১২০. একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য

১২০

গয়ার ওপরে পেছনের ডেকে কিওয়া এসে থামতেই, ডেল্টা-ওয়ান নিচের দিকে তাকালো। তার চোখ একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের দিকে আঁটকে গেলো।

মাইকেল টোল্যান্ড একটা ছোট সাব-এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাব-টার রোবোটিক হাত দুটোতে, একটা বিশাল পোকার মতো ডেল্টা-টু ঝুলে আছে।

সে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বৃথা তার চেষ্টা।

হায় ঈর একি??

একই রকম আশংকাজনক চিত্র হলো, রাচেল সেক্সটন, হাত-পা বাঁধা এক লোকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা পড়ে রয়েছে সাব-এর নিচে। সেটা ডেল্টা-থৃ ছাড়া আর কেইবা হতে পারে। রাচেল ডেল্টা ফোর্সের একটা মেশিনগান ধরে কপ্টারটার দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো তাদেরকে আক্রমণ করবে সে।

ডেল্টা-ওয়ান ভড়কে গেলো। বুঝতেই পারলো না এসব কীভাবে হলো। মিলনে আইস শেলফে ডেল্টা ফোর্সের ভুল ত্রুটিগুলো ছিলো বিরল ব্যাপার, আর এটাতো একেবারেই অকল্পনীয়।

ডেল্টা-ওয়ানের এই অপমানটা অনেক বেশি বেড়ে গেছে, কারণ তার সাথে কপ্টারে আরেকজনের আছে। এমন একজন লোক যার উপস্থিতি খুবই অপ্রচলিত একটি ব্যাপার।

কন্ট্রোলার।

এফডিআর মেমোরিয়ালের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হবার পরই কন্ট্রোলার ডেল্টা-ওয়ানকে হোয়াইট হাউজের খুব কাছেই একটা ফাঁকা পাবলিক পার্কে যাবার নির্দেশ দিয়ে ছিলো। একটা গাছের ছায়া থেকে কন্ট্রোলার বেড়িয়ে এসে কিওয়াতে উঠে বসতেই তারা আবার তাদের গন্ত ব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে গিয়েছিলো।

যদিও মিশনে কন্ট্রোলারের সরাসরি অংশ নেয়াটা বিরল ব্যাপার, কিন্তু ডেল্টা-ওয়ান কোনো অনুযোগ করেনি। কারণ মিলনেতে তাদের ভুলের জন্য মিশনটা পুরোপুরি বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে।

এখন কন্ট্রোলার কপ্টারে বসে আছে, স্বচক্ষে দেখছে এমন এক ব্যর্থতা যা ডেল্টা-ওয়ান কখনও দেখেনি।

এটা এখনই শেষ করতে হবে।

.

কন্ট্রোলার কিওয়া থেকে গয়ার ডেকে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে গেলো। এটা কীভাবে হতে পারলো এটা তার মাথায় ঢুকছে না। কোনো কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না।

“কন্ট্রোলার, ডেল্টা-ওয়ান বললো, তার কণ্ঠে বিস্ময় আর হতাশা, “আমি কল্পনাও করতে পারছি না–”

আমিও, কন্ট্রোলার ভাবলো। তাদের শিকারদের খুব বেশি খাটো করে দেখা হয়েছে।

কন্ট্রোলার নিচে রাচেল সেক্সটনের দিকে চেয়ে আছে। রাচেল হেলিকপ্টারের উইন্ড শিল্ডের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু প্রতিফলিত উইন্ডশিল্প বলে ভেতরে কে আছে সেটা দেখতে পারছে না। তার হাতে ক্রিপ-টকটা ধরা। তার সিনথেসাইজ কণ্ঠটা যখন কিওয়ার ভেতরে কোনো গেলো, তখন কন্ট্রোলার আশা করলো সে দাবি জানাবে কপ্টারটা যেনো ফিরে যায় অথবা জ্যামিং সিস্টেমটা যেনো বন্ধ করে দেয়া হয়। যাতে করে টোল্যান্ড সাহায্যের জন্য ফোন করতে পারে। কিন্তু রাচেল সেক্সটন যে কথা বললো সেটা আরো বেশি আশংকাজনক।

“তোমরা খুব দেরি করে ফেলেছে,” সে বললো, “কেবল আমরাই এখন সেটা জানি না।”

শব্দটা কপ্টারের ভেতরে কিছুক্ষণ প্রতিধ্বনিত হলো। যদিও তার দাবিটাকে সত্য বলে মনে হচ্ছে না, তারপরও এটা সত্য হবার মৃদু সম্ভাবনা কন্ট্রোলারকে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করিয়ে দিলো। এই প্রজেক্টের সফলতার জন্যই যারা সত্যটা জানে তাদের সবাইকে শেষ করে দিতে হবে।

অন্য কেউও জানে…

রাচেল আবারো ক্রিপটকে বললো। “ফিরে যাও, তানা হলে তোমার লোকদেরকে শেষ করে দেবো। আরেকটু কাছে এলেই তাদেরকে মেরে ফেলা হবে। যেভাবেই হোক সত্যটা

বেরিয়ে আসবে ফিরে যাও।”

“তুমি ধোকা দিচ্ছো, কন্ট্রোলার বললো। সে জানে রাচেল যে কণ্ঠটা শুনবে সেটা রোবোটিক কণ্ঠ। “তুমি কাউকে বলোনি।”

“তুমি সেই সুযোগটা নিতে প্রস্তুত?” রাচেল পাল্টা বললো। “আমি পিকারিংকে পাইনি, তাই আমি একটু অন্যভাবে করেছি, একটা ইস্যুরেন্সের মতো।”

কন্ট্রোলার চিন্তিত হলো। এটা সম্ভব।

“তারা এটা পাত্তাই দিচ্ছে না,” রাচেল টোল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে বললো।

ঝুলে থাকা সৈনিকটি ঠাট্টার হাসি দিয়ে বললো, “তোমাদের অস্ত্রে গুলি নেই, কপ্টারটা তোমাদেরকে উড়িয়ে দেবে। তোমরা দুজনেই মরবে। তোমাদের একমাত্র আশা হলো আমাদেরকে যেতে দাও এখান থেকে।”

নরকে, রাচেল ভাবলো, এরপর কী করবে হিসেব করার চেষ্টা করলো। সে হাত-পা-মুখ বাধা লোকটার দিকে তাকিয়ে হাটু গেড়ে তার সামনে বসে পড়লো, শক্ত চোখে তাকালো সে, “আমি তোমার মুখ খুলে দিচ্ছি, ক্রিপটকটা ধরো, তুমি হেলিকপ্টারটাকে ফিরে যেতে রাজি করাবে। বুঝতে পেরেছো?”

লোকটা সায় দিলো।

রাচেল তার মুখের বাঁধনটা খুলে দিতেই লোকটা রক্তমেশানো থুথু রাচেলের মুখে ছুঁড়ে মারলো।

“কুত্তি,” সে রেগেমেগে বললো। “আমি তোর মৃত্যু দেখবো। তারা তোকে শূয়োরের মতো খুন করবে। আর আমি সেটা মজা করে দেখবো।”

রাচেল তার মুখে লাগা থুথুটা মুছতেই টোল্যান্ড তাকে ধরে তুললো। সে মেশিন গানটা উঁচিয়ে গুলি করতে উদ্যত হচ্ছিলো। টোল্যান্ড কয়েক গজ দূরে কন্ট্রোল প্যানেলে গিয়ে একটা লিভার ধরে ডেকে শোয়া লোকটার দিকে তাকালো।

“দ্বিতীয় আঘাত,” টোল্যান্ড বললো। “আর আমার জাহাজে, এটাই তুমি পাবে।”

একটা হ্যাঁচকা টান মারতেই, ট্রাইটনের নিচে একটা পাটাতন মানে ট্র্যাপ-ডোর খুলে গেলো। যেনো ফাঁসি কাষ্ঠের পাটাতনটা সরে গেলো। হাত-পা বাঁধা সৈনিকটি একটা চিৎকার দিলো। তারপরই উধাও হয়ে গেলো সে। গর্তের ভেতর দিয়ে ত্রিশ ফিট নিচে সমুদ্রে গিয়ে পড়লো।পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাঙ্গরের তার দিকে তেড়ে আসবে।

কন্ট্রোলার নিচের দিকে চেয়ে দেখলো হাঙ্গরগুলো ডেল্টা-গৃ’র শরীর ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলছে।

যিশু খৃস্ট।

কন্ট্রোলার ডেকের দিকে আবার তাকালো, ডেল্টা-টু ঝুলে আছে সেখানে, ট্রাইটনের রোবোটিক হাতে। এবার সাব-এর হাত তাকে ঐ খোলা পাটাতনের সামনে নিয়ে আসতে লাগলো৷ টোল্যান্ডকে যা করতে হবে, তাহলে রোবোটিক হাতটা ছেড়ে দিলেই হবে। ডেল্টা টুও নিচে পড়ে যাবে।

“ঠিক আছে,” কন্ট্রোলার ক্রিপ-টকে গর্জে বললো। “দাঁড়াও। একটু দাঁড়াও।”

রাচেল কিওয়ার দিকে তাকালো। “তুমি এখনও ভাবছো আমরা ধোকা দিচ্ছি?” ক্রিপ টকে সে বললো। “এনআরও’র মেইন সুইচ বোর্ডে কল করো। জিম সামিলিয়নকে চাও। সে। রাতের শিফটের পিএন্ডএ, আমি উল্কাপিণ্ডের ব্যাপারে সব বলে দিয়েছি তাকে।”

সে আমাকে নির্দিষ্ট একটা নাম বলছে?

রাচেল সেক্সটন বোকা নয়। এটা যদি ধোকা হয় তবে কন্ট্রোলার সঙ্গে সঙ্গেই চেক করতে পারবে। যদিও কন্ট্রোলার জিম সামিলিয়ান নামের কাউকে এনআরও-তে চেনে না, কিন্তু এজেন্সিটা অনেক বড়। চূড়ান্তত খুটি করার আগে কন্ট্রোলার নিশ্চিত হতে চাইলো–এটা ধোকা কিনা।

“আপনি যাতে কল করতে পারেন তার জন্য কি আমি জ্যামারটা বন্ধ করে দেবো?” ডেল্টা-ওয়ান বললো।

“জ্যামারটা বন্ধ কর,” কন্ট্রোলার বললো। একটা সেলফোন বের করলো সে। “আমি রাচেলের কথাটা সত্য কিনা দেখছি। তারপরই আমরা ডেল্টা-টু’কে উদ্ধার করবো, আর এই ব্যাপারটা শেষ করে ফেলবো।”

***

ফেয়ার ফ্যাক্সে, এনআরও’র অপারেটর অধৈর্য হয়ে উঠলো। “আমি তো আপনাকে বলেছিই, এখানে কোনো জিম সামিলিয়ান বলে কেউ নেই।”

কলার আবারো চাপাচাপি করলো। “অন্য ডিপার্টমেন্টে চেষ্টা করে দেখবেন? বানানটা অন্যভাবে করে?”

অপারেটর আবারো চেক করে দেখলো। কয়েক সেকেন্ড বাদে সে বললো, “না, এ নামে কেউ নেই। অন্য কোনো বানানেও এরকম কেউ নেই।”

কলারের কথা শুনে মনে হলো সে খুশিই হয়েছে। “তাহলে, আপনি নিশ্চিত জিম সামিলিয়ান বলে এখানে কেউ নেই–”

হঠাৎ করেই লাইনে একটা বিশৃঙ্খল শব্দ হলো। কেউ কিার করলো তারপর, কলার আক্ষেপ করে লাইনটা কেটে দিলো।

.

কিওয়ার ভেতরে, ডেল্টা-ওয়ান জ্যামিং সিস্টেমটা আবার চালু করতেই রেগেমেগে চিৎকার করে উঠলো। সে বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছে। ককপিটের এলইডি মনিটরে দেখা গেলো একটা SATCOM ডাটা সিগনাল গয়া থেকে এইমাত্র ট্রান্সমিশন হয়ে গেলো। কিন্তু কীভাবে? কেউ তো ডেক ছেড়ে যায়নি!

হাইড্রোল্যাবের ভেতরে, ফ্যাক্স মেশিনটা বিপ করতে শুরু করলো।

ফ্যাক্সটা গন্তব্যে চলে গেছে।

১২১

মারো না হয় মরো। রাচেল তার নিজের একটা অংশ আবিষ্কার করলো, যার অস্তিত্বের ব্যাপারে সে অবগত ছিলো না। বেঁচে থাকার তাড়না– একটি বন্য আকাঙ্খ, ভয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছে।

“এই ফ্যাক্সটাতে কী আছে?” ক্রিপটকের কণ্ঠটা জানতে চাইলো।

ফ্যাক্সটা যেতে পেরেছে বলে রাচেল স্বস্তি পেলো। পরিকল্পনা মতোই ব্যাপারটা ঘটেছে। “এখান থেকে চলে যাও, সব শেষ হয়ে গেছে। তোমাদের সিক্রেটটা ফাঁস হয়ে গেছে।”

রাচেল ফ্যাক্সের সব কথা বলে দিলো। “আমাদের ক্ষতি করলে তোমাদের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।”

একটা গভীর নিরবতা নেমে এলো। “কার কাছে ফ্যাক্সটা পাঠিয়েছো?”

এ প্রশ্নে জবাব দেবার কোনো ইচ্ছে রাচেলের নেই।

“উইলিয়াম পিকারিং,” কণ্ঠটা অনুমান করে বললো। “তুমি পিকারিংয়ের কাছে ফ্যাক্সটা পাঠিয়েছো?”

ভুল। রাচেল ভাবলো। সে আসলে পিকারিংয়ের কাছে পাঠায়নি, কারণ তার অনুমান তাকে ইতিমধ্যেই শেষ করে ফেলা হয়েছে। রাচেল সেটা অন্য কারো কাছে পাঠিয়েছে।

তার বাবার অফিসে।

রাচেল কখনই ভাবেনি তার বাবাকে তার এভাবে কখনও দরকার হবে।

কিন্তু দুটো কারণে এটা সে করেছে– কেবলমাত্র তিনিই এই ভূয়া উল্কাখণ্ডের খবরটি মরিয়া হয়ে প্রকাশ করবেন, কোনো রকম ইতস্তত করবেন না। আর তিনি হোয়াইট হাউজকে এই খবরটা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে হত্যা স্কোয়াডটাকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন।

আক্রমণকারীরা যদি জানেও রাচেল কোথায় এই ফ্যাক্সটা পাঠিয়েছে, তারপরও তাদের পক্ষে ফিলিপ এ হার্ট বিল্ডিংয়ের ফেডারেল নিরাপত্তা ভেদ করা মোটেই সম্ভব হবে না।

“তুমি ফ্যাক্সটা যেখানেই পাঠাও না কেন, তুমি সেই ব্যক্তিকে বিপদে ফেলে দিয়েছে, কণ্ঠটা বললো।

“এখানে একজনই বিপদে আছে, আর সে হলো তোমাদের এজেন্ট, ডেল্টা ফোর্সের ঝুলে থাকা সদস্যের দিকে ইঙ্গিত করে রাচেল বললো ক্রিপটকে। “খেল খতম। চলে যাও। ডাটাগুলো এখান থেকে চলে গেছে। তোমরা হেরে গেছে। এখান থেকে চলে যাও, তানা হলে এই লোকটা মরবে।”

ক্রিপ-টকের কণ্ঠটা পাল্টা ঝেড়ে বললো, “মিস্ সেক্সটন, তুমি গুরুত্বটা বুঝতে পারছ না–

“বুঝতে পারছি না?” রাচেল ক্ষেপে ওঠে বললো। “আমি কেবল বুঝি তোমরা নিরীহ লোকদের হত্যা করো। আমি বুঝি উল্কাপিণ্ড সম্পর্কে মিথ্যে বলেছে! আর আমি বুঝি, তোমরা কোনোভাবেই পার পাবে না! এমন কি আমাদেরকে হত্যা করলেও, খেল খতম হয়ে গেছে।”

দীর্ঘ একটা নিরবতা নেমে এলো। অবশেষে লোকটা বললো, “আমি নিচে নেমে আসছি।”

রাচেলের পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেলো। নেমে আসবে?

“আমি নিরস্ত্র, কন্ঠটা বললো। “উল্টা পাল্টা কিছু করো না। তোমার আর আমার মুখোমুখি কথা বলার দরকার।”

রাচেল কিছু বলার আগেই কপ্টারটা গয়ার ডেকে নেমে এলো। দরজাটা খুলে গেলে একটা অবয়ব দেখা গেলো। কালো কোট আর টাই পরা একজন। মুহূর্তেই, রাচেলের চিন্ত ভািবনাসমূহ ফাঁকা হয়ে গেলো।

সে উইলিয়াম পিকারিংয়ের দিকে চেয়ে রইলো।

.

উইলিয়াম পিকারিং রাচেলের চোখে এক বিপজ্জনক আবেগ দেখতে পেলো।

অবিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার, দ্বিধাগ্রস্ত, আর ক্রোধ।

সবটাই বোধগম্য, সে ভাবলো। অনেক কিছুই আছে সে বুঝবে না।

মুহূর্তের জন্য, পিকারিংয়ের তার মেয়ের কথাটা মনে পড়ে গেলো। ডায়না।রাচেল আর ডায়না একই যুদ্ধের বলি। এমন একটা যুদ্ধ, পিকারিং প্রতীজ্ঞা করেছে সারা জীবন চালিয়ে যাবে। কখনও কখনও যুদ্ধের বলিটা খুবই নির্মম হয়ে থাকে।

“রাচেল,” পিকারিং বললো। “আমরা এখনও এটা সমাধান করতে পারি। অনেক কিছুই আমার ব্যাখ্যা করার আছে।”

রাচেলকে খুবই তিক্ত দেখালো। তার বমি এসে গেলো প্রায়। টোল্যান্ড তার মেশিন গানটা পিকারিংয়ের বুকে তাক করে রেখে বিস্ময়ে চেয়ে আছে।

“আগে বাড়বে না!” টোল্যান্ড চিৎকার করে বললো।

পিকারিং রাচেলের দিকে তাকিয়ে পাঁচ গজ দূরেই দাঁড়িয়ে রইলো।

“তোমার বাবা ঘুষ নিচ্ছে, রাচেল। প্রাইভেট স্পেস কোম্পানির কাছ থেকে। সে নাসা’কে ধ্বংস করে, মহাশূন্যকে প্রাইভেট খাতে ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। তাকে অবশ্যই থামাতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরেই।”

রাচেল চেয়ে রইলো।

পিকারিং দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “যতো সমস্যাই থাকুক, নাসা’কে সরকারীই থাকতে হবে।”

রাচেলের কণ্ঠটা কাঁপতে লাগলো।

“আপনি ভূয়া উল্কাখণ্ড বানিয়ে, নির্দোষ লোকদেরকে হত্যা করেছেন … জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে?”

“এটা আসলে এভাবে হবার কথা ছিলো না।” পিকারিং বললো। “পরিকল্পনাটা ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী এজেন্সিকে বাঁচানরো। খুন করার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না।”

উল্কাপিণ্ডটির প্রতারণা, পিকারিং জানে কীভাবে হয়েছিলো। তিন বছর আগে, এনআরও’র হাইড্রোফোন ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণ করার জন্য গভীর সমুদ্রে যাবার প্রয়োজন হয়েছিল। নাসার উদ্ভাবিত একটি অত্যাধুনিক সাবমেরিন দুজন মানুষবিশিষ্ট, সমুদ্রের গভীরে অভিযান চালিয়েছিলো– তার মধ্যে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশও অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

এই দুই মনুষ্যবাহী সাবমেরিনটার নক্সা ক্যালিফোর্নিয়ার ইনজিনিয়ার গ্রাহাম হকের কম্পিউটার হ্যাঁক করে করা হয়েছিলো। টাকার অভাবে হক এটার প্রোটোটাইপটি নির্মাণ করতে পারেনি। অন্যদিকে, পিকারিংয়ের টাকা পয়সার কোনো সমস্যা ছিলো না।

এই গোপন সিরামিকের তৈরি সাবমেরিনটা ব্যবহার করে পিকারিং একটি গোপন দল পাঠায় সমুদ্রের নিচে নতুন হাইড্রোফোন স্থাপন করার জন্য। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের খাদেও সেটা স্থাপন করতে হয়েছিলো। সেখানেই খনন করার সময় একটি ভৌত বস্তু তারা খুঁজে পায়। এমন কিছু যা কোনো বিজ্ঞানী কখনও দেখেনি। এই পাথর খণ্ডটাতে অজ্ঞাত পরিচয়ের কিছু প্রাণীর ফসিল আর কন্ড্রুইল ছিলো। যেহেতু এনআরও’র এই অভিযানটি খুবই গোপন ছিলো, তাই এটার খবর কেউ জানতে পারেনি।

কিছুদিন আগেই, পিকারিং এবং এনআরও’র বিজ্ঞান উপদেষ্টারা এই সিদ্ধান্তে এসেছিল যে মারিয়ানার অনন্য এই বস্তুটা ব্যবহার করে তারা নাসাকে বাঁচিয়ে দেবে। মারিয়ানার পাথরটাকে উল্কাপিণ্ড বলে চালিয়ে দেয়াটা খুবই সহজ কাজ ছিলো। ইসিই স্ল্যাশ হাইড্রোজেন ইনজিন ফিউশন ক্রাস্ট তৈরি করে। তারপর ছোটখাট একটা সাব ব্যবহার করে পাথরখণ্ডটাকে মিলনের আইস শেলফের নিচে স্থাপন করা হয়। একবার পাথর খণ্ডটা বরফের। মধ্যে স্থাপন করার পর, সেটাকে দেখে মনে হবে যে ওটা ওখানেই তিনশত বছর ধরে আছে।

দুঃখের বিষয় হলো, পুরো পরিকল্পনাটা ভেস্তে যায় কিছু বায়োলুমিনিসেন্ট প্লংটনের কারণে…

থেমে থাকা কিওয়ার ককপিটে বসে ডেল্টা-ওয়ান সবকিছু দেখছিলো। রাচেল আর পিকারিং কথা বলছে, টোল্যান্ড মেশিন গানটা পিকারিংয়ের বুকে তাক করে রেখেছে। ডেল্টা ওয়ানের প্রায় হাসি এসে পড়লো, কারণ এতো দূর থেকেও সে টোল্যান্ডের মেশিনগানটার ককিং বারটা পেছনের দিকে টানা দেখতে পেলো। এর মানে, তাতে কোনো গুলিই নেই। এটা একেবারেই মূল্যহীন।

ডেল্টা-ওয়ান বুঝতে পারলো তার এখন কিছু করার সময় এসে গেছে। সে কপ্টারটা থেকে নিঃশব্দে নেমে সেটার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। নিজের মেশিনগানটা উঁচিয়ে করে সে এগিয়ে গেলো চুপিসারে। ডেকে নামার আগে পিকারিং তাকে নির্দিষ্ট করে অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলো। আর ডেল্টা-ওয়ানের এই সহজ সরল কাজটাতে ব্যর্থ হবার কোনো ইচ্ছেই নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই, সে জানে, এটার পরিসমাপ্তি হবে।

১২২

বাথরোবটা পরেই জাখ হার্নি ওভাল অফিসের নিজের ডেস্কে বসে আছেন। হতবিহ্বলতার নতুন অংশটা এইমাত্র উন্মোচিত হয়েছে।

মারজোরি টেঞ্চ মারা গেছে।

হার্নির সহকারীরা তাকে বলেছে, টেঞ্চ এফডিআর মেমোরিয়ালে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিল উইলিয়াম পিকারিংয়ের সাথে দেখা করার জন্য। এখন পিকারিংকেও পাওয়া যাচ্ছে না। আশংকা করা হচ্ছে, সেও মারা গিয়ে থাকবে।

এর আগে থেকেই হার্নি আর পিকারিংয়ের মধ্যে একটা সমস্যা হচ্ছিলো। একমাস আগে, হার্নি জানতে পেরেছিলো পিকারিং প্রেসিডেন্টের হয়ে অবৈধ কিছু কাজ করে যাচ্ছে হার্নির ক্যাম্পেইনকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য।

এনআরও’র সম্পদ ব্যবহার করে পিকারিং সিনেটর সেক্সটনের নোংরা কাজের প্রমাণ সংগ্রহ করে চলছে সেক্সটনের ক্যাম্পেইনের ভরাডুবির জন্য– সেক্সটন আর তার সহকারী গ্যাব্রিয়েল এ্যাশের অবৈধ সঙ্গমের রগরগে ছবি, প্রাইস্টে স্পেস কোম্পানি থেকে সেক্সটনের ঘুষ গ্রহণের প্রমাণপত্র ইত্যাদি যোগাড় করেছে সে। পিকারিং নিজের পরিচয় লুকিয়ে এসব জিনিস মারজোরি টেঞ্চের কাছে পাঠিয়েছিলো, এই ভেবে যে, হোয়াইট হাউজ এটা ভালোভাবেই ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু হার্নি এসব ছবি আর তথ্য দেখে টেঞ্চকে কড়াভাবে বলে দিয়েছিলেন সে যেনো এসব ব্যবহার না করে। যৌন কেলেংকারী আর ঘুষ ওয়াশিংটনে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে আছে। নতুন করে এসব জানিয়ে সরকারের ওপর জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি করার কোনো ইচ্ছে তার নেই।

নিন্দাবাদ এই দেশটাকে খুন করে ফেলছে।

হার্নি এসব খবর ফাঁস করে সেক্সটনকে ধ্বংস করতে চায়নি, কারণ এতে করে ইউএস সিনেটকে হেয় করা হবে। যা হার্নি কোনোভাবেই করতে চায় না।

আর কোনো নেতিবাচকতা নয়।

পিকারিংয়ের দেয়া প্রমাণপত্রগুলো হোয়াইট হাউজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করায়, সে রটনা রটিয়ে দেয় যে সেক্সটন তার সহকারীর সঙ্গে যৌন সঙ্গমে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেক্সটন সব অস্বীকার করে উল্টো হোয়াইট হাউজকে এসব নোংরামীর জন্য অভিযুক্ত করলে শেষ পর্যন্ত জাখ হার্নিকে ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিলো। হার্নি পিকারিংকে এই ব’লে শাসিয়েছিলেন যে, তাঁর ক্যাম্পেইন নিয়ে মাথা ঘামালে তাকে বরখাস্ত করা হবে। পরিহাসের ব্যাপার হলো পিকারিং প্রেসিডেন্টকে মোটেও পছন্দ করত না। এনআরওর প্রেসিডেন্ট কেবল নাসা’কে বাঁচাতেই হার্নির ক্যাম্পেইনে সাহায্য করতে চেয়েছিলো। জাখ হার্নি। হলেন দুই শয়তানের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম খারাপ।

এখন কেউ কি পিকারিংকে খুন করেছে?

হার্নি ভাবতেও পারছে না।

“মি: প্রেসিডেন্ট?” এক সহকারী বললো। “আপনার কথামতো আমি লরেন্স এক্সট্রমকে ফোন করে মারজোরি টেঞ্চের ব্যাপারটা বলেছি।”

“ধন্যবাদ তোমাকে।”

“তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন, স্যার।”

“তাকে বল, আমি তার সঙ্গে সকালে কথা বলবো।”

“মি: এক্সট্রম আপনার সাথে এক্ষুণি কথা বলতে চাচ্ছেন, স্যার।” সহকারীকে খুব বিমর্ষ দেখালো। “তিনি খুব ভেঙে পড়েছেন।”

সে ভেঙে পড়েছে? হার্নির মেজাজ বিগড়ে গেলো। এক্সট্রমের ফোনটা নিতে যাবার সময় তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন আবার কি উল্টাপাল্টা কিছু হলো নাকি।

১২৩

গয়ার ডেকে, রাচেলের মনে হলো তার মাথাটা হালকা হয়ে গেছে। যে রহস্যময়তা তার চারপাশ জুড়ে ভারি কুয়াশার মতো বিরাজ করছিলো, সেটা এখন কাটতে শুরু করেছে। সে তার সামনের অগম্বুকের দিকে তাকিয়ে আছে আর তার কথা খুব কমই শুনতে পারছে।

“নাসা”র ইমেজকে আমাদের পুনঃনির্মাণ করতে হবে।” পিকারিং বলছিলো। “জনপ্রিয় তা এবং ফান্ড দ্রুত কমে যাচ্ছে, বিপজ্জনকভাবেই।” সে একটু থামলো, তার ধূসর চোখ রাচেলের দিকে স্থির। “রাচেল, নাসার একটা বিজয়ের দরকার ছিলো। কাউকে এটা সম্ভব করে তোলার দরকার ছিলো।

কিছু একটা করতেই হোতো, পিকারিং ভাবলো।

উল্কাপিণ্ডের ব্যাপারটা ছিলো শেষ প্রচেষ্টা। পিকারিং এবং বাকিরা প্রথমে নাসাকে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির সাথে সংযুক্ত করে বাঁচাতে চেয়েছিলো। কিন্তু হোয়াইট হাউজ এ প্রস্তাবটাকে পাত্তাই দেয়নি। কিন্তু সেক্সটনের নাসা বিদ্বেষী বক্তব্য জনপ্রিয় হতে থাকলে পিকারিং এবং তার মিলিটারি পাওয়ার-ব্রোকাররা জানতো সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। স্পেস এজেন্সিটাকে বাঁচাতে হলে তাদের এমন কিছু করতে হবে যা সবাইকে সন্তুষ্ট করবে। এমন কিছু, যাতে করদাতারা মনে করবে যে তাদের পয়সা নাসা নষ্ট করছে না।

“রাচেল,” পিকারিং বললো। “আপনি যে খবরটা ফ্যাক্স করেছেন, সেটা খুবই বিপজ্জনক। আপনি এটা অবশ্যই বুঝবেন। এটা প্রকাশ পেলে হোয়াইট হাউজ আর নাসা’কে বিপদে ফেলে দেবে। অথচ প্রেসিডেন্ট এবং নাসা কিছুই জানে না, রাচেল। তারা নির্দোষ। তারা বিশ্বাস করে উল্কাপিণ্ডটি সত্যি।”

পিকারিং এক্সট্রম আর হার্নিকে এই ঘটনায় জড়ায়নি, কারণ তারা খুব বেশি আদর্শবাদী। এক্সট্রম কেবল পিওডিএস’এর সফটওয়্যারের ব্যাপারে মিথ্যে বলেছে। কিন্তু সে এতো কিছু জানতো না।

মারজোরি টেঞ্চ প্রেসিডেন্টের ক্যাম্পেইনের নাজুক অবস্থা দেখে এক্সট্রমের সঙ্গে মিলে পিওডিএস-এর ব্যাপারে মিথ্যে বলেছিলো। তারা আশা করেছিলো পিওডিএসএর ছোট্ট একটা সফলতা হয়তো প্রেসিডেন্টের সাহায্যে আসবে।

টেঞ্চ যদি আমার দেয়া ছবিগুলো আর ঘুষ নেবার প্রমাণগুলো ব্যবহার করতো, তাহলে এসব কিছুর দরকার হেতো না।

টেঞ্চের হত্যাটি দুঃখজক। রাচেল তাকে উল্কাখণ্ডটি ভূয়া এই অভিযোগ করার পর পিকারিং জানতো, টেঞ্চ একটি তদন্ত করবে, ঘটনার গভীরে গিয়ে দেখবে আসল নায়ক কারা। এটা পিকারিং হতে দিতে পারে না। তাই তাকে মরতে হলো।

রাচেল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার বসের দিকে তাকালো।

বুঝতে পেরেছেন,” পিকারিং বললো। “এই খবরটা চাউড় হলে আপনি দুজন। নির্দোষীকে ধ্বংস করে ফেলবেন, নাসা এবং প্রেসিডেন্ট। আপনি, একজন বিপজ্জনক লোককেও সেইসাথে ওভাল অফিসে পাঠাবেন। আমাকে জানতে হবে আপনি ফ্যাক্সটা কোথায় পাঠিয়েছেন।”

এই কথাটা যখন সে বলছে, তখন রাচেলের মুখে একটা অদ্ভুত ভঙ্গীর উদয় হলো। এটা এমন একটা ভঙ্গী, যে কেউ যেনো বুঝতে পেরেছে সে বিশাল একটা ভুল করে ফেলেছে।

ডেল্টা-ওয়ান চুপিসারে কপ্টারের পেছন থেকে হাইড্রোল্যাবের সামনে এসে পড়েছে। একটা কম্পিউটারে অদ্ভুত একটা ছবি দেখা যাচ্ছে– গভীর সমুদ্রের নিচে একটা উত্তাল স্রোত, মনে হচ্ছে গয়ার ঠিক নিচেই কুণ্ডলী পাকাচ্ছে।

এখান থেকে চলে যাবার আরেকটা কারণ, সে ভাবলো, তার টার্গেটের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

ফ্যাক্স মেশিনটা এই ঘরেই দেখা যাচ্ছে। এর ট্রেতে একগাদা কাগজ। ডেল্টা-ওয়ান কাগজগুলো হাতে তুলে নিলো। রাচেলের লেখা একটা নোট রয়েছে সবার ওপরে। মাত্র দুটো লাইন। সে ওটা পড়লো।

ডেল্টা-ওয়ানের ফ্যাক্সটা কোথায় পাঠানো হয়েছে সেই নাম্বার জানার জন্য কোনো চেষ্টাই করতে হলো না। শেষ ফ্যাক্স নাম্বারটা এলসিডি ডিসপ্লেতে উঠে আছে।

ওয়াশিংটন ডিসির একটা নাম্বার। সে ফ্যাক্স নাম্বারটা সতর্কভাবে টুকে নিয়ে কাগজপত্রসহ ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেলো।

টোল্যান্ড মেশিনগানটা পিকারিংয়ের দিকে তাক করে আছে। সে এখনও রাচেলকে ঐ একই কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে –ফ্যাক্সটা কোথায় পাঠানো হয়েছে।

“হোয়াইট হাউজ এবং নাসা নির্দোষ,” পিকারিং আবারো বললো। “আমার সাথে কাজ করুন। আমার ভুলের জন্য নাসা আর প্রেসিডেন্টকে শেষ করে দেবেন না। আমরা একটায় সমঝোতায় আসতে পারি। উল্কাখণ্ডটির এদেশের দরকার রয়েছে। আমাকে বলুন, ফ্যাক্সটা কোথায় পাঠিয়েছেন, দেরি হবার আগেই বলুন।”

“যাতে করে আপনি আরো একজনকে খুন করতে পারেন?” রাচেল বললো। “আপনি আমাকে অসুস্থ করে ফেলেছেন।”

“আমি এই কথাটা আর একবার বলব, পিকারিং বললো। “পরিস্থিতিটা এতোই জটিল যে, আপনি পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। এই জাহাজ থেকে তথ্যটা পাঠিয়ে আপনি বিশাল। একটা ভুল করেছেন। আপনি আপনার দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।”

পিকারিং নিশ্চিতভাবেই সময়ক্ষেপন করতে চাচ্ছে, এটা এখন টোল্যান্ড বুঝতে পারলো। টোল্যান্ড একেবারে ভড়কে গেলো যখন দেখতে পেলো সৈনিকটি হাতে কাগজ আর মেশিন। গান নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

টোল্যান্ড সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে সেই সৈনিকের দিকে মেশিন গানটা তাকরে ট্রিগার টিপলো।

“আমি ফ্যাক্স নাম্বারটা খুঁজে পেয়েছি,” সৈনিকটি বলেই পিকারিংয়ের দিকে এক টুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিলো। “আর মি: টোল্যান্ডের মেশিন গানে কোনো গুলি নেই।”

১২৪

সেজউইক সেক্সটন নিজের অফিসে ছুটে এলেন। গ্যাব্রিয়েল কীভাবে এখানে এসেছিলো সে সম্পর্কে তার ধারণাই নেই, কিন্তু সে তার অফিসে এসেছিলো নিশ্চিত। তারা যখন টেলিফোনে কথা বলছিলো সেক্সটন তখন তাঁর অফিসের টুপল-ক্লিক জরডেন ঘড়ির শব্দটা শুনতে পেয়েছে।

কীভাবে সে আমার অফিসে ঢুকল?

সেক্সটন খুব খুশি যে তিনি তাঁর কম্পিউটারে পাসওয়ার্ডটা বদলেছিলেন।

সে অফিসে ঢুকে গ্যাব্রিয়েলকে হাতে নাতে ধবার উদ্দেশ্যে ছুটে এসেছে। কিন্তু তার অফিসটা ফাঁকা আর অন্ধকার। কেবল কম্পিউটার মনিটরের হালকা আলো জ্বলছিলো। বাতি জ্বালিয়ে ঘরটার চারপাশ তাকিয়ে দেখলেন। সবই ঠিক আছে। সুনসান। কেবল ঘড়ির শব্দটা হচ্ছে।

সে গেলো কোথায়?

কোথাও খুঁজে না পেয়ে সেক্সটন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছবিটা দেখলেন। ভাবলেন আজ রাতে খুব বেশি মদ খেয়েছন বলে কি তাঁর এরকম হয়েছে। আমি কিছু একটা শুনেছি। হতাশ আর দ্বিধান্বিত হয়ে তিনি অফিসে এসে বসলেন।

“গ্যাব্রিয়েল?” তিনি ডাক দিলেন, হলের দিকে গেলেন। সেখানেও সে নেই। গ্যাব্রিয়েলের অফিসটা অন্ধকার।

টয়লেট থেকে একটা ফ্লাশের শব্দ শুনে সেক্সটন দৌড়ে সেখানে গেলেন। ঢুকেই দেখেন রেস্ট-রুমে গ্যাব্রিয়েল হাত শুকাচ্ছে। সে তাকে দেখে চমকে গেলো।

“হায় ঈশ্বর! তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ!” সে তাকে বললো, তাকে দেখে সত্যি ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো। “তুমি এখানে কী করছো?”

“তুমি বলেছিল, তুমি তোমার অফিস থেকে নাসার ডকুমেন্ট নিচ্ছো।” তিনি তার হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন। “সেগুলো কোথায়?”

সেগুলো আমি খুঁজে পাইনি। সবজায়গায় খুঁজেছি। এজন্যেই এতো দেরি হয়ে গেছে।” তিনি তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি আমার অফিসে ছিলে?”

.

আমি তাঁর ফ্যাক্স মেশিনের কাছে ঋণী, গ্যাব্রিয়েল ভাবলো।

কয়েক মিনিট আগেই সে সেক্সটনের কম্পিউটারের সামনে বসেছিলো। সে ফাইলগুলো প্রিন্ট করতে যেতেই সেক্সটনের ফ্যাক্স মেশিনটা রিং করলো। সঙ্গে সঙ্গে গ্যাফে কম্পিউটার ফাইল বন্ধ করে সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে। সেক্সটনের বাথরুমে যখন সে উঠতে যাচ্ছে তখনি সেক্সটনের আসার শব্দ শুনতে পেয়েছিলো।

এখন সেক্সটন তার সামনে। সে জানে সে যদি মিথ্যে বলে সেক্সটন তা ধরে ফেলবে।

“তুমি মদ খেয়েছো, গ্যাব্রিয়েল বললো। সে কিভাবে জানলো আমি তাঁর অফিসে ছিলাম?

গ্যাব্রিয়েল ভেতরে ভেতরে ভড়কে গেলো। “তোমার অফিসে? কীভাবে? কেন?”

“তোমার সাথে কথা বলার সময় ফোনে আমি আমার জরডেন ঘড়িটার শব্দ শুনেছি।”

গ্যাব্রিয়েল জিভ কাটলো। তাঁর ঘড়ি? “তুমি কি জানো কথাটা কতোটা হাস্যকর কোনোচ্ছ?”

“আমি সারাদিন আমার অফিসে কাটাই। আমি জানি সেটার আওয়াজ কেমন হয়।”

গ্যাব্রিয়েল টের পেলো এটা এক্ষুণি শেষ করতে হবে। সেরা আত্মরক্ষা হলো আক্রমণ করা। গ্যাব্রিয়েল তার দু’হাত কোমরে তুলে সিনেটরের দিকে এগিয়ে গেলো। “তাহলে শোনো, সিনেটর। এখন ভোর চারটা বাজে। তুমি মদ খাচ্ছিলে, তুমি ফোনে তোমার ঘড়ির টিটি শব্দ শুনেছে, আর এজন্যে তুমি এখানে ছুটে এসেছো?” গ্যাব্রিয়েল একটু দম নিয়ে আবার বললো, “তুমি বলতে চাচ্ছো আমি এলার্মটা অফ করে, দুটো তালা খুলে তোমার অফিসে ঢুকেছি। তাই না?”

সেক্সটন চোখের পলক ফেললেন বার কয়েক।

“একারণেই কাবোর একা একা মদ খাওয়াটা উচিত নয়।” গ্যাব্রিয়েল বললো। “এখন তুমি কি নাসা সম্পর্কে কথা বলতে চাও নাকি চাও না?”

সেক্সটন একটু চুপ মেরে এক গ্লাস পেপসি ঢেলে পান করলেন, আরেক গ্লাস পেপসি গ্যাব্রিয়েলকে দিলেন।

“খাবে?” বলেই নিজের ঘরের দিকে ফিরে গেলেন। কিন্তু গ্যাব্রিয়েল তাঁকে অনুসরণ করলো না। “ওহ ঈশ্বরের দোহাই! আস। নাসা’তে কী পেয়েছে বলো?”

“আমার মনে হয় আজ রাতে অনেক খাটুনি গেছে,” সে বললো, “আগামীকাল কথা বলি।”

সেক্সটনের এই তথ্যটা এখনই জানা দরকার। আর এজন্যে এতো অনুনয় বিনয় করার তার কোনো ইচ্ছে নেই। “আমি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি, দিনটা খুব বাজে গেছে। জানি না কী ভাবছিলাম আমি।” সেক্সটন বললেন, একটু চালাকি করলেন আসলে।

গ্যাব্রিয়েল ঠায় দাঁড়িয়েই রইলো।

সেক্সটন নিজের ডেস্কে বসে বললেন, “বসো, সোডা পান করো। আমি মাথাটা সিঙ্কে ভিজিয়ে আসছি।” বাথরুমের দিকে চলে গেলেন তিনি।

গ্যাব্রিয়েল তখনও নড়লো না।

“আমার মনে হয় আমি একটা ফ্যাক্স দেখেছি,” সেক্সটন যেতে যেতে বললেন। তাকে দেখাও যে তুমি তাকে বিশ্বাস করো।

“সেটা একটু দেখবে?”

সেক্সটন বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মুখে পানি দিলেন। সেক্সটন ভালো করেই জানেন যে, গ্যাব্রিয়েল তাঁর অফিসে ঢুকেছিলো।

কিন্তু কীভাবে? সেটা তো অসম্ভব।

সেক্সটন আপাতত এটা তুলে রাখলেন। এখন তার দরকার নাসা’র খবরটা। গ্যাব্রিয়েলকে তার এখন ভীষণ প্রয়োজন। তাকে বিচ্ছিন্ন করার সময় এটা নয়। সে কী জানে। সেটা তার জানা দরকার।

বাথরুম থেকে বের হয়ে সেক্সটন দেখতে পেলেন গ্যাব্রিয়েল তার অফিসে এসে বসেছে। একটু স্বস্তি পেলেন সেক্সটন। বেশ। তিনি ভাবলেন। এখন আমরা কাজে লেগে যেতে পারি।

গ্যাব্রিয়েল ফ্যাক্স থেকে কতগুলো কাগজ বের করে তাকিয়ে আছে।

“কী আছে?” সেক্সটন তার কাছে এসে বললেন।

গ্যাব্রিয়েল স্তম্ভিত হয়ে আছে।

“কি?”

“উল্কাপিণ্ডটি “ সে কাঁপতে কাঁপতে কথাটা বললো। তার হাতটাও কাঁপছে। আর তোমার মেয়ে … সে খুব বিপদে আছে।”

অবাক হয়ে সেক্সটন সামনে এসে ফ্যাক্সটা গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে নিয়ে নিলেন। উপরের পাতাটিতে হাতের লেখা নোট। সেক্সটন লেখাটি চিনতে পারলেন মূহুর্তেই। কথাটা খুব সংক্ষিপ্ত আর শোচনীয়।

উল্কাপিন্ডটি ভূয়া। এখানে তার প্রমাণ রয়েছে।

নাসা/হোয়াইট হাউজ আমাকে হত্যা করতে চাচ্ছে। সাহায্য করো! আর এস

সিনেটর খুব ভড়কে গেলেন। রাচেলের নোটটা পড়ে তিনি কী বুঝবেন সেটাই ভেবে পেলেন না।

উল্কাপিন্ডটি ভূয়া? নাসা আর হোয়াইট হাউজ তাকে খুন করতে চাচ্ছে?

একটা ঘোরের মধ্যেই সেক্সটন আধ ডজন কাগজ নেড়েচেড়ে দেখলেন। কিছু কম্পিউটার প্রিন্টের ছবি, আর কাগজ পত্র। যাতে নিশ্চিত প্রমাণ রয়েছে উল্কাপিণ্ডটি কীভাবে বরফের নিচে ঢোকানো হয়েছে।

আরেকটা পাতায় সেক্সটন দেখতে পেলেন অদ্ভুত এক সামুদ্রিক প্রাণীর ছবি, যার নাম বাথিনোমাস জাইগানতিয়াস। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন। এটাতো উল্কার ভেতরে থাকা ফসিলের প্রাণীটা!

সেক্সটন সবটুকু পড়ার পর চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লেন।

নাসার উল্কাপিণ্ডটি ভূয়া!

সেক্সটনের জীবনের আর কোনো দিন এরকম উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যায়নি। চূড়ান্ত ধ্বংস হবার পর আবার জেগে ওঠা। একেবারে মাথা উঁচু করে। বিজয়ীর বেশে।

আমি যখন এই তথ্যটা জনগণকে জানাবো, প্রেসিডেন্ট পদটা তখন আমারই হয়ে যাবে।

প্রচণ্ড খুশির চোটে সিনেটর সেক্সটন নিজের মেয়ের চরম বিপদের কথা ভুলে গেলেন।

“রাচেল বিপদে আছে,” গ্যাব্রিয়েল বললো, “তাকে নাসা এবং হোয়াইট হাউজ খুন করতে চাচ্ছে-–”

সেক্সটনের ফ্যাক্স মেশিনটা আবারো বিপ করে উঠলো। সেক্সটন ভাবলেন রাচেল হয়তো আরো কিছু পাঠাচ্ছে। কিন্তু এবার আর কোনো কাগজ বের হলো না। এলারিং মেশিন ফিচারে একটা ফোন এসেছে।

“হ্যালো, আমি সিনেটর সেক্সটন বলছি। আপনি যদি ফ্যাক্স পাঠাতে চান যেকোন সময়ে পাঠাতে পারেন। তানা হলে একটা মেসেজ রেখে যেতে পারেন।” সেক্সটন বললেন।

“সিনেটর সেক্সটন?” লোকটা বললো। “আমি এনআরও’র ডিরেক্টর পিকারিং বলছি। আপনার সাথে আমার এক্ষুণি কথা বলার দরকার।” সে একটু থামলো, যাতে কেউ রিসিভার তুলে নেয়।

গ্যাব্রিয়েল রিসিভারটা তুলে নিলো। সেক্সটন তার হাতটা ধরে বাধা দিলেন। গ্যাব্রিয়েল অবাক হলো। “কিন্তু এটা তো এনআরও’র–”

“সিনেটর, পিকারিং বলতে লাগলো। আমি খুব বাজে সংবাদ দিচ্ছি আপনাকে। আমি এইমাত্র খবর পেয়েছি আপনার মেয়ে রাচেল খুব বিপদে আছে। আমি একটা দল পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করব। ফোনে ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারবো না। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, সে এইমাত্র আপনার কাছে কিছু তথ্য ফ্যাক্স করে পাঠিয়েছে। সেটা নাসা’র উল্কাপিণ্ড বিষয়ক। যে লোকগুলো আপনার মেয়ের জীবন নাশ করার হুমকী দিচ্ছে তারা আমাকে। সাবধান করে বলেছে কেউ যদি এটা পাবলিকের কাছে প্রকাশ করে তবে আপনার মেয়েকে তারা হত্যা করবে। স্যার। আপনার মেয়ের পাঠানো তথ্যগুলো কাউকে জানাবেন না। আর জীবন এটার উপরেই নির্ভর করছে। যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। আমি খুব জলদিই আসছি।” সে একটু থেমে আবারো বলতে লাগলো, “ভাগ্য ভালো হলে, আপনি ঘুম থেকে ওঠার আগেই এটা সমাধান হয়ে যাবে। আপনি আপনার অফিসেই থাকুন, কাউকে ফোন করবেন না। আপনার মেয়েকে বাঁচাতে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো আমি।”

পিকারিং ফোনটা রেখে দিলো।

গ্যাব্রিয়েল কাঁপতে লাগলো। “রাচেলকে জিম্মি করা হয়েছে?”

সেক্সটন এরকম খৃস্টমাস উপহার পেয়ে, তা ব্যবহার করবে না, এটা ভেবেই খুব খারাপ লাগলো তার। তার মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

পিকারিং চাচ্ছে আমি চুপ থাকি?

তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন এসবের মানে কী।

“তুমি কী করবে?” গ্যাব্রিয়েল জানতে চাইলে অবাক হয়ে। “তারা রাচেলকে খুন করতে পারবে না,” সেক্সটন বললেন। যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়েও যায়, সেক্সটন জানে তার মেয়েকে হারালেও তার অবস্থান আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক, তিনিই জিতবেন।

“এসব কপি করছো কেন?” গ্যাব্রিয়েল জানতে চাইলো। “পিকারিং বলেছে কাউকে না জানাতে!”

সেক্সটন গ্যাব্রিয়েলের দিকে ফিরে চাইলো। এখন সে কেবল তার স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। কোনো কিছুই তাকে থামাতে পারবে না। ঘুষের কোনো ব্যাপার থাকবে না। যৌনকেলেংকারীর গুজবেরও কিছু থাকবে না।

“বাড়িতে যাও গ্যাব্রিয়েল। তোমাকে আর আমার দরকার নেই।”

১২৫

খেলা শেষ হয়ে গেছে। রাচেল ভাবলো। সে এবং টোল্যান্ড ডেল্টা ফোর্সের সৈনিকের বন্দুকের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, পিকারিং এখন জেনে গেছে রাচেল ফ্যাক্সটা কোথায় পাঠিয়েছে। সিনেটর সেজউইক সেক্সটনের অফিসে।

রাচেলের সন্দেহ, তার বাবা ফ্যাক্সটা কখনও নিতে পারবে কিনা। আজ সকালে অন্য কারোর আগেই পিকারিং সেক্সটনের অফিসে চলে যেতে পারবে। যদি সে তা করতে পারে তবে সেক্সটনের কোনো ক্ষতি না করেই পিকারিং ফ্যাক্সটা নষ্ট করে ইনকামিং নাম্বারটা মুছে ফেলতে পারবে খুব সহজেই। পিকরিং হলো ওয়াশিংটনে সেই স্বল্প সংখ্যক লোকদের একজন যে সিনেট অফিসে প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখে।

অবশ্য এতে যদি সে ব্যর্থ হয় তবে, একটা হেলফায়ার মিসাইল ছুঁড়ে দেবে সেক্সটনের জানালা দিয়ে। ঘরের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। ফ্যাক্স মেশিনটাও। কিন্তু তার মন বলছে এসবের কোনো দরকার হবে না।

এখন সে আর মাইকেল একসাথে বসে আছে, টোল্যান্ডের হাতটা আনমনে রাচেলের হাতটা ধরে ফেললে রাচেলের এক ধরণের অদ্ভুত অনুভূতি হলো। যেনো সারাজীবন তারা। এভাবেই থাকবে।

কখনও না, সে বুঝতে পারলো। এটা কখনও হবে না।

মাইকেল টোল্যান্ডের মনে হলো সে এমন একজন মানুষ যে ফাঁসির দড়ির সামনেও আশার আলো দেখতে পায়।

জীবন আমার সাথে ঠাট্টা করছে।

.

সিলিয়ার মৃত্যুর পর টোল্যান্ডও মরে যেতে চাইতো। তারপরও সে বেঁচে থাকাটাই বেছে নিয়েছিলো। একা একা থাকার প্রতীজ্ঞা করেছিলো সে। তার বন্ধুরা অবশ্য তাকে সঙ্গী জুটিয়ে নিতে বলতো।

মাইক তোমার একা থাকার দরকার নেই। আরেকজনকে খুঁজে নাও।

টোল্যান্ডের এখন মনে হলো সিলিয়ার আত্মা তাকে ডেকের ওপর থেকে দেখছে। তাকে কিছু একটা বলছে।

“তুমি একজন যোদ্ধা,” তার কণ্ঠটা নিচু স্বরে বললো যেনো। “আমাকে কথা দাও তুমি আরেকজনকে খুঁজে নেবে।”

“আমি কখনই সেটা করবো না,” টোল্যান্ড তাকে বললো।

“তোমাকে শিখতে হবে,” সিলিয়া হেসে বলেছিলো।

এখন গয়ার ডেকে টোল্যান্ড বুঝতে পারলো, সে শিখছে। তার অন্তরের গভীরে একটা আবেগ উথলে উঠছে। সে বুঝতে পারলে সেটা সুখের।

আর এটার সঙ্গেই বেঁচে থাকার একটা সর্বশক্তির আবির্ভাব হচ্ছে। পিকারিংকে একটু অন্যরকম মনে হলো। সে রাচেলের সামনে এসে দাঁড়ালো।

“কখনও কখনও,” সে বললো, “পরিস্থিতির জন্য অসম্ভব সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”

“আপনি এসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, রাচেল তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো।

“যুদ্ধে হতাহত হয়ই,” পিকারিং বললো। “ডায়না পিকারিংকে জিজ্ঞেস করুন, অথবা অন্য যে কাউকে যারা এই দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিবছর মারা যায়। আপনারা সবাই সেটা জানেন, রাচেল,” সে তার চোখের দিকে তাকালো। “লেকচুরা পোকুর্ম সার্ভা সুলতোস।”

রাচেল কথাটার মানে জানে– অনেককে বাঁচাতে অল্পকয়েকজনকে বলি দেয়া।

“এখন আমি আর মাইক আপনার কাছে হয়ে গেছি সেই অল্পকয়েকজন?” প্রচণ্ড ঘৃণায় রাচেল বললো।

পিকারিং কথাটা শুনলো। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে ডেল্টা-ওয়ানের দিকে ঘুরে ললো, “তোমার সঙ্গীকে মুক্ত করে এসব শেষ করে ফেলো।”

ডেল্টা-ওয়ান সায় দিলো।

পিকারিং রাচেলের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে জাহাজের রেলিংয়ের দিকে চলে গেলো। এটা এমন কিছু যা সে দেখতে চাচ্ছে না।

ডেল্টা-ওয়ান তার সঙ্গীকে মুক্ত করতে গেলো। ডেকের ফ্লোরে সে ট্র্যাপ ডোরটা আছে সেটা খোলা রয়েছে। তার ঠিক উপরেই তার সঙ্গী ঝুলছে। তাই সবার আগে ট্র্যাপ ডোরটা বন্ধ করতে হবে। সে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকালো। অনেকগুলো লিভার রয়েছে সেখানে। ভুল কোনো লিভার টেনে সে কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। তাতে করে সাব-টা পনির নিচে পড়ে গিয়ে তার সঙ্গীও শেষ হয়ে যাবে।

কোনো ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।

সে টোল্যান্ডকে দিয়ে এ কাজটা করাতে চাইছে।

তোমার শত্রুদেরকে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করো।

ডেল্টা-ওয়ান তার অস্ত্রটা রাকেলের দিকে তাক করে টোল্যান্ডকে তার সঙ্গীর বাঁধন খুলে দেবার জন্য বাধ্য করলো।

“মিস সেক্সটন, উঠে দাঁড়াও,” ডেল্টা-ওয়ান বললো।

সে উঠে দাঁড়ালো।

ডেল্টা-ওয়ান রাচেলকে ট্রাইটন সাব-এর উপরে ওঠে বসতে বললো।

রাচেলকে খুব ভীত আর দ্বিধান্বিত বলে মনে হলো।

“এক্ষুণি করুন, ডেল্টা-ওয়ান বললো।

“সাব-এর উপরে উঠুন,” সৈনিকটি বললো। টোল্যান্ডের কাছে ফিরে গিয়ে তার মাথায় অন্ত্র ঠেকালো সে।

রাচেল ট্রাইটনের ইজিন কেসিং এর ওপর গিয়ে বসলো। সাব-টা ঝুলছে আর নিচে ট্র্যাপ-ডোরটা একেবারেই খোলা।

“ঠিক আছে, এবার ওঠ,” টোল্যান্ডকে সৈনিকটি বললো। “কন্ট্রোল প্যানেলে গিয়ে ট্র্যাপ ডোরটা বন্ধ কর।”

অস্ত্রের মুখে টোল্যান্ড কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে এগোতে লাগলো। তার পেছনেই অস্ত্রধারী। রাচেলের কাছাকাছি আসলে, সে একটু ধীর গতির হলো। রাচেল বুঝতে পারলো মাইকের চোখ তাকে একটা বার্তা দিচ্ছে। সে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে তারপর ট্রাইনের খোলা ঢাকনাটার দিকে তাকালো।

রাচেল তার পায়ের নিচে তাকিয়ে দেখলো ঢাকনাটা মানে হ্যাঁচটা ভোলা আছে। সে চাচ্ছে আমি এটার ভেতরে ঢুকে পড়ি?

রাচেল আবার টোল্যান্ডের দিকে তাকালো, সে এখন প্রায় কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে চলে গেছে। টোল্যান্ডের চোখ তার দিকে আঁটকে আছে।

তার ঠোঁট নড়ছে, যেনো নিঃশব্দে বলছে, “উঠে পড়ো, এক্ষুণি।”

.

ডেল্টা-ওয়ান যে-ই দেখলো রাচেল খোলা হ্যাঁচটা দিয়ে ট্রাইটনের ভেতরে ঢুকে পড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে সে গুলি চালালো। কিন্তু বুলেটগুলো হ্যাঁচের গায়ে লেগে ছিটকে অন্যত্র সরে গেলো, ভেদ করতে পারলো না।

টোল্যান্ড, মূহুর্তেই বুঝতে পারলো অস্ত্রটা আর তার পেছনের তা করা নেই। সে তার বাম দিকে ট্র্যাপ-ডোরটার অন্য পাশে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ডেকের ফ্লোরে পড়েই সে গড়িয়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রটাও গর্জে উঠলো। টোল্যান্ড গড়িয়ে জাহাজের সামনের দিকে নোঙরের স্পুলটার আড়ালে চলে যাওয়াতে একটা গুলিও লাগেনি– স্পুলটা বিশাল আকৃতির একটা মোটা পিলারের মতো, যাতে কয়েক হাজার স্টিল ক্যাবল পেঁচানো রয়েছে। জাহাজের নোঙরটা সেই স্টিলের তারের সাথেই লাগানো। টোল্যান্ডের একটা পরিকল্পনা রয়েছে, আর তাকে এটা খুব দ্রুতই করতে হবে। সৈনিকটি তার দিকে আসতেই টোল্যান্ড দু’হাত দিয়ে নোঙরের লটা ছেড়ে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে নোঙরের সাথে আটকানো ক্যাবল ছাড়তে শুরু করলো।

স্পুলটাতে পেঁচানো স্টিলের ক্যাবল দ্রুত ছাড়তে শুরু করলে গয়া স্রোতের টানে চলতে শুরু করলো। আচমকা চলতে শুরু করার কারণে ডেকের উপর সবকিছুই দুলতে লাগলো। নোঙরের স্টিল ক্যাবল যতই খুলতে লাগলো জাহাজটা ততোই সরে যেতে লাগলো স্রোতের দিকে। সৈনিকটি কোনোরকম ভারসাম্য বজায় রেখে টোল্যান্ডের দিকে আসতে চাইলো। টোল্যান্ড শেষ মূহুর্তটার জন্য অপেক্ষা করলো। এবার সে নোঙর-এর স্পুলটা লক্ করে দিলো। স্টিলের ক্যাবল ছাড়া বন্ধ হয়ে গেলো আচকা। জাহাজটা প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেলো। টোল্যান্ডের সামনে আসতে থাকা সৈনিকটি ভারসাম্য হারিয়ে হাটু গেঁড়ে পড়ে গেলো। পিকারিংও রেলিং থেকে ছিটকে ডেকের ওপর পড়লো। ট্রাইনটনটাও প্রচণ্ডভাবে দুলতে লাগলো ঝুলন্ত অবস্থায়।

জাহাজের নিচে, একটা ধাতব জিনিসের ভেঙে পড়ার বিকট শব্দ কোনো গেলে জাহাজটা ভূমিকম্পের মতো কাঁপতে লাগলো। ভগ্নপ্রায় একটা স্টুট ভেঙে পড়েছে। গয়ার ডান দিকটা তার নিজের ওজনে ধ্বসে পড়তে শুরু করলো। জাহাজটা এমন ভাবে পড়তে লাগলো যেনো একটা টেবিলের চারটা পায়ার একটা ভেঙে গেছে। ভেঙে পড়ার বিকট শব্দ হলো।

ট্রাইটনের ভেতর থেকে রাচেল সব দেখতে পেলো। সে একেবারে ভড়কে গেছে। তার সামনের কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখতে পেলো নিচের সমুদ্র উথলে উঠছে। তার চোখ ডেকের ওপর টোল্যাভকে খোঁজার চেষ্টা করলো।

কয়েক গজ দূরে, ট্রাইটনের রোবোটিক হাতের থাবায় ঝুলতে থাকা ডেল্টা সৈনিকটি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পিকারিং রেলিংয়ের একটা রড ধরে কোনোভাবে ভারসাম্য রক্ষা করছে। নোঙরের লিভারের কাছেই টোল্যান্ডও ঝুলছে। ঢালু দিয়ে যাতে গড়িয়ে সমুদ্রে না পড়ে যায় সেই চেষ্টাই করছে। রাচেল যখন দেখতে পেলো সৈনিকটি অস্ত্র নিয়ে গুলি করার চেষ্টা করতে যাচ্ছে, সে সব-এর ভেতর থেকেই চিৎকার করে উঠলো, “মাইক, দেখো।”

কিন্তু ডেল্টা-ওয়ান টোল্যান্ডকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেলো। সৈনিকটি তার হেলিকপ্টারের দিকে তাকিয়ে তীব্র আতংকে মুখ হা করে ফেললো। রাচেল সেদিকে তাকিয়ে দেখলো থেমে। থাকা হেলিকপ্টারটা হেলিপ্যাড থেকে এক পাশে পড়ে যেতে শুরু করেছে। ঢালু হয়ে যাওয়াতে সেটা কাত হয়ে আসলেট্রাইটন সাব-এর দিকেই হেলে পড়ছে।

.

ডেল্টা-ওয়ান দৌড়ে গিয়ে হেলে পড়া কপ্টারটার ককপিটে উঠে বসলো। তাদের একমাত্র বাহনটি হারাবার কোনো ইচ্ছেই তার নেই। ডেল্টা-ওয়ান কপ্টারটা চালু করে দিলো। ওড়! কানটা শব্দে হেলিকপ্টারটার ব্রেড ঘুরতে শুরু করলো। ওঠ, শালা ওঠ! কিন্তু হেলিকপ্টারটা কাত হয়ে ট্রাইটনের দিকে পড়তে লাগলো। ডেল্টা-টু ককপিটে বসে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওটা ওড়াতে।

কিওয়ার নাকটা সামনের দিকে ঝুঁকতেই কিওয়ার ব্রেডও নিচু হয়ে গেলো, আরেকটু কাত হলে ব্রেডটা ট্রাইটন সাব-এ ঝুলতে থাকা ডেল্টা টুর মাথাটা এবং সাব-এর উপরিভাগে লেগে যাবে।

ট্রাইটন সাব যে স্টিলের তারে ঝুলছে কিওয়ার ব্রেডটা সেটার সাথে লাগলে প্রচণ্ড একটা শব্দ হলো। ধাতব ব্লেডের সাথে তারের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়লো। কিওয়ার ব্লেডটাও দুমড়েমুচড়ে গেলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কপ্টারটা হেলিপ্যাড থেকে গড়িয়ে জাহাজের ডেকে আছড়ে পড়লো। তারপর একটা পল্টি খেয়ে ডেকের রেলিংয়ে গিয়ে আঘাত করলে সেটা।

কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিলো রেলিংটা বুঝি ভাঙবে না।

তারপরই ডেল্টা-ওয়ান একটা ভাঙনের শব্দ শুনতে পেলো। বিশাল কপ্টারটা হুড়মুড় করে সমুদ্রে পড়ে গেলো।

ট্রাইটনের ভেতরে রাচেল অসাড় হয়ে বসে রইলো। সাব-টা একেবারে কাত হয়ে আছে, এটা যে তারগুলোতে ঝুলেছিলো সেটার কয়েকটা ছিঁড়ে গেলেও সাব-টা কোনোরকম ঝুলেই আছে।

রাচেল ভাবতে লাগলো কতো দ্রুত এই সব থেকে বের হয়া যায়। যে সৈনিকটি সাব-এর রোবোটিক হাতের থাবায় আটকে ঝুলে আছে সে তার দিকে চেয়ে আছে, ক্ষতবিক্ষত সে, রক্ত ঝরছে, আগুনের ফুলিঙ্গের কারণে পুড়ে গেছে।

রাচেল দেখতে পেলো উইলিয়াম পিকারিং এখনও ঢালু হওয়া ডেকের একটা আঙটা ধরে আছে।

মাইকেল কোথায়? সে তাকে দেখছে না। তার ভয়টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নতুন একটা ভীতিতে আক্রান্ত হলো সে। যে তারে সাব-টা ঝুলছিলো সেটা ছিঁড়ে গেলো এবার।

কিছুক্ষণের জন্য রাচেলের নিজেকে ওজনহীন বলে মনে হলো। সাব-টা ট্র্যাপ-ডোর দিয়ে সোজা ত্রিশ ফুট নিচে সমুদ্রে পড়ে গেলো। পানিতে সেটা একটু ডুবেই, আবার ভেসে উঠলো, অনেকটা শোলার মতো। হাঙ্গরগুলো সঙ্গে সঙ্গে আঘাত হানলো। রাচেল তার চোখের সামনেই এই দৃশ্যটা দেখলো।

.

ডেল্টা-টু’র মনে হলো ধারালো কিছু তার বাঁধা হাতের উপরের অংশ কেটে ফেলছে। একটা হাঙ্গর তার হাত কামড়ে মাথাটা দুপাশে সজোরে নাড়াতেই ডেল্টা-টু’র হাতটা তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। অন্য হাঙ্গরগুলো তার পা কামড়ে ধরলো। একটা ধরলো পেট, আরেকটা তার ঘাড়। ডেল্টা-টু চিৎকারও দিতে পারলো না, তার দম বন্ধ হয়ে গেছে। শেষ যে জিনিসটা তার মনে আছে সেটা হলো একটা বিশাল হা-করা মুখ তার চেহারা বরাবর ধেয়ে আসছে।

পুরো জগৎটি অন্ধকার হয়ে গেলো।

***

ট্রাইটনে ভেতরে, রাচেল এবার তার চোখ খুললো। লোকটা উধাও হয়ে গেছে। তার। চারপাশের পানির রঙ ঈষদ লাল।

রাচেল তার সিট থেকে পড়ে গিয়েছিলো প্রচণ্ড ধাক্কায়। সে এবার উঠে বসলো। তার মনে হলো সাব-টা চলছে। এটা স্রোতের টানে সরে যাচ্ছে গয়ার নিচের ডাইভ-ডেক থেকে। সে আরো টের পেলো এটা আকেরটা দিকেও যাচ্ছে। নিচে। আমি ডুবে যাচ্ছি!

তীব্র ভয়ে রাচেল আচম্‌কা উঠে দাঁড়ালো। মাথার ওপর ছাদটার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করলো। ঢাকনাটার হাতল ধরতে পারলো। সে যদি ঢাকনা খুলে সাব-এর ওপরে উঠতে পারে তবে এখনও সময় আছে লাফিয়ে গয়ার ডাইভ ডেকে উঠে পড়তে পারবে। এটা কেবল মাত্র কয়েক ফিট দূরে এখন।

আমাকে বের হতে হবে!

ঢাকনাটার হাতল ঘুরিয়ে সে খুলতে চাইলো কিন্তু সেটা খুললো না। আঁটকে আছে। সে আবারো চেষ্টা করলো। কিছুই হলো না। সর্বশক্তি দিয়ে রাচেল ধাক্কা মারলো।

ঢাকনাটা খুললো না।

ট্রাইটনটা আরো কয়েক ইঞ্চি ডুবে গেলো। বিশালবপু নিয়ে সেটা সমুদ্রে ডুবতে শুরু করছে।

১২৬

“এটা করো না,” সিনেটর কাগজগুলো কপি করার সময় গ্যাব্রিয়েল তাঁর কাছে অনুনয় বিনয় করলো। “তুমি তোমার মেয়ের জীবনকে বিপদে ফেলে দিচ্ছো!”

সিনেটর কাগজগুলো নিয়ে নিজের ডেস্কে বসলেন।

মিডিয়া জগতে সবচাইতে ভয়ংকর মালমসলা, সেক্সটন ভাবলো। প্রতিটি কপিই একটা সাদা এনভেলপে ভরতে লাগলেন। প্রতিটি এনভেলপেই তার নাম আর অফিসের ঠিকানা সেই সাথে সিনেটোরিয়াল সিল সংবলিত। এই তথ্যগুলো কোত্থেকে এসেছে সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহই থাকবে না। শতাব্দীর সেরা রাজনৈতিক কেলেংকারী, সেক্সটন ভাবলেন, আর আমিই সেটা প্রকাশ করবো!

গ্যাব্রিয়েল এখনও রাচেলের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু সেক্সটন কিছুই বলছে না।

পিকারিং এই বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে, সেক্সটন যদি এই খবর প্রকাশ করে তবে কেবল রাচেলেরই ক্ষতি হবে না, বরং নাসা আর হোয়াইট হাউজেরও বিপর্যয় হবে।

জীবনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, তিনি ভাবলেন। আর তারাই বিজয়ী হয় যারা এটা নিতে পারে।

গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ সিনেটরের চোখে এরকম কিছু এর আগেও দেখেছে। অন্ধ উচ্চাকাঙ্খ। সে বুঝতে পারলো, সেক্সটন তার নিজের মেয়ের জীবনকে বিপদাপন্ন করে হলেও নাসা’র জালিয়াতিটা প্রথমে জানানর সুযোগ নিচ্ছে।

“তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না, তুমি ইতিমধ্যে জিতেই গেছো?” গ্যাব্রিয়েল জানতে চাইলো। “জাখ হার্নি এবং নাসা’র এই কেলেংকারী থেকে বেঁচে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। এসব প্রকাশ কে করলো, কখন করলো, তাতে কিছু যায় আসে না। রাচেল নিরাপদে আছে কিনা সেটা জানার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করো। পিকারিংয়ের সঙ্গে কথা বলার আগ পর্যন্ত অন্তত এটা করো না!”

সেক্সটন তার কথা মোটেও শুনছেন না। তিনি এনভেলপগুলোতে সিল মারতে শুরু করলেন।

“এটা করবে না, সে বললো, “তানা হলে আমি আমাদের সম্পর্কে কথা ফাঁস করে দেবো।”

সেক্সটন উচ্চস্বরে হেসে ফেললেন। “সত্যি? তোমার ধারণা এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে– ক্ষমতালোভী আমার এক সহকারী আমার প্রশাসনে উপযুক্ত পদ না পেয়ে প্রতিহিংসাবশত একাজ করছে। আমি আমাদের ব্যাপারটা একবার অস্বীকার করেছি, আর পৃথিবী আমার কথা বিশ্বাস করেছে। আমি এটা আবারো অস্বীকার করবো।”

“হোয়াইট হাউজের কাছে এসব ঘটনার ছবি রয়েছে,” গ্যাব্রিয়েল জানালো।

সেক্সটন তাকিয়ে দেখলেন না।

“তাদের কাছে কোনো ছবি নেই। আর যদি থাকে সেগুলো অর্থহীন।” তিনি শেষ সিলটা মারলেন। “আমার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যে যা-ই করুক না কেন, এইসব এনভেলপ সেগুলোকে উড়িয়ে দেবে।

গ্যাব্রিয়েল জানে তিনি সত্যি কথাই বলছেন।

সেক্সটন সব কিছু গুছিয়ে অফিস থেকে চলে যেতে উদ্যত হলেন। গ্যাব্রিয়েল তাঁর পথ আগলে ধরলো। “তুমি ভুল করছ। অপেক্ষা করো।”

সেক্সটন তার দিকে তাকালেন। “আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি, গ্যাব্রিয়েল, এখন আমি তোমাকে শেষ করবো।”

“রাচেলের পাঠান ফ্যাক্সের কারণে তুমি প্রেসিডেন্ট হতে পারবে। তুমি তার কাছে। ঋণী।”

“আমি তাকে অনেক দিয়েছি।”

“তার যদি কিছু হয়, তবে কি হবে?”

“তাহলে তার জন্য আমি সহমর্মীতার ভোট পাবো।”

গ্যাব্রিয়েল কথাটা বিশ্বাসই করতে পারলো না। সে ঘেন্নায় কুঁকড়ে গিয়ে ফোনের কাছে গেলো। “আমি হোয়াইট হাউজে ফোন–”

সেক্সটন তার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন।

গ্যাব্রিয়েল পড়ে যেতে লাগলো, তার মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে আছে। এই লোকটাকে সে পূজা করতে এক সময়।

সেক্সটন তার দিকে চেয়ে কটমট করে তাকালেন। “তুমি যদি আর বাড়াবাড়ি করো, তবে সারাজীবনের জন্য পস্তাবে।” তিনি হন হন করে কাগজগুলো নিয়ে চলে গেলেন।

গ্যাব্রিয়েল রক্তাক্ত ঠোঁট নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসলো। তারপর, ওয়াশিংটনে আসার পর, এই প্রথম গ্যাব্রিয়েল কান্নায় ভেঙে পড়লো।

১২৭

ট্রাইটনটা পড়ে গেছে…

মাইকেল টোল্যান্ড নিজের পায়ের ওপর উঠে দাঁড়ালো। নোঙরের স্পুলটা ধরে নিচের পানির দিকে তাকিয়ে দেখলো সে।ট্রাইনটনটা এইমাত্র পানি থেকে একটু ভেসে উঠলে স্বস্তি পেলো সে। সাব-টা অক্ষতই আছে। টোল্যান্ড ঢাকনাটার দিকে তাকালো। দেখতে চাইলে রাচেল সেটা খুলে ওখান থেকে বের হয়ে লাফিয়ে নিরাপদে আছে কিনা। কিন্তু ঢাকনাটা বন্ধ রয়েছে। টোল্যান্ড ভাবলো সে হয়তো প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ভেতরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে।

ডেক থেকেই টোল্যান্ড দেখতে পেলো, ট্রাইটনটা আসলে ডুবে যাচ্ছে। এটা ডুবে যাচ্ছে। টোল্যান্ড ভাবতেই পারলো না, কেন। কিন্তু সেই কারণটা জানা এখন অপ্রাসঙ্গিক।

আমাকে এখনই রাচেলকে ওখান থেকে বের করতে হবে।

টোল্যান্ড যেনো এগোতে যাবে, তার ওপর মেশিন গানের গুলির বৃষ্টি নেমে এলো। সবগুলো গিয়ে লাগলো মোটা নোঙরের স্কুলটার গায়ে। সে হাটু মুড়ে বসে পড়লো। তাকিয়ে দেখলো পিকারিং ওপরের ডেক থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। ডেল্টা-ওয়ান তার মেশিন গানটা ফেলে হেলিকপ্টারে উঠে গিয়েছিলো। পিকারিং সেটা তুলে নিয়েছে।

স্পুলের আড়াল থেকে মাইকেল ট্রাইটনের দিকে আবার তাকালো। রাচেল! বের হও ওখান থেকে সে অপেক্ষা করলো ঢাকনাটা খোলার জন্য, কিন্তু সেটা খুললো না।

গয়ার ডেকে আবার সে তাকালো। তার নিজের অবস্থান থেকে জাহাজের পেছনের রেলিংয়ের মধ্যে আনুমানিক বিশ গজ দূরত্ব। আড়াল নেবার মতো কিছুই নেই এর মাঝখানে।

টোল্যান্ড একটা দম নিয়ে মনস্থির করে ফেললো। নিজের শার্টটা খুলে সে তার ডান দিকে ছুঁড়ে মারলো। পিকারিং শার্টটা ছিন্নভিন্ন করে ফেললো গুলিতে। সঙ্গে সঙ্গে টোল্যান্ড বাম দিকে ছুটলো, পেছনের ডেকে। বড় বড় পা ফেলে সে জাহাজের পেছনের রেলিংয়ে এসে পড়লো। সেখান থেকে ঝাঁপ দেবার সময় তার পেছনে গুলির শব্দ শুনতে পেলো। সে জানে একটা বুলেট লাগলেই পানিতে পড়ার সাথে সাথেই হাঙ্গরের খপ্পরে পড়ে যাবে।

.

রাচেল সেক্সটনের মনে হলো সে একটা খাঁচায় বন্দী জম্ভ। সে ঢাকনাটা বার বার খোলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। তার নিচে একটা ট্যাংকএ পানিতে পূর্ণ হবার শব্দ পাচ্ছে সে। বুঝতে পারলো সাব-টা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে।

আমি পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছি।

সে ট্রাইটনের কন্ট্রোল প্যানেলের লিভার টেনে চেষ্টা করে দেখলো সাব-টা চালান যায় কিনা। কিন্তু ইনজিনটা বন্ধ হয়ে আছে। সে একটা তালাবদ্ধ লোহার ট্যাংকে ডুবে মরছে। তার

মনে পড়ে গেলো শৈশবের ডুবে যাওয়ার ঘটনাটি। চোখ বন্ধ করে ফেললো রাচেল।

নিঃশ্বাসহীন। পানির নিচে। ডুবে যাচ্ছে।

তার মার কণ্ঠস্বর। “রাচেল! রাচেল!”

সাব-টার বাইরের দিক থেকে একটা আঘাত লাগলো। কেউ যেনো ধাকাচ্ছে। রাচেল বর্তমানে ফিরে এলো আবার। তার চোখ খুলে গেলো।

“রাচেল!” গ্লাসের ওপর পাশে একটা ভূতুরে চেহারার উদয় হলো। শরীরটা উল্টে আছে। অন্ধকারে চেহারাটা চিনতে কষ্ট হচ্ছে।

“মাইকেল!”

টোল্যান্ড পানির ওপর উঠে এসে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিলো, রাচেল সাব-টার ভেতরে ঠিকমতো আছে বলে। সে বেঁচে আছে।

ট্রাইটন যদি পুরোপুরি ডুবে যায় তবে পানির চাপের কারণে ঢাকনাটা আর খোলা যাবে। তাই টোল্যান্ড বুঝতে পারলে তাকে খুব দ্রুত করতে হবে।

“হয় এখন নয়তো কখনই নয়, সে এই বলে দম নিয়ে ঢাকনাটার হুইল ধরে একটা মোচড় দিলো। কিছুই হলো না। আবারো চেষ্টা করলো সে। সর্বশক্তি দিয়ে। তারপরও খুললো না।

সে ভেতর থেকে রাচেলের ভয়ার্ত কণ্ঠটা শুনতে পেলো। “আমি চেষ্টা করছি!” চিৎকার করে বললো, “কিন্তু খুলতে পারছি না!”

“একসাথে টান দাও!” টোল্যান্ড চিৎকার করে বললো। “ডান দিকে ঘোরাও!”

“ঠিক আছে, এখনই!”

সে জোরে মোচর দিলো। ভেতর থেকে রাচেলও একই কাজ করলো। হুইলটা আধ। ইঞ্চির মতো ঘুরলেও ঢাকনাটা খুললো না।

এবার টোল্যান্ড সেটা দেখতে পেলো। ঢাকনাটা ঠিকমত লাগানো হয়নি। তাই ওটা একেবারে ফেঁসে গেছে। ঢাকনাটার চারপাশে যে রাবারের প্যাড আছে সেটা একেবাওে দুমরেমুচরে গেছে। এটা একমাত্র ওয়েল্ডিং করেই খুলতে হবে। তার মানে রাচেলকে বের করা যাবে না। টোল্যান্ডের হাত-পা শীতল হয়ে গেলো।

.

দু’হাজার ফিট নিচে হেলিকপ্টার কিওয়া তার ফিউসলেজে বোমাসহ ডুবে যাচ্ছে গহীন সমুদ্রের নিচে। ককপিটের ভেতরে, ডেল্টা-ওয়ানের নিষ্প্রাণ দোমড়ানো-মোচড়ানো শরীর দেখে চেনা দুষ্কর। মারাত্মক পানির চাপে তার শরীর চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।

এয়ার ক্রাফটা চক্রাকারে পাক খেতে খেতে নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। সেটার হেলোফায়ার মিসাইল এখনও ওটার সাথে লাগানো আছে। আর ম্যাগমাডোমর উদগীরনের ফলে সমুদ্রের তলদেশ প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে। তলদেশের তিন মিটার নিচে গলিত লাভা উদগীরনের জন্য অপেক্ষা করছে। সেটার তাপমাত্রা ১০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

১২৮

টোল্যান্ড হাটু পানিতে, ডুবন্ত ট্রাইটনের ইনজিনের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। সে রাচেলকে বাঁচানোর জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবছে।

সাব-টাকে ডুবতে দিও না!

সে গয়ার দিকে ফিরে তাকালো, যদি কোনোভাবে এটাকে পানিতে ভাসিয়ে রাখা যেতো। অসম্ভব। সেটা এখন পঞ্চাশ গজ দূরে। আর পিকারিং সেটার বৃজের ওপরে একজন রোমান সম্রাটের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

ভাবো! টোল্যান্ড নিজেকে বললো। সাবটা ডুবে যাচ্ছে কেন?

সাব-এর ভেসে থাকার যান্ত্রিক ব্যবস্থাটি খুবই সহজ। নিশ্চিত ট্যাংকটাতে পানি ঢুকে যাচ্ছে।

কিন্তু সেটা তো হতে পারে না!

বৃষ্টির মতো গুলির মধ্যে কি সেটাতে গুলি লাগেনি? সেটা তো হতেই পারে।

বুলেটের ছিদ্র।

ধ্যাত! টোল্যান্ড সঙ্গে সঙ্গেই পানিতে ডুব দিয়ে পানির নিচে ট্যাংকের গায়ে হাত বুলালো। টোল্যান্ড টের পেলো সেটাতে কয়েক ডজন বুলেট লেগেছে। সেটা দিয়েই পানি ঢুকছে। এজন্যেই ট্রাইটনটা ডুবতে যাচ্ছে। টোল্যান্ড সেটা পছন্দ করুক আর নাই করুক।

সাব-টা এখন পানির তিন ফুট নিচে ডুবে আছে। টোল্যান্ড সাব-এর ডোমের কাঁচটায় সামনে মুখ এনে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলো। রাচেল কাঁচের মধ্যে আঘাত করছে, চিৎকার করছে। রাচেলের কণ্ঠের ভীতিটা তাকে অক্ষম করে তুললো। কয়েক মুহূর্তের জন্য টোল্যান্ড একটা হাসপাতারে চলে গেলো। তার ভালোবাসার নারীকে দেখতে লাগলো। সে জানে তার প্রিয়তমা মারা যাবে, আর তার কিছুই করার নেই। পানির নিচে ডুব দিয়ে ডুবন্ত সাব-টার ভেতরে রাচেলকে দেখে সে নিজেকে বললো, সে দ্বিতীয়বার এটা সহ্য করতে পারবে না। তুমি একজন যোদ্ধা, সিলিয়া তাকে বলেছিলো, কিন্তু টোল্যান্ড একা একা যুদ্ধ করে বাঁচতে চায় না… আবার এটা হতে দেয়া যায় না।

রাচেল চিৎকার করে বলছে যে ভেতরেও পানি ঢুকে পড়ছে। জানালা দিয়ে। ভিউয়িং জানালাটা লিক করেছে।

জানালাতেও বুলেট লেগেছে? এটা তো সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। তার ফুসফুসে বাতাস খালি হয়ে গেছে, তাই সে পানির উপরে উঠলো একটু। পানিতে আবারো ডুব মেরে সে দেখতে পেলো ককপিটেও একটা ফুটো হয়ে গেছে, সেটা ওপর থেকে জোরে পড়াতে এমনটি হয়েছে। আরো দুঃসংবাদ।

সাবটা এখন পানির পাঁচ ফুট নিচে। টোল্যান্ড ওপরে ওঠে দম নিয়ে ভাবতে লাগলো কি করা যায়। রাচেল ক্রমাগত কাঁচে আঘাত করে যাচ্ছে।

টোল্যান্ড কেবল একটা কাজের কথাই ভাবলো। সে যদি ডুব দিয়ে ট্রাইটনের ইনজিন বক্সের ট্যাংকটারে থাকা হাইপ্রেসার সিলিন্ডারটা ফাটিয়ে ফেলতে পারতো। এতে অবশ্য তেমন কাজ হবে না। কারণ সিলিন্ডারটা বিস্ফোরিত হলে সাব-টা কিছুক্ষণের জন্য পানির ওপরে উঠে গেলেও তারপরই ট্যাংকটা পানিতে ভরে গিয়ে সাব-টা আবার ডুবতে শুরু করবে।

তারপর কী হবে?

আর কোনো উপায় না দেখে টোল্যান্ড আবারো ডুব দিলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো সে। যতো বেশি বাতাস নেবে ততো বেশিই অক্সিজেন। তার বুকে বাতাস নেয়ার ফলে সে টের পেলো তার পাজরে চাপ লাগছে, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথায় একটা অদ্ভুত চিন্তা খেলে গেলে।

সাব-এর ভেতরে চাপ বেড়ে গেলে কী হবে? ভিউয়িং ডোমটার একটা ভাঙা সিল রয়েছে। টোল্যান্ড যদি ককপিটের ভেতরে চাপ বাড়ায়, তবে ভিউয়িং ডোরটা ফেঁটে যাবে, আর রাচেলকেও বের করে আনা যাবে।

সে ওপরে উঠে শ্বাস নিয়ে ব্যাপারটা সম্ভাবনার কথা নিয়ে ভাবলে। খুবই যুক্তিসংগত বলে মনে হচ্ছে, তাই না? হাজার হোক, সাবমেরিন বানানো হয় একটা মাত্র দিকের কথা মাথায় রেখেই– বাইরের চাপ থেকে রক্ষা করা। কিন্তু ভেতরের চাপ নিয়ে কিছুই ভাবা হয় না। কখনও। সেটার দরকারই বা কী।

টোল্যান্ড দম নিয়ে ডুব দিলো।

সাব-টা এখন আট ফিট পানির নিচে। তীব্র স্রোত আর অন্ধকারের জন্য টোল্যান্ডের খুব বেগ পেতে হলো। সে প্রেসার ট্যাংকের হোস পাইপটা খুলে ককপিটের ফুটোর ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। প্রেসার ট্যাংকের পাশে হলো রঙের একটা লেখা দেখতে পেলো সে :

সাবধান : কমপ্রেসার এয়ার-৩০০০ প্রতি বর্গ ইঞ্চি।

তিন হাজার পাউন্ড প্রতি ইঞ্চিতে, টোল্যান্ড ভাবলো। আশা করলো এই পরিমান চাপে ট্রাইটনের ভিউয়িং ডোমটা ফেঁটে যাবে। টোল্যান্ড এবার প্রেসার সিলিন্ডারের ভাটা খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলো হোস পাইপ দিয়ে বাতাস ঢুকে ককপিট বাতাসে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

ট্রাইটনের ভেতরে, রাচেলের মনে হলো আচমকা একটা তীব্র ব্যথা তার মাথাটাতে চেপে বসেছে। সে চিৎকার দেবার জন্য মুখ খুললো। কিন্তু তার মুখ দিয়ে বাতাস ঢুকে তার বুকে এমন চাপ দিলো যে সেটা যেনো ফেটে যাবে। তার মনে হলো চোখ দুটো যেনো মাথার পেছন থেকে জোরে চাপ খাচ্ছে। তার কানটাতে এমন চাপ লাগলো যেনো কানে তালা লাগবার যোগাড় হলো। আর এতে করে সে অচেতন হয়ে পড়তে শুরু করলো। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায়, সে তার চোখ বন্ধ করে দুহাতে কান চেপে ধরলো। ব্যাথাটা বাড়তে লাগলো এখন।

রাচেল ঠিক তার সামনেই আঘাতের শব্দ শুনতে পেলো। সে চোখ খুলতেই দেখতে পেলো মাইকেল টোল্যান্ড আঘাতটা করছে। কাঁচের সামনে তার মুখটা। সে তাকে ইঙ্গিতে কিছু করতে বলছে।

কিন্তু কি?

অন্ধকারে তাকে খুব ভালোমত দেখতেও পাচ্ছে না রাচেল। তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে, চোখের মণি প্রচণ্ড চাপে দৃষ্টিশক্তি বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।

টোল্যান্ড ট্রাইটনের জানালার সামনে নিজেকে হাত-পা ছড়িয়ে মেলে ধরলো। সেই সাথে আঘাত করতে লাগলো। তার বুক বাতাস নেবার জন্য পুঁড়ে যাচ্ছে। সে জানে তাকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওপরে ওঠে দম নিতে হবে। কাঁচে ধাক্কা দাও! সে তাকে আকারে ইঙ্গিতে বললো। শুনতে পেলো চাপের বাতাস কাঁচের আশপাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। টোল্যান্ড হাতটা দিয়ে একটা কোনো চেপে ধরলো।

তার অক্সিজেন নিঃশেষ হয়ে গেলে শেষবারের মতো সে কাঁচে আঘাত করলো। সে আর রাচেলকে দেখতে পেলো না। অন্ধকার হয়ে গেছে। বুকের ভেতরে শেষ নিঃশ্বাসটি দিয়ে সে পানির নিচে চিৎকার দিলে।

“রাচেল… ধাক্কা….দাও…কাঁচে?”

তার কথাগুলো বুদবুদের সৃষ্টি করলো। নিঃশব্দ কথা।

১২৯

ট্রাইটনের ভেতরে, রাচেলের মনে হলো তার মাথাটা মধ্যযুগের কোনো নির্যাতন যন্ত্রে চেপে ধরে রাখা হয়েছে। ককপিটে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সে টের পাচ্ছে মৃত্যু তাকে চার পাশে থেকে চেপে ধরছে। তার সামনের ডোমের কাঁচটির সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না এখন। অন্ধকার। আঘাত করাটা থেমে গেছে।

টোল্যান্ড নেই। চলে গেছে তাকে রেখে। সাব-এর ভেতরের ফ্লোরটা এক হাতের মতো পানিতে ডুবে আছে। আমাকে বের করো! হাজারটা স্মৃতি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে।

অন্ধকারে, সাব-টা ভুবতে শুরু করছে। রাচেল ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে পড়ে গেলে ডোমের কাঁচের সাথে তার মাথাটার আঘাত লাগলো। আচম্‌কা তার মনে হলো সাব-এর ভেতরের বাতাসের চাপটা কমতে শুরু করেছে। সাব-টার ভেতর থেকে বাতাস বের হওয়ার জন্য পানিতে যে বুদবুদ হলো সেটার আওয়াজও সে শুনতে পেলো।

মূহুর্তেই সে বুঝে গেলো কী হচ্ছে। একটু আগে সামনের দিকে যখন ঝুঁকে পড়েছিলো তখন তার মাথার সাথে কাঁচের আঘাত লেগে ডোমের কাঁচটা একটু আলগা হয়ে গেছে, সেই ফাঁক দিয়েই বাতাস বের হচ্ছে ভেতর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে রাচেল বুঝে গেলো টোল্যান্ড তাকে ভেতর থেকে চাপ বাড়ানোর কথাই বলার চেষ্টা করছিলো।

সে ডোমের কাঁচটি ফাটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিলো।

ওপরে, ট্রাইটনের প্রেসার সিলিন্ডার দিয়ে বাতাস ভেতরে ঢুকেই যাচ্ছে। সেও বুঝতে পারলো চাপটা আবারো বাড়ছে। সে তার শরীরের ভার কাঁচের ওপর দিয়ে চাপ দিলো। কিছুই হলো না। তার কাঁধে একটা আঘাত লাগার জন্য কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। সে আরেকটা ধাক্কা দিতে উদ্যত হতেই ধাক্কা দেবার আর সময় পেলো না। আচমকাই সাব-টা উল্টে গেলো– এবার সেটার ভেতরে দ্রুত পানি ঢুকতে লাগলো।

রাচেল ককপিটের পানিতে অর্ধেক ডুবে উল্টে পড়ে রইলো। সে ওপরে তাকিয়ে ডোমের ফুটোটার দিকে তাকালো, সেটাকে তার বিশাল স্কাই লাইটের মতো মনে হলো।

বাইরে কেবলই রাত… আর হাজার হাজার টন সামদ্রিক চাপ।

রাচেল উঠে দাঁড়াতে চাইলেও তার শরীর খুব ভারি মনে হলো, সে উঠে দাঁড়াতে পারলো না।

“লড়াই করো, রাচেল!” তার মা যেনো কথা বলছে, পানির নিচ থেকে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। হাতটা ধরো?”

রাচেল তার চোখ বন্ধ করলো। আমি ডুবে যাচ্ছি।

“লাথি মারো, রাচেল! পা দিয়ে লাথি মারো!”

রাচেল লাথি মারার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। তার শরীরটা বরফের গর্ত থেকে একটু ওপরে। উঠে এলে তার মা তাকে ধরে ফেললো।

“হ্যাঁ!” তার মা চিৎকার করে বলেছিলো। “তোমাকে ওঠাতে সাহায্য করা। পা দিয়ে লাথি মারো।”

রাচেল রাথি মারতেই শরীরটা একটু ওপরে উঠে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মার দুহাত তাকে টেনে তুলে ফেললো। মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো।

এখন, অন্ধকার সাব-এর ভেতরে, রাচেল দু’চোখ খুলে তাকালো। সে তার মা’র কণ্ঠটা এখনও শুনছে, যেনো কবর থেকে বলছে।

পা দিয়ে লাথি মারো।

রাচেল মাথার ওপরে ডোমের দিকে তাকিয়ে তার সমস্ত সাহস সঞ্চয় করলো। ককপিটের চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়ালো সে, সেটা এখন একপাশে উন্টে আছে। অনেকটা একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছিলো। তাদের একটা ডলফিন হেলিকপ্টার সমুদ্রে হারিয়ে গেছে, তাই তারা দুর্ঘটনার আশংকাই করেছিলো। তারা তাদের নেভিগেশন সিস্টেমের সাহায্যে কপ্টারটার শেষ গন্তব্য খুঁজে বের করে উদ্ধারের আশায় একটা কপ্টার পাঠায় এখানে।

উজ্জ্বল আলোতে জ্বলতে থাকা গয়ার আধমাইল দূরে, তারা একটি স্পিডবোটের জ্বলতে থাকা অবশেষ দেখতে পায়। তার কাছেই একটা লোক পানিতে পড়ে আছে। তাদের দিকে হাত নাড়ছে সে। তারা তাকে টেনে তুলে নেয়। সে একেবারে উলঙ্গ ছিলো কেবল এক পায়ে ডাক্টটেপ পেঁচানো।

হাফ ছেড়ে টোল্যান্ড হেলিকপ্টারটার পেট দেখতে পেলো। রাচেলকে তার দিয়ে টেনে তুলতেই টোল্যান্ড দেখতে পেলো ফিউসলেজের দরজা দিয়ে অতি চেনা অর্ধ নগ্ন একটা লোক তার দিকে চেয়ে আছে।

কর্কি? তার হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। তুমি বেঁচে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা তার ফেলা হলে সেটা দশ ফুট দূরে গিয়ে পড়লো। টোল্যান্ড সেটার কাছে সঁতরে যেতে চাইলো কিন্তু সে ইতিমধ্যেই মেগাপ্লামের টানটা আঁচ করতে পারছে। সাগরের মুঠো যেনো তাকে ধরে ফেলেছে। ছাড়তে চাইছে না আর।

সমুদ্রের স্রোত নিচের দিকে টানছে। সে ওপরের দিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। কিন্তু তার শরীর খুবই ক্লান্ত। তুমি একজন যোদ্ধা, কেউ যেনো তাকে বললো। সে তার পা দিয়ে লাথি মারলো। ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করলো। কপ্টার থেকে ফেলা তারটা তার থেকে একটু দূরেই। ওপরের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো রাচেল নিচে তার দিকে চেয়ে আছে, তার চোখ তাকে ওপরের দিকে টেনে তুলতে চাচ্ছে।

চারটা স্ট্রোকের দরকার হলো উপর থেকে ফেলা তারটা ধরার জন্য। নিজের শরীরের শেষ শক্তি বিন্দু দিয়ে সে তার হাতটা ধরার জন্য এগিয়ে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্রটা যেনো তার নিচে পড়ে রইলো।

টোল্যান্ড নিচে এইমাত্র সেটা তৈরি হওয়া সমুদ্রের ঘূর্ণির মুখটা দেখলো। মেগাপ্লম অবশেষে ওপরে উঠে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *