প্রসঙ্গ কথা / ভূমিকা

প্রসঙ্গ কথা

আমরা গ্যেটের রচনাসমগ্র প্রকাশ করছি। বিশ্বের ধ্রুপদী সাহিত্যের যে সিরিজ প্রকাশনার সংকল্প করেছি তার অন্যতম এই রচনাসমগ্র। মহামতি গ্যেটের রচনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে একটা শতাব্দীকাল সময়ের ভাবনার সাথে পাঠকের অসম্পৃক্ততা থেকে যাবে। ইউরোপে এমন এক ক্রান্তিকালে গ্যেটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন–যে সময় গির্জা ও যাজকদের ছিল অপ্রতিবোধ্য দাপট। ভালোমন্দ যাই হোক তাদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেশের রাজন্যবর্গেরও সাধ্যে কুলাতো না। ইতোপূর্বে গির্জার সিদ্ধান্তে বিশ্ব স্বীকৃত মহান মানুষদেরও কারাভোগ, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। অনেককে অগ্নিদগ্ধ কিংবা বিষ পান করিয়ে জীবন হনন করাও হয়েছিল। প্রাচীন দুটি গ্রন্থ ফ্রাংকফুট ফাউস্ট বুক এবং ট্র্যাজিক্যাল হিস্ট্রি অব ডকটর ফন্টাসে থেকে গ্যেটে ফাউস্টের অভূতপূর্ব জীবনকাহিনী অবগত হন। প্রথাগত ধর্মের আচার-আচরণের বাইরে বেরিয়ে আত্মস্বাতন্ত্রের বিশাল প্রান্তরে জীবনের জয়গান গেয়েছেন যাঁরা তাঁদের সকলের প্রতিই গ্যেটের সীমাহীন শ্রদ্ধা ছিল। ফাউস্ট সেই চিন্তার ফসল। ফাউস্ট ও মেফিস্টোফেলিস বিপরীত প্রান্তের দুটি প্রতীক-যথাক্রমে তারা শুভ ও অশুভের পতাকাবাহী। সত্যের বিরুদ্ধে অসত্য তা–সে যতবড় ক্ষমতাধারী হোক না কেন কোনো কালেই বিজয়ী হবে না ‘ফাউস্ট’ গীতিকাব্য মানুষের সম্মুখে এই উদাহরণ স্থাপন করেছে। তাই ফাউস্ট না জানলে মানব জীবনের সার সত্যটি জানা দুষ্কর। 

প্রথাবদ্ধ ধর্মের ধ্বজাধারীরা যখন প্রবল বিক্রমে ইউরোপে আধিপত্য বিস্তার করেছিল–সেই সময়ের জাতক মহামতি গ্যেটের মনে সংশয়বাদের উদ্ভব হয়। এরজন্য তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি। ফাউস্টের দুটি খণ্ড রচনা করতে তার প্রায় তিরিশ বছর সময় ব্যয় করতে হয়। দীর্ঘ সেই সময়ে দেশ, কাল, প্রথা ও জীবনযাপনে, নিত্য-প্রক্রিয়ায় তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে প্রতিদিনই। 

ফাউস্টের ভূমিকায় অনুবাদক অতি সত্য যে কথাটি বলেছেন–তাহলো বিজ্ঞান আজকের মানুষকে যে ক্ষমতা দান করেছে, মানুষ সে শক্তির সীমাকে মানতে চাইছে না। অসাধ্য সাধনের যে উদ্ধত প্রয়াস মানুষের জ্ঞান ও শক্তিগত সীমাকে অস্বীকার করে আধুনিক মানুষের আত্মার সংকটকে ঘনীভূত করে তুলেছে, দ্বিধাবিভক্ত করে তুলেছে তার অন্তরাত্মাকে, মেফিস্টোফেলিস হলো সেই প্রয়াসের প্রতীক। ফাউস্টের মতো আমরা যখন বুঝতে পারি–আমাদের কর্মময় সংগ্রামশীল-আত্মশক্তির বৃথা অপচয় করে-সীমাহীন-তলহীন উদ্দেশ্যহীন শূন্যতার মাঝে যে অলীক নিশ্চয়তাকে হাত প্রসারিত করে ধরতে যাচ্ছি সে নিশ্চয়তা হলো আত্মপ্রতারণারই নামান্তর। তখন আর কোনো উপায় থাকে না। সারা জীবনের সকল ভ্রান্তির প্রান্তসীমায় এসে আমরা যখন উপস্থিত হই তখন দেখতে পাই-দিগন্ত যেথায় উদ্ভাসিত তিমিরাবৃত মৃত্যুর এক ভয়াল মূর্তি–মৃত্যু তো অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়। দেখি–ক্লান্ত জীবনের একদার বহমান নদীটি আগেই ঢলে পড়েছে কুয়াশালীন-সমুদ্রের গভীর ইন্দ্রনীল কোলে। এরচেয়ে চরম সত্য আর কী হতে পারে। 

আয়রন হ্যান্ড ও এগমঁত সার্থক ট্রাডেজি নাটক। সমকালীন-রাজনৈতিক সংকট এর পটভূমি হলেও আজও তার আবেদন শেষ হয়ে যায়নি–কখনো যাবেও না। প্রথম নাটকটির নায়ক ভরসা স্থাপন করেছে বিপ্লবী-অশিক্ষিত অসংযত কৃষকদের ওপরে। একান্তভাবে সে বিশ্বাস করেছে তার শক্তি সামর্থ-সততা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ঐ কৃষকরা বিনা দ্বিধায় মেনে নিবে। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টো। মানুষ অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় যতবড় অশিক্ষিত হোক-পৃথিবীর পাঠশালা তাকে যে কিছু শিক্ষা দিতে পারে সেই সত্য এখানে দেদীপ্যমান আভায় উদ্ভাসিত হয়েছে। মানুষ সাদা দৃষ্টিতে যাকে মূর্খ মনে করে-প্রকৃতভাবে সে তা নাও হতে পারে।

এগমঁত এক দুঃসাহসী বীরের কাহিনী। স্পেনীয়-সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডবাসীদের বিদ্রোহ। সমকালীন ইতিহাসের এটা এক প্রত্যক্ষ দলিল। তার প্রতিটি রচনাই জীবনধর্মী ও হৃদয়গ্রাহী। গ্যেটের জীবনকাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত যে সত্য সূর্যকিরণের মতো জাজ্বল্যমান তাহলে কোনো স্বৈরাচারী দুর্ধর্ষ শাসকের কাছে গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা বা অধিকারের কোনো মূল্য নেই। কতকাল আগে কতবড় সত্য তিনি মানুষের সামনে উপস্থিত করলেন তা বিস্ময়কর নয়কি! 

সগ্রামী এই মহান লেখক জীবনের পথ পরিক্রমায় অনেক আলোকিত রাজপথ ছায়ান্ধ গলিপথে হেঁটেছেন একাধারে জীবনের জয়গান ও যেমন গেয়েছেন একেকসময় জীবন থেকে পালাতেও চেষ্টা করেছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে তার বলা আমি কোথায় চলেছি-তা আমি জানি না। শৈশব হতে বাল্যে, বাল্য থেকে যৌবনে আমার সারা জীবন ধরে কী খুঁজে চলেছি? পাহাড়ে প্রান্তরে, জলে-স্থলে, সুন্দরে-অসুন্দরে, রূপে অরূপে, ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয়ের মাঝে কি খুঁজেছি আমি? যা খুঁজেছি তা কি আমি পেয়েছি কোনোদিন! তাকি কেউ পায়? গাড়ি এগিয়ে চলেছে। চালকের হাতে লাগাম ধরা। আমার মনে হলো, কোনো এক অদৃশ্য দেবতার দ্বারা প্রহৃত হতে হতে অবিরাম কালের অশ্ব ছুটে চলেছে সারা বিশ্ব জীবনের বিপুলায়তন বেগভার নিয়ে। সেই আশ্চর্য অশ্বের লাগাম ধরার শক্তি সবার নেই। হয়তো কোনো মানুষের নেই। তবু মানুষের মতো বাঁচতে হলে সে লাগামটা শক্ত মুঠিতে ধরে রাখতেই হবে। জীবনের সার সত্য জানতে হলে গ্যেটের রচনার সাথে পরিচিত হওয়া আবশ্যক-সেই তাগিদেই আমাদের এহেন উদ্যোগ। পাঠক যদি তাতে সামান্যতম উপকৃত হন আমাদের পরিশ্রম সার্থক বলে মনে করব। 

তপন রুদ্র 

ভূমিকা 

কবিতা, নাটক, গল্প-উপন্যাস প্রভৃতি সাহিত্যের বিচিত্র খাতে গ্যেটের প্রতিভা সমান সাবলীলতার সঙ্গে প্রবাহিত হলেও তাঁর অমর কাব্য-নাটক ফাউস্ট তাঁর এমনই এক শীষস্থানীয় সৃষ্টি যার জন্য এক বিশ্ববিশ্রুত মর্যাদায় আজও অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। তিনি। দান্তে এবং মিলটনের মতো গ্যেটেও শুধু একটি বিশেষ সৃষ্টির জন্যই এক সুচিরকালীন আবেদনের অক্ষয় গৌরবতিলকে পরিচিহ্নিত হয়ে আছেন আজও। ফাউস্টের আবেদনের এই অন্তহীন বিপুলতা ও বিশ্বজনীনতার প্রধানতম কারণ এই যে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ হতে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এক শতাব্দীকাল ধরে যে যুগমানস আধুনিক ভাবধারা ও জীবনাদর্শের প্রেক্ষিতটিকে গড়ে তোলে সে যুগমানসটিকে তার আনুষঙ্গিক আত্মিক সমস্যা ও সংকটসমূহের সঙ্গে এই কাব্য নাটকটির মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিভাত করে তোলেন গ্যেটে। 

ইউরোপীয় নবজাগরণ সত্যানুসন্ধিৎসার এক সুতীব্র সার্চলাইট ফেলে যুগান্তব্যাপী কুসংস্কারের অন্ধকার ছিন্নভিন্ন করে মানুষের স্বাধীন চিন্তার বিকাশের পথে বাধাগুলোকে অপসারিত করতে থাকে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও বিজ্ঞানজনিত যুক্তিবাদ এক বিরাট ব্যাপ্তি দান করে সে অনুসন্ধিৎসার আলোকে। গ্যেটে যে যুগের আবহাওয়ায় মানুষ হন সে যুগের আকাশে-বাতাসে জীবনজিজ্ঞাসার এক সর্বব্যাপী আবেগ ভেসে বেড়াত অশান্ত তীব্রতায়। লিপজিগ ও স্ট্রসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা ধীরে ধীরে সংশয়বাদের দিকে নিয়ে যায় তাঁর মনকে। প্যারাসেলসাস ও ব্রুনোর প্রকৃতিবাদী দর্শনের দ্বারা বেশকিছুটা প্রভাবিত হয়ে ধর্মগত সত্যের সর্বাত্মকতায় ও সার্বভৌম ক্ষমতায় সন্দিহান হয়ে ওঠে তার মন। ধর্মের প্রথাগত নিরাপদ সীমার মধ্যে জীবন ও জগতের যে সত্য একদিন এক সুস্থিত অস্তিত্বে প্রকটিত ও এক সুদীর্ঘকালীন নিশ্চয়তার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল সে সত্যের ভাবমূর্তিটিকে এক সুতীক্ষ্ণ প্রশ্নের শায়ক দিয়ে বার বার বিদ্ধ করতে থাকেন গ্যেটে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় এই সময় বলেন তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী হলেও ধর্মান্থতা পছন্দ করেন না। 

১৫৮৭ সালে প্রকাশিত ফ্রাঙ্কফুট ফাউস্ট বুক’ ও মার্লোর লেখা ‘ট্রাজিকাল হিস্ট্রি অফ ডক্টর ফস্টাসে’ ফাউস্টের উদ্ভুত জীবনকাহিনী পড়ে ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন গ্যেটে। শুধু ফাউস্ট নয়, যে সব পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পুরুষপ্রবর তাঁদের সুমহান ব্যক্তিত্বের আশ্চর্য বলিষ্ঠতাটিকে প্রথাগত ধর্মের একাধিপত্য হতে মুক্ত হতে প্রচলিত মূল্যবোধকে হেলাভরে অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করে আত্মস্বাতন্ত্রের উদার উন্মুক্ত আকাশে মাথা তুলে এক অন্তহীন স্পর্ধায় দুহাত বাড়িয়ে জীবনের সত্যকে নূতনভাবে বুঝতে চেয়েছেন, জীবন ও জগৎকে নূতনভাবে বুঝতে চেয়েছেন, সেই প্রমিথিয়ুস, সিজার, মহম্মদ প্রমুখদের দ্বারাও আকৃষ্ট হয়েছেন তিনি। তাঁদের নিয়ে কিছু না কিছু লিখতে চেয়েছেন। 

যে ফাউস্টের অদ্ভুত জীবনকাহিনী আকৃষ্ট করেছিল গ্যেটের মনকে, সে ফাউস্ট কিন্তু নিছক কল্পনার সৃষ্টি নন, তিনি হলেন জার্মানির ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের নেতা মার্টির লুথারের সমসাময়িক এক রক্ত-মাংসের মানুষ। মোড়শ শতকের ইউরোপে প্রথাগত ক্যাথলিক ধর্মের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে যে বিপ্লব দেখা দেয়, সুগভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের সাধক ডক্টর জর্জ ফাউস্ট ছিলেন সেই বিপ্লবের মূর্ত প্রতীক। তাঁর চিন্তার স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা ছিল অসাধারণ। তিনি আবার মধ্যযুগীয় রসায়নবিদ্যা ও যাদুবিদ্যায় ছিলেন পারদর্শী। একই ধাতুকে অন্য এক ধাতুতে রূপান্তরিত করার রহস্য আয়ত্ত করার ফলে তিনি একই সঙ্গে প্রকৃতি জগত ও মানব জগতের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা বিস্তার করে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেন। যে ক্ষমতা একান্তভাবে ঈশ্বরের করতলগত, যা কোনও মানুষ অর্জন করতে পারে না অথবা করাটা নীতি ও ধর্মসম্মত নয় তার পক্ষে, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস হারিয়ে শয়তানের কাছে তার আত্মাকে হীনভাবে বিক্রি করে সেই ক্ষমতা অর্জন করেন ফাউস্ট। এর জন্য ঐশ্বরিক অভিশাপও নেমে আসে তার জীবনে। এইভাবে দেখা যায়, মধ্যযুগের ফাউস্টকে নিয়ে যে কবিতা, নাটক লেখা হয় তার মূল পরিকল্পনার সঙ্গে খ্রিস্টীয় পাপচৈতন্য ও নাস্তিকের শাস্তিভভাগের ব্যাপারটি যুক্ত হয়। 

কিন্তু যুক্তিবাদী আবহাওয়ায় লালিত গ্যেটের মন অপরাজেয় পৌরুষের প্রতীক ফাউস্টের মতো অসাধারণ পুরুষের জীবনকাহিনীর সঙ্গে খ্রিস্টীয় পাপপুণ্যতত্ত্বকে যুক্ত করে দেখার রীতিটিকে মেনে নিতে পারে না কিছুতেই। গ্যেটে ফাউস্টকে দেখেন অন্য দৃষ্টিতে। তার জীবনকাহিনীতে বিবৃত করতে চান সম্পূর্ণ এক ভিন্ন আঙ্গিকের মাধ্যমে। তাঁর মতে ফাউস্টের আত্মিক বিদ্রোহের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গোচ্ছাস শুধু খ্রিস্টীয়-ধর্মতত্ত্বের বিরুদ্ধেই প্রবাহিত হয়নি, ব্যক্তি ও সমাজজীবনে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত সকল রকম জীবনবোধ ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও তা পরিচালিত হয়। মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি যতই উল্কর্ষ লাভ করুক না কেন, তার একটি সীমা আছে, যেমন সমুদ্রতরঙ্গ যতই ঊর্ধ্বে উত্তল হোক না কেন, তার সার্বিক ব্যাপ্তির পথে বাধা থাকবেই, তা কখনও বেলাভূমি অতিক্রম করতে পারবে না। কিন্তু ফাউস্ট এই সীমাটি না মেনেই তার অতিমানবিক বুদ্ধির স্পর্ধিত তন্তুর সমন্বয়ে বিশ্বব্যাপী এক লালসার জাল বিস্তার করে। ধীরে ধীরে নিজেই জড়িয়ে পড়ে সে জালে। 

ফাউস্টের প্রারম্ভিক প্রস্তুতি হিসেবে গ্যোটে যে উৎকর্ষ ও মঞ্চসম্পর্কিত ভূমিকার অবতারণা করেছেন তার সঙ্গে মূল নাটকের কোনও অঙ্গগত সম্পর্ক নেই। ‘প্রিলিউড’ বা মঞ্চের ভূমিকা অংশে শুধু দেশের প্রচলিত নাট্যধারা ও আদর্শ নাট্যরীতি সম্পর্কে গ্যেটের কিছু মতামত আছে। কিন্তু ‘প্রোলোগ ইন হেভেন’ অংশে ঈশ্বর ও শয়তান মেফিস্টোফেলিস-এর যে সব কথাবার্তা হয় তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঈশ্বর বললেন, বাস্তব কার্যক্ষেত্রে মেনে চলা কঠিন হলেও ন্যায়-অন্যায়বোধই মানব চরিত্রের প্রধানতম ধর্ম। যতদিন এই ন্যায়-অন্যায়বোধ মানুষের বিচারবুদ্ধির মর্মমূলে থেকে তার সকল কর্মপ্রচেষ্টাকে নিয়ন্ত্রিত করে চলে ততদিন ঈশ্বরের করুণা ও মোক্ষলাভ সহজ হয়ে ওঠে তার পক্ষে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ঈশ্বর নাম করলেন নরলোকের আদর্শ মানুষ ফাউস্টের। কিন্তু বাইবেলের স্যাটানের মতো মেফিস্টোফেলিস এমনই এক শয়তান যে বিশ্বসৃষ্টির কোথাও কোনও সত্য বা সৌন্দর্যকে স্বীকার করতে চায় না। এক অকারণ বিতৃষ্ণার অমিত বিষমিশ্রণে বিশ্বের সকল সত্যকে বিকৃত করে দেখাই ছিল তার ধর্ম। এইভাবে তার অসাধারণ বুদ্ধি ও চাতুর্যের সকল তীক্ষ্ণতা এক দুঃখবাদী ও ধ্বংসাত্মক মানসপ্রক্রিয়ার মধ্যে সংহত ও সংবদ্ধ হয়ে ওঠে। মেফিস্টোফেলিস তাই ফাউস্টের ন্যায়-অন্যায়বোধের সততায় স্পষ্টত সন্দেহ প্রকাশ করে ঈশ্বরের আত্মপ্রসাদাত্মক ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দিল। তখন ঈশ্বর বললেন, মানুষ তার বাস্তব কার্যক্ষেত্রে সকল সময় নীতিচেতনানিঃসৃত বিচারবুদ্ধির সর্বাত্মক ও সুসংহত পরিচয় দান করতে না পারলেও স্বতোৎসারিত এই নীতিচেতনা ভালোমন্দ সকল কর্মকর্মকে স্পর্শ ও নিষিক্ত করে তার জীবন ও পশু জীবনের মধ্যে এক শাশ্বত ও অলঙ্নীয় ব্যবধান রচনা করে চলেছে। 

এরপর নাটকের প্রথম দৃশ্যে ফাউস্টকে আমরা প্রথম দেখি তখন তাকে অতুলনীয় পাণ্ডিত্যে সমৃদ্ধ এমনই এক ব্যক্তি বলে মনে হয় যে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় লাভ করেছে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি, অথচ যে কোনও বস্তু বা ঘটনার চূড়ান্ত অর্থ উপলব্ধির উপযুক্ত অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হয়ে উঠতে পারেনি। তাই এই বিশ্বসৃষ্টির মহাজাগতিক তাৎপর্যটি উপলব্ধি করতে গিয়ে ফাউস্ট বুঝতে পারে, সে জ্ঞানবিদ্যার মৃঢ় অহঙ্কারে স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে উঠেছে সে, আপাত বিশাল সেই জ্ঞানবিদ্যার সকল ব্যাপ্তি ও গভীরতা শুধু তার পার্থিব অভিজ্ঞতার মধ্যেই শোচনীয়ভাবে সীমাবদ্ধ। তার যুক্তিবাদী সহকারী ওয়াগনারের সহায়তায় ফাউস্ট আরও বুঝতে পারে, অপার্থিক তুরীয় জগতের কথা তো দূরের কথা, পার্থিব জগৎ সম্পর্কেও তার জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ। জ্ঞানবিদ্যার যে বিপুলতায়ন অহঙ্কারের মধ্যে তার জীবনগত অস্তিত্বের সমস্ত সার্থকতাকে কেন্দ্রীভূত দেখেছিল ফাউস্ট, সেই জ্ঞানবিদ্যার শোচনীয় অপূর্ণতা ও ব্যর্থতার দুঃখে মুহ্যমান হয়ে উঠল সে। অপরিসীম হতাশার নিবিড়তায় আত্মহত্যার কথাও ভাবল। কিন্তু অকস্মাৎ শৈশবের স্মৃতির এক মধুর উত্তাপে ও নগরদ্বারে জনতার সংস্পর্শে বাঁচার এক দুর্মর এষণা এক প্রভাবসুলভ স্নিগ্ধ স্বচ্ছতায় সমীরিত হয়ে উঠল তার মনের মধ্যে। জীবনের যে অর্থ সে হারিয়ে ফেলেছিল সেই হারানো অর্থটি এক অনাস্বাদিতপূর্ণ মাধুর্যে দ্যোতিত হয়ে উঠল তার কাছে, মূৰ্ছিত হয়ে উঠল অশ্রুত ধ্বনিতে। মনে মনে সংকল্প করল ফাউস্ট, প্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত যে কোনও উপায়ে জীবনের সেই সতত অপসৃয়মান অর্থটিকে এবারে সে তার প্রতিটি জীবকোষের খণ্ডিত জৈবচেতনায়, তার ইন্দ্রিয়যন্ত্রের প্রতিটি তন্ত্রীতে ধরে রেখে দেবে অক্ষয়ভাবে। 

এমন সময় তার এই দুর্বল মুহূর্তে ছদ্মবেশে উপস্থিত হলো মেফিস্টোফেলিস। ফাউস্টের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার ভোগবাসনা চরিতার্থ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক প্রলোভনজাল বিস্তার করল তার সামনে। সে জালে সহজেই ধরা পড়ল ফাউস্টের আত্মা। মেফিস্টোফেলিস এটা জানত। সে জানত ফাউস্ট তার আত্মাকে বাঁচাবার জন্য কেলিকপটিনী নারীর মতো যে সব যুক্তি উপস্থাপিত করবে সে সব যুক্তি আসলে কোনও ভিত্তি নেই, তা মানুষের অন্য সব যুক্তির মতোই এক শাশ্বত দুর্বলতায় ও দ্বৈত্য সত্যের সংঘাতে খণ্ডিত। 

মেফিস্টোফেলিস প্রথমে ফাউস্টকে ডাইনিদের রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে দেখাল, ডাইনি বা যাদুকরেরা কিভাবে প্রাকৃত বস্তুর সাহায্যে এক অতিপ্রাকৃত আবেশ ও ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে। এ বিদ্যার মোহে ধরা না দিয়ে পারে না কোনও মানুষের আত্মা, কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, ফাউস্টের যে আত্মা মেফিস্টোফেলিসের হাতে পাতা প্রলোভনজালে আকাশ থেকে ঝরেপড়া ভোরের শিশিরের মতো পড়ে গিয়েছিল, সে আত্মার নিঃশব্দ অধঃপতনের নীরব ইতিহাসটিকেই দুটি খণ্ডে বিভক্ত এই নাট্যকাব্যের মধ্যে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন গ্যেটে, তাহলে তিনি ভুল করবেন। তা যদি হতো তাহলে এ নাটকের মধ্যে এ সব সুজটিল ঘটনাজাল সংস্থাপন করতেন না গ্যেটে, এত বুদ্ধি, কল্পনা ও আবেগানুভূতি দিয়ে ফাউস্টের মনোজগৎকে সমৃদ্ধ করে মেফিস্টোফেলিসের মতো অসাধারণ দুঃখবাদী ও ধ্বংসাত্মক শক্তিসম্পন্ন পুরুষের সমকক্ষ করে তুলতেন না ফাউস্টকে। 

ফাউস্টের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ১৮২৭ সালের ৬ই মে তারিখে একারম্যানকে গ্যেটে নিজের একটি কথা বলেছিলেন, কারণ অনেকেই তাকে জিজ্ঞাসা করত এ বিষয়। তিনি Boccia They come and ask what idea I meant to embody in my Faust as it I know myself and could inform them. From heaven through the world to hell could indeed be something; but this is no idea, only a course if action. And further, the devil loses the wager and that a man continually struggling from difficult errors towards somthing better, should be redeemed, be an effective and to many a enlightening thought; but it is no idea at the foundation of the whole or of every individual scene. It would have been a fine thing indeed, if I had strung so rich, varied and highly diversified a life as I have brought to view in Faust upon the slender string of one pervading idea. 

তিনি বলেছেন, শয়তানের সঙ্গে সংগ্রামরত মানবাত্মার মুক্তিলাভ এবং শয়তানের পরাজয় এ নাটকের বিষয়বস্তু হলেও নাটকের মধ্যে সমস্ত দৃশ্যের ঘটনাগুলো এই একটিমাত্র বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংগতি রেখে সমাবিষ্ট হয়নি। যদি তিনি একটিমাত্র উজ্জ্বল ভাববস্তুর সুতো দিয়ে নাট্যবর্ণিত সকল ঘটনাজালকে গ্রথিত করতে পারতেন তাহলে খুবই ভালো হতো। 

ফাউস্টের দুটি খণ্ডেই পাঁচটি করে অংশ আছে। অনেকের মতে প্রথম খণ্ডের থেকে দ্বিতীয় খণ্ডটি আরও দুর্বোধ্য। কিন্তু আমার মনে হয় আবেগানুভূতির প্রাধান্য বেশি থাকায় নাট্যবস্তু অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য হলেও দ্বিতীয় খণ্ডে ফাউস্ট মেফিস্টোফেলিসের অবাঞ্ছিত আধিপত্য হতে অনেকাংশে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারায় তার চরিত্রটি সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করতে পেরেছে; এ দিক দিয়ে এ খণ্ডের নাট্যমূল্য অনেক বেশি এবং নাটকীয় উদ্দেশ্য সাধনের দিক দিয়ে সমধিক তাৎপর্যপূর্ণ। 

তবে দুটি খণ্ডের রচনকালের মধ্যে পঁচিশ বছরের ব্যবধান থাকায় দুটি খণ্ডের রচনারীতি ও জীবনবোধের মধ্যে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হওয়া স্বাভাবিক। ১৮৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গ্যেটে একারম্যানকে বলেন, It all issues from a more composed more passionate individual, and this twilight may well explain its great appeal. But in the second part there is scarely anything subjective, here there appears a higher, broader, brighter, less passionate would and those who have not knocked a lot of gathered experience will not be able to make much of it.

মোহনাবিলীন কোনও অবসন্ন নদীর কুয়াশা যেমন সমুদ্রনীল এক বৃহত্তর সত্যকে আভাসিত করে তোলে, জীবনসায়াহ্নে উপনীত ফাউস্টও তেমনি যথাসম্ভব যত সব আবেগানুভূতির উচছলতাকে সরিয়ে দিয়ে এক বৃহত্তর জীবনসত্যের সাধনায় নৈর্ব্যক্তিকভাবে এগিয়ে গেছে। 

দ্বিতীয় খণ্ডের প্রারম্ভেই তার পার্থিব অভিজ্ঞতার স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতার প্রতি পূর্ণমাত্রায় সচেতন হয়েও এক বৃহত্তর ও মহত্তর জীবনসত্যকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে ফাউস্ট। শিশুর মতো এক অবুঝ কামনায় আতিশয্যে এমন বিহ্বল হয়ে পড়েছে। তার দুচোখের দৃষ্টি যে সে বিহ্বল দৃষ্টির সামনে সম্ভব-অসম্ভবের বাস্তব সীমারেখাঁটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কখন নিঃশেষে। কোনও প্রতিকূল অবস্থায় বিচলিত করতে বা হার মানাতে পারেনি তাকে। তার পরাভূতপ্রায় আত্মশক্তি নির্বাপিতপ্রায় দীপশিখার মতো এক বিরল উজ্জ্বলতায় জ্বলে উঠেছে বারবার। 

প্ৰথম খণ্ডে ফাউস্ট মার্গারেটকে ভালোবেসেছে। কিন্তু মার্গারেটের মতো সাধারণ একটি মেয়ে ফাউস্টের মতো এক বেগবান সত্তাকে কখনও ধরে রেখে দিতে পারে না। বর্তমানের সীমায়িত কালখণ্ডে ও ভূমিখন্ত্রে মধ্যে জীবনের চূড়ান্ত সার্থকতাকে যে খুঁজে পায় না কখনও, মন যার আকাশগামী পাখির মতো বৃহত্তর জীবনসত্যের এক স্বপ্নলীন পিপাসায় সতত উড্ডীয়মান সেই ফাউস্ট কোনও এক শান্ত গৃহকোণে এক সাধারণ নারীর বস্ত্রাঞ্চলে আবদ্ধ থাকতে পারে না কখনও। এজন্য প্রতিকূল ঘটনার স্রোত এসে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে দুজনকে নির্মমভাবে। এই কারণেই পরে দেখা যায় কোনও এক নির্বোধ রাজার অসংযত কামনা চরিতার্থ করতে গিয়ে শ্রেষ্ঠ নারীসৌন্দর্যের ক্লাসিকাল প্রতীক হেলেনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে ফাউস্ট। 

দ্বিতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় অঙ্কে ফাউস্টের সহকারী ওয়াগনার যে কৃত্রিম নলজাতক সন্তান সৃষ্টি করেছে, সে সন্তান শক্তিধর হলেও যার সমস্ত শক্তি চৈতন্যসর্বস্ব এক নিরাবয়ব সত্তামাত্র, সে সন্তানের মধ্য দিয়ে গ্যেটে দেখাতে চেয়েছেন মানুষ শত সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী হলেও দেহমনের সুষম সম্বন্ধে গড়া সার্থক মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। সেই কৃত্রিম সন্তান হোমুনকালাসের সাহায্যে হেলেনের দেখা পেয়েছে ফাউস্ট। মার্গারেটের প্রতি তার যে প্রেম একদিন ছিল কেন্দ্রানুগ সে প্রেম জৈব ইন্দ্রিয়চেতনায় সব স্তর পার হয়ে বহু যুগের কালগত ব্যবধান জয় করে হেলেনের কাছে গিয়ে সহসা হয়ে উঠেছে কেন্দ্রাতিগ। যে সর্বাত্মক দুর্লভ নারীসৌন্দর্য সর্বগ্রাসী কালের কুলিশ প্রভাবকে অগ্রাহ্য করে এক অখণ্ড সত্যের অম্লান ভাবমূর্তিতে পর্যবসিত, সে সৌন্দর্যকে লাভ করার জন্য ফাউস্টের কেন্দ্রাতিগ প্রেম স্বচ্ছন্দে উঠে গেছে এক নিষ্কাম বায়বীয়তার প্রতীকী ভাবরাজ্যে। এই ভাবরাজ্যেই হেলেনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে। এ বিবাহ যেন কল্পনার সঙ্গে এক ভাবসত্যের মানসপ্রতিমার। এই ভাবসম্মিলনের ফলস্বরূপ যে সন্তান প্রসূত হয়েছে সে সন্তানও স্বাভাবিকভাবেই হয়ে উঠেছে অলীক ভাবসর্বস্ব এক কল্পনামাত্র। সে উড়তে গিয়েও উড়তে পারেনি। উড়তে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। হেলেনের সন্তান ইউফোরিয়নের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হেলেনের পার্থিব দেহটা সহসা বাষ্পীভূত হয়ে উবে যায় ফাউস্টের চোখের সামনে দিয়ে। শুধু তার পোশাকগুলো তার হাতে থাকে। ফাউস্টের চৈতন্য হয়। fluechger Tage grossen Sinn. নশ্বর জীবনের ক্ষণভঙ্গুর অস্তিত্বের এক বিরাট তাৎপর্য সহসা উদঘাটিত হয়ে উঠল ফাউস্টের কাছে। ফাউস্ট আবার বুঝল, নশ্বর দেহকে ফেলে যাওয়া অবিনশ্বর আত্মার মতো সকল সৌন্দর্যের ভাবমূর্তি তার বাস্তব অস্তিত্বের বাহ্য রূপায়বটি সাপের খোলসের মতো ত্যাগ করে চলে যায় এবং তখন হেলেনের পরিত্যক্ত উজ্জ্বল পোশাকের মতোই সে সৌন্দর্যের এক উজ্জ্বল স্মৃতি শুধু পড়ে থাকে আশাহত বিহ্বল মনের কোণে। সকল প্রেম ও সৌন্দর্যের একটি আত্মিক তাৎপর্য আছে এবং সেই তাৎপর্য আত্মিক বা তুরীয় তাৎপর্যের আলোকে মৃত মাগারেটের স্মৃতিটি ফাউস্টের মনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সহসা। গ্যেটে এখানে পাপপুণ্যগত নৈতিক বিচার থেকে হেলেনকে মুক্ত করে এক পরিপূর্ণ আত্মিক সৌন্দর্যের প্রতীক হিসাবে উপস্থাপিত করেছেন। যে সৌন্দর্য মানুষের আত্মাকে প্রসারিত করে অন্তঃকরণকে বিশুদ্ধ করে সেই শুচিশুদ্ধ সৌন্দর্যের নির্বিশেষে সত্তার কছে । মেফিস্টোফেলিসের মতো কোনও অশুভ শক্তি সশরীরে যেতে পারে না। এই জন্য শয়তান মেফিস্টোফেলিস ক্ল্যাসিকাল ওয়ালপার্গিস নৈশভোজের সভায় প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত না হয়ে অশুভ দৈবশক্তির প্রতীক ফোর্সিয়ার মুখোশ পরে হাজির হয়। ফোসিয়া ও মেফিস্টোফেলিস হেলেনের বাহ্য রূপটিকেই বড় করে দেখেছিল; তারা তার রূপসৌন্দর্যের অবিনাশী অতীন্দ্রিয় ভাবমূর্তিটি দেখতে পায়নি, কারণ সে অন্তদৃষ্টি তাদের ছিল না। 

হেলেনের পরিপূর্ণ সর্বাত্মক সৌন্দর্যের সংস্পর্শে ফাউস্টের আত্মা যে প্রসারতা লাভ করে তাতে তার মধ্যে জেগে ওঠে এক অননুভূতপূর্ব বীরত্ব ও সামাজিক দায়িত্ববোধ। মেফিস্টোফেলিসের যাদুর সাহায্যে যুদ্ধ জয় করে সম্রাটের কাছ থেকে পুরস্কারস্বরূপ এক বিরাট জলা জায়গা নিয়ে সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে তাকে উর্বর শস্যক্ষেত্রে পরিণত করার পরিকল্পনা করে সে। যত সব অলস রোমান্টিক ভাবকল্পনাকে বিদায় দিয়ে ফাউস্ট এবার সৃজনাত্মক এক কর্মোদ্দীপনায় ফেটে পড়তে চায়। এই উদ্দীপনার আতিশয্যে সমুদ্রের মতো এক অসংযত অনুৎপাদিকা প্রাকৃতিক শক্তিকে সংযত ও উৎপাদিক শক্তিতে পরিণত করে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করতে চায় তাকে।

আপাতশান্ত আপাতনিস্পৃহ প্রকৃতির অন্তঃস্থলে আবদ্ধ থাকে উল্লঙ্ঘন-অভিলাষী এক বিদ্রোহাত্মক শক্তির প্রচণ্ডতা যা মাঝে মাঝে ফেটে পড়ে পর্বতশৃঙ্গের অপ্রধৃষ্য উতুঙ্গতায়, সমুদ্রতরঙ্গের সর্বগ্রাসী উত্তালতায় ও প্রভঞ্জনের বৈপ্লবিক মত্ততায়। ফাউস্টের দ্বন্দসঙ্কুক্ষিত দ্বৈতসত্তাটি যেন প্রকৃতির এই দুটি শক্তির প্রতীক। যে ফাউস্ট একদিন হতাশা আর বিষাদে মুহ্যমান হয়ে পৃথিবীর সব আশা, বিশ্বাস ও সহিষ্ণুতাকে অভিশাপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছে, সে ফাউস্ট একদিন মেফিস্টোফেলিসের শয়তানী প্রভাবের শান্ত ক্রীড়নক হিসাবে কাজ করে গেছে, সেই ফাউস্টই আবার অতিমানবিক কামনার স্পর্ধিত উচ্ছ্বাসে এক মহাজাগতিক অভিলাষে ফেটে পড়েছে। তার বিষণ্ণ। প্রতিহত প্রাণের পথহারা প্রস্রবণটি সহসা তার চারদিকের সমস্ত প্রস্তরশৃঙ্খল ও গুহান্ধকার হতে নিজেকে মুক্ত করে মানবকল্যাণবোধের এক বিশ্বাত্মক সমুদ্রসত্তায় বিলীন হয়ে গেছে। এই জন্যই মেফিস্টোফেলিসের সব বাধাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ফাউস্টের আত্মাকে স্বর্গে নিয়ে গেছে মার্গারেটের আত্মা। 

কিন্তু ফাউস্টের এই মোক্ষলাভের আগে তাকে যাদুবিদ্যার মোহ ত্যাগ করতে হয়েছে। যে যাদুবিদ্যা মানুষের কাছে প্রাকৃত-অপ্রাকৃতের সীমারেখাঁটিচকে বিলুপ্ত করে দেয়, তাকে বিধির বিধান লঙ্ঘন করতে উৎসাহ দেয়, সে বিদ্যা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এক প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছুই নয়। 

সে বিদ্যা ত্যাগ না করা পর্যন্ত নিজের মুক্তি বা জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পায়নি ফাউস্ট। এই জন্য সে বলেছে, 

Not yet have I my liberty made good
If I could banish Magic’s fell creations
And totally unlearn the incantation
Stood I, O Nature’ Man alone in thee,
Then were I it worth one’s while a man to be! 

শতবর্ষপূর্তির পর জীবনসায়াহ্নে এসে ফাউস্ট বুঝতে পেরেছে যাদুবিদ্যার মোহে ধরা না পড়লে সে জগতের মাঝে মানুষের মতো এক মানুষ হয়ে উঠতে পারত। যখন সে তার নিজের ভুল বুঝতে পারল তখন তার কোনও উপায় নেই। উনিশ শতকের অনেক সমালোচক মনে করেন ফাউস্টের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষের পক্ষে মেফিস্টোফেলিসের হাতে ধরা দেওয়া উচিত হয়নি। আমার মতে ফাউস্টের ট্রাজেডি এইখানে। শুধু ফাউস্ট নয়, আধুনিক মানব জীবনের ট্রাজেডিও এইখানে। বিজ্ঞান আজকের মানুষকে যে শক্তি দান করেছে, মানুষ সে শক্তির সীমাকে মানতে চায় না। অসাধ্যসাধনের যে উদ্ধত প্রয়াস মানুষের জ্ঞান ও শক্তিগত সীমাকে অস্বীকার করে। আধুনিক মানুষের আত্মার সংকটকে ঘনীভূত করে তুলেছে, দ্বিধাবিভক্ত করে তুলেছে তার অন্তরাত্মাকে, মেফিস্টোফেলিস হলো সেই প্রয়াসেই প্রতীক। ফাউস্টের মতো আমরা যখন বুঝতে পারি, আমাদের সংগ্রামশীল আত্মশক্তি বৃথা অপচয় করে সীমাহীন তলহীন শূন্যতার মাঝে যে অলীক নিশ্চয়তাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েছি সে নিশ্চয়তা হলো আত্মপ্রতারণারই নামান্তর মাত্র, তখন কোনও উপায় থাকে না। সারাজীবনের সকল ভুলভ্রান্তির প্রান্তভূমিতে এসে আমরা যখন উপনীত হই তখন দেখি দিগন্তের পটে ফুটে উঠেছে তিমিরাঙ্কিত মৃত্যুর এক ভয়াল মূর্তি। দেখি, ক্লান্ত প্রাণের নদীটি আগেই ঢলে পড়েছে কুয়াশালীন সমুদ্রের ইন্দ্রনীল কোলে। 

ফাউস্ট শুধু এক সাধারণ নাট্যকাব্য নয়, ফাউস্ট আধুনিক জীবনের এক সাহিত্য মহাকাব্য। গ্যেটের মতো আর কোনও কবি বা নাট্যকার তাঁর রচনার মধ্যে আধুনিক মানবজীবনের আশা-নিরাশা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পুণ্য নিয়ে, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সংকটের বিচিত্র দিকগুলো নিয়ে এমন করে ভাবেননি। তবে ফাউস্টের শেষদৃশ্যে দান্তের ডিভাইন কমেডিয়ার প্রভাব প্রকটিত হয়ে তাঁর ভাবকল্পনার মৌলিকতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। দান্তের বিয়াত্রিসের মতো মার্গারেটের মৃত্যুহীন প্রেম ফাউস্টের আত্মাকে নিয়ে গেছে ঐশ্বরিক মার্জনা আর মোক্ষলাভমণ্ডিত স্বর্গের সর্বোচ্চ লোকে। আমার মনে হয় যে গ্যেটে একদিন শুধু বিশুদ্ধ যুক্তিবাদের উপর নির্ভর করে ধর্মনিরপেক্ষ চূড়ান্ত জীবনসত্যটিকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন, সেই গ্যেটে মিস্টিক বা মরমী খ্রিস্টান সাধক ল্যাভেতারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জীবনের চূড়ান্ত সত্য ও পরম অর্থটি খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন। 

গ্যেটের অন্য দুটি নাটক আয়রন হ্যান্ড ও এগমঁত ট্রাজেডি হিসাবে সার্থক। দুটি নাটকেরই পটভূমি হলো সমকালীন রাজনৈতিক সংকট। আয়রন হ্যান্ড নাটকের নায়ক বার্লিশিঞ্জেনের জীবনে ট্রাজেডি নেমে এসেছে এক ভ্রান্তি থেকে যে ভ্রান্তি বলে সে ভেবেছে দেশের কৃষকবিদ্ৰোহজনিত অরাজকতার মাঝেও তার শক্তি, সামর্থ্য, সততা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সমানভাবে কার্যকরী হবে। বিপ্লবী অশিক্ষিত অসংযত কৃষকরা তার নেতৃত্ব অস্বীকার করে তাকে আঘাত করেছে। এগমঁত নাটকের পটভুমি হলো স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডবাসীদের বিদ্রোহ। এই নাটকের নাটক কাউন্ট এগমঁত এক অসঙ্গত দুঃসাহসের বশবর্তী হয়ে শত্রুদের শক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে উপযুক্ত আত্মরক্ষা বা প্রতিরক্ষাগত কোনও ব্যবস্থা অবলম্বন করেনি, বন্ধুদের সতর্কবাণীতে কান দেয়নি। এগৰ্মতের এই বিচারবুদ্ধিগত ত্রুটিই ট্রাজিক পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে তার জীবনকে। 

গ্যেটের উপন্যাস তিনটির মধ্যে তাঁর জীবনের প্রথম রচনা সাফারিংস অফ ইয়ং ওয়ার্দার’ উপন্যাসটি একান্তভাবে কাব্যগুণান্বিত। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের পটভূমিকায় নায়ক ওয়ার্দারের আবেগানুভূতির বিস্তারের মধ্য দিয়ে তার আত্মজীবনের কিছু কিছু উপাদান প্রতিফলিত হয়েছে। লোত্তের প্রতি তার ব্যর্থ প্রেমের অসংযত অদম্য বেদনা অন্তরাবর্তন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। গ্যেটে নিজেও একবার আত্মহতার কথা চিন্তা করেন এবং এই আত্মহত্যার স্বপক্ষে উদ্ভাবিত যুক্তিগুলো এই উপন্যাসে পরিব্যক্ত করেন। 

‘উইলেম মেস্তার’ উপন্যাসটি ঘটনাপ্রধান। অসংখ্য ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবন সম্পর্কে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছে মেস্তার, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তার নাট্যপ্রতিভা প্রাণরস আহরণ করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসের নায়কের মধ্যে গ্যেটের আত্মগত প্রতিফলন পড়েছে। গ্যেটে একের পর এক করে যেমন ব্যক্তিজীবনে গ্রেচেন, ফ্রেডারিক ও লিলি এই তিনটি মেয়েকে ভালোবাসলেও তিনটি প্রেমের ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হন তেমনি ইউলেম মেস্তারও একের পর এক কয়েকটি মেয়েকে ভালোবেসে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সেই ব্যর্থ প্রেমের বেদনা তার নিরন্তর পথচলার গতিকে ব্যাহত করতে পারেনি। তবে উপন্যাসের মধ্যে অহেতুক অসংখ্য ঘটনাজাল বিস্তার করায় নায়কের চিন্তাভাবনাগত মানব প্রক্রিয়ার অবিচ্ছিন্ন ধারাটি ক্ষুণ্ণ হয়েছে মাঝে মাঝে। 

গ্যেটের ঔপন্যাসিক প্রতিভার সার্থক পরিচয় পাই তাঁর কাইন্ডার্ড বাই চয়েস বা ‘সিলেকটিভ অ্যাফিনিটি’ উপন্যাসটিতে। একই পরিবেশে লালিত কয়েকটি নর-নারীর স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে নিয়তির অপরিহার্য দ্বন্দ্ব এবং তার বিস্তারই এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এ উপন্যাসে এডওয়ার্ড ও ওতিলে চরিত্র দুটি অস্বাভাবিকভাবে আবেগপ্রবণ। তাই তারা যখন দেখেছে তাদের স্বাধীন ইচ্ছা আপন আপন আকাক্ষার বস্তুকে লাভ করতে পারেনি তখন তারা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু অপরদিকে শার্লোতে ও ক্যাপ্টেনের চরিত্র অসাধারণ আত্মসংযমের জীবন্ত প্রতীকরূপে এক চমৎকার বৈপরীত্য সৃষ্টির মাধ্যমে উপন্যাসে ভাবগত ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে। অটল অটুট আত্মসংযমের দ্বারা মানুষ কিভাবে তার অদশ্য উদ্দাম ইচ্ছাশক্তিকে দমন করে অবস্থার অবাঞ্ছিত প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে, শার্লোতে ও ক্যাপ্টেন তার প্রমাণ দিয়েছে তাদের জীবনে। আবেগের স্রোতে কোনও অবস্থাতেই গা ভাসিয়ে না দিয়ে সব সময় তাদের যুক্তি ও বুদ্ধিগত প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই উপন্যাসে ক্লাসিক ও রোমান্টিক এই দুটি পরস্পর বিরুদ্ধ মননশীলতার সার্থক রূপায়ণ বড় একটা দেখা যায় না। ভিন্ন জটিল পরিবেশের মধ্যে ফাউস্টের মধ্যেও এই দুটি মননশীলতার রূপায়ণ এক আশ্চর্য সার্থকতা লাভ করেছে। ফাউস্ট এক জায়গায় বলেছে : 

I am so far away, yet so near 
Still I am so fain to say here I am here.

কখনও মনে হয় আমি দূরে চলে গিয়েছি, আপনার আত্মার কেন্দ্রগত শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভেঙে যায়। মনে হয় আমি আছি, এখানেই আছি, আপন অন্তরাত্মার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছি আমি আর সেই সুসমন্বিত অন্তরাত্মা হতে বিচ্ছুরিত আলোকে অর্থময় হয়ে উঠছে জগতের সব বস্তু, অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নিকট-দূরের সব ব্যবধান। আপন মৃগনাভির গন্ধে আত্মহারা আকুল বনহরিণী যেমন দিক হতে দিগন্তের পথে ছুটে বেরিয়ে অবশেষে তার আরণ্যক বাসায় এসে। আবিষ্কার করে এ গন্ধ তার নাভিদেশনিঃসৃত, তেমনি মাঝে মাঝে আমাদের রোমান্টিক উন্মার্গগামী মনও সমস্ত দিগন্ত পিপাসার অবসানে ফিরে এসে আপন আত্মার চৈতন্যালোকিত বৃত্তসীমার মধ্যেই বিশ্বের বিপুল পরিধিটাকে অনিবার্যভাবে সীমায়িত ও বিন্যস্ত দেখতে পায়। আমাদের অসংযত রোমান্টিক মন ক্লাসিকাল সংযমে আবদ্ধ হয়ে ওঠে। 

এই গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে সাহিত্যরসিক, বন্ধুবর ডক্টর বিষ্ণু বসু সাহায্য করে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন আমাকে। 

–সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *