১০. মুজাহিদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু

অধ্যায় ১০

আজিজাবাদ, করাচি

আগের জায়গাটা যদি জেলখানা হয়ে থাকে তাহলে এখনকারটা কনডেমসেল।

মুজাহিদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বড়ভাই ইসমাইল চুপচাপ বসে ভাবছে। তিনজন কাপুরুষের জন্য তাদেরকে এমন শাস্তি দেবার কোনো মানেই হয় না। আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই তাদের ইহকালের জীবনটা অত্যন্ত সম্মানের সাথে পরিসমাপ্তি ঘটবে। মহৎ একটি উদ্দেশ্যে তারা জান-কুরবান করতে যাচ্ছে, দুনিয়ার আরাম-আয়েশ নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় কিন্তু অন্যের অপরাধে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে বলে ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে খেয়াল করেছে, দলের প্রায় সবাই, এমনকি যে লোকটা সারাদিন কোরান পড়ে সময় কাটায়, কারোর সাথে কথা বলে না, সেও মনোক্ষুণ্ণ হয়েছে এমন সিদ্ধান্তে।

দশজনের দলটি আগেও খুব একটা কথাবার্তা বলতো না, এখন এই অজ্ঞাত সেফহোমে নিয়ে আসার পর তারা যেনো পাথর হয়ে গেছে। শুধুমাত্র বয়সে সবচেয়ে ছোটো মুজাহিদের মধ্যে অস্থিরতা একটুও কমে নি।

“আমাদেরকে এখানে কতোদিন রাখবে, ভাইজান?”

ইসমাইল তার দিকে না তাকিয়েই বললো, “জানি না।”

বিশাল একটা ঘরে এদি-ওদিক জটলা করে বসে আছে দশজন মানুষ। ইসমাইল ঘরের এককোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে মুজাহিদের পাশে। অল্পবয়সি ছেলেটা উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।

“অনেক দিন রাখবে?”

এবার মুজাহিদের দিকে তাকালো সে। “অনেক দিন মানে কি?” একটু রুষ্ট হয়েই বললো। “আমরা শাহাদাত বরণ করতে এসেছি। আমরা কেন দিন গুনবো? কতোদিন কোথায় থাকবো, কি করবো এসব নিয়ে আমাদের ভেবে কী লাভ?”

মুজাহিদ চুপ মেরে গেলো, তবে সেটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য। “ভাইজান, সবাই তাহলে মন খারাপ করে আছে কেন?”

ইসমাইল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাচ্চাছেলেটাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সেও তাদের দলের একজন, সবার মনোভাব তার চোখ এড়িয়ে যাবে তাতো হয় না। “জায়গাটা কারোর পছন্দ হয় নি।” সত্যিটাই বললো সে।

আবু মুজাহিদ মাথা নেড়ে সায় দিলো। আরেকবার ঘরের চারপাশে চোখ বুলালো সে। আগের ফ্ল্যাটের তুলনায় আকারে বিশাল একটি ঘর কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে এটা আসলে মালঘর। শহরের লোকজন এরকম ঘরকে গোডাউন বলে। পাঞ্জাব শহরে সে ঠিক এরকম গোডাউন দেখেছে। তার বাল্যবন্ধু আখতার আর সে গ্রাম থেকে পালিয়ে সেই শহরে গেছিলো। একটা গোডাউন থেকে কিছু মাল চুরি করে বিক্রি করেছিলো তারা। লাহোরে যখন রাজমিস্ত্রির যোগাল হিসেবে কাজ করতো তখনও এরকম অনেক ঘর বানানোর কাজ করেছে।

“আমারও জায়গাটা পছন্দ হয় নি,” বললো সে। “এটা আসলে মালঘর।”

ইসমাইল তার দিকে তাকালো। “মালঘর? তুই মালঘর চিনিস?”

কাচুমাচু খেলো মুজাহিদ। “ইয়ে…মানে, সিনেমাতে দেখেছি।” মিথ্যে বললো সে।

মাথা দোলালো ইসমাইল। “তুই কি সিনেমা ছাড়া আর কিছু বোঝোস না?”

নির্দোষ হাসি দিলো ছেলেটি। “আমি তো খালি মারামারির সিনেমা দেখতাম, এজন্যেই ট্রেইনিংয়ে ভালো করেছি।”

ইসমাইল মুচকি হাসলো। কথাটা আসলেই সত্যি। মুজাহিদ ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো হলেও ট্রেইনিংয়ে সে বেশ পারদর্শিতা দেখিয়েছে। গুলি করাতে, গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতে, এমন কি সাঁতার কাটতেও সে বেশ ওস্তাদ। “বুদ্ধ। সিনেমা দেখে কেউ এসব শিখতে পারে!”

“পারে তো,” আগ্রহভরে বললো মুজাহিদ। “এই যে আমি…সিনেমা দেখেই তো মারামারি শিখেছি। পিস্তল কিভাবে চালায়, বোমা কিভাবে মারে

“ব্যস,” হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো ইসমাইল। “এবার একটু চুপ থাক। আমার মন-মেজাজ ভালো নেই। কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করবি না।”

চুপ মেরে গেলো মুজাহিদ। বড়জোর দু-মিনিট। তারপরই আবার তার বেমক্কা প্রশ্ন।

“আচ্ছা, যারা পালিয়ে গেছে ওদেরকে যদি বুজুর্গ আর চাচারা ধরতে পারে তাহলে কি করবে?”

“সোজা জাহান্নামে পাঠিয়ে দেবে?”

 হাসলো মুজাহিদ। “আর আমরা সবাই যাবো জান্নাতে, তাই না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বড়জন। “যদি কথামতো কাজ করতে পারি তাহলে আমরা সবাই জান্নাতের সবচেয়ে সম্মানের জায়গায় থাকবো।”

“কাজটা কি সেটা আমাদের বলছে না কেন?”

“সময় হলেই বলবে।”

“আমার মনে হয় খুব জলদিই আমাদের কাজে পাঠাবে।”

ইসমাইল তাকালো অল্পবয়সির দিকে। “তুই কেমনে বুঝলি?”

“বা-রে, আমাদের ট্রেইনিং শেষ হয়ে গেছে না?”

ছেলেটার সহজ-সরল জবাবে ইসমাইল কিছু বললো না। সে জানে খুব জলদিই তাদেরকে মিশনে পাঠানো হবে। তবে মিশনটা ঠিক কি ধরণের সেটা তাদের দলে মাত্র পাঁচজনকে বলা হয়েছে। বাকি পাঁচজন কিছুই জানে না। জানার দরকারও নেই। ওদের কাজ হবে ঐ পাঁচজনকে অনুসরণ করা। ওদের নির্দেশে কাজ করা।

অধ্যায় ১১

নতুন জায়গায় এলে সব সময়ই অপ্রত্যাশিত কিছুর সাথে পরিচয় ঘটে। করাচিতে নামার সাথে সাথে বাস্টার্ডেরও তাই হলো। আরব-সাগরের তীরে অবস্থিত করাচি পাকিস্তানের রাজধানী নয় তবে একসময় তাই ছিলো। পরে রাওয়ালপিণ্ডি, তারপর ইসলামাবাদে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হলেও এ শহরের গুরুত্ব মোটেও কমে যায় নি। পাকিস্তানের প্রায় সবকিছুই এই করাচিকেন্দ্রিক। প্রধান সমুদ্রবন্দর, বাণিজ্যিক শহর, ব্যবসা-বাণিজ্য, টিভি-পত্রিকার অফিস সবকিছু এখানে। এটা পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় আর জনবহুল শহরও বটে। মেট্রোপলিটান শহর হিসেবে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ আর জনবহুল একটি নগরী।

পাকিস্তান আর করাচি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেছিলো, যেমনটা মনে মনে আশা করেছিলো তার কিছুই দেখতে পেলো না জিন্নাহ এয়ারপোর্টে নেমে। বিশাল আর জমকালো স্থাপত্য। যেমন আধুনিক তেমনি অভিজাত। বিশ্বের যেকোনো উন্নত দেশের বিমানবন্দরের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। চারপাশের স্কাইলাইন দেখেও তার মনে হচ্ছে শহরটা বেশ সমৃদ্ধ। এই সমৃদ্ধির অন্তরালে যে তকালীন পূর্ব-পাকিস্তানকে শোষণ আর তাদের সোনালি আঁশ পাটের বিরাট ভূমিকা রয়েছে সেটা ক-জন জানে?

টারমার্ক দিয়ে হেঁটে এক্সিট লাউঞ্জে যাবার সময় বাতাসের গন্ধটা টের পেলো। প্রতিটি শহরের নিজস্ব গন্ধ রয়েছে। সেই গন্ধই বলে দেয় শহরটা কি রকম হতে পারে। সেদিক থেকে দেখলে করাচির গন্ধ তাকে বিভ্রান্তই করলো।

বাস্টার্ড তার যে পাসপোর্টটি ব্যবহার করে খুব সহজেই পাকিস্তানের ভিসা পেয়ে গেছে তাতে ভারতীয় কোনো ভিসা নেই, বরং মিডলইস্টের কিছু দেশসহ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আর হংকংয়ের ভিসা রয়েছে। এটাই বোধহয় নির্বিঘ্নে ভিসা পাওয়ার অন্যতম কারণ।

নভেম্বরের শীত হাঁড়ে কাঁপন ধরাচ্ছে না। দরকার পড়লো না জ্যাকেটের জিপার লাগানোর। এই অচেনা জায়গায় প্রথমবার পা রাখলেও এয়ারপোর্টে তার জন্য অপেক্ষা করছে একজন। ব্যাপারটা দারুণ স্বস্তির, আর এটা সম্ভব হয়েছে শুটার সামাদের বদান্যতায়। ঐ লোকটি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে এয়ারপোর্টের বাইরে-এমনই বলা হয়েছে তাকে।

সমস্ত ফর্মালিটি সারতে আরো আধঘণ্টা লেগে গেলো। মাত্র একটি লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখতে পেলো একপাশে অসংখ্য ট্যাক্সিক্যাব সুশৃঙ্খলভাবে পার্ক করে আছে। অন্যপাশে প্রাইভেটকারের ভীড়। বেশিরভাগ ট্যাক্সিক্যাবের সামনেই উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভাররা। অনেকক্ষণ ধরে দেখে গেলো সে, কোনো প্ল্যাকার্ড চোখে পড়লো না। শুটার সামাদ বলে দিয়েছে লোকটার হাতে তার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড থাকবে।

“তওফিক ভাই?”

কথাটা শুনে চমকে পেছনে ফিরে দেখলো ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। পুরু গোফ আর পরনে ঘিয়েরঙা ঐতিহ্যবাহী কাবুলি পোশাক, তার উপরে সবুজ রঙের একটি কোটি। গায়ের রঙ ঘন-শ্যামবর্ণ। কিন্তু লোকটার হাতে কোনো প্ল্যাকার্ড নেই।

“ইয়েস,” বললো সে।

“আমি জাভেদ। জাভেদ ওয়ার্সি। সামাদ ভায়ের লোক।”

উর্দুতে বললেও বাস্টার্ড বুঝতে পারলো। সে অবশ্য উর্দু বলতে পারে না, হিন্দিজ্ঞান দিয়ে বুঝে নিলো। সামাদ ভাই বলেছে, ছেলেটা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই, এর সাথে হিন্দি দিয়ে চালিয়ে নিতে পারবে।

হাত বাড়িয়ে দিলো সে। জাভেদ সহাস্যে করমর্দন করলো তার সাথে।

“চলেন?”

বাস্টার্ড তার সাথে সাথে এগিয়ে গেলো অসংখ্য প্রাইভেটকারের দিকে। “আমি কিন্তু উর্দু বলতে পারি না। টুকটাক হিন্দি পারি,” কথাটা হিন্দিতেই বললো।

হাসি দিলো জাভেদ। “সমস্যা নেই। হিন্দি আর উর্দু প্রায় একই রকম। যে উর্দু পারে তার পক্ষে হিন্দি বোঝা আরো সহজ। আপনি হিন্দিতেই কথা বলেন।” একটু থেমে আবার বললো, “আমার বাপ-দাদারা বিহারের লোক ছিলো। বাড়িতে আমরা হিন্দি বলি।”

কথাটা শুনে খুশি হলো বাস্টার্ড।

জাভেদ আর কোনো কথা না বলে তার হাত থেকে লাগেজটা নিয়ে নিলো।

“শুকরিয়া।”

“এই তো, আপনি ভালোই উর্দু বলছেন,” উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে বলে উঠলো বিহারি ছেলেটা।

মুচকি হেসে মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “আশা করি আপনার সাথে কয়েকদিন থেকে টুকটাক উর্দু শিখতে পারবো।”

“অবশ্যই।” গাড়ির ড্রাইভিং দরজাটা খুলে দিয়ে বাস্টার্ডকে ঢুকতে দিলো ভেতরে। তারপর ঘুরে লাগেজটা ভেতরে রেখে ড্রাইভিং সিটে এসে বসে পড়লো। ইগনিশান করার আগে বললো, “আমাকে তুমি করে বলবেন। ঠিক আছে?”

“ওকে।”

“আমি অল্প-অল্প বাঙালা শিখেছিলাম…এখন আর তেমন পারি না,” উর্দুটানে বংলায় বললো জাভেদ।

“হুম…সামাদভাই বলেছে,” বাস্টার্ডও বাংলায় বললো এবার।

দাঁত বের করে হাসলো মোহাজের। “আমি সহজ-সহজ উর্দু বলবো…একেবারে হিন্দির মতো করে…আপনার বুঝতে কোনো সমস্যাই হবে না।”

সৌজন্যমূলক হাসি দিলো সে।

“ভালো কথা, কতদিন থাকবেন আপনি? সামাদ ভাই বলেছেন এক কি দু-সপ্তাহ।”

“দু-সপ্তাহের বেশি থাকবো না মনে হয়,” হিন্দিতে বলার চেষ্টা করলো সে।

গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো ছেলেটি। “ভালোই হলো আমার জন্য। পনেরো-বিশদিন পর আমার লিডার আসবে লন্ডন থেকে…তখন খুব ব্যস্ত হয়ে যাবো।”

“লিডার?”

আবারো চওড়া হাসি দিলো জাভেদ। গাড়িটা পার্কিং এরিয়া থেকে বের হতে শুরু করেছে। “আমি এমকিউএম করি। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট। নাম শুনেছেন নিশ্চয়।”

এই দলটির নাম বহুবারই শুনেছে সে। এরা করাচির সবচেয়ে আলোচিত একটি রাজনৈতিক দল। ভারত-পাকিস্তান জন্মের সময় থেকে যেসব মুসলমান ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে করাচিতে এসেছিলো তাদেরকে মোহাজের বলে ডাকা হয়। এই মোহাজেররা আশির দশকে এমকিউএম নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে।

“কিন্তু আমি তো জানতাম এমকিউএম মানে মোহাজের কওমি মুভমেন্ট?” বললো সে।

মুখে হাসি ধরে রেখে মাথা ঝাঁকালো ছেলেটি। তার চোখ রাস্তার দিকেই। “প্রথমে ওটাই ছিলো…পরে মোহাজের বাদ দিয়ে মুত্তাহিদা করা হয়েছে।”

তাদের গাড়িটা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে প্রধান সড়কে উঠতেই জাভেদের কণ্ঠটা আবার শোনা গেলো।

মানে ইউনাইটেড,” হাসি দেখা গেলো তার মুখে, “আমিও টুকটাক ইংলিশ পারি। আপনার সাথে কয়েকদিন ঘুরে আরো কিছু শিখতে পারবো, ইনশাল্লাহ্।”

বাস্টার্ড কিছু না বলে মাপা হাসি হেসে বাইরে তাকালো। করাচির পথঘাট আর অত্যাধুনিক সুউচ্চ ভবনগুলো দেখে আরেকবার ভিরমি খাবার জোগাড় হলো তার। চোখ ধাঁধানো একটি শহর। রাস্তাগুলো বেশ চওড়া আর পরিস্কার। যানবাহনও প্রচুর। দামি দামি সব গাড়ি। সুরম্য অট্টালিকা। অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট গজিয়ে উঠছে। আমাদের এখানে যেটাকে সিএনজি নামে ডাকা হয় সেই স্কুটারও দেখা গেলো পথেঘাটে তবে রিক্সার মতো কিছু চোখে পড়লো না।

“আপনি কিন্তু এখনও বলেন নি কোথায় যাবেন?”

জাভেদের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো সে। “ও, সরি…খেয়াল ছিলো না,” আবারো হিন্দিতেই বললো। “আসলে ভালো একটা হোটেলে উঠতে চাইছি। মোটামুটি ভালো…খুব হাই-ফাই কিছু নয়।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি। “বুঝতে পেরেছি। এরকম প্রচুর হোটেল আছে করাচিতে। কোন এলাকায় থাকবেন সেটা কি ঠিক করেছেন?”

“গুলশান-এ-ইকবাল। ওই জায়গাটার আশেপাশে থাকলেই আমার জন্যে বেশি সুবিধার হবে।”

বাস্টার্ডের দিকে পাশ ফিরে তাকালো জাভেদ। তার মুখে হাসি। “ওখানে ভালো একটা হোটেল আছে। কোনো সমস্যা নেই। পার ডে দু-হাজার কি তিনহাজার রুপির মতো লাগবে…অবশ্য ওই হোটেলে চার-পাঁচ হাজার রুপির রুমও আছে…আপনার যেটা খুশি।”

“দু থেকে তিনহাজার রুপির রুম হলেই চলবে।”

“ওকে,” হেসে বললো জাভেদ।

শুটার সামাদ তা নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছে, জাভেদ তার কাজের ব্যাপারে কিছু জানতে চাইবে না। দরকারি প্রশ্ন ছাড়া কোনো প্রশ্নও করবে না। ওকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারে। তারপরও নিজের মিশন সম্পর্কে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে বিন্দুমাত্র ধারণা দেবার ইচ্ছে নেই তার।

“করাচি কেমন দেখছেন?” রাস্তার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা।

“খুব সুন্দর,” ছোট্ট করে বললো সে।

নিঃশব্দে হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো এমএমকিউএম-এর কর্মি। যেনো বোঝাতে চাইছে, দেখো, আমাদের শহরটা! এবার তোমাদের সাথে মিলিয়ে নাও!

“আমার একটা গাড়ি লাগবে…কয়েকদিনের জন্য,” আস্তে করে বললো বাস্টার্ড।

“হুম, সামাদ ভাই বলেছে।” রাস্তা থেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকালো। “এই গাড়িটা হলে চলবে তো?”

জাভেদ একটা টয়োটা চালাচ্ছে। গাড়িটা বেশি দামিও না আবার একেবারে সস্তাও বলা যাবে না। এমনটাই তার কাজের জন্য বেশি উপযুক্ত। “চলবে।”

“কয়দিনের জন্য নিতে চাইছেন?”

“উমম,” মনে মনে দ্রুত হিসেব করে নিলো সে, “এক সপ্তাহ…বড়জোর আট-নয়দিন?”

কাঁধ তুললো ছেলেটি। “ওকে।”

“গাড়িটা তো তুমিই চালাবে, তাই না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো। “জি, ভাই…আপনার এই বান্দাই চালাবে।”

আশ্বস্ত হলো সে। “গুড,” একটু থেমে আবার বললো, “এটা কি তোমার নিজের গাড়ি?”

“না…আমার লিডারের। আমি উনার এই গাড়িটাই চালাই। গত বছর লিডার মামলা খেয়ে লন্ডনে চলে গেছেন। পনেরো-বিশদিন পর আবার চলে আসবেন। তখন আমি আবার তার ড্রাইভার হয়ে যাবো।”

বাস্টার্ড বুঝতে পারলো জাভেদের কাজটা কি। সে এমকিউএম-এর লিডারের নিছক কোনো ড্রাইভার নয়। সম্ভবত, বডিগার্ড-কাম ড্রাইভার। এরকম লিডাররা নিজেদের বিশ্বস্ত লোকজনকে নিয়ে সারাক্ষণ চলাফেরা করে।

“তবে আমি কিন্তু লিডারের ড্রাইভার না,” বললো ছেলেটি। “লিডার আমাকে খুব বিশ্বাস করেন। আমি তার খুবই ঘনিষ্ঠ লোক।”

“তোমাকে দেখেই বোঝা যায়…তুমি খুবই বিশ্বাসী।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, ভাইজান,” হেসে বললো জাভেদ।

এবার মুচকি হেসে বাইরে তাকালো বাস্টার্ড। রাস্তার সাইন দেখে বুঝতে পারলো গুলশান-এ-ইকবাল এসে গেছে তারা। চমৎকার একটি জায়গা। মোটামুটি ধনীদের আবাসিক এলাকা বলেই মনে হচ্ছে। এখনও ডুপ্লেক্স বাড়িগুলো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ফাঁকে ফাঁকে। তবে হিসেব করলে হয়তো দেখা যাবে ডুপ্লেক্স বাড়ির সংখ্যাই বেশি। এলাকাটি বেশ সুনসান। যানবাহনের ভীড় তেমন একটা নেই। আবাসিক এলাকাটি শেষ হতেই কিছুটা জনাকীর্ণ জায়গায় চলে এলো তারা। এখানে রাস্তার দু-পাশে বাড়ি-ঘরের সংখ্যা অনেক কম, অফিস আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রচুর। রাস্তার দু-পাশের দৃশ্য দেখতে লাগলো। জাভেদ চুপ মেরে আছে অনেকক্ষণ ধরে। কিছুক্ষণ পরই গাড়ি থামলো একটি পাঁচতলা ভবনের সামনে। তার নজরে পড়লো বড় করে লেখা সাইনটার দিকে : হোটেল সামুনাবাদ।

“এই হোটেলটা বেশ ভালো…” বললো জাভেদ। “অন্য হোটেলের চেয়ে একটু সস্তাও।”

বাস্টার্ড কিছু বলার আগেই গাড়িটা ডানে মোড় নিয়ে ফ্রন্টগেটের সামনে থামলো।

“আজকে আমার কাজ কি?”

“আমার দুটো সিম লাগবে…কাগজপত্র ছাড়া কি ওগুলো কেনা যাবে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি। “যাবে। করাচিতে আপনি সবই পাবেন শুধু একটু বেশি টাকা দিতে হবে। এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি দুটো সিম নিয়েই আসবো।”

“কতো দিতে হবে?” মানিব্যাগটা বের করতে করতে বললো সে।

“সাত শ’ রুপি দিলেই হবে।”

এক হাজার রুপির একটা নোট বের করে ছেলেটার হাতে দিলো। “তোমার ফোন নাম্বারটা আমাকে দাও।”

জাভেদ তার নাম্বারটা বলে গেলে নিজের মোবাইলে সেভ করে নিলো।

“তুমি একটু লাউঞ্জে বসো, আমি চেক-ইন করে রুম নাম্বারটা তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি। একটু পর সিমটা কিনে আমাকে দিয়ে চলে যাবে। আমি বিকেলের দিকে তোমাকে ফোন দেবো।”

“ঠিক আছে। আর ওটা কখন লাগবে?” জাভেদ জানতে চাইলো।

“তিন-চারদিন পর।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি। “ঠিক আছে। কিন্তু জিনিসটা রাখবেন কোথায়?”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো বাস্টার্ড। “এই হোটেলে কি ওটা রাখা যাবে?”

“না। এখানকার গেটে মেটাল-ডিটেক্টর বসানো আছে। মাঝেমধ্যে পুলিশ চেকও হয়।”

“ও,” গাল চুলকালো সে।

“অন্য কোথাও রাখতে হবে।”

“কোথায় রাখা যায়, বলো তো?”

জাভেদও একটু ভেবে নিলো। “গাড়িতে রাখা যায় কিন্তু অনেক সময় রাস্তাঘাটেও চেকিং হয়। করাচিতে কোনো অঘটন ঘটলে ব্যাপক তল্লাশি চলে।”

ঠোঁট ওল্টালো বাস্টার্ড। বুঝতে পারছে ব্যাপারটা। “তাহলে তো প্রবলেম হয়ে গেলো।”

 “আরে কী বলেন, আমি আছি না,” অভয় দিয়ে বললো ছেলেটি। “এটা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমি একটা উপায় বের করে নেবো। ভালো কথা, অটোমেটিক লাগবে তো, নাকি?”

“হুম।”

“আর কিছু?”

“সাইলেন্সর জোগাড় করে দিতে পারবে?”

ভুরু কুচকে তাকালো এমকিউএম-এর কর্মী। “আপনার ওই জিনিস লাগবে?”

“হুম…শুনেছি এখানে ওসব জিনিস পাওয়া যায়।”

“তা পাওয়া যায়। মার্কেট থেকে কিনে দেয়া যাবে।”

বাস্টার্ড জানে এই মার্কেট মানে বৈধ কিছু নয়। করাচিতে অস্ত্র বিক্রি করার মতো প্রচুর জায়গা রয়েছে। উন্নতমানের অস্ত্র থেকে শুরু করে সবই পাওয়া যায়। “গ্রেট।”

“আপনি কি ওটা কিনতে চাইছেন?”

“হুম।”

“ওকে। নো প্রবলেম। যখন বলবেন কিনে দেবো। ওগুলো মার্কেটে এভেইলেবেল।”

গাড়ি থেকে লাগেজটা নিয়ে হোটেলের লবিতে চলে গেলো জাভেদ, তার সাথে সাথে মি: তওফিক আহমেদ। সে একজন পর্যটক। অনেক দেশ ঘুরেছে, এখন বেরিয়েছে উপমহাদেশ ঘুরতে।

ভদকে লাউঞ্জে বসিয়ে রেখে খুব সহজেই সামুনাবাদ হোটেলের রিসেপশনে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ফেললো। ৪০৯। চারতলার একটি চমৎকার রুম। জাভেদ রুম নাম্বারটা জেনে চলে গেলো।

রুমসার্ভিসের ছেলেটাকে বেশ ভালো অঙ্কের বখশিস দিয়ে তার গোমড়া মুখ এক নিমেষে পাল্টে দিলো। ঘরে ঢুকেই বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো সে। স্লাইডিংডোরটা টেনে খুলে দিতেই দেখতে পেলো করাচির অভিজাত এলাকাটি।

নতুন একটি শহর, নতুন একটি মিশন। সব সময়ের মতো এক ধরণের চ্যালেঞ্জ অনুভব করছে সে। ভিনি ভিডি ভিসি’র মতোই-এই শহরে এসে কাজটা করে চলে যাবে। এখানে তার কোনো পিছুটান নেই। মওলানা ইউসুফ ছাড়া আর কোনা লেনদেনও নেই করাচির সাথে।

অধ্যায় ১২

বিহার কলোনি
আল ফালাহ রোড, করাচি

দুপুরের পর এই কুফা সময়ে যেখানে কাস্টমারের জন্য হা করে বসে থাকতে হয়, কিংবা মাছি মারার মতো বেশুমার সময় থাকে হাতে তখন গুল্লা একটুখানি ঘুমিয়ে নেয়। নিজের চেয়ারে বসে পা দুটো ডেস্কের উপরে তুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। অনেক সময় গাঢ় ঘুমেও ঢলে পড়ে। কাস্টমার কিংবা ইয়ার দোস্তরা এসে তার সেই ঘুম ভাঙায়। কিন্তু আজ সেটা হয় নি। একটু আগে পা দুটো তুলে দিয়ে যে-ই না ঘুমাতে যাবে অমনি কোত্থেকে এক কাস্টমার এসে হাজির হয় তার দোকানে। ভনিতা না করেই সরাসরি জানতে চায় কোনো রকম কাগজপত্র ছাড়া সেলফোনের সিম কেনা যাবে কিনা।

কয়েক মুহূর্তের জন্য গুল্লা ভুরু কুচকে চেয়ে থাকে, লোকটাকে ভালো করে দেখে নেয়। মুখে চাপদাড়ি, পরনে শার্ট-প্যান্ট, হাতে ছোট্ট একটি হ্যান্ডব্যাগ। আস্তে আস্তে মুখের পান চিবোচ্ছে। চোখ দুটো কেমন ধূর্ত।

কাগজপত্র ছাড়া সিম বিক্রি করা বে-আইনি। তবে এখন পর্যন্ত এই বে আইনি কাজ-কর্মের ব্যাপারে কেউ ইনকোয়্যারি করতে আসে নি তার দোকানে। কিন্তু আসতে কততক্ষণ। গুল্লা তাই সতর্ক হয়ে জবাব দেয়, তার দোকানে কাগজপত্র ছাড়া সিম বিক্রি করা হয় না।

পাথরের মতো খোদাই করা নির্বিকার মুখটা আশ্বস্ত করে বলে সে কোনো সরকারি লোক নয়, আর তার কাছে খবর আছে গুল্লামিয়ার দোকানে কাগজপত্র ছাড়া সিম কেনা যায়। সে যদি বিক্রি করতে রাজি হয় তো এক্ষুনি কিছু সিম কিনবে, নইলে অন্য জায়গা দেখবে।

লোকটার কথা শুনে ধন্দে পড়ে যায় গুল্লা। কিছু সিম কিনবে-তার মানে একটা নয়, দুই-তিনটা? আজ সকাল থেকে মাত্র একটা সিম বিক্রি করেছে। সারাদিনে বড়জোর তিনটা বিক্রি করবে। তার মধ্যে কাগজপত্র ছাড়া হয়তো একটা কি দুইটা থাকবে। লাভ তো ওসবেই বেশি হয়।

কাস্টমারের দিকে ভালো করে তাকায় সে। তার মনে হয় নি লোকটা সরকারি কেউ-পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার। লাভের আশায় সে একটা ঝুঁকি নিয়েই ফেলে। ব্যবসা মানেই তো ঝুঁকি। ঝুঁকি না নিলে কিসের ব্যবসা? এতো ভয়-ডর থাকলে ফয়-ফরমাশ খেটে অন্যের চাকরি করাই ভালো।

একটু ভেবে তারপর সে বলে, আলবৎ দেয়া যাবে। তবে একটু বেশি টাকা দিতে হবে।

লোকটাকে দেখে মনে হয় নি বেশি টাকার কথা শুনে একটুখানিও ভেবেছে। সঙ্গে সঙ্গে জানতে চায়, প্রতি সিমের জন্য কতো দিতে হবে।

প্রায় দ্বিগুন দাম হাঁকিয়ে বসে গুল্লা। যদিও সে জানতো শেষপর্যন্ত দেড়গুন দামে ফয়সালা হবে, কিন্তু ঐ কাস্টমার আর কিছু না বলে পকেট থেকে একগাদা টাকা বের করে গুণতে শুরু করে। টাকাগুলো দেখে গুল্লার চোখ গোল গোল হয়ে যায়। বোকার মতো কাস্টমারের দিকে তাকায় সে।

তারপরই লোকটা নির্বিকারমখে জানায় একটা নয় দুটো নয়, ত্রিশটি সিম চাই তার! সে যেনো টাকাগুলো গুণে ঝটপট সিমগুলো দিয়ে দেয়।

কথাটা হজম করতে গুল্লার কয়েক মুহূর্ত লেগে গেছিলো। ধাতস্থ হতেই সে উঠে গিয়ে দরজাটা লক করে দেয়। ড্রয়ার খুলে দ্রুত হিসেব করতে থাকে আদৌ তার কাছে ত্রিশটি সিম আছে কিনা। গোণা শেষ হলে দেখে বত্রিশটি সিম আছে। হাফ ছেড়ে বাঁচে সে।

ত্রিশটি সিমকার্ড হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে কাস্টমার চলে যায়, দ্বিতীয় কোনো শব্দও উচ্চারণ করে নি আর।

এই বেশুমার বিক্রি থেকে কতো লাভ হলো সেটা হিসেব না করে গুল্লা হতভম্ব হয়ে বসে থাকে কয়েক সেকেন্ড। তারপর সৌভাগ্যের দিনটাকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ে আরেকজন কাস্টমার। এই ছেলেটা অবশ্য তার পরিচিত, তাই জাভেদ ওয়ার্সির আগমনে তার বিহ্বলতা কেটে যায়। টুকটাক কথা বলে পাকটেলের দু-দুটো সিম কিনে চলে যায় সে। এই দুটো সিমও কাগজপত্র ছাড়া বিক্রি করেছে। মোট বত্রিশটি কাগজপত্রবিহীন সিম বিক্রি করে কতো লাভ হলো সেটা হিসেব করতে গিয়ে গুল্লাকে রীতিমতো ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে হয়েছে।

এখন সেই খুশিতে গদগদ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো ইলতুৎমিশ মিয়ার শাহী-বিরিয়ানি ছাড়া লাঞ্চ করাটা ভীষণ অন্যায় হয়ে যাবে আজ। পকেটে একগাদা টাকা নিয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে যে-ই না উঠতে যাবে অমনি ভুতের মতো হাজির হলো আরেকজন কাস্টমার।

ঘটনা কি? মনে মনে বলে উঠলো গুল্লা। করাচির সব কাস্টমার কি আজ তার দোকানকেই টার্গেট করেছে নাকি?

কিন্তু লোকটা তার দোকানে ঢুকেই কোনো কথা না বলে দরজা লক্ করে দিলে গুল্লা ভড়কে গেলো।

“দরজা বন্ধ করলেন কেন?” জানতে চাইলো সে।

“কাজ আছে,” জবাব দিলো নতুন কাস্টমার। তার মধ্যে খবরদারি মনোভাব প্রকট।

গুল্লা ভালো করে দেখলো লোকটাকে। বয়স ত্রিশের মতো হবে। গায়ের রঙ অতোটা ফর্সা নয়। মোটা গোঁফ আর চোখ দুটো কেমন সতর্ক। সাদা ফুলহাতা শার্ট আর খয়েরি রঙের প্যান্ট পরে আছে। কালো কুচকুচে চুলে সম্ভবত তেল দেয়া। লোকটা স্থিরচোখে চেয়ে থেকেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো।

“একটু আগে এক লোক কিছু সিম কিনে নিয়ে গেছে…কোনো রকম কাগজপত্র ছাড়া।”

গুল্লা মনে মনে প্রমাদ গুণলো। তার এমন সৌভাগ্যের পর এই আজরাইল কোত্থেকে উদয় হলো? কে এই লোক? তার কাছে এসব জানতে চাইছে কেন?

“ওর কাছে কয়টা বেচেছো?”

হায় আল্লাহ! মনে মনে বলে উঠলো দোকানি। এভোদিন ধরে এই ব্যবসা করে আসছে, এই প্রথম সরকারী লোকজনের পাল্লায় পড়লো বুঝি।

“ভয় পেয়ো না…আমাকে বলো…তোমার কোনো সমস্যা হবে না।”

ঢোক গিললো গুল্লা। বুঝতে পারছে না কি বলবে। লোকটার হাবভাব দেখে সাহস করে বলতেও পারছে না সে কেন এসব জানতে চাইছে। “ইয়ে মানে…”

“বললাম তো তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি শুধু বলো কয়টা বেচেছো।”

মাথার পেছনটা চুলকালো দোকানি। “পাঁচ-ছয়টা…” অবশেষে কমিয়ে বললো সে। অপরাধ ধরা পড়ে গেলে কমিয়ে স্বীকার করে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

মাথা নেড়ে সায় দিলো লোকটি। “ঠিক আছে, ঐ সিমগুলোর নাম্বার আমাকে দাও…তোমার কোনো সমস্যা হবে না।”

গুল্লা কিছুই বুঝতে পারলো না। “নাম্বারগুলো!”

“প্রতিটি নাম্বারের জন্য তোমাকে পাঁচশ’ রুপি দেবো।” কথাটা বলেই পকেট থেকে পাঁচশ’ রুপির পাঁচটা নোট বের করে দিলো সে। “এই নাও…এখন আমাকে ঐ নাম্বারগুলো দাও, ঠিক আছে?”

গুল্লা বেকুব হয়ে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে।

“নাও?” তাড়া দিলো আবার।

মন্ত্ৰতাড়িত হয়ে টাকাগুলো তুলে নিলো। প্রতিটি সিমের নাম্বার জানতে একহাজার রুপি দিচ্ছে?! সরকারী লোক হলে তো উল্টো তাকে ফাপড় মেরে টাকা খেতো। তাহলে এই লোকটা কে?

“কাগজপত্র ছাড়া সিম বিক্রি করা বে-আইনি কিন্তু আমি তোমাকে সেজন্যে ধরবো না। শুধু নাম্বারগুলো দিয়ে দিলেই হবে। যারা বে-আইনি সিম কিনেছে আমরা কেবল তাদের ধরবো…তোমাকে ধরে কোনো লাভ নেই…তুমি গরীব মানুষ..ছোটোখাটো ব্যবসা করে চলো।”

মনে মনে সায় দিলেও গুল্লা চুপ মেরে রইলো। লোকটা বোঝাতে চাইছে সে সরকারী লোক। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে তাকে টাকা দিচ্ছে কেন?

“তোমাকে টাকা দিচ্ছি যাতে তুমি এটা কাউকে না বলো।” যেনো তার মনের কথা পড়ে ফেলে বললো লোকটি।

“সাহাব,” ঢোক গিলে বললো সে, “ওই আদমি তো বত্রিশটা সিম কিনেছে।” ইচ্ছে করেই অন্য দুটো সিমও যোগ করে দিলো বেশি পাবার আশায়।

“কি!” লোকটার চোখ কপালে উঠে গেলো। “বত্রিশটা?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো গুল্লা। ড্রয়ার থেকে সিমকার্ডের নাম্বার সংবলিত কাগজগুলো বের করে রাখলো ডেস্কের উপরে। এই কাগজগুলো প্রতিটি সিমের সাথেই থাকে। বিক্রি করার সময় এগুলো দেয়া হয় না। প্রতিটি নাম্বারের জন্য ভুয়া কাগজ তৈরি করে ফোন কোম্পানিতে জমা দিয়ে দেয়। ব্যস, সব ল্যাঠা চুকে গেলো। আইনও মানা হলো আবার ব্যবসাও করা গেলো। ফোন কোম্পানির মার্কেটিংয়ের লোকজন তাদের মতো ডিলারদের এটা শিখিয়ে দিয়েছে।

“এই যে…এগুলো…”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো লোকটি, তারপর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে পকেট থেকে আরো ছয়টি একহাজার রুপির নোট বের করে গুল্লার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “এ মুহূর্তে আমার কাছে তো অতো টাকা নেই…তুমি এগুলো রাখো…ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে, সাহাব।” টাকাগুলো পকেটে রেখে দিলো সে।

লোকটা ধাতস্থ হয়ে ডেস্কের উপরে রাখা কলম আর এক টুকরো কাগজ নিয়ে সিমের নাম্বারগুলো লিখে নিলো দ্রুত।

গুল্লা চুপচাপ দেখে গেলো সবকিছু। নিজের সৌভাগ্যকে সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। কাগজ ছাড়া সিম বিক্রি করলে এমনিতেই বেশ ভালো লাভ হয়, তার উপরে বত্রিশটি সিমের শুধু নাম্বারের জন্য সাড়ে-আট হাজার রুপি ইনকাম করতে পেরে সে যেনো আকাশে উড়ছে।

“এই ব্যাপারটা কাউকে বলবে না,” নাম্বারগুলো টুকে নিয়ে বললো লোকটি। “বললে তোমারই মুসিব্বত হবে।”

“জি, সাহাব, মাথা নেড়ে সায় দিলো গুল্লা। “আপনার সাথে আমার এই জিন্দেগিতে কখনও মোলাকাতই হয় নি।” দাঁত বের করে হাসলো সে।

“তুমি খুব আকালমান্দ!” মুচকি হেসে লোকটা চলে গেলো তার দোকান থেকে।

গুল্লার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আল্লাহ যখন দেয় তখন ছাপ্পাড় মেরেই দেয়! এখন ইলতুৎমিশ মিয়ার বিরানিটাও কেমন ফকিরি-ফকিরি বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। আরেকটু ভালো, আরেকটু খানদানি লাঞ্চ করা উচিত।

গুন গুন করে জনপ্রিয় একটা গান গাইতে গাইতে দোকান বন্ধ করে চলে যেতে উদ্যত হলো সে। আজকে আর দোকানদারি না করলেও চলবে। শুধুমাত্র নাম্বার বিক্রি করে হাজার-হাজার রুপি কামাই করার মতো দিন তো আর রোজ রোজ আসে না।

অধ্যায় ১৩

তাড়াহুড়ো করে কাজ করা তার ধরণ নয়, তবে এ শহরে বেশিদিন থাকার কথাও ভাবছে না। তাই বলে প্রথম দিনে কাজে নেমে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই। কাজ শুরু করবে আগামীকাল থেকে।

হোটেলরুমে ঢুকেই শাওয়ার নিয়ে জামা পাল্টে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিলো একটু। আগামীকাল সকালে, লাঞ্চের ঠিক আগে মওলানা দর্শন করবে। বিজনেস কার্ডে যে ঠিকানাটা দেয়া আছে সেটা এই গুলশান-এ ইকবাল এলাকার। তার ধারণা হোটেল সামুনাবাদ থেকে বড়জোর পাঁচ-দশ মিনিটের পথ হবে।

সে জানে কাজটা খুব সতর্কতার সাথে করতে হবে। একদম স্বাভাবিক থাকতে হবে তাকে। ঘুণাক্ষরেও যেনো মওলানা কিছু টের পেয়ে না যায়। প্লেনের সহযাত্রি ভুল করে সামান্য একটি বই নিয়ে গেছে আর সেটা ঢাকা থেকে করাচিতে লোকমারফত ফেরত পাঠানোর ব্যাপারটা মোটেও সহজভাবে দেখার কথা নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে ভালোমানুষটির কাছ থেকেও কেউ এমনটি আশা করবে না। আর যদি এমন কেউ থেকেও থাকে, যে কিনা অন্যের সামান্যতম জিনিসও-সেটা যতো তুচ্ছই হোক না কেন-নিজের কাছে রাখতে চায় না, সে নিশ্চয় করাচিতে লোক পাঠিয়ে ওটা ফেরত দেবে না। ডিএইচএল, ফেডেক্সসহ আরো কিছু ইন্টারন্যশনাল কুরিয়ার সার্ভিস আছে, তাদের মাধ্যমে পাঠানোটাই স্বাভাবিক আর যৌক্তিক।

রুমের সিলিংয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। বই ফেরত দেবার প্রস্তাবটি যখনই করেছিলো তার ক্লায়েন্ট তখনই সে বুঝতে পেরেছিলো সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে হবে। এটাকে শুধু মওলানা দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। অনেক ভেবে অবশেষে করাচির উদ্দেশ্যে রওনা দেবার আগেই একজনের সাথে দেখা করেছিলো। লোকটা ইলেক্ট্রনিক্সের বিভিন্ন গেজেট নির্মাণ করে; মোডিফাই করে। ডুপ্লিকেট সিম বানানো, আইডি নাম্বার শো না করাসহ বহু কিছু করে থাকে সে। বলাই বাহুল্য, এগুলো একদম বে-আইনি কাজ। তাই তাকে কাজ করতে হয় আন্ডারগ্রাউন্ডে। বিশ্বস্ত কাস্টমার ছাড়া কারো সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথাও বলে না। এর আগে মাত্র দু-বার গিয়েছিলো তার কাছে। প্রথমবার কলার আইডি শো না-করার কাজে, দ্বিতীয়বার একটি সিমের ডুপ্লিকেট বানাতে। এই লোকের ঘনিষ্ঠ একজন আবার তার খুব কাছের লোক। ফলে খুব একটা যোগাযোগ না থাকলেও অনেকদিন পর দেখা করতে সমস্যা হয় নি।

‘বইয়ের মইদ্যে ঢুকাইতে হইলে তো অনেক পাতলা হইতে হইবো,” সে কি চাইছে তা জানার পর লোকটি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেছিলো। “একটা সিমের চায়া সামান্য বড় সাইজ হইলে হইবো?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো সে। “মনে হয় হবে।”

“সিমের চায়া ডাবল মোটা…স্কয়্যার সাইজ…এই ধরেন এতো বড় হইবো…” তর্জনি আর বুড়ো আঙুল দিয়ে আকারটা বোঝালো সে। “তাইলে কি চলবো?”

তখনই হিসেব করতে শুরু করেছিলো বাস্টার্ড। একটা সিমের চেয়ে দ্বিগুন পুরু? সেটা বইয়ের কোন জায়গায় রাখলে কখনও কারোর চোখে পড়বে না-এমন কি বইটা পড়তে গেলেও?

“চলবো না?” ইলেক্ট্রনিক্সে অভিজ্ঞ লোকটি জানতে চেয়েছিলো।

“এরকম জিনিস বইয়ের কোথায় লুকিয়ে রাখলে বোঝা যাবে না?” পাল্টা প্রশ্ন করেছিলো সে।

“উমমম,” চুমুভাই নামের লোকটি আবারো চিন্তা করে জবাব দিলো, “বইটা কতো মোটা?”

“এই ধরেন এরকম…” তজর্নি আর বুড়ো আঙুলের মাঝখানে আড়াই ইঞ্চির মতো ফাঁক তৈরি করে দেখালো সে।

“বাইন্ডিংটা কেমন?”

“মানে?” বাস্টার্ড বুঝতে পারলো না।

“মানে, হার্ড বাইন্ডিং নাকি পেপারব্যাক?”

এ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা না থাকায় সে বলতে পারে নি, তবে চুনুর ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পায় সেখানে অল্প কিছু বইপত্র আছে। কিছু গল্পের বই, বাকিগুলো কম্পিউটার মেরামতের ম্যানুয়াল।

“আপনার ঐ পূর্ব-পশ্চিমের মতো,” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত বইটির প্রথম খণ্ড দেখিয়ে বলেছিলো সে।

“ও,” হাসি দিয়ে বলেছিলো চুন্ন। “তাইলে তো হার্ডবাইন্ডিং। ওই রকম বইয়ের ভিতরে আরামসে ঢুকানো যাইবো। কেউ টের পাইবো না। বইটা আমার কাছে নিয়া আইসেন…আমি নিজে সেট কইরা দিমু, কোনো সমস্যা নাই।”

কথাটা শুনে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো বাস্টার্ড। মাত্র পাঁচ-হাজার টাকার বিনিময়ে একদিন পরই কাজটা করে দিয়েছে চুন্নভাই।

এই জিপিএস ট্র্যাকার জিনিসটা খুবই নতুন। আর ছোটো আকারের ডিভাইস সচরাচর পাওয়া যায় না। চুন্নুভাই নিজে এটা মোডিফাই করে নি, বাইরে থেকে কালেক্ট করেছে।

“এগুলারে বলে স্পাই-গেজেট,” বলেছিলো সে। “আগে তো এইসব জিনিস পাবলিকের হাতে থাকতো না…এখন যুগ পাল্টাইছে। কতো কি যে বাইর হইতাছে…দেখলে মাথা নষ্ট হইয়া যাইবো।”

বাস্টার্ড নিজেও এসব জিনিসের কথা শুনেছে, তবে এই প্রথম ব্যবহার করতে যাচ্ছে।

“চায়না থেইকা এক পিস নিয়া আসছিলো এক লোক কিন্তু ইউজ করবার পারে নাই…আমার কাছে বেইচা দিছে।”

এই ব্যাপারটাই তাকে একটু দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো। সে সব সময় ব্যাক-আপ রাখে। জিপিএস ট্র্যাকারের বেলায় সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না। যাহোক, আগামীকাল সকালে রওনা দেবার আগে সে আরেকবার পরীক্ষা করে দেখবে ডিভাইসটি ঠিকমতো কাজ করে কিনা। চুমুকে সে দেখেছে কিভাবে বইয়ের বাইন্ডিং খুলে ওটা সেট করেছিলো। কতো সহজেই না সামান্য একটি অ্যাডহেসিভ ব্যবহার করে বইটা আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে পেরেছিলো লোকটি।

আরেকটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। বইটা ফেরত দিয়েই সোজা চলে আসবে। সম্ভবত পাঁচ মিনিটের একটি সাক্ষাত। এর বেশি সময় নেবে না। মওলানাকে বুঝিয়ে দিতে হবে মি: জামিল আহমেদের অনুরোধের চেঁকি গিলেছে সে। এইসব ফালতু জিনিস পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে তার একটুও আগ্রহ ছিলো না। নিতান্তই সম্পর্কের খাতিরে করেছে এটা।

বিছানায় উঠে বসলো সে। জিপিএস ডিভাইসটি বের করে অন করলো। ভার্চুয়াল মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে করাচির গুলশান-এ-ইকবাল এলাকার একটি জায়গায় লাল-বিন্দুটি বিন্ করছে। বইয়ের ভেতরকার ডিভাইসটি ঠিকঠাকমতোই কাজ করছে তাহলে। জিপিএসটি পকেটে ভরে রুম থেকে বের হয়ে গেলো সে। নীচতলায় নেমে রুমের চাবিটা ডেস্কে জমা দিয়ে হোটেলের বাইরে চলে এলো। রাস্তায় নেমে বামদিকে বেশ কিছুটা হেঁটে আবারো পকেট থেকে বের করলো ডিভাইসটি। এখনও কাজ করছে ওটা। মুচকি হাসলো সে। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সেলফোন কোম্পানি পাকটেলের সিম ব্যবহার করেছে। এটা সমগ্র পাকিস্তানই কাভার করবে।

জিপিএস ট্র্যাকারটি পকেটে রেখে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এক ব্লকের মতো দূরে এসে আরেকবার চেক করে দেখলো। জিনিসটা এতো দূরেও ঠিকমতোই কাজ করছে। সবকিছু যখন ঠিকঠাক কাজ করে তখন তার ভালো লাগে। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বহুগুনে।

ডিভাইসটি পকেটে ভরে আবারো ফিরে গেলো হোটেলে। আজকে আর কোনো কাজ নেই। এখন বিশ্রাম নিয়ে নিজেকে ফিট করতে হবে। আগামী কয়েকটা দিন বেশ ভালোই ব্যস্ত থাকতে হবে তাকে।

অধ্যায় ১৪

বুজুর্গ খুব টেনশনে পড়ে গেছে। সে জানে তিনটি ছেলের পালানোর ঘটনাটি খুবই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তবে আপাতত একজনের কাছে জবাবদিহি করাটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উপরওয়ালাদের কাছে জবাবদিহি করতে সে কখনও ভয় পায় না কিন্তু একটু পর যে লোক আসবে তার সামনে কথা বলতেই কেমন অস্বস্তি বোধ করে। লোকটা তার থেকে কম করে হলেও বিশ বছরের ছোটো। এর সম্পর্কে অনেক কিছুই তাদের অজানা। এক রহস্যময় আদমি। তাদের দলের চিফ-কমান্ডার এই ত্রিশবছর বয়সি লোকটাকে খুবই সমীহ করেন। বলা হয় কমান্ডারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন হলো এই মীর!

হ্যাঁ। তাকে সবাই মীর বলেই ডাকে। বুজুর্গ শুনেছে তার নাকি আরো অনেক নাম আছে। সাজিদ মীর। মাজিদ সাজিদ। আবু বারা। আঙ্কেল বিল। সাজিদ বিল। ইব্রাহিম।

একজন মানুষের এতোগুলো নাম থাকার একটাই অর্থ-লোকটা গভীরজলের মাছ। ভীষণ বিপজ্জনকও বটে। তারা যে বিশাল কাজটা করতে যাচ্ছে সেটার সর্বেসর্বা হলো এই লোক। নিজেকে সে এই প্রজেক্টের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দেয়। তাকে দেখলে মনে হবে খুবই সজ্জন আর ভদ্রগোছের একজন মানুষ। তার ব্যবহার সব সময়ই অমায়িক। কখনও তাকে রাগতে দেখে নি। মাঝারি উচ্চতা, গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, পরিপাটি করে আচড়ানো চুল আর সুন্দর করে ছাটা চাপদাড়ি। যখনই দেখা করতে আসে সঙ্গে থাকে দু-জন বিশ্বস্ত দেহরক্ষি। আর সব সময় কোমরে থাকে তার প্রিয় অস্ত্র মাকারভ পিস্তল।

বুজুর্গ শুনেছে লোকটা নাকি এক সময় মিলিটারিতে ছিলো। আরবি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলো, ইউরোপ-আমেরিকায় হরহামেশা যাতায়াত করে। এই রহস্যময় লোকটি সাদা চামড়াদের সাথে এমন সখ্যতা গড়ে তুলেছে যে, তাদের দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও করিয়ে নেয়। ফ্রান্সে তার প্রচুর কানেকশান রয়েছে।

এতো বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন লোক বলে এর সান্নিধ্যে এলেই বুজুর্গ একটু নার্ভাস বোধ করে। লোকটার চোখ দুটোও গভীর আর অন্তর্ভেদি। মনে হয় ভেতরটা পড়ে ফেলছে বিনা বাধায়।

দরজায় নক করা হলে সম্বিত ফিরে পেলো বুজুর্গ। বুঝতে পারছে ঐ রহস্যময় লোকটি চলে এসেছে। নিজে গিয়েই দরজা খুলে দিলো।

দু-জন বডিগার্ড দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ঠিক পেছনেই চাপদাড়িতে হাত বোলাচ্ছে মীর।

“আসোলামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু…” বুজুর্গ আদবের সাথে সালাম দিলো।

“ওয়ালাইকুম আসোলাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ, প্রসন্নভাবে হেসে ঘরে ঢুকে পড়লো মীর।

তার দেহরক্ষি দু-জন ভেতরে ঢুকলো না। তাদের মধ্যে একজন বাইরে থেকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

“বুজুর্গ কি পেরেসানে পড়ে গেছেন নাকি?” ঘরের এককোণে সোফার দিকে এগিয়ে যাবার সময় বললো মেহমান।

“না, মানে…” কাচুমাচ খেলো সে। “…আসলে চিন্তা না করেও তো উপায় নেই…তাই না?”

সোফায় বসে অভয় দেবার জন্য চওড়া হাসি দিলো মীর। “তসরিফ নিন।”

বুজুর্গ পাশের একটি সোফায় বসে পড়লো।

“বাকিদের কি অবস্থা?”

“ওরা ভালোই আছে। মনে হয় না ওদের মধ্য থেকে কেউ পালাবে।”

মির স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলে একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলো বুজুর্গ।

“আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি ওদের মধ্যে জিহাদি জোশ পয়দা করতে। এরইমধ্যে ভিটামিনও দেয়া শুরু করে দিয়েছি। আমার মনে হয় বাকি দশজনকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই।”

আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো মেহমান। “ভালো, কিন্তু ওদের দিকে কড়া নজর রাখতে হবে।”

“জি। আমি কড়া নজর রাখছি সবার উপরে।”

মুচকি হাসলো সাজিদ মীর। “আপনি একা দশজন ছেলের উপরে নজর রাখতে পারবেন না। তাছাড়া নজরদারি করার কাজও আপনার নয়।”

বুজুর্গ আবারো টের পেলো সেই পরিচিত অস্বস্তিটা।

“এটা যাদের করার তারাই করবে।”

মনে মনে ঢোক গিললো সে। তার আশংকা তাকে এ কাজ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলো চুপচাপ সব শুনে যাবার জন্য।

“আমি আগামীকালই দু-জনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি…ওরা-ই সব ব্যবস্থা করে দেবে।”

“ঠিক আছে,” মাথা নেড়ে সায় দিলো বুজুর্গ। তর আশংকা সত্যি প্রমাণিত হলো।

“ঐ ছেলেগুলো যেনো ওদের না দেখে…বুঝলেন?”

বুজুর্গ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। ওদের দেখবে না মানে? তাহলে নজরদারির কাজটা কিভাবে করবে? “জি, বুঝলাম না?”

“ওই দু-জন এখানে এসে কিছু কাজ করবে…ওই সময়টাতে আপনি ছেলেগুলোকে অন্য ঘরে সরিয়ে রাখবেন। ভালো হয় নামাজ-ঘরে ওদের রেখে দিলে। কাজ শেষ হলে ওরা চলে যাবে। আপনি নিজে ওদের সাহায্য করবেন।”

“জি, আচ্ছা,” বুজুর্গ একটু খুশি হলো। এবার সে বুঝতে পারছে, তাকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র নজরদারি করার একটি ব্যবস্থা করা হবে। আর সেটা কোনো মানুষ দিয়ে নয়।

মির পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে বুজুর্গের হাতে তুলে দিলো। “এটা রাখুন। এখানে কিছু ভিডিও ফাইল আর ডকুমেন্টারি আছে…ওদেরকে কোন্টা কখন দেখাবেন সেটার ইস্ট্রাকশনও দেয়া আছে।”

“জি, আচ্ছা।”

“তবে তার আগে আপনি নিজে দেখে নেবেন। আর এইসব দেখানোর সময় ওদের কি বলবেন সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখবেন। বুঝেছেন?”

“জি, জি…সবটাই বুঝতে পেরেছি।”

“শুকরিয়া,” প্রসন্নভাবে হেসে বললো মীর।

বুজুর্গ টের পেলো তার ভেতর থেকে একটা চাপা আশংকা আর অস্বস্তি দূর হয়ে গেছে মুহূর্তে।

অধ্যায় ১৫

যা ভেবেছিলো তা-ই। হোটেল সামুনাবাদ থেকে মওলানা ইউসুফ হোসাইনীর

অফিসটি গাড়িতে করে গেলে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ।

কথামতোই গতকালের গাড়িটা নিয়ে সকাল সাড়ে দশটার দিকে হোটেলে এসে হাজির হয় জাভেদ। ততোক্ষণে সে নাস্তা সেরে ফিটফাট পোশাক পরে নিয়েছিলো। তার আজকের এই পোশাকটি একদমই অন্যরকম। সচরাচর এ ধরণের পোশাক সে পরে না, কিন্তু আজকের ভিজিটটাও আর সব কিছুর চেয়ে আলাদা-একজন ব্যবসায়ি কিংবা এক্সিকিউটিভ। করাচিতে একটা কাজে এসেছে। জামিল আহমেদের সাথে তার সখ্যতার কারণে একটা অনুরোধ রাখতেই মওলানার অফিসে আসা।

রওনা দেবার আগে জাভেদকে ঠিকানাটা বলতেই অবাক হয়ে যায় সে। এটা তো হাটাপথের দূরত্ব!

যাহোক, ছেলেটার একটা গুণ আছে, খুব বেশি প্রশ্ন করে না। মেজাজ বুঝে টুকটাক কিছু কথা বলে। ঠিকমতো সাড়া না পেলে একদম বোবা হয়ে থাকে। এটা তার দারুণ পছন্দ।

হোটেল সামুনাবাদের চারপাশে প্রচুর অফিস আর বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে। মওলানা ইউসুফের অফিসটি সে-রকমই একটি ভবনের আটতলায় অবস্থিত। পার্কিংলটে গাড়ি না রেখে জাভেদকে ভবনের বাইরে থাকতে বললো। সে। মাত্র পাঁচ মিনিটের সাক্ষাত। সব মিলিয়ে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।

বইটা হাতে নিয়ে বাস্টার্ড ঢুকে পড়লো ভবনের ভেতরে। সে মওলানার বিজনেস কার্ডটা জাভেদকে দেখায় নি। ওখান থেকে অফিসের ঠিকানাটা মুখস্ত বলেছে। এটুকু সতর্কতা তাকে করতেই হয়েছে। কোন্ ভবনে যাচ্ছে সেটা জানানো যেতে পারে কিন্তু কার সাথে কি নিয়ে দেখা করতে যাচ্ছে সে-সব এই পাকিস্তানিকে জানানোর দরকার নেই। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, অপ্রয়োজনীয় কাজ করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। যার যতোটুকু জানার তাকে ততোটুকুই জানাও-এই নিয়মটি সে বহুকাল আগেই শিখেছিলো। জাভেদ যতোই বিশ্বস্ত হোক, দরকারের বাইরে তাকে কোনো কিছু জানানো যাবে না।

যে ভবনে সে ঢুকলো সেটা খুবই ছিমছাম আর দেখতে মনোরম। মেইনগেটে দু-জন সশস্ত্র রক্ষী, তাদের হাতে চায়নিজ রাইফেল। যেখানে প্রতিনিয়তই আত্মঘাতি বোমা হামলা হয়, গান-ফাইট হয়, হত্যা-খুন নিয়মিত ব্যাপার, সেখানে এমন নিরাপত্তা থাকাটাই স্বাভাবিক।

লিফট দিয়ে আটতলায় ওঠার সময় কি বলবে সে-সব কথা শেষবারের মতো গুছিয়ে নিলো। এ ধরণের কাজে তার মধ্যে কখনও নার্ভাসনেস কাজ করে না, শুধু বাড়তি একটু সতর্ক থাকে সে। ভালো করেই জানে, আগেভাগে শিকার টের পেয়ে গেলে শিকারীর জন্য কাজটা কঠিন হয়ে যায়–সেই শিকার যতোই নিরীহ হোক না কেন।

হরিণের মতো দুর্বল আর নিরীহ প্রাণীকে শিকার করার সময়ও বাঘ-সিংহ ধৈর্য ধরে ওৎ পেতে থাকে। দূর থেকে শিকারকে নজরবন্দি করে, তার গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করে, তারপর আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে যায়। পরাক্রমশালী শিকারী পশুও চায় না দুর্বল হরিণ আগেভাগে টের পেয়ে যাক। তাই একদম শেষ সময়ে এসে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের উপর। কোনোভাবে যদি শিকার আগেভাগে টের পেয়ে যায় তাহলে সামান্য হরিণও বাঘ-সিংহকে ভুগিয়ে ছাড়ে। কখনও কখনও শিকার বেহাতও হয়ে যায়।

লিফটের দরজা খুলে যাবার পর গভীর করে দম নিয়ে পা বাড়ালো বাস্টার্ড। ঘুণাক্ষরেও সে চায় না একাত্তরের ঐ ঘাতক সামান্যতম সন্দেহ করুক তাকে নিয়ে। বিজনেস কার্ডে অল্প যেটুকু তথ্য আছে তার সবটাই তার মুখস্ত, তারপরও কার্ডটা পকেটে রেখেছে। বাম হাতে বড় একটা এনভেলপের ভেতরে বইটা নিয়ে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই মওলানার অফিসের মেইনগেটের সামনে চলে এলো সে। কাঁচের ডাবল-ডোরটা দিয়ে অফিসের সামনের অংশটা বাইরে থেকে দেখতে পেলো। খুব একটা লোকবল নেই। মাঝারিগোছের একটি অফিস। কাঁচের দরজায় লেখা ‘আল হোসাইনী ফিসারিজ লিমিটেড,’ তার নীচে লাল অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা ‘পুশ। বাস্টার্ড দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

রিসেপশন ডেস্কে বসা মাঝবয়সি লোকটি হাতে কিছু কাগজ নিয়ে দেখছে, তাকে ঢুকতে দেখে উর্দুতে বলে উঠলো, সে কি চায়।

কিন্তু বাস্টার্ড তাকে ইংরেজিতে জানালো মওলানা ইউসুফ হোসাইনীর সাথে দেখা করার জন্য এসেছে।

তার কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে?

না।

এটা কি প্রাইভেট সাক্ষাৎ?

না।

মওলানা কি তাকে চেনে?

না।

তাহলে?

মওলানার বিজনেস কার্ড রিসেপশনিস্টের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সংক্ষেপে জানালো এখানে আসার উদ্দেশ্য।

রিসেপশনিস্ট তাকে অপেক্ষা করতে বলে পাশের একটা ঘরে ঢুকে পড়লো। বাস্টার্ড তিনসেট সোফার কোনোটাতে না বসে দাঁড়িয়েই রইলো ডেস্কের সামনে। অফিসের চারপাশে খুব একটা চোখ বুলালো না ইচ্ছে করেই। এখানে যদি কোনো সিসিক্যাম থেকে থাকে তাহলে তার এই তাকানোর ব্যাপারটা ধরা পড়ে যেতে পারে। সে বরং বিরক্তিকর একটি ভাব করলো চোখেমুখে। যেনো খামখেয়ালি লোকজনের ফালতু অনুরোধ রক্ষা করতে এসেছে। তারপরও যেটুকু দেখলো তাতে মনে হলো এই অফিসটি শুধুমাত্র আল-হোসাইনী ফিসারিজের কাজেই ব্যবহার করা হয় না, আরো একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ঐ প্রতিষ্ঠানের লোগো আর নাম উর্দু কিংবা আরবিতে লেখা-সে নিশ্চিত হতে পারলো না। আরবি-উর্দুর নীচে ছোট্ট করে ইংরেজিতে কিছু লেখা থাকলেও দূর থেকে সেটা বুঝতে পারলো না। ভালো করে লেখাটা দেখতে যাবে অমনি রিসেপশনিস্ট ফিরে এলো ডেস্কের কাছে।

“প্লিজ, দিস্ ওয়ে,” দরজাটা দেখিয়ে ইংরেজিতে বললো সে।

“থ্যাঙ্ক ইউ,” সৌজন্যমূলক হেসে বাস্টার্ড ঢুকে পড়লো মওলানা ইউসুফের রুমে।

মাঝারি আকৃতির চমৎকার একটি অফিস। দরজার ঠিক বিপরীত দিকের দেয়াল ঘেষা ডেস্কে বসে আছে বয়স্ক একজন মানুষ। মাথায় টুপি থাকলেও গায়ে ঘিয়েরঙা সুট আর টাই। মুখের চাপদাড়ি আর গোফের বেশিরভাগই সাদা হয়ে গেছে। সম্ভবত চুলগুলোও, তবে টুপির কারণে সেটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না। গায়ের রঙ মোটামুটি ফর্সাই। চোখে কালো ফ্রেমের পাওয়ারের চশমা। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“স্লামালেকুম,” মুখে হাসি এঁটে বললো সে।

“ওয়ালাইকুম আস সালাম ইয়া রহমাতুল্লাহ,” বেশ নম্রভাবেই সালামের জবাব দিলো মওলানা।

“আমি তওফিক আহমেদ…বাংলাদেশ থেকে এসেছি।”

ইংরেজিতে বললো মওলানা, “প্লিজ, বসুন।”

বাস্টার্ড একটা চেয়ারে বসে পড়লো। সে খেয়াল করেছে বাংলাদেশের কথা শুনে মওলানা জোর করে অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টা করছে। “মি: জামিল আহমেদের কথা আপনার নিশ্চয় মনে আছে…দুবাইর ফ্লাইটে আপনার সহযাত্রি ছিলেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে প্রসন্ন হাসি দিলো মওলানা। “হুম, মনে আছে। চমৎকার একজন ভদ্রলোক। খুব মিশুক,” বেশ চোস্ত ইংরেজিতে বললো সে।

বাস্টার্ড এনভেলপে মোড়ানো বইটা বাড়িয়ে দিলো মওলানার দিকে। “এই যে আপনার বই…এটা উনি আপনার কাছ থেকে নিয়েছিলেন পড়ার জন্য…তারপর ফেরত দিতে ভুলে গেছিলেন।”

বইটা হাতে নিয়ে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করলো মওলানা ইউসুফ। “সামান্য একটা বইয়ের জন্য উনি আপনাকে পাঠিয়েছেন? বইটা ফেরত দেবার কোনো দরকারই ছিলো না। তাছাড়া, উনি খুব সহজে কুরিয়ার করে দিলেই পারতেন।”

যা ভেবেছিলাম তা-ই, মনে মনে বললো বাস্টার্ড। তবে মুখে হাসি এঁটে রাখলো। “উনি তা-ই করতেন, কিন্তু যখন শুনলেন আমি করাচি যাচ্ছি তখন ঠিক করলেন আমার লাগেজের ভার একটু বাড়িয়ে দেবেন।” কথাটা ঠাট্টাচ্ছলে বললো সে। “বড়দের অনেক কিছুই ছোটোদের সহ্য করতে হয়…আমাকেও তাই এরকম অনুরোধ রক্ষা করতে হয়েছে।”

হাসলো মওলানা ইউসুফ। “উনি বোধহয় ব্যাপারটা একটু বেশি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছেন।”

“একদম ঠিক বলেছেন,” সহমত পোষণ করলো বাস্টার্ড। “উনি মনে করেছেন বইটা ফেরত না দিয়ে বিরাট অন্যায় করে ফেলেছেন,..আপনি হয়তো উনাকে বইচোর ভেবে বসে আছেন।”

হেসে ফেললো মওলানা। “বিজনেস ক্লাসের সহযাত্রি…যার হাতে রোলেক্স ঘড়ি তাকে আমি পঁচিশ ডলারের একটি বইয়ের জন্য বইচোর ভাববো?”

মুচকি হেসে কাঁধ তুললো বাস্টার্ড। চকিতে দেখে নিলো মওলানার ডেস্কের উপরে একটি ক্যালেন্ডার আর পেছনের দেয়ালে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের লোগো আর নাম বড় করে লেখা।

“আমার কি মনে হয় জানেন?” তারপর জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই আবার বললো সে, “জামিল ভাই হয়তো চোর বলতে ক্লেপটোম্যানিয়ার কথা বুঝিয়েছেন। এ ধরণের মানসিক রোগিরা বড়লোক হলেও সামান্য জিনিস হাতিয়ে নেয়।”

অবাক হলো এক সময়কার ইউসুফ আলী। “আমি উনাকে ক্লেপটোম্যানিয়াক ভাববো?” হাসতে হাসতে মাথা দোলালো সে। “বলতে বাধ্য হচ্ছি, সামান্য একটা বইয়ের জন্য অনেক বেশি ভেবে ফেলেছেন উনি।”

“এ ব্যাপারে আর কেউ একমত পোষণ না করলেও আমার পক্ষে দ্বিমত পোষণ করা সম্ভব নয়,” হালকা চালে বললো তওফিক আহমেদ। “কারণ এই পঁচিশ ডলারের সেকেন্ডহ্যান্ড বইটা আমাকেই কষ্ট করে এতোটা পথ বয়ে আনতে হয়েছে।”

নিঃশব্দে হেসে মওলানা ইউসুফ বললো, “মি: জামিল আহমেদ আমাকে একটা ফোন করে জানালেই হতো বইটা ভুলে ফেরত দেন নি। উনার কাছে তো আমার বিজনেস কার্ডটা ছিলোই, এতো ঝামেলা করার দরকারই ছিলো না।”

“আসলে উনি খুব লজ্জিত ছিলেন তাই হতো ফোন করেন নি।” মওলানা কিছু বললো না।

“উনি খুবই রক্ষণশীল আর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ছেলে। আপনি হয়তো অবাক হবেন, উনার লাভ ম্যারেজটা ভেঙে গেছিলো স্রেফ উনার শ্বশুড় ঘুষ খান বলে।” মিথ্যেগুলো অনায়াসে বলে গেলো সে। কখনও ভেবে দেখে নি এটা সে কবে থেকে রপ্ত করেছে।

“ইন্টারেস্টিং,” মওলানা কৃত্রিম অবাক হবার চেষ্টা করলো। “হুম। আমার কাছে অবশ্য এটা বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়েছে।”

“না, না। আমি মনে করি উনার পরিবার সঠিক কাজটাই করেছেন। হারামের পয়সা রোজগার করা পরিবারে বিয়ে না করাই ভালো। তাতে হারামের সাথে অংশীদার হয়ে যেতে হয়।”

কাঁধ তুললো বাস্টার্ড। “এ নিয়ে আমি তর্ক করবো না। এটা একদমই আমার নিজস্ব মন্তব্য।” তারপর হুট করে কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গি করে বললো সে, “ওহ,” হাতঘড়ির দিকে তাকালো। “আমাকে এখন উঠতে হবে। আসলে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে এসেছি এখানে।”

“কি বলেন, আজব!” এবার সত্যি সত্যি অবাক হলো মওলানা ইউসুফ। “কিছু না খেয়ে কিভাবে যাবেন? মেহমান বলে কথা। অন্তত এককাপ কফি”

“প্লিজ,” উঠে দাঁড়ালো সে। “আমি মোটেও মেহমান নই…আমাকে বড়জোর একজন ডেসপাচার বলতে পারেন। আসলে যাবার পথে বইটা দিয়ে গেলাম। আমাকে এক্ষুণি লিয়াকাতাবাদ যেতে হবে। জরুরি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ওখানে।”

“আশ্চর্য, তাই বলে কিছু-”

হাত তুলে মওলানাকে থামিয়ে দিলো সে। “আমাকে যদি আপনার ধন্যবাদ দিতে হয়, আপ্যায়ন করতেই হয় তবে দেরি না করে চলে যাবার এজাজাত দিন।” ইংরেজির মধ্যে এজাজাত শব্দটি সে ব্যবহার করলো ইচ্ছে করেই।

“কী আর করা…এতো দূর থেকে এলেন অথচ কিছুই খেয়ে গেলেন …ভালো করে আলাপ পরিচয়ও হলো না…”

“যদি করাচিতে আরো এক সপ্তাহ থাকি তাহলে চেষ্টা করবো একদিন আপনার এখানে এসে এককাপ কফি খেয়ে যেতে।” কথাটা বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো সে।

ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো ইউসুফ হোসাইনী।

“আপনার সাথে দেখা করতে পেরে খুব ভালো লাগলো। খোদা হাফেজ।”

“খোদা হাফেজ,” প্রায় বিড়বিড় করে বললো মওলানা।

দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেলো বাস্টার্ড। তাকে দেখে সত্যি মনে হচ্ছে জরুরি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করার টেনশনে পড়ে গেছে।

দরজা দিয়ে বাইরে পা রাখতেই একটা প্রশ্ন তার মনে উদয় হলো : লোকটার বামহাতে ছয় আঙুল ছিলো কি? অতি সতর্ক আর সচেতন থাকার কারণে সে লোকটার হাতের দিকে খুব একটা তাকায় নি।

অধ্যায় ১৬

আজিজাবাদ, করাচি

অসংখ্য লাশ। কোনোটা মুখ থুবরে, কোনোটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে। কারো চোখ খোলা, কারোর বন্ধ। কিছু মুখ দেখলে মনে হবে তারা বুঝি ঘুমাচ্ছে। কারো কারোর চেহারায় সুতীব্র আতঙ্ক চিরকালের জন্যই স্থির হয়ে আছে। রক্তের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃতদেহগুলো। কাঁচাহাতের ক্যামেরাম্যান সবগুলো লাশের ছবি তুলতে গিয়ে ক্যামেরাটা ডানে-বায়ে সরাচ্ছে অস্থিরভাবে। ক্লোজশট নিতে গিয়ে বার বার আউট অব ফোকাস হয়ে যাচ্ছে। ভীতিকর একটি দৃশ্য। বিশেষ করে ছোটোছোটো বাচ্চাদের মুখগুলো! নিষ্পাপ শিশুরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষের চরম বর্বরতার বলি হয়ে গেছে।

তারপরই আরেকটি দৃশ্য। আগের চেয়ে আরো বেশি পৈশাচিক। আরো বেশি বীভৎস। শুধু নিহত মানুষজনই নয়, তাদের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কারোর হাত, কারোর পা। কোনো লাশের মস্তক নেই। কারো শরীরের নিমাংশ উড়ে গেছে বোমায়। রক্তগুলো কালচে হতে হতে রাজপথের পিচের মতো রঙ ধারণ করেছে।

দৃশ্যের বদল চলছে তো চলছে।

বোমা ফেলা হচ্ছে আকাশ থেকে। শত শত যুদ্ধযান ধেয়ে যাচ্ছে ধুলো উড়িয়ে। বোমায় উড়ে যাচ্ছে বাড়ি-ঘর। শহরের একাংশ। গ্রামের পর গ্রাম। ভেঙে পড়া ভবনের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে আহতদের। বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে লাশ।

অন্ধকার ঘরে বিশাল পদায় যুদ্ধ প্রক্ষেপিত হচ্ছে বিরামহীনভাবে। দ্রুত এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যের আর্বিভাব ঘটলেও ঘরে বসে থাকা দশজন মানুষ চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে যেনো। তাদের সবার অভিব্যক্তির মধ্যে একটি মিল আছে-ক্ষুব্ধ তারা। বিক্ষুদ্ধ তাদের হৃদয়।

“এরা সবাই মুসলমান!” অন্ধকার ঘরে একটি পরিচিত কণ্ঠ বলে উঠলো। দশজনের মতো তার কণ্ঠেও ক্ষোভ সুস্পষ্ট। “আমাদের ভাই।” তারপর একটা নিখুঁত হিসেব করা বিরতি। ঘরের দশজন যুবক এরইমধ্যে বুঝে গেছে বুজুর্গ কতোটা বিরতি দেবার পর আবার শুরু করবে। এটা তাদের দীর্ঘ দু মাসের অভ্যস্ততা। “কিন্তু যারা হত্যা করছে, যারা নির্বিচারে আমাদের ভাইদের বোনদের শিশুদের খুন করছে তারা কারা? তাদের কি আমরা চিনি?”

দশজন যুবক, যারা মেঝেতে বসে আছে সুশৃঙ্খলভাবে তাদের চোখমুখ আরো শক্ত হয়ে গেলো।

“আমরা তাদেরকে চিনি।” কণ্ঠটা জোর দিয়ে বললো। “আমরা তাদেরকে জানি। আমরা তাদের পাশাপাশি বসবাসও করি!” তারপর আবারো সেই হিসেব করা বিরতি। “কিন্তু আমরা কি করি? আমরা মুসলমানেরা তাদের কি করি?”

সামনে বসে থাকা মুখগুলোর দিকে ভালো করে তাকালো বুজুর্গ। প্রজেক্টরের আলো আর দৃশ্য প্রতিফলিত হচ্ছে অন্ধকারের মুখগুলোতে!

“আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেনো আমাদের মুসলিম ভাইদের এই নিদান থেকে নাজাত দেন।”

গভীর করে দম নিলো এবার। তার চোখেমুখে তিক্ততা। মঞ্চ-অভিনেতার মতোই প্রতিটি চানি আর অভিব্যক্তি আগে থেকে ঠিক করে, হিসেব করে, তারপর ডেলিভারি দেয় সে।

“কিন্তু পাক-কিতাবে মহান আল্লাহ-তা-আলা আমাদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, চোখের বদলে চোখ! খুনের বদলে খুন!” কেউ মুখ না খুললেও তিনি জানেন দশজনের দলটি তার কথার সাথে একমত পোষণ করছে। “এভাবে মার খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকার কী মানে আছে? আখেরাতে গিয়ে তো আল্লাহর কাছে মুখও দেখাতে পারবো না। তিনি যখন বলবেন, তোমাদের মুসলিম ভায়েরা যখন নির্যাতিত হচ্ছিলো, বাল-বাচ্চা নিয়ে বেঘোরে মারা যাচ্ছিলো তখন তোমরা তাদের জন্য কি করেছো…তখন কি জবাব দেবো আমরা?” একটু থেমে আবার বললো, “আমাদের শত্রু…কাফিররা ক্ষমতাশালী তাই আমরা কিছু করি নি? আমরা কাপুরুষের মতো গুটিয়ে রেখেছিলাম নিজেদের?” গভীর করে দম নিলো বুজুর্গ। “আমরা কি এমন কথা বলে পার পাবো ওনার কাছ থেকে?”

মাথা না দোলালেও ঘরের দশজন যুবকের মনোভাব বোঝা গেলো তাদের চোখমুখ দেখে।

“কাপুরুষের এই জিন্দেগির চেয়ে শাহাদাঁতের মৃত্যু কি শ্রেষ্ঠ নয়? যে মৃত্যু আমাদেরকে জান্নাতবাসি করবে, সম্মান দেবে, সেটা কি এই নান্নতের জীবনের চেয়ে উত্তম নয়?”

দশটি মুখের চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো।

বুজুর্গ জানে তার সামনে বসে থাকা যুবকদের জীবন তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর। এদের কোনো লক্ষ্য নেই। উদ্দেশ্য নেই। এরা জন্মেছে নিতান্তই জৈবিক নিয়মে! দীনহীন জীবন এদের। এখন মহান একটি উদ্দেশ্য বাতলে দেয়া হচ্ছে ওদেরকে। নিজেদের তুচ্ছ জীবনটাকে মহিমান্বিত করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে এরা।

“ইসলামের জন্য শহীদ হবার সৌভাগ্য সবার হয় না,” আচমকা বেশ শান্ত কণ্ঠে বললো বুজুর্গ। “আল্লাহপাক সবাইকে সেই তৌফিক দেনও না। কিন্তু তিনি তোমাদের প্রতি রহম করেছেন। তোমাদেরকে শহীদের পথে এনে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। আমরা তো উসিলামাত্র। আমাদের ক্ষমতা নেই। তোমাদের রুহের ভেতরে শাহাদাঁতের মর্ম ঢুকিয়ে দেবার। এটা করতে পারেন শুধু ঐ মহান রাব্বল আলামিন।” একটু থামলো এবার। “তোমরা যদি খাস দিলে চাও, তোমাদের নিয়ত যদি ঠিক থাকে তাহলে তিনি তোমাদের শাহেদান কবুল করবেন।”

ঘরে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। প্রজেক্টরে ভেসে উঠলো কোরানের বাণী। সম্মোহিত কণ্ঠে কেরাত করছে একজন কৃারি।

“অনেক পরিশ্রম, অনেক কষ্টের পর তোমাদের সেই সৌভাগ্যের দিন আজ সমাগত। বলো, আলহামদুলিল্লাহ।”

দশজন যুবক সমস্বরে বলে উঠলো : “আলহামদুলিল্লাহ!”।

“মনে রাখবে, তোমরা এক একজন ফেদেইন! আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা সৈনিক! যার কোনো পিছুটান নেই। ভয় নেই। এক আল্লাহ ছাড়া যে কাউকে ভয় করে না। কাউকে পরোয়া করে না। তার সামনে শত্রুরা কাপুরুষের মতো পেঁজ গুটিয়ে পালাবে। যারা আমাদের ভাইদের হত্যা করে তারা নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য দিগদ্বিক হয়ে পালানোর পথ খুঁজবে। যারা আমাদের ভাই-বোনদের, নিষ্পাপ বাচ্চাদের হত্যাকাণ্ড দেখে মুচকি হাসে তারা তাদের স্বজনদের লাশ নিয়ে আহাজারি করবে।”

এবার বেশ দীর্ঘ বিরতি দিলো বুজুর্গ। সবার মুখভঙ্গি দেখে নিলো তীক্ষ্ণ চোখে। সন্তুষ্ট হলো সে। এরা কেউ পালিয়ে যাবে না! কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। এদের ভেতরে আরো আগুন জ্বালিয়ে দিতে হবে। এরা এক একজন বারুদের ডিপো। সেই ডিপোতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারলেই হলো।

“তোমরা ফেদেইন!” বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললো। “তোমরা নির্ভিক। অপ্রতিরোধ্য! তোমাদের সামনে একটাই লক্ষ্য…ইসলামের শত্রুকে খতম করা। ইসলাম আজ বিপদে পড়ে গেছে। সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হলে চাই রক্ত। আর মুসলমান রক্ত দেখে কখনও ভয় পায় না।”

একটু দম নিয়ে নিলো সে।

“ইসলামের শত্রদের এমনভাবে খতম করতে হবে, এমনভাবে ওদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে যেনো আর কোনো মুসলমানের গায়ে হাত তোলার আগে, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার আগে এক শ’ বার ভাবে।”

আবারো বিরতি। সবগুলো মুখের দিকে তাকালো। কেমন জ্বলজ্বল করছে চোখগুলো! বুজুর্গ খুব খুশি হলো ভেতরে ভেতরে।

“তোমাদের ভয় নেই! তোমাদের সাথে আল্লাহপাক আছেন। তোমাদের জন্য তিনি জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান বরাদ্দ করে রেখেছেন।” তর্জনি উপরের দিকে তুলে প্রতীকি ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করলো। “জান্নাতের সর্বোচ্চস্থানে তোমরা

অধিষ্ঠিত হবে। দুইদিনের এই পাপি দুনিয়াদারির কোনো মূল্য নেই। জান্নাতের তুলনায় এসব নিতান্তই ফালতু। তুচ্ছ!”

বুজুর্গ দেখতে পেলো দশটি মুখ কেমন মন্ত্ৰতাড়িত হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। “আল্লাহর পথে নেমেছো তোমরা। তোমাদের কোনো ভয় নেই!”

“আমাদের কোনো ভয় নেই, বুজুর্গ!” বসে থেকেই বেশ জোর গলায় বলে উঠলো মুলতান থেকে আসা বাদা নামের ছেলেটি।

মাথা নেড়ে সায় দিলো বুজুর্গ। “আমি জানি। আর এও জানি, তোমরা শাহাদাঁতের পরীক্ষায় জয়ি হবে।”

“আমরা জয়ি হবো!” বেশ জোরে বলে উঠলো ফাহাদুল্লাহ। “আমরা ফেদেইন! আমরা শেষ নিঃশ্বাস নেবার আগ পর্যন্ত লড়ে যাবো শত্রুর বিরুদ্ধে!”

বাকিদের মুখের দিকে তাকালো বুজুর্গ। তারাও তার কথায় উদ্দীপ্ত। “শহীদের মুখ কখনও দেখেছো তোমরা?”

দশজনের কেউ কখনও শহীদ দেখে নি, তবে গাজি দেখেছে প্রচুর। তাদেরকে যারা ট্রেইনিং দিয়েছে, যারা তাদেরকে সবক দেয় তারা প্রায় সবাই গাজি। তাদের সামনে এখন যে কথা বলছে সেও একজন গাজি।

“তাদের মুখ থেকে নুরের জ্যোতি বের হয়। মুখগুলো নুরের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। সেই মুখ দেখাটাও খোশ-নসিবের ব্যাপার।” একটু থেমে আবার বললো সে, “আমি এখনই তোমাদের মুখে সেই নুরের জ্যোতি দেখতে পাচ্ছি।”

“আমরা ফেদেইন! আমরা মরবো! আমরা লড়বো! আমরা শহীদ হবো!” চিৎকার করে বলে উঠলো পেছন থেকে কেউ একজন। তার কণ্ঠের আবেগ যেনো বাঁধ ভেঙে পড়েছে।

তারপর প্রায় সমস্বরে একসাথে বলে উঠলো দশজন মানুষ, “আমরা শহীদ হববা!”

বুজুর্গের মুখ প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।

অধ্যায় ১৭

মওলানার অফিস থেকে সোজা হোটেল রুমে চলে আসার পর তার আত্মবিশ্বাস টগবগ করছে। যেমনটি ভেবেছিলো তার চেয়েও ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে কাজটা। মওলানা ইউসুফ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না তার আগমনের সত্যিকারের উদ্দেশ্যটি।

খুশির আরেকটি কারণ, জিপিএস ডিভাইসটি দারুণ কাজ করছে। ভার্চুয়াল মানচিত্রে দেখতে পাচ্ছে গুলশান-এ-ইকবালের একটি মেইনরোডের পাশে ডিরেকশন পয়েন্টটি দেখা যাচ্ছে। এটাই মওলানার অফিস ভবন। এখন বইটা নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেই জিপিএস ডিভাইস তাকে জানিয়ে দেবে মওলানা কোথায় থাকে।

মোহাজের জাভেদকে বলে দিয়েছে সে যেনো লাঞ্চ করে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার দিকে চলে আসে। আজ করাচি শহরের রাত দেখবে। একসাথে খাওয়া-দাওয়াও করবে। এ শহরকে সিটি অব লাইট বলা হয়-সেটা কতোটুকু সত্যি দেখতে হবে। আদতে শহর দেখার কোনো ইচ্ছে তার নেই।

তার দৃঢ় বিশ্বাস, আজই জানা যাবে মওলানা কোথায় থাকে। লোকটা কোথায় থাকে সেটা জানা খুব জরুরি। অফিস এলাকাটি মোটেও নিরাপদ নয়। দু-জন অস্ত্রধারী প্রহরা দেয় মেইনগেটে। প্রচুর পুলিশও দেখেছে রাস্তায়। নিশ্চয় সাদাপোশাকেও আছে অনেকে। তাছাড়া অফিসের সামনের রাস্তাটি বেশ ব্যস্ত থাকে। সুতরাং অফিসের ভেতরে কিছু করার প্রশ্নই ওঠে না। বাইরেও কাজটা করা প্রায় অসম্ভব। ঝুঁকির হিসেব করলে এটা বাতিল করে দেয়া যায় অনায়াসেই।

করাচিতে পা দেবার আগেই সে ধারণা করেছিলো, মওলানাকে তার বাড়িতে খুন করটাই বেশি সহজ হবে। মানুষ নিজের বাড়িতে একদম নিশ্চিন্তে থাকে। এদিক থেকে দেখলে মওলানা টার্গেট হিসেবে কঠিন কিছু নয়। একজন ব্যবসায়ি। বিদেশে মাছ রপ্তানী করে ভালোই আছে। পাশাপাশি একটি ইসলামি এনজিও পরিচালনা করে। জীবনের উপরে হুমকি আসতে পারে, তাও আবার তিনযুগের পুরনো কোনো ঘটনায়, এটা তার কল্পনাতেও নেই।

অল্প সময়ের মধ্যে মওলানার যে স্ট্যাটাস সে দেখেছে তাতে মনে হচ্ছে মোটামুটি সচ্ছল জীবন-যাপনই করে। তার বাড়িটা যেখানেই হোক কয়েকদিন রেকি করার পর জানা যাবে কাজটা কিভাবে করলে ভালো হবে। দরকার পড়লে বাড়িতে ঢুকেও কাজটা করা যেতে পারে। তার ধারণা ঐ লোক বাড়িতে কুকুর পোষে না। একজন মওলানার বাড়িতে ছাপান্ন ইঞ্চির টিভি থাকতে পারে কিন্তু কুকুর থাকবে না। কারণ খুব সহজ। ইসলামে কুকুরকে সুনজরে দেখা হয় না। বাড়িতে যদি সিসিক্যাম থাকে তাহলে সেটা নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। কাজটা হয়ে যাবার পর পুলিশ যদি তার ছবি সিসিক্যাম থেকে সংগ্রহও করে তাতে কোনো সমস্যা হবে না-তততক্ষণে সে করাচি থেকে সটকে পড়তে পারবে। সাধারণ একজন ব্যবসায়ি খুন হলে পুলিশ নিশ্চয় বিদ্যুৎবেগে মাঠে নেমে পড়বে না।

সামুনাবাদ হোটেলে ফিরে সুইমিংপুলে সাঁতার কেটে নিলো একটু। তারপর নীচতলায় চমৎকার একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করে এলো বাস্টার্ড। পাকিস্তানি খাবারের মান ভালোই মনে হলো তার কাছে। একটু মসলাদার আর মাংসনির্ভর, কিন্তু খুবই সুস্বাদু। রেস্টুরেন্ট থেকে রুমে আসার সময় একটি কোকের বোতল নিয়ে এলো। জিপিএস ট্র্যাকারটার দিকে বার বার চোখ রাখতে শুরু করলো সে। মওলানাকে দেয়া বইটা একদমই নড়ছে না। ওটা যেখানে থাকার সেখানেই আছে। বুঝতে পারলো অফিস আওয়ার শেষ হলে ঘটনা ঘটতে শুরু করবে।

কিন্তু বিকেল পাঁচটার পরও কোনো পরিবর্তন না-হলে সে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করলো। যদিও তার মনের একাংশ বলছে, সবাই নিশ্চয় বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করে না। দরকার পড়লে কেউ কেউ ছ’টা-সাতটা পর্যন্ত অফিসে থাকতেই পারে।

সন্ধ্যার একটু আগে যখন জাভেদ ফোন করে জানালো সে হোটেলের নীচে আছে তখনও ট্র্যাকারে আশাব্যঞ্জক কিছু দেখতে না পেয়ে হতাশ হলো। জিপিএস ট্র্যাকারটা পকেটে ভরে হোটেল রুম থেকে বের হয়ে গেলো সে।

*

মওলানা ইউসুফ হোসাইনী নিজের অফিসে বসে আছে। সাধারণত অন্য কোনো দিন হলে আরো আগেই অফিস থেকে বের হয়ে যেতো। আজকে জরুরি কোনো কাজও নেই, কিন্তু অন্য একটা কাজে তাকে থাকতে হচ্ছে। দুপুরের পর থেকে বেশ কিছু কাজ ছিলো বলে একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবার ফুরসত পায় নি।

ডেস্কের উপরে রাখা বইটা হাতে তুলে নিলো। সেথ জি. জোন্সের লেখা ইন দ্য গ্রেভইয়ার্ড অব এম্পায়ার্স : আমেরিকা’স ওয়ার ইন আফগানিস্তান। ৪৪৮ পৃষ্ঠার সুবিশাল এই বইটির বড়জোর একশ’ পৃষ্ঠার মতো পড়েছিলো দুবাই থাকতে। প্লেনের বিরক্তিকর ভ্রমণে বইটা আবার হাতে নিয়েছিলো, দুই পৃষ্ঠার বেশি পড়তে পারে নি। অনেকেই প্লেনে বই পড়ে কিন্তু তার পক্ষে বেশিক্ষণ পড়া সম্ভব হয় না, হালকা মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। তার সহযাত্রি বইটা পড়ার জন্য বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিলো। যদিও বই পড়ার চেয়ে তার সাথে গল্প-গুজব করতেই বেশি উৎসাহি ছিলো ভদ্রলোক। প্রচুর প্লেন-জার্নি করার অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, এরকম বেশিকথা বলা প্যাসেঞ্জার হরহামেশাই জুটে যায়। খুব সম্ভবত এরা প্লেন-জার্নির ভয় কাটানোর জন্য এটা করে নয়তো তাদের স্বভাবটাই এমন যে, কথা না বলে থাকতে পারে না। তবে তার মনে হয়েছিলো মি: জামিল আহমেদ এরকম কোনো কারণে বকবক করে নি। তার আগ বাড়িয়ে খাতির করা, এটা ওটা জানতে চাওয়ার মধ্যে প্রচ্ছন্ন অস্বাভাবিকতা ছিলো। তাছাড়া বার কয়েক তার বামহাতের ষষ্ঠ আঙুলের দিকেও চোখ যাচ্ছিলো লোকটির। সে পুরাপুরি নিশ্চিত হতেও পারছে না। এটা তার মনের ভুলও হতে পারে। মানুষ চেনা আসলেই কঠিন। হলফ করে বলে দেয়া যায় না এই মানুষটি এরকম আচার-ব্যবহার করার কারণে এরকম কিংবা ওরকম। মানুষ একেক সময় একেক রকম আচরণ করতে পারে। তার মেজাজ, পরিস্থিতি, মানসিক অবস্থা, আশেপাশের মানুষজনের সাথে তার সম্পর্ক-এরকম অনেক কিছুই ব্যক্তির আচরণের জন্য দায়ি। সম্ভবত মি: জামিল আহমেদের ব্যাপারটা অন্যরকম-নিঃসঙ্গতা যাদের একদম সহ্য হয় না। হতে পারে নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যে পাশের যাত্রির সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছিলো সে। আর বাড়তি আঙুলের দিকে তাকানোর ব্যাখ্যা আরো সহজ। তার সাথে প্রথম পরিচয় হওয়া প্রায় সব মানুষই এরকম চোরা চাহনিতে আঙুলটা দেখে।

প্লেন ল্যান্ডিং করার আগে দিয়ে অবশ্য ভদ্রলোক একটু গুটিয়ে গেলে মওলানা হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে তার কাছ থেকে বইটা নেবার কথা ভুলে যায়। এটা এমন কোনো ঘটনা ছিলো না। সত্যি বলতে দেশে ফিরে এসে বইটার কথা ভুলেই গেছিলো। তার রিসেপশনিস্ট যখন সংক্ষেপে ঘটনাটা বললো তখনই বইটার কথা মনে পড়ে যায় তার। কিন্তু এরকম একটা বই ফেরত দেবার জন্য বাংলাদেশ থেকে কেউ করাচিতে আসবে ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। অবশ্য ঐ যুবক যা বললো তাতে মনে হচ্ছে, বইটা এভাবে করাচি পর্যন্ত বয়ে আনতে সে মোটেও পছন্দ করে নি। সম্ভবত সিনিয়র ব্যবসায়ির কথা রাখতে গিয়ে তাকে এরকম অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে তার মধ্যে কোনো সন্দেহ তৈরি হচ্ছে না। তার যেটুকু সন্দেহ মি: জামিলকে নিয়েই। ভদ্রলোকের আচরণ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটা কে? তাকে কি কখনও দেখেছে?

মাথা দোলালো সে। প্রশ্নই ওঠে না। এর আগে তার সাথে কোথাও দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। তাছাড়া ভদ্রলোকের বয়স বড়জোর চল্লিশ পাঁচল্লিশের কোঠায়। আজ থেকে সাইত্রিশ বছর আগে সে ছিলো নাবালক। পরিবার আর আত্মীয়স্বজনের বাইরে এরকম নাবালক কারোর কথা সে মনেও করতে পারলো না।

ফোনটা বেজে উঠলে সম্বিত ফিরে পেলো সে। বইটা ডেস্কের উপর রেখে ফোনটা তুলে নিলো। এই ফোনের অপেক্ষায়ই ছিলো এতোক্ষণ।

“আসোলামুয়ালাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহে।”

অধ্যায় ১৮

করাচিতে রাত নেমে এসেছে। আর অসংখ্য রঙের বাতি জ্বলে উঠে সিটি অব লাইট নামটি স্বার্থক করে তুলেছে যেনো। দিনের চেয়ে রাতেই বেশি মোহনীয় লাগছে শহরটাকে। চারপাশে যেদিকেই তাকাচ্ছে আলোয় ঝলমল করছে। চমৎকার স্থাপত্যশৈলির সব ভবন। প্রশস্ত পথঘাট। রাস্তায় দামি দামি গাড়ি। অত্যাধুনিক বিলবোর্ড আর নিয়ন-সাইন বাড়তি অলঙ্কার হিসেবে শোভা বর্ধন করছে রাতের শহরে। দেখে মনে হচ্ছে না এটা খবরের শিরোনাম হওয়া সন্ত্রাস কবলিত একটি নগরী।

গাড়ির জানালা দিয়ে অনেকটা ফাঁকাদৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে সে। জাভেদ ছেলেটাও চুপ মেরে আছে অনেকক্ষণ ধরে। হোটেল থেকে বের হবার সময় জানতে চেয়েছিলো সে কোথায় যেতে চায়। কাঁধ তুলে ছেলেটাকে বলেছিলো, তার যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারে। শুধু একটু ঘোরাঘুরি। দেখার মতো নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। আজকের রাতে কোনো কাজ নেই বলে এই নিশুতি অভিযান। শুধুই ঘুরে দেখবে। জাভেদ মুচকি হেসে বলেছিলো, কোনো সমস্যা নেই। পুরো শহরটা তার নখদর্পনে। সে তাকে ভালো ভালো জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবে। আর যেসব জায়গায় প্রবলেম আছে সেগুলোতে ভুলেও নিয়ে যাবে না।

প্রবলেম? স্বাভাবিক কারণেই বাস্টার্ড জানতে চেয়েছিলো।

জাভেদ বোকার মত হেসে জানিয়েছিলো, বিদেশিরা টিভিতে আর পত্রপত্রিকায় যেসব গণ্ডগোলের খবর দেখে সেগুলো করাচির হাতেগোনা কয়েকটি স্থানে সংঘটিত হয়। ঐ জায়গাগুলো সে ভালো করেই চেনে। সত্যি বলতে ঐ জায়গাগুলো বাদ দিলে শহরের বেশিরভাগ অংশ একদম নিরাপদ। কেউ যদি জানে কোন্ কোন্ জায়গা বাদ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে তাহলে ঝামেলায় পড়ার সম্ভাবনা নেই।

কথাটা শুনে আশ্বস্ত হবার ভঙ্গি করেছিলো সে, যদিও ভেতরে ভেতরে মোটেও চিন্তামুক্ত ছিলো না, তবে এর কারণ করাচির ‘প্রবলেম নিয়ে নয়। জিপিএস ট্র্যাকার তাকে হতাশ করে দিয়ে জানান দিচ্ছে বইটা এখনও একই জায়গায় আছে। এটা তার হিসেবে মিলছে না। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পরও মওলানা নিশ্চয় অফিস করছে না।

“তওফিকভাই, আপনি কি বিবাহিত?” গাড়ি চালাতে চালাতে নিজের মাতৃভাষায় জানতে চাইলো জাভেদ।

“না।” একটু থেমে আবার বললো সে, “তুমি?”

“আমিও না।” ছেলেটা এমনভাবে হাসি দিলো যেনো বিয়ে না-করাটা এক ধরণের বাড়তি সুবিধা!

মুচকি হাসলো সে। “তাহলে যেকোনো দরকারে আমাকে বলবেন। শরমিন্দা হবেন না।”

বাস্টার্ড বুঝতে পারলো কথাটার মানে। “এখানে ওসবও চলে নাকি?” চলনসই হিন্দিতে জানতে চাইলো সে।

পাশ ফিরে চকিতে তাকালো জাভেদ। “করাচিকে আপনি কি মনে করেন? মক্কা? মদিনা?” মাথা দোলাতে দোলাতে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো সে।

“না, তা ভাবি না,” হেসেই জবাব দিলো।

“এখানে আপনি সবই পাবেন। বুঝলেন?”

ভুরু তুললো বাস্টার্ড। “সব?”।

মাথা নেড়ে সায় দিলো জাভেদ ওয়ার্সি, তারপরই ইঙ্গিতপূর্ণভাবে হাসলো। “এ শহর আপনাকে তাজ্জব করে দেবে।”

সে জানে সব বলতে জাভেদ কি বুঝিয়েছে। মদের বার, বেশ্যাপাড়া, জুয়ার আখড়া-এই হলো আন-হলি ট্রিনিটি! এই তিনটি জিনিস পৃথিবীর সবখানেই পাওয়া যায়। এমনকি কট্টর ইসলামিক রাষ্ট্রেও।

গাড়িটা ডানে মোড় নিয়ে আবার বললো জাভেদ, “ড্রিঙ্ক চলে?”

“চলে।”

“বিয়ার, হুইস্কি, ভদকা?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“গুড।” হেসে বললো ছেলেটি। “আমি ভদকা খুব পছন্দ করি।”

“আমি বিয়ার।”

“ভদ্রলোকের জিনিস,” বলেই তাকালোলা তার দিকে। “তেমন নেশা হয় না, মনে হয় সরবত খাচ্ছি।”

হা-হা-হা করে হেসে ফেললো বাস্টার্ড। “আমার অবশ্য এরকম সরবতই বেশি ভালো লাগে।”

“খাবেন নাকি, আপনার ঐ সরবত?”

“এখানে?”

মাথা দোলালো জাভেদ। “এখানে না। সামনেই বিচ আছে, ওখানে পাওয়া যাবে।”

বিচ? সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের কথা মনে পড়ে গেলো তার। সে যে কয়টি দেশে গেছে তার মধ্যে বেশিরভাগ দেশেরই বিচ আছে। কিন্তু কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব না করেই বলা যায়, কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতটি সবচেয়ে সেরা, শুধু অব্যবস্থাপনা আর আমাদের নোংরা করার স্বভাবটা বাদ দিলে।

“তাহলে চলো…দেখি তোমাদের বিচটা কেমন।”

মুচকি হাসলো ছেলেটি। “আমার মনে হয় আমাদের বিচ আপনার ভালোই লাগবে।”

দেখা যাক, মনে মনে বললো বাস্টার্ড।

অধ্যায় ১৯

আজিজাবাদ, করাচি

“হায় ভগবান! হায় ভগবান!” কথাটা বলেই কম্বলের নীচ থেকে ফিক করে হেসে দিলো মুজাহিদ।

ভাগ্য ভালো আশেপাশে এখন তারা দু-জন ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিরা বিশাল ঘরের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাচ্ছে। শীতের তীব্রতায় মোটা কম্বলের নীচে গুটিশুটি মেরে আছে সবাই।

তার দিকে ভুরু কুচকে তাকালো ইসমাইল। “কি হয়েছে? ইঁদুরের মতো হাসছিস কেন?”

“হিন্দি সিনেমায় এই ডায়লগটা কতো শুনেছি,” হাসতে হাসতেই বললো মুজাহিদ। “কিছু হলেই ওরা বলে হায় ভগবান।”

“সব সময় তুই সিনেমার কথা বলিস কেন, সিনেমা ছাড়া আর কিছু নেই?”

কাচুমাচু খেলো অল্পবয়সি।

“আমরা যা করছি তা কোনো সিনেমা নয়, বুঝলি? তাছাড়া সিনেমা দেখা পাপ। এতে গুনাহ্ হয়।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মুজাহিদ। বুজুর্গও এটা বলেছে। “আচ্ছা ভাইজান, ভগবান নাকি ভগমান?”

বিরক্ত হলো ইসমাইল। “এখন কেন এটা জানতে চাচ্ছিস? তুই না সিনেমায় বলতে দেখেছিস…ওখানে ওরা কি বলে?”

মাথা চুলকালো ছেলেটি। “ওদের কথা শুনে তো মনে হয় ভগমান-ই বলে। কিন্তু বুজুর্গ বললেন ভগবান। কোটা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“তোর কানের চেয়ে বুজুর্গের মুখ অনেক বেশি সঠিক। উনি যেটা, বলেছেন সেটাই ঠিক।”

“জি, ভাইজান।” একটু থেমে আবার বললো, “বুজুর্গ সব সময় ঠিক কথা বলেন কিভাবে? আমরা তো এটা করতে পারি না। আমাদের কতো ভুল হয়!”

“আমরা আর বুজুর্গ কি এক? না-বুঝের মতো কথা বলিস কেন।” ইসমাইল পাশ ফিরে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে থাকার চেষ্টা করলো। এবার ঘুমা। ফজরের ওয়াক্তে যেনো দশবার ডাকতে না হয়।”

“আচ্ছা ভাইজান, বুজুর্গ কি আসলেই গাজি?” অন্ধকার ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলো মুজাহিদ।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইসমাইল। এই ছেলেটার সমস্ত প্রশ্ন কেবল তার কাছেই। “উনি গাজি কিনা আমি জানি না। তবে উনি যে বুজুর্গ এটা সবাই জানে।”

“আমার মনে হয় না উনি গাজি।”

ইসমাইল পাশ ফিরে আবার তাকালো মুজাহিদের দিকে। “কেন তোর এটা মনে হচ্ছে?”

“আমি স্কুলে কিছুদিন পড়েছি…যারা টিচার তারা কখনও পরীক্ষা দেয় …তারা সব সময় এলেম দেয় আর পরীক্ষা নেয়। বুজুর্গও আমাদের এলেম দেন…কিন্তু কখনও পরীক্ষা দেন না।”

“গাধা,” ভৎর্সনা করে বলে উঠলো ইসমাইল। “টিচাররা অনেক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেই টিচার হয়, বুঝলি?”

“তাহলে বুজুর্গ অনেক পরীক্ষা দিয়েছেন?”

“আলবৎ দিয়েছেন।” জোর দিয়ে বললো বড়জন।

“তার মানে উনি অনেকবার বেঁচে গেছেন…গাজি হয়েছেন?”

ইসমাইল চুপ মেরে রইলো কয়েক মুহূর্ত। প্রশ্নটার উত্তর কি দেবে বুঝতে পারছে না। এটা সে জানে না তাই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। আন্দাজে কিছু বলাটা মিথ্যেরই শামিল। মিথ্যে কথা বলে জীবনের শেষ কটা দিন সে পাপেপূর্ণ করতে চাইছে না।

“কোনোবারই শহীদ হন নি…সব সময় বেঁচে গেছেন?”

ইসমাইল নিশ্চুপ রইলো।

“উনি কেন আমাদের শেখাচ্ছেন না কিভাবে বার বার বেঁচে থাকা যায়? গাজি হওয়া যায়?”

ইসমাইল চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “এবার ঘুমা। এতো বেশি প্রশ্ন করা ঠিক না।”

“কেন ঠিক না?”

“এতে করে ঈমানের জোর কমে যায়। যার ঈমানের জোর যতো কম তার মনে ততো প্রশ্ন।”

মুজাহিদ চুপ মেরে গেলো। এটাও বুজুর্গ একদিন তাদের বলেছিলো। একিনে দরিয়া পার। বিশ্বাস করলে নাকি নদীও পার হয়ে যাওয়া যায়। পানির উপরে দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু সে জানে তার মনে অনেক প্রশ্ন। বিক্ষিপ্তভাবে সেগুলো মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। বেশিরভাগের সদুত্তরই তার জানা নেই। আর যেগুলো জানে সেগুলো নিয়েও তার মনে আবার প্রশ্নের উদয় হয়। এটা যে তার দুর্বল ঈমানের পরিচয় সেটা বুঝতে পেরে ভয়ে কুকড়ে গেলো কম্বলের নীচে। মনে মনে ঠিক করলো যে কটা দিন বাঁচে চেষ্টা করবে প্রশ্ন না করতে। আস্তাগফিরুল্লাহ! আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিও!

*

করাচির ক্লিফটন বিচের নিরিবিলি একটি জায়গায় বসে আছে বাস্টার্ড। তার হাতে কার্লসবার্গ বিয়ার। পাশে বসা জাভেদও বিয়ার পান করছে। এখানে প্রকাশ্যে ভদকা খাওয়ার উপায় নেই। ওটা খেতে হলে ধারেকাছে অনেক বার রয়েছে সেখানে যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ঢাকা থেকে আসা লোকটি বারে যেতে রাজি হয় নি। তার কথা পান করার কোনো ইচ্ছে নেই, শুধু বিচটা দেখবে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই সরবত খাচ্ছে জাভেদ।

“কেমন লাগছে?”

“ভালো। চমৎকার।”

মুচকি হেসে ক্যানে চুমুক দিলো মোহাজের। “কিছু যদি মনে করেন একটা কথা বলবো?”

বাস্টার্ড সমুদ্রের জলরাশি থেকে চোখ সরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো। “বলো।”

“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে টেনশনে আছেন।”

চুপ মেরে রইলো সে। কথাটা মিথ্যে নয়। “না। আমি ঠিকই আছি।” আবারো ফিরে তাকালো কালো জলরাশির দিকে। জাহাজ আর ট্রলারের বাতিগুলো ছোটো ছোটো আলোক-বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ওগুলো থেকে হুইসেলের শব্দও ভেসে আসছে, তবে সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দটাই বেশি জোড়ালো। প্রচুর লোকজন এসেছে বেড়াতে। বউ বাচ্চা নিয়ে কোনো স্বামী, প্রেমিকাকে নিয়ে কোনো প্রেমিক, দল বেধে বন্ধুবান্ধব। এমন কি বয়স্ক কিছু লোককেও দেখতে পেলো। একঘোড়ায় টানা দু-চাকার কিছু ছোটোছোটো গাড়ি এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিঠে যাত্রি নিয়ে মরুর উট ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রসৈকতে! দারুণ দৃশ্য।

বিয়ারে চুমুক দিয়ে শেষ করে ফেললো ক্যানটা।

“আরেকটা নেবেন?” জাভেদ নতুন একটা ক্যান বাড়িয়ে দিলো তার দিকে।

নতুন ক্যানটা খুলে চুমুক দিলো সে।

“রাতে কোথায় খেতে চান? এখানকার কোনো রেস্টুরেন্টে নাকি অন্য কোথাও?”

বিয়ারে আবার চুমুক দিয়ে বললো, “ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট হলেই চলবে।”

“ওকে।”

সব সময় বিয়ার পেটে পড়তেই তার ভালো লাগার অনুভূতি হয় কিন্তু আজ একদম হচ্ছে না। একটা চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এখানে আসার পর গাড়ি থেকে নামার আগেও জিপিএস ট্র্যাকারটা চেক করে দেখেছে, আশাব্যঞ্জক কিছু পায় নি। বইটা একই জায়গায় রয়ে গেছে। এখন রাত সাড়ে আটটা। এতো রাতে নিশ্চয় মওলানা অফিসে নেই। সম্ভবত বইটা সাথে করে বাড়িতে নিতে ভুলে গেছে, নয়তো আরো খারাপ কিছু ঘটবে-বইটা আদৌ বাড়িতে নেয়া হবে না। ওটা অফিসেই রেখে দিয়েছে।

আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। জিপিএস ট্র্যাকারের মতো জিনিস পাবার পর ভেবেছিলো মওলানার বাড়ি খুঁজে বের করাটা পানির মতো সহজ হয়ে যাবে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি, ঐ বইটা নিজের অফিসেই রেখে দেবে। সাধারণত এ-ধরণের বই বাড়িতেই সংগ্রহ করে রাখা হয়। অফিসে যে কেউ বই রাখে না তা নয়। তবে লোকটার অফিসে কোনো বই, বই রাখার শেলফও দেখে নি। পুরো ব্যাপারটা যে এভাবে হতাশায় পরিণত হবে সেটা কে জানতো। তার মন বলছে, ঐ বইটা আর মওলানা নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে না।

“ওটা কবে লাগবে, বড়ভাই?”

জাভেদের কথায় আনমনা কাটিয়ে তাকালো সে। “তিন-চারদিন পর।”

“ঠিক আছে। যখন লাগবে তার একদিন আগে আমাকে বলবেন। ওসব জিনিস আমি বাড়িতে রাখি না, অন্য একজনের কাছে রাখি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“আগামীকালের প্ল্যান কি?”

চুপ মেরে রইলো কয়েক মুহূর্ত। মওলানার বাড়ি কোথায় সেটা জানার আগ পর্যন্ত এভাবে বসে বসে সমুদ্রের ঢেউ গোনা ছাড়া কোনো কাজ নেই। “আমি ফোন করে জানাবো, তবে সকালের দিকে আসার দরকার নেই, লাঞ্চের পর আসলেই হবে।”

“ঠিক আছে,” বলেই বিয়ারে মনোযোগ দিলো জাভেদ। বাস্টার্ড চুপচাপ বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বিকল্প একটা পরিকল্পনার কথা ভাবলো। সব সময়ই ব্যাক-আপ রেখে কাজ করে সে কিন্তু জিপিএস ট্র্যাকারের ক্ষেত্রে সেটা করা যায় নি।

চিন্তায় মগ্ন বাস্টার্ড খেয়াল করলো না জাভেদ নামের করাচির বাসিন্দা বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে এরমধ্যেই বার কয়েক তাকে দেখে নিয়েছে। ছেলেটার মাথায় ঢুকছে না এরকম এক লোক করাচিতে এসেছে কেন। তাকে দেখে মোটেও খারাপ কিছু ভাবার উপায় নেই। একেবারে সুদর্শন এক যুবক। তার যদি এরকম চেহারা আর শরীর-স্বাস্থ্য থাকতো তবে নির্ঘাত লাহোরে চলে যেতো, নায়ক হিসেবে নাম লেখাতো। পরক্ষণেই তার মনে হলো, সে যেমনটা ভাবছে আদতে এই যুবক তেমন কেউ নয়। নিষ্পাপ চেহারার এই মানুষটি ঢাকা থেকে করাচিতে এসেছে গোপন এক মিশন নিয়ে। সেই মিশনটা কি তা তার জানা নেই। এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। সামাদভাই জোর দিয়ে বলেছে, এই লোকের সাথে কাজ করার সময় বাড়তি কোনো প্রশ্ন যেনো না করে। তার যা প্রাপ্য তারচেয়ে বেশিই পাবে, শুধু কথামতো কাজ করতে হবে। তবে তার ধারণা সামাদভায়ের মতোই কোনো কাজ করবে সে। তার বড়ভায়ের সাথে সামাদের বেশ খাতির ছিলো। এমকিউএম-এর হয়ে ঢাকার লোকটি কিছু কাজ করেছে। তার হাতের নিশানা নাকি দুর্দান্ত।

কিন্তু একটা বিষয় তার মাথায় একদমই ঢুকছে না-একা আর একটামাত্র পিস্তল দিয়ে এই যুবক করবেটা কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *