২. অস্তাচলের পানে

অস্তাচলের পানে

১.

১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে লন্ডনে পৌঁছোনো গেল। হিথরো বিমানবন্দরে আমাদের নিতে এলো আমার ভাগ্নে মামুন এবং, বেবীর সম্পর্কে নানা কিন্তু বয়সে ছোটো, হায়দার। ওরা অনেক শীতবস্ত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। তার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল বেবীর।

লন্ডনের দক্ষিণ-পশ্চিমে কলিয়ার্স উড অঞ্চলে মামুন আমাদের জন্যে বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিল। ২০ ক্লাইভ রোডের বাড়িতে দোতলায় আড়াইটে শোবার ঘর, টয়লেট ও বাথরুম। নিচে বসার ঘর, খাবার ঘর ও রান্নাঘর। পেছনে একটু খালি জমি। হিটিংয়ের ব্যবস্থাটা একটু বৈচিত্র্যপূর্ণ : কোনো ঘরে ইলেকট্রিক হিটার, কোনো ঘরে প্যারাফিন দিয়ে হিটার চালাতে হয়, কোথাও গরম পানি দিয়ে স্বয়ংচালিত তাপবিকিরণের ব্যবস্থা। টেলিফোন সংযোগ আছে, গ্যাস বিদ্যুৎ রয়েছে। বাড়ির মালিক চট্টগ্রামের এক ভদ্রলোক। স্বামী-স্ত্রী মিলে ‘মেঘনা’ নামে একটা গ্রোসারি চালান বালহামে। ভাড়া কম নিয়েছেন। বলেছেন, দেশের লোক বলে এবং একমাত্র ভাড়াটে বলে আমার কাছ থেকে সপ্তাহে তিন পাউন্ড কম নেবেন, কিন্তু কেউ জানতে চাইলে আমাকে বলতে হবে পুরো ভাড়ার পরিমাণ। বলা যায়, মিথ্যে কথা বলার মজুরি বাবদ সপ্তাহে তিন পাউন্ড পেতাম।

আমরা যখন প্রবেশ করলাম, বাড়িটা তখনো অগোছালো। মালিক এবং মামুন মিলে যতটা পারেন, করেছেন তবে আরো অনেক পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সে-কাজ আপাতত মুলতুবি রাখতে হবে। কেননা, পরদিনই মামুন আমাদের সবাইকে নিয়ে গাড়ি করে ওয়েসে বেড়াতে যাবে। গ্ল্যামোরগান অঞ্চলে মার্থার টিডফিল বলে একটা জায়গায় আশরাফ ও নাদিরা নামে এক চিকিৎসক-দম্পতি বাস করেন। আমাদের ভাগ্নে-বউ মীরা। সেখানে এর মধ্যে পৌঁছে গেছে। তার অবকাশের দিনগুলো মামুন সেখানে কাটাবে–সঙ্গে করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। ব্যবস্থাটা যে আমাদের মনঃপূত হয়েছিল তা নয়, তবে মামুনের সঙ্গে ভালোবাসাটা উভয়পক্ষে এত প্রগাঢ় যে আমরা আর না বলতে পারিনি।

সকালে উঠে দেখা গেল, বেবীর জ্বর। জ্বরগায়েই সে যাত্রা শুরু করলো। পথের দুধারে দেবালয় দেখা হলো না তার এবং পথের প্রান্তে পৌঁছেও সুস্থ হতে একটু সময় লাগলো। মার্থার টিডফিল মনোরম জায়গা-ধারেকাছে কয়লাখনি আছে, কিন্তু পরিবেশে দূষণ নেই। গৃহকর্তা-গৃহকত্রী প্রচুর সমাদর করলেন, মামুনও আমাদের দিকে নজর রাখলো এবং এদিক-ওদিক বেড়াতে নিয়ে গেল। দিন তিনেক পরে লন্ডন-প্রত্যাবর্তন।

ফিরে এসে এবারে ঘরবাড়ি গোছানো, কিছু কাপড়চোপড় হাঁড়িবাসন কেনা, আমার একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাছে রেজিস্ট্রিভুক্ত হওয়া। আমরা সবাই পাড়ার সাহেব-ডাক্তারের খাতায় নাম লেখালাম, বেবী চাইলো বাঙালি ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে। সে একটু দূরে গিয়ে মামুনের এক পরিচিত চিকিৎসকের কাছে রেজিস্ট্রি করলো। সাহেব ডাক্তার একটু গোলেই পড়েছিলেন তার ফলে। বললেন, তুমি এবং তোমার তিন সন্তানের নাম দেখা যাচ্ছে আমার তালিকায়–ওদের মা কোথায়?

অ্যাসোসিয়েশন অফ কমনওয়েথ ইউনিভার্সিটিজের পক্ষ থেকে আমাদের স্প্রেংগার মনোজ্ঞ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আরো কেউ কেউ কিছু বলেছিলেন–কিন্তু তা বোধহয় আমার মনে দাগ কাটেনি। বক্তৃতার আগে ছিল পানপর্ব, পরে ভোজনপর্ব। পানপর্বের সময়ে ঘুরতে ঘুরতে রেবেকা জেমসের সঙ্গে দেখা হলো–আমাকে দেখে তিনি প্রীতি প্রকাশ করলেন। একটু পরে দেখি, ক্যাথি কারো সঙ্গে কথা বলছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে একটু অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আমাকে সম্বোধন করলো এবং তারপর কেবল আমার সঙ্গেই কথা বলতে থাকলো। ফলে তার সঙ্গী ভদ্রলোক সরে গেলেন। সেই সন্ধ্যায় এবং তার পরে একাধিক দিন ক্যাথি আমাকে বলেছিল যে, তার কাছে তখন আমাকে মনে হয়েছিল ঈশ্বরপ্রেরিত তারণকর্তা। ভদ্রলোকের অখণ্ড ও অতিরিক্ত মনোযোগ সে কিছুতেই এড়াতে পারছিল না, যদিও তার সঙ্গে তার আলাপ হয় মাত্র ওই সন্ধ্যায়ই। কাজেই আমি কাছে যেতেই আমাকে আঁকড়ে ধরে সে পরিত্রাণের পথ খুঁজলো। এই ঘটনা নিয়ে আমরা অনেক হাসাহাসি করেছি।

আমাদের যাতায়াত ও বৃত্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে থাকার ব্যবস্থা ছিল ব্রিটিশ কাউনসিলের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের আচরণীয় ও অনাচরণীয় কী, তা বোঝাতে একটা অধিবেশন হলো। কমনওয়েলথ ও ব্রিটিশ কাউনসিলের অন্যান্য বৃত্তি নিয়ে যারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ–প্রথমবার বিদেশের মাটিতে পা দিয়েছেন। অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলোশিপ পাওয়া আমরা কজন শুধু একটু অভিজ্ঞ। সুতরাং অনেক সামান্য কথা শুনতে হলো এবং অনেকরকম ফরম হাতে পাওয়া গেল–তার মধ্যে ঘরবাড়ির উদ্দেশ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুপারিশ সংবলিত কাগজ–এসবও ছিল। সভার শেষে আমি যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে একটা কাগজে আমার ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ লিখে দিয়েছিলাম, ভদ্রমহিলা বিস্মিত ও পুলকিত হয়ে বললেন, ‘আহ্, সবাই যদি তোমার মতো স্বনির্ভর হতো!’

একটা বড়ো কাজ বাকি রইলো–রুচি-শুচিকে স্কুলে ভর্তি করা। শুচি এই প্রথম স্কুলে যাবে। তার ব্যবস্থা সহজেই হয়ে গেল। বয়সের হিসেবে রুচিকে যেতে হবে মিডল স্কুলে। আমাদের বাড়ির কাছেই আছে আলফিয়া মিডল স্কুল–কিন্তু সেখানে ওর ক্লাসে সিট খালি নেই। কদিন ঘোরাঘুরির পরে বরা অফ মর্ডেনের শিক্ষা-কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানালাম। তারা একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত তরুণী বললো, আলফিয়ায় তারা চেষ্টা করছে, সেখানে ভর্তি করা না গেলে রুচিকে যেতে হবে একটু দূরের স্কুলে। তবে শিক্ষা কর্তৃপক্ষের বাস আছে–তাতে করে সে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারবে। তবু রুচির এবং আমাদের কিছুটা অসুবিধে হবে। তা স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত কি না? আমি বললাম, তাই সই। মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম। কদিন পরে সে ফোন করে জানালো, সুসংবাদ আছে, আলফিয়ায় তোমার মেয়ের ভর্তির ব্যবস্থা করা গেছে–কালকের মধ্যেই সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হবে। পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আমি তখনই স্কুলে ছুটলাম।

স্কুল থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, আমরা যেন বাড়িতে ওদের সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা না বলে সর্বদা ইংরেজি বলি। বুঝতে পারি, তাতে ওদের ইংরেজি শেখার সুবিধে হবে। রুচিকে আবার দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্কুলে ফরাসি নিতে হয়েছে। ফলে নানা ভাষার চাপ বা দ্বন্দ্ব যত কম হয় তত মঙ্গল। কিন্তু বাড়িতে বাংলা না-বলার কথা আমরা ভাবতে পারলাম না। ঠিক করলাম, ওদের সঙ্গে একযোগে বাংলা-ইংরেজি বলব। যদি ইংরেজি বাক্য ব্যবহার করি, সঙ্গে সঙ্গে তার বাংলাটা বলব; আর যদি বাংলায় কিছু বলি, তবে তার ইংরেজি অনুবাদও করে দেবো একসঙ্গে। ব্যবস্থাটা বোধহয় মন্দ হয়নি। মাঝে পড়ে আনন্দ, দেখি, টেলিভিশন থেকে, আশপাশ থেকে, বোনদের কাছ থেকে ইংরেজি শিখে নিচ্ছে। একবার বোধহয় কেউ একটা দুষ্কর্ম করেছিল। কে করেছিল, অনুসন্ধান করায় আনন্দকে বলতে শুনলাম, শি ডিড ইট–আই ডিডন্ট ডু ইট। আনন্দের বয়স তখন আড়াই হয়েছে কী হয়নি।

শি মানে শুচি। সে স্কুলে পৌঁছে মায়ের হাত ছেড়ে ক্লাস-টিচার মিসেস বোরেটের হাত ধরতো। দিনের শেষে আবার তার হাত ছেড়ে মায়ের হাত। ভদ্রমহিলা ধৈর্য ধরে শুচির আবদার মেনে চলতেন। শুচি স্কুলে ছবি আঁকতে ভালোবাসততা এবং ভালো ছবি আঁকতো। ওর শিক্ষয়িত্রী তাতে খুব প্রীত ছিলেন।

দেশের মতো বিদেশেও সংসারের সব দায়িত্ব ছিল বেবীর। সকালবেলায় আমাদের নাশতা খাইয়ে ছেলেমেয়েদের তৈরি করে কখনো তিনজনকে নিয়ে, কখনো মেয়ে দুজনকে নিয়ে আলাদা আলাদা স্কুলে পৌঁছোনো। বিকেলে আবার আনন্দকে প্র্যামে ঠেলে নিয়ে মেয়েদের স্কুল থেকে আনা। মাঝে বাজার-সওদা করা, রান্নাবান্না সারা, কাপড়চোপড় ধোওয়া, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা। তবে তাতে তার আনন্দের ঘাটতি হতো না।

২.

ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে পরে, ব্রিটেনের মধ্যেও ইংল্যান্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে কিছুটা দেরিতে। অকসফোর্ড বারো শতকে আর কেমব্রিজ তেরো শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই তুলনায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় একেবারেই শিশু–এর সূচনা ১৮২৮ সালে, তবে রাজকীয় সনদ পেতে আরো সাত বছর লেগে যায়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কিন্তু লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছিল একাধিক বিষয়ে। প্রথমত, এর দ্বার উন্মুক্ত হয় সকল সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রীর জন্যে; দ্বিতীয়ত, পাঠ্যবিষয় থেকে এখানে ধর্মতত্ত্ব বাদ পড়ে। তাছাড়া গির্জার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এর পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। এসব সিদ্ধান্ত এমনই আলোড়নের সৃষ্টি করে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠায় অনেক বাধা দেওয়া হয়েছিল। তাতে সফল না হওয়ায় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা হয় ‘গাওয়ার স্ট্রিটের নিরীশ্বর প্রতিষ্ঠান’ বলে, আর সমকালীন এক ব্যঙ্গ-কবিতায় লেখা হয় :

Birbeck, and Brougham, and Gregory,
And other Wicked People,
Had laid a Plan to undermine
The Church, if not the Steeple!
The London University!
O what a shocking notion;
To think of teaching anything
But Church and State devotion!

অন্যপক্ষে, পাঠ্যবিষয় হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম প্রবর্তিত হয় ইংরেজি সাহিত্য এবং আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ছাড়াও নানান আধুনিক ভারতীয় ভাষা। পরে এশিয়া ও আফ্রিকার ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি–এসব অধ্যয়নের জন্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড অ্যাফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) পত্তন হয়। আমি এই সোয়াসেই যুক্ত থাকতে যাচ্ছি।

প্রথম দিনে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড সিলোন বিভাগের প্রধান প্রফেসর রাইট আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন এবং সংস্কৃতের অধ্যাপকরূপে সম্প্রতি প্রদত্ত তাঁর উদ্ববাধনী বক্তৃতার একটি কপি উপহার দিলেন। সোয়াসে যা যা করার দরকার–সিনিয়র কমনরুম ব্যবহারের সুযোগ, লাইব্রেরি কার্ডের ব্যবস্থা–এসব করে দিলেন এবং আমাকে যে একটা ঘর বরাদ্দ করতে পারছেন, তার জন্যে দুঃখপ্রকাশ করলেন। নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরু-উপলক্ষে সেদিন সন্ধ্যায় শিক্ষকদের একটা পার্টি ছিল। রাইট তাতে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁর কথামতো আমি তাঁর সঙ্গেই পার্টিতে গেলাম এবং তিনি নিজেই অন্তত বিশ-পঁচিশ জন শিক্ষকের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই পার্টিতেই হিন্দির শিক্ষক ড. পাণ্ডের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল–আমি যখন শিকাগোতে ছিলাম, তখন তিনি সেখানে হিন্দির লেকচারার ছিলেন। উর্দু ও পাঞ্জাবির শিক্ষক ড. রাসেলের সঙ্গে সেখানে পরিচয় হয়–ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতার দক্ষ অনুবাদক হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেছিলেন। অর্থনীতির রিডার ড. কে এন [কীর্তিনারায়ণ] চৌধুরীকেও সেখানে। পেলাম–তিনি নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মধ্যম পুত্র। যেহেতু রাইট আমাকে বলে কয়ে পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে, আমি লক্ষ রাখছিলাম, উনি কখন পার্টি ছেড়ে যান। উনি বেরোবার উপক্রম করতে আমিও তার সঙ্গে যোগ দিলাম। মনে হয়, এতে তিনি খুশি হয়েছিলেন। রাইট মানুষ ভালো, তবে তাঁর মধ্যে আনুষ্ঠানিকতার একটা ব্যাপার ছিল। আনিস বলা দূরে থাক, তিনি আমাকে আনিসুজ্জামান বলেও ডাকতেন না, সব সময়ে প্রফেসর আনিসুজ্জামান। বলে সম্বোধন করতেন। আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না সে-বিষয়ে জানতে চাইতেন, কিন্তু আমার কাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করতেন না। ফলে তাঁর সঙ্গে আন্তরিক কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি।

সকালে প্রফেসর রাইটের কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের ঘরে। আগের বার যখন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর জন্যে কালো জমিনের একটা জামদানি শাড়ি নিয়ে যেতে। আমার শ্যালিকা নাজু তার পরিচিত কারিগর দিয়ে তা বানিয়ে দিয়েছিল। সেটা সমর্পণ করা গেল তাঁর হাতে। স্থির হলো, দুপুরে সিনিয়র কমনরুমে একসঙ্গে যাবো, সন্ধ্যার পার্টিতেও আবার মিলিত হবো। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরিয়ান বি সি ব্লুমফিল্ডের কাছে। ব্লুমফিল্ড সদাশয় ব্যক্তি। মুখে প্রায় সর্বদা হাসি লেগে আছে এবং সে-হাসি প্রায়ই কৌতুকের। সোয়াসের লাইব্রেরির জন্যে আমি বই নিয়ে গেছি বলে তিনি অনেক ধন্যবাদ জানালেন। ড. বোলটন সে-বছরটায় ছুটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও প্রধানত ওড়িশায় এসেছিলেন গবেষণা ও দেখাসাক্ষাতের কাজে–তাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হলো না।

তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের অফিসকক্ষের অদূরে রাজেশ্বরী দত্তের অফিসঘর। তিনি সোয়াসে সংগীতের প্রভাষক। শিকাগো ছাড়ার পর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, কিন্তু তিনি চিনতে পারলেন ঠিকই। পরে জেনেছিলাম, প্রফেসর রাইটের কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে, আমি সোয়াসে আসছি। সোয়াসে আমার অফিসঘর থাকবে না জেনে তিনি বললেন, ‘বোলটন তো এ-বছরটা থাকবে না। ওর ঘরটা তোমায় দেয় না কেন?’ বললাম, ‘শুনেছি, বিষয়টা বিবেচনা করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁর অসুবিধে সৃষ্টি না করার সিদ্ধান্ত হয়। রাজেশ্বরী যুক্তিটা মানতে চাইলেন না। সন্ধ্যার পার্টিতে তাঁর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হলো।

সোয়াসে প্রথম দিনটা আমার বেশ ভালো কাটলো।

৩.

আমার গবেষণার উপকরণ সোয়াসের লাইব্রেরিতে তেমন ছিল না। তবে অন্যান্য বিষয়ে পড়ালেখার জন্যে এ-গ্রন্থাগার আমার বেশ কাজে এসেছিল। আমি কাজ করেছিলাম ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে এবং প্রধানত ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। আগেরবার যেখানে কাজ করেছিলাম, ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরি তখনো সেখানেই অর্থাৎ মিউজিয়ম-ভবনেই ছিল। কিন্তু আগের জায়গা থেকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি উঠে এসেছিল ব্ল্যাকফ্রায়ার্স রোডে–ওল্ড ভিক ও ইয়ং ভিক থিয়েটারের কাছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে প্রথমে যে-কার্ড করেছিলাম ১৯৬৫ সালে, তার সূত্র ওঁরা খুঁজে বের করলেন এবং সেটারই নবায়ন হলো। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে অবশ্য নতুন করে কার্ড করতে হলো।

প্রথম দু-একদিনে এসব কাজ সারলাম। তারপর গেলাম বুশ হাউজে-বিবিসি বাংলা বিভাগে। জন ক্ল্যাপহাম সেখানে অধিকর্তা–একদা পাদরি ছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে অনেককাল বাস করেছেন। তার পরে আসেন কমল বোস। সৈয়দ শামসুল হক বলতেন, বুশ হাউসের ভিত্তির কাজ করার সময়ে রাজমিস্ত্রি দেখলো একটা লম্বা ছায়া পড়েছে ইটের ওপর–ফিরে তাকিয়ে সে যাকে দেখতে পেলো, তিনিই কমল বোস। তার পরে আছেন সিরাজুর রহমান–আমাদের সিরাজ ভাই–আমার অনেকদিনের পরিচিত। তারপর শ্যামল লোধ, নূরুল ইসলাম, দীপংকর ঘোষ, সৈয়দ শামসুল হক। চাকুরে না। হয়েও প্রোগ্রাম করতে আসেন অনেকে-নাজির আহমদ, নূরুস সাফা, নরেশ ব্যানার্জি, ঝর্ণা গোরলে, শফিক রেহমান, তালেয়া রেহমান, ওয়ালী আশরাফ, মানসী বড়ুয়া, আরো কেউ কেউ। সিরাজ ভাই আমাকেও সেই দলে ভিড়িয়ে দিলেন।

৪.

মাসাধিককাল বিদেশ সফরশেষে দেশে ফেরার পথে তাজউদ্দীন আহমদ লন্ডনে এলেন অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। খবর পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম হোটেলে। অনেক লোকজন ছিলেন সেখানে। আমরা তার শয়নকক্ষে গিয়ে বসলাম, কিন্তু সেখানেও কেউ কেউ ঢুকে পড়লেন। তাজউদ্দীন কথা বললেন। একটু ছাড়া-ছাড়াভাবে, যেন কিছুটা অন্যমনস্ক। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বব্যাংকের কাছে তিনি খাদ্যসাহায্য চেয়েছেন, বন্যা-নিয়ন্ত্রণে ও অধিকতর সার-উৎপাদনে অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্যে তাদের সহযোগিতা কামনা করেছেন। এই মুহূর্তে খাদ্যপরিস্থিতি নিয়ে তিনি বেশি চিন্তিত। সরকারি লঙ্গরখানা খোলা হয়ে থাকলেও মানুষ অনাহারে মরছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো নয়। তবে তাঁর সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা এই নিয়ে যে, স্বনির্ভর হওয়ার পথে আমরা এগোতে পারছি না। রাজনৈতিক সহনশীলতারও বড়ো অভাব। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত। ওয়াশিংটন থেকে দেশে ফিরেই তিনি ইস্তফা দেবেন।

তাজউদ্দীনের কাছ থেকে ফিরলাম একটু বিচলিত হয়েই। কিন্তু তাকে নিয়ে আরো বিষণ্ণতা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তিনি যে মন্ত্রিত্ব ছাড়বেন, সেকথা বোধহয় বেশি লোককে বলে ফেলেছিলেন। ফলে দেশে ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে লিখিত নির্দেশ পেলেন পদত্যাগ। করবার। অক্টোবরের শেষেই তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করলেন, কেবল স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্বত্যাগের সম্মানটুকু থেকে বঞ্চিত হলেন। আমরা যারা ঘটনাধারার সঙ্গে পরিচিত, তারা জানি, তাজউদ্দীন যথার্থই ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু পাথুরে প্রমাণ রয়ে গেল যে, তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমনকী, কী ভাষায় তিনি পদত্যাগপত্র লিখবেন, তাও স্থির করার সুযোগ পাননি। এই অসম্মান তার প্রাপ্য ছিল না।

লন্ডনের ওই সাক্ষাঙ্কারই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।

৫.

লন্ডনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতান আমার পূর্বপরিচিত–রাজনীতি ও ওকালতির পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চা করেন, আমার আব্বার সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল কলকাতা থেকে, তার এক মেয়ে ও এক ছেলের আমি সরাসরি শিক্ষক। ছেলেটি তার সঙ্গেই তখন লন্ডনে ছিল, ওয়েস্ট এন্ডের একটি সিনেমায় আশারের–দর্শকদের আসন দেখিয়ে দেওয়ার–কাজ নিয়েছিল। তাতে তার বাবার খুব আপত্তি–হাই কমিশনারের ছেলে হবে থিয়েটারের আশার! ফিরোজ বলে, আপনারা না শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে রচনা লিখতে শিখিয়েছেন! নিজের যোগ্যতায় যে কাজ পাই, তাই করে খাবো। বাবার ঘাড়ে বসে খাওয়ার চেয়ে তো ভালো। হাই কমিশনার একদিন বেবীকে ও আমাকে তার বাসভবনে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন–সেদিন অবশ্য ফিরোজ ছিল না। তিনি থাকতেন পাটনিতে, বেশ বড়ো একটা বাড়িতে। তা নিয়ে লন্ডনের বাঙালিরা সমালোচনা করতো এই বলে যে, আমাদের মতো দরিদ্র দেশের হাই কমিশনারের পক্ষে অমন বাড়িতে থাকা বিলাসিতা। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

ডেপুটি হাই কমিশনার ছিলেন ফারুক চৌধুরী–বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে আমার এক ক্লাস ওপরে পড়তেন। আগের মতোই হাশিখুশি দিলখোলা আছেন। আমার সহপাঠী নূরুল মোমেন খান ওরফে মিহির ছিল কাউনসেলর। সেকেন্ড সেক্রেটারি এ কে এম আবদুর রউফের কথা আগেই বলেছি–তার সৌজন্যে মাঝেমাঝে শুল্কমুক্ত পানীয় ও সিগারেট সংগ্রহ করা যেতো। সব মিলিয়ে লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের পরিবেশ আমার জন্যে বেশ অনুকূল ছিল।

অক্টোবর বা নভেম্বরে হাই কমিশনের মাধ্যমে কামাল হোসেনের চিঠি পেলাম–ইউনেসকো সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে প্যারিসে যাওয়ার জন্যে আমি যেন প্রস্তুতি নিই।

ব্যাপারটা এরকম। ইউনেসকোর সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের জন্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল যাবে। নেতৃত্ব দেবেন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। দেশের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা করে সদস্যসংখ্যা কম রাখা হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন প্রস্তাব করলেন, প্রতিনিধিদলে আমাকে সদস্য রাখা হোক–আমি লন্ডনে আছি, সেখান থেকে আমাকে প্যারিসে পাঠাতে সরকারের খরচা কম পড়বে। আসলে ব্যয়সংকোচটা বড়ো কথা নয়, আমাকে দলে অন্তর্ভুক্ত করার অজুহাত মাত্র, তবে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের কাছে তা গ্রাহ্য হয়েছিল।

আমার পক্ষে তখন যুক্তরাজ্যের বাইরে যেতে হলে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বৃত্তিদাতাদের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন, কেননা বৃত্তির একটা শর্ত ছিল এই যে, বৃত্তিভোগকালে ওই গবেষণার কাজ ছাড়া আমি অন্য কিছু করবো না। এখন একটা দরখাস্ত করলাম–আমাকে কয়েকদিনের ছুটি দেওয়া হোক বিনাবৃত্তিতে, আমি ইউনেসকোর সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেবো, ফিরে এসে আবার গবেষণার কাজ ধরবো। দরখাস্ত নিয়ে প্রথমে গেলাম প্রফেসর রাইটের কাছে। এমন আবদারের জন্যে তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না–কী করবেন, কী লিখবেন, কিছুই ভেবে পাচ্ছিলেন না। শেষে অ্যাসোসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজের অফিসে রেবেকা জেমসকে ফোন করে জানালেন তার বিপত্তির কথা। তারপর আমাকে বললেন, আবেদনপত্রটা আমি ফরোয়ার্ড করে দিই ওদের কাছে, কেমন? অর্থাৎ সুপারিশ করার কাজটা এড়িয়ে গেলেন। আমি তখন আবেদনপত্র নিয়ে গেলাম মিসেস জেমসের কাছে। তিনি মৃদু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে তুমি একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ-নইলে সরকার তোমাকে ইউনেসকোতে পাঠাতে চাইবে কেন? তবে বৃত্তির যা শর্ত, তাতে তোমাকে ব্রিটেনের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া শক্ত–তাও এমন কাজে যার সঙ্গে তোমার গবেষণার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তুমি যেতে পারলে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুশিই হবো-আর কিছু না হোক, তোমার একটা অভিজ্ঞতা হবে বলে। তাছাড়া, প্যারিস–ও, সেখানে আগে গেছো? তা হোক–ওটা এমন শহর যেখানে বারবার যাওয়া যায়। তোমার আবেদনপত্রটা নিয়ে আমি সেক্রেটারির কাছে যাই–দেখি, কর্তা কী বলেন!

খানিক পর ফিরে এসে বললেন, সেক্রেটারি তো তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দিলেন না। কাগজটা রেখে দিলেন। তুমি আমাকে পরশু সকালে একবার ফোন করবে? কী স্থির হয়, তোমাকে জানাবো। তোমাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেললাম বলে দুঃখিত।

তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম। যথাসময়ে ফোন করলাম। তিনি বললেন, আজ কি তুমি সারাদিনের মধ্যে একবার আসতে পারো? সেক্রেটারি কথা বলতে চান তোমার সঙ্গে।

ই ই টেম্পল উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে আমাকে বসতে বললেন, তবে আমার প্রার্থনায় তিনি যে বিরক্ত হয়েছেন, তা আমার অগোচর রইলো না। তিনি বললেন, বৃত্তির শর্ত সম্পর্কে তোমাকে তো আরেকবার বলার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমরা চাই না, আমাদের বৃত্তিভোগী কেউ রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ুক। আমি একটু চমকে উঠে বললাম, রাজনৈতিক কাজ আবার কোথায়? জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ হলেও না হয় বুঝতাম–আমি তো যেতে চাইছি ইউনেসকোর সাধারণ পরিষদে–সেটা তো শিক্ষাসংস্কৃতিমূলক কাজ। ভদ্রলোক ঈষৎ হাসির ভঙ্গি করলেন। বললেন, জাতিসংঘে এবং তার সকল অঙ্গ সংগঠনেই রাজনীতি আছে–দল আছে, গোষ্ঠী আছে; মত আছে, মতান্তর আছে; তদবির আছে, ভোটাভুটি আছে; প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে; পক্ষ আছে, বিপক্ষ আছে। আমাদের বৃত্তিভোগীরা তার সঙ্গে যুক্ত হবে, সেটা কেউ চাইবে না। তোমার সরকারকে তুমি বুঝিয়ে বোলো, এইখানে তোমার গবেষণার সময়টায় তারা যেন তোমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে দেয়। সেটা তোমার পক্ষে ভালো, আমাদের পক্ষেও সুবিধেজনক।

আমি পালাতে পারলে বাঁচি। সেখান থেকে সরাসরি আমাদের হাই কমিশনে এসে কামালকে বার্তা পাঠালাম–আমি যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছি না, বিকল্প প্রতিনিধি মনোনীত করুন।

৬.

ব্রিটিশ কাউনসিল থেকে একদিন কাজ সেরে বেরিয়ে আসছি। দেখা হয়ে গেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ড. রশিদুল হকের সঙ্গে। তিনি আমার আগের বছরে একই বৃত্তি নিয়ে এখানে এসেছিলেন। এখন ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, ফিরে যাওয়ার কথা তিনি ভাবছেন না।

কারণটা বুঝতে আমার বিলম্ব হয়নি। বিষয়টি সংক্ষেপে বললে বোঝা যাবে কি না জানি না, কিন্তু সবিস্তারে বললে হয়তো পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। রশিদুল হক যখন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সপরিবারে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তাঁর ভগ্নিপতি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা আতাউর রহমান কিছুটা দেরিতে হলেও পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে বিদেশ থেকে তিনি তাঁর জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেন রশিদুল হকের কাছে। বাড়িতে স্থান সংকুলান হবে না জেনে রশিদুল হক সেগুলো রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের কেন্দ্রীয় গুদামে। হঠাৎ ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর নেতৃত্বে একদল ছাত্র এক রাতে এইসব জিনিসপত্র নিয়ে এমন হই-হাঙ্গামার সৃষ্টি করে যে, রশিদুল হক বিস্মিত, অপদস্থ ও বিমূঢ় হয়ে যান। এ ঘটনায় তার প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়। তিনি যে চট্টগ্রামে ফিরতে চাননি, আমার বিশ্বাস, সেটিই ছিল তার প্রধান কারণ। কিছুকালের মধ্যে তিনি লিবিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে সরাসরি চলে যান। তার বহু বছর বাদে তিনি দেশে ফিরে আসেন।

লন্ডনে রশিদুল হকের সঙ্গে কথা বলে আমি যখন তাঁর মনোভাব আঁচ করতে পারি, তখন গভীর দুঃখ পেয়েছিলাম। তাঁর মতো দেশপ্রেমিক ও কৃতী অধ্যাপক মনের দুঃখেই যে দেশে ফিরতে চাইলেন না, সে-ক্ষতি তাঁর একার নয়।

ক্রিসমাসের অবকাশে লিডসে গেলাম সবাই মিলে। আবদুল মোমেন ও রোজীর বাড়িতে ওঠা গেল। মোমেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি লিডসে এসেছিলেন উচ্চশিক্ষা নিতে। মুক্তিযুদ্ধের কাজে নিজেকে জড়িত করায় তার পড়াশোনার কিছু ব্যাঘাত ঘটেছিল এবং আমরা যখন বিলেতে যাই তখনো তার রেশ কাটেনি। লিডসে আমাদের বন্ধু ওসমান জামাল ও মঞ্জু থাকতেন। জামালও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা সামান্য কিছু আগে-পরে কাটিরহাট-রামগড়-আগরতলা হয়ে কলকাতায় পৌঁছেই। জামাল একসময়ে লিডসে একটি স্কুলে পড়াতেন। কলকাতা থেকে তিনি সে-কাজে ফিরে যান। পরে মঞ্জু তার সঙ্গে যোগ দেন এবং তারা লিডসেই পাকাপাকিভাবে রয়ে যান। এই দুই পরিবারের বাইরে লিসে গিয়ে দেখা পেলাম কুদুস ও রেশমা, বেণু ও শাহীন এবং ইকবাল ও সাকীর। তাছাড়া আমারই মতো লন্ডন থেকে গেছেন সিভিল সার্ভিসের কামাল সিদ্দিকী–তিনিও তখন সোয়াসে পিএইচ ডি ডিগ্রির জন্যে গবেষণা করছেন। তার বোন পড়ে লিডসে–তার কাছেই গেছেন তিনি। বাঙালি আড্ডার জন্যে ও-ই যথেষ্ট সমাগম। বাঙালি আড্ডায় যেমন হয়, রাজনীতিই চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রে।

সরকারি কর্মকর্তা হলেও কামাল সিদ্দিকীর রাজনৈতিক সত্তা প্রবল। তিনি বাংলাদেশ সরকারের কঠোর সমালোচক–প্রবল বিরোধী বললেই ঠিক বলা হয়। সমাজতন্ত্রে নিবেদিতপ্রাণ মোমেনও সরকারের সমালোচক, তবে কামালের মতো অত তীব্র নন। জামাল প্রকৃতিগতভাবেই মৃদুভাষী ও মৃদুকণ্ঠ–তিনি সর্বদিক দেখতে অভ্যস্ত, এবং শুনতে অধিক আগ্রহী। সরকারের দোষত্রুটি কিছু দেখতে পেলেও আমি মোটামুটি তাকে সমর্থন করছি। এই অবস্থায় কামাল সিদ্দিকীর উত্তেজনা কিছু বাড়ে।

একরাতে এমনি উত্তেজিত আলোচনার মুখে আনন্দ আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে আড্ডারত মহিলাদের খবর দিলো, ও ঘরে ‘গোমলাল’ লেগে গেছে। কামালের বোন হেসেই অস্থির। সে আনন্দকে দেখে বলতো, ‘একেবারে মেজো ভাই’ অর্থাৎ কামাল সিদ্দিকী। আনন্দের চোখদুটো বড়ো, চুলও ছিল লম্বা–কোথাও তাদের সাদৃশ্য থেকে থাকবে।

দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার–অন্তত ভাবিত হওয়ার–যথেষ্ট কারণ ছিল। প্রথম ছিল দুর্ভিক্ষাবস্থা। এ-নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। বাংলাদেশে খাদ্যাভাব নিয়ে একটি ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৈরি তথ্যচিত্র আমরা দেখলাম টেলিভিশনে। লঙ্গরখানার ছবি–আনজুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িতে লাশ নিয়ে যাচ্ছে–তার ছবি। এক বৃদ্ধা লাঠিতে ভর করে কোনোমতে লঙ্গরখানায় যাচ্ছেন। যে-বাঙালি ছেলেটি দোভাষীর কাজ করছে, সে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, তার কী অসুবিধে। বৃদ্ধা বললেন, বাতের কষ্ট। ছেলেটি ইংরেজি করে বললো, ভাতের অভাব। পরিবর্তনটা ইচ্ছাকৃত। আমি বললাম, এটা অসংগত, বিকৃতি। কামাল তাতেই খুশি–টেলিভিশনের শ্রোতারা বেশির ভাগ তো ইংরেজিটাই মানবে।

খাদ্য-পরিস্থিতি ছাড়াও রক্ষীবাহিনী নিয়ে বিতর্ক আছে। তার ওপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্‌বেগজনক হয়ে পড়েছিল। ডিসেম্বরের শেষে সারা দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা, মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়ে যায়। আমার খালি মনে হয়, মাত্র দু বছর আগে যে-সংবিধান রচিত হলো এত কষ্টে ও এত যত্নে, কী হলো তার হাল!

লিডস থেকে ফিরে আসতে আসতে জরুরি ক্ষমতা আইন ঘোষিত হলো। সেই আইনবলে সভা, সমাবেশ, ধর্মঘট নিষিদ্ধ হয়ে গেল। তার আগে পুলিশের হাতে আটক অবস্থায় সিরাজ শিকদার নিহত হলেন। সংসদে এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এমন উক্তি করলেন যা মানবিক নয়!

আমি কখনোই সিরাজ শিকদারের রাজনীতির সমর্থক ছিলাম না। শ্রেণিসংগ্রামের নামে তাঁর দলীয় কর্মীদের হাতে অনেক নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বহু পরিবার ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু বিনাবিচারে পুলিশের গুলিতে কারো মৃত্যু কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। সংসদে বঙ্গবন্ধু যা বললেন এবং যেভাবে বললেন, তাঁর মতো সংগ্রামী রাজনীতিকের ও দরদি মানুষের তা উপযুক্ত হয়নি। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।

৭.

১৯৭৫ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি মন্ত্রিত্ব থেকে ছুটি নিয়ে কামাল হোসেন অক্সফোর্ডে চলে এলেন অল সোলস কলেজের ফেলো হয়ে। সঙ্গে তার পরিবারের সকলে। প্রথম সুযোগেই আমরা সবাই মিলে অক্সফোর্ডে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করে এলাম। তখন জানলাম, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নূরুল ইসলাম সরকার থেকে পদত্যাগ করে সেন্ট অ্যান্থনিজ কলেজে যোগ দিয়েছেন ফেলো হয়ে।

সেদিন রোববার ছিল। আমি একাই লন্ডন থেকে গেছি অক্সফোর্ডে। কামালের বাড়িতে নূরুল ইসলামকে পেলাম। খানিকক্ষণ পরে এক বাঙালি ছাত্র এসে খবর দিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার এবং একটিমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একইসঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও বাকশালের সভাপতির পদ গ্রহণ করেছেন। শুনে আমি খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। নূরুল ইসলাম আমাকে বললেন, ‘অত চিন্তার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে কোনো ব্যবস্থাই ঠিকমতো চলে না। দেখবেন, আপনি যেরকম একদলীয় ব্যবস্থার কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করছেন, আসলে ব্যাপারটা সেরকম হবে না। কামালের প্রতিক্রিয়া থেকে ধারণা হলো, এমন যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে, তা তিনি জানতেন। আমার এখন প্রত্যয় হলো যে, এই ধরনের অবস্থা থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতেই তিনি লেখাপড়ার জগতে ফিরে এসেছেন।

আমার মনে পড়ল, আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের সহপাঠী, সিভিল সার্ভিসের সদস্য, সদ্য পাকিস্তান-প্রত্যাগত ড. আবদুস সাত্তার একদিন ঢাকায় কামালের বাড়িতে বসে তানজানিয়ার আদর্শে বাংলাদেশে একদলীয় সরকারপদ্ধতি প্রবর্তনের পক্ষে খুব যুক্তি দিচ্ছিলেন। কামাল তাঁকে এসব কথা বলতে নিষেধ করেন এবং এক পর্যায়ে তার বাড়ি থেকে সাত্তারকে চলে যেতে প্রায় বাধ্য করেন। তবে এতে একদলীয় রাষ্ট্রের পক্ষে সাত্তারের অভিযান ব্যাহত হয়নি। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু আমার সামনে একাধিকবার বলেছেন, আমি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দুইই চাই একসঙ্গে। তবে যদি সমাজতন্ত্রের জন্যে গণতন্ত্র ছাড়তে হয়, তাহলে আমি তা-ই করবো। একবার একজন সংসদ-সদস্য যুগোস্লাভিয়া থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে সে-দেশের খুব সুখ্যাতি করছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘টিটোকে তো আর বিরোধী দল কি লালবাহিনী সামলাতে হয় না? তখন বোধহয় লালবাহিনী একদিন ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু। আমাকে বললেন, ‘কোথাও সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ডাকে, এমন শুনেছ?’ (বাকশাল-গঠনের ঠিক আগে জরুরি ক্ষমতা আইনে শ্রমিক লীগের সভাপতি ও লালবাহিনীর প্রধান, সংসদ-সদস্য আবদুল মান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়।) বঙ্গবন্ধুর এসব কথার তাৎপর্য এখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

লন্ডনে ফিরে এসে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে ফোন করলাম। বাকশালের প্রতিষ্ঠায় তিনি আমারই মতো উদবিগ্ন। পরে অবশ্য তাঁর মত পালটে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি প্রকাশ্যেই বাকশালের সমর্থনে লিখেছেন ও বলেছেন। আমি তখনো ভেবেছি এবং এখনো মনে করি, বাকশাল গঠন করাটা ভুল হয়েছিল।

চতুর্থ সংশোধনীর বিরোধিতা করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। বাকশালে যোগ না দেওয়ায় পরে সংসদ-সদস্যপদ হারান আবদুল্লাহ সরকার ও মইনুদ্দীন আহমদ মানিক। কিন্তু জনে জনে দলে দলে নানা পেশার নানা বয়সের নানা দলের লোক একাকী কিংবা শোভাযাত্রা করে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। মেজর-জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ সশস্ত্র বাহিনীর কাউকে কাউকেও বাকশালে যুক্ত করা হয়েছিল। তখন যারা সোৎসাহে বাকশালে যোগ দেন, বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরে তারা অনেকে তেমনি উৎসাহের সঙ্গে বাকশালের নিন্দা করেছিলেন।

৮.

সোয়াসের লাইব্রেরিতে কাজ করতেন আমার শিক্ষক সৈয়দ আলী আশরাফের শ্যালিকা। তিনি একদিন আমার কাছে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশে নাকি আজান দেওয়া বন্ধ এবং মসজিদে গিয়ে নাকি নামাজ পড়া যায় না? অপপ্রচার কতদূর গড়াতে পারে এবং তাতে মানুষ কতটা আস্থা স্থাপন করতে পারে, সে-কথা ভেবে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাকে বললাম, এটা সর্বৈব মিথ্যে প্রচারণা–ওর সত্যতা তাঁদের ভাইজানের–অর্থাৎ সৈয়দ আলী আহসানের কাছ থেকেই তারা জেনে নিতে পারেন। মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আলী আহসান ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে তার ওপরে তাদের আস্থা বিচলিত হয়েছে।

ওদিকে আমার এক ছাত্রী একদিন বাসায় এলো পরামর্শ নিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সে ঢাকা বেতারে খবর পড়তো। তাতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই তার কিছু সমস্যা দেখা দেয় এবং কোনোরকমে একটা পাসপোর্ট সংগ্রহ করে সে শিশুসন্তান নিয়ে বিলেতে চলে আসে। লন্ডনে সে একটি অফিসে কাজ পেয়েছিল, সেসঙ্গে তার প্রচলিত নাম পালটে ভালো নামের একাংশ ব্যবহার করে বিবিসির বাংলা বিভাগে বেতার-অনুষ্ঠান করতো। এখন তার এদেশে থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে, তবে সে দেশে ফিরতে চায় না। বিলেতে থেকে যাওয়ার যে সহজ উপায় তার সামনে খোলা আছে, তা হলো একজন ব্রিটিশ নাগরিককে টাকা পয়সা দিয়ে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে দেখানো-বিয়ে করা। উপার্জনের উপায় হিসেবে অনেক ব্রিটিশ নর-নারী এমন করে থাকে। কিন্তু আমার ছাত্রীর ভয় হলো, এই মিথ্যে বিয়ের পাত্র যদি হঠাৎ করে তার কাছে দাম্পত্য সম্পর্ক দাবি করে, তাহলে কী হবে? আমি এত অল্পদিন হয় ওদেশে গেছি এবং এসব বিষয়ে এত কম জানি যে, তাকে কোনো পথ বাতলাতে পারলাম না। পরে, মনে হয়, তাকে এরকম ঝুঁকির মধ্যে যেতে হয়নি, ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে সে বিলেতে থাকার সময় বাড়াতে পেরেছিল। বিবিসিতেও তার আসা-যাওয়া অনেকদিন অব্যাহত ছিল।

বিবিসিতে আমিও নিয়মিত অনুষ্ঠান করতে লাগলাম। সাম্প্রতিক ঘটনার অনুষ্ঠান প্রবাহ, সংস্কৃতি, শিল্প ও বিজ্ঞান–এসবে। এরমধ্যে প্রবাহের কাজটা ছিল তাৎক্ষণিক অনুবাদের, বাকি সব বাড়িতে বসে তৈরি করা যেতো। প্রবাহের কাজটা হতো দুপুরবেলায়–তা প্রচার হতো সরাসরি।

তখন লাইব্রেরি থেকে বুশ হাউসে চলে যেতে হতো। দুপুরের খাওয়াটা সারা হতো ওই বাড়ির ক্যান্টিনে। বাকি সব অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং হতো বিকেলে বা সন্ধ্যায়। তখন লাইব্রেরির পাঠ শেষ করে এসে কাজটা করা যেতো। সেসঙ্গে বুশ হাউসের নিচের তলায় বিবিসি ক্লাবে তুমুল আড্ডা দেওয়া যেতো। সিরাজুর রহমান ও শ্যামল লোধ খুবই আড্ডাবাজ মানুষ–তাদের উপস্থিতি ছিল প্রত্যহ। মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল সিরাজুর রহমানের, আপ্যায়ন করতেও তিনি ছিলেন অকৃপণ। নূরুল ইসলাম ও দীপঙ্কর ঘোষও প্রায় আসতেন। অনুষ্ঠান থাকলে তো বটেই, অনুষ্ঠান না থাকলেও নাজির আহমদ সেখানে আসতেন আর তাঁর অফুরন্ত ভান্ডার থেকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা বলে আসর জমিয়ে রাখতেন। আমার মতো আর যারা বাইরে থেকে অনুষ্ঠান। করতে আসতেন–শফিক রেহমান, তালেয়া রেহমান, নূরুস সাফা, নরেশ চক্রবর্তী–এই আড্ডায় তাদের যোগদানও ছিল অনিবার্য। আচ্ছাটি খুবই উপভোগ্য হতো, আমার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে সত্যিই অনুকূল। মাঝে মাঝে বিবিসি ক্লাব থেকে শ্যামল লোধের সঙ্গে বেরিয়ে বাসে চেপে আসতাম ওয়াটারলু। স্টেশনে। শ্যামল থাকতেন লন্ডনের একটু বাইরে–ওয়াটারলু থেকে তিনি বাড়ি যাওয়ার ট্রেন ধরতেন, আমিও সেখান থেকে টিউব ধরে বাড়ি ফিরতাম। কোনোদিন উদ্দিষ্ট ট্রেন না ধরতে পারলে কিংবা ট্রেনের দেরি থাকলে স্টেশনেরই কোনো বারে বসে শ্যামল আরেক পাইন্ট বিটার খেয়ে নিতেন। তাঁর ট্রেন না আসা পর্যন্ত আমি তাকে সঙ্গ দিতাম।

প্রবাহের কাজ করতাম বলে বাংলা বিভাগের সাপ্তাহিক রোস্টারে আমার নাম মুদ্রিত হতো। আমার ছাত্র, লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমতের সম্পাদক এ টি এম ওয়ালী আশরাফ একদিন খানিকটা ইতস্তত করে বলেই ফেললো যে, রোস্টারে এভাবে নাম থাকাটা আমার অধ্যাপক পদমর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে তার মনে হয়–আমি যেন বিষয়টা ভেবে দেখি। ওয়ালী আশরাফ নিজেও বিবিসিতে অনুষ্ঠান করতো। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াটা আমার পক্ষে অসম্মানজনক বলে তার মনে হয় কি না। সে বললো, অনুষ্ঠান করতে কোনো বাধা নেই, কিন্তু আর দশজনের সঙ্গে বার ও সময় উল্লেখ করে কর্তব্যতালিকায় যেভাবে আমার নাম দেওয়া হয়, তাতে আমাকে বিবিসির চাকুরে বলে মনে হয়। আমি বললাম, কাজটা যদি অসম্মানজনক হয়, তাহলে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়মকানুন বা আনুষ্ঠানিকতা মানতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ওয়ালী আমার যুক্তি যে মানলো তা নয়, তবে চুপ করে গেল। তার কথাও আমি স্বীকার করিনি, কিন্তু আমার সুনাম ও সম্মানরক্ষায় তার এই উদ্বেগ আমার মন স্পর্শ করেছিল। তার অনুরোধে কিছুদিন আমি জনমতে লিখতে আরম্ভ করেছিলাম, তবে তা বেশিদিন চালাতে পারিনি। সেসব লেখার সম্মানী সে নিয়মিত পাঠিয়ে দিতো। বৃত্তির অতিরিক্ত কিছু উপার্জন যে আমার প্রয়োজন, তা সে বুঝেছিল।

৯.

ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে আমার গবেষণার উপকরণ ছিল অপেক্ষাকৃত কম, তাই সেখানকার কাজ আগে শেষ করতে চাইলাম। আঠারো শতক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিত্যনতুন যেসব আইন প্রণয়ন করছিল, তার বাংলা মুদ্রিত অনুবাদ সেখানে রক্ষিত ছিল। একেবারে আন্দাজের ওপর ভর করে ওয়ারেন হেস্টিংসের ব্যক্তিগত কাগজপত্রের সংগ্রহ খুঁজতে আরম্ভ করলাম এবং সত্যিই তার মধ্যে বাংলা হস্তাক্ষরে কাগজ পেয়ে গেলাম। লন্ডনে যখন হেস্টিংসের অভিশংসন হচ্ছিল, তখন বড় মানুষ ও সওদাগর ও আশরাফ ও ভদ্রলোক কলিকাতা শহরের বাসীসকল’ হেস্টিংসের পক্ষসমর্থন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টরদের কাছে বাংলা ভাষায় এক আবেদনপত্র–এখনকার ভাষায়, স্মারকলিপি–পাঠিয়েছিলেন, তার একাধিক নকল পাওয়া গেল। ওই লাইব্রেরিতে টোকাটুকি যা করার করলাম, বেশকিছু কাগজপত্রের ফটোকপিও সংগ্রহ করলাম। যেদিন ফটোকপি পেলাম, সেদিন এই ভেবে লাইব্রেরি থেকে বের হলাম যে, আপাতত এখানে আর না এলেও চলবে।

বাড়ি ফেরার পথে সেইদিনই টিউবে আমার ব্রিফকেস ফেলে এলাম। আমার যত টোকা, যত ফটোকপি, ঠিকানা ও টেলিফোন-নম্বরের বই, চেকবই, এটাসেটা–সবই তার মধ্যে। কী করে যে ব্রিফকেস ছাড়া গাড়ি থেকে নামলাম, সেটা ভেবে অবাক হই এবং নিজেকে ধিক্কার দিই। যখন টের পেলাম, তখনো অবশ্য ট্রেনটা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে বলে কোনো লাভ হলো না। পরদিন যথারীতি লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডে ফরম পূরণ করে হারানোর খবর জানালাম। কিমাশ্চর্যতঃপরম! আমাদের ডাক এলেই ওপর থেকে শব্দ পেয়ে আনন্দ এক দৌড়ে নিচে চলে যেতো চিঠিপত্র আনতে। একদিন সে একতলা থেকেই চেঁচাতে আরম্ভ করলো, তোমার ব্যাগ পাওয়া গেছে।’ খোলা ডাকে যে-চিঠি এসেছিল, তাতে ছড়ি-ছাতা-ব্যাগের ছবি ছিল, তা দেখেই সে অনুমান করে নিয়েছে। সেই চিঠি নিয়ে যখন লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডের জায়গায় পৌঁছোলাম, ব্রিফকেস সমর্পণ করে বয়স্ক অ্যাটেনডেন্ট সন্দেহ প্রকাশ করলেন, আমার তালিকার সব জিনিস তাতে আছে কি না। আসলে সবই ছিল, কিছুই খোয়া যায়নি। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন বিলেতে যান, তখন সেখানে পৌঁছে ইংরেজি গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপিসমেত একটা পোর্টম্যানটো ব্যাগ ব্রিটিশ রেলে ফেলে এসেছিলেন রথীন্দ্রনাথ–সেটিও লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড থেকে পাওয়া গিয়েছিল।

ব্রিফকেস ফেরত পাওয়ার আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। ১৯৬৫ সালে সেখানে যখন কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলাম, তখন। লাইব্রেরিটা ছিল হোয়াইটহলের কাছে। এখন তা উঠে এসেছে ব্ল্যাকফ্রায়ার্সে। ওয়াটারলু স্টেশনে নেমে–সেটা আমার বাসস্থানের অপেক্ষাকৃত সন্নিকটে–ওল্ড ভিক-ইয়ং ভিক পেরিয়ে সেখানে পৌঁছোতে হয়, বেশি হাঁটতে হয় না। এখানকার পরিবেশ ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরির মতো নৈর্ব্যক্তিক নয়। পৃথিবীর নানান দেশ থেকে নানান বিষয়ে গবেষকেরা ছোটেন মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে। পরস্পরের আগ্রহের ক্ষেত্রের ভিন্নতাহেতু একজনের সঙ্গে আরেকজনের বন্ধুতা হয় না সহজে। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির বেশির ভাগ পাঠক গবেষণা করেন। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা নিয়ে–চীন বা ইরান, ইরাক বা মিশর নিয়ে কাজ করেন, এমন গবেষকও আছেন, তবে তাদের সংখ্যা কম। অনেকে একই দেশ থেকে বা একই প্রতিষ্ঠান থেকে পূর্বপরিচয় নিয়ে আসেন, গবেষণার ক্ষেত্র সম্পর্কে পারস্পরিক কৌতূহলের কারণে অনেকের মধ্যে নতুন বন্ধুত্ব হয়। লাইব্রেরির কর্মকর্তা ও গবেষকদের মধ্যেও সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে অল্পকালে। আমি তো ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহীর অনেককে পেলাম, কলকাতা-দিল্লি-কলম্বোরও কাউকে কাউকে। দু-চারজন ইংরেজ পণ্ডিতের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল এবং লাইব্রেরির কর্মকর্তাদের কারো কারো সঙ্গেও ভাব হয়ে গেল।

প্রতিভা বিশ্বাস ছিলেন উত্তর ভারতীয় আধুনিক ভাষার বইপত্রের দায়িত্বে। আমার দু-একটি বই যে লাইব্রেরির সংগ্রহে আছে, এ-কথা তিনি উৎফুল্ল হয়ে। জানালেন। অল্পবয়সে বিধবা হয়ে বেশ সংগ্রাম করে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ভদ্রমহিলা। এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বেশ হাসি-হাসি মুখ, তবু মনে হয় সদাই একটা চিন্তা লেগে আছে তার মনে। পদমর্যাদায় তার ওপরে মাইকেল ও’কিফ–সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত বই ও পাণ্ডুলিপির সহকারী সংরক্ষক। তার সঙ্গে সহজে সখ্য হয়ে গেল। কিছু না জেনেই পরে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তালিকায় নেই, এমন বাংলা কাগজপত্র লাইব্রেরির কোথাও গচ্ছিত আছে কি না। সে বললো, আছে কিছু, তবে সেসব যে কী, তা আমার জানা নেই, লাইব্রেরির আর কেউ জানে না। আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। বললাম, সেগুলো একবার দেখা যায় না? সে বললো, জানাব। তারপর একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে গেল স্ট্যাকে। সেখানে একটা শেলফের একেবারে নিচের তাকে বেশকিছু কাগজপত্র, সুতোয় গাঁথা খাতার মতো। এমন গোটাদুই খাতা পড়ার ঘরে এনে দেখার ব্যবস্থা হলো। খানিক পরীক্ষার পরে বুঝতে পারলাম, এসব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির দৈনন্দিন চিঠিপত্র। ঢাকা কুঠি কাপড়ের ব্যবসা করতো। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরার কয়েকটি জায়গায় ছিল কোম্পানির আড়ং। সেসব আড়ংয়ের গোমস্তারা তাঁতিদের ফরমাশ ও দাদন দিয়ে কাপড় তৈরি করিয়ে নিতো। ফরমাশ আসততা লন্ডন থেকে কলকাতায়, কলকাতা থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে এসব আড়ংয়ে, আড়ং থেকে তাঁতিদের কাছে। তাঁতিরা কাপড় বুনে দিলে তা যাচাই-বাছাই হয়ে উলটো পথে লন্ডনে পৌঁছোতো। চিঠিগুলো কুঠি ও আড়ংয়ের মধ্যে চালাচালি হয়েছিল। বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটা অধ্যায় স্পষ্ট হয় এসব চিঠিপত্রের সাহায্যে। এর ভাষা ও রীতিও উল্লেখযোগ্য। আমি কিছু চিঠি হাতে নকল করে নিতে থাকলাম–কেননা এগুলো ফটোকপি করা যাবে না।

এই অবস্থায় মাইকেল একদিন বললো, তুমি কি এই কাগজপত্রের একটা তালিকা করে দেবে–সামান্য কিছু বিবরণ দিয়ে? আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। খাতাগুলোতে ওদের রীতি-অনুযায়ী ডাক-নম্বর বসালাম। বিবরণীতে কাগজের মাপ-জোক, ধরন, প্রেরক ও প্রাপকের নামধাম, পৃষ্ঠা সংখ্যা ইত্যাদি দেওয়া গেল। নিজে হাতে টাইপ করে একটা বাইন্ডার লাগিয়ে A Handlist of Uncatalogued Bengali Manuscripts in the India Office Library and Records নাম দিয়ে তালিকাটা মাইকেলকে দিলাম। সে খুব খুশি হয়ে বললো, এটা বরঞ্চ তুমি আমাদের ডাইরেক্টরের হাতে দাও–আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করছি! মিস জোন ল্যানকাস্টার ডাকসাইটে গ্রন্থাগারিক–সহকর্মীরা তাঁকে একটু বেশিই সমীহ করতেন। তার হাতে যখন তালিকাটি সমর্পণ করলাম, তিনি যথেষ্ট সন্তোষ ও সৌজন্য প্রদর্শন করলেন। বললেন, তার দেখা হয়ে গেলে ওটা ক্যাটালগ-হলে অন্যান্য তালিকা গ্রন্থের সঙ্গে স্থান পাবে। এটা আমার জন্যেও ছিল আশাতীত পুরস্কার।

১০.

এর আগে উল্লেখযোগ্য দুটি ঘটনা ঘটেছে।

১৯৭১ সালে দিল্লিতে যে-দুই বিশিষ্ট ইতিহাসবিদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, তাঁরা দুজনেই তখন ইংল্যান্ডে। তপন রায়চৌধুরী আছেন অক্সফোর্ডে। তিনি নাফিল্ড কলেজে আলোচনাচক্রের আয়োজন করছেন ১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মকালে। আমাকে আদেশ দিলেন একটি লিখিত প্রবন্ধ পড়তে। খেটেখুটে একটা লেখা দাঁড় করলাম, Towards a redefinition of identity: East Bengal, 1947-71 নামে। সেটা সেখানে পড়া হলো। সমাগম হয়েছিল বেশ ভালো। আমার প্রবন্ধটা দীর্ঘ হওয়ায় এবং সবটা পড়তে বাধা না পাওয়ায় পুরো সময়ই লেগে গেল। ফলে প্রশ্নোত্তর পর্বের আর অবকাশ রইলো না। একদিকে বেঁচে গেলাম, অন্যদিকে অন্যের দৃষ্টির আলোক থেকে বঞ্চিত হলাম। তবে যারা আমাকে মতামত জানাতে এলেন, তাঁরা সবাই ভালো বললেন। সেটা কতটা সৌজন্যবশত বলা, আর কতটা তাঁদের সত্য অনুভূতির প্রকাশ, বলতে পারবো না।

রণজিৎ গুহ অধ্যাপনা করছিলেন সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। অক্সফোর্ড বনেদি, সাসেক্স নবীন-যুদ্ধোত্তর রেডব্রিক ইউনিভার্সিটিগুলির একটি। এর অবস্থান রবীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনের স্মৃতিধন্য ব্রাইটনে-বড় সুন্দর জায়গা। রণজিৎ গুহের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার ও তার স্ত্রীর আতিথ্য গ্রহণ করতে হলো। অধ্যাপক তখন সাবঅলটার্ন হিস্ট্রির তত্ত্ব ও সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত। নীলদর্পণ নিয়ে সদ্য চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন Journal of Peasant Studies নামে গবেষণা-পত্রিকায়। প্রবন্ধের একটি রিপ্রিন্ট আমাকে দিয়ে বললেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আফ্রিকান অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সেমিনারে একটি প্রবন্ধ পড়তে হবে। তার ইচ্ছে, উনিশ-বিশ শতকের বাঙালি মুসলিম লেখকদের চিন্তাধারা সম্পর্কে আমি লিখি, তবে ইচ্ছে করলে অন্য বিষয়েও লিখতে পারি। তার প্রস্তাবিত বিষয়ে লেখা আমার পক্ষেও সহজ। The World of the Bengali Muslim Writers in the Nineteenth Century (1870-1920) নামে একটি প্রবন্ধ সেখানে পাঠ করলাম। সামান্য আলোচনা হলো। সভাভঙ্গের পরে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও কর্মী বিপ্লব দাশগুপ্ত ও তার স্ত্রী এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন। বিপ্লব দাশগুপ্ত বললেন, প্রবন্ধের নাম শুনে তার সন্দেহ হয়েছিল, লেখাটায় সাম্প্রদায়িকতার রেশ থাকতে পারে। তিনি তেমন মনে করেই তা শুনতে এসেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলেন, তার আশঙ্কা অমূলক।

পরে রণজিৎদাকে আমাদের সংলাপের কথা বললাম। তিনি বেশ চটলেন। বললেন, এই হলো তোমাদের বামপন্থী বুদ্ধিজীবী। নাম শুনে, ভেতরে না ঢুকে, একটা ধারণা করে ফেললেন!

নীলদর্পণ নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধ সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন রণজিৎদা। বললাম মনে হচ্ছে, দীনবন্ধু মার্কসবাদ কেন জানলেন না, তা নিয়ে আপনি ক্ষুব্ধ।’ রণজিৎ গুহ বললেন, ‘বটেই তো। নীলদর্পণ লেখার আগেই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো এবং মার্কসের অন্য লেখা বেরিয়ে গেছে। কলকাতায়ও তা পাওয়া যেত। উনি পড়েননি কেন?’ এটা বোধহয় কৌতুকের ছলে বলা। তবে ওই প্রবন্ধে তার একটা প্রতিপাদ্য ছিল এই যে, সংকটের সময়ে কোন পক্ষ নেবেন, মধ্যবিত্ত তা স্থির করতে পারে না, ফলে তার ধ্বংস হয়ে পড়ে অনিবার্য। এই কথা, নাটকের বসু-পরিবার এবং নাট্যকার সম্পর্কে সমানভাবে প্রযোজ্য।

পরে আমার ওই ইংরেজি বক্তৃতাদুটির বাংলা ভাষ্য প্রকাশ করেছিলাম স্বরূপের সন্ধানে (ঢাকা, ১৯৭৬) বইতে। মূল ইংরেজি লেখা আরো পরে সংকলিত হয় আমার Creativity, Reality and Identity (ঢাকা, ১৯৯৩) গ্রন্থে। তপন রায়চৌধুরী ও রণজিৎ গুহের উদযোগ ছাড়া এ-দুটি কখনো লেখা হতো না।

১১.

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের শিক্ষক গিয়াসউদ্দীন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন। তিনি ঠিক রাজনৈতিক লোক ছিলেন না, কিন্তু মনেপ্রাণে পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি কাজ করেছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আর দেশে ফেরেননি। কষ্টেসৃষ্টে বিলেতে প্রবাসজীবন যাপন করছিলেন। আর চট্টগ্রামে তার স্ত্রী চমন আরা পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনাতিপাত করছিলেন আরো কষ্টে। ভদ্রমহিলা ছিলেন বেবীর সহপাঠিনী। তাঁর পরিবারের জন্য আমাদের অনেকেরই সহানুভূতি ছিল। আমি যখন লন্ডনে যাই, তখন সহকর্মীদের কেউ কেউ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, আমি যেন গিয়াসউদ্দীনকে দেশে ফিরে আসতে প্রণোদিত করি। তিনি যেহেতু বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য স্বীকার করেননি, তাঁর পক্ষে। পাসপোর্ট সংগ্রহ করাও ছিল কঠিন। উপাচার্য আবুল ফজল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাদের হাই কমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানকে একটি আধা-দাপ্তরিক চিঠি লিখে আমার হাতে দিলেন। তাতে তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন, গিয়াসউদ্দীনের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনে হাই কমিশনার যেন ব্যক্তিগত উদযোগ নেন। আমাকেও বলে দিলেন, সৈয়দ আবদুস সুলতানকে যেন আমিও ব্যক্তিগতভাবে সব বিষয়টা বুঝিয়ে বলি।

লন্ডনে আমি পৌঁছোবার কিছুকাল পরে গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হলো। তারপর তিনি দিনক্ষণ ঠিক করে আমাদের বাসায় এলেন। তাঁর ভয়, দেশে ফিরলে তিনি গ্রেপ্তার হবেন এবং তাঁকে জেল খাটতে হবে। আমি তাকে বললাম যে, সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হওয়ায় সে-ভয় নেই; তাছাড়া, উপাচার্য স্বয়ং তাঁর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন, তিনি যাতে পাসপোর্ট পেতে পারেন সেজন্যে উপাচার্য চিঠি দিয়েছেন হাই কমিশনারকে, এবং এমন একজন প্রভাবশালী উপাচার্যের সাহায্য পেলে অনেক বাধাবিপত্তি তিনি পার হতে পারবেন। এতে গিয়াসউদ্দীন আরো ভয় পেলেন। তার মনে হলো যে, পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে তাঁকে কোনোমতে দেশে নিয়ে ফেলার পরিকল্পনা। নইলে তার মতো একজন সহকারী অধ্যাপকের জন্যে উপাচার্যের এত উৎকণ্ঠা কেন! যদিও তিনি আমাকে বললেন, ‘ভেবে দেখি’, কিন্তু আমি বুঝে গেলাম যে, তিনি দেশে ফিরবেন না। পরিবারের বিষয়ে তিনি তেমন উদৃবিগ্ন ছিলেন না। তাঁর ভরসা মুখ্যত আল্লাহর উপরে এবং গৌণত শ্বশুরকুলের উপরে। অতএব তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি রয়ে গেলেন–আমার সঙ্গেও আর কোনো যোগাযোগ রাখলেন না।

পরে, ১৯৭৬ সালের দিকে, গিয়াসউদ্দীন দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মে যোগ দেন। শুনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন, এই দাবিতে তিনি দু বছরের অ্যান্টি-ডেটেড সিনিয়রিটি দাবি করেছিলেন। প্রমাণস্বরূপ নাকি মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সংগৃহীত বিলেতের কোনো তহবিলে দু পাউন্ড চাঁদা দেওয়ার একটা রসিদের ফটোকপি দাখিল করেছিলেন। তবে এটা আমার শোনাকথা মাত্র।

১২.

দেশে রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতির মন্ত্রিসভা গঠিত হয়ে গেছে জানুয়ারিতে। মন্ত্রীদের নামের ঘোষিত তালিকায় কামাল হোসেনের নাম ছিল, কিন্তু তিনি তখন অক্সফোর্ডে। দেশে গিয়ে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্যে তার কাছে তাগাদা আসতে থাকল। বঙ্গবন্ধুও ব্যক্তিগত পত্র দিলেন। কামাল এসব চিঠির জবাবে ইংরেজিতে খসড়া তৈরি করে রাখেন, আমি অক্সফোর্ডে গেলে তার বাংলা করে দিই, তিনি তা কপি করে পাঠিয়ে দেন স্বাক্ষর দিয়ে। কামাল অক্সফোর্ডে তাঁর। দায়িত্বের কথা বলেন, মন্ত্রিত্ব থেকে আপাতত অব্যাহতি চান, রাজনীতিতে পুনরায় যোগ দেওয়ার জন্যে সময় প্রার্থনা করেন। আমরা দেশের পরিস্থিতি আলোচনা করি, হামিদা মৃদু হেসে বলেন, কনশেন্স-টকের সময় এক ঘণ্টা–তারপর সবার সঙ্গে বসে সময় কাটাতে হবে।

কামালের কাছে একবার গিয়ে জানতে পারলাম, জার্মানির কোনো এক পত্রিকায় ঢাকায় দেওয়া ফজলুল হক মনির সাক্ষাঙ্কার প্রকাশিত হয়েছে। তাতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কামালের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য আছে। তিনি যে জাতীয় কর্তব্য পালন না করে বিদেশে বসে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করছেন, তা নিয়ে কটাক্ষ আছে, কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক কথা, বাংলাদেশের প্রতি কামালের আনুগত্যে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে বাকশালের তিন সম্পাদকের একজন–এমনিতেই প্রতাপশালী, তার ওপরে আনুষ্ঠানিক পদ অলংকৃত করে রয়েছে।

স্বভাবতই কামাল খুব ব্যথিত হলেন। কেন তিনি এই আকস্মিক আক্রমণের লক্ষ্য হলেন, এ-প্রশ্ন নিশ্চয় তাঁর মনে উঠে থাকবে। কিন্তু তার চেয়ে প্রবল হলো এই জিজ্ঞাসা যে, এই আক্রমণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আদৌ ওয়াকিবহাল কি না। এই প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কী করা উচিত, এ-প্রশ্নও দেখা দিলো। শেষ অবধি তিনি স্থির করলেন, ওই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন না, তবে বঙ্গবন্ধুকে তার ক্ষোভের কথা জানাবেন।

অক্সফোর্ড থেকে ফিরে আসার পরদিন সকালে বি বি সি-তে গিয়েছি। জন ক্ল্যাপহাম আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, আজকের অনুষ্ঠানের কোনো কাজ আপনাকে করতে হবে না, আমার হাতে একটা স্পেশাল রিপোর্ট আছে–এটির বাংলা অনুবাদ করে দিতে হবে। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি, কামাল সম্পর্কে সেই জার্মান পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের বি বি সি-র নিজস্ব ইংরেজি অনুবাদ। আমি বাংলা ভাষ্য তৈরি করে দিলাম–পরে সেটা কী কাজে লাগানো হয়েছিল, তা আমার জানা নেই। তবে খুব সম্ভব, বিষয়টি নিয়ে কামালের মন্তব্য চাওয়া হয়েছিল, তার জন্যে অবশ্য বাংলা অনুবাদের প্রয়োজন ছিল না।

কামাল অবশেষে স্থির করলেন, মার্চ মাসের মধ্যভাগে একাই দেশে ফিরবেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইবেন। হামিদা এবং আমি দুজনেই বললাম, দেশে ফিরে এলে তাকে শপথ নিয়ে মন্ত্রিত্ব করতে হবে–কেননা, এতকাল ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব তারই জন্যে রেখে দেওয়া আছে। কামাল আশা প্রকাশ করলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে তিনি আবার অক্সফোর্ডে ফিরে আসতে পারবেন, তবে তার এ-কথায় আস্থার জোর পাওয়া গেল না।

কামাল ঢাকায় ফিরলেন এবং অচিরেই মন্ত্রিত্বের শপথ নিলেন। তাঁর অক্সফোর্ডে প্রত্যাবর্তন আপাতত অনিশ্চিত হয়ে রইল। সারা-দীনা সেখানে স্কুলে যাচ্ছে, হামিদা সংসার চালাচ্ছেন। একবার সারাকে ডাক্তার দেখাবার প্রয়োজন হলো। হামিদা নিজেই ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে লন্ডনে নিয়ে এলেন তাকে। প্যাডিংটন স্টেশন থেকে তাদের নিয়ে আমি এলাম হার্লি স্ট্রিটে। সেখানে বসে থাকতে থাকতে দেখি, এ কে এম আবদুর রউফ এসেছেন একই ডাক্তারের কাছে। কাজ সারা হয়ে গেলে, হামিদার আপত্তি সত্ত্বেও, রউফ আমাদের সকলকে পৌঁছে দিলেন গোলডার্স গ্রিনে, কামালের একমাত্র বোন আহমদীর বাড়িতে। সেখানে কামালের মা-ও তখন থাকছেন। আমরা কীভাবে সেখানে পৌঁছলাম, তিনি তা জানতে চাইলেন। রউফকে দেখিয়ে বললাম, এঁর গাড়িতে। তিনি খুশি হলেন না। বললেন, তোমার বন্ধু কেমন মিনিস্টার–একটা গাড়িও পায় না। বউ-বাচ্চা টিউবে করে ঘোরে। আমি মা–কোথাও যেতে হলে অন্যের ভরসায় থাকতে হয়!’ আমি হেসে বললাম, কামাল বেশি শক্ত মন্ত্রী নয়।’ আরেকবার ও-বাড়িতেই গেছি কী এক উপলক্ষে। কামাল তখন আমেরিকায়। তার মা বললেন, তোমার বন্ধু বিলেত-আমেরিকা এ-পাড়া ও-পাড়া বানিয়ে ফেললো। কখন কোথায় থাকে, আমিই তার হদিস পাই না!’

কামাল ঢাকায়–এমন অবস্থায় হামিদার পক্ষেও সন্তানদের নিয়ে বেশিদিন অক্সফোর্ডে থাকা সম্ভবপর হলো না। ওঁরাও ফিরে গেলেন দেশে।

১৩.

প্রায় এই সময়েই খবর পেলাম, আব্বা অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেন দৌড়ঝাঁপ করে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং ডা. নূরুল ইসলামকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। পৃথক পৃথকভাবে উভয়ের একই সিদ্ধান্ত–ফুসফুসের ক্যানসার এবং সেটা অনেকখানি পরিণত। ডা. নূরুল ইসলাম আরো জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সহযাত্রী হয়ে তিনিও কমনওয়েলথ সম্মেলনে যাচ্ছেন কিংসটনে; যখন তাঁরা হিথরো বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করবেন, তখন যদি আমি ভিআইপি লাউঞ্জে ফোন করে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি, তাহলে নিজমুখেই আব্বার অবস্থা আমাকে জানাবেন।

আর তিন মাস পর আব্বার ৭৮ বছর পূর্ণ হবে। আমি তাঁকে খুব-একটা অসুস্থ হতে দেখিনি। এবার এমনি রোগাক্রান্ত হলেন যে, তাঁর প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিতে হলো, ষাট বছরের ধূমপানের নেশা ছাড়তে হলো!

২৬ এপ্রিল হিথরো বিমানবন্দরে টেলিফোনে ডা. নূরুল ইসলামকে ধরলাম। নিজের দেশের বিমানবন্দরে এভাবে কাউকে পাকড়াও করতে পারতাম কি না সন্দেহ। নূরুল ইসলাম কেবল বললেন, আপনার আব্বাকে দেখতে চাইলে আপনাকে অক্টোবরের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। বললাম, আমি আগস্টেই ফিরবো। উনি বললেন, ‘সেই ভালো।’

ক্যানসারের চিকিৎসা করেন। তিনি আবার বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী সুমিত্রা দেবীর বোন। তারাপদ বললেন, আপনার বাবার চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাগজপত্র একবার এমাকে দেখাতে পারেন। ও কিছু পরামর্শ দিতে পারে, কিংবা পরামর্শ নেওয়ার জন্য অন্য ডাক্তারের কথা বলতে পারে আপনাকে।

বড়ো দুলাভাইকে লিখলাম, আব্বার এক্স-রে প্লেট এবং অন্যান্য কাগজপত্র কামাল হোসেনের দপ্তরে পৌঁছে দিতে। কামালকে লিখলাম, সেসব আমাকে পৌঁছোবার ব্যবস্থা করে দিতে। কামাল সবকিছু ব্যাগে পাঠালেন হাই কমিশনে। নূরুল মোমেনের ফোন পেয়ে সেগুলো নিয়ে এলাম। এমা মুখার্জি তখন লন্ডনের বাইরে কাজ করেন। ট্রেনে করে গেলাম তাঁর কাছে। তিনি মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করলেন এবং কাগজপত্র সব দেখে বললেন, রোগটা অ্যাডভান্সড স্টেজে পৌঁছে গেছে, এখন কিছু করার সুযোগ নেই।

মেনেই নিতে হবে। এখন শুধু দিনক্ষণ গনা। শেষ দেখার অপেক্ষা মাত্র।

১৪.

রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো, কিন্তু তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কী নিয়ে যেন বিরোধ আছে তাঁর। তারাপদ কখনো এ-বিষয়ে আমাকে কিছু বলেননি, কিন্তু রাজেশ্বরী একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সঙ্গে তারাপদর বুঝি খুব ভাব!’ তাঁর প্রশ্ন শুনেই খটকা লাগলো, সুতরাং সতর্কতার। সঙ্গে জবাব দিলাম, না, ভাব বেশি নয়, তবে একই ক্ষেত্রের লোক তো, তাই একসঙ্গে ওঠাবসা আছে।’ রাজেশ্বরী বললেন, ‘তোমার চিঠিপত্র দেখি ওর দরজার বাইরে গেঁথে রাখে–অফিসে রাখে না।’ বললাম, এটা সেক্রেটারির কাজ। পাছে আমি এসে ওকে না পাই, বাইরে রাখা সুবিধে মনে করে।’ বোঝাই গেল, আমার উত্তরে উনি সন্তুষ্ট হলেন না।

তবু ওঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। বিকেলবেলায় কাজ সেরে সোয়াস থেকে ওঁর গাড়িতে চেপে গেলাম ওঁর চমৎকার ফ্ল্যাটে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্বকণ্ঠের আবৃত্তির টেপ চালিয়ে দিলেন। ওঁর জন্যে পানীয়ের একটা বোতল নিয়ে গিয়েছিলাম–সেটা খুললেন। খানিক পরে আমাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে এক চীনা টেক অ্যাওয়ে থেকে খাবার কিনে আনলেন। ওঁর ঘরে বসে ভোজনপর্ব সারা হলো। খেতে খেতে গল্প। সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে টুকিটাকি, নিজের জীবনের বেশ কিছু কথা। জানতে চাইলেন, বাংলাদেশে সুধীন্দ্রনাথ। সম্পর্কে আগ্রহ কেমন, কেউ লিখেছে নাকি কিছু তার বিষয়ে। বাংলায় এম এ ক্লাসে তাঁর কবিতা পাঠ্য শুনে খুব খুশি হলেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘কালো সূর্যের নিচে ব্যুৎসব’ প্রবন্ধটির উল্লেখ করতেই হেসে বললেন, ‘এ তো সুধীনের লেখার মতোই কঠিন মনে হচ্ছে।’

রাজেশ্বরী তাঁর জীবনের পাঞ্জাব-পর্বের কিছু গল্প বললেন, আমি আরো একটু জানতে চাইলাম। তারপর বললেন শান্তিনিকেতন-পর্বের কথা, থেমে গেলেন সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়ের কথায় এসে। শুনতে ভালো লাগছিল। বললাম, ‘আপনি স্মৃতিকথা লেখেন না কেন? অকপটে উত্তর দিলেন, আমি তো লিখতে পারি না। তাছাড়া কার আগ্রহ হবে এসব কথায়?’ বললাম, আপনার ভক্ত অনেক আছেন। আর আপনার জীবনকথা তো খুব কৌতূহলোদ্দীপক। কেমন করে পাঞ্জাব থেকে বাংলায় এসে আপনি রবীন্দ্র-সংগীতের একজন প্রধান শিল্পী হয়ে গেলেন, এটা জানতে অনেকেরই আগ্রহ হবে। আপনি রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য, সুধীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী, কতবছর ইউরোপ-আমেরিকা করলেন–এসব বিষয়েও আপনার বলার অনেক থাকবে। উনি স্বীকার করলেন সে-কথা, তবু বললেন, ‘আমাকে দিয়ে লেখা হবে না। বললাম, আপনি যদি মুখে বলে যান, আমি লিখে নিতে পারি, পরে আপনি অনুমোদন করলে তা ছাপা যেতে পারে। উনি আমার হাতে মৃদু চাপ দিলেন, বললেন, তুমি আমার গান শুনতে চেয়েছিলে-।’ টেপ ছেড়ে দিলেন, কথা বন্ধ হলো। একসময়ে বিদায় নিলাম, তার আগে ওঁর ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখালেন।

এর কদিন পরে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের অফিসকক্ষে গেছি। উনি খুব খুশি হয়ে বললেন, ভালো হয়েছে, আপনি এসেছেন। নিমাই আসছে, একসঙ্গে লাঞ্চ করা যাবে।’ নিমাই মানে নিমাই চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫৬ সালে শান্তিনিকেতনে যে সাহিত্যমেলা হয়েছিল, তার প্রধান সংগঠক–তাতে কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শামসুর রাহমান ও কায়সুল হক যোগ দিয়েছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখকেরা সম্মেলনের গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। নিমাই চট্টোপাধ্যায় বহুকাল ধরে লন্ডন-প্রবাসী। ১৯৬৯ সালে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক যখন লন্ডনে ছিলেন, তখন নিমাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উনি খুব প্রীত হন। ফলে, তার পাঁচ বছর পর নিমাইয়ের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হলো, তখন আমরা উভয়েই উভয়ের সম্পর্কে কিছু জানি। নিমাই মাঝে মাঝে বি বি সি বাংলা বিভাগে সংস্কৃতি-বিষয়ে অনুষ্ঠান করতে আসতেন। সেই সূত্রেই যোগাযোগটা হলো। ব্রাইটনে নিমাইয়ের একটা বাড়ি ছিল–ফলে সেখানেও তাকে মাঝে মাঝে যেতে হতো। ফলে রণজিৎ গুহের সান্নিধ্যেও তাঁকে পেয়েছিলাম একাধিকবার। নিমাইয়ের বাড়িতেও গেছি–তার স্ত্রী জয়া চমৎকার সঙ্গী।

সেই দুপুরে খোশমেজাজে আমরা তিনজনেই সোয়াসের সিনিয়র কমনরুমে চললাম লাঞ্চ খেতে। প্রথমে তারাপদ, তারপর নিমাই, শেষে আমি। এক হাতে দরজা খুলেই বন্ধ করে দিলেন তারাপদ, বললেন-রেজো। রেজো মানে যে রাজেশ্বরী দত্ত, সেটা আমি যেন কীভাবে বুঝে গেলাম, কিন্তু তাতে পালাবার কী কারণ আছে, তা বুঝিনি। তবে এটা বুঝলাম যে, তারাপদ ও নিমাই বিদারণ রেখার একদিকে এবং রাজেশ্বরী অন্যদিকে এবং সেই রেখাঁটি অনতিক্রম্য। সোয়াস থেকে বেরিয়ে আমরা সিনেট হাউজে গিয়ে খেলাম।

বেশ কয়েকদিন পরে রাজেশ্বরী দত্তের আহ্বান এলো, তার ফ্ল্যাটে সন্ধ্যা কাটাবার জন্যে। আমি এককথায় রাজি। আগেরবারের মতো শেষ বিকেলে সোয়াস থেকে যাত্রা। ফ্ল্যাটে ঢুকে কোট ইত্যাদি যথাস্থানে রেখে ওঁর বসার ঘরে প্রবেশ করলাম। উনি কাউচে না বসে কার্পেটে আসন নিলেন। আমি জ্যাকেটটা কাউচে রেখে ওঁর মুখোমুখি বসলাম। রাজেশ্বরী একটা মাইল্ড ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন–তার একটা ধরিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সেদিন তোমরা অমন করলে কেন?

প্রশ্নটা আমার বুকে সজোর ধাক্কা দিলো। সেদিন এবং অমন কী, আমি বুঝে ফেলেছি। তবু, আশা করেছি, উনি টের পাননি। জানতে চাইলাম, কী, কবে? রাজেশ্বরী বললেন, ‘সেদিন লাঞ্চের সময়ে, আমাকে দেখে তুমি, তারাপদ, নিমাই দরজা থেকে ফিরে এলে। তার গলা ধরে এলো, চোখে উদ্গত অশ্রু। তিনি বললেন, ‘ওরা যাহোক, তোমাকে আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম, এখন দেখছি, তুমিও ওই দলে–কিন্তু কেন, আমার সঙ্গে এমন করবে কেন?

আমি তার হাঁটুর ওপরে একটা হাত রাখলাম, কিছু বলতে পারলাম না।

একটু পরে বলতে গেলাম, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।

রাজেশ্বরী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না, আমি ভুল বুঝিনি। আসলে তোমরা আমাকে অ্যাকসেপ্ট করো না–বোধহয় আমি অবাঙালি বলে।

বললাম, আপনি বাঙালি না অবাঙালি, এ-প্রশ্ন কারো মাথায় ঢুকবে না।

উনি বলে চললেন, ‘হ্যাঁ, সেজন্যই তুমি আমাকে মেমোয়ার্স লেখার কথা বলছিলে, আমার পাঞ্জাবি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে প্রশ্ন করছিলে। আমি তখন বুঝিনি, এখন স্পষ্টই বুঝছি–তোমরা আমাকে অন্য কিছু প্রতিপন্ন করার জন্য ব্যস্ত। পুরু চশমার ভেতর দিয়ে অশ্রু দেখতে পাচ্ছি।

জীবনে কখনো এত বিব্রত হইনি। ওঁকে কথা বলতে দিলাম; ওঁর হাঁটুর ওপরে যেমন হাত রেখেছিলাম, সেটা তেমনি রইলো। তাতে মিনতি ছিল।

খানিক পরে জানতে চাইলাম, ‘খাবার আনতে যাবেন না?

করুণ হাসি হেসে বললেন, ‘চলো।’

সেই টেক-অ্যাওয়ে চীনা রেস্তোরাঁ। এবারে খাবারের দামটা আমি দিলাম। রাজেশ্বরী বাধা দিলেন না। ম্লান হাসি হাসলেন।

ওঁর ফ্ল্যাটে এসে খাওয়া-দাওয়া সারলাম। বেশি কথা হলো না। বিদায় নিয়ে ফিরলাম। যখন উনি দরজা খুলে দিলেন, তখনো মনে হলো ওঁর দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়নি। সারা পথ আমার মনের মধ্যে কাঁটা বিঁধতে লাগলো। কেন জানি না, সোয়াসে আর ওঁর অফিসঘরে ঢুকিনি। ওঁর বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে শুধু একদিন ওঁর পছন্দের পানীয় রেখে এসেছিলাম। উনি পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রাপ্তিস্বীকার করেননি।

রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। এর পরের বার কলকাতায় এসে তিনি মারা যান। কী একটা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন বলে শুনেছি।

তার আগে আমিই ক্ষতবিক্ষত হয়েছি দুর্ঘটনায়–যে-দুর্ঘটনার ওপরে আমার হাত ছিল না।

১৫.

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল ফজলের লেখা চিঠি পেলাম :

পরম প্রীতিভাজন।

আনিস, তোমার বন্ধু আর আত্মীয়দের কাছ থেকে তোমার খবর পেয়ে ও নিয়ে থাকি। সেদিন ঢাকায় আহমদ হোসেনের সঙ্গে দেখা হলো, জানালেন সম্প্রতি তিনি তোমার চিঠি পেয়েছেন এবং তুমি ভালো আছো।

ইতিমধ্যে তুমি বোধ করি খবর পেয়েছ সৈয়দ আলী আহসান সাহেব আমাদের বাংলা বিভাগে তার সাবেক পদে যোগ দিয়েছেন। জাহাগীর নগরে তিনি কিছু স্বার্থ আর বিদ্বেষবাদী রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন। তার শরীরও অনেকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। তাকে শান্তি আর নিরাপত্তা দেওয়া আমি আমার নৈতিক কর্তব্য বলেই মনে করেছি। তাই সর্বান্তকরণে আমি তাঁর আগমন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানকে স্বাগত জানিয়েছি। তার জন্য আমি সঙ্গে সঙ্গেই রশীদুল হক সাহেবের বাড়িটিও বরাদ্দ করে দিয়েছি।

যেদিন তিনি কাজে যোগ দিয়েছেন সেদিন থেকে, অধ্যাপকের (Professor) দ্বিতীয় যে পদটি রয়েছে তাতে তোমাকে নিয়োগ করেছি। আমার বিশ্বাস এতে তোমার পদ, মাইনে এবং সিনিয়রিটির কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না। আমাদের এ সিদ্ধান্তের প্রতি তোমার সমর্থন আছে। জানতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করবো। তোমার নিজের যদি কোন দ্বিধা বা এ সম্পর্কে পরামর্শ থাকে তা অসংকোচে আমাকে জানাবে।

তোমার প্রতি আমার স্নেহ আর ঔৎসুক্য এ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে নয়। আশা করি সর্বাংগীণ কুশলে আছো। তোমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের প্রতি আমার আন্তরিক স্নেহ।

শুভার্থী
আবুল ফজল

১৯৭২ সালে সৈয়দ আলী আহসানের ছুটিজনিত শূন্যপদে আমি অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগলাভ করেছিলাম। তারপরে বাংলা বিভাগে দ্বিতীয় একটি অধ্যাপক-পদসৃষ্টির উদযোগ নিয়েছিলেন উপাচার্য, তবে আমি লন্ডনে রওনা হওয়া অবধি সে-উদযোগ ফলপ্রসূ হয়নি। ওই পদটি যে সৃষ্ট হয়েছে, তা আমার জানা ছিল না। উপাচার্যের এই চিঠি পেয়ে তাই আমি যেমন স্বস্তি পেয়েছিলাম, তেমনি তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম।

নবনীতা দেবসেন সে-সময়ে লন্ডনে এসেছিল। আবুল ফজলের চিঠিটা তাকে দেখালাম। সে বললো, ‘কী ভাগ্য তোমার! এমন ভাইস-চান্সেলরের সঙ্গে কাজ করো। আমাদের ভাইস-চান্সেলররা কোনো টিচারের জন্য এত ভাবনা-চিন্তা করে না, তাদের সে সময় নেই।’

সেমিনার-কনফারেন্স নিয়ে সারা দুনিয়া চষে বেড়ায় নবনীতা। অমনই কিছু একটা নিয়ে সে এসেছে এখানে। তার কাজের শেষে তুমুল আড্ডা হলো। সে আমার বাড়িতে এলো তার বন্ধু ডা. অমেয়া দেবাকে নিয়ে। অমেয়া লন্ডনে জেনারেল ফিজিশিয়ান–শুনেছিলাম, নবনীতার মতো অমেয়া নামটিও রবীন্দ্রনাথের দেওয়া, তবে তার ডাকনাম বুলুই অধিক ব্যবহৃত হতো। পরে তার সঙ্গে আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়।

সেদিন বুলুর গাড়িতে চড়ে আমরা তিনজন ইতস্তত ঘুরে বেড়ালাম, বইয়ের দোকানে ঢু দিলাম, ওয়েস্ট এন্ডের রেস্টুরেন্টে খেলাম। খেতে খেতে হঠাৎ নবনীতার খেয়াল হলো, সিনেমা দেখবে। সিনেমা দেখতে দেখতে পরদিনের করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনা করা গেল। এমনি করে সময়টা খুব ভালো কাটলো।

কলকাতায় ফেরার আগে একগাদা বই আমাকে দিয়ে নবনীতা বললো, তুমি এগুলো অমর্ত্যর অফিসে পৌঁছে দিয়ে বোলো আমাকে মেইল করে দিতে।

অমর্ত্য সেন তখন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসে অধ্যাপনা করেন। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় যৎসামান্য। যতটুকু বুঝতে পারলাম, বইপত্রের বিষয়ে নবনীতা তাঁকে কিছুই বলেনি, বলার প্রয়োজনও বোধ করছে না। আমি এগুলো বয়ে তার অফিসে নিয়ে যাবো–তারপর না দুজনেই বিব্রত হই!

আমার ইতস্তত ভাব দেখে নবনীতা অবাক হলো। তারপর সমাধান দিলো, ‘তোমার যদি কিন্তু কিন্তু লাগে তাহলে আজিজকে দিয়ে বোলো, সে যেন অমর্ত্যকে বলে এগুলো পাঠিয়ে দিতে।’

আজিজ মানে ড. আজিজুর রহমান খান–অমর্ত্য সেনের প্রিয় ছাত্র এবং এল এস ই-র শিক্ষক। আর দ্বিধা করা নিষ্ফল। বইগুলো রেখে দিলাম। পরে আজিজের অফিসে নিয়ে গিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করলাম। আজিজ মুদৃ হেসে বললেন, ‘বইগুলো থাক আমার কাছে, কিছু একটা করতে হবে।’ তিনি পরে তা কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তবে অমর্ত্যকে কিছু বলেছিলেন কি না সন্দেহ।

১৬.

সেই ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি ব্যাপার ঘটলো–বলা যেতে পারে, আমার চোখের সামনে, অর্থাৎ টেলিভিশনে আমি তা প্রত্যক্ষ করলাম।

একটি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা সাধারণ বাজারে যুক্তরাজ্যের যোগদান। এডওয়ার্ড হিথের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে কাজটা প্রায় হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপর ক্ষমতায় এলেন হারল্ড উইলসন। এই প্রশ্নে দেশে, এমনকী, দুই বড়ো রাজনৈতিক দলের মধ্যেই মতান্তর ছিল। সুতরাং উইলসন গণভোটের আয়োজন করলেন। কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো না এই বিষয়ে, নিজের বিবেক অনুযায়ী প্রচারণার স্বাধীনতা সবাইকে দেওয়া হলো। আমরা দেখলাম, মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য একপক্ষে, আরেকজন অন্যপক্ষে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। উইলসন নিজে কোনো পক্ষ নিলেন না। পরে যারা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠন করেছিলেন, লেবার পার্টির সেসব নেতা–রয় জেনকিনস, ডেভিড ওয়েন, শার্লি উইলিয়মস–ইউরোপে যোগদানের পক্ষে, সম্ভবত ইয়েন হিলিও সেইসঙ্গে, প্রচারণায় নামলেন। আবার মাইকেল ফুট তো প্রচণ্ডভাবে তার বিরোধিতা করলেন, তার সঙ্গে রইলেন টোনি বেন এবং জুনিয়র মিনিস্টার জুডিথ হার্ট। ইউরোপে যোগদানের পক্ষে কনজারভেটিক পার্টির নেতা এডওয়ার্ড হিথের বক্তৃতা যেমন ছিল খুব যুক্তিপূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন, তেমনি তার বিরুদ্ধে প্রবল আবেগময় ভাষণ দিতেন ওই দলেরই পার্লামেন্ট-সদস্য ইনোক পাওয়েল। বর্ণবাদী বলে পাওয়েলকে পছন্দ করতাম না, কিন্তু তার ইউরোপ-বিরোধী বক্তৃতা ভালো লাগত। মাইকেল ফুটও খুব আবেগের সঙ্গে নিজের কথা বলতেন, তবে নিজের দলের মধ্যে ইউরোপের পক্ষে অত সমর্থন দেখে তিনি যে খানিকটা হতাশ হয়েছিলেন, সেটা বোঝা যেতো। টোনি বেন তো হারজিতের পরোয়া না করেই সংগ্রাম করে যেতেন। রয় জেনকিনসের ভাষণ আমার ভালো লাগত না, যেমন ভালো লাগত ইউরোপের সমর্থনে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলা মার্গারেট থ্যাচারের বক্তৃতা।

গণভোটে ইউরোপে যোগদানের সিদ্ধান্তই নেওয়া হলো। সিদ্ধান্ত যাই হোক, পুরো ব্যাপারটা এমন সুরুচিসম্পন্ন হলো যে তার তারিফ না করে পারা যায় না। পরমতসহিষ্ণুতার এক অসাধারণ নিদর্শনের সাক্ষ্য হয়ে রইলাম। সোয়াসে ছাত্রদের কমনরুমেও উত্তেজিত আলোচনা হতে দেখেছি কিন্তু সবটাই যুক্তিতর্ক-অধ্যয়ন-চিন্তনের বিষয় ছিল, গায়ের জোরের নয়। ফলাফল মেনে নেওয়ার ব্যাপারেও সেই একই মনোভাবের প্রকাশ দেখলাম।

ওদিকে ভিয়েতনামের যুদ্ধ বাঞ্ছিত পরিণামের দিকে চলেছে। ১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তিচুক্তির পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করতে শুরু করে, কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট থিউ একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে তার সেনাবাহিনীর পরাজয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনর্থক যুদ্ধ চলে তারপরও। যুদ্ধের শেষ দেখতে দক্ষিণ ভিয়েতনামে জড়ো হন নানা দেশের সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, চিত্রনির্মাতা। বিবিসি বা আইটি এনের যে-সংবাদপাঠককে আজ টেলিভিশনে দেখলাম, দু-দিন পর দেখি তিনি নমপেন বা হুয়া বা সায়গন থেকে সরাসরি খবর দিচ্ছেন। এপ্রিলের ৩০ তারিখে সায়গনের পতন হলো–থিউ পালিয়ে গেলেন তাইওয়ানে, আমি টেলিভিশন সেটের সামনে ঠাই বসে রইলাম। এগারো বছরের যুদ্ধের অবসান–সোজা কথা নয়। সব শেষ হওয়ার পরে মনে হলো, ঢাকায় থাকলে আরো না কত আনন্দ করতে পারতাম! ভিয়েতনামের পক্ষে বিজয়-মিছিলে নিশ্চয় শরিক হতাম।

এ-সম্পর্কে অবশ্য কিছুদিন পর এক ভিন্ন ধরনের গল্প বললেন আমার শিক্ষক আবদুল ওয়াজেদ খান চৌধুরী। খুলনা জেলা স্কুলে তিনি যখন প্রধান শিক্ষক, তখন আমি তার ছাত্র ছিলাম। আমাদের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল, তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল আমার বন্ধু মসিহুর রহমান তাঁর মেয়ে রেহানাকে বিয়ে করায়। তবে এই যোগাযোগের বাইরেই তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার ছেলে মোরশেদ চৌধুরীর কাছে যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে–মোরশেদ ওয়াশিংটন ডিসিতে আমাদের দূতাবাসে অর্থনৈতিক কাউনসেলর। তার গ্রুপের রক্ত দুষ্প্রাপ্য বলে নিজের রক্তও চার ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে। লন্ডনে যাত্রাবিরতি করতে হবে। ঢাকায় স্বজনেরা তাঁকে পরামর্শ। দিয়েছিল লন্ডনে আত্মীয়-বাড়িতে উঠতে। তিনি বলেন, এয়ারলাইনসের ব্যবস্থায় থাকবেন, আর যদি কারো বাড়ি উঠতে হয়, তাহলে আনিসের বাড়িতে উঠবেন। হিথরো বিমানবন্দরের কাছেই হোটেলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে–এই হোটেলেই আমি একবার ছিলাম। হোটেল থেকে ফোন করেছেন আমাকে–আমি তখন বাড়ি নেই। ঘরে ফিরে যোগাযোগ করে ঠিক করলাম, পরদিন সকালেই আমি পৌঁছে যাবো ওঁর হোটেলে, তারপর উনি বিমানবন্দরে রওনা হলে ফিরবো।

গিয়ে দেখি, ঘরে বসে ব্রেকফাস্ট করেছেন তিনি তার থেকে কিছু খাবার জমিয়ে রেখেছেন আমার জন্যে। যত বলি, ‘আমি খেয়ে এসেছি, এখন খাবো না’, উনি সেকথা কানে নেন না। শেষে কিছু একটা মুখে দিয়ে খাবারের ট্রে দরজার বাইরে রেখে এলাম। ইত্যবসরে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তিনি খুলে দেবেন মনে করে একটু অপেক্ষা করলাম, শেষে দরজায় টোকা দিলাম। এখন তার গলা শুনতে পেলাম, ঘরের চাবি না নিয়ে বের হলে, এখন ঢুকবে কী করে!’ বললাম, ‘সার, আপনি খুলে দিন।’ তিনি বললেন, তাই তো, আমি তো ভিতরেই আছি। দরজা খুলে দিলেন।

আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হলো। উনি একটা উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছেন, লেখা শেষ হলে আমাকে পাঠাবেন–আমি যেন ভূমিকা লিখে দিই। অবশ্য শরীরের যা অবস্থা–সেই সুযোগ পাবেন কি না কে জানে! তখন ওঁর বয়স ৭৪ বছর, শরীর ভালো থাকছে না। নিজের অসুস্থতা ও চিকিৎসা। নিয়ে কিছু কৌতুককর কথা বললেন।

দেশের অবস্থাও ভালো নয় তাঁর মতে। সেই প্রসঙ্গেই গল্পটা করলেন। ভিয়েতনামের মুক্তি-উপলক্ষে বিজয়-মিছিল বেরিয়েছে ঢাকার রাস্তায়। পাশ দিয়ে যেতে যেতে রিকশাওয়ালা জানতে চাইছে আরোহীর কাছে : ‘কী হইছে ভিয়েতনামে?’

: ‘ভিয়েতনাম স্বাধীন হয়েছে।’

: ‘স্বাধীন হইছে? তাইলেই সারছে।’

১৭.

কমনওয়েলথ দিবস-উপলক্ষে ব্রিটেনের রানি এক বা একাধিক দিনে গার্ডেন পার্টি দেন তার প্রাসাদে। সেখানে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর লন্ডন–বাসী। অথবা প্রবাসী কিছু নাগরিককে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রিতদের নাম সংগৃহীত হয় সেসব দেশের হাই কমিশন থেকে। এই সুবাদে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত হলাম।

প্রথমে এলো সেন্ট জেমস প্যালেসে লর্ড চেম্বারলেনের দপ্তর থেকে টেলিফোন–নির্দিষ্ট দিনক্ষণে উপস্থিত থাকতে পারবো কি না। কারণ এই আমন্ত্রণগ্রহণ বা আমন্ত্রণগ্রহণে অপারগতাজ্ঞাপনের বিধি নেই। যেতে পারলেই আমন্ত্রণপত্র আসে–সেইসঙ্গে আসে কাপড়ে সাটার জন্যে আমন্ত্রিতদের নামলেখা ছোটো কার্ড। কোনো কারণে যেতে অপারগ হলে সেই ছোটো কার্ড সেন্ট জেমস প্যালেসে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হয় লর্ড চেম্বারলেনের অফিসে।

আমন্ত্রণপত্র এলো। নির্দিষ্ট দিনে ফোন করে ট্যাকসি ডাকলাম, বললাম, মলে যাবো। ট্যাকসিতে ওঠার সময়ে ড্রাইভারের হাতে প্যালেসের স্টিকার দিয়ে বললাম, এটা লাগিয়ে নিন।

ড্রাইভার হাসলেন। বললেন, ট্যাকসি ডাকার সময়ে প্যালেসের কথা বলেন নি কেন?

বললাম, আপনারা ভাবতে পারতেন, কেউ মশকরা করছে, নাও আসতে পারতেন।

ড্রাইভারের হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হলো। বললেন, আমিও কখনো বাকিংহাম প্যালেসের ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আজ আপনাদের সুবাদে যাওয়া যাবে।

প্যালেসের চত্বরে গিয়ে ট্যাকসি ছাড়লাম। প্রাসাদের একতলা পেরিয়ে উদ্যানে পৌঁছোনো গেল। নানা দেশের লোকে ভরে গেছে জায়গাটা। কারো কারো সঙ্গে আলাপ শুরু করতেই রানি এসে পড়লেন, সঙ্গে প্রিন্স ফিলিপ।

একটু একটু বৃষ্টি আরম্ভ হলো। রানি নিজেই ছাতা খুললেন। আলাপ করলেন অনেকের সঙ্গে। প্রিন্স ফিলিপও কথাবার্তা বললেন।

বৃষ্টি ছাড়ল। চা-পান শেষ করে প্রত্যাবর্তন।

পুসিক্যাটের মতো রানির সঙ্গে দেখা করতে আমরা লন্ডনে যাইনি। দৈবাৎ দেখা হয়ে গেল।

১৮.

খুব সম্ভব নিমাই চট্টোপাধ্যায় আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ডেভিড চেভিটের। সে ইতালীয় বংশোদ্ভূত, যদিও তার জন্ম লন্ডনে, বয়সে আমার কয়েক বছরের ছোটো। আবাল্য তার অনুরাগ ছিল চিত্রাঙ্কনে, কাজেই লন্ডনের বিখ্যাত স্লেড স্কুল অফ ফাইন আর্টে সে ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে সে শিল্প ও শিল্পের ইতিহাস পড়িয়েছিল কয়েক বছর, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সট্রা-মুরাল ডিপার্টমেন্টে খণ্ডকাল শিক্ষকতাও করেছিল। এক সময়ে সে ঠিক করে যে, লেখালিখিতেই সে সার্বক্ষণিক মনোযোগ দেবে। আমার সঙ্গে যখন তার আলাপ, তখন তার এই অবস্থা।

স্লেডের ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিক উপলক্ষে লন্ডনে আয়োজিত রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রদর্শনী দেখে ডেভিড খুব অভিভূত হয়। তার মনে হয়, এই চিত্রকর এবং তাঁর শিল্পকর্ম ভালো করে বুঝতে হলে তাঁর সাহিত্যকর্ম পাঠ। করতে হবে এবং তা অনুবাদে নয়, মূল ভাষায়। সে বাংলা শিখতে লেগে গেল। এবং কিছুকাল পরে রবীন্দ্রনাথ এবং তিরিশের কবিদের কবিতা অনুবাদ করতে শুরু করে দিলো। এর মধ্যে তার মন ঘুরে গিয়েছে পুরোপুরি সাহিত্যের দিকে, কবিতা লিখতেও আরম্ভ করেছে। ভাষাশিক্ষায় ডেভিডের স্বাভাবিক পটুত্ব ছিল। আমার সঙ্গে পরিচয়কালে সে ইংরেজি, ইতালীয়, ফরাসি, স্প্যানিশ, সংস্কৃত, বাংলা, ফারসি, তুর্কি জানতো। তার স্ত্রী ফউজিয়া মালয়েশিয়ার মেয়ে বলে মালয় ভাষাও খানিকটা শিখেছিল, যদিও তা জানতো বলে সে স্বীকার করতো না। একাধিক ভাষার কবিতা সে অনুবাদ করেছিল, বিশেষ করে, অক্টেভিও পাজের কবিতা। বিলেতের খ্যাতনামা প্রকাশনা-সংস্থা জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড তার সম্পাদিত একটি বই প্রকাশ করে : The Shell and the Rain (লন্ডন, ১৯৭৩), এর উপ-শিরোনাম ছিল Poems from New India-তাতে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয়। চক্রবর্তী, সমর সেন, নরেশ গুহ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত ও তারাপদ রায়ের কবিতার অনুবাদ ছিল নানাজনের করা, আর ছিল এ কে রামানুজন, নিসিম ইজিকিয়েল, আর পার্থসারথী, অরুণ কোসাটকার, তিলোত্তমা রাজন ও শনমুঘা সুব্বিয়ার মূলত ইংরেজি কবিতা, তামিল থেকে অনুবাদ দু-চারটি।

এটি যে ভারতীয় কবিতার প্রতিনিধিত্বমূলক সংকলন নয়, এই ঘোষণা দিয়েই বইটি শুরু হয়েছিল। সর্বতোভাবেই এটি ডেভিডের পড়া এবং ভালো লাগা কবিতার একটা নির্বাচিত সংগ্রহ। একথা বলতে সাহসের দরকার হয়, কেননা সে কে এমন যার ভালো-লাগার কবিতা পাঠযোগ্য বিবেচনা করবে পাঠক? ডেভিডের সে-সাহস ছিল। নিজের অনুবাদ সে এই সংকলনভুক্ত করেনি, কিন্তু দীর্ঘ একটি ভূমিকা লিখেছিল প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গৌণত আধুনিক বাংলা কবিতা-বিষয়েই, এবং এই ভূমিকাকে সে এই সংকলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেছিল।

বইটি আমাকে উপহার দিয়ে ডেভিড মন্তব্য চেয়েছিল। আমার মনে প্রশ্ন ছিল–’নিউ ইন্ডিয়া সম্পর্কে, কবিতার নির্বাচন সম্পর্কে, বাংলা বইপত্রের মূল নাম না দিয়ে তার ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া সম্পর্কে (যেমন, সবুজ পত্র না লিখে গ্রিন লিফ লেখা), কাজী নজরুল ইসলামের নামের প্রতিবর্ণীকরণ সম্পর্কে। ততদিনে আমাদের পরিচয় কিছু এগিয়েছে, যে-রাতে ফউজিয়াকে হাসপাতালে সেবিকার দায়িত্বপালন করতে হতো না, তেমন সময়ে তার রান্নার সুস্বাদ গ্রহণ করেছি। ডেভিড আমার দু-একটা আপত্তি গ্রাহ্য করেছে, প্রশংসাকে সৌজন্য বলে বিবেচনা করেছে, এবং প্রবলভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে। একেবারে গল্পে-গল্পে ডেভিড যখন সংস্কৃতের সঙ্গে ফারসির, ফারসির সঙ্গে তুর্কির, ফরাসির সঙ্গে ইংরেজির এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলা কবিতার তুলনা করতো, তখন তা আমি মুগ্ধ হয়েই শুনেছি। পরে যে তার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেললাম, সে-ক্ষতি আমারই।

১৯.

স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে সে-বছর বোল্টন ছুটি নিয়েছেন, সুতরাং বাংলার ছাত্র মানেই তখন তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র। সংখ্যায় দুজন, উভয়েই ইংরেজ। তরুণীটি বাংলা শিখছে প্রাথমিক পর্যায়ে, তারাপদর কথায় মনে হলো, বেচারি হিমশিম খাচ্ছে বেশ। তরুণ সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, আত্মপ্রত্যয়ী। নাম উইলিয়াম রাদিচে, পিএইচ ডি করছে মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য নিয়ে–অনুবাদ ও টীকাভাষ্য। অনুবাদ শুনে বোধহয় আমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল, তারাপদ বললেন, ছেলেটি কবিও, তার মাও সাহিত্যচর্চা করেন, মায়ের দিক থেকে বোধহয় ইতালীয় বংশোদ্ভূত। রাদিচের সঙ্গে আমার দু-তিনবার দেখা হয়েছিল। স্বল্পক্ষণের আলাপেই প্রীত হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে কবি হিসেবে, রবীন্দ্রনাথের গদ্যপদ্যের অনুবাদক হিসেবে, সাহিত্যসমালোচক হিসেবে তিনি যে এত সফল হবেন, তা তখন বোঝা যায়নি। তারাপদ দুঃখ করেছিলেন এই বলে যে, এমন ভালো ছেলেরও চাকরি-বাকরির কোনো ভবিষ্যৎ নেই ইংল্যান্ডে। ঘটনাপ্রবাহে তার আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এখন তারাপদ নেই, বোল্টন নেই, রাদিচেই বাংলার ধ্বজা ধরে আছেন সোয়াসে এবং সারা যুক্তরাজ্যেই। জগতের বিদ্বজ্জনসভায় তিনি সর্বত্র সমাদৃত।

প্রফেসর রাইট একবার আমাকে নৈশভোজে নিয়ে গেলেন এক রেস্টুরেন্টে। বিভাগের আরো কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন সেখানে, কিন্তু বাংলার তারাপদ মুখোপাধ্যায় বা হিন্দির এস এম পাণ্ডে ছিলেন না। উপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে উর্দুর রাসেলের কথা বিশেষভাবে মনে আছে। তার চেয়েও বেশি মনে আছে নিজের এক ব্যর্থতার কথা। সোয়াস থেকে রেস্টুরেন্টে হেঁটে যাওয়ার পথে রাইট আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘সৌরেন্দ্র’ বলে কি কোনো শব্দ আছে, নাকি তা ‘সুরেন্দ্র’র বিকার? যখন বললাম, ও-দুটো পৃথক শব্দ, তখন তিনি তার অর্থ ও ব্যুৎপত্তি জানতে চাইলেন। সৌরের সোজা ইংরেজি ‘সোলার কথাটা কিছুতেই আর মনে এলো না। আমি বলি বিশ্বজগৎ, সূর্যসম্পর্কিত, ইত্যাদি ইত্যাদি। রেস্টুরেন্টে বসে রাইট তাঁর সহকর্মীদের একজনকে জানালেন, প্রফেসর আনিসুজ্জামান বলছেন, সৌরেন্দ্র একটি পৃথক শব্দ। তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, তাই নাকি? কী অর্থ তার? ব্যুৎপত্তি কী? আমি একইরকম উত্তর করি। বুঝতে পারি, বিষয়টা নিয়ে আগে কোনো আলোচনা হয়েছে, কিন্তু অভিধান না দেখে এতক্ষণ পরে আমাকে সাক্ষী মানা কেন? রাতের খাওয়াটাই নষ্ট হয়ে গেল। বিল দেওয়ার সময়ে বুঝলাম, ভোজটি সমবায়ী উদ্যাগের ফল, কিন্তু আমি যখন নিজের ভাগ দিতে চাইলাম, রাইট শশব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না, তুমি আমাদের অতিথি। বিদায় নিয়ে মন খারাপ করেই ফিরতি পথে রওনা হলাম। টিউব ছাড়ার সময়ে ধাক্কা দেওয়ামাত্রই ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল ‘সসালার’। কিন্তু গল্পগুচ্ছের পোস্টমাস্টারের মতো ততক্ষণে আমারও নৌকার পালে বাতাস লেগেছে। পরদিন তারাপদর কাছে খেদের সঙ্গে সবটা বললাম, উনি পাত্তাই দিলেন না।

২০.

রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির পরে পারতপক্ষে সোয়াসে আর দুপুরে খেতাম না। তাছাড়া কাজ করছি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। তার উলটো দিকের ফুটপাতেই স্যান্ডউইচের এক দোকান। যে-দম্পতি সেটা চালান, তারা খুব সম্ভব ইতালীয় বংশোদ্ভূত। ওই দোকানে বসে খাওয়া যায়–তবে বসার জায়গা অল্প এবং দুপুরে বেজায় ভিড়। অনেকে খাবার কিনে লাইব্রেরির দোতলার একটা ঘরে–লাউঞ্জ বা কমনরুম যাই বলি না কেন, সেখানে–চলে আসতেন। ওই কক্ষে তখনো ধূমপান করা চলতো, পরে সে সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। যারা সঙ্গে করে খাবার নিয়ে আসতেন বাড়ি থেকে, তারাই এই ঘরটা বিশেষ করে ব্যবহার করতেন। বেলা তিনটের দিকে স্যান্ডউইচের দোকানটায় আরেক দফা আসা হতো–চা-কফি খেতে। আড্ডা দেওয়ার জন্যে এ-সময়টা ছিল প্রশস্ত। সেই আড্ডায় কিন্তু লেখাপড়াসংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যেতো।

কাছাকাছি আরো দুটি জায়গায় খাওয়া চলতো। ইয়ং ভিক থিয়েটারে একটা কফিশপ ছিল। সেখানে খাবারের দাম একটু বেশি। ঘরে-তৈরি খাবারও সেখানে পাওয়া যেতো–সেসবের দাম আরেকটু বেশি, তবে তা খেতে সত্যিই ভালো। একটা গ্রিক রেস্টুরেন্ট ছিল–তার কেবাব-ইন-পিটা ছিল খুবই সুস্বাদু। সপ্তাহে একদিন হয়তো সেখানে খাওয়া যেতো, কেননা তার সবকিছুই ছিল মহার্ঘ, আর খাবার পরিবেশন করা হতো বলে মূল্যের অতিরিক্ত বকশিসও দিতে হতো। অনতিদূরে দুদিকে দুটি পাব ছিল–কিন্তু পাব-লাঞ্চ তখনো তেমন জুতসই ঠেকেনি, সোয়াসের কাছে এক পাবে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দিন। দুই খেয়েছি মাত্র–সেখানে তাই যাওয়া হতো না।

গ্রীষ্মবকাশের সময়ে দেশবিদেশের নানা গবেষক এসে জুটতেন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়াটা ছিল উপরি পাওনার মতো। এমনি করেই সেবারে দেখা হয়ে গেল আমার পুরোনো বন্ধু, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক, রোনাল্ড বি ইনডেনের সঙ্গে। সে ভালো বাংলা রপ্ত করেছিল এবং বাঙালিদের সঙ্গে সবসময়ে বাংলায় কথা বলতো। আমি সর্বদা টিউবে যাতায়াত করতাম, আর রন যতটা পারে টিউব এড়িয়ে চলতো। আমাকে বলতো, তুমি তো কেবল শেয়ালের গর্ত দিয়ে চলাফেরা। করো; লন্ডনের ওপরটা, তার আকাশটা, কখনো দেখেছ? আমাদের বাড়িতে এসে একবার সে জানতে চেয়েছিল, বেবীকে নিয়ে থিয়েটারে গেছি কি না। বেবী বলেছিল, বাচ্চাদের রেখে একসঙ্গে দুজনের যাওয়া অসুবিধে।’ রন বললো, ‘আপনি আনিসের সঙ্গে থিয়েটারে যাবেন–আমাকে একটু আগে জানাবেন, আমি এসে বাচ্চাদের দেখবো।’ এর উত্তরে বেবীকে হাসতে দেখে সে বললো, ‘ভাবছেন, ওদের রাখতে পারবো না? আমার এক ভাগ্নে আছে–মহা বদমাশ। সে পর্যন্ত আমার কাছে ঠিকমতো থাকে, আর আপনার ছেলেমেয়েরা তো দেখছি। খুবই লক্ষ্মী। ওদের আমি ঠিকই সামলাতে পারবো।’ রনকে আমরা খাটাইনি, তবে তার এমন করে স্বেচ্ছাসেবা দিতে চাওয়া আমাদের খুব ভালো লেগেছিল।

রন তখন তার দ্বিতীয় বই Kinship in Bengal নিয়ে কাজ করছিল। খসড়াটা আমাকে পড়তে দিয়ে মতামত চাইলো। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত আত্মীয়তাবাচক শব্দগুলি সংগ্রহ করলো আমার থেকে। বাঙালি আত্মীয়তাবাচক শব্দের বাহুল্য ও পার্থক্য নিয়ে যদিও সে অনেকসময়ে হাসাহাসি করতো-মামাতো বোনের স্বামীর ভাগ্নেকে কী বলে’-জাতীয় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতো–তবু বেশ ধৈর্যসহকারে সে তার তালিকা তৈরি করেছিল।

রনের বিবেচনাশক্তি ও সৌজন্য–দুই ছিল অসাধারণ। একবার আমাদের বাসায় রাতে খেতে ডেকেছিলাম ব্রিটিশ কাউনসিলের যে-মহিলা আমাদের দেখশোনা করতেন, তাঁকে, অ্যাসোসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটির রেবেকা জেমস, আমার ব্রিটিশ বন্ধু ইয়েন মার্টিন ও রন ইনডেনকে। ক্যাথি রবার্টসকেও ডাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে ও তার স্বামী সেই সপ্তাহান্তে লন্ডনের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে বসে আছে। অনেককাল আগে ক্যাথিকে লাঞ্চ খাইয়েছিলাম রেস্টুরেন্টে–সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সে বলে, ‘এই তো সেদিন খাওয়ালে। আমি বলি, ‘সে কি আর সেদিন! সে তো তোমার বিয়ের আগের ঘটনা। ওরা দাওয়াতে থাকতে পারলো না, রেবেকা জেমসও শেষ পর্যন্ত আসতে পারলেন না। বাকিরা এলেন।

তখনো আমার পানীয় নির্বাচনের জ্ঞান ও পরিবেশনের নৈপুণ্য–দুয়েরই অভাব ছিল। ওয়াইনের ব্যবস্থাই করিনি; শুল্কমুক্ত স্কচ ছিল আর পাড়ার দোকান থেকে কয়েক ক্যান বিয়ার এনে রেখেছিলাম, বড়ো বোতলে কোমল পানীয়। পানি খাওয়ার বড়ো গ্লাস ছিল কয়েকটা, তাতে বিয়ার দেওয়া চলতো। ছটা ওয়াইন গ্লাস ছিল–বি বি সি ক্লাবে প্রায়ই ওয়াইন গ্লাসে হুইস্কি দিতে দেখেছি, সেটা যে বিধেয় নয়, তা বুঝিনি। দেখা গেল, কেউই কোনো পানীয় নিচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত কেবল রনই ‘তুমি নাও’ বলে এক ক্যান বিয়ার ঢেলে নিলো। পরে মনে হয়েছিল, ব্যবস্থার অপ্রতুলতা টের পেয়ে পরে যদি আমি লজ্জিত হই, সেজন্যেই সে তা করেছিল।

আগে বলেছি, ইয়েন মার্টিন লেবার পার্টিতে সক্রিয় ছিল। ওই দলের মধ্যেই সে ছিল বাম মার্গের। ব্রিটিশ কাউনসিলের ভদ্রমহিলা কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক না হলেও তুলনায় রক্ষণশীল। ব্রিটেনের অর্থনীতির আলোচনা উঠে যাওয়ায় কথাটা বোঝা গেল। আমি ইচ্ছে করেই আবহাওয়াটা লঘু করতে চাইলাম। বললাম, সোয়াসের এক ছাত্র বলছিল, তার বাবার পাবলিক হাউজ খুব ভালো চলছে। ভদ্রমহিলা তখন ব্রিটেনের অর্থনীতি সম্পর্কে আমার। পর্যবেক্ষণ কী, তা জানতে চাইলেন। আমি বিপদে পড়ে গেলাম। বললাম, এত অল্প সময়ে এত সামান্য দেখে মতামত দেওয়া যায় না। আর একটা পাব ভালো চলছে বলে অর্থনীতিও মজবুত বলা চলে না। সবটা সামাল দিলোরন। সে ধীরে ধীরে পুরো আলোচনাটাই বিতর্কের বাইরে নিয়ে গেল।

তবে যেসব বিষয়ে রনের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল, সেসব বিষয়ে মতপ্রকাশে তার দ্বিধা ছিল না।

২১.

লন্ডনে বেবীর চাচির সঙ্গে সাক্ষাৎকার ছিল একটি স্মরণীয় ঘটনা। তবে সেটা বলার আগে চাচির পরিচয়টা ঠিকমতো তুলে ধরা দরকার।

বেবীর একমাত্র চাচা আবদুল আহাদ ছিলেন সলিসিটর, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অর ডিগন্যাম অ্যান্ড কোম্পানি নামের আইন ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। এদেশে শিল্পোদ্যাগের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন এবং সেই সুবাদে পাকিস্তান চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইনডাস্ট্রিজের সভাপতি হয়েছিলেন, একাধিকবার পাকিস্তানের বাণিজ্য-প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিদেশে। তিনি প্রথমে বিয়ে করেন হুসনা শেখকে। চাচির বাবা ছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লোক, চল্লিশের দশকে কলকাতার নিউ মার্কেটের সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন। চাচা ও চাচির পরিচয় হয় কলকাতায়, পরে তারা বিয়ে করে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন, এখানে তাঁদের দুই মেয়ের জন্ম হয়। বেবীর সব ভাইবোনকে চাচা-চাচি খুব ভালোবাসতেন, বিয়ের পরে আমিও তাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছি। চাচির সঙ্গে আমাদের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাংলা শিখতে গিয়ে তিনি বর্ণমালায় হোঁচট খেতেন এবং আমার কাছে প্রতিকার চাইতেন। ষাটের দশকের শেষদিকে চাচা-চাচির বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে মেয়েদের নিয়ে চাচি চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। চাচা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদক ও সাহিত্য-সমালোচক এবং Poems from East Bengal (করাচি, ১৯৫৪) গ্রন্থের সম্পাদক ইউসুফ জামাল বেগম ওরফে ড. ফয়জুননেসা ওরফে রোজী মুসাকে–তার প্রথম স্বামী মুহম্মদ হোসেন ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। চাচার দ্বিতীয় বিয়ের পরও চাচি বলতে আমরা হুসনা শেখকেই বুঝতাম এবং নতুন চাচিকে উল্লেখ করতাম রোজী চাচি বলে। আইনব্যবসার সূত্রে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে চাচার ঘনিষ্ঠতা ছিল, তার সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তার অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। এ কে এম আহসান ও সানাউল হকের মতো আমলা এবং শওকত ওসমান ও সিকান্দার আবু জাফরের মতো সাহিত্যিকের সঙ্গেও চাচার বন্ধুত্ব ছিল। পরে জেনেছি, আওয়ামী লীগকে তিনি নিয়মিত অর্থসাহায্য করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়-এ সময়কার কোনো কথা তিনি নিকটজনের কাছেও প্রকাশ করেননি। তারপর আবার অফিস থেকে নিয়ে গিয়ে তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখা হয় এবং, যতটুকু জানা যায়, সেখানেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

হুসনা চাচির বোন লন্ডনে বাস করতেন সপরিবারে। তার কাছ থেকে একদিন খবর পাওয়া গেল যে, চাচি লন্ডনের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কালবিলম্ব না করে বেবী ও আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বেবী ও চাচির সে কী কান্না! বহুবছরে, বিশেষত, চাচার মৃত্যুর পর সেই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎকার। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বোনের বাসায় গেলেন চাচি। তারপর দুই বোন মিলে সারাটা দিন কাটাতে এলেন আমাদের বাসায়। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে আমি তাঁদের নিয়ে এলাম, আবার দিনশেষে সেখানেই বিদায় দিলাম! চাচির আচরণ থেকে কারো বোঝার উপায় ছিল না। যে, যে-স্বামীর সঙ্গে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন, তাঁরই ভ্রাতুস্পুত্রীর সঙ্গে তিনি সময় কাটাচ্ছেন।

বইপত্রে পড়েছি, হুসনা শেখ পরে হয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর তৃতীয় স্ত্রী। এ-সম্পর্কে আমাদের প্রত্যক্ষ কোনো জ্ঞান নেই। তবে চাচির বড়ো মেয়ের বিয়েতে যোগ দিতে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি যখন করাচি গিয়েছিলেন, চাচি তাদের বিমানবন্দরে নিতে এবং পৌঁছোতে এসেছিলেন–তখন তাঁরা যে-আমার শ্বশুরের অপ্রত্যাশিত অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন, তাতে ধারণা হয়েছিল যে, সরকারের ওপরমহলে চাচির নিশ্চয় খুব প্রভাব আছে। আমার শুধু মনে হয়, ঘটনাটি সত্য হলে বলতে হবে, এই হতভাগ্য মহিলার দুই স্বামীই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। ভুট্টোর পতনের পরে চাচিকে অনেকদিন পাকিস্তান ছেড়ে থাকতে হয়েছিল, এ-কথা সত্যি।

চাচির সঙ্গে এখনো আমাদের একটা পরোক্ষ যোগ আছে। তার মেয়েদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, পারস্পরিক খোঁজখবরই নেওয়া হয়েছে বেশি।

২২.

লন্ডনে আমাদের সামাজিক জীবন আবর্তিত হতো মূলত প্রবাসী আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কেন্দ্র করে। সপ্তাহান্তে একটি দিন ঘরবাড়ি গোছানো এবং আরেকটি দিন বেশির ভাগ অন্যত্র খেতে গিয়ে, কখনো অতিথি সৎকার করে কেটে যেতো। আমার ভাগ্নে মামুন এবং ভাগ্নে-বউ মীরা ভিন্ন ভিন্ন জায়গার হাসপাতালে চিকিৎসা করতো। সময় পেলে তারা কখনো একসঙ্গে, প্রায়ই একা একজন, আমাদের কাছে চলে আসততা। একবার ছুটির দিনে বিনা এত্তেলায়। মীরা চলে এসেছে–তখন আমাদের খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ। আমি এক দৌড়ে পাড়ার চীনা রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে এলাম তার জন্যে। পরিবেশন করতে গিয়ে শুনলাম, সে এসব খাবে না, কেননা চীনা খাবারে অভক্ষ্য থাকে। এতক্ষণ ধরে ঘরেও কিছু বানাবার চেষ্টা হয়নি বাইরের খাবারের ভরসায়। মীরার প্রত্যাখ্যানের পরে যথাসম্ভব দ্রুত কিছু তৈরি করা হলো বটে, কিন্তু সব। মিলিয়ে দেরি হয়ে গেল অনেক।

আরেকবার এরকম বিব্রত হয়েছিলাম মনসুর ভাইদের নিয়ে। মনসুর ভাই সম্পর্কে বেবীর নানা, কিন্তু তাঁকে আমরা ভাই ডাকি। তিনি এসেছেন দুই মেয়ে নিয়ে। তার শ্যালক হায়দার ও তার স্ত্রী হুসনা এবং ওদের ছোটো দুই মেয়ে রুনা-রুমাও আছে। খেতে খেতে মনসুর ভাই বললেন বেবীকে, ‘গরুর গোসতটা খুব ভালো কোত্থেকে এনেছ?’ বেবী বললো, ‘পাড়ার বুচারের কাছ থেকে।’ অমনি মনসুর ভাই খাওয়া বন্ধ করে দিলেন, হাত সরিয়ে নিলেন প্লেট থেকে। আমরা দুঃখপ্রকাশ করি, তার খাওয়ার যোগ্য এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তিনি আর খেতে পারেন না, তার খাওয়ার রুচি চলে গেছে। আমরা বিব্রত হই, এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তিরিশ বছর আগে লন্ডনে হালাল গোশত এত সুলভ ছিল না-খুঁজে-পেতে আনতে হতো ইহুদির দোকান থেকে। খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে আমার সম্পর্কে মীরা হতাশ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বেবীকে সে খুব জোর দিয়ে বলতো, রুচি-শুচির স্কুলে যেন বলে দেওয়া হয় খাওয়ার বিধিনিষেধ সম্পর্কে–দুপুরবেলায় ওরা তো স্কুল ডিনার খায়!

মনসুর ভাইয়ের বাড়িতে আমরা খেতে গেছি, আমার বন্ধু মোহাম্মদ আলীর বোন নার্গিস ও তার স্বামী শাহাদাঁতের আতিথ্যস্বীকার করেছি, গেছি রউফদের ঘরে। বেশি খাওয়া হতো হুসনা-হায়দার দম্পতির এবং আমার ছাত্রী মর্জিনা ও তার স্বামী শাহাবুদ্দীনের বাড়িতে। এদের প্রায় সকলের সঙ্গেই মামুনদের ভালো যোগাযোগ ছিল। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে মামুনরাও হতো তাদের অতিথি। মর্জিনাদের ওখানে গেলে চেষ্টা হতো খাওয়াদাওয়া সেরে তিন পরিবার মিলে কোনো পার্কে যাওয়ার। ছবি তোলার শখ ছিল শাহাবুদ্দীনের। তিনি অজস্র ছবি তুলতেন আমাদের–বিশেষ করে আনন্দের। মর্জিনার সন্তানদের তখনো জন্ম হয়নি–তাদের বাৎসল্যের সবটাই লাভ করেছিল আনন্দ। ছবি ছাড়া শাহাবুদ্দীনের যে-সংগ্রহ দেখে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম, তা হলো ১৯৭১ সালের লন্ডনের ইংরেজি সংবাদপত্রের–কী না যত্ন করে তিনি তা রক্ষা করতেন! এতবার বাড়ি-বদলের পরেও এখনো সে-সংগ্রহ তিনি সযত্নে ধরে রেখেছেন।

হাসি-হাসি মুখ করে বেড়াতে আসততা টুলু-বেবীর ফুপাতো ভাই। ডাকনাম-ব্যবহারে তার ভারি আপত্তি, পরিচয় করিয়ে দিতে হবে কাজী কামালউদ্দীন বলে, অন্তত কামাল বলে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়, তার নিবন্ধে, সোনালী ব্যাংকের লন্ডন শাখায় দশ পাউন্ড দিয়ে একটা হিসাব খুলেছিলাম, তা কোনোদিন পরিচালনা করা হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, সুদসুদ্ধ ওই দশ পাউন্ড টুলুর থেকে আদায় করে নিই, কিন্তু সে–এবং পরে আমার শালাজ–যে-সার্ভিস দিয়েছে, তার চার্জ অনেক হবে ভেবে পিছিয়ে পড়ি।

আমার মামাতো বোন হালিমার ছেলে সাদেক আমাদের সঙ্গে থাকতে এলে সবাই খুব আনন্দ পেতো। একটা ব্রিটিশ বৃত্তি নিয়ে সে স্কুলে পড়তো সে-দেশে। ছুটির সময়ে সে আপেল তুলতে যেতো কিছু রোজগার করতে। তারই মধ্যে সময় বাঁচিয়ে সে চলে আসততা আমাদের কাছে এবং এসে কতো না সাহায্য করতো বেবীর কাজে। সকালে-বিকেলে বাচ্চাদের স্কুলে নেওয়া এবং সেখান থেকে আনা, তাদের সঙ্গে সময় দেওয়া, রান্নাঘরে বেবীকে সহায়তা করা–এসব তো ছিলই। রাতে খেয়েদেয়ে বাসনকোশন হাঁড়িকুড়ি ভিজিয়ে রাখা থাকতো–সকালে আমাদের ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেখা যেতো, সাদেক সব নিজের হাতে ধুয়ে পরিষ্কার করে রেখেছে। তার স্বভাব এমনই মিষ্টি যে, সে কাছে থাকলেই ভালো লাগতো। সে ছিল আপনের চেয়ে অধিক।

কিছুকাল পর মামুন একদিন বললো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রাক্তন সহকর্মী ডা. মাসুদুর রহমানের বাসস্থানের খুব দরকার হয়ে পড়েছে হঠাই। দোতলার ছোটো ঘরটা মাসুদ ও স্নিগ্ধাকে দিলে ভালো হয়। মাসুদ যখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে প্যাথলজি বিভাগে কর্মরত ছিলেন, তখন এক গভীর রাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার ডা. কে এম আখতারুজ্জামান তাঁকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গেছিলেন ল্যাবরেটরিতে রুচির রক্তপরীক্ষার জন্যে এবং সে-পরীক্ষার ফলাফল তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে জানিয়েছিলেন–লিখে দেওয়ারও সময় পাননি, তাতেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে রুচি অ্যাপেনডিসাইটিসে আক্রান্ত। তাকে তদ্দণ্ডেই হাসপাতালে ভর্তি করে পরদিন সকালে তার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। স্নিগ্ধাও ডাক্তার–দিনাজপুরের বামপন্থী নেতা, তেভাগা-আন্দোলনের মহানায়ক, বরদা চক্রবর্তীর কন্যা। আমরা প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম, তাঁরা অতিথি হিসেবে কয়েকদিন থেকে অন্যত্র বাসস্থান খুঁজে নেবেন। পরে ওই একটি ঘরেই তারা অনেকদিন রয়ে গেলেন বাড়িভাড়া ভাগ করে নিয়ে এবং যথেষ্ট বিবেচনাশক্তির পরিচয় দিয়ে।

লন্ডনের বাইরে একাধিকবার যাওয়া হয়েছিল লিডসে–আবদুল মোমেন ও ওসমান জামালদের টানে। সেখানে অন্য বন্ধুদের সমাগম হতো–তার কথা কিছু কিছু আগে বলেছি। কামাল হোসেনদের কারণে অক্সফোর্ডে বেশ ঘন ঘনই যাওয়া হতো। সেখানে কামাল হোসেন, তপন রায়চৌধুরী এবং তাঁর অধীনে গবেষণারত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী রফিউদ্দীন আহমদকে আমি আখ্যা দিয়েছিলাম বরিশালের ত্রিভুজ বলে। অচিরেই ড. নূরুল ইসলাম অক্সফোর্ডে এসে যোগ দেওয়ায় পরিচিতের গণ্ডি একটু বাড়লো। ইতিহাসের তরুণ গবেষক গওহর রিজভির সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাছাড়া আইন-অধ্যয়নরত আরেক তরুণ তওফিক নওয়াজ ছিলেন এবং, সময়ের ভুল না হলে, আবুল হাসান চৌধুরী ওরফে কায়সারও।

অকস্‌ফোর্ডের কথায় একটা ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা যখন লন্ডনে তখন বেনজির ভুট্টো অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সেক্রেটারি। তার উদ্যোগে, পাকিস্তান সরকারের সক্রিয় প্রয়াসে, এবং পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বিদ্বজ্জন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমর্থনে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অক্সফোর্ডের সম্মানসূচক ডিলিট দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপিত হলো। ভুট্টো অক্সফোর্ডের প্রাক্তন ছাত্র–এখন একটি দেশের প্রেসিডেন্ট, সুতরাং এ মর্যাদা তাঁর প্রাপ্য, এ যুক্তি এক পক্ষের। প্রফেসর গমব্রিকের নেতৃত্বে অক্সফোর্ডের অধ্যাপকদের এক বড়ো অংশ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন–১৯৭১ সালে তাঁর গণতন্ত্রবিরোধী আচরণের এবং বাংলাদেশের গণহত্যায় তার ভূমিকার কারণে। তাঁরা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। কামাল হোসেন এবং তপন রায়চৌধুরী ভুট্টোবিরোধী আন্দোলনে যথেষ্ট শক্তি ও সময় ব্যয় করেছিলেন। পাকিস্তানি শিবির থেকে এমনও বলা হয়েছিল যে, ভুট্টোবিরোধী প্রচারণা চালাতেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অক্সফোর্ডে এসে অ্যাকাডেমিক সাজ পরেছেন। শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটিতে ভুট্টোকে ডিগ্রি দেওয়ার প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল।

আগের কথায় ফিরে যাই। আমাদের সামাজিক মেলামেশার কথা বলছিলাম। সপরিবারে আমাদের আরেকটি যাওয়ার জায়গা ছিল কেন্ট–অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খান সেখানে থাকতেন, আর থাকতো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের বন্ধু ওবায়েদ জায়গীরদার। ওবায়েদের বাড়িতে একবার দেখা হয়ে গিয়েছিল সার আজিজুল হকের পুত্র ক্যাপ্টেন আহসানুল হকের সঙ্গে। তিনি আমার শ্বশুরকে জানতেন বলে বেবীর সঙ্গে অনেক গল্প করেছিলেন এবং রুচির সঙ্গেও আলাপে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

আমার বিলেত-যাত্রার আগে রশিদ চৌধুরী একদিন তার দুটি ট্যাপেস্ট্রি মুড়ে নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘সপরিবারে বিদেশ-বিভুয়ে যাচ্ছেন–টাকা-পয়সার দরকার হবে। কিছু মনে করবেন না, এ-ট্যাপেস্ট্রি দুটি ওবায়েদকে দেবেন, ও বিক্রি করে আপনাকে টাকা পৌঁছে দেবে।’ রশিদের এই বদান্যতায় আমি এত অভিভূত হয়েছিলাম যে, অনুভূত কুণ্ঠাও প্রকাশ করতে পারিনি। লন্ডনে যাওয়ার পরে ওবায়েদ জায়গীরদার একদিন আমার বাড়ি থেকে ট্যাপেস্ট্রিগুলো নিয়ে গিয়েছিল এবং বেশ কিছুকাল পরে বাড়ি এসে ১০০ পাউন্ড দিয়ে গিয়েছিল। পরে মূল্যের পরিমাণ শুনে রশিদ বলেছিলেন, তিনি আরেকটু বেশি অর্থাগম প্রত্যাশা করেছিলেন; আমি তাকে জানিয়েছিলাম, ওবায়েদ বলেছিল, ছবি বিক্রির বাজার এখন ভালো নয়। বেশি হোক, কম হোক, অর্থটা যে কাজে এসেছিল, তা বলা বাহুল্য এবং সব ব্যাপারটার পেছনে রশিদের যে ভাবনাটুকু কাজ করেছিল, তার দাম ছবির নগদ মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি।

আর-দশজন পর্যটকের মতো লন্ডনের যা দর্শনীয়, তার যতটা পারা যায়, সপরিবারে দেখা হয়েছিল ধীরে ধীরে। বরাবরের মতো কেনাকাটা যা করার বেবীই করেছে। আমি নিজের জিনিসপত্র কিছু কিনেছি, আর দরজি দিয়ে একটা কালো স্যুট বানিয়েছি। বেবী আর আমি হারডসের দোকান দেখতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে–আমি কিনেছিলাম একটা টাই, আর সে একটা তোয়ালে। এই ছিল বিলাসিতার সীমা। সিনেমা-থিয়েটারে একসঙ্গে গেছি, তবে খুব বেশি নয়, আমি একাই গেছি বেশি। বাঙালিদের কিছু অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে গেছি। কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে সেবার বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয়েছিল সাড়ম্বরে। সেখানে সপরিবারে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। বইয়ের দোকানে নিজে যথেষ্ট গেছি–লন্ডনে তো বটেই, অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজেও, এর মধ্যে কেমব্রিজের বইয়ের দোকানই আমাকে আকর্ষণ করেছে অধিক। লন্ডনের পুরোনো বইয়ের দোকান বরঞ্চ হতাশই করেছে। ফয়েলসে ততদিনে পুরোনো বইয়ের জায়গা নিতে শুরু করে দিয়েছে নতুন বই।

সপরিবারে আসা-যাওয়ার পথে একবার বিপদেই পড়েছিলাম। টিউবে সবাই উঠতে-না-উঠতেই গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অনতিতরুণ দুই শ্বেতাঙ্গ নিজেদের সর্বশরীর ও সর্বশক্তি দিয়ে দরজা আগলে থাকায় কনডাক্টর-গার্ড আবার দরজা খুলতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সেই সুযোগে যারা গাড়িতে উঠতে পারিনি, তারা উঠে পড়েছিলাম। আমাদের উদ্ধারকারীদের ধন্যবাদ দিতে একজন তিন সন্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিল, ‘তোমার দু-হাত ভরা ছিল।’ আরেকজন বলেছিল, এরকম ঘটলে ঘাবড়ে যেও না। যারা গাড়িতে উঠে পড়েছ, তারা পরের স্টেশনের প্ল্যাটফরমে নেমে অপেক্ষা কোরো। যারা উঠতে পারোনি, তারা পরের গাড়িতে গিয়ে সেখানে ওদের সঙ্গে মিলিত হোয়য়া।

কাজের সূত্রে পরিচয় বাড়ছিল এক-আধজনের সঙ্গে। তার মধ্যে একজন ছিল আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের কৃষ্ণাঙ্গ টিকিট-চেকার। আমি ত্রৈমাসিক টিকিট কিনতাম। তখন যাত্রার সময়ে টিকিট দেখাবার কোনো আবশ্যকতা ছিল না–ফেরার পথে স্টেশন থেকে বেরোবার মুহূর্তে দেখাতে হতো। অল্পকালের মধ্যেই বিশেষ করে সেই চেকারের সঙ্গে ভালো চেনা হয়ে গেল। ফলে, অনেক সময়ে তাকে টিকিট না দেখিয়ে কেবল অভিবাদন করেই বেরিয়ে আসতাম। একদিন সে আমায় ডেকে বললো, দেখো, আমি জানি, তোমার কোয়ার্টার্লি টিকেট আছে। কিন্তু সবাই তো জানে না। তুমি যখন ‘গুড ইভনিং’ বলে বেরিয়ে যাও, তখন কেউ ভাবতে পারে, তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে খাতির করে আমি তোমার টিকেট চেক করছি না। এটুকু বলতেই আমি শশব্যস্ত হয়ে বললাম, এখন থেকে আর এই ভুল হবে না। সে হেসে বললো, আমি বুঝি, কথাটা তোমার মনে ওঠেনি। কিছু মনে কোরো না কিন্তু।

আমাদের বাড়িতে যে দুধ সরবরাহ করতো, আনন্দ তাকে মিকম্যান ভাই বলে ডাকতো। সে-ও খুব মজা পেতো এই ডাকে, ভাই কথাটার অর্থ তাকে ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছিল। সে এলেই আনন্দ ছুটে যেতো এবং ব্যস্ততা সত্ত্বেও সে আনন্দের জন্যে দু-মিনিট সময় ব্যয় করতো। তার সঙ্গে আনন্দের। ছবি তোলা হলে সাগ্রহে সে ছবির এক কপি চেয়ে নিয়েছিল।

প্রতি মাসে দু-তিন তারিখের মধ্যে দৈনিক পত্রিকার বিল শোধ করতাম বাড়ির কাছে নিউজস্ট্যান্ডে গিয়ে। এর মালিক ছোটোখাটো দেখতে, বয়স্ক মানুষ, ককনি হওয়াই সম্ভবপর। বিল-পরিশোধের অবকাশে তার সঙ্গে কুশল-বিনিময় হতো, সামান্য দু-একটি কথা। যেদিন শেষ বিল দিতে যাই, সেদিন দেখি, বুড়োর চোখ ছলছল করছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নিশ্চয় দেশে ফিরে যেতে পেরে খুশি হবে, তাই না? আচ্ছা, বাংলাদেশ কি অনেকদূর? প্লেনে যেতে কতো ঘণ্টা লাগে? আমার সঙ্গে দোকান থেকে বেরিয়ে তিনি কয়েক কদম হাঁটলেন। তারপর আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে, আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘গড ব্লেস ইউ।’ তারপর চকিতে ফিরে গেলেন।

এখানে আরো একজনের কথা বলতে হয়।

মিস এলিজাবেথ ক্লার্কসন ছিলেন সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক। তিনি কিছুকাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। সে-সময়ে একদিন ঈশ্বরদী বিমানবন্দর থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবাসে যেতে তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। সেই সূত্র ধরে চট্টগ্রামে বেড়াতে এসে তিনি আমাদের অতিথি হন। ভদ্রমহিলার বয়স হয়েছে, কিন্তু খুবই রসিক তিনি। রাজশাহীর কোনো সহকর্মীর রহস্যময় আচরণ ও কথাবার্তার গল্প করে তিনি আমাদেরকে খুব হাসিয়েছিলেন। তিনি যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন আমাদের বিলাতযাত্রা একরকম স্থির হয়ে গেছে। তিনি জানালেন। যে, আমরা ইংল্যান্ডে যেতে যেতে তিনিও সেখানে ফিরে যাবেন এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গেলেন, আমরা যেন অবশ্যই সপরিবারে সোয়ানসিতে বেড়াতে যাই–সেখানে থাকার ব্যবস্থা উনি করে দেবেন।

লন্ডনে যাওয়ার পর আমরা টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি আর তিনি প্রায়ই টেলিফোন করে তার আমন্ত্রণের পুনরাবৃত্তি করেন। শেষ পর্যন্ত আমরা সোয়ানসিতে যেতে পারিনি। এলিজাবেথ ক্লার্কসন যখন নিশ্চিত হন যে, আমরা যেতে পারছি না, তখন তিনি এক ছুটির দিনে লন্ডনে আসেন শুধু আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের বাসায় চা খেয়ে তিনি আবার ফেরার পথ ধরেন। তার এই সহৃদয়তা যে আমাদের খুব স্পর্শ করেছিল, তা বলা বাহুল্য।

২৩.

মামুনের সঙ্গে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, দেশে ফেরার আগে তার গাড়ির সঙ্গে ট্রেলার লাগিয়ে আমরা দুই পরিবার একবার প্যারিস দেখে আসবো। সেরকম প্রস্তুতিও নেওয়া হলো খানিকটা। কিন্তু বাদ সাধলো মীরা। সে ওই অবকাশে নাদিরাদের বাড়ি যাবে মার্থার টিডফিল্ডে-ইচ্ছে করলে আমরা ওয়েলসে খানিকটা ঘুরে নিতে পারি। আমরা হতাশ হলাম–বিশেষ করে, বেবী, এবং রুচিও খানিকটা–সে স্কুলে ফরাসি ভাষার প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছিল, ফলে প্যারিস সম্পর্কে তার একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। লন্ডনে নেমেই তো আমরা একবার ওয়েলসে এসেছি–আবার সেখানে কেন?

শেষ পর্যন্ত ওয়েলসেই যাওয়া হলো। প্রথমে মার্থার টিডফিল্ডে এবং পরে উত্তরদিকে উপসাগরের পাড় ঘেঁষে বাঙ্গোর প্রভৃতি স্থানে। বাঙ্গোর আমাদের বেশ ভালো লেগেছিল–সতার-না-জানা মানুষ সমুদ্রের উপকূলে যতটা দাপাদাপি করতে পারে, আমরা সকলে তা করলাম।

বাঙ্গোরে এক বাঙালি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে দেখা গেল, বেয়ারা আমাকে ঠিকই শনাক্ত করেছে। নিজের পরিচিতি বঙ্গদেশ ছাড়িয়ে বাঙ্গোর পর্যন্ত পৌঁছেছে জেনে আত্মশ্লাঘা জাগলো। তারপরই রহস্যভেদ। লন্ডনের বাংলা সাপ্তাহিক জনমরে সাম্প্রতিকতম সংখ্যার একটি সচিত্র প্রতিবেদনে আমি অন্তর্ভুক্ত। তা সত্ত্বেও কিংবা সে-কারণেই রেস্টুরেন্টে বেশ খাতির পাওয়া গেল।

লন্ডনে ফিরে এসে বিদায় নেওয়ার পালা। খাওয়া-দাওয়ার এক-আধটা আয়োজন নিজের বাড়িতেও করা হয়েছিল। তার একটিতে মিসেস জেমস আসতে পেরেছিলেন।

আমি চলে আসার আগে সোয়াসের ডাইরেক্টর প্রফেসর ফিলিপস একদিন মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের ছাত্রদের পড়াশোনার কথা তুলেছিলেন এবং একজন সম্পর্কে হতাশা ও বিরক্তি জ্ঞাপন করেছিলেন। ব্যাপারটা আমার খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি। তিনি কি চেয়েছিলেন সেই ছাত্রকে আমি তার মনোভাব জ্ঞাপন করি? কিন্তু তার সঙ্গে যে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই, তা আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম। আমি অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাউকেই কিছু বলার চেষ্টা করিনি।

২৪.

আগস্টের ১২ তারিখে সরকারি সফরে ড. কামাল হোসেনের যুগোস্লাভিয়া যাওয়ার কথা। তিনি লন্ডনে এলেন আগের দিন এবং এত্তেলা পাঠালেন। ১২ আগস্ট আমিও সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে যাবো।

কামাল আমাকে খুব করে অনুরোধ করলেন আর-কিছুদিন লন্ডনে থেকে যেতে। কারণটা এই : অক্সফোর্ডের সেন্ট অ্যান্থনিজ কলেজে বাংলাদেশ স্টাডিজের একটা চেয়ার সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছিল কিছুকাল ধরে–সেটা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে এসেছে। কামালের খুব ইচ্ছা, ওই পদটা আমিই প্রথম লাভ করি, এবং তিনি মনে করেন, আমি লন্ডনে থেকে গেলে আমার মনোনয়ন পেতে অনেক সুবিধে হবে। আমি আব্বার অসুস্থতার কথা বললাম এবং আমার পক্ষে যে কোনো অবস্থাতেই আর প্রবাসে থেকে যাওয়া সম্ভবপর নয়, তা বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কামাল একটু ক্ষুণ্ণ হলেন বটে, কিন্তু আমার কথা মেনে নিলেন।

তাঁর সঙ্গে দেশের অবস্থা সম্পর্কে বেশি কথা হলো না। তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েও যে বেশি স্বস্তিতে নেই, তা বোঝা যাচ্ছিল। তাছাড়া, দুদিন পর তো নিজেই দেশে ফিরে স্বচক্ষে সব দেখতে পাবো, তাকে বিব্রত করে আর কী লাভ!

ক্লাইভ রোডের যে-বাড়িতে আমরা থাকতাম, আমরা লন্ডন ছেড়ে আসার আগে তা ভাড়া নিতে এলেন হাসিনুর রেজা চৌধুরী। তাঁর অনুজ জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাদের ঘনিষ্ঠ, হাসিনুর রেজার শ্বশুর এম এ বারীর (এককালে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে বোর্ড ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান) পরিবারের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় দীর্ঘকালের। তিনি সঙ্গে নিয়ে এলেন এম এ লস্করকে। লস্কর সাহেবও আমার দীর্ঘকালের পরিচিত, এক সময়ে তিনি মতিঝিলের কো অপারেটিভ প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন। শুনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চলে গিয়েছিলেন সউদি আরবে। সেখান থেকে এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। বাড়িটা সম্ভবত তাঁরই দরকার ছিল। লস্কর সাহেব প্রথম সাক্ষাতে একটু বিব্রত হলেন, কিন্তু পুরোনো পরিচয়ের দাবিতে তা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নিলেন না। বাড়িওয়ালা এলেন, সব ব্যবস্থা হয়ে গেল।

আমরা বাড়ি ছেড়ে এবং জাহাজে মালপত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করে গিয়ে উঠলাম হায়দারের কাউনসিল-ফ্ল্যাটে, এক বিশাল বাড়ির ১৪ তলায়। কষ্ট যা হওয়ার তা হায়দার ও হুসনার হলো। আমরা কটা দিন আনন্দেই কাটালাম। আমাদের বিদায় দিতে মামুনও এলো লন্ডনে। তারপর দেশে ফেরার পালা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *