ফাউস্ট (কাব্য-নাটক)

উৎসর্গ

আবার এসেছ হে ছলবিলাসিনী মায়াবিনীরা! মেঘাচ্ছন্ন স্মৃতির কুয়াশা সরিয়ে আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি সুদূর অতীতে আর একবার এসেছিলে তোমরা তোমাদের আপাত উজ্জ্বল রূপ দিয়ে আমায় মোহমুগ্ধ করতে। আজ আবার এক মোহপ্রসারী মায়াবরণ দিয়ে আবৃত করে দিতে এসেছ আমার অন্তরকে? এবার কি তোমাদের আমি বেঁধে দেব। তোমাদের এই প্রকটিত রূপে এলে যদি আরও কাছে এস! আমার জীবন-যৌবনের। সার্বভৌম কর্তৃত্বভার গ্রহণ করো। তোমাদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে যাদুমন্ত্রসুলভ এক ক্ষণ-উন্মাদনায় ছায়ান্ধকার যে রহস্যের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় আমার ইন্দ্রিয়চেতনা, যে অশান্ত যৌবনাবেগের মেঘভারে মৃদু বিকম্পিত ও শিহরিত হয়ে ওঠে আমার সমগ্র অন্তরাত্মা, সে কুয়াশা সে মেঘ থেকে মুক্ত করো আমায়। একান্তভাবে পার্থিব বিশাল বস্তুপুঞ্জমণ্ডিত বর্তমান দিয়ে ঘেরা প্রায়ান্ধকার এই অস্বচ্ছ চেতনার রাজ্য হতে আমাকে নিয়ে চলো আরও উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের পানে। 

তোমরা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার অতীত দিনের অনেক সুখস্মৃতি ভিড় করে আসছে আমার মনে। প্রেম ও কত বন্ধুত্বের স্মৃতি সকরুণ বেদনার এক একটি মূর্তি ধরে গোলোকধাঁধা সদৃশ আমার জীবনের সুপ্রাচীন কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে আবার। কেলিকপটিনী ভাগ্যদেবী অতীত জীবনের চলমান সুখস্রোত হতে অকস্মাৎ আমায় বিচ্ছিন্ন করে দিলেও স্মৃতিসিক্ত এক অবিচ্ছিন্ন মানসপ্রক্রিয়া এক দুঃসহ বেদনার জাল বুনে চলেছে আজও। সুদূর অতীতে একদিন যাদের আমি গান শোনাতাম তারা আজ। আমার গান শোনে না। তারা সবান্ধবে চলে গেছে আমার জীবন থেকে আর তার সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে বিলীন হয়ে গেছে সে গানের সব ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। হয়ত তারা আজও বেঁচে আছে, কিন্তু আমার কাছে আর আসে না। তারা সব পৃথিবীর জনারণ্যে ছড়িয়ে আছে। এখানে-সেখানে। আজ যারা আমার গান শোনে, শুনে আনন্দ পায়, তাদের আনন্দ আমাকে বেদনা দেয়। সে বেদনা যত বাড়তে থাকে, বহু-আকাক্ষিত এক আত্মিক প্রশান্তির জন্য ততই প্রবল হয়ে উঠে আমার ব্যাকুলতা। 

তবু আমি গান গেয়ে যাই। আইওনিয়ার গানের ধ্বনিকে ছাপিয়ে যাবার জন্য এক আকাশচুম্বী উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে চায় আমার গান। বাতাসের প্রতিটি কম্পনে ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে আমার গানের বীণা। কম্পিত হয়ে উঠে আমার সারা দেহ। একের পর এক করে উত্তপ্ত অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ে আমার চোখ থেকে। অশান্ত অধীর হয়ে ওঠে আমার হৃদয়। আমি যা পেয়েছি তারা আমাকে ফাঁকি দিয়ে দূরে সরে যায় আর যা কিছু আমি হারিয়েছি তাদের অশরীরী স্মৃতিরা আমার চোখের সামনে এসে মূর্ত হয়ে উঠে বিব্রত করে তুলছে আমায়। 

মঞ্চ সম্পর্কে মুখবন্ধ 

ম্যানেজার কবি-নাট্যকার মেরি অ্যান্ড

ম্যানেজার : তোমরা দুজনে আমাকে বিপদে-আপদে অনেক সাহায্য করেছ। আমার অনেক প্রয়োজন মিটিয়েছ। আজ আমি আমাদের জার্মান দেশের জন্য সে নাট্যপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি সে বিষয়ে তোমাদের দুজনের অভিমত জানতে চাই। এ বিষয়ে আমার ইচ্ছা হলো এই যে জনতা বা দর্শকবৃন্দ হচ্ছে অসংখ্য জীবন্ত মানুষের সমষ্টি এবং তাদের দয়াতেই আমরা বেঁচে আছি। সুতরাং তাদের প্রতি যেন সুবিচার করা হয়। এখন মঞ্চ নির্মাণের কাজ শেষ। আমাদের অনুষ্ঠানের জন্য এক নীরব প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে আছে দর্শকরা। কৌতূহলবিহ্বল তাদের দ্রুযুগল উত্তোলিত করে বিস্ময়কর অনেক কিছু দেখার প্রত্যাশায় এরই মধ্যে বসে আছে তারা। আমি জানি দর্শকদের কিভাবে খুশি করতে হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে এক অস্বস্তিসিক্ত কুণ্ঠা অনুভব করছি আমি। তারা কি ভালোবাসে, প্রচলিত কোন শব্দদৃশ্যে তারা অভ্যস্ত সেটা আমার কাছে বড় কথা নয়। তবে একথাও ঠিক আজকের দর্শকরা অনেক কিছু পড়েছে। অনেক কিছু খবর রাখে। তাহলে কেমন করে আমরা আমাদের নাট্য-পরিকল্পনায় এক অভিনব ও অভূতপূর্ব বস্তুকে উপস্থাপিত করব যা একই সঙ্গে অভিনব হয়েও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে দর্শকদের কাছে এই দর্শকরা যখন দলবদ্ধভাবে বেগবান নদীস্রোতের মতো মঞ্চাভিমুখে এগিয়ে আসে অথবা যখন তারা দিনের বেলায় রুটির দোকানের সামনে ভিড় করতে থাকা দুর্ভিক্ষপীড়িত বুভুক্ষু জনগণের মতো টিকিট কেনার জন্য অফিস ঘুরে ভিড় করে তখন তা দেখতে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগে। বিভিন্ন প্রকৃতির অসংখ্য মানুষকে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে এক জায়গায় এভাবে সমবেত করার ইন্দ্রজাল একমাত্র কবিরাই সৃষ্টি করতে পারেন। হে কবি, সেই ইন্দ্রজাল এবার সৃষ্টি করো। 

কবি : বিচিত্র বর্ণের পোশাক পরিহিত বিচিত্র মনোভাবাপন্ন ঐ জনগণের কথা আর আমায় বলল না। ওদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে গীতিকাব্য রচনার সমস্ত জ্বলন্ত প্রেরণা আমার নির্বাপিত হয়ে যায় মুহূর্তে। আমার দৃষ্টিসীমার অন্তরালে চলে যেতে দাও ঐসব চলমান জনতার স্রোতকে। ওদের অস্থির মানসিকতার অশান্ত ঘূর্ণাবর্তে আমাকে যেন ওরা জোর করে কখনও না ফেলতে পারে। তার চেয়ে আমাকে নিয়ে চলো সেই স্বর্গীয় নীরবতার রাজ্যে। যেখানকার আকাশে-বাতাসে এক আশ্চর্য অসীম স্বচ্ছতায় প্রতিফলিত হয় কবিসুলভ এক বিমল আনন্দের জ্যোতি। যেখানে এক অপরিসীম প্রেম আর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয় সব মানুষ আর সেই প্রেমের রঙে রাঙা হয়ে ওঠে মানুষের বাসনার সব আবেগ। 

মানুষ তার অন্তরের গভীর থেকে ভীরুতার সঙ্গে আমতা আমতা করে যা প্রকাশ করে তার বেশির ভাগ উন্মত্ত মূহূর্তের লোভাতুর বক্ষের মধ্যে নিঃশেষে তলিয়ে যায়। যা কিছু অস্থায়ী ও আপাত-উজ্জ্বল তা ক্ষণভঙ্গুর মুহূর্তের সঙ্গে সঙ্গেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। যা কিছু খাঁটি, যা কিছু সত্য ও চিরায়ত তাই ভাবীকালের সম্পদ হয়ে বিরাজ করে যুগ যুগ ধরে। 

মেরি অ্যান্ডরু : ভাবীকালের কথা আমি যদি জোর করে প্রচার করে চলি তাহলে সমকালীন জীবনের রস কেমন করে উপভোগ করব? সব মানুষেরই উচিত এই জীবনের রস উপভোগ করা। এই রস উপভোগ করার জন্য কোনও এক প্রাণোচ্ছল জীবনরসরসিক যুবকের সাহচর্য প্রত্যেক মানুষেরই দরকার। যে যুবক তার নিরন্তর পরিহাস রসিকতার মাধ্যমে তার অনর্গল স্বভাবের মাধুর্য ছড়িয়ে চলে, তার প্রতি কেউ কখনও বিরূপ হয় না, কেউ কখনো ক্রুদ্ধ হয় না। এইভাবে তার বন্ধু ও অনুরাগীর সংখ্যা যতই বেড়ে চলে ততই সে পরিহাসরস পরিবেশনে প্রেরণা পায়। সুতরাং সাহস সঞ্চয় করো, হাস্যরস পরিবেশনে তোমাদের কল্পনাশক্তিকে পূর্ণমাত্রায় নিয়োজিত করো। তোমাদের নীতিজ্ঞান, যুক্তিবোধ, ভাবপ্রবণতা, আবেগ, অনুভূতি সব কিছু মিলিত হয়ে সেই কল্পশক্তির সহায়তা করুক। 

ম্যানেজার : যে নাটক তোমরা মঞ্চস্থ করবে তা প্রধানত ঘটনাবহুল হবে। মনে। রাখবে দর্শকবৃন্দ নাটকের মধ্যে ঘটনাপরস্পর্যের একটি অবিচ্ছিন্ন সূত্রকে তাদের চোখের সামনে ক্রমোদঘাটিত দেখতে চায়। দেখতে দেখতে তারা সম্মোহিতের মতো এক অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মঞ্চের দিকে। এইভাবে তাদের আগ্রহ ও আবেগ আকর্ষণ করেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারবে। মনে রাখবে, একমাত্র সম্মিলিত প্রার্থনার দ্বারাই সমবেত জনগণের হৃদয় স্পর্শ করা যেতে পারে, কারণ এই ধরনের প্রার্থনায় প্রত্যেকে আপন আপন কণ্ঠের সুর মিলিয়ে তৃপ্তি অনুভব করে। তেমনি। একই নাটকের মধ্যে বিভিন্ন রুচির মানুষ বিভিন্ন রকমের আগ্রহের উপাদান খোঁজে। আর তা পেলেই তারা এই রসতৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে যায় অভিনয় শেষে। একই ধরনের এক অখণ্ড ভাববস্তুকে সম্বল করে নাটক নাই বা লিখলে। নাটকে যদি বিভিন্ন ধরনের ভাব ও রসের উপাদান ছড়িয়ে থাকে তাহলে দেখবে বিভিন্ন রুচিসম্পন্ন দর্শকরা। তার থেকে এক-একটি উপাদান কুড়িয়ে নেবে আপন আপন রুচি অনুসারে। 

কবি : তুমি বুঝতে পারছ না কোনও কবির পক্ষে এ কাজ কত অসম্মানজনক। যে শিল্পী যত আত্মসচেতন এবং সব সময় সত্য বস্তু দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে সমৃদ্ধ করেন। সেই শিল্পীর পক্ষে এ কাজ মোটেই শোভা পায় না। যে সব ছলনাময় কুশলী শিল্পী। অসত্য বস্তুকে সত্য বলে তাঁদের সৃষ্টিকার্য চালিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত একমাত্র তাঁদের কাজই তোমার নীতির সঙ্গে খাপ খাবে।

ম্যানেজার : তোমার এই তিরস্কারবাক্য কোনওক্রমেই রুষ্ট করতে পারবে না আমায়। কোনও মানুষ যখন কোনও কর্মকে ফলপ্রসূ করে তুলতে চায় তখন সে অবশ্যই এমন এক পদ্ধতি গ্রহণ করে যা সবচেয়ে কার্যকরী হয়ে উঠবে তার সে কর্মের পক্ষে। ভেবে দেখো, একটা নরম কাঠকে টুকরো টুকরো করার জন্য তোমাকে দেওয়া হয়েছে। আরও ভেবে দেখো। তুমি কাজের জন্য লিখছ। একই নাটক দেখে কেউ যখন বিরক্ত বোধ করে, ক্লান্তি বোধ করে তখন আর একজন এক নিবিড় তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। আবার কেউ বা খবরের কাগজ পড়ে কেবল কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে এক অলস ঔদাসিন্য সহকারে আসে নাটক দেখতে। আসে তাদের উজ্জ্বল পোশাক-পরিহিতা অর্ধাঙ্গিনীদের সঙ্গে নিয়ে। তোমার মধ্যে যে কাব্যপ্রতিভা রয়েছে। তার দ্বারা আর কি মহৎ কার্য সম্পাদন করতে চাও? আমার কাছে এসে দেখ, তোমার অনুরাগীদের মুখমণ্ডলগুলো দেখো। তাদের মধ্যে অর্ধেক হলো বড় নীরস ও স্কুল প্রকৃতির, নাটকাভিনয় শেষ হয়ে গেলে তারা বাড়ি ফিরে কোনও বারাঙ্গনার অঙ্কশায়ীরূপে পান-ভোজন ইত্যাদি সহকারে এক উন্মত্ত রাত্রি যাপন করবে। দর্শকদের অপর অর্ধেক নাট্যরস আস্বাদনে সক্ষম। তাই বলি, হে নির্বোধ কবির দল, তোমরা কাব্যনাট্যগুলোতে এমন সব রসোত্তীর্ণ উত্তম নাট্যবস্তু দান করবে যা স্বচ্ছন্দে দর্শকদের প্রতাশ্যার সীমাকে যাবে ছাড়িয়ে। এইভাবে তোমরা পার্থিব ধনসম্পদ ও গৌরব একই সঙ্গে দুই-ই লাভ করবে। দর্শকদের মনে এমন বিপুল পরিমাণ সন্তোষ উৎপাদন করবে যে তারা যেন বিহ্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু এ কাজে কুণ্ঠা কেন? এ কাজ করতে গিয়ে আনন্দ না বেদনা কি অনুভব করছ? 

কবি : যাও, অন্যত্র কোথাও গিয়ে তোমার এক অনুগত দাসানুদাসের সন্ধান করো। কী! যে কবিকে প্রকৃতি স্বয়ং এক সৃষ্টিশীল প্রতিভা দান করে সর্বশ্রেষ্ঠ মানবসন্তানরূপে সৃষ্টি করেছেন এবং যাকে সর্বাপেক্ষা বড় মানবিক অধিকারে ভূষিত করেছেন। সেই কবি কখনও তোমার আনন্দ বৃদ্ধির জন্য আপনার প্রতিভার অপব্যয় করবে না। যে কবি জীবনের যত সব উপাদানগুলো করায়ত্ত করে তার হৃদয়ের উপর তাই দিয়ে এক স্বাধীন সাম্রাজ্য স্থাপন করে, সে কবি কখনও কারও দাসত্ব করবে না। সকল কবির মধ্যে এমনই এক অগ্রপ্রসারী সত্তা আছে যা তার আপন অন্তর্নিহিত প্রেরণায় এক বিশ্বব্যাপী সূত্রজাল বিস্তার করে জগতের বিচিত্র বস্তুর সঙ্গে তার অন্তরের যোগসাধন করে। প্রাকৃতিক যত সব বাধাবিপত্তি দূর করে বিভেদ ও অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য আনে। কবিরা ছাড়া আর কে ছন্দের নৃত্যের দ্বারা বিশ্বের অপরিবর্তনীয় জীবনধারার মধ্যে বৈচিত্র আনে? একমাত্র কবিরাই প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষকে বিশাল বিশ্বজীবনের সঙ্গে যুক্ত করে। সকলকে এক মধুর মিলনের মধ্যে আবদ্ধ করে একসঙ্গে মিলে মিশে থাকতে প্রেরণা দেয়। কবি ছাড়া আর কে মানুষের বিষাদগ্রস্ত অন্তরে সহসা নিয়ে আসে বিক্ষুব্ধ কামনার ঝড়? প্রেমের উজ্জ্বল পথে কবি ছাড়া আর কেই বা বসন্তের ফুল ছড়ায়, একমাত্র কবিরাই সামান্য গাছের পাতা দিয়ে তৈরি মুকুটকেও রাজমুকুটের গৌরব দান করতে পারে। এতিয়নের প্রান্তরের মতো উষর মরুভূমির মাঝেও ফুল ফোঁটাতে পারে। তাদের কল্পনার শক্তি দিয়ে দেবতাদের দ্বারা অধর্ষিত স্বর্গের অলিম্পাসকে তারাই জীবন্ত করে তুলতে পারে। চারণ কবিরা যুগে যুগে মানুষের কীর্তি ও মহত্ত্বকে অমর করে রাখে, বর্ণনার দ্বারা সজীব করে তোলে তাদের। 

মেরি অ্যান্ড : সুতরাং এই সব সূক্ষ্ম শক্তিগুলোই সম্মিলিতভাবে উচ্চতর কবি প্রতিভাকে চালিত করে। এই সব সূক্ষ্ম শক্তিগুলোই কবিদের হৃদয়ে ক্ষণে ক্ষণে নিয়ে আসে আনন্দ-বেদনার ঝড়। ঠিক যেমন প্রেমের ব্যাপারে হয়। প্রেমের ক্ষেত্রে একটি পরিষ্কার রোমান্সের ঘটনা ঘটে যায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের জীবনে। প্রথমে দুজনের দেখা-সাক্ষাৎ, পরে সঙ্গপ্রবণতা, এইভাবে দুজনের অন্তর অপনা-আপনি আবদ্ধ হয়ে পড়ে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে। প্রথমে আনন্দ, পরে বেদনায় জর্জরিত হয় উভয়ের অন্তর। এই ধরনের প্রেমকাহিনী সম্বলিত একটি নাটক উপহার দিতে পার দর্শকদের। যে জীবন অসংখ্য মানুষ অহরহ যাপন করছে সেই জীবনের এক পূর্ণাঙ্গ রূপকেও ফুটিয়ে তুলতে পার নাটকে। প্রতিটি মানুষ যে জীবনযাপন করছে সেই জীবন যখন শিল্পে বা কাব্যে তুলে ধরা হয় তখন খুব কম লোকেই বুঝতে পারে সে জীবনের কথা। বিচিত্র রং ও রূপের ছবিতে জীবনকে শিল্পীরা উপস্থাপিত করেন তাতে সত্যের আলোর থেকে ভুলের কালিমাই থাকে বেশি। তবু জগতের লোকে শিল্প বা সাহিত্যবর্ণিত সেই জীবন কাহিনীকে উপভোগ করে। এইভাবে নাটকের মধ্যে এমন অনেক ভালো উপাদানও পরিবেশন করতে পার যার থেকে লোকে আনন্দের সঙ্গে কিছু শিক্ষাও পেতে পারে। আবার দেখবে তোমার এই নাটক দেখে কত সুন্দর সুন্দর যুবক-যুবতী সংযত করতে শিখছে তাদের প্রমত্ত যৌবনের উদ্দাম গতিবেগকে। ভাবাবেগপ্রবণ তরুণ-তরুণীরা কত বিষাদের উপাদান খুঁজে পায় এই সব নাটকে। 

আসল কথা, বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন দর্শক তাদের আপন আপন প্রবৃত্তি ও রুচি অনুসারে বিভিন্ন রকমের উপাদান খুঁজে নেয় একই নাটক থেকে। কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউ বা তোমার কল্পনার প্রসারতা ও ঔদ্ধত্য দেখে বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে পড়ে। তবে সকলেই যে নাটকের নাট্যরস উপভোগ করে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মনের ধাতু একবার গঠিত হয়ে গেলে পরে আর পরিবর্তিত বা অন্য পরিবেশে খাপ খায় না। তাই তরুণদের উপর নাট্যবস্তুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। 

কবি : তাহলে আমাকে আবার সেই বিগত যৌবনের আনন্দোচ্ছল দিনগুলো ফিরিয়ে দাও। যখন আমি মনের আনন্দে গান গাইতাম আর স্বতোৎসারিত ঝর্নাধারার মতো অসংখ্য সুললিত সাবলীল ছন্দের স্রোত অবাধে অপ্রতিহত বেগে বেরিয়ে আসত আমার মন থেকে। সেদিন এক শুচিশুভ্র কুয়াশার মোহপ্রসারী অবগুণ্ঠন সতত আচ্ছন্ন করে রাখত আমার সামনের জগৎটাকে। সেদিন বনে প্রান্তরে উপত্যকায় যেদিকেই তাকাতাম সেদিকেই দেখতাম অজস্র অচিরোদগত কুসুমকোরক অস্ফুট লাবণ্যে টলমল করছে, অমিত পরিমাণে এক স্বর্গীয় সুবাস ছড়াচ্ছে চারদিকে। এক তরল বিস্ময়ে ভরে যেত আমার মন। যৌবনে মানুষের এমনিই হয়। কিছু না পেয়েও সব পেয়ে যেতাম আমি। ভ্রান্ত অথচ এক মধুর আনন্দে সত্যানুসন্ধানের এক আবেগোেচ্ছাসে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হয়ে উঠত আমার হৃদয়, আমার সমস্ত প্রাণমন। আমাকে আবার সেই অতীতের অবাধ আনাবেগকে ফিরিয়ে দাও যার যাদু স্পর্শে মধুর হয়ে উঠত আমার জীবনের সমস্ত বেদনা, ঘৃণা, ভক্তি, ভালোবাসা। আমার সেই হারিয়ে যাওয়া যৌবনকে ফিরিয়ে দাও। 

মেরি অ্যান্ড : হা বন্ধু, যুদ্ধক্ষেত্রে যখন শত্রুরা এগিয়ে আসছে তোমার দিকে তখন অবশ্যই যৌবনের শক্তি তোমার প্রয়োজন। যখন সুন্দরী যুবতীরা এক মধুর কামনার আবেগে ঢলে পড়ছে তোমার বুকে, আদরে চুম্বনে বিব্রত করে তুলছে তোমায় তখন দূরস্থিত লক্ষ্যস্থলবর্তী কষ্টার্জিত এক জয়মালা এক নীরব উজ্জ্বলতায় প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্য। যখন একের পর এক নৃত্যোচ্ছল বিনিদ্র যামিনী যাপন করতে হয় শ্বাসরুদ্ধ হৃদয়ে তখন অবশ্যই যৌবন তোমার একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু হে প্রৌঢ় কবি মহাশয়, তোমার হৃত যৌবনের পুনরুদ্ধারের আশা ত্যাগ করে তোমার বর্তমানের স্বাভাবিক সৃষ্টিশক্তিকে সম্বল করেই একটি সুনির্বাচিত লক্ষ্যকে খাড়া করে এগিয়ে যেতে হবে সাহসের সঙ্গে। তোমার প্রকাশনৈপুণ্য ও সৃষ্টকর্মে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে। কিন্তু তার জন্য আমরা কিছুমাত্র কম শ্রদ্ধা করব না তোমায়। লোকে বলে বার্ধক্য শিশুসুলভ নির্বুদ্ধিতা নিয়ে আসে, বলে বৃদ্ধ বয়সে শিশু হয়ে ওঠে মানুষ। কিন্তু একথা ঠিক নয়। আমি বলি বার্ধক্যের সুপক্ক ও সুপরিণত অভিজ্ঞতায় সিদ্ধ হয়েই আমরা বয়োবৃদ্ধরা প্রত্যেকে প্রকৃত শিশু হয়ে উঠি। প্রকৃত শিশুর মতো সরল এবং সৎ হয়ে উঠি মনে-প্রাণে। 

ম্যানেজার : অনেক কথা বলেছ তোমরা দুজনেই। এবার আমি কাজ চাই। যুক্তিজালমণ্ডিত বাক্যবিস্তারে দুজনেই সিদ্ধ তোমরা। এবার প্রকৃত শক্তির পরিচয় দিয়ে কাজের কাজ করো। প্রেরণার কথা বলে সময় নষ্ট করে কি লাভ? কোনও অভাব কখনও বিলম্বের সঙ্গত অজুহাত হিসাবে গণ্য হতে পারে না। কাব্যরচনা যদি তোমার পেশা হয় তাহলে কাব্য অবশ্যই তোমার ইচ্ছা ও আদেশ মেনে চলবে। তুমি ভালোভাবেই জান কি ধরনের নাটক এখানে দরকার। এখানকার দর্শকসাধারণ চায়। কড়া মদের মতো এমন এক ধরনের নাট্যরস যা তাদের সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেবে। এবং আমিও তোমাক সেই ধরনের নাটক লিখতে অনুরোধ করি। আজ যদি এ ধরনের নাটক লেখা না হয় তাহলে আজকের এ প্রয়োজন কখনও ভবিষ্যৎ মেটাবে না। সুতরাং বৃথা বাক্যব্যয়ে আর একটি দিনও নষ্ট না করে মনের মধ্যে সদ্যসম্ভুত প্রতিটি ভাবের সদ্ব্যবহার করে সাহস ও সঙ্কল্পের সঙ্গে কাজে নেমে পড়ো। এ কাজ তোমাকে করতেই হবে, কারণ এটাই তোমার জীবিকা। তুমি জান আমাদের জার্মান দেশের মঞ্চ জগতের বর্তমান অবস্থা। সেখানে ইচ্ছামতো যে যা খুশি নাটক লিখে বা মঞ্চস্থ করে যাচ্ছে। সুতরাং তুমি তোমার ইচ্ছামতো নাট্য-উপাদান সংগ্রহ করে নাটক লিখে ফেলো। ঈশ্বর প্রদত্ত কবি-কল্পনার আলো অল্প-বিস্তর প্রয়োগ করে প্রয়োজন মতো নাট্যচরিত্র সৃষ্টি করে পশু পাখি, পাহাড়, পর্বত, জল, আগুন, অন্ধকার, দিন-রাত্রি প্রভৃতি সব কিছুর থেকেই উপাদান গ্রহণ করে বিশাল বিশ্বসৃষ্টির অনুরূপ এমন এক নাট্যজগত সৃষ্টি করতে পার যা সুদূর স্বর্গালোক হতে কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে মর্ত্যলোকে নেমে এসে সে লোক ভেদ করে নরক পর্যন্ত গমন করবে অর্থাৎ স্বর্গ, মর্ত্য, নরক ত্রিভুবন প্রতিভাত ও প্রকটিত হয়ে উঠবে সে নাটকে। 

স্বর্গলোকের অবতরণিকা

ঈশ্বর ও স্বর্গের দেবতাবৃন্দ 

মেফিস্টোফেলিস

(তিনজন প্রধান দেবদূতের আবির্ভাব)

রাফায়েল : সূর্য তার আপন কক্ষপথে অন্যান্য গ্রহনক্ষত্রদের সঙ্গে অনন্তকাল ধরে আবর্তিত হয়ে চলেছে। এ পথ যেদিন তার শেষ হবে সেদিন এক মহাপ্রলয় নেমে আসবে সর্বধ্বংসী বজ্রপাতে। সেই সৌরলোক হতে দেবদূতের তাদের আপন আপন। যে শক্তি সঞ্চয় করে তার পরিমাণের কথা কেউ বলতে পারে না। এই বিশ্বসৃষ্টির নির্মাণ পদ্ধতি এমনই সূক্ষ্ম সুজটিল ও মহান যে তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। এই সৃষ্টির উজ্জ্বলতা প্রথম দিন হতে আজ পর্যন্ত ম্লান হয়নি কিছুমাত্র। 

গ্যাব্রিয়েল : এই বিশ্বসৃষ্টি তার অমিত-ঐশ্বর্যসম্ভার নিয়ে এত দ্রুত তার কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে যে তার গতিবেগ অকল্পনীয় প্রতীত হয় প্রতিটি মানুষের কাছে। ভয়াবহ রাত্রির গুমোট গভীর অন্ধকারের পর দিবসকালের স্বর্গীয় উজ্জ্বলতার তপ্ত আস্বাদন পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মানুষ। শুভ্রফেশীর্ষ সমুদ্রতরঙ্গমালা অটল পর্বতমালার নিষ্ঠুর পাদদেশে বারবার প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়। বিশ্বের দুটি গোলার্ধ আর তার মানুষ এক অনাদ্যন্ত চক্রবর্তনে বিমূর্ণিত হচ্ছে ক্রমাগত। 

মাইকেল : এই বিশ্বসৃষ্টির মাঝেই চলছে ধ্বংসের লীলা। কখনও সমুদ্রবক্ষ হতে স্থলভাগে, আবার কখনও বা স্থলভাগ হতে সমুদ্রবক্ষে প্রতিকূল বাতাসের ঘনীভূত রূপ প্রচণ্ড ঝঞ্জার উন্মত্ত আলোড়নে ফুলে ফুলে ওঠে। ক্ষান্তিহীন ধ্বংসের তাণ্ডব একের পর এক ফেটে পড়ে ভয়াবহ ক্রোধাবেগে। কোথাও বজ্রাগ্নিপ্রজ্বলিত বিরাট অগ্নিকাণ্ড বিধ্বস্ত করে দেয় অনেক কিছু। তথাপি হে ঈশ্বর, হে প্রভু, তোমার দূতেরা তোমার সৃষ্টিলীলার প্রশংসা করে চলেছে। 

তিনজন একসঙ্গে : যদি দেবদূতেরা নিজেরা বিশ্বসৃষ্টির দুর্বোধ্য রহস্যজাল ভেদ করতে পারে না, তথাপি তারা হে ঈশ্বর, তোমারই সৃষ্ট সৌরলোক হতেই সঞ্চয় করে তাদের সমস্ত শক্তি। হে ঈশ্বর, তোমার এই বিশাল বিশ্বসৃষ্টি চির ঐশ্বর্যবর্তী যুবতী। সেই আদিকাল হতে তার অক্ষয় উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে পড়েনি আজও। 

মেফিস্টোফেলিস : হে ঈশ্বর, যেহেতু আমার মতো এক অধমের উপর সদয় হয়ে আমরা এই পৃথিবীতে এখন কেমন আছি তা জানতে চেয়েছ সেই হেতু এখন আমার মুখটা দেখো। আমাকে ক্ষমা করো। আর আমি এই সব হীন মানুষদের নিয়ে পারছি 

। ওরা আমায় ঘৃণা করে, অবজ্ঞার চোখে দেখে। তবু আমি ওদের মহান ভাব সমন্বিত বড় বড় কথা বলে ওদের বোঝাতে পারি না। আমার এই সব দুঃখের সকরুণ কথাগুলো নিশ্চয় তোমার মধ্যে হাসি জাগাবে। আনন্দ বা হাসিখুশির তো অভাব নেই তোমার জীবনে। তা তোমার বেশই জানা আছে। আমি কিন্তু আমাদের অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে সৌরলোক বা বিশ্বপ্রকৃতির কথা কিছু বলব না। বলব শুধু মানুষের সেই সব দুঃখকষ্টের কথা যা আমি নিজের চোখে দেখেছি। এই মানবজগতের একটি নিজস্ব দেবতা আছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে সে দেবতা আপন মতে চলে আসছে একই পথে। যদি তুমি তোমার স্বর্গীয় আলোর একটি উজ্জ্বল রশ্মি সে দেবতাকে না দিতে তাহলে জীবনটা তার কাছে আর একটু বেশি আনন্দদায়ক ও বেশি উপভোগ্য হতো। মানুষ বলে সে দেবতা হলো যুক্তি। বলে এই যুক্তিবোধ হতে শক্তি সঞ্চয় করে বড় হয়েছে তারা। বড় হয়েছে মানে পশুর থেকেও হীন হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার সুমহান সর্বব্যাপী উপস্থিতি ছাড়া এই বিশ্বজগৎ ও জীবনের কোনও অর্থ নেই। তুমি ছাড়া মানুষকে আমার দৃষ্টিতে লম্বা লম্বা ঠ্যাংওয়ালা ফড়িং বলে মনে হয়, সে ফড়িং ঘাসের বনে আর ঝর্নার ধারে চিরদিন ধরে সেই একই গান গেয়ে বেড়ায়। সেই ঘাসের বনে নাক ডুবিয়ে মানুষ কি আজও শুধু গোবরের দানা খুঁজে যাবে? 

ঈশ্বর : তোমার কি আর কিছু বলার নেই? এইরকম কুমতলব নিয়ে কেন এসেছ? এই বিরাট পৃথিবীতে ভালো ও চিন্তন কিছু পেলে না? 

মেফিস্টোফেলিস : না প্রভু! আমি পৃথিবীতে সব কিছু আগের মতোই খারাপ দেখছি। মানুষের দুঃখ আমার মতো শয়তানের হৃদয়কেও বিগলিত করে তুলেছে। এই সব হতভাগ্য মানুষদের নতুন করে দুঃখ দিতে আমার প্রাণ চায় না। 

ঈশ্বর : তুমি ফাউস্টকে চেন?

মেফিস্টোফেলিস : ডাক্তার ফাউস্ট?

ঈশ্বর : হ্যাঁ, আমার সেবক। 

মেফিস্টোফেলিস : তা বটে! সে কিন্তু অদ্ভুতভাবে তোমার সেবা করে। তাকে যত বেশি পরিমাণেই মাংস বা মদ দাও না কেন সে তাতে তৃপ্ত হবে না। কিন্তু তার চির উত্তপ্ত চিত্তের আশা আরও অনেক কিছু চাইবে। সে তার উন্মত্ত অশান্ত চিত্তাবস্থায় অর্ধাবগুণ্ঠিত চেতনায় অনেক সময় দূর আকাশের সুন্দরতম নক্ষত্রকেও কামনা করে বসবে। লঘু ও সর্বাপেক্ষা আরামদায়ক আমোদপ্রমোদ ছাড়া দূরস্থিত ও নিকটস্থ এমন অনেক কিছু ভোগ্য দ্রব্যকে সে চায়। কিন্তু কোনও কিছুই তার বিক্ষুব্ধ বুকের উত্তাল কামনারাশিকে তৃপ্ত অবদমিত করতে পারে না। 

ঈশ্বর : যদিও এখনও পর্যন্ত আমার প্রতি তার সেবার নিষ্ঠা ও একাগ্রতায় সন্দেহের অবকাশ আছে তথাপি শীঘ্রই আমি তাকে সমস্ত অশুভ শক্তির তমিস্রাবসানে এক উজ্জ্বল প্রভাতের আলোয় নিয়ে যাব। যে বাগানের গাছে গাছে ফুল ফোঁটাবার জন্য। কুঁড়িগুলোকে প্রস্তুত করে তুলছে সে বাগানের মালীকে সে আজও দেখেনি। অদূর ভবিষ্যতে সে ফুল ও ফল একই সঙ্গে পাবে। সে ফুলে ও ফলে সমৃদ্ধ ও শোভিত হয়ে উঠবে তার ভবিষ্যৎ জীবন। 

মেফিস্টোফেলিস : কি বাজি তুমি রাখবে প্রভু তুমি তাকে ভালো করতে পারবে না। তবে তাকে উদ্ধার করার, শোধন করার একটা মাত্র পথ আছে। সে পথ হুলো তাকে আমার উপর ছেড়ে দেওয়া। আমার মতে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবার জন্য যদি আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দাও তাহলেই তার পুনর্জীবন সম্ভব। 

ঈশ্বর : যতদিন সে পৃথিবীতে জীবিত থাকবে আমি তাকে কোনও বিষয়ে বাধা দেব না। কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করব না তার উপর। মানুষ জীবনে যতদিন কামনা-বাসনার দ্বারা চঞ্চল হবে ততদিন সে ভুল করবেই। কামনা কবলিত মানুষ ভুল না করে। পারে না। 

মেফিস্টোফেলিস : ধন্যবাদ। আমি কোনও মৃত ব্যক্তির আত্মাকে চাই না। তাতে আমার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি চাই জীবন্ত মানুষকে যার গণ্ডভিত্তিক উজ্জ্বল ত্বকের উপর লাল তাজা রক্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে। যখন কোনও মৃতদেহ আমার বাড়ির কাছ দিয়ে তখন মনে হয় যেন কোনও ইঁদুর কোনও বিড়ালের দ্বারা নিহত হয়েছে। 

ঈশ্বর : যথেষ্ট হয়েছে। তুমি যা চেয়েছিলে তা পেয়েছ। তার মাথা থেকে তাহলে বর্তমানের যত সব সুবুদ্ধি ও যুক্তিবোধ অপসারিত করে দাও। তার পরিবর্তে তার মাথায় পেতে দাও তোমার অশুভ শক্তির ফাঁদ। তাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি আরও নিচে নেমে যাও। তারপর একসময় তুমি নিজেই লজ্জা পাবে। দেখবে তার যত সব জটিল অতৃপ্ত কামনা-বাসনা সত্ত্বেও আসলে লোকটা ভালো। ন্যায়পথে, সৎপথে চলার এক নিগূঢ় প্রবৃত্তি আজও রয়ে গেছে তার বাসনাবিক্ষুব্ধ চিত্তের তলায়। 

মেফিস্টোফেলিস : রাজি। কিন্তু এটা আমার পক্ষে স্বল্পকালের কাজ। এজন্য আমি কোনও ভয় করি না। যদি আমি আমার আশানুরূপ কাজ করতে পারি, যদি আমি সফল হই তাহলে যেন বিজয়গৌরব আমার বুকটাকে স্ফীত করে তুলল। আমার এক নিকট আত্মীয় যেমন একবার হাসিমুখে আমার পায়ের ধুলো চেটেছেন সেও তাই করবে। 

ঈশ্বর : এ ব্যাপারে যা ভালো বোঝ করো। এ বিষয়ে তুমি স্বাধীন। তোমার মতো আর কোনও আত্মা আমার মধ্যে এতখানি ঘৃণা সঞ্চার করেনি। তোমার মতো আরও যে সব দুঃসাহসী নাস্তিক শয়তান আছে তারা কেউ আমাকে এতখানি বিরক্ত করেনি কখনও। নিয়ত ক্রিয়াশীল মানুষের স্বরূপ এমনই যে তার চিত্ত কামনায় মাঝে মাঝে উত্তাল ও অশান্ত হয়ে উঠলেও আসলে সে চিত্ত শান্তি চায়। নিঃশর্ত শান্তি। সে অশান্ত চিত্ত শীঘ্র শান্ত হয়ে ওঠে; যে মানুষ মাঝে মাঝে কামনা-বাসনায় উত্তেজিত হয়ে। শয়তানের মতো কাজ করে অনেক কিছু অশুভ বস্তু ও ঘটনা সৃষ্টি করে তাকেও আমি শান্তি দিই। কিন্তু যারা ঈশ্বরের প্রকৃত সন্তান, কর্তব্যপরায়ণ ও প্রেমময়, সেই তোমরা সকলে একমাত্র যা কিছু অক্ষয় ঐশ্বর্য ও অনন্ত সৌন্দর্যে ভরা সেই সব বস্তুকেই উপভোগ করবে, কামনা করবে। এমন সৃষ্টিশীল শক্তির উপাসনা করবে যার দ্বারা চিরন্তন কিছু সৃষ্টি করে যেতে পারবে। চঞ্চল উচ্চাশার বিকম্পিত প্রেক্ষাপটে যা কিছু উজ্জ্বল মনে হয় সেই সব আপাত-উজ্জ্বল বস্তুর জায়গায় সুচিরকালীন অক্ষয় ভাবসত্যগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করো। 

(স্বর্গদ্বার রুদ্ধ হয়ে গেল : পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল প্রধান প্রধান দেবদূতেরা।) 

মেফিস্টোফেলিস (একাকী) : যে কথা শাশ্বত সনাতন তা আমার এক এক সময় বড় ভালো লাগে। তখন আমার ইচ্ছা জাগে আমি যেন খুব ভালো ও ড্র হয়ে উঠি। আমার মতো এক শয়তানের সঙ্গে মানুষের মতো কথা বলা মহান ঈশ্বরের পক্ষে কত বড় দয়া ও মহানুভবতার কাজ তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *