাবে রাতে। সোজা চলে যাবে মেরিয়ানার কাছে। 

একদিন মেরিয়ানার বাসায় কতকগুলো পুতুল নিয়ে গেল উইলেম। প্রথমে পুতুলগুলোকে নিয়ে নিজেই খেলা করতে লাগল মেরিয়ানা। তাদের প্রেমের কথা শেখালে লাগল। পরে তার আদর গিয়ে পড়ল পুতুলের মালিকের উপর। এমন সময় রাস্তায় গোলমালের শব্দ শোনা গেল। বারবারা বলল, একদল লোক হোটেল থেকে বেরিয়ে মদের নেশায় মাতলামি করছে। 

মদের কথা শুনে উইলেম কিছু পয়সা দিয়ে বারবারাকে বলল, আমাদের জন্যও কিছু মদ নিয়ে এস। আমাদের সঙ্গে তুমিও খাবে। 

খাবার সময় বারবারা পুতুলনাচের কথাটা তুলল উইলেমের কাছে। উইলেম তার সেই ছোটবেলাকার পুতুলনাচের কথাটা নূতন করে শোনাতে লাগল। সেই সঙ্গে তার বাবার অনুশাসন কথাটাও বলল। বলল, বাবা এসব মোটেই পছন্দ করতেন না। একবার পুতুলনাচের একটা অনুষ্ঠানের সময় বাবা সব পুতুলগুলো কেড়ে নেন। আমি মাকে তা বলায় মা চেষ্টা করেও বাবার মন ঘোরাতে পারেন নি। বেশি আনন্দ বা ফুর্তি ভালো নয়। সব আনন্দানুষ্ঠাই ভালো নয়। ছেলেরা তো দূরের কথা ভালো-মন্দ জ্ঞান বুড়োদেরও নেই। 

আমাদের নূতন বাড়িটা হবার সময় একজন ইঞ্জিনিয়ার বাবাকে বিশেষ সাহায্য করেন। তাঁর সঙ্গে বাবার বন্ধুত্বও ছিল। তিনি একবার জোর করে আমাদের বাড়ির ছাদে একটা পুতুলনাচের ব্যবস্থা করেন। তাঁর পীড়াপীড়িতে বাবা মত দিতে বাধ্য হন। পাড়ার ছেলেদের সব নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অনেক দিন পর আবার পুতুলনাচ দেখলাম। পুতুলনাচ দেখতে আমার বড় ভালো লাগত। যদিও আড়াল থেকে মানুষেরা পুতুলগুলোকে নাড়াত, নিজেরাই কথা বলত, তবু অনুষ্ঠান আরম্ভ হলে আমার মনে হতো পুতুলগুলো সব জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ওরা নিজেরা চলাফেরা ও অঙ্গভঙ্গি করে। অভিনয় করছে, কথা বলছে, হাসছে, কাঁদছে মানুষের মতো। সে এক বিপুল আনন্দমেশানো বিস্ময়। সে বিস্ময়ে শিহরণ লেগেছিল আমার সর্বাঙ্গে। 

এইভাবে একে একে মেরিয়ানাকে ছেলেবেলাকার প্রধান প্রধান সব ঘটনা, সব ভালো লাগা মন্দ লাগার কথা একের পর এক করে বোঝাতে লাগল উইলেম। শোনাতে শোনাতে রাত বাড়তে লাগল। ঘুমে চোখ দুটো জড়িয়ে এল মেরিয়ানার। তবু সেদিকে কোনও খেয়াল নেই উইলেমের। শুনতে শুনতে ঘুমভেজা চোখে মেরিয়ানা যখন তার উপর ঢলে পড়ল তখন শুধু তাকে আরও টেনে নিল বুকের কাছে। 

আর পুতুলনাচের প্রতি আগ্রহ ও নাট্যপ্রীতির কথা বলতে গিয়ে নাট্যতত্ত্বের মধ্য চলে গেল উইলেম। বলল, ট্রাজেডি আমাদের ভালো লাগত না। ট্রাজেডির থেকে ভালো কমেডি লেখা অনেক কঠিন। কিন্তু হে আমার প্রিয়তমা, কোনও নাটক, কোনও কবিতা যতই ভালো হোক না কেন, আমাকে সেই সৌন্দর্যের জগতে নিয়ে যেতে পারবে না। কোনও কবিতার যাদু নয়, তোমার এই নিবিড় বাহুবন্ধনের মধ্যে যে উত্তপ্ত প্রাণস্পন্দন অনুভব করছি সেই প্রাণস্পন্দনই আমাকে নিয়ে যাবে মায়াময় এক চিত্র সৌন্দর্যের রাজ্যে। 

এই বলে মেরিয়ানাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল উইলেম। তার বাহুর চাপ আর কণ্ঠস্বরের আবেগসিক্ত তীব্রতায় জেগে উঠল মেরিয়ানা, জেগে উঠেই নিজের ভুল বুঝতে পারল সে। আর তা সংশোধনের জন্য আদর করতে লাগল উইলেমকে। 

এইভাবে মেরিয়ানার নিবিড় সান্নিধ্যের মধ্য দিয়ে রাতের পর রাত কেটে যেতে লাগল উইলেমের। মেরিয়ানাকে যখন প্রথম পায় উইলেম তখন পাওয়ার আনন্দের সঙ্গে আশঙ্কা ছিল। অন্তত সংশয় আর আশঙ্কা ছিল। মনে হতো হয়ত বা এ মিলন স্থায়ী হবে না। কিন্তু এইভাবে দিনের পর দিন নির্বিঘ্নে কেটে যাওয়ায় মনে সাহস বেড়েছে উইলেমের। মেরিয়ানার প্রতি তার যে ভালোবাসার ধারণাটা ভাসা ভাসা ছিল, আশা-আশঙ্কার আলো-ছায়ায় চঞ্চলভাবে কাঁপত অনুক্ষণ, আজ তা বিশ্বাসের দৃঢ় ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। 

উইলেমকে পেয়ে মেরিয়ানাও খুবই সুখী। উইলেমকে কাছে পেলে ছাড়তে মন চায় না তাকে। সে যতক্ষণ কাছে থাকে ততক্ষণ কখনও তার বাহুলগ্ন হয়ে, কখনও বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে থেকে, কখনও তার গলা জড়িয়ে কোনদিকে কাটিয়ে দেয় সময়টা। কিন্তু উইলেমের মতো মেরিয়ানার এই সুখ, মিলনের এই আনন্দ অনাবিল। নয়। উইলেম তার কাছ থেকে চলে গেলেই তীব্র অনুশোচনা জাগে মনে। নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে থাকে। ভাবে সে প্রতারণা করছে উইলেমের সঙ্গে আর উইলেমের ভালোবাসা পাওয়া মানেই প্রতারণার কাছে সফল হওয়া। এমনকি উইলেম যখন কাছে থাকে তখনও বুকে মুখ গুঁজে থেকে বা তার বাহুলগ্ন হয়েও এই আত্মধিক্কার, অনুশোচনার দংশন হতে রক্ষা পায় না মেরিয়ানা। সে যখনই নিজের অন্তরের পানে তাকিয়ে দেখে তখনই মনে হয় সেটা যেন একফালি শূন্য পতিত জমি। সেখানে দেবার মতো কিছুই নেই তার। মনে হয় একথা যখনি জানতে পারবে উইলেম তখনি সে ছেড়ে চলে যাবে তাকে। কিন্তু এই সংশয় আর শঙ্কার দুঃখ যতই প্রবল হয়ে ওঠে তার মধ্যে ততই সে আরও নিবিড়ভাবে সমস্ত অন্তর দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চায় উইলেমকে। তার ভালোবাসার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে চায় নিজেকে। 

সেদিন তার নিজের ঘরে কিছু বই ও কাগজপত্র ঘাঁটছিল, এমন সময় তার বন্ধু ওয়ার্নার এসে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলল, আবার ঐসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করছ? তুমি তো শুধু একটা কিছু লিখতে শুরু করবে, আর কিছু পরেই সেটা ফেলে রাখবে। কোনও একটা লেখা বা কাজ তুমি কখনও একেবারে শেষ করো না। এটা তোমার বড় দোষ। 

উইলেম বলল, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষ কোনো কাজে সফলতা লাভ করে পূর্ণতা লাভ করে। 

এই বলে উইলেম একটা নাটক বার করে দিল তার কাগজের স্তূপ থেকে। ওয়ার্নার সেটা দেখেই বলল ওটা ফেলে দাও, আগুনে পুড়িয়ে দাও। ও লেখাটা আমার বা তোমার বাবার কারোই ভালো লাগেনি। লেখার ছন্দটা ভালো হয়েছে, কিন্তু আসলে বক্তব্যটা বাজে। এতে তুমি যে আদর্শ ব্যবসায়ী চরিত্র এঁকেছ তা একেবারে অচল। 

উইলেম ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে বলল, তোমাদের মতো ব্যবসাদারেরা শুধু জীবনের পথটাকে বড় করে দেখে, কিন্তু জীবনের চূড়ান্ত অর্থের কথাটা তলিয়ে দেখে না। 

ওয়ার্নার বলল, আমার মনে হয় তুমিও আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের কাজকর্ম ও ভাবধারার প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল নও। যদি হতে তাহলে বুঝতে ব্যবসাগত কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের কত বড় বড় গুণ ও অন্তরবৃত্তি বিকাশলাভ করে। 

উইলেম বলল, অবশ্য আমি যে দেশভ্রমণ করতে চলেছি তাতে আরও কিছু শিক্ষা হবে আমার। আরও অনেক কিছু দেখতে পাব। বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে ওয়ার্নার বলল নিশ্চয়। তুমি যে কোনও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজারে গিয়ে দেখবে ব্যবসায়ীরা। আসলে কি চায়। নদী, সমুদ্র, আকাশ মাটির বেশির ভাগই তো পৃথিবীর রাজা রাজড়ারা অধিকার করে রেখে দিয়েছে। আমরা ব্যবসায়ীরা কিছু পণ্যদ্রব্য নিয়ে কেনাবেচা করে জীবনধারণের কিছু উপকরণ সংগ্রহ করতে চাই। পণ্যদ্রব্যের ক্রমাগত হাত বদল হচ্ছে। আর তার মধ্য দিয়েই ব্যবসায়ীরা কিছু লাভ করছে। তুমি কোনও শহরে গিয়ে দেখবে সব মানুষই কিছু না কিছু করছে। অসংখ্য কর্মব্যস্ত মানুষ নিরন্তর এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাচ্ছে। প্রত্যেকেরই একটা করে উদ্দেশ্য আছে, লক্ষ্য আছে। কর্মব্যস্ত সেই মানুষের ভিড়ের মধ্যে তুমিও নিজেকে মিশিয়ে দিতে পার। দেখবে তার মধ্যে সত্যিই আনন্দ আছে, দেখবে প্রতিটি পণ্যদ্রব্যের প্রচলনগতিই মানুষের জীবনকে গতি দান করে। অর্থ দান করছে। 

এ-কথার কোনও প্রতিবাদ করল না উইলেম। বাধা দিলো না কোনওরূপ। বুদ্ধিমান ওয়ার্নার বাধা না পেয়ে বলে যেতে লাগল, যারা পরিশ্রমী, কর্মঠ, বুদ্ধিমান, বাস্তববাদী, ভাগ্যদেবী তাদেরই মাথার উপর জয়ের মুকুট পরিয়ে দেন। জানবে প্রতিটি পণ্যের মূল্য বুঝে সময় বুঝে তাকে চালনা করা বড় কঠিন কাজ এবং এর জন্য প্রচুর বুদ্ধি এবং দূরদর্শিতার দরকার। তুমি তোমার কল্পনাশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি ও কাব্যপ্রতিভাকে যদি এইদিকে চালাতে পারতে তাহলে তুমিও অনেক কিছু করতে পারতে। যখন কোনো পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে নোঙর করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ী জাহাজ থেকে মাটিতে পা দেয়, তার জীবন ও পণ্যসম্পর্কিত অনিশ্চয়তা আর খেয়ালী সমুদ্রের কবল থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চিত মাটির জগতে ফিরে আসে তখন যেন সে নবজীবনের আনন্দে হয়ে ওঠে আত্মহারা, তখন তার সেই আনন্দ দেখে যে কোনও সাধারণ মানুষ ও আনন্দ লাভ না করে পারে না। তবে অবশ্য ব্যবসার ব্যাপারে এটাও ঠিক যে সব সময় অঙ্কের হিসাবে কাজ হয় না। অঙ্কের হিসাব যতই নির্ভুল হোক, ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন না হলে ব্যবসাতে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করা যায় না। 

দুজনের স্বভাবের মধ্যে কিছু অমিল থাকলেও উইলেম ও ওয়ার্নারের মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তেমনি তাদের বাবাদের মধ্যেও গড়ে উঠেছে দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব। ব্যবসাগত প্রবৃত্তির দিক থেকে উইলেমের বাবা বৃদ্ধ মেস্তার আর ওয়ার্নারের বাবা বৃদ্ধ ওয়ার্নার দুজনেই সমান। তবে বৃদ্ধ মেস্তার বেশ কৃপণ প্রকৃতির। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুব হিসেব করে চলেন। বাড়িতে বড় একটা কাউকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান না। বৃদ্ধ ওয়ার্নার কিন্তু একজন পাকা ব্যবসায়ী হলেও খাওয়ার ব্যাপারে অনেক উদার। আমোদ-প্রমোদের দিকেও তার নজর আছে। জীবনকে কিভাবে ভোগ করতে হয় তা তিনি জানেন। দুজনেই একই কারবারের শরিক। 

সেদিন বৃদ্ধ মেস্তার ও বৃদ্ধ ওয়ার্নার এক জায়গায় বসে কারবার সম্বন্ধে কথা বলছিলেন। মেস্তার তাঁর ছেলে উইলেম সম্বন্ধে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। বৃদ্ধ ওয়ার্নার পরামর্শ দিলেন, তোমার ছেলেকে একবার বাইরে পাঠিয়ে দাও। কাজকর্ম শিখুক। অনেক জায়গায় অনেক কোম্পানিতে আমাদের করবারের অনেক টাকা পড়ে আছে। সেই টাকাগুলো ও গিয়ে আদায় করুক, তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদের ব্যবস্থাগত সম্পর্কগুলো নূতন করে গড়ে উঠবে। 

বৃদ্ধ মেস্তার তাতে রাজি হলেন সঙ্গে সঙ্গে। ঘোড়ার জন্য আটকাচ্ছিল। কিন্তু মেস্তার ঠিক করলেন আগামী পরশু দিন সোমবারেই উইলেম চলে যাক। 

উইলেমকে ডেকে পাঠানো হলো। তাকে জানিয়ে দেওয়া হলো সিদ্ধান্তের কথা। একথা শুনে খুশি হলো উইলেম। একটানা একঘেয়ে জীবনযাত্রা থেকে মুক্ত নূতন জায়গায় জীবন শুরু করার সুযোগ আপনা হতে এসে গেল তার। শুধু তাই নয়, তার মধ্যে ভাগ্যদেবীর প্রসন্নতার আভাস পেল। তবে একবার মেরিয়ানার সঙ্গে দেখা করতে হবে। রাত্রির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল উইলেম। 

মেরিয়ানার বাড়িতে নির্দিষ্ট সময়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল মেরিয়ানা। তাদের আসন্ন বিচ্ছেদের কথা সব খুলে বলল উইলেম। বলল, আমি যেখানে ব্যবসার কাজে যাচ্ছি সেখানে ঘর পেলেই তোমাকে নিয়ে যাব। আশা করি। বিয়েতে তোমার কোনও আপত্তি হবে না। 

মেরিয়ানা এ-কথার কোনও উত্তর দিল না। তার চোখের জল চেপে রেখে শুধু নীরবে চুম্বন করতে লাগল উইলেমকে। তাকে বুকের উপর চেপে ধরল আরও জোরে। এরপর বিদায় নেবার আগে একবার উইলেম জিজ্ঞাসা করল সে পিতা হতে চলেছে কি না। তাতেও কোনো স্পষ্ট উত্তর দিল না মেরিয়ানা। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে একটা চুম্বন করল। 

পরের দিন সকালে বুকে এক গম্ভীর হতাশা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল মেরিয়ানা। নিঃসঙ্গতার এক দুর্বিষহ বেদনায় ভারী হয়ে উঠল তার অন্তরটা। যাকে সে মনেপ্রাণে ভালোবাসে তার সেই ভালোবাসার মানুষ দূরে চলে যাচ্ছে আর যাকে সে ভালোবাসে না অথচ সে জোর করে তাকে পেতে চায় এই অবাঞ্ছিত মানুষটা কাছে আসার ভয় দেখাচ্ছে। চোখ দিয়ে জলের ধারা নীরবে বয়ে যেতে লাগল মেরিয়ানার। 

বারবারা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, চুপ করো, শান্ত হও, কেঁদে কেঁদে সুন্দর চোখদুটো নষ্ট করো না বাছা। দুজন প্রেমিককে সহ্য করা কি একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার নয়? একজনকে যদি ভালোবাসতে নাই পার তাহলে তার ভালোবাসার প্রতিদানস্বরূপ তাকে অন্তত কিছু ধন্যবাদ দিতে পার। তাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে পার। 

সে-কথায় কান না দিয়ে মেরিয়ানা বলল, হায়, আমার হতভাগ্য উইলেম একদিন রাতে আমার কাছে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেছে। স্বপ্নে দেখছে সে যখন এক দূর পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একা একা তখন হঠাৎ আমাকে একটা পাহাড়ের চূড়ার উপর দেখতে পায়। কিন্তু আমাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে যেতেই আমি সেই চূড়া থেকে কোথায় নেমে যাই। এইভাবে আমাদের বিচ্ছেদের আভাস আগেই পেয়েছিল সে। সে সেই স্বপ্নে আরও দেখেছিল অন্য একটা লোক কোথা হতে এসে আমার হাত ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়। 

বারবারা এবার অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি তো জান, আমি তোমার জন্য সব কিছু করতে পারি। এখন বলো, কি চাও, কি পেলে খুশি হবে তুমি। 

মেরিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি আর চাইব আমি? যে উইলেম আমাকে ভালোবাসে, যাকে আমি ভালোবাসি সে ব্যবসার কাজে আটকে পড়ে থাকবে বিদেশে। 

বারবারা বলল, হ্যাঁ ওরা এমনই প্রেমিক যারা শুধু হৃদয় ছাড়া আর কিঝুঁই সঙ্গে আনে না। হৃদয় আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না তাদের প্রেমিকাদের।

মেরিয়ানা বিরক্ত হয়ে বলল, এখন ঠাট্টা রাখো। কাজের কথা ভাব, সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। 

বারবারাও বিরক্ত হয়ে বলল, অমন নিঃস্ব অবস্থায় বিয়ে করার লোক আমাদের অনেক আছে। 

মেরিয়ানা বলল, আমাকে দুটোর মধ্যে একটাকে বেছে নিতেই হবে। তবে আমার গর্ভে যে সন্তান বেড়ে উঠছে তার খাতিরে উইলেমকে আমাকে পেতেই হবে। এখন ঠিক করে ফেল আমি কি করব। 

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বারবারা বলল, যৌবনে মানুষ বড় চরমপন্থী হয়ে ওঠে। দুটোর একটাকে কেন বাছতে হবে? একই সঙ্গে দুজনের কাছ থেকে লাভ আর আনন্দ পেতে দোষ কি? একজনকে তুমি ভালোবাসবে আর একজনকে তার দাম দেবে। তবে একটা কাজ আমাদের করতে হবে। দুজন প্রেমিক যেন কেউ কাউকে দেখতে না পায়। 

মেরিয়ানা বলল, যা করার করো। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। 

উইলেমকে প্রথমে এক জায়গায় যেতে হলো ঘোড়ার জন্য। বৃদ্ধ ওয়ার্নার একটা চিঠি দিয়েছিলেন সঙ্গে। চিঠিটা দেখলেই মালিক পত্রবাহককে ঘোড়া দিয়ে দেবে। কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে উইলেম দেখল বাড়ির মালিক নেই। তার স্ত্রীরও মনমেজাজ খারাপ। উইলেম চিঠিটা দেখাতেই গিন্নী বলল, তাদের সৎ মেয়ে হঠাৎ এবটা ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেছে। তাই তার বাবা মেয়ের খোঁজে ব্যস্ত। 

উইলেম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাড়ির মালিক এসে গেল। উইলেমের চিঠি দেখে বিশেষ খাতির করল উইলেমকে। সঙ্গে সঙ্গে তার ঘোড়াটা দিয়ে দিল। তবে রাত্রিটার মতো উইলেমকে তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতে বলল। 

রাতটা কোনওরকমে কাটিয়ে এবং লোকটাকে তার মেয়ের জন্য কিছু সান্ত্বনা দিয়ে পরের দিন সকালে ঘোড়ায় চেপে তার আসল গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হলো উইলেম। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই এক অশ্বারোহী সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী দেখে থমকে দাঁড়াল। শুনল, মেয়েটি তার প্রেমিকসমেত ধরা পড়েছে। 

একটা গাড়িতে খড়ের উপর তাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে। ওদের দুজনকে দেখে মায়া হলো উইলেমের। মেয়েটিকে দেখে সাবালিকা মনে হলো। মনে হলো ওর বাবা জোর করে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়ে চায় মেয়েটাকে। দুজন তদন্তকারী অফিসার মেয়েটাকে জেরা করতে লাগল। মেয়েটা নির্ভিকভাবে বলতে লাগল, আমার বয়স কত জানতে চাইছেন? আমি আপনার বড় ছেলের সমবয়সী। আমার সৎ মা বাড়িতে আমায় এমন জ্বালাতন করতেন যে সে বাড়িতে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে। তাছাড়া আমি যার সঙ্গে এসেছি তাকে ভালোবাসি। তাকে আমি অনেক আগে থেকেই সাথী হিসাবে বরণ করে নিয়েছি। 

একজন অফিসার বলল, তা তো হবে না। তোমার প্রেমিককে গ্রেপ্তার করে আটক রাখা হবে, তার বিচার হবে। আর তোমাকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। 

মেয়েটি দৃপ্ত কণ্ঠে বলল, আমার প্রেমিকের দোষ নেই। ও তো আমাকে জোর করে আনেনি। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি ওর সঙ্গে। আমি কোনও অপরাধ করিনি। তবু আমাকে লজ্জাজনক অবস্থার মধ্যে ফেলা হয়েছে। অথচ কোনও উচ্চ আদালতে আমাদের নিয়ে গেলে আমরা মুক্তি পাব। 

আর্লম্যান নামে একজন বয়োপ্ৰবীণ তদন্তকারী অফিসারকে উইলেম অনুরোধ করল ওদের কথা বিবেচনা করার জন্য। অফিসার মেয়েটির লম্বা বক্তৃতা শুনেও বেশ কিছুটা অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। বেশ ভিড় জমে গিয়েছিল। কিন্তু কি করবেন তা ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না। 

অফিসার যাই করুক ওদের দেখতে বড় ভালো লাগছিল উইলেমের। ওদের প্রতি এক সকরুণ সহানুভূতির সঙ্গে সঙ্গে কবিসুলভ এক ভাবানুভূতি জেগে উঠল তার মনে। তার মনে হলো, প্রেমের দুটি রূপ আছে-একটি সলজ্জ, অন্যটি সোচ্চার। একটির রূপ প্রচ্ছন্ন, ললিতকোমল ও শান্ত, অন্যটি প্রকাশ্য, দৃপ্ত এবং সংগ্রামশীল। উইলেম এতদিন প্রেমের যে রূপ দেখে এসেছে সে প্রেম ভীরু, দুর্বল, আত্মগোপনকারী। কিন্তু আজ মেয়েটির স্পষ্ট স্বীকারোক্তি আর দৃপ্ত কষ্টস্বরের মধ্যে প্রেমের একটি অদৃষ্টপূর্ব রূপ দেখে ধন্য হলো উইলেম। যে প্রেম গোপন গৃহকোণ থেকে প্রকাশের স্বচ্ছ আলোয় নিজেকে টেনে এনে রাজপথের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বের কথা অকপটে ঘোষণা করতে পারে, সব বাধাকে অস্বীকার করে সমাজ ও সংসারে আপন প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানাতে পারে, সে প্রেমের মধ্যে অবশ্যই এক বিরল গৌরব আছে। সে গৌরব দেখে নিজেকে ধন্য মনে করল উইলেম। 

অফিসার আর্লম্যানের কাছে ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনুমতি চাইল উইলেম। আর্লম্যান সহজেই সে অনুমতি দান করল। উইলেম সোজা মেলিনার প্রেমিকের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি দেখব একটা মিটমাট করতে পারি কি না। মেয়েটির বাবা আমাদের কাজ-কারবারের সঙ্গে জড়িত। কিছু লেনদেনও আছে। মনে হয় সফল হতেও পারি। 

দুঃখে মুহ্যমান যুবকটি কিছুটা ভরসা পেল। সে আগে থিয়েটারে অভিনয় করত। এবার সে উইলেমের সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতে লাগল। উইলেম ভেবেছিল বন্দি ব্যাঙ যেমন মুক্তির পাবার সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি যুবকটি মুক্তি পেলে দুজনেই অভিনয়ের জগতে চলে যাবে। উইলেম বলল, সুযোগ্য অভিনেতার জন্য যা যা দরকার অর্থাৎ সুন্দর চেহারা, মধুর কণ্ঠস্বর, তীক্ষ্ণ অনুভবশক্তি-তা সবই তোমার আছে। 

কিন্তু যুবকটি বলল, তা আছে। তবে আমি আর মঞ্চে ফিরে যাব না ভবিষ্যতে। 

কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেল উইলেম। কিন্তু তার প্রেমিকের কথা সমর্থন করে মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে। আমরা আর অভিনয় করব না। অন্য কিছু কাজ-কারবারের কথা ভাবছি। 

উইলেম বলল, অভিনেতার জীবনে কত সুযোগ আছে। তার ভবিষ্যৎ কত উজ্জ্বল। তাছাড়া যার যা পেশা তাই নিয়েই থাকতে হয়। তাতেই উন্নতি হয়। যখন তখন এক পেশা ছেড়ে অন্য পেশা ধরতে নেই। 

মেলিনা বলল, আপনি কখনও অভিনয়ের কাজ করেননি, তাই একথা বলেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঈর্ষা, ম্যানেজারদের পক্ষপাতিত্ব, দর্শকদের নিয়ত পরিবর্তনশীল রুচি প্রভৃতি পদে পদে বাধা, কত অসুবিধা ভোগ করতে হয় অভিনেতাদের তার ঠিক নেই। 

যুবকটি বলল, যাই হোক, আপনি মিটমাটের চেষ্টা করুন। আমার প্রেমিকার বাবাকে বলেন কেরাণি, কর আদায়কারীর যে কোনও পদে আমি চাকরি করতে রাজি আছি। যে কোনও একটা চাকরি পেলেই তাতে আমার চলে যাবে। 

উইলেম কথা দিল, পরের দিন সকালেই সে মেয়েটির বাবার সঙ্গে কথা বলবে। 

হোটেলে রাতটা কাটিয়েই সকালে বেরিয়ে পড়ল উইলেম। উইলেম গিয়ে দেখল মেয়েটির বাবা বাড়িতেই আছে। তাকে সব কথা বিজ্ঞতার সঙ্গে বুঝিয়ে বলল, লোকটিও কথা কথা ধৈর্য ধরে শুনল। শুনে যা বলল, তাতে উইলেম একরকম সাফল্যই লাভ করল। লোকটি বলল, তার মেয়ে যুবকটিকে বিয়ে করতে পারে। সে মামলা তুলে নেবে। তাদের কোনও শাস্তিও দেবে না। কিন্তু বিয়ের পণ হিসাবে কোনও যৌতুক পাবে না। তাছাড়া তার মেয়ে তার মাসির যে সম্পত্তি পেয়েছিল। তা তার বাবার কাছে বছর কতেকের জন্য রাখতে হবে। অর্থাৎ তার বাবাই তার আয় উপসত্ত্ব ভোগ করবে। উইলেম তার মেয়ে-জামাইকে ঘরে রাখার জন্য অনুরোধ করল লোকটিকে। কারণ এখন ওদের কোনও সংস্থান নাই। লোকটি তার উত্তরে বলল, তার মেয়েকে ঘরে জায়গা দিতে তার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে। ছোকরাটিকে নিয়ে। ওই ছোঁড়াটার উপর তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীরও লোভ ছিল। কিন্তু যুবকটির দৃষ্টি ছিল তার মেয়ের উপর। তাই তারা পালিয়ে যায়। 

কথাটা শুনে লজ্জায় পড়ে গেল উইলেম। এই গোপন কথাটা জানলে সে এ অনুরোধ করত না। 

যাই হোক, মিটমাটের ব্যবস্থা শেষ করে মনটাকে স্থির করে মেরিয়ানাকে একখানা চিঠি লিখল উইলেম। কয়েকদিন ধরে তার মনে হচ্ছিল, রাত্রিবেলায় খাওয়ার পর কাগজ নিয়ে বসে পড়ল। লিখল, 

যে মধুর রাত্রি তার নীল আবরণ দিয়ে আমাদের ঢেকে রাখত, আমাদের মিলনের নিবিড়তাকে মধুর করে রাখত, সেই রাত্রিরই শান্ত নীরব আকাশে তোমাকে চিঠি লিখছি মেরিয়ানা। এখন আমি এক নববিবাহিত যুবকের কাছে আছি যার সামনে জীবনের এক নতুন দিগন্ত খুলে গেছে, যে একটু পরেই তার নববধুর বুকের উপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাদের প্রেম স্বভাবতই তোমার কথা, আমাদের ভালোবাসাবাসির কথা মনে পড়িয়ে দিল নতুন করে, আরও তীব্র করে।

আমার ফিরতে আরও কিছুদিন দেরি হবে। তা হোক। কারণ একথা ভাবতে খুবই ভালো লাগছে যে এই বিচ্ছেদের পর আগের থেকে আরও মধুর হয়ে উঠবে আমাদের মিলন। পুনর্মিলনের সেই মধুর নিরবচ্ছিন্নতা এই বিচ্ছেদের সব বেদনা, সব যন্ত্রণাকে ভাসিয়ে দেবে। আমি আমাদের সন্তানের জন্য কিছু ভাবি না। আমাদের মিলনের সুখস্মৃতিরূপেই সে সন্তান আনন্দ বর্ধন করে যাবে আমাদের। একটা কথা প্রায়ই মনে হয় আমার প্রিয়তমা। বক্তৃতামঞ্চ থেকে নাট্যমঞ্চ কোনও অংশে কম নয়। ঈশ্বর এবং প্রকৃতি আমাদের যে শক্তি, যে যোগ্যতা দান করেছেন তার বিকাশ সাধনের জন্য আমি মঞ্চে অবতীর্ণ হব যে কথা দর্শকরা যুগ যুগ ধরে শুনতে চাইছে, তোমাতে আমাতে দুজনে এক সুন্দর জোট বেঁধে সেকথা তাদের প্রাণভরে শোনাব। এত সব কথা মুখে বলে জানানো সম্ভব নয় বলেই চিঠি লিখে জানালাম। এখন এখানেই ইতি। বিদায় প্রিয়তমা, আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। বন্ধ হয়ে আসছে। এখন রাত্রি নিশীথ। 

প্রথম কিস্তির কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে গেল উইলেম। আবার তাকে যেতে হবে আর এক জায়গায়। আবার বার হতে হবে। কিন্তু তার প্রস্তুতির জন্য দিনকতক লাগবে। তাই বাড়ি ফিরেই পরদিন বিকালের দিকে মেরিয়ানার সঙ্গে দেখা করতে গেল উইলেম। চিঠিখানা ডাকে ফেলেনি। সঙ্গে করে নিয়ে গেল। ভাবল হাতেই দেবে। বিকালে বা সন্ধ্যায় এর আগে কখনও যায়নি সে মেরিয়ানার কাছে। সাধারণত সে যায় গভীর রাত্রিতে। কিন্তু আজ ঠিক করল, সন্ধে হতেই সে চিঠিখানা তার হাতে দিয়ে আসবে। পরে রাত্রি গম্ভীর হলে গিয়ে তার উত্তর চাইবে। 

মেরিয়ানাকে কাছে পেতে ইচ্ছা করছে আর একটা কারণে। বাইরে থেকে যে বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তার বন্ধু ওয়ার্নার এসেছিল তার প্রেম সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে। মেরিয়ানার প্রতি তার গোপন প্রেম, তার বাড়িতে গভীর রাত্রিতে নিয়মিত যাওয়া এসব কথা সব জেনেছে ওয়ার্নার। শুধু তাই নয়, সে মেরিয়ানা সম্বন্ধেও অনেক খবর সংগ্রহ করেছে। ওয়ার্নার তাকে সাবধান করে দিয়েছে, মেরিয়ানা ভালো মেয়ে নয়। মেরিয়ানা তাকে উপরে ভালোবাসার ভান করলেও আসলে আর একটা লোকের কাছে সাহায্য নেয়। আর একটা লোকের সঙ্গে তার আছে এক গোপন সম্পর্ক। 

ওয়ার্নারের কথা শুনে মনটা কিছু খারাপ হলেও মেরিয়ানার প্রতি কিছুমাত্র বিশ্বাস হারায়নি উইলেম। মেরিয়ানার মতো সুন্দরী মেয়ে কখনও খারাপ হতে পারে, সে কখনও বিশ্বাস করতে পারে না একথা। তার ভালোবাসা কখনও মিথ্যা হতে পারে না। এ বিশ্বাস এখন অটুট আছে তার। 

এই অটুট বিশ্বাসে বুক বেঁধে মেরিয়ানার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল উইলেম। ঘরে ঢুকেই ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেরিয়ানার বুকে। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। কিন্তু আবেগের প্রবলতায় একটা জিনিস লক্ষ্য করেনি উইলেম। মেরিয়ানার আদর-অভ্যর্থনায় ও আচরণে আগের মতো আন্তরিকতা নেই, আবেগের সেই উষ্ণ নিবিড়তা নেই। 

সেটা যে নেই মেরিয়ানা নিজেও সচেতন সে বিষয়ে। তাই তার কারণ হিসাবে একটা যুক্তি দেখাল। বলল, আজ তার শরীর খারাপ। উইলেম বলল, এখন এসেছে এমনি দেখা করতে, আজ রাতে আবার আসবে সে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মৃদু প্রতিবাদ জানিয়ে মেরিয়ানা বলল, আজ না, অন্যদিন এসো। আজ শরীরটা বড় খারাপ। 

কোনও কিছু সন্দেহ না করে সরল বিশ্বাস মেরিয়ানার সব কথা মেনে নিল উইলেম। এ নিয়ে সে আর পীড়াপীড়ি করল না। তবে অনেক আশা অনেক উৎসাহ নিয়ে যে চিঠিটা তুলে দিতে এসেছিল মেরিয়ানার হাতে, সে চিঠিটা বার করল না। পকেটেই তা রয়ে গেল। মেরিয়ানার এই নিরুত্তাপ ভাব দেখে সে চিঠি তার হাতে দেবার কোনও যুক্তি খুঁজে পেল না উইলেম। 

তবে সবেমাত্র সন্ধে হয়েছে। মেরিয়ানার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে গেল উইলেম। কয়েক দিনের বিচ্ছেদের পর নিবিড়তর মিলনের আশায় সম্ভাব্য যে আনন্দের আবেগ ও উত্তেজনার ঢেউ উত্তাল হয়ে উঠেছিল বুকে, সে ঢেউ আপনা হতেই অসময়ে ফেটে মিলিয়ে গেল। মনে মনে মুষড়ে পড়ল উইলেম। বাড়িতে থাকতে ভালো লাগল না কিছুতেই। তাই পোশাক পরে আবার বেরিয়ে পড়ল পথে। 

পথে বার হতেই এক অচেনা পথিকের সঙ্গে দেখা হলো। পথিক তাকে কোনো এক ভালো হোটেলের সন্ধান দিতে বলল। কথা বলতে বলতে তাকে সঙ্গে করে নিকটবর্তী একটা হোটেলে নিয়ে গেল উইলেম। হোটেলে পৌঁছে পথিকটি উইলেমকে এক কাপ চা খেয়ে যাবার অনুরোধ করল। হাতে কোনও কাজ না থাকায় উইলেম বসে পড়ল ভদ্রলোকের কাছে। উইলেমের পরিচয় জানতে পরে পথিকটি বলল, সে নাকি তার পিতামহকে চিনত। তার পিতামহের কেনা যে ছবিগুলো তার বাবা বিক্রি করে দেন সে ছবিগুলো সে নাকি কিনে নেয়। যাই হোক, একথা-সেকথার পর ভদ্রলোক উইলেমকে বলল, তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করো? তুমি কি বিশ্বাস করো অদৃশ্য কোনও শক্তি উপর থেকে আমাদের জীবনকে চালনা করছে? 

উইলেম বলল, তোমার মতো এক যুবকের পক্ষে একথা সাজে না।

ভদ্রলোক তখন বলল, মনে করো তুমি একটা বড় কাজ করতে চলেছ অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু মাঝপথে অকস্মাৎ কোনও বাধা এসে গেল। তুমি তা করতে পারলে না। এখানেও কি তুমি নিয়তির বিধানে বিশ্বাস করবে না? 

উইলেম বলল, একথার উত্তর এত তাড়াতাড়ি এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। 

চা খেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল উইলেম। পথে কোথায় একজন লোক। একটা মিস্টি গানের সুর বাজাচ্ছিল বাদ্যযন্ত্রে। সেই সুর শুনতে শুনতে হঠাৎ মেরিয়ানার কথা মনে পড়ল তার। ইচ্ছা না থাকলেও ধীরে ধীরে মেরিয়ানার বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হলো। তখন বেশ রাত হয়েছে। সদর দরজা বন্ধ। তবু তার সামনে বোয়াকটায় একটু বসল উইলেম। দরজায় কাঠগুলোয় হাত বুলিয়ে দেখল। এই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কতদিন মেরিয়ানা তার জন্য অপেক্ষা করেছে কত উষ্ণনিবিড় আগ্রহে। দরজার চৌকাঠ পার হবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু সে দিন কি আর ফিরবে না? আজ কেন তাকে যেতে নিষেধ করল মেরিয়ানা? কিন্তু এসব কথা এখানে বসে ভেবে কোনও ফল হবে না। 

এই সব ভাবতে ভাবতে আবার বাড়ির পথে রওনা হলো উইলেম। কিন্তু কয়েক পা যেতেই হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল আধো অন্ধকারে কোন এক পুরুষের ছায়ামূর্তি মেরিয়ানার বাড়ির সদর দরজা থেকে নিঃশব্দে বার হয়ে কোথায় চলে গেল। এক অদম্য কৌতূহলের বশে পথের উল্টো দিকে এগিয়ে চলল উইলেম লোকটাকে অনুসরণ করার জন্য। সে স্পষ্ট দেখল লোকটা মেরিয়ানার বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা পথ ধরে চলে গেল। কিন্তু উইলেম কিছুটা এগিয়ে যেতেই আর তাকে দেখা গেল না। হয়তো কোনও পাশের গলিপথে ঢুকে পড়েছে। 

বাড়ি ফিরে এ বিষয়ে সব সন্দেহ, সব সংশয় মন থেকে মুছে ফেলল উইলেম। সেই চিঠিটা বার করে তার শেষে কয়েকটা কথা জুড়ে দিল। লিখল, হে আমার প্রিয়তমা, গত রাতে তোমার কি হয়েছিল? কেন তুমি যেতে নিষেধ করলে আমায়? 

তোমার হয়ত ওখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না। কিন্তু ধৈর্য ধরো, সময়মতো। আমি তোমার একটা ব্যবস্থা করবো। ওই কালো গাউনটা পরেছিলে কেন? আমি তো তোমাকে একটা সাদা নাইটগাউন পাঠিয়েছি। সেটা পরলে তোমাকে বড় সুন্দর দেখাবে। চিঠি পাঠাবে বুড়ি সিবিলের মাধ্যমে। শয়তান নিজে তাকে দূত আইরিস হিসাবে বেছে নিয়েছে। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

এমন অনেক রোগ আছে যা বলবান লোকদের ধরলে বেশি দুর্বল করে দেয়, বেশি করে কায়দা করে। উইলেমের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হলো। মেরিয়ানার সঙ্গে তার ব্যর্থ প্রেম সম্পর্কটা একটা দুষ্ট রোগের মতো অত্যধিক আবেগে স্ফীত উইলেমের অন্তরটাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল একেবারে। তবু একেবারে আশা ছাড়ল না উইলেম। তার ধারণা আবার মিলন ঘটবে তাদের। সব সংশয়, আর ভুল বোঝাবুঝির মেঘ কেটে যাবে নিঃশেষে। 

কিন্তু তার বন্ধু ওয়ার্নার মেরিয়ানার জীবন সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে যেভাবে তার মুখোশ খুলে দিয়েছে তাতে তার প্রতি মেরিয়ানার প্রতারণার বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। অবশেষে উইলেম যখন দেখল মেরিয়ানাকে ফিরে পাওয়া আর সম্ভব নয় তার পক্ষে তখন তার অভাবটাকে আর এক চরম ক্ষতি বলেই ধরে নিল। কিন্তু আবার সঙ্গে সঙ্গে দেখল এ ক্ষতি সহজভাবে সহ্য করা অসম্ভব তার পক্ষে। নিজের অন্তরকে ঘৃণা করতে লাগল উইলেম। নীরব অশ্রু আর অবদমিত শোকাবেগকেই একমাত্র ওষুধ বা প্রতিকার বলে ভাবতে লাগল। 

বর্তমানের দুঃখটাকে ভোলার জন্য অতীতের হারিয়ে যাওয়া সুখের ও মিলনের দিনগুলোকে কল্পনার রং-রস দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করে নূতন করে। কিন্তু তাঁরা বাঁচে না। উইলেম শুধু একবার অতীতের গভীর অন্ধকার খাদটার মধ্যে নিবিড় হতাশার সঙ্গে তাকায়। তারপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মধ্যে। এইভাবে বর্তমানের জীবনযন্ত্রণাকে ভুলতে গিয়ে স্বেচ্ছায় আর এক যন্ত্রণার জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে উইলেম। যৌবনে স্বাভাবিক উন্মাদনা বশে তার বর্তমানের ক্ষতিটাকে অপূরণীয় ভেবে এক বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা দান করে।

প্রথম প্রেমে এক তিক্ত ব্যর্থতা লাভ করার সঙ্গে এক বিরাট রূপান্তর এল উইলেমের জীবনে। প্রেমের ক্ষেত্রে তার আকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে হারানোর সঙ্গে সঙ্গে শিল্প সাধনার প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা জাগল তার মনে। কবিতা লেখা ও অভিনয় করার মধ্যে কোনও যুক্তি খুঁজে পেল না। তার মনে হলো কবিতা কতকগুলো শব্দের ছন্দোবদ্ধ গ্রন্থন যার মধ্যে গাঁথা থাকে কতকগুলো বাঁধাধরা নীরস চিন্তা আর আবেগ। আবার তার চেহারা, আবেগানুভূতির স্বচ্ছন্দ ও সংযত প্রকাশ, তার বাকভঙ্গিমা, অঙ্গভঙ্গি প্রভৃতি সব মিলিয়ে তার যে সহজাত অভিনয়প্রতিভা ছিল এবং যার নিয়মিত চর্চা করলে সে একজন উচ্চস্তরের অভিনেতা হতে পারত, সে প্রতিভাও বিষাদ ঠেকল তার কাছে। 

এখন কাব্যসাধনা ও অভিনয়চর্চা দুইই ছেড়ে ব্যবসার কাজে মন দিল উইলেম। কখনও এক্সচেঞ্জে, কখনও কাউন্টিং হাউসে, কখনও বিক্রয়কেন্দ্রে, স্টোরে, কখনও অফিসঘরে বা প্রচারকেন্দ্রে সব সময় ঘুরে বেড়াত উইলেম অক্লান্তভাবে। তার উপর যখন সে কাজের ভার দেওয়া হতো, সে তাই প্রচুর যত্নও পরিশ্রমের সঙ্গে করত। তার এই নূতন কর্মতৎপরতা দেখে তার বন্ধুরা বিস্মিত হলো, তার বাবা খুশি হলেন। 

মন থেকে সব প্রেম ও কাব্যসাধনার স্মৃতি চিরতরে মুছে দেবার জন্য একদিন সন্ধের সময় নিজের ঘরে আগুন দিয়ে সব চিঠিপত্র ও লেখা কবিতা পোড়াতে লাগল উইলেম। তার এতদিনের প্রিয়বস্তুগুলো তারই চোখের সামনে দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। 

এমন সময় ওয়ার্নার ঘরে ঢুকল। ঢুকেই উইলেমের কাণ্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। তার বুঝতে দেরি হলো না উইলেম কি করছে। উইলেম নিজে থেকেই বলল, যে কাজে আমার কোনও সহজাত প্রতিভা বা যোগ্যতা নেই তা যে সত্য সত্যই আমি ছেড়েছি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেবার জন্যই আমি এ কাজ করছি। 

ওয়ার্নার তাকে বাধা দিয়ে বলল, কোনও কবিতা সৃষ্টি হিসাবে সার্থক বা পূর্ণতা অর্জন করতে না পারলেও তা পুড়িয়ে ফেলার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। 

উইলেম বলল, কবিতা হয় রসোত্তীর্ণ হবে অথবা তার অস্তিত্ব থাকবে না। যার কাব্যসৃষ্টির কোনও জন্মগত প্রতিভা নেই তার এ কাজে হাত দেওয়া মোটেই উচিত নয়। যদি তা সে করে তাহলে বলব সে বিষয়ে সে প্রতারণা করছে সকলের সঙ্গে, নিজের সঙ্গে। সব মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু অনুকরণপ্রবৃত্তি আছে। সে ভাবে প্রকৃতি জগতে ও মানব জগতে তোনও বস্তু বা ঘটনা দেখলেই তার প্রতিরূপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এ বিষয়ে তার ক্ষমতা আছে। 

ওয়ার্নার বলল, তোমার অন্তরের অনুভূত সত্যগুলোকে এভাবে জোর করে নির্বাসিত করা উচিত নয়। এই সব স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলোর সঙ্গে মানিয়ে চলাই ভালো। কারণ এগুলোকে অস্বীকার করলে নিজের আত্মাকেই অস্বীকার করা হয়। তাছাড়া এটা এক নির্দোষ আনন্দের ব্যাপার। এ আনন্দ ত্যাগ করার কোনও অর্থই হয় না। 

উইলেম বলল, কি কারণে আমি এসব পুড়িয়ে ফেলেছি। তার কারণ হলো এই যে এই কাগজপত্রগুলোর মধ্যে আমার অতীতের কামনা-বাসনাগুলো সব লেখা আছে। বর্তমানে আমি যতই এই সব কিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করে জীবনের কোনও বৃহত্তর অর্থ চাই ততই এই সব লেখাগুলো আমাকে সেই সব ব্যর্থ কামনা-বাসনাদের কথা জোর করে মনে পড়িয়ে দেয়। আমার তা মোটেই ভালো লাগে না। মোটেই না। 

এই বলে আরও দুটো কাগজের প্যাকেট পুড়িয়ে ফেলল উইলেম। আর তার সামনে হতবুদ্ধি হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল বিব্রত ওয়ার্নার। তার করার বা বলার আর কিছুই ছিল না। এর আগে সে উইলেমকে দু তিনবার বাধা দিতে গিয়েও পারেনি। 

এমনি করে প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাব্যসাধনা ও শিল্পসাধনায় জলাঞ্জলি দিয়ে কাজ-কারবার ও পৈত্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে খুব বেশি করে মন দিল উইলেম। ব্যবসার সঙ্গে বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা, লেখা চিঠিতে কিছু কিছু কাব্যিক আবেগের সংমিশ্রণতার সাফল্যের মাত্রা ক্রমেই বাড়িয়ে দিতে লাগল। ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল উইলেম। তখন তার বাবা আবার বাইরে পাঠাবার মনস্থ করলেন তাকে। বললেন, বাইরে যেসব পাওনা টাকাগুলো পড়ে আছে বেশ কিছুদিন ধরে সেগুলো আদায় করে আনুক। 

এবার উইলেমকে পাঠানো হলো পার্বত্য অঞ্চলে। ঘোড়ায় চেপে রওনা হয়ে পড়ল উইলেম। পার্বত্য এলাকায় এই তার প্রথম যাওয়া। পাহাড়ের উত্তুঙ্গ, শৃঙ্গ, শ্যাওলাধরা বড় বড় পাথর, গভীর খাদ প্রভৃতি দেখতে খুব ভালো লাগছিল তার। আপনা থেকে মুখ দিয়ে গান বেরিয়ে এল উইলেমের। তার সঙ্গে নিজের লেখা কিছু গানও। 

এমন সময় কয়েকজন লোকের কাছে শুনল হকড নামে এক জায়গায় এক নাটকের অনুষ্ঠান হবে। 

অবাক হয়ে গেল উইলেম কথাটা শুনে। এই পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে আবার থিয়েটার! তা যদি হয় আমি অবশ্যই তা দেখতে যাব।

লোকগুলো বলল, থিয়েটার হবে এক কারখানায়। কারখানার মালিক তার কর্মচারীদের নিয়ে একখানা নাটক মঞ্চস্থ করছে। এখানে তো আর কোনও আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা নেই। তাই মালিক মাঝে মাঝে ওই থিয়েটারের আয়োজন করে। 

উইলেম সেখানে গিয়ে দেখল কারখানার মালিক তাদের কারবারের একজন খরিদ্দার। তার কাছে তাদের কোম্পানি কিছু টাকাও পাবে। তার কাছে দেনাদারদের যে তালিকা আছে তাতে তারও নাম আছে। যাই হোক, উইলেমকে দেখে খুশি হলো সেই কারখানার মালিক। সব টাকা মিটিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে। তার থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা করল। তার স্ত্রী বলল, উইলেমকে দেখতে ঠিক তার বাবার মতো। 

রাতে নাটক দেখে বিশ্রাম করে পরের দিন সকালে আবার হোটেলে চলে গেল উইলেম। কিন্তু টাকা আদায়ের ব্যাপারে এই পার্বত্য এলাকায় বিশেষ সুবিধা করতে পারল না সে। আইনগত বিষয়ে পরামর্শদাতারও একান্ত অভাব এখানে। দুচারদিন এই পাহাড়-জঙ্গলে রাজ্য ছেড়ে সমতলভূমির দিকে রওনা হলো উইলেম। 

উঁচু-নিচু বন্ধুর পার্বত্য পথ, ছায়াঘন জঙ্গল, তার উপর মেঘ বৃষ্টি কুয়াশা প্রভৃতির অবাঞ্ছিত অন্যভ্যস্ত অভিজ্ঞতার পর সমতলে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল উইলেম। উর্বর ঘাসেঢাকা সবুজ উপত্যকা, অবারিত সুন্দর প্রান্তর, আর তার বুক চিরে বয়ে যাওয়া কত মন্থরগতি নদী দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল তার। এমনি এক নদীর ধারে ছোট্ট এক সাজানো সুন্দর এক শহর পেয়ে গেল উইলেম। 

শহরের মধ্যে খোঁজ করে একটা ভালো পান্থশালায় উঠল উইলেম। দেখল তার সামনে ভিড়। কোথা হতে এক দড়ির খেলা দেখানো নাট্যদল এসেছে। রাত রাত্রি থেকে দু-তিনদিন ধরে তাদের খেলা দেখানো চলবে। 

কিছুক্ষণ পরেই এক ফুলওয়ালী মেয়ে ফুল বেচতে এল। উইলেম তার থেকে কিছু ফুল কিনল। তার কিছু পরে তার ঘরের উল্টো দিকে এক ঘরের জানালায় তার হঠাৎ চোখ পড়ল, এক সুন্দরী যুবতী চুল আঁচড়াচ্ছে। হঠাৎ একটি ছেলে এসে বলল, আপনি যে ফুল কিনেছেন তার থেকে কিছু ঐ ভদ্রমহিলা চাইছেন। সানন্দে তা দিল উইলেম। 

ওর কিছু পরে লার্তেস নামে এক ভদ্রলোকে এসে আলাপ করল উইলেমের সঙ্গে। আলাপ-পরিচয়ের পর লার্তেস উইলেমকে সঙ্গে করে সেই সুন্দরী যুবতীর ঘরে নিয়ে গেল। লার্তেসই আলাপ করিয়ে দিল। যুবতীটি প্রথমেই তার ফুলের জন্য ধন্যবাদ জানাল উইলেমকে। উইলেম দেখল মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী।-তার চোখ, মুখ, চুল সব মিলিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে তার দেহের লাবণ্যকে। লার্তেস বলল, আমি আর ফিলিনা একই নাট্যদলের অংশীদার। আমরা জাহাজে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে যেতে নেমে পড়েছি এখানে। জায়গাটা খুব ভালো লাগায় দু-চারদিন থেকে যেতে চাই। 

উইলেমকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল ফিলিনা। সে তখন একটা কালো পোশাক পরেছিল। পোশাকটা একটু ছোট হলেও তাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। উইলেমের একটা হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল তার শোবার ঘরে। ফিলিনার একটা হাতে ছিল উইলেমের দেওয়া সেই গোলাপ ফুলটা। 

লার্তে দোকান থেকে কিছু মিষ্টি নিয়ে এল উইলেমের জন্য। এসেই ফিলিনার কোলের উপর কিছু চিনির রসে পাক দেওয়া বাদাম ছুঁড়ে দিল। তা দেখে ফিলিনা উইলেমকে লক্ষ করে বলল, দেখছেন, এই বীরপুরুষ আমাকে কত শিশু ভাবছে। অথচ উনিই এই সব জিনিস খেতে বেশি ভালোবাসেন।

উইলেম হেসে ফেলল কথাটা শুনে। লার্তেস প্রস্তাব করল, আজকের দিনের আবহাওয়াটা বড় চমৎকার। চলো বাইরে কোনও গ্রামাঞ্চলে গিয়ে বেড়িয়ে আসি। ওখানেই খাওয়াটা সেরে নেব। 

ফিলিনা উৎসাহিত হয়ে বলল, তাহলে তো খুবই ভালো হয়। তাহলে আমাদের এই নবপরিচিত বন্ধুটিও বেশ কিছুটা আনন্দ পান। 

উইলেম বলল, আমি আমার ঘর থেকে মুখ-হাত ধুয়ে চুলটা আঁচড়ে আসছি। 

ফেলিনা বলল, আপনি এটা এখানেই সারতে পারেন। এই বলে সাবান পাউডার প্রভৃতি সব প্রসাধন্দ্রব্যের ব্যবস্থা করে দিল সঙ্গে সঙ্গে। 

সকলে তৈরি হয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করল। ফিলিনার মনটা বড় নরম। যাবার পথে ভিখিরি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু না কিছু পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছিল সে। অবশেষে মিল নামে একটা পান্থশালায় এসে পৌঁছল ওরা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে খাবার জন্য তৈরি হলো তারা। এমন সময় ওরা দেখল অদূরে স্থানীয় খনিশ্রমিকরা এক নাচগানের অনুষ্ঠান করছে। অনুষ্ঠানটা একই সঙ্গে গীতি ও নৃত্যনাট্য ধরনের। তাতে দেখা গেল মঞ্চের উপর এক খনিশ্রমিক গাঁইতি দিয়ে কয়লা কাটছে আর গান গাইছে। এমন সময় এক কৃষক এসে তাকে গানের মধ্যে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কেন সে মাটি কাটছে। কেন সে তার জমিটাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। খনিশ্রমিক তার উত্তরে বলল, এইভাবেই মাটির ভিতর থেকে সব খনিজ সম্পদ বার করে আনতে হয়। তাতে অসংখ্য মানুষের মঙ্গল হয়। এভাবে দেখা গেল প্রথমে কৃষকটি রেগে গেলেও পরে খনিশ্রমিকের কথায় শান্ত হয়ে চলে গেল। 

অনুষ্ঠান শেষ হলে ওরা অন্যত্র চলে গেল কথাবার্তা শুরু করল নিজেদের মধ্যে। ফিলিনা গান শুরু করল। তার গলাটা বড় মিষ্টি। গান শুনতে শুনতে ওরা আবার সেই শহরের হোটেলে ফিরে গেল। সন্ধ্যায় হবে হোটেলের সামনে দড়ি নাচের খেলা। ফিলিনা বলল, তোমাদের ঘরের চেয়ে আমার ঘরটা এ বিষয়ে সবচেয়ে সুবিধাজনক। তোমরা দুজনেই আমার ঘর থেকে অনুষ্ঠান দেখবে।

অনুষ্ঠানের প্রথমে কিছু অপটু ছেলেমেয়ে ও কিছু আনাড়ি লোক খেলা দেখিয়ে হাসাল দর্শকদের। অবশেষে এল এ খেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দুজন বড় খেলোয়াড় নার্সিস আর লান্দ্রিনেত্তে। 

অনুষ্ঠান শেষে খেলোয়াড়দের তাঁবুর বাইরে অদ্ভুতদর্শনা একটি মেয়ে দেখে তাকে ডাকল উইলেম। মেয়েটি ওদের কাছে আসতে উইলেম জিজ্ঞাসা করল তার বয়স কত। 

মেয়েটি বলল, তা সে জানে না। তাদের দলের কেউ জানে না।

উইলেম আবার জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাবার নাম কি?

মেয়েটি বলল, সে শয়তানটা মারা গেছে। 

উইলেমের মনে হলো, মেয়েটির বয়স বারো-তের হবে। তার মুখ-চোখ ভালো। বয়স অনুপাতে তার স্বাস্থ্য খুবই উন্নত। কিন্তু সেই অনুপাতে তার হাত-পাগুলো পুষ্ট হয়নি। তাকে দেখতে সত্যিই ভালো লাগছিল উইলেমের। ফিলিনা তাকে কিছু মিষ্টি দিতেই সে চলে গেল। 

লার্তেস আবার একটা প্রস্তাব আনল। আগামীকাল জাগারহানস শহরে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারবে। জাগারহানস হচ্ছে এক বিরাট বনাঞ্চল। খুব নিস্তব্ধ আর মনোরম। বেড়াবার জায়গা হিসেবে চমৎকার। ওরা তিনজনেই যাবে। 

আনন্দের মিষ্টি উত্তেজনায় সারারাত ভালো ঘুম হলো না উইলেমের। সকাল। হতেই মুখ-হাত ধুয়ে কাপড়-জামা পরে ফিলিনার ঘরে গিয়ে দেখে ফিলিনা নেই। বেশ কিছুটা হতাশ হয়ে লার্তেসের ঘরে গেল উইলেম। লার্তেস শান্ত কণ্ঠে বলল, ফিলিনা যেখানে যাক তারা দুজনে যাবে। 

রওনা হবার আগে কিছুক্ষণ মেয়েদের সম্বন্ধে কথাবার্তা হলো ওদের মধ্যে। উইলেম লক্ষ করল মেয়েদের সম্বন্ধে খুব একটা উৎসাহ নেই লার্কেসের। একসময় লার্তেস বলল, ফিলিনা কাউকে ঠকায় না। অবশ্য সাময়িকভাবে নিরাশ করতে পারে। সে মেয়ে হিসাবে আদিমাতা ঈভের সুযোগ্য বংশধর। সে এমনই এক জাতের মেয়ে যে দেওয়া-নেওয়ার মাত্রা সম্বন্ধে অতিমাত্রায় সচেতন। তাকে যতটুকু দেবে, ঠিক ততটুকুই পাবে তার কাছ থেকে। 

সহসা মেরিয়ানার কথাটা মনে পড়ে গেল উইলেমের। জাগারহানসের জঙ্গলে গিয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরতেই একটা পাথরের ধারে ফিলিনাকে একা একা বসে। থাকতে দেখল ওরা। লার্তেস তাকে সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল তার সঙ্গীরা কোথায়। ফিলিনা উত্তরে বলল, সে আগেই তাদের বিদায় দিয়েছে। ফিলিনা বলল, লোকগুলো ভীষণ কৃপণ প্রকৃতির। হোটেলে খেতে গিয়ে বার বার প্রতিটি জিনিসের দাম জিজ্ঞাসা করছে আর এ ওর মুখপানে তাকাচ্ছে। আমি ওদের ভাবগতিক বুঝতে পেরে ওয়েটারকে এমন এক ডিনারের অর্ডার দিলাম যার বেশির ভাগ উপকরণ হোটেলে নেই। অগত্যা ওরা বাইরে চলে গেল। ওরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আমিও ওদের বিদায় দিয়ে মুক্তি দিলাম। আর ওরা এক দিকে মুখ করবে না। 

একথা-সেকথার পর হঠাৎ একসময় ফিলিনা বলল, তোমরা দুজনে কিছু ফুল নিয়ে এস্র। বেশি করে আনবে। 

ওরা দুজনে ফুল আনলে সেই ফুল দিয়ে একটা মালা গেঁথে নিজের গলায় পরল ফিলিনা। তারপরেও অনেক ফুল অবশিষ্ট থাকায় আর একটা মালা গেঁথে উইলেমের গলায় গম্ভীরভাবে পরিয়ে দিল। তখন লার্তেস হেসে বলল, আমাকে তাহলে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হবে? 

ফিলিনা তখন নিজের গলা থেকে মালাটি খুলে লার্তেসের গলায় পরিয়ে দিল। বলল, শূন্য হাতে কাউকে ফিরতে হবে না। 

লার্তেস শুধু বলল, এখান থেকে আমরা দুজনেই যদি তোমার প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী হই? 

ফিলিনা তখন নীরবে লার্তেসের মুখের কাছে তার মুখটা বাড়িয়ে দিল যাতে লার্তেস চুম্বন করতে পারে। তার পরমুহূর্তে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করলে উইলেমকে। তারপর বলল, পুরুষ নারীর কাছে সাধারণত যা চায় তা আমি তোমাদের দুজনকেই দিলাম। সুতরাং প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও কারণ নেই।

ফিলিনা বলল, এখন সবেমাত্র বিকেল। চলো ওদের খেলা আরম্ভ হবার আগেই আমি কিছুক্ষণের জন্য নাচব। আমাদের ঘরে চলো। 

ঘরে গিয়ে ফিলিনার সঙ্গে লার্তেসও নাচতে লাগল। কিন্তু উইলেম ভালো নাচতে জানে না। তার অভ্যাস নেই। তখন লার্তেস ও ফিলিনা দুজনেই উইলেমের হাত ধরে তাকে নাচ শেখাতে লাগল। 

ওদের দড়িনাচের খেলা আরম্ভ হবার আগে হঠাৎ আসরের সামনে একটা গোলমাল শুনে ছুটে গেল উইলেম। দেখল মিগনন নামে সেই অদ্ভুতদর্শনা মেয়েটিকে দলের ম্যানেজার নির্মমভাবে মারছে। মিগনন নাকি ডিমের নাচ দেখাতে রাজি হয়নি। 

মিগননের চিৎকারে লোক জড়ো হয়েছিল। তার প্রতি করুণাও অনেকের জেগেছিল। কিন্তু ম্যানেজারের শাসনের কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করার সাহস পায়নি। উইলেম ছুটে গিয়ে ম্যানেজারের গলার জামার কলারটা চেপে ধরল। তার হাতের চাপে মিগননকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো ম্যানেজার। আর ছাড়া মেয়ে মিগনন তীরবেগে কোথায় ছুটে পালিয়ে গেল। লোকটা তখন আস্ফালন করতে বলতে লাগল, কোথায় পালাবি, আমি তোকে খুন করব। তুই ডিমের নাচ দেখাব বলে দর্শকদের দেখাসনি। 

উইলেম বলল, তার আগে এই শহরের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গিয়ে তোমাকে বলতে হবে ওকে কোথা থেকে তুমি চুরি করে এনেছ? আমি তোমাকে সহজে ছাড়ব না। এর জন্য যেখানে যেতে হয় যাব। 

ম্যানেজার তখন বলল, আমি ওর পেছনে যা খরচ করেছি সেই খরচটা আমাকে দিয়ে দিন। তারপর ওকে নিয়ে যা খুশি করুন। আমাদের দেখার দরকার নেই। 

উইলেম বলল, ঠিক আছে। খেলা ভেঙে যাক। আমি তোমার দাবি মিটিয়ে দেব। 

অনুষ্ঠান শেষে হ্যাঁনেজারকে একশো ডুকেট দিয়ে মিগনানকে যুক্ত করল উইলেম। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। উইলেমের ভয় হতে লাগল ভয়ে ও মনের দুঃখে কোনও পুকুরে ঝাঁপ দেয়নি তো বেচারি। 

পরের দিন সকালেই নাচের দল তাঁবু গুটিয়ে চলে গেল। আর তার কিছু পরেই কোথায় হতে মিগনন এসে হাজির হলো উইলেমের সামনে। উইলেম তখন বাইরের ঘরে লার্তেনের সঙ্গে বসেছিল। লার্তেস বলল, কোথায় ছিলি। এখন থেকে তুই মুক্ত। তোমাকে আমরা কিনে নিয়েছি লোকটার কাছ থেকে। 

মিগনন খুশি হয়ে বলল, কত দাম দিতে হয়েছে?

লার্তেস বলল, একশো ডুকেট।

আর কোনও কথা না বলেই ওদের ঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেল মিগনন। 

হঠাৎ রাস্তায় গোলমাল শুনে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উইলেম দেখল, একটা চতুর্দোলায় নাসিস আর লান্দ্রিনেত্তাকে বসিয়ে বাহকরা শহর পরিক্রমা করছে। খেলোয়াড়ের জনপ্রিয়তার কথা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে তাই তাদের যাবার সময় তাদের একবার দেখার জন্য বিরাট ভিড় জমে যায় পথের দুধারে দুপাশের বাড়িগুলোর বারান্দা ও ছাদে। সমগ্র দল তাদের জন্য গর্বিত। তাই তাদের নিয়ে সারা শহর পরিক্রমার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। নাসির্স ও লান্দ্রিনেত্তার খাতির ও জনপ্রিয়তা দেখে সমগ্রভাবে নাট্যশিল্প সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগল উইলেমের মনে। লার্তেস ও ফিলিনাকে বলল উইলেম, জনগণের কাছ থেকে এই বিপুল শ্রদ্ধা ও সম্মান লাভ করা কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব? সত্যিকারের প্রভাবশালী অভিনেতার মর্যাদা দিতে মানুষ জানে। 

উইলেমের কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারল না লার্তেস। লার্তেস ও ফিলিনা দুজনেই তাই চুপ করে রইল। 

ফিলিনা আর মিগনন দুজনেই বেশ একটা গভীর ছাপ ফেলেছিল উইলেমের মনে। ওদের দুজনের কাউকে ছেড়ে যেতে মন সরছিল না তার। তাই যাই যাই বা উঠি উঠি করেও যেতে পারছিল না। তাই কাজের অজুহাত দেখিয়ে আরও কিছুদিন বয়ে গেল হোটেলটায়। লার্তেস ও ফিলিনার সাহচর্যে দিনগুলো তার কোনওমতে কেটে যাচ্ছিল। 

এমন সময় হঠাৎ একদিন মেলিনা আর তার নবপরিণীতা স্ত্রী এসে হাজির হলো সেই হোটেলটায়। মেয়েটির বাবাকে বলে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা উইলেমই করে দেয়। বিয়ের পরে ওদের ঘরে জায়গা দিতে রাজি হয়নি মেয়ের বাপ। তাই তারা কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে। মেলিনা ভালো অভিনতো বলে ভালো থিয়েটারের দলের সন্ধান করে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে। কার কাছে এই ধরনের এক থিয়েটারের দলের সন্ধান পেয়েই এখানে এসে হাজির হয়েছে এরা। 

উইলেম লার্তেস ও ফিলিনার সঙ্গে মেলিনাদের পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, ওরা দুজনেই সুযোগ্য অভিনেতা। কিন্তু ওদের তেমন পছন্দ করল না লার্তেস ও ফিলিনা। বরং ওদের মনে হলো ওদের তিনজনের মিলিত সাহচর্যে কেমন সুন্দরভাবে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। তার মাঝে কোথা হতে একটা বাধা এসে জুটল। 

মেলিনা কিন্তু যে কাজের জন্য এখানে এসেছে তার কথা একবারও ভুলে যায়নি। সে শুনেছে এখানে একটা থিয়েটারের দল ছিল। সে দলের পোশাকগুলো এখনও আছে। শুধু কিছু টাকা হলেই একটা নূতন দল খোলা যায়। 

একদিন উইলেমকে সঙ্গে করে পোশাকগুলো দেখতে গেল মেলিনা। একটা ভালো থিয়েটার দলে যা যা পোশাক দরকার তা সব আছে। পোশাকগুলো একটা ঘরের মধ্যে দেখে নূতন করে তার অবদমিত নাট্যপ্রীতি হঠাৎ জেগে উঠল উইলেমের মনে। মেলিনা বলল এই সব দামী পোশাক পাওয়া ভাগ্যের কথা। শুধু দুশো ক্রাউন হলেই দলটা চালু করা যায়। মেলিনা লার্তেস ও ফিলিনাকে দলে নিতে চাইল। তারপর উইলেমের কাছ থেকে টাকা চাইল। মেলিনা প্রস্তাব দিল উইলেম টাকাটা দিয়ে দলের মালিক হতে পারে। ওরা অভিনেতা হিসাবে তার অধীনেই কাজ করবে। 

উইলেম বলল, সে বাড়ি ফিরে গিয়ে কথাটা ভেবে দেখবে। বাড়ি না গিয়ে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু মেলিনা বার বার টাকার জন্য চাপ দিতে থাকায় সে তার বন্ধু ওয়ার্নারকে সব কথা জানিয়ে একটা চিঠি দিল। 

এদিকে মিগননের প্রতি দিনে দিনে মায়াটা বেড়ে যাচ্ছিল উইলেমের। মেয়েটা অদ্ভুত ছটফটে আর চঞ্চল। কিন্তু খুব ভোরে ওঠে। সব কাজ ঠিকমতো করে। রাত্রে একটা মেঝের উপর শোয়। কিন্তু কোনও বিছানা নেয় না। অনেক করে বলা সত্ত্বেও নেয় না। 

সেদিন হোটেলের বসার ঘরে ওরা তিনজন বসেছিল এমন সময় একজন বৃদ্ধ দুটি তরুণীকে নিয়ে হোটেলে এসে উঠলেন। হোটেলে সে কখন নূতন লোক আসছে সেদিকে ফিলিনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল সব সময়। একটু সুযোগ পেলেই লোকেরা পিছনে লাগতে ছাড়ত না। আবার এক মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নিতেও পারত। 

বুদ্ধ ভদ্রলোকের পোশাক-আশাকের মধ্যে কিছু দৈন্যের ছাপ ছিল। অথচ তাকে দেখে বেশ বিদগ্ধজন বলেও মনে হচ্ছিল। তাকে দেখে উইলেম কিন্তু এক নজরেই চিনে ফেলল। সে তাদের শহরে অতীতে অনেকবার মঞ্চে মেরিয়ানার সঙ্গে অভিনয় করতে দেখেছে ভদ্রলোককে। তিনি মেরিয়ানাকে অভিনয় করতেও শেখান। বহুদিন পর ভদ্রলোককে দেখে মেরিয়ানার ভুলে যাওয়া কথাগুলো আবার মনে পড়ল উইলেমের।

ফিলিনা তার বালক ভৃত্যকে ডেকে বলল, আমাদের খাবার টেবিল সাজাও, এঁদের নিয়ে আমরা একসঙ্গে খাব। কিন্তু ফ্রেডারিক রেগে গিয়ে বলল, আমি শুধু আপনার কাজ করার জন্যই নিযুক্ত। আর পাঁচজনের জন্য আমি খাটতে পারব না। 

ফিলিনা তখন রেগে গিয়ে বলল, তাহলে তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। তুমি যেতে পার।

ফ্রেডারিক তৎক্ষণাৎ তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেল। উইলেম সঙ্গে সঙ্গে মিগননকে ডেকে বলল, এই ভদ্রমহিলা যা যা বলবেন সব শুনবে। 

খাবার সময় উইলেম কিন্তু বেশি কথা বলল না। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পানে। সে শুধু ভাবছিল একটুখানি সুযোগের কথা। একটু সুযোগ। পেলেই বৃদ্ধকে কোথাও আড়ালে নির্জনে নিয়ে গিয়ে মেরিয়ানার কথা জিজ্ঞাসা করবে। মেরিয়ানা এখন কোথায় কি করছে তা জানতে ইচ্ছা করছে তার। এ ইচ্ছা ক্রমশ প্রবল আর অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে তার মনে। 

খাওয়ার পর বৃদ্ধকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে বার হলো উইলেম। একথা-সেকথার পর মেরিয়ানার কথাটা তুলল সে। সে এখন কি করছে কোথায় আছে তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানেন কি না এই সব প্রশ্ন একের পর এক তুলে ধরল সে বৃদ্ধের কাছে। 

প্রশ্ন শুনে বিরক্তির সঙ্গে নাসিকা কুঞ্চিত করলেন বৃদ্ধ। বললেন, ঐ ঘৃণ্য মেয়েটার কথা আর তুলবেন না মশাই। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আমি ওর কথা আর কখনও ভাবব না। 

উইলেম একবার ভাবল সে প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে দেবে। কিন্তু বৃদ্ধ অত সহজে থামবেন না। তার আগে উথলে উঠেছে অন্তরে। তিনি তার সব কথা বলবেন। তিনি বললেন, তার সঙ্গে একদিন আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল এটা ভাবতেও এখন লজ্জাবোধ হয় আমার। আপনি যদি একে চেনেন তাহলে কেন একথা বলছি তার মানেটা বুঝতে পারবেন। প্রথমে তো মেয়েটাকে ভালোই লেগেছিল। দেখতে সুন্দরী, স্বভাবও নম্র বিনয়ী, তার আচরণও ভালো। কিন্তু ওসব উপরকার ব্যাপার। তখন বুঝতেই পারিনি মেয়েটা এতদূর অবিবেচক এবং অকৃতজ্ঞ হতে পারে। 

হঠাৎ বৃদ্ধের চোখে জল এল। তা দেখে ব্যস্ত ও বিব্রত হয়ে পড়ল উইলেম। তবে কি কোনও খারাপ খবর আছে? খবর যাই হোক সব জানতে চায় উইলেম। সে জিজ্ঞাসা করল, কি হলো? আপনি সব কিছু বলে যান। আমি শুনতে চাই। কিছুই লুকোবেন না। 

বৃদ্ধ বললেন, বলার আর কীই বা আছে। আমি তার জন্য যে মনোবেদনা লাভ করেছি তা ক্ষমার অতীত। অথচ একদিন মেয়েটা আমাকে বিশ্বাস করত। আমার কথা মান্য করে চলত। আমার স্ত্রী তখন বেঁচে ছিল। আমি তাকে আপন মেয়ের মতো স্নেহ করতাম। আমি তাকে আমার নিজের বাড়িতে নিজের মেয়ের মতো রাখার এক পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী হঠাৎ মারা যেতেই সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।

আজ হতে বছর তিনেক আগে যখন আমি আপনাদের শহর ছেড়ে চলে যাবার উদ্যোগ করি তখন এক বিষাদময় ভাবান্তর লক্ষ্য করি মেরিয়ানার মধ্যে। লক্ষ্য করি সে সন্তানসম্ভবা। সে নিজেও তা স্বীকার করে এবং সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারের ম্যানেজার তাকে অভিনয়ের কাজ থেকে বরখাস্ত করবে এই ভেবে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। পরে দেখা যায় ম্যানেজার কোনওভাবে কথাটা জানতে পেরে সত্যি সত্যিই তাকে বরখাস্ত করে। তারপর আমি শহর ছেড়ে চলে আসি। 

বৃদ্ধের প্রতি মেরিয়ানা কি অন্যায় করেছে এবং তার প্রকৃত দোষ কোথায় বৃদ্ধ তা বললেন না। তাঁর বলা এত কথার মাঝে কোথাও তা পাওয়া গেল না। উল্টে তার কথার ফাঁকে শত দোষারোপ এবং কটুক্তি সত্ত্বেও মেরিয়ানার প্রতি তাঁর স্নেহশীল আসক্তি আর অনুকম্পার ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

বৃদ্ধের সব কথা শুনে মেরিয়ানার সঙ্গে তার প্রেম সম্পর্কের প্রসঙ্গটা আবার উঠে এল তার মনের উপর। বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজখবর নেবার এক অদম্য আগ্রহ জাগল সঙ্গে সঙ্গে। গভীর রাত্রিতে শোবার ঘরে ঢুকে উইলেম স্পষ্ট বুঝতে পারল আজ রাত্রে ঘুম আসবে না তার চোখে। এমন সময় হঠাৎ মিগনন এসে একটা প্রার্থনা জানাল তার কাছে। এখন মিগননই তার একমাত্র সান্ত্বনা। মিগননের আনুগত্য আর সরলতার তুলনা হয় না। মেয়েটাকে দারুণ ভালো লাগে তার। তার প্রতি অন্তহীন মমতা জাগে অন্তরে। 

মিগনন বলল, আজ সে সেই ডিমের নাচ দেখাবে তাকে যে নাচ না দেখাবার জন্য ম্যানেজার তাকে একদিন নির্মমভাবে প্রহার করে এবং দল ছাড়তে হয় তাকে। তবে এ ঘরে আর কেউ থাকবে না। 

খুশির সঙ্গে রাজি হলো উইলেম। একটানা ভাবনা-চিন্তা থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি পাবে, পাবে এক মিষ্টি বৈচিত্র্যের আস্বাদ। প্রথমে বাইরে থেকে একটা কার্পেট বয়ে আনল মিগনন। তারপরে সেটা ঘরের মেঝের উপর পেতে দিল। তার চার কোণে চারটা বাতি জ্বেলে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর একজন বেহালাদারকে ডেকে এনে ঘরের এক কোণে বসিয়ে দিল। এরপর আনল এক ঝুড়ি ডিম। ডিমগুলো বার করে সারা কার্পেটের সর্বত্র এমনভাবে ছড়িয়ে রাখল যাতে একটি ডিম থেকে আর একটি ডিমের মাঝে ফাঁক থাকে এবং একটি পা রাখার মতো জায়গা রেখে ডিম সাজিয়ে রাখার পর কাপড় দিয়ে চোখ দুটো বেঁধে দিল মিগনন। 

সব প্রস্তুতি শেষে নাচ শুরু করল মিগনন। সে এক আশ্চর্য নাচ। বেহালার ঝঙ্কারের তালে তালে মিগনন যখন পা ফেলে ফেলে নেচে চলছিল তখন প্রতি মুহূর্তে উইলেমের মনে হচ্ছিল এই বুঝিবা ডিমের গায়ে তার পা লেগে যাবে অথবা একটা ডিমের সঙ্গে অন্য ডিমের ঠোকাঠুকি হবে। কিন্তু একটি ডিমের গায়ে একটিবারের জন্য তার পা লাগল না। চোখ বাঁধা থাকলেও এমনভাবে পা ফেলছিল মিগনন আর সেই সতর্কিত প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে ভয়ঙ্কর অথচ মধুর একটা ছন্দ ছিল যা না দেখলে বা না শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। বেহালার সুরঝঙ্কার মিগননের পায়ের সেই অবিশ্বাস্য ও একাধারে ভীষণ সুন্দর ছন্দটাকে মূর্ত করে তুলছিল। 

নাচের শেষের দিকে পায়ে করে একে একে সব ডিমগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে রাখল মিগনন অভ্রান্তভাবে। তারপর নিজের হাতে চোখের বাঁধনটা খুলে দিয়ে প্রথাগত ভঙ্গিতে মাথাটা নত করে উইলেমের সামনে। অবশেষে আবার ডিমের ঝুড়ি আর কার্পেটটা গুটিয়ে ঘর থেকে চলে যাবার জন্য তৈরি হলো। উইলেম খুশি হয়ে বলল, আমি তোমার নাচ দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি মিগনন। আমি তোমাকে একটা পোশাক করিয়ে দেব। 

মিগনন তখন বলল, পোশাকটা যেন আমার স্যুটের রঙের মতো হয়। এখন আপনার কিছু দরকার আছে? 

উইলেম বলল, না, তুমি শোওগে। 

বেহালাবাদক উইলেমের কাছে এসে বলল, ও অনেকদিন ধরে আমাকে এই বাজনার কথা বলছে। আমার পারিশ্রমিকও দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি নিইনি। আমি প্রথমে এ নাচের বাজনা জানতাম না। ওই আমাকে এর সুর শিখিয়ে তৈরি করে নিয়েছে। 

উইলেম বলল, এ নাচের কথা সেদিন প্রথমে শোনার পর থেকে দেখার ইচ্ছা। হচ্ছিল। আজ তা দেখে প্রচুর আনন্দ পেলাম। 

যাই হোক, রাতটা কেটে গেল উইলেমের। দু-একবার মেরিয়ানার কথাটা মনে এলেও মোটের উপর ঘুম হয়েছিল। সকাল হতেই মিগননের ডাকে ঘুম ভাঙল। দর্জিকে সঙ্গে করে ডেকে এনেছে মিগনন। আর পোশাকের কাপড়ও পছন্দ করে এনেছে দর্জির মারফৎ। আকাশী-নীল রংটা খুব পছন্দ মিগননের। অথচ প্রেমের ব্যাপারে ঘা খাবার পর থেকে একমাত্র ধূসর রং ছাড়া আর কোনও রং পছন্দ হয় না উইলেমের। 

কিছুটা বেলা হবার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিনা ও লার্তেস দুজনে আবার এক নূতন জায়গায় বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করল। এবার ওরা নৌকোয় করে যাবে। এক একদিন এক-এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সেখানে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে সবাই মিলে খাওয়ার মধ্যে সত্যিই এক আনন্দ আছে যা ঘরের মধ্যে পাওয়া যায় না। 

সানন্দে রাজি হয়ে গেল উইলেমস। ওদের সঙ্গে সেই বৃন্ধ আর মেলিনা-দম্পতিও। আছে। আজ ওরা নদীপথে নৌকোয় করে বেশ কিছুটা যাবার পর নদীর ধারে কোনও এক মনোমতো জায়গায় নেমে বসবে ও খাবে। 

মোটামুটি ওরা সবাই অভিনেতা। লার্তেস ও ফিলিনা, মেলিনা, বৃদ্ধ-এরা সবাই। পেশাদার অভিনেতা। উইলেম পেশাদার অভিনেতা না হলেও নাট্যকার এবং অভিনয় বোঝে। ফিলিনা নৌকোতে উঠে একটা প্রস্তাব করল, ওরা মুখে মুখে এই নৌকোয় একটা নাটকের অভিনয় করবে। এমন সময় নদীর এক ঘাট থেকে এক যাজক এসে। ওদের নৌকোয় উঠল। তাকেও ওরা দলে টেনে নিল। সব মিলিয়ে দৈনন্দিন কতকগুলো বাস্তব ঘটনা নিয়ে নাটক বেশই জমে উঠল। কারণ ওরা প্রত্যেকেই অভিনেতা। ওদের সহজাত অভিনয় প্রতিভার জোরে একজনের সংলাশ শেষ না হতে হতে আপনা থেকে সংলাপের কথা এসে যাচ্ছিল ওদের মুখে। 

অভিনয় শেষ হয়ে গেলে মাঝি নদীর কূলে এক জায়গায় নৌকো ভেড়াল। ওরা নেমে খাওয়া সেরে নিল। তারপর কিছুক্ষণ এখানে-সেখানে বেড়াল। উইলেম সেই যাজকের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। 

কিন্তু ফিরে যাবার জন্য রওনা হবার সময় সেই যাজককে আর কোথাও পাওয়া গেল না। মেলিনার স্ত্রী বলল, এটা অভদ্রতা। যাবার সময় আমাদের কাছ থেকে ভদ্রভাবে বিদায় নিতে পারত। 

দুটো ঘোড়ার গাড়িতে করে ওরা রওনা হলো। ফেরার পথে আর নৌকায় করে গেল না। ফিলিনা ও মেলিনার স্ত্রী উইলেমের উল্টো দিকে বসল। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার। সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল ফিলিনা। গান গেয়ে সারা পথটা কাটাল সে। 

মেরিয়ানার সঙ্গে তার প্রেমসম্পর্কটা ছিন্ন হওয়ার পর উইলেম নারীদের প্রতি খুব সতর্ক হয়ে উঠেছিল মনে মনে। প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনও নারীর বাহুবন্ধনে ধরা। দেবে না। তার মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল যে নারীমাত্র চটুল প্রেমাভিনয়ে সিদ্ধ এক-একটি ছলনাময়ী। তাই যাতে কোনও ছলনাময়ীর বিলাসকলার কবলে না। পড়ে তার জন্য সদাজাগ্রত থাকত সব সময়। কোনও নারীর প্রতি কখনও কোনো কামনা জাগলেও সে কামনাকে ব্যক্ত করত না কখনও বাইরে। বুকে চাবি দিয়ে ভরে রাখত সেই অব্যক্ত কামনাকে। 

এমন সময় ফিলিনা এল তার জীবনে। গানে-গল্পে, অভিনয়ে-হাসিতে, হুল্লোড়ে সব সময় ভরে দিতে লাগল তার মনটাকে। পান্থশালার এক অচেনা মেয়ে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে তার মনটাকে একথা কখনও ভাবতে পারেনি উইলেম। মেরিয়ানার আঘাত, তার অভাব ও বিচ্ছেদ যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল তার মনে সে শূন্যতার অনেকখানি আপনা থেকে পূরণ করে দিল ফিলিনা। অথচ প্রতিদানে কিছুই চাইল না তার কাছ থেকে। এখানে আসার প্রথম দিনে ফিলিনা তার ঘরে তাকে যে সব প্রসাধন্দ্ৰব্য দিয়েছিল ভদ্রতা ও সৌজন্যের খাতিরে তার জন্য তাকে একটা উপহার। দেবে বলেছিল উইলেম। কিন্তু সে উপহার আরও দেওয়া হয়নি। 

হোটেলে ফিরে এসে সবাই উঠল উইলেমের ঘরে। কারণ তার ঘরটাই বেশ গোছাল অবস্থায় ছিল। বৃদ্ধের কাছে একটা নাটকের বই ছিল। ওরা এসেই সেই নাটক থেকে অভিনয় করতে লাগল। 

পরদিন সকালে উঠেই উইলেম শুনল গতকাল লার্তেস তার যে ধার করা ঘোড়াটা করে বেড়ানোর জায়গা থেকে আসছিল সেটা পথে পড়ে যায়। লার্তেস ঘোড়ায় চড়তে বা চালাতে ভালো জানে না। ফলে পড়ে গিয়ে ঘোড়টা এমন আঘাত পায় যে তার সেরে উঠতে অনেক সময় লাগবে। ঘোড়া হোটেলের মালিকের কাছ থেকে ধার করা। উইলেম ঘোড়ার মালিককে জানিয়ে দিল তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সে দেবে। 

হোটেলের মালিক তার ঘর থেকে চলে যেতেই ফিলিনার ঘরের দিকে তার চোখ পড়ল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ফিলিনা তাকে নমস্কার করছে। সঙ্গে সঙ্গে তার সেই প্রতিশ্রুত উপহারের কথাটা মনে পড়ে গেল। 

একটু পরে দোকানে গিয়ে উপহার কিনে আনে উইলেম। আনে দুটো কানের দুল, একটা টুপি, একটা নেকটাই আর কিছু প্রসাধদ্রব্য। এই উপহারগুলো যখন ফিলিনার হাতে তুলে দেয় উইলেম তখন তা মাদাম মেলিনা দেখে। দেখে ঈর্ষাবোধ করে। ভাবে ফিলিনার প্রতি দুর্বলতা আছে উইলেমের। সে কথা মাদাম মেলিনা ঠাট্টার ছলে প্রকাশ করলে উইলেম বলল, যে মেয়ের সব কিছু আমি জানি, যার জীবনযাত্রার প্রতিটি খুঁটিনাটি আমার সব জানা তার প্রতি কোনও ভালোবাসাই অনুভব করি না। আসলে ফিলিনাকে দেওয়া আমার এই উপহার বন্ধুত্ব আর সৌজন্যের পরিচায়ক। তবু কিন্তু এ যুক্তিতে সন্তুষ্ট হলো না মাদাম মেলিনা। 

হোটেলের মালিক একজন অচেনা বৃদ্ধ গায়ককে নিয়ে এল। সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ইনি একজন ভালো গায়ক। আপনাদের কাজে লাগবে। এর গান শুনে দেখতে পারেন। 

মেলিনা বলল, উনি যেতে পারেন। আমাদের এত সময় নেই।

কিন্তু ফিলিনা জেদ ধরল, ওরা গান শুনবেই। 

প্রথমে বীণা বাজাতে শুরু করল বৃদ্ধ। অপূর্ব তার সুরঝঙ্কার। মুগ্ধ হয়ে গেল উপস্থিত সকলে। বৃদ্ধকে উইলেম অনুরোধ করল, আপনি একটা বাজনার সঙ্গে একটা গান করুন। বাণীহীন সুর আকাশপথে উড্ডীয়মান অধরা পাখির মতো। কিন্তু বাণীময় সঙ্গীতের সুর শুনে মনে হয় আকাশগামী অধরা পাখিটা হাতে এসে ধরা দিয়েছে। শধু তাই নয়, আমাদের মধ্যেও আকাশপিপাসা জাগিয়ে আমাকেও কোথায় যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধে একটি বড় গান গাইল বৃদ্ধ! বেশ ভরাট মিষ্টি গলা। সে গানের বিষয়বস্তু ছিল মানবতা, ভালোবাসা, দেশপ্রেম প্রভৃতি কতকগুলো গুণের জয়গান। তার গলাটা এমনি মিষ্টি ও ভরাটি যে সে গাইছিল আর সকলের শুনতে ভালো লাগছিল। তার গান থামলে ফিলিনা বলল, আপনি সেই রাখাল তাকে সাজাও, এই গানের সুরটা বাজাতে পারবেন? তাহলে আমি গানটা গাইব। 

বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বীণাটা তুলে বাজাতে লাগল। তার তালে তালে গান গাইতে লাগল ফিলিনা। ফিলিনা ভালোই গাইল। তার গান শেষ হলে বৃদ্ধকে মন দিয়ে। আপ্যায়িত করা হলো। উইলেম উঠে গিয়ে বৃদ্ধের হাতে একটা মুদ্রা দিল তার পারিশ্রমিক হিসাবে। বলল, আবার আপনার গান শোনা যাবে। তার দেখাদেখি অন্যান্য সকলেও কিছু কিছু দিল। তবে উইলেমই দিল সবচেয়ে বেশি। 

উইলেম যাবার আগে ফিলিনাকে বলল, তোমার গানটা কাব্যিক বা নীতিবাগীশ না হলেও মঞ্চে এইভাবে গাইলে প্রচুর প্রশংসা পাবে দর্শকদের কাছ থেকে। এই বৃদ্ধ 

দ্রলোকের বাজনার হাত ও গানের গলা অনেক শিল্পীকেই হার মানিয়ে দেবে। হয়ত লক্ষ্য করে থাকবে ওর গানের মধ্যে অনেক নাট্য উপাদান আছে। যেগুলো গীতিনাট্যে প্রয়োগ করা যেতে পারে। 

মেলিনা বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলল, আমাদের মতো শিল্পীকে উনি লজ্জা দিতে পারবেন কি না জানি না। তবে একটা বিষয়ে সত্যিই উনি আমাদের হারিয়ে দেবেন। সেটা হচ্ছে নিজের কাজ গুছিয়ে নেবার বা স্বার্থপূরণের কৌশল। দুদিন পরে কি করে আমাদের খাবার জুটবে বলে আমরা যখন ভাবছি তখন উনি আমাদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছেন। যে পয়সা দিয়ে আমরা চাকরির খোঁজ করে বেড়াবো, উনি কৌশলে তাতেও তার ভাগ নিচ্ছেন। 

কথাটা শুনে খুবই দুঃখিত হলো উইলেম। মনে হলো এটা যেন তাকেই লক্ষ করে বলা। কারণ সে আর ফিলিনাই বৃদ্ধের প্রতি বেশি শ্রদ্ধাশীল। এরপর উইলেমকে সরাসরি আক্রমণ করল মেলিনা। আজ একপক্ষকাল হয়ে গেল। থিয়েটারের পোশাক বাছাই করে বন্ধক দেওয়া আছে, আমরা আশা করে বসে আছি অথচ আপনি টাকা দিলেন না। অথচ টাকার জন্য বাড়িও যাই যাই করে গেলেন না। আপনি টাকা দিলে এতদিন আমরা কাজ শুরু করে দিতাম। অথচ আপনি বাজে খরচ ঠিকই করে যাচ্ছেন। 

এবার রেগে গেল উইলেম। বলল, সেই এই ধরনের অকৃতজ্ঞ এবং হৃদয়হীন লোকদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চায় না। 

হোটেলের বাইরে ঘরে একা বসেছিল উইলেম। এমন সময় ফিলিনা গান করতে করতে এসে তার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে আবদারের ভঙ্গিতে বলল, মেলিনার জন্য আমরা এ হোটেলে আর থাকব না। কাছাকাছি অন্য এক হোটেলে উঠে যাব। তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো। তাছাড়া তোমার এখন বাড়ি যাওয়া হবে না। 

উইলেম বলল, তুমি কি পাগল হয়েছ ফিলিনা? আমার এখানে থাকা চলবে না। আমাকে এবার বাড়ি যেতেই হবে। আমাকে ছেড়ে দাও। 

ফিলিনা তাকে আরও জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে করতে বলল, তাহলে তো কিছুতেই ছাড়ব না। 

উইলেম বলল, কি করছ? লোক রয়েছে যে। 

সত্যিই তাদের কাণ্ড দেখে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দু-চারজন লোক জড়ো হয়ে দেখছিল। ফিলিনা তাদের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বকে উঠতেই তারা চলে গেল। লজ্জার ভয়ে আর জোর করার চেষ্টা না করে নীরবে শান্তশিষ্ট স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে লাগল উইলেম। ফিলিনা বলল, আগে কথা দাও, এখন চলে যাবে না, তবে ছাড়ব। 

অবশেষে প্রতিশ্রুতি দিল উইলেম। সে আগামী বা পরের দিন বা তারপরের দিনও বাড়ি যাবে না। 

কথা পেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল ফিলিনা। দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল, আমি একবার আমার ঘরে যাচ্ছি, আমার দরকার। ফিরে এসে যেন আমি তোমাকে এখানেই দেখি। 

ফিলিনা চলে গেল। উইলেম কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে পড়ল। কোনও প্রয়োজন ছিল না, তবু মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যেতে লাগল মেলিনার ঘরের দিকে। এক রহস্যময় দুর্বোধ্য প্রবৃত্তির তাড়নায় সে যেন না গিয়ে পারল না। কিন্তু মেলিনার ঘরে কাছে যেতেই সে এসে ক্ষমা চাইল তার কাছে। বলল, রাগের মাথায় যা তা বলে ফেলেছি, কিছু মনে করবেন না। আমার হাতের টাকা ফুরিয়ে আসছে, নিজের স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ক্ষমতা নেই। তার উপর সন্তান আসছে। তাই কোনো আনন্দের আসর বা উৎসব আমার ভালো লাগে না, সব সময় চাকরি বা কাজ-কারবারের কথা ভাবি। প্রাণ খুলে হাসতে বা আনন্দ উপভোগ করতে পারি না আপনাদের মতো। আমাকে ক্ষমা করবেন। 

মেলিনার কথা শুনে শান্ত হলো উইলেম। বলল, ঠিক আছে, আজই রাতে না হয় সকালে তোমাকে টাকা দেব আমি। 

হঠাৎ ফিলিনার সেই বালকভৃত্য ফ্রেডারিককে ফিরে আসতে দেখে বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে এলে উইলেম। এসে দেখল মিগনন কি লিখছে। মন ভালো থাকলে তার লেখাটা নিয়ে দেখত, তার বিচার করত। কিন্তু আজ কিছু না বলে বিশ্রামের জন্য পোশাকটা খুলতে লাগল। এমন সময় হোটেলের সদর দরজার কাছে চোখ পড়তেই দেখল ঘোড়ায় চেপে কে একজন গণ্যমান্য আগন্তুক এসে হাজির হলো। আর হোটেলের মালিক ব্যস্তভাবে তার দিকে ছুটে গেল। 

কৌতূহলের বশে উইলেম তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হোটেল মালিক বলল, হের স্টলমেস্তার, অবশেষে আমাদের মনে পড়ল? 

আগন্তুক ঘোড়া থেকে না নেমেই বলল, কাউন্ট তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আসছেন। প্রিন্স ডনের সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে দিনকতক থাকবেন তারা।

হোটেল মালিক বলল, আপনিও থাকলে ভালো হতো। ঘর আছে, কোনও অসুবিধা হবে না।

হঠাৎ মনটা কেমন যেন চঞ্চল হয় উঠল উইলেমের। সে সেখানে আর না দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধ বীণাবাদক ও গায়কের সন্ধানে চলে গেল। শুনল সে নাকি একটা অখ্যাত পল্লীতে চলে গেছে। খুঁজে খুঁজে একটা বাড়িতে তার বাজনা শুনতে পেল উইলেম। উইলেমকে দেখে খুশি হয়ে একটি গান স্পষ্ট ভাষায় গাইতে লাগল বৃদ্ধ। গানটার মানে হলো এই যে, যে কোনওদিন দুঃখ ভোগ করেনি, যে কোনওদিন চোখের জল ফেলেনি সে ঈশ্বরকে জানতে পারেনি, পারবেও না কোনওদিন। 

ঈশ্বরই আমাদের পৃথিবীতে নিয়ে আসেন, আমাদের পাপের পথে নিয়ে যান আবার তিনিই অনুতাপের মোচড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেন আমাদের অন্তরকে। 

প্রথমে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর বৃদ্ধের কাছে সরে গেল উইলেম। গান শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। চোখে জল আসছিল। রোধ করতে পারছিল না। যে বেদনা হিম হয়ে জমে ছিল এতদিন অন্তরে, এই সকরুণ সুরের আঘাতে উত্তাপে তা গলে জল হয়ে বেরিয়ে এল চোখ থেকে। 

গান থামলে উইলেমকে বৃদ্ধ বলল, আমি আজ সন্ধ্যায় আপনার জন্য ওখানে অপেক্ষা করেছিলাম। আপনাকে গান শোনাতে চেয়েছিলাম কিন্তু দেখতে না পেয়ে এখানে চলে আসি। 

উইলেম দেখল মেঝের উপর ছোট একটি বিছানায় বসে আছে বৃদ্ধ। এছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। উইলেমও সেখানে বসে বলল, গান শোনাবার এটাই হলো উপযুক্ত জায়গা। যেখানে অন্য কোনও মানুষ নেই সেখানেই আপনার আত্মা ধরা দেবে আপনার কাছে। যে গান আমাকে শোনাতে চেয়েছিলে সেই গান আমাকে শোনাও বন্ধু। 

গান শুনে হোটেলে ফিরে এসে উইলেম দেখল মেলিনা একজন উকিল সঙ্গে করে টাকা ধার করতে এসেছে তার কাছে। উইলেম তাকে তিনশো ক্রাউন দিল। মেলিনা তার বিনিময়ে থিয়েটারের মালপত্র সব বন্ধক রাখল তার কাছে। বলল, কাল সকালে সেগুলো তার কাছে নিয়ে আসবে। মেলিনা চলে গেলে হঠাৎ ফ্রেডারিকের চিৎকার শুনে বাইরে গিয়ে দেখল তার সামনে মিগনন অবাক হয়ে দেখছে ফ্রেডারিককে। ফ্রেডারিক পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে। আসল ঘটনাটা জানতে পারল হোটেলের মালিকের কাছ থেকে। আসল কথা হলো স্টলমেস্তার প্রথম দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিনার প্রেমে পড়ে গেছে। ফিলিনার কাছে একসঙ্গে খেতে চায়। ফিলিনা ফ্রেডারিককে খাবার টেবিল সাজাতে বলে। ফ্রেডারিক স্টলমেস্তারকে দেখেই রেগে যায়। তার উপর খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে যখন দেখে স্টলমেস্তার ফিলিনার পা ঘেঁসে বসে রয়েছে তখন সে খাবার সমেত একটা প্লেট স্টলমেস্তারের গায়ে ফেলে দেয় আর অসতর্কতার ভান করে। তাতে সে প্রতিশোধের আনন্দে নিজেই হেসে ওঠে আর স্টলমেস্তার তাকে একটা লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেয়। তাই বাইরে এসে ফ্রেডারিক পাগলের মতো শাসাচ্ছে। সে দেখে নেবে স্টলমেস্তারকে। 

কথাটা শুনে উইলেমের মনেও ঈর্ষা জাগল। জাগল লার্তেসের মনেও। তারা ভাবতেই পারেনি এত সহজে একজন বয়োপ্রবীণ আগন্তুকের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেবে ফিলিনা। 

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলল উইলেম। সে কালই বাড়ি চলে যাবে। আর এখানে একদিনও থাকবে না। নিজের ঘরে বসে বিছানায় শুয়ে আপন মনে বলে উঠল, আমি চলে যাব। তার বিষাদ দেথে মিগনন কাছে এসে বলল, কি হয়েছে মালিক। 

উইলেম বলল, আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি রে। 

মিগননের চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। কাঁদ-কাদ গলায় বলল, আমি তাহলে কোথায় যাব মালিক? আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাবে? 

হঠাৎ উইলেমের মনে হলো মিগনন হয়ত পড়ে যাবে। মূৰ্ছিত হয়ে পড়বে। সে তাকে ধরে নিল। জড়িয়ে ধরল। বারবার বলতে লাগল, আমি তোকে ছাড়ব না। চিরদিন আমার কাছেই রেখে দেব বাছা। আমার মেয়ের মতো থাকবি। হঠাৎ চোখ মেলে মিগনন বলল, তুমি আমার বাবা। আমি তোমার সন্তান। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পরদিন সকালে উঠে মিগননকে প্রথমে দেখতে পেল না উইলেম। কিছুক্ষণ পরেই একটা যন্ত্র হাতে গান গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকল মিগনন। সে গানের বাণী বড় চমৎকার! যেখানে আছে থোকা থোকা ফোঁটা ফুলে ভর্তি লেমন গাছ, আছে লম্বা লরেল আর ঘনসন্নিবিশস্ট মার্বেল, যেখানে ঘনকৃষ্ণ পাতার ফাঁকে ফাঁকে সোনার বরণ কমলালেবু দোল খায় আর অদূরের নীল সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাকে দুরন্ত বাতাস এসে খেলা করে এই সব গাছদের সবুজ সংসারে, জান কি সে জায়গা কোথায়? জান কি সে দেশে কোন দিকে? হে পিতা, হে আমার পিতা, আমি তোমাকে নিয়ে যাব সেই দেশে। 

গাণের বাণীটা ভালো লাগায় কাগজে টুকে নিল উইলেম। 

এদিকে গান শেষ হতেই মেলিনা ডাক দিল দরজার বাইরে। একটু আগে সে টাকা মিটিয়ে দিয়ে থিয়েটারের পোশাকগুলো নিয়ে এসেছে। এবার সে হাতের কাছে যে সব অভিনেতা-অভিনেত্রী রয়েছে তাদের নিয়ে চমৎকার একটা দল গড়তে পারে। উইলেমকে জানাবার মতো কৃতজ্ঞতার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না মেলিনা। সে বলল, আপনি আমাকে এই বিপদে সাহায্য করে যে মমতাপূর্ণ মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না আমি। আমি এবার এখানে আমার যে সব বেকার অভিনেতা বন্ধুরা রয়েছেন তাদের কাজ দিতে পারব। আপনার সঙ্গে আমার যখন প্রথম দেখা হয় তখন থিয়েটার ও অভিনয়ের প্রতি আমার গভীর বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের পর এ ধারণা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছি আমি। আমার স্ত্রী আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেও অভিনয় করবে এবং এর দ্বারা জীবনের চরম আনন্দ আর জনগণের প্রশংসা দুটোই অর্জন করবে। আমিও এখনও এটাকে পেশা হিসাবেই নিতে চাই। 

মেলিনার কথাগুলো শুনে খুশি হলো উইলেম। দেখল মেলিনার স্বভাবটা বদলে গেছে একেবারে। এখন সে সকলের প্রতি প্রতিটি আচরণে ভদ্র ও সৌজন্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

উইলেমের কাছ থেকে বেরিয়ে মেলিনা প্রতিটি অভিনেতার সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করতে লাগল। তার দলের যারা আসলে অভিনয় করবে তার শর্তাবলি সব জানিয়ে দিল তাদের। আপাতত অবশ্য তাদের বেশি বেতন দিতে পারবে না। কিন্তু দল একবার দাঁড়িয়ে গেলে তারা লাভবান হবে সকলে। 

এই সব কথাবার্তা চলতে থাকাকালেই কাউন্ট এসে হাজির। আগের দিন স্টলমেস্তার যে কাউন্টের আগমন ঘোষণা করেছিল সেই কাউন্ট এক গাড়ি মাল আর তার পত্নীকে সঙ্গে করে হোটেলে এসে উঠলেন। হোটেল নূতন যারা আসে তাদের। যেচে আলাপ করে ফিলিনা। স্বভাবটাই এইরকম। সব সময় হাসিখুশিতে ভরা থাকে যেমন তার মুখটা তেমনি মনেও কোনও মান-অপমান বোধ নেই। ফিলিনা সোজা। কাউন্টপত্নীর কাছে চলে গেল। 

কাউন্টপত্নী জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি? 

কাউন্টপত্নীর গাউনের আঁচলটাকে চুম্বন করে ফিলিনা। সরলভাবে হাসিমুখে বলল, সামান্য এক অভিনেত্রী, আপনার সেবায় সতত প্রস্তুত। 

এদিকে কাউন্টের চারদিকেও অন্যান্য অভিনেতারা ভিড় করেছে। এতগুলো অভিনেতাকে একটি হোটেলের মধ্যে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন কাউন্ট। স্ত্রীকে বললেন, এরা যদি ফরাসি হতো তাহলে এদের দিয়ে রাজপ্রসাদে একটা নাটক করিয়ে রাজাকে প্রীত করতাম। 

কাউন্টপত্নী বললেন, হলেই বা এরা জার্মান। এদের দিয়েও করানো যেতে পারে। এদের দলে যখন এতে লোক রয়েছে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া ব্যারন ওদের সাহায্য করতে পারেন। 

এরপর কাউন্ট একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন এই দলের ম্যানেজার কে, কত জন অভিনেতা আছে। মেলিনা এগিয়ে এসে ম্যানেজার হিসাবে পরিচয় দিল। কাউন্ট তখন সব অভিনেতাদের জড়ো করে বললেন এক জায়গায়। তিনি একজন নাট্যসমালোকও বটেন। তিনি নিজে সবাইকে দেখে অভিনেতাদের যোগ্যতা সম্বন্ধে একটা আঁচ করে নেবেন। সবশেষে বললেন, তোমার কোন নাটকটা মঞ্চস্থ করতে চাও তা জানাবে। 

অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সকলকে দেখার পর কাউন্ট সবচেয়ে খুশি হলেন সেই বৃদ্ধ অভিনেতাকে দেখে যে দুটি মেয়ে নিয়ে একদিন এসে ওঠে এই হোটেলে এবং যে একদিন মেরিয়ানার সঙ্গে উইলেমদের শহরে এক মঞ্চে অভিনয় করত। অথচ মেলিনা তাকে কাউন্টের সামনে হাজির করেনি। সে ঘরের এক কোণে বসেছিল। কাউন্ট বললেন, এ যে কোনও অভিনয় করতে পারবে।

বৃদ্ধ আধ-ময়লা আধ-ছোঁড়া পোশাক পরে মাথা নত করে কাউন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। কাউন্ট বললেন, হাস্যরসের ভূমিকা তো বটেই তাছাড়া যে কোনও ভুমিকায় 

অভিনয় কররার যোগ্যতা এর আছে। আমরা চোখ-মুখ দেখলেই বুঝতে পারি। 

ফিলিনা এদিকে উইলেমকে তার উপরকার ঘর থেকে জোর করে নিয়ে এল কাউন্টপত্নীর কাছে। তার কথা কাউন্টপত্নীর কাছে আগেই বলেছিল ফিলিনা। বলেছিল, আর একজন শিক্ষক ও সুন্দর যুবক আছে আমাদের দলে। সে নাটক ও কবিতা লিখতে পারে।

কাউন্টপত্নীকে নমস্কার করে দাঁড়াল উইলেম। তার পানে গভীর আগ্রহভরে তাকিয়ে লজ্জায় মাথাটা নত করলেন কাউন্টপত্নী। কাউন্টপত্নীকে দেখে ভালো লাগল উইলেমের। কাউন্টপত্নী বয়সে যুবতী এবং সুন্দরী। তাঁর চোখ-মুখে চমৎকার একটা মার্জিত ভাব। 

এমন সময় কাউন্ট ফিরে এলে উইলেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু কাউন্ট তার প্রতি কোনও বিশেষ মনোযোগ দিলেন না। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। কাউন্টপত্নী উইলেমের পানে তাকিয়ে বললেন, আবার আমাদের দেখা হবে। এখন চলি। 

তারপর ফিলিনাকে কাউন্টপত্নী বললেন, তুমি কিন্তু আবার আমার কাছে আসবে মেয়ে। তবে পোশাকটা একটু ভালো পরবে। 

ফিলিনা বলল, আমার এর থেকে ভালো পোশাক নেই। 

কাউন্টপত্নী তখন সঙ্গে তার প্রতীক্ষমানা এক সহচরীকে একটা সিল্কের গলবন্ধনী আর একটা টুপি আনতে বললেন। তার নিজের হাতে তা ফিলিনাকে পরিয়ে দিলেন। 

কাউন্টের কথায় রাজপ্রাসাদে একখানা নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে যাবতীয় ব্যবস্থাদি করার জন্য এক ব্যারনও সামন্ত এসে কথা বলতে লাগল মেলিনার সঙ্গে। মেলিনা এটার প্রতীক্ষা করছিল। তার প্রত্যাশা অনেক এ বিষয়ে। রাজপ্রাসাদে অনুষ্ঠান করার জন্য বায়না হলেই তার দল জাতে উঠে যাবে। প্রথম কথা ওই অনুষ্ঠানের জন্য যে টাকা সে পাবে তাতে উইলেমের ঋণ অর্ধেক শোধ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় কথা হলো এই যে, শহরে তাদের দলের নামটা ছড়িয়ে যাবে এর ফলে। 

যাই হোক, প্রথম কথা হলো নাটক বাছাই। তারপর অভিনেতাদের মধ্যে অভিনয়ের ভূমিকা বিতরণ। ব্যারণ আসার সঙ্গে সঙ্গে মেলিনা বলল, আমাদের দলের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী উইলেম খুব ভালো কাব্যনাটক লিখতে পারেন। ব্যারণ তা দেখতে চাইলেন। উইলেমের লেখা মোটামুটি পছন্দ হলো ব্যারনের। ব্যারণ উইলেমকে প্রাসাদে যাবার জন্য নিয়ন্ত্রণ করলেন। সেখানে গেলে কাউন্টপত্নীর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে মনে মনে উল্লসিত হলো উইলেম। মেলিনারও গর্বে ভরে গেল বুকটা। 

লার্তেসকে দেওয়া হলো প্রেমিকের ভূমিকা। ফিলিনাকে দেওয়া হলো প্রেমিকার দাসীর ভূমিকা। বৃদ্ধকে দেওয়া হলো হাস্যরসের এক ভূমিকা, তাঁর মেয়েদের দেওয়া হলো প্রেমিকার ভূমিকা। মেলিনা নিজে নিল বীরত্বব্যঞ্জক এক ভূমিকা। উইলেম কিছুই নিল না। মেলিনা বারবার তাকে কোনও না কোনও ভূমিকা গ্রহণের জন্য জ্বালাতন করতে লাগল। উইলেম কোনও ভূমিকা নিল না। তা না নিয়ে সে নাটকের দিকে মন দিল। এরপর প্রস্তুতির পালা। রীতিমতোভাবে রিহার্সাল দিতে হবে। দিনের পর দিন চলতে লাগল রিহার্সাল। 

অবশেষে একদিন প্রাসাদে যাবার খবর এল। গোটা দলটাকে রাজপ্রসাদে গিয়ে দিনকতক থাকতে হবে। ওরা সেখানে গেলে প্রাসাদের সীমানার ভেতরেই কোনও এক সুবিধাজনক জায়গা বেছে নিয়ে মঞ্চ তৈরি কর হবে। ব্যারন কথা দিলেন সেখানে কাউন্ট ও কাউন্টপত্নী আছে। ওরা গেলে থাকা-খাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। 

কিন্তু যাবার দিন সকাল থেকে বৃষ্টি নামল। তবু দলের সবাই যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। দু-তিনটে ঘোড়ার গাড়িতে সব মালপত্র তুলে দেওয়া হলে ওরা সবাই চেপে বসল। হোটেলের মালিকও গেল ওদের সঙ্গে। বিকালের দিকে গাড়ি ছাড়ল। বন, উপত্যকা ও গ্রাম ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল গাড়িগুলো বৃষ্টির জল আর কনকনে ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে। সন্ধ্যা হতেই একটা পাহাড়ের উপর দিয়ে যেতে যেতে প্রাসাদের আলো দেখা গেল দূর থেকে। যাত্রীরা আশ্বস্ত হলো। সকলেই ভাবতে লাগল ঐ প্রাসাদের আলোকোজ্জ্বল এক-একটি প্রশস্ত কক্ষে তারা পাবে আরামঘন আশ্রয়। 

কিন্তু প্রাসাদের সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াতেই কেউ কোনো খোঁজখবর নিতে এল না। ওরা গাড়ি থেকে নেমে মালপত্র নামিয়ে বৃষ্টিতে একরকম ভিজতে লাগল। অনেকক্ষণ পর স্টলমেস্তার আলো নিয়ে এসে মেলিনাকে নিয়ে গেল ভিতরে। তার অনেক পরে একজন আলো হাতে এসে ওদের একটা ঘর খুলে দিল। সকলেই বাক্স পেটরা নিয়ে সেই ঘরে ঢুকল; পাশাপাশি দুটো বড় ঘর। কিন্তু কোনও আসবাবপত্র বা বিছানাপত্র নেই। কোনও খাবারেরও ব্যবস্থা নেই। 

অনেকে অধৈর্য হয়ে উঠল। চেঁচামেচি করতে লাগল। কাউন্টপত্নীর একজন দাসী এসে উইলেমকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু উইলেম রাজি হলো না তাতে। এতগুলো লোককে অসুবিধায় রেখে সে একা সুবিধা ভোগ করতে পারবে না। 

অবশেষে প্রায় গভীর রাতে সকলের জন্য খাদ্য-পানীয় ও প্রয়োজনীয় বিছানাপত্র এল। মেয়েরা সবাই একটা ঘরে আলাদা রইল। পুরুষেরা রইল অন্য একটা ঘরে। ঠাণ্ডার জন্য ঘরে আগুন জ্বালাল। কিন্তু ঘরের চিমনিটার মুখ ব্যবহারের অভাবে বন্ধ থাকায় ধোঁয়া বার হলো না। ফলে সব ধোয়া ঘরে মধ্যেই ঘুরপাক খেতে লাগল। তাতে ঠাণ্ডার থেকে বেশি কষ্ট হতে লাগল সকলের। 

যাই হোক, সকলে খাওয়ার পর মধ্যরাত্রিতে শুয়ে পড়ল। কিন্তু পাশাপশি শোবার জন্য একে অন্যের গায়ে খোঁচা দিয়ে বারবার রসিকতা করতে লাগল। তাতে সকলেরই ঘুমের ব্যাথাত ঘটতে লাগল। তবু ভালো, শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাবটাকে রসিকতার আনন্দ দিয়ে ভরিয়ে দিতে চাইল। পরদিন কাউন্ট আসার সঙ্গে সঙ্গে সকলে একসঙ্গে চরম অব্যবস্থার অভিযোগ তুলল। অভিযোগ শুনে অবাক হয়ে গেলেন কাউন্ট। কারণ। তিনি প্রাসাদের স্টিউয়ার্ডকে তাদের দেখাশানার সব ভার দিয়ে গিয়েছেন। তাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য থাকা-খাওয়ার যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার জন্য। লক্ষ্য রাখতে বলেছেন। কিন্তু তারা যথাকর্তব্য পালন করায় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে ডেকে ভৎর্সনা করলেন কাউন্ট। কাউন্টের সঙ্গে সঙ্গে ব্যারনও এলেন। তিনি গতকাল ঘোড়া থেকে কোথায় পড়ে গিয়েছিলেন বলে পায়ে চোট লেগেছে। তাই খোঁড়াচ্ছিলেন। 

কাউন্ট মেলিনাকে সঙ্গে করে এক জায়গায় নিয়ে গেলেন। নাটক মঞ্চস্থ করার জায়গাটা নির্বাচিত হলো। মঞ্চ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। 

এদিকে দলের ম্যানেজার হিসাবে মেলিনা এক আদেশ জারি করে হাতে লিখে তা টাঙিয়ে দিল ঘরের দেওয়ালে ও দরজার সামনে। তাতে স্পষ্ট লেখা ছিল দলের প্রতিটি অভিনেতা অভিনেত্রীদের থেকে পৃথকভাবে অবস্থান করবে। তারা কোনও অবস্থাতেই কারও সঙ্গে অশোভন আচরণ করবে না। যদি কেউ এই নির্দেশ অমান্য করে তাহলে তাকে জরিমানা দিতে হবে। 

দলের লোক যাই করুক, প্রাসাদের অফিসার বা উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা প্রায়ই এই নির্দেশ ভঙ্গ করতে লাগল। তারা যখন-তখন ঘরে এসে অভিনেত্রীদের সঙ্গে রসিকতা করতে লাগল। 

একসময় ব্যারন এসে উইলেমকে কাউন্টপত্নীর কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। ব্যারন বললেন, আপনার যে যে লেখা কবিতা ভালো লাগে তার কিছু নিয়ে যাবেন কাউন্টপত্নীর কাছে। তাঁকে শোনাবেন। তিনি বড় সমঝদার। 

উইলেম রাত্রিতে অনেক ঘেঁটে কিছু পুরনো লেখা থেকে বাছল। আবার কিছু লিখল নূতন। তারপর ভালো করে নির্বাচন করে পকেটে রেখে দিল। সত্যি সত্যি এক সময় ডাক পড়ল তার। 

অন্দরমহলে একটি ঘরে গিয়ে উইলেম দেখল কাউন্টপত্নীর কাছে ব্যারণ-পত্নী বসে রয়েছে। তার উপর ফিলিপ বসে রয়েছে কাউন্টপত্নীর পায়ের কাছে। ফিলিনা খুব চালাক। সে কাউন্টপত্নীর কাছে কাছেই প্রায় সব সময় থাকে। তাকে গান শুনিয়ে হাসির কথা বলে আনন্দ দেয়, নানারকমের উপহার আদায় করে। 

কাউন্টপত্নী উইলেমের দিকে আগ্রহভরে তাকালেন। দু-একটা কথা বললেন কিন্তু তার লেখার কথা কিছু বললেন না। উইলেমও তা বার করতে সাহস করল না। করত যদি অনবরত নানা ধরনের লোক আসা-যাওয়া না করত। অবশেষে ঘণ্টাখানেক বৃথা অপেক্ষা করার পর চলে গেল উইলেম। কিন্তু কাউন্টপরী তার কবিতা না শুনলেও যথাসময়ে তিনি তাঁর দাসীকে দিয়ে দুটো উপহার পাঠিয়ে দিলেন উইলেমকে। একটা ছোট পকেট বই ইংল্যান্ডের আমদানি, আর একটা ফুলগোজা দামী ওয়েস্টকোট। বিরক্তির সঙ্গে সঙ্গে একটু কৃতজ্ঞতা অনুভব না করে পারল না উইলেম। 

এদিকে কি ধরনের নাটক মঞ্চস্থ হবে, কিসে খুশি হবেন যুবরাজ তা নিয়ে বাকবিতণ্ডা চালাতে লাগলেন কাউন্ট। যুবরাজের আসতে আর বেশি দিন বাকি নেই। কাউন্ট উইলেমকে একটা ভূমিকা লিখতে বললেন প্রথমে। নাটক শুরু হবার আগে একটা দীর্ঘ ভূমিকা থাকবে যা শুনে যুবরাজ যেন খুশি হন। উইলেম কথা বলে বুঝল আসল জীবনের ঘটনার থেকে প্রতীক আর রূপক বেশি ভালোবাসেন কাউন্ট। ব্যারন এক সময় উইলেমকে বললেন, কাউন্ট যা বলে বলুক। তুমি যে নাটক পছন্দ করো তার গল্পটা একবার কাউন্টপত্নীকে শুনিয়ে তাঁর মত নিয়ে আসবে। তাহলে আর কিছু ভাবতে হবে না। 

ব্যারনপত্নী কাউন্টপত্নীর সঙ্গে উইলেমের এক গোপন সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিল। পিছনের দরজা দিয়ে নিয়ে গেল তাকে। কাউন্টপত্নীর কাছে তখন মাত্র তার এক বান্ধবী বসে ছিল। তার সামনেই তার নাটকের মূল পরিকল্পনার কথাটা বলল উইলেম। সুন্দর করে আবেগের সঙ্গে বুঝিয়ে দিল তার আবেদনের কথাটা। 

কাহিনী হলো। পাড়াগাঁয়ের এক শান্ত প্রকৃতির পরিবেশে একদল কৃষক বালক বালিকা নাচছিল। নাচের শেষে তারা একটা গান গাইবে সমবেত কণ্ঠে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের দলের এক বৃদ্ধ বীণাবাদক মিগননকে অর্থাৎ এক বালিকাকে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করবে। বীণাবাদক বীণা বাজিয়ে শান্তিও আনন্দের গান গাইবে আর বালিকাটি ডিম সহযোগে এক নাচ দেখাবে। এমন সময় সহসা সামরিক সঙ্গীত শুনে চমকে উঠবে তারা। হঠাৎ একদল সৈনিক এসে হাজির সেখানে। তারা বালিকাটিকে ধরতে যাবে। বৃদ্ধ গায়ক বাধা দিতে গিয়ে বন্দি হবে। বালিকাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে তারা। এমন সময় আবির্ভাব ঘটবে সামরিক নেতার। এই নেতাই হবে নাটকের নায়ক। সে হবে একই সঙ্গে সামরিক অধিনায়ক এবং কাহিনীর নায়ক। সে এসে সকলের সব অভিযোগের প্রতিকার করবে। দেশে শান্তিও শৃঙ্খলা স্থাপন করবে। তার সম্মানার্থে সারা দেশ জুড়ে অনুষ্ঠিত হবে এক বিরাট আনন্দোৎসব। 

নাটকের কাহিনী শুনে খুশি হলেন কাউন্টপত্নী। তবে শুধু বললেন, কাউন্টকে খুশি করার জন্য কিছু রূপক ঢুকিয়ে দেবেন। ব্যারণ পরামর্শ দিলেন ঐ সামরিক অধিনায়ককে প্রতিহিংসা ও যুদ্ধবিবাদের এক অপদেবতারূপে উপস্থাপিত করা যেতে পারে। এরপর শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী মিনার্ভা এসে তাকে বশীভূত করবে। হঠাৎ উইলেমের মনে পড়ে গেল কাউন্টের কথাটা। কাউন্টও এক সময় তাকে বলেছিলেন মিনার্ভাকে নাটকের কোথাও ঢুকিয়ে দিতে অর্থাৎ তার সম্পর্কে কোনও এক নাটকের অবতারণা করতে। যাই হোক, ঠিক হলো লার্তেস করবে ঐ সেনাপতি ও নায়কের ভূমিকা। এরপর অন্য অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের ভূমিকা বুঝিয়ে দিল। কিন্তু সকলে একবাক্যে উইলেমকে কোনও একটা ভূমিকা গ্রহণ করতে বলল। অবশেষে সকলের অনুরোধ উপেক্ষা না করে রাজি হলো উইলেম। সে ঠিক করল এক কৃষক নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সে এবং কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করবে সেই সুযোগে। 

কাউন্টপত্নী মুস্কিলে পড়লেন তার স্বামীকে নিয়ে। কাউন্ট যে ধরনের নাটক চেয়েছিলেন এ নাটক তা হবে না। তবে তাঁর পছন্দমতো কিছু কিছু ঘটনা এবং চরিত্র থাকবে। তখন ব্যারনপত্নী ও জার্নো নামে এক কর্মচারী বলল, রিহার্সালের সময় বিভিন্ন কাজে ও কথায় এমনভাবে তারা ভুলিয়ে রাখবে কাউন্টকে যে তিনি ভালো করে পুরো নাটকটার রিহার্সাল দেখতেই পাবেন না। 

এদিকে উইলেমও একটা বিপদে পড়ল। মিগনন ডিমের নাচ নাচতে রাজি হচ্ছে না। আসলে সে চায় না উইলেম এইভাবে নাটক নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকুক। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, না বাবা, আমি মঞ্চে নাচতে পারব না। আর তুমি ওসব ছেড়ে দাও। 

অবশেষে যুবরাজ এসে গেলেন। তিনি শুধু দেশের রাষ্ট্রনেতা নন, একজন সদাশয় ব্যক্তি। প্রাসাদদ্বারে এক বিরাট অভ্যর্থনা জানানো হলো তাঁকে। কাউন্ট এক হুকুম জারি করে বললেন কোনও অভিনেতা যেন এককভাবে যুবরাজের সামনে না যায়। তারা সমবেতভাবে মঞ্চে অবতীর্ণ হবে এবং অভিনয় শেষে পরিচিত হবে তার সঙ্গে। 

প্রথমে উইলেমের লেখা প্রশস্তি পাঠ করা হলো। খুশি হলেন যুবরাজ। তারপর। সন্ধে হতেই আলোকমালায় সুসজ্জিত এক বিরাট প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে যাওয়া হলো যুবরাজকে। নাটক শুরু হলো। সকলেই আপন আপন সাধ্যমতো অভিনয় করল। নাটক শেষে যুবরাজ প্রীত হলেন। তিনি সব অভিনেতাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন। বিশেষ করে নাট্যকার উইলেমের সঙ্গে কিছু কথা বললেন। 

এরপর রোজ সন্ধের সময় সেই প্রাসাদ অন্তর্গত প্রেক্ষাগৃহে সেই একই নাটক মঞ্চস্থ করে চলল ওরা। নাটক দেখার জন্য দূর গ্রাম-গ্রামান্তর হতে প্রচুর লোক আসতে লাগল। প্রাসাদে অনেক অতিথিও আসতে লাগল। ব্যারন, কাউন্ট প্রভৃতি আত্মীয় স্বজনরা আসতে লাগল বিভিন্ন জায়গা থেকে। 

কিন্তু উইলেমের কেবলি মনে হতে লাগল সাধারণ মানুষের ভালো লাগলেও তাদের নাটক বিদগ্ধজনের তেমন ভালো লাগেনি। যুবরাজ একবার করে এসে বসলেও বেশিক্ষণ থাকেন না। তাছাড়া কোনও উচ্চশিক্ষিত রসিকজনও তাদের নাটক আগ্রহভরে শোনেন না। 

তবে উইলেমের একটা ব্যাপার খুব ভালো লাগল। সে লক্ষ করল, সে যখন মঞ্চে অভিনয় করে বা কবিতা আবৃত্তি করে তখন কাউন্টপত্নী একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে কষ্ট হয় না উইলেমের। সে নিজেও যখন অভিনয় করে মঞ্চে, কাউন্টপত্নীর মুখপানেই তাকিয়ে থাকে। কাউন্টপত্নীর প্রতি এক আবেগঘন আগ্রহ ও আসক্তি বেড়ে যেতে থাকে উইলেমের। তীক্ষ্ণ গভীর দুটি দৃষ্টির পথ ধরে তাদের দুজনের অন্তর যেন জন্ম, সমাজ ও পরিবেশ প্রভৃতি অনেক দুস্তর ব্যবধান পার হয়ে কাছে এসে পড়ে পরস্পরের। 

এদিকে লার্তেসের প্রতি বেশ কিছুটা আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ব্যারনপত্নী। লার্তেও ব্যারনপত্নীর প্রতি আসক্ত হয়ে উঠল রীতিমতো। একদিন না বুঝে ভুল করে ব্যারনের কাছে তাঁর পত্নীর প্রশংসা করতে থাকে লার্তেস। ব্যারনপত্নী নারীজাতির মধ্যে এক অমূল্য রত্ন, সর্বগুণে ভূষিতা-এই ধরনের কথা বলল লার্তেস। ভেবেছিল স্ত্রীর প্রশংসা শুনে খুশি হবেন ব্যারন। কিন্তু তার ফল হলো উল্টো।

লার্তেসের বলা গুণাগুণ শুনে ব্যারন মৃদু হেসে বললেন, অপরিচিত ব্যক্তিরা যারা ওর সংস্পর্শে আসে তারই একথা বলে। কত প্রৌঢ়, কত যুবক ওর একটুখানি কৃপা পাবার জন্য কত সেবা করে। 

কাউন্ট প্রতিদিন সকালে দলের অনেককে ডেকে পাঠাতেন। তাদের অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করতেন। তাদের সুখ-সুবিধার জন্য নজর রাখতেন। এক একদিন রাত্রিবেলায় খাবার পরও ভোজসভায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনেই তাদের ডাকা হতো। এদের দলের লোকেরা খুশি হতো। তাদের গুরুত্ব বেড়ে গেল। 

কাউন্ট উইলেমকে আলাদাভাবে ডেকে একটা কথা বারবার বললেন। বললেন, ফরাসি নাট্যকার রেসিনের লেখা পড়। বই না থাকলে আমি দেব। আমার কাছ থেকে নেবে। আমাদের যুবরাজ নিজে রেসিনের ভক্ত। তাহলে তাঁর অনুগ্রহ পেতে তোমার দেবি হবে না। 

কাউন্টের কথা শুনে রেসিন পড়ল উইলেম। তাঁর নাটকে অভিজাত সমাজের কথাই বেশি। যেন ভিন্ন এক জগৎ সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে। পড়তে সত্যিই ভালো লাগল তার। 

কাউন্ট ও যুবরাজ উভয়েরই প্রিয়পাত্র জার্নো একদিন উইলেমকে বলল ভিন্ন এক কথা। শেকস্‌পিয়ার পড়েছে। 

উইলেম বলল, না, কারণ যখন শেকস্‌পিয়ার জার্মানিতে খ্যাতি লাভ করে তখন নাট্যজগতের সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় ছিল না। আমরা তখন ছোট। তবে শেকস্‌পিয়ার সম্বন্ধে আমি যেটুকু শুনেছি তাতে তো তাঁর নাটক পড়ার কোনও উৎসাহ পাইনি। কোনও আগ্রহ জাগেনি আমার মনে।

জার্নো বলল, আমি তোমাকে কিন্তু অনুরোধ করব একবার চেষ্টা করে জোর করে শেকস্‌পিয়ারের নাটক পড়তে। দেখবে অদ্ভুত এক রস পাবে তাতে। 

এদিকে ব্যারন দলের লোকদের কাছে আচরণের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করতে লাগলেন। তিনি সেই বৃদ্ধ অভিনেতাতে বেশি পছন্দ করতেন। একদিন তাকে ডেকে একটা কোট উপহার দেন। তাতে দলের অন্যরা ঈর্ষাবোধ করে। 

খাওয়া, থাকা ও মাইনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দলের লোকেরা ক্রমশই সোচ্চার দাবি জানাতে থাকে। সব ব্যাপারেই একটু বেশি সুবিধা চায় তারা। উইলেম কিন্তু কোনও ব্যাপারেই চোখ-কান দেয় না। সে একটা ঘরে দিনরাত শেকস্‌পিয়ারের নাটক নিয়ে পড়াশুনা করে। একমাত্র সেই বীণাবাদক ও মিগনন ছাড়া সে ঘরে ঢোকার আর কারো অনুমতি ছিল না। যখন নাটকের অনুষ্ঠান ও রিহার্সাল হতো তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসত উইলেম। 

একদিন রাত্রিবেলা চেঁচামেচি শুনে ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল উইলেম। এসে দেখল ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে ভিড় জমে গেছে। তাকে মারার ব্যবস্থা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানল সেই বৃদ্ধ হাস্যরসিক অভিনেতা সন্ধের পর ব্যারনের সঙ্গে দেখা করে অন্দরমহল থেকে নিচের তলায় নেমে আসছিল তখন এই চোর ছেলেটা বাইরের থেকে লুকিয়ে প্রাসাদে ঢুকে উপরে আসছিল। ওর কাছে ধাক্কা খেয়ে বৃদ্ধ পড়ে যায়। তার চিঙ্কারে লোক ছুটে এসে ধরে ফেলে ছেলেটাকে। তারপর কাউন্টকে খবর দেওয়া হয়। ব্যারণ ও স্টলমেস্তার ছুটে আসে।

উইলেম দেখল, ছেলেটা ফ্রেডারিক। হোটেল থেকে সেদিন স্টলমেস্তারের কাছ থেকে লাথি খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আবার হঠাৎ আজ কোথা থেকে এসে হাজির। ফ্রেডারিককে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে এসে ঘটনাটা কি তা জিজ্ঞাসা করল উইলেম। ফ্রেডারিক বলল, সে খোঁজখবর নিয়ে ফিলিনার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল। হঠাৎ বুড়োটার গায়ে ধাক্কা লেগে যায়। তার কোনও দোষ নেই। উইলেম স্টলমেস্তার ও কাউন্টকে অনুরোধ করে, ওকে ছেড়ে দিতে। আমি চিনি ছেলেটাকে। ফিলিনার কাছে যাচ্ছিল সেকথা গোপন করে গেল উইলেম। ওরা ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। উইলেম তাকে ডাকল। 

ফ্রেডারিক সোজা উইলেমের ঘরে চলে গেল।

ফিলিনা আর ব্যারনপত্নী দুজনে মিলে একটা ষড়যন্ত্র করছিল। তারা কিছুদিন ধরে চাইছিল কাউন্টপত্নী আর উইলেম ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠুক পরস্পরের সঙ্গে। তারা তাই ঠিক করল একদিন নির্জন ঘরে দুজনের মিলন ঘটাতে হবে। 

একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে একটা সুযোগ পেয়ে গেল ওরা। কাউন্ট শিকারে চলে গেলেন। বললেন, আজ-কাল দুদিন আসবেন না। ব্যারনপত্নী সোজা উইলেমের কাছে এসে তাকে অনেক করে বলে রাজি করালেন। 

কাউন্টপত্নীর প্রতি উইলেমের আসক্তির কথাটা তিনি জানতেন। ঠিক হলো উইলেম কাউন্টের পোশাক পরে তাঁর শোবার ঘরে বসে থাকবে। তখন হঠাৎ তারা কাউন্টপত্নীকে পাঠিয়ে দেবে সে ঘরে। প্রথমে বুঝতে না পেরে স্বামী ভেবে কাঁধে হাত রেখে আদর করবেন। কি মজা হবে। উইলেম ভয় পেয়ে গেল। যদি পরে রেগে যান কাউন্টপত্নী? এই প্রতারণা যদি পছন্দ না করেন? 

ব্যারনপত্নী বললেন, সে ভার আমার। তোমাকে ভাবতে হবে না। 

ব্যারনপত্নী জানতেন উইলেমের প্রতি কাউন্টপত্নীর একটা দুর্বলতা আছে। একটা গোপন আসক্তি আছে। তাই উপরে যাই বলুন খুশি হবেন মনে মনে। 

যে কথা সেই কাজ। উইলেমকে অন্য পথে কাউন্টের ঘরে নিয়ে গিয়ে সাজিয়ে দিলেন ব্যারনপত্নী। তাকে কাউন্টের টুপি, কোট প্রভৃতি প্রিয় পোশাকে সাজিয়ে চেয়ারে বসিয়ে রেখে কাউন্টপত্নীকে ডাকতে গেলেন। 

চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ ভূত দেখে যেন চমকে উঠল উইলেম। ঘরের একদিকের দরজা খুলে কাউন্ট ভিতরে ঢুকে তাকে একবার চকিতে দেখেই দরজা বন্ধ। করে চলে গেলেন। শিকার থেকে অকস্মাৎ কাউন্ট ফিরে এসেছেন জানতে পেরে ভয়ে আঁতকে উঠল উইলেম। সে বুঝে উঠতে পারল না কাউন্ট তাকে এই জঘন্য অপরাধের জন্য কি শাস্তি দেবেন।

কথাটা ব্যারনপত্নীও জানতে পেরে ছুটে এলেন উইলেমকে বাঁচাবার জন্য তিনি তাড়াতাড়ি উইলেমকে বার করে তাঁর নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে পোশাক খুলে দিলেন। তাকে ছেড়ে কাউন্টকে সামলাবার জন্য চলে গেলেন। 

কাউন্ট কিন্তু মোটেই রাগলেন না। শুধু কিছুটা গম্ভীর হয়ে রইলেন। শিকার থেকে হঠাৎ ফিরে এসে একটু বিশ্রাম করেই উইলেমকে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে কাঠ হয়ে গেল উইলেম। ভাবল হয়তো কাউন্ট তার বিচার করবেন। শাস্তি দেবেন। 

কিন্তু যা ভেবেছিল উইলেম তার কিছুই হলো না। কাউন্ট তাকে শুধু কতকগুলো নির্বাচিত কবিতা ও নাট্যাংশ পড়ে যেতে বললেন। উইলেম যতদূর সম্ভব ভালো করে পড়ে যেতে লাগল। পড়া শেষ হলে তিনি প্রশংসা করলেন তার আবৃত্তির। তারপর ভালোভাবেই বিদায় দিলেন। 

ব্যারনপত্নী তাঁর প্রিয়পাত্র জার্নোকে কথাটা সব বললে জার্নো বলল, কাউন্ট নিশ্চয়ই মনে ভেবেছেন ওটা ওর প্রেতাত্মা। তাই ভয়ে কোনও কথা বলেননি। এর একমাত্র প্রতিকার হলো নানারকম ভূতপ্রেতের কথা বলে কাউন্টের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া। তাঁর মনটাকে দুর্বল করে দিতে হবে। অতিপ্রাকৃতের প্রতি বিশ্বাসটাকে গাঢ় করে তুলতে হবে। হলো ঠিক তাই। কাছে পেলে বা সুযোগ পেলেই ব্যারনপত্নী ও জার্নো দুজন মিলে যত সব ভৌতিক ঘটনার কথা বলতে লাগল। কাউন্টও তাই বিশ্বাস করতে লাগলেন। তার মুখের হাসিখুশি আনন্দময় ভাবটা পাল্টে গেল দিনে দিনে। তিনি গম্ভীর হয়ে উঠলেন। 

আবার একদিন হঠাৎ জার্নোর সঙ্গে দেখা হলো উইলেমের। তখন তার শেকস্পীয়ারের অনেক ভাল ভাল নাটক পড়া হয়ে গেছে। এক নতুন জগৎ আর এক অনাস্বদিতপূর্ণ রসের সন্ধান পেয়েছে সে নাটকের মধ্যে। তার জন্য সে ঋণী জার্নোর কাছে। সে ঋণ অকুষ্ঠ ভাষায় স্বীকার করল উইলেম। বলল, শেকসপিয়ারের প্রতিটি চরিত্র কেমন জীবন্ত, কেমন স্বাভাবিক। অথচ তারা প্রত্যেকেই মানব জীবনের এক একটা সমস্যাকে তুলে ধরেছে। তারা প্রত্যেকেই দেখাচ্ছে সব জীবনের মধ্যেই যেন একটা রহস্য আছে।

জার্নো খুশি হয়ে বলল, দেখো, তোমাকে দেখে একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়। তোমার বংশপরিচয় ও সাংসারিক অবস্থার কথা আমি কিছুই জানি না। তবু আমি– বলব তুমি এইভাবে আর থেকো না। কি হবে এ দলে থেকে? এই লোকগুলোর দ্বারা। কিছু হবে না, কোনও ক্ষমতা নেই তাদের। শুধু শুধু কি হবে এ দলে থেকে? তার থেকে তুমি আমাদের মাঝে চলে আসতে পার। যুবাজের সেবা করতে পার কাজের। মধ্য দিয়ে। 

কথাটা কিন্তু মনঃপুত হলো না উইলেমের। মনে মনে বলল, জার্নো যাই বলুক, সে তার দল বা মিগননকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। ওরা যত অপদার্থই হোক ওদের মধ্যে প্রাণ আছে। 

অবশেষে একদিন যুবরাজের যাবার দিন স্থির হয়ে গেল। কাউন্ট ঠিক করলেন ঐ দিন তাকে বিদায় সম্বর্ধনা জানানো হবে। উইলেম তার জন্য একটি নূতন কবিতা রচনা করে তা আবৃত্তি করল। সভায় কাউন্টপত্নী তার পানে সমানে তাকিয়ে দেখে সে কবিতা উপভোগ করলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। 

সভাশেষে কাউন্টপত্নী ব্যারনপত্নীর সঙ্গে তাঁর ঘরে গিয়ে পৌঁছতেই উইলেমের ডাক পড়ল। কবিতার খাতা নিয়ে তাকে এই মুহূর্তে যেতে হবে কাউন্টপত্নীর ঘরে। 

যে কবিতা দেখাতে গিয়ে আবৃত্তি করল উইলেম তা কবিতা হিসাবে সত্যিই ভালো। কিন্তু উইলেম মোটেই ভালোভাবে তা আবৃত্তি করতে পারল না। তার দৃষ্টি সব সময় নিবদ্ধ ছিল সুসজ্জিত কাউন্টপত্নীর উপর। কবি হিসাবে যে অঙ্গের অলঙ্কারকে এতদিন অর্থহীন বাহুল্য ও অপ্রয়োজনীয় আতিশয্য বলে গণ্য করে এসেছে, আজ স্বচক্ষে দেখল সেই অলঙ্কার আর বেশভূষার জৌলুস শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে কাউন্টপত্নীর অঙ্গ লাবণ্যকে। সে আরও দেখল কাউন্টপত্নীও ঘন ঘন তার দিকে তাকাচ্ছেন। কিন্তু কাউন্টপত্নীর এমন দৃষ্টি কোনওদিন দেখেনি। এক সূতীক্ষ বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে যাচ্ছিল যেন সে দৃষ্টির মধ্যে আর তার আঘাতে শিহরিত হয়ে উঠছিল উইলেমের সারা দেহ। তার সমগ্র মস্তিষ্কের মর্মমূল পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছিল যেন সে আঘাতে। 

উইলেম দেখল এর মাঝে ফিলিনা এসে কাউন্টপত্নীর তোষামোদ শুরু করে দিয়েছে। বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাউন্টপত্নীর রূপের প্রশংসা করে বলতে লাগল, এমন বাহু না হলে এ ব্রেসলেট মানায় না, এমন গলা বা বুক না হলে এ হার মানায় না।

কাউন্টপত্নী কপট রাগের সঙ্গে বললেন, চুপ কর ফিলিনা। তোর এই সব ন্যাকামি সব সময় আর ভালো লাগে না। 

ফিলিনা সে কথায় কান না দিয়ে উইলেমকে উদ্দেশ্য করে বলল, আজ এই শিল্পীকেও চমৎকার মানিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় আজ ও কোনও গোপনস্থানে আপনার সঙ্গে মিলিত হলে ভালো হতো। 

কপট রাগের সঙ্গে কাউন্টপত্নী বললেন, আমার কাছে আদর পেয়ে পেয়ে তোর স্পর্ধা বেড়ে গেছে ফিলিনা। এ ধরনের কথা আর কখনও বলিস না। 

পড়া শেষ করে উইলেম বসেছিল একটি চেয়ারে। এমন সময় কাউন্টপত্নী একটা কৌটো থেকে একটা হীরের আংটি বার করে সেটি উইলেমের দিকে তুলে ধরে বললেন, আমার এই সামান্য উপহারটি গ্রহণ করবেন। আমি আপনার এমনই এক বান্ধবী যে শুধু আপনার উন্নতি ও মঙ্গল চায়। 

উইলেম তার কবিতা লেখা একটি কাগজে নাম সই করে কাউন্টপত্নীকে দিয়ে বলল, এটা আমার নামের স্বাক্ষর। কিন্তু আপনার নামের স্বাক্ষর আমার অন্তরে মুদ্রিত হয়ে আছে। তা কখনও মুছে যাবে না। আপনার একগাছি চুল দেবেন? এই আংটির সঙ্গে জড়িয়ে রাখব? 

ফিলিনা কাউন্টপত্নীর বাঁ হাতথানি ধরেছিল। উইলেম আবেগের বশে কাউন্টপত্নীর ডান হাতখানি তুলে নিল নিজের হাতের মধ্যে। এমন সময় ফিলিনা ও ব্যারনপত্নী। বেরিয়ে গেল ঘর হতে। বুঝতে পারল তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। নতজানু হয়ে কাউন্টপত্নীর পাশে বসল উইলেম। তাঁর ডান হাতখানি তখনও ছিল তার হাতের মধ্যে। এবার উইলেম কাউন্টপত্নীর হাতখানি চুম্বন করে বলল, এবার আমি যাই। 

উঠতে যাচ্ছিল উইলেম কিন্তু হঠাৎ একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। কি করে কি হলো তা জানে না। হঠাৎ উইলেম দেখল কাউন্টপত্নী দুহাত দিয়ে তার গলাটা জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁট দুটো তার মুখের কাছে তুলে দিয়েছে। কাউন্টপত্নীর মুখে মুখ দিয়ে তার দেহটাকেও বুকের কাছে টেনে নিল উইলেম। এইভাবে নিবিড়তম এক আলিঙ্গন ও চুম্বনের বন্ধনে কতক্ষণ আবদ্ধ ছিল তা জানে না, হঠাৎ চমকে উঠল উইলেম, কাউন্টপত্নী যেন হঠাৎ ভয়ে চমকে উঠে ছাড়িয়ে নিল নিজকে। অথচ কেউ আসেনি ঘরের দরজার বাইরে। তবে কি এক কাল্পনিক শঙ্কার শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন কাউন্টপত্নী? এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন উইলেমের দিকে। সে দৃষ্টির অর্থ সে বুঝতে পারল না। কাউন্টপত্নী বললেন, তুমি চলে যাও এই মুহূর্তে। আমাকে যদি ভালোবাস তাহলে চলে যাও। আর দেরি করো না। 

অবশেষে একদিন কাউন্ট আর কাউন্টপত্নী প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

সৈন্যদের শিবির উঠে গেছে। যুবরাজ তাঁর সৈন্যদের নিয়ে চলে গেছেন। প্রাসাদের চারপাশে মাঠগুলোতে সৈন্যদের যে ছাউনি গড়ে উঠেছিল সে ছাউনি আর নেই। মাঠগুলো আবার ফাঁকা হয়ে উঠেছে। একদিন সকালে লার্তেস প্রাসাদের একটি ঘরের জানালা থেকে মাঠের দিকে তাকিয়ে এইসব দেখছিল আর ভাবছিল। এমন সময় ফিলিনা এসে মাদাম মেলিনার কথা তুলল। মাদাম মেলিনার পেটটা বড় হয়ে উঠেছে। অথচ তা ঢাকার চেষ্টা করছে না। ঐভাবেই সব কাজ করে যাচ্ছে। ফিলিনা বলল, এমন নির্লজ্জ মেয়ে কখনও দেখিনি আমি। 

ওরা যখন এইসব কথাবার্তা বলছিল তখন ব্যারন এসে উইলেমকে ডাকলেন। ব্যারন বললেন, কাউন্ট আপনাকে সামান্য কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। যদিও আপনার বুদ্ধি ও প্রতিভার সঠিক মূল্য দান করা সম্ভব নয়, তথাটি আপনার অমূল্য সময় ও শ্রম ব্যয়ের ক্ষতিপূরণস্বরূপ সামান্য কিছু দান করেছেন। এটা গ্রহণ করুন। আপনি তাঁর জন্য অনেক খেটেছেন। অনেক কিছু করেছেন। 

এই বলে ব্যারন একটি থলি বার করে উইলেমের হাতে দিতে গেলেন। কিন্তু উইলেম বলল, দেখুন, এটা আমি নিতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করুন। আমার মনে হচ্ছে এটা যদি আমি গ্রহণ করি তাহলে আমি যা কিছু তার জন্য করেছি তা সব পণ্ড হয়ে যাবে। তাহলে তাদের মধুর স্মৃতি কেমন যেন কলুষিত হয়ে যাবে আমার কাছে। আর তা হয়ে যাবে আমার স্বার্থপরতার জন্য। যেখানে টাকার ব্যাপার সেখানে কোনও প্রীতি বা শ্রদ্ধাসিক্ত কোনো স্মৃতি বেঁচে থাকতে পারে না। 

তবু ছাড়লেন না ব্যারন। বললেন, তাহলে কি বলতে চান কাউন্ট আপনার কাছে ঋণী হয়ে থাকবেন চিরদিন? আপনি যদি তাঁর এ দান, এ উপহার গ্রহণ না করেন তাহলে তিনি ভাববেন আপনি এতে সন্তুষ্ট নন। তাহলে আমি কোন মুখে তার কাছে দিয়ে দাঁড়াব? 

উইলেম শান্ত কণ্ঠে বলল, যদি বিবেকের নির্দেশ মানতে হয় তাহলে এ দান গ্রহণ করা আমার উচিত নয়? তবু এ দান আমি গ্রহণ করব বর্তমান প্রয়োজনের খাতিরে। বর্তমানে এই দলকে চালাতে হলে টাকার দরকার এবং মহামান্য কাউন্টের এই সদয় দান সে বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য করবে আমাদের। দলের সকলেই উপকৃত হবে এতে। 

ব্যারন বললেন, সত্যিই এটা এক আশ্চর্যের কথা যে মানুষ মানুষের কাছ থেকে আর সব উপহার খুশির সঙ্গে গ্রহণ করে, কিন্তু একমাত্র টাকা নিতে চায় না। ভাবে টাকা নিয়ে ছোট হয়ে যাবে। 

ব্যারন চলে গেলে নিজের ঘরের ভিতরে গিয়ে থলেটা খুলে উইলেম দেখল সব স্বর্ণমুদ্রা। গণনা করে দেখল যেদিন সে প্রথম হোটেলে এসে ওঠে এবং ফিলিনার সঙ্গে ফুল নিয়ে আলাপ হয়, সেদিন তার কাছে যে পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা ছিল, কাউন্ট তাকে আজ সেই পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দান করেছেন। অনেকখানি আশস্ত হলো উইলেম। কাগজ-কলম টেনে নিয়ে বাড়িতে একটা চিঠি লিখতে বসল। চিঠিতে আশ্বাস দিল বাড়ির সকলকে। লিখল সে শুধু বাজে কাজে সময় ও অর্থ ব্যয় করছে না। তাতে কিছু লাভও হচ্ছে। 

হঠাৎ স্টলমেস্তার এসে হাজির। সে বলল, তোমরা সবাই তৈরি হয়ে নাও। কাউন্ট ঘোড়া পাঠিয়ে দিচ্ছেন; ঘোড়ার অভাব হবে না। দিন কতকের জন্য তোমাদের বাইরে যেতে হবে। সব মালপত্র গুছিয়ে নাও।

উইলেম দেখল তার একটি বাক্স মাদাম মেলিনা নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করছে। উইলেম মিগননকে বলল, থাকগে, না দিক। অন্য বাক্স নিয়ে কাজ চালাও। 

মেলিনা এসে বলল, আমরা বাইরে যাচ্ছি। এখানে যা হয় হোক। বাইরে যাবার সময় এবার একটু ভদ্রভাবে যেতে হবে আমাদের। তার জন্য মিগননকে মেয়ের পোশাক পরতে হবে। আর বীণাবাদককে দাড়ি কামাতে হবে। 

কথাটা শুনে মিগনন আর বৃদ্ধ বীণাবাদক দুজনেই ক্ষেপে গেল। মিগনন উইলেমকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি বেটাছেলে, মেয়েছেলের পোশক পরব না। বৃদ্ধ গায়কও বলল, দাড়ি কামানো হবে না। তার জন্য তাকে দল ছাড়তে হলেও তার কোনও ক্ষতি নেই। 

ফিলিনা বলল, কাউন্ট কিন্তু এই সব ভালোবাসেন। তাঁর মতে নাটকে মানুষ যে পোশাক পরে সে পোশাক যথাসম্ভব দৈনন্দিন বাস্তব জীবনেও ব্যবহার করা উচিত। যে দাড়ি গায়ককে রাত্রিবেলায় মঞ্চে পরতে হয় সে দাড়ি দিনের বেলাতেও পরা ভালো। তার মানে এই যে অভিনয় জীবনের সঙ্গে বাস্তব জীবনের ব্যবধানটা যত চলে যাবে ততই অভিনয়ও সহজ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। 

কথাটা শুনে অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা হাসতে লাগল। বৃদ্ধ গায়ক উইলেমকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, আমাকে যেতে দিন। আমি আর এখানে থাকব না। 

উইলেম বুঝল মেলিনার কথায় বৃদ্ধের রাগ হয়েছে। উইলেম বলল, আপনার কোনও চিন্তা নেই। আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ আপনার চুল-দাড়িতে হাত দেবে না। এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি। আমি থাকতে কেউ আপনার কিছু করতে পারবে না। 

বৃদ্ধ বলল, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি, শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আপনার চারপাশে যারা রয়েছে তারা সবাই ভালো নয়। আমার কিছু গোপন কথা আছে, আমার জীবনের একটা গোপন অংশ আছে। সেটা ওরা নির্মমভাবে টেনে বার করতে চায়। কিন্তু আমি তা পারব না। তাই আমি আমার সেই গোপন কথার সম্পদ, জীবনের সেই অনাবিষ্কৃত দিকটি নিয়ে বিদায় নিই। 

উইলেম কিন্তু ছাড়ল না। বলল, আমি আপনার গোপন কথার কিছুই জানতে চাই না। আপনার ভাগ্যকে আমার হাতে সঁপে দিতে পারেন। 

যাই হোক, উইলেমের কথায় রয়ে গেল বৃদ্ধ। 

আগে যে রাজপ্রাসাদে ছিল তার থেকে কিছু দূরে একটা ছোট শহরে তার দল নিয়ে থেকে যেতে চাইল মেলিনা। উইলেমও বাড়ি যাব-যাব করেও গেল না। এই দল ছেড়ে কোথাও যেতে মন সরছিল না তার। তার পোশাকটাও পথিকের মতো হালকা ও সাদাসিধে করে নিল। একটা হালকা ওয়েস্ট কোট, ঢিলে প্যান্ট, ফিতেওয়ালা বুট জুতো, মাথায় গোল টুপি আর সিল্কের নেকটাই। ফিলিনা তার পোশাকের দারুণ প্রশংসা করল। 

অবসর সময়ে দলের সবাই একটা আনন্দ উপভোগ করত। তা হলো হঠাৎ ওরা সবাই মিলে একটা নাটক করত মুখে মুখে। আর সেই নাটকে কিছুদিন আগে যে সব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছিল তাদের এক-একজনকে চরিত্র হিসাবে খাড়া করে হাসাহাসি করত। বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে তাদের উপস্থাপিত করে তারা মজা পেত। 

উইলেম একদিন তার প্রতিবাদ করে বলল, ওসব করা উচিত নয়। তাদের জন্মের জন্য তারা দায়ী নয়। ছোট থেকে যারা পার্থিব ঐশ্বর্যের দ্বারা পরিবৃত থাকে সব সময় তারা অন্তরের ঐশ্বর্যের কোনও দাম দিতে জানে না। এ জন্য তাদের দোষ দেওয়া উচিত নয়। 

এরপর উইলেম প্রস্তাব করল, আমাদের অভিনয় প্রতিভাকে ক্রমে ক্রমে বাড়িয়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। নিয়মিত অভ্যাস দরকার। তোমরা যদি অভিনয়ে কৃতিত্ব দেখাতে পার তাহলে বসে বসে কাজের জন্য ভাবতে হবে না। 

ওরা সবাই তখন প্রস্তাব করল পরিচালনার জন্য একজনকে সাময়িকভাবে প্রধান করে একটা সিনেট গঠন করা হবে। প্রধানকে সকলের ভোটে নির্বাচন হতে হবে। 

মেলিনা তাতে রাজি হলো। ওরা সবাই মিলে ভোট দিয়ে প্রথমে উইলেমকে ম্যানেজার নির্বাচিত করল। তারপর তাকে সর্ববিষয়ে সাহায্য করার জন্য একটা সিনেট গঠন করা হলো। মেয়ে-পুরুষ মিলিয়ে তার সদস্য নির্বাচন করা হলো। 

লার্তেসের একটা দোষ। মেয়েদের সে দেখতে পারে না। কোনও মেয়েকেই সে ভালোবাসার চোখে দেখতে পারে না। একটা জায়গায় দুই-একদিনের জন্য থাকতে হয়েছিল। স্থানীয় একটি মেয়ে লাতেঁসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তার কিছু বিষয়-সম্পত্তি ছিল। কিন্তু লার্তেস তার প্রতি এমন নীরস ঔদাসিন্য দেখায় যে, মেয়েটা চলে যেতে পথ পায় না। 

কথাটা উঠতে ফিলিনা হাটের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে দিল। লার্তেসের পূর্ণ জীবনের একটি গোপন কথা বলে দিল সকলের কাছে। তখন লার্তেসের বয়স মাত্র আঠারো। কোনও এক নাটকের দলে সে কোনও এক বৃদ্ধ অভিনেতার চোদ্দ বছরের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। কাজ শেষে যখন বৃদ্ধ তার মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন। লার্তেস তাকে অনুনয়-বিনয় করে। সে মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়। অবশেষে অনেক করে বৃদ্ধ রাজি হয়। লার্তেস মেয়েটিকে বিয়ে করে। বিয়ের পর লার্তেস তার নূতন বউকে নিয়ে একটি ঘরে থাকত। সে একদিন রিহার্সালে যায় সন্ধ্যার সময়। রাত্রিবেলায় বাড়ি ফিরে দেখে তার ঘরে তার নূতন বউ-এর কাছে রয়েছে তার আগের প্রেমিক। এরপর সে মেয়ের আগেকার প্রেমিক লার্তেসকে ডুয়েলে আহ্বান করে। ডুয়েল লড়তে গিয়ে আঘাত পায় লার্তেস। সেই থেকে ও মেয়েদের ঘৃণা করে। তাদের সততায় বিশ্বাস করতে পারে না। 

এবার ওদের যাত্রা শুরু হবে। মেলিনা এসে বলল, সব ঠিক। এবার রওনা হতে হবে। কাউন্টের নির্দেশমতো ওরা যাবে এক শহরে। সেখানে ওদের থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু হঠাৎ একটা বাধা এসে উপস্থিত হলো। স্থানীয় দু-একজন বলল যে পথে তারা যাবে এবং যেটা সোজা পথ সে পথ ভালো নয়। এখন যুদ্ধের সময়। প্রায়ই দস্যু দেখা যায় সে পথে। সব কেড়ে নেয়। জীবনও সংশয় হয়ে ওঠে। হয় যাত্রা স্থগিত করতে হবে, না হয় ঘুর পথে যেতে হবে অনেক কষ্ট করে। 

উইলেম বলল, যুদ্ধের সময় এরকম গুজব প্রায়ই রটে। সুতরাং গুজবে কান না দিয়ে সোজা পথেই যাত্রা শুরু করা যাক। সবাই সমর্থন করল তাকে। লার্তেস বলল সে যাবেই ঐ পথে। বৃদ্ধও তাই বলল। আসন্ন সন্তান-সম্ভবা মেলিনাও বেশ মনের জোর দেখাল। দুটো কোচে ওরা মালপত্র নিয়ে উঠে বসল। দ্বিতীয় দিনে পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে গাড়ি যাবার সময় গাড়ির চালকরা বলল, শহরটা এখনও অনেক দূরে, গাছপালায় ঘেরা ঐ পাহাড়টায় বিশ্রাম করে নিন আপনারা। 

সকলেই রাজি। ছোট পাহাড়টার মাথায় উঠতে হলে একটা ঘন জঙ্গল পার হতে হয়। সতর্কতার জন্য কিছু অস্ত্রও ছিল ওদের হাতে। উইলেমের কাছে ছিল দুটো রিভলবার আর লার্তেসের ছিল একটা বন্দুক। ফ্রেডারিক সেই বন্দুকটা কাঁধে তুলে নিল। ওরা পাহাড়ের উপর উঠে চারদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। চারদিকে শুধু পাহাড় আর বন। কোনও কোনো জনমানব বা কোনও প্রাণীর চিহ্ন নেই। চারদিক ভীষণভাবে নিস্তব্ধ। উইলেমের মনে হলো জীবনে এত আনন্দ আর কখনও পায়নি। এমন পরিবেশ, এমন আনন্দঘন মুহূর্ত জীবনে আর কখনও আসেনি। দলের অন্য সকলেও খুব খুশি। মেয়েরা গুনগুন করে গান করতে লাগল। খাবার জন্য কিছু আলু সেদ্ধ করতে লাগল। মালপত্র সব গাড়িতেই রইল। ঘোড়াগুলো জোয়ালমুক্ত করে গাছে বেঁধে দিল চালকরা। 

হঠাৎ একটা বন্দুকের শব্দ শোনা গেল। তারর একদল সশস্ত্র দস্যু বনভূমি পার হয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তাদের একজন গাড়িতে উঠে মালপত্র নামাতে শুরু করে দিল। লার্তেস তার বন্দুকটা নিয়ে গুলি করল। গাড়ির উপর থেকে পড়ে গেল লোকটা। উইলেমও এগিয়ে গিয়ে অস্ত্র নিয়ে বাধা দিল। কিন্তু সংখ্যায় দস্যুরা বেশি থাকায় পেরে উঠল না ওরা। লার্তেস আর উইলেমকে আহত করে মালপত্র নিয়ে পালিয়ে গেল দস্যুরা। একমাত্র ফিলিনা তাদের সর্দারকে অনেক কয়ে বলে তার বাক্সটা রক্ষা করল। 

আঘাতটা উইলেমেরই বেশি লেগেছিল। কতক্ষণ অচৈতন্য পড়ে পড়েছিল তা সে। নিজেই জানে না। চেতনা ফিরলে দেখল সেই পাহাড়ের উপরেই সে আছে। মাথাটা ফিলিনার কোলে রয়েছে। পায়ের কাছে বসে আছে মিগনন। আর কেউ নেই। সেই স্তব্ধ নির্জন বনভূমিতে শুধু তারা তিনজন। 

ফিলিনার কাছ থেকে জানল দলের অন্যরা সব কিছু হারিয়ে রাগে-দুঃখে পাগলের মতো হয়ে গেছে। তারা নিকটবর্তী একটা গাঁয়ের এক পান্থশালায় গিয়ে উঠেছে। বৃদ্ধ গায়ক গেছে তার জন্য ডাক্তার ডাকতে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার এসে উইলেমের ক্ষতস্থানগুলো ব্যান্ডেজ করে দিল। ক্ষত দিয়ে প্রচুর রক্ত বার হওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছে উইলেম। উত্থানশক্তি রহিত । এমন সময় একদল অশ্বারোহীকে তাদের দিকে আসতে দেখে আবার ভয় পেয়ে গেল ওরা। কিন্তু পরে দেখল তারা তাদের সাহায্য করতে এসেছে। তাদের পুরোভাগে একজন নারী অশ্বারোহী। অদ্ভুত পোশাক আর টুপির জন্য তাকে চেনা যাচ্ছিল না। অশ্বারোহীদল তাদের নির্দেশে চলছিল। সেই নারী নেমে এসে তার গায়ের কোটটা। খুলে উইলেমের গায়ে চাপিয়ে দিল। তারপর একজন গ্রাম্য সদরকে নির্দেশ দিল উইলেমকে বয়ে নিয়ে গিয়ে যেন পাশের গায়ে তার ঘরে শুইয়ে রাখে। 

সেই সর্দার আরও লোকজন এনে উইলেমকে বয়ে নিয়ে গেল বাঁশের মাচায় করে। পাশের গায়ের পান্থশালাতেই দলের সব লোকরা উঠেছে। সর্দার উইলেমকে প্রথমে সেখানেই তুলল। পরে তার বাড়িতে নিয়ে যাবে। সর্দার প্রস্তুতির জন্য বাড়ি গেলে তার দলের লোকেরা দুর্ঘটনার জন্য উইলেমকে দায়ী করে গালাগালি করতে লাগল। তারা একবাক্যে সর্দার ও ফিলিনাকে বলল, ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যাও। ওরই জন্য আমরা সব হারিয়েছি। ওই জোর করে আমাদের এই পথে আনল। 

মেলিনা এতদিন যা সঞ্চয় করেছিল সব গেছে। তার স্ত্রী একটা মরা ছেলে প্রসব করে। 

বারবার ওদের এক কথা শুনে কথা বলার ক্ষমতা না থাকলেও উঠে বসে উইলেম। বলল, আমি কি তোমাদের জন্য কিছু করিনি? আমি প্রস্তাব করেছিলাম মাত্র। তোমরা সবাই তখন আমাকে সমর্থন করেছিলে এ পথে আসার জন্য। তবে কেন আমাকে দোষ দিচ্ছ? 

মেলিনাকে বলল, তোমাকে যে টাকা ঋণ হিসাবে দিয়েছি সে ঋণ থেকে মুক্তি দিলাম তোমায়। তোমরা সব ভুলে আমার পাশে এসে দাঁড়াও। আমি তোমাদের দুঃখ বুঝতে পারছি। আমি কথা দিচ্ছি তোমরা যে যা হারিয়েছ তার দ্বিগুণ-তিনগুণ আমি দেব তোমাদের। 

তবু তারা শান্ত হলো না। বিশ্বাস করল না উইলেমের কথায়। এদিকে সর্দার এসে উইলেমকে নিয়ে গেল। উইলেম বুঝতে পারল উত্তেজনার জন্য তার ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। 

ফিলিনা ও মিগনন উইলেমের সঙ্গে এল। 

পরদিন সকলে ঘুম ভাঙলে শুনল সেই নারী আবার তাকে দেখতে এসেছিল। উইলেমের মনে হলো নারী না, কোন দেবদূত স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। তার কোটটা গায়ে দিয়ে কেবল সে কোটের গন্ধ শুঁকতে ইচ্ছা করেছিল তার। কারণ সে কোটে সেই নারীর স্পর্শ আছে। ডাক্তার এসে তাকে ক্ষতস্থান ধুয়ে দিয়ে গেল। উইলেম ফিলিনাকে। বলল, তুমি এবার যেখানে খুশি যেতে পার ফিলিনা। তোমার বাক্সে আমার যা কিছু সম্পদ রক্ষা করেছ এজন্য ধন্যবাদ। তার জন্য আমার সোনার হাতঘড়িটা আমি তোমাকে দেব। 

ফিলিনা বলল, আমি কোথাও যাব না। 

মিগননের মতো বৃদ্ধ বীণাবাদকও সঙ্গী হয়ে উঠল উইলেমের। একটু সুস্থ হয়েই লার্তেস দেখা করতে এল তার সঙ্গে। সে বলল, হোটেলে যখন দলের লোকেরা তাকে অপমান করে তখন সে অন্য ঘরে অসুস্থ ছিল। তা নাহলে সে কখনই চুপ করে থাকত না। উইলেমের প্রতি তার আনুগত্য ও সমর্থন আজও অটুট আছে। 

লার্তেস বলল, সার্লোর অধীনে ওরা আবার একত্র হয়ে একটা নতুন দল গড়তে চায়। যাবার সময় তোমার কাছে ওরা পাথেয় খরচ চাইবে। মনে হয় এতদিন দল চালিয়ে ফিলিনা কিছু টাকা করেছিল। কিন্তু সব গেছে। 

ফিলিনা বলল, ওদের টাকা দেবার কি আছে? সর্দার ওদের প্রত্যেককে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। 

তবু ওরা যখন উইলেমের কাছে এল, উইলেম তাদের প্রত্যেককে কিছু কিছু দিল। 

একদিন সকালবেলায় হঠাৎ ঘুম ভাঙতে উইলেম দেখল তার বিছানার এক ধারে ঘুমিয়ে আছে ফিলিনা। রাত্রিতে হয়ত বই পড়তে পড়তে তার ঘুম এসে যায়। বইখানা পাশে পড়ে রয়েছে। মাথার চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এই অগোছালো ভাবের মধ্যে ফিলিনাকে খুব ভালো লাগছিল উইলেমের। এই ভালো লাগার মধ্যে দিয়ে তার প্রতি তার অন্তরের অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা। তাকে যখন দলের সবাই ত্যাগ করে যায় তখন একমাত্র ফিলিনাই তার পাশে থেকে দিনরাত সেবা করে তাকে সুস্থ করে তোলে। মিগননও করে। কিন্তু মিগননের সে একদিন উপকার করেছে। কিন্তু ফিলিনার জন্য সে এমন কিছু করেনি যার জন্য ফিলিনা এই বিপদের দিনে একখানি করতে পারে তার জন্য। সুতরাং ফিলিনার ঋণ সে শোধ করতে পারবে না। এখন ফিলিনার ঘুমটা ভেঙে গেল। সে আবার নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসল। উইলেম তাকে বলল, তুমিও দলের অন্যান্যদের সঙ্গে চলে যাও। সার্লোর অধীনে গিয়ে কাজ করো। 

এই ফিলিনা দলের লোকদের পাথেয় খরচ হিসাবে টাকা নেওয়ার জন্য ঝগড়া করে তার সঙ্গে। ফিলিনা কথাটার জের টেনে বলল, তুমি যদি আমাকে তাড়াতে চাও, আমি চলে যাব। ফ্রেডারিক আমার কাছে থাকলে আমি ভাবতাম না। তোমাদের কাউকে আমার দরকার হতো না। কিন্তু ডাকাত পড়ার পর থেকে ছেলেটা কোথায় যে চলে গেল তার ঠিক নেই। 

উইলেম চুপ করে রইল। তার কষ্ট হচ্ছিল মনে। ফিলিনার সেবার অভাবটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করবে সে। তবু কোনও কথা বলল না দেখে ফিলিনা সত্যি সত্যি চলে গেল। 

উইলেম এবার সুস্থ হয়ে উঠেছে। এবার সে হাঁটতে পারে। এখানে একজন গ্রাম্য যাজক আসেন। তাকে প্রায়ই সান্ত্বনা আর পরামর্শ দেন। ফিলিনা চলে গেছে এবং দেহে কিছুটা বল পেলে সেই অজ্ঞাতনামা নারীর খোঁজ করতে লাগল উইলেম। চকিতে সে একবারে যতটুকু দেখেছে তার আহত আবিল চৈতন্যের মধ্যে তাকে দেখেছে, কাউন্টপত্নীর সঙ্গে তার অনেকটা মিল আছে। যার জন্য সে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরে আসতে পেরেছে, যার জন্য নবজীবন লাভ করেছে তাকে একটু কৃতজ্ঞতা জানাতেও পারেনি। কিন্তু সর্দার বা যাজক শত অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো সন্ধান দিতে পারল না সেই সুন্দরী অশ্বরোহিণীর। হঠাৎ কোটের পকেটে হাত দিয়ে একটি চিঠি পেল উইলেম। এই কোট তার সেই সুন্দরী উদ্ধারকারিণীরই দেওয়া। সে চিঠি তারই হাতে লেখা তারই কোনও আত্মীয়কে। উইলেমের কাছে কাউন্টপত্নীর হাতে লেখা একটি গান ছিল। মিলিয়ে দেখল দুজনের হাতের লেখার মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে। 

পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের জন্য আরও দিনকতক থাকতে হলো উইলেমকে। কিন্তু মনে চিন্তা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারল না। কিছু না কিছু সে করতে চায়। অজ্ঞাতনামী সেই সুন্দরীরও কোনো খোঁজ না পেয়ে একদিন মিগনন আর বৃদ্ধ বীণাবাদককে সঙ্গে নিয়ে সার্লোর বাড়ির পথে রওনা হলো উইলেম। সার্লো তার নাট্যজগতের অন্তরঙ্গ বন্ধু। শেকস্‌পিয়ার নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে তার সঙ্গে। 

সার্লোকে আগেই একটা চিঠি দিয়েছিল উইলেম। তাই উইলেম তার বাড়িতে পা দিতেই দুহাত বাড়িরে ছুটে এল সার্লো। সাদর অভ্যর্থনার পর উইলেমকে কাছে বসিয়ে সার্লো বলল, তোমার দলের লোকদের কিছুই হবে না। যত সব অপদার্থের দল। 

উইলেম কোনও কথা বলল না। ওদের প্রতি এখনও সমান মমতা আছে তার। অপদার্থ হলেও ওদের নিয়ে কিছু করা হবে এ বিষয়ে একটা গোপন বিশ্বাস মনটাকে দোলা দেয় তার। কথায় কথায় উইলেম শেকসপিয়ারের হ্যামলেট’ নাটকের কথাটা তুলল। 

সার্লো বলল, পলিনিয়াসের ভূমিকায় অভিনয় করার আমার বড় ইচ্ছা। আমার বোন অরেলিয়াও ওফেলিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে যদি যুবরাজ হ্যামলেটের ভূমিকার জন্য উপযুক্ত লোক পাওয়া যায়। 

অরেলিয়ার সঙ্গে আলাপ করল উইলেম। ওফেলিয়ার চরিত্রটাকে ভালোভাবে জানতে চাইল অরেলিয়া। উইলেম গোটা হ্যামলেট নাটকটা নিয়েই আলোচনা করতে লাগল। সে বলল, সে বিরাট কাজের ভার হ্যামলেটের উপর দেয়া হয়েছিল তার অপরিণত অপটু অশক্ত অন্তরাত্মা সে ভার সহ্য করতে পারেনি। একটা ওক গাছের চারাকে একটা ছোট্ট কাঁচের জারে বসালে যেমন হয়, তার শেকড়গুলো বড় হলে জারটার যেমন ফাটল ধরে, হ্যামলেটেরও ঠিক তাই হয়েছিল। হ্যামলেটের ট্রাজেডি এইখানে। নায়ক শুধু ভেবেছে খলনায়কের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সে কিছুই করেনি। কিন্তু নাটকটা এমনভাবে সাজানো যে খলনায়ক নিজেকে নিরঙ্কুশ করার জন্য নায়কের জন্য যে মৃত্যুফাঁদ পাতে সে ফাঁদে নায়কের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেও পড়ে যায়। 

পরদিন অরেলিয়া ব্যক্তিগত কারণে তার ঘরে উইলেমকে ডাকল। উইলেম ঘরে ঢুকে দেখল, সোফার উপর বসে আছে অরেলিয়া। কিন্তু কোনও বিশেষ কথা হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে সার্লো আর ফিলিনা ঘরে ঢুকল। এরপর সার্লো আর অরেলিয়া দুজনেই বেরিয়ে যেতে ফিলিয়া রয়ে গেল। 

প্রথমে সারা ঘরময় শিশুর মতো অবুঝ আনন্দে লাফিয়ে বেড়াতে লাগল ফিলিনা। তারপর মেঝের উপর শুয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল। প্রথমে ফিলিনাকে দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল উইলেম। তার সেই বিস্ময়কে উপহাস করে ফিলিনা বলল, তোমার আগেই আমি এখানে চলে এসেছি। দেখলো তো? আমি কিন্তু সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। এবার এখানকার কথা শোনো। এখানে আসার পর থেকে আমার মন্দ লাগছে না। কিন্তু এদের সম্বন্ধে কিছু জেনে রাখা উচিত তোমার। থিয়েটারের দল করে কিছু পয়সা করবে সার্লো। সে এখন আমাদের নতুন দলের ম্যানেজার। এই দলে একটা নাচিয়ে মেয়ে আছে। তার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে সার্লো। আবার এক অভিনেত্রীর সঙ্গে বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি। তার উপর শহরে আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে। তার বোন অরেলিয়ার স্বামী মারা গেছে। এই দলেরই এক অভিনেতার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তার মৃত্যুর পর এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে তার আলাপ হয়। ভালোবাসা হয়। কিন্তু তাকে ফেলে সে পালায়। এই বাড়িতে তিন বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে আছে। দেখে মনে হয় ওর বাপ খুব সুন্দর ছিল। ছেলেটাকে আমার খুব ভালো লাগে। অরেলিয়া কিন্তু সেই লোকটার জন্য এখনও হাহুতাশ করে। তার ভাই সার্লো আবার তার প্রেমিকাদের তালিকায় আমার নামটাও লিখে নিয়েছে। আমার প্রতিও তার একটা দুর্বলতা গড়ে উঠেছে। আমার কথা শোনো, তুমি অরেলিয়াকে ভালোবাস। তাহলে ভালোবাসাবাসির খেলাটা বেশ জমে উঠবে। তুমি অরেলিয়াকে ভালোবাসবে, অরেলিয়া ভালোবাসবে সেই পলাতক ভণ্ড প্রেমিকটাকে। আমি তোমাকে ভালোবাসব আর আমাকে ভালোবাসবে সার্লো। একজন যার পিছনে ছুটে চলবে, সে ছুটে চলবে আর একজনের পিছনে। তা না হলে, ভালোবাসার খেলা। 

এরপর একদিন অরেলিয়া সত্যি সত্যিই তার জীবনের কথা সব খুলে বলল উইলেমকে। বলল, আমার মা আমার খুব ছেলেবেলায় মারা যান। আমি মানুষ হই আমার পিসির কাছে। তাঁর নীতিজ্ঞান মোটেই তীক্ষ্ণ ছিল না। আমি আমার যৌবনে একজনকে না বুঝে না ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। সে আমার দাদার অধীনে অভিনয় করত। কিছুদিন পরে সে মারা যায়। আমাদের কোনও সন্তানও হয়নি। তারপর এক ভদ্রলোকে আসেন এখানে বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে। ভদ্রলোক প্রথমে আমার কাছে প্রতিটি কাজে ও কথাবার্তায় নিঃস্বার্থ প্রেমের ভান করে যাতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। জীবনে প্রথম ভালোবাসা জাগে আমার হৃদয়ে। তাকে খুশি করার জন্যই যেন দিনে দিনে ভালো অভিনয় করতে শিখি। সে আমার অভিনয় দেখে খুব প্রশংসা করত। কিন্তু হঠাৎ বাড়ি থেকে একখানা চিঠি পেয়ে সেই যে চলে গেল আর এল না। এখন কিভাবে এক পরিত্যক্ত অনাথা বিধবা দিন কাটাচ্ছে নিবিড় হতাশার মধ্যে তা দেখ নিজের চোখে। 

অরেলিয়া বড় আবেগপ্রবণ। নিজের দুঃখের কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই কেঁদে ফেলে। হঠাৎ সার্লো ঘরে এসে তার চোখে জল দেখে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছুরি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অরেণিয়া ঝড়ের বেগে সোফা থেকে উঠে গিয়ে সেটা কাড়ার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগল। অবশেষে সেটা কেড়ে নিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। সার্লো বলল, একটা অভিনেত্রী কখনও ছোরা-ছুরি নিয়ে বাস করে না। 

অরেলিয়া বলল, ছোরাটা দেখতে ধারাল এবং ভয়ঙ্কর বলেই সে খারাপ হবে তার কোনও মানে নেই। 

সার্লো চলে গেলে অরেলিয়া উইলেমকে বলল, এখানে আমার মোটেই ভালো লাগে না। যে দলটা এসেছে তাদের কাউকে আমার ভালো লাগে না। আমার দাদার কাছে থাকতেও আর আমার ভালো লাগে না। 

ওদিকে সার্লো ক্রমাগত তার দলের লোকদের অযোগ্যতার কথা বলতে থাকায় উইলেম নতুন করে তাদের অভিনয় শেখাতে লাগল। তবু এত কিছু সত্ত্বেও ওদের মন পেল না উইলেম। মেলিনা সহ দলের প্রায় সবই তখনও ক্ষুব্ধ তার প্রতি। একমাত্র লার্তেস ও ফিলিনা তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। 

আর একদিন সার্লোর খোঁজে এসে উইলেম অরেলিয়ার সঙ্গে দেখা করল তার ঘরে গিয়ে। উইলেম একা সোফার উপর বসল। অরেলিয়া বলল, কাল সন্ধ্যায় নাটক আর না। আজ সকালে আমি আমার ভূমিকা বুঝে নিলাম। 

উইলেম বলল, তোমার প্রতিভা আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার যৌবনসমৃদ্ধ। সুন্দর চেহারা ও প্রতিভা আছে। তুমি একদিন চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করবে জীবনে। অতীতের জন্য কিছু ভেবো না। 

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অরেলিয়া বলল, আমরা নারীরা এমনই দুর্বল প্রকৃতির যে আমরা কাউকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের যৌবন সৌন্দর্য জ্ঞান বিদ্যা বুদ্ধি সব তোমাদের মতো পুরুষদের পায়ে বিলিয়ে দিই। কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে সব সমৰ্পণ করি। 

এই বলে ঘরের মধ্যে অশান্তভাবে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল অরেলিয়া। এক সময় বলল, বুঝি বন্ধু, সব বুঝি। কিন্তু অতীতের চিন্তা-ভাবনা থেকে মনকে বিচ্ছিন্ন। করে নেওয়া যে কত কঠিন কাজ তা কি করে বোঝাব? আমি আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না লোকটা আমাকে ত্যাগ করলেও কেন আমি তাকে ভালোবাসব না? কোন যুক্তিতে আমি তাকে ভালোবেসে যাব না তা সত্যিই বুঝতে পারছি না। ভাবতে গিয়ে মাথাটা আমার ঘুরে যায়। হ্যাঁ, তবু আমি ভালোবেসে যাব তাকে। যতদিন বাঁচব ভালোবাসব। 

অরেলিয়ার একটা হাত ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল উইলেম। তাকে মেরিয়ানার কথাটা বলল। মেরিয়ানাও তো বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার সঙ্গে। তবু সে নূতন উদ্যামে বুক বেঁধে কাজ করে চলেছে। একদিন সেও এমনকি করে ভেঙে পড়েছিল প্রথম প্রেমে ঘা খেয়ে। কিন্তু আজ আর সেকথা ভাবে না। অরেলিয়া বলল, তুমি কখনও কোনও মেয়েকে মিথ্যা বলে ঠকাওনি একথা জোর গলায় বলতে পার? 

উইলেম শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, পারি। সে কথা বলার কোনও প্রয়োজন হয়নি। যে মেয়েকে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করতে পরব না তাকে আমি কোনওমতেই ভালোবাসা জানাব না। সে আমার ভালোবাসা পাবে না। 

অরেলিয়া বলল, তাহলে হাজার মিথ্যাবাদী পুরুষের মাঝে তুমি একটা। তবে তোমার প্রতিশ্রুতির কথা মনে আছে তো? 

উইলেমস তার একটা হাত ধরেই বলল, হ্যাঁ আছে। অরেলিয়া বলল, ঠিক আছে। আমি মেনে নিচ্ছি তোমার কথা। 

এই বলে ডান হাত দিয়ে তার পকেট থেকে ছুরিটা বের করে উইলেমের একটা হাতের চাটু চিরে দিল সেই ছুরিটা ডগাটা দিয়ে। তারপর তার রুমাল দিয়ে তার হাতটা বেঁধে দিল। তখনও রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল উইলেমের হাত থেকে। উইলেম আশ্চর্য হয়ে বলল, একি করলে অলেরিয়া, তোমার হিতাকাক্ষী বন্ধুকে আঘাত করলে? 

চুপ! তার একটা হাত দিয়ে উইলেমের মুখটা চেপে ধরল। তারপর ড্রয়ার থেকে ওষুধ এনে লাগিয়ে দিল। বলল, আমার মতো অর্ধপাগল এক নারীকে ক্ষমা করো। মাত্র কয়েক ফোঁটা রক্তের জন্য দুঃখ করো না। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

কদিন ধরে অরেলিয়ার মাথাটা যেন বেশি খারাপ হয়ে পড়ে। সে সব সময় হাহুতাশ করতে থাকে। তখন তাকে একটা নির্জন বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাছাড়া সে একা একা থাকতেই ভালোবাসে। আর তিন বছরের ছেলে ফেলিক্স এ বাড়িতে রয়ে গল। মিগননের সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। মিগনন তার দেখাশোনা করতে লাগল। মিগননের কাছে সে ভালোই থাকে। 

সার্লো একটু গানের ভক্ত। সমস্ত দলের মধ্যে তাই দুজনকে বেশি পছন্দ করত। তারা হলো বৃদ্ধ বীণাবাদক আর মিগনান। লার্তেসও কিছু গল্প জানত বলে তাকেও ভালোবাসত। 

একদিন হঠাৎ উইলেম বাড়ি থেকে ওয়ার্নারের লেখা একটি চিঠি পেল। চিটি খুলে দেখল তার বাবা মারা গেছে। হঠাৎ মাত্র কয়েক দিনের অসুখে অকালে মারা গেছেন তার বাবা। ওয়ার্নার লিখেছে সে তার বোনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এবং তাদের বাড়িতেই আছে। সুবিধাবাদী ধান্দাবাজ লোকেদের আনাগোনা চলেছে অনবরত। সুযোগ পেলই যা পাবে চুরি করে নিয়ে যাবে এটা-ওটা। 

ওয়ার্নার আরও লিখেছে সে স্থায়ীভাবে তাদের পৈতৃক বাড়িতে বাস করতে আসেনি। তার বোনের সঙ্গে তার বিয়েটা হয়ে গেলেই তারা তার বাড়িতে চলে। আসবে। তার মাও তাদের বাড়িতে এসে থাকবেন। তখন তাদের বাড়িটা মোটা টাকায় বিক্রি করে দিয়ে সেই দিয়ে গ্রামাঞ্চলে এক বিরাট খামারবাড়ি কিনবে। তাদের ইচ্ছা তখন অর্থাৎ আজ হতে মাস ছয়েক পরে উইলেমই সে খামারবাড়ি দেখাশোনা করবে। 

তার উত্তরে উইলেম লিখল ওয়ার্নারকে, তোমার চিঠিখানা সুলিখিত। এতে তুমি যথোচিত বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছ। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। আমি যদি প্রভাবশালী কোনও সামন্তবংশের সন্তান হতাম তাহলে আমি ঘরে থেকেই আমার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারতাম। আমার প্রতিভার সম্যক বিকাশ সাধন করতে পারতাম। কারণ সমাজের সর্বস্তরে রাজাদের মতো সামন্তদেরও প্রভাব প্রসারিত। কিন্তু আমি একজন সাধারণ ঘরের ছেলে। আমাকে অনেক অসুবিধা ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে আমার প্রতিভার বিকাশের জন্য কাজ করে যেতে হবে। 

আমার জন্মগত প্রবৃত্তি ও প্রবণতাকে অবলম্বন করেই আমার ব্যক্তিসত্তার চরম উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে চাই। আমার সাধনায় সিদ্ধিলাভ না করা পর্যন্ত আমি কাজ করে যাব। আমার সাধনার উপযুক্ত পরিবেশ আমি এই বিদেশে খুঁজে নিয়েছি। তোমার চিঠি পাবার আগেই আমি আমার জীবনের লক্ষ্য ও কর্মপন্থা ঠিক করে ফেলেছি। আমি জানি আমার যা কিছু পৈতৃক সম্পত্তি আছে তা যোগ্য লোকের হাতেই আছে। শুধু মাঝে মাঝে প্রয়োজন হলে তোমার কাছ থেকে কিছু চাইব। তবে যতদূর মনে হয় আমার নিজের খরচ আমি এখন থেকে নিজেই চালিয়ে নিতে পারব। 

চিঠিখানা পাঠিয়ে দিয়েই সার্লোর সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ল উইলেম। সার্লো অনেক আগে থেকেই তাপে চাপ দিচ্ছিল, এভাবে অনিশ্চিত অবস্থায় না থেকে চুক্তিবদ্ধভাবে কিছু করা ভালো। উইলেম বলল, সার্লেই ম্যানেজার থাকবে। সার্লোর দলে থেকে সে অভিনয় করে যাবে এবং নাটকও লিখবে। উইলেম এ চুক্তির ফলে সবাই কাজ পেল। কিন্তু একমাত্র লার্তেস ছাড়া আর আর কেউ তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাল না, অথচ তারা এই চুক্তির জন্য কত প্রত্যাশা করেছে। তারা বলল, ফিলিনা উইলেমকে প্রভাবিত করে এই কাজ করিয়েছে। 

যাই হোক, চুক্তিপত্রে সই করতে গিয়ে হঠাৎ উইলেমের মনে পড়ল সেই সুন্দরী অশ্বারোহিণীর কথা যার মুখ চকিতে একবার সেই বনভূমিতে শায়িত অবস্থায় আবিষ্ট। চেতনার মধ্য দিয়ে দেখেছিল, যার মুখখানা দেখতে অনেকটা কাউন্টপত্নীর মতো। ভাবতে ভাবতে অভিভূত হয়ে পড়েছিল উইলেম। সই করার পরেও কলমটা তার হাতে আটকে পড়েছিল যেন। যেন পাথরের মতো জমে গেলে তার হাতটা। পাশে থেকে মিগনন তাকে নাড়া না দিলে সে ওইভাবেই থাকত। 

ঠিক হলো ওরা হ্যামলেট মঞ্চস্থ করবে। হ্যামলেটটা ইংরাজি ভাতা থেকে জার্মান ভাষায় নাটকের আকারে অনুবাদ করবে উইলেম। তবে সার্লোর মতে কিছু বাদ দিয়ে এখানকার দর্শকদের উপযোগী করে তুলতে হবে। অর্থাৎ বলতে পার গম পেষাই করে আটা বের করে ভূষিটাকে বাদ দিতে হবে। 

উইলেম প্রথমে রাজি হতে পারল না। বলল, নাটকের ব্যাপারে গমের উদাহরণ খাটে না। বরং বলতে পারত গাছ। সব মিলিয়ে একটা গোটা গাছ; তার থেকে শাখা প্রশাখা, পাতা, কাণ্ড কিছুই বাদ দিতে পার না। 

সার্লো প্রতিবাদ করে বলল, একটা আস্ত গোটা গাছ তো আর টেবিলের উপর উপস্থাপিত করতে পার না দর্শকদের জন্য। কিছু কাটছাঁট করতেই হবে। 

উইলেম বলল, নাটকটা অনুবাদ ও সম্পাদনা কিসের ভিত্তিতে করব তা ভেবে ঠিক করে রেখেছি আমি। দুটো বিষয়ে আমাকে লক্ষ্য রেখে চলতে হবে। এক হলো। চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক আর অন্যটা হলো বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্ক। এই সব ঘটনার মধ্যে লার্তেসের ফ্রান্সযাত্রা, তার প্রত্যাবর্তন, হ্যামলেটকে ইংল্যান্ড পাঠানো, ফোর্টিব্রাসের পোল্যান্ড অভিযান প্রভৃতি। আরও অসংখ্য ঘটনা আছে। কিন্তু এইসব ঘটনা এমনভাবে গ্রথিত হবে যাতে কেন্দ্রগত ঐক্য ব্যাহত না হয়, বিশেষ করে। নায়কের অনুপস্থিতিতে নাটকের কোনও বিশেষ নাট্য তাৎপর্য লাভ করতে না পারে। তবে আমি ঠিক করেছি ঘটনাগুলোকে এইভাবে সাজাব। হ্যামলেট হোরেশিওকে তার কাকার গোপন অপরাধের কথা খুলে বলতেই হোরেশিও তাকে পরামর্শ দিল তার সঙ্গে। নরওয়ে গিয়ে সেখানে হ্যামলেট সৈন্য সংগ্রহ করুক। তখন এক বিরাট সেনাদল নিয়ে ডেনমার্ক ফিরে এসে তার কাকার উপর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে। হ্যামলেটও ধীরে ধীরে তার কাকা ও মার উপর অস্বাভাবিকভাবে বিরূপ হয়ে উঠবে। তখন রাজা। হ্যামলেটকে যুদ্ধজাহাজে করে নরওয়ে পাঠানো স্থির করলো। দুজন গুপ্তচর রোজেনক্রান্তস ও গিল্ডারস্টার্ন তার উপর কড়া নজর রাখবে। হ্যামলেটের প্রতিদ্বন্দ্বী। লার্তেস ফ্রান্স থেকে ফিরে এলে তাকেও পাঠানো হবে তার পিছনে। এরপর সমাধিক্ষেত্রে ওফেলিয়ার সমাধির কাছে লার্তেসের সঙ্গে দেখা হলো উইলেমের। রাজা তখন দেখল আর বেশি দূর এগোতে দেওয়া ঠিক হবে না। হ্যামলেটকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরিয়ে দেওয়া হোক পৃথিবী থেকে। তারপরেই শুরু হলো সেই ভয়ঙ্কর ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা লার্তেস আর হ্যামলেটের মধ্যে। তারপর চার-চারটে মৃতদেহের ছড়াছড়ি। দেখাতেই হবে। কোনও উপায় নেই। 

সার্লো উৎসাহিত হলে বলল, ঠিক আছে। শেষ করে ফেলো। 

উইলেমের অনুবাদের কাজ শেষ হয়ে যেতেই ভূমিকা বিতরণ শুরু হয়ে গেল। 

উইলেম নিজে করবে হ্যামলেটের অভিনয়। তার অনেকদিনের ইচ্ছা। সার্লো করবে পলোনিয়াসের চরিত্রে অভিনয়। তারও এটা অনেক দিনের ইচ্ছা। অরেলিয়া নিল ওফেলিয়ার ভূমিকা। উইলেমকে এ বিষয়ে আগেই কথা দিয়েছিল সে। ফিলিনা করবে হ্যামলেটের মা অর্থাৎ রানির ভূমিকা। মুস্কিল হলো রাজা ক্লডিয়াস আর হ্যামলেটের বাবা মৃত রাজার প্রেতের ভূমিকা নিয়ে। সার্লো বলল, হাস্যরসিক বৃদ্ধ অভিনেতাকে দেওয়া হোক এই ভূমিকা। কিন্তু উইলেম প্রতিবাদ করল। লার্তেসকে দেওয়া হলো লার্তেসের ভূমিকা। এক নবাগত যুবককে দেওয়া হলো হোরেশিওর ভূমিকা। 

সার্লো একবার বলল, রোজেনক্রান্তস আর গিল্ডারস্টার্ন চরিত্র দুটো বাদ দাও অথবা একটার মধ্যে দিয়ে সেরে দাও। 

কিন্তু উইলেম বলল, এইসব ছোটখাটো চরিত্রের মধ্য দিয়ে শেকসপিয়ার মানব চরিত্রের অনেক কিছু বোঝাতে চেয়েছেন। তাদের মতো ভীরু, তোষামোদকারী, মাথামোটা অথচ সাবধানী চরিত্র সমাজে খুব বেশি ঘোরাফেরা করে। এই ধরনের আরও দু-একটা চরিত্র থাকলে ভালো হতো। 

ফিলিনা রানির ভূমিকা পেয়ে খুব খুশি। সে বলল, প্রথম স্বামীকে খুব ভালোবাসা সত্ত্বেও দ্বিতীয় একজনকে বিয়ে করা, এই তো? আমি এমনভাবে অভিনয় করব যাতে মনে হবে দরকার হলে তৃতীয় একজনকেও বিয়ে করতে পারি। 

কথাটা শুনে রেগে গেল অরেলিয়া। সে আজকাল ফিলিনাকে মোটেই সহ্য করতে পারে না। সার্লো একসময় বলল, এটা দুঃখের বিষয় রানির দুটো নাচ নেই। প্রথম স্বামী ও দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে দুটো নাচ দিতে হবে। 

সঙ্গে সঙ্গে ফিলিনা বলল, আমি যা সুন্দর নাচতাম না। আমার পায়ের পাতাগুলো দেখনি তো? 

এই বলে পা দুটো ফিলিনা টেবিলের তলা থেকে বার করতেই সার্লো তার চটির প্রশংসা করতে লাগল। সে বলল, এ চটি কাউন্টপন্থী তাকে দিয়েছে। সকলের সামনেই আদর করে ফিলিনাকে জড়িয়ে ধরল সার্লো। অরেলিয়া রাগ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। 

অন্য একদিন উইলেমের একটা কথায় রাগ করে অরেলিয়া। উইলেম সেদিন সার্লোকে বলেছিল, এখন যত হ্যামলেট পড়ছি ততই মনে হচ্ছে আমার চেহারার সঙ্গে হ্যামলেটের কোনো মিল নেই। ওরা নর্ম্যান, ডেনমার্কের লোক। ওদের চুল হবে কোঁকড়া। 

সার্লো বলল, চেহারা যাই হোক, অভিনেতার কাজ হলো অভিনেয় চরিত্রকে যথাযথভাবে রূপ দান করা, ফুটিয়ে তোলা। 

অরেলিয়াও তাই বলল। তাছাড়া দর্শকদের মনোভাবেরও একটা মূল্য আছে নাট্যরস আস্বাদনের ব্যাপারে। আমাদের যদি অভিনেতাকে দেখে মনে হয় অভিনেয় চরিত্রের সঙ্গে এ খাপ খেয়ে গেছে তাহলে সেটাই যথেষ্ট। সুতরাং অমতের কোনও কারণ থাকতে পারে না। 

সার্লো বলল, আমাদের প্রম্পটার খুব ভালো নাটক পড়তে পারে। খুব ভালোভাবে প্রম্পট করতে পারে। একবার আমি আমার সংলাপ সব ভুলে গিয়েছিলাম মঞ্চের উপর। কিন্তু ও আমার মুখে সব কথা যুগিয়ে দিয়েছিল চমৎকারভাবে। 

অরেলিয়া বলল, একবার ও কিন্তু প্রম্পট করতে গিয়ে আমার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল, তার কারণ ও আমার সংলাপ পড়তে গিয়ে আবেগে নিজেই অভিভূত হয়ে পড়েছিল। ওর চোখে জল এসে গিয়েছিল। তাই ঠিকমতো পড়তে বা কথা যোগাতে পারেনি আমায়। 

সার্লো বলল, অভিনয় সম্বন্ধে ওর কিন্তু পুরো জ্ঞান আছে। সংলাপগুলো পড়ার সময় তোমার কণ্ঠের ওঠানামা কেমন হবে তা ও সব জানে। ওর পড়াটা এত ভালো যে, অভিনেতারা তার থেকে অনেক সাহায্য পায়। 

উইলেম বলল, উনি তো নিজেও অভিনয় করতে পারেন। উনি মঞ্চে নামেন না কেন? 

সার্লো বলল, ওর গলার স্বরটা ভারী মোটা আর চেহারাটাও ভালো নয়।

উইলেম বলল, কিন্তু রাজা ক্লডিয়াসের ভূমিকাটা তো ওঁকে দেওয়া যেতে পারে। 

সার্লো সঙ্গে সঙ্গে কথাটা লুফে নিল। বলল, হ্যাঁ, এ-ই হচ্ছে উপযুক্ত লোক। তবে ভ্রাম্যমান নাট্যদলের নাটকাভিনয়ের সেই দৃশ্যটা বাদ দিতে হবে। এই প্রসঙ্গে অর্থাৎ সেই নাটকের প্রতিক্রিয়া হিসাবে রাজার যে সংলাপ আছে, সেটা কঠিন হবে ওর পক্ষে। 

উইলেম বলল, এই ভ্রাম্যমান নাট্যদলের নাটকাভিনয়ের উপস্থাপনার পিছনে শেকসপিয়ারের একটা বড় উদ্দেশ্য আছে। কারণ এই নাটকের অভিনয় একদিকে যেমন হ্যামলেটের বিবেককে এক তীব্র খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তার কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দেয় তাকে, অন্যদিকে তেমনি রাজাকেও সচেতন করে দিল তার গোপন অপরাধ সম্বন্ধে। তাঁর বিবেককে আঘাত দিল। আমরা ওকে এ বিষয়ে শিখিয়ে-পড়িয়ে ভালো করে মেজে ঘষে নেব। 

সার্লো বলল, তা না হয় হলো। কিন্তু প্রেতের ভূমিকাটা কাকে দেবে? ও বৃদ্ধের দ্বারা হবে না। 

উইলেম বলল, বাইরে দু-একজন লোক প্রায়ই আসছে অভিনয় করার জন্য। তাদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিলেই হয়। 

কিন্তু একদিন সন্ধেবেলা একটা মজার ব্যাপার ঘটল। কি করে কি হলো তা কেউ বুঝতে পারল না। উইলেম তার ঘরে ঢুকেই একটা খামের চিঠি পেল। তাতে লেখা আছে, আপনার হ্যামলেট মঞ্চস্থ করার জন্য শ্রম ও নিষ্ঠাসহকারে যেখাবে কাজ করে চলেছেন তাতে আমরা খুব খুশি। প্রেতের ভূমিকায় অভিনয় নিয়ে কোনও চিন্তা করার নেই। যথাসময়ে প্রেত আবির্ভূত হবে। 

চিঠি যে কে লিখে পাঠিয়েছে তা কেউ বুঝতে পারল না। উইলেম সার্লোকে দেখাল। সার্লো অনেকক্ষণ দেখে এবং অনেক ভেবে বলল, আমাদের ভেবে দেখতে হবে আমরা একথার উপর ঠিক নির্ভর করতে পারব কিনা। 

সার্লো চলে গেলে অরেলিয়া উইলেমকে বলল, এ নিশ্চয়ই কার্লোর কাজ।

সেদিন সকালে প্রথম স্টেজ রিহার্সালে নেমে একটা কথা মনে পড়ে গেল উইলেমের। অতীতের এমনি কোনও এক সকালে তাদের শহরে এমনি এক রিহার্সালের সময় এই একই দৃশ্যপট সাজানো ছিল মঞ্চে। সে দৃশ্যেও ছিল চাষিদের ছোট ছোট কুঁড়ে। সেদিনের রিহার্সালের নায়িকা ছিল মেরিয়ানা। সেই সকালে মেরিয়ানা সর্বপ্রথম প্রেম নিবেদন করে তাকে। মঞ্চের ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল এক ফালি সূর্যের রশ্মি এসে মেরিয়ানার বুক আর কটিদেশকে আলোকিত করে তুলেছিল। উইলেমের কেবলি মনে হতে লাগল একটু পরেই যেন মেরিয়ানা এসে হাজির হবে মঞ্চে। পুরনো স্মৃতির ব্যথাভারে এমনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল উইলেম। যে সে তার অভিনয়ের কথা ভুলে গেল একেবারে। দুজন বাইরের শৌখিন অভিনেতার ডাকে চমক ভাঙল উইলেমের। 

এই দুজন শৌখিন অভিনেতা হলো স্থানীয় দুজন যুবক। এরা তাদের দলের বেতনভুক্ত অভিনেতা নয়। তবে প্রায়ই আসে, তাদের রিহার্সাল দেখতে। তারা কিন্তু ভালো সমঝদার। তাদের রুচিবোধ ও রসবোধ আছে। তারা তাদের অভিনয় ও মঞ্চ পরিচালনা দেখে দোষত্রুটি সম্বন্ধে যে সব মন্তব্য করে তা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। তার থেকে কিছু না কিছু গ্রহণ করার চেষ্টা করে সার্লো এবং উইলেম দুজনেই। এই যুবক দুজনের একজন নিছক নাট্যপ্রীতির খাতিরেই আসে তাদের কাছে। আর একজন মাদাম মেরিলার প্রতি আসক্ত। 

যাই হোক, ওরা মোটের উপর দলের শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু। রিহার্সালের সময় ওদের উপস্থিতি খুবই উপকারে লাগে। বিদগ্ধ দর্শকের মতো ওরা সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে, মুক্ত কণ্ঠে সমালোচনা করে। যেমন ওরা সেদিন বলল, কোনও বিয়োগান্ত নাটকে কোনও অভিনেতা হাত বেশি দোলাবে না। মেয়েরা তাদের হাত পোশাকের ভঁজের ভিতরে ঢোকাবে না। এটা ঠিক নয়। ওদের দ্বারা একটা উপকার হলো। যেহেতু হ্যামলেট অনেক তরোয়াল খেলা ও সামরিক দৃশ্য আছে, ওরা সেই সব অভিনেতাদের শেখাত। লার্তেস ও উইলেম দুজনেই ভালো করে তলোয়ার খেলাটা শিখে নেয়। বিশেষ উদ্যমের সঙ্গে ওরা আর একটা জিনিসের উপর জোর দিল। ওরা সব অভিনেতাকে বলল, কথাগুলো জোরে বলবে, মঞ্চ থেকে যাতে শ্রোতারা সব শুনতে পায়। সব কথা শুনতে না পেলে অভিনয় ভালো হলেও শ্রোতাদের ভালো লাগে না। এইভাবে যুবক দুজন উইলেমের মন জয় করে। উইলেম তাদের এক কোণে বসতে বলে। 

অভিনয়ের যাবতীয় পোশাক আর দৃশ্যসজ্জার কাজ এগিয়ে চলতে লাগল। কোন দৃশ্যে কি কি থাকবে, কিভাবে দৃশ্য সাজানো হবে তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হলো সার্লো আর উইলেমের মধ্যে। 

হঠাৎ একসময় সার্লো অদ্ভুত একটা কথা বলল উইলেমকে। তুমি কি শেষ দৃশ্যে সত্যি সত্যিই হ্যামলেটকে মৃত দেখাতে চাও? 

উইলেম বলল, তা না দেখিয়ে উপায় কি? নাটকের মূল পরিকল্পনাই তো এইভাবে হয়েছে। 

সার্লো বলল, কিন্তু দর্শকরা তা চায় না। 

উইলেম বলল, সাধারণ দর্শকদের মতে সব সময় চলতে হবে এমন কোনও কথা নেই। তারা কি চায় না চায় সেটাকে সব সময় প্রাধান্য দিলে ভালো নাটক দেখাতে পারবে না। তারা অনেক সময় বাজে মিথ্যা আবেগে আপ্লুত হয়ে আনন্দ পেতে চায়। 

সার্লো তবু থামলো না। বলল, যারা টাকা দেয় তাদের ভালো লাগা মন্দ লাগাটাও দেখত হবে বৈকি। 

উইলেম বলল, ফেরিওয়ালারা যখন মিষ্টি ফেরি করে তখন তাদের ডাকে শিশুরাই ক্রেতা হিসাবে ছুটে যায় তাদের কাছে। বড় মানুষেরা তাদের কথায় ভোলে না। তুমি যদি ভালো জিনিস তোমার নাটকের মধ্যে পরিবেশন করো তাহলে দর্শকের মনে ধীরে ধীরে তাদের রুচিবোধ উন্নত হবে। তখন তুমি যে টাকা তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করছ তার দ্বিগুণ তারা দেবে। 

প্রধান রিহার্সাল হয়ে গেল। চলল অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু কয়েকটা দৃশ্য ভালো জমল না। কারণ হ্যামলেটের বাবা মৃত রাজার ছবি সামনে না রাখার অথবা প্রেত না আসায় হ্যামলেট ও তার মার যৌথ অভিনয়ে কেউ কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। সার্লো আর বিশ্বাস করতে পারলো না। একটা উড়ো চিঠির উপর আর নির্ভর করে থাকা যায় না। প্রেতের ভূমিকা কাউকে বিলি করে দেওয়া হোক। 

উইলেম বলল, আমাদের কোনও হিতাকাক্ষী নিশ্চয় একথা লিখেছে। তার কথা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ থাকতে পারে না। 

তখন ঘরের মধ্যে দলের অনেকেই ছিল। ফিলিনা বলল, তোমরা শেকসপিয়ারের উপর অনেক খবরদারি করেছ। নাটকটি কাটছাঁট করেছ। 

সার্লো আর উইলেম জানতে চাইল কোন জায়গাটা বাদ দেওয়া হয়েছে যার জন্য খারাপ লাগছে তার। 

ফিলিনা তা স্পষ্ট করে বলল না। তা না বলে ও একটা গান করতে লাগল আপন মনে। কথা বলতে বলতে তখন রাত হয়ে গেছে অনেক। সবাই উঠে পড়ল। শুধু অরেলিয়া আর উইলেম বসে রইল। অরেলিয়া বলল, আমি ঐ মেয়েটাকে মোটেই সহ্য করতে পারি না। ওকে দেখলেই আমার ঘৃণা হয়। ওর মাথার চুলগুলো কোঁকড়ানো বলে আমার দাদার একটা দুবর্লতা আছে ওর উপর। আর তোমাকে দেখেও কেমন যেন নরম মনে হয় ওর প্রতি। তুমিও ওকে বেশ একটু খাতির করে চলো যে খাতির পাবার কোনও যোগ্যতা নেই ওর। 

উইলেম বলল, আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা ঋণী ওর কাছে। আমি কৃতজ্ঞ ওর কাছে। আসলে দোষ হচ্ছে যে পরিবেশে ও মানুষ হয়েছে সেই পরিবেশের। ওর স্বভাবগত চরিত্রটা খারাপ নয়। 

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাগে আগুন হয়ে উঠল আরেলিয়া। বলল, তোমরা সব পুরুষই এক। নারীদের গুণাগুণ বিচার করার কোনও ক্ষমতাই নেই তোমাদের। 

উইলেম বলল, তুমি কি আমাদের সন্দেহ করো? আমি যতক্ষণ ওর কাছে থাকি তার পূর্ণ বিবরণ দান করতে পারি।

অরেলিয়া অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, নাও, নাও, খুব হয়েছে। এখন দেবী হয়েছে। স্বর্গলোকের উজ্জ্বল পাখি আমার। যাও যাও খুব হয়েছে। 

অরেলিয়া আর দাঁড়াল না। অরেলিয়া চলে গেলে কেমন ভারী হয়ে উঠল উইলেমের মনটা। তার মনের কথাটা ঠিক বোঝাতে পারল না অরেলিয়াকে। 

পোশাক খুলে শুতে যাবার জন্য শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল উইলেম। কিন্তু ঘরের চৌকাঠের কাছে মেয়েমানুষের একজোড়া চটি দেখে থমকে দাঁড়াল। উইলেম বুঝতে পারল এ চটি ফিলিনার। ঘরের পর্দাটা উড়ছে। উইলেমের মনে হলো ফিলিনা তার শোবার ঘরে ঢুকে তার বিছানায় হয়ত শুয়ে আছে। এক নির্লজ্জ রসিকতায় মেতে উঠেছে যেন। উইলেম কড়া গলায় ডাকল, বেরিয়ে এস ফেলিনা, আমি এসব বাজে রসিকতা ভালোবাসি না। 

কোনও সাড়া না পেয়ে পর্দাটা সরাতেই দেখল ঘরের ভিতর কেউ নেই। দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল উইলেম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। রাত্রে মোটেই ঘুম হলো না তার। চারদিকে খুঁজেও ফিলিনার দেখা পেল না। কিন্তু বুঝতেও পারল না কে এই নারী। 

ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল উইলেম। অনেক বেলায় সার্লো এসে ডাকাডাকি করতে লাগল। বলল, কত কাজ আজ। আজ রাত্রেই নাটকাভিনয়। 

সন্ধ্যার সময় নাটক শুরু হবার আগে উইলেম দেখল বেশ লোক হয়েছে। শ্রোতাদের বেশি ভিড় হয়েছে। ভয়ে ভয়ে নাটক শুরু করলেও কিছুক্ষণ পরেই প্রেত এসে হাজির হলো কিন্তু তার মুখ ও সারা দেহ কাপড়ে ঢাকা থাকায় কেউ তাকে চিনতে পারল না। কেউ বুঝতে পারল না কে এইভাবে প্রেত সেজে তার পূর্ব প্রদত্ত পত্রগত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে এসেছে। 

হোরেশিও দেখিয়ে দিলে তার কথামতো প্রেতের দিকে কিছুটা এগিয়ে এল হ্যামলেট বেশী উইলেম। প্রেতকে ঠিক না চেনার এক অতিপ্রাকৃত রহস্যময় অনুভূতি গাঢ় হয়ে উঠল উইলেমের মনে। তার উপর সম্প্রতি তার পিতৃবিয়োগ হওয়ায় সেই অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত হলো তার আপন হৃদয়ের অকৃত্রিম শোকানুভূতি। সব মিলিয়ে অপূর্ব হয়ে উঠল হ্যামলেটের অভিনয়। প্রেতও তার দীর্ঘ সংলাপটি ভালোভাবেই ব্যক্ত করল। স্বল্প ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘেরা শুভ্র বস্ত্রাবৃত প্রেতমূর্তি ও তার রহস্যময় সংলাপ এক চমৎকার অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টি করল মঞ্চের উপর। অতিপ্রাকৃত হলেও বাস্তব সত্যের প্রতীতী জন্মাল দর্শকদের মনে। অভিভূত হয়ে গেল দর্শকরা। এই দৃশ্য শেষে হ্যামলেট যখন মঞ্চ ত্যাগ করে প্রস্থান করল তখন ঘন ঘন হাততালি দিতে লাগল দর্শকরা। এরপর সব অভিনেতাই উৎসাহ পেয়ে ভালো অভিনয় করল। সব মিলিয়ে অদ্ভুত সাফল্য লাভ করল নাটাকাভিনয়। 

অভিনয় শেষে অভিনেতারা ঠিক করল আপন আপন নাটকীয় পোশাক পরেই। একসঙ্গে বসে নৈশভোজন করবে। খাওয়ার পর ওরা সবাই আনন্দ করতে লাগল। মেয়েরা গান করতে শুরু করল। সেই উন্নাসিক বৃদ্ধও বীণাবাদকের বীণায় একটা সুর বাজাতে লাগল। মাদাম মেলিনা এতদিন পর উইলেমের প্রতি এত গভীর শ্রদ্ধাসিক্ত আসক্তি দেখাতে লাগল। লার্তেস শিস দিতে লাগল মুখে। সার্লো মুখে বাজি ছোঁড়ার শব্দের অনুকরণ করতে লাগল। সমস্ত দলটার মধ্যে একবার অরেলিয়ায় চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসে রইল। তারপর একসময় বলল, এবার ওঠা যাক। 

ক্লান্ত হয়ে উইলেম তার ঘরে গিয়ে পোশাক ছেড়ে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে আসছিল তার। কিন্তু হঠাৎ কিসের একটা মৃদু শব্দ হলো বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বোঝার আগেই এক অদৃশ্য নারীর নরম দেহ জড়িয়ে ধরল তার দেহটাকে। তার মুখে তার ঠোঁট দুটো চেপে ধরল এমন জোরে যে উইলেম তা ঠেলে প্রথমে সরিয়ে দিতে পারল না। 

কোনওরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে পোশাকটা পরতে গিয়ে সে দেখল ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল এবং দরজাটা খোলা। ঘরের আলো জ্বেলে দেখে বিছানায় বা ঘরে কেউ নেই। তবে কে এই নারী! আশ্চর্য হয়ে ভাবতে। লাগল উইলেম। প্রথমে তার সন্দেহ হলো এ নিশ্চয় ফিলিনার কাজ। কিন্তু পড়ে দেখল। সে নয়। এদিকে-সেদিক তাকাতে বিছানার উপর দেখল একটা ওড়না পড়ে রয়েছে। তার মনে হলো এই ওড়নাটাই প্রেমূর্তির গায়ে জড়ানো ছিল। তার আঁচলের কাছে সেলাই করা একটা লেখা, এই প্রথম এবং শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি পালিয়ে যাও যুবক, পালিয়ে যাও। 

এই লেখাটাতে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল। 

পরদিন সকালবেলায় ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল এরপর কোন্ নাটকের রিহার্সাল শুরু করবে আজ সন্ধে থেকে। অনেক আলোচনার পর ঠিক হলো, হ্যামলেটই অভিনীত হবে আবার। উইলেম তখন সতর্কবাণী খোদিত সেই রহস্যময় ওড়নার কথাটা বলল। তখনই ঠিক হলো প্রেতের ভূমিকা দলের কাউকেই দেওয়া। হবে। বাইরের কোনও লোককে প্রেতের ভূমিকা দেওয়া হবে না। এলেও তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সার্লো বলল, আমাদের দলের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকে এইভাবে ভয় দেখানো বরদাস্ত করব না আমরা। 

প্রাথমিক আলোচনা ও কথাবার্তার পর সভা ভঙ্গ হতে আপন আপন ঘরে সবাই চলে গেল। হঠাৎ মিগনন ছুটে এসে উইলেমের ঘরে ঢুকে বলল, মালিক, মালিক, আগুন লেগেছে। শীগগির বেরিয়ে আসুন। অরেলিয়া একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে। তার ছেলে ফেলিক্সকে উইলেমের হাতে তুলে দিল। মিগননও তাকে বলল, আপনি ছেলেটাকে দেখুন। আমি অন্য সবাইকে দেখছি। এই বলে মিগনন ছুটে অন্যত্র চলে গেল। 

উইলেম প্রথমে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। সে দেখল বীণাবাদক উপরতলা থেকে তার বীণা হাতে বেরিয়ে আসছে। ফেলিক্সকে বীণাবাদকের হাতে তুলে দিয়ে উইলেম আগুনের উৎসটা কোথায় তা দেখার জন্য খুঁজে বেড়াতে লাগল। পরে দেখল আগুনের উৎস এ বাড়িতে নেই। ধোঁয়াটা আসছে বাগানবাড়ির ওধার থেকে। কিন্তু উৎস যেখানেই থাক, আগুনটা ক্রমশ জোর হতে লাগল। তিন-চারটে বাড়ির কাঠের জিনিসপত্র এবং অনেক কিছু পুড়ে গেল। উইলেম পাড়ার লোকদের সাহায্যে অনেক কষ্টে আগুন নেভাল। এমন সময় মিগনন এসে উইলেমকে ব্যস্তভাবে ডাকাডাকি করতে লাগল, মালিক তাড়াতাড়ি এস, ফেলিক্সকে বুড়োটা মেরে ফেলবে। ও হঠাৎ পাগল হয়ে গেছে। 

মিগননের সঙ্গে বাগানবাড়িতে ছুটে গিয়ে উইলেম দেখল শুকনো কাঠ আর খড়ের গাদায় আগুন জ্বলছে। আর তার পাশে ফেলিক্সকে শুইয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বীণাবাদক তার বীণাটা ধরে রয়েছে। উইলেম গিয়ে বৃদ্ধকে বলল, এসব কি হচ্ছে? 

মিগনন তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। ছেলেটা তখন চিৎকার করে কাঁদছিল। বৃদ্ধ উইলেমের কথার কোনও উত্তর দিল না। তাকে আর কিছু না বলে তাদের বাড়িটায় চলে এল সে। তার ট্রাঙ্কটা কোনওরকমে রক্ষা পেয়েছে। তবে কাপড় জামা অনেক পুড়ে গেছে। গোটা বাড়িটার ঘরগুলো থেকে ধোঁয়া বার হচ্ছিল।

মিগনন উইলেমকে দেখতে পেয়ে বলল, মালিক, আজ একটা বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি আমরা। মৃত্যুর কবল থেকে কোনওরকমে বেঁচে গেছে ফেলিক্স। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আসল ব্যাপারটা জানতে পারল অবশেষে। মিগননের হাত থেকে লণ্ঠনের আলো দিয়ে খড়ের গাদায় বুড়ো বীণা-বাজিয়েটাই আগুন লাগায়। তারপর ছেলেটাকে পাশে ফেলে তার গলাটা ছুরি বার করে কাটতে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন ছেলেটাকে উৎসর্গ করতে যাচ্ছে সে। এমন সময় মিগনন তা দেখতে পেয়ে চিৎকার করে লোক ডাকে। ছেলেটাকে কেড়ে নিয়ে অন্যত্র সরিয়ে রেখে উইলেমকে ডেকে আনে। 

কিন্তু আগুনের জন্য তখন এ বিষয়ে আর মন দিতে পারল না উইলেম। সারাটা রাত কেটে গেল আগুন নেভাতে গিয়ে। তখন সকাল হয়ে গেছে। কনকনে শীতে কাঁপছিল সবাই। আগুন নিভে গেলেও ঘরগুলো গরম ছিল। জিনিসপত্র বেশ কিছু পুড়ে গেলেও মানুষজনের কোনও ক্ষতি হয়নি। তবে ঘরগুলোর কিছু কিছু ক্ষতি হওয়ায় উইলেম আপাতত বাগানের মধ্যে যে বাড়িটা খালি ছিল সেখানে গিয়ে উঠল। বৃদ্ধ বীণাবাদককে আর দেখা গেল না। কেউ তার খোঁজও করল না। 

সেই দিনই বেলা দশটার সময় সার্লো দলের সবাইকে ডাকল। বলল, রিহার্সাল হবে হ্যামলেটের। আজ রাত্রেই আবার অভিনয় হবে। বিশেষ করে যে সব দৃশ্যে নূতন লোক ভূমিকা গ্রহণ করছে।

আজকের রাত্রিতে নাটকের অভিনয় নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছু বাদানুবাদ হয় সার্লোর। নগর কর্তৃপক্ষ ও জেলাপ্রশাসক বললেন, এত বড় অগ্নিকাণ্ডের পর নাট্যানুষ্ঠান দিনকতক বন্ধ থাক। 

সার্লো বলল, প্রথম কথা, আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নাটক করে তা পূরণ করতে হবে। দ্বিতীয় কথা, এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে দলের লোকের মনমেজাজ খুব খারাপ। নাটকের অভিনয় আবার সেই মনকে খুব তাড়াতাড়ি আনন্দ দান করে গরম করে তুলতে পারে। 

অবশেষে অনুমতি পায় সার্লো। নাটকের ঘোষণা শুনে দর্শকদেরও বেশ ভিড় হয়। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে যায়। তবে আজকের দর্শকরা প্রায় সব নূতন। তাই তারা গতকালের অভিনয়ের সঙ্গে আজকের অভিনয়ের গুণগত মানের কোনো বিচার করে দেখতে পারল না। মোটের উপর নির্বিঘ্নেই কেটে গেল নাটকের অভিনয়। 

অভিনয় শেষে ফিলিনা তাকে একটু ধাক্কা দিয়ে কি বলল বুঝতে পারল না উইলেম। হঠাৎ সেদিনকার কথাটা মনে পড়ে গেল তার। ফিলিনার সেই চটিজোড়াটা যেটা সরিয়ে রেখেছিল সে তা পুড়ে গেছে। তার ঘরের সেই দরজাটাও পুড়ে গেছে। যাই হোক, বাগানবাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল উইলেম। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল বাগানে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। ফিলিনা যা বলল তাতে মনে হলো ও রাত্রিতে তার কাছে আসবে। কিন্তু উইলেমের মনে হলো ও না এলেই ভালো হয়। তবে তার কাছ থেকে কয়েকটা কথা জানতে চায় সে। 

বাগানবাড়ির ভেতর থেকে বীণাবাদকের গলার স্বর ভেসে আসতেই থমকে দাঁড়াল উইলেম। বাড়ির সদর দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ। তার চাবি তার কাছে। হঠাৎ চোখে পড়ল তার বীণাবাদক তার হাতের বীণাটা নিয়ে ভেতর থেকে দরজার কাছে এসে দরজা বন্ধ করে পাঁচিল টপকাতে যাচ্ছে। উইলেম বাইরে থেকে বাধা দিল। নিজের হাতে দরজাটা খুলে বাড়ির ভিতরে ও বৃদ্ধকেও জোর করে ঢুকিয়ে দিল। বৃদ্ধ বলল, 

আমাকে ছেড়ে দাও। আমি চিরদিনের মতো চলে যাব এখান থেকে। 

উইলেম বলল, তুমি বাগানবাড়ি থেকে চলে যেতে পার কিন্তু শহর থেকে পালাতে পারবে না। ম্যাজিস্ট্রেট সব জেনে গেছেন। তোমাকে খুঁজছে অনেকে। 

বাড়ির ভিতর থেকে জোর করে বৃদ্ধকে নিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। 

উইলেম বুঝতে পারল মস্তিষ্কের বিকৃতির জন্য এই জঘন্য কাজ করে ফেলেছে বৃদ্ধ বীণাবাদক। তাই ভাবতে লাগল কি করা যায় ওকে নিয়ে। এমন সময় লার্তেস এসে তাকে একটা খবর দিল। লার্তেস বলল, আমি কিছুক্ষণ আগে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করে জানলাম তারও বিষাদের অত্যধিক চাপ থেকে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেছিল। কিন্তু এক গ্রাম্য যাজক তা সরিয়ে দিয়েছে। 

সেই যাজকের খোঁজ নিয়ে বৃদ্ধকে সেখানেই পাঠিয়ে দিলে উইলেম। তার আগের বীণাটা পুড়ে যাওয়ায় আবার তাকে একটা বীণা কিনে দেওয়া হয়। সেই বীণাটা তার সঙ্গেই দেওয়া হলো। 

এদিকে ফিলিনার হাবভাবটা কেমন হয়ে উঠছিল দিনে দিনে। সমগ্রভাবে দল ও দলের লোকজনদের প্রতি তার একটা অনাসক্তি গড়ে উঠেছিল যেন দিনে দিনে। ফিলিনা অন্য একটা ঘর ভাড়া করে উঠে গিয়েছিল। সে থাকত এলমিরা নামের একটি লোকের সঙ্গে। সে সার্লোর কাছে খুব কম আসত। এত অরেলিয়া বিশেষ খুশি হয়। কিন্তু সার্লো মাঝে মাঝে তার কাছে যেত। তার প্রতি একটা দুর্বলতা তখনও ছিল। একদিন সার্লো উইলেমকে নিয়ে ফিলিনার বাড়ি গেল তার সঙ্গে দেখা করতে। 

ওরা গিয়ে দেখল, ফিলিনা একজন যুবক অফিসারের সঙ্গে বসে রয়েছে ভিতরকার ঘরে। বাইরের ঘরে সার্লো আর উইলেম বসতে ফিলিনা একবার ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। সার্লো এবং উইলেম দুজনেই বলল, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ, আমরা একটু আলাপ করতে চাই। 

ফিলিনা বলল, আসলে উনি একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা। বিশেষ কারণে উনি আমার কাছে পুরুষ সেজে আছেন। 

উইলেম বলল, আমি একবার দেখা করতে চাই ওঁর সঙ্গে। ওঁর নাম কি? 

ফিলিনা বলল, তা বলব না। আমি প্রথম ওঁকে জানাব। ওঁর মত হলে আমি তোমাদের খবর দেব। তখন এসে আলাপ করবে। 

উইলেমের একবার মনে হলো, মেয়েটি হয়ত তার মেরিয়ানা। অনেকটা তার মতো দেখতে। তবে মেরিয়ানার থেকে একটু লম্বা মনে হলো। 

কিন্তু দুই-একদিনের মধ্যেই দল ছেড়ে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল ফিলিনা। তার বাড়িওয়ালার কাছে শুনল। সেই যুবক অফিসারের সঙ্গে ফিলিনা তার সব ভাড়া ও দেনা মিটিয়ে দিয়ে চলে গেছে। আর আসবে না। কোথায় গেছে তা কেউ জানে না। 

ফিলিনার এই আকস্মিক অন্তর্ধান দলের লোকদের মধ্যে এমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারল না। সার্লোও ব্যাপারটা সহজভাবে মেনে নিল। তার জায়গায় অভিনয়ের জন্য অন্য মেয়ের ব্যবস্থা করল। 

ফিলিনা ছিল দলের মধ্যে এক সংযোগসূত্র। দলের বিভিন্ন লোকের মধ্যে যেটুকু ফাঁক থাকত হাসিখুশি দিয়ে তা ভরিয়ে তুলত ফিলিনা। ফিলিনা চলে যেতে কেমন যেন শিথিল হয়ে উঠল পারস্পরিক যোগসূত্র। ফিলিনা উইলেম আর সার্লো দুজনকেই খুশি রাখত। অরেলিয়ার সব বিতৃষ্ণা ও বিরক্তি নীরবে সহ্য করত। কেউ কোনও বিষয়ে রেগে গেলে তা মতান্তর দেখা দিয়ে তাকে বোঝাত। তাই প্রথম প্রথম ফিলিনার অভাবটা বোঝা না গেলেও ক্রমে তা সবাই অনুভব করতে লাগল।

ফিলিনা চলে যাবার পর অরেলিয়ার জ্বর হতে লাগল, মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে। উঠল। একদিন উইলেম তার কাছে ফরাসি ভাষায় একটা লেখা পাঠ করতে গিয়ে বেশ বকুনি খেল। অরেলিয়া বলল, যে লোকটা আমাকে ঠকিয়ে চলে যায় সে ফরাসি ভাষায় কথা বলত। সেই থেকে ফরাসি ভাষা শুনলেই লোকটাকে মনে পড়ে। আমার মাথায় নূতন করে আগুন জ্বলে যায়। 

উইলেম হঠাৎ একদিন এর মাঝে বীণাবাদকের খবর নিতে গেল সেই গ্রামে। যাজকের কাছে যেতেই উইলেম দেখল বৃদ্ধ বীণাবাদক একটি ছেলেকে বীণা বাজানো শেখাচ্ছে। যাজক বললেন, মানুষের বিক্ষিপ্ত ব্যথাহত ও হতাশাগ্রস্ত মনকে যদি কোনও সৃষ্টির কাছে নিয়োজিত করতে পারা যায় এইভাবে তাহলে সে কখনই উন্মাদ হতে পারে না। আবার অনেক উন্মাদ ব্যক্তিকেও এইভাবে সারিয়ে তোলা যায়। 

কথা বলতে বলতেই ডাক্তার এলেন। উইলেম আলাপ করল তার সঙ্গে। ডাক্তার কথা প্রসঙ্গে বললেন, আরও দুটি কেস আমি পেয়েছি। এই দুটি কেসেই দেখা যায় এক গম্ভীর হতাশা আর বিষাদ থেকে এই উন্মাদ ভাব গড়ে উঠেছে। এঁরা দুজনেই কোনও এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্বামী-স্ত্রী। এক কাউন্ট ও তাঁর স্ত্রী। তাঁদের কোনও সন্তানাদি নেই। এদের বয়স কম। একবার এই কাউন্ট শিকারের ব্যাপারে দু-এক দিনের জন্য বাইরে যান। তখন বাড়ির লোকজনেরা তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে এক যুবককে কাউন্টের পোশাক পরিয়ে তাঁর শোবার ঘরে বসিয়ে রাখে। তারা ভাবে কাউন্টপত্নীকে এইভাবে ঠকিয়ে বেশ মজা করবে। কিন্তু আসলে আমার মনে হয় তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল কাউন্ট ও কাউন্টপত্নীকে হেয় প্রতিপন্ন করে পরিবারের উপর কলঙ্ক আরোপ করে। কাউন্ট ঐ সময় হঠাৎ ফিরে এসে তার শোবার ঘরে তার বেশে এক যুবককে বসে থাকতে দেখে আতঙ্গগ্রস্ত হয়ে অন্য ঘরে চলে যান। তাঁর ধারণা হয় তিনি নিজেই প্রেতাত্মাকে দেখেছেন অর্থাৎ তার মৃত্যুর সময় আর বেশি দিন বাকি নেই। এখন কাউন্ট ভদ্রলোক তার বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-পরিজন কারও সঙ্গে মেশেন না। 

উইলেম রুদ্ধশ্বাসে সব শুনে বলল, আর তাঁর স্ত্রী? 

ডাক্তার বললেন, স্ত্রীর মানসিক অবস্থা আরও খারাপ। তিনি আরও বেশি পরিমাণে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ঐ যুবকটি প্রাসাদ থেকে চলে যাবার সময় তাঁর কাছে যখন বিদায় নিতে যায় তখন তার প্রতি তার গোপন আসক্তির কথাটা প্রকাশ করে ফেলেন কাউন্টপত্নী। তখন যুবকটি সাহস পেয়ে কাউন্টপত্নীকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে। কাউন্টপত্নীর বুকের কাছে তাঁর স্বামীর একটা ফটো ছিল। আবেগের বশে যুবকটি কাউন্টপত্নীর বুকের উপর চাপ দিতে গিয়ে ফটোটা ভেঙে ফেলে। তাতে তার বুকের কাছটা সামান্য একটু হয়ত ছিঁড়ে যায়। আসলে আমি ডাক্তার হিসাবে বলছি তাতে তার দেহের কোনও ক্ষতি হয়নি। তবু তার ধারণা সেই ক্ষতটা বেড়ে উঠছে দিনে দিনে এবং শীঘ্রই সেটা এক দূরারোগ্য ক্যান্সার রোগে পরিণত হয়ে তাঁর যৌবনসৌন্দর্যকে চিরতরে নষ্ট করে দেবে। 

আর শুনতে পারল না উইলেম। চোখে-মুখে হাত দিয়ে এক সকরুণ অসহনীয়তাকে প্রকাশ করে অকস্মাৎ চলে গেল সে। অবাক হয়ে তার পথপানে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার। উইলেম ভাবতে লাগল এই পারিবারিক দুর্ঘটনার জন্য সেই হচ্ছে একমাত্র দায়ী। তারই জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এক সুখী দম্পতির সুন্দর জীবন। 

ফিরে এসে উইলেম দেখল অরেলিয়ার অসুখটা বেড়ে উঠেছে। তার ইচ্ছা ছিল অরেলিয়াকে সেই মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে দেখাতে। কিন্তু দেখল আর তা সম্ভব নয়। তাছাড়া অরেলিয়া যাবে না। তার জ্বর বেড়ে গেছে। মেজাজটা আরও খিটখিটে হয়ে উঠেছে। আজকাল সার্লো আর বেশি খোঁজখবর নেয় না তার। ফিলিনা চলে যাওয়ার পর হাস্যরসিক বৃদ্ধ অভিনেতার দুই কন্যার একজন এলমিরার উপর 

অত্যধিক আসক্ত হয়ে উঠেছে সে। এলমিরা শেষের দিকে ফিলিনার কাছেই থাকত। 

এদিকে উইলেমের অনুপস্থিতিতে মেলিনা এক চক্রান্ত করে বসেছে। সে অনেক বুঝিয়ে সার্লোকে হাত করে। সে বলে এই থিয়েটার ছেড়ে এক নূতন অপেরার দল গড়ে তোলা যাক। উইলেমের হাত থেকে পুরো কর্তৃত্বভাব সার্লো নিয়ে নিক। তাতে লাভ বেশি হবে আর জনপ্রিয়তাও তাড়াতাড়ি বেড়ে যাবে। 

একদিন সেই অপেরায় খুব প্রাণ দিয়ে অভিনয় করল অরেলিয়া। ভূমিকাটা খাপ খেয়ে গিয়েছিল তার ব্যথাহত ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে। আবেগটা একটু বেশি প্রকাশ করে ফেলল সে। তবু তা দর্শকদের ভালো লাগল। স্বাভাবিক মনে হলো। ফলে প্রচুর হাততালি পেল। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় এত পরিশ্রম তার সইল না। অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগল তার অভিনয় শেষ হবার পর থেকেই। 

অরেলিয়া উইলেমকে ডেকে পাঠাল। ফেলিক্স তার কাছে বারবার আছে। মিগনন তাকে খুব ভালোবাসে। অরেলিয়া উইলেমের হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল, আমরা। অবিশ্বস্ত বন্ধুর হাতে এটা পৌঁছে দেবে। আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচব না। আমি বেঁচে থাকতে থাকতে সে এলে ওকে আমি শেষবারের মতো আলিঙ্গন করব। আর আমি তার আগেই মরে গেলে তাকে তুমি সান্ত্বনা দেবে। বলতে আমি তাকে ক্ষমা করেছি। আমি তার মঙ্গল কামনা করি। 

হঠাৎ মেজাজটা অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে উঠল অরেলিয়ার। এতটুকু বিরক্তি বা অসহিষ্ণুতার ভাব নেই। কোনও রোগযন্ত্রণা বা দুর্বলতার চিহ্নও নেই। 

পরদিন নিয়মিত খবর নিতে গিয়ে উইলেম দেখল অরেলিয়া আর নেই। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেই তার অবিশ্বস্ত বন্ধুর উদ্দেশ্যে আপন প্রতিশ্রুতি অনুসারে রওনা হলো উইলেম। অরেলিয়া তার মনের কথা আত্মজীবনীমূলক একটি রচনায় সব লিখে যায়। সেটা উইলেম পড়ে দেখে। লেখাটা ভালোই হয়েছে। উইলেম ঠিক করল লোকটার দেখা পেলে সে প্রচুর ভর্ৎসনা করবে তাকে। আসলে তার হৃদয়হীনতাই অরেলিয়ার অকালমৃত্যুর কারণ হলো। ফেলিক্সকে মিগননের কাছে রেখে একদিন সকালে তার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল উইলেম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

অরেলিয়ার স্বীকারোক্তি

আট বছর পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্যটা ভালোই ছিল। কিন্তু এই সময় একবার নয় মাস কাল শয্যাগত হয়ে থাকতে হয় আমাকে এক কঠিন রোগে। এই দীর্ঘ রোগভোগ কালেই আমার আজকের এই মানসিকতার ভিত্তি রচিত হয়। তারপর থেকেই শরীরটা আবার ভেঙে পড়ে। জ্বর, সর্দি প্রায়ই হতো। 

যতক্ষণ দেহে আমার রোগ থাকত আমি চুপ করে নীরবে থাকতাম বিছানায়। আমার সহ্যশক্তি বেড়ে গিয়েছিল দিনে দিনে। কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠলেই আমি পাগলের মতো জীবনকে উপভোগ করতে চাইতাম। হাতের কাছে যা কিছু আনন্দের উপকরণ হিসাবে পেতাম তাই অপরিসীম আগ্রহে ও আকুলতায় জড়িয়ে ধরতাম। বাবা আমাকে অনেক পুতুল ও ছবির বই এনে দিতেন। তিনি নিজে অবসর সময়ে বাইবেলের কাহিনী শোনাতেন। তবে আর একটু বড় হলে পুতুল ও ছবিগুলো প্রাণহীন মনে হলো আমার। কাছে। আমার দৃষ্টি পড়ল তখন পোষা কুকুর, পাখি প্রভৃতির উপর যাদের ভালোবাসলে ভালোবাসার প্রতিদান পাওয়া যায়। 

বছর খানেক পরে সেরে উঠলাম আমি। আমার হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পেলাম। কিন্তু বালসুলভ এক উচ্ছলতা উবে গেল আমার প্রকৃতি থেকে। বয়স অনুপাতে কেমন যেন বেশি গম্ভীর হয়ে উঠলাম। এরপর কিছু বইপত্রও পড়লাম। তাদের মধ্যে ছিল ক্রিশ্চান জার্মান হার্কিউলেস, লি রোমান অক্টেভিয়া প্রভৃতি আরও কত কি। পড়ার সঙ্গে রান্নাও শিখতাম মার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে শিখতে লাগলাম ফরাসি ভাষা, চিত্রশিল্প আর নৃত্য। আমাকে ফরাসি ভাষা শেখাবার জন্য একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তার শেখাবার কৌশলটা ছিল বড় চমৎকার। বড় হৃদয়গ্রাহী। তিনি যতক্ষণ থাকতেন বড় ভালো লাগত আমার। আবার কখন আসবেন তার জন্য মুহূর্ত গণনা করতাম আমি। 

একবার এক নাচের আসরে দুটি সুদর্শন যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তখন আমার বয়স তের কি চোদ্দ। ছেলে দুটি ছিল ভাই। একজন আমার সমবয়সী আর একজন আমার থেকে দু বছরের বড়। তারা দুজনেই দেখতে ছিল ভারি সুন্দর। তাদের আমার খুব ভালো লাগত। আমি তাদের সঙ্গে নাচতে ভালোবাসতাম। তাদের সঙ্গে নাচবার জন্য আমি যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করতাম। একবার বড় ভাইয়ের অসুখ করে। আমাকে তারা বাড়িতে ডেকে পাঠায়। আমাকে দেখে অসুস্থ ছেলেটি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। আমার প্রতি তার এক ঐকান্তিক আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই আমি। তখন থেকে তাদের দুজনের মধ্যে তাকেই ভালোবাসতে থাকি আমি। তার শরীরটা রোগা এবং প্রায়ই সে ভুগত বলে তার জন্য প্রার্থনা জানাতাম আমি ঈশ্বরের কাছে। কিন্তু তাতে ছোট ভাই রেগে যেত। 

ঠিক এই সময় একদিন বাবা তাঁর এক পরিচিত যুবককে বাড়িতে নিয়ে এলেন। যুবকটি ভালো চাকরি করত বৈদেশিক বিভাগে। এক সান্ধ্য আড্ডায় তার সঙ্গে রোজ দেখা হতো বাবার। সেইখানেই আলাপ। তার কথাবার্তা ও আচরণ বেশি মিষ্টি লাগল আমার। বাবাও তার প্রায়ই প্রশংসা করতেন। একদিনকার এক ঘটনায় আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম আমরা দুজনে। যুবকটির নাম ছিল নার্সিস। 

একদিন কোনো এক বাড়িতে এক সান্ধ্য ভোজসভায় আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। এই ধরনের ভোজসভায় আমার যেতে মোটেই মন সরত না। আমাদের সমাজে লোকদের মোটেই ভালো লাগত না আমার। কারণ তাদের মধ্যে কোনও সংস্কৃতিবোধ ছিল না। বিজ্ঞান বা কলাবিদ্যা কোনওটার প্রতিই ঝোঁক ছিল না তাদের। তারা শুধু পশুর মতো খেতে আর ফুর্তি করতে জানত। হৈ-হুঁল্লোড় করে আমোদ-আহ্লাদের প্রতি তাদের প্রবণতা ছিল সবচেয়ে বেশি। আমার নিজের সমাজের প্রতি অনীহার যে ফাঁক বা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল আমার মনে নার্সিস তা পূরণ করে দিয়েছিল।

আমার বোনরা গেলেও এই সান্ধ্য ভোজের আসরে আমি গেলাম না। কিন্তু যখন শুনলাম নার্সিসও সেখানে নিমন্ত্রিত হয়েছে এবং যাবে তখন না গিয়ে পারলাম না। গিয়ে দেখি সবাই খুব মদ্যপান করছে। ফরফিট’ খেলা চলছে। ওই খেলায় হারলেই তাকে জরিমানা দিতে হয়। নার্সিস হারলে তার জরিমানা স্বরূপ একটা শাস্তি দেওয়া হয় তাকে। সে উপস্থিত প্রত্যেকের কানে কানে একটা করে মিষ্টি কথা বলে বেড়াবে। নার্সিস তাই করতে শুরু করে দিল। কোনও এক ক্যাপ্টেনের এক সুন্দরী স্ত্রী ছিল। সেই মহিলার কানে মিষ্টি কথা বলতে গিয়ে অনেকক্ষণ তার গা ঘেঁষে কানে মুখটা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল নার্সিস। এতে তার স্বামী ক্যাপ্টেন খুব রেগে গেল। রেগে গিয়ে এক ঘুষি মেরে দিল নার্সিসকে। তারপর দুজনেই তারবারি বার করল খাপ থেকে। কিন্তু নার্সিস তা বার করার আগেই ক্যাপ্টেন তার পিঠে, মাথায় ও হাতে তরবারির ঘা বসিয়ে দিল। নার্সিসের গা থেকে রক্ত পড়তে লাগল। তাকে নিয়ে আমি সেই বাড়িরই একটা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ক্যাপ্টেনকে ওরা শান্ত করল। তারপর ডাক্তার এসে ব্যান্ডেজ করে দিল নার্সিসকে। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ল সে। তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। আঘাতের জন্য জ্বর এসে গেল। 

কথাটা শুনে আমার বাবা খুব রেগে গেলেন। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ডুয়েল লড়ে তাকে আহত করলেন। এদিকে নার্সিস সেরে উঠতে মাস দুই লাগল। সেরে উঠতেই আমাদের বাড়ি এসে প্রথমে আমাকে ধন্যবাদ জানাল যেন আমিই তার একমাত্র উদ্ধারকারিণী। 

এরপর থেকে প্রায়ই সে আমাকে তার প্রেমের কিছু কিছু নিদর্শন পাঠাত। মাঝে মাঝে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হতো। তবে আমাদের মেলামেলার মধ্যে কোনও উত্তাপ বা উচ্ছ্বাস ছিল না। আমি আমার মনের কথা কারও কাছে বলতে পারতাম না। স্বভাবতই এই সময় প্রায়ই ঈশ্বরের কথা ভাবতাম। আমার স্বাস্থ্য ও দেহগত কান্তি ফিরে পাওয়ার জন্য প্রায়ই ধন্যবাদ জানাতাম তাকে। 

বসন্তকাল আসতেই একদিন খবর না দিয়ে হঠাৎ আমার কাছে এসে হাজিল হলো নার্সিস। আমি তখন আমার ঘরে একা ছিলাম। সে এল এবার পূর্ণ প্রেমিকের বেশে। আমাদের ভালোবাসাবাসির ব্যাপারে সে খোলাখুলিভাবে আমার মত চাইল। 

তার প্রতি আমার কিছুটা শ্রদ্ধা ও আসক্তি থাকলেও তাকে আমার সম্পূর্ণরপে নির্ভরযোগ্য বলে মনে হলো না। তবু আমি সরাসরি তাকে প্রত্যাখান না করে আমার বাবা-মার মত নিতে বললাম। সে বাবাকে বুঝিয়ে বলল। বাবা আমার মত চাইলেন। আমি চুপ করে রইলাম। 

যাই হোক, এইভাবে আমাদের প্রেম পারিবারিক সমর্থন লাভ করল। কিন্তু আমার অমতে বিয়ে হলো না। নার্সিসকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম। আমার বেশভূষযার সকল পরিপাট্য, আমার নৃত্যের সমস্ত ছন্দ তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো। আমি তাকে খুশি করার জন্য এসব করতাম। কোনও ভোজসভায় সে না গেলেও আমিও যেতাম না। তবু দেহ-মনের ব্যবধানটা আমাদের মাঝে সমানেই রয়ে গেল। এতে নার্সিসের অমত ছিল। তা থাকাই স্বাভাবিক। তবু আমার জেদ। দেহসংসর্গহীন কামগন্ধহীন এক মহৎ প্রেমের বায়বীয় ভাবাদর্শে মত্ত হয়ে উঠেছিলাম আমি যেন মনে মনে।

আমি বই পড়তে ভালোবাসতাম। বেশির ভাগ সময় একটা একা থাকতে চাইতাম। নার্সিস প্রায়ই আমার জন্য বিভিন্ন রকমের বই নিয়ে আসত। নানা বিষয় আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করত। আমি কিন্তু আমার মনের কথা বেশি প্রকাশ করতাম না। এই সময় আমাদের পাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এসে বাস করতে থাকে। কোনও কাউন্টের পরিবার। উঁচু মহলে তাদের যোগাযোগ। ক্রমে আমি তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠলাম। 

সরকারি বিভাগে এক সময় কিছু ভালো পদ খালি হলো। তাতে নার্সিস ঢোকার জন্য অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু পরে দেখা গেল তার থেকে অযোগ্য ব্যক্তি সে পদ পেয়ে গেল। তার সঙ্গে আমিও কিছুটা হতাশ হলাম। তবু তাকে সান্ত্বনা দিলাম। 

আমাদের মেলামেশা ও ঘনিষ্ঠতা নিয়ে শহরের চারদিকে কথা উঠতে লাগল। আমার সুনাম জড়িয়ে আছে এ কথার মধ্যে। আমি আমাদের বিয়েটা সেরে ফেলার জন্য চাপ দিলাম নার্সিসের উপর। 

কিন্তু নার্সিস স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে ভালো চাকরি না পাওয়া পর্যন্তক আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। তবে চাকরি পেলেই বিয়ে করবে। আমি বাড়িতে জানিয়ে দিলাম আমাদের বিয়ের ব্যাপারে সব ঠিক হয়ে আছে। তার জন্য ভাবতে হবে না। মাস নয়েকের মধ্যে নার্সিস চাকরি পেয়ে গেল। এবার নার্সিস এসে আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করল। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে এমন এক শর্ত জুড়ে দিল যা মানা সম্ভব হলো 

আমার পক্ষে। নার্সিস বলল, তার স্ত্রী হিসাবে আমার কোন গোঁড়া মতবাদ পোষণ করা চলবে না। অর্থাৎ তার মতে চলতে হবে। আমার নিজের মত সব ব্যাপারে জাহির করা চলবে না। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানিয়ে দিলাম আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। নার্সিস তখন বিদায় নিল আমার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য। পরে বিয়ে হয় ওর। সুখে ঘর-সংসার করতে থাকে। আমার কাছেও বিয়ের জন্য অনেক ভালো ভালো। প্রস্তাব আসতে লাগল। কিন্তু আমি কিছু ঠিক করতে পারলাম না। 

তবে নার্সিসকে হারিয়ে আমি যেন এই মাটির পৃথিবীতে ফিরে এলাম। মহৎ প্রেমের বায়বীয় ভাবাদর্শটা কেমন উবে গেল মুহূর্তে। আমি আমার বেশভূষা ও পোশাক-আশাকের দিকে মন দিলাম। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেলা করতে লাগলাম। 

এই সময় আমাদের বাড়িতে আমার বাবার এক খুড়তুতো ভাই যাতায়াত শুরু করলেন। তিনি আমাদের বাড়ি আগে বিশেষ আসতেন না। বহুদিন তাঁকে দেখিনি। তিনি তার মার একমাত্র সন্তান। ভবিষ্যতে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন তিনি। বর্তমানেও তাকে কোনো চাকরি করতে হয় না। কিন্তু আমার বাবাকে চাকরির মাইনেটার উপর নির্ভর করতে হয়। 

কাকাকে আসা-যাওয়া করতে দেখে আমাদের বাড়ির কেউ কেউ মনে করল, তিনি আর বিয়ে-থা করবেন না। তিনি বিয়ে করেছিলেন কিন্তু তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান। মারা যায়। তারপর থেকে তিনি আর বিয়ে করেননি। তাই সবাই ভাবল আর যদি কাকা বিয়ে না করেন তাহলে তার প্রচুর বিষয়সম্পত্তি সব আমাদের দান করে যাবেন। 

কিন্তু কাকা এবার তার আসল উদ্দেশ্যটা বললেন। তিনি বললেন, আমার ছোট্ট বোনটাকে তিনি তাঁর ঠিক করা এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। পাত্রটি ভালো। ভবিষ্যতে তিনিই তাদের দেখাশোনা করবেন। আর পাশের গ্রামে একটা চার্চে আমার একটা চাকরি ঠিক করেছেন। যা হোক কিছু করে নিয়মিত মাইনে পেয়ে যাব। 

কাকার পছন্দ করা পাত্রকে আমার ছোট বোনের ঠিক পছন্দ না হলেও কাকার মুখের উপর কথা বলতে পারলাম না। সুতরাং বিয়ে হলো। আমিও চাকরি করতে লাগলাম। কিন্তু আমার শরীরে সহ্য হলো না। অসময়ে খাওয়া-দাওয়া, অত্যধিক হাঁটাহাঁটি এ সব সহ্য হলো না আমার শরীরে। আমি ক্রমশই ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করতে লাগলাম। আমার শরীর ভেঙে গেল। 

বিপদের উপর বিপদ। আমার মা এক দুরারোগ্য রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। পাঁচ বছর পর মারা গেলেন। আমার বাবাও সঙ্গে সঙ্গে শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। স্বাভাবিকভাবে এই পারিবারিক অশান্তির জন্য আমার মন-মেজাজ দারুণ খারাপ হয়ে উঠল। 

অন্ধকারের মাঝে আবার এক আলোকরশ্মি দেখতে পেলাম আমি। কতখানি নির্ভরযোগ্য সে আলো তা অবশ্য বুঝতে পারলাম না। তবু সে আলোকে গ্রহণ না করে পারলাম না। এই সময় ফিলো নামে এক মধ্যবয়সী বিশিষ্ট ভদ্রলোক আমাদের পাড়াতে কিছু সম্পত্তি কিনে বাস করতে লাগলেন। আমরা পরিচিত হয়ে উঠলাম পরস্পরের সঙ্গে। তিনি আমার উপর বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন। নার্সিসের সঙ্গে কিছুটা মিল থাকলেও ফিলো তার থেকে আরও প্রাণখোলা এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন। 

যদিও আমি ঈশ্বরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম তথাপি রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে এটা বেশ বুঝতে পারলাম যে একমাত্র মৃত্যুর পর ছাড়া ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন সম্ভব নয়। মাটির পৃথিবীতে থাকতে হলে রক্তমাংসের মানুষ চাই। নার্সিসকে ভালোবেসে যে ভুল করেছিলাম আবার সেই ভুল করে বসলাম আমি। আমি ফিলোকেও ভালোবেসে ফেললাম। দিনে দিনে সে ভালবাসা বেড়ে যেতে লাগল। আমি আমার এক ভালোবাসার অনুভূতিটাকে নিজেই ঘৃণা করতে লাগলাম। তবু সে অনুভূতিটাকে দূর করতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম মানবজীবনের এক শাশ্বত দুর্বলতার ফাঁদে ধরা পড়ে গেছি আমি। এ থেকে পরিত্রাণের কোনও উপায় নেই। আমার রুগ্ন বাবাকে রোজ দেখতে আসত ফিলো। কাকাও তাকে ভালোবাসতেন। 

কাকা এবার আমার ছোট বোনের বিয়ের দিন ঠিক করলেন। বিরাট জাঁকজমকের ব্যবস্থা করলেন। বিয়ের সময় আমি ফিলোর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফিলো আমাকে চুপিচুপি বলল, কোনও বিয়ের সময় বরকনের হাতে হাত দেখলেই আমার সর্বাঙ্গে যেন আগুনের এক ঢেউ খেলে যায়। 

কাকা আমার যে বোনের বিয়ের উপলক্ষে সবাইকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে গেলেন। আমরা কাকার বাড়িতে দিনকতক থেকে গেলাম বিয়ে উপলক্ষে। আমার বোনর বিয়ে হয়ে গেল। সেখানে এক ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় হলো আমাদের। কাকার প্রাসাদোপম বাড়িতে কিছু ভালো ছবি ছিল। আমি তা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। 

কাকা আমার যে বোনের বিয়ে দিলেন তাকে একটা গ্রাম্য এস্টেট দিয়েছিলেন। জমিজমা ঘরবাড়ি সব ছিল তাতে। বিয়ের পর আমার বোন সেখানে চলে গেল। 

এরপরেই শুরু হলো দুঃখের পালা। আমার অসুখ বেড়ে গেল। আমার এক বোনের বিয়ে হলেও আর এক অবিবাহিত বোন ছিল বাড়িতে। তার স্বাস্থ্য ছিল ভালো। আমি যখন রুগ্ন বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, আমার বোন সংসারের কাজকর্ম করত। হঠাৎ তার হৃদরোগ দেখা দিল। তিন সপ্তাহ ভোগার পর মারা গেল সে। শোকে-দুঃখে বাবার রোগ যেন আরও বেড়ে গেল। 

আমার বিবাহিত বোন সন্তানসম্ভবা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তার প্রসবব্যথা দেখা দিল। বাবা অসুস্থ শরীরেই বোনকে দেখতে গেলেন আমাকে নিয়ে। তিনি বললেন, হয়ত শেষ বয়সে আমাকে সব সন্তানই হারাতে হবে। 

যাই হোক, আমার বোন ভালো হয়ে উঠল। নির্বিঘ্নে সন্তান প্রসব হলো। তবে যাবতীয় সেবা-শুশ্রূষার কাজ আমাকেই করতে হলো। আমাকে তাদের ঘরে থেকে। যেতে হলো কিছুদিন। বোনের স্বামীর সঙ্গে আমার বোনের সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিল। না। তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। অনেক সময় তাদের ঝগড়া মেটাতে হতো আমাকে। আমি অনেক করে আমার ভগ্নিপতিকে বোঝাতাম। 

আমার বোন আবার সন্তানসম্ভবা হলো কিছুকাল পরে। প্রসবব্যথা উঠলে আবার তাকে দেখতে গেলেন বাবা। আর এক পুত্রসন্তান প্রসব করল সে। ছেলের মুখ দেখে। খুশি হলেন বাবা। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে আর বেশিদিন বাবা রইলেন না এ জগতে। 

বাবার মৃত্যু এক অদ্ভুত পরিবর্তন নিয়ে এল আমার জীবনে। বাবা বেঁচে থাকতে সব সময় কাজ নিয়ে থাকতাম। ঘর-সংসারেরর কাজ, সেবা-শুশ্রূষার কাজ, কত রকমের কাজ। সময়ের কত অভাব। একটু ইচ্ছেমতো পড়াশুনো করতে পারতাম না। সব সময় বাঁধাধরা নিয়মের মধ্য দিয়ে চলতে হতো। কিন্তু এখন আমার হাতে অফুরন্ত সময়। আমি একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না এই সময়। কোনও প্রিয়বস্তুর পিছনে। ছুটে চলা বা কোনো প্রিয় কাজ করে যাওয়ার মধ্যে মানুষের প্রকৃত সুখ নেই। মানুষ যে পথ ন্যায়ের পথ, ধর্মের পথ বা মহৎ পথ বলে মনে করে সেই পথে অবাধে চলতে পারার মধ্যেই আমার প্রকৃত সুখ। সে পথ চলায় দুঃখ থাকলেও তাতে পাওয়ার অপার সুখ। 

আমি সবাইক ছেড়ে একা সেই পথেই চলা শুরু করেছিলাম। আমি তাতেই সুখ পেতাম। আমার সে সুখের অর্থ কেউ বুঝতে পারত না। এই সময় আমার মনটা এতই সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছিল যে আমি আমার দেহটাকে বাইরের এক জড়বস্তু বলে মনে করতাম। আমার মনে হতে দেহ-আত্মা দুটো পৃথক বস্তু। মনে হতো আমার দেহের সঙ্গে আত্মার কোনো সম্পর্ক নেই। 

আমার কাকার বাড়িতে যে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সেই প্রকৃতিবাদী ডাক্তার একবার বেড়াতে এলেন আমাদের বাড়িতে। দিনকতক তার সঙ্গে কথা বলে বেশ কাটল। তিনিও আমাকে বলতেন দেহটাকে বাইরের প্রকৃতি জগতেরই এক অঙ্গ বলে মন করবেন। ঈশ্বর যদি বিশ্বাস করেন তাহলে প্রকৃত জগতের সব বস্তুর মধ্যেই সেই ঈশ্বরকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করবেন। দেখবেন তাতে আনন্দ পাবেন। বুঝবেন সেই ঈশ্বরই প্রতিটি বস্তুর স্বরূপ। আসল সত্তা। 

সত্যি কথা বলতে কি, আমি ঠিক তাই দেখতাম। 

এদিকে আমার এই বিবাহিত বোনকে নিয়ে আবার বিপদে পড়লাম। প্রায় প্রতি বছরই তার সন্তান হতে লাগল একটি করে। কিন্তু কন্যা সন্তান হতে লাগল বেশি। এতে তার স্বামী বিরক্তিবোধ করতে লাগল। তার চাই পুত্র সন্তান। আমার বোন সন্তানসম্ভবা হলেই সে আশা করত পুত্র সন্তান। কিন্তু কন্যা হলেই হতাশ হতো। তার মুখ ভার হতো। তার একটা কারণও ছিল। যে বিরাট ভূসম্পত্তির যে মালিক হয়েছিল ভবিষ্যতে তারা এই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে, তাদের বাবাকে সাহায্য করতে পারবে। 

এবার আমার বোনের চতুর্থবার। এবারও তার স্বামী অন্যবারের মতো পুত্র সন্তান আশা করেছিল। নিবিড় প্রত্যাশায় দিন গণনা করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে পারল না। হঠাৎ ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেল। এদিকে আমার বোন পর পর দুবার দুটি কন্যা সন্তান প্রসব করার পর এবার সত্যিই একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল। দুঃখের বিষয় তার স্বামী এত আশা করেও তা দেখে যেতে পারল না। 

প্রসবের পর আমার বোনও আর রইল না পৃথিবীতে। তিন-চারটি সন্তানের বোঝা আমার ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে অকালে মারা গেল হঠাৎ। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

আবার বসন্ত এল। রঙে রসে পত্রপল্লবে উজ্জ্বল হয় উঠল চারদিকের প্রকৃতি। আকাশে মেঘ-বৃষ্টি নেই, সমুদ্রে ঝড় নেই, পাহাড়ে কুয়াশা নেই। যেদিকেই তাকানো যায় শুধু আলো আর রং। নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল উইলেম ঘোড়ায় চেপে। একটা পাহাড়ের কাছে একটা লোককে দেখতে পেয়ে তাকে কাউন্ট লোথারিরও বাড়িটা কোথায় জিজ্ঞাসা করল। লোকটি বলল, ঐ পাহাড়টার ওধারে। ওই কাউন্ট লোথারিওর সঙ্গে দেখা করে তাকে অরেলিয়ার দেওয়া চিঠি আর পাণ্ডুলিপিটা দিতে হবে। 

লোথারিওর প্রাসাদে যেতেই এক মোটা ভদ্রলোক তার সামনে এগিয়ে এল। বলল, কাউন্টের সঙ্গে দেখা হবে না। অনেক লোক আগে থেকেই তাঁর দর্শনপ্রার্থী হয়ে। বসে আছে। উইলেমের অনেক অনুনয়-বিনয়ে লোকটি তাকে কাউন্টের কাছে নিয়ে গেল। 

কাউন্টের চেহারা দেখতে ভালো। কিন্তু তখন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। উইলেমকে দেখেই বললেন, আপনাকে বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত। একটা অদ্ভুত সংবাদ পেয়ে আমি ব্যস্ত ও বিব্রত আছি। আপনি আজ রাত্রিটা এখানে থেকে যান। 

এরপর বিশপ আব্বেকে ডেকে বলে দিলেন, দেখবেন এর যেন কোনও অসুবিধা হয়। উইলেম অরেলিয়ার কাগজপত্র সব দিয়ে দিল। 

শোবার সময় পোশাক ছাড়তে গিয়ে দেখল তার পুঁটলির কাপড়চোপড়ের সঙ্গে সেই ওড়নাটা ভরে দিয়েছে মিগনন; সেটার এক প্রান্তে লেখা ছিল, পালাও যুবক, পালাও। লেখাটা পড়ে উইলেমের মনে হলো কোথায় কার কাছে পালাবে সে। তার মনে হলো একথা না বলে বলা উচিত ছিল, নিজের কাছে ফিরে যাও।

রাত্রিতে একটা স্বপ্ন দেখল উইলেম। সে স্বপ্নে মেরিয়ানা আর অরেলিয়া দুজনকেই দেখল। 

সকালে উঠতেই উইলেম শুনল কাউন্ট লোথারিও ঘোড়ার চেপে কোথায় বেরিয়ে গেছেন। বিপশ আব্বের সঙ্গে কথা হচ্ছিল উইলেমের। এমন সময় একজন বিক্ষুব্ধ মহিলা ঘরে ঢুকে আব্বোকে বিক্ষোভের সঙ্গে বলল, তাকে তোমরা কোথায় পাঠালে? এই তোমাদের চক্রান্ত। 

আব্বে শান্তভাবে বললেন, আপনি শান্ত হোন, তিনি এখনি এসে পড়বেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কোচ এসে থামল প্রাসাদের সামনে। আহত কাউন্টকে ধরাধরি করে নামানো হলো। ভদ্রমহিলা চিৎকার করে বলতে লাগল, ও আহত হয়েছে। হা ভগবান, কি হবে! 

হঠাৎ উইলেম কাউন্টের দলের মধ্যে জার্নোকে দেখতে পেল। জার্নোর সঙ্গে তার। আগে থেকেই পরিচয় ছিল। জার্নোর সঙ্গে উইলেমের পরিচয় হয় এর আগে। ওরা দল বেঁধে নাটক করার জন্য সেই সময় কাউন্টের প্রাসাদে বাস করত। জার্নো ঠাট্টা করে উইলেমকে বলল, যেখানেই নাটক সেখানেই তুমি। এখানেও এখন এক নাটক জমে উঠেছে। 

জার্নো অন্যত্র চলে গেলে আব্বে উইলেমকে বললেন, কিছুদিন আগে আমাদের কাউন্ট লিভিয়া নামে এক মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। মহিলাটি এই প্রাসাদেরই। একজন হিসাবে বাস করতে থাকেন। পরে কাউন্ট কিছুটা অনাসক্ত হয়ে পড়েন তার প্রতি। এতে লিভিয়া চলে যান। কথাটা তার পূর্ববর্তী স্বামী জানতে পেরে কাউন্টকে এক ডুয়েলে আহ্বান জানান। আজ সেই ডুয়েলে কাউন্ট ও লিভয়ার স্বামী দুজনেই আহত হলো। এই জন্য লিভিয়া এত বিক্ষুব্ধ। এখন তিনি কাউন্টের জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন। 

উইলেম আশ্চর্য হয়ে দেখল কাউন্টের চিকিৎসার জন্য সে সার্জন এল সেই সার্জেনই একদিন সে পথের ধারে জঙ্গলে দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করে। জার্নো ও সার্জেনকে দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল উইলেম। আগেকার সেই রহস্যটা ঘনীভূত হয়ে উঠল আরও। 

আব্বে উইলেমকে বললেন, কাউন্ট চান আপনি দিনকতকের জন্য এখানে তার আতিথ্য গ্রহণ করুন। তিনি একটু সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনার বাড়িতে চিঠি দেবার প্রয়োজন হলে দিন। আমার যথাশীঘ্র পাঠিয়ে দিব। 

ডাক্তার এসে জার্নোকে খবর দিল, ভয়ের কোনও কারণ নেই। কাউন্ট শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। উইলেম তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ডাক্তার চলে গেল। উইলেম একসময় জার্নোকে বলল, আপনি তো অনেক কিছু জানেন। আচ্ছা বলতে পারেন কি এই কাউন্ট পরিবারের সঙ্গে আগেকার সেই আমাদের পরিচিত কাউন্ট পরিবারের কোনও সম্পর্ক আছে কি না? 

জার্নো বলল, যে কাউন্টের ভূত হয়ে তাঁকে তুমি ভয় দেখিয়েছিলে তিনি এই কাউন্ট লোথারিওর ভগ্নিপতি। যে কাউন্টপত্নী তোমার জন্য আজ পাগল হতে বসেছে। সেই কাউন্টপত্নী লোথারিওর আপন বোন। লোথারিওর কোনো সন্তান না থাকায় তিনি তাঁর বিষয়সম্পত্তি গরীব-দুঃখীদের অর্থাৎ তথাকথিত এক নিম্নশ্রেণীর লোকদের দান, করে যাবেন। 

উইলেম ভয়ে ভয়ে বলল, লোথারিও আমার সম্পর্কে সব ব্যাপার জানেন। 

জার্না বলল, সব জানেন। 

উইলেম বলল, তাহলে আমি চলে যাই এখান থেকে। আমি তাহলে কেমন করে কোন মুখে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াব?

জার্নো উত্তর করল, কিন্তু এখন তো আগের মতো অত সহজে পালিয়ে যেত পারবে না বন্ধু। এখন আমার অফুরন্ত অবসর। আমার বন্ধু, পরম উপকারী হিতাকাক্ষী বন্ধু যুবরাজের মৃত্যু ঘটায় এখন আমি নিঃসঙ্গ কর্মহীন। এখন তোমার সেই বেদের খবর কি? তাদের নিয়ে আবার কি নাটক করলে? 

উইলেম বিরক্তির সঙ্গে বলল, খুব শাস্তি পেয়েছি। তাদের কথা আর বলো না। ওরা একেবারে অপদার্থ। এতটুকু চিন্তাশক্তি ওদের কারও নেই। নিজেদের প্রকৃত যোগ্যতা সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই ওদের। ওরা সবাই মনে করে ওরা এক-একজন মহান অতুলনীয় অভিনেতা। বিন্দুমাত্র কেউ ওদের সমালোচনা করলেই ক্ষেপে যায়। ওরা চির অভাবী। কিন্তু যুক্তি ও সুরুচিকে ওরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। 

উইলেম একটু চুপ কর থেকে বলল, তুমি সব জার্নো। একবার আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে পার না? 

জার্নো বলল, ধীরে ধীরে সব হবে। ধৈর্য ধরো। 

জার্নো একবার সেই মানসিক রোগের ডাক্তারকে পাঠাল প্রাসাদে যাঁর আশ্রমে বৃদ্ধ বীণাবাদককে ভর্তি করে দিয়েছে উইলেস এবং যার সঙ্গে একদিন তার আলাপও হয়। এই ডাক্তারই বর্তমানে তার পরিচিত কাউন্টদম্পত্তির চিকিৎসা করছেন। 

উইলেম কৌতূহলের সঙ্গে বৃদ্ধ বীণাবাদকের কথা জিজ্ঞাসা করল। ডাক্তার বললেন, মনে হয় ভালো হয়ে যাবে। কোনও এক আত্মীয়ের সঙ্গে ওর ভালোবাসা হয়, একটা সন্তানও হয়। তাদের মৃত্যু হবার পর হতাশা ও বিষাদের আতিশয্যে ও এই রকম হয়ে পড়ে। ওর সমগ্র অস্তিত্ব হয়ে ওঠে এক অন্তহীন অন্ধকার শূন্যতা। ওর একটা ধারণা হয়, কোনো এক বালকের দ্বারা ওর মৃত্যু হবে। প্রথমে ও মিগননের পোশাকের জন্য তাকে বালক ভেবেছিল। পরে ওর রাগটা পড়ে ফেলিক্সের ওপর। বেটাছেলেদের সব পুড়িয়ে মারার জন্যই হয়ত ও বাড়িতে আগুন লাগায়। 

ডাক্তার চলে গেছেন। কাউন্টদম্পতির কথা আর জিজ্ঞাসা করা হলো না। এদিকে জার্নো একটা বড় কাজের ভার দিল উইলেমের উপর। জার্নো বলল, ডাক্তার এইমাত্র বলেছেন লিভিয়াক দুই-একদিনের জন্য বাইরে কোথায় সরিয়ে নিয়ে যাওয় দরকার। ও দিনরাত কাউন্টের কাছে বসে আছে। ওর অত্যধিক প্রেমানুরাগ এবং আদরযত্নের আতিশয্য কাউন্টের আরোগ্যলাভের পথে প্রচুর বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ওকে এমনি কোথাও যেতে বললে কাউন্টকে ছেড়ে যেতে চাইবে না। তাই আমরা একটা পরিকল্পনা করেছি। আমরা ওকে বলব আমাদের এই পরিবারের উকিলের বাড়িতে একবার ওকে যেতে হবে। তার প্রণয়িনী ফ্রলিন থেরেসা তাকে ছেড়ে চলে গেছে এইমাত্র আমরা খবর পেয়েছি। লিভিয়া গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেবে। তিনি বলবেন থেরেসা হয়ত কাছাকাছি কোথাও আছে। লিভিয়া তখন বলবে আমরা তখন তাকে খুঁজে নিয়ে আসছি। তারপর যে ঘোড়ার গাড়িতে করে তোমরা যাবে তাতে করেই এখানে-সেখানে খোঁজ করে বেড়াবে। লিভিয়া ফিরতে চাইলে সরাসরি তাকে বাধা দেবে না। কিন্তু তখন রাত্রি হয়ে যাবে। তার কোচম্যানকে বলা থাকবে সে ঘুরপথে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটিয়ে দেবে। 

উইলেম বলল, এভাবে কাউকে আমি প্রতারণা কখনও করিনি, যদিও অবশ্য এ প্রতারণা একজনের ভালোর জন্য। 

উইলেমের যেতে মন সরছিল না দেখে জার্নো বলল, ওখানে গেলে তোমার লাভ ছাড়া লোকসান হবে না। থেরেসা সাধারণ মেয়ে নয়। ওখান থেকেই তুমি তোমার কাউন্টপত্নীর খোঁজ পেয়ে যাবে। 

আর কোনও প্রতিবাদ করল না উইলেম। গাড়ি এসে নিচের তলায় গাড়িবারান্দার কাছে দাঁড়াল। লিভিয়ার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। ঝি-চাকরদের বলল, রাত্রির আগেই চলে আসবে। 

গাড়িতে ওঠে লিভিয়া উইলেমকে বলল, থেরেসার সঙ্গে একসময় লোথারিওর ভালোবাসা ছিল। সে অনেক পুরুষকেই ঠকিয়েছে। 

নির্দিষ্ট বাড়ির সমানে এসে গাড়ি দাঁড়াতেই উকিল ভদ্রলোক এসে ওদের অভ্যর্থনা করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বললেন, থেরেসা চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। কাছাকাছি কোনও শহরেই আছে। 

উইলেমরা বলল, আমরা তাঁকে খুঁজে এনে দেব। 

আবার গাড়ি ছেড়ে দিল। কয়েকটা গা ঘুরে বেড়াতে হলো। কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। লিভিয়া কোচম্যানকে ফিরে যেতে বলল। তখন রাত্রি হয়ে গেছে। কোচম্যান বলল, পথ হারিয়ে ফেলেছি। সকাল না হলে উপায় নেই। 

এইভাবে সারারাত পথেই কেটে গেল। চোখের পাতা এক করল না লিভিয়া। কিছুটা বেলার পর কোনও এক গাঁয়ের এক বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই এক যুবতী এসে গাড়ির দরজার কাছে দাঁড়াল। তাকে দেখে কিছুক্ষণ তার পানে তাকিয়ে উইলেমের কোলের উপর মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল লিভিয়া। 

উইলেমকে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। থেরেসার সঙ্গে পরিচয় হলো তার। থেরেসা নিজের মুখেই তার পরিচয় দিলো। এক মুহূর্তেই তার বন্ধু করে নিল। তাকে লিভিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, লিভিয়া খুব রেগে গেছে। তাকে যারা ভুলিয়ে ঘর থেকে বার করে এনেছে তাদের দলে তোমাকেও টেনেছে। সে বলেছে তোমার মুখ সে আর দেখবে না। 

কাউন্ট লোথারিওর খুব প্রশংসা করতে লাগল উইলেম। থেরেসা বলল আমার মনের কথাটাই আপনি বলে দিলেন। আমিও সত্যিই খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখি লোথারিওকে। 

উইলেম বলল, তাঁর মতো উদারহৃদয় আর সরল প্রকৃতির লোক আমি খুব কম দেখেছি। কিন্তু তিনি যাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে আছেন তারা সবাই ভালো নয়। সেটাই। সুখের বিষয়। 

এইভাবে থেরেসার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল উইলেম। তাকে বিশ্রাম করতে বলে ঘরের কাজে অন্যত্র উঠে গেল থেরেসা। বর্তমানে তার কোনও ঝি-চাকর বা বঁধুনী নেই। আগে ছিল। তাই ঘরের সব কাজ তাকেই করতে হয়। 

সারা দুপুর ও বিকেলটা একা একা কাটাল উইলেম। সন্ধের একটু আগে তার ঘরের দরজা খুলে হঠাৎ একজন সুদর্শন যুবক ঢুকল। ঢুকেই বলল, বেড়াতে যাবেন? 

উইলেম ভালো করে তাকিয়ে দেখল থেরেসাই পুরুষের পোশাক পরে এসেছে। যাই হোক, দুজনেই বেড়াতে বের হলো। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা মাঠ পার হয়ে ওরা একটা পাহাড়ের উপর উঠতে লাগল। তারপর একটা বসার জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়ল দুজনে। থেরেসা বলতে আরম্ভ করল তার নিজের জীবনের ইতিহাস। 

আমার বাবা ছিলেন এই অঞ্চলের এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তিনি ছিলেন সদা আনন্দময়, তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন মিতব্যয়ী এক মানুষ। নির্ভরযোগ্য বন্ধু, স্নেহশীল পিতা। বাবার চরিত্রে আমি শুধু একটা দোষই দেখছি। সেটা হলো অযোগ্য স্ত্রীর প্রতি অত্যধিক অসংগত সহনশীলতা। আমার মা ছিলেন বাবার ঠিক উল্টো প্রকৃতির। নারীসুলভ বোধ মার চরিত্রে খুঁজে পেতাম না আমি। তাঁর মন সময় সময় বাইরে পড়ে থাকত। থিয়েটার, যাত্রা, নাটক, লোকজন নিয়ে বাইরের জীবনেই থাকতেন তিনি। স্নেহ-ভালোবাসায় কোনও আন্তরিকতা কোনওদিন ছিল না তাঁর মধ্যে। তিনি কখনও আমাকে আদর করেছেন বা ভালোবেসে কিছু তুলে দিয়েছেন হাতে-একথা আমার মনে পড়ে না। বরং বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে প্রায়ই তিরস্কার করতেন। যতক্ষণ মা বাড়িতে থাকতেন না, ততক্ষণ আমরা অর্থাৎ আমি ও বাবা বেশ ভালো থাকতাম। বাবার সঙ্গে বেড়াতে যেতাম। মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম। হাসিখুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠত আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত। কিন্তু মার কাছে বাবার সেই আনন্দোজ্জ্বল মূর্তিটি কেমন ম্লান হয়ে যেত এক বিমর্ষতায়। কথায় কথায় রাগারাগি করতেন মা। মার সামনে কোনও কথা বলতে পারতেন না বাবা। তার কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেও পারতেন না। মার কাছে বাবাকে যেন নিষ্প্রভ দেখাত সব সময়। 

এক সময় মা দূর গ্রামাঞ্চলের এক এস্টেটে চলে গেলেন। সংসারে আমি আর বাবা। আমরা তখন হাতে স্বর্গসুখ পেলাম। মার অবর্তমানে প্রতিটি মুহূর্ত অবাধ স্বর্গসুখ অনুভব করতে লাগলাম। কিন্তু সে স্বর্গসুখ বেশি দিল সইল না। হঠাৎ বাবার ডান অঙ্গটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেল। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় বাকশক্তি হারিয়ে ফেললেন বাবা। সব সময় তাঁকে দেশে মনে হতো তিনি যেন কি বলতে চাইছেন। বাবা বলতে বা লিখতে পারতেন না। অন্য সময় এর আগে বাবার চোখ দুটো আয়নার মতো ঝকঝক করত। কিন্তু এখন সে চোখ এমনই ঘোলাটে হয়ে উঠল যে তাতে কোনও ভাব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারত না। 

অবশেষে সব কষ্ট থেকে মুক্তি পেলেন বাবা। বাবা মারা গেলেন। বাবার মৃত্যুর পর মার কাছে লিখলাম। তাঁর কাছে লিভিয়া তখন থাকত। আমার সমবয়সী লিভিয়া তাঁর দেখাশোনা করত। কিন্তু মা আমাকে যেতে নিষেধ করলেন। আমাকে কোনওমতেই তিনি সহ্য করতে পারবেন না। আমি নিজের জন্যেই ভাবছিলাম। এমন সময় একদিন লিভিয়া এসে হাজির হলো আমার কাছে। মা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। 

আমাদের পাড়ায় এক ধনী সম্পত্তিশালিনী মহিলা ছিলেন। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমি তাকে বললাম আমি তাঁর ঘরসংসার দেখাশোনা করব। ভদ্রমহিলা রাজি হলেন। আমি তাঁর ঘরেই থাকতাম। কিন্তু লিভিয়া আসাতে লিভিয়াকেই তিনি। রাখলেন ঘরের কাজকর্ম করার জন্য। অবশ্য তিনি আমাকেও তার সম্পত্তি দেখাশোনার কাজ দিলেন। তাঁর অনেক বন ছিল। আমি সেই বনাঞ্চল থেকে স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করলাম। লিভিয়া যে বাড়িতে থাকত সেই বাড়িতে কাউন্ট লোথারিও মাঝে মাঝে যাতায়াত করতেন। তিনি ছিলেন ঐ মহিলার আত্মীয়। সেই সূত্রে লিভিয়া ও আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় হয়। একবার আমি পুরুষের পোশাক পরে বন্দুক কাঁধে করে শিকার করতে যাই। লিভিয়া দেখতে খারাপ না হলেও সমাজের নিচু স্তর থেকে আসা এক মেয়ে সে। আর আচার-আচরণ ও কথাবার্তার মধ্যে কোনো মার্জিত ভাব বা সূক্ষ্মতা ছিল না। আমার মধ্যে এই ভাবটা থাকায় লোথারিও আমাকেই পছন্দ করত বেশি। 

একদিন সেই ভদ্রমহিলা আমাকে জানিয়ে দিলেন লোথারিও আমার পাণিগ্রহণ করতে চেয়েছে। আমার আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছ থেকে একথা শুনে এক অপার আনন্দ অনুভব করলাম আমি। এরপর লোথারিও যেদিন এল সেই বাড়িতে সেদিন দুহাত। বাড়িয়ে লোথারিও জড়িয়ে ধরল আমাকে। আমিও খুশি হয়ে আলিঙ্গন করলাম তাকে। তারপর আমার বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেল। 

একদিন লোথারিও এলে আমি তার একটা ফটো চাইলাম। তার ফটোটা সযত্নে রাখার জন্য আমি আমার গয়নার কৌটোটা এনে খুলে ফেললাম। হঠাৎ তার মধ্যে আমার মার ফটোটা দেখে ছোঁ মেরে সেটা তুলে নিল লোথারিও। ভালো করে দেখে। বলল, কে এই মহিলা? সুইজ্যারল্যান্ডে বেড়াতে যাবার সময় তার সঙ্গে আলাপ হয় আমার। সাময়িকভাবে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল। 

আমি বললাম, উনি আমার মা। এখন ফ্রান্সে থাকেন। মার ছবিখানা নিয়ে কি একবার ভাবল লোথারিও। তারপর হাতে মুখটা ঢেকে বেদনার্ত অস্ফুট স্বরে বলল আমার মতো হতভাগ্য লোক আর পৃথিবীতে নেই। 

এই বলে আমাকে কোনও কথা না বলে বেরিয়ে চলে গেল সে। বাইরে ঘোড়ায় চেপে আমার পানে তাকিয়ে হাতটা নাড়িয়ে ঘোড়া ছেড়ে দিল। 

পরে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সুইজারল্যান্ডে থাকার সময় মার সঙ্গে এক অবৈধ সংসর্গ হয় লোথারিওর। সেই জন্য সে আমাকে এড়িয়ে চলতে চায়। আমিও এ বিষয়ে এ নিয়ে তাকে কোনও পীড়াপীড়ি করিনি। আমি তাকে সহজেই মুক্তি দিই। এই সুযোগে লিভিয়া ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল লোথারিওর সঙ্গে। 

কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠটা ভারী হয়ে উঠল থেরেসার। সে একটা হাত আবেগের সঙ্গে বাড়িয়ে দিল উইলেমের দিকে। উইলেম সে হাতটা নিয়ে চুম্বন করল। তারপর বলল, চলো, যাওয়া যাক। 

ওরা থেরেসার বাড়ি ফিরে দেখল দরজার সামনে বিষণ্ণ মুখে বসে রয়েছে লিভিয়া। লিভিয়া উইলেমকে বলল, আমি ওদের চক্রান্ত বুঝতে পেরেছি। আমাকে সরিয়ে দিয়ে ওরা সব লুটেপুটে খাবে। তোমাকেও ওরা ওদের স্বার্থ চরিতার্থ করার যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। 

সন্ধের সময় দুটো ছোট ছেলে এল থেরেসার কাছে পড়তে। থেরেসা বলল, আমি সন্ধেয় গ্রামের কিছু গরিব ছেলেমেয়েকে পড়াই। লোথারিওর বোনও মাঝে মাঝে আসে। এই মহীয়সী নারীর সঙ্গে তুমি যদি পরিচিত হও তাহলে তার সৌন্দর্যে, ঔদার্যে ও মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে যাবে। 

উইলেম এই কথা স্বীকার করতে পারল না যে এই নারীর সঙ্গে ঘটনাক্রমে অনেক আগেই সে পরিচিত হয় এবং সেই পরিচয় অনেক দুঃখ নিয়ে আসে তার জীবনে। যাই হোক, থেরেসা প্রসঙ্গ পাল্টে দেওয়ার পুরনো স্মৃতির অপ্রীতিকর এক পীড়নের বোঝা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল উইলেম। 

পরদিন কাউন্ট লোথারিওর প্রাসাদে ফিরে যাবার জন্য তৈরি হলো উইলেম। লিভিয়ার সঙ্গে দেখা করে বলল, কাউন্ট আমাকে ভীষণ ভালোবাসে এবং শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের সঙ্গে। দিনকতকের মধ্যেই আমি যাচ্ছি। ওদের সব চক্রান্ত ভেঙে দেব আমি। 

প্রাসাদে একা একা ফিরে এল উইলেম। দেখল আব্বে ও ডাক্তার নেই। কাউন্টের কাছে রয়েছে শুধু জানেনা। কাউন্ট এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। জার্নো বলল, আজ তাহলে আপনার ভ্রমণটা বেশ আনন্দদায়ক হয়েছে। 

কাউন্ট বললেন, তা ঠিক বলতে পার। বেশ কিছুদিন পর আমি ঘোড়ায় চেপে নদী পার হয়ে মাঠের ওপারে গ্রামে চলে গেলাম পুরনো অভ্যাসের বশে। ঠিক সেই বাড়িটার সামনে গিয়ে ঘোড়ার বেগটা কমিয়ে দিলাম। 

জার্না বলল, আপনি এক চাষির মেয়েকে ভালোবাসতেন। আপনি হয়ত তাদের বাড়িতেই চলে গিয়েছিলেন। 

. কাউন্ট বললেন, হ্যাঁ, ঠিক তাই। সেই মেয়েটির দূরে কোথাও বিয়ে হয়েছে। সে এখন ছয়টি সন্তানের জননী। তবে শুনেছি সে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে করে তার বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। তাদের বাড়ির সামনে কজন ছেলেমেয়ে খেলা করছিল। আমি যেতেই একটি মেয়ে একটি ছেলেকে আমার ঘোড়ার কাছ থেকে নিয়ে গেল। আমি ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়াটা দূরে এক জায়গায় বেঁধে রেখে তাদের বাড়িতে গেলাম। তাদের দেখে ঠিকই চিনতে পারলাম। সে আগের থেকে বেশ মোটা হয়েছে। আমি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। সেও আমায় চিনতে পেরে হাতটা বাড়িয়ে দিল। তার মুখে লজ্জারুণ ভাব নেই। অন্তরের কোনও গোপন আলোড়ন মুখে-চোখে রঙিন চাঞ্চল্যে ফেটে পড়ল না। তবু তাকে আমার ভালো লাগল। তার কোলে ছেলে ছিল। আগেকার দিনের তার সেই তারুণ্যে যত সব চঞ্চলতা, যৌবনের যত উত্তাল আর উদ্দমতা মাতৃত্বের এক শান্ত শীতল যৌবনের মধ্যে কেমন গাঢ় ও স্তব্ধ হয়ে উঠেছে। সে গাঢ়তা সে স্তব্ধতার মধ্যে কম মনোহারিতা নেই। 

আমি বললাম, দীর্ঘ দশ বছর পর তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। 

সে হাসিমুখে বলল, আমারও যে কি আনন্দ হচ্ছে তোমাকে দেখে তা বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আমি তার স্বামীর কথা তুললাম। সে তার ছেলেমেয়েদের সবাইকে ডাকল। বড় মেয়েটি মুখখানা তার মতোই হয়ে উঠেছে। আমার মনে হলো আমি যেন এক কমলালেবুর বনে এসেছি। আমার চারদিকে শুধু ফল আর ফুলের এক অদ্ভুত সোনালী সংসার। 

কাউন্টের কথা শেষ হয়ে গেলে উইলেম ফেলিক্সের কথা তুলল। কাউন্ট অশান্ত হয়ে বলল, আপনি কার কথা বলছেন? 

উইলেম বলল, অরেলিয়ার গর্ভে আমার ঔরসে যে সন্তানের জন্ম হয় তার কথা বলছি। 

লোথারিও বললেন, অরেলিয়ার গর্ভে আমার কোনও সন্তানের জন্ম হয়নি। তার কোনও সন্তান হয়নি। সে নিজের মুখে আপনাকে একথা বলেছিল? 

উইলেম বলল, না, স্পষ্ট করে বলেনি। তবে অনেকেই তাই মনে করেন। 

কাউন্ট বললেন, যাই হোক, আপনি ওদের নিয়ে আসুন এখানে। আপনি মিগনন নামে যে মেয়েটির কথা বলছেন সে থাকবে থেরেসার কাছে। খুব ভালো থাকবে। আর ফেলিক্স আপাতত আপনার কাছেই থাকবে। 

জার্নো বলল, তবে তোমায় থিয়েটার ছাড়তে হবে। ও তোমার দ্বারা হবে না।

উইলেম বলল, আগে ওদের নিয়ে আসি তো। তারপর সেকথা ভেবে দেখা যাবে। 

একটা বিষয়ে নিশ্চিত হলো উইলেম। সে কাউন্টের কাছে জানতে পারল, ফেলিক্স অরেলিয়ার সন্তান নয়। এক বৃদ্ধার কাছ থেকে পাওয়া একটি ছেলে যাকে সে মানুষ করত এবং যাকে অনেকে তার ছেলে মনে করত। 

অবশেষে এই শহরে তার বাগানবাড়িতে পৌঁছে দেখল সব ঠিক আছে। একটি ঘরে সে ফেলিক্স ও মিগননকে এক বৃদ্ধার কাছে বসে থাকতে দেখল। এদের দুজনকেই সে নিয়ে যাবে থেরেসার কাছে। তার কাছে ওরা সুখে থাকবে। আর তাতে সে নিজে হয়ে উঠবে নিশ্চিন্ত। 

হঠাৎ যেন ভূত দেখে চমকে উঠল উইলেম। এই বৃদ্ধা আর কেউ নয়, বারবারা মেরিয়ানার গৃহকত্রী। প্রথমটার চিনতে পারেনি। উইলেম কড়াভাবে জিজ্ঞাসা করল আচ্ছা তুমিই কি ফেলিক্সকে অরেলিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলে? 

এদিকে ছেলেরা উইলেমকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। বারবারা চুপ করে থাকায় উইলেম আবার জিজ্ঞাসা করল, মেরিয়ানা এখন কোথায়? 

এবার বারবারা ভারী গলায় বলল, সে আর ইহলোকে নেই।

উইলেম ব্যস্ত হয়ে বলল, আর ফেলিক্স 

ফেলিক্স হচ্ছে মেরিয়ানারই হতভাগ্য সন্তান। সে রত্ন আজ তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি সে আমাদের একদিন অনেক দুঃখ দিয়ে আজ তোমাকে প্রচুর সুখ দান করবে। 

বারবারা উঠে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে উইলেম বলল, কোনও কাগজপত্র আছে? 

বারবারা উঠে গিয়ে মেরিয়ানার একটি চিঠি এনে দিল। সত্যিই মেরিয়ানার হাতের লেখা। উইলেম চিনতে পারল। মেরিয়ানা লিখেছে, জানি না এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁছবে কি না। যদি তোমার হাতে যায় তাহলে তোমার হতভাগ্য সেই বান্ধবীর জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলো। মনে রাখবে তোমার প্রেমই তার মৃত্যু ঘটায়। কয়েকদিন প্রসবযন্ত্রণা ভোগ করার পর একটি পুত্র প্রসব করে মারা যাচ্ছি আমি। আমি তোমার প্রতি বিশ্বস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছি। বারবারার কথা শুনবে? 

বারবারা বলল, তবু ভালো, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও, তোমার প্রেমাস্পদকে হারালেও তোমার সন্তানকে পেয়েছ। তুমি যদি শোনো সে তোমার জন্য কতখানি কষ্ট করেছে, কতখানি ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং শেষ পর্যন্ত কতদূর বিশ্বস্ত ছিল তোমার প্রতি তাহলে দুঃখ রাখবার জায়গা থাকবে না তোমার মনে।

মিগনন উইলেমকে বলল, হ্যাঁ, মালিক, ফেলিক্স তোমারই ছেলে। 

উইলেম বারবারাকে বলল, হ্যাঁ তোমাকে শুনতে হবে। মেরিয়ানার সব কথা, শেষ কথা শুনতে হবে। 

বারবারা উইলেমের ঘরে এল গভীর রাতে। এল মেরিয়ানার কথা শোনাতে। তিন গ্লাস শ্যাম্পেন নিয়ে এসে নিজে এক গ্লাস খেয়ে উইলেমকে এক গ্লাস দিয়ে এক গ্লাস রেখে দিল মেরিয়ানার আত্মার জন্য। বলল, মেরিয়ানার কাছে রাত্রিতে যখন তুমি আসতে তখন আমি এমনি করে তিন গ্লাস শ্যাম্পেন আনতাম। 

বারবারা বলল, মেরিয়ানার সঙ্গে তোমার যেদিন শেষ দেখা হয় সেদিন তুমি তার ঘরের মেঝের উপর একখানি চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছিলে এবং তা নিয়ে গিয়েছিলে। তা মনে আছে? তাকে কি লেখা ছিল? 

উইলেম বলল, হ্যাঁ সব মনে আছে। সে চিঠি কোনও এক বিক্ষুব্ধ প্রেমিকের লেখা যার সঙ্গে আগের দিন সন্ধ্যার তার প্রেমিকা ভালো ব্যবহার করেনি এবং যে সেদিন সন্ধ্যাতেও আসে ভালো ব্যবহারের প্রত্যাশায়। সে প্রেমিক সেদিন রাতেও এসেছিল তোমাদের ঘরে। তাকে আমি অন্ধকারে বেরিয়ে যেতে দেখেছি তোমাদের বাড়ি থেকে। 

উইলেমের কথায় বেশ কিছুটা ক্ষোভ ছিল। বারবারা বলল, তুমি তাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলে, কিন্তু সে রাত্রে মেরিয়ানা কত কষ্টে কাটায়, কত দুঃখ পায় তার খবর তুমি জান না। তুমি জান না সেই ক্রুদ্ধ প্রেমিকের সঙ্গে দুটি দিনের মধ্যে একদিনও কোনও কথা বলেনি মেরিয়ানা। আমি শুধু তাকে মিথ্যা অজুহাত আর মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে পাঠিয়ে দিই। আসল কথা তুমি আসার পর থেকে এক বিরাট পরিবর্তন আসে মেরিয়ানার জীবনে। তার আগে নবার্গ নামে এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে তার আলাপ হয়। ছেলেটি তাকে মনপ্রাণে ভালোবাসে। আমিও বারবার তাকে নর্বার্গের নিবেদিত প্রেমকে বরণ করে নেবার জন্য অনুরোধ করি। মাঝে মাঝে তাকে কত ভালো ভালো উপহার পাঠাত নৰ্বার্গ। মেরিয়ানার মন কুণ্ঠা ও দ্বিধার দোলায় দুলতে থাকে সব সময়। তুমি তার সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে সব কুণ্ঠা দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তোমাকেই গ্রহণ করে বসে সে। আমার এতে ইচ্ছা না থাকলেও বাধা দিতে পারিনি কারণ তার সুখই হলো আমার সুখ। আমার কথার অবাধ্য হলেও আমি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতাম না তার কাছ থেকে। মেয়েটা ছিল শিশুর মতো সরল এবং সৎ। তার সরলতা ও সততার সুযোগ নিয়েছে অনেকে অনেকবার। তুমি রাগ করে চলে গেলে, আর এলে না। অথচ দিনের পর দিন সে পথ চয়ে বসে থেকেছে। তোমার কথা ভেবে ভেবে দিন কাটিয়েছে। আর সেই প্রতিটি মুহূর্তের সকল দুঃখ-বেদনার নীরব সাক্ষী হয়ে আছি আমি। তোমার মনে যাই থাক একবার দেখা করে সব কথা বলতে পারতে। কিন্তু তুমি আর একবারও এলেও না। তার মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী একমাত্র তুমিই। পালা করে আমরা দিনের পর দিন জানালার ধারে তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম। যদি তুমি রাস্তা দিয়ে যাও। সে জানালা থেকে একবার সরে গেলেই আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হতো। বিরক্তি সত্ত্বেও তারই জন্য এ কাজ করতে হতো আমায়। 

উইলেম অধৈর্য হয়ে বলল, খুব হয়েছে বারবারা। অনেক কিছু করেছ, এবার একটা কাজ করো। আমার মেরিয়ানাকে বার করে দাও। তুমি নিশ্চয়ই তাকে লুকিয়ে রেখেছ কোথাও। 

বারবারা বলল, সে আর ইহজগতে নেই। তার কবরের কাছে ফেলিক্সকে নিয়ে যাও। বলবে তোমার মাকে প্রণাম করো। 

কিন্তু বারবারার এত কথাতেও উইলেম ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না ফেলিক্স তার ঔরসজাত সন্তান কি না। এ বিষয়ে সন্দেহাতীত কোনও সত্যে পৌঁছাতে পারছিল না সে। কেবলি মনে হচ্ছিল বারবারা তার সঙ্গে চাতুরি খেলছে। পরের ছেলের সব দায়িত্বভার তার কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাইছে কৌশলে। 

মাদাম, মেলিনা তার এই সন্দেহ বাড়িয়ে দিল। বলল, ফেলিক্স অরেলিয়ার ছেলে। ও তোমার ছেলে নয়। 

লার্তেস, সার্লো বা দলের অন্য সবাই উইলেমের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতে লাগল। উইলেম বলল, সে অভিনয় আর করবে না। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে একমাত্র মাদাম মেলিনা ছাড়া আর তাকে এ বিষয়ে ভেবে দেখার জন্য কোনও অনুরোধ করল না। মাদাম মেলিনা বারবার তাকে বলল, আপনি আবার ফিরে আসুন। আমরা আপনার কাছে অনেক ঋণী। 

উইলেম বলল, সে কথা তো কেউ স্বীকার করে না। 

স্থানীয় নাট্যমোদী লোকেরা উইলেমের অভিনয়ের প্রচুর প্রশংসা করতে লাগল। তাকে নাট্য জগতে আবার ফিরে আসার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। কিন্তু উইলেম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ওয়ার্নারকে একটা চিঠিতে লিখে দিল, আমি অভিনয় ছেড়ে দিয়ে তোমার কথামতো চলতে চাই। আমি আবার আত্মীয়-বন্ধুদের মাঝে ফিরে যেতে চাই। 

একবার ঠিক করল উইলেম বারবারা, ফেলিক্স, মিগনন, এই তিনজনকেই থেরেসার কাছে পাঠিয়ে দেবে। সেইখানে ওরা থাকবে। মাঝে মাঝে ও গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসবে। কিন্তু পরে ঠিক করল বারবারাকে একটা মাসিক বৃত্তি দিয়ে বিদায় করে দেবে। শুধু মিগনন আর ফেলিক্সকে পাঠাবে থেরেসার কাছে। 

মনে মনে উইলেম যতই ভাবতে লাগল ফেলিক্স থেরেসার কাছে থাকবে, থেরেসা তাকে মার মতো স্নেহ করবে, তাকে কোলে করবে, ততই থেরেসা আরও প্রিয় হয়ে উঠতে লাগল তার কাছে। ফেলিক্সকে কোলে করা অবস্থায় থেরেসার এক কাল্পনিক মূর্তি খাড়া করে বড় আনন্দ পাচ্ছিল সে মনে মনে। 

মিগনন তাকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। অনেক করে তাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিল থেরেসার কাছে। তারই জন্য ফেলিক্সকেও তার সঙ্গে পাঠাতে হলো। ফেলিক্সকে সে ভালোবাসে এবং তার টানে টানে সেও যাবে। ওদের পাঠিয়ে দেবার পর কাজকর্ম ও কথাবার্তা সব সেরে সে রওনা হলো কাউন্ট লোথারিওর প্রাসাদের অভিমুখে। প্রাসাদে গিয়ে দেখল শুধু জার্নো ছাড়া আর কেউ তখন প্রাসাদে নেই। জার্নো আর ডাক্তার আব্বে বাইরে গেছে। কাউন্ট নিজেও নেই। তবে তিনি আমাদের সকলকে একটা কাজের ভার দিয়ে গেছেন। এই অঞ্চলে একটা বড় ভূসম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে। তিনি সেটা কেনার ভার আমাদর সকলের উপর দিয়ে গেছেন। দরদাম সব কিছু ঠিক করতে হবে। 

কিছুক্ষণ আগে আব্বে এসে গেল। আব্বে ফেলিক্সকে এর মধ্যেই দেখে ফেলেছেন থেরেসার বাড়িতে। একথা-সেকথা বলার পর ফেরিক্সের কথা তুলে উইলেম তার মনের আসল সন্দেহের কথাটা বলল আব্বেকে। আব্বে অকুণ্ঠভাবে বললেন, ফেলিক্স। তোমারই সন্তান। তার মাও গুণবতী রমণী ছিলেন। আমি বলছি। এতে কোনও সন্দেহ। করো না। 

এমন সময় ফেলিক্স একজনের সঙ্গে এসে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে বুকের উপর চেপে ধরল উইলেম। তার সকল সন্দেহ, সকল জ্বালা দূর হয়ে গেল। নিমেষে। 

প্রাসাদের মধ্যে হঠাৎ ওয়ার্নারকে দেখে অবাক হয়ে গেল উইলেম। পরে জানল কাউন্ট লোথারিও যে ভূসম্পত্তি কিনতে যাচ্ছেন সেটি আসলে তাদের। ওয়ার্নার তাদের পক্ষ থেকে নিশ্চয় কথাবার্তা বলছে। ওয়ার্নার তার শেষ চিঠিটা পেয়েছিল যথাসময়ে। 

ওয়ার্নার বলল, আমার মনে হয় এই নূতন পরিবেশে কাউন্টের মতো এই সব দ্র ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে তোমার উন্নতি হয়েছে। এখন তোমার চেহারা ও পোশাক-আশাকের উন্নতি হয়েছে। 

উইলেম বলল, বাড়ির মেয়েদের খবর কী?

ওয়ার্নার বলল, সব ভালো আছে। আমার ছেলে হয়েছে দুটি। তোমার মা-বোন ভালো আছে। জমিজমার ব্যবস্থাও সব ঠিক হয়ে গেলে তুমি যাবে। তোমার কাজ আছে। 

ফেলিক্সের কথাটা ওয়ার্নারের কাছে তুলল না উইলেম। ওয়ার্নার কিভাবে সেটা নেবে বুঝতে পারল না। অথচ ফেলিক্স তার কাছে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওয়ার্নারওে তার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। 

হঠাৎ উইলেমের একটা কথা মনে হলো। মনে হলো যে সে ফেলিক্স, মিগননের প্রতি ঠিকমতো নজর দেয়নি। মিসননের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে পারত। ফেলিক্সের মতো সোনার চাঁদ ছেলের জন্য আরও আদর-যত্নের ব্যবস্থা করতে পারত। 

অনেক ভাবনা-চিন্তা করে থেরেসাকে একখানা চিঠি খিলল উইলেম। থেরেসার মতো সেবাপরায়ণা মেয়ের উপরেই সে তার নিজের ও ছেলেদের ভবিষ্যৎকে অকুণ্ঠভাবে ছেড়ে দিতে পারে। সে তাই সংক্ষেপে চিঠিখানিকে থেরেসার কুশল জিজ্ঞাসা করে তাকে তার অন্তরের অকৃত্রিম শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও একই সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবও জানিয়েছিল। 

চিঠিখানা থেরেসার কাছে সবেমাত্র পৌঁছতে কাউন্ট লোথারিও ফিরে এলেন প্রাসাদে। ব্যস্তভাবে বললেন, তোমার বোন তোমাকে অবিলম্বে তার বাড়িতে তোমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। এদিকে মিগননের অবস্থা খারাপ। তোমার সেখানে অভিলম্বে যাওয়া একান্ত দরকার। 

হঠাৎ উইলেমের মনে হলো থেরেসাকে চিঠিটা লিখে ভুল করেছে। এ চিঠি লেখা উচিত হয়নি তাকে। এই কাউন্ট লোথারিওই ছিলেন একদিন থেরেসার প্রেমিক এবং মনোনীত স্বামী-এ কথাটা কোনওদিন ভুলে যেতে পারবে না। 

কাউন্ট তার বোনের লেখা একটুকরো কাগজ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে লোকটা কাউন্টপত্নী কি না তা বুঝতে পারল না। কাউন্ট লোথারিওর দুটি বোন আছে। একজন হচ্ছে সেই কাউন্টপত্নী যার সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে ব্যারনপত্নীর মাধ্যমে। আর একজনের নাম নাটালিয়া যে সেই জঙ্গলে দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত ও আহত হলে তার আরোগ্যলাভের ব্যবস্থা করে অনেক উপকার সাধন করে। অনিন্দ্যসুন্দরী বীরাঙ্গনা মূর্তিটি তার অন্তরের অনেকখানি শ্রদ্ধা ও আসক্তি কেড়ে নেয়। 

লোথারিও তার বোনের বাড়ি থেকে যে ঘোড়ার গাড়িতে করে এসেছিলেন সেই গাড়িতে করেই পরদিন রাত্রিশেষে ফেলিক্সকে নিয়ে রওনা হলো উইলেম। দুটি বোনের মধ্যে কোন বোন তাকে ডেকেছে তা নিশ্চিতভাবে জানতে না পারায় যেতে মন সরছিল না তার। গাড়িতে অনবরত সেই কথাই ভাবছিল। 

শহরের মধ্যে একটি বড় বাড়ির গাড়িবারান্দার নিচে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল। বাড়ির চাকর এসে দরজা খুলে দিল। আর একজন চাকর এসে বলল, আপনার জন্য অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলাম। তাকে সঙ্গে করে দোতলার একটি ঘরে নিয়ে গেল। ফেলিক্সকে বিছানার উপর শুইয়ে দিল উইলেম। উইলেম চাকরের মুখে ব্যারনপত্নী আছে শুনে ভেবেছিল কাউন্টপত্নীই তাকে ডেকেছেন। কিন্তু তার ঘরে যে এসে হঠাৎ ঢুকল সে হচ্ছে লোথারিওর অন্য বোন নাটালিয়া। উইলেম নতজানু হয়ে নাটালিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া একটি হাত চুম্বন করল। নাটালিয়া তার কুশশ জিজ্ঞাসা করার পর মিগননের কথা তুলল। বলল, আপনি ফিলিক্সকে তার কাছে রাখার ব্যবস্থা করলে সে ভাল থাকবে। এখন সে মেয়েছেলের পোশাক পরে। আমি তাকে ভালো পোশাক দিয়েছি। 

পরদিন সকালে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল উইলেম। চাকর এসে প্রাতরাশের জন্য ডেকে নিয়ে গেল। উইলেম গিয়ে দেখল, নাটালিয়া তার জন্য অপেক্ষা করছে। কথায় কথায় নাটালিয়ার কাছ থেকে জানতে পারল উইলেম তাদের আর এক ভাই আছে। তিনি প্রায় হাসিখুশির সঙ্গে ঘুরে বেড়ান। তাঁর নাম ফ্রেডারিক। আব্বে সম্বন্ধে প্রশ্ন করে উইলেম জানল আব্বে হচ্ছে নাটালিয়াদের গৃহশিক্ষক। বর্তমানে তার দাদার কাছেই থাকেন। তবে ওঁর জীবনের একমাত্র আদর্শ হলো, কাজ করে যাওয়া। তবে তিনি বিশ্বাস করেন মানুষ ইচ্ছামতো কোনও মহৎ কাজ করতে পারে না। মানুষ আপন জন্মগত কর্মপ্রবৃত্তি আর প্রেরণার বশেই কাজ করে যায়। ইচ্ছা করলেই কেউ কবি হতে পারে না। 

এমন সময় ডাক্তার ঘরে ঢোকায় আলোচনাটা থেমে গেল। ডাক্তারকে মিগননের কথা জিজ্ঞাসা করায় বললেন, সে অনেক কথা। বলছি। 

নাটালিয়া ফেলিক্সকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বলে গেল, ছেলেটাকে আগে হতে দেখতে সে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে উঠবে আপনাকে দেখার জন্য। 

নাটালিয়া চলে গেল ডাক্তার অবাধে ও অকুষ্ঠভাবে বলতে লাগলেন, মিগননের ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যময়। আপনি শুনলে নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাবেন। ওর বিভিন্ন কথা, গান প্রভৃতি থেকে আমরা জেনেটি ওর বাড়ি ইত্যালির মিলান শহরের কোথাও। ওর শৈশবে দড়ির খেলা দেখানোর একটি দল ওকে চুরি করে নিয়ে আসে। তাইও আর বাড়ি ফিরে যেতে পারেনি। তারপর ও একদিন অদ্ভুত এক স্বীকারোক্তি করে বসে। আপনার নিশ্চয় সেই আশ্চর্য এক রাত্রির কথা মনে আছে যে রাত্রে এক অদৃশ্য নারী জড়িয়ে ধরে আপনাকে, অথচ আলো জ্বেলে আর দেখতে পাননি তাকে। সেই রাতে আপনি হ্যামলেটের ভূমিকায় অভিনয় করেন। 

উইলেম শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় কোনওরকমে বলল, আমার ভয় হচ্ছে। সে মেয়ে মিগনন নয় নিশ্চয়? 

ডাক্তার বললেন, সে মেয়ে মিগনন কিনা জানি না, তবে ও কিন্তু সে রাতে আপনার বিছানার ভিতরে লুকিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল। এই কামনা সে রাতে প্রবল হয়ে উঠেছিল ওর মনে। কিন্তু সাদা পোশাকপরা অন্য এক মেয়েকে দেখে তাকে প্রতিদ্বন্দিনী ভেবে ও পালিয়ে গিয়ে বৃদ্ধ বীণাবাদকের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আকাক্ষিত ব্যক্তির প্রতি অদম্য সঙ্গলিপ্সার সঙ্গে অজানা প্রতিদ্বন্দ্বিনীর প্রতি এক প্রবল ঈর্ষা মিলেমিশে সে রাতে ভয়ঙ্করভাবে বিক্ষুব্ধ ও উত্তাল করে তুলেছিল ওর অনুভূতিকে। 

উইলেম বিব্রত হয়ে ডাক্তারকে বলল, কিন্তু তার কাছে আমি গিয়ে কি করব? বরং আমার উপস্থিতি অহেতুক উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে তার মধ্যে। তাতে কোনও ফল হবে না। 

ডাক্তার বললেন, যেখানে আমি রোগ নিরাময় করতে পারি না সেখানে সে রোগকে কিছুটা প্রশমিত করতে পারি। প্রেমের বস্তুর উপস্থিতি প্রেমিক-প্রেমিকার মন থেকেও ধ্বংসাত্মক চিন্তাগুলোকে সরিয়ে দিতে পারে। তার অনেক প্রমাণ আমি পেয়েছি। তবে তুমি গিয়ে তার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করবে। তার ফল কি হয় সেটা আমরা লক্ষ্য করব। 

নাটালিয়া এসে উইলেমকে সঙ্গে করে মিগননের কাছে নিয়ে গেল। উইলেম গিয়ে দেখল মিগনন শান্তভাবে শুয়ে আছে, আর তার বুকের উপর ফেলিক্স খেলা করছে। ফেলিক্সকে পেয়ে ও অনেকখানি শান্ত হয়ে উঠেছে। উইলেম যা ভেবেছিল তা কিন্তু হলো না। তাকে দেখে কোনও উত্তেজনা প্রকাশ করল না মিগনন। শুধু বোঝা গেল সে খুশি হয়েছে মনে মনে উইলেমকে দেখে। 

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল মিগনন। অবশ্য দুর্বলতা তখনও ছিল তার দেহে। রোজ একবার করে উইলেম তাকে নিয়ে বেড়াত। তার জীবনের উদ্ধারকর্তাকে প্রেমিক হিসাবে কল্পনা করেছিল মিগনন তার অপরিণত মনে। উইলেম যখন কাছে না থাকত তখন ফেলিক্স থাকত তার কাছে। 

নাটালিয়া বলল, থেরেসার সঙ্গে আপনার বিয়ের কথা ঠিক হওয়ার কথাটা জানতে পারলে খুব রেগে যাবে। 

উইলেমও বিয়ের কথাটা মিগননকে জানাতে সাহস পেল না। 

অবশেষে থেরেসার বহু প্রতিক্ষিত চিঠিটা এসে গেল। নাটালিয়া নিজে তার বান্ধবীর চিঠিটা উইলেমের হাতে তুলে দিল। বলল, এখন খুশি তো? থেরেসা আমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিল। আমার মতামত চেয়েছিল। আমার প্রতি আপনার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। উইলেম গম্ভীর মুখে চিঠিটা খুলল। তাতে লেখা আছে, আমি তোমার, তুমি আমার। আমরা যেহেতু কোনও আবেগের দ্বারা প্রভাবিত হইনি, আমাদের পারস্পরিক শুভেচ্ছা উৎফুল্লতা ও যুক্তিবোধের দ্বারা আমাদের বিবাহ-বন্ধনকে সার্থক করে তুলব। আমি তোমার ফেলিক্সকে বুকে চেপে ধরে অনেক শান্তি পাব। তাকে মার মতো মনে মানুষ করব। আমি ভাবব, সে আমারই সন্তান। তুমি আমার বাড়িতে চলে এলেই আমরা হয়ে উঠব একচ্ছত্র অধিপতি। আমরা শুরু করব আমাদের সুখের জীবন। 

নাটালিয়া তার ভাই লোথারিওকে একটা চিঠি লিখল। এমন সময় হঠাৎ জার্নো এসে হাজির। জার্নো এসে বলল, আমি জানি না আমার বন্ধু কি মনে করবে। তার নিয়তি ঘটনার গতিকে ফিরিয়ে দিতে পারে। 

উইলেম বলল, আজ আমি সত্যিই খুশি। আজ আমার সারা জীবনের সকল আশা, সকল আকাক্ষা সফল হতে চলেছে এই মিলনের মধ্যে। 

জার্নোর কাছ থেকে উইলেম যখন শুনল থেরেসা তার মার নিজের সন্তান নয় বলে কাউন্ট লোথারিও তার মন পাল্টেছে এবং থেরেসাকে গ্রহণের পথে অন্য কোথাও বাধা নেই, তখন উইলেম বলল, তিনি আমার অকৃত্রিম অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমি তাঁরই জন্য, তাঁকে প্রীত করার জন্যই থেরেসার পাণিগ্রহণ করতে চেয়েছিলাম আবার তাঁরই খাতিরে থেরেসাকে ত্যাগ করে তার হাতে তুলে দিতে পারব। একথা কাউন্টকে গিয়ে জানিয়ে দিয়ে যাও। 

জার্নো ঘোড়ায় করে চলে গেল। 

কাউন্ট লোথারিও সত্যি সত্যিই তাঁর মত পাল্টেছেন। তিনি এখন নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছেন সুইজারল্যান্ডে থাকাকালে থেরেসার যে কুপথগামিনী ব্যভিচারিণী মার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়, থেরেসা তার সন্তান নয়। থেরেসার মা অন্য নারী, তিনি ইহজগতে নেই। এবার থেরেসাকে গ্রহণ করতে কোনও বাধা নেই। 

উইলেম প্রথমে ভেবেছিল এটা বুঝি জার্নোর চক্রান্ত। কিন্তু লোথারিওর একখানি চিঠি তাদের সব সন্দেহ ভঞ্জন করে নিল। নাটালিয়াকে লোথারিও লিখেছেন, তোমার উপর এমন গুরুদ্বায়িত্ব এসে পড়েছে নাটালিয়া। তার তোমরই উপর নির্ভর করছে তোমার এই ভাই-এর ভবিষ্যৎ সুখ-শান্তি। একদিকে থেরেসাকে বোঝাতে হবে তোমাকেই। আবার আমার বন্ধুও যেন ক্ষুণ্ণ না হয়। তাকে কোনও মতেই তুমি ছাড়বে না। আশা করি শীঘ্রই মন ঠিক হয়ে যাবে। 

নাটালিয়া চিঠি পড়ে শান্ত কণ্ঠে উইলেমকে বলল, কথা দাও, তুমি আমার অমতে কোনওদিন আমার এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে না। 

উইলেম তার হাত বাড়িয়ে বলল, কথা দিচ্ছি, এবার হতে তোমার মতেই চলব এ ব্যাপারে। তোমার অমতে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব না।

বাগানে গিয়ে কিছু ফুল তুলল নাটালিয়া। বিভিন্ন রঙের বিচিত্র ধরনের ফুল। নাটালিয়া বলল, তোমাকে নিয়ে আমার কাকার কাছে যাব। আমার জীবনের সব আনন্দ সকল শান্তি এখন তোমার হাতেই নির্ভর করছে। 

ফুল তোলার পর কথা বলতে বলতে প্রাসাদের এমন একটি দিকে যেতে লাগল যেখানে সচরাচর কেউ যায় না। নাটালিয়া বলল, এ দিকটায় আমার কাকা থাকতেন, এ ফুল তাঁরই জন্য নিয়ে যাচ্ছি। 

হলঘরে ঢুকতেই মর্মরপ্রস্তরের এক মূর্তি দেখতে পেল উইলেম। জানল ইনিই ছিলেন নাটালিয়ার কাকা। এ এক অদ্ভুত জগৎ। চারদিকে শুধু নানা ধরনের ভালো ভালো ছবি। কত অপরূপ ভাস্কর্য ও চিত্রকলার সার্থক নিদর্শন। দেখতে দেখতে দুচোখ জুড়িয়ে গেল উইলেমের এই নির্জন পরিত্যক্ত অঞ্চলে আপাতদৃষ্টিতে কোনও প্রাণচাঞ্চল্য দেখতে না পেলেও এই শিল্পসৃষ্টির মধ্যে স্তব্ধ জীবনের এমন এক চিরন্তন রূপ দেখতে পেল উইলেম, যে রূপ অবিচ্ছিন্ন কালপ্রবাহে চিরপ্রবহমান। মৃত্যুশীতল এক অতীতাশ্রয়ী স্তব্ধতার সঙ্গে কালজয়ী প্রাণচঞ্চলতার এক প্রচ্ছন্ন তাপপ্রবাহ মিলেমিশে এক অদ্ভুত জীবন রসায়নে পরিণত হয়ে উঠেছে যেন। 

কথা বলতে বলতে ওরা হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় ছেলেরা ছোটাছুটি করতে করতে এগিয়ে এল তাদের দিকে। ফেলিক্স বলল, আমি আগে এসেছি। মিগনন বলল, আমি। আসলে হঠাৎ থেরেসা আসায় ওরা খবর দিতে এসেছে ছুটে। মিগনন হাঁপাচ্ছিল। নাটালিয়া তাকে ধরে বলল, দুষ্টু মেয়ে কোথাকার, আমি তোকে বলেছি না, মোটেই ছুটবি না। বুকটা লাফাচ্ছে। 

থেরেসা এগিয়ে এসে আবেগের সঙ্গে উইলেমকে বলল, কেমন আছ হে আমার বন্ধু? ওদের দ্বারা তুমি তাহলে এখনও প্রতারিত হওনি? 

উইলেম এগিয়ে যেতেই ছুটে গিয়ে তার গলাটা জড়িয়ে ধরল থেরেসা। বলল, হে আমার মনের মানুষ, আমার স্বামী। তুমি আবার চিরদিনের। বলতে বলতে পাগলের মতো চুম্বন করতে লাগল উইলেমকে। ফেলিক্স তার গাউনটা ধরে টানতে টানতে বলল, মা, আমি এখানে রয়েছি। 

হঠাৎ মিগনন দাঁড়িয়ে এসব দেখতে দেখতে নাটালিয়ার পায়ের কাছে পড়ে গেল। উইলেম তাকে দুহাতে তুলে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। তাকে মৃত ভেবে আকুলভাবে কাঁদতে লাগল। তাকে থেরেসা সরিয়ে নিলে গেল অন্য ঘরে। কিন্তু কারও কোনও সান্ত্বনায় কান দিল না উইলেম। বলতে লাগল, আমারই হৃদয়হীনতার জন্য ওর মৃত্যু ঘটেছে। ও আমার কত উপকার করেছে। নিজে আহত হয়েও রক্তাক্ত দেহে আমার সেবা করে আমাকে বাঁচিয়েছে। 

ডাক্তার ও সার্জেন এসে বললেন, একেবারে আশা ত্যাগ করবেন না। দেখি কি করতে পারি। 

উইলেম লক্ষ্য করল এই সার্জেনই নাটালিয়ার নির্দেশে এই বনে গিয়ে তার চিকিৎসা করে। 

ঠিক এই সময় কাউন্ট লোথারিও, আব্বে ও জার্নো এসে হাজির হলো প্রাসাদে। জার্নো উইলেমকে সরিয়ে নিলে গেল। কিন্তু তার কোনও কথা ভালো লাগল না উইলেমের। কুষ্ঠির কথা, তার ভবিষ্যতের কথা, কোনও কিছুই আকৃষ্ট করতে পারল না তাকে। বিশেষ করে এই শোকদুঃখের সময়ে জার্নো তার বিয়ের কথাটা তোলায় তার রাগ হলো জার্নোর উপার। জার্নো বলল, ঐ আব্বে এসে গেছেন। সব সংশয় ঝেড়ে ফেলে সকল কথা ওঁকে বলো। সাক্ষাৎ নিয়তির মতো উনি সব ঠিক করে দেবেন। উনি অনেকের মধ্যে অনেক মিলন অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটিয়ে থাকেন। 

এক জায়গায় সবাই যখন বসে গল্প করছিল, একজন দূত এসে একটি চিঠি দিয়ে গেল কাউন্ট লোথারিওর হাতে। কাউন্ট বললেন, তোমার মালিক কখন আসবেন? 

কিন্তু দূত তা বলতে পারল না। এই অতিথি কে হাতে পারে এই নিয়ে সবাই যখন জল্পনা-কল্পনা করছিল তখন ফ্রেডারিক এসে হাজির হলো সবাইকে অবাক করে দিয়ে। আশ্চর্য হলো উইলেম যখন সে নিজের চোখে দেখল কাউন্ট লোথারিও ও নাটালিয়ার ভাই হচ্ছে তার অতিপরিচিত ফিলিনার বালকভৃত্য ফ্রেডারিক। 

এদিকে উইলেমকে তাদের প্রাসাদে দেখে খুব খুশি হলো ফ্রেডারিক। বলল, ইনি যখন অভিনয় করতেন তখন আমি এদের সাজাতাম। ইনি আমার যথেষ্ট উপকার করেছেন। একবার ঘুষিবৃষ্টি হতেও আমাকে রক্ষা করেন। 

ফ্রেডারিককে দেখে পুরনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ল উইলেমের। একটু সরে গিয়ে ফ্রেডারিক তাকে বলল, ফিলিনার জন্য আমি তোমাকে ঈর্ষা করতাম। একদিন রাত্রে ফিলিনাই সাদা পোশাক পরে তোমার ঘরে যায়। এতে আমার ঈর্ষা আরো বেড়ে যায়। ছোকরা অফিসারের বেশে আমিই শেষের দিকটায় তার ঘরে ছিলাম। আমার সঙ্গে সে তোমাদের দল ছেড়ে চলে আসে এবং এখন একটা নির্জন প্রাসাদে আমার সঙ্গেই থাকে। গ্রামাঞ্চলের সেই প্রাসাদে আমরা বেশ সুখেই আছি। 

ফ্রেডারিক চলে গেলে জার্নো এল উইলেমের কাছে। উইলেম বলল, এখানকার ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন দেখছি আমার থেরেসার প্রতি আর সে আসক্তি নেই। 

সেদিন নাটালিয়ার পাশে উইলেম আর জার্নো বসেছিল। নাটালিয়া একসময় জার্নোকে বলল, কয়েকদিন ধরে দেখছি তুমি যেন কি ভাবছ সব সময়।

জার্নো বলল, হ্যাঁ সত্যিই তাই। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি ভাবছি। অবশ্য ব্যাপারটা আমার বন্ধু উইলেমের উপর অনেকটা নির্ভর করছে। শোনো বন্ধু, অল্পদিনের মধ্যে তুমি আমার সঙ্গে আমেরিকা যাচ্ছ। 

আকাশ থেকে পড়ল যেন উইলেম। আমেরিকা যাব। আমি একথা কখনও ভাবিওনি। 

জার্নো বলল, আজ সারা পৃথিবীর মধ্যে আমেরিকা দ্রুত সমৃদ্ধি ও উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন দেশের লোক তাই সেখানে গিয়ে গড়ে তুলছে নূতন নূতন উপনিবেশ। গড়ে উঠছে কত রকমের কাজ-কারবার। তুমিও আমার সঙ্গে যেতে পার। অবশ্য দুটো বিষয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে পার। হয় তুমি জার্মানিতে যেতে। 

উইলেম বলল, তোমার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখতে হবে। এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারব না। 

ফ্রেডারিক সব সময়ে বেশি কথা বলে। সে এই কথা শুনে ভ্রমণের গুণাগুণ সম্বন্ধে এক দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করে দিল। তারপর শেষকালে বলল, লিভিয়াকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। ব্যর্থ প্রেমের সব দুঃখ অন্তত সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে দিতে পারবে। আমাদের বন্ধু উইলেম তো পরিত্যক্ত রমণীকে ভালোবেসে গ্রহণ করতে ওস্তাদ। না হয় তো আমিই লিভিয়াকে গ্রহণ করে আমেরিকা পাড়ি দিতে পারি। 

জার্নো বলল, বড় দেরি হয়ে গেছে, আমি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। 

নাটালিয়া বলল, ব্যর্থ প্রেমের আঘাতে আহত নারীকে এ প্রস্তাব দান করা এক জঘন্য কাজ।

নাটালিয়া আরও কি বলতে যাচ্ছিল এমন সময় আব্বে এসে আর একটা প্রস্তাব উত্থাপন করলেন উইলেমের কাছে। বললেন, কাউন্টের কাকার বন্ধু এক ইতালীয় ভদ্রলোক আসছেন এখানে। উনি সমগ্র জার্মানি পরিভ্রমণ করবেন। উনি সঙ্গে এমন একজন জার্মান যুবক চান সে ভালো জার্মান ভাষা জানে এবং যে সামাজিক মেলামেশায় সক্ষম। আমরা তাই তোমাকেই ঠিক করেছি। 

উইলেম বলল, আপনি বললেই যে মানতে হবে এমন কোনও কথা নেই। আমাকে ভেবে দেখতে হবে ব্যাপারটা। তাছাড়া আমি গেলে আমার ছেলে ফেলিক্সকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। 

আব্বে বললেন, তা কি সম্ভব হবে? 

একমাত্র নাটালিয়ার উপস্থিতি ছাড়া আর কারও উপস্থিতি ভালো লাগছিল না উইলেমের। তবে নাটালিয়া কাছে থাকলেও ওদের যে কোনও প্রভাব বিসদৃশ ঠেকছিল উইলেমের কাছে। মনে হচ্ছিল এক-একটা প্রস্তাব হলো তাকে এখান থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার এক-একটা হীন চক্রান্ত। মনে হচ্ছিল বিয়ে বা নিবিড় পারিবারিক সুখশান্তি তার ভাগ্যে আর নাই। মেরিয়ানাকে সে প্রথমে ভালোবেসেছিল, কিন্তু পায়নি। তারপর ফিলিনার প্রতি তার প্রেমাসক্তি জাগে, কিন্তু তাকেও কাছে পায়নি। তারপর অরেলিয়ার। অকাল মৃত্যু তার প্রতি তার আসক্তিকে ঘন হতে দেয়নি। পরিশেষে তার বারবার প্রতিহত ও ব্যর্থ প্রেমের নদীটি ক্লান্ত থেরেসার বুকে চিরতরে ঢলে পড়তে চায় ক্লান্ত হয়ে, কিন্তু এরা তাও হতে দিল না। এখন শুধু বাকি আছে নাটালিয়া। 

ফেলিক্সকে কোলে করে বুকে চেপে ধরে কিছুটা শান্তি পেল উইলেম। সেই ইতালীয় ভদ্রলোক হঠাৎ এসে পড়লেন। সকলের সঙ্গে আলাপ করার পর উইলেমের সঙ্গেও আলাপ-পরিচয় হলো। ইতালির লম্বার্ডি অঞ্চলের লোক। বয়স অল্প। 

ইতালীয় ভদ্রলোক তাঁর পরিচয়ের যে পূর্ণ বিবরণ লিখে এনেছিলেন তাতে অনেক আশ্চর্য নূতন কথা জানা গেল। অনেক জটিলতার জট খুলল। তাতে জানা গেল, বৃদ্ধ বীণাবাদক তাঁর অর্ধোন্মাদ ভাই অগাস্টিন এবং মিগনন তার স্পেরাবা নামে এক বোনের বিকলাঙ্গ মেয়ে, সমুদ্রতীরের একটি বাড়িতে তাকে রাখা হয়েছিল। স্পেরাবা থাকত কনভেন্টে। সেখান থেকে সে চুরি হয়ে যায়। তার টুপিটা সমুদ্রের এক খাড়ির জলে। ভাসতে দেখা যায়। লোকে ভাবে সে জলে ডুবে গেছে। মিগননা তাঁর ভাইঝি। ভাইঝির মৃত্যুসংবাদে মার্শেজী কাতর হলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভাইঝির ত্রাণকর্তা উইলেমের প্রতি জানালের অকৃত্রিম মমতা। 

উইলেমকে মার্শেজী বললেন, আপনি ফেলিক্সকে সঙ্গে নিয়ে চলুন। দেখবেন মিগননের জন্মস্থান, তার বাল্যের লীলাভুমি। আপনি তাকে স্নেহ করতেন। 

এমন সময় সহসা কাউন্টপত্নী এসে হাজির হলেন। উইলেমের হাতটা ধরে একটু চাপ দিয়ে তার মুখপানে গভীর দৃষ্টিতে একবার তাকালেন। তারপর তার বোন। নাটালিয়ার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। 

আগে মার্শেজীর হাতে লেখা বিস্তৃত বিবরণটি সকলের সামনে পড়ে শোনালেন। হতভাগ্য মিগনন ও বৃদ্ধ বীণাবাদক প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে দুঃখে ভারী হয়ে উঠল সকলের হৃদয়। ভাগ্য বিড়ম্বনার এই সব সকরুণ কাহিনী শুনে অনেকে চোখের জল মুছতে লাগলেন। 

একমাত্র মিগননের কথা ভেবেই ফেলিক্সকে সঙ্গে নিয়ে মার্শেজীর সঙ্গে প্রথমে জার্মানি ও পরে ইতালি যেতে চাইলেন উইলেম। তার ভাইঝি মিগননের প্রতি সদয় ব্যবহার ও স্নেহপ্রীতির জন্য উইলেমকে মোটা রকমের সম্পত্তি দান করতে চান মার্শেজী। ওর ছেলের বাড়িতে গেলে উনি উইলেমকে তা দেবেন। আপাতত কিছু মূল্যবান ধাতু ও রত্ন উপহার দিলেন। 

উইলেম ডাক্তারের কাছে লোক পাঠাল বীণাবাদকের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য। সে ভালো হয়ে উঠলেও তাকেও নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। 

উইলেম এদিকে লক্ষ্য করল থেরেসা ক্রমশই কাউন্ট লোথারিওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। তারা হয় তো চাইছে যে সে এখান থেকে চলে গেলেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে তারা। 

ডাক্তার লোক মারফৎ কোনও খবর না পাঠিয়ে নিজে এলেন। এসে অদ্ভুত একটা খবর দিলেন। বললেন বীণাবাদক এখন দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে নূতন মানুষ হয়ে উঠেছে। ভাক্তারকে এবার তার আসল পরিচয়ের কথা বলা হলো। বলো হলো তার আসল নাম অগাস্টিন। খ্যাতিসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক। 

অগাস্টিনকে প্রাসাদে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু তার আসল পরিচয় তাকে বলা হলো না। মার্শেজীকেও বলা হলো না। ওরা সকলে ভাবল বীণাবাদকরূপী অগাস্টিন সত্যিই ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু অগাস্টিন সকলের সঙ্গে ভালোভাবে কথাবার্তা বললেও ফেলিক্সকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে কটমট করে তাকাচ্ছিল তার দিকে। ওরা কেউ বুঝতে পারল না তার ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিটা তখনও অবদমিত হয়নি একেবারে। 

একদিন সকলে বসে গল্প করছিল। উইলেম কবে রওনা হবে তা নিয়ে কথা হচ্ছিল এমন সময় ব্যস্তভাবে অগাস্টিন উন্মাদের মতো ঘরে ঢুকল। তার মধ্যে হঠাৎ উন্মত্ততা জেগে উঠেছে দেখে সকলে তাকে ধরে ফেলল। সে তখন স্বাভাবিক মানুষের মতো বলে উঠল, আমাকে নয়, ছেলেটাকে পার তো বাঁচাও গে। আমি তাকে বিষ খাইয়েছি। 

সকলে ছুটে গেল ফেলিক্সের কাছে। দেখল একটা টেবিলের সামনে ফেলিক্স বসে রয়েছে। তার সামনে টেবিলে রয়েছে একটি গ্লাস ও একটি বোতল। গ্লাসের জলে মাত্রাতিরিক্ত আফিম মিশিয়ে দিয়েছিল অগাস্টিন। ফেলিক্সকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে বলল, গ্লাসের জল খেয়েছি। তখন হতাশ হয়ে উইলেম মাথা চাপড়াতে লাগল। ভাবল ফেলিক্সকে আর বাঁচানো যাবে না। 

ডাক্তারকে ডাকা হলো। ডাক্তার বললেন, চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না। নাটালিয়া ফেলিক্সকে কোলে করে বসে রইল। তার পা দুটো রইল উইলেমের কোলে। ভিড় দেখে কাঁদছিল ফেলিক্স। সারারাত এইভাবে কাটল। নাটালিয়া সামনে বসে রইল। নাটানিয়ার হাতে প্রায়ই হাত ঠেকছিল উইলেমের। নাটালিয়া তার পানে তাকাচ্ছিল শান্ত অথচ গভীর দৃষ্টিতে। 

এদিকে অগাস্টিনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন সকাল হতেই একজন এসে খবর দিল অগাস্টিন উপরতলার একটি ঘরে রক্তাল্পত অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে একটা ধারাল ক্ষুর। সেই ক্ষুর দিয়ে নিজের গলার শিরা কেটে আত্মহত্যা করেছে অগাস্টিন। 

ডাক্তার গিয়ে অতিকষ্টে রক্ত বন্ধ করে গলায় ব্যান্ডেজ করে দিল। কিন্তু কিছু পরে অগাস্টিন বলল, আমি মার্শেজীর লেখাটা এক জায়গায় পড়ে থাকতে দেখে সব জানতে পারি। তখন দেখি এত কাণ্ডের পর আর আমার বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় না। তাই আত্মহত্যা করলাম। 

পরে ফাঁক পেয়ে নিজের হাতের ব্যান্ডেজ সরিয়ে দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষণের ফলে মারা গেল অগাস্টিন। 

এদিকে ফেলিক্সের অবস্থা আগেই মতোই রইল। ডাক্তার নাড়ি টিপে দেখল কোনও বিকার নেই। বিষক্রিয়ার কোনও কুফল দেখা গেল না। অনেকে নিশ্চিন্ত হলো। কিন্তু একা উইলেম বলল, এখনও বিপদ কাটেনি। ফেলিক্স বলেছে ও গ্লাসের জল খেয়েছে। 

কিছু পরে নাটালিয়া ফেলিক্সকে কোলে করে অন্যত্র নির্জনে নিয়ে গেল। সেখানে নাটালিয়ার প্রশ্নের উত্তর ফেলিক্স শান্তভাবে সবল সে গ্লাসের জল খেয়েছে। সে কথা নাটালিয়া এসে সকলকে জানাতে নিশ্চিত হলো। সংশয়মুক্ত হলো উইলেম। 

এবার যাবার দিন হয়ে গেল। আব্বেও যাবেন। রওনা হতে আর দুদিন বাকি। কাউন্টপত্নী সকলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। যাবার সময় নাটালিয়াকে গোপনে কি বলে গেলেন। 

ফ্রেডারিক এসে হঠাৎ একটা খবর দিল সকলের সামনে! উইলেমকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, আমি সব শুনেছি। নাটালিয়ার সঙ্গে তোমার বিয়ের সব ঠিকঠাক। একটি রুদ্ধদার ঘরে আব্বেকে তার মনের কথা বলছিল নাটালিয়া। সে কথা আমি শুনেছি। ফেলিক্সের অসুখের সময় সেই অতন্দ্র রাত্রিতে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে। উইলেমকেই বিয়ে করবে। 

এদিকে কাউন্ট লোথারিও উইলেমকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমার বিয়ে না হলে আমার বিয়েও হবে না। থেরেসার সঙ্গে নাটালিয়ার এক চুক্তি হয়েছে। থেরেসার ইচ্ছা দুটি দম্পতি একসঙ্গে উপস্থিত থাকবে বিবাহের বেদীতে। লোথারিও উইলেমকে জড়িয়ে ধরে নাটালিয়ার কাছে নিয়ে গেলেন। ওদিক থেকে থেরেসা সঙ্গে করে নিয়ে এল নাটালিয়াকে। 

ফ্রেডারিক ঠাট্টা করে বলল, আমার যত সব পুরনো কথা মনে পড়ছে। লজ্জার কিছু নেই। আজ তোমার সুখ দেখে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে কিশোর পুত্র মলের কথা। 

যে তার বাবার গাধা খুঁজতে গিয়ে এক রাজ্য পেয়ে যায়।

উইলেম বলল, রাজ্য লাভ করেছি কিনা জানি না। তবে একটা জিনিস বলতে পারি। আজ যে সুখ আমি লাভ করলাম তার আমি যোগ্য নই এবং এ সুখের বিনিময়ে অন্য কোনও কিছু গ্রহণ করতে পারব না সারা জীবনের মধ্যে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *